প্রীতম জিজ্ঞেস করে, তুই কোত্থেকে শিখলি এসব?
শতম লজ্জা পায়, শিখেছি, শিখেছি। দেখো না তোমাকে ভাল করে তুলবই।
তোর মনের জোর আছে। আমার নেই।
জোর-টোর নয়, আসলে তোমার ইচ্ছে নেই। তুমি কি বিশ্বাস করো না, যার মনে যত প্যাঁচ-ঘোচ, যত কুটিলতা জটিলতা তার তত ব্যারাম? খামোখা কারও ব্যারাম হয় না। রোগের প্রথম অঙ্কুর গজায় মনে। তারপর তা শরীরে ফুটে বেরোয়।
ম্লান হেসে প্রীতম বলে, আমার মনে বোধহয় অনেক প্যাঁচ-ঘোঁচ, অনেক জটিলতা কুটিলতা। মাথা নেড়ে শতম বলে, তা নয়। তবে তোমার একটা রোগ-বোগ বাতিক ছিল দাদা। শরীর নিয়ে তুমি বড় বেশি ভেবেছ।
তা ভেবেছি।
তোমার কখনও ভাবতে ইচ্ছে করেনি যে, এই শরীর মানুষকে দেওয়া হয়েছে কাজ করার জন্য। বসিয়ে বাখার জন্য নয়! যত শরীর-শরীর করবে তত আজ চুলকুনি, কাল পাঁচড়া, পরশু আর একটা না একটা কিছু এসে ধরবেই।
শরীরকে ভুলে যেতে বলছিস?
একদম। গতর পুষে রাখার জন্য তো নয়। মনের ওপর শরীরের সব ভালমন্দ। মনটাকে তাজা রাখো, শরীর উজ্জ্বল হবে। আর বসে বসে মরণের চিন্তা করো, শরীরে তাব ছায়া পড়ে যাবে। শরীরকে কখনও বিশ্রাম দিয়ো না। খাটাও, কেবল খাঁটিয়ে যাও।
প্রীতম হেসে বলে, বিশ্রাম নেব না?
নেবে। কে নেবে না? তবে শরীরের বিশ্রাম কেমন জানো?
কেমন?
তুমি তো অ্যাকাউন্ট্যান্ট! রোজ হিসেব-নিকেশ করতে করতে যখন ক্লান্তি আসে তখন যদি হঠাৎ একটু টেবিল টেনিস খেলো বা কবিতা লেখো, কি একটু বাগান করলে, সেইটেই বিশ্রাম। রোজকার অভ্যস্ত কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করলে শরীর বিশ্রাম পায়।
ঘুমোব না?
ঘুমোবে। দিনে রাতে চার ঘণ্টা।
বলিস কী? ডাক্তাররা যে আট ঘণ্টার কথা বলে।
বলে তোত কী? শরীরের জন্য চার ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। দেখ না কুলি-লাইনের পশ্চিমারা সার। দিন মাল বয়, অসুরের মতো খাটে, আবার কত রাত অবধি জেগে ‘রামা হে’ গান গায়। আবার ভোররাতে কাজে বেরিয়ে পড়ে। ক’ঘন্টা ঘুমোয় বলো তো! তারা বেঁচে নেই? তোমার আমার চেয়ে ঢের ভালভাবে বেঁচে আছে। ওই যে চার ঘণ্টা ঘুমোয় সে ঘুম খুব গভীর, নিপাট, গায়ের ওপর দিয়ে মোষ হেঁটে গেলেও টের পাবে না তা জানো?
জানছি।
ভুল বললাম?
প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, না। তবে এত সব ভাল করে কখনও লক্ষ করিনি।
এখন থেকে করো। শরীর নিয়ে ভেবো না।
রোজ সকালেই এরকম কিছু উজ্জীবক কথাবার্তা বলে শতম তার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুধের গ্লাস হাতে আসে। শরীর নিয়ে কখনও কিছু বলে না। কথাবার্তা অনেকটা কমে গেছে। দুধের মধ্যে অনেকটা সর তুলে নিয়ে আসে। পাশে বসে চামচ দিয়ে খুঁটে খুঁটে সরটাকে দুধের মধ্যে মেশাতে থাকে। এতে নাকি বেশি পোষ্টাই।
কিন্তু এ সবই অনভ্যস্ত অস্বাভাবিক লাগে প্রীতমের কাছে। বিলুর সঙ্গে থেকে থেকে ওই একরকম অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। বিলু কোনওদিন তার দিকে বিশেষ নজর দেয়নি, মনোেযোগী হয়নি। তবে মনকে সরিয়ে রেখে হৃদয়হীন কর্তব্য করে গেছে। আর তাইতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে প্রীতম। এখন তার প্রতি কেউ বেশি মনোযোগ দিলে, তাকে কেউ বেশি ভালবাসলে, ভারী অস্বস্তি বোধ করে সে। মাঝে মাঝে বাড়ির লোকের অতি আদরের অত্যাচারে সে বিরক্ত হয়। রেগেও যায়। মা বরাবরই তাকে খুব ভাল বোঝে। তার মুখ দেখেই মনের ভাব এঁচে নিতে পারে। তাই প্রীতমের জন্য আহা উহু সবচেয়ে কম করেছে মা।
সর ঘুঁটে দুধটা খাইয়ে নীরবে মা একটা তেল-পড়ার বোতল নিয়ে এসে হাতে পায়ে মালিশ করে দেয়। প্রথম-প্রথম বিচ্ছিরি লাগত, মাখতে চাইত না প্রীতম। আজকাল হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার অসুখের প্রথম দিকে অফিসের এক কলিগ গৌরাঙ্গ বোস হাবড়ার এক ফকিরের কাছ থেকে বার দুই মন্ত্রপূত তেল এনে দিয়েছিলেন মালিশের জন্য। সে তেল আবার আগাগোড়া হাতে করে বয়ে আনতে হত, কোথাও রাখার নিয়ম ছিল না। গৌরাঙ্গবাবু ভিড়ের ট্রেনে ঘেমে চুপসে কষ্ট করে সে তেল আনতেন। বিলুকে পই পই করে বুঝিয়ে দিতেন, কী করে মালিশ করতে হবে। বিলু সে তেল রেখে দিত। কখনও মালিশ করেনি। একদিন প্রীতম বলেছিল, গৌরাঙ্গবাবু কষ্ট করে তেলটা আনলেন, ফেলে রাখবে?
ওসব বুজরুকি দিয়ে কী হবে? তেলপড়ায় অসুখ সারলে এত লোক ডাক্তারের কাছে যেত না।
খুবই যুক্তিপূর্ণ জবাব। অবশ্য প্রীতম নিজেও তেলপড়ার গুণে খুব বিশ্বাসী নয়। কিন্তু তার মন বলত, আমি যদি তোমার প্রিয়জনই হয়ে থাকি, তবে আমার কঠিন অসুখের সময় তুমি লজিক মেনে চলতে পারো কী করে? মানুষ যাকে ভালবাসে তার একটু কিছু হলেই সে পাগল হন্যে হয়ে যায়। তখন যুক্তি থাকে না, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন থাকে না, সে তখন ডাক্তার বদ্যি, তাবিজ তাগা মাদুলি জলপড়া মাথাখোঁড়া ধরনা দেওয়া সব করে করে বেড়ায়। তাতে কাজ না হোক, উদ্বেগ আর ভালবাসার একটা জমজমাট প্রকাশ তো ঘটে। বিলুর ঠান্ডা মুখশ্রী আর ক্ষুরধার বুদ্ধির সামনে কচুকাটা হয়ে গেল প্রীতম। কিন্তু বিলু জানে না, সংসারে সব লড়াই জিততে নেই।
তেলের প্রথম শিশিটা কৌতূহলভরে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিল লাবু। গৌরাঙ্গবাবু খবর পেয়ে আবার তেল এনেছিলেন। দ্বিতীয় শিশিটা আবার তাকে তোলা রইল। মাস দুই পরে একদিন শিশিটা নজরে পড়ায় গৌরাঙ্গবাবু প্রীতমকে একান্তে বললেন, আজকালকার ওয়াইফরা কেমন বলুন তো মশাই? এদের কাছে স্বামী কি কোনও ফ্যাক্টরই নয়? আমি বলে গেলাম আপনাকে, যদি বাঁচতে চান তা হলে নিজের মায়ের কাছে চলে যান।
এখন মা পায়ের গোছ থেকে ঊরু পর্যন্ত টান টান করে ভারী এবং দুর্গন্ধযুক্ত তেলটা মালিশ করে দিচ্ছে। মুখে কথা নেই। মা জানে, প্রীতমের মেজাজ এখানে এসে ভাল থাকছে না। এখানে মন বসতে সময় নেবে। এ জীবনে তো তার বহুকাল অভ্যাস নেই।
নিষ্ঠুর হোক, শীতল হোক তবু বিলুর প্রতি এক চোখভরা তীব্র আকর্ষণ আজও আছে প্রীতমের। শুধু আছে নয়, এখানে আসার পর তা আরও তীব্র হয়েছে। সব দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে এসেছিল, তবু মন থেকে বিসর্জন দেওয়া গেল না। তেমনি বুকে ঢেউ দেয় লাবুর কথা মনে হলে। সারাদিন ভবানীপুরের সেই ঘরটার ছবি চোখে ভাসে। নাকে আসে লাবুর গায়ের গন্ধ। বিলুর স্পর্শ টের পায় যেন শরীরে।
প্রীতম ডাকল, মা!
উঁ!
শতমকে বলো, আবার আমায় কলকাতায় দিয়ে আসুক।
ভাল হ, যাবি।
আমার এখানে খুব ভাল লাগছে। কিন্তু কলকাতায় থাকলে ঘরে বসেও আমি কিছু কাজ-টাজ পাই, রোজগার করতে পারি।
মা কথাটার কোনও জবাব দিল না, কিন্তু আপন মনে বলতে লাগল, বউ-মেয়ের জন্য মন তো কেমন করবেই। কিন্তু সেখানকার যা অবস্থা শুনি কে কাকে দেখে।
প্রীতমের এসব কথাও ভাল লাগে না। চোখ ফিরিয়ে সে জানালার বাইরে কলকে ফুলের গাছটার দিকে চেয়ে থাকে। ঘন সবুজ পাতায় ঝোপ ফেলেছে জানালাটাকে। তার ওপাশে শরতের নীল আকাশ জুড়ে অফুরন্ত রোদ।
প্রীতম চুপ করে থাকে। তেল মালিশ করা শেষ হলে মা আবার নিঃশব্দেই চলে যায়।
বাড়ির লোক এ ঘরে কমই আসে। প্রীতমের বিরক্তি ও বদমেজাজ সবাই লক্ষ করেছে। এমনিতেও প্রীতমকে সবাই বরাবর একটু সমঝে চলে। বাবা একদমই ঘরে ঢোকে না। মেজো বোনটার সঙ্গে ভাব ছিল খুব এক সময়ে। সে মাঝে মাঝে আসে, গল্প করে বসে বসে। কিন্তু অল্পেই ক্লান্তি আসে প্রীতমের। তার কেবল ভবানীপুরের বাসার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে, চুপচাপ শুয়ে থাকে।
বিলুকে একটা পৌঁছ-সংবাদ দিয়েছিল প্রীতম। তারপর বিলুর তিন-চারখানা চিঠি এসেছে। প্রীতম জবাব দেয়নি। মেজো বোন ছবি এসে বহুবার বলেছে, বউদিকে চিঠি দেবে, দান? দিলে বলল, লিখে নিচ্ছি।
প্রীতম মাথা নেড়ে বলেছে, তোরাই দে। আমার ইচ্ছে করছে না।
নিজে চিঠি না লিখলেও বিলুর চিঠির জন্য উৎকণ্ঠা থাকে সব সময়ে। আজকাল বিলু বাবাকে বা শতমকে বা ছবিকেই চিঠি দেয়। বেশ ঘন ঘন দেয়। প্রীতমের সব খবর খুঁটিয়ে জানতে চায়। ওরা কী জবাব দেয় তা জানে না প্রীতম! জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু বিলুর চিঠি যখন আসে তখন বুকটা কেঁপে ওঠে উত্তেজনায়, আবেগে।
বিলুর প্রতি নিজের এই অন্ধ ভালবাসা দেখে অবাক মানে প্রীতম। ওই ঠান্ডা, নিরুত্তাপ যুক্তিবাদী নিষ্ঠুর মহিলাকে এতকাল ধরে কী করে ভালবাসছে সে?
নিজেকেই প্রশ্ন করে প্রীতম, ও যে অরুণের সঙ্গে… তোমার ঘেন্না করে না প্রীতম?
নিজেই জবাব দেয়, করে তো! শিউরে উঠি, কেঁপে উঠি ঘেন্নায় লজ্জায়। তবু অন্ধ অবাধ্য এক মমতা কেন যে মনের মধ্যে টলটল করে!
নিজেকে বিষিয়ে ফেলো, প্রীতম। অব্যাহত রাখো ঘৃণাকে। কখনও ক্ষমা কোরো না, নরম হোয়ো নাকো।
বিষিয়ে গেছি। জ্বলছি। টানটান রাখছি নিজেকে। তবু স্পঞ্জের মধ্যে যেমন লুকোনো জল নিংড়োলেই বেরিয়ে আসে এই ভালবাসাও তেমনি।
অবিশ্বাসী স্ত্রীকে ভালবাসা কি ঠিক, প্রীতম?
শোনো শোনো। আমার লাবু যদি শত অন্যায়ও করে তবু কি আমি তাকে না ভালবেসে পারি? বলো! যা-ই করুক তবু মনে হবে, ও যে আমার লাবু! আমার ছোট্ট লাবু! বিলুর প্রতি আমার ভালবাসাও অবিকল সেরকম। যা-ই করুক, যেমনই হোক, ও যে বিলু।
তোমার বিলু?
হতাশায় মাথা নেড়ে প্রীতম বলে, তা বলছি না। বিলু কার তা কী করে বলব? কিন্তু মন! মনকে কী করে মেরে ফেলা যায় বলো তো! বিলুকে আমি এক ফোটাও ক্ষমা করিনি, জানো? তবু বিলুকে মন থেকে তাড়াবই বা কী করে? যায় না যে!
কিন্তু বড় জঘন্য যে তার পাপ!
মানুষ কখনও পাপ থেকে মুক্তি পায় না, না? কিছুতেই শুদ্ধ হয় না? মুক্ত হয় না?
উত্তেজিত প্রীতম কাত হয়ে দু’হাত ভর দিয়ে উঠে বসে বিছানায়। সারা গায়ে ঘন তেলের প্রলেপ। পায়জামাটা তেলে ভিজে সপসপ করছে। গায়ের বুকখোলা শার্টটা নিংড়োলে বোধহয় এক-পো তেল বেরোবে।
রাগের গলায় প্রীতম ডাকে, মা! মা!
ছবি দৌড়ে আসে। পরনে স্কুলের খয়েরি পাড় শাড়ি, চুল আঁচড়ানো, মুখে পাউডার। বলল, কী দাদা?
দেখ তো, কী বিচ্ছিরি তেল মাখিয়ে গেছে। গা-টা মুছিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।
আমি দিচ্ছি, দাঁড়াও। মা গেছে কালীবাড়ি।
থাক গে, তুই স্কুলে যা।
কিছু হবে না, মুছে দিচ্ছি দাঁড়াও।–বলে দৌড়ে গিয়ে একটা গামছা আনে ছবি।
লজ্জা পেয়ে প্রীতম হাত বাড়িয়ে গামছাটা নিয়ে বলে, তুই যা, আমি পারব।
ছবি দ্বিধাভরে দাঁড়িয়ে থাকে একটু। আর চাপাচাপি করতে সাহস পায় না। দাদা হয়তো রেগে যাবে। বড় রেগে যায়।
আসছি তা হলে, দাদা!–বলে ছবি চলে যায়।
গামছাটা পায়ের কাছে মেঝেয় ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে প্রীতম। বুকের মধ্যে এক অক্ষম রাগের মাথা খোঁড়াখুঁড়ি। অভিমানের বান ভাসিয়ে নিচ্ছে তাকে।
গাড়োয়ান যেমনভাবে তার দুই অবাধ্য গোরুকে সামলায়, চাবুক মারে, পাঁচনের গুঁতো দেয়, ঠিক তেমনিভাবে নিজেকে লক্ষ করে প্রীতম বলে, র’-র’! শক্ত হও। শক্ত হও। তুমি কখনও এরকম ছিলে না। তুমি এরকম নও। মনে করা, পৃথিবীতে তোমার কেউ নেই। ইউ আর এ লোন বাস্টার্ড।
কিন্তু এই মনের খেলা বেশিক্ষণ খেলতে পারে না প্রীতম। বড় ক্লান্তি আসে, হতাশা, ধৈর্যহীনতা আসে।
দুপুরে শতম খেতে আসে। একবার উঁকি মারে ঘরে।
দাদা!
আয়।
ঘুমোওনি?
না।
বড় বেশি রেস্টলেস দেখছি তোমাকে।
না, না, ভাল আছি।
ভালই তো আছ। তবে কেন মাকে বলছ, কলকাতা যাবে!
ভাবছিলাম, চেষ্টা করলে হয়তো এখনও অডিটের কাজ করতে পারি ঘরে বসে। সময়ও কাটবে, কিছু টাকাও আসবে।
করবে? তা তার জন্য কলকাতা কেন, এখানেই কাজ দেব।
দিবি? দে না!
শতম দুপুরেই একগাদা কাগজপত্র সমেত গোটা তিনেক ফাইল প্রীতমের চৌকির পাশে একটা টেবিল এনে রেখে গেল। সঙ্গে রেখে গেল একটা টেপ-রেকর্ডার আর অনেকগুলো গানের ক্যাসেট। বলল, হিসেব করতে করতে টায়ার্ড লাগলে একটু গান শুনো। তুমি তো একটু-আধটু গাইতেও পারতে। গাও না কেন?
দুর, বরং হিসেব করলেই ভাল থাকব।
যা খুশি করো। শুধু মরার কথা ভেবো না।
প্রীতম অনাবিল হেসে বলে, আচ্ছা, তুই যা তো।
শিলিগুড়িতে বেশ শীত পড়ে গেছে এই শরতের শুরুতেই। দুপুরেও গায়ে একটা কিছু দিতে হয়। পায়ের জানালাটা দিয়ে রোদ আসে।
প্রীতম নির্জন দুপুরে খানিকক্ষণ ফাইলের কাগজপত্র দেখল। ছক কেটে অনেকগুলো এন্ট্রি করল। আস্তে আস্তে অ্যাকাউন্টেন্সির পুরনো নেশা খুব পেয়ে বসল তাকে। বিলু হলে বাধা দিত। এখানে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। দরজা ভেজানো। একটানা অনেকক্ষণ কাজ করে গেল সে। শতমের ব্যাবসার কাগজপত্র থেকে সে জানতে পারল, বছরে কম করেও শতম ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা রোজগার করে। জেনে ভারী খুশি হল সে।
বিকেলের দিকে ক্লান্তি এল। চোখ বুজে শুয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়ে হঠাৎ শতমের সেই কথাটা মনে পড়ল, অভ্যস্ত কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করলে মানুষের বিশ্রাম হয়। ভেবে একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসল সে। তবু এক্সপেরিমেন্ট করতে উঠেও বসল সে।
গান গাইবে? গাইত এক সময়। অল্পস্বল্প। কতকাল গায় না! ভুলে গেছে কথা সুর।
বালিশে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে নিচু স্কেলে সে গুনগুন করল কিছুক্ষণ। অনেক বিস্মৃতি আর অনভ্যাসের পলিমাটি পড়েছে গলায়। তবু কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সে মোটামুটি সুরের ওপর রেখে গাইতে লাগল, দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়…।
আশ্চর্য! ক্লান্তিটা ধীরে ধীরে কেটে গেল।
শতম অনেক রাতে এসে হানা দিল ঘরে। বলল, দেখি, কী করলে সারাদিন!
কাগজপত্র উলটেপালটে দেখে বলল, বাঃ! এ যে অনেকটা হিসেব করে ফেলেছ। বলে খানিক চুপ করে শতম বলে, তোমাকে খাটাচ্ছি জানলে বউদি আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু না খাটালে যে হবে না। মানুষ নিজের ক্ষমতা টের পেলে বুঝত সে কতখানি। খাটতে খাটতে শরীর যখন ভেঙে পড়ে, হাত-পা চলতে চায় না, তখনও ইচ্ছে করলে জোর করে মানুষ ফ্যাটিগ লেয়ার পেরিয়ে যেতে পারে। তখন দেখা যায় ক্লান্তি ঝেড়ে সে আবার দ্বিগুণ কাজ করছে।
তোর অডিট আমিই করে দিতে পারব।
দিয়ো। তুমি থাকতে আমি অন্যের কাছে খামোখা যাব কেন?
আগের রিটার্নের রেকর্ডটা দেখলাম। সব কিছুই রিটার্নে দেখাস কেন? অনেকগুলো এন্ট্রি না দেখালেও চলত।
আমি কিছুই লুকোই না।
প্রীতম মাথা নাড়ল, বুঝেছে। শতম আর পাঁচজনের মতো নয়। সামান্য একটু অহংকার বুকের পালে এসে লাগে।
শতম বিছানায় বসে বলে, রোজ রাতে খাওয়ার পর আমি মা ছবি মরম রূপম পুঁচকি মিলে আড্ডা দিই। তা জানো?
তো! টের পাই না। তোমাকে কেউ ভয়ে আড্ডায় ডাকে না।
প্রীতমের অবশ্য এই পারিবারিক আড্ডা ভাল লাগার কথা নয়। একা ঘরে বসে ভবানীপুরের বাসার স্মৃতি আঁকড়ে গুমরে গুমরে উঠতেই সে বোধহয় আনন্দ পায় বেশি। তবু ভদ্রতাবশে সে বলল, ভয়ের কী? ডাকলেই পারতিস।
ডাকব না। মাঝে মাঝে সবাই মিলে তোমার ঘরেই চলে আসব।
বেশ তো।
আজ গান গেয়েছিলে? ছবি বলছিল, দাদার গলায় এখনও কী সুর!
ধ্যেত!
বউদির একটা চিঠি এসেছে আজ। দেখেছ?
না তো, কেউ দেয়নি আমাকে।
তোমাকে লেখা নয়। বাবাকে লেখা।
কী লিখেছে?
বউদি নভেম্বরের আগে আসতে পারবে না। ডিসেম্বরও হতে পারে।
ও।
এ মাসেই আসার কথা ছিল।
আর কোনও খবর নেই, না?
না।
প্রীতম বসে ছিল। আস্তে আস্তে শুয়ে চোখ বুজল।