এতকালের সুনামসম্পন্ন হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। ছাত্র সংখ্যা কমতে কমতে এমন হলো যে কোনো কোনো শ্রেণীতে তিন-চারজনের বেশী ছাত্র থাকে না। তৃতীয় শ্রেণীতে শুধু চন্দ্রনাথ একা। সে প্রতিদিন বই খাতা নিয়ে যথাসময়ে এসে ক্লাস ঘরে চুপ করে বসে থাকে, হিন্দু শিক্ষকরা কেউ তাকে পড়াতে রাজি নন, ইংরেজ শিক্ষকরা এসে তার মেধাশক্তি দেখে চমৎকৃত হয়ে যান। এরকম সুদৰ্শন, সুশীল ও মেধাবী ছাত্র এ কলেজে খুব কমই এসেছে।
কিন্তু এভাবে আর কলেজ চালানো সম্ভব নয়। সরকারের শিক্ষাবিভাগ এ কলেজের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। কিন্তু একজন বারবনিতার পুত্ৰকে কলেজে গ্রহণ করার পর থেকে শহরের উচ্চবংশীয় এবং ধনী হিন্দু সমাজ এ কলেজকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে চাইছে। ওদিকে প্রতিযোগী মেট্রোপলিটান কলেজ। কয়েক মাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল, ছাত্র সংখ্যা হলো এক হাজারের বেশী। হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন প্রতিশোধ স্পহায় নবপ্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান কলেজের জন্য খাটতে লাগলেন প্ৰাণপণে, শহরের মাথা মাথা ব্যক্তিরা সাহায্য করতে লাগলেন এই নতুন কলেজটিকে, দানশীল রানী রাসমণি একাই দিলেন দশ হাজার টাকা।
হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ ছাত্র-বেতন কমিয়ে দিলেন, তবু ছাত্রদের আকৃষ্ট করা গেল না। কোনো ভদ্র বংশের ছেলেই। আর ঐ বেশ্যাপুত্ৰ চন্দ্রনাথের ছায়াও মাড়াবে না।
এ অবস্থায় আর বেশী দিন আদর্শ বজায় রাখা যায় না। চন্দ্রনাথকে কলেজে। গ্ৰহণ করার দিনটিতে যে বিপুল হুলস্থূল হয়েছিল, সে তুলনায় চন্দ্রনাথের বিতাড়ন পর্বটি হলো খুবই সংক্ষিপ্ত এবং আড়ম্বরহীন। হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ একদিন হঠাৎ তৃতীয় শ্রেণীর কক্ষের দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। তারপর চন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন, বালক, এদিকে আইস।
একজন তরুণ ইংরেজ শিক্ষক তখন পড়াচ্ছিলেন চন্দ্রনাথকে। শিক্ষক ও ছাত্ৰ দুজনেই অধ্যক্ষের কণ্ঠস্বর শুনে বিস্মিত। চন্দ্ৰনাথ ভয়ে ভয়ে উঠে এলো।
অধ্যক্ষ তর্জনী উঁচিয়ে চন্দ্রনাথকে বললেন, তুমি দূর হইয়া যাও! আর কোনোদিন এ বিদ্যালয়ে আসিবে না। কোনোদিন ইহার দ্বারা দিয়া প্রবেশের চেষ্টা করিবে না।
চন্দ্রনাথ বিমূঢ়ভাবে বললো, মহাশয়, আমি আর আসিব না?
–নাঃ!
চন্দ্রনাথ নির্বোধ নয়। সে বুঝেছিল যে তার জন্যই হিন্দু কলেজের ছাত্র সংখ্যা এত কমে যাচ্ছে। এর প্রতিকারের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ একটা কিছু ব্যবস্থা গ্ৰহণ করবেনই। তার নিজের পাঠতৃষ্ণা এত প্রবল যে সে কলেজ ছাড়ার কথা চিন্তাই করেনি। সে আশা করেছিল, তার জন্য পৃথক কোনো বন্দোবস্ত হবে। অধ্যক্ষ হঠাৎ এমন ত্রুদ্ধভাবে তাকে চলে যেতে বলবেন, এমন সে আশঙ্কা করেনি একবারও। আর এক সপ্তাহ পরেই তার পরীক্ষা শুরু হবার কথা।
সে কাতরভাবে জিজ্ঞেস করলো, মহাশয়, তাহা হইলে ইহার পর আমি কোথায় পাঠ লইতে যাইব?
অধ্যক্ষ হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোমার ইচ্ছা হয় তুমি জাহান্নামে যাইতে পারো। এ কলেজের সহিত তোমার আর কোনো সংশ্ৰব নাই!
তরুণ শিক্ষকটি উঠে এসে মৃদু প্রতিবাদ করতে গেলে অধ্যক্ষ তাকে থামিয়ে দিলেন। এবং চন্দ্রনাথ তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে অধ্যক্ষ দ্বারবানদের ডাকলেন।
বেশ্যা-পুত্রকে দ্বারবানরাও ঘৃণা করে। ইতিমধ্যে একদিন চন্দ্রনাথ জল খাবার ঘরের কলসী থেকে জল গড়িয়ে খেতে যাওয়ায় দ্বারবানরা তাকে আরে আরো জাত মারলে রে, ঘড়া মাৎ ছোঁও বলে ধমকে উঠেছিল। এখন দ্বারবানরা খুব উপভোগ্য ভঙ্গিতে চন্দ্রনাথের ঘাড় ধরে কলেজ দ্বারের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে।
প্রথম প্রথম কিছুদিন রাইমোহন নিজে রোজ কলেজ ছুটির পর চন্দ্রনাথকে নিয়ে যাবার জন্য কলেজের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইদানীং আর নিয়মিত আসে না। তা ছাড়া এখন কলেজ ছুটির সময়ও নয়। বেলা দ্বিপ্রহর। চন্দ্রনাথের ভয় হলো, পথে হয়তো আজও ভাড়াটে গুণ্ডারা তাকে মারবে। সে একা একা বাড়ি ফিরবে। কী করে? তারপর সে ভাবলো, মারে মারুক।
সে ধীর পায়ে হেঁটে প্রবেশ করলো গোলদীঘিতে, বসলো গিয়ে জলের ধারে। একটু পরেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, দুই হাঁটুতে মুখ ওঁজে সে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তার সবঙ্গে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। ঠিক কার বিরুদ্ধে যে তার রাগ বা দুঃখ তা সে ঠিক জানে না, কিন্তু তার কিশোর-হৃদয় যেন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে!
গোলদীঘিতে নিষ্কম লোক ও বয়াটে ছোঁকরাদের কখনো অভাব হয় না। বিপরীত দিকের বাজার ফেরত ফড়ে আর ব্যাপারীরাও এখানে গাছতলায় ঘুমোতে আসে। কিন্তু দুপুর রৌদ্রে জলের ধারে বসে থাকা এক কিশোরের কান্নার দৃশ্য কারুকে আকৃষ্ট করে না। কেউ তার পাশে এসে প্রশ্ন করে না, তোমার কী হয়েছে ভাই?
চন্দ্ৰনাথ অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলো। কান্নারও ক্লান্তি আছে। এক সময় থামতেই হয়। এক সময় চন্দ্রনাথ মুখ তুলে জলের দিকে চেয়ে রইলো। জলে তার মুখের প্রতিবিম্ব। অনেকেই তাকে রূপবান বলে, কিন্তু চন্দ্রনাথের মনে হলো তার মুখখানি যেন কোনো বীভৎস প্রেতের মতন। মানুষের সমাজে তার স্থান নেই। সে রামায়ণ, মহাভারত পড়েছে, মিলটন, বায়রন, শেক্সপীয়ারও পড়েছে কিছু কিছু, এসব কাব্যের জগতের সঙ্গে সে একাত্মতা বোধ করে, কাব্যের নারী-পুরুষদের সে মনে করে অতি আপনজন, কিন্তু তাকে কেউ আপনজন মনে করবে না। এই পৃথিবীতে সে কেন জন্মালো? সে তো স্বেচ্ছায় এ পৃথিবীতে আসেনি। এ পৃথিবীতে কেউই নিজের ইচ্ছেয় আসে না, তবু সে কেন একা অস্পৃশ্য!
প্ৰথমে সে একটা বই থেকে একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে ভাসাতে লাগলো জলে। তারপর এক সময় সমস্ত বই খাতপত্র কুটি কুটি করে ছিঁড়ে নিক্ষেপ করলো দীঘিতে। এরপর তার কলেজে আসবার জন্য যে বিশেষ পিরানটি প্রস্তুত করানো হয়েছিল, সেটিও সে খুলে ফেললো গা থেকে। সেটিকেও ছেড়ার চেষ্টা করলো। শক্ত বনাতের কাপড়, সহজে ছেড়া যায় না, তবু ক্রোধের চোটে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে সে দু-হাতে টানতে লাগলো প্ৰাণপণে, শেষ পর্যন্ত কুতটিকে ফালাফালা করে ফেলে সে তাতে এক তাল মাটি জড়িয়ে ড়ুবিয়ে দিল জলের মধ্যে। তারপর সে উঠে দাঁড়ালো। ধুতির কোচা খুলে কোমর বেড়া দিয়ে বাঁধলো শক্ত করে।
বাড়ির দিকে না গিয়ে চন্দ্রনাথ আচ্ছন্নের মতন ঘুরতে লাগলো পথে পথে। কোনোদিন সে একা এমনভাবে হাঁটেনি, সে এ শহরের রাস্তাঘাটও সব চেনে না। তবু যেদিকে দুচোখ যায় সে যাবে।
এক জায়গায় দেখলো, একজন সাহেবের তদারকিতে এক দঙ্গল মজুর গাছপালা কেটে সাফ করছে আর আরেক দঙ্গল মজুর একটা পুকুর ভরাট করছে। এ শহরের পথের দুপাশে দু পা অন্তর একটা করে পুকুর বা ডাবা। তার পাশে ঝোঁপঝাড়। সম্প্রতি সরকার বাহাদুর উদ্যোগ নিয়েছে ডোবাগুলি ভরাট করবে। আর ঝোঁপঝাড় আগাছার নিকেশ করবে। সন্ধে হতে না হতেই মশার উৎপাতে টেকা যায় না, ওলাউঠোয় প্রতি বছরই বাড়িকে বাড়ি ছারখার করে দিচ্ছে। এইসব আগাছার জঙ্গল আর পচা জলের জন্যই নাকি রোগ ছড়ায়।
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে সেই কর্মকাণ্ড। কিন্তু একটু পরেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, আবার তার চোখে জল আসে। ধুতির খুঁট তুলে চোখ মুছে সে আবার হাঁটতে শুরু করে।
একটু পরে একটি বিরাট ধুমধামের শোভাযাত্রার মধ্যে পড়ে গেল সে। কিসের শোভাযাত্রা তা প্রথমটায় বোঝাই যায় না। একদল লোক খোল-করতাল বাজিয়ে ধেই ধেই করে নাচছে আর চিল্লাচিল্লি করে একটা গান গাইছে। শোভাযাত্রার অগ্রভাগে একটা রথের মতন জিনিস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক, দূর থেকে সেটিকে ভালো করে দেখতে পেল না চন্দ্রনাথ। লোকগুলি সকলেই যেন একেবারে ভাবে বিভোর। চন্দ্রনাথের একবার মনে হলো এ বুঝি কোনো খানদানি মানী লোকের মড়া নিয়ে শ্মশানযাত্রা হচ্ছে।
একটু মনোযোগ দিয়ে সে গানটা শুনলো।
যিনি গুরু তিনি কৃষ্ণ না ভাবিও আন
গুরু তুষ্টে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিবা প্ৰমাণ।
প্ৰেমারাধ্যা রাধাসমা তুমি লো যুবতী
রাখ লো গুরুর মান যা হয় যুকতি।
শ্মশানযাত্রায় কি এ গান হয়? তাছাড়া খোল করতালধারীরা গাইতে গাইতে এমন লাফাচ্ছে যে দেখলে হাসি পায়। এদের দেখবার জন্য ভিড় জমে গেছে পথের দুপাশে। বারান্দা থেকে উঁকি মারছে স্ত্রীলোকেরা। চৌমাথার বেনের দোকানের সামনে ভর্তি লোক, তাদের নানারকম বেশ, কারুর কফ ও কলারওয়ালা কামিজ, রূপের বগলস অ্যাটা শাইনিং লেদার বা ইণ্ডিয়া রাবারের জুতো, কেউ পরেছে। চায়না কোট, কাঁধে ক্রেপের চাদর, হাতে স্টিক। কেউবা খ্যাংরাওঁপো, গামছা-কাঁধে। কেউ ছোট আদালতের উকিল। কেউ সেকশন রাইটার, টাকাওয়ালা গন্ধবোনে, কেউ তেলী বা কেউ কামার অথবা ফলারে যজমেনে বামুন, কোথাও বা চার-পাঁচজনের দল বাঁধা নারী, তাদের কোলে কাঁখে বাচ্চা।
যে-কোনো হুজুগেই শহরের পথে এমন ভিড় জমে যায়। কেউ ভক্তিভরে কীর্তনিয়াদের উদ্দেশে প্ৰণাম করলো, কেউ বা নানান টিটকিরির মন্তব্য ছুঁড়তে লাগলোকেউ বললে, চোখে তেমন জল নেই ক্যান, বাপ? বেহ্মরা আরও বেশী কেঁদে ভাসায়। কেউ বললে, আহা-হা, জয় গুরু গুরু, এবার হলো কলির শুরু! কেউ বললো, হরি হে মাধব, চান করবো না গা ধোবো! কেউ আরও উচ্চস্বরে বৈষ্ণবদের চেয়ে শাক্তদের গলার জোর বেশী প্রমাণ করবার জন্য বললো, ব্যোম কালী কোলকেতাওয়ালি!
কীর্তিনিয়ারা তাতে একটুও দমে না। একজন খোলাধারী মিছিল থেকে বেরিয়ে এসে দর্শকদের উদ্দেশ্য করে চটচটাং চটচটাং করে খোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে ঝুঁকে পড়ে গান ধরলো : তাৰ্থইয়া তথইয়া নাচত ফিরত গোপাল ননী চুরি করি খাঞিছে,/আরে আরে ননী চুরি করি খাঞিছে তার্থইয়া তথইয়া…। অমনি দর্শকরা হরিবোল হরিবোল দিয়ে উঠলো।
চন্দ্রনাথ ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। রথটি দেখবার জন্য তার কৌতূহল।
রথটি নানারকম ফুল ও রাংতার ঝালর দিয়ে সাজানো। তার ওপর কোনো বিগ্রহ নেই, বসে আছেন এক জ্যান্ত গোঁসাই। আজ পর্যন্ত এ শহরে কেউ রোগা চেহারার গোঁসাই দেখেনি, ইনি আবার একই তিনজনের সমান। জনা ছয়েক লোক রথটি ঠেলতে ঠেলতে একেবারে গলদঘর্ম। গোঁসাইজীর শরীরটা প্ৰকাণ্ড, মুণ্ডিত মস্তক, মধ্যে তরমুজের বৌটার মতন চৈতন্য ফক্কা। সবঙ্গে হরিনামের ছাপ। নাকে তিলক ও অদৃষ্ট (কপালে) এক ধ্যাবড়া চন্দন, ঠিক যেন মনে হয় কাকের অপকর্ম। পাছে পাপীতাপী এবং অবিদ্যাদের ওপর চোখ পড়ে সেইজন্য গোঁসাইজী চক্ষু বুজে নাম জপ করছেন।
ইনি মল্লিকবাড়ির কুলগুরু নদেরচাঁদ গোস্বামী জিউ বাবা। যত বড় ধনীর বাড়ির গুরু, তত বেশী জাঁকজমক, নইলে যজমানের ইজ্জৎ থাকে না। ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সারা শহর কাঁপিয়ে আগমন ঘটালে লোকে বলে, হ্যাঁ, অমুক বাড়ির গুরুদেব এলেন বটে!
এত হই-চইয়ের মধ্যে মিশে গিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটতে চন্দ্রনাথের মন্দ লাগলো না। কিন্তু কিছুতেই তার মনের ভার কাটে না। ঢেউয়ের মতন হঠাৎ হঠাৎ অভিমান এসে আছড়ে পড়ে বুকে। এত লোক আনন্দ ফুর্তি করে নাচতে নাচতে যাচ্ছে, ওরা তো কেউ জানে না। ওদের মধ্যে বুক ভরা দুঃখ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক কিশোর। নিজের অজ্ঞাতসারেই চন্দ্রনাথ আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
চন্দ্রনাথকে কাঁদতে দেখে এক ভক্ত তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিল রথের ওপরে, তারপর গদগদ স্বরে বলতে লাগলো, অহো, অহো, অহো! গুরো, তুমিই সত্য! ধন্য তোমার মহিমা! বালককেও তুমি তরালে। বল বাবা, বল, জয় গুরু, জয় গুরু!
চন্দ্রনাথ হাত পা মুচড়ে নেমে পড়লো। সে কুণ্ঠরোগীর মতন অস্পৃশ্য, যদি এরা সে কথা জেনে যায়? সে মিছিল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেই ভক্তপ্রবর তার হাত ধরে বললো, যাস কই, ওরে যাস কই? চল, আমাদের সঙ্গে চল, গুরুর প্রসাদ পাবি, তেমন জিনিস তোর বাপের জন্মে খাসনি।
হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো চন্দ্রনাথ। তার এখন বুক হালকা করা দরকার। সে একটি মসজিদের সিঁড়িতে বসে আবার কাঁদলো অনেকক্ষণ। তারপর সেখানেই কত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
তার যখন ঘুম ভাঙলো, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে, সন্ধ্যা সমাগত। সে দেখলো তার পাশে কয়েকটা পাই পয়সা ও আধলা পড়ে আছে। রমজানের মাস, ভক্ত মুসলমানরা নামাজ সেরে বেরুবার সময় ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখে মনে করেছে। কোনো অনাথ আতুর, তাই কেউ কেউ কিছু দান করে গেছে।
চন্দ্রনাথ সে পয়সা ছুঁলো না। ঘুম ভাঙার পর প্রথমে সে দিশাই করতে পারলো না, এখন ভোর না সন্ধ্যা। তারপর একটু ধাতস্থ হবার পর সে আবার এক বিড়ম্বনায় পড়লো। এটা কোন জায়গা? সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় সব কিছুই অচেনা মনে হয়। সে এখান থেকে বাড়ি ফিরবে। কী উপায়ে? একবার তার মায়ের কথা মনে পড়লো। এই সময় তার মা বেশভূষা পরিবর্তন করে চোখে সুমা আঁকে, সারা অঙ্গে আতর ছিটিয়ে রাত্রের বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি হয়। মায়ের প্রতি চন্দ্রনাথের কোনো রাগ হলো না, কিন্তু সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না।
মসজিদের কাছে একটা কাবাবের দোকান। সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে জটিল করছে। কোনো একটা ব্যাপারে তাদের বেশ উত্তেজিত মনে হয়। চন্দ্ৰনাথ সেদিকে এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো, এ জাগাটার নাম কী?
লোকগুলো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, কেউ উত্তর দিল না। দোকানটিতে মস্ত বড় চুল্লিতে ঝলসানো হচ্ছে মাংস, সেই গন্ধে চনচনিয়ে উঠলো ক্ষিদে। কলেজ থেকে ফিরে এই সময় চন্দ্রনাথ রোজ তার খাবার খায়। আর কোনোদিন সে কলেজে যাবে না। সে বাড়ি ফিরে গিয়ে সব কথা বললেই রাইমোহনদাদা আবার তাকে নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে। রাইমোহনদাদা অতি ধুরন্ধর, হয়তো নাম ভাঁড়িয়ে চন্দ্রনাথকে আবার অন্য কোনো জায়গায় ভর্তির ব্যবস্থা করবে। সেখানেও কিছুদিন পর চন্দ্ৰনাথ ধরা পড়ে যাবে নিশ্চিত, আবার সেখান থেকে তাকে বিতাড়িত করা হবে। না, চন্দ্ৰনাথ আর এই অপমান সহ্য করতে রাজি নয়। সে আর জীবনে কোনো বই ছোবে না।
সে এবার দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো। এই জায়গাটির নাম। এবং জানলো যে এটা গরানহাটা। আর ঠিক তখনই দূর থেকে তিন চারজন লোক ছুটে এলো এদিকে।
তাদের মধ্যে একজন ভয়ংকর চেহারার লোক হুংকার দিয়ে বললো, আরো কালু! তারপরই তার হাতে ঝলসে উঠলো একটা ছুরি, সে ঝাঁপিয়ে পড়লো আগের জটলোটার মধ্যে।
চন্দ্রনাথ এমনই ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গিয়েছিল যে কী করবে তা বুঝতে পারার আগেই কিছু লোক তাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল। আচমকা পড়ে গিয়ে তার মাথায় বেশ চোট লাগলেও সে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো, এরই মধ্যে জায়গাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই পালিয়েছে, দোকানদারও ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে, শুধু রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে একটা লোক, তার বুকে একটা আমূল ছুরি বেঁধা। লোকটার বুক ভেসে যাচ্ছে রক্তে, তখনও সদ্য মুণ্ডকাটা ছাগলের মতন কেঁপে কেঁপে উঠছে তার দেহ। একটুবাদেই একেবারে নিথর হয়ে গেল।
এরকম ভয়ংকর দৃশ্য চন্দ্রনাথ কখনো দেখেনি। তার চক্ষু দুটি যেন স্থানচ্যুত হতে চাইছে, তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। লোকটি কি সত্যিই মরে গেল? একটু আগে এই লোকটিই চাঁচাচ্ছিল তারস্বরে, এর মধ্যেই সব শেষ? একবার সে ভাবলো, কাছে গিয়ে দেখবে লোকটির নাক দিয়ে এখনো নিশ্বাস পড়ছে কি না। কিন্তু পর মুহূর্তেই তার ভেতরকার সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি তাকে বলে দিল পলায়ন করতে। সে পিছন ফিরে অন্ধের মতন দৌড় লাগালো।
দৌড়োতে দৌড়োতে কত পথঘাট পেরিয়ে গেল চন্দ্রনাথ, তার কোনো হিসেব নেই। অনেক অন্ধকার পথ পেরিয়ে সে চলে এলো একটি আলো-উজ্জ্বল পল্লীতে। এলাকার অনেক বাড়ির দরজায় জাহাজীল্যাম্প হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাজগোজ করা স্ত্রীলোকেরা। পথে মাতালের হল্লা ও জুড়িগাড়ির ভিড়। এইসব স্ত্রীলোকরা কোন উদ্দেশ্যে রাত্ৰিবেলা এত বেশী প্রসাধন করেছে, তা বুঝতে চন্দ্রনাথের কোনো ভুল হলো না। এ পল্লীর নাম যদিও সোনাগাহী। কিন্তু চন্দ্রনাথের ভ্রম হলো সে বুঝি নিজের বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। সে আবার প্রাণপণে ছুটলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা অন্ধকার অঞ্চল দেখে চন্দ্রনাথ একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে জিরোতে লাগলো। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছুরি বেঁধা লোকটির শরীর। লোকটার শরীর যেমনভাবে ছটফট করছিল, ঠিক সেইভাবেই যেন চন্দ্রনাথের শরীরও কাঁপছে। মৃত্যু এত সহজ? লোকটার নাম কাল্প, ওর বাড়ির লোক নিশ্চয়ই এখনো কিছু জানে না। ওর মা হয়তো ওর জন্য রাত্তিরবেলা ভাত বেড়ে অপেক্ষা করে থাকবে। ওরা ভাত খায় না, রুটি খায়। রুটি আর কাবাব। কালু আর কোনোদিন রুটি আর কাবাব খাবে না।
আজ চন্দ্রনাথ বাড়িতে না ফিরলেও তার মা হীরেমণি কোনো বাবুর বাড়িতে মুজরো গাইতে যাবে? রাইমোহনদাদা আজও একতলার সিঁড়ির নীচের ঘরে মদের আসর বসাবে? হীরেমণি নিজে হাতে রোজ বিকেলে ছেলেকে খাবার দেয়। আজ তো বিকেল কখন পেরিয়ে গেছে, মা এখন কী করছে? মা কি এতক্ষণে জড়ির চুমকি বসানো ঘাঘরাটা খুলে আবার আটপৌরে শাড়ি পরে এখন কাঁদতে বসেছে? কিংবা কতা দেওয়া আচে, যেতেই হবে গা, চাঁদু ফিরলে একটা খপর পাঠিয়ো বলে মা উঠে বসেছে কোনো বাবুর জুড়িগড়িতে? রাইমোহনদাদা খুঁজতে বেরিয়েছে তাকে?
চন্দ্রনাথ ভাবলো, সে যদি আজই মরে যায়, তা হলে তারপরও কি তার মা বাবুদের কাছে যাবে? চন্দ্রনাথের ধারণা হলো, সে মরে গেলে তার মা খুব কাঁদবে, শুধু কাঁদবে, আর কোনোদিন ঐ পাপের জীবনে যাবে না। তা হলে তো তার মরে যাওয়াই ভালো। কত সহজে মরে যাওয়া, কেউ তার বুকে একটা ছুরি বসিয়ে দিলেই হলো। কিংবা, সে নিজেই নিজের বুকে একটা ছুরি বসিয়ে দিতে পারে।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে চন্দ্রনাথের পেছনে কেউ একটা লাথি কষিয়ে বলে উঠলো, এই শাল্লো! ভাগ!
চন্দ্রনাথ ধড়ফড় করে উঠে দেখলো মুখ ভর্তি দাড়িওয়ালা একজন লোক, খালি গা, পরনে একটা শতাচ্ছিন্ন ধুতি, হাতে একটা বাঁশের লাঠি। মনে হয় কোনো পাগল!
লোকটি বললো, আমার জায়গায় শুইচিস শাল্লো! কাঁচা খেয়ে ফেলবো! আমার সাত পুরুষের ভিটে, এখেনে যে আয়গা, ও মরে গা!
চন্দ্রনাথ এবার তাকিয়ে দেখলো, গাছের গোড়ায় একটা মাটির হাঁড়ি আর একটা পুঁটলি পাকানো কম্বল রয়েছে। এই লোকটি এখানে শোয়, চন্দ্ৰনাথ ভুল করে সে জায়গা দখল করেছিল।
লোকটা চন্দ্রনাথকে মারবার জন্য লাঠিটা তুলেছে, অমনি চন্দ্রনাথ হাতজোড় করে অনুনয় করে বললো, মেরো না মেরো না, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
লোকটা বললো, যাবি না তো, তোর খাল খিচে দেবো, শাল্লো!
চন্দ্রনাথ সুরুত করে পালিয়ে গেল সেখান থেকে। ভয়ে তার বুকের মধ্যে দুমদাম শব্দ হচ্ছে। কালুকে ছুরি-বেঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চন্দ্রনাথ ভয় পেয়েছিল, কিন্তু এই লোকটি লাঠি তুলে দাঁড়ানোতে চন্দ্রনাথ যে ভয় পেল, তা একেবারে অন্যরকম। এ তার নিজের মৃত্যুভয়। অথচ একটু আগেই তো চন্দ্ৰনাথ মরে যেতে চাইছিল।
না। এভাবে মরা চলবে না। চন্দ্ৰনাথ মরবোই, তবে, অন্যের হাতে নয়, নিজের ইচ্ছায়। সবচেয়ে ভালো জলে ড়ুবে মরা। তাদের পাশের বাড়ির চপল নামে এক বালিকা গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে ড়ুবে মরেছিল। চন্দ্রনাথও গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। সে সাঁতার জানে না। গঙ্গায় মরলে সব পাপী-তাপীই উদ্ধার পেয়ে যায়। মা গঙ্গা সবাইকে বুকে আশ্রয় দেন। তিনি সকলের মা, তিনি জাতি বিচার করেন না, দীন দুঃখীদেরও তিনি বুকে টেনে নেন। এখন চন্দ্রনাথকে খুঁজে বার করতে হবে, কোথায় গঙ্গা।
কিছুটা দৌড়ে, কিছুটা হেঁটে চন্দ্রনাথ আবার পৌঁছে গেল লোকালয়ে। এ পল্লীটির নাম বাগবাজার। এখানে অনেক ধনী মানুষদের অট্টালিকা রয়েছে। একটি বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। এই সব ধনীদের বাড়িতে বারো মাসে তের পার্বণ লেগেই থাকে। এই বাড়ির অন্দরে খুব খাওয়াদাওয়া চলছে বোঝা যায়। বড় বড় ঝুড়িতে করে এঁটো কলাপাতা আর মাটির গেলাস ফেলা হচ্ছে রাস্তায়। সিংহদ্বারের কাছে ভিড় জমিয়েছে কাঙালীর দল। চন্দ্রনাথও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার পাকস্থলী যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষিধের আগুনে, গলা একেবারে ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। মৃত্যু চিন্তার চেয়েও তার খাদ্য চিন্তা অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠলো।
সে দেখলো একজন লোক বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃহৎ চাঙ্গারি ভর্তি লুচি এনে কাঙালীদের উদ্দেশে হেঁকে বললো, সব সার দিয়ে বসে যা, গোলমাল করবিনি, সবাই পাবি, অনেক খাবার রয়েচে, মাংস মেঠাই সব পাবি, বসে যা–
কাঙালীরা হুড়মুড় করে বসে গেল রাস্তার ওপর সার বেঁধে। একজন পাণ্ডা গোছের কাঙালী হেঁকে বললো, জয় হোক, বোসবাবুদের খাওয়া যেন অমের্ত! আর কোনো বাবুদের এমন দরাজ দিল নেই!
চন্দ্রনাথও বসে পড়েছে তাদের মধ্যে। তার গৌর বর্ণ, সুঠাম শরীর। কাঙালীদের মধ্যে তাকে একেবারেই বেমানান লাগে। তার কখনো খাবার কষ্ট হয়নি, সে যখন যা ইচ্ছে হয়েছে পেয়েছে, কিন্তু আজ কাঙালীদের সঙ্গে বসতে তার একটু দ্বিধা হলো না। তার দু-পাশে যারা বসেছে, তারা একটু অবাক হয়ে দেখলো তাকে।
চারখানা লুচি ও কুমড়োর ছক্কা খাওয়া হয়ে গেছে, এর পরেই আসছে মাংস। এইটুকু খেয়ে চন্দ্রনাথের ক্ষিধে যেন আরও বেড়ে গেছে, সে অধীর প্রতীক্ষ্ণয় আঙুল চাটছে। এমন সময় নিয়তি দেবী তার সঙ্গে আর একবার পরিহাস করলেন।
পরিবেশনকারী ব্যক্তিটি চন্দ্ৰনাথের সামনে এসে থমকে গেল। কালো কালো নোংরা চেহারার কাঙালীদের মধ্যে চন্দ্রনাথকে মনে হয় যেন কোনো দেবদূত। পরিবেশনকারীটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, তুমি কে গা? এখেনে বসোচো? তুমি কাঁদের বাড়ির ছেলে?
আর তখনই চন্দ্রনাথেরই বয়েসী এক কিশোর, ঐ বাবুদের বাড়িরই ছেলে, এগিয়ে এসে চন্দ্রনাথকে দেখে ভূত দেখার মতন চমকে উঠলো। সে বললো, ওমা, এই তো সেই ছোঁড়া! ও ছোটকাকা, দোকবে এসো, দোকবে এসো!
পরিবেশন বন্ধ হয়ে গেছে। দেউড়ির ওপাশে এক প্ৰবীণ ব্যক্তি বিশিষ্ট অভ্যাগতদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি এগিয়ে এসে বললো, কী হয়েচে? গোলমাল কিসের?
কিশোরটি বললো, ছোটকাকা, এই দ্যাকো, এই সেই ছোঁড়া। এর জন্যই তো আমার হিন্দু কলেজে যাওয়া তোমরা বন্ধ করে দিয়েচো! এই সেই বেশ্যার ছেলেটা।
বেশ্যার ছেলে যেন একটা দারুণ দর্শনীয় বস্তু। এই হিসেবে অনেকেই ভিড় করে দেখতে এলো চন্দ্রনাথকে। এমন কি কাঙালীরাও এমন একজনের সঙ্গে পঙক্তি ভোজনে বসাটা অসম্মানজনক মনে করে হই। হই করে উঠলো। যেন তাদেরও জাত চলে যাবে।
বাবুদের বাড়ির কিশোরটি বললো, এ ছোঁড়া এসে আমাদের কেলাসে ভর্তি হলো, ওর মা-মাগীটা নিজে নিয়ে এয়েছেল ওকে, সবাই দেকেচে—!
তারপরই সে, হারামীর বাচ্চা, আমাদের সৰ্ব্বেবানাশ করে আবার আমাদের বাড়িতেই খেতে এয়েচে! এই বলে এক লাথিতে উলটে দিল চন্দ্রনাথের খাবারের পাতা। তার ছোটকাকা চন্দ্রনাথের কান ধরে বললো, দূর হ! বেজন্ম কাঁহিকা?
চন্দ্রনাথ একটা কথাও বললো না। দু-তিনজন মিলে তাকে তুলে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেল খানিকটা। তারপর দ্বিপ্রহরে কলেজের দ্বারবানরা মিলে যেভাবে তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিল এখন এরাও যেন তার চেয়েও বেশী প্ৰতিহিংসায় আরও জোরে ছুঁড়ে দিল তাকে।
তবু এবার শরীরে কোনো রকম ব্যথা বোধ করলো না চন্দ্রনাথ। পড়ে গিয়েই সে তাকালো এদিক ওদিক। কাছেই একটা পাথরের চাঙ্গার দেখতে পেয়ে সেটা হাতে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। যারা তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে পরিবেশনকারী ব্যক্তিটিকে দেখে সে উন্মাদের মতন ছুটে এসে সেই পাথরের চাঙ্গড় দিয়ে মারলো তার মাথায়। লোকটি বাপ রে, মলাম রে, বলে পড়ে গেল ধপাস করে। চন্দ্রনাথ পাথরটি জোরে ছুঁড়ে মারলো অন্যদের দিকে, তারপর প্রাণপণে ছুটলো।
পাইক বরকন্দাজ সমেত অনেকেই অনেক দূর পর্যন্ত তাড়া করে এসেছিল, কিন্তু কিছুতেই তার নাগাল পেল না।
চন্দ্রনাথ ক্রমে এক সময় পৌঁছেলো গঙ্গার ধারে। কিন্তু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার কথা তখন আর তার মনে এলো না। তার হাত চটচট করছিল। প্ৰথমে সে ভেবেছিল এটো লেগে আছে, কিন্তু নদীতীরে জ্যোৎস্নায় সে ডান হাতের পাঞ্জাবি তুলে দেখলো, সেখানে লেগে আছে রক্ত। মানুষের রক্ত।
জলের কাছে নেমে গিয়ে সযত্নে হাত ধুতে লাগলো চন্দ্ৰনাথ। এক হিসেবে আজ তার আর একবার হাতেখড়ি হলো।