৭০. ধুলা-ভস্ম মাখা নগ্ন এক মানুষের মূর্তি

৭০.

কতক্ষণ ওপারের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম, জানি না। গোপীদাস কতক্ষণ চুপ করেছিল, খেয়াল করিনি। ওপারের কোনও কিছু যে দেখছিলাম, তাও না। গোপীদাস-বর্ণিত সেই বিশাল কালো ধুলা-ভস্ম মাখা নগ্ন এক মানুষের মূর্তি আমার চোখের সামনে ভাসছিল। আর গোপীদাসের কথাগুলো মস্তিষ্কের সীমান্তে সীমান্তে চক্র দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বসনভূষণ নগ্নতা, সকলই কোথায় যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা এক অদেখার গভীরে। মানুষ সেথায় চলছে অন্য কলে। সেথায় চোখের দেখায় সব দেখা না। তাতেই সব কথা না। সে যেন আর এক অলক্ষ্যের চোখে দেখা। সেই দেখাতেই কথা। নইলে গোপীদাসকে অঘোর ক্ষ্যাপা অমন ভাবে বলেছিল কেমন করে।

কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব বুঝে উঠতে পারি না। কেবল এই বিরাট সংসারের বিশাল চলমানতায় নিজের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে দেখি, ভারী দীন অতি ছোট। তাইতে আতুর বোধ করি।

গোপীদাস গায়ে হাত দিয়ে ডাকে, ‘ইবার নেয়ে লিবে চলো বাবাজি।’

চমক ভাঙে। চোখ ফিরিয়ে চাই। বলে উঠি, ‘একবার ওপারে ঘুরে এলে হত না?’

গোপীদাস হেসে বলে, ‘যাব বাবাজি, যাব বই কী, ইদিককার পাট মিটিয়ে লিই। তা’পরেতে যাব। শ্মশানের উদিকটো সব দেইখে আইসব।’

অগত্যা তা-ই। কী দেখতে যেতে চাই, তাও জানি না। তবু মনে হয়, ওপারে যেন কী আছে। ওপার যেন আমাকে হাতছানি দেয়। জলে নামবার আগে তবু না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘অঘোর ক্ষ্যাপার প্রকৃতি ছিলেন?’

গোপীদাস তার লোমশ ভুরু তুলে চোখ বড় করে বলে, ‘লিশ্চয় বাবাজি। পিকিতি ছাড়া সাধন হয় না। তবে ই ক্ষ্যাপার বেলায় অন্য কথা। ক্যানে, না কী ওঁয়ার সাধনে পিকিতির নাম ভৈরবী।’

‘কে ছিলেন তাঁর ভৈরবী?’

‘বইলতে লাইরব বাবাজি। উনি ছিলেন ই শিবক্ষেত্রে বইসে মহাভৈরব। ইখ্যানে কত ভৈরবী এইসেছে, যেইছে। খাঁটি বুজরুকি তো ওঁয়ার চখে ফাঁকি যাবার উপায় ছিল না। বাবাজি, সোম্সারে আছ, লজরটিও তোমার খারাপ না। নায়িকার নাম লিয়ে, রতির নাম লিয়ে কত শত ঝি বিটি শরীলের সোখের জন্যে হেথা হোথা পাক দিয়ে বেড়াচ্ছে, দেইখছ তো! তা, যোবতী বিটি তুমি অঙ্গে লিলে গেরুয়া, মাথায় রাইখলে জটা, হাতে লিলে ত্রিশুল, আর ভৈরবীটি হইয়ে কেবল সঙ্গ করবার জন্যে সাধু খুঁইজে বেড়াবে, তা হয় না। অমন অনেক ভৈরবীকে অঘোর ক্ষ্যাপা চিতার কাঠ মেরে তাড়া কইরেছেন। নিজের কানে শুইনেছি বাবাজি, একবার এক বিটিকে কী গালাগাল! অই বাবা, কান পাতা যায় না। সব বুইঝতে পাইরতেন। আবার তেমন ভৈরবী হলে তাকে ভক্তি কইরে বইসতে দিতেন, তার সঙ্গে সাইধতেন। তা বলে কী আর যিদিন যখন খুশি? তা না, মহাযোগের সোময় না হলে কিছুই না। মহাযোগের সোময় যদ্দিন না আইসবে, তদ্দিন কেবল ভৈরবীর যোগে বইসে ধ্যান করা। তাও দেইখেছি। তা-ই বইলছি, ওঁয়ার কোনও ভৈরবীর নাম জানি না। ক্ষ্যাপা নিজেও কি তাদের নামধাম জাইনতেন? না, মনে হয় না। উসব নামের খোঁজে আদত মিলে না।’…

যত শুনি, ততই অবাক লাগে। গোপীদাসের কথা না শুনলে কোনও দিন জানতে পারতাম না, প্রকৃতি আর ভৈরবীদের মধ্যে খাঁটি আর বুজরুক থাকে। সাধিকার ছদ্মবেশে শরীরের সুখের খোঁজে নারী ফেরে, তা-ই কি কখনও শুনেছি। তা-ও এই বক্রেশ্বরের মহাশ্মশানের মতো জায়গায়! ভাবতেও কি পেরেছি কখনও! নগরে, জনপদে যে সমাজে পরিবেশে বাস করি, সেখানে বসে ঘরত্যাগিনী নারীর এমন রূপের কথা কি চিন্তা করা যায় কখনও! তাও কিনা শুধু শরীরের সুখের খোঁজে! কারা সেই নারী? কেমন তাদের রূপ? কী তাদের মন? কত, কতই না বিচিত্র, আমারই আঙিনার বাইরে নরে নারীতে লীলা করে। কিছুই তার জানি না। যতটুকু জানি, দেখি, তা শুধু ধন্দ লাগায় চোখে মনে।

এ যেন ঘরে থাকি, পরিবারের কাউকে পুরো দেখি না, চিনি না। দেশে থাকি, দেশের রূপ মন দেখি না, চিনি না।

গোপীদাস উঠে দাঁড়ায়। ওপারের দিকে চোখ রেখেই বলে, ‘মাহিন্দ্রক্ষ্যানে দু’জনার সঙ্গে দু’জনার দেখা হলেই সাধন হয়। যারা সাইধতে জানে তারা সাধে।’…

কথার শেষে গোপীদাসের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মুখ নামিয়ে জলের দিকে চেয়ে বলে, ‘এইস বাবাজি, নেয়ে লিই।’

আমি তার পিছু পিছু গিয়ে জলে নামি। সত্যি, এ শীতের বেলায় ঈষদোষ্ণ জলের স্পর্শ যেন মধুর মতো। খাঁটি মধু যেমন মুখে উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়, এও যেন তেমনি। ওপরের কুণ্ডে জল টগবগিয়ে ফোটে। আর এখানে যেন ঠান্ডায় গরমে মেশানো গা সহানো। তেল সাবানের প্রশ্ন নেই। পথে বেরিয়ে সে কথা কেই বা চিন্তা করে। পথ চলাতে কেই বা চায়।

ইতিমধ্যে শ্মশানবাসী মদন কখন ডুব দিয়ে উঠে গিয়েছে। আরও দু-চারজন যারা স্নানে আসে যায়, তারা কেউ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে না আমাদের। নিজেদের মধ্যেই কথা বলে চলে যায়। তার মধ্যে কেউ বা একেবারে মৌনী। আপনার ভাবেই আছে।

জলে নেমে গোপীদাস বলে, ‘এ জলে নাইলে বাত ব্যামো সারে। চামড়ার রোগ যায়। বাবা বক্কেশ্বরের পুণ্যি লাগে। ডুব দাও বাবাজি।’

ডুব দিই। আরোগ্য বা পুণ্যের চিন্তায় না। এ জলের স্পর্শে শরীরে যেন নতুন অনুভূতি জাগে। অস্পষ্ট ধাতব গন্ধ, কিন্তু জলের স্বাদ বিকৃত না। নিজের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ জলের নীচে পরিষ্কার দেখি। জলের দূরে গভীরে অনেকখানি পর্যন্ত রোদের ঝিলিক দেখতে পাই।

স্নান করে উঠতেই ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ে। কিন্তু তাতে তেমন শীতবোধ করি না। ভিতরে যেন জলের উষ্ণতা চুঁইয়ে ঢুকেছে। গা মুছতে গিয়ে শুনি হরিধ্বনি। চেয়ে দেখি, একদল নতুন শ্মশানযাত্রী আসে শ্মশানের দিকে। কাঁধে তাদের শববাহী মই। মহাশ্মশান। চিতা এখানে কখনও নেবে না।

এখন ভাবি, এখানে এসে কেন আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, এ যেন পৃথিবীর কোন এক শেষ প্রান্তে এসেছি। এখান থেকে আর কোথাও যাবার নেই। কেন মনে হয়েছিল এ কথা, কে জানে। কিন্তু এই মহাশ্মশানের সেও এক সত্য। শেষ গন্তব্যের এক ঠাঁই এখানে।

কুণ্ডের পাশ দিয়ে ঘুরে ছোটখাটো অনেক মন্দির পেরিয়ে স্বয়ং বক্রেশ্বরের পাথর বাঁধানো চত্বরে এসে পড়ি। বক্রেশ্বরের সীমানা আলাদা। যেখান দিয়ে প্রবেশ করি, চত্বরে এসে বাঁদিকে দেখি এক জলাশয়। নাম শ্বেতগঙ্গা। কিন্তু গঙ্গা কেন। এ তো নদী নয়। চার দিক ঘেরা বিবর্ণ একটি জলাশয়। গোপীদাস কী যেন এক কিংবদন্তীর কথা বলে। কে যেন এই নাতিশীতোষ্ণ জলাশয়ে গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন, নাম শ্বেতগঙ্গা। গঙ্গাস্নানের পুণ্যি হয় এখানে নাইলে। আমার আর তার দরকার ছিল না। লম্বা সিঁড়ি নেমে গিয়েছে ধাপে ধাপে। গোপীদাস জানায়, এ জলাশয়ের জল গরম না। জলাশয়ের চারদিকে বাঁধানো। চত্বরে ঢুকে ডান দিকে বক্রেশ্বরের মন্দির। চত্বরের পিছনে জলাশয়ের ওপারে সবদিকেই গাছপালার নিবিড় ছায়া। সীমানার পাঁচিলে ভাঙন লেগেছে। তাতে শ্যাওলা ধরেছে, আগাছা জন্মেছে।

নিঃশব্দ নিশ্চুপ চারদিক। কেবল কোনও কোনও পাখি যেন ডাকে থেকে থেকে। আর ঝিল্লিস্বর। সব মিলিয়ে এখানে আর এক পরিবেশ। তবু যেন সবুজ নিবিড় না, একটা ছন্নছাড়া রুক্ষতা বিরাজ করে সবখানে। ডান দিকে ফিরে মন্দিরের দরজার কাছে যাই। পায়ের পাদুকা চত্বরে ঢোকবার আগেই খুলে রেখে এসেছি। আমি একা না। বক্রেশ্বর দর্শনেচ্ছু আরও কিছু আছে। তবু ভিড় নেই বললেই চলে। কেবল একটি থামের পাশে এক রমণী দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তার মন্দিরের দরজার দিকে। রমণী যুবতী, কিন্তু যেন আবেশে আচ্ছন্ন, বিষণ্ণ অথচ উৎসুক। তার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটি শিশু সন্তান বলে মনে হয়, একই মুখ তাদের। একই ভাব যেন দু’জনের মুখে। কেবল শিশুর চোখে মুখে কৌতূহল বেশি।

সহসা যেন এক অজন্তার চিত্র ভেসে ওঠে চোখে। দৃশ্যটা যেন অনেকদিনের চেনা। রমণীর সীমন্তে ঝাপসা সিঁদুর। চুল ঘোমটার বাইরে এলানো।

আমি দরজার কাছে যেতে সামনেই দেখি সেই পাণ্ডা। প্রথম যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে একগাল হেসে অভ্যর্থনা করে, ‘আস্যেন, আস্যেন, বাবাকে দর্শন কইরবেন, আস্যেন।’

তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে পিছন ফিরি। গোপীদাসকে দেখতে পাই না। সে আবার গেল কোথায়! আমি জানি, সে আমার পিছনে পিছনে আছে। সচকিত অনুসন্ধিৎসায় চত্বরের দিকে ফিরি। দেখি, দূরের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে গোপীদাস ভেজা দাড়িতে ঝাপটা মারছে। ভেজা লম্বা চুল কাঁধে পিঠে ছড়ানো।

নজর রেখেছিল আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই হাত তুলে বলে, ‘যাও বাবাজি, বাবাকে দশ্শন কইরে এইস। আমি হেথাতেই আছি।’

তবুও কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলাম। কেন, গোপীদাস কি দর্শন করবে না? দেখি, গোপীদাস হাসছে। আর আমার পাণ্ডা আওয়াজ দেয়, ‘ওদের মশায় ঈশ্বরের বালাই। ওদের কথা বাদ দেন ক্যানে। আস্যেন, আপনি আসেন।’

সেই মুহূর্তে আমারও মনে পড়ে যায়, বাউলের দেবদেবী ঈশ্বর নেই। আছেন শুধু গুরু। পাণ্ডার সঙ্গে মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে ঠেক। দরজার কাছে এসে দেখি অন্ধকার। নীচের অন্ধকারে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। নীচে প্রদীপের রক্তিম শিখা তিরতির করে কাঁপছে।

সেখানে আরও অন্য মানুষের অস্পষ্ট ছায়া। তাদের অস্পষ্ট নানা গলার স্বর। আমি কী করব স্থির করবার আগেই পাণ্ডামশাই আমার হাত চেপে ধরে। নীচের ধাপে পা দিয়ে প্রায় টান দিয়েই বলে, ‘আস্যেন, আস্যেন।’

জোর করে নামাবে নাকি? অন্ধকারে কী আছে, কারা আছে, কিছুই জানি না। অন্ধকারকেই ভয়। তবু কৌতূহলের টান কী কম? জেদাজেদির প্রশ্ন নেই। না দেখে কি আমিই ফিরতে চাই? পাণ্ডার হাত-ধরা হয়ে নেমে যাই।

নীচের পাথরে পা পড়তেই বুঝতে পারি ঠান্ডা ভেজা পাথর। প্রদীপের আলোয় দেখতে পাই গোল করে কাটা পরিখার মাঝখানে শিবলিঙ্গ। ইনি বক্রেশ্বরের বিগ্রহ। সেখানে দুইজন পাণ্ডা পুরোহিত। দু’জনকে নিয়ে বসে, সম্ভবত পুজোই করাচ্ছে। আমার পাণ্ডামশাই বক্রেশ্বরের বক্রতা দেখান। তারপরে কোনও কিছু না বলেই হঠাৎ হাতে যেন কী তুলে দেন।

বুঝতে না পেরে হাত বাড়াই। দেখি, কিছু ফুল-বেলপাতা। জিজ্ঞেস করি, ‘কী করব?’

‘বইসেন।’

বসব? ভাববে পরে, তার আগেই আমার হাত ধরে পাণ্ডা বসিয়ে দেয়। তার পরেই পাণ্ডা নির্দেশ দেয়, ‘নেন, ইবারে বলেন!’…

বলেই সংস্কৃত উচ্চারণ শুরু হয়ে যায়। আমি প্রতিধ্বনি করি কী না, তাও শোনে না। নিজের মনেই বলে যায়। আমি তেমনি বসেই থাকি। উচ্চারণ করি কী না, নিজেই জানি না। সেখানে আরও অন্য গলায় মন্ত্রোচ্চারণ ও প্রতিধ্বনি বেজে চলেছে। আমি সকলের দিকে দেখি। অন্ধকারের কোণে কোণে দেখি। আমার ঘ্রাণে ধূপ দীপ বেলপাতা ফুলের গন্ধ। তার মধ্যে দুধের গন্ধ আছে। এই ঘ্রাণের ভিতর দিয়ে সমস্ত পরিবেশ যেন প্রথম থেকেই নতুন জগতে নিয়ে যায়।

কিন্তু এমনি করে কেন বসে আছি? এমনি করে ফুল-বেলপাতা নিয়ে? আমি কি বিশ্বাস করি? না, করি না!

তবে কেন বসে আছি? আমি কি মন্ত্রোচ্চারণ করি?

না, করি না।

তবে সব ফেলে দিয়ে আমি কেন চলে যাই না?

তা আমি জানি না।

এও কি বিশ্বাসের নামান্তর নয়?

আমি এ-সবে বিশ্বাস করি না।

তবু কেন উঠে চলে যাই না?

জানি না, জানি না, জানি না। আমার যেন দুই ধারার মাঝখানে বাধা এক কষ্টের অবস্থা। এই স্রোত যায়, ওই স্রোত যায়। আমি কোন স্রোতে যাই, বুঝতে পারি না। পাণ্ডা মন্ত্রোচ্চারণ করে, আমি নিঃশব্দেও প্রতিধ্বনি করি না। তার নির্দেশে কেবল ফুল-বেলপাতা ফেলে দিই, নিই। কেন, তা জানি না। কেবল মনে হয়, আমি এখানে নেই, বর্তমানে নেই। আমি যেন হাজার বছর ধরে অনেক পায়ের চিহ্নে চিহ্নে চলেছি। আমি বহু দূর থেকে আসি আমারই ছায়ায় ছায়ায়। একা না, বহু লক্ষ কোটির সঙ্গে।

আমি আসি, দেশ কাল গোষ্ঠীর পূর্ব পরিচয়ের আলো-অন্ধকার বেয়ে। পিছনের বিচ্ছিন্নতাকে যোগ দিয়ে দিয়ে। আমার বর্তমানের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ রূপে পাবার কৌতুকে, ঔৎসুক্যে।

‘এবার প্রণাম করুন।’

প্রণাম করি! হে বর্তমান, যুগযুগান্ত দেখিয়ে নিয়ে এলে অনেক রূপ-অরূপের মধ্য দিয়ে। এখন যে রূপ তুমি দেখাও, অরূপের যে স্রোতে টেনে নিয়ে যাও, সেই পথেই চলি।

মন্দিরের নীচে থেকে বাইরে যখন আসি, তখন যেন রোদের রং অন্যরকম লাগে। একটু আগে দেখেছিলাম যেন কাঁসার মতো ঝলক। একটু সময়ের মধ্যেই কাঁসা যেন সোনার মতো হয়ে উঠেছে। পাণ্ডা তখনও ডাকে, ‘আস্যেন।’

আইসেন বলে কি আস্যেন বলে, তাও বুঝি না। শুনে মনে হয়, আস্যেন! কিন্তু আবার কোথায়? একটু ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য মুখে আর একটি বিগ্রহের সামনে উপস্থিত করে। ইনি গুহাগহ্বরে নন, খোলা দরজার সামনে মেঝের ওপরেই। ইনি বক্রেশ্বরের শক্তি। যা হয় কিছু নাকি এখানে দিতে হবে।

দেবতা থাকলেই দেবী থাকবে। বক্রেশ্বরই বা শক্তিবিহীন বসত করেন কেমন করে। স্ত্রী ছাড়া স্বামী থাকবেন, এ বে-আক্কেল কথাবার্তা, আমাদের জানা নেই! যেমন, যা নাই ভাণ্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে; তেমনি, যা নাই ঘরে, তা নাই মন্দিরে। অতঃপরে এ মন্দিরের শক্তির দর্শনী না দিলেই বা চলবে কেমন করে। দর্শন করলেই দর্শনী লাগে। তবে, এর পুরোহিত আলাদা। দেখি, একজন গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে পাশেই বসে আছে। দর্শনী কিছু দেবার পর সে আমার হাতে একটি ফুল তুলে দেয়। সেটি ঝোলায় ফেলি।

বক্রেশ্বরের গুহামন্দিরের প্রাপ্য সবই ঝোলায় ফেলেছি। কোথা থেকে কখন যে শালপাতায় মোড়া ফুল-বেলপাতা-বাতাসা পাণ্ডা জোগাড় করল টের পাইনি। পুজোর শেষে সেটি হাতে তুলে দিয়েছে। অতঃপর পাণ্ডামশাইয়ের উক্তি, ‘বেলা অনেক হল। আপনার পূজা হইয়ে গেল, ইবারে ঘরে যাই।’

যাবার আগে দক্ষিণাটা মিটলেই যেতে পারে। সেটা বলে বোঝাতে হবে, তেমন আহাম্মক তোমাকে সে ভাবে না।

সি তো বটেই কথা। কিন্তু কী দক্ষিণা দিলে মশায়কে খুশি করা যাবে তা জানি না। জিজ্ঞেস করতেও ভয়। আমার মুরোদে কুলাবে কেন। তবু ভয়ে ভয়ে যা পারি তাই দিই।

জয় বাবা বক্রেশ্বর। কী কৃপা! মশাইয়ের হাসিখানি দেখ ক্যানে একবার। বলে, ‘বেঁচ্যা থাক্যেন বাবা, বেঁচ্যা থাক্যেন।’

সঙ্গে সঙ্গে কোমরের কষি থেকেই বেরোয় একখানি তেলচিটে ছোট খাতা, দুই ইঞ্চি সমান একটি পেন্সিল। জিজ্ঞেস করে, ‘নাম-ঠিকানাটো বলেন তো বাবা, লিখে রাখি। আবার যখন আইসবেন, আমার নাম কইরবেন, সব্বাই বাড়ি দেখিয়ে দিবে। আপনি না এল্যেও আপনার বাপ-খুড়ো-দাদা যেই আসুক, নাম শুইনলেই সবাই জাইনবে, আমার যজমান।’

বাবা স্বর্গে। খুড়া দাদা আমি কেউ কোনওদিন আর আসব কিনা জানি না। তবু বলতে আপত্তি কী। নাম-ধাম পিতৃপরিচয় সবই দিয়ে দিই। কিন্তু তারপরেও যে মশায় যান না! বেলা তো অনেক হল, ঘরে যেতে হবে না?

যাবেন যাবেন, একটা কর্তব্য বলে কথা আছে তো। সেইটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, ‘ল্যান বাবা, আমাকে ছেইড়ে দেন। বইললাম, আমার ঘরে চলেন, একটুক ভাত পেসাদ হত। আমাদিগের গ্রামখানি দেখা হত। আর তো সিদিন নাই বাবা। বিটা-লাতিরা এখন পড়াশুনা কইরছে। গাঁয়ে লাইবেরি-টাইবেরি হইয়েছে। হাওয়া লেইগেছে সব জায়গায়। আস্যেন বাবা, আমাকে বিদায় দেন, নমস্কারটা সের‍্যা ল্যান।’

হে বক্রেশ্বর! এ কি ভুল আমার! পূজা করালেন, দক্ষিণা নিলেন, যজমান প্রণাম না করা পর্যন্ত মশাই বিদায় নেয় কেমন করে। এ বিষয়ে একেবারে কুণ্ডের জলের মতন সাফ-সুরত্ মানুষ। একটু কথার কারচুপি নেই। যজমানকে ধন্দ ধরানো নেই। তুমি নাহয় এসব নিয়ম-কানুন জানো না, মশাই ভোলে কেমন করে। যে কাজের যা।

আমারও কোথাও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে ঠাকুরের পদধূলি নিই।

‘জয়স্তু, জয়স্তু বাবা, আমি চলি।’

সত্যি সত্যি মশাই চলে যায়। আমি চেয়ে দেখি। হয়তো আমার মুখে হাসি লেগে আছে। মনে মনে অবাকও মানি। কিন্তু বিদ্রূপের বাঁকাচোরা খোঁচা কোথাও লাগে না আমার। একটু যদি বা করুণ লাগে, তবু কেমন একটা খুশির ছটা ঝলকে ওঠে। মানুষটি যেন হঠাৎ অনেক চেনা, সহৃদয় সরল হয়ে ওঠে আমার কাছে। মানুষ যে কী বিচিত্র!

কিন্তু গোপীদাস গেল কোথায়! আবার চত্বরে ফিরে আসি। দেখি, চত্বরের জলাশয়ের ধারে সিঁড়িতে বসে সে গুনগুন করছে। আমাকে দেখে কাছে উঠে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘পূজা দিয়েছ তো বাবাজি?’

‘ঠাকুর যা বলেছে, তাই করেছি।’

গোপীদাস আমার চোখের দিকে চায়, মিটিমিটি হাসে। আবার জিজ্ঞেস করে, ‘পাওনাগণ্ডা মিটল?’

‘তাও মিটেছে। লোকটাকে বড় ভাল লাগল।’

গোপীদাস হেসে চোখ ঘোরায়। বলে, ‘তা না হল্যে কি বাবাজির চখেমুখে এত ঝিলিক মারে। তুমি সত্যি বাবাজি চিতে বাঘ। তোমাকে চেনা মুশকিল আছে।’

আমি বলি, ‘কেন?’

গোপীদাস কেশো গলায় বিটলে হাসিতে কাঁপে। তার হাসি শুনে আমারও যেন হাসি পায়। সে আমার গায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘ভাল বাবাজি, খুব ভাল। এমনটি তো চাই গ। গুরু তোমাকে কিরপা করুন।’

গোপীদাস এ মন্দির, সে মন্দিরের মাঝখান দিয়ে ঝোপ-লতাপাতা সরিয়ে কোথায় যে নিয়ে চলে বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় চলেছি?’

গোপীদাস বলে, ‘একেবারে চিঁড়ে-মুড়কি খেয়্যা থাইকবে? তাই দেখি, একটুক ব্যবস্থা কিছু হয় কী না।’

এই শত শত মন্দির আস্ত ভাঙা পোড়ো, হেথায় জঙ্গল, হোথায় পাথর বিছানো বক্রেশ্বরের খোয়াই, এর মাঝখানে কোথায় ব্যবস্থা দেখতে চলেছে সে? পূজারী পুরোহিতের গ্রাম তো এদিকে না। বরং উলটো দিকে। দু-একটি কঞ্চির বেড়ার সীমায় যে কাঁচা বেড়ার ঘর দেখা যায়, সে সবই বন্ধ। এই রুক্ষু খোয়াইয়ের মন্দির ছড়ানো সীমায় কোথায় কী ব্যবস্থা দেখবে সে? জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার চেনাশোনা কেউ আছে নাকি?’

গোপীদাস বলে, ‘না থাইকলে অচিনার কাছেই যাব। যদি কুথাও একটুকু অন্ন ফুটিয়ে লিবার ব্যওস্থা করা যায়, সিটো দেইখছি। তবে কিনা, একটুক দেরি হইয়ে যাবে, বাবাজির কষ্ট লাইগবে, না কি বাবাজি?’

তেমন একটা ক্ষুধার তাড়না বোধ করছি না। তেমন স্থানে পরিবেশে একটু যদি অন্নের সংস্থান হয়, মন্দ কী। পরে আবার কোথায় জুটবে না জুটবে, কে জানে। তার চেয়ে একটু সময় কাটিয়ে কষ্ট করে এখানেই যদি মিলে যায়, সে-ই ভাল। বলি, ‘কষ্ট আবার কীসের! জুটলেই হল।’

‘জয় গুরু। তাই চলো, দেখি যেইয়ে। তবে ভাত ফোটার আগে দু’চার মুঠ চিঁড়ে-মুড়ি জুইটে যাবে।’

এই বলতে বলতেই কঞ্চির বেড়া ঘেরা একটি কুঁড়ের সামনে গোপীদাস দাঁড়ায়। ঘরের দাওয়া বাইরের দিকে, সেখানে কোনও বেড়া নেই। মাথায় খড়েরই চাল। কিন্তু অনেক কাল ভাল করে ছাওয়া হয়নি মনে হয়। তবে মাটির দাওয়া আর সিঁড়ি নিকনো, পরিষ্কার।

বাঁ দিকের ছেঁচাবেড়া একটু এগিয়ে এসেছে। সেদিকে নজর পড়তে একটু চমক লাগে। দেখি, আলকাতরা দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে—‘ব্রহ্মানন্দ অবধূত। বক্রেশ্বর।’ অতএব কুটিরবাসীর নামেই পরিচয়।

গোপীদাস ডাক দেয়, ‘কই গ, ঘরে মানুষ নাই ক্যানে?’

দাওয়ায় উঠে ঘরের যে দরজা রয়েছে সেটা বন্ধ। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। গোপীদাস আবার ডাকে, ‘অবধূত বাবাজি আছ ক্যানে গ, না কী?’

অবধূত বটে, আবার বাবাজিও! কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ নেই। কুঁড়ে যেমন চুপচাপ, তেমনিই থাকে। গোপীদাস গলা চড়িয়ে যেন নিজের মনেই বলে, ‘কোনও সাড়াশব্দ নাই, সব গেইলছে কুথা?’

বলতে বলতে একবার আমার দিকে চায়। আবার বলে, ‘ঠাকরুনও নাই মনে হইলছে।’

বলে নিচু হয়ে দরজার মাথায় লক্ষ করে আবার বলে, ‘না, বাইরে থেক্যা তো শিকল টানা নাই। মনে হইলছে ভিতর থেক্যা বন্ধ।’

এবার সে দাওয়ার ওপর ওঠে। আবার ডাকবার আগেই শব্দ করে দরজা খুলে যায়। আমি বাইরের থেকে পুরোপুরি না দেখতে পেলেও সরু লাল পাড়ওয়ালা একটা আধ-ময়লা গেরুয়া শাড়ির অংশ দেখতে পাই। যার পরিধানে সেই কাপড়, তার কোমর অবধি চোখে পড়ে। বাকি খড়ের চালে ঢাকা। তারপরেই একটু যেন ভারী ভারী বামা গলা কানে আসে, ‘তা মা, তুমি? আমি ভাবি, কে না কে। এইস, ঘরে এইস।’

দরজাটা সবটুকু খুলে যায়। গোপীদাস বলে, ‘আইসব বই কী দিদি। ভৈরব কুথা?’

জবাব শোনা যায়, ‘সি দাদা অনেক কথা, পরে হবে। ঘরে এইস। রাধাদিদিকে লিয়ে এইসেছ নাকি?’

‘না, রাধাদিদি আসে নাই। তবে একজনকে নিয়ে এইসেছি।’

‘অ মা, ডাইকবে তো, কুথা, কে বটে?’

গোপীদাস দাওয়া থেকে নিচু হয়ে আমার দিকে চেয়ে ডাকে, ‘এইস বাবাজি।’

তা যাব, তবু নতুনের আড়ষ্টতা যায় না। নতুনের কৌতূহল যেমন থাকে, তেমনি আড়ষ্টতাও থাকে। গোপীদাস আবার কোথায় নিয়ে তুলছে, কে জানে। অবধূতের সঙ্গে বাউলের কী সম্পর্ক থাকতে পারে, জানি না। ধর্ম ও সাধনমতে তারা এক কিনা, তাও জানি না। এইটুকু বুঝতে পারছি, একেবারে অচেনা কোনও জায়গায় এনে তোলেনি। গোপীদাসের সঙ্গে বেশ আঁতের কারবার আছে। নইলে ডেকে ঘরে নিত না।

ইতিমধ্যে দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় গোপীদাসের ঠাকরুন। আমি এক পলকে দেখি। লালপাড় গেরুয়া শাড়ির অংশ দেখে বিন্দুর কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু ঠাকরুন বেবাক উলটো। এর রংটি কটা, ফরসা বলা চলে। রাঢ়ের কাঠের পুতুলের মতো একটু খাটো কিন্তু বাঁধুনিতে আঁটোসাঁটো। কাঠ-খোদাইয়ের মতোই যেমন শরীর উদ্ধত, তেমনি সটান। শরীর দেখে মনে হয় কুমারী বা। তবে মুখের গোল ছাঁদে কেমন করে যেন একটু বয়সের ছাপ পড়েছে। সেটা চোখের কোলের কালির জন্য হতে পারে। মুখে যেন কীসের দাগও আছে। মেছেতা না ছুলি, কে জানে। তবে শরীরে ষোড়শী, মুখেতে ত্রিংশ। এটুকু জীবনযাপনের ছাপ হতেও পারে। নাক চোখ মুখও মন্দ না, কাটা কাটা ভাবের। মাথায় ঘোমটা নেই, চুল খোলা। গায়েতে জামা নেই, তবে নীচে অন্তর্বাস।

চোখ একটু আরক্ত। হয়তো নিদ্রা যাচ্ছিল। তাই কোলে কালি থাকলেও চোখ দুটি যেন ভেসে উঠেছে। কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। নজর সোজাসুজি। আমার দিকে কয়েক পলক দেখে গোপীদাসের দিকে ফিরে চায়। গোপীদাস বলে, ‘আমাদিগের চিতেবাবাজি।’

ততক্ষণে আমি দাওয়ার সিঁড়িতে পা দিই। ঠাকরুন একটু হাসে। জিজ্ঞেস করে, ‘কুথা থেক্যা আমদানি কইরলে?’

‘আমদানি করি নাই গ ঠাকরুন, লিজে থেক্যাই ভেইসে আইসছে।’

‘তাই বুঝি?’

‘হঁ গ, বোলপুরের পোষ মেলাতে দেখা। সিখ্যান থেক্যাই এক সাথে।’

‘তা, চিতেবাবাজি ক্যানে?’

‘সি কথাটো তোমাকে বইলতে লাইগবে? চখের দিকে চেয়্যা দেখ ক্যানে?’

যেন দেখতে হলে মুখে আঁচল চাপতে হয়। সেইরকম মুখে আঁচল চেপে ঠাকরুন আমাকে দেখে। কী ব্যাজ বলো! এ কী পরীক্ষা নেওয়া নাকি! দেখি, ঠাকরুনের সুঠাম অঙ্গে একটু তরঙ্গ লাগে। বলে, ‘হুঁ, মিছা না।’

তারপরে হুস্ করে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘রক্তের আশ মিটে না।’

বলেই আমার দিকে আবার চেয়ে ডাকে, ‘এইস বাবাজি, ঘরকে এইস।’

ঠাকরুন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। নিশ্বাসের হাওয়াটাও ভাল না। আমি গোগীদাসের পিছনে পিছনে ঘরে ঢুকি।

.

৭১.

আমাদের পিছু পিছুই ঠাকরুন ঢোকে। অন্ধকার ঘরে কিছুই দেখতে পাই না। ঠাকরুন নিজেই সেই অন্ধকার ঘোচায়। আর একটি ছোট দরজা সে অন্যদিকে খুলে দেয়। ঘরে আলো ঢেকে।

নতুন দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, একপাশে একটি লাউয়ের মাচা। সবুজ কচি লাউডগা মাচার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুল ধরেছে অনেক। ফল আসেনি এখনও। এ ফুলের সঙ্গে ও ফুলের রেণুতে রেণুতে মাখামাখি করবে, সেই দূত মৌমাছি এখনও তার কাজ করেনি। আর এক পাশে গুটি কয় গাঁদাফুলের গাছ। তাতে ফুল ধরেছে। একটি ঝাড়ালো জবাফুলের গাছ। তাতে গুটি কয় পাঁচ-পাপড়ি ফুল ধরে আছে।

এদিকেও কঞ্চির বেড়ার সীমানা রয়েছে। বাইরে এলোমেলো কয়েকটি মন্দির দেখা যায়। কোনও মন্দিরের পলেস্তারা খসেছে। কোনওটার গায়ে বড় ফাটল। কোনওটার বা অর্ধেক ধসে স্তূপীকৃত জমে আছে মন্দিরের পায়ে। বাবলার ঝাড়ের গায়ে, বনশিউলির বনের গায়ে নানা লতাগুল্মের জট পাকামো। দু-একটি বড় গাছ। তারপরে উঁচু-নিচু পাথরমাটির ঢেউ-বিস্তৃতি। সেই বিস্তৃতিতে ছোট ছোট শিবমন্দির ছড়ানো।

‘বইস ভাই বাবাজি।’

ঠাকরুনের গলা শুনে ঘরে দৃষ্টি ফেরাই। একপাশে একটি ছেঁড়া মাদুর পেতে দিয়েছে। তার দরকার ছিল না। মাটির মেঝে অনেক ভাল।

গোপীদাস বলে, ‘হঁ, বইস ক্যানে বাবাজি।’

অগত্যা। অতিথির একটা মান আছে তো। কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে মাদুরেই বসি। তখন নজর পড়ে, ঘরটা চৌকো না। একদিকে বড়। বাইরে থেকে যেদিকে ঘরের ছেঁচাবেড়া এগিয়ে গিয়েছে, আলকাতরা দিয়ে আশ্রমবাসীর নাম সে বেড়াতে লেখা আছে। ঘরের ভিতর সেদিকটাতেই দেখি, মাটির মেঝেতে একটি সিঁদুরমাখা ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে। ত্রিশূলের গায়ে একটি জবাফুলের মালা চড়ানো। পিছনের বেড়া ঘেঁষে একটা কাঠের পাটাতনে দড়ি বেঁধে তাক করা। তার ওপরে একটি নরমুণ্ডের কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের কপালেও সিঁদুর মাখানো। তাকের দু’পাশে বেড়ার গায়ে সিঁদুরগোলা দিয়ে স্বস্তিকাচিহ্ন আঁকা।

আমি যখন এসব দেখি, তখন ঠাকরুনের গলা শুনি, ‘কই গ গোপীদাসদাদা, দাঁড়িয়ে ক্যানে, বইস।’

গোপীদাস বলে, ‘বইসব তো। কিন্তুক ব্যাপারটা কী, বুইঝতে লাইরছি। অবধূত বাবাজি কুথা, তুমি ক্যানে একলা ঘরে?’

ঠাকরুন হাসে। হাসতে গিয়ে গায়ের আঁচল বিস্রস্ত হয়। সে টেনে দেয়। তার মধ্যেই দেখতে পাই, একটি রুদ্রাক্ষের মালা গলায় রয়েছে। চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘ভয় নাই গ, অবধূত এখনও আমাকে ত্যাগ করে নাই। এলেকাটার পোড়োয় যেলেই তাকে দেইখতে পাবে।’

গোপীদাস অবাক হয়ে বলে, ‘এলেকাটার পোড়োয়? তাকে তো দেইখলাম কুণ্ডের ধারে জঙ্গলে বইসে রইয়েছে।’

‘কিছু বলে নাই?’

‘হঁ, তুমাদিগের কথা জিগেঁসা কইরতে খালি বইললে, উয়াদের কথা জানি না, আমাকে কিছু জিগেঁসা করো না। একটুকু যেন গোঁসা গোঁসা ভাব।’

ঠাকরুন আবার হাসে। বলে, ‘তা বেচারির গোঁসা ক্যানে হবে না বলো। তার ঘরখানি যদি তুমি দখল কইরে বইসে থাকো, ঘর থেক্যা তাড়িয়ে দাও, তবে? গোঁসা হবে নাই নাকি?’

‘এলেকাটাকে তার ঘর থেক্যা খেদিয়ে দিয়েছে?’

‘হঁ গ’।

‘ক্যানে, বিত্তান্ত কী?’

ঠাকরুন হাসতে হাসতে বলে, ‘এলেকাটার ঘরকে যে এক ভৈরবী এইসেছে! তা উয়াকে যেইয়ে তোমার অবধূত বাবাজি সাধন-ভজন বুঝলছে, বুইঝলে তো? এলেকাটা তো উসব বুঝে না, তাই উয়াকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’

গোপীদাসের চোখ ঠায় ঠাকরুনের ওপর। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা আর অনুসন্ধিৎসা। আমারও একটু চমক লাগে। ব্যাপার যেন কেমন কেমন। অবধূতানী যত সহজে ভাষে, ব্যাপার যেন তেমন সহজ না। কোথায় একটু ঘোরপ্যাঁচ আছে। এলেকাটার ঘরে এক ভৈরবী এসেছে, তাকে গিয়ে অবধূত সাধনভজন বোঝাচ্ছে। আর এলেকাটা ঘর থেকে বিতাড়িত। এদিকে ঠাকরুন অবধূতাশ্রয় একলা আগলাচ্ছে। কেমন যেন ধন্দ-সন্দ’র গন্ধ লাগে।

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘কবে থেক্যা?’

ঠাকরুন বলে, ‘দু’দিন থেক্যা।’

‘তা ই ঘরে না বইসে এলেকাটার ঘরে যে?’

‘এলেকাটার ঘরেই যে ভৈরবী ঠাঁই লিয়েছে। তা তুমি বইস ক্যানে।’

‘বইসব তো, কিন্তুক।’

‘আবার কিন্তুক কী। আমি আছি তো, না কী?’

‘তা আছ। ভাইবলাম কি যে, চিতেবাবাজিকে লিয়ে তুমাদিগের কাছেই আসি, ইখানেই দুটো অন্ন জুইটবে। তুমাদিগের খাওয়া লেওয়া যদি হইয়ে যায় তো, আবার দুটো ফুটিয়ে লেওয়া যাবে।’

ঠাকরুন এবার একটু অবাক মুখে চমকায়। বলে, ‘অই যা, বইলতে লাগে! কী লোক গ তুমি গোপীদাদা! এখুনি কাঠ জ্বাইলছি, হাঁড়ি চড়ালছি, ইতে ভাবনা কী।’

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার খাওয়া হইয়েছে?’

ঠাকরুন ঠোঁট উলটে বলে, ‘না, আমার শরীল ভাল নাই। চুলায় আগুন-মাগুন কিছু দিই নাই। শুইয়ে ছিলাম, তুমি ডাইকলে তাই উইঠলাম।’

এখন বুঝে দেখ, শরীর খারাপ, না মন খারাপ। প্রথমে মনে হয়েছিল, নিশ্বাসের হাওয়াটা ভাল না। অবধূতানীর চোখের কোলে কালি কি আর এমনি পড়েছে? মুখের শীর্ণতা কি অকারণ? আসলে এদিকে উপবাস। ওদিকে মনোকষ্ট। নিজের আশ্রম ছেড়ে সাধক যাবে অন্য আশ্রমে, অন্য ভৈরবীকে সাধনভজন বোঝাবে, এতে কি আর খেতে বসতে ইচ্ছা করে! তার চেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতেই ভাল লাগে।

এমন ঘটনার মাঝখানে আমরা দুই অনাহূত অতিথি। আমি বিব্রত বোধ করি। বলি, ‘রান্নাবান্নার পাট থাক না। আমরা না হয়—।’

কথা শেষ করতে পারি না। ঠাকরুন বাগানের দিকের দরজার দিকে এগুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘ক্যানে গ বাবাজি। ইখানে কি রান্না-খাওয়া হয় না?’

আমি বলি, ‘তা হয়। কিন্তু আপনার শরীর খারাপ।’

‘অই মা গ!’

ঠাকরুনের ঘাড়ে একটা চকিত দোলা লাগে। রুদ্রাক্ষের মালাটি কণ্ঠার কাছে এলিয়ে আসে। বলে, ‘মরে তো যাই নাই। ই শরীল খারাপে দুটো চাল ফুটাতে মরে যাব না। কানে যখন শুইনেছি, তখন যেতে লাইরবে বাবাজি। তবে—।’

কথা থামিয়ে সে গোপীদাসের দিকে তাকায়। একবার একটু ঠোঁট টিপে হাসে। বলে, ‘তোমার কাছে আর কী লজ্জা কইরব। তুমাদিগের অবধূতের ঘরকে চাল বাড়ন্ত গ গোপীদাদা। গাঁয়ে যেইয়ে লিয়ে আইসতে হবে।’

গোপীদাস তৎক্ষণাৎ আওয়াজ করে ওঠে, ‘অই অই, জয় গুরু। ই আবার কোনও কথা নাকি। কী কী আইনতে হবে, তুমি বলো, লিয়ে আইসছি।’

‘আর কিছু না। চাল আর ছটাকখানি সর্ষের তেল লিয়ে এইস। উতেই হবে। আর সবই আছে।’

বলতে বলতে সে বাগানের দিকে দরজা দিয়ে বাইরে যায়। বাইরে বেড়ার গায়েই বোধ হয় কোথাও দড়িতে বাঁধা তেলের শিশি ঝোলানো ছিল। সেটা এনে দেয়। আর একখণ্ড পুরনো গেরুয়া কাপড়ের টুকরো। চাল আনবার জন্য।

আমিও তাড়াতাড়ি উঠি। ঠাকরুন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ‘কুথা যাচ্ছ বাবাজি?’

বলি, ‘আমিও সঙ্গে যাই।’

ঠাকরুনের অমনি চোখের তারা ঘুরে যায়। বলে, ‘ক্যানে, আমার কাছকে একলা থাইকতে ভয় লাইগছে? তুকতাক বশীকরণ কইরব, তার ভয়?’

‘না, না…।’

তার আগেই ঠাকরুন নিঃশব্দে হেসে কাঁপে। গোপীদাস বলে, ‘যেতে হবে না বাবাজি, তুমি বইস। যা দেবার, আমাকে দাও, তা হলেই হল।’

বলে মিটিমিটি হাসে। গোপীদাস আমাকে এখন বুঝতে পারে না শুধু। সহজে কথা বলতেও পারে। বক্রেশ্বরে সে আমার সঙ্গে এসেছে। সে চাল তেল কিনতে যাবে, আমি চুপ করে থাকি কেমন করে। তা-ই সঙ্গে যেতে চাওয়া। আমি তাকে পয়সা বের করে দিই। তার মধ্যেই সে ঠাকরুনকে বলে, ‘ইখানকার পাণ্ডাঠাকুর বাবাজিকে পেসাদ খাওয়াবে বইলে ঘরে লিয়ে যেতে চেইয়েছিল। আমি যেতে দিই নাই।’

ঠাকরুন বলে, ‘বেশ কইরেছ। একা একা আর ভাল লাইগছিল না। তবু একটু কথা বইলবার লোক পাওয়া গেল।’

এবার গোপীদাসের একটা নিশ্বাস পড়ে। বলে, ‘তা এলেকাটার ঘরে ভৈরবী, ই তো লতুন কথা শুনালে গ যোগো দিদি।’

এতক্ষণে তবু একটা নাম শোনা গেল ঠাকরুনের। যোগো কীসের আগে কে জানে। মায়া না বালা, বুঝি না। তবে যেরকম সিঁদুরের ত্রিশূল গাঁথা দেখি, সিঁদুর মাখা নরমুণ্ডের কঙ্কাল, তাতে বা যোগমায়া-ই হবে। ভৈরবী শক্তির সঙ্গে মায়ার যোগই বেশি। বালাও হতে পারে। শুনেছি, জ্যোৎমার্গী দশনামী সন্ন্যাসীদের বিশেষ অনুষ্ঠানে বালা নামে সুন্দরীর আবির্ভাব হয়। চৈত্রের শুক্লা নবমী রাত্রে তার ব্রত পালন করে তারা।

সে ব্রত অতি গুহ্য। সে গুহ্য গূঢ় কথা যথাতথা কহনে না যায়। তবে মদ্য মাংস রমণী সেই ব্রতের অবিশ্যি উপকরণ। আচরণ মরণ তথা উজান সাধন।

যোগো বলে, ‘আহ্, সে কি আর এলেকাটার ঘরকে এইসেছে? সে এইসেছিল বক্কেশ্বরে, তীত্থি কইরতে, সাধনভজন সাইধবে বলে। এলেকাটা নিজের ঘরকে লিয়ে গেলছে উয়াকে।’

গোপীদাস বলে, ‘অই! তা বটে। এলেকাটাকে দেইখছি তোমার ভক্ত, তোমার কাছাটিতে বইসে থাইকতে পাইরলে আর কিছু চায় না।’

যোগো ঘাড় বাঁকিয়ে ঝামটা দেয়, ‘মরণ! তুমি যাও, আর দেরি করো না। আমাদিগের কথা আলাদা, তোমার চিতেবাবাজি কতক্ষণ খিদে খেয়ে বইসে থাইকবে?’

‘হঁ হঁ। তবে, বাবাজিকে সহজ পাত্তর ভেইব না। লইলে আর আমাদিগের সঙ্গ করে?’

বলে দরজার কাছে গিয়ে গোপীদাস আবার জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি, অবধূতের সপ্তমী কিঞ্চিৎ ঘরে আছে?’

যোগো বলে, ‘তা আছে। ঘুরে এইস, তা পরে দম দিয়ো।’

‘জয় গুরু।’

গোপীদাস বেরিয়ে যায়। কিন্তু সপ্তমী কী, তার সঙ্গে দমের সম্পর্কই বা কী, বুঝতে পারি না। অথচ শোনা শোনা লাগে। তা-ই যোগোর দিকেই জিজ্ঞাসু চোখে একটু চেয়ে থাকি। যোগো ফিরতে গিয়েও আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী?’

জিজ্ঞেস করি, ‘সপ্তমীটা কী? শোনা শোনা লাগছে যেন।’

যোগো ঘাড় কাত করে ভুরু কুঁচকে চায়। তার এরকম ভাবভঙ্গি দেখলে কেমন যেন একটু ভয় ভয়ই লাগে। বিন্দুর মধ্যে যেমন একটু সখী ভাবের তরঙ্গ খেলে, এর তা নয়। এর সবই যেন একটু চোখা চোখা। আরক্ত চোখের দৃষ্টি যেন দপদপে, পাকানো পাকানো। বলে, ‘শোনা শোনা লাইগছে? ক্যানে হে, সাধুসন্ন্যেসীদের সাথে কখনও ঘুর‍্যা বেড়াল্ছ নাকি?’

অবাক হয়ে বলি, ‘না তো।’

‘তবে? তবে আর সপ্তমী কাকে বলে, সি তো সবাই জানে। তিথিকে বলে, ক্যানে কী? তুমি কি আর কিছু জানো?’

বলে ও আমার চোখের দিকে চেয়ে ঠোঁট দুটিতে হাসি হাসি ভাব করে। এলিয়ে পড়া চুল গালের কাছে। রুদ্রাক্ষের মালাটা সাপের মতো কণ্ঠার কাছ থেকে বুকের কাপড়ে ঢাকা পড়েছে।

কিন্তু শুধু তিথির কথা এখানে হয়নি, তা বুঝতে পারি। নিজের স্মৃতিশক্তিকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে।

যোগো আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আর কিছু শুইনেছ বুঝিন?’

‘তাই তো মনে হয়।’

‘তা হলে এই শুইনেছ কী?’

বলে সে দু’ হাতে কলকে ধরার মতো ঠোঁট ছুঁচালো করে টেনে দেখায়। তখনই আমার মনে পড়ে যায়, গাঁজার কথা। সাধুদের কাছে, বিশেষ কুলাচারীদের কাছে, গাঁজার ছদ্মনাম সপ্তমী। সাধারণের দুর্বোধ্য। শুনেছিলাম প্রয়াগের কুম্ভমেলায় সাধুদের কাছে। বলে উঠি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এ কথাই শুনেছিলাম সাধুর কাছে।’

যোগো হঠাৎ হাঁটু মুড়ে, পিছনে পা দিয়ে, ধপাস করে বসে আমার সামনাসামনি। বলে, ‘দেখি, কাজে কম্‌মে হাত দেবার আগে, তোমার কথাবার্তা একটুক জেইনে লিই। সাধুসঙ্গ কইরেছ বুঝিন? দেইখে তো মনে লেয় না।’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না না, ওসবের মধ্যে নেই। চলতে ফিরতে যেটুকু দেখি শুনি, তার বেশি নয়।’

যোগো বলে, ‘বটে? তা তুমাদিগের মতন মানুষ হিল্লি দিল্লি বেড়ায়। শ্মশানে মশানে ক’জনা বেড়াতে যায়? ক’জনই বা গোপীদাসের সাথে ঘোরে?’

আমি বলি, ‘ওই দু-একদিন একটু ভাল লাগছে, তাই।’

যোগো খানিকক্ষণ কথা বলে না। চোখের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। এ আবার কেমন দেখা! দপদপে চোখে এমন করে চেয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে। সত্যি সত্যি তুকতাক মন্ত্রে মায়ায়, সম্মোহনে ভেড়া বানাবে নাকি হে!

যোগো বসবার পরে তার সারা গায়ে মাথায় ভাল করে আলো পড়ে। এখন দেখি তাঁর সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ। কপালের সিঁদুরটিপ হালকা হয়ে গিয়েছে। একটু পরে জিজ্ঞেস করে, ‘চিতেবাবাজি নামই তো খালি শুইনলাম। আসল নামটি কী?’

ভারী ভারী গলায় এই জেরার সামনে চুপ করে থাকা যেন কঠিন। তাই আসল নামটি বলি। তারপরেও যোগোর নানা প্রশ্ন। ঘর বাড়ি কোথায়, ঘরে কে কে আছে, কী কাজ করি? যতদূর সম্ভব জবাব দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করি।

সব কথা শোনার পরে যোগো আমার চোখের দিকে চেয়ে একটু একটু ঘাড় নাড়ে। বার দুয়েক হুঁ দেয় নিজের মনে। তারপরে বলে, ‘তবে গোপীদাদা ধইরেছে ঠিক, চিতে তুমি বটে।’

নিজের প্রসঙ্গ পাড়তে ইচ্ছা করে না। তবু জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’

‘চিতার মতন এক লজর। লজর লাইগল তো আর ইদিক উদিক নাই।’

‘সেটা কীরকম?’

‘যিদিকে মন, সিদিকেই ধ্যান। কোনও লড়চড় নাই।’

বুঝতে পারি না। তাই চুপ করেই থাকি।

যোগো শরীরে একটা বাঁক দেয়, যেন আড়মোড়া ভাঙতে চায়। কিন্তু বাঁকে থেকেই বলে, ‘বুইঝতে লাইরলে? বইলছি নিজে মজো আর মজিয়ে ছাড়।’

সে আবার কেমন কথা? জিজ্ঞেস করি, ‘কী মজানো?’

‘মন।’

‘কার?’

যোগো রুদ্রাক্ষের মালাটা আঁচলের আড়াল থেকে টেনে বের করতে করতে একটু হেসে দোলে। বলে, ‘কেবল বিটি-ঝিদের লয় গ, বিটাছেল্যাদেরও বটে। তোমার চখে মুখে তা আছে। আর উতে তোমার জায়গা, অজায়গা নাই, যখন যিখানে হক। তবে—’

তার চোখ দুটি যেন নতুন করে ঝিলিক দেয়। হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খুঁইজে বেড়াল্ছ, বলো তো?’

একটু অবাক হই। কেমন যেন থতমত খাই। অথচ তার কোনও কারণ নেই। তবু যোগোর জিজ্ঞাসাটা তার দৃষ্টির মতোই, কোথায় যেন বিঁধে যায়। বলি, ‘জানি না তো।’

‘তবে?’

‘এমনি একটু ঘুরে বেড়াই।’

যোগোর শরীর কাঁপে। সে নিঃশব্দে হাসে। চোখ যেন আরও লাল হয়ে ওঠে তার। তারপরেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘বেড়াও। অনেক বেড়াতে হবে।’

যেন তার ঠোঁট বেঁকে যায় বিদ্রূপে। কিন্তু চোখের তারায় তা দেখতে পাই না। অন্যদিকে চেয়ে সে যেন নিজের মনেই বলে, ‘তাই তো হয়। অনেক মার খেতে হয়, অনেক মাইরতে হয়, তবু আসল মরা হয় না, মারাও হয় না। ঘাটে ঘাটে জল খেইয়ে ঘুইরতে হয়। বিষ পচা পাতকো, যা উঠে মুখে, তাই গিলতে হয়, তা’পরে আবার ঘোরা।’

বলে সে ঘাড়ের ঝটকায় গালের চুল সরায়। তার কাঠখোদাই শরীরে আঁচলটা একটু টেনে দেয়। তারপরে বাগানের দিকে বাইরে যেতে যেতে বলে, ‘বইস, জলটল আছে কিনা দেইখে আসি।’

যোগো চলে যায় বাইরে। কিন্তু আমার ভিতরে যেন সকলই নির্বাক হয়ে যায়। আমার দেহের স্পন্দনও যেন স্তব্ধ। যোগোর কথাগুলো যেন আমার সকল নির্বাক নৈঃশব্দ্যের মধ্যে একটা স্পষ্ট ঝিকিমিকির মতো চিকচিক করছে কেবল। আমি যে তার সব কথা বুঝেছি, তা মনে করি না। কিন্তু বোঝা না-বোঝার মাঝখানে কোন এক দূরের দিগন্তে সে যেন আমার সকল চেতনাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল। যেখানে আমি এক অসহায় কষ্টে যেন দাঁড়িয়ে থাকি।

এই অবস্থায় আমার চোখ পড়ে তেল-সিঁদুরমাখা ত্রিশূলের দিকে। সহসা ত্রিশূলটাকে কেমন এক প্রতিমার মুখের মতো মনে হয় আমার। যেন দু’ পাশের দুই উর্ধ্বগামী বক্ৰগতি মুখেরই আদলে উঠেছে। তারপর দুই ভুরুর মতো দু’ পাশে বেঁকে গিয়েছে। মাঝখানের ঋজু রেখায় যেখানে সিঁদুর মাখানো সেখানে মুখ, তার ওপরে থাক; তারও ওপরে তৃতীয় চোখের ঝলক।

একই সঙ্গে, একটু ওপরে, নরমুণ্ডের কঙ্কালের দিকে চেয়ে মনে হয় বিকট হাঁ-মুখে দন্তব্যাদান। চোখের কালো ছিদ্রে যেন পলক দৃষ্টি আমার দিকে। তার কপালে করোটিতে মাখানো সিঁদুরের ঝলকেও যেন দৃষ্টি রয়েছে।

কেন এমন মনে হয় জানি না। হয়তো মুহূর্তে এক চিত্রের কল্পনাতেই এমন মনে হয়। সেই সঙ্গে যোগোর বলে যাওয়া কথাগুলো আমার চেতনার গভীরে তেমনি এক অসহায় কষ্টে আমাকে স্তব্ধ করে রাখে।

কতটুকু সময় কাটে জানি না। আস্তে আস্তে আমি আবার বক্রেশ্বরের এই কুটিরে ফিরে আসি। আমার কানে এখন শুধু একটি কথাই বাজে, ‘অনেক বেড়াতে হবে।’… এখন ক্রমে অবাক হই। ভাবি একথা আমাকে বলে যায়, বক্রেশ্বরের এক কুটিরবাসিনী ভৈরবী। যার শিক্ষা দীক্ষা অভিজ্ঞতা, কোনও কিছুর ওপরেই আমার কোনও আস্থা থাকার কথা না। আমি সমাজের পরিবেশের যে সীমানা থেকে এসেছি, সেখানে এ আস্থা থাকবার কথাও না।

তবু যেন ক্রমেই বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। যেন এক দৈববাণী শুনেছি, ‘অনেক বেড়াতে হবে। কিন্তু সে কথা এমনি এক নারীর মুখে।—এইটুকু বিস্ময়। বিস্ময়ের মধ্যে যেন এক চকিত খুশির ঝিলিক লেগে যায়। তাতে এক ভিন্ন বিচিত্র সুর বেজে ওঠে। কতই অজানা। তবু একটুকু জেনে মন ভরে যায়। আমার ঘরের কাছে এমন বিচিত্র পড়শি, তাদের আমি দেখতে পাই। চিনতে পারি না। কিন্তু সব মিলিয়ে মনে একটা দোলা লেগে যায়।

যেন এই দেখাতে চলতে পারি।

যোগোর খোঁজে বাগানের দিকে দরজায় চোখ তুলতে যাই। এ সময়েই হঠাৎ দেখি ঘরের এক কোণে খাঁচার মতো কী একটা রয়েছে। সেটা আচমকা নড়েচড়ে উঠছে। প্রথম ঘরে ঢুকে একবার চোখে পড়েছিল। ভেবেছিলাম অবধূতের সংসারাশ্রমের জিনিসপত্র কিছু।

হঠাৎ নড়ে উঠতে ভাল করে লক্ষ করি। গাছের ডাল কেটে খাঁচা তৈরি। মাথাটা নিশ্চয় ঢাকা। কেন না তার ওপরেও দু’টি হাঁড়িও রয়েছে। একটু কোল-আঁধারে বলে ভাল করে দেখতে পাই না কিছু। কিন্তু খাঁচাটা নড়ে উঠল কেন? বাইরে থেকে বেড়ার গায়ে ধাক্কা লেগেছে নাকি?

পরমুহূর্তেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। দেখি খাঁচার ফাঁকে সাপের চেরা জিভ বাইরের দিকে লকলক করছে। খাঁচাটা আর একবার নড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে খাঁচার ওপরে হাঁড়ি দুটোও।

চকিতে উঠে দাঁড়াই। আমার সকল চিত্র-কল্পনা, মনের ভাব মুহূর্তে মত্যুভয়ে কণ্টকিত! সাপ! খাঁচার মধ্যে সাপ! নাকি বাইরে থেকে সে ঢুকেছে। আমি এখন স্পষ্ট দেখতে পাই, কাঠের বেড়ার ফাঁকে সাপের একটি চোখ যেন নিষ্পলক আমার দিকে চেয়ে। খাঁচার মধ্যে তার শরীর পাক খাচ্ছে। খাঁচার বাইরে চেরা জিভ ছুড়ে ছুড়ে শূন্যে লেহন করছে।

ত্রিশূল, কঙ্কাল, সাপ। বাইরে ভাঙা আভাঙা শিবমন্দির। বক্রেশ্বরের খোয়াইয়ের উঁচু নিচু, বনপালা স্তব্ধ প্রকৃতি। কারুর কোনও সাড়া-শব্দ নেই। কোন দরজা দিয়ে বাইরে যাব, আমি তাই ভাবি। বেরুবার উদ্যোগ করি।

ঠিক এই মুহূর্তেই রাস্তার দিকের দরজায় একজনের আবির্ভাব। হাঁটু অবধি নামানো কাছাহীন ময়লা গেরুয়া কাপড় পরা এক পুরুষ। গোঁফদাড়ি কামানো মাথায় চুলের জটা বিড়ে করে বাঁধা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। দুই ডানায় রুদ্রাক্ষের তাগা।

সে সবে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু আরক্ত চক্ষু, মাজা মাজা রঙের বুকও আরক্ত যেন। দেহের অবস্থা টলটলায়মান। ঢুকেই দরজা ধরে ঝুঁকে পড়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। নেহাইয়ের মতো শক্ত বুক দেখলে মনে হয় আমার মতো একটি জীবকে বুকে চেপেই খতম করতে পারে। বুক কপাল আরক্ত, কপালে সিঁদুর লেপা।

আসছিল বেশ বেগে এবং ঝোঁকেই। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে। একটু জড়ানো বজ্রস্বরে প্রথম প্রশ্ন, ‘কে তুমি?’

‘আমি?’

এই পালটা প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই উচ্চারণ করতে পারি না। কোন গ্রহে ফেলে গোপীদাস, কে জানে। ত্রিশূল কঙ্কাল সাপ, তার সঙ্গে এই মদমত্ত পুরুষ। রসের গন্ধে ঘর ভরে যায় ইতিমধ্যেই।

আরক্ত চক্ষু শিবনেত্র করে সে আমার দিকে দেখতে থাকে। তারপর হঠাৎ আবার হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘কে বটে, বইলছ না ক্যানে হে, আঁ?’

‘ক্যানে, কী দরকার?’

যোগোর গলা তীক্ষ্ণস্বরে বাজে। ফিরে দেখি বাগানের দিকের দরজা দিয়ে সে কখন এসে ঢুকেছে। তার রক্তিম চোখের দপদপানিতে এখন যেন অঙ্গারের আগুন। নাসারন্ধ্র কাঁপে থরথর। তার সারা গায়ে চোখে মুখেই যেন আগুন লেগেছে। যেন ফণা তোলা সাপিনী, দংশনে উদ্যত।

আমি ভাবি, ইনি কে স্বয়ং ব্রহ্মানন্দ অবধূত!

.

৭২.

জটাধারী, গোঁফদাড়িহীন, আরক্তচক্ষু মত্ত পুরুষ যোগোর দিকে তাকায়। তাকায় না তো, যেন আগুনের শলা দিয়ে বেঁধে। রসের ঝোঁকে শরীর একবার টাল খায়। বুকের নেহাই খানিক এগিয়ে আসে। যেন চাপা গলায় গরগরিয়ে ওঠে, ‘ক্যানে, জিগেঁস করতে নাই?’

যোগোর অঙ্গার দৃষ্টি একটুও এদিক-ওদিক হয় না। শুধু তিরের মতো একটি শব্দ বেরোয়, ‘না।’

‘বট্‌ট্যে?’

জটাধারীর আরক্ত চোখ একবার পাকিয়ে ওঠে। কপালের রেখা কিলবিল করে। তারপরেই চোখ দু’টি ছোট হয়ে আসে। চোখের কোণ কুঁচকে যায়। মুখ শক্ত ক্রুদ্ধ দেখায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘ক্যানে গ মা, নতুন ভৈরব পাকড়াও কইরেছ নাকি?’

হে বক্রেশ্বর, এ কী সম্বোধন! এ আবার কেমন প্রশ্ন। কিন্তু দেখ রাঢ়ের খোদাই করা দারুমূর্তি হঠাৎ সজীব হয়ে কেমন দুলে ওঠে। চোখের আগুন মুখে জ্বলে। ঠোঁট দু’টি বেঁকে যায় ধনুকের মতো। অথচ ঘাড় বাঁকিয়ে বড় যেন মিষ্টি সুরে, সুর করে বলে, ‘হুঁ গ বাবা বেহ্মালন্দ অবধূত, সি খবরটো জানো নাই?’

বলতে বলতে যোগো পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে আমার দিকে। কিন্ত চোখ সরায় না অবধূতের দিক থেকে। বলে, ‘তবে ভৈরব লয় গ অবধূত। তোমার মতন মালা লিয়ে ই লোক তো টপো টপো জপ কইরতে জানে নাই, সাধন ভজনও শিখে নাই। উতে আমারও ঘেন্না ধরে যেইছে। ইটো আমার লাগর গ, লাগর! দেইখছ না, কেমন চেহারা আর জামাকাপড়! এখন আমি উয়ার লাগরী।’

‘খপরদার।’

মানুষ তো না, বাঘের গর্জন বাজে। যেন কুটিরও কেঁপে ওঠে। খাঁচার অজগরও গর্জন শুনে জিব গুটিয়ে নেয়। আর আমার কী অবস্থা। কোথা হে বিপদঘ্ন, শ্রীমধুসূদন, গোপীদাস বাউল, তোমার চিতেবাবাজিকে রক্ষা করো এসে। ভৈরব ভৈরবীর পাল্লায় পড়ে বক্রেশ্বরেই বুঝি প্রাণটা যায়।

কিন্তু ওদিকে যেমন বাঘের গর্জন, এদিকে তার কিছুই না। ধনুকের ছিলায় আরও জোর টান। যোগোর ঠোঁটের তীক্ষ্ণ বাঁকে নিষ্ঠুর বিদ্রূপের ঝিলিক। ঘাড় আরও কাত হয়ে পড়ে। ভৈরবী যোগিনীর ঘোমটা খসে যায়। বুকের কাপড় আরও নেমে আসে। রক্তিম বক্ষদেশে রুদ্রাক্ষের মালা দোলে। বলে ওঠে, ‘আহা হা, অমন চটেন ক্যানে গ, অবধূত! আপনি হল্যেন সাধক পুরুস্ যোগী মানুস্‌। আমাকে খবরদার কইরছেন ক্যানে গ বেহ্মালন্দ। আমি কি আপনার যুগ্যি? আমি এখন লাগরী হইয়েছি। দ্যাখেন ক্যানে, কেমন কাঁচা বয়সের লাগর জুইটেছে আমার। আপনার মতন বুড়া লাগর আমার আর ভাল লাগে নাই?’

‘কী, আমি লাগর? বেহ্মানন্দ অবধূত তোর লাগর? আমার আশ্রমে দাঁড়িয়ে এত বড় কথা? তবে র‍্যা মাগী পাপিষ্টি, তোর বুকের রক্ত আজ খাব।’

হাঁক দিয়েই ব্রহ্মানন্দ অবধূত ছুটে ঘরের এক কোণে যায়। যেদিকে যায় সেদিকেই সেই প্রকাণ্ড অজগরের খাঁচা।

এদিকে চিতেবাবাজির প্রাণ খাঁচা-ছাড়া। এ কেমন সাধক সাধিকা, এ তাদের কেমন সম্বোধন হে? তারপরে আরও ভয়ংকর কথা, বুকের রক্ত খাবে বলছে! তীর্থ ঘোরা, মানুষ দেখার সাধ মিটেছে। আর না। শরীর শক্ত করে দরজার দিকে একবার লক্ষ করি। এত সহজে কারুর লাগর হয়ে প্রাণ দিতে পারব না।

ব্রহ্মানন্দ কোণের অন্ধকারে হাতড়ে হঠাৎ একটা ত্রিশূল বের করে। আমার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে, যোগোর দিকে ত্রিশূল তুলে গর্জে ওঠে, ‘আজ তোর একদিন আর আমার একদিন। আশ্রমে দাঁড়িয়ে মাগি লাগর ডাগরী দেখাল্‌ছে।’

উদ্যত ত্রিশূল মদমত্ত ক্ষ্যাপা ভৈরবের হাতে। ভৈরবীর বুকে এসে এই বুঝি বেঁধে! কিন্তু যার দিকে উদ্যত, সেই যোগোর যেন ভুরুক্ষেপও নেই। সে যেন ভারী সন্ত্রস্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘ইস্ ইস্, একেবারে শিবঠাকুরের মতন দেখাল্‌ছে গ। দক্কযজ্ঞ কইরবেন। আহা, তা না হবেক ক্যানে, কত বড় সাধক দেইখতে লাইগবে তো? এত এত মদ গাঁজা টাইনতে পারে, কাঁড়ি কাঁড়ি ভৈরবী লিয়ে সাধন-ভজন কইরতে পারে, শিবঠাকুরের থেক্যাও বড়। তা দাঁড়িয়ে ক্যানে, মারেন। মেইরে বুকের রক্ত খান।’

সর্বনাশ! যোগো যেমন করে বুক এগিয়ে দাঁড়ায় তার আঁচলটুকুই না খসে। তার ধনুক ঠোঁটের, অপলক চোখের আগুন দেখে আমারই ভয় করে। ওদিকে ব্রহ্মানন্দের হাতের ত্রিশূল আরও উঁচুতে ওঠে। চিৎকার ওঠে, ‘সাবধান, হুঁশিয়ার, চোপা সামাল দে বইলছি। আমার চখের সামনে থেক্যা দূর হ মাগি। কুলটা, ব্যাশ্যা…।’

‘সি কী গ অবধূত, আঁ? লাগরী বইলতে বারণ, আশ্রমে দাঁড়িয়ে কুলটা ব্যাশ্যা বইলছ? ধাম্মিক তুমি, পাপ লাইবে না?’

যোগোর গলা যেন ক্রমেই খাদে নামে, আরও সরু হয়। কিন্তু তীব্রতা তীক্ষ্ণতা বাড়ে।

ব্রহ্মানন্দ হাঁকড়ে ওঠে, ‘না, পাপ লাগে না। ব্যাশ্যাকে ব্যাশ্যা বইলছি। তুই কুলটা, তুই ছিনাল…।’

আহ্, আহ্, আর শুনতে পারি না হে। এর চেয়ে একটা হেস্তনেস্ত ভাল। কিন্তু তার কোনও আশা নেই দেখে কোনওরকমে অস্ফুটে উচ্চারণ করি, ‘আচ্ছা আমি চলি।’

পা বাড়াবার আগেই যোগো খপ্ করে আমার হাত টেনে ধরে। কিন্তু চোখ আমার দিকে না। জ্বলন্ত দৃষ্টি ব্ৰহ্মানন্দের দিকেই। কথাও বলে তার সঙ্গেই, ‘তাতেই বা আপনার মান যাবেক ক্যানে গ অবধূত। আপনি যে বলেন, ব্যাশ্যা কুলটা ভৈরবী দিয়ে সাধন ভাল হয়? এখন এত গোঁসা ক্যানে?’

‘চোপ, চোপ হারামজাদি। যা, দূর হ, দূর হ আমার আশ্রম থেক্যা।’

ত্রিশূলটা কিন্তু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে না। বুকের রক্ত খাওয়ার দৃশ্যটাও ঘটছে না। যোগো তেমনি চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যানে গ ভৈরব, লতুন ভৈরবী এন্যে তুইলবে নাকি?’

‘হঁ, তা-ই তুইলব। তুই দূর হ।’

‘তব্‌বে র‍্যা চিতের মড়া। বড় বাড় হইয়েছে তোমার, আঁ?’

বলেই যোগো আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, ‘বাবাজি, ভয় পেয়ো না, একটুক দাঁড়াও। ই কত্‌ত বড় অবধূত হইয়েছে, আমি একবার দেখ্যা লিই। মরণ তোর মিনসের নিকুচি কইরেছে, আয়, আয় দেখি কেমন শিবঠাকুর হইয়েছিস।’

বলেই ছুটে গিয়ে ঘরের আর এক কোণ থেকে সে টেনে বের করে লম্বা একটা বর্শা। ফলায় তার জং ধরেছে বটে, তেমন করে মারলে এফোঁড়-ওফোঁড় করা যায়। সেটা তুলে একেবারে সোজাসুজি ব্ৰহ্মানন্দের বুকে ঠেকায়। সঙ্গে সঙ্গে অবধূতের ত্রিশূল নামে। শংকিত অথচ ক্রুদ্ধ চিৎকার ওঠে, ‘অ্যাই সাবধান, খপরদার বলছি অস্তর লিয়ে ছেল্যেখেলা ভাল না।’

‘ছেল্যেখেলা, আঁ?’

যোগোর গলা তেমনি নিচু। কিন্তু মুখ ভয়ংকর। দৃষ্টি খুনির। কী বিপদ। এখন কি এই হত্যা দেখতে হবে? যোগো তেমনি বলে, ‘নিজে তিরশূল লিয়ে আমার বুকের রক্ত খেতে আইসছিলে, এখন আমি অস্তর লিয়ে ছেলেখেলা কইরছি? তোমার রক্ত দশ্শন কইরব আজ।’

অবধূতের আবার সেই চিৎকার, ‘সাবধান, বইলছি আর একটুক খোঁচা মাইরলে ঢুক্যে যাবে কিন্তুক।’

‘ঢুকুক, ঢোকাব বইলেই ধইরেছি। বাটপাড়, মিথ্যুক, ভণ্ড! জানি না ভাইবছ, না? কোন তোমার ছুঁচো চামচিকে যেইয়ে খবর দিয়েছে, ই ঘরকে লোক এইসেছে। তা-ই তুমি ঘর সামলাতে এইসেছ, না?’

‘অ্যাই, অ্যাই দ্যাগ্ গ, ভৈরবী…।’

ওই শোনো, এখন আর ক্রোধ নেই ব্রহ্মানন্দের গলায়। উদ্বিগ্ন মিনতি। বুকে ঠেকানো বর্শার ফলাটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে অবধূত। আবার বলে, ‘মরণ লিয়ে খেলা করিস না গ। তোল, তুলে লে।’

‘ক্যানে, তুইলব ক্যানে? আমি ব্যাশ্যা কুলটা মাইরবে বল্যে বাবার তিরসূল লিয়েছ, এখন মারো দেখি। এলেকাটার ঘরকে যাকে সাধনভজন বুঝাইল্‌ছ আজ দু’রাত ধইরে, সে যোগীর তেজ দেয় নাই, আঁ।’

বাবার ত্রিশূল তো অনেক আগেই নত হয়েছে। অবধূতের তেজ যদি কিছু থেকেও থাকে তবে আপাতত তা গুপ্ত আছে। প্রকাশের কোনও লক্ষণ দেখি না। প্রথম দর্শনে যেটুকু দেখা গিয়েছিল সেই তুলনায় ক্ষ্যাপা মহাদেব এখন একেবারে বাবা ভোলানাথ। আর চেয়ে দেখ যোগো ভৈরবীকে বর্শা হাতে খোলা-চুল যোগিনী। লাল পাড় গেরুয়ার এক বেড় আঁচল, উদ্ধত বুকের ওপর থেকে অনেকখানি নেমে গিয়েছে। রোষে নিশ্বাসে দুলছে। চোখ দপ্দপে, মুখ ঝকঝকে।

এ মূর্তির নাম কী আমি জানি না। তবু অসুরের বুকে বর্শা বেঁধানো দুর্গা প্রতিমার কথা মনে পড়ে যায়। যোগোর মুখে কীসের দাগ? হয়তো এই কটা মুখখানি পাঁচ সাত বছর আগে খুবই সুন্দর ছিল। এখন তেমন সুন্দর না। সেই অর্থে সুন্দর না, যে অর্থে নারীর লাবণ্য ভাবি। কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে আরও কী এক সৌন্দর্য যেন আছে। যে সৌন্দর্য বাস করে মনের গভীরে, শক্তিতে ভক্তিতে জ্ঞানে তেজে। এখন যেন যোগোর মুখে সেই সৌন্দর্যেরই ঝলক লেগেছে।

দু’জনের মাঝখানে পড়ে কোনও কথা বলা উচিত কি না বুঝি না। এখন আমি অনেক নির্ভয়। স্বয়ং আশ্রয়দাত্রীর হাতে এখন অস্ত্র। ভয়ে ভয়ে বলি, ‘বর্শাটা তুলে নিন, আমার বড় অস্বস্তি লাগছে।’

ব্রহ্মানন্দ আরক্ত চোখে চকিতে একবার আমাকে দেখে নেয়।

তার চোখ থেকে রাগ বিদ্বেষ যে একেবারে অপসারিত তা মনে হয় না। আমার প্রতি এখনও যেন কেমন একটু সন্দিগ্ধ কুটিল কটাক্ষ হানে।

যোগো আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে, অবধূতের দিকেই চেয়ে বলে, ‘নোক নাই, জন নাই, চেনা-অচেনা নাই, যার-তার সামনে তুমি আমার বেইজ্জত কইরবে! ক্যানে, ই ঘরকে নোক এইসেছে শুন্যে চুপ কইরে থাইকতে পাইরলে না? ভাইবলে বুঝি হাতেরটা পিছলে বেরিয়ে যেইছে তা-ই সামলাতে এইসেছ। ক্যানে, যাকে সাধন ভজন বুঝাল্ছ তাকে লিয়ে থাকো না। ইখানে মইরতে ক্যানে? বড় তুমি বেহ্মালন্দ বেহ্মচারি হইয়েছ, না? মরণ তোমার, মুখে আগুন অমন অবধূতের।’

ব্রহ্মানন্দ অবধূত যেন ধ্যানমগ্ন। দৃষ্টি যোগোর দিকে। কিন্তু আগুন নেই। কথাটি নেই। নাকি যোগো দর্শনে একেবারে অবশ হয়ে গেল।

এও যে দেখতে হবে এমন ভাবিনি। কে আমাকে পথে ঘোরায়, পথে চালায়, দিক নির্দেশ করে জানি না। সে যে আমাকে এমন দেখাও দেখাবে ভাবিনি। ভয় গিয়েছে, এখন মনের ভিতরে যেন একটা তরঙ্গ দুলে উঠছে।

যোগোর বর্শা নেমে আসে। অবধূত বুকে হাত দিয়ে মুখ নামিয়ে দেখে। যেখানে বর্শার ডগা ঠেকেছিল, সেখানে বার কয়েক আঙুল বোলায়। তার মুখ আবার শক্ত হয়। বোধ হয় একটু লেগেছে। শত হলেও নিটুট বর্শা তো! আর যোগো একেবারে আলতো করেও ছুঁইয়ে রাখেনি। রোখের বশে, একটু-আধটু খোঁচাও মেরেছিল নিশ্চয়।

অবধূত আর একবার আমার দিকে চায়। তারপরে ত্রিশূলটাকে ছুড়ে ফেলে একদিকে। বলে, ‘বেশ, আমি চইললাম। তোর মুখ আর আমি দেইখতে চাই না।’

যোগো বর্শাটা মাটিতে ঠেকিয়ে বলে, ‘বাঁচি, আমার হাড় জুড়োয়। তোমার মতন অবধূতের সাথে, আমাকে যেন আর না থাইকতে হয়। একদিন যেমন কর‍্যা এইসেছিলাম, তেমনি কর‍্যা চইলে যাব। তবু তোমার নষ্টামো ভণ্ডামো, উতে আমি থুথু দিই। উতে আমি ন্যাকার করি।’

বাবা, প্রতিবাদের কী তীব্র ভাষা! এর বোধ হয় আর তুলনা হয় না। অবধূত বলে ওঠে, ‘তবে মনে রাখিস, আশ্রমে যদি কোনও অনাচার করিস, তবে মহাপাতকী হবি, শরীলে পোকা পইড়বে।’

বলে সে দরজার দিকে ফিরতে যায়। যোগো বলে ওঠে, ‘যা যা, শকুনের শাপে আবার গরু মরে! তুমি যদি হেথা হোথা দশটা ভৈরবী জুটিয়ে সাধন-ভজনের র‍্যালা কইরতে পারো, তবে আমিও পারি। করবও তা-ই।’

সসম্মানে পশ্চাদপসরণকারী অবধূতের গলায় কেবল একটা তীব্র হুংকার শোনা যায়। সে বেগে ধায় দরজার দিকে। তখনই শোনা যায়, ‘জয় গুরু জয় গুরু! এইসেছ দাদা বেহ্মানন্দ! এইসে ইস্তক তোমার খোঁজ কইরছি।’

কথা ঘরে বা দাওয়ায় না। একেবারে বাইরে, গোপীদাসের সঙ্গে অবধূতের দেখা। সেখানে অবধূতের গলা শোনা যায়, ‘অ, তুমি। তুমি কখন এল্যে?’

‘এই তো একটু আগে। সাধে এক বাবাজিকে লিয়ে আইসছি। ছেলেমানুষ, বড় ভাল মানুষ বাবাজি, বক্কেশ্বর দশ্শন কইরতে এইসেছে। তা ভাইবলাম কী যে, তোমাদিগেও একটুক দশ্শন কইরবে, ইখানেই দুটো ফুটিয়ে লিয়ে খাওয়া হবে। তা তোমারই পাত্তা নাই। এইস, যেইছ কুথা?’

সঙ্গে সঙ্গে সেই গর্জন, ‘নাঃ, আর ই আশ্রমে লয়। আমাকে কি না বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে মাইরতে আসে?’

‘সি কী! কে গ, কে মাইরতে আসে?’

‘কে আবার! ইখানে আর আছে কে! অই পাপিষ্টি ডাকিনী মাগি।’

অমনি গোপীদাসের গলায় ভিন সুর বাজে, ‘আ ছি ছি অবধূতদাদা, কী বইলছ গ! যোগোদিদিকে গালি পাইড়ছ?’

ঘরের মধ্যে আমি যেমন চুপ করে শুনছিলাম, যোগোও তেমনি শুনছিল। আর বোধ হয় থাকতে পারল না। বর্শাটা নিয়েই বেরিয়ে গেল দুপ দুপ করে। বাইরে থেকে তার গলা শুনতে পাই, ‘ফুঁড়ে মাইরতে যেইছি, বেশ কইরছি। মারি নাই, সে তোমার ঠাকুরের দয়া৷ এখন যাবে, না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখ খারাপ কইরবে?’

অবধূতের গলা শোনা যায়, ‘অই, অই দেখ, মিছে বইলছি কি না। কথা শোনো একবার।’

যোগোর গলা, ‘হুঁ শুইনবে, আমার কথা শুইনবে। ক্যানে, আমাকে ব্যাশ্যা কুলটা বইলবে না আরও? বলো, বলো আবার, দ্যাখ ক্যানে কী করি।’

গোপীদাসের গলায় বাজে, ‘জয় গুরু, জয় গুরু! আহ; ছি ছি ছি! এমন কথা ভৈরবীকে বইলতে আছে? এইস, এইস গ অবধূতদাদা, রাগারাগি করো না, ঘরকে এইস। দুটো ফুটানো হোক, খেয়ে লিয়ে বস্যে দুটো সোখ দুঃখের কথা বলি।’

অবধূতের তেড়িয়া হাঁক, ‘নাঃ, আর না। উয়ার কাছে আর না। বাবার কাছে যদি ধম্মত ঠিক থাকি, তবে উয়ার জন্যে আমার সাধনভজন আটকে থাইকবে না।’

যোগো বলে, ‘অ মা গ, তাই কখনও হয়! এমন ভোলানাথের পায়ে আমার মতন কত ভৈরবী গড়াগড়ি যেইছে। আমার জন্যে কখনও তোমার সাধনভজন আটকায়?’

গোপীদাস সামাল দেয়, ‘চুপ করো গ যোগোদিদি, বাগের কথা ছাড়ো, এইস বেহ্মালন্দদাদা, ঘরে এইস।’

সেখানে জবাব সেই এক, ‘নাঃ, যাব নাই। তবে, তুমি যদি আমার কাছকে এইসে থাকো, ইখানে আর না। চলো, আমার সাথে চলো। তোমার সাথে কে আছে, উয়াকে ডেক্যা লিয়ে এইস।’

সর্বনাশ! ব্রহ্মানন্দ অবধূতের আতিথেয়তা! এখানে যদি একটু মনে মনে ভরসা পাচ্ছি, অবধূত দর্শন করে তার কিছুই পাই না। গোপীদাসের গলা শোনা যায়, ‘এস্যেছি তোমার ঘরে, যাব অন্য ঘরে, সেটা কি ভাল দেখায়? তুমি থাইকবে, যোগোদিদি থাইকবে, কত কথা হবে, তাতেই সোখ। আমার চিতেবাবাজির মনেও আনন্দ হব্যে। এইস, ঘরে এইস। ই দ্যাখ, চাল লিয়ে এইসেছি। ঠাকরুন এখনি চাপাবে।’

আবার সেই জবাব, ‘নাঃ, ইখানে লয়। চাল লিয়ে এলেকাটার ঘরকে চলো, সিখানেই রান্না হবে।’

যোগো যোগ করে দেয়, ‘সেথা রাঁইধবার লোকও আছে। যাও ক্যানে গোপীদাদা, তোমাদিগের অবধূতদাদার লতুন ভৈরবীর হাতে আজ একটুক পেসাদ পেইয়ে এইস। আমার হাতে তো অনেকবার হইয়েছে। ইবার লতুন হাতে হবে।’

গোপীদাসের গলা শোনা যায়, ‘আর লতুনের ঝোঁক নাই গ যোগোদিদি। যা পাই, তা পুরনো হাতে লিয়ে থুয়ে যেতে পাইরলে হয়। তা, আমি বলি অবধূতদাদা, সিখানে যদি কেউ থাকে, তাকে ডেক্যা লিয়ে এইস ক্যানে। না কী বলো গ ঠাকরুন।’

যোগো বলে, ‘সি তো পেখম দিন থেক্যা বইলছি গ। তাকে আমি নিজে বইলছি, এই আশ্রমে থাইকতে। থাইকবে কেমন কর‍্যে? সাধন ভজন হব্যে, চক্ষুলজ্জা নাই?’

অবধূতের গলা শোনা গেল, ‘চইললাম। তবে ই মাগিকে বইলে দিয়ো আমার আশ্রমে যেন কোনও অনাচার না হয়।’

যোগোর গলায় আবার ঝাঁজ বাজে, ‘আরে যা যা, অমন বেহ্মানন্দ বেহ্মচারি ঢের দেইখেছি।’

‘আচ্ছা, তোর বিষ দাঁত…।’

অবধূতের গলা মিলিয়ে যায়। যোগো ডাকে, ‘এইস গোপীদাদা, আর দেরি করা চলে না।’

বলতে বলতে সে ঘরে ঢোকে। আমার দিকে চেয়ে একবার হাসে। কিন্তু এ হাসি সে হাসি না। যোগো ভৈরবীর চোখের আগুন এখনও নেবেনি। মুখের রক্ত এখনও নামেনি। তবু যেন কোথায় একটা বিষাদের ছায়া লেগে গিয়েছে। মেঝে থেকে ত্রিশূল কুড়িয়ে বর্শাসহ এক কোণে রাখতে রাখতে বলে, ‘কী চিতেবাবাজি, আক্কেল একেবারে গুড়ুম হয়্যা গেলছে তো? এমনটি আর দেইখেছ কখনও?’

সে ঘরের মাঝখানে এসে আমার দিকে ফিরে তাকায়। আমিও তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। এখন যোগো ভৈরবীর চোখে চোখ রাখতে ভয় হয় না। এখন তার আরক্ত চোখের ভাব অন্যরকম। বলি, ‘না, দেখিনি।’

যোগো একটু হাসে। গায়ের আঁচল টেনে দেয়। এই মুহূর্তে সহসা যেন তাকে গৃহস্থ বধুর মতো মনে হয়। শ্মশানের যোগিনী নয়।

ইতিমধ্যে গোপীদাস এসে ঘরে ঢোকে। যোগো তাকে বলে, ‘লাও, তোমার চিতেবাবাজিকে একটু দ্যাখ গ গোপীদাদা। বেচারি অনেকক্ষণ ধইরে ভূত-পেতনীর লড়াই দেইখছে। একবার তো পালাবার জন্যে পা বাড়ালছিল, আমি ধর‍্যে রাইখছি।’

এ ব্যাপারে গোপীদাসের তেমন উৎসাহ কৌতূহল দেখা যায় না। সে নিচু হয়ে চালের পুঁটুলি আর তেলের শিশি রাখে। আমার কাছে যা অভাবিত বিচিত্র ঘটনা, তার কাছে হয়তো পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বলে, ‘বাবাজি পালাবার মানুষ না। ঘরের বাইরে যেইয়ে বইসতে চেয়েছিল হয়তো। এ মানুষ আমার চেনা হইয়েছে ঠাকরুন। এ মানুষ সব ঠাঁই, সবকিছুতে থাইকতে পারে।’

বড় ব্যাজ, বড় ব্যাজ। এ কথা থাকুক। আমি অন্য কথা বলতে যাই। তার আগেই যোগো বলে ওঠে, ‘বাব্বা! চিতেবাবাজিকে লিয়ে যে তোমার মন ভোর হইয়ে আছে গ?’

‘তা আছে, সিটি বইলব। হাজারবার বইলব। একবার রেখ্যা দেখ তো, এত কথা, এত ঘটনা, তবু কেমন মোহন মুত্তিটি লিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’

যোগো আবার তাও চেয়ে দেখে। কী বিশ্রী! আত্মধিক্কারই লাগে প্রায়। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা, ওই সাপটা কেন ওখানে?’

যোগো খাঁচার দিকে চেয়ে বলে, ‘উটি অবধূতের বাহন।’

বলেই সে তাড়াতাড়ি খাঁচাটার কাছে গিয়ে বসে। খাঁচার গায়ে হাত দেয়। মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়। খাঁচার গায়ে তার চুল এলিয়ে পড়ে। তারপরে যেন শিশুকে আদর করে বলে, ‘আহা আমার সোনা, আমার মাণিক, আজ ক’দিন ধর‍্যে কিছু খেতে দিতে লাইরছি, ঘরে বাগানে, দুটো ইঁদুরের কল পেত্যা রেখ্যাছি। তা মরণ, ইঁদুরগুলানও চালাক হয়্যা গেলছে। একটাতেও ঢোকে নাই। আহা, আহা!’…

অবাক হয়ে দেখি, প্রকাণ্ড সরীসৃপের গোটা মুখখানি, খাঁচার দুই ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে পুরো বেরোয় না। কিন্তু লকলকে সরু চেরা জিভ দিয়ে, যোগোর চুলে মুখে চেটে দেয়। তার যে-চোখটিকে দেখতে পাই, সেটিকে হঠাৎ সাপের চোখ বলে মনে হয় না। যেন, স্নেহার্থী আতুর অপলক নিবিড় কোনও চোখ। তবু আমার গাটা কেমন শিরশির করতে থাকে। শিরদাঁড়ার কাছে যেন একটা কাঁপুনি লাগে।

গোপীদাস আমার দিকে একবার চেয়ে হাসে। যোগোও আমার দিকে একবার চায়। তারপরে গোপীদাসকে বলে, ‘তবু শীতকাল বইলে রক্ষা, খিদেতেষ্টা তেমন নাই। গীসসিকালে বাছার আমার ভারী কষ্ট। তা মদনা ডোমকে বইলে রেইখেছিলাম। মাঝেমধ্যে ইঁদুর পাখি যা হক, দু-একটা ধর‍্যে দিয়ে-টিয়ে যায়। তিনদিন তার পাত্তাও নাই।’

গোপীদাস বলে, ‘তাকে তো আজ দেইখলাম ঘাটে। লাইছিল। তবে খুব রস খেইয়েছিল। উদিকে ঘাটেতে বউয়ের সাথেও এক পেস্ত হয়ে গেল্‌ছে।’

যোগো বলে, ‘অই, শ্মশানের সাধক বলো, ডোম বলো, সব এক গোত্তর। উয়াদের কোনও তফাত নাই।’

বলতে বলতে সে আবার অজগরের দিকে নজর দেয়। খাঁচার ফাঁকে হাত বাড়িয়ে মুণ্ডে বুলিয়ে বলে, ‘খাবার পেইলেই দেব বাবা, এখন একটু কুণ্ডলী হইয়ে থাকো। আমি উঠি।’

বলে সে উঠে চালের পুঁটুলি আর তেলের শিশি তুলে নেয়। তারপরে পিছনের দরজার দিকে, যেতে গিয়ে আমার দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কী বাবাজি, খুব ঘেন্না কইরছে?’

প্রশ্ন শুনে আমি চমকে উঠি। ঘেন্নার কথা তো একবারও মনে হয়নি। বরং অবাক হয়ে অজগর আদরের বিস্ময়কর ঘটনা দেখছিলাম! বলি, ‘না তো। কেন?’

যোগো বলে, ‘কইরতে তো পারে। সবার সব জিনিস তো ভাল লাগে না। তবে আমি হাত ধুইয়ে লিব, ভেব নাই।’

বলে সে আমাকে অবাক করে দিয়ে চলে যায়। আরও অবাক লাগে এই ভেবে, কথাটা একেবারে মিথ্যা বলেনি সে। আমার গায়ের মধ্যে যে শিরশিরানি লেগেছিল, তা যে কেবলই ভয়ের, তা বলতে পারি না। ঘৃণা না হোক, চিরসংস্কারে একটা গা পাক দেওয়া ভাব নিশ্চয়ই আছে। হয়তো খাবার সময় এ কথা আমার মনে হত।

গোপীদাস বলে, ‘বইস বাবাজি। ভাত ফুটবার এখনও দেরি আছে। ততক্ষণ একটুক গা পেইতে লাও।’

বলে যোগোর উদ্দেশে জিজ্ঞেস করে, ‘কই গা ঠাকরুন, সপ্তমী দেবে নাকি?’

‘অই মা, ভুইলে যেইছি গ।’

যোগো বাইরে থেকে ঘরে এসে ঘরের বেড়ায় গোঁজা একটা ছোট পুরিয়া এনে দেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘আর সব সামগ্গিরি আছে তো?’

‘হঁ হঁ, সব আছে।’

কিন্তু এই মুহূর্তে যোগোকে যেন আরও অন্যরকম মনে হয়। তার চোখ-মুখের আরক্ত ভাব গিয়েছে। তবে, তার চোখের বর্ণই হয়তো একটু রক্তাভ। কিন্তু তার মুখের ভাবে ইতিমধ্যেই কেমন একটা অন্যমনস্কতা এসে গিয়েছে। সেই সঙ্গে বিষাদের ছায়া। সে আবার পিছনের দাওয়ায় চলে যায়।

গোপীদাস গাঁজার সামগ্রী ঝোলা থেকে বের করে নিয়ে বসে। গাঁজা ডলতে ডলতে কী একটা গানের কলি যেন গুনগুন করে।

স্বর শুনি, কথা বুঝতে পারি না।

আমি বলি, ‘একটু বাগানে গিয়ে ঘুরব?’

‘হঁ, হঁ, ঘোরো ক্যানে বাবাজি, যেথাতে ইচ্ছা ঘোরো। কেউ কিছু বইলবে না।’

আমি পিছনের দরজা দিয়ে দাওয়ায় পা দিই। বাঁ দিকে দেখি, কাঠের উনোনে কয়েক খণ্ড কাঠে পিড়পিড়িয়ে আগুন জ্বলছে। তার ওপরে হাঁড়ি চড়ানো হয়ে গিয়েছে। কাছেই পা ছড়িয়ে বসেছে যোগো। তার ছড়ানো পায়ের ওপর কুলোর বুকে চাল। তার সেই রক্তাভ বক্ষের লজ্জা এখানে নিরিবিলি অবকাশে অনেকখানি খোলা। কিন্তু, তার চোখের কোণে যেন দুটি মুক্তো বসানো। আলোয় চিকচিক করে।

আমার পায়ের শব্দে সহসা মুখ তুলে আমাকে দেখেই ঝটিতি মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাশ ফিরে তাড়াতাড়ি চুলার কাঠ উসকে দিতে থাকে। আমিও একটু চমকে অস্বস্তি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাগানে নেমে যাই। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা বিষাদের ছায়া নেমে আসে। যোগো ভৈরবীর মুখখানি আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

অমন যার দাপট, অমন খোদাই করা দপদপে যার চেহারা, যার চোখের তারায় আগুন জ্বলে, বর্শা নিয়ে দুর্গা প্রতিমার মতো পুরুষের বুকের ওপর এলো চুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার চোখের কোণ দুটিও টলটল করে। আশ্চর্য, সংসারে বলল, সংসারের উপান্তে শ্মশানে বলল, গৃহিণী বলো, ভৈরবী বলো, সেই এক মন, এক প্রাণ, সবখানে রাজে। সবখানে বাজে। যত বিচিত্র হেরো, সেই এক সুর বাজে।

যোগোর চোখের কোণ কেন টলমল, জানি না। কিন্তু রণচণ্ডী সব না। তারপরেও সেই মূর্তি আছে। দারুণ আগুনের পর যেখানে পাত্রে পাত্রে জল ঝরে। যেখানে বেদনা বাজে শান্তির মতো। বাজে গভীরে নিঃশব্দে, যেন সকল কল্যাণের প্রার্থনায়। অপরের না শুধু, নিজেরও।

হঠাৎ শুনতে পাই, ‘অই চিতেবাবাজি, বেড়াল্ছ তো ভাল কইরছ, আমাকে দুটো শুকনো কাঠ কুড়িয়ে দেবে গ?’

যোগোর গলা শুনে ফিরে দেখি সে আমার দিকে চেয়ে হাসছে। মুখে এখন তার একটি স্নিগ্ধ আলো। বলি, ‘হ্যাঁ, দেব।’

‘তবে দাও। কিন্তুক ভেজা কাঠ না, আমার চখ যেন না জ্বলে।’

বলে আবার হাসে।

.

৭৩.

ব্রহ্মানন্দ অবধূতাশ্রমের কঞ্চির বেড়ার সীমায় কোথায় শুকনো কাঠ জানি না। কিন্তু যোগো ভৈরবীর কথা কানে লেগে থাকে। ভেজা কাঠ যেন তাকে না দিই। তার চোখ যেন না জ্বলে। একটু আগে তার চোখের কোণে টলটলানো মুক্তোর ফোঁটা দেখেছি। কেন, চোখ চোঁয়ানো সেই মুক্তাবিন্দু কি ভেজা কাঠের ধোঁয়ার জ্বালায়?

হয়তো সেইটুকু তার সান্ত্বনা। বলতে চায়, যোগোর চোখে যা দেখেছ তা প্রাণ চোঁয়ানো না। নিতান্ত ধোঁয়ার জ্বালা। বেশ তো, তাই হে, তাই। তাতে যদি মান বাঁচে, বাঁচুক। তার চেয়ে বাঁচোয়া, যদি প্রাণের ধোঁয়া একটু যায়।

কিন্তু কাঠ কোথায়? বাগানের চারপাশে সব তো সাফসুরত্ পরিষ্কার। শুকনো কাঠপাতার ভাজও নেই। একবার এদিকে যাই, আবার ওদিকে। তখন ভৈরবীর গলা আবার শোনা যায়, ‘অ মা, কুথা যেইয়ে খুঁইজছ? কাঠ কি সবখানে ছড়ান ছিটান রইয়েছে নাকি? ই কি তোমার বনজঙ্গলে কাঠ কুড়নো?’

তবে? জিজ্ঞেস না করে তার দিকে চেয়ে দাঁড়াই। সে আমার দিকে চেয়ে এক প্রস্ত হেসে কাঁপে। তারপর লাউমাচার কাছে এক জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘উই দ্যাখ ক্যানে, কাঠকুটো ডাঁই করা রইয়েছে উখানে। তোমাকে কি আমি ঘুর‍্যা ঘুর‍্যা কুড়তে বইলছি? উখান থেক্যা কিছু শুকনো কাঠ লিয়ে এইস।’

তা বটে। কিন্তু আগে কুড়িয়ে দেবার কথা হয়েছিল। তুলে দেবার না। তাইতেই প্রমাদ। লাউমাচার কাছে গিয়ে কাঠের স্তূপে হাত দিই। টান দেবার আগেই ছপ করে কী যেন একটা হাতের কাছে এসে পড়ে। পড়েই হাতের ওপর দিয়ে ডিঙিয়ে মাটিতে পড়ে কিলবিলিয়ে চলে যায়। আমিও চমকে উঠে হাতের ঝটকা দিয়ে একটু সরে আসি। গাটা শিরশিরিয়ে ওঠে।

ভৈরবী দাওয়া থেকে উদ্বেগে বেজে ওঠে, ‘কী গা বাবাজি, কী?’

আমি বলি, ‘টিকটিকি।’

‘টিকটিক—।’

পুরো উচ্চারণ করতে পারে না। তার আগেই ভৈরবীর মুখে আঁচল চাপা পড়ে। শরীর কেঁপে ওঠে। ঘর থেকে গোপীদাসের মোটা গলা শোনা যায়, ‘কী হল গ৷’

যোগো বলে, ‘দ্যাখ এইসে ক্যানে, তোমার চিতেবাবাজির কী দোগ্‌গতি।’

ঘরের ভিতর থেকে ঝিমঝিমনো মোটা গলায় উদ্বেগ ফোটে, ‘কী দোগ্‌গতি গ ঠাকরুন?’

যোগোর দৃষ্টি আমার দিকেই। তার রক্তিম চোখে হাসির ঝিলিক। বলে, ‘তুমি এখন দম দিয়ে বইসে আছ, দেইখবে কেমন কইরে। টিকটিকি গ টিকটিকি।’

‘টিকটিকি?’

‘হঁ। বাবাজির হাতে পইড়ছে।’

‘অই।’

গোপীদাসের গলায় স্বস্তির সুর বাজে। বলে, ‘তাই বলো ক্যানে। তা আচমকা পইড়লে একটুক চমক লাইগবে। কি তোমার বনের চিতার গায়ে পইড়লেও লাগে।’

গোপীদাসের গলা এত ঝিমনো আর অস্পষ্ট, সব কথা বোঝা যায় না প্রায়। শুধু গাঁজা তো না। প্রেমের গাঁজা। তায় আবার সন্ন্যাসীর সপ্তমী। একটু ঘোর লাগবে বই কী। আমি ততক্ষণ থেমে নেই। শুকনো কাঠের পাঁজা হাতে তুলে নিই।

যোগো জিজ্ঞেস করে, ‘কোন হাতে পইড়ল হে বাবাজি? ডাঁয়ে, না বাঁয়ে?’

তার মতো করেই জবাব দিই, ‘ডাঁয়ে।’

‘যাক, তবু ভাল।’

‘আর বাঁয়ে পড়লে?’

‘বিটিছেল্যাদিগের ভাল।’

অর্থাৎ মেয়েদের। জীব টিকটিকি। তার ডাইনে বাঁয়ে পড়াপড়িতেও ভাল-মন্দ। শুকনো কাঠের পাঁজা এনে যোগোর সামনে রাখতে রাখতে বলি, ‘কী ভাল?’

‘তা জানি নাই। অই শুইনেছি, সবাই ভাল বলে, তা-ই বলি।’

কিছু না ভেবেই বলি, ‘কেন, আপনি তো ভৈরবী, আপনি জানেন না?’

যোগো হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে এমন করে তাকায়, আমার অবাক লাগে। একটু বিব্রতও হই। তার সেই বড় বড় দপদপে চোখের দৃষ্টি যেন আরও ধারালো, তীব্র হয়ে ওঠে। কেমন একটি সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসার তির হানে। আমার মনে অপরাধের ছায়া ঘিরে আসে। অন্যায় কিছু বললাম নাকি?’

যোগো আবার হঠাৎই চোখ ফিরিয়ে নেয়। দেয়ালের কাছে পাট করা পুরনো শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া চটের আসন একটা খুলে পেতে দেয় তার কাছাকাছি। না তাকিয়ে বলে, ‘বইস।’

বলে কুলো কাত করে হাঁড়ির মধ্যে চাল ঢেলে দেয়। হাঁড়ির মুখে ঢাকনা ঢেকে উনোনের মধ্যে কাঠ দিয়ে আগুন খুঁচিয়ে উসকে দেয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে ফিরে বলে, ‘কী হল্য, বইসলে না?’

বসব বটে, মন যে খাড়া। কোথায় যেন একটু বেসুর বেজেছে মনে হয়। কিন্তু কোথায় কেমন করে তা জানি না। যোগোর কাছাকাছি আসনে বসতে বসতে বলি, ‘এই যে বসি।’

কিন্তু যোগো বিন্দু না। একটু যেন ভয়ে ভয়েই বসি। না জেনে যদি কোনও অপরাধ করে থাকি, এখুনি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে রাজি। তা-ই জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি রাগ করেছেন আমার ওপর?’

‘কইরেছি।’

সহজ কথা, সোজা জবান। কিন্তু যোগোর মুখে তার কোনও ছাপ নেই। এমনকী একটু আগের ধারালো তীক্ষ্ণতা, সন্দেহ, কিছুই নেই। বরং তার রক্তিম চোখের ফাঁদে কেমন একটা টানা স্রোতের ঝিকিমিকি। তাতে নানা ছায়া খেলা করে। বলে, ‘ভৈরবী হল্যে বুঝি সব জাইনতে হয়?’

এই কথা! তার জন্যে রাগ কেন? মন্দ ভেবে কিছু বলিনি। যোগো অবধূতানীকে ঠাট্টাও করিনি। এই কেমন একটা ধারণা, শ্মশানবাসিনী ভৈরবী, টিকটিকির ডাইনে-বাঁয়ের বৃত্তান্ত তার জানা আছে বা। যে কথা অন্য জানে না, ভৈরবী তা জানে। সে যে ভৈরবী। তার জগৎ ভিন্ন, যোগ আলাদা। সে জানে অনেক কিছু। এই ধারণা থেকে বলেছি। তাড়াতাড়ি বলি, ‘আমি কিন্তু অন্য কিছু ভেবে বলিনি, বিশ্বাস করুন। আমি ভাবলাম, আপনি ভৈরবী, একজন সাধারণ মেয়ে তো নন। আপনি নিশ্চয় জানেন।’

যোগোর ঠোঁটের কোণে যেন একটু চিকুর হানা হাসি খেলে। তার সারা চোখে মুখেই এমন একটা রক্তাভ জ্বলজ্বলে ভাব আছে, হাসির ধারে তা যেন আরও তীব্র দেখায়। বলে, ‘তা-ই বুঝি? তা, অই কী বলে ছাই, অসাধারণ কুথা দেইখলে গ?’

বলতে বলতে তার শরীরে কেমন একটা দোলা লেগে যায়। ঘাড় কাত হয়ে পড়ে, চোখ দুটি আধবোজা ভাব করে, দৃষ্টিতে আবেশ ফোটায়। তার কাঠ-খোদাই শরীরে যেন কেমন আগুনের খেলা। পুষ্ট, শক্ত, উদ্ধত উজ্জ্বল। লালপাড় গেরুয়া শাড়ির ঢাকায় অঙ্গার যেমন জ্বলজ্বল করে। চোখ রাখা যায় না। তবু সাপের মতো রুদ্রাক্ষের মালা দোলানো বারে বারে চোখ টানে। রক্তাভ স্ফীত দুই স্তনান্তরের মাঝখানে যেন জগজ্জনের অন্ধকারকে দারুণ দীপ্তিতে হানে।

আমি বলি, ‘সংসারে যাদের দেখি, তাদের সঙ্গে আপনাদের মেলাতে পারি না। মনে হয় অনেক তফাত।’

‘ক্যানে গ?’

বলে গায়ের আঁচল তুলে রুদ্রাক্ষের মালা টেনে দেখিয়ে বলে, ‘ইয়ার জন্যে?’

এমন করে দেখায়, যেন এখুনি সব টেনে খুলে ফেলে দেবে। বলি, ‘না, এজন্যে নয়। কেবল বসনভূষণ কেন, সবই।’

‘অই, শ্মশানে মশানে থাকি, তা-ই?’

শুধু তাই-ই বা কেন। বসনভূষণ বাসস্থান ছাড়াও জীবনযাপন আচার-আচরণ আছে। তার চেয়ে বড় কথা, অবধূতের ভৈরবী। সে কি কখনও সংসারের আর দশ নারীর মতো হতে পারে? যার জীবনে সব কিছুর মূলে সাধনভজন সার। যে কারণে সংসারের বাইরে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে এ মহাশ্মশানে। ঘরে যাদের নরমুণ্ডের কঙ্কালের শোভা, ত্রিশূল গাঁথা, খাঁচায় অজগর। আমি বলি, ‘আপনি ভৈরবী, সাধিকা।’

‘থাক, উ কথা বল্যো না।’

আমার কথার ওপরেই ঠেক দেয় সে। তারপরে হঠাৎ আঁচল গুছিয়ে ঘোমটা টেনে বসে, আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘দেখ তো, তা-ই কি আমাকে মনে হয়?’

দেখতে দেখতে যেন যোগোর ধার, ধারালো তীব্রতা ঢাকা পড়ে যায়। যেমন ভাদ্রের বিশাল বেলার দারুণ রৌদ্রের সহসা ছায়া পড়ে, সকলই কেমন গভীর গম্ভীর বিষণ্ণ লাগে, যোগোকে তেমনি দেখায়। এমনকী, তার রক্তিম চোখেও ছায়ার নিবিড়তা। জলের রং যেমন হোক, আকাশের ছায়ায় বদলায়, তেমনি। তার গলার স্বরেও যেন দূর গভীরের সুর বাজে। তবু একটুখানি হাসি তার মুখে, তাতে ছায়ার প্রসন্নতা। বলে, ‘তফাত কুথা দেইখলে বাবাজি? সম্সারে মা বইন বিটি ঝি থেক্যা আলাদা কী দেইখছ বলো। একজনের ঘর করি, সম্সার করি, তার মতো থাকি। আর তো কিছু জানি নাই।’

বলতে বলতে যোগোর চোখের রং বদলায়। লাল কুসুমের দুটি ডাগর পাতা যেন হিমে ভেজা। আরও বলে, ‘সে যিখানে লিয়ে যাবে, সিখানেই যাব। যেমন রাইখবে, তেমন থাইকব। সে যেদিন ভৈরবী হতে বলে তো ভৈরবী। যোগিনী কর‍্যা রাখে তো যোগিনী। আর তো কিছু জানি নাই ভাই বাবাজি।’

বিন্দু বিন্দু হিম বড় ফোঁটায় টলে। আর আমার কানে যে কথাগুলো বাজে, তা আসে যেন সংসারের মাঝখান থেকে, সেই পুরাতন দিনের সুরে। এক নিয়ে থাকি, এক মনে, এক বেশে। তার বেশি আর কিছু না। শুনতে শুনতে আমার কথা ফুরিয়ে যায়। আমার বুকে কীসের উত্তাপে বাষ্পের সঞ্চার হয়। একটা ব্যথা ধরে যায়। তবু বিস্ময়ের ঝলকে অপার কৌতূহলে চেয়ে থাকি। কথা বলতে পারি না। সংসারে শ্মশানে যেখানে মেশামেশি, যোগো যেন সেইখানে নিয়ে যায়। যেখানে স্থান-কালের সীমা নেই।

সংসারে যে আছে, শ্মশানেও সে-ই। কৈলাসে শ্মশানে এক মন, এক প্রাণেরই লীলা। যোগো আবার বলে, ‘তাও দ্যাখ ক্যানে, সম্সারে ঝগড়া বিবাদ মারামারি। হেঁথাতেও তা-ই। লোকে বলে, “মাগ-ভাতারের বিবাদ, পাড়ায় যেন ডাকাত পইড়েছে।” ইও তো তা-ই। ঘরে দব্য থাইকলে ফোটাই, রাঁধি বাড়ি, দিই খাই। আর তো কিছু জানি নাই। ইয়াতে যদিন তফাত বলো তো বলো৷ ই যদিন সাধন-ভজন হয়, তা হল্যে সাধন-ভজন। আর তো কিছু জানি নাই।’

আর কিছু জানে না যোগো। যোগো ভৈরবী, ব্রহ্মানন্দ অবধূতের শ্মশান-সাধিকা। চোখ তার জলে ভরে যায়। গলায় দোলে রুদ্রাক্ষের মালা। কিন্তু সে আর তো কিছু জানে না। পরমের পিছে পিছে মরম চলে। রাঁধে বাড়ে খায়, ঝগড়া বিবাদ করে। হয়তো কাঁদালে কাঁদে, হাসালে হাসে। সুখ দুঃখ নিয়ে ফেরে একের পিছে পিছে। মরম ফেরে পরমের পিছে পিছে। একে যদি তুমি সাধন-ভজন বলো তবে তাই।

শিলা যেমন জলে ভাসে, তেমনি। কাষ্ঠের সঙ্গে পিরিতি করে লোহাও যেমন জলে ভাসে, সেইরূপ। সমর্পণে নিবেদনে প্রেম বাজে, যোগোর কথায় সেই বাণী শুনি। সেই তার সাধন।

এ কী সংসারের বাইরের কথা? অন্তরে বাহিরে সীমান্তে সেই এক কথা। কিন্তু ভৈরবীর মুখে না শুনলে বুঝতে পারতাম না। এ রূপে, সে রূপে, নানা রূপের ধন্দ। অরূপের সীমা নেই, এক সুরে বাজে। তখন কথা ফুরায়। তখন বুঝহ মনে, যে জানো রসের সন্ধান।

যোগোর দিকে চেয়ে আমার মনের একদিকে যখন টলটলিয়ে ওঠে, আর একদিকে তখন খুশির ঝোরা ঝরে। তারপরে সহসা চিড় খাওয়া মেঘের ফাঁকে যোগাকে দেখি আর এক রূপে। এত কথা যোগো এই নতুন চেনা লোকটিকে এমনি বলেনি। চোখের জল অকারণে গলেনি। ব্রহ্মানন্দ অবধূত শেল হেনেছে ভৈরবীর বুকে। সেই শেল আছে, এলেকাটার ঘরে।

সংসার, সংসার এই! শ্মশানে মশানে তীর্থে, নগরে বন্দরে গ্রামে, সেই এক খেলাখেলি। বৃন্দাবনে গোকুলে সেই নায়ক-নায়িকা লীলা। যোগো আজ বেজেছে বড় বেদনায়। সাধিকার কোথাও লাগেনি, যোগিনী ভৈরবীর কোথাও বাজেনি। বেজেছে সেই এক মানবীর প্রাণে।

যোগোর মতো নারীও আমার চোখের দিকে চেয়ে সহসা লজ্জা পায়। চোখে জল নিয়েই একটু হেসে, তাড়াতাড়ি মুখ ফেরায়। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে উনোনের কাঠ ঠেলে আগুন উসকে দেয়। এখন নিশ্চয়ই ভেজা কাঠের ধোঁয়ার জ্বালা না। জল লেগেছে, প্রাণের আগুনেই।

কিছুই বলতে হয় না, জিজ্ঞেস করতে হয় না। চোখে চোখ পড়ে, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিতেই যেন সকল জানাজানি হয়ে যায়। অবিশ্বাসী কপট ভৈরব, ভৈরবীকে কাঁদিয়েছে।

ওদিকে ঘরের মধ্যে কোনও সাড়াশব্দ নেই। যোগো আমার দিকে আবার বলে, ‘কী, কথা বইলছ না যে বাবাজি।’

বলি, ‘আপনার কথাগুলোই ভাবছি।’

হঠাৎ যেন হাত তুলে মারতে আসে যোগো। কথার মাঝখানেই বলে , ‘অই, তুমি আর আমাকে আপুনি আজ্ঞা কর‍্যো না হে, শুইনতে পারি না।’

তা-ই ভাল। ভাবলাম, না জানি আবার কী অপরাধ করেছি। বলি, ‘সে হবে। নতুন তো।’

অমনি যোগোর চোখে দপদপানি। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘তা আর জানি নাই। লতুন বেলা তোমাদিগের জোড় হাত। পুরনো কইরতেই বা কতক্ষণ লাগে।’

বলে, দীপ্ত কোপে হানে। তা বটে। নায়ক পুরুষদের লক্ষণ সেরকম বটে। বৃন্দাবনে লীলা করে মথুরাতে চলে যায়। নতুন বেলায় মান ভঞ্জন, নৌকাবিলাস। পুরনো হলেই বিশ্বের দরবারে।

একটু ভয়ে ভয়ে দ্বিধায় জিজ্ঞেস করি, ‘উনি কি আর সত্যি আসবেন না?’

যোগো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’

‘মানে—আমি অবধূত মশাইয়ের কথা বলছি।’

সঙ্গে সঙ্গে যোগোর ঠোঁট দু’খানি ধনুকের মতো বেঁকে যায়। চোখেও সেই পরিমাণ বিদ্রূপ হানা। যেন আমাকেই প্রায় হানে। যেন আমাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘কুথা যাব্যে?’

‘অ্যাঁ?’

‘কুথা যাব্যে, জিগেঁস করি?’

আমিই ঢোক গিলে বলি, ‘তা তো জানি না।’

‘হুঁহ্‌, মরণ! তোমাদিগের বেহ্মালন্দই কি জানে নাকি?’

বলে ঘাড়ে ঝটকা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। হাঁড়ির ঢাকনা খুলে, বগবগানো হাঁড়িতে হাতা দিয়ে ভাত তুলে দেখে। ঘটি থেকে একটু জল ঢেলে দিয়ে ফিরে বলে, ‘অমন কতই দেইখলাম। বেড়ালের আড়াই পা জানো তো?’

‘শুনেছি।’

‘অই সিরকম। ছোঁকছোঁকানি থাইকলে মাঝে মাঝে অইরকম মরণ ধরে। ই বেলাটা পার হল্যে বাঁচি। অবধূতের আমার হয়্যা গেছে।’

সেটা খানিকটা আন্দাজেই অনুমিত। মহাশয়ের অবধূতীয় তেজ তখনই যেন কেমন নিবু নিবু হয়ে এসেছিল। তবে সেটা নিতান্ত প্রাণের ভয়ে। কেন না বুকে বর্শা বিঁধিয়ে প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলার উদ্বেগ সেটা। কিন্তু যেভাবে শাসিয়ে গেলেন তাতে তো মনে হল, এ-মুখো আর কোনওদিন হবেন না। অবিশ্যি তাঁর আশ্রমে অনাচার হচ্ছে কিনা তা দেখতে আসতে পারেন।

ভৈরবী আবার বলে, ‘অমন কতবার কত জনাকে সাধন-ভজন শেখাতে গেল, কিন্তুন মরতে সি যোগমতীর কাছকে। তা লইলে ওয়াঁর আদত মরণ হয় না।’

এ মরণ কী, তার আবার আদত বে-আদত কী, তা জানি না। কিন্তু যোগোর কথা শুনে আমার মনের ভিতরটা কুলকুলিয়ে ওঠে। এসব বাক্যি নেহাত বাক্যি না। প্রাণের জোর না থাকলে বলা যায় না। এবার ভাবো হে ব্ৰহ্মানন্দ অবধূত, সেদিন তোমার কেমন।

ভৈরবী জিজ্ঞেস করে, ‘বুকে জাম হয় জানো তো?’

‘জাম?’

‘হ গ, জাম, সদ্দি কাশির জাম লাগে না? তখন পুরনো ঘিয়ের মালিশ লাগে। জাম লাগুক, তখন আইসবে। যখন আইসবে তখন আমিও দেইখব। এই সারাটো জেবন ধইরে দেখ্যা এলাম। উ মিনসেকে আমি চিনি না?’

মিনসে! ব্রহ্মানন্দ অবধূত মিনসে? এ যে কেবল সংসারের কথা না। সংসারের জমজমাট চাকের বচন! তার ওপরে আমিও যেমন উদোমাদা মানুষ। ফস করে জিজ্ঞেস করে বসি, ‘আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতকাল?’

‘কী বইললে? বিয়ে?’

‘হ্যাঁ, মানে—।’

‘মরণ!

বলেই হাঁড়িতে হাতা ডোবায়। ভাত দেখে হাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখে ঠক ঠক ঝাড়ে। ঘটি কাত করে, হাতে জল দিয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে বলে, ‘বিয়ে কুথা দেইখলে হে?’

তাও তো বটে, সাধন-ভজনে আবার বিয়ে কীসের। একি সমাজ-সংসারের বিষয় নাকি যে, সাতপাকে বেঁধে স্বামীর ঘর করবে। তবু একটা কিছু নিশ্চয় আছে। নইলে আর দু’জনের দেখাসাক্ষাৎই বা হল কেমন করে। পরিচয়ই বা কীভাবে। কিন্তু যোগোমতীর দিকে চেয়ে সে কথা জিজ্ঞেস করতে ভরসা পাই না। তার চোখমুখ তো আবার সেই অসুরসংহারিণী। তাতে আবার একটু সন্দেহের ছোঁয়া। তাড়াতাড়ি বলে, ‘না, মানে জানি না তো।’

আমার কথা শুনে মুখ দেখে সন্দেহটা বোধ হয় ঘোচে। বলে, ‘মিনসে বিয়ে আর মাইনল কুথাক। আমি হলাম তাঁতিদের বউ, আর উ হল্যা বামুন।’

লাও, শোনো এবার কথা! কথা কোন দিকেতে বহে। প্রায় হাঁ করেই চেয়ে থাকি যোগোমতীর দিকে। ব্রাহ্মণ অবধূত, তার ভৈরবী তাঁতিদের বউ। কী দিয়ে কী মেলাবে, এখন বসে বসে ভাবো। কেবল গলা দিয়ে শব্দ করি, ‘অ।’

যোগোমতী বলে, ‘তব্‌বে? আমাকেও ঘর কইরতে দিলে না, নিজেও ভরাভত্তি সম্সার ফেল্যে, শ্মশানে এল্য সাধন কইরতে।’

অবাক হয়ে উচ্চারণ করি, ‘ভরাভরতি সংসার মানে?’

‘ইয়ার আবার মানে কী। ঘরেতে বামনি রইয়েছে, বিটাবিটি রইয়েছে। ক্ষেতখামার চাষবাস পুজো যজমান সবই রইয়েছে। সব ফেল্যে ছড়্যে আমাকে মহাপাতকে ডুবিয়ে লিয়ে চল্যে এল্য।’

‘নিয়ে চলে এল!’

‘ত কী বইলছ, আমি নিজে চল্যে এইসেছি?’

সর্বনাশ, কথা উলটো পালে যায়। তাড়াতাড়ি বলে, ‘না না, তা বলছি না। অবধূতের কথা বলছি, এভাবে হঠাৎ একেবারে নিয়ে চলে এল।’

‘তা মরণ ধইরলে অইরকম হয়।’

বলে ভৈরবী উনোন থেকে হাঁড়ি নামায়। ফ্যানের মালসায় অত বড় হাঁড়িটা উপুড় করে অনায়াসে ঠেকো দিয়ে রেখে ছেড়ে দেয়। আবার হাত ধোয়। দাওয়ার কোণ থেকে হাত বাড়িয়ে ধোয়া কড়াই নিয়ে আঁচল দিয়ে মুছে উনোনে চাপায়। তাতে জল ঢেলে দেয় অনেকখানি। আমি তখনও সেই মরণের রূপের কথা ভাবছি। বারেবারেই যে মরণ ধরার কথা শুনি, সেই মরণের সংজ্ঞা কী, কে জানে!

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ভৈরবী একবার আমার দিকে চায়। আবার মুখ নামিয়ে ঠোঁট টিপে ডালের কুন্‌কে তুলে কয়েক মুহূর্ত নাড়াচাড়া করে। তারপরে হঠাৎ বাগানের দিকে চেয়ে বলে, ‘তবে খালি তো উয়ার মরণ ধরে নাই, আমারও ধইরেছিল। তা লইলে কী আর আসি?’

সেটা একটা কথা। একা ব্রহ্মানন্দর না, যোগোমতীরও মরণ ধরেছিল। যোগোমতী ঘাড় ফিরিয়ে ভুরু বাঁকিয়ে যেন কৈফিয়তের মতো করে বলে, ‘তা কী বলো, তখন চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়স, উদিকে বামুনের নজর সরে না। এখন দেইখছ ইরকম, তখন অবধূতের অন্য মুত্‌ত্তি। এখন তো পুড়্যে গেল্‌লে, পোড়া কাঠ মুত্‌ত্তি হইয়েছে। তখন সোন্দর চেহারা, গোরা রং, মিছা বইলব না, হঁ, মনে হত কন্দপ্পকান্তি। আর যেমন-তেমন ঘর তো লয় যে, খালি অগ্‌গদানীদের মতন ছেরাদ্দের পিণ্ডি খেয়ে বেড়াল্‌ছে। বাঁকড়োর নাম-করা শাক্ত বংশ। ঘরে ধূমাবতীর নিত্যি পূজা, ধূমাবতী উয়াদের ঘরের দেবী। পালা-পাবোনের কথা বাদ দাও, সে ভারী ধুমধাম ব্যাপার। তা হল্যেই বুঝ ক্যানে, ঘোষাল ঠাকুর কেমন মানুষ। অই তোমার বেহ্মালন্দর কথা বইলছি গ, ঘোষাল বামুন তো। শিবঠাকুরের ছোট বিটার নামে নাম, ময়ূর যার বাহন, নামটো আর মুখে লিতে পাইরব নাই বাপু, বুইঝলে তো?’

তা বুঝি, তবু জিজ্ঞেস করি, ‘কার্তিক ঘোষাল তো?’

‘হঁ হঁ, অই অই।’

অর্থাৎ ব্রহ্মানন্দ অবধূতের গৃহস্থ নাম শ্রীযুক্ত কার্তিক ঘোষাল। কিন্তু নিজেরও মরণ ধরার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে প্রথমে যেমন যোগো ভৈরবীর গলায় ক্ষোভ খেদ বেজে ছিল, এখন আর তেমন বাজে না। এখন যেন বাঁকুড়ার কোন এক গ্রামের তাঁতি বউয়ের গলায় কোনও এক শাক্ত পরিবার ঘোষালদের রমরমা বার্তা শুনি।

যোগোমতী কড়াইয়ের জলে কুন্‌কের ডাল ঢেলে দিয়ে খুন্তি দিয়ে একবার নেড়ে দেয়। আবার আমার দিকে ফিরে বসে। এ মুখ আর সে মুখ নেই। মুখ এক পনেরো বছরের তাঁতি বউয়ের। যে মুখে অন্য এক জীবনের বিস্ময় কৌতূহল, ভয়তরাসের নানা রং। যেমন জলের বুকে আলোছায়ার নানা ঝিকিমিকি। ঘাড় কাত করে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বলে, ‘তা বলো, পাড়ায় যার ছায়া দেইখলে বুক ধড়াইস্যে মরি, সে যদিন দিনরাত যোগো, যোগো করে, তা হল্যে ঠিক থাকা যায় কেমন কর‍্যা, আঁ? অ্যাই লম্বা খাঁড়ার মতন ঝকঝকে মুত্‌ত্তি, কপালে সিঁদুর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গলাতে রুদ্দাক্ষর, হাতের তাগাও তাই। গলাখানিও তেমনি মিঠে, মায়ের নাম লিয়ে গান ধইরলে মনে হয়, ঘোষাল ঠাকুর সাক্ষাৎ মায়ের বিটা। ক্যানে কী জানি, আমার তাই মনে হত।’…

বলতে বলতে যোগোমতী মুখ নিচু করে। নিজেরই পায়ের পাতায় আঙুল ঘষে। বেশ কয়েকদিন আগের আলতার আবছা দাগ এখনও তার নিটোল পায়ে রয়েছে। হয়তো সেই ঘোষাল ঠাকুরের গানের সুর তার কানে বাজে। সে কী করবে বলো। তার যে মনে হত ঘোষাল যেন সাক্ষাৎ মায়ের ছেলে। সে কী করবে বলো। যার ছায়া দেখলে বুক ধড়াসে যায়, সে যদি বারে বারে নাম ধরে ডাকে, তবে কেমন করে ঠিক থাকা যায়। বাঁশি লাজ মানে না। বড় নিষ্ঠুর, প্রাণও মানে না। সে নাম ধরে বেজে যায়। যার নাম ধরে বাজে, সে যে লাজে মরে। প্রাণেও মরে।

তবু যোগোমতীর দিকে চেয়ে আমি রুদ্ধবাক। কী এক আশ্চর্য কথা যেন শুনি, এমনি অবাক হয়ে কীসের একটা ঘোরে যেন ডুবে থাকি।

যোগোমতী বাগানের দিকে মুখ তুলে চায়। দৃষ্টি তার বহু দূরে, দূর কালে, বাঁকুড়ার এক গ্রামে। গলাও যেন তেমনি দূর থেকে আসে, ‘অই, কী বইলব গ, ঠাকুর কী দেইখল আমার মধ্যে, যিখানে যাই সে আমার সামনে। ঘাটকে যাই, ঘাটকে। ঘরকে যাই, ঘরকে। তা’পরেতে একদিন বলে কী, “অই যোগো, তোকে আমি পূজা কইরব গ!” অই মা, কী পাপ গ, আমাকে পূজা কইরবে কী গ! এমন কথা কি বইলতে আছে! “বইলতে নাই ক্যানে গ, ধূমাবতীর আদেশ হইয়েছে যে। তুই যে ধূমাবতীর অংশ!” আঃ হায় হায় গ, আমার গায়ে কাঁটা, মুচ্ছো যাই শুনে। বলে কী ঘোষাল ঠাকুর!… আমাদিগের ঘরকে ঠাকুর যেইলে, সব্বাই এইসে পায়ে হুমড়ি খেয়্যা পড়ে। মায়ের নাম লিয়ে থাকে, ঠাকুরের কত পাগলামি, কেউ কিছু মনে কইরত নাই। যখন তখন আইসত। বস্যে বস্যে গান গাইত, শাশুড়ি ননদ বস্যা বস্যা শুইনত। আমিও শুইনতাম। আবার সবার সামনেই আমাকে বইলত, “ইয়ার মধ্যে দেবীর অংশ আছে। ইয়াকে সাবধানে রেখ্য গ তাঁতি দিদি।” আমার শাশুড়িকে দিদি বইলত। তা’পরেতে একদিন—।’

হঠাৎ থামে যোগোমতী। সে যেন কেঁপে ওঠে। চোখ বুজে চুপ করে থাকে। আমি অবাক হয়ে এই মূর্তির দিকে চেয়ে থাকি। একদিন কী হয়েছিল? কী ঘটেছিল? যোহোর কাঁপুনি যেন আমার গায়েও লাগে। সে ফিসফিস করে বলে, ‘গাঁয়ের উত্তর পাড়ায় মোচ্ছব হচ্ছিল। সিখানে গেল্‌ছিল শাশুড়ি ননদ। সোয়ামী তো ঘরকে থাইকবার মানুষ ছিল নাই। সাঁঝবেলাতে বাতি দেখিয়ে মাত্তর উঠান থেক্যা ঘরকে যেইছি, শুনইতে পেল্যেম ঘোষাল ঠাকুর গান কইরতে কইরতে আইসছে। ঠাকুর এল্য, একেবারে ঘরের ভিতর এল্য। এইসেই উপুড় হয়্যা পড়্যা আমার পায়ে হাত। দু’ হাতে পা চেপ্যা ধর‍্যা কেঁদ্যে বইললে, “অই গ যোগো, যোগোমতী, যোগমায়া তুই। মহামায়া তুই। আমাকে উদ্ধার কর গ। তুই আমার পূজা না লিলে আমার সব বেরথা। ধূমাবতীর আদেশ হইয়েছে, আমি তোকে ছাড়ব নাই”।’

বলতে বলতেও যোগো যেন কাঁদতে থাকে। তার চোখ মুখে ভয়-তরাসের ছাপ। দৃষ্টি তার দূরে। যেন সাঁঝবেলাতে ঘরে ঢুকে ঘোষালের সেই পায়ে ধরা দেখছে। একটু থেমে আবার বলে, ‘সিই আমি পেখম কথা বইললাম ঠাকুরের সাথে, “এমন করবেন নাই গ, পা ছাড়েন। আমার যে পাপ লাইগছে। আমার ভয় লাইগছে। ছাড়েন, পা ছাড়েন।” না, ছাইড়বে না। বলে, “ছাইড়ব না মা, তোমার পা ছাইড়ব না, ই পায়ে পইড়ে থাইকব।” তা বইললে কী হয়। কেউ দেইখলে কী বইলবে। ঘরে রাইখবে ক্যানে আমাকে। ঠাকুর বইললে, “দরকার নাই। চল ক্যানে, দু’জনায় চল্যে যাই। সিখানে যেইয়ে তোমার পূজা কইরব।” কিন্তুক কথা কি বইলতে পারি। আমার শরীলে তখন যেন কী হলছিল গ। আমি বইসে পইড়লাম। ঠাকুরের পা ধইরলাম। মিছা বইললে আমার পাপ লাইগবে, ঠাকুর যেন আমার ধ্যান জ্ঞান। হয়্যা যেইছিল। খেত্যে শুত্যে চইলতে ফিরতে, ঠাকুরকে দেইখতাম। আমার মনটা সব সোময় ঠাকুর ঠাকুর কইরত। তাকে যেন আমার সাক্ষাৎ শিব মনে লিত।… আর পাইরলাম না। ঠাকুরের পায়ে হাত রেখ্যা বইললাম, “যা বইলবেন তাই হবেক গ, কিন্তুক কুথাক যাবেন? আপনার এত বড় সম্সার—।” বইলতে দিলে না। বইললে, “কিছু চাই না মা, এ জেবনটা তোমার পূজা কর‍্যা সাত্থক কইরব।” তা’পরেই তো…।’

একটু থামে যোগো। কী বলতে গিয়ে আবার কী যেন মনে পড়ে যায়। ঘাড় নেড়ে নিজের মনেই বলে, ‘তব্বে, হঁ, ইয়ার ভিতর একটো কথা আছে। দশ বছর বয়সে বিয়া হয়্যেছিল। সোয়ামীকে দেইখতাম, পাড়ার ভানু বল্যে এক ছোঁড়ার সাথে দিনরাত ঘোরে। তার সাথে খায়, রাতে তাকে লিয়ে ঘরে শোয়, মাঠে যেইয়ে থাকে। আ মরণ, ভানু ছোঁড়া শাড়ি পর‍্যা থাইকতো। আমাদিগের মতন বিটি জামা গায়ে দিত, কপালে ফোঁটা, পায়ে আলতা, ঢং ঢাং সব বিটি-ঝিদের মতন। মনে লিত, উয়াকে ঝাঁটা পিটা করি, নুড়ো জ্বেল্যে দিই মুখে। তা সোয়ামী হয়্যা তুমি যদি আমাকে না দেইখলে, আমার কী হয় গ। তাই ঠাকুর যত যোগো যোগো কইরত, আমার মনটোও ঠাকুর ঠাকুর কইরত। তা’পরে সি সাঁঝবেলার তিনদিন পরে সাঁঝবেলাতেই ধূমাবতীর নাম লিয়ে ঠাকুরের সাথে ঘর ছেড়্যা গেলাম। ঘুইরতে ঘুইরতে এই বক্রেশ্বরে। সি কি ই দিনের কথা। পেরায় আঠারো বচ্ছর হয়্যা যেইল।…।’

যোগো থামে। চুপ করে তাকিয়ে থাকে দূরের দিকে। তারপরে হঠাৎ উনোনের দিকে ফিরে কড়াইয়ে হাতা চালায়। আমি আবিষ্ট হয়ে থাকি। যে কাহিনী শুনি, সে কি কোনও সাধক-পূজকের কথা শুনি? নীতিবিগর্হিত কোনও নরনারীর পাপ কথা শুনি কী? নাকি সব মিলিয়ে এও এক পিরিতি পরম কথা। ধূমাবতী আদেশে, কার্তিক ঘোষাল কহে, পূজি গিয়ে তাঁতিবালা যোগোমতীকে।

এমনকী আর কোথাও ঘটে। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে, অন্য মনে! যোগোর দিকে চেয়ে দেখি। তার সেই কথাটি আবার মনে পড়ে যায়, ‘আর তো কিছু জানি নাই।’ ব্রহ্মানন্দ বিহনে সে আর কিছু জানে না। কই, একবারও পাপ মনে হয় না। যোগোকে ভ্ৰষ্টা স্বৈরিণী স্বামী-সংসারত্যাগিনী অন্ধকারের প্রাণী বলে মনে হয় না। এর নাম সাধন-ভজন, তার বিচ্যুতি নেই। একমনে এক সাধন। তবে ব্রহ্মানন্দকে সে চিনবে না কেন? সেই তো চেনে।

আমি জানি, যোগো মুখ ফিরিয়ে আছে। কিন্তু চোখ তার শুকনো নেই। কঙ্কাল ত্রিশূল না, এই তো সাধন। ঝগড়ায়, বিবাদে, বিরহে চোখের জলে এই তো সাধন।

আমার ভিতরেও কোথায় যেন কলকলিয়ে যায়। তাতে যদি চোখের জলের ছিটেও থাকে, একটা খুশির ঝরনাও বাজে। অবাক যত লাগে, মুগ্ধ তার বেশি। চলার পথে এইটুকু প্রাপ্য। কী খুঁজে ফিরি জানি না। পথ চলাকে গড় করি, নমঃ নমঃ নমঃ । নমঃ বিচিত্র, নমঃ জীবন। বক্রেশ্বর, ঈশ্বর কোথায়, কে জানে। তার চেয়ে পথ চলার এই অপরিচয়ের পরিচয় নমঃ যোগোমতী, নমঃ নমঃ।…

.

৭৪.

গোপীদাস কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। যোগোও পায়নি। তার মুখ তখনও উনুনের দিকে ফেরানো। গোপীদাস বলে ওঠে, ‘সব শুনতে পেইয়েছি গ ঠাকরুন।’

যোগো নড়ে ওঠে। বলে, ‘পেল্যেই বা, লতুন কথা তো লয় দাদা। তোমাদিগের জানা কথা।’

বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে রেখেই আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। আবার বলে, ‘তোমার চিতেবাবাজি জিগ্যেসা কইরলে যে কবি বিয়া হইয়েছে। তাই বইললাম।’

গোপীদাসের লাল চোখ দুটি এখনও ছোট, ঢুলুঢুলু ভাব। দাড়ি দুলিয়ে বলে, ‘আমিও তাই বইলছি গ যোগোদিদি। তিন আখরের তাগদ আলাদা, সেথা বিয়া শাদির কী কথা। অই তিন আখরে বাঁধে তিন আখরে ছাড়ে। তিন আখরে সতী তিন আখরে কুলটা। যা বইলবে তাই অই তিন আখর সব—পি-রি-তি। পিরিতি-কলে যে পইড়েছে, তার আর ঘর-সম্সার বিয়া বিটাবিটি সব ফোক্কা।’

বলে ঘড়ঘড়ে মোটা গলায় গেয়ে ওঠে:

‘কলে কলে কল কইরেছে

কল দেখ্যে মন ভুল্যে আছে

কলের কলে কল পইড়েছে

ই কল হারাল্যে চইলবে না হে।’

যোগো বলে ওঠে, ‘ছাই। অমন কলের মরণ, পিরিতির মুখে আগুন।’

গোপীদাস বলে, ‘তা দাও গা। যত খুশি আগুন দাও গা পিরিতির মুখে। না, কী বলো হে বাবাজি?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ দিই, ‘হ্যাঁ।’

যোগো ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চায়। তার চোখে মুখে আবার সেই আগের ভাব ফিরে এসেছে। লাল কুসুমের পাতার মতো চোখ দুটিতে ঝিলিক হেনে ভ্রূকুটি করে বলে, “উ বাবা, ই যে দেখি বিন্দার শুকপাখি গ। কথা বইলবার আগে আওয়াজ দেয়।’

গোপীদাস আবার বলে, ‘তা হতে পারে। পিরিতির কথা যে। না, কী বাবাজি?’

আমি আবার জবাব দিই, ‘তা-ই।’

যোগো বুঝি এতটা আশা করেনি। তাই চোখে কৌতূহল, আর বিস্ময়। কয়েক মুহূর্ত ঠায় চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। তারপরে হঠাৎ হেসে কাঁপে সর্বাঙ্গে। বলে, ‘অই গ গোপীদাদা, ই যে সত্যি চিতে গ।’

‘তব্যে? এমনি এমনি কী আর বইলেছি। দেখে শুনে বইলেছি।’

আমি মিটিমিটি হাসি আর মনে মনে বলি, তা যা বলো আর তা-ই বলো, অচেনার ভয় আর আমার নেই। পিরিতের মুখে তুমি যত আগুনই দাও সে পোড়াতে তুমি অঙ্গার হয়েছ। অঙ্গারের নীচে পিরিতির মরণে যে সোনা তার রূপও দেখেছি। দেখেছি বলেই সাহস পাই। যোগোমতী ভৈরবীকে ভয় পাই না আর। তার দপ্দপানো সংহারিণী রূপের আড়ালে যে বিগলিত ধারা বহে, এখন আমার চিন পরিচয় সেখানে।

যোগো আমার ওপর থেকে চোখ নামায় না দেখে না বলে পারি না, ‘যা সত্যি, তাই বলব তো।’

যোগো প্রায় হুমকে ওঠে, ‘বট্যে। দেখি শালার চিতের চখ গেল্যে দিই।’

বলে একেবারে খুন্তিটা উঁচিয়ে ধরে আমার মুখের সামনে। আমি তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলি, ‘দোহাই।’

সঙ্গে সঙ্গে যোগো খুন্তি রেখে হেসে বেজে ওঠে। গোপীদাসও।

তারপরে যেন যোগোর হঠাৎ খেয়াল হয়, বেলা পড়ে গিয়েছে। মিথ্যে না, শীতের বেলার রোদ ঢল খেয়ে গিয়েছে গ্রাম বক্রেশ্বরের পশ্চিমের ঢালুতে। মুখের লাজে লাভ নেই, মহাপ্রাণী অতি ক্ষুধার্ত। যোগোও সেটা টের পায়। নিমেষের মধ্যেই ডালের সম্বরায় ঝাঁজ ছড়িয়ে ছুটোছুটি করে ঘর থেকে শালপাতা পেতে খেতে দেয়। আমাকে আর গোপীদাসকে ভাত বেড়ে দিয়ে কড়া চাপিয়ে আলু বেগুন ভাজে।

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি খাবেন না?’

ভাজার ছ্যাঁকছোঁক শব্দে যোগোও যেন ছ্যাঁকা দিয়ে কথা বলে, ‘ক্যানে হে, শ্মশান বল্যে কি নিয়ম নাই? অতিথি না খাইয়ে খাব আমি?’

তা বটে। বলি কোন লজ্জায় তা-ই ভাবি। এমন খাওয়া যে কপালে ছিল তাও কোনওদিন ভাবিনি। মহাশ্মশান ক্ষেত্রে, অবধূতাশ্রমে, ভৈরবীর হাতে। বলি, ‘ভুল হয়ে গেছে।’

যোগো ভ্রূকুটি করে হাসে। গোপীদাস দাড়ি গোঁফে মাখিয়ে খায়। যোগো ভাজার দিকে চোখ রেখে বলে, ‘তোমার চিতেবাবাজির লক্ষণ ভাল না গোপীদাদা।’

‘ক্যানে?’

‘অবধূত ঠিক বইলেছে। ই আশ্রমে থাইকলে অনাচার হত্যে পারে।’

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘না না, সে কী!’

গোপীদাস আর যোগো দু’জনেই হেসে ওঠে। গোপীদাস বলে, ‘অনাচার ক্যানে গ ঠাকরুন। সি তো রসিকের আচরণ গ।’

আমি খাওয়া থামিয়ে দু’জনের দিকে চেয়ে থাকি। লজ্জাও করে বিব্রতও হই। যোগো হাত তুলে মারার ভঙ্গি করে বলে, ‘দ্যাখ ক্যানে, তবু হা করে চেয়ে থাকে। ভাত খা চিতে, ভাত খা।’

যাক, ঠাট্টা তবু ঠাট্টাই। যোগোর সম্বোধনে বচনে ভাষণে সেটা আরও বেশি করে বোঝা যায়। তার চেয়ে বেশি তার প্রীতি আর বন্ধুত্ব যেন নতুন সুরে বাজে। মাঝখানে যেটুকু বা সংশয়ের অস্পষ্টতা থাকে সেটুকুও কাটিয়ে দেয়।

আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে যোগো সব গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখে। আমরা পাত ফেলে দিয়ে হাত মুখ ধুই। যোগো ততক্ষণে উনুন আর দাওয়া লেপে নেয়। ভাবি, সে হয়তো চান করে এসে খাবে। গোপীদাস আর আমি ঘরে গিয়ে বসি।

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘বাবাজি কি রাতটো বক্কেশ্বরেই থাইকবে?’

‘কোথায় থাকব?’

আমার অবাক হওয়া দেখে সে বলে, ‘ক্যানে, ইখানেই থাইকবে, ই ঘরে।’

বক্রেশ্বরে আর কেন থাকব তা জানি না। নতুন করে কিছু দেখবার আছে বলে মনে হয় না। তবু এই মুহূর্তে মনে হয় একটা রাত্র থেকে গেলি ক্ষতি কী? এই মহাশ্মশান, উষ্ণ কুণ্ড, শত শত মন্দির, বক্রেশ্বরের খোয়াই গাছপালা সব মিলিয়ে কেমন একটা উদাস বৈরাগ্যে গাম্ভীর্য। অথচ ঘরছাড়া মনকে এখানে কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ডাক দিয়ে বসায়। একটা অচেনা আকর্ষণে টানে।

কিন্তু এই ঘরে! শুধু যে ব্রহ্মানন্দ অবধূতের মুখ মনে পড়ে তা না। ঘরের কোণে অজগরের খাঁচা, বেড়ার গায়ে নরমুণ্ডের কঙ্কাল—ভাবতেই অস্বস্তি লাগে।

গোপীদাস হেসে বলে, ‘কী বাবাজি, ইদিক উদিক দেইখছ যে? সাপের জন্যে ভয় লাইগছে? কোনও ভয় নাই। অনেক থেক্যেছি ই ঘরে। খাঁচা থেক্যা সাপ বের হতে পাইরবে না। আমি তো থাইকব তোমার কাছেই।’

সেটা একটা ভরসা। কিন্তু তা যেন হল, অবধূত মশাই এসে যে অনাচারের দায়ে ত্রিশূল খুঁচিয়ে দণ্ড দেবেন না তা জানব কেমন করে। জিজ্ঞেস করি, ‘আর অবধূত?’

গোপীদাস হেসে আমার পিঠে হাত দেয়। বলে ওঠে, ‘অই অই, উয়ার কথায় ভয় লাইগছে তোমার? উ ভারী ভাল লোক গ বাবাজি। যদি আসে কথাবাত্তা শুইনলে বুইঝবে। উসব উয়ার মুখের কথা, ভৈরবীর সাথে বিবাদ হইয়েছে তা-ই।’

তবু যেন ভরসা পাই না। মাঝ রাত্রে এসে হুংকার দিলেই হল। যোগোমতী রক্ষাকর্ত্রী আছে। কিন্তু বিড়ম্বনা রোধ করা যাবে কি না কে জানে।

গোপীদাস আবার বলে, ‘আর যদি নিতান্ত তোমার মন না চায় অন্যত্তর থাইকতে পারি। গাঁয়ে যেইয়ে থাইকতে পারি। ঠান্ডার দিন, তা-ই। তা না হল্যে যিখানে সিখানে রাতটো কেট্যা যেত। একটুক কইসে গড়ায়ে লাও, তা’পরে ঘুর‍্যে ফির‍্যে দেইখে ঠিক করা যাবে।’

সে-ই ভাল। সেরকম দেখলে সন্ধ্যাবেলার বাস ধরে দুবরাজপুর চলে যেতে বাধা কী। দুবরাজপুর ইস্টিশনে একটা রাত কেটে যাবে। কিন্তু সব যেন কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার আর গোপীদাসের ধূমপান শেষ হয়ে যায়। তারপরেও অনেকখানি সময় পার হয়ে গেল। ভৈরবীর এখনও দেখা নেই।

জিজ্ঞেস করি, ‘উনি কোথায় গেলেন?’

‘কে, যোগোদিদি? বাইরে বস্যে, খাইচ্ছে বোধ হয়।’

কিন্তু তা কেমন করে হবে! খাবার তো সব ঘরেই তোলা হয়েছে। যোগো যে খাবার বেড়ে নিয়ে যায়নি, তা দেখেছি। বাইরে দাওয়ায় কারুর কোনও সাড়াশব্দও নেই। বলি, ‘খাবার তো সব ঘরেই ঢাকা দেওয়া রয়েছে।’

গোপীদাসের একটু ঝিমনো ভাব এসেছিল। মুখ তুলে চেয়ে বলে, ‘তা-ই তো। গেল কোথা। লাইতে যেইয়ে কি এত দেরি কইরবে?’

গোপীদাসের সঙ্গে আমিও চোখ তুলে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। সেখানে শিবমন্দিরের মাথায় গায়ে, গাছের ডালে পাতায় বিকেলের পড়ন্ত রোদ। ছায়ার বিস্তার বেশি, ফাঁকে ফাঁকে পড়ন্ত বেলার লাল রোদ।

গোপীদাস ডেকে ওঠে, ‘অই গ যোগোদিদি, বাইরে আছ নাকি?’

নেই সে বিষয়ে সন্দেহ কী। থাকলে এতক্ষণে তার সাড়া পাওয়া যেত। কিন্তু অবাক হয়ে শুনি তার গলার শব্দ আসে বাইরের দাওয়া থেকে, ‘আছি।’

আছে! গোপীদাস আর আমি দু’জনেই চোখাচোখি করি। গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘লাইতে যাও নাই?’

বাইরে থেকে জবাব আসে, ‘সি আমার সকালবেলাই হয়্যা যেইছে।’

‘খাবে না?’

জবাব আসে না আর। অতিথির খাওয়া হয়ে গেলে সে খাবে তা-ই জানতাম।

গোপীদাস আবার জিজ্ঞেস করে, ‘খাবে না ঠাকরুন?’

কেমন যেন উদাস গলায় আওয়াজ আসে, ‘খাব পরে।’

ব্যাপারটা কেমন যেন ধন্দ ধরায়। যোগোমতী ঠিক সুরে যেন বাজছে না। গোপীদাস ওঠে। আমিও কৌতূহল না চাপতে পেরে তার পিছু পিছু যাই। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ভৈরবী দুই হাঁটুতে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে বাইরের দাওয়ায়। আমাদের দেখে একটু লজ্জা পেয়ে হাসে। গোপীদাস বলে, ‘ক্যানে, পরে আবার কখন খাবে গ?’

যোগো বলে, ‘রাতে খাব!’

বলে আবার হাসে। কিন্তু সে-ই বেসুর। কেমন একটা খটকা লাগে তার হাসি দেখে। চোখের কোল দুটি এখন যেন আরও বেশি বসা মনে হয়। তীক্ষ্ণ মুখটা যেন আগের থেকে শীর্ণ দেখায়। খিদের জন্য কি না জানি না। কিন্তু সাততাড়াতাড়ি আমাদের রেঁধে-বেড়ে খাওয়ালে, তারপরে নিজে সব গুছিয়ে চুপচাপ বসে আছে! দেখে ভাল লাগে না। মন খারাপ হয়ে যায়।

গোপীদাস আবার অবাক হয়ে বলে, ‘রাতে খাবে কী গ। গোটা দিন না খেইয়ে থাইকবে?’

যোগো কোনও কথা বলে না। সে দূরের দিকে চেয়ে থাকে। আর সেই মুহূর্তেই সহসা আমার মনে একটা চমক লেগে যায়। মনে হয় আজকের গোটা দিনটিই শুধু না। হয়তো এমন কয়েকটা গোটা দিনরাত্রিই না-খেয়ে কেটেছে। আমি ঘরের বাইরে এসে বলি, ‘এটা ভাল লাগছে না। আপনি খেয়ে নিন।’

যোগো মুখ তুলে ভুরু কোঁচকায়। বলে, ‘আবার আপুনি আগ্‌গা কইরছ?’

বলি, ‘তা না হয় করব না। কিন্তু খেয়ে নিতে হবে।’

যোগো কথা এড়িয়ে যায়। গোপীদাসকে বলে, ‘দেইখছ তো তোমার চিতেবাবাজিকে। আমার জন্যে মইরছে।’

অনায়াসে বলে উঠি, ‘মরছি।’

‘বাবা রে! সত্যি সত্যি ম’রো না যেন।’

সে চোখ ঘুরিয়ে ঘাড় বাঁকায়। গোপীদাস বলে, ‘কিন্তু খেয়ে লাও যোগোদিদি।’

যোগো কী বলবার জন্যে মুখ তোলে। হঠাৎ আবার মুখ নামিয়ে নেয়। আবার যখন মুখ তোলে তখন তার ভাব আলাদা। বলে, ‘গোপীদাদা উদিকে তো একজন এলেকাটার ঘরে যেইয়ে সাধনভজন শিখাল্‌চ্ছে। মদ গাঁজাও খুব চইলছে। পেটে ক’টা দানা পইড়েছে একবার জিগেঁস করগা দেখি।’

বলে যেন রুষ্ট কোপে ঘাড়ে ঝটকা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর আমার বুকের কাছে হঠাৎ যেন একটা খোঁচা লেগে যায়। খোঁচা লেগে ব্যথা করে ওঠে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি। তা-ই তো পরমের মুখ চেয়ে মরমের বসে থাকা। রেঁধেবেড়ে তাড়াতাড়ি অতিথিকে খাওয়ানো যায়। অতিথি যদি দেবতা, তার বড় দেবতাও তো আছে। সে সাতপাকের পতি না হোক, পতির চেয়ে বড়। সে যে গৃহত্যাগিনী তাঁতিবউয়ের সতীত্বের সুন্দর। নারীত্বের একমাত্র নয়। জাতিকুলমান সকলই আন্। সে আর যা-ই করুক, তবু সে সেই মানুষ যার জন্যে সব ত্যাগ, শ্মশানবাস। তাকে রেখে কি যোগোমতী খেতে পারে কখনও!

আমি যেমন থমকে যাই গোপীদাসও তেমনি। কারুর মুখে হঠাৎ কোনও কথা জোগায় না। যোগো আবার নিজের মনেই বলে, ‘কী বইলব বলো। এমনিতেই তো হাঁড়ি চড়ে না! তা রোজ রোজ দু’বেলা না খেল্যেও এখন আর কষ্ট হয় না, একবেলাতেই যথেষ্ট। অথচ, ই মানুষের কীসের অভাব ছিল। দ্যাখ যেইয়ে তার ঘরের ভাত কে খায় তার ঠিক নাই। শিবঠাকুর শ্মশানে বস্যে ভিক্ষে কইরছে।’

যোগো চুপ করে। আমরা কেউ কথা বলতে পারি না। একটু পরে সে আবার বলে, ‘রোজ রোজ বেড়ে দেব এত ভাগ্য করি নাই। আর যদি বা একবেলা দিতে পারি তা-ই বা কে ল্যায়, কে খায়।’

মুখ তুলে গোপীদাসের দিকে চেয়ে বলে, ‘তোমরা রাগ কর‍্যো নাই গোপীদাদা। ঠান্ডার সময় কিছু লষ্ট হবেক নাই। চারজনার ভাত রেঁধ্যেছি, একজনের ভাত হাঁড়িতে পড়্যে থাইকবে?’

গোপীদাস বলে, ‘দু’জনারটোই বা থাইকবে ক্যানে?’

যোগো হাসে। গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘চলো তো বাবাজি, অবধূতকে ধইরে লিয়ে আসি।’

‘বইস ক্যানে। লিজেই আইসবে।’

গোপীদাস দাড়ি ঝাঁকিয়ে ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘না, সে আসাতে চইলবে না। আইসবে তো জানি, যাবে কোথা। কিন্তুক এখন খেইয়ে যেত্যে হবে। চলো তো বাবাজি, চলো।’

আমার মনে একটু দ্বিধা। যা মূর্তি দেখেছি সামনে যেতে ভরসা পাই না। সেখানে গিয়ে কী দেখব তা-ই বা কে জানে। একবার ভৈরবীর দিকে তাকাই। তারপর গোপীদাসের সঙ্গে যাই। কয়েকটা মন্দিরের এপাশ-ওপাশ দিয়ে উঁচু-নিচু খোয়াইয়ের ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে একটু পুবে গিয়ে প্রায় একটা হেলেপড়া ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ছোট নিচু বেড়ার ঘর। মাথার খড় প্রায় নেই। তার বদলে নানান গাছের ডালপালা পাতা দিয়ে খড়ের অভাব মেটানোর চেষ্টা হয়েছে। দরজাটা খোলা। দিনের বেলাও ভিতরটা অন্ধকার। কারুর কোনও সাড়াশব্দ নেই।

গোপীদাস আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু। বেহ্মালন্দদাদা আছ নাকি?’

কোনও সাড়া নেই। তবে একজনের দেখা পাওয়া যায়। সে দরজার সামনে এসে অচেনা মানুষদের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। চোখে তার সন্দেহ, কৌতূহলও বটে। তারপরে একটু যেন ভয়ে ভয়ে, ভাব জমাবার ভাব করে ল্যাজ নাড়ে। শ্মশানের সারমেয় বটে, কালো কুচকুচে রং, হলদে চোখ।

গোপীদাস এগিয়ে যেতেই, শ্মশানবাসীটি ঘরের বাইরে এসে একটু দূরে সরে যায়। গোপীদাস নিজের মনেই বলে, ‘কেউ নাই নাকি! অই গ বেহ্মালন্দদাদা, কোথা গেল্যে?’

ভিতর থেকে কেমন যেন চমক খাওয়া মোটা গলা ভেসে আসে, ‘কে?’

স্বরেতেই মালুম দেয়, কণ্ঠস্বর ব্রহ্মানন্দ অবধূতেরই বা। কিন্তু কৃষ্ণবর্ণ কুকুরটিও কি এ ঘরের বাসিন্দা নাকি! নাকি, শ্মশানবাসীদের প্রাণিজগতেও কোনও ভেদাভেদ নেই।

গোপীদাস আর এগোয় না। একবার আমার দিকে দেখে, বলে, ‘আমি গোপীদাস। একবার বাইরে এইস।’

এবার আর চমক খাওয়া স্বর না। প্রশ্ন আসে, ‘ক্যানে, কী হইয়েছে?’

‘এইস ক্যানে একবার।’

‘তুমি এইস ক্যানে।’

পালটা ডাক আসে। গোপীদাস আবার আমার দিকে তাকায়। তার চোখ দেখে বুঝতে পারি, ঘরে ঢুকতে দ্বিধা। দ্বিধার কারণ, আর একজনের কথা ভেবে। ব্রহ্মানন্দ যাকে এ ঘরে সাধনভজন শেখাচ্ছে, যার জন্যে সে যোগোমতী ত্যাগ করে আশ্রমছাড়া হয়েছে। কিন্তু গরজ কার? গোপীদাসের না ব্রহ্মানন্দর। গোপীদাসেরই। তার গরজের পিছনে, যোগোমতীর উপবাসী মুখখানি জেগে আছে। অতএব, সে পায়ে পায়ে খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, মাথা গলিয়ে দেয় ভিতরে। এদিক ওদিক দেখে, ঘরের ভিতর এক পা দিয়ে, জিজ্ঞেস করে, ‘একলা রইয়েছ নাকি?’

মোটা গলার জবাব শুনি, ‘হুঁ। সংসারে একলা এস্যেছি, একলা যাব।’

গোপীদাসের গলায়, সনিশ্বাসে বাজে, ‘জয় গুরু!’

আমারও তো সেই অবস্থা। অবধূত মহাশয়ের গলায় যেন কেমন বৈরাগ্যের সুর বাজে। ও-বেলায় জোয়ারের তোড়। এ-বেলায় ভাঁটার ঢল। প্রকৃতির নিয়মই তা-ই।

গোপীদাস পিছন ফিরে আমার দিকে চায়। বিটলে বাউল পিট পিট করে, আমাকে দেখে চোখ টিপে ইশারা করে। ডাক দিয়ে বলে, ‘এইস গ চিতেবাবাজি, দাদার কাছে এইস।’

আমিও তার পিছে পিছে ঘরে গিয়ে ঢুকি। এমনিতেই বিকেল হয়ে গিয়েছে। ঘরের ভিতরটা যেন ঘুটঘুটি অন্ধকার গুহার মতো। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ে না। কেবল একটা বিশ্রী গন্ধ নাকের মধ্যে ঢোকে। তারপরেই, অন্ধকার কোণে, দুটি চোখের সঙ্গে আমার দৃষ্টি মেলে। চোখ তো না, দুই খণ্ড অঙ্গার। আস্তে আস্তে গোটা মানুষটা জেগে ওঠে। ব্রহ্মানন্দ অবধূত বটে। আমার মনে পড়ে গেল, ধূমাবতীর সাধক, শাক্ত কার্তিক ঘোষালের কথা। সন্দিগ্ধ প্রশ্ন শোনা যায়, ‘ইটি কে?’

গোপীদাস অতি বিনয়ে জানায়, শান্তিনিকেতন থেকে বাবাজির আগমন। বক্রেশ্বর দেখবে, সেই সঙ্গে, অবধূত দর্শন করবে, তা-ই সে আমাকে নিয়ে এসেছে। সে যতক্ষণ বলে, ততক্ষণই অবধূত আমার দিকে চেয়ে থাকে। সেই অবসরে, যোগোমতীর কথা আমার মনে পড়ে যায়, ‘হঁ, মনে হত কন্দপ্পকান্তি।’ অবধূত কন্দর্পকান্তি ছিল, সন্দেহ নেই। এই মদরক্ত চক্ষু, মাথার জট পাকানো চুল, চোখের কোলে গর্ত, কয়েক দিনের আকাটা গোঁফদাড়ি, পোড়া মূর্তির মধ্যে, কোথায় যেন এখনও সেই একদা কন্দর্পকান্তিকে দেখা যায়।

গোপীদাস তার পাশে আমাকে বসতে বলে, জিজ্ঞেস করে, ‘আর কে যেন ছিল হেঁথাকে?’

ব্রহ্মানন্দ উদাস চোখে দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়। বলে, ‘উ মাগিটা বড় বজ্জাত, খেদিয়ে দিইচি।’

গোপীদাস চোখের কোণে একবার আমাকে দেখে নেয়। কিন্তু কিছু বলে না। আমি মনে মনে বলি, জয় গুরু, আপদ গিয়েছে। কিন্তু, এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এত বড় বিপ্লব ঘটে গেল কেমন করে। ও-বেলার কথা শুনে তো কিছুই বুঝতে পারিনি। অবধূত নিজেই নিজের মনে বলে, ‘উ সব হল্য রাক্‌কুসি বরাহী। সাধনের নামে খালি কামাচার কইরবে আর গিলবে। উয়াদের কোনও শক্তি নাই।’

গোপীদাস ভাল মানুষটির মতো, আঙুলে আঙুল ঠোকে। আওয়াজ করে, ‘অ।’

অবধূত বলে ওঠে, ‘হুঁ, শক্তি বইলব কাকে? যার মধ্যে প্রকৃত শক্তি আছে। তুমি নামেও ব্যাশ্যা কুলটা, কামেও তা-ই, আবার মনেও তা-ই, তা হল্যে আর কী রইল তোমার? রইল খালি একখানি স্ত্রী অঙ্গ। ঝাঁটা মার শালা, ঝাঁটা মার। হুঁ, শাস্ত্রে আছে বট্যে, কুলটাও শক্তি হত্যে পারে, কিন্তু মনে মনে তোমাকে সাধিকা হত্যে হব্যে, তব্যে তো।’

গোপীদাস সায় দিয়ে বলে, ‘হঁ, সবাই কি আর আমাদিগের যোগোদিদি।’

তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ গর্জন, ‘কী বইললে, তোমাদিগের যোগোদিদি? উয়ার কথা আর আমাকে বল্যো না।’

অবধূত বসেছিল একভাবে। গোটা শরীরে ঝটকা মেরে, পাশ ফিরে বসে। চোখ জ্বলে ধক্ধক্। বলে, ‘উয়ার বড় বাড় হইয়েছে। অত্‌ত কীসের হ্যাঁ, আঁ? আমাকে খালি ঠাট্টা অচ্ছেদ্দা কইরবে, গালাগাল দিবে। ক্যানে, আমি যদি সিরকম হত্যাম, তা হল্যে তোমাকে আজ একপাল বিটাবিটির হাত ধর‍্যে ভিখ মাঙতে যেতে হত্য। আমি যদি লম্পট হত্যাম, কে তোমাকে দেইখত, আঁ? উ নিজেকে দুর্গা ভাবে, না কালী ভাবে। উয়ার অহংকার দেইখলে আর কাছকে যেত্যে ইচ্ছা করে নাই। তা উ ছাড়া কি আর আমার শক্তি জুটবে নাই?’

গোপীদাস চুপ। আমার তো কথাই নেই। কিন্তু যা জুটছে, অবধূতের নিজের ভাষায়, সব তো ‘রাক্‌কুসি বরাহী।’ অর্থাৎ শূকরী।

গোপীদাস একটু পরে, বড় মিহি সুরে বাজে, ‘সি তোমার মতন সাধকের শক্তি জুইটবে না, তা-ই কি হয়। তব্যে হঁ, আমাদিগের যোগোদিদির মেজাজটা একটুক চড়া।’

‘একটুক? একটুক বইলছ তুমি, আঁ। যা লয় তাই চোপা কইরবে, আবার আমাকে মাইরতে আসে? উ ভুল্যে যেইছে, আমি কে, আর উ কে, আঁ?’

বেসুর বেসুর, বড্ড বেসুর বাজে যেন। অবধূতের গলায় যেন কার্তিক ঘোষালের স্বর শুনি। কথায় যেন সেই ইঙ্গিত, সে হল কার্তিক ঘোষাল আর যোগোমতী এক তন্তুবায় বধূ, কিন্তু আর কি সে হিসাবের দিন আছে! শ্মশানে, সাধনে, আশ্রমে আর গ্রাম-গৃহের কী সম্পর্ক!

তবে পিরিতি বিবাদে কোন বাদানুবাদ না চলে? কারণ, পিরিতি থাকলে সব রীতিতেই কথা বলা যায়। গোপীদাস আবার বলে, ‘তব্যে বেহ্মালন্দদাদা, যা-ই বলো আর তা-ই বলল, যোগোদিদি তোমাকে ছাড়া কিছু জানে না। অমন পবিত্তির সাধিকা আর হয় না।’

বলে গোপীদাস কপালে হাত ঠেকায়। ব্রহ্মানন্দ চুপ করে থাকে। ইচ্ছা না যে, চুপ করে থাকে। প্রতিবাদযোগ্য কথা যেন ঠিক হাতড়ে পায় না। আর আমি দেখি, গোপীদাসকে। বুড়া বাউলের দাড়ির ভাঁজে ভাঁজে, ধূর্তামি চোখ দেখে বুঝতে পারি। কোন সাপের কোন মন্ত্র, ঠিক জানা আছে। চোখের কোণে বারে বারেই আমার দিকে চায়। অর্থাৎ ইশারায় জিজ্ঞাসা, ‘কেমন বুইঝছ বাবাজি?’

ব্রহ্মানন্দ আর একবার ঝেঁঝে ওঠে, ‘বেচাল আমি দেইখতে পারি না। অই বেচাল দেখ্যেই মাগিটাকে খেদিয়ে দিলাম। গাঁ থেক্যা জনার্দন চক্কোত্তি বেগুনপোড়া আর ভাত পাঠিয়ে দিইছিল। মদন হাঁড়ি ভরতি কর‍্যে কারণ রেখ্যে গেল্‌ছিল। ফিরে এস্যা দেখি, বিটি বেবাক খেয়্যা লিয়েছে, আঁ? তুমি ইখানে খালি গিলতে এইসেছ, আঁ? আবার হাইসতে হাইসতে বইলছে, সব খেয়্যা লিয়েছি। তব্যে র‍্যা মাগি, আঁ, তুই খালি ইসব কইরতে এইসেছিস? যা, দূর হ, দূর হয়্যা যা। কারুর বেচাল আমি সইব না, সি তুমি যে হও।’

গোপীদাস তেমনি নরম মিহি সুরে সনিশ্বাসে বলে, ‘আর উদিকে দ্যাখ যেইয়ে, যোগোদিদি রেঁধে-বেড়ে বইসে আছে। আমাদিগে খাইয়ে-দাইয়ে সব তুলে পেড়ে রেখ্যে দিয়েছে। জিগেস কইরতে বইললে, তোমাদিগের অবধূতকে না খাইয়ে কোনওদিন খাই নাই, আজ কী কর‍্যে খাব বলো। ছি ছি ছি, আগে জাইনলে আমরাই কি খেতাম। যোগোদিদির মুখখানি দেখ্যা বড় কষ্ট লাইগল।’

গোপীদাস চুপ করে। অবধূতও নীরব। একটু পরে আর একবার পাশ ফিরে বসে বলে, ‘ক্যানে, খেয়্যা লিলেই হত্য।’

কিন্তু গলার স্বরে তেমন ঝাঁজ নেই। গোপীদাস বলে, ‘উ কথা বল্যো না দাদা। তা-ই কি হয়, না হইয়েছে কোনওদিন!’

অবধূত আবার চুপ। গোপীদাসও। তবে তার জপানোর ভাবখানা একবার দেখ। এদিকে হাতজোড় করে বসে। ওদিকে, আমার দিকে ঘন ঘন চোখের কোণে দৃষ্টিপাত। আর এতক্ষণে সহসাই যেন আমার দিকে অবধূতের দৃষ্টি পড়ে। জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কী?’

নাম বলি, তারপরে ধামের ঠিকানা, কর্মের সন্ধান সবই হয়। গোপীদাস এক ফাঁকে নিবেদন করে, ‘দাদা, তা হল্যে আর দেরি ক্যানে। তোমারও পেটে কিছু নাই, উদিকে একজন উপবাস দিচ্ছে। চলো যাই।’

খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপরে অবধূত বচন, ‘যেতে ইচ্ছা করে নাই।’

‘কিন্তুক যেত্যে হবে।’

‘ইবারটো যেইছি চলো, কিন্তু মন্দ কিছু বইললে আমি থাইকব নাই।’

‘সি আমি দেইখব, তুমি চলো।’

গোপীদাস উঠে দাঁড়ায়। আমিও। একটু পরে অবধূতও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কারণবারির উত্তাল অবস্থা আর নেই। অনেকখানি ঝিমিয়ে গিয়েছে। ঘরের বাইরে এসে মনে মনে বলি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি!…

অবধূতাশ্রমের কাছে এসেই গোপীদাস হাঁক পাড়ে, ‘যোগোদিদি, ভাত বাড় গ, দাদার ভাত বাড়।’

আমরা ঘরে ঢুকতেই যোগোমতী মেঝে থেকে উঠে বসে। সে শুয়ে ছিল বোধ হয়। আমাদের সঙ্গে ব্রহ্মানন্দকে দেখে সে ঘোমটা টেনে দেয়। দিয়ে, বাইরে চলে যায়। তারপরে দেখ অবধূতের চেহারা। যে লোককে সাধ্য-সাধনা করে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে হয়, এ কি সেই লোকের মুখ! যেন, নতুন মানুষের, কুটুমের সংকোচ। শান্ত মুখখানি নিচু করে থাকে।

যোগো আবার ঘরে আসে। আসন পেতে জল গড়িয়ে, আমাদের মতো পাতা পেতেই খেতে দেয়। অবধূত কোনও কথা না বলে বসে পড়ে। আমি গোপীদাস একটু দূরে বসি। কেউ কোনও কথা বলে না।

কিন্তু ভাতে হাত দিয়েই, অবধূতের চেতন জাগে। যোগোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার আছে তো?’

যোগোর দৃষ্টি মাটির দিকে। মুখের ভাব শক্ত, নির্বিকার। ভাতের হাঁড়ি, ডালের কড়া, সব এনে বসিয়ে দেয় অবধূতের সামনে। অর্থাৎ দেখে নাও, আছে কি না-আছে। এর বেশি কথা খরচ করতে সে নারাজ।

অবধূত প্রায় হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘জয় ধূমাবতী।’ তারপরেই মুখে গরাস পুরে দেয়। মুখে ভাত নিয়েই বলে, বুইঝলে গোপীদাস, সাধন কইরতে হল্যে—।’

যোগোমতী অমনি ঘাড় বাঁকিয়ে, গোপীদাসের দিকে তাকায়। গোপীদাস বলে ওঠে, ‘পরে হব্যে, খেইয়ে লাও ক্যানে আগে।’

অবধূতও চকিতে একবার যোগোর দিকে দেখে, চুপ করে খেতে থাকে। তার খাওয়া দেখে ভাবতে ইচ্ছা করে, মা ধূমাবতী এত ক্ষুধা কোথায় রেখেছিলেন। আর এই মুহূর্তে, আর একটি কথাও আমার মনে পড়ে যায়। যে-মানুষ আজ এখানে বসে এভাবে খাচ্ছে, সেই কার্তিক ঘোষালের ঘরে অন্নের অভাব নেই। সংসারের সেই সুখ ছেড়ে, এ মানুষ যোগোমতীকে নিয়ে শ্মশানে এসে আশ্রম করেছে। যখন যেমন জোটে, তখন তেমন খায় পরে।

আমি সাধনভজন জানি না, বুঝি না। কিন্তু এই যে মানুষ খাচ্ছে, ক্ষুধার তৃপ্তি মুখে ছড়িয়ে পড়ছে, যোগোমতীর দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে, তাকে দেখে তো একবারও মনে হয় না, একটা উচ্ছৃঙ্খল বাউন্ডুলে জীবন-যাপনের জন্যে সে ঘুরছে। বিকার? বিকারগ্রস্ত মানুষের আর যা-ই থাক, দুঃখ বহনের শক্তি থাকে না। মনের বিকার নিয়ে সংসারের সুখভোগের মধ্যেই তার দিন চলত ভাল।

কী জানি, শেষ নাহি যার, শেষ কথা কে বলবে! মানুষের শেষ কোথায়, তল কোন গভীরে, কতটুকু জানি। কেবল অবধূতকে দেখে, তার খাওয়া দেখে, সেই মত্ত রুদ্র মানুষটিকে এখন সহসা অন্যরকম লাগে। সংসার ছেড়ে যে শ্মশানে এসেছে। অথচ সংসারের সকল দুঃখের ঢেউয়ে যে মানুষ দোলে, নানা রূপে জাগে। হয়তো সংসারে সুখের চৌহদ্দি ছোট লেগেছিল। শ্মশানের অসীমেই সে বাঁচে।

অবধূতের খাওয়া হয়ে যাবার পর, সেই পাতাতেই যোগো নিজের ভাত বাড়ে। কথাটি না, তাকে সাধাসাধিও করতে হয় না। আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসে খেতে থাকে। আর অবধূত হাত ধুয়ে, ঘরে এসেই, একেবারে গলা ছেড়ে গান ধরে দেয়,

‘ই সব ক্ষ্যাপা মায়ের খেলা।

যার মায়ায় ত্রিভোবন বিভোলা

মাগির আপ্তভাবে গুপ্ত লীলা—।’

যোগো মুখ ফিরিয়ে একবার গোপীদাস আর একবার আমার দিকে চায়। কিন্তু এবার ক্রুদ্ধ কোপ কটাক্ষ না। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক। আর অবধূত যেন ক্ষুধার্ত শিশুটি, পেট ভরতেই গানের গলা খুলে যায়। সে আমাদের কাছে এসে বসে। বলে, ‘বুইঝলে হে, আসল জিনিস, তার চেহারা আলাদা। অ্যাই তোমার মায়ের ভাবের কথা বইলছি।’

বলে আবার গান ধরে,

‘সগুণে নির্গুণে বাধায়ে বিবাদ।

ঢ্যালা দিয়া ভাইঙ্‌ছে ঢ্যালা

মাগি সকল বিষয়ে সমান রাজি

নারাজ কেবল কাজের বেলা।’…

যোগো আর একবার মুখ ফিরিয়ে চায়। দেখি তার চোখে মুখে হাসির ছটা। মনে হয়, নতুন রূপে আর এক মানভঞ্জনের পালা দেখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *