সন্ধের মুখে আবার একদিন গুপী স্যাকরার দোকানের ঝাঁপ ঠেলে ঢুকলো রাইমোহন। গুপী তখন বেরুবার উদযোগ করছিল, রাইমোহনকে দেখে বসে গেল।
—ঘোষালমশাই যে! বহুৎদিন পায়ের ধুলো দ্যাননি ইদিকে। ভাবলুম বুঝি গরীবকে ভুলেই গ্যালেন।
বেতের মোড়ায় হাঁটু উঁচু করে বসে পানের ডিবে বার করলো রাইমোহন। গুপীকে একটি দিয়ে, নিজে একটি মুখে পুরে বললো, দিনদিন যত গরীব হচ্চিস গুপী, তেমি তোর ভূড়িখানাও তো দিব্যি নেওয়াপাতি হচ্চে বেশ!
—ওদিকে নজর দেবেন না! গরীবের তো এটাই সম্বল। আরও বেশী দুদিনের জন্য জমিয়ে রাখতে হয়।
—বসত বাড়িটে একতোলা থেকে দোতোলা করিচিস দেকলুম যানো!
—সেইজন্যই তো হাত একেবারে খালি। বাড়ি কত্তে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হলুম।
—এমন সর্বস্বান্ত হওয়াও ভাগ্যের কতা। তা একদিন বাড়িতে ডেকে নুচি মণ্ডা খাওয়া! তোর বাড়ি মানে তো আমাদের বাড়ি, আমাদেরই টাকায় করিচিস যখন–
—আপনাদের মতন লোক এই অধমের কুঁড়েতে আসবেন, এ তো মহাভাগ্যের কতা। কবে পায়ের ধুলো দেবেন, বলুন!
—সহজে দিতে পারবো না, অ্যাখন পায়ের ধুলো বড় আককারা, যা বৃষ্টি বাদলা চলছে। আমাদের এই চিৎপুরের রাস্তায় তো মেঘ ডাকলেই হাঁটু জল। পদ কাদা দিতে পারি।
—তাই-ই দেবেন না হয়। আপনার পা ধুয়ে একটু চরণামৃত খেয়ে নেবো।
–কী ব্যাপার রে, গুপী! এত খাতির কচ্চিস কেন রে আমাকে? অতি ভক্তি কিসের লক্ষণ য্যানো।
—আপনাকে খাতির করবো না তো করবো কাকে? আগে পায়ে হেঁটে ঘুরতেন, তারপর দেখলুম পালকি ধরেছেন, অ্যাখুন। আবার দেখচি জুড়ি গাড়ি হাঁকাচ্চেন। গত মঙ্গলবার আমার পাশ দিয়ে ধাঁ করে চলে গেলেন, আমি কত ডাকাডাকি কল্পম, আপনি গেরাহ্যিই কল্লেন না। তবে বড় খুশী হইচি, আপনার উন্নতি দেখলে আমাদেরও আনন্দ হয়।
—র, র, আর কাঁটা দিন সবুর কর, আরও কত দেকবি! এই তো সবে ছিপ ফেলিচি। অ্যাখুন। জুড়ি গাড়ি হাঁকাচ্চি, এরপর দেকবি তেঘূড়ি চৌঘুড়ি হাঁকাবো, নিজের, একেবারে নিজের!
—সিদিনকে তবে কার গাড়িতে যাচ্চিলেন? আপনার নিজের নয়!
—না রে, পাগলা।। ও গাড়ি রামকমল সিংগীর।
—সিংগী বাড়িতে আবার ভিড়লেন কবে? এই যে কদিন খুব সরকার মশায়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি কচ্চিলেন। তেনাকে ছেড়ে এবার বুঝি রামকমল সিংগীকে ধরলেন?
—ছাড়িনি, তেনাকেও ছাড়িনি। দুজনকে দু হাতে খেলাচ্চি বুজলি, পুকুরের দু ঘাটে চার ফেলিচি।
—তাহলে আপনাকে একটা কাজ কত্তেই হবে আমার জন্যে। বাবু রামকমল সিংগী শুনলুম শিগগীরই ছেলের বে দিচ্চেন। কিছু না হোক, লাখখানেক টাকা খরচ হবে নিশ্চয়!
—লাখখানেক কি রে ব্যাটা! এক লাখ তো আমার মতন বারো ভূতে লুটেপুটেই খাবে। শুনচি, গয়নার হিসেবই হয়েছে আড়াই লাখ।
—ঘোষালমশাই, ওর থেকে আমায় কিছু কাজ ধরে দিতেই হবে। হাজার পঞ্চাশেক পেলেই আমার যতেষ্ট।
নিঃশব্দ হাসিতে রাইমোহনের মুখখানা কুঁচকে গেল। তার হাসির মধ্যেও খানিকটা হিংস্ৰতা আছে। এই পৃথিবীর কাছে কখনো নিজে জব্দ হয়ে যাবার আগেই সে নানারকম বুদ্ধির প্যাঁচ খেলিয়ে দিতে চায়।
বাঁ হাতটি তুলে গুপীর দিকে অভয় মুদ্রা দেখিয়ে সে বললো, এই কতা! মোটে পঞ্চাশ হাজার পেলে তুই সন্তুষ্ট?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
—যদি আরও বেশী কাজ দিই?
–সে আপনার দয়া।
—বিধু মুকুজ্যেও মেয়ের বে লোগাবে, সে খপির শুনিচিস?
—কোন বিধু মুকুজ্যে? যিনি বড় উকিল?
–হ্যাঁ, আমাদের রামকমল সিংগীর ফে ফি গা—কী বললেন?
—ফেরেণ্ড, ফিলজফার অ্যাণ্ড গাইড। এটুকুও জানিস না?
—এসব জানলে তো আমিও বাজারে নেমে পড়তুম। মুখ্যু বলেই না। সারাদিন আগুনের ধারে বসে হাঁপর চালাই।
—সেই বিধু মুকুজ্যের বাড়ির কাজেরও বায়না। যদি জোগাড় করে দিই?
—তাহলে আপনাকে রোজ দু বেলা পেন্নাম ঠুকবো!
—শুধু পেন্নাম! হিস্যে দিবি না ব্যাটা বজ্জাত!
–সেও আপনার দয়া। আপনি হিস্যে চাইলে কি আর আমি কখনো না বলতে পারি?
—টাকায় এক আনা বাট্টা দিবি তো বল এখন থেকেই কাজে লেগে যাই। সিংগী বাড়িতে মাধব স্যা করার কাজ বাঁধা।
দপ করে জ্বলে উঠলো গুপী। আর পাঁচজন নিরীহ, দুর্বল মানুষের মতন সে-ও নিজের পেশায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম সহ্য করতে পারে না। ইদানীং স্বর্ণকার হিসেবে মাধবের খুব খ্যাতি। আন্দাজে ঢ়িল ছোঁড়ার মতন রাইমোহন ওর নামটা তুলেছে।
—মাধব! সে তো এক নম্বুরি চোর। বিষাকুম্ভ, বুঝলেন ঘোষালমশাই, বিষাকুম্ভ, এই বলে দিলাম আপনাকে। ও গুখেগোর ব্যাটাকে কেউ সেঁকো বিষ খাওয়াতে পারে না!
—তবেই বোজ! মাধবকে সরানো চাট্টিখানি কতা নয়। দস্তুর মতন মেহনৎ করতে হবে, বুদ্ধি খচৰ্গ করতে হবে। কিছু আগাম দে!
–আজ্ঞে?
—একবার বললে বুঝি কতা বুঝিস না? দুবার তিনবার করে বলতে হবে? কিছু আগাম দে আমায়। এত বড় একটা কাজের পত্তন করবো, কিছু মালকড়ি ছাড়তে হবে না?
—আগাম! এখন তো আমার হাতে কিচু নেই। আগে কাজ করি, বাবুদের কাঁচ থেকে পয়সা পাই, তারপর কড়ায় ক্রান্তিতে আপনার হিস্যে বুঝে দেবো।
—আরে ব্যাটা, আগে দারোয়ানগুলোনকে হাত কত্তে হবে না? সেজন্য খচাঁপাতি নেই? এসব বড় বড় বাড়ির দারোয়ানরা এক একজন কাঁচাখেকো দেবতা, এদের খুশী না করে কিছুটি করার উপায় নেই।
—ঘোষালমশাই, বিশ্বাস করুন, হাত একেবারে খালি।
—দে দে ব্যাটা, বেশী ভ্যানতাড়া করিস না, শুভ কাজে অমন ব্যাগড়া দিতে নেই, অন্তত পঞ্চাশটা টাকা বার কর।
—আজ নয়, আর একদিন বরং—
–তবে কি মাধবের কাচে যাবো বলতে চাস? তোর ভালো চাই বলেই বলচি, নইলে আগ বাড়িয়ে আমার এত গরজ দেকাবার ঠ্যাকাটা কী? সিংগী বাড়িতে একবার যদি ঢুকতে পারিস-টিকটিকি হয়ে ঢুকবি, পাঁচ বছর বাদে কুমির হয়ে বেরিয়ে আসবি!
—তবে আজ তিরিশ টাকা নিন!
—অ্যাই তো! অমনি দরদরি শুরু করে দিলি। স্বভাব যায় না মলে, অভাব যায় না ধুলে। স্বভাবটা যাবে কোতায়! লাখ লাখ টাকার কারবার, আর তুই দশ-বিশ টাকা নিয়ে ঝামেলা কচ্চিস।
—পঁয়তিরিশ নিন। তার বেশী আজ আর কিছুতেই দিতে পারবো না!
—আর একটু ওঠ। আর একটু বাড়। আচ্ছা বেশী কতার দরকার নেই। দে, পঁয়তাল্লিশই দে। বাকি পাঁচ টাকা তোর ছেলে-মেয়েদের আমি মোয়া মিছরি খেতে দিলুম।
অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গা মোচড়া-মুচড়ি করতে করতে গুপী কাঠের ক্যাশ বাক্সটা খুললো। ঘর থেকে টাকা বার করে দিতে গুপীর যেন হাড় পাঁজরা ভেঙে যায়। কিন্তু উপায়ও তো নেই, রাইমোহন ঘোষালের সঙ্গে সে কথায় এঁটে উঠতে পারবে না। কাজটাও বড় বেশী লোভনীয়। এই সব বড় মানুষদের বাড়ির একটা বিয়ের কাজ করেই অনেকে ভাগ্য ফিরিয়ে নেয়! মাধবের নাম করেই রাইমোহন গুপীর একেবারে ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছে। মাধবের কাছ থেকে কাজ কেড়ে নেবার আনন্দে গুপী পঞ্চাশ একশো টাকা অনায়াসে জলাঞ্জলি দিতে পারে।
টাকাগুলো গুণে বেনিয়ানের জেবে ভরে নিয়ে রাইমোহন তৃপ্তির হাসি হাসলো। নিজের কৃতিত্বে সে নিজেই মুগ্ধ। উদারভাবে সে আবার পানের ডিবেটা বাড়িয়ে দিল গুপীর দিকে।
—তাহলে কাজ ঠিক হাসিল হবে তো, ঘোষালমশাই?
—তুই নিশ্চিন্তি থাক। তোর বাড়ি এবার তিনতোলা হলো বলে!
—আজ মাল আনেননি কিচু?
–নাঃ!
—তাহলে এবার গা তোলা যাক। আজ খবর-টবরও কিচু শোনালেন না।
—বোস, আরও কাজ আচে। খবর আর কী, দেশে মড়ক লেগেচে, ওলাউঠোয় কত মানুষ পটাপট মরে যাচ্চে! লোকে মড়া পুড়েবারও ফুর্সোৎ পাচ্চে না। গঙ্গায় হাজারে হাজারে শব ভাসচে। দেকে আয় গে, সে এক দ্যাকার মতন জিনিস!
—রাম কহো! ও আবার কেউ দোকতে যায়!
–ঘাটে এত মড়া ভাসচে যে সাহেবরা জাহাজ ভিড়োতেও পাচে না। বড় বড় কত্তারা এই নিয়ে মিটিং কত্তে লেগেচে। এমন মড়কের কথা জন্মে শুনিনি। এর মধ্যে শুনলুম দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেত থেকে ফিরলেন।
গুপী চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলো, বলেন কী? উনি বিলেত গেলেন কবে? কিচুই শুনিনি তো! কালাপানি পেরুলেন? জাত ধম্মো সব জলাঞ্জলি দিলেন?
—ওঁর আর জাত ধম্মো আচে কী? বড় মানুষদের জাতে কখনো ফোস্কা পড়ে? কেউ পাঁতি দিতে গেলে তাদের গায়ে চাঁদির জুতি কষাবেন, অমনি সব ঠিক হয়ে যাবে। ওঁর গুরুঠাকুর কালাপানি পেরিয়েছেল আর উনি পেরুবেন না? যাকগে, শোন, এক ছড়া সোনার হার দে তো আমাকে। ছোট হলেই চলবে, বেশী বড়র দরকার নেই।
—হার? আপনি কিনবেন?
গুপী যদি অতিরিক্ত বিস্ময়াপন্ন হয়ে পড়ে, তা হলেও তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। রাইমোহনই এদিক সেদিক থেকে হাত সাফাই করে আনা সোনার জিনিস বিক্রয় করে গুপীকে। বস্তুত সেই উপলক্ষেই তার এখানে পদাৰ্পণ ঘটে। আজ ঠিক তার বিপরীত ব্যাপার সঙঘটিত হচ্ছে।
—হ্যাঁরে ব্যাটা, আমি কিনবো। কেন, ক্ষ্যামতা নেই নাকি আমার সোনা কেনার?
—না, বলছিলুম কি, আপনি নিজেই আবার বে-শাদী কচ্চেন নাকি?
—কতা বাড়াসানি। তোর কাচে হারটার কী আচে দ্যাকা, আমার তাড়া আচে।
গুপী ছোট বড় নানা মাপের চার পাঁচটি হার বার করলো। কোনোটিতে পাথরের লকেট বসানো, কোনোটি সাধারণ নক্সাকাটা। এর মধ্যে থেকে একটি ছোট মফচেন তুলে নিয়ে রাইমোহন জিজ্ঞেস করলো, এটা ওজন কর, দ্যাক কতোটা সোনা–
হারটি ছোট হলেও বেশ ভারী, পুরো দেড় ভরি। গুপী তার দর হাঁকলো পয়ত্ৰিশ টাকা। রাইমোহন তাই শুনে গুপীর খুতনিটা নেড়ে দিয়ে বললো, বা বা বা বা বা বা! বলিহারি। আক্কেল রে! আমি বেচিতে এলে বলবি উনিশ টাকা ভরি, তার বেশী একটা আধলা না, আর আমাকে তুই বেচাবি বেশী দরে? অ্যাঁ?
—আজ্ঞে আমার বানিটা ধরবেন তো!
—চশমখোর, আমার কাছ থেকেও বানি চাইচিস!
অনেক দরাদরি করে বত্ৰিশ টাকায় রফা হলো। গুপী তার কমে কিছুতেই দেবে না। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইমোহন বললো, আচ্ছা দে! আর পারি না তোর সঙ্গে।
ছোট বাক্সে হারটি ভরে দিতে দিতে গুপী বললো, কিন্তু ঘোষালমশাই, এত ছোট হার তো কোনো হুরী-পরীর গলায় মানাবে না। লাল পাতর বসানোটি নিলে পাত্তেন, বেশ দ্যাখানদার ছিল।
—তার দামটিও যে দ্যাখানদার! দে, দে, ওতেই হবে! তোকে আর ফোঁপরন্দালালি করতে হবে না।
—কার গলায় পরাবেন?
—চুপ মার!
রাইমোহন যেন একটু লজ্জা পেয়েছে মনে হয়। আর কথা বাড়াতে চায় না। মোড়া থেকে টক র উঠে পড়লো, আর সঙ্গে সঙ্গে ওঁতে খেল মাথায়। তার দৈর্ঘ্যের তুলনায় এ ঘরের ছাতটি যে নীচু, সে কথা তার প্রায়ই মনে থাকে না।
—চলি রে, গুপী!
–দামটা দিলেন না?
—অ! ভুলেই গিসলাম। আমি নগদানগদির কারবারই পছন্দ করি। ধারধোর রাখা আমার স্বভাব নয়।
বেশ সাড়ম্বরে রাইমোহন একটু আগে গুপীরই দেওয়া সিকাগুলি বার করলো জেব থেকে। গুণে গুণে বত্ৰিশ টাকা তুলে দিল গুপীর হাতে। তারপর কৌটোটি ট্যাঁকে গুঁজে নিষ্ক্রান্ত হলো।
এবার গুপীও মুচকি হাসলো একটু। সব দুঃখেরই সান্ত্বনা আছে। রাইমোহন চিনতে পারেনি। এই হারটিই রাইমোহন কিছুদিন আগে গুপীর কাছে বিক্রি করে গিয়েছিল আঠাশ টাকায়। গুপী তার ওপর চার টাকা লাভ রেখে দিল। ভাগ্যে না থাকলে এরকম দাঁও জোটে না।
রাইমোহনের গন্তব্য বউবাজার। গুপীর দোকান থেকে বেরিয়েই অদূরেই পথে পড়লো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। সেদিকে তাকিয়ে রাইমোহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এই বাড়িটির ওপর তার রাগ আছে। রাইমোহন এ বাড়িতে ভিড়তে গিয়েছিল, কিন্তু ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এসেছে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়ি গতায়াত করতে পারলে দেশের দশটা লোকের কাছে ইজত বাড়ে। রাইমোহনের কাকা দ্বারকানাথের বয়স্য ছিলেন। তিনি অকালে চোখ বুজেছেন। খুড়োর জায়গায় উপযুক্ত ভাইপোরই কাজ পাবার কথা। তা দ্বারকানাথ তো এখন আর দিশী লোকদের আমোলই দ্যান না। সাহেবসুবো ছাড়া কথা নেই, ঘুরে এলেন খোদ সাহেবদের মুলুক থেকে। সে যাই হোক, তাঁর ছেলে দেবেন্দ্ৰ এখন লায়েক হয়েছে, বিষয়কর্ম দেখছে, তাঁরাও এখন পারিষদের প্রয়োজন। গোড়ায় গোড়ায় দেবেন্দ্ৰবাবু যেরকম ফুর্তি-ফাতা শুরু করেছিল, তাতে বেশ আশা হয়েছিল রাইমোহনের। কয়েকবার সে ঘুরঘুর করেছিল দেবেন্দ্ৰবাবুর আশেপাশে। কিন্তু ঠিক পাত্তা পায়নি। দেবেন্দ্ৰবাবুর নাকি মতিগতি বদলে গেছে, মদ মেয়েছেলেতে আসক্তি নেই, নাচ গানের আসর বসান না, পুরুষমানুষের যোগ্য কাজ কিছুই করেন না। সংস্কৃত শেখার খুব ঝোঁক হয়েছে নাকি। এটা একটা অন্যায় কথা নয়? অত বড় বংশের ছেলে, একটু আধটু বখামি না করলে আর পাঁচজন লোকের অন্ন সংস্থান হবে কী করে? দেবেন্দ্রবাবুকে বাইরে আর প্রায় দেখাই যায় না, কিছু মেনিমুখো মদার সঙ্গে দিনরাত কী সব গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুর করেন। রাইমোহন ঠিক তাল ধরতে পারছে না। লোকে বলাবলি করছে, দ্বারকানাথের মোসাহেবরা এক একটি গড়র পক্ষী, আর সেই মানুষের ছেলে হয়ে দেবেন্দ্রবাবু চাট্টি বায়স পুষিছেন।
রাইমোহন মনে মনে বললো, কেটে যাবে, এসবও কেটে যাবে। এসব নিরিমিষ্যি ভড়ং আর কতদিনের। জমিদার বাড়ির ছেলে রক্ত চাটবে না। এ কখনো হয়?
জানবাজারে কমলাসুন্দরীর বাড়িতে আজ দারুণ আসর জমেছে। লখনৌ থেকে কালোয়াতী গানের এক ওস্তাদ আর তবলা বাজনাদার আনিয়েছেন রামকমল সিংহ। এ সবই কমলাসুন্দরীর মনোরঞ্জনের জন্য। কমলাসুন্দরীর নৃত্যের খ্যাতি দিকবিদিক ছড়িয়েছে, সে আরও তালিম নিতে চায়। ব্যয়ের ব্যাপারে রামকমল সিংহের কোনো কার্পণ্য নেই। কমলাসুন্দরীর যে-কোনো আবদার তিনি রক্ষা করতে প্ৰস্তুত। বাবু তো বাবু রামকমল সিংহ। এ কথা স্বীকার করছে সকলে। পাঁচজন লোক ডেকে নিজের রক্ষিতার নাচ দেখানো এমন কাজ আগে কেউ কখনো করেনি। বাঈ নাচের আসর বসাতে হলে সকলেই বাঈজী ভাড়া করে আনে, নিজের মেয়েমানুষকে রাখে আড়ালে। কিন্তু কমলাসুন্দরীকে আর পাঁচজনে তারিফ করলে রামকমল সিংহ যেন আরও বেশী আনন্দে মেতে ওঠেন।
সন্ধ্যে থেকে বসে নাচ গানের আসর। জানবাজারের বাড়িটি সম্প্রতি রামকমল সিংহ কিনেই ফেলেছেন। ইয়ার বন্ধুদের সেখানে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনেন তিনি, খাদ্য মদ্য থাকে অঢেল, কিন্তু স্ত্রীলোক ঐ একটিই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুর্তির মাত্ৰাও চড়তে থাকে। কমলাসুন্দরীর গাত্ৰবৰ্ণ ভ্ৰমরকৃষ্ণ, লাল রঙের ঘাঘড়া ও ওড়নাই তার পছন্দ, আসরের মাঝখানে তাকে মনে হয় একটি ঘুরন্ত রক্তবর্ণের শিখা। এক একবার নাচ থামলেই কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ এনকোর এনকোর চিৎকারে হুলুস্কুলু পড়ে যায়। উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখনই এক সময় রামকমল সিংহ উঠে আসরের মাঝখানে এসে কমলাসুন্দরীর কোমর বেষ্টন করেন। সে সময় যুগল নৃত্যের জন্য সমস্বরে অনুরোধ আসে মুহুর্মুহু, কিন্তু রামকমল সিংহ সকলের সামনে নিজেকে এতটা খেলো করতে চান না। তাঁর মুখে ফুরফুরে হাসি, চক্ষু ঢুলু ঢুলু, তিনি সেই অবস্থায় কমলাসুন্দরীকে পাশের শয়ন কক্ষে নিয়ে গিয়ে দ্বার বন্ধ করে দেন।
এই প্রকার ব্যবহারে রামকমল সিংহ বেশী আনন্দ পান। লাস্যময়ী কমলাসুন্দরী যখন উপস্থিত ভদ্র পঞ্চজনের কাছে কামনীয়া হয়ে ওঠে, যখন সে সকলেরই বুকে লালসা বহ্নি জ্বেলে দেয়, সেই সময়ই রামকমল সিংহ যেন তাদের বোঝাতে চান, দেখো, এই রমণী শুধু আমারই অঙ্কশায়িনী।
রাইমোহন এ আসরে নিয়মিতই উপস্থিত থেকে এই মজা দেখে। আজ সে সেই গৃহের কাছাকাছি গিয়েও অন্দরে প্রবেশ করলো না। প্রথমে ভেবেছিল, কিছুক্ষণ অন্তত বসে খানিকটা পরস্মৈপদী সুরা টেনে আসবে। কিন্তু মন বদল করে ফেললো। সে চললো বউবাজারের দিকে।
ছিপছিপ ছিপছিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা সঙ্গে রাখে না। রাইমোহন, ভিজতেই লাগলো। লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলো খানাখন্দ বাঁচিয়ে। তার মনের মধ্যে একটা দো-টানা চলছে। তার ফুর্তিপ্রিয় মনটা তাকে টানছে পেছনের দিকে, গান বাজনা সম্পর্কে তার একটা সহজাত প্রীতি আছে, প্ৰথম যৌবনে সে অনেক শখ করে সঙ্গীতের চাচা করেছিল। তখন উদ্দেশ্য ছিল বিশুদ্ধ আনন্দ, এখন অবশ্য সে সঙ্গীতকে অন্য কাজে লাগায়। তবু এখনো উঁচু জাতের গান তাকে আকৃষ্ট করে, সঠিক তালের নাচের মধ্যে সে লাস্য ছাড়া আরও কিছু পায়। কমলাসুন্দরী রামকমল সিংহের বলতে গেলে ক্রীতা রমণী, সেদিকে রাইমোহনের নজর নেই, কিন্তু তার নাচ দেখলে তবু অন্তত নাচটাই দেখা হয়। তাছাড়া সন্ধ্যের পর মজলিশে মজলিশে সময় কাটানো তার অনেক কালের অভ্যোস, দু পাত্তর টানার জন্য গলার ভেতরটা শক শক করছে। অথচ এ কথা রাইমোহন বোঝে যে একবার ঐ মজায় মজলে সে আর সহজে বেরুতে পারবে না। প্রায় রাতেই রাইমোহন কমলাসুন্দরীর নাচঘরের ফরাসেই গড়াগড়ি দেয়।
আবার হীরেমনির কাছেও পাঁচ সাতদিন আসা হয়নি। সেজন্য রাইমোহন একটু একটু অপরাধী বোধ করে। শেষ পর্যন্ত পিছুটান উপেক্ষা করে সে জোরে জোরে পা চালালো।
পায়ের ইংলিশ জুতো জল কাদায় মাখামাখি। মসজিদের পাশের পুকুরে ভালো করে পা ধুয়ে নিয়ে সে এসে দাঁড়ালো হীরেমনির বাড়ির সামনে।
এ গৃহ আজি বর্ণহীন। জানলাগুলি বন্ধ, ভিতরে কোনো জনমনুষ্য আছে বলেই বোঝা যায় না। রাইমোহন অবাক হলো না। সদরদ্বার খোলাই ছিল, সে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঘুটফুটে অন্ধকারের মধ্যে পা ঘষে ঘষে কোনোক্রমে সে উঠতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। হীরেমনির নোকারটি পালিয়েছে, রাইমোহন আগের দিন এসেই দেখেছিল, তার বদলে কাজ করছিল একটি পশ্চিমা স্ত্রীলোক। আজ বোধহয় সে-ও নেই। হীরোমনি আছে তো?
ওপরে উঠে এসে বড় ঘরটির দরজা ঠেলে সে সভয়ে ডাকলো, হীরে, হীরোমনি!
এ ঘরটিও অন্ধকার প্রায়। এক কোণে একটি মাটির মালসায় তুষের আগুন জ্বলছে ধিকিধিক করে। ঘরে কেউ আছে কি না বোঝা যায় না।
দু তিনবার ডাকবার পর ক্ষীণ গলায় সাড়া এলো, কে?
নিশ্চিন্ত হয়ে রাইমোহন ঢুকে পড়লো ঘরে। চক্ষু সঙ্কুচিত করে আধার সইয়ে নিয়ে সে দেখলো জাজিমের ওপর লম্বমান এক নারীকে।
—কেমন আচিস, হীরোমনি?
—তুমি ফের এয়েচো?
রাইমোহন চলে গেল তুষের মালসার কাছে। সে জানে, পাশেই গন্ধক মাখানো টুকরো টুকরো পাটখড়ি রাখা থাকে। হাতড়ে হাতড়ে সেইরকম একটি পাটখড়ি পেয়ে সে তুষের আগুনের মধ্যে ঠেসে ধরলো, অমনি ফস করে জ্বলে উঠলো সেটা। সেই জ্বলন্ত পাটখড়ি উঁচু করে ধরে সে জিজ্ঞেস করলো, মোমবাতি কোতায় রে?
বেশী খুঁজতে হলো না, মোমবাতি সে নিজেই পেল, সেটা ধরাবার পর সে বললো, একটা গামোছা কোতায় পাই বল দি নি? মাতাটা ভিজে জবজবে হয়ে গ্যাচে।
স্নান আলোয় মেঘলুপ্ত চাঁদের মতন দেখায় হীরেমনির মুখখানি। দু চোখের নীচে মৃত্যুর পাণ্ডু রঙ। শরীর কঙ্কালসার। কণ্ঠে জোর নেই, তবু হীরোমনি বললো, পোড়ামুখো মনিষ্যি, তুমি ফের মরতে এয়োচো এখেনে! দূর হও! দূর হও!
রাইমোহন হেসে বললো, আসা মাত্তরই দূর দূর করচিস কেন রে? লোকে কুকুর বেড়ালকেও এমনিভাবে তাড়ায় না!
হীরোমনি বললো, তোমায় কতবার আসতে বারণ করিচি! আমি তো মরতে বসিইচি, তোমারও মারার সাধ হয়েচে বুঝি?
হীরোমনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। তার ধারণা, তার সংস্পর্শে এলে রাইমোহনও পড়বে সেই অসুখে। তিন মাস হয়ে গেল হীরেমনিকে আঁকড়ে আছে। এই কালরোগ, নিচ্ছেও না, ছাড়াচেও না। হীরেমনির কাছে অনেকদিনই আর কেউ আসে না। তার জিনিসপত্রও ক্রমে ক্ৰমে উধাও হয়ে গেছে। যৌবন চলে গেলে বারবনিতার আর কিছুই থাকে না, কিন্তু হীরেমনির বয়েস এখনো কুড়ি পূর্ণ হয়নি, তবু তার এই দরদৃষ্ট।
—চাঁদু কোতায়? চাঁদু?
—ঘুমুচ্চে পাশের ঘরে।
—এই সন্ধেবেলা ঘুমুচ্চে? খেয়েচে কিচু?
–তোমার আত কতার দরকার কী?
—আ মোলো, অমন কতায় কতায় মুখ ঝামটা দিচ্চিস কেন? ছেলেটা খেয়েচে কিনা জানবো না? সেদিন যে মাগীকে দেখে গোসলুম তোদের রান্না করে দিচ্চে, সে গেল কোতায়?
-কে জানে!
রাইমোহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বেঘোরে মরতে বসেও হীরেমনির অহংকার যায়নি, সে কিছুতেই রাইমোহনের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিতে চায় না। রাইমোহন টাকা দেওয়ার চেষ্টা করলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। হীরেমনির ছেলে চন্দ্রনাথের বয়স এখন তিন বছর, মায়ের এই অসুখে তারও দুরবস্থার একশেষ হচ্ছে। কেই বা দেখাশুনো করবে। যা অবস্থা, তাতে চোর ডাকাতরা যে কোনোদিন মা-ছেলেকে কেটেকুটে বাকি সব জিনিসপত্রও নিয়ে চলে যাবে। রাইমোহনের সংসারে কেউ নেই, কবেই সব উৎসন্নে গেছে, সুতরাং চন্দ্রনাথকে সে নিজের কাছে নিয়ে রাখতেও ভরসা পায় না। আর কার কাছেই বা রাখবে, বেশ্যার ছেলেকে কে নেবে?
পাশের ঘর থেকে ঘুমন্ত চন্দ্রনাথকে তুলে নিয়ে এলো রাইমোহন। ছেলেটার চোখের নীচে শুকনো জলের দাগ, তাই দেখে কঠিন হৃদয় রাইমোহনেরও বুকটা একটু মুচড়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে রাগও হলো তার।
হীরেমনির পাশে বসে সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, তুই এখনো বল, হীরেমনি, এ ছেলে কার? আমি তার গলায় গামছা দিয়ে এখানে হিড়হিড় করে টেনে আনবো! গোটা কালকেতা শহরে খবর রটিয়ে দেবো।
হীরেমনি ফোঁস করে উঠে বললো, ফের ঐ কতা? দূর হয়ে যাও আমার চোকের সুমুখ থেকে। ছেলে আমার, ভগমন আমায় দিয়েচেন।
এ কি বিস্ময়কর বিশ্বস্ততা হীরেমনির! মৃত্যু শিয়রে রেখেও, সে সততার জেদ ছাড়বে না। এই ব্যাপারটাই রাইমোহনকে বেশী টানে। তঞ্চকতাই তার পেশা; ভণ্ডামি, জুয়াচুরি ও মিথ্যের অস্ত্রগুলি সে সারা জীবন শানিয়ে বেড়াচ্ছে; আর একজন সামান্য স্ত্রীলোক হারিয়ে দিচ্ছে তাকে। সতীত্ব নেই অথচ সততা আছে, এমন স্ত্রীলোকও বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে থাকে?
—যদি জগমোহন সরকার হয় তো একবারটি বল, আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙবো। সে নচ্ছারটা ফিমেল উদ্ধারের নাম করে ভদ্দরলোকের বাড়ির অন্দরে টু মেরে বেড়াচ্চে। মাথা ভরা কুমতলব, আর মুখে বড় বড় কতা! কত পিরীত ছিল তোর সঙ্গে, এখুন। আর ইদিকে আসবার নামটি নেই।
—হাজার বার বলিচি তিনি নন।
–বেশ, তবে আজ থেকে আমিই চাঁদুর বাপ হলুম।
—না, তোমার মুরোদে কুলোবে না। ওর বাপ কেউ নয়। ওর বাপ নেই। আমি মরলে চাঁদুও আমার সঙ্গে মরবে।
—হীরে, আমার ওপর কেন অত রাগ করিস? সুখের খোঁজে লোকে তোদের মতন মেয়েমানুষের কাচে আসে। অসুখে-পড়া মাগ দেখতে কেউ ভুলেও আসে না। কিন্তু আমি তো এসিচি।
–বেশ কোরেচো। এখন বিদায় হও।
–চাঁদুকে আমি আজ থেকে পুষ্যি নিলুম। এই দ্যাখ।
ট্যাক থেকে সোনার হারটা বার করে সে পরিয়ে দিল চন্দ্রনাথের গলায়। তারপর ছোট একটি হাততালি দিয়ে বললো, বাঃ দিব্যি মানিয়েচে।
—খুলে নাও, এক্ষুনি খুলে নাও। কার ঘর ঠেঙে চুরি করা মাল তুমি এখেনে গচাতে এয়োচো!
—চুরি করা? তোকে কিরে কেটে বলচি, এ আমার হকের জিনিস। ওকে আজ ছেলে বলে ডাকালুম, খালি হাতে আসা যায়? তোকে আর একটা কতাও বলচি, আজ থেকে আমি এখেনেই ঠাঁই নেবো। আর যাচ্চিনি। আমি এখুনি বেরিয়ে খাবারদাবার কিনে আনচি। তুই ভেবেচিস আমায় ফাঁকি দিয়ে পালাবি?
চন্দ্রনাথের মুখশ্ৰী সুন্দর, গৌরবর্ণ, সোনার হারটি পরানোতে সেই শিশুকে আরও সুশোভন দেখায়। রাইমোহন সেদিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো। পুষ্যি নেওয়ার দিন একটা কিছু স্বৰ্ণালঙ্কার দেওয়া নিয়ে কথা। তারপর আবার টাকা পয়সার হঠাৎ ঘাটতি পড়লে ঐ হারটিই বেচে দিয়ে আবার দু পাঁচদিন চালানো যাবে।
হীরোমনি আর পারলো না, নিঃশব্দে অশ্রু বর্ষণ করতে শুরু করলো। রাইমোহন হীরেমনির শীর্ণ গ্ৰীবায় হাত রেখে বললো, তোকে আমি সারিয়ে তুলবোই! তুই ভালো হয়ে ওঠ, হীরে, তারপর তোতে আমাতে মিলে আগুন জ্বালাবো! তোকে আমার খুব দরকার।