২। ইরতেনসেনু
থীবস নগরী, মিশর।
থীবসের সূর্য ঝলমলে আকাশে আজ খুশির আলো। বাতাসে খুশির গন্ধ। গুগগুল আর মৃগনাভি ইন্ধন জোগাচ্ছে সেই গন্ধে। শহরের রাস্তায় আজ মানুষের ঢল নেমেছে। আনন্দে আত্মহারা তারা। আজ যে ওপেতের উৎসব!
সদ্য কয়েকমাস আগেই নীলনদে বন্যা হয়েছে। নদের পাড়ে থাকা শহর থেকে বন্যার জল নেমে গেলেও নীচু চাষের জমিতে তার চিহ্ন রয়ে গেছে। এই জলই বয়ে এনেছে নীলের বুকের কাদা মাটি। এতে আবাদি জমি আরও উর্বর হয়ে উঠবে। জমা জল সরে গেলেই শুরু হবে চাষের কাজ। গম, ভুট্টা, যব, পিঁয়াজ, বাঁধাকপিতে ভরে উঠবে খেতগুলো। এখান থেকেই খাদ্যের জোগান যাবে গোটা দেশে। বছরের এই সময়ে তাই ওপেতের উৎসবে মেতে ওঠে মিশরীয়রা। ধন্যবাদ জানায় আমুন-রাকে।
আমুন-রা মিশরের প্রধান ঈশ্বর। আকাশে থাকা সূর্য তিনি। তাঁর আঙুল থেকে জন্ম নিয়েছে নীলনদ। আমুনের আলোতে আলোকিত হয় পৃথিবী। রাতে আমুন পশ্চিমে হারিয়ে গেলে যে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে আসে চাঁদের ক্ষীণ আলো তাকে দূর করতে অক্ষম। মিশরীয়রা মনে করে এই অন্ধকারেই বাস শয়তানের। তাই তারা প্রতি রাতে প্রার্থনা করে যেন আগামী সকালে আবার আকাশে আমুনের দেখা পাওয়া যায়।
তাদের দেবতা কখনও তাদেরকে নিরাশ করেননি।
ওপেতের উৎসব আমুন-রা’র উদ্দেশেই। থীবস শহরের লাক্সরে আছে আমুনের বিশাল মন্দির। আজকের দিনে আমুনকে মন্দির থেকে বার করে পবিত্র নীলনদের জলে স্নান করানো হয়। তাঁর গায়ে জড়ানো হয় গাঢ় নীল পশমের বস্ত্র, গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় বহুমূল্য রত্নহার। আমুনের সেই মূর্তিকে বসানো হয় একটি কাঠের তৈরি নৌকায়। আজ আমুনের গন্তব্য কার্নাকের মন্দির। লাক্সর আর কার্নাক এই দুই মন্দিরই নীলনদের তীরে। দুই মন্দিরকে যোগ করেছে একটি বেশ চওড়া রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে রাখা অজস্র অদ্ভুতদর্শন মূর্তি। তাদের কারোর মাথা মানুষের, কারোর ভেড়ার, কারোর বা কুমিরের, কিন্তু তাদের শরীরগুলি হয় সিংহের। পবিত্র এই রাস্তার সর্বসময়ের রক্ষী এরা।
রাস্তার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে এক বিশাল শোভাযাত্রা। সবার সামনে আছে আমুনের পতাকা বাহকেরা, তাদের পিছনে বাদকেরা। ঢোল, বীণা, খঞ্জনি বাজাচ্ছে তারা, সেই বাজনার সুরে দেবতার গীত গাইছে মন্দিরের গায়কেরা। তাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষ। উজ্জ্বল নীল, লাল, হলুদ পোষাক তাদের পরনে। গায়কদের পিছনে আসছে কসরতকারীদের দল। তাদের কেউ ডিগবাজি খাচ্ছে, কেউ হাঁটছে উল্টো হয়ে হাতের ওপরে ভর দিয়ে। তাদের পিছনে দেখা যাচ্ছে দেশের সর্বশক্তিমান মানুষটিকে। আজ তাঁর জন্যও বড় একটি দিন। আজই তিনি ফারাও হবেন। আমুন-রা এর শক্তি আজ প্রবাহিত হবে তাঁর আত্মা ‘কা’-এর মধ্যে।
তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে মৃদু আপত্তি আছে এই মানুষটিকে নিয়ে। তার কারণ তিনি তো পুরুষ নন, এক নারী! এক মেয়ে দেশ শাসন করবে, এমনটা মিশরীয়রা দেখেছিল বটে কয়েকশো বছর আগে। কিন্তু সেই ঘটনা যে আবার ঘটতে পারে তা কেউ কোনওদিন ভাবেনি। রানি হাতসেপসুতের গায়ে আজ বহুমূল্য পোশাক। রক্তের মতো লাল এই পোশাকের কাপড় আসে পূর্বের যে দেশ থেকে তার নাম ভারতবর্ষ। আজ রানির সর্বাঙ্গে সোনার অলঙ্কার, তাতে শোভা পাচ্ছে চুনী ও পান্নার মতো রত্নেরা। রানি দু’হাত আকাশের দিকে তুলে মৃদু কণ্ঠে প্রার্থনা করছেন আমুন-রা’র। তাঁর খুব কাছে কেউ থাকলে আজ বুঝতে পারত হাতসেপসুতের গলার স্বর কাঁপছে। মুখের অমলিন হাসিটি বুকের মধ্যে থাকা আশঙ্কার দোলাচলকে লুকিয়ে রেখেছে। তাঁর দু’হাতে পরা চামড়ার দস্তানার দিকেও হয়তো কারোর নজর যায়নি।
হাতসেপসুতের পিছনেই আসছেন স্বয়ং আমুন-রা। কাঠের নৌকার ওপরে বসে থাকা তাঁর বিগ্রহকে কাঁধে করে নিয়ে আসছেন লাক্সরের মন্দিরের আট পুরোহিত। তাদের মুণ্ডিত মস্তক, পরনে সাদা কাপড়। তাদের মধ্যে প্রধান পুরোহিত সেনেনমুতকে আলাদা করে চেনা যায় তাঁর কোমরে জড়ানো চিতা বাঘের চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে। আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি। সেনেনমুত একাধারে পুরোহিত এবং রাজসভার মহামন্ত্রী। আবার তাঁর জ্যোতিষ শাস্ত্রের জ্ঞান অবিশ্বাস্য! প্রতি বছর খরা বা বন্যার সময় তিনি আগে থেকেই অনুমান করে ফেলেন অব্যর্থ ভাবে। সেনেনমুত তাঁর কর্তব্যে অবিচল। হাঁটার সময় যেন তাঁর চোখের পলকও পড়ছে না। এই দীর্ঘ রাস্তায় এত ভারী বিগ্রহকে কাঁধে করে আনার সময় বেশ কয়েকবার পুরোহিত বদল হলেও সেনেনমুত তাঁর জায়গা ছাড়েননি। রানি হাতসেপসুত একবার পিছন ফিরে তাকালেন সেনেনমুতের দিকে। অপাঙ্গে সেই দৃষ্টিকে খেয়াল করলেন তিনি। চোয়াল শক্ত হল। সেই সময় আগত প্ৰায়।
হে আমুন-রা! রক্ষা করুন আমাদের!
অনাম্নী এক জনৈকা কোলের শিশুটিকে নিয়ে এই শোভাযাত্রা দেখছিল। বাজনার তালে তালে দুলে উঠছিল শিশুর হাত। একসময় সে আকাশের দিকে তাকাল অবাক চোখে। আঙুল তুলে কিছু দেখাতে চাইল মাকে। পাখির দল শহরের আকাশ বেয়ে পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিমের দিকে। কিন্তু এখন তো ওদের ঘরে ফেরার কথা নয়! সেই ভরা দুপুরে…একী! একী হচ্ছে! আলো কমে আসছে কেন!
মুহূর্তের মধ্যে বাজনা থেমে গেল। কোন সম্মোহনী শক্তিতে যেন জনসমুদ্রের কলরব ক্ষণিকের নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে গেল। তার পরেই জেগে উঠল হাহাকার! কালো হতে থাকা আকাশের দিকে দু’হাত তুলে আর্তনাদ করতে লাগল তারা।
স্বয়ং আমুন-রা কুপিত হয়েছেন। তাঁর অভিশাপ নেমে আসছে মিশরের বুকে!
ওপেতের উৎসবের কয়েক চন্দ্রমাস আগের কথা।
‘সূর্যগ্রহণ!’
‘হ্যাঁ রানি, সূর্যগ্রহণ। আকাশের সূর্য ঢাকা পড়ে যাবে কালো এক বলয়ের আড়ালে। ‘আপনি ঠিক বলছেন তো সেনেনমুত?’
‘হ্যাঁ রানি, আমার গণনা নির্ভুল। আসন্ন ওপেত অনুষ্ঠানের দিনেই হবে সূর্যগ্রহণ। তা স্থায়ী হবে বেশ কয়েক ঘণ্টা।’
ভয়ে রানি হাতসেপসুতের দম যেন বন্ধ হয়ে এল। এমন কিছুর জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না! রানি সাহসী, বুদ্ধিমতী। স্বামী দ্বিতীয় তুতমোসের আকস্মিক মৃত্যুর পরে দেশের শাসন ব্যবস্থার হাল ধরতে হয়েছিল রানিকেই। তাঁর সৎ ছেলে তৃতীয় তুতমোসের বয়স যে তখন মাত্র দুই! এই সময় রাজধানীর সিংহাসন খালি থাকলে মিশরের সমূহ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আশেপাশের দেশগুলি সবসময় ওৎ পেতে থাকে। সামান্য দুর্বলতার সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে মিশরের ওপরে। তছনছ করে দেবে সোনার দেশটিকে।
গত আট বছর ধরে রানি বেশ শক্ত হাতেই সামলেছেন তাঁর দায়িত্বকে। তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধিতে শত্রু দেশ নুবিয়াও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আক্কাদিয়ান, হিতাইত, মিতানিদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গিয়েছিল। তারা জানে আদতে মিশরের সিংহাসন শূন্য। এক নারী বকলমে রাজত্ব চালাচ্ছেন। এই সময় প্রয়োজন এক ফারাওয়ের। নাবালক তুতমোসকে তো আর ফারাও বানানো যায় না, তাই স্বয়ং রানিই এগিয়ে এসেছিলেন আবার। মিশরের ইতিহাসে তৃতীয় বারের জন্য কোন নারী পরতে চলেছিলেন ফারাওয়ের মুকুট।
ওপেতের উৎসব হল ফারাওয়ের রাজ্যাভিষেকের দিন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করে এই দিনই আমুন-রা’র শক্তি প্রবাহিত হয় ফারাওয়ের মধ্যে। ফারাওয়ের আত্মা ‘কা’ এক হয়ে যায় আমুন-রা এর সঙ্গে। তাই রানি হাতসেপসুতেরও ফারাও হওয়ার দিন এই ওপেতের উৎসবই।
কিন্তু সূর্যগ্রহণ!
‘এ কীভাবে হয়?’
‘সেদিন সূর্য আর পৃথিবীর মাঝে চলে আসবে চাঁদ। তার ছায়ায় ঢাকা পড়বে সূর্যের আলো।’
‘তাহলে উপায়? আকাশে সূর্য না থাকলে যে দেশের মানুষ আমাকেই দায়ী করবে। তারা ভাববে আমার সাথে একাত্ম হতে চান না আমুন-রা! কোনওভাবেই আমি ফারাও হতে পারব না, আর তার ফল কী হবে বুঝতে পারছেন সেনেনমুত!’
প্রধান উপদেষ্টার কপালে তখন গভীর চিন্তার ছাপ, ওপেত উৎসবের দিন পূর্ব নির্ধারিত। সেই দিনটি বদলাতে গেলে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ জাগবে।
অস্থির ভাবে নিজের কক্ষে পায়চারি করছিলেন রানি। তাঁর সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেনেনমুত। কক্ষের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ
‘আর কে জানে এই সূর্যগ্রহণের কথা?’
‘আর কেউ জানে না রানি। গত পরশু আমি সামনের একটি বছরের আসন্ন মাসগুলির গণনা করছিলাম। তখনই আমার নজরে আসে এটি। দু’রাত আমি চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বার বার মিলিয়ে দেখেছি আমার অঙ্ক। প্রতিবার একই উত্তর এসেছে।’
সূর্যের দেবতা আমুন-রা এর উৎসবেই আকাশে সূর্য থাকবে না!
আলো, আলো চাই!
রানি সেনেনমুতের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। হতাশা আর দুশ্চিন্তা মেশানো গলায় বললেন, ‘এই আলোচনা আমার আর আপনার মধ্যেই থাক। অন্য কাউকে ঘুণাক্ষরেও এর কথা বলবেন না। আর একটা কাজ করুন, ইরতেনসেনুর কাছে খবর পাঠান। বলুন আমি এখনই দেখা করতে বলেছি।’
ছোট্ট পিঁপড়েটির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে ছিল ইরতেনসেনু। পিঁপড়ে তখন রুটির টুকরো মাথায় নিয়ে তার বাসার দিকে চলেছে। এই বাসাটি ইরতেনসেনুর বানানো। নিজের গবেষণাগারের একটি কোণে বালি এবং শুকনো মাটি দিয়ে তৈরি করেছে পিঁপড়েদের বসতি। দিনের অনেকটা সময় কাটে এদেরকে লক্ষ করে। থীবস শহর থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের গায়ে তৈরি হচ্ছে রানি হাতসেপসুতের বিশাল মন্দির। সেই মন্দির বানানোর দায়িত্ব ইরতেনসের উপরে। ওর তৈরি নকশা দেখে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে কয়েকশো শ্রমিক।
তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য ইরতেনসেনু বানিয়েছে একটি যন্ত্র। যাতে দড়ির সাহায্যে খুব ভারী পাথরও টেনে উপরে তোলা যায়। কিন্তু মানুষের শরীরের গঠন এমন যে আধুনিক যন্ত্র আবিষ্কার করলেও তার কায়িক পরিশ্রম সামান্য মাত্র কমে। একটানা বেশিক্ষণ কাজও করতে পারে না তারা। অথচ এই পিঁপড়েদের দেখ, নিজের থেকে অন্তত কুড়ি গুণ ভারী বস্তুকেও কেমন অনায়াসে বয়ে নিয়ে যায়। ইরতেনসেনু তাই এখন এদের নিয়েই মেতেছে। খুব কাছ থেকে এদেরকে লক্ষ করে বোঝার চেষ্টা করছে এই অমিত শক্তির রহস্য। পিঁপড়েদের দৈহিক গঠনের ওপরে ভিত্তি করে শ্রমিকদের জন্য বর্ম বানানোর ইচ্ছা ইরতেনসেনুর। সেই বর্ম পরলে হয়তো মন্দির তৈরির জন্য পাথর বয়ে নিয়ে যেতেও সমস্যা হবে না আর। কাজও এগোবে দ্রুত।
সামনের দুটো পা আর শুঁড়ই ধরে রেখেছে রুটির টুকরোটাকে। বাকি পাগুলি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করছে। ইরতেনসেনু অনেকটা ঝুঁকে এসেছে পিঁপড়েটির দিকে। নীলনদে ফোটা পদ্মের মতো আয়ত চোখ তার। পান্নার মতো হালকা সবুজ মণি সেই চোখের। ইরতেনসেনু দীর্ঘাঙ্গী, তার গায়ের রঙ শ্যামলা। দু’দিকে সামান্য উত্তল মুখ এসে শেষ হয়েছে তীক্ষ্ণ থুতনিতে। ঘন কালো চুল কাঁধ ছাপিয়ে পিঠের উপরে এসে নেমেছে। ইরতেনসেনু সুন্দরী, কিন্তু সেইদিকে ওর নিজের ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর মতে মানুষের আসল সৌন্দর্য তার শরীরে নয়, মস্তিষ্কের গভীরে। বুদ্ধিহীন সুন্দর মানুষ নিষ্প্রাণ রঙিন পাথরের মতোই। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই ইরতেনসেনু রানি হাতসেপসুতের সভার প্রধান কারিগর এবং বৈজ্ঞানিক। থীবস শহরের কোলাহল থেকে দূরে ছোট এক গ্রামের মধ্যে থাকে সে। এখানে তার কাজে মন বসে বেশি। নিজের বাড়ির একটি ঘরে সে বানিয়েছে গবেষণাগার। ইরতেনসেনু প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী।
সেনেনমুত নিজে দেখা করতে এসেছিলেন ইরতেনসেনুর কাছে। তিনি ইরতেনসেনুর পালক পিতা। ইরতেনসেনুর বয়স যখন সাত তখন এক অনাথ আশ্রম থেকে তাকে দত্তক নেন সেনেনমুত, তাকে আশ্রয় দেন নিজের পরিবারে। তারপর থেকে সযত্নে বড় করে তুলেছেন এই কন্যারত্নটিকে। এখন এই মেয়ে মিশরের গর্ব! ইরতেনসেনুর সঙ্গে একান্ত আলাপে সেনেনমুত জানিয়েছিলেন আসন্ন বিপদের কথা। সব শুনে ইরতেনসেনুর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। কিন্তু খানিক পরেই সে উজ্জ্বল চোখে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
‘রানিকে আমি কিছু দেখাতে চাই পিতা!’
‘খুব ভালো ইরতেনসেনু, তাহলে কবে প্রাসাদে আসবে বলো। তুমি চাইলে এখনই আমার সঙ্গে যাত্রা করতে পারো।’
‘না, আমি যেতে পারব না। যা দেখাব তা এখনই এই গবেষণাগারের বাইরে বার করা উচিত হবে না মনে হয়। আপনি রানিকে বলুন এখানে আসতে। আমার বিশ্বাস উনি কিছু মনে করবেন না।’
হাতসেপসুত চরম রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণী হয়েও আত্মদম্ভে ডুবে যাওয়ার মানুষ নন। অতি বিচক্ষণ তিনি। যখন শুনলেন ইরতেনসেনু তাঁর দর্শনপ্রার্থী, তখনই মনস্থির করেছিলেন ওর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার। সাধারণত ইরতেনসে এমন কিছু করে না। নিজেই হাজির হয় রাজপ্রাসাদে। এবারে নিশ্চয়ই কোন যথার্থ কারণ আছে। দু’দিন পরে রাত্রির অন্ধকারে এক ছায়া মূর্তিকে দেখা গেল রাজপ্রাসাদ থেকে বার হতে। অতি সাধারণ পোষাকে রানি হাতসেপসুত যখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে থীবসের রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কেউ ফিরেও তাকায়নি তাঁর দিকে। ইরতেনসেনুর কাছে আগাম খবর ছিল রানির আগমনের। নিজের গৃহের দরজার বাইরে সে অপেক্ষা করছিল।
‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই রানি এতটা পথ আসার জন্য। একই সঙ্গে আমি ক্ষমাপ্রার্থীও।’
‘তার কোন প্রয়োজন নেই ইরতেনসেনু। তুমি নিশ্চয়ই সেনেনমুতের মুখে সব শুনেছ?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা সত্যিই গুরুতর। তবে এর সমাধান করার একটি উপায় আমার জানা আছে।’
এই কয়েকদিনে এই প্রথমবার রানির মুখে আশার আলো ফুটে উঠল, ‘সত্যি! পারবে তুমি এই সূর্যগ্রহণকে ঠেকাতে?’
‘না, তা পারব না, এই মহাজাগতিক ঘটনাকে আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই রানি। কিন্তু আকাশে সূর্য না থাকলেও মাটিতে তার বিকল্প আমি হয়তো তৈরি করতে পারব।’
‘মাটিতে সূর্য! তার মানে?’
‘এই জন্যই আপনাকে আজ এখানে আসতে বলা। আপনাকে কিছু দেখাতে চাই আমি।’
ইরতেনসেনুকে অনুসরণ করে ওর গবেষণাগারে প্রবেশ করলেন রানি। ঘরের দেওয়ালের মধ্যে করা একটি খুপরিতে রাখা চুল্লীর আলোয় আলোকিত সেই ঘর। ঘরের মাঝখানে একটি কাঠের আসন, সেখানে বেশ কিছু প্যাপিরাসের পুঁথি অবিন্যস্ত ভাবে পড়েছিল। ইরতেনসেনু সেগুলোকে সরিয়ে রাখল একপাশে। তারপরে ঘরের এক কোণ থেকে একটি কাঠের বড় বাক্স নিয়ে এল। বাক্স খুলতেই দৃশ্যমান হল ভিতরে রাখা বস্তু। একটি কাচের গোলক, আকারে মানুষের মাথার তুলনায় সামান্য বড়। গোলকটি সম্পূর্ণ নয়। তার ফাঁকা অংশে লাগানো আছে ধাতব পাত, তা থেকে সরু সুতার মতো একটি অংশ উঠে গেছে গোলকের মধ্যে।
‘এটি কী?’
‘এই আমার আবিষ্কার রানি, এটিকে দেখাব বলে আজকে আপনাকে এখানে আসতে বলা।’
হাতসেপসুত বেশ ধন্দে পড়লেন, ‘তুমি বলতে চাইছ এই গোলকই সূর্যের বিকল্প হবে?’
‘হ্যাঁ, আপনাকে একটি জিনিস দেখাই।’
চুল্লীর মধ্যে রাখা ছিল একটি লোহার তৈরি পাত। এই ধাতু এ দেশে খুবই বিরল। আকাশ থেকে ধেয়ে আসা উল্কাতেই একমাত্র পাওয়া যায় একে। দেশের যত লোহা সব জমা হয় রাজ দরবারে। ইরতেনসেনু নিজের পদমর্যাদা বলে কিছু লোহা পেয়েছিল, এই টুকরোটি তার মধ্যে একটি। একটি আঁকশির সাহায্যে ইরতেনসেনু সেই পাতটিকে তুলে আনল চুল্লী থেকে। গনগনে আগুনের আঁচে সেই পাতে তখন কমলা আভা ফুটে উঠেছে। পাতটিকে দুটি কাদামাটির ইটের ওপরে রেখে তার ওপরে বসাল কাচের গোলকটিকে। গোলকের ধাতব অংশটি স্পর্শ করে রইল লোহার পাতকে।
এবার অপেক্ষা।
উৎসুক চোখে রানি তাকিয়ে ছিলেন গোলকের দিকে। ধীরে ধীরে গোলকের ভিতরে থাকা সরু সুতার মতো অংশটি লাল আভা ধারণ করল। তারপরে মনে হতে লাগল ওটি নিজেই একটি আগুনের টুকরো। সেই আগুনের আভা কাচের গোলক বেয়ে বাইরে আসতে লাগল। যদিও সেই আলো খুব সামান্যই, তাও রানির মনে বিস্ময় সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
‘এ কী করে সম্ভব হল! এ কোন জাদু!’
‘জাদু নয় রানি। বিজ্ঞান। এই কাচের গোলকের ভিতরে যে সূক্ষ্ম তন্তুর মতো বস্তুটি দেখতে পাচ্ছেন তা আমার তৈরি এক সংকর ধাতু। এই ধাতু সামান্য তাপেই উত্তপ্ত হয়। আর সেই উত্তাপে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তা থেকেই আলো আসে। কাচের গোলক সেই আলোকে প্রতিসারিত করে চারিদিকে। কিন্তু ক্ষীণ আলো কোন কাজের জন্যই যথেষ্ট নয়। যে উত্তাপ এর প্রয়োজন তা প্রায় গলন্ত লোহার পাতও দিতে অক্ষম। এখানেই আমি পিছিয়ে পড়েছি।’
‘তাহলে তুমি বলতে চাইছ….’
ইরতেনসেনু জানে রানি বুদ্ধিমতী, তাঁর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই সে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। পর্যাপ্ত পরিমানে তাপ এই ধাতুর তন্তুতে প্রবাহিত হলে যে আলো তৈরি হবে তা অন্ধকার রাতেও দিনকে ডেকে আনবে। ওপেতের উৎসবের দিন সূর্যগ্রহণের সময় এই যন্ত্রই আলো নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেই তাপ উৎপাদনের সময়ে যে শক্তির প্রয়োজন হবে তা আমি তৈরি করে উঠতে পারিনি। সেই বিদ্যা এখনও আমার অধরা।’
রানির মুখমণ্ডলে যে সামান্যতম আনন্দ ফুটে উঠেছিল তা ইরতেনসেনুর কথায় নিভে গেল আবার।
‘তাহলে উপায়? তোমার এই গোলকই আমায় চরম বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারত। সেই আশাটুকুও আর রইল না!’
ইরতেনসেনু রানির দিকে তাকিয়েই ছিল, এবারে দ্বন্দ্ব ভরা গলায় সে বলল, ‘একটি ক্ষীণ আশা এখনও আছে। আজকে আপনাকে এখানে আসতে বলার এটি দ্বিতীয় কারণ। প্রাসাদে প্রকাশ্যে এই কথা আমি আপনাকে বলতে পারতাম না।’
‘এই বিপদের দিনে তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছ ইরতেনসেনু। নির্দ্বিধায় বলো তুমি কী চাও? যত সোনা, যত লোহা তোমার লাগবে নিতে পারো। আমি কোষাধ্যক্ষকে বলে রাখব। মন্দির নির্মাণের কাজ থেকেও আপাতত তোমায় অব্যাহতি দিলাম। আর বলো, কী চাই তোমার?’
‘সোনা আমার চাই না। হ্যাঁ, আরও লোহার প্রয়োজন অবশ্যই। তবে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন একজন মানুষকে।’
‘কে সে?’
‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেই ভিনদেশি কয়েদি।
‘কার কথা বলছ বলত?’
বেশ কিছু আসামী এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় বন্দি। ওপেতের উৎসবের পরেই তাদের সাজা হবে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভিনদেশী। চুরির দায়ে ধরা পড়ে সাধারণত এরা। রানি বুঝতে চাইলেন ইরতেনসেনু ঠিক কার কথা বলতে চাইছেন। নামটি ইরতেনসেনু মুখে আনতে চাইছিল না। সেই নামের উচ্চারণে রানি হাতসেপসুতের প্রতিক্রিয়া তার ইচ্ছার অনুকূলে যাবে না, এই ছিল ইরতেনসেনুর আশঙ্কা। কিন্তু সেই নাম নিতেই হল। শব্দটি উচ্চারণের সময় গলা কেঁপে গেল তার।
‘অগস্ত্য!’
অগস্ত্য কোন চোর নয়, খুন করতে যাওয়ার সময় ধরা পড়েছে সে। যাকে সে খুন করতে যাচ্ছিল স্বয়ং সেই মানুষটি আজ দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইরতেনসেনুর সামনে। রানি হাতসেপসুত!