৮০. আমার অবাক লাগে

৮০.

আমার অবাক লাগে অন্য কারণে। লিলি ঝিনির মতন এমন বিদুষী নাগরিকদের সঙ্গে বিন্দু নামে বাউল প্রকৃতির এত আশনাই কেমন করে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোন পেরিয়ে আসা নগরের একেবারে হাল গমকে গামিনী এমনি মেয়েদের কাছে, কোনও বাউল প্রকৃতিকে এত নিকট হতে দেখিনি। কেবল তা-ই কেন, এমন দুই দুনোকে পাশাপাশি কে দেখেছে। তাদের জগৎ আলাদা, বহেও দুসরা গাঙে। অথচ দেখ, জয়দেবের বেদনাশা বটের তলায় তিন সখীতে এক ভাবের ভাবিনী।

সংসারে সবই আছে; সমাজ শিক্ষা নগর গ্রাম। কিন্তু তার ওপরে আরও কিছু আছে, যেখানে কোনও কিছুতেই ফাঁক ফারাক থাকে না। সে তুমি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এস কিংবা পাড়াগাঁয়ের পাকশালা থেকে। সেই যে এক চিরন্তনের খেলা আছে, কালো ধলো রাঙা হরিৎ সকল নদী সাগরে গিয়ে মেশে, সেই রকম। সেই এক চির মেয়ে, এক অগাধে যেয়ে মেশে। তখন আর আলাদা করে চেনা যায় না। এখানে এই বেদনাশা বটের তলায় সেই চির প্রকৃতির খেলা।

এর মধ্যেও একটা সুর বেজে যায়। যে যা-ই বলুক, হাসুক কাঁদুক রাগুক, সব মিলিয়ে একটা সুর বেজে ওঠে। বেসুরের আঘাত লাগে না। যে অচিনের খোঁজেই ফিরি, ফেরার তালে, যতই দ্বিধা সংশয় ভয় বিরক্তির দোলা লাগুক, জানি যাবো ‘আপন দেল’—এ’। ফকির যেমন তার মুরশেদের দেল্-এ যায়, তেমনি আমার নিজের দেল-এ। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাব এই সুরটুকুও। কোথাও একটু থেমে ঝুলি ঝাড়া দিলেই এই সুরটুকু বাজবে মনের কোণে। সেইটুকু আমার প্রাপ্য। তবু ওরা তিন সখীতে যখন হাসে তখন নিচু স্বরে বিন্দুকে না বলে পারি না, ‘তা বলে এমন একটা নাম দিলে?’

বিন্দু অমনি আমার কাছে এসে কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘রাগ কইরলে বাবাজি?’

বলি, ‘না, লজ্জা পেলাম।’

বিন্দু আমার ঘাড়ের কাছে আলতো করে একটি চাটি মারে। ফিসফিস করে বলে, ‘দূরছাই, তোমাকে কিছু বইলছি নাকি? যাকে বলার, তাকেই বইলছি, তোমার নাম দিয়্যে বইলছি। তোমার লজ্জার কী আছে।’

বিন্দুর সঙ্গে আমার চোখে চোখ মেলে। দৃষ্টিতে তার অনুসন্ধিৎসা, একটু বা কটাক্ষে কোপ, কিন্তু কৌতুকে নিবিড়। গলার স্বরে সান্ত্বনার আভাস। এ সময়ে সেই কথাটা মনে হয়, স্ক্রিয়াশ্চরিত্রম্। বিন্দুকে যেন একটু ছলনাময়ীই মনে হয়। ভোলাতে চায় নাকি আমাকে।

তারপরে আবার চুপিচুপি বলে, ‘তবে বাবাজি, ঝিনদিদিটো একেবারে মইরেছে গ, উয়ার আর কিছু নাই।’

আমি হাতজোড় করি না বটে। অসহায় করুণ চোখে বিন্দুর দিকে চাই। বিন্দু তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা, বইলব না বাবাজি, বইলব না।’

বিন্দু হাসে নিশ্বাসও পড়ে সেই সঙ্গে। নিশ্বাসের বাষ্প জমে আমারও। তবু যেন কৃতজ্ঞতা বোধ করি বিন্দুর কাছে।

ইতিমধ্যে গোপীদাস আসর থেকে উঠে আসে গাছতলায়। এসেই দু’ হাত বাড়িয়ে দেয়, হাঁটু পেতে বসে। আমি তার হাত ধরতে যাবার আগেই মোটা কাঁথার আলখাল্লা সহ বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। তার দাড়ি আমার মুখে লেগে যায়। দাড়িতে মুখে স্পষ্ট গাঁজার গন্ধ। তা হোক, তার এই ব্যগ্র আলিঙ্গনে মনটা টলটলিয়ে ওঠে। হঠাৎ মনে হয়, গোপীদাসের পায়ে হাত দেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু লজ্জা করে। আমি যে আমাকে ছাড়তে পারি না। নিজেকে ভুলতে পারি না। তাই নানা লজ্জা, নানা সঙ্কোচ।

সে বলে, ‘জয় গুরু, জয় গুরু, ভাল তো বাবাজি।’

বলি, ‘ভাল।’

‘তখন থেক্যে দেইখছি আর ভাইবছি, কখন বাবাজির কাছে যাব। আনন্দে ছিলে তো বাবাজি? আনন্দে থেক্য, খালি আনন্দ।’

তার ঘড়ঘড়ে গলায় আবেগ। তার আনন্দের স্বরূপ কী, জানি না। তাকে যেরকম সদানন্দ মনে হয় তেমন কি আমি হতে পারি? আমার সে মন নেই। কিন্তু তার কথার মধ্যেই যেন একটা আনন্দের সুর বাজে, অনুভবে বাজে। বলি, ‘আপনি ভাল আছেন তো?’

‘ভাল, ভাল বাবাজি। কিন্তুন “আপনি আজ্ঞে” ক্যানে গ, উনি কর‍্যো না।’

ঝিনি এমন করে আমাদের কুশল জিজ্ঞাসার ছবি দেখে যেন মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ। যেন ওর চোখেও একটা আকাঙক্ষা।

গোপীদাস আলিঙ্গন ছেড়ে আমার হাত ধরে বলে, ‘তব্যে বাবাজি, দিদিমণিদের সাথে আমার কথা নাই। ওঁয়ারা আমাদিগের আখড়ায় আসেন নাই। ক্যানেই বা আইসবেন। আমাদিগের হল্য গরিবের আখড়া। ই ভাঙা পোড়োতে কোনওরকমে একটুক জোড়াতালি দিয়ে লিয়েছি। ইখানে দিদিমণিদের আসা চলে না।’

ঝিনি কয়েকবারই গোপীদাসের কথার মাঝখানে কথা বলবার চেষ্টা করে। বাউল বুড়াও তেমনি। একদমে বলে যায়। ঝিনি বলে ওঠে, ‘এটা ঠিক বললেন না গোপীদাস বাবাজি। আপনাকে তো এসেই বলেছি, আমার উপায় ছিল না।’

ব্যাপারটা এখনও আমার বোধগম্য না। লিলি ঝিনি বিশেষ কোনও জায়গায় এসে উঠেছে নাকি? প্রথম থেকে আমার ধারণা, আমার মতোই মেলায় চলে এসেছে। তারপরে যেমন সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, সেইরকম একত্র হওয়া। আমি ঝিনি লিলির দিকে তাকাই।

গোপীদাস বলে, ‘সি তো আমার কপালের দোষ গ ঝিন্‌দিদি। নইলে মদনের আখড়ার খোঁজ মেলে কলকেতায় বস্যে, ই বুড়ার কথা মনে থাক্যে না।’

আমি জিজ্ঞাসু চোখে ঝিনির দিকে তাকাই। ও একটু লজ্জা পেয়ে বলে, ‘আমাদের এক ইস্কুলের এক মাস্টারমশাই মদন বাউলের আখড়ার খবর দিয়েছিলেন। চিঠিপত্র লিখে আগে থেকেই যোগাযোগ করেছিলেন, সেই সূত্রেই অন্য আখড়ায় উঠেছি। কোনও ঠিক ছিল না তো, হঠাৎ—’

আর বলতে দেয় না গোপীদাস। বলে, ‘বুইঝলে বাবাজি, সি খোব বড় আখড়া, বড় মানুষের আখড়া। বাঁকুড়ার মদন বাউলের যে মেলাই নামডাক। কত বড় বড় লোক ওঁয়ার শিষ্যি সাবুদ, জজ ম্যাজিস্টর উকিল বেস্তর। উই পচ্চিমে গেলেই দেইখতে পাবে অজয়ের পাড়ে পেকাণ্ড তাঁবু খাটিয়েছে। কত লোকজন, অষ্টপ্রহর চুলা জ্বইলছে, রান্না হইলছে। অই সি কী বল্যে গ, আহ্ হঁ হঁ, মায়িক মায়িক। সব সোময় মায়িক বাইজছে…।’

এবার কথার মাঝে বিন্দু বলে ওঠে, ‘কিন্তুন গোঁসাই মদন মস্ত বড় সাধক বাবা।’

গোপীদাস তাড়াতাড়ি কান মলে জিভ কাটে। বলে, “অই, সি কথা কি বইলতে গ মা! গুণ না থাইকলে কি কেউ গুনিন হয়! এমনি এমনি কি আর মদন গোঁসাইয়ের কাছে সবাই ছুট্যে যায়? ওঁয়ার কত বড় আখড়া, তাই বইলছি।’

ঝিনি বলে, ‘আমি কিন্তু বড়-ছোটর কথা কিছু ভাবিনি। ভাবলাম, অচেনা জায়গা, এত বড় একটা মেলা, কে কোথায় আছে, কোথায় গিয়ে উঠব। এমন সময় আমাদের ইস্কুলের এক মাস্টারমশাই বললেন, তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। তিনি নিজেও মদন গোঁসাইয়ের শিষ্য।’

গোপীদাস হাত তুলে বলে, ‘বুঝিছি গ ঝিন্‌দিদি।’

বুকে হাত দিয়ে বিষণ্ণ হেসে বলে, ‘মন যে মানে না। নিজের মানুষ পরের ঘর কইল্ল্যে কার মন মানে। তোমরা আমার মানুষ য্যে, ক্যানে কী না, আঁ? তব্যে—’

কথা শেষ না করে বুড়া দাড়িতে হাত বোলায়। আর একবার আমার দিকে, আবার ঝিনির দিকে চোখ ঘুরিয়ে চায়। ঘাড় নেড়ে বলে, ‘হঁ, চিতেবাবাজিকে ত ছাইড়ছি না। এখন দেখি কোন পাল্লায় ওজন বেশি।’

তার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। গোপীদাস তখনও বলে, ‘দেখি ইবারে কোন আখড়ার নোক কোন আখড়ায় ঘুরাফিরা করে।’

বলেই আমার ঘাড়ের থেকে হাত বাড়িয়ে ঝোলাটা টেনে নামায়। বলে, ‘এখনও কাঁধে করে রইয়েছ? দাও ওটা। নে বিন্দু, চিতে বেঁধ্যে থো যেইয়ে।’

আবার হাসে সবাই। বিন্দু হাত বাড়িয়ে আমার ঝোলাটা নেয়। লিলি বলে, ‘বোঝাই যাচ্ছে আপনার আখড়ার পাল্লাই ভারী হবে। আমি তো সব সময় আপনাদের আখড়াতেই এসে পড়ে থাকব।’

বলে ঘাড় বাঁকিয়ে তেরছা চোখে সখীর দিকে তাকায়। ঝিনি লজ্জা পায়। বলে, ‘এক জায়গায় উঠতে হয় তাই উঠেছি। চেনাশোনা সবাই যেখানে থাকবে সেখানেই সময় কাটবে।’

গোপীদাস একেবারে গলগলিয়ে হাসে। চোখে বিটলে ঝলকানি। বলে, ‘তা হল্যেই হল্য।’

তারপরে গোপীদাসের সঙ্গে আমার দু-চার কথা হয়। কখন এসেছি, আপাতত কোথা থেকে আগমন। শুনে বলে, ‘আমাদিগের ঘরে লিয়ে যা মা বিন্দু, বাবাজি একটুক হাত-পা ছড়িয়ে বসুক যেইয়ে। তা’পরে গান তো সারা রাত্তির আছেই।’

অবাক হয়ে বলি, ‘সারা রাত্রি?’

‘বট্যে ক্যানে বাবাজি, সারা রাত্তিরই তো মেলা। সে জন্যেই তো জয়দেবে আসা। রসিককে মনে মনে ভইজব আর গান গাইব। একদিন হক আর সাত দিন হক, হেথায় এস্যে থাইকলে গাইলে রসিকভজন হয়। উতেই বাউলের পুণ্যি। তা’পরেতেও অনেকের অনেক মানত মানসিক আছে, হেথায় এস্যে রেঁধ্যে বেড়্যে খাবে থাইকবে। আজ মকর সংক্রান্তি গেল, কত নোকে অজয়ে চান কইল্ল। আজ যে অজয়েতে গঙ্গাসাগরের পুণ্যি।’

এত ব্যাপার জানা ছিল না। আজ অজয়ের জলেই গঙ্গার স্রোত বহে। মনে করলে কোপাইয়ের জলে যমুনা বহে, সে কথাও শুনেছিলাম কোপাইয়ের কূলে। সব থেকে ভাল লাগে, মানত মানসিকের জন্যে জয়দেবে এসে সবাই রাত্রিবাস করে। রেঁধে বেড়ে খায়। জিজ্ঞেস করি, ‘এই রকম মানত করলে কী হয়?’

বিন্দুর চোখ দুটি অমনি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। চকিতে একবার ঝিনিদের দিকে দেখে নিয়ে বলে, ‘ক্যানে গ বাবাজি, মানত কইরবে নাকি?’

‘না।’

‘তব্যে?’

‘এমনি জানতে ইচ্ছে হয়।’

গোপীদাস বলে, ‘মনোবাসনা পুইরলে আবার হেথায় এস্যে ই সোমায়ে থাইকতে হয়। রেঁধ্যে বেড়্যে খেত্যে হয়, অজয়ে ডুইবতে হয়। যেমন করে মানত তেমন কর‍্যেই পূরণ।’

বিন্দু বলে, ‘তুমি যদিন আছ উবেলা আইসতে, তবে মকর চান কইরতে আমাদিগের সাথে। ঝিন্‌দিদি লিলিদিদি, সবাই কর‍্যেছে।’

লিলির ঠোঁট তৎক্ষণাৎ বক্র। বলে, ‘তবে আর নয়। যা নোংরা, বিশ্রী!’

গোপীদাস সস্নেহে হেসে বলে, ‘সি তো হব্যেই গ দিদিমণি। কত নোক এস্যেছে, হাজার হাজার।’

তারপরে বিন্দুকে বলে, ‘যা মা, সব্বাইকে লিয়ে যা। বাবাজি আর দিদিদেরও লিয়ে যা।’

আমি ঝিনি আর লিলির দিকে ফিরে চাই। ঝিনি আমার দিকে চেয়ে ছিল। চোখাচোখি হতে চোখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় লিলির দিকে। লিলি জবাবে বলে, ‘হাতে-মুখে একটু জল দিতে ইচ্ছে করছে। তোয়ালে সাবান, সব তো সেখানে রয়েছে। তোর ইচ্ছে করছে না চোখে-মুখে জল দিতে?’

ঝিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। বিন্দু বলে, ‘সাবাং তয়লে দিতে লাইরব ভাই। তবে জল দিতে পাইরব আমাদিগের আখড়ায়।’

লিলি বলে, ‘তার জন্যে নয়। সারাদিনের এই জামাকাপড়গুলো ছাড়তে ইচ্ছে করছে। সেই তো কোন সকালে নদীতে স্নান করে পরেছি। এর পরেও তো সারা রাত আছে।’

লিলির কথা শেষ হবার আগেই আমার কানের কাছে ঝিনির নিচু স্বর বাজে, ‘খুব ক্লান্ত নাকি? অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেবে?’

বলি, ‘না। আমারও একটু চোখে-মুখে জল দেবারই ব্যাপার।’

লিলি বলে ওঠে, ‘আমাদের থেকে তো ক্লান্ত নন মশাই। যান হাত-মুখ ধুয়ে নিন গ, তারপরে আমাদের ওখানে আসুন।’

‘আপনাদের আখড়ায়?’

‘ওই যাই বলুন। কেন, নিষিদ্ধ জায়গা নাকি?’

‘তা নয়, জানাশোনা নেই—’

আমার কথা শেষ হবার আগেই ঝিনি বলে ওঠে, ‘আমরাই আসব, তুমি থেকো।’

তার কী প্রয়োজন জানি না। লিলি বলে ওঠে, ‘তুই আর মেয়েদের ইজ্জত কিছু রাখলিনে ঝিনি। উনি আসতে পারবেন না?’

বিন্দু বলে, ‘পাল্লা কোনদিকে ভারী সিটি দেইখতে হবে তো৷ তোমাদিগেরই আইসতে হব্যে। আমাদিগের আখড়ার মান নাই ক্যানে? এস্য বাবাজি।’

বিন্দু ওদের দিকে নিঃশব্দ হাসি ছুড়ে দিয়ে প্রায় আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়। ওরা হেসে চলে যায়। গোপীদাস ইতিমধ্যে আবার আসরে গিয়ে বসেছে। যেদিকে গানের আসর তার পিছনদিকেই ভাঙা পোড়োর ঘর। তার দেওয়াল আছে তো ছাদ নেই। ঘরের মেঝে বলে কিছু নেই। তাতেই বেড়া বেঁধে খড়ের আচ্ছাদন করে সাময়িক আশ্রয় তৈরি করে নেওয়া গিয়েছে। দরজার কোনও পাল্লা নেই। এখানে তার দরকারও নেই। পিছনের উঠোনে ত্রিপলের ঢাকনা দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। সেখানেই দেখা যায় নিতাইকে। নিতাই ছাড়াও দু-তিনজন রয়েছে। তার মধ্যে একজন স্ত্রীলোক। সেখানে হ্যারিকেন ছাড়াও মোটা শীষের লম্ফ জ্বলে। ঘরের মধ্যে হ্যারিকেন। খড় বিছিয়ে তার ওপরে শতরঞ্জি পাতা। এই শীতের মধ্যে ব্যবস্থা মন্দ না।

পাশে আর একটি ঘর আছে। সেখানেও টিমটিমে আলো। বিন্দু আমার ঝোলা নিয়ে পাশের ঘরেই যায়। বলে, ‘ঝোলাটো ই ঘরেই রইল। আশ্রমের জিনিসপত্তর সব ই ঘরেই রইয়েছে।’

তারপর সে এদিক-ওদিক ফিরে কুসুমকে ডাকাডাকি করে। তার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। আমি বলি, ‘তাকে যে গাছতলাতেই দেখেছিলাম।’

বিন্দু হতাশায় ঘাড় নেড়ে বলে, ‘উয়ার কথা আর বল্য না বাবাজি, আমার হাড়-মাস কালি কর‍্যে খেল্যে সি বিটি। কখন কোথা যেইছে না যেইছে বুইঝতে লাইরছি। উ এস্যেই তো আমাকে বইললে, তোমাকে নাকি কোথা থেক্যে ধর‍্যে লিয়ে আইসছে।’

‘হ্যাঁ, কুসুমের সঙ্গেই আমার প্রথম দেখা হয়েছে। কাশীনাথ আসেনি?’

‘আস্যে নাই আবার! সিই তো জ্বালা বাবাজি। দুটোতে কাক চিল বইসতে দিচ্ছে না, ঝগড়া ঝগড়া ঝগড়া।’

আমি হেসে ফেলি বিন্দুর কথা শুনে। বিন্দু বলে, ‘হাইসছ কী বাবাজি, আমি যে আর পারি না। কুসিরও বলিহারি! আজ দুপুরে কী মারটা মের‍্যেছে কাশী কুসিকে। তবু কি লজ্জা আছে ছুঁড়ির? দ্যাখ যেইয়ে, দুটোতে কোথাও বেড়াল্‌ছে, লয় তো কাশী লুকিয়ে কোন আসরে যেইয়ে গাঁজা টাইনছে, কুসি খুঁজ্যে মইরছে।’

তথাপি আমার হাসি দমে না। সামনের প্রাঙ্গণে আসরে গোকুলের গলায় গান শুনতে পাচ্ছি। চারদিকেই গানের সুর। নানান যন্ত্রে, নানা স্বরে বটতলার বিশাল প্রাঙ্গণ মুখরিত। তার মাঝখানে কাশী আর কুসুম এক বিচিত্র খেলা খেলে চলেছে। ওদের নাম-গান নেই, ভজনসাধন নেই। চারদিকে আখড়ায় আশ্রমে সকলের কত কাজ। সেই দায়দায়িত্ব নেই ওদের। চারদিকের এই ডামাডোলে ওরা আপনাতে আপনি মত্ত। সেও যেন এক সাধন, কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এতে যে কোন রসিকের ভজন হচ্ছে কে জানে। মনে হয় কোন এক অদৃশ্যে বসে কে যেন মিটিমিটি হাসে চোখ চিকচিক করে। অলক্ষ্যে তার দৃষ্টি ফেরে কাশী কুসুমের সঙ্গে।

বিন্দু বিরক্তিতে হেসে বাজে। আবার বলে, ‘সত্যি, দুটোকে লিয়ে আর পারি না।’

আমি বলি, ‘ওরা আপন মনে আছে।’

‘ছাই, তা থাইকলে তো বাঁচা যেত্য। দ্যাখ ক্যানে, হাঁকডাক পেড়্যে এল্য বল্যে। হ্যাপা যত আমার। আসুক, কাশী কুসি, একজনও নালিশ কইরতে আসুক, দুটোকেই আমি ইবারে দুচ্চার ঘা লাগাব।’

বলে, ঘাড়ে একটা দোলা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। রোষের মুখেও একটু হাসি তবু লেগে থাকে। তাতে বোঝা যায়, দুচ্চার ঘা দেবার মতো হাতের বা মনের জোর তার নেই।

তারপরে বিন্দু আমাকে পিছনের উঠোনের এক পাশে নিয়ে যায়। সেখানে জল ছিল। হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে আসতেই নিতাই এসে ‘জয়গুরু’ দেয়। আসল কাজের লোক সে-ই। মাটির ভাঁড়ে করে গরম চা খাওয়ায় সে। গুড়ের চা, একটু হলুদের গন্ধও আছে। তা হোক। গরম পানীয় তো। এই শীতের রাত্রে তা-ই বা কে দেয়। নিতাইয়ের হাতের চা, একটু হলুদের গন্ধই বা না হবে কেন। হলুদ রঙের হাত দেখেই বোঝা যায়, বাটনা তাকেই বাটতে হয়েছে।

ইতিমধ্যে বিন্দু রান্নার দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মধ্যেই ডেকে বলে, ‘বাবাজি, একটুকু বসো, ইদিকে দেখ্যে যাই।’

এ যেন অনেকটা যজ্ঞিবাড়ির গিন্নির ব্যস্ততা। তার ওপরে অনেক দায়িত্ব। হয়তো খিচুড়ি, একটা পাঁচমিশেলি তরকারি, একটু বা ভাজাভুজির আয়োজন। তবু খাবে হয়তো অনেক লোকে। প্রকাণ্ড মাটির উনুন আর হাঁড়ির আকৃতি দেখে তা-ই মনে হয়। বিন্দুর ব্যস্ত না হয়ে উপায় কী। তবু সে নিতাইকে আমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে যায় না। আমিই বলি, ‘আপনি যান, কাজ করুন গে, আমি বেশ আছি।’

‘বিন্দুঠাকরুন রাগ কইরবে।’

‘রাগ করবে না। বলবেন, আমি বলেছি। আমি একটু একলা থাকি ততক্ষণ।’

নিতাই উঠতে উঠতে হঠাৎ কেমন কাঁচুমাচু মুখ করে শরীর বাঁকিয়ে হাসে। হাত বাড়িয়ে বলে, ‘তবে আপনার ওই বস্তু একটো দেন খাই।’

কী বস্তু? অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে আর একটু সলজ্জ হেসে গলে। ঠোঁটের ওপর দু’আঙুল রেখে ধূমপানের ভঙ্গি করে বলে, ‘অই বস্তু।’

অর্থাৎ সিগারেট। আমি তখন সিগারেট ধরিয়েছি। আমারই ভুল, আমারই সাধা উচিত ছিল। তবু, এই মুহূর্তে ইছামতীর বুকে অধর মাঝির নৌকোয় মামুদ গাজির কথা আমার মনে পড়ে যায়। সিগারেট আর দেশলাই এগিয়ে দিই। তখুনি নিতাইয়ের চলে যাবার লক্ষণ না দেখে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনিও বাউল তো নিশ্চয়?’

নিতাই জিভ কেটে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আমি কিছু না বাবাজি। আমাকে আপনি-আজ্ঞা কইরবেন না। আখড়ায় থাকি, কাজ কম্‌মো করি। আর কিছু না।’

বলে নিতাই মাথা নিচু করে হুস্ হুস্ সিগারেট টানে। কী যেন ভাবে, কী যেন বলি বলি করে বলতে পারে না। তারপরে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আমি আজ্ঞে আসলে—কী বইলব বলেন, দাগি চোর ছিলাম।’

দাগি চোর? বলে কী লোকটা! অবাক অবিশ্বাসে নিতাইয়ের দিকে দেখি। তার মুখ তেমনি নিচু, কিন্তু মুখের চামড়া কাঁপে। যেন অনেক কথার তরঙ্গ। কিন্তু গোকুলদাসের আখড়ায় দাগি চোর, ব্যাপার বুঝতে পারি না।

নিতাই নিজেই বলে, ‘আপনাকে বইলতে তো বারণ নাই, আপনি হলেন গোকুলদাস বিন্দুঠাকরুনের নিজের নোক। আমি জেলখাটা দাগি চোর ছিলাম। সিঁদেল চোর।’

এলিয়ে বসেছিলাম। সোজা হতে হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘জেল খাটাও হয়েছে?’

‘আজ্ঞে হুঁ, তা দু’দফায় তিন বছর। তারপরে ই দুনার পাল্লায় পড়্যে দশ বছর আর উ কাজ করি নাই।’

‘কেন?’

‘তা কী জানি বাবাজি। আমিও তো শিউড়ির মানুষ, ইয়াদের কাছে একটু আধটুক আসা-যাওয়া ছিল। যিখানেই যেত্যেম, সব্বাই দূর দূর কইরত। তা কইরবে বটে, চোরকে আবার বইসতে দিবে কে। কিন্তুন গোকুল বিন্দু কোনওদিন তাড়ায় নাই। উ তো দূরের কথা, বিন্দু আবার বইসতে দিত। ক্যানে, ইয়াদের কি ভয় নাই? ভাইবতাম, মনে মনে ভাইবতাম। জিগেঁসাও কইরেছি, “চোর বল্যে মনে করো না নাকি, খাতির কর‍্যে বইসতে দাও যে?” বলে, “তা যিখানে চোর আছ, সিখানে চোর আছ, আমাদিগের কী।” “ক্যানে, তোমাদিগের ঘরে চুরি করতে পারি তো।” “পারো, কইরবা। আমাদিগের কী চুরি কইরবা লিতাই, কী আছে। পিতল-কাঁসার কিছু বাসনপত্তর, মরাইয়ের দু-চার মণ ধান। আর কী লিবে? তা সি ও তুমি এখনই লিতে পারো, পিতল-কাঁসা ছাড়াও লোকের চলে। ঘরে ভাত না থাইকলে ভিক্ষে কইরতে যাব।” কথাটা যে মিথ্যা বইলত তা লয়। আমাকে বসিয়ে রেখ্যে দু’জনায় নিজের নিজের কাজে যেত্য। ইচ্ছা কইরলে চুরি কইরতে পাইরতাম। তা ইচ্ছা হত্য না।’

প্রায় নিবে আসা সিগারেটে পর পর কয়েকটা টান দেয় নেতাই। মুখ এখনও তার নিচু। আর আমি এক অদ্ভুত কথা শুনি। সে আবার বলে, ‘তা কেউ যদি আমার হাতে ধন তুল্যে দিয়ে বলে, লাও হে চুরি করো, তা কি হ—য় বাবাজি! গোকুল-বিন্দুকে নোকে সাবধান কইরত, লিতাই চোরে একদিন উয়াদের পথে বসিয়ে যাব্যে। তাতেও ভয় ছিল না। উলটে কী হল্য জানেন বাবাজি, দেখি গোকুল বিন্দু আখড়া ছেড়্যে, শিউড়ি ছেড়্যে কোথা কোথা চল্যে যায়, আর আমিই আখড়া দেখাশুনা করি। তখন গোয়াল গরু দেখি, না আখড়ার ঘর-দোর সামলাই, না গাছপালা, মাচা মরাই দেখি। তার উপরে অই কুসি বিটি, সিটি তো এতটুক। উয়াকেই বা কে দেখে। শুধু কি তা-ই, কেউ এল্যে, তার সেবাযত্ন করা, বসানো খাওয়ানো। লাও ঠ্যালা, কখন সিঁদ কাইটতে যাব বলেন।’

সে হাসতে হাসতে এবার আমার দিকে চোখ তোলে। দেখি, তার চোখ দুটো কেমন আরক্ত। একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের অঙ্গার, সে অনায়াসে দু’আঙুলে টিপে নিবিয়ে ফেলে। যেন ওটা আগুনই না। আমার কথা কখন বন্ধ হয়ে যায়। আমি যেন এক অবিশ্বাস্য আশ্চর্য কাহিনী কেবল শুনি।

নিতাই হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘একদিন বিন্দু বলেছিল, “দ্যাখ লিতাই, চুরি যদিন কইরতে হয় তো একটা জিনিস কইরবে, তার কোনও মার নাই।” কী জিনিস? না, বইললে, “মন”।’

বলে নিতাই আবার নিঃশব্দে তার শক্ত পেশিবহুল শরীরটা কাঁপিয়ে হাসে। হাসিতেই তার চোখ দুটো প্রায় ঢেকে যায়। বলে, ‘বাবা রে, সে কি আমার কম্‌মো, বলেন তো বাবাজি! বসেন, উদিকে একটুক দেখ্যে আসি।’

সে চলে যায়। আর নিতাইয়ের মুখের ওপরেই গোকুল বিন্দুর মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই যুগল রূপকে আমার ভাল লেগেছিল। সেই ভাল লাগাটা নিতান্ত চোখ ভরানো। নানুর থেকে শিউড়িতে ফিরে আসা সেই রাত্রেও তা-ই। কিন্তু এমন মুগ্ধ বিস্ময়ে মন ভরে যাওয়া না। এখন জানি, এ যেমন-তেমন যুগল না। আপন অন্বেষণে আছে।

আর নিতাই। চোরের রানি বিন্দু যে সিঁদকাটি তার হাতে তুলে দিয়েছিল, তার কী গতি। সে কি কেবল সিঁদ কেটেই চলেছে? না কি মনের ঘরের খোঁজখবর কিছু পেয়েছে? কে জানে।

এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ সামান্য শব্দে চমকে উঠে দেখি দরজায় দুই সখী দাঁড়িয়ে। লিলি আর ঝিনি। বেশবাসে এমন কিছু অদলবদল নেই। পশমি শাল এবং কোট, দুই আছে। তবু যেন নতুন দ্যুতিতে ছটা লাগানো। রঙে ঝলকানো।

আমার সঙ্গে ওদের চোখাচোখি হতেই ওরা পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপরে লিলি আমাকে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার মশাই, কীসের স্বপ্ন দেখছেন?’

অবাক হয়ে বলি, ‘না, স্বপ্ন দেখিনি তো।’

লিলি আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে বলে, ‘তা-ই নাকি? আমরা তো ভাবলুম আপনার বাহ্যজ্ঞান নেই। কখন থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আপনার কোনও চৈতন্যই নেই।’

বলি, ‘তা নয়, একটা কথা ভাবছিলাম। এইমাত্র শোনা একটা কথা।’

লিলি ঝিনি চোখাচোখি করে। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কী কথা?’

‘এদের আখড়ার নিতাইয়ের কথা।’

লিলি তাড়া দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, সে কথা শুনব, এখন উঠুন তো, চলুন।’

‘কোথায়?’

‘যেখানে খুশি। যেখানে আমরা যাব সেখানেই। আজ সারা রাত্রি আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’

‘অ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ মশাই, হ্যাঁ। আসুন।’

.

৮১.

লিলি ঝিনিকে দেখতে পেয়ে বিন্দু ঘরে আসে। দু’জনের দিকে চেয়ে চোখ ঘুরিয়ে হাসে। ভেজা হাত লালপাড় গেরুয়ার আঁচলে মুছতে মুছতে বলে, ‘বাবা গ, তোমাদিগের মতলব কী গ! আজ কী জয়দেবের সব বাউল-বাবাজিদিগের মাথা ঘুরিয়ে দেব্যে, না কি মেলার মানুষদিগের?’

দুই সখীর সাজ দেখেই বিন্দু এমত বচনে বাজে। আড় চোখে একবার আমাকেও দেখে নেয়। বিন্দুর কথা একেবারে মিথ্যে না। বেশবাসে যদিও তেমন অদল-বদল হয়নি, ঝিনির কুসুম রঙের, আর লিলির গাঢ় পুঁইমেটুলি রঙের রেশমি শাড়িতেই চোখে ঝলক লেগে যায়। তার ওপরে ঝিনি যদিবা প্রসাধনের দিকে ততটা যায়নি, একটু যা মুখের ওপর হালকা প্রলেপ, ঠোঁটে সামান্য একটু রং বুলানো, লিলি একেবারে পুরোপুরি। মুখে, চোখে, ঠোঁটে, সবখানেই তার গাঢ় রঙের প্রলেপ। সেই সঙ্গেই ফাঁপানো চুলের আবাঁধা তরঙ্গে সে যেন নিজেই দোলে। ঝিনি ওর গায়ের চাদরটা কেমন করে যেন ঘাড়ের ওপর দিয়ে জড়িয়েছে, পিছনের চুলের গোছা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। দুই সখীর হাতে দুটি নাগরিকা-ঝোলা। এর নাম জেনানা কি ফুটানি কি থলিয়া, কী না কে জানে। জয়দেবের এই বাউল সমাবেশের মেলায় একটু যেন কেমন খেই হারানো।

জবাবে লিলি ঘাড়ে একটা ঝটকা দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘সেরকম লোক পেলে তো৷ মাথা ঘোরাবার মানুষ কোথায় এখানে।’

ঝিনি হেসে ওঠে, একটু যেন লজ্জা পেয়েই বলে, ‘কী সব বলছিস।’

লিলি তাড়াতাড়ি চোখ বড় করে বলে, ‘তাও তো বটে! তোমাকে কিছু বলিনি ভাই, আমি আমার কথাই বলেছি শুধু।’

বিন্দু হেসে বলে, ‘তব্যে? সাবধানে মুখ খুল্যো গ লিলিদিদি। তোমাকে বল্যে রাখি, মাথা ঘোরাবার মানুষ কোথা কে ওত পেত্যে রইয়েছে, জাইনবে কেমন কর‍্যে। নিজের মাথা না ঘুইরলে কী জানা যায়?’

লিলি বলে, ‘দেখা যাবে। কই মশাই, আসুন।’

তা ছাড়া উপায় আছে নাকি। যেতে তো হবেই, দেখতে হবে, এ স্রোতের টান কত দূরে, কোথায় নিয়ে যায়। বেরুবার আগে বিন্দু স্মরণ করায়, ‘যিখানেই যাওয়া হক, ইখানে এস্যে খাবে, মনে রেখ্য বাবাজি। দিদিদের যদিন লিয়ে আসতে পারো, আরও ভাল। তোমার টানে যদি আস্যে।’

বলে বিন্দু লিলি ও ঝিনির দিকে তাকায়। আর বিন্দুর দিকে দেখে নিতাইয়ের কথা আর একবার আমার মনে পড়ে যায়। বলি, ‘চেষ্টা করব।’

আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বিন্দুও খানিকটা আসে। আবার বলে, ‘মেলার পুব দিকে বেশি যাবার দরকার নাই, সাবধানে ঘুরাফিরা কর‍্যো।’

কোনও দিকে তার নজর ফাঁকি যায় না। ফাঁকি গেলে সিঁদেল চোরকে মন-চুরির মতলব দিত না। এক মুহূর্ত তার দিকে আমার অবাক দৃষ্টি থমকে যায়। বিন্দুর নজরও সজাগ। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘কী বইলছ বাবাজি, কিছু বইলবে?’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না। একটা কথা মনে পড়ল, তা-ই।’

‘কী কথা?’

‘পরে বলব।’

তৎক্ষণাৎ বিন্দু ছেলেমানুষের মতো ঘাড়ে দোলা দেয়। বলে, ‘না, ইবেলাতেই বইলতে লাইগবে।’

আমি হেসে বলি, ‘নিতাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল।’

বিন্দু ভুরু কুঁচকে এক পলক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। বলে, ‘কী বলো তো?’

বলি, ‘সিঁদকাটি ছেড়ে সে এখন মনচুরির খোঁজে আছে।’

অমনি একেবারে বিন্দুর চোখ বড় হয়ে ওঠে। মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘অই মা গ, ইস্! লিতাই আবার কী বল্যেছে তোমাকে?’

আমি হাসতে হাসতে এগিয়ে যাই। বিন্দু পিছনেই দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ ফিরিয়ে বলি, ‘মন্দ কিছু বলেনি, ভালই বলেছে।’

বিন্দুর দুই চোখে তখনও অবাক হাসির ঝিকিমিকি। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার?’

ভিড় কাটিয়ে প্রায় দুই সখীর মাঝখানে চলতে চলতে দু-এক কথায় নিতাইয়ের বৃত্তান্ত বলি। শুনে আমার মতোই ওদের মনের অবস্থা। ঝিনি বলে, ‘সত্যি, না মিশলে জানতে পারতুম না, বিন্দু কী আশ্চর্য মেয়ে!’

লিলিও অন্যমনস্ক স্বরে বেজে ওঠে, ‘বিন্দুর কাছে নিজেকে তো আমার তুচ্ছ মনে হয়। সত্যি, কিছুই জানি না। কিছুই দেখিনি।’

বলে কী এরা, এইসব গরবিনী নাগরিকারা। নিশ্চয়ই এসব কেবল নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞানের বিলাস নয়। বিন্দুকে এরা এতখানি মূল্য দিয়ে বোঝে? দু’জনের মুখের দিকে তাকাই। ঝিনি বলে, ‘নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস হত না, বিন্দু পরিষ্কার জয়দেবের কবিতা বলতে পারে।’

এবার আমার অবাক হবার পালা। জিজ্ঞেস করি, ‘পারে মানে, সংস্কৃত উচ্চারণ?’

‘হ্যাঁ। হয়তো শুধুই মুখস্থ। সবটা না হলেও, অনেকখানি। যেভাবেই হোক, মানেও সবই প্রায় বোঝে।’

এ কথা আমারও অজানা। বিন্দুর মুখে গীতগোবিন্দের বচন শোনা আমার ভাগ্যে ঘটেনি। রাঢ়ের এক সামান্য বাউল প্রকৃতি, যে হেথা-হোথা আলখাল্লাধারী পুরুষের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়ায়, মাত্র এক জোড়া প্রেমজুরি যার বাদ্য, গলায় কিছু গানের ডালি, সে যদি গীতগোবিন্দ ভাষে, তবে অবাক লাগে বই কী! আমার আপন সীমার পরিবেশে চোখ ফিরিয়ে মনে হয়, অনেক ঝলকের মধ্যে বড় গরিব হয়ে আছি।

এ বিস্ময়ের ঘোর কাটাবার আগেই এক আলো-ঝলকানো আসরের মাঝখানে এসে পড়ি। এখানে চেহারাই আলাদা। এখানে মাইকের—গোপীদাসের ভাষায় মায়িকের গলায় গান। অনেকখানি অংশ ঘিরে শক্ত বাঁশের বেড়া। গানের আসরের সামনে, মস্ত বড় গদিতে সাদা ঝকঝকে চাদর। গুটিকয় তাকিয়া। সামনে একজন আসীন। মধ্যবয়স্ক গৌরাঙ্গ পুরুষ, সুপুরুষ। ধূসর গোঁফদাড়ি, মাথার ধূসর চুল চুড়ো করে বাঁধা। গায়ে গেরুয়া রঙের রেশমি আলখাল্লায় ঝিলিক দিচ্ছে। আশেপাশে আরও দু-এক বাবাজি। তার চেয়ে বেশি শহুরে মানুষের ভিড়। সামনে দাঁড়িয়ে, যন্ত্রের কাছে মুখ রেখে গান করে এক বাউল। কোট-পাতলুন পরা এক লোক, চোখে চশমা এঁটে, হাতের কাছে যন্ত্র নিয়ে বসেছেন। বোঝা যায়, যন্ত্রের ফিতেয় গান তুলে নিচ্ছেন। গৌরাঙ্গ পুরুষ, তদ্‌গত ভাবে, আধ-বোজা চোখে, শরীরের দোলায় গান শোনেন। শ্রোতার ভিড়ও কম নয়।

আসরের থেকে আমরা দূরে। বেড়া-ঘেরা বিরাট জায়গা জুড়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি হয়েছে। যেমন-তেমম ঘর না, তার আবার সাজপোশাক আছে। নীল কাপড়ে বেড়া জড়ানো লাল ঝালরে সাজানো। দরজার কোনও পাল্লা নেই, কিন্তু ভারী কাপড়ের পর্দা আছে। পর্দা একটু সরানো, তার ফাঁকেই দেখতে পাই সেখানে নানা বয়সের, নানা রূপের মহিলাদের ভিড়। সাজানো-গোছানো বাক্স-প্যাটরা বিছানা। মাঝখানে বড় বড় গদি পাতা। কেউ শুয়ে, কেউ বসে। কেউ বা পান সাজে, তরকারি কোটে। এলাহি ব্যাপার। তা ছাড়াও, ছোট ছোট তাঁবুর ঘর। সেখানেও যাদের ভিড়, সেই সব নারী-পুরুষকে দেখে মনে হয়, নগরের সম্পন্ন মানুষ।

অন্যদিকে রান্নার আয়োজন। গুটি ছয়েক বিশাল উনুন জ্বলে। কাঠ-লকড়ির ব্যাপার না, কয়লার আগুন। সেখানে ব্যস্ত কম করে জনা পনেরো-ষোলো। কে যে কার দিকে দেখছে বুঝতে পারি না। তবে, আলো ঝলমলে গানের আসরের তুলনায় অন্যদিকে ভিড় কম, হই-হট্টগোল নেই। বেদনাশা বটের তলায়, দেখেই তোমার ঠেক লাগবে, ই আখড়ার ছাঁদ-ছন্দ ধরন-ধারণ একটুক আলাদা।

লিলি ডেকে বলে, ‘কী হল, আসুন। আমরা কোথায় উঠেছি, একটু দেখিয়ে দিই।’

সেটা আমারও অনুমান, এটিই গোপীদাসের কথিত মদন বাউলের আখড়া। ঝিনিদের আশ্রয়। আমাকে ডাক দিয়ে ওরা গানের আসরের উলটো দিকে নিয়ে যায়। যেদিকে থাকবার ঘর আর তাঁবু। রান্নার জায়গাটা একেবারে নদীর উঁচু পাড় ঘেঁষে হয়েছে। সেখানেও মাথার ওপরে টিনের চাল।

আমার আর দেখার কী আছে। সব থেকে বড় ঘরের পর্দা সরিয়ে ওরা দু’জনেই ভিতরে যায়। তখন টের পাই, বড় ঘরের সংলগ্ন, আর একদিকে পর্দা ঢাকা অন্য ঘরও রয়েছে। বাইরের থেকে তার কিছুই দেখা যায় না। বড় ঘর পেরিয়ে ওরা অন্যদিকের পর্দার আড়ালে চলে যায়। আমার আর ভিতরে যাওয়া হয় না। নানা আবরণে আভরণে সাজা মহিলাদের নানা ব্যস্ততা, নানা রকমের আলস্য বিশ্রাম। দু-এক পুরুষও তার মধ্যে আলাপে মগ্ন।

আমি দরজার কাছেই থমকে দাঁড়াই। ওদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, একটু ধূমপানের ইচ্ছা জাগে। সিগারেট ধরিয়ে আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখি। কয়েক মুহূর্ত যায় কী না সন্দেহ। খপ করে কে যেন আমার সিগারেট সুদ্ধ হাত চেপে ধরে, আর সঙ্গে সঙ্গে, প্রায় বীণানিন্দিত তীব্র অথচ মন্থর গলায় বেজে ওঠে, ‘কে তুই, আমার আশ্রমে দাঁড়িয়ে ফুরুক ফুরুক সিগ্রেট ফুঁকছিস?’

হস্তধারণ এবং কণ্ঠস্বরেই আমার বুক ধড়াসে যায়! তার ওপরে আত্মসম্মানের ভয়, বিব্রত লজ্জা। নানা কিছুতে হকচকিয়ে যাবার সঙ্গে কথাও বন্ধ অবাক মনে। যিনি আমাকে ধরেন, এবং কণ্ঠস্বরের অধীশ্বরী এক মহিলা। বয়স অনুমানের সাধ্য নেই। যুবতী কি না, বলতে পারি না, লক্ষণ কলই আছে। হয়তো বেলা যায়, কিন্তু মধ্য ঋতুর ভাদ্রের মতো, এ শরীর থেকে যৌবন যেতে গড়িমসি করে। তা করুক, শেষ রশ্মিও যেমন জলে পড়লে বড় বেশি ঝলকায়, এ গৈরিকবসনা রমণী তেমনি।

চোখ তাঁর ডাগর, দৃষ্টির ভাবেতে যেন লাস্যের জড়িমা। নাগরিকা ছাঁদের সুন্দর চশমা থাকলেও এ চোখ সুন্দর, তাহে অঞ্জনবিলাসিনী কৃষ্ণনয়না। রেশমি গেরুয়ায় পাড় নেই, পরনের চালে নাগরিকা। পাতলা রেশমি গেরুয়ার কাঁধইস্তক জামা, অন্তর্বাসের ইশারা জাগানো। মুখের ছাঁচখানি মিঠে। তাম্বুলরঞ্জিনী রক্তবিম্বোষ্ঠা। রুক্ষু কেশপাশে আলগা বাঁধমের খোঁপা।

ক্রুদ্ধ কটাক্ষের বদলে তাঁর অনুসন্ধিৎসু আয়ত চোখে ঢুলুঢুলু ভাব বেশি। তবু এই অপলক দৃষ্টিপাতের সামনে চোখ তুলে রাখতে পারি না যেন। অপরাধের চিন্তায়, জড়ীভূত হবার আগে কোনওরকমে বলতে পারি, ‘আমি—মানে—।’

মহিলা মুখ থেকে একরাশ জর্দার মোহিনী গন্ধ ছড়িয়ে, ঘাড় দুলিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ বাছা, তুমি। তুমি কে, আমার আশ্রমের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খাচ্ছ। পায়ে আবার লটবরের মতো জুতাও রয়েছে।’

আত্মসম্মানের ভয় যত, কথাগুলো বুকে বেঁধে তত! দৃষ্টি যুবতীর পিছুপিছু, কাঁচপোকার পিছনে, আরশোলার মতো কোথায় এলাম! কার হাতে পড়লাম। কী লাঞ্ছনা কপালে আছে। ইনিই বা কে, তাও জানি না। তবে হাতের কব্‌জিতে যে শক্তি আছে, তা তাঁর উষ্ণ করধৃতিতেই বুঝতে পারি। এই শীতেও ওঁর গায়ে কোনও গরম জামা নেই।

আশ্রমের দু-একজন কৌতূহলী হয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু বলে না, আমাদের উভয়ের দিকেই দেখে। তাদের মুখভাব তেমন মারাত্মক মনে হয় না যে, আদেশ পেলে এখুনি এই অপরিচিত নিষ্ঠাহীনকে উত্তমমধ্যম দান করে। এদিকে হাত ছাড়বারও কোনও লক্ষণ দেখি না। অথচ, যে পর্যন্ত জুতো পায়ে এসেছি, সে পর্যন্ত লিলি-ঝিনিও এসেছে। ঘরের দরজার কাছে ওরা ছেড়ে রেখে গিয়েছে। এখন কি এই মহিলার হাতে-পায়ে ধরতে হবে নাকি। তাতেও আমার আপত্তি নেই, অপরাধ যখন করে ফেলেছি। বলি, ‘দেখুন, আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি।’

আমরা কথা শেষ হবার আগেই ঝিনি এসে একেবারে আমার গায়ের কাছে দাঁড়ায়। বলে ওঠে, ‘কী হয়েছে?’

মহিলা বলেন, ‘দ্যাখ মা, ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খাচ্ছে।’

উচ্চারণে ‘সিগ্রেট’ শব্দটা অদ্ভুত, এক শ্রেণীর লোক সবখানেই কেন যেন সিগারেটকে সিগ্রেট বলে। আমার বিব্রত লজ্জা এখন সবই ঝিনির গলায় বাজে, ‘ওহ্, মানে উনি জানেন তো, তা-ই।’

লিলি বলে ওঠে, ‘মা, উনি আমাদের সেই লোক, যাঁর কথা আপনাকে বলেছিলাম।’

ও আমার নামটাও উচ্চারণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মহিলার আচরণ ভিন্ন। স্পর্শ কোমল হয়ে ওঠে। হাত ছেড়ে দিয়ে, একেবারে চিবুকে হাত দিয়ে বলে, ‘তাই বলো, আমি ভাবি এমন ভালমানুষ মুখখানি কার। খুব ভয় ধরিয়ে দিয়েছি তো? আয়, আমার কাছে আয়।’

বলে একেবারে গলা জড়িয়ে ধরে, গায়ের কাছে আকর্ষণ। ইতিমধ্যে ঝটিতি পরিস্থিতি বদল হলেও একটু একটু নিশ্বাস বইতে আরম্ভ করে। আগেই জ্বলন্ত সিগারেট ফেলবার উদ্যোগ করি। তিনি হাত ধরে বারণ করে বলেন, ‘থাক, মুখের জিনিসটা খা। ফেলিস না। আমাকে আবার সব লক্ষ রাখতে হয় তো।’

বলে নিশ্বাসে এক রাশ মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে হেসে ঢুলুঢুলু চোখে তাকান। আঙুল দিয়ে আমার গালে টোকা মারেন। বলেন, ‘তাই ভাবি, এমন মিঠে ভাবের ঠাকুরালি মুখ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন৷’

ঝিনি তখন আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মহিলার দিকে দেখছে। লিলি বলে, ‘আমরা আবার ভেতরে আপনাকেই খুঁজতে গেছলাম। ওঁকে ডেকে নিয়ে এলাম। বলেছিলেন, যেন আলাপ করিয়ে দিই।’

‘না দিলে রাগ করতাম। চল, ভেতরে একটু বসবি। এই, এই ধনু, একটা মাটির ভাঁড় দে তো রে, জলখাবার ভাঁড়। সিগ্রেটের ছাই ফেলবে।’

যাকে ডেকে বলে, সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে একটা খুরি এনে দেয়। আমিই হাত বাড়িয়ে নিই। বাহুপাশের আলিঙ্গন থেকে তখনও মুক্ত নই। মহিলা বলেন, ‘কাল থেকে তা হলে তোমার জন্যেই হা-পিত্যেশ?’

বলে ঝিনির দিকে একবার তাকান। তাম্বূল-লাল ঠোঁটে হাসি। দৃষ্টি তেমনি ঢুলুঢুলু। এমন সময় একটু দূর থেকে হাসি আর গলাখাঁকারির শব্দ হয়। মুখ তুলে দেখি, সীমানা-বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে জনা তিন-চারেক লোক, আমাদের দিকে দেখছে। মহিলা ডাকেন, ‘এসো, ভেতরে এসো।’

এমন একজন মহিলার অঙ্গাঙ্গি থাকতে অস্বস্তি হয়, তথাপি তাঁর নির্বিকার উদাসীনতায় বাধা দিতে পারি না। পায়ের জুতো বাইরে রেখে ভিতরে ঢুকি। ঝিনি লিলি সঙ্গে। মহিলা আমাকে তেমনি ধরে নিয়েই চলেন। চলতে চলতেই বলেন, ‘গিরিবালা আমাকে দুটো পান দিয়ো গো।’

গায়ে এক গা গহনা, প্রায় প্রৌঢ়া এক মহিলা পান সাজতে সাজতেই বলেন, ‘দিচ্চি মা।’

আমি যেতে যেতেই ঝিনি-লিলির দিকে তাকাই। দু’জনেই ঠোঁট টিপে, চোখের তারা কাঁপিয়ে কী যেন ইশারা করে। কী আর ইশারা করবে, যা হচ্ছে, তা-ই হতে দিতে বলে নিশ্চয়ই। তখন তো মনে মনে বলেছিলাম, দেখি, এই দুই সখীর স্রোত কোথায় টেনে নিয়ে যায়। তবু, ঘটনা-জালের জটায় কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।

ঘর ছাড়িয়ে, পর্দা সরিয়ে আর এক নতুন পরিবেশ। এখানে সম্পূর্ণ আলাদা তাঁবুর ঘর। মাটির সবখানেই মোটা করে খড় বিছানো। এক পাশে তার ওপরে মোটা করে গদি পাতা। গদির ওপরে ধোপদুরস্ত বিছানা। মহিলা আমাকে সেই বিছানায় বসিয়ে দেন। বলেন ‘বসো। বসো গো তোমরা।’

আমার পাশে বসে ঘাড় কাত করে চেয়ে হেসে বলেন, ‘খুব ভয় পেয়েছিলে তো।’

সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তি, ‘তা পেয়েছিলাম।’

স্বীকারোক্তির ভঙ্গিতেই বোধ হয় তিনজনেই হেসে ওঠে। আবার তৎক্ষণাৎ মহিলা ভুরুতে যেন শর জুড়ে তাকান। ঝামটা দিয়ে বলেন, ‘তা মুখপোড়া ছেলে বলবে তো, তুমি ওদের সঙ্গে এসেছ। তখন তো মনে হচ্ছিল, ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানো না। দেখে তো বুঝতে পারছি, তা মোটেই নও।’

লিলি তাতে ফোড়ন দেয়, ‘একেবারেই নয়।’

মহিলা আবার বলেন, ‘মেয়েগুলোকে সেই থেকে ঘুরিয়ে মারছ।’

সেই একই অভিযোগ। লিলি বলে ওঠে, ‘গুলো নয় মা, আমি ওর মধ্যে নেই।’

মহিলা বলেন, ‘আহা, বলিস কেন। বললে মনে হয়, আছিস। ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’

এবার লিলির রং-করা গালেও লালের ছোপ ধরে যায়। ঝিনির দিকে একবার দেখে প্রায় আর্তস্বরে অস্ফুট শব্দ করে, ‘মা কী বলছেন!’

মা প্রায় সখীর মতোই লিলির গায়ে চাটি মেরে বলেন, ‘তুই যেমন বললি, আমিও সেইরকম বললাম। আমি তো অন্য কিছু বলিনি, বলেছি, মেয়েগুলোকে ঘুরিয়ে মারছ।’

লিলির অবস্থা ঝিনি উপভোগ করে হাসে। লিলি তাকায় আমার দিকে। মহিলা আরও বলেন, ‘দু’জনেই যদি ঘুরে মরিস, তাতেই বা ক্ষতি কী। কী বলো ছেলে, ক্ষতি আছে কিছু?’

আবার আমাকে কেন। আমি তো এমনিতেই বাক্যহারা হয়ে গিয়েছি। তবুও, কোনও গুরুত্ব আর জটিলতা আরোপ না করেই বলি, ‘না, ক্ষতি আর কী।’

এবার ঝিনি লিলি, দুই সখীতে চোখাচোখি করে হঠাৎ একসঙ্গেই হেসে ওঠে। তখন গিরিবালা নাম্নী পান নিয়ে আসেন। মহিলা পান হাতে নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘খাবে?’

ঘাড় নেড়ে জানাই, ‘না।’

‘কেন, দাঁত নষ্ট হবে?’

‘সেজন্য নয়, খাই না তো।’

‘এই মেয়েগুলোকেও খাওয়াতে পারলাম না। কলকাতায় এত পানের দোকান চলে কী করে?’

তা বটে। নিজেকে কলকাতার লোক বলে আমার দাবি নেই। বাকি দু’জন কলকাতারই। দু’জনে পান না খেলে দোকানগুলো চলে কেমন করে।

উনি ঝিনিকে বলেন একটা ছোট বাক্স দেখিয়ে, ‘ওটার থেকে আমার জর্দার কৌটোটাও দাও তো।’

ঝিনি বাক্স থেকে জর্দার কৌটো বের করে দেয়। মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার খালি হাত কেন, ঝোলাঝুলি কিছু নেই।’

‘আমি অন্য জায়গায় উঠেছি।’

‘কোথায়?’

‘গোপীদাস বাউলের আখড়ায়।’

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা বলেন, ‘অ, হেরুকের গোপীদাস? বড় ভাল মানুষ। তবে তো সেখানে বিন্দু, গোকুলও আছে!’

আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আপনি চেনেন?’

চোখ ঢুলুঢুলু করে তাকিয়ে বলেন, ‘চিনব না? এক সম্প্রদায়ের লোক আমরা, এক সাধনভজন। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সব জায়গার সবাইকে চিনি।’

আমি ঝিনি লিলির দিকে একটু অবাক জিজ্ঞাসায় তাকাই। কেন, ওরা কি এ মহিলাকে কিছু বলেনি। ঝিনির সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতেই মহিলার দিকে ফিরে বলে ওঠে, ‘আপনার সঙ্গে যে ওঁদের চেনা-পরিচয় আছে, তা তো জানি না। বিন্দুদের সঙ্গে আমাদের শান্তিনিকেতনে পরিচয় হয়েছে।’

মহিলা বলেন, ‘ওমা, বলবে তো সে কথা!’

আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘আমার কথা বলো। কালই খবর পাঠাব, আমার এখানে এসে ওদের সবাইকে একবার গেয়ে যেতে হবে। গোপীদাসের গান শুনতে উনি খুব ভালবাসেন।’

‘উনি’ সম্ভবত মদন বাউলের কথাই বলেন। কিন্তু পান দুটো সেই হাতেই। জর্দার কৌটো আর খোলা হয় না। আমাকে আবার বলেন, ‘তা তুমিও এখানে এসে উঠলেই পারতে।’

বলি, ‘ওদের সঙ্গে আগেই কথা ছিল।’

মহিলা লিলি ঝিনির দিকে ফিরে তাকান। বলেন, ‘এ বছরে, আশ্রমে এ দুটিকেও আমি ভাল পেয়েছি। মনগুলো বড় ভাল। ভাগ্যে না থাকলে মেলে না।’

ওরা দু’জনেই লজ্জা পেয়ে যায়। একটা খুশির রংও লাগে। মহিলা আমার দিকে ফিরে ঠোঁট টিপে একটু হাসেন। বলেন, ‘তোমার জন্যেই পেয়েছি বটে।’

লজ্জিত বিস্ময়ে বলি, ‘না না, আমার জন্য কেন। ওঁরা নিজেরাই এসেছেন।’

‘তা জানি হে৷ কাল থেকে এ পর্যন্ত, তোমার কথা অনেক হয়েছে। দেখলাম বটে, শুনলামও বটে, তাতেই বুঝেছি, তোমার আসার কথা না থাকলে ওরা আসত না।’

চুপ করে থাকি। ঝিনি সবখানে, সকলের কাছে, এক রূপে এক স্রোতে বহতা। তবু বলে ওঠে, ‘কেদুঁলির মেলা দেখার ইচ্ছেটা অনেক দিনের।’

মহিলা হাত তুলে ধমক দেন, ‘থাম দিকিনি বাপু, খালি আগ বাড়িয়ে কথা। আমি কিছু বলেছি নাকি। ও এসেছে বলে না-হয়, এ বছরে ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, এই তো?’

লিলি বলে, ‘তা-ই।’

‘আর তুমি কীজন্য এসেছ বাছা।’

প্রশ্নটা আমাকে। বাছা বাবা যা-ই বলুন, ওঁর মুখে যেন এ সম্বোধন মানায় না। সর্বাঙ্গে, ভাবে ভঙ্গিতে যেন অন্য এক নারী। রমণী, রঙ্গিণী। বলি, ‘দেখতে শুনতে।’

যেন গোপন কথা জিজ্ঞেস করেন, এমনি ভাবে কানের কাছে মুখ এনে বলেন, ‘কী?’

বলি, ‘মেলা, বাউল, বাউলের গান।’

‘কেন।’

‘ভাল লাগে।’

‘শুধু ভাল লাগে? শুনলাম, এখানে সেখানে নানা জায়গায়, মেলায় খেলায় ঘুরে বেড়াও।’

‘তা বেড়াই।’

‘কেন, লেখবার জন্য?’

প্রশ্নটা অনেকের মতোই যুক্তিতর্কহীন। অর্থহীন তো বটেই। বলি, ‘না। ঘুরে বেড়াবার সঙ্গে লেখার কিছু নেই। ঘুরে বেড়াই বলেই মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে।’

‘আর ঘোরার তাগিদটা?’

‘ঘোরার তাগিদেই।’

হঠাৎ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে, বুকের জামা মুঠি করে ধরে জোরে টান দেন। আমার চোখের দিকে তাকান। একটু একটু নাড়েন। আর যেন প্রায় রুদ্ধ গলায় বলেন, ‘দাগা খাওয়া তুই!’

কীসের দাগা খাব? অবাক হয়ে তাকাই তাঁর দিকে। তিনি হাসতে হাসতে কাঁপেন, আর মুহূর্তেই দেখি, চোখের কাজল ভাসিয়ে জল গলে। আমি চেয়ে থাকি, কিছু বলতে পারি না। কারণ আমি বুঝতে পারি, হাস্যে লাস্যে তরঙ্গিণী রমণী ভিতর থেকে একটা কষ্টজাত আবেগে চোখের জলে ভাসেন। গলার কাছে তাঁর স্বর রুদ্ধ। যা উপছে আসতে চায় তা আর কিছু।

এই ভাব ও আবেগের সহসা লক্ষণের কিছুই বুঝি না আমি। কিন্তু আমার কোথায় যেন একটা বিকল ভাব লাগে। আমি যেন নিজের মধ্যেই হাতড়ে ফিরি। ঝিনি আমার দিকে গভীর অনুসন্ধিৎসায় দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকে। লিলি নিজেও জানে না, কেন অকারণ ওর চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

একটু পরে মহিলা নিচু স্বরে বলেন, ‘দাগা খাওয়া মানে জানো তো? কোনও মেয়েকে সমাজ যদি কুলটা বলে, সেটা একটা দাগা। কিন্তু সে মেয়ে যদি আপন ধর্মে চলে, তবে প্রাণে দাগা খেয়েও তার স্বর্গ। রাধা যেমন, বুঝলে তো? কীসের সমাজ, কীসের সংসার, কীসের বন্ধন। সব তো সেই “এক”-এর জন্য। সেটাই আসল দাগা। তুমি সেই রকমে দাগা খাওয়া, ঠিক বলেছি?’

ওঁর চোখের জল শুকোয় না, তার ওপরে গলে। আমি বলি, ‘জানি না।’

‘তা জানবে না। জানো খালি ঘোরার তাগিদেই ঘোরা। ভাল। তাই জানোগে। তবে দাগা খাওয়ারাই কিন্তু দাগাবাজ বেশি হয় তা জানো তো?’

বলতে বলতে ভেজা চোখেই দেখি, ঢুলুঢুলু দৃষ্টি বক্র হয়। আমি কোনও জবাব দিই না। উনি বলেন, ‘যখন দাগা খায়, তখন “দেহি পদপল্লবমুদারম্।” কেন? না, “জ্বলতি ময়ি দারুণো মদনকদনানলো হরতু তদুপাহিতাবিকারম্।” আর দাগাবাজ হল শঠ ধূর্ত, কেবল কাঁদায়।’

এ কথারও জবাব দিতে পারি না। কিন্তু কেউ কারুর দিকে ফিরে তাকাতে পারি না। ঝিনি একেবারে অধোবদন। লিলি মুখ ফিরিয়ে বোধ হয় ঠোঁট টিপে টিপে হাসে। তবু মনে মনে এ মহিলার বাণীবিন্যাস ও ভাবকে ভাল লাগে।

আমাকে একটু ঠেলা দিয়ে বলেন, ‘কী, সত্যি কী না।’

বলি, ‘বলতে পারছি না।’

‘দাগাবাজ!’

বলেই উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘দেখি একবার ওঁকে ডাকি। উনি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন।’

.

৮২.

এ যেন এক তাঁবুর ফাঁদ। ঘরের মধ্যে ঘর, তারপরেও ঘর। পর্দায় পর্দায় সীমানা। এমন মোটা পর্দা যে, পাশের ঘরের দৃশ্য দূরের কথা, কথাও শোনা যায় না। দেখি মহিলা অন্যদিকে আর এক পর্দা তোলেন। পাশে আর একটি ঘর। তেমনি বিছানো খড়ের ওপরে শতরঞ্জি পাতা। সেই ঘরের খোলা পর্দা দিয়ে চকিতে দেখা গেল, আশ্রমে প্রথম প্রবেশের মুখে আলো ঝলকানো গানের আসর। যেখানে ‘উনি’ বসে আছেন। ঘরের ভিতর দিয়েই আসরে যাওয়া যায়।

মহিলা অদৃশ্য হতেই আমি লিলি ঝিনির দিকে ফিরে তাকাই। আমার মনে ও চোখে কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। ঝিনির চোখে মুখে তখনও জয়দেবের বাণীর রং। কিন্তু আমি দাগাবাজও নই, আর দুরন্ত কামাগ্নির বিকার নষ্ট করার জন্যে কারুর পদপল্লব মাথায় নিতে চাইনি। কিন্তু ভঙ্গির লাস্যে, বচনের চটুল দীপ্তিতে একটু রং ছড়ায় বই কী। মহিলা শুধু অভীষ্ট ভাষণে সিদ্ধা নন। এক হিসাবে রসিকা বিদুষী বলে মনে হয়। ভাষণের চাতুর্যেও পাকা স্যাকরার জড়োয়ার কারুমিতি। অথচ তারই মধ্যে এক লহমায় গলার স্বরও রুদ্ধ হয়ে যায়, চোখ ভেসে যায়। ইনি কে!

আমার এই কৌতূহলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাতের আগেই লিলি ঘাড় বাঁকিয়ে চোখের কোণে হেসে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল!’

বলি, ‘অর্থ অনর্থ বাদ দিয়ে, অপূর্ব!’

অমনি লিলির চোখে শঙ্কা। কাজলা চোখ বড় করে একবার সখীর দিকে তাকিয়ে দেখে। তারপরে বলে, ‘এত ভাল লেগেছে? দেখবেন মশাই, পাড় ধ্বসে না যেন।’

হেসে বলি, ‘সে আশঙ্কা নেই!

লিলি বলে, ‘বলা যায় না, পুরুষ মানুষ তো। আর আমাদের মা-টিও যা। বাবারে!’

সেটা একেবারে মিথ্যা না। মহিলার প্রতি আমার কটাক্ষ নেই। কিন্তু অন্যের অঘটন অনায়াসেই ঘটিয়ে ছাড়তে পারেন বোধ হয়! ঝিনি বলে ওঠে, ‘কী যে বলিস। উনি কি তা-ই।’

অর্থাৎ মহিলাটি। লিলি যাঁকে কয়েকবারই মা বলেছে। লিলি তেমনি নিচু স্বরেই বলে, ‘উনি যাই হোন ভাই, কী যে না পারেন আর না জানেন, তা জানি না।’

গলার স্বর আরও নামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমি তো ভাবলাম, আপনাকে আর ছাড়বেন না। যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন।’

ঝিনি একটু ত্রস্ত সুরে বেজে ওঠে, ‘আহ্ লিলি, চুপ কর।’

আমি বলি, ‘ইনি মদন বাউলের প্রকৃতি মনোহরা।’

বলে উঠি, ‘বাহ্, নামটিও চমৎকার!’

বলতেই ঝিনির সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। ওর দৃষ্টিতে অনুসন্ধিৎসা। চোখে চোখ পড়তে হেসে মুখ নামায়। আমি আবার বলি, ‘মাতোয়ারা নাম হলেও ওঁকে মানাত।’

লিলি আলতো করে ধাক্কা দেয় ঝিনির গায়ে। বলে, ‘এই ঝিনি, ভদ্রলোক কী বলছেন রে। একেবারে মজে গেছেন মনে হচ্ছে।’

বলি, ‘তা একরকম ভাবে মজেছি বলতে পারেন। সেই খপ করে হাত ধরা থেকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই যেরকম দেখলাম, না মজে কে পারে। আপনারা মজেননি?’

দুই সখীতে চোখাচোখি করে ঠোঁট টিপে হাসে। লিলি বলে, ‘মজেছি। তবে আমরা মেয়ে তো, সেইটিই ভরসা।’

দুই সখীতে নিচু স্বরে হেসে ওঠে। অর্থাৎ পুরুষকেই ভরসা নেই। ঝিনি হাসি থামিয়ে বলে, ‘আমার কিন্তু ওঁকে খুবই ভাল লেগেছে। বাইরের থেকে ওঁকে যা দেখা যায়, ভেতরে তা নন। এমনিতে সেজেগুঁজে থাকতে ভালবাসেন, কিন্তু সব সময়েই যেন কীসের একটা ঘোরে আছেন।’

বলতে বলতে ঝিনির মুখের রূপান্তর হয়। ওরও যেন একটা ঘোর লাগে। মদন বাউলের এ প্রকৃতি মনোহরাকে দেখে, আমার মনে হয়, যেন কীসের একটা ঘোরে রয়েছেন। এইমাত্র চোখ পাকিয়ে, পরমুহূর্তেই হাসেন। তৎক্ষণাৎ আবার কাঁদেন। তবু রাধারানির কথা আমার মনে পড়ে যায়। সে প্রকৃতির সঙ্গে যেন এ প্রকৃতি মেলাতে পারি না। বাউল প্রকৃতি কি এমনটিও হয়। বলি, ‘আমি এমন বাউল প্রকৃতি দেখিনি।’

‘কেমন বাউল প্রকৃতি হে?’

একেবারে পালটা প্রশ্ন পর্দার পাশ থেকে। দেখি স্বয়ং মনোহরা। পর্দা তুলে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আবার সেই বুক ধড়াসে যাওয়া। হঠাৎ কথা জোগায় না মুখে। কিন্তু এত সোজা প্রশ্নের সোজা জবাব না দিলেও চলে না। অথচ তাঁর পাশেই মদন বাউলের গোরা মূর্তি। রেশমি গেরুয়া, ধূসর গোঁফদাড়ি। দীর্ঘ পুরুষের চোখ দুটি যেন হাসিতে চিকচিক করে। তাতেই আরও ঠেক খেয়ে যাই। তবু বলে ফেলি, ‘আপনার মতো।’

মনোহরা ঝটিতি বাউলের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে যেন ছোট মেয়ের মতো নালিশ করেন, ‘দেখেছেন তো গোঁসাই।’

তারপরেই আমার ওপরে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েন। কাছে এসে নিচু হয়ে ঝংকার দিয়ে ওঠেন, ‘কেন রে মুখপোড়া, বাউল প্রকৃতি কি মাথায় জটা নিয়ে খেঁকি বোষ্টমী হয়ে থাকবে?’

মদন হেসে ওঠেন হা হা করে। আমি তাড়াতাড়ি বলি, ‘তা বলিনি। আমি—মানে— ।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না, আমার সাজপোশাক, পান খাওয়া এ সবের মধ্যে ওসব থাকে না, তাই তো? প্রকৃতির তুই কী জানিস?’

বলেই ঝিনির একটা হাত ধরে টান দিয়ে কাছে এনে বলেন, ‘এই দ্যাখ দাগাবাজ, এও একটা প্রকৃতি। বাউল প্রকৃতি। চিনতে পারিস, বুঝতে পারিস?’

ভঙ্গিতে যতখানি, গলায় তত রোষ ফোঁস নেই। বরং যেন একটা আবেগের ধারায় কৌতুকের ছটা, তরঙ্গ তোলে স্বরে। ঢুলুঢুলু চোখেও সেই কৌতুক রহস্যের বান। ঝিনি আমার দিকে চেয়ে লজ্জিত হেসে চোখ নামায়। মদন বাউল গাঢ় স্বরে বলে ওঠেন, ‘বাহ্ বাহ্ মনোহরা, বড় ভাল বইলছ গ।’

আবার সেই রাঢ়ের সুর বাজে তাঁর গলায়। মনোহরা তখন লিলিকেও আর এক হাত দিয়ে ধরে বলে, ‘কে প্রকৃতি নয় বল দেখি। যেখানে প্রেমরসের গতি সেখানেই প্রকৃতি। প্রেম কি আর বেশবাসে গন্ধে ধরা পড়ে? প্রকৃতি হয় মনে মনে, বুঝেছ হে ছোকরা।’

মদন যেন ফুকারি ওঠেন, ‘সোন্দর, মনোহরা সোন্দর বইলছ গ। প্রেমপিরিতি বিনা রসের গতি নাই। রসের গতিপ্রকৃতি ভিন্ন বইতে নারে।’

স্পষ্টই দেখতে পাই মদন বাউলের চোখ দুটি ছলছলানো। যখন এলেন তখন থেকেই ভেজা ভেজা, একটু রক্তিম। মনোহরা তাঁর দিকে ফিরে বলেন, ‘সেইজন্যেই তো দেহ সাজাবার কথা কেউ বলে না। বলে মন।’

মনোহরা সুর করে গেয়ে ওঠেন, ‘মন সাজো, প্রকৃতি সাজে।’…

মদন বাউল রুদ্ধ গলায় বলে ওঠেন, ‘আহা অই অই, যথার্থ গ, যথার্থ।’

মনোহরা হাত বাড়িয়ে দেন মদমের পায়ে। মদনও নিচু হয়ে মনোহরার পা স্পর্শ করেন। দু’জনেরই যেন কীসের একটা আবেশ। দু’জনেরই চোখ ভিজে ওঠে। ভিতরের ভাব না বুঝতে পারি, দেখতে পাই, এঁরা আপন স্রোতে বহতা। সেই একই বাউল রীতিভঙ্গি। লিলি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে। কিন্তু ঝিনি ওর অপলক চোখ দুটি আমার চোখ থেকে সরায় না। কী ওর মনের ভাব সবটুকু বুঝি না। যেন এক কূলে দাঁড়িয়ে আর এক কূলে নজর করে। মদন মনোহরার কূলে দাঁড়িয়ে আর একজনের দিকে চেয়ে থাকে। সবাই আপন স্রোতে বহতা।

মনোহরা এই ঘোরের মধ্যেই সহজ ভাবে বলেন, ‘গোঁসাই, আমার মেয়েরা যে ছেলের কথা বলেছিল, এ সে-ই৷’

মদন অমনি দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকের কাছে টেনে নেন। এমন দ্বিধাহীন অসঙ্কোচ আবেগে টেনে নেন, এ মানুষদের হৃদয়ের যেন কোনও তল খুঁজে পাই না। বলেন, ‘এস্য বাবা, এস্য। তুমার কথা আগেই শুন্যেছি।’

যেন কতদিনের চেনাজানা, কত আপন। মেকিপনার দরকারও তো নেই। দেওয়া-নেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের। তথাপি, দেখ, যেন স্নেহে সোহাগে আলিঙ্গন দেন। এ মন-প্রাণের গতিপ্রকৃতি জানি না। তাঁর বিশাল শরীরের স্পর্শে একটি স্নিগ্ধতা। অস্পষ্ট হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ। হয়তো চুলদাড়িতে কিংবা রেশমি আলখাল্লায়। পান যে খান না, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে অই এক ব্যাজ, মুখের সামনে কথা বললেই হালকা একটু প্রেমের গন্ধ পাবে। অর্থাৎ গঞ্জিকা।

মনোহরা সংবাদ দেন আমার গোপীদাসের আশ্রমে ওঠার কথা। তারপরে বলেন, ‘এ আবার কী বলে জানেন তো গোঁসাই?’

‘কী গ?’

‘বলে, লেখার জন্যে ঘুরি না, ঘরি বলে লিখি।’

মদন হেসে আমার চিবুক ধরে নাড়া দেন। বলেন, ‘ঠিক ঠিক, সাধে বল্যে জপে, জপে বল্যে সাধে না। ঠিক কী না বাবা।’

বলি, ‘কী সাধি, তা-ই তো জানি না।’

মদন একেবারে হাঁকাড় দিয়ে হেসে বাজেন, ‘জয়গুরু জয়গুরু। তবু সেধ্যে বেড়াও। তাই বেড়াও বাবা, তাই বেড়াও।’

মনোহরা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন বোঝেন গোঁসাই?’

‘কীসের বুঝাবুঝি গ? ই বিটাকে? দ্যাখ ক্যানে, সব মনমনা ই বিটার। খুঁজ্যে মইরছে। এখন ইয়ার মইরছি না মইরতে আছি। কে ধর‍্যে রাইখবা রাখো।’

বলে, আর একবার নিবিড় করে জড়ান। মনোহরা ঘাড় নেড়ে শব্দ করেন, ‘হুম্, বুঝেছি।’

তারপরেই হঠাৎ ঝিনির দিকে ফিরে বলে ওঠেন, ‘চোখের জল মোছ মা, সবাই আমরা মরেছি নয় মরতে আছি।’

অবাক হয়ে চেয়ে দেখি, ঝিনির চোখ টলটলিয়ে ভেসে যায়। আমার চোখ পড়তেই মুখ নামিয়ে নেয়। মদন তাড়াতাড়ি একটা হাত বাড়িয়ে ঝিনির মাথায় রাখেন। বলেন, ‘বট্যে ক্যানে গ মা। তুমাকে বা কে ধর‍্যে রাইখবে?’

লিলির দিকে আমার চোখ পড়ে। ওর বিষণ্ণ মুখ। আমার দিকে চেয়ে থাকা চোখে যেন একটা অভিযোগের ছায়া। কার প্রতি সেই অভিযোগ জানি না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে হঠাৎ চলতি টানে মোড় বেঁকে যায়। একটা ঘোর লাগে। হয়তো মদন বাউলের সব কথা বুঝি না। তবু নিজের মনের কথা কারুর মুখে এমনি করে শুনি না। গোপীদাসের মুখে শুনেছিলাম। আবার মদনের কাছে শুনলাম। যেন তাঁর কথা শুনেই মনে পড়ে যায়, কী খুঁজি। কিছু কি খুঁজি! আমি কি কখনও এমন গতি পেয়েছি, যেন ফিরে যাবার কথা আমার কানে যায় না। চলি চলি চলি, এখন আর মরি কি না মরি। না হয় মরতেই আছি। এমন গতি কি আমার! না কি, এও সেই গতির কথা, বারংবার বহু ডাকাডাকি, তবু যাই সেই তার কোলে, মরণ মরণ মরণ।

ঝিনি বা কেন কাঁদে! ওর গতিও কি এমনি। স্বরূপের কথা শুনে কি ওর চোখ ভাসে। না কি আর কিছু। ওর চোখ সহসা টলটলিয়ে না উঠলে, আমার নিজের কথাও এমন করে মনে হত না। মদন বাউল কী ভেবে বলেন, জানি না। আমি এক স্রোতে ভেসে যাই। তাঁর চোখও শুকনো নেই।

তারপরে মদন বলেন, ‘কিন্তু আমার কাছে একদিন থাইকতে হবে বাবা।’

মনোহরা বলেন, ‘সে কথা বলেছি।’

খুশি হয়ে বলেন, ‘বেশ করেছ। জাইনলে গ মনোহরা, আজ গোপাল আমাকে ভাসাইচ্ছে। আমি আর থির থাইকতে লাইরছি।’

বলতে বলতেই তাঁর গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসে। চোখ ফেটে জল গলে। মনোহরা হাত দিয়ে তাঁর বুকের কাছে চেপে ধরেন। বলেন, ‘জানি গোঁসাই। গোপাল ক্ষ্যাপার গান শুনলে আপনি কী করে থির থাকবেন!’

মদন মাথা নাড়েন, আর চোখের জলে গলেন। বলেন, ‘আহা হা কানা মানুষ, আমার হাতখান ধর‍্যে ধর‍্যে গান কইরছে, আমার ভিতরে যেন কী হয়্যে যেইছে গ। পেখম গানই ধইরলে, “আয় মজা দেখবি আয়, ভবলদীর মাঝখানে; রসরাজ উইঠছে ডুইবছে হাইসছে খেইলছে, ডাইকছে ভাবুক জনে।” গোপাল আমাকে পাগল কইরবে গ আজ। বড় সুখে রইয়েছি।’

তারপরে হঠাৎ আমাদের দিকে ফিরে বলেন, ‘তুমরাও এস্য মা-বাবারা, কানা গোপালের গান শুইনবে এস্য, আমি যাই।’

বলেই একেবারে উঠে পড়েন। কে কানা গোপাল, যাঁর গান শুনে মদনের ভর হয়। এখন বুঝতে পারি, কেন প্রথম থেকেই তাঁর চোখ আরক্ত ছলছল। উনি আপন মন্ত্রে ডুবেছিলেন। আমার কৌতূহল হয় গোপালকে দেখতে, তার গান শুনতে। মদন যাবার আগে আবার বলেন, ‘অই মনোহরা, উখানে যে সব বাবু ভেয়েরা যন্তরপাতি লিয়ে বস্যে রইয়েছেন, উয়াঁদের একটু সইরতে বলো গ!’

মনোহরা বলেন, ‘যাই, আপনি চলুন।’

মদন চলে যান। মনোহরা বলেন, ‘এই আজকাল একদল মানুষ হয়েছেন গান তুলে নিয়ে যাবার বাতিক। কী, না সিনেমা-থিয়েটারে গিয়ে লাগাবে। মূলে হা-ভাত, খালি রং।’

বলে ঘাড়ে একটা ঝটকা দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে হাসেন। খুলে যাওয়া এলো খোঁপায় বাঁধন কষেন। দেখে মনে হয় একটি উদ্ধতস্বাস্থ্য যুবতী। জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা যাবে আসরে?’

লিলি বলে ওঠে, ‘পরে। এই বেলা আমরা একটু ঘুরে আসি।’

লিলি চোখ ঘুরিয়ে একবার আমার দিকে দেখে বলে, ‘তা হয়েছে, তবু আর একবার।’

মনোহরা আমার দিকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘আর একবার দাগাবাজের সঙ্গে!’ যাও, ঘুরে এসো। গোপালের গান পরেও শুনতে পারবে।’

ঝিনি উঠে দাঁড়ায়। আমি বলি, ‘আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।’

লিলি ঝিনির দিকে তাকায়। ঝিনি আমার দিকে। এখন ওর চোখ শুকনো। বলে, ‘একটু ঘুরে আসি।’

‘যা রে যা ছোঁড়া।’

মনোহরা ঠাস করে একটা চড় লাগান আমার কাঁধে! বলেন, ‘গান শোনার দিন আসবে, এখন ঘুরে আয়।’

অগত্যা। আমরা তিনজনেই আগের পথ ধরেই বেরিয়ে আসি।

তিন সখীরই গতি দেখি বটতলার বাউল-আসর ছাড়িয়ে নিছক মেলার আঙ্গিনায়। যেতে যেতেই লিলি আমাকে প্রায় ধমকে বলে, ‘পুরুষ মাত্রেই স্বার্থপর। আপনাকে বললাম না, ওবেলা ঝিনির খাওয়া হয়নি। আশ্রমের রান্নাও এখনও হয়নি। একটু যা হোক চা-টা খাবে তো!’

চমকে উঠে তাড়াতাড়ি বলি, ‘সত্যি, মনেই ছিল না।’

ঝিনি আমার একপাশে। লজ্জিত হেসে বলে, ‘এমন কিছু নয়, একটু চা খাব মেলায় গিয়ে।’

‘নিশ্চয়।’

কিন্তু ক্রমে ভিড় বাড়ে। পাশাপাশি চলা সম্ভব হয় না। লিলি সকলের আগে চলে। ঝিনিকে মাঝখানে রেখে আমি পিছনে। কিন্তু হঠাৎ ঝিনি থমকে দাঁড়িয়ে ফেরে। বলে, ‘দেখি!’

বলে, আমার কাঁধের ওপর পাট করে রাখা চাদরটা টেনে নামিয়ে ভাঁজ খুলতে খুলতে বলে, ‘সেই তখন থেকে দেখছি, কাঁধে ফেলা রয়েছে। গায়ে দেওয়া যায় না?’

একটু অবাক হয়ে থমকে গিয়েছিলাম। তারপরে হেসে বলি, ‘তেমন শীত করছে না।’

‘কিন্তু ঠান্ডাটা ঠিক লাগছে। একটু জড়িয়ে নিলে ক্ষতি কী?’

বলে ও নিজেই চাদরটা গোটা গায়ে জড়িয়ে দেয়। আমার হাত বাড়ানোটাও চোখে পড়ে না। এমনকী, সরু পথ, লোকের ভিড়, কোনও কিছুতেই ওর নজর নেই। ওদিকে লিলি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’

জবাব দেবার আর প্রয়োজন হয় না। দর্শনেই বোঝে। আমার দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসে। আবার ফিরে চলতে আরম্ভ করে। ঝিনিও এগিয়ে চলে আবার। কিছু বলার নেই আমার। বিব্রত ও লজ্জিত হই না। পিছন থেকে ঝিনিকে দেখি। ভাবি, ও কী ভাবে? ওর মনকে কি ও চেনে? লোকে কী বলে জানি না, কিন্তু মানুষ তার নিজের দুঃখ নিজে ডাকে একথা বিশ্বাস করি না। ঝিনির বেলাতেও বিশ্বাস করি না। তবু ওকে কি একটু ফেরানো যায় না?

আমরা মন্দিরের কাছে চলে আসি। আলো ঝলমলে মেলা। বেদনাশা বটতলা ছাড়িয়েও দোকানপাট কিছু আসে। কিন্তু এদিকেই বেশি। জনস্রোতের টান উত্তর দিকে। সেই একই মেলা। মনোহারির নানান ঝলক, খেলনা পুতুল, নানা অঙ্গরাগ, অঙ্গসজ্জা, অলংকার। কাঁসা, পিতল, পাথর, লোহা, যত রকমের বাসন চাইবে সব পাবে। মন্দিরের কাছ থেকেই অজয়ের তীরে তীরে যত বাজিকরদের তাঁবু পড়েছে। সেখানে নানান ছবি, যন্ত্রের গলায়, সং সেজে বাজিকরের খেলার নানা বিজ্ঞাপনের চিৎকার। সব থেকে যেটা জরুরি ঘোষণা, “এই শুরু হয়ে গেল গেল গেল।” বলার ভঙ্গিটা এমনই নির্দয়, আর একটু হলে খোকাকে কাঁধে নিতে এক হাতে বউকে ধরে ছুটোছুটি করে বেচারি পড়েই মরত। এই তো সবে ধানপান উঠেছে, বউ-ছেলে নিয়ে মেলায় এসেছে। খেলা না দেখে কি ফিরে যেতে পারে। তারপরে তো আবার সেই কোদাল শাবল লাঙল নিড়ানি নিয়ে মাঠে মাঠে ফেরা। এখন তবু দু-চার মণ ধান বেচার নগদ কড়ি ট্যাঁকে আছে। তারপরে তো ঘর পেট জোত সবই মহাজনের কাছে বাঁধা। এখন একটু সবুরে চলতে দেবে তো।

আজকের মেলাই সব থেকে জমজমাট। তাই, সব তাঁবুর সামনেই ভিড়। নগদ পয়সার ঝনঝনা। আমরা উত্তরের স্রোতেই ভাসি। আর দেখি দুটি বিদুষী নাগরিকাকে। চারদিকেতে চোখ। এমনি চোখ না। খুঁটিয়ে দেখার চোখ। এবার আমিই একটু পিছনে। দু’জনে চারদিকে দেখে, কী যেন বলে, হাসাহাসি করে। লিলি বারেবারেই দাঁড়াতে চায়। ঝিনি টেনে টেনে নিয়ে যায়। আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে নেয়।

কিন্তু এদিকে খাবারের দোকান কোথায়। আর যদি বা থাকে সেখানে কী খাবে ঝিনি।

শান্তিনিকেতনের মতো সেরকম শহুরে মেলা এটা নিশ্চয় না। আশেপাশে, পথের ধারে ধারে পাঁপর ফুলুরির দোকান অনেক।

তারপরে খানিকটা যেতেই আলো ঝলকানো বড় বড় খাবারের দোকান চোখে পড়ে। আলোর চেয়ে ঝলকায় বেশি বাটায় সাজানো খাজা গজা। বড় বড় কড়া। ভরতি রাজভোগ-রসগোল্লা। আর একটু এগোও, এবারে লিখিত বিজ্ঞাপন, চপ কাটলেট ওমলেট। কিন্তু ভোজনালয়ের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় বড় গরিব কেতার ব্যাপার। মাঝেমধ্যে ভাতের হোটেলও আছে।

এর মধ্যেই একটা ছোট ঘরের সামনে লিলি ঝিনি দাঁড়ায়। আমার দিকে ফিরে চায়। তবু একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে। ইতিমধ্যে আশেপাশে ডাকাডাকি পড়ে যায়, ‘দিদিমণি, আমার এখানে আসেন, মটন কারি আছে, মটন চপ কাটলেট আছে।’

অন্যদিকে কে যেন চেঁচায়, ‘ফাউল পাবেন, ফাউল ইদিকে দিদিমণি।’

কে যে কোনকালে আমাদের এই মটন ফাউল শিখিয়েছিল। পেলে একবার তাঁকে উপুড় হয়ে গড় করি। বাংলাদেশে যত দূরের মেলাতেই যাবে, মটন ফাউলের স্বাদ পাবেই পাবে। স্বাদ না পাও নাম শুনতে পাবেই।

দিদিমণিরা ইতিমধ্যেই সেই ছোট দোকানেই ঢুকে পড়েন। যেরকম ডাকের বহর, দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। পায়জামার ওপরে একটা মোটা কোট গায়ে দেওয়া লোক খাবারের তালিকা ঘোষণা করতে আরম্ভ করে। তার আগেই ঝিনি বলে ওঠে, ‘আপনার দোকানে পাউরুটি আছে তো?’

‘আছে বই কী, দিদিমণি।’

‘তা হলে পাউরুটি সেঁকে দিন। আর ভাল করে কাপ ধুয়ে চা দিন।’

দোকানি অবাক হয়ে পুছ করে, ‘এক পেলেট দোপেঁয়াজি খেয়ে দ্যাখেন দিদিমণি, ফাস্‌কেলাস। খেয়ে ভাল না লাগলে দাম নেই।—বংকা, এই বংকা!’

প্রায় ছাগল-ডাকের মতো একটা আচমকা চিৎকার, ‘কী-ই-ই।’

‘তিন পেলেট মটন দোপেঁয়াজি লাগা।’

আমি যে একটা বিটাছেল্যা রয়েছি সেদিকে খেয়ালই নেই। এমনকী ঝিনির ঘাড় নাড়াও লোকটা দেখতে পায় না। যেন তার কথাতেই সব কিছু। কিন্তু আমার তো কাটলেট মটন দোপেঁয়াজি চলবে না। দুই সখীর যদি চলে, চলুক।

ঝিনি প্রায় ধমকে ওঠে, ‘বলছি যে ওসব লাগবে না।’

‘আহা, খেয়েই দ্যাখেন না।’

নাছোড়বান্দা লোক দেখছি। ঝিনি তেমনি করেই বলে, ‘না। আপনার পাউরুটি থাকে তো দিন, নইলে চলে যাচ্ছি।’

‘তাতেও লোকটা ফিরে তাকায় না। পাউরুটির কাগজ ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ‘আচ্ছা আচ্ছা বসেন। চপ কাটলেট খাবেন তো?’

‘না, অন্য কিছুই চাই না।’

লোকটা এবার চেঁচিয়ে ডাকে, ‘বংকা, এই বংকা।’

পিছনের একটা পর্দার আড়াল থেকে জবাব আসে, ‘ইঁ-ইঁ-ইঁ!’

‘ওসব থাক, এদিকে আয়, রুটি সেঁকার যন্তর দে।’

রুটি সেঁকার আবার যন্তর। বংকা তারের যন্ত্রটি নিয়ে উপস্থিত হয়। বংকাকে দেখে বোঝা গেল, কেন গলার স্বর মিউ মিউ চিঁচিঁ। রোগা কালো বংকা, বোধ হয় বঙ্কিমই হবে পুরো নামখানি। গায়ে একটি গেঞ্জি ছাড়া কিছু নেই। পরনে একটি ময়লা হাফপ্যান্ট এই শীতে, তারপরে আর ভাল আওয়াজ বেরোবে কী করে।

তিনজনেই বেঞ্চির ওপর মুখোমুখি বসি। টেবিলের ওপর হাত রাখতে ভয়। জলের ছেটা এখানে ওখানে। ঝিনি হঠাৎ আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কিছু খাবে এখানে?’

প্রায় চমকেই চোখ বড় করে তাকাই। বলি, ‘আমার কোনও খিদেই নেই।’

ঝিনি হেসে ফেলে। কিন্তু আমাদের দু’জনকেই চমকে দিয়ে লিলি বলে ওঠে, ‘আমি কিন্তু খাব।’

ঝিনি চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খাবি?’

‘ফাস্‌কেলাস দোপেঁয়াজি।’

ঠাট্টা ভেবেই, অবাক হই না আর। কিন্তু ঝিনি ওর বন্ধুকে ভাল চেনে, জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যি নাকি?’

লিলি ওর মেমসাহেবি চুলে ঝটকা দিয়ে রং মাখানো ঠোঁট টিপে ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘নিশ্চয়ই। এই যে, এই যে শুনুন।’

সত্যি সত্যি দোকানিকে ডাকে সে। লোকটা প্রায় ছুটে আসতে আসতে বলে, ‘বলেন দিদিমণি।’

‘এক প্লেট মটন দোপেঁয়াজি।’

লিলি এত গম্ভীর হয়ে বলে, তখন আমার হাসি চাপাও দায় হয়। এদিকে তখন হুংকার বেজে ওঠে, ‘বংকা।’

শব্দ আসে, ‘হিঁ-ই-ই।’

‘এক পেলেট মটন দোপেঁয়াজি।’

বলে সে রুটি সেঁকতে চলে যায়। ঝিনি আমার দিকে চেয়ে হাসে৷ লিলিকে বলে, ‘আজব মেয়ে বাবা।’

লিলি বলে, ‘তা কী করব। এখানকার ঝাঁজালো গন্ধে আমার খেতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের ইচ্ছে না করলে আমি কী করব।’

ঝিনি বলে, ‘আমাকে কোনও দিন খেতে দেখেছিস এসব?’

লিলি আমার দিকে তাকায়। আমি তাড়াতাড়ি বলি, ‘বেশি ঝাঁজালো বলেই আমি পারি না।’

ঝিনি লিলি দু’জনেই হেসে ওঠে। লিলি বলে, ‘কিন্তু আমার খাওয়া দেখে যেন নাক সিঁটকোবেন না। আমি তেলে ভাজা-টাজা এসব খেতে খুব ভালবাসি।’

খুব ভাল। আর এক দফায় প্রমাণ পাচ্ছি, বেশবাসে যাই হোক, এও সেই অধিকাংশ রমণী-রুচি।

রুটি চা আগে আসে। তারপরে দোকানি স্বয়ং দোপেঁয়াজির পাত্র নিয়ে আসে। ধোঁয়া তপ্ত, সন্দেহ নেই। রঙের তেজও যথেষ্ট। এখন লিলির জিভে কতখানি ঝাঁজ দিতে পারবে, কে জানে। তবে টিনের চামচটা সরিয়ে রেখে ঠোঁটের রং বাঁচিয়ে ওর খাওয়া দেখলেই বোঝা যায়, দোপেঁয়াজি জমেছে। তবু লজ্জা ঘোচে না। মুখ টিপে হাসে আর খায়। ঝিনি নিজে দু’ টুকরো রুটি খায়। আমাকে বলে, ‘খাও।’

‘দরকার নেই।’

‘এক টুকরো।’

মুখের থেকেই চোখেই বেশি বলে। অতএব অনিচ্ছাতেই এক টুকরো রুটি তুলি। তখন আবার বলে, ‘আচ্ছা থাক, জোর করে খেতে হবে না।’

বলি, ‘তার জন্যে নয়, আমার ঠিক খিদেই নেই।’

‘কখন খেয়ে বেরিয়েছ?’

‘বেলা বারোটা নাগাদ।’

লিলি বলে ওঠে, ‘আর এখন রাত্রি সাড়ে আটটা।’

ঝিনি চায়ের পেয়ালা মুখে ঠেকিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি এক টুকরো রুটি নিয়ে চিবোতে আরম্ভ করি। আর ঝিনি তাড়াতাড়ি লিলির দিকে ফিরে বলে, ‘আর কিছু খাবি?’

লিলির তখন চোখে জল। হুসহুস করে শিসোচ্ছে। ঝিনির কথা প্রায় বিদ্রূপের মতো শোনায় ওর কানে। ইহার নাম ফাস্‌কেলাস মটন দোপেঁয়াজি। বলে ওঠে, ‘চুপ কর হতচ্ছাড়ি— জল জল জল।’

ঝিনি বলে ওঠে, ‘জল দিন এখানে।’

সঙ্গে সঙ্গে জল আসে। সঙ্গে সঙ্গেই পান। পানের পরে লিলি বলে, ‘একটু যা ঝাল, খেতে মন্দ হয়নি সত্যি।’

‘তবে খা আরও।’

লিলি পরিষ্কার জিব ভেংচে দিয়ে বলে, ‘তুই খা গিয়ে।’

তারপর হেসে বলে, ‘দেখুন না!’

বিনা নোটিসেই ঝিনি ওর ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে দিয়ে দেয়। এতে ঝিনির খেদ কতখানি মিটল, কে জানে। আবার মেলায়। জনস্রোতের টান তখনও উত্তরে। সেদিকে খানিকটা যেতেই আসল গ্রামীণ মেলাটা চোখে পড়ে। কাঠের দরজা, জানালা, ঢেঁকি, যত রকমের গৃহস্থালি প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এদিকটায় আলোর ঝলক কম। হ্যারিকেন লম্ফই বেশি। দুই চারি হ্যাজাকের চড়া বাতি। গৃহস্থালি বিপণির পরেই ধানকাটা মাঠের শুরু। মাঠের পথ দিয়ে গরুর গাড়ি চলাচল করে।

ফেরার পথে লিলি কী কিনতে যে বাকি রাখে জানি না। কাঠের কুনকে থেকে পাথরের গেলাস, কাঠের দু-তিন রকমের পুতুল। ঝিনি কিছুই কেনে না। ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার কিছু কেনাকাটা নেই?’

ঝিনি কেবলই মাথা নাড়ে। লিলির দিকে চেয়ে হাসে। আর যতবারই অন্যদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঝিনির দিকে চাই, চোখাচোখি হয়ে যায়। কী দেখে, কী বলতে চায়? একবার কাছাকাছি হয়ে হঠাৎ মুখ তুলে বলে, ‘কী কেনা যায় এখান থেকে?’

ওর জিজ্ঞাসায় অবাক হয়ে বলি, ‘তা তো জানি না।’

‘তোমার কিছু কিনতে ইচ্ছে করে না?’

‘ভেবে দেখিনি।’

তারপরেই ঝিনির মুখে সহসা পরিবর্তন দেখা দেয়। এক মুহূর্ত মুখ নামিয়ে রেখে আবার চোখ তুলে চায়। এক মুহূর্তেই চোখের দৃষ্টিও বদলে যায়। চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে। গলার স্বর নেমে যায়। বলে, ‘কিছু কিনতে আসিনি এখানে, বরং—।’

‘বরং?’

যেন হঠাৎ হেসে উঠে বলে, ‘বিকোতেই এসেছি।’

বলে আবার মুখ নামিয়ে নেয়। অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ায়, যাতে ওর মুখ দেখতে না পাই। চারদিকে জনস্রোত। দোকানপসার কেনাকাটা। তার মধ্যে জয়দেবে দাঁড়িয়ে কী বিচিত্র কথা বলে ঝিনি। কী বিকোতে, সে কথা জিজ্ঞেস করবার দরকার হয় না। হাসিটা যে ছল, তাও বুঝতে পারি। লোকে যে ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, তাও ওর খেয়াল থাকে না। কী বলি, বুঝতে পারি না। তবু চুপ করে থাকতে পারি না। ডাক দিই, ‘ঝিনি।’

ও ফেরে না। আমাকেই ওর সামনে যেতে হয়। প্রায় চুপিচুপি বলে, ‘বলো।’

লিলি ইতিমধ্যে আরও কিছু কেনে। জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যি কিছু কিনবি না ঝিনি?’

ঝিনি ঘাড় নাড়ে। আমার দিকে চেয়ে হেসে বলে, ‘হাট করতে এলেম আমি অধরার সন্ধানে। আমার ধরা ছোঁয়াতে নেই কিছু।’

লিলি বলে, ‘তবে সেই হাট করগে।’

আমরা অজয়ের কাছাকাছি এসে পড়ি। প্রায় পুবদিকের কাছাকাছি এসে মনে পড়ে যায়, বিন্দু এদিকে দিকশূল দিয়েছে। অথচ আমাদের ঢলটা সেদিকেই। বেশি দূরে যেতে হয় না, গন্ধেই টের পাওয়া যায়, ওদিকে একটু ভিন রসের আসর। হাসি কথার মত্ততাতেও তারই আভাস। ছোট ছোট চালা ঘর, ঘাড় গোঁজা গরুর গাড়ি, গাছের ঝুপসি ঝাড়ে লম্ফ হ্যারিকেনের রক্তিম আলো, সেখানে যেন কী এক রহস্য ছড়িয়ে রেখেছে। ছায়া-কায়ায় মেশামিশি, যাদের দেখতে পাই, তাতে মনে হয় অন্য রসের খেলাও কিছু চলছে।

এদিকটায় এসে টের পাওয়া গেল, পুবের গাছপালার ওপরে আকাশে ক্ষীণ আলোর ইশারা। ছোট এক ফালি চাঁদ উঠে আসছে। এখনও তা গাছপালা ছাড়িয়ে ওঠেনি।

আমি আবার পশ্চিম দিকে ফিরি। সেদিকে বেদনাশা বটতলা। ফেরবার মুহূর্তেই ঝিনি বলে, ‘একটা কথা বলব।’

‘কী?’

‘ওপারে যাবে একটু?’

‘এই নদী পেরিয়ে?’

‘কত লোক তো যাতায়াত করছে।’

শুধু লোক কেন। কাতার দিয়ে গরুর গাড়িও পারাপার করছে। নদীর বুকে অনেকের হাতেই হ্যারিকেন লম্ফ ঝুলছে। ঘণ্টা বাজছে গরুর গলায়। কিন্তু কেন বলে ঝিনি। সব জেনেও কেন যেতে চায়। বলি, লিলি একলা ফিরবে?’

‘আমি ওকে বলছি।’

তার আগেই লিলি ফেরে, ‘কী হল?’

ঝিনি বলে, ‘ওপারে যাব। তুই একলা ফিরতে পারবি?’

আমি প্রায় করুণ চোখে তাকাই লিলির দিকে। লিলি আমার দিকে একবার দেখে বলে, ‘মরগে যা। একটু দেখবেন মশাই, জলে ডোবে না যেন।’

বলেই সে হনহনিয়ে হাঁটা দেয়। হাতজোড়া ওর জিনিসপত্র। খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে, হাসে। আমাকে বলে, ‘যান।’

আমি ওর দিকেই তাকিয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখি, ঝিনি জলের ধারে নেমে গিয়েছে। হাতে ওর স্যান্ডেল, ঘাটের কাছে অন্ধকার। যদিও লোকজন আছে। কিন্তু ওপারে কোথায় যাবে ও? আমি নেমে যাই? ঝিনি জলে পা দেয়। ফিরে ডাকে, ‘এসো।’

অতএব আমারও পাদুকা হাতে। ওপারের মানুষের পিছন ধরে দু’জনেই চলি। জলে ছপ্ছপ্ শব্দ বাজে। জিজ্ঞেস করি, ‘ওপারে কোথায়?’

অস্পষ্ট ছায়ায় ওর মুখ দেখি। শুধু অবয়ব। ওপারের পশ্চিম দিকে আঙুল তুলে দেখায়। অন্ধকারে নিবিড় গাছপালা ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। গভীর ছায়ার বাইরে অস্পষ্ট নিরালা বালুচর।

জিজ্ঞেস করি, ‘কী আছে ওখানে?’

‘নিরালা।’

নিরালায় যেতে চায় ঝিনি। ডাক দিকে ফেরাতে ইচ্ছা করে। পারি না। তবু জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’

ও পালটা জিজ্ঞেস করে, ‘ভয় লাগে?’

‘ভয় লাগবে কেন?’

ও আমার দিকে ফিরে চায়। বলতে পারি না, ভয় লাগে না। চলার পথকে বিড়ম্বিত হতে দেখি। উড়াল দিয়ে চলব, ডানায় যেন ব্যথা ধরিয়ে দিতে চায় ও। আমার স্বরের খুশিতে করুণ সুর ধরিয়ে দিতে চায়, এইটুকু আশঙ্কা।

জলের কল্‌কল্ ছপ্ছপ্ শব্দে ওর গলা শোনা যায়, ‘আমাকে ভয় করো না।’

যেন এক করুণ আর্তস্বরে বাজে। বলি, ‘ভয় করিনি তো।’

আমরা ওপারে পৌঁছুতে পৌঁছুতেই চরের বালি যেন চিকচিকিয়ে ওঠে। সবকিছুই একটু যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি নিজেদের ছায়া পড়েছে বালিতে লম্বা হয়ে। পুবদিকে ফিরে দেখি রক্তিম একফালি চাঁদ আকাশের গায়ে।

ঝিনি বলে, ‘ওদিকটায় দিনের বেলা দেখেছি, সুন্দর গাছপালা, পরিচ্ছন্ন নিরালা। দুপুরে মনে হয়েছিল, জয়দেব ওদিকে তাকিয়ে লিখতেন।’

ঝিনির কথা শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘দুরালোক: স্তোকস্তবকবকাশোক-লতিকা বিকাশ: কাসারোপবনপবনোহপি ব্যথয়তি। অপি ভ্রাম্যদভৃঙ্গীরণিতরমণীয়া ন মুকুলপ্রস্থতিশ্চতানাং সখি শিখরিণীয়ং সুখয়তি।’ সই, এই ছোট ছোট নতুন গুচ্ছে সাজানো অদ্ভুত অশোকলতা আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। এই গাছপালার ঠান্ডা বাতাসে কষ্ট হচ্ছে। সবই সুন্দর, গায়ে জড়ানো কুঁড়ি মাথা তুলে আছে, ভোমরা গুনগুনিয়ে ফিরছে, কিন্তু আমার প্রাণে একটু সুখ নেই।…কেন না আমার আগের দিনের কথা সবই মনে পড়ছে, যখন মামুদ্বীক্ষ্য বিলক্ষিতস্মিতসুধামুগ্ধাননং কাননে।

ঝিনি যে কানন সরসী নিবিড় বনের দিকে যায়, জয়দেব কি তাই দেখেই কল্পনা করেছিলেন? আমরা যত এগিয়ে যাই ততই নিরালা হয়ে আসে। রক্তিম চাঁদের আলো যেন আর একটু স্পষ্ট হয়। তথাপি কুহেলি প্রচ্ছন্নতা। স্থান নিরাপদ কিনা জানি না। সেই ভাবনার সীমা পেরিয়ে এসেছি। যত এগিয়ে যাই, ওপারের নানা কলরব ছাপিয়ে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। একটা রাত-জাগা পাখির স্বর বেজে বেজে ওঠে।

ঝিনি থমকে দাঁড়ায়। ওপারের মেলার সীমানাও পেরিয়ে এসেছি। ও নদীর দিকে দেখে, আমার দিকে ফিরে তাকায়। জিজ্ঞেস করি, কী?’

ও আমার একটা হাত ধরে। বলে, ‘বালি শুকনো, ওখানে একটু বসবে?’

‘চলো।’

আজ তো তাই ভেবেছিলাম সন্ধ্যায়, দেখি কত দূরে নিয়ে যায়। খানিকটা গিয়ে ঝিনি বলে, ‘বসো।’

বলে, আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বসে। আমিও বসি। আস্তে আস্তে মনে হয়, লোকজন সবাইকেই দেখতে পাচ্ছি। মেলার আলো যেন আমাদের গায়েও এসে পড়েছে।

ঝিনি চোখ নামায় না দেখে ওর দিকে ফিরি। অস্পষ্টতার মধ্যেও দু’ পাশের বেয়ে পড়া চুলের মাঝখানে ওর মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। অসঙ্কোচ অপলক চোখের দৃষ্টি, তবু ওর ঠোঁট যেন কাঁপে। আবার জিজ্ঞেস করি, ‘কী?’

ও আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে। প্রায় অস্ফুটে বলে, ‘শুধু এইটুকুই।’

বলে মুখ নামায়। ওর মুখে, ওর সমস্ত ভঙ্গিতে একটা অসহায় কষ্টের ছাপ ফোটে। ওর বিকোতে আসার কথা আমার মনে পড়ে, মনে পড়ে, ও হাট করতে এসেছে অধরার সন্ধানে। বোধ হয় আপনাকে বিকিয়ে। ওকে কিছু বুঝিয়ে বলব, সে মেয়ে ও না। কিন্তু ওকে কোনওরকমে একটু স্নেহের প্রবোধ জানাব, সে সাহস পাই না। তথাপি আমার বুকে বিঁধে যায়।

মুখ নিচু রেখেই ও সহসা বলে, ‘জানি, আমার লজ্জা নেই। তুমি দুঃখ পাও, বিরক্ত হও।’

এত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, বাধা দেবার সময় পাই না। তবু বলি, ‘বিরক্ত হইনি।’

‘হও হও, আমি বুঝি। কিন্তু—এইটুকু, এইটুকু।’

ওর গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। আমি ডাক দিই, ‘ঝিনি।’

ও মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন এমন হল, তুমি কি জানো?’

জবাব দিতে পারি না। ও বলে ওঠে, ‘আমি জানি।’

ওর জলে ভেজা চোখের দিকে তাকাই। ও বলে, ‘তোমার জীবনটা আমাকে লোভী করেছে। তুমি যেন একটা স্বপ্নের ঘোরে চলে যাচ্ছ। কোনও কিছুতেই দৃকপাত নেই। যেন কেউ ডাকছে।’

আমি বলি, ‘জানি না তো। আমি তো কোনও ডাক শুনতে পাই না।’

‘কিন্তু তোমাকে যে দেখবে, সে-ই বলবে একথা। তারপরে মনে হল, তুমি সুখের খোঁজে যাচ্ছ না। ত্রাণের খোঁজে চলেছ। তাই আর মন মানাতে পারি না, চোখ ফেরাতে পারি না। কেবল ভাবি, আমিও, ‘তুমি’ হব।

ও আমার দু’ হাত নিজের হাতে নেয়। বলি, ‘ঝিনি, তোমার সব কথার জবাব আমার জানা নেই। ত্রাণের খোঁজে যাই কিনা জনি না, শুধু এইটুকু জানি, আমার সবই বিষের ভরা। এ বিষ আমি সইতে পারি না। এই নিয়ে আমার চলা।’

‘হ্যাঁ, তুমি বিষ, বিষাক্ত। সে বিষ তুমি আমাকেও দিয়েছ।’

‘দিইনি ঝিনি।’

‘তবে নিয়েছি।’

একথার কোনও জবাব দিতে পারি না। শুধু বলি, ‘তবু সে তোমারি যন্ত্রণা, মুক্তি সে তোমারি নিজের উপায়ে।’

ঝিনি বলে, ‘এইটুকু তোমার বলবার আছে জানি। সে পথ কখনও মিলবে না। একটা কথা বলব।’

‘বলো।’

‘কিছু তো নেবে না, কিছু দাও।’

‘কী?’

ঝিনি ঘাড় নাড়তে নাড়তে দু’হাতে মুখ ঢাকে। শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘জানি না, তা জানি না।’

বলতে বলতে বালিতে নিচু হয়ে পড়ে। অসহায় কষ্টে ওর দিকে চেয়ে থাকি। যে আলো আমার হাতে নেই, তা আমি জ্বালি কেমন করে। জানি, এই বাজিতে আগুন দিলে সংসারের আকাশ জুড়ে, নানা রঙের আলোর ঝড়ে ঝলকাবে। কিন্তু সে আগুন আমি হাতে করে নিতে পারি না। দিতে পারি না।

একটু পরে ও শান্ত হয়, মুখ তোলে, উঠে বসে। পশ্চিমের দূরে নদী আর চরের অসীমে, অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে ক্ষণকাল চেয়ে থাকে। তারপরে আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘আমার লজ্জা ঘৃণা ভয়, কিছু নেই। আমাকে তোমার খুব খারাপ লাগছে, তাই না?’

এই মুহূর্তে আমারও বুকের ভিতরটা দুলে ওঠে। মনে হয় একটা আবেগের ঢেউ ভেঙে পড়তে চায়। বলি, ‘আমি অমানুষ নই। কী বলব, তোমাকে কেমন লাগে? তোমার মতো সর্বাংশে সুন্দর আর—।’

কথা শেষ করতে না দিয়ে ও বলে ওঠে, ‘বিষ বিষ বিষ। আর দিয়ো না। বুঝেছি, কী বলবে, থাক।’

বলতে বলতে ওর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে ওঠে। বলে, ‘চলো যাই।’

দু’জনেই উঠি। ঝিনি আবার বলে, ‘একটা কথা রাখবে?’

‘বলো।’

‘আজ সারারাত মদন বাউলের আখড়ায় দু’জনে গান শুনব।’

‘শুনব।’

‘সত্যি, তুমি কী বাধ্য।’

বলে, যেন রঙ্গ করে হেসেই ওঠে। পথে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে, ‘এখান থেকে কোথায় যাবে?’

‘ঠিক জানি না। তবে হাভোয়ার পির গোরাচাঁদের মেলায় একবার গাজির সঙ্গে দেখা করতে যাব।’

‘গাজি? কোন গাজি?’

‘সেই মামুদ গাজি।’

‘ওহ্‌, সেই মানুষ, যার সঙ্গে তোমাকে প্রথম দেখি।’

‘হ্যাঁ।’

ঝিনি কথা বলে না। যেন সেদিনের স্মৃতির মধ্যে ডুবে যায়। একটি কথাও না বলে, নদী পার হয়ে চলে আসে।

ঝিনিকে মদন বাউলের আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে বিন্দুদের আশ্রমে ফিরি। কথা থাকে, খেয়ে এসে ওদের সঙ্গে সারা রাত্রি গান শুনব। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয়, জয়দেব দেখা আমার শেষ হয়েছে। জয়দেবের রাধামাধবের মন্দির দর্শনে লাভ কী। কেবল স্মৃতি। বিগ্রহ বৃন্দাবন থেকেই জয়পুররাজ জয়পুরের ঘাটি নামে জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আশ্রমে ফিরে দেখি গানের আসর তখনও জমজমাট। আমি ঘরে ফিরে যাই। সেখানে দেখি, বিন্দু কার সঙ্গে বসে কথা বলছে। নতুন একজন বাউল। গোপীদাসেরই বয়সী হবে। মোটা কাঁথার আলখাল্লায় শরীর জড়ানো। মাথার পাকা চুল আলুলায়িত। পাকা দাড়ি কুঁকড়ে পাকিয়ে গিয়েছে গলার কাছে।

বিন্দু আমাকে দেখেই কাছে উঠে আসে। বলে, ‘এস্য বাবাজি, ঘুরাফিরা হল্য?’

সে আমার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। তারপরে যেন চমকে উঠে বলে, ‘কী হয়েছে চিতেবাবাজি?’

অবাক হয়ে বলি, ‘কিছু না তো?’

বিন্দু তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসায় তাকিয়ে বলে, ‘মুখখানা যে বড় শুকনো দেখি, চখের কোল বসা।’

হেসে বলি, ‘কিছু না। বেড়িয়ে ফিরলাম তো৷’

বিন্দুর চোখে অতৃপ্ত সংশয় লেগে থাকে। বৃদ্ধ বাউল জিজ্ঞেস করে, ‘কে গ বিন্দু।’

বিন্দু ফিরে বলে, ‘ই সিই চিতেবাবাজি, যার কথা বইলছিলাম তোমাকে।’

আমার দিকে ফিরে বলে, ‘ই বাবাজির নাম গোপাল গোঁসাই। আমার বাবার আর ওঁয়ার একই গুরু, গুরুভাই দু’জনায়।’

গোপাল গোঁসাই। আমি ভাল করে বাউলের চোখের দিকে তাকাই। বিন্দু বলে, ‘কী দেইখছ বাবাজি? ওঁয়ার চখ নাই। মায়ের দয়ায় লজর হারিয়েছে।’

বলি, ‘হ্যাঁ, ওঁর কথাই শুনছিলাম মদন বাউলের কাছে। উনি বোধ হয় ওখানে গান করছিলেন।’

গোপাল নিজেই বলে ওঠেন, ‘হঁ হঁ বাবা, উখানে গান কইরেছি। এস্য বাবাজি, আমারে কাছকে এস্য।’

গিয়ে ডান দিকে বসি। গোপাল হাত বাড়িয়ে গায়ে দেন। তারপরে কাঁধের থেকে, গোটা মুখে চোখে মাথায়। বলেন, ‘বাহ্, সোন্দর বাবাজি। মাথা মুখ বেজায় ঠান্ডা ক্যানে বাবাজি?’

বলি, ‘বাইরে ছিলাম তো।’

‘তাই। খুব ঠান্ডা।’

বলে আমার হাত টেনে নেন। যেন গরম করে দিতে চান। চোখের ভিতরে কিছুই দেখি না, তবু যেন কী চিকচিক করে।

ওঁর সঙ্গে দু-চার কথা হতে হতেই গোপীদাস আসে। রাধা বৃদ্ধাও আসে। তারপরে নিতাই খাবার জন্য ডাক দেয় সবাইকে। কিন্তু যতবারই বিন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়, দেখি তার অনুসন্ধিৎসা ঘোচে না। একটু বা উদ্বেগের ছায়া।

আমার খাওয়া শেষ হতেই লিলি আসে। বলে, ‘ডাকতে এসেছি।’

বলি, ‘আমি তো যাব বলেছিলাম।’

‘যাকে বলেছেন, তার মন মানলে তো। তারপরে কী করেছেন কে জানে। খেল না কিছুই। আমাকে বললে, ডেকে নিয়ে আয়, নইলে আসবে না হয়তো।’

লিলি কথা বলতে বলতে আমার চোখের দিকে বারেবারেই চায়। চোখাচোখি হলেই, দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ওর চোখেও অনুসন্ধিৎসা। বিন্দুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গোপীদাসকে বলে মদন গোঁসাইয়ের আখড়ায় যাই।

ঝিনি ঢোকবার মুখে দরজাতেই দাঁড়িয়েছিল। আমরা আসরের একেবারে সামনে গিয়ে বসি। গিয়ে বসতে হয় না। আশ্রমের যাত্রী উদ্যোক্তারাই ডেকে বসান। ইতিমধ্যে গান আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, গুচ্ছ গুচ্ছ দল সব বসে আছে। একের পর এক গানের পালা।

ঝিনি আমি লিলি তিনজনেই পাশাপাশি বসি। ওরা দু’জনে এক চাদরে পরস্পরকে জড়িয়ে বসে। ঝিনি আমার চাদরটা তার আগেই টেনে একেবারে আমার পা অবধি ঢেকে দেয়। মদন বাউলের সঙ্গে যতবার চোখাচোখি ততবারই হাসাহাসি। চোখে চোখে নিঃশব্দে। তিনি যেন কেবলই ইশারায় ভুরু কাঁপান।

মনোহরা মাঝে মাঝে এসে বসেন, আবার উঠে যান। মাঝে রাত্রে মদন একবার আসর ছেড়ে উঠে যান। লিলি তখন কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। ঝিনি আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘুম পেয়েছে?’

বলি, ‘না।’

‘বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?’

আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই। বলি, ‘না।’

আমার যেন মনে হয়, ঝিনিই ক্লান্ত বেশি। বলি, ‘তোমার একটু শোয়া দরকার।’

ও সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘শোবো।’

‘শোও।’

‘তোমার পায়ের ওপর মাথা রাখলে কষ্ট হবে?’

আমি এক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে থেকে বলি, ‘আমার কোলের ওপরেই রাখো।’

মুহূর্তে ওর মুখের পরিবর্তন হয়। অস্ফুটে একবার উচ্চারণ করে, ‘বিষ!’

স্পষ্ট করে বলে, ‘যাবার আগে ডাক দিয়ো।’

বলে ও আমার পায়ের কাছেই মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। গানের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়েও যতবার তাকাই, দেখি ঝিনি মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। চাদরের ভিতর দিয়ে ওর একটা হাত আমার পায়ে। ইতিমধ্যে মদন গোঁসাই আবার আসেন। এসে ঝিনি লিলির দিকে ইশারা করে মাথা নাড়েন। তারপরে হাতের ভঙ্গিতে জানান, থাক, এমনিই থাক ওরা।

শেষ রাত্রির আগেই ঝিনির চোখ বুজে যায়। এখন আমি ওর মুখের দিকে দেখি। ওর ঘুমন্ত মুখে যেন বিষণ্ণ হাসির আলোছায়া মাখা।

আসর অনেক ঝিমিয়ে এসেছে। শেষ রাত্রের দিকে চারদিকেই অনেকে ধরাশায়ী। এমনকী নাসিকা গর্জনও শোনা যায়। আমি আস্তে আস্তে পা থেকে ঝিনির হাত সরাই। সেই মুহূর্তে একবার মদন বাউলের সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়। তিনি দাড়ি দুলিয়ে হেসে ঘাড় নাড়েন। আমি আস্তে আস্তে পা গুটিয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াই। ঝিনি এখন গভীর ঘুমে অচেতন। ওর হাতটা চাদরের বাইরে পড়ে থাকে। ওর চাদর দিয়ে ঢাকতে গেলে পাছে জেগে যায়। তাই আর ঢেকে দিই না। কিন্তু এলানো হাতটা দেখে কেমন একটা শূন্যতা জেগে ওঠে।

আমি আবার মদন গোঁসাইয়ের দিকে তাকাই, তিনি স্নিগ্ধ হেসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত তুলে নমস্কার করি। তিনি দু’ হাত তুলে ঘাড় নেড়ে আমাকে বিদায় দেন। আমি বেরিয়ে আসি।

এখনও কোথাও কোথাও গান চলছে। কিন্তু অনেকটাই চুপচাপ হয়ে এসেছে। আমি আমার আশ্রয়ে ফিরে আসি। সেখানে একেবারেই নিঝুম। ঘরে ঢুকে দেখি, অচেনা অনেকে শুয়ে আছে। নিতাই আর সুজন তার মধ্যে চেনা।

হঠাৎ শব্দে পাশ ফিরে দেখি, পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বিন্দু। আমি তাড়াতাড়ি তার কাছে যাই। নিচু স্বরে বলি, ‘বিন্দু, আমার ঝোলাটা দাও।’

বিন্দু কিন্তু অবাক হয় না। আমার মুখের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বলে, ‘ঝিনিদিদিকে কোথায় রেখে এল্যে।’

কী আশ্চর্য প্রশ্ন। আমি কেন তাকে রেখে আসব। বলি, ‘ও আসরে ঘুমোচ্ছে।’

‘আর তুমি পালাইচ্ছ?’

বলে, জবাবের প্রত্যাশা না করে সে আমার ঝোলাটা এনে দেয়। আমি বলি, ‘সবাইকে বলো, আমি গেলাম।’

বিন্দু আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকে। ওর চোখের কোণ দুটো চিকচিকিয়ে ওঠে। বলে, ‘বুঝি চিতেবাবাজি, তোমাকে বুঝি, তোমাকে দুইষব না। তবে—।’

বিন্দুর গলার স্বর বন্ধ হয়ে যায়। আমি বলি, ‘যাই বিন্দু।’

আমার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজার কাছে আসে। বলে, ‘আবার এস্য বাবাজি, যখন মন কইরবে এস্য। তোমার তো পথের বাধা নাই।’

ঘাড় নেড়ে চলে আসি। মনে মনে বলি, ‘কত যে বন্ধন প্রতি পদে পদে, তা যদি বোঝাতে পারতাম। আমার পথের বন্ধন তো অন্য মানুষ না, আমার মন। সে যদি ঠিক, আমিও ঠিক।

জয়দেবকে মনে মনে স্মরণ করি। কে জানে, কেমন দেখতে ছিলেন। শুধু জানি, তিনি এক কবি। তিনি পদ্মাবতীরমণ, চরণচারণ চক্রবর্তী।

অজয়ের জলে কুয়াশা উঠছে ধোঁয়ার মতো। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকে স্নানে নেমেছে। চাঁদ চলে গিয়েছে, পশ্চিমের সেই নিরালা কাননের পিছনে। এখন অন্য আলোর ইশারা। আমি নদী পার হয়ে যাই।

.

৮৩.

এবার ফিরে চলো। এখন অবতরণ। রাঢ়ের উত্তর থেকে দক্ষিণের ঢলে নেমে যাওয়া। মনের দৃষ্টি ভরে যেন প্রকাণ্ড এক আলখাল্লা দোলে। কত যে ধুলা, কত যে রং তার গায়ে। দেশান্তরের ধুলা রূপান্তরের রং। যত সেলাই, পট্টিতালি মারার রঙে। তালিতে তালিতে রং। ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাঁথার তালি, কাপাসি নামাবলি, রেশমি, পশমি কত ঝলক দেওয়া তালি এই আলখাল্লায়।

এ আলখাল্লাটা যে কার গায়ে, তাকে দেখতে পাই না। কে যে ভিতর দিকে দৃষ্টি টেনে নিয়ে চোখের সামনে সেটাকে দোলায়, তা-ও দেখি না। মনে হয়, অনেক দূরে কোথায় যেন ডারা ডুপ্‌কি প্রেমজুরি, একতারা বাঁয়ার মিলিত শব্দ বাজে ক্ষীণ সুরে। তার সঙ্গে গানের কলি,

দিনে দিনে হল আমার

দিন আখেরি

আমি কোথায় ছিলাম

কোথায় এলেম

সদায় ভেবে মরি।

কে গায়, কার গলা, চিনতে পারি না। যেন কোন এক আত্মভোলা আপন মনে গেয়ে চলে। তার গলায় নেই সুরের বাহার, অথচ স্বরে আবেগ। কাঁদে, না হাসে—বোঝা যায় না।

পথ চলি। চলতে চলতে এমনি মনে হয়। চলার পথে যে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তা না। কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা ভার। অথচ একটা ব্যাকুলতা রয়েছে। কীসের ভার, তা জানি না। যে পথ পিছনে রেখে আসি, যা-কিছু ছেড়ে আসি, তার জন্যই কী না, কে জানে। তবু একটা ভার, কেমন একটা ব্যথা ধরানো।

ব্যাকুলতা যেন একটু বুঝতে পারি। যে আমাকে অচিনের খোঁজে ফেরায়, সে একটা পাগল, সন্দেহ নেই। পাগলই পাগল করে আমাকে। গাজির নিমন্ত্রণের কথা মনে পড়ে বারে বারে। যেতে হবে। ব্যাকুলতার মধ্যে তার সেই কালো মুখের ভাঁজে ভাঁজে হাসি, ঝাঁকড়া চুল, গোঁফ-দাড়ি, আলখাল্লাপরা চেহারাটা বারে বারে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর পান-খাওয়া তার সেই লাল দাঁত। ওইটুকু মাপ করতে হবে। মুরশেদের নামে ফেরে, কিন্তু পানের পিকছোপানো লালিমাটুকু দাঁতে লেগে থাকে। তবু একটা মুখ, সমস্তটাই যেন হাসি।

জয়দেবের রাত পোহাতেই মাঘ মাস পড়ে যায়। তাই ফেরার পথে নবদ্বীপ হয়ে যাই। মাঘ মাসে ধুলট। ধুলট উৎসব। যত বৈষ্ণব কীর্তনিয়া, সকলের আগমন এখন নবদ্বীপে। যত নাম, যত গান, তত ধুলামাখামাখি। যে ধুলায় নিমাই চলেছে, যে-ধুলায় নিমাই গড়াগড়ি দিয়েছে, সেই ধুলায় ভক্ত গায়কের গড়াগড়ি। যতেক কীর্তনিয়া, মেয়ে-পুরুষ, ভদ্রাভদ্র, সকলেই নিমাই-ক্ষেত্রে গান নিবেদন করতে আসে এ সময়ে। নবদ্বীপে মাঘ মাস গানের মাস। প্রথম নিবেদন এখানে। তারপরে গ্রামে জনপদে যত্রতত্র। যাঁর গান, আগে তাঁকে দিয়ে, তারপরে অন্যে পরে।

মাধবী দাসীর গান শুনে মনে হয়েছিল, গান না, আর কিছু শুনি। তার জীবনটা কেমন কে জানে। চওড়া কালো পাড় ঢাকাই শাড়ি পরে প্রৌঢ়া গায়িকাটি যখন আসরে নেমেছিল, তখন তেমন কোনও আশা জাগেনি মনে। তার জামা শাড়ির বহর, পান খাওয়া ঠোঁট, সিঁদুরের ঔজ্জ্বল্য, পায়ের আলতা, হাতে পানের রুপার কৌটা, একটা রাজেন্দ্রাণী ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল, মাইফেলের আসর তো না। কেমন যেন একটু ‘অংখারের’ ছাপ দেখা যায়।

কিন্তু মাথুর ছাড়া সে কিছু গায়নি। বিলম্বিত লয়ে তার সুর, সেই লয়েতেই শেষ। দীর্ঘশ্বাস, কান্না, বিরহ। গরবিনীবেশিনী মাধবী দাসী আসলে বিরহিণী। অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে নিজে গেয়েছে, শ্রোতারা সবাই কেঁদেছে। তার গলার সুরে কান্না ছিল। চোখে জল ছিল না। ‘হেন এ অবলা, করেছে বিকলা, নিয়ে চল সখী মথুরাপুরে।’ নিজেকে দেখিয়ে দেখিয়ে কান্নার সুরে সে গেয়েছে, ‘চল চল চল নিয়ে চল সখী।’ অন্যেরা কেঁদেছে। রাই সখী মথুরায় গিয়ে ধিক্কার দিয়ে আসে, ‘ধিক ধিক ধিক তোরে হে কালিয়া, কে তোরে কুবুদ্ধি দিল।’ মাধবী দাসী চোখ পাকিয়ে তর্জনী তুলে তুলে গেয়েছিল, ‘কে বা সেধেছিল পিরিতি করিতে, মনে যদি এত ছিল।’ তারপরে চোখ বুজে রাগে অভিমানে ব্যাকুল স্বরে বলেছিল, ‘তোমার কি একটু লজ্জা নাই হে, অ্যাঁ? একটা মেয়েকে কাঁদাতে বুঝি খুব ভাল লাগে। ওরে নষ্ট দুষ্টু!’

কিন্তু এক সময়ে মাধবী দাসীর চোখ ফেটেও জল এসেছিল, যখন নিজেকে দেখিয়ে আখর দিয়ে বারে বারে গেয়েছিল, ‘এই অথির জীবন, অথির যৌবন, আর কতক্ষণ। ওহে, আর আর আর, আর কতক্ষণ।’…তখন সে গান যেন মাধবী দাসীর আপন গান হয়ে উঠেছিল। শ্রোতাদের সকলের গান হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, আমার সারা রাত ঘুমের মধ্যে সেই গান শুনেছি।

সুদেব গোস্বামীর গানও ভাল লেগেছিল। বৃদ্ধ গায়ক, ধুলায় গড়িয়ে গড়িয়ে গেয়েছিলেন। তাঁর গান নিমাই-হারা নদিয়াবাসীর গান। পুত্রশোকাতুরা শচীমায়ের গান। স্বামীহারা বিষ্ণুপ্রিয়ার গান। ‘হাজার চাঁদে আলো করুক, নদের আকাশে আর চাঁদ নাই।’ নদিয়াবাসীর অন্ধকারে হাহাকার। শচীর, ক্রন্দন, ‘এ-বাড়ির পরাণ কেন থাকে।’ বিষ্ণুপ্রিয়ার একলা কান্না, ‘তোমার কৃষ্ণের একি অভিলাষ।’

মন্দিরে মন্দিরে আখড়ার গান শুনি। ধুলট উৎসব না দেখলে, এ গান না শুনলে নবদ্বীপের মরমে যে রসের ধারা বহে, তা জানা যেত না। রাসযাত্রা বা অন্যান্য উৎসবের আলো কোলাহল বেশি। সে রূপে এ রূপ নেই।

এই উৎসবের শেষে আবার পথ চলা। বারোই ফাল্গুন হাড়োয়ার হাটে পির গোরাচাঁদের মেলায় যেতে হবে। গাজির নিমন্ত্রণ। কিন্তু এত ভাব, কোথা থেকে মনে নামে। চকিতে চকিতে সচকিত হয়ে কী দেখি। যেন কেমন একটা চমক লাগে থেকে থেকে। আর ব্যাকুলতা বাড়ে।

তবুও ফেরার পথে, ঘুরপথে যাই। মাঘের পূর্ণিমায়, বর্ধমানের কুলীনগ্রামে ঘুরে যাই। শ্যামের মন্দিরে এখন উৎসব, কুলীনগ্রামে মেলা। একটু না দেখে যেতে পারি না। কেবল শ্যামের মন্দির আর মেলা না। সেখানে ভক্ত হরিদাসের একটি স্মৃতিমন্দির আছে। মেলা পেরিয়ে সেখানে যখন যাই, বিশাল একটা গাব গাছের দিকে চেয়ে মনে হয়, যুগ-যুগান্তর দাঁড়িয়ে আছে যেন। এত বিশাল আর প্রাচীন গাব গাছ আর কোথাও দেখিনি। এমন বিশাল পাথরের মতো এবড়োখেবড়ো অবয়ব আর কখনও চোখে পড়েনি।

হরিদাসের স্মৃতিমন্দির দেখবার মতো এমন কিছু না। অনেক দিনের পুরনো শ্যাওলা-ধরা খানিকটা ইট বাঁধানো জায়গা। তার এক পাশে একটি সামান্য ঘর। গাছপালার ছায়ায় ঘেরা, নিঃশব্দ নিরালা। বারো মাস জঙ্গলেই ঢাকা থাকে বোধ হয়। উৎসব উপলক্ষে একটু সাফসুরত্ করা। মেলার কোনও হট্টগোল এখানে নেই। দু-চারজন একাকী বা যুগল বৈষ্ণব সেখানে চুপচাপ বসা। তারাও সেই নিরালা নিঃশব্দের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে যেন।

কুলীনগ্রাম থেকে নৌগ্রামের জলেশ্বরের ক্ষেত্র দেখে যাই। শিব জলেশ্বর। ফাল্গুনে শিবরাত্রির উৎসবে মেলা হয়। সে মেলা কেমন জানি না। কিন্তু জলেশ্বর ক্ষেত্রের এই অরণ্যের নিবিড়তা মন ভুলিয়ে দেয়। চোখ জুড়িয়ে যায়। বনে, নিরালায়, কে এই শিব প্রতিষ্ঠা করেছিল, কে জানে। বাংলাদেশের অধিকাংশ দেবদেবীর প্রতিষ্ঠাই দেখি নদীর কূলে, ঘর-গৃহস্থের দুয়ার পেরিয়ে, আকাশের নীচে, সুদূর বিস্তৃতিতে। কোথাও বা অরণ্যে বনে নিরালায়। বছরের কয়েক দিন উৎসব মেলা যা কিছু সব সেখানেই।

মানুষ সেখানে আর-এক জগৎ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। দেখি, পথ চলি, দেখি। ‘তবু ভরিল না চিত্ত।’ ভরবেও না। কীসের খোঁজে ফেরা, তার সন্ধান যে জানেনি, তার ভরাডুবির কোনও কথা নেই। শুধু এই এক, দেখি, চলি আর দেখি, নানা মানুষ। ভাবের পটে, ছবির মতন। এত বিচিত্র, বিস্ময়কর, অভয় মন-প্রাণের শূন্যতার কথা ভুলে যাই। বৈরাগ্য আমার নেই, আমি বৈরাগী না। তাই অনেক শূন্যতার মধ্যেও যে বিচিত্র বিস্ময়কে দেখি, তার সামনে দাঁড়িয়েই সহসা স্তব্ধ হয়ে যাই। বুকের কাছে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়ি।

বসিরহাটগামী বাস ধরে বেড়াচাঁপার কাছে নামি। এবার হাড়োয়ার পথে। আমার গাজির নিমন্ত্রণ। এতক্ষণ পুবে গতি ছিল। বেড়াচাঁপা থেকে সোজা দক্ষিণে। বেড়াচাঁপার ভিড় দেখেই বোঝা যায়, মেলা লেগেছে। দু’খানি বাস ছেড়ে দিতে হয়। ভিড়ের মধ্যে জায়গা পাই না। যাত্রী দেখলেই বোঝা যায়, সকলের গতি এক দিকে। হাড়োয়া, পির গোরাচাঁদের মেলায়। বিদ্যাধরী নদীর কূলে।

সেখানে গিয়ে গাজির সঙ্গে দেখা করেই নতুন কাজ, নৌকা আর মাঝির খোঁজ। যাব দক্ষিণে, দূর দরিয়ার কূলে। সুন্দরবন, সাগরসঙ্গমে।

গাড়িতে উঠে গাজির কথাই বারে বারে মনে হয়। মনে মনে অনেকবার বলেছি, গাজি না পাজি। যেমন তেমন পাজি না। রসের পেজোমিতে ওর মন ভরা। আশমানি ছায়া দরিয়ার মতো চোখ দেখলেই বোঝা যায়। তার জন্য কিছু নিয়ে যাবার নেই আমার, শুধু কয়েক প্যাকেট সিগারেট ছাড়া।

তা-ই নিয়েছি। মনে আছে, ইছামতী পার হবার সময়ে আমার ধূমপানে তার নাসারন্ধ্রের স্ফীতি। তারপর ‘বাবুর ছিরগেটের কী খোশবু। ভারী মিঠে বাস ছাড়তিছে।’ তার মানেই, একটু আস্বাদ দাও। সাধু-ফকিরদের এসব দেখলে যে বিরক্তি লাগে না, তা না। তবু একটা ‘ছিরগেট’ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাকে দু’ টুকরো করে সে যে নৌকার মাঝিকেও আধখানা দান করবে, তা ভাবিনি। সেই অধম মাঝিকেও ভোলবার নয়। পারাপারের অনেকটা সময় তাকে দেখেছিলাম। খালি গা, খড়ি-ওঠা দাগ, দুটি গভীর কালো চোখ, যেন একটা ঘোর-লাগা মানুষ। সে অধর মাঝি আমার কাছে অধরই থেকে গিয়েছে। তাকে আধখানা সিগারেট দিতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। অমন জিনিসের ভাগ দেবার উদারতাও যে গাজির আছে, বুঝতে পারিনি। মানুষ চিনি কতটুকু।

তারপরে তো মুরশেদের নামের মজুরি করে ফেরা গাজি গান দিয়েই মাত করেছিল। মনে আছে, কালীনগরের ঘাট থেকে ঝিনিদের নিয়ে যখন লঞ্চ ছেড়ে গিয়েছিল, সে গুনগুনিয়ে উঠেছিল, ‘ও সে না জানি কি কুহক জানে, অলক্ষ্যে মন চুরি করে।’…সেই মুহূর্তে কেন গেয়েছিল এই গান। গাজি সত্যি পাজি।

তা ছাড়া, এবার তো শুধু গাজি না। সঙ্গে তার ‘পিকিতি’ নয়নতারার দেখাও পাওয়া যাবে। ‘পিকিতি না হলি তো সাধন হয় না বাবু। একটি পিকিতি চাই।’

কেমন করে সেই প্রকৃতি প্রাপ্তি ঘটেছিল, তারও বাখানি আছে। এই হাড়োয়ার মেলাতেই একদা এক যুবতী বৈষ্ণবী গাজির গান শুনে নিজের দল আখড়া সব ছেড়ে গাজির সঙ্গে চলে গিয়েছিল। নাম তার নয়নতারা। গাজির পিকিতি।

একি যে-সে গাজি। তারপরেও বলেছিল, ‘তা বলি, এ পুরুষ-পিকিতি কিন্তু মিয়া-বিবির ঘর করা নয় বাবু। দুইজনের সাধনা, ছাওয়াল-পাওয়াল হতি পারবে না।’

দেহতত্ত্বের কথা বলেছিল। আর শেষ মুহূর্তের বিদায়ের সময় জানিয়েছিল, ঘরে তার চারটি ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়ে নয়নতারা গাজির অপেক্ষায় আছে। আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। তার জবাবে, ‘অই মুরশেদের নাম নিয়িই ফিরি, সাধন-ভজন আর হল কমনে বাবু৷’…এর নাম গাজি। তবু সেই চারটি ছাওয়াল-পাওয়ালের বাবা গাজিকে কিছু অর্থ দিয়ে বলেছিলাম, ‘ছেলেপিলেদের একটু মিষ্টি কিনে দিয়ো।’

জানি না, নয়নতারা পিকিতির সঙ্গে ছাওয়াল-পাওয়ালরাও আসবে কী না। তবে গাজি আর নয়নতারাকে আসতেই হবে। পির গোরাচাঁদের স্মরণোৎসব বলে নয়। দু’জনের মিলনের স্মৃতির দিনও তো বটে। মিয়া-বিবি, কর্তা-গিন্নির বিবাহ বাৎসরিক না হতে পারে। প্রকৃতি প্রাপ্তি দিবস তো বটে। তাই হাড়োয়ার মেলায় একবার আসতে হবে। পির গোরাচাঁদের থানে গান গাইতে হবে।

পথে শুধু মোটর বাস চলে না। তিন চাকার গাড়ি, যেগুলো মালপত্র টানে, আজ তাদেরও মালখানা থেকে ছুটি। তারাও মানুষ বহন করে চলেছে প্রায় মালের মতোই বোঝাই করে। তার শব্দে যেন আর্ত চিৎকার। গরুর গাড়ির তো কথাই নেই। হিন্দু মুসলমান, সব রকমের যাত্রী। গাড়ির ছইয়ের মধ্যে কর্তা-গিন্নি ছেলেমেয়ের গাদি। তার মধ্যে আবার নবীন প্রবীণদের ভাগাভাগি আছে। সাইকেল আর সেইকেল-রিকশার যাত্রীও বিস্তর। পায়ে হাঁটার দলের কোনও হিসাব নেই। সব নদী যেমন সমুদ্রে যায়, এই লোকজন যানবাহন, সকলই পির গোরাচাঁদে যায়।

দু’ পাশের মাঠে এখন অনেকটাই শূন্যতা। কিন্তু নারকেল সুপারি আম জামের ঘন নিবিড়তা। ফাল্গুনের বাতাসে, তারাও যেন মত্ত মাতোয়ারা।

অনেকক্ষণ থেকেই, পাশে এক বুড়ো দরবেশ কী যেন গুনগুন করছে। ঠিক গানের মতো। সুর করে পাঁচালি বলার মতো। দেখলেই বোঝা যায়, হাড়োয়ার যাত্রী। মুসলমান ফকির বিশেষ। কিন্তু তার জামা কালো। কালো আলখাল্লা, কালো পায়জামা, মাথায় কালো টুপি। গলায় গুচ্ছের কাচপাথর পুঁতির মালা আর হার। রুপোর চৌকো তাবিজ। চোখাচোখি হলেই একটু হাসে। গুনগুনানি চলে সমানেই। বাধা দেওয়া উচিত না। বোধ হয় মন্ত্র জপ করে।

তারপর নিজেই এক সময়ে বলে, ‘পিরের মেলায় চললেন বাবু?’

বাঙালি। একটু যেন সন্দেহ ছিল মনে। বলি, ‘হ্যাঁ!’

দুই চারি কথার পরে সে আমাকে পির গোরাচাঁদের কাহিনী শোনায়। অনেক তাঁর কিস্যা। তিনি ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। এসেছিলেন দলের সঙ্গে মক্কা থেকে। বালান্ডার রাজা চন্দ্রকেতুকে মুসলমান করতে চেয়েছিলেন। তিনি লোহার দলা পাকাতে পারতেন। বেড়ার গায়ে চাঁপা ফুল ফোটাতে পারতেন। তার জন্যেই নাকি এ জায়গার নাম বেড়াচাঁপা। তাঁর অভিশাপেই, চন্দ্রকেতুর তিন দিনের মধ্যে সর্বনাশ হয়। হাতিয়াগড়ের রাজা আকানন্দ, তার ভাই বাকানন্দর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন তিনি। আকানন্দ মরেছিল, বাকানন্দ হারিয়েছিল। তাতে এমন আহত হয়েছিলেন, মরবার মতো। সে সময় তাঁকে সেবা করে ভার্গবপুরের কানু আর কিনু ঘোষ। সেখানেই মারা যান। তাঁর হাড় যেখানে কবর দেওয়া হয়, তার নাম হাড়োয়া, আর ভার্গবপুর নয়। তাঁর অলৌকিকতার জন্যে হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁকে পূজে। এই হল ইতিবৃত্ত।

ইতিমধ্যে গাড়িও গন্তব্যে এসে পৌঁছয়। মেলার অনেক আগেই গাড়ির পথ রুদ্ধ। মানুষের ভিড়ে সেখানে আর গাড়ির প্রবেশ অচল। থানা পেরিয়ে সড়ক ধরে খানিকটা সবাই সরে দাঁড়ায়। জনা পঞ্চাশের একটা মিছিল প্রায় দৌড়েই চলে যায়। হাতে হাত ধরে জড়াজড়ি করে, পতাকা আর রঙিন ডুলি কাঁধে করে তারা ছুটে যায়। তাদের ধ্বনির মধ্যে শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, ‘হজরত শাহ সৈয়দ পির গোরাচাঁদ রাজী!’…কিংবা, ‘আব্বাস আলি রাজী রহমতুল্লাহ।’…একটা রঙিন কাগজও তারা ছড়িয়ে দিয়ে যায়। ছাপানো কাগজ, ভিন্ন ভিন্ন পদ্য। পড়ে মনে হয়, পির গোরাচাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই তার উদ্দেশ্য। ‘শিরিন সুরের আজান বহিয়া বহিছে বাতাস আজ ফজরে। ভক্তি উপহারে সাজিয়ে ডালি চল সে পিরের আরাধনে।’ কিংবা, ‘নূরের নবি ঘুমিয়ে আছে, হাড়োয়াতে দেখবি যদি আয়।’

আমি এগিয়ে যাই। বাঁধানো পাকা সড়ক ধরে যেতে যেতে এক সময়ে থামতে হয়। সামনে নদী, বিদ্যাধরী। ঘাটে নৌকার ভিড়। ওপারের খেয়া পারাপার চলেছে। বাঁয়ের রাস্তা চলে গিয়েছে অর্ধবৃত্তাকারে বাঁধের ওপর দিয়ে। পাশে পাশে ঘর। সেদিকেও ভিড়, তবে কম। ডান দিকে ঠাস বুনোট হাটের চালা। অনেক দিন পরে আবার কালীনগরের গঞ্জের কথা মনে পড়ে যায়। গাজি কোথায় আছে কে জানে।

হাটের দিকে চেয়ে মনে হয়, মেলার কলরবটা সেদিকেই বাজছে। কলের গানের যান্ত্রিক চিৎকার কেবল মা। বাজিকরদের হাঁকডাকও যেন অস্পষ্ট ভাবে শোনা যায়। বিদ্যাধরী নদীর বুকে বেলা একটার রোদ ঝলকায়। পশ্চিম থেকে আসে নদী, দক্ষিণেতে যায়। সামনেই মাঝখানে এক চর। নাম-না-জানা এক ধরনের গাছে নিবিড় বনের মতো দেখায়। গাছগুলোর ডালে ডালে, অজস্র হলুদ ঠোঁট সাদা বকের ভিড়। সম্ভবত এ পাখিরা মানুষের শিকার না তাই মানুষের হাতের কাছে এমন নির্বিবাদে ভিড় করে আছে।

আমি হাটের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দু’ পাশে নানা দোকান। কালীনগরের থেকেও যেন এখানে দোকানপাট বেশি। হাটের দিন কী না জানি না। মেলার ভিড়েই ঠাসাঠাসি। জনস্রোতের চাপেই কোন একদিকে চলতে থাকি। কোনদিকে নিয়ে যায় বুঝতে পারি না।

খানিকক্ষণ চলার পরে এক জায়গায় এসে হাটের শেষ হয়। সামনেই দেখি এক মসজিদ। খোলা দরজা দিয়ে সামনে বাঁধানো চত্বর দেখা যায়। সেখানেও ভিড় কিন্তু কম। এক পাশে লেখা রয়েছে পির গোরাচাঁদের সমাধি। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতেই আমার কানে এসে বাজে একতারার শব্দ, তার সঙ্গে, ‘অহে, সাঁই আমার যখন খেলে, কী খেলা।’…

প্রায় বুক ধড়াসেই যায়। এমন চমক লাগে শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। কার গলা, কে গায়। সেই পাজি গাজিটা নাকি। কিছু না ভেবেচিন্তে আমি সমাধিক্ষেত্রের দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁধানো চত্বর পেরিয়ে যাই। চত্বরের শেষে আর এক দরজা। তার বাইরে নানান ভিড়। দেখি এক মস্ত খোলা আঙিনা। গাছের ছায়ায় শীতল। শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। তার মধ্যে এখানে সেখানে গুচ্ছে গুচ্ছে বসে সবাই গান গেয়ে গোরাচাঁদের ভজনা করে। এখানেও সেই ধূলি আলখাল্লা, ডারা ডুপ্‌কি খঞ্জনি একতারা।

একটা জায়গায় একটু বেশি ভিড়। সমাধির মূল দরজা সেখানে। সামনের এক মেলার যাত্রীকে জিজ্ঞেস করি, ‘ওখানে কী হচ্ছে?’

‘ওখানে সবাই পুজো-হাজোত দিচ্ছে। পিরের হাজোত দেয় না? তাই দিচ্ছে।’

হয়তো তা-ই। ব্যাপারটা সেইরকম দেখাচ্ছে। ডালি ভরে বাতাসা কিংবা আরও অন্যান্য মিষ্টি এনে দিচ্ছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মৌলবীই হবে বোধ হয়, তার হাতে দিচ্ছে। সে ভিতরে নিয়ে একটু বাদে আবার ফিরিয়ে এনে দিচ্ছে। তাই মাথায় করে সব নিয়ে চলেছে। অনেকটা মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদ করে নেওয়ার মতো। কিন্তু নিয়ে যেতে পারছে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের বিরাট দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ‘আমাকে দু’খান দেন গো, দিয়ে যান বাবা।’…

এ সব পরে হবে, আগে গাজিকে দেখি। আমি গায়কদের দলের দিকে ফিরি। প্রতিটি মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘুরি। সে মুখ দেখতে পাই না। সেই কালো মুখের ভাঁজে ভাঁজে হাসি, পান খাওয়া লাল ছোপ দাঁত, গহিন দরিয়া চোখ, মাথার ঝাঁকড়া চুলে গেরুয়া ফালির ফেট্টি বাঁধা। কমনে গেলে হে গাজি। তবে, আজ সে একলা তো থাকবে না। সঙ্গে তার নয়নতারা পিকিতিও থাকবে।

চারপাশে পাঁচিল ঘেরা গোরাচাঁদের সমাধি আঙিনায় কোথাও তাকে চোখে পড়ে না। দক্ষিণের পাঁচিলের ওপারে আর জায়গা নেই, তারপরে বিদ্যাধরী নদী। সুদীর্ঘ বাঁকের কোলে স্রোতে বাঁকা ঝিলিক দেয়।

পশ্চিমের দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে দেখি অপর্যাপ্ত দোকান। সবই বাতাসা আর মিষ্টির দোকান৷ পুজো হাজোতের সিধের দোকান সব। হঠাৎ মনে হয় আমিও কিছু মিষ্টি কিনে হাজোত দিই। পিরের পূজা তাতে কতখানি হবে জানি না। গাজি আর নয়নতারাকে ডালি ধরে দিতে পারব। গাজির নয়নতারার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সেটাই উপহার।

বাতাসা আর কিছু মিষ্টির একটা ডালি কিনি। তার মধ্যে দোকানিদের প্রতিযোগিতার হাঁকডাক, ‘এখানে আসেন বাবু, কী চাইলেন বলেন না।’ ডালি নিয়ে গিয়ে সকলের মতো সমাধিমন্দিরের দ্বারীর হাতে দিই। একটু বাদে আবার ফিরে পাই। হাতে নিয়ে বুঝতে পারি পূজায় কিছু বাতাসা মিষ্টি লেগেছে। কিন্তু ডালি নিয়ে বেরোয় কার সাধ্য। চারদিক থেকে ছেঁকে ধরে। ‘একখান দেন বাবু।…আমারে একটু মিষ্টি দেন। দেন দেন দেন।’…

মনে হয় অজস্র হাত আমার ডালি ঘিরে। আহ্, অভাগী একটা সোমত্ত মেয়ে আমার ডালিটা ধরেই টান দেয়। আমি তাকে ধমক দিতেই সে দাঁত বের করে হাসে। কিন্তু সবাইকে দিতে গেলে গাজিদের জন্য কী থাকবে! আমি তো হরির লুট দিতে আসিনি।

এ সময়েই লাঠি হাতে এক গ্রামীণ মানুষ খেঁকিয়ে ওঠে। লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে, ‘এই, এই হাঘোরেরা, চক্ষির বিষ, যা সর বলতিছি। ঠ্যাঙায়ি শেষ করব।’

তাড়া খেয়ে অনেকেই সরে পড়ে। ধাক্কাধাক্কি করে আছাড় খায়। আমার সাধ্যানুযায়ী সবাইকে যা পারি দিয়ে ভিড় কাটিয়ে আসি। কাঁধের ঝোলার মধো ডালি ঢুকিয়ে দিই। আবার পশ্চিমের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাই। বাতাসা মিষ্টি সিধের দোকান পেরিয়ে নাকে পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ লাগে। দেখি, বড় বড় হাঁড়িতে মাংস রান্না হচ্ছে। অনেকেই খেতে বসেছে। এত বড় বড় মাংস আর রুটি-ভাতের ভোজনালয় কোনও মেলায় দেখিনি। হুগলির পাণ্ডুয়ার মেলায় কিছুটা দেখেছি বটে, এত নয়। দেখে মনে হয়, অধিকাংশ দোকানই মুসলমানরা খুলেছেন।

তারপরেই মিষ্টির দোকান। যেমন হতে হয় তেমনিই, খাজাগজা জিলিপি, রাজভোগ, রসগোল্লা, লেডিকিনি। মুড়ি-মুড়কির দোকানও অনেক। তারপরে মনিহারি, তার সীমানাও কম না। এ সীমানা পেরিয়ে গেলেই বাজিকরদের তাঁবু। তাও কি একটা-আধটা। মৃত্যুকূপ থেকে শুরু করে অগ্নিকন্যা, কী নেই। হাড়োয়ায় এত বড় মেলা আশা করিনি। এত বড় মেলা দেখেছিও খুব কম।

বিদ্যাধরী নদীর বালি মাটির বিশাল বিস্তৃত চড়ায় তাঁবুর পরে তাঁবু। শুধু বাজিকরের ভোজবাজি না। হাতি বাঘের খেলাওয়ালা সার্কাসও এসেছে। সেখানে শূন্যের দোলনায় দোলাখেলার মেয়েরাও আছে।

আশেপাশে প্রচুর গরুর গাড়ি। তাতে যে শুধু গ্রামীণ নরনারীরা এসেছে তা না। কাজল মাখা চোখের কোলে কালি, পান রাঙানো ঠোঁট, চোখের ত্যারছা নজর আর সেই সঙ্গে বাঁকা সিঁথেয় একটু ঝ্যানো কেমন কেমন লাগতিছে। হারমোনিয়াম আর ডুগিতবলা পুরুষদের হাতে। কালীনগরের দুলালীদের কথা মনে পড়ে যায়। কেঁদুলিতে পুবের দিকে বিন্দুর দিকশূল দেবার কথাও মনে পড়ে। এসবও যেন মেলার একটা অঙ্গ।

কোথাও কোথাও পির গোরাচাঁদের আখ্যায়িকা নিয়ে গানের আসর জমেছে। কোথাও ছোট ছোট ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে পায়ে ঘুংগুর দিয়ে নাচানো হচ্ছে। কোমর ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে চোখে দেয় টিপ, ঘুরে ঘুরে গান করে, ‘সজনী তর ভরা কলসি ছপছপায়ে পড়ে গো।’…

তা যেন হল, নিমন্ত্রিত ঘুরে ফেরে, নিমন্ত্রণকর্তার দেখা নেই কেন। পারাপারের ঘাটের কাছে আসি। সবখানেই কিছু দরবেশ, ফকির বাবাজি বৈরাগীদের দেখা পাওয়া যায়। কেহ গায় বসে, কেহ ঘুরে ঘুরে। আমার গাজিটা কোথায়!

ঘাটে অনেক নৌকা। সেদিকেই এগিয়ে যাই। একটা নৌকা আমার দরকার। দু-একজন মাঝি জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। একজন বুড়ো এসে জিজ্ঞেস করে, ‘নৌকো চাই নাকি বাবু?’

‘চাই।’

‘যাবেন কমনে?’

‘দক্ষিণে।’

‘দক্ষিণে যাবেন? ফাগুন মাস, বাতাস উঠি গ্যাছে যে!’

‘তা হলে কি যাওয়া যাবে না?’

‘যেতি পারবেন, তয় ভাল মাঝি চাই। দাঁড়ান দিকি।’

বলে সে হাঁক দেয়, ‘সত্য আছ নিকি, অ সত্য।’

মাঝারি একটা নৌকার ছইয়ের থেকে একজন বেরিয়ে আসে। গেরুয়া রঙের লুঙ্গি না কাপড় তার পরনে বুঝতে পারি না। গলায় একখানি গামছা। বয়স বেশি না, একটু খাটোর ওপরে শরীরখানি যেন পাথরে খোদাই। যেমন শক্ত তেমনি বলিষ্ঠ মাথায় উসকোখুসকো ঘাড় অবধি চুল। চোখ দুটি কেবল ডাগর না। বয়সের তুলনায় যেন অতিরিক্ত শান্ত, গম্ভীর। এমন মাঝি কি সমুদ্রে যায়। কিন্তু গলার স্বর শুনে অবাক হয়ে যাই। গম্ভীর মোটা স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বল খুড়া।’

‘এই বাবু দক্ষিণে যেতে চায়, নিয়ে যেতি পারবা?’

সত্য মাঝি আমার দিকে চায়, বলে ‘পারব।’

‘তবে কথা কয়ি নাও।’

সত্য আবার আমার দিকে চায়। শান্ত গম্ভীর চোখে চেয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘যাবেন কমনে, জায়গার ঠিকানা আছে?’

বলি, ‘না।’

‘বনে যাবেন?’

‘যাব।’

‘সাগরে?’

‘যাব।’

‘চলেন। হিসাব করি যা হয় দিবেন। তবে কিছু চাল-ডাল তরিতরকারি এখান থেকিই কিনে নিতি হবে। দুইজন মাঝি আর আপনি। তিনজনের খাবার। মিঠে জল জালায় করে নেব।’

এমনই একটা শান্ত উদাস গাম্ভীর্য সত্য মাঝির, তাকে কোনওরকমেই অবিশ্বাসী বা তস্কর ভাবতে পারি না। তার হাতে কিছু টাকা তুলে দিই। দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘যাত্রা কখন?’

মাঝি বলে, ‘জোয়ার আরও ঘণ্টা তিন আছে। ভাঁটায় যাব।’

বলি, ‘তা হলে আমি আর একটু ঘুরে আসি।’

‘আসেন গিয়া। নৌকো এখানেই থাকব।’

তবু জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার পুরো নাম কী।’

‘সত্য বাউল।’

বাউল! বাউল কি পদবিও হয় নাকি। জিজ্ঞেস করি, ‘বাউল পদবি নাকি?’

‘আঁজ্ঞা। এ দেশে, গুনিনকে বাউল কয়। আমাদের বাউলের বংশ।’

এ সেই বাউল না, গুনিন বাউল। তথাপি সত্য মাঝিকে যেন কেমন একরকম বাউল বলেই মনে হয়। তার এই গম্ভীর শান্ত নৈর্ব্যক্তিকতা আমার ভাল লাগে। তার গলায় তুলসীর মালা দেখে মনে হয়, সে ধর্মে বৈষ্ণব।

কিন্তু আমার আর দেরি সয় না। আবার মেলার দিকে ফিরে যাই। গাজি কি কোনও কারণে এবার আসতে পারেনি। নাকি, আমিই এত লোকের ভিড়ে খুঁজে পাই না। এই বিশাল ভিড়ের মধ্যে একজনকে খুঁজে বের করাও কঠিন।

মেলা পেরিয়ে হাটের ভিড় ভেঙে বড় সড়কের দিকে যাই। সড়কের পুবদিকেও ছোটখাটো মেলার আসর আছে। সেখানে একবার খুঁজে দেখি। কিন্তু হাট পেরিয়ে বড় সড়কে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াই। মুখোমুখি সামনাসামনি যার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সেটা একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

আমি কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই উদগত চোখের জলে রুদ্ধ স্বরে ঝিনি বলে ওঠে, ‘ঘুম ভাঙিয়ে ডাক দিয়ে এলেও তোমাকে আটকে রাখতাম না।’

বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠবার আগেই অপরাধভঞ্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বলি, ‘সে জন্য নয়, ভাবলাম শেষরাত্রের ঘুম। তুমি একলা নাকি?’

ঝিনির চোখ ঝাপসা। কথা বলতে পারছে না। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই ফাল্গুনের চড়া রোদে পুড়েছে। হাড়োয়ার হাটের যত ধুলা ওর সারা শরীরে, মুখের ঘামে, রুক্ষু চুলে। রেশমি কাপড়ের ছটা নেই। এই প্রথম ওকে আমি কাপাসি রংহীন সাদা কাপড়ে দেখলাম। জামাটাও তা-ই। কাপড়ের পাড়ে পর্যন্ত কোনও ঔজ্জ্বল্য নেই। হালকা বাসন্তী রঙের পাড়। হাতের গোল কাপড়ের ব্যাগটাই যা একটু নাগরিকতা রক্ষা করেছে। হাতে গলায় অলঙ্কার না থাক, হাতের ঘড়িটারও কি দরকার নেই।

ঝিনি কয়েক মুহূর্ত পরে নদীর দিকে ফিরে চোখ মোছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি একলা এসেছ?’

মুখ না ফিরিয়েই বলে, সব সময় দোকলা পাব কোথায় বলো।’

ওর গলা এখনও ভেজা শোনাচ্ছে। জিজ্ঞেস করি, ‘কখন এলে?’

‘সকালের দিকে।’

আমার দিকে ফিরে বলে, ‘খুব বিরক্ত হলে তো।’

‘না, খুব অবাক হয়েছি তোমাকে এখানে দেখে।’

ও আমার চোখের দিকে এক পলক চেয়ে থাকে। তারপরে বলে, ‘তুমি আসবে বলেছিলে— গাজির নিমন্ত্রণে। তাকে আমারও একটু দেখতে ইচ্ছে করল, তাই চলে এসেছি।’

বলতে পারি না, তা বলে এমনি ভাবে। ঝিনি কি নিজেকে এমনি করে ভুলে যায়। তার কি স্থান কাল পাত্র ভুলে এমনি করে হঠাৎ ছুটে আসা চলে।

ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল।’

বলি, ‘তোমাকে দেখছি।’

ও যেন হঠাৎ একটু লজ্জা পায়। মুখ নামিয়ে বলে, ‘না এসে থাকতে পারলাম না। দেড় মাস তো হয়ে গেল। তারপরে আবার কবে কে জানে।’

এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। জীবনের সবটাই আকস্মিকতায় ভরা, তা যেমন মানি না; তেমনি জীবনের অনেক কিছুই অজানা বলে জানি। বলি, ‘কিন্তু যার নিমন্ত্রণে আসা, তার দেখা এখনও পাইনি।’

ঝিনি বলে, ‘তাকে আমিও এখনও পাইনি। ভাবলাম, তোমাকে দেখতে পেলে তাকেও দেখতে পাব।’

আমি বলি, ‘তবে চল, তাকেই দেখি।’

বলে, পুব দিকে পা বাড়াতে যেতেই ঝিনি বলে, ‘ওদিকে সে নেই, এটুকু বলতে পারি। আমি সব দেখেছি।’

আমার মনে নিরাশার ভার নামে। বলি, ‘তবে?’

ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘তাকে খুব ভালবাস, না?’

চেয়ে দেখি ঝিনির চোখে গভীর কৌতূহল আর অনুসন্ধিৎসা। বলি, ‘তা জানি না। ভালবাসার ধার সে ধারে কি না কে জানে। তবে সে আমাকে আসতে বলেছিল, সে কথা আমার মনে আছে।’

ঝিনি কী বলতে গিয়েও মুখ নামিয়ে নেয়। তারপরে যেন অন্যমনস্ক সুরে বলে, ‘এ-ই বোধ হয় তুমি।’

কেন এ কথা ও বলে, জানি না। তারপরে হঠাৎ যেন ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘চল, তাকেই খুঁজে বের করি। তাকে না দেখে আমিও যাব না। সে নিশ্চয়ই সমাধির কাছে বা মেলার ওদিকে কোথাও আছে।’

সে-ই ভাল। আমারও সময় বেশি নেই। জোয়ারের কাল ফুরালেই আমার যাত্রা। হাটের ভিড়ে ঝিনি আমার সামনে চলে। আবার আসি সেই সমাধির আঙিনায়। ঝিনি বলে, ‘এখানেও তোমাকে খুঁজে গিয়েছি।’

‘আমিও খুঁজেছি।’

আবার সকলের কাছে গিয়ে গিয়ে দেখি। সে মুখ দেখতে পাই না। একজন বুড়া দরবেশ জিজ্ঞেস করে, ‘কারুরে খোঁজেন নাকি বাবু?’

‘হ্যাঁ।’

‘কারে?’

‘মাহমুদ নামে এক গাজিকে।’

বুড়ো যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করে, আপন মনে উচ্চারণ করে, ‘মামুদ গাজি! কমনেকার লোক কন তো?’

বলি, ‘বসিরহাটের।’

তার আগেই সে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দিঘির পাড়ে ছিল মামুদ গাজি। গলাখানি বড় সোন্দর ছিল। জয় মুরশেদ।’

জিজ্ঞেস করি, ‘সে কি আসেনি?’

বুড়ো দাড়ির ভাঁজে উদাস হেসে বলে, ‘আসবে কমনে বাবু, নালিশ রুজু, মোক্তারনামা সব তো তার খতম হয়ি গেছে, সে খালাস নিয়েছে।’

এ কথার অর্থ কী। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। জিজ্ঞেস করি, ‘তার মানে!’

বুড়া বলে, ‘সে তো আর নাই বাবু। এই মাঘ মাসের মাঝামাঝি সে তো ডানসায় ডুবি মরেছে।’

‘ডানসায়?’

‘ডানসা গাঙে নৌকো থেকে জলে পড়ি গিছল আর ওঠে নাই।’

মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার বোধ হয়। ডানসা গাঙে ডুবে গাজি মারা গিয়েছে! কেন, মুরশেদের নামের মজুরিতে বেরিয়েছিল নাকি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমি চুপ করে থাকি। কিন্তু আমার ভিতরে শুনতে পাই, ‘পাজি পাজি, সত্যি গাজিটা যে এত বড় পাজি, তা কোনও দিন বুঝতে পারিনি। নিমন্ত্রণ জানিয়ে সে পালিয়ে যায়।’…আমি যেন তার সেই পাজি মুখটা দেখতে পাই। কালো মুখের ভাঁজে ভাঁজে পাজির হাসি। গহিন দরিয়া চোখে পাজির ঝিলিক।

বুড়ো ফকির জিজ্ঞেস করে, ‘তাকে কোনও দরকার ছিল বাবু?’

ঘাড় নাড়ি। না, এই বিশাল পৃথিবীতে মানুষের সহস্র দরকারের কোনও কিছুই ছিল না গাজির কাছে। বরং এক সুবিশাল অদরকারেই তাকে খুঁজেছি। যে অদরকারের কথা সংসারে কাউকে বলা যায় না। যে অদরকার, সংসারে নিতান্তই অদরকার।

বুড়ো দরবেশ বলে, ‘অই যে দ্যাখেন মেয়েছেলেটি বসি রয়েছে, হাঁ, অই গাছতলার কাছে, মামুদের বিবি।’

নয়নতারা! গাজির পিকিতি! ঝিনির সঙ্গে চকিতে একবার আমার চোখাচোখি হয়। জলে ভেজা চোখেই ওর আলো দেখা দেয়। কাছে যাবার আগে আমি আর একবার দেখি। আশ্চর্য, পুজো দিয়ে ফেরবার সময় এই মেয়েলোকটি আমার কাছে একবার হাত পেতেছিল। এই কি সেই নয়নতারা। যার জন্য ডালি নিয়ে ফিরি। সামান্য একটা ময়লা শাড়ি তার পরনে। মাথায় ঘোমটার পাশ দিয়ে তেলহীন রুক্ষু চুলের জটা বেরিয়ে আছে। দৃষ্টি যে তার কোনদিকে বুঝতে পারি না। চুপচাপ বসে আছে। যৌবন তার গত না, কিন্তু জীবনযাপন শুষে নিয়েছে। শোকে শীর্ণ। পুরনোদিনের কিছু কিছু চিহ্ন যেন এখনও চোখের টানায়, বাহুর গঠনে রয়ে গিয়েছে।

গাজিহীন নয়নতারা কেন এসেছে পির গোরাচাঁদের মেলায়। গাজির জন্যেই নাকি। এই তো সে-ই স্থান, যেখানে তারা পুরুষ-প্রকৃতির প্রথম লীলায় নিজেদের দেখা পেয়েছিল।

আমি আর ঝিনি তার কাছে এগিয়ে যাই। সে খানিকটা অবাক কৌতূহলে আমাদের দিকে চোখ তোলে। জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার নাম কি নয়নতারা?’

সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করে না। তাকিয়েই থাকে। আমার গলায় যেন কথা আসতে চায় না। জোর করে বলি, ‘গাজির সঙ্গে চেনাশোনা ছিল।’

সে একটু শব্দ করে, ‘অ।’

তাড়াতাড়ি ঝোলা থেকে ডালি বের করি। আর সেই কয়েক প্যাকেট সিগারেট। ছিরগেট, যার বাস বড় মিঠে। বলি, ‘এগুলো তার জন্যেই রেখেছিলাম, তুমি রাখো।’

সে হাত পেতে নেয়, বলে, ‘অ।’

কিন্তু চোখে তার জল আসে। অথচ সে যে কিছু বুঝতে পারে তা মনে হয় না। কেমন একটা মূঢ় ভাবলেশহীন মুখ। এমন নয়নতারার কথা একবারও ভাবিনি।

আবার জিজ্ঞেস করি, ‘ছাওয়াল-পাওয়ালরা কোথায়?’

আবার যেন একটু অবাক হয় নয়নতারা। বলে, ‘রেখে এসেছি। এবারে যাব। একবার না এসে পারলাম না, তাই। বাবু।’

নয়নতারা আমাকে ডাকে। গাজির সেই চোখে ঝিলিক হানা, বৈষ্ণবী গায়িকা প্রকৃতি। ফিরে তাকাই, সে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে?’

বলি, ‘তুমি চিনবে না।’

‘অ। কিন্তু ছিরগেটগুলন নিয়ে কী করব বাবু, সে তো নাই।’

বলতে বলতেই তার চোখ বুজে যায়। নিচু স্বরে কোনওরকমে বলি, ‘তার নামে রেখে দিয়ো।’

বলে, আর দাঁড়াই না। সেখান থেকে চলে যাই। ঝিনির স্পর্শ অনুভব করি। ও আমার গায়ে গায়ে চলে। মেলা খেলা সকল কিছু পেরিয়ে, ঘাটের কাছে যাই। ঘাটে নেমে যাবার আগে জামায় টান লাগে। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাচ্ছ!’

বলি, ‘নৌকোয়।’

‘কেন!’

‘দক্ষিণে যাব।’

ঝিনি যেন চমকে ওঠে। গলায় শব্দ হয়, ‘ওহ্!’

আমি ঝিনির দিকে ফিরি। ঝিনি অসহায় করুণ চোখে তাকায়। আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আবার কবে কোথায় দেখা হবে?’

একটু চুপ করে থেকে বলি, ‘বলতে পারছি না যে।’

‘কেন।’

‘জানি না যে!’

ঝিনির ঠোঁটের ফাঁকে অস্পষ্ট শব্দ বাজে, ‘বিষ।’

সত্য মাঝি গম্ভীর গলায় ডাক দেয়, ‘বাবু আসেন, ভাঁটা পড়েছে।’

ঝিনির দিকে তাকাই। ঝিনি আমার বুকের দিকে চোখ রেখে বলে, ‘যদি না জানো, তবে কেমন করে বলবে। তবে আর কোথায় দেখা হবে। তবু দেখ—।’

ওরা গলা বন্ধ হয়ে আসে। বলি, ‘বল ঝিনি।’

ও ভাঙা ভাঙা নিচু গলায় বলে, ‘বলি, বলি, বলবই তো। তবু দেখ নিতান্ত মেয়ে তো আমি। তাই একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে।’

‘বলো।’

‘মনে থাকবে, আমাকে?’

‘থাকবে।’

যেন সাপের ছোবলে ঝিনি আর্তনাদ করে ওঠে, ‘উঃ, কী ভীষণ বিষ। মনে হয় অমৃতের মতো গলায় ঢেলে দিই, দিয়ে জুড়িয়ে যাই। তবে, একটা কথা।’

আবার ও থামে।

বলি, ‘বলো।’

‘মনে থাকুক না থাকুক, আমি বলি, একটু মনে রেখো।’

আমার বুকের কাছে জামাটা একবার ধরে আবার ছেড়ে দেয়। আমি নেমে যাই ঘাটের দিকে। যাবার আগে আবার বলি, ‘যাই।’

ও বলে, ‘আমি আর একবার নয়নতারার কাছে যাই।’

ওর এই শেষ কথাটা যেন, সহসা কেমন এক তীব্র ভয়ংকর সুরে বেজে ওঠে। যেন মনে হয়, নয়নতারা আর ঝিনি, একাকার হয়ে গিয়েছে। তারা দু’জনে এক।

ও পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্য বাউল নোঙর তুলে নৌকা ঠেলে দেয় জলে। তারপরে হাত দিয়ে, বিদ্যাধরীর জলের গণ্ডূষ নিয়ে আমার মুখে মাথায় ছিটিয়ে দেয়। নিজের মনেই গম্ভীর স্বরে বলে, ‘জয় গুরু, যাত্রা করি।’

বিদ্যাধরীর জল আমার মাথা থেকে মুখে এসে পড়ে। ঠোঁট চুইয়ে জিভে স্বাদ পাই, জল লবণাক্ত। কিন্তু আমার চোখ ঝাপসা। ঝিনিকে আর দেখতে পাই না। হাড়োয়ার ভূমি, পির গোরাচাঁদের মেলা, কিছুই চোখে পড়ে না। কেবল মনে হয়, গাজির গুনগুনানি শুনি যেন,

‘ক্ষ্যাপা, তুই না জেনে তোর আপন খবর

যাবি কোথায়।’…

সত্য মাঝির নৌকা নামে বিদ্যাধরীর স্রোত বেয়ে।

_________

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *