৫৫. আশ্রমের সীমানা পেরিয়ে

৫৫.

আশ্রমের সীমানা পেরিয়ে রাস্তার ওপারে মেলা। সেখানে পা দেবার আগেই পাশ থেকে ডাক শুনতে পাই, ‘শুনুন।’

পাশ ফিরে দেখি, ঝিনি। নীল রেশমি শাড়ির ওপরে হাতে বোনা উলের জামা। দক্ষিণ পল্লিতেও যে শীত হানা দেয়, তার প্রমাণ ঝিনি, লাল রেশমি রুমালে মাথায় ঘোমটা দিয়ে গলায় বেঁধে জড়িয়েছে। তবু রুক্ষু চুলের গোছা একেবারে ঢেকে রাখতে পারেনি। ঢাকা ছাড়িয়ে কপালের কাছে এসে পড়েছে। ঠোঁটে নেই রং, চোখে নেই কাজল। তবু কেন যেন হালকা লালের একটা টিপ আঁকা কপালে। এ যেন বৈরাগ্যের মধ্যে হঠাৎ একটু রঙের ছোঁয়া লাগানো। আর এইটুকুতেই হঠাৎ দেখলে মনে হয়, লাল কাপড়ে ঘোমটা টানা একটি বউ। মুখে তার হাসি নেই, ভঙ্গিতে জড়তা। একটা লজ্জা পাওয়া বিব্রত ভাব। কী যেন একটা থমকে থাকা আড়ষ্টতা বন্ধ ঠোঁটের কোণে।

অনুমানে ফিরে চাই আশেপাশে। কিন্তু রাধা লিলি সুপর্ণাদি শুভেন্দু নীরেনদাকে দেখি না। মনে মনে অবাক মানি। গতকালের ঘটনা মনে পড়ে যায়। ঝিনির দিকে চেয়ে, কিছু বলতে গিয়ে ঠেক খাই। দেখি, কী একটা কষ্টের ছাপ ওর মুখে। কেবল বিব্রত লজ্জা না। জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি একলা নাকি?’

‘হ্যাঁ’।

‘ওরা সব কোথায় আপনার সঙ্গীরা?’

‘জানিনে।’

এতক্ষণ নত মুখ। এবার হঠাৎ মুখ তোলে ঝিনি। চোখ তুলে বলে, ‘আপনাকে খুঁজছিলাম।’

‘তাই নাকি!’

আবার নত মুখ। একটু রং বদলায়। এক মুহুর্ত, আবার মুখ তোলে। বলে, ‘হ্যাঁ। খুব ব্যস্ত আছেন?’

বলি, ‘না, ব্যস্ত আর কী। মেলায় চলেছি।’

‘কোপাইয়ের ধারে যাবেন?’

মেলা ছেড়ে কোপাইয়ের ধারে! ঝিনির দিকে চেয়ে দেখি কাজলহীন চোখে জিজ্ঞাসু সংশয়। অচিনদার কথা মনে পড়ে গেল। বলি, ‘সবাইকে না বলে যাবেন, খুঁজবে না?’

‘না।’

কেন, সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না। ঝিনির চোখের দিকে চেয়ে মনে হয় কোথায় যেন এক সহায়হীন ব্যগ্র ব্যাকুলতা থমকে রয়েছে। কতটুকু জানি ওকে, কতটুকু বুঝি! তবু এই প্রথম দক্ষিণের স্রোত ভেঙে রাঢ়ের ধুলায় দাঁড়িয়ে একটা যেন কষ্ট লাগা কাঁটা ফুটে যায়। আর হঠাৎ ওর বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। যাঁদের স্নেহের মেয়েটি এখানে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে। বলি, ‘চলুন যাই।’

আবার ঝটিতি একবার রং বদলায় মুখের। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিকে ঘোরে। ভিড়ের মধ্যে খালি রিকশার অভাব নেই। দু’জনেই একটায় উঠে বসি। গন্তব্য বলে দিতেই তিন চাকার গাড়ি ছোটে ভেঁপু ফুকতে ফুকতে। খাল পেরিয়ে যখন খোয়াইয়ের লাল রাস্তায় পড়ি, তখন মনে হয়, ঝিনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। মুখ ফিরিয়ে চাই। তারপরে ডানদিকের খোয়াই মাঠের মাঝখানে বাঁশঝাড় দেখিয়ে বলি, ‘গতকাল রাত্রে অচিনদার সঙ্গে ওই বাঁশঝাড়ে গিয়েছিলাম।’

ঝিনি তাকিয়ে একটু অবাক হয়। শব্দ করে, ‘ও।’ তারপরেই আবার নিজের মধ্যে ডুবে যায়। পথে গ্রামের লোকের যাওয়া আসা। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে জানা যায়, সামনের গ্রামের নাম গোয়ালপাড়া। রাঢ়ের গ্রাম, মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। মাঝেমধ্যে পাকা ইমারত। তেলেভাজার দোকান, গেলাসে খচমচ করে চামচ নাড়ানো চা। মুদি দোকানের বেচাকেনা। গৃহস্থের ঘরের দরজায় ভাই কাঁখে বোন, ওখানে বাঁধা গরুটা খড় চিবোয়। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় উঠানে মরাই। এখানে সেখানে এখনও ধান ঝাড়াইয়ের কাজ চলেছে।

সবই চোখের উপর দিয়ে চলে যায়, কেউ কথা বলি না। বলি বলি করে বলা হয় না। কাল রাত্রে অচিনদার সঙ্গে কেন যেতে চেয়েছিলাম সেই কথাটা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দৃশ্যের পর দৃশ্য বদলে যায়। চোখ টেনে নিয়ে যায় অন্যত্র। বিমনা হয়ে পড়ি। ভাবি, ঝিনিরও সেইরকম।

এক সময়ে গ্রাম ছাড়িয়ে খোয়াইয়ের তেপান্তর ভেসে ওঠে। চলায় লাগে ঢল। রাস্তা বাঁক খেয়ে নেমে গিয়েছে নীচে। দূরে গেরুয়ার উঁচু-নিচু বিস্তৃতির বুকে একটা বাঁকা নীল রেখা চোখে পড়ে। সহসা পশ্চিমে ঘুর লাগাতে বাতাসের ঝাপটা লাগে। ঝিনির লাল রেশমি রুমালের ঝালর এসে পড়ে আমার মুখে। আমার চোখ ঢেকে দেয়। সরাতে গিয়ে শুনি রিকশাওয়ালা বলে, ‘হুই কোপাই।’

রুমাল সরাতেই দেখি, ঝিনি আমার দিকে চেয়ে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘শুভেন্দুবাবুর খবর ভাল তো?’

ঝিনির ভুরু যেন বারেক অবাক লতায়। কোপাইয়ের কূলে এসে হঠাৎ এমন কথা শুনবে বলে যেন আশা করেনি। আসলে আমার হঠাৎই মনে পড়ে যায়, ঝিনির কাল সন্ধ্যার উদ্বেগের কথা। আমার দিকে ঝিনি পালটা প্রশ্ন ফেরায়, ‘ওর কী হয়েছে?’

বলি, ‘কাল ওভাবে চলে গেছলেন হঠাৎ। আপনার দুশ্চিন্তা ছিল। নীরেনদা চলে গেছলেন।’

তবু চোখ থেকে চোখ সরাতে ঝিনির দেরি হয়। একটু পরে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘ভালই আছে।’

রিকশা প্রায় জলের ধারে এসে দাঁড়ায়। রিকশাওয়ালা বলে, ‘এই হলেন কোপাই। পায়ের পাতা ডুবিয়ে ওপারে চলে যান। এখন জল নাই।’

তারপরে বাঁ দিকের বাঁশঝাড় দেখিয়ে বলে, ‘হুই উখানে পিঁকিক হয়, দাদা দিদিমণিরা আসেন।’

সংবাদ যাবতীয় জুটে যায়। তবে পিঁকিক মানে পিকনিক বুঝতে হবে, এইটে একটু মনে রাখবেন বাবু, ক্যানে কি না, সবাই ওই বলে।

পাদুকা রিকশাতে রেখেই নামি। ঝিনিও নামে স্যান্ডেল রেখে। নদীতে, সাঁওতাল মেয়েপুরুষ কেউ হাঁটুজলে বুক ডুবিয়ে চান করে। গরুর গা ধোয়ায়। ছোট ছেলে একটা জলেতে জল ছিটায়। ওপারে একটা পীচ-বাঁধানো সড়ক। জিজ্ঞেস করি, ‘ও রাস্তাটা কোথায় গেছে!’

‘এঁগে, কসবা, পানরুই, উষাগেরাম হয়ে একেবারে শিউড়ি।’

কিন্তু ঝিনির তেমনি নতমুখ। মুখের সেই ভাব। কোপাইয়ের তীরে এসে কোপাই দেখে না। চোখ তুলে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ফেরায়। জিজ্ঞেস করি, ‘কোনদিকে যাবেন।’

‘যেদিকে খুশি।’

এমন কথা ছিল না। কোপাই দেখতে আসার ডাক ওর নিজের। এখন ওর খুশিতেই চলা।

হঠাৎ শুনতে পাই, ‘ও দিকটায় যাই।’

যেদিকে ওর চোখের নির্দেশ কোপাই সেদিকে পুবে বেঁকে চোখের বাহিরে। পাড় ধরে ধরে যত এগিয়ে যাই কোপাইয়ের ধারা তত নীচে নামে। পাড় উঁচু হয়ে হয়ে ওঠে। এ হল খোয়াইয়ের রঙ্গ। সে চড়াইয়ে ওঠে, নদী বহে নীচে। কিন্তু রূপেরও নানা রঙ্গ এদিকে। যত এগোই জল তত গভীর। স্রোতে ভারী টান। মুরলী বাঁশের ছেউটি ঝাড় ছড়ানো ছিটানো এখানে ওখানে। যাকে বলে এমনি বাঁশ, এ তা না, এর নাম এক দেশেতে তল্‌দা, আর দেশের মুরলী। এ বাঁশের লাঠি হয় না, ঘরের খুঁটি হয় না, না হয় ছিটেবেড়া। এ বাঁশে বেড়া হয় আর হয় বাঁশি, যার নাম মুরলী। এ বাঁশের বাড় কখনও আকাশ ছোঁয় না, মোটা হয় না। এর নাম কিশোরী বেণু। তাই বলি মুরলী বাঁশের ছেউটি ঝাড়। এখন পাতাগুলো টুনটুনি পাখির মতো রং, আকারেও টুনটুনির মতো। তাই, টুনটুনিরা পুচ্ছ নাচিয়ে মুরলীর ঝোপে নেচে নেচে বেড়ায়। পিক্‌পিক্‌ শিস দেয়।

আশেপাশে আরও নানা গাছ। শাল শিমুল আম জাম কেন্দু। শালে শিমুলে পাতা নেই। পায়ের নীচে শুকনো পাতা ভাঙে। কোথায় কোন গাছে ঘুঘু ডাকে। আরও কোন কোন পাখিরা ডাকে ঝোপে ঝোপে, হয়তো দোয়েল শ্যামা। মনে হয়, এলাম যেন এক জনহীন বনে, যেখানে মানুষের পা পড়েনি কোনওকালে। ছায়ানিবিড়, ঠান্ডা তাই বেশি। কোপাই এখানে কৃষ্ণকালোয় মেশানো গভীর। কোথায় যেন বাজে কলকল।

ঝিনি থমকে দাঁড়ায় আমার আগে। আমিও তা-ই। জিজ্ঞেস করতে যাই কথা, তার আগেই সে ফেরে। রেশমি রুমালের ঘোমটা খোলা, ঘাড়ে ভেঙেপড়া। মুখ নত, বাঁ চোখের ওপরে একগুছি চুল। মুখ নিচু রেখেই হঠাৎ বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন।’

ক্ষমা! কারণ কী, কী অপরাধে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবার আগেই ঝিনির গলা যেন বহু দূর থেকে আসে, ‘কাল আমার অন্যায় হয়ে গেছে। কী লজ্জা যে করেছে, সারাটা রাত প্রায় ঘুমোতে পারিনি। নিজেকে একটু চাপতে পারি না…।’

কথা শেষের আগেই যেন স্বর ডুবে যায়। কথা হারিয়ে যায়। কাঁপন লেগে যায় ঠোঁটে। অবাক ধন্দে চেয়ে দেখি, কাজলহীন চোখ দুটিতে জলের রেখা চিকচিক করে। তাড়াতাড়ি বলি, ‘না না, তা কেন। অন্যায় তো আমারই হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি।’

আমার কথা শেষ হয় না। তার আগেই ঝিনির মাথা নড়ে ওঠে। গলার স্বর আসে কোপাইয়ের পাতাল থেকে, জলে চলকানো রুদ্ধ; ‘না না না, মিথ্যে বলবেন না, আমি জানি,আমি—আমি কি বিশ্রী ব্যবহার করেছি। আমি কেন ওরকম করে…।’

আবার স্বর ডুবে যায়। আর সহসা পিছন ফিরে দু’হাতে মুখ ঢাকে। কী বলি কিছু বুঝতে পারি না। কেবল ডাক দিতে পারি, ‘ঝিনি, শুনুন।’

শ্রবণ নেই এখন, শুনবে কে। এখন নিদ্রাহীন রাতের যত দমিত কথা, এমনি জলে ভেসে যায়। পাথার পারে ভাসে। তবু পাখি ডাকে পিক্‌পিক্‌। বাতাসে আওয়াজ দেয় শুকনো পাতা যত। কোপাই বাজে যেন কোথায়, কলকল করে। ঝিনির গ্রীবা জড়ানো লাল রেশমি রুমালে যেন তরঙ্গের দোলা।

তবু বলে যাই, ‘যদি একবারও বুঝতে পারতাম আমার সঙ্গ আপনাদের ভাল লাগবে, তা হলে কখনোই যেতে চাইতাম না। আসলে—’

ঝিনির ভেজা স্বর শোনা যায়, ‘অচিনদার সঙ্গে যেতেই আপনার ভাল লেগেছিল।’

‘না, তখন ভাল-মন্দর বিচার করিনি।’

‘তা হোক, তবু আমি কেন অমন করে বলতে গেলাম। আমি কেন রাগ করতে গেলাম।’

‘ক্ষতি কী। রাগও তো হয় মানুষের।’

‘আপনাকে তা জানাতে গেলাম কেন।’

সে জবাব কি আমার দেবার। রাগ যার, মনও তার। সে কেন রাগ জানায় সে-ই জানে। আমার যে জানতেও ভয় করে। আমার বলতে দ্বিধায় বাজে। পথের মাঝে হঠাৎ এ কোন অভিনয়, বেড়া ঘেরে।।

তবু বলি, ‘রাগ হয়েছিল তা-ই জানিয়েছেন।’

তখনও ভাল করে চোখ মোছা হয়নি। ঝিনি ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে ভেজা আরক্ত চোখে একবার তাকায়। সহসা মুখে একটু লাল ছুঁয়ে যায়। যেন ওর রেশমি রুমালের ঝলক লাগে। মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘আপনার কথা শুনে আপনাকে একটুও বুঝতে পারি না।’

আমি যে এত দুর্বোধ্য, কোনওকালে জানা ছিল না। ওর কথাই জিজ্ঞেস করি, ‘মিথুক বুঝি?’

‘তার চেয়ে বেশি।’

‘সেটা কী?’

‘যাকে বলে ছলের ছলী।’

কী একটা সুর যেন ঝিনির গলায়। কৌতুক মেশানো বুক চলকানো গলায় ঢেউ দেওয়া। ঝিনি কোন ধারাতে বহে, কোন ঢলেতে নামে। পথের ধুলা পায়ে আমার। পায়ে নিয়েই ফিরব। ঝিনি মোড় ফেরে না কেন। জিজ্ঞেস করি, ‘কেন।’

ঝিনি ফিরে দাঁড়িয়ে তাকায়। বলে, ‘শুভেন্দুর কথা তখন জিজ্ঞেস করলেন কেন?’

বলি, ‘কাল ওঁর অমনি করে চলে যাওয়াটা ভুলতে পারিনি, তা-ই।’

‘কেন গেছল জিজ্ঞেস করেননি তো একবারও!’

‘অল্প পরিচয়ের বাধায়।’

‘বুঝতে পেরেছিলেন?’

বোঝাবুঝিতে যেতে চাই না। ঝিনি কেন জিজ্ঞেস করে। জবাব না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাঁকে হারানো কোপাইয়ের দিকে চাই। ঝিনিও জবাব না নিয়ে দৃষ্টি ফেরায়। একটু পরে বলে, ‘ডেকে নিয়ে এলাম বলে রাগ করেছেন?’

রাগ করিনি। পথ চলাতে আপন পরের দুঃখের দায়ী হতে চাইনি। সে কথা বলতে পারি না।

বলি, ‘না।’

‘কিন্তু ক্ষমা পেলাম কি না, জানতে পারলাম না।’

বলি, ‘তা হলে সেটা আমাকেও জিজ্ঞেস করতে হয়।’

ঝিনি ফিরে তাকায়। ওর দু’চোখের লজ্জায়, হাসির ছটা ঝিকিমিকি। আরও যেন কিছু ওর ঠোঁটের কোণের টিপুনিতে। হয়তো, রুমালের রঙের ছটাই মুখে লাগে।

মুখ ফিরিয়ে কাছেই খানিকটা ঘাস দেখিয়ে বলে, ‘ওখানে বসবেন একটু?’

ঝিনির চোখের দিকে চাই। ঝিনি পায়ে পায়ে ঘাসের কাছে যায়। পা গুটিয়ে বসে, মুখ ফিরিয়ে চায়। আমি ওর কাছে গিয়ে বসি। নীচে দিয়ে কৃষ্ণকালো কোপাই বহে যায়। কোথায় যেন কলকল করে বাজে। পাখিরা ডাকে শিস দিয়ে দিয়ে।

.

৫৬.

দূরের পাকা সড়কের ওপার থেকে হাওয়া আসে। ঝিনির চুল ওড়ে, ঘাড়ের কাছে রুমালে যেন একটি রক্তিম আলো তিরতিরিয়ে কাঁপে। গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিলিমিলি রোদ এসে পড়েছে ওর গায়ে। যেন রোদের ঝালর দিয়ে জড়ানো হয়েছে ওকে। আমিও সেই রোদের একটু অংশ পেয়েছি।

ঝিনি কেবল পোশাকে নাগরিকা না, প্রসাধনেও। হাতের নখগুলো দীর্ঘ, প্রতিটি সিজিল মিছিল কাটা, হালকা গোলাপিতে রাঙানো। সেই নখ দিয়ে ও একটা একটা ঘাসের ডগা ছেঁড়ে। নোয়ানো বাঁকানো ঘাড়ে, ওর মুখের এক পাশ দেখা যায়। মন যে ওর ঘাসে নয়, বোঝা যায়। টিপে রাখা ঠোঁট দুটোতে ঢেউ খেলে। কী যেন ভাবে, কী যেন বলি বলি করে, যে কথা ঠোঁটের তটে এসে উপচে পড়তে চায়। তবু বলতে পারে না। তারপরে হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে চায়। একটু লাজানো হাসির ঝিলিক খেলে যায়। মুখের রং বদলায়। আবার মুখ নামিয়ে নেয়। নদীর ওপারের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি আওয়াজ দিয়ে চলে যায়।

এখন আমার কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত। এই হাসি, এই ব্ৰীড়া, এই বলি বলি মুখের ওপরে, একটি জিজ্ঞাসা, যাতে ওর বন্ধ কথা সরে। তাই তো উচিত। কিন্তু উচিত বাজে অনুচিতের সুরে। জিজ্ঞেস করতে পারি না। তাতে যদি ওর কথা না সরে, সেই ভাল। সংসারে কিছু কথা অব্যক্ত থাকুক, না বলা থাকুক, সেই ভাল। বলো যদি, পথে চলার পায়ে ধন্দ লাগে, তা-ই কাঁটা। ঝিনির এই হাসি-দৃষ্টির ওপারে যে ছবিটি ভাসে, সে যে একেবারে ঝাপসা অচেনা তা না। তবু অবাক মানি, ঝিনির মতো মেয়ে কেন এমন রূপে ফোটে। এমন সুরে বাজে।।

এখন ওর মুখে ছায়া নেই। চোখেতে নেই ছলছলানি। মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাবছেন?’

‘কোন বিষয়ে?’

ঝিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে, ‘এই এইসব দেখে?’

বুঝতে পারি, ঝিনি ওর নিজের আচরণের কথাই বলছে। তবু, না-বুঝ থাকতে চাই। বোঝাবুঝির দায় নিতে চাই না। সে যেন এক কথার ফাঁদে ধরা দেওয়া। জিজ্ঞেস করি, ‘কোন সব?’

ঝিনি ঘাড় ফিরিয়ে এক মুহুর্ত আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকে। বলে, ‘এই যে এখানে দেখা হওয়া অবধি আপনাকে কেবলই বিরক্ত করছি।’

‘বিরক্ত করবেন কেন?’

‘নয় বুঝি?’

বলতে গিয়ে একটু হাসির ছটায় ঝিলিক দিয়ে কপট বিস্ময়ে চোখের ফাঁদ বড় করে। একটু ঘাড় হেলিয়ে দেয়। দেখে মনে হয়, আমার কম কথা, অ-ভাবব্যঞ্জক ভাবকে ওর একটুও রেয়াত নেই। জোয়ারে যেমন স্রোত আপন বেগে চলন্তা, ও তেমনি প্রবাহিণী। অবাক যতই মানি না কেন, তবু সেই অবাকের গায়ে একটু যেন রঙের ছিটা লেগে যায়। যেন আমাকেও ভাসিয়ে দিতে চায়। বলে, ‘তবে বুঝি ভয় ধরিয়ে দিয়েছি?’

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি আরও বেশি অবাক হয়ে বলে উঠি, ‘ভয়? কীসের ভয়, কেন?’

ওর চোখে কৌতুকের বান ডেকে যায়। চোখে যে ওর কাজল নেই, সে কথা আর মনে হয় না। ঠোঁটে রং নেই, তা আর মনে হয় না। টানা কালো চোখ দুটিতে হাসি আর কৌতুকের ছটায় মনেরই অঞ্জন লেগে যায়। ঠোঁটের মনের রক্তাভা। শব্দ করে হাসে না, কিন্তু ওর রেশমি শাড়ি টলটলিয়ে ওঠে, তরঙ্গিয়া যায়। ওর ঝকঝকে সাদা দাঁতে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বলে,‘আমি বুঝি কিছু বুঝি না?’

আমি ওর চোখের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিতে যাই। ও আবার বলে ওঠে, ‘আমি কিছু দেখতে পাই না বুঝি?’

জিজ্ঞেস করি, ‘কী?’

এখন ওর হাঁটুর ওপরে কনুই। কনুইয়ের ওপর গাল পেতে মুখ ফেরানো আমার দিকে। রুক্ষু চুলের গোছা, গালের কাছে এসে পড়েছে। চোখ রাখে আমার মুখের ওপরে। বলে, ‘আপনার অবস্থা। আপনার চোখ-মুখের ভাব।’

জবাব না দিয়ে, একটু আড়ষ্ট ভাবে হাসি৷ ঝিনির দৃষ্টি চলে যায় অন্য দিকে। বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনি মনে মনে অবাক হচ্ছেন, রাগ করছেন, বিরক্ত হচ্ছেন, আর একটু একটু ভয়ও পাচ্ছেন বোধ হয়।’

কথাগুলো একেবারে মিথ্যা না। তবু মুখ ফুটে স্বীকার করতে বাধে। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কেন, তা বুঝি না।’

এ কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে ঝিনি আমার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আমাকে কি খুব অস্বাভাবিক লাগছে?’

একেবারে অস্বীকার করার উপায় কী। সংসারের স্ব-ভাবপ্রবাহে তাকে একটু উজানি টানের মনে হয় বই কী। কিন্তু ওর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে যদি সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে, তা হলে সত্যি বলতে বাধে। তাই বলি, ‘অস্বাভাবিক লাগবে কেন?’

ঝিনি.আবার হেসে ওঠে, শরীরে তরঙ্গ তুলে। বলে, ‘আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করলে বুঝি আপনাকেও করতে হবে। আমি জানি, আমাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে করতে পারছেন না আপনি। তাই, ওরকম করে বলছেন। সত্যিই তো, মনে করবেনই বা কেন। আমি নিজে তো বুঝি।’

কথার শেষে ওর ছোট একটা নিশ্বাস পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী বোঝেন?’

ঝিনি বলে, ‘এই আমার আচরণ, ব্যবহার। বলছিলাম আপনাকে, সার রাত ঘুমোতে পারিনি। আপনাকে ওরকম করে বলে গেলাম। আপনি হয়তো তেমন করে গায়েও মাখেননি। কিন্তু আমি ছটফটিয়ে মরেছি।’

হঠাৎ একটু হেসে নিয়ে বলে, ‘আপনাকে ছোবলাতে গিয়ে নিজেই ছোবল খেয়ে মরেছি।’

তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘না, না, তা কেন—।’

‘তা-ই। ওটা আমার নিজের ব্যাপার তো, আমি তা-ই জানি। কাল দুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে নিজের সব কথাবার্তাগুলো যতই ভাবছিলাম, ততই আপনার মুখটা আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। রাধা লিলি সুপর্ণাদি নীরেনদার কথাও মনে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু—।’

আমি অবাক জিজ্ঞাসু চোখ তুলে ওর দিকে তাকাই। ও কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী?’

আমি ঘাড় নেড়ে বলি, ‘কিছু না। বলুন।’

ঝিনি আমার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে, কিছু বই কী। হয়তো আপনাকে অনেক চিনি না। তবু একটু তো বুঝি। আপনি ভাবলেন, শুভেন্দুর নামটা কেন বললাম না।’

বলে একটু হাসে। আমার প্রতিবাদের আগেই ঘাড়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘আপনার চোখ দেখেই বুঝেছি। আপনি কী ভাবছেন, তা জানিনে, কিন্তু ওর নামটা ইচ্ছে করেই বলিনি। কেন, সে কথা পরে বলব, ওকে ঠিক এদের সঙ্গে জুড়তে পারিনে। ও একটু আলাদা।’

বলতে বলতে ওর ভুরু জোড়া একবার একটু কুঁচকে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে এক মুহূর্ত অন্য দিকে চেয়ে থাকে। ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে রাখে। তারপরে জিজ্ঞেস করে, ‘ঠিক বলিনি?’

বেঠিক যে না, তা ঠিক জানি। সঙ্গীদের সকলের নাম করতে গিয়ে, একজনের নাম উহ্য রাখলে আপনা থেকেই জিজ্ঞাসা জাগে। ভিন্ন বৈচিত্রের কৌতুহল লাগে। বলি ‘না, ঠিক মানে, নামটা না শুনে একটু ভাবছিলাম।’

ঝিনি হাসতে হাসতেই টুকটাক করে কয়েকগাছি ঘাস ছিঁড়ে ফেলে। হালকা গোলাপি নখের সঙ্গে সবুজ ঘাসের রঙে যেন একটা ছেঁড়াছিঁড়ির খেলা। বলে, ‘যে কথা বলছিলাম। নিজের ব্যবহারের কথা মনে করে ওদের কথাও আমার মনে পড়ছিল। কিন্তু, কী জানি কেন, আমার একটুও লজ্জা করেনি। রাত্রে সব কথা ভাবতে ভাবতে রাধা লিলিদের দু-একটা ঠাট্টার কথা মনে পড়ছিল। এমনকী অচিনদার কথাও। তাতেও আমার একটু লজ্জা করেনি। আমি মিথ্যে কথা বলতে পারিনে। আমি ছনা করতে পারিনে। তাই আমার লজ্জাও করেনি। তা ছাড়া, আমার সঙ্গীরা আমাকে সবাই ভালবাসে। এমনকী, অচিনদাও।’

বলে ঝিনি একটু থামে। আমার দিকে তাকায় না। আশেপাশে, ঘাসের ওপর আঙুল দিয়ে যেন বিলি কাটতে থাকে। তারপরে, গালের চুলে আস্তে একটা ঝটকা দেয়। আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘আপনি তো ওরা নন। অথচ যা কিছু তা আপনাকে নিয়েই। আপনার মুখটা তাই বারেবারে মনে পড়ছিল, ছটফটিয়ে মরছিলাম।’

যেন আরও কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। মুখ ফেরাতে গিয়ে আবার হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘একটা কথা বলব?’

গম্ভীর না, ঝিনির চোখে যেন, ‘ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা।’ বলি, ‘বলুন।’

ঝিনি ঘাড় কাত করে। তাতে ওর মুখ সরে যায় দুরে। কিন্তু নীল রেশমি শাড়ির ছোঁয়া আসে ঘনিয়ে। বলে, ‘জীবনের সব কিছু কি যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায়?’

‘করতে পারলে ভাল।’

ঝিনি কথা না বলে চোখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি আবার বলি, ‘করতে পারা উচিত।’

ঝিনি বলে, ‘লেখকরা বুঝি তাই করেন।’

আমি বলি, ‘লেখকদের কথা বলতে পারি না। সব মানুষের কাছে সংসারের সেটাই দাবি।’

‘সংসারের দাবিই সব? মনের দাবি বলে কিছু থাকবে না?’

সে কথা কি বলতে পারি! এ দুয়ের দাবিতে মেলে না বলেই দুয়ের হাতাহাতি। দুয়েতে তাই বিবাদ। মনে সংসারে লড়াই নেই, এমন মানুষ কোথায় আছে, কে জানে। হয়তো আছে কোটিকে গোটিক। কোটির কথা বলো। মনে সংসারে লড়াইয়ের টান ভাঁটাতেই, এ জীবন চলকে চলকে উঠছে। তাই রূপ-অরূপের অশেষ খেলা নিরন্তর বহে। তবু বলি, ‘সব কথার যে ঠিক জবাব জানি, তা বলতে পারি না। তবে, দুয়ে মেলাতে পারলে ভাল।’

‘মেলে কী?’

ঝিনির ব্যাকুল চোখের দৃষ্টি আরও দূর-বিদ্ধ হয়ে ওঠে। ওর এই চোখের দিকে চেয়ে এক কথাতে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারি না। চুপ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই!

ঝিনি চোখ ফিরিয়ে চায়, কোপাইয়ের ওপারে বেণুবনের দিকে। যেন নিজেকেই নিজে বলে ‘আমি তো কখনও মেলাতে পারলাম না।’

আমি জবাব না দিয়ে, চুপ করে থাকি। ঝিনির গলায় এমন একটা সুর বেজে ওঠে, যেন মনের কোথায় একটা চির আতুর স্থানে গিয়ে সেই সুর বিষন্ন করে দেয়। একটা ব্যথা ধরিয়ে দেয়। কেন ফিরি দিকে দিকে, প্রান্তে প্রান্তে, রাঢ়বঙ্গের পথে মেলায়, কখনও তার হদিস পাইনি। মেলাতে পেরেছি বলে, নাকি মেলাতে পারিনি বলে। তার চেয়ে নিজেকে আরও জিজ্ঞেস করি, নাকি মেলাবার জন্যেই?

তার চেয়ে আরও ভাল, এ প্রসঙ্গ থাক। পথ চলার এই দেখাতে এমন কথায় কী মিলবে। ঝিনিকে তা বলতে পারি না। জানি, ঝিনিও তা মানতে রাজি না।

কোপাইয়ের বাঁকে, জল কলকলিয়ে বাজে। ছেউটি বেণুর ঝোপে ঝাপে, গাছ-গাছালির ঝুপসি ঝাড়ে পাখিরা ডেকেই চলে। ঝিনির দৃষ্টি এখনও ওপারের বেণুবনে। যেন সেখান থেকেই হঠাৎ ওর গলা ভেসে আসে, ‘লোকে বলে, এই জানো, সেই জানো, সব কিছু জানো। কিন্তু নিজেকে জানার কথাটা কেউ বলে না। কত রকমের যুক্তি দিয়ে, কারণ দিয়ে ভেবেছি, সেই গোসাবা যাওয়া-আসার পথে কতটুকুই বা একজনকে দেখা, কতটুকুই বা তাঁকে চেনা। তবু—তবু, গায়ের এক একটা দাগ যেমন সারা জীবনেও মেলায় না, মনেরও বোধ হয় সেইরকম। একটা কী ধরে যায়, একটা কী লেগে যায়, কিছুতেই সেই একটা কিছুকে সরানো যায় না, মেলানো যায় না। বুদ্ধিতে কুলোয় না, যুক্তিতে পাই না, এমনকী কোনও আশাও নেই…।’

কথা শেষ না করেই ঝিনি আমার দিকে তাকায়। আমিও চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না। ওর দিকে চেয়ে চমকে উঠি। মুখে ওর ছায়া ঘনায়নি। যেন একটা কীসের ঝলকে ঝলকানো। অথচ ওর চোখে জল এসে পড়েছে। তবু নিচু স্পষ্ট গলাতেই বলে, ‘কে জানত, আবার এখানে এসে দেখা হয়ে যাবে। জানতাম না, কিন্তু কেন জানিনে, রোজ মনে হত, কোথাও না কোথাও একবার দেখা হবেই। হবেই হবে। হলও তাই। চিঠির জবাব না পেয়ে একলা একলা অনেক দিন চোখ মুছেছি। কিন্তু সেটা বোধ হয় আসল জল নয়। কাল আপনাকে দেখে তাই আর সামলাতে পারলাম না।’

কথা থামিয়ে, ঝিনি হঠাৎ একটু হাসে। অথচ ওর চোখের কোণে বড় বড় দুটি জলের ফোঁটা চিকচিক করে। ও মোছে না। বলে, ‘আমার লাজলজ্জা কিছু নেই আর, না?’

বলে আবার হাসতে যেতেই জলের ফোঁটা গালে নেমে আসে। ওর দিকে তাকিয়ে আমার কষ্ট হতে থাকে। আমার জিভের ডগায়, হাতের সীমায়, সংসারের কঠিন ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুই বলতে পারি না, কিছু করতে পারি না।

ঝিনি যেমন করে গাল কপাল থেকে রুক্ষু চুলের গুছি সরিয়ে দেয়, তেমনি স্বাভাবিক ভাবেই গলার রেশমি রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নেয়। তারপরে আমার দিকে আবার চোখ তুলে বলে, ‘কেন এমন হয়, বলতে পারেন!’

অন্তত এইটুকু সত্যি বলতে পারি, এই ‘কেন’-র কারণ আমি জানি না, বুঝি না। তাই ঘাড় নাড়ি। ঝিনি আবার জিজ্ঞেস করে, ‘যিনি লেখেন, তিনিও বলতে পারেন না? তিনি তো মানুষের মন চেনেন?’

‘মানুষের মন চেনাটা কোনও কথা নয়, নিজেকে চেনাটাই চেনা। যে নিজেকে কিছু চেনে, সে অন্যকেও কিছুটা চিনতে পারে। আসলে, যা দেখি তা নিজের চোখেই। বিচার নিজের মনেই। নিজেকে দিয়েই পরকে চেনা যায়।’

ঝিনির শরীরে বাঁক লাগে। গ্রীবাতে ঢেউ লাগে, মুখ অনেকখানি এগিয়ে আসে। নিচু গলায় যেন কীসের আবেগ চলকানো সুর। জিজ্ঞেস করে, ‘নিজেকে দিয়ে কি আমার কথা একটু বলা যায় না?’

ওর চোখের দিকে চেয়ে কেমন যেন অসহায় বোধ করি। বলি, ‘নিজেকে তেমন চিনলাম কবে।’

ঝিনি তেমনি গলায়, আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তবে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। ও যেন আরও নিবিড় হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এতে কি অপরাধ হয়?’

সহসা জবাব দিতে পারিনে। ওর মুখের দিকে বিব্রত অবাক চোখে চেয়ে থাকি।

ওর গলা আরও নিচু হয়। যেন অনেক দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসে, ‘যার কোনও কারণ যুক্তি কিছুই জানিনে, তার জন্যে কী কোনও অন্যায় অপরাধ হয়?’

চোখ সরাতে পারি না। বলি, ‘আমি তা জানি না।’

‘আমিও তো জানি না।’

যেন এত আর্তস্বর বাজে ওর গলায়। নুয়ে পড়ে সহসা। আর মুহূর্তে আমার পায়ে কীসের স্পর্শ লাগতেই চমকে উঠি! চোখ নামিয়ে দেখবার আগেই টের পাই, ঝিনির হাত আমার একটি পা চেপে ধরেছে। ওর মুখ ভেঙে পড়েছে ওর বুকের কাছে। আমার পায়ে রাখা ওর হাতের ওপর তাড়াতাড়ি হাত রাখি। ডাক দিই, ‘শুনুন।’

ও যে আমার কথা শুনতে পায়, তা মনে হয় না। কেবল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়। কিছু বলে না। আমি আবার ডাকি, ‘শুনুন।’

ওর অস্পষ্ট গলা শোনা যায়, ‘কী?’

তারপরে আস্তে আস্তে মুখ তোলে। দেখি, ওর চোখ ভেজা ভেজা, কিন্তু টলটলানো না। বরং মুখের রং রোদ-লাগা জবার মতো হয়ে গিয়েছে। তেমনি অস্পষ্ট অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘রাগ হচ্ছে?’

‘না।’

‘ভয়?’

‘না।’

‘তবে একটু এমনি করে বসে থাকি।’

আমি মনে করতে পারি না, এ সেই অলকা চক্রবর্তী, দর্শন শাস্ত্রের বিদুষী, নিখুঁত নাগরিকা। এ যেন আর কেউ, অন্য কোনও মেয়ে। যার পরিচয় আমার জানা নেই। অথচ তার চোখের জলের গভীর থেকে একটি নম্র লাজানো হাসিতে সুখ-দুঃখের খেলা খেলে।

.

৫৭.

কিন্তু রাগ করিনি, ভয় পাইনি সত্যি। শুধু বিব্রত সঙ্কোচে আড়ষ্ট হয়ে থাকি। এতখানি সইতে পারি না। তা-ই ডাকতেই হয়। পাছে ওর আবেগে চমক লাগে, তেমন করে ডাকি না। ওর ভাবেতে সুর মিলিয়ে ডাকি, ‘ঝিনি দেবী।’

‘উঃ!’ যেন আচমকা কাঁটা বেঁধা খোঁচানিতে আর্তরবে সোজা হয়ে বসে। তারপরে চোখের জল না মুছেই ভুরু বাঁকিয়ে হেসে ওঠে। বলে, ‘কী অদ্ভুত যে আপনার কথা—“ঝিনি দেবী।” ঝিনি আবার কখনও দেবী হয় নাকি! একে বলে গুরুচণ্ডালী দোষ।’

তাড়াতাড়ি শুধরে নিতে যাই, ‘তা হলে অলকা—।’

‘না, দেবী জুড়ে দেওয়া চলবে না। ঝিনিতে নয় অলকাতেও নয়।’

বলতে বলতে গলা থেকে রুমাল খুলে অনায়াসে চোখ আর গাল মুছে নেয়। ছোট মেয়ের মতো, রুক্ষু চুলে একটা ঝাপটা দিয়ে বলে, ‘আর অলকা বলাও আপনার নিষেধ, সে , কথা আগেই বলেছি, চিঠিতে যে জন্যে ঝিনি লিখেছিলাম। এর পরে ঝিনির নাম ধরে যদি “তুমি” না বলতে পারেন তা হলে আর কথা বলে দরকার নেই।’

বলে এমন ভাবে অন্যদিকে ঘাড় ফেরায়, যেন এ-দু’দিনের যা কিছু এত কথা, হাসি-কান্না, সব এক কথাতে নাকচ। দেখ তো এবার সেই দক্ষিণের দরিয়া থেকে এই রাঢ় পর্যন্ত দেখা মেয়েটিকে চিনতে পারো কি না! আমি তো পারি না। বিদুষী বলো, নাগরিকা বলো, সকল ভেদাভেদের জট পেরিয়ে সে-ই এক মেয়ে। সে-ই এক চিরদিনের মেয়ে। যে রূপেতেই আবির্ভাব তোক সে-ই এক রূপ-অদ্বিতীয়া। যে অদ্বিতীয়া রূপেরও কোনও শেষ নেই। বৈষ্ণব কবির মতো, এক নায়িকার রূপের কথা বলি না। বলি, সেই বহুর মধ্যে এক-এর কথা, যাকে জনম থেকে দেখেও নয়ন তৃপ্ত হল না। কিন্তু অতৃপ্ত নয়নের সামনে এই রূপ দেখে যে আমার চলায় লাগে ঠেক। বলায় বাকরুদ্ধ।

তবু, আপাতত কৌতুকবোধেই ঝিনির দিকে তাকিয়ে থাকি। জবাব খুঁজে পাই না। ঝিনি আবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। দেখি ওর আয়ত চোখে বাঁকিয়ে চাওয়ার ঝলকানি। ঠোঁটের কোণের হাসিতেও কী এক অচিন কথার স্ফুরণ। না, না, একে আমি আগে কখনও দেখিনি। এ সেই প্রকৃতি, যার সবটুকু জুড়ে উদ্যত পঞ্চশর ফুলধনুর টঙ্কারে। চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ‘কবুল?’

বলি, ‘কবুল।’

‘ভয়ে ভয়ে?’

‘নির্ভয়ে।’

‘গলাটা তবু যেন কেমন শোনাচ্ছে।’

‘কেমন?’

‘গম্ভীর গম্ভীর।’

‘ওটা স্বরের দোষ।’

ঝিনি হেসে ওঠে। আস্তে অথচ হাসির বেগে, শব্দ বেজে ওঠে। যেন ঠিনঠিনিয়ে কার হাতের চুড়ি বেজে ওঠে দূর থেকে। তারপরে হঠাৎ হাসি থামিয়ে কোপ কটাক্ষে চায়। তবু নাসারন্ধ্র ফুরিত—কাঁপে থিরিথিরি। ঠোঁটের কোণে টিপে রাখা একটি দ্যুতি ফুটি ফুটি করে। বলে, ‘স্বভাবের দোষ নয় তো?’

হেসে বলি, ‘তাও হতে পারে।’

‘চমৎকার। কেন এমন করে কথা বলতে শিখিনি।’

‘কেমন করে?’

‘লেখকের মতো করে।’

‘কেন?’

‘সবই যেন কলমে লেখার মতো, একেবারে তৈরি।’

‘তা কেন, আমি তো—।’

কথা শেষের আগেই আবার হাসি। বলে, ‘বুঝতে পারিনে তো। মনে হয় সবই যেন সত্যি। শুনে কি কেউ বুঝতে পারবে, এ শুধু কথার কথা।’

‘কথার কথা কেন?’

‘তবে খাঁটি সত্যি!’

এবার হাসি চাপা দায়। বলতে যাই, ‘মিথ্যে হবে কেন।’ তার আগেই ঝিনি আবার বেজে ওঠে, ‘দায়ে পড়ে বুঝি সারাদিন অনেক মিথ্যে কথা বলতে হয়।’

তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘না না, তা কেন হবে।’

ঝিনি চুপ। শুধু ঘাড় কাত করে চোখে চোখ রাখে। ওর চোখের খোঁজাখুঁজির ঝিলিক দেখে আমার হাসিতে বেগ লাগে। কিন্তু হাসতে ভরসা পাই না। ও বলে, ‘সত্যি, বড্ড মিথ্যেবাদী বলতে ইচ্ছে করে।’

‘বেশ তো, তা-ই বলো।’

ঝিনির দৃষ্টি নেমে যায়। মুখ একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘না। তা হলে যে আর একটুও আশা থাকে না।’

কোনও জবাব দিতে পারি না। হয়তো, ঝিনির নিশ্বাস পড়ে না। বাতাস লাগে ঝোপে ঝাড়ে ঘাসে পাতায়। শুকনো পাতা ঝরে, ওড়ে। মনে হয়, যেন কোন গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কোথায় যেন, দু’ একটি গলার স্বর শোনা যায়। অস্পষ্ট ভাঙা-ভাঙা, ছাড়া-ছাড়া। কাছে না দূরে, বোঝা যায় না। কোথা দিয়ে কে চলে যায়, কে জানে। আমি ঝিনির দিকে একবার চেয়ে কোপাইয়ের ওপারে তাকাই। ঝিনি এক জলধারা, আপন বেগে এক টানে চলে। আমি যত ভাবি, ভিন স্রোতে যাই, তা হয় না। তাকে ফেরাতে পারি না।।

তবু এবার ফেরার কথাই বলতে হয়। একটু চুপ করে থেকে বলি, ‘এখন তা হলে ফেরা যাক।’

ঝিনি ফিরে চায়। তারপরেই আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছু বলে না। যেমন ছিল, তেমনি থাকে। সেই ভাবেই জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে কী মনে হল?’

কিছু না ভেবেই বলে ফেলি, ‘ভাল।’

ঝিনি আবার ফিরে চায়। একটু যেন হাসেও। অবিশ্বাস আর বিষন্নতার হাসি। একটু আগের ঝিলিক ঝলক এখন আর নেই। বলে, ‘এত উদাসীন কেন? আমার সম্পর্কে কি একটু কিছু জানতেও ইচ্ছা করে না?’

এমন করে বলে না, যাতে চমক লেগে যায়। যদি বলতে পারতাম, এ মেয়ে বড় নিলাজ পরাণী, নাগরিকা না, নাগরী, তা হলে আমার কথা ফুরাত। নটে গাছ সেখানেই মুড়োত। কিন্তু কেমন করে জানি না, নিজের কথা শোনাতে চায়, তবু নির্লজ্জ মনে হয় না। যেন এক বিষাদ শালীনতার প্রকাশ। নাগর। বলতে গেলে জিভ খসে। স্বৈরিণীর দায়হীন নির্বিকার রঙ্গ ওর মধ্যে দেখিনি। কেবল ক্ষণেক সুখের আগুনে কিছু ছাই ছিটিয়ে রেখে যাওয়ার মাতঙ্গিনী ছুট দেখিনি। তা-ই, ঝিনি চমক লাগাতে না চাইলেও, মনের কোথায় একটা চমক লেগে যায়। মনে হয়, যা আমার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, তা নিজে থেকেই থমকে দাঁড়ায়। এতক্ষণে মনে হয় কেবল একটা ধারাকে, একটানা চলে যেতেই দেখছি। তার আঁকাবাঁকা পথের সন্ধান একটুও জানতে পারিনি। এখন ওর দিকে চেয়ে হঠাৎ মনে হয়, অনেক কথা শুনেছি; কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি কথা শোনা হয়নি। যে কথা এত কথার সৃষ্টি করেছে।

তাড়াতাড়ি বলি, ‘জানতে ইচ্ছা করে।’

আবার ওর চোখের কোণে একটু ঝিলিক দেখা যায়। ঠোঁটের কোণে একটু দ্যুতি। তারপরে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবে। কী যেন বলি-বলি করে। তারপরে বলে, ‘আপনার কথা শুনে তো সত্যি-মিথ্যে বুঝতে পারিনে। কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে করে।’

তারপরে আবার একবার নিচু হয়ে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে, ‘জানেন আমি বিধবা।’ হয়তো ভয়ংকর কোনও কথা নয়। কিন্তু অজানার চমকের কাছে সবটুকু সেই রকম। সেই দক্ষিণের দরিয়া থেকে এই রাঢ়ের কোপাইয়ের ধারে। কখনও একবারও এমন কথা মনে হয়নি। তা-ই, কেবল চমকে ফিরে তাকাই না, হঠাৎ যেন কোথায় একটা কী বিঁধে যায়। কে মারে, কোথা থেকে মারে, খুঁজে পাই না। বিঁধে যাওয়ার স্বরূপ বুঝতে পারি না, কতখানি বাজে। এমন একটা কথা নিয়েও ঠাট্টা করবে তেমন মেয়ে না। তবু যেন বিশ্বাস করতে পারি না। কথা বলতেও পারি না। কেবল চেয়ে থাকি ওর দিকে।

ঝিনিও তৎক্ষণাৎ আর কোনও কথা বলে না। চোখে ওর জল পড়ে না। কেঁদেও ভাসায় না। কথা শুরু করেও কথা বলতে যেন বাধে। তেমনি বলি বলি ভাবে, নিচু মুখে, ঘাসের গায়ে হাত বুলিয়ে যায়। আর আমি যেন নতুন করে আবার ওকে দেখতে থাকি। আর একবার ওর চব্বিশ পঁচিশের শরীরের দিকে তাকাই। শরীরে বৈধব্যের কোনও দাগ লাগে কি না, জানি না। কিন্তু দক্ষিণের দরিয়ায় যে মেয়েকে দেখেছিলাম, কোথাও তার টোল টুটানো দেখি না। স্বাস্থ্যে ওর তেমনি ঔদ্ধত্যের থেকে দীপ্তি বেশি। নম্র অনম্রের খেলাখেলি বন্ধুর অঙ্গে। কূলে কূলে জোয়ার-তরঙ্গের ছপছপানিতে, ধরা অধরায় ঢল ঢল করে। তাকে ঘিরে, এখনও সেই বেশবাসের রং রাঙানো। কেবল আজ সকালেই একটু রং-বিবাগী দেখেছি। কিন্তু তার ভিতর থেকেও আর একজনকে ফুটে উঠতে দেখেছি। পঞ্চশরের ফুলধনুর ছিঁলায় যার টান। যে লক্ষ্যভেদের সীমায় দাঁড়িয়ে আমি হাতজোড় করে আছি। এর মধ্যে আমি কোনও বৈধব্য আবিষ্কার করতে পারিনি।

সহসা ওর বাবা-মায়ের কথা আমার মনে পড়ে যায়। ওর মৃত দাদার কথা, হেনরির কারাবাস। ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তীর পারিবারিক জীবনের বিষাদ অন্ধকারে এ অন্ধকারতম সংবাদ শুনিনি।

এতক্ষণ পরে, ঝিনি চোখ তুলে চায়। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘সত্যি?’

ওর ঠোঁটে আবার একটু হাসি দেখা দেয়। বলে, ‘এ নিয়ে কি কোনও মেয়ে মিথ্যে বলতে পারে?’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না, তা নয়। কিন্তু মাত্র মাস দুয়েক আগে যখন দেখা হয়েছিল তখনও শুনিনি।’

‘কে বলবে?’

বলতে বলতে ঝিনি আবার একবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। সেইভাবেই বলে, ‘বাবা-মা আজও কিছুই জানেন না।’

অবাক মানি, কথা বলতে পারি না। বুদ্ধি বিভ্রান্ত হয়। সংসারে এত বিস্ময়! এত অবিশ্বাস্য কথা কে কবে শুনেছে! বলি, ‘বুঝতে পারলাম না।’

ঝিনি তেমনি ভাবেই বলে, ‘তারা বিয়ের কথাও জানতেন না, তা-ই এ কথাও জানেন না।’

তবু তেমনি অবাক চোখে নির্বাক বিভ্রান্তি নিয়ে চেয়ে থাকি ঝিনির দিকে। ওর কথার ওপারে কী ঢাকা পড়ে আছে, দেখতে পাই না। বুঝতে পারি না। ঝিনি মুখ ফিরিয়ে, আমার চোখের দিকে একবার চায়। তারপরে ওর কথায় যেন কুয়াশার রোদ পড়ে। বলতে থাকে,

‘সে কথা তখন বাবা-মাকে বলতে পারিনি…।’

যে কথা ছিল ওর নিরালায় নির্বিঘ্নে বেড়ে ওঠা, নিপ বনফুলের পাপড়ি ঢাকা মনে। কুয়াশা সরে যায়, আমি শুনতে থাকি। দু’বছরের বড় এক ছেলে ওর সহপাঠী, কেন তাকে ওর ভাল লেগেছিল সে প্রশ্ন আমার নেই। সহপাঠী হয়েও সে যে ঝিনির মতো পড়াশুনো করা ছেলে, তাও না। কলকাতায় অনাত্মীয় স্বজনহীন ঘরে, পুরনো বিশাল অট্টালিকায় ছিল তার বাস। ঝিনির কৈশোরে সে পক্ষিরাজের পিঠে চেপে ঝনঝনিয়ে আসেনি রাজপুত্রের মতো। মনোহরণ রূপ ধরে সে ভোলায়নি। ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, বিরাগী এক প্রাচীন বংশের বেগহীন রক্তধারার নিঃসঙ্গ দুর্বল শিশু। অপচয়ের একটি অবশিষ্ট মাত্র যেন। তার জীবনের চার পাশে সংসারে সবাই যখন স্বার্থান্ধ, কুটিল, স্বার্থপরের বেশে, যৌবনের প্রথম পর্বেই যখন সকল অন্ধকার তখন ঝিনির মধ্যে আলোর আবিষ্কার। ঝিনির কথায়, ‘ওর অসুখী অবিশ্বাসী গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কারুর কথা বলতে ইচ্ছা করত না। সবাই ভাবত, ও হাসতে জানে না, মিশতে জানে না।’…

কিন্তু সংসারে এমন মানুষ আছে, সে যেন কোন দূরে, আড়ালে পড়ে থাকা এক জলাশয়ের মতো। অন্য স্রোতের বেগ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে না এলে সে মিশতে পারে না। তার হাসিটা দশজনের থেকে তফাত। সে ছিল সেই রকমের মানুষ। যাদের হাসির চাবিকাঠিটা সামনাসামনি পড়ে থাকে অবহেলায়। কারুর চোখেও পড়ে না। সেটাও তার অভিমান ছিল। কিন্তু, ‘ও যে কী সুন্দর হাসতে পারত, হাসাতে পারত, যারা চোখে দেখেনি, তারা বিশ্বাস করতে পারবে না। আসলে ও ছিল ভীষণ দুষ্টু, হাসকুটে, কত রকমের বুদ্ধি যে ওর মাথায় খেলত! একেবারে একলা ছিল তো, সেজন্যে ও নিজেকে যত দেখত, অন্যকেও তাই। ও নিজেকে যত ঠাট্টা করত, অন্যকে নিয়েও ততটা। কে কেমন ভাবে চলে ফেরে, হাসে, কার কী মনের ভাব, নিখুঁত বলত। ওর এসব ব্যাপার কেউ জানত না। ওর মধ্যে যে ওরকম একটা ছেলে আছে, কেউ টের পেত না।’…

আর সে ছিল একেবারে ছেলেমানুষ। বয়সটা তার কিছু না। ছেলেমানুষের যেমন পড়ায় মন বসে না, অথচ বুদ্ধি আর পারদর্শিতা থাকে, তারও সেইরকম ছিল। পড়া পরীক্ষা, সবকিছুই যতক্ষণ তার ভাল লাগে ততক্ষণ। অন্য সব বিষয়েই সে এত ছেলেমানুষ ছিল, তাকে সামলানো দায়। একটু একরোখা ছেলেমানুষের মতো। যা চাই, তা তাকে পেতে হবে। কিন্তু তার চাইবার মানুষ ছিল না। তার কাছে পাবার মানুষ ছিল বেশি। তাই যখন সে চাইবার মানুষ খুঁজে পেল, তার কাছ থেকে সে সবকিছু ছেলেমানুষের মতো জোর করে আদায় করেছে।

বলতে বলতে ঝিনির মুখে হাসি ফোটে। দৃষ্টি ওর কোপাইয়ের ওপারে, আসলে অন্য এক জগতে। বলে, ‘ও এমন ভাবে চাইত, এখুনি এই করতে হবে। এখুনি এই এনে দিতে হবে। আর আমি যেন কেমন হয়ে যেতাম। ওর কোনও কথার অবাধ্য হতে পারতাম না। অথচ ও যে হুকুম করে কিছু বলত তা নয়। যেমন ছেলেমানুষেরা হেসে, পা দাপিয়ে, খুনসুটি করে বলে, তেমনি করে বলত। আমি কখনও কখনও বিরক্ত হতাম, রাগ করতাম, তবু ওর কথা না শুনে পারতাম না। আমার নিজের মনটাই টনটনিয়ে উঠত…ঠিক তেমনি করেই ও একদিন বিয়ের কথা বলল। বাবা-মায়ের ইচ্ছে তো দূরের কথা, ওর আর আমার কথা যেসব বন্ধুরা জানত, তাদের একটুও ইচ্ছে ছিল না। তাদের কাছে ও ছিল অসুখী, অস্বাভাবিক, স্বাস্থ্যহীন। তারা কেউ ওকে বুঝত না, তা-ই। বাবা-মায়ের কাছে সেটা তো ছিলই। আমাদের সমাজে জাত বর্ণের কথাও তো কেউ ভোলে না। সেদিক থেকেও ওর সঙ্গে আমাদের অমিল ছিল। সাহস করে তাই কখনও বলতে পারিনি।’…

তবু বিয়ে হয়েছিল। সানাই বাজিয়ে ছাঁদনাতলায় না। সম্ভবও ছিল না। আইনের আশ্রয়ে, কাগজ কলমের সই সাবুদে। সাক্ষী ছিল তিনজন। আজ ছাতিমতলার মেলায় যারা তার সঙ্গী, সেই রাধা, লিলি আর শুভেন্দু।

তখন ঝিনি মনে করত, একদিন বাবা-মাকে, দাদাকেও বলবে। তখনও দাদার সেই দুর্ঘটনা ঘটেনি। সবাইকে বলে ঝিনি স্বামীর সংসারে যাবে। কিন্তু দুর্ঘটনা যখন ঘটল, তখন পর পর দুটো। আগে দাদা, তারপরে সে। মাঝখানের সময়ের পরিধি ন’ মাস। তার মধ্যে কোনও কথা বলা যায়নি। সংসার করতেও যাওয়া হয়নি। দাদার মৃত্যুর পরে সেকথা আর কখনও উচ্চারণের সাহস হয়নি। এখন ঝিনির কষ্ট, সেই দিনের অপেক্ষা, কবে বলতে পারবে।

ঝিনি নিচু মুখে, যেন ঘাসের সঙ্গে মুখোমুখি করে, ঘাড় নাড়িয়ে একটু হাসে। বলে, ‘এখন হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন, আজ শুভেন্দু আমার কাছে কী চায়।’

বলে ও আমার মুখের দিকে চায়। কিন্তু আমি তখনও ওর পিছনের জীবনসীমায় পড়ে আছি। যা শুনেছি তার সবখানি যেন মন দিয়ে ঠিক ধরতে পারিনি। তবু বলি, ‘পারি।’

ঝিনি বলে, ‘এর জন্যে শুভেন্দুকে আমি খুব দোষ দিই না। হয়তো ওর দিক থেকে ও ঠিক। কিন্তু আমি পারি না। কেন পারি না তাও জানিনে। পারলে হয়তো ভাল হত। কোথায় যে ছিটকে পড়েছি, মনে হয়, আমি যেন ওদের থেকে আলাদা।’

ঝিনি চুপ করে। আমি এক আশ্চর্য বিধবা দেখি। বৈধব্যের স্পর্শ যার নেই। বরং যার জীবনের চারপাশে এক ভিন যমুনার জলস্রোতের টান। আমি যেন দেখি, শূন্য কলসি কাঁখে অভিসারে চলে এক চির অভিসারিকা। তার যৌবনে যে বেজেছে প্রেমজুরির ঝনক ঝনক, তা-ই শুনি কথায় হাসিতে।

দেখি, পোড়ারমুখী কলঙ্কিনী রাই আঁধার ছেড়ে প্রেম-যমুনায় যায়। কিন্তু ওর এই যাতনাজাত আলো সইবে কে। যাত্রা ওর অনেক দিনের, কলসি ওকে ছাপামাপি করতে হবে। সেটা ঘাটের ঠিকানা কে জানে!

.

৫৮.

তথাপি দেখ, মনের চমক ঘোচে না। যে বিবাহ-বৈধব্য সংবাদ শুনেছি, তার মর্ম বুঝি না। সংবাদের মধ্যে যে ঘটনা, তা-ই কখনও সব না। নদী কেবল তরঙ্গে বহে না। তার তলে স্রোতের ধারা বহে কোন টানে, কে জানে। তা-ই জিজ্ঞেস করি, ‘তারপরে?’

ঝিনি ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে, ‘কীসের তারপরে?’

পাল্‌টি জিজ্ঞাসায় হঠাৎ জবাব দিতে পারি না। কেবল ওর চোখের দিকেই চেয়ে থাকি। ঝিনিও একটু তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কী যেন ভাবে। তারপরে বলে, ‘জানিনে। খালি এইটুকু বলতে পারি, ওকে আমার মনে পড়ে। কিন্তু আমি যেন নিজেকেই চিনতে পারিনে। তখনকার সেই “আমি”-কে। কেন যে ওর এত বাধ্য হয়েছিলাম, কেন যে কেবলই ওর কাছে কাছে থাকতে ইচ্ছে করত, কখনও বুঝে উঠতে পারিনি। ভালবাসা?’

যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করে। নিজের কাছেই জবাব চায়। একটু চুপ করে থাকে। বলে, ‘জানিনে। তাও জানিনে। সব ঘটনা যেন ভাল করে মনে করতেও পারিনে। ওকে যত মনে পড়ে, ঘটনার কথা তত নয়। যেন একটা আবছা ঝাপসা মতো কিছু। কী যেন ঘটেছিল, কী যেন হয়েছিল। মনে মনে অনেক খুঁজি, কিছু একটা খুঁজে পাইনে। তারপরে তো আর কিছু জানিনে।’

বলে ঝিনি আমার দিকে চায়। চোখে আর ঠোঁটে এমন এক হাসি, যেন আমাকেই জিজ্ঞেস করে, কিছু জানা আছে কিনা। দেখে এমন অসহায় লাগে, হঠাৎ আবার একটা কষ্ট বিঁধে যায়। চোখ ফিরিয়ে চাই কোপাইয়ের ওপারে! মনে মনে আবার বলি, কলঙ্কিনীর আসলে সে-ই যাত্রা। চিরদিনের অ-ভর কলসি, ভরতে চলেছে। শূন্য কলসির শব্দ থাকে, বয়ান থাকে না। তার এক বয়ান, ‘ভরতে চলেছি।’ ‘তারপরের’ কথা সে কী বলবে।

‘আমি খারাপ, না?’

কথা শুনে চমকে ফিরি। মুখের দিকে চেয়ে বলি, ‘না তো।’

ঝিনি হেসে মুখ নামায়। তার আগেই একটু রঙের ছোপ লেগে যায় মুখে। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। শুভেন্দুর অপরাধে কী? তার আগে বলো, ধন না, বিত্ত না, দান গ্রহণ-বর্জন না। একে বলে, মন গুণে ধন দেয় কোন জন। সেখানে কে অপরাধী, কে নয়, তার কোনও বিচার নেই। এখানে হেতু-সেতু কার্যকারণে অ-বন্ধন। বন্ধন চলে না।

আমি ঝিনির দিকে দেখি। যত বিব্রতই হই, যত আড়ষ্ট লাগুক, সহসা যেন মনেতে কী এক সুর বেজে যায়। বিস্ময় যত লাগে, মুগ্ধবোধের টানে ভেসে যাই, তার চেয়ে বেশি। কেন পথে পথে ফিরি, কীসের সন্ধানে, তার নামধাম জানি না। কিন্তু এ যেন এক অচিন চেনার কূলে দাঁড়িয়ে প্রাণ গলে যায়। মানুষ চিনি কতটুকু, দেখি কতখানি। তার বন্ধ দরজার চাবি নিয়ে ফিরি না। কুলুপের হদিস জানা নেই। কার হাতে চাবি, কে খোলে, কেমন করে, কে জানে। যখন খুলে যায়, তখন মুগ্ধ প্রাণ দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকি। আর কী খুঁজি, জানি না, এইটুকুই পাওনা।

মানুষ দেখতে বেরিয়েছি, সে হলফ আমার নেই। কিন্তু আমার চোখের কূল জুড়ে তার মেলা। আমার সকল আস্বাদনের স্বাদে স্বাদে ভাসা। যেন, আপনি সুরা হয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায়; মনে হয়, এই পরম পাওনা।।

ঝিনি কেন বলেছে, সে ভাবনা ওর। আমার ফেরা এই পাওনা পাখায় নিয়ে উড়ে যাওয়া।

ঝিনি হঠাৎ ফিরে তাকায়। সাজানো মুখে ভুরু তুলে বলে, ‘কী?’

বলি, ‘কিছু না। এবার ফেরা যাক?’

‘তাড়া আছে বুঝি?’

তাড়া আমার না। মাঝ-আকাশ ধরতে যাওয়া সূর্যের তাড়া। হাতে-বাঁধা ঘড়ির তাড়া। কিন্তু সে কথা ঝিনিকে বলা বৃথা। ওর ওঠবার কোনও লক্ষণ নেই। কেবল একবার ঘড়ির দিকে তাকাই। সেটা লক্ষ করে ও বলে, ‘ওটা তো চিরদিনই দেখতে হবে, এখন থাক না। কিন্তু আমার কথা শুনে কী মনে হল বললেন না তো।’

‘বলি, ‘এমন আর কখনও শুনিনি।’

‘খুব খারাপ, না?’

‘এর খারাপ ভাল জানি না।’

তবে?

বলতে গিয়ে বাধে। তবু বলি, ‘কষ্ট হয়।’

ঝিনি মুখ ফিরিয়ে নেবার আগে একবার আমার চোখের দিকে তাকায়। একটু চুপ করে থাকে। তারপরে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘চলুন যাই।’

কিন্তু ওর চোখ দুটো এখন টলটলানো। যদিও বিমর্ষতা নেই, বরং একটু যেন রং ছোঁয়ানোই। তারপরেই হঠাৎ কোপাইয়ের ওপারে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কীসের ধোঁয়া উঠছে ওখানে বলুন তো?’

তেমন গভীর বন না যে, বলি, দাবানল। বাঁশঝাড়ের ওপার থেকে ধোঁয়া উঠছে। বলি, ‘কেউ হয়তো আগুন দিয়েছে।’

‘দেখতে যাবেন?’

‘কিন্তু এখানে জল গভীর, পার হওয়া যাবে না।’

ঝিনি ধোঁয়ার দিকে চোখ রেখে আমার আগে আগে চলে। যে পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেই দিকে যেতে যেতে বলে, ‘যেখান দিয়ে সবাই পার হচ্ছে, সেখান দিয়ে পার হওয়া যাবে।’

বলে আমার দিকে চেয়ে ছোট মেয়ের মত হাসে। এই মাত্র টলটলানো চোখ দুটোতে যেন কেমন এক কৌতুক আর অনুরাগের ছটা। লাল বড় রুমালটা এখন ওর হাতে জড়ানো। আবাঁধা চুল ছড়ানো ঘাড়ে পিঠে। প্রায় ঠোট ফুলিয়ে বলে, ‘যাব কিন্তু সত্যি।’

পাছে আপত্তি করি, তা-ই এই ভঙ্গি। কাকে ফেরাব। অবুঝকেও বোঝানো যায়। নোঙর-ছেঁড়া নৌকো ফেরানো যায় না। কিন্তু লোকসমাজের গাঙে ঝিনি সে নৌকার যাত্রী করেছে আমাকে। ওকে বোঝাই কেমন করে। ফেরাই কেমন করে।

টিবির ঢালুতে পা দিতেই হঠাৎ যেন হাসির ছটায় সুর-ভরানো অবাক গলা ভেসে আসে, ‘অই গ দিদিমণি, কুথা যাচ্ছেন গ।’

প্রথম ঠেক লাগে ঝিনির পায়ে। তারপরে আমার। কোপাইয়ের ওপারে, কাঁকুরে মাটি যেখানে ধাপের মতো নেমেছে জলে, ঘাটের মতো হয়েছে, সেখানে দেখি বিন্দু, বাউল গোকুলের প্রকৃতি, কাঁসার বাসন মাজে। তার কাছে বসে সুজন বাউল মাটির হাঁড়ির পিছনে লাল মাটি লেপে। তার শক্ত পেটা কালো শরীরে একটি মাত্র গেরুয়া উড়নি। এক টুকরো কাছাহীন গেরুয়া কাপড়। চুল চুড়ো করে বাঁধা।

বিন্দুর গায়ে একমাত্র লালপাড় গেরুয়া শাড়ি। ঘাড়ের কাছে চুল আলগা করে বাঁধা। দু’জনেরই চোখে অবাক কৌতুকের ছটা। হাসিতে ঝিকিমিকি দাঁত।

ঝিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা এখানে কী করছ?’

বিন্দু আর সুজন একবার চোখাচোখি করে হাসে। বিন্দু জবাব দেয়, ‘বোনভোজন কইরছি। গ দিদিমণি। আসেন ক্যানে।’

সুজন আমার দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ডাকে, ‘বাবাজি আসেন। বাবা মাও এখানে রয়েছে।’

অর্থাৎ গোপীদাস আর রাধা বৃদ্ধা। ঝিনি আমার দিকে চায়। ওর চোখে মুখে রীতিমতো উত্তেজনার ঝলক। শরীরে লাগে তরঙ্গ। বলে, ‘চলুন যাই।’

এমনিতেই ওকে সামলানো দায় ছিল। এখন তো কথাই নেই। এতক্ষণে ধোঁয়ার রহস্য ফাঁস। বাঁশঝাড়ের আড়ালে বাউলদের বনভোজনের আসর জমেছে। কিন্তু, যতদূর জানি, এরা ছাতিমতলার মেলায় নিমন্ত্রিত অতিথি। সেখান থেকে এরা বনের মধ্যে কেন?

ইতিমধ্যে ওপার থেকে বিন্দুর আবার ডাক আসে, ‘আসেন দিদিমণি।’

দিদিমণির পায়ে লাগে পাগলা হরিণীর বেগ। সে ঢালু বেয়ে কোপাইয়ের জলের দিকে যায়। ওপার থেকে সুজন হেঁকে ওঠে, ‘আহা, করেন কী, করেন কী দিদিমণি, এখান দিয়ে আসতে পারবেন না। এখানে যে ডুব জল।’

বিন্দু তার কালো অঙ্গের নিটোল হাসিতে টোল খেলিয়ে বাজে। বলে, ‘জলে ডুববেন না গ দিদিমণি।’

সুজন বলে ওঠে, ‘আর যদি ডুবসাঁতার জানেন তো আলাদা কথা।’

বলে চোখের কোণে চায় বিন্দুর দিকে। বিন্দু বলে, ‘যে ডোবে, তার আবার ডুবসাঁতার জানলেই বা কী! আপনি আসেন গ দিদিমণি, উই উদিক দিয়ে ঘুরে আসেন।’

কথায় যেন রহস্যের আলো-কালোর খেলা। বিন্দু আমার দিকে চেয়ে একটু ঠোঁট টিপে হেসে বলে, বাবাজি, দিদিমণিকে নিয়ে ঘাটের পথ দিয়ে আসেন।’

ঘাটের পথে লোকচলাচলের পথ। পায়ের পাতা ডোবানো জল, যেখান দিয়ে মানুষ পশু যানবাহন, সব পারাপার করে। যেখানে আমাদের রিকশা রয়েছে।

ঝিনির চুল ওড়ে, শাড়ি ওড়ে। পিছন ফিরে আমাকে ডাক দেয়, ‘আসুন।’

তারপর ঢালু দিয়ে ছুটে নেমে যায় ঘাটের দিকে। ভয় লাগে, খোয়াইয়ের পাথরে হোঁচট খেয়ে দুর্ঘটনা না ঘটায়। কিন্তু ডেকে সাবধান করে ওর এই বেগ থামানো যাবে না। নিজে যে পিছ-পা হব, তারও উপায় নেই। অথচ দেখ, এ যাত্রায় আমার মনে দিকশূলের ধন্দ। সে কথা কে বোঝাবে ঝিনিকে। ঘাটের কাছে জলেতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঝিনি। পিছন ফিরে আবার আমাকে ডাকে ‘আসুন।’

কাছে গিয়ে দু’জনে পাশাপাশি পার হয়ে যাই। আমাদের রিকশাটা পড়ে রয়েছে। চালকের পাত্তা নেই। কোপাইয়ের কুলে এসে সেও যেন দিনযাপনের কাজের কথা ভুলে গিয়েছে। নদী পেরিয়ে আমরা ডান দিকে যাই। সুজন বিন্দুরও তখন হাতের কাজ শেষ। সুজনের ধোয়া হাতে মাটি লেপা হাঁড়ি। বিন্দুর হাতে ঝকঝকে মাজা কাঁসার থালা বাটি।

বিন্দুর ঠোঁটে তেমনি টেপা হাসি। চোখে ছটার ঝিকিমিকি। আমাদের দু’জনের দিকেই তাকিয়ে ডাক দিয়ে চলতে থাকে। চলা না, যেন নাচের তরঙ্গে দোলে। ঝিনিকে বলে, ‘বেড়া কইরতে এসেছিলেন বুঝি?’

ঝিনি আমার দিকে একবার দেখে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ।’

বিন্দু আর সুজন চোখাচোখি করে হাসে। বিন্দু বলে, ‘ছুটিতে এসেছেন, বেশ কইরেছেন।’

বিন্দুর কথায় ইঙ্গিত অস্পষ্ট না। তার কথার ছটাতেই ছোপ লেগে যায় ঝিনির মুখে। তবু বলে, ‘কোপাই দেখতে এসেছিলাম।’

বিন্দু তার ডাগর চোখে ভারী তাজ্জব হয়ে চায়। বলে, ‘কোপাই দেখলেন কুথা গ?’

আমি অবাক, ঝিনিও তাই, বলে, ‘কেন, এই যে নদী!’

বিন্দু বলে ওঠে, ‘অ মা গ, ই কী কোপাই নাকি? ই তো যমুনা গ দিদিমণি। যমুনার ধারে এইসেছেন বলেন।’

বলে সে চোখের কোণে আমাকে দেখে।হাসিতে বেজে ওঠে খিলখিলিয়ে। সুজন হেঁকে ওঠে, ‘ভাল হে ভাল। যমুনে এই কি তুমি সেই যমুনে, পরবাহিনী!’

মুহূর্তেকের মধ্যেই বিন্দুর কোপাই-যমুনার ইঙ্গিত বুঝতে পারি। সে যে কেবল বাউল প্রকৃতি, তা না। মেয়ে যে ডাকিনী তা অনুমান করেছিলাম। কিন্তু এতটা বুঝতে পারিনি। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমার মুখের রং বদলে যায়।

ঝিনি তখনও ধাঁধায় দোলে। বিন্দুর কথা বুঝতে না পেরে ভুরু তুলে আমার দিকে। চায়। এক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ ওর মুখেও ছোপ লেগে যায়। সাজানো মুখের চকিত ছটায় চোখের পাতা বুজে যায়। কোনও কথা বলে না। আর আমি হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না। কেবল দেখি সবাই এক বগ্‌গায় চলে। কিন্তু কোথায় চলে, তা জানে কিনা কে জানে। আমার সেই চলাতে ঠেক। সেই চলা যে অন্ধ পথের যাত্রা। হাসির ছটায় অন্ধকারের ভার।

এদের সে কথা বোঝাব কী করে। অচিনদাকেই বোঝাতে পারিনি। উলটে বিন্দু,গুনগুনিয়ে সুরে বাজে, ‘সখি, রাই চাতকী, যথা তথা যমুনা ভাসায়।’…

ঝিনির নত মুখ তবু পদক্ষেপে বেতালা। হঠাৎ হোঁচট লাগতেই বিন্দু ওর আঁচল চেপে ধরে। বলে, দেখবেন গ দিদিমণি। . কী আশ্চর্য দেখ, ঝিনি ওর আঁচল ধরা বিন্দুর হাতটা অনায়াসে ধরে। বলে, “দিদিমণি নয়, ঝিনিদিদি।’

‘বেশ, ঝিনিদিদি, আমার ঝিনিদিদি।’

বলে বিন্দু চোখ ঘুরিয়ে একবার আমাকে দেখে। আবার বলে, ‘গোঁসাইয়ের এমন মুখখানাতে হাসি না থাইকলে ভাল লাগে না গ।’

তার কথা শুনে হাসি পায়। সুজন বলে ওঠে, ‘তা যদি বললে বিন্দু, তা হলে জানবে, খাঁটি গোঁসাইদের হাসি হল মনমনা।’

তাই শুনে বিন্দু আর একবার আমার দিকে চায়। সুজন হেঁকে ওঠে, ‘কাকে নিয়ে এসেছি দেখ বাবা।’

বাঁশঝাড়ের আড়ালে আসতে আসতেই সুজনের হাঁক। বনভোজনের জায়গাই বটে। উত্তর পশ্চিমে উঁচু ঢিবি, বাতাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ দিকে বেণুবন, মাঝখানে দূর্বা-ছাওয়া ফাঁকা জমি। শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। পুব দিকে দুই চারি নানা গাছের মধ্যে বাবলা আসশেওড়ার ঝোপজঙ্গল। বনভোজনের জায়গাখানি রোদে মাখামাখি।

একদিকে উনুন করে মাটির কড়ায় রান্না চাপিয়েছে রাধা বৃদ্ধা। আর একদিকে ছেঁড়া ময়লা শতরঞ্জি পাতা। তার ওপরে ঝোলাঝুলি, বাঁয়া, ডুপ্‌কি, একতারা, দোতারা। গোপীদাস পাতলা কাঁথার মতো কী একটা গায়ে দিয়ে বসে আছে। গোকুল পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। শব্দ পেয়ে ফিরে চায়। তাড়াতাড়ি উঠে বসে। সবাই একযোগে অভ্যর্থনা করে, ‘জয় গুরু জয় গুরু। আসেন গ আসেন।’

তার আগে দেখ, গোপীদাসের কাঁচা-পাকা চুলদাড়িতে ঢাকা মুখের হাসিখানি। তার নয়ন দু’খানি কেবল ডাগর না, চাহনিখানিও এই বয়সে বিলক্ষণ বিটলেমিতে ভরা। সেই চোখে কৌতুকরঙ্গ, আবার ভুরু কাঁপিয়ে তির্যকে হানে। প্রথমে একখানি হাসি দেয়, হেঁঃ হেঁঃ হেঁ।

তারপরে হাসতে গিয়ে কাশি। কাশতে কাশতে কোমরের আলগা কষি কষতে কষতে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে। একবার আমাকে দেখে, আবার ঝিনিকে। বলে, ‘আসেন গ, আমার গোসাই মানিক আসেন। আমার চিতাবাবাজি আসেন। অই গ বিন্দু, অ রাধে, গোঁসাই দিদিকে বসতে দাও।’

বলে খ্যাঁকখেঁকিয়ে হাসে। রাধা বৃদ্ধা মাটির কড়া নামিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে আসে। বিন্দু ওদিকে ছেঁড়া শতরঞ্জি হাত দিয়ে ঝেড়ে দেয়। বলে, ‘বসেন ঝিনিদিদি।’

গোপীদাস ঝিনির দিকে চোখ ঘুরিয়ে চেয়ে হাসে। বলে, ‘কী সোন্দর নাম, ঝিনিদিদি। প্রেমজুরির ঝিনিঝিনি। হেঁ হেঁ হে।’

যেন একটা খুশির হাওয়ার দোল লাগে। কোপাইয়ের ধারের বন-নিরালায় এক উৎসবের তরঙ্গ। ঝিনিকে গোঁসাইদিদি বলতে কী বুঝিয়েছে, জানি না। কিন্তু গোপীদাসের চোখের নজর, হাসির রকম বড় সহজ ভাবের না।

ঝিনির মুখে রাঙা ছোপ পাকা হয়ে গিয়েছে। তা আর যাবার না। ওর টানা চোখ দুটি খুশি লজ্জায় ঝিলিক ঝলকানো। একবার আমার দিকে চায়। তারপরে শতরঞ্জির দিকে এগিয়ে যায়। সেই প্রথম গোকুল বলে, ‘বসেন, বসেন।’

গোপীদাস মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তা হাঁ গ সোজন, মেলার মানুষ ইখ্যানে পেইলে কুথা হে।’

সুজন বলে, ওঁয়ারা দুটিতে বেড়াতে এসেছিলেন।’

‘অই, অই।’

গোপীদাস খুশিতে আওয়াজ দিয়ে ওঠে, সুজন আবার বলে, ‘তা বাবা, বিন্দুকে ঝিনিদিদি বললে, কোপাইয়ের ধারে বেড়াতে এসেছেন। আর বিন্দু বললে, কোপাই কোথায় দেখলেন গো ঝিনিদিদি, এ যে যমুনা নদী।’

গোপীদাসের বুড়ো হাড়ে ভেলকি। অমনি এক লাফ, আর আকাশ ফাটিয়ে ডাক, ‘জয় গুরু, জয় গুরু। ধন্যি বিটি গ তুই বিন্দু, ধন্যি বিটি।’

হাসির হররা লাগে। ওদিকে গোকুল বিন্দু চোখাচোখি করে হাসে। গোপীদাস আমার হাত টেনে ধরে বসায়। প্রায় ঝিনির পাশাপাশি। হুস্‌ করে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আঃ, আমার অচিনবাবু নাই, বইলব বা কারে, দেখাই বা কারে।’

বলে চোখ দুটো আধ-বোজা করে আমার দিকে চায়। ঝিনি চকিতে একবার আমার দিকে চায়। গোকুল বিন্দু সুজন, সবাই হেসে ওঠে।

এই হাসির মুখে ভিন কথা বলি, সে সাহস নেই। এই উৎসবের রঙ্গে বাধা দিই, সে ক্ষমতা নেই। বরং দেখি, গোপীদাস দাড়ি কাঁপিয়ে হাসে আমার দিকে চেয়ে। আর একটু একটু ঘাড় নাড়ে। রাধা বৃদ্ধা ওদিকে রান্না দেখতে যায়। আর গোপীদাস হঠাৎ সুর ধরে দেয়,

‘অ ভোলা মন, মন চিতা তোর

ধ্যানে ঘাপটি মারে।

করে রে অধরা শিকার, ধরার ঘরে

ভাণ্ডেতে চাঁদ লখে রে।’…

সুজন গোকুল একসঙ্গে ‘জয় গুরু’ ধ্বনি করে। ওদিক থেকে রাধা বৃদ্ধা ফোগলা দাঁতে হাসে। বলে, “ঠিক বইলছ গোঁসাই।’

বিন্দু ওদিকে সুজন গোকুলের মাঝখানে খিলখিলিয়ে বাজে। হাসিতে খানখান শরীর এক বাঁকে ছোঁয় গোকুলকে, আর বাঁকে সুজনকে।

গোপীদাসের গানের কথা সঠিক বুঝি না। কিন্তু অচিনদা আর তার আমাকে চিতা বলে ঠাট্টার কথা মনে পড়ে যায়। তোর চোখের দিকে চোখ রাখতে পারি না। তার দাড়ি কাঁপে, ভুরু নাচে, চোখে ঊর্ধ্বনেত্র চাহনি। দেখে আড়ষ্ট লাগে, লজ্জা করে। চোখ নেমে যায়। গোপীদাস ঘড়ঘড়ে গলায় তেমনি করেই আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান করে,

‘এ চিতা দেখলে চেনা যায় না গ,

লয়ন ঢুলু গোঁফ ধসানো রে।

পীত বসনে ঢাকা দিয়ে, মোহন হেঁইসে।

বড় ল্যাজ বিশিষ্ট থাকে রে।’…

এদিকে সুজন গোকুলের হাততালি লেগে গিয়েছে। বিন্দুর প্রেমজুরিতে ঝিনিঝিনি। আর গোপীদাস যেন চোর ধরা দারোগার মতো আমার দিকে চেয়ে ঘাড় নাড়ে। হাঁক দিয়ে ‘ভোলার মন’-কে ডেকে নতুন কথায় সুর জোড়ে,

‘এ চিতা চলে, বঙ্ক নালে, অমবস্যা পুন্নিমেতে

আওয়াজ করে না রে।

শিকার করে, চুপিসাড়ে, তখন দেখ উর্ধ্ব লয়ান

শিকার ধ্যানে ধ্যান আবেশ রে’…

গোপীদাস কোমর ঘুরিয়ে পাক মারে। তারপর ধপাস করে বসে আমার সামনে। ঝিনিকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন লাইগল গোঁসাইদিদি।’

ঝিনির গলায় যেন মিঠে লজ্জায় সুধা উপচানো বলে, ‘সুন্দর।‘

বিন্দু বেজে ওঠে হাসিতে। গোপীদাস বলে, ‘লাইগতে হবে, লাইগতে হবে। যেমন চিতা, তার তেমনি গান। জয় চিতাবাবাজি!’

আবার হাসি বাজে সকলের। আর আমার দিকে চেয়ে গোপীদাস চোখ ঘোরায়। তার অর্থ বুঝি। কিন্তু আমার কথা বলতে পারি না। কেবল অসহায় হয়ে একবার ঝিনির দিকে তাকাই।

গোপীদাস এবার ভিন সুরে বাজে, ‘অই গ বিন্দু, রাধা তো খালি তরকারি রাঁধে। এবার ডালে চালে হাঁড়ি বসা। বাবাজি আর দিদির সঙ্গে খাব।’

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘না, না, তা হবে না।’

ঝিনিও বলে ওঠে, ‘খাওয়া থাক, অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

গোপীদাস ভুরু তুলে চোখ ঘুরিয়ে একবার আমাকে দেখে। আবার ঝিনিকে। তারপর রাধার দিকে চেয়ে বলে, ‘অই, ই দুয়েতে যে এক দেখি গ!’

এতক্ষণে গোকুল আবার মুখ খোলে, ‘এক সুরেতে বাজে।’

সবাই হেসে ওঠে। তার মধ্যে সব থেকে হাসি-কাশির চড়া সুর গোপীদাসের। বলে, ‘কিন্তুক, হলে বড় সুখ পেতাম।’

ঝিনি বলে, ‘কাউকে বলে আসিনি তো।’

গোকুল আবার মুখ খোলে, ‘তাই কি আবার কেউ বইলে আসে?’

আসরের প্রথম থেকেই যেদিকে ঢাল লেগেছে, ব সেদিকেই বহে। ঝিনি মুখ নামিয়ে নেয়। আমি জিজ্ঞেস করি গোপীদাসকে, ‘কিন্তু মেলা ছেড়ে আজ এখানে কেন?’

গোপীদাস মাথার চুলের ঝুপসিতে আঙুল চালিয়ে বলে, ‘আজ তো কী সব হচ্ছে উখানে, ইল্লি দিল্লি থেকে মন্তীর কত্তারা সব এইসেছেন। তাই ভাবলাম কী যে, এ বেলাটা কোপাইয়ের বনে যেয়ে, চালে ডালে ফুটিয়ে খেয়ে আসি।’

সরল উক্তি। সাতে নেই, পাঁচে নেই। তোমরা থাকো গিয়ে মন্ত্রী কর্তা নিয়ে। সেখানে আমাদের আসর নেই। তার চেয়ে নদীর ধারে, বনের নিরালায় একটু কাটিয়ে আসি। আগুন জ্বালো, পাক করো, ভোজন সারো এখানেই।

আবার চোখ ঢুলুঢুলু করে বলে, ‘ঘাটে-বাটেই তো কাটে বাবাজি। খাঁচায় থাকতে পারি না। তা হ্যাঁ বাবাজি, এ মেলার পরে যাওয়া হবে কুথা?’

আমি বলি, ‘ইচ্ছা আছে নানুর যাব।’

গোপীদাস যেন অবাক হয়ে যায়। সকলের সঙ্গে চোখাচোখি করে। তারপরে বলে ওঠে, ‘জয় গুরু, জয় গুরু। মনের কথা বইললেন যে গ। আমরাও তো ফিরতি পথে নানুর হয়ে যাব।’

‘তাই নাকি?’

‘হঁ বাবাজি।’

বিন্দু বলে ওঠে, ‘সে বেশ হবে। আর ঝিনিদিদি যাবে না?’

ঝিনির মুখে ছায়া ঘনায়। বলে, ‘জানিনে। আমার সঙ্গে লোক আছে তো। বলতে পারিনে।’

কথা শেষের আগেই সে একবার আমার দিকে চায়। আমি তাকাই গোপীদাসের দিকে।

গোপীদাস বলে, ‘ক্যানে বাবাজি, দিদিকে লিয়ে আপনি আসেন। অমন গুরুর থান কি না দেখে যেতে আছে?’

হেসে বলি, ‘ওঁর সঙ্গে যে লোক আছে।’

বিন্দু বলে, ‘সব্বাই যাবে, তাতে কী।’

ঝিনি বলে, ‘দেখা যাক।’

বলে সে উঠে দাঁড়ায়। আমিও দাঁড়াই। গোপীদাস বলে, ‘ও বেলা আবার মেলায় দেখা হবে।’

রাধা বৃদ্ধা ছাড়া সবাই একটু এগিয়ে আসে আমাদের সঙ্গে। গোপীদাস সহসা পিছন থেকে গেয়ে ওঠে, ‘দুয়ে যুগল, একে হেরি, মরি মরি।’…

ঝিনির মুখের পাকা ছোপ আরও গাঢ় হয়। কিন্তু চোখ হঠাৎ টলটলিয়ে ওঠে।

আমি কথা বলতে পারি না। পিছনে শোনা যায়, ‘জয় গুরু, জয় গুরু।’

.

৫৯.

নদীর ঘাটে এসে দেখি, রিকশাওয়ালা স্বয়ং আসনৈ অধিষ্ঠান করেছে। আমাদের দেখে লাফ দিয়ে নামে। বলে, ‘অই দ্যাখেন, আমি ভাবি কি যে, বাবুরা বুঝি চলে গেছেন। কুথা গেছিলেন?’

নদী পেরিয়ে এসে বলি, ‘ওপারে।’

‘আর আমি দেখতে না পেয়ে, একে তাকে শুধাচ্ছি, কেউ বইলতে লারছে। খালি বলে, আপনারা চলে গেছেন। তাই কি হয়! বাবু দিদিমণির জুতা পড়ে রইল আমার গাড়িতে চলে যাবেন ক্যানে।’…

তার মুখের দুশ্চিন্তা আর হতাশায় আলো ফোটে। সংশয় থেকে অসংশয়ে এসে এখন কেবল বকবকিয়ে চলে। আমরা রিকশায় উঠে বসি। সে টেনে নিয়ে ওঠে। চড়াইয়ে টেনে তুলতে কষ্ট। বালি কাঁকর পাথুরে মাটি বড় নির্দয়, অ-বন্ধুরতা কোথাও পাবে না। নেমে হাঁটতে চাইলেও চালক গররাজি। সে বীর বা দয়ালু না। তার কাজ সে করে। যাত্রীর করুণা তার বালাই।

ঝিনি কোনও কথা বলে না। একটু আগেই ওর চোখ ভিজে উঠেছিল। এখন শুকনো। রোদে বাতাসে শুকায়, নাকি মনের রহস্যে, তা জানি না। এখন ও রোদের ঝলকে ভুরু বাঁকিয়ে এদিক-ওদিক চোখ ফেরায়। কিন্তু ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি লেগে আছে। মুখের ভাবে যেন একটু লাজ-লাজ। লাল রেশমি রুমালখানি গলায় বেড় দিয়ে, বুকের কাছে জামার দু’পাশে গুজে দিয়েছে। আসবার সময়ে পাশাপাশি বসার মধ্যে হয়তো কোথাও ওর কিঞ্চিৎ আড়ষ্টতা ছিল। কিংবা বলি, একটু সাবধানতা। এখন যেন সে চেতনে নেই। বড় অনায়াস, নিবিড়, গভীরে ধরা-ধরা। তাই এখন আড়ষ্ট যে কে, সে জানি আমি, আমার মন।

আমিও কোনও কথা বলি না। সামনের পথে চেয়ে থাকি। মাঝে মাঝে অবাক লাগে, আম গাছের অকাল মুকুল দেখে। কাঁঠালের ডালে কচি এঁচোড় দর্শনে। কিন্তু আসলে আমার শ্রবণ ভরে গোপীদাসের গান বাজে। তার মুখ আমার চোখে ভাসে। সব মিলিয়ে কেমন একটা তালে বাজানো খুশির সুরের আমেজ। অথচ একটা দীর্ঘশ্বাসের বাতাস যেন বুক-জোড়া। উদাস বৈরাগ্যের হাতছানিতে ভেসে যাবার মতন।

মনে ভাবি, গোপীদাসদের মনপ্রাণ এত ভরা কীসে? ধুলি আলখাল্লায়, ধুলি জটায়, ধুলা গায়ে, ঝোলায় একতারা বাঁয়া প্রেমজুরিতে, মাঠেঘাটের বাটে বাটে ফেরায়, কোন নেশাতে ভরপুর। এমন না যে, চাঁদির জেল্লায় ঝকমকানো দৌলতের টাটে বসে মৌজ করে। চোখে তো দেখি, ফৌত ফতুর মানুষ সব, চালচুলো নেই। তবু যেন প্রাণ ভরা, বুক ভরা, মুখে ভুবনমোহন হাসি। দুনিয়ার সব পাওনা ঝোলায় তুলে যেন এখন নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে। মনকে ডাকে ‘ভোলা’ বলে, ‘মনের মানুষ’ ডেকে বেড়ায়। না বুঝি সেই মন। না চিনি সেই মনের মানুষ।

জীবনধারণের চাপাচাপিতে পা গুনে চলি। পদে পদে হিসাব-নিকাশ। পান্তা আনতে নুন ফুরালে চোখে অন্ধকার দেখি। উদ্বেগে ছুটোছুটি করি। কোনও রূপেই নয়ন ভোলে না। কোনও পাওয়াতেই মন ভোলে না। জনপদে নগরে প্রাসাদে ইমারতে, কেবল হারাই হারাই, সদা ভয়ে ফিরি। কেবল সোনায় দানায়, ভোগের ভাগে-চক্রে পাক খাই। তাতে যখন হাঁফ লাগে, শ্বাস বন্ধ মরি-মরি, তখন ছুট লাগাই। মনে করি, রূপ ছেড়ে অরূপ দেখে আসি। যা পাই না, তার আসল-নকল বিচার করে আসি। কী পাই না, তার সন্ধানে যাই।

কিন্তু দেখ, কায়ার যেমন ছায়া, মন তেমনি পিছু ধাওয়া করে। যে মনের দিবানিশি হারাই হারাই, চাই চাই, হিসাব-নিকাশ মাপজোক বিচার। ওদের ঝোলায় কী ধন আছে? কোন রূপের নেশায় মৌত হয়ে অরূপের সীমায় বসে আছে? জীবনের কি দায় নেই? মরণের কি ভয় নেই?

এমন মন পায় কোথায়? দেয় কে?

প্রান্তর ছাড়িয়ে, গ্রাম পেরিয়ে অনেকখানি এসে পড়েছি। হঠাৎ মনে হয়, ঝিনি যেন অনেকক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। ফিরে তাকাই। চোখাচোখি হতেই ও তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নেয়। মুখের রঙে একটু গাঢ় ছোপ লাগে। ঠোঁটের কোণে হাসি।

কিছু জিজ্ঞেস না করে মুখ ফেরাতে যাই। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাবছেন?’

অকপটেই বলি, ‘গোপীদাসের কথা।’

‘কী কথা?’

‘ওদের জীবন, আচার-আচরণের কথা। ওদের কিছুই বুঝি না। কী চায়, কী করে। অথচ যেন কীসের নেশায় আছে।’

ঝিনির গলায় হঠাৎ যেন কীসের এক আবেশ লেগে যায়। বলে, ‘ওরা সাধক। সাধনার মধ্যে আছে।’

অবাক হয়ে ঝিনির দিকে চাই। এ যেন আর এক ঝিনি। বিদুষী না, নাগরিকা না, রং ছোপানো মুখে, চোখের ঝিলিকে, মেয়ের মন জানানো প্রাণলীলা না। এও যেন এক বাউলানি কথা বলে! জিজ্ঞেস করি, ‘কী সাধে, কীসের সাধন?’

ঝিনির চোখে কেমন এক নিবিড় চাহনি। বলে, ‘সে কথা সাধকরাই জানে।’

আমি বলি, ‘কিন্তু এ কেমন সাধন? গান গেয়ে পথে পথে ফেরা, যেন কেমন এক ভাবের ঘোরে আছে! জীবনের আর কোনও তাগিদ নেই?’

‘কীসের তাগিদ?’

ঝিনির প্রশ্ন শুনে হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারি না। আমার কথা কি সত্যি ও বুঝতে পারে না? বলি, ‘কই, আমি তো এরকম পারি না! এমন করে জীবন কাটানোর সাহস তো আমার হয় না!’

ঝিনি বলে, ‘ওদের যদি এটাই সাধনা হয়! হয়তো, এমনি করে চলা ফেরা গাওয়া। এ জীবনের সবটাই সাধনা। তা হলে আর ভাবনা কীসের, সাহসের কথা কীসে আসবে।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘এমনি চালচুলোহীন অবস্থায়?’

‘এ-ই যদি সাধন হয়, তবে চালচুলো দিয়ে কী হবে। ওরা তো এই রকমই। আসলে ঠিক থাকলেই হল।’

‘আসল কী?’

‘তা আমি জানিনে। ওরা তো বলে, মনের মানুষ।’

আমি ভুলে যাই, কার সঙ্গে কথা বলছি। জিজ্ঞেস করি, ‘মনের মানুষ কী?’

ঝিনি চুপ করে থাকে, কোনও জবাব দেয় না। দেখি, সে আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। আমার চোখ পড়তেও সে চোখ সরায় না। কেমন এক বিহ্বল আবেশ চোখে। আমি আবার জিজ্ঞেস করবার আগেই ও জবাব দেয়, ‘আমি জানিনে, ওদের মনের মানুষ কে। খালি মনে হয়, ওদের মতো করে মনের মানুষ সাধি।’

ছোট একটা নিশ্বাসের সঙ্গে ওর গলায় যেন কী এক সুর বেজে ওঠে। আমি শুনি, কথা সেই এক টানে বহে। দেখি, সেই এক মেয়ে, অন্য রূপে ফোটে। আমার ভাবেতে ঠেক লাগে। কিন্তু কী যে মোহের মায়া ঝিনির গলায়, রূপে যে কী এক অপরূপ জাগে, এ পথ যেন তার রং বদলায়। মনে হয়, এ কোনও কুসুমকানন, কুঞ্জগলি পথ। আফোটা ফুলগুলো ফুটে ফুটে ওঠে, গন্দে বিহারে, ভোমরা গুনগুন করে। কোপাইয়ের খোয়াইয়ের রাস্তা সেই চিরদিনের বাঁশি বাজানো, ধেনু চরানো, কদম্বের ডালে ডালে ফুল দোলানো, যেন নীপবনপথ হয়ে ওঠে। আর যমুনার জলশাড়ি পরে, কে যেন চলে সেই পথে। তার প্রাণের সাধের কথায় ফুল ফুটে ফুটে ওঠে।

কিন্তু সেই চলাতে আমার পা মেলে না। সেই সাধাতে বাঁধা আমার বেড়ি। সে কথা আমার কথা। বলা বে-এক্তিয়ার। কেন না, ঝিনি যে আপন রসে ফোটে। নিজের গন্ধে জাগে। সবই ওর স্বধর্ম। তুমি আপন খোঁজায় থাকো।

তবু আমি তাকাতে পারি না। চোখ ফেরাই দূরে। বাতাসে শীত, রোদে তাপ লাগে। সূর্য ঢলেছে পশ্চিমে। রিকশাওয়ালা থেকে থেকে জোর নিশ্বাসের চাপে একটা সুর ভেজে বলে, ‘লতুন—লতুন পায়রাগুলান…।’

সে যে কী গান, তা জানি না। চোখের সামনে সাঁকো জেগে ওঠে। ঝিনি চোখ সরিয়ে নেয়। আবার অন্য সুরে বলে, ‘আপনার সেই বসিরহাটের গাজি যা সাধে, এরাও তাই সাধে, মনে হয়।’

একটু অবাক হই। গাজিকে যে ঝিনির এতখানি মনে আছে, ভাবিনি। বলি, ‘কিন্তু ওর ঘরসংসার আছে।’

ঝিনি বলে, ‘থাকতে পারে। এদেরও হয়তো সেরকম আছে। কিন্তু ওদের ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা, সব যেন একরকম। সবাই যেন এক সাধনাই সাধছে।’

গাজির কথা মনে পড়ে যায়। তার শেষ কথাগুলো মনে আছে। তবু, তার মধ্যেই মনে হয়, সেও যেন তার ঝোলাতে কী এক পরম রতন নিয়ে বসে আছে। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, আপন ভাবে বিভোর।

ঝিনি আমার দিকে চেয়ে, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি, কেন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ান?’

বলি, ‘সেটা আলাদা।’

‘কেমন আলাদা?’

‘আমি বাউল দরবেশ নই।’

‘তা জানি। তবু?’

‘থাকতে পারি না বলে।’

‘কেন?’

‘তা জানি না।’

ঝিনি আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। ঝিনি যেন রহস্যের সুরে বেজে ওঠে, ‘তার মানে, জানতে।’

ঝিনি আমার মনে চমক লাগিয়ে দেয়। জিজ্ঞেস করি, ‘কী জানতে?’

ওর চোখে তেমনি এক নিবিড় রহস্যের ঝিলিক। বলে, ‘কী জানি!’ সে কথা কি আপনার মুখ থেকে আমি বের করতে পারব?

হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারি না। ঝিনিকে যেন মনে হয়, ও জাল ফেলে ফেলে চলে, মীন ধরবে বলে। ও যখন আপন সুরে বাজে, তখন বুঝতে পারি। এখন যেন ওর হাতের আঙুল ভিন্ন যন্ত্রে, ভিন্ন তারে সুর খোঁজে। এখন বুঝতে গিয়ে নিজেকেই সরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে। নিজেকেই অবুঝ লাগে। বলি, ‘হয়তো তাই। কিন্তু আমি জানি না।’

‘আমি জানি।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী?’

ঝিনির ভ্রুভঙ্গিতে, চোখের তারায় যেন রহস্য আরও ঘনীভূত হয়। বলে, ‘কতটুকু পাওয়া হল, তা-ই জানতে।’

‘সেটা কী?’

‘যা নেবার জন্যে ফেরেন।’

‘কী নিতে?’

‘তা জানিনে। মনে হয়, সকলের চোখের আড়ালে কী যেন নিয়ে নিয়ে চলে যান।’ হঠাৎ একটু থেমে বলে, ‘চুরি করে।’

অবাক হলেও ঝিনির কথায় আমার যেন টনক নড়ে যায়। সহসা কিছু বলতে না পেরে হেসে উঠি। আমার হাসির মুখেই ঝিনি আবার বলে ওঠে, ‘কিন্তু দিতে কিছুই চান না। আপনি শুধু নিতেই জানেন, দিতে জানেন না।’

আবার হেসে তাকাতে গিয়ে চমকাই। ঝিনির মুখে অন্ধকার নামেনি। বিষাদ নেমেছে। জিজ্ঞেস করি, ‘কী দিতে জানি না?’

‘তাও জানেন না? কথা শুনে তো কিছু বোঝা যায় না। তবু বলতে ইচ্ছে করে আপনি বড় মিথ্যুক।’

এই একটি অপবাদ সারা জীবনে কখনও ঘোচে না। ঘুচবে না বোধ হয়। আর মুহূর্তেই আমার মনে হয়, এ সেই মেয়ে! সেই মেয়েটিই! রহস্য না, কথা না, শুধু সেই মেয়েটি। যে ফোটে আপন রূপে গন্ধে। এখন যে ওর চোখের কোণ চিকচিক করে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে, তবু ভুরুর বাঁক ঘোচে না, এ সকলই একান্ত ওর আপন রূপ, নিজের গন্ধ।

হঠাৎ চমকে উঠি, বাজখাঁই গম্ভীর গলা শুনে, ‘এই রিকশা, দাঁড়া।’

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দাড়ায়। আমাদের দিকে ফিরে চায়। দেখি, রাস্তার ধারে বিলিতি মোটরগাড়ি। তার ভিতরে চালকের জায়গায় অচিনদা। পিছনে বসে রাধা আর লিলি।

হাসতে গিয়ে থমকে যাই। অচিনদা তাঁর লোমশ ভুরু কুঁচকে একবার নিজের হাতের ঘড়ি দেখেন। ঠিক সেই ভাবেই আমার দিকে চেয়ে বলেন, ‘রিকশার ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে নেমে এসো।’

ঠিক যেন চোর-ধরা দারোগা। ঝিনিকে আঙুল তুলে ডেকে বলেন, ‘তুমি নেমে এসো।’

বলে তিনি পিছনের আসনে রাধা লিলির দিকে একবার তাকান। ওরা গম্ভীর, ঠোঁট টেপা। তবু ওদের চোখে ঝিকিমিকি। ঠোঁটের কোণে কাঁপুনি। ঝিনি একবার আমার দিকে চায়। ঝটিতি ছটার ঝলক লাগে ওর মুখে। বাধ্য বালিকাটির মতো সুড় সুড় করে নেমে যায় রিকশা থেকে। মোটরের দরজা খুলে রাধা লিলির পাশে গিয়ে বসে।

আমি ততক্ষণে পকেটে হাত দিয়েছি। সাঁকো পেরিয়ে কখন যে ছাতিমতলার সীমায় এসে পড়েছি, খেয়াল করিনি। ঝিনির কথার চমকে গমকেই নজর হারিয়ে গিয়েছিল। পয়সা মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে আসি। আর কী আমার কপাল দেখ হে, রিকশাচালকটি পর্যন্ত আমার দিকে এমন করে তাকায়, যেন ধরা পড়া চোর দেখছে। ওর চোখের কথা যদি পড়তে পারো তো দেখ, এই চুরি ধরার মধ্যেও যেন রসের গন্ধ পেয়েছে। মান-ইজ্জত আর রইল না।

অচিনদা তাঁর পাশের দরজা খুলে দেন আমার জন্য। আমি উঠে বসে দরজা বন্ধ করতেই আওয়াজ ওঠে। অচিনদা গাড়ি ঘুরিয়ে নেন। তিনি যে ওস্তাদ চালক, চালনা দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু একটি কথাও বলেন না। ভুরু কুঁচকে সামনের দিকে চেয়ে, সোজা দক্ষিণে। তারপরে বাঁয়ে ঘুরে, মেলা পাশে রেখে এগিয়ে যান। কী অস্বস্তি দেখ। পিছনে তিন সখীতে কী করছে, মুখ ফিরিয়ে দেখতে পারি না। অচিনদা ফিরেও তাকান না। কিছু দূর গিয়ে ডানদিকে ঘুরে এক ছায়াভরা লাল রাস্তায় চলেন। আর তখনই তাঁর গলায় গম্ভীর আওয়াজ বাজে, ‘ক’টা বেজেছে, সে খেয়াল আছে?’

তাড়াতাড়ি হাত তুলে ঘড়ি দেখে বলি, ‘পৌনে দুটো।’

অচিনদা মুখ কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, ‘থাক, সেটা আপনি না বললেও আমি জানি। তা সেই সকালে বেরিয়ে পৌনে দুটোতেই যদি ফিরতে হয়, সেটা বলে যেতে কী হয়েছিল। এদিকে ললিতা বিশাখারা যে হেদিয়ে গেল সখীর জন্যে।’

তখন পিছন থেকে তাড়াতাড়ি ঝিনির গলা শোনা যায়, ‘অচিনদা, ওঁকে আমিই ডেকে নিয়ে গেছলাম।’

অচিনদা ঠোঁট উলটে বলেন, ‘আরে, সে কি আমি জানিনে! তুমি ডেকে নিয়ে যাবে না তো কি, এই মেনীমুখো তোমাকে ডেকে নিয়ে যাবে!’

সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে রুদ্ধ হাসির দুই-চারি নিক্কণ বেজে ওঠে। রাধা লিলি, নিঃসন্দেহে। কী সব অপবাদের কপাল দেখ। এখন সব দোষই আমার। এমনকী, আমি মেনীমুখোও বটে। অচিনদা তেমনি গলাতেই আবার বাজেন, ‘ও কি কাউকে ডাকতে পারে। ওকে ডাকলে, ও সুড়সুড়িয়ে যায়।’

পিছনে আবার রুদ্ধ হাসির টুংটাং। কিন্তু এও মিথ্যা অপবাদ। আসলে, অচিনদা ঘটনায় যে রং দিতে চান, তাইতে আমার বিরাগ। সে কথা বলবে কে এখন।

অচিনদা একবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে নেন। বলেন, ‘কী গো দূতীগণ, তোমাদের বলেছিলাম কি না, দুটির কাউকেই যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন একসঙ্গেই কেটেছে।’

আহা, এবার ভাষা শোনো। কেটে পড়াও শুনতে হল। পিছনে তেমনি হাসির তরঙ্গ। ইতিমধ্যে ঘেরা বাগানের ছোট দরজার কাছে গাড়ি থামে। একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের বারান্দার রোদে নীরেনদা আর সুপর্ণাদি বসেছিলেন। নীরেনদাই প্রথম ব্যস্তত্রস্ত হয়ে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করেন, ‘পেলেন?’

অচিনদা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলেন, ‘যাবে কোথায়?’

কেন, আমরা কি হারিয়ে গিয়েছিলাম, না পালিয়েছিলাম। নীরেনদা হাসেন। সুপর্ণাদিও বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসেন। ওরা তিন সখীতে নামে। আমিও নামি।

নীরেনদা আমার দিকে চেয়ে ডাকেন, ‘আসুন।’

অচিনদাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায় পেলেন?’

অচিনদা বলেন, ‘মাঝ পথেই।’

তাঁর বলার ধরনে নীরেনদা জোরে হেসে ওঠেন। সুপর্ণাদিও মুখে আঁচল চেপে হাসিতে কাঁপেন। ঝিনি বলে, ‘আমরা কোপাই দেখতে গেছলাম।’

আমি যোগ করি, ‘সেখানে গোপীদাসরাও ছিল দেখলাম। রান্নাবান্না করছিল।’

অচিনদা ভুরু তুলে বলেন, ‘ও, গাঁজাখোরগুলো সেখানে গেছে। তাই গোটা দলটাকেই সকাল থেকে দেখতে পাইনি।’

গাঁজাখোর! আসলে অচিনদা প্রেমেই বাজেন। ওঁর বাউল বন্ধুরা যে প্রেমের গাঁজা খায়। আমার হঠাৎ চোখ পড়ে রাধা লিলির দিকে। রাধা ডাকে, ‘আসুন, বসবেন।’

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন বুঝি? অনেক হয়রান হতে হয়েছে নিশ্চয়?’

প্রায় ক্ষমা চাইবার মতো করেই বলি। রাধা লিলি চোখাচোখি করে হাসে। লিলি গলা নামিয়ে বলে, ‘না, না, চিন্তা আমরা একটুও করিনি, খোঁজাখুঁজিও করিনি। আমরা বুঝতেই পেরেছিলাম, ঝিনি আর আপনি কোথাও গেছেন। আসলে, অচিনদাই মতলব দিলেন। বললেন, “চলো দুটোকে খুঁজে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসি”।’

নীরেনদার সঙ্গে অচিনদা বারান্দায় যান। আমরা কয়েকজন এক স্বর্ণচাঁপার ঝাড়ালো ছায়ায়। রাধা চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘তা বলে ভাববেন না যে, একটুও দুশ্চিন্তা হয়নি। শত হলেও আমাদের বন্ধুটি তো যুবতী।’

লিলি ঝিনিকে একবার দেখে যোগ দেয় ‘রূপসীও।’

‘এবং বিদুষী।’ রাধা জুড়ে দেয়।

ঝিনি ছোপ ধরা মুখে লজ্জিত নিচু স্বরে বলে, ‘যাঃ, কী সব বলছিস।’

সে কথায় কান না দিয়ে, রাধা আবার বলে, ‘আর আপনিও—।’

লিলি বলে ওঠে, ‘মেনীমুখো। অচিনদাই বললেন।’

রাধা—‘তায় যুবক।’

লিলি—‘এদেরই ভয় বেশি।’

রাধা—‘তাই একটু ভাবনা হবে বই কী!

সেই যে কথায় বলে, কোথায় খাপ খুলেছ। আমার সেই দশা। এখানে আবার মুখ খোলার সাহস করি আমি।

ঝিনি অমনি সাজানো স্বরে, হেসেই বলে, ‘কী রে, কী আরম্ভ করলি তোরা!’

তার আগেই, স্বর্ণচাঁপার তলায়, সখীদের গলায় হাসি বেজে ওঠে। বারান্দা থেকে অচিনদা বলেন, ‘রসের কেঁড়েটা সব ওখানেই সাবড়ে দিলে? আমাদের এক-আধ পাত্তর দাও।’

রাধা বলে, ‘শাসন করছি।’

অচিনদা বলেন, ‘অ, তাই এত হাসি। শাসন হচ্ছে কি না!’

রাধা প্রায় হুকুমের স্বরে ডাকে, ‘আসুন। একটু চা খেয়ে যান।’

আপাতত বিনা প্রতিবাদে যাওয়াই ভাল। সবাই মিলে বারান্দায় যাই। সুপর্ণাদি রান্না দেখতে চলে যান। আমি প্রায় ভয়ে ভয়ে বলি, ‘এত বেলায়, এখন না হয় চা থাকত।’

রাধা অমনি বলে ওঠে, ‘শুনেছেন অচিনদা, চায়ের বেলায় এত বেলা।’

অচিনদা বলেন, ‘হুম্‌, কোপাইয়ের ধারে নিয়ে যাও, সেখানে বেলা হয় না।’

নীরেনদা প্রায় ছেলেমানুষের মতো হেসে ওঠেন। কিন্তু অচিনদাই আবার ভিন সুর ধরেন, ‘তবে, এই বেলা দুটোয়, চা-টা থাক ভাই। ওটা ও-বেলার জন্যে তুলে রাখো। এখন তোমরা চান খাওয়া-দাওয়া করো।’

লিলি বলে, ‘না, খেয়ে যেতে হবে।’

অচিনদা ঘাড় নাড়েন, ‘উঁহু, এভাবে নয়। অন্য জায়গায় খাবার নষ্ট হবে। তবে এর কথা বলতে পারি না, দেখ যদি রেখে খাওয়াতে পারো।’

ঠেলার চোটে যেমন বাবা বলায়, তেমনি কথার চোটেই হাসি ঝরায়। আমার চোখ পড়ে যায় ঝিনির দিকে। তার চোখে সেই ইচ্ছা, থাকা-খাওয়ার নিমন্ত্রণ। আমি তাড়াতাড়ি বলি, ‘আমার বন্ধুদের কিছু বলে আসিনি। ও-বেলা আসব।’

অচিনদা বলে ওঠেন, ‘আরে সে তো আমরা না বললেও আসবে জানি।’

আবার হাসি। কিন্তু জানি, অচিনদাকে কিছু বোঝাতে পারব না। বিদায় নেবার আগে, একবার জিজ্ঞেস করি, ‘শুভেন্দুবাবুকে দেখতে পাচ্ছি না।’

নীরেনদা একটু বিরক্ত হতাশ সুরে বলেন, ‘ও ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে।’

ইচ্ছা না থাকলেও ঝিনির সঙ্গে আবার আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। তারপরে অচিনদার সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠি। রাধা লিলি ঝিনি সবাই বাগানের ছোট দরজার কাছে দাঁড়ায়। রাধা বলে ওঠে, ‘অচিনদা, ও-বেলা ওঁকে ধরে নিয়ে আসবেন।’

‘নিশ্চয়ই।’

ঝিনির চোখের দৃষ্টি কোনও কিছুই মানতে চায় না। গাড়ি এগিয়ে যায়। অচিনদা নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘জীবন মরণ পরশরতন কাচের সমান ভেল।’

বলে, একটু হাসেন। আবার বলেন, ‘ভাল-মন্দ জানিনে। নদী বহে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই ভাল লাগে।’

জানি, এ কথা কেন বলেন। কিন্তু বলতে পারি না, সে নদী যদি যাত্রীর পথ ভাসিয়ে দিতে চায়, তবে বড় বিড়ম্বনা।

অচিনদার গাড়ি এসে দাঁড়ায়, আমার বন্ধুর দরজায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *