একদিন কলেজ থেকে ফিরে নবীনকুমার দেখলো তার শয়নকক্ষে তার পত্নী কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে আর একটি বালিকা বসে খেলা করছে। দুজনেই সমবয়সিনী, দুজনেই রেশমী শাড়ি ও হাত ভর্তি সোনার চুড়ি পরিহিতা দুটি পুত্তলিকার মতন। ওরা খেলাও করছে কাচকড়ার বিলাতি পুতুল নিয়ে।
নবীনকুমার ঘরে ঢুকতেই মেয়েটি মাথায় ঘোমটা টেনে পিছন ফিরে বসলো।
নবীনকুমার কৃষ্ণভামিনীকে জিজ্ঞেস করলো, এ মেয়েটি কে গা?
কৃষ্ণভামিনী বললো, ও তো আমার মিতেনী, আমাদের বের সময় ওকে দ্যাকেননি? সব সময়ই তো আমার পাশে ঠায় বসেছেল!
বাসরঘরে এক সঙ্গে অনেক মেয়েই উপস্থিত থাকে বলে কারুকেই ঠিক মত দেখা যায় না। এই মেয়েটিকেও নবীনকুমারের মনে নেই।
সে আবার জিজ্ঞেস করলো, তোমার মিতেনী? আমাদের এ পাড়ায় আবার তোমার মিতেনী কী করে হলো?
কৃষ্ণভামিনী বললো, এ পাড়ার কে বললো? ওর বে হয়েচে হাটখোলায়, আমার ঠিক এক মাস পরে। ওদের বাড়ির পালকিতে আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে এয়েচে।
তারপর সে তার সখীকে বললো, আমার বরকে দেকে অত লজ্জা কিসের লা? তোর বরকে দেকে কি আমি ঘোমটা দিই?
মেয়েটি তবু যেন লজ্জায় একেবারে নুয়ে পড়েছে। কৃষ্ণভামিনী জোর করে তার ঘোমটা খুলে দিলো। মেয়েটির মুখখানি ফুটফুটে, অপরূপ সুন্দরী যাকে বলে। কৃষ্ণভামিনীও খুব ফর্সা, কিন্তু এ মেয়েটির রং যেন গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতন, চোখের মণি দুটিতে নীলবৰ্ণ আভা।
কাঁধের উড়নিটা শয্যার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে নবীনকুমারও বসে পড়লো। ওদের পাশে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, এই মিতেনীটির নাম কি গো?
কৃষ্ণভামিনী তার সখীর গায়ে খোঁচা মেরে বললো, এই নাম বল না!
মেয়েটি এখনো লাজ-কুষ্ঠিতা, মুখ খুলবে না। দু-তিনবার সাধাসাধিতেও সে নাম বললো না। কৃষ্ণভামিনী বললো, কী জানি ছাই, আমি ওর নাম ভুলেই গেচি! মিতেনী বলেই তো ডাকি! ও, মনে পড়েচে, মনে পড়েচে! কুসোম! তোর নাম কুসোম না রে?
মেয়েটি এবার অস্ফুট গলায় বললো, আমার নাম কুসুমকুমারী!
নবীনকুমার বললো, এঃ! কুসুমকুমারী! পচা নাম! একদম মানায়নিকো!
বলেই সে হেসে উঠলো। হা-হা করে।
কৃষ্ণভামিনীর মনে হলো, তার সখীকে বুঝি যথোচিত সম্মান জানানো হচ্ছে না। সে রেগে গিয়ে বললো, পচা নাম! কে বলেচে আপনাকে? সবাই বলে আমার মিতেনীর নাম আমার চেয়েও সোন্দর।
নবীনকুমার বললো, এ তো কেষ্টযাত্রার সখীদের এরকম নাম হয়। কুসুমকুমারী, অবলাবালা, বিধুমুখা!
কৃষ্ণভামিনী চক্ষু কপালে তুলে বললো, ও মা! আমার পিসীমার নাম বিধুমুখী! সেটা বুঝি খারাপ নাম?
কুসুমকুমারী শাড়ির আঁচল গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললো, আমি ভাই এবার যাই? বেলা পড়ে এলো, মা এবার পুজোয় বসবেন।
নবীনকুমার তার হাত ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিয়ে বললো, অমনি বুঝি রাগ হলো মিতেনীর। আমি তোমায় একটা সুন্দর নাম দিয়ে দিচ্চি!
কৃষ্ণভামিনী বললো, আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে দেকা করে আসুন না। আমরা এখন এ ঘরে খেলাচি, আমার ছেলের সঙ্গে ওর মেয়ের এধুনি বে হবে!
নবীনকুমার বললো, আমিও খেলবো! আমায় তোমরা খেলায় নেবে না কেন?
নবীনকুমার বাল্যকাল থেকেই দুলালের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রের লড়াই, তেপান্তরের মাঠ, ভূত আমার পুত, নৃসিংহ অবতার—এই সব খেলা খেলতো। বিবাহের পর কৃষ্ণভামিনী পিত্ৰালয় থেকে তার সমস্ত মেয়েলি খেলনা সঙ্গে নিয়ে এসেছে, সে একা একাই সেগুলি নিয়ে খেলতে বসতো, তা দেখে নবীনকুমারও যোগ দিয়েছে সে খেলায়। পুতুলের সংসার নিয়ে খেলা করতে সে আমোদ পেতে শুরু করেছে। ইদানীং।
কুসুমকুমারী বললো, ব্যাটাছেলেদের সঙ্গে আমাদের খেলতে নেই। তা হলে আমার মা রাগ করবেন।
নবীনকুমার অমনি বললো, বেশ তো, আমি মেয়েমানুষ হয়ে যাচ্চি। দোকবে, দোকবে, আমি কেমন মেয়েমানুষ হতে পারি!
পালঙ্কের মাথায় কৃষ্ণভামিনীর একটা শাড়ি বুলিছিল, সেটা ফস করে টেনে নিয়ে নবীনকুমার শরীরে জড়িয়ে ফেললো, তারপর বাম হাতের কড়ে আঙুলটি মুখে পুরে, ঘাড় বেঁকিয়ে হেলে দুলে হেঁটে, কণ্ঠস্বর বদলে ফেলে বললো, হ্যাঁ গা মিতেনী, তুমি রাগ করেচো আমার ওপর!
বাল্যকাল থেকেই নবীনকুমার অনুকরণপটু, তার ভাবভঙ্গি অবিকল কোনো স্ত্রীলোকের মতনই দেখায়।
কৃষ্ণভামিনী বললো, ঢং! কত ঢংই যে আপনি কত্তে পারেন!
কুসুমকুমারী কিন্তু ফিক করে হেসে ফেললো।
নবীনকুমার সেই স্ত্রী সাজেই ওদের পাশে বসে পড়ে বললো, এই তো মুখে হাসি ফুটেচে। এবার থেকে ভাই আমরা তিনজনে মিলে খেলবো বেশ! তার আগে মিতেনীর একটা নাম দিয়ে দিই? তোমার নাম বনজ্যোৎনা!
কৃষ্ণভামিনী বললো, ওমা, ও আবার কী নামের ছিরি! বনজোচ্ছনা! মেয়েমানুষের এমন নাম হয় সাতজন্মে শুনিনিকো।
নবীনকুমার বললো, তোমার সাত সাততে উনপঞ্চাশ জন্ম আগে এমন নাম হতো। কি গো, মিতেনী, তোমার পছন্দ হয়নি!
কুসুমকুমারী বললো, এ তো একটা লতানে ফুল গাচের নাম! মেয়েমানুষের নাম কেন হবে!
নবীনকুমার এবার সত্যিকারের বিস্ময়ে ভুরু উত্তোলিত করে বললো, ওমা, তুমি জানো? কী করে জানলে?
কুসুমকুমারী বললো, সেই যে শকুন্তলা বলে একটা গল্প আছে না? সেই গল্পের মধ্যে শুনিচি!
—সে গল্প তুমি কোতায় শুনলে?
—পোনামশাই আমার দাদাদের পড়াতেন, তখন আমি পাশে বসে থাকতাম। গল্পটা খুব দুঃখের।
নবীনকুমার তার স্ত্রী কৃষ্ণভামিনীর দিকে তাকিয়ে বললো, দেকোচো, তোমার মিতেনী তোমার চে কত বেশী জানে!
কৃষ্ণভামিনী বললো, আমার কি একটাও দাদা আচে নাকি যে পণ্ডিতমশাই এসে বাড়িতে পড়াবে?
নবীনকুমার কুসুমকুমারীকে বললো, শোনো ভাই, মিতেনী, তোমাকে তো একটা লতানে ফুল গাচের মতনই দোকতে, তাই তোমার বাপ মা তোমার নাম দিয়েছিলেন কুসুমকুমারী। আমি নাম দিলাম বনজ্যোৎস্না। একই তো!
কৃষ্ণভামিনী বললো, শুধু কতাই হবে, খেলা হবে না বুঝি?
নবীনকুমার বললো, হ্যাঁ, এবার খেলা হোক। তোমাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবে তো! তা ছেলেমেয়ের কী নাম রেকোচো?
দুই সখী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। নামের কথা তাদের মনে আসেনি।
নবীনকুমার বললো, তা হলে মেয়েটার নাম শকুন্তলা, আর ছেলের নাম দুশমন!
কুসুমকুমারী বললো, না ভাই, আমি খেলবো না! তোর বর বড্ড খারাপ খারাপ কতা বলচে! দুশমন নাকি, রাজার নাম তো ছিল দুষ্যন্ত।
নবীনকুমার হাসতে হাসতে বললো, তোমার তাও মনে আচে? আচ্ছ বেশ, দুষ্যন্তই হলো।
কুসুমকুমারী বললো, না। ও নাম আমি দেবো না। ওটা বড্ড দুঃখের গল্প, আমি জানি।
নবীনকুমার বললো, শেষকালে সুখ আচে।
কৃষ্ণভামিনী আর একটি পুতুল বার করে বললো, উনি বড় বিরক্ত কচ্চেন রে, তাড়াতাড়ি বে দিয়ে দে, এই হলো গে পুরুতমশাই।
নবীনকুমার বললো, এ বিয়েতে পুরুতি লাগবে না। এ তো বনের মধ্যে বিয়ে, ওরা নিজেরা নিজেরাই বিয়ে করবে।
কৃষ্ণভামিনী বললো, আমন বিচ্ছিরি বে আমি দেবো না!
নবীনকুমার এরপর সেই খেলায় এমন মত্ত হয়ে গেল যে এখন কে বলবে এই সেই হিন্দু কলেজের অতি দুরন্ত ছাত্র। সে কখনো পুরুষ, কখনো নারীর কণ্ঠস্বর-অনুকরণ করে বিভিন্ন পত্রপাত্রীর মুখে সংলাপ বসাতে লাগলো। কৃষ্ণভামিনী সন্দেশ এনে রেখেছিল, বিয়ের শেষে পরিবেশন করা হবে বলে, নবীনকুমার আগেই সেই সন্দেশ কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো মাটিতে।
খেলা শেষ হয়ে গেছে, এবার যেতে হবে কুসুমকুমারীকে। তার সঙ্গে এসেছে দুটি দাসী ও চার বেহারির পান্ধী। গোধূলিতে আকাশ স্নান হয়ে এসেছে, এখুনি অন্ধকার হয়ে যাবে বলে নবীনকুমার সে পালকির সঙ্গে দুজন পাইক পাঠিয়ে দিল। বিদায় দেবার আগে কৃষ্ণভামিনী তাঁর সখীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো, আবার কবে আসবি বল? কাল? পশ্যু?
কুসুমকুমারী বললো, আহা—হা, আমিই বার বার আসতে গেলুম রে! তুই বুঝি যেতে পারিস না?
কৃষ্ণভামিনী তার স্বামীর দিকে তাকালো।
নবীনকুমার বললো, যাবে না কেন, নিশ্চয়ই যাবে। তা মিতেনী, আমায় যেতে বললে না যে? আমি বুঝি তোমার মিতে নয়?
কুসুমকুমারী তার সারল্যমাখা নীলবৰ্ণ চোখ দুটি তুলে নবীনকুমারকে একবার অপাঙ্গে দেখলো শুধু। কোনো উত্তর দিল না। তার কোলে দুটি পুতুল, মেয়ে-জামাইকে সে নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোক্রমে পুতুল দুটিকে সামলে সে উঠে পড়লো পালকিতে।
কুসুমকুমারী তাঁর সখী কৃষ্ণভামিনীর চেয়ে বয়েসে একটু বড়, তার বয়েস এখন সাড়ে দশ, আর কৃষ্ণভামিনীর নয় ছুঁই ছুঁই। তাদের দুজনেরই পিত্ৰালয় বাগবাজারে পাশাপাশি গৃহে। দুজনে একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে। এ দুই বালিকা পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে এখনো অভ্যস্ত হয়নি। কৃষ্ণভামিনী বাপের বাড়িতে যাওয়ার বেশী সুযোগ পায়, তবু পালা-পার্বণে যখন দু-একদিনের জন্য যাওয়া হয়, তখন খবর পেয়ে কুসুমকুমারীও চলে আসে বাগবাজারে, দুজনে প্ৰায় সর্বক্ষণ একসঙ্গে কাটায়।
কুসুমকুমারীর স্বামী অঘোরনাথ, নবীনকুমারের চেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। প্ৰথমা পত্নীর মৃত্যুর পর সে নাকি ব্ৰাহ্ম হতে গিয়েছিল, ঠিক সময়ে সে খবর পেয়ে তার মা গলার সামনে একটি বড় আশি বটি ধরে বলেছিলেন, আমার কথা শুনবিনি, তুই জোর করে যাবি? তো যা, ফিরে এসে আমার মরা মুখ দেকবি!
মাতৃহন্তা হতে হবে বলেই অঘোরনাথ শেষ পর্যন্ত ব্ৰাহ্ম হয়নি। কিন্তু সেই সময় থেকেই নাকি সৰ্বক্ষণ সে বিষণ্ণ উদাসীন হয়ে দিন কাটায়। সে তাদের পৈতৃক জমিদারি কার্য দেখে না, কলকাতায় তাদের নিজস্ব হীসেও যায় না। দ্বিতীয় বিবাহের পরও তার মানসিক কৈব্য কাটেনি।
পত্নীর কাছ থেকে এই সব তথ্য জানলো নবীনকুমার। ব্ৰাহ্মদের সম্পর্কে তার সঠিক কোনো ধারণা এখনো গড়ে ওঠেনি। ব্ৰাহ্ম শুনলেই তার মনে পড়ে কিছু দাড়িওয়ালা গভীর গভীর মানুষ, যারা কদাচ হাসে না, এবং অনেকেই রূপের ফ্রেমের চশমা চোখে দেয়। কুসুমকুমারীর স্বামী সে রকম মানুষ?
কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে ওপরে উঠে এসে নবীনকুমার বললো, তোমার যদি ছেলে হয়। আর তোমার মিতেনীর স্বযদি মেয়ে হয়, তা হলে তোমাদের ছেলেমেয়ের সত্যিকারের বিয়ে হলে বেশ হয়, তাই না?
কৃষ্ণভামিনী একটুও লজিত না হয়ে বললো, আমি তো তাই ঠিক করে রেখিচি!
নবীনকুমার আড়চোখে তার বালিকা বধূর মুখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণভাবে নজর করে দেখলো। একটি বিষয়ে নবীনকুমারের মনে খটকা আছে। সে জানে যে বিবাহিত নারী পুরুষদেরই শুধু সন্তানাদি হয়। যাদের বিবাহ হয়নি কিংবা যে স্ত্রীলোকেরা বিধবা এবং যে পুরুষরা একা থাকে, তাদের কখনো পুত্ৰ কন্যা হয় না। কিন্তু বিবাহের পর ঠিক কখন, কীভাবে এবং কেন পুত্ৰ কন্যা জন্মায়, সে সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা নেই। প্রায়ই সে এই কৌতূহলে ছটফট করে কিন্তু কারুকেই জিজ্ঞেস করতে পারে না। সে যে-সব কেতাব পড়েছে, তার মধ্যেও এর কোনো উত্তর নেই। কলেজে ভর্তি হবার পর নবীনকুমারের মধ্যে একটা সবজান্তা ভাব এসেছে, কিন্তু এই একটি বিষয়ে অজ্ঞতা তাকে পীড়া দেয়। কৃষ্ণভামিনী তার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট হলেও এ ব্যাপারটা জানে নাকি?
লজ্জাবশত এ কথাটি সে নিজের স্ত্রীকেও জিজ্ঞেস করতে পারলো না।
কৃষ্ণভামিনী শয়ন কক্ষে ঢুকে মন দিয়ে তার পুতুলের সংসার গুছোতে লাগলো। এর মধ্যে একটি পুতুল পাওয়া যাচ্ছে না, সেটি কুসুমকুমারীরও নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পরও সেটি না পেয়ে সে নবীনকুমাকে চেপে ধরে বললো, আপনি নিশ্চয়ই নুকিয়েচেন! আমার পুতুল কোতায়?
নবীনকুমার নিরীহ মুখ করে বললো, কই, আমি তো দেকিনি।
কৃষ্ণভামিনী বললো, তা হলে কোতায় গেল? ওটা আমার মা কালীঘাট থেকে কিনে এনেছেলেন, ঐ পুতুলটা সবচে ভালো।
নবীনকুমার বললো, তা হলে বোধ হয় তোমার মিতেনীর খুব পছন্দ হয়েচে, সেই সেটা চুরি করে নিয়ে গ্যাচে!
কী, আপনি আমার মিতেনীকে চোর বললেন? এ কথা বলেই কৃষ্ণভামিনী সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল নবীনকমারের গালে।
কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থেকেই নবীনকুমার লাফিয়ে গিয়ে কৃষ্ণভামিনীর চুলের মুঠি চেপে ধরলো এবং কণ্ঠস্বর বিকট করে বললো, রে রে, হতভাগিনী তোর এ দুমতি! আজি তোরে নরকে পাঠাইব! পরনিন্দা, অতি লোভ, স্বামী প্রহরণ, যেই নারী করে তার নরকে গমন!
খানিকক্ষণ ঝাঁটাপটি করার পর কৃষ্ণভামিনী নবীনকুমারের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলো। হঠাৎ রাগ হলে তার মাথার ঠিক থাকে না। কিন্তু স্বামীর গায়ে হাত তোলা যে মহা পাপ, তা সে জানে। নবীনকুমারের কাছে অবশ্য এ সবই কৌতুক। সারা দিনের প্রতিটি ঘটনা থেকেই সে মজার উপাদান খোঁজে। কৃষ্ণভামিনী ক্ষমা চাইবার পর সে জাজিমের তলা থেকে বার করে দিল লুকোনো পুতুলটি।
এই দুই কিশোর-বালিকার খুনসুট, বিবাদ ও রাগ ছাড়া এই অট্টালিকার দ্বিতল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। আর কোনো কক্ষে প্ৰাণের সাড়া নেই। বিম্ববতী পুত্ৰশোকে শয্যা নিয়েছেন।
ইব্রাহিমপুর থেকে বেশ কিছুদিন আগে ফিরে এসেছে বজরা। বৃদ্ধ খাজাঞ্চি সেনমশাই অশুভারাক্রান্ত নয়নে সব কথা জানিয়েছেন বিম্ববতীকে। গঙ্গানারায়ণের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেনমশাই তার তল্লাশে লোক পাঠিয়েছিলেন নানা দিকে, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ যেন কপূরের মত মিলিয়ে গেছে। শূন্যে। গঙ্গানারায়ণকে বজরা থেকে বলপ্রয়োগ করে কেড়ে নিয়ে যাওয়া কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না, প্রহরীরা সে রকম একটি শব্দও শোনেনি। স্বেচ্ছায় সে রাত্ৰিবেলা বজরা ছেড়ে চলে যাবে, এও যে বড় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সে বজরার মালিক, তার হুকুমেই বজরা যেখানে খুশী যেতে পারে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে যদি তার সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা না থাকতো, তবে সে রাত্ৰেই তো নোঙর তুলে কলকাতার অভিমুখে রওনা হওয়া যেত। এমনকি একথা সেনমশাই অনেকবার বলেও ছিলেন গঙ্গানারায়ণকে। গঙ্গানারায়ণ এক বস্ত্রে চলে গেছে। এ বড় বিচিত্ৰ ঘটনা, এমনটি আর কখনো শোনা যায়নি। গঙ্গানারায়ণ নিরুদ্দিষ্ট বা মৃত। মৃত বলেই বেশী সন্দেহ হয়।
নবীনকুমারের জন্মের পর থেকে গঙ্গানারায়ণের প্রতি বিম্ববতীর মনোযোগ অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় গঙ্গানারায়ণও তো ছিল তাঁর অতি আদরের। এখন নবীনকুমারও তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গঙ্গানারায়ণের সংবাদ শুনে বিম্ববতীর মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হয়েছিল, প্রথম পুত্রের প্রতি তাঁর সমস্ত স্নেহ ভালোবাসা ফিরে এলো শোক ও পরিতাপ হয়ে। গঙ্গানারায়ণ তাঁর আপনি গর্ভের সন্তান নয়, তবু তার প্রতি বিম্ববতীর নাড়ির টান আছে যে সে কথা বিম্ববতী আবার অনুভব করলেন।
বিম্ববতী কয়েকদিন কেঁদে ভাসালেন। জনে জনে অনুরোধ করলেন, যত টাকাই লাগুক, গঙ্গানারায়ণের সন্ধানে আবার সারা দেশ তোলপাড় করে খুঁজে দেখা হোক। কিন্তু কারুরই গরজ নেই সে ব্যাপারে। বিধুশেখর তাঁর মন থেকে গঙ্গানারায়ণকে মুছে ফেলতে চান। কর্মচারীরা শুধু টাকা খায়, কাজের কাজ কিছুই করে না।
অগ্রজের নিরুদ্দেশের সংবাদে নবীনকুমার খানিকটা বিস্মিত হয়েছিল বটে, কিন্তু খুব বেশী তাপ উত্তাপ বোধ করেনি। দাদা বজরা ছেড়ে কোথাও চলে গেছে, আবার নিশ্চয়ই একদিন ফিরে আসবে।
গঙ্গানারায়ণের পত্নী লীলাবতী প্ৰথমে সংবাদ শুনে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। তারপর সে আর একদিনও এ বাড়িতে থাকতে চায়নি। তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক মাসের মধ্যেই যেন গঙ্গানারায়ণকে সবাই বিস্মৃত হয়ে গেল। তার কক্ষটি তালাবন্ধ, সারা বাড়িতে আর কোথাও তার কোনো চিহ্ন নেই। সাতাশ বছর যে এ গৃহে কাটিয়েছে, এক বৎসরের মধ্যে সে মুছে গেল। শুধু বিম্ববতী একা এক অশ্রুপাত করে বালিশ ভিজিয়ে দেন।
নবীনকুমারের যখন যে ঝোঁক চাপে, তখন সেটি নিয়ে মেতে ওঠে। একবার যেমন নীচতলা থেকে একটা ফুটফুটে সাদা বেড়াল একদিন উঠে এসেছিল ওপরে। বেড়ালটি দেখে তার এমন পছন্দ হলো যে তাকে সে সেদিন থেকে পুষতে লাগলো। বেড়ালটির নাম রেখেছিল মুঞ্জরী। পোষা মানে কি, সৰ্বক্ষণ বেড়ালটিকে তার সঙ্গে রাখা চাই। তার খিদমদগার দুলাল পাহারা দিত, যেন মুঞ্জরী আর কোনোক্রমেই নীচতলায় যেতে না পারে। মুঞ্জরী দু-তিন বার অকারণে ম্যাও ম্যাও করলেই নবীনকুমারের সন্দেহ হতো। ওর খিদে পেয়েছে আর দুলাল নিশ্চয়ই ওর বরাদ্দ দুধ চুরি করে খেয়েছে। সেই উপলক্ষে এক ডজন কানমলা পাওনা হতো দুলালের। রাত্রেও মুঞ্জরীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতো নবীনকুমার।
মুঞ্জরী বেড়াল ছিল না, বেড়ালী। অত সংরক্ষণ সত্ত্বেও সে কোন ফাঁকে অভিসারে চলে যেত, তা জানা যায় না, একদিন দেখা গেল সে গর্ভবতী। তখন নবীনকুমার বিম্ববতীর সঙ্গে এক শয্যায় শুতো। বিম্ববতী বেড়াল পছন্দ করেন না, কিন্তু পুত্রের আবদারের জন্য তাঁকে মেনে নিতে হতো সবই। মুঞ্জরীর সন্তান-সম্ভাবনা দেখে তিনি বলেছিলেন, ওরে এ সময় বেড়ালকে আঁকড়ে রাখতে নেই, ওরা এ সময়টা একা একা থাকতে চায়। ওকে এখন ছেড়ে দে, ছোটকু। নবীনকুমার তা শুনবে না। মুঞ্জরীর বাচ্চা হবে শুনে তার মহা আনন্দ, সারা বাড়ি এরপর বেড়ালে ভরে যাবে।
একদিন ভোরে জেগে উঠে নবীনকুমার দেখলো তার আলিঙ্গনের মধ্যে মুঞ্জরী মরে কাঠ হয়ে আছে। তারপর নবীনকুমারের সে কি কান্না! পরমাত্মীয় বিয়োগেও মানুষ বুঝি অমন মর্মবিদারী কান্না কাঁদতে পারে না। তিনদিন নবীনকুমার মুখে অন্ন তুলতে পারে নি। এর পর থেকে অবশ্য সে আর অন্য কোনো বেড়াল দুচক্ষে দেখতে পারে না, এ অট্টালিকার দ্বিতলে কোনো বেড়াল দৈবাৎ এসে পড়লে সে নিজে লাঠি নিয়ে তেড়ে যায়।
কৃষ্ণভামিনীর মিতেনীর সঙ্গে পুতুল খেলাতেও নবীনকুমারের সে রকম ঝোঁক চাপলো। পরদিনই সে জিজ্ঞেস করলো, কই, তোমার মিতেনী আর এলো না? তোমার ছেলেকে কতদিন শ্বশুর বাড়ি ফেলে রাকবে? এ বাড়ির পুরুষরা কক্ষনো শ্বশুর বাড়িতে থাকে না। সিংহ কি সিংহীর কাছে যায়, না সিংহীই আসে সিংহের গুহায়?
দু তিন দিন পর নবীনকুমার অস্থির হয়ে উঠলো একেবারে। সে কৃষ্ণভামিনীকে বললো, পত্তির পাঠাও! তোমার মিতেনীকে লেকো তোমার ছেলে আর তার বউকে সে যেন কালই নিয়ে আসে!
নবীনকুমার নিজেই মুসাবিদা করে তার মুক্তোর মতন হস্তাক্ষরে লিখলো কৃষ্ণভামিনীর ব-কলমে চিঠি। এক পরাত সন্দেশ ও একটি বড় রোহিত মৎস্য সমেত একজন বাহক মারফত পাঠিয়ে দেওয়া হলো সেই পত্র। পরদিন কুসুমকুমারী নিজে এলো না, দ্বিগুণ তত্ত্বসমেত পাঠিয়ে দিলে পুতুল দুটিকে। সঙ্গে একটি ছোট চিঠি, বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, কাব্যাঞ্চে নিবেদন এই যে, আমি যাইতে পারিলাম না, কবে পারিব ঠিক নাই, পরমেশ্বরের কৃপায় ইহারা সুখে থাকুক। ভবদীয়া কুসুমকুমারী বনজ্যোৎস্না মিতেনী।
চিঠিখানা দেখে ভুরু কুঁচকে নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, এ চিঠি কে লিকে দিয়েচে? ওর বর?
কৃষ্ণভামিনী বললো, আমার মিতেনী নিজেই লিকতে পারে। সব জানে।
নবীনকুমার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, যেমন বিচ্ছিরি হাতের লেকা, তেমন বদ স্বভাব মেয়েটার। আবার দেমাক করে লিকেচে, কবে পারিব ঠিক নাই!
কুসুমকুমারীর ব্ৰাহ্ম স্বামীকে দেখার খুবই কৌতূহল নবীনকুমারের। সে কৃষ্ণভামিনীকে বললো, তোমার মিতেনীর গোমড়ামুখো বর নিশ্চয়ই তার বউকে আর একলা পাঠাতে চায় না। একদিন ওদের এ বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াও না!
এবার নবীনকুমার নিজেই অঘোরনাথকে সম্বোধন করে এক লৌকিকতাপূর্ণ নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরণ করলো। কিন্তু তার উত্তর অঘোরনাথের কাছ থেকে না এসে এলো কুসুমকুমারীর হস্তাক্ষরে। সে দুঃখ প্ৰকাশ করে জানিয়েছে যে নানা কারণে এখন তাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তার বদলে একদিন কৃষ্ণভামিনীরা কি আসতে পারে না?
বাড়ির কর্তার কাছ থেকে নিমন্ত্রণ না এলে সেখানে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নবীনকুমার একদিন বাড়ির ঘেরাটোপ পালকিতে কৃষ্ণভামিনীকে পাঠিয়ে দিতে পারে বটে, তার নিজের যাওয়া শোভা পায় না। কিন্তু কুসুমকুমারীর সঙ্গে তার পুতুল খেলা অসমাপ্ত রয়ে গেছে বলে সে খুবই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। সামাজিক নিয়ম উপেক্ষা করে সে একদিন কৃষ্ণভামিনীকে বললো, চলো। আজ হাটখোলায়, তোমার মিতেনীর বাড়িটা দেকে আসি। পুতুলগুলোন সঙ্গে করে নাও—।
সে বাড়িতে গিয়ে বড় অপমানিত হতে হলো নবীনকুমারকে।