মণিদীপা অনেক পুরুষকে পার হয়ে এসেছে জীবনে। সে জানে, পুরুষমানুষের এই হঠাৎ রাগ থেকেই আসে আশ্লেষ। দীপনাথ তাকে এই থরো থরো রাগের চূড়ায় যে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়তে পারে অনুরাগে, চুমু খেতে পারে, এমনতরো ঘটনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু দীপনাথ পিছিয়ে গেল। ক্লান্ত স্বরে বলল, চারদিকে বদনাম রটে গেছে মিসেস বোস।
কিসের বদনাম?
আপনাকে আর আমাকে নিয়ে। আমার ছোটবোন পর্যন্ত জানে।
অবাক হয়ে মণিদীপা বলে, এইজন্য আপনি এত ডিস্টার্বড আজ?
ভীষণ ডিস্টার্বড।
বদনাম রটলে ক্ষতি তো মেয়েদের। আপনারা পুরুষমানুষ, আপনাদের বদনামটাই ফেম।
দীপনাথ মাথা নাড়ে, না। আপনি কবে বুঝবেন, নিজের জন্য আমি ততটা চিন্তিত নই, যতটা আপনার জন্য।
মণিদীপা আবার একটু অবাক হয়। তবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বদনামকে আমি তো ভয় পাই না। আমার নামে এ পর্যন্ত বহু বদনাম রটেছে। আপনি আমার জন্য অনর্থক ভাবছেন।
অনর্থক। তাই হবে।—বলে দীপনাথ সোফায় বসে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে নিজের আঙুলগুলো দেখে। তারপর এক সময়ে বিবর্ণ বিভ্রান্ত মুখখানা তুলে বলে, আমার মাথার ঠিক ছিল না। আপনার সঙ্গে একটু রাফ ব্যবহার করে ফেলেছি।
মণিদীপা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই একদৃষ্টে দেখছিল দীপনাথকে। চোখের দৃষ্টি কোমল, স্বপ্নাচ্ছন্ন। কথাটা শুনে মৃদু একটু হাসল। বলল, রাফ ব্যবহার? একটুও নয়। আমি পুরুষদের সত্যিকারের রাফনেস দেখেছি। আপনি রাফ নন। তবে টাফ। ভেরি টাফ আর হেডস্ট্রং।
কফি ঠান্ডা হচ্ছিল। কয়েকটি ব্যগ্র চুমুকে কাপ শেষ করে দীপনাথ উঠল, আজ চলি।
হঠাৎ কেন উদয় হয়েছিলেন, বললেন না তো!
আপনার সঙ্গে একটা শশা-ডাউনের জন্য। অনেকদিন ধরে আপনি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
শো-ডাউন কি হয়ে গেল?
ম্লান হেসে দীপনাথ বলে, হল আর কই? আপনার সামনে এলেই আমার সব গুলিয়ে যায়।
আমার বদনাম নিয়ে আপনি খুব চিন্তিত, কিন্তু একবারও বোস সাহেবের বদনাম নিয়ে ভাবছেন না তো!
দীপনাথ হেসে বলে, এই যে বললেন পুরুষমানুষের বদনাম মানেই ফেম।
তা ঠিক। তবু অ্যাজ এ ওয়েল-উইশার আপনার আর-একটু ইন্টারেস্টেড হওয়া উচিত। আজকাল শুনি বোস সাহেব আপনাকে জিজ্ঞেস না করে কোনও ডিসিশন নেন না।
অতটা সত্যি নয়। তবে কোনও কোনও ব্যাপারে উনি আমার অ্যাডভাইস নেন।
শুনেছি আমার মাসোহারা কত হওয়া উচিত তাও আপনিই ঠিক করে দিয়েছেন।
দীপনাথ অস্বস্তি বোধ করে বলে, আমাকে বোস সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি যা ভাল বুঝেছিলাম তাই বলেছি। আপনি কি তার জন্য রেগে আছেন?
আমি মাঝে মাঝে খামোখাই রেগে যাই। সে আমার স্বভাব। কিন্তু চারশো টাকা যে অনেক টাকা তাও আমি জানি।
আপনি রাগ করেছেন।
আমার রাগে আপনার কী আসে যায়! আপনি আমার কে? আমি শুধু ভাবছি বোস সাহেব কী করে এ কথাটা মেনে নিল! চারশো টাকার প্রশ্ন নয়, আমার হাত থেকে সব অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার ডিসিশনটা ও মেনে নিল কী করে?
দীপনাথ মুখ তুলল না। কিন্তু শান্ত গলায় বলল, এই ডিসিশন না নিলে বোস সাহেব এতদিনে পথে দাঁড়াতেন। অফিসে ওঁর লোন কত ছিল জানেন?
ঠোঁট উলটে মণিদীপা বলে, জানতে চাই না। আমি জানতে চাই, বোস সাহেব যে মেয়েটাকে নিয়ে মাখামাখি করছে সেও আপনার রিক্রুট কি না।
দীপনাথ এবার মুখ তোলে। মুখ সামান্য লাল। খাস গাঢ়। চাপা গলায় সে বলে, আমাকে আপনি কী ভাবেন বলুন তো!
এ ম্যান উইদাউট ব্যাকবোন অ্যান্ড ভয়েড অব পার্সোনালিটি! আপনার মতো মানুষ বসকে সন্তুষ্ট করতে সব পারে।
দীপনাথ উঠে দাঁড়াল। কাঁধ কঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে। কোনওদিন আমার সম্পর্কে আপনার ধারণা যদি পালটায় তবে আবার দেখা হবে।
মণিদীপা তাকিয়েই ছিল। স্থির গভীর দৃষ্টি। একটু হাসল। বলল, আপনি আমার অনেক ক্ষতি করেছেন। আমার এত ক্ষতি আর কেউ কখনও করেনি। কিন্তু মুশকিল হল, সেটা আপনি টের পাচ্ছেন না।
দীপনাথ মণিদীপার দিকে চেয়ে বলে, সত্যিই জানি না। চারশো টাকা মাসোহারা বা অর্থনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপকে যদি ক্ষতি করা বলেন তবে ক্ষতি করেছি। কিন্তু তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। গত কয়েক মাসে বোস সাহেবের কিছু টাকা জমে গেছে। গলফ ক্লাবে একটা জমি বায়না করেছেন। এসব কি ক্ষতি?
মণিদীপা চেয়েই ছিল। ধীর স্বরে বলে, না, এসব বোস সাহেবের দিক থেকে খুবই ভাল খবর। নিজের বাড়িতে নতুন ছুকরি বউ নিয়ে থাকবে। কিন্তু তাতে মণিদীপার কী এসে যায়?
দীপনাথ গভীর শ্বাস ফেলে বলে, বিশ্বাস করুন, আমি বোস সাহেবের প্রণয়ঘটিত কোনও ব্যাপার আছে বলে জানি না।
মণিদীপা শান্ত স্বরে বলে, বিশ্বাস করছি। আপনি হয়তো এখনও অত নীচে নামেননি। তবে জেনে রাখুন, বোস সাহেব গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা নন।
আমি খোঁজ করব। ইফ ইট ইজ টু তা হলে আমি ওঁর সঙ্গে কথাও বলব।
তাতেও মণিদীপার কিছু যায় আসে না।—মণিদীপা তেমনি অকপটে চেয়ে থেকে বলে, তাতেও আমার ক্ষতিপূরণ হওয়ার নয়।
আমি আপনার আর কী ক্ষতি কবার ক্ষমতা রাখি?
কী ক্ষতি তা জানেন না?
এতক্ষণে মণিদীপার এই অস্বাভাবিক শান্ত স্বর, স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টি আর একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পেয়ে কেঁপে উঠল দীপনাথ। বলল, না, জানি না।
লোকে কি মিথ্যে বদনাম করে?
দীপনাথ চুপ করে চেয়ে থাকে।
বলুন, লোকে কি মিথ্যে মিথ্যেই কিছু রটায়?–মণিদীপা জিজ্ঞেস করে।
দীপনাথ মুখ নামিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলে, আমি জ্ঞানত আপনার কোনও ক্ষতি করিনি।
মণিদীপা যে সুখে নেই তা কি জানেন?
মাথা নাড়ে দীপ। জানে।
কেন, তা জানেন না?
মৃদু স্বরে দীপনাথ জিজ্ঞেস করে, আমি কি তার কারণ?
হিংস্র অস্ফুট চাপা স্বরে ক্রোধ হতাশা অপমানকে মুক্তি দিয়ে মণিদীপা বলে ওঠে, আপনি! শুধু আপনি! আর কেউ নয়। আর কিছু নয়। দয়া করে আমার আর ভাল করতে হবে না আপনাকে। এবার যান! যান!
এরকমভাবে ভেঙে পড়ার মেয়ে মণিদীপা নয়। দীপনাথ একটু অবাক হয়ে তাকাল। মণিদীপা পেছন ফিরে আবার ফুলদানিতে ফুল সাজাচ্ছে। কাঁদছে কি না তা পিছন থেকে বোঝা গেল না।
প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়েছে দীপনাথ। গাঢ় এক ভালবাসা বহুকাল যাবৎ তার বুক থেকে ওই কিশোরীপ্রীতম মেয়েটির দিকে বয়ে যাচ্ছে। এত লোভনীয় বহুকাল যাবৎ তার কাছে আর কেউ নয়। এই তো সময়। উঠে গিয়ে শুধু একবার স্পর্শ করে বলতে পারে যে, তোমাকে ভালবাসি মণিদীপা। তা হলেই ও বুকের মধ্যে ভেঙে পড়বে, আর কোনওদিকে চাইবে না, তার হয়ে যাবে চিরকালের মতো। বড় অসুখী মণিদীপা, বহুকাল এই পরের ঘরে বাস করছে।
লোভ হল, বড় লোভ হল আজ। সমস্ত শরীর পিপাসায় উন্মুখ। পলকা ডিমসুতোর মতো একটু নীতিবোধের বাধা আছে বটে, সেটুকু ছিঁড়তে কষ্ট নেই।
ঘর ভাঙবে দীপনাথ? ভিতরে ভিতরে সেই সিরিওকমিক স্বরটা আবার বহুকাল বাদে শুনতে পেল সে।
ঘরই কি সব? ভালবাসা কিছু নয়?
ভালবাসার মানে হল ভাল-তে বাস করা। বাস করতে ঘর চাই, দীপনাথ। পাকা ঘর। নইলে আবার কোন ভালবাসার ঘুঘু এসে তোমার ভিটেতেও চরবে। ওকে বরং এই ঘরে স্থিতু হতে দাও। নিজের সুখ-অসুখ বুঝতে দাও। সওয়া নেই, বওয়া নেই, বিয়ে কি চাট্টিখানি কথা! কত সুখ-দুঃখ সয়ে, কত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে তবে স্বামী আর স্ত্রীর ভালবাসা হয়। ওদের সময় দাও আর-একটু।
দিলাম।
দীপনাথ ওঠে।
মিসেস বোস!
মণিদীপা খুব আস্তে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। বড় চোখ, অবাক দৃষ্টি।
আমি আজ আসি।
একটু হাসল মণিদীপা, অনেকক্ষণ ধরেই যাই-যাই করছেন। এত তাড়া কিসের?
আমিও সুখে নেই। বড় জ্বালা, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না।
তাই বুঝি? আজ আমি কেবল ঝগড়া করলাম।
না। তা নয়। আপনার দুঃখ আমি বুঝি।
ধন্যবাদ। কিন্তু বেশি বুঝতে যাবেন না। তাতে বিপদ বাড়বে।
তার মানে?
বোস সাহেবকে ঘাটানোর দরকার নেই। ও আমাকে চায় না। আমি বরং চলেই যাব। আপনি শুধু কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিন ওকে বলে। আমার তো একটু ফুটিং চাই।
সেই দোকানের কথা এখনও মাথা থেকে যায়নি?
অন্য কোনও আইডিয়া আসছে না যে!
দোকান করাটা আমার পছন্দ নয় মিসেস বোস।
আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, তবে কী পছন্দ?
ভেবে দেখি। বলব। কিন্তু যা বলব শুনবেন তো?
মণিদীপা মাথা নাড়ে, শুনব। আমাকে কেউ তো গাইডেন্স দেয়নি এতকাল। আমি ভারী একা হয়ে গেছি। এত একা সহ্য হয় না।
আমি আপনার ভাল চাই। ভীষণভাবে চাই।
মণিদীপা সত্যিকারের লজ্জায় মাথা নত করে বলে, জানি। খুব জানি।
আজ যাই।
আসুন।–বলে একটু থেমে মণিদীপা আরও মৃদু স্বরে বলে, এবার ফোন করলে কথা বলব।
দীপনাথ বোস সাহেবকে এতটাই জানে যে, খুব বেশি খোঁজ-খবর না করেই সে মেয়েটির পাত্তা লাগিয়ে ফেলতে পারল পরদিন।
বোস সাহেব বোকা নয়। সন্ধের মুখে দীপনাথ হঠাৎ বিনা এত্তেলায় তার খুপরিতে ঢুকলে দীপনাথের মুখের দিকে চেয়েই বোস সাহেব বুঝতে পারে, সামথিং রং।
বসুন চ্যাটার্জি। দীপনাথ বসে এবং বিনা ভূমিকায় বলে, মহুয়া আপনার কাজিন?
বোস স্তব্ধ ও স্থির হয়ে বসে থাকে। চোখ টেবিলে। বোস সাহেবের শরীরের যন্ত্রপাতি খুব ভাল নয়, দীপনাথ জানে। তাই ওই স্তব্ধতায় একটু ভয় পেল সে। কিন্তু তবু নীরবতা ভাঙল না। ব্যক্তিত্বের লড়াইতে প্রথম রাউন্ডটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বোস সাহেব ঠিক এক মিনিট দশ সেকেন্ড বাদে বাঁ হাতের তর্জনীর ধার দিয়ে থুতনিটা ঘষে নিয়ে নড়ে বসল। তারপর খসখসে ভাঙা গলায় বলে, দরজাটা লক করে দিয়ে আসুন।
দরকার নেই। অফিস ফাঁকা।
বোস মাথা নাড়ল। মুখটা ফ্যাকাসে, অসহায়, ভিতু কেমন এক ধরনের হয়ে গেছে। হাতে একটা কাগজচাপা নিয়ে নাড়তে নাড়তে তেমনি অদ্ভুত গলায় বলে, দীপা কতটা জানে?
সামান্যই। অন্তত মহুয়ার কথা জানে না। শুধু জানে সামথিং ইজ কুকিং।
মহুয়া আমার ডিসট্যান্ট কাজিন।
তা যোক বোস সাহেব। ইট ইজ এ রং চয়েস।
উই হ্যাভ অ্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফ্রম অলমোস্ট চাইল্ডহুড। কিন্তু পারিবারিক বাধায় বিয়ে হতে পারেনি। ওর বাবা ছিল ভীষণ কনজারভেটিভ।
বাট ইট ইজ নাউ এ ডেড কেস।
বোস মাথা নাড়ে, না, রিলেশন না থাক, উই অলওয়েজ হ্যাড দ্যাট ফিলিং ফর ইচ আদার।
বোস সাহেব!–দীপনাথের গলাটা ধমকের মতো শোনায়, ব্যাপারটা ইনএভিটেবল নয়, আমি জানি।
আমি তা বলিনি।
তবে? আপনি অতীতকে খুঁড়ে বের করছেন।
দীপার সঙ্গে আমার রিলেশন তো আপনি জানেন। অথচ আই নিড সামওয়ান। যাকে বিশ্বাস করা যায়, যার ওপর নির্ভব করা যায়।
বোস সাহেব, আপনার এক ভাই এই অফিসে কাজ করে।
বোস অবাক হয়ে বলে, ও কিছু বলেছে?
না। তবে ও শুনেছে। ওর মুখে ঘেন্নার ভাব দেখলেই তা বোঝা যায়।
বোস সাহেব পিছনে মাথা হেলিয়ে বলে, দীপা অলসো উইল হেট মি। চ্যাটার্জি, আই অ্যাম সরি। কিছু করার নেই।
দীপনাথ বিদায় নেওয়ার একটা নাটকীয় এবং জুতসই ক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। একটা সাইকোলজিক্যাল মোমেন্ট। এই কথার পরই তা পেয়ে গেল সে। আচমকা উঠে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল।