১০. কে না বাঁশী বায়ে বড়ায়ি

১০.

এ যেন, ‘কে না বাঁশী বায়ে বড়ায়ি, কালিনী নই কুলে।’ বড়ায়ি, কে যেন বাঁশি বাজায় কালিন্দী নদীর ধারে। সুন্দরবনের হাতায়, এই হাটের মধ্যে, এ যেন সেইরকম। দোকানপসার বুঝতে পারি, ধানচালের আড়ত তো থাকবেই। তার মধ্যে এমন সরু সুরের চড়া শব্দে হারমোনিয়াম কে বাজায়। শুধু বাজায় না, আবার গান করে। তাই বা যদি হল, তাও আবার ইস্তিরিলোকের গলায়। গলাখানিও সেইরকম। চন্দ্রবিন্দু প্রতি অক্ষরেই আছে, সেই সঙ্গেই ধারণা হয়, গলাখানি কাঁসা দিয়ে বাঁধানো। তারপরে যদি বাণীর বিচারে যাও, তবে তো মুচ্ছো যেতে হয়। তখন থেকে এক কলিই দু’তিনবার শোনা যাচ্ছে, ‘প্রেম করে ভাই, সঙ্গে মিলে না…।’ এখন এ কোন ভাই, সেটাই বিচার্য। এ ভাইয়ের অনেক অর্থ। ক্ষেত্রে আর পরিবেশে, কে কাকে না ভাই বলে। প্রেমিক-প্রেমিকাও পরস্পরের ডাকাডাকিতে ভাই হয়ে ওঠে। এ গায়িকার ভাইটি কে, কার প্রতি এমন নালিশ, কে জানে।

গাজি পাশে হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলে। আড়তদার মশাইদের কারুরই সেরকম কাজের তাড়া নেই। আড়তের সামনেই ধানের পাহাড়। মজুরেরা কাজ করছে। পাল্লায় ওজন হচ্ছে। বাইরের ধান ঘরে উঠছে। খাতা-কলম নিয়ে হিসাব করছে কেউ কেউ। এই বে-দিনে সম্ভবত, কেবল সংগ্রহ। এখন কেনারাম, পরে বেচারাম। লাভরাম তারও পরে। বলা যায় না, লোকসানরাম হতেই বা কতক্ষণ। কেনা-বেচার মাঝখানে, লাভ-লোকসানের জোয়ার-ভাঁটা বাইরে দেখতে পাবে না। তবে যদি আড়তদারদের মুখের দিকে নজর করে দেখ, জোয়ারের ঝলক দেখতে পাবে। দিগন্তের মাঠ তার সাক্ষী। বসুমতী পরিপূর্ণ। সেখানে ভরা ভরতি থাকলেই হল। জোয়ারের কোটালের তিথি-নক্ষত্র সেখানেই।

‘ও গাজি, তোমার সঙ্গে কে?’

আড়তের মহাজন মশাইরা সবাই, মাত্র চোখে দেখে নির্বিকার থাকতে পারে না। হাটের দিন হলেও একটা কথা ছিল। ভিড়ের মধ্যে কত লোকের আনা-যানা। তার আবার চেনা-অচেনা। কিন্তু এই ফাঁকায় ফাঁকায়, বে-দিনে অচেনা লোক দেখলে একেবারে নির্যস চুপ করে থাকা যায় না। তাই জিজ্ঞাসাবাদ। গাজির জবাব সেই এক, ‘বাবু বেড়াতি এসেছেন।’

আড়তদার মশাইদের কারুর কারুর ভুরু কুঁচকে যায়। চোখ দিয়ে গাজির বাবুকে একটু মাপজোক করা হয়। অবাক না হয়ে করে কী। এ তোমার ভারী শহর বন্দর নয়। এই নোনা গাঙের কূলে, বাদার গঞ্জে কেউ আবার বেড়াতে আসে নাকি। বুড়া আড়তদার মশাই ভুড়ুক ভুড়ুক হুঁকা টানেন, হেসে বলেন, ‘এখানে আর কী দেখবেন। খালি ধান আর চাল।’

পথে বেরুনোর কারণ যদি শুধু তাই হয়, তবে বলি, এ পাপচক্ষে তাই বা দেখতে পাই কোথায়। ধান চাল তো নিজের সীমায় আর তেমন নজরে পড়ে না। তবু, সোজাসুজি কথার একটা জবাব দিতে হয়, ‘এই একটু নতুন জায়গা দেখা আর কী।’

‘অই সেই।’ আড়তদার বৃদ্ধ হুঁকার চুমো থামিয়ে বলেন, ‘যেখানে যাবেন সেখানেই এক। এদিকে গেলে মাঠ, ওদিকে গেলে জল। মধ্যখানে এই বাজার। বসেন না, বসেন এসে।’

বসব না, বসতে চাই না। তবু বুড়ো মানুষের ডাকটি বেশ। সেই ‘এস জন বস জন’ বলে বাংলায় একটা কথা শোনা ছিল, সেইরকম মনে হল। কাজকর্ম আছে, তার মধ্যে লোকজনের আসা-যাওয়া। চেনা-অচেনা কথা নেই। থাকতে আসনি, রাখতেও চাই না। একটুও বসে যাও। এসেছ আমাদের দেশে। একে বলে সাবেকি শালীনতা। যার মধ্যে একটু প্রাণের সুরের রেশ পাওয়া যায়। তাও বোধ হয়, এই বয়স বলেই এখনও এটুকু শোনা যায়। আগামীকালের কালীনগর গঞ্জের কোনও বৃদ্ধ আড়তদার এ কথাও আর বলবে না। তার চালচলন হবে আলাদা। শহরের আধুনিকতা দিয়েছে পাশাপাশি মানুষের বিচ্ছিন্নতা। মানুষে তা নিক বা না নিক, সময়ের ফের বুঝে, স্রোত ধরে, বিচ্ছিন্নতা টুকরো টুকরো করে দিয়ে যাচ্ছে। সে কেবল আপনা বোঝে। তাইতেই সে হাসল। দুসরাকে সে দেখবে কখন।

সেই ধারা কি এখানেও চোঁয়াচ্ছে না। চোঁয়াচ্ছে, আসছে। সময় তার সব কিছুই সবখানে দিয়ে যাবে। আগে পরে, দেরিতে আর ধীরে। যোগের সুতো এখনও কিছু এইসব মানুষের হাতে। যাদের মুখ হয়তো সামনের দিকে এখনও ফেরানো। কিন্তু হাঁটা শুরু হয়েছে পিছনে, যেদিকে সূর্য পাটে নামে, পড়ন্ত রোদ যাদের মুখে শেষবার আলো দেয়।

ধন্যবাদ দিতে পারি না কেতাবি রকমে, বলি, ‘বসব না, একটু ঘুরে ঘুরে দেখি।’

আড়তদার ফোকলা দাঁতে হাসেন। বলেন, ‘দেখেন, তবে অই দেখবার কিছু নেই। হাটের দিন এলেও হত, দেখতেন কত তরিতরকারি ধান চাল বোঝাই হয়ে যায়। তার সঙ্গে গরু ভেড়া ছাগল, ইস্তক মানুষও।’

‘মানুষও?’ অবাক না হয়ে পারি না।

আড়তদার ফোকলা দাঁতে হাসেন। বলেন, ‘তা বাবা, অত চমকান কেন। খালি কি ধান চাল তরিতরকারি পশু পাখি বিকোয়। মানুষ বিকোয় না? কত মানুষ আপনার কতখানে চালান হয়ে চলে যাচ্ছে। বসে থাকবার জো কই। হাটের দিনে দেখবেন, মানুষ নৌকা ভরে চলে যাচ্ছে। এখন, বাবা, বেচা বলেন, যা-ই বলেন, পেটের ধান্দায় কমনেকার মানুষ কমনে চলে যাচ্ছে। একটু তামাক খাবেন?’

অন্য কোথাও হলে সব কথাগুলোকে ঠাট্টা মনে করতাম। অন্তত তামাক খাবার ডাকে তো বটেই। কিন্তু ভুলে যাই,বয়স দিয়ে ভব্যতার বিচার হয় না। পথ-চলতি লোক একেবারে কচিকাঁচাটি নয়। নিজে খাচ্ছেন, আর একজনকে না বললে কি ভাল দেখায়। তায় আবার ভিনদেশি। বলি, ‘না, না, তামাক খাব না।’

গাজি হেসে বলে, ‘বলি অ বিশ্বাস মশাই, এনারা তামাক খান না, ছিরগেট খান, ছিরগেট।’

বিশ্বাসমশাই ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘তবু বলা দরকার তো।’

এগিয়ে যাই আস্তে আস্তে। কিন্তু বৃদ্ধের মানুষ বিকোবার কথাটা হঠাৎ ভুলতে পারি না। আমি যে চমকে ভেবেছিলাম, ধান চাল গরু ভেড়ার মতো মানুষও বুঝি বিকিয়ে যায়, তা নয়। মানুষ শ্রমে বিকোয়। সেও এক রকমের বিকোনো। দূরের এই ভেড়ি বাঁধের নোনা কূলের হাটে, রোজের শোনা কথার মধ্যে কেমন যেন নিষ্ঠুরতা ফুটে ওঠে। হয়তো সে নিষ্ঠুরতা একেবারে মিথ্যে নয়।

গাজির সঙ্গে এগিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিতেই দেখি, সামনে এক মস্ত পুকুর। তবে, তার বুক-জোড়া কচুরিপানা। পুকুরের প্রায় চার পাশেই ঘর। গাছের গুঁড়ি আর পাটাতন ফেলে ঘাটলা করা আছে। যার যেমন দরকার, সে ততখানি কচুরিপানা সরিয়ে দিয়েছে। সেখানে জল দেখা যায়। বাকি সবই দেখ, শত সহস্র নাগের ফণা তোলার মতো কালো সবুজের ডগা মাথা তুলে আছে। একদা হয়তো এই পুকুরই ছিল এই নোনা কূলে মিঠে জলের ভাণ্ডার। এখন হয়েছে টিউবওয়েল। চাপা কল যাকে বলে। ডান্ডা ধরে চাপ দাও, ভলকে ভলকে জল পড়বে। তাই এ মিঠা জলের ভাণ্ডারের আর কদর নেই। কেবল একজনকে দেখি, কোমর-জলে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে গা ডলছে। তারপরের ঘাটে, খোলা পিঠে চুল এলো করা, পাশ ফেরানো এক মেয়ে বাসন মাজে। বউ বলতে পারি না, কারণ তার ঘোমটা দেখি না। হাটের পিছনে, এমন খোলা জায়গায় বউমানুষের মতো তার ভাবও দেখি না।

কিন্তু সেই গান গেল কোথায়। হারমোনিয়ামের সেই সরু সুতো কাটার শব্দ আর তার সঙ্গে, ‘প্রেম করে ভাই সঙ্গে নিলে না।’… গাজিকে জিজ্ঞেস করতে যাব। তার আগেই দেখ, প্রলয় কাণ্ড। কোনদিক থেকে এল, ধরতে পারি না। এক মাঝবয়সী মোটাসোটা শক্ত গড়নের খালি গা মানুষ ক্ষ্যাপার মতো ছুটে আসছে আমাদের পিছনেই। তাকে কয়েকজন ধরে রাখবার চেষ্টায় টানাটানি করছে। কিন্তু তার জো কী। সে আকাশ কাঁপিয়ে হাঁকে, ‘না, ছেড়ে দাও, ছাড়ো, আজ ওর রক্তদশ্‌শন না করি ছাড়ব না।’

কার রক্ত দর্শন করতে চায়! গাজির দিকে তাকাই। গাজি তাকায় ক্ষ্যাপার দিকে। এই অচেনা তল্লাটে গাজি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু আমার দিকে তার খেয়াল নেই। সে আপন মনে বলে, ‘এই দেখ, পালমশাই যে ক্ষেপে উঠেছে একেবারে। হলটা কী।’

ততক্ষণে পালমশাই আরও এগিয়ে এসেছেন। যারা ধরে রাখবার চেষ্টায় আছে, তাদের মধ্যে একজন বলে, “আরে অ অনাদি, একটু ঠান্ডা হও দি’নি। তুমি যাও, আমরা দেখি কী করা যায়।’

যাকে বলা, সেই অনাদির কাছে থেমে থাকা অনন্তকালের মতো। সে এমন ভাবে এগিয়ে আসে, আমাকে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াতে হয়। সেও এগোয়, তাকে যারা সামলায়, তারাও এগোয়। পুকুরধারে সরু রাস্তা, রাস্তার ধারে ঘর। ঘরে ঢুকতে পারি না, অতএব আমি গাজি দু’জনেই অনাদি আর সামলানো দলের ধাক্কা খাই। গাজিকে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যাপার কী, কার রক্ত দর্শন করতে চায়?’

আমার থেকে সে সমস্যা গাজির অনেক বেশি। সে অনাদির দিকে চোখ রেখে বলে, ‘সেইটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না বাবু। তয়, কেমন যেন একটা সন্দ লাগে। চলেন দেখি, আগায়ে যাই। লোকটাকে তো ভাল বলিই জানি।’

গাজির তো আজ মুরশেদের নামে ভরাডুবি, বাবুর সঙ্গেই দিন কেটে গেল। কিন্তু আমি না জানি মুরশেদ, না গুরু। কেথায় যাই, কেন যাই, কীসের সন্ধানে, তার হদিস জানি না। একটু জানি, এই দূরের বাদার গঞ্জে রক্তারক্তি দেখার ইচ্ছা এক ফোঁটাও নেই। তাই বিরক্ত হয়ে বলি, ‘তুমি যাও, মারামারি দেখতে চাই না।’

গাজি ভরসা দিয়ে বলে, ‘আ হা হা বাবু, ভয় পাবেন না। আসেন না দেখি, বিষয়টা কী।’

ভয় নেই, ভাবনা আছে। যেসব ভাবনা রেখে এলাম পিছনে, এইসব হাঁকডাক উত্তেজনায় সেই ভাবনাগুলোই বিরাজ করে। কে জানে, কার সঙ্গে তার কীসের সংঘাত। যাতে আমার হাত নেই, তাতে আমার কাম নেই। ওই যে অনাদি পাল, এখন সে যদি কারুর রক্ত দর্শন করে, এমন প্রত্যয় নেই যে, ঠেকাতে পারি। তবে যাই কেন। কৌতূহল? সে কৌতূহল আমার আজ নেই। তাও আজ রেখে এসেছি আমার জনপদের সীমায়, সমাজে। সেখানে আমার করবার আছে, বলবার আছে। সেখানে আমার কৌতূহলের কার্যকারণ থাকে। আজ আমার শরিকানা অন্য রূপের সীমায়। কে এক অনাদি পালের ক্ষ্যাপামি আজ আমি দেখব না।

দেখবে না! সব কি তোমার মর্জিতে চলে। দেখ, নামের মজুরের কালো ফাটা হাতখানি তখন বাবুর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। তুমি যাকেই ছাড়ো, ছাড়ো; তোমাকে কে ছাড়ে। ‘যে তোমারে ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না হে।’ কিন্তু লোকটা এত সাহস পায় কোথায়। আলখাল্লা তো বলব না, তালিতে তালিতে তালিখাল্লার ধুলা আমার গায়ে লাগিয়ে অবলীলায় হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। কোনও মানামানি নেই নাকি। বাবু কি তার হাতের লোক নাকি, যেমন খুশি টেনে নিয়ে যাবে। বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে ধমক দিতে যাই। তার আগেই নতুন দৃশ্যে চোখ পড়ে যায়। ভুলে যাই হাত ছাড়াবার কথা। ধমক আটকে থাকে গলায়। দেখি, এক ঘরের সামনে নিচু দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে এক মেয়ে। অনাদি পাল আর তার সামলানো দল সেখানে এসে ঠেক খেয়েছে।

কবুল আমার আগেই করা, মেয়েদের বয়সবিচারে যাব না। তবে নজর বলে, এ মেয়ে যুবতী। কিন্তু সরে দাঁড়াও ভিনদেশি, নজর হুঁশিয়ার। এ তো মেয়ে নয়, যেন নাগিনী ফণা তুলে ঘাড় কাত করে আছে। ছায়াটিও যদি নড়ে, জানবে তা হলেই ছোবল। সেইরকমই দেখি যেন। নয়া কাজলের কালি নয়, বাসি কাজলের কালি তার চোখে। তার সঙ্গেই দেখ, রাত-জাগা ছায়া চোখের কোলে। তাইতে যেন বড় ফাঁদি চোখের চাহনিকে খরতা দিয়েছে বেশি। চোখ নয়, শান দেওয়া ছুরি। তাতে আবার আগুন দপদপায়। বাসি পানের ছোপ ঠোঁটে। সেও যেন আর এক বাঁকা ছুরি। ঠোঁট টেপা, বুকের আগুন বাঁকানো। এর থেকে নতুন খাওয়া পানের রঙে রাঙানো ঠোঁটের ঝলক আলাদা। তাতে রং থাকে, আগুন থাকে না। কালো কালো মুখখানির ছাঁদ এদিকে মন্দ নয়। নাক একটু বোঁচা বোঁচা, তবে তোলো কম নয়। নাকের পাটা থরো থরো, তাইতে নাকছাবির পাথর ঝিলিক হানে, মাথায় ঘোমটা নেই। বাসি খোঁপা এলো। সিঁথের বাসি সিঁদুর কিঞ্চিৎ মলিন। কপালের ফোঁটা, কপাল জুড়ে মাখামাখি করা। জামা নয়, জামার চিলতে গায়ে, অন্তর্বাস বলি। তার ওপরে শাড়িটি ফিনফিনে পাতলা, ফুল ফুল ছাপ। সব ছাপিয়ে সায়ার ফুলছাপ ইস্তক দেখা যায়। পায়েতেও বাসি আলতার দাগ। সাজেগোজে বসনে একটু যেন বিলাপের ছাপ। গলার হারে হাতের চুড়িতেও তাই বলে। তবে ভাবভঙ্গি বিপরীত। যুবতীর নজর যে কার ওপর, বুঝতে পারি না। ঠিক কারুর দিকেই নয়। সাপিনীর চোখ যেন ছায়ার দিকে নিবিষ্ট।

যে দাওয়াতে বসে আছে সে, তার ওপরে ঘরের দরজা বন্ধ। অনাদি পালের লক্ষ সেদিকে। তিনজনে তাকে ধরে রাখতে পারে না, সে জোর করে দাওয়ায় উঠতে চায়। আর মুখে বুলি, ‘ও দরজা আমি লাথি মেরে ভাঙব। আজ আমি ওর রক্ত দশ্‌শন করব। বের হয়ে আয় বলছি, যদি মানুষ হস ত, আমার সামনে বের হয়ে আয়, তোর পিরিতের দৌড় দেখি . আমি।’

সামলানো দলের একজন বলে, ‘আহা ছি ছি, কী করো অনাদি। হাটে বাজারে লোক হাসিয়ে লাভ কী বলো দি’নি। তুমি চলো, আমরা যা করবার তা করছি।’

অনাদি পালের ভৈরব কণ্ঠ তার ওপরে যায়, ‘আর লোক হাসাতে বাকি কী আছে। এ বাজারে কি কারুর কিছু অজানা। ও আমার মাথা হেঁট করেছে, বংশের মাথা হেঁট করেছে। ওকে আমি ছাড়ব না, না না না। অনেক দিন বলেছি, আর না। যে কুত্তায় একবার গু খেয়েছে, সে কুত্তায় আর তা ছাড়তে পারে না। ওকে আজ আমি শেষ করব।’

বলেই সে সকলের হাত ছাড়িয়ে, ঠেলে দাওয়ায় উঠতে যায়। যদিও পারে না, এবং হাঁক দেয়, ‘বের হয়ে আয়, ওরে হারামজাদা, দেখি তোর পিরিত কুড়কুড়ায়, না জান কুড়কুড়ায়।’

ব্যাপার বুঝি না। বন্ধ ঘরে কে, কার উদ্দেশে এমন গুরুতর অভিযোগ যে কুকুরের মতো তার নোংরায় নেশা। তবে, এই যে মেয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, ওদিকে ঘরের দরজা বন্ধ, এদিকে পিরিতি বিষয়ক ধিক্কার, তাতে যেন কেমন একটা চেনা চেনা গন্ধ লাগে। কিন্তু ঘরেই বা কে। মেয়েটি বা কে।

ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন এসে জুটেছে। জোটবার জন্যে আসছে এদিক ওদিক থেকে। কেবল এক ব্যাপারে ধন্দ লাগে। যুবতীর ভাবভঙ্গিটা একটু যেন কেমন। তার খর চোখে আগুন বটে, ফণা তোলা ভাবখানিও ঠিক আছে। ঠোঁটের বাঁকানিতে এমন একটা তুমুল ব্যাপার যেন ভারী তুচ্ছতায় খান খান। আর নজর যদি ঠিক থেকে থাকে, তবে একটা জিনিস ঠিক দেখেছি। অনাদি পাল যতই ঠেলাঠেলি করুক, দাওয়ায় উঠে দরজায় লাথি মারা যেন তার ক্ষমতায় অকুল। কোথায় কীসে বন্ধন করেছে, এমনি ধরা যায় না। মনে হয়, পা ঝুলিয়ে বসা মেয়ে সেই বন্ধন। অথচ দেখ, এ মেয়ে একবারও চোখ তোলে না অনাদি পালের দিকে। অনাদি পালও তার ক্ষ্যাপা ঘোরে যেন বড় সজাগ। মেয়েটির দিকে তার নজর পড়ে না।

আমি গাজির দিকে চাই। গাজির নজর সকলের মুখে মুখে ঘোরে। সে এখন অন্য ঘোরে আছে।

সামলানো দলের একজন আবার বলে, ‘শোনো অনাদি, পাগলামি করে না। তুমি যাও, আমরা ওকে বের করে আনছি। তারপরে মার কাট, পরে হবে। যাও, তুমি যাও দি’নি।’

অত সহজ নয়। আজ রক্ত সব মাথায়, সেই রক্তে আজ আগুন লেগেছে। ভাবে কথায় বোঝা যায়, অনাদির ধৈর্য আজ অধরা। সে চিৎকার করে, ‘না, ওকে না নিয়ে আজ যাব না। আজ ওর একদিন, নয় আমার একদিন। লম্পট, ইল্লুতে! এই সেদিনে হারামজাদাকে কিরা কাড়িয়েছি, নাকে খত দিয়েছে। গত হপ্তায় গে নিজে মেয়ে দেখে এসেছি, বে’ দেব বলে, আর সেই আবার এখেনে, অ্যাঁ?’

অনাদি পাল দু’হাত তুলে ঘোষণা করে, ‘বলি দেব, পাঁটাকে আজ আমি বলি দেব। বের হয়ে আয়।’

কী বিড়ম্বনা! সত্যি সত্যি একটা রক্তারক্তি দেখতে হবে নাকি। গালাগালির তোড় যেরকম, তাতে কানে জ্বালা ধরে যায়। যারা এসে জুটেছে, তাদের মধ্যে থেকেই একজন হঠাৎ বলে, ‘অরে, অ দুলি, একটা কাণ্ডমাণ্ড হবে, তার চে’ বের করে দে না ছোঁড়াকে।’

যুবতী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় বক্তার দিকে। ছিলায় যেন টান পড়ে। ঠোঁটের ধনুক আরও বেঁকে ওঠে। এইবার শোনো, গলায়ও কেমন ছুরি ঝলকায়, ‘কেন, দুলি কি ঘরে ঢুকে কোলে করে বসে আছে নাকি। তোমরা যেখেনে, দুলিও তো সেখেনেই।’

তা বটে, কথায় খুঁত পাবে না। জলজ্যান্ত তোমাদের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার নাম জানা গেল দুলি, কিন্তু এ মেয়ে কে। এ ঘরের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী, ভিতরের প্রাণীটিই বা কে! এক ব্যাপার বোঝা গিয়েছে, ভিতরের প্রাণীটি একটি ছোঁড়া। সে নাকে খত দিয়ে কিরা কেটেছে, আর এখানে আসবে না। তার বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখা হয়েছে। তবু সে এখানে এসেছে। তাতে একটু ‘সন্দ’ লাগে, এ ঘরের অধিষ্ঠাত্রী দুলি নামে এই যুবতী। এবং এই যুবতীর সঙ্গে ঘরে বন্ধ প্রাণীটির কী যেন কী আছে। বোধ হয় সেই পিরিত না কী, অনাদি পালের ভাষায় যা কুড়কুড়ায়।

বক্তা আবার পথ দেখায়; ‘না, সে কথা হচ্ছে না। ছোঁড়াকে বের হয়ে আসতে বল। না হলে একটা কী বিপদ আপদ ঘটবে।’

দুলি শরীরে একটা ঝাঁকুনি দেয়। যেন বিপদ আপদের বোঝা ঝেড়ে ফেলে। তেমনি ঠোঁট বাঁকিয়েই বলে, ‘ডেকে তো আনিনি। নিজের মনে এসে ঢুকেছে, ইচ্ছে হলে নিজের মনেই বেরুবে।’ এই তার বক্তব্য। এ বক্তব্যেও কোনও ত্রুটি নেই। দুলি যদি না ডেকে থাকে, আর সে যদি নিজের মনে এসে থাকে, তবে তাকে নিজের ইচ্ছেতেই বেরুতে দাও। হ্যাঁ, কথার ত্রুটি নেই বটে, কিন্তু এ যেন তলায় তলায় স্রোত বয়ে যায়। যে ডুব দিতে জানো, সে দেখে নাও। তলে তলে একটা যেন লড়াই চলেছে।

বক্তার এবার রুষ্ট স্বর; ‘ঘর তো তোর, তুই না বললে বলবে কে?’

হঠাৎ যেন সাপিনী ঘাড় হেলিয়ে তাকায়। চোখের ছুরিতে খান খান করে কাটে। ঘৃণা যেন উপচে পড়ে। রোষে রোষে ফোঁসে। বলে, ‘ঘর আমার হতে পারে, যাতা’ত্‌ ত সকলের। চলে যাবার কথা নিজের মুখে বলি কোন মুখে বলো। গেরস্তের ঘর তো নয়, এখেনে সবাই আসে।’

বলে যেন বিতৃষ্ণায় আর ধিক্কারে ঘাড় ফেরায় সজোরে। বাসি খোঁপায় ঝাপটা লেগে, আর এক প্রস্ত ভাঙে। একটা ঝকঝকে রুপোর কাঁটা শিথিল হয়ে ঝোলে ঘাড়ের কাছে।

পথিক, আপন বুঝে চলো। বাজারের কোন সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি, এবার তার একটা পরিচয় পাওয়া গেল। এও এক বেচাকেনার হাট। মনের কোণে একটু যে এই ধারণার উঁকিঝুঁকি না ছিল, তা বলতে পারি না। একটু ধন্দ ছিল। এ বেচাকেনার ইতিহাস জানা নেই, কবে থেকে শুরু। কিন্তু যবে চোখ মেলে তাকিয়েছি এই পৃথিবীর দিকে, তখন থেকে এই হাটের দেখা পেয়েছি সমাজের পাশে, জনপদের ধারে। এ সভ্যতার দান কি না, কে জানে। তার হদিসে যাব না। নাগরী। যেখানে যত ঝলক, সেখানেই নগর-নাগরী। যেখানে যত ঝলক সেখানেই নগর-বিলাসিনী বাররামা নায়িকা। দুলির স্পষ্ট কথায়, এলাকা আপন চিহ্নে ফোটে। এখন যেন খেই ধরিয়ে দেয়, সেই সরু তীক্ষ্ণ সুরের হারমোনিয়ামের বেসুরো বাজনা, আর কাঁসা বাজানো গলায়, ‘প্রেম করে ভাই সঙ্গে নিলে না…।’এবার বোঝ সে কোন নিকুঞ্জ থেকে শোনা গিয়েছিল।

কিন্তু এমন বেচাকেনার হাটের দেখা যে এই সুন্দরবনের হাতায়, নোনা গাঙের কূলে, দিগন্ত-জোড়া মাঠের মাঝে, হাটের ধারে পাব, ভাবতে পারিনি। এই বেচাকেনার হাট যবে প্রথম দেখেছি তখন তার মর্ম বুঝিনি। সংসার কবে কাকে চিরকাল কল্পলোকের আলোয় মিনারে বসিয়ে রেখেছে? আলোতে অন্ধকারে, ধুলাতে কুলাতে সে টেনে নিয়ে চলেছে। জীবন ভরে কেবল আমি সু দেখেছি, কু দেখিনি; এমন ‘অংকার’ নেই। বলার কথা কইতে গেলে, তুমি কেবল সু-ভাষ করেছ, কু-কথা বলনি, এমন নিপাট, পবিত্র প্রকাশের চোখ বোজানো ঠ্যাকার নেই। তাই, যবে মর্ম বুঝেছি, তখন সংসার আমার রক্তে দিয়েছে কাঁটা। ঘৃণা দিয়েছে শিহরন। ভয় দিয়েছে দূরে পালাবার তাড়া।

তারপরে এই সংসারের পথে, আপন জীবনে জীবিকায়, চলার চড়াইয়ে উৎরাইয়ে, নিজের গায়ে পায়ের ধুলায়, কান্না হাসিতে চেতন পেয়েছি, এ হাটের প্রমোদকুঞ্জে বিলাপ বাজে, অন্ন অন্ন করে। এরা বাতিল ঝলকের তেল আসলে গ্লানি, যে গ্লানি চোখের আলোর নীচের কালোয়। সলতের বুনোট নিষ্ঠুর পাকে বোনা। পানের পিকে গলাক্ষতের রক্ত ঢেকে রাখার মতো হাসিটা মর্মান্তিক করুণ। অতএব, ওহে মানুষ, নিজের হাতে গড়া বিষপাত্রের গড়নখানি দেখ। আপন চড়াই দেখ, দুরন্ত চড়াই। সেই কলিটি ভাবো, ‘আপনারে চিনলে পরে, চেনা যায় পরওয়ারদিগরে।’

এখানে দাঁড়িয়ে আমার চমক লাগে না, শিরদাঁড়াতে কাঁপন ধরে না। লাজে লাজানো সংকোচে অপমানিত হই না। এইসব সারি সারি ঘরে কাদের বাস, এখন আর তা অস্পষ্ট নয়। তবে, দুলি নামক যুবতীর কথায় অনাদি পালের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। গলার শির ছেঁড়ে কি মাথার রগ ফাটে, সে ঝাঁকুনি দেয় প্রচণ্ড, হাঁক দেয় প্রবল, ‘ওরে লোচ্চা, শুয়োর, এখনও যদি না আসিস, তবে কিন্তু আমি দরজা ভাঙব। এই তোমরা সবাই সাক্ষী।’

দুলি তৎক্ষণাৎ দুলে ওঠে, যেন নাগিনী। আগুনের মতো চোখে রক্তের ছিটা লেগে যায়। অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঘরের দরজা মাগনা নয়। এই ঘরে যখন বাস করি, তখন তা’লে ভাঙচুর আমাকে আগলাতে হবে। তারও সবাই সাক্ষী।’

এইবার বুঝি সত্যি সত্যি রক্তারক্তি হয়। এতক্ষণ স্রোত ছিল তলে তলে। এখন ঢেউ জাগে ওপরে। সোজাসুজি ঢেউ তোলে দুলি বিলাসিনী। কেন, ঘর যখন গৃহস্থের নয়, এ মেয়ে বিবাদে কেন যায়। এ যে বাদার হাটে এসে দেখা পেলাম হালের বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণির। এই রূপের হাটে অরূপের আলো কোথাও ধিকি ধিকি জ্বলে নাকি। তবে কি এ পিরিতি সেই পিরিতি নাকি। ধরায় ফেরে অধরা চিন্তামণি, ফাঁদ পেতেছে বিল্বমঙ্গল। দুলির কথায়, ঘুর ঠিকানায়, সেই কথাটাই বাজে যেন। আসতে বলিনি, যেতে বলব না। এতে কী বোঝ হে। ভিতর ভরে যে আছে সে থাক।

এবার গাজিকে না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘কে আছে ভেতরে?’

গাজিটা নেহাত পাজি, এখনও চোখ ঝিকিমিকি করে। চুপি চুপি বলে, ‘পুরনো কিস্যা বাবু। ঘরের মধ্যি পাল মশাইয়ের ছোট ভাই, অনন্ত পাল। সব বলব আপনাকে পরে।’

ওহ্, ব্যাপার অনাদি-অনন্ত। কবে শুরু, শেষ হবে, কেউ বলতে পারে না। তার চেয়ে, এ পালা চলতে থাকুক, অন্য দিকে যাই। যতটুকু কৌতূহল, সেটুকু মিটে যায়। বাকি যেটুকু, সেটুকুর মধ্যে কোনও টান পাই না। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেকেই অনন্তর নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করেছে। অনাদি পাল হেঁকে চলেছে, ‘আমার বাপের ব্যাটা যদি হোস, তবে বের হয়ে আয়।’…

ভেবেছিলাম, কোনও কিছুতেই এই কাঁঠালকাঠের দরজাটি খুলবে না। দুলির ঠোঁটের মতোই তো শক্ত করে টেপা। কিন্তু সকল বাঁধন ঝরো ঝরো, খুট করে হুড়কো খুলে গেল। অনন্ত পাল দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। দাদা-ভাইয়ের চেহারায় অব্যর্থ মিল, বয়সের একটু ফারাক যা আছে। অনন্তর মাথা নিচু, দৃষ্টি আপন পায়ে। যেন চুরি করে খাওয়া অপরাধী সারমেয়টি। সত্যি অনাদি বাপেরই ব্যাটা, এইটি প্রমাণ হাতেনাতে দিয়েছে।

সকলেরই মুখে যখন স্বস্তি, একটা বিপদ-আপদের ভয় যখন ভঙ্গ, তখন দেখ দুলির দপদপে চোখে কেমন চমক। সে অবাক হয়ে ঘাড় ফেরায়। তার ঠোঁট খুলে যায়। তবু নাকছাবির পাথরটা বারেক ঝিকমিকিয়ে ওঠে। যেন স্বপ্ন দেখা বিশ্রাম, খর চোখে ছায়া ঘনায়।

ইতিমধ্যে অনাদি পালকে তার লোকজন ঠেলাঠেলি করে নিয়ে চলেছে। ‘চলো চলো, বিচার যা তা পরে হবে। বের হয়ে এসেছে যখন, তখন আর এখেনে ল্যাটা বাড়িয়ে কাজ নাই।’

অনাদি পাল জয়ী। ফিরে যাবার পথেও সে নিজের বাপের ব্যাটার দিকে ঘৃণা ছুড়ে বীরবিক্রমে যায়। অনন্ত নেমে আসতে থাকে পায়ে পায়ে।

দুলি আবার ফণা তোলে। এবার সে ঘা খাওয়া সাপিনী, আরও ভয়ংকরী। এবার চোখের সবটুকুই আগুনে আগুন। পণ্যাঙ্গনার গোটা শরীরটাই আগুনের শিখা। যেন শিস দিয়ে বলে, ‘দাঁড়াও।’

অনন্ত দাঁড়ায়। দুলি বিদ্যুতের মতো ঘরে ঢোকে। তার ঘরের ভিতর থেকে এসে দাওয়ায় পরতে থাকে নতুন একটি ছাপা শাড়ি, মনোহারি জিনিস কিছু, হিমানী, পাউডার, আলতা, একটা রুমাল, যেন তাতে কিছু টাকা বাঁধা। এক ঠোঙা খাবার। তারপরে দরজার পাশে একবার তার মুখ ঝলকে ওঠে। গলা শোনা যায়, ‘ওগুলন নিয়ে যাও, লজ্জা থাকে তো আর এ মুখো হয়ো না।’

পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার যেন মনে হল, দুলির চোখ দুটো চলকানো গাঙের মতো দেখাল।

.

১১.

ভেবেছিলাম, বিল্বমঙ্গল অনন্ত পাল দরজা খুলে তার দাদার বাপের ব্যাটা প্রমাণ করেই চলে যাবে। কিন্তু উপহারের ডালি যখন দাওয়ায় এসে পড়ল, অনন্ত থমকে দাঁড়াল। দেখ, অনাদির এত করে দরজা খোলানো কেঁচে যায় বুঝি। অনন্ত আবার বন্ধ দরজায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। সে-পালা শুরুর আগে এবার সরে পড়াই উচিত। ভিড় করে যারা এসেছিল, থমকানো ভাব তাদের চোখে-মুখেও। একবার নজর অনন্তর দিকে, আবার উপহারের ডালির দিকে।

সেই মুহূর্তে অনাদির দলের একজন ফোড়ন দেয়, ‘দেখ অনন্ত, হাটের মেয়েমানুষের ফরকানি দ্যাখ। মুখের উপর বে-ইজ্জত করে।’

ফিরে যেতে গিয়ে কথাটা কানে বেসুরো লাগে। তার থেকে বেসুরো ভঙ্গি দেখি বিল্বমঙ্গলের ভাবে। দেখি, তার বুক চিতিয়ে ওঠে, আগুন চোখে মুখে। এ যে সত্যি সত্যি মানীর মানে লেগেছে। তারপরেই শোনো প্রেমিকের দাওয়া কাঁপানো হাঁক, ‘কী, এত বড় আস্‌পদ্দা, মুখের উপর জিনিস ফেলে দিলে। আবার তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? তবে আমিও এই পিতিগ্‌গে করে যাচ্ছি, শালার এ মুখো আর কোনওদিন হব না।’

বলেই সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে—দরজায় নয়, উপহারের সামগ্রীর ওপর। দু’ হাতে সাবড়ে তুলে নেয়।

আপন জনপদে হলে এমন সহজে দাঁড়িয়ে অপার কৌতূহলে এ দৃশ্য দেখা হত না। ওই যে সেই কথা, অপরিচয় কোনও সীমারেখার দাগ টানে না, তার কোনও দাবি-দাওয়া নেই। চেনাচিনিতেই গোলমাল, সে তখন পরিচয়ের নানান বেড়া তুলে দেয়। সেখানে ভদ্রলোকের সহবত ঘাড়ে আমার পাল্লার কাঁটায় এদিক-ওদিক করে। এখানে অচেনার ভিড়ে আমার সে দায় নেই।

সে দায় নেই, কিন্তু বাদার এই বিল্বমঙ্গলের ব্যাপার দেখে কোথায় যেন নিজের লজ্জা লেগে যায়। মাথা নত হয়ে পড়ে, আর একটা ধিক্কারের ধ্বনি বাজে, ‘ছি ছি ছি।’কী করব, যখন আমি দর্শক, তখন আমিও যোগে যোগ হয়ে যাই। ঘর থেকে প্রেমিকের বেরিয়ে আসা তবু একরকম ছিল। তাতে চলতি স্রোতের টান দেখেছিলাম। এ যে কাদায় পাঁকে ঘুলিয়ে গেল হে।

ঘোলানোর ঘূর্ণি আরও দেখি। দড়াম করে দরজা খুলে যায় আবার। দুলি ফুঁসে ওঠে, হ্যাঁ, এ পিতিগ্‌গেখানিই মনে রেখো, আর এ মুখো হয়ো না, হয়ো না, হয়ো না।’

কথা শেষের আগেই দ্বিগুণ শব্দে আবার দরজা বন্ধ। কিন্তু এবার আর সন্দেহ সংশয় নেই, দুলির খর চোখে গাঙের ধারা, বাসি কাজল ধুয়ে যায়।

‘হবো না, হবো না, হবো না।’

বার বার, তিন বার, এই ‘পিতিগ্‌গে’ আবার ঢোল-শোহরত করে প্রেমিক। বুকের ওপর যাবৎ উপহার তুলে নিয়ে, দাওয়া থেকে হাঁটা ধরে। তার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন। কে যেন ছুড়ে দেয়, ‘হ্যাঁ, ঘরের দব্যি ঘরে নে’ যাও, কাজ দেবে।’

এমন পল্লিতে দাঁড়িয়ে এমন ‘মজা’আর দেখিনি। কিন্তু মজার তালে তাল লাগে না যেন। দোল লাগে না তেমন। মনের যেখানে লজ্জা লেগেছিল, ধিক্কার হেনেছিল, সেখানটা সহসা উদাস হয়ে যায়। বুকের কাছে নিশ্বাস দীর্ঘতর, ভারী লাগে, আলোর বৃত্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। ঝমক ঝমক তালে যেমন আচমকা তারের যন্ত্রে ছড়ের লম্বা টান পড়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে থাকে কেবল বাসি কাজল-ধোয়া দুটো গাঙ-চলকানো চোখ।

গাজি বলে ওঠে, ‘একে বলে মরণ৷’

চোখ ফিরিয়ে দেখি, গাজির লাল ছোপানো দাঁত দেখা যায়। কিন্তু তার ইছামতী-আরশি চোখে ছায়া। সেই যে পাজি পাজি ঝিকিমিকি, তা নেই। আমার দিকে ফিরে বলে, ‘বোঝলেন না বাবু, একে বলে মরণ। সেই যে মুরশেদ বলে না “কল্লি কল্লি সবই কল্লি, আ মরণ, মল্লি কবে জানলি না”, এ সেই রকম।’

আশেপাশে সবাই তখন দুলি-অনন্ত কাহিনীতে আপন বয়ান জুড়তে ব্যস্ত। কেউ তার কথা শোনে না। জিজ্ঞেস করি, ‘কার মরণ?’

‘যে মরেছে, তার।’

বলতে বলতে আবার গাজির চোখের আরশি ঝিকমিকিয়ে ওঠে। দেখ, ছায়ার ছ-ও নেই। বলে, ‘মরণ বোঝেন তো বাবু। তমালের ডালে ঝুলে থাকবার জন্যে যেমন একজন মরতে চেয়েছিল, সেইরকম। জ্যান্ত মরা যাকে বলে।’

ভানুসিংহের পদাবলীতে পড়েছিলাম, ‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান।’ সে মরণে সুখ আছে না দুঃখ আছে, সে চেতন আমার নেই। তবে, গাজির কথায়, মরণ যদি ঘটে থাকে, তবে হাটের মেয়ে দুলির ঘটেছে। নইলে হাটের মাঝে যে মেয়ে আপনাকে হাট করে খুলে বসেছে, সে তো নগদ বিদায়ের আশায়। মজুরি বলো, উপহার বলো, সব কেন সে ছুড়ে ফেলে দেয়। সে যে নিয়মে অনিয়মের তাল বাজে। বুকে যে ডঙ্কা মেরে, ফণা তুলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে দাওয়ায়, দরজা খুলতেই তার কেন বুকের খিল খুলে যায়। তার কেন ফণা নেমে যায়, মুখে ছায়া নামে, বুকের মেঘ গলে গলে পড়ে চোখের দরিয়ায়। কোন জ্বালাতে সে গিয়ে মুখ ঢাকে অন্ধকারে। একে কি বারোবাসরের চাল বলে!

সমাজ আছে, অনাদি-অনন্তে। মনকে বলি, আমাকে তুমি এই ক্ষণে সামাজিক হতে বলো না। দুলির পরাজয়ের মাঝখানে যে মন বিরাজ করে, চোখের জল পড়ে, তার শরিক করো। আজ আমার সেই মনেতে বসত, সেই মনেতে ভাসি। নিরুদ্দেশের অবুঝ ফেরায় আজ আমার এইটুকু পাওয়ানা।

যে পথে চলেছিলাম, সেই পথেই চলতে চলতে বলি, ‘মরণ যদি হয়ে থাকে, তবে তো মেয়েটারই।’

গাজি ঘাড় ঝাঁকিয়ে হেসে বলে, ‘কেন বাবু। অনন্ত পাল জ্যান্ত নাকি।’

রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলি, ‘তাই তো মনে করি। কোন মুখে সে ঝগড়া করে। তাতেই তো সব ঘোলা করলে।’

একটু চেতন মেনে নিজের কথা নিজে শুনলে অবাক না হয়ে উপায় ছিল না। মানী ভদ্রলোক, সে কিনা দুলি-অনন্ত নিয়ে কথা বলে। তাও একটা পথের ফকিরের সঙ্গে।

গাজির আমার সে-সব ভাবনা নেই, যেন রহস্য করে চুপিচুপি বলে, ‘বাবু, ঘোলায় বলেই থিতোয়, তাই কি না বলেন।’

কথার স্রোত যেন বাঁকা। তাতে ডুব দিতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাই। গাজি হেসে বলে, ‘অই যে তখন বললাম আপনাকে, পরে সব বলব। বাবু, এই দাওয়াতে কত ফেলাফেলি ছোড়াছুড়ি, কসম খাওয়াখাওয়ি দেখলাম। সব বিড়ালের আড়াই পা, বোঝলেন না। পুরনো কিস্যা বাবু, পুরনো কিস্যা। গঞ্জের তাবৎ লোকে জানে।’

‘তার মানে, তুমি বলছ—।’

কথা শেষের আগেই গাজি বলে ওঠে, ‘আমি বলব কেন বাবু। আজই রাতের বেলায় আবার যার জিনিস তার ঘরে আসবে, তখন মানভঞ্জনের পালা। তারপরেতে একেবারে ভাব সম্মিলন।’

বলে গাজি হেঁ হেঁ করে হাসে। আবার বলে, ‘তয় যদি বলেন, অনন্ত ঘর থেকে বের হয়ে এল কেন, তা হলি বলতি হয়, দশজনের মধ্যি দাদার একটা মান রাখতি হয়। তেমনি আবার দুলি ছুঁড়িরও মান যায় যে দশজনের সামনে। অই বাবু ঘরের বলেন, হাটের বলেন, সব মেয়েমানুষের এক কথা, “হেঁই, জগতে তোমার কাছে আমি বড়, না বাপ-দাদা বড়?” দুলিরও সেই কথা। মেয়েমানুষকে বলতে লাগবে, “রাই, তুমি ছাড়া কী ছাই জগৎ আছে।” তাইতেই বাবু অনন্তের গোলমাল হয়েছে।’

শুনতে শুনতে এবার চোখের ফাঁদ বড় হয়! ছেঁড়া তালির আলখাল্লা ধুলায় মাখানো, কাঁধে-ঝোলা ফকির এমন মেয়েমানুষ বোঝে কেমন করে। এ তো মুরশেদের নামের মজুরের কথা নয়। সুরের সঙ্গে সঙ্গত যে করে না, সে কেমন করে বোল দেবে। এ মানুষ তবে মুরশেদের নামের মজুর নয় কেবল। ডুপ্‌কি বাজিয়ে ফেরা, পথে ঘোরা উদাসীন নয় শুধু। অন্য মজুরিও আছে। প্রকৃতি নামের মজুরানা না থাকলে, এ বোল কেন বাজবে। অথচ চেয়ে দেখ, প্রকৃতি নাম এর কোথায় আছে।

গাজি তখনও অব্যর্থ চালের বোল দিয়ে চলেছে, ‘আর মান যায় বলেই, মন খেদে মরে, তখন ঝগড়া। অই আপনি যা বলেন, ঘোলা করা। তাই বলি বাবু, না ঘোলালে কি থিতোয়। তয় হ্যাঁ, যদি দেখতেন, দাওয়ার মাল দাওয়ায় পড়ি রইল, হাঁকোড় পাকোড় নেই, অনন্ত চলি গেল, তা হলি জানতেন, ও আলগা রশি, ছাড়াছাড়ি। তলায় তলায় বগবগায়, তাই জল ঘোলায়।’

আবার সেই পাজির চোখে গাজির হাসি। আর যা কিছু বাতপুছ, সব আমার জিভেতেই ঠেক খেয়ে যায়। যা বলার শোনার, এখানেই শেষ। তবু, ভুরু কুঁচকে লোকটার চোখের দিকে না তাকিয়ে পারি না। এ দেখছি রস-দরিয়ার পাকা মাঝি। এমনি চেয়ে দেখ দরিয়ায়, কোথায় আছে ঘূর্ণি, তোমার চোখে পড়বে না। চিনিয়ে দেবে পাকা মাঝি, দেখিয়ে দেবে উতরে যাওয়া। এ যেন সে গোত্র। আমার মনের যেখানে ছিল লজ্জা, ধিক্কারের ছি ছি ধ্বনি, সেই নির্লজ্জতাতেও পিরিতি মন্থিত। যখন তুমি সহজ বোঝ, তখন সে উলটা। প্রেম নামে নদী, সে চলে অদেখায়। তাকে দেখে তরী বাইবে, সে কাণ্ডারি নেই। যে আছে অদেখায়, তাই দেখে চলাই এ মাঝির দায়। কিন্তু, অবাক লাগে, এ গাজিতে সেই মাঝি কোথায়! এ আলখাল্লার ভাঁজে ভাঁজে চাপা আছে নাকি।

আমার দৃষ্টি দেখে তার একটু মন কুঁকড়ে যায় বুঝি। হাতজোড় করে বলে, ‘রাগ করবেন না বাবু, এসব অচাল কুচাল দেখতি হল আপনাকে।’

রাগ করিনি, এ কথাটা জানাবার আগেই আবার সেই, হারমোনিয়ামের সরু সুরের বেসুরো চিৎকার। তার সঙ্গে কাঁসর গলা। এবার একেবারে সামনেই। গাজি নিজের পায়ে বেগ দিয়ে বলে, ‘আসেন, আসেন।’

বহুরূপী বটে, এতক্ষণে গাজি বাবুর কাছে লজ্জা পাবার অবকাশ পায়। তাই তাড়াতাড়ি এ হাট থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। একটু এগিয়েই আবার বাঁকে বাঁক ফেরে সে। ফিরতেই নতুন দিগন্ত, সারি সারি খাবারের দোকান। যাকে বলে, মণ্ডা মেঠাই, খাজা গজা, এ তাই। এই দূরের হাট বলে অচ্ছেদ্দা করা চলবে না। রীতিমতো কাচ লাগানো আলমারিতে থরে থরে সাজানো। রসগোল্লা রাজভোগ পানতোয়া, সব আছে গামলায় গামলায়। হতে পারে অ্যালুমিনিয়ামের গামলা। কাঠের বারকোশে আছে গাল-ফুলানো গজা, প্যাঁচানো অমৃতি, পেতলের বাটায় সন্দেশ। আরও দেখ, লেখা আছে, ‘মিষ্টি দধি’। আড়ালে আবডালে নয়, দোকানের ভিয়েন বসেছে সামনেই। শিঙাড়া নিমকির তো কথাই নেই। তবে, ছবির কথা আর বলব না। এখানেও তার রাজত্ব বেড়ায় বেড়ায়। তার সঙ্গেই ঠাকুরদের নানান বাণী।

এক নয়, কয়েকটি সারি সারি দোকান। ভিতরে বসবার জায়গা অনেক, যজ্ঞিবাড়ির খাওয়া হয়। তার আশেপাশেই রয়েছে চিঁড়া মুড়ি মুড়কি বাতাসা। চিনি মিছরি কদমার দোকান। চারদিকে মাছি পাবে পর্যাপ্ত। তার সঙ্গে বোলতা মৌমাছি। ভয়ে ভয়ে অমন করে হাত পা ছোড়বার দরকার নেই। তুমি যদি হুল না ফোটাও, সে তোমাকে ফোটাবে না। সকলেরই উদ্দেশ্য এক, খাবার সংগ্রহ।

এ দিগন্তে আসা মাত্র হঠাৎ গাজি ভুলে যাই। দুলি-অনন্ত ভুলে যাই। এত যে আমার বেরিয়ে পড়া অচিন পথে পথে, কীসের খোঁজে তাও না জেনে, সেই রসিকের সব রস এখন দেখি জিভের রসের ধারায়। তাত্ত্বিকেরা কাকে বলেন ‘মহাপ্রাণী’, কে জানে। এখন দেখি, মহাপ্রাণী আমার সারা দিনের শূন্য জঠরে উপবাসে কাঁদে। হায়, এত কথা এক নিমেষে হারায়। হঠাৎ মনে হয়, সূর্য অনেক দূরে ঢল খেয়েছে, দুপুর কেটে গিয়েছে কখন। যে দিগন্তেই যাই, দানা বিনে কোন পাখিতে নাম গায়! দেখ, কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে মানুষ, কেবল মানুষ কেন, একেবারে টায়ে-টিকে জীব, এই কথাটা কোনওরকমেই ভুলতে পারা যায় না। সারাদিনের এত ক্ষুধা, কোথায় কখন এমন করে ঝিমিয়েছিল, কে জানে। এখন যেন ডাকাতের মতো হাঁক দিয়ে উঠল।

কেবল যে এইসব দেখেই মহাপ্রাণী চমক খেলেন, তা নয়। রক্তে আর এক নেশা আছে, তার গন্ধও পাই। কোথায় যেন ভাতের গন্ধ ভাসে। তার সঙ্গে তরকারি ব্যঞ্জনের। এত দূরের হাটে সে আশা নিশ্চয় বৃথা। এখানে যাদের বসত, তাদেরই রান্নাবান্না হচ্ছে। তবু মুড়ি-মুড়কি মিষ্টির থেকে ভাত-ব্যঞ্জনের গন্ধেই এই বাঙালি মাছি পাগল।

দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আগেই। দু’পা এগিয়ে গাজিও ফিরে তাকায়। কাছে এসে বলে, ‘খাবার কিনবেন বাবু!’ তা নইলে আর এ হাটে দাঁড়ানো কেন। বললাম, ‘খিদে পেয়েছে, একটু খাওয়া দরকার।’

গাজির যেন নিজের প্রাণে লাগে। বলে, ‘আহ্‌ মুরশেদ, দোয়া করো হে। এতখানি বেলা হল, আমার ইস্তক মনে নাই। কী খাবেন, বাবু!’

অভাবে যা জোটে। বললাম, ‘কী আর খাব। অন্য কিছু তো পাব না, দই মিষ্টি দিয়েই মিটিয়ে নিই।’

ইতিমধ্যে এক দোকান থেকে ডাক পড়েছে, ‘আসেন বাবু, ভাল রাজভোগ আছে, সন্দেশ আছে…।’

ফিরিস্তি শুনতে শুনতে পা বাড়াব ভাবছি, তার আগেই গাজি বলে ওঠে, ‘কইতি তো সাহস পাই না বাবু, দুই তিনখানা ভাতের হোটেলও আছে।’

‘ভাতের হোটেল?’

‘এঁজ্ঞে বাবু। তার মধ্যি, লারাণদার হোটেলখানি বেশ সাফসুরত্‌ আছে। অই যে শোনলেন না, মাহাতো চাচা বললে, একবার নায়ারণের ঘর ঘুরি যাবে। তার মানে, চাচা চাচি ওখেন থেকে ভাত খেয়ে হাঁটা দেবে।’

ভাতের হোটেল শুনে শরীরে ক্রিয়া হয়, কিন্তু মন খুঁতখুঁত করে। হঠাৎ কোনও দিকেই এগোতে পারি না। গাজি উৎসাহ দেয় ‘লারাণদার ঘরে আপনি চ্যার টেবুলও পাবেন, কাচের গিলাস পাবেন, চিনামাটির সানকি পাবেন।’

একটু যেন মন টানে। সামান্য কথা নয়, এ দূরের হাটে চেয়ার টেবিলে বসে, ডিশে বেড়ে ভাত খাওয়া। দেখতে দোষ কী। বললাম, ‘চলো দেখি।’

চলো বলে চলা নয়, সামনের দুটো ঘরের মাঝখানের সরু ফালি দিয়ে ঢুকেই দেখি, সামনে দরমার বেড়ার গায়ে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা, ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণ হিন্দু হোটেল।’ আর কিছু লেখা নেই। মাটির দাওয়া পেরিয়ে ঘর। ঘরের ভিতর কোনও জনপ্রাণীর কায়া তো দূর, ছায়াও দেখি না। চ্যার টেবুলের কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে না। তবে কোথায় যেন ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হয়, তার সঙ্গে মানুষের গলা। গাজির দিকে ফিরে তাকাই। তার নজর অন্য দিকে, সে কদম কদম এগিয়ে যায় শ্রীশ্রীকৃষ্ণ হিন্দু হোটেল পেরিয়ে। এবার দেখ, দরমার বেড়ার গায়ে নয়, যথার্থ কাঠের তক্তা গোলপাতার চালার মাথায় ঝোলানো। তাতে লাল রং দিয়ে লেখা আছে, ‘মহামায়া হিন্দু হোটেল।’ নীচে স্থানের নাম। তবে, দরমার বেড়া এখানেও, এবং তা একেবারে ফাঁকা নয়। রীতিমতো ডাক দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আসুন, সর্বপ্রকার আহার পাইবেন।’ আরও যেন কী সব লেখা ছিল। তার দাগ আছে, অক্ষরের অবয়বগুলো আর অটুট নেই। কালের থাবায় খুঁটে নিয়েছে, নাকি দরমা বেড়া আলকাতরা ধরে রাখতে পারেনি, তা বোঝার উপায় নেই।

সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ডাক শোনা গেল, ‘গাজি যে। খেতি এলে নাকি।’

তাকিয়ে দেখি, ঘরের মধ্যে বেড়া ঘেঁষে মাহাতো খুড়ো কাঁচা মাটির মেঝেয় বসে। সামনে তার কলাই করা থালায় গরম ভাতে ধোঁয়া উঠছে। তার সামনে মুখোমুখি আর একজন উটকো হয়ে বসে কথা বলছে। খালি গা, রোগা রোগা লোকটা, গলায় এক গাছা পৈতা, দুই আঙুলের ফাঁকে বিড়ি। পৈতাগাছার রং দেখে একখানি কেঁচো ভাববার কোনও কারণ নেই। চান করার সময় মাজাঘষা না হয়, তা নয়। তবে নিত্যকার তেলে জলে একটা রং ধরেছে। মাহাতোর কথায় সেও ফিরে তাকায়।

গাজি বলে, ‘বাবুকে একটু খাওয়াতি নে এলাম।’

খুড়ার নজর তখন বাবুর দিকে। নিজেই ডাকে, ‘আসেন না, ঘরে আসেন। ডাল ভাত ট্যাংরা মাছের ঝোল পাবেন। আর-আর যেন কী আছে বললে নারায়ণ।’

সামনের ব্যক্তিটি, আদুর গায়ে পৈতাতে যার পরিচয়, বিড়িতে দুটি টান দিয়ে, মোটা গলায় জবাব দেয়, ‘কুচো চিংড়ির অম্বল।’

তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মুরশেদের নামে, চ্যার টেবুল তো দেখি না। কাচের গেলাসের বদলে দেখি, মাহাতোর সামনে ছোটখাটো একখানি ঘটি। চিনেমাটির সানকির জায়গায় কলাই করা থালা। এ পোড়া চোখে যদি ছানি না পড়ে থাকে, তবে খানে খানে কলাই উঠে যাওয়া কারুকার্য অব্যর্থ দেখেছি।

তুমি দেখ চোখে চোখে, গাজি দেখে মনে মনে। সে বলে, ‘ঘরে চলেন বাবু, চ্যার টেবুল সব আছে ওপাশে। মস্ত বড় ঘর কি না।’

ভাবি, আগে যাবে গাজি, পিছে আমি। কিন্তু গাজি এগোয় না। এসেছি যখন, দেখে যাই। মহাপ্রাণীকে চোখ ঠারবো না, গরম ভাত, ট্যাংরা মাছের ঝাল শুনে, তার আটপৌরে বাংলা স্বাদে রস কাটে। তবে কোথায় যেন পিছটান ফিরিয়ে নিতে চায়। গাজিকে বলি, ‘চলো।’

গাজি হেসে বলে, ‘আমি তো যেতি পারব না বাবু, হিঁদুর হোটেল। আপনি যান, আমি ওই দরজার সামনে গে দাঁড়াই।’

বলে সে আরও কয়েক পা এগিয়ে যায়। লক্ষ পড়ে, আর একটা দরজা আছে ঢোকবার। কিন্তু গাজির কথায় মনের অন্য চমক ভাঙে। গাজি যে মুসলমান, তা মনে ছিল না। তোমাদের নগরে বন্দরে, ঘরে পান্থশালায় যে ব্যবস্থা সে ব্যবস্থা। সেখানে বাবুর্চিতে জাত যায় না। তোমার জিভের রস-খসানো খানা বানায় খানসাহেব। জাত দূরের কথা, তুমি খেয়ে কৃতার্থ। আর এখানে গাজি তোমার দাওয়ায় পা দিলেই ধর্ম রসাতল।

এবার নারাণঠাকুর স্বয়ং দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করে, ‘আসেন বাবু, ভিতরে আসেন।’

দাওয়া পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াই। কী সর্বনাশ, আমার বুক ধড়াসে যায়। পায়ের কাছে, কালো চকচকে এটা কী এঁকেবেঁকে যায়! সাপ মনে করে পেছুতে যাই। নারাণঠাকুর হেসে ভরসা দেয়, ‘ভয় পাবেন না বাবু, ওগুলোন পিঁপড়ে।’

‘পিঁপড়ে?’

‘আজ্ঞে। ডেয়ো পিঁপড়ে। আপনাকে কিছু বলবে না, যান, ওখেনে চেয়ারে যেয়ে যুত করে বসেন।’

এমন কিছু উমদা বাঙালির অহংকার নেই যে, ডেয়ো পিঁপড়ে চিনি না। তা বলে, এইরকম! কোথায় কোন অন্ধকার কোণ থেকে যে এমন পুষ্ট কালো পিঁপড়ের সারি বেরিয়ে আসছে, ঠাহর করতে পারি না। কেবল দেখছি, কাঁচা মেঝের ওপর দিয়ে গুটি কয় বাঁকা লম্বা দাগে, উনি এক গর্তের মধ্যে নিরন্তর চলেছেন। চওড়া কম করে পৌনে এক ইঞ্চি। পাশাপাশি তিন চারজন করে লাইন দিয়েছে।

নারাণ ঠাকুর আবার ডাকে, ‘আসেন, এই যে ইদিকে।’

পিঁপড়ের গণ্ডি পার হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষে তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ, যথার্থই চেয়ার টেবিল। তবে রূপের ব্যাখ্যা চেয়ো না। কিন্তু চেয়ার টেবিলের ওপাশে ভুঁয়ে কে বসে? চিনি চিনি যেন। ভাবতে ভাবতেই মাহাতো খুড়ি তাড়াতাড়ি ঘোমটার আড়াল দেয়। আ ছি ছি, বিড়িতে লাজ নেই, তা বলে ভাতের গরাস পরপুরুষের সামনে তোলা যায়!

.

১২.

কিন্তু মাহাতো গিন্নির পাত পড়েছে এমন জায়গায়, চোখ না পড়ে উপায় নেই। তার দিকে পিছন ফিরে বসব, তাতেও বিঘ্ন। চ্যার টেবলের ব্যবস্থা সেরকম নয়। অথচ, ঘোমটা টানা লজ্জাবতী বউ বলে কথা। আন-পুরুষের সামনে বসে খায়-ই বা কী করে। ভেবে একটু ঠেক খাই। সেই মুহূর্তেই আবার একটু লাল ঘোমটার ফাঁক। মধ্যঋতু আশ্বিনের ঢলঢল মুখখানি চকিতে দেখা যায়। শরতের দিঘি চোখের দৃষ্টি কোন দিকে, বুঝে ওঠবার আগেই দেখি, বারেক ঝিলিক হেনে ওঠে। আবার ঘোমটা আড়াল পড়ে যায়।

দেখতে হবে না, নিশ্চয়ই নারাণঠাকুরকে দৃষ্টি হেনে ধমকাচ্ছে, ‘আ মরণ, মিনসেকে এখানে বসতে দিচ্ছ কেন।’

সরে যাব ভাবতেই নারাণঠাকুর বলে, ‘বসেন বাবু, বসেন।‘

ওদিক থেকে মাহাতোর গলাও শোনা যায়, ‘বসি পড়েন মশাই, অনেক বেলা হল।’

‘হ্যাঁ, আর দিক দিক্‌কত নয়, বসি পড়েন বাবু।’

সামনের দরজায় দেখি, গাজি বাইরের বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে। একেবারে মুখোমুখি। সেও এক কথাই বলে। তবে মাহাতো গিন্নির মোটা-দাগের দেশি কাজলমাখা চোখ দুটিতে যে ঝিলিক হানা দেখলাম, তার কারণ কী!

যাই হোক, পথের মানুষ এসেছ ভোজনাগারে, খাবার পছন্দ হলে খাবে, চলে যাবে। তোমার অত কার্যকারণের খোঁজ কেন। সবাই যখন বলছে, আসন নিয়ে নাও। তবে দাঁড়াও, অমন নগর চালে চেয়ার টেনে বসতে গেলেই বসা যায় না। আর একটু হলেই টাল খেয়ে একেবারে ভুঁয়ে আসন নিতে হত।

এ তো আর পালিশ করা ঘরের মেঝে নয়। লেপামোছা আছে বটে। তা বলে একটু এবড়ো-খেবড়ো থাকবে না, বা দু’একটা ছোটখাটো গর্ত-গার্তা থাকবে না, এমন হলফ কেউ করেনি। চেয়ার টান দিয়ে যেই বসতে গিয়েছি, দেখি সেটা কাত হয়ে টলে যায়। চার পায়ার এক পায়া একটা গর্তে বসে গিয়েছে। নারাণঠাকুর হাত বাড়ায় ধরতে। তার আগেই সামনে নিয়ে বলি, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’

নিজেই টেনে তুলি চেয়ারের পায়া। তার মধ্যেই নারাণঠাকুরের ডিগডিগে রোগা শরীর থেকে গম্বুজ ফাটানো বাজখাঁই হাঁক বেজে ওঠে, ‘ফোঁচা, অ্যাই শালা ফোঁচা।’

একে ফোঁচা, তায় শালা। দুটো শব্দই গালগাল কি না বুঝতে পারি না। কারণ, অমন নাম আগে শুনিনি। যেন গালাগালের মতোই শোনায়। ছোঁচা যদি গালি হয়, ফোঁচাই বা নয় কেন। ডাকা মাত্রই এ ঘরের পিছন থেকে জবাব আসে, ‘এই যে, যাই ঠাকুরমশায়।’

গলা শুনে মনে হয়, হাঁড়ির ভিতর থেকে শব্দ আসছে। এবং স্বর আর্ত। দুপ্‌ দুপ্‌ শব্দে, মাটি কাঁপিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে সে ঢুকল, সে একেবারে নারাণঠাকুরের বিপরীত। দানবতুল্য বললে দোষ হয় না। কিন্তু রঙের নিন্দে করতে পারবে না। হতে পারে তেলহীন রুক্ষু, গোটা গায়ে খড়ির দাগ। তাই বা দেখতে পাচ্ছি কোথায়, লোমেই তো অনেকখানি ঢাকা। তবু রংটি বেশ ফরসাই বলতে হবে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, কিংবা মহামায়া হিন্দু হোটেলের ধোঁয়ায় আগুনে পুরনো তামার পয়সার মতো হয়ে গিয়েছে। গায়ের লোম আর মাথায় চুল, কালোর ভাঁজ কোথাও নেই। ইস্তক ভুরুর চুল পর্যন্ত পাটালি বর্ণ। একটু বেঁটে, তবে যেমন মাংস, তেমনি পেশি। ডিগডিগে নারাণঠাকুরকে এক হাতে ডিগবাজি খাওয়াতে পারে। অথচ ছোট ছোট চোখ দুটি পিটপিটিয়ে এল এমন ভাবে, যেন হাতির সামনে ব্যাঙ এসেছে। পরনের ময়লা কাপড়টা হাঁটুর ওপরেও দেড় বিঘত তোলা।

তাকে দেখা মাত্র নারাণঠাকুর আবার সেই পাঁজরা কাঁপিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে, ‘শালা, কদ্দিন না তোকে বলেছি, মাটি এনে এ গত্তটা বুজোবি।’

এখন শোনো, হাতি করে চিঁ চিঁ ব্যাঙে দেয় হাঁক। এ কি আজব দেশ নাকি যেন সব কিছুতেই আজব খেলা, আজব মেলা। না কী জগৎ-জোড়া এমনি আজব ছড়ানো। নজর করলেই চোখে পড়ে। বেঠিকেতেই ঠিক, অমিলেতেই রং খোলে। ফোঁচা যেন অজগরের সামনে ছাগলছানা। নারাণের দৃষ্টি-ধরা হয়ে ভাঙা গলায় সরু সুতো কাটে, ‘বুজিয়েছিলাম তো।’

‘চোপ! চোপরাও শালা।’

ঘর কাঁপানো ধমকে আমাকেই আবার চেয়ার ধরে টাল সামলাতে হয় প্রায়। যেন দোদমা বোমা ফাটে। কী রেয়াজ দেখ, ওহে পান্থ, যদি চেয়ার ধরে টানতে গেলে তবে তা গর্তে কেন পড়ে। তা হলে তো চেয়ারের পায়া বলবে, গর্ত কেন আছে। গর্ত বলবে, ফোঁচা কেন বোজায়নি। ফোঁচা তো জবাব দিয়েই আছে, ‘বুজিয়েছিলাম তো।’ সব আপদের গোড়া দেখছি, খিদে কেন পায়।

নারাণঠাকুরের গলা তখনও থামেনি, ‘আবার মিছে কথা বলে হচ্ছে।’

তার রোগা রোগা হাত-পা নাড়ার বহর দেখে সন্দেহ হয়, চড়চাপড় বা পদাঘাত না পড়ে। তাতে অবাক হবার কিছু নেই। ফোঁচার ভাব দেখলে সেই রকমই মনে হয়। ইতিমধ্যে আর এক মূর্তি ভিতরের দরজায় উদয় হয়েছে। ময়লা ময়লা ডুরে শাড়ি, কালো-কুলো বউটি। নজর তার নারাণঠাকুরের দিকে, মনও নিশ্চয় ঘটনায় নিবিষ্ট। হাতে ধরা কোলের ওপর ছেলে। মায়ের বুক সে ঢেকে রাখতে দেয়নি। একটিতে কচি থাবা রেখে আর একটিতে মুখ ডুবিয়ে শোষণ চলেছে। যাকে বলে, গাই-বাছুরের খেলা।

মাহাতো এবার সামাল দেয়, ‘যাক, যেতি দাও ঠাকুর, ওসব পরে হবে।’

ঠাকুরের গোঁসা অত সহজে শান্ত হবার নয়। বলে, ‘না দ্যাখ মা’তোদ্দা, শালা আবার মুখের ওপর মিছে কথা বলে। এই কি গত্ত বুজোবার লক্ষণ, অ্যাঁ! শালা খাবে কাঁড়ি কাঁড়ি, কাজের বেলায় নাই। ওদিকে দ্যাখ, বাবুর আমার বউটি বছর বছর বিইয়ে চলেছেন। এত ভার সইবে কে!’

মর্মান্তিক অভিযোগ, অপরাধ অশেষ। ফোঁচার সব দিকেতেই বেশি বেশি। শুধু নারাণঠাকুর কেন, সরকার বাহাদুরের পর্যন্ত ফোঁচাকে কোতল করা উচিত। এ যুগে যে দুটোতে আঁটন শাসন, সে দুটোতে এত বাহাদুরি দেখালে চলবে কেন।

ভাববার অবকাশ মেলে না, হঠাৎ বন্ধ মুখের পাক-খাওয়া অবাধ হাসির খিল খুলে যায়। প্রথম মাহাতো গিন্নির। বোধ হয় নাক-মুখ দিয়ে ভাত ছিটকে যায়। আঁচল খসে যায় ঘোমটার। খিলখিল হাসিতে এমন একটা রাগী আর ভারী আসর কোথায় ভেসে যায়। তারপরে মাহাতো খুড়ো। সেই এক অবস্থা, তবে হাসির গলায় অজস্র কাশি। যাকে বলে দম-ফাটানো। মাহাতোর সঙ্গে সঙ্গেই, বাইরে দাওয়া থেকে গাজির হাসিও বেসামাল হয়ে উঠল। তিনের হাসি আর থামতে চায় না।

কেন। কেমন যেন একটু ধন্দ-লাগানো হাসি। যেন তলায় তলায় কী রহস্যের স্রোত বয়ে যায়। আবার ওদিকে দেখ, এ যেন সেই কথাটাই, পড়ল কথা সভার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। হাসির লহরা বেজে উঠতেই দরজায় দাঁড়ানো বউটি হঠাৎ অদৃশ্য। আর নারাণঠাকুরের অমন যে ব্ৰহ্মতেজের দপদপানি, তা যেন হঠাৎ কেমন হাসির ঝাপটায় নিবু নিব। ঝিমিয়ে-পড়া মুখ একটু বিব্রত। তবু ধমকে দেয়, যদিও গলাতে আর সে জোর নেই। একটি নিটোল খেউড় করে বলে, ‘আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সঙ দেখাতে হবে না। তাড়াতাড়ি ডিশ গেলাস বের করগে যা, টেবিলটা মুছে দিয়ে যা, বাবুকে খেতে দিতে হবে।’

বলে সে এক লহমা দাঁড়ায় না। কারুর দিকে তাকায় না। যেন দৌড় দিয়ে ভিতরের দরজায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই সঙ্গে ফোঁচাও। আর তিনের হাসি আর একবার উচ্চ রোলে ঘর ভাসায়।

কেন, ব্যাপার কী। কেমন যেন একটা ভোজবাজির হাওয়া মনে হয়। ভাবতে ভাবতে চেয়ার টেনে সাবধানে বসি। তিনজনের দিকেই ঘুরে ফিরে তাকাই। মাহাতো গিন্নির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে জিভ কেটে ঘোমটা টানে। পরপুরুষ না! বিড়ি খাওয়ার কথা এখন ভুলে যাও।

গাজি হাসতে হাসতে বলে, ‘জয় মুরশেদ, কী ব্যাজ দ্যাখো দি’ নি। কে দেয় সিঁদ, কারে কই চোর।’

মাহাতোর হাসি আরও জোরে বাজে। বলে, ‘ঘাস খেয়ি যায় ঘোড়ায়, মার খায় গাধায়, সেই গোত্তর হলি।’

কর্তার কথা শুনে গিন্নি আর একবার খিলখিলিয়ে ছলকায়। গাজি বলে, ‘যা বলেছ, চাচা। ওই সেই কথা হলি, ভোলার মন, আমি কার গলাতে ঝুলোব এখন, সখী গো মদন যে তশিলদার ভারী।’

হাসিতে কাশিতে মিলিয়ে জবাব দেয় মাহাতো, ‘কেন, গলায় ঝুলোবার জন্যে ফোঁচাই তো আছে। এই যে বলি গেল, বউ বছর বছর বিয়োয়। তোত ফোঁচাকেই তো বাপ বলি ডাকে। ঠাকুরকে তো ডাকে না।’

আবার ঘর-ভাসানো হাসি। রহস্যের বন্ধ মুখ যেন খুলি খুলি করে। ধন্দের ঘোর যেন কাটে। কিন্তু ধন্দের ঘোরে এতক্ষণ যদি বা মাহাতো আর গাজির দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছিলাম, তা আর পারি না। কোথা থেকে লজ্জা আসে, রুচিতে বাধে। কোথায় যেন একটা দুর্নীতির কাঁটা উঁকিঝুঁকি দেয়। ব্যাপারটা ঘোরালো নিঃসন্দেহে। তবে মাহাতো আর গাজির সঙ্গে এই আলাপের শরিক হতে চাই না।

চেয়ো না, কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি। তা বলে তুমি কারুর মুখে খিল দিতে পারো না। গাজি বলে, ‘তার জো নেই। ছেলেগুলোনও কত্তা বলে ডাকে। বাপ বলি ডাকলে, ওঁয়ার আবার মান যাবে যে।’

‘কী মরণ গ! ’

কথা আসে ঘোমটার ভিতর থেকে, তারপরে হাসি। মাহাতো বলে, ‘তা মন্দ কী বলো। ফোঁচাই ভাল আছে, মিনি মাগনায় একপাল ছেলের বাপ হয়ে ঘুরি বেড়াচ্ছে।’

ঘোমটার ভিতর থেকে হাসির সঙ্গে আবার কথা আসে, ‘আহ্‌ ছি, কী মুখ গ!’

গাজি হা-হা করে হাসে। মাহাতো আবার বলে, ‘কেন, আমার মুখের কী দোষ হলো। অই হে গাজি, বলো না কেন। বউ তোমার ঘর করবি, আর তার পেটের ছাওয়াল এসে বাপ বলবি আমাকে—।’

‘আহ্‌ দূর অ!’

মাহাতো গিন্নি শুধু ঝামটা দেয় না, কাজল-কালো চোখ দেখিয়ে বিরক্তি হানে। যা বলবে তা বলো, আবার নিজেকে নিয়ে টানাটানি কেন। তাতে গিন্নির গায়ে লাগে। হ্যাঁ, আমিও মনে মনে বলি, এবার মাহাতো ক্ষান্ত দিক। এ প্রসঙ্গের মধুতে গাদ বড় বেশি। যত ঘষবে তত আঠা। জমলে আবার মাছিকে টেনে তোলা দায়। কিন্তু আমি ভাবি, খেতে এসে এ কি রঙ্গ দেখি। হাটের মানুষ আসে, চলে যায়। গোলপাতার এই ছাউনির তলায় সবাই দেখে, এ এক ভোজনাগার। মহামায়া হিন্দু হোটেল। কিন্তু এক রূপেতে কত রূপ। এ যেন এক মঞ্চ। এখন এক পালা, অন্য সময় আর-এক পালা। এখন এই পালাতে পাঠ আলাদা, সাজগোজ ভূমিকা বেবাক ভিন্ন। নতুন পালায় নতুন সাজ। তখন নতুন ধড়াচূড়া, ভিন্ন চরিত্র। হাস্যে রহস্যে জানা গিয়েছে, ওসব মহাজন পাচক ঠাকুর প্রেমিক নাগর, দাসী প্রেমিকা। আর ফোঁচা আয়ান তখন কী করে।

ভাবতে গিয়ে বুকের কাছে হঠাৎ কেমন ফিক লেগে যায়। চোখ পিটপিটানো, তামা-রং সেই প্রকাণ্ড মুখখানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ব্যথা কিছু ছিল কি না দেখিনি, একটা অ-মানবিক অসহায়তা মুখ ভরে ছিল। সে কি তখন ঘুমায়, নাকি এই নোনা গাঙের কূলে কূলে, বাঁধে বাঁধে কোনও নিশির ডাকে ফেরে। কোন কূলেতে জন্ম তার, কোন দেশেতে বিয়ে। কোন ঘরের বালা তার ঘরনি হয়েছে। সেই ঘরনির প্রাণের ঘরে কোথায় আছে তার ঠাঁই। এই জীবনের দরিয়া তার কোন প্রবাহে চলে।

বৃথা জিজ্ঞাসা। কোন কাব্য পুরাণ কবে জবাব দিয়েছে, আয়ান-মন-কথা। কে জানে, ফোঁচার প্রাণের বউ-সায়রে, বউ কতখানি খেলে। সেখানে অনুভূতির বোধ কত গভীরে, কতটুকু তরঙ্গ ওঠে, নাচে, কে জানে। কিছুই জানি না। সব প্রাণের কুলুপ টুক টুক করে খুলি, তেমন চাবি আমার হাতে নেই। দেখি মাত্র, রূপ দেখি। যে দেখাকে অরূপ বলে, সেই চেনাচিনি কোথায় আমার। চিনি বলে হাঁক দেব না। তাই, কে জানে, ফোঁচা নামক লোকটির প্রাণে ফুল কোথায় ফোটে, কোথায় ঝরে যায়।

সেই যে লোকটি, কালো কেঁচোর মতো পৈতে গলায়, ডিগডিগে শরীর, হাসির মুখে যার তেজ নিবে যায়, বিব্রত হয়, অন্তর্ধান করে সহসা, এখন তার রহস্য বুঝতে পারি। তাকে দোষ দিতে পারলে, মনের সব গোল মিটে যায়। কিংবা সেই কালো-কুলো বউটি, যে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল একটু আগে, কোলেতে যার ছেলে, সসাগরা ক্ষুধার ভাণ্ড খুলে দিয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছিল, যার চলে যাওয়া দেখে এখন বুঝতে পারি, সে-ই ফোঁচার বউ। মনের গোল মিটিয়ে দুষতে পারি তাকেও। কিন্তু মন বলো, তাইতে কি মন সব সওয়াল জবাব শেষ। এ তো তোমার রূপের বিচার। অরূপ তুমি দেখলে না। না চিনে কার দোষ গাও। অরূপ থাকে সেই বিচিত্রে, যার মুখোমুখি তুমি চিরদিন দাঁড়িয়ে। তোমার অপার বিস্ময়ের চোখে সুখে দুঃখের অকূলের ঢল নেমে যায়। কোনও জবাব কোথাও উচ্চারিত হয়নি। চির-জিজ্ঞাসা, চির-নীরবতায় কেবল ঝিকিমিকি করেছে।

আমি পথের মানুষ, একটু মাত্র ঠেক খাওয়া এই পথের ধারে। আমি নামহীনের মজুর, অচিনের খোঁজে ফেরা মানুষ। আমি কেন এসব ভাবি। বিচিত্র থাক তার বাহারে। আমি চলে যাব, নিরুত্তর ঝিকিমিকি দেখে।

তবে মাহাতো ক্ষান্ত কেন হবে। শুনি, সে তখনও বলছে, ‘একবার কী হল, জানো। ফোঁচাকে বললাম, তোর ছেলে তো তিনটে। একটাকে আমাকে দে, আমি মানুষ করব। ব্যাটা বলে কি জানো? বলে, আচ্ছা, কত্তাকে জিগ্যেস করব। সত্যি যে জিগ্যেস করবে, তা কে জানে। এই গত সনের কথাই বলছি। আড়তদারদের কাছে টাকা আদায়ে এসেছিলাম। একটু পরেই দেখি, ঠাকুর একেবারে মারমূর্তি হয়ে এসি হাজির, হেঁই তুমি কোন সুবাদে ফোঁচার ছেলে চাও? হতি পারো তুমি বড় জোদ্দার, টাকার মঠ থাকতি পারে তোমার ঘরে। তা বলি কি ফোঁচার ছেলেরা জলে ভেসে এসেছে। তারা কি রাস্তার কুকুর বিড়াল। বোঝো দি’নি ঠ্যালাটা। মশকরা করি একটা কথা বললাম—।’

তার কথা শেষ হয় না। ঘোমটার ভিতর থেকে হাসির সঙ্গে খুশির গলা বাজে, ‘বেশ করেছিল, ঠিক বলেছিল।’

গাজি বলে ওঠে, ‘অই, এবার যা বোঝবার তা মনে মনে বোঝো, কোথায় কার টান। যা বলো তা বলো, রক্তের টান বলে একটা কথা আছে তো।’

কান পেতে আছি, মাহাতোর কথা শুনতে পাব বলে। কোনও কথাই আসে না সেখান থেকে। কিন্তু আমার চোখে তখন সহসা ডিগডিগে ঠাকুরটার মুখ ভেসে ওঠে। না, দোষগুণের বিচারে যাব না। তবে কবুল করি, কেবল যে প্রেমিক নাগর মনে করেছিলাম সে বড় মিথ্যে। শুধু প্রেমিক নাগর নয়, জীবের মধ্যে মহৎ যে, সেই পিতৃদেবকে দেখি। রূপেতে নয়, অরূপে ধরা পড়েছে। নাম যাদের ফোঁচার ছেলে, তাদের বাঘের মতো আগলে থাকে নারাণঠাকুর। আসলকে চেনা হলে আর রূপের ধন্দ থাকে না। মন কি যন্ত্র দেখ, ঠাকুরটাকে ভাল লেগে যায়।

কিন্তু ওদিকের নীরবতায় একটু অবাক লাগে। ফিরতে দেখি, সেই কালো-কুলো বউটি এসে ঢুকেছে। এক হাতে ছেলে ধরা, অন্য হাতে বালতি। স্বাস্থ্যটি বেশ আঁটোসাঁটো, মানুষটিও খাটোখুটো। সাজগোজ কিছু নেই তেমন। দেখলে বুঝবে, বসে খাওয়া শরীর নয়। মাহাতো গিন্নির মুখ আমি দেখতে পাই না। কিন্তু ফোঁচার বউয়ের সঙ্গে নিশ্চয় নজর চালাচালি হয়। তাই একটু হাসি দেখা যায় তার মুখে। বালতিসুদ্ধ এসে দাঁড়ায় টেবিলের সামনে। বালতি রেখে তার ভিতর থেকে টেনে তোলে জল-ন্যাকড়া। একে আমরা ন্যাকড়া বলি না, ন্যাতা বলি। হাত তুলে তাড়াতাড়ি সামাল দিই, ‘থাক, থাক, কি করবে?’

বউ একটু চমক খায়, থমকে গিয়ে বলে, ‘মুছব।’

সে আন্দাজ আগেই করেছি, তাই সামলানো। ন্যাতার রং দেখে আর মোছা টেবিলে খাবার ইচ্ছা নেই। তার চেয়ে অ-মোছা এই শুকনো টেবিল ভাল। যদিও অনেক দিনের তেলে-জলের ন্যাতা মোছার যত্নে এই টেবিলের রংও এখন ন্যাতার মতোই হয়েছে। তক্তার মাঝে মাঝে পোয়া ইঞ্চির ফাঁক। ন্যাতার এত আদর যত্নে এখনও কেন ঘুণ ধরেনি, কে জানে। বললাম, ‘মুছতে হবে না, এমনি থাক।’

বউটি যেন কথা ধরতে পারে না। তাই কী করবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক চায়। গাজি বলে ওঠে, ‘বাবু যা বলে তাই করো, আর মোছামুছির দরকার নাই।’

বউ কী বোঝে না-বোঝে জানি না। ন্যাতা বস্তুটি বালতিতে ফেলে তাড়াতাড়ি নিজের শুকনো আঁচল দিয়ে টেবিলটা ঝেড়ে দেয়। একেবারে এমনি কি খেতে দেওয়া যায়। একটা নিয়ম আছে তো। তাকিয়েছিলাম বউটির মুখের দিকেই, হয়তো সে তাকাবে। চোখের দিকে দেখে তার মনটা হয়তো বুঝব। কিন্তু সে তাকায় না। যেমন করে মাহাতো গিন্নির দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, তেমনি একটু হাসে আপন মনে। সেটা লজ্জা কিংবা আর কিছু বুঝতে পারি না। বরং বলি, সংকোচের একটা মাধুর্য যেন আছে। কোলের ছেলেটা আঁচল টেনে খুলতে যায়। বাঁ হাত দিয়েই তাকে একটু থামিয়ে দিয়ে বালতি নিয়ে সরে যায়। মাহাতো গিন্নির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ন্যাতার রংটাই অমনি।’

বলে চলে যায়। বুঝতে পারি, আমার মন তখন এক দুর্নীতির কালি খোঁজে বউটির সর্বাঙ্গে। কিন্তু কোথায় যে সেই পরকীয়ার কালো কালি, দেখতে পেলাম না।

ইতিমধ্যে ফোঁচার আবির্ভাব। সে আমার সামনে রাখে চিনামাটির সানকি, যার নাম প্লেট। আর কাচের গেলাসে জল। আবার দেখ, কী রেয়াজ। নিজেকে নিয়েই মরো তুমি, এ কি ঝামেলা। ফাটাফুটি মাকড়সার জালের দাগ দেখি প্লেটে, এদিক ওদিক ভাঙা। কী করব, মন পরিষ্কার হয় না যে। লজ্জা আর অস্বস্তিতে এবার করুণ স্বরেই বলি, ‘কলাপাতা আছে?’

ফোঁচা একেবারে গোল হয়ে বেঁকে পড়ে। ঘাড় নেড়ে ভাঙা গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আছে। কলাপাতায় খাবেন?’

‘হ্যাঁ।’

একটু যেন অবাক হয় ফোঁচা। বলে, ‘বাবুরা তো এতেই খান কি না। আচ্ছা, নিয়ে আসি।’

বলে সে প্লেট তুলে নিয়ে যায়। আমি বলি, ‘পাতাটা একটু জল দিয়ে ধুয়ে এনো।’

‘আজ্ঞে।’

আবার তাড়াতাড়ি বলি, ‘পাতাটা যেন ন্যাতা দিয়ে মুছো না।’

‘আজ্ঞে, আচ্ছা বাবু।’

জবাবটা প্রায় ভিতর-ঘর থেকেই আসে। মাহাতো হেসে উঠে বলে, ‘দ্যাখ কেমন মজা। আর আমাদের এদিকি কাউকে কলাপাতায় খেতি দাও, অমনি বাবুর মেজাজ খারাপ, হেঁই, থালায় দিতে পার না! ’

গাজি বলে, আমি আবার ভাবি, বাবুর বুঝি চিনামাটির সানকিতেই ভাল হবে। তা—এই ভাল।’

ওদিকে মাহাতো গিন্নির ঘোমটা একটু সরে। বুঝতে পারি, চোখাচোখি গাজির সঙ্গে। একটু পরেই পাতা এসে যায়। ধোয়া কচি সবুজ পাতায় তখনও জলের কণা। এবার চোখে ও মনে একটু ঝলক লাগে। তারপরে পিছনে পিছনেই নারাণঠাকুর। হাতা দিয়ে গরম ভাত দেয় পাতে। দুটি বেগুন ভাজা পাশে দিয়ে ডাল তোলে হাতায়। রূপে গন্ধে ঠিক চিনতে পারার উপায় নেই, কী ডাল। তা ছাড়া, এবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা, কোন পাত্র থেকে, কী পাত্র দিয়ে ঢেলে দেয় চেয়ে দেখব না। যে ডালই হোক, ধোঁয়া দেখে বুঝেছি গরম। ডাল দিয়ে মেখে ভাত মুখে দিতে যাব, হঠাৎ গাজির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। হতেই, গাজি একটু হাসে। বলে, ‘অনেক বেলা হয়ি গেছে, দেরি হয়ি গেল।’

কিন্তু আমার হাতের গরাস হাতেই থেকে যায়, মুখে তোলা হয় না। আমি নামহীনের মজুর, অচিনের সন্ধানী, তবু মনের রসের ধারা কি এই প্রাণে পাক খায় না। কেবল যে একটা মোচড় লাগে বুকে, তা নয়। শুনি, কে যেন আমার মধ্যে ধিক্কার হেনে ভর্ৎসনা করে। এক মুহূর্ত চোখ ফেরাতে পারি না গাজির মুখ থেকে। ফাটা ফাটা মুখখানি, তবু যেন হাসির তরঙ্গে তরঙ্গে ভাঁজ লেগেছে। কোথাও একটু মালিন্য নেই। কিন্তু বেলা যায়, তোমার পেট জ্বলে। মুরশেদের নামের মজুর কি মানুষ নয়। সঙ্গীকে ভুলে যাও, এ. তোমার কেমন ক্ষুধা হে। হাতের গরাস পাতে নামিয়ে বলি, ‘ওহে, তুমি কী খাবে। ভাত না অন্য কিছু।’

এবার দেখ, গাজির আরশি-চোখে কেমন শিশুর লজ্জা ফোটে। তাড়াতাড়ি বলে, ‘সে হবি’খনে বাবু, আগে আপনি দুটো সেবা করে নেন।’

কিন্তু যদি ঠিক দেখে থাকি, তার মুখের আলোয় হঠাৎ নয়া ঝলক ফাঁকি যায়নি আমার চোখে। কেবল নিজের মহাপ্রাণীটিকেই দেখেছিলাম। এখন দেখি, আর-এক মহাপ্রাণীও আমার সামনে। এখন তার চোখ দুটি যেন অনুরাগে তরতরানো। বলি, ‘তা হয় না, যা হবার তা একসঙ্গেই হোক। কী খাবে তা বলো।’

গাজি হা-হা করে হাসে। বলে, ‘বাবুর যে কথা! যা হবার তা একসঙ্গেই হোক।’

হাসি শুনে তার প্রাণের খুশি বুঝতে পারি! তার নজর ধরে, নজর করি মাহাতো গিন্নির দিকে। ঘোমটা কিছু সরানো। আবার চোখাচোখি হয়। কাজল-কালো চোখের নজর, এবার যেন একটু রকম বদলেছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে একটু দেরি হয়। ভুল দেখি, না ঠিক দেখি, কে জানে। মাহাতো গিন্নির চোখেও যেন আমার গাজির দৃষ্টি খেলে। তারপরে গাজির দিকে ফিরে বলে, ‘এখন আবার কী খাবে, চাড্ডি গরম গরম ভাতই খাও।’

ঘোমটা-সোমটা যাই থাক, আওয়াজ ঠিকই দিয়ে যাচ্ছে। ওদিক থেকে মাহাতো বলে, ‘হ্যাঁ, এত বেলায় এখন কি আর মিষ্টি-মাসটায় পেট বোঝে!’

বলে নিজেই ডাকে, ‘কই হে ঠাকুর, গাজিকেও ভাত দাও।’

গাজি বলে আমাকে, ‘আপনি শুরু করেন বাবু।’

ঠাকুর ঘরে ঢুকে একবার অবাক হতে চায়। নতুন খদ্দের পেয়ে তেমন খুশি নয় মনে হচ্ছে। গাজির দিকেই ফিরে বলে, ‘তোমাকে ভাত দেব নাকি।’

গাজি হেসে বলে, ‘তা আজ যখন মুরশেদে দিন দিইছেন—।’

কথা শেষ করতে পারে না সে। তার আগেই নারাণঠাকুর বলে, ‘কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, দাওয়ায় বসে খাওয়া হবে না বাপু। দশজনের খাওয়ার জায়গা, ছোঁয়াছুঁয়ির ভয় আছে।’

যাই বলো, মুখির হাসিটি নিতে পারবে না। গাজি বলে, ‘নিচি বসিই খাবো। একখান কলাপাতা দিতি বলেন। জল খাবার পাত্তর আমার ঝোলায় আছে।’

বলে ঝোলা থেকে বের করে এক অ্যালুমিনিয়ামের গেলাস। নারাণঠাকুর সেসব দেখে না, ‘কী কী খাবে বলো।’

‘অই আপনার যা আছে, সবই দেন। তবে মাছ-টাছ দেবেন না।’

ঠাকুর ভিতরে যেতে যেতে বলে, ‘এদিক নেই, ওদিক আছে।’

চমক একটু আমার মনেও লাগে। গাজির ধর্মে আটকায় কি না জানি না, কিন্তু মুসলমানের সন্তান নিরামিষাশী, এরকমটা দেখিনি। খেতে খেতে চোখ তুলি। গাজি হেসে বলে, ‘সাঁই গাজি দরবেশদের কোনও মানামানি নাই বাবু। মাছ মাংসে রুচি লাগে না।’

বলে সে হঠাৎ গলা তুলেই সুর করে গেয়ে ওঠে,

‘কেয়া হিন্দু কেয়া মুসলমান।

মিল্‌ জুল্‌কে কর সাঁইজী কা কাম।’

মাহাতো গিন্নি আওয়াজ দেয়, ‘এ গান নয়, ভাল গান শোনাতে হরে।’

গাজি বলে, ‘তা শুনোব চাচি। তয়, কবীরের কিস্যা আগে বলি, শোনো, বড় মজার। বাবু, শোনবেন নাকি?’

কবীরের কী কিস্যা শোনাতে চায়, কে জানে। বলি, ‘বলো।’

গাজি কবীরের কিস্যা শুরু করে।

.

১৩.

‘এক ছিল জোলা, বাবু, তার ছিল এক জোলানি। কোন দেশে, তা আমি বলতি পারব না। হবি হয়তো কাশী-গয়ার কাছে কোনও এক জায়গায়।’…

কোথায় গয়া, কোথায় কাশী, সে বিচারে যেয়ো না। কথার ভাবে মনে হবে, যেন এ-পাড়া ও-পাড়া। নিদেন এ-গ্রাম ও-গ্রাম। দুই প্রদেশে, দু’ জায়গার ফারাক কত দূর, কথায় তা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নারাণঠাকুর ততক্ষণে তার কলাপাতায় ভাত বেড়ে দিয়ে হাঁকে, ‘গল্পসল্প পরে ব’লো, আগে ভাত ভাঙ দি’নি, ডাল ঢেলে দিয়ে যাই।’

গাজি ভাত ভেঙে বলে, ‘দ্যান, দ্যান। গল্পখানি তো আপনাকেও শুনোবার জন্যি বলছি ঠাকুরমশাই।’

‘হ্যাঁ, আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই, তোমার ভড়কিবাজি শুনব।’

ঠাকুর খেতে দেয় না, যেন আপদ বিদায় করে। আবার ধমক দিয়ে বলে, ‘আস্তে হাত চালাও, ছিটামিটা লাগবে। দশজনের খাবার জায়গা এটা। দেখি, চচ্চড়িটা নিয়ে নাও।’

গাজির সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। না, এতেও হার মানবার নয়, আরশি চোখের ঝলক ঠিক আছে। বলে, ‘আমি তো আপনার এগারো জন, ছিটা কখনও লাগাতি পারি!’

গাজি বলে, আবার চোখের পাতা নাচায়। সেই নাচন দেখে, চোখ নাচে মাহাতো গিন্নিরও। মাহাতো চাচির সঙ্গে দেখছি, গাজির একটু ভাবের খেলা আছে। হয়তো অনেক দিনের চেনা, অনেক গান গাওয়া আর শোনা। গৃহস্থের বউ আর পথের গাজির ভাবের খেলা তার ভিতর দিয়ে খেলে। ওদিকে মাহাতোর গলা শোনা যায়। ‘তারপরে, বলতে বলতে থেমে গেলে যে। জোলা জোলানির কী হল, বলো।’

ঠাকুর এতক্ষণে ছোঁয়া বাঁচিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে এসেছে। গাজি বলে, হ্যাঁ, তো এক জোলা আর জোলানি, রওনা দিয়েছে, যাবে এক বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নে। জোলার নাম নুরি, জোলানির নাম নিমা। তো, যেতি যেতি জোলানি দ্যাখে, সামনে এক সরোবর, সরোবরে বিস্তর পদ্মফুল আর পদ্মপাতা। ড্যাঙার কাছে সেই পাতাতে এক সোন্দর ছাওয়াল ভাসছে। দেখে জোলানির মন মানে না, মায়ের পেরান তো, বুইলে চাচি। জোলানি সে ছাওয়াল পদ্মপাতা থেকে নিজির বুকে তুলি নিলে।…আচ্ছা বাবু, বলেন দি’নি এখন, এই যে ছাওয়াল, মানুষের সন্তান, এঁয়ার কী জাত আছে।’

দুরূহ প্রশ্ন। বাবুর কান ছিল গাজির দিকেই, কিন্তু পাতে তখন ধূমায়িত ট্যাংরা মাছ। ঝোলের রঙের বাহার দেখলে মেজাজ মোগলাই না হয়ে যায় না। লাল রং যদি মিশিয়ে না থাকে, তবে শুকনো লঙ্কা বিনে এমন ঝলক দেয় না। সে কথা ভাবতেই পেটের নাড়িতে জালা ধরে যায়। তবে একেবারে অপযশ করব না। রূপ দেখে যত ভয়ই লাগুক, ঘ্রাণের ভিতর দিয়ে আদিম রিপুর একটা রিপু উথলে ওঠে। সেটা টের পাওয়া যায় জিভের জলের ধারায়। বরং এতক্ষণে সব মিলিয়ে ‘মহাপ্রাণী’টির কোথায় যেন একটা বিঘ্‌নি বেসুর গাইছিল, সেখানটা জলের ধারায় সাফ হয়ে যায়। ওদিকে মাহাতো কর্তা-গিন্নিকে দই পরিবেশন করা হয়েছে। তাতে কারুর বিশেষ মন আছে, মনে হয় না। এদিকে প্রশ্ন, সরোবরের পদ্মপাতায় যে ছাওয়াল ভাসে, তার জাত কী বলো।

তবে বাবুর আগেই মাহাতো বলে, ‘ছাওয়ালের বাপ কে মা কে, তাই জানা গেল না, জাত বলবে কেমন করে।’

গাজি হেসে ঘাড় দোলায়। বলে, ‘তয় বলো, যে ছাওয়াল জলে ভাসছে, তার বাপ-মা খুঁজতি যাবে কোথায়। এখন, এ ছাওয়াল যে মানুষির, তা মানতে লাগবে। সেই জন্যি বলি কি, মানুষির কি জাত আছে! এ সেই গানের কথা হচ্ছে, ছুন্নত আর পৈতা না দিলি, জাত বানানো যায় না।’…

হঠাৎ কথা থামিয়ে একেবারে সুর করে সেই গানের কলি গেয়ে ওঠে, ‘ছুন্নত দিলি হয় মোচলমান, নারী লোকের কী হয় বিধান। বামুন চিনি পৈতা ধরে, বামনি চিনি কী করে।’…

পুরো গাওয়া শেষ হয় না, নারাণঠাকুরের হাঁক শোনা যায়, ‘আরে খাও দি’নি আগে। পাতে রইল ভাত পড়ে, উনি এখন বামনা বামনি বোঝাচ্ছেন।’

মাহাতো গিন্নির হাসি বেজে ওঠে খিলখিল। তার সঙ্গে আর একটি মেয়ে গলায় হাসি সঙ্গত করে দরজার পাশ থেকে। এ সেই বউটি, যাকে ফোঁচানি বলব না নারায়ণী, বুঝতে পারি না।

ভাতে একবার হাত ঘুরিয়ে গাজি বলে, ‘না, তাই বলি কী যে, মানুষের তুমি একখান নাম দিতি পার, জাতের নাম বলো মানুষ, না কি বলেন বাবু। নামে তোমাকে ডাকি, কামে তোমাকে বুঝি। আচ্ছা বলেন তো বাবু, ফুলের কি কোনও জাত আছে।’

দুরূহ থেকে দুরূহতর প্রশ্ন। শুধু মানুষের হয় না, এবার ফুল ধরে টানাটানি। গাজির মতো এত ব্যাখ্যা বয়ান বাবুর জানা নেই। তবে জবাবের মুখ চেয়ে গাজি কথা বলেনি। তার কথকতার ধুয়া এখন ‘বাবু’। একজনকে না ডেকে কথা বলা যায় না। বলে, ‘ফুলের কোনও জাত নাই। ফুল হলি ফুল, এখন কেষ্টকালি বলেন আর জুঁই টগর বলেন, সে তোমার নাম। কামে তোমার মিঠে বাস, রূপে ঝলমল করো, তুমি ঠাকুর-দেবতার পুজোয় লাগো, তাই কি না বলেন, অ্যাঁ?’

বলতে ইচ্ছা করে, আর যখন মালা হয়ে গলায় দোলে, খোঁপার শোভা হয়, তখন? তবে, তখনও সেই কামের কথাই আসে। কামের অর্থ ‘কামে’র নয়, কাজের, যাকে বলে গুণের বিচার। গলায় দোলা, খোঁপার শোভা, তাও গুণের মধ্যেই পড়ে।

নারাণঠাকুর অমনি বাণ কষে, ‘তবে আর কি। যে ফুলের শোভা নাই, বদ গন্ধ ছাড়ে, তার বিষয়ে কী বলবে।’

গাজি জবাব দেয় ঝটিতি, যেন জোগানো ছিল মুখে। বলে, ‘নিগ্‌গুণ বলব, বুইলেন ঠাকুরমশায়, নিগ্‌গুণ বলব। জাত দিয়ে গুণ বিচার হয় না। অই সেইজন্যি বলি কি, মানুষ হল ফুলির মতন, কেমন কি না বলেন বাবু। তুমি রাম হও কি রহিম হও, তাতে পেয়োজন নাই। এখন তুমি পুজোয় লাগো কি না লাগো, সেই কথাখানি ভাবো, না কি বলেন বাবু।’

বলে চোখ ঘুরিয়ে ঘাড় দোলায়, দাড়িতে নাড়া খেয়ে যায়। যেন গানের মতো সুর করে বলে, ‘পুজোয় লাগতি হবে, লাগতি হবে, তাইতে তোমার জাত মান।’

কথাগুলোর গায়ে তেমন ঝলক নেই। মনে তরঙ্গ ঝাঁপ খায় না। কিন্তু কোথায় যেন চমক লেগে যায়। রাম রহিমে যায় আসে না, পুজোয় লাগো কি না লাগো, তাই ভাবো। এ আবার সেই, ‘কথা কইতে জানলে হয়, কথা ষোলো ধারায় বয়।’ কানে শোনো এক, ভিতরের ধরতাই দুসরা। এবার ভাবো, গাজি কোন বায়ে যায়।

সেই এক কথা, জাতের নাম ছাড়ো, জীবনকে পুজোয় লাগাও।

চেয়ে দেখি, গাজির চোখে ঝিকিমিকি। যেন ধাঁধা বলে, রহস্যে হাস্যে ধাঁধা বানানেওয়ালা। এখন কোন পূজাতে লাগবে তুমি, কী তার মর্ম, তা বোঝো গে মনে মনে। কিন্তু আমি ভাবি, কাঁধে ঝোলা, গায়ে আলখাল্লা, যে নামেরই মজুর হোক, এই তালিতে ধুলাতে রুক্ষুসুক্ষু মানুষটা এক প্রকার ভিখারি ছাড়া আর কী। জীবন কাটে যার দরজায় দরজায়, পথে পথে, নামের গান করে, হাত পেতে যার ভরণ-পোষণ, সে এসব কথা পায় কোথায়। ভাবে কেমন করে। বিদেশের কথা জানি না। জানি না, সেখানে পথে পথে ফেরা, দোরে দোরে ঘোরা মানুষেরা এমন হাসি হেসে, এমন কথা বলতে পারে কি না। কিন্তু ভারতবর্ষের দরজা খুলে উঁকি দাও, দেখবে হাটের মাঝে, চালচুলোহীন মানুষ তত্ত্বকথা বলে। গাছতলাতে নগ্ন মানুষ জীবন ব্যাখ্যা করে। এই দেশেতেই আছে কেবল, সোনার মুকুট ছার, রাজার ছেলে বটতলাতে রাজার রাজা সাজে। আলখাল্লা গায়ে তুলে ঊর্ধ্ববাহু নাচে। আধুনিকতার সুখের বেড়া ডিঙিয়ে চলে যায়, রাঢ়ের ছাতিম গাছের তলায়। যাকে ঘর থেকে দিয়েছি সরিয়ে, একেবারে দাওয়ার নীচে, সেও ধুলোয় বসে হেসে হেসে এমন কথা বলে। কেতাব পুঁথি রাখো, এমন জায়গায় এমন জিনিস পৃথিবীর আর কে আমাকে দেবে!

কেউ না। তাই দেখ, এই দেশেতে ধুলার কথা আগে। এই দেশের গানে ধুলা, প্রাণে ধুলার দাগ। এই দেশেতে তাই ধুলায় লুটানো দেখবে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত। এই দেশ জেনেছে, সোনার চেয়ে দামি যত সব মহৎ প্রাণের জন্ম এই ধুলায়, এই ধুলাতেই লয়। এই দেশ তাই গায়ে ধুলা মেখে মিষ্টি হাসে, তত্ত্ব ভাষে। হৰ্ম্যতল ছেড়ে গাছতলাতে এসে সে পরম কথা শুনিয়েছে। রূপকে অরূপ করেছে।

প্রাণের কথা প্রাণেই লাগে। নারাণঠাকুরের মুখে ঠিক উলটো কথা জোগায়নি। বিরস বিরক্তিতে বলে, ‘যত বাজে প্যাচাল পাড়ে।’

ওদিকে মাহাতো খুড়োর হঠাৎ যেন ধ্যানভঙ্গ হয়। হুস্‌ করে এক নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঠিক, কথাখানি ঠিক বলেছ। তা সে আর পুজোয় লাগাতি পারলাম কই।’

দেখ, ঘরের হাওয়া কেমন বদল হয়ে যায়। হাসিখুশির দোলদোলানি হঠাৎ যেন দীর্ঘশ্বাসে ভার হয়ে ওঠে। যদিও তাতে অন্ধকারের কালি নেই। দশাসই কালো লোকটা, কোকিলের মতো লাল চোখ। যার শ্রী দেখলে নজরে অরুচি। তার ওপরে মোটা মোটা কালো আঙুলগুলো পাতের দইয়ের মধ্যে ডোবানো। তবু হঠাৎ লোকটাকে কেমন করুণ লাগে। যেন এই মানুষ পৃথিবীর আদিম যুগের গুহার মুখে বাস। তার অস্ত্র খাদ্য সবই মজুত, তবু যেন কী এক পরম অসহায়তা তাকে আতুর করে তুলেছে। এখন কে জানে তার প্রাণের কথা। গাজি তার প্রাণের কোন তারেতে ঝঙ্কার দিয়েছে।

ওদিকে মাহাতো গিন্নির ডাগর চোখ দুটিও যেন সন্ধ্যা নামা শান্ত আর গম্ভীর হয়ে ওঠে। আধখোলা ঘোমটার পাশ দিয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় দূরে। বাইরের শূন্যতায়, হয়তো ভিতরের কোনও উথালি পাথালি তরঙ্গে। আর গাজি তখন মাথা নিচু করে। মুঠা মুঠা ভাত মুখে তোলে। তার শব্দ শোনা যায়, সপ্‌ সপ্‌ সপ্‌।

এবার তাই, আমাকেই আওয়াজ দিতে হয়, ‘কিন্তু সেই গল্পটার কী হল, পদ্মপাতার ছেলে?’

গাজি মুখে ভাত নিয়ে ঘাড় দোলায়। তাড়াতাড়ি গেলাসে চুমুক দিয়ে বলে, ‘অই হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। বুইলে কি না মাহাতো চাচা…।’

মাহাতো বলে, ‘হ্যাঁ বলো, তারপরে।’

‘তো জোলানি তত সেই ছাওয়াল বুকে করি তুলি নিয়েছে। নিয়ে জোলাকে বলে,“দেখ এক ছাওয়াল পেইচি।” তা, সেই ছাওয়াল হল একটুখানি, মাত্তর পেট থেকে পড়া। আহ্ মুরশেদ, সে ছাওয়াল হঠাৎ টকটকিয়ে বলি ওঠে, “আমাকে কাশীতে নিয়ে চলো৷” এই যাঁহাতক বলা, জোলার জান খাঁচা-ছাড়া। ভাবে কী যে, এতটুকুন ছাওয়ালে এমন করি কথা বলে, এ না জানি কোন জিন্‌ পেরেত হবি। সে জোলানিকে ফেলি দিল দৌড়। তা বললি কী হয়, তোমার আজ মুরশেদের দিন। এক মাইল ছুটেও দ্যাখে, সামনে সেই ছাওয়ালের মুখ। ছাওয়াল বলে, “আমি জিন্‌ পেরেত নই, তোমার কোনও অনিষ্ট হবি না। তুমি বিবির কাছে ফিরি চলো।” ছাওয়ালের সুন্দর মুখখান দেখে জোলার কেমন পেত্যয় হয়। সে ফিরে আসে। তখন ছাওয়াল বলে, “তোমরা আমাকে পালন করো, ভয়ের কিছু নাই।” সেই থেকে সেই ছাওয়াল জোলা-জোলানির ঘরে মানুষ। আর এই ছাওয়াল হলেন গে কবীর। তয়, যে কারণে বলা—’

গাজির কথা শেষ হয় না। নারাণঠাকুর বলে ওঠে, ‘ওসব গালগল্প রাখো, কবীরের বিত্তান্ত তুমি আমাকে শোনাতে এসো না। ঘরে এখনও আমার বই আছে, তাতে ছাপার অক্ষরে যাবৎ লেখা আছে। চাও তো, পড়ে শুনিয়ে দিতে পারি।’

এ যে ইতিহাসের বিতণ্ডা। তাও কি না, দূর বাদার এক হাটের ভোজনালয়ে। তার্কিক হলেন পাচকঠাকুর। আর এক রাস্তার দরবেশ।

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ঐতিহাসিক কবীরের ঐতিহাসিকতা এই অধীনের তেমন জানা নেই। নিজের ঝোলা ঝেড়ে এইটুকু বলতে পারি, সম্বত শকের ষোড়শ থেকে সপ্তদশের কোনও এক সময়ে তাঁর উদয় এবং অস্ত। পাঠান সেকেন্দর শা তখন বোধ হয় বাদশা। কাশীতে তখন হিন্দু রাজার রাজত্ব। কিন্তু জন্মবৃত্তান্তের হদিস আমার জানা নেই।

গাজি বলে, ‘কেতাবের দরকার কী, আপনি বলেন, আমরা শুনি।’

নারাণঠাকুর তেমন সোজা পাত্র নয়। বলে, ‘কবীরের গুরু ছিলেন কে বল তো।’

গাজি হেসে বলে, ‘রামানন্দ ঠাকুর।’

একটু যেন ঠেক খেয়ে যায় নারাণঠাকুর। তবু বলে, ‘হ্যাঁ, ওই রামানন্দের কিরপাতেই কবীর তরে গেছিল।’

গাজি মাথা দুলিয়ে হাসে। বলে, ‘সে কথা ছাড়েন, তার জবাব আছে। তারপর কী বলবেন, বলেন।’

ঠাকুর বলে, ‘বলছি। ওই রামানন্দ ঠাকুরের এক বামুন শিষ্যি ছিল। সেই শিষ্যির ছিল এক বিধবা মেয়ে। সেই মেয়েকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে রামানন্দ ঠাকুর বলে ফেলেছিলেন, “তুমি ছেলের মা হও।” উনি বিধবা বিবেচনা করেন নাই। অথচ গুরুদেবের আশীর্বাদ, তা না ফলে যায় না। তারপরে দেখা গেল, সেই বিধবা মেয়েরই ছেলে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, বিধবার ছেলে, লোকে নিন্দা-মন্দ করবে, তাই লুকিয়ে ছেলের জন্ম দিয়ে অন্য জায়গায় রেখে এসেছিল। সেই ছেলে কুড়িয়ে পায় এক জোলা আর জোলানি। তারা তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে মানুষ করে।’

গাজি বলে, ‘তা হতি পারে, তবে কথা সেই একই।’

‘কেন এক হবে। কবীর হিন্দুর ছেলে…।’

গাজি ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে, ‘বাপের নামখানিও জানেন নাকি। আজ পর্যন্ত তো শুনি নাই, কবীরের বাপ কে।’

কোথায় গেল খাওয়াদাওয়া, কোথায় কীসের পরিবেশন। এখন এখানে কবীর নিয়ে লাগ্‌ ঝমাঝম্‌। নারাণঠাকুর কেবল বিরক্ত নয়, এবার ক্রুদ্ধ। গাজির দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘দেখ তো, এই ঢেঁকিকে কী বোঝাব। শুনছ গুরুর আশীর্বাদ, তার আবার বাপ কীসের। গুরু আশীর্বাদ করেছিলেন বলেই তো ছেলে হল। তা হলেই বোঝো, হিন্দু গুরুর আশীর্বাদ, হিন্দু বিধবার পেটে জন্ম। এখন তুমি জাত না মানো, তা হলে কী হবে।’

গাজি তবু হাসে। যদিও গুরুর আশীর্বাদে মানুষের জন্ম, কিংবা পদ্মপাতায় আপনা থেকে ভেসে আসা ছেলে, আমার কাছে দুই বৃত্তান্তই সমান। তবে কোথায় একটা বাস্তবের ইশারা এই গল্পে উঁকি দেয়। কিন্তু গাজি কেন হাসে। হেসে হেসে সে বলে, ‘আপনি বলতি চান, কবীর হিন্দু, না কি ঠাকুর মশায়!’

নারাণঠাকুর বিড়ি ধরিয়ে বলে, ‘নিশ্চয়।’

গাজি বলে, ‘তবে শোনেন, “জাতি পাঁতি কুল কাপড়া, এক শোভা দিন চারি। কহে কবীর শুনি হো রামানন্দ! এও রহে ঝকমারি ॥ জাতি হামারি বাণীকুল করতা ঔর মাহি। কুটুম্ব হামারে সন্ত্‌, হ্যায় কোই মুরখ সমঝতে নহী।” হতি পারে রামানন্দ ঠাকুর ওঁয়ার গুরু, তয়, কবীর জাতি পাঁতি ছাড়া। ওঁয়ার কথাই ওঁয়ার জাত, মনের মানুষ কুল, সাধুরা হল কুটুম। ওঁয়ার কোনও জাত নাই। হিঁদুও না, মোচলমানও না।’

নারাণঠাকুর আবার ঠেক খায়। চমক খাই আমি। এ যে ধুকড়ির মধ্যে খাসা চাল। গাজির দৌড় দেখছি অনেকখানি। মিছে মামলার কারবারি নয়, প্রমাণ দিয়ে সওয়াল করে। কেবল যে মুরশেদের নামের মজদুরি নিয়ে ফেরে, তা বলতে পারবে না। এক পাল্লায় কথা, আর এক পাল্লায় বাটখারা। ওজন ছাড়া কেবল কথার কথা নয়। কে জানে, নারাণঠাকুর আবার ছাপার অক্ষর দেখাবে কি না। কিন্তু তার ভাব-সাব একটু অন্যরকম। বলে, ‘সে কথা আলাদা।’

গাজি হেসে আবার ভাত খায় সপাসপ্‌, তারপরে গলায় মধু ঢেলে বলে, ‘আর চাট্টি ভাত দেন ঠাকুরমশায়।’

মুখ দেখলেই বোঝা যায়, নারাণঠাকুরের পিত্তি জ্বলে গিয়েছে। নিজে না গিয়ে সে ঘর থেকেই হাঁক দেয়, ‘ফোঁচা, বকনোতে যে ভাতগুলোন আছে, সেগুলোন একে দিয়ে যা!’

কিন্তু মাহাতো গিন্নি না হেসে পারে না। এখন তার সন্ধ্যা নামা চোখে আবার দুপুরের ঝলক। ঠাকুর আর গাজিতে তলে তলে লড়ে কোথায়, বোধ হয় ধরা পড়ে তার কাছে। গাজির দিকে চেয়ে যেভাবে হাসে, বোঝা যায়, মান্য তার সেখানেই। বলে, ‘ওই নাকি তোমার গল্প।’

গাজি বলে, ‘না, আরও আছে। আসল গল্প তো বলাই হয় নাই। জাতের মজা সেখানেই।’

বলে সে ফোঁচার কাছ থেকে ভাত নিয়ে মাখতে মাখতে বলে, ‘তারপরেতে কবীর তো মারা গেলেন। যেমনি মরা, অমনি মোচলমান শিষ্যরা বলে, তারা কবর দেবে। হিঁদুরা বলে পোড়াব। দু’ দলেতে ঘোর বিবাদ। এও লাঠি তোলে, সেও লাঠি তোলে। বেঁচে থেকি মানুষটা যে এত বলি গিলেন, সব পয়মাল। দুই দলে যখন মারামারি লাগে লাগে, তখন কবীর এসে দেখা দিলেন, বললেন, “বিবাদ করো না, আমার মরার ঢাকা খুলে দেখ।” অমনি দুই দল গে ঝাঁপ খেয়ে প’লো। দ্যাখে, কবীর নাই। ঢাকার নীচে এক রাশ ফুল পড়ি রয়েছে। তখন নাও, কাকে পোড়াবে, কাকে কবর দেবে! তবে বিহিত তো একটা করতে লাগে। তাই, আদ্দেকখানি ফুল নিয়ি গেল কাশীর মহারাজা। সেই ফুল দাহ করি, তার ছাই রেখি দিল এক জায়গায়। আর বাকি আদ্দেক নিয়ি গেল দিল্লির বাদশা। কবর দিই রাখলে গোরখপুরের এক গাঁয়ে। নাও, এবার তুমি কী জাতের বিচার করবে, করো।’

বলে মাথা নামিয়ে আবার খাওয়া আরম্ভ করে। একবারও মনে হয় না, গাজি তত্ত্বকথা বলে। যেন দুষ্টামিতে পরিপূর্ণ, কেবল নারাণঠাকুরকে রাগিয়ে মনে মনে নৃত্য করে। আবার হাঁক দিয়ে বলে, ‘এবার হরি হরি বলো মন। ঠাকুরমশায়, ফোঁচাকে বলেন একটু দই দিতি।’

একে পাজি ছাড়া আর কী বলে। নারাণঠাকুর ততক্ষণে ভিতরে অন্তর্ধান করেছে। ইতিমধ্যে আমার পাতে দই পড়েছে। মাহাতো উঠে দাঁড়িয়েছে। সে যেন এতক্ষণ গল্পের মর্ম ঠাহরের ধ্যানে ছিল।

আপন মনেই ঘাড় ঝঁকিয়ে বলে, ‘দ্যাখ, দেখা দিয়ে নিজির ব্যবস্থা নিজিই করি গেলেন। তা নইলি তো শরীরটাকে কেটিই দু’খান করত সবাই।’

মাহাতো গিন্নি পাত ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘গান কিন্তু শোনাতে হবে।’

একটা বিষয় লক্ষণীয়। মাহাতোর কথায় যেমন এই নোনা কূলের টান, গিন্নির কথায় তা নেই। হবে হয়তো দুজনা দুই অঞ্চল থেকে এসেছে।

গাজি বলে, ‘সময় কোথায়। ভোলাখালি যেতি হবে না!’

মাহাতো বউ শরীরে একটু মোচড় দেয়, হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে। বলে, ‘একটু বসে যেতে হবে। ভরা পেটে হাঁটতে পারব না।’

বলে একবার চোখের কোণে তাকায় কর্তার দিকে। কর্তা তখন দাওয়ায় পা দিয়েছে। সেখানে আঁচাবার ব্যবস্থা রয়েছে। গিন্নিও সেদিকে যায়।

গাজি আর একবার ডাক দেয়, ‘ঠাকুরমশায়, একটু দই দেন গো।’

ভিতর থেকে উচ্চ রবে রুষ্ট স্বর আসে, ‘দই-টই নাই, এখন ওঠ দিকিনি।’

‘আচ্ছা গো মশায়, আচ্ছা আচ্ছা।’

বলে গাজি একবার আমার দিকে চেয়ে হাসে। পাতাখানি গুটিয়ে তুলে কোথায় যেন চলে যায়। বোধ হয় তার এঁটো পাতা যাতে ছোঁয়াছুঁয়ির এলাকা বাঁচিয়ে ফেলা হয়, সেইরকম দূরত্বে চলে গেল।

কিন্তু তার হাসিমুখখানি হঠাৎ কেমন করুণ মনে হয়। মহামায়া হিন্দু হোটেলের দই কিছু অমৃত নয়, আমি সবটুকু মুখে দিতেও পারিনি। আর গাজি একটু চেয়েও পায় না। এ যে শুধু পয়সার জন্যে তা নয়। এর মধ্যে আছে অন্য গ্লানি, অসহায় অপমান। ওর আরশি-চোখে হাসির ঝলকই কেবল দেখি, তার তলায় কি অন্য কোনও স্রোত নেই। নারাণঠাকুরের ওপর মনটা বিরূপ হয়ে ওঠে।

কিন্তু তাই বা কেন ওঠে। তার চেয়ে গাজির হাসন হাসি। তোমার বিরূপ হওয়ার কুরূপ অনেক পথ জুড়ে। তাকে দেখতে গেলে ঠেক খেতে। মানতে গেলে মুখ কালো। হেসে চলে যাও।

সাবধানে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। একে খাওয়া পর্বের শেষ বলব না। বরং কবীর পর্ব বলা ভাল। অবেলায় শরীরে রেশ ভার লাগে। বাইরে বেলার গায়েও ভার পড়েছে বেশ। রোদের রং গিয়েছে ঝিমিয়ে, দিনের শেষের নিরুত্তাপে রক্তিম আর শান্ত।

.

১৪.

হাতমুখ ধোবার পরে এবার দাম চোকাবার পালা। কিন্তু নারাণঠাকুর কোথায়! নিশ্চয় অনুমানে ভুল করিনি, ঠাকুর স্বয়ং পাচক ও মালিক। আদায়-উশুল হিসাব-নিকাশ তারই কাজ। এদিকে গাজিরও খবর নেই। অন্য দিকে কর্তা-গিন্নি অন্য কথা বলে। মাহাতো বলে, ‘যা পাবো, তাই আনব, তুই বস গে যা।’

এমন সময় আসে ফোঁচা। গলার স্বর সেই চিঁচিঁ, চেহারার সঙ্গে একেবারে বেমানান। আমাকে বলে, ‘বাবু কি বসবেন, না যাবেন?’

বসার কোনও প্রশ্ন নেই। খাওয়া হল, এবার খদ্দের বিদায়। মাহাতো বলে ওঠে, ‘কেন, বাবু কি জলে পড়ি গেছে, না এজলাসে হাজিরা দিতি যাবে যে, খেয়েই বিদেয় নিতি হবে।’

ফোঁচা বলে, ‘তা বলি না। ঠাকুর মশায় জিগেস করতে বললেন, তাই।’

মাহাতো তো মাহাতো। বলে, ‘জিগেস করাকরির কী আছে। খাওয়া হয়েছে, একটু বসে বিড়িটিড়ি টেনে যাওয়া হবে। তুমি দাওয়ায় আসন পেতি দাও দেখি একখান। তোমার ঠাকুরমশায় বুঝি খেতি বসবে এখন?’

‘হ্যাঁ।’

‘বসতি বলো গে। খেয়ি এসে দাম নেবে।’

কার কথা, কে বলে। ফোঁচাকে আমি কিছু বলবার আগেই দেখি, যেন হুকুমবরদার হুকুম নিয়ে চলে গেল। কিন্তু খাওয়ার পর হোটেলের দাওয়ায় বসার রীতি আমার জানা নেই। সেই কথাটিই মাহাতো বলে, ‘বসেন না একটু মশায়, বসেন, পান বিড়ি খান। এ তো আপনাদের শহরের হোটেল নয় যে, খাওয়া হতি না হতি দাম মিটিয়ে চলি যেতি হবে।’

বলে আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে গিন্নির দিকে ফেরে। জিগ্যেস করে, ‘হ্যাঁ কী বলছিলি বল।’

বউয়ের মুখ ফেরানো অন্য দিকে। জবাব আসে, ‘বলছি, গাজির জন্যে দুটো পান এনো।’

মাহাতোর হ্যাঁ-না কোনও শব্দ নেই। দাওয়া থেকে নেমে সে হাঁটা দেয়। ফোঁচা এসে একটা শীতলপাটির আসন পেতে দিয়ে চলে যায়। এখন যা করতে হয় করো।

করার কিছু নেই। খেয়েছি, পয়সা না দিয়ে যেতে পারি না। তা ছাড়া গাজি যে আমাকে খাড়া করে রেখে গেল। সে না এলে যেতেও পারি না। অতএব, শীতলপাটির আসনে অধিষ্ঠান। মাহাতো-বউ দাওয়া থেকে সরে দরজার কাছে দাঁড়ায়। আধখানা শরীর ঢাকা পড়ে ঘরের মধ্যে, আধখানা বাইরে। ঘোমটার আড়াল থাকলেও বুঝতে পারি, মুখ ফেরানো তার অন্যদিকে।

খাওয়ার পরে নেশা। গাজির ভাষায় যার নাম ছিরগেট, যার গন্ধ নাকি খুবই মিষ্টি তাই বের করে ধরাই। মুখোমুখি কোনও ঘর নেই। কাঠা দুয়েক জমি ছাড়িয়ে যে-ঘর আছে, তার দরজা অন্য দিকে। সামনে একটা বড় গর্ত, তাতে উনুনের ছাই ছড়ানো, পাঁশ আবর্জনাও কম নেই। গর্তের সামনেই বড় একখানি নিবিড় ছায়া ছড়িয়ে রেখেছে বড় একটা গাছ। হাটের বুকে যে কয়টি গাছ আছে, এই বনস্পতি তার অন্যতম। হয়তো যবে এ জায়গা ছিল সুন্দরবনের আওতায়, তখন এই নাম-না-জানা ঝাড়াল বর্ষীয়ান বনস্পতি ছিল কিশোর। যার নাম সভ্যতা, তার বড় মাটির লোভ। বন কেটে সে চাষ করেছে। তার মধ্যে কোনও রকমে এই গাছের গর্দান বেঁচে গিয়েছে। বয়সের হিসাবে এখন তার ঋতুরাজের কাল, না কি মধ্যঋতুর হাল, বুঝতে পারি না। পুষ্টতা আর সবলতা দেখে অনুমান হয়, বুড়ো সে হয়নি এখনও। পাতায় পাতায় ঝোপে-ঝাড়ে, গাঢ় সবুজের রঙে রঙে বাড়বাড়ন্ত দেখি। প্রথম শীতের ছোঁয়াতে এখনও একটি পাতা ঝরার লক্ষণ নেই। বেলা শেষের আলোয় পাতাগুলো চিকচিক করে। চোখে দেখি না, কানে শুনি, তার ছায়া ঝোপে কোন সব পাখিরা যেন ডাকে। চড়াগলায় নয়, নিচু স্বরে, সেইসব পাখিরা যেন আলস্যে বিলাসে কী সব বলাবলি করে।

হঠাৎ হারাই, হারিয়ে যাই কোথায় যেন। আপন বলে চিনি যাকে, অস্তিত্ব যার নাম, যে আছে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে, সে যেন নিমেষে যায় কোথায়। তার সঙ্গে চলে যায় স্থান কাল পাত্র। কোথা থেকে কোথায়, কেন এসেছি, সে কথা আমার মনে পড়ে না আর। যেন আমার কোনও গুরু ছিল না। শেষ কোথায়, জানা নেই। ওই যে ছায়া, ওই যে গাছ, ওই যে পাখি আলাপ করে নিবিড় নিভৃতে, কোথায় যেন, কোন লোকে মানুষের অস্পষ্ট দু-একটা কথা ভেসে আসে, আর এই দরজায় দাঁড়িয়ে লাল শাড়ি জড়ানো আধখানা মূর্তি দেখা যায়, এইসব যেন এক অরূপ সায়র। আমি তাতে ডুবে যাই। কেন, তা জানি না। সংসারের মুগ্ধ বা অবাক হবার কিছু ছিল না এখানে। তবু সব মিলিয়ে এ যেন এক ঘোর। যেন কী এক সুর বাজে কোথায়, অদেখা অচিন লোকে, মানুষের অধরা সীমায়। বাজে এক নামহীন সুর। আর যেমন করে স্তব্ধ প্রহরের ঘোরে ঘণ্টা বেজে যায়, তেমনি করে আমার হৃৎপিণ্ডে ধুকধুক ধ্বনিত হতে থাকে।…

কখন যেন একটা রোগা কুকুর আসে। কালো-ধলো রং। ছাইগাদায় নেমে বারেক সন্দেহে দেখে দাওয়ার দিকে। তারপর কাছে এসে কান কাঁপিয়ে, ল্যাজ নেড়ে আশা-নিরাশার ধন্দ লাগা চোখে তাকায়। দরজার কাছে বাজে চুড়ির রিনিঠিনি। দেখি, ও গাজির থেকে সাহসী। লাফ দিয়ে দাওয়ায় উঠে ছুটে যায় শব্দের দিকে। শুধু তাই নয়, লাফ দিয়ে হাত বাড়ায় লাল শাড়ির দিকে। হঠাৎ শুনি মাহাতো-বউ হাসে খিলখিল করে। বলে, ‘অই মুখপোড়া, গায়ে উঠিস না। কী আছে যে দেব তোকে।’

তা যদি ও জানত! তাই নড়বার নাম করে না। তবু নড়তে হয়, হঠাৎ মাহাতো আর গাজিকে দেখে। দেখি, দু’জনেরই মুখ চলছে। চিবুনো আর কথা বলা, একসঙ্গেই। চিবুনোর বস্তু পান, দু’জনের ঠোঁট দেখলেই বোঝা যায়। কথার খেই মাহাতোর গলায়, ‘আরে সে তুমি আমাকে কী বলবে। অন্‌তাকেও চিনি, অন্যদিকে চিনতিও আমার বাকি নাই। রাগ হয় অই দুলি ছুঁড়িটার ওপর..হ্যাঁ, এই নাও।’…

দাওয়ায় উঠতে উঠতে এক কথা থেকে আর এক কথায় আসে মাহাতো। বউয়ের দিকে পান বাড়িয়ে দেয়। আবার বলে, ‘কী এক রাংতা দেওয়া জর্দার কথা যেন বলিছিলে, তা পেলাম না। অই দিয়ে কাম চালাও।’

তারপরে দেখি, মাহাতো পানের খিলি বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। বলে, ‘নেন, একটু পান খান।’

গাজিও লাল ছোপের দাঁত দেখিয়ে তাল দেয়, ‘হ্যাঁ বাবু, পান খান।’

কিন্তু গোবিন্দদাস ও রসে বঞ্চিত। তাই বলতে হয়, ‘পান খাই না।’

তা বললে কি মাহাতো শোনে। বলে, ‘আপনার নাম করি এনিচি, খেয়ে ফ্যালেন মশায়।’

গাজি হেসে ঘাড় নাড়ে। কিন্তু ফোঁচার আনা আসনে না বসে উপায় ছিল না। পানের বিষয়ে তা চলবে না। যা বুকে আটকায়, গলা বন্ধ হয়ে যায়, এমন বস্তুর নিমন্ত্রণে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। মাহাতো মশায়কে তাই হাতজোড় করে বলতে হয়, ‘খেতি পারি না, কষ্ট হয়।’

যেন মাহাতো এমন মজার কথা শোনেনি কখনও। বলে, ‘বলেন কী মশায়!’

বলেই সেই কাশি জড়ানো গলায় হাসি। লাল কোকিল চোখে তাকায় বউয়ের দিকে। বউও হাসে, হাসির শব্দ চাপা দেবার চেষ্টা করে। গাজি হাসতে হাসতে বলে, ‘বাবুর আমার এমনি মজার কথা। তয়, বাবুর যখন ইচ্ছা নাই, পানটা তুমি খেয়ে ফ্যালো।’

মাহাতোর তখনও হাসি থামেনি। আমার পাশেই বসে বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে বলে, ‘পান খেতে কষ্ট হয়, কোনওদিন শুনি নাই। আমার তো পেট থেকে পড়ি ইস্তক যাবৎ নেশা ধরিচি। মদ ভাং যা বলেন, কোনওটাতে অরুচি নাই।’

সোজা কথা, সোজাই বেরোয়। দাগের ছিটা লাগাবে, তার জায়গা কোথায়। কিন্তু পান চিবুতে না পারার সঙ্গে এই তুলনা কোথায় খাটে, সে বিতর্কে যেয়ো না। অতএব দেখন-হাসি হেসে মাথা নাড়ি। বলি, ‘ভাল লাগে না।’

গাজি বলে, ‘অ্যাই গে হলি কথা, যার জুড়ি নাই। ভাল লাগে না। এর পরে আর কথা হয় না।’

যেন এতক্ষণ আমার কথার ভুলেই কথার সৃষ্টি হচ্ছিল। মাহাতো বলে, ‘সে ঠিক কথা। আঙ্‌রি খাবি নাকি গো।’

ইতিমধ্যে দরজা ঘেঁষে মাহাতো গিন্নিও ভুঁয়ে বসেছে। জবাব আসে, ‘না। আমার মজা পান, আর মুখে দেবো না।’

এতক্ষণে মাহাতো-গিন্নির একটা নাম শোনা গেল, আঙ্‌রি। কী থেকে এই নামের উৎপত্তি হতে পারে, ধারণায় আসে না। কিন্তু সে না হয় নামের কথা। মজা পান আবার কাকে বলে। এ মজা, কোন মজা। এ বোধ হয় মজা লাগার মজা নয়, মজে যাওয়ার মজা।

মাহাতো বলে, ‘আমারও তাই।’

তৎক্ষণাৎ গাজি আওয়াজ দেয়, ‘তয়, আমাকেই দাও চাচা।’

‘হ্যাঁ, তোমার বাবুর পান, তুমিই খাও।’

হাত বাড়িয়ে গাজিকে পান দেয় সে। পকেট থেকে বিড়ি বের করতে করতে বলে, ‘একটুখানি ধোঁয়াও হবি নাকি।’

গাজি দাওয়ার ধারে বসতে বসতে বলে, ‘তা আর না হবি কেন। তুমি খাওয়ালিই হয়।’

মাহাতো এক হাতে তিনটি বিড়ির মুখ এক করে ধরে। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন জ্বালায় তিন বিড়ির মুখে। জ্বালিয়ে একটা দেয় গাজিকে, আর একটা বাড়িয়ে ধরে ডান দিকে। একটা শাঁখা চুড়ি পরা হাত সেটি নেয়। জ্বলন্ত বিড়ি অদৃশ্য হয়ে যায় ঘোমটার আড়ালে। তিনজনের ধোঁয়ায় মাখামাখি করে। আহারের পর একটি নিটোল বিশ্রামের ছবি। বিড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে জর্দার গন্ধটা মিশে আবহাওয়াটাকে যেন আরও নিবিড় করে তোলে।

আমার সিগারেট তখন প্রায় শেষ।

মাহাতো-গিন্নির গলা শোনা যায়, ‘গান কিন্তু শোনাতে হবে।’

মাহাতো-গিন্নি নয়, আঙ্‌রি। অনেকটা যেন আঙ্‌টির মতো শোনায়। গাজি বলে, ‘শুনোব গো চাচি। পান বিড়িটা মজিয়ি নেই আগে।’

মাহাতোর দিকে ফিরে বলে, ‘অই, জিগেস করতি ভুলি গেলাম, কলকাতায় গিছিলে নাকি চাচা।’

মাহাতো একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘না, কলকাতায় যাব কী করতি।’

‘না বলে, আলিপুরির কাচারিতি গিছিলে কি না। মামলা-মকদ্দমা থাকতি পারে!’

কথাটা ঠিক যেন মাহাতোর মনঃপূত হয়নি। গাজির দিকে ফিরে বলে, ‘কেন, খেয়ি-দেয়ি কি আমার আর কাম নাই, খালি মামলা ঠুকে বেড়াচ্ছি।’

দেখ, আবার কথার পৃষ্ঠে কথা কোথায় নিয়ে যায়। মাহাতোর মেজাজ বুঝি না। গাজি একটু ঠেক খেয়ে বলে, ‘না, বলে কি, যাও তো পেরায়ই। মাসান্তর তো লেগিই আছে।’

ভাবি, হাঁক দিয়ে বুঝি চিৎকার ওঠে। কিন্তু না, দেখি মাহাতো আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে। তার ছোট ছোট লাল চোখের দৃষ্টি যেন অনেক দূরে চলে যায়। কালো কুচকুচে প্রকাণ্ড মুখখানি হঠাৎ যেন পাঁকের মতো নরম তলতলে দেখায়। দু-চার খানি খানা-খন্দ দেখা দেয়। অনেকটা কাদার ডেলার মতো। একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘তারকেশ্বর গিছিলাম একটু।’

‘অ! পূজাপাট দিতি নাকি?’

মাহাতো মুখ ফেরায় না, চোখ ফেরায় না। বিড়িও টানে না। ওদিকে যেন কেমন করে আঙ্‌রির ঘোমটা খুলে যায়। বউদের ঘোমটা যে কেন বারে বারে খুলে যায়, আর বারে বারে টানতে হয়, সেকথা কেউ বলতে পারে না। হয়তো, বউদের শাশুড়ি ননদিনীরা সে কথা বলতে পারে। কিন্তু আঙ্‌রি ঘোমটা টেনে দেয় না। তার মুখের এক পাশ দেখা যায়। তার মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোয় না। বিড়ি বোধ হয় হাতে কোথাও আছে। কিন্তু দেখ, আঙ্‌রির কালো মুখখানি মূর্তির মতো নিরেট। কাজল-মাখা চোখের দৃষ্টি স্বামীর মতোই কোথায় কোন দূরে যেন নিবদ্ধ।

মাহাতো বলে, ‘না, পূজাপাট আর কী দেব।’

গাজি তবু ছাড়ে না। জিজ্ঞেস করে, ‘তয় কি, মানত-টানত ছিল।’

এবার মাহাতো একবার আঙ্‌রির দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু আঙ্‌রি তাকায় না। সে তেমনি স্থির হয়ে বসে থাকে। পান চিবুতে চিবুতে সে যে গান শুনতে চেয়েছিল, সে কথা আর মনে হয় না। খোঁপায় গোঁজা রুপোর ঝুমকোকাঁটার ঝুমকো পর্যন্ত একটু নড়ে না, ঝিলিক দেয় না।

মাহাতোর সেই যে ভার-ভারিক্কি আত্মপ্রত্যয়ের একটা ভাব ছিল, তাতে যেন ঢল খেয়ে যায়। এখন এ মানুষ যেন কেমন অসহায়। কোথায় একটা দুর্ভাগ্যের ছায়া তাকে ঘিরে ধরে। বলে, ‘অই আর কি। মানত তো করিই যাচ্ছি, ফল তো পাই না।’

কথার সঙ্গে নিশ্বাসে মনের ঢাকনা খুলে আসে। কী একটা দাগ যেন দেখা যায় সেখানে। আঙ্‌রি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘আহ্‌, কি কথা দ্যাখ দিকি। ফল পাও কি না পাও, সে তুমি বলো কেন। মানত করেছ, সে কথা বলো।’

আঙ্‌রির স্বরে একটু উদ্বেগের সুর। সংস্কার বলো, আর যাই বলো, শোনায় যেন, ‘তোমার কাজ তুমি করো। ফলের বিচার অন্যত্র।’

মাহাতো বলে, ‘তা ঠিক, তবে দ্যাখ আঙুর, মানুষের মন তো।’

তার গলায় নিরাশা, সুরে আক্ষেপ বাজে। এবার জানা যায়, আঙ্‌রি আঙুর। হয়তো আঙুর শুনতে সুন্দর, তবে আঙ্‌রি যেন আরও মিষ্টি। আঙ্‌রি বলে, ‘তা হোক। ফল পাও না, সে কথা বলতে নাই।’

মাহাতো ঘাড় নাড়ে আস্তে আস্তে। আবার একটা নিশ্বাস পড়ে। আর তার কালো মোটা ঠোঁটে হাসি দেখা যায়। বলে, ‘কিন্তু, ওদিকে বেলা যে যায়।’…

কথাটা সঠিক ঠাহর হবার আগে প্রায় বাইরের রোদের দিকে চোখ ফেরাতে যাই। দেখি, গাজির আরশি-চোখ মাটির দিকে। তার ফাটা ফাটা মুখখানিও যেন ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। মাহাতোর গলায় আবার শোনা যায়, ‘সময়ের বস্তু সময়ে না এলি কি আর তাকে ধরা যায় ? না কী বলো হে গাজি।’

গাজি মুখ না তুলেই গানের কলি বলে, ‘তা বটে চাচা। ওই সেই আছে না, “সোঁতে বাঁধাল বাঁধ গা জলে, এই কোটালে। পড়েছে মীন, ধরগা ত্বরা, পাবি না রে জল শুকালে।”

মাহাতো ঘন ঘন মাথা দোলায়, বারে বারে বলে, ‘এই এই এই, এই কথাখানি বলো। পাবি না রে জল শুকোলি। তো আঙ্‌রিকে সেই কথাই বলি। মন যে মানতি চায় না।’

তিনজনেই চুপ করে থাকে। দেখি, তিনজনেরই ধূমপান বন্ধ, বিড়ি নিবে গিয়েছে। এবার নিজেকেই নিজের কথা বলতে ইচ্ছা করে, ‘ওরে জন্মকানা, দেখলি না রে, আলোতে ঝলক খেলে যায়।’ এ যেন সেই, ‘কথা কয় রে, দেখা দেয় না। নড়েচড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না।’ এই তিনে মিলে কী যেন এক কথা বলে যায়, আমি যার মর্ম বুঝি না। অথচ, তাদের মাঝে বসে আমি অন্য স্রোতে চলি। কী এক রহস্যধারা যেন তলে তলে চলে। আর দেখ, আমি যে ভিনদেশি লোক, আমি যে বাইরের, তা ফুটে ওঠে এই তিনজনের ভাবে। এখন ওরা এক, আমি ভিন্ন। আমি বিস্মৃত, অস্তিত্বহীন।

আঙ্‌রির গলা শোনা যায়, ‘মন না মানলে কী করবে বলো, মন না মানিয়ে আমাদের উপায় কী। তবে অই বেলা যায় বেলা যায় প্যাচাল পেড়ো না। ও তোমার মনে ধন্দ।’

বলে সে ঘোমটাটা টেনে দেয়। মাহাতো তেমনি শব্দ না করে হাসে। সে হাসিটা যেন আঙ্‌রি টের পায়। তাই একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে। যদি ঠিক দেখে থাকি, তবে দেখেছি, কাজল-মাখা ডাগর চোখ দুটিতে জল নেই। জলের থেকে বেশি, কী একটা কষ্ট যেন অথই হয়ে পড়বার জন্যে থমকে আছে। তবু অথই হয়ে পড়ে না।

গাজিও দেখি এবার তার আরশি-চোখের পাতা একটু নাচায়। মাহাতোর দিকে চেয়ে বলে, ‘তাও হতি পারে। মনের ভরমে করম নাশে, মন বাঁধ মন রসে কষে। বেলা যাবার মতন বয়স তো তোমার হয় নাই চাচা।’

মাহাতোর সে কথায় কান নেই। যেন নিজের সঙ্গে নিজে বলে, ‘ডাক্তার বদ্যিও তো কম করলাম না। ধরো গে, আলিপুর কোটের যত চেনা উকিল মোক্তার, যে যেমন ডাক্তারির কথা বলেছে, সবারি দেখিয়িচি। তারা সব কলকাতার ডাক্তার। কালীঘাট তারকেশ্বরও তো কম হলি না। এখন কী আছে কপালে, দেখি।’

কথা শেষ হবার আগেই মাহাতোর নিশ্বাস পড়ে। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সে পোড়া বিড়ি ধরায়। গাজিও তার কাছ থেকে ধরিয়ে নেয়। এবার যেন আমার চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে যায়। একটা সন্দেহ নড়েচড়ে ওঠে, একটা ধারণার মূর্তি ফুটে ওঠে। মাহাতো কি অপুত্রক পিতা। কোনও একদিন ফোঁচার কাছে ঠাট্টা করে ছেলে চাওয়া, কেবলমাত্র ঠাট্টা নয় তা হলে।

তারপরেই দেখি, মাহাতো জামা সরিয়ে ট্যাঁকের ভিতর থেকে কোমরের সঙ্গে সুতোয় বাঁধা একটা পকেট ঘড়ি বের করে। কখনও আশা করিনি, বিদেশি এক বিখ্যাত কোম্পানির, বহুকালের পুরনো এক সোনার ঘড়ি এমন একটা মানুষের ময়লা কাপড়ের কষি থেকে বেরুবে। তাও এই দূরের বাজার হাটে। মনে মনে অবাক হই, প্রকাশ করতে পারি না। অথচ এই লোকটিকে আমি আমার ছকের ভাবনায় সামান্য দরিদ্র এক চাষি ছাড়া ভাবিনি। আর, কোনও দরিদ্র চাষির কাছে এমন ঘড়ি দেখলে আমার মতো কোন মানুষের চোখে ধন্দ না লাগে! এই আমাদের মন। হঠাৎ মাহাতোর সম্পর্কে আমার মন অন্য বায়ে বইতে শুরু করে।

গাজি বলে ওঠে, ‘দ্যাখেন তো বাবু, নক্‌কীঠাকরুন যার ঘরে বাঁধা, তার ভোগের মানুষ নাই।’

মাহাতো হেসে তাকায় আমার দিকে। তারপর গাজির দিকে ফিরে বলে, ‘তাই বা আর কমনে বলো। গত সনে ট্যাকসো দিইচি চল্লিশ হাজার টাকা। এ বছরি আবার কত দিতি হয় দ্যাখ। সব দিকিই আমার ফরসা। কিছুই আর রেখি যেতি হবে না।’

এই কথা শেষ হতেই হঠাৎ দেখি আঙ্‌রির মাথাটা নিচু হয়ে পড়ে। ঘোমটা খসে যায়। এবার তার ঝুমকো কাঁটার ঝুমকো ফুল ঝিকিমিকি করে। সেই সঙ্গে শরীরখানিও কাঁপে। গাজি একবার তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নেয়। মাহাতো আঙ্‌রির কাঁধে হাত দিয়ে বলে, ‘কাঁদিস না, আমি তো মন্দ কিছু বলি নাই।’

সব কিছুই এমন চকিত আর আঁকাবাকা, খেই ধরতে পারি না। অন্তঃস্রোতের সব প্রবাহে নজর করি, তেমন শক্তি নেই। তবু সব মিলিয়ে কোথায় একটা ব্যথার ভারের সঙ্গে ধন্দে থমকে থাকি। ধন্দ লাগে এই কারণে, মাহাতোর শ্ৰেণী বুঝতে ভুল করেছি। গাজির ভাষায়, নক্‌কী ঠাকরুন যে তার ঘরে বাঁধা, তাতে ভুল নেই। অথচ এমন একজন ধনী, সেকালের সোনার ঘড়ি যার ময়লা কাপড়ের বন্ধনীতে, সে কি না এমন বেশে এমন করে এই ভোজনাগারের দাওয়ায় বসে। শুধু কি তাই। ট্যাকসো বলতে, সম্ভবত কৃষি আয়কর বুঝিয়েছে সে, তার অঙ্ক চল্লিশ হাজার টাকা। সেই লোক কি না সস্ত্রীক বিড়ি টানতে টানতে এল মোটর বাসে করে তারকেশ্বর থেকে। এখন গাজির কাছে বসে কাঁদে বংশধরের ক্ষুধায়। আঙ্‌রি কাঁদে মুখ নিচু করে। তার চোখে জল। স্বামী তার পিঠে হাত দিয়ে কাঁদতে বারণ করে। লাল চোখ দুটি তার জলে ভাসে না। কিন্তু দেখি, চোখের জলের থেকে তার কান্না যেন গভীর। জলেতে যে ক্ষণেক ধোয়া, যাতনা থেকে একটু মুক্তি, সেটুকুও তার নেই।

এখন ব্যথার ভারে, সেই তো অবাক মানি, এই লোককে তুমি কেবল কৃপণ ভাববে নাকি। না কী, ভারতের এ আর এক রূপ। হয়তো সাবেকি রূপ। লক্ষ টাকা কষিতে বাঁধা, তবু আপন সমাজ পরিবার বেশবাস আচরণবিধির এদিক-ওদিক নেই। ধুলায় চলে, ধুলায় বসে, রাস্তায় কাঁদে। দূরের এই বাজার গঞ্জে, না জেনে পথ, অচিন খোঁজে, এইটুকুও দেখাজানা পাওনা ছিল আমার।

ওদিকে গাজির গলায় গুনগুনানি বেজে ওঠে। সে মুখ তোলে না, ফিরে তাকায় না। যেন নিজেকে নিজেই মাথা নেড়ে কী বলে, গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজে। তারপরে নিচু স্বরে টানা সুরে গায়, নাকি কেবল সুর করে কথা বলে, বুঝতে পারি না। গান করে ‘মন না হলে সোজা, ফকির সাজা কেবল রে তার বিড়ম্বনা।’

এই একটা কলি বার দুয়েক গেয়ে মাহাতোর দিকে চায় সে। মাহাতো তাকায় তার দিকে। গাজি হাত ঘুরিয়ে গায়,

‘ফকিরের সজ্জা ধরে, নেত্য করে,

করছ ধম্‌মের আলাপনা

(আরে দূর হ বান্দা)—তুমি যে আপন কাজে,

বেঠিক নিজে,

পরকে কী বোঝাও বল না।’

বলে মাহাতোর দিকে চেয়ে হাত দুটি জোড় করে হাসে। বলে, ‘চাচিকেও সেই কথাখানিই বলি। কী দিয়ে যে মন বাঁধতি বলব, তা জানি না। তয়, চাচি, মন বশ না করি উপায় কী! ’

বলে সে আঙ্‌রির দিকে চায়। আঙ্‌রি তবু মুখ তোলে না। তবে তার শরীরে আর কাঁপন খেলে না। গাজি আবার গায়,

‘(গাজি বোঝে না) তুমি যে এত গান গাও, পরকে বুঝাও।

নিজে কেন তা বুঝ না।

নিজে না বুঝলে পরে অন্য পরে বুঝবে কেন

তা ভাব না।

পরকে কী বোঝাও বল না।’…

বলে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে থাকে আঙ্‌রির দিকে। ফাটা মুখের ভাঁজে ভাঁজে একটু হাসি খেলে যায়। গাজিটা করে কী। গুণ, না বশ। অবাক হয়ে দেখি, পাজিটা যেন আর এক খেলা খেলে। ওদিকে আঙ্‌রিও দেখি মুখ তোলে। চোখের জল মোছে। গাজির দিকে তাকাতে চায় যেন, পারে না। কেবল বলে, ‘গাও।’

গাজি তৎক্ষণাৎ ধরে-দেয়,

‘(গাই) মনের মানুষ পেলাম না, মনে মনে ভাবছি যে তাই

মনের দুখ্‌খু মনেই রইল, মনে মনে ভাবছি তাই।

বন পোড়া যায় সবাই দ্যাখে

(বুইলে চাচি) মনের আগুন কেউ না দ্যাখে

এখন কোন ছায়াতে তাপ জুড়াই।’

গেয়ে ঝোলা থেকে টান দিয়ে বের করে ডুপ্‌কিটা। ডুপ্‌ ডুপ্‌ তাল দেয়, ঘাড় দোলায়। আঙ্‌রির পান খাওয়া ঠোঁটে একটু হাসি ঝিলিক দেয়। ডাগর চোখ তুলে গাজিকে দেখে একবার।

গাজি ডুপ্‌কি থামিয়ে গায়,

‘কোন্‌ সাধনে পাই গো তারে

যে আমার জীবনধন রে

সেই আশাতে ঘুরে বেড়াই।

মন্দির মসজিদ সব ঘুরেছি

মোল্লা মুন্‌সী সব পুঁছিছি

আমি তারে কোথায় পাই।’

তারপরেই সে আকাশ ফাটানো হাঁক দেয়,

‘(জয় মুরশেদ!) মিয়াজান ফাঁকরে কয়

ঘরের কোণে বান্ধা রয়

ওরে দিনের কানা

রাত দেওয়ানা

দেখলি না রে তাই।’…

সে গান থামায়। আর মাহাতো বলে, ‘অই হলি কথা।’

গাজি বলে, ‘তয় অবুঝ কেন। আমি বলি, ছুটাছুটির দরকার কী। ভুঁয়েতে গাছ দুই খান, ফল ফলবে একখান, মনের বুঝ কর।’…

মাহাতো আর আঙ্‌রি দু’জনেই যেন দৈববাণী শোনে গাজির দিকে চেয়ে। আমার হালও তাই। লোকটার তাল ধরতে গিয়ে আমার চেয়ে থাকা সার। অথচ দেখ, মনের কোথায় তরঙ্গিয়া যায়।

ইতিমধ্যে কখন নারাণঠাকুর এসে দাঁড়িয়েছে। ভোজনের পরে বিড়িটি সদ্য ধরানো। গাজিকে বলে, ‘ওই গলাখানির গুণেই তরে গেলে।’

গাজি জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে, ‘আপনার যেমন হাতের গুণে, ডাল-চচ্চড়ি একেবারে অমর্ত স্বাদ হয়েছে।’

নারাণঠাকুর সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে একবার গাজির মুখ দেখে। তারপরে বলে, ‘যত বাজে প্যাচাল পাড়ে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *