৪০. চোরকুঠুরির ভেতর শুয়ে

চোরকুঠুরির ভেতর শুয়ে-শুয়ে এই কথাগুলোই ভাবছিলে ভূতনাথ। রাত্রের নির্জনতা নেমে এসেছে বড়বাড়িতে। কিন্তু আগের চেয়েও যেন চারিদিক আরো নিস্তব্ধ। দক্ষিণের বাগানের দিক থেকে সেই শব্দগুলো আর আসে না। দাসু জমাদারের ছেলের বাঁশীতে—’ওঠা-নামা প্রেমের তুফানের সুর আজ আর শোনা গেল না। সেই অদৃশ্য পাখীটা আর ডেকে উঠলো না বাগানের আমলকি গাছটার ডাল থেকে। রাত অনেক হলো আস্তে-আস্তে। কিন্তু বংশী তো এখনও এল না।

বংশী বলে গিয়েছিল—খুব সাবধানে থাকবেন শালাবাবু, মেজবাবু খুব রেগে গিয়েছে সব শুনে বলেছে, বাড়ির বউ-এর সঙ্গে বাইরের পুরুষ দেখা করে, এ কেমন কথা!

ভূতনাথ বলেছিল—তবে আমার আর এখানে থাকা কেন বংশী—কালই চলে যাই এখান থেকে।

বংশী বলেছিল–ছোটমা যদ্দিন আছে, তদ্দিন থাকুন শালাবাবু, এখন তো হাঁড়ি আলাদা—তারপরে আমিও আর থাকছি না আজ্ঞে-কার জন্যেই বা থাকা।

সত্যিই তো! ভেবে দেখতে গেলে বড়বাড়ির ঐশ্বর্যের আকর্ষণ আর ভূতনাথের নেই। সে ছিল প্রথম-প্রথম। বড়বাড়িতে গাড়ি, ঘোড়া, চাকর-বাকর, বিয়ে, পূজো—সমস্তর সঙ্গে ভূতনাথ একদিন একাত্ম করে দিয়েছিল নিজেকে। সকলের সঙ্গে তারও জামা-জুতো-কাপড় আসতো। আর সকলের সঙ্গে ভূতনাথও নিজেকে এ-বাড়ির একজন বলে ভাবতো!!

বংশী বলেছিল-এবার বোধ হয় পূজোও বন্ধ হবে আজ্ঞে ভাগের পূজো, কে ভার নেবে বলুন তো?

তা সত্যিই তাই হলো। এতদিনকার পূজা, এত স্মৃতি জড়ানো! এতগুলো মানুষের কল্যাণকে জলাঞ্জলি দিয়ে পূর্বপুরুষের পূজো বন্ধ রইল—এ যেমন অভাবনীয় তেমনি মর্মান্তিক। কলকাতার সমাজে বদনাম হয়েছে এবার চৌধুরীবাবুদের। নটে দত্ত ছোটবাবুর চুনীদাসীকে নিয়ে আছে। গাড়ি নাকি কিনে দিয়েছে তাকে। বড়বাড়ির এত বড় পরাজয়কে চোখের সামনে দেখেও সম্বিত ফিরলো না কারো। আর ননীলাল! সেই ননীলালের কাছেই এখন এত বড় বাড়ি, অবশিষ্ট যা কিছু সব দাসখৎ লিখে দিতেও বাধলো না চৌধুরীদের আত্মমর্যাদায়। মাসেমাসে সুদ নিতে আসে ননীলালের বাড়ির লোক। এ কেমন করে রক্ষা পাবে। অনিবার্য ধ্বংসকে কেমন করে নিবারণ করবে এরা।

মাঝ রাত্রে দরজায় টোকা পড়লো।—শালাবাবু।

বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে দিয়েছে ভূতনাথ। বললে-এসেছে বংশী? আমি তখন থেকে কেবল ভাবছি।

—চলুন, কিন্তু মেজবাবু আজকে মেজমা’র ঘরে শুয়েছে।

–বৌঠানকে খবর দিয়ে রেখেছো তো তুমি?

–দিয়েছি, কিন্তু খুব আস্তে-আস্তে যাবেন হুজুর, দেয়াল উঠে গিয়েছে বারান্দার মধ্যে, কিন্তু গলার শব্দ ও-পাশ থেকেও শোনা যায় কিনা।

টিপি-টিপি পায়ে আবার বৌঠানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভূতনাথ।

বৌঠান বোধ হয় ঘুমোচ্ছিলো। ভূতনাথের খবর পেয়ে উঠে বসেছে। কিন্তু তখনও ঘুম-জড়ানো চোখ। ভূতনাথকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—কোথায় ছিলি এতদিন ভূতনাথ?

ভূতনাথ বললে—রাগ করো না বৌঠান, আমি ছিলাম না এখানে, আজ এসেছি—রাত্তির ছাড়া তো তোমার কাছে আসা যায় না।

বৌঠান বললে—যেখানে ছিলি সেইখানেই থাকলে পারতিস, আর আসা কেন-কী দেখতে এসেছিস?

ভূতনাথ ভালো করে চেয়ে দেখলে। বৌঠানের গায়ের গয়নাগুলো যেন কম-কম। নাকের নাকছাবিটা কোথায় গেল? হীরের সে কানফুলটাও নেই। অন্য একটা সোনার দুল রয়েছে সেখানে।

ভূতনাথ বললে—তুমি সেই বরানগরে যাবে বলেছিলে সেদিন, তাই জন্যে এসেছি বলতে—যাবে বৌঠান একদিন?

–আমাকে সত্যিই নিয়ে যাবি তুই ভূতনাথ? বৌঠান যেন এক নিমেষে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললে—ছোটকর্তার কী দশা হয়েছে ভূতনাথ—চোখে দেখা যায় না মানুষটাকে, দিন-দিন আরো বাড়ছে। আর সারবে না বোধহয়—শশী ডাক্তার দেখছে, টাকাও নিয়ে যাচ্ছে মুঠো-মুঠো—আমি শুধু বলবে গিয়ে—ছোটকর্তা যেন ভালো হয়ে ওঠে—আর আমার কোনো মান নেই।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—তুমি মদ খাওয়া ছেড়েছে। বৌঠান?

—ছাড়তে আর পারলুম কই রে ভূতনাথ, লুকিয়ে-লুকিয়ে এখনও আনাই, বংশীও আজকাল আর কথা শোনে না আমার কেউ কথা শোনে না—তবু না খেয়েও পারি না—অথচ ছোটকর্তা কেমন করে না খেয়ে থাকে কে জানে—বৌঠান তাকিয়ায় হেলান দিলে এবার।

ভূতনাথ বললে—আমিও তোমার জন্যে মান করবে বৌঠান, তুমি যেন ভালো হয়ে যাও—আমারও পাঁচ পণ পান-সুপুরি যোগাড় করে রেখে দিও।

—তা হলে কবে যাবি? বৌঠান জিজ্ঞেস করলো।

ভুতনাথ উত্তর দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ বাইরে যেন কিসের গোলমাল শুরু হলো। সঙ্গে-সঙ্গে ঝড়ের মতন বংশী ঘরে ঢুকেছে!

—শালাবাবু, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে—চলে আসুন।

—কী হলো রে বংশী? বৌঠানের কথার জবাব দিলে না বংশী। শুধু বললে—তুমি বেরিও না ছোটমা—আমি আসছি।

বাইরে এসে বংশী বললে—আপনি চোরকুঠুরিতে ঢুকে পড়ন আজ্ঞে—ওদিকে বৈঠকখানায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

আগুন? ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে। বললে—কে?

বংশী বললে—আপনি ঘর থেকে বেরোবেন না যেন আজ্ঞে। সবাই জড়ো হয়েছে উঠোনে, মেজবাবুকে ডাকতে গিয়েছে বেণী।

—কে আগুন দিলে বংশী?

বংশী চলতে-চলতে বললে–বদরিকাবাব।

–বদরিকাবাবু? কেন?

ভূতনাথের যেন বিস্ময়ের আর অন্ত নেই। বদরিকাবাবু এত জিনিষ থাকতে শেষে কিনা আগুন জ্বালালে?

বংশী বললে—এদানি ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিনা।

—মাথা খারাপ হলে আবার কবে?

—আজ্ঞে, মেজবাবু সেদিন বকেছিল যে ওকে খুব, বাড়িতে পনেরোটা ঘড়ি, একটাও ঠিক সময় দেয় না-দিনরাত কেবল চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকে। তাই মেজবাবু তাড়িয়ে দেবে ভয় দেখিয়েছিল। বিধু সরকার মশাই বলেছিল—আর দরকার নেই লোকের—ঘড়ির দম নিজেমাই দিয়ে নেবে। একটা লোকের খেতে কি কম খরচ!

বংশী চলে যেতেই চোরকুইরি থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে একান্তে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভূতনাথ দেখতে লাগলো। অন্ধকার উঠোনের সামনে আলোর লাল আভা ফুটে উঠেছে। সবাই জড়ো হয়ে ঘড় ঘড়া জল ঢালছে বৈঠকখানার দিকে। এ কেমন প্রতিশোধ নেওয়া! বংশীও সকলের সঙ্গে ঘড়ায় করে জল নিয়ে ঢালছে। জলে-জলে ভেসে গেল উঠোনটা। ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন একটা চিমসে পোড়া গন্ধ সমস্ত বাতাসকে যেন কলুষিত করে দিয়েছে। নাকে কাপড় দিলে ভূতনাথ।

ততক্ষণে দেখা গেল যেন সবাই বৈঠকখানা ঘর থেকে কাকে টেনে বার করছে। অন্ধকারে লোকজনকে ছায়ামূর্তির মতো মনে হয়। কিছু স্পষ্ট চেনা যায় না। আকাশটা ঘোলাটে। কোথাও চাঁদের চিহ্নমাত্র নেই। ভয়ার্ত রাত যেন হঠাৎ আরো ভয়াল হয়ে উঠলো।

বংশী আবার এল। বললে—আপনি ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকুন। আজ্ঞে। ওখানে মেজবাবু এসেছে—আপনাকে দেখতে পাবে।

ভূতনাথ বললে—কাকে ঘর থেকে যেন টেনে বার করলে বংশী?

—আজ্ঞে, বদরিকাবাবুকে, পুড়ে একেবারে বেগুনপোড়া হয়ে গিয়েছে শালাবাবু—এখনও একটু-একটু জ্ঞান আছে, চি-চি করছে।

—কী করে হলো?

বংশী বললে—বাড়িতে আর একটাও ঘড়ি নেই হুজুর, পনেরোটা বড়-বড় ঘড়ি, সব জড়ো করেছে বৈঠকখানায়, তার ওপর নিজের জামা-কাপড় চাপিয়ে, তার ভেতরে নিজে ঢুকে আগুন দিয়ে দিয়েছিল। কী সহি ক্ষেমতা বলুন—কখন যে সব বসে-বসে তোড়জোড় করেছে, কেউ টের পায় নি আজ্ঞে-বলেই বংশী আবার দৌড়ে ওদিকে চলে গেল।

এতক্ষণে দমকল এল বুঝি। ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজাতে-বাজাতে ঢুকে পড়লো বড়বাড়ির ভেতর। তার সঙ্গে পাড়ার লোকের চিৎকারে ছায়াচ্ছন্ন রাত কলমুখর হয়ে উঠলো। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। আশে-পাশের বাড়ির ছাদে লোকজন জড় হয়েছে। আগুনের শিখা নিবে যাবার পরেও ধোঁয়ায় আর চোখ মেলা যায় না। চোখ জ্বালা করতে লাগলো ভূতনাথের। দমকল এসে শা-শাঁ করে জল ছিটিয়ে সমস্ত বাড়িটা ভিজিয়ে একেবারে একসা করে দিলে। সমস্ত ঠাণ্ডা হলে যেন এতক্ষণে। ভূতনাথ চোরকুঠুরির ভেতরে ঢুকে দরজায় খিল বন্ধ করে দিলে আবার। দরকার কী! মেজবাবু হয় তো দেখে ফেলবে তাকে! কাল অনেক কাজ—ভোর রাত্রে উঠেই জবাদের বাড়িতে যেতে হবে। তারপর বিকেলবেলা বৌঠানকে নিয়ে আবার বেরোতে হবে বরানগরে। আজ আর রাত বুঝি বেশি নেই। একটু চোখ বুজবার চেষ্টা করলে ভূতনাথ।

কিন্তু তবু অন্ধকারের মধ্যেই যেন বদরিকাবাবুর চেহারাটা ভেসে ওঠে বিনিদ্র চোখের সামনে। কিন্তু ঘড়িগুলোর ওপর অত রাগ কেন বদরিকাবাবুর! যে লোক প্রতিদিন ঘণ্টায়-ঘণ্টায় ঘড়ি মিলিয়ে রাখতে, সময়ের পদধ্বনি শোনবার আশায় সঙ্গে টাকঘড়ি রাখতে দিনরাত, তার এ কী কাণ্ড! তবে কি বদরিকাবাবু সময়ের গলা টিপে মারতে চেয়েছিল? কিম্বা সময় বুঝি বদরিকাবাবুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে শেষ পর্যন্ত! কে জানে!

 

এ এক আশ্চর্য রাত। ঘুমও ঠিক নয় আবার জাগরণও নয়। ঘুম আর জাগরণের মধ্যেই মনে হলো যেন বদরিকাবাবুর আত্মা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে। যেন বদরিকাবাবু ঘুরে-ঘুরে আজ প্রত্যেক ঘরে দেখতে এসেছে নিজে। সব ঘড়িগুলো পুড়েছে তো শেষ পর্যন্ত! পনেরোটা ঘড়ি। ওয়াল ক্লক। এতকাল সঠিক সময় দিয়ে এসেছে কালের সঙ্গে দুলে-দুলে। ভূমিপতি চৌধুরীর আমল থেকে প্রত্যেক পদে-পদে তারা কেল্লার তোপের সঙ্গে ঘণ্টা বাজিয়েছে। বার্তা শুনিয়েছে জয় ঘোষণার। কাহিনী শুনিয়েছে বিজয়-গৌরবের। তাই আজ যেন বদরিকাবাবু হঠাৎ ধমক দিয়ে বললেন—থাম, থাম মিথ্যেবাদীর দল।

বংশী বলেছে—মেজবাবু খুব বকুনি দিয়েছিল যে আজ্ঞে।

-কেন?

—দেখতে পায় তো সবাই, কোনো কাজ করে না, চুপ-চাপ শুধু শুয়ে থাকে চিৎপাত হয়ে। মেজবাবু শুধু বলেছিল—ঘড়িগুলোতে ধুলা জমেছে, কালি জমেছে, দেখতে পাও না?

বদরিকাবাবু বলেছিল—ও ধুলো নয় স্যার পাপ, পাপ জমেছে সব।

-পাপ? কিসের পাপ? মেজবাবু হেয়ালি বুঝতে পারেনি।

বদরিকাবাবু বলেছিল—সব রকমের পাপ স্যার, অত্যাচার, অন্যায়, অপব্যয়ের পাপ, কুঁড়েমির পাপ পাপের কি আর শেষ আছে এ-বাড়িতে?…

মেজবাবু তবু বুঝতে পারে নি। বিধু সরকারকে গিয়ে বলেছিল —ঘড়িবাবু কি পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি বিধু?

বিধু সরকারের তো রাগ ছিলই বহুদিনের। সেই যেদিন মোটর এসেছিল বাড়িতে ইব্রাহিমের ছেলেটা থুতু দিয়েছিল মুখে। সব মনে ছিল তার। বললেও তো বরাবরই পাগল মেজবাবু, আপনি তো দেখেন না কোনো দিকে, কেবল খাবার কুমীর, রোজ চার সের চালের ভাত খায় একলা, অথচ কী-ই বা কাজ, আমি নিজেই দম দিতে পারি ঘড়িতে, ও আবার একটা কাজ নাকি!

মেজবাবু বলেছিল—তা হলে দাও ওকে তাড়িয়ে।

তা সেই তাড়িয়ে দেবার কথা শুনেই এই কাণ্ড! কখন যে সব ঘড়িগুলো দেয়াল থেকে নামিয়েছে, কখন জড়ো করেছে ঘরে, কখন আগুন জ্বালিয়েছে কেউ টের পায়নি। আর তা ছাড়া কে-ই বা ও-ঘরের দিকে যায়!

ভূতনাথের মনে হলো—সময় যেন সব একসঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বদরিকাবাবু চলে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে বড়বাড়িতে যেন আর চলছে না কিছু। অচল হয়ে গিয়েছে সব। সব। যেন কালের চাকা ভেঙে গিয়েছে। খুড়িয়ে-খুড়িয়ে যদিই বা একটু চলছে তা-ও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার জন্যেই। দম আটকে আসছে সংসারের। তিনটে সংসারের তিন-চারে বারোটা দেয়ালের মধ্যে বড়বাড়ির আত্মা যেন অসাড় মুমূষু। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। ব্রিজ সিং আজো দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় বটে। মেজবাবুর গাড়ি কচিৎ কদাচিৎ যখন বেরোয় তখন চিৎকার করে—হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার হো–কিন্তু গলাটা যেন ভাঙা-ভাঙা। গাড়ি বেরিয়ে গেলেই সামনের ফেরিওলাকে ডেকে বসে-বসে গল্প জোড়ে। খইনি খায়। আগের মতন তেমন খাতির করে না কেউ আর। আবার সব দিন পাগড়ি পরতেও মনে থাকে না। গেট-এর গা দিয়ে একটা অশ্বত্থ গাছের চারা গজিয়েছিল বহুদিন আগে, সেটা এখন ডাল-পালায় ছেয়ে ফেলেছে মাথাটা। তারই ছায়ায় দাঁড়িয়ে ব্রিজ সিং বলে—এ ভুখন ভাই, কা খবর মুলুক কা

ভুখন আসে। দু’ দণ্ড গল্প করে। খইনি দেয়। আবার চলেও যায়। নিজের কাজে।

উঠোনের মাঝখান দিয়ে যে-পাঁচিলটা উঠেছিল, তার মাথাতে শ্যাওলা জমেছে। শীতকালের দুপুরবেলা একদল কাক এসে বসে তার ওপর। এটো ভাত তরকারি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কাড়াকাড়িতে সে-ভাত-তরকারি উঠোনময় ছড়াছড়ি। দাসু জমাদার আগে দু’বার করে ঝাঁট দিতে উঠোন। এখন সেই এটো তিন দিন ধরে শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে যায়। শুধু হাঁটা পথটা মানুষের পায়ে-পায়ে পরিষ্কার থাকে। সৌদামিনী বাঁ হাতে ঘোমটা টানতে-টানতে বাইরে উঠোনের দরজায় আসে। তারপর উঁকি মেরে এদিক-ওদিক দেখে ভাতের এটো মাছের কাটাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাঁচিল ডিঙিয়ে।

যদি হঠাৎ সদুর-মা দেখতে পায়, বলে—তোর আক্কেলখানা কী লা—মাছের আঁশ যে বাড়িময় করলি—এখন কি নোংরা ছুঁয়ে চান করবো এই বারবেলায়।

বিধু সরকার আসে একবার সকালবেলা। ক্যাশ বাক্সয় ধুনট গঙ্গাজল দিয়ে লেখাপড়া করে কিছুক্ষণ। দু’একজন যদি আসে তো বলে—আজ হবে না হে, আজ বিষুবার, বিষ্যৎবারের বারবেলা, কলিকাল বলে কি ধম্মকম্মও উল্টে গেল নাকি সব?

তারপর দুপুরবেলা খাজাঞ্চীখানায় তালাচাবি লাগিয়ে বেরিয়ে যায় আদালতে মামলা-মকদমার তদ্বির-তদারক করতে হয়। অনেকগুলো মামলা একসঙ্গে থাকে। নথিপত্র নিয়ে সারাদিন ঘুরে বড়বাড়িতে যখন এসে পৌঁছিয় তখন সন্ধ্যে। তখন মেজবাবুর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ হয়।

বিধু সরকার বলে—আজ আবার দিন পড়লো হুজুর।

মেজবাবুর তখনও তামাক ভালো করে ধরেনি। বেণী ককেতে ফুঁ দিচ্ছিলো পাশে বসে! বলে—নটে নত্ত কী বললে বিধু?

বিধু সরকার বলে—বড়বাবুর অংশ তো শোধ হয়ে গিয়েছে। এখন আপনার আর ছোটবাবুর অংশটা পেলে তবে মামলা তুলে নেবে বলেছে।

মেজবাবু বলে—তুমি একবার ননীবাবুর পটলডাঙার বাড়িতে যাও তো বিধু।

—আজ্ঞে, ননীবাবু তো বিলেতে।

—তা হোক, তার সম্বন্ধীরা আছে, শাশুড়ী আছে—সবাই আছে। বলে এসো, এ-মাসের বাকিটা একসঙ্গে ও-মাসেই দিয়ে দেবোনইলে কবে আবার মামলা করে বসবে।

বিধু সরকার ধুলো-পায়েই আবার বেরিয়ে পড়ে। মেজবাবু বসে-বসে তামাক টানতে-টানতে একবার বেণীকে ডাকে। বেণী তখন সংসারের অন্য কাজ করছে। রান্নাবাড়ির উঠোন থেকে শুনতে পাওয়া যায় না মেজবাবুর ডাক। উঠোন ঝাঁট দেয় আর বলে—কালই আমি দেশে চলে যাবো গিরি।

গিরি মেজমা’র জন্যে পান সাজতে এসেছিল। বলে—যাস, যাস —ভয় দেখাচ্ছিস কাকে শুনি—ওই তো ওদের বংশী একবচ্ছর মাইনে পায়নি—কাজ করছে না? কাজ করতে ভয় করি নাকি আমি? যা না তুই চলে, তা বলে গেরস্তবাড়ির কাজ বন্ধ থাকবে ভেবেছিস?

তা কাজ কি আর বন্ধ থাকে? কোথা থেকে সব জিনিষপত্তার আসে কে জানে! মেজবাবুর জন্যে সময় মতো তামাকও আসে। মদও আসে। আর আসে হাসিনী, বড়মাঠাকরুণ, মেজমাঠাকরুণ। নাচঘরে বসে সবাই আজকাল। মাঝে-মাঝে ঘুঙুরের শব্দও শোনা যায় ভেতর থেকে। গানের শব্দ ভেসে আসে। ঘণ্টায়ঘণ্টায় তামাক দিয়ে আসে বেণী। কোনো-কোনো দিন রাত বারোটা বাজে। কোনোও দিন বা একটা।

আবার আর একদিন মুন্নালাল এল। পায়ে নাগরা, মাথায় মুরেঠা। বললে—কোথায়, সরকার সাহেব কোথায়?

বিধু সরকারের তালাচাবি লাগানো খাজাঞ্চীখানা। মুন্নালালও যেন অবাক হয়ে গিয়েছে সব দেখে-শুনে। এই উঠোনেই কতবার এসে দাঁড়িয়েছে সে। কতবার বিধু সরকারের ঘরে গিয়ে বসেছে। কিন্তু এ-যেন অন্য চেহারা। উঠোনের মধ্যে এবার একটা পাঁচিলের ব্যবধান দেখে কেমন যেন সন্দেহ হলো তার।

বেণী যাচ্ছিলো। বললে—কী সাহেব, কী খবর? নান্নেবাঈ এসেছে নাকি?

-বাবু সাহেব কোথায়?

মেজবাবুকে খবর দিলে বেণী।

মেজবাবু বললে–নিয়ে আয় তাকে এখানে।

নাচঘরে ঢুকে আভূমি নিচু হয়ে মুন্নালাল সেলাম করে বললে— হজৌর খোদাবন্দ,

—কী রে মুয়ালাল, বেটা এসেছিস–নাবো কোথায়?

—একদিন গান-বাজনা হবে না হুজুর?

–জরুর হবে, আলবাৎ হবে—কে বললে হবে না, কোন্ আহাম্মক বলেছে? মেজবাবুর মেজাজ রঙিন ছিল তখন।

মুন্নালালের কথায় যেন নবাবী মেজাজে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। বললে-লে আও নাগ্নে বাঈকো–

—যো হুকুম খোদাবন্দ,–

তা এল নাম্নেবাঈ। বড়বাড়ি যেন বহুদিন পরে আবার হেসে উঠলো। আবার ঝাড়-লণ্ঠন জ্বলে উঠলো নাচঘরে। আবার মোহর পড়লো রূপোর থালায়। সারেঙ্গীওয়ালা মাথা হেলিয়ে বাজায় আর নাম্নেবাঈ-এর ঘাগরা ওড়ে। আতরদান থেকে আতরের ফোয়ারা ছোটে। ভৈরববাবু আজ নেই, তারকবাবু, মতিবাবু কেউ-ই নেই, তবু তাতে মেজবাবুর কিছু আসে যায় না। মেজবাবু একাই এক শ’। পায়ের পামশু কোথায় খুলে পড়ে গেল তার। পরনের কাপড় গেল খসে। অনেকদিনের পর আবার জমে উঠেছে নাচঘর। রূপের আর রূপের বাহার খুলেছে বহুদিন বাদে।

মেজবাবু চিৎকার করে উঠলো—কেয়াবাৎ—কেয়াবাৎ–

নান্নেবাঈ তখন মেজবাবুর চোখে চোখ রেখে গাইছে—

নয়না না মেরে রাজা
ঘুঘুট ঘটপট খোলে—

হঠাৎ যেন সারেঙ্গীর তার ছিঁড়ে গেল।

মেজবাবু হঠাৎ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে তাকিয়ার ওপর উপুড় হয়ে পড়েছে। নান্নেবাঈ ভয় পেয়ে গান থামিয়ে দিয়েছে। সারেঙ্গীওয়ালা থামিয়ে দিয়েছে হাতের ছড়ি।

বেণী কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকলো—বাবু, মেজবাবু, ও মেজবাবু–

ভূতনাথের এ-সব শোনা ঘটনা। রোজ ভোরবেলা বেরিয়ে যায় ভূতনাথ। আর আসে সেই রাত্রে। মেজবাবুর দৃষ্টিকে এড়িয়ে চলতে হয়। শুধু কি মেজবাবু। বিধু সরকারই কি কম! দুজনেই যেন যমের মতন খর-দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে। একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে গেলে বড়বাড়ি ছেড়ে দেবে ভূতনাথ। কিন্তু মনে হয়—এই সময়ে বৌঠানকে ছেড়ে চলে যাওয়াই কি উচিত হবে!

ছোটকর্তার তরফে এক-একদিন রান্না হতে দেরি হয়ে যায়। সেজখুড়ি সকালে উনুনে আগুন দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। বাজার তখনও আসেনি। ছোটকর্তার বিছানা সাফ করে, তাকে ওষুধ খাইয়ে, তার মুখ ধুইয়ে ছুটি পেতে বেলা হয়ে যায় বংশীর। তখন বাজারে যায়।

এক-একদিন টাকার বদলে সোনার দুল নিয়েই বাজার করতে যেতে হয়। দুল ভাঙিয়ে বাজারও আসে, ছোটমার একটা বোতলও আসে। ওটা বৌঠানের চাই। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে না পেলে কেমন যেন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ছোটমা’র। হাই ওঠে। ঘুম ভেঙেও যেন গা ম্যাজম্যাজ করে।

ছোটমা বলে—এত দেরি কেন রে তোর বংশী?

বংশী বলে—শুনুন শালাবাবু, কথা শুনুন, একা মানুষ কত দিকে দেখি বলুন তো—হাত তো দুটো।

ছোটমা বলে—আগে বোতলটা এনে দিয়ে, তারপর বাজারে গেলে পারতিস।

এদিকে সেজখুড়ি ওদিকে রাঙাঠাকমা। রাঙাঠাকমা এতদিন ভাঁড়ারের কাজ করে এসেছে। বুড়ো বয়েসে রান্নার কাজ করতে অসুবিধে হয় বৈকি! ভাতের হাঁড়ি নামাতে গিয়ে একদিন হাতে পায়ে গরম ফ্যান পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে বড়-বড় ফোস্কা উঠলো। কিন্তু তাই নিয়েই কাজ করতে হয়। বলে—কাজের কথা আর বলো না মা, কাজ কি একটা? লোকই কমছে, কাজ তো আর তা বলে কমছে না—আমি যে কবে ছাড় পাবে এই জেলখানা থেকে, ভগমান জানে!

সৌদামিনী বলে—মুখে আগুন ভগমানের, ঝাঁটা মারি অমন ভগমানকে। ভোলার বাপ বলতে, ফুলবউ চোখ থাকতে-থাকতে তিভুবন চিনে নাও—তা সেই ভোলার বাপ থাকলে আজ আর আমার ভাবনা—ভগমানের কি আক্কেল-গম্যি আছে মা, নইলে আমি পিদিম দিচ্ছি কার-না-কার ভিটেয়, আর আমার সোয়ামীর ভিটে আজ অন্ধকার ঘুরঘুট্টি।

সদুরমা পাঁচিলের ওপাশ থেকে বলে–হ্যাঁ লা সদু, গেরণ কখন লাগছে না?

সৌদামিনী সলতে পাকাতে-পাকাতে বলে—তুই তো বাঁজা বিধবা, গেরণের খোঁজ তোর ক্যান লা! যখন একত্তোর ছিল বউমণির, তখন তোর হাতের জল তো খেতে না কেউ–এখন তুইও সতী হলি—কালে-কালে কতই দেখবো মা!

রাঙাঠাকমা ওদিক থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে—আজ কি ব্লাঁধলি সেজখুড়ি?

সেজখুড়ি বলে—দুটো তো মানুষ ভারী, তার আবার রান্না, তাও ছোটবাবু তো ভাত মুখে দেয় নাম মাত্তোর-—আর ছোটমা’র পালা-পাৰ্বণ লেগেই আছে সারা বছর।

বেশি-বেশি রান্নার হাত, অল্প রান্নায় মন বসে না সেজখুড়ির। বেশি নুন উঠে আসে হাতে! বেশি মশলা, বেশি চিনি, বেশি বাটনা।

ছোটবাবুকে খাইয়ে দিতে হয়। তবু মুখের স্বাদ আছে। বলে-থুঃ-থুঃ— মুখে যেন লাগে না আর আগেকার মতো। ছোটবাবু যখন খেতে বসতে আগে, চারপাশে সার-সার বাটি পড়তে গোল হয়ে। খেতে যে খুব তা নয়। সব জিনিষ একটু করে চেখে দেখতে বটে! তারিফ করতে রান্নার। রসিক মানুষ, কদর বুঝতো! কিন্তু আজকাল কিছুই ভালো লাগে না।

সেজখুড়ি বলে—এ কী রে বংশী—নুনে পুড়ে গিয়েছে যে?

এই সব দেখে শুনে হাবুল দত্ত মেয়েকে বলে—এখানে থাকলে তোরও শরীর খারাপ হয়ে যাবে মা, পাথুরেঘাটাতেই চল সবাই মিলে।

মেয়ে বললে—আমার শাশুড়ীর কী হবে, তার যে ছুঁচিবাই।

ছুটুকবাবু সেবারও ফেল করেছে পরীক্ষায়। বার-বার পরীক্ষা দিয়ে আর ফেল করে ছুটুকবাবু যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে গিয়েছে। আগেকার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন বিচ্ছিন্ন। কোলিয়ারিতে লোকশান হওয়াতে যেন ঘা খেয়েছে আরো বেশি। তারই আগ্রহ ছিল সব চেয়ে বেশি। কাকাদের সে-ই বলে-কয়ে নামিয়েছিল। এখন যেন লজ্জা করে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কথা বলতে লজ্জা। কোথাও যেন আশা নেই। চারিদিকেই শুধু দুঃসংবাদ। বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করাও ছেড়ে দিয়েছে। পুরোনো বন্ধু-মোসায়েবরা প্রথম-প্রথম চেষ্টা করেছিল। সন্ধ্যের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এসে দাঁড়াতে উঠোনে। বলে ‘পাঠাতে—খবর দাও তো–বিশ্বম্ভর এসেছে।

ওপর থেকে খবর পাঠাতে ছুটুকবাবু—এখন নামবো না আমি–বল গে যা ওদের।

এমনি করে চলেছিল। কিন্তু নান্নেবাঈ-এর নাচ গানের দিন যেদিন পেটে হঠাৎ একটা ব্যথা উঠলে মেজবাবুর, সেদিন রাজি। হয়ে গেল ছুটুকবাবু।

পরদিন সকাল বেলাই চার পাঁচখানা ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়ালো বড়বাড়ির উঠোনে। মাল-পত্তোর উঠলে গাড়িতে! জুটুকবাবু উঠলো। ছুটুকবাবুর বউ উঠলো। আর উঠলো বড়মা। সিন্ধুর হাত ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বড়মা উঠলো গিয়ে গাড়িতে। কিন্তু কাঁদতে-কাঁদতেও বললে—গাড়ি যেন রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে যায়, বলে দিস ছুটুক-নইলে অপথ-কুপথ দিয়ে যাবে ওরা, অবেলায় চান করে মরতে হবে।

বেনারসীর থানের আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে বিদায় নিলে এ-বাড়ির গৃহলক্ষ্মী। এ-বাড়ির বড়বউ। পাড়ার লোকজন, বউ ঝি সবাই জানালার খড়খড়ি তুলে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো।

মেজবাবু নাচঘরে তাকিয়া হেলান দিয়ে শুয়েছিল।

বেণী গিয়ে বললে—বড়মা চলে যাচ্ছেন আজকে।

তামাক খেতে লাগলো একমনে মেজবাবু। যেন শুনতেই পায়নি কথাটা। বেণী আর একবার বলতে যাচ্ছিলো কথাটা।

মেজবাবু চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলো—চোপরাও হারামজাদ–

এ-সব ঘটনাও বংশীর কাছে শোনা। এ-রকম যে হবে তা যেন ভূতনাথের জানা ছিল। কিছুই যেন অবিশ্বাস্য নয়। অপ্রত্যাশিত নয়। ভূতনাথ যেন প্রতীক্ষার আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে গিয়েছে। ওই উঠোনের ইটের ফাঁক দিয়ে ঘাস গজাতে শুরু করেছে। আস্তাবলবাড়ির দেয়ালে ঝুল জমেছে। মিয়াজান নেই, ইয়াসিন নেই, আব্বাসও নেই। ইব্রাহিম টিমটিম করে টিকে আছে বটে কিন্তু তাই বা আর ক’দিন!

বংশী সেদিন হঠাৎ বললে—জানেন—শালাবাবু, কাল মেজবাবুও চলে যাচ্ছে।

-কোথায়?

—গরাণহাটায়। মেজবাবুর শ্বশুরের বাড়িতে।

পরদিন ভোর বেলা থেকেই ঠেলাগাড়ি এল অনেকগুলো। বিধু সরকার নিজে তদারক করছে।

—উহুঁ, হলো না, অমন করে তুললে, কাঠের জিনিষ, দাগ লাগবে যে।

আগাগোড়া হাতির দাঁতের কাজ করা পালঙ একখানা। আর তার সঙ্গে মিলিয়ে মশারি টাঙাবার ছরি! বড় দামী জিনিষ। সাবধানে নিতে হয়। বাক্স, প্যাটরা, সিন্ধুক, আলমারি, মেজগিন্নীর পুতুলের বাক্স, পায়রার খোপ, মেজবাবুর গরু-বাছুর, বিছানা-বালিশ, ভাঁড়ারের বাসন, কেঠো, কুলল, ডালা। সবই তত ভাগ হয়ে গিয়েছিল আগে। কত যে জিনিষ। জিনিষের আর শেষ নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ঠেলাগাড়ি আসছে, মাল তুলছে আর চলে যাচ্ছে। বিধু সরকারেরও সকাল থেকে নাওয়া নেই, খাওয়া। নেই। নাগাড়ে খেটে চলেছে।

বিকেল নাগাদ ইব্রাহিম গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ালো গাড়িবারান্দার তলায়। আজ সে আবার উর্দি পরেছে, তকমা এঁটেছে গায়ে। ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে একবার।

মেজবাবু মলমলের পাঞ্জাবী চড়ালে। কানে গায়ে আতর লাগিয়ে দিলে বেণী। পামশু বেরোলো। চুনোট করা চাদর। বেরোলো। তারপর মেজবাবু বললে—ছড়িটা দে আমার।

মেজবাবু ছড়ি নিয়ে গটগট করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে যেন কী ভেবে ঘুরে দাঁড়ান। তারপর দোতলার বারান্দা দিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়ান ছোটকর্তার ঘরের সামনে। কত বছর পরে। আবার এ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ান মেজবাবু মনেই পড়ে না। আগে যখন ছোটবেলায় একসঙ্গে খেলা করেছে দুজনে তখন যেন সত্যিকারের আপনার ছিল। বড় হবার পর, বিশেষ করে বিয়ে করার পর আর কখনও কথা বলার প্রয়োজন হয়নি। সুখচর থেকে খাজনা এসেছে, জমা হয়েছে খাঞ্জাঞ্চীখানার খাতায়, জমীদারির আয় পাহাড় হয়ে জমেছে সিন্দুকের ভেতর। যে-যার নিজের-নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কারো প্রতিবন্ধক হয়নি, কারোর জন্যে কারোর আটকায়ওনি কিছু, অনায়াস গতিতে সংসার চলে এসেছিল। কিন্তু আজ মেজবাবু অনেক কথা বলবার জন্যেই প্রস্তুত ছিল বুঝি।

বংশীই প্রথমে দেখতে পেয়েছে। বললে—ছোটবাবু ঘুমোচ্ছে আজ্ঞে।

ঘুমোচ্ছ! খানিক কী ভেবে নিয়ে মেজবাবু বললে—তবে থাক।

বংশী বললেন মেজবাবু, আমি ডেকে দিচ্ছি—বসুন।

বংশী ছোটবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকতে লাগলো —ছোটবাবু, ও ছোটবাবু–

ছোটবাবুর পালঙটাও হাতির দাঁতের কাজ করা। তার ওপর মিনে করিয়ে নিয়েছিল ছোটবাবু পরে। কাপড় চোপড়গুলো সামলে দিলে বংশী। ক’দিন দাড়ি কামাতে আসেনি বুঝি নাপিত। মেঝের ওপর একটা পিকদানি। মালিশের শিশি। পাথরের খল।

ছোটবাবু হঠাৎ চোখ মেললে। সামনে চোখ চেয়েই দেখলে–মেজদাদামণি! কেমন যেন ভাসা-ভাসা চাউনি ছোটবাবুর।

মেজবাবু কী বলবে বুঝতে না পেরে ছড়িটা একবার ঘুরিয়ে বললে-চললুম রে মিঠু!

এতদিন পরে নিজের ডাক নামটা শুনে ছোটবাবুর কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সব। কিন্তু ভালো করে দৃষ্টি দিতেই দেখলে মেজদাদামণি তখন চলে গিয়েছে।

খিড়কির দরজা দিয়ে নামবে মেজগিন্নী। জিনিষপত্র সবই চলে গিয়েছে। বাঘবন্দির ছককাটা জায়গাটার ওপর দাঁড়িয়েছিল মেজগিন্নী। গিরি বললে—চলে মেজমা, বেণী ডাকছে ওদিকে—

মেজগিন্নী পায়ে-পায়ে গিয়ে দেয়ালের দরজাটা খুলে ডাকলে— ছুটি, কী করছিস?

চিন্তা দেখতে পেয়ে বললে—ছোটমা, বাইরে এসে তো একবার!

ছোটমা ঘুমোচ্ছিলো বুঝি। চোখ মুছতে-মুছতে মাথায় ঘোমটা দিয়ে এসে দাঁড়ালো।

মেজগিন্নী ছোটমা’র চিবুকে হাত দিলে—সাবধানে থাকিস ছুটি—কী আর বলবো তোকে।

—চললে মেজদি?

—কী আর করি বল, বড়দিই রইলেন না, বাড়ি যেন খাঁ-খাঁ করছে—আর থাকা যায় এখানে?

—আমি কিন্তু থাকবে মেজদি, আমি আর কোন্ চুলোয় যাবোবলে খিল-খিল করে হেসে উঠলো ছোটমা।

মেজগিন্নী বললে—তোর মেজভাসুরেরও তো অসুখের শরীর, তাই বাবা আর ছাড়লে। তারপর চিন্তার দিকে চেয়ে বললেদেখিস তোর ছোটমাকে—কী আর বলবো–চলি।

চিন্তা হঠাৎ গলায় আঁচল দিয়ে দু’হাত দূরে মাটিতে ঢিপ করে একটা প্রণাম করলে।

তারপর খিড়কির দরজা দিয়ে বেরুলো মেজগিন্নীর গাড়ি আর সদর-গেট দিয়ে বেরুলো মেজবাবুর। একে-একে বেণীও গেল। রাঙাঠাকমাও গেল। সৌদামিনীও গেল।

বংশী বললে—এবার?

ফাঁকা উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেন কান্না পেতে লাগলো ভূতনাথের। ভাঙনের পালা যখন শুরু হয়েছে, তখন এর শেষ কেমন করে হবে কে বলতে পারে। একবার মনে হলো পালিয়েই যাবে সে। কাউকে বলবে না! বংশীকেও না, বৌঠানকেও না। কেউ জানবে না। কাকেও তার ঠিকানা জানাবে না। একেবারে এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবে। শুধু জবার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই তার যেন সমস্ত দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। ভবানীপুরেই সে একটা বাসা করবে। ওখানে গেলে আর এসব কথা মনে পড়বে না। নতুন করে শুরু করবে তার শহর-বাস। আজো মনে পড়ে—সেদিন বড়বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন বড় মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল—সব মিথ্যে। স্নেহ, ভালোবাসা, প্রেম, আত্মীয়তা, স্বার্থত্যাগ, সব মিথ্যে। কোনো কিছুর মূল্য নেই মানুষের সংসারে। এত বড় বাড়ির ভেতরে তেতলার এককোণে কেবল একটি প্রাণী, আর দোতলার একটি ঘরে শুধু আর একটি মুমূর্য। এখানে কেমন করে বাস করবে সে!

বংশী বললে—ছোটমা’র একটা ব্যবস্থা হলে আমিও চিন্তাকে নিয়ে দেশে চলে যাবো হুজুর।

ভূতনাথ বললে—আর ছোটবাবু—ছোটবাবুকে কে দেখবে?

—ওই মুখেই শুধু বলি শালাবাবু, সত্যি কি আর যেতে পারব শেষ পর্যন্ত!

ভূতনাথেরও যেন সেই একই সমস্যা। বদরিকাবাবু প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছিল। তখনই কোথাও চলে গেলে ভালো হতো। কিন্তু কোথায়ই বা সে যেতো! তখন একটা মাত্র উপায় ছিল নিবারণদের আড্ডা। ওদের সঙ্গে মিশে গেলে হয় তো জীবনটা অন্য দিকে মোড় ঘুরে যেতো। যে-কলকাতার আদি ইতিহাস শুনেছে সে বদরিকাবাবুর কাছে, সে-কলকাতা আবার নতুন করে দেখতে পেতো। যে-কলকাতার দেওয়ান ছিল গোবিলরাম মিত্র সেই কলকাতা এখন ভারতবর্ষের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সে-দৃশ্য দেখেছে ভূতনাথ। একদিন কিংসফোর্ড সাহেব রাস্তা দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। সঙ্গে আছে দুজন বডিগার্ড।

পেছন থেকে কারা যেন বলে উঠলো-বন্দে মাতরম—

কিংসফোর্ড সাহেব থেমে দাঁড়ায়।—কৌন্ হ্যায়—কৌন্‌ হ্যায়—

কিন্তু যারা চেঁচিয়েছিল, তারা তখন পালিয়েছে। সাহেব রাগে বিড়বিড় করে গালাগালি দেয়—শালা নেটিভ রাসকেল—

হঠাৎ ওপাশ থেকে দুজন ছোট-ছোট ছেলে আবার চেঁচিয়ে ওঠে—বন্দে মাতরম্–

সাহেব এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে। বলে-পাকড়ো–পাকডো রাসকেল লোগকো কিন্তু ধরতে পারা যায় না কাউকেই।

সঙ্গের একজন বডিগার্ড বলে–সাহেব ঘর চলিয়ে।

সাহেব চিৎকার করে ওঠে—চোপরাও–

এমন সময় একজন ছেলে সামনে এসে বলে–-সাহেব সেলাম।

সাহেব পকেট থেকে চকলেট বার করে বলে–গুড বয়।

চকলেটটা নিয়েই ছেলেটি কিন্তু আবার বলে ওঠে—বন্‌ডেমাটরম্‌–

সাহেব ছড়ি নিয়ে মারতে ছোটে—রাসকেল—ইল্প…ছেলেটা তখন দৌড়ে পালিয়েছে। সাহেব বলে—This horrible Bandemataram will make me mad…

নিবারণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একদিন। বড় ব্যস্ত ভাব। বললে—ভূতনাথবাবু না?

ভূতনাথ তখন সাইকেল-এ চড়ে আপিস থেকে ফিরছিল। নেমে পড়লো। বললে-কী খবর তোমাদের নিবারণ?

নিবারণ বললে—আমাদের কাজ তো আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, দেখেন নি?

দেখেছে বৈ-কি ভূতনাথ। খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে ভূতনাথের। বড়-বড় অক্ষরে কোনো দিন লেখা থাকে— “ঢাকার ম্যাজিস্টেট এ্যালেন সাহেবের উপর গুলী।” কখনও থাকে—“বাংলা দেশে স্বদেশী ডাকাতের উৎপাত”। আবার কখনও থাকে–“ছোটলাট সাহেবের ট্রেনে বোমা”।

নিবারণের গায়ে দেশি কাপড় জামা। বিলিতি কাপড় কেনা বয়কট করেছে অনেকে। সেদিন রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে ভূতনাথ গান শুনেছিল—’বলিহারি পাড়ের বাহার স্বদেশী শাড়ি। নিবারণ বললে—বরিশালে কনফারেন্স হয়েছিল—জানেন?

–শুনেছি।

—রসুল সাহেব প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, কেম্প সাহেবকে জব্দ করা হয়েছে খুব।

-কেম্প সাহেব কে?

—পুলিশের কর্তা–আর এমার্সন সাহেব ওখানকার ম্যাজিস্ট্রেট।

—বলেছিল—কেউ ‘বন্দে মাতরম্’ বলতে পারবে না। সুরেন বাড়জ্জে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন—’বন্দে মাতরম্’–সে সব অনেক কাণ্ড, খবরের কাগজে সব তত বেরোয়নি, আমি নিজের চোখে যে-সব দেখে এসেছিলাম—আর তাই নিয়ে গান বেঁধেছেন কাব্যবিশারদ, শোনেননি?

—কোন্ গানটা?

নিবারণ বললে—গান তো অনেক বেঁধেছেন—কিন্তু এই গানটাই সব চেয়ে ভালো—

আজ বরিশাল পুণ্যে বিশাল হলো লাঠির ঘায়
ওই যে মায়ের জয় গেয়ে যায়।
রক্ত বইছে শতধার
নাইকো শক্তি চলিবার
এরা, মার খেয়ে কেউ মা ভোলে না,
সহে অত্যাচার!
এত পড়ছে লাঠি ঝরছে রুধির
তবু হাত তোলে না কারু গায়।

সেদিন বেশি সময় ছিল না। নিবারণও বুঝি কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু বড়বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে নিবারণের কথাটাও মনে পড়লো ভূতনাথের। সামান্য পুজি, সামান্য কামনা, কোনোদিন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেনি সে। কেমন যেন ভয় করে। মৃত্যুর ভয় নয়। কিন্তু সে কি পারবে,? ব্রজরাখাল তো তাকে বলেনি ও-পথে যেতে। তার নিজেরও তো অন্য পথ! তবে কোনটা সঠিক পথ, কে বলে দেবে।

একবার নিবারণকে ওরই ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ— ব্ৰজরাখালবাবুর খবর কিছু জানো নিবারণ?

-না।

—কিন্তু আমার এক-একবার মনে হয় তোমাদের দলে ঢুকি।

নিবারণ বললে একদিন তো বলেছিলাম আপনাকে আসতে —সেদিন এলেন না।

—আজ কিন্তু আমি বদলে গিয়েছি—বিবেকানন্দের পথ আমার বড় শক্ত লাগে, কিন্তু তোমাদের কাজ আমি পারবো।

নিবারণ বললে–স্বামী বিবেকানন্দ তো উল্টো কিছু বলেননি— আপনি অরবিন্দ ঘোষের লেখা পড়ছেন?

ভূতনাথ বললে—ওই ‘বন্দে মাতরম্’ কাগজে যা লেখেন পড়েছি—কিন্তু..

–পড়ে দেখবেন, অরবিন্দ ঘোষ যা বলেন স্বামী বিবেকানন্দ সেই কথাই বলেছিলেন চার-পাঁচ বছর আগে–পড়ে দেখবেন আপনি, আমি আপনাকে বই দেবো।

কিন্তু ভূতনাথ রূপচাঁদবাবুর লাইব্রেরীতে খোঁজ করে সে-বই পড়েছিল। তখন খুব পড়ার নেশা ছিল ভূতনাথের। বড়বাড়ির লাইব্রেরী-ঘরে কতদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বই মুখে দিয়েই কেটে গিয়েছে তার। রূপচাঁদবাবুর লাইব্রেরীতেও কজ দামী-দামী বই ছিল। অরবিন্দ ঘোষ লিখেছিলেন—

Vivekananda was a very lion among men. We perceive his influence still working gigantically. We know not well how, we know not where, in something not yet formed, something leonine, grand intuitive ‘upheaving that has entered the soul of India and we say-Behold! Vivekananda still lives, in the soul of the mother and in the souls of the children.

ভূতনাথ আর একটা প্রশ্ন করেছিল নিবারণকে।—আচ্ছা, বঙ্গভঙ্গ যে হলো—তা কি আর রদ হবে ভাবছো?

নিবারণ পায়ের জুতোটা মাটিতে ঠুকে বলেছিল—রদ করতেই হবে, স্বামিজী বলেছেন—সাধনা করলে সিদ্ধি লাভ অনিবার্য। আমাদের এও তো সাধনা-কদমদাকে শিবনাথকে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছে—কিন্তু আমরা তো দমিনি—আমাদের ‘যুবকসঙ্ঘের এখন কত মেম্বার জানেন–পাঁচ শ একত্রিশ জন-অথচ প্রথমে তো মোটে তিন-চার জনে মিলে আরম্ভ করেছিলাম।

ভূতনাথের মনে পড়লো—সেই বড়বাজারে চাকরির চেষ্টায় যখন ঘুরতে রোজ, সেই সময়েই প্রথম শুনেছিল। সেই দোকানপাট বন্ধ হওয়া, অরন্ধন, রাখী বেঁধে দেওয়া। অথচ মেজবাবু কিছুই মানেনি। গেট বন্ধ করে দিয়েছিল পাছে ভলান্টিয়াররা এসে বাড়ি চড়াও করে। সেই দিনভূতনাথেরও যেন মনে হয়েছিল—এ-সব করে কী হবে! বিলিতি কাপড় পোড়ানো! দিশি জিনিষ কেনা? সব মিছে। ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, স্বামী বিবেকানন্দকে তা হলে তোমরা মানে?

—মানি মানে, স্বামী বিবেকানন্দই তো আমাদের গুরু, আমাদের সঘে কেউ মেম্বার হলে তাকে প্রথমে স্বামী বিবেকানন্দের বই-ই তো পড়তে দিই, ওঁকে মানবে না—কী যে বলেন আপনি।

–আচ্ছ, তা হলে ব্রজরাখালও তো বিবেকানন্দর ভক্ত, সে কেন তোমাদের কাজে যোগ দিলে না?

নিবারণ হাসলো। বললে—বড় শক্ত প্রশ্ন তুললেন আপনি ভূতনাথবাবু, কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি এর আলোচনা হয়? একদিন আসবেন আমাদের ওখানে-কেমন?

কিন্তু যেদিন প্রথম খবরের কাগজে বেরুলো সেই মুরারীপুকুরের খবর। মনে আছে, ৩২ নম্বর মুরারীপুকুর রোড। কি ভয়ানক কাণ্ড!

নিবারণের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলার পর রাস্তায় আসতেআসতে হঠাৎ মনে হলো যেন আর একজন কে তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে। সে-ও সাইকেল-এ চড়ে আসছে। পেছনে ফিরে একবার চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। তখনও আসছে। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে চলে আসবার চেষ্টা করলে ভূতনাথ। অনেক ঘোরা পথ দিয়ে বাড়ি এসে পে ছিলো যখন ভূতনাথ, তখন আর তাকে দেখা যায়নি।

কিন্তু পরদিন সন্ধ্যেবেলা বড়বাড়ির সামনেই গলির ওপর যেন সেই লোকটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল আবার। কমলালেবু রং-এর একটা আলোয়ান গায়ে। মুখে যেন বসন্তের দাগ। সেই স্পষ্ট সেদিনকার চেহারা।

একদিন বংশীকে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—ও লোকটা কে বংশী, দাঁড়িয়ে থাকে আর রোজ আমার পেছন-পেছন ঘোরে?

বংশী খানিকক্ষণ দেখলে ভালো করে। তারপর বললে—কে আর, এমনি রাস্তার লোক হবে।

—রাস্তার লোক তা আমার পেছন-পেছন যায় কেন?

যেখানে গিয়েছে ভূতনাথ ক’দিন, সেখানেই সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরেছে। তারপর যখন ছুটুকবাবু, মেজবাবু সবাই বড়বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, ফাঁকা বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে উঠোন, গেট-এ কেউ পাহারায় নেই—তখনও মনে হয় যেন চট করে কে যেন তাকে দেখে সরে গেল সামনে থেকে। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে সেদিন আবার ভূতনাথ বললে-ওই যে বংশী, সেই লোকটা!

বংশী বললে—কই, কোনদিকে? বংশী হাঁ করে অন্ধকার গেট-এর দিকে চেয়ে দেখতে থাকে।

আজকাল কিন্তু সন্ধ্যে হবার সঙ্গে-সঙ্গে বংশী গেট-এ তালা বন্ধ করে দেয়। আর তো কেউ যাবার-আসবার নেই। সন্ধ্যেবেলাই বড়বাড়ি নিঝুম হয়ে যায়। আলোগুলো নিবিয়ে রাখে বংশী। মিছিমিছি আলো জ্বললেই তো পয়সা খরচ। আর ছোটবাবুও তো বাইরে যায় না। কে আর রাত ভোর করে বাড়ি ফিরবে। ভূতনাথের যখন দেরি হয় ফিরতে, তার কাছে চাবি থাকে আলাদা। একলা চাবি খুলে ঢোকে, তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে চোরকুঠুরিতে গিয়ে শোয়। চোরকুঠুরিতে যদি অসুবিধে হয়, অন্য অনেক ঘর পড়ে আছে, যেখানে খুশি গিয়ে শোও। বৈঠকখানাটা সেইদিন থেকে বন্ধই থাকে। সেই বদরিকাবাবুর আত্মহত্যা করবার পরদিন থেকে। ও-ঘরে কেউ ঢোকে না। ঢোকবার প্রয়োজনও হয় না কারো। বদরিকাবাবু হাসপাতালে যাবার পথেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবু মনে হয়, এখানের এই ঘরটার মধ্যেই যেন তার আত্মা কোথাও লুকিয়ে আছে! কোথাও কোনো অভিসন্ধি নিয়ে ঘুরে-ফিরে বেড়ায় এখানে। ভয় করে সকলের।

সেদিন কিন্তু বনমালী সরকার লেন-এর ওপর তেমনি আর একজন কে এসে দাঁড়ালো।

ভূতনাথ বলে—ওই দেখ বংশী—ওই—

–কই? কে?

-ওই, ওই যে—

কিন্তু এবার বংশী দেখতে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে তালা খুলে দেয়। বলে—এ যে ননীবাবুর ম্যানেজার আজ্ঞে।

বেশ বয়েস হয়েছে ম্যানেজারের। হাতে ক্যামবিশের পেটফোলা ব্যাগ। রোগা-রোগা চেহারা। ছু চলো একজোড়া গোঁফ মুখের দু’পাশে। অন্ধকারে যেন সেই আলোয়ান-গায়ে লোকটার মতোই দেখাচ্ছিলো। ভেতরে ঢুকে লোকটা বলে-মেজবাবু কোথায়—মেজবাবু?

বংশী বলে-মেজবাবু তো আর এ-বাড়িতে থাকে না।

–থাকে না? কোথায় থাকে তবে? দেখো দিকিনি কী গেরো!

—গরাণহাটায়।

লোকটা যেন একটু ভাবলে!

বংশী বললে—আজ রাত্তিরবেলা কেন ম্যানেজারবাবু?

-আরে বেরিয়েছি সেই সকালবেলায়, সারা কলকাতা চষছি, চষতে-চষতে এই এখন এলাম বৌবাজার, তারপর এখন আবার যাবো পটলডাঙা, সেখান থেকে হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে তবে ঘর—তা এখেনে আজকাল থাকে কে?

বংশী বললে—আর ছুটুকবাবুও চলে গেল পাথুরেঘাটায়, থাকে এক ছোটবাবু, তা ছোটবাবু তো রোগে ভুগছে—উঠতেই পারে না বিছানা ছেড়ে।

ম্যানেজার বলে—তা হলে টাকা দেবে কে? তিন মাস যে বাকি পড়লো সেটা কে দেখবে—হুজ্জতে ফেললে দেখছি গো।

তারপর পেটফোলা ব্যাগটা খুলে কী যেন খুজতে লাগলো ম্যানেজার। বললে—আলোটা জ্বালো দিকিনি, খুঁজে পাচ্ছিনে কাগজটা। আলোর তলায় এসে একখানা ভাঁজ করা কাগজ তুলে ম্যানেজার দিলে বংশীর হাতে।

—কীসের কাগজ ম্যানেজারবাবু?

—এ কাগজটা দিও দিকি তোমার ছোটবাবুকে, বাবু পড়লেই বুঝতে পারবেন, সাপও নেই, ব্যাঙও নেই, সোজা করে লেখা আছে।

বংশী বললে—কী আছে খুলেই বলুন না?

ম্যানেজার যেন বিরক্ত হলো। বললে—আরে বাবা, নোটিশ, নোটিশ! বাড়ি ছাড়ার নোটিশ! সব জিনিষ চাকর মানুষের জানা কী দরকার! যাই আবার সেই পটলডাঙায়, না মলে আর পাপ ঘুচবে না। তারা ব্ৰহ্মময়ী–

ম্যানেজার চলে গেল।

বংশী বললে—দেখুন তো শালাবাবু, কী লিখেছে?

ভূতনাথ কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলো। এতদ্বারা জানানো হইতেছে যে.. ইত্যাদি, ইত্যাদি। বন্ধকী সম্পত্তির বাবদ একুনে এত টাকা পাওনা হইয়াছে, গত তিন মাস যাবৎ কোনো টাকা না পাওয়াতে বাড়ি ছাড়িয়া দিবার নোটিশ দেওয়া যাইতেছে, অন্যথা.. আদালতের সাহায্যে দখলীকারদের উৎখাত করা হইবেক।…

বংশী বললে—বাড়ি ছাড়তে হবে নাকি শালাবাবু?

—সেই রকমই তো লিখেছে।

—সে কী করে হবে শালাবাবু, বাড়ি ছেড়ে অমনি গেলেই হলো?

ভূতনাথও যেন কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে। সত্যি কি শেষ পর্যন্ত তাই হবে! ভূতনাথ বললে-ম্যানেজার কি চলে গেল।

–ডাকবো শালাবাবু?

—ডাক, ডাক তো একবার।

বংশী সেইখানে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে ডাকতে লাগলেও ম্যানেজারবাবু, ম্যানেজারবাবু–

ম্যানেজার বোধ হয় ততক্ষণে অনেক দূর চলে গিয়েছে। বংশী দৌড়ে গেল পেছন-পেছন। বনমালী সরকার লেন-এ তখন বেশ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। দু’-একটা দোকানে শুধু আলো জ্বালিয়েছে ওদিকে। বড়বাড়িতে উঠোনটা কিন্তু সকলের চেয়ে যেন বেশি নির্জন। বিমূঢ়ের মতন এখানে দাঁড়িয়ে একটু-একটু ভয় করে ভূতনাথের। মেজবাবুর পায়রার খোপগুলো খালি পড়ে ছিল কয়েকটা। তারই মধ্যে কয়েক জোড়া গোলা পায়রা এসে বাসা বেঁধেছে। অন্ধকার রাত্রে এক-এক সময়ে তারা বক্‌-ব-বকম্ করে ওঠে আচমকা। ঝটাপট শব্দ হয় হঠাৎ! তারপর আবার চুপ হয়ে যায় সব। ইব্রাহিমের ঘরের ছাদের সামনে বাক্সবাতিটা ঝুলে আছে তো ঝুলেই আছে। অন্ধকারে মনে হয় বুঝি একটা বাদুড়। বাদুড়ের মতই নিঃশব্দে ঝোলে আর বাতাস পেলেই দোলে। একটা ইদুর উঠোনের এ-কোণ থেকে ও-কোণে দৌড়ে যাবার সময় পায়ে শুকনো পাতা লাগলে খড়-খড় শব্দ ওঠে। শুধু ভূতনাথ নয় যেন ইদুরটাও চমকে ওঠে নিজে। রান্নাবাড়ির পেছনে যখন বংশী বসে-বসে হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙে, সমস্ত বড়বাড়িতে সে-শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ফাঁকা-ফাঁকা ঘরগুলো গুম-গুম করে ওঠে। ঝনঝন করে লোহার শেকল আর কড়াগুলো বেজে ওঠে। ভূতনাথের মনে হয় বদরিকবাবু যেন বলে—কেমন, বলেছিলাম কিনা, কেমন।

দেউড়িতে আর কেউ ঘণ্টা বাজায় না আগেকার মতো। ঘণ্টাটা তো ঝুলছে কিন্তু বাজাবে কে! ঘড়িগুলো তো সব বদরিকাবাবু আগুনে পুড়িয়েছে কিন্তু সময় কি থেমেছে সে-জন্যে। সময় জানবার অবশ্য দরকার হয় না আর কারো। কেউ ইস্কুলেও যায় না, কেউ আপিসেও যায় না। সময় বেঁধে ঘুম থেকে উঠে রান্না চড়াবার দরকার নেই আর। দারোয়ান নেই যে ডিউটি বদল হবে ঘড়ি দেখে। ছুটুকবাবু নেই যে, পরীক্ষার পড়া করবে ঘড়ি দেখে, কিম্বা ঘড়ি দেখে রাগ-রাগিণী শুরু হবে আর গানের আসর জমবে। ঘড়ি দেখে ঘোড়ার ডলাই-মলাই আর দানা খাওয়ানোর দরকার নেই। এখন সূর্য মাথার ওপর উঠলে বুঝতে হয় বারোটা বেজেছে, সূর্য ড়ুবে গেলে বুঝতে হয় সন্ধ্যে হলো। ঘড়ি নেই কিন্তু তবু সময় কি থেমে থেকেছে? বদরিকাবাবু বড়বাড়ির সব ঘড়ি না হয় পুড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু সূর্য কি উঠেছে না?

ভূতনাথ বেশ বুঝতে পারে, বড়বাড়ির সূর্য যদিই বা ড়ুবেছে কিন্তু সূর্য উঠেছে আর এক জায়গায়, উদয় হচ্ছে আর এক পাড়ায়। সেখানে রূপচাঁদবাবুর বাড়ি উঠছে হাজারে-হাজারে। সেখানে আর এক মানুষের দল আর এক সভ্যতার পত্তন করছে। সেমানুষেরা হয় তো এত বড় নয়, এত অভিজাত নয়, তাদের বাড়িতে ঘরে-ঘরে হয় তো এত ঘোড়া, পাল্কি, মেয়েমানুষ, হাম, ল্যাণ্ডোলেট নেই, তাদের বউরা হয় তো হীরের নাকছাবি পরে না, পুতুলের বিয়েতে বারো হাজার টাকা ওড়ায় না, একটা চীনে-অর্কিড গাছের চারা তিন শ’ টাকার দরে নীলেমে কিনে বিলিয়ে দেয় না, পুরুষরা রাজাবাহাদুর খেতাব পায় না—তবু রাত্রে তারা বাড়িতে ঘুমোয়, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে, পরের পরিশ্রমের আয়ের ওপর ভাগ বসায় না। তারা হেঁটে আপিসে যায়, বৃষ্টি হলে মাথায় ছাতা দেয়, তারা খেটে খায়। সবাই তারা ননীলালের মতো বড়লোক হয় তো নয় কিন্তু কেউ স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কেউ বা উকিল, ব্যারিস্টার, আপিস-কেরানী, মুহুরী, ব্যাঙ্কার।

ভাবতে-ভাবতে ভাবনার তলায় তলিয়ে যায় ভূতনাথ। সে কোন ১৩৪৫ সালের কথা। কোন এক গির্জার ঘড়িতে প্রথম বুঝি বেজে উঠেছিল যন্ত্রযুগের আগমনী। কিন্তু কে জানতো একদিন সেই ঘড়িই মধ্যযুগের সেই মহাকালের কল্পনা-সৌধ ধূলিসাৎ করে দেবে? ঘণ্টা মিনিট আর সেকেণ্ডে মহাকালকে খণ্ড খণ্ড করে সময়ের ক্ষয়ের অক্ষয় ইতিহাস রচনা করবে? মহাকালকে টুকরোটুকরো করে কেটে অভিজাতের আভিজাত্য হরণ করবে? এই ঘড়িই বুঝি মহাকালের কল্পনা ধ্বংস করে প্রথম জানিয়ে দিলে গগনচুম্বী গির্জার গম্বুজ, মসজিদের মিনার আর মন্দিরের চূড়ো শাশ্বতও নয়, সনাতনও নয়। সে বললে—ধর্ম, দেবতা আর বামুনদের প্রভাব প্রতিপত্তি উপদেশ সমস্ত কল্পনা—সমস্ত ছলনা, সত্যি শুধু পায়ের তলার মাটি আর এই ভালোয় মন্দে মেশানো মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য—একথা চণ্ডীদাসের বহু আগে বলে গিয়েছে ঘড়ি। বলে গিয়েছে মানুষই কেবল সত্যি নয়, তার চব্বিশটা ঘণ্টা সত্যি, চৌদ্দ শ’ চল্লিশ মিনিট সত্যি, ছিয়াশি হাজার চার শ’ সেকেণ্ডও সত্যি। আরো বলেছে—হিসেবের গণ্ডী দিয়ে সময়কে মেপে-মেপে চলতে হবে, আরো সব জিনিষের মতো সময়েরও মূল্য আছে, বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণি চৌধুরীদের মতো সময়ের অপব্যয় করলে সে তার প্রতিশোধ নেবেই। ”

বদরিকাবাবুর কাছে শোনা কথাগুলো এই বড়বাড়ির অন্ধকার আবহাওয়ায় যেন মুখর হয়ে ওঠে আজকাল।

বদরিকাবাবু বলতো-Time is Money.

আর ননীলাল বলতো–God is Money.

সত্যিই সময় তো থেমে থাকেনি। বদরিকাবাবু ঘড়ি পুড়িয়ে দিয়ে কি তার নিজের ওপরই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় তো তার নিজের পথেই এগিয়ে গিয়েছে। কারোর মুখের দিকেই চায়নি সে। যেমন চায়নি চৌধুরীদের মুখ, তেমনি চায়নি লর্ড কার্জনের।

১৮৯৯ সালের ৬ই জানুয়ারী লর্ড কার্জন এল বড়লাট হয়ে। যে-কার্জনের পরিকল্পনায় বাঙলাদেশ দু’ভাগ হয়ে গেল, সেই কার্জনকেই আবার শেষ পর্যন্ত সময়ের ফেরে চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে চলে যেতে হলে নিজের দেশে। সে-তারিখটাও মনে আছে ভূতনাথের। ১২ই আগস্ট, ১৯০৫ সালে। কিন্তু সময় তা বলে চুপ করে বসে থাকেনি। গ্রামে-গ্রামে ‘অনুশীলন-সমিতি’ গড়ে উঠেছে তখন। নিবারণদের দল বিলিতি কাপড় পুড়িয়েছে, বোমা ফেলেছে, লাঠি খেলেছে। ভাবতে গিয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ে। সে দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়ি। আধো-অন্ধকার ঘরের ভেতর ভালো করে সব নজরে পড়ে না। ঘরের মধ্যে এক সঙ্গে বসে আছেন তিনজন। অরবিন্দ ঘোষ, সুবোধ মল্লিক আর পি. মিত্তির। আর ঘরের চার পাশে বসে আছে আরো ক’জন। বারীন ঘোষ বসে আছে তাদের মধ্যে এক পাশে।

হঠাৎ বারীন উঠে বললে—কিংসফোর্ড সাহেবের অত্যাচারের মাত্রা দিন-দিন বেড়ে চলেছে—আপনারা বিচার করুন এর—এর বিহিত করুন।

পি. মিত্তির নড়ে উঠলেন—Yes, Kingsford must die!

অরবিন্দ ঘোষ বললেন—I concur.

রাজা সুবোধ মল্লিক বললেন—I concur.

ঘরের অন্ধকার হঠাৎ আরো যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে এল।

এ-ঘটনার অনেক বছর পরে নিবারণের মুখেই এ সব শোনা। কিন্তু সে বোধ হয় ১৯১১ সালের পরের কথা। সেই বছরই দরবার হলো দিল্লীতে। বাংলাদেশ জোড়া লাগলে আবার। আর কলকাতা থেকে রাজধানী উঠে গেল দিল্লীতে। সেই ১২ই ডিসেম্বরের রাত্রেই রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল নিবারণের সঙ্গে। কিন্তু সে কথা এখন থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *