2 of 2

৫২. দক্ষিণের খোলা বারান্দায়

সকালে দক্ষিণের খোলা বারান্দায় ইজিচেয়ারে নরম কাঁথা বিছিয়ে বসানো হয় প্রীতমকে। চনচনে শীত পড়ে গেছে এখানে। গলা পর্যন্ত শাল দিয়ে ঢাকা থাকে তার। পায়ে মোজা। সামনের এই বারান্দাটা চমৎকার। সামনে কাঁচা নর্দমা আর কিছু অসুন্দর কাঠের বাড়ি বাদ দিলে চেয়ে থাকতে খারাপ লাগে না। রোদ এসে কোমর পর্যন্ত তপ্ত করে রাখে। এদিকে পাহাড় দেখা যায় না বটে, কিন্তু অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। খুব নীল, খুব গভীর। শুধু একটাই অসুবিধে। বারান্দায় বসলেই রাস্তা দিয়ে যত চেনা মানুষ যায় সবাই দাঁড়িয়ে কুশল প্রশ্ন করে, অসুখের ইতিবৃত্ত জানতে চায়। সেটা ভারী অস্বস্তিকর।

কয়েক রাত ভাল ঘুম হচ্ছে না প্রীতমের। বিলু শিগগির আসবে না। লাবুকে অনেকদিন দেখতে পাবে না সে। এসব ভাবনা আছে। আর নতুন এক রহস্যময় প্রশ্ন তাকে বড় জ্বালাতন করে। বিলুকে এখনও সে এত গভীরভাবে ভালবাসে কী করে? কেন বাসে? বিলুকে ছেড়ে এসে কেন শিলিগুড়ি একদম ভাল লাগছে না তার?

সামনে একটু বাগান ছিল। শতম তার ব্যাবসার কাজে একগাদা পাথরকুচি এনে ফেলেছিল। এখন বাগানময় সেই পাথরকুচি ছড়িয়ে রয়েছে। গাছপালা নেই-ই বলতে গেলে। শুধু ফটকের দু’ধারে দাউ দাউ করে জ্বলছে লালচে বোগেনভেলিয়া। এই বাগান, বোগেনভেলিয়া, নর্দমা, রাস্তা, বাড়িঘর সবই প্রীতমের সত্তায় জড়িয়ে রয়েছে। তবু হায়, এই সকালের রোদে বারান্দায় বসে কোনও শৈশবস্মৃতিই আসে না তার মনে! বরং জায়গাটাকে অচেনা, অনভ্যস্ত লাগে কেবল।

বসে থাকতে থাকতে রোদে চোখ জ্বালা করে। চোখ বুজলে নিদ্রাহীন রাত্রির প্রতিশোধ নিতে অসময়ের আচমকা তন্দ্রা এসে চোখ এঁটে ধরে। প্রায় রোজই এইভাবে ঘুমিয়ে পড়ে প্রীতম। ভয়ে কেউ তাকে জাগায় না। অনেক বেলায় শতম যখন ফেরে তখন ডাকে।

সকাল বিকেল এক ডাক্তার এসে দেখে যায় তাকে। নতুন কোনও ডাক্তার নয়। বাবুপাড়ার সেই পুরনো বয়স্ক ডাক্তার সেনগুপ্ত। প্রায় ছেলেবেলা থেকেই এঁর চিকিৎসায় বড় হয়েছে তারা। লম্বা চওড়া ডিগ্রি নেই, সাদামাটা এম বি বি এস। কিন্তু ভাল বিচক্ষণ ডাক্তার।

কলকাতার ডাক্তার যে কেস-হিস্ট্রি লিখে দিয়েছিল সেইটে পড়ার পর প্রথম দিনই ডাক্তার সেনগুপ্ত বলেছিলেন, এ রোগ বাঁধালে কী করে?

উদ্বিগ্ন শতম জিজ্ঞেস করে, আপনি পারবেন তো?

কালীভক্ত ডাক্তার সেনগুপ্ত একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই মায়ের ইচ্ছে। দেখি কী হয়!

তলে তলে শতম এক হোমিয়োপ্যাথের কাছ থেকেও ওষুধ আনে। মালিশের তেল তো আছেই।

শতম যে একাই চেষ্টা করছে তা নয়। মরম কোত্থেকে একটা মাদুলি এনে মা’র হাতে দিয়েছে। মা সেটা বেঁধে দিয়েছে ডান হাতে। বাবা বিদেশের বিভিন্ন হেলথ রিসার্চ সেন্টারে চিঠি লিখছে। সবাই তটস্থ, সক্রিয়।

শুধু প্রীতমেরই মাঝে মাঝে মনে হয়, এত চেষ্টা সব বৃথা। সে আর কোনওদিনই ভাল হবে না। শেষ ক’টা দিন যদি কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারত।

পুজো এল, চলে গেল। চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, লাউড স্পিকার, আলো, ভিড় একেবারেই স্পর্শ করল না প্রীতমকে। এ বাড়ির কাউকেই করল না তেমনভাবে। এমনকী এবার কারও জন্য জামাকাপড়ও কেনা হল না পুজোয়। পুজোর দিন ক’টা শুধু একটু ছটফট করল প্রীতম। বিলুর অফিস ছুটি ছিল, আসতে পারত। বিলুর বদলে অবশ্য তার চিঠি আসে। তাতে কী লেখে তার খোঁজ নেয় না প্রীতম। বাবাকে লেখে, বোনকে লেখে, ওরাই জবাব দিয়ে দেয়। আর চিৎকখনও আসে দীপনাথের চিঠি। খুব ব্যস্ত। উত্তরবাংলায় ট্যুরে আসার কথা ছিল, কিন্তু তা কেবলই স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। তার বদলে দীপনাথ বাংগালোর, রাঁচি, দিল্লি ঘুরে এল। বড্ড ব্যস্ত, সময় নেই। প্রীতম যেন ভাল থাকে। চিঠি পড়ে প্রীতম ম্লান হাসে। তারই কোনও ব্যস্ততা নেই।

তবে কাজ আছে। আজকাল শতম তাকে অনেক হিসেবপত্রের কাজ গুছিয়েছে। টুকটুক করে সেগুলো করেও ফেলছে প্রীতম। খুব খারাপ লাগছেনা। পেনসিল বা কলম ধরতে কিছুদিন আগেও আঙুলে কিছু জড়তা ছিল। ক্রমে সেটা কমে যাচ্ছে বা সয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ তো ঠিক কাজ নয়। কাজ-কাজ খেলা। শতম তাকে খেলনা দিয়ে মৃত্যুর কথা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

সবচেয়ে ছোট ভাই রূপম। বছর সতেরো-আঠারো বয়স হবে। ভাইদের মধ্যে বোধহয় সে-ই একটু বখা-গোছের ছেলে। অনেককাল খোঁজ রাখেনি প্রীতম, তাই কে কেমন হয়ে উঠেছে তা সঠিক জানে না। তবে বার কয়েক কথা বলার সময় ওর মুখে সিগারেটের গন্ধ পেয়েছে। প্রায়ই বেশ রাত করে ফেরে। মাঝে মাঝে যেসব ছেলে তাকে এসে ডেকে নিয়ে যায় তাদের চেহারা-ছবি অন্য ধরনের। বখা ইয়ারবাজ ছেলে বলে মনে হয়। তারা কেউ বাড়ির মধ্যে ঢোকে না কখনও। এসব মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করল প্রীতম।

তবে এতেও তো তার কিছু যায় আসেনা। সংসারের সঙ্গে যত না জড়িয়ে থাকা যায় সেই চেষ্টায় সে চোখ কান বন্ধ করে থাকে। যা ইচ্ছে তোক।

বিজয়াদশমীর রাতে বাড়িতে একটা চাপা গন্ডগোল শুনেছিল প্রীতম। কে কাকে বকছে। গলাটা মা’র। কাকে বকছে তা বোঝেনি প্রথমে। সম্ভবত তার ভয়েই এইসব গুজ-গুজ ফুসফুস চাপাচাপি।

ঘটনাটা আরও স্পষ্ট হল কালীপূজার দিন। চৌ-পহর রূপম বাড়িতে নেই। সন্ধেবেলা বাসাটা ফাঁকাই ছিল। বাবা গেছেন কালীবাড়িতে মাকে নিয়ে আরতি দেখতে। অন্য ভাইবোনরাও বেরিয়েছে একটু। প্রীতম নিজের ঘরে বসে খাতাপত্র খুলে হিসেব কষছিল। এমন সময় খুব জোরে কড়া নড়ে উঠল। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক জোরে ঘটাং ঘটাং করে সে কী আওয়াজ! রান্নার জন্য যে বয়স্কা বিধবাটিকে রাখা হয়েছে সে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর একটা চিঙ্কার।

প্রীতম হতচকিত হয়ে কিছুক্ষণ নড়তে পারেনি। বাড়িতে ডাকাত পড়ল নাকি? আজকাল শিলিগুড়িতে ভীষণ ডাকাতি হয়।

একটু বাদেই রূপম এসে তার ঘরের দরজায় দাঁড়াল, আকণ্ঠ মদ খেয়েছে, চোখে মোদো চাউনি। চৌকাঠে ভর রেখে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা, আমার শরীরটা খারাপ, কিছু মনে কোরো না। মা কোথায় বলো তো?

প্রীতম সবই বুঝল। কিন্তু সেই চেঁচানিতে যে বুকে কঁপুনি উঠেছিল, সেটা তখনও রয়েছে। আড়ষ্ট শরীরে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, চেঁচিয়েছিল কে বল তো!

ও তো রুমকির মা। আমি ভয় দেখাচ্ছিলাম। এমনি মজা করে বাঘের ডাক ডেকে উঠেছিলাম, হঠাৎ প্রায়ই করি ওরকম, কিছু হয়নি। তুমি আজ কেমন আছ দাদা, আমার মাথাটা বড্ড ধরেছে, এমন একটা জরদা পান খাওয়াল কিন্তু আমি জরদা খাই না তো, আজ খুব লেগে গেল, তুমি বরং শুয়ে পড়ো, আমি মাকে খুঁজে দেখি।

মা বাড়িতে নেই।

ও, তা আর কী করা যাবে, তা হলে আমি বরং খুঁজে দেখিগে কোথায় গেছে, কালীবাড়ি-টারি হবে ঠিক খুঁজে পেয়ে যাব। মেজদা বাড়ি ফেরেনি তো দাদা?

না। এখনও ফেরেনি।

তবে আমি যাই।— বলে পিছন ফিরল রূপম।

ভাই মদ খেয়েছে, এ ঘটনা তেমন স্পর্শ করে না প্রীতমকে। শুধু সে মনে মনে বলে, কলকাতায় আমি এর চেয়ে ঢের ভাল ছিলাম। সেখানে এই সব ঘটত না।

প্রীতমের যে প্রখর অনুভূতি কলকাতায় সক্রিয় ছিল তা এখানে আসার পর ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রীতম আজকাল চারদিকটাকে ভাল করে টের পায় না, লক্ষ করে না, পাত্তা দেয় না।

রূপম চলে গেলে সে আবার হিসেবে মন দিতে চেষ্টা করল।

রূপম সেই রাতে ফিরল না। খাওয়ার সময় প্রীতম খুব উদাস গলায় মাকে জানাল, রূপম সন্ধেবেলা এসেছিল। তোমাকে খুঁজছিল।

মা একটু কেমন ফ্যাকাসে গলায় বলে, তোর ঘরে ঢুকেছিল নাকি?

ঠিক ঢোকেনি। দরজা থেকে কথা বলে গেল।

রাঁধুনিও বলছিল, এসেছিল।

তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি?

না তো!

না হয়ে ভালই হয়েছে।

মা কোনও প্রশ্ন করল না। কাঁচুমাচু হয়ে চেয়ে রইল প্রীতমের দিকে। মার মুখের ভাব দেখেই প্রীতম বুঝতে পারে, রূপমের ব্যাপারটা মা খুব ভালই জানে। কিন্তু প্রীতম জেনে গেছে বলে ভয় পাচ্ছে।

প্রীতম অবশ্য কথা বাড়াল। এ বাড়ির সঙ্গে অলক্ষে তার একটা দুরত্ব রচিত হয়ে গেছে কবে থেকে যেন। এতকাল টের পায়নি। এখানে আসার পর থেকে পাচ্ছে। সেই দূরত্বটাকে প্রীতম আর পেরোতে চায় না। লাভ কী? কারও কোনও পরিণতিকেই তো আর সে ঠেকাতে পারবে না।

শোওয়ার পর প্রীতম অনেক রাত অবধি বাড়িতে একটা চাপা উত্তেজিত কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে চোখ বুজল সে। বাড়ির লোক হয়তো সবকিছু তাকে বলতে চাইছে না। সে তো ঠিক পুরোপুরি এ বাড়ির মানুষ নয়। তার খানিকটা গ্রাস করেছে কলকাতা, খানিকটা বিলু আর লাবু। এ বাড়িতে তার অধিকার সদরের চৌকাঠ অবধি। আর ভিতরে সে নিজেও ঢুকতে চায় না।

খুব ভোরবেলা, তার ঘুম ভাঙারও আগে, শতম এসে চুপ করে শিয়রে বসে তার মাথা স্পর্শ করে অনেকক্ষণ জপ করে যায়। কোনওদিন তা টের পায় প্রীতম, কোনওদিন পায় না। কিন্তু কে বলবে কেন, ওই জপটুকু তার আজকাল বড় জরুরি বলে মনে হয়। শরীরের মধ্যে, মনের মধ্যে কিছু একটা হয়। অনেক স্নিগ্ধ বোধ করে সে। সতেজ লাগে। বেলা বাড়লে আস্তে আস্তে অবশ্য সেই ভাবটুকু কেটে যায়।

আজও জপ করছিল শতম। প্রীতমের মনে কিছু অস্বস্তি ছিল কাল রাত থেকে, তাই ঘুম গভীর হয়নি। ভোররাতে শতমের জপের মাঝখানে সে চোখ চাইল। মশারির মধ্যে বালিশের পাশে সংকীর্ণ জায়গায় খুব কষ্ট করে মস্ত শরীরটাকে কুঁচকে শতম বসে আছে। শিরদাঁড়া সোজা, চোখ বন্ধ, মুখ গম্ভীর। সন্তের মতো এক উদাসীনতা আজকাল ছেয়ে থাকে শতমের মুখে। খুব গভীর ও শক্তিমান বলে মনে হয়। বোধহয় সেইজন্যই আজকাল প্রীতম একটু একটু নির্ভর করে ওর ওপর। নির্ভরতা আসছে। যদি সেই পথ বেয়ে নির্ভয়তাও আসে কোনও দিন!

চোখ চেয়ে শতমকে দেখে আবার চোখ বুজে থাকে প্রীতম। সে নাস্তিক না ঈশ্বরবিশ্বাসী তা সে নিজেও জানে না। কোনওদিন ওসব নিয়ে মাথাই ঘামায়নি। ভবানীপুরের বাসায় কোনও ঠাকুর-দেবতার ছবি পর্যন্ত নেই। এমনকী বিলু ভগবান মানে কি না তাও সে স্পষ্ট জানে না। সোজা কথা, এতকাল ভগবান নিয়ে ভাবার অবকাশই হয়নি তার। কঠিন এই অসুখে পড়েও ঈশ্বরের শরণ নেয়নি সে। কিন্তু তা নাস্তিক বলে নয়, নেহাত মনে পড়েনি বলে।

বিলু কি নাস্তিক? তার অসুখ হওয়ার পর বিলু একবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিল মনে পড়ে। তা ছাড়া আর কিছু মনে নেই। তবু বিলুর নাস্তিক হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ অরুণ ঘোর নাস্তিক, আর বিলু বরাবর অরুণেরই অনুগামী।

বুকের মধ্যে একটু জ্বালা করে ওঠে প্রীতমের। পুরুষের স্বাভাবিক অধিকারবোধ আর ঈর্ষা তাকে এখনও ছাড়েনি। কিন্তু ছাড়া উচিত ছিল। সে তো বিলুকে বলেই এসেছে, বিলু যেন অরুণকে বিয়ে করে। সেটা অবশ্য হয়ে উঠবে না। অরুণ বোধহয় এতদিনে বিয়ে করে ফেলেছে। তা হলে বিলু কী করবে? চিরকাল অরুণের উপপত্নী হয়ে থেকে যাবে না তো! ভেবে গা-টা একটু রি রি করে ওঠে তার।

আবার চোখ খোলে প্রীতম। ভোরের আলো আর-একটু স্পষ্ট হয়েছে। ধ্যানস্থ শতমকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে এই আলোয়। চলছে জপ, শব্দের তরঙ্গ। এইসব জিনিসের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। তার। তবু মাথা স্থির রেখে শুয়ে থাকে সে। ভাল কিছু, সুন্দর কিছু ভাববার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ে না। একমাত্র লাবুর মুখখানা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। এই একমাত্র জন যার সঙ্গে তার সম্পর্ক শর্তহীন, জটিলতাহীন। লাবুর মুখখানাই মনে মনে আঁকড়ে থাকে সে।

জপ শেষ করে নিঃশব্দে চলে গেল শতম। আবার এল চায়ের কাপ হাতে অনেকক্ষণ বাদে। বলল, বেড়াতে যাবে দাদা?

আমি? আমি কী করে যাব?

খুব পারবে। আমরা তো সঙ্গেই থাকব।

কোথায়?

তুমি তো পাহাড় ভালবাসো না তেমন। পাহাড়ে এখন শীতও খুব। বীরপাড়ার কাছে আমার বন্ধু প্রত্যুষের এক চা-বাগান আছে। ভাল বাংলো। কদিন গিয়ে থেকে আসবে? সবাই যাব।

প্রীতম মাথা নাড়ে, না রে। নড়াচড়া ভাল লাগে না।

কিছুদিন একটু অন্য পরিবেশে মনটা অন্যরকম লাগত।

মন! না, কোথাও মন ভাল লাগে না।

শতম একটু গম্ভীর হয়ে বলে, এই শিলিগুড়িতেই তোমার জন্ম। এখানেই বড় হয়েছ। এখানে তোমার কত চেনা মানুষ, বন্ধুবান্ধব। এই জায়গা তোমার ভাল লাগে না কেন বলো তো?

বন্ধুবান্ধব আর চেনা লোককে তার আসার খবর দিতে বারণ করে দিয়েছে প্রীতম। তাই তেমন কেউ আসে না। কিন্তু শিলিগুড়ি কেন ভাল লাগে না প্রীতম বলবে কী করে? সে মাথা নেড়ে বলল, ভাল লাগবে না কেন? তবে সেই শিলিগুড়ি তো আর নেই।

সে তো ঠিকই! বউদি বা লাবুর জন্য মন কেমন করে বলে এমন মনমরা হয়ে থাকো না তো?

না, না। ওসব নয়। এখানেও তো তোরা আছিস। শতম একটু অহংকারের সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, আমরা আছি। যারা বরাবর তোমার পাশে থাকব। তুমি অত ভাবো কেন?

না, ভাবি না।

শোনো, রূপমটা বি কম পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিয়ে বদ বন্ধুদের সঙ্গে মিশছে। মেরে পাট পাট করেছি কয়েকবার। এখনও ভূত ছাড়েনি। আমি বাইরে বাইরে কাজে থাকি, নজর দিতে পারি না। ওকে তুমি একটু দেখো না!

প্রীতম শঙ্কিত হয়ে বলে, আমি! আমি কী দেখব?

তুমি ইনভলভড় হতে চাইছ না। কেন? আমরা তোমার কেউ নই?

প্রীতম একটু লজ্জিত হয়। বলে, আমি ঠিক শাসন-টাসন করতে পারি না, তুই তো জানিস।

শাসন বলতে যদি বকাঝকা আর মারধর হয় তবে বলি, ওতে রুপুর কিছু হবে না। রাস্তায় ঘাটে ও বিস্তর মারপিট করে। মারে, মার খায়ও। ওসবে ওর ঘাঁটা পড়ে গেছে। আর সে রকম শাসনের জন্য তোমাকে দরকার কী? আমি আর বাবা ওকে কম আসুরিক শাসন তো করিনি। এখন ওকে অন্যরকমভাবে ট্রিট করতে হবে। কিন্তু রকমটা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি ওর বড়দা, একটু দুরের লোক। কলকাতায় থাকো বলে ও তোমাকে খুব ভাল করে জরিপ করতে পারেনি এখনও। একটু সমীহও করে বোধহয়। দায়িত্ব নিলে হয়তো তুমি পারবে।

কথাগুলোর যৌক্তিকতা মনে মনে স্বীকার করে প্রীতম। কিন্তু ভিতরে কোনও আগ্রহ জাগে না তার। ছোট ভাইয়ের জন্য যেটুকু উদ্বেগ থাকা উচিত ছিল তাও তার নেই। উপরন্তু সে একটু ভয় পায়, কুঁকড়ে যায় মনে মনে। তবু বলে, ঠিক আছে। ওকে মাঝে মাঝে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস।

মাঝে মাঝে নয়। আমি ভাবছি তোমার ঘরেই ওকে স্থায়ীভাবে থাকতে বলব। ও তোমার দেখাশোনাও করতে পারবে। অবশ্য যদি করে।

প্রস্তাবটা পছন্দ না হলেও প্রীতম বলল, আচ্ছা।

রূপমের টিকির নাগাল পেতে অবশ্য আরও দিন তিন-চার পেরিয়ে গেল। তারপর একদিন সন্ধেবেলা একটু কুণ্ঠিত পায়ে সে এসে ঘরে ঢুকল।

দাদা, ডেকেছ?

প্রীতম চোখ তুলে ভাইটিকে খুব মন দিয়ে দেখে। সবচেয়ে ছোট। ছেলেবেলায় এ ভাইটাকে খুব বেশি ভালবাসত প্রীতম। তারপর স্বার্থপরের মতো সেইসব ভালবাসা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কবে।

রূপমের চেহারা খুব মজবুত নয়। অন্য ভাইদের চেয়ে বরং প্রীতমের সঙ্গেই তার চেহারার মিল বেশি। লম্বাটে গড়ন, রোগা। তবে প্রীতমের মুখে যে লাবণ্য ছিল তা এর নেই। কর্কশ শ্রীহীন মুখ। বোঝা যায়, শরীরের ওপর নেশার অত্যাচার বড় কম নয়। চোখে একটা তীব্রতা আছে, যা সব সময় কু-চিন্তা করলে হয়।

তাড়াতাড়ি প্রীতম লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কী বলা উচিত, কী বললে ভাল হয় তা ঠিক করতে পারল না সে। একটু বিভ্রান্ত বোধ করে এবং একটু বিরক্ত হয়েও সে বলল, একটু বাদে আসিস। মিনিট পনেরো পরে।

আচ্ছা।–বলে চলে গেল রূপু।

ততক্ষণ একটু দম ধরে থাকে প্রীতম। খুব বেশি আদর দেখালেও সন্দেহ করবে, খুব বেশি কঠোর হলে ছিটকে যাবে। তার চেয়ে সহজ, অকপট ব্যবহার ভাল। মনে মনে তৈরি হয়ে নিল

প্রীতম।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই আবার এল রূপু।

প্রীতম খুব সরলভাবে বলল, তুই তো অ্যাকাউন্টেন্সি একটু বুঝিস। আমাকে একটু হেলপ করবি তো!

রূপু একটু হাসল। বলল, অ্যাকাউটেন্সি তো শিখিনি।

শিখতে সময় লাগে না। পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিস শুনলাম।

কী হবে পড়ে? চাকরি পাব?

তা অবশ্য ঠিক।

তোমার মতো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হব তেমন মাথা আমার নেই।

তা হলে কী করতে চাস?

আমার আর্ট পড়বার ইচ্ছে ছিল। বাবা, মেজদা বারণ করল। বলল, বি কম করে কস্টিং পড়। আমার মাথায় কমার্স ঢোকে না। অবশ্য আর্টস পড়েও কিছু হত না।

আমার পাশে এসে বোস।

রূপু বিছানায় এসে বসে। পরনে প্যান্ট আর খয়েরি রঙের একটা হাতকাটা সোয়েটার। শিলিগুড়ির এই ভয়ংকর শীতের পক্ষে নিতান্তই তুচ্ছ পোশাক।

এই পোশাকে বেরোচ্ছিলি?

এখানে যা শীত! আমার শীত লাগে না।

আমার একটা ভাল পুলওভার আছে। সুটকেসটা খোল গিয়ে, ওপরেই আছে। আমি তো পরি না, তুই পর।

থাক না। তোমার লাগবে।

লাগবে না। যা, বের করে গায়ে দে।

রূপু উঠে গিয়ে পুলওভারটা বের করে। ক্রিম রঙের নরম উলে বোনা! নিউ মার্কেট থেকে বছর দুই আগে কেনা। খুব বেশি গায়ে দেওয়ার সময় পায়নি প্রীতম।

গায়ে দিয়ে রূপু বলে, একটু লুজ হচ্ছে।

তখন আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল। তবু আমারও একটু বড় বড় হত। ভেবেছিলাম, মোটা তো হবই, বয়স হলে সবাই হয়। তাই একটু বড়ই কিনে রাখি।

এ কথায় হাসল রূপু। বলল, আমার মোটা হতে দেরি আছে। চাকরি না পেলে—

দূর বোকা! মোটা হওয়া কি ভাল! রোগা লোকেরাই চটপটে হয়। এটা কিন্তু তোকে মানিয়েছে।

আরম্ভটা এইভাবে মন্দ হল না। ঘুষ দেওয়ায় এবং নরম সুরে কথা বলায় রূপম বোধহয় তাকে অপছন্দ করল না তেমন। জানালার ধারে একটা দড়ির খাঁটিয়ায় বিছানা পেতে শুতেও লাগল রোজ রাতে। প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, দাদা তোমার কিছু লাগবে? কিছু করব তোমার জন্য?

দামি পুলওভারের ঋণ বোধহয় ভুলতে পরছে না সে। প্রীতম বলে, না, কী আর করবি? শুধু এই হিসেবপত্রের কাজে আমাকে একটু হেলপ করিস।

নভেম্বরের শেষ দিকে জমজমাট শীতের এক ভোরবেলা হঠাৎ বাড়িতে খুব হইচই। একটা চেনা গলার স্বর অনেক কুয়াশা আর দূরত্ব অতিক্রম করে এসে হানা দিল। কাঁপা বুকে উঠে বসেছিল প্রীতম।

দরজা ঠেলে ঘরে এল দীপনাথ।

বাঃ, তুই তো দারুণ ইমপ্রুভ করেছিস!–বলে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার বাইরে চেয়ে ডাকল, বিলু! বিলু! দেখে যা তোর কর্তার চেহারা। চিনতে পারবি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *