১৩। মেন্তুহোতেপের প্যাপিরাস

১৩। মেন্তুহোতেপের প্যাপিরাস

প্রাসাদে ফিরে আসার পর এক পরিচারিকার সঙ্গে গ্রন্থাগারে এল অগস্ত্যরা। ফারাও এবং বাকারি কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হলেন, অগস্ত্যদের পৌঁছনোর খবর তাঁরা পেয়েছিলেন। হাতসেপসুত তাঁর বর্ণাঢ্য অঙ্গবস্ত্র ছেড়ে এখন একটি হালকা হলুদ বর্ণের বস্ত্র পরে আছেন, তাঁর অঙ্গশোভা বিহীন চিন্তান্বিত মুখের কালিমা দেখে আরও একবার বুকের মধ্যে কষ্ট অনুভব করল ইরতেনসেনু। এক নারী হয়েও আজ হাতসেপসুত যে উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন তার কথা যুগ যুগান্তর ধরে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

মিশরের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাঁকে বারবার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে। এমনকি নিজের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও রাজদরবারে হাতসেপসুতকে সোনার তৈরি নকল দাড়ি পরতে হয়। ফারাও যে কেবলমাত্র এক পুরুষই হতে পারবে এমন ভাবনা যেন মিশরের মানুষের মনের অবচেতনে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি যে বুদ্ধিতে এবং সাহসে কোন পুরুষের চেয়ে কম নন তা হাতসেপসুত বারবার প্রমাণ করেছেন।

মিশরে ফেরার পর ইরতেনসেনু শুনেছে যে হাতসেপসুতের কূটনৈতিক বুদ্ধিবলে হিতাইত জাতির সঙ্গে বহুবছরের শত্রুতার পর প্রথমবার সন্ধিস্থাপন সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে আবার তিনি নাকি সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে কঠোর হাতে পশ্চিম মিশরের একটি দাঙ্গাকে দমন করেছেন। কিন্তু নিয়তির লিখন হয়তো অন্যরকম ছিল, নারী হওয়ার জন্যই কি এখন তাকে আরও একবার এমন কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে?

‘মন্দিরে অনুসন্ধান করে কিছু অনুমান করতে পারলে?’ হাতসেপসুত ইরতেনসেনুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

‘না ফারাও, তেমন কিছু না। অগস্ত্যরা আগে কখনও জেহের জেসেরু দেখেনি তো, আমিও এই মন্দির তৈরি হওয়ার সময়টুকু দেখেছিলাম। তাই আজ একটু মন্দিরটি ঘুরে দেখলাম।’

মাটিতে গন্ধক পাওয়ার কথা ইরতেনসেনু বলল না, তারা ঠিক করে নিয়েছিল যে, বিষক্রিয়ার কারণে শ্বেতপুষ্পের গাছের মৃত্যুর কথাটা তারা ফারাওকে জানাবে না। কারণ তারা নিজেরাই এখনও নিজেদের অনুমানের উপরে সন্দিহান। আর এখন এই কথা জানিয়ে ফারাওকে আরও বিচলিত করে দেওয়াও ঠিক হবে না।

ইরতেনসেনুর কথায় ম্লান হাসলেন হাতসেপসুত, ‘তোমার তৈরি নকশায় বানানো জেহের জেসেরু। মিশরে এমন অপরূপ মন্দির আর দ্বিতীয়টি নেই। তবুও কোথাও কোনও কারণে হয়তো ভগবান আমার উপরে রুষ্ট হয়েছেন।’

এই বলে কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকলেন। ফারাওয়ের এই কথার কোনও উত্তর ইরতেনসেনুর কাছে ছিল না, সেও চুপ করে রইল। নিস্তব্ধ গ্রন্থাগারের মধ্যে আরও একটি অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতার সৃষ্টি হল যেন। সেটিকে কাটাবার জন্যই সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে উপল বলল, ‘আপনি আমাদের কিছু একটা দেখাবেন বলেছিলেন ফারাও। যে কারণে ইরতেনসেনুকে এখানে ডেকে আনা।’

উপলের কথায় হাতসেপসুতের যেন সম্বিত ফিরল, তিনি এবার বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।’

হাতসেপসুত আর বাকারির পিছনে গ্রন্থাগারের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগল ইরতেনসেনুরা। থীবস শহরের জনসাধারণের জন্য একটি আলাদা গ্রন্থাগার থাকলেও প্রাসাদের অভ্যন্তরে এই গ্রন্থাগারটি কেবলমাত্র বিশেষ কয়েকজনের জন্য উন্মুক্ত। ফারাও এবং তাঁর রাজসভার অমাত্যরা ছাড়া দেশের মন্দিরগুলির প্রধান পুরোহিতরাই কেবল এই গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারেন।

গ্রন্থাগারটি আকারে বেশ বড়। দৈর্ঘ্যে প্রায় আশি হাত লম্বা, প্রস্থে কুড়ি হাতের মতো। ঘরের দু’পাশে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে বড় বড় কাঠের তৈরি দেরাজ। তাদের মধ্যে রাখা আছে অসংখ্য কুণ্ডলী পাকানো প্যাপিরাস, পোড়ামাটি আর পাথরের পট্ট। মিশরীয়রা লেখালিখির জন্য এই তিনটি মাধ্যম ব্যবহার করে। একসময় নিজের গবেষণার তেমন কোনও কাজ না থাকলে দিনের প্রায় গোটাটাই ইরতেনসেনু এখানে কাটাতো। এই দেশের কত জ্ঞানী মানুষের হস্তে লিখিত কত মূল্যবান পাণ্ডুলিপি যে এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে তার সঠিক হিসাব মনে হয় কেউ জানে না।

পাণ্ডুলিপিগুলির বিষয়ও নানা রকমের। কোনওটির বিষয় হয়তো বিজ্ঞান, কোনটি আবার দেশের বিশেষ কোনও ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছে। আবার কোন পাণ্ডুলিপিতে দেশের ভূগোল, জল, মাটি, বায়ু নিয়ে লেখা আছে। পাথর এবং পোড়ামাটির পট্টগুলির বেশিরভাগ কোন আগের ফারাও-এর দেশের জনগনের জন্য তৈরি নিয়মাবলী। রাজত্ব পরিচালনার সময়ে কখনও কখনও মহামন্ত্রী বা ফারাওদের এই প্রাচীন পট্টগুলির দ্বারস্থ হতে হয়।

হাতসেপসুত ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। এখানে দেওয়ালের গায়ে একটি অংশে মাটি থেকে কিছুটা উপরে একটি ছোট কাঠের দরজা আছে। দরজাটির আকার দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তার পিছনে কোন কুঠুরি অবস্থিত। দরজাটি বাদামি বর্ণের, তার গায়ে সোনার পাতের উপরে তৈরি ফারাওয়ের প্রতীক লাগানো রয়েছে। এই ছোট্ট কুঠুরিতে রক্ষিত যা কিছু তা ফারাওয়ের নিজের সম্পত্তি।

ইরতেনসেনু বরাবর দরজাটিকে বন্ধ অবস্থাতেই দেখে এসেছে। কাঠের গায়ে ডান দিকে একটি ছোট ছিদ্র রয়েছে। রানি হাতসেপসুত তাঁর মাথার চুলের খোঁপা থেকে একটি লম্বা সরু শলাকা বার করে আনলেন। কুমিরের দাঁত থেকে তৈরি শলাকাটি একটি আঙুলের মতো লম্বা, শ্বেতবর্ণের। কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় শলাকাটির গায়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব ছেড়ে বেশ কিছু খাঁজ কাটা আছে। হাতসেপসুত শলাকাটি দরজার গায়ের ছিদ্রের মধ্যে প্রবেশ করালেন। তারপরে শলাকাটিকে সামান্য ঘোরালেন। খুট করে একটি শব্দ হল। দরজাটি খুললেন ফারাও। গ্রন্থাগারের দেওয়ালে লাগানো একটি মশাল খুলে নিয়ে এসে কুঠুরির কাছে ধরল বাকারি।

অগস্ত্য, উপল এবং ইরতেনসেনু সামনের দিকে ঝুঁকে এল। ডান হাত কুঠুরির মধ্যে ঢুকিয়ে একটি প্যাপিরাসের কুণ্ডলী বার করে আনলেন হাতসেপসুত। তারপর কোন কথা না বলে সেটিকে ইরতেনসেনুর হাতে দিলেন। ইরতেনসেনু সেটিকে নিয়ে কাছেই রাখা একটি ত্রিপদীর সামনে এসে দাঁড়াল। খুব যত্ন নিয়ে প্যাপিরাসের কুণ্ডলীটিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘এর গায়ে তো ফারাও মেন্তুহোতেপের সিলমোহর লাগানো আছে।’

‘হ্যাঁ, এই প্যাপিরাসটি মেন্তুহোতেপের নিজ হস্তে লেখা। তবে সিলমোহরের গায়ের হরফগুলি মিশরীয় হলেও ভিতরের ভাষা মিশরীয় নয়।’

ইরতেনসেনু অবাক চোখে হাতসেপসুতের দিকে তাকাল, তারপর সাবধানে শীলমোহর সরিয়ে প্যাপিরাসের কুণ্ডলীটিকে খুলতে লাগল। হাতসেপসুত বলে চললেন, ‘ফারাও মেন্তুহোতেপ পুন্ত থেকে ফেরবার পর কিছু একটা লিখে রাখেন এই প্যাপিরাসে। তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল যে সর্বদা এটি যেন ফারাওয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহেই থাকে। আর অন্য কেউ যেন ফারাওয়ের অনুমতি ব্যতীত এই প্যাপিরাসকে স্পর্শ না করে। কিন্তু এর ভাষা মিশরীয় ছিল না। দু’বছর দক্ষিণের সেই নগরীতে কাটিয়ে তাদের ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন মেন্তুহোতেপ। সেই হরফে লেখা এই প্যাপিরাস।

ইরতেনসেনু কুণ্ডলীটিকে খুলেই তার হরফগুলিকে চিনতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে সে যেন চলে গেল প্রায় কুড়ি বছর আগের এক সন্ধ্যাবেলায়। এক কিশোরী প্রবল মনযোগ দিয়ে একটি অদ্ভুত ভাষাকে আয়ত্ত করার চেষ্টায় রত। তাকে তার পালক পিতা এই শিক্ষা প্রদান করেন প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায়। কাজটি মোটেই সহজ নয়, এই অদ্ভুত ভাষার হরফগুলিকে শিখতে কিশোরীকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। অথচ সে দেখে যে তার আশে পাশের কেউ এই ভাষায় কথা বলে না, এই হরফে লেখা কোনও প্যাপিরাস অথবা মন্দির গাত্রের কোনও মন্ত্র সে পড়েনি। অনুশীলনের প্রয়োজন ব্যতীত আর কোথাও সে এই ভাষার অস্তিত্ব দেখতে পায় না। তাই একদিন সে তার পালক পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই ভাষাটি আমি কেন শিখছি? এর ব্যবহার তো আমাকে কোনদিন করতে হয় না।’

ইরতেনসেনুর আজ মনে পড়ল আবার, সেদিন তার সেই প্রশ্নে সেনেনমুতের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। নিজের স্বাভাবিক শান্ত স্বরে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘প্রিয় কন্যা, এই ভাষা তোমাকে আয়ত্ত করতেই হবে। এই ভাষার পাঠ এই দেশে একমাত্র আমি করতে পারি, সেই জ্ঞান আমি কেবল তোমাকে দিয়ে যেতে চাই। ঈশ্বর করুন এই ভাষার সম্মুখীন যেন তোমাকে কখনও না হতে হয়। যদি কখনও তেমন দিন আসে তাহলে জানবে, এই ভূখণ্ডের উপরে মহাবিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে। সেদিন তোমার এই বিদ্যা কাজে আসবে।’

তাহলে আজই সেই দিন! কৈশোরের সেই শিক্ষার দিনগুলির কথা ইরতেনসেনু বিস্মৃত হয়েছিল। আজ এই প্যাপিরাস হাতে নিয়ে যেন সেই সন্ধ্যাগুলিকে স্পষ্ট দেখতে পেল সে। আজ সত্যিই এই দেশের ভবিষ্যত অনিশ্চিত, শিয়রে বিপদ এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের সমস্ত স্নায়ুকে একত্র করে প্যাপিরাসটির উপরে ঝুঁকে পড়ল ইরতেনসেনু। দেশের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।

ফারাও মেন্তুহোতেপ এই প্যাপিরাসের কোথাও পুন্তের হারানো সেই শহরের কথা লিখে থাকলে সেই শহরে পৌঁছনোর পথের কথাও নিশ্চয়ই লিখে গেছেন। মশালের কমলা-হলুদ আলোয় প্যাপিরাসের গায়ে লেখা হরফগুলিকে পড়ার চেষ্টা করতে শুরু করল সে। বহু বছর আগে শেখা ভাষাটি একেবারে ভুলে যায়নি সে, হরফগুলিকে চিনতে পারছে একটু একটু করে।

ইরতেনসেনুর দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল অগস্ত্য এবং উপল। তারা দুজনেই মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে হরফগুলিকে দেখতে লাগল। এই ভাষার চিহ্নগুলি কিছু সাংকেতিক ছবি এবং কিছু দাগের সমন্বয়ে তৈরি। সংকেতগুলি জীবের, সেগুলি যেন কিছু মাছ, পাখি এবং চতুষ্পদ জন্তুর মতো। তার সঙ্গে মিলে মিশে থাকা দাগগুলি রয়েছে উল্লম্ব এবং পাশাপাশি। দাগগুলি সরল রেখাতে হলেও তাদের কোনওটির মাথার কাছে সামান্য চওড়া এবং কৌনিক একটি করে দাগ দেওয়া রয়েছে। অগস্ত্য এবং উপল পরস্পরের মুখের দিকে চাইল, তাদের দুজনের চোখেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। পরক্ষণেই আবার তারা প্যাপিরাসটির দিকে তাকাল।

ইরতেনসেনু বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্যাপিরাসটি নিরীক্ষণ করে চলল। হঠাৎই তার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হল, ফারাওয়ের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘মহামান্যা ফারাও, আপনি দয়া করে আজকের রাতটুকু আমাকে দিন। বহু বছরের অনুশীলন না থাকার কারণে সবক’টি হরফ চিনতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমার স্মৃতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আজ রাতের মধ্যেই এই প্যাপিরাসের পাঠোদ্ধারে সক্ষম হব আমি। হয়তো এতেই খুঁজে পাব পুন্ত শহরে পৌঁছনোর উপায়। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি এই ভাষাটি পড়তে পারব?’

হাতসেপসুত কিছু বলার আগে বাকারি বলল, ‘পিতা মৃত্যুশয্যায় থাকাকালীন আমাকে বলে গিয়েছিলেন, পুন্ত শহরের ভাষা তুমিই কেবল জানো, কোনও প্রয়োজনে যেন তোমার সাহায্যপ্রার্থী হই। সেই দিনটি যে এত দ্রুত চলে আসবে তা ভাবিনি।’

সেনেনমুত যে জীবিত নেই সেই চিন্তা যেন আরও একবার ইরতেনসেনুকে আঘাত করল। তার হৃদয় আর্দ্র হয়ে এল। কিন্তু পরক্ষণেই মনকে শক্ত করে নিল সে। সেনেনমুত তাকে যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তা সে পালন করবেই। অগস্ত্য এবং উপলের সঙ্গে সে অতিথিশালায় ফিরে এল। সঙ্গে করে নিয়ে এল প্যাপিরাসটিকে। রাত্রের আহারের শেষে অগস্ত্য এবং উপল শুয়ে পড়লেও ইরতেনসেনু জেগে রইল, নিমগ্ন হল প্যাপিরাসটির পাঠোদ্ধারে। এই নিস্তব্ধ রাত্রি তার একমাত্র সঙ্গী। সেনেনমুতের আত্মাও যেন এই সময়ে ইরতেনসেনুর পিছনে এসে দাঁড়ালেন, তাকিয়ে রইলেন তার পালিত কন্যাটির দিকে। ইরতেনসেনুর একাগ্র অধ্যয়ন চলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *