০১. বাবুর যাওয়া হবে কোথায়?

কোথায় পাবো তারে – কালকূট
প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ১৯৬৮
স্বৰ্গত পিতৃদেবের উদ্দেশে

.

‘বাবুর যাওয়া হবে কোথায়?’

লোকটির চেয়ে চেয়ে দেখা, একটু হাসি হাসি ভাব দেখেই বোঝা গিয়েছিল, এরকম একটা কিছু বলবে। বাবু ছাড়া, সে-ই আছে। তৃতীয় কোনও যাত্রী নেই। আর আছে মাঝি। কিন্তু এ মাঝির কাছে, জগৎ-সংসার তো যেন নিরাকার। অন্যথায় সে এমন নির্বিকার কেন। নতুন শীতের এই সকালে তার আদুর গা। গায়ে খানে খানে খড়ির দাগ। কালো গায়ে দাগগুলো ফুটেছে পরিষ্কার। ময়লা কাপড়টা হাঁটুর ওপরে গোটানো। মুখে কয়েকদিনের গোঁফদাড়ি। তাও বেশ জুতসই নয়, আধা মাকুন্দের গোঁফদাড়ি। অনেক ফাঁক আছে। চোখ দুটি কালো, ডাগরও বটে, কিন্তু যেন রাজ্যের ঘুম সেখানে জড়ো হয়ে আছে। একে ঘুমকাতর বলে, না ঢুলুঢুলু বলে, কে জানে। সে জল দেখে না, যাত্রী দেখে না, এপার ওপার লক্ষ নেই, বৈঠা টানছে ছপ্‌ ছপ্‌। তার যেন শীত-গ্রীষ্ম বোধ নেই। জলে জোয়ার না ভাঁটা, খেয়াল নেই। মাঝি তুমি কী করো। পারাপার করি। আর কী করো। পারাপার করি। মাঝির দিকে তাকিয়ে এমনি মনে হয়, তার জগৎ-জোড়া দরজা বন্ধ।

যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা আঘাটা নয়। খেয়াঘাট নয়, আন্দাজ করেছিলাম। অতএব, এ মাঝি খেয়া পারানির বাঁধা ঘাট-মাঝি নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওপারটা হিন্দুস্থান না পাকিস্তান।’

‘হিন্দুস্থান।’

মুখ না তুলে, পাটাতন ফাঁক করে, জল সেঁচতে সেঁচতে জবাব দিয়েছিল। একটা বেশি কথা বলবে, সেরকম পাওনি। অচেনা লোক, তাকিয়ে দেখতেও কি চোখ সরে না। সরলে তো দেখতই। সকলের অমন কথায় কথায় চোখ সরে না। অর্থাৎ নড়ে না। দেখছে, জল সেঁচছি। মানুষ এলে, কী বলার আছে বলো, জবাব দিচ্ছি।

কিন্তু এত সোজাসুজি হলে হয়! মানুষটা এল কোথা থেকে, দেখবে তো। তার চলাফেরার ধাঁচ-ধোঁচ, খেই ধরতাই দেখবে তো। শহর থেকে মানুষ এল, মানুষ নয়, বাবু এল, জানো, তার এক কথাতেই চুন খসে যায়। তোমার কাছে একটা কথা পাড়বে, তারপরে যদি তুমি তার মান না রাখো।

তবে মানের বোঁচকা নিয়ে হাঁটা দাও। সে কেন মিছে বকে মরবে। রাজা মহারাজা তো করবে না হে, তবে আর হেসে তাকিয়ে কথা বলে ভেজাল মিশেল দিয়ে কী হবে। আশেপাশে আরও দু’চারখানা নৌকো ছিল। তাদের মাল বোঝাইয়ের বহর দেখে, কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তাই তাকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘পার করে দেবে!’

‘দু’আনা লাগবে।’

এক কথাতেই সব জবাব। দেবে কি দেবে না, অত কথার দরকার বোঝেনি। বারো নয়া তেরো নয়, সে সবও বলেনি, সাবেকি হিসেবেই কথা। নয়া চালের কী-ই বা দেখছ এখানে। এ ইছামতী নদী নয়া নয়। এই যে জোয়ারে উজান যান, এ নয়া নয়। যত পুরুষ পেছিয়ে যাবে, অনেক সাবেকি হিসাব পেয়ে যাবে। তোমার বারো নয়া তেরো নয়ায়, ইছামতীকে নয়া করতে পারনি। আগের ভাঁটার যে পাল এখনও ডোবেনি, তার রং সেই সাবেকি, কালো কুচকুচে, পাতায় মোড়া পাত-ক্ষীরের মতো। গাঙ শালিকেরা ঝাঁক বেঁধে, চঞ্চু খুঁচিয়ে, পোকা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে সেখানে। সূর্যের ছটা-লাগা আকাশটা সেইরকম সাবেকি। প্রথম শীতের হাওয়ায়, মেঘের ছিটেফোঁটাও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। ঝকঝকে নীল পাথরের মতো, এত চেকনাই যে, চোখ রাখা যায় না। ইছামতী জোয়ারে বাড়ন্ত, একটু ঢেউ নেই। ধোয়ামোছা একখানি আরশি, আকাশের ছায়ায় নীল। ওপারে দেখা যায় যে গ্রামখানি, তার আম জাম জারুল গাম্বিল কাঁঠাল নারকেলের গা ভরে রোদ। মস্ত মস্ত হিজল নেই, গেমোর ঝাড় ঝোপ জলে নেমে দাঁড়িয়েছে। কোমর ডুবিয়ে, ডাল বাড়িয়ে ইছামতীর জোয়ারে ছপ্‌ছপ্‌ খেলছে। মাঝেমধ্যে ক্যাওরার ঝোপ। বারো নয়া তেরো নয়ার মতো নতুন কিছু নেই, সবই সাবেকি। নয়া তো তোমার মিলের ধুতির পাড়ে, মিলবাবুর জামায়, চোখের জামান কাচের কালো ঠুলিতে, শান্তিনিকেতনী ঝোলায়। কথার ভেজাল বাড়িয়ে লাভ কী। উঠে বসেছিলাম। দরাদরি করা যেত, কেন না, টিকেট যখন ছাপানো নেই। ছাপাছপি না দেখলে, কোনও কিছুতেই এক দর বলে মানতে শিখিনি। কিন্তু এ যা মাঝি, তার এক মুখ খোলা, বাকি সব বন্ধ। কথার ভেজালে নেই, কথাই ছাপানো।

উঠে বসতেই জল সেঁচা বন্ধ করে পাটাতনে বসিয়ে দিয়েছিল। ছই নেই, খোলা, জেলে নৌকার মতো। জালের ভাঁজ ছিল না যে মাঝিকে মাছধরা ভাবব। এই মালবোঝাইয়ের ঘাটে যে সে বেগার দেবার জন্যে বসেছিল না, তাতে সন্দেহ নেই। হতে পারে, মাছ মারে, মাল বহে, পারাপারও করে। নৌকা যখন একটা আছে। কিন্তু আমার তো মনে হয়েছিল, মাঝি তুমি কী করো, পারাপার করি। এ ছাড়া আর কিছু নয়। আর কী করো। পারাপার করি।

নৌকার খুঁটি তুলে ঠেলা মারতে যাবে, তখনি ইনি এলেন, দ্বিতীয় যাত্রী। চিৎকার শোনা গিয়েছিল, ‘অদরদা অদরদা, দাঁড়িয়ে।’

অদর। অর্থাৎ অধর। তবে আমি অধর মাঝিকে ধরতে চেয়েছিলাম! ও ভোলার মন, সবাই কি আর অধর ধরার কল পাততে জানে। দেখ, বগলে কী একটা চেপে, রং ওঠা গেরুয়াই হবে—আলখাল্লার মতো জিনিসটা হাঁটুর ওপর অবধি তুলে কেমন ছুটে আসছিল লোকটা। কোথায় যাবে, যাবে কিনা, দর কত, কোনও জিজ্ঞাসাবাদ নেই। ‘অদরদা দাঁড়িয়ে’, তো অধর নৌকার দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে। অধর মাঝি একবার তাড়া দেবার হাঁক দেয়নি। কালো মুখখানিতে, কপাল বা ভুরুতে কোথাও একটু এদিক ওদিক হয়নি। ঢুলুঢুলু চোখ দুটো তুলে একবার লোকটিকে দেখেছিল মাত্র। সে এসে উঠতেই নৌকা ঠেলে দিয়েছিল। তারপরে শোনো কথা।

‘জয় মুরশেদ। বেলা হয়ে গেল। একটুকুন তাড়াতাড়ি আসতি পারলে জানি, পারের চিন্তা নাই। তবু যাগ্‌গা, তোমাকে মিলিয়ে দিলে গোরাসায়িবে। বেরুতি যাবো, হরেকেষ্ট আর তার বউয়েতে কী ঝগড়া। পাড়ায় কাক চিল থাকতি চায় না। বিত্তান্ত কি, না হরেকেষ্ট গাই দোয়াবার আগে এক ফেত্তা হুঁকো টানতে বসেছিল। বেরুবার মুখেতেই, এসব বড় খারাপ, দিনটা না বেরথা যায়। দাঁড়িয়ে একটু জোড়াতালি দিলাম, তারপরে…।’

কিন্তু মুরশেদের জয় হয়েছে, গোরাসায়িবে মিলিয়ে দিয়েছে, ঝগড়া মেটানো হয়েছে, সব বৃত্তান্তই বলা হয়েছিল, অধর মাঝি অধর। সে তেমনি নির্বিকার। তার চার পাশে সব যেন নিরাকার। তার বৈঠা জলে পড়ছিল ছপ্‌ছপ্‌, সে পারাপার করে। তার দৃষ্টি না জলে না থলে; কথা নেই, শোনে কি না কে জানে। লোকটি এমনি বসে কথা বলছিল না। ছুটে এসে, সে তার কাঁধের ঝোলা ঠিক করছিল। আলখাল্লা না জোব্বা, যা হোক, দেখে নিচ্ছিল। ছিঁড়ে যাবার ভয় ছিল বোধ হয়। দেখে ভাবছিলাম, ছিঁড়বে না বা কেন। ও আলখাল্লার আর আছে কী। শতখানে শতেক তালি, এখানে মচকানো, ওখানে মচকানো। ওটার নাম এখন তালিখাল্লা হলেই ভাল হয়। নয় তো কাঁথাখাল্লা। তালিতে তালিতে এমন মোটা হয়েছে, কাঁথার মতোই দেখাচ্ছে। তার ওপরে যত ঝাড়ে, তত ধুলো ওড়ে। কবে যে রঙে ছোপানো হয়েছিল, কে জানে। এখন গেরুয়া জলে ধোয়া। মাথার পাগড়িটা অন্তত আস্ত আছে, মনে হয়েছিল। সেটা খুলে যখন ঝাড়া দিয়েছিল, জয় মুরশেদ, সেটিতে অজস্র ছিদ্র আর গিঁটে ভরতি। অথচ বাইরে থেকে এমন নিপাট ভাঁজ জড়াবার কেরামতি, সব ছিদ্র বন্ধন। এক কলসিতে নয়টি ছিদ্র, নবম পদ্মদলে। মন, ছিদ্র বন্ধন করো। পাগড়ির খেলা সেই রকম দেখেছিলাম। ঘাড় অবধি বাবরি চুলে, ঝাপটা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে, আবার পাগড়ি বাঁধতে দেখেছিলাম। তারপরে ওই শোনো, ইছামতীর বুকের ওপরেই ডাক শুরু হয়ে গিয়েছে:

আমি এসে এই দুনে,

মন মুরশেদ না নিলেম চিনে।

আমি যাব কোথা কেউ বলে না

হয় নারে মনে,

আমি ছিলাম কোনখানে

আমারে আনলে কোনজনে।

অধর মাঝি বৈঠা টানে। আর একজন মন মুরশেদকে ডাকে। তার আগে যে অত কথা, হরেকেষ্ট যুগলের গাই দোয়ানো বিভ্রাট, অধর মাঝির কাছ থেকে কি তার কোনও জবাবের প্রত্যাশা নেই। থাকলে শুনতে পেতে। গোরাসায়িবে মিলিয়ে দিয়েছে, তাই দুটো কথা। ও হল কথার কথা। আর সব মনে মনে। যাবে তো পারে হে, নায়ের নাগাল পেয়েছ, আর তো কিছু বলার নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার যত খুশি হাঁকো, ‘মুরশেদ আমার কোন শিয়রে জাগে রে।’…

উনি সাঁইবাবা না দরবেশ, তা কে জানে। গোঁফদাড়িতে পাক ধরেছে মাত্র, অথচ মুখ দেখ, ফাটাফুটি চৌচির, যেন আদ্যিকালের মুখটি। বালা পরা হাতের চেহারাও তেমনি। যত ফাটার দাগ, তত শির। তবে এই চৌচির মুখে, চোখ ইছামতী। এই রোদ-লাগা চলন্তা জলের মতো। ছোট ফাঁদে, কালো তারা, থেকে থেকেই নড়ে চড়ে, ঝিলিক মারে। কেবল দাঁতের কথা বলো না মুরশেদ, পান খেয়ে খেয়ে পাকা ছোপ ধরিয়ে ফেলেছে। দরবেশের গলাটা কেবল ভরাট নয়। কম করে দুটো গ্রাম পেরিয়ে শোনা যাবে, এত জোর। শহরে হলে, কী হত, বলতে পারি না। এখানে তো দেখি, পলিপাড়ের গাঙ শালিকেরা একবার মাত্র ত্রস্তব্যস্ত হয়ে উঠল। তারপরে আবার পেটের ধান্দায়, চঞ্চু-পাঁকে লড়াই। মন-মুরশেদের ডাক তাদের শোনা আছে। ওপারের বনে বনে, আর এই আকাশের ছায়া পড়া নীল ইছামতীর আরশিতে, মন-মুরশেদের হাঁকে কোনও হকচকানি নেই। যেন পলিপাড় বলো, বন বলো, নদী বলো, মায় অধর মাঝি বলো, সব যেন কান পেতে ছিল। যেন পারাপারের কোথায় কিছু সুর ছিল আবাঁধা। এবার বাঁধা হল।

নিজের কথাই বা বাদ দিই কেন। ‘আমি ছিলাম কোনখানে, আমারে আনলে কোনজনে’ শুনব বলে, আমি কান পেতে ছিলাম না। তবু মনে হয়েছিল, কান পেতেছিলাম, আমার জানা ছিল না। প্রথম কয়েক কলি বেশ হাঁক পেড়েই হয়েছিল। তারপরে ইছামতীর জলে হাত ছুঁইয়ে, আঙুল দিয়ে একটু দাড়ি আঁচড়ে নেওয়া হয়েছিল। নিতে নিতে গুনগুনানি শুনেছিলাম, ‘মুরশেদ আমার কোন শিয়রে জাগে রে, মুরশেদ আমার কোনখানে বিরজে রে।’

বিরজে সম্ভবত বিরাজ। আর গুনগুনানি যে এমন বাঁশির সুরের মতো ভাঁটির টানে সমুদ্রে যেতে চায়, আগে কখনও মনে হয়নি। তখনি দেখেছিলাম, কালো মোটা ঠোঁটের ফাঁকে, পানের পাকা ছোপের দাঁতের হাসি। ছোট ফাঁদের চোখে ধরা কালো তারায় বারে বারে দেখা। দরবেশের চোখে ধন্দ বুঝতে পারি, তার সঙ্গে হাস্য কীসের। তারপরেই, সন্দেহ যা করেছিলাম, ‘বাবুর যাওয়া হবে কোথায়!’

বললাম, ‘ওপারে।’

‘না, বলে, চিনতে পারলাম না কিনা।’

চুপ করে থাকতে চাও, থাকতে পারো। তবে অধর মাঝিকে যা মানায়, তোমাকে কি তাই মানায়। তা ছাড়া দরবেশের গলা কি তোমাকে একটুও মাতায়নি। মুরশেদের ডাক! আমারে আনল কোনজনে। জবাব দিলাম, ‘কেন, অচেনা লোক কি এ তল্লাটে দেখা যায় না।’

‘জয় মুরশেদ!’

বাতাস লাগলে যেমন পাড়ে পাড়ে ঢেউ লাগে, দরবেশের চৌচির মুখে সেই রকম লাগল। বলল, ‘তা আবার যায় না। অচেনা লাগল কিনা, তাই। বোলে সাঁইয়ের ঠাঁই তো সবখানে, এ তল্লাটে বাবুকে দেখি নাই।’

অধর মাঝি কী বলে। কিছু না কেবল বৈঠা ছপ্‌ছপ্‌। বললাম, ‘কোথায় যাব, তা জানি না। ওপারে যাবার ইচ্ছা হল, তাই যাচ্ছি। নাম কী ওপারের।’

জিজ্ঞেস করলাম। দরবেশের ঝোলা থেকে তখন একখানি পুরনো ডুপ্‌কি বেরিয়েছে। ডুপ্‌কির চামড়ায় টোকা দিতে গিয়ে, সাঁইবাবা হেসে মরে গেল। বলল, ‘বাবু বলে কিগো অদরদা! পারের নাম জানে না।’

অধর সেই রকমই অ-ধরা। সে কেবল পারাপার করে। নৌকা এখন মাঝ দরিয়ায়। আরশির তলায় তলায় টান। উজান কি আর এমনি ওঠে। গোটা সাগর চাপ দিচ্ছে। বৈঠা হাতে নাও, বুঝতে পারবে উজানি টান কাকে বলে।

দরবেশ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তবে যাচ্ছেন কোথায়!’

‘ও পারে।’

‘ওপারে!’ সাঁইবাবার আবার হাসি। বলল, ‘কোনও ঠিকানা নাই?’

লোকটার গলায় যেন হাসির বান আটকে রয়েছে। জবাব শুনলেই কলকলিয়ে ফেটে পড়বে। তবু বলতে হল, ‘না।’

একেবারে দাড়ি ওড়ানো হাসি হাসল দরবেশ। বলল, ‘মজার ব্যাপার তো। বাবু যে মুরশেদ খুঁজতে বেরয়েছেন। আমারে আনলে কোনজনে, আমি ছিলেম কোনখানে। তা আসছেন কোত্‌থিকে?’

আর একটু কাছে এগিয়ে এসে বসল। মাঝি একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি। সাঁইবাবার কথা ফুরায় না। আমার বাসস্থানের আধা শহরটার নাম বললাম। সে অমনি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘গেছি গেছি, আপনার দেশ ঘুরে এসেছি। তা সেখেন থেকে সাত সকালে বেরিয়ে পড়েছেন, ওপারে যাবেন বলে।’

‘হ্যাঁ।’

‘আর ওপারের নামও জানেন না।’

জানবার দরকার কী, তা নিজেই জানি না। নিজেকে যে কথা জিজ্ঞেস করিনি, তা এ লোককে বলি কেমন করে। আমি তো নামের খোঁজে আসিনি। আমি যেতে চাই, ওই আম জাম নারকেলের ছায়ায় যে পথ গিয়েছে, সেই পথে। যে পথ আমার অদেখা, অচেনা। আমি ইছামতীর আয়নায় আকাশ দেখব, যতদূর চোখ যায়, তত দূরে। আর এমনি, মন-মুরশেদের ডাক যদি শুনি, তবে তাই শুনব। আমার অজানাকে নিয়ে এত হাসি কীসের। তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম ওপারের!’

‘ইটিন্ডা।’

নামটা শোনা শোনা লাগল। ম্যাপে দেখেছি কি বইয়ে পড়েছি, মনে করতে পারি না। দরবেশ বলল, ‘তা বাবু, ঠিকানা যদি নাই, ওপারে গিয়ে কী করবেন। দু’পাক না দিতেই তো সেই বডার।’

বডার মানে বর্ডার, দুই বাংলার সীমানা। বললাম, ‘তাই নাকি। তবে কোথায় যাব।’

তাই তো, মুরশেদের ভাবনা কেড়ে নিলে বাবু, দরবেশকে সে ভাবিয়ে তুললে। ওই বেরোবার মুখে, হরেকেষ্ট আর তার বউ-ই ফ্যাসাদ করেছে। বলল, ‘কাছেপিঠে কোথাও মেলা-খেলাও নাই যে বলব, একটু ঘুর দিয়ে যান।’

মেলার কথা শুনে উৎসাহিত হলাম। কিন্তু দরবেশের ঠোঁট উলটে গিয়েছে, ঘাড় নড়তে আরম্ভ করেছে। বলল, ‘উহুঁ, এক আপনার গে সেই সাখোরের রাসের মেলা। তাও ভাঙা মেলা, দূর বেজায়।’

অতএব দু’ পাকের ইটিন্ডাতেই ঘুরে আসা যাক। বাংলাদেশের ওপারের রংটা আলাদা হয়ে গিয়েছে কিনা, দেখে আসা যাবে। দরবেশ দেখি ডুপ্‌কিতে আঙুলের টোকা মারছে, ডুপ্‌ ডুপ্‌ ডুপ্‌কি ডুপুক। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। দেখলাম, দরবেশের চোখ বোজা, নাকের পাটা ফোলানো। তারপর হুস্‌ করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হুম্‌, যা ভেবেছি, একেবারে তাই।’

কথার শেষে, পাকা ছোপের দাঁত দেখা গেল। চোখের তারা সিগারেটের ডগায়। বোঝার উপায় নেই, কাকে বলছে, কী বলছে। আবার বলল, ‘বুইলে অদরদা, এ সেই তোমার পচা কাট পুরনো ছিরেট নয়। বাবুর ছিরেটের গন্দই আলাদা। এর অনেক দাম, না বাবু।’

মন গেল, মুরশেদ গেল, মেলা খেলাও গেল, এখন বাবুর ছিরেটের গন্ধ দেখ আর দাম হিসেব করো। হতে পারে, এসেছি ইছামতীর কূলে। তা বলে কি, অমন কথা শোনা নেই। এমন সকালটা না মাটি হয় মনের বিরক্তিতে। মুখ ফিরিয়ে তাকালাম, দূর পলিচরের গাঙ শালিকগুলোর দিকে। শুনতে পেলাম, ডুপ্‌কিতে চাপা তাল, তার সঙ্গে গুনগুন, ‘আসিবের কালো বান্দা দিল্লি মৌত লিখে। এখন কেন কান্দিস বান্দা পরের মৌত দেখে।’

দেখ, এখন বিরক্ত হবে, না হাসি চাপবে। ফিরে তাকিয়ে দেখি, দরবেশের চোখ ফেরানো দুরের নদীতে। তবে আর এত কঠিন হওয়া কেন যদি এখন মন খচখচ করে। যদি এমন করে শহুরেবৃত্তি মাথা নিচু করে। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে বললাম, ‘চলবে নাকি একটা।’

‘জয় মুরশেদ। আপনার কম পড়বে না তো বাবু।’

দায় দোয়া জ্ঞান টনটনে। প্যাকেট খুলে সিগারেট দিয়ে বললাম, ‘না।’

‘তবে বাবু দিয়াশলাইখানিও দেন।’

ঘোড়াই যখন দিয়েছি চাবুক রেখে আর কী করব। দেশলাই বের করে দিতে গিয়ে দেখি, সিগারেট দু’খণ্ড করে ছেঁড়া হয়েছে। ভাবছি, অর্ধেকটুকু আপাতত ঝোলায় যাবে। তার আগেই হাত বাড়িয়ে বলল, ‘খাও গো অদরদা, বাবু দিলে।’

মাঝি তখন স্রোতের টানে, বৈঠা ছাড়তে পারে না। কেবল শোনা গেল, ‘রাখ।’

দরবেশ বাকি অর্ধেক ধরাল গোঁফদাড়ি বাঁচিয়ে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আচ্ছা বাবু, আপনি এলাত বেলাত গেছেন?’

বেলাত যদি বা বোঝা যায়, এলাত কোথায়, জানি না। কিন্তু হঠাৎ এলাত বেলাতের কথাই বা উঠছে কেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘না।’

সিগারেটে আর এক টান, একেবারে খতম। কোনওরকমে শেষের কাগজের চিলতে ধরে জলে ফেলে দিয়ে বলল, ‘না, আজকাল সবাই তো এলাত বেলাত যায় বাবুরা, তাই জিগেসাঁ করলাম।’

ঠোঁট চেটে, দাঁত দেখিয়ে একটু চোখ ঘোরানো হল। অধর মাঝির নৌকা তখন ডাঙায় লেগেছে। মাঝি আগে নেমে, মাটিতে চেপে খুঁটি পুঁতে দিল। ওপার থেকে যেমন নিরালা দেখেছিলাম, তেমনি নিরালা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে গুটিক্‌য় বেড়ার ঘর দেখা যায়। কোথায় যেন ছাগলছানা ডাক দিয়ে উঠল। আর মোরগের তড়পানি তাড়া, মুরগির কক্‌ককানি ছুট। ঘাটের জায়গাটা শক্ত, পাঁক নেই। দু’ আনা পয়সা দিয়ে নেমে গেলাম।

দরবেশও নামল। নামবার আগে আধখানা সিগারেট বাড়িয়ে ধরল। অধর মাঝি সিইটি নিয়ে কানে গুঁজল। দেখি, পাটাতন সরিয়ে জল সেঁচতে বসল আবার। কিন্তু দরবেশের পারানি কোথায়। তার বুঝি পারানি লাগে না।

এ আমার আন চিন্তা। মাঝি অধর। যাত্রী দরবেশ। এ ওকে ছিরেট ছিঁড়ে দেয়, এ ওর জন্যে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এ নয়া জমানার কথা নয়, সাবেকি ঘরানার নিয়ম। এ নিয়মে পারানির কড়ি পাটনি কী মূল্যে যাচাই করে তুমি জানবে কেমন করে।

সামনের দিকে চেয়ে দেখি, পথ একটা গিয়েছে পুবে। হাঁটা যাক। হারাবার ভাবনা তো নেই।

তোমার না থাক, দরবেশের তো আছে। বলল, ‘কোন দিকে যাবেন।’

‘যাই একদিকে।’

হাঁটতে লাগলাম। দরবেশ পাশে পাশে। বলল, ‘আবার ফিরবেন কখন।’

বলতে পারলাম না, পেটে জ্বালা ধরলে। বললাম, ‘দেখি একটু ঘুরে-ঘেরে। ফেরার নৌকো পাব তো?’

‘তা পাবেন। সব সময়েই এক-আধখানা পারাপার হয়।’

দু’পা চলে, আবার বলল, ‘বড় মজার ব্যাপার। বাবুরা যায় হিল্লি দিল্লি। আপনি এলেন গাঁয়ে জঙ্গলে।’

‘এমনি বেরিয়ে পড়লাম।’

‘জয় মুরশেদ, বড় মজার ব্যাপার।’

আবার সেই হাসি। তারপরে প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘সত্যি কোনও কাজ নাই বাবু?’

আশ্চর্য, লোকটা আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবছে নাকি। বললাম, ‘এখানে আবার কাজ কী থাকবে।’

দরবেশ বলল, ‘তা বাবু, কত রকমের কাজ থাকতি পারে। জমি-জিরেত কেনাকাটা, ধানচালের খোঁজ-খবর, পাটের আগাম দরাদরি। তারপরে গে আপনার, বডারের কাজকম্মো।’

‘বর্ডারের কাজ?’

দরবেশ এবার একটু চোখ গোল করল। বলল, ‘তা আর হয় না। আপনাদের মতন বাবুরা মাঝে মদ্দিই তো গাঁয়ে গেরামে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ-টুলিশ নয় বাবু, আপনাদের মতন সাফ-সুরত্‌ জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। মানে, বুঝতি পারছেন, খবর নেয়।’

গলা সে নিচু করল আরও। বুঝতে পেরেছি। এতক্ষণ বেশ ছিলাম। এবারে যেন বাংলা সীমানার দুর্গন্ধ পেলাম। এখন দুই বাংলার একটা সীমানা আছে। বললাম, ‘না, আমার কোনও কাজ নেই। একটু আসতে ইচ্ছে হল চলে এলাম।’

‘সে বড় মজার ব্যাপার।’ হেসে বলল, ‘তবে, দুনিয়ার তাবত লোকের একটা ধান্দা থাকে তো, তাই জিগেসাঁ করলাম।’

ধান্দার কথাটা শুনে বিরক্তি লাগল। এ দরবেশকে বোঝাবার কিছু নেই। রুষ্ট হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কেন বেরিয়েছ?’

‘আমি?’ দরবেশ ঝোলা ধরে ঝাঁকুনি দিল। ডুপ্‌কিতে দু’বার তাল দিয়ে, মাথা নেড়ে হেসে বলল, ‘মহাপেরাণীর ধান্দায় বাবু, পেটের ধান্দায়। যদি বলেন, কীসের মজদুরি, মুরশেদের নামের মজদুরি।’

কথাটা শুনে, মনের কোথায় একটা চমক লেগে গেল। মুরশেদের মজদুর এমন সহজে পেটের ধান্দার কথা বলে। সকলের ধান্দা আছে, তোমারও কি ধান্দা নেই। কার নামের মজদুরি তোমার, কীসের খোঁজে ফেরো। সহসা দরবেশের কথার কোনও জবাব দিতে পারি না। সে তখন ডুপ্‌কিতে ডুপ্‌ ডুপ্‌ করছে। আর আমার চমকের আলোয়, মনের ভিতরে একটি ছেলেকে দেখতে পেলাম। যার চোখে পড়ন্ত বেলার উদ্বেগ, যার ঠোঁটে সাবধানী চুপি চুপি শব্দ, ‘যাব, যাব, যাবই।’

.

০২.

দরবেশের পাশে পাশে, ইছামতীর ধারের গাঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে, আমার চমকের চিকুরে দেখলাম, ছোট ছেলে, পাঠশালার পড়ো, বছর দশ বয়স। ওপার বাঙলার ঢাকা শহরের একরামপুর দিয়ে হেঁটে চলেছে। জিয়সের গলিতে সে দৌড় দিয়ে বাড়ি ঢোকে। মায়ের পায়ের কাছে বই সেলেট নামিয়ে দিয়ে দে ছুট। মায়ের মুখের দোষ দিয়ো না, হাঁক দিয়ে বলল, ‘ওরে মুখপোড়া কোথা যাস?’

ছেলের গলায় উত্তেজনা, রুদ্ধশ্বাস, ‘খেলতে।’

‘খেয়ে যা রে।’

ছেলে তখন আবার একরামপুরের বড় রাস্তায়। চোখে তার পড়ন্ত বেলার রোদ। ইস্‌, ছোট বেলা, চলে যায়। খালি পা, গায়ে একটি পাতলা জামা, ডুরি পরানো প্যান্ট। জামার পকেটে তার হাত ঢোকানো। সেখানে হাতের মুঠোয়, ষষ্ঠ জর্জের মাথা ছাপানো দুটি নতুন তাঁবার পয়সা। যার গন্ধ স্বাদ ওর জানা। হাতের ঘামে যা চটচটিয়ে উঠেছে। পকেটের মধ্যে। এই পয়সা দিয়ে ও যাবে যাবে যাবেই। পাঠশালার জেলখানা থেকে পালাতে পারেনি, হেড পড়োটা, ইঁদুর ধরা বেড়ালের মতো তাকিয়েছিল। নইলে আগেই যেত। এই পয়সা দিয়ে দুটো জিভে গজা কেনা যেত। দুটো অমৃতি বা দুটো লুচি আর মোহনভোগ। জিভের সব লালা ও ঢোক গিলে খেয়েছে।

এ দু’ পয়সা তো রোজের পয়সা নয়। দুটো পয়সা, এ যে মেলে কালে-ভদ্রে। এই পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া যায় না। তার চেয়ে অনেক বিরাট স্বপ্ন সফল করতে হয়। ও যাবে, আজ যাবেই যাবে।

কদমতলা পার হয়ে ওর পাগলা ছোটা নারিন্দার পুলের দিকে। পিছন থেকে আসে ঘোড়ার গাড়ি, সামনে থেকে আসে ঘোড়ার গাড়ি। জোড়া ঘোড়ায় টানা, যাকে বলে পালকি গাড়ি, ঢাকা শহরের সেই আমলের সর্বকালের একমাত্র যানবাহন। তাদের চাবুকে বাজে শিস। ছোট ছেলেটার ডাইন-বাঁয় জ্ঞান নেই, দেখে হাঁক দেয়, ‘আরে মাক্‌খন, স্‌সরকাইয়া যা।’

ওরে মাখন, সরে যা। ছেলেটার নাম মাখন নয়, গাড়োয়ানের আদরের ডাক। ননী মাখনের থেকে, আদর করে আর বেশি কী-ই বা বলা যায়। মাঝেমধ্যে বড় লোকের এক্কা গাড়ি, বড় ঘোড়া, দুলকি চাল, চোখে ঠুলি, মাথায় শিরস্ত্রাণ। গাড়ির মধ্যে দেখবে, মোটাসোটা গোলগাল মানুষ, নয়তো সুন্দর সুন্দর বউ। গা ভরতি তাঁদের গহনা, সুন্দর শাড়ি, আর মিঠে গন্ধ। ছেলেটার এইরকম ধারণা। ক্বচিৎ এক-আধটা মোটরগাড়ি। তাতে যে কারা চলে, ওর কোনও ধারণা নেই।

একবার ও চকিত হয়, ছোটার বেগ একটু কমে। বাঁ দিকে কালাচাঁদবাবুর মাঠ। সেখানে ওর বন্ধুরা তখন অনেকে খেলায় মত্ত। টেনিস বলের লোফালুফি, রিঙয়ের ছোড়াছুড়ি। কে যেন ওর নাম ধরে ডাক দিয়েছে। তাই ও একবার চকিত হয়, একটু বেগ কমে। আবার পরমুহূর্তেই বেগ বেড়ে যায়। ওর সময় নেই। বেলা যতটা পড়ন্ত, ওর চোখে তার থেকে বেশি। ওর চোখে রোদ বাড়ন্ত। কম তো বলতে নেই। হাঁড়িতে চাল না থাকলেই বাড়ন্ত।

বাঁ দিকের সাজিয়ালনগরের রাস্তা ছাড়িয়ে ও তখন নারিন্দার পুলের ওপর। নীচে বহে যায় তরতরানো খাল। খালে কালো জল, তাতে রোদ চিকচিক খেলা। নৌকা দেখা যায় না। টানের দিনে, খাল একটু খালি খালি থাকে। খাল ওর বাঁয়ে গিয়েছে সোজা, ডাইনে দিকহারা। হঠাৎ এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে, কোনদিকে যে ঢল, তা টের পাওয়া যায় না। যাবে কেমন করে। ধু ধু মাঠের মতো ওই যে সবুজ দেখা যায়, সব কচুরিপানা। তার মাঝখান দিয়ে, কোথায় যে আসল খাল তরতরিয়ে চলে গিয়েছে, হদিস পাওয়া যায় না পুলের ওপর থেকে।

না-ই পাওয়া যাক, নীচে নামলেই পাওয়া যাবে। ও তখন পুল পেরিয়ে ডাইনের ঢালুতে নামে ছুটে। ইটের ভাটা পেরিয়ে ছোটে খালের ধার দিয়ে দিয়ে। ধারে ধারে পাড়া, গরিব মুসলমানদের। তাদের বাড়ির নীচে নীচে খানকয়েক ইট বা তক্তা বা কাঠের গুঁড়ি ফেলে ঘাটলা করা রয়েছে। এ তো পাছদুয়ার কি না। ঘাটের দখল বিবিদের। পাছদুয়ার হল খিড়কি। ওদিকে গিয়ে দেখ আগদুয়ারে সদর। মিঞাদের আনা-যানা সেখানে। ঘাটে ঘাটে তখন বিবিদের সাফ-সুরতের ধোয়াধুয়ি। কেউ মাজে বাসন, কেউ ধোয় গা। মুখের সাবানের ফেনায় কারুর একটি ধানের মতো নাকের নোলক গায়েব। কোনও কোনও ঘাটে নৌকা বাঁধা।

ছেলেটির নজর একবার বাড়ির দিকে একবার ঘাটের দিকে। ঘাটের দিকে নয়, ঘাটে বাঁধা নৌকার দিকে। আগে দেখে নৌকা, তারপরে দেখে বাড়ি। ঘন নিশ্বাসে বুক ওঠে নামে। কপালে নাকে ভুরুতে ঘাড়ে গলায় ঘাম ঝরঝর। ত্রস্ত উৎকণ্ঠা ওর চোখে। ও যা খোঁজে, তা কোথায়।

আছে। দু’কদম এগোতেই দেখতে পায়, আছে। নতুন গাবের আঠা মাখানো কোষা ডিঙ্গিখানি। একটা বাঁশের খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা। টানের দিনের খাল, স্রোত কোথায় কে জানে। ঢেউ নেই একরত্তি। যেন আয়নার ওপরে বসানো কোষা ডিঙ্গা, উলটো করে নিজের মুখ দেখছে। ঘাটেতে নেই কেউ। ছেলেটি ওপরে তাকিয়ে দেখে, এক পাশে ঝিঙের মাচা আর এক পাশে লাউ। মাঝখানে কোমর সমান কঞ্চির আগল। আগলের কাছে এসে ইতিউতি দেখে। এক মাচার নীচে নটে শাক, আর এক মাচার নীচে বেগুনের চারা। মাঝখানে নিকানো উঠোন, দু’পাশে দুই মাটির ঘর, মাথায় টিনের চাল। ছেলেটির চোখে ধিকিধিকি জ্বলে ওঠে আশা। ডাক দেয়, ‘নানি ও নানি।’

দুই ডাকেতেই ঘর থেকে সাড়া। এক বুড়ির গলা শোনা যায়, ‘কে রে? অ সলিমা, দ্যাখ তো ক্যাটায় ডাকে।’

সলিমা বেরিয়ে আসার আগেই ছেলেটি জবাব দেয়, ‘নানি, আমি।’

মুসলমান দিদিমাকে যে নানি বলে ডাকতে হয় ও তা জানে। সলিমা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে, ঘাড় কাত করে ওকে দেখছে। বেড়া বিনুনি বাঁধা, ছ সাত বছরের মেয়েটা। লাল রঙের ফ্রক গায়ে। চোখে সুরমা, দুই হাতের তালু মেহেদিতে রাঙানো। ছেলেটির দিকে চোখ রেখেই, নানিকে জবাব দেয়, ‘একটা ইন্দু পোলা।’

একটা হিন্দু ছেলে। দিদিমা তখন বেরিয়ে এসেছে। সাদা কাপড়, ঘোট আর ময়লা, গায়ে একটা পুরনো ছিটের ঢলঢলে জামা। বুড়ির ফরসা মুখের চামড়ায় মেলাই হিজিবিজি দাগ। দাঁত নেই, চোপসানো ঠোঁট দুটি পানের পিচে টুকটুকে লাল। ঠিক বুলবুলি পাখির ইয়ের মতো, ছেলেটির মনে হল। চোখে ছানি পড়েছে কি না কে জানে। লোমওঠা ভুরু তুলে, টুকটুক করে দেখে বুড়ি। জিজ্ঞেস করে, ‘কী কস্‌ রে সোনা।’

ছেলেটির পকেটে তখনও হাত, দু পয়সায় ঠেকানো। বলে, ‘ডিঙ্গা ভাড়া চাই।’

বুড়ি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে আগলের কাছে। তার কাপড় ধরে আসে নাতনি সলিমা। বুড়ি ভুরু কাঁপিয়ে দেখতে দেখতে ফোকলা মুখে হাসে। বলে, ‘এতটুকু পোলা, সাঁতার জানোনি?’

ছেলেটির চোখে চকিত হতাশার মেঘ দেখা দেয়। বলে, ‘জানি।’

বুড়ি হাসতে হাসতেই ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘না গো সোনা, মিছা কথা কও।’

ছেলেটির মুখের ঝলকে প্রতিবাদ। বলে, ‘দেখামু?’

তাতেও বুড়ির সন্দেহ যায় না। বলে, ‘দেখাও তো।’

ছেলেটি একটানে জামা খোলে। প্যান্টে হাত দিয়েই ঠেক খায়। সলিমা যে অবিশ্বাসী চোখে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে! নানির সামনে ল্যাংটা হওয়া যায়। তা বলে, ওই এক ফোঁটা মেয়ের সামনে! নানি বলে, ‘ওদিক ফিরা খোল, কেউ দেখব না।’

নাতনির দিকে ফিরে বলে, ‘যা তো সলিমা, গামছাখান লইয়া আয়।’

নানি বুড়ি এমনি ছাড়বার পাত্রী নয়। ছেলেটি দেখে, তবু সলিমা যায় না। কিন্তু গরজ বড় বালাই। সাঁতার জানার পরীক্ষা দিতেই হবে। মনে মনে সলিমাকে গালাগাল দেয়, ‘পেতনীটা, গিদধরীটা।’ তারপরে নানির কথানুযায়ী, পিছন ফিরে প্যান্ট খুলেই দৌড় একেবারে জলে। ঝাঁপ খেয়ে এক ডুবেতেই অগাধ জলে। এবার দেখ, পাকা হাতে, কাঁথায় যেমন ছুঁচের ফোঁড় পড়ে, ছোট ছেলেটির নগ্ন শরীর তেমনি করে জলে ফোঁড় কেটে কেটে এগিয়ে যায়। যেন জলের মাছ না পোকা। মাঝ খালে গিয়ে ফিরে তাকায় পাড়ের দিকে। বুড়ি তখন ঘাড় নেড়ে হাসছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

ছেলেটি ফিরে আসতে আসতেই, সলিমা ছুটে গিয়ে গামছা নিয়ে আসে। ইন্দুর পোলাটাকে দেখে তখন তার চোখে সমীহ। নাকের নোলকটি দুলিয়ে হাসবে কি হাসবে না, ভাবছে। তারপরেই নানির কাপড় ধরে চিৎকার করে ওঠে, ‘নানি, জোঁক জোক।’

হ্যাঁ, গুটি তিনেক ছোট ছোট কালো জোঁক ছেলেটির পায়ে গায়ে কুচকির কাছে ধরেছে। নানি গামছা নিয়ে, আগল পেরিয়ে এগিয়ে আসে। ছেলেটির মাথায় গামছা ফেলে, টেনে টেনে জোঁক খুলে দেয়। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলে ‘আ আমার সোনার চাইন, জোঁকে খাইয়া ফালাইছে।’ তারপরে গামছা টেনে নিয়ে, নিজের হাতে মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘এমুন সোন্দর সাঁতার জানো ছাও, তোমারে শিখাইল ক্যাটায়?’

ছেলেটি বলে, ‘বাবায় আগে আগে, তারপরে আপনে আপনে।’

ইতিমধ্যে ও প্যান্ট গলিয়ে নিয়েছে। জামাটাও পরে নেয়। পকেটে হাত দিয়ে দেখে, পয়সা দুটো আছে কিনা। কিন্তু তখনও ওর চোখে সন্দেহের ঘোর। বলে, ‘এইবার ডিঙ্গা দ্যান।’

বুড়ি ওর মাথার জল গামছা দিয়ে ঘষে ঘষে শোষে। বলে, ‘দিমু রে সোনা। কতক্ষণের লেইগা নিবি?’

‘এক ঘণ্টা।’

বলেই পকেট থেকে চকচকে তামার পয়সা দুটো বুড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরে। কোষা ডিঙ্গা ঘণ্টায় দু’পয়সা ভাড়া। তামার ঝলক বুড়ির লাল টুকটুকে ফোকলা ঠোঁটে। বলে, ‘সলিমা, বৈঠাখান আইন্যা দে।’

সলিমা তখন এক পায়ে খাড়া। নানির কথামাত্র দিল ছুট। নানি পয়সা দুটো নিয়ে আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘তোমাগো বাড়ি কই?’

ছেলেটির ব্যাকুল চোখ তখন উঠোনের দিকে। রাক্ষুসীটা বৈঠা নিয়ে আসে না কেন। বেলা যে যায়। রোদের রং যেন লাল লাল দেখায়। নানিকে জবাব দেয়, ‘একরামপুরে।’

‘আগে নি আইছ এইখানে? ডিঙ্গি নি বাইছ?’

‘দুইবার বন্ধুগো লগে।’

‘এইবার যে সোনা একলা? পারবা নি?’

ছেলেটি জোরে ঘাড় কাত করে। সলিমা দু’হাতে বৈঠা নিয়ে আসে। ছেলেটি ছোঁ মেরে তুলে নেয়। ছুট দিয়ে নামে ঢালুতে, লাফ দিয়ে কোষা ডিঙ্গায়। বুড়ি বলে চেঁচিয়ে, ‘খুটার কঞ্চিখান লইয়া যাও, লগির কাম দিব। যাইবা কোন দিকে?’

‘গ্যান্ডাইরা।’

মনের কথা নয়, মিথ্যে কথা বলে। বুড়ি বলে, ‘কিনারে যাও, ডাঙ্গায় লগি মারতে পারবা।’

ছোট হাতের একটু টানাটানিতেই কঞ্চির লগি খুলে যায়। সেটা ডিঙায় রেখে, বৈঠা দিয়ে ডাঙায় ঠেলা দিয়ে, ভেসে যায় অনেকখানি। পুলের ওপর থেকে খালের যে বাঁধ দেখা যায়নি, ঢাকা ছিল কচুরিপানায়, তাই এখন দেখা যায়। কালো একটা গা চকচকে সাপের মতে, বাঁক নিয়ে চলে গিয়েছে পুবে। কচুরিপানার যত ভিড় সব ডান দিকে, সীতানাথের আখড়ার মাঠে। মাঠে নানান খেলার ভিড়। ভলি লাঠি চু কিত্‌কিত্‌ আর রিং। ওখানেই বা ওর কত বন্ধুরা রয়েছে, কে জানে। তবে অনেক দূরে, কচুরিপানার একটা কালো সবুজের লকলকে রাজ্য রয়েছে মাঝখানে। জলের দিকে ওদের কারুর দৃষ্টি নেই।

সবাই যখন তীরে, সবাই যখন মাঠে খেলছে তখন এই ছোট মাঝিটি কোথায় যায়। কোন দরিয়ায় সে পাড়ি দেবে। মা ডেকেছিল পিছু পিছু। বাড়া ভাত বুঝি এখনও পড়ে রইল। এই আসে এই আসে করে মা হেঁশেলে তুলে রাখতেও পারছে না। কিন্তু সে যে এখন মাঝি হয়ে বৈঠা টানে, তরতরিয়ে ভেসে যায় দোলাই খালে, মা তা জানে না। এ মাঝি শুধু জানে, সে খাল দিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গায়। সেখানে কী আছে?

সেখানে আছে অথৈ জল বুড়িগঙ্গা। আর কী? ওপারে ইটের ভাটা, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠে। এপার থেকে মনে হয়, ইটের ভাটা লালে লাল। আর কিছু না? হ্যাঁ, শসা ক্ষিরাইয়ের খেত, মটর কলাইয়ের মাঠ। আকাশের কোনও শেষ নেই। কেন, ওই সবে কী আছে। সবাই যখন শত খেলায় মেতে, একটু পরে সবার যখন বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসার সময়, বাড়া ভাত পড়ে থাকে পিছনে, তার ওপরে অনেক রক্তচক্ষু শাসন পীড়ন, সব ভুলে তুই বুড়িগঙ্গায় কেন যাস ডিঙ্গা বেয়ে। খেলার আনন্দ না হয় নেই। ক্ষুধাও কি তোকে ছেড়েছে। ক্ষুধা যদি বা ছাড়ে, কোনও ভয়ও কি নেই। কী সুখ তোর খাল দিয়ে বুড়িগঙ্গায় যাবার। কীসের খোজে।

ও তা জানে না। ওর চোখে তখন দোলাই মোহনার অথৈ বুড়িগঙ্গা। বাঁক পেরিয়ে ও ততক্ষণে, সোজা পুবে নেমে চলেছে। ক্যাপটেন কুক, কলম্বাস ওর পড়া, কিন্তু তাঁরা ওর মাথায় নেই। সেখানে ওর আবিষ্কারের কিছু নেই। কী এক অচিন আনন্দ যেন বুড়িগঙ্গার বুকে রয়েছে। ডিঙ্গা বেয়ে সেই মোহনায় না গেলে, তা যেন জানা যাবে না। ওর চোখে কেবল বুড়িগঙ্গার ঢেউ।

কিন্তু ডিঙ্গার তলায় যেন কেউ থাবা দিয়ে আঁচড়ায়। উলটো টানে ঠেলে নিতে চায়। মনে পড়ে, বুড়িগঙ্গার স্রোত আসছে, তারই টান। বুড়ি ঠিক বলেছিল, ‘কিনারে কিনারে যাও, ডাঙায় লগি মারতে পারবা।’ মাঝি নয়া, বৈঠা তার কথা শোনে না। ডিঙ্গা তো মাতাল। মাথা একবার বাঁয়ে যায় তো বাঁয়েই ফেরে ডাইনে তো ডাইনেই। কষ্টেসৃষ্টে পাড়ের কাছে নিয়ে, লগি তুলে খোঁচা মারে মাঝি। বুড়িকে বলেছিল, গ্যান্ডারিয়া যাবে। এখন দেখ, গ্যাভারিয়া বাঁয়ে, ডাইনে কলুটোলা। ঘাটে ঘাটে মেয়ে-বউয়েরা গা ধোয়, বাসন মাজে। কলুটোলার দিকেই অনেক শান-বাঁধানো ঘাট, পুরনো পুরনো মন্দির। মস্ত মস্ত বট গাছ। তার ওপারে গ্যান্ডারিয়া নতুন গজাচ্ছে। জলে ঘাট মন্দির আর গাছের ছায়া যেখানে পড়ে সেখানেই যেন আচমকা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ছেলেটির চোখে তড়াগ ফোটে। ঝুঁকে পড়ে, শরীর বাঁকিয়ে লগিতে দেয় ঠেলা। পাখির দল বেশি ডেকে উঠলেই, মন আনচানিয়ে ওঠে। বেলা বুঝি যায়।

বিকেলের ঘাটে, পুরুষদের আনাগোনা কম। ঘাট এখন মেয়েদের এক্তিয়ারে। নয়া মাঝিটাকে তাদের লজ্জা নেই। তারা জল ছোড়াছুড়ি করে কলসি আড়াল দিয়ে। খিলখিল করে হাসে। পা দাপিয়ে দাপিয়ে সাঁতার কাটে। এমনকী নয়া মাঝিকে ডাক দিয়ে বলে, ‘অই ছ্যামরা, কই যাস?’

ছ্যামরা বলে ছোঁড়াকে। ছোঁড়ার তখন মশকরা নেই মনে। ও ডিঙ্গার তাল সামলায়, চোখে বুড়িগঙ্গা ভাসে। তবু যখন শান-বাঁধানো পৈঠায় দাঁড়িয়ে গাছকোমর বাঁধা শাড়িতে, খালি গা মেয়েটা এক পায়ে ধিন ধিন করে নাচে আর বলে, ‘ওই ছ্যামরা বান্দর, তর মায় সোন্দর। কলাগাছে বল্লার চাক, ঘুইরা ঘুইরা বাপ্‌ ডাক।’ তখন সে আর নিজেকে তেমন নির্বিকার রাখতে পারে না। একবার হাত তুলে থাপ্পড় দেখায়। বোঝে না, তাতে ধিনধিনাকি মেয়েটার নাচন বকন আরও বাড়ে। মেয়েটা একনাগাড়ে বলে যেতেই থাকে। ছোঁড়াটা বাঁদর তার মা-সুন্দর। কলাগাছে কি আবার বোলতার চাক থাকে নাকি। আর তা না হয় হবে, শুধু শুধু ও ঘুরে ঘুরে বাপ ডাকতে যাবে কেন। আর ডাকবেই বা কাকে। নয়া মাঝি তাই মনে মনে বলে ‘পেতনীটা যেন মরে।’

মনে মনে রাগ হলেও, তা মন জুড়ে বসতে পায় না। লগির খোঁচায় খোঁচায় ও টেনে এগোয়। দেখ, মুখে রক্তের বান, সারা গায়ে ঘাম ঝরে। কিন্তু লাল রোদটুকু যে কোথায় হারিয়ে যায়। লাল শুধু আকাশটাই থাকে। অথচ গ্যান্ডারিয়ার খেয়াঘাট পেরিয়ে, ডিঙ্গা তখনও সূত্রাপুরের বাজারের কাছে। সামনে লোহার পুল। চওড়া বড় ঝোলানো পুল তার ওপর দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলে। পুল পেরিয়ে আবার একটা বাঁক। কিন্তু পুলের তলায়, টান পেরোতে পেরোতেই, আকাশের লালে কালিমা দেখা দেয়। ছোট ছেলেটির চোখেও কালিমা নেমে আসতে চায়। জলের তলায় কাদের যেন বড় বড় থাবা, ডিঙ্গার তলায় খামচাতে থাকে। টেনে ছিটকে নিয়ে যেতে চায় পিছনে। অথচ, ওই তো সামনে, বাঁয়ে ফৌজি ব্যারাক, ডাইনে মালাকারপাড়া। মালাকারপাড়ায় বন্ধু বিলটু থাকে। ওদের পুরনো শ্যাওলা ধরা ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তো, দূরের বুড়িগঙ্গাকে অনেকবার দেখেছে।

ডান দিকের ডাঙ্গায় এখানে কয়েকটা জেলে নৌকা নোঙর করেছে। বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরে, খালে ঢুকে, রাত্রিবাস করে। মাঝিরা হুঁকো টানছে, জাল বুনছে। ছোট মাঝিটিকে কেউ কেউ তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু তাদের কৌতূহল নেই, জিজ্ঞাসাবাদ নেই, ধমকধামক নেই। মাঝিটিকে বোধ হয় নয়া বলে চিনতে পারছে না। কে যেন আবার গেয়ে ওঠে, ‘হায়, কী করিলি বিষ্ণুপিয়ে নিমাইচান্দকে বিদায় দিয়ে—এ-এ-এ-হে-হে-ই!’…

কানে আসে, তাই শোনা। ছোট মাঝিটি ঝোলানো পুল পেরিয়ে, ফৌজি ব্যারাকের ডাঙা ছুঁয়েছে। এবার ডান দিকে বাঁক, ছোট বাঁক। তারপরে বাঁক নিলেই বুড়িগঙ্গা। কিন্তু তার আগেই দেখ, মালাকারপাড়ার গাছের ঝুপসিতে, ঘাটে ঘাটে অন্ধকার নামে। ব্যারাকের পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বেজে ওঠে। ছোট মাঝিটার এক ঘণ্টা কত মিনিটে। ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ডে পলের অঙ্ক কি কষা হয় না। বুড়ি নানি, ডিঙ্গার মালিকানীর মুখখানি বুঝি এখন আর মনে নেই। কেবল বুড়িগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা।

নয়া মাঝি থামে না, সে চলে লগি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। এই ডাঙাতে একটা ভয়, ব্যারাকে নাকি গোরা আর গাড়োয়ালীরা থাকে। বিলটু বলেছে, ওরা কাউকে এপারে দেখতে পেলে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু দেখতে পাবে কী? সে তো উঁচু পাড়ের অনেক নীচে। আর একটু, আর একটু। তখন একবার মনে পড়ে একবার দেখা ঢাকেশ্বরীর প্রতিমার কথা। ধানমণ্ডাইয়ের মাঠ পেরিয়ে, সেই আশ্চর্য মন্দিরে যে প্রতিমা আছে। যাকে বললে, সব আশা পূরণ হয়।

ভাবতে ভাবতেই, সহসা যেন কী ঘটে। ডিঙ্গাটাকে কে যেন সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলে। হাতের লগি হাতে থেকে যায়, তলায় তলায় যেন কারা হাত দিয়ে ডিঙ্গা এগিয়ে নেয়। মুহূর্তে ছোট বাঁকটি ঘুরে যায় আর একটু দূরেই, দিগন্ত খোলা। কলকল ছলছল শব্দ। কিন্তু বুড়িগঙ্গা কোথায়। ওপার কোথায়।

দেখা যায়, অস্পষ্ট ছায়ার মতো। অন্ধকার পলে পলে বাড়ে। দূরের ওপারে কেবল একটি আলোর বিন্দু। হয়তো ইটের ভাটায় জ্বলে। আর, আলো নেই, তবু বুড়িগঙ্গার বুকে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় কোথাকার কোন আলো যেন চিকচিকিয়ে ওঠে। সেখানেই যে সে যেতে চেয়েছিল। অথচ অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে। আকাশে কখন কয়েকটি ঝিকিমিকি তারা জ্বলছে।

কিন্তু ডিঙ্গা টেনে নিয়ে যায় কে। মোহনা ডাইনে, যেদিকে সদরঘাট গিয়েছে, সেখানে কয়েকটা মাস্তুলের ছায়া। দু’একটা মিটিমিটি বাতি। ডিঙ্গা টেনে নিয়ে যায় কে। নয়া মাঝি বৈঠা নিতে ভুলে যায়। বাইতে তার আর মনে থাকে না। তার ছোট মস্তিষ্কে কোনও কার্যকারণের বোধ নেই। ডিঙ্গা ভেসে যায় কুটার মতো।

তারপরে সহসা আকাশ কাঁপানো হাঁক ‘সামাল, সামাল।’

নয়া মাঝির বুক ধড়াসে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে, প্রকাণ্ড এক কালো ছায়া, এগিয়ে আসছে তার ছোট্ট কোষা ডিঙ্গার ওপর। কথায় বলে, কোষাকুষি তার থেকে জল নিয়ে তর্পণ করা চলে। যখন সে ডিঙ্গা হয় তখন সে হাঁ-দরিয়ায় মোচার খোলা। বুড়িগঙ্গার বুকে যাবে যে, তার মাথায় কিছুই ঢোকে না। সামনের প্রকাণ্ড কালো ছায়াটাই ওকে গিলতে আসে, না কি সে-ই তরতরিয়ে তার কালো হাঁ-এর মধ্যে চলে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারে না।

আবার চিৎকার। এবার কয়েকজনের একসঙ্গে। তারপরেই ঠক করে কী যেন একটা ডিঙ্গায় এসে পড়ে। পড়েই, ডিঙ্গা ঠেলতে থাকে একপাশে। ঠেলতে ঠেলতে, কালো ছায়াটার কাছ থেকে সরিয়ে দেয় অনেক দূর! গলা শোনা যায়, ‘কে হে তুমি ব্যাতরিবত্‌ লোক। নাও বাইতে জানো না?’

আর একজনের গলা শোনা যায়, ‘একটা ছোট ছ্যামরা দেখি ডিঙ্গায়?’

আগের গলা, ‘জিগাও তো, যায় কই?’

পরের গলা, ‘কে হে তুমি, যাওন কোনখানে?’

তখন নয়া মাঝিটি বুঝতে পারে কালো ছায়াটি প্রকাণ্ড এক নৌকা। হাতির মতো তার ছইয়ের পিঠ। তবে কোষা ডিঙ্গা যে টানে চলেছিল, সেই টানে ধাক্কা লাগলে, এতক্ষণে মোচার খোলা ছত্রখান। তাই লম্বা লগি দিয়ে ঠেলে মাঝিরা সরিয়েছে। নয়া মাঝি এবার জবাব দেয়, ‘ডিঙ্গাটা আপনেই যায় গা, আটকাইতে পারি না।’

‘সব্বনাশ!’ প্রথম গলাটাই আবার শোনা যায়, ‘কাগো পোলা তুমি। নদীতে ডুববার চাও নাকি, আঁ? শিগগির লগিটা ধরো।’

নয়া মাঝি তখন বড় নৌকার লগিটা চেপে ধরে। মাঝিরা টেনে বড় নৌকার কাছে নেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘দড়ি আছে নি?’

নয়া মাঝি তার ডিঙ্গার দড়িটা বাড়িয়ে ধরে। একজন দড়ি নেয়। আর একজন হাত বাড়িয়ে বলে, ‘আইয়ো।’

ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিতেই একজন তাকে বড় নৌকায় টেনে তোলে। তুলে একেবারে ছইয়ের ওপরে পাঠায়। সেখানে হাল মাঝির কাছে তাকে বসায়। ছেলেটি দেখে, মাঝিরা ডিঙ্গা বেঁধে নেয় বড় নৌকার গায়ে। তারপরে ছইয়ের ওপরে আসে বাতি। চার মাঝিতে বাতি তুলে তাকে দেখে। নয়া মাঝিটির নজর তখন পুবে। যেখানে বুড়িগঙ্গা হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চোখে তার অন্ধকার। জল আসে কি না আসে। ভাবে ‘এ যাত্রা হল না। আবার কবে কে জানে। দু’পয়সা নয়, এবার চার পয়সা চাই। দু’ঘণ্টার কমে হয় না। আর—আর—আর—পাঠশালার ছুটির পরে নয়, আগে। পাঠশালা পালিয়ে।’…

ইতিমধ্যে মাঝিদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গিয়েছে। কাদের ছেলে সে, কোথায় যাবে। ভয় নেই, শীত নেই, মনিষ্যি কি না হে তুমি। একে একে সব কথার জবাব দেয় ছেলেটি। মাঝিরা বকা-ধমক করে আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসে। হুঁকা টানে। জানায়, তারা যাবে শহরের নবাবপুরের কাছে, মালপত্র বোঝাই করতে। বুড়িগঙ্গায় যেতে-চাওয়া মাঝিটির কপাল ভাল, এদের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে।

এখন নৌকা চলেছে, বুড়িগঙ্গার স্রোতের টানে। তবু হাল মাঝি বুড়া বলে, ‘জনা দুইয়ে দড়ি মার হে, পোলাটারে আউগাইয়া দেও আগে।’

ছোট ছেলেটি চিনতে পারে না, এরা হিন্দু না মুসলমান। হাল মাঝিটি দাড়ি-ভরতি মুখ। হাসে কি না বোঝা যায় না। ভুড়ুক ভুড়ুক হুঁকা টানে, আর একনজরে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। চোখ দেখলে অনেক সময় হাসি বোঝা যায়। ছেলেটির মনে হয়, হাল মাঝি যেন হাসে। তারপরে এক সময়ে হাল মাঝি যেন রহস্য করে জিজ্ঞেস করে, ‘কই যাইতে চাইছিলা বাসী।’

‘বুড়িগঙ্গায়।’

‘বুড়িগঙ্গার কোনখানে?’

‘বুড়িগঙ্গায়।’

এর বেশি সে বলতে পারে না। বলতে জানে না। মাঝি জিজ্ঞাসা করে, ‘ক্যান, কী আছে হেইখানে? কীসের খোঁজে?’

‘জানি না।’

‘জানো না?’

বুড়ো মাঝি খল খল করে হেসে ওঠে। অন্য মাঝিদের হেঁকে বলে, ‘শোন, পোলায় কই যায়, কী চায় জানে না।’

সকলেই হাসে। কিন্তু কেউ খবর রাখে না, ছেলেটির বুকে তখন কত অন্ধকার। তেমন অন্ধকার তখন দোলাই খালে, বনে, গাছে, মন্দিরে, ঘাটেও নামেনি। বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের ওপরে তখন কেবল কতগুলো মুখ। বাবা, মা, দিদি, মাস্টারমশাই। আঃ, যেন বুকের মধ্যে বেত্রাঘাত। ধুকধুকিতে ঢেঁকির পাড়।

টানে টানে, অল্প সময়েই নানির ঘাটে এসে ওঠে। নানি তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে, বাতি নিয়ে ঘাটের ওপরে বসে। বগলের কাছে সলিমার মুখে আলো পড়েছে। ছেলেটির শঙ্কা, বুড়ি এবার বাড়তি পয়সা দাবি করবে। এক ঘণ্টা তো কখন কাবার। পাড় থেকে বুড়ির গলা ভেসে আসে, ‘অ মাঝিরা, কোষাডিঙ্গা লগে, এক পোলারে নি দ্যাখছ?’

বড় নৌকা তখন বুড়ির ঘাটের কাছে, লগি ঠেলে দাঁড়িয়েছে। হাল মাঝি জবাব দেয়, ‘ধইরা লইয়া আইছি। পোলায় তো আইজ বুড়িগঙ্গায় যাইতো।’

ছেলেটি ততক্ষণে কোষাডিঙ্গায় নেমে আসে। বুড়ি বাতি নিয়ে তাড়াতাড়ি এগোয়। মুখে বলে, ‘অয় আল্লা গো, এই পোলারে কি জিনে ধরছে।’

ছেলেটির গায়ে আলো পড়ে। সে ডিঙ্গা থেকে নেমে, কঞ্চির লগি কাদায় পোঁতে। ডিঙ্গার দড়ি বেঁধে দেয়। কিন্তু বুড়ির দিকে চায় না। বড় নৌকা লগি তুলে, পশ্চিমে চলে যেতে থাকে। মাঝিরা তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। বুড়ি এসে ছেলেটির হাত ধরে। নয়া মাঝির হাল তবিয়ত তখন খুবই খারাপ। সলিমার চোখের পাতা পড়ে না। ইন্দুর পোলাটারে সত্যি জিনে পেয়েছে কি না, তার সুরমা-টানা চোখে তখন সেই জিজ্ঞাসা। নয়া মাঝি বলে, ‘নানি, আমার পয়সা নাই।’

নানি অবাক মানে। বলে, ‘পয়সা? পয়সার কী কাম?’

‘আপনের ভাড়ার পয়সা।’

বুড়ির গলায় তখন স্নেহ বিদ্রূপ হাসি, সকলে মিলে খেলা করে। বলে, ‘আরে, আমার হজরত রে, তর পয়সার লেইগা নি বইয়া রইছি? দুধের পোলারে ডিঙ্গা দিছি, জলে ডোবে না সাপে খায়, হেই চিন্তায় মরি। তর বাপ্‌ মায়ের কী জান রে, তারা না জানি কী করতে আছে। বাড়িত নি যাইতে পারবি?’

বাপ্‌-মায়ের কথা উচ্চারণ মাত্রই বুকে যেন শেল হেনে যায়। ও কোনওরকমে বলে, ‘পারুম।’

বুড়ি তৎক্ষণাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘তবে যা গা।’

নয়া মাঝি যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে যায়। পথে পথে দোকানে দোকানে বাতি। গাড়িতে বাড়িতে বাতি। ডিঙ্গার খোঁজে যাবার বেলায়, রোদ যত বাড়ন্ত মনে হয়েছিল, এখন ফেরার বেলায় সন্ধ্যারাত্রিকে যেন মাঝরাত্রি দেখছে। বড় রাস্তা থেকে গলির মুখে এসে, নিশ্বাস প্রায় বন্ধ। স্বয়ং ঢাকেশ্বরীর ওপরেও যেন ভরসা রাখা যাচ্ছে না। গলিতে ঢুকতেই, এক জানালায় আলো। সেখানে তখন পড়া চলছে। সকলের খেলা কখন ভেঙেছে। ঘরে ঘরে সবাই বই খাতা নিয়ে পড়তে বসে গিয়েছে। আর ও এখন ফিরছে। গায়ে ওর এখনও দোলাইয়ের জলের গন্ধ।

আর একটু ঢুকতেই, সাড়া পড়ে যায়। প্রথমে চোখে পড়ে এক প্রতিবেশীর। তারপরে আর এক প্রতিবেশীর। ছেলেটির নাম ধরে সবাই বলে, ‘আইছে, আইছে।’ যার অর্থ, খোঁজাখুঁজি অনেকক্ষণ ধরেই চলছে। তারপরেই, একটা দোতলা বাড়ির থেকে একটি আলো ছুটে আসে। দিদি! তার পিছনেই মা! গেল গেল, নয়া মাঝির প্রাণটা বুঝি ভয়েই যায়। মায়ের গলা শোনা যায়, ‘কই, দেখি কই ও?’

তারপরেই ঠাস ঠাস, ‘আরে যম রে, আরে মরণ রে, তর মুণ্ডু রাখুম না।’

যেন মুণ্ড বলি দেবার জন্যেই এত খোঁজাখুঁজি, হা-হুতাশ। মা আর দিদির কথাবার্তাতেই বোঝা যায়, ইতিমধ্যে থানায় খবর দেবার কথা চিন্তা করা হয়েছে। দরজার কাছেই, ছোট আদালতের বিচার শুরু হয়। আসামিকে বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে কি না। মায়ের অভিমত না। সন্ধ্যা-আহ্নিক করে উনি এখন একটু মহাভারত নিয়ে বসেছেন। ওঁর কাছে কাল সকালে হাজির করলেই হবে। দিদির অভিমত, তা নয়। উচ্চ আদালতের সাজাটা এই রাত্রেই হোক, ওর ইচ্ছা। শেষ পর্যন্ত মায়ের কথাই থাকে। দিদি আসামিকে নিয়ে উপস্থিত করে পড়ার ঘরে, যেখানে মাস্টারমশাই রয়েছেন, আর মেজদা। মেজদার চোখে রাগ না ঘৃণা, বোঝা যায় না। সেই রকম একটা কিছু। ওর নাকের পাটা ফোলানো। ওর হাতে শাস্তির ভার থাকলে ডগলাস ফেয়ার ব্যাংকস-এর তামেচা কাকে বলে, বুঝিয়ে ছাড়ত। তারপরে কবুলের পালা। কবুল করতেই হয়, কেবল বুড়িগঙ্গার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। কবুলের পর হাত-মুখ ধোয়া। তারপরে, মাস্টারমশাইয়ের সামনে ঠ্যাং ফাঁক করে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। হায় মাঝি, পাপের কী ভরাডুবি!

কিন্তু কেউ কি জানত, কান ধরে যখন দাঁড়িয়ে তখন ওর চোখে বুড়িগঙ্গার ঢেউ। রাত্রে খেয়ে যখন দিদির পাশে শোয়, বাতি নিবে যায়, ওর ঘুম-জড়িয়ে আসা চোখে বুড়িগঙ্গা ভাসে। হাল মাঝির হুঁকার শব্দ আর জিজ্ঞাসা, ‘কী আছে সেখানে, কীসের খোঁজে?’…

আজ, এখন ইছামতী পার হয়ে চলেছি, এক অচেনা গ্রামের পথে। সেই ছেলেটিকে দেখি, আমার রক্তে, আমার প্রাণে, আমার মন জুড়ে বসে। এই যে দরবেশ পুছ করে, ‘আপনি কোথায় বেরয়েছেন, কীসের খোঁজে।’ কী জবাব দেব ওকে। সেই ছেলেটি বলতে পারেনি। আমিও পারি না। তখন সেই ছেলেটির চোখ জোড়া ছিল রূপের তৃষ্ণা। বুড়িগঙ্গার রূপ, ওপারের রূপ। আজও তাই দেখি, দু’চোখ ভরা তৃষ্ণা, তৃষ্ণা। কিন্তু কীসের খোঁজে, সেই অরূপের কী নাম, কে জানে। বেরিয়েছি অনেক কাল, চলেছি কালান্তরে। এখন ভাবি, এই মানুষ আর প্রকৃতির রূপের হাটে, অরূপের নাম যদি দিই, মনের মানুষ, তবে কেমন হয়।

কিছু হয় না। কেবল বলতে হয়, কোন মানুষে, সেই মানুষ আছে! থাকে কোথায়! চলে কোন আজবের কলে। দরবেশকে কিছু বলতে পারি না।

হঠাৎ হাঁক ওঠে, ‘এই যে মামুদ গাজি, একটু নাম হবি নাকি?’

দরবেশ দাঁড়িয়ে পড়ল। আশেপাশে ঘর। বিরাট বটগাছের নীচে ছায়ায় মুদির দোকান। দোকানি ডাক দিয়েছে। আরো দু-একজন গাছের নীচে উটকো হয়ে বসে। এতক্ষণ যাকে জানা ছিল দরবেশ বা সাঁইবাবা বলে। সেটা অবিশ্যি নিজের মনে মনে জানা। আসল পরিচয় জানা গেল, ইনি মামুদ গাজি।

গাজি ডুপ্‌কিতে ডুপ্‌ ডুপ্‌কি শব্দ তুলে বলল, ‘তা হবি নে কেন। নাম নিয়ে তো বেরিয়েছি।’

আমাকে ডাক দিয়ে বলল, ‘আসেন বাবু, আপনাকেও একটু শোনাই।’

বলে গাজি ঝোলা থেকে বের করল ঘুংগুরের গোছা। সেটা জড়ানো বাঁ হাতের আঙুলে। ডান হাতে ঠোকা দিল ডুপ্‌কিতে। অনেকটা ছড়া কাটার মতো শুরু করল, ‘আমি গুরু করব শত শত, মন্ত্র করব সার। যার সঙ্গে মন মিলবে দায় দিব তার॥’…

.

০৩.

দু’কলি আওড়াবার পর খানিকক্ষণ চলল ডুপ্‌কি ঘুংগুরের তাল মেলানো। বোধ হয় একেই বলে আসর জমানো। ডুপ্‌কিতে যে এত রকমের বোল ফোটানো যায়, আগে জানা ছিল না। তাও ওই শ্রীহস্তে। আঙুল তো নয়, মরচে পড়া লোহার ডান্ডা। বোধ হয় ঘা দিলে পাথর ভাঙে। আর ডুপ্‌কির চামড়া তো সামান্য। কিন্তু সামান্য ও পলকা মিহি চামড়াখানি দেখছি গোদা আঙুলের প্রেমে মজেছে। একবার ভাব দেখ।

তা হবে। কাঁটা গাছে ফুল ফোটে। তার রূপ দেখে মরি, গন্ধে ভোমরা হতে সাধ। এই বিকট কিম্ভূত পাথরের চাংড়া! দেখ গিয়ে, তার গায়ে কেমন হরেক রঙে সুন্দরী ফুল ফুটে আছে। কার রসের ধারা কোন বিজনে বহে, কে জানে। অধম মাঝি-মামুদ গাজি, গাজির হাত-পলকা ডুপ্‌কি, কাঁটা গাছ-রূপের ফুল, পাথর চাংড়া-সুন্দরী ফুল, এদের মিলজুলের রসের ধারা কোন বিজনে বহে, কে জানে। কিন্তু গাজি বাবুকে কেন বিপদে ফেললে। গ্রাম জুড়ে সে তার আসর বসাক। বাবু যাক তার আসরে। গাজি আছে মহাপ্রাণীর ধান্দায় মুরশেদের নামের মজদুরি করবে সে। বাবুর তো কোনও খোঁজই জানা নেই। বাবুর বরং সেই জানাতেই যাওয়া ভাল ছিল। ভাল ছিল আরও এক কারণে। গাজি তো দু’ হাত তুলে বাজাচ্ছে, মাথা নিচু, চোখ বোজা। মাঝে মাঝে পিছনের বাবরিতে ঝটকা লাগছে। এদিকে শ্রোতার দল বাবুর দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না। বাবুর রূপ দেখে নয়। মানুষ কে, যায় কোথায়, গাজি কেন গান শোনাতে চায়, এখানে কেন। ঘুরে ফিরে, চোখে চোখে সেই এক কথা। নৌকাতে যেমন গাজির ছিল।

কিন্তু তার আগে এদিকে শোনো, গাজি কেমন তাল ধরিয়ে দিয়েছে। প্রথমে শিরদাঁড়ার কাছে কোথায় একটা তাল অনুভব করছিলাম। ওদিকে বটতলায় একজনের কোমরে দোলানি লেগে গিয়েছে। আমার কোমর দোলেনি। পায়ের আঙুলে তাল শুরু হয়েছে। ভিতরে জোড়া তাল লেগেছে। সর্ব অঙ্গ ফাঁকি দিলেও, পায়ের আঙুল মানেনি। তারপরেই আকাশের দিকে মুখ করে, গাজি সুর করে হাঁক দিল, ‘ওহে দেল আমারে বলে দ্যাও না…।’

ইতিমধ্যে আসরে অনেক শ্রোতা জুটে গিয়েছে। অধিকাংশই এল ছুটে। তারা কেউ দিগম্বর, কেউ দিগম্বরী। ভিড়ের মাঝে এসে পড়ে, তখন হাত চাপা দিয়ে লজ্জা ঢাকাঢাকি। বোধ হয়, ওদিকে খেলাঘরের ভাত ফুটে যায়। ছেলের বিয়ে আটকে থাকে। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার মুখেই ডুপ্‌কি ঘুংগুরের ডাক পড়েছে। কচি কচি হাতে পায়ে মুখে রাজ্যের ধুলা কাদা তবে সকলেরই শরীর একেবারে হাট করে খোলা নয়। কারুর কারুর ফ্রক ইজের জামা মায় পাঁচহাতী ডুরে শাড়ি জড়ানো পাকা গিন্নিটিও আছে। তাদের সঙ্গে বড়রা এল হেঁটে হেঁটে। আঃ ছাওয়ালগুলোনে সবোত জানে না। বটতলায় গাজি মামুদের আসর। এই-ই সব নয়। আসর আছে আরও। একটু চোখ তুলে দেখতে হবে। হ্যাঁ, ওই যে, বেড়ার ফাঁকে, দাওয়ার নীচে, গাছগাছালির আড়ালে, ডাগরীদের চোখ যদি বা দেখে থাকো ঘোমটা সরতে দেখা যায়নি। ওইরকম কেরামতি। নজর যদি বা চলে, আসল ভাঙতে পারবে না। তার মানে কেবল খেলাঘরের ঘরকন্নাতেই বেয়াজ পড়েনি। গেরস্থের ঘরকন্না এখন মামুদ গাজির লুটের মাল। পড়শিনীদের ঘোমটার ফাঁকে চোখের ঝিলিক হাসির ছটা দেখেই বোঝা যায়, ঘরকন্নার দম ফাপঁরে, গাজি পেড়ে এনেছে নীল আকাশ। গায়ে দিয়েছে এই প্রথম শীতের বাতাস। গাজি বৃন্দাবনের কালা নাকি।

না, মুরশেদ নামের মজুরা। তার চড়া গলায় তখন একটু চাপ লেগেছে। তাল মিলিয়ে গাইছে,

‘এখন, আমার মনের মানুষ কোথা পাই।
যায় তরে মন খেদে প্রাণো কান্দে সব্বোদাই॥
ওহে দেল-ল্‌-ল্‌-ল্‌’

গান থামিয়ে তাল দিতে দিতেই, হাঁক দেয়, ‘কেউ যদি জানেন, তয় বলি দ্যান।’

দেল মুরশেদ নয় বট গাছের তলায় যদি কেউ জানেন, গাজির মনের মানুষ কোথায়, তা হলে বলে দিন। কিন্তু প্রস্তাবনায় ছিল, ‘গুরু করবো শত শত মন্ত্র করবো সার।’ এ গান যে সে গান নয়, তা বোঝা যায়। বোধ হয়, সেটা ছিল তার গৌরচন্দ্রিকা। তাল দিতে দিতে গান ভেজেছে আলাদা। তার কথা শুনে কেউ কেউ হাসে। গাজি আমার দিকে চেয়ে চোখ ঘুরিয়ে হাসে। তাতে আবার একটু ধন্দ ভাবের ভুরুর কাঁপন। গাজি যেন মন-কাজি। যেন আমাকে পুছ করে, ‘বাবু কি জানেন?’

জানি না কিছুই। কিন্তু ফাটা চৌচির মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতে ভুলে যাই। কেন, ও মুখ এই সকালের নীল আকাশ না ইছামতীর আরশি-জল। কীসের খোঁজে বেরুনো, সেই কথাটাও ভুলিয়ে দেয় যেন। ওর আরশিতে কি আমাকে দেখে।

ততক্ষণে আবার শুরু হয়ে যায়,
‘যার তরেতে মন ভুলেছে
আমারে বলবে কে সে কোথা আছে
তারে না দেখে যে হিয়া ফাটে
সদা মন তাপে জ্বলে যাই।
মনের মানুষ কোথা পাই।
ওহে দেল্‌…’

গাজি আলখাল্লা উড়িয়ে, মারে তিন-চার পাক। গানের শেষে ডুপ্‌কি ঘুংগুর বেজে ওঠে জোরে। তারপরে দেখ, গাজির নিজের কোমর দোলানি। কিন্তু মুরশেদ, কয় জমানার, কত মুলুকের ধুলা যে জমিয়ে রেখেছে আলখাল্লায়, তার হিসাব কে রাখে। শহর হলে বলা যেত, ছ্যাকরা মোটর চলে গেল।

আবার গান,

‘তারে দেখা পাবার আশে,
কত করি খুঁজি বেড়াই দেশে বিদেশে।
দেখি, কতখানে কত জনে,
(দেল্‌) তার দেখা না পাই।
যারে পুছি তার কথা রে,
ঘোলায় পড়ে সে জন ঘোরে, বলতে নারে।
বলে আমার প্রাণ জুড়াবে,
এমন ব্যথার ব্যথী কেহ নাই।
এখন, মনের মানুষ কোথা পাই।
ওহে দেল…।’

এবার গানের শেষে আর পাক মারা নয়। গাজি যেন মাতাল হয়েছে। টলে টলে বাজায় গান নতুন করে ধরে। গাজি তো তবু মাতাল, টলে চলে। কিন্তু শ্রোতার হাল তার বেহদ্দ। ইছামতী পেরিয়ে, ইটিন্ডার বটতলাতে সে বুঁদ। ভাবে, এমন গান কারা বাঁধে, কেন বাঁধে, কথাগুলো পায় কোথায়। তাদের প্রাণের ভিতর কী আছে। বারেক কি উঁকি দিয়ে দেখা যায় না। হেসে বাঁধে, না কেঁদে বাঁধে, একটু দেখতে ইচ্ছা করে। একটু দেখতে ইচ্ছা করে, কার জন্যে মন খেদে প্রাণো কান্দে হিয়া ফাটে। একটু দেখতে ইচ্ছা করে, চিনি কি না-চিনি। রূপ কেমন।

রূপ তখন হাত বাড়ানো ডুপ্‌কিতে। গান শেষ। সে কোথায়, বলতে যখন পারলেন না, এবার যা পারেন, তা দিয়ে দিন। যে গদিতে বসেছে, তার মানই বড়। নয়া হিসাবে পুরো দশ পয়সা, নেমে এসে ডুপ্‌কিতে ফেলে। ইতিমধ্যে কচি-কাঁচাগুলো সব ছুটতে আরম্ভ করেছে। বাড়ি থেকে সাজানো সিধে এনে ঢেলে দিয়ে যায় ঝোলায়। গাজি তখন আমার পাশে। সাধ্যে যা কুলায়, পকেট থেকে তুলে দিলাম ডুপ্‌কিতে। বললাম, ‘ভাল লাগল বেশ। কার গান?’

মামুদ গাজির ফাটা চৌচির মুখে তখন ঘামের দরানি। হাত উলটে বলল, ‘তা জানি না বাবু। কার কখন আজান লেগেছিল, কে জানে। যার লেগেছিল, সে-ই ডাক ছেড়েছে।’

তা বটে। ভিতর যখন ডাক দিয়েছে তখন নামের ভনিতা মনে থাকে না। সে ডেকে খালাস, যে শোনে সে শোনে। কিন্তু কেতাবি ধাঁচের একটা মন বোঝনি আছে, নাম পেলে সে খুশি হয়। বললাম, ‘চলি।’

গাজির চোখ ফেরাবার সময় হল না। সে তখন নিচু হয়ে ঝোলা ভরতে ব্যস্ত। আবার সেই চোখে চোখে পরিচয় কার্যকারণের অনুসন্ধিৎসা। পুবে হাঁটা ধরি। বটের ছায়ায়, একটু যেন শীত-শীতই করছিল। ছায়ার বাইরে রোদ লাগতেই তাপের আমেজ লাগে। কিন্তু দেখ, গাছের পাতার বোঁটার বোঁটায় শীতের হানা। রস নিয়ে যায়, পাতা ঝরিয়ে দেয়। অথচ মৌল মুকুলের পাখিটা কোথায় বসে এখনও ডেকে চলেছে, কুহু কুহু। ওর কি সময়ের বোধ নেই। ঋতুর হিসাবে ও পেছিয়ে পড়েছে, নাকি তাড়া লেগেছে আগেই। এই অসময়ে কাকে ডাকছে এখন। সাড়া পাবে তো। কিংবা ইটিন্ডায় ওর মৌরসিপাট্টা, সালতামামি ব্যবস্থা আছে।

যার সম্পর্কে এত চিন্তা, সে থেকে থেকে ডেকে চলেছে। যে চিন্তা করে, সে নিজের মনেই হাসে। তবে এটা ঠিক, ওর ডাকে তেমন ফুর্তি নেই। পুচ্ছ নাচানো ঝলক নেই। এও যেন সেই ‘মন খেদে প্রাণো কান্দে’ অবস্থা। আর বাদবাকিদের পিক পিক কিচির কিচির শুনে বোঝা যায়, তারা এখানকার গাছগাছালির ঝোপঝাড়ের আদি বাসিন্দা। লোকে বলে ওদের বুলবুলি আর টুনটুনি, শালিক চড়ুই, দোয়েল শ্যামা। ওরা নিজেদের কী বলে, কে জানে।

একটা বুড়ো মুচুকুন্দ চাঁপার পাশ বেঁকতেই প্রলয় হাঁক, কক্‌ কক্‌ কক্। ধবধবে সাদা, মাথায় লাল তাজ, আর চিবুকে লাল নুর, সব কাঁপিয়ে মোরগ দিল ছুট। মুকুন্দ চাঁপার গোড়ায় তখনও নখ-আঁচড়ানোর দাগ। বাদশা মহাপ্রাণীর ধান্দায় ছিলেন। আর বেয়াদপ প্রাণীটার হঠাৎ সাড়ায় চমক লেগেছে, ভয়ও পেয়েছে। তার কক্‌ককানির সঙ্গে সঙ্গেই কাছেই ঝনাত করে শব্দ। অবাক হবার অবকাশ নেই। সামনে পুকুর। ও-পারের পিটুলির ছায়ায়, ঘাটলায়, কে যেন হকচকিয়ে ঘোমটা টানে। আর টানতে গিয়ে, মুখ ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু অচেনা পুরুষের চোখে, গোটা পিঠখানি উদাস। পায়ের কাছে বাসনের পাঁজা।

সহবতে চলো। চোখ ফেরাও, বউ বড় লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু খিড়কি দিয়ে যাচ্ছি, না সদর দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা তো একটাই। কোন ঘোমটা খোলা নিরালা অবকাশে যে হানা দেবার পথ ধরেছি, তা বুঝতে পারিনি। হবে হয়তো, এ ঘাট সদরেই পড়েছে। এরকম হয়।

পুকুর পেরিয়ে আবার একটা বাঁক। একটু দূরেই ঝাড়াল তেঁতুল গাছটার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে, যত দূরে জমিন, তত দূরে আশমান। জমির রং পাঁশুটে। আকাশ রোদে নীলে মাখামাখি। জনমুনিষও চোখে পড়ে কয়েকজন। মাঠে ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর এ সময়েই, কানের কাছে শোনা গেল, ‘সবাই জিগেসাঁ করে, গাজি, বাবু আনলে কোত্‌থেকে।’

পাশ ফিরতেই মামুদ গাজি। বাঁ হাতে ডুপ্‌কি। ডান হাতে মাথার পাগড়ি খুলে নিয়ে মুখ মোছা হচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আবার শোনা গেল হাসি। তারপরে কথা, ‘আমি বলি, আমি আনব কোত্‌থিকে। বাবু আপনার মনে বেরয়ে পড়েছেন।’

বলতেই হয়, ‘তাই বুঝি।’

মাথায় আবার পাগড়ি বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘লোকের যত কথা। তা বাবু, ইদিকে কোথায় যাবেন।’

বললাম, ‘সোজা।’

‘সোজা!’ যেন এমন অর্বাচীন কথা আর শোনা যায়নি। গাজি খ্যাক খ্যাক করে হেসে মরে গেল।

বলল, ‘সোজা কোথায় যাবেন বাবু। সোজা কি যাবার জো আছে?’

গাজির দিকে ফিরে তাকালাম। দেখি চকচকে চোখ দুটিতে রহস্যের আমেজ। বললাম, ‘কেন, এই তো পথ রয়েছে, মাঠের ওপর দিয়ে চলে গেছে।’

গাজি বলল, ‘কত দূর। মাঠ পার হলিই তো বডার। গিয়ে দেখবেন, ডাকিনীর মাঠ, এপারে পুলিশ, ওপারে পুলিশ।’

আবার সেই বর্ডার। আকাশের রোদ আমার মুখে ছায়া হয়ে ওঠে। খাকি রং, শিরস্ত্রাণ আর ডাকিনীর মাঠ দেখবার ইচ্ছা নেই একটু। কিন্তু মাঝখানের মাঠের নাম ডাকিনীর মাঠ কে রাখল। এমন অব্যর্থ নাম তো হয় না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাকিনীর মাঠ বলে নাকি ওটাকে।’

গাজি ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘ওই হল আর কি, একটা কথার কথা। তা বাবু, কম করি মেয়েছেলে আর ব্যাটাছেলে মিলিয়ে, গুটিকয়েক ওই মাঠে মরেছে।’

‘মরেছে?’

‘মরবে না? গুড়ুম-গাড়ুম গুলি মারলে বাঁচে কে?’

‘কারা মেরেছে?’

‘ওদিক থেকে এলি, ওদিককার সেপাইরা, ইদিক থেকে হলি, ইদিককার। কী অধম্মের বেড়াজাল দ্যাখেন।’

তাই গাজি নিজেই মাঠকে বলে ডাকিনীর মাঠ। কেতাবিতে বোধ হয় বলতে হবে, নো ম্যানস ল্যান্ড। তেঁতুল গাছের নীচেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ডাকিনীর মাঠে যাব না, দেখবও না। তার চেয়ে বটের তলায়, গাজির গান শোনা ছিল ভাল। গাজির গানের পর, যে রকম ছোটার তাল লেগেছিল, সে তাল দেখছি, বে-তালের ছুট। তার সঙ্গে আকাশ জোড়া নীলিমা, আর ভূমিতে নুয়ে পড়া সোনালিতে দুঃস্বপ্নের চমক। এই বেরিয়ে পড়া সকালে অধর্মের বেড়াজাল দেখতে যাব না। ওখানে শুধু সীমানা নয়। ওখানে মনের কল অচেনা, তাই মানুষ মারার কল করেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাঁকা পথে কোথায় যাওয়া যায়?’

গাজি যেন লজ্জা পেয়ে হাসে। বলে, ‘বাবুর কী কথা! গেরামেই যান।’

এই সংবাদ দিয়েই আবার বলে, ‘আমি একটা মতলব দেবো বাবু?’

জয় মুরশেদ, এখন সেটাই বাকি আছে। কিন্তু ব্যাপারখানা বুঝি না। গাজি নামের মজদুরি নিয়ে কেন গ্রামান্তরে যায় না। বাবুর পিছনে দৌড়ায় কেন। তার মহাপ্রাণীর ধান্দা কি আজ এক আসরেই শেষ।

জিজ্ঞেস করেই বা লাভ কী। ইছামতীর তলার স্রোত কোন বায়ে বহে, তাই দেখা যাক। বললাম, ‘কী বলো তো।’

‘আপনার থল জলের ভাবনা নাই তো?’

সে আবার কী। তাই যদি থাকবে, তবে বাবু ইছামতী পাড়ি দিল কেন। পথ খোঁজে কেন। কিন্তু যদি, থল জলের ভাবনা নেই বলে, গাজি সাগর দেখিয়ে দেয়, কিংবা দক্ষিণরায়ের ভিটায়। সেই সুন্দরবনে পাক দিয়ে আসতে বলে, তবেই তো দিক্কত। বিপদ হয়তো আছে। আপাতত সে ভাবনা নয়। কীসের খোঁজে ফেরা, তার নাম জানি না বটে, পাঠশালার পাঠ আমার জীবনে মেটেনি। সে পাঠশালার কত রূপ, কত নিয়ম, তার ব্যাখ্যা মহাভারত। সেখানে সবাই কাজের মানুষ। সবাই ঘরের মানুষ। সেখানে জীবনযাপনের জানালায় জানালায় বাতি জ্বালানো৷ সেখানে সবাই ঘাড় নিচু করে পাঠ মুখস্থে ব্যস্ত। সেখানটাকে ফাঁকি দিয়ে জীবনব্যাপী খুঁজে ফেরার ছোটা। তবু ফিরতে হয় সেখানে। ফাঁকির দেনা মেটাতে হয় কড়ায় গণ্ডায়। সে যাকে অকাজ বলছে, সেই অকাজের দিগন্তকে একেবারে হাট করে খুলে দেয়নি। অতএব, থল জলের ভাবনা নেই, এক কথাতে বলা যায় না। বলি, ‘থাকলেও শুনি, না থাকলেও শুনি।’

গাজি আবার জিজ্ঞেস করে, ‘গোটা দিনখানি বাবুর হাতে আছে তো।’

‘তা আছে।’

‘তয় বাবু এক কাজ করেন। বেরয়ে যখন পড়িছেন, হাসনাবাদে চলি যান।’

‘হাসনাবাদে?’

‘আজ্ঞাঁ। নদী পেরয়ে, বসিরহাট থেকে মটর ধরে হাসনাবাদে যান। হাসনাবাদ থিকে চলি যান মটর লঞ্চে করে।’

‘কোথায়?’

‘ফেরার গোত্তর রেখে, যদ্দূর খুশি। ফেরত লঞ্চ পাবেন। নয় তো, যেখানে হোক নেমে যাবেন। ন্যাজাট তক মটর পাবেন। কলকাতায় যাবার গাড়ি পেয়ে যাবেন।’

কথাটা মন্দ লাগল না। ফেরার সময় মেপে, লঞ্চে করে যত দূর খুশি, তাই বা মন্দ কী। চোখ ফেরালেই তো সব অচেনা। যত দূরেই চাই। দেখে আসি, যতটুকু দেখা যায়। দেখে আসি, কত ঘাট, কত মানুষ। দেখে আসি, আমার বাঁধা সময়ের সীমায়, প্রকৃতি কী সাজে সেজে আছে। তবু গাজির প্রস্তাবে অবাক না হয়ে পারি না। তার মুরশেদ নামের মজদুরিতে, এমন মতলব দেবার জায়গা কোথায়। পাখি নাকি। সব ঘাটেই ঘোরা আছে বোধ হয়।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওদিকে গেছ কখনও?’

গাজি হাসে। বলে, ‘না গেলি কি আর বলতি পারি বাবু। দক্ষিণের কিছু বাকি নাই। তা, মনটা বলে, বাবুর ওদিকটায় ভাল লাগবে। তয় বাবু, একটা কথা বলি, ফাসট্‌ কেলাসের টিকিট নেবেন। সারেঙের ঘরের পাশে বসে যাবেন, সব দেখতি দেখতি যাবেন।’

গাজির চোখও দেখছি সজাগ। কিন্তু ফাসট্‌ কেলাসে বসার মজা সে জানে কেমন করে। ফেরার পথ ধরে, শেষ কথাটা না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘ফাসট্‌ কেলাসে গেছ নাকি?’

গাজি হা হা করে হেসে বলে, ‘তোবা তোবা মুরশেদ, বাবুর কথা শোনো৷ টিকিট কাটার মুরোদ নাই, ফাসট্‌ কেলাসে যাব কি বাবু।’

‘তবে কি বিনা টিকিটে?’

‘তয়? সারেংকে দু’খানি গান শোনাই, তারপরে তার পায়ের কাছে বসি চলে যাওয়া।’

যাক, নামের মজুরিটা আছে। কিন্তু গাজি এখনও সঙ্গে কেন। গ্রামান্তরে যাবার রাস্তাও ঘাটে ফেরার পথেই নাকি। জিজ্ঞেস করি, ‘পারাপারের নৌকো পাব?’

‘চলেন দেখি, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

চলেন দেখির মানেটা কী! গাজি আমার ওপার যাবার ব্যবস্থা করে দিতে চলেছে নাকি। তাকিয়ে দেখি, তার মাথা নিচু, নজর পথের দিকে। গোঁফদাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ভাবের স্রোত। দেখে কিছুই বোঝা যায় না। কেবল গুনগুনানি শোনা যায়, আর তারই তালে ঘাড় দোলানি, ‘আশমান জোড়া ফকির রে ভাই, জমিন জোড়া ক্যাঁথা। এসব ফকির মলে পরে তার কবর হবে কোথা।’…

হঠাৎ গাজির এ চিন্তা কেন জানি না। কিন্তু তার তালের খেই ধরতে পারছি না। আশমান জোড়া ফকির কে, জমিন জোড়া কাঁথা কার, আর কোন ফকিরের কবরের ভূঁই নিয়ে তার ভাবনা, সকলই রহস্যময়। তার ভাব-সাব ব্যবহার কথাবার্তার মতোই রহস্যময়। এখন এর উদ্ধার কোন মঃ পোয়ারো বা ব্যোমকেশ গোয়েন্দা করতে পারবেন, কে জানে।

ইতিমধ্যে সেই ইছামতী আবার দেখা দিয়েছে। যে ঘাট দিয়ে এসেছিলাম, সেই ঘাটেই ফেরা। দেখি, অধর মাঝির নৌকা বাঁধা খুঁটিতে। মাঝি বেপাত্তা। গাজি বলে ওঠে, ‘জয় মুরশেদ, অদরদা এ পারেতেই আছে দেখছি। গেল কোথায়?’

বলেই গলা ফাটিয়ে হাঁক, ‘অদরদা—! গেলে কোথায়?’

সাড়া নেই শব্দ নেই, বাঁ দিকের জলে ডোবানো গেমো গাছের ডাল ধরে নেমে এল অধর মাঝি। পরনের ছোট কাপড়টা সাব্যস্ত করতে করতে এল। গাজি বলল, ‘বাবু হাসনাবাদে যাবেন, পার করে দ্যাও।’

এমন ভাববার কোনও কারণ নেই, অধর মাঝি তার ঢুলুঢুলু চোখ দুটিতে অবাক হয়ে তাকাবে। অবাক হয়ে দুটো কথা জিজ্ঞেস করবে। সে গিয়ে তার খুঁটিতে হাত দিল। উঠব কি উঠব না ভাবছি। মাঝির অনুমতি পাওয়া যায়নি তখনও। গাজিই তাড়া দিল, ‘ওঠেন বাবু।’

আমি উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গাজিও উঠে এল। আমার বলবার কিছু নেই। আসবার সময় যেমন বসেছিলাম, তেমনি বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমিও ওপার চললে?’

অধর নৌকা ঠেলে দিয়ে উঠল। গাজি বলল, হ্যাঁ। মুরশেদে যখন মিলয়ে দিছেন, আজ আপনার সঙ্গই ধরি।’

আমার সঙ্গ! গাজির মুখের দিকে ফিরে তাকাই। কথাটার অর্থ সঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম না। গাজি দাড়ির ভাঁজে ভাঁজে হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘একা একা যাবেন, তাই চলেন একটু ঘুরে আসি। মটরের ভাড়াটা দিবেন বাবু, আর যদি হরিপদ সারেং না থাকে, তা হলি লঞ্চের ভাড়াটা—।’

কথা শেষ না করেই সান্ত্বনা দিল, ‘বেশি লাগবে না বাবু, আমাকে নীচের ঘরের টিকিট কেটে দিবেন, তা হলিই হবে।’

তার মানে কী। এত দিন জানা ছিল, একমাত্র মাতুলালয়েই এরকম আবদার করা যায়। মোটর ভাড়া, লঞ্চের ভাড়া দিয়ে কে তাকে আমার একলাকে দোকলা করতে বলেছে। বিরক্তিতে আমার মুখের বাক্যি সরে না। এদিকে দেখ, সঙ্গদাতা ইছামতীর জল দিয়ে দাড়ি সজুত করে, আর গুনগুনায়, “স্বরূপের বাজারে থাকি। শোন রে ক্ষ্যাপা, বেড়াস একা, চিনতে পারলি, ধরবি কী।”…

এ সবও আমাকেই বলা হচ্ছে কিনা কে জানে। আমি যদি স্বরূপের বাজার চিনব, তবে আর ছুটব কেন। কিন্তু গাজি আমাকে চেনাবে, ধরাবে, একাকিত্ব ঘোচাবে, তা আমি চাইনি। থাক আমার সঙ্গ দরকার নেই। সে কথাটা বলব বলে মুখ-খোলবার আগেই মুরশেদের শ্রীমুখ আবার খুলে গেল, ‘কী রকম তাজ্জব কথা শোনেন বাবু, “কালার সঙ্গে বোবায় কথা কয়, কালা গিয়া শরণ মাগে, কে পাবে নির্ণয়।” কী মজার কথা দ্যাখেন দিকি। গানটা শুনেছেন বাবু?’

‘না।’

বিরক্তিতে প্রায় ধিক্কার দিতে চাই। চাইলেই তো হয় না, তারপরে শোনো, আবার বলে কি, “আর অন্ধ গিয়া রূপ নিহারে, তার মম্মো কথা বলব কী। মড়ার সঙ্গে মড়া ভেসে যায়। জ্যান্তে ধরতে গেলে হাবুডুবু খায়। সে মড়া নয় কো রসের গোড়া, তার রূপেতে দিয়া আঁখি।”

বলেই গাজি হে হে করে হেসে উঠল। কিন্তু আমার দৃষ্টি তখন অন্যদিকে। যদিও নজর নদীতে নেই, মন নেই আকাশে, কেবল পিত্তি বলে বস্তুটা তখন মাথায় গিয়ে জ্বলছে। এরা কী মানুষের মন মেজাজও বোঝে না।

বোধ হয় বোঝে বলেই বাবুকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে গলুইয়ের দিকে ফিরে বলে, ‘বিত্তান্তটা বুইলে অদরদা?’

জানি, সে গুড়ে বালি। অধরকে তুমি ধরতে পারবে না। মাঝি কেবল পারাপার করে। তার বৈঠা ইছামতীর জলে ছপ্‌ছপ্‌ পড়ে। ওখানে রা ফোটানো মামুদ গাজির কর্ম নয়।

কিন্তু ভাবনা শেষ হল না। তার আগেই অবাক হয়ে শুনি, অধর মাঝির মোটা গোঙানো গলা ইছামতীর বুক থেকে উঠছে, ‘তা বলব কি স্বরূপ কীরূপ, হয় অপরূপ তোমার মনে। যেরূপ অটল হইয়ে অটলের নিরঞ্জনে।’

আরও অবাক হয়ে দেখি, আদুর গায়ে খড়ি ওঠা, চুলঢুল-চোখ অধর মাঝি যেন গোলাপি নেশায় আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু বৈঠা থামায় না। গাজির তো আকাশ কাঁপিয়ে হাঁক, ‘জয় মুরশেদ, জয় অদরদা। অই, কী শোনালে গো। তারপরেতে তরে শোন, ‘বিজলি মেঘের কোলে, যেরূপ ভাবেতে খ্যালে, সেও কিছু স্থায়ী বলে জ্ঞান হয় আমার মনে, আমি কোথায় খুঁজে ফিরি তিরিভুবনে।’

এ যে দেখি, বাংলা ছড়ার মতো, ‘কথা কইতে জানলে হয়, কথা ষোলো ধারায় বয়।’ নাকি, ‘কথা পড়ল সভার মাঝে, সব কথা তার গায়ে বাজে।’ বৃত্তান্ত সেই রকম। গূঢ় ভাষায় ভাবের কথা, বুঝহ যে জন। আমি শুনি এক, গাজি মাঝি আর এক রকমে চোখাচোখি করে। আমার চোখ ফেরে না অধর মাঝির দিক থেকে। সে অধর, সে হিসাব করেছিলাম তার ভাব ভঙ্গি দেখে। এখন সে দেখি, এ আর এক মানুষ, গূঢ় মানুষ। চোরাকে চিনতে পারিনি।

কথা তাদের সেখানেই শেষ নয়, অধর মাঝি একবার গাজির দিকে দেখে, আবার চোখ তোলে সেই দূরের আকাশে। তেমনি মোটা গোঙানো স্বরেই বলে, ‘যখন চোক বুজে থাকি, তখন তার টুক দেখি। যেই খুলেছি চোক আর তারে দেখতে পাইনে। পরে আশমান জমিন খুঁজি—যদি কোনখানে।’

গাজি দু’হাত তুলে ডুপ্‌কি বাজিয়ে দিল। জলে তরঙ্গ তুলে হাঁক দিল, ‘অই, মরে যাই গো অদরদা। বড় জবর শোনালে।’

কথা শেষ হবার আগেই, নৌকা এসে পাড়ে ঠেকল। অধর মাঝির কথাতেই কান পেতে ছিলাম। নৌকার ধাক্কা লাগতে সংবিৎ ফিরল। অধর আগে নেমে গিয়ে খুঁটি পুঁতল মাটিতে। সংবিৎ ফিরতেই প্রথম মনে হল, ইছামতীতে কত জল ঠাহর পেলাম কি। দুটো পাগলের পাল্লায় পড়েছি কিনা বুঝতে পারি না। লোকটাকে দেখেছিলাম নির্বিকার। চোখে তার সবই নিরাকার যেন। এখন দেখছি, যমুনার মতো, নদীর তলায় বাঁকা স্রোত। মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে দু’আনা পারানি দিলাম। ভেবেছিলাম, একবার বুঝি তাকাবে। কিন্তু পয়সা গুনে নিয়ে নৌকায় গিয়ে জল সেঁচতে বসল।

অধর মাঝির কিছুই জানি না। তবু কালো ভাবলেশহীন মুখটার দিকে চেয়ে হঠাৎ মনে হল, অধর মাঝি বোধ হয় একেবারে অধর নয়। জায়গাটা চিনতে না পারি, তবু কী একটা জায়গা যেন তার ভিতরে দেখা গেল। সেখানকার ঝলকটা চোখের জলের না হাসির, বুঝতে পারলাম না।

গাজির তখন হাঁক, ‘বাবু গাড়ি এসে গেছে।’

তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম। জায়গা পাবার আশা নেই। কিন্তু উঠতে না উঠতেই গাড়ি ছাড়ে ছাড়ে। তার মধ্যেই গাজির ত্রাহি চিৎকার শোনা গেল বাইরে থেকে, ‘মুরশেদের দোহাই, আমারে উঠতি দ্যান কনডরবাবু। ওই যে বাবু গাড়ির মধ্যি, উনি আমার পয়সা দিবেন।’

.

০৪.

গাজির চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি, বড় বেকায়দা। এখন মুখ দেখে কে বলবে, অরূপ অটল নিরঞ্জনের তত্ত্ব রসে টলমল—এই মানুষে সেই মানুষ আছে। কনডরবাবু অর্থাৎ কনডাক্‌টরের মুখের দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে, যেন কেউ হাতে পাওয়া মুরশেদ নিয়ে চলে যায়। ফাটা চৌচির মুখখানি চুর্ণ চুর্ণ হয়ে যাবে। এদিকে মোটর বাস যত গর্জায়, তত বর্ষায় না। তার এঞ্জিনের গর্জন, সহিসের হাঁক, আর থেকে থেকে দুলে ওঠা, কেঁপে ওঠা, সব মিলিয়ে এক এলাহি কাণ্ড। এই বুঝি ছাড়ে। চলে যায়, চলে যায়, তাড়াতাড়ি এসো। যাত্রীরা অসবুর হয়ে দৌড় দেয়। মফস্বলের যেখানেই যাবে, সেখানেই এরকম হাঁকডাক। যেখানে যেমন। এখন ঘণ্টা বাজে না, ভোঁ বাঁশি কিছু বাজে না। সহিসকেই হেঁকে জানাতে হয়, গেল, গেল, ছেড়ে গেল। নইলে যাত্রীদের হুঁশ হতে চায় না।

ওদিকে তখনও আর্ত গাজির কাতর কাঁদন চলেছে, ‘কিরা কেড়ে বলছি কনডরবাবু, বিনি পয়সায় যাব না, আমাকে উঠতি দ্যান।’

কনডাক্‌টরটি দেখছি শুকনো চিঁড়ে। কাতরের কাতরানিতে সে ভেজে না। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে, হাত পেতে বলে, ‘দাও, পয়সা ছাড়ো বাবা গাজি। তারপরে ওঠ। ওসব গাজি বাজি ছোড়।’

সবই দেখছি, চেনাচিনির ব্যাপার। গাজির অমন অনেক কাকুতি-মিনতি বুঝি শোনা আছে। কনডাক্‌টরের। তাই দরজা আগলানো, প্রবেশ নিষেধ। ততক্ষণে আমার জায়গা হয়েছে। জানালা নিয়ে বসে পড়েছি। কিন্তু স্বস্তি নেই। কান পড়ে আছে দরজার দিকে। নিজেই কিছু বলব কিনা ভাবছি। গাজি তখন জানালা দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল, ‘অই যে, অই বাবু আমার ভাড়া দিবেন, জিগেসাঁ করেন, মিছা বলব না।’

তারপরেই আমাকে ডাক, ‘বাবু, দিবেন না বাবু, অ্যাঁ?’

মুরশেদের কাছে কসম কিছু খাইনি। কিন্তু কোথাও নিশ্চয় কবুল করেছি। নইলে ঘাড় ফেরাব কেন। চেয়ে দেখি, দাড়ির ভাঁজে হাসিটি করুণ, চোখ ধন্দে ভরা। কনডাক্‌টরের দিকে ফিরে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিই ভাড়া দেব।’

কনডাক্‌টর সরে দাঁড়িয়ে গাজির দিকে চেয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল, ‘আচ্ছা যাও, আজ তোমার মুরশেদের দিন।’

শোনা গেল, গাজি উঠতে উঠতে বলছে, ‘মুরশেদের দিন বাবু রোজই। তা বলি মিছে বলব না।’

কনডাক্‌টরের আর সেদিকে তখন কান নেই। সহিসের সঙ্গে সেও হেঁকে চলেছে। গাড়ির মধ্যে কয়েকজনের গলা শোনা গেল, ‘জয় মুরশেদ। তা, আজ গাজির যাত্রা কোন দিকে?’

গাজি বলল, ‘যাই তো আগে হাসনাবাদ। তারপরে দেখা যাবে, কী বলেন বাবু।’

কয়েকজন তাকিয়ে দেখল আমাকে, সেই একই দৃষ্টি, অনুসন্ধিৎসা। কে, কোথাকার, যোগাযোগ কীসের। যাত্রীরা অধিকাংশই কাছেপিঠে গ্রামের। চেহারা দেখে তাই মনে হয়। যদিও গাড়ি আসছে সোজা কলকাতা থেকেই। কিন্তু কলকাতার মানুষ বলে চেনা যায় না কাউকেই। বসিরহাটে গাড়ি খালি হয়ে, আবার ভরে ওঠে। পোশাক দিয়ে যদি ভদ্রলোকের বিচার হয়, তবে আমার মতো দু’একজন যে না আছেন, তা বলা যাবে না। বাদবাকি অধিকাংশই মাঠের মানুষ। তার সঙ্গে হাটুরে বাটুরে মেশামিশি। মহিলা যাত্রীও কম নয়। তারা যে এ গাড়ির অধিকাংশদের কন্যা ঘরনি, সে ছাপ আছে তাদের বেশবাসে, চেহারায়। যার হাতে সময় ছিল, যাত্রা হল কুটুমবাড়ি, তার একটু তেলের চিকনচাকন। ভাঁজভাঙা কাপড়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ। ড্রাইভারের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা মেয়েটির গায়ে নয়া ফ্রক। যাদের কাজকর্মের ফিকির, তারা একটু রুক্ষুসুক্ষু। তাদের তেমন ঢাকাঢুকির শালীনতা নেই। বাদবাকি বয়স্থাদের মুখ দেখতে পাবে, তা হবে না। সব কলাবউ। ইস্তক, ওই যে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়িপরা কোলে একখানি শাঁখা পরা কালো রেখায় ভরা প্রৌঢ়ার হাত দেখা যায়, তার মুখেরও অর্ধেক ঢাকা। হতে পারে বয়স হয়েছে, নাতিনাতনি হয়ে গিয়েছে, তা বলে সধবা মেয়েমানুষের একটা সহবত তো আছে।

আরও খানিকক্ষণ তর্জনগর্জনের পর বাস ছাড়ল। গাজি ইতিমধ্যে এক জায়গায় বসে পড়েছে। কথাবার্তা চলেছে সমানে। চলবেই, তার অচেনা কে আছে। কথাবার্তার বিষয়বস্তুরই বা অভাব কী। ধানের অবস্থা কেমন, খন্দ কেমন হবে, অমুকে কবে মারা গেল, কার ছেলে হল, এসবের মাঝে মাঝে মন খেদে প্রাণো কান্দে বুলিও চলেছে। আমাকে বিশেষ করে উৎকর্ণ হতে হল, যখন শোনা গেল, ‘বাবু পেলে কোত্থেকে?’

গাজির জবাব শোনা গেল, ‘পথ থিকে।’

আমি আড়ষ্ট হলাম, পাছে গাজির মুখ খুলে যায়। রামায়ণ না গাইতে আরম্ভ করে। বাইরের দিকে তাকিয়েই শুনছিলাম। গাড়ি চলেছে বেগে। মাঝে মাঝে ওঠানামার দাঁড়ানো। কেউ নামে, ওঠে কেউ। কেবল শেষ নেই সবুজের। যেন ছক কাটা আছে, মাঠে ধান, ডাঙায় নারকেল সুপারির ভিড়। যেখানেই গ্রাম, সেখানেই নারকেল সুপারি। শেষ হেমন্তের রোদে চিকচিক করছে। মাঝেমধ্যে গরুর গাড়ি, গৃহস্থের ঘরের সামনে বাঁধা গরুছাগলের রাস্তা পারাপার। বাসের সহিস হাঁক দেয়, হেই হেই! শুধু তাই নয়। শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় থেকে ও এসেছে। ছোকরা সহিসের থলেয় অনেক মজার মজার কথা। পথ চলতি কিষেনকে ডাক দিয়ে বলে, ‘ও দাদা, পয়সা পড়ে গেল যে।’

কিষেনের ট্যাঁকে পয়সা থাক বা না থাক, চমকে তাকায় মাটির দিকে। সহিস ছোকরা হাসে খ্যালখ্যাল করে। কান পাতলে শোনা যাবে, ঠকে যাওয়া রেগে-ওঠা কিষেন তখন চিৎকার করছে, ‘হ্যাঁ, এই যে পেইছি। ন্যে যাও।’

নিয়ে যাবার জন্যে তখন কেউ দাঁড়িয়ে নেই; গাড়ি অনেক দূর। পুকুরঘাটের ধার দিয়ে, কলসি কাঁখে বউটিকে চমকে দিয়ে, গাড়ি তখন ছুটেছে। আর সহিসের ঝাঁকড়া চুলে ঝটকা লাগে, গলায় বাজে গান, ‘ম্যায়নে দেখা তেরি সুরত্‌…।’

কার সুরত্‌ দেখে, কে জানে। মনে হয়, কোনও বোম্বাইওলীর সুরত্‌ তখন ওর চোখে নেই। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার জটিল প্রাণটা আসলে দুরন্ত গতি আর বাধাহীন দিগন্তের সামনে অথই হয়ে পড়েছে। ও তাকে ধরে রাখতে পারছে না।

কে পারে। আমি কি পারি। আমি সহিস নই, কিন্তু পুচ্ছনাচানো একটা পাখি যেন নিজের মধ্যেও দেখি। আপন বাসা ছেড়ে যে অসীমে যেতে চায়, প্রাণ অথই হয়ে পড়ে। এই দিগন্তজোড়া রূপের মাঝে তাকে ধরে রাখতে পারি না। নিজের গলার গুনগুনানি চেপে রাখতে পারি না। এ অনুভূতির নাম কি, কে জানে। এ সবুজের কাজলমাখা স্বপ্ন কিনা কে জানে। মনে হয়, কার সোহাগের দুটি হাত যেন জড়িয়ে নেয় বুকে। তার কেমল উত্তাপের সকল তৃপ্তি যেন সহসা আমার চোখের জলে গলে আসতে চায়। আর অবাক হয়ে শুনি, গাজিরই প্রতিধ্বনি আমার অস্ফুট গলায়, ‘যার তরে মন খেদে প্রাণো কান্দে সর্বদাই…।’

এই জানাটা, জানি না, যদি তৃপ্তি, তবে কেন চোখের জল গলে। যদি দিগন্তের রূপে প্রসন্নতা, তবে ‘মন খেদে প্রাণো কান্দে’ কেন। যেন এপারেতে রোদ, ওপারেতে ছায়া। এ দুয়ের মাঝে দরিয়া। আমি এই দরিয়া চিনে উঠতে পারি না। এ দুয়ের মাঝে দরিয়াকে কী দিয়ে বন্ধন করতে হবে, তার সন্ধান আমার জানা নেই। কেবল রোদ ঝলকানো দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রাণে দুয়ের খেলা দেখি।

‘এই যে বাবু, টাকি চলে গেল, হাসনাবাদ আসছে।’

গাজির গলা। তাকিয়ে দেখি, আমাকেই বলছে। কিন্তু চারপাশে অনেক নয়া মুখ। যাদের দেখেছিলাম বসিরহাটে, তাদের কেউ প্রায় নেই। গাজির আসর এখন অন্য লোকদের নিয়ে। তা হোক, তাতে চেনাচিনি আটকায়নি। কথাবার্তা বৃত্তান্তের অভাব নেই মোটেই। বরং গাজি এবং আরও দু’জন রীতিমতো আইন অমান্য করে বিড়ি ধরিয়ে বসেছে। চোখ তুলে দেখি, স্বয়ং ‘কনডরবাবুও’ ‘ছিরেট’ ধরিয়েছেন। মহাজন যদি পথ দেখান, সাধারণের দোষ নেই। আর এক দিকে ঈষৎ ধোঁয়ার চিহ্ন দেখে, চোখ ফেরাতেই দ্বিগুণ চমক লাগল। মহিলা যাত্রী এখন তিন; এবং বিলকুল নতুন। তাদেরই মধ্যে একজনের মুখে বিড়ি!

স্ত্রীলোকের মুখে বিড়ি দেখা নতুন নয়। কিন্তু ঘোমটা কেন। বয়সও আশ্বিনের ঢলে, ঋতুচক্রের মাঝামাঝি। হাতে রুপো বলো, কাচ বলো, শাঁখ বলো, সব রকমই আছে। এমনকী, যাত্রীদের দিকে ঘোমটার আড়াল থাকলেও, সীমন্তে সিঁদুরের চিহ্ন চোখে পড়ে। মিলের লাল শাড়ি, আটপৌরে বাঙলা ছাঁদে পরা। দেখে মনে হয়, বাঙালি গৃহিণী। এখন আমার চোখে ধন্দ লাগিয়ে উনি যদি ওড়িশি হন, বলতে পারি না। শ্রেণীবিচারেও অক্ষম। তবে চোখে কাজল, তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁট, সেই ঠোঁটে, বিড়ি এবং তৎসত্ত্বেও নাকে নাকচাবি। তার ওপরে ঘোমটার আড়াল। সব মিলিয়ে কেমন একটা ধন্দ লেগে গেল। অপযশ করব না, মুখখানি একেবারে ফ্যালনা নয়। গ্রামীণ ছাপটা পুরোপুরি আছে। তার সঙ্গে, একটু রোখাচোখা ভাব। দুটো কথা বলে যে কেউ পার পেয়ে যাবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার চমক লাগল, ঘোমটা কেন। কাকে দেখে। নলচে আড়াল বলে একটা কথা আছে শুনেছি। নলচে আড়াল-বিচিত্রাও কম দেখিনি। বাপ দখিন ফিরে কথা বলে। ছেলে উত্তর দিকে ফিরে জবাব দেয়। মুখে তার হুঁকা। বাপ-ব্যাটা কিনা। মুখোমুখি খাওয়া যায় না। হাজার হলেও একটা সহবত বলে কথা আছে। সে তবু তো বাপ-ছেলে। একবার দ্বারভাঙার পথে পেট ফুলে ওঠা কাকে বলে দেখেছিলাম। ছোট একটি ফার্স্ট ক্লাস কামরা, যাত্রী কুল্যে কয়েকজন। যে ভদ্রলোক সপরিবারে, তিনি একজন রেলওয়ে কর্মচারী। উত্তর বিহারের অধিবাসী, গন্তব্যও সেদিকেই। কামরাটিতে বাইরের লোক একমাত্র আমি। দু’এক কথার পর, দেখা গিয়েছিল ভদ্রলোক নিপাট ভালমানুষ। ছেলেমেয়ে দুটির বয়স অল্প। গিন্নিটিও দেখতে শুনতে ভাল। বয়স তাঁর অল্পই। সাজগোজে কিছু কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি ছিল। সেটা বোধ হয় বাইরে বেরোবার জন্যেই। ঘোমটা তাঁর খসতে দেখিনি কখনও। হিন্দি যতটা বুঝি, তাতে এটুকু ধরা গিয়েছিল, তিনি স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় পুরুষ বচনে সম্বোধনহীন সম্বোধনে কথা বলছিলেন। যেমন, ‘ছেলেকে একটু জল দেওয়া হোক।’ ‘জানালাটা একটু বন্ধ করে দিক।’ ‘উনি কি এখন খাবেন?’ বাঙালি মাত্রেই জানেন, ও বচন কর্তাগিন্নির মান-অভিমানের। এ ক্ষেত্রে তা নয়। দেখা গিয়েছিল, ওটা সহবত। গিন্নির হাতে একটি হিন্দি ম্যাগাজিন ছিল। মলাটে মুখোশ পরা যুবতী রমণীর হাতে পিস্তলওয়ালা ছবি। সে কি কোনও মেয়ে রবিনহুড, নাকি পাঁচকড়ি দে-র পাপীয়সী জুমেলিয়া জাতীয় কেউ, কে জানত। লক্ষ না করে পারা যায়নি, কোনও কোনও সময় মহিলাটি আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন। কেন, নিষেধ আছে নাকি কিছু। না, নিষেধ ছিল না। কিন্তু, তাকানোর মধ্যে দেখা গিয়েছিল, চোখের তারায় কী যেন এক কথা। ভিন পুরুষের দিকে রমণীর পলকহারা চোখ, ভিন পুরুষের কথাটাও ভাববার। যেন চক্ষে হারানোর মতো, হেরিতে সাধ মেটে না। তারপর, হেরিতে হেরিতেই, সহসা ঠোঁটের কোণে একটু বিষণ্ণ হাসি। তাতে নাকচাবি ঝলকায়নি। কিন্তু তাঁর বুক দুলে ওঠা হুস্‌ করা দীর্ঘশ্বাসে সেই শীতেও ভিন পুরুষের বিনবিনিয়ে ঘেমে ওঠার অবস্থা। রমণীর মন বুঝতে হাজার বছরের সাধনার দরকার, কাব্যে পড়া আছে। তত পরমায়ু কোনওকালেই পাওয়া যাবে না। অতএব সে চেষ্টা বাতুলতা। অথচ সেই পলকহারা চোখ, বিষণ্ণ হাসি এবং দীর্ঘশ্বাসের হাহুতাশ কেন। মানুষ তো, তার ওপরে রমণীর মন না বোঝা পুরুষমানুষ। প্রথমেই যে কথাটা মনে হয়েছিল, তার নাম…ছি ছি। এখন ভাবলে প্রায় নিজের চোখেই না দরিয়া ভেসে যায়।

যাই হোক, ক্ষণে ক্ষণে সেই পলকহারা দৃষ্টি, বিষণ্ণ হাসি, দীর্ঘশ্বাসের কাঁটা বেঁধা নিঃশব্দ নাটক কত কথাই ভাবিয়েছিল। এমনকী, জুমেলিয়ার ডাকিনী রহস্যের কথাও একবার মনে হয়েছিল। রাত্রি ন’টা নাগাদ, ছেলেমেয়ে দুটি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কর্তাকে দেখেছিলাম, কখনও ছেলেমেয়েদের সেবায়, কখনও বাইরের দিকে দৃষ্টিপাতে চিন্তান্বিত উদাস। উদাস কিনা জানি না, কেন না হাই উঠছিল খুব। ক্বচিৎ কখনও গিন্নির সঙ্গে দু-একটা কথা। তারপরেই তিনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। আমার বুকটা দুরুদুরু করছিল। করতে করতেই নিশ্বাস বন্ধ। শুনতে পেয়েছিলাম, ‘আপ কা কৃপা…।’

ভিন পুরুষ চমকে চোখ তুলেছিল। ‘আপ কা কৃপা’ মানে ‘দয়া করে আপনি…।’ দেখেছিলাম রমণীর ঠোঁটে কুণ্ঠিত হাসি, দৃষ্টি সলজ্জ। তার মধ্যেই বার দুয়েক ভীরু চকিত চোখে বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টিপাত। তিনি যা বলে উঠেছিলেন, তার বাংলাটা ঠিক এইরকম, ‘দয়া করে আপনি আমাকে একটা সিগারেট দিন। আর আপনার দেশলাইটা। মেহেরবানি করে তাড়াতাড়ি দিন, উনি এসে পড়লে আর হবে না।’

কামরায় বজ্রাঘাত হয়েছিল কিনা, মনে পড়ে না। তবে নিজের কানকে বিশ্বাস করব কিনা বুঝতে পারছিলাম না। আমি কি সত্যি ওই কথাগুলো শুনেছিলাম। নিজের মুখ তো দেখতে পাইনি, কেমন করে জানা যাবে, তার কী হাল হয়েছিল। কিছু একটা হয়েছিল। কারণ, কয়েক মুহূর্ত দেহমন অবশ হয়ে গিয়েছিল। আবার, প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে শোনা গিয়েছিল, ‘জলদি…আপ কা কৃপা…।’

তাড়াতাড়ি সিগারেট বের করে দিয়াশলাই সুদ্ধ বাড়িয়ে ধরেছিলাম। তিনি ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিলেন। আর মুহুর্তেই তা তাঁর ‘দেহবল্লরী আচ্ছাদিত’ ঝলকানো শাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়েছিল। আঃ, আহা, জীবনে কোনওদিন কোনও রমণীর অমন খুশিঝলকানো তৃপ্ত মুখ দেখেছি কিনা, মনে করতে পারি না। শুনতে পেয়েছিলাম, আমার ভিতরে যেন কেউ অস্ফুটে ডেকে উঠেছিল, ‘মা, মাগো!’

সেই মুহূর্তে তার বেশি কিছু নয়। একটু পরেই কর্তা বেরিয়ে এসেছিলেন। গিন্নি তৎক্ষণাৎ খাড়া। সটান বাথরুমে। কর্তাটি একেবারে নির্বিকার। তিনি ভাল করে বিছানা পাততে মনোযোগ দিয়েছিলেন। আর সেদিকে তাকিয়ে, মাতৃসম্বোধনে আর্তপ্রাণ কবিতার সেই কলিটি আওড়াচ্ছিল, ‘রমণীর মন, সহস্র বর্ষেরই সখা সাধনার ধন…।’ ওরে পুরুষ, তোরে ধিক্‌। ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌! মনে করেছিলে, রমণীর সব কটাক্ষই এক। সব হাসি, সব দীর্ঘশ্বাস এক বায়ে বহে। মনে করেছিলে, সব অটল অরূপ নিরঞ্জনের খোঁজে এক দিকেতেই ছোটা। তারপরেই অবাক মানার পালা। আর যত অবাক, ততই রূপের মাঝে অরূপের আলো ভিন পুরুষের প্রাণে। সেই মুহূর্তে কার কাছে যে কৃতজ্ঞতা জানাব, ভেবে পাইনি। দ্বারভাঙাগামী রাত্রের ট্রেনে, জীবনের কোন রসিকে যে সেই নেশাবিচিত্রা দেখিয়েছিল, তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গ এখন থাক। তোলা থাক বারান্তরের পাতায়। কিন্তু আপাতত নলচে আড়ালের সহবতটা এই গাড়ির মধ্যে কোন পরস্পরে ঘটছে, তা ধরতে পারি না। ওই সেই মানুষ নাকি, গাজির পাশে বসে যিনি হুস্ হুস্ বিড়ি টেনে চলেন। হুম্‌, মনেতে টুকুস সন্দ লাগে। কারণ, মহাশয়ের কালো মুখে গোল দুটি লাল চোখের নিবিড় দৃষ্টি থেকে থেকেই ঘোমটার দিকে হানে। নিবিড়তাটুকু শাসন কষণের নয়। স্নেহেরও বলা যাবে না। তার থেকে বেশি, একটি গাঢ় গভীর প্রেমাবেগ বলা যায়। কেন। ওই তাম্বূলরঞ্জিত ঠোঁটে বিড়ি খাওয়া দেখতে ভাল লাগে বুঝি। দুটিতে মুখোমুখি বসে নেশার আমেজ জমাতে পারলেই, নেশা জমত নাকি। নলচে-আড়ালে তা হলে লোক দেখানো সহবত। ঘরের লোকের মুখোমুখি, সে এক কথা। তা বলে বাইরের লোকের ‘ছামুতে’।

ঘোমটা আড়াল দেওয়া এক চমক। দ্বিগুণ চমকের আর এক চমক, ধূম-উদ্‌গারিণীর পাশেই ছাপা সিল্ক-এর কোলের ওপরে কালো ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগ ধরা হাতে ছোট একটি সোনার বিন্দু ঘড়ি। দু’হাতে দুই সোনার বেড়ি, সাপ বাঁকানো চূড়। এসবের যিনি মালিকানী, তাঁর কেশে শ্যাম্পু কিনা কে জানে। কুসুমের ভাঁজ নেই। পিছন দিকের বাঁধনটাকে অশ্ব-লাঙুল বলে কিনা জানি না। ঘাড়ের কাছে একটি শক্ত বাঁধনের মুঠি কষে ধরে আছে। এখন দেখ বাকি অংশের নাচ। টাকি না শাঁখচূড় পেরিয়ে যাওয়া দিগন্তের বাতাসের তালে, গালে চিবুকে গলায় বুকে ঘন ঘন ঝাপটা। কপালে নেই টিপ ছাপ। সিঁথিতে নেই মুচলেকার রক্তলেখা। কালো ডাগর চোখ দু’টি আরও কিছু কালোয় কালো করা। কৃষ্ণ সবুজ নারকেলের পাতায় যেমন রোদের ঝলক চিকচিকিয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে, বয়স বলার বেয়াদপি যেন না করি। আন্দাজে বলো, কুড়ির ঘরে।

তাঁর পাশে যিনি, বর্ষীয়সী সধবা। মুচলেকার কী গরব! কপালে সিঁথেয় রাঙা হাসির ঝলক। লালপাড় তাঁতের শাড়িতে আটপৌরে বেষ্টন। হাত ভরতি শাঁখা সোনায় জোড়া। মা-মেয়ে কিনা, তত খুঁটিয়ে দেখা দায়। সহবতের দায়। সঙ্গে যিনি আরও আছেন, তিনি কি অন্য দিকের গলাবন্ধ কোট প্রৌঢ় সজ্জনটি। মাথার মাঝখান থেকে কেশ গতায়ু। মোটা লেন্সের চশমা পরা মুখে, গোঁফ-দাড়ি নিশ্চিহ্ন। কেবল মোটা লেন্স যে চোখের মণি দুটিকে একেবারে বিন্দুসদৃশ করে তুলেছে, সেই মণি দুটি ঘন ক্ষেপণে চঞ্চল। একবার বাইরে, একবার ভিতরে। একবার এ মুখ, একবার সে মুখ। সেই ধাঁধার মতো, “তাকের ’পরে শিশিটা, নড়ে চড়ে, পড়ে না। যদি না বলতে পার, তুমি জম্‌মো কানা।” শিশুর চোখ নয় যে বলবে, ওর অবাক চোখ দিকে দিকে দিশেহারা। যার অর্থ হল, প্রৌঢ়ের চোখ বাইরে নেই, মনে মনে। কিন্তু এঁরা উঠলেন কোথা থেকে, লক্ষ পড়েনি।

হবে কোথাও থেকে। বসিরহাট থেকে এ পর্যন্ত যে-কোনও এক জায়গা থেকে। যখন আমার চোখ নিয়ে গিয়েছিল দিগন্ত, সেই ফাঁকে। চোখে পড়ার কারণ আর কিছু নয়। হাসনাবাদের যাত্রী হিসেবে একটু ভিন রঙের ছাপ দেখি। কে জানে, হাসনাবাদের চেহারা কেমন। শহর না গ্রাম, তাই বা কে জানে। তবে বহুশ্রুত নাম। শ্যামবাজারে দাঁড়িয়ে অনেকবারই সহিসের গলার হাঁকে শুনেছি। হবে হয়তো, এ ভিন রঙের ছাপ সেখানে বেমানান লাগবে না। তাও কি লাগে! এক রং তো রং নয় রঙে রঙে রঙিন। দেখতে ভাল তাই।

কিন্তু ওই শোনো, যাবে কোথায়। গাজির গলা শোনা যায়, ‘বাবুকে তো চিনতি পারলাম না।’ ঠিক অব্যর্থ জায়গাতেই কথা যায়। প্রৌঢ় ফিরে তাকান। এবার জবাব অধর মাঝির বাবুযাত্রীর নয়। সোজা কথায়, ‘চিনবে কী করে। আমি এদিকের লোক নই।’

গাজির চোখ ঘোরানো হাসি। বলে, ‘সেই কথাই তো বলছি, বলে নতুন বাবু দেখি। টাকি থেকে উঠলেন দেখলাম কিনা। বেড়াতে এসেছেন বুঝি।’

এবার জবাব সংক্ষিপ্ত, ‘হুম্‌।’

মোটা লেন্সের ফাঁকে, বিন্দু বিন্দু তারায় বিরক্তিও টের পাওয়া যায়। সেই বিরক্তির রেশ গিয়ে পড়ে আর দু’জনের মুখে। সধবা কুমারীর চোখে চোখে চাওয়া, ঈষৎ হাস্য, গাড়ি চলে যাওয়া একটি ঝলকের মতো। কিন্তু প্রৌঢ় জানেন না, ওর নাম মামুদ গাজি। প্রসঙ্গ কীসের থেকে কোথায় যেতে পারে, তাঁর ধারণায় নেই। তাই, যখন মুখ ফিরিয়ে নিতে যাবেন, তখনই আবার, ‘বাবুর যাওয়া হবি কোথায়?’

প্রৌঢ় দেখছি এদিক ওদিক পছন্দ করেন না। মুখ না ফিরিয়েই বলেন, ‘গোসাবা।’

মামুদ গাজি ঘাড় নাড়িয়ে বলে, ‘তাই তো বলি, বাবুকে তো হাসনাবাদেও কোনওদিন দেখি নাই। লঞ্চ ধরে যাবেন তো?’

প্রৌঢ়ের ভুরু জোড়া যেভাবে তির হানা বাঁকে বেঁকে ওঠে, একটা ধমক নিশ্চিত আশা করা যায়। হতে পারে অচেনা অঞ্চল, তবু আমার নিজের ধারণাই বলে, গোসাবা ক্যানিং-এর কাছে। আর ততদূর যাবার জন্যে লঞ্চ ছাড়া আর কোনও বাহন আছে বলে মনে হয় না। যা আছে, তা নৌকা। গোসাবার যাত্রী নিশ্চয়ই এখান থেকে নৌকায় যাবেন না।

কিন্তু মানুষ আমার কবে চেনা হয়েছে। প্রৌঢ়ের চোখের তারার অস্থিরতা এবার শরীরে দেখা যায়। বলেন, ‘তাই তো যেতে হবে। কিন্তু সময় তো হয়ে গেল, লঞ্চ পাওয়া যাবে কী।’

গাজির ফাটা মুখে, হাবজা দাড়িতে হাসির তরঙ্গ। দৈববাণী শোনায়, ‘তা পাওয়া যাবে বাবু।’

‘যাবে?’

প্রৌঢ় যেন অকুলে কুল দেখছেন গাজির বরাভয় মুখে। এতক্ষণে বোঝা যায়, তাঁর চোখ এত দিকে দিকে দিশাহারা কেন। আসলে দিকে দিকে নয়। মনে মনে দিশেহারা, লঞ্চ পাওয়া যাবে কিনা। গাজি বলে, ‘তা আর যাবে না! এই মটরখানি না দেখে লঞ্চ ছাড়বি নে। আমরাও তো যাব।’

বলে সে হাসিটি তুলে ধরে আমার দিকে। আমরা বলতে এখন, সে আর আমি। তার চাহনির রকম দেখে, ভদ্রজনের সাব্যস্ত মন ত্রস্ত হয়ে ওঠে। নজরটা তাই আগেই যায় সধবা কুমারীর দিকে। গাজি আমার সহযাত্রী, এই ঘোষণায় সহসা একটা অস্বস্তি ঘনায় মুখে। আর অস্বস্তিটা মিথ্যে নয়। সধবা কুমারী তখন গাজির সহযাত্রীকে একটু দেখে নিচ্ছেন।

রাগ করবে, করো। কোথায় কবুল করেছ এখন তাই ভাব। মুরশেদের নামের মনজুরিতে তো আজ ইস্তফা। মনের খেদ গিয়েছে, প্রাণের কাঁদন গিয়েছে, এমনকী বোবাকালার রহস্যেও খেয়া পার হয়ে গিয়েছে। আজ দেখছি তার বাবু নামের মজদুরি। তাতে আপত্তি নেই। এতই যখন বাবু বাবু, তখন এক বাবুর শরণ নিলেই তো হয়। সব বাবুকে জড়ো করা কেন।

মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালাম। ভাবি বলি, ‘আমরা আবার কে। আমি তোমার সঙ্গী নই।’ কিন্তু ভাবা এক, বলা কঠিন। কাকেই বা বলবে। ওই তো শোনা যায় আবার, ‘ওই যে দেখা যায় হাসনাবাদ এসে পড়া গেল।’

সামনে তাকিয়ে দেখি, দিগন্ত ঠেকেছে এক ঘন বসতির সীমায়। কাঁচা-পাকা বাড়ি, দূর থেকে লাগে যেন চাপাচাপি ঠাসাঠাসি। তবে আকাশে হাত বাড়ানো নারকেল সুপারি গাছ মাঝে মাঝে ফাঁক রেখেছে। গাড়ির ভিড়ও কম নয়। শুধু লরি নয়। লরির ছাঁরের মতো শহরে যেগুলো দাপিয়ে বেড়ায়, সেই টেম্‌পোও আছে। আরও গুটিকয়েক বাস। তারপরেই নদীর কূলে, সারি সারি নৌকা। মাস্তুলগুলো ভিড় করে আছে পাশাপাশি। নৌকার ভিড়ের মধ্যেই একটা স্টীম লঞ্চ দাঁড়িয়ে। ডাঙার সাঁকোর খুঁটোয় কাছি দিয়ে বাঁধা। বাস দেখা মাত্রই, লঞ্চের ভেঁপু বাজে ঘন ঘন। ওদিকে যত ভেঁপু বাজে, এদিকে তত হর্নের সাড়া। কারুর ব্যাখ্যা করতে হবে না, গাজির গলাই শোনা গেল, ‘ওই শোনেন, উনি বলেন, এইসো এইসো, ইনি বলেন, যাই যাই।’

হাসতে গিয়ে কাশি কাশে কে, বলে, ‘যা বইল্‌ছ।’

তাকিয়ে দেখি, কালো মুখ, লাল চোখ, গাজির বিড়ি পানের সঙ্গী। যাত্রী তখন মোট দশ হতে পারে। বাস ধুলো উড়িয়ে দাঁড়াল। গাজি হেঁকে বলল, ‘বাবু, চলেন চলেন, সারেঙের বড় তাড়া।’ যাওয়া যখন স্থির, তাড়াতাড়িই ভাল। আমার পিছন পিছনেই গাজি। সেখান থেকেই হাঁক দিল, ‘দাঁড়ান গো, আমরা অনেকে যাব।’

মাথায় পাতার ছাউনি, ছোট এক মাটির ঘর! তার কঞ্চির গরাদ দেওয়া জানলার কাছে, অসমান ইংরেজিতে লেখা, ‘বুকিং অফিস।’ সম্ভবত আলকাতরা দিয়েই লেখা। অভ্যাস অনুযায়ী আগে সেদিকেই দৌড় দিই। দরাদরির বিষয় নয়, ছাপানো টিকেট। গাজি তাড়াতাড়ি ডেকে বলে, ‘ওদিকে কই যান বাবু। অনেক দেরি হয়ে গেছে, টিকেট আর এখন ঘরে নাই। টিকেটবাবু লঞ্চে গিয়ে উঠেছেন। চলেন তাড়াতাড়ি যাই।’

কিন্তু গাজিকে দাঁড়াতে হয়। ডাক দিয়েছেন সেই প্রৌঢ়, ‘ওহে, কী বলব, মোল্লা না সাধু, আমরাও কি এই লঞ্চেই যাব?’

‘তয়? তাড়াতাড়ি আসেন। মায়েরা পা চালিয়ে আসেন গো।’

বলে, হেসে হেসে হাত তুলে নিজেই ডাকে। যেন সে লঞ্চের লস্কর খালাসি। সে-ই সবাইকে ডাক দিয়ে নেয়। শুধু তাদেরই নয়, অন্য দিকেও তাল ঠিক আছে, ‘কই গো, মাহতো চাচা, কোথা গেলে। চাচির হাত ধরে সাবধানে এসো।’

মাহাতো চাচা আবার কে! তার লক্ষ দেখে, চোখ ফিরিয়ে দেখি, মাহাতো চাচা সেই বিড়ি খাওয়ার সঙ্গী। দেখছি, মানুষ না চিনি দেখতে ভুল করিনি। সেই রক্তাম্বরী, তাম্বূলরঞ্জিনী, ধূমপায়ী মধ্যবয়স্কা, ঘোমটা টেনে এখনও মাহাতো খুড়োর পাশে। চাচা তখনও পান কিনতে ব্যস্ত। শুধু বিড়িতে হয় না। চাচা চাচির পান না হলেও চলে না। ততক্ষণে আমাদের পিছনে প্রৌঢ় এসে পড়েন সধবা কুমারীকে নিয়ে। গাজি আমাকে নির্দেশ দেয়, ‘বাবু উপরে যান গিয়া। ছোট ঘর আছে, সেই ঘরে গিয়া বসেন।’

কথা শেষ হল না, হঠাৎ টিং টিং করে ঘণ্টা বেজে ওঠে। সারেঙের দিকে তাকিয়ে দেখি, মাথার ওপর সে দড়ি ধরে টানে। আর দিক-দিশারির টান পড়তেই, যন্ত্রের শব্দ যেন ছিটকে বেরিয়ে এল, ছাদের ওপর নলের মুখ দিয়ে। তার সঙ্গে অল্প ধোঁয়া। ছাদের ঘরের প্রথম শ্রেণীর কাছে গিয়ে ভয় পেলাম, ভিড় বাঁচাতে গিয়ে কান দুটি না খোয়া যায়। ঘরের মধ্যে ঢুকে শুনি, তেমন ঝালাপালা নয়। যেদিকে নল, সেদিকে কাঠের দেয়াল। ডাইনে বাঁয়ে জানালা। সামনেও কাঠের দেয়াল। ওপরে কাচের ঢাকনা ঘেরা সারেঙের আসন।

প্রথম শ্রেণী বলতে যেমন গদির চিন্তা আসে, তা নয়। নিতান্তই নীরস তরুবরের তক্তাসন। তবে ভিড় বাঁচানো নয় কেবল। আসনে বসতেই মনে হল, এপার ওপার দুই দিগন্ত আমার জানালায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এপারের হাসনাবাদকে মনে হয় যেন বিশাল এক গঞ্জ। ওপার বাংলায় এরকম নদীকূলের গঞ্জকেই বলে বন্দর। যে ঘাটে দূর দেশান্তরের নদীনালা ডিঙিয়ে আসে নানান জলযান। এপারেও দেখছি সেইরকম। তাকিয়ে দেখি, ঘাটে ঘাটে অনেক নৌকা। পিছনের বাঁকের দিকে আরও কয়েকখানা লঞ্চ। ওপারে উঁচু পাড়ের বাঁধ। এপারের ভিড়-ব্যস্ততায় মনে হয়, ওপারটা গাছপালায় রৌদ্রছায়ায় মাখামাখি করে জমিয়ে আছে নিবিড় নিশ্চুপে। যেন তার ঝোপে ঝোপে ঝাড়ে ঝাড়ে পাখিদের কলকাকলিও শুনতে পাই।

কিন্তু এখানেও সেই টানাটানি। লঞ্চে টিকেটবাবুর প্রত্যয় নেই, গাজি পয়সা দিয়ে যাবে। যন্ত্রের ডাক ছাপিয়ে শোনা যায়, ‘বিনা পয়সায় নিয়ে যেতে পারব না বাপু।’

মুখ বাড়িয়ে দেখি, গাজি ওপরে আসতে গিয়ে থেমেছে। বলছে, ‘না দিয়ে যাব কেন। বলছি যখন, দেব, পয়সা দেব। তয়, আমাকে উপরে গিয়ে বসতে দিতে হবে দাদা, মুরশেদের দোহাই। ওইটি দোয়া।’

বলতে বলতেই সে উঠে আসে৷ আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দ্যাখেন তো বাবু, মিছা বলব কেন, বলেন তো।’

বলে সে ঘরের বাইরে জানালার নীচেই ছাদের ওপর বসে। ওদিকে কাছি খোলবার তোড়জোড়। শেষবারের হাঁকাহাঁকি। হঠাৎ শব্দে, এদিকে তাকিয়ে দেখি, মোটা লেন্সের চশমা সহ এক জোড়া চোখ ঢুকে এল প্রথম শ্রেণীর ঘরে। পিছনে ভ্যানিটি ব্যাগ, ছাপা সিল্ক-এর শাড়ি, অশ্ব-লাঙুল কেশ। তাঁর পিছনে বাংলা তাঁতের লালপাড় শাড়ি। মুচলেকার রক্তগরব সিঁথিতে কপালে।

প্রথমেই প্রৌঢ় কণ্ঠে বিরক্ত বিদ্রূপ, ‘হুঁ, এর নাম ফাস্‌টো কেলাস। নাও বসো। তুমি ওদিকটায় বসো। ঝিনি, তুই এদিকটায় বস।’

বলে নিজে আমার পাশে বসলেন। বাকি দু’জন, আজ্ঞা বলো, নির্দেশ বলো, পেয়ে অন্য দিকের আসনে বসলেন। লঞ্চ তখন মোড় বেঁকে কোনাকুনি ওপার মুখে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *