৩৫. রাতের রোশনাই, দিনের ছাইগাদা

কথায় বলে রাতের রোশনাই, দিনের ছাইগাদা। দিনের বেলার দৃশ্য দেখে সত্যিই কিছু বোঝার উপায় নেই। এই সব বাড়ি অনেক বেলা পর্যন্ত নিদ্রিত থাকে, গবাক্ষগুলি সব বন্ধ। গোয়ালা গরু নিয়ে দুধ দুইতে এসে হল্লা লাগায়, সহজে দাস-দাসীরাও দুধের পাত্র নিয়ে আসে না। এখানে দাস-দাসীদের মর্জিও অন্যরকম। হীরেমণির গৃহে প্ৰাতে দশ ঘটিকা পর্যন্ত শুধু এক বালকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাঠাভ্যাস করে। সে বালক হীরেমণির পুত্ৰ চন্দ্রনাথ।

রাতে এ গৃহের দ্বিতলের বড় প্রকোষ্ঠে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে, সেখান থেকে ভেসে আসে হারমোনিয়াম, ড়ুগি-তবলার আওয়াজ ও নূপুর নিক্কন। দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে জমকালো ধরনের জুড়িগড়ি। সঙ্গীত লহরী ছাপিয়েও এক এক সময় মদ্যপায়ীদের স্বলিত কণ্ঠ রাত্রির মসৃণতাকে বিদীর্ণ করে। দিনের বেলায় সব শান্ত, অন্যান্য বাড়িগুলির তুলনায় হীরেমাণিদের মতন বারাঙ্গনাদের গৃহ যেন বেশী স্তব্ধ।

হীরেমণির এখন অবস্থা ফিরেছে, শহরের বাবু মহলে তার খুব নামডাক, টাকা-পয়সাও আসছে যথেষ্ট। এখন এ শহরে বারাঙ্গনাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নামডাক কমলাসুন্দরী আর হীরেমণির। এরা শুধু তো দেহপশারিণীই নয়, কমলাসুন্দরী নৃত্যকলা পটিয়সী আর হীরেমণির কণ্ঠের গান যে একবার শুনেছে, সে আর ভুলতে পারে না। হীরেমণির আসল নাম ভুলে গিয়ে লোকে তাকে এখন বুলবুল বলে ডাকে। বুনিয়াদী পরিবারের দোল-দুর্গোৎসবের মজলিশে যখন সাহেব মেমদেরও নেমন্তন্ন হয়, তখন সেখানে কমলাসুন্দরী হীরেমণিদেরও ডাক পড়ে। সাধারণ ছা-পোষা লোকেরা ভাবে হীরেমণির মতন। তয়ফাওয়ালি রেণ্ডিরা বুঝি বাড়িতে হীরে মুক্তো চিবিয়ে খায় আর সোনার বিছানায় শুয়ে রূপের পাশবালিশ জড়ায়। এরা কেউ কোনোদিন দ্বিপ্রহরে গৃহে এলে বিস্ময়ে বাকরহিত হয়ে যেত। কুচোচিংড়ি দিয়ে পুঁইশাকের ডাঁটাচচ্চড়ি হীরেমণির অতি প্রিয় খাদ্য। এক বাটি খেসারির ডাল সে চুমুক দিয়ে খায়। মাংস দেখলে সে নাক সিটকোয়, এমনকি বড় জাতের মাছও তার না-পছন্দ, ঐসব মাছে নাকি কাদা কাদা গন্ধ। সে ভালোবাসে পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা। দ্বিপ্রহরে সাধারণ কস্তা পাড়ের ড়ুরে শাড়ি পরে সে যখন রান্নাঘরের সামনের বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পুঁইডাঁটা চিবোয়, তখন তাকে কোনো সাধারণ বাড়ির বউ-ঝি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। অবশ্য এই সব খেয়েও হীরেমণির রূপ এখনো যেন ফেটে পড়ছে।

সকাল দশটার সময় ঘুম ভাঙার পরেই রাইমোহনের ওপর একটা কাজ বর্তেছে। অবস্থা ফেরার পর হীরেমণির এখন দাসদাসীর অভাব নেই, তবু কোনো প্রয়োজন হলেই সে রাইমোহনের ওপরেই হুকুম চালায়। আজ সকালে হীরেমণি কুয়োতলায় স্নান করতে গিয়েই দেখে যে জল তোলার দড়ি ছেড়া, কলসীটিও উধাও। ছিচকে চোরেরা প্রায়ই কুয়োতলার কলসী চুরি করে পালায়, সেইজন্য ব্যবহার করার পরই কলসী ভেতরে তুলে রাখতে হয়। কাল সন্ধ্যায় হয়তো কোনো অমনোযোগী দাসী ভুল করে কলসী ফেলে রেখে গিয়েছিল।

হীরেমণি গতকাল মুজরো গাইতে গিয়েছিল শোভাবাজারে, ফিরেছে শেষ রাতে। ঘুম থেকে উঠেই স্নান করা তার অভ্যাস। কলসী নেই। আর দড়ি ছেড়া দেখেই তার মেজাজ। সপ্তমে চড়ে গেল। দাস-দাসীদের সকলকে ডেকে হীরেমণি তার কুৎসিত গালিগালাজের ভাণ্ডার একেবারে উজাড় করে দিল। অবশ্য দাসদাসীরাও এমন বে-আক্কেলে, কেউ দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে চায় না, দোষারোপ করতে লাগলো পরস্পরের ওপর। তারা বলতে চায় যে কলসী চুরি যায়নি। দড়ি ছিঁড়ে কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছে,

তখন হীরেমণির জেদ চাপলো, কুয়ো থেকে সেই কলসী তোলাতে হবে, নইলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে চুরি যায়নি। একটার জায়গায় দশটা কলসী তখনই হীরেমণি কিনতে পারে, কিন্তু জেদ হচ্ছে জেদ।

হীরেমণি চেঁচিয়ে বললো, সেই হতচ্ছাড়া বে-আক্কেলে মিনসেটা কী করচে? এখনো পড়ে পড়ে নাক ডাকাচে! ওফ, ভগমন আমার কপালে কত দুঃখই দিয়েচেন! আমায় দেকবার কেউ নেই গা!

হরচন্দ্ৰ বলে যে মাতালটিকে রাইমোহন আশ্রয় দিয়েছিল, সে আজও রয়ে গেছে। এছাড়া আরও দুজন বৃদ্ধ এখানে আশ্রিত। ভাগ্যহীন বাউণ্ডুলেদের সম্পর্কে রাইমোহনের বেশ দুর্বলতা আছে, সে রকম কারুকে চোখে দেখলে সে ডেকে আনে এ বাড়িতে। হীরেমণি অবশ্য এদের দু চক্ষে সহ্য করতে পারে না, তবু তার মুখচোপা সহ্য করে টিকে আছে। এই তিনজন।

হীরেমণির চ্যাঁচামেচিতে তাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। উঠেনে কুয়োতলায় গামছা পরে দাঁড়িয়ে সে সমানে চালাচ্ছে হাত, পা, মুখ। গামছায় তার সোনার অঙ্গ ঢাকা পড়েছে খুবই সামান্য। আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে লাফালাফি করলে হঠাৎ তার বিবস্ত্রা হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা আছে। হীরেমণির সেদিকে হুঁশ নেই। অমন রূপসী একটি নারী এবং গানের জন্য যে কোকিলকণ্ঠী নামে পরিচিতা, তার কণ্ঠ থেকেও যে এত কদৰ্য কুবাক্যের স্রোত বেরিয়ে আসতে পারে, তা কল্পনা করাই শক্ত।

হরচন্দ্ৰ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, আ দিদি, আমি দৌড়ে গে একটা কলসী নিয়ে আসবো? হীরেমণি তার দিকে ফিরে ক্ৰোধ ঘূর্ণিত নয়নে বললো, দিদি? আমি তোর কোন সাতজন্মের দিদি রে, অলপ্পেয়ে? দুনিয়ার কোথাও ঠাঁই নেই। তাই এখেনে মাটি কামড়ে পড়ে আচিস, আবার দিদি বলে সোহাগী! গা জ্বলে যায়!

হরচন্দ্ৰ বললো, চান না করলে যে গা আরও বেশী জ্বলবে! কলসী এনে দি?

হীরেমণি বললো, চুপমার! কেন, সে কোতায়? সেই খাল ভরা, ড্যাকরা, খগরাজের মতন চ্যায়রা হতভাগাটা পড়ে পড়ে ঘুমুবে? তাকে দিয়ে এক তিল উবগার হয় না, তাকে কেউ ডাকতে পাচ্চিসনি?

রাইমোহনের ঘুম গাঢ়, তাছাড়া নেশার ঘুম, সহজে ভাঙে না। একজন ভৃত্য গিয়ে তাকে ঠেলা ঠেলি করতে লাগল।

চক্ষু রাগড়াতে রাগড়াতে নেমে এসে রাইমোহন বললো, কী হলো? আজ আবার কী বৃত্তান্ত?

হীরেমণি বললো, আমার সব্বোনাশ হলেও তো তুমি চোখ বুজে থাকবে। আদুড় গায়ে সেই কখন থেকে ডাঁড়িয়ে আচি, কেউ একবার ভাবে না। আমার কতা!

রাইমোহন অন্যদের কাছ থেকে ঘটনাটি জেনে নিয়ে হীরেমণিকে বললো, এই জন্যই তো তোমায় পইপই করে বলচি, কলসী আর রেকোনি। পেতল কাসার জিনিস, তাই চোর ছাঁচোড়ে নিয়ে যায়। আজকাল বালটি বলে একরকম জিনিস বেরিয়েচে, বেশ মজবুত, লোহার তৈরি, তা কেউ নেবে না।

হীরেমণি প্ৰায় আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, আমি নোয়ার জিনিসের জলে চান করবো? ওরে আমার পেয়ারের নাঙ রে! অতি বড় শতুর ছাড়া কেউ এমন ধারা কতা বলে! আমার যদি কেউ হিতকারী হতো। তাহলে আমার চানের জন্যে সোনার কলসী থেকে গোলাপ জল ঢেলে দিত! বলে কিনা নোয়ার জিনিসে জল তুলবো! সেই জলে চান করে আমার গতরটা পচে যাক, তাতেই তোমাদের সুক হবে! ওঃ, এত বড় শত্তুরকে ঘরে রেকিচি!

রাইমোহন এক গাল হেসে বললো, আমার তো শত্ৰু রূপেই ভজনা, তা তুমি জানো না? তুমি যতই আমায় গালি-গালাজ দাও, ততই আমার কানে সুধা বর্ষণ হয়!

এতে হীরেমণি আরও বেশী ক্রুদ্ধ হয়ে আরও তপ্ত বাক্যস্রোত বইয়ে দিতে লাগলো। রাইমোহন অনবরত কৌতুক চালিয়ে গেল তার সঙ্গে। তারপর সত্যিই একবার হীরেমণির অঙ্গ থেকে গামছা খসে যেতেই রাইমোহন দাস-দাসী ও আশ্রিতদের তাড়া দিয়ে বললো, যা, যা, এখেনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেকচিস? যা না, মসজিদের পাশের তালাও থেকে জল তুলে নিয়ে আয়!

কিন্তু হীরেমণি তাতেও শান্ত হবার পাত্রী নয়। সে পুকুরের জলে স্নান করবে না, এমনকি অন্য কোনো পাত্রে তোলা জল হলেও চলবে না। আগে তার হারানো কলসীর ব্যাপারটির মীমাংসা করা দরকার। এবং তা রাইমোহনকেই করতে হবে।

সেইজন্য রাইমোহন বউবাজারের মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়োর-জিনিস-তোলাবে-গোর খোঁজে। কিন্তু যখন যে জিনিসটি খুব বেশী প্রয়োজন, তখনই সেটি পাওয়া দুর্ঘট হয়ে ওঠে। যখন প্রয়োজন কোনো পরামাণিকের, তখন দেখা যায় গণ্ডায় গণ্ডায় মুচি। যখন চাই মুড়িওলীকে, তখন চোখের সামনে দিয়ে অনবরত যাবে দইওয়ালা। কুয়োর-জিনিস-তোলাবে-গোরা অন্যদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চেঁচিয়ে কান ঝালাপালা করে, আর এখন এই সঙ্কটের সময় তাদের পাত্তা নেই। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর রাইমোহন আরও শঙ্কিত হয়ে উঠলো, এতক্ষণে বাড়িতে কী কাণ্ড ঘটছে কে জানে! হীরেমণির অঙ্গ থেকে হয়তো আরও কয়েকবার গামছা খসে গেছে। রাত্তিরবেলা বড় বড় রহিস বাবুরা হীরেমণির রূপসুধা সন্দর্শনের জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করেন, সে হীরেমণিই দিনের বেলা যেন কারুকে মানুষ বলেই গ্রাহ্য করে না।

রাইমোহন একটি নতুন কলসী ও এক গাছি মোটা দড়ি কিনে বাড়ি ফিরলো। হীরেমণি তখন প্ৰায়োপবেশনের ভঙ্গিতে কুয়োর পাশের পাথরের পৈঠায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। নতুন কলসী দেখে সে আবার রাগে জ্বলে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই রাইমোহন হাত তুলে বললো, রসো, রসো! সে মুখপোড়াদের একটারও দেকা পেলুমনিকো, তাই আমি নিজেই নাবচি। আমি নিজে এই কুয়োর মধ্যে ড়ুববো। তোমার জন্য আমি কী না পারি!

তারপর সে কুয়োর ধাপের ওপরে উঠে বসে বললো, এক পাড়াগেয়ে বাঙালের মুখে একবার একটি গান শুনিচিলুম, বড় সরেস কথাগুলিন। তার দুটো একটা পংক্তি মনে আচে, কোথায় পাইমু কলসী কইন্যে, কোথায় পাইমু দড়ি, তুমি হইও গহীন গাঙ, আমি ড়ুইব্যে মারি? আমি ভেবেচিলুম, আমিও তোর ঐ চোখের গহীন গাঙে ড়ুবে মরবো, কিন্তু তা তো আর হতে দিলিনি, তাই দড়ি কলসী কিনে আনতে হলো।

হীরেমণি বললো, আর রঙ্গ কত্তে হবে না তোমায়। অত যদি মরার ইচ্ছে তবে অ্যাতোদিন মরোনি কেন, কে তোমায় বারণ করেছেল?

রাইমোহন বললো, মরিচি তো! তবে একবার মরলে সুখ হয় না, বারবার মর্তে ইচ্ছে করে!

কুয়োর ওপরের লোহার দণ্ডটির সঙ্গে দড়িটিকে মজবুত করে বেঁধে তার অন্য প্ৰান্ত নিজের কোমরে জড়িয়ে রাইমোহন বললো, এই আমি বুললুম!

তারপর কুয়োর মধ্যে এক পা গলিয়ে আবার সে বললো, যদি না ফিরি, তবে পরজন্মে দেকা হবে।

অমনি সব কিছু বদলে গেল। হীরেমণি ছুটে এসে হাউ মাউ করে কেঁদে বললো, ওগো, না, যেওনি, যেওনি! আমার ঘাট হয়েচে!

রাইমোহন বিয়োগান্ত নাট্যের শেষ দৃশ্যের নায়কের ভঙ্গিতে বললো, বুলবুল, তুই চাইলে আমি গোখরো সাপের মাথার মণিও আনতে যেতে পারি, এ তো সামান্য একটা কলসী!

হীরেমণি বললো, না, না, আমার কলসী চাই না, আমার কিচু চাই না, তুমি চলে গেলে আমায় চিল শকুনে ছিঁড়ে খাবে!

রাইমোহন আরও এক ধাপ নেমে বললো, বন্দুকধারী দ্বারোয়ান রেকো, চিল শকুন আলসের ধার ঘেষতে সাহস পাবে না!

দাস-দাসী, আশ্রিতরা বারান্দায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকে হরচন্দ্র উৎসাহ দিয়ে বলে উঠলো, নেমে পড়ো, দাদা! ড়ু অর ডাই!

হীরেমণি রাইমোহনের চুল খামচে ধরে বললো, এই আমি এখেনে কপাল কুটবো! তুমি মরে গেলে আমিও মরবো, আর একটি দিনও বাঁচবো না।

আরও কিছুক্ষণ এইরূপ মস্করা চলার পর রাইমোহন উঠে আসে। বলাই বাহুল্য কুয়োর মধ্যে নেমে প্ৰাণ হারাবার ঝুঁকি নেবার বিন্দুমাত্র বাসনা তার ছিল না, সে হীরেমণিকে অতি উত্তমভাবেই চেনে। এরপর হীরেমণি খানিকক্ষণ কাঁদে এবং রাইমোহন নিজে জল তুলে হীরেমণির মাথায় ঢেলে স্নান করায়। খানিকবাদে শুদ্ধ বস্ত্ৰ পরে, এস্রাজ বাজিয়ে হীরেমণি যখন রেওয়াজ করতে বসে, তখন আবার তাকে মনে হয় সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।

এটি একদিনের ঘটনা। তবে প্রতিদিনই এ গৃহে এরকম কিছু না কিছু হয়ই। দিনের বেলা রাইমোহনের রঙ্গে হীরেমণির সম্পর্ক পুরোনো দাম্পত্যের মতন মধুর। রাইমোহনের ওপর হীরেমণি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আর হীরেমণির সংসারই এখন রাইমোহনের সংসার। শহরের দু-চারজন বড় মানুষের গৃহে এখনো যাতায়াত থাকলেও মোসাহেবী পেশা রাইমোহন পরিত্যাগ করেছে, সারাদিন সে হীরেমণির সঙ্গে নানারকম ফষ্টি করে, আর রাতের বেলা বাবুরা এলে সে অদৃশ্য হয়ে থাকে। হীরেমণি কোথাও মুজরো গাইতে গেলে রাইমোহন নিজে পৌঁছে দিয়ে আসে তাকে।

গায়িকা হিসেবে প্ৰতিষ্ঠাপন্ন হবার পর থেকে হীরেমণিরও খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। নিছক দেহলোলুপ ধনীদের সে আর নিজ গৃহে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে চায় না। নিতান্ত দু-চারজন পুরোনো বাবুদের সে এখনও ফেরাতে পারে না। শুধু। তাদের মধ্যেও যারা বেশী বাড়াবাড়ি করে, হীরেমণির শরীর-মনের ওপর অত্যাচার করার ব্যাপারে যাদের কোনো মায়া। দয়া নেই, তাদের তাড়াবার মোক্ষম কৌশল বার করে দিয়েছে রাইমোহন। সেই সব ধনীদের গুপ্ত পাপ কাহিনী নিয়ে গান বাঁধে রাইমোহন, হীরেমণিকে সেগুলো শিখিয়ে দেয়।

রাইমোহন বলে, দ্যাখ না হীরে, শিগগির এমন দিন আসবে, যখন তোকে আর গাইতেও হবে না। শুধু শহরময় রটিয়ে দেবো যে তুই অমুক অমুক বড় মানুষ সম্পর্কে গান শোনাবি! অমনি দেকবি তারা ছুটে এসে সেই গান বন্ধ করার জন্য তোর পায়ে টাকা ঢেলে দেবে। বাগাড়ম্বর মিত্তির, গাধাকান্ত দেব, একে একে সববাইকে ধচ্চি!

হীরেমণির পুত্ৰ চন্দ্ৰনাথ এখন বেশ ডাগরটি হয়েছে। তার বয়েস এখন চতুর্দশ বৎসর, পিতৃপরিচয়হীন এই কিশোরটির মুখশ্ৰীর মতন ব্যবহারও অতি মধুর। এই বয়েসেই সে অতি কম কথা বলে, যেটুকু বলে, তাও অতি নম্রভাবে। সে একা একা ক্রীড়া করে, একা একা পড়ে। বাড়িতে এত রকমের গোলমাল, সে ভ্রূক্ষেপও করে না। অতি শৈশবে তাকে দুধের সঙ্গে ঈষৎ আফিং-এর জল মিশিয়ে খাওয়ানো হতো বলে সে সন্ধ্যা থেকে নিদ্রা যেত। রাইমোহন সে কথা জানতে পেরে এখন তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিশোরটি অতিশয় বুদ্ধিমান, মায়ের পেশার কথা সে জানতে পারবোই, বা ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে হয়তো, সুতরাং কৃত্রিমভাবে তাকে ঘুম পাড়াবার কোনো প্রয়োজন নেই। বুকুক বা না বুকুক, চন্দ্রনাথ এ বাড়ির রাতের অতিথিদের সম্পর্কে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করে না। হীরেমণির মনে হয়, তার পুত্রের বুঝি স্নেহ ভালোবাসা ইত্যাদি প্রবৃত্তিগুলিই কম। হীরেমণি যতটা ভালোবাসে তার সন্তানকে, সে তুলনায় চন্দ্রনাথের যেন মায়ের প্রতি তেমন টান নেই, এমনকি সে মায়ের কাছে কোনো আবদার পর্যন্ত করে না।

লেখাপড়ায় তার অসম্ভব আগ্রহ। রাইমোহন নিজে তাকে বাংলা পড়িয়েছে। হরচন্দ্ৰ নামের মাতালটি ইংরেজি জানে বেশ, তার কাছেও ইংরিজি শিক্ষা করেছে চন্দ্রনাথ, এখন হরচন্দ্র নিজেই স্বীকার করেছে যে তার যতখানি বিদ্যে ছিল, তা চন্দ্ৰনাথের শিখতে বাকি নেই। আর, এখন তার উন্নততর শিক্ষক আবশ্যক। কিন্তু চন্দ্রনাথকে কোনো ইস্কুলে ভর্তি করার উপায় নেই। যে-কোনো বিদ্যালয়ে পড়তে গেলেই ছাত্রের পিতৃপরিচয় জানাবার প্রয়োজন হয়। রাইমোহন বারংবার বলেছে যে চন্দ্রনাথকে সে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে চায়। বারাঙ্গনার গৃহের আবাসিক হলেও তার শরীরে এখনো খাঁটি ব্ৰাহ্মণের রক্ত বইছে। তার পদবী ঘোষাল, সমাজে এই পদবীর যথেষ্ট কদর আছে। এই ব্যাপারে হীরেমণি বিষম জেদী, সে কিছুতেই রাইমোহনের কথা শোনে না, সে এখনো বলে, ঈশ্বর তাকে এই পুত্রটি দান করেছেন, ঈশ্বরই তার পিতা।

হায়, সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, তবু বিশেষ কোনো একজন মানুষকে শুধু ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিলে, সমাজ তা কিছুতেই মানবে না, উপহাস, ধিক্কার দেবে।

ফিরিঙ্গিদের পাঠশা যায় অবশ্য ভর্তি করে দেওয়া যায়। ফিরিঙ্গিরা অতশত মানে না। কিন্তু সেখানে পাঠাতেও হীরেমণির নিতান্ত আপত্তি। ইদানীং শহরে যেন জুজুর ভয় রটেছে। ওলাউঠার হেঙ্গামার চেয়েও খৃষ্টানী হেঙ্গামা অতি প্রবল। একটু আধটু লেখাপড়া শিখলেই ছেলেরা খৃষ্টান হয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে মিশনারিদের উৎসাহ উদ্দীপনাও যেন হঠাৎ চতুৰ্গুণ হয়ে উঠেছে। বর্গীর ভয়ের মতন মা বাপের ছেলে-মেয়েদের ঘরে আটকে রাখে, কী জানি কখন পাদ্রীরা তাদের কানে ফুসমস্তর দিয়ে টেনে নিয়ে যায়।

চন্দ্রনাথের লেখাপড়া বিষয়ে হীরেমণির মনে একটা অশান্তি চলছিল। সে নিজে বিদ্যাশিক্ষার অত কিছু মর্ম বোঝে না, কিন্তু তার ছেলেকে যারাই দেখে তারাই বলে যে, এ ছেলে বড় হলে হীরের টুকরো হবে। হীরেমণি দিশেহারা হয়ে যায়।

একদিন দুপুরবেলা খেতে বসে রাইমোহন বললো, বুজলি হীরে, ইচ্ছে করলে চাঁদুকে এ দেশের সবচে বড়, সবচে ভালো বিদ্যালয়ে ভিত্তি করে দেওয়া যায়। হিন্দু কলেজের বহুৎ নাম ডাক, সেখানে তোর ছেলে পড়বে, যদি তুই নিজে দু-একটা কাজ করতে রাজি থাকিস।

হীরেমণি অবাক হয়ে বললো, আমি আবার কী করবো? আমার ক অক্ষর গো-মাংস, ইস্কুলের ব্যাপার। আমি কী জানি!

রাইমোহন বললো, সে আমি তোকে শিখেয়ে পড়িয়ে দেবো।

রাইমোহনের পাশেই বসেছিল। হরচন্দ্ৰ। সন্ধের পর থেকেই সে মাতাল হয়ে থাকলেও দুনিয়া সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর রাখে। সে বললো, দাদা, এ কথাটি আমিও ভাবছিলুম কদিন ধরে। লোকমুখে শুনতে পাচ্চি, বেথুন নামে নাকি একজন সাহেব এয়েচে, সরকারি ইস্কুল বিভাগের বড় কত্তা হয়ে। তিনি নাকি অনেক নিয়ম উল্টে দিয়েচেন আর মেয়েছেলেদেরও পড়ালেখা শিকোচেন। সে সাহেবটি খানিকটা দিলাদরিয়া, মাতা পাগলা গোচের। অনেকটা–সেই যে ডেভিড হেয়ার ছেলেন, তেনার মতন আর কি!

রাইমোহন বললো, তুই ডেভিড হেয়ারের কতাও জানিস নাকি?

হরচন্দ্ৰ কানে হাত দিয়ে বললো, সে মহাত্মার কথা কে না জানে! আমি নিজেই তো হেয়ার সাহেবের পটলডাঙার ইস্কুলে পড়িচি।

—তা নেকাপড়া শিকেও তোর এই অবস্থা হলো কেন? এমন নিষ্কম্মার টেকি হয়ে রইলি!

—সে দাদা, আমার নিয়তি।

–তুই কতদিন বাড়ি-ছাড়া হয়ে আচিস?

–তা বছর পাঁচেক হবে।

–তুই তার পর থেকে আর কিছুই জানিসনি বোধ করি? সে হেয়ার সাহেব তো কবে পটল তুলে হেভেনে চলে গ্যাচেন রে! ভালো সাহেবরা এ দেশে বেশী বাঁচে না। যে গুলোন রক্তখেকো, সে গুলোন বাঁচে।

হীরেমণি বললো, আবার কী সব হ্যান ত্যান কতা শুরু করলে। চাঁদুর ইস্কুলে ভত্তির কতা কী বলছেলে যে!

হরচন্দ্র বললো, দিদি, আমি নিজে গিয়ে চাঁদুকে হিঁদু কলেজে ভত্তি করিয়ে দিয়ে আসবো। দরকার হলে সাহেবদের পায়ে ধরে বলবো, টেস্ট নাও! ছেলেকে যাচিয়ে দেকো।

রাইমোহন তাকে ধমক দিয়ে বললো, তুই থাম! ওতে কিচু হবে না। সাহেবরা পারবে না। আমাদের জাতের বড় বড় মাতা মাতা লোকেরা এখনো কমিটি মেম্বর রয়েচেন, তাঁদের অমতে কিচু হবেনি কে। তাঁদের ধরতে হবে।

তারপর সে হীরেমণির দিকে ফিরে বললো, পশু দত্ত বাড়িতে তো গান গাইবার মুজরো আছে। আমি খবর নিইচি, সেখানে লাট-বেলোট ইংরেজরা তো আসবেই, শহর ছেঁকে বড় মানুষরা আসবে, তার মধ্যে হিন্দু কলেজের অভিভাবক সভার অধ্যক্ষও থাকবেন পাঁচজন। তুই তাঁদের পানে চেয়ে গাইবি। গান গেয়ে তাঁদের মাৎ করে দিতে পারবিনি?

হীরেমণি বললো, কী জানি বাবা! অত বড় আসরে কে মাৎ হলো কি না হলো, তা কি আমি ঠাহর কত্তে পারি?

রাইমোহন বললো, ভাবের গান গাইবি, ভক্তির গান গাইবি। মদের আসরে ভক্তির গান বেশী জমে, বাবুদের চোকে জল এসে যায়। তোকে সেইটি কত্তে হবে। যে পাঁচজন বাবুর নাম বলে দেবো, তাদের পানে চেয়ে কুর্নিশ করবি। তেনারা নিশ্চয়ই কেউ তোকে মালা কিংবা মোহর ছুঁড়ে দেবেন। দেন তো সেরকম!

হীরেমণি ওষ্ঠ উল্টে বললো, কতো! যেগুলো ফোতো, তারা মালাই বেশী দেয়।

রাইমোহন বললো, শোন, যখন ঐ পাঁচজনার মধ্যে কেউ কিচু দেবে, না হয় শুধু মালাই দিল, তখন তুই উঠে তেনার একেবারে সামনে গিয়ে চোখ ছিলোছালো করে বলবি, আমি সামান্য স্ত্রীলোক, আমার আর শিরোপা দরকার নেই, যদি আপনাদের মনোরঞ্জন কত্তে পেরে থাকি, তবে আমার ছেলেটার একটা গতি করে দিন। তারপর সব খুলে বলবি, দরকার হয় পায়ে পড়বি প্রথমেই। পারবি না?

রাইমোহনের এই পরামর্শ একেবারেই কার্যকর হলো না। সে রাত্রে ফিরে এসে হীরেমণি তাকে এই মারে কি সেই মারে! তাকে অপমানের একশেষ হতে হয়েছে। হিন্দু কলেজ কমিটির মেম্বারদের যে পাঁচজনের নাম সে করেছিল, তাদের একজনের কণ্ঠে অতিরিক্ত বাহবা শুনে এবং বারবার মালা ছোঁড়ার বহর দেখে হীরেমণি এগিয়ে গিয়ে তার বক্তব্যটি শোনাবার আগেই পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করেছিল। ব্যস, আর যায় কোথায়। সেই মহাপুরুষ অমনি অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, কী, এতবড় সাহস! একজন পতিতা তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করে? এর মানীর মান রাখতে জান না। বাঁদর যেমন লাই দিলে মাথায় ওঠে…

সব শুনে ক্ৰোধে রাইমোহনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। অনেককাল সে ধনীদের মোসাহেবী করেছে, ইদানীং যেন সব ধনীদের ওপরেই তার জাতক্ৰোধ জন্মে গেছে। সে নিষ্ঠুর হাস্যমিশ্রিত কণ্ঠে বললো, তাই! কাঁদিসনি, বুলবুল। তোর ছেলেকে আমি ঐ হিন্দু কলেজে ভত্তি করাবোই। এ নিয়ে আমি ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধাবো, তুই দেকে নিস। পিশোচের দল! পতিতা অঙ্গ স্পর্শ করলে রাগ দেখানো! লোকসমক্ষে ভণ্ডামি। আর একলা একলা ঘরের মধ্যে ঐসব বাবুরাই যে তোর মতন মেয়েমানুষের পায়ে ধরে–একে একে আমি সব হাটে হাঁড়ি ভাঙবো।–

এরপর দিনক্ষণ দেখে এক সকালে রাইমোহন চন্দ্ৰনাথ আর হীরেমণিকে নিয়ে যাত্রা করলো। সেদিন সে চন্দ্রনাথকে নিজের হাতে সাজিয়েছে, ধুতির ওপর মলমলের কুর্তা, কাঁধে মুগার উড়নি, পায়ে ইংলিশবাড়ির জুতো। চন্দ্রনাথকে দেখাচ্ছে যেন এক বিয়ের আসরের খুদে বরের মতন। হীরেমণিকেও সে দারুণ জমকালোভাবে সাজতে বাধ্য করেছে। দিনের বেলা হীরেমণির এমন সাজ কেউ কখনো দেখেনি। পায়ে জরির নাগরা, সিল্কের শালোয়ার কামিজ, তার ওপরে কাশ্মিরী মলিদা। তার দশ আঙুলে সাতটি অঙ্গুরীয় এবং ওষ্ঠ তাম্বুল রঞ্জিত। এই সাজে সে রাত্রিকালে প্রমোদভবনে যায়, অথচ আজ দিনের বেলা রাইমোহন এমন সাজেই তাকে নিয়ে যেতে চায় বিদ্যালয়ে।

একটা ভাড়া করা জুড়িগাড়ি এসে থামলো পটলডাঙ্গার মোড়ে হিন্দু কলেজ ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে রাইমোহন হীরেমণিকে বললো, যা, ছেলের হাত ধরে সটান ভেতরে ঢুকে যা। চিবুক উঁচু রাখবি, চোক মাটির দিকে নামাবিনি একবারও। যা শিখ্যে দিইচি, ঠিক তেমনটি তেমনটি বলবি। যা।

হীরেমণি বললো, তুমিও সঙ্গে চলো না। আমার যে ভয় কচ্চে!

হীরেমণিকে দেখে ইতিমধ্যেই পথে ভীড় জমে গেছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রাইমোহন বললো, কোনো ভয় নেই, চলে যা। আমি খপর নিইচি, আজ মেম্বারদের মিটিন আছে। দেখচিসনি, তেনাদের গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আচে সার বেঁধে। একেবারে সক্কিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি!

রাইমোহন নিজে তাদের ধরে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়ে আবার ফিসফিস করে হীরেমণির কানে কানে বললো, সব ঠিক ঠিক মনে আচে তো? চিবুক উঁচিয়ে একেবারে সক্কিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি। বলবি, আমার ছেলেকে ভত্তি করাতে এনিচি। আমার নাম হীরা বুলবুল, আমাকে আপনার চেনেন না? তারপর ওনারা যখন শুধোবেন, ছেলের বাপের নাম কী, তুই একে একে সকলের মুখের দিকে তাকবি। তারপর কচাং করে একবার চোখ মেরে, আলতো করে হেসে বলবি, বলবো? ওর বাবার নাম এখেনে বলাটা কি ভালো হবে? তার চেয়ে বরং লিখে নিন, ওর বাবার নাম ভগবান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *