২৮. হীরেমণির বাড়িতে

হীরেমণির বাড়িতে এসে জগমোহন সরকার কেঁদে একেবারে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন। নেশাটি বেশ জমেছে, রাত্রিও গভীর, এই সময় জগমোহনের হঠাৎ দেশের মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা মনে পড়ে যায়, হৃদয়টা উথালি পথালি করে। বিশেষত অবলা জাতির অসহায় অবস্থা দূর করার জন্য আজও কিছু করা গেল না! অবলারা এখনো অবোলাই রয়ে গেল! জগমোহন সরকার ফিমেল উদ্ধারের জন্য সেই কবে থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু কেউ তাঁকে মদ্যুৎ দিল না। হেয়ার সাহেব মারা যাবার পর সব ধামা চাপা পড়ে গেছে আবার। জগমোহন সরকার মেয়েদের ইস্কুল খোলবার জন্য নিজে জায়গা দিতে প্ৰস্তুত আছেন, কিন্তু ছাত্রী পাওয়া যাবে কোথা থেকে? পাড়াপাড়শীরা কেউ রাজি নয়। সবাই ওকথা শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়, কেউ কেউ আবার দাঁত কিড়মিড় করে।

জগমোহন সরকার শুনেছেন যে বারাসতে নাকি মেয়েদের জন্য স্কুল খোলা হয়েছে একটি। উত্তরপাড়ার রাজা রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও স্ত্রীশিক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন, অথচ এত বড় শহর কলকাতা, সেখানে ভদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়েদের পড়াশুনোর কোনো ব্যবস্থা এখনো হলো না! সাহেব মেমরা এর আগে যে-কয়েকটা স্কুল খুলেছে, সে সব জায়গাতেই শুধু কচি কচি মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে খৃষ্টান করে নেওয়া হয়েছে। যীশু-ভজনা না করলে নাকি লেখাপড়া হয় না। কলকাতায় প্রথম অ-খৃষ্টানী বিদ্যালয় স্থাপনের কৃতিত্ব জগমোহন নিতে চান।

 

জগমোহন সরকার বারাঙ্গনা গৃহে কখনো ইয়ার-বক্সিদের নিয়ে আসেন না। এসব জায়গায় তিনি গোপনে একা আসাই পছন্দ করেন। তাঁর ধারণা, তাঁর নিজস্ব কোচম্যান এবং এক অতি বিশ্বস্ত ভৃত্য ছাড়া তাঁর এই অভিযানের কথা আর কেউ জানে না।

জগমোহন বললেন, বুজলি হীরে, এতখানি জন্মো আমার ব্ৰেথাই গেল, কিচুই করতে পারলুম। নিকো…ওফ…ওফ।

লাল মখমলে মোড়া জাজিমের ওপর হীরেমণি বসে আছে জগমোহনের মুখোমুখি। জগমোহনের এমন স্বভাবের কথা সে ভালোভাবেই জানে। এই বিশালবপু বাবুটির দুটি বিচিত্র অভ্যোস আছে। প্রথমে ঘরে ঢুকেই তিনি বেশ জোরে একটি উদগার তুলবেন। এইটিই যেন তাঁর তৃপ্তির লক্ষণ। তারপর সুরা পান শুরু করার পরও এইরকম উদগার চলতেই থাকবে। সুরাপানের সময় এমন অ্যাও অ্যাও শব্দে ঢেঁকুর তুলতে আর কারুকে দেখেনি। হীরেমণি। আর শেষের দিকে এই কান্না। জগমোহন সরকারের কান্না শুনলেই হীরেমণি বুঝতে পারে যে আর আধঘণ্টার বেশী ওঁর চৈতন্য থাকবে না।

হীরেমণি ছোট্ট একটি হাই গোপন করে বললো, আপনি অ্যাত কিচু করেচেন, অ্যাত বাড়ি, গাড়ি, বিষয় সম্পত্তি—

জগমোহন হীরেমণির হাত চেপে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ওরে তাতে কী হয়, তাতে কী হয়…এই তো গ্যালো মাসেই আর একটা বাড়ি কিনলুম, কিন্তু বিষয় সম্পত্তি সবই তো মায়া প্ৰপঞ্চ…কিচুই সঙ্গে যাবে না।

হীরেমণি বললো, আপনি দানধ্যানও কম করেননি—

জগমোহন হীরেমণিকে আরও কাছে টেনে এনে বললেন, কাপণ্য করিনি, যে যা চেয়েচে দিয়িচি…তোকে দিইনি, বল? দিইনি?

—তা দিয়েচেন বইকি! সে কতা স্বীকার না করলে আমার পাপ হবে।

—গ্যালো হস্তাতেই তোকে এক জোড়া কঙ্কণ দিলুম, আমাদের বাড়ির সুরো দাসীকে একটা আংটি দিয়িচি, কমলাকে দিয়িচি একছড়া চন্দ্ৰহার—

—এখন বুঝি কমলার ওপর খুব মন মজেচে?

—ওরে সে মাগী বড় দেমাকী। বড় দেমাকী! তোকে কী বলবো! রামকমল সিংগী মরে ভূত হয়ে গোল কবে, আর এখনও সে মাগী বেধবা সেজে ঢং করে আচে। নাক নেই তার নিথ, বেশ্য আবার বেধবা! হুঁ!

কৃত্রিম কোপ দেখিয়ে হীরেমণি নিজেকে জগমোহনের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বললো, কমলার ওপরেই যখন এত টান, তবে আর আমার কাচে আসা কেন?

 

জগমোহন তাকে নিবিড় করে টেনে এনে বললেন, ওরে কমলি আলায়দা আর তুই আলায়দা। তোর মতন গান কমলি গাইতে পারবে? কমলির গায়ের রং কালো আর তোরা যেন দুধে আলতা। আমি তো পেয়ার করি তোকেই। তবু কমলিকে কেন চাই জানিস? সে ছেল রামকমল সিংগীর মতন একজন বড়মানুষের বাঁধা মেয়েমানুষ, রামকমল সিংগী মারা গ্যাচে, এখন তার মেয়েমানুষকে কে নেবে এই নিয়ে যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গ্যাচে শহরে। বুজলি নে, রামকমল সিংগীর মেয়েমানুষকে যে নিতে পারবে তার কতটা মান বাড়বে? আমি ওর বাড়িতে প্ৰথমে একছড়া চন্দ্ৰহারি পটালুম, তা বেশ নিয়ে নিলে। ওমা, তারপর আর আসেই না, আসেই না। দুটো অন্য মাগীকে জুতে দিলে আমার সঙ্গে। সে দুটো যেন আশশ্যাওড়া গাচের পেত্নী! আমি বললুম, কমলাকে ডাকে, তার সঙ্গে দুটো কতা কইবো, তা সে পেত্নীরা বলে কিনা। উনি তো আসবেন না, আজ যে ওনার একাদশী!–শোন কতা! এমন কতা শুনলে গা পিত্তি জ্বলে যায় না?

এতক্ষণ একটু কান্নাটা থেমেছিল,আবার ফুঁপিয়ে উঠে হীরেমণির বুকে মুখ গুঁজে জগমোহন বলতে লাগলেন, তুই বল হীরে, এটা কী ওরা উচিত কাজ হয়েচে? আমার মতন একটা মানী লোককে ফিরিয়ে দিলে? উফ উফ!

হীরেমণি আদর করে জগমোহনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আহা গো, মনে বড় নেগেচে, দুঃখু করো না, দুঃখু করো না, ঐ গতরখাগী শতেক খোয়ারি কমলি ঠিক একদিন তোমার পায়ে এসে লুটোবে

—ওর থেতামুখ যদি ভোঁতা করে না দিতে পারি, তাহলে আমার নাম জগমোহন সরকার নয়। আমি জানি ব্যাচা মল্লিকও ঐ কমলির কাছে ঘুরঘুর কচ্চে! ব্যাচা মল্লিক। আমার ওপর টেক্কা দেবে!

—ব্যাচা মল্লিক তোমার নখের যুগ্য নয়!

—তুই বল হীরে, তুই বল, ব্যাচা মল্লিকের নাম কজনা জানে? সাহেবদের কাচে সুদ খাঁটিয়ে ওর বড় টাকার গরমই হয়েচে! আমি কাগচে আটিকেল লিকি, দেশের জন্য এত কাজ কচ্চি, আর ঐ কমল ষ্টুড়ি আমায় না পুঁচে ব্যাচা মল্লিককে পুঁচবে!

–কক্ষণো না।

—তুই দেকিস কমলি, আহা কমলি কি বললুম, হীরে, তুই তো আমার আসল হীরেমণি, আর ঐ কমলিটা ঝুটো মুক্তো! তুই দেকিস, আমি বালিকা বিদ্যালয় খুলে দেশে অক্ষয় কীর্তি রেকে যাবো।

-কী খুলবেন?

–ইস্কুল, মেয়েদের জন্য ইস্কুল—

—ইস্কুল? তাহলে সেখেনে আমার ছেলেটাকে ভর্তি করে নিন গো! জগমোহন সরকার ধড়ফড় করে উঠে বসে বিস্ময় বিস্ফারিত চক্ষে বললেন, ছেলে? তোর আবার ছেলে হলো কবে?

হীরেমণির মুখ থেকে কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। বারাঙ্গনাদের পুত্রসন্তান থাকতে নেই, থাকলেও বাবুদের সামনে তার কথা উচ্চারণ করা চলে না।

কিন্তু হীরেমণির মনের মধ্যে দিন দিন মাতৃভাবটিই যেন প্রবল হয়ে উঠছে। যখন তখন ছেলের কথা মনে পড়ে, এমনকি কোনো বাবুর অঙ্গশায়িনী অবস্থাতেও চোখে ভাসতে থাকে তার সন্তানের মুখ। আর হীরেমণির ছেলেটিও দিন দিন হয়ে উঠছে বড় সুন্দর। যেমন তার রূপ, তেমনি তার গুণ। বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ তার ছেলের, এর মধ্যেই পড়াশুনোয় তার বেশ মেধা দেখা যাচ্ছে। রাইমোহন কোথা থেকে একটি মাতালকে ধরে এনে আশ্রয় দিয়েছে বাড়িতে, পেঁচি মাতাল হলেও লোকটি গ্যাট ম্যাট করে ইংরেজি বলে মাঝে মাঝে, যাতে বোঝা যায় কিছু বিদ্যোসিধ্যে আছে তার। পেট খোরাকি আর নেশার দ্রব্য জোগাবার চুক্তিতে সে রোজ সকালবেলা হীরেমণির ছেলে চন্দ্রনাথকে পড়ায়। সুস্থ অবস্থায় সে বেশ বিনীত আর ভদ্র থাকে। সে চন্দ্রনাথকে নিয়ে ইংরেজি শব্দ ঘোষায় : পমকিন—লাউ, কুমড়ো, কুকুম্বার—শশা, ফিলজফর—বিজ্ঞ লোক, প্লৌম্যান-চাষা।

ছেলে লেখাপড়া শিখছে দেখে হীরেমণির চোখ কান যেন জুড়িয়ে যায়। একেক সময় এমন কথাও চিন্তা করে হীরেমণি যে সে এই পাপ ব্যবসা ছেড়ে শুধু ছেলেকে নিয়েই থাকবে। সে রাইমোহনকে জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁ গা, চাঁদুর যখন নেকাপড়া শেখার অত ঝোঁক, তা ওকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া যায় না? রাইমোহন বলেছিল, ইস্কুলে ভর্তি হতে গেলেও ওর বাপের নাম শুধোবে। তুই তো আজও ওর বাপের নাম বললিনি!

এইসব কথাই মাথায় ঘুরছিল বলে হীরেমণি ইস্কুলের নাম শুনেই ছেলের কথা বলে ফেলেছে। এখন আর কথা ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই।

সে বললো, আমার ছেলে রয়েচে-অনেকদিন। জগমোহন সরকার তবু যেন বিশ্বাস করতে পারেছেন না। এতদিন যাওয়া আসা করছেন তিনি এ বাড়িতে, অথচ হীরেমণির যে একটি ছেলে আছে, তাই টের পাননি!

–কত বয়েস?

—তা প্ৰায় আট ন বচরের হলো।

জগমোহন সরকার হীরেমণির আপাদমস্তক দেখলেন আরেকবার। পশ্চিমা স্ত্রীলোকদের মতন হীরেমণি কাচুলি ও ঘাগরা পরে আছে আজ, তার উদ্যত স্তন, মসৃণ ত্বক, ধারালো দুটি চোখ, ভরা যৌবনা যুবতী সে, তাকে জননী রূপে যেন কল্পনাই করা যায় না।

–কোথায় থাকে তোর ছেলে?

–এ বাড়িতেই থাকে, নীচতলায়!

—দূর! যত সব! আয়, আমার কাচে আয়, ঘুম পেয়েচে, তোর কোলে মাতা রেকে এবার আমি ঘুমোবো।

হীরেমণি জানে, এবার জগমোহনের ঘুমেরই সময়। চোখ জুড়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ছুটি পাবে।

জগমোহন হীরেমণির কোলে মাথা রেখে বললেন, তুই আর পাঁচ জায়গায় মুজরো খাটতে কেন যাস? আমি যা দিই, তাতে তোর কুলোয় না?

কথা না বাড়াবার জন্য হীরেমণি বললো, আচ্ছা, আর যাবো না!

–বোতলে আর ব্র্যাণ্ডি আচে? দে, আমায় শেষ এক ঢোক খাইয়ে দে।

—আপনার ইস্কুলে আমার ছেলেটাকে ভর্তি করে নিন না!

—দূর পাগলি? তোর ছেলে লেখাপড়া শিখে কী করবে? সে কি গোরস্তবাবু হবে নাকি?

—আমার ছেলে নেকাপড়া শিখলে কুঠিওয়ালাদের মতন আপিসে চাকরি করবে!

—হেঃ, যেমন তোর কতা! বেশ্যার ছেলের মাতায় কখনো বিদ্যে ঢোকে? বরং তুই ওকে কুস্তি শেখা, লাঠিখেলা শেখা, তাহলে বরং এ পাড়ার গুণ্ডোদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে।

—না গো, তার বেশ বুদ্ধি হয়েচে। সে নিজের নাম নিকতে পারে।

—তবে আর কি, যথেষ্ট হয়েচে! তাকে কুস্তি শেখাতে না চাস ড়ুগি। তবলা বাজাতে শেখা!

—কেন, আপনার ইস্কুলে তাকে একবারটি ভর্তি করে দেকুনই না–

—আরে দূর! আমার ইস্কুলে কি ছেলেরা পড়বে নাকি? ছেলেদের ইস্কুল তো গণ্ডীগণ্ডা নিত্যি নতুন গজাচ্চে। ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি ইস্কুল খুলবো মেয়েদের জন্য।

—মেয়েরা নেকাপড়া শিখবে? ভদ্রঘরের মেয়েরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে ইস্কুলে যাবে। ওমা সে কি কতা গো! সাধ করে কে জাত খোয়াবে?

—জাত খোয়াবে কেন? দেকবি ঠিক আসবে-কচি কচি, ফুটফুটে, সুন্দর সুন্দর মেয়েরা, আহা, যেন সব তাজা তাজা ফুল!

তারপর হীরেমণির স্তনে মুখ ঘষতে ঘষতে জগমোহন সরকার বলতে লাগলেন, মেয়েদের আমি বড্ড ভালোবাসি রে, বড্ড ভালোবাসি, তাদের আমি জ্ঞানের আলো পৌঁচে দেবো, তারা হাসবে, খেলবে, ছুটোছুটি করবে, আহা হা, আমি বড় ভালোবাসি।

 

হীরেমণি ঘুম পাড়াবার জন্য জগমোহনের মাথায় ছোট ছোট চাপড় দিতে লাগলো।

জগমোহন জড়িত কণ্ঠে বললেন, একটা গান শোনা, হীরে আমার, বুলবুল আমার, তোর গান শুনলেই আমার মন জুড়োয়, চোখ জুড়োয়, তোর গান শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়বো…

হীরেমণি একটুখানি গুন গুন করে সুর ভেজে গান ধরলো :

দাঁড়াও দাঁড়াও প্ৰাণনাথ, বদন ঢেকে যেও না
তোমায় ভালোবাসি তাই
চোখের দেখা দেখতে চাই
কিন্তু থাকো থাকো বলে ধরে রাখবো না।
আমি কোনো দুঃখের কথা তোমায় বলবো না
তুমি যাতে ভালো থাকো সেই ভালো
গেলো গেলো বিচ্ছেদে প্ৰাণ আমারই গেলো।

জগমোহন সরকার উপুড় হয়ে শুয়ে হীরেমণির উরুতে চাপড় মেরে মেরে তাল দিতে লাগলেন। তাঁর ঘুম প্ৰায় এলো এলো।

পাশের ঘরের দরজায় একটা মৃদু শব্দ হতেই হীরেমণি তাকালো সেদিকে। দরজাটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেছে, তার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে রাইমোহন।

রাইমোহন হাত পা নেড়ে ইশারা করছে তার দিকে। হীরেমণি বুঝতে পেরেও দু-একবার মাথা নাড়লো, রাইমোহন তবু কোনো ব্যাপারে তাকে জোর করতে চায়।

তখন হীরেমণি ঐ গান মাঝপথে থামিয়ে অন্য গান ধরলো আড়ে ঠেকায় :

হেরি অবলার দুখ, ওগো গুণনিধি
বুঝি গেল তোমার বুক ফেটে
সদরে রইলো না আগল, ওগো গুণনিধি
তবু তুমি ঢুকলে সিদ্ধ কেটে
তুমি জগতের মোহন, বংশীধারী
তাই বুঝি, ওগো গুণনিধি, চাই
ষোড়শ গোপিনী উপচারই…

জগমোহন মুখ ফিরিয়ে বললেন, এ কি গান? অ্যাঁ? এ গান তো কখনো শুনিনি! এ গান কে বাঁধলে?

হীরেমণি বললো, কাল এক ভিকিরী ছোঁড়া গাইছেল, শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গ্যালো। সুর লাগিয়েছে খাসা…এ গান আমিও আগে শুনিনি।

জগমোহন আতঙ্কিতভাবে বললেন, আবার গা তো! আবার গা একবার।

হীরেমণি আবার ধরলো গানটা।

জগমোহন শুনে যেন আঁতকে আঁতকে উঠতে লাগলেন।

বিড়বিড় করে বললেন, তুমি জগতের মোহন? তার মানে তো আমি! হেরি অবলার দুখ, ওগো

গুণনিধি, বুঝি গেল তোমার বুক ফেটে—এ তো আমার সম্বন্ধে-কী সব্বোনেশে কথা, তবু তুমি ঢুকলে সিঁধ কেটে, আমি কোথায় সিঁধ কেটে ঢুকিচি? অ্যাঁ? খবর্দার, এ গান গাইবি তো জিভ ছিঁড়ে দোবো! কে এ গান তোকে শিখুলে সত্যি করে বল।

হীরেমণি নিরীহ মুখ করে বললো, বললুম তো, এক ভিকিরি ছোঁড়া গাইছেল।

—সে কোথাকার ভিকিরি?

—তা আমি কী করে জানবো। আমি তো তার ঠিকুজী ঠিকানা রাখিনি! তবে সে আসে মাঝে মাঝে, দু-চারদিন অন্তর।

—ওরে কেউ আমার সৰ্ব্বেবানাশ করতে চাইচে! কেউ আমার পেচুনে লেগেচে। আমার নামে কুচ্ছে রটাচ্ছে। তুই এ গান গাইতে গেলি কেন, বল? সত্যি করে বল?

—ও মা, আমি জানবো কী করে যে এ গানে আপনার ঘুম চটে যাবে? আমি ভাবলুম ভক্তির গান, শুনে তাড়াতাড়ি আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন-রাত অনেক হলো।

-ভক্তির গান? অভক্তি! অভক্তি! লোকের ভালো করতে গেলে এই হয়। এ গানের আরও পদ আচে নাকি?

হীরেমণি মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, হ্যাঁ গো। অনেক আচে।

পরের লাইনগুলি শুনে জগমোহন সরকার প্রায় তিড়িং তিড়িং করতে লাগলেন। বিরাট শরীর নিয়ে তিনি একবার ঘরের এদিক আর একবার ওদিক ছুটতে লাগলেন উদভ্ৰান্তের মতন। চোখ দিয়ে আবার জল গড়াচ্ছে। ধরা গলায় বলতে লাগলেন, গভীর ষড়যন্ত্র! গভীর ষড়যন্ত্র! কে এমন করলে? ব্যাচা মল্লিক? বাগাড়ম্বর মিত্তির? ওফ! হীরে, তুই আমায় বাঁচা!

হীরেমণি বললো, আমি সামান্য মেয়েমানুষ, আমি আপনাকে কী করে বাঁচাবো?

জগমোহন সরকার হাহাকার করে বললেন, তুই এ গান ভুলে যা! কোনোদিন ভুলেও আর গাইবনি। তুই পাঁচ জায়গায় মুজরো গাইতে যাস, কোনোদিন যেন তোর মুখ ফস্কে এ গান না বেরোয়। কতা দে আমায়। দিব্যি করা!

বাঁ হাতের মধ্যম থেকে একটি বড় পান্না-বসানো আংটি খুলে হীরেমণির কোলে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, এই নে! ওরে, তুই এ গান ভুলে যা!

হীরেমণি ভালোমানুষের ঝিয়ের মতন বললো, আপনি হুকুম করচেন, এরচে আর বড় কতা কী! মুকুন। কানোদিন এ গান আর মনও আনবো না। এ গানের মধ্যে যে আত তা আমি জানবো কী করে।

—তুই না হয় গাইবি না, কিন্তু সেই ভিকিরি ছোঁড়া?

—তার আমি কী করে মুখ আটকাবো বলুন?

–তুই বললি না যে সে আসে মাঝে মাঝে?

–তা আসে।

এবার এলেই তাকে চেপে ধর। তাকে মুখ সামলে থাকতে বলবি, নইলে, তাকে ভয় দেকাবি, আমি তাকে গারদে পুরে দেবো! বুঝলি?

–হ্যাঁ বুজলুম।

কোটের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দু মুঠো টাকা বার করে জগমোহন সরকার ছুঁড়ে দিলেন। হীরেমণির দিকে। বললেন, এই নে! আরও নে! আমার মুখ রক্ষে কর। তবু তুমি ঢুকলে সিদ্ধ কেটে ওরে বাপরে বাপ, কী সাংঘাতিক কতা। আমার মতন একটা মানী লোক—

হীরেমণি বললো, আপনি অত ছটফটাচ্চেন কেন? শুয়ে পড়ুন, এবার ঘুমোন।

জগমোহন সরকার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আর আমি শুয়িচি, ঘুম আমার মাতায় উঠে গ্যাচে। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলচে-ভোর হতে আর দেরি নেই বোধহয়, আমি গঙ্গাচ্চান করে তবে বাড়ি ফিরবো।

 

আর একটুও অপেক্ষা করলেন না জগমোহন সরকার, দরজা খুলে অন্ধকারের মধ্যেই দুপদাপ করে নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে। তারপর বাইরে শোনা গেল তাঁর জুড়িগাড়ির শব্দ।

দরজা ঠেলে এ ঘরে এসে রাইমোহন একেবারে হেসে আকুল। হীরেমণিও হাসতে লাগলো। একটা গানে যে এরকম প্রতিক্রিয়া হবে, তা হীরেমণি কল্পনাও করতে পারেনি।

রাইমোহন বললো, দেকলি, হীরে, দেকলি, কেমন ওষুধ ধরেচে!

হীরেমণি বললো, ইস, মনে বড্ড দাগ পেয়েচেন গো! কাটা পাঠার মতন ছটফটাচ্চিলেন মানুষটা।

রাইমোহন বললো, হবে না! ঐ সিঁদ কাটার কথাটাতেই আতে ঘা লেগেচে যে! সত্যি যে সিঁধ কাটে।

-সে কি গো! অত বড় একটা মানুষ!

—রেকে দে তোর বড়মানুষ। ও একটা পিশেচেরও অধম! ফিমেল উদ্ধারের নাম করে ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে জাত কুল নষ্ট করচে। এক ব্ৰাহ্মণের বিধবা, একটি মাত্র ছোট মেয়ে আচে তেনার, সেই মেয়েকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনবার জন্য মেয়ের মায়ের সব্বেনাশ করে দিলে গো! আমি সব জানি। এতেই কী হয়েচে, ওকে নিয়ে আরও একটা গান বেঁধেচি, সেটাও তোকে শিকিয়ে দেবোখন।

হীরেমণি বললো, অমন গান দ্বিতীয়টি শুনলে উনি আর ইদিক পানেই আসবেন না!

রাইমোহন বললো, আসবে, আসবে, যত বেশী শুনবে, ততই বেশী জ্বলেপুড়ে আসবে। শুধু জগু সরকার কেন, ব্যাচা মল্লিককে নিয়েও একটা গান বাঁধা হয়ে গ্যাচে আমার। এবার কারুক্কে ছাড়বো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *