শমিতা চিৎকার করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তোকজন যখন এসে তাকে তুলল, তখন দাঁতে দাঁত লেগে গেছে, দু’ হাতে শক্ত মুঠো, গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
ভূত! ভূত! চিৎকারটা শুনেছিল অনেকেই। কিন্তু কী দেখে ভয় পেয়েছে তা কেউ বুঝতে পারছিল না।
চামচের উলটো দিক ঢুকিয়ে শমিতার দাঁত আলগা করে দিল বৃন্দা। গরম লোহার হ্যাঁকা দেওয়া নুন খাওয়ানো হল। জলের ঝাপটা চলছিলই।
সকলেই উদ্বিগ্ন। কিন্তু সোমনাথ ক্রুদ্ধ। সে বার বার সেজদার কাছে মৃদু স্বরে নালিশ করছে, কনসপিরেসি! ওকে কেউ ভয় দেখিয়েছে। আমি এর শোধ নেব সেজদা।
মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই চোখ খুলল শমিতা। তবে চোখের দৃষ্টি বোবা, শূন্য। প্রকৃত চেতনা ফিরতে আরও অনেকটা সময় নিল সে।
সোমনাথ যত আস্তেই বলুক তার কথাগুলো কানে গেছে তৃষার। তার মুখ থমথমে। শমিতাকে প্রথম প্রশ্ন করল সে-ই, কাকে দেখেছিলি বল তো ছুটকি ঠিক করে? কী হয়েছিল?
শমিতা একটু শিউরে উঠে চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে বলল, নতুন বাড়ির আলসেয় বড়দা দাঁড়িয়েছিলেন।
বড়দা?
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা। খুব লম্বা-চওড়া। বাবরি চুল।
স্পষ্ট দেখলি?
একদম স্পষ্ট।
তৃষা কাউকে কিছু বলল না। নিঃশব্দে গিয়ে নিজের বড় টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
নতুন বাড়ির ভিতরে পাতলা অন্ধকার। তৃষা টর্চটা জ্বালল না। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। এ বাড়িতে এতকাল থেকেও সে কোনওদিন মল্লিনাথের ভূতকে দেখেনি। শমিতা ভাগ্যবতী, তাই দেখেছে, তবে ভূত নয়।
ছাদ পর্যন্ত উঠতে দমে টান পড়ল তৃষার, সিঁড়ির চাতালে দাঁড়িয়ে একটু দম নিল সে। ছাদের একধারে জলের ট্যাংক সদ্য বসানো হয়েছে। বেশ বড় ট্যাংক।
তৃষা নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। তবে বুকটা সামান্য দুরদুর করে। সে তো জানে কে আছে আড়ালে। এই পৃথিবীতে একমাত্র একজনেরই মুখোমুখি হতে সে অস্বস্তি বোধ করে।
ডাকতে হল না। তৃষার নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পেয়েই জ্যোৎস্নায় অকপটে বেরিয়ে এসে ভূতটা দাঁড়ায়। জ্যোৎস্নাতে তাকে আজ মল্লিনাথ বলে ভুল করতে ইচ্ছে হল তুষারও।
তৃষা কিছু বলার আগেই সজল বলল, আমি কী করে জানব যে কাকিমা ওরকম ভয় পাবে?
তুই এখানে কী করছিলি?
হাওয়া খাচ্ছিলাম।
তৃষা জ্যোৎস্নায় তার সামনের বিভ্রমের দিকে চেয়েছিল। মল্লিনাথ যেন রূপ ধরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে মা, তবু তার চোখেও ধাঁধা লেগে যায়।
তৃষা একটু তেতো গলায় বলে, তোর হঠাৎ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরার শখ হল কেন?
বাঃ, এখন লম্বা হয়েছি না! হাফপ্যান্ট পরলে সবাই খ্যাপায়।
কথাটা ঠিক।
তৃষা মৃদু স্বরে বলল, আস্তে করে নেমে যা। সকলের চোখের সামনে যাওয়ার দরকার নেই। বিন্দুদের বাসায় গিয়ে পোশাক পালটে শুয়ে থাক।
সজল একটু মাথা উঁচু করে তেজি গলায় বলল, লুকোচুরির কী আছে? আমি তো কোনও খারাপ কাজ করিনি।
তৃষা তেতো গলায় বলে, খারাপ কাজ করিসনি তো কাকিমা যখন চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল তখন নেমে গিয়ে ধরিসনি কেন?
আমি বুঝতে পারিনি যে, কাকিমা আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আমি বরং চেঁচামেচি শুনে চারদিকে ভূতটাকে খুঁজলাম!
কথাটা পুরো সত্যি নয়, তৃষা জানে। তবে সে তর্ক না করে শুধু বলল, তবু এখন লোকের সামনে যাওয়াই ভাল। সোমনাথের সন্দেহ, ছুটকিকে ইচ্ছে করে ভয় দেখানো হয়েছে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছিল। কথার আওয়াজ। একাধিক লোক ছাদে তদন্ত করতে আসছে।
তৃষা ছেলের দিকে চেয়ে বলল, কী করবি?
বিরক্ত গলায় সজল বলে, যাচ্ছি।
তারপরই অত্যন্ত লঘু অভ্যস্ত হাতে-পায়ে সে ছাদের পিছন দিকের বাঁশের ভারা বেয়ে চোখের পলকে নেমে হাওয়া হয়ে গেল। তৃষা ন্যাড়া ছাদটার পাশে গিয়ে উঁকি মেরে নিশ্চিন্ত হয়। তারপর টর্চ জ্বেলে চারদিকে দু-তিনটে সিগারেটের অবশিষ্ট টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে ফেলে দেয়।
দীননাথ আর সোমনাথ ছাদে এসে দাঁড়ায়।
দীপনাথ বলে, সাহস বটে তোমার। এইমাত্র একজন ভূতের ভয় পেল যেখানে, সেখানে তুমি একা এলে কোন সাহসে?
তৃষা গম্ভীর মুখ করে বলে, আমরা তো গাঁয়ের লোক, অত ভয় থাকলে আমাদের চলে না।
সোমনাথ জিজ্ঞেস করে, কাউকে দেখলে?
তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ছুটকিটা ভুল দেখেছে।
সোমনাথ একটু রাগের গলায় বলে, ভুল তো বটেই। তবে দেখেছে না দেখানো হয়েছে সেইটাই প্রশ্ন।
গত দুদিন ধরে সোমনাথ আর শমিতা এ বাড়িতে আছে বটে, কিন্তু তারা এখনও সজলকে দেখেনি, তৃষা জানে। পরীক্ষার পড়ার ক্ষতি হবে বলে শ্রাদ্ধের তিন-চারদিন আগেই সজল গিয়ে তার বন্ধু বিন্দুদের বাড়ি উঠেছে। সজল বেশি লোকজন সহ্য করতে পারে না। তাই ক’দিন বাড়িমুখো হয়নি। কী খেয়ালে আজ হঠাৎ যে চুপি চুপি এসে ছাদে উঠেছিল! সিগারেট খেতেই কি? ছোট্ট সজল যে খোলস ছেড়ে কতটা অন্য রকম হয়েছে তা দেখে তৃষাই চমকে যায়, শমিতা বা সোমনাথ তো যাবেই। কিন্তু সজলের কথাটা এখন ভাঙারও মানে হয় না।
তৃষা মৃদু স্বরে বলল, ছুটকিকে কে ভয় দেখাতে যাবে বলো তো? তুমি সব সময়ে অন্য রকম ভাবো কেন? স্বাভাবিক কিছু ভাবতে পারো না?
সোমনাথ তৃষার গলার স্বরে মৃদু ইস্পাতের স্পর্শ টের পেল ঠিকই। সেই মায়ের স্মৃতি সে ভুলে যায়নি। এখানে বউদির লোক তাকে মেরে পুঁতে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না। সোমনাথ সামলে গেল।
দীপনাথ চারদিকটা ঘুরে ঘুবে দেখছিল। হঠাৎ বলল, যেই হোক, এই সরু কার্নিশের ধারে তার দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই দুঃসাহসের কাজ।
কথাটার মানে সোমনাথ বুঝল না। তৃষা বুঝল।
দীপনাথ কী যেন একটা কুড়িয়ে নীচে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর বলল, না, কেউ ছিল বলে মনে হয় না। শমিতা উপপিস-টুপোস করে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভুলই দেখেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় নানা রকম দেখা যায়।
তিনজন নেমে এল আস্তে আস্তে।
সোমনাথ তার ঘরে চলে গেল। দীপনাথ একটু পিছিয়ে তৃষার দিকে চেয়ে একটু রাগের গলায় বলল, ওকে ওরকম কার্নিশের ধারে দাঁড়াতে বারণ কোরো। পড়ে গেলে কী হত?
তৃষা বলে, বারণ শোনে নাকি?
কোন বাড়িতে গিয়ে পালিয়ে আছে যেন?
বিন্দুদের বাড়ি। কাছেই।
বুলু আর শমিতা কাল চলে যাবে। তার আগে যেন এ বাড়িতে না আসে, খবর পাঠিয়ে দিয়ে।
দেব।
সিগারেট খায় নাকি?
তাই তো দেখছি।
একটা টুকরো কুড়িয়ে পেলাম কার্নিশের ধারে।
আমিও পেয়েছি।
এ কথার পর দুজনেই পরস্পরের দিকে চেয়ে হেসে ফেলে।
দীপনাথ হাসতে হাসতেই ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, আজকালকার ছেলে। যা-ই হোক, ওকে বোলো এই বয়সে সিগারেট ধরলে আর বক্সার বা কুংফু মাস্টার হওয়ার আশা নেই। এ কথাটা বললে কাজ হবে।
তৃষা বলল, তার চেয়ে বেশি কাজ হবে বড়কাকা বারণ করে গেছে বললে।
তবে তা-ই বোলো।
তৃষা আচমকাই বলে, আমেরিকা কবে যাচ্ছ?
খুব শিগগির। হয়তো সামনের মাসে।
ছ’ মাস থাকবে?
তাই কথা আছে। তবে বেশি দিনও থাকতে হতে পারে।
চিরদিনের জন্য থেকে যাবে না তো?
থাকলে দোষ কী? আমার তো পিছুটান নেই।
তোমার নেই জানি। তোমার মায়া-মমতাও বড় কম। কিন্তু আমাদের তো তা নয়। তুমি গেলে আমার মনটা ভারী খারাপ হবে।
জানি বউদি।–বলে দীপনাথ হঠাৎ একদম চুপ হয়ে গেল।
মাঝরাতে সোমনাথের ঘরে আবার হানা দিল ভূত।
মাথা গরম ছিল বলে সোমনাথের ঘুম গাঢ় হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে জেগে উঠে জল আর সিগারেট ধরায়। আবার খানিকক্ষণ ঝিমুনির মতো আসে। তৃষার অন্যান্য বিষয়সম্পত্তি, শমিতার ভূত দেখা থেকে শুরু করে অতীতের সব স্মৃতি তাকে বড় জ্বালাচ্ছিল।
মাঝরাতে যখন বেশ লম্বা একটা ঝিমুনি এসেছে তখনই সে মৃদু ডাক শুনল, বুলু! এই বুলু!
চটকা ভেঙে চাইল সে। অবিকল বড়দার গলার স্বর। অবিকল। শিয়রের জানালায় শেষ রাতের একটু অবশিষ্ট জ্যোৎস্না ছিল। চোখ গেল সেদিকেই।
পাঞ্জাবি পরা বড়দা দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা।
সোমনাথ কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেল ভয়ে। এমনকী চোখের পাতাটা পর্যন্ত ফেলতে পারল না। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
বড়দা বলল, দাবি ছাড়িস না। এই সম্পত্তিতে তোরও অধিকার।
ব্যস, তারপরই বড়দা মিলিয়ে গেল জ্যোৎস্নায়।
যখন মিনিট দশেক পর সে শমিতাকে ডেকে তুলল তখন তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। চোখ অস্বাভাবিক।
স্বামী-স্ত্রী বাকি রাতটা আর ঘুমোল না। বাতি জ্বেলে পরস্পর গা ঘেঁষে বসে রইল।
সোমনাথ বলল, বড়দা আজ আমাদের দু’জনকেই দেখা দিয়েছে!
শমিতা বড় অবাক এখনও। বলে, কেন বলো তো? আমার ভীষণ ভয় করছে।
বড়দা দাবি ছাড়তে বারণ করে গেল।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু এখন আমরা কী করব? দিদির হাতে যে অনেক গুন্ডা।
তা হোক। বড়দা যখন বলে গেছে তখন আমরা একনি না একদিন সম্পত্তি পাবই।
সকাল হতেই সোমনাথ সবিস্তারে রাতের ঘটনা জনে জনে রটিয়ে বেড়াতে থাকে। কিন্তু বলতে বলতেও সে বুঝতে পারে, কথাটা কেউ খুব একটা বিশ্বাস করছে না।
সকালের চায়ের আসরে ঘটনাটা শোনার পর দীপনাথ একটু হেসে বলল, বড়দা যে কেন তোদের দুজনকেই সম্পত্তির দাবি ছাড়তে বারণ করল সেটাই তো বুঝছি না। ভাইয়ের সম্পত্তিতে যদি ভাইয়ের দাবি থাকে তবে আমিও তো বাদ যাই না।
তোমার তো দরকার নেই সেজদা। তুমি চার হাজার টাকা মাইনে পাও।
মাইনের সঙ্গে দাবির কী সম্পর্ক তা বুঝল না দীপনাথ। তবে আড়ালে গিয়ে তৃষাকে বলল, সজলটা বড় বাড়াবাড়ি করছে। ওর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।
পরে বোলো। ওরা চলে যাক।
আমাকেও যে সকালের গাড়িতেই যেতে হবে। ছুটি নেই।
রবিবারেও কাজ?
আমাকে রবিবারেও যেতে হয়।
দেরি করে যেয়ো। আমি সকালে ওর কাছে গিয়েছিলাম। মুখে গুচ্ছের পাউডার মেখে সাদা করেছিল রাত্রে। সেই পাউডার তখনও লেগে আছে।
কী বলল?
কিছু না। কোনও জবাব দিল না।
ও কি সোমনাথকে তোমার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিতে চায়?
তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বোধ হয় তাই।
কেন বলো তো বউদি?
তৃষা এক অদ্ভুত ক্লান্ত চোখে দীপনাথের দিকে চেয়ে বলল, তোমাকে অনেকদিন আগেই তো বলেছি, আমার আপনজনেরা কেউই আমার বন্ধু নয়। তার মধ্যে ছেলেটা আরও বেশি শত্রু। আমি মরলে ও খুশি হয়।
দীপনাথ এ কথার জবাব দিল না। চেয়ে রইল।
আমেরিকা যাচ্ছ যাও। এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমারই পাপের শাস্তি। একদিন হয়তো খবর পাবে, বউদি নেই।
সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছ বউদি।
না গো। আমি অত সহজে ভেসে যাই না। সহজে ভেসে যাবও না।
আমি সজলের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। বিন্দুদের বাড়ি কোন দিকে?
সঙ্গে তোক দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু গিয়ে লাভ হবে না। এতক্ষণে হয়তো বাসা থেকে বেরিয়েই গেছে।
সজলকে তুমি সামলাতে পারছ না, না বউদি?
না। এই একটি জায়গায় আমি হেরে যাচ্ছি।
ও একটু ওয়াইল্ড। কিন্তু ওর মধ্যে জিনিস আছে।
সে তোমরাই বুঝবে।
হি হ্যাজ পার্সোনালিটি।
হবে বোধহয়।
দীপনাথ একটু হাসল। আর কিছু বলল না। সাত-পাঁচ ভেবে সে বিন্দুদের বাড়িতেও হানা দিল। দুনিয়ার সব বিবাদই যে অশুভ এমন নয়। হঠাৎ তার মনে হল আজ, এই যে বউদির সঙ্গে সজলের অ-বনিবনা এর মধ্যেও একটা অস্তিবাচক কিছু আছে। একনায়কতন্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে যেমন শক্ত বিরোধীদের দরকার হয়, এও হয়তো তাই। তৃষার “পাপের শাস্তি” কথাটা সারাক্ষণ কানে লেগে আছে দীপনাথের। পাপ! কীরকম পাপ? পাপ বলতে কি মল্লিনাথের সঙ্গে সেই অবৈধ প্রণয়? সজল সেই প্রণয়ের মুর্তিমান জলজ্যান্ত প্রমাণ! আজ সজলের দিকে তাকালে, যারা মল্লিনাথকে চিনত তাদের আর কোনও সন্দেহ থাকবে না।
সেই পাপের একটু শাস্তি তো তৃষারও হওয়া দরকার। দীপনাথ তাই সজলের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করল না। যা হচ্ছে হোক। হয়তো ভালই হবে তাতে।
কয়েক দিনের মধ্যেই সোমনাথ একটা বেনামা চিঠি পেল: মহাশয়, আমি গোপনসূত্রে জানি মল্লিনাথ চট্টোপাধ্যায় তাহার সমুদয় সম্পত্তি তিন ভাইয়ের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করিয়া একটি উইল রাখিয়া গিয়াছেন। শ্রীনাথবাবুর স্ত্রী-র সিন্দুকে সেই উইল লুকানো আছে। তিনি একটি জাল উইল দ্বারা সম্পত্তি দখল করিয়াছেন। মল্লিনাথবাবুর প্রেতাত্মা আপনাকে যে দেখা দিয়াছিলেন তাহা আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি…ইত্যাদি।
সেই চিঠি নিয়ে সেদিনই সোমনাথ হাজির হল দীপনাথের অফিসে।
দেখো সেজদা, কী বলেছিলাম!
দীপনাথ ভ্রু কুঁচকে চিঠিটা পড়ল। বুঝল, ঘটনা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আদালতে এই চিঠি বা ভূতের গল্প টিকবে না বটে, কিন্তু লোভী সোমনাথ বিস্তর ঝামেলা পাকাবে। তার ফলে সোমনাথই নিঃস্ব হয়ে যাবে, হেরে যাবে। তৃষারও শান্তি থাকবে না। সজল এ কেমন প্রতিশোধ নিচ্ছে?
দীপনাথের গলা ধরে গেল দুঃখে, হতাশায়। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু খুব দীন আন্তরিকতায় সে বলল, বুলু, ওসব ভুলে যা…। সম্পত্তির লোভে হুট করে কিছু করে বসিস না। তোর ক্ষতি হবে।
সোমনাথ গম্ভীর মুখে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, মামলায় অনেক টাকা চলে গেছে। আবার মামলা জিইয়ে তোলার মতো টাকাও আমার নেই।
মামলা করিস না বুলু। শেষ হয়ে যাবি।
এত বড় অন্যায় মেনে নেব?
মেনেই নে৷ ওই সম্পত্তি তুই রোজগার করিসনি। দুঃখের কী?
সোমনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বলল, সেজদা, কেন যে বরাবর তুমি বউদির পক্ষ নাও তা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। লোকে বলে বউদি মারণ উচাটন বশীকরণ জানে। তোমাকে কি বউদি বশীকরণই করেছে?
দীপনাথ করুণ চোখে এই স্বার্থে অন্ধ ভাইটির দিকে চেয়ে রইল। তাদের জন্মসূত্র এক, তবু তারা কত আলাদা রকমের! সোমনাথের মতো সেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সোমনাথ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ কাজে মন দিতে পারল না সে। অনেকক্ষণ বসে বসে সে শ্রীনাথ, সোমনাথ আর বিলুর কথা ভাবল। একজন পাগল, একজন স্বার্থপর আর একজন দ্বিচারিণী। এদের পাশে নিজেকেও দাঁড় করাল সে। নিজেও কি সে ভাল? বীথির কথা মনে নেই? সুতরাং তার তিন ভাই-বোনের পাশে নিজেকেও দিব্যি মানিয়ে যেতে দেখল সে।
বহুদিন এত ভার হয়নি মন। আজ বিষণ্ণতার বাতাসে ভরে গেল তার পৃথিবী। এই কুৎসিত পৃথিবী থেকে যদি প্রীতম বিদায় নিয়ে থাকে তবে ভালই করেছে। এখানে তোকে মানাত না প্রীতম। একদম মানাত না।
পাশপোের্ট ভিসা প্লেনের টিকিট সবই তার হাতে এসে গেছে। ভেবেছিল রওনা দেওয়ার তারিখটা দিন সাতেক পিছিয়ে দেবে। একবার শিলিগুড়ি ঘুরে আসবে। কিন্তু আজ সে মত পরিবর্তন করল। তারিখ পিছানোর কোনও মানেই হয় না। বরং যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় ততই ভাল। আর কখনও এ দেশে ফিরে আসতে না হলে আরও ভাল।
লাঞ্চের পর বোস সাহেবের ফোন এল।
চ্যাটার্জি, কবে ফ্লাইট?
তেরো।
আনলাকি ডেট। শুনুন, হাউ অ্যাবাউট এ ফেয়ারওয়েল ডিনার? সময় করতে পারবেন?
কবে?
আজ বললে আজই। আমার বাসায়।
বাসায়?
হ্যাঁ। দীপা নিজে রাঁধবে।
উনি রাঁধতে জানেন?
বোস খুব হাসল হোঃ হোঃ করে। বলল, জানে। তবে ভয় পাচ্ছে, আপনি বামুন হয়ে কায়েতের হাতে খাবেন কি না!
আগে খাইনি নাকি?
ওর রান্না তো খাননি!
আপনি খেয়েছেন?
আমি! ও আগে তো রাঁধত। খেয়েছি। কেন বলুন তো?
না, জিজ্ঞেস করছিলাম, ওর রান্না খাওয়া যায় তো?
দাঁড়ান ওকে গিয়ে বলব।
রক্ষে করুন।
তবে কি আজ আসবেন? আপনি গ্রিন সিগন্যাল দিলে আমি ওকে টেলিফোন করব। শি উইল অ্যারেঞ্জ।
আজ থাক। কাল হবে।
ওকে।
বোস সাহেব, আপনার গলা শুনে মনে হচ্ছে শরীর এখন বেশ ভাল আছে।
আছে। একজন যোগীর কাছে আসন করা শিখছি।
কাজকর্ম কেমন চলছে?
কম্প্যানি লিকুইডেশনে যায়নি এখনও। ভাল কথা, সানফ্লাওয়ারে আপনার কাজকর্মের খুব সুখ্যাতি হয়েছে শুনলাম।
কে বলল?
বাতাসে শোনা যায়। আই অ্যাম প্লিজড।
ধন্যবাদ।
সুখ্যাতি আপনার পাওনাই ছিল। দেন টিল টুমরো।
টিল টুমরো।
ফোন রেখে দেয় দীপনাথ। এবং হঠাৎ টের পায়, পৃথিবী থেকে বিষণ্ণতার বাতাস বিদায় নিয়েছে। চারদিকে যেন অজস্র আলো, প্রজাপতি, সুগন্ধ।
কাল মণিদীপার সঙ্গে দেখা হবে। কাল মণিদীপার সঙ্গে দেখা হবে। কাল মণিদীপার সঙ্গে…