১৪। প্রহেলিকা

১৪। প্রহেলিকা

ভোরবেলায় ইরতেনসেনুর ঠেলায় অগস্ত্যর ঘুম ভেঙে গেল। তার পাশাপাশি ধড়ফড় করে উঠে বসল উপলও। উত্তেজিত গলায় ইরতেনসেনু তখন বলে চলেছে, ‘আমি পেরেছি! আমি পেরেছি! মেন্তুহোতেপের প্যাপিরাসের পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি আমি!’

তার কুড়ি বছর পূর্বে প্রাপ্ত শিক্ষার সামান্য অংশও যে সে আদতে ভোলেনি এই ভাবনায় ইরতেনসেনুর চোখমুখ ঝলমল করছিল। তার হাতে এখন ধরা আছে অন্য আরেকটি প্যাপিরাসের টুকরো, যাতে সে মিশরীয় ভাষায় লিখে রেখেছে মেন্তুহোতেপের লিখে যাওয়া কথাগুলিকে। অগস্ত্য ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘কী পেলে? পুন্তের শহরের হদিস পাওয়া গেল তাতে?’

ইরতেনসেনুর মুখের ঔজ্জ্বল্য যেন কিছুটা কমে এল। এবারে নিষ্প্রভ গলায় সে বলল, ‘না কোনও দিক নির্দেশ নেই। ফারাও মেন্তুহোতেপ একটি প্রহেলিকা লিখে রেখে গেছেন।’

চোখে মুখে জল দিয়ে অগস্ত্য এবং উপল আবার ইরতেনসেনুর পাশে এসে বসল। ঘুম এখন কেটে গেছে, মস্তিষ্ক পরিষ্কার। উপল জিজ্ঞাসা করল, ‘কী লেখা আছে তাহলে প্যাপিরাসটিতে, বলো তো।’

এই কথাটি লেখা আছে এতে, ‘উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা সর্পের মস্তক তুষারে আবৃত। সেখানে কামারু রক্ষা করেন আমুন-রাকে।’

‘আর কিছু লেখা নেই?

‘না, আর কিছু নেই। শুধু এইটুকু।’

অগস্ত্য, ইরতেনসেনু এবং উপল এরপর কিছুক্ষণ নীরব রইল। কারোর মুখে শব্দ নেই। এমন প্রহেলিকার সামনে পড়ে তিনজনেই স্তব্ধ। নীরবতা ভঙ্গ হল ইরতেনসেনুর জন্য, রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি জড়ানো গলায় সে বলল, ‘এই দুটি বাক্য যে পুন্তের শহরের দিক নির্দেশ করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’

অগস্ত্য বলল, ‘হ্যাঁ ঠিক। কামারু রক্ষা করেন…কামারু পুত্তের দেবতা তা তোমার মুখে গতকালই শুনলাম, মেন্তুহোতেপকে যে জন্তু নাকি দক্ষিণের যুদ্ধে জিতিয়েছিল।

‘হ্যাঁ। কিন্তু সর্পের মস্তক? তুষার? আমুন-রা?’

‘এগুলিরই কোন অর্থ বুঝতে পারছি না।’ এই বলে ইরতেনসেনু বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল। হাতদুটিকে শরীরের দু’পাশে টানটান করে ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। অগস্ত্যও উঠে দাঁড়াল।

ইরতেনসেনুকে লক্ষ করে বলল, ‘অনিদ্রার ক্লান্তি তোমার চোখে মুখে লেগে রয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নাও ইরতেনসেনু। আমি আর উপল ততক্ষণ ভাবছি না হয় এই প্রহেলিকার অর্থ।

সামান্য হেসে এর প্রত্যুত্তরে ইরতেনসেনু বলল, ‘এখন আর ঘুম আসবে না অগস্ত্য। ফারাও এত আশা করে আছেন আমার উপরে। তাঁর চোখের দিকে আমি তাকাতে পারছি না, একটা অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করছে। শুধু মনে হচ্ছে এই প্রহেলিকার অন্য প্রান্তে রয়েছে পুন্তের ঠিকানা, সেইটুকু জানতে পারলেই আমরা শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষটিকে সংগ্রহ করে আনতে পারি।’

‘সেই হারিয়ে যাওয়া শহর এখনও আদৌ বিদ্যমান কি না তাইই কিন্তু আমরা জানি না ইরতেনসেনু।’

‘কিন্তু এতটুকু আশা তো বুকের মধ্যে রাখতেই হবে, যে পুন্তের শহর এখনও বেঁচে আছে, সেখানে এখনও শ্বেত পুষ্প ফোটে। এই আশাটুকুর আলোও না থাকলে থীবসের ভবিষ্যত যে অন্ধকার! খবরটিকে কতদিনই বা আর গোপন করে রাখতে পারবেন ফারাও? যে কোনওদিন রাজ্যের সাধারণ মানুষরা জানতে পারবেন শ্বেতপুষ্পের একটি বৃক্ষ মৃত, দেবতা মন্তু আর রক্ষা করছেন না এই দেশকে। ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর উপরে এর প্রভাব কী হবে ভাবতে পারছ? তারা মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে, এরপর যে কোন বহিরাগত আক্রমণে…’

উপল এইসময় বিছানায় আবার শুয়ে পড়েছিল। তার ঘুম পাচ্ছিল। কিন্তু চোখ বুজে শুয়ে থেকেও তার কর্ণে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনুর কথোপকথন পৌঁছচ্ছিল। ইরতেনসেনুর কথা শেষ হল না, তার আগেই উপল লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘শ্বেতপুষ্প! ঠিক ঠিক! তখন থেকে আমি ভেবে চলেছি মিশরের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তুষার আসবে কীভাবে! পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা তুষারের বর্ণ শুভ্র। শুভ্র পুন্তের বৃক্ষের ফুলগুলিও!’

‘ঠিক!’

চঞ্চল গলায় অগস্ত্য বলল, ‘তাই তো। তাহলে তুষারে আবৃত অংশটিতে খুব সম্ভবত পুন্তের এই বৃক্ষরাজির কথাই বলা হয়েছে। একটি নয়, হয়তো কয়েক সহস্র বৃক্ষ, যাদের কাণ্ডে, শাখা-প্রশাখায় ফুটে থাকা অজস্র পুষ্পকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন তুষারই।’

ইরতেনসেনুর গলাতেও যেন এবারে সামান্য উচ্ছ্বাসের ঝলক দেখা গেল, ‘ফারাওয়ের মন্দিরের বাইরে বৃক্ষদুটি কিন্তু গত ছ’শো বছর ধরে বেঁচে ছিল। আমাদের সন্দেহ অনুযায়ী তাদের একটিকে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা না করা হলে সেটিও আজ মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকত শ্বেতপুষ্পের সমারোহে। অর্থাৎ পুন্তের সেই শহর হারিয়ে গেলেও, তাতে বসবাসকারী মানুষেরা সেখানে আর না থাকলেও সেই বৃক্ষরাজি নিশ্চয় এখনও আছে! প্রকৃতির নিজের খেয়ালে হয়তো কিছু কিশলয়েরও দেখা মিলতে পারে সেখানে! আশা তাহলে আছে অগস্ত্য! আশা আছে!’

‘কিন্তু সর্প? আমুন-রা?’

উপল এবার বলল, ‘এই দুটি জায়গাতেই আটকে যাচ্ছি আমরা। নাহ, এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে থেকে আমরা আর বেশি কিছু ভাবতে পারব না। বাইরের পরিবেশ এখন হয়তো অতি মনোরম। ভোরের এই সময়টায় সূর্যের তেজ কম থাকে। চল, আমরা একটু হেঁটে আসি।’

উটের উষ্ণ দুধ আর কিছু খেজুর দিয়ে প্রাতরাশ সেরে নিয়ে প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াল অগস্ত্যরা। কিছুক্ষণ আগেই ভোর হয়েছে। থীবস শহর সবেমাত্র জাগা শুরু করেছে। ফারাওয়ের প্রাসাদটি একটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। শত্রুর আকস্মিক আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য কোন অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ মিশরের রীতি। এতে বহুদূর থেকে আগত সেনার গতিবিধির উপরে নজর রাখা যায়।

পাহাড়টির পূর্ব কোলের সমতল অংশে প্রাসাদটি তৈরি হয়েছে। প্রাসাদের পিছনের পাহাড় আরও অনেকটা উপরের দিকে উঠে গেছে। তার চূড়াতে একটি পর্যবেক্ষণ কক্ষ অবস্থিত। এখানে সৈন্যরা দিবারাত্র পাহারারত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে চারটি দিকেই নজর রাখা যায়। ইরতেনসেনুরা সরু পাকদণ্ডী বেয়ে সেই চূড়ার দিকে উঠতে লাগল। এই রাস্তা সাধারণের নিত্য চলাচলের যোগ্য নয়। সৈন্যরা ছোট বড় পাথর সরিয়ে ভেঙে কোনরকমে যাওয়ার একটি পথ তৈরি করেছে। প্রথমে ইরতেনসেনু, তার পিছনে অগস্ত্য এবং উপল এই সঙ্কীর্ণ পথ দিয়ে চলতে লাগল।

চূড়ায় পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হল তাদের, এই পথে আসার জন্য যে পাদুকার প্রয়োজন তা তাদের তিনজনের কারোর পায়েই ছিল না। কিন্তু চূড়ায় পৌঁছে যে দৃশ্যের সম্মুখীন তারা হল তাতে এত পরিশ্রম যে সার্থক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দিগন্তে উজ্জ্বল রক্তবর্ণের সূর্যকে দেখা যাচ্ছে। দিনের এই সময়টায় তার দিকে চোখ মেলে তাকানো যায়। সূর্যের নরম আলোয় নীচে থীবস নগরীকে যেন ঘুমন্ত মায়াবিনীর মতো লাগছে, সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ায় সে যেন একটু একটু করে জেগে উঠছে।

নগরীর বাসিন্দাদের কক্ষে রাত্রে প্রদীপের আলো জ্বলে, সরণীগুলির ধারে জ্বলতে থাকে মশাল। এখনও তাদের সবক’টি নিভে যায়নি। এত উপর থেকে সেই ক্ষীণ আলোর বিন্দুগুলিকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত এই মায়বিনীর অঙ্গে যেন স্বর্ণের ঝলকানি। শহর ছাড়িয়ে উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণের দিকে যতদূর চোখ যায় ততদূরই ধূ-ধূ মরুভূমি। পূর্বে অনেকটা দূরে বয়ে চলেছে নীলনদ। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণ ভোরে শ্বাস নিল তারা তিনজন। পর্যবেক্ষণ কক্ষটি থেকে একজন পাহারাদারী সেনা বেরিয়ে এসেছিল।

ইরতেনসেনুদের দেখে মাথা নীচু করে কুর্নিশ জানিয়ে সে আবার কক্ষে ফিরে গেল। ফারাওয়ের প্রাসাদে আগত তিন অতিথির কথা সে শুনেছিল, তাদের মধ্যে একজন প্রাক্তন রাজ-উপদেষ্টা এবং বৈজ্ঞানিক ইরতেনসেনু তা সে জানে। একটি প্রশস্ত পাথরের উপরে ইরতেনসেনুরা তিনজন বসল। এই পরিবেশে মন অনেকটা শান্ত লাগছে। এতে যেন চিন্তাগুলিকেও কেন্দ্রীভূত করা যায় ভালো ভাবে। উপল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘সর্প, ফারাও মেন্তুহোতেপ কোন সর্পের কথা বলে গেছেন তা বুঝতে পারছি না। এই দেশে কেমন ধরণের সর্প দেখতে পাওয়া যায় ইরতেনসেনু?’

‘তিন-চার প্রকারের সর্প আছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগকেই দেখা যায় মরুভূমিতে। সবচেয়ে বিষধর সর্প হল গোখরো। এদের মাথার দু’পাশে চোখের ঠিক উপরে ছোট ছোট দুটি শৃঙ্গ থাকে। এদের একটি ছোবলেই মৃতু নিশ্চিত। এছাড়া আছে বালির ময়াল সাপ। এগুলি বিষধর নয়, কিন্তু এরা দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে গোখরোর তুলনায় বেশ কয়েকগুণ বড়। এরা শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে তার শ্বাসরোধ করে দেয়। মরুভূমিতে ছোট হরিণ বা পক্ষীকে শিকার করে অনায়াসে এরা গিলে ফেলতে পারে। আর নগরীর মধ্যে গৃহস্থের ভিটার আনাচে কানাচে থাকে কিছু বেলে সাপ, এরা নির্বিষ।’

‘হুম, এই সাপগুলির একটির কথাই কি বলেছিলেন ফারাও মেন্তুহোতেপ?’

‘জানি না উপল, মেন্তুহোতেপ কেন সর্পের কথা বলছেন তা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’

অগস্ত্য এবার বলল, ‘আচ্ছা, কোনও সর্পদেবের কথা বলা হয়নি তো ওই প্রহেলিকায়? যেমন কামারু এবং আমুন-রা এর কথা বলা আছে?’

‘সেটা হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। কারণ আমাদের পুরাণে সর্প কোন দেবতা নয়, দানব। তার নাম আপেপ। সে মাটির নীচের জগতে বাস করে। আমুন-রা দিনের শেষে যখন দিগন্তে মিলিয়ে যান তখন রাত্রির সময়ে মাটির নীচে যাত্রা করেন। পরের দিনের ভোরে আবার আমুন-রা তাঁর যাত্রা শেষে আকাশে দেখা দেন। রা-এর এই যাত্রাকালে তাঁর নৌকাকে আক্রমণ করে যে বিশালাকায় সর্প তার নাম হল আপেপ। আপেপ মিশরীয়দের কাছে অমঙ্গলের সূচক। কোন সাধারণ নগরবাসী খুব সহজে আপেপের নাম মুখেও আনবে না, কোনওভাবে অসাবধানতা বশত সেই নাম জিহ্বার অগ্রে এসে গেলেও সে আমুন-রাকে স্মরণ করবে।

‘সুতরাং রাজা মেন্তুহোতেপ কোনওভাবেই তাঁর প্রহেলিকায় আপেপের কথা বলবেন না। আপেপ ছাড়া আরও একটি সর্পের কথা মিশরীয় পুরাণে আছে বটে, তার নাম নেহেবকাউ। সেই সর্পটিও দানব প্রকৃতির। পরে রা তাকে নাকি বশ মানিয়ে দেবতায় পরিণত করেন। মৃত্যুর পর বিয়াল্লিশ জন দেবতা মৃতের আত্মার পরীক্ষা নেন, এদের মধ্যে নেহেবকাউ একজন। তবে নেহেবকাউয়ের উল্লেখ খুব বেশি আর কোথাও নেই। এই দেশে নেহেবকাউয়ের কোন মন্দিরও নেই। আরেকজন সর্পদেবতা আছেন, নাম আনহুর। কিন্তু তাকে পূজা করে মিশরীয়রা নয়, নুবিয়ার অধিবাসীরা। ফারাও এই দেবতাদের উল্লেখ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নথিতে করবেন বলে মনে হয় না।’

‘তাহলে সর্পটি কী? তা উল্টো ভাবেই বা শুয়ে আছে কেন?’

অগস্ত্যর এই প্রশ্ন যেন স্বগোতক্তির মতো শোনাল। তারা তিনজন আবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে প্রস্তর খণ্ডটির উপরে বসে রইল। একসময় কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবেই ইরতেনসেনু বলল, ‘ফারাওয়ের প্রহেলিকাটি আমাদের যথেষ্ট ভাবাচ্ছে বটে। পুন্ত নগরীর হদিশ যাতে খুব সহজে কেউ না পায় তার জন্যই এর সৃষ্টি সেটি বুঝতে আমাদের আর বাকি নেই। তবে ফারাও যে সেই শহরের ভাষাকে পুরোপুরি ভাবে রপ্ত করতে পারেননি তা বুঝেছিলাম।’

‘কীভাবে বুঝলে? হরফগুলির আকার দেখে?’

‘না না, সেগুলিকে বেশ যত্ন নিয়েই এঁকেছিলেন মেন্তুহোতেপ। কিন্তু একটি স্থানে চিহ্নে ভুল ছিল। অথবা বলা যায় ভুল চিহ্নের ব্যবহার করেছিলেন তিনি।’

‘আচ্ছা? কোন স্থানে?’

‘যেখানে চারটি চিহ্ন মিলে সৰ্প শব্দটিকে তৈরি করছে। সেখানে পাঁচটি চিহ্ন ছিল। বাকি চারটির সঙ্গে এটি থাকায় প্রথম দিকে এই অংশটির পাঠোদ্ধার আমি কিছুতেই করতে পারছিলাম না। তারপর মনে হল এই একটি চিহ্ন কোনওভাবেই পুন্তের ভাষারীতিতে নেই। সেটিকে বাদ দেওয়ার পরই বাকি চারটি চিহ্ন মিলে তৈরি করল সর্প শব্দটিকে।’

‘ইরতেনসেনু তুমি নিশ্চিত যে ওই চিহ্নটি পুন্তের নয়?

অগস্ত্য জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি একেবারেই নিশ্চিত। আমার স্মৃতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। গতরাত্রের চেষ্টায় পুন্ত নগরীর ভাষার সবক’টি হরফই আমার মনে পড়েছে নির্ভুল ভাবে।’

এবারে অগস্ত্যর কপালে ভাঁজ দেখা দিল। ফারাও মেন্তুহোতেপ এই ভুলটি করবেন? এত প্রয়োজনীয় একটি নথি, যাতে প্রহেলিকার আড়ালে লুকিয়ে রাখা আছে একটি আশ্চর্য নগরীর কথা, সেই নথিতে ভুল থাকবে? মাত্র দুটি বাক্য লেখার সময় ফারাওয়ের মনোযোগ বিঘ্নিত হবে? কোথাও যেন এটিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না অগস্ত্যর। সে বলল, ‘চিহ্নটিকে এঁকে একবার দেখাতে পারবে তুমি?’

ইরতেনসেনু সামান্য চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ পারব। দাঁড়াও।’

এই বলে সে উঠে গেল। সামান্য নীচু হয়ে কুড়িয়ে নিল একটি শুকনো গাছের শাখাকে। তারপর তা দিয়ে মাটির উপরে আঁক কাটতে লাগল। শুষ্ক, নরম মাটিতে এবার অস্পষ্ট একটি চিহ্ন দেখা দিল। ঝুঁকে দেখলে সেটিকে অপেক্ষাকৃত ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছে। মাটির কাছে বসে চিহ্নটিকে পরীক্ষা করছিল অগস্ত্য এবং উপল। উপল এবার বলল, ‘চিহ্নটিকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।’

একটি উল্লম্ব দাগ। তার মাঝখানটি সামান্য স্ফিত, সেখান থেকে দু’পাশে মোট চারটি দাগ বেরিয়েছে। এদের দুটি উপরের দিকে উঠেছে এবং দুটি নীচের দিকে বেঁকে নেমে এসেছে। চিহ্নটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মস্তকটিকে সামনে পিছনে আন্দোলিত করছিল উপল। অগস্ত্য জানে উপল কোনও কিছুকে মনে করার চেষ্টা করলে এমন আচরণ করে। একসময় উঠে দাঁড়াল সে। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমি নিশ্চিত এই চিহ্নটিকে দেখেছি। এবং কোথায় দেখেছি তাও মনে পড়েছে এখন। ফারাও মেন্তুহোতেপের সেই মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আমরা গতকাল দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানের একটি মাত্র অবশিষ্ট দেওয়ালে মেন্তুহোতেপ, শ্বেতপুষ্পের গাছ এবং কামারুর ছবি ছিল। মনে করে দেখো, সেখানেই ফারাওয়ের পায়ের কাছে এই চিহ্নটি খোদাই করা ছিল।’

উপল বলার সঙ্গে সঙ্গেই অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনুরও খেয়াল হল। সত্যিই তো এই চিহ্ন গতকাল তারা দেখেছে। প্রহেলিকার পাঠোদ্ধারের সময়ে ইরতেনসেনুর মস্তিষ্ক পুন্তের হরফ চেনাতেই ব্যস্ত ছিল। তাই এই চিহ্নটিকে একটি নিছক ভুল বলে ভ্রম হয় ইরতেনসেনুর। মেন্তুহোতেপ তাহলে হয়তো ইচ্ছা করেই সর্প শব্দটির মধ্যে চিহ্নটিকে রেখেছিলেন!

কিন্তু এই চিহ্নের অর্থ কী?

‘মেন্তুহোতেপের যে-কোনও মূর্তির গাত্রে এই চিহ্নকে দেখতে পাবে। ফারাও মেন্তুহোতেপই মিশরের প্রথম রাজা যিনি সমগ্র উত্তর এবং দক্ষিণ মিশরকে এক করতে পেরেছিলেন। এই চিহ্নের মধ্যের উল্লম্ব দণ্ডটি ফারাওয়ের রাজদণ্ডের প্রতীক। দু’দিকের বাঁকানো অংশ দুটি উত্তর এবং দক্ষিণ মিশরের প্রতীক। এই দুই অংশ এসে মিশেছে দণ্ডের মাঝখানে।’

‘কিন্তু এই দু’দিকের অংশ বাঁকানো কেন?

‘কারণ এই অংশদুটি উত্তর এবং দক্ষিণ মিশরের স্থলভাগকে বোঝায় না। বোঝায় নীলনদের উত্তর এবং দক্ষিণ অংশকে।’

এই কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে ইরতেনসেনু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, বুঝতে পেরেছি! ফারাও মেন্তুহোতেপের সর্প মরুভূমির গোখরো কিংবা আপেপ নয়! নীলনদ!

তাদের তিনজনের চোখের সামনে তখন বহুদূরে সুতোর মতো সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে নীলনদ। এতক্ষণ তাদের চোখের সামনেই ছিল সে। কিন্তু ফারাও যে সর্প বলতে নীলনদকে বোঝাবেন তা কেউ ভাবতেই পারেনি। অগস্ত্য যেন ইরতেনসেনুর কথায় এখনও সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে বলল, ‘কিন্তু উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা সর্প? নীলনদ উল্টো হয়ে থাকার অর্থ কী?’

ইরতেনসেনু আনন্দের আবেশে অগস্ত্যর দিকে এগিয়ে এল। তার উজ্জ্বল মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অগস্ত্যের দু’কাঁধে দু’হাত রেখে উত্তেজনায় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলল, ‘নীলনদ তো উল্টোই অগস্ত্য! এই নদীর গতি বিপরীতমুখী। অন্যান্য নদীর মতো এর জন্ম উত্তরে নয়, এই দেশের দক্ষিণে। সেখানে তৈরি হয়ে নীলনদ উত্তরে প্রবাহিত হয়েছে। তাই উল্টানো সৰ্প নীলনদই!’

এবারে অগস্ত্যর বুঝতে আর বাকি রইল না, ‘তাহলে সর্পের মস্তকে অর্থাৎ নীলনদের উৎসে রয়েছে তুষার, যা কিনা আসলে শ্বেত পুষ্পে আবৃত বৃক্ষের দল! সেখানেই আছে হারিয়ে যাওয়া শহর পুন্ত! ধন্য ফারাও মেন্তুহোতেপ! ধন্য তার মেধা!’

সত্ত্বর ফারাও হাতসেপসুতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল ইরতেনসেনুরা। খুশিতে আন্দোলিত গলায় ইরতেনসে ফারাওকে জানালো মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার কথা এবং তার অর্থ। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে ফারাওকে প্রহেলিকার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মেন্তুহোতেপের চিহ্নের ব্যাপারেও জানালো।

‘পুন্ত শহরের খোঁজ আমরা এবারে পাবই ফারাও! সেই স্থান থেকে শ্বেতপুষ্পের কিশলয় নিয়ে আসা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা!’

ইরতেনসেনুর দক্ষতায় ফারাও যে যারপরনাই খুশি হয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার প্রীত মুখেই তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ইরতেনসেনুর বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোতে যেন তবুও হাতসেপসুত ভেসে যাচ্ছিলেন না। তার কপালের অস্পষ্ট একটি ভাঁজ ইরতেনসেনুর চোখ এড়ায়নি। সে এবারে বলল, ‘আপনি মনে হয় এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না যে আমরা এই প্রহেলিকার সমাধান করেছি। আমরা কিন্তু নিশ্চিত যে নীলনদের উৎসেই রয়েছে হারিয়ে যাওয়া সেই পুন্ত নগরী।’

‘না ইরতেনসেনু, তোমাদের মেধার উপরে আমি বিন্দুমাত্র সন্দিহান নই। পুন্তের যে শহরের কথা আজ অবধি কেবল মাত্র লোকগাথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল সেই শহর যে আদতে কোথায় রয়েছে তা তোমরা খুঁজে বার করেছ। এখন তা আবিষ্কারের অপেক্ষা। কিন্তু আরও একটি বড় প্রশ্ন যে এখন তোমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। তার অস্তিত্ব হয়তো তোমাদের কাছে অজ্ঞাত, কিন্তু তুমি খবরটি আমাকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে সেই প্রশ্নটিকে একটি পর্বতের মতো দেখতে পেয়েছি। যা অলঙ্ঘনীয়।

‘সেটি কী ফারাও? জানান আমাদের। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’

ফারাও হাতসেপসুত এবারে ইরতেনসেনুর কাছে এগিয়ে এলেন, স্নেহের ছোঁওয়ায় নিজের ডান হাত দিয়ে ইরতেনসেনুর কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলিকে ঠিক করতে করতে বললেন, ‘এই দেশের সন্তান হিসাবে তোমার তো জানার কথা ইরতেনসেনু। নীলনদের উৎসে আজ অবধি কোন মিশরবাসী পৌঁছতে পারেনি। সেই পথ অগম্য।’

সঙ্গে সঙ্গে ইরতেনসেনুর বুকের মধ্যে একটি দীপ যেন কোনও এক হাওয়ার দমকে নিমেষে নিভে গেল। ফারাও যা বলছেন তা সঠিক। আনন্দের আতিশয্যে এই কঠোর বাস্তবিক সত্যটিকে ইরতেনসেনু ভুলে গিয়েছিল। মিশরের চারহাজার বছরের ইতিহাসে একটি মাত্র মানুষও নীলনদের উৎসে পৌঁছতে পারেনি। এই নদী যে কীভাবে তৈরি হয়েছে তা মিশরবাসীর কাছে অজ্ঞাতই থেকে গেছে। এই বাধা অলঙ্ঘনীয়, কোন মানুষের সাধ্য নয়। সে মাথা নামিয়ে নিয়ে চুপ করে রইল। তার মুখমণ্ডলের আলোকিত ভাব তখন অন্তর্হিত হয়েছে।

হাতসেপসুতের বলা কথাগুলি অগস্ত্যর কানে গিয়েছিল। সে এবার বলল, ‘কেন? সেই পথ অগম্য কেন?’

‘তার কারণ সেই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান। নীলনদ দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হয়েছে। নদী উত্তরে সাগরে মিশে যাওয়ার আগে তিন ভাগে বিভক্ত হলেও তার আগে অবধি একটিই খাতে বয়েছে। রাজধানী থীবসের দক্ষিণে এই নদীর অববাহিকা বরাবর পঞ্চাশ যোজন দক্ষিণে একটি জলপ্রপাত অবস্থিত। এই অঞ্চলেই রয়েছে নুবিয়দের রাজ্যের সীমারেখা। নদীটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হলেও এর উপরের বায়ু বিপরীত মুখে বয়। সেই বায়ুর বলে নৌকা নিয়ে প্রথম জলপ্রপাত অবধি পৌঁছে বাকিটা পথ যাওয়া যায় স্থলভূমির উপর দিয়ে, ঘোড়ায় বা উটের পিঠে।

‘মেন্তুহোতেপের সময় থেকেই নুবিয়রা ফারাওয়ের বশ্যতা স্বীকার করেছে, তাই সেই রাজ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন হবে না। কিন্তু তার পরের অংশেই দুর্গম এক অরণ্য শুরু হয়েছে, এর নাম সেশেনু। এই সেশেনুর জঙ্গল সমতলে নয়, পাহাড়ের গায়ে, গিরিখাতে বিস্তৃত। এই জঙ্গলে নুবিয়রা প্রবেশ করে না। তাদের বিশ্বাস সেখানে এক অপদেবতা বাস করে। কিছু বছর আগে সাহসে বলিয়ান হয়ে বেশ কয়েকজন মিশরীয় এবং নুবিয় অভিযাত্রী সেশেনুর অরণ্যে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ফিরে আসেনি। ফারাও মেন্তুহোতেপ কোনও এক গোপন পথে ওই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পুন্তে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল তার সঙ্গে সেই শহরের দুই নাগরিক থাকার কারণে। মেন্তুহোতেপ তার প্রহেলিকায় সেই পথের কোনও বিবরণ তো দিয়ে যাননি।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন হাতসেপসুত। অগস্ত্য এর প্রত্যুত্তরে বলল, ‘অপদেবতায় আমি বিশ্বাসী নই ফারাও। সেশেনুর জঙ্গলে প্রবেশ করার পর নীলনদের অববাহিকা ধরে হাঁটলেই তো উৎসে পৌঁছনো যাবে।’

‘সেটি সম্ভব নয় অগস্ত্য। কারণে যে স্থানে সেশেনুর জঙ্গল শুরু হচ্ছে সেখানেই রয়েছে নীলনদের বুকে সৃষ্ট দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম জলপ্রপাতটি। এই জলপ্রপাতের দু’পাশেই এমন ভাবে দুটি পাহাড় রয়েছে যে নদীর অববাহিকায় পৌঁছনোই যায় না। সেই কারণে পাহাড়ে এড়িয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বারে বারে সেই স্থানে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিলেন অভিযাত্রীরা।’

অগস্ত্যের কপালে এবারে চিন্তার ভ্রুকুটি পড়ল। সত্যিই কী তাহলে কোন উপায় নেই? শ্বেতপুষ্পের সন্ধান পেয়েও তার কাছে পৌঁছতে পারবে না তারা? সে মাথা নীচু করে বলল, ‘আমাদের কিছুটা সময় দিন ফারাও।’

হাতসেপসুত ক্লান্তির হাসি হেসে বললেন, ‘অবশ্যই।’

ফারাওয়ের চোখ দেখে বোঝা গেল তিনি কোনওরকম আশা রাখছেন না। এখন কোনও এক চমৎকারের অপেক্ষা করা দিবাস্বপ্ন দেখারই সমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *