১৩. গোরা সৈন্য ও সিপাহী

গোরা সৈন্য ও সিপাহীরা শহরের উপান্তে এক স্থলে বন্দুকের তাক অভ্যাস করে। দিনরাত গোলাগুলির শব্দের জন্য লোকে সেই অঞ্চলের নাম দিয়েছে দমদমা। এই দমদমা বা দমদমে যাবার পথেই এক জায়গার নাম বেলগাছিয়া। যে পল্লীতে যে গাছ বেশী দৃষ্ট হয় সেই গাছের নামেই পল্লীর নাম। যেমন বটতলা, কাঁকুড়গাছি, লেবুবাগান, পেয়ারাবাগান, তালতলা, ডালিমতলা ইত্যাদি।

বেলগাছিয়ায় দ্বারকানাথের মনোরম বিলাসপুরী বেলগাছিয়া ভিলা। এক বিশাল উদ্যানের মধ্য দিয়ে একেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে মতিঝিল, তার স্বচ্ছ নির্মল জল, সে জলে ফুটে আছে নীল পদ্ম ও রক্ত পদ্ম, যা কবিদের অতি প্ৰিয়। উদ্যানটিও সযত্নে কেয়ারি করা, এর মধ্যে রয়েছে গোলাপ, কদম্ব, স্থলপদ্ম, যুঁই, বেল, পিটুনিয়া, জিনিয়া, সাকিসপার্স, আরও কত না বাহারী ফুল।

বাহির বাড়িটিতে অতি প্রশস্ত সব হলঘর। সেগুলির ত্রুটিহীন সৌষ্ঠবে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দেয়ালগুলি আধুনিক শিল্পীদের চিত্রকলায় সজ্জিত। মধ্যে মধ্যে এক একটি ভাস্কর্যের নিদর্শন। কোনো কোনো কক্ষে দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম আয়না। ওপর থেকে ঝুলছে এক শো দেড়শো মোমের ঝাড়বাতি, যার আলো ঠিকরে পড়ছে দপণে। প্রতিটি প্রকোষ্ঠের মেঝেতে ছড়ানো রয়েছে মীর্জাপুরী গালিচা। বুটিদার লাল রঙের কাপড় ও সবুজ সিল্কে আসবাবগুলি মোড়া। মধ্যে মধ্যে শ্বেতপাথরের টেবিল, তার ওপরে সাজানো পুষ্পস্তবক। সিঁড়ির দু পাশে ঝুলছে দুস্তপ্ৰাপ্য অর্কিড, লোহার রেলিং ঢেকে দেওয়া হয়েছে লতাপাতায়।

বাইরে একটি মার্বেল পাথরের ফোয়ারা, তার ওপরে দণ্ডায়মান প্রেমের দেবতা কিউপিড। ফোয়ারাটিকেও আজ আলোকোদ্ভাসিত করা হয়েছে। এ যেন সত্যিই ইন্দ্রপুরী।

মতিঝিলের মাঝখানে একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপের ওপরেও রয়েছে আর একটি গৃহ, এটির নাম গ্ৰীষ্মাবাস। একদিকে একটি ঝুলন্ত লোহার সেতু ও আর একদিকে একটি কাঠের সেতু দিয়ে এই গ্ৰীষ্মাবাসটি বাগানের সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য এই দুই সেতুও সদ্য আনীত দেবদারু পাতায় মোড়া এবং স্থানে স্থানে উড়ছে বহুবর্ণ পতাকা। অতিথিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার তারতম্য অনুযায়ী কেউ বৈঠকখানায় কেউ ঐ গ্ৰীষ্মাবাসে বসেছেন। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে। যন্ত্রবাদ্য ও নৃত্যগীতের ধ্বনি। উদ্যানে অবিরাম বাজি পোড়ানো চলেছে।

শীতকাল, ফিনফাইন বার্তাস বইছে। আকাশ পরিষ্কার, অজস্র নক্ষত্রের সভাসদ নিয়ে নিশাপতি আজ সেখানে পূর্ণ গৌরবে বিরাজমান। ধরণীতলে, এই বেলগাছিয়া ভিলাতেও যেন দ্বারকানাথ আজ তারকাদের মধ্যে চন্দ্ৰ। ইওরোপ বিজয় করে এসেছেন তিনি, সেই উপলক্ষে আজ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলনোৎসব। তাঁর অভিজ্ঞতা শ্রবণের জন্য সবাই উদগ্ৰীব।

বেলগাছিয়া ভিলা স্থাপনের প্রথম দিকে দ্বারকানাথ তাঁর শ্বেতাঙ্গ বন্ধু ও কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুদের পৃথক পৃথক দিনে নিমন্ত্রণ জানাতেন। ইদানীং তিনি সেই প্ৰভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন। বিশিষ্ট রাজপুরুষ, কাউন্সিলের সদস্য, সুপ্রিম কোটের বিচারক, সামরিক কর্মচারী এবং জেলাশাসকরা যেমন আসেন, তেমনি ভারতীয়দের মধ্যে খ্যাতিমান বিদগ্ধ ব্যক্তি, জমিদার ও ব্যবসায়ীদেরও তিনি আমন্ত্রণ জানান। বিলাসিতায় দ্বারকানাথের কাপণ্য নেই। কিন্তু বেলেল্লা তিনি পছন্দ করেন না। ফুর্তি ও কৌতুক যাদৃচ্ছিা! হতে পারে, কিন্তু কেউ বে-এক্তিয়ার হয়ে গেলেই জানবে যে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন বেলগাছিয়া ভিলায় তার নিমন্ত্রণ হবে না।

ইওরোপ যাত্রার আগে থেকেই দ্বারকানাথ ফরাসী রুচির অনুরাগী। তাঁর বিলাসপুরীর নৈশভোজে ফরাসী রান্না এবং মোগলাই কাবাব, পোলাও, হোসেনীর—এই দুরকমই খাদ্য পরিবেশিত হয়। শ্রেষ্ঠ মদ্য আনয়ন করেন তিনি সরাসরি ফরাসী দেশ থেকে এবং তা অঢেল, অফুরন্ত। ভোগ বাসনার চেয়েও আড়ম্বরপ্রিয়তাই এই মানুষটির চরিত্র লক্ষণ।

মতিঝিলের মধ্যে দ্বীপের ওপরের গ্ৰীষ্মাবাসটির একটি কক্ষে দ্বারকানাথ নিবাচিত বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে দণ্ডায়মান। অতিথিরা উপবিষ্ট, তাঁদের হাতে সুরাপত্র, কারুর আচরণেই কোনোরকম ব্যস্ততা নেই, কেননা উৎসব চলবে সারারাত।

দ্বারাকানাথের পরনে মখমলের পাজামা, তার ওপরে সোনার জরির কাজ করা একটি জানু-ছাড়ানো জোব্বা, কণ্ঠে মণিমাণিক্যখচিত স্বর্ণহার, মাথায় উষ্ণীষ। গায়ে স্বর্ণািলস্কৃত একটি কাশ্মীরী শাল আলগাভাবে জড়ানো, পায়েও সেই অনুরূপ কারুকার্যখচিত সুড়তোলা নাগরা। তিনি খুব দীর্ঘকায় নন, কিন্তু উজ্জ্বল চোখ দুটিতে তাঁর ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুট। নাসিকার নীচে লম্বা গুম্ফ, তিনি কথা বলেন ধীর স্বরে, প্রতিটি শব্দের ওপর আলাদাভাবে জোর দিয়ে। ইংরেজি বাহুল্যবর্জিত এবং পরিষ্কার। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি টেবিলে এক হাতের ভর দিয়ে, সেই টেবিলের ওপর রাখা একটি রূপের আলবোলা এবং একটি মরোক্কো চামড়ায় বাঁধানো খাতা। খাতাটিতে তিনি তাঁর ভ্ৰমণকালীন দিনলিপি লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

মাঝে মাঝে খাতাটির পৃষ্ঠা উল্টে তিনি তাঁর ভ্রমণ বর্ণনা শোনাচ্ছেন অতিথিদের।

এক সময় এক ইংরেজ পুরুষ প্রশ্ন করলো, মহাশয়, ইহা কি সত্য যে আপনি যাবতীয় খ্ৰীষ্টান জগতের গুরু মহামান্য পোপের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন?

দ্বারকানাথ মৃদু হেসে বিনীতভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, মহাশয়, ইহা সত্য। রোমের ইংলিশ কলেজের প্রিন্সিপাল মহোদয় অনুগ্রহ করিয়া আমাকে পোপের সন্নিধানে লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহাকে দর্শন করিয়া আমি ধন্য হইয়াছি।

অপর একজন ইংরেজ বললো, ইহার পূর্বে কোনো পোপ কি কোনো অ-খ্ৰীষ্টানকে নিজ কক্ষে গ্রহণ করিয়াছেন?

—তাহা আমি বলিতে পারি না।

প্রথম ইংরেজটি এবার একটু উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তবে কি ইহাও সত্য যে আপনি পোপের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়াও আপনার মস্তক হইতে উষ্ণীষ খোলেন নাই?

—হাঁ, ইহাও সত্য।

উপস্থিত ইংরেজ পুরুষ ও মহিলারা আহত বিস্ময়ের ধ্বনি করে উঠলো। পোপের সম্মুখে পৃথিবীর রাজাধিরাজরাও মস্তক নগ্ন করে।

দ্বারকানাথ বললেন, আপনারা বিচলিত হইবেন না। মহামান্য পোপ আমার উপর ক্ষুব্ধ হন নাই, তিনি সাদরেই আমাকে অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিয়াছিলাম যে, কোনো ব্যক্তিকে সম্মান প্ৰদৰ্শন করার জন্য মস্তকে উষ্ণীষ রাখাই আমাদিগের দেশীয় প্ৰথা।

অনেকেই এ কথায় তেমন প্ৰসন্ন হলো না।

তখন ডিরোজিও-শিষ্য উচ্ছ্বাসপ্রবণ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, প্রিন্স দ্বারকানাথ উপযুক্ত ব্যবহারই করিয়াছেন। আমাদের দেশীয় প্রথায় তিনি মাননীয় পোপকে সম্মান জানাইয়াছেন।

আর একজন ইংরেজ প্রশ্ন করলো, ইংলণ্ডে গিয়াও কি আপনি আপনার দেশীয় প্ৰথা সর্বত্র মান্য করিতে পারিয়াছেন?

দ্বারকানাথ তৎক্ষণাৎ বললেন, হাঁ মহাশয়, যতদূর সম্ভব মান্য করিয়াছি। আমি স্বীকার করিতে বাধ্য, এ বিষয়ে আপনাদের স্বদেশবাসীদিগের মনোভাব যথেষ্ট উদার। প্রতিদিন স্নানের পূর্বে গায়ত্রী জপ করা আমার অভ্যাস। ইংলণ্ডে গিয়াও সে অভ্যাস ত্যাগ করি নাই। এমনও হইয়াছে, আমি গায়ত্রী জপে বসিয়াছি, এমন সময় কোনো সম্রাস্তবংশীয় রমণী তাঁহার পতি সমভিব্যাহারে আমার সহিত সক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন। আমি ভৃত্যদের দিয়া সংবাদ পঠাইয়াছি, তাঁহারা যেন অনুগ্রহ করিয়া একটু অপেক্ষা করেন। কেননা, আমি জপ ছাড়িয়া উঠিতে পারিব না।–আর একদিনের ঘটনা আমার স্মরণে আছে। সম্রাজ্ঞী ভিকটোরিয়ার আমন্ত্রণে আমি এক দিবস রাজপ্রাসাদের শিশুসদন পরিদর্শনে গিয়াছিলাম। সেস্থলে আপনাদিগের ভবিষ্যৎ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস এবং রাজকুমারী ছিলেন। মুক্তাখচিত শ্বেত মসলিন পরিহিত সেই অনিন্দ্যকান্তি বালক বালিকাকে দেখিয়া আমি পরম প্রীতি পাইয়াছিলাম। উহারা কখনো কোনো হিন্দু দেখে নাই, সে-কারণে অদ্ভুত বিস্ময়ভরা চক্ষে আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। আমি প্ৰথমে উহাদের প্রতি কোনো সম্ভাষণ করি নাই। আমার সেদিনের পথ-প্রদর্শিক লেডি লিটলটন আমায় প্রশ্ন করিলেন, অল্প বয়স্কদের আপনারা কোন প্রথায় অভিবাদন করেন? এবং উহারা আপনার সহিত করমর্দন করিতে পারে কি? আমি উত্তর করিলাম, বিলক্ষণ! অল্প বয়েসীদের আমরা অঙ্গ স্পর্শ করিয়াই প্রীতি জানাই। তখন সেই বালক বালিকা আসিয়া করমর্দন করিল এবং আমিও তাদের স্কন্ধে হস্ত রাখিয়া আমার শুভাশিস অপণ করিলাম।

উপস্থিত ইংরেজগণ কেউই কোনোদিন ইংলণ্ডের যুবরাজকে চর্মচক্ষে দেখেনি, তার সঙ্গে করমর্দন করা তো স্বপ্নের বিষয়। এই নেটিভ ব্যক্তিটি সেই সৌভাগ্য তো অর্জন করেছে বটেই, এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঈশ্বরী মহামাননীয়া ভিকটোরিয়ার সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন পর্যন্ত সেরে এসেছে। কিন্তু সেজন্য এর মধ্যে গর্বরেখা নেই।

দ্বারকানাথের আত্মীয় প্রসন্নকুমার ঠাকুর ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, সে দেশের তো বহুপ্রকার মুরুমকের কথা শুনিলাম। কিন্তু সেথায় এই বেলগাছিয়া ভিলার মতন এমন সুরম্য ভবন আছে কী?

এবার দ্বারকানাথ একটি দীর্ঘশ্বাস নীরবে গোপন করলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভ্ৰাতঃ, এক সময় এই ভিলার জন্য আমার গর্ব ছিল, কিন্তু বিলাতে গিয়া সে গর্ব আমার চুর্ণ হইয়াছে। সেই কারণেই সে স্থল হইতে আমি আমার পুত্র দেবেন্দ্ৰকে এক পত্রে লিখিয়ছিলাম, মানুষের যদি ঐশ্বৰ্য থাকে, তাহা হইলে সে ঐশ্বৰ্য উপভোগ করিবার উপযোগী দেশ হইল এই। সে দেশের উদ্যানবাটিকগুলি যে কী মনোরম তাহা ভাষায় প্রকাশ করিবার ক্ষমতা আমার নাই। আমার এ বাগানটি এখন আমার চক্ষে দুয়োরানীর তুল্য অপ্রিয় বোধ হয়।

এক ইংরেজ প্রশ্ন করলো, আপনি ডিউক অব ডেভনশায়ারের কানন-সৌধটি পরিদর্শন করিয়াছেন কি?

দ্বারকানাথ এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আ, আপনি যথার্থ নামটি উচ্চারণ করিয়াছেন। অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু উহার তুল্য আর দেখি নাই। চ্যাটসওয়ার্থে ডিউক অব ডেভনশায়ারের কানন,তাহাতে যে কত প্রকার দেশী বিদেশী বৃক্ষ রহিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। কে জানিত, এই পৃথিবী এতপ্রকার বৃক্ষ ঐশ্বর্ষে ঐশ্বর্যান্বিতা। আরও বড় বিস্ময়ের কথা, সেই শীতপ্রধান দেশেও ডিউক মহাশয় কতপ্রকার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বৃক্ষরাজি সযত্নে সংগ্ৰহ করিয়াছেন। সেই উদ্যানের তুলনায় আমার এই ভিলা? যেন সমুদ্রের তুলনায় গোস্পদ।

—ও দেশের আর কোন কোন বস্তু দেখিয়া আপনি বিস্ময়ান্বিত হইয়াছেন?

—আসল কথাটাই তো এখনো বলি নাই। একটি বিস্ময়ই আর সব কিছুকে ছাড়াইয়া বহুদূর গিয়াছে। শ্বেতাঙ্গজাতি এক অসাধ্য সাধন করিয়াছে। তাহারা এক মহাশক্তিশালী দৈত্যকে বন্দী করিয়া ভৃত্য করিয়াছে।

—মহাশয়, রহস্য না করিয়া একটু খুলিয়া বলিবেন কি?

—আমি ফারসী ও আরবী ভাষা শিক্ষা করিয়াছি। উহাতে কতকগুলান অত্যুৎকৃষ্ট কিস্যা রহিয়াছে। একটির নাম কলসীর দৈত্যের কিস্যা। কলসীর মধ্যে বন্দী এক দানবকে মুক্ত করিয়া এক ব্যক্তি তাহার সাহায্যে যাবতীয় কর্ম করাইয়া লইত। যুরোপে গিয়া দেখিলাম, তাহা অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী এক দৈত্য এখন শ্বেতাঙ্গদের দাস। সেই দৈত্যের নাম বাষ্প। আপনারা কল্পনা করিতে পারেন কি, এক বিশাল লৌহ শকট, যাহাতে শতশত লোক বসিতে পারে, সেই শকট বাষ্পে টানিয়া লইতেছে? সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বটে। বিলাতের কয়েক স্থলে এই শকট চলিতেছে, ইহার গমন পথকে রেইল রোড কহে। আমি জার্মানির কলোন নগরীতে, বিলাতের ম্যানচেষ্টারে স্বয়ং এই রেইলিযোগে গমনাগমন করিয়াছি। সে যে কী বিস্ময়!

উপস্থিত ইওরোপীয়দের অনেকেরই রেলওয়ে সম্পর্কে প্ৰত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। বাঙালীরাও যে বাষ্পচালিত রেলের কথা আগে শোনেনি, তা নয়, সংবাদপত্রে প্রায়ই এ বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদ থাকে, কিন্তু দ্বারকানাথ সবচক্ষে রেলগাড়ি দেখে প্ৰায় যেন শিশুর মতন মুগ্ধ। নিউ ক্যাসেল-এ কয়লাখনি পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি দেখলেন যে সেখানেও কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে বাষ্পশক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, কয়লা বহন করা হচ্ছে রেলগাড়িতে। বাংলাদেশে রানীগঞ্জে সর্বশ্রেষ্ঠ কয়লাখনির প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ নিউ ক্যাসেল-এ গিয়ে আফসোস করেছিলেন, যদি তাঁর নিজের দেশেও কয়লা চালানের এমন সুবিধা থাকতো! এ দেশে রেললাইন পাতা যায় না?

দ্বারকানাথ বললেন, শুধু রেইলগাড়ি কেন, বাষ্প আরও কত অদ্ভুতকর্ম করিতেছে। আমি দেখিলাম, বাষ্পশক্তির সাহায্যে সংবাদপত্র মুদ্রিত হয়, ব্যাঙ্ক নোট মুদ্রিত হয়।

একজন কেউ মন্তব্য করলো, জাহাজেও আজিকালি তো বাষ্প কল লাগান হইতেছে।

দ্বারকানাথ বললেন, লিভারপুলে আমি জাহাজ নির্মাণ কারখানাও দেখিতে গিয়াছিলাম। বিলাত গমনের পূর্বেই আমার দুইখানি জাহাজ নির্মাণের জন্য ফকেট কম্পানিকে বরাৎ দেওয়া ছিল। আমি স্বচক্ষে দেখিলাম, সেই জাহাজদ্বয়ের এঞ্জিন নির্মিত হইতেছে। আমার আত্মীয়-বান্ধবদের আগ্রহে ও অনুরোধে একটি জাহাজের নামকরণ হইয়াছে, আমার নামে। সেই দ্বারকানাথ জাহাজের এঞ্জিন তিন শো পঞ্চাশ অশ্বশক্তি বিশিষ্ট। কল্পনা করুন একবার, সার্ধ তিনশত অশ্বের স্থান লইয়াছে শুধু বাষ্প। তাহা হইলে সে কত বড় দৈত্য?

ঈষৎ রঙীন নেশায় সকলে হঠাৎ চটপট করে করতালি ধ্বনি দিয়ে উঠলো।

গল্পে গল্পে ঘন হয়ে এলো রাত। দ্বারকানাথের ভ্ৰমণ বর্ণনা সাহেব ও নেটিভ উভয় দলের কাছেই খুব আকর্ষণীয়। এই প্রথম কোনো সম্ভ্রান্তবংশীয় নেটিভ ইওরোপ পরিভ্রমণ করে এসে চক্ষুষ বিবরণ পেশ করছেন। এবং দ্বারকানাথ যে সব কিছুরই প্ৰশংসা করছেন, তা নয়। এবং দ্বারকানাথের বর্ণনার মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে একটা কথাও ফুটে উঠছে যে ভারতের সম্পদ আহরণ করেই ইংলণ্ডের এতখানি উন্নতি। সাহেবরাও এই প্রথম একজন নেটিভের মুখ থেকে তাদের পিতৃভূমি সম্পর্কে নানা কথা শুনছে। এই এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, নেটিভ হয়েও এই ব্যক্তি এমন এমন স্থানে গমন করেছে, যেখানে যাওয়ার সুযোগ তাদের নিজেদেরই হয় না।

প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে যেতে কথা একটু অপ্রিয় দিকে বাঁক নিল এক সময়। সুরার প্রভাবে কারুর কারুর ব্যবহার আরও সুমিষ্ট হয়, কারুর বা ভেতরের তিক্ততা বেরিয়ে আসে।

ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া পত্রিকার জনৈক লেখক হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, শ্ৰীযুক্ত ঠাকুর, আমরা বুঝিতে পারিতেছি যে, ইংলণ্ড, গৌরবোজ্জল ইংলণ্ড আপনাকে মুগ্ধ করিয়াছে। আপনি কি সেখানে পুনরায় যাইতে পরিবেন?

দ্বারকানাথ দৃঢ়ভাবে বললেন, নিশ্চয়। ফিরিবার পথেই আমার মনে হইতেছিল যে কত কিছুই দেখা ধ্ৰুং।। অতৃপ্তি বহিয়া গেল। আবার আসব। অনেক নবলব্ধ বন্ধুবৰ্গকে বলিয়া আসিয়াছি আবার  আসিব।

—কিন্তু আপনি ব্ৰাহ্মণ হইয়া নিষিদ্ধ কালাপানি পাড়ি দিয়াছেন, আপনার সমাজ আপনাকে জাতিচ্যুত করিবে না? এ বিষয়ে যে একটি আন্দোলন উঠিয়াছে, তাহা আমরা জানি। আপনাকে প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে হইবে নিশ্চয়? ইহা কি সত্য যে হিন্দুশাস্ত্ৰ মতে প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে গেলে গোময় আহার করিতে হয়?

কেউ কেউ হেসে উঠলো, কেউ কেউ হাসি গোপন করলো। ভ্রূকুঞ্চিত করে দ্বারকানাথ একটুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া মাঝে মাঝেই তাঁকে কুটুস কুটুস করে দংশন করে। অবশ্য বিলাত যাত্রার প্রাক্কালে তারা অভিনন্দন জানিয়েছিল। এখন এই ব্যক্তি তাঁর বেদনার জায়গায় ঘা দিয়েছে। এতকাল ধরে তিনি কত ব্ৰাহ্মণের ভরণপোষণ করেছেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে এরা কখনো তাঁর বিরুদ্ধে যাবে। অথচ এরাই এখন তাঁকে সমাজচ্যুত করার জন্য কলকোলাহল শুরু করেছে। মুখ ও সংস্কারসর্বস্ব ব্ৰাহ্মণদের তিনি আজকাল দু চক্ষে দেখতে পারেন না। হিন্দুধৰ্ম আর কতকাল কুপমণ্ডুক হয়ে রইবে? দেশ-বিদেশের জ্ঞান আহরণ, মানুষের সৃষ্ট এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য দর্শনেরও বাধা সৃষ্টি করে এই মুখরা!

ধীর গম্ভীর স্বরে দ্বারকানাথ প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছেন যে পরলোকগত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু। তাঁহার আদর্শে আমি এই সকল ক্ষুদ্র সংস্কার বর্জন করিতে সমর্থ হইয়াছি। এ সমাজ যদি আমাকে পরিত্যাগ করে, তবে আমি স্বয়ং সুখী চিত্তে পৃথক সমাজ গড়িব। সে সাধ্য আমার রহিয়াছে।

—আপনার পরিবারের সকলে আপনার পক্ষে যাইবে কি?

দ্বারকানাথ একবার প্রসন্নকুমারের দিকে তাকালেন। তাঁর এই জ্ঞাতিভ্রাতা তাঁকে পরিত্যাগ করেনি। প্রসন্নকুমারের পিতা রামমোহন-দ্বেষী ছিলেন কিন্তু প্রসন্নকুমার রামমোহনের মুক্তচিন্তার অনুসারী। অথচ, দুঃখের বিষয়, তাঁর নিজের পিতৃব্য ও ভ্রাতারা সর্বাংশে তাঁকে সমর্থন করেননি, স্নেচ্ছ-সংসর্গ দোষের জন্য তাঁরাও দ্বারকানাথের প্রায়শ্চিত্তের দাবি জানিয়ে গুনগুন করছেন।

দ্বারকানাথ বললেন, নিজ পরিবারের মধ্যে সাময়িক মনান্তর হয়ই, তাহাতে গুরুত্ব দিবার কিছু নাই। তবে আবার আপনাদের বলিতেছি, আমি কদাচ প্ৰায়শ্চিত্ত করিব না। আমি কোনো দোষ করি নাই, বরং দেশবাসীর সম্মুখে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছি।

—আপনার সুযোগ্য পুত্র বাবু দেবেন্দ্ৰ কি আপনার সমর্থক? আমরা জানিতে ইচ্ছা করি, আপনি কতখানি নিঃসঙ্গ?

—আমার পুত্র-অবশ্যই সে আমার সমর্থক-আদ্যকার উৎসব সার্থক করিবার ভার তো তাহারই উপর।

প্রকোষ্ঠের বাইরে অপেক্ষমান ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে দ্বারকানাথ বললেন, ওরে, কে আচিস? দেবেন্দ্ৰকে একবার ডাক তো!

কেউ কোনো সাড়া দিল না।

অঙ্গের শালখানির একপ্রান্ত মাটিতে লুটিয়ে দ্বারকানাথ চলে এলেন দ্বারের পাশে। তাঁর ব্যক্তিগত দুজন ভৃত্য সেখানে নিথরভাবে দাঁড়িয়ে।

তিনি রুক্ষস্বরে বললেন, দেবেন্দ্ৰ কোথায়? সে এখানেই ছেল না?

ভৃত্য দুজন অত্যন্ত ভীত স্বরে বললো, আজ্ঞা না হুজুর।

—সে কি বৈঠকখানা বাড়িতে রয়েচে? যা দেকে আয়। আমার নাম করে বলবি এখুনি আসতে।

ভৃত্য দুজন তড়িৎগতিতে ছুটে চলে গেল। তবু ওদের ব্যবহারে কেমন একটা খটকা লাগলো দ্বারকানাথের মনে। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা তাঁর মনে পড়লো।

তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, রক্তের ঝলক এসে গেল তাঁর মুখে। তিনি কক্ষের অভ্যাগতদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা বিশ্রাম্ভালাপ করুন, আমি অবিলম্বে আসিতেছি।

জুতো মসিমসিয়ে দ্বারকানাথ সেতু পার হয়ে চলে এলেন বৈঠকখানা বাড়ির দিকে। তাঁর ললাটে কুঞ্চন রেখা। ফোয়ারার সামনে আর কয়েকজন ভৃত্যকে দেখে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তোরা কেউ দেবেন্দ্ৰকে দেকিচিস?

ভূত্যেরা উত্তর দিতে সাহস পায় না। তারা কতবাবুর মেজাজ জানে। ওঁর অপছন্দমত সত্য কথাও উনি একেবারে সহ্য করতে পারেন না। ভূত্যেরা সবাই জানে কতবাবুর বড় ছেলে এখানে নেই, তবু তারা খোঁজ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল। দেবেন্দ্ৰবাবু যাবার সময় ভৃত্যদের এবং বৈকুণ্ঠ নায়েবকে বলে গেছেন যে বাবামশাইকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি সুস্থ বোধ করছেন না, তিনি চলে যাচ্ছেন।

বৈকুণ্ঠ নায়েব দূর থেকে দ্বারকানাথকে দেখেই দ্রুত উদ্যানের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। দ্বারকানাথ নিজে দেবেন্দ্র, দেবেন্দ্র বলে ডাকতে ডাকতে প্রতিটি কক্ষে উঁকি দিতে লাগলেন। তারপর যখন তিনি বুঝলেন, তাঁর পুত্র বেলগাছিয়া ভিলার কোথাও নেই, তখন তাঁর মুখখানি বিবৰ্ণ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে তিনি বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন উন্মুক্ত আকাশের তলায়।

বৎসর কয়েক আগে বড়লাট লর্ড অকল্যাণ্ডের ভগিনী মিস ইডেনের সম্বর্ধনার উদ্দেশ্যে তিনি এই বেলগাছিয়া ভিলাতেই মহাসমারোহের সঙ্গে এক ভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেদিনও তিনি। দেবেন্দ্ৰকে দিয়েছিলেন পরিচালনার ভার। পুত্ৰকে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এইসব উৎসবের অর্থব্যয় কখনো বৃথা যায় না। ব্যবসা ও জমিদারি পরিচালনার জন্য মান্যগণ্য রাজপুরুষদের সঙ্গে সৌহাদ্য রাখলে অনেক সুবিধে হয়। সেদিনও দেবেন্দ্র তার কাজে অবহেলা করেছিল, এক সময় দেখা গিয়েছিল যে সে অনুপস্থিত।

কিন্তু আজও সে চলে গেছে? অতিথিরা এ-কথা জানলে সকলের সামনে তাঁর মাথা হেঁট হয়ে যাবে। তাঁর পুত্র পিতৃগৌরব সম্পর্কে উদাসীন!

পুত্রের মতিগতি তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কলেজ ছাড়ার পর দেবেন্দ্ৰ হঠাৎ অত্যন্ত বেশী বাবুয়ানি শুরু করেছিল। সে সংবাদ দ্বারকানাথের কানে গেলেও তিনি বাধা দেননি। তিনি বুঝেছিলেন, বয়েসকালে ও দোষ কেটে যাবে। একবার দেবেন্দ্র এমনই এক সরস্বতী পুজোর ধূম লাগালো যে সারা শহরে গাঁদা ফুল আর সন্দেশ বাকি ছিল না, সবই এসেছিল। ঠাকুরবাড়িতে। এতটা বাড়াবাড়ি দ্বারকানাথ পছন্দ করেননি। পুজো উপলক্ষে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করার চেয়ে যে এইরূপ ভোজের আসরের উপযোগিতা বেশী, তা দেবেন্দ্ৰ বুঝবে না। দেবেন্দ্রর চপলমতি কিছুটা সংশোধন করার অভিপ্ৰায়ে দ্বারকানাথ ছেলেকে ব্যাঙ্কের হিসাব রক্ষকের কাজে লাগিয়ে দিলেন।

দ্বারকানাথ লক্ষ করেছেন, দেবেন্দ্র সাহেব-সুবোদের সঙ্গে খুব একটা সংসৰ্গ করতে চায় না। সে ইংরাজিতে কিছু কাঁচা, সে তো শিক্ষক রেখে কিছুদিনের মধ্যেই আয়ত্ত করে নেওয়া যেতে পারে। দেবেন্দ্ৰ বুদ্ধিমান যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পিতা এ দেশের শিরোমণি, জজ ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে উচ্চতম পদের ইংরেজের সঙ্গে যাঁর শুধু পরিচয় নয়, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তাঁর পুত্র পারতপক্ষে ইংরেজদের সংস্পর্শেই যেতে চায় না। দ্বারকানাথ দেবেন্দ্ৰকে কার টেপোর কোম্পানির অংশীদার করে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে দেবেন্দ্র সাহেবদের সঙ্গে মিলেমিশে সে কোম্পানি চালাবে কী করে?

দেবেন্দ্রর সেই সাময়িক বাবুয়ানি ঘুচে গেছে। কিন্তু তার পরিবর্তে যা শুরু করেছে, তার চেয়ে বাবুয়ানি ছিল ভালো। বড় মানুষের ছেলে মাঝে মাঝে আমোদ-আহ্লাদ করবে। সেটাই তো স্বাভাবিক, অথচ দেবেন্দ্ৰ এখন দিনরাত সংস্কৃত চর্চা করে, আর কী এক পাঠশালা স্থাপন করে তাই নিয়ে মেতে আছে। একদিন তিনি এজন্য শাস্ত্রী মশায়কে ধমক দিয়েছিলেন। এতবড় বিষয় সম্পত্তির তদারকি করতে হবে যাকে, সে কেন ঐসব অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকছে! প্রবাস থেকে ফিরে তিনি এমন কথাও শুনেছেন যে কোনো কোনোদিন দেবেন্দ্ৰ নাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেদারায় বসে থাকে, নাওয়া খাওয়ার ব্যাপারেও হুঁশ নেই, কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না। এসব কিসের লক্ষণ? দ্বারকানাথ নক্ষত্ৰখচিত আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে বেদনার গাঢ় ছায়া। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই সব কিছু সঙ্ঘটিত হবে। কিন্তু আজ নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ হলো। সামান্য অবস্থা থেকে কত কঠোর পরিশ্রমে ও জেদে তিনি প্ৰায় একটি সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন। কিন্তু কী লাভ হলো? ইংরেজ পুরুষটি প্রশ্ন করেছিল, তিনি আজ কতটা নিঃসঙ্গ। বস্তুত, তাঁর মতন নিঃসঙ্গ মানুষ বুঝি আর কেউ নেই! পিতা নেই, মাতা নেই, সহধর্মিণীও কয়েক বৎসর আগে গত হয়েছেন।

কিন্তু সে দূরে দূরে সরে থাকে, কখনো নিজে থেকে এসে ঘনিষ্ঠ বাক্য বলে না। বাড়ির সকলে তাঁকে সমীহ করে, ভয় করে, যেন তিনি একটা বাঘ। একটা মেহের কথা বলার মতন কেউ নেই। দেবেন্দ্ৰ কি তাঁর জীবন প্ৰণালীর প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করে?

দ্বারকানাথ অভিমানের সঙ্গে চিন্তা করলেন, তাহলে আর বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির জন্য এত শ্রম করে কী হবে? তাঁর জীবন তো শুষ্কই থেকে যাবে। মনে পড়লো, প্রবাসের দিনগুলি কত মনোরম ছিল। কত অভ্যর্থনা, কত স্তুতি। তিনি যেখানেই গেছেন, সকলের দৃষ্টি ঘিরে থেকেছে। তাঁকে।

অর্থ উপার্জন তো অনেক হয়েছে, আর নয়, দ্বারকানাথ সঙ্কল্প করলেন যতশীঘ্র সম্ভব তিনি আবার সাগরপাড়ের দেশের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়বেন। এ পোড়া দেশের জন্য আর মস্তক ঘর্মাক্ত করে লাভ কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *