৩৫.
কত যে জলহাস মত্তভাষ স্রোতের টানে ভেসে চলেছিল আমার দু’পাশ দিয়ে, তার হিসাব করতে পারিনি। নিশিঘোর কাটেনি আমার। যেন অগাধ অসীম অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ভেসে চলেছিলাম। কখনও সোজা, কখনও এঁকেবেঁকে, কুটির ইমারত মন্দিরের পাশ দিয়ে। পথে পথে, আমার চলার স্রোতে মানুষ। আমার উজানেও অনেক। যে যার আপন পথে চলেছিল। সেই কালো রাত্রে, কারুর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। সকলই অস্পষ্ট, ছায়া-ছায়া। যেন আমরা কেউ মর্তভূমে নেই। যেন অন্য কোথাও কোন দূর লোকে—কালের ওপারে, সময় যেখানে বন্দি হয়ে পড়েছে, বাঁধা পড়েছে ডাকের উদ্দাম দগরের ঝম ঝম ঝন ঝন কম্পনে।
কেবল মাঝে মাঝে এক-একটা আলোকিত দ্বীপ ভেসে উঠছিল। যেখানে শ্রবণ ফেটে যাওয়া ঢাকের শব্দ। ফুলঝুরি রংমশাল দুম দুম বাজি, মানুষের ভিড় আর সেই কালীর প্রতিমা, যার সঙ্গে কেবলই চোখাচোখি, যে-দিকেই চোখ ফেরাই। আলোর দ্বীপগুলো এক-একটা পূজাবাড়ি। কারা যেন কথা বলেছিলেন। কারা যেন সামাজিকতা করেছিলেন, এইস হে, বইস হে। হয়তো বসেছিলাম, হয়তো দুই-চারি কুশল বার্তা বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু মনে নেই কিছু। কোথায় যেন আরও কিছু গাঢ়, আরও গূঢ় কিছু ছিল, মলুটির সেই অজ্ঞেয় সীমায় চলে গিয়েছিলাম।
পূজাবাড়ির সকল ছাড়িয়ে এলেই আবার অন্ধকার। ঘোর করাল সেই রাত্রি। উদ্দাম উন্মত্ত নিশা। কানে আসছিল কত বিচিত্র বচন। কেউ হাসে খিলিখিলি, খলখল কেউ। কেউ হাঁকে রুদ্র গলায়, কেউ কাঁদে ফুঁপিয়ে। তারা কে, দেখতে পাইনি কাউকে। তারা কোন নারী, কোন পুরুষ, কাউকে চিনিনি।
তার সঙ্গে, কোথা থেকে এসেছিল বাতাস, কে জানে। রাজমহলের পাহাড় থেকে, নাকি বঙ্গোপসাগর থেকে, বুঝতে পারিনি। তালের পাতায় পাতায়, অসিধারে খান খান, সেই বাতাসে শুনেছিলাম চাপা গোঙানি গরগর। পাতায় পাতায় ঝাপটা। সব মিলিয়ে যেন শাসানি গোঙানি প্রহার। কিন্তু সাবধান হে, অন্ধকারে পা পড়ে গিয়েছিল কার গায়ে। মেয়ে গলায় শুনেছিলাম অস্ফুট আর্তনাদ, ‘উহ্!’
যেন অবশ হয়েছিল পা। কালো ডাগরী মেয়েটির আঢাকা বুক মুখ বাহু কেমন করে চোখে পড়েছিল জানি না। কালো চোখ দুটিতে যেন ব্যথার তরাস। আমি ত্রাসে লজ্জায় বিমূঢ়। সঙ্গের সঙ্গী হেঁকে উঠেছিল, ‘পথের উপর শুয়ে রইছিস। সরে শুবি তো।’
তখন, লক্ষ পড়েছিল, কেবল যাতায়াত না। মলুটির পথে-পথে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মন্দিরের ধারে, কুটিরের পাশে, ইমারতের দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে। মেয়ে পুরুষ শিশু, সপরিবারে সাঁওতাল প্রজারা এসেছে রাজার গ্রামে। পূজায় এসেছে। যে যেখানে পেরেছে, পেতেছে রাত্রের আস্তানা। মন্ত্র পূজা, যা কিছু আর্য নিয়মের পার, তাদের উৎসব। তখন সেই প্রতীক্ষা।
দেখেছিলাম, তাদের কারুর সঙ্গে মাদল, কারুর বিশাল বাঁশি। কেউ বাজাচ্ছিল, কেউ মাদল বুকে ধরে ঘুমে কাতর। তবু, তারই মধ্যে কোনও মেয়ের গলায় গুনগুনানি। পুরুষের রস খাওয়া মদ্দা পায়রার বক্বকম। আর যদি থেকে থেকে হঠাৎ কারুর হাতের কেরোসিনের টিমটিম লাল আলো ভেসে উঠছিল, তখন আরও অলৌকিক। জীবন্ত নরনারী, আর কাঁপা আলোয় কাঁপা কাঁপা মন্দিরের গায়ের দেবতারা, সকলই যেন একাকার হয়ে উঠছিল।
আমার নিশিঘোর, নিশায় নিশায় বাড়ছিল। কখন এক সময়ে, তাল সারির নীচে, বাবলা বনের ধারে, এক মন্দিরের কালো জমাট মূর্তির পাশ দিয়ে, সহসা ভেসে উঠেছিল আগুনের লেলিহান শিখা। কাছে না, দূরে—এক উৎরাইয়ের মন্থর ঢালুর ওপারে, প্রান্তরে। সারি সারি চিতার মতো, পাশাপাশি, আগুনের কুণ্ড। কালো আকাশের তারায় হাতবাড়ানো শিখা। দু-একটা কালো ছোট ছোট মানুষের মূর্তি সেখানে ভেসে ভেসে উঠছিল।
ওখানে কী! ওরা কারা! কী করে!
এই যখন মনে মনে জিজ্ঞাসা, সঙ্গের সঙ্গীরা নিজেরাই বলে উঠেছিল, ‘উয়ারা রস জ্বাল দিচ্ছে। পচুই রস সব চোলাই হচ্ছে, কালকের জন্যে।’
তারপরেই যেন একটা স্তব্ধতা নেমে এসেছিল। অই, কী বইলব হে, অমন নিঝুম নিশ্চুপে কেউ সোজা খাঁড়া থাকতে পারে না। ঢাকের দগরে কম্পন থেমে গিয়েছিল। এত নিশ্চুপ, ঝিঁঝির ডাক শোনা গিয়েছিল। পাখির স্খলিত গলা। যেন ভুলে ডেকে উঠে থেমে গিয়েছিল। কিন্তু সেই নিশ্চুপ স্তব্ধতায় যেন আমার শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, কী যেন ঘটতে চলেছে। একটা ভয়ংকর কিছু। তারই পূর্বমুহূর্তের নিশ্চুপ নিশ্চলতায় সব কিছু থমকে গিয়েছিল। সর্বচরাচর।
নিজের, সঙ্গীদের পায়ের শব্দে শব্দে কখন ফিরতে আরম্ভ করেছিলাম, জানি না। হঠাৎ, আচমকা ছুরি বেঁধার মতো একটা আর্ত চিৎকার উঠেছিল। অসহায় পশুর চিৎকার। তখন আমি এক আলোকের দ্বীপে, পূজাবাড়িতে। কোন বাড়ি কোন রাজার, কিছুই বুঝতে পারিনি। তাকিয়ে দেখার কথা মনে ছিল না।
কেবল দেখেছিলাম, জলে ভেজানো কালো চকচকে একটা প্রকাণ্ড মূর্তি পাক দিয়ে ফিরছে। চক্ষু তার আরক্ত, চাহনি ক্ষ্যাপা। সে একবার এদিকে ছুটে যায়, আবার ওদিকে। ছোটরা তার চোখের সামনে ফুলঝুরি রংমশাল জ্বালিয়ে ধরছিল। কেউ শব্দ করছিল পটকার। কেউ টেনে ধরছিল তার ল্যাজ। কালো মূর্তি ভয়ে রাগে তার নাতিদীর্ঘ শিং নিয়ে ঢুঁ মারতে আসছিল। হয়তো পালাতে চাইছিল। কিন্তু খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ছিল সে।
তারপরেই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যূপকা যুপকাষ্ঠে। আষ্ঠের কাছে। সেই কালো মূর্তির অন্ধকার প্রাণে কী ভাব এসেছিল, কে জানে। যমের বাহন সে মহিষ, আপন ঈশ্বরের কথা হয়েছিল নাকি! কার দুটো বলিষ্ঠ হাত যূপকাষ্ঠের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার গর্দান। আর এক জোড়া ঘিয়ে ডোবানো হাত এগিয়ে এসে, তার গলায় মর্দন করতে আরম্ভ করেছিল। তখন একজন সামনের দড়ি ধরে টানছিল। আর একজন পিছন থেকে। আর কেবলই, মর্দন-মর্দন।
অই, কী অন্ধকার হে, মলুটি, তুমি আমার বুকের নিশ্বাস যেন বন্ধ করে দিয়েছিলে। আমার দৃষ্টিকে অসহায় করে তুলেছিলে। ঢাকের পিঠে সহস্র কাঠির সজোর শব্দে দগর উঠেছিল। আবার সেই কম্পন। সেও যেন এক স্তব্ধতা। মহাকালকে বন্দি করে রাখা।
তারপরেই খাঁড়া উঠেছিল শূন্যে। শাণিত উজ্জ্বল ধারে দেখেছিলাম, দুটি চোখ-আঁকা খাঁড়া। আমার দৃষ্টি চকিতে একবার ছুটেছিল প্রতিমার দিকে। সেই চোখ! সেই চক্ষু! আমার সঙ্গেই যেন তখনও তার চোখাচোখি। পরমূহূর্তেই কী ঘটে গিয়েছিল। খাঁড়া একবার ঝিলিক হেনে নেমে গিয়েছিল নিঃশব্দে।
যমের বাহন তখন ছিন্ন। কালো এক বিশাল ধড়, আকুঞ্চিত, অস্থির বেগে থরথর দাপাদাপি। কিন্তু, তার কণ্ঠনালি থেকে নির্গত, প্রথম রক্তের ফোঁটা রাঙিয়ে দিয়েছিল পুরোহিতের মধ্যম আঙুল। প্রতিটি কপালে কপালে লাগিয়ে দিয়েছিল নিহতের রক্তের ফোঁটা।
কখন এক সময়ে, সেই আঙুল ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার কপাল। তখনও রক্ত ঠান্ডা হয়নি। কপালে একটা উষ্ণ স্পর্শের মতো লেগেছিল। আমার গায়ের মধ্যে শিউরে উঠেছিল। বুকের মধ্যে একটা আর্তধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম যেন। তখনই কালো কচি নধর আর একটি জীব তুলে দেওয়া হয়েছিল যূপকাষ্ঠে। আমি চোখ বুজে ফেলেছিলাম। আমার সেই নিশির ঘোর, আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আলোর বাইরে। অন্ধকারে কোথায় চলেছিলাম জানি না। কেবল সেই দোতলার ঘরটির সন্ধানে চলেছিলাম।
অই, কী অন্ধকার হে! চারদিকে ঢাকের পটহ ধ্বনি, পশুর চিৎকার, মানুষের উল্লাস। আরও আরও কিছু, চারপাশে, বিহ্বল কুহর, শীৎকার, কাচ ও রুপার চুড়ির নিক্কণ। কুথা হে, সেই ঘরখানি!
আমার প্রথম বার দেখা, বিচিত্রের সন্ধানে ফেরা, কী বিচিত্র দেখেছিলাম! কার খোঁজে ঘুরে ফিরি, কীসের সন্ধানে, এদিনে যেমন জানি না, সেদিনেও না। যখন যা পেয়েছি, নিয়েছি মন ভরে। কিছু গিয়েছে উপছে, কিছু পুরনো ঝোলার ছিদ্রে গিয়েছে ঝরে। যা কিছু থেকে গিয়েছে, সে-ই আমার অচিনে ফেরার অধরা কি না জানি না। যদি তাই, তবে সেই আমার মলুটির এক রাত্রি, এক দিনের স্মৃতি। নির্বাকে, যেখানে কেবল, বুকের কাছে হাত জড়ো করে, দু’চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম।
এ কথা বলব না, আমার অনুভূতির গোচরে কিছু ধরা দিয়েছিল। এ কথা বলব, পৃথিবীর এক ঠাঁই, মানুষের এক লীলা দেখেছিলাম।
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে, কেমন করে আমার নিমন্ত্রণের বাড়ি এসেছিলাম, জানি না। সেখানেও সেই ঢাকের নিরন্তর বাজনা, পশুর চিৎকার, মানুষের উল্লাস। কালা কালী ধলা ধলী রাঙারাঙি কতেক নারী-পুরুষ, প্রতিমা আর যূপকাষ্ঠ ঘিরে। কী আশ্চর্য হে, বড় রায় যেন কেমন আচ্ছন্ন। কাছে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। ছোট রায়ও না। তাঁদের রাঙা মুখে তখন যেন কীসের ঘোর।
আমি বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলাম। সেখানে তখন একটি মাত্র আলো, এক দাওয়ার কাছে টিমটিম করছিল। যেন সেখানে উৎসববর্জিত হাহাকার। উঠোন পেরিয়ে, দক্ষিণের দাওয়ায় উঠে ডান দিকে ফিরে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। আবার থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল।
কে যেন কোথায় বলছিল, ‘না না না।’
মেয়েলি স্বরে কান্নার আভাস। তারপরে পুরুষের গলা, ‘অ্যাই তোর পায়ে ধরি, অন্যায় হয়ে যেছে, মাইরি।’
যেন আর এক জগৎ। রক্তের উৎসব থেকে মুরলীধ্বনি বলে, ‘দেহি পদপল্লবম্মুদারম্।’ গলা চিনতে ভুল করিনি।
সেই ডাকা আর ডাকিনী, ধনু আর তিপু। কিন্তু কোথায়, আওয়াজ বোলে কোথা থেকে!
তারপরে ত্রাস রোষ, ‘এই বইলছি, পায়ে হাত দিয়ো না। আমি যাব না পূজা দেখতে।’
‘তিপু, তু নক্কী মেয়ে, কথা শুনবি না!’
অই, ওহে পুরুষ, তুমদিগে চিনতে বাকি নাই। তাই কান্না ঝাঁজানো গলায় বেজেছিল, ‘না না না। ক্যানে, লজ্জা করে না, মুখ দেখবে না বইলছিলে। মুখে থাপ্পড় মারবে।’
ওরে পুরুষ, তখন কী ধনে ধনী হয়ে অমন বুলি বলেছিলি, মনে ছিল না। আর তোষবার সময় বলছিল, ‘মাইরি বইলছি, অন্যায় হয়ে গেছে, অ্যাই শোন তিপু—।’
মানভঞ্জনের পালা, আর কিছু শোনবার ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিলাম। এক কোণে একটি টিমটিমে বাতি ছিল। সেই আলোয় জামা খুলে, পাতা বিছানায় লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। বারান্দার দরজার কাছ থেকে সুষির গলা জেগে উঠেছিল, ‘খাবেন না?’
একটু চমক খেতে হয়েছিল। কিন্তু মলুটির নিশিঘোর আমার মন মস্তিষ্কের সীমায় সীমায়। সেই ঘোরে একটু চমক লেগেছিল। সুষি এখানে কেন, এই অন্ধকারে, নিরালা নির্জনে, উৎসবের আসর ছেড়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি পূজার ওখানে যাওনি?’
‘না।’
ছোট জবাব, কিন্তু ছোট না। স্বর এসেছিল যেন অনেক দূর থেকে। কী একটা সুর ছিল, ধরতে পারিনি। যেন কীসের ভারে চাপ খাওয়া সুরের মতো। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন৷’
‘ভাল লাগে না।’
কার্তিকের চতুর্দশী মহানিশায়, মলুটিতে নতুন কথা! নতুন সুর, নতুন ভাব! ভাল লাগে না! টিমটিমে অস্পষ্ট আলোয় দেখেছিলাম, সুষির মাথা নিচু। কোনও এক অবসরে, খোঁপা বাঁধবার সময় হয়েছিল ওর। সেই খোঁপাটি, নত মাথায় বড় হয়ে জেগেছিল। একটু বুঝি সাজতেও হয়েছিল। কিছু রঙিন বসন, কিছু চাকচিক্য।
আস্তে আস্তে মাথা তুলেছিল। দেখেছিলাম, কপালে একটি টিপ। যেন দু’চোখে দুই তারা, কপালে আর এক। সেখানে হাসির ঝিলিক না, উৎসবের উল্লাস না। নির্বাক বিস্ময়াহত বিমর্ষ মুখ। তার চেয়ে বেশি, যেন ভিতরে প্লাবন বহে, বাইরে থমথম।
আমরা জিজ্ঞাসু মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে, আবার বলেছিল, ‘আমি দেখতে পারি না।’
কী দেখতে পারে না, সে কথা আর জিজ্ঞেস করিনি। হঠাৎ দেখেছিলাম, কালো টিপ পরা ত্রিনয়নী মেয়েটির চোখের কোণে জল জমে উঠেছে। আবার বলেছিল, ‘আমি পারি না।’
বলেই সুষি পিছন ফিরে, বারান্দার কোলে আঁধারে সরে গিয়েছিল। আমি চুপ করে বসেছিলাম। বাইরে পূজা-দালানে উল্লাস বাজনা পশুর চিৎকার। ঘরের নীচে, অন্ধকারে ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’-এর সুর, ওপরে ‘শ্রীমতী নামে সে দাসী’ রক্তের ধুলায় যে অহিংসার সাহসে কাঁদে!
মনে হয়েছিল, পথ চলার এমন বিচিত্র ছবি আর কবে দেখেছি। বারে বারে বুকের কাছে হাত এনে, কাকে যে নমস্কার করতে চেয়েছিলাম, জানি না। কেবল, প্রার্থনা করেছিলাম, আমার মনকে স্পন্দিত রাখতে দাও, আমার চোখ খোলা রাখো।
একটু পরেই আবার সুষি দরজায় ভেসে উঠেছিল। তখন তার দৃষ্টিতে ও গলায় স্বচ্ছলতা। বলেছিল, ‘আপনি চলে এলেন কেন!’
মন খুলেই বলেছিলাম, ‘তোমাদের এই মলুটির এক নিশির ঘোর লেগেছে আমার। আমি যেন ঠিক কিছুই বুঝতে পারছি না। অথচ পারছি।’
সুষি এক মুহূর্ত, তিন চোখে অপলক চেয়েছিল আমার দিকে। দৃষ্টিতে অনুসন্ধিৎসা, কিছু বা বিস্ময়। হঠাৎ চোখ নামিয়ে আবার তাকিয়েছিলাম। তখন যেন ওর কালো মুখে হাসি ফুটেছিল একটু। বলেছিল, ‘যাদের সঙ্গে গেছলেন, তারা কোথায়?’
‘জানি না।’
‘ওদের সঙ্গে যদি একটু মেতে যেতেন, তা হলে সব ঠিক লাগত।’
কথাটা ঠিক হৃদয়ঙ্গম হয়নি। তাই অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম।
সুষি যেন একটু লজ্জা পেয়ে হেসেছিল। বলেছিল, ‘যেমন ঠাকুরের যেমন পুজো। জানেন তো, কারণবারি ছাড়া এ পুজো হয় না।’
বলেও সুষি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আর বেশি বলবার দরকার ছিল না। সেইটুকু ইঙ্গিতেই বুঝতে পেরেছিলাম, ওর বক্তব্য কী। কিন্তু সুষির একটু বুঝতে ভুল হয়েছিল। আমি মেতেছিলাম ঠিকই। সে-মাতনের চেহারাটা অন্যরকম। আমার সমগ্র অনুভূতি জুড়ে তার খেলা। এমনি তার প্রাণ-ধাঁধানো ঝলক, অসীম বিস্ময়, প্রায় এক অলৌকিকের রহস্যে যেন বিবশ হয়েছিলাম। তার চেয়ে বলি, আমার ঘোর লেগেছিল, মাতনের ঘোর। বলেছিলাম, ‘তার দরকার নেই। বেঠিক আমার লাগেনি কিছুই। এমন আর কখনও দেখিনি।’
সুষি তাড়াতাড়ি দু’ পা এগিয়ে এসেছিল। অবাক ত্রস্ত গলায় বলেছিল, ‘রাগ করলেন নাকি!’
হেসে বলেছিলাম, ‘না।’
তারপর সুষির চোখের দিকে এক পলক দেখে, জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মলুটির পুজো কি এই তোমার প্রথম দেখা?’
সুষি ভুরু তুলে বলেছিল, ‘না না, ছেলেবেলা থেকেই দেখছি।’
‘তবে তুমি দেখতে পারো না কেন?’
সুষি একটু চুপ করে ছিল। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল টিমটিমে আলোটার দিকে। দৃষ্টি দেখে মনে হয়েছিল, সে-ঘর থেকে ও যেন অন্য কোথায় চলে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে বলেছিল, ‘ছেলেবেলায় বেশ ভাল লাগত। তারপরে যত বড় হতে লাগলাম, আর ভাল লাগত না। বাবা মারা যাবার পর, বলি দেখতে আর কখনও যাই না।’
দেখেছিলাম, এক হরিণী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। সংসার যাকে অসহায় করেছে। ব্যাধভীতা হরিণী করেছে। পিতৃহীনা একটি মেয়ে, যে তার চারপাশে দেখেছে অনেক উদ্যত খড়্গের ভিড়। যে তার নিজের বুকে কান পেতে শুনেছে অসহায়ের আর্তনাদ। চারদিকে তার অনেক যূপকাষ্ঠ, ক্ষুধা-অসম্মান অনিরাপত্তা অপ্রতিষ্ঠা।
বাইরে বাজনা উল্লাস আর্তনাদ। ঘরের মধ্যে তখন, সুষির দিকে তাকিয়ে, আমার ঘোরের`মধ্যেও এক নিবিড় মমতা স্পন্দিত হচ্ছিল। ইচ্ছা করেছিল, মেয়েটিকে কাছে ডেকে একটু স্নেহ করি। অনেক কথা ও বলেনি। কয়েকটি কথার মধ্যে ওর ভিতরের পুরো ছবিটা ভাসছিল।
‘আপনাকে খেতে দিই?’
কথা শুনে চমক ভেঙেছিল। চোখ ফেরাতে ভুলেছিলাম। পুরুষের অপলক চোখের সামনে, কখন লজ্জায় সঙ্কোচে কুঁকড়ে উঠেছিল সুষি। ঘোর ভাঙাবার জন্যেই ডেকে কথা বলেছিল। আবার বলেছিল, ‘জেঠি বলেছে, আপনি ফিরে এলে খেতে দিতে। রাত কিন্তু দুটো বেজে গেছে।’
দুটো! হাত তুলে ঘড়ি দেখেছিলাম। দুটো না, তার চেয়ে আধঘণ্টা বেশি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আর সবাই খাবে কখন?’
সুষি বলেছিল, ‘তার কোনও ঠিক নেই।’
ক্ষুধার অনুভূতি আমার একটুও ছিল না। মলুটির নিশিঘোরের মধ্যে, স্নায়ুতন্ত্রে কেমন একটা শৈথিল্যের আচ্ছন্নতা নিবিড় হয়ে এসেছিল। বলেছিলাম, ‘খাবার ইচ্ছা একটুও নেই। তার চেয়ে একটু শুয়ে থাকি।’
শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। সুষি বলেছিল, ‘তবে বাতিটা একেবারে নিভিয়ে দিই।’
ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কী করবে এখন?’
অন্ধকারের মধ্যে সুষির গলা শোনা গিয়েছিল, ‘বারান্দায় বসে থাকব।’
‘শুতে পারো তো।’
‘আমার ঘুম আসবে না।’
আমি চুপ করেছিলাম। টের পাইনি, সুষি বারান্দায় গিয়েছে কিনা। সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারিনি। নিকষ অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে, তবু সুষির মুখটিই ভাসছিল। আর ওর অকপট করুণ স্বর শ্রবণে বাজছিল, ‘আমার ঘুম আসবে না’…বাইরে বলির উৎসব তেমনিই চলছিল। আমার চেতনা কখন হারিয়ে গিয়েছিল, জানতে পারিনি।
সহসা কানের কাছে যেন ঢাকের দর বেজে উঠেছিল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছিলাম, দিনের আলো। আমার সারা গায়ে ঘাম। নীচে থেমে, থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। উঠান ভরে রক্ত। গলি দিয়ে চোখে পড়েছিল, পূজামণ্ডপে তেমনি ভিড়। সেই বাজনা, সেই উল্লাস, সেই আর্তনাদ।
রোদের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, বেলা কম হয়নি। বলি তখনও থামেনি। গলিটা রক্তে ভাসছিল। কখন যে হাতমুখ ধুয়েছিলাম, সুষির কাছ থেকে চা খেয়েছিলাম, এখন মনে করতেও পারি না। মলুটির নিশি আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
দেখেছিলাম, মলুটির পথে পথে রক্তের স্রোত। মুণ্ডহীন রক্তাক্ত বলির দেহ নিয়ে, শূন্যে ছুড়ে লোফালুফি। হাত দিয়ে ছাল ছাড়িয়ে, দগদগে ধড় কাঁধে করে মত্ত কুর্দন নর্তন। অই কী বইলব হে, রক্ত নিয়ে গায়ে ছোড়াছুড়ি, রক্ত ছিটিয়ে খেলা। গত রাত্রির রক্তপাত, দিনের বেলাও সমানে চলছিল। মলুটির লাল মাটিতে, রক্তে রক্তে দইকাদা।
তার সঙ্গে, রসের অনুপান। সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষেরা, পাত্র উজাড় করা মত্ততায়, কলকল ঢলঢল। ঢাকীদেরও সেই দশা। ঢুকুটুকু রসের ধারায়, হাতে তাদের অসুর শক্তি। থামতে ভুলে গিয়েছিল। দাঁড়াতে ভুলে গিয়েছিল। ছুটে ছুটে, পাক দিয়ে দিয়ে শূন্যে লম্ফ নাচ। রক্তচোখে মত্ত দৃষ্টি, মাতাল মুখে রসের ঝলক।
যেন চতুর্দশীর অমানিশা তখনও শেষ হয়নি। ঢাকের বাজনায়, রক্তে, নৃত্যে, উল্লাসে, সময় সেখানে বাঁধা পড়েছিল। ভদ্রাভদ্র, সকলের এক দশা। বড় রায় ছোট রায়, সবাই উল্লাসের ঘোরে। তবু তার মধ্যেই পুছাপুছি কাজকর্ম সবই চলছিল।
কেমন করে যে দুপুরের স্নানাহার মিটেছিল, সেই স্মৃতি অস্পষ্ট। দেখেছিলাম, মলুটির পথে পথে কোথা থেকে এসেছিল মনোহারির দোকানদার। ঘণ্টা বাজানো মিঠাইওয়ালা। আর এসেছিল, ঝাঁপি মাথায় মেয়ে-পুরুষ সাপুড়ে।
তারা ঝাঁপি খুলে, সাপ ছড়িয়ে দিয়েছিল পূজা বাড়ির উঠানে। খেলিয়েছিল মলুটির ক্ষ্যাপা ভিড়ের পথে পথে। ‘অইগ, ই দেখে লাও চন্দ্রবোড়া। লীলেতে সনার চক্কর। আশমানে তারা হে!’ বলে আবার মেয়ে সাপুড়ে, তার ক্ষীণ কটি গুরুনিতম্বে, চন্দ্ৰবোড়া জড়িয়ে পাছাবাহার দেখিয়েছিল। কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচেছিল। কেউটে নিয়ে সোহাগ করে বুকের উপর ছেড়ে দিয়ে চাপড়ে চাপড়ে বলেছিল, ‘লেটো করে থাক রে নাগ, ঘুম যা।’
আর সাপুড়ে গলায় ঝুলিয়ে অজগর, দুধ গোখরোর ফণা গিলেছিল হাঁ করে। অই হে, তোমার গায়ে কাঁটা দিলে কী হবে। ই দ্যাখ গ, নাগিনীর চুমা কেমন লাগে। সাপুড়ে শব্দ করে চুমো খেয়েছিল। সাপিনী তার লকলকে জিভ দিয়ে সাপুড়ের মুখের ভিতর চেটেছিল। মাতাল সাঁওতাল মেয়েরা তখন গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠেছিল। তাদের চোখেমুখে রসের ঝলক, রসের গলন।
মলুটিতে না গেলে, অমন সাপ খেলাও দেখতে পেতাম না।
.
৩৬.
কে জানে কী ধরন-ধারণ, সাপের খেলা দেখে যেন সাঁওতাল মেয়েরা সব লাজে ভরে শিউরে শিউরে উঠেছিল। কেবল সাঁওতাল মেয়েরা বলব কেন, বাউরি বাগ্দি মেয়েরাও। তাই যদি বইললে হে, বাকিরাও বাদ থাকে কেন। কেতাবিতে যারা ভদ্রমহিলা, অন্তঃপুরের ঝি-বউয়েরাও মুখে আঁচল চেপে হেসে কুটিপাটি। পাছে পুরুষদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় তাই ঘন ঘন ঘোমটা ঢাকা, ভারী লাজে লাজানো।
সাঁওতালি বাউরি বাগ্দি মেয়েদের অত ঢাকাঢাকি ছিল না। লাজে লাজানো ছিল। হাসতে গিয়ে যেন গায়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছিল ভয়ে, ‘ই বাবা গ! অই গ, আহ্ ছি, উয়াদের লজ্জা নাই গ! বলে খিলখিল হাসি। হেসে ঢলাঢলি। কেন, সাপুড়ে মেয়ের নাচে, না সাপুড়ে পুরুষের বয়ানে! ধরতে পারিনি। সাপুড়েদের ভাবভঙ্গি একটু কেমন কেমন ছিল, সেইটুকু নজর করেছিলাম। চোখ পুরু পুরু, হেসে বচন, ‘ই দ্যাখ গ, সামলে বিটি, নাগের ফণা কুথা উঠে হে। দমশন কইরলে জানি না।’
বলে হঠাৎ কাপড় ঝাড়া দিয়ে সাপ বের করেছিল। অমনি হাসাহাসি ঢলাঢলি। আবার ফণা চেপে ধরে যখন মুখে পুরে দিয়েছিল তখন মেয়েদের গলায় আর্তস্বর। আর্তস্বর নয় হে, বলো শীৎকার। নাগরদোলার ভয় পাওয়া খুশি।
যখন পুজাদালানের উঠানে খেলা, তখন সুষিকে দেখেছিলাম। মেয়েদের দলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। রক্তারক্তিতে যার ভয়, সাপের খেলা দেখে যেন তার চোখেতেই আমেজ। কালো মেয়েটির ডাগর চোখে খুশির ঝলকে যেন রাঙা ছোপ ধরে গিয়েছিল। বারেক চোখাচোখি হয়েছিল বলে হেসে চোখের পাতা নামিয়ে নিয়েছিল। যেন রাঙা ছোপ চোখে না, মনেতে লেগেছিল, কেন, তা বুঝতে পারিনি।
আমি দেখেছিলাম, সাপ নিয়ে জাদু। চোখের সামনে সাপ লুকোবার হাতসাফাই। তার সঙ্গে অমন ভয়ঙ্কর নাগ-নাগিনী নিয়ে হাসি-ঢঙের খেলা। খেলার সঙ্গে আর যেসব দাবি ছিল তা হল, ‘লতুন লতুন কাপড় চাই। নাগের দুধ চাই, পেট ভরা খাবার চাই। তবে একেবারে এমনি না।’ কেবল খেলা দেখিয়েই সব চাওয়া না। ‘বিষ ঝাড়বার শিকড় দেব, নাগ ঠেকাবার জন্যে হেঁতালের ডাল দেব, মন মজাবার ওষুধ দেব।’ তবে না এত দাবিদাওয়া!
ওদিকে যত নাগ-নাগিনীর খেলা, সাপুড়েদের নাচ-নাচন, তত যেন সাঁওতালি মেয়েদেরও নাগিনী দোলন লেগেছিল। রসের ভরায় তারা ঝলকাচ্ছিল। তারপরে নাগিনীর মতোই দুলতে আরম্ভ করেছিল। একা একা না। দলে দলে, গুচ্ছে গুচ্ছে। কেবল মেয়েরা না। মেয়েরা যেমন সারি সারি হাত ধরাধরি, কোমর ধরাধরি, পুরুষেরা তেমনি তাদের মুখোমুখি, দলে দলে, গুচ্ছে গুচ্ছে, সারি সারি। তাদের কারুর গলায় মাদল, কারুর হাতে বাঁশি। মেয়েদের গলা তখনও তেমন খোলেনি, গুনগুনানি চলছিল।
তাদের নাচ চলেছিল পূজাদালানের উঠানে, বাড়ির মধ্যে উঠানে। তারপরে উঠান থেকে একেবারে এ ঘরের দাওয়ায়, সে ঘরের দাওয়া। ইস্তক রান্নাঘরের সামনেও।
সবাইকে দেখাতে হবে যে। ‘উই গ রাঙা বউ, লাচ দেখবি না?’ দেখবে বই কী। বড় গিন্নি, ছোট গিন্নি, তাবত বউ-ঝিয়েরা সব বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর ছেড়ে। কর্তারা দেখতে দেখতে আবার সামাল দিচ্ছিলেন, ‘হঁ হঁ, খুব হয়েছে রে, খুব হয়েছে।’
সে কথাটি বলবার জো ছিল না। ‘ক্যানে, খুব কুথা দেখলি রে, ই কি লাচ হল যে, খুব দেখলি?’
বলেই কাছের রস-অধরা ঢলঢল মেয়েটিকে ধরে সে কী প্রাকৃত ভঙ্গির নাচ হে। ওহে নগর-মজা চোখওয়ালা বিদ্যেধর, অমন অশ্লীল জ্ঞানে নজর ঘুরিয়ে নিয়ো না। মশকরা বোঝ না হে, মশকরা! অশ্লীলতা যদি কোথাও ছিল সে তোমার চোখে। ওদের না। ওরা যেমন, তেমনি-ই। নিজেদের মতো নিজেদের সব কিছু। তোমার নগর-ঝলক যখন ওদের হাতছানি দেয়, জানবে তখন ওরা বিপরীতে বাঁকা। নয়া রীতের ধরতাই জানা নেই অথচ আপন রীত ছাড়া সে বড় বিষ। এ আপন রীতে চলা, এ হল অনায়াস, স্বচ্ছন্দ, সুন্দর।
তবু বড় রায় ছোট রায় রাঙা মুখে হেসে ধমক দিয়েছিলেন, ‘আরে ধু—হারামজাদা।’
বউ-ঝিয়েরা হেসেই বাঁচেননি। ঘোমটা টেনে আঁচল চেপে সরে গিয়েছিলেন।
উঠানে, দাওয়ায়, পথে পথে নাচ গান, সাপ খেলানো। টিং টিং ঘণ্টা, বোম্বাই মিঠাই, লাড্ডু, জিলিপি, তেলেভাজা। আর ‘বেলোয়ারি চুড়ি লয় গ, ইয়ার নাম রেশমি চুড়ি, চ্যাংড়া ধরার ফাঁদ, পয়সা পয়সা দাম।’ তার সঙ্গে চোখঝলসানো টিপ ছাপ আলতা সিঁদুর, বেলাতি পাথর বসানো আংটি। রামপুরহাটের দোকানদার সেসব জানে। বেলাতি পাথর কাকে বলে আর কলকেতার ফুলেল তেল।
তারপরে দেখেছিলাম মলুটির পথে পথে রক্ত শুকোবার আগেই বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠেছিল। ‘জয় মা কালী৷’ তখনও সূর্য অস্ত যায়নি। তখনও খড়ের চালে, তালপাতায়, গাছে গাছে, মন্দিরের চূড়ায় চূড়ায় হেমন্তের রাঙা রোদ। ঢাকের কাঠিতে নতুন তাল বেজে উঠেছিল। ঢাকীদের নাচেও। কালো পাথরে তৈরি এবড়ো-খেবড়ো বিশাল মূর্তি রক্তচক্ষু পুরুষেরা বাঁশের চালি পেতেছিল উঠানে। বরণের জন্য, প্রতিমার পায়ে সিঁদুর ছোঁয়াবার জন্য, সেই সিঁদুরের অবশিষ্ট ঘরে তোলবার জন্য সধবারা পূজাদালান ঘিরে ধরেছিল।
নাচ গান সাপ খেলানো ঢাকের দগর আর কালীর জয়ধ্বনি। মলুটির রূপ বদলে যাচ্ছিল। তবু সেই উৎসবের মত্ততায় মলুটির মন্দিরের চূড়ায় যে রাঙা রোদ চিকচিক করছিল, সে যেন এক কাঁদন-ভরা হাসির ছোঁয়া মনে হয়েছিল। সেই শ্রবণফাটা শব্দের মধ্যেও দেখেছিলাম পাখাগুটানো পাখি নির্বাক হয়ে বসে ছিল গাছের ডালে। দূর পশ্চিমের লাল আকাশে যেন বিহঙ্গের নিবিড় দৃষ্টি। রক্তঝরা লাল মাটিতে যেন ছায়ার বিষণ্ণতা। আর তেমনি নিশ্চুপ নতমুখ প্রাণহীন স্থবির দেখেছিলাম মন্দিরের দেওয়ালের দেবদেবীদের।
প্রতিমার বিদায় কী, তা জানি না। বিসর্জনের ব্যথা কী, তা-ই বা কী জানি। উৎসব শেষ, শেষ হতে চলেছে। সব মিলিয়ে আকাশের রাঙা রোদ, নির্বাক পাখি ও মূর্তি, মৃত্তিকার ছায়া যেন তারই অন্য রূপ।
দাঁড়িয়েছিলাম ভিড়ের পিছনে। হঠাৎ লক্ষ পড়েছিল, বড় রায় দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরেই। শেষ প্রণাম সেরে সরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই গরদের কাপড়খানিরই এক অংশে পিঠ ঢাকা দেওয়া। খোলা বুকে উপবীতটি দেখা যাচ্ছিল। দু’হাত জোড় করে রেখেছিলেন বুকের উপবীতের কাছেই। গতকাল থেকে দাড়ি কামাবার সময় পাননি। তাই রাঙা মুখে দাগ ফুটেছিল। দেখেছিলাম তাঁর নীল চোখে জল। রাঙা গাল বেয়ে পড়ছিল। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ছিলেন প্রতিমার দিকে।
দেখে চোখ ফেরাতে পারিনি। মন চলকে উঠেছিল। অবাক তেমন হইনি, বুকের কোথায় একটু ঠেক লেগেছিল। হাত কয়েক দূরে, ইচ্ছা হলেও কাছে যেতে পারিনি। তাকিয়ে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, কেন, কীসের জন্য। এমন মন তো আমার হয় না। এই কি বিসর্জনের অশ্রুপাত?
চোখ ফেরাতে গিয়ে আর একবার ঠেক। দেখেছিলাম, বড় গিন্নি স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তখন সধবাদের মাখানো বরণের সিঁদুরে তার সিঁথি কপাল লালে মাখামাখি। কী যেন বলেছিলেন, শুনতে পাইনি। নিজের লালপাড় শাড়ির আঁচল তুলে স্বামীর চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলেন। যেন মা মুছিয়ে দিয়েছিল ছেলের চোখ। রানি মুছিয়ে দিয়েছিলেন রাজার চোখ। কত লোক সেখানে, সে দৃশ্যে কারুর লক্ষ ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গে বড় রায়ের রাঙা মুখে বিব্রত হাসি। তাড়াতাড়ি নিজের গায়ের কাপড় টেনে নিজে নিজেই মুছেছিলেন। পরমুহূর্তেই হঠাৎ বড়গিন্নি চমকে একটু সরে স্বামীর পায়ের ধুলা নিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, পা ঠেকেছে বুঝি। বড় রায় বলে উঠেছিলেন, ‘থাক, থাক।’
বড় গিন্নি তারপরে কী বলেছিলেন শুনতে পাইনি৷ দেখেছিলাম, বড় রায় হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছিলেন। আসতে গিয়ে আমার সঙ্গে চোখাচোখি। ভেবেছিলাম, কথা বলবার অবকাশ পাবেন না। গত রাত্রে পূজা শুরু হওয়ার সময় থেকে পাননি। যেন কীসের ঘোরে ছিলেন।
কিন্তু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। হাত ধরেছিলেন। তখন ছোঁয়াছুঁয়ির নিষেধ শেষ। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দেখছ তো বাবা!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
তখন হঠাৎ একবার প্রতিমার দিকে তাকিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এইটুকুই বাবা, আর কিছু না। ব্যস, শেষ হয়ে গেল। এই একটা দিন সারা বছরের মধ্যে। কী দিয়েই বা কী হয়, কিছু কী আর আছে আমাদের। আচ্ছা বাবা, দেখ, দেখ। এইবার বিসর্জন—মৌলীক্ষার মাঠে চলো।’
বলতে বলতেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল গলাটা যেন কোন গহনে ডুবে যাচ্ছিল। নীল চোখ দুটো আবার টলটলিয়ে উঠছিল। পূজাদালানে তখন প্রচণ্ড চিৎকার, ‘সাবধান হে!’…চালচিত্র সহ প্রতিমা থরথর করে কাঁপছিল। প্রতিমাকে চালির ওপর তোলা হচ্ছিল।
কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম নিশ্চুপে, এক আতুর ভাবে। বড় রায়ের কথাগুলো বাজছিল কানে। মনে হয়েছিল, যা বলে গেলেন সে কথাগুলো শুধু কথা না। তার গভীরে আরও কিছু। রাজা বাজবসন্তের অধস্তন পুরুষ, পশ্চিমের বেলাশেষের আকাশে তাকানো পাখির মতো কী যেন বলে গিয়েছিলেন। হয়তো দিন যায়, রাত্রি আসে—এই কথা বলেছিলেন।
জয়ধ্বনি ক্রমেই বাড়ছিল। প্রতিমা আসন থেকে সরছিল। তেমনি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপরে সেই যে বলে ষষ্ঠেন্দ্রিয় চকিত হয়, আমার তেমনি হয়েছিল। মনে হয়েছিল, কে যেন আমাকে দেখছে, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি পিছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, লাল মাটির এক ছোট ঢিবির ওপরে সুষি দাঁড়িয়ে।
চোখ ফেরাতেই চোখ মিলেছিল। সুষি চোখ নত করেছিল। একটু হয়তো হেসেছিল। কেন জানি না, মনে হয়েছিল, বড় রায়ের মুখের ছায়া যেন ওর মুখে পড়েছে। সেই চোখের জল এই চোখেও যেন টলটলানো।
প্রতিমা যাত্রা করেছিল। আমি পিছনে পিছনে গিয়েছিলাম। সুষিও এগিয়ে এসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাঠে যাবেন?’
বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ। সেখানেই তো বিসর্জন?’
‘হ্যাঁ। মাঠের কাছে যে পুকুর আছে, সেখানে।’
‘কেন, মাঠের কাছে তো নদী আছে?’
‘তাতে আর জল কতটুকু। প্রতিমা ডুববে না।’
মনে হচ্ছিল, নিজের জোরে চলছি না। ভিড়ের ঠেলায় আপনিই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দাঁড়াবার উপায় ছিল না। ঢাকের শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে হাঁক শোনা যাচ্ছিল, ‘সাবধান— সাবধান হে।’ ঢাকের শব্দ, জয়ধ্বনি, সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষের মত্ত মিছিল, সেই সবকিছুর মধ্যে কোথা থেকে যেন ক্ষ্যাপা গোবিনের গলায় গান বেজে উঠছিল:
‘অই হে, আমি এই ভয়ে মুদি না আঁখি।
নয়ন মুদিলে পাছে, তারা-হারা হয়ে থাকি।
অহে, যখন থাকি শয়ানে তখন এই ভয় মনে,
না হেরে হারাই পাছে, চাহিয়ে ঘুমায়ে থাকি।’
এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়েছিলাম। ক্ষ্যাপা গোবিন্কে দেখতে পাইনি। সুষি তাকিয়েছিল সামনের দিকে। ভিড়ের ওপারে যেখানে প্রতিমা দেখা যাচ্ছিল। চালির ওপরে মানুষের কাঁধে প্রতিমা থরথর কাঁপছিল, দুলছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল, সুষি যেন প্রতিমার দিকে চেয়ে অন্য কিছু ভাবছিল। সেই আওয়াজই দিয়েছিল সে। হঠাৎ চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ক্ষ্যাপার গান শুনতে পাচ্ছেন?’
গানেতে শ্রবণ ছিল সুষির। বলেছিলাম, ‘পাচ্ছি।’ সুষি বলেছিল, ‘ও কিন্তু কাঁদছে।’
‘ক্ষ্যাপা গোবিন্?’
‘হ্যাঁ।’
বলতে বলতেই থেমে গিয়েছিল সুষি। পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যাবে না?’
‘না, মাঠে আমরা যাই না।’
‘কেন?’
‘মেয়েরা যায় না।’
মেয়েরা যাচ্ছিল। সাঁওতাল বাউরি মেয়েরা। অন্তঃপুরের মেয়েদের মৌলীক্ষার মাঠে যাত্রা নিষেধ। সুষির কথার ভাবে সেই ইঙ্গিত ছিল। তবু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন?’
সুষি বলেছিল, ‘বড় মাতালের ভিড়। বিসর্জনের সময় যখন প্রতিমা মাঠে পাক দেয় তখন তরফে তরফে মারামারি লেগে যেতেও পারে।’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘নিজেদের মধ্যে?’
‘হ্যাঁ। তা ছাড়া—।’
কথা শেষ করেনি সুষি। কী যেন সে বলতে চেয়েছিল, বলতে পারেনি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলেছিল, ‘দেখে আসুন।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। স্রোতের টানে হারিয়ে গিয়েছিলাম। স্রোত নয় হে, প্লাবন। ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের বাইরে, উৎরাইয়ের ঢলে গড়ান লাগতেই ভিড় ছড়িয়ে গিয়েছিল। মৌলীক্ষার মাঠ ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। পশ্চিমের দিগন্তে, যেখানে আকাশের গায়ে পাহাড়ের রেখা, সেখানে রক্তের গোলার মতো সূর্য। যেন একখানি নরম কোমল শান্ত আর বিষন্ন রক্তিম মুখ। আকাশ লাল, মৌলীক্ষার প্রান্তর লাল, তালের পাতায় পাতায় লাল। আর মানুষ লাল, সকলই রক্তাভ।
দেখেছিলাম, প্রতিমার চালিতে হাত রেখে বড় রায়, ছোট রায় সকলেই এক মত্ত ঘোরে ছুটেছেন। মাঠ প্রদক্ষিণ করে চলেছেন দৌড়তে দৌড়তে। অন্যান্য তরফের প্রতিমারও সেই প্রদক্ষিণ আর ছোটার বেগ। সুষি ঠিকই বলেছিল, প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজনা। যখনই এক তরফের প্রতিমার কাছে আর এক তরফের প্রতিমা এগিয়ে আসছিল, তখনই হুংকার বাজছিল, লাঠি উঠছিল, ‘খবরদার, যেতে দাও।’ সেই বেগে ছুটেছিল ঢাকীরাও।
কিন্তু লক্ষ করেছিলাম, সাঁওতালিরা ক্রমে নাচে মেতে উঠেছিল। সেই গুচ্ছে, দলে দলে মেয়েদের সারির মুখোমুখি পুরুষদের সারি। প্রথমে দেখেছিলাম শতে শতে, তারপরে সহস্রে। শত শত গুচ্ছে, সহস্রের নাচ। মেয়েদের শরীরগুলো হাড় দিয়ে গড়া ছিল না যেন। অই কি বইলব হে, নাগরিক নজরে জগৎ-জোড়া বিস্ময়। মেয়েদের হাঁটু যখন সামনে, কটি তখন পিছনে। যখন কটির দোলন সামনে, তখন উঁচা পাহাড় বুকে ঢেউ খেয়ে চলে পিছনে। তারপরে যখন বুক এগিয়ে আসে তখন ফুল জড়ানো খোঁপার ভারে মাথা হেলে যায় পিছনে। যেন সাপিনীর দাঁতে বিষ, ছোবলে উদ্যত, এবার ফণা পিছনে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমনি যখন হিলহিলানো, তখন দেখ পদক্ষেপের গোনা গাঁথা মাপ। শরীরে তিন মোচড়ে তিন ঢেউ, পায়ে পায়ে তিন ধাপ এগনো আর পিছনো, পুরুষদেরও তাই। মাদল বলো, বাঁশি বলো, রসের ধারায় মত্ত বলো, পদক্ষেপে ত্রুটি ছিল না। যেন মুখোমুখি নাগ-নাগিনী পেছিয়ে যায়, এগিয়ে আসে। এগিয়ে যখন আসছিল, মনে হচ্ছিল, মুখোমুখি ধাক্কা লেগে যাবে। কিন্তু স্পর্শ পর্যন্ত ছিল না। কেবল দুঁহু দোঁহার কটি বুকে ছুঁতে গিয়ে না ছুঁয়ে পেছিয়ে যাচ্ছিল। দু’জনে দু’জনের নিশ্বাস মাখামাখি করে ফিরে যাচ্ছিল।
মেয়েদের গলা তখন খুলে গিয়েছিল। ভাষা বুঝিনি। গানের বচনের ভাব ছিল তাদের চোখমুখের ছটায়। তাদের হাসির ঝরায়, চোখের ঝিলিকে। মেয়েরা গান করছিল। পুরুষেরা মুখে শব্দ করছিল, হিস্ হিস্ হিস্ হিস্!…
মলুটির নিশিডাকের শেষ ঘোর আমার বাকি ছিল। মৌলীক্ষার মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, আমি দুলছি। নাচের তালে তালে আমি দুলছি, মাঠ দুলছে, আকাশ দুলছে। মাদলের বোল, বাঁশির কাঁপানো সুর, মেয়েদের গান, পুরুষের হিস্ হিস্ সব মিলিয়ে আমার চিরকালের জগৎ কোথায় মনে করতে পারিনি। যে জগতে অনেক নাচ ছিল, গান ছিল, হাসি ইশারা সব কিছু ছিল। কিন্তু সে নাচ গান রূপে ছিল। মৌলীক্ষার প্রান্তে দেখেছিলাম অরূপের খেলা। আমি ফিরে গিয়েছিলাম সেই কোন হিসাবহীন অতীতে। যবে সভ্যতার আলোতে ঝাঁপ খেয়ে পড়েনি মানুষ। বাস প্রকৃতির প্রাকৃত অঙ্গনে। যে অরূপ আমার রূপে-ভোলা চোখের সীমা পেরিয়ে রক্তে ছড়িয়েছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। ইন্দ্রিয়ের দরজা পেরিয়ে কোন এক দূর লোকের রহস্যে ভাসিয়ে দিয়েছিল। যেখানে আমার চির দেখা মানুষের ও-পিঠে আর এক মানুষ লীলা করে। যেখানে মানুষের আপন হাতের নিয়ম নেই। জগতের অমোঘ নিয়মে যেথায় সে প্রাণী মাত্র।
কখন ঢাকের শব্দ কমে আসছিল, খেয়াল করিনি। কখন প্রতিমার প্রদক্ষিণ শেষে বিসর্জন শুরু হয়েছিল জলাশয়ে, চেয়ে দেখিনি। কখন দূর পাহাড়ের আড়ালে রক্তের গোলা ডুবে গিয়েছিল, আকাশের রাঙা ঝলকে কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছিল, চোখে পড়েনি। দেখেছিলাম, হেথা-হোথা এক-একটা মশাল জ্বলে উঠছিল। আর নাচ আর গান, মাদলের বোল, বাঁশির সুর।
দেখেছিলাম, যেন মৌলীক্ষার মন্দিরের গায়ে পুরাণের কুশীলবেরাও নাচের তালে তালে দুলছে। নাচের তালে তালে সুঠাম দেহের নাচ। উদ্ধত বুকের কম্প, গর্বিত কটির ঝম্প, ব্যাকুল বাসনার আর্তি, সবে মিলে নাচ নাচ নাচ।
তারপরে যেন চেতনার শেষ রেশটুকুও মুছে গিয়েছিল। অই, ওহে, পবিত্রতার এমন অহংকার আর কোথাও দেখিনি। আমার চোখ থেকে সভ্যতার ঠুলিটা কে তুলে নিয়েছিল। দেখেছিলাম, প্রকৃতি নিরাবরণ। মানবসন্তান যেখানে মুখ দিয়ে প্রথম অমৃতপানে পৃথিবীতে চিৎকার করেছিল, সেই অমৃতভাণ্ড স্তন মুক্ত আকাশের নীচে। সৃষ্টির উৎসমুখ সকল উন্মুক্ত, মৃত্তিকার মতো, মৃত্তিকার মুখোমুখি। পুরুষও তাই। বস্ত্র সে ছেড়ে ফেলেছিল। সৃষ্টির প্রক্রিয়া-আবেগে প্রকৃতির মুখে তার ঘন বর্ষণের ধারায় গভীর চুম্বন। সৃষ্টির কারণে তার ধরিত্রীর বুকে কৃষিকাজ। যেন মানুষের সুখের শ্রম।
ছায়া ছায়া আঁধারে দেখেছিলাম, নগ্ন প্রকৃতির বুকে নগ্ন মানব-মানবী। লীলা করে দুঁহু দোঁহা কুহরে শীৎকারে। হাসিতে, ঝঙ্কারে, আকর্ষণে, আলিঙ্গনে। এক না, একাধিক, শতেক যুগলে। রূপে না, অরূপে। যা চোখের সীমায় শুধু থাকেনি, দৃষ্টির ওপারের অসীমে, বিস্ময় শিহরন ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল অচেতন চেতনার ঘোরে। রূপে যা অবিশ্বাস্য বলে জেনেছিলাম, অরূপে তা-ই বিশ্বাস্য হয়ে জেগে উঠেছিল। মৌলীক্ষার মাঠের আঁধারে সৃষ্টির নগ্ন খেলা চলেছিল। মনে হয়নি, প্রার্থনা ছিল, তা-ই আত্মদান। যেন যে যাকে চেয়েছে, তাকে নিয়ে সেই তার উৎসব।
উৎসব যা কিছু করো, ওহে মানুষ, ধরিত্রী উর্বরা হোক, সেই তোমার পূজা। পূজার আচার অনুষ্ঠান, যা কিছু সকলই সৃষ্টির ক্রিয়ায়। যে ক্রিয়া বৃষ্টিধারার অনুকরণে ক্রিয়ায়। যে-ক্রিয়া বৃষ্টিধারার অনুকরণে বীজবপনের ভঙ্গিতে, মৃত্তিকার গভীর স্তরে প্রবেশের অক্লান্ত আনন্দ শ্রমের প্রক্রিয়ায়। সে-ই তার আদিম কামনা, ধরিত্রী তুমি গর্ভবতী হও, শস্য দাও। যে মতো তোমার ক্রিয়া, সেই মতো আমার অনুষ্ঠান। হে মা, সেই অনুষ্ঠানে আমি সন্তান উৎপাদন করি।
ওপরে অসীম আকাশ, নীচে গণমিলনের আসর। মৌলীক্ষার মন্দিরের গায়ে তখন যেন দেখেছিলাম পুরাণের নরনারীরা একই অনুষ্ঠানে লিপ্ত। সকলের এক প্রার্থনা।
কতক্ষণ কেটেছিল, জানি না। বুকের কাছে দু’হাত রেখে আমার অচিন খোঁজার দ্বারে নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, পশুবলির চিৎকারে, ঢাকের দগরে, সময় যেমন বন্দি হয়েছিল আগে, তখন যেন মহাকাল মহাবেগে ছুটেছে। বিশ্ব-সংসার সকলই তার রথের রশিতে বাঁধা। তার প্রবাহে চলেছে।
‘এই যে বাবা, সবাই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। চলো, বাড়ি চলো।’
বড় রায় আমার গায়ে হাত দিয়েছিলেন। হাত ধরেছিলেন। সেই স্পর্শেও আমার চেতন ধমক খায়নি। তাঁর আকর্ষণে গ্রামের দিকে ফিরেছিলাম। দেখেছিলাম, অন্ধকারে মৌলীক্ষার মাঠ তখনও যেন কী এক ঢেউয়ে দুলছে। আর নক্ষত্রগুলো সেই মাঠের বুকেই ঝিকিমিকি করছে।
বড় রায়কে কোনও কথা জিজ্ঞেস করিনি। গ্রামটাকে শ্মশানের মতো স্তব্ধ নিশ্চুপ মনে হচ্ছিল। কিংবা আমার ভিতরটাই সেরকম স্তব্ধ হয়েছিল। বড় রায় একবারও আমার হাত ছাড়েননি। একেবারে বাড়িতে ঢুকে ছেড়েছিলেন। বাতি নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছিল সুষি। চোখে তার অনুসন্ধিৎসা, অপলক চেয়ে ছিল আমার দিকে। বড় রায় তাকে দক্ষিণের ওপরের ঘরে আলো দিয়ে আসতে বলেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন একটু বিশ্রাম করে নিতে।
সুষি ডেকেছিল, ‘আসুন।’
আমি আচ্ছন্নের মতো ওকে অনুসরণ করেছিলাম। গোবিনের মোটা গম্ভীর নিচু গলা শোনা যাচ্ছিল, ‘মা আমাকে অভয় দিলি না। জগদম্বা নাম ধর হর অঙ্গনা।’…
‘এই যে স্সার, বোলপুর এসে গেছে।’
চমকে ফিরে তাকালাম। মলুটি না, রেলগাড়ি। ইস্টিশন বোলপুর। চমক খেয়ে চেয়ে দেখি, সামনে অতুলদাসের মুখ। বাংলার মসনদের সিরাজদৌল্লা। রেলের কিলিনার। বাইরে চোখ ফেরাতেই, অ৷ কী ব্যাপার হে, ইস্টিশন লোকে লোকারণ্য। ছাতিমতলার মেলার যাত্রী সব।
.
৩৭.
মনে হল, রেলগাড়ির তাবত লোক, গাড়ির ঘর খালি করে নেমে এল। কেউ আর কোথাও যাবে না। সকলেরই যেন বোলপুরে গন্তব্য, গতি। যত অ-বোল বোলা, সব হেথাতে। ঝোলাঝুলি নিয়ে আমিও তখন ইস্টিশনের দাওয়ায়। কিন্তু মলুটির ঘোর তখনও মনে। আমার প্রথম দেখা রাঢ়ের কীর্তন, তখনও যেন আখরের পৌনঃপুনিক বোলে বাজছে। মনের নজর পড়ে আছে মৌলীক্ষার মাঠে। সেই সূর্য-ডোবা আলোছায়া প্রান্তরে, যেখানে অরূপের খেলা খেলে নরনারী জীবন্ত মিথুন মূর্তিত, বন্ধকাম লীলায়।
তারপরেও মলুটিতে বারেক গিয়েছি। দেখেছি সব, তবু প্রথমের তুলনা যেন নেই। সেই দেখা, সেই এক দেখা, যখন বিচার ছিল না আচরণ দর্শনে। তারপরে যা দেখেছি, শুধু দেখেছি। প্রথম যা দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন আঁকা চোখে দেখেছি কি দেখিনি, সত্য না মিথ্যা, বিস্ময়ের আবেগে দেখা, সেই দেখাটা সত্য হয়ে আছে আজও। অনুসন্ধিৎসা, বিচার-বিশ্লেষণ, যত প্রকার প্রকরণে দেখা, তার কোনও দাগ নেই মনে।
‘ওদিকে না, এদিকে আসুন। ওপারে যেতে হবে স্সার পোল পেরিয়ে।’
তখনও সিরাজদৌল্লা, ভিড়ে হারিয়ে যায়নি, ছেড়েও যায়নি। বরং আবার হাত বাড়িয়ে বলে, ‘দিন না, একটা কিছু আমার হাতে দিন।’
না না, তা-ই কি কখনও হয়। বটে, আমার হাতে বোঝা, কাঁধে বোঝা। বোঝা সকলই আপন। বাহক না পেলে তা আপনিই নেব, সিরাজের ঘাড়ে তা চাপাতে পারি না। বলি, ‘না না, চলুন, ঠিক আছে। কুলি-টুলি—।’
আহ্ যা বলছে, তাই শুনুন না কেন স্সার। মিছে প্যাচাল কেন। এ তো আর লুট কাড়াকাড়ি না। যে যেখানে যার বাজনদার, তাকে সেখানে তাই বাজাতে দাও। অতুলদাস কিলিনার সিরাজ তেমনি করে হেসে বলে, ‘কুলিটুলি মেলাই আছে, কিন্তু প্যাসেনজার দেখেছেন কত! কলকাতার গাড়িও তো এসেছে ওপারে। দিন, একটা দিন আমাকে।’
হ্যাঁ স্সার, না দেন তো, এমনি করেই নেব। বাঁধানো বাংলার মসনদখানি আলখাল্লা সদৃশ গরম কোটের যে পকেটে ঢুকেছে, সেটিকে বলতে পারো, হাত ভর এক গর্ত। এখন সেই পোশাকটির সকল বোতাম খোলা। দেখতে যদি বা মনে হয়, তবু মনে করো না, যেন সঙের ঝালঝোপ্পা। লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া আতেলা চুলে ঝাঁকানি দিয়ে, একটা ঝোলা হাত থেকে টেনে নেয় সে। পা বাড়িয়ে দেয়, লাইন পেরনো পোলের সিঁড়ির ধাপে। তার পাশেতেই, সীমানা পাঁচিলের ধারে, সাইকেল রিকশাওয়ালাদের ডাকাডাকি। আমাদের দরকার নেই, আমরা যাব ওপারে।
বোঝা খালাসে যে স্বস্তি পাইনি, এমন কথা বললে জিভ খসে যাবে। আর একথাও ঠিক, কলকাতার গাড়িও ইস্টিশনের ভিন দাওয়াতে দাঁড়িয়ে। সেই কারণেই লোকে লোকারণ্য দেখেছিলাম। ইতিমধ্যে অতুলদাসের স্বর বদলেছে, হাসির রকমখানিও ভিন জাতের। পোলের ওপর যাওয়া-আসার ভিড়। তার মধ্যেই সে বলে, ‘দেখুন স্সার, মানুষের ধর্ম হল মানুষকে দেখা, না কী বলেন।’
‘তা তো বটেই।’
‘আপনার বাক্সোটা আমি একটু হাতে করে বয়ে দিলে, হাতে তো আমার আর ফোস্কা পড়ে যাবে না।’
সেইজন্যেই মানুষের ধর্মের কথা। তবে আর আপনি এত লজ্জায় পড়েন কেন স্সার। তা না হয় পড়ব না, তবে পোলের এই এত ভিড়ে, যেখানে গোঁত্তা দিয়ে, কাত হয়ে ঠেলে চলতে হচ্ছে, সেখানে মানুষের ধর্মের বচন ঠাওরানো একটু কষ্টসাধ্য, এই আর কি। তা হোক, তবু শুনুন, ‘সময়ে আপনারটা আমি নেব, আমারটা আপনি, না কী বলেন।’
বটেই তো। কিন্তু সেই তো ব্যাজ, অতুলদাসের মতন অমন উদার নজর পেলাম কোথায়। হাত বাড়িয়ে যে পরের বোঝা নেব, হাতে মনে তেমন তাগদ পাইনি। তাই লম্বা কোট পরা ঝালঝোপ্পায় ঠেলে চলা সিরাজের চলার চালখানি দেখলাম। তোমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসির বাঁক লাগতে পারে। কিন্তু দেখেছ, যেন ঘাড় সোজা, মাথা তোলা, দরবারের পায়চারির চাল।
হয়তো আরও কিছু বলত, তার আগেই এক হাঁক শোনা গেল, এই যে ওত্লে, এ গাড়িতে এলি?’
ওপারে সিঁড়ির রেলিঙের বাইরে, একরাশ মানুষ। হাত বাড়িয়ে ডাক দিচ্ছিল, ‘রিকশা চাই নাকি বাবু। এই যে বাবু, আমি বলেছি, আমি।’
সেই ভিড়ের মাঝখান থেকে ওত্লে ডাকের হাঁক বেজেছে। তারপরেই দেখ, অতুলদাসের মুখে হাসি। যার সঙ্গে হাসাহাসি, তাকেও দেখ। বীরভূমের মফস্বল শহরে খেটে খাওয়া যোবার মতন চেহারাখানি! গায়ে একখানি জামা, বুকের বোতাম খোলা। শীত লাগে না বুঝি! পরনের ময়লা কাপড়খানি হাঁটুর ওপরে তোলা। হাসির বেবাকটুকুই বন্ধু দরশনে খুশি। অতুলদাসের তা না। হাসির ধাচধোচ ঘোচঘাচ একটু ভিন জাতের। সেই দরবারি দরবারি। সেই ভাবেই, একটু ঘাড় নেড়ে জানান দেওয়া, হাঁ, ওত্লেই বটে, এ গাড়িতেই এল।’ আওয়াজ দেয় অন্য কথায়, ‘তোর গাড়ি আছে নাকি রে নিতাই।’
নিতাই জবাব দেয়, ‘আছে।’
তার আগেই, ভিড় করা তিন চাকার গাড়ি চালকদের মধ্যে একজন পুছ করে, ‘ক্যানে, তুই যাবি নাকি?’
পুছ করার সঙ্গে সঙ্গেই দু-চার গলায় হাসির রোল বাজে। ব্যাপারটা যেন একটু কেমন কেমন। অতুলদাসের দিকে একবার আড় নজরে চাই। না, এত সহজ লয় হে, হাজার হাজার লোকের সামনে আসরে পালা করি। অমন দু’চার চিপটেনিতে আমাকে ঘায়েল করা যায় না। জবাব দেয়, ‘না, এই ইনি যাবেন।’
ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখিয়ে, রেলিঙের ওপর দিয়েই আমার চামড়ার বাক্সো এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা নে রে নিতাই, বাবুকে নিয়ে যাবি।’
ভিড়ের ভিতর থেকে নিতাইয়ের হাত এগিয়ে আসে। আমার ঝোলা চলে যায় তার হাতে। তারপরে অতুলদাস আমার কাঁধের ঝোলাটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘দিন স্সার, ওকে দিয়ে দিই।’
তা দেব কিন্তু অই দেখ হে, নগর-কুটিল মন আমার। ভাবি, ঝোলাঝুলি বে-হাত করে কার হাতে দিই, কিছু তো জানি না। মূলে হাভাত হব না তো। জিজ্ঞেস করি, ‘ওর গাড়ি কোথায়?’
অতুলদাস অনায়াসে হাসে। বলে, ‘আছে, বাইরে ভিড়ের মধ্যে আছে, দিয়ে দিন-না।’
আমি নামাবার আগেই সে কাঁধ থেকে ঝোলাটা নিয়ে বাড়িয়ে দেয় নিতাইয়ের দিকে। তখন আবার একজনের গলা শোনা যায়, ‘লেতাইয়ের কপাল ভাল, ওত্লে প্যাসেনজার ধরিয়ে দিল। আমাদিগের এক-আধটো হবে না হে!’
আবার একটু হাসির রোল বাজে। তা বলে তুমি হেসো না হে। মনে মনে বলো, ‘লোকগুলো বড় ব্যাদরা তো।’ তবে কিনা, তেমন বিষ গরলের ঝাঁজ নেই যেন। মজাখোরদের মজা। তার মধ্যে যেটুকু তেতোর আভাস, সেটুকু রসের তিক্ততা। অতুলদাস হেসে বলে, ‘কত লিবি, লে না ক্যানে, প্যাসেনজার তো মেলাই। আমার দিতে লাগবে না।’
হ্যাঁ, এত সহজে মচকাতে পারবে না। তবে যতক্ষণে বলা, ঘটনা ততক্ষণ না। ঠেলা বাঁচিয়ে কোনওরকমে ঝোলা চালান দিতে যতক্ষণ। তারপরেই ধাক্কায় ধাক্কায় একেবারে সিঁড়ির নীচে। তখন এদিকে চাপ, ওদিকে চাপ। যাবে কোথায় যাদু, দাঁড়াও। এর নাম ছাতিমতলার মেলা।
কিন্তু ই কী রকম মেলার যাত্রী হে! এতখানে এত মেলা দেখে এলে, এমনটা তো কোথাও দেখনি। এমন নগর ছানিয়া, নাগরিয়া চালের যাত্রী, আর কোথায় দেখা যায়! অই যে সেই কী বলে, সড়কের নাম চৌরঙ্গী,কলকেতার বুকের হারের লকেট, যাত্রীবৃন্দ অনেক যেন সেই লকেটের খুলে পড়া ঝিকিমিকি পাথর গ! ইঙ্গবঙ্গ মিল মেশানো, মাথাতে টুপি, মুখেতে চুরুট, কোট-পাতলুনের ছড়াছড়ি। গলায় গলায়, সেই কী ভাষায় বলে ‘কণ্ঠলেঙ্গুটি’, তার নানা প্রকার বাহার। তার সঙ্গে মেলাই দিশি ধুতি-চাদর চোগা-চাপকানও আছে। কিন্তু দেখ, সেথাও বেজায় নগর ঝলকানো ঝলক। মুখেতে ধূমপানের নল, হাসির জাত আলাদা, ভাষাতে দেশি-বিদেশি চিবিয়ে ছাড়া বাত।
ছাতিমতলার মেলার এত ঝলক, এই দূরের রাঢ়ে, রাজধানী ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে। না, এমন মেলার যাত্রী আর কোথাও দেখিনি।
কেবল কি যাত্রী নাকি, যাত্রিণীরা? দেখ এসে, রং-বাহার কাকে বলে। ধলীর মাথায় মীনারের মতন খোঁপা, কালীর চুল ঘাড় ছাঁটা, ফাঁপিয়ে দোলে বাতাসে। এমন ঝলক দেওয়া কাচস্বচ্ছ শাড়ি, তার ওপরে গরম জামার কী চোখ-ভোলানো শ্রীছন্দ। চোখের কালো ঠুলি যদি খোলা পাও, দেখ কাকে বলে কাজল-আঁকা, নয়ন প্রসাধন। কাকে বলে বিম্বোষ্ঠা, রঙে রাঙিয়ে। তার সঙ্গে চলন-বলন-হাসি, ঝকঝকানো মেয়ে-ঝোলার দোল্দোলানি, ই বাবা গ, চলো সব ছাতিমতলায় যাই। না জানি সে মেলা কেমন!
তবে কি না, এর সঙ্গে সর্বপ্রকার পাবে। দেখ, এদিক ওদিক, দু’ চার দশ ইস্টিশন টপকে আসা স্থানীয় মানুষ, নরনারী, তাদের দেখলে চেনা যায়। ঘর গৃহস্থির ছাপ, জামা-কাপড়ে, চোখেমুখে, কথায়-বার্তায়। আগামীকাল সাতুই পৌষ, এদের আগাম আগমন। এরাও মেলার যাত্রী, কিন্তু মেলার আগেই মেলা দর্শন করে দূরনগরের নাগরিক নাগরিকাদের দেখে। যেন অবাক কৌতুহলে অচিন দেখা দেখছে।
এদের মধ্যেই দেখলে চিনবে মেলার দোকানদারদের। কুলিদের মাথায় মাল চাপিয়ে চলেছে কেউ। কেউ আপন হাতে মাথায় পসরা নিয়েছে। হয়তো কেউ আসে বর্ধমান থেকে এক গাড়িতে, কেউ শিউড়ি থেকে আর এক গাড়িতে। তাদের বড় ব্যস্তত্রস্ত ভাব। সময় নেই, সময় নেই। পসরা নিয়ে বসবার একটা জায়গা চাই তো। তার একটা বিলিব্যবস্থা আছে তো। এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো দুই-চারি রাঙামাটি-রং আলখাল্লা পরা না পাবে, এমন না। কারুর আছে বাঁয়া একতারা, কারুর দোতারা গলে। কারুর মাথায় রাঙা পাগড়ি, কারুর কেশে বাঁধা চুড়া। এরা বৈষ্ণব না বাউল, কে জানে। গাজির কথা মনে পড়ে যায়। আরও পড়ে, কেন কি না, এক দুই পিকিতিও চোখে পড়ে যে। অর্থাৎ প্রকৃতি। গেরুয়া ছোপানো কাপড় তাদেরও অঙ্গে। ভিড়ের মধ্যে আরও আছে, সাঁওতালি আদিবাসী নরনারী। দেখে মনে হয়, সকলেই মেলায় যায়।
ইস্টিশনের দাওয়ার খাঁচা থেকে যখন কোনওরকমে বেরিয়ে এলাম, দেখি অতুলদাস আমার হাত ধরে আছে। ভিড় ঠেলে টেনে নিয়ে যায়। তিন চাকার যান বিস্তর। আমি চাই নিতাইকে। যার কাছে আমার সব। তবে ভয় নেই, তোমার নজরে পড়বার আগেই, ডাক শোনা যায়, এই যে, ওত্লে ইদিকে।’
অতুলদাস আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কার বাড়িতে কোথায় যাবেন বলুন তো।’
বন্ধুর নাম করি। নিতাই বলে ওঠে, ‘আর বলতে হবে না, আপনি ওঠেন, সে-বাবু আমার জানাশোনা।’
না হওয়াটাই তো আশ্চর্য। আমি উঠে বসি। অতুলদাস বলে, ‘ভাড়া যেন বেশি লিস না নিতাই।’
নিতাই হেসে বলে, ‘সে তোকে বলতে হবে না। মেলার সময় বাবুরা এসেছেন। মেলার মতন দেবেন।’
বলে আমার দিকে চেয়ে হাসে। অতুলও হাসে। বলে, ‘তা হলে স্সার আসবেন কিন্তু। মঙ্গলবার আমাদের যাত্রা।’
‘নিশ্চয়ই আসব।’
নিতাই গাড়ি ঠেলে। অতুল তার ঝালঝোপ্পার হাতাসুদ্ধ হাত তোলে। বিদায় দেয়। আমিও হাসি। কিছু বলি না, কিন্তু সিরাজদৌল্লাকে মনে হয় ভাঙাচোরা মুখ একখানি, চোখের কোল বসা, ধুলা-মাখা আলখাল্লা পরা একজন বাউল, এই সকল হাসি কথার মাঝখানে, ওর চোখে কোথায় যেন একটা পরম খোঁজার আর্তি। যে-আর্তি যেমন গানে ভঙ্গিতে ঢাকা পড়ে থাকে, হঠাৎ চোখে পড়ে না, সেই মতো। জানি না, কিলিনারের সংসার-জীবনের অসহায়তা, না কি শিল্পীর হাহাকার। সব মিলিয়ে, কেমন একটা প্রাণ-উদাসী নিশ্বাস পড়ে। করুণা করব, তেমন সাহস নেই। মমতা বোধে বাধা কী। আর মনে হয়, কত না কিঞ্চিৎ আমি। কারুর জন্যে কিছু করতে পারি না। তা-ই কেবল ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে থাকি। অতুলদাস হারিয়ে যায়, রিকশার মিছিলের আড়ালে।
মিছিল ছাড়া বলব না। সামনে পিছনে অগুনতি রিকশা। তার মধ্যে আছে বোলপুর শহরের অন্যান্য যানবাহন। লরি বাস গরু-মহিষের গাড়ি। দেখে বোঝা যায়, বেচাকেনার বাজার ছোট না। দূরান্তের মানুষের এখানে আনাগোনা এখানে। শহরের মানুষেরা দেখছে দূরের মেলার যাত্রীদের। সব থেকে বেশি, নগর যাত্রী-যাত্ৰিণীদের, যাদের ছাটে কাটে বেশভূষাতে, পৃথিবীর বাজারে প্রকাশ, গতকালের প্রথম নমুনা। অঙ্গরাগে প্রসাধনেও তাই। বলো, দূর রাঢ়ের চোখে, হাঁ করে অবাক হয়ে দেখবার বস্তু কি না!
তুমি দেখ, তা বলে সে কি দেখে! সে যায় ছাতিমতলার অঙ্গনে। কে জানে, সাধকের পীঠভূমিতে সে কেন যায়। কেন চলে সেই মরমিয়ার ঠাঁই। যেখানে গান বেজেছে ধ্যান থেকে। প্রাণের জন্ম হয়েছে কাব্যের তপস্যায়। যেখানে ‘আলো আলো’ ডাক ভারী আঁধার যাতনায়। হয়তো কেবল উৎসবে, তোমার মতন। কেবল মাতনে, কৌতূহলের অবাক বানের ঢেউ খেলাতে।
ঠেক খেতে খেতে, কিছু উত্তরে আসার পর, একটু ফাঁকা। তবু নগর চালের কোঠাবাড়ি, বায়স্কোপের ঘর পাবে। আবার লাল মাটিতে গোড়া রাঙানো ছোটখাটো বেণুবন, অন্যান্য গাছপালা, মাটির কুটির, মাঠ, জলাশয়, দু’ পাশে ছড়ানো ছিটানো। তারপরে ডাইনে, পুবের প্রাঙ্গণে দেখ, মেলার সাজগোছ। অস্থায়ী চালাঘরের চালবেড়া, নানা খানে নানা রঙের শামিয়ানা, বড় বড় ঘেরাটোপে ঘেরা, কী যেন ব্যবস্থা সেথা। খেলা কি শিল্প, কে জানে। তবে মেলায় সেই যে, নানা জাদু, সাপ পশু পাখির খেলা, চোঙা মুখে ডাকাডাকি, যন্ত্রে বাজানো গানের তারস্বর, তাও শোনা যায়। নীল আকাশের গায়ে দেখ নাগরদোলা এখনও কেমন ঠেক খেয়ে আছে। তবু যেন কলরবের মাঝে, বাজে তালপাতার বাঁশি। রিকশা বেঁকে যায় বাঁয়ে, এক লৌহ-দরজার খোলা পাল্লার ভিতর দিয়ে।
যেন রং বদলে যায়, ভাব বদলে যায়। মনের মধ্যে সুর বদলে যায়, দৃষ্টিতে এক চমক খাওয়া চমকে, সহসা নতুন কাজলমাখা নিবিড়তায় স্বপ্নবৎ লাগে। রাঙা পথের দু’ ধারে, গাছের নিবিড় ছায়া। রোদ এসেছে তার ফাঁকে ফাঁকে পশ্চিমের ঢলে যাওয়া বেলা থেকে। যতই কেন না-চিনি তবু আম জাম শাল জারুল চিনি। তারা সকলে মেশামিশি করে, কোথাও যে এমন রমণীয় হয়ে ওঠে, দেখিনি। অরণ্য দেখেছি। তার রূপ আলাদা। কিন্তু ছাতিমতলার সীমানায়, বাঁ দিকে মোড় খেয়ে, যেন এলাম এক স্বপ্নরাজ্যে। আপনভোলা এক গভীর গহনে। চোখ ফিরিয়ে যেখানে আমলকীর চিরল চিরল পাতা চিনতে ভুল হয় না। যেখানে মেলার কোলাহল দূরে, স্তিমিত; মানুষের ভিড় আরও দূরতর, এই শীতের অবেলায়, শুনিয়ে দিল হঠাৎ ময়ূরের কেকা। রূপকথার দেশ নাকি! পাখি ডাকে চিকচিক পিক্ পিক্। এই মৃদুতর শীতের বাতাসে কোন পাখি শিস দেয়। আর এতক্ষণের সকল ধুলা-ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়িয়ে, নিশ্বাসে নিশ্বাসে যেন কী এক বিচিত্র গভীর গন্ধ। প্রকৃতির গন্ধ, শিরায় শিরায় প্রবাহে দেয় নিবিড় স্নিগ্ধ মদিরতা।
পথ কোথা দিয়ে বেঁকে যায়। ছায়া নিবিড়তা ঘনিয়ে আসে আরও বন যেন নিবিড়তর, প্রকৃতির গন্ধ হয়ে আসে ঘন। কামিনী বকুল যত অ-ফুল গাছ, শীতে যত অমুকুলিত বন, যেন শীত শীৎকারে ডেকে ডেকে বলে, ‘মাঘের বুকে সকৌতুকে কে আজি এল, তাহা বুঝিতে পারো তুমি? শোননি কানে, হঠাৎ গানে কহিল, ‘আহা আহা’ সকল বনভূমি।’
আর আমার বুকে বেজে যায়:
দুলিয়ে দিল সুখের রাশি,
লুকিয়ে ছিল যতেক হাসি,
দুলিয়ে দিল জনম-ভরা ব্যথা অতলা।
কেন বলি, তা জানি না। কেন ফিরি পথে পথে, কীসের সন্ধানে, সেই অচিনের নাম জানি না। ওহে, আমি তেমনি, জানি না, সাধকের ধ্যানস্থানে, মরমিয়ার লীলাভূমে, কেন আমার সুখ দুলে ওঠে। লুকানো হাসি হাসতে, জনমভরা ব্যথা বেজে যায় কেন।
মনে হল, ছাতিমতলায় দীক্ষা দিনের যে মেলা দেখতে এসেছি, তার প্রথম মেলা এই দেখা। এই গাছপালা বন আকাশ, রাঙা মাটি, ছায়া নিবিড়, পাখির ডাক, এই প্রকৃতি মেলা। কেন হে, এই ভাবি মনে, ঋষি কেন এই ঠাঁই বেছে নিয়েছিলেন। এই ঠাঁইয়ে কেন পেতেছিলেন আসন, নমস্কারে নত, আর উচ্চারণ, ‘আনন্দং, অনন্তং, শুভং’⋯ এই প্রকৃতির মধ্যে কি দেখা মিলেছিল নিরবয়ব-এর, নির্বিকার-এর, একমাত্ৰ-এর! কোন পাতার শ্যাম চিকনে ছিলেন ঋষির ‘সর্বব্যাপী’। কোন ফুলেতে ছিলেন সেই ‘নিত্য’। এই আকাশেই দেখেছিলেন নাকি ‘অনন্ত-স্বরূপ’। যখন সকল তর্ক শেষ, যখন যুক্তি যুক্তিহীন, সকল ব্যাখ্যা অসীমে হারানো, তখন কি তা-ই এই ঠাঁই সেই ধ্যানে বসা ‘জিন প্রেমরস চাখা নহী, অমৃতরস পিয়া তো ক্যায়া হুয়া?’ তখনই কি এখানে এসে সেই প্রেম বন্দনা, ‘যে প্রেমরস চাখেনি, সে অমৃতরস খেলেই বা কী।’ প্রেম দাও, ‘ঋষির’ যবে এই ডাকাডাকি, প্রেম দাও, তখন কি তা-ই ‘মহর্ষি’!
যেন মনে হয়, সেই প্রেম থেকে শুরু মরমিয়ার। মরমিয়ার সৃষ্টি যত, সব প্রেমে বেজেছে।
‘এই যে বাড়ি, বাবু।’
সামনে বাগান, শীতের নানান ফুল। খানে খানে ঘাস, খানে রাঙা মাটি। মাধবী বিতান আর টগরের ঝাড়, জুঁইয়ের লতানো কেয়ারি, পাশে হাসনুহানা। জামের ছায়ায় নিবিড়, শালের ছায়ায় ঢাকা। ডাক দেবার আগেই বন্ধুর সাড়া। তিনি একজন শান্তিনিকেতনের কর্মী। তবে যে একাল-ষেঁড়েবিত্তি নিয়ে ভাববে, এমন নিবিড় নিকেতনে, মনোহর ঠাঁইটিতে ঝোলাঝুলি নিয়ে একলা ঠাঁই নেবে, সে গুড়ে বালি। কেন হে, তুমি কি একলা বন্ধু। দেখ, দরজা খুলে দিয়েছে। বাসাখানি যাত্রীতে ভরপুর। নরনারী, ভরাভরি, হাসি গানে সবাই আকুল। আমাকে দেখে সবাই যেন অনেকদিনের চেনা, এমনি করে ডাক দিল, ‘আসুন আসুন।’
তার ভিতর থেকে বন্ধুপত্নী মিষ্ট ভাবে ডাক দেন, ‘ভিতরে আসুন।’
তা যাব, মুহূর্তে মনে হল, মেলা লেগেছে, হেথা সবখানে বনে বনে, বনের নিকেতনেও।
.
৩৮.
বন্ধু-নিকেতনের জম-জমাটি আসরে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা মনে ছিল না। বিশ্রাম তো পরের কথা। আমার মতন কেবল যে বাইরের লোকেরা এসেছেন, তা নয়। এবার যাঁরা স্নাতকোত্তর, সেই ছেলেমেয়েদের ভিড়ও কম না। আশ্রমের দীক্ষান্তে শিক্ষান্তে এবার যাঁরা বিদায় নেবেন, যাবেন জীবনের পথে, সেইসব নবীন-নবীনারা এসেছেন কেউ কেউ। যাঁরা বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর ঘনিষ্ঠ সীমায় নিবিড় হয়ে ছিলেন এতকাল। বন্ধুর কর্ম এখানে এক দপ্তরে, তদীয় পত্নীর এক শিল্প-শিক্ষাভবনে। বিদায়ীদের এতকালের নিবিড়তা, সেই কারণে না। হেথা কারণের নাম প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-ভালবাসা। তাই বিদায়ের সময় যত ঘনিয়ে আসে, মোচড় দিচ্ছে তত। কোথায় দিচ্ছে, তাই ভাবো মনে।
এখন এই পড়ন্ত বেলায়, পৌষ মাসের ছ’ তারিখে বিদায় নিতে আসেনি কেউ। এ হলো বিদায়ের পূর্ব পর্ব সকল। গানে গল্পে কেবল স্মৃতিচারণ। অনেক দিনের অনেক কথা। অচিন মানুষ, কান পেতে শুনি তার মধ্যে অনেক সুখদুঃখের বারতা। কবে কোন চড়ুইভাতির আসরে কত হাস্যকর ঘটনা ঘটেছিল, কবে খোয়াই ধরে এগিয়ে কোপাইয়ের কলকল ধারার বেলাশেষের ভ্রমণে কতটুকু সুখ দুলেছিল, ব্যথা বেজেছিল, সেইসব স্মৃতিচারণ। কবে কঙ্কালীতলার পথে কী মজা লেগেছিল, কবে অজয় দর্শনে গিয়ে কী বিপদ ঘটেছিল, সেইসব স্মৃতিচারণ। বন্ধুগৃহের মেলায়, এক ধারে বিদায়ীদের এমনি স্মৃতিচারণের মেলা। বলো, স্মরণোৎসব।
আর এক দিকে, আমার মতন বহিরাগতের আগমন। তারা কেউ বাজে হাস্যে, কেউ হাঁকে। বন্ধু ও বন্ধুপত্নী অভ্যর্থনা করেন, আসুন, আসুন। সব কিছু আছে। তবে, ওহে ছাতিমতলার যাত্রী, এক দিকেতে শিকড় নামিয়ো না, খানে খানে ছড়াও। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো। নইলে, ফাঁকি পড়ে যাবে অনেক কিছু। মেলার এক দিকে দেখে কি চোখ ভরে, না মন ভরে! তবু সেই কোন দূর উত্তর-পশ্চিমের দেশ পাঞ্জাবের বিদায়ী মেয়েটিকে তার বন্ধুরা সবাই যখন গান গাইবার জন্যে ধরে, তখন অবাক মানি তার মুখে মরমিয়ার বাংলা গানের সুরে, ‘তবু মনে রেখ…।’
গৌরী মেয়ে, টিকলো নাক, বড় বড় ফাঁদের নীল নীল ভাবের চোখ, একটু যেন রাঙা রাঙা ছোপের খোলা চুল দেখলে মনেতে আন্দাজ পাবে, সে মেয়ে বাংলার না। অথচ গান শুনে, সুরে স্বরে উচ্চারণে আন্দাজ পাবে না, সে মেয়ে কোন সীমার। তখন তোমার মন আওয়াজ দেবে, রূপে যাই হোক, অরূপে তার খেল। সেখান থেকে দেখলে মনে করবে, সে মেয়ের বুঝি জন্ম কর্ম সকলই বাংলায়। তাই সে সীমার ধরায় নেই, সে অসীমা।
কিন্তু, তাই কি সব কথা গান দিয়ে শেষ করতে পারে! দেখ, হঠাৎ গান থেমে যায় গলার কাছে, সুর বেধে যায় বুকের কাছে। সহসা, সবার মাঝে চোখ হয়ে যায় দরিয়া। কান্নার বেগে গান হরণ। বাকি বিদায়ীদের মধ্যেও যেন হঠাৎ তারই ছোঁয়া লাগার আশঙ্কা। সবাই চুপ, স্তব্ধ।
আহ্, অমন করলে কী হয়! বন্ধু অমনি হেঁকে ডেকে ওঠেন, ‘আহা, কী ছেলেমানুষ দেখ, গানটাকে মাটি করলে। এমন সুন্দর ধরেছিলে। কেউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার যখন খুশি, তখনই তো আমাদের দেখা হতে পারবে।’
বলে গলা খুলে হাসি।
তাই বুঝি! অই মশায়, দাঁড়ান গ, আওয়াজেই মালুম পাওয়া যাচ্ছে, হাসিটা তেমন যেন প্রাণের ঝরায় ঝরছে না। টুকুস কাষ্ঠ-কাষ্ঠ লাগছে। শুধু তাই না, হাসতে গিয়ে পত্নীর দিকে তাকানোর লক্ষণটিও তেমন ঝরঝরানো না। একটু বিষাদ-ছায়া-ছায়া।
পত্নী যেতে চাইলেন তার ওপর দিয়ে। মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে হেসে প্রায় ধমকের সুরে বলেন, ‘কী পাগল মেয়ে রে বাবা। ওরকম করলে কিন্তু আমি খুব রাগ করব। চোখ মোছো, গানটা আবার ধরো, আমি আসছি।’
বলতে বলতে সরে গিয়ে পর্দা তুলে পাশের ঘরে যান। হ্যাঁ, একটু জলদে যান, নইলে আপনার চোখের জল ধরা পড়ে যাবে। আপনার চোখের ধোয়া কাজল সকলের চোখে পড়ে যাবে। তখন আপনার পাগলামি কে দেখবে। আপনার ওপর কে রাগ করবে।
কিন্তু তেমন হাওয়া বেশিক্ষণ থাকে না। থাকলে চলে না। তাই হাওয়া ঘোরাবার দল নতুন সুরে নতুন গান জুড়ে দেয় গুনগুনিয়ে। গৃহকর্তা অতিথির পরিচর্যায় ব্যস্ত হন। হোক পড়ন্ত বেলা। এসব নিয়ে এখনই বসে পড়লে হবে না। স্নানাহার, তৎসঙ্গে কিঞ্চিৎ ক্লান্তি মোচন চাই। অতএব বন্ধুর নির্দেশে আমাকে যেতে হয় গৃহের অন্য সীমানায়। স্নানাহার ক্লান্তি মোচনের সীমানায়।
সেখান থেকে শুনতে পাই, অন্য ঘরে হাসি বেজে উঠছে। তবু, গলায় ঠেক খাওয়া, গান থেমে যাওয়া ছোট ঘটনাটি ভুলতে পারি না। হয়তো এই আশ্রমে ওরা এসেছিল কাঁদতে কাঁদতে, আজ যাবেও তাই। আসার সময় হয়তো মনে হয়েছিল, চলেছে নির্বাসনে, অচেনা অপরিচয়ে, ভয়ে সংশয়ে। হয়তো ছেড়ে কিছু যায় না, নিয়েই যায় কিছু। তবু আজ ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে ভেসে ওঠে অনেক কিছু। অনেক মুখ, অনেক আলো-কালো দিন, প্রকৃতির বিচিত্র লীলা। ছাতিমতলার যে প্রকৃতিকে এই মাত্র দেখে এলাম, এক মুহূর্তে। এখানে কেবলই কি অধ্যয়ন, কেবলই শিক্ষা কী! আর কি কিছু না। আর একটি জন্মের কাহিনী, ইতিহাস কি নেই! আর একটি মনের, আর একটি প্রাণের জন্মের, যার সঙ্গে জড়ানো রয়েছে নানা ঘর, নানা লোক, বন-বনান্তরের স্মৃতি!
হয়তো আজ শান্তিনিকেতনের ঘরে ঘরে এই পূর্ব পর্বের পালা চলেছে। এক দেখেই বহুকে চেনা যায়। তবেই বলো, মেলা কেবল ঝলকে না, অলখেও বটে, যাকে বলে অলক্ষ্যে। ছাতিমতলার মেলায়, এও এক মেলা।
কিন্তু স্নানাহার যদি বা সারা গেল, ক্লান্তি মোচনে অরুচি। যা নেই, তা মোচনের কী কথা। বন্ধু জিজ্ঞেস করেন, ‘তবে, ঘরে, না বাইরে?’
বলি, ‘হাতছানিটা তো বাইরেই দেখছি।’
‘আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। বেলা এখনও একটু আছে, চলুন এ বেলাতেই বেরিয়ে পড়া যাক। আপনার সাধ ছিল এখানকার গুণিজন দর্শনের। মেলার কাজে অনেকেই ব্যস্ত, তবু দেখা যাক, কতজনের দেখা মেলে।’
এমন উৎসাহী বন্ধু পেলে উৎসাহ বাড়ে। অতএব, তৎক্ষণাৎ বাইরে। পথে পা দিয়ে আবার চোখের রং বদলে যায়, মন ভুলে যায়। শীতের বিকাল সোনালি বলে জানি। শান্তিনিকেতনের সেই সোনালিতে আরও যেন কী মিশেছে। ব্যাখ্যা করতে পারব না। ছায়াতে রহস্য থাকে। আলোতেও এমন রহস্য আর দেখিনি। মাটিতে আকাশের প্রতিবিম্ব, নাকি আকাশে, মাটির, ধরতে পারি না। সকলেই যেন সোনায় সোনায় মাখানো। শালের পাতায় যত লালের আভা, সে জানবে, শীতে। নতুনের পথ ছেড়ে দিতে, এখন তার ধুলায় যাবার দিন। তাই দেখি, লাল হয়ে আসা শালের পাতায় পাতায়, একেবারে নিষ্পত্র গোলকচাঁপার ডালপালায়, সবখানে সোনা মাখামাখি। শুকিয়ে আসা আমের পাতায়, জাম আমলকী স্বর্ণচাঁপার পাতায় পাতায় সোনালি ঝিলিক। একেবারে সোনালি বলব না, এ সোনায় রাঙা রাঙা ছায়া। এ যেন যাবার বেলা রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়া। যে যাওয়াতে লাজে লাজানো সুখের বালাই। কেবল যেন নিশ্চুপ অপলক চোখে ব্যথায় চেয়ে থাকা। সহসা বেজে ওঠে ব্যথায় যেমন, নির্বাক মুখে লাগে ব্যথার রক্তাভা। সব মিলিয়ে এ শুধু শীতের এক লালে সোনায় মাখামাখি না। এর নাম ছাতিমতলার বিকাল। আর একটু বলি, শান্তিনিকেতনের বিকাল।
বন্ধু এদিকে দেখান চীনাভবন, ওদিকে হিন্দি। বলেন—নানা ভবনের কাছাকাছি আছে পিয়ারসন পল্লি, এন্ড্রুজ পল্লি।
মরমিয়ার প্রাণে যবে ‘বলাকা’র পাখা মেলেছিল, ‘ফাল্গুনী’র ছন্দে বেজেছিল দোলা, তখন আর এক স্বপ্ন কর্মযজ্ঞের সাধনায় রূপ নিতে চেয়েছিল, তার নাম বিশ্বভারতী। রূপ নিতে চায়নি কেবল, সৃষ্টিঘরের ঘন্টায় তখন যুগের এক নতুন তাল বেজে উঠেছিল। রূপ পেতে চলেছিল। আর অরূপ ঝরার দুই প্রবাহে মরমিয়া যেন ভেসে চলেছিলেন, যে প্রবাহের এক নাম মানুষ, আর এক নাম ঈশ্বর। টান লেগেছিল যেন দুই স্রোতের ধারায়। সেই দুয়েতে কোথায় যে এক বাঁধাবাঁধির খেলা, চাওয়া পাওয়া, ভালবাসাবাসি, প্রেম পিরিতি, ছোঁয়াছুঁয়ির লীলা, পারাপারের সেই সাঁকোটাই নানা রূপে দেখেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন বনের সবুজে, আকাশের নীলে, রৌদ্রে মেঘে, ফুলে ফুলে, ফলে আর শস্যের মাঠে, পাখপাখালির ডাকাডাকিতে, পতঙ্গের রহস্যগুঞ্জনে। সেই সাঁকোর নাম প্রকৃতি। তাঁর ঈশ্বর মানুষ। দুই ধারাতে পারাপার প্রকৃতির সাঁকো ধরে।
দুই প্রবাহের টানে তাঁর চলনও সেই সাঁকোতে। মরমিয়ার সাধ, তিনি যাবেন মহাসাগরে। যেখানে সকলের মিলে মিলনলীলা। এইখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, রয়েছি সেই মহাসাগরের এক উপকূলে। শান্তিনিকেতনে সেই বিশ্বভারতের মিলমিশের মেলা। এখানে সকল ভুবন ভবনের নামে নামে, কানে কানে। গাঁয়ের নামের স্মৃতিতে।
রাস্তা চলে গিয়েছে পুবে পশ্চিমে। লাল সড়কে বাঁক লেগেছে পশ্চিমে, সোজাসুজি সবুজ মাঠ শেষ রোদের সোনায় মোড়া। পুবেতে লোহার ফটক, যে পথ দিয়ে এসেছিলাম। তার ওপারে মেলা। এখানে ওখানে, সব পথে লোকচলাচলের বাড়াবাড়ি মেলা জমতে শুরু করেছে।
রাস্তা পেরিয়ে বন্ধু নিয়ে চললেন নানা কাননের মাঝে। দু’ পাশে আমলকীর সারি। দেখি, লাল পথের ওপর ফল পড়ে আছে। নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে তুলে নেব না, তেমন নির্লোভ হতে শিখিনি। সামনে এক নানা রঙের ঝিলিকি ঝলক-হানা গৃহ। ফটক পেরিয়ে চোখে পড়ে টালির ছাদ। নানা রঙের কাচের চৌকোয় সাজানো দেওয়াল। নানা ছাঁদে লোহার ফ্রেমের নানা কারুমিতি। তার গায়ে লাগানো, আর এক দিকে, দূর থেকে যেন দেখি রথের মতো চূড়া নিয়ে উঠেছে এক অংশ। বন্ধু বলেন, উপাসনার মন্দির।
তারপরে যাই ছাতিমতলায়, যেখানে পাথরের বেদি পাতা রয়েছে। ধ্যানী যেখানে আসন পেতেছিলেন, যে আসনের গায়ে লেখা আছে মন্ত্রের বাণী। দুই বৃদ্ধ ছাতিম, তাদের ঘিরে পাকা আসন পাতা। এইখান থেকে শান্তিনিকেতনের শুরু। এইখানে বসে, ‘আগে চাখি প্রেম, পরে অমৃত’ এই সাধনার শুরু। যার অলখ দুয়ার থেকে সেই মহাসাগরের প্রেম-দুয়ারে যাত্রা।
দেখি, ছাতিমের পাতায় পাতায় লাল-সোনার প্রলেপ। তার ছায়ার কোলে কোথায় কারা কী যেন কথা বলে। কথা বুঝি না, ডাক শুনি, পিক্ পিক্, কিচির কিচির। এমন না যে, সবাই মিলে সমবেত গায়। যেন একা একা, আচমকা, ক্ষণে ক্ষণে কী বলে ওঠে। হেথা হোথা দু-একটি শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। ছাতিমের গোড়ার দিকে চেয়ে, কী বলব হে, হঠাৎ যেন শিরায় শিরায় কীসের এক শিহরন খেলে যায়। থির নিস্তরঙ্গ প্রাণ কেমন ছলছলিয়ে যায় তরঙ্গে। সহসা এক ছবি ভেসে ওঠে চোখে। এই ছাতিমের মতো প্রাচীন গম্ভীর এক মানুষ যেন ধ্যানে বসে আছেন। যাঁর দৃষ্টি বন্ধ না। যেন ছলছল দু’ চোখ ভরা বিস্ময়, মুগ্ধতা, আনন্দে টলটল করে। সে ঋষির সকল কিছুতেই ধ্যানের রূপ দেখা।
সেখান থেকে আমবাগানের পথ ধরে যাই সেই পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে। বলো, তপোবনের সেই প্রথম কুটির। ঋষির নিবাস। লাল উঠোনের মাঝখানে শিল্পীর বিচিত্র ভাস্কর্য। উত্তর দিকে লাল কাঁকর ছড়ানো পথের দু’পাশে গাছ। দেখি, তার মধ্যে আমলকীই শুধু। ফিরতে গিয়ে, আম গাছের এক নিচু ডালে দেখি, তিনি বসে আছেন, একেবারে ভুঁয়েতে পুচ্ছ ঠেকিয়ে। কৃষ্ণের মাথায় যার শোভা, সেই শিখিপুচ্ছ ধুলা হে! কিন্তু কিছু বলতে পারবে না, আপন পুচ্ছ নিয়ে কর্তা যা খুশি তাই করবেন। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ, তেমন একটা ভয়-চকিত চাহনি না। তবে, কে-ক্ বলে ডাকটি না শুনিয়ে ছাড়বে না।
বুঝতে পারি, আশ্রমের সীমানায় ঢুকে প্রথম কোথা থেকে এই ধ্বনি বেজেছিল। ইনিই বাজিয়েছিলেন। কেন, এই শীতে কি বর্ষার তপস্যা! যবে এই রাঙা মাটি ভিজবে, গাছে গাছে ঘাসে ঘাসে ঝিরিঝিরি ঝরবে, আর আকাশ জুড়ে কালো মেঘে সৌদামিনীর হাসি হানবে। ময়ূরের চোখেতেও সেই দিনের ধ্যান নাকি।
তবে বর্ষা না পড়লেও এ পাখি ডাকে। মনে পড়ে যায়, ছোটনাগপুরের সারঙ্গার গভীর অরণ্যে, আগুন জ্বালানো শীতের রাত্রে সারা রাত কেকাধ্বনি শুনেছি। দিনের বেলা দেখছি, নির্ভীক বনময়ূরের চলাফেরা।
ঘুরে ঘুরে বন্ধু দেখান সেই ছোট বাড়িখানি, যেখানে মরমিয়া নিজের বাসা করেছিলেন। এখন কোনওটাই আর বাসগৃহ না, কাজের ঘর। দেখতে দেখতে নানা কথা শুনি। বন্ধু পুরনো দিনের কথা বলেন। তাঁর নিজেরও শোনা কথা সেসব। হয়তো কেতাবেও পড়েছেন। বলেন, কতটুকু জায়গা নিয়ে প্রথম কবে ধ্যানী এসেছিলেন। ছাতিম গাছ দুটিকে ঘিরেই প্রথম পত্তন। ওই যে দক্ষিণে, যেখানে নিচু বাংলা, আরও পরে জলাশয়, তার ওপারে ভুবনডাঙা গ্রাম। সেই গ্রামে থাকত তখন শুধু ডাকাতদল। অমন সুন্দর নাম, কিন্তু গ্রামের অধিবাসীরা সব ডাকাত। সেই কথাটিই বোঝো তা হলে, নামে কামে অমিল বড়। যেমন-তেমন ডাকাত না। তাদের যে সর্দার ছিল, তার হাতে নাকি লাঠি তলোয়ার সমান চালে খেলত। রণ-পা চড়ে এক রাত্রের মধ্যে সে-ই বর্ধমান গিয়ে ডাকাতি করে নাকি ভোররাত্রে ঘরে এসে শুয়ে পড়ত।
তবে সে-ই শেষ না। সেই সর্দার ডাকাতি করে ধরা পড়েনি। ধরা পড়েছিল ধ্যানীর কাছে। যে ধরাতে শাস্তির থেকে আনন্দ বেশি। ঋষিবাক্যে কেবল ডাকাতি ছাড়েনি, সারা জীবনটা তারপরে ভুবনডাঙার ডাকাত সর্দার এই নিকেতনের নানান কাজে থেকেছে। শুধু সর্দার না, ভুবনডাঙার সব ডাকাত ডাকাতি ছেড়ে মাঠে নেমেছিলেন হাল বলদ নিয়ে। ডাকাত তখন কৃষক।
বন্ধু দেখিয়েছিলেন উত্তরায়ণ গৃহ। তার উত্তরে শ্যামলী। উত্তরায়ণের পিছনের বাগানে গাছের ডালে নানান কলাকৌশলের কারুমিতি। যে গাছের কথা ছিল আকাশ উচ্চে হাত বাড়ানোর, সে তার দেহ নিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সমান্তরাল। নানা জাতের, নানা গাছে, ডালপালাতে জড়াজড়ি। আম-পেয়ারায় মেশামেশি, তার চেহারা আলাদা, পাতাও যেন অন্যরকম। সে ফলের নাম কি, কে জানে। আমপেয়ারা নাকি! সেখানে ছোট জলাশয়, তাকে ঘিরে বিচিত্র বীথি ও কুঞ্জ। তার পাশে নতুন ভবন, বিচিত্রা। বন্ধুর কথা শুনে বুঝতে পারি, কেবল বিচিত্রা না, রবীন্দ্র বিচিত্রা। মরমিয়ার যত কিছু হাতে ছোঁয়া বস্তু, তাঁর যত কর্ম, যত ঘরে-বাইরে পরিচয়, সব কিছুর মেলা সেথায়। আশা আছে, দেখতে পাব পরে।
বেলা যখন পড়ে যায়, সোনালি চলে যায়, লালের ওপর ছায়ার আঁধার পড়ে লাল গাঢ়তর হয়, তখন খেয়াল পড়ে, আমরা গুণিজন দর্শনে বেরিয়েছিলাম। সেই গুণিজন, যাঁরা মরমিয়ার ঠাঁইয়ে থেকে মরমিয়ার ধ্যানের অংশে নিজেদের প্রকাশ করেন।
তা দর্শন কম মেলেনি। নায়ক, চিত্রকর, ভাস্কর, শিক্ষক, সাহিত্যিক। যত ঘরে গেলাম, সকল ঘরেই অতিথির ভিড়, আমার বন্ধুর বাড়ির মতোই। সব ঘরেতেই মেলা।
সেদিন রাত্রি হয়ে যায় অনেক। মেলা দেখব পরের দিন। রাত পোহাবার পরেই প্রথম যাত্রা ছাতিমতলায়। প্রথমে উপাসনা, প্রার্থনা, তারপরে অন্য কিছু।
.
৩৯.
সাতুই পৌষ। সকালবেলার প্রথম শুরু ছাতিমতলায়। গম্ভীর উচ্চরবে প্রথম উচ্চারিত স্তোত্র। রোদ উঠেছে সবে। এ রোদ কাল বিকালের না। এ রোদে কাঁচা সোনার ছটা। কাঁচা সোনার ছটা লেগেছে, ছাতিমের ছায়া পেরিয়ে দূর্বা ঘাসে, লাল কুচো পাথর ছড়ানো ভুঁয়ে। লেগেছে আশাপাশে, আমবাগানে, শাল-সেগুনের পাতায় পাতায়। ছাতিমের ছায়াতলে বেদি। সেখান থেকে উচ্চারিত হয় স্তোত্র। সুরে গাম্ভীর্যে, রবে যেন কোন দূর দিনের স্মৃতি নিয়ে আসে মনে। দূর কালের ছবি জাগিয়ে দেয় চোখে। তখন মনে হয়, ছাতিমতলা ঘিরে এত চিত্রবিচিত্র মানুষের ভিড় থেকে চোখ সরিয়ে নিই। নত দৃষ্টি কিংবা ঊর্ধ্বে চেয়ে থাকি, যেখান থেকে উঠেছে ডাক, যেখানে ছড়ায়। মনে করি, না যেন বলি, দাও ফিরে সে অরণ্য। তবু কেন ছবি ভাসে তপোবনের। তবু কেন মনে হয় একবারই যাই সেথা, যেথা বনস্পতিচ্ছায়ে ঋষি বন্দনা আবৃত্তি করেন। যেন সবুজ পাতায় পাতায়, রোদে রোদে, আকাশে, মহাশূন্যে সেইসব পৌঁছয়। আর দূরে দূরে কৃষক-রাখালগণে সেই সুরে কান পেতে পশু নিয়ে চলে, যাদের গলায় বাজে দূর ঘণ্টাধ্বনি। পাখি সব করে রব, কাননে কুসুমকলি ফোটে। আর উঠোনের হরিণী সংকেত পায়, এবার খাবার সময়, কান পাতে ঋষিবালা মানবী মায়ের পায়ের শব্দে। দানা দাও এই কথা জানায় অন্যে, কেকারবে পুচ্ছ নড়া দিয়ে।
যখন হাটে-বাটের লেনাদেনায় শ্রমে-ঘামে ফিরি, তখন ভুলে যাই এমন ভারত ছিল। সে ভারতের প্রয়োজন আছে কিনা, সে কথা পুছ করো না। কালের দাগ নিয়ে নিয়ে চলে অধরা পৃথিবী। তবু এক মন থাকে—এক মন, আপনাকে আগের দেখায় দেখতে তার সাধ। পূর্বপুরুষের সেই ভারতলীলায়।
স্তোত্র শেষ হয়। উপাসনার বাণী উচ্চারণ করেন আচার্য। একটু নীচে বড় বেদিতে আসন নিয়েছেন সংগীত ভবনের গুণিজনেরা। সঙ্গে তাঁদের শিষ্য-শিষ্যরা। লাল কুচো পাথর ছড়ানো ভুঁয়ে আসন নিয়েছেন অতিথিরা, আশ্রমিক সংঘের বড় ছোট নর-নারী, বালক-বালিকারা। আর সব আমার মতন, যারা ছড়িয়ে আছে ঘিরে।
তার মধ্যেই দেখ, কত লয়ে কত কথা, কত সুরে হাসি। ওই দেখ গাছতলাতে তামাকের নল চিবিয়ে চিবিয়ে গলায় লেঙ্গুটি বাঁধা যুবা যুবতীর কানে গুনগুন করে। হোথা দেখ সুবেশ-সুবেশাদের কী যেন হাসিখুশির ভিন জটলা। এখানে সকলের ডাক, সবাই আসে। সবাই আপন ভাবেতে আছে, যার যেমন ভাব। তুমি থাকো স্ব-ভাবে!
উপাসনার পরে সমবেত গান। নানা গলায় এক সুরেতে সব নতুন রূপে ফোটে। কাঁচা সোনার রোদ যেন চকিত হয়ে ওঠে। ঠান্ডা বাতাসে পাতায় পাতায় দোলা লেগে যায়।
বন্ধু সংবাদ দেন, আগে এই অনুষ্ঠান হত উপাসনা-মন্দিরে। ক্রমে মানুষের ভিড়ে মন্দিরের অনুষ্ঠান এসেছে গাছতলায়, মাঠের বিস্তৃতিতে। আরও সংবাদ, আগে মেলা যায়নি, রাস্তার ওপরে পূর্ব আর দক্ষিণ পল্লির মাঠে। আগের মেলা ছিল, উত্তরায়ণের পুব গাঁয়ের মাঠে, যার এক দিকে বাঁক খেয়ে চলে গিয়েছে শ্রীনিকেতনের রাস্তা, আর এক দিকে কোপাইয়ের ধারে। সেই মাঠের দক্ষিণে বটের তলায় ছিল বাউল সমাবেশ। এখন সকলই অন্যখানে।
গানের শেষে প্রথম যাই বিচিত্রা-তে। রবীন্দ্র-বিচিত্রা যাকে ভেবেছি। মরমিয়ার নানা লীলা, নানান খেলার চিহ্ন এখানে। প্রিয়জনের দেওয়া নানা স্মৃতি-উপহার, ব্যবহারের নানান জিনিস, বরণ-সংবর্ধনার পদক, পাণ্ডুলিপি, চিত্র, আর দেশ-বিদেশে দিগ্বিজয়ের অনেক ছবি। তবু তার মধ্যে যেখানে তিনি ঘনিষ্ঠ রূপে, সেইসব পারিবারিক ছবি। যার ভিতর দিয়ে এই দর্শকের চোখে আর মনে থেকে যায় গভীর বিস্ময়, পরম কৌতূহল। হয়তো আগেও অনেক দেখেছি, আবার দেখি আর বিস্ময় আর কৌতূহলে এই কারণে বারেবারেই দুলি, যখন ভাবি এই মানুষে সেই মানুষ ছিল। এই রূপেতে সেই অরূপ ছিল, লক্ষ্যেতে আলেখ। দেহরূপের এই খাঁচাতেই সেই অচিন পাখির যাওয়া-আসা ছিল। যে পাখির নাম প্রাণপাখি না, কেবল অচিন পাখি। যে পাখি আলেখেতে ঝলক দেয়, তার নাম সাধকের সাধন, যার প্রসাদ নিয়ে ফিরি আমরা, নানান উপচারে, চারু কারু একাকারে।
আমি তাঁর সাধনে সাধতে চেয়েছি। আমার মতো এই জগতের অনেকে চেয়েছে। যারা চেয়েছে, তারা সবাই আমার মতন এমনি করে চেয়ে থাকবে মরমিয়ার দিকে, যাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনি পরম কৌতুহলে আর বিস্ময়ে।
বিচিত্রা থেকে বেরিয়ে এবার মেলায়। বন্ধু হাতে-বাঁধা সময়ের কাঁটা দেখিয়ে বলেন, ‘বেলা অনেক হয়েছে, এবার ঘরে ফেরা যাক। শীতের বেলা, এমনিতেই ছোট।’
সেইজন্যেই ঘরে যাব না। শীতের এই সোনার বেলা বড় যে ছোট। মেলায় মানুষের উৎসব, শীতের ছোট দিনে রোদের উৎসব। আমি যাব না যাব না যাব না ঘরে। কিন্তু বন্ধুকে আটকাতে চাই না। আমি তাঁর একলা অতিথি না। অভ্যাগত আরও আছেন গৃহে, তদুপরি গৃহিণী আছেন সেথায়। রৌদ্রে আর মানুষের মাখামাখি করে করে ঘুরে বেড়াতে বলতে পারি না তাঁকে। বলি, ‘আপনি ঘরে যান, আমি একটু মেলা ঘুরে আসি।’
বন্ধুর তা ইচ্ছা নয়, বাধা দিতেও সঙ্কোচ। জিজ্ঞেস করেন, ‘পথ চিনে ফিরতে পারবেন তো?’
সামান্য তো পথ, রাস্তার এপার-ওপার মাত্র। একবার দেখলে ভুল হবার কোনও কারণ নেই। হেসে বলি, ‘তা পারব।’
বন্ধুও সেটা আন্দাজ করতে পারেন। তা-ই হেসে বলেন, ‘পথ তেমন দূরের নয়, বাঁকাচোরাও খুব বেশি নয়, তবে নতুন তো।’
কেবল বন্ধুর কথার সুরে না, কাচে ঢাকা চোখের দৃষ্টিতে অস্পষ্ট এক ইঙ্গিতের ঠাট্টা। জবাব দিই, ‘নতুনকে চিনে নিতে চেষ্টা করব।’
ভিন পথে হাঁটা ধরে মনে মনে ভাবি, ঠিক ঠিকানায় চলতে পেরেছি কবে! ভুল ঠিকানায় আনাগোনা চিরদিন, ঘুর-পথে ঘুরে মরছি সেই শুরু থেকে। আসলে, ঠিকানার গোলমাল কোনও গোলমাল না। কীসের সন্ধান, কার খোঁজে ফেরা, যদি জানা থাকত, ঠিকানা মিলত আপনি আপনি।
মেলার পথ চিনিয়ে দিতে হয় না। মেলাই পথ চিনিয়ে নিয়ে যায়। লোক চলার ঢল দেখলে বোঝা যায়, মোহানা কোথায়। লোক-সাগরের ঢেউ কোথায় খেলছে। কিন্তু এ তোমার সেই মেলা না হে। প্রথম দর্শনেই ঠেক খেতে হয়। এ মেলার রকমসকম আলাদা। ছাতিমতলার মেলা বলেই বোধ হয়। দেখ, চারদিকেতে শহুরে সাজগোজের ভিড়। সে-ই যাদের দেখেছিলাম ইস্টিশনে, তাদের মতন নরনারী, নানা সাজে ঘোরাফেরা করছে। তবে মন গুণে ধন। দেখ, এই বিচিত্র দেখেও মনে রং লেগে যায়। সাজেতেই কেবল মানুষ না, কাজেতে তার চিন-পরিচয়। সবাই যে এই দূর রাঢ়ের মেলায় বেশ প্রাণের ভেলায় ভাসছে, হাসছে, তা বোঝা যায়।
কেবল তো তাদের দেখলে হবে না। এমন পসরা সাজিয়ে বসা পসারি পসারিনী বা কোথায় দেখেছ! এই যে দেখ, ডাগর চোখো, ধুতিপাঞ্জাবি-পরা যুবা দোকানদার আপন হাতে বিকোয় বসে আপন হাতে গড়া পুতুল। এই পুতুল গড়ার শিক্ষা তার এই আশ্রমেই, শিল্প ভবনে। ওই যে তন্বী হেসে ভাষে ক্রেতার চোখে চেয়ে, বাটিকের চোখ জুড়ানো কাপড় দেখিয়ে, সেও আশ্রমিক সঙ্ঘের। কেবল যে সব আশ্রমিক সঙ্ঘের পসরা সাজানো চারদিকে, তা না। বাইরের থেকেও, অনেক পসরা নিয়ে এসে বসেছে, এমন অনেক পসারি পসারিনী। নানা জেলা, নানা রাজ্যের, বিচিত্র কারুকলা শিল্প, গ্রামীণ, প্রাচীন, অতীতের ভুলে যাওয়া নানান বস্তু। কার্পাস রেশম বলো, সেলাইয়ের নানা কারুমিতি, পুতুল মুখোশ বলো, মাদুরের সূক্ষ্ম বোনা নানা জিনিস, তারই মধ্যে পিতল কাঁসার বিবিধ কারিগরি, কাঠের বিচিত্র শিল্প, সবই সাজানো থরে থরে।
ক্রেতা-ক্ৰেত্রীদের চোখ দেখলে বুঝবে, সব কিছু হাত ভরে নিয়ে নিতে চায়। কেবল তো এ রাজ্যের মানুষ না, ভারতের নানা রাজ্যের মানুষ। নানা ভাষা ভাষে নানা রূপে। কেবল ভারতের নাকি। নজর করলে দেখবে, সাত সমুদ্রের ওপারের নরনারীও মেলায় এসেছে। গোরা গৌরীরাও মেলার নানা পসরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাত ভরে, ঝোলা ভরে কিনছে নিচ্ছে।
তার মধ্যেই দেখতে পাবে সাঁওতাল শিল্পীটি ভুঁয়েতে চোখ-ধাঁধানো পসরা সাজিয়ে বসে আছে। পসরা সাজিয়ে বসে তো নেই, ফাঁদ পেতে বসে আছে। রুপো না, কিন্তু রুপোলি ধাতুতে গড়ে এনেছে নানা সাঁওতালি গহনা। গলার হার, কানের দুল, হাতের বালা, নাকের বেসর, নাকছাবি, নিতম্বের মেখলা, কটির ঝাপটা, পায়ের নূপুর, মল, বন্ধনী। আরো এনেছে, নানা চুলের বিনুনির অলংকার, খোঁপার কাঁটার ফুল। সেখানে যে কেবল বিচিত্র বর্ণবাহার প্রজাপতির মতন কিশোরীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা নয়। তন্বীরাও ভুঁয়েতে আঁচল লুটিয়ে বসে পড়েছে। কিনেকেটে ঘরে গিয়ে সাজ, সে বড় বালাই। তখন-তখনই নানা অলংকারে সেজে মেলা-প্রাঙ্গণে বিচরণ। একে দেখে ওর আশা মেটে না, ওকে দেখে এর। ওরা অলংকারের নিক্কণে নিক্কণে বাজে, হাওয়ায় ‘সুন্দরী রাধে আওয়েবনি।’…‘আমার গোপন কথা, শুনে যা ও সখী।’…
ওরা যে সবাই আশ্রমিক সংঘের মেয়ে, তা না। বাইরেরও অনেক। যা দেখবে, সবই ওদের জন্যে। আর যে নারী ঘরনি, তার জন্যেও থরে থরে অনেক কিছু সাজানো। তবে কেবল যে রুপোলি ধাতুর গহনা-ঝলক, তাও না। পুঁতির মালা কি কেউ পরবে না। পাথরের রংবাহারি হীরা-পান্নার ঝলক দেওয়া অলংকারগুলো পড়ে থাকবে নাকি। মোটেও তা ভেব না। সবখানেতেই প্রজাপতিগুলোর ছুটোছুটি। যেন গাছে গাছে, কচি পাতায় পাতায় ঝাঁপ দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। তা-ই বলি, কেবল তো সাজিয়ে বসা নয়, ফাঁদ পেতে বসা। যা ধরবার, সে তা ধরে নিয়ে পুঁজি করছে। কিন্তু সবই ভুঁয়েতে না, তার জন্যেও চোখ-ঝলকানো দোকান সাজানো আছে। সেখানেও পসারি-পসারিনী আছে। তোরে কে নিবি কত, নিয়ে যা। কেবল কি সাজবাহারে চলে! পেটের ধান্দা নেই নাকি! তাও পাবে, তবে সেই যে খাজা গজা জিলিপি, পাঁপর আর তেলেভাজা, কচুরি আর পুরি, সে এ তল্লাটে না। এখানে পাবে অন্য জিনিস, সেই যে রুটির মধ্যে নানান খাদ্য, যার নাম স্যান্ডউইচ, যার নাম চপ কাটলেট, ওমলেট, তা পাবে। দেখ, এখানেও রাজধানীর ঝলক, দোকানের গায়ে লেখা আছে, কফি হাউস। ভিতরে যাও, দেখবে নাগরিক নাগরিকা কাকে বলে। যার নাম লাঞ্চ ডিনার, তার ব্যবস্থাও পাবে। কাগজে পড়ে দেখ, তোমার জন্যে লেখা আছে খানার নাম পরিচয়। সব রকমের বন্দোবস্ত আছে।
এমন জায়গায় চেনাশোনা লোক পাবে না, তা হতে পারে না। দেখ, রাজধানীর সাংবাদিক সাহিত্যিকের জটলা, কবিদের গোল টেবিল, শিল্পীদের তর্কের আসর। আরও পাবে, যাঁদের বলে বড় বড় মানুষ, কেতাবিতে আওয়াজ দিয়ে বলো, ভি আই পি, তাঁদের ভারিক্কি বৈঠক।
তবু দেখতে দেখতে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। দেখি, এমনি এক নগর সাজের পান-ভোজনালয়ে নরনারী সবাই ছুটে যায়। ছোটার রকম দেখি, পড়ি কি মরি। কেন, কী আশ্চর্য লীলা সেথায় ঘটে, কার পিছনে ছোটে এমন করে। অই হে, কী বইলব, দেখি একটা বায়স্কোপের ছবির মানুষ, রক্তমাংসে জ্যান্ত চলে বেড়াচ্ছে। উটি এক বায়স্কোপের তারা। দেখি, মেয়েদের চোখে ঝিকিমিকি, ছেলেদের চোখে ঝলক লাগা। কেউ মেলায় হাত, কেউ দেয় কাগজ বাড়িয়ে, নামের সহি চাই। ছাতিমতলার মেলায়, নগরের নাগরিয়া উৎসবের আর কী বাকি!
এখানে সবাই আসে, সকলের লীলা। ছাতিমতলার মেলার ছবির সেইটুকু সৌন্দর্য। আর, মানুষ একেতে না, বহুতে। বহুর এই বিচিত্রে মানুষ দেখার নেশা লেগে যায় চোখে। সেই নেশাতে দেখি, আর নেশার দোলা লেগে যায়। যদি মন বাঁকাতে যাও, তবে তোমার মুখই বাঁকা। তফাত যাওয়াই সহজ, কাছে থাকতে পাওয়া দুর্লভ। রকমে রকমে দেখব বলেই আসা। সেই দেখাতেই চোখ ভুলে যায়, মন দুলে যায়। আজ আমিও এই মানুষের সাগরপারের শরিক।
তবে ঠেক খাব না, দেখতে দেখতে যাব। চেনাশোনাদের দেখতে দেখতে, হাত তুলে, হাসি দিয়ে যেতে যেতে, অচেনাতে যাই। আরও অনেক মানুষে, অচিন মানুষের খোঁজে। কিন্তু, হঠাৎ একেবারে জিভে জল এসে যাবার মতন খাবার দেখে ঠেক খাই, অবাকও হই। দেখি ক্ষীরের পিঠে, চন্দ্রপুলি, ছানার পায়েস, রসবড়া সাজিয়ে বসে আছে এক পসারিনী। যাকে বলে সম্পন্ন বধূ, তা-ই, পসারিনী হেসে হেসে রসিকদের খাওয়াচ্ছেন।
কিন্তু চোখের ক্ষুধা মেটাই আগে, মনজঠরে ভরাই। রসনা ও জঠর, তারপরে। তবে, না দেখে দুর্নাম করা কেন। খাজা গজা জিলিপি, ঝোল ভাত তরকারি, সব ভোজনেরই ব্যবস্থা আছে।
দেখতে দেখতে যত যাই, টান দক্ষিণে। মেলা সেই দিকেই টেনে নিয়ে যায়। যত যাই, কানে একটা বাজনা ভেসে আসতে থাকে। তারপরেই শুনতে পাই, ‘এমন মানব-জনম আর কী হবে। অ ভোলা মন, মন যা কর, ত্বরায় কর, এই ভবে।’…
দরাজ গলার স্বর শুনে বুকটা যেন বহুদিনের হারানো চেনাকে খুঁজে পাওয়ার চমকে ধকধকিয়ে ওঠে। চেয়ে দেখি, সমুখে এক খড়ের চাল ঢাকা মস্ত দাওয়া। সেখানে কোমরে বাঁধা বাঁয়া, বাঁয়ের দিক ঘেঁষে, গেরুয়া আলখাল্লা পরা এক মানুষ। ডান হাতে তার একতারা। আবার বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘুংগুর। বাঁয়াতে তাল পড়লেই, ঘুংগুরে ঠিনঠিনিয়ে যাচ্ছে। মুখে তার অল্প অল্প পাতলা দাড়ি, গোঁফখানিও সেই প্রকার। বোঝা যায়, গায়কের বয়স বেশি না। চোখ দুটি ডাগর, টিকলো নাক, একহারা রোগা, কিন্তু শ্যাম রঙের জেল্লা দেখ একবার। গেরুয়া বসনে এ বিবাগী নবীন। তাকে ঘিরে আছে আরও কয়েকজন। সকলেরই এক পোশাক, কেবল চেহারায় আর বাজনার যন্ত্রে আলাদা। কেউ বাজায় দোতারা, কেউ ডারা ডুপ্কি খঞ্জনি। কেবল প্রেমজুরিতে আঙুল গলিয়ে ঝনক ঝনক বাজাচ্ছে এক মেয়ে। মেয়েই বলতে হবে, বয়স যদি কুড়ি-বাইশ হয়, তবে বেশি! রঙেতে সেও শ্যামা, কিন্তু চোখ দুটি যেন হরিণীকে হার মানানো। ফাঁদে যত বড়, ভাবে তত স্নিগ্ধ মধুর। পরনে তার লালপাড় শাড়ি, জমিন বুঝি রাঢ়ের মাটিতে ছোপানো। কিন্তু কপালে সিঁথেয় সিঁদুরের ঝলক।
এদের যে চিনি, তা না, তবু সেই এক গানের কলির মতো মনে হয়, ‘তুমি কে, পাগল পারা হে। বহুদিনের চেনা বলে মনে হতেছে।’ আরও অনেক দেখব বলে যেতে গিয়ে দেখি, পা চলে না। এই সমাবেশের দাওয়ার কাছে পা গেঁথে গিয়েছে।
আলখাল্লা পরা ডাগরা গায়ক তখন নিজের দিকে দেখিয়ে, অন্যদের গেয়ে বলছে:
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
ভোলার মন রে, পেয়েছে এই মানবতরণী।
এখন—বেয়ে যাও (অই রে ভোলা) ত্বরায় এই ধরায়
যেন ভরা না ডোবে।
এমন মানবজনম আর কী হবে।…
অমনি সবাই গলা মিলিয়ে, জয় গুরু জয় গুরু ধ্বনি দিতে দিতেই মাথায় পাগড়ি বাঁধা, দোতারাওয়ালা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আলখাল্লায় ঝাপটা দিয়ে, বাজনা বাজিয়ে নাচতে থাকে। কেবল যে নবীন বিবাগীর দল, তা না। বয়স্ক বিবাগীরাও আছে। বিবাগী বলি এই কারণে, গেরুয়া দেখে। কিন্তু রাঢ়ের বাউলদের চিনতে অসুবিধা নেই। বয়স্ক বাউলদের সঙ্গে দু-একজন বয়স্কা বাউলানিও আছে। তখন আমার মনে পড়ে গাজির কথা। ভাবি, এরা কি সেই পিকিতি নাকি হে।
শ্রোতার সংখ্যাও কম না। তবে রকমে সব মিল-মেশানো। গ্রামীণ শহুরে, সব রকমের আছে। ধুতি-পাঞ্জাবি কোট-পাতলুন, ক্ষারে কাচা জামাকাপড়ের ওপরে সুতির চাদর জড়ানো, নিতান্ত গামছাখানি কাঁধে নিয়েও কেউ কেউ বসেছে। এক না, অপরও আছে, শ্রোত্রীদেরও সেই প্রকারের ভাগাভাগি।
নীচে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ শুনতাম, জানি না। হঠাৎ কাঁধের ওপর হাতের ছোঁয়া পড়তে ফিরে দেখি, এক সৌম্য প্রৌঢ়। মাথার চুলে ধূসরতা, অথচ উলটা টানায় বড় বড় চুলে এমন একটা উসকোখুসকো ভাব, বিবাগী বিবাগী লাগে। গায়ে একটা মোটা পশমের জামা, তার ওপরে কম্বলের মতো একখানি চাদর। রংটি রোদে-পোড়া গৌর, চোখে-মুখে হাসির দিক থেকে ভিতরে যেন রসের ছলছলানি বেশি। তার চেয়েও দীপিত যেন বুদ্ধির ঝিলিক। গোঁফদাড়ি নেই, মুখে একখানি বিঘতখানেক লম্বা চুরুট। নিচু স্বরে, যেন রহস্য হেসে বলেন, ‘ভায়া, এখানে কেন, আসরে চলুন।’
অবাক হলেও বলি, ‘নিশ্চয়, কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না।’
মহাশয়ের চোখে যেন রহস্য নিবিড় হয়। বলেন, ‘না চিনলে কি, ডেকে নিতে পারি না?’
বলার ঢঙে নিজেই লজ্জা পাই। তাড়াতাড়ি বলি, ‘না না, তা কেন, নিশ্চয়ই পারেন।’
‘তবে তো ভায়া আর কোনও কথা নেই। এখানে রসিক ডাকে রসিককে। দেখলাম কিনা, দাঁড়িয়ে শুনছেন। তাই ভাবলাম, ডেকে নিয়ে বসি। চলুন বসি গিয়ে, তারপরে অন্য কথা।’
এর পরে আর কথা চলে না। দাওয়ায় উঠে আসরে গিয়ে বসি। তিনি বসতে বসতে হাসিতে রহস্য নিবিড়তর করে আবার বলেন, ‘অচেনাতেই চিনাচিনি। ঠিক মিলে যাবে, দেখবেন, বসুন।’