২৫.
সেই এক অরূপরতন, চোখেতে তার রূপ দেখি না। তবু দেখি, কোথায় যেন এক রূপের ঝোরা ঝরে যায়। রতন বলে ঝিলিক হানা বস্তু নিয়ে ঠুং-ঠুং বাজিয়ে ঝোলায় ভরি না। তবু আমার ঝোলা ভরে যায়। কেবল ইচ্ছা করে, প্রৌঢ়াকে একটু স্পর্শ করি। একবার তাঁর হাত ধরি। নয়তো হাত রাখি তাঁর বুকে।
তাও পারি না। তোমার ছোঁয়ায় কার শূন্যতা ভরে হে। আপন খাঁচা খোঁজ করো গিয়ে। যার শোক, তার কান্না। প্রবোধ, সান্ত্বনা-ভরা ভবন যার-যার নিজের মনে। গাজির কথায়, সেই যে ‘মজার মানুষ’, তা তোমার বানানো নয়। হাসানে দুষ্ট মাস্টারমশাই, সেও তাঁর নিজের মনেই। এই যে নিহত আত্মজের কথা বলেন আকাঁপা গলায়, তাও তাঁর নিজের স্বর, নিজের কথা।
তার চেয়ে যা পেলে অরূপরতন বলে, তাই নিয়ে যাও আয়ের ধনে। অরূপরতনের একটা নাম দিতে চাও; দাও—মানুষ। অরূপরতনের আরও অনেক নাম। তার আর এক নাম বলো, প্রাণ। বলো, মন।
তবু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারি না। স্তব্ধতার মধ্যে ঘটনার ভয়ংকরতা যেন নতুন করে হানে। ধস নেমে যাওয়া স্তব্ধতায় যেমন ক্রমে ক্রমে চেতন আসে, কোথায় কতখানি সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। কত ঘর বস্তি মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মনে মনে একবার অনায়াসে বলা বৃত্তান্ত নিজের মনে সাজিয়ে ভাবি। ‘বিদেশ-টিদেশ ঘোরা’ বলতে বিলাত-ফেরত বুঝি। বিলাত-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে তার বন্ধু ডেকে নিয়ে খুন করেছে। ভাবতে গিয়ে ভিতরটা আরও অন্ধকারে ভরে যায়। ছিদ্রহীন ঘেরাটোপে যেন আটকা পড়ে থাকি। তাকিয়ে দেখি, তিনজনের তিনদিকে মুখ। বাপ মা মেয়ে, একটি গোটা পরিবার। তাদের মাঝখানে, বীরু নামে এক স্মৃতি না জানি কী রূপেতে ভাসে। কী দোলাতে দোলে!
দেখি, ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী চোয়াল নাড়ান। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন দূরে। যে দূরেতে রোদ মাখানো সবুজ অথই হয়ে আছে। সবুজে যে তাঁর এত মনোযোগ আগে দেখিনি। মায়ের মুখ ফেরানো, নিচু। মেয়ের মুখ জানালার ওপরে ঝুঁকে পড়ছে।
আমি শ্রোতা, কথা শুনেছি, ঘটনা জেনেছি। তারপরে একেবারে আওয়াজ দেব না, তা হয় না। একটু পরে বলি, ‘পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয় দেখছি।’
ব্রহ্মনারায়ণ চোখ ফিরিয়ে তাকান না। বাইরের দিকে চোখ রেখেই একটু মাথা নাড়েন কেবল। অস্পষ্ট শব্দ করেন, ‘ঠিক।’
গাড়ির দরজার কাছে সহিস ছোকরার চিৎকার বাজে। পথের মানুষকে ডেকে কথা বলে। ওদিকে গাজি যেন কী গান করে। শুনে দশজনে দশ রকমের হাসি হাসে, বাত দেয়। কনডাক্টর ঘণ্টা বাজায়, পয়সা নিয়ে টিকেট দেয়। গাড়ি তার আওয়াজ তুলে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যায়। এই কলরবের মাঝখানে আমাকে ঘিরে যেন এক সিন্ধুর মৌনতা।
এখন ফেরার পথে সেই একই ছবি। ঝোপে গাছে পুচ্ছ-দোলানো পাখি, যাদের ডাক শুনতে পাই না। আকাশ-জোড়া সেতারে যেন তার বাঁধা, টেলিগ্রাফের তার দেখে তাই মনে হয়। ল্যাজ-ঝোলা ফিঙে সেখানে দোদুল দোলে। পুকুরঘাটে বউ চান করে, বউ জল নিয়ে যায় কলসি কাঁখে, বউ ঘোমটা সরিয়ে বারেক দেখে হাওয়ার গাড়ি চলে যাওয়া।
একটু পরে আস্তে আস্তে ঝিনি মুখ ফিরিয়ে চায়। মুখ ঢেকে পড়া রুক্ষু চুলের গোছা সরিয়ে নেয়। কাজলহীন চোখের জল মুছে নিয়েছে। মোছা যায়নি জল চোঁয়ানো আরক্ত ছাপ। তবু একটু হাসতে চায়। তাতে অন্ধকার সরে, বিষাদের ভার যায় না।
নিজের থেকে বীরু প্রসঙ্গ আর তুলতে পারি না। অথচ এই মানুষের মন, তার কৌতূহল ঘোচে না। বরং অন্য কথা জিজ্ঞেস করি, ‘আপনারা ক’ ভাই-বোন?’
ঝিনি বলে, ‘ছিলাম দুই, এখন এক।’
বলেও আবার সেই হাসির চেষ্টা। যেন একটা ভার সরাবার চেষ্টা। যেন ছায়া নড়াবার ঝলকে টান। সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘কিন্তু জানেন, হেনরির ওপর আমাদের কারুর রাগ নেই। এখন ওর জন্যে আমাদের কষ্ট হয়।’
অবাক হয়ে তাকাই ঝিনির চোখে। এ আবার কেমন কথা। অহিংসা উদারতা থাকবে মানি। তা বলে ভ্রাতৃহন্তাকে ক্ষমা কীসের। রাগ না থাকতে পারে, কষ্ট কেন। ব্রহ্মনারায়ণের মুখের দিকেও চোখ ফিরিয়ে আনি একবার। প্রৌঢ় যেন কোথায়, এখানে তিনি নেই। ঝিনিকে বলি, ওর বাবার কথার খেই ধরে, ‘তাতে সান্ত্বনা কোথায়?’
ঝিনি বলে, ‘সান্ত্বনা কিছু নেই, কারণ দাদাকে ফিরে পাব না আর। কিন্তু ভুলকে ভুলই বলতে হবে।’
‘কার ভুল?’
‘হেনরির।’
কথাটা যেন অতি উদারতায় বাজে। যেন একটু চড়া সুরে ঝনঝনায়, কানে লাগে। ভাল লাগে না। ভাই হারানোর সান্ত্বনা নেই। খুনির ভুলের বিচার কেন। জিজ্ঞেস না করে পারি না, ‘কার বিচারে?’
ঝিনি বলে, ‘হেনরির নিজের বিচারে।’
একটু ঠেক খেয়ে যাই, তুরন্ত কিছু বলতে পারি না। ঝিনির চোখের দিকে দেখি। দেখি, সেখানে পিছনের, দূর-দূরান্তের অচিন আলো-ছায়া। বলে, ‘হেনরি কোনওরকম মামলা লড়েনি, নিজেকে বাঁচাতে চায়নি। প্রথম থেকে শেষ অবধি ও অভিযোগ স্বীকার করেছে। যেদিন ওর রায় হয়েছিল, সেদিন ওর মা আর বোন এসেছিল কোর্টে। কিন্তু সকলের আগে, হেনরি বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাটা ভালই বলতে পারত। বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “কাকাবাবু, আমাকে ক্ষমা করুন।”
দেখি, ঝিনির চোখের কোণে আবার জল উপচায়। এবার আর কথা জোগায় না আমার। শুধু শোনা আর অবাক হওয়া। কেবল কোথায় একটা মোচড় খেয়ে নিজেকে শক্ত করে, চোখ নিচু করা। এখন দেখ, নাগরিকার চোখের জলের লাজ কেটে গিয়েছে। মুখ না ফিরিয়ে অসংকোচে চোখ মোছে। তান যখন জমে, সুর তখন আপনি খেলে। আবার বলে, ‘আসলে হেনরি আমাদের বাড়ির ছেলের মতো ছিল। দাদার মতোই আমাকে তুই-তোকারি করত। একসঙ্গে বসে খেত। কী বলত জানেন? ও বলত, “ওই অ্যাংলো শব্দটা বাদ, ওটার হাত থেকে এবার আমাকে রেহাই দে। আমি ইন্ডিয়ান।” অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বললে খুব চটে যেত, মনে মনে অপমান বোধ করত।’
অদেখা হেনরি সম্পর্কে এবার নতুন চেতনা জাগে। ফিরিঙ্গি ভারতীয় বলে যাদের জানি, তাদের সঙ্গে হেনরি যেন একটু অমিলে বিরাজ করে। তাদের ভারত-চিন্তা জানি না, ভারতীয় বলে ডাক দিয়ে ওঠার স্বরে তেমন জোর শুনিনি। বিব্রত সংশয়ের অস্পষ্টতা দেখেছি। তাই বলি, ‘এরকম সাধারণত দেখা যায় না।’
ঝিনি বলে, ‘হ্যাঁ, ও একটু আলাদা ছিল। ও যে আমাদের বাড়িতে কীভাবে আসত, না দেখলে বোঝানো যায় না। একবারও মনে হত না, যেন একটা অদ্ভুত কিছু করছে, যেন মজা করছে। চেঁচিয়ে চিৎকার করে দাপিয়ে ছুটোছুটি করে বাড়ি মাথায় করত। কথায় কথায় ঝগড়া আর তর্ক, গান করা, ঘুড়ি ওড়ানো, কী না করত! আর বুঝতেই পারেন, পাড়ার লোকেরা ওর আসাটা কিছুতেই ভাল চোখে দেখত না। তারা যা খুশি রটাত।’…
কথাটা যেন ঠিক শেষ হয় না। ঝিনির ঠোঁটের কোণে একটু বিরক্তির হাসি ঝিলিক দেয়। একবার চোখ নামিয়ে আবার চায়। মুখের ভাবে যে লজ্জা ফোটে, তা বলব না। পড়শি-ভাবনায় একটু যেন বিব্রত হয়ে ওঠে। তারপরে আর ভেঙে বলতে হয় না, পড়শিদের যা খুশি তাই রটনার বয়ান কী। কোথায় ইঙ্গিত করে। পড়শি বলো, পথিক বলো, আমরা তো সবাই তাই। আমিও অতএব বাদ যাই কেমন করে। কথা শুনে, নজরে একটু শান দিয়ে হানি। অলকা চক্রবর্তীর প্রাণের স্রোত কোন তরঙ্গে দোলে। ফুল কোথাও ফুটেছিল নাকি। অচিনে অজানায় নিভৃতে, কোথাও ফুটেছিল নাকি কুসুমকলি। হেনরি কি শুধুই হেনরি, অলি নয় মোটে?
ঝিনি আবার একটু হাসে। আমার চোখের দিকে চায়। বলে, ‘হেনরি সেই কথা নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করত। আবার কী বলত জানেন। বলত, “কেন, পাড়ার লোকেরা নিজেদের ভাই-বোন সম্পর্কে এরকম ভাবতে পারে।” আমি ওকে হেনরিদা বলতাম। বলতাম, “তুমি তো আর সত্যি সত্যি আমার ভাই নও।” কী যে চটে যেত ও কথা বললে। বলত, “আমি তা হলে সত্যি সত্যি তোর কী।” বলতাম, “তুমি দাদার বন্ধু।” শুনেই রেগে তেতাল হয়ে উঠত। পেছনে লেগে সহজেই ওকে চটানো যেত। আবার ও-ও আমার পেছনে লাগত।’
ঝিনি হেসে ওঠে। ব্রহ্মনারায়ণ এদিকে কখন কান দিয়েছেন, জানা যায়নি। বলে ওঠেন, ‘সত্যি, একেবারে পাগলা ছিল। অথচ কী মতি দেখ।’
আবার সবাই চুপ করে যায়। দূরান্তে, সেইসব দিনের স্মৃতির গভীরে যেন ডুবে যায়। ঝিনি বলে, ‘জেল থেকে প্রতি সপ্তাহেই এখনও চিঠি দেয়। চিঠিগুলো পড়লে ওর জন্যেই বেশি কষ্ট হয়। দাদা তো নেই জানি, ও আছে, সেইটাই কষ্ট। লেখে, “বেঁচে আছি, এটাই সব থেকে বড় কষ্ট।”
ঝিনি চুপ করে। পরমুহূর্তেই চোখ তুলে বলে, ‘কিছু মনে করছেন?’
অবাক হয়ে বলি, ‘কেন?’
‘এত কথা বললাম বলে?’
এবার দেখ, নাগরিকা আত্মপ্রকাশ করে। এতক্ষণে নগর-ধর্ম মনে জাগে। সচকিত হয়ে ভাবে, পান থেকে চুন খসেছে নাকি। বলি, ‘এতে কি কেউ কিছু মনে করতে পারে নাকি।’
ঝিনি বলে, ‘আপনি বলেই বললাম।’
একবার পুছ-নজরে চাই, পুছ করি না। ঝিনি নিজেই বলে, ‘আপনি ঠিক বুঝবেন, তাই।’
ঠিক বোঝার দায় নেব না, মনে মনে জানি। কারণ, সারা জীবনে ঠিক বোঝাবুঝির নজির আমার শূন্য। বেঠিক যদি না হবে, তা হলে পথে পথে ফেরা কেন। কেন সব অচিন থাকে, সন্ধানের খোঁজ জানা থাকে না। বুঝি না-বুঝি এইটুকু মানি, মৃতের চেয়ে অ-মৃতের ভাবনা ভাবায় বেশি। শোকে শূন্যতা, কষ্টে আকূতি, শূন্যতায় কেবলই হাহাকার। আকূতিতে জীবনতৃষ্ণা। তাই ঝিনির কষ্ট আমাকে এখন ছুঁয়ে যায়। হেনরির কথাগুলো মনে মনে বাজে, “বেঁচে আছি, এটাই সব থেকে বড় কষ্ট।”
এমন সময় গাজির হাঁক শোনা যায়, ‘শাঁখচূড় পেরায় এসি গেল বাবু!’ শোনা মাত্রই নড়ে ওঠেন ব্রহ্মনারায়ণ। দাঁড়িয়ে উঠতে যান। বলে ওঠেন, ‘তাই নাকি।’
গাজি সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে সামাল দেয়, ‘বসেন বাবু বসেন, এখনও একটু দেরি আছে। অই বললাম আর কী, আর বেশি দূরে নাই।’
আবার পুরনো ব্রহ্ম দেখা দেন। ভ্রূকুটি করে একবার গাজিকে দেখে, বসতে বসতে বলেন, ‘তবে আর তোমার ডাকাডাকির দরকার কী।’
আমি একবার গাজির দিকে চাই। হাসিঝরা চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। ফিরে চোখে চোখ পড়ে ঝিনির। ঝিনিও হাসে।
হঠাৎ ব্রহ্মনারায়ণ মাথা দুলিয়ে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ, একটা কথা মনে পড়ল। তুমি এক কাজ করো না কেন?’
কাকে বলেন! মুখ ফিরিয়ে দেখি, নজর আমার দিকে। বলি, ‘কী বলুন তো।’
প্রৌঢ়ের গালের ভাঁজের রেখায় যেন কেমন রহস্য ভাব। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন, ‘বুঝলি ঝিনি, একেও শাঁখচুড়ে নামিয়ে নেওয়া যাক।’
সঙ্গে সঙ্গে ঝিনির ঘাড়ে লাগে ঝটকা। চুলের গোছ নিয়ে যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। দেখি, যেন কিশোরী মেয়েটির চোখে খুশি ঝলকে ওঠে। বলে, ‘খুব ভাল হয় বাবা।’
অমনি দেখি, গিন্নিও দৃষ্টি ফেরান। মুখে ভার আছে, তবে চোখে কৌতুকের ছটা লেগেছে। কিন্তু আমি যেন তখনও ভেবে উঠতে পারিনি, নামিয়ে নেওয়া হবে কাকে। তার জন্যে পলক অপেক্ষা করে না। ঝিনিই তাড়াতাড়ি আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে বলে, ‘আসুন আমাদের সঙ্গে।’
শ্যামচিকন গ্রীবা বাঁকানো মুখে আর চোখে, অনুনয়ে আন্তরিকতা নয়। নাগরিকা যেন মুহূর্তে বালিকার বেশ ধরে, আবদারে গলে। আকাশ আমার মাথার ওপরেই, সেখান থেকে পড়িনি বটে, তবে সেই মুহূর্তে মনে হল, তাই পড়েছি। বিস্ময়ের ধাক্কাটা পুরোপুরি লাগবার আগেই প্রায় ডুকরে উঠি, ‘আমাকে বলছেন?’
জবাব যেন কানের কাছে গমগমিয়ে বাজে, ‘হ্যাঁ হে। তোমাকেই। কালীনগরের থেকে খারাপ জায়গা তো নয়।’
তৎক্ষণাৎ আমার মুখ থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসে, ‘না না, সে কি কথা।’
এবার শোনো ব্ৰহ্মনারায়ণের ব্ৰহ্ম হুমকি, ‘কেন, কথাটা এমন কি পাপের হল।’
‘না, পাপের নয়—।’
‘তবে?’
কথা শেষ করতে দেন না। ঝিনি ওদিকে ঝিনঝিনিয়ে হাসে। কিন্তু চোখের পাতায়, পাখির ডানার গুটিয়ে আনা নিবিড়তা। খুশি নজরে উপচে পড়া নিবেদন। তারই সংক্রমণ দেখ, মেয়ের স্নিগ্ধ চোখে। আমি বলি, ‘না, মানে—।’
কথা শেষ করতে দিলেই হল! ব্রহ্মনারায়ণ হাঁকেন, ‘না মানে বলে তো কোনও কথা নেই। ভদ্রলোকের বাড়ি, গঞ্জ হোটেল নয়।’
ঝিনি যোগ করে, ‘বেলাও অনেক হয়েছে, একটা বাজে।’
সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মনারায়ণের কিঞ্চিৎ যুক্তিবাচক বচন, ‘পথে একটু আলাপ পরিচয় হল, বেশ হল। এবার নেয়েখেয়ে একটা বেলা একটু জমিয়ে গপ্পো করা যাবে। কী বলো গো?’
গিন্নিরও একটা মতামত তো চাই। তিনি তৎক্ষণাৎ একটু ঘোমটা টেনে খুশি হয়ে হাসেন। বলেন, ‘এ আবার বলব কী, খুব ভাল হয়।’
এ আন্তরিকতায় বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস নেই, ধন্দ দ্বন্দ্ব নেই। ছলছলিয়ে যাই এই পথিক ডাকের খুশির বিস্ময়ে। বরং নিরুপায় বলে খচখচ করে মনে। না হেসে পারি না। অসহায়ের হাসি। কিন্তু বক্তব্যের গুরুত্বটা যেন না হারাই, সেইভাবেই বলি, ‘সত্যি, এভাবে বলছেন, খুব ইচ্ছে করছে নেমে যাই। কিন্তু কোনও উপায় নেই, জানেন।’ ব্রহ্মনারায়ণ এবার বেশ শরীর নিয়েই বেঁকে বসেন। ভুরু দিয়ে খুঁচিয়ে, গলায় আওয়াজ করেন, ‘কেন?’
সংকটের কথা সহজ ভাবেই বলি, ‘আপনি তো জানেনই, কাল আমার ফেরার কথা ছিল। নিতান্ত দায়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল, আর দেরি করা চলে না।’
প্রৌঢ় হুমকানি দেন, ‘বাজে কথা ব’লো না তো হে। গতকাল ফিরবে বলে যে একদিন পরে ফিরতে পারে, একটা বেলাতে তার বেহ্মাণ্ড উলটে যাবে! কোনও মানে হয় এসব কথার!’
গিন্নি আর একটু টানেন, ‘বেলা তো প্রায় কেটেই গেল। কতটুকু সময় আর।’
ঝিনি ঘাড়ে ঝটকা দিয়ে চুল সরিয়ে, স্বরে ঢেউ দিয়ে বলে, ‘চলুন না।’
এবার দেখ, বিদুষী নাগরিকা আস্ত একটি মেয়ে। ফিলজফির খোঁজ করে দেখ, সবকিছু কেবল জীবনের আর মনের ছন্দ বাজে।
এমন সময় সহিসের হাঁক বেজে যায়, ‘স্সাখচুড়, স্সাখচূড়।’
থামাবার ঘণ্টা বেজে ওঠে। আওয়াজ ওঠে, ‘মেয়েছেলে আছে।’
ব্রহ্মনারায়ণ দাড়িয়ে উঠে বলেন, ‘চলো হে চলো।’
টেনে নামাবেন নাকি। আমিও দাঁড়িয়ে উঠেই বলি, ‘সত্যি কোনও উপায় নেই, মাপ চাইছি।’
‘থাক, আর মাপ চাইতে হবে না। ভাল কথা তো শুনবে না, শুকোতে শুকোতে যাও।’
বিদায় নেবার এই শেষ কথা ব্রহ্মনারায়ণের। দরজার দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘ঝিনি, তোর মাকে নিয়ে আয়।’
ঝিনি তখনও তাকিয়েছিল। গতকালের বিদায় নেবার ছবিটা মনে পড়ে। এখন তার চেয়ে বেশি অন্ধকার তার মুখে। খুশি লাগা ঝলকে হতাশার একটু ছায়া। বলতে ইচ্ছা করে, কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের চাঁদের মতন। পথ চলাতে এইটুকু ব্যাজ। তার ওপরে দেখ, মন খারাপের বাঁকটুকু লেগেছে সরু কালো ভুরুতে। এখানে লেনাদেনার বিচার নেই। তাই, দাবিটা এমন নিটোল সহজ, বলতে পারো, মন খারাপের বাঁকটুকুর আর এক নাম অভিমান।
গাড়ি তখনও দাঁড়িয়ে পড়েনি। মা একটু বিমর্ষ হেসে বলেন, ‘চলি বাবা।’
আমি ঘাড় কাত করে বলি, ‘আচ্ছা। আমার দুর্ভাগ্য—।’
কথা শেষ করতে পারি না। বিদুষীর গলা ঝংকৃত হয়ে ওঠে, ‘সে বিচারটা আপনি করবেন না। দুর্ভাগ্যটা কাদের, বুঝতে নিশ্চয়ই পারছেন।’
বলে, মায়ের হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘চলো।’
ঝিনি পিছন ফেরবার আগেই অসহায় হয়ে বলি, ‘ভুল বুঝবেন না যেন।’
তবু ঝিনি পিছন ফেরে। কিন্তু তাকায় না। কোনও জবাব দেয় না।
গাড়ির গতি মন্থর হয়ে আসে। ব্রহ্মনারায়ণের ডাক শোনা যায়, ‘আয় রে ঝিনি।’
ঝিনি দু’ পা বাড়িয়ে আবার হঠাৎ পিছন ফেরে। হেসে বলে, ‘ঠিকানাটা কিন্তু রেখে গেছেন।’
‘মনে আছে।’
‘সত্যি?’
ওর ঠোঁটের কোণে হাসি একটু বেঁকে ওঠে। পরমুহূর্তেই সারা মুখে স্পষ্ট হাসি ঝলকে ওঠে।
বলে, ‘দেখা যাবে। চলি।’
‘আচ্ছা।’
ওরা নেমে যাবার মুহূর্তেই গাজি হেঁকে ওঠে, ‘চললেন বাবু?’
ব্রহ্মনারায়ণের তেমনি জবাব, ‘তবে কি থাকব!’
গাজি তেমনি গলাতেই বলে, ‘পেন্নাম হই বাবু, পেন্নাম হই মা, পেন্নাম দিদিমণি।’
গাড়ির গর্জনে তার গলা ডুবে যায়। জবাব পাবার আশায় গাড়ি আর তখন দাঁড়িয়ে নেই। এমন একটা বাঁক নেয়, জানালা দিয়ে আর কাউকে দেখা যায় না। পিছনে থাকে কেবল একটি ছায়া-ঘেরা নিবিড় আম জাম নারকেলের বাগান।
তবু যা হোক, ঝিনি একটু হাসির ঝলকে সহজ করে দিয়ে যায়। না নামতে পারার জন্যে মন যে একটু খারাপ হয় না, তা নয়। সংসারে এইটুকু আজ দুর্মূল্য। প্রীতি কেউ দু’ হাত বাড়িয়ে বিলোয় না। যদি কেউ দান করে, তবে তা হাত ভরে নিতে না পারার দুঃখ তোমার।
গায়ে এসে রোদ লাগে। সূর্য পশ্চিমে ঝুল খেয়েছে বোঝা যায়। কিন্তু প্রথম শীতের এই দুপুর রোদ, এখন আরাম দেয় না। অস্নাত রুক্ষ শরীরে একটু জ্বালা দেয়। দিগন্তে তাকিয়ে মনে হয়, আমার গায়ের জ্বালা যেন প্রকৃতিকেও জ্বালাচ্ছে। সেখানেও দুপুরের রোদ ঝলকানো নিঝুমতা। পথের ধারে হেথা সেথা পাখিগুলোকে আর দেখা যায় না।
পাশে শুনতে পাই, ‘এবার একটু বাবুর কাছে বসি। সময় তো হয়ি এল।’
জিজ্ঞেস করি, ‘আর কতক্ষণ?’
‘বেশি না। দেখতি দেখতি এসি যাবে। বসিরহাটে যেয়ি, গাড়ির জন্যি আর দাঁড়াতি হবে না।’
সে কথা জানি। নতুন করে কেন আর সান্ত্বনা দেয় গাজি। সরে গিয়ে তাকে পাশে বসতি দিই।
সান্ত্বনা দেয়, তার কারণ আছে। কাছে বসে গাজি আমার মুখের দিকে তাকায়। টের পাই, কোনও দিকে সে ফিরে তাকায় না, নজর সরায় না। আমি তার দিকে ফিরে চাই। দেখ, যেন স্নেহ-করুণ নিবিড়তা গাজির আরশি-চোখে। বলে, ‘খুব কষ্ট লাগে বাবু, না?’
বলি, ‘কই, না তো।’
গাজি বলে, ‘এতখানি বেলা হয়ি গেল। চান খাওয়া কিছু হয় নাই, আরও কত পথ যেতি হবে আপনাকে।’
তা হবে। পথ চলার এই রীতিটুকু, আপন প্রকৃতি দিয়ে মেনেছি। বলি, ‘এমন কিছু নয়।’
গাজি বলে, ‘খালি মনে হয়, বাবুকে আমি কষ্ট দিলাম। হ্যাঁ বাবু, গাজিকে মনে থাকবে তো?’
হেসে তাকিয়ে বলি, ‘থাকবে বই কী!’
‘তয় বাবু, আপনাকে একটা কথা বলি।’
‘বলো।’
গাজি বলে, ‘হাতে যদি সময় থাকে বাবু, তয় হাড়োয়ার মেলায় আসবেন। ফাগুন মাসের বারো তারিখে, পির গোরাচাঁদের মেলায়। আসবেন বাবু?’
একটু লালের আভায়, এ আরশি-চোখ ঝিনির নয়। তবু দেখ, যেন প্রেমে থরোথরো অনুনয়। জবাবের আশায় যেন দাড়ি স্তব্ধ, পট নিশ্চল। মনে পড়ে যায়, গাজির কাছে, হাড়োয়ার মেলা কেবল পির গোরাচাঁদের মেলা নয়। সেখানে তার নয়নতারা মিলেছিল। ও মেলা গাজির নয়নতারার মেলা। জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি যাও নাকি প্রতি বছর?’
‘জয় মুরশেদ, বলেন কী বাবু। হাড়োয়ায় না গেলি কি চলে। অত বড় মেলা আর কম্নে আছে।’
গম্ভীর থাকবার চেষ্টা করে বলি, ‘তোমার নয়নতারাও যায় নাকি?’
গাজি হা হা করে হেসে বলে, ‘সে কথা কি আর পুছ করতি হয় বাবু। তা নিয়ি গেলি, গাজির গদ্দান যাবে না?’
সর্বনাশ, একেবারে গর্দান। তা ব্যাজ করতে পারবে না, গাজিনীর যুক্তি আছে বই কী। অধর ধরার সাধনের জন্যে যেখানে প্রকৃতি প্রাপ্তি হয়, সে তো স্মৃতিতীর্থ হে। বলো, মুরশেদের মিলিয়ে দেওয়ার তীর্থক্ষেত্র। তোমরা গিয়ে বিবাহ বার্ষিকী করো। এখানে তো সে সব চলে না। ফাল্গুনের বারো তারিখ, হাড়োয়া হল প্রকৃতি-প্রাপ্তিবার্ষিকীর থান। যাওয়া মানেই পালন।
বলি, ‘সময় পেলে নিশ্চয় আসব। রাত্রে মেলায় থাকবার জায়গা আছে?’
গাজি বলে, ‘এক রাত্তিরির তো ব্যাপার বাবু। সারা রাত আপনাকে গান শুনাব।’
মনে মনে ভাবি, মন্দ না। অধর ধরার সাধিকা, নয়নতারাকেও তখন দেখা যাবে। মিয়া-বিবির ঘর করা না, এ পুরুষ-প্রকৃতির উজান চলা। তার ওপরে অমন যার প্রাণের তেজ, তাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করে।
বসিরহাট এসে গেল। এবার গাড়ির অভাব নেই। কিন্তু চায়ের তৃষ্ণা না মিটিয়ে পারি না। গাজিকেও ডেকে নিই। বিদায়ের আগে, একটু গলা ভেজানো।
চা খেতে খেতে বলি, ‘তা তুমি যে কাল থেকে ঘর ছাড়া, তোমার নয়নতারা চিন্তা করবে না?’
গাজি হেসে বলে, ‘এই কি নতুন নাকি বাবু। এমন কত বাইরি থাকি। নয়নতারা ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়ি—।’
আমার গালে যেন ঠাস করে চড় লাগে। বলে কী হে লোকটা। এতক্ষণ পুরুষ-প্রকৃতির উজান টানের কথা বলে, এখন ছাওয়াল-পাওয়াল শোনায়।
আমার নজর দেখে ঠেক খায় গাজি, বলে ‘কী হল বাবু!’
বলি, ‘তুমি যে বলছিলে, মিয়া-বিবির ঘর করা নয়, মনের মানুষ—’
কথা শেষ করতে পারি না। গাজি একেবারে লজ্জায় নুয়ে পড়ে। টেনে টেনে হাসে, বলে, ‘বাঁধাল আর বাঁধতি পারলাম কম্নে বাবু। সে বড় কঠিন কাজ কিনা।’
বটে! মনে করেছিলাম, আলখাল্লা পরা এই গাজি বুঝি তার দীনদরদীর খোঁজে চলে। মুরশেদ সত্য, আর সব মিথ্যা। কিন্তু এ যে বিবির মিয়া, ছাওয়াল-পাওয়ালের বাপ। আবার বলে, ‘এখন বাবু, মিয়া-বিবি হয়ি গেছি। তবে অই, মুরশেদের নামের মজদুরিটা—।’
এবার ঠেক মারি আমি। বলি, ‘ছাড়তে পারনি। তা, ছাওয়াল-পাওয়াল ক’টি?’
‘আজ্ঞে চারটি।’
চমৎকার! মুরশেদের নামের গুণ আছে। এখন দেখ একবার, যাকে দেখেছিলে সংসারের বাইরে, সে সংসারের খুঁটে খাওয়া কোটির এক। এবার দেখ, আরশি-চোখে যেন লড়িয়ে বাবা, সন্তানের স্নেহে করুণ। বিবির প্রীতিতে প্রেম গদগদ। ঝোলা ডুপ্কি আলখাল্লা, সব নিয়ে এ এক বাংলাদেশের গায়ক, জীবধর্মে একেবারে সোজাসুজি মানুষ।
গাজিটা সত্যি পাজি। হাসব না রাগব, বোঝবার আগেই আমার গাড়ি হাঁক দেয়। কিন্তু কোথায় যেন ঠেক খাই, মোচড় লাগে। তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে নিজের সামান্য শ্রমের ধন তুলে দিয়ে বলি, ‘ছেলেমেয়েদের কিছু কিনে দিয়ো।’
বলে দৌড়ে গাড়িতে উঠি। চকিতে একবার সেই মুখখানি দেখি। একবার যেন শুনতে পাই, ‘বারোই ফাল্গুন—বাবু—হাড়োয়ার মেলায়…।’
.
২৬.
কেন, কী কারণে, সে কথা পুছ ক’রো না। নিজেরও কি প্রত্যয় আছে যে, বাতিয়ে দেব, কে ঘরছাড়া করে ডেকে নিয়ে যায়। সেই পাগলের নাম জানি না, কে যে ‘বাহির করেছে পাগল মোরে।’ যদি ঈশ্বরের কথা বলো, এক কথায় নাকচ। তার সঙ্গে কোনও চিন্-পরিচয় নেই। না এক-কে, না বহুকে। জানা কেবল শোনায়, পড়ায়, পটে-প্রতিমায়। মোকাম সাকিন নিবাস, কোনও খোঁজই জানা নেই। সংসারের কথা বলতে পারো। তাতে ক্ষতি বই লাভ হয়নি। মজ্জাগত সংস্কারটা কাজের কাজ কিছু করে না। মনের ভাবে অ-ভাব আনে। অকাজ বাড়ায়। আমি ওর মধ্যে নেই।
তবে আছ কীসে? এত বাহির বাহির কেন। যেন কেবল হাতছানি, ঘরেতে রইতে নারি। কেবলই ছটফট, ফাপর ফাপর, তখন একটু আগল খোলা পাওয়া যায়। ফাঁক পেলেই ঝোলা নিয়ে দে দৌড়। যেন, ‘শুনিয়া বাঁশিরো গান, মনো করে আনচান, গেহকায্য রয় না আমার স্মৃতিতে।’ কেন, দায়-দায়িত্ব কর্ম নেই?
আছে, সর্বাঙ্গে মুড়ে আছে, পিছমোড়া করে বেঁধে আছে। কিন্তু মর্ম মানে না যে। কেবল কর্মের ঋণ শুধবে, মর্ম উপোসী থাকবে, তা হয় না। একে যদি ছুটির অবকাশ বলা হয়, আপত্তি আছে। সেসব দেখ গিয়ে দেওয়ালপঞ্জির পাতায়। সালতামামি ভিড়ের ঠেলায় মরসুমি ধাক্কাধাক্কি দেখ গিয়ে টিকেট-ঘরের কাছে, ইস্টিশনে, গাড়িতে। এখানে তা নেই, উচ্চস্বর উচ্চগ্রাম, উচ্চ উচ্চ রাজভ্রমণ, ডেয়ো-ঢাকনা লটবহরের টানাটানি। এ হল উঠোন ডিঙিয়ে, বনের পথটুকু পার হয়ে, যমুনার ধারে যাওয়া। আনচান মনের ছুট কিনা। কেবলই ফাঁকে ফাঁকে যাওয়া। ফাঁক না পেলে ছল দিয়ে ফাঁক তৈরি করে যাওয়া। কেন না, ওই সেই মর্মের তাড়া। তাই যেতেই হবে। যদি বলো, কীসের লাগি, বলতে পারব না। কতদিন তো ধোয়ামাজা ঝকঝকে, নয়তো মেঘমেদুর আকাশ দেখে মনে মনে ভেবেছি, এই তো সেই ব্যথা-ধরানো খুশির পাওয়া পরম রতন। কতদিন বনস্থলীতে দাঁড়িয়ে শ্যামচিকন চিকচিক পাতা দেখে সুখেতে চিকচিকিয়ে উঠেছে চোখের কোণ। নামী বেনামী কুসুমগন্ধে বুক ভরেছে, সব গন্ধেই যেন কেমন এক সুখ-দুঃখে মাখামাখি। সেখানে পাখি ডেকে যায়, ভোমরা মধু খায় ফুলে ফুলে, প্রজাপতিরা রঙের গুমরে ঝলকায়। তখন কথা সরে না। এমন এক আনন্দ বেজে ওঠে, যেন চোখ ফেটে ঝরঝরিয়ে যেতে চায়। আর মন বলে, এই চাওয়াতেই ফিরি, এই ভরাতেই ডুবি। তখন যে সব ভরেই ওঠে।
তবু কী যেন বাকি থেকে যায়। সব কিছুর মধ্যে যেন কী ‘তবু ভরিল না…।’ সেই নামহীন অচিনের কী যে নাম, কোথায় সন্ধান, প্রাণে সেই আফসানি এ ‘শূন্য মাঝারে।’ তা-ই চলো যাই দেখি, কী মেলে, মেলে কিনা কিছু।
পথ একটু ঘোরালো, ঘুরে যেতে হচ্ছে। গন্তব্য ছাতিমতলায়। ছাতিমতলার মেলায়, পৌষ যেখানে ডাক দিয়েছে, তোরা আয় আয় আয়। সেখানে মহাঋষির স্মৃতিতীর্থ, উপাসকের আশ্রম। সেখানে আছে বটতলা, যেখানে ঋষি সূর্যোদয় দেখতেন। যবে ঋষি দীক্ষা নিয়েছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেইদিন তাঁর জন্মান্তর। জন্মান্তরের সেই দিনটি, সাতুই পৌষের স্মরণোৎসব। এবার সেই লীলাভূমি যাত্রা, গেরুয়া রঙে ছোপানো মৃত্তিকাদেশ বীরভূমের অন্তঃপাতী। তার সঙ্গে দেখবে চলো ঋষিপুত্রের কীর্তি। সে এক তিল তিল রূপে গড়া তিলোত্তমা নয়, বিশ্ব ছেনে বিশ্ববিদ্যালয় গড়া। সে হল কীর্তিমানের কর্ম। মর্মের কথা আলাদা। মহর্ষির ধ্যানের বীজে সেই মরমের জন্ম, যে মরমের ধ্যানের কথা শ্রুতিগোচর গানের সুরে। সে মরমিয়ার ব্যাকুল চাওয়া, ধ্যানের চাওয়া, অরূপরতন, তার নিজের মিলে ছিল কিনা, কে জানে। আলো আলো আলো বলে আর্তরবের অন্ধকারে তাঁর চোখের তীরে আলো জেগেছিল কিনা, কে জানে। সেই ক্ষ্যাপার কথা যে মনে পড়ে যায়, খুঁজে ফেরার পরশমণি যে ফেলে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের হাত তো ভরে গিয়েছে সোনায় সোনায়, অরূপরতনের কাব্যবিতানের মালিকায় যা গাঁথা। আমাদের চোখের তীরে তো আলোর ঝলক, চারু সম্ভারের আলোতে। তাই সেখানে যাই। মহর্ষির তীর্থে, মরমির থানে, কর্মীর বিশ্বলোকের প্রাঙ্গণে। সেই এক ছাতিমতলা ঘিরে যার বিস্তার। উপলক্ষ, মহর্ষির দীক্ষাদিনের সাতুই পৌষ। সাতুই পৌষের মেলা। সেখানে বঙ্গ রঙ্গ করে নানা রূপে, নানান উপচারে। এ কথা পড়ায় জানা, সংবাদে শোনা। একবার দেখে আসি গিয়ে।
তবে সেই কথা, ছাতিমতলায় যাত্রাটা সোজাসুজি হয়নি। একটু ঘুরপথে চলা। সাঁওতাল পরগনা ঘুরে আসা, রাজধানী থেকে যাত্রা নয়। তাই অন্ডাল থেকে সোজা সড়ক ছেড়ে বাঁকা পথে ঢোকা। দেখ, গায়ে বুঝি এখনও দক্ষিণের দরিয়ার নোনা লেগে আছে। গাজির কালো মুখের হাসির আলো ঝিকিমিকি করে। তথাপি, রাঢ়ের ধুলায় রাঙা হয়েছি। রং মাখামাখি হয়েছে সাঁওতাল পরগনার পথে প্রান্তে। একা আমি নয়। দেখে এস গিয়ে, উত্তরীয়া হাওয়ায় যেটুকু ওড়ে, তাতেই মানুষ পশু ছার, ইস্তক গাছপালাতেও গেরুয়ার ছোপ লেগেছে। এর পরেও যদি ফাল্গুনের কথা ভাবো, দিশা পাবে না।
এ গাড়ি যাবে সাঁইথিয়া। আবার বদলের পালা। সাঁইথিয়া থেকে বোলপুর নামে ইস্টিশন। আসলে নাম শান্তিনিকেতন। সেখান থেকে ছাতিমতলা। আসল শান্তিনিকেতন। ডান পাশে বুড়ো বসে ছিল। দেখে জীবিকা বোঝবার উপায় নেই। চেহারায় পোশাকে গ্রামীণ জন বুঝি কৃষাণ হতে পারে। আমার হাতে খোলা বইটার দিকে অনেকক্ষণ ধরেই তার নজর করা দেখেছি। দু-একবার ঠোঁট নড়াও চোখে পড়েছে। যেন বানান করে করে পড়ছে। ফিটফাট ভদ্রলোক পড়ো হলে একটু অস্বস্তি হত। এখানে তো নেই। তবু ঠোঁটের কোণটা একটু টিপে রাখতে হয়। পাছে ঠোঁট ছড়িয়ে গিয়ে হাসি ধরা পড়ে। এ হাসি বিদ্রূপে দোষাবহ হতে পারে, কিন্তু মজা লাগে বেশি। নইলে বইটা নিজের কোলের ওপর এমন করে খুলে রাখার কারণ নেই। কারণ, নজরকে বই ধরে রাখতে পারেনি। জানালা দিয়ে দূরান্তরে টেনে নিয়েছে।
প্রথম ক্ষেপের এক বাক্য শুনতে হয়েছিল অন্ডাল ছাড়বার পরেই। এক জিজ্ঞাসা, ‘কুথাক্ যাবেন?’
এ সেই ‘যাওয়া হবে কম্নে’ নয়। এখানে সুর স্বর উচ্চারণ, বেবাক আলাদা। এখানে নোনা গাঙের ছলছলানি, কলকলানি, ভেজা ভেজা ভাব নেই। যেন উপছে পড়া, ঢল নামা গহিন গাঙের তরতরিয়ে যাওয়া। যেন কালো নরম সমতলে সোজা চলে যাওয়া। না। এখানে কাঁকরে পাথরে যেন রক্তে সেঁচা মাটি, চড়াই-উৎরাইয়ে চলে। কথার সুরে পাবে সেই পাথুরে ওঠানামার তাল। এ আর এক রসের সুর। জাত আলাদা। ছন্দে একটু বাঁকাচোরা, ঠেক-খাওয়া ঠেক-খাওয়া। ভাটিয়ালির লম্বা টানের থেকে গুপ্গুপাগুপ্ গোপীযন্ত্রের গানের সুরে মিশবে ভাল। ঝুমুর বাউলের ওঠা-নামা এই প্রকৃতিতে আছে। কাঁদনেও সেই সুর। উজানিয়া গাঙের মাঝির শোকের সুর না। সুখের তরতরানো ছলছলানি না। এখানে রসের ধারা নীচে দিয়ে বহে। ছোটে যখন ঝরনা তালে, লাফিয়ে নেচে ঘুরে ঘুরে ছোটে। যখন উত্তাপে রক্তমাটি ফাটে, তখন কেটে দেখ, তালশাঁসে টলটলে রস, গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। নদীতে জল নেই, পুকুর খটখট। মহুয়ার গন্ধ ছড়িয়ে যায়, মৌমাছি গুনগুন করে। কথাবার্তা যা শুনবে, সব সেইরকম। যেন ভিতর থেকে খোঁচা খেয়ে খেয়ে ওঠে, শোনায় এক নতুন সুরের ছন্দে। এক ভিন রসের সন্ধান পাবে। তার নাম রাঢ়ের রস।
জবাব দিতে গিয়ে ছাতিমতলা বলিনি। শান্তিনিকেতনও না। বলেছি, ‘বোলপুর’।
‘অ, সাঁইথে যেয়ে বদলাতে হবে।’
এই সংবাদটি দেবার পর থেকেই কী যে কাল কেতাবে নজর পড়ে। সেই থেকে পৌষরুক্ষু মুখখানিতে নানান ভাব। চোখ কুঁচকে কুঁচকে দেখার ঘটা। আর ওই, মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ানো। একবারটি মুখ ফুটে চাইলেই ছাতিমতলার বাংলা ইতিহাসখানি দিয়ে দিই। তাও চায় না। অতএব মেলে ধরে কোলে নিয়ে বসে আছি।
এইটুকু এক রঙ্গ, তার ফাঁকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এক অনন্ত আকাশ। এ আকাশকে কেবল মাজা বলব না। শীতের বেলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটু ঘষা-ঘষা। সকালবেলা যেমন নীল, নীলকান্ত মণির স্বচ্ছতা ছিল; কী জানি, মুখ বাড়ালে না জানি মুখখানিই দেখা যেত আরশির মতো, এখন তেমন নয়। রোদ খেয়ে খেয়ে এই বেলায় একটু যেন রুখু। নীচে ধানকাটা মাঠ গাড়ির ছোটায় যেন পাক খেয়ে খেয়ে যায়। তার মাঝে কখনও গ্রাম। রাঢ়ের মাটির ঘর, খড়ের চাল। হেথা হোথা তাল গাছ, যেন আনিমানি জানি না, এমনি সব দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাবলা কেয়া বন। আম-জাম যে চোখে পড়ে না, এমন নয়। আর এই রক্তিম তেপান্তরে, পথে ঘাটে গ্রামে আরও যে কত গাছ দেখি, যারা বনস্পতির মতো দাঁড়িয়ে, তাদের নামই জানি না। বট অশ্বত্থ চিনতে অসুবিধা নেই। গ্রামের পথে দেখি, ল্যাংটা ছেলেরা খেলা করে। কেন, শীত কি নেই। পৌষ কি তোদের হাড় কাঁপায় না। বড়দেরও দেখ না কেন, খালি গায়ে রোদ নিয়ে এখানে ওখানে দঙ্গল পাকিয়ে বসে আছে। রেল-লাইনের ধারে যেসব জলাশয় সেখানে মেয়েদের স্নান, কাপড় কাচা চলেছে। কাছে দূরে রাখালেরা লাঠি হাতে ধেনু চরিয়ে ফেরে। এখন আগলানো শুধু মুগ মটর কলাইয়ের ক্ষেত। দেখ হে রাখাল, তোমার গাই গরু যেন ছোঁচাবৃত্তি না করে। মাঝে মাঝে আখের ক্ষেত, বাতাসে মাথা দোলায়। গরুর গাড়ি চলে গ্রামের পথে। কোনওটা ছই-ঢাকা, পরিবার পরিজনে ভরা। কোনও গাড়ি খালি, খোলা। কোনওটাতে খড়ের বোঝা। এই যত লোক, সবাই একবার গাড়ি দেখে। এমন দেখি না, একবার কেউ চোখ ফিরিয়ে রাখে।
তারপরে মাঝে মাঝে দেখ, হঠাৎ যেন ছোট এক তালবন। আসলে, জলাশয় ওখানে। রাঢ়ের এই এক বৈশিষ্ট্য। বিশেষ, দূর উত্তর-পশ্চিম রাঢ়ে। যেখানে জলাশয়, সেখানেই তালবনের বেষ্টনী।
বৈদ্যনাথপুর নামে এক ইস্টিশন পার হয়ে দেখি, ভূমি নেমে যায়। যেন উৎরাইয়ের ঢালে নামে, সঙ্গে নামে সকল প্রকৃতি। আমার পায়ের নীচে কী এক গুমগুম শব্দ যেন বাজে। তারপরে দেখি, হঠাৎ আকাশ আরও দূরান্তে ছড়ায়। মাঝে লাল রং বালির চর ধু-ধু গায়ে পাক দিয়ে, মোচড় খেয়ে, এলিয়ে পড়ে রোদ পোহায়। এপারে ওপারে লাল মাটির পাড় এবড়ো-খেবড়ো, বিস্তীর্ণ গাছপালা বন তার গায়ে। পুলের উঁচু থেকে মনে হয় একমেটে রং প্রকাণ্ড সাপ, আলস্যে আরামে রোদে পড়ে আছে। বড় উদাস তার ভঙ্গি। তার গা চিরে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে এক নীল নীল শিরা। তাতে রোদ চিকচিক করে, ক্ষণে ক্ষণে যেন টলটলিয়ে যায়। সেই শিরার গায়ে। ছোট ছোট কালো মূর্তি নড়েচড়ে ওঠে। হয়তো কাপড় কাচে, চান করে।
এ নদীর নাম কী, যেন মনে মনে জানি। তবু নতুন দেখার একটু সংশয়। তাও দূর হয়। আমার উৎসুক চোখের সামনে, পাশের বুড়োর কথা শোনা যায়, ‘ইটি অজয় লদী।’
অজয় নদ। মুখ ফিরিয়ে দেখি, বুড়ো অজয় দেখে না। আমার মুখের দিকে দেখে। আমি যেমন মজা পেয়েছিলাম তাকে দেখে, সেও যেন, সেইরকম মজা পায়। আকাটা গোঁফদাড়িতে একটু হাসে। বলে, ‘আগে কখনও দ্যাখেন নাই?’
ঘাড় নেড়ে জানাই, না। বুড়ো বলে, ‘এর পরে, কস্তগেরম, বীরভূম পড়ছে।’
নতুন লোককে একটু জানান দেওয়া আবশ্যক বোধ করে। সেটাই ভব্যতা। আমি দেখি, অজয় পিছনে পড়ে থাকে, বীরভূমে প্রবেশ। নতুন ইস্টিশনে ওঠা-নামার ছোটাছুটি হাঁকডাক পড়ে। এক ঝাঁক সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষ ওঠে। দু-একজনকে একটু অসাব্যস্ত লাগে। বেলা হয়েছে তো, রস গেঁজেছে। হাসাহাসি দাপাদাপি কম নেই। তার মধ্যেই কার যেন গান গাইবার একটু ঝোঁক হয়। ভাষাটা একটু কানে ঠেকল, তা-ই শ্রবণ যেন চমক খেল। ‘প্রাণে সয় না সয় না ওহে ঠাকুরপো !…’ তারপরে একটু জোর করে হাসাহাসি। দেখি, সাঁওতাল দলের পাশ ঘেঁষে বসা গুটি কয় ডাগর যুবা। মাথায় তাদের বড় বড় রুক্ষ চুল। সবাই ধূমপানের মজলিসে আছে। তারপরে তাদের গল্প শুরু হয়ে যায় সাঁওতালদের সঙ্গে। মেয়েরা কী যেন বোঝে অর্থাৎ যা বোঝার তাই বোঝে। যুবতী দেখলে যুবারা যা করে, তা-ই বোঝে। তবে কাপড় টানা ঢাকাঢুকি অত বোঝে না। নিজেদের সঙ্গে বারেক চোখাচোখি করে একটু বা হাসে।
আমার পাশ থেকে বুড়ো বলে, ‘ব্যাটারা মদ খেয়ে মরেছে।’
সাঁওতালদের কথাই সম্ভবত বলে। কিন্তু ওটাকে মরা বলে কিনা, আমি জানি না। তবে এক বিষয়ে চোখের নজর নিবারিত হয় না। ওরা সবাই বেশ সেজেগুজে চলেছে। পুরুষেদের ধোয়া জামা। মেয়েদের ধোয়া শাড়ি। কারুর কারুর জামা গায়ে। কেবল জিজ্ঞাস্য, দুর্মূল্যের বাজারে ওরা এত তেল পেয়েছে কোথায়। চুল মাথা সবই কেমন তেল-চকচকে। তার ওপরে সব মেয়েরই খোঁপায় গোঁজা এক আশ্চর্য বস্তু। যেন ধানের শীষের মতো সবুজ একটি লম্বা ডগা খোঁপায় গোঁজা। মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে অনেকখানি, ডগায় গিয়ে বেঁকে গিয়েছে। অল্পেতেই তুলতুলিয়ে দোলে। ধানের শীষ নয়, ঘাস নয়, যেন কোনও এক ফুলের রেণু। যাদের বয়স বেশি, তারা গোঁজেনি। কিশোরী যুবতীরা বাদ যায়নি।
সব মিলিয়ে বকবকানি গান গাহনি যখন বেশ উচ্চ গ্রামে, তখন একটা ধমক বেজে ওঠে, ‘ওহে, ওহে, তোমরা একটু চুপ করবে হে, না কী! একেবারে কান ঝালাপালা করে দিলে যে, আঁ?’
এ সেই লোক, যে আমার মুখোমুখি ভিন্ন আসনে বসেছিল। অন্ডাল থেকেই আমি তার সহযাত্রী। চুল বড় বড়, গোঁফদাড়ি কামানো মুখখানি দেখে মনে হয়, এই রাঢ়ের রোদবৃষ্টির অনেক ঝাপটা খাওয়া। এখানকার মৃত্তিকার মতোই খানাখন্দ চড়াই-উৎরাই। রেখা তো নয়, গাঢ় নালা। এর থেকে বয়স বিচারে যেয়ো না। একটি চুলেও পাক ধরেনি। চোখ দু’টি বেশ কালোই, তবে কেমন যেন ধন্দ-ধরানো কালো। সন্দেহ লাগে, একটু কাজলের স্পর্শ আছে। কাপাসি মোটা কাপড়ের প্যান্ট তার পরনে। গায়ের জামার ওপরে খাকি রঙের একটা প্রকাণ্ড গরম কোট। সেটা যে ময়লা, বোঝা যায় এক এক জায়গায় তেলচিটে দাগ দেখে। তবে কোনও মিলিটারি মানুষ যে এটা পরেছিল তার কোনও হিসাব লেখাজোখা নেই। এ সম্পদ এ মানুষের জুটল কেমন করে, কে জানে। নিজে যে মিলিটারি নয়, বোঝা যায় অন্য পোশাক দেখে। তবে যুদ্ধ এমন অনেক দিয়ে গিয়েছে। পায়ে তার আজকাল যার নাম হাওয়াই চপ্পল। যেমন যেমন মিলেছে, তেমন তেমন পরা। গায়ের ধোকড়া কোটের সঙ্গে রবার চপ্পলের তুলনা দিলে চলবে না। পায়ে যখন শীত করে তখন তুমি কী বুঝবে। সেই জন্যেই শ্রীচরণের দশা একটু করুণ। ফাটার দাগে দাগে একটু রক্তের ছাপও যেন দেখা যায়।
যখন থেকে তাকে দেখেছি তখন থেকেই তার চোখের সামনে একটা বই খোলা। মলাটের ওপর নাম নেই। চটি বাঁধানো বই। সেদিকে সে একবারও চোখ তোলেনি। একবার তাকিয়ে দেখেনি। কেবল বিড়ির নেশাটা বড় নাছোড়। তাই মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বেলে ধরাতে দেখেছি। এমন গভীর মনোনিবেশ কম দেখা যায়। আর তাতেই বাধা। রাগ হয় কিনা, বলো। হলই বা সরকারি গাড়ি, একটা মানামানি আছে তো। আর সেইজন্যেই তো সাউকারি বলো, সহকারী বললো, তাই মানা। ওদিকে বলে, এদিকে ফিরে আওয়াজ দেয়, ‘দ্যাখেন তো। মশায় কাণ্ডটা।’
গলায় বেশ জোর, যে জোর শুনলে বলি বাজখাঁই। তার মধ্যেও কথার ঢং যেন একটু অন্যরকম। এলোপাথাড়ি হাঁক নয়, ওর মধ্যেই একটু সাজানো। সবাই একটু ঠেক খেয়ে যায়। বক্তার দিকে ফিরে তাকায়।
এক বুড়ো সাঁওতাল হেসে বলে, ‘ক্যানে, তুকে কী বলা হয়েছে।’
বক্তা বলে, ‘আমাকে কী বলবি। এত চেঁচামেচি করছিস ক্যানে।’
বুড়ো চুপ করে চেয়ে থাকে। বাকিরাও তাই। কেবল গায়ক যুবার দল থেকে একটা গলা শোনা যায়, ‘ল্যাখাপড়া করছে হে, বুঝছ না ক্যানে।’
দেখ, একটা তুলকালাম লাগে বুঝি। কিন্তু লাগে না। ওদিকে হাসাহাসি কথাবার্তা সমানেই চলে। একটু স্বর নামিয়ে, এই যা। অথচ এই অধমের হাল দেখ। পড়ো বক্তার সোজা নজর আমার দিকে। যেন চোরদায়ে আমি ধরা পড়েছি। অর্থাৎ নিঃশব্দে আমাকেই সাক্ষী মানে।
তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাতে যাই আর তখনই শুনতে পাই, ‘মুখ্খুদের কী বুঝাব, বলেন তো। আজ বাদে কাল আমার শমন ধরা, আমার কী বসে থাকবার সময় আছে।’
শমন ধরা! সে আবার কী। আপনা থেকেই চোখ বড় হয়ে ওঠে। বক্তা বইখানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘বইটা দেখছেন তো। বাংলার মসনদ। থেটার নয়, যাত্রার বই, আমার মশায় সিরাজের পাট, সব থেকে বড়। লোকো শেডের কাজ, চার্জম্যান তো ছুটিই দিতে চায় না। পথে যেতে যেতে মুখস্থ করতে হচ্ছে। এসব কে বুঝাবে এদের, বলেন।’
আমি ঢোক গিলে বলি, ‘তাই নাকি?’
সিরাজ ঝুঁকে বলে, ‘তবে আর বলছি কেন। বোলপুরে শান্তিনিকেতনের কথা জানেন তো?’
এবার থতমত। বাংলার মসনদের নায়ক সিরাজের সঙ্গে শান্তিনিকেতন কেন। একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলতে হয়, ‘জানি।’
‘সেখানে মেলা হয় জানেন?’
‘শুনেছি।’
‘আর কাল বাদ পরশু সেই মেলা। নয়ুই পোষ সেখানে আমাদের যাত্রা। তা সে কথা এদের কী বুঝাব বলেন তো।’
পৌষ মেলায় যাত্রা! এবার হঠাৎ লোকটাকে অনেক কাছাকাছি মনে হল। ছাতিমতলার উৎসবে যাত্রার নায়ক আমার সহযাত্রী। বাংলার মসনদের সিরাজ চলেছে সঙ্গে।
.
২৭.
দিকে দিকে না, দেহে দেহে মনে মনে রোমাঞ্চ জাগে। শুধু যাত্রার কথায় না, যাত্রার নায়ককে দেখে। মন কবুল করো। একদিন তো এই হতে চেয়েছিলে হে। ছেলেবেলায় যাত্রা দেখতে দেখতে নয় কেবল। দেখতে দেখতে, আসর চড়াও হয়ে, একদিন তো ঘরের টান ভুলেছিলে। নাম লিখিয়েছিলে খাতায়। আহ্, তখন সে কি গৌরব, এ ছেলে ‘যাত্তার দলের ছেলে।’ এ ছেলে প্রহ্লাদ সাজে, পীত বসনে মুরলীধর। পদে থাকতে চির নারাজ, আপদে থেকে সুখী। ইস্কুল পালানো, ঘর পালানো, যাত্রার দলে ঘুরে বেড়ানো। অথচ এমন বলতে পারবে না, ঘরের কোণে একটু স্নেহের কোল ছিল না। বলতে পারবে না, মুখের ভাত বেড়ে নিয়ে মায়ের উদ্বেগ দুই চক্ষে ঝরঝরিয়ে যায়নি। সারা রাত আঁধার ঘরে মায়ের দু’চোখের আকুল চাওয়ায় নিরুদ্দিষ্টের কত খোঁজ। কিন্তু অই, বলে কে! ব্যাখ্যা চাও পাবে না। তবে হ্যাঁ, তারপরে কাকে বলে পিঠের ওপর ডুগডুগি বাজানো, তাও কম জানা নেই। পিঠের ওপর ডুগডুগির তালই তো তারপরে যাত্রাদলের আসর ছাড়িয়েছিল।
তবু দেখ, স্বপ্ন এখনও চোখ ভরে। রোমাঞ্চ দেহে মনে। কী যেন এক রহস্যপুরী যাত্রার দল। সেখানে যত রহস্যমানবের ভিড়। এক বিচিত্র লোক। ছেলেবেলায় তার দরজা খোলা পেয়েছিলাম, ভিতরে ঢোকা হয়নি। সেই থেকে এক তৃষ্ণা ইহকালে গেল না। তখন স্বপ্ন ছিল, হাতে পায়ে বড় হয়ে আমিও একদিন রাজা হব, বাদশা বনব। এখন দেখ, স্বপ্ন মিথ্যা। রাজা উজির দুরস্ত। পকেটে কলম, কাঁধে ঝোলা। নবাব সিরাজদৌল্লা তোমার সমুখে বসে। একে লোকো শেডের চার্জম্যানের নিষ্ঠুরতা। তিনি ছুটি দিতে চাননি। তায় আবার কানের কাছে ব্যাজর ব্যাজর। এতে কি পাঠ মুখস্থ হয়। সত্যিই তো, কী বুঝাবে এই যাত্রীদের। কিন্তু লোকো শেডের চাকরিটা কীসের। একবার জিজ্ঞেস করে তৃপ্ত হতে চাই। ‘কী কাজ করেন!’
জবাব আসে, ‘কিলিনার।’
খুব কিলিন জবাব, বলতে পারো। কিন্তু কথা তো সেখানে নয়। কথা হল বাংলার মসনদ, তাতে সিরাজদৌল্লার ভূমিকা। অতএব, কিলিনার কি ফায়ারম্যান, ওসব কথা ছাড়ো। আসল কথা শোনো, ‘একে তো, পালা হবে কি হবে না, তারই ঠিক ছিল না। সবই তো পরের হাতে, বুঝছেন না? মানে, মেলার কত্তাদের কথা বলছি।’
ছাতিমতলার মেলায় নানান রঙ্গ, সে কথা আগেই শুনেছি। কিন্তু সেখানে যে যাত্রাগানও হয়, এ খবর জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করি, ‘মেলাতে যাত্রাও হয়?’
সিরাজের হাবভাব বেশ ভার-ভারিক্কি। রুক্ষু চুলের গোছা কান ঢেকে লম্বা জুলপির কাছে এগিয়ে এসেছিল। মাথা ঝাঁকুনির ঝটকা দিয়ে চুল সরিয়ে বলে, ‘বন্ধই হয়ে গেছিল। আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। সে দেখেছি স্সার আমরা ছেলেবেলায়, কত বড় বড় কোম্পানি, সে কি বাঘা অ্যাকটর! আর অ্যাকটিনের কথাই বা কী বলব, বাব্বা!’
বলতে একেবারে চোখ উলটে যায়। স্মৃতির ঝলকে বেদরম তরর্র। তার ওপরে নাও, এক চোটে অনেক পেয়েছ। আগে ছিল ‘মশায়’, এখন পেলে ‘স্সার’, যার মানে স্যার। তারপরে কোম্পানি, অ্যাকটর, অ্যাকটিন। তবে যদি নজর ঠিক রেখে থাকো, দেখেছ, সিরাজবাবুরও গলার স্বরে সুর বাচনভঙ্গিতে একটু অ্যাকটিন অ্যাকটিন ভাব। আর, সে তো হতেই হবে গ। এমন কথা আর কী। তারপরেও শুনে যাও, বিষাদ কাকে বলে। তুমি উপলক্ষ, দেখ সিরাজের কোল-বসা চোখের নজর জানালা দিয়ে দূরে উদাস। বলে, ‘সেসব কোম্পানিও নাই, সেরকম অ্যাকটিনও আর কেউ দেখবে না। হেঁজিপেজি না, বামুনের ঘরের লেখাপড়া জানা, তাবড় তাবড় লোকেরা অ্যাকটিন করত।’…
তারপরে হঠাৎ নজর ফিরিয়ে হাসে। বলে, ‘সেরকম বাজনাই এখন পাবেন না। তখন নল ভেঁপুতে যেরকম ফুঁ দিত, দশটা গাঁয়ের লোকে শুনতে পেত, প্যাঁ-পোঁর—প্যাঁ-পোঁর— প্যাঁ-পোঁর—প্যাঁ।…এখন ওরকম দিতে গেলে বাই জম্মে যাবে। আর ফুলুটের কী রব ছিল, বাপস্। মনে হত বাঁশিয়ালার বুকে কুড়িটা হাপর আছে।’
অবাক হচ্ছ কি না বলো৷ একেবারে্ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছ তো। সিরাজ যে সেইরূপে ভাষে। অবাক খবর দিয়ে একটু ঠোঁট টিপে হাসে। মুখের দিকে চেয়ে মাথা দোলায়। একটু ঘাঁটিয়ে দেখ, অজানা বৃত্তান্তের হাঁড়ি খুলে দেবে।
আমার যে তার চেয়ে বেশি। অবাক, মন্ত্রমুগ্ধ, যা বলো সব ছাপিয়ে সিরাজ যে সেই ছেলেবেলাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেইসব ঘুম-পাড়ানো উত্তেজনা-ভরা রাতগুলোতে। ফুলুট বাঁশির সেই রব আর বাজে কোথায়। রাজা কাঁদে, রানি কাঁদে, আর কাঁদে ফুলুটের সুর। কোথায় বা সেই পাখোয়াজের রণদামামা, ঝাঁঝরের ঝমঝম, ‘ওরে নরাধম, আয় তবে দেখি, মুণ্ডুচ্ছেদ করে তোরে দিব উচিত শিক্ষা!’ তেমন বাজনদার আর অভিনেতা এখন আছে কিনা জানি না। তবে, সেই নজর আর কোথায় পাব। সেই শ্রবণ বা কোথায়।… তবে, তোমাকে আওয়াজ দিতে হবে না। তার আগেই সিরাজ হাত ঘুরিয়ে দেয়। বলে, ‘এখন হয়েছে সব আড়ালে আবডালে। তিনদিক ঢাকা, যেন ঘরে বসে পালা হচ্ছে। পাঠ মুখস্থ করার দরকার নাই, পর্দার আড়াল থেকে সব বলে বলে দেবে। ইশারা করে দেখিয়ে দেবে। বাজনা বাজে, তাও মিনমিন করে। খালি থেটার আর থেটার। ওতে কী হয়। যাত্রাপালায় ক্ষ্যামতা চাই, কী বলেন, আঁ?’
ঘাড় নাড়তে গিয়ে ঠেক। দাঁড়াও, অন্যদিক থেকে আওয়াজ এসেছে, ‘সে কথা ঠিক বটে।’ আমার সঙ্গে সিরাজও ফিরে তাকায়। সেই বুড়ো, আমার পাশের লোক। আকাটা গোঁফদাড়িতে ভাঁজ খেলেছে হাসিতে। বলে, ‘থেটার-টেটার খালি দ্যাখন বাহার, উ কি আর আমাদিগের ভাল লাগে বাপু। আসর হবে দশজনের মাঝখানে, তবে না!’
এ যেন দরবারে জঙ্ বাহাদুর খান বাহাদুর থাকতেও ছোট উজিরের গায়েপড়া বাত। সিরাজের ঠোঁট বেঁকে যায় হাসিতে। যেন করুণা করে বৃদ্ধকে, কিন্তু আমল দিতে পারবে না। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘সেই কথাই—।’
দাঁড়ান জাঁহাপনা, উজিরকে অতটা হাতঝাড়া দেবেন না। বুড়ো বলে ওঠে, ‘আমাদিগের রামপুরহাটের রেলের টিকেটবাবু লোচন রায়, দুটো বাজনা বাজাত, নিজের চকে দেখ্যাছি। অই যাত্তার আসরে বসেই একবার ফুলুট, একবার বেয়ালা। হাত থেকে ফুলুট নামে ত বেয়ালা ওঠে, বেয়ালা নামে ত ফুলুট ওঠে। অ মশায়, ঘাম মুছবার সোময় ছিল না গ। শিষ্যি-সাগ্রেদরা গামছা লিয়ে কাছে বসে থাকত, ঘাম মুছে দিত। কী বুলব, শুনবার মতন বাজনা বটে।’ এবার কী বলবে সিরাজ! বুড়ো তো সটান মানুষ। অনেকক্ষণ ধরে হাঁ করে কথা গিলেছে। গিলতে গিলতে পেট ফুলেছে। এখন তুমি চাও বা না চাও, উগরে দেবার পাত্র চাই। তারও তো স্মৃতিমন্থন। কিন্তু সিরাজের যেন একটু লড়াই লড়াই ভাব। ঠোঁট-বাঁকানো বিরাগের হাসিটা দেখ, নবাব সাহেব যেন বাতুলের প্রলাপ শুনছেন। খাঁটি দেশি বোলে বলে, ‘বাজনদার তো আর কুস্তিগীর লয় হে। লোচন রায়ের বাজনা অনেক শুনেছি। বাজায় বটে, তবে মন মজে না।’
লোচন রায়ের বুড়ো ভক্তের লড়াইয়ে মন নেই। তোমরা বলছ, মনে পড়ে গেল। চুপ করে থাকা যায় না। হাত উলটে বলে, ‘তা কী জানি, আমাদিগের ত মন মজত বাপু। তা’ পরে সি গোলায়ালা কিষ্ট চৌধুরি, তার পালাও শুনেছি। যেমন গলা, তেমন চেহারাখানি। রামেও যেমন, রাবণেও তেমন।’
সিরাজ একখানি হাসি দিলে, চমৎকার। আসরে হলে হাততালি না দিয়ে কোথায় যেতে। যেন ঘসেটির অভিশাপের মুখে দাঁড়িয়ে সিরাজদৌল্লা হাসে। বলে, ‘আরে, বল না ক্যানে হে, রামপুরহাটের কিষ্টদাকে কি তুমি চিনাবে। একসঙ্গে অনেকবার দু’জনে এক আসরে নেমেছি।’ বুড়ো বলে, ‘তবে আর বুলব কী, তুমার ত জানাই আছে।’
সিরাজ বলে, ‘কিষ্টদার সব ভাল, তবে মোশন নাই। লড়তে-চড়তেই সময় চলে যায়। তবে হ্যাঁ, বয়সকালে ভালই ছিল।’
বুড়োর সেই এক কথা। বলে, ‘তা কী জানি। এই তো সেদিনে করলে ছিন্নমস্তা।’ কিষ্ট চৌধুরি শিব সেজ্যাছিল। দেখবার মতো হয়েছিল বটে।’
বুড়োর কথা যেন সিরাজের কানে যায় না। গায়ে গতরে লাগে না। নবাব সাহেব একবার আমার দিকে চেয়ে তেমনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। আড়চোখে দেখে বুড়োকে। আমার কথা তো ব্যাজ, রামপুরহাটের টিকেটবাবুর বাজনা শুনিনি কখনও। কিষ্ট চৌধুরির পালাও দেখিনি। তবে কথা শুনে একটা ছবি ভাসে। সেই ছবিতে যেন মনে হয়, লোচন রায়কেও চিনি, কিষ্ট চৌধুরিকেও চিনি। বিলাতি জিনিস তো না, খাঁটি দেশি জিনিস। একের কিছু রকমফের, বাহান্ন-তেপ্পান্ন গোছের। পদ্মার ওপারে যা দেখেছি ছেলেবেলায়, অজয়ের এপারে তার চেয়ে আর কত তফাত হবে।
সিরাজের হাবেভাবে বুড়োর ভাবে-বচনে ঝিম্ খায়। সে একবার অ্যাকটরের আপাদমস্তকে চোখ বুলায়। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ভাবি, সিরাজও এবার পাঠ মুখস্থ নিয়ে বসবে। না, সে আগের কথার খেই ধরে, ‘সেই কথাই বলছি, এদের কী বুঝাব বলেন। সেই দু’বছর আগে করেছি, কিছু কি মনে থাকে! মহড়া নাই, কিছু নাই, তাই ভাবলাম, যতটা পারা যায়, দেখে নিই। গিয়ে তো নাওয়া-খাওয়ার সময় পাব না।’
তা বটে। নিশ্ৰুপে ঘাড় নেড়ে সায় জানাই। তবে কিনা, ছাতিমতলার পৌষমেলার যাত্রা, এ সিরাজ কোন কোম্পানির, তা একটু জানতে ইচ্ছা হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘আপনাদের কোথাকার দল?’
সিরাজের মুখে একটু বিষাদের হাসি ফোটে। বলে, ‘আমাদের বোলপুরেরই দল। এখন আর নাম-ধাম কিছুই নাই। তবে হ্যাঁ, একসময়ে ছিল। বুঝেন ত, যা দিনকাল, তাতে আর যাত্রা গানে চলে না। অই যদ্দিন বে-থা না করা যায়, ছেলেপিলে না হয়, তদ্দিন চলে।’
বিষাদের কারণ আছে বটে। শিল্পীর জীবনধারণের তাগিদ। কোথায় লোকের মনোহরণ করবে, না রেলের লোকো শেডের এঞ্জিনের জাম ছাড়াতে হচ্ছে। ভাত বড় ব্যাজ, কোনও জাত রাখে না। তবু বলে, ‘তবে অই, ডাক পেলে আর থাকতে পারি না। একবার শুনলেই হল, ঠিক ছুটে আসব।’
নামের মহিমা, শুনলেই অস্থির। কিন্তু খুঁটিনাটি আরও আছে, শুনে নাও। সিরাজ আবার বলে, ‘নিজেরা খরচ-খরচা করে তো করতে পারি না। কেউ একটু ডাকলে-টাকলে —তা এবার আমাদের কপাল পুড়েছে, মেলাতে ডাক পড়েছে।’
ঘাড় নেড়ে বলি, ‘বোলপুরেই থাকেন বুঝি?’
‘অনেককাল। বাপ ঠাকুদ্দারও আগের আমল থেকে।’
সব কথাতেই একটু ভার-ভারিক্কি ভাব। কোনও কিছুতেই অল্পস্বল্প একটু-আধটু না। গায়ের সেই আলখাল্লার মতো মুনকে ওজনের কোটে একটু ঝাড়া দিয়ে বলে, ‘আমার বাপ্ আবার ওখানেই কাজ করত কি না, মানে শান্তিনিকেতনে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
বলে কী, হঠাৎ যেন লোকটার মূল্য বেড়ে যায় অনেক। সম্মাননীয় মনে হয়। শান্তিনিকেতন একটা নামমাত্র নয়, আরও কিছু। সেখানে কাজ করেছে, এমন একটা যোগসূত্রও যেন সকৌতুক গাম্ভীর্য এনে দেয়। হতে পারে, মনের এক সংস্কার। তবু মরমিয়ার থানের মানুষ, তাকে দেখার নজরে যেন একটু ভিন্ন রঙের ছোঁয়া লাগে। যা চোখে দেখিনি, অথচ বাঁশি শুনেছি। তাতে এক কল্পনা বিস্ময় জড়াজড়ি করে জমাট বেঁধে আছে মনের গহিনে। সেখানেই যেন একটা দোলা লেগে যায়। লোকটাকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
কাজের রকম পুছ করতে হয় না, বোলপুরবাসী নিজেই বলে, ‘অই আপনার ঘরদুয়ারে ঘরামির কাজ করত, মাঠের কাজ করত, বারো মাসের লোক ছিল। সেই আপনার কত্তা ঠাকুরের আমলে।’
কত্তাঠাকুর কে। ঠিক যেন ধরতে পারি না। পুছ-নজরে তাকাই। সিরাজ নিজেই বলে, ‘মানে অই রবিঠাকুর।’
কানে যেন খচ্ করে লাগে। বহুদিনের, বহুবারের শোনা একটা নাম এই লোকের মুখে যেন বেসুরে বাজে। দেখ, শ্রবণের কী বিড়ম্বনা। একে সংস্কার বলতে পারো। এই লোকের মুখে যেন এ নাম মানায় না। কত্তাঠাকুর বেশ শোনায়। অথচ, সেই ছবিটা মনে করে নিজে যে কত্তাঠাকুর উচ্চারণ করব, ভাবতেও পারি না। তোমরা দূরের মানুষ, রবিঠাকুর বলো, তাতেই ভাল। কাছের মানুষের অমন দূর-সম্ভাষণ মানায় না। এবার কৌতূহলীর নাড়িতে টান, না জিজ্ঞেস করে পারি না, ‘তাঁকে দেখেছেন কখনও!’
ঘাড় কাত করে তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘কতবার!’
এ লোকের কাছে একটু-আধটুর কারবার নেই। দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই এই জবাব। লোকো শেডের কিলিনারের চোখের দিকে তাকাই। ওই চোখে কি সেই ছবিটা আঁকা আছে। রক্ত-মাংসের সেই মানুষটা, সেই মরমির ছবি। লোকটার প্রতি ঈর্ষা আসে না। কেবল ভাবি, এ লোকটাও সেই জীবন্ত মূর্তি দেখেছে। বই লেখে না, কেতাব লেখে না, সভা-সমিতিতে বচন দেয় না। লোকো শেডে কাজ করে, যাত্রাপালায় অভিনয় করে। অথচ আমি দেখতে পাইনি।
তারপরেও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, লোকটা কোনওদিন কথাও বলেছে নাকি ওঁর সঙ্গে। নিজেই বলে, ‘আমরা তো উদিকটায় বেশি যেতাম না, ছেলেবেলায় ভয়ও করত। তবে অই মেলার দিনে, পথ চলতে ইস্টিশনে। কাছেপিঠে থাকলে যেমন দেখা যায়।’
লোকটার যেন ধেয়ান নেই, কার কথা বলছে। তাতেই তার খাঁটি চালের খোঁজ ধরা পড়ে। ছেলেবেলায় সে রবিঠাকুরকে দেখেনি, তার বাবার কত্তাঠাকুরকে দেখেছে। কথার সুরের ব্যঞ্জনায় তাই গদগদ ভাব নেই। যেমন দেখা, তেমনি বলা।
এবার বাতপুছের পালা বদল। সিরাজ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
‘বোলপুরে।’
‘বোলপুরে? বোলপুরে থাকেন নাকি?’
সিরাজের চোখে ভ্রূকুটি, ধন্দ। তাড়াতাড়ি বলি, ‘না।’
সে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘তাই তো বলি, তা হলে তো চিনতে পারতাম। শান্তিনিকেতনে কাজ করেন বুঝি?’
‘না। মেলা দেখতে যাচ্ছি।’
সিরাজ এবার আর-একটু নড়েচড়ে বসে। বলে, ‘অ, তাই বলেন।’
বলতে বলতেই সিরাজের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। জিজ্ঞেস করে, ‘আগে এসেছেন কখনও?’
‘না।’
‘কোথা থাকবেন, তার ব্যবস্থা আছে তো?’
খবর ছিল আগেই, মেলা বড় ভারী। তিলধারণের ঠাঁইয়ের জোগাড় আগে না দেখলে গাছতলাতে ঠাঁই নিতে হবে। রাঢ়ের এই পৌষের ব্যাঘ্র থাবার বড় ধার। মনের গরম যতই থাক, দেহের গরমে অতটা লড়াই চলবে না। তাই ব্যবস্থা একটা আগে থেকেই করা আছে। টিকে থাকলে সেই ব্যবস্থাই আছে। অন্যথায়, শুধু তেপান্তরের একলা যাত্রী তো না হে। দশের সঙ্গে একটা দশা হবেই। বলি, ‘একটা ব্যবস্থা তো আছে।’
সিরাজ বলে, ‘দেখবেন স্সার, না হলে বড় বিপাক। আজকাল যা ভিড় হতে লেগেছে, আমাদের জম্মে দেখি নাই।’
সর্বনাশ, জন্মকালের ভয় দেখায় যে। একটু খোঁজ না নিয়ে পারি না। জিজ্ঞেস করি, ‘খুব ভিড় হয়?’
সিরাজের চোখে যেন ইংরাজের কামানের গোলা। মুখের খানাখন্দ কুঁকড়ে বলে, ‘আরে বাস্! বোলপুরের বাজারের দর চড়ে যায়। কত লোক যে আসে, লেখাজোখা নাই। দেখবেন, মেয়েমানুষ, যে যেখানে পেরেছে, সেখানেই আস্তানা নিয়েছে।’
ভিড়ের কথা শুনে যে ভয় পাই না, তা নয়। তবু, সেই আবার ভরসা। মানুষ পাওয়া যাবে অন্তত। কেবল কি আর ছাতিমতলায় যাই। ছাতিমতলায় যারা যাবে, তাদেরও কি দেখব না একটু। তা নইলে আর মেলায় কেন। বে-দিনের নিরিবিলিতে এলেই হত। বঙ্গদেশের রূপের রঙ্গও তো সেথায় বটে। আর ভিড়ের কথা যদি বলো, প্রয়াগের কুম্ভমেলার থেকে বেশি নয় তো। অতএব মাভৈঃ বলো, পৌষের ডাকে চলো।
সাঁইথিয়া এল।এবার গাড়ি বদলের পালা। সিরাজ আমার সঙ্গ ছাড়েনি। বরং আমার বড় ঝোলাটার এক পাশ ধরে বলেছে, ‘দু’জনেই নিয়ে যেতে পারব, চলুন।’
গাড়িতে তেমন ভিড়ের বাড়াবাড়ি ছিল না। সিরাজ আমার পাশে বসে পুছ করে, ‘আপনি এলেন কোত্থেকে।’
বলি, ‘বেড়াতে বেড়াতে, সাঁওতাল পরগনার দিক থেকে।’
‘তাই বলেন। বোলপুরে যেয়ে দেখবেন, কলকাতার দিক থেকে কীরকম লোক আসছে।’
তারপরে সিরাজের মুখে একটু হাসি দেখা যায়। নজর করলে, হাসি যেন একটু লাজে লাজানো। বলে, ‘যাক, মেলাতেই যাচ্ছেন যখন, নয়ুই পোষ আমাদের পালাটাও দেখবেন স্সার।’
‘নিশ্চয়ই দেখব।’
মনে মনে ভাবি, কতদিন যাত্রা দেখা হয়নি। তাও আবার শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়। এর স্বাদ কেমন লাগবে, কে জানে।
সিরাজের মুখে হাসি। বলে, ‘তবে আপনাকে তো বললাম, রিস্যেল মহড়া কিছু নাই, পাঠ মুখস্থ নাই, অই হবে একটা রকম আর কি। ক্ষমা-ঘেন্না করে দেখবেন।’
তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না, তা কেন। যাত্রা দেখতে আমার ভাল লাগে।’
‘তাই নাকি? আচ্ছা!’ বেশ একটা অন্তরঙ্গ দরাজ হাসি দেয় সিরাজ। বলে, ‘তা হলে আপনাকে আমিই নেমন্তন্ন করছি। বলা রইল, এসে আমার খোঁজ করবেন। গিরিনরুমে যেয়ে বলবেন, অতুলদাসকে ডেকে দাও। তা হলেই হবে। আমি আপনাকে বাজনদারদের সঙ্গে বসিয়ে দেব।’
অতুলনীয় অতুলদাস। তবু একটু যেচে মান দিতে চেয়েছে। আর, যাত্রা দেখতে যারা যায় না, তারা কোনওদিন জানবে না, আসরের একেবারে সামনের সারিতে বাজনদারদের কাছে বসে দেখার রোমাঞ্চ কী। নেহাত ছেলেবেলাটা নেই। নইলে এ সংবাদে সুখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। এই বয়সেও তার ইশারা যেন পাই। বলি, ‘যাব।’
অতুলদাসের মুখে হাসির ঝলক, মুখের খানাখন্দ গভীর করে তোলে। বলে, ‘তবে অই কথা, খুশি করতে পারব না, চেষ্টা করব।’
বলে, জোরে নিশ্বাস ফেলে উদাস গলায় আক্ষেপ করে, ‘চেষ্টাই বা কী করব। আগের সেদিন নেই, আর পারিও না। তবু জানেন, বাংলার মসনদে এই সিরাজ করে দু’বছর আগেও মেডেল পেয়েছি।’
‘তাই নাকি।’
‘হ্যাঁ। কী বলব, পেত্যেক বছরে জোর কমে যাচ্ছে গলার। একটা হাঁক যে দেব, কী খেয়ে দেব বলেন। অ্যাকটিনের আসল জিনিস হচ্ছে দম। দম থাকবে কোত্থেকে বলেন। যা আক্কারার বাজার। আপনাকে বলেই বলছি, ছেলেপিলে নিয়ে পেট ভরে খাওয়াই জোটে না।’
কেবল আমাকে কেন, সবাইকে বলা যায়। লোকো শেডের কিলিনার তবু জীবন একরকম কাটায়। কিন্তু এখানে শিল্পী কথা বলে। তার বুকে দম নেই, গলায় স্বর ফোটে না। কেমন যেন সংকোচে কুঁচকে যাই একটু। অতুলদাস অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে শেষবেলার মাঠের দিকে তাকায়।
.
২৮.
ইচ্ছা করে, পুছ করি, সংসারের ওজন কত। কত ভার বহন করে শিল্পী অতুলদাস। কিন্তু তার কী প্রয়োজন হে। দুনিয়ায় যে দানা খুঁটে খায়, তার নজর দুনিয়া-জোড়া। নিজের আঁতে ভাবো না কেন। পুছ করলেই কি সব জানা যায়, ‘ওহে, তোমার পুষ্যি কত!’ মনে মনে দেখ, কিলিনারের মাসান্তের মুদ্রার মুখ চেয়ে কত পুষ্যি আছে। ধুলা-রুক্ষু, ল্যাংটা আধল্যাংটা, আধপেট খাওয়া ছেলেমেয়েদের ছবি কি দেখতে পাও না। যারা তবু হাসে, কনুই দিয়ে সিক্নি মোছে, ধুলা খেলে অপরাজিত। পলে পলে মরণ ঝাড়ে মন্ত্র, শুষে নিতে চায়। জীবন হেসে-খেলে আগলে রাখে, প্রাণের তেজে ডগডগায়।
তাকিয়ে দেখ অতুলদাসের দিকে। নজর যার দূরের মাঠে, কথা না বলে চুপ করে থাকে। তার চোখের চাওয়ায় দেখতে পাবে, স্নেহে উদ্বেগে টলটলায়। যাদের নিয়ে তার পেট ভরে খাওয়াই জোটে না, তাদের মুখগুলো যেন দুলদুলিয়ে ভাসে। দেখ, ওই দূরে আর একখানি মুখ, যার সঙ্গে তার ঘর-করনা মিলন-গড়ন, যার ঘোমটা খসা মুখখানি হাসিতে ভরা, চোখ দু’খানি ঝাপসা ঝরা, সেই ঘরনি। তবু দেখ শিল্পী হার না মানে। কিলিনার তবু ভাঙাচোরা মুখখানি কামিয়ে, চোখের ফাঁদে কাজলের সূক্ষ্ম প্রলেপ দিয়েছে। দানার ভাবনা পিছনে রেখে, শিল্পী এখন আসরে চলেছে। কিলিনার কেবল পেটে বাঁচে। শিল্পী বাঁচে অধরায়। তার ধরা-ছোঁয়া অনেক দূরে, যখন ভাববে, ‘এই মানুষে সেই মানুষ আছে।’…
না, তাকে ডাক দেব না। সে যাক তার আপন ভাবে। আমিও চোখ ফিরিয়ে চাই বেলাশেষের মাঠে। যেখানে লাল মাটিতে লাল লেগেছে রাঙা আকাশের আলোয়। লাল লেগেছে ধানকাটা মাঠে মাঠে, কাছে দূরের গাছে গাছে। ভূমির উঁচুতে নিচুতে, ধাপে ধাপে ছায়া, যে ছায়ার রং ধূসর নয়। কালো নয়, লালের ওপর যেন বেগুনি ছাপ পড়েছে। গাছগুলো অনেক চেনা অচেনা, দুইয়ে মিলে মাখামাখি ভাব। তার মধ্যে দেখ, তালপাতার ধারালো ধারে লাল কেমন শানানো, যেন অসি ঝকঝকায়। এমনকী, ছোট ছোট ছেউটি বাবলার বনেও লালের আভা। শীতের এই রাঙা আকাশের আলো যখন এমনি মাখামাখি, তখন মনে হয়, চক্ষে জল নেই, তবু যেন কোথায় একটা কাঁদন লেগেছে। এমনকী, একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়তে চায় না। আর মন যেন চলে যেতে চায় কোন দূরে!
রাঢ়ভুমির এই লাল বিকেল আজ নতুন দেখা না। প্রথম দেখেছি, কয়েক বছর আগে। আজ চলেছি, ছাতিমতলার ধ্যানের আসন লক্ষ করে। এখনও তার রং রূপ কিছুই জানা নেই। কিন্তু নানান ভাবে একটা ধারণা হয়েছে। আর সেই যে প্রথম দেখা, তার রং রূপ সবই আলাদা। কেতাবিতে সেই যে বলে, প্রথম দর্শনের প্রেম, সে দেখা সেইরকম। সে দেখার সঙ্গে রক্তে একটা তোলপাড়ের দোল-দোলানো তরঙ্গ। রাঢ়ের সে রূপে ছিল এক মত্ত মাতনের ঝঞ্ঝা। সেখানেও লাল বিকাল দেখেছিলাম। কেবল রাঙা আকাশের আলোর লাল নয়। রক্ত নিয়ে হোলি খেলার লাল। ছাতিমতলার সঙ্গে যার কোথাও মিল নেই। সেখানে ধ্যানের মৌন গাম্ভীর্য ছিল না। ছিল নাচের ছন্দে মানবলীলার অকপট শিশুর খেলা। সেথায় নরের কোলে নারী ছিল অনাবরণ ঐশ্বর্যে, আদিম খেলার মাতনে। রক্তে রমণে ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখের কোলে হাত দিতে চেয়েছি। কিন্তু তাই কি কখনও হয়! রূপ দেখবে বলে বেরিয়েছিলে। সব কি তোমার মনের মতন হবে! যেমন রূপ তেমনি দেখা।
সে যাত্রা এ পথে ছিল না। যে সাঁইথিয়া পেরিয়ে এলাম, রাজধানী থেকে, সোজা সেই পথে যাত্রা ছিল। বোলপুর নামে এক ইস্টিশন তখন দেখেছিলাম, গভীর রাত্রের নিরিবিলিতে। তখন একবার ছাতিমতলার কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু যাত্রা ছিল অন্যত্র। ইস্টিশনের শেষ ছিল সেখানে, যেখানে একটু আগে শোনা, ফুলুট আর বেয়ালা বাজিয়ে লোচনবাবু ছিলেন টিকেটবাবু, সেই রামপুরহাটে। তখন আমার কাছে যতটুকু বোলপুর, ততটুকুই রামপুরহাট। শেষ রাত্রের প্রায় অন্ধকারে গিয়ে নেমেছিলাম। ইস্টিশন তখন ঘুম জড়ানো। গাড়ির আওয়াজে একবার উঠে বসে আবার পাশ ফিরে শোবার মতন। এখন নাকি সেখানে অনেক আলো, অনেক ঝলক। তখন তত নয়। যাদের সঙ্গী ছিলাম, সহযাত্রীরা রাজপরিবারের লোক। এখন রাজা শুনলেই যদি চোগাচাপকান অসি দেখ, তবে নাচার। আবার যিনি রাজপুরুষের বংশধর, তাঁর গায়ে একখানি মোটা হাফশার্ট, মোটা কাপড় পায়ের কব্জি ছাড়িয়ে নামেনি। হাতের কব্জিতে একখানি যেমন-তেমন ঘড়ি, মোটেই রাজরাজসিক নয়। পায়ে ফিতে বাঁধা ধ্যাবড়ামুখো কালো জুতা। সারা রাত কচকচিয়ে পান চিবনোর দাগ কেবল ঠোঁটে কষে দাঁতে ছিল না, ছিটাফোঁটা জামাতেও ছিল।
তবে হ্যাঁ, চেহারার কথা যদি বলো, যাকে বলে চোখ ঝলসানো গোরা, সে রাজপুত্রের তাই ছিল। সে রঙের নাম গোরা না, আগুন বলা যায়। চোখের তারায়, মাথার চুলে কালোর ঝিলিক কম। চোখের তারায় আশমানি নীল ঝলক, চুলের রাঙা ছাপ। বুকের ছাতি মাপতে চাইলে, দু’হাতে বেড় পাওয়া দায় ছিল। পরিচয়ে রায়মশাই। পেশায় সেই লোচনবাবু, ইনিও একজন টিকেটবাবু ছিলেন রেলের অন্য সীমানার। তা বলে, রাজপরিচয় মিথ্যা না। এবার সেই রাজ্যে যাত্রা, যার নাম মলুটি। ইনি সেই রাজ্যের রাজাদের ছয় তরফের, বড় তরফের বড় কর্তা। সঙ্গে গৃহিণী। দিনকাল থাকলে, বড় তরফের বড় রানি বলতে হত। তখন প্রবাসে রেল কলোনিবাসিনী, টিকেট কালেক্টরের গিন্নি। তাঁকে ঘিরে কয়েক জোড়া ছেলেমেয়ে, যাদের চোখে তখন শেষ রাতের ঘুম। রাঢ়ে প্রথম যাত্রায়, তাঁরাই আমার সহযাত্রী।
কার্তিকের শেষরাত, একটু শীত-শীত ভাব। সবাই মিলে ইস্টিশনের বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখেছিলাম, দুটো কালো কুচকুচে মনুষ্যপ্রাণী কোত্থেকে ছুটে এসে একেবারে রায় মশাইয়ের পায়ে পড়েছিল। রায়মশাইয়ের আগুন রাঙা মুখে রাঙা হাসি ফুটেছিল। খাঁটি মলুটির ভাষায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কে রে, সানা বটে?’
একজন জবাব দিয়েছিল, ‘হঁয় গ, কত্তা।’
‘উটি কে বটে, চিনতে লারছি?’
তখন উটি জবাব দিয়েছিল, ‘অ্যাই দ্যাখ গ, বড় কত্তা আমাকে চিনতে লারছে। আমি তো লারান।’
লারান! অর্থাৎ নারায়ণ। সেই প্রথম উঁচু রাঢ়ের বুলি শোনা। শ্রবণ যত অবাক উৎকর্ণ, আমার চোখের ফাঁদ তত বড়। সানা নাম এর আগে কখনও শুনিনি। লারান তবু শোনা শোনা। দুজনেই তখন গিন্নিকে প্রণামে ব্যস্ত। রাজা তখন বলছিলেন, ‘অ, তু আমাদিগের গদাইয়ের ব্যাটা?’ লারান যেন এমন হাসির কথা কভু শোনেনি। খ্যালখ্যাল করে হেসে বলেছিল, ‘তবে না ত কী গ।’ সানা আর লারান, তার মধ্যেই অপরিচিতকে দেখে নিচ্ছিল। ওদের চোখের রং যে কী ছিল, বুঝতে পারিনি। হলদে মনে হয়েছিল। আর অমন কালো, ডগমগিয়ে বলতে পারব না, কালো তা সে যতই কালো হোক, কালো হরিণ চোখ তো দেখিনি। মনে হয়েছিল, দু’হাত সরে গেলে, সেই শেষ রাত্রের আঁধারে আর চোখে দেখতে পাব না।
বড় কর্তা তখন বলেছিলেন, ‘চিনতে লারলে আর দোষ কী বল্। বছরে একবার করে আসা, সব ভুলে যাচ্ছি আস্তে আস্তে।’
সানা বলে উঠেছিল, ‘তা ক্যানে হবেক নাই। কালে ভদ্দে আসা। নেহাত কী যে, মা কালীর টানে তবু একটা বাঁধন।’
বড় কর্তা হেসে বলেছিলেন, ‘তা যা বুল্যেছিস। গাড়ি ক’খানা এনেছিস!’
সানা-ই জবাব দিয়েছিল, ‘ক্যানে, দু’খানা। চিঠিতে তাই লিখ্যাছিলেন যে।’
‘হঁ হঁ, অই তাই জিগেসাঁ করছি।’
লারান ছেলেমানুষ যুবা। সে বেশি কথা বলেনি, খালি হাসছিল। সানা আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ই বাবুটো কে বড় কত্তা, চিনতে লারছি?’
বড় কত্তা বলেছিলেন, ‘বেড়াতে এসেছে, আমাদিগের কালীপূজা দেখবে।’
আমি তখন রাজা-প্রজার কথা শুনছিলাম। রাজা-প্রজার অমন ভাব ভাষা আগে কখনও দেখা জানা ছিল না। এমনি দু-চার কথার পর, সবাই গাছতলাতে গাড়ির কাছে গিয়েছিলাম। সে গাড়ির নাম গো-শকট। বলদগুলো আলাদা বাঁধা ছিল। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে, গাড়িতে বলদ যুতে অন্ধকারে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এক গাড়িতে কয়েকটি শিশুকে নিয়ে গৃহিণী। আর এক গাড়িতে, আমি আর বড় কত্তা। তাঁর কোলে একটি ঘুমন্ত শিশু। দুই চাকা গাড়ি। সামনে পিছনে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একেবারে পিছন দিকে বসেছিলাম, তাই আকাশটা তবু চোখের ওপর ছিল। শুকতারাটা চিনতে পারিনি। কিন্তু নাম-না-জানা সেই তারাটা দেখেছিলাম, যেটা অনেক নীচে, চরকির মতো পাক খেয়ে ঘোরে। আর ঝিলিক দিয়ে দিয়ে ওঠে লাল হলুদ নীল রঙে। তাকে দেখে, বুঝতে পেরেছিলাম, যাত্রা পশ্চিমে।
মাঝে মাঝে দেখেছিলাম, চোখের সামনে পাহাড়ের মতো উঁচু কালো রেখা। গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে সেইখানে উঠছিল। আবার নীচে গড়িয়ে নামছিল। কখনও কখনও, দূর অন্ধকারে, আকাশের তারার গায়ে ঠেকানো খোলা জায়গায় কী যেন অস্পষ্ট হয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। আন্দাজ করেছিলাম, ধানের খেত। আর চিনতে পেরেছিলাম তারা-ছিটানো আকাশতলায় তাল গাছের সারি। কখনও কখনও জলের শব্দ। গরুর পা আর গাড়ির চাকায় ছপ্ ছপ্ চলকে যাওয়া। সেই সঙ্গে বিশেষ করে সানার গলায়, বলদ শাসনের ভাষা, ‘ই দ্যাখ, দ্যাখ ক্যানে, কানার মরণ দ্যাখ গ—। অরে, ও রাস্তা ছেড়্যা যাল্ছিস কুথা, আঁ? আঁই আঁই আঁই, হোইত্তেরি…।’ তারপরেই পাচনবাড়ির ঠাস্ ঠাস্।
সেই অন্ধকার, সেই আকাশ নক্ষত্র, সেই চড়াই উৎরাই, অস্পষ্ট ধানখেত, তালের সারি, বিচিত্র ভাষা আর শব্দ, সব মিলিয়ে, আমি যেন ছিলাম এক স্বপ্নের ঘোরে। কেবল মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা জবাব আপন মনে চলছিল; কোথায় চলেছি? এক নতুন রাজ্যে, নাম তার মলুটি। কখন একসময়ে যেন বড় কত্তা বলতে আরম্ভ করেছিলেন, ‘মলুটি কথা কোথা থেকে এল জাননা? এল, মৌলীক্ষা থেকে।’
যখন বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতেন, তখন রায় মশাইয়ের ভাষা আলাদা। তখন এক রঙের কথা নয়, এক সীমানায় বাঁধা নয়। তখন সীমাহীন সার্বজনীন বাংলা। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মৌলীক্ষা কী?’
বলেছিলেন, ‘দেবী। রাজবংশের অধিষ্ঠাত্রী, মা মৌলীক্ষা রাজবংশের দেবী, গ্রাম্য দেবীও তিনিই। ইনি তান্ত্রিক দেবী। মৌলীক্ষা থেকে গ্রামের নাম মলুটি! শোনো, তোমাকে রাজবংশের কাহিনী বলি।’…
গাড়ি চলেছিল, ধিকিয়ে ধিকিয়ে, উঁচুতে নিচুতে। আকাশ-জোড়া তারা ছিটানো। বাতাসে শীতের আভাস। তখন এক রূপকথা শুনেছিলাম:
যদি রাজা না থাকে, তবে রাজার কথা বলবে কেমন করে। তারও আগে বলো, রাজা কেমন করে হয়। শোনো, এইরকম করে হয়। সে অনেক—অনেক—অনেকদিনের আগের কথা। প্রায় তিনশো বছর হবে। দিল্লির বাদশা তখন ছোটখাটো কেউ না, মস্ত শাহানশা।
সেই সময়ে এই রাঢ়ের এক গ্রামে থাকত এক ব্রাহ্মণ। তিনি বড় গরিব। সামান্য ধান জমি, তাতে বছর কুলায় না। কোনওরকমে তবু দিন গুজারি চলে, দুধে আর ভাতে। দুধ কোথা থেকে আসে? না, ব্রাহ্মণের গরু ছিল কয়েকটি। এমন অবস্থা ছিল না যে, রাখাল রেখে গরু চরায়। ছেলেই গরু চরাত মাঠে মাঠে। ঘরে তো গরুর খাবার ছিল না। মাঠের ঘাসেই পেট ভরানো।
তা সে যাই হোক, ছেলে গরু চরিয়ে বেড়ায়। অবসর সময়ে পাঠ নিয়ে থাকে। সেই ছেলে, গরু চরাতে চরাতে একদিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই গাছতলাতে গিয়ে শুয়েছিল। তখন গাছতলাতে ছায়া ছিল। তারপর ছায়া সরতে সরতে, রোদ ছেলের মুখের ওপর এসে পড়ল। আহা, সারাদিনের রাখালি কাজ, তাতে একটু নিদ্রা। রোদের মায়া-দয়া নেই, মুখের ওপর এসে পড়ল। কে একটু ছায়া দেবে?
দেবে, যার দেবার। সে-ই ছায়া দিতে এল, কালো বিশাল নাগ, তার প্রকাণ্ড ফণা মেলে। কোথা থেকে এল, সে কথা জিজ্ঞেস করো না। ছেলের মাথার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে ফণা তুলে ছত্রধর হল। ছেলে তখন সুখে ঘুমোতে লাগল, কিছু জানতে পারল না।
তারপরে—তারপরেতে, সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক সন্ন্যাসী। তিনি দেখতে পেলেন, কালীয় নাগ ফণা ছড়িয়ে ছত্রধর হয়েছে। তখন তিনি আর চলতে পারলেন না, কথা বলতে পারলেন না। প্রাণ ভরে মুগ্ধ হয়ে সেই কচি মুখখানি দেখতে লাগলেন। মনে মনে বললেন, ‘এ তো যে-সে ছেলে না। এ তো যেমন-তেমন ব্যাপার না। এই ভাগ্যমন্ত ছেলেটিকে জানতে হয়।’
তাই তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন, সেই আশ্চর্য ব্যাপার দেখলেন। তারপরে সেই ছেলে নড়েচড়ে উঠল। ঘুম ভাঙতে চলেছে তার। অমনি কালো নাগ ফণা গুটিয়ে নিশ্চুপে একদিকে চলে গেল। ছেলে ঘুম থেকে উঠে বসল। তখন সেই দণ্ডী সন্ন্যাসী এসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাছা, তোমার বাড়ি কোথায়, আমাকে একবারটি সেখানে নিয়ে চলো।’
ছেলে ভাবে, ইনি আবার কে! তবে সন্ন্যাসী মানুষ, বাড়ি যেতে চান, ভাল। সে তাঁকে নিয়ে বাড়ি গেল। ছেলের মা ছিল ঘরে। দণ্ডী সাধু মাকে বলল, ‘আজ আমি এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি। তাই বলছি, তোমার এই ছেলে রাজা হবে। তার আগে ওকে আমি দীক্ষা দেব। দীক্ষা দিয়ে সীমানা না বাঁধলে, ওর বিপদের সম্ভাবনা আছে। কাশীতে আমার বাস।’
সন্ন্যাসীর পরিচয় পেয়ে মা খুশি হলেন। সন্ন্যাসী তখন সেই ছেলেকে দীক্ষা দিয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ‘সময় হলে আমি নিজেই আসব।’
তারপরে—দিন যায়, রাত্রি আসে, মাস যায়, বছর ঘোরে। ছেলে একদিন তেমনি গরু চরাচ্ছে। হাপুস করে এক পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে বসে একেবারে ছেলের হাতে। আহা, কী সুন্দর পাখি! যেন সোনা দিয়ে পাখা মোড়ানো, সোনালি এক বাজ। তার এক পায়ে আবার একটা ছেঁড়া সোনার সরু শিকল।
কার পাখি, কোথা থেকে এল? তা কে জানে! যেখান থেকেই আসুক, এমন সুন্দর পাখি সে ছাড়বে না। শিকল ধরে বুকে করে বাড়ি নিয়ে এল।
এদিকে কী হয়েছে, দিল্লির বাদশা তখন সফরে বেরিয়েছে। তার তাঁবু পড়েছে সেই গ্রামের বাইরে, বন-মাঠের ধারে। আসলে সেই সোনালি বাজপাখি বাদশার নিজের। বড় আদরের পাখি, সোহাগের ধন। কোন বিদেশ থেকে নাকি অনেক দামে কেনা। কিন্তু দাম দিয়ে তার যাচাই হয় না, বাদশার সে চোখের মণি। নিজের হাতে খাওয়ায়, কাছে কাছে রাখে।
সেই বাজ হারিয়ে তো বাদশার আহার-নিদ্রা গেছে। খোঁজ খোঁজ, কোথায় গেল সোনার বাজ। লোক-লস্কর সেপাই, সবাই ছুটোছুটি করে। কোথাও খুঁজে পায় না। এদিকে বাদশা সকলের গর্দান নিয়ে টানাটানি করে। হয় বাজ, নয় জান। কিন্তু ছেলে তো সে খবর জানে না। সোনালি বাজকে সে খাওয়ায়। চালার বাতার খাঁচায় ঝুলিয়ে দোল দেয়।
তখন বাদশা ঘোষণা করে, যে তার বাজ এনে দিতে পারবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। তখন আর সেপাই লস্কর নয় কেবল, দশটা গাঁয়ের লোকে খোঁজে লেগে যায়। লাগতে লাগতে সেই বাজ-পাওয়া ছেলের মামা বোনের বাড়িতে আসে। এসে দেখে ভাগ্নের হাতে সোনালি বাজ। মামা অমনি সেই বাজ নিয়ে বাদশার কাছে যেতে চায়। কিন্তু ভাগ্নে বেঁকে বসে। না, বাজ সে কাউকে দেবে না।
মামা দেখল বেগতিক। তখন সে ভয় দেখায়। ছেলের মা-ও ভয় পায়, বলে বাদশা বলে কথা, প্রাণ রাখবে না। ফিরিয়ে দেওয়াই ভাল। ছেলে তবু বাঁকা, কথা শোনে না। মামা বুঝল, ছেলে বড় ত্যাড়া। তখন পুরস্কারের কথা বলে বাজ সহ ভাগ্নেকে নিয়ে গেল বাদশার তাঁবুতে। যাক, নিজের না হোক, ভাগ্নেরই পুরস্কার লাভ হোক।
বাদশা তো বাজ ফিরে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। ছেলেকে কী দিয়ে খুশি করবে তাই ভাবে। ভেবে বলে, ‘বেশ, আমি খুশি হয়ে বলছি, কাল সুর্যি উঠলে তুমি ঘোড়ায় চেপে ছুটবে। যতখানি পাক দিয়ে ঘুরে আসতে পারবে, সব তোমাকে দান করব।’
পরদিন যেমনি আকাশে সূর্যি উঠল, ছেলে ছুটল ঘোড়া নিয়ে। সাঁঝবেলাতে ছেলে যখন তাঁবুতে ফিরে এল, বাদশা তখন খানা খেতে বসেছে। ফারমান তৈরি ছিল। ফিরে এলে বাদশা সেই দানপত্র হুকুমনামায় দস্তখত করে দেবে। কিন্তু খেতে বসেছে, হাতে খাবার লেগে আছে। কলম ধরা যায় কেমন করে। তার দরকার নেই, নিয়ে এস ফারমান। দস্তখতের জায়গায় এঁটো হাতে পাঞ্জার ছাপ দিয়ে বললেন, ‘এই আমার দস্তখত।’
এই পর্যন্ত বলে একটু ক্ষান্ত হয়েছিলেন বড় কর্তা। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটেছিল। আকাশের পুব গায়ে লালের আভা লেগেছিল। দেখেছিলাম বড় কর্তার রাঙা মুখে স্বপ্ন ছড়ানো। নীল চোখের নীল মণিতে যুগ-যুগান্তের ছায়া। কোলে তাঁর টিকেটবাবুর অপুষ্ট ঘুমন্ত শিশু।
সম্ভবত কিছু পথ আসা গিয়েছিল চওড়া বাঁধানো সড়ক ধরে। ভোরের আলোয় দেখেছিলাম, চওড়ায় এক গরুর গাড়ির পথ। যেন রক্তে-ধোয়া লাল পথে গরুর গাড়ির চাকার গভীর দাগ। ভাঙাচোরা এবড়ো-খেবড়ো, কাঁকর-পাথরের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে নদী-খাতের মতো গর্ত। তাতে কোথাও গেরুয়া-রং, অল্প জলের ধারা, কুলকুলিয়ে যায়। মনে হয়েছিল, গরুর গাড়ি যেন দলামোচড়া হয়ে চলেছে। লাফিয়ে, কাত হয়ে, গোঁত্তা মেরে, একটা প্রকাণ্ড বিদঘুটে পশুর মতো। যার ওপরে বসে আমার হাড়গোড় মড়মড়িয়ে যাচ্ছিল। অথচ, প্রায়ই ধানের খেত আকাশতলায় ঢেউ খেলেছিল। তবে সেইসব ধানের খেত তেমনি এলোমেলো, উঁচু-নিচু।
বড় কর্তা হেসেছিলেন, যেন স্বপ্নে বলেছিলেন, ‘বাদশার হাতের ছাপ দেওয়া সেই ফারমানটা আজও আমাদের কাছে আছে। ফারসিতে লেখা, তখনকার দিনের কাগজ। পুরনো হয়েছে, কিন্তু এখনও বেশ শক্ত।’
বাদশার ফারমান, এঁটো হাতের পাঞ্জার ছাপ। চোখে দেখিনি কখনও, কৌতূহলে যেন মরে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাকে একটু দেখাবেন?’
বলেছিলেন, ‘কেন দেখাব না! ওটা তো আমার বাড়িতে আমার কাছেই আছে। আমরা বড় তরফ কিনা, তা-ই!’
মনের কি ব্যাপার দেখ, ভেবেছিলাম, বাদশা কী খাবার খেয়েছিলেন, কেমন তার রং। বাদশা যখন, কাবাব কোপ্তা নিশ্চয়। কাগজে কি ঠিক সেই রং এখন আর আছে! আর সেই গন্ধ। সেও আবার কথা বটে, বাদশার খাবারের গন্ধ নেবে কী হে। নিষিদ্ধ খাবার না? তা হলে নৈকষ্য কুলীন ব্রাহ্মণেরা সেই অস্পৃশ্য দলিল হাত পেতে নিয়েছিলেন কেমন করে? জাত যায়নি?
সে কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। দেখেছিলাম, রাজা তখন আপন ঘোরে। অথচ, সেই সময়ে মনে পড়েছিল আর এক কিস্যা। বইয়ে পড়েছিলাম, তা বলে কবুল করতে পারব না সে কিস্যা ঐতিহাসিক। যার থেকে প্রবাদ হল ‘নবাব খানজা খাঁ, সেই নবাব খান জাঁহান খাঁ-এর দরবারে নাকি কাজ করতেন দুই ব্রাহ্মণ। নবাব তাঁদের ভোজের নিমন্ত্রণ করেছিল। তাঁরা কানে আঙুল দিয়ে জিভ কেটে বলেছিলেন, ‘দুর্গা দুর্গা, তাই কি কখনও হয়! সে খাদ্য আমাদের স্পর্শ করতে নেই, এমনকী ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং। তাতেও পতিত হতে হয়। নবাব যেন মার্জনা করেন।’
নবাব তখন চালাকি করল, মনে মনে বলল, ‘দেখাচ্ছি তোমাদের বামনাইগিরি।’ এমন জায়গায় নিষিদ্ধ মাংসের রান্নার ব্যবস্থা করল, যেখান দিয়ে সেই ব্রাহ্মণদের যেতে হয়। আড়ালে রান্না চাপানো হল, ভুরভুর করে তার গন্ধ ছড়াল। রসুনে পেঁয়াজে মশলায় ঘিয়ে যাকে বলে খোশবু। ব্রাহ্মণেরা যাবার পথে গন্ধ পেলেন। নবাবকে গিয়ে বললেন, ‘কাছেই কোথাও রান্না হচ্ছে, তার গন্ধ পেলাম।’
নবাব বলল, ‘পেয়েছেন? চলুন, তা হলে দেখিয়ে নিয়ে আসি কী রান্না হচ্ছে।’
দেখতে গিয়ে তো ব্রাহ্মণদ্বয়ের চক্ষু কপালে। খান জাঁহান খাঁ হেসে বললেন, ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং। সংবাদটা আপনাদের সমাজপতিদের জানানো দরকার।’
জানানো হল, তাঁরা পতিতও হলেন। তাই যখন হলেন, তখন নবাবের নিমন্ত্রণ রাখায় আপত্তি কী। নিষিদ্ধ মাংস তো খাওয়া হচ্ছে না। আর এঁদের থেকেই নাকি পিরালি ব্রাহ্মণের সৃষ্টি। সাচ্চা ঝুটা পুছ করো না। এই অধম ইতিহাসের কবুল খেতে পারবে না।
আমি বড় কর্তা রায়মশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর?’
বড় কর্তা বলেছিলেন, ‘তারপর অনেক কথা। অনেক দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, দেশে দেশে ছুটোছুটি। শেষ পর্যন্ত এই মলুটিতে। ‘রাজা’ আখ্যা পেয়েছিলাম দিল্লির বাদশার কাছ থেকেই। এখনো সেই নামটা ঘোচেনি, আমাদের তো বাবা, দেখতেই পাচ্ছ।’
বলে নীল নীল শিরা জাগা অপুষ্ট গোরা শিশুটির দিকে তাকিয়েছিলেন। কী ভেবেছিলেন, কে জানে। বোধ হয় টিকেট কালেক্টর তাঁর কোলে আর একজন রাজার বংশধরকে দেখেছিলেন। তারপরে হঠাৎ মুখ তুলে বলেছিলেন, ‘তবে হ্যাঁ, যদি মনে করে থাকো, রাজাদের মস্ত মস্ত বাড়ি দেখবে, চকমেলানো, থাম জোড়া জোড়া অট্টালিকা, তা হলে ঠকবে। মলুটির রাজারা নিজেদের বাস্তু কখনও পাকা করেনি। সব মাটির দেয়াল, খড়ের চাল।’
সে আবার কী। রাজার বাড়ি, অথচ মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। এমন তো শুনিনি। মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। বড় কর্তা রাঙা মুখে হেসে বলেছিলেন, ‘প্রথম আমলে হয়েছিল। তারপরে একবার নতুন রাজবাড়ি ধসে পড়েছিল। তাতে অনেকেই মারা গেছিল। সেই থেকে, মৌলীক্ষার আদেশ, পাকা বাড়ি আর কোনওদিন হবে না। হয়ও নাই।’
বাড়ি কেন ধসেছিল, মৌলীক্ষা কেন আদেশ দিয়েছিলেন, এ দুয়েতে জোড় মেলাতে যেতে তুমি এক আদি বংশের রূপকথা শোনো। বড় কর্তা আবার হাসেন। বলেন, ‘তার জন্যে ভেব না যে, রাজারা ইট গেঁথে কিছু করে নাই। করেছে, পূজার দালান করেছে, নাটমন্দির করেছে। মলুটি হল মন্দিরের দেশ। যত ঘর, তত মন্দির। তার চেয়ে বেশি। পাকা মন্দির, কোটি কোটি ইট আছে মলুটিতে। আর হাজার হাজার ইটে মূর্তি ফুল আঁকা আছে।’
বলেই হঠাৎ চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন। বলে উঠেছিলেন, ‘ওই যে দেখা যায় মলুটি। আমরা এসে পড়েছি।’
গাড়িটা তখন গড়িয়ে নামছিল নীচে। মাজড়া পাথরের মতো কিম্ভূত আকৃতি ভূমি। পাথরই আসলে, যেন একটা অতিকায় জীব রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল উপুড় হয়ে। গাড়িটা সেই রক্তাক্ত বাঁকা পিঠের ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে নামছিল। তখন রোদ উঠেছিল। ভূমির রক্তাভা দেখে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল।
গাড়ির ছই শক্ত করে ধরে, চোখ তুলে দেখেছিলাম। ঘর নয়, বাড়ি নয়, গাছপালা নয়। উৎরাইয়ের পরে, চড়াইয়ের গায়ে, প্রথম দেখেছিলাম মন্দির। লাল রং মন্দির, গায়ে তার অস্পষ্ট কারুকার্য ছাপ।
.
২৯.
তারপরে মলুটিতে কত মন্দির দেখেছিলাম। কিন্তু তার আগে উপুড় হয়ে পড়া মাজড়া পাথরের লাল গা বেয়ে গাড়ি যেভাবে নেমেছিল, তাতে ছইয়ের মুখছাটের কঞ্চিতে কপাল বাঁচাতে পারিনি। ঠোঁটে লেগেছিল জবর। যেন কাঠপিঁপড়ের হুল ফোটানো দংশনে একখানি ডাঁশা লাল বৈঁচিফল ফুটেছিল ঠোঁটে। রাজা রায়মশাই ডুকরে উঠেছিলেন, ‘আহা, বাবা চোট পেলে?’
বলে আগুন-রাঙা হাতখানি আমার মুখে মাথায় বুলিয়েছিলেন। তারপরে কি আর চোট বলে কিছু থাকে! আমি তো তখন আর এক মফস্বল শহরের রেলইস্টিশনের টিকেটবাবুকে দেখছিলাম না। দেখছিলাম মলুটির রাজাদের বড় তরফের রাজবংশধর। স্নেহে বিগলিত মুখ যদি দেখে থাকো, তবে সেই রাঙা মুখে দেখেছিলে। কথার সুরে ভাবেও সেই টলটলানো তরঙ্গ। সেই যে বলে না, বাবা ছাড়া কথা নেই, বাছা ছাড়া সম্বোধন নেই, সেইরকম। তা বলে ভেব না, দত দিয়ে কথা। একেবারে আঁত গলানো বচন। বলেছিলাম, ‘না, এমন কিছু—’
দাঁড়াও হে, কথা শেষ করবে কী, তার আগেই বড় কর্তার গলায় হাঁকাড় উঠেছিল, ‘অই, আরে অই সানা, সামাল দে ক্যানে। লোক খুন করবি নাকি।’
হাঁকাড় মানে গর্জন না। সেই যে তালপুকুরে ঘটি ডোবে না, সাতপুরুষ আগের ঘিয়ের গন্ধে হাত চাটে, বারো শরিকের জমিদারি, তেরো নম্বর কর্তা তর্জন গর্জন করেন, সে রকম না। উদ্বেগে হাঁকাড় দিয়েছিলেন। অতিথির চোট লাগাতে মনেতে চোট পেয়েছিলেন যে।
প্রজাও সেইরকম। পথের পাথুরে ঢলে যে বলদ সামালের চেষ্টা করেনি, তা নয়। আওয়াজেই তার প্রমাণ ছিল, ‘ই দ্যাখ হে, দ্যাখ দ্যাখ দ্যাখ, শো’রের গোঁ ধরাল্ছে, ইঃ ইঃ…।’ ইত্যাকার। বড় কর্তা কথা শুনে জবাব দিয়েছিল, ‘অই গ বড়কর্তা, বুলেন ক্যানে, হারামজাদারা ঘরের গন্ধ পেয়েছে যে। গাঁয়ে ঢুকছে কি না।’
নইলে আর ঘরমুখো গরু বলেছে কেন। মানুষের কথাই বলো, সারা দিনের শ্রম সেরে ঘরের মুখে তার ঢল নামে। পশুদেরও সেইরকম। তখন যত তাড়াতাড়ি হয়, কাঁধ থেকে জোয়াল নামিয়ে টুকুস খড়ে-জলে মুখ দিতে হবে। যত নজ্দিক, তত অসবুর।
রায়মশাই হেসেছিলেন। এমতাবস্থায়, প্রজাকে কী বলবেন, বলদকেই বা কী। বলেছিলেন, ‘তোমাদের তো অভ্যাস নাই এরকম। আমরা ঠিক সামলে নিতে পারি।’
ওদিকে তখন প্রচণ্ড হাঁক উঠেছিল, ‘যা যা যা, চল্ চল্ চল্, চল্ ক্যানে।’
দেখেছিলাম, সেই যে সেই গদাইয়ের বিটা লারান, তার গাড়ি আমাদের আগে আধখানা চাকা জলে ডুবিয়ে আছোড়-পাছোড় করছে। সেই গাড়িতে রায়গিন্নি ও সন্ততিগণ। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, ই দ্যাখ, আবার জল এল কুথা থিক্যা হে। যেন কলকলিয়ে যাচ্ছিল, আওয়াজে ছলছলানো। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘খানা নাকি?’
রায়মশাই বলেছিলেন, ‘না বাবা, খানা না, কাঁদর।
কাঁদর! জলাশয়ের তেমন নাম আগে কখনও শুনিনি। সে বিষয়ে রায়মশাইয়ের ধ্যান ছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অই তোমার, নদীর মতন আর কি। কাছেপিঠে পাহাড় আছে তো। সেখান থেকেই একটা ধারা নেমে এসেছে। এখানকার লোকেরা কাঁদর বলে, নদীও বলে। মল্টির লোকেরা বলে সতীঘাট।’
মলুটিকে ‘মল্টি’ সেই প্রথম শুনেছিলাম। বাঙালির যেমন চরিত্র, সবকিছুকেই সে তার একটা চলতি নামে ডাকে। তার মধ্যে আপন বোধের পরিচয়। কৃষ্ণ যেমন কেষ্ট, বিষ্ণু যেমন বিষ্টু। অমন করে না বললে যেন বলার জুত হয় না। কিন্তু সতীঘাট কেন? পুছ করার আগেই খবর দিয়েছিলেন, ‘এই কাঁদরের ঘাটে সতীদাহ হয়েছিল। সেই সতীদাহ না যে, স্বামীর সঙ্গে পুড়ে মরা। কী বলব বাবা তোমাকে, সে যেন তার থেকে বেশি। বলি শোনো।’…
তখনও বুঝতে পারিনি, কোন রাজ্যে গিয়েছি। যে রাজ্যে কিংবদন্তীর শেষ নেই। সেথা কিংবদন্তীর মায়ের দেশ, অজস্র তার সৃষ্টি। এদিকে যখন সানা এই গাড়ি সামলে রেখেছিল লারানের অপেক্ষায়, কেন না লারানের গাড়ি কাঁদর না পেরোলে সানার প্রতিবন্ধক, তখন বড় কর্তা বলেছিলেন, ‘আমাদের বংশে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন, তাঁর নাম রাখড়চন্দ্র। তিনি সুখ সংসার স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করে পুরীতে জগন্নাথদেবের কাছে ঠাঁই নেবেন, এই ছিল প্রতিজ্ঞা। রানিকে বললেন, ছেলেরা রইল, সংসার দেখবে, রাজত্ব দেখবে; তুমি দেখবে তাঁদের। রানি বললেন, তা হয় না। আপনাকে ছাড়া আমার জগৎ-সংসারে কিছু নাই। যেতে চান, আমাকে নিয়ে চলুন। আপনাকে ছেড়ে আমি একদিনও বাঁচব না। রাজা তা শুনলেন না। তিনি যাবেনই। তখন রানি বললেন, বেশ যাবেন, তবে সামনের পূর্ণিমা পর্যন্ত থেকে যান, এই প্রার্থনা। রাজা সে কথা রাখলেন।… তারপরে সেই পূর্ণিমা এল। রানি ভোরবেলা স্নানশুদ্ধ হয়ে চেলি পরে বাড়ির তুলসীতলায় গিয়ে শুলেন। ঝিকে বললেন স্বামী আর ছেলেকে ডেকে দিতে। তাঁরা যখন এলেন, তখন তিনি স্বামীকে বললেন, আমার মাথায় পা ছুঁইয়ে আপনি বসুন, ছেলেরা আমাকে ঈশ্বরের নাম শোনাক। আমার যাবার সময় হয়েছে, বেশি দেরি নাই।
‘রাজা তৎক্ষণাৎ তাঁর কথামতো কাজ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেন তুমি যাও? রানি বললেন, আজ পূর্ণিমা, কাল আপনি চলে যাবেন। তখন আর আমি থাকব না। আপনাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।… এ কথা বলে রানি সজ্ঞানে মারা গেলেন। তখন তাঁকে এই কাঁদরের ধারে এনে দাহ করা হয়েছিল, হুই-ই ডান দিকে, পশ্চিমে। সেই থেকে সতীঘাট, সেই থেকে সতীঘাটই মল্টির শ্মশান, বুঝলে বাবা, সেই হল মল্টির গঙ্গা।’
দেখেছিলাম রায়মশাইয়ের নীল চোখে দূর আকাশের বিস্তার। সেথায় স্বপ্নের খেলা, রূপসাগরের কত না ঝিকিমিকি। সে মানুষ টিকেটবাবু নন, যিনি গেট আগলে চাপকান দেখিয়ে টিকেট, মাশুল আদায় করতেন। মলুটির সেই এক রাজা রাখড়চন্দ্রের পায়ের ধ্বনি, সতীর ইচ্ছামরণের মন্ত্র শুনেছিলেন নিজের রক্তে কান পেতে। মিথ্যে বলব না, ঢেউ-তোলা রক্তমৃত্তিকা রাঢ়ে সেই প্রথম গমনে স্বপ্নে পেয়েছিল আমাকেও। আমার পথে পথে ফেরার দিশায় মলুটি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল রাঢ়ের এক রূপকথার দেশে।
ইতিমধ্যে লারানের গাড়ি ওপারের চড়াইয়ে উঠে গিয়েছিল। সানা ছুটিয়ে দিয়েছিল যেন পাণ্ডবের রথ। গাড়ির চাকার ঘর্ঘর আর সানার গলার উদ্বেগব্যগ্র হাঁকাড়, দুয়ে মিলে কান পাতে, কার সাধ্য ছিল। ‘যা যা, মহাদেবের চ্যালা তু, হট্ট হট্ট হট্ট, ঘাঁইক ঘাঁইক ঘাঁইক—আহ্ আহ্ লুঃ লুঃ লু…।’
হুঁ, যদি মনে করে থাকো, সানার ইসব কথার মানে বুঝতে পারবেক, তবে ভুল করেছ হে। মানুষের অবোধ্য, বোঝে কেবল বলদে। ওর নাম বলদ-তাড়ানো ভাষা। তবে হ্যাঁ, সানার গাড়ি কাঁদরে ঠেক খায়নি। জল পেরিয়ে, এক হ্যাঁচকায় চড়াইয়ের ঢালুতে গিয়ে উঠেছিল। যদি একচোখো না হও, তা হলে এটাও কবুল করতে হবে, সানার গাড়িতে ভার কম ছিল। কেবল লারান আর তার বলদের দোষ না। কাছের থেকে দেখেছিলাম, যার নাম কাঁদর, সে যেন এক নির্ঝর। পশ্চিমের উঁচা থেকে পুবেতে তার বাঁক খাওয়া ঢল। নুড়ি আর বড় পাথরে জলের তলা ভরা। তখন লক্ষ পড়েছিল, কাঁদরের এখানে ওখানে মলুটির ঝি-বউয়েরা স্নান করে, বাসন মাজে, কাপড় কাচে। তার মধ্যেই কেউ কেউ ঘোমটা টানছিল, গায়ের কাপড় সামলাচ্ছিল, তবু গাড়ির দিকে দেখছিল। কিন্তু এমন মেয়েও দেখেছিলাম, কালো কষ্টিপাথর কেটে যে মেয়ে তৈরি। ইস্তক, কী বুলব হে, উয়ার ভরা যৌবন তক্। শাস্ত্রের ভাষায় যদি বলো, তবে বলি, ক্ষীণ কটি, সুঠাম নিতম্বিনী। পীনপয়োধরা নয়, পীনোদ্ধতা যাকে বলে, সেই সঙ্গে বলিষ্ঠ আজানু বাহু, কালো দুটি ডাগর চক্ষু, ঝকঝকে সাদা দাঁত। দাঁড়িয়েছিল একটা বড় পাথরের ওপর। কাঁদরের জল তার দু’পাশে কলকলিয়ে যাচ্ছিল। আর যাই হোক, সে ব্রাহ্মণী নয়, এক নজরে বোঝা গিয়েছিল। কৃষ্ণা কালিন্দী সে মেয়ে যেন সেই কোন যুগের শবরীবালা। গায়ের খাটোখুটো ভেজা কাপড়খানি টেনে দেবার কথাও মনে ছিল না। গলা তুলে ডাক দিয়ে বলেছিল, ‘অই গ বড় কত্তা, গড় করি গ।’ এবার কোমর নুইয়ে কপালে হাত ঠেকিয়েছিল। রায়মশাই রাঙা হেসে বলেছিলেন, ‘হুঁ হুঁ, ভাল আছিস তো?’
হাসির সঙ্গে জবাব এসেছিল, ‘অই তুমার কিপায় গ বড় কত্তা। উটি কুন্ বাড়ির জামাই গ?’ আ ছি ছি ছি দ্যাখ, মেয়েটা বলছিল কী গো। রায়মশাই হেসে ধমক দিয়েছিলেন, ‘আ দূর মুখপুড়ি, লতুন মুখ দেখলেই খালি জামাই বুলবে। বড় ছেল্যার বন্ধু।’
বোঝা যায়, ঘাটের ঝি-বউদের মধ্যেও একটা হাসির ঢেউ লেগেছিল। ডাগরী কালিন্দী জিভ কেটে তাড়াতাড়ি বলেছিল, ‘আ ছি ছি দ্যাখ, চকের মাথা খেয়্যাছি গা।’
তারপরে খিলখিল হাসিটা পিছনে পড়ে ছিল। গাড়ি তখন চড়াইয়ের অনেকখানি ওপরে। গ্রাম মলুটির প্রবেশমুখে। রায়মশাই আমাকে বলেছিলেন, ‘বাউরিদের মেয়ে।’
সেরকম একটা কিছু অনুমান করেছিলাম। কিন্তু মনে মনে পুছ করেছিলাম, অমন কালো কুচকুচে ছিলছিলানো শরীরের গড়নখানি ওদের কে দিয়েছে। ছাতিমতলার নন্দলালের পুরাণের ছবিতে যেমন মহেশানী উমাকে দেখেছিলাম, এ যেন তেমনি গড়ন। কিন্তু বাউরি মেয়ে তো আর আর্যকন্যা নয়। তবে অমন ঋজু অথচ নম্রতায় ঔদ্ধত্যে মাখামাখি গড়ন পেয়েছিল কোথা থেকে।
মনের কথা তখন মনেই। গ্রামের প্রবেশমুখে প্রথম দর্শন মন্দির। পোড়া ইটের গায়ে দেবদেবীর নানান লীলা নজর হরে নিয়েছিল। তবে অস্পষ্ট, কালের জিহ্বা চেটেছে অনেক দিন ধরে। গ্রামে ঢুকতে না ঢুকতেই মন্দির একাধিক। কোনও মন্দিরেরই দরজা নেই। দাওয়ার গায়ে অজস্র ফাটল। ইটখেকো আগাছার বেশ বাড়-বাড়ন্ত। তাল শাল আম আমলকি গাছের ছায়ায় নিবিড়। মন্দিরের পাশেই দেখেছিলাম লাল মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, নিকচিকানো ভদ্রাসন। গাছের রং সবুজ, আর যে মানুষদের রং কালো, প্রকৃতির মধ্যে তা ছাড়া সব এক রং। তার নাম লাল মেটে। সেই আমার প্রথম দেখা রাঢ়ের গ্রাম।
কোথা থেকে যেন ছুটে এসেছিল গোটা কয়েক কুকুর। কেউ ডেকেছিল, কেউ ডাকেনি। ল্যাজ নাড়িয়ে, কান নাড়িয়ে ভয় পাওয়া পুছ নজরে তাকিয়েছিল। তবে পথে-ঘাটে ভদ্র অভদ্র অনেকের সঙ্গে দেখা। কেউ ছিল পথ চলাতে, কেউ বসেছিল মন্দিরের রকে। কারুর খালি গায়ে উপবীত, হাঁটুর কাছে কাপড়। কারুর উপবীত নেই। বাতে ভাবেই বোঝা গিয়েছিল, কারা কে। কেউ ডেকে বলছিল, ‘কে, অমুক এলে নাকি?’ জবাবে রায়মশাই হাত জোড় করে এক একবার নামতে যাচ্ছিলেন প্রায়। জবাব পাচ্ছিলেন, ‘আহা থাক থাক বাবা, এখন আর লামতে হবেক না। ভাল আছ তো?’ রায়মশাই কাউকে কাকা, কাউকে জ্যাঠা, কাউকে ঠাকুদ্দা বলছিলেন, আবার কাউকে নাম ধরে। কিংবা, ‘হলধর, যাল্ছিস্ কুথা? হুঁ, ভাল আছি।’ এমনি সব বাতপুছের সঙ্গে, প্রায় প্রতিজনাকেই অপরিচিতের পরিচয়টাও দিতে হচ্ছিল। না দিলে তো হয় না। গ্রামে একটা মানুষ এসেছে, চিনি না শুনি না, জানতে চাইব বই কী, ‘ইটি কে গ?’
গাড়ি চলছিল গ্রামের ঘনবসতির মধ্য দিয়ে। কিন্তু হঠাৎ নজর ঠেক খেয়ে অবাক হয়েছিল। দেখেছিলাম, প্রকাণ্ড অট্টালিকা। ঠাকুর-দালান পূজা-মণ্ডপ না। তার চেহারা চিনি। অমন দোতলা বাড়ি, উঁচু আলসে, তাল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে প্রায়। তাও আবার আলসেতে শাড়ি ধুতি শুকোচ্ছিল। মলুটির হৈমন্তিক আকাশে চিলেকোঠাটা দেখাচ্ছিল যেন কোনও এক অবাক মনের স্বপ্ন-বোনার কুঠরি। তাও এক নয়, একাধিক। আরও দু-একখানি ইমারত দেখেছিলাম, তালসারির ফাঁকে, আম জামরুলের আড়ালে।
অথচ তার একটু আগেই যে শুনেছিলাম, সেই রূপকথার দেশে রাজাদের বাস খাস আম ইমাম কোনও কিছুই ইটে গাঁথা পাকা ইমারত নয়। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই রায়মশাই বলেছিলেন, ‘ক’দিন ধরেই গ্রামের লোক সব আসছে। আজ সন্ধেবেলার মধ্যে যাদের আসবার সবাই এসে পড়বে। আর সবাই এ রকম উঁকিঝুঁকি মারবে, জিজ্ঞেস করবে, কে এল?’
কত যেন খুশি, সবাই ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছিল। রাঙা হাসিতে যেন প্রেম করছিল, আনন্দ আর গর্ব। মলুটির লোক কি না সব। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ সময়ে সবাই আসেন বুঝি!’
রায়মশাই বলেছিলেন, ‘তাই তো আসবে বাবা, কালীপূজাই যে আমাদের সব। মল্টিতে দুর্গাপূজা নাই। রাজবংশের দুর্গাপূজা নাই।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, সে একটা ঘটনা ঘটেছিল বহুকাল আগে, তখন রাজা—।’
আবার শুরু হয়েছিল এক কিংবদন্তী, সে যে কিংবদন্তীর মায়ের দেশ। সেথায় কেবল কথায় কথায় তাদের সৃষ্টি। কিন্তু কথা শেষ হয়নি। গরুর গাড়ি বাঁ দিক ফিরে মস্ত বড় এক পাকা পূজামণ্ডপের উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। লারানের গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল তার আগেই। রায়গিন্নি সবে তখন নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। উঠোনের এক প্রান্তে লাল মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, দু’ পাশে দুটো ঘরের কোণা মিলেছে। সেই কোণের মাঝখান দিয়ে সরু গলি দেখা যাচ্ছিল। গলির ওপারে আর একটা উঠোনের এক অংশ। সেই গলি দিয়ে তখন ঘোমটা মাথায় এক বউ এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঘোমটাবিহীন এক সধবা যুবতী। তাঁদের সঙ্গে এক দঙ্গল কুচো-কাঁচা। সবাই মিলে ঘিরে ধরেছিল রায়গিন্নির গাড়ি। সকলের একসঙ্গে হাঁকেডাকে পূজামণ্ডপের উঠোন জুড়ে একটা হট্টগোল পড়ে গিয়েছিল।
তার মধ্যেই দেখেছিলাম খালি গায়ে একজনকে এগিয়ে আসতে। বয়স নিদেন চল্লিশোর্ধ্বে। আগুন-রাঙা বর্ণ, বুকের ছাতি প্রকাণ্ড। সেই বুকে একগাছা মেটে রঙের পৈতা। পরনের কাপড়খানি উঠেছে প্রায় হাঁটুর কাছে। খালি পা। তবে হ্যাঁ, একটাই যা তোমার একটু চোখে লেগেছিল, বাঁ হাতের কব্জিতে একটা ঘড়ি। চোখে সই আশমানি নীল, চুলে রাঙা ছাপ। বলতে হবে কেন, তিনিও রাজবংশধর। গাড়ির কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে বলেছিলেন, ‘দাদা এলে?’
‘হঁ। তুরা সব ভাল আছিস?’
‘অই আছি।’
বলে দাদার কোল থেকে ভাইপোকে দু’ হাতে তুলে কোলে নিয়েছিলেন। তারপরেই নীল চোখে অচিনটাকে দেখে দাদাকে পুছ, ‘ইটি কে বটে?’
জিজ্ঞাসার সময় মুখে একটু হাসিহাসি ভাব। রায়মশাই বলেছিলেন, তাঁর বড় ছেলের নাম করে, ‘আমাদিগের জ্যোছ্নার বন্ধু, শহরে কাছাকাছিই থাকে। তা বাবার একটু ঘুরে বেড়িয়ে দেখার শখ। ভাবলাম কী যে, আমাদিগের কালীপুজোটা দেখে যাক।’
‘খুব ভাল, খুব ভাল, লেমে আসেন।’
সেই একই রাঙা হাসি, একেবারে মুখ ভরে। অতিথিতে এমন খুশি এ-কালে বিরল। আঁতের কি দাঁতের হাসি, দেখলে তা বোঝা যায়। ততক্ষণে রায়মশাই নেমেছিলেন। ছোট রায় উপুড় হয়ে প্রণাম করেছিলেন। একবার বেরাদারি দেখ, দাদা ছোট ভাইয়ের চিবুক ছুঁয়ে আবার নিজের মুখে ঠেকিয়ে চুক শব্দ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জয়স্তু।’
গাড়ি থেকে নেমে আমি ছোট রায়কে প্রণাম করেছিলাম। ছোট রায়ের একেবারে হা হা রব, ‘আহা থাক না ক্যানে, পায়ে হাত দিবেন না বাবা। আজকাল কি আর সিদিন আছে?’
যেখানে নেই সেখানে নেই, মলুটিতে ‘সেদিন’ ছিল জানি। দিন কাল অবস্থার হালের পানিতে না মনের দরিয়ায়। বড়কে ছোটর প্রণাম কি কেবল প্রথা নাকি হে। শ্রদ্ধা জানাই, পরিচয় পাড়ি, কুশল জিজ্ঞাসা করি। বলেছিলাম, ‘আপনি করে বলবেন না।’
ছোট রায় হেসে এক কথাতেই রাজি, ‘আচ্ছা, সে হয়্যা যাবে বাবা, উ লিয়ে ভাবতে হবেক না গ।’
ততক্ষণে আমার দৃষ্টি পড়েছিল ঠাকুরদালানের দিকে। সেইদিনের মহানিশাতেই পূজা। মলুটির কালীপূজাই প্রথম দেখার উপলক্ষ। অথচ দেখেছিলাম, কুমোর মশাই তখনও প্রতিমার কালি লেপন করছেন। তখনও প্রতিমার চোখের ক্ষেত্র সাদা। যা দিয়ে প্রতিমার আসল পরিচয় সেই জিভেও তখনও সাদা রং লাগানো। গলায় ঝোলানো নরমুণ্ড আর কাটা-ছেঁড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালাখানিও তথৈবচ। এক কুমোরে রং লাগাচ্ছিল প্রতিমার গায়ে। আর এক কুমোর পিছনের চালচিত্রে।
হাত তুলে ঘড়িতে দেখেছিলাম, সকাল সবে সাড়ে সাতটা। রাত্রি একটার অনেক দেরি। তার মধ্যে প্রতিমার চক্ষুদান হয়ে যাবে। তারপরে, মহানিশায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা।
পূজা-দালানের অনেক ধাপ সিঁড়ি। সেখানে ছোটরা অনেকেই জায়গা করে নিয়েছিল। তারা সেই কঞ্চিখড়ের বাঁধন থেকে সাক্ষী। প্রতিমার রূপ গড়ানো শেষ পর্যন্ত দেখবে। তার মধ্যেই এদিক ওদিক যারা ছিল, সবাই প্রায় খালি গা, কুচকুচে কালো মানুষ। লজ্জা নিবারণের একখানি ঢাকনা ছিল কোমরে। তারা অনেকেই বড় কর্তাকে এসে গড় করেছিল। কেবল কুশল জিজ্ঞাসা নয়, কেউ দাবি করেছিল, ‘ইবারে একটো লতুন কাপড় দিতে হবেক গ বড় কত্তা।’ কেউ বলেছিল, ‘আমাকে দুটো হাঁড়ি মদ দিতে লাগবে কিন্তু, হঁ। এমন বাজনা বাজাব মা জেগ্যা উঠবেন একেবারে।’
রায়মশাই হেসে কাউকে বলেছিলেন, ‘হবেক রে, হবেক।’ কাউকে, ‘আর রে ধু— হারামজাদা।’ তারপরে আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘চলো বাবা, বাড়ির ভিতর যাই। হাতমুখ ধুয়ে জল খেয়ে একটু বিশ্রাম করো।’
তা করব, কিন্তু না-দেখা মলুটির রক্ত-তেপান্তর যেন আমাকে হাতছানি দিচ্ছিল। অমন দেশ তো আর কখনও দেখিনি। যেখানে প্রকৃতি লালে সবুজে মাখামাখি। তাকে লাল বা বলি কী করে। লাল বলে সুখ পাই না, মেটে বলে জুত পাই না। কী আমার ভাষার দারিদ্র হে। এমন গরিবকে আমি নিজেই কৃপা করি। বিশ্রামের চেয়েও তখন সেই এক রাখাল-রাজার রাজ্য মলুটির প্রকৃতি আমাকে ডাক দিয়ে ফিরছিল।
রায়মশাইয়ের সঙ্গে গিয়ে পড়েছিলাম একেবারে অন্দরমহলের ভিড়ে। এখন অন্দরমহল বলতে যদি সাত মহলা পেরিয়ে ভাবো, আমি নিরুপায়। মাঝখানে উঠোন, চারদিকেতে ঘর। ছেলেবেলায় পুব দেশেতে দেখার মতোই, তবে ফারাক বিস্তর। রঙে মিল ছিল না, আকারে মিল ছিল না। যে ঘরে গিয়ে বসেছিলাম, সে ঘরে অনেক মহিলা পুরুষ। প্রথমে পরিচয়ের পালা। রায়মশাইয়ের ফারমান, ‘সবাইকে দেখিয়ে রাখলাম, তুমি বাবা যখন যেখানে খুশি যাও, ঘোরো বাড়ির মধ্যে, কিছু বলার নাই। তুমি বাড়ির ছেলে।’
এর মধ্যে যে কথাটা বলতে ভুলেছি, রায়মশাইয়ের বড় ছেলে, আমার বন্ধু, যে সূত্র ধরে আসা, সে তখন শহরে বসে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিল। তাই আসা হয়নি। হতে পারে রাজবাড়ির পূজা, বন্ধু আমার রাজবংশধর। সেকালের হিসাবে ধরলে বড় তরফের বড় ছেলে তখন সে, রাজার মুকুট তার মাথাতেই শোভা পেত। কিন্তু অই কে বলে হে, রাজপুত্তুর তখন কেরানির চাকরির আশায় পরীক্ষার্থী।
রায়মশাই ভাইকে ডেকে আমার কথা বলেছিলেন, ‘শোন, উয়াকে আমাদিগের দক্ষিণের উপরের ঘরে লিয়ে যা একটু নিরিবিলি পাবে। ইদিকে তো পূজাপাজার ব্যবস্থা, হই হট্টগোল।’
বলেছিলাম, ‘তাতে কী, আমি তো তাই দেখতে এসেছি।’
রায়মশাই রাঙা হেসে বলেছিলেন, ‘তা তো দেখবেই বাবা, দেখবে বই কী। রাত্রেই তো সব—পূজা, বলি, যা কিছু। সারা রাত জেগে থাকতে হবে। দিনের বেলাটা নিরিবিলিতে একটু ঘুমিয়ে নেবে।’
কিন্তু উপরের ঘরে বলতে কী বুঝিয়েছিলেন, তখন বুঝিনি। জীবনে সেই জিনিসও নতুন দেখেছিলাম, মাটির ঘরের দোতলা, মাথায় খড়ের চাল। উঠোন পেরিয়ে দক্ষিণের ভিটায় গিয়ে মাটির সিঁড়ি উঠে গিয়েছিল। কোণ ঘেঁষে। উঠে দেখেছিলাম, চমৎকার। ইট-সিমেন্টের ভাজ নেই, গোবর-নিকানো মাটির মেঝে। তায় আবার দক্ষিণে পশ্চিমে জানালা। উত্তরে মাটির বারান্দায় দাঁড়ালে বাড়ির উঠোন। দক্ষিণের জানালায় মলুটির তেপান্তর দেখতে পাইনি। গুটিকয় গাছের নিবিড় ছায়া দেখেছিলাম, আম জাম তাল, আরও যেন কী। সেখানে ঘুঘুর কুররর কুররর ছাড়াও নানান পিক্ পিক্ চিক্ শিস ডাকাডাকি শুনতে পেয়েছিলাম। গাছের আড়ালে আড়ালে লাল মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল।
কিন্তু পাকাবাড়ি দেখেছিলাম যে! মলুটিতে নাকি রাজাদের পাকাবাড়ি করতে নেই। ছোট রায় তখন বলছিলেন, ‘জামাকাপড় ছেড়ে নীচেয় এসো, জল দিতে বলি। হাতমুখ ধুয়ে লাও।’
না জিজ্ঞেস করে পারিনি, ‘আচ্ছা, শুনেছিলাম, মলুটিতে আপনারা পাকা ঘর করেন না। কিন্তু কয়েকটা বাড়ি যেন—’
কথার মাঝখানেই ছোট রায় রাঙা মুখে হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সে বাবা তুমি ঠিকই দেখেছ, মলুটিতে মেলাই পাকা ঘর আছে। তবে, বুঝলে বাবা, সেসব আমাদিগের লয়, আমাদিগের দৌহত্তির বংশের। রাজারা যখন মেয়্যাদের বিয়া দিতেন তখন কুলীনদের ছেল্যা লিয়ে এসে, জমি-জিরাত দিয়ে মলুটিতেই বসত করাতেন।’
চলতে চলতে দেখেছিলাম ছোট রায়ের রাঙা মুখে, রাঙা হাসিতে একটু ধনুকের বাঁক। বলেছিলেন, ‘এখন কী হয়েছে জানো তো, আমাদিগের থিক্যা আমাদের দৌহিত্তিররা মল্টিতে বেশি হয়্যা গেল্ছে, হাঁ বুঝলে? তাদিগের অবস্থাও অনেক ভাল। আমাদিগের পাকা করতে নাই বটে, উয়াদের তা আছে। পাকাবাড়ি সব উয়াদের। তখন ছিলেন এক রাজা, তার নাম আনন্দচন্দ্র। তিনি—।’
ছোট রায় নিজেই থেমেছিলেন। অনুমান করেছিলাম, আর এক কিংবদন্তী। বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। আমি জল দিতে বলি গা, তুমি এসো।’
আমি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েছিলাম। তিনি নীচে নেমে গিয়েছিলেন। বাসি জামা খুলতে খুলতে ভাবছিলাম, কেন, মলুটির রাজারা কি আজ সব দিকেতেই সর্বহারা? নিজেদের জন্যে কি তাঁরা কিছুই রাখেননি?
সেই সময়ে মনে হয়েছিল, মেয়ে-গলায় যেন শুনতে পেয়েছিলাম, ‘ই দ্যাখ ক্যানে মুখপোড়া, হাত ছাড়। না হলে পিসামশায়কে যেয়ে সব বুলে দিব।’
কথাটা যেন কেমনধারা! দক্ষিণের জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়েছিলাম। বছর কুড়ি-বাইশের এক লম্বা শ্যামলা ছেলে, অই কি বলব হে, এক গোরা যুবতীর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে। ই দ্যাখ হে, নিজের শ্রবণকে না বিশ্বাস করতে পারি, শুনতে পেয়েছিলাম, ‘একটু কাছে আয় না!’
আ ছি ছি ছি, মুখপোড়াই তো বটে। যুবতীও ঠিক যুবতী নয়, ষোলো সতেরো হবে। ডাগর চোখের তরাস যা দেখেছিলাম, আগুন ছিল হে। তারপরেই এক গোঙানি, ‘তবে রে…।’
কথা শেষ হয়নি, চটাস করে এক থাপ্পড় মুখপোড়ার গালে। তৎক্ষণাৎ আঁচল শিথিল, শ্ৰীমতীর বেগে ছোটা। ছিরিমানের গালে হাত, তবে রাগ ঝাল ছিল না মুখে। তবে আস্তে আস্তে সরে এসে আমিও গালে হাত দিয়েছিলাম, ‘ই বাবা, মলুটি যে সাংঘাতিক রূপকথার দেশ হে!’