৬। আগন্তুক

৬। আগন্তুক

জয় প্রজাপালক রাজা বসুমানের জয়!

জয় মহর্ষি অগস্ত্যের জয়!

রাজপ্রাসাদের বাইরের প্রাঙ্গণে জমা হওয়া মানুষের জয়ধ্বনি প্রাসাদের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। প্রাসাদের দ্বিতলের প্রশস্ত অলিন্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজা বসুমান ও রাজমাতা কঙ্কাবতীদেবী, অগস্ত্য, ইরতেনসেনু এবং উপল। উপল জীবিকায় বণিক। বছরের বেশির ভাগ সময় তার কাটে সমুদ্রে। সে রাজানুগ্রাহী নয়। কিন্তু অগস্ত্যের সঙ্গে উপলের বন্ধুত্ব অচ্ছেদ্য। তারা দু’জনে একসঙ্গে এসেছিল বিদর্ভে। রাজা বসুমান উপলকে পছন্দ করেন। প্রশস্ত স্কন্ধের এই যুবকটি যেমন বলশালী তেমনই সাহসী এবং বুদ্ধিমান।

সম্প্রতি উপলের একার প্রচেষ্টাতেই সুদূর অসিরি দেশের সঙ্গে বিদর্ভের বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়েছে। উপল গতবছর বাণিজ্যের শেষে সেই দেশ থেকে এক অদ্ভুত সুন্দর রত্ন এনে দেয় রাজাকে। তার বর্ণ গাঢ় সবুজ- নীল। রাজা রত্নটির নাম রেখেছেন নীলকণ্ঠ। এখন যে উষ্ণীষটি পরে আছেন তাতে শোভা পাচ্ছে রত্নটি। এর বিনিময়ে বসুমান উপলকে পুরস্কার দিতে চাইলে সে নম্র স্বরে তা প্রত্যাখ্যান করে। বলে, ‘সমুদ্রেই আমার সংসার রাজন। আমার তরণীটি আমার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্থান। বছরের বেশিরভাগ দিন আমার সেখানেই কাটে, আমার ব্যক্তিগত সৌখিনতা বলতে সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্যের প্রতি দুর্বলতা। বিদর্ভের মাটিতে যেটুকু সময় কাটাই তাতে সেই সৌখিনতা যথেষ্ট পরিমাণে পূর্ণ করে আপনার পাকশালার রাঁধুনীরা। আমার এই মুহূর্তে তেমন কিছুই চাই না। যদি কখনও কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে নিশ্চয়ই আপনার দ্বারস্থ হব।’

উপল বিদর্ভে থাকলে অগস্ত্যের সঙ্গে তার গৃহে আশ্রয় নেয়। রাজপ্রাসাদে তার যাতায়াত অবাধ হলেও তাকে সাধারণত অন্তঃপুরে দেখা যায় না, মধ্যাহ্নে এবং সন্ধ্যায় রন্ধনশালার মধ্যেই উদরপূর্তি করে সে ফিরে যায়। তবে আজ বসুমান তাকে প্রায় জোর করেই এই অলিন্দে নিয়ে এসেছেন। সে বিদর্ভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রত্নটিকে আজ রক্ষা করেছে, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও। এবারেও তাকে পুরস্কৃত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন রাজা। সে বলেছে, ‘অগস্ত্য আমার ভাই, আমি বিপদে পড়লে সেও একই ভাবে ওই উন্মত্ত স্রোতে ঝাঁপ দিত আমাকে বাঁচাবার জন্য। এই কাজের বিনিময়ে আমি পারিতোষিক গ্রহণ করলে মহাপাপ হবে।’

তবে আজ উপল রাজার অপর অনুরোধটি ফেলতে পারেনি। প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হওয়া জনসমষ্টির অভিবাদন গ্রহণের পর অন্তঃপুরের ভোজনকক্ষে আজ সে যোগ দেবে রাজা, রানি, অগস্ত্য এবং লোপামুদ্রার সঙ্গে। ক্ষণিক আগেই তাদের আলাপ হয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য তাকে একা পেয়ে সব কথা খুলে বলেছে অগস্ত্য। এই দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মধ্যে গোপন কিছুই নেই।

অগস্ত্যের কথা শুনে আওয়াজ করে বেশ খানিকক্ষণ হেসেছিল উপল। কৌতুক করে বলেছিল, ‘হে ঋষি অগস্ত্য, আপনি ধর্মীয় শ্লোক আর গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি কাল্পনিক কাব্য রচনাতেও মনোনিবেশ করতে পারেন তো। নাম করবেন বেশ! তা ভালো, সহধর্মিনীটি তোমার অতীব সুন্দরী এবং বিদুষী। তার বুদ্ধির পরিচয় তো এই বাঁধ নির্মাণের কথাতেই শুনলাম তোমার কাছে। এই মেয়েই হয়তো এবারে তোমাকে গার্হস্থ্যের পথে নিয়ে যেতে পারবে।’

ইরতেনসেনুকে বেশ পছন্দ হয়েছে উপলের, ক্ষনিকের আলাপে বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে দু’জনে। তবে এখানে সবার সম্মুখে তাকে লোপামুদ্রা নামেই ডাকছে সে। এখন তার ডান পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরতেনসেনু, তার বাঁ-পাশে অগস্ত্য। রাজা এবং রানি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাদের সামান্য আগে।

বসুমান এবং অগস্ত্যের নামে ক্রমাগত জয়ধ্বনি চলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর অগস্ত্য কয়েক পা এগিয়ে এল। নিজের ডানহাত সামনের দিকে এগিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে জয়ধ্বনি স্তব্ধ হল। গলার স্বর উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়ে অগস্ত্য এবারে বলল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ। রাজা বসুমানের সম্মতি এবং রাজকোষের অনুগ্রহ ছাড়া এই কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। তবে এই কাজের সম্মান প্রাপ্তির অধিকার আরও যাদের আছে তারা হল সেই সহস্র শ্রমিক যারা এখন তাদের কুটিরে শ্রান্ত দেহে বিশ্রাম করছে, আপনারা তাদের নামে জয়ধনি করুন।’

প্রাসাদ প্রাঙ্গনে এবার শ্রমিকদের নামে স্তুতির রোল উঠল। তা থামলে পর অগস্ত্য আবার বলল, ‘একজন মানুষের দান এখনও আপনাদের অগোচরে রয়ে গেছে। সে না থাকলে এই প্রকাণ্ড কর্মযজ্ঞ শুরু করা যেত না। তার বুদ্ধিতেই দৈত্যাকার প্রস্তরখণ্ডগুলিকে নদীর তীর অবধি টেনে আনা সম্ভব হয়েছিল। সে আর কেউ নয়, আমার স্ত্রী, রাজকন্যা লোপামুদ্রা।’

ক্ষনিকের জন্য স্তব্ধতায় ছেয়ে গেল প্রাসাদপ্রাকার। বিদর্ভের মন্দিরে শিবের পাশাপাশি শক্তির পূজা হলেও প্রকাশ্যে কোনও নারীর নামে জয়গান গাওয়া হয়নি কখনও। রাজকন্যা লোপামুদ্রার অনির্বচনীয় রূপের পাশাপাশি অসীম গুণেরও অধিকারিনী! তার বুদ্ধি রাজগুরু অগস্ত্যের সমতুল্য। যোগ্য ধর্মপত্নী তিনি বটে!

জয় রাজকন্যা লোপামুদ্রার জয়!

জয় রাজকন্যা লোপামুদ্রার জয়!

কয়েক সহস্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে রাজদুহিতার জয়ধ্বনি হতে লাগল। বসুমান পিছন ফিরে তাকালেন ইরতেনসেনুর দিকে। সেই দৃষ্টি স্নেহ এবং গর্ববোধের অনুভূতিতে জারিত। ইরতেনসেনু রাজার দিকে তাকিয়ে সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে তাঁকে প্রণাম জানাল। তারপর প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার দিকে তাকাল। তার চোখ আনন্দে ঝলমল করছে। তার মন চলে গেল কয়েকশো যোজন দূরে থাকা নীলনদের দেশটির কাছে। তার নিজের দেশ, যে তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিল।

সামনে থাকা জনস্রোতের মধ্যে যেন তার দৃষ্টি আর স্থির হয়ে রইল না। সে দেখতে পেল সহস্র বছর আগে মরুভূমির বুকে ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্যকে। মাটির সঙ্গে কৌনিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা পাটাতন বেয়ে ভারী ভারী পাথর উপরের দিকে টেনে তুলছে শ্রমিকেরা। তৈরি হচ্ছে ফারাও খুফুর সমাধি। মাটি থেকে কয়েকশো হাত উপরে থাকা সেই সূচিমুখ সমাধিটি বর্তমানে এই পৃথিবীর এক অন্যতম আশ্চর্য।

ইরতেনসেনু নতুন কিছু আবিষ্কার করেনি। সহস্র বছরের পুরোনো এক জ্ঞানকে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছে ভারতবর্ষের মাটিতে। তার দেশ মিশরের জন্য মন কেমন করতে লাগল। ক্ষনিকের জন্য সে ভুলে গেল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অগস্ত্যের কথা, প্রাঙ্গণের জনতার কলরবের কথা। কেমন আছে তার ফেলে আসা গবেষণাগারের সঙ্গীসাথীরা? কেমন আছেন রানি হাতসেপসুত? তিনিও তো এক নারী হয়ে নিজের বুদ্ধিবলে মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন, আদায় করে নিয়েছেন দেশের মানুষের সম্ভ্রম। সেই দেশেও তো মন্দিরে মাতা হাথোরের পুজো হয়, যেমন এদেশে হয় মা শক্তির আরাধনা। কিন্তু সমাজে নারীর জায়গা কি পুরুষের সমান? তা যে নয় ইরতেনসেনু জানে।

এই বিপুল জনস্রোতের মাঝে এমন মেয়ে বেশ কিছু আছেই যারা হয়তো মেধায় তার সমকক্ষ, অথবা তার চেয়েও অধিক তীক্ষ্ণ তাদের বুদ্ধি। কিন্তু শিক্ষার আলো থেকে তারা বঞ্চিত, তাই এই পুষ্পগুলি কোনদিন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। ইরতেনসেনু চায় এমন এক পৃথিবী যেখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই। যেখানে নিজের মেধার পরিচয় দেওয়ার জন্য সমাজের উচ্চকোটির সুবিধাপ্রাপ্তির প্রয়োজন হবে না তার মতো। মনে মনে এই তুমুল জয়ধ্বনির মধ্যে সে সামান্য লজ্জিতই হয়। তার মন আবার চলে যায় মরুভূমির দেশটায়। মিশরে সে মেয়েদের একটি শিক্ষালয় তৈরি করেছিল। সেটি আছে এখনও? রাজধানী থীবসের মেয়েরা এখনও যায় সেখানে?

এমনটা ভাবতে ভাবতে আকাশের পানে তাকিয়ে ছিল ইরতেনসেনু। হঠাৎই তার নজর গেল আকাশের গায়ে লেগে থাকা একটি বিন্দুর দিকে। বিন্দুটি যেন চক্রাকারে ঠিক রাজপ্রাসাদের মাথার উপরে ঘুরছে। ইরতেনসেনু চিনতে পারে পাখিটিকে। বাজপাখিটিও নিশ্চয়ই অত উপর থেকেও চিনতে পেরেছিল ইরতেনসেনুকে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার কারণে তার ডানায় ক্লান্তি জমেছে।

সে এখন ধীরে ধীরে মাটির দিকে নেমে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *