১৯। উড়ান

১৯। উড়ান

নীলনদের তীরে আজকে সাজো সাজো রব। মনে হচ্ছে যেন কোনও আনন্দ উৎসবে মেতেছে সবাই। নদীর পশ্চিম পাড়ের একটি নির্দিষ্ট অংশকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সেখানে কারোর প্রবেশের অধিকার নেই। এই অংশের বাইরে এবং নদীর পূর্ব তীরে মানুষের ঢল নেমেছে। শিশুরা তাদের পিতার কাঁধের উপরে বসে আছে। কিছু মানুষ নদীর নিকটবর্তী গৃহগুলির ছাদে ভিড় জমিয়েছে। তাদের সবার নজর বায়ুযানটির দিকে I

বায়ুযানের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে আছে ইরতেনসেনু এবং বাকারি। তারা তাদের অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে শেষ মুহূর্তের জন্য পরীক্ষা করে নিচ্ছে যানের সবক’টি অংশ। যে বিরাট আকারের কাপড়টিকে তৈরি করা হয়েছে তার সেলাইয়ের অংশগুলিতে আরেকটু মোমের প্রলেপ দিয়ে নেওয়া হচ্ছে শেষ বারের মতো। বাকারি প্যাপিরাসের কাণ্ড এবং খড় দিয়ে তৈরি চুপড়িটির এক কোণে জড়ো করে রেখেছে বেশ কিছু শুকনো খাদ্যদ্রব্য। তাদের মধ্যে আছে খেজুর, ভুট্টার রুটি এবং রোদে শুকানো মাছ এবং শূকরের মাংস।

তিনটি বড় আকৃতির ঘড়ায় জল এবং কিছুটা সুরাও নিয়ে নিয়েছে সে। কতদিনের যাত্রা তা তারা এখনও জানে না। এই খাদ্য এবং পানীয় পরিমিত পরিমাণে খরচ করলে দশদিন অনায়াসে চলতে পারে। চুপড়ির অপর একটি কোণে একটি চামড়ার থলিতে নিজের যন্ত্রপাতিগুলিকে আগেই জমা করে রেখেছিল উপল। সে এখন অগস্ত্যর সঙ্গে রয়েছে।

বায়ুযানটি থেকে কিছুটা দূরেই সেই স্নানাগার যেটিকে অগস্ত্য তার যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করেছে। স্নানাগারটির বাইরে সারি দিয়ে রাখা কলসগুলির উপরের ঢাকনাগুলি খোলা। প্রতিটি কলসের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন করে শ্রমিক। তাদের হাতে ধরা রয়েছে একটি করে মাঝারি আকারের পাত্র। অগস্ত্য স্নানাগারের ভিতরে প্রবেশ করল।

যে দুটি মোটা তামার তার জলাধারের উপরের লোহার পাতের গায়ে এসে শেষ হয়েছে তাদের পরীক্ষা করল। তারপর স্নানাগারের বাইরে বেরিয়ে এসে এগিয়ে গেল কলসগুলির দিকে। অগস্ত্য এবং উপল প্রতিটি কলসের নিচ থেকে যে সরু তামার তার বেরিয়ে এসেছিল সেগুলিকে একের সঙ্গে একে যুক্ত করল।

তারপর তারা এসে দাঁড়াল স্নানাগারের অপর প্রান্তে, যেখান থেকে ধাতব নলটি বেরিয়ে এসে মিশেছে বায়ুযানের ছিদ্রের মধ্যে। ততক্ষণে বাকারিও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। অগস্ত্য তার দিকে তাকাতে সে হাসিমুখে বলল, ‘বায়ুযান প্রস্তুত। ইরতেনসেনু ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

অগস্ত্য তার দিকে তাকিয়ে হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তারপর উপলের দিকে তাকাল, ‘তাহলে আর বিলম্ব করা সাজে না।’

কলসগুলির পাশে যে শ্রমিকরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের দিকে মুখ করে অগস্ত্য উচ্চস্বরে বলল, ‘কাজ শুরু করো!’

অগস্ত্যর আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি শ্রমিক আরও এক পা এগিয়ে এল কলসের কাছে। নিজের হাতে ধরা পাত্রটি থেকে এবারে উজ্জ্বল নীল বর্ণের একটি তরল ঢালতে লাগল কলসের মধ্যে। শ্রমিকদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, কোনভাবেই যেন তাদের শরীরের কোন অংশ কলস অথবা কলসের নীচ থেকে বেরিয়ে আসা তামার তারের সংস্পর্শে না আসে। অতি সাবধানতার সঙ্গে সেই নিয়ম মেনে চলছে শ্রমিকেরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাত্রের সব তরল কলসে ঢেলে দেওয়ার পর কলসের মুখ বন্ধ করে দিয়ে পিছনের দিকে চলে এল তারা।

এবার অগস্ত্যর আসল পরীক্ষা। মুখে হাসি টেনে রাখলেও তার বুক অতি দ্রুত কম্পিত হতে লাগল। এত বড় যন্ত্র সে আগে তৈরি করেনি। যন্ত্রটি কাজ না করলে ইরতেনসের তৈরি বায়ুযানের কোন প্রকার ব্যবহারই করা যাবে না। কোনও কথা না বলে চুপ করে ওই স্থানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। উপলও অগস্ত্যর মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল, সেও গম্ভীর মুখ নিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল কিছুটা দূরের বায়ুযানের দিকে। বাকারি কিন্তু এক কিশোরের মতো কৌতূহলী মুখ নিয়ে ঘুরে ঘুরে সমস্ত আয়োজন আরও একবার দেখছিল। স্নানাগারটি থেকে যে নলটি বেরিয়ে এসেছে সেটির নীচে এসে দাঁড়াল সে। নলটি কি সামান্য কেঁপে উঠল? নাকি তার মনের ভূল?

আরও ভালো করে নলটির দিকে তাকিয়ে রইল বাকারি। যেন মনে হল এক মুহূর্ত আগেই নলটি কেঁপে উঠেছিল? না, সেটা এখন আর মনে হচ্ছে না। তবে নলটির মধ্য দিয়ে খুব মৃদু এক আওয়াজ আসছে কি? শনগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাতাস চলাচলের সময়ে যেমন আওয়াজ হয়! কিছুক্ষণের মধ্যেই এক আশ্চর্য জিনিস দেখল বাকারি। বায়ুযানটি যেন সামান্য নড়ে উঠল!

অগস্ত্য, উপলের চোখেও তা ধরা পড়েছিল। তারা তিনজনে একছুটে এবারে চলে এল বায়ুযানটির কাছে। ইরতেনসেনুর পাশে এসে দাঁড়াল অগস্ত্য। সে তখনও প্রবল মনোযোগে বায়ুযানটির দিকে তাকিয়ে আছে। বায়ুযানের কাপড়টি যেন ফুলে উঠতে শুরু করেছে। অগস্ত্য এবারে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল! জড়িয়ে ধরল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উপলকে। তাদের যন্ত্র কাজ করছে! দেখতে দেখতেই কাপড়ের অনেকটা অংশ ফুলে উঠল। যেন কোনও ঘুমিয়ে থাকা দৈত্য অতি দ্রুত জেগে উঠছে। বাকারি অগস্ত্যর পাশে এসে বলল, ‘এই জাদু কী করে সম্ভব হল অগস্ত্য!’

অগস্ত্য হাসিমুখে খুব সংক্ষেপে বাকারিকে এর উত্তর দিল, ‘কলসগুলির মধ্যে এখন এক শক্তির সৃষ্টি হচ্ছে, সেই শক্তি তামার তারগুলির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এসে জড়ো হয়েছে স্নানাগারের মধ্যের জলাধারের ভেতর রাখা লোহার পাতদুটিতে। এই লোহার পাতদুটি এবারে জলকে দ্বিখণ্ডিত করছে। আমার পরীক্ষায় আমি আগে খেয়াল করেছিলাম যে জলের মধ্যে এই শক্তি প্রবাহিত হলে জল দু’প্রকারের বায়ুর জন্ম দেয়। সেই দুই বায়ুর একটি হল উড়ানবায়ু। এই উড়ানবায়ু এখন ওই নল বেয়ে এসে জমা হচ্ছে বায়ুযানের ভিতরে। এই বায়ু বাতাসের তুলনায় হালকা, দেখবে খানিকক্ষণের মধ্যেই বায়ুযানটির উপরিভাগ কেমন আকার নেবে।’

সত্যিই তাই হল। অগস্ত্যর উচ্ছ্বাসের মধ্যেও ইরতেনসেনু চুপ করেছিল। কারণ তার অংশের পরীক্ষা তখনও শেষ হয়নি। উড়ানবায়ুকে ধরে রাখতে সক্ষম হবে তো এই বিশেষভাবে তৈরি কাপড়? সে জানে যে উড়ানবায়ু ভীষণ ভাবে দাহ্য, তাই কাপড়ে নেসের গাছের রস লাগানো হয়েছে, এতে কোনভাবেই বায়ুযানে অগ্নি সংযোগ হবে না। কিন্তু তবুও তার মন অশান্ত। চিন্তার দোলাচল তাকে এখনও অবধি মূক করে রেখেছিল।

তবে ধীরে ধীরে তার মুখেও হাসি ফুটল। উড়ানবায়ুর প্রভাবে কাপড়ের তৈরি বায়ুযানের উপরিভাগ এক অদ্ভূত আকার ধারণ করল। নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সমুদ্রের ভিতর থেকে বিস্ময় এবং উল্লাস মেশানো এক আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল।

বায়ুযানের কাপড়ের তৈরি অংশটি এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটিকে এখন উল্টানো অশ্রুবিন্দুর মতো লাগছে। উচ্চতায় এটি দশ পুরুষের সমান। এর উপরিভাগটি উত্তল, সেই অংশের পর নিচের ভাগটি ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। সরু অংশটি এসে শেষ হয়েছে সেই ছিদ্রে যেখানে নল এসে মিশেছে। ওই খান দিয়ে এখনও উড়ানবায়ু প্রবেশ করে চলেছে। এক সময় এই অংশটি টানটান হয়ে ফুলে উঠল।

উড়ানবায়ুর প্রভাবে এখন এটি উপরের দিকে উঠে আসতে চাইছে। নীচের অংশে লাগিয়ে রাখা চুপড়িটি মাটির সামান্য উপর উঠে শূন্যে ভাসমান রয়েছে এখন। তবে এটিকে মাটির সঙ্গে ধরে রেখেছে চুপড়ির চার কোণ থেকে বেরিয়ে আসা চারটি মোটা রজ্জু। নদীর তীরের মাটিতে গেঁথে রাখা কাঠের টুকরোর সঙ্গে বাঁধা রয়েছে এগুলি।

বায়ুযানের কাপড়ের অংশটি অনিন্দ্যসুন্দর ভাবে রঙ করা। হলুদবর্ণের পশ্চাদপটের উপরে বৃত্তাকারে নীল রঙের নকশা আঁকা। নকশার মধ্যে আঁকা রয়েছে এক দেবীর ছবি। দেবী নগ্নপদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর পরনের বস্ত্র উজ্জ্বল রক্তবর্ণের। গলায় লাল এবং নীল বর্ণের মণিহার। দেবীর চুল গাঢ় নীল বর্ণের। তাঁর মাথায় বসানো মুকুটটিতে একটি রক্তবর্ণের বৃত্ত আছে, যাকে পেঁচিয়ে আছে একটি সর্প। বৃত্তটির দু’পাশ দিয়ে উঠে এসেছে দুটি শৃঙ্গ। ইনি দেবী হাথোর।

সাধারণত দেশে কোন প্রকার পবিত্র কাজে সর্বাগ্রে দেবতা আমুন-রা এর চিত্রই বর্ণিত হয়ে এসেছে এ যাবৎ। কিন্তু আজ এই অদ্ভুত দর্শন বস্তুটি, যা শূন্যে ভাসমান হয়ে আছে, মিশরের ইতিহাসে যার তুলনীয় কিছু কোনদিন হয়নি, সেই বায়ুযানে দেবতা রা-এর কোন স্থান নেই! দেবী হাথোরের মুকুটের গোল অংশটি রা-এর প্রতীক, ওইটুকুই। বায়ুযানের গায়ে দেবী হাথোরের উপস্থিতিতে থীবসবাসী অবাক হল বটে, তবে এই নিয়ে তাদের মনে বিশেষ প্রশ্ন জাগল না। বিস্ময়ের ঘোরে তখনও তারা হতবাক।

ইরতেনসেনু মাথা উঁচু করে দেবীর চিত্রটির দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখে তখনও হাসি লেগে রয়েছে। চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও যে ফারাও হাতসেপসুতের কূটনৈতিক বুদ্ধি অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে এই চিত্রটি তার প্রমাণ। তাঁর নির্দেশেই হাথোরের ছবিটি আঁকা হয়েছে। ফারাও প্রকাশ্যে নিজেকে দেবতা আমুন-রা এর সন্তান বলে দাবী করেছিলেন, যে দাবীর বলে তিনি আজ মিশরের সিংহাসনে আসীন। কিন্তু হাতসেপসুত গোপনে দেবী হাথোরের উপাসক।

দেবী হাথোরের ক্ষমতা অপরিসীম। তিনি মাতার মতো স্নেহবৎসল, তাঁর আশীর্বাদে নারীর শরীর উর্বর হয়, সন্তানসম্ভবাদের যে-কোনও প্রকারের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন দেবী হাথোর। কিন্তু ইনি মন্দিরে পূজিত হলেও মহান আমুন-রা এর তূল্য নন। হাতসেপসুতের ইচ্ছা দেবী হাথোরকে দেশের প্রধান দেবতার মর্যাদা দেওয়া। পুরুষ শাসিত সমাজে এক ফারাও হয়েও হাতসেপসুতকে নকল দাড়ি পরে পুরুষ সাজতে হয়, তা না হলে এই দেশের মানুষের থেকে নাকি যোগ্য সম্মান পাওয়া যাবে না। এক নারী কেন পুরুষের ন্যায় সম্মান পাবেন না? মেধার তুলনায় কেন বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে লিঙ্গের ভেদকে? হাতসেপসুত চান এই সামাজিক ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়, একদিনে এটি সম্ভব হবে না। এই অনির্দিষ্ট যাত্রার ভবিষ্যত হাতসেপসুতকে চিন্তিত রেখেছে, ফারাও হিসাবে তাঁর নিজের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বায়ুযান।

কিন্তু আজকের দিনটি মিশরবাসীর মনে আজীবন অটুট রয়ে যাবে। তাই এমন দিনে নিঃশব্দে থীবসবাসীর কাছে নিজের আরাধ্যা দেবীকে এই ভাবে উন্মোচিত করলেন হাতসেপসুত। দেবী যদি সহায় হন, যদি ইরতেনসেনু পুন্তের বৃক্ষ নিয়ে ফিরে আসতে পারে, তাহলে তাঁর মন্দিরটিকে হাথোরের নামে উৎসর্গ করবেন তিনি। এক নারী এই দেশকে শাসন করছে, এক নারীই ধীরে ধীরে হয়ে উঠবেন এই দেশের ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক।

রজ্জুর তৈরি মই-এর সাহায্যে একে একে বায়ুযানের চুপড়িটির ভিতরে উঠে এল অগস্ত্য, ইরতেনসেনু, উপল এবং বাকারি। কাপড়ের অংশটিকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল অগস্ত্য। উড়ানবায়ুর প্রভাবে এখন টানটান হয়ে ফুলে রয়েছে এটি, যথেষ্ট বায়ু প্রবেশ করানো হয়েছে। সে এবারে মাথার উপরে হাত তুলে নিৰ্দেশ দিল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শ্রমিককে। শ্রমিকটি স্নানাগারের দরজার বাইরের মোটা তামার তারটিকে একটি কাঠের দণ্ডের সাহায্যে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আর উড়ানবায়ু তৈরি হবে না।

অগস্ত্য এবারে বাম হাতে যে নলটি বায়ুযানে প্রবেশ করেছিল তাকে টেনে খুলে দিল এবং একইসঙ্গে ডান হাতে ধরে রাখা রজ্জুতে টান দিল। এই রজ্জুটিকে গোল করে সেলাই করা ছিল বায়ু প্রবেশের মুখটিতে, টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখটি বন্ধ হয়ে গেল, যাতে উড়ানবায়ু আর এই ছিদ্রপথে বেরিয়ে না আসতে পারে। এবার যাত্রা শুরু করতে হবে। উপলের দিকে তাকাল অগস্ত্য, ‘প্রস্তুত?’

‘প্রস্তুত ভাই, সব দেখে নিয়েছি। এবার আর বিলম্বের কী প্রয়োজন?’

উপল এবার নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ে নির্দেশ দিল, ‘রজ্জুগুলি খুলে দাও!’

উপলের নির্দেশের অপেক্ষাতেই যেন ছিল চারজন শ্রমিক। তারা দাঁড়িয়েছিল চুপড়িটিকে মাটির সঙ্গে ধরে রেখেছে যে রজ্জুগুলি তাদের কাছে। এবারে তারা নীচু হয়ে মাটিতে গেঁথে রাখা কাঠের গজালগুলিকে হাত দিয়ে ধরল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে এক সঙ্গে গজালগুলিতে টান দিল।

এই সময় এমন এক কাণ্ড হল যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। তিনটি গজাল মাটি থেকে উপড়ে এলেও একটি এল না। এতে এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটল! তিনটি রজ্জু মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বায়ুযান শূন্যে অনেকটা ওপরে উঠে গেল। কিন্তু তখনও একটি রজ্জু মাটিতে গেঁথে রয়েছে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেও সেই গজালটিকে মাটি থেকে তুলতে পারল না শ্রমিকটি। এদিকে বাতাসের টানে বায়ুযান কিছুটা এগিয়ে গেল, তার ফল হল আরও সাংঘাতিক! যে গজালটি মাটিতে গেঁথে ছিল তাকে টানতে টানতেই নিয়ে চলল বায়ুযান, গজাল মাটি কেটে দ্রুত এগিয়ে চলল নদীর দিকে।

শ্রমিকটি নিজের সব শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছিল গজালটিকে, তাকেও টেনে নিয়ে চলল। নদীর তীরের পিছল কাদামাটির জন্য কিছুতেই নিজের পা দুটো মাটিতে গেঁথে দিয়ে গজালটির গতি রোধ করতে পারল না সে। একটি বড় পাথরের টুকরো যেন নদীর ঠিক পাশটিতে এই দুর্ঘটনার জন্যই অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করছিল। পাথরের খাঁজে গিয়ে আটকে গেল গজাল, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকটি সজোরে আছড়ে পড়ল পাথরের গায়ে। এই আঘাতে অচৈতন্য হয়ে পড়ল সে। এবারে বায়ুযানেরও গতি রুদ্ধ হল, রজ্জুটি যেন টেনে ধরে রইল তাকে, বায়ুযান রজ্জুটির দিকে বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়ল! অগস্ত্যরা কোনওক্রমে চুপড়ির ধারটিকে ধরে রেখে নিজেদের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছিল। নদীর বুকের প্রবল বাতাসে বায়ুযানটি আর একটু পরেই আছড়ে পড়বে নদীতে!

এমন সময় এক দুঃসাহসিক কাজ করল বাকারি। চুপড়ি থেকে রজ্জুটিকে লক্ষ করে ঝাঁপ দিল সে! কোনওক্রমে এক হাতে রজ্জুটিকে ধরতে পারল। পরক্ষণেই অন্য হাত দিয়ে রজ্জুটিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কোমর থেকে একটি ছোট ছুরি বার করে কাটতে লাগল রজ্জুটিকে। ঘষে ঘষে মোটা রজ্জুটিকে কয়েকক্ষণের মধ্যেই কেটে ফেলল সে। সঙ্গে-সঙ্গেই যেন সদ্য খাঁচা ছেড়ে বেরোন বাজপাখির মতো আকাশের দিকে দৌড় দিল বায়ুযান।

ঝুলতে থাকা রজ্জুটিকে তখনও শক্ত হাতে ধরে আছে বাকারি! বাতাসের টানে সে রজ্জু সমেত উড়ে এসে বায়ুযানের গায়ে ধাক্কা মারল, তারপর আবার দূরে সরে যেতে থাকল। ততক্ষণে উপল রজ্জুর অপর প্রান্ত ধরে নিজেকে নীচের দিকে নামিয়ে এনেছে, উপলের পা দুটি ধরে আছে অগস্ত্য। উপল বাকারির উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, ‘সাহস ত্যাগ কোরো না বাকারি! রজ্জুটিকে শক্ত করে ধরে রাখো! একটু একটু করে উপরের দিকে উঠে আসার চেষ্টা করো!’

কিছুটা উপরের দিকে উঠে বায়ুযান যেন শান্ত হল। নদীর ঠিক উপরের বায়ু চঞ্চল, কিন্তু বেশ কিছুটা উঠে আসার পর তার গতি যেন অনেকখানি কমল। যে রজ্জুটি বাকারি শক্ত করে ধরে ছিল তা আরও একবার আছড়ে পড়ল বায়ুযানে গায়ে। ঠিক সেই সময়ই উপল ডান হাত বাড়িয়ে প্রায় অচৈতন্য বাকারিকে ধরে নিল, তারপর অমিত শক্তিবলে তাকে টানতে টানতে রজ্জুর উপর দিয়ে নিয়ে এল।

অগস্ত্যও উপলকে ধরে রেখেছিল, চুপড়ির উপরে বাকারিকে জড়িয়ে থাকা উপল হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পরক্ষনেই উঠে দাঁড়িয়ে চুপড়ির গায়ে বাকারিকে সোজা করে বসিয়ে দিল উপল। তার ডান হাতের কব্জির উপরে নিজের দুটি আঙুল কিছুক্ষণ রেখে ইরতেনসেনুর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে বলল, ‘জ্ঞান হারিয়েছে, কিন্তু নাড়ি সবল। একটু পরই জেগে উঠবে ও। অসম্ভব সাহসিকতার পরিচয় দিল বটে তোমার এই ভাই!’

সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অগস্ত্যদের রক্ষা করল বাকারি। মাটিতে তখনও সমবেত জনগনের হর্ষধ্বনি শোনা যাচ্ছে। উল্লাসে কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ দেবতার জয়গান গাইছে, কারোর শিঙার আওয়াজ বাতাস বিদীর্ণ করে বায়ুযানে এসে পৌঁছে যেন তাকে কম্পিত করছে। বাকারির জ্ঞান ফিরে এল। ডান হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে সোজা করে তুলল অগস্ত্য, তারপর বুকে জড়িয়ে ধরল তাকে। বলতে লাগল, ‘ক্ষমা করে দিও আমাকে, ক্ষমা করে দিও।’

বাকারি আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে হতভম্বের মতো চেয়ে রইল উপল আর ইরতেনসেনুর দিকে। ইরতেনসেনু কিছু বলার আগেই উপল এগিয়ে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘আজ তুমি না থাকলে আমাদের এই যাত্রার এখানেই সমাপ্তি ঘটত। বায়ুযান এই নদীতে আছড়ে পড়লে আমরা কেউই বাঁচতাম না। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে ভাই। আমি নিজেকে সাহসী ভাবতাম, কিন্তু তোমার সাহস আর প্রত্যুতপন্নমতির কাছে আমার সাহস তুচ্ছ।’

নিজের শয়নকক্ষের অলিন্দে দাঁড়িয়ে এই কাণ্ড প্রত্যক্ষ করছিলেন হাতসেপসুত। নদীর তীরে নিজে উপস্থিত থেকে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাননি তিনি। এখান থেকেই ইরতেনসেনুদের যাত্রা শুরুর সাক্ষী থাকবেন ভেবেছিলেন। যেভাবে বায়ুযান উড়ানের সঙ্গে সঙ্গেই বিপজ্জনক ভেবে হেলে পড়ে নদীর দিকে এগিয়ে আসছিল সেই আশঙ্কায় ক্ষণিকের জন্য যেন তাঁর হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি দেখলেন কীভাবে বাকারি নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করল বাকিদের।

এতদূর থেকে দেখলেও বেশ ভূষার মাধ্যমে বাকারিকে বেশ চিনতে পেরেছিলেন হাতসেপসুত। অগস্ত্য সেনেনমুতের মৃত্যু নিয়ে যে-কোনও কারণে সন্দিহান তা অনুমান করতে পেরেছেন তিনি, কিন্তু তাকে এই নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি। ‘অগস্ত্য কি বাকারিকে সন্দেহ করছে?’ এমন প্রশ্নেরও উদয় হয়েছিল তার মনে। এখন তিনি ভাবলেন অগস্ত্য বাকারিকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে থাকলেও এবারে তার নিরসন হবে। বাতাসের টানে ধাবমান বায়ুযানটি এবারে একটু একটু করে ছোট হতে লাগল।

ফারাও হাতসেপসুত আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে প্রার্থনা করলেন, ‘হে মহান হাথোর, আপনি আপনার সন্তানদের আশীর্বাদ করুন, যেন তাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন হয়, যেন তারা সবাই অক্ষত শরীরে এই দেশের বুকে আবার ফিরে আসতে পারে। আমি আপনার দাসানুদাসী। আমার এই আকুতি যেন আপনার কর্ণে গিয়ে পৌঁছয়।’

হাতসেপসুত এরপর আবার বায়ুযানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন আকাশে একটি ভাসমান ভুট্টার দানার মতো লাগছে সেটিকে। যতক্ষণ না সেটি দিগন্তে মিলিয়ে যাবে ততক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইবেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *