নিজের টেবিলে এসে অপেক্ষা করছিল দীপনাথ। একটু বাদেই বোস তার লম্বা মেদবহুল চেহারাটা নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। মুখ ভীষণ ভাবালু, গম্ভীর। চোখে অনির্দিষ্ট দৃষ্টি।
বোস একটু ইতস্তত করে দীপনাথের টেবিলের কাছে আসে, চ্যাটার্জি, উঠবেন না?
এই যাব।
চলুন।
কোথায়? চলুন, কোথাও যাওয়া যাক।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আজ আমার ঘোট বোনের বাড়িতে যাওয়ার কথা।
আজ ক্যানসেল করুন।
দীপনাথ একটু দম ধরে থেকে বলে, মিস্টার বোস, আমি আপনাকে হেলপ করতে চাই, কিন্তু এখন দেখছি সব ব্যাপারেই আপনাকে হেলপ করা সম্ভব নয়। আই কানট হেলপ ইউ টু বি আনহ্যাপি।
বোস একটু হাসে, ইংরেজিটা আপনি মাঝে মাঝে ভালই বলেন। কিন্তু এখন আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বাসায় চলুন।
খুব জরুরি কথা কি?
খুব জরুরি।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা তুলে বিলুদের পাশের ফ্ল্যাটের নম্বর ডায়াল করল। বিলুকে ডাকিয়ে বলে দিল, আজ নয়। কাল যাচ্ছি।
কত কথা জমে আছে তোমার সঙ্গে।
আজ একটু কাজ পড়ে গেল রে।
প্রীতম ঠিকই বলত, ভীষণ কাজের লোক হয়েছ তুমি আজকাল। আমি যে তোমার জন্যই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে খাবার তৈরি করাতে বসেছি।
একটু রাতের দিকে গেলে যেতে পারি। তবে ঠিক নেই।
দূর। থাকগে আজ। কবে আসবে?
কাল।
ঠিক তো?
ঠিক। কাল অফিস থেকে একবার ফোন করিস।
বোস সাহেব নীচে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে। সামনে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছে। দু’জনে উঠল। গাড়ি নিউ আলিপুর রওনা হতেই বোস সাহেব বলে, আপনি আমার ওপর স্পাইং করছিলেন?
একথা কেন?
নইলে এত খবর আপনার জানার কথা নয়।
খবর নেওয়াটা দোষের, না খবর হওয়াটা?
বোস সাহেব মৃদু হাসে। বুঝদারের মতো খুব সামান্য একটু মাথা নেড়ে বলে, আমি অবশ্য ব্যাপারটা গোপন রেখেছি, কিন্তু সেটা পাপবোধ থেকে নয়। ডিসেন্সির জন্য। সময় হলেই মণিকে জানাতাম।
আমি কিন্তু মিসেস বোসকে খবর দিইনি। উনি আগে থেকেই জানতেন।
কতটা জানে?
খুব বেশি নয়। জানে, একটা মেয়ের সঙ্গে মিশছেন।
মেয়েদের সঙ্গে আমার মেলামেশায় তো বাধা নেই।
কিন্তু এবার একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ একজনের সঙ্গে মিশছেন।
সেটা দীপা জানতে পারে না। জানলে আমাকে বলত। ছেড়ে দিত না।
ডিভোর্স হবেই ধরে নিয়ে উনি হয়তো ততটা কিছু করতে চাইছেন না।
তা হলে হেডেকটা কার? আপনার?
আমার একটু হেডেক তো আছেই।
বোস হাসল আবার। এবারকার হাসি দেখে বোঝা গেল, বোস নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। বলল, স্ট্রেঞ্জ। তবু আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।
হাসি এবং গলার স্বরটা দীপনাথের খুব ভাল লাগল না।
বোস একটু চাপা গলায় বলল, দীপার ওপর আমার আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তবু আমি ডিভোর্স করতে চাইছিলাম না। আপনাকে বলেছিলাম তো যে, আমি একটা লং-টুরে বাইরে চলে যাচ্ছি।
বলেছেন।
হয়তো তাই যেতাম। তবে শেষ পর্যন্ত আর-একটা অ্যাফেয়ার ঘটে যাওয়ায় মনে হল, জীবনটা আর-একবার গড়ে তোলা যায়।
বোস বোধ হয় দীপনাথের সমর্থন পাওয়ার জন্যই এ সময়ে একটু চুপ করে রইল। কিন্তু দীপনাথ জবাব দিল না। সে খুব সন্তর্পণে চাল দিচ্ছে। কথা বলার চেয়ে চুপ করে থাকাটাই এখন জরুরি। লেট হিম টক অ্যান্ড টক।
তাই এখন আমি ডিভোর্স চাই।
আবার চুপ করে থাকে বোস। দীপনাথ আবার নীরব।
বোস সাহেব একটু কাত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে জিতানি সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে। সিগারেট ধরিয়ে বলে, দীপার অন্য ইন্টারেস্ট থাকলে আমার আপত্তি নেই। অন্য কেউ ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড হয়ে থাকলেও বলার কিছু থাকবে না। ইন ফ্যাক্ট –
বোস সাহেব আবার অর্থপূর্ণভাবে দীপনাথের দিকে তাকায়। কিন্তু দীপনাথ নিজেকে সংযত রাখে। অনেক দিন বাদে এই লোকটার ওপর তার রাগ আর অল্প একটু ঘৃণা হচ্ছে।
ইন ফাক্ট, কেউ কেউ দীপা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড বলেও আমি জানি।
দীপনাথ সামান্য একটু নড়ে বসে। অস্বস্তি বোধ করছে মনে মনে।
বোস সাহেব সিগারেটটা টানছে না। আঙুলে ধরে আছে মাত্র। বাইরের দিকে চেয়ে থেকে খুব আস্তে করে বলে, ইন ফ্যাক্ট, আপনি নিজেই যদি দীপা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড হয়ে থাকেন তবে আমি আপনাকে দোষ দিই না। দীপা ইজ মডারেটলি গুড লুকিং, ইন্টেলিজেন্ট। তার ওপর লোনলি।
দীপনাথের বুকটা ঝাঁৎ করে উঠল বটে। কিন্তু তেমনই উত্তেজিত হল না। পাথরের মতো মুখ করে বলল, আর আমি?
বোস অবাক হয়ে বলে, আপনি? আপনি কী?
আমি কেমন?
বোস হাসে, এলিজিবল। কোয়াইট এলিজিবল। হ্যান্ডসাম, ওয়েল-প্লেসড, ইন্টিগ্রেটেড। কোয়াইট এলিজিবল।
আপনি আপনার স্ত্রীর জন্য কি ঠিক এ রকম পাত্রই খুঁজছেন বোস সাহেব?
কথাটার ভিতরকার মার বোসকে একটু কাহিল করে ফেলে। সিগারেটটা জানালা দিয়ে ময়দানের ফাঁকা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে বলে, পাত্র-পাত্রীরা পরস্পরকে খুঁজে পেয়ে থাকলে আমার আপত্তি নেই, আমি এই কথাটাই বলতে চাইছি।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আমি এখনও পাত্রী খুঁজে পাইনি। তবে পাত্রীর গার্জিয়ানের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। তার পরিত্যক্ত স্ত্রীকে আমি বিয়ে করলে অফিসে তার পজিশনটা কী দাঁড়াবে।
জিতানির প্যাকেটটা হাতেই ধরা ছিল, বোস সাহেব আর-একটা সিগারেট বের করে প্যাকেটের ওপর ঠুকতে ঠুকতে বলে, দেয়ার ইজ এ পয়েন্ট টু পন্ডার অন। দীপাকে আপনি বিয়ে করলে আমাদের এক অফিসে থাকা বোধ হয় ভাল দেখাবে না। দেয়ার উইল বি এ লট অফ টক।
সেক্ষেত্রে বোধ হয় আমাকেই সরে যেতে হবে।
বোস মাথা নেড়ে বলে, তার কোনও মানে নেই। বাংগালোরের অফারটা এখনও আমার কাছে ওপেন আছে।
দীপনাথ বিজ্ঞের মতো হেসে বলে, আর এবার বোধ হয় আপনি আমাকে বাংগালোরের সঙ্গী করতে চাইবেন না।
না।–বোস শ্বাস ফেলে বলে, ইন ফ্যাক্ট দীপাকে যদি আপনি নেন তা হলে আপনার এবং আমার এক শহরেও বসবাস করা উচিত হবে না।
আর মিসেস বোস যদি কাউকে বিয়ে না করতে চান, তা হলে কী হবে?
বোস কাঁধ তুলে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, নাথিং।
কিন্তু উনি কাউকে বিয়ে করলেই তো আপনার সুবিধে।
বোস একবার তাকিয়েই দীপনাথের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, তা কেন?
দীপনাথ চাপা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা হলে আপনাকে মাসোহারার টাকাটা গুনতে হবে না।
বোস এ কথায় চুপ করে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, শুধু তা-ই নয়।
তা হলে আর কী?
বোস উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনে চেয়ে থেকে বলে, দীপা ছেলেমানুষ, ইমম্যাচিয়োর, রেস্টলেস, একস্ট্রাভ্যাগান্ড। একা থাকলে ও একদম শেষ হয়ে যাবে। আমি ওকে ট্যাকল করতে পারিনি বটে, কিন্তু আমার চেয়ে ইন্টিগ্রেডেড কোনও পুরুষ হয়তো পারবে।
পাত্রীর গার্জিয়ানের মতো কথা বলছেন না মিস্টার বোস। পাত্রপক্ষকে দোষের কথা শোনাতে নেই। শুধু গুণের কথা জানাতে হয়।
জিতানির ধোঁয়া গলায় লেগে বোস কিছুক্ষণ কাশে। কড়া ফরাসি সিগারেট, ধোঁয়া লাগতেই পারে। কেশে একটু ধরা গলায় বলে, আপনি বলেন খুব চমৎকার।
আপনি মিসেস বোসের জন্য এত চিন্তা করছেন কেন? ওঁর ভবিষ্যৎ ওঁকে ভাবতে দিন।
তা দিয়েছি। আমি কোনও ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করি না। আপনাকে কথাটা বলছি অন্য কাবণে।
কী কারণ?
আমি জানি, ইউ আর ইন লাভ উইথ হার, অ্যান্ড ভাইস ভার্সা।
এ কথায় দীপনাথের পায়ের তলার ভিত একটু নড়ে যায়। কিন্তু ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। তাই সে সামলে নেয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আপনি হয়তো সত্যি কথাই বলছেন, ইয়েস, উই আর ইন লাভ।
বোস অবাক হয়ে বলে, ইউ অ্যাডমিট! কনগ্রাচুলেশনস।
থ্যাংকস। কিন্তু মুশকিল হল—
বোস সাগ্রহে একটু ঝুঁকে বলে, হ্যাঁ, মুশকিল হল—
মুশকিল হল, আমি মিসেস বোসকে ভালবাসি বলেই তার ভাল চাই।
বটে তো! তাতে মুশকিল কী?
মুশকিল হল, কীসে মিসেস বোসের ভাল হবে তা আমি এখনও ভেবে পাইনি।
ভালবাসার একটাই এইম থাকে চ্যাটার্জি, ভালবাসার লোকটাকে কজা করা।
ঠিক। তবে যদি তাতে তার ভাল না হয়!
ভাল হবে। তাতেই ওর ভাল হবে।
আপনাকে এ ব্যাপারে বড় বেশি উৎসাহী মনে হচ্ছে বোস সাহেব।
বোস একটু বিরক্ত হয়ে বলে, আমাকে সাহেব সাহেব করেন কেন বলুন তো!
আপনি যে ভীষণ সাহেব, বোস সাহেব।
বোস আবার কাঁধ ঝাকায়। তারপর বলে, আমিও ওর ভাল চাই। আমি জানি কীসে ওর ভাল হবে।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, পাত্রীর ভাল দেখলেই তো হবে না। পাত্রের ভাল হবে কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
আপনারও ভালই হবে। আপনাদের দু’জনেই দুজনকে ভালবাসেন, দেয়ার উইল বি নো প্রবলেম।
ভালবাসি বলেই প্রবলেম। ভালবাসা মানে ভাল-তে বাস করা।
মানছি। কিন্তু আপনার প্রবলেমটা ধরতে পারছি না।
কী করে বুঝবেন? আপনি তো কখনও কাউকে ভালবাসেননি বোস সাহেব! বুঝতে গেলে ভালবাসতে হয়।
বোস একটু গুম হয়ে থাকে।
দীপনাথ দেখে, গাড়ি বাঁক নিয়ে আলিপুরে ঢুকে যাচ্ছে।
বোস সাহেব একটা শ্বাস ফেলে বলে, ইউ আর বিয়িং এ বিট ডিসেপটিভ। হয়তো দীপার প্রতি আপনার অ্যাটাচমেন্টটা ফিজিক্যাল। মে বি ইউ ওয়ান্ট টু এক্সপ্লয়েট হার। মে বি ইউ হ্যাভ অলরেডি এক্সপ্লয়টেড হার।
দীপনাথের ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, কান জ্বালা করছে। তবু শুকনো হাসি হেসে সে বলে, যদি তাই করে থাকি তবু আপনার কিছু করার নেই বোস সাহেব। ইউ আর এ ম্যান উইদাউট ব্যাকবোন। আমার যদি স্ত্রী থাকত আর তার যদি পরপুরুষ জুটত, তবে আমি স্ত্রীকে ভালবাসি বা না বাসি সেই পরপুরুষের ঠ্যাং না ভেঙে ছাড়তাম না।
আপনি আমাকে আপনার ঠ্যাং ভাঙার জন্য ইনভাইট করছেন!
করছি। অ্যাট লিস্ট ইউ শুড ট্রাই।
বোস হেসে ওঠে।
গাড়ি এসে থামে ফ্ল্যাটের সামনে। দীপনাথ দেখতে পায় দোতলার বারান্দায় ম্লানমুখী মণিদীপা উদাস চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। ধড়াস ধড়াস করতে থাকে।