মানিকগঞ্জের জমিদার পূর্ণচন্দ্র রায় যাবেন কলকাতা দর্শনে। বাঙাল দেশের লোক, আগে কখনো পদ্মা পার হননি, রাজধানী কলকাতা সম্পর্কে মনের মধ্যে কিছুটা ভয় ভয় ভোব আছে। কিন্তু দেশ গাঁয়ে আমোদ ফুর্তির মধ্যে কোনো বৈচিত্ৰ্য নেই, একটু বিদেশ ঘুরে আসার জন্য মন ঘুরঘুর করে। তা ছাড়া একটি মাতৃদায়ও রয়েছে। পর পর দু বৎসর উত্তম ফসল হওয়ায় আদায়-তহশিলও ভালো, সারা বাড়িতে টাকার থলিগুলি ঝামর ঝামর করে নাচে। তাই বাবু পূৰ্ণচন্দ্ৰ বিষার পরই ঘুরে আসা মনস্থ করলেন।
পূৰ্ণচন্দ্রের পিতা গত হয়েছেন অনেকদিন আগেই। তাঁর মা অনঙ্গমোহিনী ছিলেন অতি জাঁদরেল নারী, নাবালক পুত্রের হয়ে তিনিই জমিদারী শাসন করতেন অতি দক্ষতার সঙ্গে। এমনকি পূৰ্ণচন্দ্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও অনঙ্গমোহিনী একটুও রাশ আলগা করেননি, পুত্র তখন নামে মাত্র জমিদার হলেও সমস্ত কর্তৃত্ব ছিল তাঁর হাতে। বৎসর দেড়েক আগে সেই অনঙ্গমোহিনীও স্বগারোহণ করেছেন। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি পুত্রকে বলেছিলেন, বাবা পূর্ণ, মা কালীর কাছে আমার একটা মানত আছে, তুই কালীঘাটে মায়ের পূজা দিয়ে আসিস, নইলে আমার আত্মা স্বর্গে গিয়াও তৃপ্তি পাবে না।
মানতটি অবশ্য পূৰ্ণচন্দ্র সম্পর্কেই, মায়ের মৃত্যুকালে পূর্ণচন্দ্রের বয়স উনত্রিশ কিন্তু তখনও বংশে নতুন উত্তরাধিকারী আসেনি। নাতির মুখ দেখার জেদে অনঙ্গমোহিনী আট বৎসরের মধ্যে পাঁচবার পুত্রের বিবাহ দিয়েছেন। সেই পাঁচটি বধুই এ বাড়িতে থাকে। কিন্তু তারা কেউই স্বামীকে একটিও সন্তান উপহার দিতে পারেনি। কালাশৌচ কেটে যাবার পর ইয়ার বন্ধুরা পূৰ্ণচন্দ্ৰকে আর একবার দার পরিগ্রহ করার পরামর্শ দিচ্ছিল, তার আগে পূৰ্ণচন্দ্র ঠিক করলেন একবার কালীঘাটটা ঘুরে আসা যাক।
পাশের পরগণার জমিদার ইব্রাহিম শেখের সঙ্গে পূৰ্ণচন্দ্রের দোস্তি আছে। ইব্রাহিম শেখ বুঝদার লোক, ইতিমধ্যে তিনি দুবার ঘুরে এসেছেন কলকাতা থেকে। সুতরাং পূর্ণচন্দ্ৰ গেলেন তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে।
ইব্রাহিম শেখ পথের সুলুক সন্ধান দিয়ে দিলেন এবং কলকাতার এমন একটি চিত্র আঁকলেন যাতে পূৰ্ণচন্দ্ৰ একেবারে তাজ্জব। জল নাকি জমে শক্ত হয়ে যায় এবং তা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খায় কলকাতার মানুষ। আরও কতক মানুষ নাকি দিনের বেলা ঘুমোয় ও রাতের বেলা জেগে থাকে। মুসলমান মেয়েমানুষের বাড়িতে হিন্দু বাবুরা যায় এবং কসবীর আম্মাকে মা বলে ডাকে।
পূৰ্ণচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ভাইডি, একটা কথা কও তো। শুনছি, কইলকাতায় গ্যালেই সাহেবরা নাকি সক্কলডিরে ধইরা ধইরা খৃষ্ঠান কইরা দেয়? তোমারে ধরতে আসে নাই?
ইব্রাহিম শেখ অহংকারী পুরুষ, মুসলমান জাতির পূর্ব গৌরব সম্পর্কে সদা সজাগ। তিনি বললেন, আমারে খৃষ্টান করতে আইব কুন পুঙ্গির পুত? হ্যারে তার মায় এখনো জন্মো দেয় নাই।
পূৰ্ণচন্দ্র বললো, ভাই তোমাগো মুসলমানগো সাহেবরা এখনো ডরায়। কিন্তু হিন্দুগুলোর উপর নাকি খুব অইত্যাচার করে?
ইব্রাহিম শেখ বললো, দোস্ত, আমি কইলকাতা থিকা অইন্য খবর শুইন্যা আইছি। তোমাগো হিন্দুগো সর্বনাশ করতে আছে হিন্দুরাই। হিন্দু ধৰ্ম আর বুঝি রইল না। ইংরাজি ল্যাখাপড়া শিখা এক দলের মাথা বিগড়াইয়া গ্যাছে, তারা হিন্দুদের জবরদস্তি কইরা বেহ্মজ্ঞানি কইরা দিতাছে।
—কী কইরা দিতাছে?
—বেহ্মজ্ঞানি। হেডা কী বস্তু তা তোমরাই ভালো বোঝবা। আমি দ্যাখলাম, সিঁদুরিয়াপট্টিতে একদল বাবুরে দেইখ্যা রাস্তার লোকেরা বেহ্মজ্ঞানি বেহ্মজ্ঞানি কইরা তরাসে চিল্লাইতে চিল্লাইতে আগল বাগল দৌড়াইয়া পলাইয়া গ্যালো।
ইংরাজি শিক্ষার ঢেউ পূর্ব বাংলার এতদূর অভ্যন্তরে পৌঁছোয়নি। পূৰ্ণচন্দ্ৰ অতি অল্প কিছুদিন এক মুন্সীর কাছে সামান্য ফাঁসী পড়েছিলেন এবং বাংলায় নাম সই করতে পারেন মাত্র। বেহ্মজ্ঞানি কথাটার অর্থ তিনি কিছুই বুঝলেন না। বেহ্মদৈত্যের নাম শুনেছেন, সেরকমই একটা কিছু বলে মনে হলো।
ভয়ে বিবৰ্ণ মুখে তিনি বললেন, তাহলে আর কইলকাতায় গিয়া কাম নাই। জাত খোয়াইতে পারমু না। স্বৰ্গ থিক মায় আমারে অভিশাপ দিবে।
ইব্রাহিম শেখ তখন আশ্বাস দিয়ে বললেন, দুই চাইরজন পাইক লাঠিয়াল নিয়া যাও সঙ্গে। কইলকাতার মানুষ দুইডা জিনিসের বড় মাইন্য করে। পেয়াদা আর পয়সা। পেয়াদার লাঠি দাখলেই ভয়ে পলায় আর পয়সা ছড়াইলেই পায়ের উপর আইস্যা পড়ে। পয়সা ছড়াও আর লাথথি মারো, কইলকাতায় এই একটা বড় সুখ।
শুভক্ষণ দেখে পূৰ্ণচন্দ্র কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে বজরায় ভেসে পড়লেন। দিন সাতেক পর লালগোলার কাছে চড়ায় আটকে গেল সেই বজরা। সে আর কিছুতেই নড়ানো যায় না। এখান থেকে স্থলপথে তিনি পালকিতে যেতে পারেন বটে, কিন্তু ইব্রাহিম শেখ বারবার বলে দিয়েছেন, নিজস্ব বজরা না নিয়ে গেলে খাতির পাওয়া যায় না। কলকাতা শহরে। সুতরাং পুরোনো বজরা সেখানেই ফেলে রেখে, লোক লাগিয়ে দেখে শুনে একটি বজরা কিনেফেললেন এবং ভগবানগোলা থেকে সেই বজরায় আবার যাত্রা শুরু করলেন। যথাসময়ে বাগবাজারের ঘাটে এসে ভিড়লো তাঁর সেই নতুন বজরা।
এই সব ঘাটে মোসাহেব ও দালালরা সদাপ্রত্যহ ছোঁক ছোঁক করে। এখান থেকেই বাবু পাকড়াতে হয়। তীর্থস্থানের পাণ্ডাদের মতন দালাল মোসাহেবরা কে আগে কোন বাবুকে পাকড়াবে তা নিয়ে রীতিমতন প্রতিযোগিতা ও ধুন্ধুমার কাণ্ড চলে। বিশেষত বাঙাল দেশের বড়মানুষ দেখলে তাদের আমোদ আর ধরে না। বাঙাল দেশের বড়মানুষরা প্রত্যেকেই এক একটি যেন নধর পাঠা।
পূৰ্ণচন্দ্ৰ যে দুই দালালের এক্তিয়ারে পড়লেন, তাদের নিজস্ব নাম যা-ই থাক, লোকে তাদের নন্দী ও ভৃঙ্গী বলে ডাকে। সেই নদী ও ভৃঙ্গ পূর্ণচন্দ্রের বজরায় উঠে ষষ্ঠাঙ্গে প্ৰণাম করলো।
কলকাতা যতই এগিয়ে আসছিল, ততই পূৰ্ণচন্দ্রের বক্ষের ধূকপুকানি বাড়ছিল। কোন আজব জায়গা দেখবেন কে জানে! পাইক লাঠিয়ালদের প্রস্তুত থাকতে বলে তিনি উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সুরাপান শুরু করে দিলেন, বাগবাজারে এসে যখন পৌঁছেলেন তখন তাঁর টপভুজঙ্গ দশা। এই সময় তাঁর ভীরুতা, দুর্বলতা একেবারে উপে যায়, সুরাপান করলেই তিনি শের। মা জীবিত থাকতে তিনি কখনো ও জিনিস স্পর্শ করতেও সাহস পাননি, মাত্র এই দেড় বৎসরেই পূর্বেকার সব তৃষ্ণা মিটিয়ে নিয়েছেন।
রক্তাক্ত চক্ষে কামরার বাইরে এসে তিনি গর্জন করে বললেন, তোমরা কেডা? আমার বজরায় আইছ কার হুকুমে?
নন্দী ও ভৃঙ্গী হাত জোড় করে বললো, হুজুর, আমরা আপনার দাসানুদাস। আপনার সেবা করবার জন্য আমরা হাজির হইচ।
দোস্ত ইব্রাহিম শেখের পরামর্শ মনে রেখে পূৰ্ণচন্দ্র তাঁর রেশমী কুতাঁর পকেট থেকে দু মুঠো টাকা বার করে ছুঁড়ে দিলেন ওদের দুজনের সামনে। ওরা সাগ্রহে সেই টাকা কুড়িয়ে নেবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেই পূৰ্ণচন্দ্ৰ দুজনের পশ্চাৎদেশে ক্যাৎ ক্যাৎ করে দুটি লাথি কষলেন।
মারের আকস্মিকতায় ঈষৎ চমকে উঠলেও নদী ও ভৃঙ্গী বিগলিত হাসিমুখ করে রইলো। দুধেল গোরু তো মাঝে মাঝে চাঁট মারবেই।
পূৰ্ণচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগলো?
নদী ভৃঙ্গী একসঙ্গে বলে উঠলো, আহা কী কোমল আপনার পা, যেন পদ্মফুল দিয়ে গড়া। যেন ছিরিকেষ্টর পদাঘাত, আমরা হলুম গে রাধিকে। আর একবার মারুন।
পূৰ্ণচন্দ্ৰ হৃষ্ট হয়ে বললেন, বাঃ বেশ!
তারপর নিজের লোকজনদের দিকে ফিরে বললেন, দেখলি? কেমন সোন্দর কথা কয়? কইলকাতা শহরের সহবৎই আলাদা।
নন্দী ভৃঙ্গী কাজে নিযুক্ত হয়ে গেল। একটি বাসা ভাড়া করা হলো রামবাগানে। তারপর মোচ্ছব চলতে লাগলো। কয়েকদিন ধরে। বাঙালি পূৰ্ণচন্দ্ৰকে শহুরে বাবু করে তোলার জন্য নন্দী ভৃঙ্গ উঠে পড়ে লাগলো। পূৰ্ণচন্দ্রের পোশাক-আসাক ও মাথার চুল দেখলেই বাঙাল বলে চেনা যায়, কথা বললে তো আর রক্ষে নেই। রাস্তা দিয়ে দশ বারোজন পারিষদ পরিবৃত হয়ে পূৰ্ণচন্দ্র যখন চলেন, অমনি ফচকে ছোঁড়া, কুষ্ঠীওয়ালা ও গেজেল গুলিখোররা চেঁচিয়ে ওঠে, বাঙালি ভিড়েচে! বাঙালের মরণ! মাথাখানা দ্যাখ, যেন কাতলা মাছ!
এসব কথায় পূর্ণচন্দ্রের মনে বড় ব্যথা লাগে। তাই নাপিত ডেকে তাঁর চুল ছটিয়ে দেওয়া হল। নন্দী ভৃঙ্গী বোঝালো যে ঘাড়ের কাছের চুল সব ছেটে ফেললে ঘাড়ে বার্তাস লাগে, বুদ্ধি খোলসা হয়, সেইজন্যই কলকাতার সব বড় বড় বাবুদের ঘাড় ছাঁটা। বেশী চুল রাখতে হয় মাথার সামনের দিকে, সেটা হলো গিয়ে শোভা, যেমন মোরগের মাথার কুঁটি। পূৰ্ণচন্দ্ৰবাবুর পোশাক ছিল ফিনফিনে আটহাতি নতকলকা ধুতি, তার ওপর নবাবী আমলের খাজাঞ্চিদের মতন রেশমী বেনিয়ান আর পায়ে ভঁড়ওয়ালা নাগরা। এসব ছাড়িয়ে তাকে পরানো হলো দো-নলা প্যান্টালুন, লালদীঘির ধারের দোকানের আলপাকার চায়না কোটি আর গরানহাটার ইংলিশ জুতো। মাথায় হাকিমী পাগড়ি। কোটের বুক পকেটে ওয়াচগার্ড সংবলিত ঘড়ি, হাতে হীরের আংটি এবং সর্বদা সঙ্গে রাখেন ফুকো-শিশি ভরা আন্তর। এই রূপে পূৰ্ণচন্দ্র ভব্য হলেন।
বাবুর জন্য সকলরকম কেনাকাটার কাজেই দালালরা দু দফা দস্তুরি পায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী দস্তুরি মেয়েমানুষে। এই বাসা বাড়ির খুব কাছেই অবিদ্যাদের আশ্রয়স্থল। অবশ্য এ শহরের কোথাই বা তারা নেই, সর্বত্রই তাদের অধিষ্ঠান। পূৰ্ণচন্দ্ৰ এক জোড়া বড় সাদা ঘোড়া সমেত একটি ফেটিংগাড়ি কিনেছেন, সেই গাড়ি এক এক রাত্রে থামতে লাগলো এক এক বারবনিতার বাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত সুকুমারী নামী এক অল্পবয়েসী বারবনিতার প্রতি তাঁর মন মজে গেল।
সুকুমারীর বয়েস উনিশ। চিকন পাতলা গড়ন, মেম-পারা গায়ের রঙ, মাথা ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। সুকুমারীরা তিন পুরুষের বেশ্যা, তার মা চুনীবালা (ডাক নাম পোটা চুন্নি) সদ্য কাজ থেকে অবসর নিয়ে বাড়িউলি মাসি হয়েছে। সুকুমারীরও খুব পছন্দ হয়ে গেল পূৰ্ণচন্দ্ৰকে। মানুষটি বেশ আলাভোলা, যখন মদ খায় না। তখন মিনমিন করে আর একটু মদ পেটে পড়লেই অন্য চেহারা। সন্ধ্যে হতে না হতেই ব্র্যাণ্ডি আর শ্যাস্পেনের স্রোত বইতে থাকে সুকুমারীর ঘরে। নন্দী আর ভৃঙ্গী চৌ-চোঁ করে মদ গিলতে পারে এবং সহজে তারা বেহেড হয় না, তারা নানারকম সরেস গল্প বলে পূৰ্ণচন্দ্রের মন খুশী রাখে। ওদের খোঁইচি, গিইচি ধরনের কথার সব অর্থ বুঝতে পারেন না পূৰ্ণচন্দ্র, তবু শুধু কথা শুনেই হেসে গড়াগড়ি যান। নেশা বেশ খানিকটা জমে উঠলে পূৰ্ণচন্দ্র অধিকতর মজার জন্য পকেট থেকে পাঁচ দশ টাকা বার করে হুংকার দেন, নন্দী!
নন্দী অমনি বুঝতে পারে, টাকাগুলো হাত পেতে নিয়ে সুবোধ বালকের মতন পশ্চাদেশটি ঘুরিয়ে বসে আর পূর্ণচন্দ্ৰ সজোরে সেখানে লাথি কষান। তারপর ভৃঙ্গীর পালা। সত্যি, কী শুলুকাই দিয়েছে ইব্রাহিম শেখ, এমন মজা আর হয় না।
সুকুমারীও এতে দারুণ আমোদ পায়। সে বলে, ওগো, আমায় ট্যাকা দাও, আমায় ট্যাক দাও, আমিও নাতি মারবো!
ইঁদুরমুখো তরলা বাজনদারটি হাঁ করে চেয়ে থাকে। একদিন সে বলেই ফেললো, হাঁ মোশাই, আপনাদের দেশে বুঝি নাথি মারবার লোক নেই! সবাই সেখানে জমিদার?
পূৰ্ণচন্দ্র বলেন, থাকবে না। ক্যান? কিন্তু নিজের দ্যাশে লাথাথি মারায় সুখ নাই। আমার প্রজাগো আমি যারে খুশী লাথথি মারতে পারি, বাঁশ দিয়ে ডলাইতে পারি, পোঙায় হুড়কা দিতে পারি, কিন্তু হ্যারা হইল আমার প্রজা, হ্যারা তো টু শব্দও করবে না!
তবলা বাজনদারটি বলে, বুইচি, দৈনিক দু, চারটি নাথি না মেরে আপনারা জলখাবার খান না। আমরা এখেনে অনেক বাবু দেকিচ, কিন্তু এসব নথি-মারা বাবু আগে দেকিনি!
নন্দী বললো, এমন নাথি নাথি করছে কেন গা? এ হলো গে। হুজুরের স্নেহাশীর্বাদ।
ভৃঙ্গী বললো, তোর বুঝি হিংসেয় বুক জ্বলচে? চুম মেরে থাক। তবলা চাঁটানো কাজ, তবলা চাঁটা!
সুকুমারী জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ গা বাবু, তোমাদের দেশে তো শুনিচি চারদিকে শুদু জল। তোমরা এ বাড়ি ও বাড়ি কী করে যাও? সাঁতরে?
নন্দী বললো, বাবু কত বড় বজরা এনেচেন, জানিস? এই অ্যাত্তিবড়, দুখানা বাড়ির সমান। বাবুর দেশে কত নৌকো, কত বজরা, বাবু সাঁতরে যাবেন কোন দুঃখে?
ভৃঙ্গী বললো, চাদিকে জল হলে কী হবে, তার মধ্যে বাবুর রাজপ্রাসাদখানি যেন ইন্দ্রের ঐরাবত!
পূৰ্ণচন্দ্র বললেন, ঐরাবত না তোমার মাথা! আমার বাড়ি থিকা সাত মাইল দূরে ম্যাঘনা নদী, তাছাড়া সব দিক শুকনা। আমি জমিদারি দ্যাখতে ঘুরায় চইড়া যাই।
সুকুমারী জিজ্ঞেস করলো, ঘুরায়?
গুগল বললেন, হা হা, ঘুরা। ছুট ছুট ঘুরা। কিন্তু ছুট হইলে কী হয়, তাগং খুব। ঠিক যেন পংখ্যারাজ!
ছুট ছুট ঘুরা, ছুট ছুট ঘুরা, এই কথা বলতে বলতে সুকুমারী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেয়।
সুকুমারীর মা পোঁটিচুন্নি বসে থাকে পাশের ঘরে। মেয়ের ঘরে যখন বাবু থাকবে, তখন সে কক্ষনো সে ঘরে ঢুকবে না, এটাই নিয়ম। মোসাহেবরা মাঝে মাঝে মদের গেলাস ভরে হাত বাড়িয়ে পোঁটিচুন্নি র দিকে এগিয়ে দেয়।
পোঁটিচুন্নি পাশের ঘর থেকে ফিসফিস করে বললো, আ সুকু, বাবুকে বল না একদিন বাজরায় করে আমাদের ঘুরিয়ে আনতে। কতদিন বাজরায় বসে হাওয়া খাওয়া হয়নি!
পূৰ্ণচন্দ্ৰ শুনতে পেয়ে বললেন, কাইলই চলেন। মা, আপনে যখন কইতে আছেন, তখন হ্যায় আর কথা কী! কাইল ক্যান, আইজ রাইতেই চলেন!
ইব্রাহিম শেখ বলে দিয়েছিল কসবীর মাকে মা বলে ডাকতে হয়, সেটাই কলকাতার প্রথা, পূৰ্ণচন্দ্ৰ তা ভুলে যায়নি। কিন্তু ঐ মা ডাক শুনে পোঁটিচুন্নি পাশের ঘরে বসে আধ হাত জিভ কাটে।
বাইরে কোনো একটা গোলমাল হতেই পূৰ্ণচন্দ্ৰ সন্ত্রস্ত হয়ে বলে ওঠে, কেড আইল, কেড আইল? বেহ্মজ্ঞানি নাকি? অ্যাঁ?
কলকাতায় এ পর্যন্ত বেহ্মজ্ঞানিদের সঙ্গে পূর্ণচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু মনে মনে ভয় আছে এখনো। সঙ্গের দুজন লাঠিয়ালকে দাঁড় করানো আছে সুকুমারীর বাড়ির সদরে।
এর পর তিন চারদিন গেল বজরা সফরে। আমোদ-হুল্লোড় ঠিক যেমন হয়—তেমনই হলো পুরোপুরি, শুধু ছোট একটুখানি বৈচিত্ৰ্য ঘটেছিল।
বজরার ছাদে বসে ব্র্যাণ্ডির নেশায় চুরচুর হয়ে হঠাৎ পূৰ্ণচন্দ্রের আবার লাথি মারার শখ জেগে ওঠায় যথারীতি নন্দী ও ভৃঙ্গী তৈরি হয়েছিল। পেছন ঘুরিয়ে। কিন্তু ভৃঙ্গীর বেলায় লাথিটা এমন জোরে হয়ে যায় যে সে ছিটকে পড়ে গেল ভরা গঙ্গায়। কলকাতার লোক অনেকেই সাঁতার জানে না, ভৃঙ্গী বেচারা প্ৰাণেই মারা যেত, শেষ পর্যন্ত বজরার দুজন দাঁড়ি জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বাঁচায়।
দিনের মনে দিন কাটতে লাগলো। পূৰ্ণচন্দ্রের যে টাকাকড়ি ফুরিয়ে আসছে, তার খেয়াল নেই। বৃদ্ধ নায়েব সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে আনলে ফুর্তির বাধা হবে বলে তাকে নিবৃত্ত করা হয়েছে। মূখ পূৰ্ণচন্দ্র টাকাকড়ির হিসেবেও বোঝে না। সুকুমারীর নেশায় সে উন্মত্ত, দেশ থেকে টাকাকড়ি আনতে অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে বজরাটি বেচে দেওয়া হলো।
পোঁটিচুন্নি আবার একদিন মেয়ের মারফত অনুরোধ জানালো, তার খুব কালীঘাট দর্শন করবার ইচ্ছে। বাবু, দয়া করলেই তাদের কালীঘাটে যাওয়া হয়।
পূৰ্ণচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললো, বিলক্ষণ। কাইল সকালেই যামু। নন্দী, ভৃঙ্গী সব ব্যবস্থা পাক্কা কইরা ন্যাও।
সুকুমারীদের পাড়ায় একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কালীঘাট ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যায় না। সুকুমারী পূৰ্ণচন্দ্রের কাছে আবদার ধরে বললো, কালীঘাটে শুধু আমরা যাবো, আমার সই, মিতিন, গঙ্গাজল, মকর, চোকের বালি, মনের কালি, নয়নতারা এরা যাবে না?
পূৰ্ণচন্দ্র বললেন, ক্যান যাবে না? হক্কলডিই যাবে!
সুকুমারী পূৰ্ণচন্দ্রের গাল টিপে আদর করে বললো, ওরে আমার হক্কলডিরে! ওরে আমার ক্যান রে! এইজন্যই তোমায় আমার এত ভালো লাগে।
দেখা গেল, সব মিলিয়ে যাবার মানুষ আটচল্লিশ জন। নদী বললো, হুজুর, এটা আপনার একটা যোগ্য কাজ হয়েচে। তিথ্যিস্থানে বড় দঙ্গল না নিয়ে গেলে পাণ্ডারা বড় হ্যাটা করে।
ভৃঙ্গী বললো, বাবুর মন এত বড়, তিনি ছোট দঙ্গল নিয়ে যেতে পারেন। কখনো? আমাদের বাবু কোনো কিছুতেই পেচপাঁও নন।
মেছোবাজারের আড়গড়া থেকে বেছে বেছে পনেরখানি ছ্যাকরা গাড়ি ভাড়া করে আনা হলো। যার যত ভালো ভালো শাড়ি গয়না ছিল, তাতে সেজোগুঁজে ছুঁড়ি ও বুড়ি বেশ্যারা পিলপিল করে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। নিজের ফিটনখানা পূৰ্ণচন্দ্ৰ আগের দিনই বেচে দিয়েছেন, সুতরাং নিজেও একটি ভাড়া গাড়িতে সুকুমারী আর তার চোখের বালি ও গঙ্গাজলকে সঙ্গে নিয়ে উঠলেন।
কালীঘাট যেতে হলে নানাবিধ সরঞ্জাম লাগে। নন্দী আগেই একলা গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছে, সেখানে গিয়ে একটি বাড়ি ভাড়া করে সব ব্যবস্থা করে রাখবে। ভৃঙ্গী এদিককার বাজার করে নিয়ে যাবে। রাধাবাজার থেকে কিনতে হবে মদের বোতল, বড়বাজার থেকে চাল ডাল, মেছোবাজার থেকে সাজিয়ে নিতে হবে গোলাপী ও ছাঁচী পানের খিলি, মোগলের দোকানের অম্বুরি তামাক।
যথাসময়ে শহর ছাড়িয়ে ওরা কালীঘাটের গ্রামে এসে পৌঁছেলে। গাড়ি থেকে নেমেই সুকুমারী খোঁজ করলো, মা কোতা? মায়ের গাড়ি এয়েচে? পূৰ্ণচন্দ্ৰও শশব্যস্ত হয়ে বললেন, মায়ের গাড়ি ঠিকঠাক আইছে তো? মায়ের কষ্ট হয় নাই তো!
পোঁটিচুন্নি পাখা দিয়ে বার্তাস খেতে খেতে সদ্য ভাড়া করা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বললো, এই তো। আমি। এসো বাছা, প্রথমে বসে একটু বিচ্ছাম নাও।
অনেক দূরের পথ, গাড়িতে বসে আসায় বেশ পরিশ্রম হয়েছে। সুকুমারী বিবি রুমালে মুখ রগড়ে রগড়ে মুখ একেবারে লাল করে ফেললে। নন্দী একটা গেলাসে ব্র্যাণ্ডি ঢেলে তাতে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে ধরলে সুকুমারীর মুখের কাছে। বিবি অমনি চটে উঠে বললো, তোমরা সহবত শেকোনি গা? মিতিন, মকর, গঙ্গাজল এরা সব রয়েচে, তাদের না দিয়ে তুমি প্রথমেই আমাকে দিলে? নিজেরা আগে টেনে বসে আচো, বাবুর যে গলা শুকোচে, সে খেয়াল নেই?
কালীঘাটে এসে এক দণ্ড বাইরে তিষ্ঠোবার উপায় নেই। পাল পাল কাঙালী এসে ছেঁকে ধরে। এ ছাড়া পুজুরি বামুন, রাঁধুনি বামুন, আরও হাজার রকমের উমেদার। কেউ খ্যাংরা-ইিণ্ডপো, কেউ গামছা-কাঁধে, কেউ ধামা-মাথায়। চতুর্দিকে একেবারে চিলুবিলু অবস্থা। বড়বাজারের দোকানে পাকানো পৈতে বিক্রি শুরু হবার পর শহরে বামুন খুব বেড়ে গেছে, কালীঘাটে এখন কাঙালী বেশী না বামুন বেশী, তা বোঝা ভার।
দোতলায় কাপেট বিছানো ঘরে এসে বসে পূৰ্ণচন্দ্র একটু জিরোতে লাগলেন। সুকুমারীর সইয়েরা বার্তাস করতে লাগলো। তাঁকে। নন্দী ভৃঙ্গী এসে সুরার গ্লাস তুলে দিল হাতে। পোঁটিচুন্নি দরজার আড়াল থেকে মৃদু ভর্ৎসনা দিয়ে বললো, আ সুকু, এসেই তোরা টানতে বসে গিলি? পুজো আচ্চার ব্যবস্থা করতে হবে না!
নন্দী বললো, পুজো তো ওবলা? এখন কী? এবালা পাঁচটা উনুন ধরিয়েচে।
পোঁটিচুন্নি বললো, ওমা, সে কি কতা! মন্দিরের ঘণ্টা শুনতে পাচ্চি, আর ও পোড়োরমুখো বলে কি না পুজো ওবলা? কালীঘাটে এসে আগে পুজো দিতে হয়, তার পর অন্য কিচু।
ভৃঙ্গী বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, পুজোর ব্যবস্থা করচি। আমি বামুন পাণ্ডা ধরে আনচি।
ভৃঙ্গী বাইরে থেকে কোরা থান পরা, পৈতের গোছা গলায়, মাথায় মস্ত টিকি, খড়ম পায়ে একজন বেশ বিশ্বাসযোগ্য চেহারার বামুনকে ডেকে আনলো। পোঁটিচুন্নি বললো, ওমা, কী হবে! আসবার সময় আমি যে তাড়াতাড়িতে সিন্দুক খুলেও টাকা বার করতে ভুলে গ্যাচি! আমি যে পুজো মানত করেচিলুম, কী করে পুজো দেবো?
পূৰ্ণচন্দ্র বললেন, একথা বলে বড় লইজ্জা দিলেন মা। আমার টাকাও যা, আপনের টাকাও তা। এই ন্যান, কত লাগবে?
পকেট থেকে কুড়ি পঁচিশ টাকা। যা ওঠে তাই পূৰ্ণচন্দ্ৰ দিয়ে দিলেন নদীর হাতে। নদী তার থেকে পাঁচ টাকা সরিয়ে বাকিটা দিল পোঁটিচুন্নিকে। পোঁটিচুন্নি আবার তার থেকে বেশ কিছু সরিয়ে মোট সাতটি টাকা দিল বামুনকে। তাই পেয়েই বামুনের এক গাল হাসি। দুটো ছোট গোছের পাঠা, দু সরাতে আধাসেরটাক চিনি, একছড়া মন্দির বেড়া জবাফুলের মালা, কুনকেটাক আলো চাল, গোটা দশেক কাঁঠালি কলা, একটু ঘি, একটু সিঁদুর—সব মিলিয়ে মোট আড়াই টাকার জিনিস কিনে মন্দিরে গিয়ে পুজো চড়িয়ে এলো।
এদিকে ভাড়া বাড়ির একতলায় বড় বড় উনুনে খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে, আর দোতলায় বোতলের পর বোতল উড়ছে। বোতল শুধু ওড়ে না, একসময় গড়ায়, তখন মানুষগুলোও গড়ায়। একজন গড়ালে অন্যজন তাকে টেনে তোলবার চেষ্টা করে, তারপর সেও গড়িয়ে যায়। কালীঘাটে এসে এতটা বাড়াবাড়ি পোঁটিচুন্নির পছন্দ হচ্ছে না; তার বয়েস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মে মতি হয়েছে। সে এসে মাঝে মাঝে বকুনি দিয়ে যাচ্ছে ওদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুকুমারীর সাইরা সব এক একজন মোসাহেবের পাশে বসে গলা জড়াজড়ি করছে। নদী আর ভৃঙ্গী মাঝে মাঝে বলে উঠছে, ওফ, এত ফুর্তি বহুত দিন হয়নি। ধন্য আমাদের পূর্ণচন্দ্রবাবু!
রান্না শেষ,নীচতলার চাতালে জল ছিটিয়ে পাত পাড়া হয়ে গেছে, কিন্তু কে খেতে যাবে? ওপরের বাবু বিবিদের খাওয়ার কথায় হুঁশ নেই। কেউ ডাকতে এলেও তারা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। চাকর-নফর,পাইক আর অন্যরাগাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে লাগলো গরম খিচুড়ি, রুই মাছের কালিয়া, পাঠার পোলাও,আলুর দম, হাঁসের ডিম, তালদা বাঁশের চোঙায় জমিয়ে ধোঁকা। বেলা গড়িয়ে বিকেল পড়ে এলো।
মদের বোতল সব শূন্য, তবু পূৰ্ণচন্দ্রের তৃষ্ণা মেটেনি। এলানো অবস্থায় সে বললো, কই বাপ নন্দী, কই বাপ ভৃঙ্গী, গেলাস যে খালি। শ্যাম্পেন কার্ক খোলার ফটাফট মধুর আওয়াজও বন্ধ। কী হইলো তোমাগো?
নদী বললো, হুজুর টাকা দিন!
পূৰ্ণচন্দ্র বললেন, টাকা চাই? কত টাকা?
এবার পোঁটিচুন্নি সত্যিকারের রেগে গিয়ে বললো, হ্যাঁ গা, কী আক্কেল তোমাদের? কাঁড়ি কাঁড়ি রান্না হলো, কিছু খেলে না। গঙ্গায় নাইলে না, মায়ের দর্শন করলে না, এ কেমন ধারা ব্যাভার? সন্ধ্যে হয়ে এলো। আগে দুটি খেয়ে নাও!
পূৰ্ণচন্দ্ৰ বীরবিক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না খামু না! মায়ের দর্শন করতে যামু। উপাস কইরাই পূজা দিতে হয়, তয় তো পুইণ্য হবে! আগে মায়ের দর্শন, তারপর আইন্য কথা! চলো, সুকুমারী!
সুকুমারী দুপা চলতে গিয়েই লুটিয়ে পড়ে গেল। একেবারে জ্ঞানহারা। তাকে একটুক্ষণ টানাটানি করেও কোনো সুবিধে হলো না। পোঁটিচুন্নি বললো, থাক, ওকে ছাড়ো, ওর আর ক্ষ্যামতা নেই।
পূৰ্ণচন্দ্রের মনে একটা আঘাত লাগলো। এত দূর এসেও সুকুমারী তার সঙ্গে মন্দিরে যাবে না? এত খরচাপাতি করে মেয়েমানুষ রেখে তাহলে লাভ কী হল? পূৰ্ণচন্দ্রের মস্তিষ্কের নেশাগ্ৰস্ত যুক্তিতে মনে হলো যে সুকুমারী যেন ইচ্ছে করেই ভিরমি খেয়ে পড়ে আছে। দু-একবার সে তাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সুকুমারীর মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরুচ্ছে।
তখন পূৰ্ণচন্দ্র বললেন, তয় আমি একলাই যামু।
সিঁড়ি দিয়ে দুপ দাপ করে তিনি নেমে এলেন। নন্দী, ভূঙ্গী এলো সঙ্গে সঙ্গে। নীচতলার লোকগুলো নেশা করেনি বটে কিন্তু প্ৰচণ্ড রকম খিচুড়ি মিচুড়ি খেয়ে পেট মোটা করে শুয়ে আছে। লাঠিয়াল দুজন ঘুমন্ত। পূৰ্ণচন্দ্র ওদের আর ডাকলেন না। রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলেন ভিড় ঠেলে। পা দুটি টিলমল করলেও তাঁর শরীরে যেন মত্ত মাতঙ্গের শক্তি। নদী, ভৃঙ্গী কাঙালীদের হঠাতে লাগলো।
পূৰ্ণচন্দ্র মন্দিরে এসে উঠলেন। হঠাৎ তাঁর মনটা বিষাদে ভরে গেছে। মনে পড়েছে স্বৰ্গগত। জননীর কথা। মায়ের মৃত্যুশয্যার অনুরোধেই কালীঘাট দর্শনের জন্য কলকাতায় আসা। অথচ এতদিনে কালীঘাট দর্শনের কথা মনেও পড়েনি। সেই কালীঘাটে আসতে হলো কিনা সুকুমারীর কথায়! আর সে কেশ্যামাগীও এমন নিমকহারাম, শেষ পর্যন্ত সঙ্গে এলো না!
পূৰ্ণচন্দ্ৰ চেঁচিয়ে উঠলেন, মা, মা, আমি তোমার কুপুত্র। আমি মহাপাতকী।
মন্দিরের পুরুতরা চেহারা ও বেশবাসের চাকচিক্যে পৰ্ণচন্দ্ৰকে একজন বেশ বড় গোছের বাবু ঠাউরে অন্য লোকজনদের সরিয়ে সাগ্রহে বলতে লাগলো, আসুন, আপনি সামনে আসুন। আপনার গোত্র কী?
পূৰ্ণচন্দ্র এগোতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন। আর অমনি মুখ দিয়ে হড়হাড়িয়ে বমি বেরিয়ে এলো। তাতে অসহ্য দুৰ্গন্ধ। পুরোহিতরা চেঁচিয়ে উঠলো, দিলে দিলে, সব কিছু নষ্ট করে দিলে। কী আপদ! এ মাতালকে সরাও!
নন্দী, ভৃঙ্গী হাত ধরে তুলে দাঁড় করালো পূৰ্ণচন্দ্ৰকে। তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বিড়বিড় করে বারবার বলছেন, আমি মহাপাতকী, মহাপাতকী! ওগো, আমার মা কী যেন মানত কইরা ছিল, তোমাগো মনে আছে?
নন্দী ভৃঙ্গী বললো, হুজুর, আপনার মায়ের মানত আমরা জানবো কী করে!
পূৰ্ণচন্দ্রের দারুণ কষ্ট হচ্ছে, কিছুতেই একটা কথাও মনে আসছে না।
পুরুতরা বললো, দক্ষিণা যা দেবার দিয়ে একে এবার এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও না!
দক্ষিণার কথা শুনে পূৰ্ণচন্দ্ৰ পকেটে হাত দিলেন। পকেট শূন্য। অসহায়ভাবে ঘোলাটে চোখে নন্দী আর ভুঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, টাকা? আমার টাকা নাই? তোমরা আমারে টাকা দেব? আমি মায়ের দক্ষিণা দিতে পারমু না?
নন্দী, ভৃঙ্গী বললো, হুজুর, আমরা ট্যাক পাবো কোথায়? আমাদের কি ট্যাকা থাকে?
হাত থেকে হীরের আংটিটা খুলে প্ৰণামীর থালার ওপরে ছুঁড়ে দিলেন পূৰ্ণচন্দ্র। তারপর ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন। নন্দী, ভৃঙ্গ ওঁকে ধরাধরি করে চত্বরে নিয়ে এলো।
একটু সামলে পূৰ্ণচন্দ্র বললো, আমি আর এ মাগীগো কাছে যামু না। আমি বাড়ি যামু। আমার দ্যাশে যামু। আমারে গঙ্গার ধারে নিয়ে চলো, আমি গঙ্গাস্নান কইরা শুদ্ধ হামু।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এখন আর স্নানটানের ঝামেলায় নন্দী, ভূঙ্গী যেতে চায় না। তারা অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু অতিশয় নেশাগ্ৰস্ত অবস্থায় পূৰ্ণচন্দ্ৰ বোধশক্তিহীন গোয়ার হয়ে গেছেন। তিনি যাবেনই স্নান করতে।
অগত্যা নন্দী আর ভৃঙ্গ ওঁকে নিয়ে চললো টানতে টানতে। পূৰ্ণচন্দ্রের আর চলার শক্তি নেই, চেতনাও আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার একেবারে কাছাকাছি এসে আর পারলেন না, একেবারে পাথর হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। আদি গঙ্গার ঢালু পাড়ে তার মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে রইলো।
নন্দী ভৃঙ্গীকে বললো, থাক, এখানেই পড়ে থাক। এ ব্যাটা ছিবড়ে হয়ে গ্যাচে!
ভৃঙ্গী বললো, দ্যাক না, ট্যাঁকে কিছু নুকোনো আচে কিনা!
দুজনে হাঁটু গেড়ে বসে ভালো করে পুর্ণচন্দ্রের টাঁক ও পকেট পরীক্ষা করে দেখলো। না, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং এর জন্য আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না ভেবে চলে যেতে গিয়েও দুজনে আবার থমকে দাঁড়ালো। দুজনের মনে একই কথা এসেছে। ব্যাটার জামাকাপড়গুলোও তো দামী, সেগুলিই বা বাদ থাকে কেন? কাছে ফিরে এসে ওরা পূৰ্ণচন্দ্রের সমস্ত পোশাক খুলে নিল। পায়ের জুতো জোড়া পর্যন্ত। সব কিছু নিয়ে একটা পুঁটলি বেঁধে উঠে দাঁড়ালো দুজনে।
আবার ওরা চোখাচৌখি করলো। ঠিক একই কথা আবার দুজনের মনে এসেছে। দুজনে দুপাশে সরে গিয়ে পূৰ্ণচন্দ্রের নগ্ন নিতম্বে সপাটে লাথি কষালো কয়েকবার।