৩। অগস্ত্য

৩। অগস্ত্য

যে দুটি কারণে শত সমৃদ্ধির মধ্যেও বিদর্ভের ললাটে দুঃখের ছায়া লেগেছিল তাদের একটি হল বিদর্ভের রানির শূন্য কোল। এই নিয়ে রাজা বসুমানের মনে কষ্টের অন্ত ছিল না। যে বিদর্ভের বসুন্ধরা শস্যশ্যামলা তার মহারানির গর্ভ অনুর্বরই রয়ে গিয়েছিল! তবে চার বছর আগে রাজা বসুমান এক আশ্চর্য উপায়ে এক কন্যাসন্তান লাভ করেছেন। কিন্তু রাজত্বের এই দুঃখ যখন মিটল তখন আরও এক শঙ্কা দিগন্তে দেখা দেওয়া কালো মেঘের মতো ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। তার প্রকাণ্ড ছায়া যেন গ্রাস করতে চাইছে বিদর্ভের ভবিষ্যতকে। আপাতদৃষ্টিতে তাকে তুচ্ছ মনে হলেও সেই মেঘ যে একসময় চরাচর ছেয়ে ফেলবে তা রাজা বসুমান জানতেন বিলক্ষণ। বিদর্ভের এই অপর দুঃখটি ছিল জলাভাবের। কিন্তু জলের অভাব বিদর্ভে কীভাবে হবে? বছরের দুটি মাস যে প্রবল বর্ষণে ভেসে যায় এই অঞ্চল, শস্যে ভরে থাকে বিদর্ভের খেত।

অভাব আসলে পানীয় জলের। গত এক শতাব্দী ধরে বিদর্ভের মানুষ বর্ষার জলকেই ধরে রাখত কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা জলাশয়ে। সেই জল ছিল রাজ্যের মানুষের পানীয় জলের একমাত্র জোগান। বিদর্ভে কোন কুয়ো নেই, কারণ ভূগর্ভস্থ জল এখানে সামান্যই। ক্রমে রাজ্যের সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে জনসংখ্যাও। গত কয়েক দশকে বিদর্ভের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আরও ভালো জীবনের আশায় এসে বাসা বেঁধেছে বিদর্ভের বুকে। এতে রাজ্য হয়েছে আরও সমৃদ্ধ, বলশালী।

এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে ঠাঁই দেওয়ার জন্য রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণে। দক্ষিণ-পূর্বের দণ্ডক অরণ্যের কিছু অংশকে পরিষ্কার করে গড়ে উঠেছে নতুন কিছু বসতি। কিন্তু বর্ষার জলের পরিমাণ তো বাড়েনি, আজও তা শস্য ফলানোর জন্য যথেষ্ট হলেও মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাহলে উপায় কী? আরও কয়েক দশকের মতো বিদর্ভেরও কি অবস্থা হবে বর্তমানে নিশ্চিহ্ন সিন্ধুর জনপদের মতো?

বিন্ধ্য পর্বতমালা থেকে যে প্রধান নদীটির উৎপত্তি হয়েছে সেই নর্মদা বিদর্ভের রাজধানী কুন্দিনাপুরী থেকে প্রায় পঞ্চাশ যোজন দূরে। এই অঞ্চলে যে অন্য একটি মাত্র নদী আছে তার নাম পয়োষ্ণী। রিক্ষ পর্বতের চূড়া থেকে তার জন্ম হওয়ার পর সে বয়ে গেছে পশ্চিমের দিকে। পয়োষ্ণীর গতিপথ বিদর্ভের সর্বপশ্চিমে থাকা রাজ্যগুলি থেকেও প্রায় আধ যোজন দূরে। রাজধানী কুন্দিনাপুরী থেকে তার দূরত্ব দুই যোজন। পয়োষ্ণীর জল বছরের কোন সময়ে শুকায় না। ভরভর সেই নদী নিজের মনের আনন্দেই যেন বয়ে চলেছে। এই নদীর জল পেলে আগামী কয়েকশো বছরে বিদর্ভবাসীদের জলের আর কোনও অভাব হবে না। কিন্তু নদীর দু’ধার পাথুরে, বসবাসের অযোগ্য। তাই বিদর্ভের রাজত্বকে যে নদীর তীরে আনা যাবে এমনটা সম্ভব নয়। অতএব মানুষ নদীর কাছে আসতে পারবে না।

‘কিন্তু নদী কি মানুষের কাছে আসতে পারে?

এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে চমকে গিয়েছিলেন রাজা বসুমান। যে যুবকের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন এসেছিল রাজা তার তুলনায় বয়সে কয়েক দশকের বড় হলেও তাকে সম্মান করেন গুরুজ্ঞানে। যুবকটির নাম অগস্ত্য। সেদিন রাজাকে এই প্রশ্ন করার সময় অগস্ত্যের মুখে লেগেছিল একটি হাসি, যেন সেই প্রশ্নের উত্তর জেনেই সে রাজাকে প্রশ্নটি করেছে।

‘এই কাজ প্রায় দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয় রাজন।

‘কীভাবে মহর্ষি? পয়োষ্ণী নদীকে আমি দেখেছি। তার প্রস্থ গঙ্গার মতো না হলেও সে খরস্রোতা, সেই নদীকে বিদর্ভের কাছে সরিয়ে আনা কি সম্ভব? এ যে অতিমানবিক ভাবনা!

‘ঠিক, অতিমানবিকই বটে, একজন মানুষের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। তবে সহস্র মানুষের পক্ষে অসম্ভবও নয়। আপনি যদি আমাকে ওই পরিমাণ মানুষ, পঞ্চাশটি হাতি এবং একশোটি তেজী ঘোড়া দিতে পারেন তাহলে আমি চেষ্টা করতে পারি।’

অগস্ত্যের কথায় রাজা বসুমান বিশ্বাস না করলেও আর দ্বিরুক্তি করেননি। এই যুবক যে অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী তা তিনি জানেন। ছয়টি বছর আগে অগস্ত্য বিদর্ভে এসে পৌঁছয়, নিজের পরিচয় জানায় এক আর্য হিসাবে। কিন্তু তাকে কি সত্যিই আর্যদের মতো দেখতে? অগস্ত্যের দীর্ঘ দেহ আর চওড়া কাঁধ আর্যদের মতো হলেও তার গায়ের রং যেন অন্যরকম। পাকা ধানের খেতে যে গাঢ় সোনালি আভা দেখা যায় তাই যেন অগস্ত্যের ত্বকে শোভা পায়। রাজা এমন জনশ্রুতি শুনেছেন যে, দীর্ঘকাল হিমালয়ে তীব্র সূর্যালোকে তপস্যা করার ফলে অগস্ত্যের গাত্রবর্ণ এমন। সেই ঘোর তপস্যাই তাকে অমিত ক্ষমতার অধিকারী করেছে।

কুন্দিনাপুরীতে এসে উপস্থিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই একের পর এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাতে থাকে অগস্ত্য। তার যোগবলে নাকি জমিতে আরও ফসল ফলেছে, কোন এক সুরা পান করিয়ে গবাদি পশুদের মারণ রোগের হাত থেকে নাকি বাঁচিয়েছে সে, মাত্র একটি লাঠিকে সম্বল করে নাকি একাই এক ডাকাতদলের মহড়া নিয়েছে। নগরের প্রান্তে থাকা তার ছোট্ট কুটিরে রাতে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। ঋষি অগস্ত্য নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের অস্ত্রটিকে নিজের কাছে এনে রেখেছে।

এমন দেবতূল্য পুরুষকে রাজা বসুমান সাদর আমন্ত্রণ জানাতে দেরি করেননি। কয়েক চন্দ্রমাসের মধ্যেই অগস্ত্য রাজার সভায় রাজগুরুর স্থান লাভ করে। তারপর একদিন হঠাৎই দেখা যায় তার কুটির শূন্য। কোনও এক রাতের অন্ধকারে বিদর্ভ ছেড়ে গেছে ঋষি। সে যে কোথায় গেছে তা কেউ জানতে পারেনি। রাজ্যবাসীর মুখে মুখে কতই না খবর ছড়িয়েছে তারপর, তার কিছু কিছু বসুমানের কানেও এসে পৌঁছেছিল। মহর্ষি অগ্যস্ত নাকি দণ্ডকারণ্যে তপস্যারত, তার শরীর নাকি প্রস্তরীভূত হয়েছে কোন এক বিশাল বটবৃক্ষের নীচে। সে নাকি স্বয়ং ইন্দ্রের আমন্ত্রণে দেবলোকে প্রস্থান করেছে, সেখানে অসুর দমনে ব্যস্ত। এমনকি এমনও শুনেছিলেন রাজা যে, মহাত্মা হিমালয়ের দিকে যাত্রা করেছে, আরও একশত বছর অতিক্রান্ত করে আরও জ্ঞানশালী হয়ে ফিরে আসবে সে।

থীবস শহরটির বেশির ভাগ অংশ নীলনদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। রানির প্রাসাদ, ধনীর অট্টালিকা, গরিবের কুটির, নাগরিকদের চলার রাস্তা, ব্যস্ত বাজার, সবুজ শস্যক্ষেত্র সবই আছে এখানে। কিন্তু এই বর্ণাঢ্য শহরের উত্তরের দিকটি রুক্ষ, শুষ্ক, ছোট ছোট বালি পাথরের পাহাড়ে আবৃত। শহরের সবাই ওই জায়গাটিকে ডাকে মৃতের উপত্যকা নামে।

এখানে যতদূর চোখ যায় দেখা যায় কবরখানা। শহরের সাধারণ মানুষদের মৃত্যুর পরে এখানে আনা হয়, স্বয়ং ফারাও ও তাঁর পরিবারের কেউ মারা গেলেও তাঁদের গন্তব্য হয় এই উপত্যকাই। এইখানে পাঁচটি মমি তৈরির কর্মশালা আছে। সারা বছর সেইগুলি ব্যস্ত থাকে মৃতের অন্য জগতে গমনের পথকে প্রস্তুত করার কাজে। কর্মশালাগুলি ছাড়া আর একটি মাত্র বড় বাড়ি আছে এখানে। নদীর পূর্ব পাড় থেকেও দেখা যায় একে। দেশের সবচেয়ে বড় এবং দুর্ভেদ্য কয়েদখানা এটি। শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের রাখা হয় এখানে।

অগস্ত্য আজ প্রায় কতদিন হল এই ছোট্ট কুঠুরিতে বন্দি তা তার খেয়াল নেই। কুঠুরির চার দেওয়ালে কোন জানলা নেই। একটি মাত্র দরজা, তাও তা আজ অবধি একটি বারের জন্যও খোলেনি। দরজার নীচের অংশ দিয়ে দিনে দুবার খাবার আসে। সামান্য ডাল আর শুকনো রুটি। তাই দিয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি করতে হয়। কুঠুরির আলো এবং বাতাসের একমাত্র উৎস পাঁচ আঙুল চওড়া একটি গোলাকার গবাক্ষ। তা অগস্ত্যের মতো দীর্ঘদেহী পুরুষেরও নাগালের বাইরে। সেই গবাক্ষের ভিতর দিয়ে আসা ক্ষীণ আলোর রেখাতেই দিন রাতের চলাচল বোঝে অগস্ত্য। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি অন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই তো দেখা যায় না। চোখের কোনপ্রকার কাজই নেই এখানে। আবার এই অন্ধকারেই যেন চোখ আরও বেশি করে দেখতে পায়। কালো পর্দায় যেন ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনগুলো। স্মৃতিরা চলতে শুরু করে। সে ভাবে তার শৈশব, কৈশোরের দিনগুলির কথা, বিদর্ভের কথা। অগস্ত্যের মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি পাগলই হয়ে যাবে। বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই অভিশপ্ত দিনটি।

সেইদিন অগস্ত্য হাজির হয়েছিল রানি হাতসেপসুতের সভায়। নিজের পরিচয় দিয়েছিল ভারত থেকে আসা বৈজ্ঞানিক হিসাবে। অগস্ত্যের মুখে স্থানীয় মিশরীয় ভাষা শুনে অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং রানি। বিজ্ঞানচর্চায় মিশর অনেক এগিয়ে থাকা এক দেশ। অগস্ত্যের উদ্দেশ্য ছিল সেই জ্ঞানের আহরণ করা বিজ্ঞানের গূঢ় তথ্য লুকানো থাকে দেশের কিছু হাতে গোনা বিজ্ঞানীর মধ্যে, তাদের সবাই ফারাওয়ের অধীনে। অগস্ত্য তাই হাজির হয়েছিল রানি হাতসেপসুতের কাছে, তাঁর অনুমতি নিতে। যাতে সেই গুপ্ত বলয়ে স্থান পাওয়া যায়। এইখানেই ভুলটি করে বসে সে।

সদা প্রাণভয়ে ভীত ছোট পাখি গাছের পাতার সামান্য নড়াচড়াকেও শিকারি বাজের আক্রমণ বলে ভ্রম করে। ফারাওহীন মিশরের অবস্থা তেমনই ছিল। রানি নিজে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও জানতেন তিনি ফারাও নন। সেই কারণে প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রেরা তাঁকে ভয় পায় না। তাদের বিষাক্ত ছোবল যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে। তাই সেদিন রাজসভায় রানির অনুচরেরা অগস্ত্যকে গুপ্তচর ভেবে বসে। দেশের বৈজ্ঞানিকদের কষ্টলব্ধ জ্ঞান সে নাকি চুরি করার চেষ্টা করছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টায় অগস্ত্য বলে এই জ্ঞানের বিনিময়ে সেও এই দেশকে কিছু দিয়ে যাবে। তার নিজের কিছু আবিষ্কার। সন্দেহের গলায় সেইদিন রাজসভায় উপস্থিত থাকা মহামন্ত্রী সেনেনমুত বলেন, ‘তুমি যে একজন বৈজ্ঞানিক তার প্রমাণ দিতে পারবে?’

‘অবশ্যই পারব।’

এই বলে অগস্ত্য তার ঝোলা থেকে বার করে আনে একটি ডিম্বাকৃতি বস্তুকে। বলতে থাকে, ‘এই হল আমার নবতম আবিষ্কার। যা চোখে দেখা যায় না অথচ তার উপস্থিতি বুঝতে পারা যায় এমন কিছু বানাতে আমি সক্ষম হয়েছি।’

‘এটি কী?’ অনুসন্ধিৎসু রানি জিজ্ঞাসা করেন।

অগস্ত্য বলে, ‘এটি একটি যন্ত্র। এর কোনও নাম এখনও আমি রাখিনি। মিথ্যা বলব না, এর বাস্তব কার্যকারিতার সম্পর্কেও আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু এর অপরিসীম ক্ষমতার ব্যাপারে আমার আস্থা আছে।’

‘কী এটি, দেখি!’ বলে রানি নিজেই সামনে এগিয়ে এসে অগস্ত্যের হাত থেকে কেড়ে নেন সেই যন্ত্রটিকে। অগস্ত্য চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সাবধান! ওই নীচের অংশে….’

অগস্ত্যের মুখের কথা ফুরোবার আগেই রানি আঙুল দিয়ে ফেলেন সেই যন্ত্রের গায়ের একটি ছোট ধাতব অংশে। সঙ্গে সঙ্গে এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাঁর হাত বেয়ে বুকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঝনঝনিয়ে ওঠে হাত! কেঁপে ওঠে হাতসেপসুতের শরীর! তাঁর হাত থেকে ছিটকে পড়ে মাটিতে গড়িয়ে যায় যন্ত্রটি। কিন্তু অগস্ত্য সেটিকে কুড়িয়ে নেওয়ার আগেই রানির দেহরক্ষীরা ঘিরে ধরে তাকে। ভিনদেশি গুপ্তচর খুন করতে চেয়েছিল রানিকে, এই দায়ে সেই থেকে সে এই কয়েদখানায় বন্দি। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ, তারপর নাকি একদিন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী হবে, জীবন্ত অবস্থায় তার শরীরের ছাল ছাড়িয়ে নাকি পুঁতে দেওয়া হবে মরুভূমির বালিতে। মৃত্যুর পরের জীবনটা তার নাকি কাটবে প্রেতাত্মা হয়ে, এমনই শুনেছে কয়েদখানার রক্ষীদের কাছে। ভয় পায়নি সে, বরং অবাক হয়েছে এই ভেবে যে সেই জীবনের কি আদৌ কোন অস্তিত্ব আছে? আর যদি থাকেই তাহলে এই জীবনে তার আহরিত জ্ঞানের সবটুকু বৃথা হয়ে যাবে?

কুঠুরির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বাররক্ষীর কণ্ঠস্বরে অগস্ত্যর চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ল। দরজা খুলছে কেউ! তাহলে কি আজই তার জীবনের শেষ দিন!

রক্ষীটি যখন তার কনুই ধরে কয়েদখানার বাইরে বার করে নিয়ে আসল তখন সূর্যের আলোয় চোখে ধাঁধা লেগে গেল অগস্ত্যর। দীর্ঘ কয়েক মাস অন্ধকারে থাকার পরে এই আলোতে অভ্যস্ত হতে সময় তো লাগবেই। ভ্রু কুঁচকে অগস্ত্য নিজের চোখের সামনে হাত এনে রাখল। শুনতে পেল এক নারী কণ্ঠ। সে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগেই প্রথমেই একটি কথা বলল, ‘আপনার আবিষ্কারটিকে আমি চিনতে পেরেছি। তড়িৎপ্রবাহের ফলেই সেদিন রানির ওইরকম অবস্থা হয়েছিল, তাই না!’

কে এ? কে এই নারী! অবশেষে একজন চিনতে পারল অগস্ত্যর আবিষ্কারকে! তার পরিশ্রম তাহলে বৃথা যায়নি! এই বিদুষীরও নিশ্চয়ই যথেষ্ট বিজ্ঞানলব্ধ চেতনা আছে! আনন্দের আতিশয্যে তার ইচ্ছা হল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু শরীর সায় দিল না। এত মাস অপুষ্টিতে কাটানোর পরে এই আকস্মিক উত্তেজনাকে সামলাতে পারল না সে।

অগস্ত্য জ্ঞান হারিয়েছিল তখন। চেতনা ফিরে আসার পর দেখল সে একটি খড়ের বিছানায় শুয়ে আছে। চারপাশের দেওয়াল হালকা সবুজ বর্ণের। কিছু আসবাবপত্রও রয়েছে ঘরে। ঘরের একপাশে রাখা একটি চারপায়ার ধারে বসে আছে এক যুবতী। অগস্ত্য তার দিকে চোখ মেলে তাকাতে মৃদু হেসে সে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আজকের গোটা দিনটিই আপনি ঘুমিয়ে কাটাবেন।’

এই গলার স্বর তো অগস্ত্যর চেনা! জ্ঞান লোপ পাওয়ার আগের মুহূর্তে এই নারীই তবে…! অগস্ত্য ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল।

‘আপনি…আপনি চেনেন আমাকে! আমার আবিষ্কারের কথা জানেন! আমি কিন্তু রানিকে খুন করতে চাইনি! বিশ্বাস করুন আমি…’

‘থাক, এখনই এত চঞ্চল হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আপনার শরীর এখনও ক্লান্ত। আগে স্নান করে আসুন, স্নানঘরে একটি ক্ষুরও আনিয়ে রেখেছি আমি, চাইলে এই শ্মশ্রুগুফের জঙ্গল পরিষ্কার করে নিতে পারেন। স্নান করার পরে আহার করতে করতে আপনার কথা শুনব। আমারও কিছু কথা বলার আছে আপনাকে।’

চকচকে পাথরের তৈরি আয়নাতে নিজের মুখ দেখে চমকে উঠল অগস্ত্য। নিজেকে সে চিনতেই পারছে না। গত কয়েক মাসে শরীর জলের স্পর্শ পায়নি। কারাগারের বদ্ধ কুঠুরির বাতাসে ওড়া ময়লা জমা হয়েছে মুখের উপরে, বুনো ঝোপের মতো বেড়ে উঠেছে দাড়ি-গোঁফ। তার ওপরে জল বুলিয়ে নিল সে। ঝিনুক দিয়ে তৈরি ক্ষুর স্পর্শ করল গাল।

অগস্ত্য যখন স্নানঘর থেকে বার হল তখন ইরতেনসেনু খাওয়ার আয়োজন করছিল। অগস্ত্যের কানের কুন্ডলির শব্দ শুনে মুখ তুলে চাইল সে। সঙ্গে-সঙ্গেই একটি হৃদস্পন্দন যেন হারিয়ে গেল কোথায়। ভারতীয়দের কথা সে আগে অনেক শুনেছে। কিন্তু এই প্রথম কোন ভারতীয়কে এত কাছ থেকে দেখছে ইরতেনসেনু। অগস্ত্যর উচ্চতা ইরতেনসেনুর প্রায় সমান, চওড়া কাঁধ। শরীর পেশিবহুল না হলেও মেদ নেই তেমন। কোমল মুখটি শিশুসুলভ। দু’চোখের মণি নীল বর্ণ, এক আশ্চর্য দীপ্তি। এমন পুরুষে ইরতেনসেনু এই প্রথম বার দেখল। নিজের খেয়ালেই হারিয়ে গিয়েছিল সে, চমক কাটতে দেখল অগস্ত্য তাঁর উল্টোদিকেই বসে আছে, চেয়ে আছে ওর দিকে। ও কি বুঝতে পেরে গেল ইরতেনসেনুর মনের কথা? চট করে নিজের বিহ্বলতাকে কাটিয়ে ইরতেনসেনু বলল, ‘আসুন অগস্ত্য। ভোজনে বসা যাক।’

অগস্ত্য ছাগলের মাংসের সুরুয়াতে মধু মেশানো রুটি ডুবিয়ে মুখে পুরল। আহা, এমন স্বাদু খাবার সে কতদিন পায়নি। এ জীবনে আর হয়তো পেতই না। কিন্তু এই নারী তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করল কেন? কী চায় সে?

‘আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?

‘রানির দরবারে আপনি যেদিন আসেন সেদিন সভাসদদের ভিড়ে আমিও ছিলাম। খানিকটা দূরে ছিলাম যদিও। তবে আপনাদের কথপোকথন শুনেছিলাম স্পষ্ট।’

‘আপনাকে রানিই বললেন আমাকে মুক্তি দিতে?’

‘প্রথমত আপনি মুক্তি পাননি, বিশেষ কারণে আপনাকে কারাগার থেকে বার করে আনা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রানি না, আমার কথায় আপনি আজ এখানে।’

তার মানে মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া এখনও তার ওপরে ঝুলে আছে! এমন কী আছে তার কাছে যা এই যুবতীর প্রয়োজন? তাহলে কাজ ফুরলেই কি তাকে আবার প্রক্ষেপ করা হবে সেই অন্ধকার কুঠুরিতেই? মেয়েটি যেন তার চোখের ভাষা পড়তে পারল। বলল, ‘আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি আপনাকে, আমি ইরতেনসেনু। রানি হাতসেপসুতের সভার প্রধান বৈজ্ঞানিক এবং কারিগর।

‘আপনিই তাহলে দেশের উত্তরে বাঁধ তৈরি করেছেন! আপনিই রানির মন্দির তৈরি করছেন? সেই মন্দির আমি দেখেছি, অদ্ভুত তার গঠন শৈলী!

অগস্ত্যের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুটির একটি টুকরো মুখে পুরল ইরতেনসেনু, নিজ প্রশংসায় তার অস্বস্তি হয়। অগস্ত্যের মুখের কথা ফুরোচ্ছেই না।

‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না!’

‘কী?’

‘বিশ্বাসই করতে পারছি না যে আপনিই সেই! আপনার নাম আমি আগে শুনিনি, কিন্তু আপনার আবিষ্কারের খবর ভারতেও ছড়িয়েছে। আপনার সঙ্গেই দেখা করার জন্য আমার এতটা পথ আসা। কিন্তু ভাবতে পারিনি যে একজন নারীর সঙ্গে আলাপ হবে আমার।’

‘মানে? আমার জায়গায় কোন পুরুষকে আশা করেছিলেন?’

ইরতেনসেনু সোজা হয়ে বসল। তার চোখে মুখে বিরক্তি ছাপ। অগস্ত্য তৎক্ষনাৎ বুঝল তার ভুল হয়েছে। যে দেশ থেকে সে আসছে সেখানে নারীকে তার যোগ্য সম্মান দিলেও জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে এখনও তাদেরকে পিছনেই রাখা হয়েছে। বিদর্ভের যে রাজার সভায় সে ছিল বিগত একবছর, সেখানেও পুরুষের আধিক্য লক্ষণীয়।

‘মাফ করবেন, এভাবে কথা বলা আমার উচিত হয়নি। আমার দেশে মাতৃরূপে শক্তির উপাসনা করা হয়। কিন্তু সমাজ পুরুষতান্ত্রিক।’

‘এই সমাজও পুরুষতান্ত্রিক অগস্ত্য। কিন্তু বিদ্যালাভের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের কোন তফাত করা হয় না। বুদ্ধিই একমাত্র মাপকাঠি এখানে।’

নিজের স্থুল চিন্তার প্রকাশে নিজেই লজ্জিত এখন অগস্ত্য। সে চুপ করে রইল।

‘থাক, এই নিয়ে আর আলোচনাতে গেলে আমাদের সম্পর্কের তিক্ততা বাড়বে বই কমবে না। সেটি এখন কাম্য নয়। কাজের কথায় আসি বরং

হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল অগস্ত্য। এই সুন্দরী বিদুষীর হাতে অপদস্থ হওয়ার সামনে মৃত্যুদণ্ডকেও আরামের মনে হচ্ছিল তার। ইরতেনসে বলল, ‘সেদিন আপনি রানিকে আপনার একটি আবিষ্কার দেখিয়েছিলেন মনে আছে?

সেইদিনের কথা ভুলবে কী করে সে? ভোলা যায়?

‘মনে থাকাটাই স্বাভাবিক, আমি চেয়েছিলাম আমার দিক থেকে যদি কিছু দেওয়া যায় আপনাদের দেশকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন রানিকে হত্যা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না! আমি বুঝতে পারিনি তিনি আমার হাত থেকে যন্ত্রটি কেড়ে নেবেন!’

‘দেখুন তো এটিকে চিনতে পারেন কী না?’

একটি ছোট বাক্স ইরতেনসেনু এগিয়ে দিলেন অগস্ত্যের দিকে। তার মধ্যে ছিল একটি ধাতব শলাকা, একটি চোঙা, আর শুকনো মাটির টুকরো। এদের চিনতে এক মুহূর্তও সময় লাগল না অগস্ত্যর। তার যন্ত্রের অংশগুলো!

‘দুঃখিত আমি, রানির হাত থেকে ছিটকে গিয়ে আপনার যন্ত্রটি ভেঙে যায়। পরে আমি এই টুকরোগুলিকে নিয়ে আসি।’

‘কিন্তু এগুলো তো কোনও কাজেই আসবে না আর ইরতেনসেনু।’

‘হুম, তা ঠিক। কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম যন্ত্রটি কী ভাবে কাজ করে। এ দিয়ে যে আপনি একধরনের শক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিলেন তা আমি বুঝতে পেরেছি। সেই শক্তিই রানির শরীরে প্রবাহিত হয়। পরে রানি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি হাত বেয়ে উঠছে। ঠিক যেমনটা হয় দেওয়ালের কোণে কনুই লেগে গেলে।’

‘আপনার অনুমান যথার্থ! এই যন্ত্রটি আমার বহু বছরের গবেষণার ফল! আমি চাইছিলাম এমন শক্তি উৎপাদন করতে যাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা যাবে, প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে। লোহা এই শক্তি পরিবহন করতে পারে। যন্ত্রের গায়ে একটি মাত্র ছোট অংশে তাই লোহা লাগানো ছিল, ভিতরে থাকা শক্তিকে বাইরে আনার একমাত্র দরজা। রানি অসাবধানতায় যন্ত্রের সেই ধাতব অংশে হাত দিয়ে ফেলেন। তাই তার মধ্যে দিয়েই শক্তি প্রবাহিত হয়। আমি যদিও জানতাম ওই সামান্য আঘাত কোনও মানুষের প্রাণ নিতে পারে না। আমি নিজেই গবেষণার সময়ে কত বার আহত হয়েছি ওই ভাবে।

‘এই যন্ত্রের কোনও নকশা কি আপনি এঁকে রেখেছেন কোথাও?’

‘অবশ্যই, কিন্তু ধরা পড়ার পরে সেই পুঁথিটি আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবে তাতে বিশেষ অসুবিধা নেই। এই যন্ত্রের নকশা আমার মস্তিষ্কে অটুট রয়েছে। এখনই এঁকে ফেলতে পারব।’

‘আমার ওই প্রকারের একটি যন্ত্রের প্রয়োজন। কিন্তু আকারে তার চেয়ে কিছুটা বড় হতে হবে। তা না হলে প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে না।’

‘কিন্তু আপনি সেই যন্ত্র দিয়ে করবেন কী? সাবধান ইরতেনসেনু, ওই শক্তির অপব্যবহারে কিন্তু প্রাণহানির আশঙ্কা আছে!’

‘না, প্রাণ নেওয়ার জন্য নয়, বাঁচানোর জন্য চাই আমার এই যন্ত্রকে। আমার দেশের প্রাণ বাঁচাতে হবে।’ তারপরে কয়েকটি সপ্তাহ কেটে গেছে। ইরতেনসের কাছে আগত বিপদের কথা শুনে অগস্ত্য আর কালক্ষেপ করেনি। যন্ত্রটি বানাতে সময় লাগছে বেশ, তার প্রধান কারণ উপকরণ সংগ্রহ। অগস্ত্যের বানিয়ে দেওয়া মাপ মতো স্থানীয় কুমোরকে দিয়ে একটি মাটির ছোট কলসি বানানো হয়েছে। তারপর তার মধ্যে রাখতে হবে তামা আর দস্তার পাত। তামা মিশরে সহজলভ্য, কিন্তু দস্তা নয়। তার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ

এই অবসরের সময়ে অগস্ত্য ইরতেনসেনুর কাছে শিখতে লাগল মিশরের পদার্থ এবং রসায়ন বিদ্যা, ইরতেনসেনু শিখতে লাগল অগস্ত্যের ভাষা। এই ভাষা না জানলে যে সে দেশের জ্ঞানের উপলব্ধি যথার্থ হবে না তা বুঝেছিল ইরতেনসেনু। অরণ্যের গভীরে যেমন দুটি গুল্ম একে অপরের সাহচর্যে বেড়ে উঠে জন্ম দেয় অতুলনীয় পুষ্পের তেমনই এই দুই প্রাণও একে অপরের সংস্পর্শে এসে আরও বিকশিত হতে লাগল। দস্তা এল দেশের দক্ষিণের নুবিয়া অঞ্চল থেকে। নুবিয়ার রাজা রানি হাতসেপসুতের মিত্র এখন, তাই খুব অসুবিধা হল না। সেনেনমুত নিজে এসে দস্তা পৌঁছে দিলেন ইরতেনসেনুর কাছে।

‘কী মনে হচ্ছে তোমার? আর কতদিন লাগবে? হাতে সময় কিন্তু আর মাত্র কয়েক দিন।

‘দস্তারই অপেক্ষা করছিলাম, যন্ত্রটি এবারে তৈরি হয়েই যাবে, ধন্যবাদ আপনাকে। রানিকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে বলুন।’

সেনেনমুতের প্রশ্ন ইরতেনসেনুর জন্য থাকলেও উত্তর দিল অগস্ত্য। তবে এখনও এই ভিনদেশিকে বিশ্বাস হয় না সেনেনমুতের।

মাটির কলসির মধ্যে রাখা হল তামা ও দস্তার পাত দুটিকে। তাদের মধ্যে দেওয়া হল কাঠের গুঁড়ো, যাতে দুই ধাতব পাত নিজেদের সংস্পর্শে না আসতে পারে। এরপরে অগস্ত্য হালকা নীল বর্ণের এক তরল রাসায়নিক যোগ করল সেই কলসিতে। ইরতেনসে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটি কী দিলে?’

‘এটি একটি যৌগিক পদার্থ। এর নীল রঙকে খেয়াল করেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘এই রঙের জন্য এর নাম আমি দিয়েছি ময়ূরের গ্রীবা। মানব শরীরের চিকিৎসাতেও এর ব্যবহার আছে। তোমায় বলব একসময় সেই কথা।’

মাটির কলসির মুখটি শুকনো খড় দিয়ে বন্ধ করতে করতে বলল অগস্ত্য। তামা আর দস্তার পাতের সামান্য অংশ শুধু বেরিয়ে রইল কলসির বাইরে।

‘এখন এর পরীক্ষার সময়।’

বাইরে তখন সূর্য অস্ত গেছে। দেবতা আমুন-রা গমন করেছেন মাটির নীচে। গবেষণাগারের জানলা দরজা বন্ধ করল ইরতেনসেনু। জানলার সামান্য ফাঁকগুলিকেও খুব সাবধানে বন্ধ করে দেওয়া হল মোটা কাপড় দিয়ে। নিজের তৈরি গোলকটি এবারে বার করল সে। গোলকের ধাতব অংশের সঙ্গে লাগানো হল দুটি তামার তার, তাদের অন্য প্রান্তটি এনে একটিকে জোড়া লাগানো হল অগস্ত্যের বানানো যন্ত্রের তামার পাতের গায়ে। আরেকটি তারকে দস্তার পাতের সঙ্গে লাগানোর আগে ইরতেনসেনুর মুখের দিকে তাকাল অগস্ত্য। দুজনের চোখেই তখন সম্ভাব্য আবিষ্কারের আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে বিফল হওয়ার আশঙ্কা। একটি, এই একটিই সুযোগ ইরতেনসেনুর কাছে নিজের দেশকে বাঁচাবার, আর একটিই সুযোগ অগস্ত্যের নিজের প্রাণরক্ষার।

দ্বিতীয় তারটি স্পর্শ করল দস্তার পাতকে।

থীবস শহর,
ওপেতের উৎসবের দিনে,

আকস্মিক সূর্যগ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গেই কার্নাকের মন্দিরের রাস্তায় যে শোভাযাত্রা চলছিল, তা দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার দু’পাশের জনস্রোত তখন দিশাহারা! এমন পবিত্র দিনেই আমুন-রা তাদের ত্যাগ করলেন! কিন্তু কেন? দেবতার পূজা তো মহা সমারোহে হচ্ছে। বছরের প্রথম শস্য তাঁকে সমর্পণ করা হয়, গৃহস্থ তাঁকে স্মরণ না করে মুখে অন্ন তোলে না। তাহলে কেন আমুন-রা মুখ ফিরিয়ে নিলেন? তবে কি তিনি চান না এক নারী দেশের ফারাও হোক? তিনি চান না তাঁর শক্তি প্রবাহিত হোক নারী শরীরের মধ্যে দিয়ে!

ভিড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘রানি অপয়া!’

এমন রব হতাশা আর ভয়ে বিহ্বল জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সংক্রামক ব্যধির মতো। এক থেকে দশ, দশ থেকে একশো জনের কণ্ঠে শোনা গেল একই আওয়াজ!

‘রানি অপয়া!’

‘রানি অপয়া!’

অতর্কিতে ধেয়ে আসা বন্যার ঢেউয়ের মতো এই দুটি শব্দ এগিয়ে যেতে থাকল ভিড়ের মধ্য দিয়ে। তীব্র গতিতে আছড়ে পড়তে চাইল আমুন-রা শোভাযাত্রার উপরে।

তারপরে আচমকাই যেন তা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। চরম বিশৃঙ্খলা হঠাৎই এক জাদুবলে পরিণত হল অপার স্তব্ধতায়। জাদুই তো! বিস্ফারিত চোখে সবাই দেখল থেমে থাকা শোভাযাত্রার মধ্য থেকে ফেটে বেরিয়ে আসছে এক উজ্জ্বল আলোর কিরণ! তার দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়!

আলোর উৎসটি মাটিতে নামিয়ে রাখা আমুন-রার বিগ্রহের সামনেই। স্বয়ং রানি হাতসেপসুত দু’হাতে মাথার উপরে ধরে রয়েছেন তাকে! রানির হাতে যেন জ্বলন্ত সূর্যই ধরা পড়েছে! এ কী করে সম্ভব! এ কি স্বপ্ন?

এই সূচি পতনের স্তব্ধতার মধ্যে ভরাট গলায় সেনেনমুত বলে উঠলেন, ‘দেবতা আমুন-রা স্বয়ং রানি হাতসেপসুতের স্বপ্নে এসেছিলেন। তিনি আমুন-রা এর নিজের সন্তান! তাঁর শক্তি তাই রানির মধ্যে দিয়ে বিকশিত হচ্ছে! রানি দু’হাতে ধরে আছেন মাটিতে নেমে আসা সূর্যের একটি টুকরোকে! থীবসের নগরবাসী, সাক্ষী থাকো এই অলৌকিক স্বর্গীয় ঘটনার! রানি নন, আজ থেকে উনি…।’

সেনেনমুতের মুখের কথা কেড়ে নিল সাধারণ মানুষ। আবার বন্যা বইল। এবারে সেই বন্যার অভিমুখ বিপরীত দিকে। গতি আরও তীব্র। জনসমুদ্রের গর্জনে ভেসে যেতে লাগল থীবস শহর। সেই কম্পনে যেন আলোড়ন উঠল শান্ত নীলনদের জলেও!

‘ফারাও হাতসেপসুত!’

‘ফারাও হাতসেপসুত!’

এতক্ষণ ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল এক জোড়া যুবক-যুবতী। তারা শ্বাস চেপে অপেক্ষা করছিল সূর্যগ্রহণের। রানি পারবেন তো সঠিক সময়ে তার দুটিকে কলসির দুটি পাতে লাগাতে? পারবেন নিজের বর্ণাঢ্য বস্ত্রের তলায় যন্ত্রটিকে লুকিয়ে রাখতে? রানি পেরেছেন! জিতে গেছেন হাতসেপসুত! জিতে গেছেন সেনেনমুত! জিতে গেছে এই যুবক-যুবতী। এখন তারা আলিঙ্গণাবদ্ধ। এই চরম আনন্দের প্রতিটা মুহূর্তকে শুষে নিচ্ছিল তারা।

ওপেতের উৎসব শেষ হওয়ার পরের দিন ফারাও হাতসেপসুতের সভায় তাঁর সঙ্গে দেখা করল অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু।

‘অগস্ত্য, তুমি আমার দেশকে বাঁচিয়েছ। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বলো তুমি কী চাও? যত সোনা, যত লোহা তোমার লাগে আমি দেব। তোমাকে তোমার দেশে পৌঁছে দেবে আমার ব্যক্তিগত সেনারা।’

আজ অগস্ত্যের ফিরে যাওয়ার দিন। রানির কথা শুনে স্মিত হাসল সে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই রানি, আমার আবিষ্কারকে একটি মহৎ কার্যে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমার দেশে সোনা, লোহার কোনও অভাব নেই। আমার কোনও লোভও নেই ওতে। আমি অন্য কিছু চাইতে এসেছি আজ আপনার কাছে।’

‘বলো, নির্দ্বিধায় বলো। তুমি আমার দেশের বিজ্ঞানের পাঠ করবে বলেছিলে না? রাজ প্রাসাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় প্রবেশাধিকার আমি তোমায় দিলাম। আগে কখনও কোনও ভিনদেশির জন্য এর দ্বার খোলেনি। তুমি তোমার ইচ্ছা মতো প্যাপিরাসের পুঁথি নিয়ে যেতে পারো।’

‘আবারও ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। কিন্তু সেই পুঁথির যা জ্ঞান তার উৎসটিকে যদি চাই আমি, দেবেন?’ অগস্ত্যের এই কথা হাতসেপসুতের বোধগম্য হল না। এবারে মুখ খুলল ইরতেনসেনু। লজ্জা মাখানো স্বরে বলল, ‘আমারও একটি ইচ্ছা আছে। আমি অগস্ত্যের সঙ্গে তার দেশে যেতে চাই। বাকি জীবন কাটাতে চাই তার সঙ্গে।’

ফারাও হাতসেপসুত না বলেননি। অগস্ত্য আর ইরতেনসেনুর ইচ্ছা একই। দুই দুর্লভ মণি একে অপরকে

খুঁজে পেয়েছে। এখন তাদের আলোয় আলোকিত হবে অন্য এক দেশ।

ভারতবর্ষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *