১২। পুন্তের বৃক্ষ
সেই দিনের দ্বিতীয় প্রহরে প্রাসাদ থেকে দুটি ঘোড়ায় টানা রথ বেরিয়ে এল। তাদের সামনে পিছনে চলল পঞ্চাশাধিক অস্ত্রধারী সেনারা। একটি রথে অগস্ত্য, উপল এবং ইরতেনসেনু, অপরটিতে স্বয়ং ফারাও হাতসেপসুত এবং বাকারি। সেনা বেষ্টিত শকটদুটি চলল পূর্ব অভিমুখে। তাদের গন্তব্য জেহের জেসেরু।
নদীর তীর থেকে বেশ অনেকখানি ভিতরের দিকে চলে এলে পর জমি আর সবুজ থাকে না। মরুভূমির রুক্ষ আবহাওয়ার মধ্যে বেশ কিছু ছোট ছোট পাহাড় তৈরি হয়েছে এখানে। ক্রমাগত বয়ে চলা শুকনো এবং উষ্ণ বাতাসের ঘর্ষনের ফলে এই পাহাড়গুলি খর্বকায়, এদের গাত্র মসৃণ। পাহাড়গুলির ফাঁকে ফাঁকে জেগে থাকা অনুর্বর জায়গাটির নাম মৃতের উপত্যকা
এখানে একটি বিরাট বড় কবরখানা আছে। এই কবরখানার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। এখানে মাটি, পাথরের নীচে বহুমূল্য রত্নখচিত সমাধি কক্ষের মধ্যে শুয়ে আছেন কয়েকশো ফারাও, তাঁদের স্ত্রী এবং ঘনিষ্ট অমাত্যরা। মিশরীয়দের কাছে এই জায়গাটি ভীষণ পবিত্র। এই মৃতের উপত্যকার কাছেই আছে থীবসের কারাগার, পাঁচ বছর আগে বেশ কয়েকদিনের জন্য অগস্ত্যকে এই কারাগারে কাটাতে হয়েছিল।
মৃতের উপত্যকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টির নাম হল আকু। মিশরীয়রা বিশ্বাস করে এই আকু পাহাড়ের চূড়ায় সন্ধ্যাবেলায় দেবী মাত এসে বসেন। তাঁর দুটি পাখা শরীরের দু’দিকে বিস্তৃত করে দেবী মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকা ফারাওদের ছায়া দেন। দিনে দেবতা রা-এর আলোয় ফারাওদের কোন ক্ষতি হয় না, কারণ তারা সবাই রা-এরই সন্তান। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে অপদেবতারা পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসেন। আকাশের চাঁদ আর তারাদের আলো তাদের পথ দেখায়। দেবী মাত সেই আলো থেকে ফারাওদের রক্ষা করেন, যাতে অপদেবতারা তাদের কাছে পৌঁছতে না পারে।
ছ’শো বছর আগে আকু পাহাড়ের দক্ষিণ গায়ে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল একটি মন্দিরকে। এই উপত্যকার একমাত্র সৌধ ছিল এটি। ফারাও দ্বিতীয় মেন্তুহোতেপ তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। কিন্তু সেই সৌধ খুব বেশি বছর স্থায়ী হয়নি। তৈরি হওয়ার মাত্র পঞ্চাশ বছরের মাথায় তীব্র ভূমিকম্পের প্রকোপে সৌধটি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষটুকু বেঁচে আছে রুক্ষ পাথুরে জমির উপরে। এই ভেঙে পড়া অট্টালিকা থেকে কিছুটা নীচে পাহাড়ের এই দক্ষিণ গাত্রেই তৈরি হয়েছে ফারাও হাতসেপসুতের সৌধ, তার নাম ‘জেহের জেসেরু’। এই কথার অর্থ ‘পবিত্রের মধ্যেও পবিত্রতম’। স্বামী দ্বিতীয় তুতমোসে বেঁচে থাকা কালীন রানি এই সৌধ নির্মাণ শুরু করেন। এই মন্দিরটির নকশা বানিয়েছিল ইরতেনসেনু। সমগ্র মিশর জুড়ে এই মন্দিরটির সমকক্ষ আর একটিও সৌধ নেই। সৌধটি চওড়ায় প্রায় কুড়ি রজ্জুর মতো। দ্বিতল এই মন্দিরের বাইরের দিকে আছে তিরিশটি পাথরের স্তম্ভ, যা দ্বিতীয় তলের ওজনকে ধরে রেখেছে।
মন্দিরের বাইরের গাত্র উজ্জ্বল নীল বর্ণের। স্তম্ভগুলির গায়ে লাল, সবুজ এবং সোনালি রঙে আঁকা আছে হাতসেপসুতের বিভিন্ন ছবি। কোনওটিতে ফারাও দাঁড়িয়ে রয়েছেন, কোনওটিতে সিংহাসনে উপবিষ্ট, কোনওটিতে আবার কোনও বিদেশি রাষ্ট্র দূতের হাত থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করছেন। থামগুলির পিছনে মন্দিরের প্রধান প্রবেশ দ্বার। সেই প্রবেশদ্বারের দু’পাশে ফারাও হাতসেপসুত এবং আমুন-রা এর ছবি খোদাই করা। মন্দিরের ভিতরে বেশ কয়েকটি কক্ষ, এখানে দেবদেবীর মূর্তি রাখা আছে। কোনওটিতে আছে জ্ঞানের দেবতা থথ, কোনওটিতে সমৃদ্ধি ও শান্তির দেবী হাথোর, কোনটিতে আবার দেবতা হোরাসের মূর্তি।
মন্দিরের একেবারে ভিতরের দিকে রয়েছে গর্ভগৃহ, সেখানে পুজিত হন মিশরের যুদ্ধের দেবতা মন্তু। দেশের এই একটি মাত্র মন্দিরেই দেবতা রা কিংবা হোরাসের উপরে কোন অন্য দেবতার স্থান। দু’বৎসর আগে এই মন্দির নির্মাণ সমাধা হলে সাধারণ মানুষের জন্য তা খুলে দেওয়া হয়। তবে গত দু’মাস ধরে এই মন্দিরে থীবসের জনগনের প্রবেশ নিষেধ। ফারাওয়ের কঠোর নির্দেশ, মন্দিরের ত্রিসীমানাতেও যেন কাউকে দেখা না যায়!
‘জেহের জেসেরু’ মন্দিরটি পাহাড়ের গায়ে তৈরি হওয়ায় মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে অবস্থিত। মন্দিরের মাঝখান থেকে পাথরে বাঁধানো একটি সোজা পথ ঢালু ভাবে নেমে এসেছে মাটি অবধি। এইখানে প্রায় চার মানুষ সমান উঁচু একটি প্রাচীর আছে। প্রাচীরের গায়ের চওড়া দরজা দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। সেই দরজা এখন বন্ধ। তার দু’পাশে দশজন সশস্ত্র প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। তারা দিবা রাত্রের প্রতিটি মুহূর্ত এখন এই দরজার সামনে পাহারা দেয়।
ফারাও হাতসেপসুতের শকটটিকে বহু দূর থেকে দেখেও এদের চিনতে অসুবিধা হয়নি। শকটের মাথায় রাখা উড়তে থাকে পতাকায় ফারাওয়ের চিহ্ন দেখেই মাথা নীচু করে দরজার দু’পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে প্রহরীরা। হাতসেপসুত রথ থেকে নামার উপক্রম করতেই সঙ্গে আসা সৈন্যরা একটি রক্তবর্ণের বর্ণাঢ্য কাপড় মাটিতে বিছানো শুরু করেছিল, যার উপর দিয়ে ফারাও হেঁটে যাবেন। হাতসেপসুত হাতের ইশারায় তাদের বারণ করলেন।
ততক্ষণে অন্য রথটি থেকে ইরতেনসেনুরা নেমে এসেছে। বাকারি সবার সামনে এগোতে লাগল। প্রহরীরা মন্দির প্রাঙ্গণের ভারী দরজা ঠেলে সামান্য ফাঁক করার পর হাতসেপসুত, বাকারি, অগস্ত্য, ইরতেনসেনু এবং উপল তার মধ্যে প্রবেশ করলেন। বাকারি এবার পিছনে ফিরে প্রহরীদের নির্দেশ করল আবার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য।
ঢালু পথটি মন্দিরের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে নেমে এসে যেখানে মাটির সঙ্গে মিশেছে তার দু’পাশে দুই বিশাল আকৃতির মূর্তি। দুটিই সিংহের, বসে থাকা অবস্থায়, কিন্তু তাদের মাথা দুটি মানুষের। মিশরীয় পুরাণের মতে তারা এই মন্দিরের রক্ষাকর্তা, অতন্দ্র প্রহরী। মূর্তি দুটি হলুদ এবং বাদামি রঙ করা। এই দুটি মূর্তির দু’পাশে পাথরের তৈরি দুটি ছোট ছোট গোলাকার ঘেরা জায়গা। বাঁ দিকের ঘেরা অংশটি থেকে একটি গাছ উঠেছে। গাছটির কাণ্ড বেশ প্রশস্ত, উচ্চতায় তিনটি মানুষের সমান তো হবেই। কাণ্ড থেকে সামান্য উপরে ঝাঁকড়া ডালপালা উঠে গেছে। মূল কাণ্ড এবং তার শাখা প্রশাখাগুলি কণ্টকাকীর্ণ।
গাছটির পাতা গাঢ় সবুজবর্ণের। ছোট ছোট শাখাগুলির গায়ে অজস্র শ্বেতবর্ণের ফুল ফুটে আছে। এমন ফুল অগস্ত্য আগে দেখেনি। ফুলগুলি আকারে বড়, পাপড়িগুলি সামান্য দীর্ঘ, তাদের অগ্রভাগ সূঁচালো। একবার দেখলে মনে হয় অন্তত পঞ্চাশটি পাপড়ি তো আছেই এক-একটি ফুলে। পুষ্পটির মাঝখান থেকে সরু সরু কয়েকটি সুতার মতো গর্ভাশয় বেরিয়ে আছে। এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ যেন ঘিরে রেখেছে এই অঞ্চলটিকে। দরজা দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই গন্ধটি পেয়েছিল অগস্ত্য।
এবারে গাছটির সামনে এগিয়ে আসার সময় যেন সেই গন্ধ আরও তীব্রতর হল। গন্ধটির যেন সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। অগস্ত্য পাশ ফিরে দেখল উপলও চোখ বন্ধ করে এই সুগন্ধকে উপভোগ করছে, তার চোখে মুখে প্রশান্তি লেগে রয়েছে। কিন্তু বাকিরা আরও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ডান দিকের গোলাকার ঘেরা জায়গাটির কাছে। হাতসেপসুত, বাকারির মতো ইরতেনসেনুরও চোখ মুখ থমথমে। অগস্ত্য তাদের দিকে এগিয়ে গেল, যাওয়ার সময় উপলের কাঁধে সামান্য টোকা দিয়ে তাকে ডেকে নিল।
মাথা একটু ঝুঁকিয়ে গোল জায়গাটির মধ্যে তাকিয়ে অগস্ত্য বুঝতে পারল এখানেও বাঁ-দিকের গাছটির মতো আরও একটি গাছ ছিল। কিন্তু এখন কেবল তার খর্বকায় শুকনো কাণ্ডটিকে দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের কৃশ কাণ্ডটির গায়ে সামান্যতম সবুজের আভাসও নেই, বোঝা যায় এই গাছটি মৃত। এটিই তবে পুন্তের সেই বৃক্ষ, যার জন্য ফারাও এমন বিচলিত। মিশরের রাজপরিবার এই বৃক্ষটির জন্যই এখন ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাসাদ থেকে জেহের জেসেরুর দিকে আসার সময় ইরতেনসেনু এই বৃক্ষের কথা বলেছিল অগস্ত্য এবং উপলকে।
‘এই দুই বৃক্ষের বয়স প্রায় ছ’শো বছর। এই দেশের দক্ষিণ দিকে নুবিয়া অঞ্চলে রয়েছে কুশের সাম্রাজ্য। কুশ সাম্রাজ্যের অধিপতিরা কখনও ফারাওয়ের অনুগত ছিল না, বরং তাদের সদাচেষ্টা থাকত উত্তর মিশরের এই থীবসের রাজত্বকে ধ্বংস করা। সেই কারণে ফারাওদের সঙ্গে কুশ সাম্রাজ্যের রাজাদের যুদ্ধ লেগেই থাকত। কিন্তু ফারাওরা বারবার কুশেদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও কখনও তাদের একেবারে হারিয়ে দিতে পারেনি।
‘ফারাও মেন্তুহোতেপই প্রথম তার সৈন্যদল নিয়ে দক্ষিণের অভিমুখে যাত্রা করেন এবং এক প্রবল যুদ্ধের পর কুশেদের পরাজিত করেন। তার সময় প্রথম বারের জন্য উত্তর এবং দক্ষিণ মিশর ফারাওয়ের অধীনে এক হয়। এই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ফারাও এবং তার সৈন্যদলেরা এক আশ্চর্য জন্তুর কথা বলতে থাকে। সেই জীব নাকি ফারাওয়ের সঙ্গে কুশেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। জীবটির নাম ছিল কামারু।
‘আশ্চর্য এক জন্তু ফারাওয়ের হয়ে লড়াই করে? কিন্তু জন্তুটা এল কোথা থেকে?’ উপল জিজ্ঞাসা করেছিল।
‘পুন্ত থেকে। ফারাও যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে পর দেখা যায় তাঁর সঙ্গে ফিরেছেন দুই ভিনদেশি যুবক। তাদের বেশভুষা একেবারেই মিশরীয়দের মতো নয় আবার নুবিয়দের মতোও নয়। মিশরের দক্ষিণে অনেক গভীরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে নাকি রয়েছে এক আশ্চর্য জনপদ, তার নাম পুন্ত। ফারাও থীবসে ফিরে আসার পর কুশেদের সঙ্গে ঘটা যুদ্ধ নিয়ে অনেক জনশ্রুতি শোনা যায়। যুদ্ধ চলাকালীন ফারাও নাকি প্রায় হারতে বসেছিলেন, কুশেদের ক্রমাগত আক্রমণে কোণঠাসা অবস্থা হয়েছিল মিশরীয় সেনার
‘সেই যুদ্ধ আরও কয়েকদণ্ড চললে নাকি শুধু ফারাও মেন্তুহোতেপই নন, একটিও মিশরীয় সেনা প্রাণ হাতে নিয়ে থীবসে ফিরে আসত না। ঠিক এই সময়েই যেন মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূত হয় এক বিকট দর্শন জন্তু। তার শরীরটা চিতাবাঘের মতো, কিন্তু গলার কাছ থেকে মাথা অবধি নাকি ছিল একটি ময়াল সাপ। সেই অদ্ভুত দর্শন জন্তুটি নিমেষের মধ্যে কুশেদের সৈন্যদের নির্মম ভাবে হত্যা করতে থাকে, সেই সঙ্গে ফারাও খেয়াল করেন ভিনদেশী আরও কিছু যুবক যুবতী তাঁর হয়ে লড়াই করছে। জন্তুটি যেমন ভাবে এসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই অকস্মাৎই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। ততক্ষণে কুশেদের বাহিনী পরাজিত হয়েছে। সেই ভিনদেশিরা নিজেদের পরিচয় দেয় পুন্তের নাগরিক হিসাবে। তাদের কাছ থেকেই ফারাও জানতে পারেন এই জন্তুটির নাম কামারু।’
এই সময় অগস্ত্য বলেছিল, ‘কিন্তু এই যুদ্ধের সঙ্গে এই বৃক্ষ দুটির কী সম্পর্ক?’
‘হ্যাঁ এবারে সেই কথাতে আসছি। পুন্তের সেই দু’জন নাগরিক বেশ কয়েক মাস ছিল থীবসে। তারপর ফারাও মেন্তুহোতেপ তাদের সঙ্গে পুন্তের নগরে যান। শুধুমাত্র মেন্তুহোতেপকেই সেই নগরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্মত হয়েছিল ভিনদেশিরা। ফারাও দু’মাসের জন্য থীবসে ছিলেন না, তাঁর জায়গায় তাঁর সিংহাসন সামলান জ্যেষ্ঠপুত্র তৃতীয় মেন্তুহোতেপ। দু’মাস পর ফারাও যখন পুন্ত থেকে ফিরে আসেন তখন যেন তিনি অন্য রকমের এক পুরুষ। যুদ্ধবিগ্রহে তাঁর আর আগ্রহ ছিল না।
‘ফারাও ফিরে আসার সময় নিজের সঙ্গে করে এনেছিলেন দুটি কিশলয়কে। তিনি কিশলয় দুটিকে মাটিতে রোপণ করেন, তারপর সেই দুটি গাছের পিছনে খানিকটা দূরে পাহাড়ের গাত্রে বানান নিজের সৌধ। মেন্তুহোতেপ সেই সময় ঘোষণা করেন যে যুদ্ধের দেবতা মন্তু কামারু নামের দানবের আকার ধারণ করে কুশের যুদ্ধে মিশরীয়দের জিত সুনিশ্চিত করেছেন এবং ফারাওকে রক্ষা করেছেন। মন্দিরটি ফারাও দেবতা মন্তুকে উৎসর্গ করেন।
‘মেন্তুহোতেপ সেই সময় আরও বলেন যে পুন্তের নগরীতে এক আশ্চর্য মন্দিরের সন্ধান পান তিনি। সেই মন্দিরের উদ্যান থেকে তিনি এই কিশলয় দুটিকে তুলে নিয়ে এসেছেন, স্বয়ং দেবতা মন্তুর আশীর্বাদধন্য এই গাছ দুটি। এরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন দেবতা মন্তু মিশরীয়দের বহিরাগত শক্তির আক্রমণ থেকে প্রতিহত করবেন। কয়েক বছরের মধ্যেই গাছ দুটি বেড়ে ওঠে এবং শ্বেতপুষ্পের জন্ম দিতে থাকে।
অগস্ত্য পাথরে ঘেরা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ফারাও হাতসেপসুত তাঁর মন্দিরটি বানাবার সময় এই গাছ দুটির পিছনে মন্দিরটিকে বানান। কয়েকশো বছর আগের ভূমিকম্পের ফলে মেন্তুহোতেপের মন্দিরটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু সেই মন্দিরের প্রাঙ্গণও যে এই দুটি গাছ অবধি বিস্তৃত ছিল তা বোঝা যায়। ফারাও-এর উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে।
শ্বেতপুষ্পের গাছদুটির একটিও মরে যাওয়ার অর্থ দেবতা মন্তুকে রুষ্ট করা। যে কোন মুহূর্তে কোন একটি প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করলে সেই যুদ্ধে দেবতার আশীর্বাদ আর পাওয়া যাবে না! হার নিশ্চিত! ছ’শো বছরেও যা হয়নি অকস্মাৎ সেই শ্বেতপুষ্পের গাছের মৃত্যুতে দেশের মানুষ ফারাওয়ের দিকেই আঙুল তুলবে, কারণ মর্তবাসীদের মধ্যে তিনিই ঈশ্বরের সবচেয়ে নিকটের। তাঁর কোনও ভুলেই হয়তো দেবতা মন্তুর অভিশাপে গাছটি মারা গেল। এই অবস্থায় মিশরবাসীরা রাজদ্রোহও করে বসতে পারে।
মৃত গাছের কাণ্ডটির দিকে তাকিয়ে থেকেই অগস্ত্য বলল, ‘কবে মারা গেছে গাছটি?’
বাকারি উত্তর দিল, ‘এক মাস হল।’
‘কী ভাবে? কোন জরার লক্ষণ দেখেছিলেন গাছটির মধ্যে? অনেক সময় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃক্ষের কাণ্ড শুকিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে বেশ কয়েক মাস ধরে দেখা যাবে যে গাছের পাতাগুলি হলুদ বর্ণের
হয়ে যাচ্ছে অথবা কোন ফুল আর ফুটছে না। তেমন কিছু খেয়াল করেছিলেন আপনারা?
‘না সেরকম কিছু ঘটেনি। একদিন ভোর বেলায় হঠাৎই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এসে খবর দেন যে একটি শ্বেতপুষ্পের গাছ মৃত! খবরটি পেয়ে আমি আর কালক্ষেপ করিনি, নিজে পরিদর্শন করতে আসি। দেখি যে গাছটি সত্যিই মৃত, এক রাতের মধ্যে যেন কোন অদৃশ্য শক্তি তার সমস্ত জীবন রস শুষে নিয়েছে। বৃক্ষটির সব কটি পল্লব ঝরে গেছে, ফুলগুলি নষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সেইদিন থেকে এই মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ করি। কয়েকজন রক্ষী, যারা সেইদিন ভোরে মন্দিরের বাইরে পাহারা দিচ্ছিল, তারা এই ঘটনাটির কথা জানতে পেরেছিল। মোটা উপঢৌকন দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। মন্দিরের পুরোহিত এই কথা গোপন রাখবেন জানি। তিনি ঈশ্বরের অভিশাপের ভয়ে ভীত হয়ে আছেন।’
উপল এবারে বলল, ‘আচ্ছা এই বাম পাশের গাছটি থেকে আরেকটি ছোট কিশলয় বানানো যায় না? তাহলেই তো এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।’
‘না সেটি সম্ভব নয়, এই অঞ্চলে আর একটিও এত বড় বৃক্ষ লক্ষ করেছেন? এই রুক্ষ পরিবেশে শুষ্ক মাটিতে ছোট ছোট কিছু গুল্ম ছাড়া আর কোন উদ্ভিদই জন্মায় না, সেখানে এই দুটি বৃক্ষ এতগুলো বছর ধরে বেঁচে থাকাই বিস্ময়ের। এই বৃক্ষের একটি ক্ষুদ্র শাখাও কেউ ভাঙতে সাহস করে না, এর পুষ্পকে কেউ স্পর্শ করে না, স্বয়ং ফারাওয়েরও সেই অনুমতি নেই। পুষ্প যখন মাটিতে ঝড়ে পরে তখন শুকিয়ে যায়, সুতরাং তা থেকেও যে-কোনও নতুন কিশলয় তৈরি করা সম্ভব এমনও নয়।’
‘হুম, বুঝলাম। তাহলে পুন্তে গিয়ে এমন আরেকটি বৃক্ষ নিয়ে এলে এই সমস্যার সমাধান হবে।’
উপলের এই কথায় ফারাও হাতসেপসুত ম্লান হাসলেন। এবার তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটিই একমাত্র উপায়।’
অগস্ত্য বলল, ‘তাহলে তো সেই নগরীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেই হয়।’
‘সেই নগরী যে কোথায় তা কেউ জানে না অগস্ত্য। একমাত্র একজনই জানতেন এর হদিস, তিনি ছিলেন ফারাও মেন্তুহোতেপ। সেই হারিয়ে যাওয়া গুপ্তনগরীর সন্ধান করার জন্যই আমি ইরতেনসেনুকে এই দেশে আসতে বলেছিলাম।’
ইরতেনসেনু ফারাওয়ের এই কথায় অবাক হয়ে তাঁর চোখের দিকে তাকাল। সে কীভাবে পারবে হাতসেপসুতকে সাহায্য করতে? পুন্ত শহরের নাম সে অন্য থীবসবাসীদের মতোই শৈশবকাল থেকে শুনে এসেছে। কিন্তু সেই শহর কোথায় সে কীভাবে জানবে? ছ’শো বছর পর সেই শহরের অস্তিত্ব আজও আছে কি না তাই তো জানা নেই।
ফারাও ইরতেনসেনুর দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘এখান থেকে রাজকীয় পাঠাগারে যাব আমরা, আমি তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।’
অগস্ত্য এই সময় বলল, ‘আপনি বাকারির সঙ্গে প্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করুন ফারাও। আমরা কিছুক্ষণ পরে আসছি, এই জায়গাটি আরেকটু ভালো করে দেখে নিতে চাই। কথা দিচ্ছি খুব বেশি বিলম্ব করব না, আমরা প্রাসাদে পৌঁছেই আপনার সঙ্গে পাঠাগারে দেখা করব।’
হাতসেপসুত এবং বাকারি রথ নিয়ে চলে গেলেন, তাদের সঙ্গে আসা সৈন্যরাও প্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা করল। অগস্ত্যদের জন্য একটি অশ্বশকট দাঁড়িয়ে রইল মন্দির প্রাঙ্গণের বাইরে। ইরতেনসেনু তখনও মাটির দিকে তাকিয়ে এক মনে ভেবে চলেছে, সে রানিকে কীভাবে সাহায্য করবে? তাকে রানি এত দূর থেকে ডেকে যখন এনেছেন তখন নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন। ইরতেনসেনুর চমক কাটল অগস্ত্যর কথায়, ‘এখানে কোন আগ্নেয়গিরি আছে?’
ইরতেনসেনু পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল অগস্ত্য মাটির কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। পাথরে ঢাকা জায়গাটির সামান্য মাটি হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে তার গন্ধ শুঁকছে। অগস্ত্যর মুখ বিকৃত, যেন কোন তীব্র গন্ধ তার নাকে এসে লেগেছে। ইরতেনসেনু অগস্ত্যর প্রশ্নটি ভালোভাবে শোনেনি, সে বলল, ‘কী বলছ?’
‘বলছি এখানে, মানে এই দেশে কোন আগ্নেয়গিরি আছে?’
‘না তো।’
‘হুম, ব্যাপারটা তাহলে বড়ই অদ্ভুত লাগছে। উপল, একবার এই জায়গাটিতে দেখো।’
উপল অগস্ত্যর দেখাদেখি তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসল, অগস্ত্যর এগিয়ে রাখা তর্জনী লক্ষ্য করে কিছুটা মাটি হাতে তুলে নিয়ে গন্ধ শুঁকল, সঙ্গে সঙ্গে তারও মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। অগস্ত্য তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী বুঝছ?’
‘এই গন্ধ খুব চেনা লাগছে কেন?’
‘চেনা লাগা স্বাভাবিক, আমাদের দেশে কোন কোন ঔষধে এই গন্ধ পাও না?’
অগস্ত্যর এই কথায় উপলের ভ্রু সামান্য কোঁচকালো, পরক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে সে বলল, গন্ধক! এই গন্ধটি তো গন্ধকের!
‘একদম তাই, গন্ধক মিশে আছে এই মাটিতে।’
কিছুটা মাটি এবারে ও ইরতেনসেনুর সামনে নিয়ে এসে ধরল, ইরতেনসেও এবারে গন্ধকের তীব্র গন্ধ পেল। অগস্ত্য বলল, ‘এই মাটির কণার খুব কাছে চোখ নিয়ে এসে দেখো, হলুদ বর্ণের সূক্ষ্ম দানা দেখতে পাবে, ওগুলো গন্ধক। কিন্তু এখানকার মাটিতে গন্ধক আসবে কী করে?’
সে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল বাম দিকের গাছটির দিক, গাছটির নিচের মাটি হাতে নিয়ে তার ঘ্রাণ নিল, তারপর বলল, ‘না, এতে তেমন কোন গন্ধ নেই। তাহলে ওই দিকের গাছটির মাটিতে গন্ধক মেশানো হয়েছে, কেউ নিশ্চয়ই মিশিয়েছে। গন্ধক অতি অল্প পরিমাণে ব্যবহার করে ঔষধ তৈরি করা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত গন্ধক আবার বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে।’
ইরতেনসেনুর চোখ দুটি বিস্ফারিত হল। সে বিস্ময় মাখানো সুরে বলল, ‘তার মানে কেউ এই মাটিতে গন্ধক মিশিয়ে দিয়েছিল! যাতে বৃক্ষটি মরে যায়!’
‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র!’
উপল উত্তেজনার বশে সামান্য উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল। অগস্ত্য এর উত্তরে উপরে নীচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘খুব সম্ভবত তাইই, ফারাও হাতসেপসুতকে কেউ সিংহাসনচ্যুত করতে চায়। কিন্তু কে? রাজপরিবারের কেউ? এ এখনই বোঝা অসম্ভব। কিন্তু আমাদের সাবধান থাকতে হবে। যে বা যারা এই কাজটি করেছে তারা নিশ্চয় আমাদের উপরেও নজর রাখবে।’
এবার অগস্ত্য আবার ইরতেনসেনুর দিকে ফিরল, ‘আর একটি ব্যাপার ইরতেনসেনু। ফারাও মেন্তুহোতেপের সৌধের ধ্বংসস্তুপটি একবার দেখতে চাই। তুমি নিশ্চয়ই পথ চেনো।’
হাতসেপসুতের মন্দিরটিকে পিছনে ফেলে ইরতেনসেনুরা পাহাড়ের গা বেয়ে আরও একটু উপরের দিকে উঠতে লাগল। পাহাড়ের ছোট বড় নুড়ি পাথরের উপরে সাবধানে পা ফেলতে লাগল তারা। বেশ কিছুটা উপরে ওঠার পর একটি সমতল ক্ষেত্রে এসে পড়ল তারা। নীচ থেকে দেখে বোঝা যায় না এই জায়গাটির অস্তিত্ব। তবে ধ্বংসাবশেষের অবস্থা দেখে বোঝা যায়, এখানেও কোনও এক সময় একটি সৌধ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকত।
এখন শুধুমাত্র তার খিলানের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে মাটির উপরে। চারদিকে ভাঙা বড় বড় পাথরের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছ’শো বছর আগের দেবালয় এখন কেবল ইতিহাসের অংশবিশেষ। মন্দির গাত্রের একটি মাত্র প্রাকারের কিছুটা অক্ষুণ্ন, সেই অংশটি এখনও মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। অগস্ত্যরা প্রাকারটির দিকে এগিয়ে গেল।
প্রাকারটি উচ্চতায় দু’মানুষ সমান। তবে প্রস্থে খুব বেশি নয়, কারণ দু’পাশের বেশিরভাগটাই ভেঙে গিয়েছে। অগস্ত্য দেখল সেটির গায়ে কিছু ছবি খোদাই করা রয়েছে। সেখানেও ফাটল ধরেছে এবং রোদ- জল-তাপে রং বিবর্ণ হয়ে এসেছে। তবু বোঝা যায় প্রাকারের দু’পাশে আঁকা হয়েছিল দুটি ছবি। বাম পাশের ছবিতে দুটি শ্বেতপুষ্প গাছ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে আছে, গাছ দুটির মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক পুরুষ। তার পরনের বেশভুষা আর মাথার মুকুট দেখে বোঝা যায় তিনি ফারাও মেন্তুহোতেপ ব্যতীত আর কেউ নন।
ডানদিকে চোখ ফিরিয়ে অন্য ছবিটির দিকে তাকাতেই যেন হাড় হিম হয়ে গেল অগস্ত্যর। মনে হল সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে! এতশত বছরে এই ছবির রং চটেছে—জল, হাওয়া, বাতাসে ক্ষয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, কিন্তু তবুও যেন আজও এই ছবি একই রকমের ভয় এবং সম্ভ্রমের উদ্রেক করতে পারে মানুষের মনে। অগস্ত্যর সামনের ছবিটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দানব। তার শরীর চিতাবাঘের, কাঁধের উপরের অংশের জায়গায় একটি ভয়াবহ ময়াল সাপ যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন চকিতে সে শিকারকে তার নাগপাশে আবদ্ধ করতে উদ্দ্যত। তবে এই সেই কামারু! দেবতা মন্তুর দানবিক রূপ! মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ছবির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অগস্ত্য, উপল এবং ইরতেনসেনু।