2 of 2

৬৬. গীতা পড়তে পড়তে

গীতা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে থামে প্রীতম, কোনও কোনও শ্লোক ব্যাখ্যা করে মাকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ পারে না। হাঁফ ধরে আসে। অবসন্ন লাগে।

আজ থাক, আবার কাল পড়িস। বলে মা হাত থেকে ছোট্ট গীতাটা খসিয়ে নিয়ে চলে যায়।

প্রীতম চুপ করে বসে থাকে। বেলা বাড়ে। প্রীতমের ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। আনন্দের উৎস থেকে যে বান এসেছিল তা আস্তে আস্তে সরে যায়। কিন্তু তীরভূমিতে নতুন পলিমাটির স্তরও রেখে যায় সে। আনন্দের রেশ অনেকক্ষণ তার সঙ্গে থাকে পোষা বেড়ালের মতো।

সামনে চেয়ে ছিল প্রীতম। দেখার তেমন কিছু নেই। রাস্তার ওধারে মাঠ বাড়িঘর, অনেক কঁঠাল গাছের ভিড়। কিন্তু এই তুচ্ছ দৃশ্যের মধ্যে এক আনন্দের আলো খেলা করে আজ। সদর স্ট্রিটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের যেমন একদা হয়েছিল, তেমনই কিছু কি এ? একটা ডিম ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে এক বিস্ফারিত বিস্ময়?

গরম জল করে মা যখন তাকে ধরে ধরে স্নানঘরে নিয়ে গেল তখনও তার মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, চোখে ঘোর। একটা জলচৌকিতে বসিয়ে মা তার গায়ে যখন কুসুম-গরম জল ঢেলে দিচ্ছে তখন সে স্পষ্টই অনুভব করে তার গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে অজস্র নিঝরিণী। ধুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন সমস্ত অসুখ। শরীরে আজ জীবাণুদের নিত্যকার কোলাহল নেই, মৃত্যুভয় নেই। পৃথিবীর দীন দরিদ্রতম ভিক্ষুক বা হতভাগ্যও মরার আগে কিছুক্ষণ সুখভোগ করে প্রকৃতির নিয়মে। তারও কি এই শেষ সুখ? হ্যাঁ, ভেবেচিন্তে তাই মনে হয়। হোক। এখনই যদি তার মৃত্যু হয় তবে তার কোনও দুঃখ নেই। অজানা পথ ধরে সে এক আনন্দধামে চলে যাবে। মৃত্যু যদি এ রকম হয় তবে কী সুন্দর!

ছেলেবেলার কয়েকজন বন্ধু প্রায়ই দেখা করতে আসে। বহুকাল এই সব বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মানসিকতারও বিশাল ফারাক ঘটেছে। এখন এরা আর বন্ধু নয়, চেনা মানুষ মাত্র। প্রথম প্রথম ওরা দেখা করতে এলে বলার মতো কথা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুরিয়ে যেত। মফসলের মানুষের সঙ্গে কলকাতার লোকের তফাত তো থাকবেই। কিন্তু প্রথম দিককার সেই দূরত্ব কমে এসেছে এখন। বন্ধুদের সঙ্গে বলার মতো কথা সে অনেক খুঁজে পায়।

আজ বিকেলে এল ধীরাজ। ধূপকাঠির একটা ব্যাবসা আছে তার। রবীন্দ্রনগরের শেষ প্রান্তে খুব দীনদরিদ্র একটা বাড়ি আছে তার। বউ, দুই মেয়ে আর মা নিয়ে সংসার। সবাই সারাদিন ধূপকাঠি তৈরি করে, ধীরাজ সাইকেলে করে তা বিক্রি করতে বেরোয়। খুবই কাহিল অবস্থা। দিন চলে না।

এই দীনহীন ধীরাজকে বড় ভাল লাগে প্রীতমের। একটা দেশলাই কেনার আগেও ধীরাজকে দু’বার চিন্তা করতে হয়। এই যে কষ্টের বেঁচে থাকা, তা আস্তে আস্তে ধীরাজের সব অহংবোধ শুষে নিয়ে ভারী নরম এক মানুষ করে তুলেছে তাকে।

আজ বিকেলে ধীরাজ আসতেই প্রীতম একেবারে বোকা গেঁয়ো মানুষের মতো সরলভাবে বলে উঠল, বুঝলি ধীরাজ, আমার আজ খুব আনন্দ হচ্ছে। ভীষণ আনন্দ।

সাইকেলটা বারান্দার নিচে দাঁড় করিয়ে উঠে এল ধীরাজ। সাইকেলের হ্যান্ডেলের দু’ধারে দুটি প্রকাণ্ড থলে ভরতি ধূপকাঠি! ধীরাজ কাছে এসে বসলেই তার গা থেকে বিচিত্র নানা আতর বা মশলার সুবাস পাওয়া যায়।

আনন্দের কথায় ধীরাজের মুখেও ভারী খুশির হাসি দেখা গেল। মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল, আনন্দ হচ্ছে? তার মানে তুমি সেরে উঠছ। এ খুব ভাল লক্ষণ।

সেরে উঠছি কি না সেটা কোনও পয়েন্ট নয় রে ধীরাজ! আজই যদি প্রাণটা বেরিয়ে যায় তা হলেও ক্ষতি নেই।

ধীরাজ সম্ভবত এ ধরনের আনন্দের খবর রাখে না। তবে শিক্ষিত ও সফল এই বন্ধুটির যাবতীয় কথাকেই সে মূল্য দেয়। শুধু এই মরার কথাটাকে সইতে পারে না। বলল, মরবে কেন? তুমি এত ভাল মানুষ, এত কিছু শিখেছ, জেনেছি, তুমি মরলে চলবে কেন? ভগবানের ওরকম অবিচার নেই।

ভাল মানুষরা কি মরে না রে ধীরাজ?

ধীরাজের সরলতা যেমন, তেমনি তার বিশ্বাসের জোর। বলে, মরবে না কেন? মরে। কষ্টও পায়। তবে আমরা বাইরে থেকে একটা লোককে দেখে কতটুকু বুঝি বল? এই জনাটা তো আর একটা মাত্র জন্ম নয়, অনেক জন্মের একটা যোগফল। কত জন্মে কত কী টেরাকো কাজ হয়েছে, এ জন্মে তার এফেক্ট পাচ্ছে মানুষ। আমরা যতটুকু দেখি তার এপারে ওধারে অনেক অজানা জিনিস রয়ে গেছে। জন্মের আগেও জীবন, মৃত্যুর পরেও জীবন। আমরা সংসারী মানুষ, স্বার্থপর ছোট মানুষ সব, আমাদের কাছে দুটো দরজাই বন্ধ। যারা জ্ঞানী-গুণী মহাপুরুষ ওই দুই দরজা তাদের কাছে ভোলা। তারা অবারিত দেখতে পায়, জন্ম-জন্মান্তর পেরিয়ে মানুষ চলেছে।

ভীষণ সরল মন, পেঁয়ো চাষাভুষোর মতো এই সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় প্রীতমের। খানিকটা বিশ্বাস আজকাল করেও সে। তবু বলে, শরীর ছাড়া কি বাঁচা যায়? আমি যে ভাবতেই পারি না। শরীর ছাড়া কি আমি বা তুই জন্মের আগেও ছিলাম, মরার পরেও থাকব?

ধীরাজ তেমনি অকপটে বলে, ছিলাম না? তা হলে আছি কী করে? আর আছি যখন, থাকতেও তো তখন হবেই।

ধূপকাঠির ঝাঁঝালো আতরের গন্ধটা আজ ভারী মিঠে লাগে তার। চুপ করে বহুক্ষণ বসে থাকে প্রীতম। সরল হওয়ার চেষ্টা করে, বিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এক ধরনের সচ্ছল শহুরে জীবনের বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য গ্রহণ-বর্জনের রীতিতে অভ্যস্ত বলে পাশাপাশি মনের মধ্যে সন্দেহের কাঁটাও ফুটে থাকে। বিশ্বাস কি এত সোজা?

প্রীতম বলে, আমার ঠিক তোর মতো হতে ইচ্ছে করে। একটু টানাটানির সংসার থাকবে। ঘরে তৈরি জিনিস সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে দোরে দোরে বেড়াব। আনন্দই আলাদা।

 

দুর ব্যাটা, আমার জীবনটা কি সুখের? সকাল থেকে রাত অবধি বাড়ি বাড়ি, দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানো, ওর মধ্যে কোনও আনন্দ নেই।

আমার যে বড় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে রে ধীরাজ।

আমারও করে। কিন্তু আমার তো হবে না। জন্ম বয়সে কর্ম করেছিলাম একবার মাকে নিয়ে কামাখ্যা ঘুরে। এখন একেবারে কুয়োর ব্যাং। তোমার মতো লেখাপড়া শিখলাম না, চাকরি করলাম না।

চাকরি কি বেশি সুখের ব্যাপার নাকি? আমিই বরং রেগেমেগে কতবার চাকরি ছাড়ার কথা ভেবেছি।

তবুও আমাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থার চেয়ে তো ভাল।

প্রীতম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

ধীরাজ বিস্ময়ের চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। বলে, তুমি মাঝে মাঝে এমন সব দুঃখের কথা বলো যা শুনলে আমার অবাক লাগে। নিঃসঙ্গতা, ন কমিউনিকেশন, মৃত্যুভয় এসব আমাদের কাছে কেতাবি ব্যাপার বুঝলে? তোমার হয়তো ছাইরঙা আকাশ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়, আমার কিছুই হয় না। তুমি হলে খুব সূক্ষ্ম অনুভুতির মানুষ। আর আমাদের সব মোটা দাগের ব্যাপার।

সূক্ষ্ম অনুভূতির নিকুচি করি। তোর মতো দায়ে পড়ে সংসারের ঘানিতে পেষাই হয়ে বেরোলে আমি বেশ একখানা ঝরঝরে মানুষ হতাম।

যাঃ, কী যে বলো!

তোর বাড়িতে একদিন নিয়ে যাবি?

তার আর কথা কী? কালই চলে। রিকশায় দশ মিনিটও নয়। তবে মাঝখানে সুভাষপল্লির রাস্তাটা একটু খারাপ, কঁকুনি-টাকুনি লাগতে পারে।

ঝাকুনিতে কিছু হবে না। যাব।

ধীরাজ খুব খুশি হয়ে বলে, বাড়ির এম• অবস্থা যে কাউকে যেতে বলতে লজ্জা করে। তুমি নিজে থেকে যেতে চাওয়ায় এত ভাল লাগল!

প্রীতম প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলে, আজ ধূপকাঠি কীরকম বিক্রি হল?

উদাস হয়ে ধীরাজ বলে, বাঁধা গাহেক কিছু আছে, তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসি। বিক্রিবাটা ভাল নয়। প্রচণ্ড কম্পিটিশন। মালমশলার দামও চড়া।

অন্য কিছু ব্যাবসা করিস না কেন?

অনেক কিছু করার চেষ্টা কি আর করিনি? কয়লার দোকান দিলাম, চানাচুর বানালাম, আলুও বেচেছি, কিন্তু কোনওটাতেই মার্কেট পাওয়া গেল না। অল্প পুঁজির কারবার তো, চটপট রিটার্ন না পেলে পেটে গামছা বাঁধতে হয়। লগ্নীর টাকা পেট্টায় নমঃ হয়ে যায়। সবই তো বোঝে। তুমি কত বড় অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

প্রীতম ম্লান হাসল। ধীরাজের আয়-ব্যয়ের হিসেব কষতে বসলে সে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে দেখবে ডেবিট-ক্রেডিটে অনেক ভুতুড়ে এন্ট্রি, অনেক অলৌকিক যোগ-বিয়োগ। সে জানে, ধীরাজের আয় মাসে দুশো টাকাও নয়। দুই মেয়ে, এক ছেলে, বউ, মা নিয়ে সংসার। প্রীতম মাথা নাড়ে, না, কোনও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের পক্ষেই সম্ভব নয় ওর ব্যালান্স শিট তৈরি করা। তার জন্য দরকার ম্যাজিক জানা।

ধীরাজ একটা শ্বাস ফেলে বলে, তবে সান্ত্বনা কী জানো, দুনিয়ায় আমার চেয়েও খারাপ অবস্থায় লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ বেঁচে আছে।

প্রীতম আনমনে মাথা নাড়ল। পৃথিবীতে কে কেমনভাবে বেঁচে আছে তা নিয়ে বহুকাল সে সত্যিকারের মাথা ঘামায়নি। দুঃখ-দুর্দশায় নাভিশ্বাস ওঠা এই দেশে যে সে নিজে সপরিবারে না খেয়ে মরবে না এবং মোটামুটি সুখেই থাকতে পারবে এটা বুঝেই তৃপ্ত ছিল। মাঝে মাঝে ভিখিরিকে ভিক্ষে দেওয়া, সমবেদনা বোধ করা এবং মানুষের জন্য কিছু করা উচিত বলে ভাবা, এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না তার।

ধীরাজ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে সে পৃথিবীর মানুষজন নিয়ে ভাবল। বুকের মধ্যে ভারী একটা চাপ কষ্ট। মরেই যদি যেতে হয় তবে দুনিয়ার আরও কিছু মানুষের সঙ্গে চেনা-জানা থোক। সারাজীবনে মাত্র গুটিকয় মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, অথচ পৃথিবীতে কত কোটি কোটি মানুষ।

রাত্রিবেলা শতম তার মাথায় জপ করতে এলে প্রীতম গম্ভীর মুখে বলে, তোর নামজপে কাজ হচ্ছে। আমি অন্যরকম ফিল করছি।

শান্ত হাসিমুখে শতম বলে, জপাৎ সিদ্ধিৰ্জপাৎ সিদ্ধিৰ্জপাৎ সিদ্ধি ন সংশয়ঃ।

মানছি।

তবে এই নাম নিজেই নাও না কেন?

এক জায়গায় মাথা মুড়োতেই হবে?

শতম গম্ভীর হয়ে বলে, এই যে তুমি এত অ্যাকাউন্টেন্সি শিখেছ, এই তুমিও তো একদিন এক দুই লিখতে জানতে না, অ আ ক খ জানতে না। কেউ হাত ধরে দাগা বুলিয়ে বুলিয়ে শিখিয়েছিল। তাই না? তখন তো সংশয় ছিল না। এখন জীবনের হিজিবিজি অনেক হিসেবনিকেশ জট পাকিয়েছে, কেউ যদি জট খুলতে শেখায় তবে আপত্তি কী?

প্রীতম চুপ করে চোখ বুজে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে আপন মনে বলে, জপাৎ সিদ্ধিৰ্জপাৎ সিদ্ধিৰ্জপাৎ সিদ্ধি ন সংশয়ঃ। শতম, ন সংশয়ঃ।

আনন্দের রেশটা রইল পরদিন সকালেও। ঘুম ভেঙে চারিদিকে আবছা ভোরের নরম আলোয় এক স্নিগ্ধ জগৎ দেখতে পায় সে। শরীরে জীবাণুদের কোলাহল নেই, একাকিত্বের বোধ নেই, মৃত্যুর বাঘ কোথাও ডাকেনি।

মরম! মরম! ওঠ, ওঠ।

ডাকছ দাদা?–বলে মরম উঠে পড়ে।

চল বাইরে। দেখ, কী সুন্দর ভোর! দরজা খুলে দে শিগগির।

খুলছি।–বলে মরম উঠে দরজা খোলে। প্রীতমের চেয়ারটা টেনে বের করে বারান্দায়।

বোসা দাদা।

প্রীতম বসে বলে, তুইও বোস। দেখ, চারদিকে চেয়ে দেখ।

মরম বারান্দার সিঁড়িতে বসে হাই তোলে। কথা বলে না। কিন্তু ঝুম হয়ে বসে সেও চেয়ে থাকে আকাশের দিকে।

প্রীতম মুগ্ধ সম্মোহিত চোখে চেয়ে থাকে। ভিতরে এক আনন্দের উৎস মুখ খুলে নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে। কোথা থেকে আসে এত আনন্দ?

ভবানীপুরের বাসা, লাবু, বিলু, অরুণ, ভিতরের সেই বিছানা সব ছায়াছবির মতো চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যায়। কিন্তু কিছুই স্পর্শ করে না তাকে।

মরম, একটা রিকশা ডেকে আন! আমি একটু বেড়াতে যাব।

বেড়াতে যাবে? পারবে?

পারব। যা।

আমি সঙ্গে যাব কিন্তু।

যাবি।

মা যদি বকে?

বকবে না। দেরি করিস না, যা।

মরম যায় এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই রিকশা নিয়ে আসে।

বারান্দা থেকে প্রীতমকে ধরে ধরে নিয়ে রিকশায় তুলবে বলে হাত বাড়িয়েছিল মরম। প্রীতম হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে, পারব। আজ পারব।

শুধু রিকশায় উঠবার সময় একটু ভর দিতে হল। কিন্তু স্বচ্ছন্দেই উঠে বসতে পারল প্রীতম।

আমি বরং সাইকেলটা নিয়ে আসি দাদা। রিকশায় দু’জন উঠলে তোমার কষ্ট হবে। মরম বলে।

যা, নিয়ে আয়।— অন্যমনে বলে প্রীতম। জাগতিক কথাবার্তা তার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে অনেক জরুরি হল বেরিয়ে পড়া। কী যে একটা কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে জগৎ জুড়ে! তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শিলিগুড়ির অতি পরিচিত হাকিমপাড়া ছাড়িয়ে তিলক ময়দান, রোড স্টেশন, সেবকের মোড় হয়ে মহানন্দার পাড়। পিছন থেকে মরম চেঁচিয়ে বলে, আরও যাবে বড়দা?

হ্যাঁ। আরও একটু।

হিলকার্ট রোড ধরে জনবিরল পিচ রাস্তা বেয়ে বহু দূর চলে আসে রিকশা। কুসুম-রঙা রোদ উঠল পুবে। প্রীতম শুধু দৃশ্যাবলী দেখছে না। এই পৃথিবীর গভীরতায় আজ পরতে পরতে ড়ুবে যাচ্ছে সে। মিশে যাচ্ছে এই রোদ, হাওয়া, গাছপালা ও শূন্যের মধ্যে।

যখন প্রীতম ফিরে এল তখন বাইরের বাবান্দায় উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা, বাবা আর ছবি। রূপম স্কুটারে বেরিয়েছে খবর করতে। বাইরের রাস্তায় খালি গায়ে দাড়িওয়ালা শতম বুকে হাত দিয়ে বিশাল চেহারা সটান সোজা দাঁড়িয়ে আছে।

মরম সাইকেল থেকে নামতে নামতে সভয়ে বলে, আমার দোষ নেই, বড়দা নিজেই গেল। আমি শুধু সঙ্গে–

মা ধমক দিয়ে বলে, তা আমাকে বলে যাবি তো! রোগা ছেলেটাকে নিয়ে বেরিয়েছিস। চিন্তায় আমার মধ্যে আর আমি নেই।

শতম শুধু প্রীতমের দিকে চেয়ে শান্ত মুখে একটু হাসল।

 

শরীর ভরে এমন দুর্বহ ক্লান্তি আগে ছিল না বিলুর। আজকাল সন্ধেবেলা যখন ফেরে তখন দম ফুরিয়ে যায় যেন। অনেকক্ষণ শুয়ে বসে বিশ্রাম না নিয়ে কোনও কাজে হাত দিতে পারে না।

প্রীতম যাওয়ার পর ফ্ল্যাটটাকে নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে বিলু। প্রীতম যে ঘরে থাকত সেটা এখন লাবুর ঘর। বড় চৌকিতে লাবু আর অচলা শোয়। আলাদা ঘরে বিলু একা। রাত্রিবেলা তার একটানা নির্বিঘ্ন ঘুম দরকার বলেই এই ব্যবস্থা। লাবু বড় হাত-পা ছড়িয়ে শোয়, ছটফট করে ঘুমের মধ্যে, দাঁত কিড়মিড় তো আছেই, ওকে নিয়ে শুলে বিলুর ঘুমের অসুবিধে হয়।

বিদেশ থেকে ঘুরে এসে অরুণ তাকে একদিন বলেছে, বিলু। ইউ নিড সেক্স।

বোকা-বোকা কথা বোলো না।

মুশকিল হল, তুমি নিজেই জানো না যে, ইউ নিড সেক্স।

না অরুণ, ওসব নয়। আমি এমনিতেই টায়ার্ড। আমার দরকার অনেক ঘুম।

তোমার ম্যালনিউট্রিশনও হচ্ছে। ডাক্তার দেখাবে?

দূর! কথায় কথায় কেউ ডাক্তার দেখায়? আমার অসুখ কোথায়?

তোমার অসুখ হয়েছে, জানতি পারতিছ না।

ইয়ারকি কোরো না।

তুমি রোজ কী খাও বলো তো?

সবাই যা খায়।

এনাফ অফ প্রোটিন ভিটামিন?

অত জানি না। মাছ মাংস ডিম মাখন তো কম গিলছি না বাপু। প্রোটিন-ট্রোটিন কতটা কী যাচ্ছে ভিতরে কে জানে!

হজম হয়?

আমার কোনওকালে হজমের প্রবলেম নেই।

তা হলে কেন টায়ার্ড ও ফিলিং লোনলি?

কী করে বলব কেন টায়ার্ড। আর লোনলি ফিল করার মতো সময় পাই কোথায়?

ডাক্তার দেখাও। তবে আমার মতে ইউ নিড সেক্স, ব্রুটাল সেক্স।

তুমি এবার বাইরে গিয়ে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে এসেছ।

সত্যি কথা বলব বিলু? তোমাদের পেটে খিদে আর মুখে লাজ আমার একদম পছন্দ নয়। সেইজন্য আমার বিদেশ বেশি ভাল লাগে, সেখানে প্রিটেনশন নেই। দে নিড ইট, দে ড়ু ইট।

বিলু ধমক দিয়ে বলে, আমার খিদে নেই, নিড নেই। আমি অন্য কোনও কারণে টায়ার্ড। আমার কাছে সবটাই ভীষণ মিনিংলেস হয়ে যাচ্ছে।

কোনটা?

সবকিছু। চাকরি, সংসার, ইভন বেঁচে থাকা।

দেন ফল ইন লাভ উইথ মি।

লাভ কী? তুমি তো কদিন বাদেই টোপর মাথায় দিয়ে ছাঁদনাতলায় গিয়ে বসবে।

নাও হতে পারে সেটা। আমি অনেক ভেবে দেখলাম ইট বেটার বি ইউ।

এ কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিলু। তারপর আচ্ছন্ন এক মুখ তুলে বলে, শুনে একটুও আনন্দ হল না, কেঁপে উঠলাম না, নতুন কিছু মনে হল না তো অরুণ!

তুমি ভীষণ ফ্রিজিড হয়ে যাচ্ছ। রাউজ, রাউজ ইয়োরসেলফ।

আমি ভীষণ টায়ার্ড। কিন্তু সেটা শরীরের ক্লান্তি নয়। মনটাই কেমন ব্ল্যাংক।

চলো, আজ তোমাকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাব।

তোমার বদমাইশির অ্যাপার্টমেন্টে আমি আর যেতে রাজি নই।

মোটেই বদমাইশি নয়। বিয়ে করে ঘর বাঁধব বলে এক কাড়ি টাকায় কেনা ফ্ল্যাট। ইয়ারকি কোরো না! চলো।

প্রতিরোধ্য অরুণকে ঠকাবে কী করে বিলু? তাছাড়া এই যে ক্লান্তি, এই যে ফাঁকা মন এর জন্যও একটা ঝকানি দরকার। হয়তো অরুণ ঠিকই বলছে। কে জানে!

ইচ্ছে-অনিচ্ছের মাঝামাঝি দোল খায় বিলু। আর সেই দ্বিধার রন্ধ্রপথে অরুণ তার পথ করে নেয়। সেই সাজানো সুন্দর ঈর্ষণীয় তিন ঘরের ফাঁকা পড়ে থাকা ফ্ল্যাটে নিজেকে বিসর্জন দেয় বিলু।

কিন্তু যখন একটু রাতে ভবানীপুরের বাসায় তাকে পৌঁছে দেয় অরুণ, তখন গলিপথটুকু একা হেঁটে আসতে আসতে সে টের পায়, ভূতের মতো তার ঘাড়ে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে সেই ক্লান্তি, সেই অবসাদ।

বহুদিন প্রীতমকে চিঠি লেখেনি সরাসরি। বাড়ির অন্য লোককে লিখেছে। আজ কী ভেবে রাতে বিলু একটা ইনল্যান্ডে প্রীতমকে লিখল, ভাবছি কিছুদিন ছুটি নিয়ে তোমার কাছে যাব। এখানে ভাল লাগছে না। তুমি কেমন আছ?…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *