মোগলসরাই নামক স্থান পার হয়ে এক অপরাহ্নে গঙ্গানারায়ণ বারাণসীর সমীপে এসে উপস্থিত হলো। গঙ্গার বাম কূলে অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি নগরীটি তখন সদ্য দীপাবলীর আলোকমালায় ঝলমল করে উঠেছে। গঙ্গানারায়ণের হৃদয় কম্পিত হতে লাগলো। আর বেশী দেরি নেই। এবার বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
গঙ্গানারায়ণ তখনই অবশ্য নগরে প্রবেশ করলো না। তার মনের মধ্যে একটি বাধা আছে। তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যে কয়েক মাস সে পরিভ্রমণে রত ছিল, ততদিন তার স্মৃতি যেন হয়েছিল। অবশ। সে আহার করেছে, নিদ্রা গেছে এবং অন্যদের সঙ্গে পথ হেঁটেছে, অথাৎ তার শরীর ছিল সক্রিয়, কিন্তু মনের কোনো কার্যকলাপ ছিল না। যে জীবন সে ছেড়ে চলে এসেছে, একবারও সে জীবনের ছায়াপাত ঘটেনি মনে। তার দুঃখ ছিল না, পরিতাপ ছিল না, ভয় কিংবা সুখের আকাঙ্খা ছিল না।
প্ৰয়াগ সঙ্গমে স্নান করার পর তার সেই মোহনিদ্রা ভেঙে গেছে। এখন সকলই তার কাছে স্পষ্ট। সে জানে, সে গঙ্গানারায়ণ সিংহ, সে ইব্রাহিমপুরের জমিদারি পরিদর্শনে এসেছিল, সে প্রজাদের পক্ষ নিয়ে অত্যাচারী নীলকরদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নোমেও মধ্যপথে অকস্মাৎ সব ছেড়ে চলে এসেছে। কলকাতায় রয়েছে তার জননী, তার ভাই ও বিবাহিতা পত্নী, এ সব কথা গঙ্গানারায়ণের মনে পড়লেও এখন এ সমস্ত কিছুও তার কাছে তুচ্ছ। সে আর পিছন দিকে ফিরে যাবে না। বিন্দুবাসিনীকে নিয়ে সে পরিচিত জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়ে মানুষের অগম্য কোনো স্থানে নীড় বাঁধবে। বিস্ময়ে বিমোহিতা বিন্দুবাসিনীর সামনে সে অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে বলবে, দাখ বিন্দু, তোকে আমি ভুলিনি। আমি এসেছি, অনেক দূরের পথ পার হয়ে। আমরা দুজনে আমাদের পরিচিত পৃথিবীকে পশ্চাতে ফেলে অজানা দেশে চলে যাবো।
কিন্তু গঙ্গানারায়ণের বাধাটি অন্য।
বিধুশেখরের নির্দেশে বউবাজারের কালীমন্দিরে গিয়ে দেবীমূর্তির পা ছুঁয়ে গঙ্গানারায়ণ শপথ করেছিল যে, সে আর কখনো বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করবে না। সেই শপথের কথা বিন্দুবাসিনীও জানে। সেই শপথের জন্যই যদি বিন্দুবাসিনী তাকে ফিরিয়ে দেয়? শপথভঙ্গকারীকে কেউ শ্রদ্ধা করে না, গঙ্গানারায়ণ নিজেও করে না। সে সময় গঙ্গানারায়ণের বয়স অল্প ছিল, বিধুশেখরের প্রতাপ অগ্রাহ্য করার মতন শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি, তা ছাড়া, বিন্দুবাসিনীর ওপর যাতে কোনো অত্যাচার না হয়, সেইজন্যই সে বাধ্য হয়ে নিয়েছিল শপথ। এখন সেই শপথের বাধা অতিক্রম করবে। কী করে?
পথশ্রমে গঙ্গানারায়ণ ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, অবসন্ন। এখন তার শরীর চাইছে বিশ্রাম। সে অনায়াসেই রাত্রির জন্য কোনো সরাইখানায় আশ্রয় নিতে পারে। আসার পথে গঙ্গানারায়ণ তার দুটি অঙ্গুরীয় বিক্রয় করেছে, তার কাছে যথেষ্ট অর্থ আছে। তবু গঙ্গানারায়ণ ইতস্তত করতে লাগলো। বারাণসীতে সে যে বিন্দুবাসিনীর সন্ধানেই এসেছে, এ ব্যাপারে সে তার মনের সঙ্গেও কারচুপি করতে পারবে না।
বারাণসী শহরের প্রবেশ পথে মস্ত বড় একটি লোহার ফটক। কাছেই একটি কোতোয়ালি। ফটকটির দুপাশে দাউ দাউ করে জ্বলছে দুটি মশাল। অনেকগুলি গো-যান, অশ্ব শকট ও মানুষজনের ভিড় সেখানে।
সেখান থেকে একটু পিছিয়ে এসে একটি বৃক্ষতলে বসে গঙ্গানারায়ণ শ্ৰান্তিতে চোখ মুদলো। অমনি সে মানস নয়নে দেখতে পেল এক করাল কালীমূর্তি, এর জিহ্বাটি সোনার, চক্ষুদুটিতেও স্বর্ণ ফলক বসানো, অন্ধকারে সেই জিভ ও চোখ ঝকঝকি করছে। এই সেই বউবাজারের কালীমূর্তি, যাঁর সামনে শপথ নিয়েছিল গঙ্গানারায়ণ। গঙ্গানারায়ণের সবঙ্গে শিহরন হলো। সে যে ঠিক ভয় পেল তাও নয়, কলেজ জীবন থেকেই সে অলৌকিক বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে আস্তে আস্তে। কিন্তু এ এক অন্যরকম অনুভূতি। সে চোখ বুজে এখন বিন্দুবাসিনীর মুখখানি মনে করতে চাইছে কিন্তু তার বদলে দেখা দিচ্ছে এই ধাতু-প্রস্তরের মূর্তির মুখ। অনেক চেষ্টা করেও গঙ্গানারায়ণ বিন্দুবাসিনীর মুখখানি মনে আনতে পারলো না।
গঙ্গানারায়ণ চোখ খোলা রেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। এই শপথের নিগড় তাকে ভাঙতেই হবে। এত দূর এসে সে তো আর ফিরে যেতে পারে না। প্রয়াগ থেকে আসার পথে সে বারবার এই কথাই ভেবেছে। অতীত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত না হতে পারলে বিন্দুবাসিনীকে পাবার কোনো উপায় নেই তার।
এক সময় গঙ্গানারায়ণ আপন মনেই বলে উঠলো, আমি মানি না!
মাটির ওপর হাঁটু দুটি স্থাপন করে বসে হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে গঙ্গানারায়ণ বললো, আজ থেকে আমি তোমাদের নিকট হতে বিযুক্ত হলুম। আমি নতুন শপথ গ্রহণ করচি, আজ থেকে আমরণ আমি আর কোনো দেব-দেবীকে প্ৰণাম জানাবো না। এই সব দেব-দেবীরা ভ্ৰান্ত বিশ্বাসে গড়া কাষ্ঠ-লোষ্ট্রের পুত্তলি মাত্র, যারা ওদের নিয়ে পুতুল খেলতে চায় খেলুক, আমার কাছে ওরা সব মূল্যহীন।
গঙ্গানারায়ণ তার বন্ধু রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে যাতায়াত করেছে অনেকবার। রাজনারায়ণ যেদিন ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করে, সেদিন গঙ্গানারায়ণ উপস্থিত ছিল সেখানে। সংস্কারমুক্ত ব্ৰাহ্মধর্মের প্রতি সেও শ্রদ্ধাশীল হয়েছিল, সে বুঝেছিল যে, রাজার জাতি খৃষ্টানদের চাপে পড়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে খৃষ্টধর্ম গ্রহণের জোয়ার এনেছে তা রোধ করার জন্য এই নতুন মত প্রচারই শ্রেষ্ঠ পন্থা এবং এর ফলে হিন্দুধৰ্মও একটা পরিচ্ছন্ন রূপ পাবে।
এই ব্ৰাহ্মধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও গঙ্গানারায়ণ নিজে তা গ্ৰহণ করতে পারেনি, তাদের গোঁড়া বৈষ্ণব পরিবারে এ এক দারুণ বিদ্রোহ, তার মা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। অনেক ধর্মপ্ৰাণা হিন্দু মহিলার ধারণা দেব-দেবীদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে অকাল মৃত্যু হয়। ধর্ম হিন্দুদের মধ্যে এনে দিয়েছে ভীরুতা। ধর্ম পালনের কারণ যেন নানাপ্রকার ভয়।
এখন গঙ্গানারায়ণ একা, তার কোনো পশ্চাৎটান নেই, সে বিশ্বাসের ব্যাপারে স্বাধীন।
গঙ্গানারায়ণ তখন সেইখানে নিজের বিবেককে সাক্ষী রেখে ব্ৰাহ্ম ধর্ম গ্ৰহণ করলো। সে উচ্চারণ করলো, ওঁ তৎ সৎ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কতা সেই সত্য।…একমেবাদ্বিতীয়ম ব্ৰহ্ম—একমাত্র অদ্বিতীয় বিশ্বব্যাপী নিত্য ব্ৰহ্ম, আমি তাঁহার বন্দনা করিব।–তিনি সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও অনন্তরূপ স্বরূপ ব্ৰহ্ম-যাঁহা হইতে সকল ভূত জন্ম লাভ করে, যাঁহাতে জীবিত থাকে এবং যাঁহাতেই সব লয়প্রাপ্ত হয়, তিনিই ব্ৰহ্ম-আমি প্ৰতিদিন শুদ্ধ চিত্তে তাঁহারই বন্দনা করিব, তাঁহা বৈ আর কাহারও নয়।…
গঙ্গানারায়ণ এখন নতুন মানুষ, পুরাতন বিশ্বাস, শপথের আর কোনো মূল্যই নেই তার কাছে। সে যদি খৃষ্টান বা মুসলমান হতো, তার পরও কি সে হিন্দু দেব-দেবীর কাছে গ্রহণ করা শপথ মান্য করতো? বেশী কথা কি, বিন্দুবাসিনীর জন্য খৃষ্টান বা মুসলমান হতেও তার আপত্তি ছিল না, সকল ধর্মের ঈশ্বরই তো এক।
গঙ্গানারায়ণ আবার চোখ বুজলো। এবারেও অবশ্য সে বিন্দুবাসিনীর মুখ দেখতে পেল না, এবারও অন্ধকারে ভেসে উঠলো। সেই স্বর্ণজিহ্বা ও স্বর্ণনয়না। কালীমূর্তির মুখ। তবু গঙ্গানারায়ণের আর কোনো দায় নেই। সে ঠিক জানে, তার দৃষ্টি একদিন স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
এবার গঙ্গানারায়ণ উঠে হাঁটতে হাঁটতে ফটক পেরিয়ে চলে এলো বারাণসী শহরের মধ্যে। পথে পথে মশাল জ্বলছে, দোকানপাটে চলছে কেনাবেচা। সে এক দোকান থেকে কিনলো এক প্রস্থ নতুন পোশাক, তীর্থযাত্রীর ধূলি-মলিন বেশ সে এবারে ছাড়বে। অপর এক দোকান থেকে সে কচৌড়ি ও মালাই কিনে উদর পূর্তি করলো, তারপর আশ্রয় নিল কাছাকাছি এক সরাইখানায়। এই রাত্রে বিন্দুবাসিনীর খোঁজ করে কোনো লাভ নেই।
বারাণসী শহরটি সম্পর্কে গঙ্গানারায়ণের সম্যক কোনো ধারণা ছিল না। কলকাতার চেয়েও এর লোকসংখ্যা বেশী। কত রকমের মানুষ! সকাল বেলা পথে বেরিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে।
কতকালের প্রাচীন এই শহর, হিন্দুদের পরম পবিত্র তীর্থ। স্বয়ং শিব এখানে এসে ভিক্ষা নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণর কাছ থেকে। আবার এই শহর মুসলমানদের অধীনেও থেকেছে, মন্দিরের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে মসজিদ। এক হিন্দু জমিদারের হাতে কাশীর জমিদারির স্বত্ব দিয়েছিলেন অযোধ্যার নবাব। আবার এই জমিদারি শাসনের অধিকার অযোধ্যার নবাব দিয়ে দিয়েছেন ইংরেজদের। ফলে এখানে হিন্দু, মুসলমান এবং ইংরাজ নারী-পুরুষ যত্রতত্র দেখা যায়। ভীরু তীর্থযাত্রীদের দলের পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় সাহেব রাজপুরুষ। অথবা ঝমোঝম করে তাঞ্জাম হাঁকিয়ে যেতে দেখা যায় কোনো অভিজাত মুসলমানকে। আবার এক সঙ্গে এক দঙ্গল সাধুর শোভাযাত্রায় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গার রাজা মহারাজারাও জাঁকজমকের সঙ্গে আসেন পুণ্য অর্জনের জন্য। নানা বয়েসের বিধবা ও বৃদ্ধ ধর্মভীরু বাঙালীর সংখ্যাও ভিড়ের মধ্যে কম নয়। গঙ্গানারায়ণ জানে, তার পিতা রামকমল সিংহ এক সময় বারাণসীতে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। বিধুশেখরের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই। এখানে। বিধুশেখর দূর দেশে ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন না বলে তাঁর ভূসম্পত্তি তিনি কলকাতাতেই বাড়িয়ে চলেছেন। সুতরাং, বিন্দুবাসিনীকে কাশীতে রামকমল সিংহের বাড়ি তেই রাখা হবে, এটাই গঙ্গানারায়ণ স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল। দলিলপত্র দেখে সে বাড়িটির ঠিক গনাও জানা ছিল তার।
পথঘাট সে চেনে না, লোককে জিজ্ঞেস করতে করতে এগোলো গঙ্গানারায়ণ। তাকে যেতে হবে দশাশ্বমেধের ঘাটের কাছে। এখানে নাকি ঘাট আছে প্ৰায় আশিটি, তার মধ্যে যে পাঁচটি ঘাটকে বলে পঞ্চতীর্থ, তার মধ্যে দশাশ্বমেধ একটি, সুতরাং সবাই চেনে। পথের লোককে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা স্বেচ্ছায় অনেক কথা জানিয়ে দেয়। কাশীর মানুষ অচেনা লোকদের সঙ্গেও কথা বলতে ভালোবাসে, এরা কলকাতার লোকদের মতন নয়।
বেশ কিছু দূর যাবার পর গঙ্গানারায়ণের চোখে পড়লো একটি উচ্চ মন্দিরের চূড়া। রৌদ্রকিরণে মন্দিরের উপরিভাগ ঠিক সোনার মতন ঝকঝকি করছে। এমন মন্দির সে আগে কখনো দেখেনি। পথের লোককে সেই মন্দিরের কথা জিজ্ঞেস করতে তারা সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়ে গেল। কাশীতে এসেও বাবা বিশ্বনাথের মন্দির চেনে না, এ কোন পাপী?
গঙ্গানারায়ণ লোকের কথায় জানতে পারলো যে, মন্দিরের চূড়াটি সত্যিই সোনার। এ মন্দির কতকালের কেউ জানে না। তবে ঔরঙ্গজেবের আমলে এই মন্দির একবার ধ্বংস করা হয়েছিল। রানী অহল্যাবাঈ মন্দিরটি আবার গড়ে দিয়েছেন আর মহারাজা রণজিৎ সিংহ শিখরটি মুড়ে দিয়েছেন সোনায়। একজন পথের সাখী গঙ্গানারায়ণের হাত চেপে ধরে বললো, চলো, আমিও–মন্দিরে যাচ্ছি, আমার সঙ্গে গিয়ে বিশ্বনাথ দৰ্শন করে আসবে। কাশীতে এসে আগে বিশ্বনাথকে প্ৰণাম করে তারপর অন্য কাজ শুরু করতে হয়।
গঙ্গানারায়ণ হাত ছাড়িয়ে নিল। দূর থেকে মন্দির দর্শন করাই তার পক্ষে যথেষ্ট। আর কোনোদিন সে পাথরের মূর্তিকে প্ৰণাম করবে না।
দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে সেই বাড়িটির সন্ধান পাওয়া গেল। সে বাড়ির চত্বরে কয়েকজন বলশালী হিন্দুস্থানী সারা গায়ে তেল মেখে কুস্তি লড়ছে। উরুতে চপাস চপাস করে চড় মেরে তারা পরস্পরের প্রতি হুংকার ছেড়ে বলছে, চলে আও, চলে আও পাঠ্যে! সে বড় মজার কুস্তি খেলা, একজন আর একজনের ওপর লাফিয়ে পড়ছে বটে, কিন্তু কেউ কারুকে ধরে রাখতে পারছে না, অত্যধিক তৈল মর্দনের জন্য তাদের শরীর দারুণ পিচ্ছিল, ধপাস ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে এবং হাসছে। তাদের খেলা দেখবার জন্য কিছু দর্শকও জমেছে। গঙ্গানারায়ণও দাঁড়িয়ে গেল। সেই যুযুধানদের ভেদ করে বাড়ির সদরে যাওয়া যাবে না। বাড়িটি আগাগোড়া কঠিন পাথরের তৈরি, ত্ৰিতল, ভিতর দিকে কয়েকটি মহল আছে বলে মনে হয়। গঙ্গানারায়ণ যখন কলেজের ছাত্র, সেই সময় তার পিতা রামকমল সিংহ এখানে কিছু দিন ছিলেন কমলাসুন্দরীকে নিয়ে।
কুস্তি শেষ হবার পর ঐ পালোয়ানদেরই একজনকে গঙ্গানারায়ণ প্রশ্ন করলে যে, ঐ বাড়ির মধ্যে কে আছে? সে কলকাতা থেকে এসেছে, ঐ বাড়ির অন্দরমহলে একবার যেতে চায়।
পালোয়ানটি বিস্মিত হয়ে বললো যে, কুঠিটির অন্দরমহলে বাঙালীবাবুটি গিয়ে কী করবে? এই কুঠির মালিক তো রাজা চৈত সিং, তিনি কয়েকদিনের মধ্যে কাশী দর্শনে আসবেন বলে তাঁর কয়েকজন দেহরক্ষী অগ্রিম এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, তা ছাড়া আর বাড়িতে কেউ নেই।
তবে কি ঠিকানা ভুল হলো? তাইবা কী করে হবে? গঙ্গানারায়ণ আর একবার বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল যে, সদর দ্বারের পাশে দেওয়ালে একটি চৌকো শ্বেতপাথরে দেবনাগরী হরফে লেখা আছে, সিংহ মঞ্জিল। গঙ্গানারায়ণ সেদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললো, এ বাড়ি তো কলকাতার সিংহবাবুদের। এ বাড়ি আমাদের।
পালোয়ানরা এ বিষয়ে কিছু জানে না। তারা প্রত্যেক বছর একবার করে রাজা চৈত সিং-এর সঙ্গে কাশীধামে আসে আর এই বাড়িতেই ওঠে। চৈত সিং-এর কুঠির নাম যে সিংহ মঞ্জিল হবে, এই সাধারণ কথাটাও এই বাঙালীবাবুট বোঝে না? তারা সরল লোক, তারা বললো, বাড়ির মালিকানা নিয়ে তো তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই, আর এক সপ্তাহের মধ্যে রাজা সাহেব নিজে এসে যাবেন, তখন তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য যেন বাঙালীবাবুটি অপেক্ষা করেন।
গঙ্গানারায়ণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সত্যিই তো, রাজা চৈত সিং-এর বাড়ির নামও তো সিংহ মঞ্জিল হতে পারে। তা হলে কী এ তল্লাটে আর কোনো সিংহ মঞ্জিল আছে? দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে সিংহ মঞ্জিল নামে বাড়ির কথাই তো সে জানে।
যে-কয়েকজন দর্শক উপস্থিত ছিল, তারা বললো যে না, এদিকে সিংহ মঞ্জিল নামে আর কোনো বাড়ির কথা তাদের জানা নেই। তবে বাঙালীবাবুটি এক কাজ করতে পারে। দশাশ্বমেধ ঘাটে মনসারাম নামে একজন ছড়িওয়ালা থাকে, যার পেশা সকলের কপালে চন্দনের ফোঁটা লাগানো, সেই মনসারাম ছড়িওয়ালা এ তল্লাটের সব কুঠির খবর রাখে। তার কাছে জিজ্ঞেস করলে সব জানা যাবে।
ঘাটে এসে মনসারামকে খুঁজে পেতে দেরি হলো না। দুএকজন উৎসাহী লোক গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে সঙ্গেই এলো। দম দিয়ে তৈরি একটা বিরাট ছাতার নিচে বসে আছে মনসারাম। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা, দেখে মনে হয়। বয়সের গাছ পাথর নেই।
মনসারাম সব বৃত্তান্ত শুনে বললো, হাঁ, কলকাত্তার বাবু রামকমল সিংজীর কথা তার খুব মনে আছে। বহুৎ রহিস আদমি ছিলেন, প্রতি রাতে এখানে বজরার ওপর বাঈজী নিয়ে খুব নাচ-গানা ফুর্তি করতেন। শুধু তাই নয়, বাবুর দিল ছিল খুব বড়, প্রতি মাসে একবার তিনি বারাণসীর সব পাণ্ডা আর ব্ৰাহ্মণদের পেট চুক্তি খাওয়াতেন। ওঃ সে কি জবর খাওয়া, মনসারাম ছড়িওয়ালার এখনো মনে আছে। হাঁ, ঐ যে কাছেই সিং মঞ্জিল, ঐটাই ছিল রামকমল সিং বাবুর কোঠি।
তাহলে ঐ বাড়ি এখন চৈত সিং-এর হলো কী করে? এ প্রশ্নের উত্তরে সে জানালো যে,পাঁচ ছবছর আগে ঐ কোঠি বিক্রি হয়ে গেছে, কলকাত্তা থেকে রামকমল সিংহ বাবুর দেওয়ান এসেছিল, তার কাছ থেকে রাজা চৈত সিং খুব মুফতে বাড়ি কিনে নিয়েছেন, মাত্র সাড়ে বারো শ রূপেয়াতে। অথচ রামকমল সিং-বাবুজী নিজে কিনেছিলেন পচিশ শো টাকা দিয়ে, সে সব জানে। এই তো নসীব, বড় মানুষ মারা গেলে তার সম্পত্তি ছারখার হয়ে যায়, মনসারাম এরকম কত দেখেছে।
উদভ্ৰান্ত অবস্থায় গঙ্গানারায়ণ ঘাটের এক প্রান্তে এসে জলের দিকে মুখ করে বসলো। এবার সে কোথায় বিন্দুবাসিনীর সন্ধান করবে? বারাণসী যে এত বৃহৎ জায়গা, সে আগে কল্পনাও করেনি। এর মধ্যে একটি অন্দরবাসিনী নারীকে সে খুঁজে পাবে কী ভাবে? নিজস্ব কোনো আশ্রয় নেই, তাহলে বিধুশেখর কোথায় পাঠালেন বিন্দুবাসিনীকে! বিধুশেখর নিজে আসেননি, কোনো কর্মচারী মারফৎ মেয়েকে বিদায় দিয়েছেন, সেই লোক কি বিড়াল পার করার মতন বিন্দুবাসিনীকে যে-কোনো জায়গায় অসহায়ভাবে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে?
অথবা এমনও হতে পারে, বিধুশেখর বিন্দুবাসিনীকে আদৌ পাঠাননি কাশীতে। সে চতুর ব্ৰাহ্মণকে কিছু বিশ্বাস নেই। ভবিষ্যতেও যাতে কোনোদিন গঙ্গানারায়ণ তার সন্ধান না পায় সেইজন্য বিধুশেখর বিন্দুবাসিনীকে হয়তো অন্য কোথাও প্রেরণ করে রটিয়ে দিয়েছেন কাশীর কথা। কৃষ্ণনগরে বিধুশেখরের পৈতৃক বাড়ি আছে, সেখানে রেখে আসেননি তো! না, কৃষ্ণনগর বেশী দূর নয়, তাহলে জানাজানি হয়ে যেতই।
রাগে হতাশায় গঙ্গানারায়ণ অত্যন্ত অবসন্ন বোধ করলো। কিন্তু সে বুঝতে পারলো, তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। বিন্দুকে খুঁজে বার করতেই হবে। বিন্দুর জন্য সে সব কিছু ছেড়ে এসেছে। আর তার ফেরার পথ নেই। বিন্দুকে সে যদি খুঁজে নাও পায় তাহলেও সে চিরজীবনের মতন এই কাশীতেই থেকে যাবে।
এরপর বেশ কয়েকদিন সে কাশীর আলি গলিতে ঘুরে বেড়ালো সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা। ভোরে কিংবা অপরাহ্নে স্নানের সময়ও সে ঘাটগুলি তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কখনো দূর থেকে কোনো যুবতীকে দেখে বিন্দুবাসিনী বলে ভ্ৰম হয়। সে কাছে ছুটে যায়, সেই সব মুহূর্তে তাকে মনে হয় উন্মাদের মতন। কিন্তু বিন্দুবাসিনীর কোনো চিহ্ন নেই।
সারা বারাণসী ঘুরে গঙ্গানারায়ণের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। যত বড় তীর্থ ক্ষেত্র, সেখানে ততবেশী পাপের আড্ডা। ইংরেজরা কাশীতে পুলিস চৌকি বসিয়েছে বটে, কিন্তু এখানে আইন শৃঙ্খলার প্রায় কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আছে, আদালত-গারদ আছে। কিন্তু কেউ তা মান্য করে না। সাধুপুণ্যার্থীদের মতনই প্ৰায় সমান সংখ্যক গুণ্ডা বদমাস গিসগিস করছে এখানে। গলিতে গলিতে অসংখ্য বাঈজী ও দেহ পসারিণী। একদিন সন্ধ্যার পর একটি গলিতে ঢুকে পড়ে সে হকচকিয়ে গিয়েছিল। প্রতি গৃহের দরজায় দরজায় রূপসী স্ত্রীলোকদের জেল্লা। তাকে দেখে খলখলিয়ে হেসে উঠেছিল তারা। দু তিনজন এসে চেপে ধরেছিল তার হাত, অতি কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে মান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে গঙ্গানারায়ণ।
আর একদিন গঙ্গানারায়ণের প্রায় চোখের সামনেই কয়েকজন দুৰ্বত্ত এক শেঠজীর মাথায় ডাণ্ডা মেরে তার সর্বস্ব অপহরণ করে নেয়। অল্প দূরত্বে গঙ্গানারায়ণ এক প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল, নইলে সেও বিপদে পড়তো। শেঠজীর সঙ্গের এক ভৃত্যু ভয় পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছিল, সে-ও বেশী দূর যেতে পারলো না, গুণ্ডারা তাড়া করে গিয়ে চুরমার করে দিল তার মাথা। আরও একদিন সে দেখেছিল, মধ্য গঙ্গার ওপরে একটি বজরায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠেছিল দাউদাউ করে। তীরের লোকেরা বলাবলি করেছিল, দস্যুরাই নাকি বজরা লুণ্ঠন করে এমনভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর বারাণসী অতি ভয়ংকর স্থান। গঙ্গানারায়ণ ধনী পরিবারের সন্তান, চিরকাল যত্নে লালিত, বাহির পৃথিবীতে এক-একা ঘুরে তার নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হতে লাগলো। মাঝে মাঝেই সে ভাবে, কতখানি হৃদয়হীন মানুষ বিধুশেখর, কাশীর মতন এমন বিপদসঙ্কল জায়গায় কন্যাকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সুস্থির থাকতে পারেন!
মনিকণিকার ঘাটে গঙ্গানারায়ণ প্রতি অপরাহ্নেই একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। এক বিশাল চেহারার সাধু ভেসে থাকেন। গঙ্গার স্রোতে। এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, কখনো বা তিনি সারাদিনই থাকেন। জলে এবং এমন নিষ্পন্দভাবে ভেসে থাকেন যে মনে হয় যেন তিনি শয্যায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই সাধুকে পথ দিয়ে হাঁটতেও দেখেছে গঙ্গানারায়ণ, ইনি সব সময়েই সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে থাকেন এবং বপুটি যেন একটি পাহাড়ের মতন, থপথপ করে হাঁটার সময় একই সমস্ত পথটা জুড়ে রাখেন।
এই সাধু সম্পর্কে কারুকে কিছু প্রশ্ন করলেই অমনি বহুরকম কাহিনী শোনা যায়। এই সাধুর আসল নাম কেউ জানে না, কেউ বলে ওঁর নাম আগে ছিল শিবরাম, কেউ বলে গণপতি সরস্বতী, কিন্তু তেলঙ্গ দেশ থেকে এসেছেন বলে সবাই তৈলঙ্গ স্বামী বলে ডাকে। এর বয়েস যে কত শো বছর তার কোনো হিসেব নেই, কাশীতেই নাকি উনি আছেন প্ৰায় দেড় শো বৎসর। ইনি ইচ্ছা মতন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। উলঙ্গ হয়ে ফেরেন বলে একবার এক ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেট ওঁকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, উনি সশরীরে বদ্ধ কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সেই ম্যাজিস্ট্রেটের পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। আর একবার এক সাহেব তাঁকে জোর করে স্নেচ্ছ খাবার খাওয়াতে চেয়েছিলেন। সাধুজীর চন্দন ও বিষ্ঠায় সমজ্ঞান, তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে বলেছিলেন, তুমুকো খানা ম্যায় খা সকতা, লেকিন ইসকে পহলে মেরে খানা তুমকো খানা হোগা। তারপর তিনি নিজ পশ্চাৎদেশে হাত দিয়ে খানিকটা পুরীষ এনে বলেছিলেন, সাহেব, এই আমার আজকের খানা। তিনি অম্লান বদনে খেয়েও নিয়েছিলেন সেটি। তারপর থেকে সাহেবরা হুকুম জারি করে দিয়েছে যে তৈলঙ্গস্বামী উলঙ্গ হয়েই যত্রতত্র ঘুরতে পারবেন, কেউ তাঁকে কোনপ্রকারে বাধা দিতে পারবে না।
আর একবার উজ্জয়িনীর রাজা মধ্য গঙ্গায় নৌকাবিলাস করছিলেন, তৈলঙ্গ স্বামী সেই নৌকায় উঠে রাজার কোমর থেকে একটি অতি মূল্যবান তরবারি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ জলে ফেলে দিলেন। তরবারিটি নানাপ্রকার রত্নখচিত এবং মহারাজার মযাদাস্বরূপ ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া, তাই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে এই উন্মাদ সাধুকে মারতে উঠলেন। তৈলঙ্গস্বামী নির্বিকার ভাবে গঙ্গার জলে হাত ড়ুবিয়ে তুলে আনলেন হুবহু একই রকম দুটি তরবারি, তারপর রাজাকে বললেন, এর মধ্যে কোনটি তোমার বেছে নাও। হতবুদ্ধি রাজা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। ঐ দুটির মধ্যে কোনটি তাঁর। তখন সাধু রাজাকে ভঁৎসনা করে বললেন, মূখ, নিজস্ব জিনিস ঠিক মতন চেনো না, অথচ এটা আমার, ওটা আমার বলে চেঁচিয়ে মরো।
তৈলঙ্গস্বামী ইদানীং মৌনী। গঙ্গানারায়ণ দেখে যে জল থেকে তিনি উঠে আসবার পর তাঁর এক মারাঠী ভক্ত তাঁর শরীর মুছিয়ে দেয়। আর দলেদলে নারী পুরুষ তখন ছুটে গিয়ে তৈলঙ্গস্বামীকে ঘিরে ধরে বিলাপ করতে করতে তাদের রোগ-ভোগ আপদ-বিপদের কথা জানিয়ে প্ৰতিকারের প্রার্থনা জানায়। সাধু যেন কিছুই শুনতে পান না। তিনি পাহাড়ের মতন বধির, অবিচল। একটু পরে তিনি ঘাট ছেড়ে চলে যান, সকলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্ৰণাম জানায় তাঁর উদ্দেশ্যে, কেউ কেউ চিৎকার করে বলে, চলন্ত শিব, চলন্ত শিব!
গঙ্গানারায়ণ দূরে বসে দেখে। বারাণসীতে পা দেবার পর থেকে সে কোনো দেবদেবীর মূর্তি কিংবা কোনো সাধু সন্ন্যাসীকে প্ৰণাম জানায়নি। ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করাব সময় সে এক অঞ্জলি জল নিয়ে পরম ব্রহ্মের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সে এখন ব্ৰাহ্ম, পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তার আর কোনো সংশ্ৰব নেই। তৈলঙ্গস্বামী ছাড়া আরও কত সাধু আছেন কাশীতে, তাঁদের ঘিরে ভক্ত দল, অনেক সাধু অনেক অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখান, নিরুদ্দিষ্ট লোকের সন্ধানও এরা বলে দিতে পারেন এমনও শোনা যায়, তবু গঙ্গানারায়ণের প্রবৃত্তি হয় না। তাঁদের কাছে যাওয়ার।
একটি তরুণী বিধবার সঙ্গে বিন্দুবাসিনীর খুব সাদৃশ্য আছে, সেই যুবতীটি আর কয়েকজন বিধবার সঙ্গে স্নান করতে আসে মনিকণিকার ঘাটে। এক এক সময় তাকে অবিকল বিন্দুবাসিনী বলেই মনে হয়, গঙ্গানারায়ণ বিন্দু বলে ডেকে উঠতে যায়! আবার অন্য সময় মনে হয়, না, এ বিন্দুবাসিনী হতে পারে না। যুবতীটির সঙ্গিনীরা কেউ বাঙালী নয়, যুবতীটি তাদের সঙ্গে পরিষ্কার হিন্দুস্থানী ভাষায় কথা বলে। অবশ্য এই কয় বৎসরে বিন্দুবাসিনী তো বারাণসীর ভাষা শিখে নিতেই পারে। মেয়েটি যেন বিন্দুবাসিনীর তুলনায় একটু বেশী লম্বা। যুবতীটির সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের চোখাচোখিও হয়েছে, তাতে পরিচয়ের সামান্য চিহ্নও নেই। বিন্দু হঠাৎ গঙ্গানারায়ণকে দেখলে নিজে থেকেই ছুটে আসবে না?
পরপর কয়েকদিন দেখার পর গঙ্গানারায়ণ সেই যুবতীটির সঙ্গে বিন্দুর আরও দুএকটি বৈষম্য খুঁজে পেল। না, এই মেয়েটি বিন্দু নয়। তবু, গঙ্গানারায়ণ ঠিক সময়ে এসে মণিকণিকার ঘাটে বসে আছে। একদিন সে হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলো। বিন্দু নয় জেনেও সে প্রতিদিন এই যুবতীকে দেখতে আসে কেন? বিন্দুবাসিনীর সন্ধান স্থগিত রেখে সে এখানে এসে ঐ যুবতীটির জন্য প্রতীক্ষ্ণ করে। গঙ্গানারায়ণ মণিকণিকা ঘাটে আসাই বন্ধ করে দিল।
মাসাধিক কাল কেটে গেছে, বিন্দুর অস্তিত্বের কোনো চিহ্নই সে পায়নি। একদিন গঙ্গানারায়ণ দশাশ্বমেধ ঘাটের পৈঠায় বসে সূৰ্য্যস্ত দেখছে, এমন সময় ছড়িওয়ালা মনসারাম তার পাশে এসে দাঁড়ালো। অনেক বাঙালীর সঙ্গে সংসর্গের দরুণ মনসারাম কিছু কিছু বাংলা জানে। সে জিজ্ঞেস করলো, আপনি বাবু রামকমল সিং-এর কোঠির খোঁজ করছিলেন, আপনি তার কে হন?
গঙ্গানারায়ণ বললো, পরলোকগত রামকমল সিংহ আমার পিতা।
মনসারাম বললো, আপনি কাশীতে এক এক কী করছেন?
গঙ্গানারায়ণ বললো, আমি একটি রমণীকে খুঁজছি, আমার আত্মীয়া বলতে পারেন। আপনি তো অনেক কিছুর সন্ধান রাখেন, আপনি বলতে পারেন কি, একটি বিধবা মেয়ে, বাঙালী, তার নাম বিন্দুবাসিনী—
মনসারাম গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, হাঁ, তার কথা আমি জানি, বাবু রামকমলের দোস্ত বিন্ধুবাবুর লেড়কি, সে এখানে থাকতো ঠিকই, কিন্তু আপনি তাকে খুঁজে পাবেন না, সে মারা গেছে, আপনি ফিরে যান। লালা হরদয়ালের কাছে ঐ লেড়কির নামে টাকা আসতো বিন্ধুবাবুর কাছ থেকে। গত বৎসর লালা হরদয়াল সে টাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
গঙ্গানারায়ণ তীব্ৰ চোখে মনসারামের দিকে তাকিয়ে বললো, সে মারা গেছে? হতেই পারে না! কবে মারা গেছে, কী করে মারা গেছে?
মনসারাম সস্নেহে গঙ্গানারায়ণের বাহু ছয়ে বললো, সে সব কথা আর জেনে লাভ কী, তাতে আপনার কষ্ট বাড়বে, তাকে তো আর আপনি ফিরে পাবেন না। আপনার মতন জোয়ান ছোঁকরার পক্ষে কাশী জায়গা ভালো না। আপনি আপনার মুলুকে ফিরে যান। আমি বলছি, তাতেই আপনার ভালো হবে। এই বয়সে কি কেউ একা এক দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!
গঙ্গানারায়ণের দৃঢ় বিশ্বাস হলো, ছড়িওয়ালা বিন্দুর মৃত্যুর ব্যাপারটি সত্য বলেনি। মনসারাম অনেক কিছু জানে, তার কাছে গোপন করে যাচ্ছে। মনসারামকে আর সে ছাড়বে না।