২০.
গাজিটা এতক্ষণ ধরে কী ভেবেছে, কে জানে। শুনি, গুনগুনিয়ে টেনে টেনে গান গায়:
‘সুখে-দুঃখে যে ভাবে হে,
থাকি যেথা সেথা।
যেন তোমার নামের মালা
আমার প্রাণে থাকে গাঁথা।
ওহে, আমি তোরে ভুললে
তোর যায় না মমতা।
তবে কি না, তুমি আমারে ভুললে,
আমার সকলি বেরথা।’…
আমি যেমন করে শুনি, তেমনি করে গায় না গাজি। এই পুব-দক্ষিণা নোনা-কূলের উচ্চারণে গায়। কিন্তু প্রতিটি কথা এমন স্পষ্ট যেন আর একবারও তার গলায় শুনিনি। অথচ গলা তার চড়া নয় মোটে। সে আমার কাছ থেকে হাত কয়েক দূর দিয়ে চলে। অস্পষ্ট আলোয় দেখি, ঝোলা কাঁধে, পাগড়ি মাথায়, পেছনে বাবরি। এই আলোতে তার আলখাল্লার রং বোঝা যায় না। তার আর আমার দু’জনেরই অস্পষ্ট ছায়া আমাদের পায়ে পায়ে চলে। তার মুখ নদীর দিকে ফেরানো, যেদিকে আমাদের গতি। যেখানে বাঁয়ের কোণে কয়েকটি মিটমিটে আলো দেখা যায়। নদীর ওপারে ন্যাজাটের দু-একটি আলোও চোখে পড়ে। কুয়াশা নয়, অথচ দেখা-না-দেখার কী এক হালকা আবরণে যেন সব ঢাকা পড়ে গিয়েছে। হয়তো আধখানা চাঁদের এই মায়া। ডাইনে বাঁয়ে সব যেন শূন্য, অশেষে হারানো। কেবল গঞ্জের যে কয়টি মিটমিটে আলো দেখা যায়, তার এক পাশে কোথায় যেন আগুন জ্বলে। যে আগুনের হাত যেন থেকে থেকে আকাশে হাত বাড়ায়। মাঝে মাঝে তার শিখা দেখতে পাই। যার আলোয় খানিকটা জায়গা জুড়ে রক্তিম আভা কাঁপে। যে আভাতে একটি গাছ ভেসে ওঠে। সব মিলিয়ে যেন এক আদিম ছবি। তার সঙ্গে গাজির এই গান।
কেন, গাজি এখন এ গান গায় কেন। কার মনের কথা বলে সে! কাকে সে ভোলে, তবু যার মমতা যায় না। অথচ সে ভুললে তার সকলই বৃথা। আমি তো কেবল কাজল মাখানো ডাগর চোখ, পান খাওয়া লাল ঠোঁট, এমনকী বিড়ি টানা সেই আঙুরলতার মুখখানিই দেখি।…
গাজি যখন গান থামায়, তখন জিজ্ঞেস করি, ‘এ গান কার?’
গাজি ফিরে চায়, কাছে এগিয়ে আসে। বলে, তা তো জানি না বাবু। মনে পড়ি গেল, তাই। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘কেন মনে পড়ি গেল?’ কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারি না। আমি তখন তথ্যসন্ধানী হই। জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা, মাহাতো দেখলাম তোমার এত কথা বলে। কিন্তু মাহাতোরা তো এ-দেশের লোক নয়।’
গাজি বলে, ‘সে কথা তো ঠিক বাবু, মাহাতো চাচারা এ-দেশীয় লোক না। তয় শুনিচি, তিন-চার পুরুষ আগে এরা এসিছিল। তখন তো এসিছিল, বাবু, আবাদের চাষের মজুর হয়ি। আর এখন দ্যাখেন, কত জমির মালিক। এখন নামে মাহাতো। ঘরে গেলি দ্যাখবেন, সব এ-দেশির মতন। পুজো-পারণ ঘর গেরস্থালি, যা বলেন।’
তা বটে, চার পুরুষ আগে যারা এই নোনা গাঙের কূলে এসেছে, মাটিকে মিষ্টি করেছে, তারা এই মৃত্তিকারই মানুষ। মাহাতো কুরমি ওরাওঁ মুণ্ডা সাঁওতাল, এসব বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভারতবর্ষের অন্য সীমান্ত। যেখানে মাটির রং ভিন্ন, বনের রূপ আলাদা। প্রকৃতি যেখানে উঁচুনিচু, পাথর মাটিতে মেশানো।
তবু না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘তোমার চাচির কর্থা তো আলাদা। সে কোন দেশের?’
অস্পষ্ট আলোয় দেখি, গাজির মুখে হাসি চিকচিক করে। বলে, ‘বাহ্ রে, বাবু দেখি বড় কান খড়খড়ি মানুষ। কোনও কিছু ফাঁক যায় না।’
বলি, ‘না, তোমাদের কথার সঙ্গে মিল পেলাম না কিনা, তাই।’
গাজি বলে, ‘পাবেন কেমন করি বাবু, চাচি তো এ-দেশির মেয়ে না।’
তবে কোন দেশের! নিশ্চয়ই সেই, ‘উঁচা উঁচা পাবত’ দেশের ‘শবরীবালা’ সে নয়। কারণ, তার কথার মধ্যে সে উচ্চারণও ছিল না।
গাজিই তার জবাব দেয়, ‘সেও এক বিত্তান্ত বাবু। অই যি দ্যাখলেন মাহাতো চাচাকে, ওঁয়ার তিন বিয়া।’
‘তিন বিয়া? মানে তিন বউ?’
‘হ্যাঁ, ওর তিন বিবি কি আর আছে। পেত্থম বিবি ব্যামোয় মরে। দোস্রা বিবি হারায়ি গেছে।’
‘হারিয়ে গেছে? কেমন করে?’
‘সে কথা বাবু কেউ বলতি পারে না। তয়—’
গাজি সুর টানে, কথা শেষ করে না। তাকিয়ে তার মুখ ভাল দেখতে পাই না। মুখটা তার নিচু, মাটিতে নিজের ছায়ার দিকে। একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘তয় শুনিচি, আমাদের সে চাচির চরণ দু’খানি নাকি বড় চঞ্চল ছিল। পথের মানামানি ছিল না।’
গাজির নিচু অন্ধকার মুখের দিকে তাকাই। কথাটা ঠিক ধরতে পারি না। তবু মনে হয়, কীসের এক ইঙ্গিত যেন, আঁধারে চিকচিক করে।
গাজি নিজেই আবার সেটুকু স্পষ্ট করে তোলে, ‘কথাখানি ধরতি পারলেন তো, বাবু। পথের মানামানি না থাকলি কি চলে। তা সে মেয়েলোক বলেন, আর পুরুষলোক বলেন, একদিন তুমি আঘাটায় যেয়ি পড়বে। তা, আমাদের সে চাচিও কোন আঘাটায় যেয়ি পড়িছে, কেউ জানে না। সে নিজিই হারায়ি গেছে।’
কথা আর অস্পষ্ট থাকে না। মাহাতোর দ্বিতীয় বউ স্বামীত্যাগিনী। আমার অবাক লাগে গাজির বচনে। কুলত্যাগিনীর নামে সে কত বিশেষণ জুড়তে পারত। বউয়ের নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেটুকু পাপের কথা আছে, ‘চরণ দু’খানি নাকি বড় চঞ্চল ছিল’, এইটুকুতেই তার ধরতাই। এবার যা বোঝার তা বুঝে নাও। আর কোনও কটুকাটব্য নেই। ক্ষোভে রোষে কোনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ নেই। বরং দেখ, গাজি মুখ তোলে না। মাথার পাগড়ির ছায়ায় তার মুখ সেই অন্ধকারেই ঢাকা। কুল ছেড়েছে মাহাতোর বউ, যেন তাতে গাজির বড় লজ্জা। সে দুঃখিত। এই কি গাজির মন, না কি শালীনতা, বুঝতে পারি না। যেটাই হোক, এমন মেলা দায়। তাও কিনা ঝুলি কাঁধে করে ফেলা এক গাজি দরবেশের কাছে।
এবার আমার চোখে ভাসে মাহাতোর মুখখানি। গাজির মন তো তার নয়। তার যে মূর্তিখানি দেখলাম, তাতে যে সে সবকিছু ধুলার মতো উড়িয়ে দিয়েছে, মনে তো হয় না। তার ওই লাল চোখে কি আগুন জ্বলেনি! না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘মাহাতো কিছু করেনি? বউয়ের খোঁজখবর করেনি?’
গাজি মুখ না তুলেই জবাব দেয়, ‘খোঁজখবর আর কী করবে, বাবু। অজানা তো কিছু না। তয়, মাহাতোর রক্ত তো চাচার শরীলি। খবর পেয়িছিল, বউ নসরতের সঙ্গি মোল্লাখালির দিকি গেছে। চাচা মোল্লাখালি দৌড়িছিল। বউ ফিরিয়ে আনবার জন্যি না, দুইখানি মুণ্ডুর জন্যি। সেখানে যেয়ি শুনলে, নসরত বউ নিয়ি জঙ্গলে চলি গেছে। চাচাও নাকি জঙ্গলে গেছিল, এক মাস ঘরে ফিরে নাই। চখে দেখি নাই, শুনিছি, হাতে একখানা ভল্লা নিয়ি চাচাকে নাকি সেই পাখিরালা থেকি রাইমঙ্গল তক সবাই ঘুরতি দেখিছে।’
আমার চোখের সামনে আবার মাহাতো ভাসে। কিছু না হোক, বারো বছর আগের মাহাতো হবে, যে ভল্লা নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে জঙ্গলে বউ আর তার সঙ্গীকে খুঁজে ফিরেছিল। সেই মূর্তিকে দেখতে পাই যেন। কুচকুচে কালো এক ভয়ংকর মূর্তি। যার আহার নিদ্রা তল। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে চোখে। হাতে ভল্লা, পরনে একখানি লজ্জা নিবারণের কানি।
জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর?’
গাজি বলে, ‘তারপর আর কী, বাবু। চাচা ঘরে ফিরি এল, তাদের দেখা পায় নাই। তয়, মজা কী জানেন বাবু, বছর না ঘুরতি নসরত বান্দর ফিরি এল। তখন লড়াইয়ির সময়, আকাল। নসরতের যা এক-আধটুকু জমি, সবই তো ভোলাখালিতে। এসি পড়ল একেবারে মাহাতো চাচার গোড়ে।’
জিজ্ঞেস করি, ‘সেই বউ?’
‘আসে নাই। চাচাও তো সে কথাই পুছ করিছিল, “সে কই।” নসরত বলিছিল, বউ তাকে ছেড়ি গেছে।’
আমি অবাক হয়ে পুছ করি, ‘ছেড়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ বাবু, সেটা মিছা না। নসরত তো তার সব ছিল না। নসরত ধরা তার স্বভাব ছিল যে। আবার এক নসরত ধরি সে চলি গেছে। আর এই বান্দর ফিরি এসেছে। যাবে কম্নে! নিজির চাষবাস বিবি ছাওয়াল সব ফেলি গেছে না? আর ভোলাখালিতে থাকতি হলি, মাহাতো চাচার গোড়ে না পড়লি কী থাকা যায়?’
‘মাহাতো কী করলে?’
এইবার গাজি মুখ তোলে। বলে, ‘খুন করে নাই, বাবু। নিজির বউকে তো সে জানত। সব কথা শুনি-টুনি খালি বলিছিল, “যা নিজির চাষবাস দ্যাখ গা।” তা সেই বান্দরের হাল আজ দ্যাখেন।’
সেই বান্দর মানে নসরত। এই বন্দর বিশেষণের মধ্যে একটা সুর ছিল। যে সুরের মধ্যে রাগ বিদ্বেষ ছিল না, করুণা ছিল। জিজ্ঞেস করি, ‘কী হাল?’
গাজি বলে, ‘কর্ম বলি একটা কথা আছে, বাবু। ভাল মন্দ জানি না, যেমন কাম, তেমন ফল তোমাকে পাতি হবে। সেই যে এক বছর, নসরত সব ছেড়ি গেল, তর ফল হলো, হাওলাত করজায় জেরবার, জমিজমা বেবাক বেহাত। এখন দ্যাখেন গে, মাহাতো চাচার মুনিষের কাম করে সে। বিবিটাকেও মাঠি নামতি হয়িছে, তাও সেই চাচার জমিনেই।’
এ তো গেল দুস্রি চাচির বৃত্তান্ত। তার সঙ্গে নসরত-কিস্যা। তিস্রি চাচির ব্যাপার কী। জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর, এই চাচি এল কোত্থেকে?’
এবার গাজি হাসে। বলে, ‘ভাসতি ভাসতি।’
অর্থাৎ ভাসতে ভাসতে। সে আবার কেমন আগমন। জলে ভাসতে ভাসতে নাকি। তা হলে তো, এই নোনা গাঙের কামট কুমিরের পেটে যেতে হত। জিজ্ঞেস করি, ‘সে কী রকম?’
গাজি বলে, ‘বললাম না বাবু তখন আকালের সময়। পেটের জ্বালায় গাঁ ঘর ছেড়ি চলি যেতি লাগল একদল। আর একদল আসতি লাগল, সবাই তো আর শহরে যায় নাই। ধান চাল যত কেন গায়েব হোক, চাষ আবাদ চাই তো। খেতি পাবার আশায় এই বাদায়ও অনেক মানুষ খাটতি এসিছিল। সেইরকম এই মজুরানী দলের সঙ্গে আমাদের এই চাচি এসিছিল। আর বাবু, কী বলব বলেন, মন বড় ব্যাজ। চাচার তখন সেই ব্যামো।’
কথার খেই ধরতে পারি না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী ব্যামো?’
‘মনের, বাবু। অই যে সেই বলে না, “অ তোর ঝুলকালিতে মাখামাখি মনের আয়না। মন, একবার ঘষে মেজে দ্যাখ রে মন মনা।” চাচার তখন সেই গোত্তর। আয়নায় ঝুলকালি, নিজিরে দেখতে পায় নাই। বউ চলি যাবার পর থেকিই ব্যামো। না, জোরজবরদস্তি করে নাই, তয় সেও ভাল বলি। কিন্তু দানা তোমার ঘরে, চিড়িয়া যাবে কম্নে। তুমি দানা ছড়ালিই চিড়িয়া আসবে।’
বলে, গাজি যেন কেমন করে হাসে। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় যেমন কুহেলি, তার থেকে বেশি রহস্য দেখি তার দাড়ি-চাঁচা মুখে। চাহনির রকম বুঝি না। কথার হদিস ধরতে পারি না। গাজি তেমনি হাসতে হাসতে আবার আমাকেই সাক্ষী মানে, ‘না কী বলেন, বাবু।’
বলি, ‘কথাটা বুঝতে পারলাম না।’
গাজি এবার আওয়াজ দিয়ে হাসে। বলে, ‘না বাবু, আপনি তো দেখি বড় সোজা, ফুটকচালি বোঝেন না। চাচার ব্যামো ধরতি পারলেন না?’
‘না তো।’
গাজি এক মুহূর্ত আবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই উচ্চারণ করে, ‘না তো! কী বলব বলো দিকি আমার বাবুকে।’
বলে হঠাৎ ঝুঁকে আসে আমার দিকে। এই তেপান্তরের ফিকে জ্যোৎস্নায়, যেখানে কাকপক্ষীটি নেই, সেখানে সে আমার কানের কাছে মুখ এনে, ফিসফিসিয়ে বলে, ‘চিড়িয়া বুইলেন না, বাবু। মেয়েমানুষ, বুইলেন। চাচার গোলায় তখন ধান, সবাই তার কাছে হাত পেতি আছে। মরদ আর ক’টা তখন গাঁয়ে, সব আপন প্রাণ বাঁচা, পেটের জ্বালায় ঘরদোর ছেড়ি দৌড়। মেয়েমানুষগুলো সব যেতি পারে নাই। ভুখ তো বাবু খালি মরদের না, মেয়েমানুষেরও সমান, না কী বলেন, অ্যাঁ? তো চাচার তখন সেই দশা, যার মুরশেদ হাফিজ হয়িছে। মুরশেদ হলো বাবু বিশ্বাস, দেল, আমার দেলবাস। তা সে যদি চায়, চক্ষি আন্ধার, আর কী থাকে বলেন। সে তখন নষ্ট হয়ি যায়। চাচাও নষ্ট হয়ি গেছিল। মেয়েমানুষ এলি ধান দিত…। এইবার বুইলেন তো। তা ওইতি কি আর প্রাণের ঘা শুকায়?’
এবার ধরতে পারি চাচার ব্যামোর ধরন। ক্ষুধার্ত ঝি-বউদের ধান দিত মাহাতো। শোধ নেবার পদ্ধতি ছিল আলাদা। সে নিজে নষ্ট হয়েছিল, তাই অপরকে নষ্ট করত। অথচ যে মাহাতোকে দেখেছি, তাতে একবারও মনে হয়নি, আঙুরের সেই স্বামীটি ধান দিয়ে, মেয়েদের ইজ্জত নিয়েছে। এ মানুষে সেই মানুষ আর নেই। গাজির কথায় আরও বুঝেছি, তখন মাহাতোর প্রাণে ঘা। বিষাক্ত ঘা। দুস্রি চাচির আঘাটায় বাওয়ার ঘা। সেই তার ব্যামো। শোধ নিতে চেয়েছিল নিরপরাধ মেরে।
জিজ্ঞেস করি, ‘সে ঘা শুকোল কেমন করে?’
গাজি বলে, ‘এই নয়া চাচিকে পেয়ি। এই নয়া চাচির বয়স তখন কাঁচা। সবাই হাত বাড়ায়ি, এই খায় তো, সেই খায়। দু-চার থাবা এদিক-ওদিক থেকি পড়ে নাই, তা বলা যাবে না। মাহাতো চাচাও তো থাবা দিতিই গেছিল। ব্যামো তো জবর।’
‘তারপর?’
‘তারপর থাবা দিতি যেয়িই চাচার হাত ভেঙি গেল।’
‘হাত ভেঙে গেল।’
গাজি হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, ‘অই আর কী। সত্যি কী আর হাত ভাঙে। চাচা নিজিরে চিনতি পারে। এবার মনের দায়। চাচা যে কাঁচাখেকো দেবতা হয়ি উঠিছিল, সেই কাঁচাখেকো দেবতার নজর গেল আটকে। কাঁচা মেয়েটিকে দেখি বাতাস লাগল উজানি। ব্যামো ছিল বটে, নজরটা হারায় নাই। পেত্থমে দিল থাকার জায়গা, কাজ দিল ঘরের। তখন দ্যাখে, মেয়েটি ঘরের ছিরি ফিরায়ি দিয়েছে। সেই থেকি আর ছাড়াছাড়ি হয় নাই।’
সমাজে বাস করি, সমাজের মন কথা বলে, ‘বিয়ে-থা হয়ে গেল?’
গাজি আরও হাসে। বলে, ‘আর কত বে’ করবে, বাবু। দু-দু’বার তো করিছিল। এবার বে’ না করি ঘর। ত’ দ্যাখেন, বে’ করি যা হয় নাই, এবার তা হয়িছে। দুটিরে দ্যাখলেন তো। বে’ করলি কী আর এর থেকে বেশি কিছু হয়।’
সে কথা মানতে হবে। আর একবার আমার চোখের সামনে মাহাতো আর আঙ্রি ভেসে ওঠে। বিবাহের চেয়ে মানুষ বড়। মানুষের জীবনধর্ম বড়। মানুষকে কি কেবল সাত পাকেই বাধা যায় ? পুরোহিত আর মোল্লার মন্ত্রেই কি মানুষ মানুষের কাছে ধরা পড়ে? মরা কি আর মন্ত্রে জাগে? প্রাণের ধিকিধিকি চাই। যেখানে প্রাণ আছে, সেখানে সব আছে। তার চেয়ে বড় বল, আঙ্রি হলো আরোগ্যের ওষুধ। শাঁখের শব্দে, বাজনা বাজিয়ে, কপালে কুলোর ছোঁয়ায় আঙ্রি স্বামী-ঘর করতে আসেনি। প্রাণের দায়ে দিশেহারা হয়ে এসেছিল। একে বলে আগমন। আসলে তার অসহায় চোখের জলে ছিল মাহাতোর আধিব্যাধি মন্ত্রৌষধি। এ কথা বলব না, আঙ্রিকে আশ্রয় দিয়ে মাহাতো মহৎ কাজ করেছিল। বরং উজান চালে বলি, সে মরা থেকে বাঁচায় ফিরেছে। তার কীসের অহঙ্কার। সে কৃতজ্ঞ তোক আঙুরলতার কাছে। আমরা সকলে কৃতজ্ঞ থাকি আঙুরলতার কাছে। যে মরতে যায়, সে প্রাণ সঞ্চার করে না। যে বাঁচতে ছোটে, জিয়নকাঠি তার হাতে। সে-ই তো রব তোলে, প্রাণ দাও, প্রাণ দাও!
মনে মনে না বলে পারি না, ‘বাহ্ আঙ্রি, জীবনে তোমার জয়। তোমার আবার পরিচয় কী। কীসের বা বিবাহ! তুমি চির আয়ুষ্মতী, চির সধবা।’… ঘরছাড়া ক্ষুধার্ত মেয়েটার চোখে ছিল ঘরের শ্রীর স্বপ্ন। হাত দিতেই সেই শ্ৰী ফুটে উঠেছিল। রুগ্ণটা সঙ্গে সঙ্গে ওর বিস্বাদে স্বাদ পেয়ে সুস্থ হতে আরম্ভ করেছিল। এখন মনে হয়, একবার ভোলাখালি না এলে পাপ হবে। চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, তাকে। কালো মুখে হাসির ঝলক। যেন তাকেই বলি, ‘একবার আসব, আসবই।’…
ইতিমধ্যে কখন যেন, কোন পথে বাঁক নিয়েছি, খেয়াল ছিল না। মনে মনে আনমনা, গাজির ছায়ায়, ছায়ায় চলি। কিন্তু পথ বদল হয়েছে কখন, ধেয়ান ছিল না। দেখি, গায়ে আগুনের রক্তাভা কাঁপে। সামনে লেলিহান শিখা মস্ত বড় কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। আগুন জ্বলে উঠোনের মাঝখানে, তার চারপাশে ছোট ছোট চালাঘর। সেই আগুনের চারপাশে নানান বয়সের নরনারী। মানুষ নয়, ছায়া যেন। দলে দলে, গুচ্ছ গুচ্ছ আগুন ঘিরে নানান জটলা। কার কথা কে শোনে, ঠাহর পাবে না। ঝগড়া করে, না বিবাদ করে; বিচার বৈঠক করে না মজলিস করে, বোঝবার উপায় নেই। তার মধ্যেই শোনো, কে যেন আবার বেসুরো গলায় গান করে। যে গানের ভাষা বোঝা দায়।
কে একজন মোটা আর জড়ানো গলায় হাঁক দেয়, ‘কে যায় হে?’
গাজি দাঁড়ায়। আমিও দাঁড়াই। গাজি হেসে বলে, ‘কে যায় না যায়, তা কি এখন চিনতি পারবে হে?’
‘ক্যানে, চিনতে ক্যানে পারব না হে।’
বলতে বলতে আধ-ন্যাংটা খালি গা এক বুড়ো টলতে টলতে উঠে আসে উঁচু রাস্তার ওপর। গেঁজে-ওঠা রসের গন্ধ তার নিশ্বাসে। বোধ হয় সারা গায়ে। রক্তবর্ণ চোখের নজর ঢুলুঢুলু। না কামানো খাবলা খাবলা গোঁফদাড়ি সারা মুখে। তাতে একটি আমেজের হাসি। বলে, ‘চিনতে পারব না ক্যানে, তুই তো গাজি।’
বলতে বলতে নজর পড়ে আমার দিকে। কী মনে হয়, কে জানে। হঠাৎ দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে কোমর ভেঙে নিচু হয়। বলে, ‘ই দ্যাখ, বাবুকে চিনতে পারি নাই। কবে এলি বাবু?’
গাজি আমার দিকে চেয়ে হাসে। বুঝতে পারি, দ্রব্যগুণে এখন সকলেই তার চেনা। অবাক হবার কিছু নেই। গাজি বলে ওঠে, ‘বাবুকে চিন নাকি?’
মাথা ঝাঁকাতে গিয়ে লোকটার গোটা শরীরে এমন টাল খেয়ে যায়, ভাবি বুঝি গড়িয়ে পড়ে ঢালুতে। কিন্তু পড়ে না। বলে, ‘ক্যানে, চিনতে লারব ক্যানে? ই তো আমাদিগের বাজারের মাহাজন ঠাকুর মশাইয়ের বিটা।’
এখন কী বলবে বলো। কোথা থেকে কোথায় এলাম। এখন বলে, মহাজন ঠাকুর মশাইয়ের ব্যাটা।
গাজি হাসতে হাসতে বলে, ‘খুব বুঝতি পেরিছি যাও, এখন যা করছিলে, তাই করগা।’
আবার সেই মাথা ঝাঁকানি। যেন ক্ষ্যাপা মোষে ঢুঁ মারতে আসে। বলে, ‘ক্যানে, এই সিদিনে বাবুর বিয়া হলো, আমরা খেতে পেলাম নাই। ইবারে কিন্তুক খাওয়াতে হবে।’
যাক, নববিবাহিত পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছি। এখন সদ্য সদ্য খাওয়াবার দায় থেকে নিষ্কৃতি পেলেই বাঁচি। ইতিমধ্যে উঠোনের ভিড় থেকে কে যেন কী বলে ওঠে। সে ভাষাটা হয়তো সাঁওতালি কিংবা অন্য কোনও আদিবাসী। এখন বুঝতে অসুবিধা নেই, এরা বাদা অঞ্চলের ভূমিহীন কৃষি-মজুর আদিবাসী। হয়তো মাহাতোর মতো বংশপরম্পরা বাস নয়, তাই ভাষা বদলায়নি। বাংলা বুলির চালটা তাদের সবখানেই একরকম।
উঠোনের কথা শুনে বুড়ো তার নিজের ভাষায় ধমকে ওঠে। কী যেন বলে, বুঝতে পারি না। গাজিও যে পারে না, তা বুঝতে পারি। তবে সে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা, তা একদিন খাওয়ানো যাবে, এখন আমরা চলি।’
তা বললে তো হয় না। এখন পেটে আমার রস, মুখে আমার বুড়বুড়ি। আবার হাতজোড় করে বলে, ‘বেশ, তবে বাবুটা আজ আমাদের সাথে খেয়ে যাক।’
উঠোনে তখন কেবল জটলা নয়, কীসের একটা বাদানুবাদে যেন ঝগড়া লাগবার উপক্রম। গাজিও এবার ধমক দিয়ে বলে, ‘অই গো, টংকো, তোমারও কি মাথা খারাপ হল। ঠাকুরমশাইয়ের ছেলে কি ওসব খায়?’
বলে সে আমাকে ইশারা দেয় তাকে অনুসরণ করতে। টংকোর তখন টনক নড়েছে। তাড়াতাড়ি জিভ বের করে কান মলে। বলে, ‘ই দ্যাখ গ, ছি ছি ছি…।’
তার কথা শেষ হয় না, আমরা চলতে আরম্ভ করি। বিবাদের মধ্যেই আবার যেন কে হাঁক দেয়, ‘অই গাজি, একটা গান গেয়ে যা।’
কথা শেষ হয় না, তার আগেই এই কুহেলি জ্যোৎস্না নিশ্চুপ তেপান্তর এক তীব্র আর্ত চিৎকারে যেন ফালা ফালা হয়ে যায়। গাজি বলে ওঠে, ‘আহা মুরশেদ! চলি আসেন বাবু।’
বলে সে কানে আঙুল দিয়ে এগিয়ে যায়। চকিতে একবার উঠোনের এক পাশে আধমরা বরাহটা আমার নজরে পড়ে। এতক্ষণ একটুও টের পাওয়া যায়নি, উঠোনের এক পাশে চার পা বাঁধা শেল-হানা জীব একটা পড়ে আছে। সম্ভবত পশুটা ওর মরণের ঘোরে আর একবার জীবনের ডাক ডাকে।
আমাকেও যেন একটা আচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে। আমার বাস্তব থেকে হারিয়ে যাই। স্মরণ থাকে না, কোথায় চলেছি, এলাম কোথা থেকে। নিশি-পাওয়া ঘোরে যেন গাজির পিছু পিছু চলতে থাকি। আর মনে হতে থাকে, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে কত বিচিত্রের খেলা। জীবনের কোনও কিছুই একটার পর একটা সামঞ্জস্য করে কেউ সাজিয়ে রাখেনি। সকলই অসমঞ্জস। যখন তুমি হাসি-ঝলকানো ডাগর-চোখ সেই মুখখানি দেখ, তখনই তোমার চার পাশে ভিন্ন উৎসব, অন্য মানুষ। তোমার তৈরি বাস্তবের সঙ্গে, আসলের কোনও মিল নেই। বাস্তব বড় স্বাধীন লীলা করে।
চলতে চলতে একসময়ে কানে আসে, ‘বাবু!’
চেয়ে দেখি, গাজি আর আমার আগে আগে নেই। সে আমার পাশে পাশে চলে। ভাবি, সে হয়তো আধমরা পশুটার কথা বলবে। বলি, ‘বলো।’
কিন্তু গাজি সেদিক দিয়ে যায় না। আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘বাবু রাগ করেন নাই তো?’
হঠাৎ এ আবার কোন বাঁকে ফেরে। এখন আবার রাগের প্রসঙ্গ আসে কোথা থেকে। বলি, ‘রাগ করব কেন?’
গাজির মুখে দেখি বিকালের সেই অপরাধীর হাসি। বলে, না বাবু, আমার ভুলির জন্যি আপনাকে আটকি পড়তি হল।’
ধন্য গাজি, এতক্ষণে এই অপরাধ ভঞ্জনের পালা। এতক্ষণ ধরে একবারও বুঝতে পারিনি, ভুলের অপরাধ এখনও সে বয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ কী জবাব দেব, বুঝতে পারি না। তার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করি। সেখানে তো রাগ বেজারের চিহ্ন দেখি না।
গাজি ততক্ষণে আবার ধরেছে, ‘আগে যদি জানতাম বাবু, তা হলি আপনাকে কষ্ট দিতাম না। তয়, বাবু জানবেন, ভয়ের কিছু নাই। আমি সারা রাত আপনার দোরে বসি থাকব।’
ফিকে জ্যোৎস্নায় গাজির মুখের দিকে তাকাই। কেন যেন তার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা টনটনিয়ে ওঠে, কথা বলতে পারি না। কেন এমন হয়, আমি জানি না। কেবল এইটুকু মনে হয়, আমার বুকে যেন কীসের এক মিলনের জোয়ার বইছে। সেই জোয়ারে আমার গলা বন্ধ হয়ে যায়।
গাজি আবার ডাকে, ‘বাবু!’
আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলি, ‘গাজি, রাগ করিনি। সবই আমার ভাল লাগছে।’
‘সত্যি বাবু।’
পারলে যেন ছোট ছেলেটার মতো কোমর দুলিয়ে নেচে দিত। তা না করে কেবল গুনগুনিয়ে দেয়, ‘মন বুঝে দ্যাখ, মনে তোমার কার উদয়। নিদ্দয় নিদ্দয় এত বলো, এবারে সদয়।’
এতটা আমার প্রার্থনা নয়। গাজি যেমন করে বলে, তেমন করে শুনতে চাই না। তার আনন্দ বুঝি। আর ভাবি, আজ এখানে এখন না-হয় গাজিকে দায়ী করব; কিন্তু সে না থেকেও যদি, এমনি বিপাকে পড়তে হত, তা হলে কোথায় পেতাম গাজি। তার ভুল হয়েছে, সে কথা মেনেছি। এবার মানি, আমি তাকেও পেয়েছি।
.
২১.
দেখতে দেখতে হাটের মধ্যে এসে পড়ি। রাতের ধন্দ আমার চোখে। বুঝতে পারি না, কোথা দিয়ে কোথায় আসি। দু-একটা ঘর পেরিয়েই হাতের কাছে দেখি সেই গাছ। কালো ছায়া তার নীচে। সেখান থেকে সামনে নারায়ণ ঠাকুরের মহামায়া হিন্দু হোটেল। দাওয়া শূন্য। ঘরেও কেউ আছে বলে মনে হয় না। ঘরের মাঝখানে একটা হারিকেন জ্বলছে।
আমরা দু’জনেই দাওয়ায় উঠে যাই। সেই সময়ে ঘরের দেয়ালের কাছে একটা ছায়া নড়ে উঠতে দেখি। ছায়া উঠে দাঁড়ায়। কায়ার গায়ে আলো; কায়ার মুখেও আলো পড়ে। কায়ার শিথিলবাস শাড়ি। তাড়াতাড়ি সাব্যস্ত করে। খোলা চুল দু’ হাতে টেনে ধরে, তাড়াতাড়ি পিছনে আঁটে। মনে হয়, এ মুখ যেন চিনি-চিনি। মুখখানি গম্ভীর। চোখ দু’টি একটু খর বটে। এখন যেন একটা স্বপ্ন-ভাঙা চমকের মতো অচেনা দৃষ্টিতে চোখাচোখি করে। আমি যে অচেনা ভিনদেশি, নজরে তার সেই খবর। আপাদমস্তক দেখে সে মুখ ফেরাতে যায়।
তখনই গাজির গলা শোনা যায়, ‘দুলি ঠাকরুন না!’
গাজি তার মুখ বাড়িয়ে আনে। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে যেন একটু অবাক হয়, চমক খায়। তারপরে বলে, ‘অ, তুমি!’
ততক্ষণে আমার মনে পড়ে যায়, এ সেই পুকুরধারের দুলি। এ সেই অনন্তর দুলি। কিন্তু সে তার ঘর ছেড়ে এই সময়ে নারায়ণ ঠাকুরের ভোজনালয়ে কেন। গাজিও সেই কথাই বলে, ‘তুমি যে এখন এখানে?’
দুলি চকিতে একবার ভিনদেশিকে দেখে নেয়। বারেক যেন নাকের পাটার নাকছাবি কেঁপে যায়। অনেকটা নির্বিকার গলাতেই বলে, ‘এই এসেছিলাম, নারায়ণদাকে একটা কথা বলতে। রাত্রে মাংস আর ভাত রান্না করে পাঠাবার কথা ছিল। বলতে এসেছিলাম, পাঠাবার আর দরকার নেই।’
গাজি বলে, ‘কেন গো ঠাকরুন, আজ কি খাওয়া-দাওয়া নাই?’
দুলি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘নাঃ, শরীরটা ভাল লাগছে না। আজ আর কিছু খাব না। তা ভাবলাম, বলে শুয়ে পড়ব গিয়ে। এসে দেখি, কেউ নেই।’
‘কেউ নাই?’ ফোঁচা, ফোঁচার বউ?’
‘কই, কারুক্কেই তো দেখি না। খালি দেখি, ফোঁচাদার একটা ছেলে বসে রয়েছে ভেতরে। জিজ্ঞেস করলাম, বলে, “কী জানি, জানি না।” তাই বসে আছি। না বলে গেলে ফোঁচাদাকে দিয়ে আবার কাঁড়ি খানেক ভাত মাংস পাঠিয়ে দেবে, সব ফেলে দিতে হবে।’
বলে দুলি আবার একবার ভিনদেশির দিকে চায়। এবার শুধু নজরে তার অচেনার খবর নয়। এবার কৌতূহল, এবার জিজ্ঞাসা। সোজা নজরে নয়, একটু বাঁকা চালের নজর। তারপরে দেখ, মুখ ফেরাতে গিয়ে আলগা চুলের বাঁধন আবার খুলে যায়। আবার হাত তুলে টেনে চুল বাঁধে। তাতে শরীরে কেন দোলা লেগে যায়, পায়রার মত কেন ঊর্ধ্বাঙ্গে বাঁক লেগে ঢেউ খেলে যায়, তা জিজ্ঞেস করো না। জীবনযাপনের একটা চাল আছে তো। পেশা বলো, জীবিকা বলো, তার একটা ছাপ ফোটেই। তা সে যখন যেখানে যেমন ভাবেই হোক। চোগা-চাপকান না থাকলেও, দেখলে উকিলের বাত বোঝা যায়। বুক দেখার নল না থাকলেও ডাক্তারের ধরতাই ধরতে পারবে। দারোগার চাল বুঝবে, পণ্ডিতের বুলি ধরতে পারবে। দুলিকে তার থেকে বাদ দেওয়া যায় না। গঞ্জে নয়া মানুষ, তায় ভোজনালয়ে। জীবিকার ভাবভঙ্গি উঁকি না দিয়ে যায় কেমন করে। তা সে ঘণ্টা কয়েক আগে প্রাণের ঘরে জ্বালানি পোড়ানি যতই হোক।
তবে যদি নজর করে দেখ, দেখবে খর চোখের কোল যেন কেমন উথলানো, ফোলাফোলা। চোখের অনেক জল গলেছে বুঝি। এখন যে একটু নজর করে, নজর কাড়ার ছল, তার ওপারে দেখ, পাখিটার চোখের সামনে যেন সন্ধ্যা। রাতের অন্ধকার নামে, তাই সুখ নেই, ডাক নেই, গান নেই। আছে শুধু বিষণ্ণতা।
তবু ভিনদেশিটার চোখ ফিরে আসে। দুলির চোখের নিঃশব্দ জিজ্ঞাসাবাদ বড় স্পষ্ট কিনা। যেন প্রায় গলার স্বরে শোনা যায়। ‘অচেনা লাগে। ফিকির কী?’
গাজি তখন হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু মাংস আজ পাবে কম্নে গো ঠাকরুন? হাটের দিন তো না, বসির কি খাসি-পাঁটা কিছু কেটেছে নাকি?’
দুলি হাসে না, ঠোঁট উলটায়। তাতে যেন মেয়েকে যেমন ঠ্যাকারে ঠ্যাকারে লাগে। বলে, ‘না, খাসি-পাঁটা নয়, রামপাখির মাংস রাঁধতে বলা হয়েছিল।’
গাজি অমনি আওয়াজ দেয়, ‘অই বাবা। তয় তো বেশ ভাল খ্যাটনের বাওস্থা ছিল আজ। তা অমন খ্যাটন ছেড়ে একেবারে উপোস কেন?’
দুলি ভুরু কোঁচকায়। নাকছাবি কাঁপে। মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘অই যে বললাম, শরীর খারাপ। কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।’
বলে সে এগিয়ে গিয়ে ভিতর দরজার দিকে যায়। গাজি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘অই গো ঠাকরুন, আমার তো ঘরের মধ্যে যাওয়া নিষেধ। একখান চ্যার দ্যাও দিনি, বাবুকে বসতি দেই।’
এবার আমার টনক নড়ে। বলে উঠি, ‘না না, থাক না, আমিই নিয়ে আসছি।’ বলে ঘরে পা বাড়াতে যাই। দুলি ততক্ষণে একটা চেয়ার তুলে নিয়েছে। দরজার কাছে আসতে আসতে আবার চোখ তুলে চাওয়া। চোখে সেই অনুসন্ধিৎসা। চেয়ারখানি আনতে আনতে হাতে হ্যারিকেনটা তুলে নিতে ভোলে না। সে দরজার কাছে আসতেই তার হাত থেকে চেয়ার তুলে নেয় গাজি। দেওয়াল ঘেঁষে পেতে দিতে দিতে বলে, ‘বসেন, বাবু। ঠাকুরমশাই বা ফোঁচা এলি হাতমুখ ধোবার জল দিতি বলি।’
দুলি তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, হাতের বাতি দিয়ে দাওয়ায় আলো ফেলে। গাজির দিকে একবার জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। তারপর হ্যারিকেনটা দরজার কাছে রেখে ঠোঁট টেপে, ভুরু টান করে। ঘরের মধ্যে চলে যায়।
এমন সময় ভিতরের দরজার কাছে সেই ডিগডিগে শরীরের ভিতর থেকে মোটা গলা শোনা যায়, ‘ওখেনে কে?’
আগে সাড়া দেয় দুলি, ‘আমি গো, নারাণদা।’
নারায়ণ ঠাকুরের স্বর এগিয়ে আসে ঘরের মধ্যে। শোনা যায়, ‘কে দুলি নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই দেখ, আমি আবার তোমার ঘর থেকে ঘুরে এলাম।’
‘ওমা, কেন?’
‘একটু মোচলমানপাড়ায় গেছলাম কিনা। টংকোদের বস্তিতে তো আজ শুয়োর মেরেছে, পচুই-টচুই খেয়ে, সব যে-যার তালে আছে। ভাবলাম, ও ব্যাটারা তো আজ আর মুরগি দিতে পারবে না। এদিকে সুস্থ না হলে মুরগি খোঁয়াড়ে ঢুকবে না। তাই বেলা পড়তে মোচলমানপাড়ায় গেলাম। ভাল জিনিসই পেয়েছি। আসবার পথে তোমাকে দেখিয়ে আনব বলে গেলাম। তা দেখি ঘর বন্ধ, আবার যা শুনলাম—।’ নারায়ণ ঠাকুর কথা শেষ করতে পারে না। দুলি বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, আমিও তোমাকে সেই কথাই বলতে এসেছি। মাংস-ভাতের আর দরকার নাই, নারাণদা।’
একটু চুপচাপ। তারপর নারায়ণ ঠাকুরের গলা শোনা যায়, ‘তা বেশ তো, তোমার আর অনন্তর, দু’জনের জন্যে বলেছিলে। সে না খায়, তুমি খাবে তো? এখন আবার ঘরে গিয়ে আখায় আগুন দেবার দরকার কী?’
দুলির গলায় এমনিতে যেন টানা তারের ঝংকার। সুর চড়া নয়, তীক্ষ্ণতা বাজে। এখন যেন কেমন একটু শিথিল হয়ে পড়ে সেই টানা তার। বলে, ‘না নারাণদা, নিজের জন্যে রাঁধব না। খিদে-টিদে নাই। আমি আজ রাতে আর কিছু খাবো না কো। পাখিটা কেটেকুটে আনো নাই তো?’
নারায়ণ ঠাকুরের মোটা গলার সুরটাও যেন কেমন বেসুরো বাজে। ঠেক খেয়ে খেয়ে বলে, ‘না, তা মারা হয় নাই, পাখি তো ফোঁচাই মারে।’
দুলির গলা শোনা যায়, ‘তবে আর মেরো না। তুমি যদি না রাখো, অন্য কারুকে বেচে দিয়ো, না তো আমিই কাউকে বেচে দিতে পারি।’
নারায়ণ বলে, ‘আহা না, সে কথা হচ্ছে না—।’
কথাটা যেন তার শেষ হয় না। তবু চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ আর কোনও কথা শোনা যায় না।
বিষয়টা এবার অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে যায়। বায়না ছিল দুলির, আজ রাত্রে তার আর অনন্তর জন্যে মাংস-ভাতের। আজ ছিল তার নিজের ঘরে অরন্ধন। খাবার আসত বাইরে থেকে। ঘরে তাদের কথা ছিল দুহুঁ দোঁহার রঙ্গে যাবে। কিন্তু অনন্ত প্রেমের থেকে দাদার মান দিয়েছে বেশি। যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা। গাজির সেই গানের কথা মনে পড়ে যায়। তা না-হয় হল। নিজের পেটের সঙ্গে লেনাদেনা বন্ধ কেন? আজ রাতে দুলির কেন খিদেটিদে নেই?
সব কেন-র জবাব চেয়ো না। জবাব পাবে না। সেই হিসাবে মিলিয়ে নাও না, যে হিসাবে উপহারের দ্রব্য দাওয়ায় ফেলে দিয়েছিল। দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। যে উপহার দেয়, তার চেয়ে কি উপহার বড়? যার সঙ্গে খাবার কথা, সেই খাওয়া থেকে কি নিজের ক্ষুধা বড়?
বলতে পারো, পেট ছাড়া বারোবাসরের মেয়েটার আছে কী। নেই বলেই তো ও মেয়ে বারো স্বামীর ঘরে। কিন্তু বলে গিয়ে, সমাজ তোমাকে টাটে বসাবে। মনের বুঝ হবে তো?
আমার পাশে চুপচাপ গাজি বসে আছে। একটা দমকা নিশ্বাসের শব্দ পাই পাশে। সামনে গাছ আর গাছের ছায়ায় নিবিড় কালো। তার আশেপাশে অস্পষ্ট জ্যোৎস্না। কাছাকাছি ঘরগুলোতে মানুষের গলার শব্দ শোনা যায়। মনে হয়, নদীর বুক থেকেই যেন কার ডাকের দূর চিৎকার ভেসে আসে।
ঘরের মধ্যে আবার নারায়ণ ঠাকুরের গলা শোনো, ‘অনাদি পালও হয়েছে যেমন! ঝাল ব্যঞ্জনকে এখন শুক্তো করার জন্যে হাতা খুন্তি নাড়াচ্ছে।’
একেবারে পাকা পাচকঠাকুরের মতো কথা। যে তরকারি আর মশলাতে ব্যঞ্জন বানানো হয়ে গিয়েছে, তাকে এখন আর শুক্তো করতে চাইলে কী হবে। অনন্ত ব্যঞ্জনকে কি আর শুক্তো করা যায়?
দুলি বলে, ‘সে কথা থাক, নারাণদা। যে কথা—।’
নারাণের গলায় বিতৃষ্ণা। তার সঙ্গে ঝাঁঝ। বলে ওঠে, ‘না, থাকবে কেন, বলো। অনন্তটার কথাও বলি, বারে বারে তোর ন্যাকামো করবার কী দরকার।’
এ সাত্বনা ভাল লাগে না দুলির। যে স্রোত চলে মনে মনে, তার ওপরে তুমি বৈঠা চালালে কি চলে! এখানে সান্ত্বনা যার যার নিজের। অপরের হাতের ছোঁয়া কেবল জ্বালা। বলে, ‘কে কী ন্যাকামো করেছে, সে খোঁজ আমি করি না, নারাণদা।’
তা বললে কি নারায়ণ ঠাকুরই থামে! তবে সে তার স্বভাব অনুযায়ী খেঁকিয়ে ওঠে না। বলে, ‘না ভাই দুলি, খোঁজ করো না, সেটা কোনও কাজের কথা নয়। অনন্ত এলেই তুমি আবার সব ভুলে যাও। এটা ভাল কথা নয়। তোমার হলো এসো জন বসো জন, দশজন নিয়ে কারবার। এসব তোমার বেশি পেশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।’
শুধু হোটেল চালানোর ফন্দি-ফিকিরই জানে না নারায়ণ ঠাকুর, দেহজীবিনীকেও উপদেশ দেয়। তবে, উপদেশ দেয় কিনা, জানি না। একটু যেন স্নেহের জোর শোনা যায় তার কথার সুরে।
দুলি বুঝি অস্বস্তিতে হাসে। বলে, ‘আহা, শুনবে তো। আমি তো সে কথাটাই তোমাকে বলতে এসেছি।’
‘তাই নাকি। কী কথা?’
দুলির গলা একটু নিচু হয়। কিন্তু শোনা যায় সবই। বলে, ‘আমার ঘরে তালা দিয়ে এসেছি। জানি তো, মাঝরাতে এসে ডাকাডাকি করবে। তাই বলছিলাম কি, আজ আর এখান থেকে যাব না। ফোঁচাদার বউয়ের কাছেই রাতটা শুয়ে কাটিয়ে দেব।’
শুধু মাংস-ভাতের বায়না কারণ নয়, পাছে রাত্রে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়, সে পথ বন্ধ করার মতলব করেই দুলি এসেছে।
নারায়ণ ঠাকুর বলে, ‘অ, সেই কথা! তা বেশ তো, ফোঁচার বউয়ের কাছেই থাকবে। তাতে আর কী হয়েছে।’
দুলি বলে, ‘তোমার আবার অসুবিধা হবে না তো?’
কথাটা শুনে আমার দুলির মুখখানি দেখতে ইচ্ছা করে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে নারায়ণ ঠাকুরের গলা, ‘না, না, আমার আবার অসুবিধা কী।’
সামনের কুহেলি আলো আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়েও, বুঝতে পারি, দুলির সামনে নারায়ণ ভারী অস্বস্তি বোধ করে। তাই সামনে থেকে চলে যেতে যেতে কথা বলে। আর তখনই গাজিটা গুনগুনিয়ে ওঠে:
‘আরে, ঘরের খিলে আঁটিসাঁটি
ওদিকে, গত্ত কাটে সিঁদকাটি
ও চোরা কালো বিড়াল মিশে থাকে আন্ধারে।’…
সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণের গলা শোনা যায়, ‘কে রে ওখেনে?’
‘আপনাদের গাজি, ঠাকুরমশায়।’
যেন বড় গলগলানো গলায় বলে গাজি। আর সেই পরিমাণেই নারাণের পিত্তি-জ্বালানো কথা ভেসে আসে, ‘আমাদের, না একেবারে তাবৎ সোন্সারের। ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়। কথা নাই বাত্তা নাই, উনি একেবারে গান ধরে দিলেন।’
গাজি বলে, ‘গান একটা মনে এল কিনা।’
‘আসুক গে, অত শশানাবার দরকার কী।’
বলতে বলতে তার স্বর আবার এগিয়ে আসতে থাকে। আসতে আসতেই জিজ্ঞেস করে, ‘তা নিজে তো এসে বসে আছ, বাবুটিকে রেখে এলে কোথায়? ভোলাখালিতেই—’
দরজা পর্যন্ত এসেই নারায়ণের স্বরে ধাক্কা লাগে। দরজার কাছে রাখা বাতির একটু আলো আমার গায়েও পড়েছিল। তাতেই তার নজরে পড়ে যাই। তাড়াতাড়ি সুর ফিরিয়ে বলে, ‘অ, এসে পড়েছেন! ভাবলাম, কী জানি, মাহাতোদের ব্যাপার তো! ভোলাখালিতেই টেনে নিয়ে গেল কিনা।’
আমি কোনও জবাব দিই না। গাজি বলে, ‘সে মতলবও হয়িছিল। চাচিটিকে জানেন তো। ছাড়বে না কিছুতেই। নেহাত বাবুর ভয়, রাত পোহালি যেতি দেরি হয়ি যাবে, নইলি।…।’
ওসব শোনবার অবসর নেই নারায়ণের। সে আমাকে বলে, ‘ঠান্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে, বাইরে বসবার দরকার কী। ঘরের মধ্যে এসে বসেন।’
আবার গাজিই বলে, ‘যাবেন। একটু জল দিতি বলেন, হাত-পা ধুয়ি যাবেন একেবারে।’
ঠাকুর বলে, ‘ফোঁচাকে পাঠিয়েছি চাপাকলে। জল তুলছে সে। হয়ে গেলেই এনে দেবে। ততক্ষণ ঘরে এসে বসেন আপনি।’
আমি বলি, ‘থাক এখন, এমন কিছু শীত লাগছে না। একটু বাইরেই বসি।’
ঠাকুর আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরে চলে যায়। আমি ভাবি, বাইরে ঠান্ডা তাই ঠাকুর আমাকে ভিতরে যেতে বলে। বারোবাসরের মেয়ে দুলিরও ভিতরে যাবার হক আছে। গাজির নেই। আমার জন্যে দরজা আগলে সে সারা রাত বাইরের দাওয়ায় পড়ে থাকবে। কেন, তা জিজ্ঞেস করো না। মানুষের নিজের হাতে গড়া বিধান, যতদিন তারা নিজেরা না ভাঙে, ততদিন কেউ পারে না। একা ভাঙলে বিধর্মী, সকলে ভাঙলে ধর্ম। তাই না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘এই গঞ্জে মুসলমানের কোনও দোকানপাট নেই!’
গাজির গলায় বিস্ময়। বলে, ‘মেলাই। কেন, বাবু?’
‘তুমি সেখানে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসতে পারো না?’
গাজি হেসে বলে, ‘সেজন্যি ভাববেন না, বাবু। এমন কত রাত কত জাগায় কেটিছে।’
‘শীতে কষ্ট হবে তোমার।’
‘ঝোলাতে একখানা ক্যাঁতা আছে, বাবু। গায়ে যেটি আছে, সেটিও কম না। পেরায় আট-দশখান ছিঁড়া কাপড় আছে।’
আট-দশখানি ছেঁড়া কাপড়! ধন্যি আলখাল্লা! এর পরে তো কথা চলে না। তার ওপরে ঝোলায় আছে একটি কাঁথা। না জানি, ও ঝোলাতে আরও কত বস্তু আছে। গাজির ঝোলা কিনা!
গাজি তারপরেও হাসে। বলে, ‘তা ছাড়া, একটা কথা কি বাবু, হিঁদু বলেন আর মোচলমান বলেন, এমন লোককে কি কেউ ঘরে থাকতি দেয়?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’
‘বিশ্বাস কি বাবু, যদি চুরি-চামারি করে?’
গাজির দিকে ফিরে তাকাই। সে আমার চেয়ারের পাশে মাটিতে বসা। হ্যারিকেনের আলো তার মুখের যে পাশে পড়েছে, সে পাশটা দেখতে পাই না। যেদিকটা পাই, সেদিকটা অন্ধকার। গাজিও আমার দিকে ফেরে। তাতে তার গোটা মুখটাই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। তবু যেন আমি তার চোখে মিটিমিটি হাসি দেখতে পাই। আর কেবলই মনে হয়, সত্যি কথাটা তো ভেবে দেখিনি। এমন একটা পথে পথে হাত পেতে গান গেয়ে ফেরা চেনা লোকই যদি আমার দরজায় এসে রাত্রিবাসের ফরমান চাইত, দিতাম নাকি?
পুছ করার দরকার কী? দিতাম না। তাই গাজির কথায় কোথায় যেন নিজের ভিতরেও ঠেক লেগে যায়। আরও লাগে এই কারণে, সে যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বলে, আমাদের গৃহস্থের মনে সেই কথাটাই আগে জাগে। তবে গৃহস্থের অবস্থাও যে ঘর-পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখার মতো। কিন্তু গাজি যখন তার নিজেকে দেখিয়ে এরকম বলে, তখন কোথায় যেন বাধে। তখন যেন নিজের মুখে থাবাড়ি লেগে যায়। অবিশ্বাসের অবিচারে মন টাটিয়ে যায়। বলি, ‘সে যে করে, সে করে। তোমাকে তো এখানে সবাই চেনে।’
গাজি তেমনি হেসে বলে, ‘তা চিনে, বাবু। তয় কি জানেন, যার যেমন অবস্থা, তার তেমন বাওস্থা। যা সয়, তা রয়। গাজি দরবেশ মানুষ, গাছতলাতি তার দিন কেটি যায়। মাথার উপর যদি একখান আস্তরণের দরকার হয়, তবে এই হাটে তার কম নাই। দ্যাখেন যেয়ি, কত চালা পড়ি রয়িছে। ঘরের মধ্যি আমার থাকতি ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করলি লোকে ব্যাজ দেখে।’
লোকে বিপরীত দেখে এই গাজির বচন। আমি তার অন্ধকারে ঢাকা মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। বুঝতে পারি, সেই হাসিটুকু লেগেই আছে মুখে। এর ওপরে কথা বলার কিছু নেই। সে সার বুঝিয়ে দিয়েছে। অবস্থা গুণে ব্যবস্থা। গাছতলাতে যার বাস, সে কেন ধরের আশ্রয় চাইবে। চাইলে লোকে বিপরীত ভাবে। তোমার মন বিমর্ষ হলে কী হবে। বাস্তবে চলো মন, তাতে স্বস্তি।
গাজি নিজেই আবার বলে, ‘সে-সব চিন্তা করবেন না, বাবু। দাওয়ার মাথার উপর চাল আছে, তাতিই আমার হয়ি যাবে। তা ছাড়া…।’
কথাটা সে শেষ করে না। মুখটা যেন আমার দিকে আরও বেশি করে ফেরায়। বলে, ‘গাজিকে আজ বেহেস্তে থাকতি দিলিও বাবুকে ছেড়ি সে যাবে না।’
এ যেন খোশামুদে, রামপেসাদে। কিন্তু বুঝতে পারি, তার কথার মধ্যে কপটতা নেই কোথাও। প্রাণের কথা বলে না কেবল। এ যেন তার শপথ, কসম খেয়ে বলে।
এ সময়ে আর একবার নারায়ণ ঠাকুরের আবির্ভাব হয়। তার আগে মনে হয়, ঘরের মধ্যে দুলি আর সে কী যেন বলাবলি করে। তারপরে নারায়ণ এসে দাঁড়ায়। দরজার কাছে দুলির ছায়াও দেখা যায়।
ঠাকুর বলে, ‘বাবুর কি মুরগি চলে?’
জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’
‘তা হলে মুরগি রান্না করতাম। রামপাখি একটা রয়েছে কিনা।’
ঠাকুরের মুখ খোলাতেই বয়ান ধরেছি। এ রামপাখি যে কোন রামপাখি, তা জানি। যদি খাই, তা হলে কারুর মুখেরটা কেড়ে খাওয়া হবে না। তবু, কোথায় যেন আটকায়, প্রাণ বিমুখ হয়। যাদের জন্যে আয়োজন, তাদের একজন কাছেই দাঁড়িয়ে। ঠাকুর যে তার অনুমতি নিয়েই প্রস্তাব দিয়েছে, সন্দেহ নেই। কেন যে তার রামপাখি বিরাগ, ক্ষুধা মন্দ, তা-ও জানি। আমি না খেলেও ও রামপাখির জান খতম ধরে নিতে হবে। কিন্তু সদ্য সদ্য যা ঘটেছে, পরে আর খেতে পারি না। তা ছাড়া, আমার গাজি রয়েছে। জানি, সে নিরামিষাশী। সে যে আমার জবাবের জন্যে কান পেতে আছে, বুঝতে পারি। ঘাড় নেড়ে বলি, ‘না, মুরগি খাব না।’
দুলি আঙ্রি নয়। বোধ করি, সে জানে না, এ ভিনদেশি তার পরিচয় জানে। সে বলে ওঠে, ‘মুরগি খান না?’
একটু অবাক হয়ে ফিরে চাই তার দিকে। দরজার কাছে হ্যারিকেনের আলো তার শরীরের একপাশে পড়েছে। ঘোমটা খোলা, আঁচল-খসা আঙ্রিকেও দেখেছি। সেখানে মধ্যঋতু আশ্বিনের ভরা ভরতিতে একটা বন্যতা দেখেছিলাম। সে দেখাতে মনের এক ভাব। দুলির হল খর স্রোতের চলকানো ঢেউ। চোখে যেন ছিটা লাগে। নজর ধাঁধিয়ে যায়। নাকে-মুখে জল ঢুকে হৃদে ধাক্কা লাগে। তার জন্যে দুলিকে দোষ দেব না। তার কথা বলার তাগিদ যে কোথায়, তাও অনুমানে আছে। মুরগির গতি হলে নারাণদার কাছে তার দায় চোকে। তবু আমাকে বলতে হয়, ‘খাই, কিন্তু আজ খাবো না।’
মুখ ফেরাতে গিয়ে বুঝতে পারি, দুলি আমার মুখটা একটু ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে চায়। বোধ হয়, কথার মধ্যে ভাব খোঁজে, কার্যকারণের সন্ধান। কিন্তু কিছু বলে না।
এবার গাজি যেন কী ভেবে বলে ওঠে, ‘কেন বাবু, খান না!’ এ হল তার আতিথেয়তা। নিজের ঘর না হোক, বাবুর সুখ-সুবিধা দেখা তার নিজের বিষয় করেছে।
বলি, ‘না, ইচ্ছে নেই।’
নারায়ণ চলে যেতে যেতে বলে, ‘তা হলে মাছ-ভাতই করি গে।’
গাজি বলে ওঠে, ‘তা হলি ঠাকুরমশাই, আপনি নিজিই সেবা করি ফ্যালেন।’
আর দেখতে হল না। তৎক্ষণাৎ ধমক ভেসে আসে, ‘মেলা বাজে প্যাচাল পেড়ো না, বুঝলে? আমি মুরগি খাই, কেউ দেখেছে কোনওদিন?’
গাজি সঙ্গে সঙ্গে ঘাট মেনে বলে, ‘আ ছি-ছি, সে কথাখানি তো এয়াদ ছিল না।’
আমি ভাবি, ইয়াদ তার ঠিকই ছিল। গাজির এটা ফাজিল-রঙ্গ নিশ্চয়। ওদিক থেকে নারায়ণ ঠাকুরের আর কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। দুলিও দরজার কাছ থেকে সরে যায়। অন্য গলা শুনতে পাই ঘরের মধ্যে। বোধ হয়, ফোঁচার সেই কালোকুলো বউটি কথা বলে দুলির সঙ্গে। বুকের ওপর বাচ্চাটি আছে সম্ভবত। ছোটখাটো ধমক শুনতে পাই। অস্পষ্ট বলাবলি শুনে বুঝতে পারি, তারা সুখ-দুঃখের কথা বলে। দুলি বলে, ‘মরণ! মুখে আগুন অমন ভালবাসার!’ আর বউ বলে, ‘মানুষের ধারা বোঝা যায় না।’…
এই হল কথার সার। একজন ভালবাসার মুখে আগুন দেয়। আর ফোঁচার বউ মানুষের ধারা বোঝে না। যে মানুষের কথা বলে, সে নিশ্চয় পুরুষ মানুষ। জানতে ইচ্ছা করে, সেই পুরুষ-মানুষটা কে? নারায়ণ ঠাকুর, না ফোঁচা? আর দুলি কোন ভালবাসার মুখে আগুন দেয়? অনন্তর না তার নিজের?
তারপরে এক সময়ে নিজের মনেই চমক লাগে। ভাবি, সবই বেয়াজ, সবই বিপরীত। দেখ, নগর ছানিয়া ফিরি। আর এখন বসে আছি কোথায়। অচেনা এক গাজি আমার পাশে। সে যে কী দিয়ে কী কেড়েছে, চেনা-অচেনার দাগ রাখলে না। ঘরের মধ্যে কথা বলে এক বিমুখ প্রেমিকা দেহজীবিনী। ফোঁচার বউকে কী বলব, বুঝতে পারি না। স্বৈরিণী? তাও বলতে পারি না। গৃহিণীই বলব। কার গৃহিণী, সে জবাব চাইব না। তবে নারায়ণ ঠাকুর তার গতি, ফোঁচা পতি। তারা সবাই মিলে সকলের সঙ্গে জড়ানো। একে বিচিত্র বলব কিনা, জানি না। হয়তো গঞ্জ-হাটের সমাজ এমনিই। তার রীতি-প্রকৃতির ধরন-ধারণ এইরকম। জীবিকা আর পেশার দায়ে সবাই হেথা জড়ো। জনপদের নিয়মকানুন এখানে নয়। একটু পরেই ফোঁচা আসে জলের বালতি নিয়ে। দাওয়ার ধারে বালতি বসিয়ে ঘটি রেখে সেই তার দম-আটকানো গলায় বলে, ‘হাত-মুখ ধুয়ে নেন, বাবু।’
সারা দিনের ক্লান্তি এবার আমাকে ভারী করে তুলেছে। হাত-মুখ ধোয়া হতে হতেই ওদিকে ফোঁচা দড়ির চারপায়া পেতে দেয় ঘরের মধ্যে, দরজার কাছে। বিছানা দেখে নাক কোঁচকাবো না। নীচে যা-ই থাকুক, গোটা একখানি লালপাড় ধোয়া ধবধবে শাড়ি চাদর হিসাবে পেতে দেওয়া হয়েছে। হয়তো ওরই বউয়ের। ঠাকুরের এবার তাড়াহুড়ো। খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিতে দেরি করে না। গাজির নিরামিষ খাওয়া সেই দাওয়ায় বসে।
দুলিকে খাবার জন্যে ঠাকুর আর বউ দুজনেই টানাটানি করে। কিন্তু মন থেকে যার ক্ষুধা গিয়েছে, তাকে খাওয়ানো যায় কেমন করে! অতএব, পাশের ঘরে গাজিদের খাওয়া মিটে যায়। পাশে ক’টি ঘর আছে, কিছুই জানি না। বুঝতে পারি, সেখানে হেঁশেলের পাট মিটে গিয়েছে। সকলে নিদ্রা যায় কিনা, জানি না। একটা নিঝুমতা নেমে আসে। ফোঁচার বাচ্চাদের গলা একটু-আধটু শোনা যাচ্ছিল। তাও নিশ্চুপ হয়ে যায়। এমনকী, একটু আলোর আভাসও সেখানে পাওয়া যায় না। তাতেই মনে হয়, হয়তো সবাই ঘুমোয়।
এ ঘরে এখনও আলো জ্বলছে। হাত তুলে ঘড়ি দেখি। রাত্রি মাত্র সাড়ে ন’টা। অথচ মনে হয়, রাত কেবল গভীর নয়, একটা আরণ্যক স্তব্ধতা যেন জগৎ গ্রাস করেছে।
আমার মাথার সামনেই খোলা দরজা। দরজার পাশে গাজি এখনও বসে বসে বাবুর কাছে পাওয়া, ভারী মিঠে বাসওয়ালা ছিরগেট টানে। আমার মাথার ওপরে মশারি চাঁদা করা রয়েছে। পয়সা দিয়ে হয়তো অনেক সুখ পাওয়া যায়। এমন একটি সামান্য ব্যবস্থা অসামান্য হয়ে ওঠে না।
হ্যারিকেনটার কী ব্যবস্থা হবে। এই প্রশ্ন যখন মনে, তখন দেখি ফোঁচার উদয় হয়। ভিতর ঘরের অন্ধকার থেকে সে আসে। হাতে তার একটা হোগলা। আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত বিড়ি। একদিকে হোগলা পেতে বসে সে বিড়ি খায়। তারপরে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবু, বাতি নেবানো থাকবে না কমানো থাকবে?’
আমি বলি, ‘নিবিয়ে দাও।’
গাজি বলে, ‘সারাদিন অনেক ঘোরা হয়িছে, এবারে শুয়ি পড়েন বাবু।’
সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মশারিটা টেনে নামিয়ে শুয়ে পড়ি। ফোঁচা বাতি নেভায়। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। আস্তে আস্তে খোলা দরজার কাছে বাইরের কুহেলি জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলো দেখা দেয়। ঘরের নিচু চৌকাঠের ওপর গাজি তার ঝোলাটা পেতে, তাতে মাথা রাখে। বাইরে ঝিঁঝি ডাকে। মুহূর্তের মধ্যেই, ফোঁচার চাপা নাসিকাধ্বনি বাজে। আর গাজিটা, কথাহীন সুর খুব আস্তে গুনগুন করে। এক সময়ে তাও থেমে যায়।
ঘুম আসে না এই নতুন জায়গায়। ক্লান্তিতে পাশ ফিরতে ইচ্ছা করে না। নিশ্চল নিঝুম হয়ে পড়ে থাকি।
হঠাৎ মনে হয়, একটা অস্পষ্ট চুপি চুপি ডাক যেন শুনতে পাই, ‘সই সই!’
পুরুষের চাপা গলা। কোন সইকে ডাকে! কার সই, কে কোথায় ডাকে, কে জানে। একটু চুপচাপ। আবার ডাক। এবার যেন একটু জোরে, একটু স্পষ্ট। মনে হয়, আমার খোলা দরজার কাছেই, দাওয়ার নীচে থেকে ডাকে, ‘সই, সই!’
থেমে থেমে কয়েকবার ডাকাডাকি চলে। তারপরেই হঠাৎ ঘরের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ আস্তে বাজে। যদি ঠিক শুনে থাকি, যেন ঠিনঠিন শব্দও বাজে তার সঙ্গে। অন্ধকারেও দেখতে পাই একটি মূর্তি, ভিতর দিক থেকে দরজায় এসে দাঁড়ায়। দরজার কাছে আসতেই তার অবয়ব দেখে চিনতে পারি, দুলি। অতি সাবধানে সে গাজিকে ডিঙিয়ে যায়। নেমে যায় দাওয়ার নীচে।
তারপরে তাকে আর আমি দেখতে পাই না। কেবল এইটুকু শুনতে পাই, দুলির গলায় যেন কান্না ঠেকানো, স্বর নিচু। সে বলে, ‘না না না, কক্খনো না।’
আর ডাক দেওয়া সেই পুরুষের নিচু গলায় আবেগ, ‘পায়ে ধরি সই।’
আবার ‘না না না।’ কিন্তু সেই না না না শব্দ ক্রমে দূরে মিলিয়ে যায়। কেবল ফোঁচার নাক ডাকানোর শব্দ বাজে।
.
২২.
কেমন একটা অস্বস্তি হয়। তবু উঠে বসতে পারি না। কৌতূহলের বেড়ায় পড়ি। যেন অনুমান করি কিছু তবু বুঝতে পারি না। সেই মুহূর্তেই গাজির নিচু স্বর শোনা যায়, ‘বাবু, ঘুমলেন নাকি?’ জবাব দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত ভাবি। কিন্তু গাজির সঙ্গে আমার কীসের লুকোচুরি! বলি ‘না।’
সে বলে, ‘বুইতি পারলেন কিছু?’
বলি, ‘দুলি বেরিয়ে গেল মনে হল।’
‘কার ডাকে জানেন তো?’
‘অনন্ত?’
‘তয় আর কার!’
বলে সে একটু হাসে। আমার চোখের সামনে ভাসে দুলির মুখ। খর চোখের তারায় আগুন। উপহার ফেলে দেয় ছড়িয়ে ছিটকে। দিব্য দেয় আর না আসতে। পাছে সে আসে, তাই নিজের ঘর ছেড়ে যায় পরের ঘরে। আর বলে, ‘অমন ভালবাসার মুখে আগুন।’
হায় গো চিন্তামণি! এখন একবার ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, মুখে যে আগুন দেবে, সে কোন ভালবাসার। তোমার, অনন্তর!
আমার অস্বস্তি যায়। নিঃশব্দ এক হাসির ধারা যেন টলটলিয়ে ওঠে। কে এক অনন্ত পাল আর এক বারোবাসরের দুলি। সমাজ যাদের অবৈধ ঘোষণা করেছে, নিষিদ্ধ বলেছে, তারা আমার প্রাণে আবেগের মুখ খুলে স্রোত বহিয়ে যায়। সংসারে এমন ঘটনা নিত্য অহরহ ঘটে। কিন্তু তা সংসারে। সংসারের সীমান্তেও যে এমন ঘটে, তা জানা ছিল না। প্রান্তে, যেখানে বিধিনিষেধ, সেখানে সকলই নিষিদ্ধ, অচ্ছুত, সেখানেও যে এমন সাংসারিক লীলা, তা কখনও দেখিনি।
আমার আবেগের কথা কাউকে বলতে যাব না। কিন্তু এখন ঘটনার আবেগ ধরা যন্ত্র আমার নেই। সংসার আর সংসারের সীমান্ত, দুয়েতেই দেখি মন একাকার। এবার কি মন দুষবে? তবে মানুষের কথাটা ভুলো না। তাকে যে এত ভাগে ভাগ করে রেখেছে, তবু দেখ সে মানুষ। সবখানে সেই এক মানুষ, এক সমান। সেই কারণে বিধিনিষেধ অমর নয়, ভাগ-বাঁটোয়ারা নয়, মানুষ অমর।
কে জানে, এই দুলি-অনন্তর কী ভবিষ্যৎ। কোনও দিন জানা হবে না, জানতেও আসব না। জীবনপ্রবাহে, স্রোতে, বাঁকে নানা রং, নানান রঙ্গ দেখে যাই। করেও যাই। এই দেখে যাওয়া, করে যাওয়ায় কার দেনা শোধ হয়, জানি না। চলি সবাই আপন আপন তাগিদে।
তবু আমার হাসি-ঝরা আবেগধারা অবাক মেনে ভাবে, এত দেখা ছিল আমার একটা দিনের নিরুদ্দেশের ফেরায়! যখন আপন সুখে হাসি, কাঁদি, তখন ভাবি, জীবন এত ছোট কেন। ভুলে যাই, সে আমার নজরবন্দি নয়। ধরা দিয়ে নেই আমার চোখের সীমায়। সে আমার বুঝ-বন্দি নয়। আমার বোঝার সীমা ছাড়িয়ে সে বিরাজ করে। আমার সত্য-মিথ্যায় তার কিছুই যায় আসে না। তার চেয়ে বলি, মন যেন না বিচারে যায়। মন খুলে রাখুক। যেখানে তার চক্ষুকর্ণ আছে।
গাজির সাড়াশব্দ নেই। হয়তো মুরশেদের নামের মজুর এবার ঘুমোয়। আমার ঘুম আসে না। প্রহর কেটে যায়। একটা আচ্ছন্নতা জড়িয়ে আসে। তারপরেই বেড়ার এক পাশ ঘেঁষে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলে ওঠে। ফোঁচা একটা বিড়ি ধরায়। সে উঠে বসেছে। কাঠির আলোয় তার মুখটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে দেখতে পাই। তার চোখ দুটো সম্পূর্ণ খোলা। নজর সামনের দিকে। কটা মুখে ভাবের ছায়া চোখে পড়ে না। তারপরে কাঠি নিবে যায়। অন্ধকারে শুধু বিড়ির আগুন থেকে থেকে জ্বলে ওঠে।
কী ভাবে লোকটা। কী চিন্তা করে। সেই এক দিনের কথা নাকি, যেদিন হয়তো শুভদিনের লগ্ন দিয়েছিলেন পুরুতমশাই। হয়তো সেই লগ্নে ফোঁচার ঘরে হ্যাজাক বাতি জ্বলেছিল। ঢোলক কাঁসি বেজেছিল। তার গলায় ছিল ফুলের মালা। গায়ে ছিল নতুন জামা। আর স্বজনে ঘেরা কালো একটু কচি কলাবউ।
সে কি সেই কথা ভাবে! তার কি লোমশ মস্ত বুকটা খালি খালি লাগে নাকি। পাশের ঘরে যারা ঘুমোয়, সেইখানে কি চোখ ফেরে তার।
বিড়ি নিবে যায়। অন্ধকারে ডুবে যায় সব। আর কোনও কিছুই দেখা যায় না। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। কোনও প্রশ্নেরই জবাব নেই। অন্ধকারের তলে সব হারিয়ে যায়।
হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী এক শব্দ যেন দূর থেকে আসে। আসতে আসতে কানের কাছে বাজে। সহসা চোখ মেলি। কয়েক মুহূর্ত সবই অচেনার চমকে অস্পষ্ট লাগে। স্থান কাল পরিবেশ মনে থাকে না। তারপরে সব চেনা দেখি। দেখি, অন্ধকার নেই। আবছায়া অস্পষ্ট আলো ঘরের মধ্যে। চোখ ফিরিয়ে ফোঁচাকে দেখতে যাই। সে নেই, তার হোগলার চাটাইও নেই। দূর থেকে যে শব্দ আসছিল, তা আসলে গাজির গুনগুনানি। শিয়রের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি, সে আর সামনে নেই। দরজার কাছেই বাইরের দিকে মুখ করে বসে আছে। ডান হাতে দাড়ি মুঠো করে ধরা। গুনগুনানির কথা শুনি,
‘ওহে দীনদরদী, বলো না কেন।
তুমি যদি মন্দিরেতে করো অবস্থানো
তবে এ জগৎ সোম্সার কার নিকেতনো।
কেউ বলে তুমি রাম, থাকো পুবে, আর পশ্চিমে আলি।
তবে কেন হিদয়পুরে খালি। ওহে দীনদরদী—
কেউ জানে না, তুমি মনের মানুষ, মনে অবস্থানো।’…
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গুনগুনায়। কাল থেকে শুনে শুনে এখন বুঝতে পারি, সব গানেতেই এক কথা। গাজি এক কথার মানুষ। তার জাত নেই, ঈশ্বর নেই, খোদা নেই। একমেবাদ্বিতীয়ম্, মনের মানুষ। কখনও সে মুরশেদ, কখনও দীনদরদী। এ ধর্মের নাম কী। কে বা সেই মনের মানুষ। মুরশেদ আর দীনদরদী বা কে!
গাজি হঠাৎ গান থামিয়ে ঘরের দিকে ফিরে তাকায়। মশারির দিকে নজর চালিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে চায়। আমাকেই দেখতে চেষ্টা করে। আমার চেয়ে-থাকা যেন তাকে নীরবে ডাক দিয়েছে। বলে, ‘বাবু কি জাগলেন নাকি!’
জবাব না দিয়ে মশারি সরিয়ে মুখ বের করি। গাজি বলে, ‘জয় মুরশেদ। আর একটু ঘুমালি পারতেন বাবু। এখনও তেমন সকাল হয় নাই।’
আমি বলি, ‘দেরিও আর নেই। দেখতে দেখতেই আলো ফুটবে।’
গাজি আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসে। একটু যেন লজ্জা পেয়ে হাসে। বলে, ‘ঘুমের কথা আর পুছ করব না। একে নতুন জায়গা, তায় যে ঢপের পালা।’
ঢপের পালা আবার কী। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সেটা আবার কী।’
গাজি বলে, ‘ঢপ গানের পালা হয় না বাবু! সেই কথাই বলি। আমাদের অনন্তবাবু আর দুলি ঠাকরুনের কথা বলছি।’
সে প্রসঙ্গে আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি তাকে ডাক দিই, ‘মামুদ গাজি।’
গাজি অনেকখানি ঝুঁকে পড়ে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে আনে। যেন মুগ্ধ হয়ে হেসে বলে, ‘বাবু দেখি আমার নামখান মনে করি রেখিছেন। কী বলেন বাবু।’
স্মৃতিশক্তির প্রশংসা সেটা নয় যে, গতকাল শোনা একটা নাম ভুলে যাব। আসলে গাজিটার বিনয় এই রকম। এমন তুচ্ছ নামটাও কেউ মনে রাখে নাকি। জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার ধর্মটা কী।’
গাজি ভুরু কুঁচকে তাকায় অনুসন্ধিৎসু চোখে। তবু দাড়ির ভাঁজে ভাঁজে হাসি। বলে, ‘সে আবার কী বাবু। কোন ধম্মের কথা বলেন।’
‘তোমার। তোমার গান শুনে তো কিছু বুঝি না।’
গাজির হাসিতে যেন রহস্যের ঝিলিক লাগে। বলে, ‘কেন বাবু, অবুঝ কথা তো কিছু বলি না।’
আমি বলি, ‘বুঝতে পারি না।’
তেমনি হেসে গাজি বলে, ‘গান দিয়ি যদি না বুঝোতি পারি, তয় আর কেমন করি বুঝাব বাবু। ধম্মো মম্মো যা বলেন, সব তো ওই গানে।’
তা বটে। এ যেন সেই কবির কথা, লিখে যা বোঝাতে পারিনি, মুখের কথায় তা কী বোঝাব। ডালে পাতায় ফুটে, গন্ধ ছড়িয়ে যদি পরিচয় না দিতে পারি, তবে কেমন করে জানাব, আমি কোন ফুল, কী নাম!
তবু কথা থেকে যায়। অবুঝ বোঝনোর দায় নেবে কে। তাই জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার রাম নেই, আলিও নেই।’
গাজি যেন চোখ ঘুরিয়ে মশকরা করে। বলে, ‘না বাবু, রাম নাই, আলি নাই। কাশী গয়া মক্কা মদিনা, কিছুই নাই।’
‘তবে কী আছে, কে আছে?’
হাত মেলে ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে তর্জনী দিয়ে নিজের বুক দেখায়। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘বাবু, এই ঘরখানি আছে।’
কাকে বলে ঘর। শরীর, না প্রাণ। গাজি নিজেই ঝুঁকে আসে আরও। যেন চুপিসারে গুপ্ত কথা বলে, “অই যে সেই বলে না বাবু, “ক্ষ্যাপা এই বেলা তোর মনের মানুষ চিনি ভজন কর। যখন পলাবে সেই রসের মানুষ, পড়ি রবে শুধুই ঘর।” এই ঘরেতে সব আছে বাবু।’
মরণের কথা বলে, না আর কিছু, বুঝতে পারি না। কে বা সেই রসের মানুষ। কার বা ভজন, কেমন বা তার ধরনধারণ, সকলই হেঁয়ালি। দেহ কেবল দেহ নয়, তার নাম আবার ঘর। জিজ্ঞেস করি, ‘আর কিছু নেই?’
বুকের কাছে দু’হাত রেখে চোখ আধবোজা করে বলে, ‘আর আছেন, দীনদরদী মুরশেদ।’
জিজ্ঞেস করি, ‘মুরশেদটি কে?’
‘তিনি গুরু। গুরু সত্য, মুরশেদ সত্য।’
দুর্বোধ্য লাগে, বুঝতে পারি না। গুরুর নাম নিয়ে চলাই ধর্ম নাকি। এদের আর কিছু নেই। মনে পড়ে যায় গাজির গতকালের গান, “আমি এসে এই দুনে, মন মুরশেদ না নিলাম চিনে।” আরও মনে পড়ে, “মুরশেদ আমার কোনখানে বিরাজে। মুরশেদ আমার কোন শিয়রে জাগে।”
‘গুরু কি তোমাদের সব নাকি?’
গাজি মাথা দুলিয়ে বলে, ‘নিশ্চয়। গুরু ছাড়া আর কে আছে বাবু। তিনি যে সব পথ দেখায় দ্যান।’
‘কীসের পথ?’
‘মনের মানুষের।’
‘মনের মানুষের?’
‘আজ্ঞা, অই যে সেই রসের মানুষের কথা আছে।’
‘সে আবার কে?’
‘কেন বাবু, যাকে বলে অধর মানুষ।’
যেন অন্ধকার দিয়ে তৈরি কথা। হাতড়ানো বৃথা। তার এদিক-ওদিক দেখা যায় না। গাজির মুখের দিকে চেয়ে থাকি। দেখি, তার ফাটা মুখে যেন এক ভাবের খেলা। স্বপ্নের ঘোর নামে তার আরশি-চোখে।
জিজ্ঞেস করি, ‘সে থাকে কোথায়!’
গাজি হাত নেড়ে বলে, ‘মন্দিরে না বাবু, মসজিদে না। আশমানেও না।’
আবার তর্জনী দিয়ে বুকে ঠেকিয়ে বলে, ‘এই ঘরে, এই ভাণ্ডে।’
অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করি, ‘দেখতে কেমন?’
‘রূপ নাই বাবু, তিনি নেরাকার।’
নেরাকার যে নিরাকার, তা বুঝতে পারি। নিরাকার ব্রহ্মের সাধন নাকি। বলি, ‘ঘরের কথা বলছ, আবার নিরাকার হল কেমন করে।’
গাজি বলে, ‘আকারের মধ্যি নেরাকার।’
সেই অন্ধকারের কথা। কেবল রহস্যের জাল ছড়ানো। প্রায় হতাশ হয়ে বলি, ‘ধরতে পারলাম না।’
গাজি বলে, ‘আমিই কি পেরিচি বাবু। তা হলি আর অধর ধরা বলচে কেন।’
‘ধরা যায় না?’
‘যায় বই কী। না হলি আর সাধন-ভজন কীসের। তবে বড় কঠিন কাম বাবু, সবাই ধরতি পারে না।’
‘কী করে ধরতে হয়? মন্ত্রতন্ত্র আছে নাকি?’
‘না বাবু, মন্ত্র নাই, তন্ত্র নাই, জপ নাই, তপ নাই।’
আবার সেই রহস্য। সন্দেহ হয়, গাজি বলতে নারাজ। হয়তো বলতে নেই, তাই কেবল কথার ধাঁধা। বলি, ‘তোমরা তো জাত মানো না।’
‘না বাবু, জাতিপাতি নাই।’
‘তবে নিরামিষ খেতে হয় না?’
গাজি হেসে বলে, ‘না বাবু, খানাপিনার কোনও বারণ নাই। ইস্তক মদ মাংস যা বলেন, কোনওটা হারাম না।’
সে আবার কেমন কথা। মদ মাংসও নিষেধ নয়। তবে যে গাজিকে দেখেছি নিরামিষ খেতে। কথা বলবার আগে গাজি নিজেই আওয়াজ দেয়, ‘আমার কথা আলাদা বাবু, আমি মাছ মাংস খেতি পারি না। তয়, এই সাঁই দরবেশ যা বলেন, তাদের কোনও কিছুতি বারণ নাই। সকলের হাতে সব খেতি পারে।’
গাজির কথা শুনে এইটুকু বুঝেছি, সব কিছু বোঝা যায় না। ভারতবর্ষ একে-তে নেই, বহুতে। সব কিছু তার বুঝতে পারব, এমন আশা নেই। একবার মনে হয়, নিরীশ্বরবাদের কথা বলে। আবার মনে হয়, এর নাম রহস্যবাদ। কিন্তু সে খোঁজে আমার দরকার নেই। রহস্য যাই থাক, এইটুকু বুঝেছি, মানুষ সে যেমন হোক, গাজির ধর্মে, সে আছে সব-কিছুতে। ধর্ম থাক, তার গান শুনেছি, সেই ভাল।
বিছানা ছেড়ে উঠতে যাব, গাজি ডাক দেয়, ‘বাবু।’
আমার মুখ থেকে সে চোখ সরায়নি। ডাক দেয় যেন স্বপ্নের ঘোরে। গাঙের জলে রোদের মতো গোটা মুখটা চিকচিক করে। তার দিকে তাকাই। বলে, ‘বলেন তো বাবু, সোম্সারে সবার বড় কে?’
তার কাছে হয়তো সেই রসের মানুষ, যার নাম মনের মানুষ। তাই জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকি। গাজি নিজেই বলে, ‘মানুষ। সবার বড় মানুষ, না কী বলেন বাবু। তয়, সেই মানুষের দুই ভাগ, নর আর নারী। মরদ আর আওরত, ঠিক তো?’
মানুষ দেখে, মানুষে যার সাধ মেটেনি, সে ‘না’ বলে কেমন করে। এমন অহঙ্কার কবে করতে পেরেছি, মানুষ বাদ দিয়ে জীবনযাপন চলে। নিজেকে বাদ দিয়ে আর সব ধরি কেমন করে। কিন্তু গাজি আমার জবাব চায় না। সে নিজের কথা নিজের ঢঙে বলে। বলে, ‘তা, জানবেন বাবু, এনাদের এই দু’জন ছাড়া কোনও কিছু মিলে না। অই যে সেই অধর মানুষের কথা, তা একলা ধরা যায় না। সোম্সার করতি হলি যেমন মিয়াবিবি ছাড়া হয় না, মনের মানুষ পেতি হলি তেমনি দু’জনার যোগ চাই, বুইলেন?’
এবার ভুরু কুঁচকে নজরে পুছ করি। কোন দিকে নিয়ে যায় গাজি। কী কথা বলতে চায়। যেন বহু দূরে শুনি এক পায়ের শব্দ। যে শব্দ আমার প্রত্যক্ষের অভিজ্ঞতায় নেই, শুধু তার কথা শুনেছি। সে কথা এক সাধন পদ্ধতির।
গাজি বলে চলে, ‘তয়, আসল কথা হল, সোম্সারে মিয়া-বিবি, আর এখেনে পুরুষ-পিকিতি, বুইলেন তো?’
পিকিতি যে প্রকৃতি, সেটা বুঝতে পেরেছি। অধর ধরার সাধন যে কী, তাও এবার কিছু অনুমান হয়। গাজি আবার বলে, ‘আর মিয়া-বিবি সোঁতে চলে। পুরুষ-পিকিতি উজানে চলে। সেই বাবু কঠিন কাম, উজানি যাওয়া। ওতি আপনার বেহ্মচয্যি চাই।’
বলে গাজি একটু দাড়ি ঝাড়া দিয়ে চোখ বুজিয়ে হাসে। অনুমানে ভুল করিনি। এ বিষয়ে কম-বেশি কিছু যে শুনিনি তা নয়। তার ধর্ম কী, মর্ম বা কী, তা জানি না। কিন্তু গাজির সম্পর্কে সহসা যেন মনেতে আমার নতুন কৌতূহল ঝলকায়। গতকাল সকাল থেকে সেই যে অধর মাঝিকে ডাক দিয়ে নৌকায় উঠেছিল, তারপরে আর ছাড়াছাড়ি হয়নি। শুধু এইটুকু জেনেছি, বসিরহাট শহরের ধারে কোথায় যেন তার বাস। ঝোলা কাঁধে করে কেবল নামের মজুরি করে বেড়ায়। এবার কথা শুনে গাজিকে যেন আমার একটু কেমন লাগে। জিজ্ঞেস করি, ‘তোমারও পিকিতি আছে নাকি?
গাজি যেন হঠাৎ চমক খায়, অবাক হয়। তারপরে দেখ, এই যে হা হা করে হাসি শুরু করে, তা আর শেষ হতে চায় না। কী ব্যাপার! মাতাল নাকি হে। চড়া হাসিও যেন ঘোরের হাসি।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে হাসি যদি বা থামে, এবার গাজির মুখখানি দেখ। এ যেন সেই গাজি নয়। এ যেন ছোকরা ডাগরা, শরমে মোচড় দেয় শরীরে। মুখ নিচু করে। বলে, ‘তা বাবু অই যা বলেন, একজন আছে।’
বটে। অমন রং ফেরানো দেখেই বোঝা গিয়েছিল, পিকিতি একজন আছেন। কিন্তু তাতে সাধকের অমন গৃহী জোয়ানের মতো লাজে লাজানো ভাব কেন। জিজ্ঞেস করি, ‘বিয়ে করেছিলে বুঝি।’
গাজি তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলে, ‘তোবা তোবা, গাজি দরবেশের আবার বে’ কী বাবু? এ সোম্সারে কে বা কার সোয়ামী, কে বা কার ইস্তিরি।’
তাও তো বটে। সব পুরুষ আর প্রকৃতি। কিন্তু পিকিতিটি আসেন কোথা থেকে। তাকে কি মুরশেদ পাঠিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করতে হয় না, গাজি নিজেই জবাব দেয়, ‘এ সব কিছু ছিল না বাবু। সময় হলি সবেরই খোঁজ পড়ে। তা সময়-টময়ের কথা কখনও ভাবি নাই। ঝোলা নিয়ি একা একাই বেড়াতাম। এই ধরেন দশ এগারো বছর আগে হাড়োয়ার মেলায় যেয়ি এক কাণ্ড হল। হাড়োয়ার মেলা জানেন তো বাবু!’
ঘাড় নেড়ে জানাই, জানি না। গাজি চোখ বড় করে বলে, ‘সে এক পেকাণ্ড মেলা হয় বাবু। পিতি বছর ফাল্গুন মাসের বারো তারিখে পির গোরাচাঁদের মেলা হয়।’
পির, আবার গোরাচাঁদ। কী দিয়ে মিলজুল হয়, সে খোঁজে যেয়ো না। পিরের দরগায় গিয়ে হিঁদু সিন্নি দেয়। মুসলমানে গোরা ভজে। কার্যকারণ জটিল ভেদ করতে যেয়ো না। নাম কী হে? আঁজ্ঞে, দুলাল আলি। ঠাকুর নয়, মানুষের নাম। দুলাল পাবে, আলিও পাবে। জিজ্ঞেস করি, ‘তিনি কে?’
গাজি বলে, ‘মস্ত এক সাধক ছিলেন বাবু। ওখেনে উনি দেহরক্ষা করিছেন। হিঁদু মোচলমান, সব ওঁনার ভক্ত। তা অই পিতি ফাল্গুনের বারো তারিখে ওঁয়ার দরগায় মেলা হয়। হাড়োয়ার হাটের নাম শুনিছেন বাবু?’
ঘাড় নেড়ে জানাতে হয়, শুনিনি। গাজি বলে, ‘সে এক পেকাণ্ড হাট বাবু, বিদ্যেধরী গাঙের ধারে। বেড়াচাঁপা থেকি যেতে হয় দক্ষিণে। যদি কোনওদিন যান বাবু, দেখতি পাবেন।’
গেলে দেখতে পাব, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশেষ গাজি যেরকম সবই পেকাণ্ড বলছে, প্রায় ব্রহ্মাণ্ডের মতো মনে হচ্ছে। দেখতে সাধ হয় বই কী!
গাজি কয়েক মুহূর্ত চৌকাঠে নখ দিয়ে দাগ কাটে। তারপরে বলে, ‘তা সেই এগারো বছর আগের কথা বলছি বাবু, সে বছরই ইনি দেখা দিলেন হাড়োয়ার মেলায়।’
জিজ্ঞেস করি, ‘কে, প্রকৃতি!’
গাজি কয়েকবার ঘাড় নেড়ে জানায়, হ্যাঁ। যদিও লজ্জার ভাবটি ঘুচতে চায় না কিছুতেই। আমার তখন কিস্যার কৌতূহল। না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘কী করে?’
গাজি যেন কেমন মনোভঙ্গ ভাবে বলে, ‘সে আর বলেন কেন বাবু। পিতি বছর যেমন যাই, সে বছরও তেমনি গেছি। তা সকালের দিকি যেয়ি দরগার লুটের বাতাসা খানকয়েক জোগাড় করি একটু বেড়ায়ি নিলাম। তারপর ভাবলাম কি যে, কম্নে আর ঘুরি বেড়াব। এক জায়গায় বসি, একটু গান করি। দু-চার পয়সা যা পাই, না-হয় চাল ডাল সন্ধেবেলা সেবা করা যাবে। তা যাব আর কম্নে, দরগার উঠোনে এক পাশে বসি ডুপ্কি ধরলাম।’
গাজির বয়ান এই রকম: উঠোনে এক বট গাছের ছায়ায় সে ভব্যি হয়ে বসে গান ধরেছিল। ডুপ্কি আর ঘুংগুরের তাল ছিল। তার ধারণা, লোকজনের ভাল লেগেছিল, তাই পয়সা চাল ডাল মন্দ পায়নি। সে যেখানে বসেছিল, তার কাছেই একটা নাকি দল বসেছিল। দেখে মনে হয়েছিল, ন্যাড়া নেড়ি ভাবেরই কোনও দল। দলের তো অভাব নেই। যদি জানতে চাও তবে গাজি তোমাকে শত নাম শুনিয়ে দিতে পারে।
যাই হোক, সেই দলের কেউ কেউ কাছে বসে তার গান শুনেছিল। সেই দলেই ছিল এক মেয়ে। তা বয়স প্রায় পঁচিশ-তিরিশ হবে। গায়ে পাড় ছাড়া গেরুয়া, কপালে রসকলি, আতেলা চুল ছড়ানো। ‘বুইলেন বাবু, দেখি মনে হল, গাজির গান তারই সব থেকি ভাল লেগিছে। তাই, সে তো আর কাছছাড়া হয় না। লজ্জার মাথা খেয়ে গাজি আর কী বলবে। যতবার চোখ তোলে, দেখে সেই বোষ্টমী আর চোখ ফেরায় না। আবার নাকি চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলে, ‘বাবাজির গান শুনে যে মরণ ধরে গো।’
কিন্তু তা বলে, সেসব কী আর দলের লোকের ভাল লাগে। তাদের মুখ ভার, রাগ রাগ ভাব। বোষ্টমীর সেদিকে খেয়াল নেই। যত শোনে, তত শুনতে চায়। গাজিই বা করে কী। গান নিয়ে কথা। শুনতে চাইলে না শুনিয়ে কি পারা যায়? ‘না কী বলেন বাবু।’
তারপরে সে বোষ্টমীর পাগলামি দেখ, দলের সবাই যখন খিচুড়ি অন্ন খেতে বসেছে, সে তখন কলাপাতা ভরে গাজিকে খেতে দিলে। গাজির তো ভারী লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। কিন্তু ওরকম করে দিলে না খেয়ে কী পারা যায়। আর গাজির কী-ই বা যায় আসে। আজ মৌত, কাল ফৌত। পরদিন ভোরবেলাই তো সে চলে যাবে। তখন এসব কোথায় থাকবে। সে পরিতোষ করেই খেয়েছিল। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতে হবে, মানুষটার মন ভাল। প্রাণখানিও বেশ তাজা। মেজাজ একটু ঝাঁঝালো।
এ সময়ে একবার না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, ‘আর দেখতে?’
গাজির আবার সেই হাসি, যে হাসি শেষ হতে চায় না। বলে, ‘বাবুর যে কথা! তা বাবু, কালোর ওপরি খারাপ বলতি পারব না। সোমত্ত মেয়েছেলে, ছাওয়াল-পাওয়াল হয় নাই। বেশ শক্তপোক্ত ডাঁটোসাঁটোটি ছিল। রংটা একটু কালো, তা বাবু, তাতে একটু ছিরি ছিল। ওইরকম কালো মুখি রসকলি বড় মানায়।’
তা বলে, বাবু যেন মনে না করে, গাজির সেদিকে কোনও ধেয়ান ছিল। এদিকে যত সন্ধ্যা ঘনায়, ভিড় তত বাড়ে। সারা রাত্রের মেলা তো। রাত্রে কত কবিগান, ঢপ, যাত্রা, তার সঙ্গে ম্যাজিক, সার্কেস—রাজ্যের ফুর্তি। তাতে আর গাজির কী করার আছে। তবে একটু ঘুরে ফিরে দেখতে ইচ্ছা করে। গাজি ভাবল, যাই, একটু হাতমুখ ধুয়ে দু-এক দণ্ড নদীর ধারে বসি গিয়ে। তারপরে ঘোরা যাবে।
নদীর জল তো মুখে দেবার উপায় নেই। নোনা জল। দরগার পাশেই চাপাকল। গাজি সেখানে হাতমুখ ধুয়ে নদীর ধারে যাবার আগে সেই দলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যদি তাকে দেখা যায়। এত গান শুনল, খুশি হয়ে পেট ভরে খাওয়াল, আবার দেখা হয় কি না হয়, একটু দেখা করে যাওয়া উচিত। কিন্তু দলের কোথাও তাকে দেখা গেল না। গাজি তাই আস্তে আস্তে বিদ্যাধরীর ধারে গেল। মেলাই লোকজন। নিরিবিলি খোঁজবার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে একটু ফাঁকায় গিয়ে বসল।
আকাশে সে সময়ে চাঁদ। তবে বড় নয়, জ্যোৎস্না একটু ফিকে। নদীর মাঝখানে এক চড়া। তাতে গোমাকেওড়ার জঙ্গল। গাজি সেদিকে চেয়ে বসে আছে। সে সময়ে কে যেন পিছন থেকে এসে ডাক দিল, ‘কী হল সাঁইবাবাজি, বিবাগী হয়ি এখানে চলি এলে যে?’ গাজি দেখে, সেই বোষ্টমী। বলে, ‘না, বিবাগী হব কেন। সারাদিন লোকজনের মধ্যি ছিলাম। এবার একটু নিরালায় এসিছি।’ কিন্তু গাজি কি বলবে, সেই মেয়ে একেবারে তার পাশে এসে বসল। বসে বলে, ‘আমার জ্বালায় পলায়ি আস নাই তো?’ গাজি হেসে বাঁচে না। বলে, ‘তোমার জ্বালায় কী কেউ পলায়। তোমার কাছে থেকি জুড়ায়।’
সে বলে ‘কই, সাঁইকে দেখি তো সেরকম মনে হয় না। তা হলি তো একবার কাছে ডাকতি হয়, বসতে বলতি হয়, নিদেন নামখান জানতি মন করে।’
হ্যাঁ, মিথ্যে বলব না, তখন যেন গাজির মনটা একটু কেমন কেমন করে। একটু যেন ব্যথায়, নিশ্বাস পড়ে। জিজ্ঞেস করে, ‘নাম কী?’
সে বলে, ‘তারা।’
তখন গাজি একটু ঠাট্টা করতে ইচ্ছা করে। বলে, ‘কোন তারা? নয়নতারা, না আশমানতারা?’
তারা বলে, ‘যে যেমন দেখে। সাঁইজি কেমন দেখে?’
‘সাঁই না, লোকে আমাকে গাজি বলি ডাকে।’
তারা বলে, ‘বেশ, গাজিই না-হয় হলো। গাজি কেমন দেখে?’
তা এতে মানুষের মন একটু মজে কি না, বাবুই জবাব দিক। গাজির তাই নিশ্বাস পড়ে। বলে, ‘আমার তো মনে হয়, আশমানতারা।’
‘কেন?’
‘চোখ চাইলি দেখা যায়, হাত বাড়ালি ধরা যায় না।’
তারা তখন খিলখিল করে হাসে। গাজির মনে হয়, বিদ্যাধরীর জলে বুঝি জোয়ার আসে। তারা বলে, ‘আর নয়নতারা?’
‘সে তো সঙ্গে সঙ্গে থাকে, নিজির মধ্যি।’
তারা একটু চুপ করে থাকে। তারপরে বলে, ‘তা যদি নাও তো থাকতে পারি।’
গাজি কি বলবে বাবুকে! তার যেন মনে হল, ভিতরে তার কোটালের বান ডাকে। ভাবে, এ বুঝি মুরশেদের লীলা। অধর ধরার ফাঁদ তুলে দেয় হাতে। গাজি জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের লোজনেরা কী বলবে?’
তারা বলে, ‘কী আবার বলবে। আমি কারুর দাসী না। কাউকি কিছু বলবও না।’
তখন গাজি তাকে নয়নতারা নামে ডেকে বলে, ‘তবে নয়নতারা, তোমাকে নিয়ি আমি মনের মানুষ ভজব।’
তারা বলে, ‘যে তোমার মনের মানুষ, সেই আমার ছিকেষ্ট।’
গাজি বলে, ‘কবে যাবে?’
‘আজই যাবো, এখুনি।’
‘তোমার জিনিসপত্তর ?’
‘কিছুই নেব না।’
গাজি যে কী বলবে বাবুকে! এ যেন সমুদ্র থেকে আসা জোয়ার। যতক্ষণ তার কাল, ততক্ষণ সে পিছন ফিরে তাকায় না। সেই তার নিয়ম। বেশ তবে তাই চলুক নয়নতারা, এখান থেকেই সোজা হাঁটা ধরা যাক।
এই পর্যন্ত বলে গাজি চুপ করে। আর ভুরু কুঁচকে ঠোঁট টিপে আমি ভাবি, ‘বাঃ গাজি, এর নাম প্রকৃতি-প্রাপ্তি।’
.
২৩.
গলায় আমার ঠেক লেগে যায়, খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি না। মনে মনে বাহবা দিয়ে কেবল গাজিটার দিকে চেয়েই থাকি। আর গাজিটার, দেখ, মুখ তোলবার নাম নেই। ময়লা কালো কালো নখে ঘষে ঘষে চৌকাঠসুদ্ধ না খুঁড়ে ছাড়ে। আমার কানে তখনও বাজতে থাকে, ‘সাগরের বান বাবু, জোয়ারে সে যতক্ষণ চলতি থাকে, ততক্ষণ আর ফিরি চায় না। সেই তার নিয়ম, বুইলেন তো। তা নয়নতারার তখন সেই হাল। মিছা বলব না বাবু, গাজিরও। ভাবলাম, কি বলে যে, তবে তাই চলুক নয়নতারা।’ ভাবো, এর পরে বাহবা না দিয়ে তুমি করো কী। এ বিয়ে না, শাদিও না। তাতেও তো আবার ‘তোবা তোবা। সোম্সারে কে কার সোয়ামী, কে কার ইস্তিরি।’ তবে ওই কথাটিও ভুল। সবই পুরুষ-প্রকৃতি নয়। যাঁর ভজন-সাধন, তিনিই সব। তাঁর কাছে আবার স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় কী। এই হল মোদ্দা কথা।
তা হতে পারে। কিন্তু এটাকে কী বলে। আমরা তো আর সাধক নই। একে কি হরণ বলে! তাও হয়তো তোবা তোবা। প্রকৃতি হরণ! এমন কি হতে পারে! এ কি তোমার বীর্যবানের বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! অতএব এর নাম বিয়ে না, শাদি না, হরণ না, ভোগ না। এর নাম প্রকৃতি-প্রাপ্তি। মুরশেদের মিলিয়ে দেওয়া। জয় মুরশেদ! জয় মুরশেদ! ঘর করা তো নয়, মনের মানুষ ভজন।
এতক্ষণে একটা ধন্দের নিরসন। তাই তো ভাবি, গাজি অমন ঠেকা বুঝে সবখানে তাল দেয় কেমন করে। লঞ্চে দেখেছি মা-মেয়েকে সামলাতে। এদিকে দেখেছি, আঙ্রি-মাহাতো, দুলি-অনন্তর বিষয়ে ঠিক তাল দিচ্ছে। এমনকী, নারায়ণ ঠাকুর আর ফোঁচার বউয়ের ব্যাপারেও দাড়ি কাঁপানো লহরায় মোক্ষম তাল দিয়েছিল। ওসব শুধু মুরশেদে হয় না। মুরশেদের মিলিয়ে দেওয়া লীলা-মাহাত্ম্যে মাতোয়ারা যে! আর আমি কেবলই কথা শুনে, ভাব দেখে ভাবি, গাজিটা পাজি।
পাজি তো বলেই, নইলে আর এমন হয়। যে কালোমুখে রসকলি আঁকার মানান দেখেছে, সে তালে ভুল করবে কেন। এখন দেখ, বেত্তমেজ ব্যাদড়া গাজি শরমে মরে যায় হে। মুখ তুলতে পারে না! জিজ্ঞেস করি, ‘তা, সেখান থেকেই তা হলে হাঁটা ধরলে?’
গাজি ঘাড় কাত করে বলে, ‘আজ্ঞা, মুরশেদের নাম নিয়ি।’
সে তো নির্যস কথা। মুরশেদের নাম না নিলে, পায়েই বা জোর দেওয়া যায় কী করে। বলি, ‘তা, নয়নতারা সবই ফেলে গেল, নিজের কিছুই নিয়ে গেল না?’
গাজি নিজের ঝোলা দেখিয়ে বলে, ‘নেবার আর কী ছিল বাবু, ওইরকম একখান ঝোলা তো!’
‘তা হতে পারে। একেবারে এক কাপড়ে গেল, একটা বাড়তি কাপড়ও তো দরকার।’
‘তয় আর জোয়ারের টান কেন বাবু।’
সেও তো কথা, মুখ বন্ধ আগেই হয়েছে। কিন্তু সে নিজেই আবার বলে, ‘তয়, তার দলের মান্ষির জন্যি যে আমার মনটা একটু দোমনা হয় নাই, তা বলতি পারব না। ভেবিছিলাম, কী জানি দেখতে পেয়ি যদি একটা ঝগড়া-বিবাদ লাগায়, তা হলি মেলার মধ্যি একটা শোরগোল পড়ি যাবে। সবাই বলবে, মামুদে গাজি মেয়েছেলে লুট করে। তা সে কথা যেমনি নয়নতারাকে বলিছি, তেমনি একেবারে ফণা ভোলা সাপের মতন ফোঁস করি উঠিছে। সে যে মুত্তি বাবু, কী বলব আপনাকে। চোখে আগুন, মুখে আগুন, গোটা নয়নতারাখানি আগুন।’…
গাজি বলে এমন করে, স্বর শুনে, মুখ দেখে মনে হয়, অমন আগুনের চেয়ে সুন্দর আর ত্রিভুবনে নেই। অমন আগুনে পুড়ে মরতে না জানি তার কত সুখ। বলে, ‘নয়নতারা ঠোঁট বেঁকায়ি, রসকলি কাঁপায়ি বলে, ‘ইস্সি হে, কেন, আমি কারু কেনা বাঁদি নাকি যে, ঝগড়া-বিবাদ করবে। তারি বোষ্টমী কারুর দেবদাসী না। আসুক দিকি কেউ কিছু বলতি, মুখে নুড়ো জ্বেলি দেবো।’ তা হলি আর গাজির দোমনা করবার কী আছে, বলেন। মনে হয়িছিল, গোটা মেলার তাবৎ লোক এসিও যদি আটকাত, তা হলিও নয়নতারাকে ঠেকাতি পারত না। বাবু মিছা বলব না, এমন মেয়েছেলে আর দেখি নাই।’
গাজির মুখে মেয়েছেলে মানায় না। বলা উচিত পিকিতি। আর অমনটি যে সে কস্মিনকালেও দেখেনি, তার বাত শুনলেই বোঝা যায়। মাত হওয়া দেখেই অনুমান হয়। আমি তো কানেও শুনিনি। কী গান যে গাজি শুনিয়েছিল, কে জানে। গানেরই গুণে, না কী গুণ হওয়ার গুণে, কে জানে, সারাদিনের দেখাদেখি, সাঁঝবেলাতে প্রকৃতি একেবারে হাত ধরে জীবনসঙ্গিনী। খাঁটি প্রকৃতি সন্দেহ নেই। খাঁটি প্রকৃতির ধরন এমনি বোধ হয়। তার লুকোছাপা ছলচাতুরি নেই। যেমন ঋতু, তেমনি সাজ। খরায় খরায় খরো, ঝরায় ঝরঝর। লাগল বান তো নামল টল। ভেসে চলে যায়। গাজির দোষ কী বলো। তার দোষ দিয়ো না।
সে বলে, ‘সারারাত হেঁটি চলি গেলাম বসিরহাট।’
জিজ্ঞেস করি, ‘সারারাত হাঁটলে?’
‘হ্যাঁ। তা বাবু, দূর তো কম না। বিশ-পঁচিশ মাইল তো হবে।’
শোনো এবার কথা, আর পুছ করবে কী। দু-দশ নয়, বিশ-পঁচিশ মাইল! না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘সে কি হে, অত দূর হেঁটে গেলে, কষ্ট হল না?’
গাজি হেসে বলল, ‘আমাদের আবার পথ চলাতে কষ্ট কী বাবু। চলিই তো আছি।’
তারপরে দেখি, গাজির দাড়িতে একটু লাজে লাজানো হাসি ফোটে। বলে, ‘আর সে চলা তো বাবু গোণের চলা। গাঙে যেমন আপনার অমাবস্যে পুন্নিমেয় গোণ লাগে, সেই রকম আর কী। অল্পস্বল্প জোছনা ছিল। সড়ক ধরি যাই নাই। শুকনার কাল, মাঠ দিয়ি হেঁটে গেছি।
তারই বা আর দরকার কী ছিল। গোণ কোটালের চলা, জ্যোৎস্নাতেই বা কী করে, আর সড়কেই বা কী প্রয়োজন। আলাদা করে আর নয়নতারার কষ্টের কথাও পুছ করার জরুরত নেই। তারও তো গোণের চলা। কেবল আমার চোখের সামনে ভাসে, আলখাল্লা গায়ে, ঝোলা কাঁধে, বাবরি আর দাড়ি ওড়ানো এক পুরুষ। তার পাশে কালোর ওপরে মুখখানির ছিরি ভাল, কপালে রসকলি আঁকা, পাড়হীন গেরুয়াপরা, চুলখোলা এক যুবতী। ফিকে জ্যোৎস্নায়, মাঠের ওপর দিয়ে তারা পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। সূর্যোদয়ের আগে যাদের মুখ চেনাচিনি ছিল না, সূর্যোদয়ের পরে তারা পুরুষ-প্রকৃতি সম্পর্ক পাতিয়ে চলে যায়। এবার অবাক হয়ে থাকো গিয়ে। কিন্তু জীবনকে ছকে ফেলতে যেয়ো না। ভাবো, তখন তাদের চোখে চোখে কী কথা। প্রাণে বা কীসের রোল।
ইতিমধ্যে নারায়ণ ঠাকুরের উদয় না হলে আর না জানি কী বাতপুছ হত। নয়নতারার কথা আর জিজ্ঞেস করা হয় না। গাজির মুখ তখনও লজ্জাহানা হাসিতে ঝলকায়। নারায়ণ জিজ্ঞেস করে, ‘ঘুম-টুম হয়েছিল তো?’
‘ওই একরকম।’
জবাব দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। ভোর-ভোরের অস্পষ্টতা আর নেই, রোদ উঠে পড়েছে। তার মধ্যে গাজি আওয়াজ দেয়, ‘দুলি ঠাকরুন কম্নে গেল ঠাকুরমশায়!’
নারায়ণ ঠাকুর মুখখানির আকৃতি বদলে বলে, ‘যে চুলোয় যাবার, সেই চুলোতেই গেছে। টের পেয়েছিলে নাকি?’
গাজির পালটা দাবি, ‘আপনারা পান নাই?’
‘তা আবার না পাই! পেত্থম তো পেছনে গিয়েই ডাকাডাকি করেছে।’
গাজি বলে, ‘তয়, আওয়াজ দিলেন না যে?’
নারায়ণ ঠাকুর তার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘দিয়ে কী হবে। নাকাল করা ছাড়া আর তো কিছু না। তা সে হলে তো। সেই বলে না, হাগন্তির লাজ নাই, দেখন্তির লাজ। নতুন তো না, এবার নিয়ে বার তিনেক হল।’
বলে নারায়ণ ঠাকুর আমার দিকে চায়। গাজি বলে, ‘সেই তাই। জয় মুরশেদ!’
বলতে বলতে সে ওঠে। ঠাকুর তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবু জানেন নাকি?’
গাজি যেন বড় সহজে বলে, ‘বাবুর পাশ দিয়িই গেল কি না। তখন আমরা জেগি রয়িছি।’
কথাটা যেন নারায়ণ ঠাকুরের সম্মানে লাগে। বলে, ‘নাঃ, আর ওসব আশকারা দেব না। দাদা দাদা বলে এসে ন্যাকামি করবে, ওসব আর হবে না। তবে ওই, ভালর কাল নেই। কাঠ খেলে আংরা ছাড়তে হবে, আমাদের আর কী।’
কিন্তু এ প্রসঙ্গ, ভুলে যাই, যখন দেখি, ফোঁচার বউ গরম চায়ের গেলাস নিয়ে ঢোকে। তৃষ্ণা ছিল মনের অগোচরে। দেখে তৃষ্ণা বাড়ে না কেবল, প্রাপ্তির আশায় মন ঝলকে যায়। তা বলে যদি ভাবো, ফোঁচার বউয়ের কাঁখে ছেলেটি নেই, তা হলে ভুল। এক হাতে সেটি ঠিক ধরা আছে, আর এক হাতে চা।
গাজি তাড়াতাড়ি হাঁকে, ‘আমার একটু হবে তো গো ঠাকরুন।’
ঠাকুরের সেই বিরক্তি। বলে, ‘হবে, গেলাসখানি বের করো।’
‘করিই আছি।’
বলে ঝোলা থেকে অ্যালুমিনিয়ামের গেলাস বের করে আঙুল দিয়ে তাল বাজিয়ে দেয়। ফোঁচার বউ নিঃশব্দে একটু হাসি ছিটিয়ে যায়। ফোঁচা জল এনে দেয় বারান্দায়। ঠাকুর বলে গাজিকে, ‘চা খাওয়া হলে বাবুকে নিয়ে একটু মাঠ ঘুরে এস।’
নির্দেশের মধ্যে ইঙ্গিত আছে। অতএব চায়ের পরে মাঠে। মাঠ ঘুরে ফেরার পথে, গাজি পথঘাটের খোঁজ-খবর করে। খেয়াঘাটে গিয়ে জেনে আসে, ওপারের পথঘাটের অবস্থা, মোটর-বাসের ক্ষণ সময়। এদিকে লঞ্চের খবর নিতেও ভোলে না। তাতে জানা গেল, বাস চলাচলের সময়ে একটু গোলমাল। তবে চলাচল আছে। পথঘাট একেবারে অচল হয়ে নেই। কিন্তু গোসাবা থেকে লঞ্চ এসে পৌছুবে সাড়ে নটায়। থামাথামি নেই, লোক তুলে নিয়েই চলে যাবে। গাজি বলে, ‘সেই ভাল। ডাঙার রাস্তায় যখন একটু গোলমাল আছে, তখন লঞ্চে করিই চলেন। নেমিই হাসনাবাদ থেকি বাস পাবেন।’
মতলবটা মন্দ না। তবে মনের মধ্যেই একটু যেন ঠেক খেয়ে যায়। ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়ের মুখখানি মনে পড়ে যায়। তাঁর কথাই যে শেষ পর্যন্ত ফলে যাবে, কে জানত। আজ যে আবার তাঁদের সঙ্গেই আমাকে ফিরতে হবে, সে ভবিষ্যদ্বাণী আগেই ঘোষণা করেছিলেন। গোটা পরিবারের কাছে আর এক প্রস্ত নাকাল। তাই বলি, ‘না গাজি, তার চেয়ে ডাঙার পথেই যাই চলো।’
‘কেন বাবু, উপায় থাকতি গোলমালে যাবেন কেন?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ চক্রবর্তীর কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিই। গাজি হেসে লুটায়। বলে, ‘বাবুর যে কথা! চুরি তো করেন নাই।’
তা করিনি। এ যেন তার চেয়ে বড় অপরাধ। যদি তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তা হলে যে বচন সম্ভাষণ জুটবে, তা এখনই অনুমান করতে পারি। তাইতেই আমার ভয়। তাঁর উপদেশ তখন শুনিনি। মাস্টারমশাই এমনি ছাড়বেন না।
গাজি আবার বলে, ‘কিন্তু ওঁয়ারা তো কলকেতাতি যাবেন। এদিকি আর আসবেন কেন, ক্যানিং থেকি রেল করিই চলি যাবেন।’
‘কিন্তু এ পথে ফিরবেন বলেছিলেন।’
গাজি বলে, ‘তা হোক গে। দেখা যদি হয়, মন্দ কী। সে বাবু বড় মজার বাবু।’
সবাই তার কাছে মজার বাবু। চক্রবর্তী মশাইয়ের ধমকধামক রুক্ষভাষের মধ্যে যে একজন মজার মানুষ আছে, রসকে গাজি তাতে ভুল করেনি। মনে ভাবি, সেই ভাল। দেখা যদি হয়, মন্দ কী। ব্রহ্মনারায়ণ ঘাড় নাড়িয়ে, মাথা দুলিয়ে, দাঁত কাঁপিয়ে, টাক ঝলকিয়ে বচন দেবেন। তাই ভোগ করব।
নারায়ণ ঠাকুরের ঘরে ফিরে এসে মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিই। সকালবেলার চা জলখাবারের ব্যবস্থাটাও একেবারে মন্দ নয়। মুড়ি, গরম জিলিপি, চা। তারপরে হিসাবপত্র করে টাকা মেটানো। কিন্তু হিসাবে কেবল আহারের দাম কেন। আশ্রয়ের মূল্য তো চায় না ঠাকুর। জিজ্ঞেস করতে বলে, ‘সে কি আবার একটা কথা হল মশাই। আটকে পড়েছেন একটা রাত্রের জন্যে, তাই একটা ব্যবস্থা করা। ওর আর কিছু দিতে হবে না।’
ফোঁচা দাঁড়িয়েছিল সামনে। তাকে কিছু না দিলে মনটা খুঁতখুঁত করবে। কিন্তু দিতে যেতেই সে তার দম আটকানো সুর গলায় বলে ওঠে, ‘না না, আমাকে আবার পয়সা দেন কেন।’
ভুলে যাই, এটা শহরের পান্থশালা নয়। যেখানে চাকর-বেয়ারারা পয়সা না পেলে কানে কম শোনে, চোখে কম দেখে। ফোঁচা এতে অভ্যস্ত নয়। সে রকম চল নেই এখানে। তবু দিতে যখন চেয়েছি, সে নিলে সুখী হই। বলি, ‘তাতে কী হয়েছে। আমি খুশি হব।’
গাজি আওয়াজ দেয়, ‘নেও গো ফোঁচাদা, বাবু দিচ্ছেন।’
ফোঁচা পয়সা নেয়। ভিতরের দরজার কাছে দেখি, তার বউ ছেলে-কাঁখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাতে সে নজর নামিয়ে নেয়! বোঝা যায়, সবাই দাঁড়িয়ে বিদায় দেয়। এমন কিছু ব্যাপার নয়। এক বেলা এক রাত্রি, তাও পান্থশালায়। তবু, এক মুহূর্তের একটু স্তব্ধতা। তার মধ্যেই যেন সকলের মনে একটা সুর বেজে যায়। অনেক যাত্রার অনেক পালা। দেখি, অনেক ভুলে যাই, অনেক ভুলতে পারি না। এখানকার না ভোলার পালা। তাই বোধ হয় একটু চুপ করে দাঁড়াতে হয়। না জানার অচিনে চলায়, এমন অনেক হয়। পা বাড়িয়ে বলি, ‘চলি।’
নারায়ণ ঠাকুর বলে, ‘এদিক পানে এলে আবার আসবেন।’
‘আসব।’
গাজি বলে, ‘চলি ঠাকুরমশায়।’
ঠাকুর একেবারে রামগডুরের ছানা। প্রায় খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আবার আপনি উদয় হচ্ছেন কবে?’
এখন বুঝে দেখ, এ কি আপদ বিদায়, না আবার নিমন্ত্রণের কথার ফের। গাজি বলে, ‘তা কি বলা যায় ঠাকুরমশায়। মুরশেদ যে কোনদিন কম্নে নিয়ি যায়, বলতি পারি না। যেদিন তিনি আনবেন সেদিন আসব।’
নারায়ণ ঠোঁট উলটে ঘাড় বাঁকায়, ‘খালি বাজে প্যাচাল পাড়ে।’
এতে প্রেম আছে কি না, কে জানে। হাটের ভিতর দিয়ে, ভেড়ি বাঁধের ওপর এসে দাঁড়াই। সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। দূরের এক বাঁকে নদী গিয়েছে হারিয়ে। সেদিকেই যেন কোথায় শব্দ বাজে গুরু গুরু করে। গাজি জানায়, লঞ্চ আসছে, তারই শব্দ বাজে। জোয়ার হলেগেছে। সূর্যছটায় চলকানো জলে নৌকা পারাপার করছে। মালপত্র ওঠানামা চলেছে গতকালের মতোই। নদীর মাঝখানে জলের চিহ্নগুলো দোলে। মাছমারার কেউ জাল ফেলে, কেউ গোটায়। আকাশে কোথাও একটু মেঘ নেই। নদীর ধারে ধারে গেমো পাতায় রোদ চিকচিক করে। জোয়ারে জল অনেকখানি ভরে উঠেছে, তাই বোধ হয় পলির পোকা খাওয়া পাখিদের ঝাঁক দেখা যায় না। কিন্তু মাঠের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখ, বনচড়াইয়ের ঝাঁক সেখানে।
দূরের বাঁকে লঞ্চ দেখা দিল। দেখতে দেখতে ঘাটে এসে ভেড়ে। বাঁধের ওপর পাটাতন এসে পড়ে। নামে না কেউ। ওঠবার যাত্রী দু’জন মাত্র। আমরা উঠে পড়ি। এক মিনিটও লাগে না যেন। আগেই চোখে পড়ে ছাদের ওপর প্রথম শ্রেণীর কামরায়। একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে। সেখানে কেউ নেই, একেবারে ফাঁকা। গোটা রাজত্বটা আমার।
সোজা ওপরে গিয়ে বসি। গাজি তেমনি বাইরে। বলে, ‘বাবু বড় ভেবেছিলেন। দ্যাখেন, বুড়াবাবু আসেন নাই।’
তা আসেননি। একে বলে মন। তাদের না দেখে যে একটা স্বস্তির নিশ্বাস এইমাত্র পড়েছিল, এই খোপের মধ্যে বসতে গিয়ে, তা হঠাৎ যেন কেমন একটু ঠেক খেয়ে যায়। একে বলে আশাভঙ্গ। কেন না, কেবলই গতকালের কথা মনে পড়ে যায়। খোপটা যেন ফাঁকা লাগে। বেমানান খোপটাকে যেমন দেখেছিলাম, তেমন যেন নেই। সেই যে একলষেঁড়ে মনটা, সে যে আসলে জনের সঙ্গ চায়, এটা অনেক সময় মনে থাকে না। তা ছাড়া ‘চাই না, চাই না’ কখন যেন ‘চাই, চাই’ হয়ে রয়েছে, টের পাওয়া যায়নি। ফাঁকা খোপে ঢুকে বসে টের পাওয়া গেল। তাই এক মুহূর্তের জন্যে, আমার জানালার কাছে ঝাঁপিয়ে পড়া আরশি-আকাশের থইথই-এর মধ্যে একটু মনোভঙ্গের সুর বেজে যায়।
কিন্তু সে একটু সময়। তারপরেও দিগন্তের সেই অশেষে আমার টান লেগে যায়। শুনতে পাই, গাজি যেন কী গুনগুন করে। তার কথা আমার মনে পড়ে যায়। তার আর নয়নতারার কথা। মনে ভাবি, যে মনের মানুষ ভজবে বলে নয়নতারাকে বলেছিল, সেই অধর মানুষ ধরা হয়েছে কিনা। এখন আর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মনে মনে বলাবলি করি। কথাটা মনে পড়ে তার গুনগুনানির কথা শুনে। শুনতে পাই, বাতাসের গায়ে সুর মিলিয়ে সে বলে, ‘অধরকে ধরব বলে, দড়ায় বাঁধা পড়েছি। এখন আপন ধরা, বেজায় কড়া, এমন মরা মরেছি।’…
পুরুষ-প্রকৃতির কার্যকারণের এসব ব্যাখ্যা জানি না। সাঁই দরবেশ ফকিরদেরও যে সাধনভজনের এসব রীতকরণ আছে, জানা ছিল না। যতটুকু জানা ধারণা, সেটা তন্ত্রমন্ত্রের কথা। কিন্তু গাজির কথায় সেই ইশারা পেয়েছি। সেই সুরেই বেজেছে মিয়া-বিবির ঘর-করা স্রোতের টানে চলা। সাধক চলে উজানে। ব্রহ্মচর্য চাই। বলে এই পথে-ফেরা, ধূলিঝাড়া আলখাল্লাওয়ালা গাজি।
সেই সব রীতিপদ্ধতির মহত্ত্ব কী, তাও আমার অজ্ঞাত। বোধ শুদ্ধির বাইরে। জানতে যে ইচ্ছা না হয় এমন নয়। গাজির কাছে জানতে ইচ্ছা করে, তার আর নয়নতারার উজান চলার রীতি কেমন। তাদের সাধনরীতি ব্রহ্মচর্যে প্রেমের লেনাদেনা আছে কিনা। তার গানেতে তার কথা। ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’ আমার চোখের সামনে ভাসে, বিদ্যাধরী নদীর কূলে বসে এক ডাগরা গাজি। পাশে ডাগরী যুবতী। সাধন-ভজন যাই থাক। আমি যে স্রোতের টানে চলা মানুষ। তাই সেই ফিকে জ্যোৎস্নায় চারি চক্ষে দেখি কেবল পঞ্চশরের তির বেঁধাবেঁধির খেলা। জোয়ারের রোল তো বিদ্যাধরীর জলে নয় হে। কলকলিয়ে বাজে যেন দুই প্রাণের ধারায়।
সে আবার পাপ কি না জানি না। হতে পারে। তবে পাপের ঊর্ধ্বে মন চলে না যে। সেই পাপেতে যেন এক দিলখুশানো দিলদরদী দেখি। তাকেই আমার শুদ্ধ মনে হয়। বিদ্যাধরীর কূলের কথায় এক নিপাট সহজ পবিত্রতা আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।…
এমনি ভাবের ভাবনাতে ঘুম-কাড়ানো রাত্রির শোধ যেন নেমে আসে চোখে। ঘুম ঘুম লাগে। যন্ত্রের গুড়গুড়ানি, জলকাটানোর কলকলানো, আমেজ ধরা রোদে আর অল্প হিমেল বাতাসে কোথায় যেন তলিয়ে যাই। তার মধ্যেই ঘাটে ঘাটে লাগে নাও, যাত্রী নামে ওঠে, টের পাই। একটা ঘোরের মধ্যে কাটে।…
একসময়ে গাজির গলায় ঘোযণা হয়, ‘বাবু, হাসনাবাদ এসে গেল।’
ফেরার পালায় গাঙের অধ্যায় সাঙ্গ। সূর্য তখন মাথার ওপরে। হাতের ঘড়িতে দেখি, দুই কাঁটা মাঝখানে প্রায় একাকার। লঞ্চ ঘাটে ভিড়বার আগেই নামবার তাড়ায় সবাই ভিতরের খোল থেকে বেরিয়ে সামনে জড়ো হতে শুরু করেছে। সারেং মশাই ধমক দেন, ‘এই দেখ, সব সামনে আগলে দাঁড়ায়। আরে বাপু, নামবেই তো।’
বলে জোরে জোরে ভেঁপু বাজিয়ে দেয়। তা বললে কি যাত্রী শোনে। তার তখন মনের তাড়ায় গায়ে ধাক্কা। কে যেন আবার বলে, ‘বসিরহাটের আদালত তো সে কথা শুনবে না গো। সেখানে যে ঘণ্টা বেজি যায়।’
আদালতে ঘণ্টা বেজে যায়। বিচারকের ডাক সেখানে। ত্বরায় চল, ত্বরায় চল। গাজি বলে, ‘বাবু, ভিতরের লোকজন নামুক, তারপরে ধীরে-সুস্থে নামবেন।’
শিরোধার্য, ঠেলাঠেলি করে লাভ নেই। সম্ভবত, প্রথমেই যে মোটর-বাস বসিরহাটের দিকে যাবে, তাতে জায়গা পাওয়া কঠিন। আমারও তাড়া। কিন্তু সে আদালত আলাদা। তা বসিরহাটের আদালত নয়। তাই এইটুকু বিলাস, আলস্যে বসে দেখি যাত্রীদের ব্যস্ত হয়ে নামা। যখন নামার স্রোতে প্রায় ভাঁটা পড়ে আসে, সেই সময়ে… কী বেয়াজ দেখ, বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে যায় প্রায়! অবাক হয়ে গাজির দিকে চাই। গাজি চায় আমার দিকে। তার ফাটা মুখে হঠাৎ কাঁড়ি কাঁড়ি হাসি, চুল দাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
দেখি খোলের ভিতর থেকে স্রোতের মুখের শেষ দিকে প্রথম বেরোয় ঝিনি, তারপরে গিন্নি, তারপর স্বয়ং ব্রহ্মনারায়ণ। টাকের কাছে যে কয়খানি চুল সিড়িঙ্গে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় ব্রহ্মনারায়ণের তর্জনীর মতো যেন শূন্যে বিঁধে আছে।
খোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসি। ব্রহ্মনারায়ণ সপরিবারে তখন লঞ্চ থেকে সাঁকোয় পা দিয়েছেন। পিছন ফিরে তাকাবার সময় নেই। পিছনে লোকের তাড়া। পিছন থেকেই মনে হয়, মাস্টারমশাইয়ের গায়ে ঘুম-ভাঙা বিরক্তি জড়ানো। গিন্নি তেমন গোছালো নন। ঝিনির সাজগোজের তেমন ঝলক ঝলকানো নয়। মায়ের চেয়ে বেশি গোছালো নয়। বরং একটু বেশি অগোছালো লাগে। কারণ, তার মাথায় ঘোমটা নেই। রুক্ষু চুলের গোছায় কোনওরকম বাঁধন-কষণ নেই। বোঝা যায়, সবাইকেই বিছানা ছেড়ে দৌড়তে হয়েছে। একটা কেবল অবাক লাগে, কালীনগরের ঘাটে কি এঁরা আমাদের দেখতে পাননি। নীচের দিকে ভিতরে আমার নজর যায়নি। আমার নজর কেড়ে রেখেছিল ওপরতলার খোপ।
সাঁকো পেরিয়ে ডাঙায় উঠে, প্রথম মুখ ফিরিয়ে চায় মেয়ে। জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, কোন বাসে উঠব?’
কথা শেষ করতে পারে না ঝিনি। ওর চুলের গোছায় ঢাকা পড়া এক চোখেতেই থমকানো বিস্ময়। আর এক চোখের চুল সরাতে ভুলে যায়। কোঁচকানো আঁচল কোথায় পড়ে আছে, সে ধেয়ান নেই। এবার দেখে নাও, অলকে নেই কুসুম, চোখেতে নেই কাজল। ঠোঁট-রাঙানিয়া রং লাগেনি একটুও।
ব্রহ্মনারায়ণ তখন কথার জবাবে হাঁক দিয়েছেন, ‘যেটাতে সবাই উঠছে, সেটাতেই উঠে পড়।’
ততক্ষণে গাজি আওয়াজ দিয়েছে, ‘আপনারা নীচির ঘরে ছিলেন বুঝি দিদিঠাকরুন।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ ফিরে তাকান। সেই সঙ্গে গিন্নি। ব্রহ্মনারায়ণের নকল দাঁতে একবার ঢেউ খেলে যায়। ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে নিতে এক মুহূর্ত লাগে। তারপরেই ঠোঁট দু’খানি বিস্তৃত করে, করুণ চোখে আপাদমস্তক দেখে বলেন, ‘বাঃ, চমৎকার।’…
.
২৪.
‘বাবুরা একটু রাস্তা ছাড়েন গো।’
গ্রামীণ জনেরা হাঁক পাড়ে পিছনে। আমি, গাজি, ব্রহ্মনারায়ণ তখনও সাঁকোয়। মা, মেয়ে ডাঙায়। ব্রহ্মনারায়ণ বাহবা দিয়ে সেই যে আমাদের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন, তারপরে পটুয়ার পটে আঁকা মূর্তি সবাই। কয়েক মুহূর্ত কারুর নড়াচড়া নেই। হাঁক পড়তে পট সচল। নড়ে-চড়ে সবাই ডাঙায় গিয়ে উঠি। তার মধ্যে ব্রহ্মনারায়ণের নির্দেশ শোনা যায়, ‘ওরে ঝিনি, তোর মাকে দাঁড়াতে বল, এ বাসে আর যাওয়া চলবে না।’
ওদিকে বাসের ছোকরা সহিস ডেকে চলেছে, ‘জল্দি জল্দি, আও আও আও।’
যাদের যাবার তাড়া, তারা ছোটে, ছুটতে ছুটতে হেঁকে বলে, ‘দাঁড়ান গো, দাঁড়ান।’
আবেদনের পরে পরিবার-পরিজনকে ধমক, ‘এইসো এইসো, চলো চলো, নইলি দাঁত ছরকুটি পড়ি থাকতি হবি নে।’
ওদিকে আবার একজন ব্ৰহ্মনারায়ণকে উপদেশ দেয়। খালি গা, কিষেন না কি ঘাটের মজুর, গা চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘এর পরের মটরে যান বাবু। মা ঠাকরুনদের নিয়ি আর এটায় উঠতি পারবেন না।’
ব্রহ্মনারায়ণ জিজ্ঞেস করেন, ‘এর পরেরটা ছাড়বে কখন।’
জবাব দেয়। পানবিড়ির দোকানওয়ালা, ‘কুড়ি মিনিট পরে।’
ব্রহ্মনারায়ণের মন্তব্য, ‘তার মানে আধ ঘণ্টা।’
সেই সঙ্গে একটু স্বস্তির নিশ্বাসও শোনা যায়। ইতিমধ্যে মা-মেয়ে যত দেখেন আমার দিকে, তত নিজেদের মুখোমুখি চেয়ে টিপে টিপে হাসেন। তবু দেখ, মা মেয়ের থেকে সরস, সহজে বিরাজ। কিন্তু মেয়ের যেন ঠেক লেগে লেগে যায়। নাগরিকার একটু বিব্রত ভাব। নজর থাকলে বুঝবে, মজা পেয়ে হাসির মধ্যেও কোথায় একটু আড়ষ্টতা। মন গুনে যে ধন। মুখে যে রং বুলানো হয়নি, নোনা গাঙের বাতাস লেগে তেলতেলে হয়ে আছে, নাগরিকার তাইতে একটু ঠেক লেগেছে। ঠোঁট ছোপানো নেই, চোখে কাজল আঁকা নেই। আহ্ ছি ছি, দেখ ফুল ফুল ছাপা কাপাস কাপড়খানিও কেমন কোঁচকানো দোমড়ানো। আতেলা চুলে টান দিয়ে যে ঘাড়ের কাছে একটু বাঁধন দেবে, তারও সময় হয়নি। তাই চেয়ে চেয়ে দেখা, মায়ের সঙ্গে হাসি, তবু শাড়ি নিয়ে টানাটানি। সারা শরীর আর মন দিয়ে যেন নিজেকে তুষ্টি বিধানের চেষ্টা।
তবে কি না, আমাকে যদি বলো, এই পোড়া চোখে নির্ভেজাল ভাল দেখি। শ্যামেতে যে চিকন সোনা চিকচিক করে, তাই দেখি। রোদ মাখানো স্বর্ণলতা যেমন চিকচিক করে। তাতে পালিশের ঝিলিক হানে না। স্নিগ্ধতা মনের মধ্যে পশে। কাল ছিল ঝিলিক, নজরে ঝলক-হানা। আজ না হেনেও পশে। আজ যেন দৃষ্টি জুড়ায়, সাড়া জাগে গভীরে। কাজলে যে চোখ আয়ত মনে হয়েছিল, আজ তার বর্ণনা মেলে ডাগরে গভীরে। রাত্রে বুঝি নিদ্রা সুখের হয়নি। তাই জাগরণের ছায়ায় এ চোখ স্বচ্ছ বেশি। আভাঁজ-কাপড়ে সহজ অনেক। হাতে দোলে সেই ব্যাগখানি।
ব্রহ্মনারায়ণ গিয়ে দাঁড়ান কন্যার পাশে। হাসেন, না বিদ্রূপ করেন, বুঝতে পারি না। ঠোঁট দু’খানি টিপে, চোখ দুটি কুঁচকে, ঘাড় কাত করে একবার দৃষ্টি হানেন আমাদের দিকে। গাজি তো প্রায় অধোবদন। বিব্রত লজ্জায়, আমারও প্রায় সেই অবস্থা। কিছু বলবার আগে, কিছু শুনে নেওয়া ভাল। তাই চোখ তুলে চাই।
কিন্তু ব্রহ্মনারায়ণ আমাকে কিছু বলেন না। ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন দেখছিস রে ঝিনি।’
ঝিনির জবাব বাজে হাসিতে। যেন প্রেমজুরিতে ঝলক বাজা ঝংকারে। সেই ঝংকারে ঝংকার লাগে মায়ের গলাতে। এমনকী, ব্রহ্মনারায়ণও, দেখি, কন্যা-গিন্নির সঙ্গে খিক্খিক্ করে হাসেন। গলাবন্ধ কোটের কাছে গলার চামড়া কাঁপে তাঁর। সেই যে সিড়িঙ্গে চুলের দু-এক গাছি বকফুলের মতো বাঁকা হয়ে ছিল, তাও বাতাসের চেয়ে হাসিতেই কাঁপে যেন। আর আমি একবার ঝটিতি তাকাই গাজির দিকে। গাজি আমার দিকে। গলা নামিয়ে বলে, ‘বড় মজার বাবু।’
তা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রায় একটা মজাখোর দুষ্ট ছেলের মতো মাস্টারমশাইয়ের ব্যবহার। হাসতে হাসতেই বলে ওঠেন, ‘খুব দেখালে বাবা!’
বলেও হাসির দ্বিগুণ বেগ। কন্যা-গিন্নিরও সেই অবস্থা। তার মধ্যেই তবু গিন্নি আওয়াজ দেন, ‘আহা, তা বলে ওরকম করছ কেন।’
কন্যা আমার দিকে চেয়ে বাবাকে বলে, ‘ব্যাপারটা শোনো না, উনি কী বলছেন।’
ব্রহ্মনারায়ণ বলেন, ‘তার আগে একবার দেখ, গরিবের কথা বাসি হলে কেমন কাজে লাগে। তখন পই পই করে বললুম। কে কার কথা শোনে। এখন হল তো।’
আমার জবাবের আগেই ঝিনি বলে ওঠে, ‘সত্যি, বাবার কথা যে ফলিয়ে ছাড়লেন আপনি।’
জবাব দেবার চেষ্টায় তাড়াতাড়ি মুখ খুলি, ‘না, মানে—।’
‘থামো হে, কথা বললেই হলো!’ মাস্টারমশাই আগেই বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ‘না, মানে বলে কিছু কথা নেই। আমার কথা ফলেছে কি না।’
তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করে বলি, ‘হ্যাঁ, ফলেছে।’
এমন হার-মানা অসহায়ের অবস্থা দেখে মা-মেয়ে ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠেন আবার। গিন্নি বলেন, ‘তোর বাবা যেন এক তরো।’
ব্রহ্মনারায়ণ হাত তুলে বলেন, ‘আচ্ছা এবার চলো, ফাঁকা গাড়িতে গিয়ে উঠে বসা যাক, তারপরে তোমার বৃত্তান্ত শুনব।’
তারপরেও আবার বৃত্তান্ত শোনা! তবু রক্ষে। কিন্তু তাই কি তিনি যেতে পারেন। আমি পা বাড়াতেই গাজিকে তাঁর চোখে পড়ে। এতক্ষণ যেন মনেই ছিল না। যেমনি চোখ পড়া, অমনি ঠেক খাওয়া দাঁতের গোটা পাটিতে ঢেউ দিয়ে বললেন, ‘এই যে বাবা, ফকির না দরবেশ, কোন মুন্ডু।’
গাজি একেবারে, মুখের আর দাড়ির ভাঁজে, মায় চুলে আলখাল্লায়, হাসিতে বিগলিত। অথচ বলিহারি সাহস, তখনও ব্রহ্মনারায়ণকে শুধরে দিয়ে বলে, ‘আজ্ঞে বাবু, গাজি।’
‘যা খুশি তাই হও গে তুমি, আমার কাঁচকলা।’
গাজিও তাড়াতাড়ি ঘাড় কাত করে বলে, ‘তা ঠিক বাবু।’
কীরকম পাজি দেখ, রা বুঝে সাড়া দেয়। এখন মজার বাবুর মেজাজ দেখে, কাঁচকলাই সই। ব্ৰহ্মনারায়ণের সেদিকে কান নেই। প্রায় রুক্ষু বিরক্তিতে ঘাড় দুলিয়ে বললেন, ‘তা বাবা, তখন যে খুব বললে, কোথায় কোন গ্যাঁজাট না ফ্যাজাট থেকে মোটরবাসে ফিরবে—।’
গাজি আবার তাড়াতাড়ি শুদ্ধি দেয়, ‘আজ্ঞে, গ্যাজাট না, ন্যাজাট।’
‘আরে রাখো তোমার ন্যাজাট। ওসব নাম ভদ্দরলোকে বলতে পারে না, তোমরাই পারো।’
ব্রহ্মনারায়ণের ধমক খেয়ে গাজি ঝটিতি বলে, ‘তা ঠিক বাবু।’
না বলে উপায় আছে! তর্ক করে দেখি, কত সাহস। ব্রহ্মনারায়ণ যেন একেবার অব্যর্থ তির বেঁধেন, ‘তা সে মোটরবাস গেল কোথায় তোমার?’
গাজি তাড়াতাড়ি কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলে, ‘নসিবের দোষ বাবু।’
‘নসিবের দোষ?’
দেখি, নসিবের নাম করে ব্রহ্মনারায়ণ ডিঙনো যাবে না। আমি বলি, ‘সেটা ওর ঠিক দোষ না।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ আমার দিকে ফেরেন, ‘ঠিক কার দোষ?’
তাঁর ভঙ্গি দেখে হাসি সামলানো দায়। কিন্তু সে সাহস আমার নেই। বলি, ‘দোষ ঠিক কারুরই নয়, বলা যায়। পথঘাট খারাপ বলে গাড়ি চলাচল অনিয়মিত হচ্ছে। কাল বিকেলের পর থেকে আর গাড়িই ছাড়েনি।’
তাতেই কি মাস্টারমশাই ছাড়েন। বলেন, ‘না জেনেশুনে তা হলে ও নিয়ে গেছে কেন।’
গাজি, দেখি, ফাটা মুখে হাসি ছড়িয়ে দু’হাত দুই কানে রাখে। বলে, ‘সেইটা আমার গোস্তাকি বাবু।’
‘রাখো তোমার গোস্তাকি আর ফোস্তাকি।’ বলে এগিয়ে যান গাড়ির দিকে। গাজি মুখ নামিয়ে নেয়। কিন্তু তার দাড়ির ভাঁজে চোরা হাসি আমার চোখে ফাঁকি যায় না। হেসে আমি দৃষ্টি ফেরাতেই চোখাচোখি ঝিনির সঙ্গে। তখন ওর অসাজের আড়ষ্টতা নেই আর। সহজের ঝলক লেগেছে। যে হাসিটা আমার আর গাজির ভিতর ছলছলিয়ে যায়, ওর চোখেও সেই হাসিরই ঝিলিক হানে যেন। চকিতে একবার বাবার দিকে দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে চায়। তখন বাবার ওপর ওর ভালবাসার হাসিটা চিকচিকে বিম্বোষ্ঠের ফাঁকে সাদা দাঁতে ঠিকরে ঠিকরে পড়ে।
কিন্তু গিন্নির প্রেম ঝরানো নজরে স্বামীর প্রতি ভ্রূকুটি। নাক কুঁচকে কন্যাকে বলেন, ‘কী যে বকবক করে। ভাল লাগে না ছাই।’
বলে ঝামটা দিয়ে মুখ ফেরাতে গিয়ে আমার দিকে চেয়ে হেসে ফেলেন। উনি কী বলবেন, বলো তো বাপু। স্বামী ওঁর ওইকম। দেখ না, আবার গাড়িতে উঠতে উঠতে হাঁকছেন, ‘এস এস, এ গাড়িতে এস।’ যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা গাড়ি, এখনও অনেক সময়। তা বললে কী হবে। উনি কি একলা বসে থাকবেন নাকি।
সবাই একে একে গাড়িতে উঠি। বসার নির্দেশ দেন চক্রবর্তী। কন্যা-গিন্নিকে দেখিয়ে দেন জায়গা। আমি এগিয়ে গিয়ে, গাজিকে নিয়ে বসতে যাই, তাড়াতাড়ি ডেকে বলেন, ‘তুমি এখানটায় এস, আমার এই পাশে।’
যে পাশেতে আর তৃতীয়ের ঠাঁই নেই। দু’জনেতেই পূর্ণ। গাজির জন্যে মনটা একটু বিমর্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু নয়নতারা-ভুলানো গাজি আগেই বলে, ‘বসেন বাবু, আপনি ওখেনিই বসেন। আমি ঠিক আছি।’
সে পিছনের দিকে বসে। মা-মেয়ে আমাদের সামনে। ঝিনি কাত হয়ে মুখ ফিরিয়ে চায়। তাতে মুখোমুখি হওয়া দুষ্কর। পাশ ফিরে দেখাদেখি করা যায়। বারে বারে ঝিনি বলি। মনে মনে বলি, তাই বলা যায়। আসলে এ বিদুষী অলকা চক্রবর্তী, তা ভুলিনি। সে কী ভেবেছে, জানি না। চোখের দিকে চেয়ে বলে, ‘গাজিকে অত দূরে রাখলেন কেন, কাছের সীটে এসে বসতে বলুন না।’
আমি জবাব দেবার আগেই ব্রহ্মনারায়ণ বলে ওঠেন, ‘ওই তোদের এক দোষ। সব তাতেই বাড়াবাড়ি। কেন, ও কি ছেলেমানুষ যে, হারিয়ে যাবে।’
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, গাজির নজর এদিকে নয়। তবে বলা যায় না, কান হয়তো এদিকে। মনে মনে হাসে হয়তো।
ঝিনি বলে, ‘তুমি যেন কী বাবা। ও—ও তো সঙ্গেরই লোক।’
আমি তাড়াতাড়ি বলি, ‘থাক না, ওখানেই ও বেশ আছে।’
ব্রহ্মনারায়ণ একটু স্থির হন। ঝিনি একটু হাসে। কিন্তু বাবার দিকে একটু অভিমানে দৃষ্টি হানে। আমি বলি, ‘আপনারা যে নীচেয় ছিলেন, বুঝতেই পারিনি।’
এ যে আর এক নিস্তরঙ্গে ঢেউ জাগানো, তা বুঝতে পারিনি। ব্রহ্মনারায়ণ তাঁর লম্বা রেখাবহুল আঙুল তুলে মা-মেয়েকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে, এদের বলো, ওপরে বসলে নাকি এরা ঠান্ডায় জমে যেত।’
মা-মেয়েতে মুখোমুখি হাসাহাসি। গিন্নির উক্তি, ‘দেখছিস, সব কথাতেই বেশি বেশি। সেই অন্ধকার থাকতে বেরিয়েছি। তখন কীরকম ঠান্ডা! তা ছাড়া ওপরে আলোও ছিল না। ভূতের মতো বসে থাকব কেন শুধু শুধু?’
ব্রহ্মনারায়ণ তৎক্ষণাৎ হাঁকেন, ‘তোমরা হাড়কাঁপানো শীতের কথা বলনি?’
এবার গিন্নির পালটা অভিযোগ, ‘তুমিও তো তখন মাথায় ফেট্টি বেঁধেছিলে। সেটা বুঝি গরমে?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ অবাক আর অসহায়। যেন কী বলবেন, ভেবে পান না। সেই ফাঁকেতেই ঝিনি বলে, ‘কিন্তু আমি তো তোমাকে একবারও ঠান্ডার কথা বলিনি বাবা।’
‘না, তুই বলিসনি।’
বলে এক মুহূর্ত চিন্তা করে ভুরু তুলে বলেন, ‘তুই যেন আবার কী বললি তখন?… হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুই বললি, “আসবার সময় ছাদে বসে এসেছি, যাবার সময় নীচেয় বসে যাব। লোকজনের সঙ্গে বেশ নতুন রকম লাগবে।” বোঝো, লোকজনের সঙ্গে আবার নতুন রকম কী লাগবে রে বাপু। তা নয়, আসলে তোরও তোর মায়ের মতো শীত ধরেছিল।’
বিদুষী অলকা এবার ছোট মেয়েটির মতো ঠোঁট ফুলিয়ে প্রায় ভেংচি দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ধরেছিল, তোমাকে বলেছে!’
বলেই নতুন পরিচিতের দিকে চেয়ে লজ্জা পেয়ে যায়। স্বর্ণলতার চিকন রঙে যেন অস্তচ্ছটার লাল লেগে যায়। মুখ ফেরাতে গিয়ে চুলের গোছায় আড়াল পড়ে।
মা মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কর্তাকেই আসলে ঝাঁঝেন, ‘তুই চুপ করে থাক না।’
ব্রহ্মনারায়ণের খোঁচা ভুরুতে তখন যেন হাসির ঝিলিক দেখা যায়। মা-মেয়েকে রাগিয়ে দিয়ে একাধারে বাবা এবং স্বামীটি যেন বেজায় মজা পান। ইনিও, দেখছি, গাজির থেকে কম যান না। ছদ্মবেশটা আরও শক্ত, এই যা। আমাকে বলেন, ‘আহা হা, তা নইলে দেখ, কালীনগরের ঘাটেও এত মুড়িসুড়ি দিয়ে বসেছিল যে, তোমাকে দেখতেই পায়নি।’
‘তুমি বুঝি দেখতে পেয়েছিলে?’
গিন্নির তিরবিদ্ধ ঝংকার বাজে। কর্তা নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘আমাকে তো তোমরা শুইয়ে রেখেছিলে। শুলে কি কিছু দেখা যায়।’
গিন্নি এবার সত্যিই বিরক্ত। তীব্র বিদ্রূপে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম!’
অসম্ভব! হাসি সামলানো দায় হয়ে ওঠে। শুধু দায় নয়, উপছে পড়া ঢলে, হাসির শব্দকে আটকে রাখা গেল না। এদিকে দেখ, হালকা এক নাম-না-জানা গন্ধ ছড়ানো, রুক্ষু চুলের গোছাতে কাঁপন ধরেছে। সেই কাঁপনে, চুলের গোছা সরে গিয়ে, চিকন শ্যাম গ্রীবা জেগে ওঠে। যার মাঝখান থেকে, শিরদাঁড়া সমান একটি রেখা নেমে গিয়েছে, হালকা রং জামার ভিতরে। হাসিটা ঝিনিকেও সংক্রমিত করেছে। রাগ নয়, হাসি তখন ছড়িয়ে কাঁপে তার সারা শরীরে। মাথাটা নুয়ে পড়ে গিয়ে জানালার কাছে।
ব্ৰহ্মনারায়ণের মুখে একটি অনির্বচনীয় শিশুর হাসি দেখা যায়। দাঁতের পাটি দুলে ওঠে একটু। বলেন, ‘দেখছিস ঝিনি, তোর মা কী রকম রেগে যায়।’
হাসির বেগে ঝিনির মুখ তোলা হয় না। মাও মুখ ফেরান না। ব্ৰহ্মনারায়ণ আমার দিকে তাকান। তাতে আমার হাসি আরও অকূল হয়ে ওঠে। ওদিকে হাসির বেগ তখন, ঝিনির শ্যাম চিকন গ্রীবায় পর্যন্ত লাল ছড়িয়ে দেয়।
ইতিমধ্যে নতুন যাত্রীরা উঠতে শুরু করেছে। সহিসের চিৎকার শুরু হয়েছে। গাজির কথাবার্তা আলাপ চলেছে চেনা মানুষদের সঙ্গে।
ঝিনির হাসি একটু প্রশমিত হলে শোনা যায়, ‘তুমিই যে মাকে রাগিয়ে দাও। আমরা তো মুড়ি দিয়ে বসিনি, উলটো দিকে ফিরে বসেছিলাম, সেজন্যে ওঁকে দেখতে পাইনি।’
প্রশ্নটা যে আমার মনে জাগেনি, এমন নয়। কিন্তু তার জন্যে এত বচনবাচন যুক্তি তর্ক মাথায় আসেনি। আসলে, যার প্রত্যাশা ছিল না, তাকে কে লক্ষ করে!
ব্ৰহ্মনারায়ণ বলেন, ‘তা বলে ওইরকম বলবে, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।’
জবাব না দিয়ে ঝিনি ঘাড় ফিরিয়ে চায়। তখনও হাসির ছটার রক্ত তার মুখে। চোখে হানা ঝিলিক। ওদিকে প্রৌঢ়ার ঝাঁঝ তখনও যায়নি। আওয়াজ দেন, ‘বেশ করেছি।’
ঝিনি বাবার দিকে চায়। বাবা মায়ের দিকে চেয়ে থাকেন কয়েক মুহূর্ত। তারপরে হঠাৎ হাত ঘুরিয়ে বলেন, ‘করো গে যাও।’
তবু হায়, মাস্টারমশাইয়ের হার-মানা হার চাপা থাকে না। আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘হ্যাঁ, তোমার কথা বলো! কাল কোথায় থাকলে, কী করলে, শুনি।’
ঝিনিও তার মায়ের দিকে ফিরে পাশ নিয়ে বসে। আমি মহামায়া হিন্দু হোটেলের কথা বলি। গঞ্জের কথা বলি। নারায়ণ ঠাকুরের আতিথেয়তার কথা বলি। জানি, মাহাতো-আঙ্রি বা দুলি-অনন্তদের বিষয় এখানে বলবার নয়।
সব শুনে ব্রহ্মনারায়ণ বলেন, ‘বলে তো গেলে দিব্যি, তোমার কি প্রাণের ভয় হল না?’
গতকালের কোথায় কীসে প্রাণের আশঙ্কা ছিল, বুঝতে পারি না। তাই অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। বলি, ‘কই, সেরকম কিছু—।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বাধা দিয়ে বলেন, ‘তুমি কি আর দেখতে শুনতে পাবে। এই বাদা অঞ্চলের কথা যদি জানতে, তা হলে আর ওরকম গরম গরম খেয়ে দরজাটি হাট করে খুলে তোমার ওই পেয়ারের গাজিকে শিয়রে নিয়ে শুতে পারতে না।’
‘কেন বলুন তো।’
‘কেন বলুন তো?’ প্রায় ধমকে উঠে বলেন তিনি, ‘পকেটে কত টাকা ছিল?’
‘সামান্যই।’
কথাটা যেন ঠিক মনঃপূত হল না। বলেন, ‘তা সে যত সামান্যই হোক। হাতের ঘড়িটা তো ছিল। আঙুলে তো একটা আংটিও দেখছি। যেখানে পাঁচ টাকার জন্যে মানুষ খুন করে, সেখানে তো রাজৈশ্বর্য হে।’
এতটা অবিশ্যি জানা ছিল না। সেরকম কিছু মনেও হয়নি। ব্রহ্মনারায়ণ বলেন, ‘জানো, এসব জায়গায় চুরি ডাকাতি লেগেই আছে। নদীর ধারে তো আরও খারাপ। যত নৌকা, তত ডাকাত। যেখানে জলে নামলে কামট-কুমির, ডাঙায় বাঘ, ঘরে ডাকাত পড়ে, সেখানে তুমি কোন সাহসে রইলে?’
তা হলে তো আর এসব অঞ্চলে ঘরগৃহস্থের ঠাঁই নেই। কিন্তু সে কথা বলবার উপায় আছে বলে মনে হয় না। ব্ৰহ্মনারায়ণ যেরকম মুখ করে বলছেন। তারপরে তিনি আসল কথাটা বলেন, ‘তার ওপরে তোমার ওই যে গাজি, সে-ই একটা ডাকাত-টাকাত কি না, তুমি তার কী জানো। যদি রাত্রে গলাটি কেটে রেখে যেত, তখন কে সামলাতো।’
ভাগ্যিস গাজি কাছে নেই। গাড়িটাও ছেড়ে দিয়েছে। যন্ত্রের গর্জনে কথা শোনা যায় না। তবে তাকে ঘিরে যারা বসেছে, তাদের তখন সে গান শোনায় শুনতে পাই, ‘মনে বলো হরি হরি, করে গোনো কড়ি কড়ি, মরি মরি, ভবেতে কী খেলা হরি।’…
ব্ৰহ্মনারায়ণের কথা শুনে হঠাৎ যেন খচ্ করে লাগে কোথায়। একটা ব্যথা লেগে যায়। আমি তার ফাটা ফাটা মুখখানি দেখি। দেখি, তার আরশি-চোখে প্রাণের তলায় সেই মুখখানি ঝিকিমিকি করে। নয়নতারার সাঁইবাবা এই মানুষ অধর মানুষ খোঁজে। যে বিচিত্রের সামনে আমার হাত উঠে যায় নমস্কারে, মন করে না সন্ধান, কিন্তু মন ভরে যায় অচিন ঝরায়, সেইখানে বলি আমি, ‘না, বিশ্বাস করব না। অন্যায়ের অনেক তাপ আমার নিশ্বাসে। তবু এমন পাপ করব না। আমি তাকে অবিশ্বাস করব না।’
কিন্তু সে কথা ব্রহ্মনারায়ণকে বলায় বেয়াজ। কী দৌলত বা লাভ তাতে। তাঁকে দোষ দেব না। সবাই যদি এক বর্গে চলে, তবে আর সংসারে রকমফেরের চালচিত্র থাকে কোথায়। তিনি তাঁর মতোই চলেন বলেন।
আমি চোখ তুলি। ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়। কখন যেন ছায়া পড়েছে আমার মুখে। তবু একটু না হেসে পারি না। বুঝতে পারি, তবু ছায়া সরানো গেল না। ঝিনির চোখে কথা ফোটে। যে কথাটা জিজ্ঞাসা। রং না দেওয়া সরু ভুরুতে একটু বাতাস লাগা লতার দোলন। তারপরে বাবার দিকে ফিরে বলে, ‘গাজিকে উনি ভালই চেনেন বাবা, তাই বিশ্বাস করেছেন।’
ভেবেছিলাম, ব্রহ্মনারায়ণ তাঁর স্বভাবস্বরে হাঁক দেবেন। কিন্তু এ ব্ৰহ্ম সে ব্রহ্ম নন। হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে যান একটু। বলেন, ‘তা ঠিক। আমি একটা কথার কথা বলছি। ও যে বিশ্বাসী, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সারা জীবন ধরে দেখলাম তো, সব ছেলেরাই একরকম কথা বলে।’
তিনি একটু থামলেন। কথাটার খেই ধরবার আগে তিনি আবার বলে উঠলেন, ‘তোকেও দেখি ঝিনি, এই পড়ে পড়ে ঘুরে ঘুরে ছেলেদের মতো কথা বলিস তুই। এসব বলতে গেলেই বীরুর কথা আমার মনে পড়ে যায়।’
হঠাৎ দেখি, ঝিনির চোখে একটা বিস্ময়ের ঝিলিক খেলে যায়। তারপরেই যেন ছপ্টি খওয়া আঘাত, ঠোঁট কেঁপে যায়। স্বর্ণলতা বর্ণে লাগে কালি। চকিতে একবার আমার দিকে দেখে বাবাকে বলে, ‘ও কথা থাক-না বাবা।’
গিন্নিও একবার স্বামীর দিকে ফেরেন। তারপরে সেই যে মুখ ঘোরান, আর ফেরান না। কেবল বুঝতে পারি, মাথাটা তাঁর নিচু হয়ে পড়ে। আর আমি যেন অনুভূতির এক দেশ থেকে দেশান্তরে যাই। সেখানে অন্য সুর, ভিন্ন কথা।
ব্রহ্মনারায়ণ বলেন, ‘থাকবে বই কী। তা নয়, দ্যাখ একদিন বীরুও তো হেনরিকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে গিয়েছিল। কত বড় বিশ্বাসী বন্ধু ছিল হেনরি, তবু সেই যে গেল, আর ফিরল না।’
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই দেখি, ঝিনির চোখের কোণে শিশিরের ফোঁটার মতো দু’টি বিন্দু চিকচিকিয়ে ওঠে। সে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেউ আর কোনও কথা বলে না। যন্ত্রের শব্দ বাজে। যাত্রীদের নানান কথাবার্তা। তার মাঝে গাজির গলা বেজেই চলেছে, ‘যখন দিন ছিল, তখন ধাঁধায় ছিলাম, এখন আন্ধারে গেরাসে, বলো কী করি।’… আমার চোখের সামনে রোদ মাখানো মাঠ ভেসে যায়। বাতাসে মাথা দোলানো নারকেল সুপারির ছায়া ছুঁয়ে যায়। তবু অনুভূতির দেশান্তরে অন্ধকার আমার চোখে। বীরু কে, হেনরি কে, কে এল না ফিরে, কেন বা।
একটু পরে গলা খাঁকারি দিয়ে ব্রহ্মনারায়ণই আমাকে বলেন, ‘বীরু ছিল আমার ছেলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল, বাইরে-টাইরেও ঘুরে এসেছিল। ওর এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধু ছিল, নাম হেনরি—হেনরি কি যেন ঝিনি?’
ঝিনির জবাব আসে, ‘ওয়াইলডেভ।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, হেনরি ওয়াইলডেভ। দু’জনে এক জায়গাতেই চাকরি করত। হেনরিকে ছাপিয়ে বীরুর একটা লিফটের সুযোগ আসে। হেনরির সেটা সয়নি। ডেকে নিয়ে গিয়ে বীরুকে মেরে ফেলেছিল। এই বছর পাঁচেক আগে।’
চাবুক খাওয়া চমকটা আগেই লেগেছিল আমার মুখে। আমি যেন ভিন্ন পরিবেশে চলে যাই। আমার পথে ফেরা অচিন খোঁজা হারিয়ে যায় যেন। বলে উঠি, ‘তারপর?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বলেন, ‘তারপরে আর কিছু না। হেনরি ধরাও পড়েছে, জেল খাটছে। তা তাতে আর কী সান্ত্বনা বলো। মানুষের যেমন মন!’…
কে জানত, এই মানুষে সেই মানুষ আছে। এমন হেঁকো-ডেকো হাসানে লোকটা যে নিহত আত্মজের ঘা নিয়ে বেড়াচ্ছে, একবারও তা বোঝা যায়নি। তাও শোনো, এত বড় একটা বুকের ধস খসানো কথা বলেন, তাও কেমন অনায়াসে। কেমন স্থির গলায়।
বোধ হয় অনেক বড় ধস নামানো বলেই। এ সেই ধস নেমে যাবার পরে পাহাড়ের স্তব্ধতা। এ সেই, একেতে সব ভরা বলেই এমন নিস্তরঙ্গ স্থির গলা।
এবার বলো, কী বলবে।
বলব, তবু গাজিকে বিশ্বাস করব। বলব, তবু এই নিহত আত্মজের পিতার সংশয়কে যেন হীনতায় না দেখি। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। এখন আমি তাঁকে আরও বেশি চিনি। দেখছি, পথের যা কিছু পাওয়া সব কিছুতেই এক অরূপরতন আছে।