০৫.
কিন্তু মন গুণেই না ধন! সেই মনটা গেল মুষড়ে। ভাবা গিয়েছিল, ফাস্টো কেলাসের রাজ্যখানি একলা ভোগে লাগবে। ধেয়ে আসা দুই দিগন্ত দুই জানালায়। তার সঙ্গে মুখোমুখি করে যদি হাসি আসত, তাকে ঠোঁটে তুলে নেওয়া যেত। যদি ভিতরে গুনগুনিয়ে উঠত গান, তাকে ছেড়ে দেওয়া যেত গলার আগল খুলে। সেই যে ভরা প্রাণের তৃপ্তিখানি অকারণে চোখের জলে গলে আসে, তা যদি আসত, তাকে দেওয়া যেত ভাসিয়ে। আর ঘরের বাইরে, জানালার ধারে মামুদ গাজি? এখন দেখি, সে তো যেন এই দিগন্তে একাকার। চলতে গেলে, মাথার ওপর আকাশ থাকে কিনা। এই যে রোদ, ওই যে ছায়া, পাখপাখালি গাছগাছালি, ভেদে ভেদে অভেদ, অখণ্ড। গাজি দেখি সেই অখণ্ডের শরিক। সে ফাস্টো কেলাসের যাত্রী নয়। তার সভ্যভব্য ভদ্রতার দাবি নেই। সহবত শালীনতা সে চায় না। তার অখণ্ড একাকারে যেমন খুশি ছড়িয়ে দেওয়া যেত।
তা হল না। এখন শুধু ভাগীদারের ভাগাভাগির কথা নয়, এখন এ ঘরে জনপদ আর সমাজের আবির্ভাব হয়েছে। মূর্তিমান সভ্যভব্য ভদ্রতা নিয়মকানুন ঢুকেছে। এখন দিগন্তে ডুব নয়। ভিনযাত্রীর সুখ সুবিধা, অস্তিত্বের সতর্কতা। এখন এ ঘর দিগন্তের হাতায় নয়। এবার পায়রার খোপ। নড়ে বসো, চড়তে যেয়ো না। তা হলেই মুখোমুখি, গায়ে গায়ে লাগালাগি।
বলবে, এ যাত্রী ভারী একালঘেঁড়ে। এমন সুজন নয় যে, ন’জনে যাবে তেঁতুল পাতায়। ভাগের ভোগ জানে না। গণে জনে নেই, একা ভোগী স্বার্থপর।
তা বলতে পারো, যদি ধর্মে কয়। তবে, এলাম যে তেঁতুল পাতা থেকেই। সুজন কিনা জানি না, সমাজে সংসারে সেখানে যে ন’জনের ভাগাভাগিতেই বাস। সেখানে সকলেরই অন্নে জলে ভাগাভাগি, লাগালাগি মুখোমুখি। কিন্তু যখন নিরালায় মন টানে মন, তখন! তখন মাঠ খুঁজে তার ধারে যাওয়া কেন। দিঘির কূলে গিয়ে বসা কেন। ছাদের নিরালা কোণটিতে কেন আশ্রয় নেওয়া।
ওটা স্বার্থপরের কথা নয়। অনেক পড়শি তো আছে, সময় বুঝে একবার নিজের ভিতরে যে পড়শির বসত, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের ইচ্ছা। তারা তোমাকে অনেক বলেছে, তুমি তাদের অনেক বলেছ। এবার নিজেকে নিজে একটু বলা-কওয়া হোক। কোথায় যাও, কেন যাও, কি চাও, কীসের খোঁজে। এবার তবে মন বন্ধই হোক। মন, চলো যাই খোপ ছেড়ে। দেহ থাকুক পড়ে। তুমি যাও দিগন্তে। ঘ্রাণে গন্ধ আসে সুবাসিত প্রসাধনের। চুল ফাঁপানো সাবানের, গায়ে মুখে মাখা বস্তুর, জামাকাপড়ের সুগন্ধির। আসুক। আরও আসে ফুলেল তেলের। আসুক। কী যেন নাম। ঝিনি। বাতাসে যার চুলের ঝটকা লাগে। ডান হাতের চুড়িতে তার রিনিঠিনি। যাক গে শোনা। শ্রবণ বন্ধন করো। আবার দেখ, টুকুস্ শব্দ, ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে যায়। ভিন পুরুষে শরম, চোখ ফিরিয়ে নাও। দেখচ না, গালের পাশে চুলের আড়ালে, সোমত্থ মেয়ের হাতে ছোট আরশি। আপন মুখখানিই যে পলকে পলকে হারায়। ঠোঁটের রং এর মধ্যেই হালকা। তাই মুখ আড়াল করে একটু রাঙিয়ে নেওয়া। এই জল-ভডভডিয়াতে দেখবে কে? আর কেউ না দেখুক, নিজের মন দেখবে। নইলে বড় অস্বস্তি। তোমার যদি বেমানান লাগে, মানিয়ে নেবার দিব্যি নেই। দৃষ্টি বন্ধন করো। তবে কিনা, বাতাসের মর্জি বোঝা দায়। ঠিক এ সময়েই সে রং-ঝলকের আঁচল দিল উড়িয়ে। কাঁধের কাছ থেকে গোটা পুষ্ট ডানাখানিতে ঢাকনা নেই। তার সঙ্গে নগরবাসিনীর কোমর কষির ওপরে এক ফালি রোদের মতো গোরা রঙের ঝিলিক দেয়। কী বেলাজ বাতাস দেখ, অব্যর্থ চমকে দিয়েছে। ঝটিতি ঠোঁট রাঙানো সামলে নিয়ে আঁচলে টান দিল। সেই ফাঁকে টুক করে দেখে নেওয়া, আপন জন নয়, ভিন মানুষে। চোখ ফেরাবার সময় পেলাম না। যুবতীর মুখে রং ধরে গেল।
নিজের ভিতরে দেখি, কে যেন চুপি চুপি হাসি সামলায়। মনের পড়শির মজা লাগে। যোগী সে নয় বটে, কিন্তু মনে হয়, এ সবই যেন এ দিগন্তে একাকার। গাজির মতো এও যেন ভেদে ভেদে অভেদ অখণ্ড। বেশ তো, বাতাস আসুক বেগে। যুবতী সাজুক। এ দিগন্ত সবই সাজে।
সহসা প্রচণ্ড হাঁক, ‘হুঁশিয়ার।’
লঞ্চ উলটো পাড়ের সীমায়। জোয়ারের জল থইথই। উঁচু বাঁধের কাছ ঘেঁষেই লঞ্চ দাঁড়ায়। তার যন্ত্র বন্ধ হয় না। খালাসি হুঁশিয়ার বলে মোটা তক্তা এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দেয় বাঁধের ওপরে। তারপরে বাঁধের মাটিতে বাঁশ ঠেকিয়ে উঁচু করে ধরে। যাত্রী দু’জন। জোয়ানের হাতে টিনের স্যুটকেস। জামার ওপরে, কোমর বেড় দিয়ে চাদর বাঁধা। কাপড় ঠেকেছে গিয়ে হাঁটুর কাছে। আর এক হাতে ধরা বছর কয়েকের ছেলে। তার গায়ে জামা আছে, কিন্তু তলায় কেন কিছু নেই, কে জানে। ওদিকে নাকের ফুটো দিয়ে দরানি ভেসে যায়।
যাত্রীদের ওঠার পরেই আবার তক্তা টেনে নেয় খালাসি। লঞ্চ মাঝ দরিয়া নিশানা করে দক্ষিণে ভেসে যায়। যত দূরে চোখ যায়, নদী আর উঁচু বাঁধ। পশ্চিমে তীরে তবু কিছু গ্রাম চোখে পড়ে। আম জামের মাথা ছাপিয়ে সুপারি, তাকে ছাপিয়ে নারকেলের মাথা দোলানো। তাও যেন মনে হয়, গ্রাম অনেক দূরে। নদীর ধারে তাকে বেঁধে রেখেছে উঁচু পাড়। পাড়ের আড়ালে আড়ালে, গ্রামের বাইরে বাইরে, পাকা কিংবা আধপাকা, সবুজ-পাংশু ধানের খেত। পুব দিকেতে, উঁচু পাড়ের আড়ালে, মনিষ্যি চোখে যত দূর দেখ, কেবলই ধান। জনপদে ঘরে ঘরে এত যে নাই নাই, এখানে সে খবর নেই। এখানে সে যেন দিক-জোড়া দাতা কর্ণ। আর দেখ, তার সবুজে পাংশু ছোপ অথই-এর বুক থেকে, মাঝে মাঝে একটা লম্বা তির যেন সোজা আকাশে উঠছে। উঠতে উঠতে হঠাৎ ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে, আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। পাখিগুলোর নাম কী, কে জানে। দূর থেকে দেখি যেন হাজার প্রজাপতি উড়ছে। উড়তে উড়তে আবার ঝাঁপ খেয়ে ধান খেতে ডুব দিচ্ছে। হয়তো বন-চড়াইয়ের দল। ঘরেতে ওদের মন নেই, বনভোজনে মত্ত।
তবু এ নদীর পাড় যেন কেমন খাঁ খাঁ করে। চাংড়া চাংড়া মাটির ঢিবি, নদী বন্ধন করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও তার তেমন সবুজের সম্পর্ক নেই। মাঝে মাঝে, দু’চারটে ঝাড়ালো গেমো গাছ। কোথাও নাম-না-জানা জলজ জঙ্গল। যেখানে পাড়ের নীচে কিছু কিঞ্চিৎ জমি জলে ডোবেনি, সেখানে গাঙ-শালিকদের নিঃশব্দ ঠোঁট খোঁচানো। এত বড় একটা জলযান যে দু’পাড়ে শব্দ ছড়িয়ে যায়, একবার তাকিয়ে দেখে না। বোধ হয়, এই পাঁকের পোকাশালে বসে রোজ দেখাশোনার ব্যাপার। যত ভয় তো অচেনাকে। ওই জল-ভডভডিয়াকে দেখা আছে, প্রথম ডিম ফেটে বেরিয়েই।
‘বাবু।’
কানের কাছেই ডাক শুনে ফিরে দেখি, গাজির বাবরি বাঁধা পাগড়ি আমার মুখে লাগে প্রায়। বলে, ‘কেমন বোঝেন বাবু?’
তার চোখের ঝিলিকে যেন রহস্য। ভুরু নেচে নেচে ওঠে। কী বোঝার কথা বলে গাজি? কথা আসে কোন বায় থেকে? জিজ্ঞেস করি, ‘কীসের?’
গাজি ঘাড় দুলিয়ে, দূরের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘এই ভেসে পড়া?’
ভুলে গিয়েছি, এই ভেসে পড়া গাজির মতলবে। ভাল লাগা, মন্দ লাগার দায় এখন তার কাঁধে। হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারি না। মনে হয়, এই যে কোথাও কিছুর শেষ নেই, তার মধ্যে আমার ভাল-মন্দ সব কিছুর হদিস যেন হারিয়ে গিয়েছে। বরং জিজ্ঞেস করি, ‘এই রকম উঁচু পাড় কতখানি?’
গাজি বলে, ‘যত দূর যাবেন। এ তো বাবু ভেড়ির বাঁধ, নদী সামাল দিয়ে রেখেছে। এক ফোঁটা জল যেন জমিনে না যেতি পারে।’
‘কেন?’
‘লোনা। এ গাঙের জল যে তিতা লোনা। ফসল হতি দেয় না।’
বাঁধ দিয়ে তাই নদী বন্ধন। এ জল যে নোনা, তা জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করি, ‘ইছামতীর যে জল দেখে এলাম, সেও কি নোনা নাকি?’
‘আজ্ঞা। উনিশ বিশ হতি পারে, তয় বাবু, লোনা। সাগর যে এখেনে আসা-যাওয়া করেন। এখানে বারো মাস লোনা। এই টানের দিন এল, এবার একটু কম পড়বে।’ বলে সে দাড়ি কঁপিয়ে হাসে। গাজির সবই রহস্যময়, হাসবার কী আছে বুঝতে পারি না। বুঝিয়ে দেয় গাজি নিজেই, ‘বাবুর যে কথা। বলে, যে জল দেখে এলাম, তাও লোনা নাকি। বাবু, মানুষ দেখে কি সুমন কুমন বোঝা যায়। জল দেখে কি কেউ বলতি পারে, লোনা, না মিঠা।’
যথার্থ কথা। নিজের বাস মিঠা জলের কূলে। গঙ্গার ধারে বসত। টানের দিনে সে জলের যেমন রং, এ জলেরও সেই রকম। তার জোয়ার ভাঁটায় যেমন তরঙ্গ, সেই তরঙ্গে রোদ যেমন চলকায়, এখানেও সেই রকমই দেখি। লোনা মিঠার স্বাদ নদীর গায়ে লেখা নেই।
‘হ্যাঁ, কথাটা ভেবে দেখতে গেলে ঠিক বলেছ তুমি।’
বলে একটু লম্বা টানের হাসি। কথা ধরেছেন গলাবন্ধ কোট, কেশ বিবাগী মাঝ-মাথা। তিনি যে আমার মুখোমুখি, সেই ধেয়ান নেই। অবাক হয়ে লাভ নেই, বিলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, কেশ বিবাগী মাথা দুলছে। যেন গাজির সঙ্গে তাঁরও রহস্য চলেছে। তারপরেই ডাক দিয়ে বলেন, ‘শুনছো, এই যে! এই যে, ওরে ঝিনি, জানিস তো, এ জল কিন্তু লবণাক্ত। মানে সী ওয়াটার যাকে বলে।’
ওপাশের বেঞ্চ থেকে দু’জোড়া চোখ ফিরল বটে। পর মুহূর্তেই নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি। যুবতীর হাসির মধ্যেও, লতা যেমন বাতাসে কাঁপে, তেমনি ভুরু কেঁপে যায়। সেই কাঁপনে হাসির ছটা নেই। ক্ষোভের বক্রতা যেন। প্রৌঢ়াও যেন একটু নাকছাবিতে ঝিলিক হানেন। গলাবন্ধ কোটকে যেন বিদ্ধ করতে চান। তাতে এই ধারণা হয়, সী ওয়াটার লবণাক্ত কি না, সে ভাবনার থেকে অন্য কোনও লবণাক্ত ভাবনা সেখানে। কিন্তু কেশ বিবাগী মাথাখানিতে দরিয়ার ঝলক হেনে তখন তিনি আমাকে লক্ষ করেছেন, ‘ইয়েস, রাইট, সল্ট ওয়াটারে ক্রপ নষ্ট হয়ে যায়, হানড্রেড পার্সেন্ট করেক্ট।’
বলার ধরনটা যেন গাজির কথায় আমার প্রত্যয় হয়নি। তাই প্রত্যয়সিদ্ধ করার দায় ওঁর কাঁধে। ঘাড় নেড়ে জানাতে হয়, কথাটা উনি যথার্থ বলেছেন। এ জল সল্ট ওয়াটার, এতে ক্রপ নষ্ট হয়। তার চেয়ে দেখি, গাজি গলাবন্ধ বাবুকে হাঁ করে দেখছে। মুরশেদ হাপিস, গোসাবা-যাত্রী বাবুর কথা বীজমন্ত্রের থেকে কঠিন।
তা হোক, প্রৌঢ়া আবার উলটো আসনের দিকে মুখ করেছেন। মনে হয়, ব্যাপারটা বুঝিয়ে ছাড়বেন। কে জানত, এই মানুষে কোন মানুষ আছে। সু কু ছাড়ো, দরিয়ার জল দেখলেই তার স্বাদ বোঝা যায় না। বললেন, ‘টাকিতে, হাঁদুও ঠিক এই কথাই বলেছিল, বুঝলে। এই যে দেখছ বাঁধ, উঁচু উঁচু ঘেড়ির বাঁধ—।’
গাজি বাইরের থেকে জানালা দিয়ে মুখখানি আর একটু তুলে তাড়াতাড়ি বলে, ‘ঘেড়ি নয় বাবু, ভেড়ি—ভেড়ির বাঁধ।’
কিন্তু সেটা কোনও কথা নয়। এখন বিষয়ে আসা গিয়েছে। গাজির দিকে হাত তুলে, উলটো আসনের দিকে ফিরে বলেন, ‘ওই হল। ঘেড়ি আর ভেড়ি, তোমাদের কোনওটারই কোনও মানে হয় না। বাঁধের আবার ঘেড়ি আর ভেড়ি।…তা বুঝলি ঝিনি, এতেই প্রমাণ হয়, লবণের একটা ক্ষয় করবার ক্ষমতা আছে…।’
এই পর্যন্তই। সহসা প্রৌঢ়ার সিদূরবিন্দুতেই যেন ধমক বেজে ওঠে, ‘কী তখন থেকে ঝিনি ঝিনি করছ। অলকা বলতে পারো না?’
বলেই একবার খোপের ভিনযাত্রীটিকে দেখে নেওয়া। আহ, এবার শোনো গূঢ় কথা। লবণাক্ত জলের বিচার এক দিকে, আর এক দিকে লবণাক্ত ভাবনা কোন ঢলে বহে, তাই দেখ। প্রৌঢ়র অবস্থা যেন ভাসন্ত নৌকা আচমকা ডাঙায় ঠেক খায়। প্রথম শব্দ হয়, ‘অ্যাঁ?’
শব্দের পরেই অধীনের প্রতি একবার কটাক্ষ। এখন কে লজ্জায় পড়ে, ভেবে দেখ। চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। সত্যিই তো, তখন থেকে ঘর করতে অষ্টপ্রহরের নাম ধরে ডাকা কেন। বাইরে লোকজনের সামনে কী পোশাকি নামটা বলা যায় না। ভিনযাত্রী তুমি না হয় ‘ঝিনি’ নাম ধুয়ে জল খাবে না। ঘরের লোক হয়ে তুমি ঘরবারটা বজায় রাখবে তো। একটা সাব্যস্ত বলে কথা আছে। গাজির চোখে মুরশেদ অকূল। তার গোঁফদাড়ির ফাঁকে, হাঁ মুখে জিভখানি দেখা যায়। যেন সে আমাকে চোখে জিভে দুয়েতেই দেখে। দেহতত্ত্বের রহস্য থেকেও বড় রহস্য কী যেন ঘটে গেল, ধরতে পারল না।
প্রৌঢ় ততক্ষণে আবার ধরতাই ধরার তাল করেন, ‘ও, সেই কথা বলছ। মনে থাকে নাকি সব সময়। আচ্ছা, অলকাই বলা যাবে। তোদের আবার…।’
আবার ঠেক। বোঝা যায়, ইশারা হয়েছে। ভিনযাত্রীকে চোখ দিয়ে দেখিয়ে সীমন্তিনী চুপ ধমকে চুপ করান। বোধ হয় সেইজন্যেই প্রৌঢ়র গলার পুরনো কথার জের; যেন সহজ গলাতেই বলছেন, ‘হ্যাঁ, ওই আর কী, নুনের কথা হচ্ছিল। নুন দেখবে, লোহা পর্যন্ত ক্ষইয়ে দেয়। এই যে বাঁধ দেখছ, ওই নোনা জলের জন্যেই। তা নইলে তো ধান কিছুই হত না।’…
মনের দোষ, চোখ ফিরিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, উলটো দিকে সাড়া কেমন। কিন্তু পারা গেল না। ভিতরে যেন কোথায় ভিনযাত্রীর আত্মসম্মান টনটনে হয়ে ওঠে। অথচ, তার মধ্যেই কোথায় একটা কুল কুলু শব্দ বাজে। তবে সাবধান, হাসি নিষেধ। গাজিকে জিজ্ঞেস করি, ‘এ নদীতে ঘাট নেই? কেউ চানও করে না?’
এখন এক চোখের পীড়া। মনেও সেই পীড়া লাগে। লোনা বলে কি সেই দরিয়ার কূলে মানুষের ছায়াও পড়তে নেই?
গাজি ভুরু তুলে চোখের ফাঁদ বড় করতে চায়। বলে, ‘দোহাই মুরশেদের, অমন কথা কবেন না বাবু। এ জলে যে শমন আছে।’
‘শমন? সে আবার কী? কুমির নাকি?’
‘না বাবু, কুমির নয় কামট?’
‘সেটা কী রকম?’
‘সে বাবু বেজায় রকম। কুমিরের মতন উনি ডাঙায় ওঠেন না। জলে ডুবে ডুবে ধারে কাছে ঘোরাফেরা করেন। একবার কেউ নামলি হয়। যেটুকুন পাবেন, এক গরাসেই সাবড়ে নিয়ে যাবেন।’ খোপের ঘরে ভয়ের ডুকরানি, ‘মাগো!’
তাকিয়ে দেখি, ঝিনি বলো, অলকা বলো, ভয়ে শরীর হিলহিলানো। গাজির দিকে কাজলকালো চোখে যেন আস্ত কামট ভাসে। প্রৌঢ়ারও সেই অবস্থা। গলাবন্ধ কোটের হাল দেখবার আগেই গলা বেজে ওঠে, ‘ডেঞ্জারাস! হাঁদু বলেছিল বটে—।’
ততক্ষণে গাজি আবার ধরে দিয়েছে, ‘তা বাবু, যার যেখেনে বাস, না কী বলেন। ইদিককার গোটা গাঙ জুড়ে ওঁয়াদের রাজত্ব। কুমির মশায়ের থেকে ওঁয়ারাও বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছু কম ধরেন না। এই যে মোটর লঞ্চখানি চলেছে, জলে গিয়া দেখেন, ওঁয়ারাও সঙ্গ নিয়ে চলছেন।’
‘কেন?’
‘যদি আজ্ঞাঁ মানুষটা জানোয়ারটা পড়ে, ওর একটু ভোজ হয়।’
উলটো আসন থেকে আবার মেয়ের আর্ত রব, ‘ও মা, শুনেছ?’
প্রৌঢ়া সীমন্তিনী গলাবন্ধ কোটের দিকে ফেরেন। তাঁরও যেন বুক ধড়াসে যায়। বলেন, ‘হাঁদু তোমাকে কিছু বলেনি?’
প্রৌঢ়ার সামনে যেন কামটের হাঁ। ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘নো। মানে, হাঁদু আমাকে কামটের কথা যেন কী বলেছিল, কিন্তু এরকম কিছু বলেনি। বাট দিস্ ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস, তার বলা উচিত ছিল।’
কেন, জলে পড়ে নাকি সবাই। কামটেরা ঘিরেছে নাকি। জলযানে এত মানুষ, মেয়ে মদ্দ ছাঁ, যারা ঘর করে এই নদীর কূলে, তাদের প্রাণ কি সব হাতে নাকি। খবর কি তাদের অজানা? তাই যদি তো, যাত্রা কেন। গন্তব্যে পাড়ি কেন। তবে হ্যাঁ, বলতে পারো, সংবাদ নতুন। অচিনকে বড় ভয়। তা বলে তোমাকে কেউ কামটের মুখে নিয়ে চলেনি। যদি ধরে নেওয়া যায়, সম্পর্কে এই তিনে বাপ-মা-মেয়ে দেখ গিয়ে, আরও অমন বাপ-মা-মেয়ে যায় এই জলজানে। অন্য মানুষে কি ধেয়ান নেই। কিন্তু আমি দেখি মুরশেদ নামের মজদুরকে। তার কালো চোখের ঝিলিকে, দাড়ির ভাঁজে হাসিতে এখন যেন সে আর গাজি নয়। শমনের দোসর নাকি সে। যেন অকূলে ভাসিয়ে এখন প্রাণ নিয়ে খেলা করে। ‘ইষ্টনাম জপ করো হে, কালের দেশে এবার কাল ঘনিয়েছে।’
না, শমনের দোসর নয়, খবর দিয়ে মজা দেখে। নিজেই তাড়াতাড়ি জানালায় হাত তুলে বলে, ‘ডরাবেন না মা-ঠাকরুন! অ দিদি, কিচ্ছু ডর নাই। ওঁয়ারা তক্কে তক্কে থাকেন বটে, তয় জানবেন, মানুষকে ভয় পায় না এমন জীব খোদায় বানায় নাই। তয়, হ্যাঁ, এইসব গাঙে চলাফিরা করতি গেলে একটু হুঁশিয়ার। পড়লেন আর ধরলে, তা নয়, তয় বলা তো যায় না, এই আর কি। এঁয়ারা আবার মানুষজনের কাছাকাছি থাকেন কিনা।’
গাজির এক হাতে বরাভয়, আর এক হাতে ভরাডুবি। এক বাক্যিতে নেই সে। ভয়ের কিছু নেই, তবে হ্যাঁ, অসাবধান হলে সেটা কপালের লিখন। এখন যেমন বোঝো। কাজের কথা জিজ্ঞেস করি, ‘সেরকম দুর্ঘটনা ঘটে নাকি?’
গাজি বলে, ‘তা বাবু, যা নিয়া আপনার ঘর করা, তা একেবারে রেয়াত না দিলি কি চলে। এই তো সিদিনের কথা বলছি। ডাঙায় কাজ সেরে জলের জন্যি গেলে তুমি গাঙে। তোমার জম্মো কম্মো এখেনে, সব তোমার জানা। অই, বলে কে, এজলাসের ফারমান এসেছিলেন। যেই গিয়া হাঁটুভর জলে নেমে বসা, অমনি জরিমানা। হাঁটুর কাছ থেকে কুটুস্ করে একখানি পা।’
কুটুস্ করে একখানি পা। বাহ্ গাজি, এজলাস ফারমান জরিমানা বলে টুকুস্ টুকুস্ দিচ্ছে বেশ।
ওদিকে গলাবন্ধ কোটের রুদ্ধ উত্তেজিত গলা, ‘নেক্সট? তারপর?’
‘তারপর আর কী। হাঁকে ডাকে লোকজন গিয়া তুলি নিয়ে এল। পাঠিয়ে দিয়া হলো বসিরহাটের হাসপাতালে। ততক্ষণে পচন ধরেছে। ওই এক ব্যাজ, বিষ বড় খারাপ। দেখতি দেখতি পচে, আর—।’
গলাবন্ধ কোট ধমকে ওঠেন, ‘আরে দুত্তোরি পচাপচি, লোকটা বাঁচল কিনা বলবে তো।’
গাজিকে চেনা ভার। তখনও দাড়ির ভাঁজে, ফাটা মুখে মিটিমিটি হেসে বলে, ‘সে জব তো আগেই দিলাম বাবু। বললাম না জরিমানা। নইলে তো ইস্তেমাল হত। ফাঁসির হুকুম হয় নাই। তয়, উরুতের কাছ-খান অবধি বাদ দিতে হয়েছিল।’
প্রৌঢ়ার গলা, ‘কী সর্বনাশ!’
প্রৌঢ় চোখ ঘুরিয়ে তাল দেন, ‘অবকোর্স!’
ঝিনি না অলকা যার নাম, সে বুঝি সাজ-পোশাক ভুলে যায়। ভয়ে আর বিরক্তিতে ঠোঁট উলটে বলে, ‘কী বিচ্ছিরি জায়গা। আগে জানলে কে আসত।’
গাজি আবার অভয় দেয়, ‘ডরাবেন না দিদি, ও সবই নসিব। এই যে এত লোক আছে, কেউ যায় না, তুমি কেন গেলে? তোমার অজানা তো কিছু না। এই ধরেন না, আপনাদের কলকাতায় দেখেছি, এই পেকাণ্ড গাড়ি, মানুষ গুড়িয়ে দিয়ে দৌড়। সে রাস্তাও তো কামটের গাঙ দেখি।’
গলাবন্ধ ধমক দিলেন, ‘আরে তুমি থামো। কোথায় কামটের নদী, আর কোথায় কলকাতা। সেখানে লোকে গাড়ি চাপা পড়ে অসাবধানে।’
গাজি হেসে সাক্ষী মানে স্বয়ং প্রৌঢ়াকে, ‘অই শোনেন বাবুর কথা, আমি তো সেই কথাখানিই বলছি। বেহুঁশিয়ার হয়েছ কি গেছ। না, কী বলেন মা, অ্যাঁ? আবার দ্যাখেন গিয়া, যে গাড়ির তলে মানুষ, সেই গাড়ি চালায় মানুষে। এখেনে দ্যাখেন গিয়া, রোজ একটা-দুটা কামট জেলের জালে ধরা পড়তিছে, আর মুগুরের মার খেয়ে মরতিছে।’
প্রৌঢ়া: ‘ধরা পড়ে?’
অলকা: ‘দেখতে কেমন?’
গাজি দিদির কথারই ‘জব’ দেয়, ‘সে আর বলতি হচ্ছে না দিদি, একেবারে শোরের মতন। দাঁত যদি দ্যাখেন তো ভিরমি। ছুতোরের করাতকে বলে ওদিক থাক। অইরকম দু’ পাটি।’
অলকা নাম্নী গালের চুল সরাতে ভুলে যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কত বড় হয়?’
‘কুমিরের মতন অত বড়টা হয় না, একটু ছোট। ওর গায়ে চাকা নাই।’
দিদির মুখের অবস্থা দেখে গাজির বুঝি আবার হাসি ফোটে। কামটের দুঃস্বপ্নে দিদির ঠোঁটের রঙে আর তেমন ঝলক লাগে না। গাজি বলে, ‘কোনও ডর নাই দিদি, মনের সুখে যান।’
গলাবন্ধ কোট প্রায় কাঁচকলা দেখান৷ বলেন না, বলা ভাল, খেঁকোন; ‘মনের সুখ আর রাখলে কোথায় বাবা।’
অধীনে ভাবে, তা বটে, সব যে কামটেই খেল। আর সে দায় যেন সব গাজির। এবার বোধ হয় গাজি তাই দায়-ভঞ্জনের বাণী বলবে। কিন্তু না, তাকিয়ে দেখি, গাজির দাড়ি ওড়ে বাতাসে। সে আমার দিকে চেয়ে হাসে। চোখের কোণ দিয়ে দেখে গলাবন্ধ বাবুকে। এমন কেউ নেই, ওর দাড়ি নেড়ে দিয়ে বলে, ‘পাজি।’ মুরশেদের নামে বেশ মজায় আছে। কিন্তু এই চোখের মজার সাক্ষী একমাত্র আমি কিনা তা বোঝবার জন্য চোখ ফেরাতে হয়।
না, অন্য সাক্ষীরা তখন নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। এই অঞ্চল যে একদা সুন্দরবনের মধ্যেই ছিল, প্রৌঢ়া মা-মেয়েকে তাই বোঝাচ্ছেন। যদিও মেয়ের চোখের নজরটা কোন দিকেতে খেলছে, তা বোঝা আমার কর্ম নয়। শুনেছি কিনা, চোখে অনেক সময় মন বসত করে। তখন আর নজর মেপে নজর বোঝা যায় না।
এদিকে গাজি গলা যতই নিচু করুক, তার মুখটা আমার শ্রবণ থেকে দূরে নয়। শুনি সে গুনগুনায়, ‘অসুখ যেখেন, সুখ সেখেনে, ক্ষ্যাপা, খুঁজে দ্যাখ না মনে মনে।’
বাইরে ফিরে তাকাই। যে গাঙ নিয়ে এত কথা, সেই গাঙের জল দেখি। আকাশের নীলের ঝলক রৌদ্রে চলকায়। যেন গলানো রুপায় নীলায় খেলে যায়। এত ছলক বলক কীসের। ছলক বলক ভাঁটার। উজানি গাঙ কখনও সাগরের ডাক শুনেছে। যেন মায়ের কাছ থেকে মেয়ে ছুট দিয়েছিল। ডাক শুনে ঢলে দৌড় দিয়েছে। ছলক বলক তাই, ‘যা-ই, যা-ই।’… জোয়ারে পাবে নীরবতা। পাবে আশমান-ছায়া আরশি। এই নদী দেখে কে বলবে তার জল নোনা, তলায় অভর পেটের ক্ষুধা, হাঁ করে আছে। মানুষ দেখে যখন সু-কু মনের হদিস পাও না, জল দেখে পাবে কেমন করে। ঘর করো কূলে থাকো, জানবে।
এখন গ্রামের খোঁজ নেই। গ্রামগুলো সব কোথায় গিয়েছে, দিগন্তে তার কোনও ঠিকানা দেখা যায় না। ভেড়ির বাঁধের শেষ নেই, দু’পাড় ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। হুঁশিয়ার নোনা গাঙ, এখানে আমাদের সোনা মোহরের সিন্দুক। যা করো বাঁধের সীমায়, এদিকে নজর দিয়ো না। বাঁধের গায়ে মাঝেমধ্যে গাছ চোখে পড়ে। অধিকাংশই গেমো, ঝাড়ালো খাটো খাটো। আর এক ধরনের গাছ, তার নাম জানা নেই। ইচ্ছে করে বলি, কৃষ্ণচূড়া। সায় পাওয়া যায় না। কৃষ্ণচূড়া যেমন ছড়ায়, তেমনি উঁচুতে ওঠে। আর, এ যেন কেবলই ছড়ায়, আর ছড়ায়। ক্রমে ক্রমে পাখির ঝাঁকের মেলা লাগে। লাগবেই। নদী যায় ভাঁটায়, চর জাগে জগতে। নোনা পলিতে অনেক খাবার ছড়ানো। ঠোঁট ঠুকে তুলে নেওয়া। দিনান্তে তো দুই দফে খাওয়া, দুই ভাঁটিতে যা পাওয়া যায়। গাঙ-শালিকেরা দুয়ে চারে চলে না, ঝাঁকের ভিড়ে তারা অগণ্য। তার ওপরে, পলির রোদে ছায়া পড়ে দেখায় যেন অজস্র। ফাঁকায় ফাঁকায় আছেন ধার্মিক, কালো আর সাদা। বকধার্মিক। নজর একটু বড়র দিকে।
বাঁধের ওপারে মানুষের আহার। চরায় পাখির ভোজ। জলে যে ফেরে, হয়তো সে হিংস্র, জীব-নিয়মের বাইরে নয়। গাজির বলা কলকাতার পথের কথাটাও ভুলতে পারি না। তবু সব মিলিয়ে এই দিক্হারা দিগন্তে কে উদাসী বিরাজে। মন বলে, চলো যাই এক অচিন স্বপ্নের খোঁজে।
তখন শুনি, মোটর-বাসের ভেঁপুর মতো প্রায় কানের কাছেই প্যাঁক প্যাঁক বাজে। তারপরেই ঢিং ঢিং ঘন্টা। অমনি ছাদের চোঙায় ভড্ ভড্ শব্দ মন্থর হয়ে যায়। ভুলে যাই, আমার কাঠের দেয়ালের আর একপাশেই সারেং বসে আছে। তাকিয়ে দেখি, সামনেই বাঁধ। নদী কখন মোড় ফিরেছে, খেয়াল ছিল না। দেখছি, মাঝদরিয়া ছাড়িয়ে কখন বাঁধ আমার হাতের কাছে। কী যেন কয়েকটা নাম-না-জানা গাছ বাঁধের বুকে। দূরে একটি কাল্চে রেখায় গ্রাম দেখা যায়। গ্রামের যিনি মাথা, সেই স্বয়ং ব্রাহ্মণবৃক্ষ নারকেল মাথা তুলে আছেন। গোটা দশ-পনেরো যাত্রীতে ঠেলাঠেলি লাগিয়েছে। এদিকে দেখ, এখনও লঞ্চ থামেনি। খালাসির কাঠের সিঁড়ি নামেনি। টিকেট কাটার ঝামেলা নেই। সে-সব লঞ্চে উঠেই হবে। বাঁধের ওপর তো কয়েকটি গাছ ছাড়া একখানি পাতার ঘরও দেখি না। এ কেমন ঘাট, কে জানে।
যাত্রীদের মধ্যে কর্তা-গিন্নি সাহেব-বিবি-ছাওয়াল পাওয়াল সব রকমই আছে। বোঁচকা-বুচকির মধ্যে একজনের হাতে যেটি চোখে পড়ে, সেটি একটি নধর ছাগলছানা। বেচারির চোখে কী তরাস! গলায় কাতর ডাক। মাকে ছেড়ে হয়তো যেতে হচ্ছে। জন্মভূমিও বটে। কোথায় নিয়ে যায়, কে জানে।
সিঁড়ি পড়তে না পড়তেই যাত্রী পা দেয়। তবে এবার বাঁধের গায়ে নয়। জল নেমে গিয়েছে ভাঁটায়। সিঁড়ি গিয়ে লাগে চরায়। সবাই নেমে এসে ওঠে।
উঠুক, কিন্তু যেভাবে সব হাঁটুভর পাঁক ঠেলে উঠছে, পিছলে না পড়ে। অনেকেরই টলমল ভাব। তার থেকে বেশি ভয় লাগে কলাবউটিকে দেখে। তবে উনি বউ কি বিবি, কে জানে। লম্বায় হাত তিনেক, বহরে বড় দেখি। লালপাড় বাসন্তী রঙের জমিনে বেজায় লাল ফুলের ঝলক। তা বলে মুখ দেখতে পাবে, সে আশায় নিমাই। শাড়ির মধ্যে কোথায় যে আছেন, তা খুঁজি পেতি হস্সে না।
তা বেশ তো, হায়া বজায় থাক, কেউ কি একটু হাতটা ধরতে পারে না। পারতো, যদি মা শাশুড়ি থাকত। স্বামীতে হাত ধরলে আর হায়া কোথায় থাকে। তিনি তো বোধ হয় ইতিমধ্যে লঞ্চে উঠে পড়েছেন।
আহ্, কী অশুভ ভাবনা দেখ। বউটি কাঠের সিঁড়ি থেকে হাঁটা দিল একেবারে ডাইনে বেঁকে। গেল গেল শব্দ ওঠার আগেই বউ নীচে। একে বলে দক্ষিণের পলি পাঁক। একেবারে কোমর অবধি নীচে। অমনি ঘোমটা ফাঁক। এবার দেখ, ভোট-জড়ানো আট-দশ বছরের মেয়েটি। শ্যামা শ্যামা তেলতেলে মুখখানিতে দুলে নোলকে সাজ। কপালে সিঁথেয় ডগডগে সিঁদুর। চিলের মতো এক চিৎকার, ‘আঁ আঁ বাবা গো!’…
বউয়ের কান্না, লোকের গেল গেল, তার মধ্যেই একজনকে দেখা গেল, এক লাফ।
মদ্দর এদিক নেই, ওদিক আছে। হাতের বোঁচকাটি তিনি ছাড়েননি। কালোর ওপরে গতরখানিও বেশ দশাসই। গোঁফের রেখামাত্র পড়েছে। ব্রণ কিংবা ডাঁশ মশার কারবার কে জানে, মুখখানি বাঁধের মতোই এবড়োখেবড়ো। বোঝা গেল, কলাবউ ওঁরই গিন্নি। টান দিয়ে তুলে একেবারে শিবের বুকে সতী। কে যেন আবার হেঁকে বলে, ‘বউ তো?’
ভেবেছিলাম, রাগের জবাব আসবে। তাই কখনও হয়। ওই সংসার খাওয়া পাঁক ঠেলে উঠতে উঠতে মদ্দ হাসি চাপতে পারে না। সলজ্জ হেসে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ।’ তারপরে শোনো হাসি। ছাদের খুপরিতেও হাসি খিলখিলিয়ে উঠছে। মায়ে মেয়েতে গড়াগড়ি। কেবল কর্তার মুখ বিরস। ঘটনা দেখতে দেখতে বলেন, ‘যাচ্ছেতাই। ননসেন্স!’ গাজি ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাসতে হাসতে হাঁক দেয়, ‘ভাগ্যি চোরাবালি নয়, তালে আর বউ পেতি হত না হে।’
বেচারি ছাড়া কী বলবে। তখন হাত ধরেনি। এখন কাঁধে ফেলে তুলছে। নিজের গায়ে অমন পাট-ভাঙা নীল রঙের জামাটা কাদায় মাখামাখি। বধূটির মাথায় আবার খোঁপা। মুখখানি স্বামীর ঘাড়ে গোঁজা। লজ্জা করে না বুঝি। হতে পারে আট-দশ বছর বয়স। বউ তো।
কর্তা গিন্নি উঠতে না উঠতেই সারেঙের ঘরে টিং টিং। অমনি যন্ত্রের গর্জন জোরে বেজে ওঠে। লঞ্চ মোড় ঘুরে সরে যায়। খালাসি সেই অবস্থায় সিঁড়ি টেনে তোলে। দিগন্ত আবার খুলে যায়।
.
০৬.
মাঝ নদীতে এসে মনে হয়, একটু আগের সমস্ত ঘটনা যেন বহুদিন গত। এ যাত্রা নিরবধি কালের। কিন্তু ওদিকে মায়ে-ঝিয়ের হাসাহাসি থামেনি। বাইরের দিকে মুখ করে তাদের কথা চলেছে। কেবল মাঝে মাঝে, কাজলকালো চোখের কোণে, খুপরিটাকে এক নজরের তদন্ত। কেন, সে কথা পুছ করো না। জীবন-মনের কি একটা ধর্ম নেই! কথাবার্তার টুকরো যেটুকু ছিটকে আসছে, তাতে পাঁকে পড়া কলাবউ এবং স্বামী সংবাদই আলোচ্য।
‘ওরে, তোদের হাসি যে থামে না!’
প্রৌঢ়ের প্রাণে বোধ হয় সইল না। যদিও গলায় তাঁর রাগ বিরক্তি নেই। বরং, একটু ধন্দে পড়ি, টাকের থেকে ওঁর চোখমুখই যেন ঝলকাচ্ছে বেশি। কখন আসনের ওপর পা তুলে নিয়েছেন। জোড়াসন করে বসে বেশ একটু মেজাজেই যেন হাঁটুতে তবলার ঠেকা তাল মারছেন। ঘন ঘন খাঁকারি কয়েকবার। তারপরে, ওঁর পক্ষে গলা বেশ নামিয়ে বললেন, ‘দেখ্ ঝিনি, তাই যদি বলিস্, বিয়ের সময় তোর মায়ের বয়স ছিল কত, জিজ্ঞেস কর। খুব বেশি তো এগারো, না কী বল।’
উলটো আসনে প্রথমে চমক। ঝিনির তো মুখের প্রলেপ ছাপিয়ে রক্তাভা ছলকায়। প্রৌঢ়া ভুরু কোঁচকাতে গেয়েও ভিনযাত্রীটির দিকে একবার দেখে খস্ করে ঘোমটা টানেন। তার পরের ঘাড় ফেরানোকে নীরব ঝামটা বলে কিনা জানি না। তবে যে কথাটা জানা ছিল, যুবতী বিহনে অনেক কিছু মানায় না, আর তা বলতে পারবে না। কাঁচা-পাকা চুলের মাঝে সিঁদুর পরা প্রৌঢ়াকে যেন যুবতীর থেকে মিষ্টি দেখি। কিন্তু সাক্ষী মানেন নিজের ডাগর মেয়েকেই, ‘দেখছিস? ভীমরতি!’
এবার দেখ মজা। প্রৌঢ়র মেজাজ এখন চলন্তা। ষাটের ঘর থেকে কুড়ির ঘরে ফিরে গিয়েছেন, না দশের ঘরেই, তা কে জানে। বলেন, ‘আরে তাতে আর কী হয়েছে, একটা কথার কথা বই তো নয়। এ তো ছেলেমানুষ, না কী বলেন।’
কাকে বলেন। চোখ তুলে দেখি, নজর ভিনযাত্রীর দিকে। হতে পারে ভুরুতে সাদা রং লেগেছে, কেশ মাথা ছেড়ে গিয়েছে, চোখের চারপাশে রেখার ভাঁজ। তবু যেন দুটি তরুণ চোখে রঙের ঝিলিক। ছেলেমানুষ বললেও, ‘আপনি’ সম্বোধনের ভব্যতাটা আছে। কিন্তু শেষে সাক্ষী কিনা সকল লজ্জা যার তরে। মাথা নেড়ে সায় দেবার সাহস নেই। কথা বলা আরও কঠিন। তবু সাক্ষী একেবারে কানা কালা বোবা হয়ে থাকতে পারে না। কোনও রকমে একটু হাসো।
হাস্য পরে, তার আগেই ঝিনির গলায় চাপা ঝঙ্কার, ‘আঃ বাবা, চুপ কর না।’
না, বাবা আর তা মানবেন না। বলেন, ‘ওই তোদের এক দোষ ঝিনি। আমি কথা বললেই তুই আর তোর মা খালি চুপ করতে বলবি।’
মা এবার সরোষে বলেন, ‘আবার ঝিনি ঝিনি কেন, বারণ করা হল না?’
কিন্তু চলন্তার টান জানো না। সেই স্রোতে সব কুটোকাটি হয়ে ভেসে যায়। বলেন, ‘আরে আগের কথা থেকে যখন বলেই ফেলেছি, এখন আর না বললে কী হবে। এর তো জানাই হয়ে গেছে।’
বলে হাত উলটে তুলে দেখান আমার দিকে। এখন কে ফাঁপরে পড়ে দেখ। ইচ্ছা করে হেঁকে বলি, ‘আজ্ঞে না, জানা নেই।’ এখন না যায় বাইরে মুখ ফেরানো, না যায় মুখ নিচু করা। তার চেয়ে ভরাডুবি, দাঁত দেখিয়ে ঘাড় নাড়া।
ওদিকে মায়ে-ঝিয়ের নাড়ি বন্ধ। মুখে কথাটি ইস্তক নেই। চেয়ে দেখি, পরস্পরে মুখোমুখি, চোখাচোখি। তারপরে খোপ ফাটানো হাসি। সেই একরকম আছে না, এ লোকের কথা শুনে হাসব না কাঁদব। সেটা এক কথার কথা। কাঁদলে রসাতল। কিন্তু এ সে ঠাঁই নয়। তাই মায়ে-ঝিয়ের হাসিতেই খোপ ফাটে। হাসির মধ্যেই একজনের গলায় শোনা যায়, ‘কী জ্বালাতন!’ আর একজনের, ‘বাবাকে নিয়ে আর পারা যায় না সত্যি।’ বলতে বলতে দু’জনেরই নজর একবার ছুঁয়ে যায় ভিনযাত্রীর মুখ। যদিও তাতে হাসি থামে না। এ মা-মেয়ে, না দুই সখী? ধূসরে আর কালো কেশে, মুখের রেখায় আর নিভাঁজ ললিত মুখ দেখে মন বিচারে যেয়ো না। মন-বুঝের ছন্দ আছে মনে মনে। পুছ করো গিয়ে প্রকৃতিকে। মায়ের কাছে ছাড়া কি মেয়ে হতে শেখা যায়। ছেলেরা যে সবাই ছেলে। বাবাও তো এক ছেলে। অবুঝ ছেলে। আর মেয়েতে মেয়েতে মা-মায়ে। প্রকৃতি রহস্যের জানাজানি এই দু’জনে। ভাবের দরিয়ায় খেল্ যদি ঠিক থাকে, তবে মা-মেয়েতেও সখী।
কিন্তু ভিনযাত্রীর মুর্দা হাল। ভিতরে কলকলায়, বাইরে আসতে পায় না। সহবত নেই নাকি। হতে পারো তুমি এক সাক্ষী।
তা বলে, মহিলারা হাসলে তুমিও কি হাসবে। দম রাখো, দমিয়ে রাখো। চোখে মুখে যদি ফুটে বেরোয়, তার কি উপায় আছে। আকাশে সূর্য থাকলে রোদ দেখা যাবেই।
তবু একবার গাজির দিকে চোখ না পড়ে যায় না। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে চোখ মেলে। অথচ চোখ দেখে মনে হয়, এ গাজি চোরা। যেন কোন দূরের এক ফাঁক থেকে চুপি চুপি দেখে। দেখে, আর মিটিমিটি হাসে দাড়ির জটায়। ইস্, যেন অন্তর্যামী বসে আছেন, মজা দেখেন বসে বসে।
প্রৌঢ় কিন্তু বেহাল নন এক ফোঁটা। ওদিকে হাসির দগর, এদিকে উনি চোখ দু’টি উপচে বলেন, ‘তা কি আর মিথ্যে বলেছি, কী বলেন? আপনি কি আর ওর ঝিনি নামটা শুনতে পাননি?’
পেয়েছি নাকি। কই, জানি না তো। কন্যে ঝিনি না অলকা, ভিনযাত্রীর তা জানতে নেই। কিন্তু, সে তো আপন বুঝ। এখন সোজা কথার জবাবটা যে চাই। তবে ওই শোনো, আমি মুখ খোলবার আগেই ঝিনি কেমন ঝঙ্কৃত হয়, ‘আচ্ছা হয়েছে বাবা, উনি শুনতে পেয়েছেন।’
পরম উদ্ধার। কৃতজ্ঞতায় একবার চোখ তুলে না তাকালে মানায় না। উদ্ধারকর্ত্রীও দেখি, নজরে রেখেছেন। ভাবখানা, ‘আমার বাবা এমনি মজার।’ এরকমটা হলে তবু একটু গলা খুলে কলকলানো যায়।
ওদিক থেকে সঙ্গে সঙ্গে নাকছাবির ওপেন্ পাথরে ঝিলিক। এই দিগন্ত যেন বিচার করে, ওঁর গলায় কপট রোষ কি না। বলে, ‘তাতে হয়েছে কী।’
একে বলে মিঠে ফোঁসানি। কর্তা গলাবন্ধ কোটসহ বুকখানি সামনে চিতিয়ে আনেন। তর্জনী দিয়ে নিজের হাঁটুতে ঠুকে বলেন, ‘হয়েছে তো তোমাদেরই। আমি বলছি, নাম কখনও খারাপ হয় না। আপনি কী বলেন, ঝিনি নামটা খারাপ!’
মুখ দিয়ে যেন তাড়াতাড়ি অপরাধ ভঞ্জন করি, ‘না না।’…
বলেই শিরদাঁড়াতে কাঁটা। শরীর একেবারে আড়ষ্ট। ছি ছি, এ মুখ খুলে গেল কী করে। ভয়ে, নাকি সহবতে। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে এবার হার মানার হাসি। এ মানুষ নিয়ে কী করা যায়!
কিছু না। চলন্তার জল ধরে রাখা যায় না। তিনি কল্কল্ করে চলেছেন, ‘জানিস্ তো, এ নামটা রেখেছিলেন তোর ঠাকুরদা—।’
কথা শেষ হতে পায় না। তার আগেই গিন্নি ঝেঁজে কোপ দেন, ‘তা সে সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ার দরকারটা কী।’
কর্তা কোপেও কাটেন না। বলেন, ‘না, দরকার কিছু নয়। বাবা তো খুব ভালবাসতেন ঝিনিকে। শেষ দিকে তো খালি ওকেই কোলে নিয়ে বসে থাকতেন, আর বলতেন, “ঝিনি ঝিনি ঝিনিক ঝিনিক, ঝিন্কি জগো ঝম্পো ঝাঁ।” তোমার মনে আছে সেই কথা?’
পরিবারকেই জিজ্ঞাসা। মা-মেয়ের আবার হার মানা। মা বলেন মেয়েকে, ‘দেখছিস তো।’ দেখছে কিন্তু সামলায় কে। প্রৌঢ় বলেন, ‘না, কথাটা উঠল, তাই আর কী। নাম কাকে বলে। নাম হল একটা জিনিসকে বা কাউকে বিশেষ ভাবে বোঝাবার জন্যে, কী বলেন। তুমি একটা কালো পাখি দেখিয়ে বললে, এটা কাক, আর একটা সবুজ ফল দেখিয়ে বললে, এটা কাঁকুড়, এইরকম আর কী। মানুষের বেলায় তা হয় না, তখন তার ভিন্ন ভিন্ন নাম। এখন তুমি যদি বলো, অমুক ইস্কুলের অমুক রিটায়ার্ড হেড মাস্টার এই লোকটা, তা বললে হবে না। তখন আমার নামটাও বলতে হবে ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী।’
খবরদার, বিষম লাগে না যেন। এমন নাম অতীতে শোনা না থাকতে পারে। কিন্তু সামনে মাস্টারমশাই। হেড মাস্টারমশাই। কথার থেকে সেরকম একটা ধন্দ মনে ছিল। শ্রীমুখে সেই জবানি আপনি ফোটে। তবু কোথায় যেন একটু রকমফেরের খেলা দেখি। এ যেন সেই কঠিন-দৃষ্টি কুটিল চোখ নয়। হাসতে মানা রামগরুড়ের ছানা, পান থেকে চুন খসার নীতিতে থমথমে নয়। ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী হাত ঝটকা দিয়ে বলেন, ‘তা সে কথা যাক। যে কথা নিয়ে কথা উঠল, তোর মা’র কথা বলছি, এগারো বছর বয়সে সেই মুর্শিদাবাদের সিল্কের ভোট জড়িয়ে—।’
এবার একেবারে রসাতল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মা এবার জোর কষুনি দিলেন, ‘দেখ ঝিনি, এবার কিন্তু আমি সত্যি রাগ করব বলে দিচ্ছি। আদিখ্যেতা হচ্ছে।’
বলেই মুখ একেবারে দিগন্তের আকাশে। এবার দেখ হেডমাস্টারের হাল। বাঁধানো দাঁতে জিভের গুঁতো ঠুকে টেনে টেনে হাসেন। মন রে আমার, এ হাসির নাম কি ব্রহ্মনারায়ণী। গৃহিণীর পিছন ঘোমটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, বলছি না। ওই খুকিটিকে পড়ে যেতে দেখলাম কিনা, তাই দু-একটা কথা মনে পড়ে গেল, এই আর কী!’
বলে হেডমাস্টার ব্রহ্মনারায়ণ তাঁর তরুণ চোখ দুটি তুলে তাকান আমার দিকে। দেখি, বুড়াটা চ্যাংড়ার মতো মিটি মিটি হাসে, চোখ পিটপিট করে। ভিতরের কলকলানি যেন আর ধরে রাখতে পারি না। মুখ ফিরিয়ে দেখি, ঝিনি চোখ ফেরাবার সময় পেল না। কালো তারা দু’টি ছিটকে যাবার আগেই একটু লজ্জায় পড়ে যায়। তারপর মুখখানি টকটকিয়ে ওঠে।
আবার এদিকে শোনো, ডুপ্কিতে কেমন তাল লেগেছে। জোরে নয়, ডুপ্কি চুপ্কি চুপ্কি বাজে, ডুপ্ ডুপ্ ডুপ্কি ডুপুক্ ডুপুক্। তাকিয়ে দেখি, সেই তালেতে মৃদু মৃদু দাড়ি নাচে, বাবরি নাচে। আর নাচে চোখের তারা। হাসি আছে ভাঁজে ভাঁজে। যেন জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন বোঝেন বাবু।’
কী বোঝে মন। বোঝাবুঝি ভিতরে বাজে। মুখেতে বোল বাজে না। রূপ অরূপের তরঙ্গ স্রোতে বহে যায়, আলোকের স্রোতে—অলক্ষ্যের টানে যাকে বলে। কথায় কী বোঝাবে। ব্যাখ্যার কথা কি জানা আছে। এত যে ভাগ-বাঁটোয়ারার চিন্তায় ছিলে, এবার দেখ, খোপ কেমন ঢাকনা খুলে দেয়। কেমন করে দিগন্তে একাকার। বাইরে দেখি ভাঁটার নদী, তীরে পাখির মেলা। মনে তো পড়ে না, এত পাখি কবে দেখেছি। ঝাপ্সা কালো পিঠের নীচে সাদা সাদা বুক পাখিগুলোর। তবে জল-ভডভডিয়ার সঙ্গে বোধ হয় এ এলাকায় তেমন জান পহছন নেই। শব্দেতে সব একযোগে মুখ তোলে। তারপরে দে ওড়া। একা দোকা নয়, শতাবধি। পাখার বিস্তারে যেন ছায়া ঘনিয়ে দিয়ে যায়। শরতের মেঘের মতো নদীর বুকের রোদে একখানি ছায়া চলে যায়। দলপতিকে চিনবে না, তবে নির্দেশ আছে জানবে। ‘চল ভাগি, জল দোলানো সেই প্রকাণ্ডটা আসছে।’
বাঁধ যে নির্যস শূন্য, তা বলা যাবে না। মাঝেমধ্যে দু-একজনাকে দেখা যাবে, কোথায় যেন যায়। পিছনে তাদের আশমান জমিন, সেই কোথায় যেন গিয়েছে। কোথায় গিয়ে যেন ঠেকেছে। বউ-ঝিয়েদের দু-একজনও যে চলাফেরা করে না, এমন নয়। হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে না। বলা যায় না, কে যায় লঞ্চে। তারপরে উপশাস্ত্র নালিশ, ‘বউটা বাঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে।’ বলা তো যায় না। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আদিবাসী মেয়ে পুরুষ দু-একজনকে দেখতে পাবে, সেই মেয়ের কাছে ঘোমটার আশা করো না। ‘চোখ আছে তাই দেখি। কোন দেশের মানুষ যেন কোন দেশেতে যায়, তাই দেখি।’ গায়ে গতরে অত ঢাকাটুকির সহবত পাবে না। তাতে যদি বল, যেন ঝোটন পায়রা বুক ফুলিয়ে যায়, তা বলতে পার।
সেই যে বলেছিলে, মন চলো যাই দিগন্তে, সব কিছুতেই সেই খেলা। এবার অবুঝ, কী চাও, কোথায় যাও, কীসের খোঁজে, জবাব না পেলে, পাড়ি পাড়িতেই ভাসো। আর হাসিতে যদি চোখ ঝাপসা হয়, হোক। জানবে, দিগন্তের সেই হয়তো দান।
গাজিকে জিজ্ঞেস করি, ‘নদীর নাম কী।’
গাজি বলে, ‘নদীর নাম বাবু ডাংসা।’
ডাংসা! এদিককার অনেক নদীর নাম শুনেছি, এমন নাম কখনও শুনিনি। হয়তো হবে। আমার চেনা সীমানার নয়। নামের মজদুরিতে যার আনাগোনা, সে-ই জানবে ভাল।
তা বললে তো হয় না। ব্রহ্মনারায়ণ কাটান দেবার ভঙ্গিতে ঘাড় ফিরিয়ে বলেন, ‘কী বললে?’
গাজি ডুপ্কি থামিয়ে বলে, ‘ডাংসা। তবে এইবার যে ডাইনে ঘুরবে, তাতেই গিয়ে বিদ্যেধরীতে পড়বেন।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘তুমি জানো কাঁচকলা।’
‘কেন বাবু।’
তা বলতে হবে বই কী, গাজি কেন কাঁচকলা জানবে। জানতে হবে এইজন্যে যে, বাবুর হাতে বোধ হয় পাকা কলা। তিনি বলেন, ‘এটা কালিন্দী নদী।’
গাজি দাড়ি ঝাড়া দিয়ে খ্যাঁকখেঁকিয়ে হাসে। বলে, ‘শোনেন, বাবু কী বলেন। সে তো বাবু পুবে, বডার ঘেঁষে কালিন্দী নেমেছেন।’
হেডমাস্টার মানতে রাজি নন। মাথা নেড়ে বলেন, ‘তুমি কিছুই জানো না। তোমরা তো কেবল যাও আর আস, নদীর নামধাম তোমরা জানবে কী করে।’
তা বটে। কোথায় তোমার বাস, তা তুমি জানো না। তুমি কেবল বাস করো। কেন। না, তবে শোনো, ব্রহ্মনারায়ণ বলেন, ‘হাঁদু আমাকে বলেছে, এটা কালিন্দী নদী।’ গাজি একবার আমার দিকে চায়। হেসে হেসে যেন অবোধকে বুঝ দেয়, ‘না বাবু, তা হতি পারে না। আপনার হাঁদু যা বলেছেন, সেটা অন্য জায়গা। তয় তো আমরা হিঙ্গলগঞ্জ দিয়া আসতাম। কালিন্দী হল গিয়া আপনার বডারের নদী। ডাংসা ধরি আমরা উজানি এলাম। এবার বিদ্যা দিয়া নামা। আপনি ক্যানিং হয়ে, মাতলা দিয়া গোসাবায় যাবেন।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ এবার অন্যদিকে সাক্ষী ডাকেন, ‘হ্যাঁ রে ঝিনি, হাঁদু তো তাই বলেছিল না! দু’বছর আগে যখন গেছলাম, তখন তো তাই বলেছিল।’
ঝিনি এবার একটু সহজ। বাবার দিকে ফিরে বলে, ‘হাঁদুদার কথা তো। না জেনেই বলেছে হয়তো।’
‘না জেনে বলেছে? তা হলে তো হাঁদুটা একটা গাধা।’
অন্তত ব্রহ্মনারায়ণ তাই বলেন। ঝিনি বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেনি, তাই মায়ের দিকে ফেরে। জবাবে, সেখানে চোখাচোখি, হাসাহাসি৷ তবে কর্ত্রীর মুখ একটু বাইরে। রাগ করে আছেন যে! কর্তা হাসি দেখতে পান যদি।
কিন্তু গাজি আবার কী জিজ্ঞেস করে শোনো, ‘কে হাঁদু, বলেন তো। কোন বাড়ির।’
ব্রহ্মনারায়ণ ছাত্র ধমকান, ‘কোন হাঁদু, কোথাকার হাঁদু, তা তুমি কী করে জানবে?’
গাজির মুখে হাসিটি তুমি কাড়তে পারবে না। বলে, ‘নাবোলে, শাঁখচূড় থেকে উঠলেন তো। বাড়ির কথা বললি চিনতি পারি।’
‘পারলেই হল। শাঁখচূড়ের সবাইকে তুমি চিনে বসে আছ? তোমার বাড়ি কোথায়?’
বোঝো এবার, কাকে ঘাঁটাতে গিয়েছ। কিন্তু গাজির কি মাস্টারেও ভয় নেই। দাড়ির ভাঁজে তেমনি হেসে বলে, ‘বাড়ি আর কবেন না বাবু, বলেন গুজরানের চালা। বসিরহাটের শহরের এক পাশেই থাকি।’
‘তা বেশ তো। তুমি থাকো বসিরহাটে। শাঁখচূড়ের লোক তুমি চিনবে কী করে?’
গাজি এবারে গলার আওয়াজ চাপতে পারে না। হা হা করে হেসে বলে, ‘নামের মজুরায় ফিরি কি না। যাওয়া-আসা সবখানে, তাই জিগেসাঁ করলাম।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ কয়েক মুহূর্ত গাজির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপরে ঘোর অবিশ্বাসে বলেন, ‘নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নাম শুনেছ? তাঁর বাড়ি।’
গাজির মুঠোয় দাড়ি। হাসির মধ্যে নজর যেন কোন কূলে। একটু একটু ঘাড় নেড়ে বলে, ‘ওই গিয়া আপনার যানাদের বাড়িতি দুইখান বেলাতি সাবুর গাছ আছে?’
বেলাতি সাবুর গাছ?
ব্ৰহ্মনারায়ণের ভুরু নয় কেবল, ব্ৰহ্ম সুদ্ধ কুঁচকে ওঠে। বলেন, ‘কী বললে?’
‘আজ্ঞা, বেলাতি সাবুর গাছ।’
গাজি এবার মাস্টারকেও ঘোল খাইয়েছে। ব্রহ্মনারায়ণ একবার আমার দিকে, তারপরে কন্যার দিকে ফেরেন। কন্যার ঠোঁটের কূলে কূলে হাসি। বলে, ‘বোধ হয় পাম গাছ দুটোর কথা বলছে।’
গাজি বলে, ‘তা হতি পারে। আমরা বাবু অতশত জানি না তো। কে যেন একদিন বললে, দেউড়িতেও দু’খান বেলাতি সাবুর গাছ, তাই জানি।’
ব্রহ্মনারায়ণ তবু ধমকান, ‘তোমার মাথা। ওই যে কী সব নদীর নাম বললে, ধাম্সা না হাম্সা—।’
‘ডাংসা, বাবু ডাংসা।’
‘আরে, অই হল। তোমাদের ডাংসাও যা, ধাম্সাও তাই।’
কিন্তু গাজির প্রাণে কী সাহস দেখ। তেমনি হেসে হেসেই বলে, ‘সব গিয়া তো সেই সাগরেই ঢলে। নাম যাই হউক গা। তয় বাবু, আপনার শাঁখচূড়ের ঠাকুরমশায়রে চিনতে পেরেছি। ওঁয়ার বড় দুই ছেলে কলকাতায় বড় কাম করে। উনি মিনি মাগনায়, ওই গিয়া আপনার কী ওষুধ বলে, চিনির বড়ির মতন, সেই ওষুধ সবাইরে দ্যান, তাই কিনা বলেন। আর ওই যে হাঁদুবাবুর কথা বলতিছেন, ওঁয়ার একখানি দোকান আছে বসিরহাটে। অ্যাঁ, তাই কি না?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ ভুরু কুঁচকে চোখ পিটপিট করেন। আর চোখাচোখি করেন ঝিনির সঙ্গে। ঝিনির রাঙানো ঠোঁটের কূল পাছে হাসিতে ভেসে যায়, তাই ভ্যানিটি ব্যাগ আড়াল করে। বলে, ‘ঠিকই তো বলছে বাবা। হাঁদুদার তো দোকান রয়েছে বসিরহাটে। গেদ্দা আর নেদ্দা তো কলকাতায় চাকরি করেন।’
তা বলেই বা মানবেন কেন। কন্যাকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘আর ওই যে কী সব বলছে, ওষুধ দেন চিনির বড়ির মতন।’
‘বড় মামা হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেন তো সবাইকে।’
‘কিন্তু সেটা চিনির বড়ির মতন নয়।’
গাজি তাড়াতাড়ি বলে, ‘মুরখু মানুষ বাবু, নাম-টাম তো জানি না। তবে ওই দিদি যা বললেন, তাই। আমাকে একবার দিইছিলেন কি না।’
‘তোমাকে?’
‘হ্যাঁ। নামের মজুরায় গেছিলাম। তা শরীলটা বাবু ছিল না। গান শুনি খুশি হয়ে কাগজের মোড়ক করি চার পেস্ত ওষুধ দিয়া দিলেন। একদিনেই শরীল একেবারে ঝরঝরে।’
ব্রহ্মনারায়ণ গম্ভীর হলেন। গাজির এতটা জানাশোনা যেন তাঁর ভাল লাগে না। এক তো, দেখ, ঠেক মারলে ব্যাটা ভেড়ির বাঁধ নিয়ে। তারপরে নদীর নাম নিয়ে। এখন আবার তাঁর নিজের আত্মীয় নিয়ে। গাজিটা সত্যি পাজি। এবার চুপ দিলে হয়।
তাই কি হয় নাকি। কবুল করিয়ে নিতে হবে তো। গাজি বলে, ‘তয় বাবু, ঠিক হলি তো। আমি যানার কথা বললাম, তানার কথাই আপনি বলছেন তো?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ নাক টানেন। বলেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। তুমি কী?’
এ আবার কেমন কথা, কোন বায়ে যায়? গাজি বলে, ‘কীসের কথা জিগেসাঁ করেন বাবু।’
মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি সাধু না ফকির?’
কৌতূহলের থেকে যেন বিরক্তিই বেশি। এবার বুঝুক গাজি, কাকে বারে বারে ঠেক দিতে যাওয়া। কিন্তু যে বলে, ‘কালার সঙ্গে বোবায় কথা কয়, কালা গিয়া শরণ মাগে কে পাবে নির্ণয়, আর অন্ধ গিয়া রূপ নেহারে, মর্ম কথা বলব কি’, সে যে সোজা জবাব দেবে, তেমন আশা করো না।
হেসে বলে, ‘বাবু, সাধু ফকিরে ভেদ নাই। আপনি যা বলেন, আমি তাই।’
ব্রহ্মনারায়ণ হাত উলটে ঘাড় নাড়েন। বলেন, ‘তা বললে কি হয়। আমি জানতে চাইছি, তুমি হিঁন্দু, না মোচলমান।’
গাজি একবার সেই দূরের আকাশের দিকে চায়। যেন কার দিকে চেয়ে হাসে। সেদিকে চোখ রেখেই বলে, ‘মুরশেদের নাম করি বাবু, তাঁর কাছে তো কোনও জাত নাই। তয় যদি জন্মের কথা বলেন তো বলি আমার বাপ মোচলমান।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ যেন আবার ঠেক খেয়ে চমকে ওঠেন। তাকান আমার দিকে। বলেন, ‘সে আবার কেমন কথা হে। বাপ মোচলমান, আর তুমি কী?’
‘মুরশেদের দাস, ওখেনে আপনার হিঁন্দু মোচলমান নেই।’
বলে গাজি চোখ ঘুরিয়ে হাসে। ডুপ্কিতে শব্দ তুলে বলে, ‘বাবু একটা গান করি শোনেন।’
বেশ গলা খুলেই আশমানে গলা তোলে গাজি—
‘সব লোকে কয়, তুমি কী জাত সংসারে।
আমি কই, জেতের কী রূপ, দেখলাম না নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীলোকের কী হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতার প্রমাণ, বামনি চিনি কী ধরে।’
.
০৭.
আমার বুকে চলকে ওঠে কী এক রস। হঠাৎ যেন একটা ব্যথা ধরিয়ে দেয়। তবু হাসিতে ডগডগিয়ে ওঠে প্রাণ। চমকে ফিরি গাজির দিকে। এমন কথা শুনিনি আগে। কে বেঁধেছে এমন কথা। কে গেয়েছে সুর করে। কোথা থেকে আসে গাজির ভাণ্ডারে। মনে হয়, এক কথাতে জগৎজোড়া জাতের বিচার দিলে মিটিয়ে।
এখন দেখ, গাজির ভুরু নাচে, চক্ষু নাচে, আর নাচে দাড়ি। বসে বসেই কোমর নাচে, মাথার বাবরি নাচে, আর নাচে অঙুলি। আরশি-চোখে হাসির ঝলক, যেন চলকে চলকে পড়ে। বলতে হয়, লোকটার মুখ বিটলেমিতে ভরা। কী রহস্য যেন করে। ডুপ্কির তাল ঠিক চলে। আকাশের দিকে চেয়ে, সুর করে ডাক দেয়, ‘ওহ্ ওহ্ ভোলা মন রে আমা-আ-আ-আর…!’
ওদিকে, ব্ৰহ্মনারায়ণ যেন এক জবর ধাঁধা শুনেছেন। কপালে ঢেউ দিয়ে ভুরুতে কোঁচ বিঁধে। এক নজরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন গাজির দিকে। গাজি ঘাড় নেড়ে, দাঁত দেখিয়ে, আবার তাঁকেই জিজ্ঞেস করে। ‘অ বাবু, বলতে পারেন নাকি!’
ব্ৰহ্মনারায়ণ যেন কোথায় ডুবে ছিলেন। চমকে উঠে জবাব দেন, ‘অ্যাঁ?’
গাজি হা হা করে হেসে ধরে, ‘সব লোকে কয় তুমি কী জাত সংসারে।’…
আবার সব কলি ক’টিই ফেরত আনে গাজি। দুলে দুলে গায়। আবার চোখের ছটায় ঝিলিক হানে উলটো আসনে, মায়ে-ঝিয়ের দিকে। মা বেশ মজা পেয়েছেন। মেয়ে তার থেকে বেশি, সে যেন মজেছে। নাগরিকা মুগ্ধ চোখে গাজিকে দেখে।
ব্রহ্মনারায়ণ ঘাড় বেঁকে বলেন, ‘তা ঠিক, মানতে হবে। কিন্তু, ওই কথাটা শোনা শোনা, অথচ ঠিক মানে বুঝতে পারলাম না।’
গাজি ডুপ্কিতে তাল রেখে বলে, ‘কোন কথাটা বাবু?’
‘ওই যে কী বললে, ছুন্নত।’
আহ্, ওহে ভিনযাত্রী ভদ্রলোক, কান লাল করো না। কী বেয়াজ, ঝিনির চোখ পড়বি তো পড় ভিনযাত্রীর দিকেই। যেন বজ্রাঘাতে লাল হল তার মুখ। কিন্তু হেডমাস্টার ব্রহ্মনারায়ণ সরল মানুষ। আজে-বাজে কথায় নেই। যা জানেন না, তা জানতে চান। তবে তার আগেই যে মেয়ের গলায় সলজ্জ অস্ফুট ধমক ফোটে, ‘আঃ বাবা।’
বাপ মেয়ের দিকে ফেরেন। মেয়ের ততক্ষণ আশমানে নজর। কিন্তু রংঝালর সিল্ক শাড়িতে যে কাঁপন। শরীরের কাঁপুনি ধরে রাখা যায় না। হাসিতে সে অধরা। এ অধীনের অবস্থা তথৈবচ। কোনদিকে মুখ ফেরানো যায়, ভেবে পাই না। ব্ৰহ্মনারায়ণের দিকে তাকালে অট্টহাসি ফাটবে। উলটো দিকে আরোই অসম্ভব। ভাবলাম, খোপ ছেড়ে যাই।
কিন্তু গাজি বলে ওঠে, ‘সুন্নত জানেন না বাবু। মুসলমানের ব্যাটাদের ছেলেবেলাতেই হয়—।’ কথা শেষ হবার আগেই, ব্ৰহ্মনারায়ণ তর্জনী তুলে হাঁকেন, ‘ও ইয়েস ইয়েস, মনে পড়েছে। তাই তো বলি, কথাটা শোনা শোনা লাগছে, অথচ…। ওই তোমার গিয়ে যাকে বলে—।’
সর্বনাশ, ব্যাখ্যা করবেন নাকি! উলটো আসন থেকে প্রায় আর্তনাদ ওঠে, ‘বাবা!’
‘অ্যাঁ?’
ব্রহ্মনারায়ণ আবার থমকান। মেয়ে ডাক দিয়েই মুখ ফেরায়। মাস্টারমশাই একবার আমার দিকে ফেরেন। তারপরে বলেন, ‘না আমি বলছি, গানটি তোফা। বেশ ধরেছ হে। গাও গাও, তারপর?’
গাজি গেয়েই আছে,
‘কেউ মালা কেউ তস্বি গলায়
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জেতের চিহ্ন রয় কার রে।
ওহ্ ভোলা মন…।’
হ্যাঁ, ভোলা মন, মন দিয়ে শোন। মরমে তোমার কী এক নেশা ধরে যায়। সেই নেশায় মন দিয়ে দেখ, কত শ্মশানের ছাই, কবরের ধুলা একাকার হয়ে গিয়েছে। সেই একাকারে হাতড়ে দেখ, কী জাত লেখা আছে। কিন্তু ভাবি, এ গানের বাঁধনদার কোন বিদ্রোহী কবি। এ কবিতে সে চোটপাট নেই, সে ধিক্কার নেই, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া।’
এ বলে, ‘সব লোকে কয় আমার কী জাত সংসারে।’ সমুদ্রের জল বিচার করে কে। মানুষের জাত বিচার করে কে। ক্ষণের নয়, মহামানবের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে যেন কোন দূরকালের কথা শুনি। তাও শোনায় কি না ধুলার আলখাল্লা গায়ে কোন এক পথের গাজি। বাহ্ বাহ্ বলে উঠি, গলায় তেমন ফাঁক নেই। সব যেন টাবুটুবু ভরা, ভর ভর জমাট।
অবাক একটু লাগে ঝিনির মুগ্ধ ঔৎসুক্যে। কুটুস্ যার ব্যাগ খোলে, আকাশ দেখিয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে, চুলেতে যার বেলাতি কষুনি। এমন নগর ছানিয়া ভাসে যে-নাগরিকা, গাজির গানে সে কেন এত উৎসুক। কাজল-মাখা চোখে যে পলক পড়ে না।
তা হোক, কিন্তু ব্রহ্মনারায়ণের বেহ্মবাক্যি শোনো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘করেকট্! গুড, ভেরী গুড!’
মাস্টারমশাইয়ের সার্টিফিকেট। তবে ছাত্রের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আর চেপে বসে নেই, হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে খাড়া বসেছে, দুলুনি হয়েছে দ্বিগুণ, বাবরিতে ঝটকা ত্রিগুণ। সে গায়,
‘ও বাবু—গত্তে গেলি কূপজল কয়
গঙ্গায় গেলি গঙ্গাজল হয়
মূলে এক জল সে ভিন্ন নয়
ভিন্ন বলে পাত্তর অনুসারে।
ওহ্ ভোলা, জগৎ বেড়ে জেতের কথা
লোকে গুমর করে যথাতথা
আমি সেই জেতের ফাতা
বিকিয়েছি সাতবাজারে
সব লোকে কয়…।’
এখন আর গাজির চোখ নাচে না, ভুরু নাচে না। দোলানি থাকে, কিন্তু চোখ বুজে আসে। গলার চড়া স্বর যেন ক্রমে নিবিড় হয়। যেন স্বপ্নে গায়। তারপরে হঠাৎ জেগে উঠে হাসি। মুরশেদের নামে, দোষ নেই, সেই লাল ছোপানো দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে, ‘তয় কন বাবু, জাতের কথা কী বলব। এই আমার জাতের কথা।’
বলবার আর কী থাকতে পারে। দেখলাম তো, চরার পলির ভোজ ফেলে পাখিরা চেয়ে চেয়ে গান শুনল। যারা উড়ে গেল আকাশ দিয়ে, তারাও। কী বুঝল কে জানে। কথা কিছু আসে না, মনে মনে বলি, চলো গাজি, কোন মতলবে কোথায় নিয়ে যাবে, যাই তোমার সঙ্গে। জেতের ফাতা বিকিয়ে আসি সাতবাজারের হাটে।
হেডমাস্টার রায় দেন, ‘ইয়েস, আই এগ্রি, এর পরে আর জাতের কথা তোমাকে বলা চলে না। কী বলিস ঝিনি, গানটা বেশ ভালই গেয়েছে।’
‘চমৎকার। সুন্দর!’
শুধু ভালতে ভাল বলা যায় না। নাগরিকার গলায় যেন স্বপ্নের আমেজ। কোথায় ডুবে আছে। ডুবো ঠাঁই থেকে কথা আসে। দেখ, আগের সেই চেতনে নেই। গোটা আদুর ডানাখানি বে-আব্রু। কাঁধকাটা জামায় কাপড়ে এক রঙা, যুবতী অচেতন, আপনাতে আপনি ফুটে গিয়েছে। কটির ওপরে রোদের মতো খোলা জায়গাটিতে শাড়ি চাপতে ভুলে যায়। বলে, ‘আর একটা গাইবে?’
মায়ের মুখেও সেই ইচ্ছা। গাজি সমঝদারের খিদমদ্গার। কেবল কি তাই! আরশি চোখে গুণটানা দেয় যেন। বলে, ‘তা দিদি, আপনি কইলি না গাইতে পারি। শোনেন তয় গাই।’
এ যেন ক্ষুধার্তকে খেতে বলা। তৃষ্ণার্তকে জলভরা পাত্র দেওয়া। গান কি তার কাছে সেইরকম। অন্যথায় এক কথায় সায় কেন। ঝিনি খুশি। আবার যুবতী লজ্জাও পায়। বাবাকে দেখে, মাকে দেখে, তারপরে গাজির দিকে। গাজি ডুপ্কিতে তাল দেয়, ঘাড় কাত করে তাকায় আমার দিকে। ঘাড় নাড়ে এমন ভাবে, যেন আমি জানি, তার ডুপ্কির বোল কী বলে। গান ধরে,
‘আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলি সে ধন দেখি চক্ষেতে।’
দু’ কলি গেয়েই গাজি ঝিনির দিকে চেয়ে চোখ ঘোরায়। এবার সে বাঁয়া হাতে ঘুংগুর নিতে ভোলেনি। বলে, ‘কেমন কি না দিদি, কেউ কি দেখে।’ ঝিনি হেসে ওঠবার আগেই আবার ধরে:
‘(কী বলব বলেন) আপন ঘরে বোঝাই সোনা
(হায় রে) পরে করে লেনাদেনা
(আর) আমি হলেম জম্মোকানা
না পাই দেখিতে।’
বলে, ‘ওই যে দিদি বলে না, “প্রেম না জেনে প্রেমের হাটের বুলবুলা” সেই মতন আর কি।’ শোনেন,
‘রাজি হলে দরোয়ানি
দরজা ছেড়ে দিবেন তিনি
(হায় রে) তারে বা কই চিনি শুনি বেড়াই কুপথে।’
এই পর্যন্ত গেয়ে গাজি যেন আর্তরবে ডাকে,
‘(ভোলা মন) এই মানুষে আছে রে মন—
যারে কয় মানুষ রতন
ক্ষ্যাপা কয় পেয়ে সে ধন
পারলাম না রে চিনিতে।’
আবার সেই কথাটাই মনে আসে, এ গান কে বাঁধে, কেন বাঁধে। কী যেন বলে, কী এক অচিন কথা। মনে করি, ধরতে পারি, তবু অধরা। গলা খুলে, কথা বলে, সুরে গাওয়া হল যেন সদর দরজা হাট। আর একটা দরজা ভিতরে, বন্ধ দরজা। হাতড়ে ফিরি, খুঁজে পাই না। হয়তো আছে কোনও তত্ত্ব পর্দায় ঢাকা। থাকুক, তবু যেন, বেরিয়ে পড়া ঘরছাড়াকে, আর একবার ঘরছাড়া করালে গাজি। দিগন্ত চলে যায়, চরাচর হারায়। নিজের মধ্যে আর্তরব, কোথায় যাই, কেন যাই, কীসের সন্ধানে। ইচ্ছা করে, আমিও ধরি, ‘পারলাম না রে চিনিতে।’ অথচ দেখ, আমার ভিতরে যেন এক পাগলা হাসি বাজে। আমার চোখ ঝাপসা করে দিতে চায়।
ঝিনির গলায় শুনি, ‘অপূর্ব!’
তারপরেই কুটুস্ ব্যাগ খোলা। হাতড়ে তুলে আনা করকরে একখানি এক টাকার নোট। ব্ৰহ্মনারায়ণের পাশ দিয়ে, হাত বাড়িয়ে বলে, ‘নাও।’
ঝিনির চোখ মুখ বলে, এ টাকা কিছু নয়, তুমি ঝিনিকেই লুটেছ গাজি। তবে কি না, সে লুট তো তোমার দেখা যায় না। একটি টাকা দিয়ে জানানো। আর গাজিকে দেখ, বিগলিত। হাসিখানি লম্বায় বাজে, হেঁ হেঁ হেঁ…। মুখে কথা নেই। মনের কথা পড়তে যদি পারো, তবে শোনো, ‘দিদি আপনি দিলি কি না নিয়ে থাকতি পারি। হেঁ হেঁ হেঁ…।’ মুরশেদের মজুরা আজ বেশ জুতের। টাকাটি চার ভাঁজ করে ঝোলায় পুরতে পুরতে একবার আমার দিকেও দেখে নেয়। এই দেখ, আমার মনটা কেমন খচখচিয়ে ওঠে। যেন আমার গুণের ধনকে আগে অন্যে রেয়াত দেয়।
কিন্তু ওদিকে যেন কেমন একটু চোখ টাটানি ভাব। ব্রহ্মনারায়ণের হাসিটি যেন তেমন খোল্তাই নয়। এমনকী তস্য গিন্নিরও। দুটি গান শুনে, আস্ত একটা টাকা! ব্রহ্মনারায়ণ বলেই ফ্যালেন, ‘একেই বলে ফিলজফি পড়া মেয়ে। তোর সেই ছাত্রীর টুইশান ফী বুঝি নিয়ে এসেছিলি?’
ঝিনি হেসে ভুরু বাঁকায়, আবার ঠোঁট ফোলায়। বলে, ‘আহা, বাবার যেমন কথা। কলকাতায় বসে যা দিনরাত্রি শুনতে হয়, তার চেয়ে এ অনেক ভাল।’
মা তৎক্ষণাৎ মেয়ের দলে। আওয়াজ দেন, ‘সে কথা ঠিক।’
কিন্তু এবার ধাঁধা আমার মনে। এও যে রূপ অরূপের খেলা। একদিকে ‘দর্শন’ আর একদিকে পায়ের নখের রং থেকে অশ্বলাঙুল কেশ বাঁধুনি। এই যোগের ভিতর দুয়ার হাতড়ে পাওয়া দায়। এ দুয়ের আনাযানা কোন দরোজায়। সাবধান, মানুষ চেনার রসিক তুমি নও। নাগরিকা যদি বলেছ, তবে কবুল করো, এ মেয়ে বিদুষী। আবার সেই কথা, জল দেখে কি জল চেনা যায়। শুধু ‘দর্শন’ পড়া নয়, আপন শ্রমের টাকা। ঝিনির জীবিকাও আছে।
ভাবনা যাক, ওদিকে ব্রহ্মনারায়ণের ডাক পড়েছে, ‘আপনি যে কোনও কথাই বলছেন না। কেমন শুনলেন?’
অতি মাত্রায় চকিত হয়ে উঠি, ‘আমাকে বলছেন?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ ঠোঁট উলটে বলেন, ‘ওহ্ বাবা, আপনার তো দেখছি ধেয়ান নেই।’
মাস্টারমশাই বলে কথা। তাড়াতাড়ি বলি, ‘খুব ভাল।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি। যেরকম ভাব লেগে গেছে। আপনারও কি ফিলজফিটফি পড়া আছে নাকি।’
ঝিনির অমনি ভুরু কেঁপে যায়। ঘাড় বেঁকে যায়। আমি বলে উঠি, ‘না না, ওসব পড়াশুনো কিছু নেই।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ জিভ দিয়ে দাঁত ঝাঁকুনি নিয়ে বলেন, ‘দেখবেন। ফিলজফি মানেই সেন্টিমেন্ট। আপনিও হয়তো পকেট থেকে উজাড় করে দিয়ে দিতেন।’
ঝিনি যেন আর পারে না, এবারে তার বেহদ্দ হার। ভিনযাত্রীর দিকে সোজাসুজি তাকিয়েই হেসে ফেলে। বাবার দিকে ফিরে বলে, ‘ওটা তোমার সত্যি কথা নয়। মেয়েদের ফিলজফি পড়াই তোমার কাছে বাজে বাজে।’
‘তাই কি না, আপনিই বলুন।’
তাই কখনও বলতে পারি! একে যুবতী, তায় দার্শনিক। ধর্ম বলে একটা কথা নেই। কিন্তু মাস্টারমশাইকে ঘাঁটাব, তেমন সাহসও নেই। শাঁখের করাতের তলায় পড়ে, এদিক ওদিক করি!
ব্রহ্মনারায়ণ হেসে বলেন, ‘ভদ্রলোক লজ্জা পাচ্ছেন। আপনি যাবেন কোথায়?’
এবার আর সাক্ষী মানা নয়, তার চেয়ে দুরূহ প্রশ্ন। আগের কথার জবাব যদি বা ছিল, এবার তাও নেই। কারণ আমার যাওয়া গাজির মতলবে। গন্তব্য জানা নেই। কী বলব ভাবতে গিয়ে গাজির দিকে ফিরি। গাজি তখন মিটিমিটি হাসে। ব্রহ্মনারায়ণের দিকে ফিরে বলে, ‘বাবু, জানেন না, বাবু কোথায় যাবেন।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ এতক্ষণে আর একটা কিছু পেলেন। তাড়াতাড়ি নড়েচড়ে বসে বলেন, ‘সে কি, কোথায় যাবেন তা জানেন না?’
বলে, ঘাড় নেড়ে নিজের বিস্ময় ছড়িয়ে দেন স্ত্রী-কন্যার দিকে। আবার বলেন, ‘এরকম তো কখনও শুনিনি। কোথায় যাচ্ছেন, তাই জানেন না?’
ন্যাকা তো নও হে বাপু। এমন কথা শুনে বাপ মা ঝি অবাক হয়ে না তাকাবে কেন। পথ চলার একটা বাত পুছ আছে। লোক মানানো জবাব চাই। বলি, ‘ঠিক কোথাও যাব বলে বেরুইনি। এমনি একটু চলেছি।’
আমার কথার থেকে ব্রহ্মনারায়ণের বিস্ময় আর হতাশাতেই যেন উলটো আসনের হাসি চাপা দায় হয়ে ওঠে। এবার একবার আমার আপাদমস্তক দেখেন। সহযাত্রীটিকে ঠাহর করার চেষ্টা। যদিও, এই খোপের দেয়ালে রেলগাড়ির সেই সাবধান করা নেই। ‘চোর পকেটমার নিকটেই আছে।’ নজরের খোঁচায় ততটা উঠেছেন কি না বুঝতে পারি না। তবে এমন বেআক্কেলে বোধ হয় আর দেখেননি। বলেন, ‘এমন একটু চলেছেন বলে, একেবারে লঞ্চে চেপে পড়েছেন। আসছেন কোত্থেকে?’
ইচ্ছে করলে চুপ দিয়ে থাকতে পারো। সে যে আর এক বেয়াজ। তা পারা যায় না।
ইচ্ছে করলে চুপ দিয়ে থাকতে পারো। সে যে আর এক বেয়াজ। তা পারা যায় না।
নিজের দেশের নাম করি। শুনে ব্রহ্মনারায়ণ আর একদফা নড়েন চড়েন। চশমাসুদ্ধ চোখ কপালে। বলেন, ‘সেখান থেকে এখানে চলতে!’
বলি, ‘এই আর কি, একটু ঘোরাঘুরি।’
ব্রহ্মনারায়ণ স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বোঝো!’
বোঝার থেকে ওখানে হাসির ছলকই বেশি। কী এক চোর দায়ে যেন ধরা পড়লাম। কওয়ায় বলায়, সামান্যকে কত অসামান্য করে তোলা যায়, ব্ৰহ্মনারায়ণ তাই দেখেন। এ কি বেয়াজ বিপদ বলো।
ঝিনি যেন বিপদগ্রস্তকে হেসে করুণা করে। বাবাকে বলে, ‘তাতে কী হয়েছে। এদিকে কি বেড়াতে আসা যায় না?’
ব্ৰহ্মনারায়ণ হাত তুলে হাঁকেন, ‘আরে সে তুমি এখন ধাপার মাঠে বেড়াতে যাও না, কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। বেড়াবার একটা জায়গা আছে তো। এখানে এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুর। লোক নেই, জন নেই, নোনা নদী, তার ওপরে কামট, আর এই তো টানা ঘেড়ির বাঁধ—।’
গাজি তাড়াতাড়ি সংশোধন করে, ‘ঘেড়ি নয় বাবু, ভেড়ি।’
‘তুমি থামো তো হে, মেলা ঘেড়িভেড়ি করো না। দুটোই এক কথা।’
গাজি যেন শিশুর খেলা দেখে হাসে। ঝিনি বলে, ‘তা কি হয়েছে। এসব কি দেখতে ইচ্ছে করে না।’
বলুক, বিদুষী একটু বলুক। কিন্তু কথা টেনে নেয় গাজি। বলে, ‘তয় দিদি, আমি বলি শোনেন। সকালবেলা বাবুকে দেখি ইটিন্ডায় চলেছে বেড়াতি। তা সেখানে আর যাবেন কোথায়। দেখলাম কি যে বাবুর কোনও ঠিক-ঠিকানা নাই। বলেন, “বেরয়ে পড়িছেন।” তাই আমি বললাম, তবে আর এখেনে কেন, চলেন হাসনাবাদ দিয়া লঞ্চে করি ঘুরি আসবেন।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বলেন, ‘ও, তোমার মতলবেই যাওয়া হচ্ছে। তা তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
‘বাবুর সঙ্গে।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ আবার হাত উলটে, স্ত্রী-কন্যার দিকে ফিরে বলেন, ‘বোঝো।’
মা-মেয়েতে আবার সেই সখীর হাসি। কিন্তু এবার আর আমি নয়, এখন গাজি। ব্রহ্মনারায়ণ প্রায় ধমকে ওঠেন, ‘বাবুর সঙ্গে তো বুঝলাম। তার মানে, বাবুই তোমার সঙ্গে যাচ্ছেন। তা যাচ্ছটা কোথায়।’
গাজি টেনে টেনে বলে, ‘ভাবতেছি, কালীনগরতক যাব।’
‘আপনি চেনেন কালীনগর?’
আবার আমাকে। বলি, ‘না।’
‘তবে, চলে তো যাচ্ছেন দিব্যি। ফিরবেন কী করে, সেটা ভেবেছেন!’
গাজি তাড়াতাড়ি বলে, ‘কেন বাবু, কালীনগরের ওপারে ন্যাজাট যাব, ন্যাজাট থিকে মটর পাব বসিরহাটে যাবার।’
‘তারপরে?’
পথের হাল হদিস সব ব্ৰহ্মনারায়ণেরই দাবি। যেন গাজিকে এবার ঠিক প্যাঁচে ফেলবেন। গাজি হেসে বলে, ‘বসিরহাট থেকে বাবুকে কলকাতার গাড়ি ধরায়ে দিব।’
ব্রহ্মনারায়ণ হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারেন না। বোঝা যায়, গাজির কাছে আবার ঠেক খেয়েছেন। গাজি হেসে বলে, ‘পথ তো সব বাঁধা বাবু। যেতি মন করলেই হয়।’
কিন্তু ব্ৰহ্মনারায়ণের কান সেদিকে নেই। আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘কী জানি, বুঝি না।’
তাঁর কথায় আমার ভিতরের কলকলানি, গলার দরজা ঠেলে আসতে চায়। কে এক ভিনযাত্রী, সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে, কী তার ফেরার সমস্যা, এসব ঠিক তাঁর মনের তারে মেলে না। তাই মন কিছুতেই বুঝ মানে না। চিরদিন ঠিক বুঝিয়ে। এসব বেঠিক দলকে কী বোঝাবেন, বুঝতে পারেন না।
কিন্তু আমি গলায় আগল দিলে কী হবে। ওদিকে মা-মেয়েতে আগল খোলা। সেই খোলাতে, আমার আগলও মড়মড়িয়ে যায়। ঝিনির সহজ গলা শোনা যায়, ‘বাবা একটু ইয়ে।’
এ আবার সেই, কথা সভার মাঝেই পড়ে, যার কথা সে নিক। চোখের তারা লক্ষ করে বুঝতে অসুবিধে নেই, ভিনযাত্রীকে মেয়ে বলে, তার বাবাকে যেন ভুল বোঝা না হয়। এমন সময়েই মোটা গলাটি শোনা যায়, ‘আপনাদের টিকেটগুলো নিন তো।’
জানালা দিয়ে দেখি, টিকেটবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন। খোপের ভিতরে আসবার দরকার নেই। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়েই হবে। বাবুর এক হাতে টিকেটের গোছা, আর হাতে পেনসিল। খাওয়ার সময় পেয়েছেন কি না কে জানে, নাওয়ার সময় পাননি। রুক্ষু চুলে চোখ ঢাকা পড়েছে প্রায়। গলায় আছে খকর খকর কাশি। অথচ বুকখানি হাট করে খোলা।
গাজি বলে, ‘দুইখান টিকেট দ্যান, কালীনগরের একখান ফাস্কেলাস, আর একখান আমার।’
টিকেটবাবু দাম বলেন টিকেট লিখতে লিখতে। আমি জানালা দিয়ে দাম বাড়িয়ে ধরি। সহসা ব্ৰহ্মনারায়ণের গলার খোঁচা এসে বেঁধে, ‘ওর ভাড়াও কি আপনি দিচ্ছেন!’
গাজি নিজেই জবাব দেয়, ‘তয় আর কে দিবে বাবু। বাবুর সঙ্গে যাচ্ছি—।’
কথা আর শেষ করে না সে। মুরশেদের নামে একটু হাসে, যদিও তা ব্রহ্মনারায়ণ-ভোলানো হাসি হয় না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আবার ফিরবে কখন?’
গাজি তেমনি হেসে বলেন, ‘বাবুর সঙ্গেই ফিরব।’
এবার যা বোঝার তা বুঝে নাও। ব্রহ্মনারায়ণ ঘাড় নেড়ে বলে ওঠেন, ‘বাহবা বাহবা বাহবা! ও ঝিনি, এ যে তোর ফিলজফির ওপরে যায় রে। সারাদিনের ভরণপোষণ মায় রাহা খরচের দায়দায়িত্ব ইস্তক নিয়ে বসে আছে।’
ঝিনির সহজ হাসি সহজ ভাবেই মুখোমুখি ঝরে পড়ে। গাজি তখন নিজের হাতে টিকেট নিয়ে, নিজের মনেই টিকেট দেখে। আবার গুনগুন করে, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা…।’
.
০৮.
ইতিমধ্যে টিকেটবাবু গিয়ে দাঁড়ান ব্ৰহ্মনারায়ণের কাছে। এক মুখে তাঁর অনেক কথা। টাকা বের করে দিতে দিতে বলেন, ‘তিনখানা গোসাবা।’
বলবার আগেই টিকেটবাবুর লেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। যেন খবর তাঁর আগেই জানা। ব্রহ্মনারায়ণ ততক্ষণে আগের সুরেই তাল ধরেন, ‘আমি ভাবছি এদিককার লোক কোথাও, ঘরে ফেরা হচ্ছে। তা নয়, একেবারে ফকিরের সঙ্গে! তাও আবার ফকিরের জন্যে নিজের ট্যাঁকের কড়ি দিয়ে একটু ঘোরাঘুরি। আপনাকে আবার আমি ফিলজফির কথা বলতে গেছি!’
এবার চোখাচোখি মেয়ের সঙ্গে। হাসিতে হাসিতে মজা লোটে বাপ-বেটিতে।
তবু তো গাজির গলার গুনগুনানি শুনতে পাননি। ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’
ভাবের অভিধানে দেখ, ও কথা কার উদ্দেশে। তা, একবার বলে দেখুক না, মাস্টারমশাই প্রেমের ভাব জানেন না। সে সাহস নেই। দেখি, গাজি আমার দিকে চোরা চোখে চেয়ে চেয়ে হাসে। অপরাধ তো আমার। ব্রহ্মনারায়ণের বিদ্রূপে সেইরকম মনে হয়। বলি, ‘তা নয়, ও বললে যাবে—।’
‘তাই, আপনি নিয়ে নিলেন, এই আর কী।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ ঘাড় নেড়ে আমার কথা পূরণ করেন। কন্যা আর গিন্নির দিকে চেয়ে চোখ পিটপিটিয়ে হাসেন। দেখ, যেন বিটলে ছোঁড়াটা ইয়ারদের দিকে চেয়ে কী রহস্য করে। তবে, সব খেলারই উলটো চাল আছে। সেই চালটা মেয়ের দিক থেকেই আসে, ‘তাতে কী হয়েছে বাবা। ওঁর ভাল লেগেছে, তাই এর সঙ্গে যাচ্ছেন। তোমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি।’
বলুক তো, কন্যা বলুক, আর বাপ তার আপন রক্তের কাছে একটু ঋণগ্রস্ত হোন। ফিলজফি কেবল সেন্টিমেন্ট, গাজি নিয়ে বেড়ালে সেটা কেবল বিফল ভাবের ঘোর, আর যত কিছু সঠিক পথের খবর শুধু মাস্টারমশাইয়ের ঝোলায়, এ ঘোর কাটুক। ঝিনি এখন অনেক সহজ। কথা বলে, হেসে তাকায় ভিনযাত্রীর দিকে। যাত্রী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়বে, সে সাহস নেই।
কিন্তু এতই সহজ! তবে আর ‘ও ভোলার মন’ বলেছে কেন, ‘ক্ষ্যাপা’ বলেছে কেন। ব্রহ্মনারায়ণ আপন ভাবেই ভোলা, আপন পথের ক্ষ্যাপা। বলেন, ‘ও, বাড়াবাড়িটা আমার হল। তবে আর কি, কেবল ওই গান শোনো আর টাকা দাও, আর এ গিয়ে পকেট উজাড় করে ঘুরুক। তোরাই সংসার করবি বটে।’
অমনি উজানি গাঙের ছলছলানি হাসির জোয়ার ঝিনির গলায়। যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাঙে, তরঙ্গে তরঙ্গে কাঁপে। মাকে বলে, ‘শুনেছ মা, বাবার কথা। যেন আমি তাই বলেছি।’
মা তাঁর দল ছাড়েননি। শোনা যায়, ‘ওঁর কথা বাদ দে না।’
‘বাদ দে না? বাঃ! টাকা কি ফুটকড়াই নাকি গো? আমার বেলায় তো তা দেখিনি?’
আবার হাসি, মা-মেয়ে দুই সখীতে। কিন্তু ব্রহ্মনারায়ণের সেদিকে তেমন নজর নেই। অধীনের দিকেই ফিরে একটু চোখ টেনে পুছ করেন, ‘তা, মহাশয়ের কী করা হয়, জানতে পারি?’
মহাশয়! স্বরে যে শুধু বিদ্রূপ, তা নয়, সুরে যেন অন্য একটু খোঁচা। পড়তে জানলে হয়, সে লিখনও লেখা আছে ব্ৰহ্মনারায়ণের চোখে। পড়ে দেখ লেখা আছে, ‘তা সাধু ফকিরের পেছনে খরচ করতে তো ভাল লাগছে, এ রেস্তো আসছে কোত্থেকে?’ চাহনির রকমটিও একটু তেরছা। একে আপাদমস্তক দেখা বলে না। একে বোধ হয় নজর খুঁচিয়ে দেখা বলে। ছেলেবেলায় পাঠশালার মাস্টারমশাইয়ের মুখখানি চোখের সামনে ভাসে। হাতে যাঁর কালনাগিনী ফণা তুলে লিকলিক করত। কালনাগিনীর মতোই সেই বেতগাছা, মাস্টারমশাইয়ের চোখে একেবারে সেই ছোট্ট বুকে গুঁজে দেওয়া নজর, হয়তো ছাত্রটির দশ আনা ছ’ আনা চুলের ছাঁটের দিকে। মিহি গলাও যে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর শোনাতে পারে, সে জ্ঞানলাভ তখন থেকেই। তার সঙ্গে কেবল একটু দাঁতে দাঁত চিবুনো, শোনা যেত, ‘বাবু কি যাত্রার দলে নাম লেখাইছেন নাকি?’
আঃ, যেন শিকার নিয়ে দুলে দুলে সাপের খেলা, এমনি মর্মান্তিক। আসন্ন ছোবলের যন্ত্রণা ততক্ষণে ভয় হয়ে বুকে কাঁপতে আরম্ভ করত। শিকারের নজর সেই যে মাস্টারমশাইয়ের চোখে আটকে যেত, তাকে আর নড়ানো যেত না।… তবে এ কথা ঠিক, পাঠশালার গুরুমশাইয়ের সেই বাঘা চোখের নজরে নির্যস ভুল ছিল না। সেই দিনের ছোট বুকের ত্রাস আজ ভরা বুকে হাসি হয়ে বাজে। একরামপুরের বামুনপাড়ার কেদার চক্রবর্তীর যাত্রার দল, সে তো ছিল তোমার চোখের আলেয়া হে। তোমার তখন নাক টিপলে দুধ গলে, তাতে আবার ভদ্রলোকের ছেলে। আর ঝাঁকড়া-চুলো কেদার চক্রবর্তী। তাকে তুই কোন নজরে দেখেছিলি। মনে করেছিলি, সে প্রহ্লাদের বাবা হিরণ্যকশিপু, বেহুলার চাঁদসদাগর। সে রামায়ণের রাম, মহাভারতের অর্জুন। কম করে ষাট বছরের সেই লোকটার হালচাল হেলা-দোলা তোকে কী গুণ করেছিল। একদিন গাল টিপে আদর করে ডাক দিল। সেই ডাক বাপ-মা ভাই-বোন ঘর ভুলিয়ে দিল। ঘর পালিয়ে তুই গেলি নীল রং মাখতে। গায়ে পীত বসন, হাতে মকরমুখো ঝকঝকে টিনের বাঁশি, পায়েতে ঘুংগুর। আসরে দাঁড়িয়ে সেই রজকদের ছেলেটা প্রহ্লাদ সেজে তোকে মধুসূদন দাদা বলে ডাকত। তুই আসরে দাঁড়িয়ে মুখে বাঁশি তুলে ধরতিস, আর পটলা মেছো আসরের নীচে থেকে ফুলুট বাজিয়ে দিত। হালের দিনে হলে কী বলত হে নাগরিক। প্লে-ব্যাক? তা সেইরকমই ব্যাপার। বাঁশি শুনে প্রহ্লাদ পাগল। তুই খিলখিলিয়ে হাসতিস। মাথার ওপরে আধ ডজন হ্যাজাক জ্বলে, সকলে দেখতে পেত কৃষ্ণকে, কিন্তু প্রহ্লাদ দেখতে পেত না। তুই পায়ের ঘুংগুর বাজিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতিস, ডাক দিতিস, ‘প্রহ্লাদ, আমি এখানে।’ প্রহ্লাদের অমনি ছুট, ‘কোথায়, কোথায় মধুসূদন দাদা!’…
তারপরে ঘরে ফিরে, কেষ্টঠাকুরের পিঠের চামড়া ক’ স্তর উঠেছিল, সে হিসাবটি চেয়ো না। তাই বলি, পাঠশালার গুরুমশাইয়ের সেই নজরে নির্যস ভুল ছিল না। কিন্তু যে কারণে নজর বিচার, সেই ব্ৰহ্মনারায়ণের নজর ততটা মর্মান্তিক নয়। তখনকার দশ আনা ছ’ আনার মর্ম ছিল আলাদা। আজকের মাথায় যে কত আনাতে কী আছে, তার হিসাব জানা নেই। তখন ছিল নরসুন্দরের সঙ্গে রাম-রাবণের লড়াই। নয় তো তোষামোদের হাতজোড়। এখন কেবল মাথাটি বাড়িয়ে দেওয়া।
তবু কেন ব্রহ্মনারায়ণের চোখে এমন বেহ্মদত্যির খোঁচা। ধুতি পাঞ্জাবি আর সঙ্গের ঝোলায় কিছু বেয়াদপি লেখা আছে নাকি। ভেবেছেন বুঝি, ভিনযাত্রীর খাওয়া আছে ঘরে। বনের মোষ তাড়িয়ে ফেরে বনে। বেকার ঘোরে পরের ধনে। রঙ্গে মজে ফকির নিয়ে অন্যের জীবিকায়।
কথা বলবার আগেই আবার ব্রহ্মনারায়ণ ত্রুটি শোধন করেন, ‘অবিশ্যি, কে কী করে, সেসব কথা নাকি আজকাল জিজ্ঞেস করলে লোকে অসন্তুষ্ট হয়।’
বলে বুড়া তাঁর চোখের চ্যাংড়া নজর ঘুরিয়ে আনেন মেয়েকে ছুঁয়ে। জবাব দেবার সুযোগ পাই না, তার আগেই শোনো, ঝিনির গলা, ‘তা সত্যিই তো, ও কথা জিজ্ঞেস করছ কেন বাবা। ওঁর তো কোনও অসুবিধে থাকতে পারে।’
অব্যর্থ। নিশ্চয়ই। খুবই থাকতে পারে। বেঁচে থাকুক এ যুগের শালীনতা। বাংলাদেশে এমন জীবিকা আছে, বলতে গেলেই কেন যেন ঠেক খেতে হয়। বরং একটু অসহায় হয়ে বলি, ‘বেকার নই, বিশ্বাস করতে পারেন।’
প্রথমে ঝিনির হাসি উপচায়। তারপরে মাস্টারমশাইয়ের। সম্ভবত আমার গলার স্বরেই কথাটা তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। হাত তুলে বলেন, ‘আহা-হা, অবিশ্বাস কেন করব। এমনি একটা কথার কথা জিজ্ঞেস করলাম আর কি।’
তা যে করেননি, সে প্রত্যয় আগাম পেয়েছি। তবে বিশ্বাসের লাভটুকুও পাওয়া গেল এবার। তাই কথার বাঁক ঘুরিয়ে নেন। কিন্তু সেই এক দরিয়ারই বাঁক। বলেন ‘তবে এই যে আজকাল সব হয়েছে, পেশা বা জীবিকার কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না, এর কোনও মানে বুঝতে পারি না। চুরিচামারি তো করি না রে বাপু যে, লোকের কাছে বলতে পারব না। আজকাল যে কী সব আদবকায়দা হয়েছে।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ হাত উলটে দেখান। বোধ হয়, সবই উলটো হাওয়ায় বহে, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেন না। সেই কথাটা বোঝাতে চান। কিন্তু ওঁর চুরিচামারির কথায় শিরদাঁড়ার কোথায় একটা খোঁচা লেগে যায়। চুপ করে থাকা যেন দায় হয়ে ওঠে। যদিও, কী বা যায় আসে। আমি যাই কালীনগর, ব্রহ্মনারায়ণ যান গোসাবা। আমি নেবে যাব আমার ঘাটে, পথের দেখা সেখানেই শেষ। আমার জীবিকায় যদি তাঁর মনে কোনও ধন্দ থেকে যায়, সে বিড়ম্বনা আমার নয়।
ঝিনি কিন্তু হাসে। বলে, ‘চুরিচামারির কথা নয়, অনেকে পছন্দ করেন না। তোমার জানতে চাওয়াও উচিত নয়।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ চোখ বুজে বলেন, ‘জানতে চাইনি তো আর।’
বলেই চোখ তাকিয়ে ঘাড় নাড়েন। আবার বলেন, ‘শুনেছি, পুলিশ গোয়েন্দা-টোয়েন্দা হলে তাদের অসুবিধা থাকতে পারে।’
ঝিনি প্রায় হতাশায় হাসে, চোখ তুলে চায় ভিনযাত্রীর দিকে। বলে, ‘তবে আর বলছ কেন বারে বারে।’
তার মানে কী? ঝিনি কি বলতে চায়, আমি পুলিশ গোয়েন্দার লোক? কথা যে এখন নিজের দায় হয়ে ওঠে। পুলিশ গোয়েন্দাতে আমার অভক্তি নেই। কিন্তু জীবনে যা নিজেকে ভাবতে পারিনি, তাই বা মুখ বুজে মানি কেমন করে। তা ছাড়া, ব্রহ্মনারায়ণকে কেমন যেন হতাশ মনে হয়। ক্ষ্যাপাটা যখন জুড়িয়ে যায়, তখন তাকে করুণ লাগে। বেশ তো, পথের দেখা পথেই যখন শেষ, তখন না বলার দায় যতটুকু, বলার দায় তার চেয়ে আর কতখানি। মুখ তুলে বলি, ‘না বলার কিছু নেই, আমি একটু লিখি-টিখি।’
—লেখেন-টেখেন?
ঢলে যাওয়া পালে যেন দমকা বাতাস লাগে। ব্রহ্মনারায়ণের ভঙ্গি হয়ে ওঠে যাত্রার দলের বিবেকের মতো। হাঁক দিয়ে বলেন, ‘দেখ ঝিনি, তখন থেকেই আমার সেই সন্দেহ হয়েছিল। নিশ্চয় কবি?’
—না, তার মানে—
বলার অবকাশ পাই না। ব্ৰহ্মনারায়ণ আমার কথার মাঝে চড়ে বসেন, ‘ও, তা হলে গপ্পো। নিশ্চয় গপ্পো লেখা হয়? ওই একই কথা হল। গপ্পোও যা, কবিতাও তাই। আমি চেহারা দেখেই বুঝেছি।’
একেবারে ‘গপ্পো!’ ‘গল্পের’ সম্মানটুকুও নয়। এর পরে যদি ভুলেও ‘সাহিত্য-সাধনা’ ইত্যাদি বলতে যাও, আরও কী শুনতে হবে, জানো না। কিন্তু অধীনের চেহারায় তার কী উর্দি পরা আছে, বুঝতে পারি না। বোঝবার দরকার নেই, তার আগেই ব্রহ্মনারায়ণের গলায় রহস্য উদ্ঘাটনের হাসি। বলেন, ‘তাই তো বলি, এ আবার কেন ফিলজফির ওপরে যায়। কবি লেখক না হলে কি আর ওসব হয়।’
অর্থাৎ ব্রহ্মনারায়ণের কাছে সেটা আরও হাস্যকর। যেটুকু বা কলকে পাওয়া গিয়েছিল, তাও বে-হাত। কথার সুরেই বোঝা গিয়েছে, এও যেন বনের মোষ চরানোর সামিল। নইলে, মাস্টারমশাইয়ের কাছে গপ্পো কবিতা সব একাকার হয়ে যেত না।
জবাব দেবার কিছু ছিল না, অতএব মুখ ফেরাতে হয়। তার আগেই শোনা যায়, ‘এতটা যখন হল, তখন নামটা বাকি রাখবেন না।’
ফিরে দেখি, ঝিনির কাজল-পরা চোখে কৌতূহল। এবার আরও সহজ, এবার সোজাসুজি। বাপের মিটেছে, এবার মেয়ের শুরু। এ কী বেয়াজ বলো, মনের যেন সুর কেটে যায়। পাড়ি ছিল দিগন্তে, এই রোদে নীলের অধরা আকাশে। সবুজে আর সোনা মাঠের শেষে। যত দূরে যাও, তত দূরের বাঁধে বাঁধে। পাখির ঝাঁকের ঘর-ছাড়া বনভোজনের জটলায়, আর দরিয়ায় দরিয়ায়। এখানে কারুর নামধাম নেই, পরিচয় নেই। পরিচয়েই জগৎ ছোট। তখন সীমানা চৌহদ্দি আসে, তখন বেড়া এসে খাড়া। অপরিচয়ের কোনও সীমা নেই, কোনও দায় নেই। সে চলে যেমন খুশি, বলে যেমন খুশি। বাঁধা-ধরার ছক সীমানা সরহদ্দ সে আজ পিছনে ফেলে এসেছে।
কিন্তু পথ কোথায়। এখন, এই মুহূর্তে তুমি ছকের ঘরে দাঁড়িয়ে। জবাব না দিলে কি চলে। সহযাত্রারও একটা দাবি আছে। তায় আবার এ যুগের এক বিদুষী। কবুল যখন করেছ, নাম না বলে যাবে কোথায়। তুমি তো আপন তুচ্ছতায়, সংকোচে মরো। আর একদিকে শালীনতা যায়। ওজরে অহংকারের কালি। অন্তত সম্রাট দূরের কথা, দরবারের পারিষদের গদিটা ইস্তক পাওনি, সেইটি জানান দাও। নামটা বলতে হয়।
তৎক্ষণাৎ ঝিনির গলায় বাজে, ‘কী আশ্চর্য! নাম তো জানা।’
সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মনারায়ণ উলটো কোপ মারেন, ‘তুই জানিস নাকি, আমি তো কই জানি না।’
একেবারে সোজাসুজি কোপ, একটু এদিক ওদিক নয়। হাত ঘুরিয়ে বলেন, ‘তা হবে, আমি আবার ওসব পড়িটড়ি না তো।’
শোনো হে বাঙালি লেখক। আহা, মরমের ব্যথা না হয় পরে সামলিয়ো, মাস্টারমশাইয়ের পাওনাটা নিয়ে নাও।
ঝিনি তখন পিতৃদেবকে সামাল দেয়, ‘তুমি তো কিছুই পড় না, জানবে কী করে। আমি ওঁর অনেক বই পড়েছি।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ জিভ দিয়ে দাঁতে ঠেলা দেন। বলেন, ‘অনেক! অনেক লেখার মতো বেশ ভার-ভারিক্কি লাগছে না তো!’
ঝিনি প্রতিবাদ করে, ‘অনেক লিখতে হলে বুঝি ভার-ভারিক্কি হতে হয়। বাবার যেমন কথা।’
‘না, একটা মানানসই আছে তো।’
ইতিমধ্যে গিন্নির গলাও ভেসে উঠেছে। তিনি একটি বইয়ের নাম করে বলেন, ‘সেই বইটা তো? আমিও তো পড়েছি, বেশ লেগেছে।’
মাস্টারমশাইয়ের চোখ কপালে। গৃহিণীর দিকে তাকান যেন, সেই বাগবাজারের বারো বছরের সিল্ক-এর ভোট জড়ানো মেয়েটির দিকে। বলেন, ‘তুমিও পড়ে ফেলেছ, তবে তো আর কথাই নেই।’
বলে বুড়া চ্যাংড়া গলায় হাসেন। কিন্তু অন্য পক্ষে, সেদিকে কান নেই। এখন মা-মেয়েতে কথা। এ যুগের বিদুষীর কাছে যেটুকু পাওয়ানা, সেটুকু দেখতে পাই তার চোখের আলোতে। সংকোচের পর্দাটা সরে না। তবু কিছু কথা, কিছু জিজ্ঞাসা তার চোখে ঝিকিমিকি করে। তাতে আমার আরও অরুচি। দেখি, দিগন্তে আমার ছায়া ঘনিয়ে আসে, যেমন খুশির অথই পারে বেড়া দাঁড়িয়ে ওঠে।
তার মধ্যেই মাস্টারমশাইয়ের গলা শোনা যায়, ‘আপনি কীরকম লেখেন-টেখেন জানি না অবিশ্যি, তবে কিস্স্যু হস্স্যে না। যা-তা সব লেখা হচ্ছে আজকাল।’
আহা মান পরে হবে, আগে শুনে যাও। আপন পাওয়ানা মিটিয়ে নাও হে লেখক। কিন্তু জবাব আসে নিজের ঘর থেকেই, ‘তুমি তো কিছু পড়ই না। ভাল-মন্দ তুমি জানবে কী করে।’
‘আরে না পড়লেও, একটু-আধটু পাতা ওলটাই তো। পড়াই যায় না, যাচ্ছেতাই, অপাঠ্য।’
ঝিনির প্রতিবাদ আওয়াজ দেয়, যুক্তির জাল ছড়ায়। তুমি বাঘের ভয় করলে কী হবে, ঠিক জায়গাতেই সন্ধে হয়। তবে শ্রবণ আমার বন্ধন করি, কান দেব না। ভাল-মন্দের ধন্দ, সারা জীবনের হাসন শাসন। আজ সেসব রেখে এসেছি। আজ কাজ নেই, আজ বিচার নেই। মন চলো যাই খোপের বাইরে। উকিলরা তর্ক করুন। কোন এজলাসে বিচারক বসে আছেন, তাঁর রায় যবে আসবে তবে। আসামি, আপন গরজে কাম করো গা।
মুখ ফেরাতেই সামনে দেখি গাজির মুখ। খোপের কথার কী প্রত্যয় তার কে জানে। এ ফকিরটা সত্যি পাজি। দেখ, সেই মিটিমিটি হাসি, যেন চোরাই মালের খোঁজ পেয়েছে। শোনো, যাকে নিয়ে এত কথার আমদানি, সে তখনও সেই ধরতাই ভোলেনি। গুনগুনিয়ে খেই টেনে চলেছে, ‘পদ্মপাতায় পানির ফোঁটা টলমল, পদ্ম ভিজে না। তার সাক্ষী দইয়ের হাঁড়ি, উপরে ভাসে ননী ছানা। প্রেমের সন্ধান যে জেনেছে, তার আবার লেনাদেনার ভাবনা। যেজন প্রেমের ভাব জানে না তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’…
গাজি গাইতে গাইতে হঠাৎ যেন চমক খায়। কপালে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে দূরে তাকায়। বলে, ‘বাবু, উই যে দেখা যায় কালীনগর, এসে পড়া গেল।’
তার নজরে নজর তুলে দেখি, দূরে পুবের বাঁকে মাস্তুলের ভিড়। বাঁধের কোলে এলোমেলো ঘর। এখান থেকে দেখি যেন, ঘরের ঘাড়ে ঘর, ঘরের মাথায় ঘর। যেন মস্ত বড় একটা চাকের মতো। দিগন্তের বুকটা একেবারে হাট করে খোলা নেই। কিছু গাছপালা সেখানে মাথা তুলে আছে। বোধ হয় হেটুরেদের ছায়া দেবার জন্যে তারা মাথা তুলেছে।
সারেঙের খুপরি থেকে ভেঁপু বেজে ওঠে। এবার যেন একট দূর থেকেই বাজে। এতক্ষণের পথে ঠিক ওরকম জায়গা চোখে পড়েনি। হয়তো, এবার যাত্রী বেশি, তাই আগে থেকেই তাড়াহুড়া। যাত্রা আসন্ন, যাত্রী তৈরি হও। লঞ্চের নীচের তলায় হাঁকডাক লেগেছে। যন্ত্রের শব্দ ছাপিয়েও তা শোনা যায়। এবার নাম-ওঠা, সকলের ভিড়ই বোধ হয় সমান।
ভেঁপুর শব্দে খোপের তর্ক দমন হয়। ব্রহ্মনারায়ণের গলা শোনা যায়, ‘কোথায় এল?’
গাজি বলে, ‘আজ্ঞা, কালীনগর গঞ্জ।’
বিস্ময়টা যেন বিদুষীর গলাতেই চকিত হয় বেশি, ‘এসে গেল আপনার?’
‘হ্যাঁ।’
‘ইস্! এই বাবার জন্যে ! ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলাম না। আপনি খুব বিরক্ত হয়েছেন তো?’
তাড়াতাড়ি বলি, ‘বিরক্ত হব কেন?’
‘হলেও কি তুমি আর তা বলবে?’
এবার শোনো গিন্নির কথা। ওসব আপনি তুমি-এর সহবতে নেই যে, অনুমতি সাপেক্ষের অপেক্ষায় সহজের মুখে দরজা টেনে দেবেন। যা মুখে এসেছে, তা-ই। সহজেই সহজ আনে। আপন মন বুঝে দেখ, বিরক্ত কি সত্যি হয়েছি। একটু হয়তো বিব্রত। সেটা কথার গুণে নয়, প্রসঙ্গের জটিলতায়। তর্কে অরুচি, আজ তাকে দিয়েছি দূরের গারদে। স্বয়ং ব্রহ্মনারায়ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি ঢেউ দিয়েছেন প্রাণের তরঙ্গে। বরং আঁত দেখিয়েছেন, দাঁত দেখাননি। একালের কলম যদি ওঁর প্রাণের দরজার কুলুপ না হয়ে ওঠে, সে কথাটা না-বলা থাকবে কেন। বলি, ‘না না, বিশ্বাস করুন, বিরক্তি হইনি।’
বোধ হয় গৃহিণীর সহজে সহজ মানেন ব্রহ্মনারায়ণ। ‘আপনি’টাকে গোল্লায় দিয়ে, তিনিও বলেন, ‘দেখো বাবা, কিছু মনে-টনে করো না। যা মনে এসেছে, তাই বলেছি।’
হেসে বলি, ‘ঠিক করেছেন।’
‘কিন্তু ঝিনি তা মানবে না, ও ঠিক রেগে থাকবে।’
আমি ঝিনির দিকে তাকাই। ঝিনি যেন সে সব কথা শোনেই না। তার গলাতে একটু যেন অবুঝ বিষণ্ণ হাসি বেজে ওঠে।
বলে, ‘আমার এখন খুব খারাপ লাগছে।’
আমি বলি, ‘না, না, আমি মোটেই—।’
‘সে কথা বলছি না। বাবার কথা ছেড়ে দিন, বাবা ওইরকমই। কিন্তু আপনি এখন নেমে যাবেন ভেবে খারাপ লাগছে।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বলে ওঠেন, ‘তা বলে তুমি এখন ওকে গোসাবায় টেনে নিয়ে যেতে পারো না।’
কথা শুনে সকলেরই হাসি সামলানো দায় হল। ইতিমধ্যে গাজির ডাক পড়েছে, ‘বাবু, লঞ্চ কিন্তু ঘাটে লাগে।’
ততক্ষণে ঝিনির ব্যাগ খুলেছে, হাতে উঠেছে কাগজ-কলম। বলে, ‘নাম ঠিকানা লিখে দিন, চিঠি দিলে জবাব দেবেন।’
এখন আর মন-দোমনার সময় নেই। লিখে দিই, যদিও জানি, কোনও প্রতিজ্ঞা নেই। তবু বিদুষীর কাজল-কালো চোখের ঔৎসুক্যে একবার মনে হয়, গোসাবা কত দূর। অকূলে নাকি। তবে, তাই বা ভাসি কেমন করে, অকূলের মাঝি আমি নই। হাত তুলে নমস্কার করি, বলি, ‘চলি।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ বলে ওঠেন, ‘নামছ নামো, তবে আজ যদি ফিরতে না পারো, তবে কাল আবার আমাদের সঙ্গেই ফিরতে হবে।’ হেসে খোপের বাইরে যাই। ব্রহ্মনারায়ণপত্নীর দিকে তাকিয়ে আর একবার শিশু হতে ইচ্ছে করে। ঝিনি চোখ নামায় না। গাজি বাবরি উড়িয়ে, দাড়ি নাড়িয়ে, ডুপ্কি সুদ্ধ কপালে ছুঁইয়ে, জানালার কাছে ভেঙ্গে পড়ে। বলে, ‘বাবু, চললাম, তবে যেন আবার দেখা হয়। চলি গো মা-ঠাকরুন। দিদিকে বলে রাখি, আবার যেন আপনাকে গান শোনাতে পাই।’
‘ও হে, ফকির না গাজি, শোনো।’
ব্ৰহ্মনারায়ণ ডাকেন। পকেট থেকে একটি সিকি বের করে বলেন, ‘আমারটাই বা আর বাকি থাকে কেন, গান যখন ভালই লেগেছে।’
মুরশেদের নামে, গাজি একেবারে জানালায় কপাল ঠোকে। মুখ তার কথা সরে না আর। মায়ে-মেয়েতে হাসে। আর আমি যেন হঠাৎ, এক সিকিতেই ব্রহ্মনারায়ণের যোলো আনা দেখতে পেলাম। নামতে নামতে ভাবি, মানুষ চেনার বড়াই যেন কখনও না করি।
পাড়ে উঠে তাকিয়ে দেখি, ঝিনি হাত তুলে আছে। ও যেন অবাক হয়েছে। তবু মনের পালে তেমন বাতাস নেই। কী যেন বলে, ঠোঁট নড়ে।
গাজি ডুপ্কিটা তুলে হাঁক দেয়, ‘দিদি, আবার যেন দেখা পাই।’
.
০৯.
লক্ষ পড়ে, সারেং তার মাথার ওপরে সুতো টেনে, ঘন্টা বাজিয়ে ইশারা দেয়। নীচের যন্ত্র আরও জোরে ঝেঁজে ওঠে। এ ঘাটের যাত্রী খালাস শেষ। খালাসি কাছি ধরে—পাটাতন টেনে নেয় বাঁধের ওপর থেকে। জল-ভডভডিয়া ততক্ষণে পিছনে সরে বাঁক নিতে আরম্ভ করেছে। তারপরে যেন হাঁক দিয়ে ভেসে যেতে থাকে দূরে—দক্ষিণে মাঝ-দরিয়া ধরে। পিছনে তার ফুলে ওঠা জলের ঢেউয়ের রেশ রেখে যায়।
এখন আমরা ঠেকি দিগন্তের এক হাতায়। এবার খোপ চলে যায় দিগন্তে। সেখানে একটি ছাপা শাড়ির আঁচল ওড়ে বাতাসে। বলব না, দাঁড়িয়ে আছি সহবতে। জানি, পথের দেখা পথেই শেষ। তবু, সুজনকে দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় দিতে হয়।
গাঙ চলে যায় স্রোতের টানে। মন, তুমি এক ঘাট। সেখানে অনেক যাত্রী ঠাঁই করে, চলে যায়। তুমি থাকো নিরন্তরে। তোমার আজকের হিসাব কালকে মেলে না। কালকের হিসাব তারপরেতে নেই। কাল ধুয়ে যায় কালান্তরের চলন্তায়। আজকের হিসাব আজকে। কেবল যে নীলে রোদে, নদীর অকূলে, পাখির জটলায়, গাছগাছালির আর আকাশ বরাবর মাঠ তোমার সবটুকুকে টলটলিয়ে দিয়েছে, এমন ব’লো না। কোথায় যাও, কেন যাও, তোমার সেই নামহীন অচিনের খোঁজে। খোপের যাত্রীরা দিয়েছেন অনেক ঝলক। অতএব, প্রসন্নতার জন্যে কৃতজ্ঞ হও। বলো, সেই ভাল ভাল মানি।
কিন্তু ব্যাদ্রা গাজিটার গুনগুনানি শোনো,
‘ও সে না জানি কী কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল হে
তবু না পেলাম তারে।
(আমার যে) প্রেমের ছিটা নাই অন্তরে।’…
এ গান গাজি কাকে শোনায়, কার উদ্দেশে। ফিরে তাকাই তার দিকে। দেখি, কালো চোখের আরশি-নজর দূর দরিয়ার বাঁকে, যেখানে জল-ভডভডিয়া বিন্দু হয়ে ভেসে যায়। শব্দটিও নেই আর। আমার কর্ণমূল যে লাজে লাজানো হয়, তা নয়। ইচ্ছে করে, মুরশেদের নামে লোকটাকে ধমক দিয়ে থামাই।
কিন্তু নামের মজদুর আমার দিকে ফিরে হাসে। হাতের মুঠিটা খুলে ধরে। দেখি, তার মাটির মতো কালো কর্কশ হাতের চেটোয় একটা সিকি ঝক্ ঝক্ করে। ব্ৰহ্মনারায়ণের দেওয়া সিকি, এখনও হাতে। ঝোলায় ওঠেনি, গাজি বলে, ‘কোনখান দিয়ে কী গলে, তা বলা-কওয়া যায় না। দেখেন দি’নি, বুড়াবাবু কেমন ঝকর মকর করে। আর আমি বলি কি, না “যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।” কি গুনাহ্ দেখেন দি’নি। মুরশেদের পাঁচ পয়জার পড়ুক আমার পিঠে।’
এবার তোমার লাজ। আসলে অলক্ষ্যে মন চুরি গিয়েছে গাজির। চোর হলেন ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী। তুমি মনের শীল পরিশীল দেখ। অথচ তোমার মনের দেখা যে এক সিকিতে ষোলো আনা, তা গাজির প্রাণেতেও বেজেছে। শেষের দান সিকিটি তাই এখনও তার হাতে। তাই সে বলে, ‘আমার যে প্রেমের ছিটা নাই অন্তরে।’ থাকলে বোধ হয় রূপেতে অরূপ দেখতে ভুল হত না। আবার শোনো, এবার গলা খুলেই গেয়ে ওঠে, ‘ও তার বসত কোথায়, না জেনে তায়, মরি হায় হায় রে।’…
‘তা মরগা না, এখন যেতি দেবে তো। সর দি’নি।’
পিছন থেকে কে যেন হাঁক দেয়। তাকিয়ে দেখি, চিনি চিনি মনে হয়। হ্যাঁ, এ আর কখনও ভুল হতে পারে! মহাশয়ের পাশে, মিলের লাল শাড়ি জড়ানো ঘোমটা টানা মহাশয়াকে দেখলেই, গাজির মাহাতো চাচা আর চাচিকে চিনতি পারা যায়। মাহাতো খুড়ার নিকষ কালো মুখে মাংসের কিছু বাড়াবাড়ি। তবে খস্খসে নয়, শক্তপোক্ত। কোকিলের চাহনির রকম জানা নেই। কিন্তু কোকিলের চোখ তুলে এনে যেন খুড়োর চোখে লাগানো হয়েছে, এত লাল। সেই অনুযায়ী মোটা ঠোঁট দুটির কথাও বলতে হবে। হতে পারে, দোকানির সেজে দেওয়া পান খেয়েছে। পাশে পাশে খুড়ির চোখের নজর ছিল যে! সেই চোখের অনুরাগেই খুড়োর মোটা ঠোঁট দু’খানি বেশ রাঙানো। সুতি কোটের ওপরে একখানি পশমি আলোয়ান কোমরে বেড় দিয়ে জড়ানো। তবে কি না, হাতে কোনও স্যুটকেস নেই, প্লাস্টিকের শহুরে ঝোলা। মাথার চুলের কথা আর বলো না। ক’দিন চিরুনি দেখেনি, কেউ জানে না। গলায় আছে হাঁক, কিন্তু লাল ছোপানো দাঁতে একেবারে বগ্বগে হাসি।
হাঁক দেবারই কথা। বাঁধের ওপর দিয়ে রাস্তা। একা মানুষ চলতে পারে। দু’জনের পাশাপাশি যাওয়া চলে না। পথ দিতে হবে।
গাজি ফিরে বলে, ‘কে, মাহাতো চাচা নিকি।’
বলতে বলতে সে বাঁধের ঢালুতে নেমে দাঁড়ায়। আমিও তার পাশে যাই। মাহাতো বলে, ‘আর কে।’ বলে পিছনে ফিরে ডাক দেয়, ‘এইস।’
খুড়ির মুখে এখন বিড়ি নেই। ঘোমটাখানিও তেমন মুখ জুড়ে ঝাঁপ ফেলে রাখেনি। অপযশ আগে করিনি, এখনও করব না। বিড়ি খাওয়া হোক, আর যা-ই হোক, মুখখানিতে এখনও ঢল ঢল ভাবের বেশ আত্মিসূয়তা রয়েছে। আটপৌরে ধরনের পরা শাড়িখানিতে আরও বোঝা যায়। মধ্যঋতু আশ্বিনের শরীরে, জলের টান যত গহিনও তত। বরং বলি, মুখের চেয়ে যেন শরীরখানি আরও কাঁচা।
হাসলে বুঝি মাহাতো-বউয়ের মান যায় এই হাটবাজারের কাছে। তবু মামুদ গাজির দিকে তাকিয়ে চাচির কপালের টিপ কেঁপে যায়। চোখে হেনে যায় চোরা হাসির ঝিলিক, গাজির পাশে ভিনদেশিতে তেমন লজ্জা জড়ানো ভাব নয়। তবে, দেখতে হলে, আড়চোখেই দেখতে হয়। মুখের কৌতূহল প্রকাশ করতে নেই।
গাজি ডেকে বলে, ‘চাচা কি এখন সেই ভোলাখালি চললে নাকি গো।’
মাহাতো বলে, ‘না, লারানের ঘরে একটু বইসে যাব।’
কথার ভাবে মনে হয়, খুড়ার চলা থামবে না। কিন্তু, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে বলে, ‘বাবুটা কে?’
গাজি আমার দিকে চেয়ে হাসে। বলে, ‘পথে পেয়িছি, বাবু বেড়াতি এসেছেন।’
মাহাতোর লাল টকটকে চোখের মণি দুটোও লাল মনে হয়। বাবুর দিকে ক্ষণেক চেয়ে হাসতে গিয়ে কাশে। বলে, ‘এই বাদার বাজারে বেড়াতি? কী বলে দেখ।’
হাসতে হাসতেই এগিয়ে যায় আবার। খুড়ি আর একবার পিছন ফিরে দেখে নেয়। হাতে পায়ে ভদ্দরলোক, আবার এমন জায়গাতেও বেড়াতে আসে।
বাঁধের নীচেই ঘর। ঘরের পর ঘর। তবে বাঁধের এদিক হল হাটের পিছন দিক। বেচাকেনার দোকানদারি সব সামনের দিকে। তবে, জলপথে আসা-যাওয়ার রাস্তা এদিকেই। কালীনগর, নগর বটে। গাড়িঘোড়ার খোঁজ ক’রো না। নদী খাল বিল নয়ানজুলি, তার ওপর দিয়ে চলাফেরা। ঘাটে মেলাই নৌকা। এক থেকে দশ মাল্লাই, যেমন নৌকাই খোঁজো। যন্ত্র বিকল কিনা কে জানে, উত্তরের সীমায় গোটা দুই লঞ্চ নোঙর করে রয়েছে। তার থেকে একটু দূরে, নৌকা এপার ওপার যাওয়া-আসা করে। বোধ হয় খেয়াঘাট। ঘাট বাবর ওপারেরও বাঁধের ধারে গায়ে গায়ে ঘর। একটা রাস্তার ইশারা পাওয়া যায় ঘরের সারির পিছনে। কিন্তু দেখা যায় না। ইশারা পাওয়া যায় লোক যাতায়াত দেখে।
ওদিকে আবার এক সোজা রাস্তা চোখে পড়ে। ঘাট থেকে উঠে পুবের মাঠ-মাথাতে সিঁথি সোজায় চলে গিয়েছে। মনে হয়, এই তো বুঝি কাছে। কিন্তু দূর বোঝা যায়, একটা গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে যখন দূরান্তরের রাস্তাটা চোখে পড়ে। যেদিকে চাও, নজর কোথাও ঠেক খায় না। এখানে ভূমি সমুদ্র। মাঠের বুকে যে গ্রামখানি রোদে পিঠ দিয়ে পড়ে আছে, তার মাথার ওপরে ধোঁয়ার রেশ। সেই বুঝি সেই বনচড়াই, বনভোজনের মাঝে মাঝে মাঠ থেকে সোঁ করে উঠছে আকাশে। যেন মাঠ ছুঁয়ে থাকা বাঁকা তিরের মতো। তারপরে হঠাৎ ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশ ভরে শতে সহস্রে। ঝাঁপ দেয় গিয়ে আর এক সীমায়। মাঠে মাঠে মানুষের দেখা পাওয়া যায়। ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে পুরো মাত্রায় নয়। স্রষ্টারা এখনও শ্রমের ফল তুলতে দল বেঁধে মাঠে নামেনি।
ফুলের গন্ধে ভোমরা পাগল, ধানের গন্ধে মানুষ। ঘ্রাণে ঘ্রাণে গন্ধ রক্তে রক্তে চোঁয়ায়। প্রাণে যেন নেশা ধরে যায়। ভেঙেচুরে ব্যাখ্যা করি তেমন কথা খুঁজে পাই না। কিন্তু দিক দিকেতে দেখে মনে হয়, কী এক উৎসব যেন আসন্ন। হাটের ঘাটে, মাঝি-মাল্লাদের হাটের দিনের হাঁকডাক ছুটোছুটি ব্যস্ততা নেই বটে। আস্তে আস্তে ভিড় করছে সবাই। অল্পস্বল্প ব্যস্ততা, অল্পস্বল্প মাল বোঝাই-খালাস চলেছে। ভাঁটার পলি পাঁকে, হাঁটুর ওপর অবধি ডুবিয়ে ওঠানামা চলেছে। একে দধিকর্দম বলা যাবে না, ক্ষীরকর্দম মালুম দেয়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে পায়ের নীচে জলের ধারে গেমো জঙ্গলের ভিড়। এখনও অনেক গেমো কোমর ডুবিয়ে আছে জলে, অনেকের গা থেকে জল নেমে গিয়েছে। পলি পাঁকে পাখিরও দলটাও ছোট নয়। হাটের ঘাটে রোজের ভোজ, মানুষকে তাদের ভয় নেই। দেখ, কেমন নির্ভয়ে ভোজ নিয়ে ব্যস্ত। একটু ওদিকেই যে নৌকা যাতায়াত করে, মাঝিরা ওঠানামা করে, বাঁধের ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করে, সেদিকে যেন একটু রেয়াত নেই।
সব মিলিয়ে যত দেখি মনে হয়, যেমন গুরু গুরু মেঘ ডাকে দূরের আকাশে, চিকুর হানে চিক চিক অলক্ষ্যের মেঘে, আশমান জমিন দেবে ভাসিয়ে, তেমনি এখানকার মাঠে জলে মানুষে সব কিছুতে এক মহোৎসব যেন আসন্ন। একটা পাগলা হাসি, খুশির ডাক যেন কোথায় এখনও ঠেক খেয়ে আছে। ফাটবে ধারায় ধারায়। কেন এমন মনে হয়, আমার মন বোঝে না। যখন সে আপনাতে আপনি দেখে, তার হাল হদিস পাইনা। কেবল হাসতে গিয়ে কোথায় যেন একটা জলের ধারা ছলছলায়। ভাবি, সে উৎসবে আমার অংশ থাকবে না। আর যে উৎসবে আমি নেই, কেন সেই উৎসবেই আমার সকল খোঁজার পরম যাবে ফিরে। আমি যার নাম জানি না, রূপ চিনি না। যার কেন ও কীসের কোনও কারণ জানি না। অথচ তার ডাক শুনেছি সেই কোন ভোরে। যখন সংসারে পরম রতন বলে জানা ছিল মাকে, যখন তাঁর কোলের কাছে শুয়ে প্রথম চোখ খুলেছিলাম। সেই থেকেই ডাক শুনেছি, দৌড় দিয়েছি। কে ডাকে, কে ডেকে যায়। চোখ-জোড়া রূপের ঘরে, এই কালীনগরের বাঁধের বুকে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই দাঁড়িয়েছি গিয়ে। মনে হয়েছে, কে যেন লুকোচুরির টুক দিয়ে যায় দূরে দূরান্তরে অন্য কোনখানে। আর প্রাণটাকে যদি বলো খেলার বুড়ি, তবে তাকে আগলে রেখে কেবল ছুটেছি সেই টুক-এর পিছনে। যদিও তার হদিস দূর, ডাকের কথাটিও বুঝিনি।
মন গুণে কি ধন দেখ, সংসারেতে যত উৎসব, সবখানে যেন আমার ‘খুঁজে ফেরা’ ফেরে। একা পারি না শতেক হতে। অথচ যেন শতখানে ‘সে’ আমার থাকে অধরায়। ওই যে সেই বলে না, ‘ও ভোলার মন, ত্রিবেণীতে বান ডেকেছে, ডুব দি গে যা ত্বরাতে’ সেই গোত্র। ডাকার খবর আসে। গিয়ে দেখ, বানের কোটাল কেটে তখন ভাঁটার জল নামে।
গাজির গলায় চুপিচুপি শোনা যায়, ‘বাবু।’
ফিরে তাকাই। চোখ ফেরে, মন গিয়েছে কোথায়? দেখি, গাজির দাড়ির ভাঁজে হাসি। আরশি-চোখে ধন্দের ঝিকিমিকি। বলে, ‘কেমন বোঝেন বাবু।’
মতলব দিয়ে যে নিয়ে এল গাজি, এখন তা ভাল কি মন্দ বোঝ। গাজি তার চাল দিয়েছে। এবার তোমার দান দাও। আবার মনের উদয় কালীনগরে। আবার দেখি দিগন্তে। নতুন ভাবনা আসে। এই যে এক আসন্ন উৎসবের স্বপ্ন দেখছিলাম, এই প্রকৃতি আর মানুষ দেখে তার মধ্যে কোথায় যেন একটা নতুন ধরন লাগে। এই যে প্রকৃতি, এ শুধুই যেন সুন্দরী নয়, আরও কিছু। এ যেন তেমন করে নিজেকে সাজায়নি। আপনাকে একেবারে উদাস করে, ছড়িয়ে মেলে ধরে আছে। প্রকৃতি যে অরণ্যে সাজে, যেন লাজে ঢাকে, তা নয়। এ মেয়ে নিলাজ বড়। আকাশকে ডাক দিয়ে সব হাট করে খুলে বসে আছে। জিজ্ঞেস করি, ‘এখানে গাছপালা নেই? চারদিক যেন কেমন খাঁ খাঁ করে।’
গাজি বলে হেসে, ‘ইনি যে এখন সোনা ফলান বাবু। গাছের জায়গাই তো ছিল। যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, এখানে যে এই সিদিনেও সুঁদুরির জঙ্গল ছিল, গড়ানের বন ছিল। দখিনরায়ের বাহন মশাইরা ঘোরাফেরা করতেন। বন কেটে আবাদ হয়েছে, এর নাম বাদা।’
সুন্দরবনের কথা বলে গাজি। যে বনেতে সুন্দরী গাছ ছিল, তার নাম সুন্দরবন। অনেক গাছের নাম শুনেছ—শাল পিয়াল সেগুন, কিন্তু মুগ্ধ চিত্তে বলে ওঠা এমন নাম শোননি। নাম খুঁজতে হয়নি। চোখ ভরে যাওয়া, মন ভুলে যাওয়া মন বলেছিল, এ গাছ সুন্দরী। কিন্তু ‘এই সিদিনেও’ বলে কেন গাজি। ক’দিনের কথা। জিজ্ঞেস করি, ‘এই সিদিনে মানে, কতদিন আগে?’
গাজি দাড়ি মুঠো করে ধরে বলে, ‘তা ধরেন গিয়া শ’ দেড়শ’ বছর হবে।’
যেন এক দেড় বছর আগের কথা বলে। গাজির বাবরিতে কালোর ঝলক, দাড়িতেও তাই। দু-চার গাছি যা একটু সাদা দেখা যায়, কালোর ভিড়ে নজর পড়ে না। না, চুল দেখে বয়স বলব না। এমনকী এই বাদাতে চৈত্র-মাঠের মতো মুখখানি যে এত ফুটফাট, তা দিয়েও হিসাব হয় না। এ সবই তো ঘাটে বাটের রোদ জল বাতাসের দান। একে দেড়শ’ কেন, আধ শ’ বছরের মানুষ বলেও মানতে পারি না। তবে সে ব্যাখ্যা চাইতে যেয়ো না। মন বুঝে দেখ, গাজি হিসাবে ভুল করেনি। আজ না হয় তার পথে পথে মুরশেদের নামের মজদুরি। তার বাপ পিতামহ ছিল। তাদের কাছে শোনা কথা শোনায় আমাকে।
এ ধরিত্রী নবীনা। এ ধরিত্রী আদিবাসিনী, এখনও আঁচল ঢাকতে শেখেনি। বিশাল মহীরুহের সভ্যতা এখনও তাকে সাজ পরাতে আসেনি। এমনকী, এই নীচের দেশে, এই যে দেখতে দেখতে এলে নারকেল সুপারির মাথা দোলানো, এখানে তার চিহ্নও কম।
এ আর এক রূপ। রূপেতে যার নেশা, সে এই রূপেতেও মজে। নিরখিয়া তো এলে জনমভোর, চোখের কপাট বন্ধ তো হয়নি। সে বারে বারে নতুন নতুন দেখে, তবু তৃষ্ণা মেটেনি। দূরের মাঠে চোখ রেখে বলি, ‘এমন কোথাও দেখিনি।’
গাজি ঘাড় দুলিয়ে বলে, ‘এমন যে আর কোথাও নাই বাবু। যেমন দেশের যেমনটা। তয় বাবু, দাঁড়িয়ে আছেন তো জগলের হাতায়। সুন্দরবন আর কত দূর। গাছ দেখতি চান, চলেন যাই কত দেখবেন। সে আবার দেখবেন, গাছ আর আশমান আছে, মাটি দেখা যায় না। দিনমানে ঘোর আন্ধার, গাছের ভিড়ে নজর চলে না।’
মনে মনে ছবি দেখি সেই নিবিড় বনস্পতির। যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ডাক আমার পিছনে, যে ডাক ঠিকানা নিয়ে পিছন ধাওয়া করে। আর গাজির দিনমানের অন্ধকারে, নজর না যাওয়া বনে যে ডাক দিলেই যাব, আমার বুকের পাটা তেমন বড় নয়। দখিনরায়ের বাহনদের সঙ্গে আমার কোনও দোস্তালি নেই। তার থেকে আজ এই দেখাটুকুই হোক, এই বন কেটে আবাদ। যে ছেউটি বন্য মেয়েটা তার কৌমার্য দিয়েছে মানুষকে। যে নিজেকে দলেছে চিরেছে মানুষের লাঙলের ফালে, আর মা হয়ে দিয়েছে সোনার ফসল। যাকে ঘিরে জনপদ, হাট গঞ্জ বাজার জমেছে। গাজিকে বলি, ‘বন দেখতে পরে যাব। আজ এখানেই দেখি।’
গাজি হাসে। বলে, ‘বললাম, বলেই কি যাওয়া যায় বাবু। গাছ দেখতি পাচ্ছেন না, তাই বললাম। চলেন, একটু ঘুরে ফিরে দেখবেন।’
বলে গাজি বাঁধের ওপর দিয়ে দক্ষিণ মুখে হাঁটে। বাঁ দিকে ঘরের সারি, মুখ তার অন্য দিকে। ডান দিকে নদী। গাজির পিছন পিছন যাই। উলটো দিক থেকে লোক এলে সবাইকে কাত হয়ে চলতে হয়। কানে আসে নানান গলা, নানান কথা, হাঁক ডাক হাসি। সবই আসে ঘরের সারির উলটো থেকে। হাটের সদর সেটা। একটু দূরেই দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে বাঁধ। সেই বাঁকে দেখি, মসজিদের মিনার, পাকা দালান। যদি দেড়শ’ বছরের আবাদ হয়, তা হলে তার থেকে পুরনো নয় পাকা মসজিদ। তার গায়ের লিখনের দাগও তেমন নয়। তবে মন্দিরের চিহ্ন না দেখে, প্রত্যয় হয়, যারা প্রথম এসেছিল এই কালীনগরে, তারা এসেছিল। খোদার নাম করে।
গাজি বাঁধের ওপর থেকে দুই ঘরের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে নামতে নামতে ডাক দেয়, ‘এদিক দিয়ে আসেন বাবু, একটা বাজার দেখে যান।’
নেমে গিয়ে দেখি সেখানে অন্য জগৎ। বাজারের এদিক ওদিক দেখা ভার। চার পাশে বাঁধানো ঘরে সারি সারি দোকানপাট, মাঝখানের উঠান জুড়ে এলোমেলো চালাঘর। তবে বাজারে বাজার নেই। চালাঘরের সবই ফাঁকা। ছেঁচাবেড়া, কাঠের খুঁটি, ফ্রেম আর টিনের চাল দেওয়া ঘরে দস্তুরমতো মনোহারি মালের কারবার। শীতলপাটি পাতা তক্তপোশের গদিতে বসে আছেন মহাজন। আলমারিতে থরে থরে কাপড় সাজানো। যেমনটি চাও, শান্তিপুরী ফরাসডাঙা মিলের ঝলকানি। কলকাতা বলো, বোম্বাই বলো, নয়নহারা ছাপা পাবে। বায়স্কোপের মেয়েদের নামে নামে শাড়ি পাবে। তার ওপরে, বলো না কেন, শাল আলোয়ান রেশমি পশমি এই নগরের বস্ত্রালয়ে আছে। আর কী চাও। আলতা স্নো পাউডার, দেখ কেমন আলমারিতে থরে বিথরে সাজানো। রেশমি চুড়ি, পুতির মালা, ঝুটো সোনা-রুপোর হার, কানপাশা, যাবৎ যাবৎ। এমনকী, সেই যে বিদুষী চলে গেল, তার বিলাসের ঠোঁটরাঙানিয়াও পাবে, টিপছাপ কাজলের ভাণ্ডারও ভরা। আরও যদি বলো, লজেন্স, বিস্কুট ছাপানো প্যাকেটে নেবে, নাও না। সব ধরে রেখেছে মনের মতো করে।
গাজি ইতিমধ্যেই সমাচার দেওয়া নেওয়া শুরু করেছে। ‘এই যে দাশকত্তা, ভাল আছেন। তো।…এই এলাম একটু…। জয় মুরশেদ, সাধনদাদা কবে এলে গো। একটা পান খাওয়াতি হবে কিন্তু। আসি একটা পাক দিয়ে।’..
তার মধ্যেই সঙ্গীকে বলে, ‘হাটের দিন হলি, দেখতেন বাবু, লোক কাকে বলে। পা ফেলাবার জায়গা থাকে না।’
সে কথা ঠিক। এত বড় বাজার, সপ্তাহের কোনও কোনও দিন সে হাট হয়ে ওঠে। এখানে রোজের বেচাকেনায় সরগরম নয়। তাই ফাঁকায় ফাঁকায় ঘোরা যাচ্ছে। তাই সব ঘরেই খদ্দের আজ কম, টিমটিমে ঝিমঝিমে। যখন সে গঞ্জ হয়ে ওঠে, তখন চেহারা আলাদা।
তবে পাবে সব। ‘গড় করি কবরেজ মশাই, বাড়ি যান নাই এখনও। বেলা তো ঢসকে যায়।’ গাজি সবার সঙ্গেই কথা বলে। কবিরাজ মশাই কী বলেন, শুনি না। দেখি, তাঁরও ঢসকে যাওয়া বয়স, চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে হাসেন। ঔষধালয়ের ছাপটি ঠিক আছে। তার সঙ্গে মোদক মকরধ্বজ আর সারিবাদি সালসার বিজ্ঞাপন দরজায় টাঙানো। ডাক্তারখানাও না পাবে তা নয়, তবে ডিগ্রিমিগ্রির কথা তুলো না। বুক দেখার নল আছে, আলমারিতে শিশি বোতল আছে। দেখ, রুগিরা এখনও ধর্না দিয়ে বসে। সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। নিজের হাতে ‘ডাক্তারখানা’ লিখতে গেলে, টিনের বুকে আলকাতরায় ওইরকমই দাঁড়ায়। একটু ছোট বড় আঁকাবাঁকা, এই যা। তাই বলে এক নয়, একাধিক। গাজির কথায়, সেই যে ‘চিনির বড়ির মতো ওষুধ’ সে ডাক্তারখানাও আছে। দু-একটা বেশি আছে। গাজির সঙ্গে সকলের আলাপ।
আর যদি অন্যরকম সাজগোজ দেখতে চাও চেয়ে দেখ নরসুন্দরের ঘরের দিকে। মনে হবে, কলকাতার দেয়ালে যত বায়স্কোপের ছবি, সব বুঝি নরসুন্দরের ছিটেবেড়ার গায়ে সাঁটা হয়েছে। এইসব কুশীলবদের নাম না জানতে পারো, কিন্তু যাকে খুঁজবে, তাকেই পাবে। তা সে কলকাতা বোম্বাই যেখানকারই হোক। তবে হ্যাঁ, যেগুলো ক্যালেন্ডার, তার সন তারিখ খুঁজতে যেয়ো না। তোমার নিজের জন্মের হিসাব না মিলতেও পারে। দেখবে, তিরিশ বছর আগের নটী হালের হিরোইনের পাশে কেমন চোখে চাক্কু হেনে রয়েছে। নটসূর্যের পাশে পাবে চুল ফাঁপানো নায়ক। ছিটেবেড়ার দরমার খোঁজ একটুও পাওয়া যাবে না। এর ওপরে পিজবোর্ডের ওপরে কালি দিয়ে লেখা, চুল ছাঁটাইয়ের ঢংঢাং নোটিস করা আছে।
এতেও যদি না হয়, তা হলে পান বিড়ির দোকানে যাও। বিড়ির জগতে নাকি অদ্বিতীয়, এমন লেখা আছে, যার নাম ‘মুকুন্দলাল বিড়ি’ ‘কিংবা ‘হানিফ সাহেবের বিড়ি’। যার পানেই দেখবে, মোটা দাগে ছাপা সুন্দরী, চুল এলিয়ে তোমার দিকে আড় চোখে চেয়ে হাসছে। এবার বলো, অমন করে চাইলে এমন বিড়ি না খেয়ে, পোড়াকপালে কী সুখ! তবে আর এক কথা কি, মহাদেব আর মহম্মদ বলো, কাশী আর মক্কা বলো, মায় দেশের নেতা মন্ত্রী, সকলের ছবি পাবে এই ভিড়ে। আর পানবিড়ির দোকানেই দু-চারজনের গুচ্ছ গুচ্ছ গুলতানি। গল্প গান তাস পাশা, এই বে-দিনে, সেখানেই জমেছে। গাজির বাতপুছ সকলের সঙ্গেই।
খুঁত কাড়া যার কাজ, তার কাজ। সব মিলিয়ে যেন এক ডিন জগতে ফিরি। নতুন ছবি, নতুন সমাচার। কৌতুকের টানা বহে যায়, মনটা টলটলিয়ে ওঠে। শহরের ঝলক নিয়ে কোনও অহংকার নেই যে, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি। মনে হয়, অপরিচয়ের বেড়াটা ডিঙিয়ে এলাম। এ সাজসজ্জা অনেকদিনের চেনা বলে মনে হয়। ওপারের পুবে, বাংলায় দেখে এসেছি বলে নয়, এই ছবিতে যেন শত শতাব্দীর অতীত কথা কয়। এই হাটে যেন নিজেকে দেখা যায়। আধুনিকতার মধ্যে দূর কালের এক চেনাচেনি, নতুনের স্বাদে চাখাচাখি।
আরও যদি চাও, দেখ, ফাঁকা চালায় কালো মেয়েটি বসে আছে কুচো চিংড়ি নিয়ে। মুখে উপোসের ছাপ, চোখের কোলে কালি। ঘোমটার হায়া নেই। রুক্ষু চুলের গোছাটা পর্যন্ত মাছিতে ছেঁকে ধরেছে। যে কচু পাতায় মাছগুলো ভূর করা, তার পাশেই ন্যাংটা শিশু শুয়ে শুয়ে হাত-পা ছুড়ে খেলা করে। কবে যে মায়ের মাছ বিক্রি হবে, কে জানে। আর ওই যে গামছা পেতে সের দুই লাল চাল নিয়ে বসে আছে লোকটি। যেন নগদের তাগাদায় মুখের চাল ক’টি নিয়ে এসে বসেছে। চালের ব্যবসায়ী ওরকম বসে না। এমনি কয়েকজন বাজার বিক্রেতা, যারা এসেছে বে-দিনের মুখ চেয়ে। এত বড় গঞ্জে এ যেন দারিদ্রের পসরা।
গাজির বচন সেখানেও মানে না। বলে ‘সোরেনের বউ না?’
ক্লিষ্ট মুখে হাসি দেখ। বউটি হেসে বলে, ‘হ্যাঁ। কবে এলে ?’
‘আজ। ফিরবও আজ। সোরেন ভাল আছে?’
‘সে আবার খারাপ কবে। দেখ গে, হাঁড়িয়া খেয়ে পড়ে আছে।’
দু’জনেই হাসে। বউটি বারেক গাজির সঙ্গীকে দেখে। গাজি বলে, ‘আর কবে বেচবে এ মাছ। এবার ঘরে নিয়ে গে কত্তাগিন্নিতে ভেজে খাও।’
আবার দু’জনেই হাসে! বউটি কোনও কথা বলে না। দুটি কথা, একটু হাসি। তবু যেন একটা পরিবারের গোটা ছবি চোখে ভেসে ওঠে। এগিয়ে এসে গাজি বলে, ‘কাণ্ড দেখেন বাবু, সাঁওতাল বউটা বাজারে বসে, মদ্দ ঘরে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছে।’
অবাক হয়ে বলি, ‘সাঁওতাল নাকি।’
‘ওই নামেই। জম্মো তো এখেনেই।’
তাও না হয় মানি। কিন্তু গলায় অমন ঠিনঠিনে হাসিটি বজায় আছে কেমন করে। কেবল যে ঘরের ভাতে হাঁড়িয়া হয়েছে, তা নয়। পুরুষ মাতাল হয়ে পড়ে। কাঁখের ছেলে হাটের ভুঁয়ে; কচু পাতায় কুচো চিংড়ির পসরা, তবু হাসি যে অমর।
তারপরেই দেখি, সামনে ধানের পাহাড়। শহরের একতলা বাড়ির সমান উঁচু হবে, এত বড় ডাঁই। এক-আধটা নয়, অনেক ক’টা।
গাজি বলে, ‘এদিকটা হল ধান-চালের আড়ত। তয় বাবু, এ কিছু নয়। দেখতি হয় হাটের দিনে।’
খবর দিয়েই সে অন্যদিকে বাতপুছ করে। সোরেনের বউ তার সঙ্গে হাসে। আবার দেখি, আড়তদারও পান চিবিয়ে হেসে বলে, ‘গাজি যে! অনেকদিন বাদে।’
কিন্তু তখন আমি শুনি হারমোনিয়ামের বাজনা। যত জোরে বাজনা, তত জোরে কাঁস বাজানো মেয়ে-গলায় গান, ‘প্রেম করে ভাই, সঙ্গে নিলে না—আ—আ—আ…।’ এ যে নয়া ধন্দ লাগায়।