৭৫.
আমি আমার সিগারেটের বাক্স বের করে অবধূতের দিকে এগিয়ে দিই। বলি, ‘নিন, সিগারেট খান।’
সদানন্দ গলায় বলে, ‘দাও। ইতে আমার কিছু হয় না, তবু একটুক টানি।’
সিগারেটটা ধরিয়ে আবার গান ধরে,
‘কালী তুই ভাবিস,
আমি তোর ছলনা বুঝি না।
ডাকিনীরে দিস আপন বেশ
তোর লজ্জা করে না।
ধন্দে ফেল্যে করিস খেলা
মনে ভাবিস জানি না,
এবার দেখ মাগি তোর ডাকিনীরে
খোলস ছেড়্যে করে কান্না।
গোপীদাস ‘জয় গুরু’ ধ্বনি দিয়ে ওঠে। কিন্তু লক্ষ যোগোমতীর দিকে। ওদিক থেকে যোগোমতীও পাশ ফিরে তার সঙ্গে চোখাচোখি করে। এখন যোগোর মুখে কেবল হাসির ছটা না—অমন যে দপ্দপানো মুখখানি, চোখ দুটি, তাও যেন লাজে লাজানো ব্রীড়ায় ভরা। সার্থক অবধূত। স্তুতি জানে বটে। নিজেই জানিয়ে দেয়, এলেকাটার ঘরে যে শক্তির বেশে এসেছিল, সে আসলে ডাকিনী। তার সঙ্গে অবধূতের কী সম্পর্ক। কালী এখন উপলক্ষ। গানের লক্ষ্য যোগোমতী। যে তার শক্তিস্বরূপিণী ভৈরবী।
কিন্তু গোপীসের ‘জয় গুরু’ শুনেই ব্রহ্মানন্দ হেঁকে ওঠে, ‘জয় গুরু লয় হে, জয় বল শালো।’
গোপীদাস হেসে বলে, ‘অই একই কথা। নামেতে কী যায় আসে।’
‘না বাবা, আমি তোমাদিগের উই নেড়া নেড়িতে নাই।’
গোপীদাস বলে, ‘থাইকবে ক্যানে। তুমি ভৈরব ভৈরবীতে থাকো।’
যোগোর ঘোমটার পাশে এলানো চুল। চুলের পাশে মুখ, আবার মুখ ফিরিয়ে গোপীদাসের দিকে চোখাচোখি করে। অবধূত আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কীসে আছ হে?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আমি?’
‘হঁ, ভৈরব ভৈরবীতে, না নেড়া নেড়িতে?’
জবাব দেয় গোপীদাস, ‘বাবাজি তো আর তোমার আমার মতন ভেক ধর্যা নাই। যেমন দেইখছ সিরকমই আছে।’
ব্রহ্মানন্দ বলে, ‘তব্যে মাগ ভাতারে আছে বল্য।’
গোপীদাসই দাড়ি দুলিয়ে বলে, ‘না গ।’
‘তব্যে?’
গোপীদাস চোখ ঢুলঢুল করে বলে, ‘নাম যাতে তাতেই দাও গা দাদা, সবাই যাতে আছে। বাবাজিও তাতেই আছে, বুইঝলে? বাবাজি প্রেমে আছে।’
প্রায় যেন ভয়ে ভয়েই উৎকর্ণ ছিলাম, কী না জানি বলে গোপীদাস। কথা শুনে অবাক খুশিতে তাকাই তার দিকে। কোন প্রেমের কথা বলে সে জানি না। প্রেমে আছি কী না, তাও জানি না। কিন্তু গোপীদাসের মনে এমন ভাবনা সহসা আসে কোথা থেকে। এমন কথা পায় কোথায়। এমন একটা জবাব তো মাথা কুটলেও নিজের ভাষায় খুঁজে পেতাম না।
গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে ঘাড় দোলায়। অবধূত ঝেঁজে বাজে, ‘ধু-র শালো, সব কথাতেই খালি প্রেম। তোমাদিগের উসব চালাকি। বাবাজির সাধন ভজন আছে কী না বল্য।’
‘ক্যানে থাইকবে না। বাবাজি প্রেম ভজে য্যা।’
‘শালা, আবার প্রেম?’
‘ক্যানে নয় গ। তোমার সাধন ভজনে প্রেম নাই? যোগোদিদির সাথে প্রেম না থাইকলে কি ভইজাতে পাইরতে?’
বলে চোখের ইশারায় আবার যোগোকে দেখিয়ে দেয়। অবধূত একেবারে বিগলিত হয়ে মোটা গলায় গলগলিয়ে হেসে ওঠে। বড় ভাল লেগেছে কথাটা। অবধূতের প্রাণ মাতানো কথা যেন। বলে, ‘শুইনলি গ ভৈরবী, শালো জয় গুরুওয়ালাটো বেজায় বদ।’
ভৈরবী কিন্তু চোখাচোখি করে গোপীদাসের সঙ্গেই। তারপরে পাতা গুটিয়ে উঠে পড়ে। খাওয়া হয়ে গিয়েছে তার। অবধূতের কথার কোনও জবাব দেয় না। তাতে কিছু যায় আসে না। ভৈরব চিৎকার করে গান ধরে দেয়,
‘মা তোরে পূজ্যে মন তুষ্ট হয় না।
ইবার পূজা ছেড়্যে পিছে ঘুইরব
খুঁজ্যে লিব ঠিকানা।’
যোগো ততক্ষণে ঘরের বাইরে। এঁটো পাতা ফেলে দিয়ে এসে হাঁড়িকুড়ি তুলে পেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। ইতিমধ্যে ঘরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাইরের সামান্য আলোয় এখনও সবই অস্পষ্ট দেখা যায়। এর পরে আর যাবে না। বাইরেও অন্ধকার ঘনিয়ে এল বলে।
যোগো দেশলাই জ্বালিয়ে মাটিতে গাঁথা ত্রিশূলের কাছে প্রদীপ জ্বালে। সিঁদুর-মাখা ত্রিশূল যেন নতুন রূপ পায়। সেই সঙ্গে নরমুণ্ডের কঙ্কালটিও। প্রদীপের কাঁপানো শীষে নরমুণ্ডও যেন কাঁপে।
গোপীদাস আমাকে ইশারা করে। বলে, ‘চলো বাবাজি, আমরা একটু ঘুর্যে বেড়্যে দেখ্যে আসি।’
সে উঠে দাঁড়ায়। আমিও। যোগো তাড়াতাড়ি ফিরে অবাক হয়ে বলে, ‘কুথাক গ?’
অবধূত বলে ওঠে, ‘আরে, তোমার বাবাজির সঙ্গে আলাপ করা হল্য না য্যা।’
গোপীদাস বলে, ‘হব্যে, হব্যে, চল্যে যেছি না তো। বাবাজিকে একটুক দেখিয়ে লিয়ে আসি, বাবার থানটো দেখুক ক্যানে।’
যোগো কাছে এসে আমার দিকে চেয়ে গোপীদাসকে বলে, ‘দেখ্য গোপীদাদা, যিখানে সিখানে লিয়ে যেইয়ো না। জায়গা ভাল না, ডাকিনীতে ঘাড় ভেঙ্যা দিবে।’
অবধূত তাড়াতাড়ি সায় দেয়, ‘হুঁ, খোব হোশিয়ার।’
যোগোর ভুরু কুঁচকে ওঠে। এক মুহূর্তের জন্যে। অর্থাৎ, তার কথায় তুমি অবধূত কেন কথা বলতে এস। এখনও আড়ির পালা চলছে না?
যাবার আগে যোগো আমাকে বলে, ‘দেখ্য বাবাজি, ইখানে চিতে মারার কল আছে।’
এবার আমিও জবাব দিই, ‘সাবধানে থাকব।’
যোগো আবার বলে ওঠে, ‘গোপীদাদা, ঠ্যাঙাবাবাকে দেখিয়ে লিয়ে এস ক্যানে।’
গোপীদাস বলে, ‘দেখাব।’
অবধূত অমনি বলে ওঠে, ‘হঁ, হঁ, তবে দূর থেক্যা, উ শালোকে বিশ্বাস নাই। হাত্যের কাছকে পেল্যে দিবে ক্যানে দুচ্চার ঘা।’
ব্যাপার বুঝতে পারি না। ঠ্যাঙাবাবা কে, দু’চার ঘা দেবেই বা কেন। কাকেই বা দেবে।
গোপীদাস শব্দ করে, ‘হঁ ,হঁ, জানি।’
‘রাতে খাব্যে, তো?’
যোগোর কথা শুনে গোপীদাস দাঁড়ায়। আমার দিকে তাকায়। আমি একবাক্যে অসম্মতি জানাই, ‘আমার দরকার নেই।’
‘আমারও নাই।’
অবধূত বলে, ‘কারুরই নাই।’
অতএব বেরিয়ে পড়া যায়।
বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে শীতের বাতাসও। হঠাৎ পশ্চিমা হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। বক্রেশ্বর গ্রামের আকাশে ক্ষীণ এক ফালি চাঁদ। প্রথমা না দ্বিতীয়া, কে জানে। পাশে এক নক্ষত্র। আরও কয়েকটি তারা অস্পষ্ট ঝিকিমিকি করে আকাশের কাছে ও দূরে। ঝিঁঝি ডাকে একটানা নানা বিচিত্র স্বরে। শিবমন্দিরগুলোর চেহারা বদলাতে থাকে। নিরেট কিম্ভূত স্থির কালো মূর্তির মতো দেখায়। জঙ্গলের ঝুপসি ঝাড় বাতাসে কাঁপে, দোলে, শব্দ ওঠে হায় হায়।
কয়েক পা অগ্রসর হতে না হতেই শিয়াল ডেকে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই যেন বক্রেশ্বরের রূপ বদলে যায়। দিনের আলোয় সে ছিল এক, রাত্রে আর-এক। দিনের আলোয় যাকে চিনেছিলাম, রাতের অন্ধকারে সে অচেনা। এখন মনে হয়, যা দেখেছিলাম তার চেয়ে অদেখাতেই বেশি রয়ে গিয়েছে। কী রয়েছে, তা জানি না। এখনও দেখতে পাই না। যা আছে তা যেন আমারই অনুভূতির গভীরে, দূরে অন্ধকারে।
গোপীদাস কোথা দিয়ে নিয়ে যায়, পথ চিনতে পারি না। সহসা এক মন্দির জেগে ওঠে অন্ধকারে। টিমটিম বাতির আলোয় দু-এক মানুষমূর্তি মন্দিরের সামনে। গোপীদাস বলে, ‘কালী মন্দির।’
একবার কাছে গিয়ে দেখি। নরমুণ্ডমালিনী ঘোর কৃষ্ণা ভয়ংকরী, লোলজিহ্বাবদনী, নগ্না চতুর্ভুজা। বক্রেশ্বরের কালো রাত্রির সকল অন্ধকার গায়ে নিয়ে এ যেন আর এক রূপ। বাইরে বেরিয়ে এসেই চোখে পড়ে দক্ষিণে আগুনের শিখা। কালো রাত্রির বুকে লাল আগুনের শিখা কেবল বাতাসে ঝাপটা খাওয়া উর্ধ্বমুখী না। নীচে তার অবিকল প্রতিবিম্ব দেখি পাপহরার নাতিশীতোষ্ণ জলে। চিতা জ্বলে, বক্রেশ্বর মহাশ্মশান। এ চিতা কখনও নেবে না।
দূর থেকে আগুনের আলোয় যাদের অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখি, কাছে যেতে যেতে তারা স্পষ্ট হয়। একটি না, তিনটি চিতা জ্বলে। যাদের চিতা জ্বলে তাদের যারা শেষ বিদায় দিতে এসেছে তাদের মধ্যে সব রকম মানুষ। গুচ্ছ গুচ্ছ হেথা হোথা ছড়ানো ছিটানো মেয়ে-পুরুষ। তার মধ্যে সব থেকে বেশি নজরে পড়ে দু-তিন বছরের শিশুকে বুকে জড়ানো একটি যুবতীকে। চোখে তার জল নেই, দৃষ্টি তার চিতার আগুনে। সেই আগুনের আলোয় এখনও তার এলো চুলের সিঁথায় অস্পষ্ট সিঁদুরের দাগ। মুছেও তুলতে পারেনি। কিন্তু হাত তার শূন্য। শাঁখা ভেঙেছে, নোয়া খুলেছে।
অবাক লাগে শিশুটির দিকে চেয়ে। সে আগুনের দিকে চেয়ে নেই। গায়ে মোটা কাঁথার মতো কী একটা জড়ানো। সে যুবতীর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। মনে করি যুবতী তার মা। মায়ের মুখের দিকেই সে অবুঝ অবাক চোখে চেয়ে রয়েছে।
একটি গুচ্ছের মধ্যে এক বৃদ্ধা কাঁদে বুক চাপড়ে চাপড়ে। কী যেন বলেও, বুঝতে পারি না। কে যেন সান্ত্বনা দেয়, ‘কাইন্লে কী হব্যে বল্য।’
তাতে কান্না বাড়ে। আর অবাক হয়ে শুনি শ্মশানরক্ষী, শ্মশানবাসী কালো এক ডোম পুরুষ বলে, ‘তা বইললে কি মন মানে। কেন্দ্যে লিক।’
অথচ মহাশ্মশানের অনির্বাণ চিতা সে প্রতিদিন জ্বালে। কান্না কিছুই ফিরিয়ে দেয় না, তার থেকে আর কে বেশি জানে। কিন্তু তারই আপত্তি নেই কান্নায়।
পাপহরার জলের কাছে কে এক গেরুয়াপরা মানুষ বসে। মাথার চুলে জটা। চিতার আগুনের দিকে চেয়ে বসে আছে। এক গেরুয়াধারিণী কপালে সিন্দূরচৰ্চিতা প্রৌঢ়া ত্রিশূল নিয়ে একদল শ্মশানবাসীর সঙ্গে বসে কী যেন বলছে। কেউ কেউ তার কথা শুনছে। এখানে-ওখানে ছাইগাদায় এলিয়ে পড়ে আছে কয়েকটা কুকুর। তাদের আধবোজা চোখের দৃষ্টি যেন চিতার আগুনের দিকে। ওদের কীসের আশা কে জানে!
দাঁড়িয়েছিলাম। কাঁধে স্পর্শ লাগতে ফিরে তাকাই। গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। বাতাসে ঝাপটা খায় তার দাড়ি। বলে, ‘চলো, আর একটুক ঘুর্যে আসি।’
সে আমাকে টানে। পুব দিকে নিয়ে যায়। স্নানের সময় দুপুরে দেখেছিলাম অঘোরী বাবার আশ্রম। সামনে খোলা কুঁড়েঘরের মতো একটি ঠাঁই। তার মধ্যে টিমটিম করে আলো জ্বলে। সেই অস্পষ্ট আলোয় চোখ ফিরিয়ে সেই অশ্বত্থের গোড়ার দিকে তাকাই। স্তূপীকৃত নরমুণ্ডের কঙ্কাল। যেন দলা পাকিয়ে ভিড় করে আছে অনেকগুলো মুখ। তাদের মুখে মাংস নেই, চামড়া নেই, কোনও অভিব্যক্তি নেই। অথচ চোখের কালো গর্তে যেন দৃষ্টি আছে। যেন এদের নিষ্প্রাণ মৃত কঙ্কাল বলে মনে হয় না। নির্নিমেষ তাদের দৃষ্টি, কিন্তু ভয়ংকর বীভৎস লাগে না। বরং, কাছে থেকেও তারা যেন কোন দূর ওপার থেকে ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে আছে।
এরা কারা কে জানে। কেন পুড়ে ছাই হয়নি তাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয় না। এরা কে নারী, কে পুরুষ, কিছু লেখা নেই। নাম-ধাম পরিচয় কিছু ছিল একদা। এখন এক পরিচয়, কঙ্কালের মুণ্ড।
কুঁড়েতে টিমটিম বাতি, বাইরে অন্ধকার। গাছের আঁধার কোলে কঙ্কাল করোটি। সহসা জোনাকি জ্বলে চিকচিক। পাপহরার জলে ঈষৎ চঞ্চলতা। বাতাসের ঝাপটায় কাঁপে। তাই যেন জলের গায়ে ঝিকিমিকি দেখা যায়। একেবারে স্থির থাকলে দেখা যেত না। ওপারে গাছপালা মন্দির। সর্বোচ্চ বক্রেশ্বর চূড়া। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি। আমি কী মানি বা না-মানি তার চেয়ে বড় আমার সমগ্র চেতনা জুড়ে যেন এক অস্পষ্ট অচিন ঘোর জীবনেরই। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমি যেন কোন এক লোকে, কোন এক দূর কালে দাঁড়িয়ে আছি। যে কালের হিসাব পিছনে ফিরে পাই না। সামনে তাকিয়েও অথই পারাবার। আমি নিজেও আমার এই অনুভূতিকে চিনি না।
এ সময়ে কার ভারী মোটা গলা শোনা যায়, ‘কে উখানে?’
গোপীদাস জবাব দেয়, ‘চিনতে লাইরবে গ, আমি গোপীদাস।’
কোথা থেকে জিজ্ঞাসা আসে টের পাই না। দিক অনুমান হয় পুবে। দক্ষিণে এক পাকা বাড়ি। দিনেও দেখেছি। রাত্রে তার কোথাও আলো নেই, ইমারতের অবয়ব মাত্র। এখানে এই পরিবেশে বাড়িটা যেন বেমানান অপরিচিত। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না কার ঘর, কার বসত।
গোপীদাস ডাকে, ‘এইস বাবাজি। আমার হাত ধর্যে এইস।’
সে নিজেই আমার হাত ধরে। পাপহরার ধার দিয়ে আরও পুবে নিয়ে যায়। ছোট ছোট গাছপালা জঙ্গল, ফাঁকা ফাঁকা লাগে চারদিক। তবু তার মধ্যেই মানুষের অস্পষ্ট অস্ফুট সাড়া পাওয়া যায়। বাতির ক্ষীণ রেশ চোখে পড়ে।
কিছু দূর যাবার পরেই পুরুষের তীক্ষ্ণ তীব্র চিৎকারে আর গালাগালিতে শ্রবণ যেন জ্বলে যায়, ‘শালো কুত্তার বাচ্চা…।’
বাকি কথা উচ্চারণ করা দায়। তারপরেই প্রচণ্ড মারের শব্দ। চটাপট থাপ্পড়, গুপ্ গুপ্ ঘুষি। শুনতে শুনতে ততক্ষণে একটা কুঁড়ের অদূরে দাঁড়িয়ে পড়েছি। সেখান থেকে অবাক সভয়ে দেখি, এক জটাওয়ালা নেংটি-পরা খালি-গা মানুষ একজনকে প্রহার করছে। যাকে করছে, সে উপুড় হয়ে পড়ে মার খাচ্ছে। তার কোনও আত্মরক্ষার চেষ্টা নেই, প্রতিবাদ নেই। কেবল একটা কান্নার শব্দ উঠছে অন্ধকারের মধ্যে। গোপীদাস বলে, ‘ঠ্যাঙাবাবা।’
জিজ্ঞেস করি, ‘মারছে কেন?’
‘ঠ্যাঙা বাবা য্যা। সবাই বলে, উনি যদি দয়া কর্যে মারেন, তব্যে জাইনবে উদ্ধার হল্যে। তব্যে জাইনবে, মনোবাঞ্ছা পূরণ হব্যে।’
কী ভীষণ বিপদের কথা! একজন জটাধারী ক্ষ্যাপা এই মারাত্মক বুলিতে গালাগাল দিয়ে এমন ভয়ংকর উত্তম-মধ্যম দিলে তবে উদ্ধার, পুণ্য, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ! প্রহারের বহর দেখে দূর থেকে আমারই গায়ের মধ্যে কেমন করে ওঠে। অথচ, যে মার খাচ্ছে, সে শুধু কাঁদে না। আমি তার আর্ত আকৃতি শুনি, ‘অই গ বাবা, মার, আমাকে মের্যে ফ্যাল গ, আমার পাপ ঘুচুক।’
এমন গভীর আর্ত আকূতি আর কখনও শুনিনি। কেবল একজনের গানের কথাই আমার মনে পড়ে যায়, “আরো আরো আরো, প্রভু আরো—এমনি করে আমায় মারো।”
এ লোকটার এত বিশ্বাস কোথা থেকে আসে। বিনামূল্যের শৌখিন বিশ্বাস না। আপন রক্তমাংস নিগ্রহের মূল্যে এ বিশ্বাস কেমন করে আসে। আমি তো ভাবতে পারি না। তার কান্নার মধ্যে দেহের কষ্ট ফোটে না। প্রাণের যন্ত্রণা জাগে। আমি তো কোনও দিনও পারব না। একজন জটাধারী নেংটি-পরা মানুষকে দূরের কথা, যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করি না, তিনি এলেও পারব কী না জানি না। অথচ এই মার খাওয়া মানুষকে কেবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকারের মানুষ ভেবে ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যাব, সে সাহস আমার নেই। আমি তা ভাবতে পারি না।
আর যে মারছে, সে যেন কী এক ভয়ংকর রুদ্ররাগে জ্বলে উঠছে। ভীষণ আক্রোশে পিটিয়ে মারছে। আমি যেন শারীরিক অস্বস্তিতে বলে উঠি, ‘কী আশ্চর্য, কতক্ষণ মারবে? মেরে ফেলবে নাকি লোকটাকে?’
গোপীদাস বলে, ‘না বাবাজি, মের্যে ফেইলবে না। সিরকম শুনি নাই কখনও।’
গোপীদাসের গলা শুনে বুঝতে পারি, মারের আঘাত যেন তার গায়েও লাগছে। তার গলার স্বর অস্পষ্ট, ভেজা ভেজা।
কুঁড়েটার কাছে আরও লোকজন রয়েছে। সামান্য একটা লম্ফর আলোয় চুপচাপ বসে থাকা মূর্তিগুলোকে যেন এই জগতের মানুষ বলে মনে হয় না। কিম্ভূত তাদের আকৃতি। মুখচোখ পরিষ্কার দেখা যায় না। দলা দলা অন্ধকারের মধ্যে তাদের কালো মূর্তির গায়ে মাঝে মাঝে লম্ফর আলো হিলহিলানো সাপের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে। আলো যেন ছুবলে ছুবলে খাচ্ছে। জটাধারী কুৎসিত গালাগালিতে চিৎকার করছে। তার মধ্যেই মেয়ে-গলায় কে যেন জয়ধ্বনি করে ওঠে, ‘জয় ঠ্যাঙাবাবা, জয় ঠ্যাঙাবাবা।’
ঠ্যাঙাবাবা! অদ্ভুত নাম। অদ্ভুত ঘটনা। এমন আশ্চর্য বিচিত্র ব্যাপার কি পৃথিবীর আর কোথাও ঘটে!
গোপীদাস বলে, ‘এতদিন খালি শুইনছি, ওয়াঁকে চখে দেখি নাই। এই পেখম দেইখলাম। শুইনেছি, বেশি দিন আসেন নাই, বেশি দিন থাকেন না কোথাও।’
প্রহারটা হঠাৎই থামে। ঠ্যাঙাবাবা যেন ক্লান্ত হয়ে সরে গিয়ে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। গালাগালও বন্ধ হয়ে যায়। মুখটা পাশ ফিরিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন।
গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘কাছে যেইয়ে দেইখবে বাবাজি?’
‘অ্যাঁ?’
শুনেই চমকাই। বলি, ‘কিন্তু যদি মারে?’
গোপীদাস আমার পিঠে হাত দেয়। বলে, ‘এখন আর মাইরবেন না। মার খাবার পিত্যেশে সবাই আসে। উনি সবাইকে মারেন না।’
তবু ভয়। তবু কৌতূহলও। পায়ে পায়ে যাই গোপীদাসের সঙ্গে। দরজা বলে কিছু নেই। সামনে বেড়াও নেই। কোনওরকমে একটা বেড়া ঘিরে মাথায় আচ্ছাদন করা হয়েছে। সামনে বসে থাকা লোকগুলো সবাই একসঙ্গে আমাদের দিকে ফিরে তাকায়। চোখে তাদের বিস্ময়ের থেকে অনুসন্ধিৎসাই বেশি। চোখে জিজ্ঞাসা, এরা আবার কী চায়!
এদের মধ্যে দু’জন স্ত্রীলোকও রয়েছে। একজন আমাদের দেখে আবার নিচু হয়ে কী যেন করতে থাকে। লক্ষ করলে দেখা যায়, গাঁজার ছিলিম তৈরি হচ্ছে। আলো-অন্ধকারে দোলানো কাঁপানো ছায়া-ছায়া মানুষগুলো যেন বিষণ্ণ। কী একটা আর্তভাব যেন তাদের মুখে। সকলেই এরা মার খেতে এসেছে। সকলেই এরা উদ্ধারের আশায় বসে। গভীর বিশ্বাসেই তারা বিষণ্ণ, আর্ত। মার-খাওয়া মানুষটি তখনও পড়ে আছে। ফুলে ফুলে কাঁদছে। ঠ্যাঙাবাবা আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। কাছে থেকে দেখে মনে হয়, মানুষটির খাড়া তীক্ষ্ণ নাক। চোখ দুটি বড়। মুখখানা একদা যেন সুন্দরই ছিল। মুখে কোনও প্রসন্নতা নেই। এখন মনে হয়, রাগ বা ঘৃণাও নেই। যেন কীসের একটা যন্ত্রণার জ্বালা গভীর ভাবনায় স্থির চোখ, অথচ একটা কষ্টের ছাপ৷ কে ইনি? কেন মারেন? কেন এদের এত বিশ্বাস?
ধর্মাধর্ম জানি না, বুঝি না। ভাবি কত বৈচিত্র্য এই সংসারে। কত বিচিত্র মানুষ। এমন বিচিত্র দৃশ্য যে কোনওদিন দেখব, কয়েক মুহূর্ত আগেও ভাবিনি। আমার চলার পথের ধারে শেষ পর্যন্ত কেবল বুকের কাছে দু’ হাত জড়ো করে স্তব্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
আবার গায়ে স্পর্শ অনুভব করি। গোপীদাস বলে, ‘চলো বাবাজি, এইস।’
তার সঙ্গে পুবের দিকেই এগিয়ে যাই, দক্ষিণে বাঁক নিয়ে। গোপীদাস কথা বলে না। আমি কথা বলতে পারি না। মনে হয়, কথা সবই ফুরিয়েছে। রাস্তা ক্রমে ঢালুতে নেমে যায়। পায়ের নীচে পাথর অনুভূত হয়। তার সঙ্গে বালি। সামনের দিগন্ত অনেকখানি খোলা মনে হয়। প্রকৃতি অনেকখানি উদার, আকাশ বড় হয়ে ওঠে। দূরে নীচে একটি জলের রেখা দেখতে পাই। বক্রেশ্বর নদীর আর এক দিক। পশ্চিম থেকে বক্রেশ্বরের উত্তরে বেষ্টন করে নদী দক্ষিণে নেমে চলেছে।
সহসাই সামনে দেখি একটি পাতার ঘর। কাঠের আগুন জ্বলছে ঘরের সামনে। সেই আগুনের আলোয় দেখি, সম্পূর্ণ নগ্ন পুরুষ বসে আছে। চুপচাপ, নির্বিকার। যেন দূরান্তের প্রকৃতির দিকে চেয়ে রয়েছে। ঘরের মধ্যে অস্পষ্ট ছায়ার মতো এক মূর্তি। সে নারী না পুরুষ, বুঝতে পারি না।
.
৭৬.
আমি গোপীদাসের দিকে তাকাই। গোপীদাস আমার দিকে। একটু ঘাড় দুলিয়ে ইশারা করে। অপেক্ষা করতে বলে। নগ্ন পুরুষ আমাদের দিকে ফিরে তাকায় না। একে ধ্যানমগ্নতা বলি না। চোখ খোলা, দৃষ্টি দূরান্তে—অন্ধকারের কোথায় যেন। গায়ে ভস্ম মাখা। ঋজু শক্ত শরীর। রুদ্রাক্ষ বা কোনও কিছুরই মালা বালা একটিও নেই। সিঁদুর বা আর কিছুর রেখা টিকা নেই। চুল দাড়ি সকলই মুণ্ডিত। এমনই নির্বিকার নিশ্চল স্থির, মনে হয় ধাতব মূর্তি। অন্যথায়, যেমন গাছ, পাথর, মাটির ঢিবি, তেমনই প্রকৃতিরই আর এক অঙ্গ।
কিন্তু শীত বলেও কি কিছু নেই! পশ্চিমা বাতাসের তীক্ষ প্রখর ঝাপটাও কি একটু কাতর করে না। দূর অন্ধকারের প্রকৃতিতে কী রূপ দেখে এমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য! যেন এই জগতে নেই। যেন জগৎ পারাবারের ওপারে অলক্ষ্যে চলে কীসের লেনাদেনা। তুমি আমি নেই সেথায়।
ঘরের ভিতর থেকে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে। একটি পুরুষ। অল্প অল্প চুল দাড়ি আছে। তারও দেখি, আমাদের দিকে নজর নেই। সামনে এসে জ্বলন্ত কাঠ খুঁচিয়ে আগুন উসকে দেয়। দিয়ে সেখানেই বসে। কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই। ঝুপসি ঝড়ে বাতাসের ঝাপটা। ঝিঁঝির ডাক। অরণ্যের অধিবাসীদের কাছে শুনেছিলাম, ঝিঁঝি কাঁদে।
গোপীদাস সহসা বসে পড়ে প্রণাম করে। নগ্ন পুরুষ সেই সময় মুখ ফেরায়। গোপীদাসের দিকে চায়। ভেবেছিলাম মানুষটি মৌন। কিন্তু এখন তার গলার স্বরও শুনি, ‘একখান গান শুনিয়ে যাও।’
সে আমার দিকে ফিরে তাকায় না। কিন্তু তার চোখ দুটি যেন ভাসা ভাসা ভেজা ভেজা। দৃষ্টি গভীর। মুখে হাসি নেই, অথচ কী এক অনির্বচনীয় ভাব। তীব্রতা নেই, তীক্ষ্ণতা নেই, ঝিলিক ঝলক নেই। মাধুর্য গাম্ভীর্য গভীরতা স্নিগ্ধতা সব মিলিয়ে একেবারে অন্যরকম। গলার স্বরটিও সেইরকম। যেন মুগ্ধতায় গভীর। মহাশ্মশানবাসীর আর এক রূপ।
গোপীদাসের দেখি আর এক রূপ। যেন তার সারা শরীরে তরঙ্গ খেলে যায়। চোখে নতুন জ্যোতি। বুড়া লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। হাতজোড় করেই বলে, ‘জয়গুরু জয়গুরু, এত কিরপা কইরলে গ।’
তারপরে গান তো না, যেন গানের সুরে ভাঙা গলায় হাত নেড়ে নেড়ে নগ্ন পুরুষকে জিজ্ঞেস করে,
‘মনের মানুষ খুঁইজলে কোথা মিলে?
আমি (আমি গ আমি আমি) আমি
দুখের দুখী দেইখতে পাই না,
আত্মসুখী সক্কলে।
বল, খুঁইজলে কোথা মিলে?’
নগ্ন পুরুষ মাথা ঝাঁকায়, আপন মনে ঘাড় নাড়ে। গোপীদাস তার দিকে দু’পা এগিয়ে নিচু হয়ে বলে, ‘বইলবে গ, কোথা মিলে?’
গোপীদাসের বুড়া চোখ ছলছলায়। নগ্ন পুরুষ বলে, ‘খুঁইজতে খুঁইজতে।’
গোপীদাস চোখ বুজে ঘাড় নাড়ে। নিজের বুকে ঠুকে গায়,
‘কিন্তুন আপগরজী ভাব জান্যে না
গরজে সদাই চল্যে
গরজ পেল্যে গরজ কথা
কইবে গ হেস্যে খেল্যে।
(বল্য বল্য বল্য গ, পায়ে ধরি বল্য)
খুঁইজলে কোথা মিলে।’
একতারা দোতারা বাঁয়া ডুপ্কি কিছু নেই। তবু যেন মনে হয়, গোপীদাসের ঘড়ঘড়ে গলায় এমন চাপা নিচু মিঠে সুর আর শুনিনি। এমন আত্মভোলা মগ্ন রূপও দেখিনি। নগ্ন পুরুষের শরীরেও যেন কীসের তরঙ্গ লাগে। যেন মধু পানে গোলাপি নেশার আমেজে চোখ ঢুলুঢুলু। আবার বলে, ‘খুঁইজতে খুঁইজতে।’
গোপীদাসের চোখ টলটলিয়ে দাড়ি ভিজে যায়। তেমনই ঘাড় নাড়ে। গায়,
‘কিন্তুন খুঁইজ কী বল্যে
পরোয়ানা হারিয়ে গেল্যে।
(কাছারির পরোয়ানাটো হারিয়ে ফেইলছি যে গ।
তল্লাশ কইরব কী দিয়ে?)
এখন পইড়েছি মায়াজালে
কত দোষ কইরেছি আমি
শ্রীগুরুর চরণ তল্যে।
বল খুঁইজব কী ছল্যে।’
নগ্ন পুরুষের শরীর হঠাৎ কেঁপে কেঁপে ওঠে। মুখভরা হাসি, চোখ ফেটে জল পড়ে। হাসে না ফুঁপিয়ে কাঁদে, বুঝি না। হঠাৎ দিগম্বর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায়। বুড়া বাউল সেই হাতে গিয়ে ঝাঁপ খেয়ে আলিঙ্গন নেয়। দুহুঁ দোঁহা জড়ানো জড়িয়ে দোলে। এ ওর কাঁধে মাথা রাখে, হাসে না কাঁদে এখনও বুঝি না। দিগম্বর বলে, ‘সবই খুঁইজতে খুঁইজতে মিলে। হারানোটাও মিলে।’
এভাবের নাম কী, আমি জানি না। কীসের ভাব তাও জানি না। ছাইভস্ম মাখা এক দিগম্বর পুরুষ, এই একটু আগেও স্থির। যেন এই জগতে নেই, এখানে দেহ রেখে ভিন জগতে কী করছিল। তারপরেই দেখ, কোথা থেকে কথা আসে। গান জাগে। চোখের জল গলে। শরীরে শরীরে হিল্লোলিয়া যায় তরঙ্গ। ল্যাংটায় জড়ায় গেরুয়া আলখাল্লা ধরে।
যেন মুহূর্তেই কি ঘটে যায়। যখন ঘটে, তখন বোধ হয় এমনি করেই ঘটে। আমি বুঝি না কিছু, কিন্তু দু’জনের আলিঙ্গন, হাসি-কান্না, সবই আমার ভিতরেও যেন কীসের স্রোত বহিয়ে দেয়। তার কুলুকুলু নাদ শুনি। অর্থ বুঝি না। শ্মশানের চারদিকে অন্ধকার—আগুনের আলোয় কী এক বিস্ময়কর গভীর মানবলীলা।
দৃশ্যের পর দৃশ্য। ব্রহ্মানন্দ অবধূত ভৈরবী যোগোমতী শ্মশানের চিতা অঘোরী আশ্রমের নরমুণ্ডের কঙ্কাল, মুক্তির প্রহার, ভাবের আলিঙ্গন। যেন সুর থেকে অন্য সুরে, তাল থেকে অন্য তালে। বিচিত্র রাগিণীতে ফিরি।
যে ঘর থেকে এসে আগুন উসকে দিয়েছিল সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে এই দৃশ্য দেখে। তার চোখও জলে টলমল।
এক সময়ে দু’জনেই শান্ত হয়। দু’জনেই বসে। দু’জনেই চুপচাপ। আমি ভাবি, হঠাৎ কেমন করেই বা গানের কথা এল। গান শুনতে শুনতে এমন ভাবের উদয়ই বা হল কেমন করে। দু’জনের চিন পরিচয় আছে বলে, গোপীদাসের মুখে শুনিনি। এই নগ্ন পুরুষ কীসের সাধক, কোন পন্থী, কেমন তার সাধন পদ্ধতি, কিছুই জানি না।
নগ্ন পুরুষ চোখ বোজে। গোপীদাস বলে, ‘যাই বাবা।’
চোখ না খুলেই সে বলে, ‘এইস।’
গোপীদাস আমাকে ইশারা করে ডাকে। আগুনের আলো পেরিয়ে চারদিকেই অন্ধকার। এক ফালি চিকন চাঁদ এখন কোথায়, দেখতে পাই না। গোপীদাস আমার হাত ধরে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ইনি কে?’
গোপীদাসের গলায় এখনও ভাবের রেশ। ভেজা ভেজা মুগ্ধতা। বলে, ‘জানি না বাবাজি, দেখি নাই কোনওদিন। এ তীর্থক্ষেত্তরে কত সোময় কত মহাপুরুষ আইসেন। কিছুদিন থাকেন, আবার চল্যে যান। এয়াঁকে আর দেখি নাই, তোমার ভাগ্যে দেইখতে পেল্যেম বাবাজি।’
অবাক হয়ে বলি, ‘আমার ভাগ্যে কেন?’
‘ক্যানে লয় বাবাজি। তুমি না এল্যে কি আসা হত্য। এয়াঁর মধ্যে শক্তি আছে, দেইখলেই মনে ল্যায়। এয়াঁর হইয়েছে, নিশ্চয় হইয়েছে, দেখ্যে বুইঝলে তো বাবাজি।’
কী হয়েছে, তা-ই বা জানব কেমন করে। জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে?’
‘সিদ্ধি গ, সিদ্ধি। চখ-মুখের ভাব দেইখলে না! উনি পেয়েছেন, খুঁইজতে খুঁইজতে পেইয়েছেন।’
‘কী পেয়েছেন?’
‘তা কি আমি জানি বাবাজি। কী পেল্যে সিদ্ধিলাভ হয়, পতিতে কি তা জাইনতে পারে!’
গোপীদাসের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সে চুপ করে পথ চলে। গভীর অন্ধকার আমার চারপাশে। ডাইনে বক্রেশ্বর নদী রেখে আমরা উত্তর বাঁকে চড়াইয়ে উঠতে থাকি। অন্ধের মতো চলি। অনুভূতিহীনের মতো শুনি। কী খোঁজে, কী পায়, কীসে সিদ্ধিলাভ ঘটে কিছুই জানি না। যে তার আপন খোঁজার নাম জানে না, হদিস পায় না, সে কেমন করে বুঝবে। তবু গোপীদাসের কথায় দিগম্বর মানুষটির মুখ আমার চোখে ভাসে। সংসারে অনেক দেখা মানুষের সঙ্গে সেই মুখের যেন অনেক অমিল। তার নির্বিকার নগ্নতা, স্নিগ্ধ দৃষ্টি, প্রসন্ন গম্ভীর মুখ, শিশুর মতো হাসি কান্না সব মিলিয়ে ভিন্ন! অন্য। খুঁজে ফিরে যে পায় তার রূপ কি এমনি? কে জানে। দীর্ঘশ্বাস সংক্রামক কিনা জানি না। অন্ধকার শ্মশান ও শিবক্ষেত্রের পথে আমারও দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আর ভাবি, কত বিচিত্র, কত বিচিত্ৰতর এই মানুষের লীলা!
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ইনি উলঙ্গ কেন?’
গোপীদাস বলে, ‘আমিও সি কথাটা ভাবি বাবাজি, উনি ল্যাংটা ক্যানে। আমি অঘোরীবাবাকে দেখ্যেছি। তিনিও ল্যাংটা ছিলেন। চুল দাড়ি ওয়াঁরও দেখি নাই। গায়ে যে কত কী মেখ্যে বস্যে থাইকতেন, অই গ, কোনও কিছুতে বিকার নাই। বাউলেরও বিকার থাইকতে নাই, তবে অঘোরীবাবা সব গায়ে মেখ্যে বইসে থাইকতেন। রস বিষ্ঠা সব। কারণবারি ছাড়া পান ছিল না। তাও বাবাজি কঙ্কালের খুলির খোলে। হাঁড়ির ভাত কঙ্কালের হাড় দিয়ে লাইড়তে দেখ্যেছি। গরম ভাতে ঘিয়ের মতন চিতার থেক্যে তুল্যে লিয়ে আসা মানুষের মাথার ঘিলুর ছিটা দিয়ে খেত্যে দেখেছি। আমি অঘোরীবাবার চুল দাড়ি দেখি নাই। কিন্তুন ওয়াঁকে দেইখলে ভয় লাইগতো, সামনে যেত্যে বুক কাঁইপতো। আবার এয়াঁর দেখ, অন্যরকম। এয়াঁরও চুল দাড়ি নাই, ছাইভস্ম মাখা ল্যাংটা মানুষ, এই ঠান্ডায় বাইরে বস্যে রইয়েছেন, ক্ষ্যাপা ভাবের কোনও লক্ষণ নাই। মুখখানি দেইখলে তো, যেন ভাবের লদী। আনন্দের ঢেল্খেল্ হছ্যে।…জয় গুরু। কার যে কী হয় জানি না।’
গোপীদাসও জানে না। সারা জীবন যার সাধনের সাধনায় গানের মন্ত্রে কেটে গেল, মানুষের আয়ুষ্কালের বিচারে যার সন্ধ্যা ঘনায় সেও জানে না। অচিনের পথ চলায় অন্ধকারের মানুষ, আমার তো কোথাও ক্ষীণ রেশও নেই।
গোপীদাসও জানে না। সারা জীবন যার সাধনের সাধনায় গানের মন্ত্রে কেটে গেল, মানুষের আয়ুষ্কালের বিচারে যার সন্ধ্যা ঘনায় সেও জানে না। অচিনের পথ চলায় অন্ধকারের মানুষ, আমার তো কোথাও ক্ষীণ রেশও নেই।
গোপীদাস আবার বলে, ‘তবে বাবাজি, অঘোরপন্থী হল্যেই যে সব একরকম হবে তা নয়। আমার গুরুকে দেখ্যেছি, তিনিও ক্ষ্যাপা ছিলেন। ওলঙ্গ হয়্যে হেস্যে কেন্দ্যে ফিরতে দেইখেছি। ধুলাবালি বিষ্ঠা গোবর, কোনও কিছুতে বিকার ছিল না। তবে সব সোময়ে লয়। যখন ক্ষ্যাপার দশা হইয়েছে তখন। উ যার হয় সি বোঝে। ক্যানে কিনা বাবাজি, ক্ষ্যাপা দশায় যখন গুরুকে দেখ্যেছি, তখন মনে হত্য কী যন্তন্নায় যেন জ্বইলছেন গ, যেন জ্বইলে পুড়ে মইরছেন। খুব দুঃখু লাইগলে, মানুষ যেমন হেস্যে ওঠে, তেমনি হেস্যে উইঠতেন। আবার চখ-মুখ পাকিয়ে একেবারে ডাক ছেড়ে হাঁক দিতেন, “তব্বে র্যা শালো, আমাকে তু ডুবাতে আইসছিস? আয় আয় ক্যানে।” বল্যে হাতে চ্যালা লিয়ে ছুইটতেন। কাকে যে মাইরতে যেত্যেন, দেইখতে পেত্যেম না।’…
বিচিত্র সেই জগতের, সেই মানুষদের কথা কিছুই বুঝি না। অঘোরীবাবা, গোপীদাসের গুরু, সদ্য দেখে আসা নগ্ন ভাবানন্দ পুরুষ। লোভ আর আকাঙক্ষার পাপেই জীবন কাটে, তাই ভয় ফেরে আমার ভিতরে ছায়ার মতো। ক্ষ্যাপার কথা জানি কেবল আপন ভোগের বঞ্চনায়। অবিচারে যদি বা ক্ষিপ্ত হয়েছি, তা আমাকে সিদ্ধিলাভের মুক্তি দেয়নি। তাই ভিন জগতের, ভিন কথায়, কেবল অবাক মানি। মানুষের অপার রহস্যের অন্ধকারে চোখ উদ্দীপ্ত করে চেয়ে থাকে।
অন্ধকারে সব ঠিক ঠাহর পাই না। মস্ত বড় এক গাছ। তার নিবিড় ঘন অন্ধকার তলে গোপীদাস দাঁড়ায়। কাছেই ঘর দেখা যায়। বাতি জ্বলে ঘরে, ফোকরে ফাকরে টের পাওয়া যায়। মানুষের অস্পষ্ট কথাবার্তাও শোনা যায়। অল্প একটু আগুনের শিখাও একপাশে লক্ষ পড়ে।
গোপীদাস বলে, ‘উটি মৌনীবাবার আশ্রম। ইটি হল অক্ষয় বট।’
অক্ষয় বট নাম শুনলেই কল্পনার রূপ যায় বদলে। প্রয়াগের কথা মনে পড়ে যায়। এলাহাবাদের কেল্লার সীমানায় মাটির গর্ভে অক্ষয় বট নামে এক গাছের ডালের প্রদর্শনী হয় কুম্ভমেলার সময়ে। সেখানে ধূপদীপ জ্বলে, পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করে। দর্শনার্থী আর বট স্পর্শকামীরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। পয়সা দিয়ে চলে আসে।
কিন্তু এক সত্যান্বেষীর সাহায্যে আসল বটের চিহ্ন দেখেছিলাম, দূর্গের নিষিদ্ধ অন্য প্রান্তে। অতীত ইলাহাবাদের সেলিমের প্রাচীন প্রাসাদের ধারে। যেখানে দুর্গের প্রাকার-নীচে গঙ্গা বহে যায়। সেইখানে ছিল সেই অক্ষয় বট। যে বৃক্ষ উঠে একদা গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অনেকে প্রাণ বিসর্জন দিত। সেই তাদের পুণ্য। তাদের মুক্তি।
এখানেও দেখি এক অক্ষয় বট। যার অন্ধকার ঝুপসিতে জ্বলে জোনাকি মিটিমিটি। এই বটের তলাতেও আগুন জ্বলে। দুই তিন মানুষের অস্তিত্ব এখানে। সাধু না সংসারী কে জানে!
পথ পশ্চিমে চলে। গাছপালা শিব মন্দির মিলিয়ে অন্ধকার যেন অন্য রূপের নিবিড়তা পায়। অন্ধকারে বক্রেশ্বরের মন্দিরের চূড়া দেখে চিনতে পারি। প্রদক্ষিণের পর মন্দির এখন দক্ষিণের আকাশে।
তারপরেই ব্রহ্মানন্দ অবধূতাশ্রম দেখেই চিনতে পারি। উত্তর দিকের বাগান ঘুরে দক্ষিণ দরজায় যখন আসি, তখন ব্রহ্মানন্দর গলা শুনতে পাই, ‘একটু পেসাদ কর্যে দে ভৈরবী। এত কষ্ট কর্যে মদ্না বিটা দিয়ে গেল, দে, একটুক পাদোদক কর্যে দে।’
জবাবে শুনি, ‘লাও, লাও, হইয়েছে। আমি আগুন কইরছি এখন।’
‘তা করিস ক্যানে, আগে একটুক পেসাদ কর্যে দে।’
যোগোর গলা আর শোনা যায় না। দরজা বন্ধ, ঘটনা দেখতে পাই না। কেবল গোপীদাস নিচু স্বরে বলে, ‘খোয়ারি চইলছে এখনও।’
তারপরে গলা তুলে আওয়াজ করে, ‘জয় গুরু।’
এক আওয়াজেই দরজা খুলে যায়। ব্রহ্মানন্দ অবধূত দরজা খুলে দেয়। টিমটিমে বাতি। সেই আলোয় দেখি মেঝেতে মস্ত বড় এক মাটির পাড় বসানো ঘরের উত্তর ঘেঁষে। কুয়োর ভিতরে মাটির যেমন পাড় বসায় সেই জিনিস। আধ হাত উঁচু তার গা। দু-হাত বৃত্তের ফাঁদ। তার মধ্যে মোটা মোটা শুকনো গাছের ডাল সাজানো হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে মেলাই ছোটখাটো কাঠের টুকরো।
পুবের বেড়া ঘেঁষে যেখানে ছেঁড়া চাটাই পাতা আছে, তার পাশেই ছোট এক মেটে কলসি। পাশে একটি নর করোটি। আমরা ঘরে ঢোকবার মূহূর্তেই যোগোকে দেখি, সে চাটাইয়ের সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে উঠে যায়। আঁচলটি তার মুখে চাপা এক হাত দিয়ে। সে গিয়ে বসে মাটির পাড়ের কাছে। কাঠ সাজিয়ে দিতে থাকে। কাঠ সাজাতে সাজাতেই উঠে এসেছিল বোধ হয়। কী যেন শুনছিলাম পেসাদ পাদোদক করে দেবার কথা। তা-ই করতেই উঠেছিল নাকি যোগো ঠাকরুন। কিন্তু কীসের পেসাদ, কীসের পাদোদক, কে জানে।
ব্রহ্মানন্দ ডেকে বসায়, ‘এইস, এইস। কুথাক ঘুইরলে?’
গোপীদাস বসতে বসতে বলে, ‘এই চাদ্দিকে একটো পাক দিয়ে এল্যেম।’
যোগো হঠাৎ উঠে দরজা খুলে বাইরে যায়। একটু পরেই আবার ফেরে। ছোট এক আঁটি খড় নিয়ে এসে কাউকে উদ্দেশ না করেই বলে, ‘দিয়াশলাই দাও।’
অবধূত গোপীদাস পাপহরার ওপারের গল্প বলে। আমিই উঠে দেশলাই এগিয়ে দিই। যোগো তখন আমার দিকে চায়। তার চোখ দুটো যেন কেমন চকচক করে। বলে, ‘বস্য।’
মাটির ওপরেই তার সামনে বসি। সে কাঠি জ্বেলে খড়ে লাগায়। খড়ের আগুন গুঁজে দেয় মাটির পাড়ের চারপাশে সাজানো শুকনো কাঠের মধ্যে। দেখতে দেখতে আগুন জ্বলে ওঠে। ঘরটা কাঁপানো আলোয় ভরে ওঠে।
সেই আলোয় দেখি যোগোমতীর কপালে মস্ত একটা টকটকে সিঁদুরের ফোঁটা। সিঁথিতেও দীর্ঘ রেখায় গাঢ় করে সিঁদুর টানা। পান চিবিয়েছে কি না ইতিমধ্যে কে জানে? ঠোঁট দুটো তা নইলে এত লাল হল কেমন করে? পা দু’খানি আলতায় রাঙানো। মুখে কি একটু রসেরও গন্ধ? আগুনের আলোয় তার কণ্ঠা আর বুকের উপরিভাগ যেন আরও রক্তাভ দেখায়। রুদ্রাক্ষের মালাটি কাপড়ের ওপর বুকে দুলছে।
‘কী দেইখছ?’
যোগো ঘাড় ফিরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে। আমি যেন চমকে উঠি। বলে উঠি, ‘না—হ্যাঁ মানে আপনাকে এখন অন্যরকম লাগছে।’
অবধূত মাটিতে ভর রেখে আগুনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ‘কী বাবাজি কী বইলছ হে?’
জবাবের প্রত্যাশা না করে ছোট লাল কলসি আর করোটি হাতে তুলে এগিয়ে নিয়ে আসে। ডেকে বলে, ‘কই হে গোপীদাস ইদিকে এইস৷’
গোপীদাস এগিয়ে আসে। ভৈরবীর এক পাশে বসে অবধূত। আর এক পাশে আমি। আমার পাশে গোপীদাস। তারপরেই হঠাৎ চমকে দেখি, আরও দুটি কালো কুচকুচে জীব ঘরের অন্ধকার থেকে এসে আগুনের সামনে উপস্থিত হয়। ঘন ঘন লেজ নাড়ে, পিট্পিট্ করে চায়। অবধূত হাত তুলে বলে, ‘বস্ হারামজাদিরা, কাছে এস্যে বস্।’
তৎক্ষণাৎ দুটিতেই একেবারে অবধূতের কোল ঘেঁষে এসে বসে। হাঁড়ির দিকে তাকায়। অবধূত বলে, ‘খাবি?’
দুই সারমেয়-বালা লেজ নাড়ে। অবধূত আদর করে হেসে বাজে, ‘হারামজাদি!’
যোগোকে জিজ্ঞেস করে, ‘পেসাদ কর্যেছ?’
যোগোমতী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। তারপরে আমার দিকে চেয়ে হাসে। অবধূত করোটি ডুবিয়ে কলসি থেকে একটু কারণ তুলে বাঁ হাতের গণ্ডূষে নেয়। কালো জীব দুটির মুখের সামনে এগিয়ে দেয়। দেখি, দুটিতেই চক চক করে চেটে খেয়ে নেয়। চমৎকার! এমন আজব দৃশ্য জীবনে কখনও দেখিনি। অপরাধ না হলে কারণকে যদি মদ বলি, তবে কুকুরকে কোনওদিন ও বস্তু খেতে দেখিনি।
যোগোমতী হঠাৎ বলে ওঠে, ‘চিতেবাবাজিকেও দাও।’
‘তুমি বইলবে তবে?’
করোটিতে মদ তুলে অবধূত আমার দিকে এগিয়ে দেয়, ‘এইস হে বাবাজি, লাও।’
আমি? কানে ভুল শুনিনি তো! শ্মশানের কারণবারি, তায় আবার নর করোটিতে! তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না, আমার দরকার নেই।’
‘দরকার নেই কী হে?’
প্রায় হুমকে ওঠে ভৈরব। বলে, ‘ধর, ধর।’
দেখি, যোগোমতী থরথরিয়ে কাঁপে। হাসিতে কাঁপে। চোখের ছটায় ঝিলিক হানে। গোপীদাস তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘থাক না বেহ্মালন্দদাদা, শরীল খারাপ-টারাপ কইরবে তা’পরে?’
‘আরে তু থাম দিকিনি বিটা বাউল। তোদিগের ত খালি গাঁজায় দম মাইরলেই হয়। আর প্রকৃতি ঠাকুরুন থাইকলেই হয়।’
গোপীদাস বলে ওঠে, ‘জয় গুরু।’
আমি তখন যোগোমতীর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে। জানি সে অগতির গতি। বক্রেশ্বরের যেমন মহিষমর্দিনী, শিবের শক্তি যেমন কালী, জগজ্জনের আশ্রয় জগদ্ধাত্রী, সে এখন আমার তেমনি।
তবু যোগো বলে, ‘একটুক দ্যাখ ক্যানে।’
হাতজোড় করে বলি, ‘পারব না।’
সদ্যপূর্ণ করোটি নামিয়ে রেখে অবধূত বলে, ‘ওহে শোন শোন, “মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রা মৈথুনমেব চ। মকারপঞ্চকঞ্চৈব মহাপাতকনাশনম্॥” বুইঝলে হে?’
মনে মনে বলি, তা বুঝেছি। মদ্য মাংস মৎস্য মুদ্রা মৈথুন পঞ্চমকারে মহাপাতক বিনাশিত হয়। কিন্তু সে তো সাধকের। আমাকে কেন। আবার বলি, ‘আমি সাধারণ মানুষ, আমার পাতক ঘোচবার নয়। আমাকে ছেড়ে দিন।’
‘অই অই বুঝ্যেছি হে, শহরে মদ খাব্যে মাংস খাব্যে, ব্যাশ্যাবাড়ি যাব্যে, সিটি পাইরবে, ইটি লাইরবে, আঁ?’
রীতিমতো আক্রমণ। কিন্তু জানি তর্কে যাওয়া বৃথা। তাই যোগোমতীর দিকেই বারে বারে চাই। যোগোমতীর এবার করুণা হয়। বলে, ‘বাবাজিকে উসব বইলছ ক্যানে গ। উ কি কথা, ছি। থাক, বইলছে যখন পাইরবে না, ছেড়্যে দাও।’
অবধূতের দ্বিতীয় কথা নেই। বাঁ হাতের মাঝখানে দুই আঙুল মুড়ে, তর্জনী, কনিষ্ঠা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে মাঝখানে কারণপূর্ণ করোটি স্থাপন করে। কী যেন বিড়বিড় করে। ডান হাত দিয়ে বুকের কাছ থেকে কল্পিত উপবীত টেনে নিয়ে স্পর্শ করে। তারপরে ভৈরবীর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে। যোগোমতীও অবধূতের দিকেই তাকিয়ে ছিল। অবধূত একবার ঘাড় নেড়ে সবটুক এক চুমুকে গলাধঃকরণ করে। একটু সময় চোখ বুজে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে স্থির হয়ে থাকে। তারপরে গলা খুলে গোঙানো স্বরে প্রথমেই বলে, ‘এ বাবাজিটোর মাথা খাইচ্ছে ই বিটা বাউল।’
গোপীদাসের সঙ্গে যোগোর চোখাচোখি হয়, দু’জনেই হাসে। আর অবধূত আমাকে বলে, “দ্যাখ ক্যানে বাবা যিখানেই থাকো, নারীর পূজা কইরবে। তবে জাইনবে, শক্তি ধারণ। ভৈরবী পেসাদ কর্যে দিয়েছে, তুমি পৰ্শ কইরলে না, এ খোব খারাপ!’
‘আচ্ছা হইয়েছে, উয়াকে আবার উ-সব কথা ক্যানে! বাবার যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে।’
যোগো ভুরু কুঁচকে বলে, আমার দিকে চেয়ে হাসে। এ আর এক বিচিত্র পরিবেশ। জীবনে কখনও যার সম্মুখীন হইনি।
.
৭৭.
তথাপি অবধূত থামতে রাজি না। করোটি পাত্রে আর এক দফা কারণবারি পান করে নেয়। অনুষ্ঠান আগের মতোই। বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ। উপবীত স্পর্শের কল্পনা। কপালে করোটি ঠেকিয়ে যোগোমতীর দিকে ফিরে বলে, ‘খাই গ মা।’
এক চুমুকে করোটি শূন্য করে সে আমার দিকে তাকায়। পলকহীন রক্তাভ চোখের দিকে চোখ রাখতে পারি না। ব্রহ্মানন্দ অবধূত আবার আমার দিকে এমন করে তাকায় কেন। অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নেবার আগেই, অবধূত অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে। আবার মিটিমিটি হাসে।
এবার কী রহস্য, কে জানে। আমার দিকে চোখ রেখেই যেন রহস্যোদঘাটনের সুরে ডাক দেয়, ‘মা।’
এই যেন যোগোমতীর নাম। সে স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘বল।’
‘ইয়ার মধ্যে একটো কী রকম ভাব আছে, দেখ্যেছিস?’
শোন এবার নতুন কথা। কার মধ্যে আবার কী ভাব আবিষ্কার করে অবধূত! দেখি, যোগো দৃষ্টি চালাচালি করে গোপীদাসের সঙ্গে। ঠোঁটের কোণে হেসে, আমার দিকে চেয়ে জবাব দেয়, ‘বাবার লজর এতক্ষণে পইল্ল? আমি তো পেখম থেক্যাই লজর কইরছি।’
অবধূত ঘন ঘন ঘাড় দুলিয়ে বলে, ‘করবি বই কী মা, তোর চখে ত ফাঁকি যাবার নয়।’
কী ব্যাজ দেখ দেখি। তিনজনেরই দৃষ্টি একজনের দিকে। অবধূত আবার বলে, ‘লজর দেখ্যাছিস, যেন ধ্যানে রইয়েছে। বিটার জোর আছে খোব। ক্ষেইপলে গুণ জ্ঞান থাইকবে না, সিরকম ভাব!’
গোপীদাস বলে ওঠে, ‘অই, অই জন্যেই তো চিতেবাবাজি নাম দিইচি গ।’
অবধূত ধমকে ওঠে, “আ রে ধুর শালো তোর চিতেবাবাজি। এ মাল ভিন্ন গোত্তরের। দেইখছিস না, কোনওদিকে লজর নাই, এক বগ্গা ছুইটছে। কোথাক কী এল্য গেল্য, এ বিটার কাঁচকলাটো।’
গোপীদাস অমনি ঘাড় দুলিয়ে, দাড়ি নাড়িয়ে আওয়াজ দেয়, ‘লদীর মতন, বল্য ক্যানে গ বেহ্মালন্দদাদা। উ তো আমি আগেই বইলেছি। বাবাজি আপন মনে বইছে।’
অবধূতের আবার ধমক, ‘তোর বাবার বাবাজি। খালি বাবাজি বাবাজি কইরছে শালোর বাউল।’
যোগো আর গোপীদাস চোখে চোখে হাসে। আর আমি ভাবি, এ কি বিব্রত করার ধরন। বিরক্তিকরও বটে। শুনতে ইচ্ছা করে না। এদের মুখের ভাব দেখতে ইচ্ছা করে না। এরা থাকে থাকে, বেশ থাকে। হঠাৎ কোথায় গোলমাল লাগে, এদের কাছে থাকা দায়। তখন এদের সামনে, নিজেকে নিয়ে নিজের গোল লাগে। এদের কাছে, নিজের কথা শুনতে ইচ্ছা করে না। কারণ, এদের দেখা, এদের ভাব, এদের কথা, সবই আলাদা। আমি বলি, ‘সে কথা এখন থাক।’
তোমার কথা কানে গেলে তো। যারা নিজের ভাবে বিভোর, তারা নিজের কথাই বলে। গোপীদাস বলে অবধূতকে, ‘তা হল্যে, তুমিই বলো।’
‘বইলব, বইলব বই কী। উয়ার ভক্তির জোরটো দেখ্যাছিস। দ্যাখ তোরা ভাল কর্যে, বিটা পদে পদে মার খায়, অপমান হয়, তবু টলাতে লাইরছে।’
কে মারে আমাকে। কে অপমান করে। আমার কথা আমি জানি না। আমার মুখের দিকে চেয়ে বলে শ্মশানবাসী অবধূত। আমার ভক্তিই বা কীসে, তার আবার জোরই বা কী। এ সবই যেন এক আত্মসম্মোহিতের কথা। আমার কথা কিছু না। তবু কথা বলতে পারি না, চুপ করে থাকি। কেন বলে, কোথা থেকেই বা আসে এসব কথা, কে জানে। হাসতে পারলে, খুশি হই। হাসতেও পারি না। অথচ কৌতূহলও বোধ করি না। বিব্রত অস্বস্তিতেই চুপ করে থাকি। কেবল যোগো আমার চোখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। গোপীদাসও তা-ই।
অবধূত আমার ঘাড়ে হাত রাখে। এই সে আমাকে প্রথম স্পর্শ করে। গরম মস্ত বড় হাতের পাঞ্জাখানি ভারীও তেমনি। একটু ঝাঁকানি দিয়ে বলে, ‘ভাল, ভাল।’
বলে, হঠাৎ হাসতে হাসতে যোগোর দিকে ফিরে বলে, ‘ই কি ভেব্যেছে জানিস মা। ই ভেব্যেছে, আমি বুঝি উয়ার ঈশ্বরভক্তির কথা বইলছি।’
আমার দিকে ফিরে বলে, ‘তা লয় হে বাবা, ভক্তির ভাব আলাদা জিনিস। উটো হল্য চষা জমির মতন। তা’পর তুমি উতে যা খুশি বীজ ছড়াও যেইয়ে, ফইলবার ধন ফইলবে, বুইঝলে? সিটি তোমার আছে।’
ভক্তিরূপের এমন ব্যাখ্যা আর শুনিনি। আমার তা আছে কি না আছে, জানি না। কথাটা মন্দ লাগে না শুনতে। গোপীদাস বলে ওঠে, ‘জয় গুরু, খাঁটি বইলেছ গ অবধূতদাদা।’
অবধূতের সে খেয়াল নেই। আবার করোটি পাত্র পূর্ণ, যথানিয়মে পান। পানের পর, আবার আমাকেই বলে, ‘ভাল লাইগল বাবা তোকে। মরবি বিটা, তোর শান্তি নাই। আয়, তোর সঙ্গে কথা কই দুটো। শব না হল্যে শব সাধন হয় না, জানিস তো বাবা। তুই না হল্যে মনের কথা হবেক নাই।’
গোপীদাস আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু।’ যোগোমতী নিষ্পলক চেয়ে থাকে আমার দিকে। সে যেন আমাকে সম্মোহন করতে থাকে।
অবধূত বলে, ‘কারণ খাস নাই। নাই খাস। তবে বাবা, ভক্তি কর্যে, নারীর পূজা কইরবি। পাঁটার মতন পাঁটী পূজা না। বিটা যেমন মা পূজ্যে, মানুষ যেমন দেবী পূজ্যে, তেমনি। তবে হাঁ, খাঁটি নরে যেমন নারী পূজ্যে, সিটিও জাইনবি দেবী পূজার অঙ্গ।’
না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘এ কথা আমাকে বলছেন কেন। আমি সাধক নই, তন্ত্রমন্ত্রও আমার নেই।’
‘না থাইকল। কিন্তু তোর মন আছে, ধ্যান আছে, তা-ই তোকে বলি। তোর এই একটা ভাব আছে, নারী ছাড়া তোর দিন যাবে নাই। যিখানে যাবি, সিখানেই উয়ারা তোর কাছকে আইসবে। দ্যাখ বাবা, আমার কিছু হয় নাই। আমি ফোঁপরা ঢেঁকি, এখন শ্মশানের কুত্তা হয়্যেছি।’…
হঠাৎ যেন অবধূতের গলায় কথা আটকে যায়। বুকে কোথায় চোট লাগে। তা-ই নিজের বুকে একটা হাত চেপে ধরে। আর যোগোমতী যেন নিচু আর্তস্বরে ডেকে ওঠে, ‘অই গ বাবা!’
গোপীদাসের গলায় বাজে, ‘জয়গুরু!’
অবধূত বুকের থেকে হাত সরিয়ে, আবার করোটি কারণে পূর্ণ করে, সেইভাবেই পান করে। মুহূর্তেই যেন পরিবেশ বদলে যায়। অবধূতের চোখ কেবল রক্তবর্ণ না। যেন রক্ত ফেটে পড়তে গিয়েই, তার চোখ দুটি চিকচিক করে।
গোপীদাসের কথা আমার মনে পড়ে যায়। সে নিজেকে পতিত বাউল বলে, নিশ্বাস ফেলে চোখের জলে গলেছিল। এখন অবধূত বলছে, সে ফোঁপরা ঢেঁকি। শ্মশানের কুকুর হয়েছে। এ সময়ে, তার মুখের দিকে চেয়ে, আমারও যেন কোথায় একটা চমক লেগে যায়। তাকে অন্য মানুষ মনে হয়।
অবধূত চোখ আধবোজা করে, মোটা স্বরে বাজে, ‘নেশা, বাবা নেশা, ই য্যা দেইখছ কুকুর দুট্যে, ইয়াদের গাঁয়ে ঘরে পাটাও, যাবেক নাই। ইখানকার মড়া না খেল্যে, ইয়াদের পেট ভরে না, মৌতাত জমে না। সি রকম আমারও বট্যে, আমার আর উপায় নাই।’
যোগোমতী বলে ওঠে, ‘ইসব কথা ক্যানে বাবা, থাক না।’
অবধূত বলে, ‘না মা, ইয়াকে তাই বলি, তবু দেইখলে চিনতে পারি। বাবাকে দেখ্যে চিনতে পারি। তা বল্যে, তোকে কি আর তন্ত্রমতে পূজা কইরতে বইলছি? তা না, হেলাফেলা করিস না, যে বিটি যে ভাবেতেই আসুক, তাকে তুষ্ট কইরবি। তার মান রাইখবি, মন রাইখবি, তোর ভাল হব্যে। শক্তি বাইড়বে।’
এ সব কথার সত্য জানি না, মিথ্যা জানি না। তবু, আমার জীবনকালের পেরিয়ে আসা নানান পটে, নানা রং ভাসে। যে কথার অর্থ কিছুই বুঝি না, সে কথাই কেমন যেন ব্যঞ্জনাময় মনে হয়। চুপ করে তার কথা শুনি।
অবধূত তার নিজের বেগে ভাষে, আপন স্রোতেই কলকলায়, ‘কলিকালে তো বাবা বেদের সাধন নাই, তন্ত্রসাধনই বিধি। তা সি শক্তি সাধনা হল্য কই। যার হল্য, তার হল্য, আমার কিছু হল্য না। ধ্যান না থাকলে হয় না শাস্ত্রে বইলছে, সুরা হল্য শক্তি, মাংস হল্য শিব। শিব শক্তির ভক্ত হল্য ভৈরব। তিনে যদি মিল্যে, তবে মোক্ষের কারণ। কিন্তু মদে মাংসে বদ হজম কইরলাম, পচা ঢেকুর, মর্যা যেইছি বাবা।’
অবধূতের চোখের কোণে, রক্তের ফোঁটাই যেন বিন্দুর মতো চিকচিকিয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে যোগোমতীর আলতা পরা পা। যোগো সেই হাতখানি দু’ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ভৈরবীর চোখে যে এর আগে জল দেখিনি, মুখের বিমর্ষতা দেখিনি, তা না। কিন্তু এখন এ মুখ একেবারে আলাদা। এখন এ মুখে যেন গাঢ় অন্ধকার গভীর শোকের ছায়া। এখন দেখি যেন, এক আর্ত মানবী, এক অসহায় পুরুষের হাত ধরে। বলে, ‘এমন কর্যে বইলছ ক্যানে গ। আমার পাপ লাগে না?’
অবধূত বারে বারে মাথা নাড়ে। বলে, ‘না গ, না। তুমি যোগমায়া, মহামায়া। তোমার পাপ লাইগবে না। কিন্তু তুমি থাইকতে আমি পূজা কইরতে লাইরলাম। কুলস্ত্রী পেল্যেম, তবু আমার শক্তি পূজা হল্য না। কেবল অনাচার কর্যে বেড়াল্যেম।’
দূর তেপান্তরের বুকে টানা বাতাসে যেমন সুরহীন হা হা রব ওঠে, অবধূতের স্বর যেন তেমনি বাজে। কান্নার স্বর এক রকম। এ স্বর আর এক রকম, কান্নার থেকে গভীর, আরও ব্যাপ্ত কিছু। বুঝতে পারি না, এ কি কেবল নিষ্ফল সাধনের হাহাকার। নাকি, যোগোমতী ভৈরবীর কাছে, আপন কৃতকর্মের অনুতাপ। এলেকাটার ঘরে থেকে, যোগোকে দুঃখ দেওয়ার পাপ কি তার আপন ভাষায় বাজছে!
যোগো বলে, ‘ক্যানে মিছা বইলছ গ। আমি কি তোমার সি শক্তি?’
অবধূত ব্যগ্র ব্যাকুল স্বরে বলে, ‘অই গ, এমন কর্যে বলিস নাই। তার মধ্যে যা আছে, তার আর কারুর নাই।’
যোগো নিজের দু’ হাতে ধরা অবধূতের হাতখানি নিজের কপালে ছুঁইয়ে বলে, ‘তোমার পূজা যেন চিরকাল কর্যে যেত্যে পারি গ। যদি আমার কিছু থাকে, তা-ই যেন পারি।’
দেখে মনে হয়, তন্ত্রমন্ত্র সাধন আচরণ দূরে, দুই নরনারী হৃদ-সায়রের তরঙ্গে ভাসে। যদি সেইখানেতে দুয়ে মিলে একাকার হওয়া যায়, তবে সফল সাধন ঘটে। দুইয়ে যদি পরস্পরকে পূজতে পারে, তবেই সকল পূজার ফললাভ। এখন দেখ, কথা যাকে নিয়ে উঠেছিল, সে ভেসে গিয়েছে। গোপীদাসের চোখে আবেশ, বিভোর হয়ে দু’জনকে দেখছে। দু’জনায় আপনাতে মগ্ন।
একটু পরে, অবধূত আবার করোটি পূর্ণ করে পান করে। তারপরে কুলস্ত্রী ব্যাখ্যা করে। ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, রজকী, গোপবালা, কাপালী, নটবধূ, বেশ্যা, নরসুন্দরী, মালাকার-কন্যা—এই নয় প্রকার কুলস্ত্রী। শুনে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, এদের মধ্যে তন্তুবায় বধূর হিসাব তো নেই। কিন্তু তার জবাব দেয় অবধূত নিজেই ‘তবে হাঁ, সব থেক্যা সেরা কুলস্ত্রী জাইনবে সি-ই, যে “বিশেষবৈদগ্ধ্যযুতা সর্বা এব কুলাঙ্গনা।” পরপুরুষগামিনী বিদগ্ধা হল্যে, সি-ই কুলস্ত্রী হব্যে। তা বল্যে, পুরুষ ধর্যে ধর্যে শোয়ার বিষয় লয়। কুলাচারী, সি যি পুরুষই হোক, তার নামই পরপুরুষ। আর পূজাকালে সি পুরুষকে, “পূজাকালে চ দেবেটি বেশ্যেয় পরিতোষয়েৎ।” বেশ্যার মতন তাকে তুষ্ট কইরবে। কিন্তু পূজাকাল ছাড়া, তোমার চিন্তায় আর পুরুষ থাইকবে না, তব্যে হল্য কুলস্ত্রী।’
কুলাচারীর মতে, আগমোক্ত পতি শিবস্বরূপ, তিনিই গুরু। বিবাহিত পতি, পতি না। কুল পূজায়, স্বামী ত্যাগ করলেও নারীর দোষ নেই। এই কুলনারী সাক্ষাৎ কালীস্বরূপা।
এই কথা শেষ করেই, সহসা অবধূত ডাক দেয়, ‘মহামায়া!’
যোগোমতী উত্তর দেয়, ‘বলো।’
‘ষটচক্র বিষয়ে কথা বইলব তোমার সাথে।’
‘বলো।’
মুহূর্তেই যেন আবার পরিবেশ বদলায়। দু’জনেই, দু’জনের মুখোমুখি, সোজা হয়ে বসে। যোগোর কোলের ওপর দুই হাত জড়ো করা। ব্রহ্মানন্দর দুই হাঁটুর ওপরে দুই হাত। সে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, মেরুদণ্ডের দুই পাশে কী আছে?’
‘ইড়া পিঙ্গলা নাড়ি।’
‘তার ডাইনে বাঁয়ে?
‘সুষুম্না মগজ পয্যন্ত।’
‘সুষুম্নার মধ্যে আর কোন নাড়ি আছে?’
‘বজ্ৰাখ্যা।’
‘বজ্ৰাখ্যার মধ্যে?’
‘চিত্রিণী।’
‘সুষুম্না নাড়িতে আর কী আছে মা?’
‘সাত পদ্ম বাবা।’
‘কী কী?’
‘আধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, সহস্রদল।’
অবাক হয়ে শুনতে থাকি। যেন এক ঘোর লাগা চোখে, দু’জনের দিকে চেয়ে থাকি। বুঝি না কিছুই। ষটচক্র কী, দেহের মধ্যে এত বিচিত্র জটিল যন্ত্রই বা কী, কিছুই জানি না। তবু, আমার সামনে এক আশ্চর্য দৃশ্য। বিচিত্র সংলাপ শুনি অবোধ কৌতূহলে। সর্বোপরি, পরমবিস্ময় লাগে বাংলাদেশের কোন এক পাড়াগাঁয়ের, একটি তাঁতি বউয়ের মুখে এসব কথা শুনে। এ যোগোমতীকে এখন যেন আর চিনতে পারি না। তার গলার স্বর ভিন্ন। সে যেন অন্য জগৎ থেকে কথা বলে। দৃষ্টি স্থির, ধ্যানমগ্না, এক ধরনের সমাধিস্থ ভাব যেন। সিঁদুরের রক্তটিপসহ, এখন সে যেন ত্রিনয়নী দেবীপ্রতিমা। আমাদের কারুর প্রতিই তাদের লক্ষ নেই।
ব্রহ্মানন্দ আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আধার পদ্মে কয়টি দল আছে?’
যোগোমতী বলে, ‘চাইরটে। চাইর দল, চাইর বর্ণ, বং শং ষং সং। ই পদ্মে চৌকোণা ধরাচক্র আছে, উয়ার আট দিকে আট শূল। মধ্যখানেতে জগৎবীজ লং রইয়েছে, আর কর্ণিকার মধ্যে ত্রিকোণ যন্ত্র। ই পদ্মের মধ্যে মহাদেব রইয়েছেন লিঙ্গের রূপ ধর্যে। ওঁয়ার অমৃত গইলবার জায়গায় সাপিনীরূপ কুণ্ডলিনী শক্তি রইয়েছেন।’
‘জয় মা ধূমাবতী। স্বাধিষ্ঠান পদ্মের কথা শুনাও মা।’
‘স্বাধিষ্ঠান থাক্যেন লিঙ্গের মূলে। উয়ার ছয় দল, বং ভং মং যং রং লং ছয় বর্ণ। ই পদ্মের মাঝখানটোতে গোল বরুণ মণ্ডল, তার মধ্যে য্যে অদ্ধচন্দর রইয়েছে, তাতে বং বর্ণ আছে। ই পদ্মে বারুণী শক্তি থাক্যেন।’
যোগোমতীর গলায় যেন একটা আচ্ছন্নতা নেমে আসতে থাকে, সেই সঙ্গেই উচ্চারণের মধ্যে স্পষ্টতা লক্ষণীয়। ব্রহ্মানন্দ যত শোনে, ততই যেন সে কী এক আবেগে আপ্লুত হতে থাকে। গোপীদাসও ইতিমধ্যে একেবারে ধ্যানস্থ হয়ে পড়েছে। সে হাতজোড় করে, যেন পূজায় বসেছে।
অবধূত বলে ওঠে, ‘জয় মহামায়া। মনিপুরের কথা বলো।’
‘মনিপুর নাঁইকুণ্ডলের মূলে। উয়ার দশ দল, দশ বর্ণ, ডং ঢং ণং তং থং দং ধং নং পং ফং। ই পদ্মের মাঝখানটোতে ত্রিকোণা অগ্নিমণ্ডল উয়ার তিন দিক্যে তিনটো স্বস্তিকার ভূপুর। তার মধ্যে বং বর্ণ রইয়েছে। ই পদ্মে লাকিনী শক্তি বাস করেন।’
‘আর অনাহত?’
‘হিদে ইয়ার থান। বারো দল, বারো বর্ণ, কং খং গং ঘং ঙং চং ছং জং ঝং ঞং টং ঠং। ই পদ্মের ছয় কোণা বায়ুমণ্ডল, উয়ার ভিতর ষং বীজ রইয়েছে। ই পদ্মে শিব আর কাকিনী শক্তি থাক্যেন।’
‘জয় যোগমায়া! বিশুদ্ধ পদ্মের কথা বল গ।’
‘ই পদ্ম গলায় থাক্যে। ষোলো দল, ষোলো বর্ণ, অং আং ইং ঈং ঋং ঋৃং ৯ং ৯’ং এং ঐং ওং ঔং অং অঃ! ইয়ার মাঝখানটোতে গোল চাঁদের মণ্ডল, ভিতরে নভমণ্ডল আর হং বীজ রইয়েছে। ই পদ্মে শাজিনী শক্তি রইয়েছেন।’
ব্রহ্মানন্দর শরীর যেন উল্লাসে কাঁপে। হাঁকে, ‘জয় মা জগত্তারিণী। আজ্ঞা কোথাক মা?’
যোগোমতী তেমনি স্থির চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ক্যানে বাবা, আজ্ঞা দ্বিদল নামে থাক্যে ভুরুর মাঝখান্যে। উয়ার দুই দল, দুই বর্ণ, হং ক্ষং। মধ্যখানে, ত্রিকোণ শক্তি, শক্তির মধ্যে শিব। ই পদ্মে হাজিনী শক্তি রইয়েছেন। ইয়ার উপরেতেই পরমাতমা থাক্যেন। তার উপরে চন্দ্রবিন্দ্যু, চন্দ্রবিন্দ্যুর ওপরে শঙ্খিনী নাড়ি। সহস্র দল উয়ার উপরে।’
‘সিখানে কী আছে গ?’
‘গোল চাঁদের মণ্ডল, ত্রিকোণ যন্ত্র, মধ্যখানে পরম শিব।’
বলতে বলতে, যোগোমতীর শরীরেও যেন তরঙ্গের দোলা লাগে। তার চোখে মুখে ভাবের আবেশ। সে মাটিতে নত হয়ে, ব্রহ্মানন্দর পায়ে হাত দেয়। ব্রহ্মানন্দও নত হয়ে যোগোমতীর দু’হাত, নিজের হাতে নেয়। যেন সুখোল্লাসে ডেকে ওঠে, ‘জয় যোগমায়া, জয় মহামায়া।’
সে উঠে দাঁড়ায়। যোগোমতীকে টেনে তোলে। বলে, ‘চল ভৈরবী, একটুক ধ্যানে বসি যেইয়ে।’
‘চল।’
হাত ধরাধরি করে, ঘন স্পর্শে, দু’জনেই প্রোথিত ত্রিশূলের সামনে যায়। ত্রিশূলের দিকে মুখ করে, দু’জনেই জোড়াসনে স্থির হয়ে বসে। তাদের মুখ আর দেখতে পাই না। আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসেছে তারা। যোগোমতীর পিঠে ছড়ানো চুল। জামাহীন পিঠের একাংশ দেখা যায়। সামান্য আলোয়, দু’জনকেই অস্পষ্ট দেখি। মনে হয়, ঘরের মধ্যে থেকেও, তারা যেন আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। বেড়ার গায়ে তাকের ওপরে, কপালে সিঁদুর মাখানো নরমুণ্ডের কঙ্কালটি যেন, অল্প আলোতেই তার সাদা বর্ণে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চোখের শূন্য কোটরে যেন স্থির দৃষ্টি রয়েছে। কালো কুকুর দুটি দু’জনের কাছাকাছি গিয়ে এলিয়ে বসে। যা শুনেছি, তা এই মুহূর্তে আর স্মরণ করতে পারি না। কিন্তু সব মিলিয়ে, আমি আমার কথা ভুলে যাই। আমার বর্তমান, দেশকাল, জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা। যেন কোনও এক কালান্তরের ওপারে, বিস্ময়াবিষ্ট রহস্যের দ্বারে, আচ্ছন্ন হয়ে থাকি।
সত্য-মিথ্যার বিচার জানি না। মোক্ষ মুক্তির মূল্য বুঝি না। কিন্তু আমার এই সামান্য জীবনকালের স্রোতে, আমারই অপরিচয়ের দূর কাল এসে মেশে। সংসারে কত মানুষ, কত ধ্যান-ধারণা, কত তার বিচিত্র স্রোত নানা দিকে বহে। তার মাঝখানে আমি, আমার চলার পথের বাঁকে বাঁকে, কেবল জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকি।
গোপীদাসের ধ্যান ভাঙে। সে ওঠে, ঘরের এক পাশ থেকে আরও কাঠ এনে, দীর্ঘস্থায়ী আগুন তৈরি করে। তারপরে আমার কাঁধে হাত দিয়ে, নিচু গলায় বলে, ‘রাত্র অনেক হল্য বাবাজি, এবারে শুয়্যে পড়, এইস।’
আচ্ছন্নের মতোই, ছেঁড়া চাটাইয়ের ওপর গা এলিয়ে দিই। চোখ বুজি। আর আমার চোখের সামনে যেন আগুনের শিখা নাচতে থাকে। ঘরের আগুন, নাকি চিতার, কিছুই বুঝতে পারি না। একটুও শীত লাগে না। বাইরে ভিতরে, সবখানে নিঝুম স্তব্ধতা। কোথাও কোনও শব্দ নেই।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙে, তখন সোনালি রোদে চারদিক ভরা। পাখির ডাক শোনা যায়। গোপীদাস ব্রহ্মানন্দ, দু’জনের কেউই ঘরে নেই। আমার ঘুম ভাঙতেই প্রথমে দেখি যোগোমতীকে। বাগানের দিকে দরজা দিয়ে সে ঘরে ঢোকে। এখন আবার তার মুখ আলাদা। গতকাল রাত্রের সে ভাব নেই। দেখলেই বোঝা যায়, সে স্নান করেছে। হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘ঘুম ভাইঙল বাবাজির?’
দু’হাত দিয়ে মুখ মুছে তাড়াতাড়ি উঠে বসি। বলি, ‘হ্যাঁ। এরা সব কোথায়?’
‘সব যেইয়ে বাইরে রোদে বস্যেছে।’
আমার ভিতরে ভিতরে তাড়া। এবার আমাকে ফিরতে হবে। বাইরে গিয়ে গোপীদাসকে ডাকি। সেও বেরোবার জন্যে প্রস্তুত। যোগোমতী বালতিতে কুণ্ডের জল রেখেছিল। জল যেন তখনও গরম। তাড়াতাড়ি হাতে মুখে একটু জল দিয়ে নিই। ঝোলাটা কাঁধে নিতেই, যোগোমতী প্রায় ধমকে ওঠে, ‘দেখ হে, ছুট লাগল্চ্ছ য্যে। বস্য ক্যানে, একটুক চা মুড়ি খাও।’
চা মুড়ি! চমৎকার! এই শীতের সকালে, এমন প্রাপ্তি তো আশাই করতে পারিনি এখানে। যোগো একটা কলাইয়ের বাটিতে মুড়ি দেয়। একটু পরে বাইরের দাওয়া থেকে এসে, অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে গরম চা এগিয়ে দেয়। বলে, ‘সবাইয়ের খাওয়া হয়ে যেইছে, তোমারটাই ছিল।’
জিজ্ঞেস করি, ‘আপনারা উঠলেন কখন?’
‘আবার?’
যোগোমতী চোখ পাকিয়ে ধমক দেয়। এবার আর স্মরণ করাবার দরকার হয় না। নিজেই তাড়াতাড়ি বলি, ‘তোমরা উঠলে কখন।’
যোগোমতী খুশি হয়ে চোখের কোণে হাসে। ঘাড় নেড়ে খুশিটুকু জানিয়ে বলে, ‘উঠাউঠির কী আছে? আমি আর কত্তা তো শুই নাই। অন্ধকার থাইকতে পাপহরাতে যেইয়ে লেয়্যেঁ এসেছি দু’জনে।’
গতকাল রাত্রের যোগোমতীকে আমার মনে পড়ে যায়। সেই স্থির দৃষ্টি, আবেশভরা মুখ, দুর্বোধ্য ষটচক্রের সেই বিচিত্র বর্ণনা। তখন যেন সে ছিল, কুলস্ত্রী সাধিকা ভৈরবী। এখন যেন পরিহাসরসিকা ঘরের গৃহিণী, কাছে বসিয়ে খাওয়ায়।
হঠাৎ দপদপে রক্তিম চোখ পাকিয়ে বলে, ‘কী দেইখছ হে?’
বলি, ‘তোমাকে। কাল রাত্রের সঙ্গে এখন আর মেলাতে পারি না।’
‘ক্যানে?’
‘কী জানি।’
হাত বাড়িয়ে প্রায় থাপ্পড় তুলে বলে, ‘তোমার চোখদুটো গেলে দেব আমি। তোমার লজর খুব খারাপ।’
বলেই হেসে কাঁপে। আবার বলে, ‘গোপীদাদাই তোমার ঠিক নাম রেখ্যেছে, চিতে বাবাজি, চিতে বাঘ।’
সে কথায় কান না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলি, ‘তোমার সেই রূপ আমি ভুলব না। আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু তুমি যে এত জানো—।’
যোগোমতী উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখে হাত চাপা দেয়। বলে, ‘ছাই জানি। উসব কথা থাক। আবার কবে আইসবে বলো।’
বলে সে আমার হাত ধরে। বলি, ‘সময় সুযোগ পেলেই আবার আসব।’
আমি দরজার দিকে যাই। সে আমার হাত ছাড়ে না। হাত ধরেই বাইরে আসে। সেখানে গোপীদাস আর ব্রহ্মানন্দ বসে কথা বলছে। আমাকে দেখে গোপীদাস উঠে দাঁড়ায়। চোখ ঘুরিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী গ যোগোদিদি, বাবাজিকে ছাইড়তে মন নাই ক্যানে?’
যোগোমতী ঘাড় নেড়ে বলে, ‘না।’
সহজ কথা, সহজেই বলে। আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমিও তার দিকে চেয়ে হাসি। শ্মশানবাসিনী ভৈরবীটিকে অনেক দিনের চেনা বলে মনে হয়। তারপর তো, আরও বিস্ময়ের অবধি থাকে না, যখন মনে পড়ে, কার্তিক ঘোষালের সঙ্গে সে এক পলাতকা তাঁতি বউ।
গোপীদাস চোখ বড় করে বলে, ‘সব্বনাশ, শুইনছ গ বেহ্মালন্দদাদা।’
ব্রহ্মানন্দ উঠে এসে আমার আর একটা হাত ধরে। বলে, ‘বিটাটোকে আমারই কি ছাইড়তো মন কইরছে হে।’
গায়ের কাছে জড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘আবার এস্য বাবা। বেঁচ্যে থাইকলে দেখা হবে।’ অবধূতের মোটা গলায় কেমন একটা করুণ সুর বাজে। গতকাল রাত্রের কথা মনে পড়ে যায়। এখন সামান্য এক ফালি কাপড় কোমরে জড়ানো। চুলের জটা মাথায় আঁট করে জড়ো করা। খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা।
বলি, ‘আসব। চলি।’
গোপীদাসের সঙ্গে অবধূত-আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে যাই। ছড়ানো শিবমন্দিরের আড়ালে পড়ে যায় অবধূতাশ্রম, সেই সঙ্গে ব্রহ্মানন্দ যোগোমতীও। চন্দ্রসায়রের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তায় এসে পড়ি আমরা। সেখান থেকে দেখতে পাই, বক্রেশ্বর মহাশ্মশানে নতুন চিতা জ্বলছে। সত্যিই, এখানকার চিতা নেভে না।
গোপীদাসের ইচ্ছা, সে আমার সঙ্গে দুবরাজপুর পর্যন্ত যাবে। সঙ্গদান ছাড়া সেটা আর কিছু না। কিন্তু গোপীদাসের কষ্ট। এখান থেকে দুবরাজপুর গিয়ে আবার তাকে রেলগাড়িতে উজান শিউড়ি ফিরতে হবে। তার চেয়ে সে বাসে চেপে, শিউড়িই ফিরে যাক। তার ফিরে যাবার ভাড়া হাতে দিয়ে, সেই কথাই বলি।
বক্রেশ্বর গ্রামের পাশে, আমার মোটর বাস আগে আসে। ওঠবার আগে মনে হয়, গোপীদাসের বুড়া চোখ দুটি চিকচিক করে। বলে ওঠে, ‘জয়দেবে যেন দেখা হয় বাবাজি।’
আমি ঘাড় নেড়ে গাড়িতে উঠি। এবার আমার যাত্রা আবার সাঁওতাল পরগনার নির্জন বাসে। সেখান থেকে শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় গিয়েছিলাম। পৌষ সংক্রান্তির অপেক্ষা, তারপরে কেঁদুলি হয়ে দক্ষিণে ফেরা।
.
৭৮.
কিন্তু চিন্তায় আর কাজে মেলাতে পেরেছি কবে! সাঁওতাল পরগনার নিরালায়, একদিন হঠাৎ অট্টহাসের হাসি যেন নতুন কৌতূহলে বেজে ওঠে। বেজে উঠতেই আর চুপ করে থাকতে পারি না। অট্টহাসে নাকি দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল। বাহান্ন পীঠের সেও এক পীঠ। ওষ্ঠ পড়েছিল, নাম তাই অট্টহাস।
এমন নাম কি আর কোথাও হয়। কেন যেতে ইচ্ছা করে জানি না। কীসের বা সন্ধানে তাও বুঝি না। কী যেন এক অপার রহস্যের কৌতূহল আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। থাকতে পারি না, তাই বেরিয়ে পড়ি।
বর্ধমান থেকে কাটোয়া। কাটোয়া থেকে আহমদপুর ছোট লাইনে, পাচনদি-তে গিয়ে নামি। পাচনদির হাটের পাশ দিয়ে মাঠে নামি, আলের সঙ্গী সাথী মেলে না। নিতান্ত গাঁয়ের পথচলা হাটুরে-বাটুরে মানুষের সঙ্গে পথে দেখা। দু-একটা কথা। পথ বাতলে দেওয়া।
কিন্তু অট্টহাস গ্রামের সঙ্গে অট্টহাস ক্ষেত্রের ব্যবধান অনেক। বেলাশেষে, গ্রামের প্রান্তে এসে দেখি, এক তীব্র স্রোতস্বিনী। সুদীর্ঘ বাঁকে কলকলিয়ে যায়। ওপারে ধান কাটা বিশাল মাঠ। তার মাঝখানে ঘন ঝোপের বিশাল মহীরুহের বিস্তৃত অরণ্যের এক দ্বীপ ভেসে আছে যেন। ওই অট্টহাসক্ষেত্র। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না।
দেখি, খুঁটিতে বাঁধা নৌকা রয়েছে এপারে। মাঝি নেই। একখানি বৈঠা নৌকার ওপরে। এদিকে ওদিকে চাই। লোক দেখতে পাই না। নিজেকেই মাঝি হতে হবে নাকি। এদিকে সময় চলে যায়।
এই সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে একটি লোক এসে দাঁড়ায়। বেঁটে খাটো মানুষ। ছোট ছোট চুল, মাথায় টিকি, কপালে সিঁদুরের হালকা ছাপ। হাঁটুর ওপরে কাপড়, গায়ে সুতির চাদর। ছোট ছোট চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা। যেন তলপেট থেকে জিজ্ঞাসা আসে, ‘কোথায় থাকেন মশায়?’
‘ওপারে, অট্টহাসের মন্দিরে।’
লোকটার দৃষ্টিতে কৌতূহল আর ঔৎসুক্য ফোটে। বলে, ‘মন্দিরে? কি করবেন?’
‘এমনি দেখতে যাব।’
‘একলা’?
‘হ্যাঁ।
‘ওখানে কেউ নেই, একটা জনপ্রাণীও না।’
‘সে কি, মন্দিরে পূজা হয় না? দেখাশোনা করবার লোক নেই?’
‘দেখাশোনার আর কী আছে? অই একবারই পূজা হয়। তখনই বাতি জ্বেলে দিয়ে আসি। সকাল থেকে দুপুর অবধি থাকি, তারপরে চলে আসি।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে বলি, ‘আপনিই পূজা করেন?’
হ্যাঁ। দেখলাম, অচেনা লোক গাঁয়ের পথ দিয়ে ইদিকে এলেন, ভাবলাম যাই দেখি যেয়ে।’
চমৎকার! স্বয়ং অট্টহাসের পূজারি পুরোহিতই উপস্থিত। মনে একটু আশা পাই, বল হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘ওখানে কি ঘরদোর নেই?’
‘আছে, তবে থাকা যায় না। সব ছেড়ে একলা কি ওখেনে থাকা যায়? এখন আর কী দেখবেন, দেখবার কীই বা আছে। তবে যান তো চলেন। অন্ধকার হলে আর যাওয়া যাবে না।’
‘নৌকার মাঝি?’
‘আসেন না কেন, ওঠেন।’
পুরোহিত মশায়ের পিছু পিছু নৌকায় গিয়ে উঠি, উনি নিজেই দড়ি খুলে নৌকা চালান। প্রবল স্রোত, অনেকখানি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু পুরোহিত শক্তিমান। ঠেলে ওপারের ঘাটে ওঠেন। সেখানেও একটা খুঁটি। সেই খুঁটিতে নৌকা বেঁধে বলেন, ‘মাঝি বলে কিছু নেই। যখন যে আসে, সে পার হয়ে নৌকা বেঁধে রাখে। এপারে নৌকা থাকলে, ওপারের লোক হা-পিত্যেশ করে থাকে, কখন একজন এসে পার হবে, তবে ওপারে নৌকা পৌঁছবে।’
নিয়ম মন্দ না। কাজ চলে যায়। তবে সময়ের কথা ভাবলে হবে না। তাড়া থাকলে, সাঁতরে পার হয়ে যাও। কারণ উলটো পারের খেয়া দিয়ে কে যে কখন আসবে, তা তোমার ভাগ্যের লিখন।
পুরোহিতের সঙ্গে মাঠ পেরিয়ে সেই নিবিড় অরণ্যের দ্বীপের সীমায় যাই। সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। ভিতরে ঢোকবার রাস্তা কোথায়! এ বনের কি কোনও পথ নেই।
পথ আছে। পুরোহিতকে অনুসরণ করেই সে পথ মেলে। এক প্রকাণ্ড ঝাড়ালো অশ্বত্থের পাশ দিয়ে বুনো ঝোপের ভিতর দিয়ে, সরু সর্পিল পথ। মাথা নিচু করে চলতে হয়। তবু মুখের ওপর ঝাপটা খেয়ে পড়ে ঝোপঝাড়ের ডালপালা। চোখ ঢেকে দেয় লতাগুল্মের নিবিড়তা। তাই হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে চলতে হয়।
ঢুকেই মনে হয় এলাম নতুন রাজ্যে। পৃথিবী ছাড়িয়ে আর এক গ্রহে। মুহূর্তেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পায়ের তলায় শুকনো পাতা ছড়ানো, মাটি ভেজা ভেজা নরম। মাকড়সার জাল মুখে লাগে। ঝোপ লতাপাতার তীব্র গন্ধ। এখানে কোনও কালে আলো উঁকি দেয়নি, রোদ কিরণ ছড়ায়নি। শীতও তাই বেশি অনুভূত হয়। চারদিক স্তব্ধ, কেবল ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। কেন এ বনে কি পাখপাখালি নেই। এত নিঝুম কেন!
পুরোহিত আমার আগে আগে চলেন। তার মধ্যেই নাম-ধাম পরিচয়ের জিজ্ঞাসাবাদ। কখনও বা এমন আন্কা জায়গায় দেবীর মন্দিরে লোকজন বিশেষ না আসার আক্ষেপের কথা। হঠাৎ দেখি, পথের বাঁ দিকে এক জায়গায় ছোট পুকুর। কিন্তু তাতে জল দেখা যায় না। যদিও জল আছে বেশ। পাতায় আর পানায় একেবারে ঢাকা। আর তখনই শুনতে পাই, সরু মেয়েলি গলায় নাকিসুরে কে যেন কেঁদে কেঁদে ওঠে। চমকে অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাই। পুরোহিতের দিকে চাই।
পুরোহিত কানে কালা কী না জানি না। কিন্তু নির্বিকার ভাবেই চলেন। কিছু শুনতে পান বলে মনে হয় না। কাছ ঘেঁষে জিজ্ঞেস করি, ‘কীসের একটা শব্দ হচ্ছে বলুন তো?’
পুরোহিত মশাই উৎকর্ণ হয়ে আমার দিকে তাকান। পালটা জিজ্ঞেস করেন, ‘কই, কীসের শব্দ?’
আশ্চর্য, শব্দটা তো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গলাটা যেন চেরা চেরা লাগে। শব্দ যেন অমানুষিক, গা ছমছমানো।
তারপরেই পুরোহিত ওপর দিকে মুখ করে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘অ, আপনি গৃধিনীর ডাকের কথা বলছেন? অই ত, গাছের উপরে বসে ডাকছে।’
তাঁর কথায় চোখ তুলে ওপর দিকে চেয়ে থমকে যাই। সহসা যেন কেমন একটা ভয় ভয় শিহরন লাগে, অস্বস্তির আড়ষ্টতা বোধ করি। প্রকাণ্ড গাছটার অনেক উঁচুতে দৈত্যের কালো কিম্ভূতাকৃতি হাতের মতো, পাতাহীন ডালপালা। তাতে, সাপের মতো ফণা তোলা ভঙ্গিতে কতগুলো শকুন বসে আছে। কারুর দৃষ্টি নীচে আমাদের দিকে। কারুর বহু দূরে, দূরান্তে। যেন তীক্ষ্ণ চোখে স্থির অনুসন্ধিৎসায় কিছু দেখছে। তাদের মাঝখানে গলায় লাল ঝুলি, লাল করোটি গৃধিনী পাখা ছড়িয়ে বসে আছে। সে-ই ডাকছে। মাথাটা অদ্ভুত ভাবে দোলাচ্ছে।
‘এই দিকে আসেন।’
ডাক শুনেই ডান দিকে ফিরি। রাস্তা একটু প্রশস্ত। তারপরেই প্রশস্ততর মন্দির প্রাঙ্গণ, সেখানে একটা হাঁড়িকাঠ। ঝাঁটপাট দিয়ে প্রাঙ্গণ পরিষ্কার রাখা যায়নি। কিছু শুকনো পাতা ছড়ানো। এখানে-ওখানে শকুনের বিষ্ঠা। ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে কোথা দিয়ে খানিকটা লাল আলো এসে পড়েছে। ডুবু ডুবু সূর্যের রক্তিম আলো। তাতে প্রাঙ্গণের খানিকটা যেন রক্তে লেপা দেখায়। হাঁড়িকাঠের গায়েও রক্তাভা।
পুরোহিতের নাভিস্থল থেকে উঠে আসা গলাটা যেন এখন বদলে গিয়েছে। নদীর ওপারে থাকতে তাঁর চোখের দিকে ভাল করে লক্ষ করিনি। এখন আমার দিকে ফিরে তাকাতেই মনে হয় ছোট ছোট রক্তবর্ণ চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অথচ যেন কী একটা ঘোরে মগ্ন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে গহ্বরের ভিতর থেকে আওয়াজ করে ডাকেন, ‘এদিকে।’
তাঁর পিছনে পিছনে গিয়ে মন্দিরের সামনে দাঁড়াই। সাধারণ মন্দির। সামনের দাওয়াটা লাল সিমেন্টে বাঁধানো। দরজা বন্ধ। সামান্য একটা পাকা ঘরের মতো দেখায়।
পুরোহিতের বুকের কাছ থেকে ময়লা চাদরটা খুলে পড়ে। গাছের গুঁড়ির মতো শক্ত কালো এবড়োখেবড়ো বেঁটে বেঁটে হাত-পায়ের চেহারা। বুকটাও সেই রকমই, কিন্তু লাল। গলার পৈতাগাছা বুকের ওপর। তিনি একদিকে তাকিয়েছিলেন। আমিও সেদিকে তাকাই। জমিটা সেখানে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। গাছ আর ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দেখি রক্তাভ জলের স্রোত চিকচিক করে। নদীটা এখানে এত কাছে এসে পড়েছে বুঝতে পারিনি। পুরোহিত ডেকে ওঠেন, ‘শিবা।’
সঙ্গে সঙ্গে দেখি, ঢালু জমির ঝোপের পাশ থেকে একটা শেয়াল আস্তে আস্তে উঠে এসে সেখানেই থমকে দাঁড়ায়। পাঁশুটে বর্ণের পশুটার চোখের মণি দেখতে পাই না। কিন্তু সে যে আমার দিকেই চেয়ে আছে, বুঝতে পারি। মোটা লোমশ ল্যাজটা এক-আধবার দুলে ওঠে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই পাশ ফিরে সে আবার চলে যায়। যেতে যেতেও ফিরে ফিরে দু-একবার তাকায়। গৃধিনীর সেই কান্না সমানে থেকে থেকে বাজতে থাকে। পুরোহিতের শিবা ডাক শুনে, তাঁকে আমার কাপালিকের মতো মনে হয়। আর কোথাও একটি জনপ্রাণী নেই। আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া নিবিড়তা সবখানে। চারদিকে গভীর বন, বড় বড় গাছের গায়ে গায়ে নিবিড় জটলা। তার এক পাশ দিয়ে চোখে পড়ে একদিকের মাঠ। যার কোনও শেষ নেই। সেই দূর আকাশে গিয়ে ঠেকেছে।
আমার ঘাড়ের কাছে শিরাটা কেমন শিরশিরিয়ে ওঠে। গায়ে ছমছম করে যেন, কাঁটা দেয়। সহসাই মনে হয়, এমন করে একলা অসময়ে এই মানুষটির সঙ্গে অট্টহাস দেবীর থানে না এলেই হত! আমার সমস্ত ভিতর জুড়ে যেন কীসের একটা ভয় বিপাকের ছায়া ঘনায়।
পুরোহিত আবার আমার দিকে ফিরে তাকান। বলেন, ‘এ বেলা থেকে সারা রাত এরাই মন্দির পাহারা দেয়।’
বলে, মন্দিরের দাওয়ায় উঠে কোমরের কাছ থেকে চাবি বের করে মন্দিরের তালা খোলেন। এই বনের নির্জনে তালা কোন কাজে লাগে, কে জানে। যদি কেউ কিছু চুরি করতে চায়, এ তালা সে অনায়াসে নির্বিঘ্নে ভেঙে ঢুকতে পারে। বাধা দেবার কেউ থাকবে না। এক পাশে দুটি চালাশূন্য চালা রয়েছে। তার দরজা খোলা। লোকজন নেই, বোঝাই যায়।
মন্দিরের দরজা খোলেন। ভিতরে গভীর অন্ধকার, কিছুই দেখতে পাই না। উনি সেই স্বরেই ডাকেন, ‘আসেন।’
কোথায়? মন্দিরের মধ্যে? সাহস পাই না যেন। তবু পায়ে পায়ে দাওয়ায় উঠে দাঁড়াই। সেখান থেকেই প্রথমে চোখে পড়ে, এক পাশে ঝোলানো খাঁড়ার ধারালো ঝলক। বলির খড়্গ। পুরোহিত ভিতরের অন্ধকারে কোথায় গেলেন দেখতে পাই না। বিগ্রহের স্থানে একটা স্তূপের মতো কিছু দেখতে পাই। দেবীর ওষ্ঠের কী রূপ আছে সেখানে চোখে পড়ে না। নাম অট্টহাস। যেন কোনও করাল মুখ ব্যাদান করে আছে সেখানে, হঠাৎ হাসি বেজে উঠবে হা হা করে।
পিছনে আচমকা পাতার সামান্য শব্দে ফিরে তাকাই। চোখের ওপর দিয়ে চকিতে যেন সেই পাংশুবর্ণ শিবা একটা ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে যায়। তার সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়। আর তখনই চোখে পড়ে, বটের গুঁড়ির গায়ে পাথরে সিঁদুর মাখানো। গুটিকয় মাটির ঘোড়ার পুতুল। গৃধিনী ডাকছে, আঁ আঁ আঁ—উউউ!
‘ভেতরে আসেন।’
সেই গলায় ডাক শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি মন্দিরের দিকে ফিরি। পুরোহিতকে দেখি না। কিন্তু ঘরে যেন ক্ষীণ আলো দেখা যায়। প্রদীপ যদি জ্বলে থাকে, শিখায় তার তেজ নেই। এখন একটি দেবীমূর্তি চোখে পড়ে স্তূপের পাশে। চতুর্ভুজা কালো মূর্তি। কালী মূর্তিই কী না বুঝতে পারি না। কারণ, প্রসারিত জিহ্বা চোখে পড়ে না।
পুরোহিত দরজায় আবির্ভূত হন। আমার দিকে চেয়ে ডাকেন, ‘আসেন, দর্শন করে নেন।’
খালি পায়ে ভিতরে ঢুকি। প্রদীপ জ্বলেছে ঠিকই, শিখা মরো মরো। যেন তেল নেই, শুকনো পলতে। বাইরে থেকে যা দেখেছি ভিতরেও তাই। বেশির মধ্যে মন্দিরের কিছু জিনিসপত্র। নতুনের মধ্যে একটি শিবলিঙ্গ।
পুরোহিত ছোট একটি কুষিতে করে চরণামৃত এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘নিন।’
নিয়ে ঠোঁটে ছুঁইয়ে মাথায় ঢেলে দিই। তারপরে প্রাপ্তি, দুটি ছোট ছোট নকুলদানা। দেবীর প্রসাদ। প্রথানুযায়ী কপালে ঠেকিয়ে খেয়ে নিই।
পুরোহিত বলেন, ‘একেবারেই যে লোকজন আসে না তা না। সকালবেলার দিকে আসে। পাল-পার্বণে বা চোতমাসে লোকজন বেশ আসে। আর মাঝেমধ্যে সাধক সাধুরা কেউ কেউ এসে থাকেন এখানে।’
না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘রাত্রেও থাকেন?’
‘হ্যাঁ থাকেন। অই যে বাইরে দুটো চালা রয়েছে, সেখানে থাকেন। চলেন, বাইরে যাই।’
অনুমতি পেয়েই তাড়াতাড়ি বাইরে আসি। পুরোহিত হাতের ঝাপটায় প্রদীপ নিবিয়ে বাইরে আসেন। ঘরের তালাটা লাগাতে দেখে একটু যেন স্বস্তি পাই। বলেন, ‘ঢাক-ঢোল বাজিয়ে পূজা করবার জায়গা তো নয়। সাধকরা নিরিবিলিতে এখানে পূজা করতেন। তান্ত্রিক কুলাচারের চক্র সাধনার ভাল জায়গা। এক সময়ে নাকি নরবলিও হয়েছে এখানে।’
খুবই স্বাভাবিক। নরবলির এমন প্রশস্ত জায়গা আর হয় না। জিজ্ঞেস করি, ‘এখানে কি শ্মশানও আছে নাকি?’
‘না, এখানে শ্মশান নাই। আমাদের এদিক থেকে সবাই উদ্ধারণপুরের ঘাটেই যায়। সেখানে গঙ্গা আছে, বড় শ্মশান। বিশ পঁচিশ মাইলের সব লোক সেখানেই যায়।’
আকাশে যত না অন্ধকার ঘনায় তার চেয়ে নিবিড় কালো এখানে। মনে হয় অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। বিশেষ কিছুই আর চোখে পড়ে না। মন্দিরের দাওয়া থেকে নেমে পুরোহিত জিজ্ঞেস করেন, ‘কারণ পান চলে আপনার?’
এখানেও সেই কারণ! এখন আর হকচকিয়ে চমকাই না। রাঢ়ের এইসব অঞ্চলে তান্ত্রিকদেরই প্রাধান্য। জবাব দিই, ‘না।’
পুরোহিত বলেন, ‘তা হলে এখানেই বসা যেত। রাত্রটা চালাতে থাকতে পারতেন।’
রক্ষে করুন! বক্রেশ্বরের মহাশ্মশানে তবু জানতাম আশেপাশে অনেক লোকজন রয়েছে। এখানে এই বনের মধ্যে হাঁড়িকাঠ মাঝখানে রেখে, সারা রাত্রি গৃধিনীর কান্না শুনে, শিবার সঙ্গে চোখাচোখি করে, পুরোহিতের সঙ্গে রাত্রিবাসে মন সাড়া দেয় না। তা ছাড়া, কারণবারি যখন আমার চলবে না। বলি, ‘না, থাক। অন্য সময় এসে থাকা যাবে।’
এখন বুঝতে পারি, মহাশয়ের চোখ কেন লাল। গলার স্বরই বা এমন কেন। কাপালিকের কিছু অংশ আছে ঠিকই। তবে এখন আর তাঁকে ভয় লাগে না। বরং অন্ধকারে তাঁর কাছ ঘেঁষেই থাকবার চেষ্টা করি। তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। পকেট থেকে দুটি টাকা বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বলি, ‘এটা রাখুন।’
টাকা দুটি নিয়ে বলেন, ‘জয়স্তু বাবা, বেঁচে থাকেন। মায়ের কৃপা হোক।’
কিন্তু সেজন্যে আমার ব্যয় না। উনি অসময়ে এলেন, দেবী দর্শন করালেন, চরণামৃত প্রসাদ দিলেন। তার একটা প্রাপ্তি তো চাই। বলেন, ‘তা হলে চলুন যাওয়া যাক। আমার হাত ধরুন।’
তাঁর হাত ধরে নিবিড় অরণ্যের অন্ধকারে পথ চলি। গৃধিনীর ডাক পিছনে পড়ে থাকে। শকুনের পাখা ঝাপটা বেজে ওঠে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় শিষ্যরা যেন আমাদের আশেপাশেই চলাফেরা করে। শুকনো পাতায় প্রায়ই খস খস শব্দ ওঠে। একটা হাত সামনে রেখে চলি মুখ বাঁচাবার জন্যে। তবু মাকড়সার জাল মুখে লেগে যায়। পুরোহিত আশেপাশের গ্রামের আর পথঘাটের বৃত্তান্ত বকবকিয়ে চলেন।
সে সব কথা বিশেষ আমার কানে যায় না। বাহান্ন পীঠের এই নির্জন নিবিড় বনক্ষেত্রের কথা ভাবি। বাহান্ন পীঠের পুরাণ কথা জানি। দেবীর ওষ্ঠ-রহস্য বুঝি না। তবু সব মিলিয়ে এক গভীর কল্পনা মনোজগতে তরঙ্গ তোলে। পৃথিবীতে কত বিস্ময় আছে। তবু বাঙলার এমন বৈচিত্র্য আর কোথায় আছে জানি না। আকাশের নীচে, দিগন্তবিসারী মাঠের মাঝে এক অরণ্যদ্বীপ। তার মধ্যে কোন মানুষেরা খুঁজে পেল দেবীর ওষ্ঠ! নাম দিয়েছে তার অট্টহাস। সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে সঁপেছে নিজেকে।
হয়তো এ সবের মধ্যে যে ভাবনা নিহিত, তার মধ্যে নিজেকে সঠিক খুঁজে পাই না। কিন্তু আমার সমস্ত কিছুর মধ্যে এই অট্টহাসও যেন কোন এক স্তরে চাপা পড়ে আছে। এই প্রকৃতি, পরিবেশ, এই হাত ধরে নিয়ে চলা, প্রায় বামনাকৃতি রক্তচক্ষু পুরোহিত, সব কিছুর মধ্যে আমি যেন কোথায় ছায়া ফেলে রয়েছি। সব কিছুতেই এক অচিন অনুভূতির দোলায় আমার মন দোলে। কোন এক রহস্যপারে যেন নির্বাক স্তব্ধ হয়ে থাকি।
সৌভাগ্য, এপারের আর যাত্রী ছিল না, তাই নৌকা ওপারে যেতে পারেনি। ওপারে গিয়ে পাচনদি যাবার চিন্তা ছাড়ি। কারণ, কাটোয়া যাবার গাড়ি রাত্রে আর নেই। পাচনদির মতোই সমান দুরে নিরোল গ্রাম। সেখানে আমার পরিচিত মুখোপাধ্যায় বংশ, এক পরম শাক্ত পরিবার আছেন। নাম বলতেই পুরোহিত চিনতে পারেন। অট্টহাস থেকে তিনি একটি গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। নিরোলে পৌঁছতে সময় যায় তিন ঘণ্টা। আমার মনে হয়, এ রাত্রির আর শেষ নেই। আমার চলা যেন এমনি করে চিররাত্রির সঙ্গে বাঁধা থাকবে।
বক্রেশ্বরে যে চাঁদকে ক্ষীণ দেখেছিলাম, এখন তার একটু বৃদ্ধি হয়েছে। তবু পাতলা কুয়াশার ঝাপসাতে এই দশমী বা একাদশীর জ্যোৎস্নাকেও কুহেলিময় লাগে। সমস্ত প্রকৃতি যেন জাগ্রত, অথচ আচ্ছন্ন। গাড়ির চালকের নাম নসীরাম। সে জানায়, সে দুলে। তার বউ ছেলেমেয়ে পরিবার পরিজনের কথা বলে। ভূমিহীন এক কৃষক। আজ রাত্রে আর সে নিরোল থেকে ফিরবে না, কাল ভোর রাত্রে বেরিয়ে পড়বে। পথের কোন এক জায়গা নাকি খারাপ। না, ঠ্যাঙাড়ে ডাকাত না, সেখানে একটু অপদেবতাদের বাড়াবাড়ি। রাতবেরাতে একলা চলাফেরায় দু-একজনের প্রাণ গিয়েছে। কী দরকার, নসীরাম কাল ভোরেই ফিরবে। এই পর্যন্ত বলে, অট্টহাসের দুলে পুরুষ বলদকে বলে, ‘চখের মাথা খেয়েছে হারামজাদা, খালি ডাইনে যাবে।’ তারপরে সেই দূর আকাশ পর্যন্ত গলার স্বর তুলে মাঠ কাঁপিয়ে গেয়ে ওঠে, ‘আমি অই ভয়েতে মুদি না আঁখি।’…
রীতিমত টপ্পা ধাঁচের সুর। ভাবতেও পারিনি, আচমকা সে এরকম গান ধরে দেবে।
তার চেয়েও বিস্ময়কর, মুখোপাধ্যায় গৃহের বাহির দুয়ারে যখন গাড়ি দাঁড়ায়, তখনও ভাঙা ভাঙা বুড়ো গলায় সেই গানই শুনতে পাই, ‘নয়ন মুদিলে পাছে তারাহারা হয়ে থাকি। অই ভয়ে মুদি না আঁখি।’ গলার স্বরেই চিনতে পারি, স্বয়ং গৃহকর্তার গলা। পূজামণ্ডপের অন্ধকারে বসে আছেন।
সাঁওতাল পরগনা ছাড়িয়ে এসে দুর্গাপুরে নামি। যাত্রা কেঁদুলি। কেন্দুবিল্ব। বাউলের পাঁচ পরম রসিকের এক রসিক, জগজ্জনের কবি জয়দেবের লীলাক্ষেত্রে।
বাউল বলে, ‘জয়দেবে যাব।’ তার মানেই কেঁদুলি যাওয়া। আজই সেই পৌষ সংক্রান্তির দিন। আজ জয়দেবের স্মারকোৎসব।
নিরোল থেকে সাঁওতাল পরগনায় ফিরেছিলাম। সেখান থেকে এখানে। কিন্তু গতিক সুবিধার বুঝি না। নতুন লৌহনগরীতে ইতিমধ্যেই মানুষ আর যানবাহনের বেজায় ভিড়। শুনেছিলাম এখান থেকেই মোটর বাস পাওয়া যাবে। ভিড়ের চেহারা-চরিত্র যা দেখি, সেই ছাতিমতলার কথা মনে করিয়ে দেয়। নগর লোকের ভিড় বেশ।
তবে কেঁদুলির বাস যখন খুঁজে পাই সেখানে নগর নাগরিক ছাপছোপ যাত্রী একটু কম। আলাদা মোটরগাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। তার দরকার নেই। সকলের সঙ্গে যাওয়াই স্থির। জানা গেল, কেঁদুলির মোটর বাস নিয়মিত না। মেলা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন।
গাড়িতে বসবার জায়গা যে পাওয়া যায় সেটাই আশ্চর্য। আমার আশেপাশে অধিকাংশই গ্রামীণ নরনারী। শহুরেরাও আছেন ছড়ানো ছিটানো। শোনা গেল, তাঁদের ভিড় বেশি হবে, যখন কলকাত্তার গাড়ি আসবে। এখন কলকাতা থেকে দুর্গাপুর দিয়েই কেঁদুলির সহজ রাস্তা। অন্যথায় অন্ডাল থেকে দুবরাজপুর, সেখান থেকে মোটর বাসে জয়দেব। বহুত ঘুর পথ।
ভিড় হলেও শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি তার কষ্টটা ভুলিয়ে দেয়। মাইলের পর মাইল শালবন। মাঝখান দিয়ে লালমাটির শক্ত সড়ক। সবখানেই লালে লাল। শালবনের ডালে ডালে পাতায় পাতায় লাল ধুলার মাখামাখি। আলখাল্লা জড়ানো বিবাগী হয়েছে মহীরুহ। পথের ধারে ধারে ঝোপঝাড়ের গায়েও লাল ধুলার ছড়াছড়ি। যাত্রীরাই বা বাকি থাকবে কেন। লাল ধুলাতে আমরাও মাখামাখি হয়ে যাই। তবু ভাল লাগে।
যাত্রী নামার থেকে, ওঠাই বেশি। কিন্তু বেকায়দা করলে এক কৃষ্ণা যুবতী। মাঝপথে কোথা থেকে উঠে কোলের কচি অজাটিকে এনে ফেলে দেয় একেবারে আমার কোলে। নিজেই ঢলে পড়ে আর একজনের কোলে। তারপরেই বিব্ৰত লজ্জায় কী হাসি। অই মা, দ্যাখ দিকিনি ছাই!
তার আগেই গুটি কয় সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষ গাড়ির মেঝেতেই বসে গিয়েছে। কনডাক্টরের ধমকে তাদের কিছুই যায় আসেনি। তাতে পা নীচে রাখাই যাচ্ছিল না। তার ওপরে এই নধর পুষ্ট ছোটখাটো একটি পাঠা কোলের ওপর!
কৃষ্ণা যুবতী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। চোট লেগেছে কী না, লজ্জাচকিত মুখ দেখে তাও বোঝা যায় না। কিন্তু এমনি দাঁড়িয়ে থাকতে তো পারে না। অতএব জায়গা থাক বা না থাক, নীচেই কোনওরকমে বসে পড়ে। তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় জীবটির জন্য। সেটিকে নিয়ে প্রায় বুকে চেপেই বসে। সে বেচারি ভয়ে ভয়ে তাকায়, এক-আধবার ডেকে ওঠে। নানান কলরবের মধ্যে একজন গ্রামীণ যাত্রীর সঙ্গে যুবতীর কথায় জানতে পারি, সে যাবে চিন্তামণিতে! নতুন কথা শুনি যে। যাচ্ছি সবাই জয়দেবে। এ বলে চিন্তামণিতে। এঁর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কী। বাউলের গানে চিন্তামণি। বিল্বমঙ্গলের কথা শুনেছি বটে। কেন না, সহজিয়াদের পাঁচ রসিকের এক রসিক বিল্বমঙ্গল। তাঁর প্রেমিকা চিন্তামণি। কিন্তু এখানে চিন্তামণি কোথায়। এ দেশে কি চিন্তামণির নামে কোনও জায়গা আছে নাকি। বিল্বমঙ্গল চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি কবি রায়শেখর আর জয়দেব।
কৃষ্ণা যুবতীর কথায় আরও ভিন গলাতেও আওয়াজ ওঠে, ‘আমরাও তো চিন্তামণিতেই যেইছি গ।’
সবাই তা হলে জয়দেবে না। অন্য রসিকের খোঁজেও। এমন কথা জানা ছিল না। ভাবি, চিন্তামণি কোথায়। আজ সেখানে কীসের উৎসব!
তার কোনও সঠিক জবাব মেলে না। কিন্তু কৃষ্ণা যুবতীর বুকে আঁকড়ানো জীবটি ম্যাঁ বলে আওয়াজ দিয়ে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে এক লাফ। কী দুর্গতি! সবাই হইহই করে ওঠে। যুবতী হেসে তাকে ধরতে গিয়ে কনুইয়ের একখানি মোক্ষম খোঁচা মারেন আমার উরুতে।
কী লজ্জা বলো দিকিনি ছাই! তাই একটু সলজ্জ হাসি। তারপরে কটাক্ষের কোপে একদিকে চেয়ে ঝঙ্কার দেয়, ‘তুমি ধরো না!’
যাকে বলে, তার দুরবস্থা আরও। হাত দিয়ে কিছু ধরবার নেই বেচারির। কাঁধে ঝোলানো পুঁটুলি। গোঁফজোড়া ভিড়ের চাপে বসে গিয়েছে বলা যায়। ওপর ঠোঁট ঢেকে দিয়েছে। সামনে পিছনে ভিড়ের চাপেই খাড়া আছে। অসহায় চোখে চেয়ে এগিয়ে আসবারই চেষ্টা করে। পাশের লোকে ধমক দেয়, ‘ধুত্তোরিকা।’
যুবতী আবার পালটা ঝামটা দেয়, ‘যাক, দরকার নাই।’
বলে নিজেই গুছিয়ে-গাছিয়ে পশুটিকে বুকে জড়িয়ে বসে। এবার কৌতূহল প্রকাশ না করে পারি না, ‘চিন্তামণিতে পাঁঠা কী হবে।’
যুবতী বলে, ‘বলি হবে।’
বলি! সহজিয়া রসিকের থানে বলি! এ যে নতুন কথা শুনি। যুবতীর পাশে যে পুরুষটি নিবিড় হয়ে বসে আছে, সে বলে, ‘ওখেনে এক দেবীও আছে ত, সেখেনেই হবে।’
যুবতী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘চিন্তামণির মানত।’
পুরুষটি জবাব দেয়, ‘অই হল। অধরার মানত।’
যুবতী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। বোঝো, এবার কী বুঝবে। লোকের মুখে শুনলে না হয় প্রত্যয় না হত, এ যে চোখে দেখি, কানে শুনি!
তবে অবাক হবারই বা কী আছে! অথৈ-এর থৈ পাবার কী আছে। এই যে নানা মতের নানা ছন্দের তরঙ্গ, এ বহু দিকের বহু স্রোতের মিলজুলের মোহনা। তুমি ভাসো সঙ্গমে যেখানে সব একাকার। আলাদা করে বাছবিচার করতে যাও, খেই হারিয়ে যাবে। বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্য লুইপাদ। সহজ ধর্মের অন্যতম প্রবর্তক। তাঁর নাম শুনবে রাঢ়ের ধর্মঠাকুরের পূজায় মেলায়। সেখানে শত শত বলি, রক্ত নিয়ে হোলি, মদমত্ত নরনারীর উল্লাস উৎসব। জয় বাবা লুই ঠাকুরের জয়! আবার লুইপাদের চর্যাপদের ইঙ্গিত পাবে রসিকের গানে কথায়। বাউলের দুর্বোধ্য গানে। তবে, সমাজে যাদের বলে নিচু ঘর, ধর্মঠাকুরের মত্ত বলিদান উৎসবে তাদের পাবে বেশি। এই কৃষ্ণা যুবতী বা যারা চিন্তামণির যাত্রী, তাদের অনেককেই দেখে মনে হয়, হিন্দু সমাজের সেই ‘নিচু ঘরের’ মানুষ।
অতএব, কোথায় কীসের যোগাযোগ, সে বিচারে নেই আমি। আমি দেখি, বঙ্গের বিচিত্র রঙ্গ। বিচিত্র এই মানুষের মিছিল। তার মধ্যে নানা বিশ্বাস, নানা চিন্তা, নানা ভাবের খেলা। সেই স্রোতে ভাসি আমি। আমার ভিতরে ছলছলিয়ে কলকলিয়ে ওঠে।
এদিকে গাড়ি যত অগ্রসর হয়, পথের ভিড় বাড়ে। কেবল পায়ে চলা মানুষের না। যানবাহনেরও বটে। তার মধ্যে গরুর গাড়ি বেশি। শহরে নতুন আসা বলদের ভারী ধন্দ। মোটর বাসের শব্দ শুনেই রাস্তা থেকে নেমে গাড়ি নিয়ে দৌড় দিতে চায় মাঠে। কেবল যে মানুষবাহী গো-শকট, তা না। মালবাহীও প্রচুর। তরিতরকারি ফলাফলারি নানান বস্তুর বোঝা। তার মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ দু-একখানা ছোটখাটো সুন্দর মোটরগাড়ি দেখা যায়। জিপ গাড়িও চলেছে। যাত্রীদের দেখলেই মনে হয়, এ পথে মেলায় ছাড়া ভিন যাত্রী নেই।
তারপর অজয়ের কাছাকাছি এসে চিন্তামণির যাত্রীরা নামে আগে। জয়দেবের যাত্রীরা একেবারে অজয়ের উঁচু বাঁধের কাছে এসে নামে। বর্ধমান বীরভূমের সীমানা। এপারে বর্ধমান, ওপারে বীরভূম। মাঝখানে অজয়। চিন্তামণি যাবার ইচ্ছাটা মনে মনে রেখে গাড়ি থেকে নামি।
এবার দেখ লোক। মেলার কাছে এসেছি , দেখলেই বোঝা যাবে। মোটর বাস দাঁড়িয়ে যায় বটে বাঁধের সীমানায়। গরুর গাড়ি বাঁধ ডিঙিয়ে চলে যায়, কাঁকর আর বালি মাটির চরার বুক দিয়ে। জিপ গাড়িগুলোও তাই।
অনেকখানি চরা পেরিয়ে তারপরে নদী। বর্ষাকালে না জানি এ নদীর কী ভয়ংকর প্রমত্ত রূপ হয়! এখনও নদীখানি ছোট না। লাল বালি আর কাঁকর মাটির রক্তাভ চরা পেরিয়ে ওপারের দূরত্ব অনেকখানি। কিন্তু পারাপারের ব্যবস্থা কী?
ব্যবস্থা একটাই, হেঁটে পারাপার। গরুর গাড়িরও তাই। তবে চেনা পায়ের চিহ্ন ধরে চলো। যারা অনায়াসে যায়, তাদের পিছন ধরো। নইলে অগাধ জলে, একেবারে টুপুস! ওদিকে দেখ, দুর্গাপুরের সরকারি জিপ গাড়িতে বাবু-বিবিরাও এসেছেন। কিন্তু কাল করেছে অন্যত্র। সাহেবের পাতলুন গুটিয়ে তোলা যায় না। মেমসাহেবের অবস্থা আরও খারাপ। কাপড় কতখানি তোলা যায়! অজয়ের একি খেলা! নারীর লজ্জা হরণ করতে চায়।
কিন্তু লজ্জা আছে তবু নারীরা পার হয়, তাও দেখি। কেন না তাদের কথা হল, জলে নামব, কাপড় ভেজাব না, তা হয় না। তারপরে আর কী লজ্জা হরণ করবে করো।
এপারে থাকতেই চোঙার ফোঁকা, যে রকম কলের গানের হুংকার শুনি, তাতে তো জয়দেবের বাউল সমাবেশের কল্পনাই মাটি হয়ে যেতে চায়। সার্কাসের তাঁবু। বাজিকরের তাঁবু, এপার থেকেই চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড গর্জনের মতো কানে এসে বাজে। মানুষের ভিড় তো অথৈ।
পার হয়ে, পাড়ে উঠে ভিড়ের মধ্যে মিশি। যার নাম মেলা, এ তা-ই। খাজা-গজা মণ্ডা-মেঠাইয়ের দোকান সারি-সারি। তার পাশে ভাত ডাল মাছ মাংস পরিবেশনকারী নানা নামের হোটেল। ইত্যে যদি লা হয়, তব্যে চপ কাটলেট চা খেয়্যে যান ক্যানে গ! কর্তার পাশে ঘোমটা ঢাকা দিয়ে বউ বসে গিয়েছে। ঘোমটার তলে খ্যামটা নাচে বলে না! ঘোমটার মধ্যে হাত, হাত ভরে খাবার। মেলায় এলে একটু না খেলে মন মানে নাকি।
মনোহারি, বাঁশি, পুতুল, কত কিছুর পসার। কিন্তু এসব এখন দেখতে চাই না। অনেক সময় পাব, জয়দেবের আসল যাত্রীরা কোথায়। তাদের দেখা আগে চাই। জনস্রোতে একদিকে ভাসতে ভাসতে চলি। তবে, অজয়ের কূল বরাবর পথ রাখি। সামনে এক মন্দির পড়ে। তার চারি ভিতে দাওয়ায় মানুষের ভিড়। শুনি শ্রীরামের মন্দির। তারপরে মনে হয়, গ্রামের পাড়ায় ঢুকে পড়েছি। ঘরের দাওয়ায় দাওয়ায় দোকান। দোকানে নানান পসরা। কোথায় যে সেই শ্রীচরণচারণ চক্রবর্তী কবির ভিটা তার খোঁজ পাই না। যার মুখের দিকেই চাই, সবাই আপনভাবে বিভোর। ভারী ব্যস্তত্ৰস্ত দ্রুতগামী।
এমন সময় এক বিবাগী বাবাজি গেরুয়াধারীকে দেখি, একতারাটা বংবঙিয়ে আপন মনে চলে যায়। তাকেই জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা, বাউলরা এখানে কোথায় বসেন!’
ঘাড় কাত করে একবার দেখে, বাবাজি বলে, ‘আসেন। সব বেদনাশা বটের তলায় আছে।
বেদনাশা বটতলা! কথাটা শোনা ছিল। স্বরূপে রূপ মাখাচোখা। বেদবিধিতে নাই। বাউল বেদবিরুদ্ধ পথের মানুষ।
খানিক যেতেই দেখি, প্রকৃতি ভিন্ন, পরিবেশ ভিন্ন। অজয়ের ধার ঘেঁষে, মস্ত জমির পরিসরে, অনেক গাছ। গাছতলাতে গেরুয়া রঙের ছেঁড়া কাঁথার ঝুলি আলখাল্লার ছড়াছড়ি। ডারা ডুপ্কি প্রেমজুরি, একতারা বাঁয়া গোপীযন্তরী, খোল করতাল খঞ্জনি, কী নেই! হেথায় হোথায় গুচ্ছ গুচ্ছ, আসরে আসরে জমজমাট। লালপাড় গেরুয়া ছোপানো শাড়িধারিণী যেমন পাবে, পাড়হীন গেরুয়া থান পরা বৈষ্ণবীর রসকলিও দেখবে। চুলদাড়িতে ঝাপটা যত, কামানো সাফানো চিকন মুখে কালার হাসিও তেমনি ঝলক দেয়।
কেউ গায়, ‘গৌরচাঁদে দেখবি যদি; চল গ নদিয়ায়।’ পায়ের ঘুংগুরে বোল তুলে, কোমর. দুলিয়ে, কেউ বলে, ‘জানগে, মানুষের করণ কীসে হয়।’…
একতারাওলা বাবাজিটি কোথায় হারিয়ে যায় দেখতে পাই না। আমি দেখতে দেখতে যাই। সবাই যে কেবল এমনি বসেছে, তা নয়। এর মধ্যে আবার অস্থায়ী আখড়াও হয়েছে। বাঁশের বেড়ায় খড়ের চালে, কোনওরকমে একটা ডেরা। বড় ব্যবস্থাও আছে। চারদিকে বেড়া দিয়ে, মাঝখানে মস্ত তাঁবুর আস্তানা। সেখানে নামকরা ক্ষ্যাপা কিংবা বাবাজিদের সমাবেশ। তাদের শিষ্যসাবুদদের চেহারাও আলাদা। কোট-পাতলুনে সাহেব। ঝকমকানো ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবু। সেই সঙ্গেই সঙ্গিনীরা মেমসাহেব আর বিবি। সব মিলিয়ে, তবু ভাল লাগে। নানা রূপের ছন্দে, এক অপরূপের সুর বাজে। রূপে রূপে লহর তোলে।
এই সমাবেশ আর আখড়াগুলোর সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে দেখি, নদীর কিনার একটু নিরালা। এই শেষ বেলাতেও সেখানে কেউ কেউ অজয়ের তুহিন জলে ডুব দেয়। নদীর ধারে, ধানকাটা মাঠের ফাঁকে ফাঁকে রবিখন্দের সবুজ আঁচল পাতা।
এদিক থেকে ফিরে যাই। কোনও একটা আখড়ায় ঢুকে পড়লেই হবে। তার আগে, গোপীদাসের সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার। জয়দেবে তারা নিশ্চয়ই এসেছে। যত ভিড়ই হোক, খুঁজে নিশ্চয়ই পাব। একটা মুখ তো না। অনেকগুলো মুখই চিনি।
অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে, দিকে দিকে বাতি জ্বলে। বড় আখড়ায় হ্যাজাক জ্বলে। ছোট্ট আখড়ায় হ্যারিকেন, গাছতলার খোলা সমাবেশে, তাও প্রায় নেই। বড় বড় কাঠের গুঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে আলো হয়েছে। আলো তাপ, একসঙ্গেই। মকর সংক্রান্তি বলে কথা। গঙ্গাসাগরের যাত্রায়, যত না শীত পাবে, এখানে রাঢ়ের সীমায় তার বেশি।
গাছতলাতে এক জায়গায় এক বাউলকে দেখে মনে হয়, রূপে ভুবনমোহন। বয়স কাঁচা। কালো রং, ডাগর চোখ। এখনও ভাল করে দাড়ি ওঠেনি। পায়ে তার ঘুংগুরের গোছা। গায়ে কাঁথার জোড়ায় আলখাল্লা। কোমরে শক্ত করে বাঁধা এক ফালি গেরুয়া। সব থেকে পাগল করে তার গলা। যেমন মিঠে, তেমনি উঁচু। ভঙ্গিতে হরিণের নাচ। সে নিজে মাতাল গানে। তার গানে মাতাল বাকিরা। সকলেরই শরীরে দোলা লেগে গিয়েছে। তার সঙ্গের নরনারীরা ঘিরে রয়েছে, মাঝখানে আগুনের শিখা।
দেখেশুনে চলতে ভুলে যাই। সেখানেই বসে পড়ি। নিজেরাই সরে বসে জায়গা করে দেয়, ‘বস্যেন, বস্যেন দাদা।’ হাতে হাতে প্রেমের গাঁজার কলকেখানি ফেরে। ফিরতে ফিরতে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা, ‘চইলবে নাকি দাদা।’ না, থাক। সেধেছে, তাই যথেষ্ট। পাগলটার গানেই মজে থাকি।
এর মধ্যেই দেখি খিচ খিচ করে বিদ্যুচ্চকিতে ঝিলিক হেনে যায়। বুঝতে পারি, নগরবাসীদের ক্যামেরার ঝিলিক। ফটো তোলা হচ্ছে। কেউ কেউ খাতা কলম নিয়ে ঘোরেন। বাউলের গান লিখে নিয়ে যান।
তারপরে হঠাৎ একেবারে আমার পাশ থেকে, মুখের সামনে একটি মুখ। চেনা মুখ যেন! ছোটখাটো মুখখানি, নাকে আবার নাকছাবি। আয়ত চোখ দুটিতে অনুসন্ধিৎসা আর রাজ্যের বিস্ময়। হঠাৎ আমার পিঠে একটা আলতো চড় মারে আবার। বলে ওঠে, ‘ই গ, তুমি! তাই ভাইবছি, ই ত সিই বাবাজি। ইখানে বস্যে আছ তুমি?’
আমার বিস্ময় ততোধিক! গোকুলের বোন কুসুম যে! এ কী করে আমাকে দেখতে পেল। এই অন্ধকারে ভিড়ের মধ্যে! চিনতেই পারে কী করে। জিজ্ঞেস করি, ‘কুসুম তো।’
তার জবাব পরে। হাত ধরে টেনে বলে, ‘এস্য, এস্য শিগগির।’
আশেপাশের কৌতূহলী অনুসন্ধিৎসায় না উঠেই বা উপায় কী। কুসুম যেন আমাকে নিয়ে প্রায় ছুট দেয়। জিজ্ঞেস করি, ‘সবাই এসেছে? গোপীদাস বাবাজি, তোমার দাদা, এরা সব কোথায়?’
‘তুমি এস্য ক্যানে।’
কোনদিকে যে সে নিয়ে যায় ঠাহর করতেও পারি না। লোকের গায়ে ধাক্কা লাগে। পড়ি না মরি, একি ছোটা! সে আসে একটা ভাঙাচোরা পাকা বাড়ির ভিটের মাঝখানে। সেখানে কয়েকটা হারিকেনের আলো। বাঁশ ঘিরে বেড়া করে মাথায় খড়ের চাল দিয়েছে। কে যেন গান করে। ভিড়ও মন্দ হয়নি।
কিন্তু সে পর্যন্ত যাবার আগেই কুসুম থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা গাছতলার কাছে। বলে, ‘দ্যাখ ক্যানে।’
লেপামোছা গাছতলায় যে কয়জন বসেছিল তাদের একজনের দিকে চোখ পড়তে অবাক হয়ে যাই। সে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। চমকিত বিস্ময়ে যেন এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সে হাসে না। তার ঠোঁট কেঁপে যায়। অস্পষ্ট উচ্চারণ শোনা যায়, ‘তুমি!’
আমি অবাক হলেও হেসে জিজ্ঞেস করি, ‘কবে এলে?’
ঝিনি কোনওরকমে বলে, ‘গতকাল।’
এখনও যেন ওর চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময়, আর সেই সঙ্গেই একটা রুদ্ধ আবেগের থর থর ভাব। জানতাম না, ঝিনি—শ্ৰীমতী অলকা চক্রবর্তী এখানে উপস্থিত। বেশবাস এত রুক্ষ কেন কে জানে। আবাঁধা চুলে মুখে যেন ধুলো। শাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। সারা শরীরের কোথাও এক কণা অলঙ্কারের চিহ্ন নেই। হাতে একটা বড় ব্যাগ। কিন্তু ওর চোখ ছলছলিয়ে ওঠে দেখে আমি বিব্রত হই। আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বলে উঠি, ‘বসো।’
ও থমকে যায়। আমার কানে আসে, ‘আপনিও বসুন।’
শ্ৰীমতী লিলিও এসেছে! ও বসে আছে গাছতলাতেই। চোখাচোখি হতে হাসে। ঘাড় নাড়িয়ে ডাকে।
কুসুম আমার গায়ে একটা খোঁচা দিয়ে বলে, ‘বস্য বাবাজি, বউদিকে সম্বাদ দিয়ে আসি।’
কুসুম চলে যায়। ঝিনি বসবার আগেই আমি বসি। তারপরে ও বসে। গায়কের দিকে ফিরে দেখি, স্বয়ং গোপীদাস। গান করে, ‘অ রাই, কিছু দিন মনে মনে, যতন করে শ্যামের .পিরিত রাখ গোপনে।’
বুড়া দাড়ি নাড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে হাসে। আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়। সে হাত তোলে আসর থেকে। আমিও তুলি। তারপরে সে ভাঙা ভাঙা গলা চড়িয়ে গায়,
‘ইশারায় কইবি কথা,
দেখিস যেন কেউ না শোনে।
কিছুদিন মনে মনে—
ও রাই, রাই লো!’…
.
৭৯.
আমার ডাইনে লিলি বাঁয়ে ঝিনি। গাছতলাতে এদিক ওদিক, আরও দু-চারজনা। দেখলে চেনা যায়, তারা শহুরে কেতার মানুষ না। গ্রামীণ মানুষ, বসে বসে গান শোনে। তবে শহুরে মেয়েদের দিকে নজরে কিঞ্চিৎ কৌতূহল। হয়তো গোকুলদাসদের সঙ্গে শিউড়ি থেকেই এসেছে। কিংবা গোপীদাসের হেরুক থেকে। নতুবা নিতান্ত জয়দেবের যাত্রী আসর নিয়ে বসে গিয়েছে।
গোপীদাসের গানের আসরেও লোকজন কম না। রাধা বৃদ্ধা পাশে আছে তার। সুজন গোকুলও রয়েছে। সুজন তার দোতারা বাজায় হেলেদুলে। বিন্দু কোথায় কে জানে। কুসুম তাকে কোথায় ডাকতে ছুটে গেল জানি না। কিন্তু মজা লাগিয়েছে বটে গোপীদাস। গান গাও তুমি আসরে বসে। তোমার যত ভুরু কাঁপানো, চোখের ইশারা, হেসে হেসে হাত তুলে এদিকে দেখানো কেন। কেবল কি তাই। গানের কথাও তেমনি। সেই যে বলে, ‘কথা পড়ে সভার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে’ সেই রকমের ব্যাপার। গোপীদাস গায় সভার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। সে যেন বিটলে বুড়োর মতো চোখের নজর আর গানের কথা, গাছতলাতে ছুড়ে মারে,
‘আগে না জেন্যে প্রেম-ফল
খেয়্যেছিলেম প্রেমের গাছে উঠ্যে।’
গানের সঙ্গে হাঁ করে হাত দিয়ে খাওয়ার ভঙ্গি করে। তারপর বুক চেপে ধরে, মুখ বিকৃত করে গায়,
‘অই গ জাইনলে খেত্যেম না,
গাছে উইঠতেম না
এখন বিষের জ্বালায় বেড়াই ছুট্যে।…
সি প্রেম সরল লয় হে, গরল মাখা,
জম্মাবধি স্বভাব বাঁকা।
এখন উগরাইতে লারি।
উহু মরি মরি
বিষের জ্বালায় আমার পরান ফাটে।’…
হায় হায় ধ্বনি ওঠে আসরে। আর গোপীদাসের বারে বারে এদিক চেয়ে ইশারা করা দেখে আসরের সবাই গাছতলার দিকে ফিরে ফিরে চায়। বড় গোলমেলে বুড়া। অকারণ মানুষের সামনে লজ্জা দিতে চায়। আবার হেঁকে জিজ্ঞেস করে, “হাঁ চিতেবাবাজি ঠিক বইলছি তো?’
হেসে ঘাড় নাড়ি। তবু একটা আড়ষ্টতা ঘোচে না। যতবার চোখ তুলি, ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। লিলি হঠাৎ পাশ থেকে বেজে ওঠে, ‘আপনি আর ঘাড় নাড়বেন না মশাই।’
‘কেন?’ বলে তার দিকে ফিরে তাকাতেই ঘাড় অবধি রুক্ষু চুলের গোছায় ঝাপটা দেয় নাগরিকা। সখীর দিকে তাকায়। ঝিনি চোখ নামিয়ে নেয়। ওর গায়ে ফুল-তোলা মেয়েলি পশমি শাল, আঁচলের মতো করে গায়ে ছড়ানো। লিলির গায়ে মেমসাহেবের পশমি কোট। সামনের দিকে বোতামগুলো সব খোলা। তার ফাঁকে রাঙা শাড়ি, রাঙা জামা শোভে। ওর তুলনায় ঝিনিকে বৈরাগিণীই মনে হয়। গেরুয়া রঙের খয়েরি পাড় শাড়িতে খয়েরি রঙের নানা ছাঁদের ছাপ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় নামাবলি বুঝি।
লিলি প্রায় চোখ পাকিয়ে বলে, ‘কাল আসতে পারেননি?’
অবাক হয়ে বলি, ‘কাল আসবার তো কোনও কথা ছিল না।’
‘কথা না থাকলে বুঝি আসতে নেই?’
এ রকম পালটা প্রশ্নের জবাব হয় না। তাই বলি, ‘না, শুধু শুধু আসব—মানে—।’
লিলি সে কথায় কানই দেয় না। আবার বলে ওঠে, ‘আর কথা থাকলেই যেন আপনি আসতেন?’
বলে ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ঝিনি হেসে বেজে ওঠে। যেন এতক্ষণে মনের মতো একটা কথা শুনেছে। বলে, ‘তাই না বটে!’
সঙ্গে সঙ্গে লিলির পালটা কথা, উলটা রূপ। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে ঝিনিকে বলে, ‘থাক ভাই, তুমি আর কথা বলো না।’
অমনি ঝিনির অবাক চোখ দুটি বড় হয়ে ওঠে। মুখে একটু রং লেগে যায়। প্রায় যেন অভিমান করে বলে, ‘কী মেয়ে বাবা!’
এবার আমার অবাক হবার পালা। আমি মধ্যখানে বসে দুই সখীকে দেখি। লিলির কথা শুনে মনে হয় না, এ মেয়ে একেবারে নিটুট নাগরিকা। ঘাড় নেড়ে বলে, ‘এখন কী মেয়ে বাবা! কই, কাল থেকে তো এরকম হাসতে দেখিনি।’
বলেই আমার দিকে চায়। আবার বলে, ‘কাল থেকে এ মেয়ে নিয়ে মশাই একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম।’
ব্যাপার বুঝতে পারি না। লিলির কথার ঢঙে হাসি পায়। তবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী ব্যাপার?’
লিলি ঝিনির দিকে দেখিয়ে বলে, ‘জিজ্ঞেস করুন কী ব্যাপার। আমার কোনও ব্যাপার নেই।’
বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তাকাই ঝিনির দিকে। ঝিনি যেন বিব্রত বিস্ময়ে সখীর দিকে চেয়ে থাকে। তবু ভুরুতে একটু বাঁক। চোখের তারায় যেন কী কথা। মুখে কিছু বলে না।
লিলি আমার দিকে ফেরে। জিজ্ঞেস করে, ‘কেঁদুলিতে কবে আসবেন নানুরে ওকে বলেছিলেন?’
মনে করতে পারি না ঠিক। কিন্তু দুই সখীর কথার বিষয় এবার অনেকটা আঁচ করতে পারি। বলি, ‘ঠিক মনে নেই। এখানে আসব বলেছিলাম।’
লিলি বলে, ‘আর কাল থেকে এসে অবধি কী খোঁজাখুঁজি। কাল তো তবু একরকম গেছে। আজ সকাল থেকে তো নাড়ি ছেড়ে যাবার জোগাড়।’
ঝিনি আর একবার অস্বস্তিতে লজ্জায় বলে ওঠে, ‘আহ্, কী হচ্ছে লিলি!’
এখন আর লিলিকে থামানো যাবে না। সারা দিনের একটা শোধ তো আছে। মনে মনে আমিও বলি, থাক না এ প্রসঙ্গ।
লিলি বলে, ‘এত বড় মেলায় এত মানুষের মুখ দেখে দেখে বেড়ানো যায়! বলুন তো মশাই।’
ওর ‘মশাই’ বলা শুনলেই আমার হাসি পায়। বলি, ‘খুব অসুবিধে!’
ঝিনি এবার আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে ভুরু বাঁকিয়ে তাকায়। বলে ওঠে, ‘মোটেই তা করিনি।’
‘করিসনি?’
লিলির কাজল লাগানো চোখের পাতায় কুঞ্চন। ঝাপসা রং ঠোঁটে ক্ষোভের স্ফুরণ। বলে, ‘আমি একলা সাক্ষী, না? কুসুম বিন্দুরা সাক্ষী নেই? তারপরে কী যেন সেই ছেলেটির নাম—কাশীনাথ, সে পর্যন্ত খুঁজেছে।’
এবার আমিই বলে উঠি, ‘তা এত খোঁজাখুঁজির কী ছিল।’
লিলি হাত উলটে বলে, ‘সেটা আপনি জানেন আর ইনি জানেন। মুখ দেখেই বুঝতে পারছেন, দুপুর বেলা ইনি মুখে অন্ন তুলতে পারেননি। এবার যান, খাইয়ে নিয়ে আসুন।’
আমাকেও জড়িয়ে দিয়ে লিলি বড় বেশি লজ্জায় ফেলে দেয়। কিন্তু ঝিনির এতটা উতলা হবার কী ছিল। হবেই বা কেন। আমি ঝিনির দিকে ফিরে তাকাবার আগেই ওর গলার প্রায় একটা আর্ত আক্ষেপের ধ্বনি বাজে, আহ্ লিলি, কিছু রাখলিনে।’
বলেই মুখটা নিচু করে দু’ হাতে ঢাকে। লিলি তখনও আপন স্রোতে বহতা, ‘আপনি আসবার একটু আগেও গোটা মেলার ধুলো মেখে ফিরেছি। সন্ধ্যাবেলা তো মেয়ে—।’
কথা শেষ হবার আগেই লিলি চকিত হয়ে ঝিনির দিকে ফিরে তাকায়। ঝটিতি উঠে গিয়ে একেবারে ঝিনির গা ঘেঁষে বসে। উদ্বেগে হেসে বলে, ‘এই ঝিনি, ও কি, রাগ করলি আমার ওপর?’
ইহার নাম মানবীলীলা। একটু ভেঙে বললে, যুবতীলীলা। এর কী বুঝবে বলো। ঝিনিকে দেখে বোঝা যায়, ও মুখ ঢেকে কাঁদছে। রোধ করতে চেয়েও পারছে না। লিলির কথায় কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে জানায়, রাগ করেনি।
লিলি চকিতে একবার আমার দিকে চায়। এখন সখীকে বিঁধিয়ে কাঁটায়, নিজে বেঁধে অনুশোচনায়। বলে, ‘তবে কেন কাঁদছিলি? আমি কি যার-তার সামনে কিছু বলেছি? ওঁর সামনেই তো বলেছি।’
ঢাকা মুখ থেকেই ভেজা রুদ্ধ গলা শোনা যায়, ‘কাঁদিনি।’
লিলি আবার আমার দিকে চায়। ওর আঁকা ভুরু কাঁপে, চোখের তারায় কী যেন ইশারা করে। ইশারা ধরতে পারি না। তাই জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকি। আর বুড়া বাউলটা কী লাগিয়েছে দেখ। সেই চোখ ঘুরিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে গেয়েই চলেছে,
‘অই অই, কে বলে সই পিরিত ভাল
পিরিত কর্যে ই লাভ হল্য
সোনার বরণ কালি কইল্য
পিরিত কন্নোদ্বারে পিরবেশিয়ে
ঢুইকল যেইয়ে হিদ্মাঝারে
শেষে ধরে আপন জোর
আমারে করে চোর।
অকলঙ্ক্যে কলঙ্ক রট্যে।’
লিলির চোখের তারায় তখনও কী এক নিঃশব্দ ইশারা। যদি বুঝেও থাকি তার ইশারা, সেই মতো কাজ করা দায়। আমার পক্ষে ঝিনিকে সান্ত্বনা দেবার কিছু নেই। বরং অন্য কথা বলি, ‘আপনারা যে আসবেন, সে কথা আমার জানা ছিল না।’
লিলি বলে, ‘নাই বা থাকল। না হয় আজ সকালেই আসতেন।’
এ কথারও কোনও জবাব থাকতে পারে না। হঠাৎ ঝিনি ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘জানা থাকলে বোধ হয় আসতে না, না?’
এখনও চোখ শুকায়নি। ভেজা আরক্ত চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি হানে ঝিনি। অবাক হয়ে হেসে বলি, ‘আসব না কেন? বলেছিলাম তো আসব।’
‘কিন্তু জানতে না যে, আমরা আসব।’
‘তা জানতাম না বটে।’
‘জানলে কি আসতে?’
কী উত্তর দেওয়া যায় এ কথার। যেন কোনও কারণেই হোক, জয়দেবের মেলায় আসব না কেন? এ তো আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। ঝিনি আসবে জানলেও আসতাম। ও এত ভুল ভাবে কেন? এত অবিশ্বাস কেন?
ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে হঠাৎ আমার দেখাটা বদলে যায়। ওর চোখ দিয়ে যেন ওকে দেখতে পাই। আর তখন হাসির মধ্যেও একটা কষ্ট কেমন খচখচিয়ে ওঠে। ও এসেছে অনেক দ্বন্দ্বের মধ্যে ধন্দের দোলায় দুলতে দুলতে। অনেক সংশয়ে হাতড়ে ফিরে প্রতি মুহূর্তে হতাশা কাটিয়ে কাটিয়ে চোখের আলোয় আশা ফুটিয়ে। ওর সঙ্গে আমরা তুলনা হয় না। ও এসেছে যোগিনী হয়ে। ওর সব কিছুতেই সেই ছায়া, সেই রূপ। ও যে আসে ভয়ে ভয়ে। কিছু ভুল, অবিশ্বাস থাকবেই তো।
এই মুহূর্তে, ওর মুখ থেকে চোখ সরাতে ভুলে যাই। মন যেখানেই ঘাড় ফিরিয়ে থাক, ও যে কী সুন্দর, তাই ভেবে মুগ্ধ হয়ে থাকি।
ঝিনি হঠাৎ ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘কী দেখছ?’
‘তোমাকেই।’
ঝিনি যেন ভয়ে চমকে কেঁপে ওঠে। যেন উৎকণ্ঠায় স্ফুরিত হয়, ‘মিথ্যুক।’
‘সত্যি।’
‘মিথ্যুক মিথ্যুক মিথ্যুক ।’
তিনবার করে বললেই যেন সত্যি হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিজ্ঞেস করে, ‘একবারও কি ভেবেছিলে, আসতে পারি?’
সত্যি কথাই বলি, ‘সেটা ভাবিনি বটে।’
‘জানলে কি আসতে?’
ঘুরে আবার সেই কথা। নির্দ্বিধায় জবাব দিই, ‘আসতাম।’
ওর সন্দিগ্ধ চোখে গভীর বিমর্ষতা ফোটে। মাথা নেড়ে বলে, ‘বিশ্বাস হয় না।’
‘কেন বিশ্বাস হয় না?’
ওর দৃষ্টিতে অন্যমনস্কতা ফোটে। গলার স্বরেও জাগে। বলে, ‘কী জানি কেন বিশ্বাস হয় না। কেবলই মনে হয়, আমি যেখানে থাকব, তার অনেক দূর দিয়ে তুমি চলে যেতে চাও।’
ঝিনির এই অসহায় রূপটা আমি চিনি। জানি, আমাকে উপলক্ষ করে যে কথাটা বলে, সে কথা ওর জীবনের গভীরে মিশে আছে। এমনিতে যে ভয়ংকর কিছু জটিলতায় জড়িয়ে আছে, তা না। ওর দাদার মৃত্যু, দাদার বন্ধু হেনরির কারাবাস, ওর প্রায় কৈশোরেই সেই রাগী বিষণ্ণ দুঃখী বন্ধু, স্বামীই বলা চলে, যার সঙ্গে ওর আইনত বিয়ে হয়েছিল, মারা গিয়েছে অথচ বাবা-মা জানেন না, সব মিলিয়ে কিছু মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা আছে। তার পরেও আর দশটি মেয়ের মতো নিটোল সংসার পেতে জীবন কাটানো এমন কিছু আশ্চর্যের ছিল না।
কিন্তু সংসারে যারা নিটোল জীবনে অনায়াস হতে পারে না, ওর ভিতরে আছে সেই বিড়ম্বিত মন। আয়াসের মধ্যেই ওর আশা ফেরে। অনায়াস কিছু দেখলে ধন্দ লাগে। যে কারণে ও ছুটে বেড়ায়। না পাওয়ার মধ্যে ডুব দিতে চায়। সম্ভবত এমন মনেরই বিশেষত্ব, চোখের জলেই হাসির কিরণ দেখবে বলে চেয়ে থাকে। ঈশ্বরে ওর বিশ্বাস আছে কি না জানি না, কিন্তু জীবনের সব কিছুই যে বড় দূরে, দূর দিয়ে চলে যায়, ওর এই আর্তস্বরে কোনও ফাঁকি নেই।
ওর কথা শুনে লিলির সামনে আমার একটু লজ্জা করে। লিলি সখীর মুখের দিকেই চেয়ে রয়েছে। আমি একটু হেসে হালকা করেই বলি, ‘এটা তুমি ভুল করো। দূর দিয়ে চলে যাবো কেন। আমি তোমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলব কেন। নিজের তাগিদেই বাঁচে, নিজের তাগিদেই চলে।’
ঝিনি দ্রুত মাথা নেড়ে বলে, ‘ঠিক তাই, ঠিক তাই। তুমি চলে যাও নিজের মনে, আমি তোমাকে ধরতে পারি না। সেটাকেই বলি, দূর দিয়ে চলে যেতে চাও।’
ঝিনি যদি এমনি করে বলে, তবে তার জবাব দিতে পারি না। তারপরে হঠাৎ হেসে, .দু’চোখে ঝিলিক দিয়ে বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, যদি এমন হত তুমি খালি আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চাও, তা হলে কী ভীষণ ভাল হত?’
ধন্দের চমকে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’
ও বলে, ‘ভাল হত না? খালি এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চাওয়া মানেই তো কিছুতেই আমাকে ভুলতে পারবে না। সব সময়ে মনে রাখতে হত।’
সহসা ওর কথার কোনও জবাব দিতে পারি না। আর ও সারা শরীরে তরঙ্গ তুলে নিঃশব্দে হাসে। আবার যেন লজ্জা পেয়েই ফুল-তোলা শাল দিয়ে ঘোমটা টেনে একটু মুখ চাপা দেবার চেষ্টা করে।
লিলিও যেন অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘তুই তো সাংঘাতিক মেয়ে ঝিনি।’
ঝিনি কোনও জবাব দেয় না। লিলিই আবার বলে, ‘অমনি করে মনের মধ্যে থাকতে হবে?’
ঝিনির যে গলার কাছে স্বর আটকে গিয়েছে, চোখ ভেসেছে, তা ওর কথায় বুঝতে পারি।
বলে, ‘উপায় না থাকলে এমনি করেই থাকতে হয়। কী করব।’
লিলি আমার দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টিতে একটা করুণ অভিযোগ ফোটে। আমি ডাক দিই, ‘ঝিনি।’
‘বলো।’
বলতে পারি না কিছু। কী বলতে হবে, তা জানি না। তবু বলি, ‘বলছি, এমন করে বলো না।’
ঝিনি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে পরিষ্কার গলায় বলে, ‘তোমাকে ভারী জ্বালাতন করছি। রাগ করো না যেন। সারাটা দিন এত কষ্ট পেয়েছি, আর ভয় পেয়েছি, আমার মাথার ঠিক নেই। চলো আমরা মেলায় বেড়িয়ে আসি।’
লিলি সঙ্গে সঙ্গে চোখ কপালে তুলে বলে ওঠে, ‘ও কি রে ঝিনি, আবার বেড়াতে যাবি কী? সারা দিন ঘুরে ঘুরে তোমার যে কোমরে ব্যথা ধরে গেছে!’
‘সত্যি, তাও তো বটে।’
লিলি বলে, ‘তুমি যাও তো যাও, তোমার এখন নতুন বল এসেছে। আমি পারব না ভাই।’
বলে আমার দিকে চেয়ে ঝিলিক হানে। ঝিনি বলে ওঠে, ‘কী বিচ্ছিরি মেয়ে!’
দুই সখীতে আবার লাগে। লিলি বলে, ‘হ্যাঁ, আমি বিচ্ছিরি, তুমি খুব সুচ্ছিরি।’
বলেই আমার দিকে ফিরে বলে, ‘কীভাবে এসেছি জানেন? কাউকে কিছু বলা নেই, কওয়া নেই, শুনি শ্রীমতী একলাই কেঁদুলিতে চলে আসছেন। শুনে বাড়ির লোকেদের দুশ্চিন্তা। ওর মা আমাকে বললেন, ‘তোরা কেউ সঙ্গে যা। একলা একলা কোথায় যাবে।’
আমি হেসে বলে উঠি, ‘খুব ভাল পন্থা বটে। এক যুবতীকে রক্ষা করতে আর এক যুবতী।’
লিলি বলে ওঠে, ‘আরে মশাই, যুবতী কাকে বলছেন। সেসব চিন্তা মাথায় থাকলে তো! আমার বন্ধু তো যাকে বলে পাগলিনী। আর আমি তার পাহারাদার। ও সব যুবতী চিন্তা-টিন্তা কিছু নেই।’
ইতিমধ্যে আমার সামাজিক প্রশ্নগুলো মনে পড়ে। ঝিনিকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার বাবা-মা কেমন আছেন!’
ঝিনির জবাব একট তেরছা হবেই। বলে, ‘তবু যা হোক, মানুষ দুটোকে লিলি মনে পড়িয়ে দিল। ভালই আছেন। তোমার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে দেখা হয়েছে শুনে বাবা বললেন, জানলে যেতাম। মায়েরও খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে দেখতে।’
অগ্রহায়ণের দক্ষিণের দরিয়ায় লঞ্চের ছাদ-ঘরে দুটি মানুষের মুখ মনে পড়ে যায়। যাঁদের সামনে দেখলে মনে হয়, প্রৌঢ়ত্বের সীমায় দুটি নিবিড় প্রাণের যোগে বহতা। অথচ শোকের ছায়া গভীর হয়ে পড়ে আছে দু’জনের মধ্যে। বলি, ‘সময় করতে পারলেই একবার দেখা করে আসব।’
ঝিনি এখন অন্য মানুষ। আমার অনেকখানি কাছে, ঘাড় বাঁকিয়ে মুখ এনে চুপি চুপি স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যি? কবে সময় করতে পারবে বলে মনে হয়?’
ওর ঠাট্টা বা বিদ্রূপ, যাই হোক, এমনই তীব্র, আমাকে অবাক হয়ে হেসে বাজতে হয়। বলি, ‘কেন, বিশ্বাস হয় না?’
‘অবিশ্বাস করিনে। কিন্তু এটুকু বুঝেছি, তোমার চলার পথে না পড়লে কারুর সঙ্গেই দেখা হয় না।’
‘কেন আমার কি সমাজ সামাজিকতা নেই?’
‘আছে, সকলের মতো নয়। ওই যে তখন বললে, মানুষ নিজের তাগিদেই চলে বাঁচে। এড়িয়ে তো তুমি যাও না।’
বলে ঘাড় কাত করে আমার চোখের দিকে কটাক্ষ করে। আমার মুখে কোনও কথা জোগায় না। এমন সময় বিন্দু এসে দাঁড়ায়। সেই লালপাড় গেরুয়া শাড়ি। এইমাত্র যেন কপালে সিঁথেয় সিঁদুর দিয়ে এসেছে। গায়ে একটি খয়েরি রঙের সুতির চাদর। এসেই সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে, ‘জয় গুরু চিতেবাবাজি, জয় গুরু।’
আমিও নড়েচড়ে বসে বলি, ‘জয় গুরু।’
বিন্দু আড়চোখে চায় ঝিনির দিকে। ঘাড় দুলিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘সি হিসাবে লয় গ বাবাজি, ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি বইলছি। না কি বলো গ লিলিদিদি?’
লিলি বলে, ‘তুমিই বলো। আমি বলতে গিয়ে তো দোষী।’
বিন্দু ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘তাই নিকি? ক্যানে, হাস্যে না কান্দ্যে?’
বলে ঝিনির দিকেই আড়চোখে চায়। লিলি বলে, ‘দুই-ই।’
বিন্দু বলে ওঠে, ‘অই অই, বুইঝলে গ লিলিদিদি, উ রাগ তোমার জন্যে লয়, কাঁদাও তোমার জন্যে নয়। সবই কারণে কারণ আছে, বুঝলে তো?’
এতক্ষণে ঝিনি বলে, ‘বাবারে বাবা, বিন্দুদি এবার চুপ করো। আমার অপরাধ হয়েছে।’
বিন্দু সেদিকে চায় না। বলে, ‘এখন আর অপরাধ বা কী, অন্যায় বা কী। আর তো আমাদিগে দরকার নাই, ক্যানে গ লিলিদিদি।’
লিলি বলে, ‘ঠিক বলেছ।’
ঝিনি লজ্জায় হাসে। বিন্দু আমাকেও বিব্রত লজ্জিত করে। জিজ্ঞেস করি, ‘ভাল আছ তো বিন্দু?’
বিন্দু কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে। বলে, ‘ভাল বাবাজি। তবে সাত্থক আমার বাবার লজর, যে তোমার নাম দিইছে চিতেবাঘ। ই কী ঝিনিখেকো গ!’
বলে সে নিজে খিলখিলিয়ে বেজে ওঠে। সেই সঙ্গে তার এই বিচিত্র বিশেষণে লিলি ঝিনিও বেজে ওঠে। আর আমি বিন্দুর ঠাট্টায় একেবারে এতটুকু হয়ে যাই। জয়দেব এসে এমন কথাও শুনতে হল। এই কি আমার নামের বিশ্লেষণ!