অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বিকেলে। অফিসের পর দীপনাথ সোজা চলে আসে নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে। আজ বোস সাহেব নেই। মণিদীপা একা রয়েছে। দীপনাথের আজ বুক কাপল না।
দরজা হাট করে খোলা। পরদা সরিয়ে দীপনাথ অতি পরিচিত বাসস্থানটিতে ঢুকল। আপাতদৃষ্টিতে মনোরমভাবে সাজানো, শান্ত ও সুন্দর এই বাসাটির ভিত ভিতরে ভিতরে কত ক্ষয়ে গেছে তা তার মতো নির্মমভাবে আর কে জানে!
তবু কয়েক দিনের অবিরল বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও দুশ্চিন্তা করে আর একটি জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে দীপনাথ বুঝি কিছু প্রবীণ হয়েছে। বয়ঃসন্ধির সেই আবেগ আর নেই। বয়ঃসন্ধি! এই বয়সে কথাটা তার ক্ষেত্রে আর চলে না। তবে ভেবে দেখলে তার কৈশোরের বয়ঃসন্ধি তো আজও ঠিক মতো কাটেনি।
সাদা খোলের কালো নকশাপাড় একটা শাড়ি গায়ে আঁট করে জড়ানো, মিশমিশে কালো ব্লাউজ আর এলো খোপায় মণিদীপাকে আজ দারুণ ভাল দেখাল ভিতরের ঘর থেকে বসবার ঘরে ঢুকবার সময়। দীপনাথ মণিদীপার প্রবেশ থেকে বসা পর্যন্ত অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখল।
আজ দু’জনেই অস্বাভাবিক শান্ত।
দীপনাথ বিনা ভূমিকায় মৃদু স্বরে বলে, কী ঠিক করলেন?
মণিদীপা ততোধিক মৃদু স্বরে অপরাধী মুখে বলে, আমার এ ছাড়া উপায় নেই। গড়িয়াহাটা ব্রিজের ওপাশে একটা দোকানঘর পাওয়া গেছে। অনেক টাকা সেলামি চাইছে।
কত টাকা?
শুনলে আপনি বকবেন।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তা হলে না-ই বললেন। কারণ আপনার সোর্স অফ ক্যাপিটাল খুবই লিমিটেড।
মণিদীপা হাল ছাড়তে চায় না। তাই করুণ গলায় বলে, আমার কিছু গয়না আছে। বেচলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। বাকিটা কোনও ব্যাংক বা কেউ দেবে না?
আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে এটুকু জানি, সেলামির খাতে কোনও লেজিটিমেট লোন থেকে টাকা পাওয়া অসম্ভব। আপনি সেলামির জন্য টাকা চাইছেন শুনলে কোন ব্যাংকার খুশি হবে বলুন!
আমি আপনার পরামর্শই চাইছি। শুধু শুধু কেন নেগেটিভ সাজেশন দিচ্ছেন!
আপনার দোকান যদি না চলে তা হলে টাকা পেলেও শোধ দেবেন কেমন করে?
চলবে। আমি জানি চলবে।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আপনি জানেন না যে আপনি আসলে স্বপ্ন দেখছেন। এই হাড্ডাহাড্ডি কমপিটিশনের বাজারে আপনার মতো অনভিজ্ঞের পক্ষে দোকান চালানো কত শক্ত জানেন?
আমি পারব দেখবেন। দীপনাথ আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আপনি আপনার না-হওয়া দোকানটাকে ইতিমধ্যেই ভালবেসে ফেলেছেন দেখছি।
আমার বাপের বাড়ি ওই এলাকায়। দরকার হলে আমার ভাইরাও হেলপ করতে পারবে। যোধপুর পার্কে আমার চেনাজানা অনেকে আছেন, তারাও পেট্রনাইজ করবেন। দোকানটা চলবে। আপনি ভাববেন না।
দীপনাথ আচমকা জিজ্ঞেস করে, স্নিগ্ধদেব এখন কোথায়?
মণিদীপা একটু অবাক হয়ে বলে, কেন, আমেরিকায়! আপনাকে তো বলেইছি।
দীপনাথ একটু হাসল, জানি। শুধু আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। এক বিপ্লবী আমেরিকায় দেদার টাকা কামাচ্ছে, আর এক বিপ্লবিনী যোধপুরে শাড়ির দোকান খুলতে সেলামির টাকা জোগাড় করছে। বিপ্লবকে একদম ড়ুবিয়ে দিলেন মিসেস বোস!
মণিদীপা একটু গম্ভীর হয়, শুনুন, কী একটা কথা আছে না! হাতি ফাঁদে পড়লে…
দীপনাথ শব্দ করে হাসল।
আমিই সেই চামচিকে তা হলে! যাকগে, নো অফেনস টেকন। আমি বলতে চাইছিলাম, টাকাটা তো অনায়াসেই স্নিগ্ধদেব আপনাকে পাঠাতে পারে। ধার হিসেবেই দিক। পরে দেশে এলে শোধ দিয়ে দেবেন।
স্নিগ্ধর টাকা নেব?
কেন নয়? এক সময়ে তাকে আপনি বিস্তর টাকা দিয়েছেন। কত টাকা তার হিসেব আছে?
মণিদীপা খুব গম্ভীর রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, স্নিগ্ধকে আমি যত টাকা দিয়েছি তা হিসেব করলে হয়তো এই সেলামির টাকার চেয়ে বেশি দাঁড়াবে। কিন্তু টাকাটা তো স্নিগ্ধ নেয়নি, পার্টির কাজে লেগেছে।
ঠিক জানেন?
মণিদীপা মাথা নেড়ে বলল, না। তবে স্নিগ্ধকে অবিশ্বাস করারও কিছু নেই।
পার্টির সঙ্গে আপনার ডাইরেক্ট যোগাযোগ ছিল না?
না। কোথায় ওদের আন্ডারগ্রাউন্ড সেন্টার তাও আমি জানি না।
টাকার কোনও রসিদ পেয়েছেন কখনও?
না। সেরকম নিয়ম নেই।
দীপনাথ আবার অন্য দিক থেকে সওয়াল শুরু করে, স্নিগ্ধদেব যখন আমেরিকায় গেল তখন ধরে নিতে হবে সে পার্টির আদর্শে অনুগত ছিল না। সে যে টাকাটা পার্টির ফান্ডেই জমা দিয়েছে এমন কথাও মনে করা যায় না। মোর ওভার, সে ছিল দরিদ্র স্কুলমাস্টার।
মণিদীপা তীক্ষ্ণ চোখে দীপনাথকে ভস্ম করে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, মানছি স্নিগ্ধ ইজ নাউ এ ফলেন গাই। কিন্তু বরাবরই সে এ রকম ছিল না।
আপনি কী করে জানেন, বোকা মেয়ে? স্নিগ্ধদেবের মতো সুপার ইনটেলিজেন্সের লোককে বুঝতে পারা কি সহজ?
আপনি বিচার করছেন কিছু না জেনেই। স্নিগ্ধদেবকে আপনি চোখেও দেখেননি কখনও।
আমি অভিজ্ঞতা থেকেই জানি।
মণিদীপা তার ঘাড় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে নেড়ে বলে, না জানেন না। স্নিগ্ধ নিজের দরকারে টাকা চাইলেও আমি দিতাম। স্নিগ্ধ নিজের জন্য কখনও ভাবত না। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল পার্টি এবং আদর্শ। বিপ্লবের জন্য অনেক টাকা দরকার। স্নিগ্ধদেব গরিব হলেও নিজের মাইনে থেকে একটা
পারসেনটেজ বরাবর পাটিতে ডোনেট করত।
ওঁর পতনের শুরু কবে থেকে তা কি আপনি জানেন?
না। ওর স্বভাব ভীষণ চাপা।
এমনও তো হতে পারে স্নিগ্ধদেবের পতন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু আপনি টের পাননি। আপনি ওঁর বাইরের ছদ্মবেশেই মুগ্ধ ছিলেন, আর তখন স্নিগ্ধদেব পার্টির নাম করে আপনার কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিজের ঘর গোছাত!
এ রকম হতে পারে না তা বলছি না। কিন্তু হয়নি।
আপনি এখনও স্নিগ্ধদেবের প্রতি দুর্বল।
মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, যেমন আপনি এখনও স্নিগ্ধ সম্পর্কে ভীষণ ভীষণ জেলাস।
দীপনাথ গাম্ভীর্য ঝেড়ে হেসে ফেলে। অত্যন্ত সরল প্রাণখোলা হাসি। তারপর বলে, তবু বলি স্নিগ্ধদেবের খপ্পরে পড়ে আপনি অর্ধেকটা জীবন নষ্ট করেছেন।
মুহূর্তে মণিদীপা জবাব দেয়, বাকি অর্ধেকটা নষ্ট করেছে কে জানেন? যে মূর্তিমানটি এখন আমার সামনে বসে জ্বালাচ্ছে।
দীপনাথ হাসল, লাল হল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, স্নিগ্ধদেব কিন্তু সত্যিই টাকাটা আপনাকে ধার হিসেবে দিতে পারেন। একটা চিঠি লিখে দেখুন না!
কিন্তু আমি যে স্নিগ্ধর টাকা চাই না। না খেতে পেয়ে মরলেও না।
কেন বলুন তো!–দীপনাথ সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করে।
দ্যাট ইজ মাই কনসেপশন অফ সেলফ-রেসপেক্ট। যাকে আমি এক সময়ে টাকা দিয়েছি, তার কাছে হাত পাততে আমার আত্মমর্যাদায় লাগে। থ্যাংক ফর দি সাজেশন, বাট ইট ইজ নট অ্যাকসেপটেবল।
দীপনাথ মৃদু হাসে। বলে, আমি অবশ্য জানতাম।
কী জানতেন?
আপনি স্নিগ্ধদেবের টাকা নেবেন না। অনেক দিন আগে আপনি একবার বলেছিলেন, বোস সাহেব ছাড়া অন্য কারও টাকা নিতে আপনার ঘেন্না করে।
মণিদীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হ্যাঁ। আজও করে। আফটার হোয়াট হ্যাজ গন বিটউইন আস। কিন্তু আমরা প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
প্রসঙ্গটা কী যেন?
সেলামির টাকা।
কত তা এখনও বলেননি।
দুই লাখ।
দীপনাথ হাঁ করে চেয়ে থেকে হঠাৎ চাপা আর্তস্বরে বলে উঠল, জল! জল! বাতাস!
মণিদীপা তড়িঘড়ি উঠতে গিয়েও থেমে হেসে ফেলে, খুব প্র্যাকটিক্যাল জোক শিখেছেন!
বাস্তবিকই আমার মাথা ঘুরছে।
ইয়ারকি মারবেন না! ইট ইজ এ কোশ্চেন অফ মাই একজিসটেনস।
দু’লাখ! আমি ভুল শুনিনি তো!
না। আর আপনি এও জানেন যে, দু’-তিন লাখে আজকাল কিছুই হয় না। আপনি এখন একটি বড় বিজনেস ফার্মের প্রায় হর্তাকর্তা। আপনার না জানার কথা নয়।
দীপনাথকে আজ দীর্ঘশ্বাসে পেয়েছে। খুব জোরালো একটা শ্বাস ফেলে সে বলে, আমরা হচ্ছি চিনির বলদ। কিন্তু মিসেস বোস, আমি আপনাকে খুশি করতে আমার যা সাধ্য তা করব।
করবেন?
করব। আমার নিজের বোধহয় হাজার ত্রিশেক টাকা ব্যাংকে আছে। এল আই সি থেকেও কিছু রেইজ করতে পারি। অফিসও কিছু অ্যাডভানস দেবে। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাট হাজার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর বেশি নয়।
আপনি দেবেন?–খুব অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে থাকে মণিদীপা।
দিলে আপনি নেবেন না?
মণিদীপা জবাব দিতে পারে না অনেকক্ষণ। দীপনাথ–দীপনাথই হয়তো তার সত্যিকারের সর্বনাশের মূল। তবু বহুকাল ধরে গোপনে গোপনে নদীর ভূমিক্ষয়ের মতো মণিদীপার সব অহংকার ভাসিয়ে নিয়েছে যে অনভিপ্রেত ভালবাসা তারই মোহনা ওই দীপনাথ। কোনওদিনই আর দীপনাথকে ভালবাসার কথা বলবে না মণিদীপা। কিন্তু ভাল না বেসেও তার উপায় নেই। কিন্তু দীপনাথের টাকাও যে নেওয়া যায় না। কিছুতেই না।
মণিদীপা ঠোঁট উলটে বলল, একজন শ্লেভের টাকা নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিতে চাই না।
প্রশ্নটা নয়। প্রশ্ন হল আমার টাকা নিতে আপনার কোনও শুচিবায়ু আছে কি না!
হয়তো আছে।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দীপনাথ বলে, বাঁচলাম। পৃথিবীতে এখনও এইজন্যই বুঝি চন্দ্র-সূর্য ওঠে।
কথাটার মানে কী?
মানে বুঝে আপনার দরকার নেই। আই ওয়াজ জাস্ট থিংকিং অ্যালাউড! কিন্তু টাকা না নিলে আপনার দোকানের কী হবে?
মণিদীপা হঠাৎ বসে বসে ছেলেমানুষের মতো ঠ্যাং দুটি নাচাল একটু। তারপর নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, হবে না।
হবে না?
না। কেউ যখন চাইছে না তখন না হওয়াই ভাল।
দীপনাথ ভ্রু কুঁচকে একটু কী যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ একটু সরল হাসি হেসে বলে, কথাটা ঠিক হল না।
কোন কথাটা?
কেউ চাইছে না এমন কিন্তু নয়। অন্তত বোস সাহেব চেয়েছিলেন যে আপনি দোকান-টোকান কিছু করে সেলফ-সাফিসিয়েন্ট হোন।
বটে? বলেনি তো কখনও।
আমাকে বলেছিলেন। আমি তাকে অন্য পরামর্শ দিই।
মণিদীপাকে এই স্বীকারোক্তি খুব একটা স্পর্শ করে না। তবু আলগা গলায় জিজ্ঞেস করে, তারপর?
তারপর আর কথাটা এগোয়নি। তবে ভাবছি, এখন একবার বোস সাহেবকে অ্যাপ্রোচ করলে উনি হয়তো টাকাটা দিয়ে দেবেন আপনাকে।
দিয়ে দেবে ঠিকই। বাট হি উইল বাই হিজ লিবার্টি বাই দ্যাট মানি।
কিন্তু আপনিও লিবার্টি দিতেই চান।
চাই। কিন্তু সেটা টাকার বিনিময়ে নয়। আই উইল গিভ হিম লিবার্টি আউট অফ পিটি, আউট অফ হেট্রেড। টাকা নয়।
দীপনাথ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বড় গোলমালে ফেললেন।
আমাকে নিয়ে আপনার অনেক গোলমাল চলছে, সরি দীপনাথবাবু।
এই সময়ে বেয়ারা ট্রে ভর্তি খাবার আনে এবং ক্ষুধার্ত দীপনাথ খেতে খেতে গোটা সমস্যাটাই ভুলে যায়।