১৮। ষড়যন্ত্র

১৮। ষড়যন্ত্র

অতিথিশালার কক্ষে ফিরে আসার পর দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিল অগস্ত্য। ইরতেনসেনু এবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমার কাছে সত্যগোপন করার কী প্রয়োজন ছিল তোমার? কেন আমাকে জানাওনি যে তুমি আমাদের পিতার মৃতদেহের কাছে নিয়ে চলেছ?’

অগস্ত্য সন্তাপ জড়ানো স্বরে বলল, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে ইরতেনসেনু। আমি যদি তোমাকে আগে থেকে বলতাম তাহলে হয়তো তুমি কর্মশালায় যেতে চাইতে না। তোমার স্থানে আমি থাকলেও আমিও মৃত পিতার সম্মুখীন হতে চাইতাম না। কিন্তু তোমাকে ছাড়া সেনেনমুতের মৃতদেহ দেখা সম্ভবও ছিল না আমার পক্ষে। তাই এই গোপনীয়তা।

উপল এখনও অগস্ত্যর উপরে রুষ্ঠ হয়ে আছে। রাগত স্বরে সে বলল, ‘সেনেনমুতের মৃতদেহ দেখার জন্য এত আগ্রহী ছিলে কেন তুমি? তুমি যে সংবেদনশীল নও তা আমি জানি, কিন্তু তার জন্য ইরতেনসেনুকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার খুব প্রয়োজন ছিল? আমাকে তোমার ভাই বলো, আমাকেও তো জানাওনি একবারের জন্যও।’

‘আমি দুঃখিত উপল। আমার জীবনে যে দুজন মানুষ আমার সবচেয়ে কাছের, আমার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় তারা হল ইরতেনসেনু এবং তুমি। কথাগুলো যে একান্তে তোমাকে বলব তার সুযোগ পাইনি।’

‘কিন্তু সেনেনমুতের মৃতদেহ দেখার জন্য তুমি হঠাৎ এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? আগামীকাল এত বড় একটি দিন আমাদের জন্য। এখনও আমরা জানি না বায়ুযান কার্যকরী হবে কি না, আমরা শূন্যে ভাসমান থাকতে পারব কি না, আমি সঠিক পথে তোমাদের নিয়ে যেতে পারব কিনা। এখনও শেষ মুহূর্তের কিছু প্রয়োজনীয় কাজ বাকি। কিন্তু আজকেই তোমাকে…’

‘সেনেনমুতের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।’

অগস্ত্যর এমন কথায় উপল চমকে উঠল! চমকে উঠল ইরতেনসেনুও, বিস্ফারিত চোখে সে তাকাল অগস্ত্যর দিকে। নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘কী বলছ! পিতাকে হত্যা করা হয়েছে! কে করেছে? কেন? কীভাবে?’

‘তোমার এই তিনটি প্রশ্নের একটির উত্তর আমার কাছে আছে ইরতেনসেনু। আমি নিশ্চিত যে, কোনও রোগভোগের কারণে সেনেনমুতের মৃত্যু হয়নি। তাঁকে খুন করা হয়েছিল বিষ দিয়ে।’

‘বিষ!’

‘হ্যাঁ উপল, ঠিক যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে শ্বেতপুষ্পের গাছটিকে।’

উপল এবারে উত্তেজনার স্বরে বলল, ‘গন্ধক!’

‘হ্যাঁ, গন্ধকই মহামন্ত্রী সেনেনমুতের মৃত্যুর কারণ।

‘কিন্তু তোমার এমনটা মনে হল কেন?’

‘আমার মনে আগে কখনও এমন চিন্তা আসেনি। কয়েকদিন আগের কথা, আমার যন্ত্রটি তৈরি করার সময়ে একদিন মধ্যাহ্নে আমি ভোজনে বসেছি, আমার সঙ্গে তখন ছিল বাকারি। বাকারি এই যন্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আয়োজন করে দিয়েছিল। সে প্রতিদিনই আসত আমাকে সাহায্য করবার জন্য। সেদিন ভোজন চলাকালীন আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। একসময় এসে গেল সেনেনমুতের কথা।

‘বাকারি তার পিতার নানা কীর্তির গল্প করতে লাগল, কীভাবে তার কূটনৈতিক বুদ্ধিবলে হিতাইতদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন সম্ভব হয়েছিল তা বলার সময়ে বাকারির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। বুঝতে পারছিলাম সে তার পিতাকে কতটা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বলতে বলতে সেনেনমুতের শেষদিনগুলির প্রসঙ্গ এল। বাকারি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে আমাকে জানাচ্ছিল তার পিতা কত কষ্ট পেয়েছেন মৃতুর আগে। আমার চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহ আছে, আমি তাই বাকারিকে জিজ্ঞাসা করি কোন রোগে মারা গেছেন সেনেনমুত। বাকারি জানায় যে সেই রোগের নির্ণয় রাজবৈদ্যও করতে পারেননি।

‘কিন্তু সেনেনমুতের শরীর ভীষণই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারণ করেছিল তাঁর শরীর, এবং একধরণের অদ্ভুত জলভরা ক্ষতে ভরে গিয়েছিল সেনেনমুতের বুক এবং উদর। এই বর্ণনা পাওয়ার পরই আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। সহজে আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি মানুষ এমন একটি প্রাণী যে নিজের স্বার্থরক্ষার কারণে অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে। আমি তাই আজ সকালে ফারাও হাতসেপসুতের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে আবার সেনেনমুতের মৃত্যুর কথা উত্থাপন করি। তখন দেখলাম তিনিও প্রায় একইরকমের বর্ণনা দিলেন। যদিও তিনি ক্ষতের কথা উল্লেখ করেননি, হয়তো সেনেনমুতকে খুব কাছ থেকে না দেখার দরুন শরীরের ক্ষুদ্র ক্ষতগুলি তাঁর নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। এতে আমার বিশ্বাস হয় যে অন্তত বাকারি মিথ্যা কথা বলেনি।

‘কিন্তু এমন কোনও রোগের কথা আমি আগে শুনিনি। তাই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসার পরই আমি ইরতেনসেনুকে বলি অতিথিশালায় ফিরে যেতে। আমি নিজে যাই রাজচিকিৎসক বেবতির কাছে। তাঁকে সেনেনমুতের অসুখের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি যা বললেন তার অধিকাংশই বাকারি এবং ফারাওয়ের বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেল।

‘তবে তিনি এমন কিছু আরও বললেন যা বাকারি আমাকে বলেনি। চিকিৎসক হিসাবে রোগীকে আরও ভালো ভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য বেবতি আরও কিছু লক্ষণের পরিচয় পান। বেবতি আমাকে জানান যে সেনেনমুতের যকৃতটি অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে গিয়েছিল। উদরে হাত দিয়ে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় যা একেবারেই সম্ভব নয়।

‘বেবতি আমাকে আরও জানান যে মৃত্যুর একদিন আগে থেকে মহামন্ত্রী অসংলগ্ন কথা বলছিলেন, অনেকটা প্রলাপের মতো। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল, এই সবক’টি লক্ষণ কোনও রোগের নয়, গন্ধকের বিষক্রিয়ার ফলে হয় এগুলি। ঠিক এই গন্ধক প্রয়োগেই বেশ কিছু বছর আগে কুন্দিনাপুরীর এক গ্রামীণ উপরাজাকে হত্যা করা হয়। সেই রাজার মৃতদেহ আমি দেখেছিলাম। তাই আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঠিক করি সেনেনমুতের মৃতদেহ একবার দেখব, সেই কারণেই মমি তৈরির কর্মশালায় ইরতেনসেনুকে নিয়ে যাওয়া, অমন নীচ ছলের আশ্রয় নেওয়া।

‘সেনেনমুতের শরীরে আমি ক্ষতগুলি দেখেছি। তারপর গোক যখন বললেন যে তাঁর যকৃত থেকে পচন ধরা ডিমের গন্ধ আসছিল তখন আর কোন সন্দেহই রইল না। ওই গন্ধ অন্য কিছুর নয়, গন্ধকের। গন্ধক সেবনের পর তা জমা হয় যকৃতে। ক্রমে যা যকৃতকে অকেজো করে দেয়, মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীরে অমন ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অন্তিম অবস্থায় গন্ধক জমা হতে থাকে মস্তিষ্কে, তখন রোগী উন্মাদের ন্যায় আচরণ করতে থাকে। এরপরই নেমে আসে মৃত্যুর করাল ছায়া।’

যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না ইরতেনসেনু। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল সে। উপলও চুপ করে ছিল তখন। একসময় ইরতেনসেনু বলল, ‘তাহলে শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষটি এবং পিতার হত্যাকারী একই জন?’

‘খুব সম্ভবত তাই, দুজন আলাদা মানুষ একই রকমের বিষ ব্যবহার করবে এটা কাকতালীয় হবে।’

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ অনুমান করা খুব সহজ। শ্বেতপুষ্পের গাছটিকে নষ্ট করতে পারলে হাতসেপসুতের সিংহাসনকে দুর্বল করে ফেলা যাবে। অন্যদিকে সেনেনমুত ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি পুন্তের ভাষা পড়তে পারেন। তাই তাঁকে খুন করলে এটা নিশ্চিত করা যাবে যে সেই বৃক্ষের হদিশ আর কোনভাবেই কেউ পাবে না।’

উপল এবারে বলল, ‘ঠিক বলেছ! ব্যাপারটা এবারে পরিষ্কার হচ্ছে। কিন্তু খুনটা তাহলে করল কে? তোমার কী মনে হয়? বাকারি?’

অগস্ত্য এ কথার জবাব দেওয়ার আগে ইরতেনসেনু বলল, ‘না, আমার তা মনে হয় না। প্রথমত, পিতার বয়স হয়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে বাকারিই মহামন্ত্রী পদে নিযুক্ত হতো। তাই সে এই পদের লোভে পিতাকে হত্যা করবে এটা ভাবাটা দুষ্কর। অন্যদিকে সে যদি হত্যা করেই থাকে তাহলে সে নিজেই আবার ফারাও হাতসেপসুতকে এটা জানাত না যে পুন্তের ভাষা পড়তে আমি সক্ষম। সেই ফারাওকে এই প্রস্তাব দেয় যে আমি যেন এই দেশে আসি এবং ফারাও মেন্তুহোতেপের রেখে যাওয়া প্যাপিরাসের পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করি। বাকারিকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি। নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো মানুষ সে নয়।’

‘তাহলে হত্যা করল কে?’

‘অথবা এটা বলা যায় যে হত্যাটা করল কারা?’

অগস্ত্যের এই কথায় সামান্য যেন অবাক হল ইরতেনসেনু এবং উপল। অগস্ত্য বলল, ‘গন্ধক কিন্তু এই দেশে সহজলভ্য নয়। এ দেশে কোন আগ্নেয়গিরি নেই যা গন্ধকের প্রাকৃতিক উৎস। এর অর্থ ভিনদেশের কেউ এটি এই শহরে নিয়ে এসেছিল। অন্যদিকে আবার এও ভাবনার বিষয় যে ফারাও-এর মন্দিরে অবাধে প্রবেশের অধিকার সবার নেই, তেমনই ছিল না সেনেনমুতের খুব কাছে পৌঁছনোর সুযোগ।

‘অর্থাৎ এই হীন কার্যে প্রয়োজন অন্তত দু’জন মানুষের। একজন অন্যদেশ থেকে গন্ধক নিয়ে এসেছে এবং অন্যজন এই শহরে তার প্রয়োগ করেছে। আচ্ছা ইরতেনসেনু, একটি প্রশ্ন তোমাকে করব ভেবেও করতে ভুলে গিয়েছি বারবার। সেনেনমুত তোমাকেই কেবল কেন পুন্তের ভাষার শিক্ষা দিতে গেলেন? বাকারি তো তাঁর নিজের পুত্র। তাকে কেন শেখালেন না?’

ইরতেনসেনু খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘এর সঠিক উত্তর আমার কাছে নেই অগস্ত্য। পিতা আমাকে বারবার বলতেন পুত্তের ভাষা আমাকে শিখতেই হবে। এ নাকি আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তখন ছোট ছিলাম, অতটা ভেবে দেখিনি। এখন তোমার প্রশ্নের পর মনে করে দেখলাম, পিতা এই শিক্ষা আমাকে বরাবর দিয়ে এসেছেন একান্তে। কখনও সন্ধ্যাবেলায়, কখনও বা গভীর রাত্রে, যখন গৃহের বাকি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন বলতেন রাত্রিযামই এই ভাষা শিক্ষার পক্ষে আদর্শ।

‘তার মানে কি এই যে, সেনেনমুত তার নিজের সন্তান বাকারিকে বিশ্বাস করতেন না? কিন্তু কেন?

উপলের চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।

‘আমি জানি না উপল। কিন্তু এই ভাষা শিক্ষার সময়ে আমার বয়স ছিল দশ। বাকারিরও বয়স তখন আট। এতটুকু বয়সের পুত্রকে অবিশ্বাস করার কী কারণ থাকতে পারে? আবার এও তো ঠিক যে পিতা কোন এক সময়ে বাকারিকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন যে পুন্তের ভাষা আমি পড়তে পারি। তা না হলে এটি তো বাকারির জানার কথা নয়। পিতা যদি বাকারির উপরে সন্দিহান হতেন তাহলে তো বলতেন না কোনভাবেই।’

‘তাহলে বাকারিকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যাবে না তাই তো?’

‘সেই প্রশ্ন এখন অর্থহীন উপল’, বলল অগস্ত্য।

‘আমাদের হাতে সময় নেই আর। আগামীকালই যাত্রা, তার অন্তে কী আছে তা আমরা কেউই জানি না। এই দেশে আসার পর থেকে সব কিছু এত দ্রুত হয়ে চলেছে যে ভাবনার কোন অবকাশ পাইনি। বুঝতে পারছি যে সেনেনমুতের মৃত্যু আর আমাদের পুন্তে যাত্রা দুটি একসঙ্গে জড়িত। কিন্তু কেন তা জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত অজ্ঞাতই থেকে যাবে।

‘বাকারি এখনও অবধি এমন কিছু করেনি যা থেকে তাকে সন্দেহ করা যায়। কাল সে আমাদের দীর্ঘ এক অনিশ্চিত যাত্রার সঙ্গী হবে, তাই তার উপরে সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখাটা প্রয়োজন। যদি সুস্থ শরীরে থীবসে আবার ফিরে আসতে পারি তাহলে সেনেনমুতের মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা যাবে। এখন আমাদের কর্তব্য ফারাওকে এই বিপদের মুখ থেকে উদ্ধার করা। আজকের রাত্রে যথেষ্ট বিশ্রামের প্রয়োজন।’

উপল নিজের ঘরে শুতে চলে যাওয়ার পর অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু কিছুক্ষণ যাবৎ যাত্রার শেষ মুহূর্তের কিছু আলোচনা করে নিল। তারপর তারা শয্যায় গেল। ইরতেনসেনু ক্ষণিকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও অগস্ত্য জেগে রইল, তার ঘুম আসছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল কোথাও যেন একটা কাঁটা বিঁধে রয়েছে, এক অস্বস্তি গ্রাস করছিল তাকে। কোথাও যেন একটা ভুল হচ্ছে, সেটি কী তা সে বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকার পর রাত্রির অন্তিম যামে ঘুম এল অগস্ত্যর। তখনই এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সে।

সে দেখল এক দৈত্যাকার শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষকে। সেই বৃক্ষের গুঁড়ি এতই চওড়া যে তাকে দু’হাতে বেড় দিয়ে ধরা যায় না। গাছটি যেন আকাশ ফুঁড়ে আরও উপরের দিকে উঠে গেছে। গাছের শাখাপ্রশাখা চারদিকে বিস্তৃত হয়ে এক ছায়া ছায়া ভাবের সৃষ্টি করেছে। সেই আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে অগস্ত্য। পুষ্পের মন মাতানো গন্ধে বিভোর হয়ে আছে ও। হঠাৎ-ই অন্য আরেক গন্ধ তার স্নায়ুকে নাড়িয়ে দিল।

এই গন্ধটি তো সুমিষ্ট নয়, এ যে রক্তের গন্ধ! মাটির দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল অগস্ত্য। শ্বেতপুষ্পের গাছের নীচে পড়ে রয়েছে এক মানুষের মৃতদেহ। কম আলোয় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে অগস্ত্যের পায়ের নীচ দিয়ে। উষ্ণ সেই রক্ত স্পর্শ করছে ওর পায়ের আঙুলের অগ্রভাগকে। অগস্ত্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়, অবয়বটিকে খুব চেনা লাগছে যে! কিন্তু মুখটিকে দেখা যাচ্ছে না তো! সহসাই ওর চোখে এসে আঘাত করে এক তীব্র আলোকরশ্মি।

ধড়ফড়িয়ে বিছানার উপরে উঠে বসে সে, দুঃস্বপ্নই ছিল তাহলে। পাশে এখনও অকাতরে ঘুমিয়ে রয়েছে ইরতেনসেনু। কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে ঘর ভরিয়ে দিচ্ছে, ওই আলো ঘুম ভাঙিয়েছে অগস্ত্যর। অনেকক্ষণ আগে ভোর হয়ে গেছে! ক্লান্ত শরীরে ওদের কারোরই ঘুম সময় মতো ভাঙেনি। ইরতেনসেনুকে ডেকে তোলাতে সেও বিছানায় উঠে বসেই বুঝতে পারল যে কত বিলম্ব করে ফেলেছে তারা, সত্বর তৈরি হতে শুরু করল।

জানলাটিকে খুলে দিয়ে অগস্ত্য অলিন্দের কাছে এসে দাঁড়াল। দিনের প্রথম প্রহরের সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল তার গায়ে। সে তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘আপনি আমার ঈশ্বর নন। কিন্তু আপনার উপরে আমার বিশ্বাস আছে, এই জগতের প্রাণরক্ষাকারী আপনি। হে আমুন-রা, হে সূর্যদেব, কোন রহস্য গোপন করে রেখেছেন আমাদের থেকে? মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার শেষ সূত্রটি আপনি। যার অর্থ আমরা এখনও জানি না। এক অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা আজ আমাদের। আমি জানি না আপনার অস্তিত্ত্ব আদৌ আছে কি না, আমার জিজ্ঞাসু মন সেই বিশ্বাসে বাধা দেয়। কিন্তু আজ আমি আপনার কাছে আমার জন্য নয়, প্রার্থনা করছি ইরতেনসেনুর জন্য, ফারাও হাতসেপসুতের জন্য, উপল এবং বাকারির জন্য, যাদের ভবিষ্যত নির্ভর করে আছে এই যাত্রার উপরে। এদের আপনি রক্ষা করুন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *