২০। উপলের যন্ত্র

২০। উপলের যন্ত্র

ধীরে ধীরে নীলনদের বেশ কিছুটা উপর দিয়ে বায়ুযান এগিয়ে যেতে থাকল। জনতার উল্লাসের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেল। এখান থেকে এখন তাদের পিপীলিকার মতো ক্ষুদ্র লাগছে। অগস্ত্যদের কাছে এমন অনুভূতি এই প্রথম। এর আগে কোনও মানুষই তো এত উপর থেকে পৃথিবীকে দেখেনি। নীলনদকে এখন একটি গাঢ় নীল বর্ণের ফিতার মতো মনে হচ্ছে। তার দু’পাশে চাষের জমিতে যেন কেউ সবুজ আসন বিছিয়ে রেখেছে। তার মাঝে জেগে রয়েছে খেজুর গাছগুলি।

চাষের জমির পরই শুরু হচ্ছে থীবসের শহর। এত উপর থেকে একতলীয় এবং দ্বিতলীয় বাড়িগুলিকে বাদামি বর্ণের কৌটোর মতো লাগছে। নদীর দু’পারের লাক্সর এবং কার্নাকের মন্দিরদুটিকে বরং অনেকটা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। কার্নাক মন্দিরে হাতসেপসুত যে স্তম্ভগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সোনায় মোড়া তীক্ষ্ণ চূড়ার কিছুটা উপর দিয়ে উড়ে গেল বায়ুযান। ইরতেনসেনু অগস্ত্যর কাঁধে ছোট একটি টোকা দিয়ে তাকে ডাকল। অগস্ত্য পিছনে ফিরে দেখল সে আঙুল তুলে উত্তরের অভিমুখে নির্দেশ করছে। অগস্ত্যর দেখাদেখি উপল এবং বাকারিও উত্তরের দিকে তাকাল, তাকিয়েই তিনজনে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল।

সেখানে যতদূর চোখ যায় ধূ-ধূ মরুভূমি। কয়েক দণ্ড আগে সূর্যোদয় হয়েছে। কিন্তু মরুভূমির বালি খুব তাড়াতাড়ি তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই তপ্ত বালির সংস্পর্শে এসে বাতাস ঘন হয়। এত দূর থেকে এই ঘন বাতাসের মধ্য দিয়ে মরুভূমিকে খুব স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবে এই অস্পষ্টতার মধ্যেও জেগে রয়েছে তিন দৈত্য। তাদের গর্ভে হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে রয়েছেন তিন ফারাও। পাথরের তৈরি এই শবগৃহগুলিকে মিশরীয়রা বলে ‘মের’। এদের ভূমিভাগ চৌকনো কিন্তু ক্রমশ তা উপরের দিকে সূঁচালো হয়ে উঠে গিয়ে যেন এক ত্রিভুজের জন্ম দিয়েছে।

এই মেরগুলির শৃঙ্গ একসময় নাকি সোনায় মোড়ানো ছিল। পরে তস্করের উপদ্রবে সেই সোনার মুকুট এখন অদৃশ্য। তবে এতে এদের খ্যাতি এতটুকু কমেনি। মিশরীয়রা বিশ্বাস করে এই মেরগুলি এই পৃথিবীর উচ্চতম সৌধ। যে অভাবনীয় কারিগরি দক্ষতায় এদের তৈরি করা হয়েছিল তা এখন অন্তর্হিত।

অগস্ত্য নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেরগুলির দিকে, এতদূর থেকেও যেন উদ্ধত অশরীরীর মতো আকাশের দিকে চেয়ে আছে তারা। অগস্ত্য মনে মনে ভাবল যদি এই অভিযানের শেষে ফিরে আসতে পারে তাহলে অবশ্যই মেরগুলিকে একবার দেখে আসবে সে। এদের রহস্য হয়তো তার কাছে অজানাই রয়ে যাবে, কিন্তু তবু তাদের অন্তত একবার সে স্পর্শ করতে পারবে। নতজানু হয়ে সম্মান জানাবে সেই নাম না জানা কারিগরিবিদকে, যার অসম্ভব প্রজ্ঞার ফসল এই পাথরের দৈত্যগুলি।

হয়তো এই ধরণীতে তারাই প্রথম যারা শূন্যে ভাসমান হল। আজকে যেন বিজ্ঞান আরও অনেকখানি এগিয়ে গেল। এই অগ্রগতিতে তারও সামান্য ভূমিকা আছে ভেবে বুকের মধ্যে গর্ব অনুভব করল ইরতেনসেনু। অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখে মুখেও একই গর্ব এবং প্রশান্তির ছবি। এতক্ষণের বিহ্বলতা কাটার পরে যেন সম্বিত ফিরে পেল তারা চারজন। তারা পেরেছে! যে পথ স্থলে অগম্য এখন তারা সেই পথে পাড়ি দিয়েছে! নীলনদ সঙ্গী হয়েছে তাদের। এখন শুধু সঠিক অভিমুখে চলার প্রয়োজন, যাতে নীলনদের উৎসে পৌঁছনো সম্ভব হয়। এই কাজের দায়িত্বে রয়েছে উপল।

উপল এখন নিজের সরঞ্জামগুলিকে তার চামড়ার তৈরি থলি থেকে বার করে গুছিয়ে রাখছে। একটি যন্ত্রকে সে খুব সাবধানে বায়ুযানের চুপড়ির একটি প্রান্তের সঙ্গে শক্ত রজ্জুর দ্বারা বাঁধল। তারপর যন্ত্রটি যথেষ্ট উল্লম্ব ভাবে রয়েছে কিনা তার পরীক্ষা করতে লাগল। রজ্জুটিকে আলগা করে আর একবার যন্ত্রটিকে স্থাপন করল উপল। তারপর অগস্ত্যদের দিকে পিছনে ফিরে বলল, ‘এটি আমার দিগযন্ত্র। যত প্রয়োজনই থাকুক, কোনভাবেই চুপড়ির এই কোণে তোমরা কেউ আসবে না, আমার এই যন্ত্রটি কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলে বায়ুযানকে চালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’

উপলের নিষেধের ফলে যন্ত্রটির খুব কাছে যেতে পারল না ইরতেনসেনু। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই মনোযোগ দিয়ে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল সে। দিগযন্ত্রটি উচ্চতায় এক হস্তের সমান। এর নীচের অংশে রয়েছে দুটি ধাতব গোলক। ইরতেনসেনু দেখল, নীচের গোলকটি যন্ত্রের পাদদেশের সঙ্গে মজবুত ভাবে লাগানো। উপরের গোলকটি আকারে নীচের গোলকের তুলনায় অনেকটাই ছোট, কিন্তু এই গোলকটি ঘূর্ণায়মান। একটি ধাতব পাতের সাহায্যে এর ঘূর্ণনকে রোধ করা যায়।

উপল ধাতব পাতটিকে সরিয়ে নিলেই গোলকটি একবার ডান দিকে এবং একবার বাম দিকে ঘুরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হচ্ছে। এই গোলকের উপরে রয়েছে ধাতুরই তৈরি এক আশ্চর্য জন্তুর মূর্তি। জন্তুটি যেন আকাশে উড়ছে, এর শরীর এক বলশালী পুরুষের হলেও মুখ যেন পাখির ন্যায়, পিঠে দুটি ডানা আছে। ইরতেনসেনুর দিকে তাকিয়ে উপল বলল, ‘এই দিগযন্ত্র কীভাবে কাজ করে বুঝিয়ে দিই। বাতাসের প্রবাহ দিনের বিভিন্ন সময়ে এবং মাটি থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় বদলে যায়, সেই সঙ্গে বদলে যায় তার গতি এবং অভিমুখ। এই যন্ত্র এই বদলাতে থাকা অভিমুখকে আমাদের চিনিয়ে দেবে।

বাতাসের প্রবাহের ফলে এই গোলকটি ঘুরতে থাকে, প্রবাহের দিক বদলালেই গোলকটিও সেই বাতাসের টানে ঘুরে যাবে। তার ফলে এর উপরে লাগিয়ে রাখা গরুড়ের মুখটিও ঘুরবে। গরুড়ের মুখ যে দিকে থাকবে আমরা বুঝে পারব বাতাসের প্রবাহও সেই দিকে আছে। সেই মতো আমরা এই বায়ুযানের অভিমুখও বদলাতে পারব যাতে করে সর্বক্ষণ নীলনদ আমাদের দৃষ্টিপথের মধ্যে থাকে। নদীর গতিপথ সোজা নয়, তাই বায়ুযানের অভিমুখও বদলাতে হবে বেশ কয়েকবার।’

বাকারি মন দিয়ে উপলের কথা শুনছিল, তার এই আবিষ্কারটি সত্যই চমকপ্রদ। সমুদ্রযাত্রার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা যে এখানে উপলের সহায় হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একটি শব্দ বাকারির অচেনা লাগল। যন্ত্রের উপরের এই অদ্ভুতদর্শন জীবটির নাম উপল কী বলল?

‘তুমি যন্ত্রের উপরের ওই জীবটির নাম কী বললে? গরুড়?’

অগস্ত্য বলল, ‘হ্যাঁ বাকারি, নামটি তুমি ঠিক শুনেছ। ভারতবর্ষের পুরাণের মতে গরুড় হলেন দেবতা বিষ্ণুর বাহন। তার পিঠে চড়ে বিষ্ণু আকাশপথে যাত্রা করেন। গরুড় একইসঙ্গে শক্তিশালী এবং দ্রুত, তিনি আবার সাহসেরও প্রতীক। আবার গরুড়কে সূর্যের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। কোনও-কোনও পুরাণ কথায় গরুড় সূর্যের রথের চালক। উপল তার যন্ত্রটির বেশ চমকপ্রদ নামকরণ করেছে। আমাদের বায়ুযানটিরও একটি নাম দেওয়া উচিত ছিল।’

ইরতেনসেনু বলল, ‘ঠিক, এর নাম দেওয়া হোক হাথোরেত! ফারাও হাতসেপসুত এই বায়ুযানকে দেবী হাথোরের নামে উৎসর্গ করেছেন, আর মিশরীয় ভাষায় আমরা রথকে বলি রেত। তাই হাথোরেত।’

‘বাহ, অতি উত্তম, আমরা সবাই তাহলে হাথোরেত নামেই এই বায়ুযানকে সম্বোধন করব।’

বাকারি আবার উপলকে বলল, ‘আপনার উল্লেখ করা গরুড়ের কথা এখনও আমার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। কেমন অদ্ভুত মিল দেখুন। উত্তরের মরুভূমির মাঝে যে মের শবাধারগুলি আপনি একটু আগে দেখলেন সেখানে একটি মেরের সামনে এক আশ্চর্য প্রাণীর অতিকায় মূর্তি আছে। এই মূর্তির বয়সও মেরের বয়সের মতো, হাজার বছরের উপরে। এর শরীর সিংহের কিন্তু মুখটি মানুষের। একে আমরা বলি হোরেম-আখত। এই হোরেম-আখত হল দেবতা হোরাসের প্রতীক।’

‘এই হোরাস দেবতা ওসাইরিসের পুত্র ছিলেন না?’

‘হ্যাঁ ঠিক, হোরাস তাঁর পিতার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সেথকে হারিয়ে দেবতাদের সিংহাসনে রাজা হিসাবে আরোহণ করেন। এই হোরাসের আরেকটি প্রতীক হল বাজপাখি। মনে করা হয় কোনও সময়ে হোরেমআখতের পিঠে বাজপাখির ডানার মতো দুটি ডানা ছিল। পরে সেটি ভেঙে যায়।’

‘সত্যিই আশ্চর্যকর মিল দু’দেশের পুরাণে।’

অগস্ত্যদের বুকে নিয়ে দক্ষিণের দিকে উড়ে চলল হাথোরেত। নীচের পৃথিবীতে দৃশ্যপট কিছুক্ষণ অন্তর বদলে যেতে থাকল। সূর্য যখন অস্ত গেল তখন লোকালয় শেষ হয়ে শুরু হয়েছে অনুর্বর বালিয়াড়ি আর রুক্ষ পাথুরে স্থলভূমি। ভুট্টার রুটি আর শুকনো মাংস দিয়ে নৈশাহার সমাপ্ত করল সবাই। তারপর এক পাত্র করে সুরা পান করা হল। রাত নামলেই এই দেশের বুকে শীতলতা নেমে আসে, মাটির এতটা উপরে তাপমাত্রা আরও কম।

রাতে পৃথিবীর বুক থেকে দিনের সূর্যের জমিয়ে রাখা যে উত্তাপ নির্গত হয় তা এই উচ্চতায় পৌঁছতে পারে না। তাই এই সুরা এখন নেশার দ্রব্য নয়, শরীরকে উষ্ণ রাখার ঔষধ বিশেষ। উপল, বাকারি ঘুমিয়ে পড়লেও অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু কিছুক্ষণ জেগে রইল। মৃদু স্বরে আলাপ করছিল তারা। ইরতেনসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমুদ্রযাত্রার সময়ের সেই রাতটির কথা তোমার মনে আছে অগস্ত্য? যে রাতে তোমাক নুত আর গেবের গল্প বলেছিলাম?’

‘মনে আছে, সেদিন ঘুম আসছিল না তোমার, দুশ্চিন্তার পাহাড় মাথায় জমে ছিল।’

‘হ্যাঁ, সে পাহাড় তো এখনও সেখানেই আছে, তাকে এতটুকু টলানো যায়নি।’

‘এমন ভাবে ভেবো না ইরতেনসেনু, বরং ভাবো সেই পাহাড়ের গা বেয়ে আমরা এখন উঠে আসছি, পথ অজানা, কিন্তু মনে বিশ্বাস আছে অচিরেই চড়াই পেরিয়ে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাবই।’

এই বলে সামান্য হেসে ইরতেনসেনুকে নিজের কাছে টেনে নিল অগস্ত্য। দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণের জন্য। সহসাই একটি শব্দ অগস্ত্যর কানে এসে পৌঁছল। শব্দটি খুব ক্ষীণ। অগস্ত্য আলিঙ্গন আলগা করে চুপড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে আরও ভালো ভাবে শোনার চেষ্টা করল শব্দটিকে। একটি সুরধ্বনি ভেসে আসছে, যেন কোনও রমণী প্রবল দুঃখে কেঁদে চলেছে। অগস্ত্য মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকাল। আকাশে এখন পূর্নিমার চাঁদ ঝলমল করছে। তার আলোয় নীচের পাথুরে মাটিকে নীলচে-সবুজ লাগছে, সেই মাটির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে নীলনদ।

নীলনদের জলে চাঁদের আলো যেন শতবার প্রতিফলিত হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন নদীর বুকে হীরকখণ্ড বিছিয়ে রেখেছে। কান্নার শব্দটি মাটি থেকেই আসছে, অগস্ত্য চোখ ছোট করে আবার দেখার চেষ্টা করল। এত উপর থেকে এই আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় না। কোন ছোট জনপদের অস্তিত্ত্ব এখানে আছে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করল সে। না, তেমন তো কিছু চোখে পড়ছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই ইরতেনসেনুর উদ্দেশে অগস্ত্য বলল, ‘কোন কান্নার শব্দ তুমি শুনতে পাচ্ছ?’

‘কান্নার শব্দ?’

‘হ্যাঁ, ভালো করে শোন, যেন মাটির বুক থেকে উঠে আসছে।’

ইরতেনসেও এবারে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। খানিকক্ষণ পর সে মুখ বন্ধ রেখেই হাসতে লাগল। হাসি থামলে বলল, ‘পৃথিবী বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, মহর্ষি অগস্ত্যর কী মনে হয়? কান্নার স্বরটি কোন নারীর? মাটিতে কোন লোকালয় তো নজরে আসছে না। তবে কি কোন অশরীরীর?’

অগস্ত্য কী উত্তর দেবে তা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। ইরতেনসেনুর কথার কৌতুকমিশ্রিত শ্লেষে সে বুঝতে পেরেছে যে, কোনও লোকালয় থেকে এই শব্দ ভেসে আসছে না। কিন্তু এই ক্রন্দনধ্বনি যে তার মনের ভুল নয় সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ইরতেনসেনু এবারে বলল, ‘এখানে কোন লোকালয় নেই অগস্ত্য। হাথোরেত যে গতিতে এখন এগোচ্ছে তাতে আগামীকাল সকালের দ্বিতীয় প্রহরের আগে কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না। এই কান্নার শব্দ আসলে প্রকৃতির নিজের সৃষ্টি। ছোট ছোট পাথরের পাহাড়ের মধ্যে যে ফাটল থাকে তার মধ্য দিয়ে হাওয়া যখন বয় তখন এমন শব্দের সৃষ্টি হয়, মনে হয় কোনও রমণী যেন কাঁদছেন।’

অগস্ত্য এবারে যেন সামান্য লজ্জা পেল, এই উপলব্ধি তো তার হওয়া উচিত ছিল। সঙ্কীর্ণ পথে বায়ু প্রবাহিত হলে এমন করুণ সুর বেরিয়ে আসে, এই ভাবেই বাঁশি বাজে। ইরতেনসেনু আরও বলল, ‘তোমার এই ভ্রম তোমার একার নয় জানো। এখন মিশরের মানুষ রাত্রির এই সুরকে কান্নার স্বর বলেই ভাবে।’

‘কেন?’

‘কারণ তাদের অপার ঈশ্বর বিশ্বাস। আমাদের পুরাণে এক গল্প আছে জানো। সকালে বাকারি তোমাকে দেবতা ওসাইরিস এবং তাঁর ভাই সেথের কথা বলেছিল না? স্বর্গের সিংহানের দখল নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে লড়াই চলছিল। একসময় সেথের নিজের কুবুদ্ধির দ্বারা ওসাইরিসকে হত্যা করে। তারপর রাত্রের অন্ধকারে তাঁর শরীর টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় নীলনদের জলে।

‘দেবী আইসিস ছিলেন ওসাইরিসের স্ত্রী। তিনি তাঁর স্বামীকে খুঁজে না পেয়ে মর্মাহত হয়ে নীলনদের তীরে একটি গাছের নীচে বসে কাঁদতে থাকেন। মিশরবাসীরা মনে করে এই কান্নার আওয়াজ আসলে দেবী আইসিসের। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নীলনদে বন্যা হয়। বন্যার কয়েকদিন আগে বাতাসের জোর বেড়ে যায়। তখন এই করুণ সুরের তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়।

‘সেইসময়ে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে সেই সুর এসে পৌঁছয়ে থীবস নগরীর মানুষের কানে। রাত্রের অন্ধকারে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলে এই সুরকে আরও ভালোভাবে শোনা যায়। তখন নগরীর অধিবাসীরা ভাবে ওই দেবী আইসিস কাঁদছেন, তাঁর চোখের জল নীলনদের দুই কুল ছাপিয়ে উঠবে, বন্যা আসবে। এবং বস্তুতই এই কান্নার কয়েকদিনের মধ্যেই নদীতে বন্যা শুরু হয়।’

‘বড় আশ্চর্যের এই ঘটনা তাই না? কেমন ভাবে বিজ্ঞান মিশে গিয়েছে লোকগাথার মধ্যে।

‘সত্যিই তাই। যেমন ভাবে মহর্ষি অগস্ত্যর কূপের জলে শক্তিপ্রবাহের দ্বারা জলকে বায়ুতে পরিণত করার গল্প বদলে গিয়েছে সমুদ্রের সব জল শুষে নেওয়ার লোককথায়।’

ইরতেনসেনুর কথায় এবার তারা দুজনেই একই সঙ্গে হাসতে শুরু করে। সেই হাসির শব্দ যেন সামান্য জোরে হয়েছিল। ঘুম জড়ানো গলায় উপল বলে উঠল, ‘কপোত কপোতিরা এবার নিদ্রা গেলেই ভালো হয় মনে হয়। তোমাদের কাজ এখন না থাকতে পারে, আগামীকাল সকালে আমার কাজের তো কোন ছাড় হবে না।’

সত্যিই তাই। নাবিকের তো কিছু বিশ্রাম প্রয়োজনই। অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু এবার শুয়ে পড়লেও আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকল। তাদের একজনের হাতের তালু বদ্ধ থাকে আরেকজনের তালুতে। তারা চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। একসময় ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।

তখনও জেগে থাকে তিনজন। আকাশের চাঁদ, বায়ুতে ধাবমান হাথোরেত এবং মিশরের মাটির উপর দিয়ে বয়ে চলা নীলনদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *