৪০.
বসতে না বসতেই দেখি, এদিক ওদিক থেকে কয়েকজন ‘জয়গুরু জয়গুরু’ বোলে বেজে ওঠে। এমনকী, ডাগরা গায়ক গান থামিয়ে, কপালে হাত ঠেকিয়ে, মাথা নিচু করে আওয়াজ দেয়, ‘জয় গুরু, জয় গুরু।’ দিয়ে আবার কালো কালো ডাগর চোখ দুটি ঘুরিয়ে হাসে। কাকে এমন সংবর্ধনা, কাকে এত আত্মীসূয়তা দেখানো। পাশে চেয়ে দেখি, আমার প্রৌঢ় সঙ্গীকেই। তিনিও কপালে হাত ঠেকিয়ে সবাইকে সেই বাক্যেই বোল দেন, ‘জয় গুরু, জয় গুরু।’
দিয়ে মহাশয় একবার আমার দিকে চেয়ে হাসেন, চোখ ঢুলুঢুলু করে। কথা বলবার অবকাশ পান না, তার আগেই ওঁর পাশে বসা আলখাল্লাধারী কাঁচা-পাকা চুলদাড়ির মাঝখানে পাকা টসটসে মুখে ঝকঝকে চোখে চেয়ে বলে, ‘ইঁটি কে বটে গ অচিনবাবু? বিটা নাকি?’
‘বিটা?’ প্রৌঢ় মহাশয় চোখ কপালে তুলে তাকান বুড়ো বাউলের দিকে, আবার তাকান আমার দিকে। তারপরে গেরিমাটিতে ছোপানো থান পরা, হাতে খঞ্জনি বৃদ্ধার দিকে চেয়ে বলেন, ‘অই শোনো গ রাধা দিদি, তোমার বুড়ার কথা শোনো। একে দেখিয়ে বলে, আমার বিটা নাকি। গোপীদাদার আর তন জ্ঞান নাই দেখছি।’
মহাশয়ের সঙ্গে বুড়িও ফোকলা দাঁতে হাসে। দু’জনেরই নজর ঘুরেফিরে আমার দিকে। বুড়া বাউল গোপীদাদার ধন্দ যে আমাকে নিয়ে, তা বুঝতে পেরেছি। তারপরে বুড়ি ভ্রূকুটি কোপে বুড়ার দিকে চায়। যেন যুবী কটাক্ষ করে যুবাকে। বলে, ‘নতুন দেখলে নাকি অচিনবাবুকে! না বিইয়ে কানাইয়ের মা?’
গোপী বাউলের মুখখানি যেন আঁতুড়ের ছেলে, টুকটুকিয়ে চায়, নজরে গোলমাল। তার রাধার মুখের কথা শুনে প্রায় হইচই করে ওঠে। ‘অই অই, জয় গুরু জয় গুরু, ভুলে গেছি, অচিনবাবুর বে-থা নাই।’
মহাশয় আবার হেসে ওঠেন, যাঁর নাম অচিনবাবু। অচিন, এমন নাম কখনও শুনিনি। তাও কিনা তাঁর সঙ্গে আবার বাউলদের দাদা-দিদি পাতানো। ছাদিমতলার মেলায় এ মানুষটি কে?
ওদিকে গান চলেছে সমান তালে, অচিনবাবু গলা নামিয়ে বলেন, ‘বে-থা নাই মানে কিন্তু “নাই” না গ দাদা।’
বুড়া অমনি দাড়ি কাঁপিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে বলে, ‘জয় গুরু জয় গুরু, তাই কখনও হয়। “নাই”-এতে “হ্যাঁ” বিরাজ করে, যেমন কামেতে প্রেম, অমাবস্যায় পুন্নিমা, টানাতে উজান।’
বলে বুড়ো দু’ চোখ কুঁচকে যেন কী রহস্যের ইশারা করে। অমনি অচিনবাবু একেবারে হাত বাড়িয়ে দেন বুড়ার পায়ের কাছে, বলেন, ‘বাহ্, বাহ্, গোপীদাদা, পায়ের ধুলো দাও।’
বুড়া তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘অ ধু-র, ই কী করে বলো দিকিনি, এত বড় একটা মানুষ, যখন-তখন পায়ে হাত দেয়।’
‘এমন কথা বললে যে হাত মানে না। কিন্তু অই বড়মানুষ কথাটা আর বলো না, খুব রাগ করব।’
বুড়াও দাড়ি দুলিয়ে হাসে। বলে, ‘বড়মানুষ মানে কী আর হোমরাচোমরা বইলছি। তুমি হলে বড়মানুষ গ, যারে বলে জাত মানুষ।’
অচিনবাবু চোখ কপালে তুলে, জিভ কেটে হাত কপালে ঠেকান। বলেন, ‘আরে বাপ্রে বাপ্৷ আর বলো না দাদা।’
আর বলে না বুড়া। দেখ, তবু বলে, দু’জনাতে চোখে চোখে হাসে, নিশ্চুপে ভাষে। আবার রাধার সঙ্গে চোখাচোখি হতে সেও সাদা কেশের মাথাখানি দোলায়, চোখ ঘোরায়। এ হল রস-রহস্যের কথা, নিজেদের মধ্যে চলে, অপরের ব্যাজ। কামেতে কোথায় প্রেম, অমাবস্যায় পূর্ণিমা আর জোয়ারে উজান, তা তুমি বুঝবে না। তার মধ্যে কোথায় কোন রসের ধারা খেলে যায়, তা দেখ এদের চোখে মুখে। তার বেশি দেখতে পাবে না।
তা না পাই, আমি বেশি দেখি অচিনবাবুকে। ওঁর গায়ে তো আলখাল্লা নেই, গেরুয়া নেই, লম্বা কেশে পাগড়ি নেই। সাজপোশাক, কথাবার্তা, মায় হাতের চুরুটখানিও দেখে মনে হয়, ঘরানা আলাদা। অথচ, এই মানুষদের সঙ্গে এত বোঝাবুঝি কেমন করে, যেন ভাবের এক ঘরেতেই বসত। কেবল, তা-ই না, চোখে মুখে এমন মুগ্ধতা, যেন ভাবের ঘোরে দোল-দোলানো। দেখি, ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কী যেন আওড়ান, বোধ হয় বুড়ার সেই কথাগুলোই। গোরা মুখে রেখায় রেখায় আঁকিবুকি অনেক। কপালের কাছ থেকে চুল উঠতে উঠতে অনেক পিছনে গিয়েছে, তবু পাতলা ধূসর চুলে, এখনও উলটো টানে, কেমন যেন একটা রূপের ঝলক দিচ্ছে। চোখ দুটি ডাগর, কিঞ্চিৎ ঢুলুঢুলুও বটে, তবে চোখের চারপাশে কালির একটা অস্পষ্ট ছাপ। তার কার্যকারণ বিচারে যেয়ো না, কারণ সব মিলিয়ে এ মুখ দেখে ভোগী সুখী বলতে পারবে না। কেন যেন মনে হয়, এ মুখেও সেই কাঁদন-ভরা হাসির ছিটা লাগানো। নাকি আমার চোখের ধন্দ কে জানে!
আমাকে দেখিয়ে বুড়া আবার পুছ করে, ‘তা ইটি কে বইললে না তো।’
‘বন্ধু’
বলে অচিনবাবু আমার দিকে একবার চোখের কোণে তাকিয়ে হাসেন। আবার বলেন, ‘অবিশ্যি সময়মতো হলে আমার বিটাও এত বড়টিই হত, এত বড় বিটাও তো বন্ধুই হয় বটে, না কি বলো।’
বুড়া বলে, ‘নিশ্চয়, তা বটেই তো, বিটা বড় হলে বাপ-বিটাতে সমান। আবার মা-বিটিতেও তাই।’
বলে বুড়া রাধার দিকে চোখ ঘুরায়, রাধাও চোখ ফিরিয়ে যেন শত শত খড়কের মতো রেখায় ভরা মুখখানিতে হাসি ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু গানের সঙ্গে খঞ্জনিতে তাল রাখে ঠিক।
অচিনবাবু আবার বলেন, ‘দেখি, দূরে দাঁড়িয়ে গান শুনছেন, আসরে ডেকে নিয়ে এলাম। আমাকে আবার বললেন, ‘আপনাকে চিনতে পারলাম না তো।’ আমি বললাম, না চিনলে কি ডেকে নিতে পারি না। এখানে রসিক ডাকে রসিককে।’
‘জয় গুরু। ভাল, ভাল বইলেছ। এখানে রসিক ডাকে রসিককে। তা তোমার রসিকের বয়স কাঁচা বটে, চোখ দু’খানির ভাব দেখেছ?’
বুড়া আমার দিকে তাকায়, অচিনবাবুও। লজ্জা পেতে গিয়ে একটু অবাক হয়ে চাই। চাইতে গিয়ে চোখ ফেরাতে হয়। অচিনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘দেখিনি আবার, কালো বেড়ালের চোখ গ গোপীদাদা, কালো বেড়ালের চোখ।’ রস্কে বুড়া হেসে কেশে একাকার। মুখ দেখ, যেন দুষ্ট ছেলেটা মাথা দুলিয়ে হাসে। বলে, ‘হেঁঃ হেঁঃ হেঁঃ, অ বাবা, জয় গুরু, জয় গুরু।’ অচিনবাবুও দেখি সেই রকম হাসেন, আর টেরে টেরে তাকান আমার দিকে। আবার বলেন, ‘ঠিক বলিনি গোপীদাদা!’ ‘যথাত্থ ভাই যথাত্থ। তোমার চখ ফাঁকি যায়! আবার দেখ, কেউটে কিলবিলানো চুল থুপি থুপি রয়েছে। কালো বেড়ালের থেক্যেও যেন সি কালো চিতার কথা মনে আসে, ই কালো চিতায় ধইরলে পরে মাইরবে গ আঠারো ঘা, অ তোর এক কলসির নয় ছিদ্দির বন্ধ কর গা যা।’
অচিনবাবু অমনি আবার হাত বাড়ান, ‘বাহ্ গোপীদাদা, বাহ্।’
‘আ ধু-র, তোমার হাত সরাও দিকিনি।’
বলে ও হাত ধরাধরি করে দু’জনে হাসে। রাধা বুড়িও দেখি আমার দিকে চেয়ে চেয়ে ফোকলা দাঁতে হাসে। এদিকে কানা রইল ঘোলায় পড়ে। না-হয় বয়সে অচিনবাবুর থেকে কাঁচা-ই, কিন্তু চোখের ভাবে কালো বেড়াল হতে গেলাম কেন। কালো চিতার বা মর্ম কী। লজ্জা পেলেও অবাক হয়ে চাই, চেয়ে চেয়ে নিশ্চুপে জিজ্ঞেস করি।
কিন্তু সে জবাব কে দেয়। দু’জনেই হাসাহাসি করে, চেয়ে চেয়ে দেখে। অচিনবাবু আবার বলেন, ‘তা হলে ঠিক দেখেছি দাদা!’
‘নিশ্চয়।’
‘আসতে গিয়ে দেখি, একেবারে তন্ময় হয়ে শুনছে, আশেপাশে খেয়াল নেই। আবার দেখি, গোকুলের গান শুনতে শুনতে চোখে ভাব, ঠোঁটে ভাব।’
‘হবেই তো, গোকুলের কথা মনে পইড়ছিল য্যা।’
অই হে, আবার দেখ দুটির কি দুষ্ট হাসির খিসখিসানি। কিন্তু এমন করে ঘোলায় পড়ে থাকা যায় নাকি! নাকি এত শোনা যায়। জিজ্ঞেস করি, ‘কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
বুড়া বলে ওঠে, ‘বইলছে—ললিতে, বেড়ালের চখেতে আগুন, এ বেড়াল মানুষ করে খুন৷’
আবার হাসির ঢেউয়ের দোলা। অচিনবাবু বলেন, ‘আর গোপীদাদা বলছে—এ চিতা রঙে কালো, থাকে কালো, কালাকাল যে মানে না, ঝোপ বুঝে কোপ মারবে যখন, মরবে তখন, মরার কথা জানবে না।’
আবার হাসি, বুড়া প্রৌঢ়ের কাশি জড়ানো চাপা গলায়। তারপরে বোধ হয় বুড়ার একটু দয়া হয়, বলে, ‘বুঝলেন না গ রসিক বাবা, অই যিনি বেড়াল, তিনিই চিতা, বাস করেন ব্ৰজেতে। তা আপনাকে দেখে সি ব্রজের বেড়ালের কথা মনে পড়ে যেছে।’
চোঁখ ফেরাতে গিয়ে দেখি, অচিনবাবু তাকিয়ে সেই রহস্যে নিবিড় চোখে হাসছেন। বলেন, ‘লজ্জা পাবেন না ভায়া, আপনার মধ্যে একটু ভাবের কারবার আছে তাই বলছিলাম আর কী। আসুন, চলবে?’
বলে গরম পাঞ্জাবির পকেট থেকে চুরুট বের করে দেন। কেবল বয়সের বড়ত্ব না, অত বড় জিনিসটা দেখে হঠাৎ হাত বাড়াতে সঙ্কোচ হয়। তাড়াতাড়ি বলি, ‘থাক না, আমার কাছে সিগারেট আছে।’
‘তা তো থাকবেই, যার যাতে মৌতাত। তবে নেশাখোরদের একটা বদ স্বভাব কি ভায়া, নিজের মৌতাত পরকে আস্বাদ করিয়ে সুখ পায়। আপনার যদি ভাল লাগে, তবে একটা নিন।’
অমনি গোপী বাউল আওয়াজ দেয়, ‘আমাদিগের অচিনবাবুর তাইতে সুখ।’
ঘাড় দুলিয়ে হাসেন অচিনবাবু বলেন, ‘হ্যাঁ।’
হাত বাড়িয়ে নিই। মন্দ কী, রাঢ়ের এই পৌষের দিনে, খড়ের চালের ছায়ায়, ঠান্ডায় জমবে ভাল। মুখের কাছে তুলে ধরতে অচিনবাবু নিজেই দেশলাই জ্বালিয়ে ধরেন। তখন আবার বুড়া ঘাড় নাড়িয়ে, দাড়ি কাঁপিয়ে হাসে। বলে, ‘একটু বেমানান লাগছে যে গ অচিনবাবু, অত বড় জিনিসটা অমন কাঁচা মুখে।’
‘সে কি গ গোপীদাদা, নেশাতে হল রসের শোভা, এখানে দেখতে শোভার কথা কী।’
‘তা বটে, তা বটে।’
দু’জনেই চোখে চোখে চেয়ে হাসে। তখন আমি সঙ্কোচে হেসে বলি, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘একটা কেন ভায়া, হাজারটা হোক না, কী কথা?’
‘আপনার নামটা অদ্ভুত, এরকমটা এর আগে শুনিনি।’
অচিনবাবু হেসে বলেন, ‘অদ্ভুত করেছে লোকে, আসলে আমার নাম হল অচিন্ত্য মজুমদার। ছিলাম অচিন্ত্য হয়েছি অচিন, তা সে যখন থেকে এই শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছি, তখন থেকেই ওই নাম।’
‘ও, আপনি বুঝি এখানেই থাকেন?’
বুলি একটু ভিন ধরনের, শুনলে টের পাবে। বলেন, ‘একদা ছিলাম, শিশু থেকে যৌবনে পড়া পর্যন্ত পড়াশোনাটা এখানেই হয়েছিল। বলতে পারেন, গুরুগৃহে যাপন। ছেলেবেলায় এসেছিলাম পাঠ ভবন থেকে, বিদ্যাভবন অর্থাৎ ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে আর এক জীবনের পথে। এখন যে কোথায় থাকি, ঠিক করে বলাই মুশকিল, আপাতত এসেছি লখনউ থেকে। চাকরি করি সরকারি, বিশ্রাম নেবার কথা তিন বছর আগেই, কর্তারা ছাড়েননি। তবে সেখানেই থাকি, এ সময়টা এখানে না এসে থাকতে পারি না। আসলে—।’
কথা থামিয়ে চুরুটে বারেক টান দেন, ধোঁয়া ছেড়ে ধোঁয়ার আড়াল থেকে নিজের মনেই হাসেন একটু। কথার খেই ধরে আবার বলেন, ‘আসলে প্রথম জীবনে ফিরে আসা। না-হয় বলতে পারেন ওপারেই বসত, এ পারে মাঝে মাঝে ঘুরে যাওয়া। আরও যদি বলেন, তা হলে বলতে হয়, একদা জীবন যৌবন দুই-ই ছিল, সেটা মনে করতে আসা…।’
যেন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, না বলে শুধু হাসলেন। এবার দেখ মুখের রেখার ভাঁজে ভাঁজে কত হিজিবিজি লেখা। গূঢ় ভাষায় কত অক্ষর হাসি-হাসি মুখখানিতে কেঁপে কেঁপে যায়। ঢুলুঢুলু চোখের আনমনা দৃষ্টিতে যার ভাষা সে-ই পড়ে, তোমার কাছে দুর্বোধ্য। কেবল এইটুকু মনে হয়, এই হাসির ওপারে কোথায় যেন তারের ওপরে ছড়ের টানে ঢেউ খেলানো সুর বেজে যায়। যেমন সহজেতে অসহজের ঘূর্ণি খেলে। সেখানে অচিনবাবুর অচিন খেলা করে।
ডাগরা বাউল তখন বাঁয়াতে ডুপ্ ডুপ্ শব্দ তুলে কোমর দুলিয়ে গাইছে,
মানুষ ডোবে, মানুষ ভাসে,
মানুষ কাঁদে, মানুষ হাসে,
মানুষ যায়, মানুষ আসে।
কেবল কর্ম প্রকাশিতে।
অ ভোলা মন, মানুষে মানুষ আছে…
কয়েকজন জয়গুরু ধ্বনি দিয়ে ওঠে। অচিনবাবু বলেন, ‘এই তো একমাত্র কথা। তা ভায়ার—।’
আবার ঠেক, কথা শেষ করতে পারেন না। ডাগর বাউল তার আগেই হাঁক দিয়ে ওঠে, ‘অই গ অচিনবাবু, অই একখানা চাই কিন্তু।’
বলে দু’ আঙুল ঠোঁটে ছুঁইয়ে ধূমপানের ভঙ্গি করে। অমনি অচিনবাবু ধমকে ওঠেন, ‘ধু-র, বাউল আবার চুরুট খাবে কী রে। তোরা খাবি গাঁজা।’
অমনি সকলের হাসি। সেখানে অনেক যুবা কবি-সাহিত্যিকেরও ভিড়। দেখলে চিনতে পারবে। সবাই কলম বাগিয়ে ধরে গান লিখে নিচ্ছে। সকলেই হাসাহাসি করে। বুঝতে পারি, এ আসরে অচিনবাবু পালের গোদা। এর মধ্যেই সকলের চেনা মানুষ তিনি। সকলের মুখ দেখলে বুঝতে পারি। বাউলদের তো কথাই নেই। বুড়া বাউলের পায়ে হাত দিতে যান, ছোকরাকে করেন তুইতোকারি। এ তো ঘরের ঘরী, দলের দলি না হলে হয় না।
ডাগরা বাউল পাগড়ি ঝাঁকিয়ে তাকায় সেই ডাগরী মেয়ের দিকে। বলে, ‘অই লও, শইনছ গ তোমার অচিনদার কথা।’
ডাগরী মুখ ফিরিয়ে টানা-টানা ভুরুতে আরও টানা দিয়ে হাসে অচিনবাবুর দিকে চেয়ে। অচিনবাবু বলেন, ‘তা কি মিথ্যা বলেছি নাকি গ বিন্দু।’
মেয়ে একবার তাকায় বাউলের দিকে, আবার অচিনবাবুর দিকে। কালো চোখের তারা ঘুরিয়ে বলে, ‘জিজ্ঞেস করেন ক্যানে, গাঁজা কী বস্তু। কথা আপনি ঠিক বইলেছেন দাদা, বাউল ক্যানে চুরুট খাবে।’
ততক্ষণে বাঁয়াতে তাল লেগেছে, একতারাতে বঙ্বঙ্। পাশের মানুষের দোতারাতেও সুর বেজে ওঠে। ডাগরা আগে বলে, ‘তবে গাঁজার কথাই শোনেন, গাঁজাকে ছোট কইরতে পারবেন না গ।’
বলেই যেন ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে সবাইকে ডাক দেয়, আর গায়,
‘অ ভাই, এইস প্রেমের গাঁজা খাবে কে।’
প্রথমে অচিনবাবুই হাঁক দিয়ে ওঠেন, ‘হরি বোল! হরি বোল!’
ডাগরা বাউল এক পাক ঘুরে চোখ আধবোজা করে গায়,
অ হে, ধইরচে নেশা, ঘুচবে বাসা,
লও আশয় ধম্মো কলিকে,
অ ভাই, এইস প্রেমের গাঁজা খাবে
রাগেরো খরসান দিয়ে
মধুর রসের জল মিশায়ে
গোলাপ তক্তি নীচে থুয়ে,
রিপুকে কাট প্রেম-কাটারিতে।’
আবার অচিনবাবু হরিধ্বনি দিয়ে ওঠেন। ডাগর বাউল নাচে ধিতাং তিতাং। গেয়ে বলে,
‘কিন্তুক, কলকেয় দিয়ো ঠিকরে
লইলে পড়ে যাবে ঠিকরে,
ঠিক ছাড়া হয়ো না ভাই
কাজের কথা বলি তোমাকে।’
অচিনবাবু বলেন, ‘বল্ বল্ শুনি।’
ডাগরা চোখ ঘুরিয়ে দু’ হাতে কলকে ধরার ভঙ্গি করে গায়,
‘সাঁপিখানি করে লয়ে
কলকের তলাতে দিয়ে
প্রেমের গাঁজা খাও পিয়ে হে
নিষ্ঠা দম রেখে গুরুরো পদে।’
অমনি অচিনবাবু দাঁড়িয়ে উঠে ধ্বনি দেন, ‘হরি বোল হরি বোল।’
বলে জামার ঝোলা-পকেট থেকে বের করেন কাঠের বাক্স। তার ভিতর থেকে মুঠো করে তোলেন অনেকগুলো চুরুট। হাত বাড়িয়ে বলেন, ‘এই নে, এই নে, জবর শুনিয়েছিস।’
সভাসুদ্ধ হাসির লহর। ডাগরী বিন্দু বলে, ‘হার মানলেন নাকি গ দাদা।’
‘হার মেনেই তো জিতলাম, না হলে কি গান বেরুতো তোর পুরুষের।’
অমনি ডাগরীর চোখের পাতায় লজ্জা, নত করে হাসে। আবার ডাগরার দিকে চায় আড়ে আড়ে।
অচিনবাবু বলেন, ‘এবার তোর আর গোকুলের গলায় গান শুনব, ধর।’
.
৪১.
অচিনবাবুর কথা শুনে শ্রোতার দলে আওয়াজ ওঠে, ‘সাধু সাধু, সাধু সাধু।’ কেবল সেইটুকুতেই সব না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যাত্রার পালার মতন জয়ধ্বনি দেয়, ‘জয় অচিনদার জয়।’ অন্যে কেউ বচন দেয়, ‘অচিনদা নইলে এসব হয় না।’
এক যুবা বলে ওঠে, ‘আমি তো কখন থেকে ভাবছি, অচিনদার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন।’
অচিনবাবুর জবাব দেন, ‘কী করি বলো। সকালবেলা পুরনো বন্ধুরা অনেকে এলেন। আমি গেলাম কারুর কারুর বাড়িতে। এই দেখাশোনার পালাতেই যা একটু দেরি হয়ে গেল। তাও তো সরকারি বেসরকারি ভি আই পি, একজিবিশনের দ্বারোদঘাটন, ওসব কোনওরকমে কাটিয়ে এসেছি। পৌষ মাসে আসার কারণ ওসব তো নয়। নতুন পুরনোয় একটু দেখাশোনা, আর এই আসরটিতে এসে বসা। ওরে, এই তো সবে শুরু, খুব দেরি করিনি।’
বলে আবার আওয়াজ তোলেন, ‘ও গোকুল, ও বিন্দু, তোরা ধর গো ত্বরা করে।’
যাদের সঙ্গে যেমন কথা। অচিনবাবুর কথার এদিক ওদিক পাবে না। যেন গানের ভাষায় ভাসেন। চেনা-শোনাদের মধ্যে এমনি কথা। আমরা যারা অচেনা, তারা এঁদের দিকে চেয়ে খুশি মনে হাসি।
ওদিকে দেখ, বিন্দু কেমন লাজে লাজিয়ে যায়। এ কেমন বাউল প্রকৃতি হে। দেখি, ডাগর চোখের কালো তারায় যেন গৃহস্থের যুবতী বধু হাসিতে ব্রীড়াময়ী। লালপাড়ের ছোপানো শাড়িতে একটু ঘোমটা টেনে দেয়। তবু, সিঁদুরের টিপ কাঁপিয়ে চোখের কোণ দিয়ে বারেক দেখে অচিনবাবুকে, বারেক পুরুষ গোকুলকে।
গোকুলেরও সেই দশা। ডাগর বাউলের আলখাল্লা টানটান, কোমরে বাঁধন জোর কষা। বুকের ছাতি দেখ, যেন লোহায় পেটানো। পেটের কাছে এক ছিটে মাংস নেই। সে একবার বিন্দুর দিয়ে চেয়ে হাসে, আবার অচিনবাবুর দিকে। দুটিতে বড় লজ্জায় পড়েছে।
তখন বিন্দু বলে, ‘আমরা তো পলায়ে যেইছি না, আর সবাইকে বলেন না ক্যানে।’
অচিনবাবু বলেন গোপীদাস বাউলকে, ‘এই দেখ তো গোপীদাদা, বাদ যাবে নাকি কেউ। সবাই গাইবে, সবাইকেই বলব। তোরা দু’জনে শোনা না একখানা।’
গোপীদাস বলে, ‘এতে আবার কথা কী আছে। বইলছেন, গাও।’
আরও কয়েকজন ঘাড় নাড়ে। অচিনবাবু হঠাৎ আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘আমার এই ছোকরা বন্ধুকে তোমাদের গান একটু শোনাতে চাই। গোপীদাদা বললে কিনা, ইটির চোখ নাকি একটু কেমন চিতাবাঘের মতো।’
বুড়া তাড়াতাড়ি দাড়ি কাঁপিয়ে বলে, ‘আর তুমি যে বইললে কালো বেড়ালের মতন।’
অমনি গোকুল বিন্দুর দল সবাই হাসিতে বেজে ওঠে। সবাই, কেউ সোজায়, কেউ তেরছায় চায়। আর আমি ভাবি, ই কি বিপদে ফেলেন গ অচিনবাবু। প্রীতি ও সম্মান বুঝতে পারি, কিন্তু এতটা তার যোগ্য নই! দশজনের সামনে লজ্জায় পড়তে হয়।
অচিনবাবু হাসতে হাসতে আমার পিঠ চাপড়ান, তারপরেই হঠাৎ হেঁকে ওঠেন, ‘না না না, ওরে বিন্দু, তোর ওই চোখে এ চিতা শিকার করিস না। চোখ ফেরা, চোখ ফেরা।’
বিন্দু তৎক্ষণাৎ ঘোমটায় একটু টান দেয়, সলজ্জ হেসে আওয়াজ করে, ‘আহ্ কী কথা গ।’
আবার সবাই হাসে। অচিনবাবু হাসেন গোপীদাসের দিকে চেয়ে। যেন বুড়া প্রৌঢ়া দুটিতেই ছেলেমানুষি বিটলেমিতে মাতে। আর আমার শ্রবণে আগুন। মহাশয়ের উপহাসের ধাত বড় কড়া। বড্ড বেকায়দায় ফেলে দেন।
আসর কিন্তু বেশ জমজমাট। সবাই মেলার হাসি হাসে। অচিনবাবু আবার আমার পিঠে চাপড় মেরে গলা নামিয়ে বলেন, ‘ভায়ার রাগ-টাগ হচ্ছে না তো।’
এবার আমারও একটু মুখ খুলতে ইচ্ছা করে। বলি, ‘রাগ নয়, অনুরাগই বলতে পারেন, তবে বড় লজ্জা করছে।’
তিনি দু’ হাত দিয়ে আমার দু’ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা। তা হলে অনুরাগও পেয়েছি। যাক, আর লজ্জা দেব না। কিন্তু ভায়া—’
এই পর্যন্ত বলে গলা আর একটু নামান। কানের কাছে মুখ এনে বলেন, ‘বলেছি কিন্তু সত্যি। তোমাতে আমাতে কথা, বলো তো, বিন্দুর চোখে চিতা শিকার হয় কি না হয়।’
বলে উঠি, ‘শতবার।’
‘হরিবোল!’ হাসতে হাসতে তিনি আবার কাঁধে চাপড় দেন। ইতিমধ্যে বাজনা বেজে ওঠে। একতারাতে বঙ্বঙা, বাঁয়াতে ডুগডুগ। তার ওপরে বাঁ হাতের কব্জিতে গোকুলের ঘুংগুর বাঁধা আছে। সেখান থেকেও শব্দ বাজে, ঝুমঝুম ঝুমঝুম।
কিন্তু অচিনবাবু হরিবোল ধ্বনি দিয়ে, ধূসর কেশে ঝাঁকি দিয়ে, ঘাড় কাত করে তাকাল বিন্দু-প্রকৃতির দিকে। বিন্দুও দেখি, ঠোঁট টিপে হাসে। চোখের কোণ দিয়ে তাকায় অচিনবাবুর দিকে। এই চোখে চোখে চাওয়াচাওয়িতে যে কোন রসের ধারা বহে, বুঝতে যদি চাও, মন ধুয়ে এসো গিয়ে। প্রাণ সাফ করে এসো। তবে, অচিনবাবুর ছোকরা বন্ধুর মনেতে গোল। সে চোখ ফিরিয়ে রাখে, পাছে বিন্দুর তেরছা নজর বিন্ ইচ্ছেতেও তার ওপরে হেনে যায়। তাতে শিকার করা হবে কিনা জানি না, পুরুষটা কুঁকড়ে যেতে পারে।
অচিনবাবু আবার হাঁকেন, ‘কই গ বিন্দু, হাতে যন্তরখানি ধরো।’
বিন্দু মুখে জবাব দেয় না, ঠোঁট টিপে হাসে। মুখ না ফিরিয়েই ঘাড় নেড়ে জানায়, ধরবে। তারপরে গোকুলের দিকে চেয়ে দুটিতে হাসাহাসি করে। সেই হাসিরই এক টুকরো বিন্দু আর একজনকে ছুড়ে দেয় একটু। সে-ও এক ডাগরা বাউল, সেই দোতারাওয়ালা। গোকুলের থেকে তার বয়স বেশি না। চেহারায় হরে-দরে গোকুলের কাছাকাছি। তবে কি না, তার নয়া গোঁফদাড়িতে যেন একটু বেশি চাকন-চিকন। সন্দ লাগে, এ বাউলের চোখেতে যেন একটু কাজলের টান লেগেছে। পাগড়িটি একেবারে চুড়ো হয়ে উঠেছে, প্রায় যেন শিখিপুচ্ছের মতো, বেঁকে দাঁড়িয়েছে ছোট একফালি।
বিন্দু তার দিকে চেয়ে হাসতেই সে ঘাড় দুলিয়ে দোতারায় আঙুল বুলায়। সুরের তরঙ্গ বেজে ওঠে। তখন অচিনবাবু বুড়া গোপীদাসকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এ বাবাজিটিকে নতুন দেখছি। কার বিটা?’
গোপীদাস বলে, ‘আমাদিগের কারও বিটা লয়। ছেল্যাটো এসেছে পাকিস্তান থেকে, অই কী বলে তোমার সি উত্তর দেশ থেকে। আমাকে বাবা বাবা বলে, আমি লিয়ে এসেছি। গত সনের জয়দেবের মেলায় দেখা হয়েছিল। থাকে সেই হুগলির কোথায়, চিঠিপত্তর লেনাদেনা করে। তা ভাবলাম, ইখানেতে একবারটি ঘুরে দেখে যাক, তা-ই লিয়ে এসেছি। গায় ভাল, বাজায়ও ভাল। বিন্দু গোকুলের সঙ্গেও জয়দেবেতেই চেনাশোনা।’
জয়দেবের মেলা হল কেন্দুবিল্ব গ্রামে, যার ডাক নাম কেঁদুলি। বাউল বলে, ‘জয়দেবের মেলা, জয়দেবেতে যাব।’ বাউল বলে, ‘জয়দেব পরম বাউল—পদ্মাবতী পরমা প্রকৃতি।’ ‘যে মানুষে গোঁসাই বিরাজ করে’। জয়দেব সে-ই মানুষ। অতএব বলো, কেঁদুলি বলে কী কথা হে। বলো, জয়দেব জয়দেব। সাধো, পদ্মাবতী। সে-ই দুয়েতে খেলেছে খেলা, মণিপুরে, যেথায় ‘তিন শো ষাট রসের নদী, বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেদি, সেই নদীতে প্রাণ বান্ধিলে মানুষ ধরা যায় রে।’ জয়দেব সেই নদীতে প্রাণ বেঁধেছিলেন, বাউলের এই বিশ্বাস, পরে জেনেছি।
অচিনবাবু বলেন, ‘বাজায় যে ভাল, সে তো প্রথম থেকেই শুনছি। ভঙ্গিটঙ্গিও বেশ সুন্দর।’
বুড়া বলে, ‘হাঁ, বয়স কাঁচা কিন্তু মনে মনে বেশ মজে আছে। মনে হয়, ছেল্যাটার ওপর গুরুর কিরপা আছে।’
অচিনবাবু কেবল গুরুর কৃপা দেখেন না। বলেন, ‘তবে কিনা গোপীদাদা, তোমার সেই চিতা-চিতা ভাবখানি কিন্তু আছে।’
বুড়া অমনি হেঁ-হেঁ করে হেসে বলে, ‘জয় গুরু জয় গুরু। তোমার কী কথা হে অচিনবাবু!’
তারপরে চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘তা সিটিও জানবে, খাঁটি বাউলের ধম্মো গ। চিতা না হলে কি শিকারের সাধন সাধা যায়। সেই গানেতেই তো আছে, চিতা শোষে কুম্ভকে, হাঁকোড়ে মদন কুহকে, হাড়েতে দাঁত বসিয়ে রক্ত খায়, ছিটা গন্ধ পাবে না।’
অচিনবাবুও অমনি বুড়ার মতোই আওয়াজ দেন, ‘জয়গুরু জয়গুরু।’
বলে দু’জনাতে চক্ষে চক্ষে চায়, যেন কী এক রসের ধারা আনাগোনা করে। কান পেতে শুনি, চোখ চেয়ে দেখি, কিন্তু ধারা ধরতে পারি না, ভাসতে পারি না। আমার দিকে চেয়ে অচিনবাবু সে কথা বুঝতে পারেন। তা-ই বলেন, ‘ভায়া নিত্য কথায় তত্ত্ব ভাষে বোঝা একটু কঠিন। পরে বুঝিয়ে দেব।’
না বুঝলেও ক্ষতি নেই। অবুঝ বোঝার মধ্যে যে এক ভাবের খেলা আছে, আমি সেই ভাবেতে আছি। যা শুনছি, যা দেখছি, তার মধ্যে গূঢ় রসের ধারা কোথায়, জানি না। মুক্ত রসের মাঝেও এক খেলা খেলছে, আমি তাতেই মজে যাচ্ছি।
অচিনবাবু আবার জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দেশের এই বাবাজিটির নাম কী গোপীদাদা?’
‘সোজন।’
অচিনবাবু বলেন, ‘সোন্দরের মতন নাকি? সুজন বলো।’
‘অই হল আর কী। আমাদিগের কথা তো জানো।’
দু’জনেই হাসাহাসি করে। অচিনবাবু আবার বলেন, ‘তা হলে সুজন বাবাজির গান শুনতে হয় এর পরে।’
‘শুনবা বই কী, গলাখানি যেমন দরাজ, তেমনি মিঠা। তবে, একটু টান আছে, জম্মের টান।’
‘উত্তর দেশের টান?’
‘হ্যাঁ।’
ওদিকে তখন বাজনা জমে উঠেছে। বিন্দু তার সামনে রাখা ঝোলায় তখন হাত ঢুকিয়েছে। তারপরেই কালো নিটোল একখানি হাত একেবারে মাথার ওপরে তোলে, যেন কালো চিকন চিকুর হানা কালনাগিনীর ফণা উঠল উঁচুতে। হাত ঝাঁকি দিতেই ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে বাজনা। দেখ, তার তালেতে, গেরুয়া ছোপানো জামাখানি সহ যেন অঙ্গের লাবণ্যখানিও বেজে ওঠে। আর সাদা দাঁতের ঝিলিক দিয়ে, কালো তারায় হানে একবার অচিনবাবুকে। অর্থাৎ দেখেন গ অচিনদাদা, যন্ত্র হাতে নিয়েছি।
কিন্তু তাইতে কি আর অচিনবাবুকে হার মানানো যায়। তিনি হেসে উঠে হাঁকেন, ‘ওরে মেয়েটা শোন—প্রেমজুরিতে প্রেম বাজে না, প্রেমেতে প্রেমজুরি বাজে।’
এবার গোকুলই ধ্বনি দিয়ে ওঠে, ‘জয়গুরু, জয় সাঁই।’
তখন আর বিন্দু না বলে পারে না, ‘আপনার সঙ্গে কি কথায় পারার জো আছে।’
অচিনবাবু বলেন, ‘কাজে পারলেই হবে।’
আবার সেই কথা, কথা কইতে জানলে হয়, কথা ষোলো ধারায় বয়। এখানেও সেই কইতে জানার বহা-বহি। সবাই শ্রুতি মুখে হাসে।
গোকুল গান ধরে দেয়,
‘অহে বল না, কেমনি করি শুদ্ধ সহজ প্রেম সাধন।
আমার, প্রেম সাধিতে ফেঁপে উঠে—
ফেঁপে উঠে হে কাম নদীর তুফান,
কেমনে করি শুদ্ধ সহজ প্রেম সাধন।’
এই পর্যন্ত গেয়ে, কেবল বাজনা বাজতে থাকে। গোকুল নাচে ঘুরে ঘুরে, চোখ ঘুরিয়ে অচিনবাবুর দিকে। তার সঙ্গে দোতারা নিয়ে নাচে উত্তরের সুজন। বিন্দুর মুখে হাসি নেই, কিন্তু কেমন যেন ভাবে ঢল ঢল। দু’ হাত বুকের কাছে নিয়ে, দু’হাতে বাজায় প্রেমজুরি, ঝিপ্ ঝিপ্ ঝিনঝিন। অচিনবাবু গোকুলের দিকে আধবোজা চোখে চেয়ে কেমন যেন এক ভাবের ইশারা করেন।
বিন্দুর গলা বেজে ওঠে। কোকিলের ডাক শুনেছি সপ্তমে, বেহালার সুর শুনেছি উচ্চ টংকারে। কোনটি যে তার গলায় ফুটল, বুঝতে পারি না। কোকিলের কথা আগে মনে আসে। মুখের কাছে যন্ত্র নিয়ে, যান্ত্রিক আওয়াজ না। এ যেন গাছে বসে পাখির শেষ রাগিণীতে ডাক:
‘অ ভোলা মন, প্রেম রতন ধন পাওয়ার আশে
তিবিনায় ঘাট বাঁধলাম কষে।’…
সঙ্গে সঙ্গে গোকুল, সেই গলাতে গলা মিলিয়ে দেয়,
‘কাম নদীর এক ধাক্কা এসে
হায় হায়, যায় ছাঁদন বাঁধন।
করি কেমনে শুদ্ধ সহজ প্রেম সাধন।’
এ যেন সাধা গলায় সুর সাধা। গলায় গলায় মিল না কেবল। একবার দেখ, কেমন চোখে চোখে মিল। সুরে টান দিতে গিয়ে, বিন্দুর ভুরু একটু বেঁকে যায়, নজর দূরের দিকে। তারপর হঠাৎ হঠাৎ মিলে যায় গোকুলের সঙ্গে। বারেক সুজনের সঙ্গে। আর উত্তরিয়া সুজন যেন পেখম খোলা ময়ূর। দোতারা বাজিয়ে, পাক দিয়ে দিয়ে ফেরে গোকুল বিন্দুকে।
সবাই তন্ময় হয়ে শোনে, তালেতে শরীর দুলিয়ে শোনে। লিখনে যারা গান লেখে, তাদের নজর কেড়ে নেয় তিনটিতে, বেচারিদের কলম চলে না। মন ভেসে যায়, চোখ ভেসে যায় তার আগে আগে। বুড়া ধ্বনি করে, ‘জয়গুরু’, আর অচিনবাবু বলে ওঠেন, ‘হায় হায় হায়।’
এখন বিন্দু এদিকে ফিরে চায় না। সেই আবার একই সপ্তমের টানায় ধরে,
‘বলব কি সে প্রেমের কথা,
কাম হইল প্রেমের লতা’…
গোকুল ধরে,
‘কাম ছাড়া প্রেম যেথা সেথা
নাই রে আগমন।’
এবার গোপীদাস আর রাধা প্রকৃতি, দুই বুড়া বুড়িতে একসঙ্গে ধ্বনি দিয়ে ওঠে, ‘জয় গুরু, জয় গুরু।’ আর অচিনবাবুই অবাক করেন বেশি। একেবারে গোকুল বিন্দুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে, ধরতাইয়ে সুর দেন, ‘করি কেমনে শুদ্ধ সহজ প্রেম সাধন।’
তাঁর গান শুনে সকলেরই মাতন লাগে বেশি। গায়ক-গায়িকা দু’জনেই ফিরে তাকায়। কিন্তু যদি ঠিক দেখে থাকি, অচিনবাবুর গোরা মুখে যেন কেমন এক লালের ছোপ ধরে গিয়েছে। চক্ষু ছলছল। সেখানে চোখ ঘোরানো হাসির ঝিলিক আর নেই।
আর আমি দেখি, গায়ক গায়িকা গান করে না শুধু। যেন চোখে চোখে আর কিছু ভাষে। সেই ভাষাটা বুঝতে পারি না, তা-ই ভাবি, গেরুয়া ছোপানো আলখাল্লা জড়ানো এই বাউল বৈরাগীরা এ কোন কথা বলে, ‘কাম ছাড়া প্রেম যেথা সেথা, নাই রে আগমন।’ অথচ এমন করে বলে। এমন সুরে সুরে, হেসে হেসে, এমন স্পষ্ট করে, যেন কাম, কাম না, প্রেমের আর এক নাম। অধর কথা, ধরতে পারি না, কেবল তানে মানে লয়ে মজে, অবাক হয়ে শুনি, আর মনের মধ্যে কোথায় যেন, এক নাম-না-জানা সুর বেজে যায়।
বিন্দু আবার ধরে,
‘পরম গুরু প্রেম পিরিতি
কাম শুরু হয় নিজ পতি।’…
গোকুল গায়,
‘অ ভোলা মন রে আমার, কাম ছাড়া প্রেম
পাই কি গতি
তাই ভাবতেছে লালন।
করি কেমনে শুদ্ধ সহজ প্রেম সাধন।’…
আবার জয়গুরু জয়গুরু, হরিবোল বেজে ওঠে। অচিনবাবুর গলায় যেন স্বপ্নের আবেশ। বলেন, ‘থামিস না গোকুল, আজ মাত করেছিস ভাই। এ গান তোর বাবার মুখে ছাড়া আর শুনিনি।’
আর আমার মনে হয়, জীবনের কী এক অরূপ খেলার আসর এখানে জমেছে।
.
৪২.
অরূপ খেলার আসর তো আর এমনি এমনি জমে না। ভাবের ভাবী না হলে কি ভাব জমে! রস না থাকলে, কী পিয়ে আর রসিক হে। এখানে গায়ক-গায়িকা আর শ্রোতায় মিলে অরূপ খেলা জমেছে। ছাতিমতলার মেলায় এখানে, বাউল আসরে, সকলের ভাব লেগেছে। যারা গায়, তাদের। যারা শোনে, তাদেরও।
ভূমি বিনে গাছ জন্মে না। দেহ বিনে প্রাণের আশ্রয় নেই। এখানে তেমনি, শ্রোতা মাতায় গায়ক-গায়িকাকে, তারা মাতায় শ্রোতাদের। গোকুল-বিন্দু একের পর এক গান গেয়ে যায়। ততক্ষণে গোপীদাস একজনকে ডেকে একটু ছিলিম সাজাতে বলে।
গোকুল-বিন্দুর গানের সব হিসাব দিই এত আমার স্মৃতিশক্তি নেই। তবু স্মৃতি ঘেঁটে দু-এক কলি স্মরণ না করে পারি না। যেমন:
‘সে ফুল মিলতে পারে
মালীর বাগানে
আমার গোঁসাই বই
আর কে জানে।’
স্মৃতি কি কেবল কথার স্মরণে। দর্শনের পটে আঁকা পড়ে রয়েছে যা, স্মরণ সেই কারণেও। বিন্দু যখন এই কলি কয়টি গেয়েছিল, তখন সে গোকুলের দিকে চেয়ে হেসেছিল। আর গোকুল কেমন ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে, ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে বলেছিল,
‘সে ফুলে যায় না ভমর
গন্ধে অমর
দুগ্ধ ভমরী সনে!’…
কথার মর্ম বোঝা দায়, নর-নারীর ভাবের মর্ম বুঝি। মনে হয়েছিল যেন চোখের সামনে ইশারায় ইশারায় কথা কয় ডাগর-ডাগরী। কথা বুঝতে পারি না, তবে দুয়ের মাঝে যে এক পরম লেনা-দেনা চলছিল তা বুঝতে পারি। বাউল বৈরাগী বুঝি না, দেখেছিলাম, গোকুলের চোখ-মুখের ভাবেতে পুরুষ, হাতে-পায়ে ভঙ্গিতে পুরুষ। আর বিন্দু এক মেয়ে। কখনও লাজে লাজানো ডাগর চোখের পাতা ভারী। হাসি চাপতে গিয়ে প্রেমজুরি দু’খানি মুখের সামনে এনে মুখ আড়াল করা।
কেবল কী তা-ই! সুজন মাঝে মাঝে দোতারা সহ নিচু হয়ে দু’ এক কথা কী যেন বলছিল বিন্দুর কানের কাছে। তখন শ্যামাঙ্গিনীর মুখখানি রক্তচ্ছটায় ঝলকায়নি। লজ্জাদ্যুতির রং সে মুখে আলাদা। একবার তো প্রেমজুরি তুলে বিন্দু সুজনকে মারের ভঙ্গি করেছিল। মনে আছে তখন গোকুল ভিন গানের ভিন কথায় আওয়াজ দিচ্ছিল,
‘অ ভোলা মন, রতির ঠিক না হইয়িলে
সতীর কিরপা হবে না
রতির ঘরে পতি বাঁধা,
একবার খুঁজে দেখ না।’
ওদিকে যখন এই চলেছে, তখন দেখ অচিনবাবুকে। ক্ষ্যাপা বাউল আর কাকে বলে। কেবল যে গলা ছেড়ে ধ্বনি তা না, মাঝে মাঝে যেন ভাবের রসে ডুব ডুবানো।
এদিকে হাতে হাতে কলকে ঘোরে, ‘আয় ভাই, কে খাবি প্রেমের গাঁজা।’ গোপীদাস আমাকে কলকেটি দেখিয়ে ডগডগে চোখে ইশারা করে, চলবে নাকি। টুকুস ইচ্ছা যে না হয় তা বলতে পারি না। তার আগেই অচিনবাবু হাত তুলে গোপীদাসের হাঁটুতে চাপড় মারেন, ‘আর চিতা মজিয়ো না।’
পর পর পাঁচখানা গানের পর গোকুল-বিন্দু থামে। রাঢ়ের পৌষালী শীতেও দেখ বিন্দুর শ্যামা মুখে ঘামের বিন্দু। গোকুলের পাগড়ির নীচে দিয়ে ঘাম ঝরে।
কিন্তু থামবার জো কোথায়। অচিনবাবু সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ তোলেন, ‘এবার সুজন ধরো, তোমার গান শুনব।’
এখানে সবাই ধনী, কিন্তু কৃপণ না। সুজন দোতারার তারে আঙুল থামায় না। সে অচিনবাবুর দিকে ফিরে মাথা নিচু করে দোতারাটাই কপালে ঠেকায়, নমস্কার। প্রণাম। অচিনবাবু বলেন, ‘জয় গুরু।’
‘তবে, সুজন কিন্তু একলা।’
বলতে বলতে সুজন হাসে। বিন্দুর দিকে তেরছা চায়। বিন্দু সঙ্গে সঙ্গে প্রেমজুরি দেখিয়ে ঘাড় কাত করে বলে, ‘তাল দেব।’
গোকুল বলে, ‘আমিও দেব, ধর ক্যানে।’
আবার শোনো, অচিনবাবুও বলেন, ‘জানা পদ হলে ধরতাইও দেব।’
সুজন আবার তেমনি করে নমস্কার করে। আসর দেখে বোঝা যায়, সবাই মজে আছে। আগের থেকে লোক বেড়েছে অনেক। এমনকী, শহরের হ্যাট-কোট রং-মাখাদের ভিড়ও লেগেছে। বায়স্কোপের তারা ফেলে বাউলের আসরে! জয় গুরু, জয় গুরু।
সুজন দোতারায় সুর তোলে, কিন্তু তার সব তাল যেন বিন্দুর প্রেমজুরিতে। বিন্দু থেকে চোখ সরে না তার। কেন হে, হোথা কি সিন্দূর অশেষ নাকি। প্রায় অন্তর্যামীর মতো অচিনবাবু আমার গায়ে একটু ঠেলা দিয়ে সুজনকে দেখিয়ে হাসেন। বিন্দু দেখে, দেখে দেখে হাসে, আর বারে বারেই গোকুলের দিকে চায়। গোকুলও মিটিমিটি হাসে, ঘাড় দোলায়।
সুজনের গলা একটু মোটা, একটু বেশি মেঠো মেঠো, যেন বাতাসে দোলা উদাসী। অথচ গলার কাজে, ঢেউ দোলানিতে কেমন একটা অনায়াসের হালকা ভঙ্গি। দুয়ে মিলে যেন একটা ঘর-বাহিরের খেলা। যে উদাসী চলে যায় তেপান্তরের বুকে, ডাক দিয়ে যায় সে ঘরের আঙিনায়। সে গান ধরে,
‘মেয়েকে না চিনতে পেরে
ঘটল বিষম দায়
মেয়ে সর্বনাশী জগৎ ডুবায়।
মেয়ে ভজতে পারলে পারে যাওয়া যায়।’
এপার প্রথম আওয়াজ ওঠে গোকুলের গলায়, ‘বলিহারি গোঁসাই।’
ধ্বনি দিতে গোপীদাস বাদ থাকে না, অচিনবাবুও না। শ্রোতা-শ্রোত্রীদের মধ্যেও যেন কেমন একটা ঢেউ খেলে যায়। অনেকেই আরও এগিয়ে আসতে চায়। আমি ভাবি, সুজন বাউল বেছে বেছে গান ধরেছে মনোহরণ। সে গান কোথায় যায়, বচন দেয় কোথায়। এ যেন পালা জমে ওঠে।
সুজন নাচতে জানে ভাল। দোতারা টেনে নামিয়েছে কোমরের কাছে, বেঁকে বেঁকে ঘোরে। বেশি লাফালাফি করে না। অচিনবাবুর দিকে ফিরে বলে, ‘পদ কি জানা আছে বাবু গোঁসাইয়ের?’
অচিনবাবু চোখে একটু ইশারা করে বলেন, ‘না। তোমার কাছে শিখব।’
সুজনের আবার নমস্কার। তারপরে বিন্দুকে একবার দেখে আবার গান ধরে,
‘মেয়ে যাকে পর্শ করে
পাঁজরাকে ঝাঁজরা করে
(যেমন) কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরে
মন, মন রে—মেয়ে কটাক্ষ বাণ হানে যারে
তার—মাথার মণি খসে যায়।
মেয়েকে না চিনতে পেরে,
ঘটল বিষম দায়।’
এবার গোপীদাসের গলা সব থেকে জোর শোনা যায়, ‘জয় সোজন, জয় সোজন।’
সুজনের আবার নমস্কার! কিন্তু বাউল সোজাসুজি কটাক্ষ হানে বিন্দুকে আর ঘাড় নাচিয়ে নাচিয়ে যেন পুছ করে কিছু।
বিন্দু হাসতে গিয়ে চোখ মেলায় গোকুলের সঙ্গে। গোকুল হাসে ঢুলুঢুলু চোখে।
অচিনবাবু গলা নিচু করে আমাকে বলেন, ‘ব্যাটা জবর চিতা বলে মনে হচ্ছে। কীরকম বুঝছ ভায়া?’
অচিনবাবু অনেকক্ষণ থেকেই আর আপনিতেই নেই। অথচ এখনও আমার নাম-পরিচয় কিছুই জানেন না। অবিশ্যি তার দরকারই বা কী। ‘এখানে রসিক ডাকে রসিককে।’ নাম-পরিচয়ের প্রয়োজন কী। বলি, ‘চমৎকার।’
‘কোন দিক দিয়ে?’
প্রশ্ন একটু জটিল লাগে। তবু সহজ জবাব দিই, ‘যেদিক দিয়েই বলুন।’
‘বেশ বলেছ, বেশ বলেছ ভায়া।’
ওদিকে সুজন আবার ধরেছে,
‘সেই ভয়েতে স্বয়ং শঙ্কর
রাখলেন মেয়ে বুকের ওপর
ওরে ভাই—জয়দেব আদি নব রসিক—আর
ছয় গোস্বামী
মাতল মেয়ের সাধনায়।
…ঘটল বিষয় দায়।’…
এবার গোপীদাস অচিনবাবুর থেকেও, আর এক নতুন গলা জোরে বেজে ওঠে, ‘ও অচিনদা, এবার এদের ছাড়ুন, এখন আর নয়।’
অচিনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ফিরে তাকাই। দেখি, গেরুয়া পাঞ্জাবির ওপর সাদা পশমি চাদর জড়ানো চশমা চোখে মাঝবয়সী ব্যক্তি। আসরের ভিড় ঠেলে একেবারে আমাদের কাছাকাছি।
অচিনবাবু প্রথম নজরে যেন চিনতে পারেন না। তারপরে বলে ওঠেন, ‘ওহো, তুমি? কেন, কী ব্যাপার?’
আগন্তুক ব্যক্তি বলেন, ‘গোপীদাসদের কয়েকজনকে আজ আমার ওখানে খেতে বলেছি। বেলা তো অনেক হল।’
‘কি, সে কথা তো গোপীদাদা একবারও বলেনি।’
বলে অচিনবাবু তাকান গোপীদাসের দিকে। রাধা বৃদ্ধা বলে, ‘ভুলে যেছে গ।’
আগন্তুক ব্যক্তি তখন ডাক দিয়ে তাড়া দিচ্ছেন, ‘কই, গোকুলদাস, সুজনদাস, চলুন চলুন, অনেক বেলা হয়ে গেছে।’
আসর মাত করা যেমন কথা আছে, তেমনি আসর পাত করাও কথা হয়। সেরকম ব্যাপারই ঘটে। যে ক’জন নিমন্ত্রিত উঠে দাঁড়ায় তাদের মধ্যে আসল লোকেরা সবাই রয়েছে। গোপীদাস, রাধা, গোকুল, বিন্দু, সুজন। তাদের সঙ্গে আরও দু’জন। তার মানে সবাই, বাকি কেউ নেই।
অচিনবাবু মুখখানি বিকৃত করে বলেন, ‘এই তোমাদের শান্তিনিকেতনের লোকদের দোষ। দিলে তো আসরটা মাটি করে!’
ইতিমধ্যে আসর ভাঙতে আরম্ভ করেছে। বিন্দু কাছে এসে বলে, ‘ক্যানে গ অচিনদাদা, নিজের কি ভোজন সেবন নাই।’
‘আরে ভোজন সেবন তো নিত্যি তিরিশ দিন আছে রে বাপু। এ জিনিস তো নেই।’
গোপীদাস বলে, ‘এই তো যাব আর আসব, সেখানে গিয়ে তো বসে থাকব না।’
তখন আগন্তুক হেসে বলেন, ‘আপনিও চলুন না অচিনদা।’
‘নাঃ, ও তোমাদের শান্তিনিকেতনী ভাব আমার ভাল লাগে না। আসলে তো নিয়ে গিয়ে খান পঞ্চাশ গান লিখে নেবে এদের কাছ থেকে।’
আগন্তুক আবার হেসে বলেন, ‘দাদা নিজেও তা-ই, শান্তিনিকেতনের বাইরে না।’
তবু বিফল মনোরথ ভাব যায় না। অচিনবাবু বলেন, ‘আমার কথা বাদ দাও, সরকারি আমলা, এখন ঘাটে পা বাড়িয়ে বসে আছি।’
আগন্তুকের সঙ্গে নিমন্ত্রিতেরা রওনা দেয়। বিন্দু তখনও অচিনবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে। বলে, ‘ও বেলা দেখা হবে তো?’
অচিনবাবু বলেন, ‘নিশ্চয়ই। আমার এই ভায়ার সঙ্গে তোদের আলাপ করিয়ে দেব, আর এখন দু’জনে আলাপ করব।’
বিন্দু আমার দিকে চায়। চোখের দিকে চেয়ে, ‘আমাদের গান গোঁসাইয়ের ভাল লেগেছে তো?’
অচিনবাবু অমনি চোখ পাকিয়ে বলেন, ‘অ বাবা, ভায়াকে আমার একেবারে গোঁসাই?’
বিন্দুর ডাগর চোখের চাহনি আর গোঁসাই শব্দে আমারও শ্রবণে একটু ঝলক লেগে গিয়েছিল। চোখে মুখে কতটা, নিজে দেখতে পাইনি।
আমার জবাবের আগেই বিন্দু আবার বলে, ‘গোঁসাই গোঁসাই লাগছে কি না!’
‘বুঝেছি, তার মানেই চিতা।’
বিন্দু আর একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। আমি বলি, ‘খুব ভাল লেগেছে।’
অচিনবাবু বলেন, ‘আচ্ছা যা এখন, ও বেলাতে হবে।’
বিন্দু ওর শরীরের লাবণ্যে ঢেউ তুলে চলে যায়। অচিনবাবু বলেন, ‘চলো ভায়া, এবার তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করা যাক।’
.
৪৩.
শূন্য বাউল-আসর ছেড়ে বাইরে এসে আলাপের প্রথম ধ্বনি, ‘ভায়ার কি চা কফি কিছু চলবে?’
বলি, ‘আপত্তি নেই।’
‘চলো তা হলে, নিরিবিলি দেখে বসা যাক।’
মেলায় কোথায় নিরিবিলি পাওয়া যায় জানি না। তবু পাওয়া যায়। কেতা-কায়দার দোকানে না গেলে নিরিবিলিও মেলে। অচিনবাবু তাই উত্তরে যান না; দক্ষিণে পদক্ষেপ করেন। কয়েক পা গিয়েই এক দোকানে ঢোকেন। কফির কথা বলে আসন নিয়ে বসে আলাপের দ্বিতীয় ধ্বনি, ‘ভায়ার নামটি কী?’
নাম বলি। কী যেন বলতে গিয়ে তাঁর ভুরু কুঁচকে যায়। নজর সজাগ করে চোখে চোখ রাখেন। গোরা মুখখানি জোড়া। হিজিবিজি রেখায় জিজ্ঞাসা। বলেন, ‘মানে?’
নামের মানে জানা থাকলেও মানে বলতে হবে কেন জানি না। তার দরকারও হয় না। তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি সেই লেখক নাকি?’
এই প্রশ্নে বড় ব্যাজ। ওটা একটা মোট কথা। তাই নিয়ে আলাপের ইচ্ছা নেই। জবাব দিই, ‘ওই আর কী।’
‘ওই আর কী মানে? তুমি তো বড় পাজি ছেলে হে! এতক্ষণ কথাটা বলনি।’
এ কী যেচে বলার কথা! হেসে বলি, ‘জিজ্ঞেস করেননি তো, তা-ই বলা হয়নি।’
‘থামো হে ছোকরা।’
প্রায় ধমক দিয়ে মুখের দিকে তাকান। দেখি ওঁর চোখে কৌতুকের ঝিকিমিকি, তার সঙ্গে একটু বিস্ময়ের ঝিলিক। বলেন, ‘তা-ই তো বলি, চিতা-চিতা কি আর এমনি মনে হয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে গান শোনার লক্ষণ দেখেই বুঝেছিলাম রসিক-রসিক ভাব। এখন তো দেখছি, বিন্দুর কথাই ঠিক, অ্যাঁ? খাঁটি গোঁসাই একেবারে। আরে বলবে তো!’
বলেই আমার কাঁধে এক চাপড়। এবার হেসে-খুশে বাজেন, ‘বাহ্, এ না হলে আর দৈব। ঠিক মীনটাই ধরেছি।’
ঘাড় বাড়িয়ে আরও বলেন এই অধমের রচিত তুচ্ছ দুই-চারি কেতাবের নাম। মনে মনে বলি, ‘বড় ব্যাজ, বড় ব্যাজ!’ জীবনের পাতায় পাতায় ফিরছি। কী কারণে, কীসের সন্ধানে, তা জানি না। শুধু এইটুকু জানি, এ পাতা পরম পাতা, বইয়ের পাতা না। কে লিখছেন বসে এই পাতা, সে লেখকের নাম জানি না। জগৎ প্রকৃতি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে এখন সেই পরম পাতায় পাঠ চলছে। কাগজের পাতার কথা থাক। সেখানে আমার ভিন পরিচয়। আমি যে কত দুর্বল, অক্ষম, আতুর, কাগজের পাতায় কেবল তারই লিখন। সেথায় আপনাকে না চেনার কান্নাকাটি। সেথায়, হতে চাওয়ার বিড়ম্বনা।
আজ যখন পরমের পাতায় ফিরি, তখন সে পাতার কথা থাক। কিন্তু শোনে কে! অচিনবাবু আওয়াজ দিয়েই চলেন। তুচ্ছ কথাই উচ্চে ভাষেন। গৌরব দান করে গরব করেন। বলেন, ‘চমৎকার। ঠিক মানুষটিই মিলেছে। নাও, এবার কফি খাও। কিন্তু হ্যাঁ হে, তুমি তুমি করছি বলে কিছু মনে করছ না তো।’
‘বড় আনন্দ পাচ্ছি।’
আবার আমার ঘাড় ধরে ঝাঁকানি দেন। বলেন, ‘ছোঁড়া একেবারে রামপেসাদে। তা উঠেছ কোথায়?’
বন্ধুর নাম বলি। পুরো উচ্চারণ করার আগেই বেজে ওঠেন, ‘ও, আচ্ছা, ওদের বাড়িতে উঠেছ। ভেবেছিলাম, সকালবেলাই ও বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে আসি। তা আর হয়ে উঠল না। তুমি গিয়ে বলো, অচিনদার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তা হলেই বুঝবে।’
সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। ছাতিমতলায় ঘরে ঘরে তাঁর আসর যে বেশ জমজমাট, বাউলের আসরে কথাবার্তাতেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। বলি, ‘নিশ্চয়ই বলব।’
অচিনবাবু নিজের মনেই আমার বন্ধু ও বন্ধুপত্নী সম্পর্কে বলেন, ‘বড় ভাল ছেলে-মেয়ে দুটি।’
এমন ভাবে বলেন, যেন আমার বন্ধু দম্পতি সত্যি ওঁর কাছে দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আগে এসেছ কখনও?’
‘না।’
‘এই প্রথম? তা হলে খুবই ভাল লাগবে।’
বলতে বলতে অচিনবাবু অন্যমনস্ক হন। বাইরের লোকের ভিড়ে দৃষ্টি মেলে দেন। কিন্তু বুঝতে পারি, লোক দেখেন না। অন্য কিছু বোধ হয় নিজেকেই দেখেন। তখন জিজ্ঞেস করি, ‘এখানকার সঙ্গে আপনার অনেকদিনের সম্পর্ক, না?’
চোখ ফিরিয়ে চেয়ে হাসেন। বলেন, ‘আর কোথাকার সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলো! তবে গোলমালটা তো জীবনে আগাগোড়াই। অসম্পর্কের দরজায় দরজায় ফিরছি, সম্পর্কের দরজাটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হয়, এই আর কী।’
শোনায় সহজ, কিন্তু তেমন সহজ কথা নয় যেন। বলে হেসে একটা চুরুট ধরান। ধরিয়ে আবার বলেন, ‘তবে তাতে খুব একটা দুঃখ লাগে না। এ শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পর্ক আর কতটুকু। এখন সবই অচেনা। চেনা যারা আছে, তাদের সকলেরই বয়স হয়েছে, অবসর নিয়েছে। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি সব মিলিয়ে আমার সঙ্গে এমন একটা মস্ত ফারাক যে, তারা তাদের অচিনকে চিনতেই পারে না। তাদের কাছে শান্তিনিকেতন হয়ে গেছে আদর্শজীবিকা-গৃহস্থজীবনের মিলমিশ মাখামাখি করা এক জায়গা। আমার ঘর নেই, গৃহস্থও নই। তোমাদের ভাষায় আমাকে কী বলা যাবে, কনফার্মড্ ব্যাচেলর?’
বলে হাসেন। নিবু নিবু চুরুটে টান দিয়ে দিয়ে ধোঁয়া বের করে আবার বলেন, ‘কনফার্মড্ কিনা বলতে পারব না, তবে ব্যাচেলর।’
হেসে আমার চোখের দিকে তাকান। ওঁর বড় কাঁদের চোখে একটু লালের আভাস। সেখানে কেবল যে কৌতুকের ঝিলিক তা বলতে পারি না। সেই যে কাঁদন-ভরা হাসির কথা বলেছি, কেবলি যেন সেইরকম লাগে। এই চোখের আলোর ওপারে কী যেন ছলছল টলটল করে।
কফির পাত্রে চুমুক দিয়ে নিজেই আবার বলেন, ‘কাউকে একটু পেলে কথা বলতে ইচ্ছা করে খুব। মেতে থাকতে ভাল লাগে। কেমন ভাল লাগে, কাদের ভাল লাগে, একটু আগে নিজের চোখেই দেখলে। ওখানে সাহস করে মুখ খুলতে পারি, হাসতে পারি, হাসাতে পারি। সবাই যতটুকু চায়, যতক্ষণ, তারপরে যে অগাধ সময়, তখন তো একেবারেই একলা। তাই বলছিলাম, কাউকে পেলে কথা বলতে ইচ্ছা করে খুব। কিন্তু বলতে চাইলেই বা শুনছে কে! ভাঁটা পড়া রক্তের কথা, তিন কাল পেরিয়ে যাওয়া মানুষের কথা কি কেউ শুনতে চায়?’
‘আমার শুনতে ইচ্ছা করে।’
অচিনবাবু চোখ তুলে হাসেন। আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন, ‘ধন্যবাদ ভায়া, ধন্যবাদ। তা ছাড়া তুমি তো শুনতে চাইবেই। যে শোনে সে-ই তো শোনায়। তোমাকে বোধ হয় একটু বুঝতে পারি। মানে তুমি ব্যক্তিটিকে না, সত্তাটাকে।’
শুনি আর আমার মনের কোথায় যেন একটা অবাকের তির বিঁধে টনটনিয়ে যায়। একটা উদ্বেগ তার সঙ্গে। ভাবি, এ মানুষের যেন মাটিতে পা নেই। এ মানুষের পাখাও নেই ওড়বার। এ মানুষ আছেন কোথায়। কোন সংসারের অচিন পথে ছুটে বেড়াচ্ছেন!
নিজেই আবার বলেন, ‘সেইজন্যেই বলছিলাম, অন্য সব পরিচয় বাদ দিই, সরকারি চাকরির জোয়াল প্রায় সারা জীবনই কাঁধে রয়েছে, আজও ছাড়াতে পারিনি, তবু আসলে বোধ হয় আমি একটা মস্ত বাউন্ডুলে। কেন তা বলতে পারিনে। সকলের ভাগ্যে তো সব কিছু হয় না। আমার আর দশজন বন্ধুর মতো আমি হতে পারিনি। সেটা আমারই দুর্ভাগ্য। এখন তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারা এক রাজ্যে, আমি আর-এক। তারা ফিরে চায় না, তাদের সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই নেই। আমি দূর থেকে, বলতে পারো, অনেকটা অবাক হাবাগোবা ছেলের মতো হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে থাকি।’
বলতে বলতে আমার চোখে চোখ পড়তে থমকে যান। যেন হঠাৎ লজ্জা পেয়েই হেসে নিবন্ত চুরুটে আগুন জ্বালেন। আর আমার যেন বুকে নিশ্বাস আটকায়। যত অস্পষ্ট কথাই হোক, সেই অবাক হাবাগোবা হাঁ করে চেয়ে থাকা ছেলেটাকে আমি যেন দেখতে পাই। আমি দেখতে পাচ্ছি, সংসারের যে সীমানায় সেই ছেলেটি যেতে চেয়েছিল, অথচ যাওয়া হয়নি, সেই দিকে সে চেয়ে আছে। চোখে তার করুণ আর্ত দৃষ্টি। বুকে তার অচিন পানীয়ের তৃষ্ণা মাথা কুটে মরে। কিন্তু তার চুল হয়ে গিয়েছে ধূসর, মুখে পড়েছে হাজার হিজিবিজি রেখা। এখন সে চুরুট মুখে নিয়ে কেবলই আগুন জ্বালে, নেবে আবার আগুন জ্বালে৷
জানতে ইচ্ছা করে, কেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হয়। পাছে এমন কোথাও হাত পড়ে যায়, যেখানে সামান্য স্পর্শে বিষের ব্যথা লাগে বা আগুন জ্বলে যায়।
জিজ্ঞেস করেন, ‘ভায়াকে বিরক্ত করছি না তো।’
তাড়াতাড়ি বলি, ‘মোটেই না।’
বলেন, ‘সেইজন্যেই বলি আর কি—তখন বলছিলাম না, বছরে একবারই এখানে এ সময়ে না এসে পারি না। আসলে ঘুরেফিরে নিজেকেই দেখতে আসা। জীবনে প্রথম চাকরি তাও এখানেই করেছি। সামান্য কিছুকাল, তারপরেই বাইরে চলে গেছলাম। মনে হয় জীবনের আসলটা সব এখানেই পড়ে আছে, তা-ই একটু ঘাঁটতে আসা।’
বলে হাসতে হাসতে পানীয়ের পাত্রে চুমুক দেন। বুঝতে পারি, প্রসঙ্গ বদলাতে চান। তা-ই বলেন, ‘এবার তোমার কথা বলো।’
আমার কিছু বলবার নেই, কেবল শোনবার। অচিনকে চিনবার সাধ আমার। বলি, ‘আমার কোনও কথা নেই।’
‘সবই তো লিখে বলো, তা-ই না?’
বাউল আসরের দরাজ হাসি বাজে আবার। বলি, ‘তাও তো বলতে পারি না। চেষ্টা করি মাত্র।’
উনি বলেন, তা হলেই হবে।’
জিজ্ঞেস করি, ‘কতকাল আগে এসেছিলেন এখানে?’
‘হিসাব করে বলা মুশকিল। সাল তারিখ নিজেরই মনে নেই। ইজেরের ওপরে একখানি জামা গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। নিয়মমাফিক হাতেখড়িটা দেশের বাড়িতে পণ্ডিত মশাইকে দিয়েই করানো হয়েছিল। বিদ্যালয় বলতে শান্তিনিকেতনকেই চিনি। বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু এখানেই। তবে আবার বলি, এই শান্তিনিকেতনে না। তখন এখন অমিল বিস্তর।’
হঠাৎ আমার চোখের সামনে একটি মূর্তি ভেসে ওঠে। মাথায় চুল, মুখে দাড়ি, গায়ে আলখাল্লার মতো জামা, শালবীথির রৌদ্রছায়ায় দাঁড়ানো এক ছবি। বলি, ‘আপনারা তো তাঁর সময়ের লোক, মানে রবীন্দ্রনাথের?’
‘নিশ্চয়ই। আমরা গুরুদেবের ছাত্র।’
বলতে গিয়ে যেন ওঁর মুখে ঝলক লেগে যায়। বলেন, ‘আমরা তাঁর কাছে পড়েছি, তাঁকে দেখেছি, আমরা যে সব সময়ে তাঁর কাছে কাছে রয়েছি, এটা কখনও ভুলতে পারতাম না। আর সেই অহংকারটাও কোনওদিন গেল না। হ্যাঁ, অহংকারই বলতে পারো।’
তাতে তুমি যা খুশি তা-ই ভাবো, অচিনবাবু সজোরে চুরুট টানেন। আর আমার কাছে এই মানুষই যেন এক বিস্ময় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সে-ই যে একদল ছেলেমেয়ে, যাদের মুখ ফিরিছে আজ পশ্চিমে, মুখে অস্তচ্ছটার রক্তাভা, ঠিক সেই দল আর ফিরে আসবে না। আমার সামনে যিনি বসে, তিনি সেই দলেরই একজন।
আবার বলেন, ‘তবে বুঝতেই পারছ, তাঁকে আমরা আর কতটুকু পেতাম। বিশ্বজোড়া লোকের ভিড়, নিজের কাজের শেষ নেই, তাঁকে কতটুকু ধরা যায়। তবু সে আর-এক শান্তিনিকেতন। আজ দেখছ বোতাম টিপলে বাতি জ্বলে, কল ঘোরালে জল পড়ে, চারদিকে আলোয় ভরা। মস্ত বড় বোলপুর স্টেশন, মেলাই গাড়ি যাতায়াত করছে, স্রোতের মতো লোক আসছে, মোটরগাড়ি সাইকেল-রিকশা ছোটাছুটি করছে। মনে আছে, বাবা এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটা গ্রামের স্টেশন, নিঝুম, ভিড় গোলমাল নেই। এক গাছতলার ছায়ায় গুটিকয় গরুর গাড়ি ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে। দড়িতে বাঁধা বলদগুলো ল্যাজ নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছে, খড় চিবুচ্ছে। আর কোনও যানবাহন নেই, সেই একটি গরুর গাড়ি ভাড়া করেই বাবা নিয়ে এসেছিলেন। সন্ধ্যা হলে কেরোসিন তেলের আলো। এখনকার চোখে মনে হবে, অন্ধকার। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডেকে যায়, ঝিঁঝির ডাকে শান্তিনিকেতনের সেই প্রকৃতিকে অন্যরকম লাগত।’…
বলেন, আর দেখি একটি মানুষ কোথায় ফিরে যান। যেন তাঁর মুখের হিজিবিজি রেখা মুছে যায়, চুলের ধূসরতা মুছে যায়। যেন তাঁর মুখে স্বপ্নের ছায়া, তাঁর গলায় স্বপ্নের সুর। আমি সেই সুরের কল্পনায় আর-এক শান্তিনিকেতনকে দেখি।
অচিনবাবু আবার সেই স্বপ্নের ওপার থেকে সেই সুরে ভাষেন, “আলোর নাচন পাতায় পাতায়, তাই তো ভাল লেগেছিল।” লাগেনি কেবল, তখন “বেসেছিলেম ভাল।”
সহসা তাঁর মুখে যেন রক্ত ছুটে এল। কেবল মুখে না, চোখেও। থমকে গিয়ে নিচু মুখে কী যেন ভাবেন এক মুহূর্ত। তারপরে একেবারে যুবকের মতো সোজা দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর নয় ভায়া, চলো বেরুই।’
আমার মনে হল, কোথায় যেন কী এক সুর বেজে উঠেছিল। সহসা সে বাঁক ফিরে যায় অন্য পথে, শব্দহীনে হারিয়ে যায়। আমি ওঁর মুখ থেকে চোখ সরাতে পারি না। উনি পকেটে হাত দিয়ে আমার দিকে চেয়ে আবার ডাকেন, ‘ওঠো হে।’
বলি, ‘তা উঠছি, কিন্তু মনে হল বাউল আসরের মতোই এ আসরটাও ভেঙে গেল আচমকা।’ অচিনবাবু হো হো করে হাসেন। বলেন, ‘তা-ই নাকি?’
বলে হঠাৎ নিচু হয়ে স্বর নামিয়ে বলেন, ‘তবে একবার যখন বেজেছে, পরেও বাজবে। ও-বেলা বাউল আসরও আবার বসবে, তোমার সঙ্গে দেখাও হবে। চলো, একটু মেলা ঘুরে বেড়াই।’
তিনি পকেট থেকে পয়সা বের করেন। আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলি, ‘না না, আপনি কেন, আমি দিচ্ছি।’
‘থামো হে ছোকরা। তুমি আমাকে ডেকেছ, না আমি তোমাকে?’
‘আপনি।’
‘তবে?’
বলে পয়সা মিটিয়ে দেন। বাইরে আসি, তখনও অচিনবাবুর পদক্ষেপ দক্ষিণেই। জিজ্ঞেস করি, ‘ওদিকেও কি মেলা আছে?’
‘আরে আসল মেলা তো ওদিকেই হে।’
মিথ্যা না। ছাতিমতলায় যে মেলাটা নেই ভেবেছিলাম, দেখলাম এদিকে সে-ই মেলা। এখানে অন্য পসার, অন্য পসারি পসারিনী। এখানে বাংলাদেশের সেই চিরচেনা শিল্পীরা নিজেদের শিল্প সাজিয়ে বসেছে। যাদের নাম কামার, কুমোর, ছুতোর। এখানে পাবে কোদাল কাস্তে শাবল কাটারি বঁটি জাঁতি কুরুনি। এখানে পাবে হাঁড়ি কলসি মালসা, ছাপের পুতুল, মানতের ঘোড়া। এখানে পাবে কাঠের তৈরি দরজা, শিক বসানো জানালা, মাঠে জল দেবার লোহার ডোঙা। বর্ষায় মাঠে কাজ করবার জন্যে মাথা ঢাকার টোকা, হুঁকো, কলকে, মায় চাঁচাছোলা ঢেঁকিও।
এ আর এক মেলা। এখানে ক্রেতা-ক্ৰেত্রীও তাই আলাদা। গ্রামীণ মাঠের মানুষ, ভিন্ন গৃহস্থী। ধান কাটা শেষ, লবাত হয়ে যেইছে, এখন পাখিরা ঘর বানাবার কুটোকাটির খোঁজে। বাসা গোছাবার জিনিসপত্রের সন্ধানে।
ছাতিমতলার মেলায় সব আছে। এই তো সেই মেলা, চিরদিনের মেলা। মেলা তো কেবল মেলা না। ঘরের বাইরে চরব খাব, ‘সব এক ঠাঁই হয়ে দূর দূর থেকে এসে কেনাকাটা করে আবার দূর-দূরান্তে চলে যাব।’
এই তো সেই মেলা, নাগরদোলনা, বাজিকরদের খেলার তাঁবু, সার্কাসের পশু, অজগরের মাছ খাওয়া, এক মানুষের তিন মাথা, আগুন-জ্বালানো মেয়ে, যার গায়ে কাঠি ছোঁয়ালেই চিকচিক করে ফুলকি জ্বলে ওঠে।
শুধু কি তা-ই। ওই দেখ না, গ্রামের বালারা কেমন করে চুড়িওয়ালিকে ঘিরে ধরেছে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সাজাও সাজাও আমাকে, সাজাও গো। ওই তো কপালের টিপ, পাথরের আংটি, ফুলেল তেল, তরল আলতা, পতিসোহাগী সিঁদুর।
কিন্তু রোদ যেন অনেক ঢল খেয়ে গিয়েছে। হাতের ঘড়ি তুলে দেখতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠে। ছি ছি ছি, বেলা তিনটে!
থমকে দাঁড়াতে দেখে অচিনবাবু হাঁকেন, ‘কী হল?’
‘তিনটে বাজে!’
‘তা কী হয়েছে?’
‘বন্ধু বসে থাকবেন কিনা জানি না, খাবার কথাই ভুলে গেছি।’
‘বাঃ, চমৎকার! আর আমি ভাবছি, তুমি বুঝি খেয়ে-দেয়েই বেরিয়েছ।’
তারপরে হেসে বলেন, ‘তবে এসেছ তো মেলায়। ঘাবড়াবার কী আছে? চলো, না-হয় মেলাতেই খাবে।’
আমি বলি, ‘সেটা হয় না। একবার যাওয়া দরকার।’
‘তবে চলো, তোমাকে দিয়েই আসি।’
দু’জনেই উত্তরের দিকে ফিরি। ফিরতে গিয়েই হঠাৎ একটা চেনা মুখ যেন ঝলকে ওঠে। এগিয়ে যাবার জন্যে দু’পা বাড়িয়েও আর একজন মুখোমুখি থমকে দাঁড়ায়। চোখ থেকে চোখ সরায় না। তার অবাক মুখে হাসি ফুটিফুটি করে। তার সঙ্গে আরও কয়েক সঙ্গী ও সঙ্গিনী। অতএব তাদেরও দাঁড়াতে হয়, অচেনা চোখে তাকায়।
কয়েকটি মুহূর্ত মনের অন্ধকারে ঝিলিক হেনে যায়। আমি বলি, ‘আপনি ঝিনি—?’
‘চিনতে পারলেন? কিন্তু ঝিনি না, কারণ চিঠিতে তাই লিখেছিলাম, জবাব পাওয়া যায়নি। যদিও কথা দিয়েছিলেন। আমার নাম অলকা চক্রবর্তী।’
হাসির চেয়ে ওর মুখে ভার বেশি। আমি যেন কেমন থতিয়ে যাই, বিব্রত লাগে। তবু হাসি। আর অচিনবাবু বলেন, ‘চলি, ভায়া, বাউল আসরে দেখা হবে। তবে বেলা কিন্তু অনেক।’
.
৪৪.
এদিক ওদিক, দু’দিক মিলিয়ে হঠাৎ কেমন ধাঁধায় পড়ে যাই। এদিকে যখন একজন চোখের ছিলায় টান দিয়ে অভিযোগে ভাসে, পোশাকি নাম শোনায়, অন্যদিকে তখন অচিনবাবু হাত তুলে আচমকা বিদায় নেন। না বলে পারি না, ‘আপনি চললেন?’
ততক্ষণে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছেন। ফিরে তাকিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, জয়গুরু জয়গুরু। ও-বেলা যেন দেখা হয়।’
বলতে বলতে চলে যান। যাবার আগে ঝিনির—থুড়ি, ‘আমার নাম অলকা চক্রবর্তী’— সেই অলকার দিকে একবার নজর হেনে যান। মনে হয়, ওঁর বড় চোখের ফাঁদে একটু দুষ্টু ছেলের ঝলকানি। যেন একটু ইশারার ঝিলিক।
কিন্তু এদিকে দৃষ্টিবন্ধনে আছে। অলকা চক্রবর্তী চোখ নামায়নি। ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওহে, এ দৃষ্টির নাম কী, আমি জানি না। বিব্রত লজ্জায় হাসতে হয়। অপরাধ করেছি, সন্দেহ নেই। একটি চিঠি আমার চোখের সামনে ভাসছে। যার সুরটা এমনি, ‘শ্রদ্ধাম্পদেষু, আশা করি ভুলে যাননি। তথাপি প্রথমেই নিজের নামটা বলি, আমার নাম ঝিনি, ওরফে অলকা চক্রবর্তী, পিতার নাম শ্রীব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী, আমাদের দেখা হয়েছিল…।’
নোনা দরিয়ায় জলযানে যে নাগরিকাকে দেখেছিলাম, সেই নাগরিকাই। চোখের কালো ঠুলি এখন হাতে। ব্যাগ ঝুলছে হাতে গলিয়ে কনুইয়ের কাছে। চুলে অশ্বপুচ্ছ বাঁধুনি নেই, এলো খোঁপায় জড়ানো রুক্ষু চুলের চূর্ণ কপালে, গালের কাছে। তাতে রাঢ়ের রাঙা ধুলার আভাস। রাঙা ধুলা সেই ক্যাঙলা। নাগরিকার সারা গায়ে মুখে ছড়িয়ে আছে, তাই কাজল এখন বাসি লাগে, ঠোঁটের আর কপালের হালকা রাঙা রংও কেমন বাসি-বাসি। ঠিক যেন গোধুলির আকাশের মতো রং, রেশমি শাড়িতেও সেই ভাব। নিরাভরণ তেমনি, কেবল সোনার শিকলিতে জড়ানো ঘড়িটা ছাড়া।
কিন্তু দৃষ্টিতে যত নালিশ থাক, ভুরু বেঁকে থাকুক, সঙ্গে আরও লোক আছে, নাগরিকা সেই কথাটা ভোলে নাকি। তাদের চোখে কৌতূহল, ভুরুতে অবাক বাঁকানি। অতএব অপরাধে হাসা যায়। হেসে কবুল করি, ‘হ্যাঁ, চিঠিটা পেয়েছিলাম, মানে—।’
কথা শেষ করা যায় না। কাছাকাছি থেকেই নিচু করে অলকা ভাষে, ‘থাক, আপনার এই হাসি আর কথা থেকে আপনাকে বোঝা যাবে না।’
গলা তুলে বলে, ‘আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুদের আলাপ করিয়ে দিই। ইনি সুপর্ণাদি, অধ্যাপিকা; লিলি ঘোষ, আমার বন্ধু; রাধা চ্যাটার্জি, বন্ধু; নীরেন হালদার, আমাদের নীরেনদা, ইস্কুলের হেডমাস্টার; শুভেন্দু ব্যানার্জি, বন্ধু।’
সকলের পরিচয় দিয়ে অলকা আমার পরিচয় দেয়। নমস্কার বিনিময়, একটু হাসি। সকলেই জানান, অলকার মুখে তাঁরা আমার কথা আগেই শুনেছেন। সেটা এমন কিছু বলবার কথা না। কেবল ভাবেন না শুভেন্দু ব্যানার্জি—বন্ধু। কিন্তু তারপরে যে প্রসঙ্গ উঠতে যায়, বড় ব্যাজ ব্যাজ। তবু সাহিত্যের কথা শুনতে হয়, বলতে হয় দু-এক কথা। জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় উঠেছেন?’
নীরেনদা বলেন, ‘এই তো কাছেই, দক্ষিণ পল্লির এক বাড়িতে আমরা উঠেছি। আপনি কোথায়?’
বলি, ‘দিকের কথা বলতে গেলে তো পশ্চিম পল্লি বলতে হয়।’
সুপর্ণাদি বলেন, ‘তার মানে, আশ্রমের দিকে।’
নীরেনদা ভারী মানুষ, মাথা-জোড়া টাক। খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবির ওপরে গরম আলোয়ান। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। সুপর্ণাদি রোগ রোগা, বয়স—অনুমানে বলি, চল্লিশের কাছে। রাধা, লিলি তাদের বান্ধবীর বয়সী, পোশাকে-আশাকে তিনজনেরই মিল কাছাকাছি। সুপর্ণাদি, সেই অনুপাতে ছিমছাম, গম্ভীর। শুভেন্দু পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাহেব। চুলেতে ঢেউ-খেলানো সামনে, চোখের কালো ঠুলি একবারও খোলেনি। সরু কালো গোঁফ জোড়াটি যেন তলোয়ারের মতো ধারালো। লম্বা, সুঠাম, সুন্দরকান্তি যুবা। এখন রোদের তাপে কোট উঠেছে হাতে। সাপের মতো মসৃণ তার কণ্ঠলেঙুটি, রঙেতে বাহার। তার বুকে ঝিলিক হানে জড়োয়া কাঁটা।
নীরেনদা বলেন, ‘আমরা এসেছি এক বন্ধুর খালি বাড়িতে। তা চলুন না, আমাদের বাড়িটা দেখে আসবেন, এই তো কাছেই। এখান থেকে দু’ মিনিট।’
আমন্ত্রণে নিরুপায়। সূর্য ঢলেছে অনেক ঢালুতে। তাড়াতাড়ি বলি, ‘পরে আসব।’
‘ও কথাটা বলবেন না।’
কথার পিঠেই ঠেক। অলকা ভাষে। চেয়ে দেখি, হালকা রাঙা টিপখানি বারেক কেঁপে যায়। ঈষৎ বক্রতা সেই রঙের ঠোঁটে। বলে, ‘জানলেন না কার বাড়ি, কোন বাড়ি, পরে আসতে পারবেন তো?’
এ যেন ঠিক অলকা না, ঝিনি ঝিনি লাগে। একটু রোষ-রোষ ভাব, চোখের তারায় কিঞ্চিৎ খর টানের ঝিলিক। দর্শন পড়া মেয়ে, এ দার্শনিকাকে তুমি অত সহজে বচনে মেরে যাবে, তা হয় না। দর্শন হল যুক্তিসিদ্ধ।
তখন রাধা চ্যাটার্জি তার ঘাড়ছাঁটা চুলেতে ঝটকা মেরে বলেন, ‘ও, তার মানে না আসবার ফিকির করেছেন?’
অলকা তাড়াতাড়ি জবাব দেয়। ‘অমন কথা বলিসনে, কথা তো দিয়ে যাচ্ছেন, পরে আসবেন বলে।’
আর লিলি বলে, ‘তারপরে আর দোষও দেওয়া যাবে না, কারণ বাড়িঘরের ঠিকানাই তো ওঁর জানা নেই।’
নীরেনদা হা হা করে হেসে ওঠেন। সুপর্ণাদিও। লিলি রাধাও খিলখিলিয়ে বাজে। অলকা না। শুভেন্দুর গম্ভীর মুখে ঈষৎ হাসি খেলে।
সুপর্ণাদি বলেন, ‘তোমরা সবাই মিলে ওঁকে এরকম করলে হবে কেন।’
তাড়াতাড়ি জুড়ে দিই, ‘বাড়ির ঠিকানাটা তো আমি জিজ্ঞাসা করতামই।’
‘আর সেটাই হত ঠিক যে, তারপরেও আপনার আসবার অবকাশ হত না।’
অলকার কথা শুনে লিলি রাধাই আবার বেজে ওঠে। নীরেনদাও। তিনি বলেন, ‘কিন্তু যাই বলো, এ অসময়ে ওঁকে নিয়ে যাবে, বেলাও অনেক হয়েছে। আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?’
প্রায় অসহায়ের মতো বলি, ‘না। আর আমি তো বন্ধুর বাড়িতে এসেছি। ওঁরা এবার হয়তো একটু ভাবছেন।’
তখন সুপর্ণাদি নিজেই দক্ষিণ পল্লির বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেন, ‘তা হলে আর এখন কিছু বলব না, কিন্তু আসা চাই।’
রাধা বলে ওঠে, ‘আমরাও খাওয়াতে পারতাম আপনাকে।’
আমি বলি, ‘তোলা রইল।’
‘সত্যি, কথা শুনলে একটুও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না।’
অলকার এ কথাতেও হাসি বেজে ওঠে। সে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘আপনারা এগোন সুপর্ণাদি, আমি আসছি।’
সবাই একটু ঠেক খায়, আমিও। নীরেনদা বলেন, ‘বুঝুন এবার, এদের ঘাঁটানো কি চাট্টিখানি কথা। কথা দিয়ে কথা না রাখা।’
বলে হেসে চলতে চলতে আবার বলেন, ‘তবে ঝিনি, বেশি দেরি করো না। তুমি না, ওঁরও করিয়ো না।’
একে একে নমস্কার বিনিময়। নীরেনদাদের দল চলে যায়। রাধা আর লিলি দু-একবার ফিরে ফিরে চায়, হাসে।
অলকা বলে, ‘আপনাকে দাঁড় করিয়ে রাখব না, চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি।’
অবাক হয়ে বলি, ‘কোথায়?’
‘যেখানে উঠেছেন, সেখানেই?’
‘কেন মিছিমিছি এত বেলায়, অত দূরে—’
‘মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি, আপনার খুব খিদে পেয়েছে।’
‘আপনার পায়নি?’
অলকা ঘাড় ফিরিয়ে চোখ তোলে। ওর চোখে যেন ঘনিয়ে আসা ছায়া, অথচ কোপে ঝিলিক দেয়। বলে, ‘পেয়েছে। তবু ছেলেদের পাওয়ার সঙ্গে, মেয়েদের একটু তফাত আছে। কষ্ট হবে না।’
ই দ্যাখ হে, কলকেতার বিদ্যাদিগ্গজ মেয়ে কেমন কথা বলে। রাঙা ধুলায় মাখামাখি, নাগরিকাকে কেমন যেন বৈরাগিণী দেখায়। মুখখানিও শুকু-শুকু। মেয়েদের সহ্যশক্তি বেশি জানি, তবু আমাকে এতখানি পথ পৌঁছে দিয়ে, আবার একলা ফিরবে, পুরুষের প্রাণে তা-ই বা সহ্য হয় কোথায়। বলি, ‘মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ বেরিয়েছিলেন।’
‘হ্যাঁ, সেই সকালে। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম শ্রীনিকেতনে।’
‘খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে।’
‘আপনার থেকে বেশি নয়।’
অগত্যা নিজেকে যখন দেখতে পাচ্ছি না। তবু না হেসে পারি না। আর একজনের ভারী মুখে হাসি-হাসি ভাব, কিন্তু হাসি নেই। অতএব, এই চলাতে ঠেক দিতে হলে যে প্রস্তাব দিতে হয়, তা-ই দিই, ‘তা হলে, আমরা কোথাও বসি।’
‘কোথায়?’
‘কোন চা-কফিখানায়।’
অলকার চোখের তারায় বিঁধিয়ে দেখার ধার। জিজ্ঞাসা আর খোঁজাখুঁজি। বলে, ‘খিদের জন্য কষ্ট হবে না?’
এবার বাত দিতে ছাড়ি না, ‘বিশ্বাস করলে বলতে পারি, মেয়েদের থেকে বেশি না।’
‘কিন্তু না-খাওয়া লোকের সঙ্গে বসে কথা বলতে, মেয়েদের বড় অস্বস্তি।’
‘ছেলেদেরও।’
অলকার ছায়া ঘনানো, অথচ খর তারার এবার যেন একটু তরঙ্গ চলকে ওঠে। আবছা রাঙা ঠোঁট দুটো টিপে রাখে। হাসি বড় বেইমান যে। বলে, ‘কিন্তু একটু কথা ছিল যে।’
‘শুনতে চাইছি তো।’
‘রাগকে বড় ভয় লাগে।’
‘কার রাগকে?’
‘যারই হোক, রাগ রাগই।’
‘আমারও ভয় লাগে।’
আবার ঠোঁটে ঠোঁটে টিপুনি। বেইমান, ছড়িয়ে পড়িস না ঠোঁট ভাসিয়ে। বলে, ‘রাগ করছেন না তো?ֹ’
ঘাড় নেড়ে বলি, ‘আমি করিনি।’
অলকা আবার চোখের দিকে চায়। চোখে তার সেই খোঁজাখুঁজির বিঁধ বেঁধানো। বলে, ‘হয়তো অল্প আলাপে, একটু বেশি দাবি হচ্ছে।’
সত্যি কি, এত মাপজোকের বিচার আছে তোমার মনে। বরং, চিঠির কথা মনে করে, তখন থেকে মনে মনে খতিয়ে আছি। বলি, ‘আমার তা মনে হয়নি।’
‘তা ছাড়া, আপনার খিদে বাদ দিলেও বন্ধুরা অপেক্ষা করবেন।’
‘অপেক্ষার থেকেও, একটু চিন্তা করবেন হয়তো। সেটা পরে সামলে নেওয়া যাবে।’
‘তবে কোথায় বসবেন চলুন।’
বেশি দূরে যাবার দরকার ছিল না। পা বাড়ালেই সরাইখানা। অচিনবাবুর সঙ্গে যেখানে বসেছিলাম, সেই নিরিবিলিতেই যাই। কফি চেয়ে, বসি। অলকা বলে, ‘শুধু কফি এত বেলায়? একটু খাবার নিলে হত।’
‘আপনি খাবেন?’
‘না, এখন আর আমার এসব শুকনো খাবার ভাল লাগছে না। আপনি খান।’
‘আমার সত্যি ইচ্ছে করছে না।’
অলকা আবার চোখের দিকে তাকায়। টেবিলের উলটো দিকে বসে, হঠাৎ বুঝি খেয়াল হয়, গোধূলি-রং রেশমি শাড়ি বুকের থেকে কিনার নিয়েছে। আর ডাগর করে কাটা দুপুর-রং জামায় তার লজ্জা শিউরে যায়। আঁচল ঘুরিয়ে টেনে দেয় বুকে। চোখের পলক নত হয়।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার বাবা কেমন আছেন? আর—।’
কথা শেষ হবার আগেই, অলকার টানা চোখে অবাক চমক খেলে। বলে, ‘আপনার মনে আছে তাঁদের কথা?’
এবার অবাক চমক আমার। বলি, ‘সে কি, মনে থাকবে না কেন?’
অলকা একটু হাসে। এ সেই বেইমান হাসি না, একটু ছায়াবিধুর। বলে, ‘এতক্ষণ কিছু বলেননি তো, তাই ভাবলাম, ভুলে গেছেন। তাঁরা কিন্তু আপনার কথা বলেন।’
আর একবার বিব্রত হয়ে পড়ি, অপরাধী মনে হয় নিজেকে। তাঁদের কথা হয়তো প্রথমেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। কিন্তু ওহে, টুকুস সময়ও তো চাই। নানা আন কথাতেই যে সময় চলে গিয়েছে। আমি বলি, ‘প্রমাণ দিতে পারব না হয়তো, কিন্তু আপনার বাবাকে আমি ভুলিনি। আপনার মাকেও না।’
অলকার নজরে বাঁক লেগে যায়। চোখ তুলে চায়। যেন কিছু জিজ্ঞেস করে। তারপরে আবার ঠোঁট টিপে চোখ নামিয়ে নেয়। বলে, ‘অবিশ্যি, জানি না, ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তীর মতো লোক কেমন করে এত মুগ্ধ হন। প্রায়ই বলেন, “ছেলিটি বড় ভাল।” আর মা বলে, “একটু গুমোর নেই।” দু’জনেরই দেখি আপনাকে বেশ মনে আছে।’
আমার চোখের সামনে সেই মুখখানি ভাসে। যাঁর মাথায় দু-চার গাছি খাড়া-খাড়া সিরিঙে মতো চুল, নকল দাঁতে ঢেউ খেলানো, ভ্রূকুটি মুখে রোখা-রোখা ভাব। কিন্তু চোখে ঢাকা কাচের ওপারে যাঁর বিটলে হাসি চিকচিক করে। তাঁর পাশে, কপালে সিঁথেয় সিঁদুর ডগডগানো সধবা। প্রাচীন নাকছাবিতে ঝলক দিয়ে যিনি ব্রহ্মনারায়ণকে হানেন। নোনা গাঙের বুকে ভেসে যাওয়া, ফিরে আসা, তার মাঝে অনেক কথা মনে পড়ে যায়।
প্রতিজ্ঞা করে তাঁদের কথা মনে রাখিনি। মন-স্বভাবের স্রোতে তাঁরা আছেন। বলি, ‘তাঁদের মতো ভাল নই, কিন্তু মনে আছে।’
‘মিথ্যুক বলব না আপনাকে।’
বলেই অলকার ঠোঁটের কোণে যেন হাসিতেই একটু ধার খেলে যায়। আবার বলে, ‘ওঁরা প্রায়ই বলেন, আপনাকে কেন একটা চিঠি দিয়ে খবর নিই না। আমি বলি শিগগিরই নেব।’
যেন মুখে আমার ধারালো ধারে কোপ লেগে যায়। এবার ভাষো হে কথার কারিগর। কয়েক পলক চোখ ফেরাতে ভুলে যাই। অলকা হাসে। হাসিতে রেশমি আঁচল ঝরে যায়। বলে, ‘একটু মিথ্যে কথা বলেছি। ভেবেছিলাম, জবাব পেলে তাঁদের জানাব। আপনিই বলুন, না জানিয়ে ভাল করিনি?’
ইতিমধ্যে কফি এসে যায়। বেইমান আমার হাসিও। লজ্জাতেও সে মুখ ফোটে। বলি, ‘না, মানে—।’
‘কফি খান।’
‘হ্যাঁ।’
ধরা পড়া চোর যেন তাতেই মুক্তি পায়। তবে এত সহজে না। অলকা আবার বলে, ‘আপনার হাসি দেখলে, কথা শুনলে ঠিক কিছু বোঝা যায় না, তা-ই আবার জিজ্ঞেস করি, সত্যি চিঠিটা পেয়েছিলেন, নাকি চাপা দেবার জন্যে বললেন।’
মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না, সত্যি পেয়েছি।’
‘তবে জবাব দিলেন না কেন?’
কেন দিইনি। সচ্ বলো হে, পথ-চলার লোক। তোমার কি কেবল মুখের কথা! কাজের কথা নেই? কিন্তু কাকে সাক্ষী মানব, নিজেকে ছাড়া। সেখানে তো এক কথা, ‘জবাব দেবার কথা ভাবতে ভাবতেই দিন চলে গেছে! কারণে না, অকারণেই জবাব দেওয়া হয়নি।’
অলকা কফির পাত্রে চুমুক দিয়ে যেন সরস হয়ে ওঠে। ওর শ্যাম চিকন মুখে এখন যেন, রোদ চলকানো গাঙের টলটলানি। বলে, ‘আমি বলব?’
ওর মুখের দিকে তাকাই। অলকা বলে, ‘আমার বাবা-মাকে মনে রাখলেও আমাকে মনে রাখতে পারেননি, তাই জবাব দিতেও পারেননি, এই তো?’
‘না, না, আপনি—।’
‘কিন্তু আমার মনে ছিল, চিঠিতেই তার প্রমাণ।’
‘নিশ্চয়ই।’
ওহে, এ কী ডাকিনী দার্শনিকা গো। দেখি, তার চোখের তারা কৌতুকে আর বিদ্রূপে নিবিড়। তাড়াতাড়ি বলতে যাই, ‘তাকে আমার মনে ছিল।’ তার আগেই গুপ্তি থেকে ছুরি আসে, বলে, ‘অনেক চিঠি পান, তা-ই জবাব দিতে ক্লান্তি, না?’
‘না না, তাও নয়।’
‘তবে—তবে কি—?’
হঠাৎ অলকার গলার স্বর বদলে যায়। যেন স্বর গলা থেকে বুকে নেমে যায়। মুখের হাসি উধাও। শ্যাম চিকন রাঙা ধুলা মাখা, চূর্ণ চূর্ণ চুল ছড়ানো মুখের ভাব বদলে যায়। নিচু স্বরে বলে, ‘আমার চিঠিটা আপনার খুব খারাপ লেগেছিল?’
অলকার মুখের দিকে তাকাই। কথা বলতে কয়েক মুহূর্ত দেরি হয়ে যায়। অলকাই আবার বলে, ‘হয়তো ফিলজফি পড়তে গিয়ে, আপনাদের মতো লোককে চিঠি লিখতে শিখিনি। বাবা-মায়ের মতো তাঁদের মেয়েটিও হয়তো—হয়তো মুগ্ধ হয়েছিল, তা-ই কী লিখতে কী লিখেছি, না জেনে কাব্য করেছি—’
‘অলকা দেবী।’
‘সেজন্যে ক্ষমা করবেন। আজ আপনাকে এমন আচমকা দেখেছি যে, সবটাই আমার আচমকা হয়ে গেল, সেজন্যেও ক্ষমা চাই।’
অলকা উঠে দাঁড়ায়, মুখ তার অন্যদিকে ফেরানো। উঠে দাঁড়াতে ভুলে যাই, কথা বলতে ভুলে যাই। ব্যক্তি ও পরিবেশ বিশেষে সামান্য যে কত অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, জেনেও জানিনি। সত্যিই তো, কত চিঠিরই জবাব দেওয়া ঘটে না। নিজেও কত জবাব পাই না। কিন্তু পথ চলার লেনাদেনায় এমন পরিস্থিতি হয়নি।
বুঝতে পারি, অলকা ব্যাগ থেকে রুমাল নিয়ে ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে। আরও কয়েক মুহূর্ত পরে, মুখ না ফিরিয়েই বলে, ‘এমন কিছু কথা নয়। এটুকু বলার জন্যে আপনাকে কষ্ট দিলাম। হয়তো পরে লজ্জা করবে, তবু—।’
কথা শেষ না করে সে ফেরে। মুখে টেনে আনা হাসির ছটা, কিন্তু চোখ ভেজা-ভেজা রাঙা। বলে, ‘আর দেরি করাব না, চলি। পয়সাটা—।’
‘আমি দেব, কিন্তু অলকা দেবী—।’
‘না, না, তখন অমনি করে বলেছিলাম বলে সত্যি অলকা চক্রবর্তী নই। আমি ঝিনি-ই।’
‘শুনুন ঝিনি—।’
ঝিনি হেসে ওঠে সত্যি। বলে, ‘সত্যি কী অদ্ভুত যে কথা না আপনার। কিন্তু এখন কিছুই শুনব না। ও-বেলা আসব।’
বলে সে চলে যায় সরাইখানার বাইরে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতেও ভুলে যাই, ও-বেলা সে কোথায় আসবে। হয়তো ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার কিছু বলার ছিল।
ঝিনি মোড় বেঁকে যাবার আগে আর একবার ফিরে চায়। হাসে, দেখে মনে হয় নীল আকাশে রোদের মতোই। তারপর হারিয়ে যায়।