মানুষের জীবনে সমস্ত রাত্রিই ভোর হয় না। কোনো কোনো রাত্রি মধ্য পথে থমকে যায়। কালস্রোত নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়ে মানুষকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বাবু রামকমল সিংহ জানবাজারের গৃহে কমলাসুন্দরীর আলিঙ্গনে মধুর আলস্যে নিদ্রিত ছিলেন, হঠাৎ গেলুম রে, মলুম রে বলে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। তারপরই সদ্য বলি দেওয়া মুণ্ডহীন ছাগের মতন ধড়ফড় করতে লাগলেন শয্যার ওপর।
কমলাসুন্দরী জেগে উঠে কী হলো গা, কী হলো বলে অতি ভীতভাবে ধাক্কা দিতে লাগলো তাঁকে। কিন্তু রামকমল সিংহের মুখে আর কোনো কথা নেই। চক্ষু দুটি ঘূর্ণিত হচ্ছে, গাঁজলা বেরুচ্ছে ঠোঁটের পাশ দিয়ে।
শব্দ শুনে ছুটে এলো দাসী-বাদীরা। পাশের মজলিশ ঘরে ইয়ার দোস্তর কয়েকজন গালিচার ওপর লম্বা হয়ে আছে, তাদের নেশার ঘুম সহজে ভাঙবে না। তবলা বাজনাদার ড়ুগিটির গলা জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে, যেন ঐ ড়ুগিটিই তার সোহাগিনী। এদের ডেকে তোলা গেল না। কিন্তু রামকমল সিংহের নিজস্ব ভৃত্য দুখীরাম তার বাবুর এই অবস্থা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
রামকমল সিংহের অবস্থা দেখে ভয় পাবারই কথা। তাঁর বাকুরোধ হয়ে গেছে, মুখখানা দারুণ যন্ত্রণায় কুঞ্চিত, মাঝে মাঝে পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে উঠছে ধনুকের মতন। এত বড় একজন মানী লোক, যাঁর হুকুমে পঞ্চাশ-একশোটা লোক যে-কোনো সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পারে, সেই মানুষের কী অসহায় দশা।
কমলাসুন্দরী দিশেহারা হয়ে পড়লো। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কিছু উপায় ঠিক করা তার ধাতে নেই। সাধারণত বারবিলাসিনীদের মায়েরাই হয় তাদের পরামর্শদাতৃ, কিন্তু কমলাসুন্দরীর মা নেই, স্বজন বলতে কেউ নেই, গত কয়েক বৎসর রামকমল সিংহ যেন তাকে দাস-দাসী, আমোদের উপকরণ আর আদর-যত্ন দিয়ে তুলোয় মুড়ে রেখেছিলেন। সামান্য অবস্থা থেকে আজ কমলাসুন্দরীকে কলকাতার মানুষ একডাকে চেনে।
কমলাসুন্দরীর দাসীরা সবাই যুবতী। রামকমল সিংহ যৌবনের পূজারী। লোলচর্ম ও পঙ্ককেশ তিনি চক্ষে সইতে পারেন না। এই সব দাসীরাও কোনো কোনো সময় তাঁর কৃপালাভে ধন্য হয়েছে। আগে তিনি দু-এক বৎসর অন্তর রক্ষিতা পরিবর্তন করতেন, কিন্তু এই কমলাসুন্দরী তাঁকে বড় মায়ার বন্ধনে বেঁধেছে। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, যখন সগ্যে যাবো, তখন তোকেও যে আমার সঙ্গে যেতে হবে রে, কমলা! তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি স্বগেই যাবেন। হায়, সেই মানুষের আজি কী দশা!
কমলাসুন্দরীর এক দাসীর নাম আতরবালা। সে বেশ বুদ্ধি ধরে। দিলাদরিয়া রামকমলের কাছ থেকে প্রায়ই টাকাটা সিকেটা বাগিয়ে নিয়ে সে ইতিমধ্যেই একটি মাঠকোটা বাড়ি কিনে নিজে আলাদা কারবার শুরু করার ব্যবস্থা প্ৰায় পাকা করে ফেলেছে। সেই আতরবালা দুখীরামকে বললো, আরে মিনসে, এখন কী কাঁদবার সময়। মান খোয়ালি রে, মান খোয়ালি! কতায় বলে, মরণের চেয়ে মান বড়। এত বড় মানুষটার এখানে যদি কিছু হয়, তবে আর ওয়ার মািগ-পুতের মান থাকবে? গাড়ি যুততে বল, বাবুকে চটজলদি বাড়ি নিয়ে যা।
একথা শুনে কমলাসুন্দরী সন্ত্রস্ত হলো। রামকমল সিংহ কি সত্যিই মরতে বসেছেন নাকি? বাবু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা তো কিছুই করে যাননি, তিনি মলে তার নিজের কী উপায় হবে? সে অসহায় স্ত্রীলোক, সবাই যদি তাকে তখন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়? বাবু মুখে অনেকবার বলেছেন বটে যে জানবাজারের এই বাড়ি কমলাসুন্দরীর নামেই কেনা, কিন্তু তার কাগজপত্র কোথায়?
দুখীরাম গাড়ির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিল, কমলাসুন্দরী তাকে বললো, ডাঁড়া ডাঁড়া! ওরে আমার সব্বোনাশ হচ্চে, আমায় একটু চিন্তা করতে দে। বাবুর এখন তখন অবস্থা, গাড়িতে যেতে যেতেই মলে আমি দোষের ভাগী হবে না?
আতরবালা বললো, তবে কি বাবু রাঢ়ের বাড়ি মরবে, সেটা ভালো হবে? দেশশুদ্ধ লোক জানবে যে…
এমন সময় তবলা-বাজনদারটি ঢুলু ঢুলু চক্ষে উঠে এসে বিরক্তভাবে বললো, কী হয়েচে, অ্যাঁ, এত গোলমাল কিসের?
তারপর রামকমল সিংহের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সে সচমকে বললো, আরে, বাবুর এ কী অবস্থা? বাবু যে ধূকচেন। এখুনো কোবরেজ ডাকিসনি? মেয়েছেলের বুদ্ধি! অনুগ্রহ কবিরাজ ডাকার উদ্যাগ করতে গিয়ে চৌকাঠ পা বেঁধে ছড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আর উঠলো না।
এ পল্লীতে বিখ্যাত ধনী রাজচন্দ্র মাড়ের সুবৃহৎ প্রাসাদ রয়েছে। রাজচন্দ্র গত হবার পর তাঁর পত্নী রাসমণিই এখন জমিদারী চালান। শূদ্ৰজাতীয় স্ত্রীলোক হলেও তাঁকে অনেকে ইদানীং রানী বলতে শুরু করেছে। সেই রানী রাসমণির প্রাসাদে সম্প্রতি কোনো পল্লীগ্রাম থেকে একজন কবিরাজ এসে রয়েছেন। তিনি নাকি সাক্ষাৎ। ধন্বন্তরি। দাসী-বাদীরাও শুনেছে তাঁর কথা।
কমলাসুন্দরী দাসীদের উদ্দেশে বললো, যা, শিগগির সেই কোবরেজ মশাইকে ডেকে নিয়ে আয়। যেমন করে পারিস নিয়ে আসবি। এত রেতে যদি তিনি না। আসতে চান, তেনার পায়ে ধরবি, পায়ের বুড়ো আঙুল মুখে পুরে চুষবি।
দাসীরা গেল কবিরাজকে ডাকতে। দুখীরামও। আর দেরী করলো না। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটলো। একটা জিনিস সে বুঝেছে, এখন যে-উপায়ে হোক বিধুশেখরকে সংবাদ দেওয়া দরকার। এ রকম সংকটে বিধুশেখরই সব কিছু সুষ্ঠুভাবে চালনা করতে পারেন।
রাত-বিরেতে কলকাতায় পথঘাটে এক চলা দায়। ঠ্যাঙাড়ে-বোম্বোটেদের হাতে পড়লে তো কথাই নেই, পাহারাওয়ালা সেপাইদের নজরে পড়লেও ভোগান্তি কম নয়। দুখীরাম নিশাচর প্রাণীর মতন অন্ধকার দেখে দেখে দৌড়োতে লাগলো প্ৰাণপণে। তার অতি বাল্যকাল থেকে সে নিযুক্ত আছে। রামকমল সিংহের সেবায়, বাবুর মতন এমন ক্ষমতাশালী অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারীও যে সাধারণ মানুষের মতন হঠাৎ মরে যেতে পারে, এ কথা তার মাথাতেই ঢুকছে না।
এক সময় সে বিধুশেখরের বাড়ির সামনে পৌঁছেও গেল। এত রাত্রে বিধুশেখরের কাছে কোনো সংবাদ পৌঁছোনোও সহজ কথা নয়। কিন্তু দুখীরাম প্রবল হল্লা তুলে দিল। বিধুশেখরের নেশাভাঙ করার অভ্যোস থাকলে হয়তো এই মধ্যরাত্রে তাঁর ঘুম ভাঙানো কঠিনই হতো, কিন্তু তাঁর সে সব দোষ নেই এবং পাতলা ঘুম, তিনি জেগে উঠলেন। নীচে নেমে এসে সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি কয়েক পলক মাত্র স্থির হয়ে চিন্তা করলেন, একটুও বিচলিত দেখালো না তাঁকে। সুগম্ভীর কণ্ঠে দারবানদের বললেন, সহিসালোককো উঠাও! আস্তাবলকা দরওয়াজ খুলো!
অতি দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে বিধুশেখর উঠে বসলেন তাঁর চার ঘোড়ার গাড়িতে। এ গাড়ি তাঁকে অত্যাল্পকালের মধ্যে পৌঁছে দেবে জানবাজার। শুধু চিৎপুরের রাস্তায় গাড়ি বাঁক নেবার মুখে তিনি শুধু একবার বললেন, রোখে। অদূরের সিংহবাড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি একটুক্ষণ চিন্তা করলেন, বিম্ববতী কিংবা গঙ্গানারায়ণকে এখনই খবর দেবেন কি না। তারপরে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন, না, চলো। রাসমণির বাড়ির কবিরাজটি অতি সদাশয়। বিপদের ডাক তিনি উপেক্ষা করেন না। এত রাতেও তিনি এসেছেন। মানুষটি পৌঁছেছেন বার্ধক্যের শেষ সীমায়। তাঁকে দেখলে মনে হয় তিনি নিজেই মারা যাবেন যে-কোনো মুহূর্তে।
বিধুশেখর জানবাজারের গৃহে পৌঁছে দেখলেন সেই অতি বৃদ্ধ কবিরাজ বসে আছেন রামকমল সিংহের শয্যার পাশে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি রোগীর নাড়ি দেখতে পারছেন না, এমনই ছটফট করছে রোগী, তার হাত ধরতে গেলেও ঝটুকা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। কবিরাজ মহাশয় কয়েকজন দাসদাসীকে বলেছিলেন রোগীকে ধরে থাকতে। তারাও চেষ্টা করে পারেনি। অবশ্য তারাও ধরেছে। বড়ই নরমভাবে। এই অবস্থাতেও প্রভুর ওপর বলপ্রয়োগ করতে তারা সাহস পায় না। বিধুশেখর এসেই কড়া গলায় হুকুম দিলেন, দুখী, পা দুটো চেপে ধর। আমি নিজে ওর হাত ধচ্চি।
রেড়ির তেলের একটি মাত্ৰ প্ৰদীপ জ্বলছে ঘরে, তাতে অতি সামান্য আলো আর প্রায় ঘরজোড়া ছায়া, বিধুশেখর দাসদাসীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ একজন একটা মশাল জ্বলো।
কমলাসুন্দরী আড়ষ্টভাবে তাকিয়ে রইলো বিধুশেখরের দিকে। এই প্রথম দেখা। এই মানুষটি সম্পর্কে এত বছর ধরে অনেক কিছু শুনেছে সে, কিন্তু আগে কখনো চাক্ষুষ দেখেনি। এই মানুষটিই সিংহ পরিবারের দণ্ডমুণ্ডের কতা। এর পর থেকে কমলাসুন্দরীরও ভাগ্য নির্ভর করবে। এর হাতে? বিধুশেখর কিন্তু একবারও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন না। কমলাসুন্দরীর দিকে। এই অপবিত্র গৃহে তাঁকে আসতে হয়েছে বলে তাঁর ওষ্ঠ ভঙ্গিমায় ঘৃণা ও বিরক্তি মাখানো।
কবিরাজ কিছুক্ষণ নাড়ি ধরে রেখে মাথা নাড়তে লাগলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, আয়ু নাই, আয়ু নাই, ইহার দিন ফুরোয়ে গেচে।
কমলাসুন্দরী তাঁর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, আপনি ধন্বন্তরি। আপনি বাঁচিয়ে দিন গো! যত টাকা লাগে, আমার গয়নাগাটি যা আচে সব দেবো গো–
কবিরাজ পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, আমার সাধ্য নাই, আমি রোগের চিকিৎসা কত্তে পারি। কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকাতে পারি না।
বিধুশেখর বললেন, মহাশয়, ইহাকে কি এখন স্বগৃহে লয়ে যেতে পারি? গাড়ির ধকল কি এর সইবো?
কবিরাজ দু-দিকে মাথা নাড়লেন।
বিধুশেখর আবার প্রশ্ন করলেন, ইহার যন্ত্রণা উপশমের কি কোনো নিদান নাই?
কবিরাজ বললেন, এই রোগের নাম ধনুষ্টঙ্কার। স্বয়ংযমও এই ব্যাধিকে ভয় পায়। যমদূতরা কাছে আসতে দ্বিধা করে, সেইজন্যই এই রোগের যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ বড় দুষ্ট ব্যাধি।
তখন নিরাশ হয়ে বিধুশেখর বললেন, ইহার কি আর চেতনাও ফিরবে না? দুটো কথাও কইতে পারবে না?
এবার সবাইকে চমকিত করে কবিরাজ বললেন, হ্যাঁ, চেতনা ফিরায়ে দিতে পারি। সে এমন কিছু শক্ত নয়। সূচিকাভরণ দিলে চেতনা হবে, তারপর সব কিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছা।
কবিরাজ যেন সত্যিই ধন্বন্তরি। কোন তীব্র বিষ তিনি রামকমল সিংহের ওষ্ঠে ছোঁয়ালেন কে জানে। কিয়াৎকালের মধ্যেই তাঁর হাতপায়ের খিচুনি কমে গেল। তিনি চোখ মেলে তাকালেন।
কবিরাজ দুর্গা শ্ৰীহরি দুর্গা শ্ৰীহরি বলে কপালে হাত ঠেকিয়ে তাঁর ইষ্ট দেবতার উদ্দেশে প্ৰণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, কেউ একটু আলোটা দেখা তো বাবা, আমি যাই, আমার কিছু করবার নেই। এখেনে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই রামকমল সিংহের মুখে কথা ফুটলো। তিনি বললেন, কে, বিধু?
কবিরাজ বলেছিলেন, ব্যথা কমবে না। কিন্তু রামকমল সিংহের মুখে রোগযন্ত্রণার কোনো চিহ্নই নেই। কণ্ঠস্বরও স্বাভাবিক। যেন কোনো অলৌকিক উপায়ে রামকমল সিংহ হঠাৎ বিপন্মুক্ত হয়ে গেছেন।
কমলাসুন্দরী পাশে বসে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে, বিধুশেখর রয়েছেন বলে সে সাহস করে রামকমল সিংহের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। রামকমল তার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বললেন, ভয় নেই কমলা। বিধু, কমলা রইলো, দেখিস যেন ও কোনো কষ্ট না পায়।
বিধুশেখর বললেন, তোকে আমি গৃহে ফিরায়ে নিয়ে যেতে এসিচি। বিম্ববতীকে, তোর পুত্রদের দেখতে ইচ্ছে করে না?
রামকমল সিংহের দু চোখের পাশ দিয়ে জল গািড়য়ে পড়লো। তিনি প্রশ্ন করলেন, আজ কি তাথ?
বিধুশেখর বললেন, একাদশী।
রামকমল এই অবস্থার মধ্যেই ক্ষীণ হেসে বললেন, ঠিক। কাশীর সেই জ্যোতিষী কী বলেচেন তোর মনে নাই? একাদশীতেই আমি যাবো।
বিধুশেখর বললেন, আরও অনেক একাদশী আসবে, এত ত্বরা কিসের?
রামকমল বললেন, তোর সঙ্গে দু চারিটি কথা আচে, যদি আর সময় না পাই…।
বিধুশেখর গলা চড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, এই, তোমরা সবাই বাইরে যাও। বাইরে যাও। দরজা বন্ধ করে দেবো।
কমলাসুন্দরী তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বিধুশেখর পরোক্ষে বললেন, দুখী, এনাকেও একটু বাইরে যেতে বল।
কমলাসুন্দরী এবার মুখ তুলে বললো, না, আমি থাকবো। আমি কোতাও যাবো না।
সরাসরি এই প্রথম বিধুশেখর তাকালেন কমলাসুন্দরীর দিকে। রাগে তাঁর গাত্ৰ জ্বলে গেল। কালো রঙের এই সামান্য স্ত্রীলোকটি কুহক জাল বিস্তার করে বেঁধে রেখেছে রামকমলকে। এর রূপেরই বা কী এমন চাকচিক্য? এ তো বিম্ববতীর পায়ের এক কণা নোখের যোগ্য নয়। বিম্ববতীকে ছেড়ে কোনো বুদ্ধিভাগ্যসম্পন্ন মানুষ এমন এক কুলটা মেয়েতে যে কী ভাবে মজে থাকতে পারে, তা বিধুশেখর কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।
তীব্রভাবে কমলাসুন্দরীর চোখে চোখ রেখে বিধুশেখর আদেশ দিলেন, আমাদের কিছু গূঢ় কথা আছে, তুই এখন বাইরে যা!
সে আদেশ অগ্রাহ্য করার সাহস কমলাসুন্দরীর নেই। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে চলে গেল। ঘরের বাইরে।
তখন বন্ধুর কপালে হস্ত রেখে বিধুশেখর বললেন, ভাই, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
রামকমল বললেন, জানতুম, মৃত্যু আমার কাচে যে কোনোদিন আসবে, আমার তৈরি থাকার কথা ছিল…কিন্তু পারিনি। যেতে ইচ্ছে করে না…বড় বাঁচতে ইচ্ছে করে।
—তুই এখন কেমন বোধ করচিস? বেদনা আর আচে কী? এযাত্রা ভালো হয়ে গেলি মনে হয়।
—না, বিধু, আর সময় নেই। শরীরে অসহ্য বেদন। কিন্তু আমি হাত পা নাড়তে পারছিনি। আর সময় পাবো না…তোর সঙ্গে একটা কতা…
—বিষয়-সম্পত্তি সব উইল করা আচে, নতুন কিছু ইচ্ছে যদি তোর থাকে!
—বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না…তুই রইলি…জানি…সব ঠিক থাকবে…শুধু একটা কতা…সে কতা না জানলে মলেও আমার শান্তি হবে না…এতকাল সেই কতা ভেবেই ছটফট করিচি।
–রামকমল, তোকে আমি বাড়িতে নিয়ে যাবো…এ পাপের জায়গা…বুকে সাহস আন…বাড়িতে গিয়ে বিম্ববতীর কোলে মাথা রেখে শুবি… সে সতী সাধ্বী।
—বিধু, আমার ছেলে…নবীন…সে আমার বড় আদরের, সে কি আমার? সে কার সন্তান?
বিধুশেখরের বুকে যেন বজ্ৰপাত হলো। মুখমণ্ডল হলো বিবৰ্ণ, রক্তশূন্য। মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে এ কী কথা তিনি শুনলেন? তিনি সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
রামকমল সিংহ বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন, আমার মুখে আগুন দেবে-কে-গঙ্গা না নবীন, ওরা কেউ আমার রক্তের নয়।
বিধুশেখর মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বললেন, কী বলচিস তুই রামকমল? নবীন তোর নিজের সন্তান-বিম্ববতী তোর সংসারের লক্ষ্মী, তোর ছেলে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে এয়েচে।
—সে কি আমার, তোর নয় তো? সত্যি করে বল?
—আমার কেন হবে? ছি, ছি্ ছি, এমন কথা…নবীন তোর ঔরস জাত সন্তান…
–বিধু, আমার বুকে বড় জ্বালা-এতখানি বয়েসে-ভোমরা যেমন ফুলে ফুলে-তেমনি আমি কত নারীতে উপগত হয়িচি, সবই নিষ্ফল? কেউ আমায় একটিও সন্তান দেয়নি, তাই আমি ভেবেচি, আমার ও ক্ষমতা নেই, বিম্ব আমাকে…
—তোর কোনো পাপের সন্তান হয়নি, সে তো ভালোই, তাতে বিষয় সম্পত্তি ছারেখারে যেত।-বিম্ববতী অনেক পুণ্য করেচে, ভগবানের কৃপায় সে তোর বংশ ধন্য করতে অমন হীরের টুকরো
—ও ছেলে আমার? তোর নয়?
—রামকমল, আমি তাঁবা, তুলসী, গঙ্গাজল ছুঁয়ে শপথ করে বলতে পারি…তুই একি পাগলের মতন কথা বলচিস!
—তুই শপথ করতে পারবি?
—হ্যাঁ…এক্ষুণি আমি আনাচ্চি সব।
—তুই আমার মাথা ছুঁয়ে বল।
—এই যে বললুম, নবীন তোর সন্তান–তোর রক্ত তার শরীরে বইচে, আমি বিম্ববতীকে কোনোদিন মন্দভাবে স্পর্শ করিনি।
—আঃ! শান্তি, শান্তি…আমার বুকে বল এলো-বিধু, নবীনকে একবার দেকতে বড় সাধ হয়…একবার বিম্বকে…আমি কৃতঘ্ন…তার কাচ থেকে দূরে দূরে রয়িচি এতদিন…
—আমি এখুনি তোকে বাড়ি নিয়ে যাচ্চি।
কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই রামকমল সিংহের গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ উঠলো, হাত পায়ের খিচুনি শুরু হলো আবার। বোধহয় সূচিকাভারণের শক্তিও নিঃশেষিত হয়ে গেল। বিধুশেখর তাঁর কপাল ছুঁয়ে থেকে তারা ব্ৰহ্মময়ী, তারা ব্ৰহ্মময়ী, নাম জপ করতে লাগলেন। এই সময় বন্ধুর মুখে ফোঁটা ফোঁটা, গঙ্গাজল দিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এই অবিদ্যার বাড়িতে গঙ্গাজলই বা পাওয়া যাবে কী করে?
শেষবারের মতন মুখ ঘুরিয়ে বিধুশেখরের হাতের ওপর মুখ রেখেই শেষ নিশ্বাস ফেললেন রামকমল সিংহ।
বিধুশেখর চিৎকার করে বললেন, দুখীরাম দরজা খুলে দে। অমনি হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এলো সকলে। কমলাসুন্দরী এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো মৃত রামকমল সিংহের বুকে। অন্য দাস-দাসীরাও এসে তাঁর পায়ে মাথা ঠুকতে লাগলো। ক্ৰন্দন চিৎকারে ভারী হয়ে গেল বার্তাস।
বিধুশেখর চাইলেন, বিলম্ব না করে তখুনি রামকমল সিংহের মরদেহ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলবেন। তাঁর বন্ধুর এই ঘৃণিত স্থানে মৃত্যু ঘটনার সংবাদ যেন কাকপক্ষীতেও না জানতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়াই শক্ত। তাছাড়া কী করে যেন বার্তাসের কানে কানে রটে যায় খবর। ভোরের আলো সবে মাত্ৰ ফুটি ফুটি, এখনো অন্ধকার যায়নি, এরই মধ্যে বেশ একটা ভিড় জমে গেছে বাড়ির সামনে। সেই ভিড়ের মধ্যেই সকলের মাথা ছাড়িয়ে দেখা গেল রাইমোহন ঘোষালের লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা। লোকজন ঠেলতে ঠেলতে সে হাউ হাউ করে কাঁদছে আর বলছে, ওরে সর সর, কত্তাবাবুকে একবার শেষ দেখা দেকেনি। মহাদেবতুল্য লোক ছিলেন আমাদের কত্তাবাবু-আহা কত বড় দরাজ দিল!
রাইমোহনকে দেখে তবু খানিকটা আশ্বস্ত হলেন বিধুশেখর। তিনি জানেন রাইমোহন অতিশয় চতুর ও চটপটে, যে-কোনো হুকুম তামিল করার শক্তি রাখে সে। তিনি বললেন, ওহে রাইমোহন, এই স্ত্রীলোকদের এখন সরে যেতে বলো, আগে রামকমলকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সেখানে শান্তি স্বাস্ত্যয়ন যা করবার
তৎক্ষণাৎ কৃত্রিম কান্না থামিয়ে তৎপর হয়ে উঠলো রাইমোহন। শোকের বাড়ি তার খুব পছন্দ। শোকের বাড়িতে সব কিছুই অগোছালো থাকে, লোকের চক্ষু থাকে। ঝাপসা। সে অমনি মেয়েদের দঙ্গলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-হাতে ঠেলতে লাগলো তাদের। আর চিৎকার করতে লাগলো, সবাই সরো সরো, বড় কত্তামশাই রাগ কচ্চেন, সরো, জানো না এখন মড়া ছুঁতে নেই!
এই সুযোগে সে কমলাসুন্দরীর গলা থেকে একটা আলগা স্বর্ণহারও হাতিয়ে ফেললো সুকৌশলে। এবং তারপরও তীক্ষ্ণ লোভমাখা চোখ ফেরাতে লাগলো। এদিক ওদিক। এতবড় একজন মানুষ মারা গেলেন সেই উপলক্ষে তার দু-দশটাকা রোজগার হবে না একী একটা কথা হলো! রামকমল সিংহের মৃতদেহ সে একাই পাঁজাকোলা করে তুললো গাড়িতে এবং তারই মধ্যে রামকমল সিংহের দু আঙুলের দুটি মূল্যবান আংটি চলে গেল রাইমোহনের জেবের গহ্বরে।
এরপর রামকমল সিংহের মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে যাত্রা এবং পরে তার শ্ৰাদ্ধ উপলক্ষে সমারোহ একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেল সব কিছুর। লোকের মুখে মুখে কথাই রটে গেল যে, হ্যাঁ, সেই পোস্তার রাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে দুর্গোৎসব হয়েছিল আর এই রামকমল সিংগীর ছোরাদ, এমনটি আর দেখা যায়নি। কাগজওয়ালারা চুটিয়ে লিখলে, ইংরেজি কাগজগুলোতেও ছাপা হলো রামকমল সিংহের গুণপণার বৃত্তান্ত। ল্যাণ্ড হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশান বিশেষ সভা ডেকে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করলে। তারপর সবকিছু চুকে যাবার পর জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়ি উৎকটরূপে স্তব্ধ হয়ে গেল একসময়। রামকমল সিংহ যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তাঁর উপস্থিতি বিশেষ টের পাওয়া যেত না এ বাড়িতে। ইদানীং তিনি তো প্ৰায় বাড়িতে থাকতেনই না। কিন্তু এখন তিনি গত হয়েছেন শুধু এই সংবাদটির জন্যই যেন বাড়িটি খাঁ খাঁ করে।
ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর মৃত্যুতে বিধুশেখর যে কতখানি আঘাত পেয়েছেন, তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কেউ তাঁর চোখে জল দেখেনি, কারুর সামনে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েননি। শ্ৰাদ্ধ উপলক্ষে যে বিরাট যজ্ঞ এবং প্রায় গোটা শহরটিকেই খাওয়ানো দাওয়ানোর সব কিছু দেখাশুনো করেছেন তিনি নিজে। এতখানি ধকল অবশ্য তাঁর সহ্য হয়নি। একেবারে শেষের দিকে তিনি নিজেই খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
আবার সামলে উঠে তিনি এলেন একদিন সিংহ বাড়িতে। কারুকে তিনি ডাকলেন না, খবর পাঠালেন না, তিনি নিজেই উঠে এলেন। দ্বিতলে। লম্বা টানা বারান্দা ধরে তিনি হাঁটতে লাগলেন। সেখান দিয়ে যেতে যেতে তিনি দেখতে পেলেন সিঁড়ির ওপর নবীনকুমার খেলা করছে দুলালচন্দ্রের সঙ্গে। নবীনকুমারের দিকে তিনি একবার সমেহ, দৃষ্টিপাত করলেন শুধু, কোনো কথা বললেন না।
বারান্দাটা ডান দিকে ঘুরে গিয়ে শেষ প্রান্তে বিম্ববতীর নিজস্ব কক্ষ। সেখানে এসে দ্বারের সামনে দাঁড়ালেন বিধুশেখর। তারপর অনুচ্চ স্বরে তিনি ডাকলেন, বিম্ব, বিম্ববতী!
দ্বার খুলে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চিন্তামণি দাসী। বিধুশেখর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন। বড়বাবুকে দেখে চিন্তামণি সলজভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে চলে গেল বাইরে। বিধুশেখর এসে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে।
পালঙ্কের ওপর বসে আছেন বিম্ববতী। নতুন বৈধব্যবেশে বিম্ববতীর রূপ এমনই বদলে গেছে যে বিধুশেখর সাঙ্ঘাতিক চমকিত হলেন। কোমর ছাড়ানো বিশাল কালো চুলের গোছা ছিল বিম্ববতীর, তার চিহ্নমাত্র নেই। বিম্ববতী মস্তক মুণ্ডন করেছেন। যে দু হাত ভর্তি স্বৰ্ণালঙ্কার ও শাঁখা ছিল, সেই হাত দুটি এখন নিরাভরণ। যে সোনার অঙ্গ সজ্জিত থাকতো একসময় বালুচরী বা মসলিনে, এখন সেই অঙ্গ ঢেকে আছে একটি ফরাসডাঙ্গার সাদা থানে। পূর্ণযৌবনা বিম্ববতী যেন ধরেছেন যোগিনীর রূপ।
পালঙ্ক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বিম্ববতী বললেন, আমি অভাগিনী, আমার নাবালক সন্তান…আমায় আর দোকবার কেউ নেই….
বিধুশেখর এক পা অগ্রসর হয়ে বললেন, তোমার এই বেশ আমি সহ্য করতে পারবো না ভেবে আমি কয়েকটা দিন আসিনি। কিন্তু তুমি তো জানো, যতদিন আমি রয়িচি, তোমার কোনো চিন্তা নেই।
বিম্ববতী বললেন, আপনার শরীর অসুস্থ হয়েছিল?
বিধুশেখর বললেন, সে আমন কিচু না-বিম্ব, তোমার মন শক্ত করতে হবে, তোমায় সংসারের হাল ধরতে হবে…আমি যতদিন আচি, অতদিন অবশ্য…
বিম্ববতী একটু এগিয়ে এসে বললেন, আমার ছেলে-সে যে আমার আধার ঘরের মানিক, সে যে আমার জীবনসব্বস্ব, যদি কেউ কোনোদিন তার নামে…
বিধুশেখর দৃঢ় স্বরে বললেন, জগতে কেউ কোনোদিন জানবে না, তোমার স্বামী শান্তিতে মরেচে, সে আমায় বিশ্বাস করে গ্যাচে, এখন তুমি শুধু শক্ত হয়ে থাকো…
বিম্ববতীর অধরোষ্ঠ কেঁপে উঠলো, শরীরে যেন লাগলো ঝড়ের বার্তাস। তিনি মুছিতার মতন এসে। পড়লেন বিধুশেখরের পায়ের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি পারবো না-আমি পারবো না…আমি দুর্বল…।
বিধুশেখর বললেন, পারবে, নিশ্চয়ই পারবে। আমি তো রয়িচিই, তোমার পাশে আমি সৰ্বক্ষণ আচি…তুমি যে আমার চক্ষের মণি…
বিম্ববতীকে তুলে বক্ষে জড়িয়ে ধরে বিধুশেখর তাঁর পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।