৩৪. খিড়কির গেট পেরিয়ে

খিড়কির গেট পেরিয়ে আবার সদর গেট দিয়ে বার-বাড়িতে ঢুকলে ভূতনাথ। সত্যি-সত্যি আস্তাবলে ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেট তখন দাঁড়িয়ে আছে। কেমন যেন সন্দেহ হলো। এমন তো হবার কথা নয়। কোথা থেকে যেন এই দুর্ঘটনা এসে হঠাৎ সমস্ত গোলমাল করে দিলে। অথচ বংশীরও দেখা নেই। ছুটুকবাবুর বৈঠকখানা ঘরটা আজও অন্ধকার। চলতে চলতে তোষাখানার দিকে গেল ভূতনাথ। লোচন তখন কাজ করছিল আপন মনে। ভূতনাথকে দেখতে পায়নি। না পাক, এখন দেখতে পেলে আবার অনেকক্ষণ সময় নষ্ট করে দেবে। বংশী বোধ হয় তোষাখানাতেই আছে। নয় তো ছোটবাবুর তদ্বির তদারকে গিয়েছে।

উঠোনের মধ্যে একবার খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়ালো ভূতনাথ।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ির ঘণ্টার শব্দে যেন চমক ভাঙলো। মেজকর্তা ঢুকছে নাকি! কিন্তু এমন সময় মেজবাবুই বা আসবে কেন!

—হটো, হট যাও—বাবুজী।

এক পাশে সরে দাঁড়ালো ভূতনাথ। গাড়ি গিয়ে থামলো। গাড়িবারান্দার তলায়। ভূতনাথ ভালো করে দেখলো। এ তো অচেনা গাড়ি। ঘোড়া দুটোও যেন রোগা-বোগা। বড়বাড়ির ঘোড়ার মতো চেহারা নয় এদের।

গাড়ি থেকে প্রথমে নামলে বিধু সরকার। তার পেছনে পেছনে নামলো শশী ডাক্তার। বৌবাজারের শশী ডাক্তার। এ-বাড়িতে শক্ত অসুখ-বিসুখ হলে শশী ডাক্তার মাঝে মাঝে আসে বটে। কিন্তু কার আবার অসুখ হলো!

বিধু সরকারের একটু তটস্থ ভাব। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমেই ওষুধের বাক্সটা হাতে তুলে নিলে। সামনে কে যেন পড়তেই খেঁকিয়ে উঠলোসররা দিকি সামনে থেকে—পায়ে পায়ে ঘোরা দেখতে পারিনে।

যে সামনে এসেছিল সে এক লাফে সরে পড়েছে।

বিধু সরকার বললে—আসুন ডাক্তারবাবু—চলে আসুন।

শশী ডাক্তারকে নিয়ে বিধু সরকার ভেতরে ঢুকে গেল। ভূতনাথ তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আজ যেন সমস্ত বড়বাড়িটা বড় নিঝুম নিঃসঙ্গ মনে হলো। কই, কারো তত সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। গেল কোথায় সব।

হঠাৎ লোচন এদিকেই, আসছিল। ভূতনাথকে দেখেই হাউ মাউ করে উঠলো—আজ্ঞে, শালাবাবু আপনি এখানে? কোথায় ছিলেন সন্ধ্যেবেলা?

লোচনের মুখের ভাব-ভঙ্গী দেখে কেমন যেন ভয় হলো ভূতনাথের। বললে—কেন, কী হয়েছে?

—আজ্ঞে, ছোটবাবু যে খুন হয়ে গিয়েছে।

–খুন! ভূতনাথ যেন সামনে ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠলেন।

–আজ্ঞে, রক্তে ছোটবাবুর কাপড় চোপড় ভেসে গিয়েছে একেবারে, ওই তত শশী ডাক্তার এলো—দেখি গিয়ে কী বলে।

কথা বলতে বলতে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়ে চলে যাচ্ছিলো লোচন।

-শোনো, শোনো,—ও লোচন,-শুনে যাও?

লোচন চলতে গিয়ে থেমে দাঁড়ালে আবার। বললে—যাই, শশী ডাক্তারকে তামাক দিয়ে আসি, ডাক্তারবাবু আমার তামাকের খুব তারিফ করেন আজ্ঞে, আমাদের বাড়ি এলে আমার হাতের তামাক না খেয়ে নড়বেন না। সেবার অত বড় অসুখটা হলো মেজবাবুর…

ভূতনাথ থামিয়ে দিলে। বললে—থামে, সে কথা পরে হবে। কী হয়েছে ছোটবাবুর খুলে বলল দিকি আগে।

লোচন বললে—যান না, বংশীর কাছে সব শুনবেন খন।

—বংশী কোথায়।

—বংশী কি আর দাঁড়াতে পারছে আজ্ঞে, তোষাখানায় যান, দেখুন গিয়ে কী কাণ্ড হয়েছে তার।

—বংশীর আবার কী কাণ্ড হলো?

লোচন বললে-বংশীরই তো দোষ আজ্ঞে, আমি বলবো বংশীরই দোষ—হাজার বার বলবো বংশীর দোষ, এদিকে ছোটবাবুর সব্বাঙ্গ রক্তারক্তি, তার ওপর বাড়িতে ঢুকে বাবুর দেখা নেই, ওদিকে ছোটবাবু বাড়িতে নেই তো ও যেন সাপের পঞ্চাশ পা দেখেছে, তাস খেলছিল বসে-বসে তোষাখানায়-অন্যায় তো বংশীরই আজ্ঞে বেশ করেছে মেরেছে ছোটবাবু।

-কে মেরেছে বললে?

লোচনের এক হাতে গড়গড়া আর এক হাতে কলকের আগুনে ফুঁ দিতে দিতে বললে–মেরেছে বেশ করেছে—আলবাৎ মারবে, ছোটবাবু তাই চাবুক দিয়ে মেরেছে—মেজবাবু হলে একে আজ খুন করে ফেলতে হুজুর। রাগে লোচন জোরে জোরে ফুঁ দিতে লাগলো কলকের মাথায়। বললে—খুব করেছে মেরেছে-ও কেবল ছোটমা আর ছোটমা। আরে ছোটমা যেন তোর মনিব— খাওয়ায় পরায় কে তোকে? সত্যি কথা বলুন তো, আপনি তো বিজ্ঞ লোক, মাইনে দেয় ছোটমা, না, ছোটবাবু? বলুন আপনি।

চুলোয় যাক বাজে কথা। ভূতনাথের রাগে গা গিস গিস করতে লাগলো।

লোচন বললে—বাড়ির মালিক তত ছোটমা নয়, মালিক হলেন ছোটবাবু-না কি বলুন আজ্ঞে। যাই, আমি আগে তামাকটা দিয়ে আসি আজ্ঞে। টিকে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল এদিকে।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু ছোটবাবুর রক্তারক্তি কেন হলে জানো কিছু?

লোচন বললে-আমিও তো তাই বলি–ছোটবাবুকে দেখলাম গাড়ি হাঁকিয়ে গেল, হাতে চাবুক নিয়ে, আমি তখন মেজবাবুর জন্যে তামাক সেজে নিয়ে যাচ্ছি কিনা—আমার তখন মাথার ঠিক নেই শালাবাবু। এদিকে নতুন তামাক এসেছে আজ একেবারে ভূযো মাল, যতবার সাজি ততবার আঠার মতো আঙুলে আটকে যায়, তামাক হবে ঠিক যেন পুরোনো খেজুরের গুড়-পুরোনো খেজুরের গুড় দেখেছেন? তা নয়, এ যেন বটের আঠা একেবারে, হাতে লাগলে…

ভূতনাথ বিরক্ত হয়ে সোজা চলে এল তোষাখানায়। তোষাখানার চারদিকে তখন বেশ ভিড় জমেছে। মধুসূদন দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামসুন্দর, বেণী সবাই আছে। নাথু সিংও দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছে।

ভূতনাথ ভিড় ঠেলে একেবারে বংশীর সামনে গিয়ে হাজির।

বংশীর মাথায়, হাতে, পিঠে তখন জলপটি।

ভূতনাথকে দেখেই বংশী হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো।

ভূতনাথ কাছে গিয়ে বসে বললে—কাঁদিসনে বংশী–থাম।

বংশী বললে—আপনি এসে গিয়েছেন শালাবাবু, ছোটমা এসেছে?

—এসেছে, এসেছে—কিন্তু এ কী হলো তোর বংশী?

বংশী তবু হাউ-মাউ করে কাঁদে। মুখ দিয়ে ভালো করে কথা বেরোয় না কান্নার চোটে।

ভূতনাথ বললে—কী হয়েছে তাই ভালো করে বল না আমায়?

বেণী বলে—আমার কাছে শুনুন তবে শালাবাবু, ছোটবাবু ওকে খুব পেটান পিটিয়েছেন চাবুক দিয়ে, দেখছেন না সারা গায়ে মুখে দাগড়া-দাগড়া দাগ বেরিয়েছে?

ভূতনাথ মুখ ঘুরিয়ে বেণীর দিকে চেয়ে বললে—কিন্তু কেন, মারলে কেন ছোটবাবু হঠাৎ?

—আজ্ঞে, গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িবারান্দায়—-ছোটবাবু ডেকেছেন কয়েকবার, সাড়া পাননি—কে ধরবে, কে ধরে নামাবে। বংশী তখন ভেবেছে ছোটবাবু নেই বাড়িতে, তাস খেলছে এখেনে বসে বসে—ওদিকে হুশ নেই। তারপর আমি যাচ্ছিলাম, দেখি ছোটবাবুর জামায় কাপড়ে রক্ত-কপালে মাথায় রক্ত-রক্তে ভাসাভাসি—আমি তো দেখেই ধরলুম গিয়ে।

—তারপর?

-তারপর যখন আমি ধরে নামিয়েছি, তখন দৌড়াতে দৌড়তে বংশী গিয়েছে সামনে। আর যাঁহাতক বংশীকে দেখা, আর শঙ্কর মাছের ল্যাজের চাবুক ছিল হাতে তাই দিয়ে বংশীকে শপাং শপাং করে মার—একবার, দু’বার, তিনবার—পঞ্চাশবার—মারতে-মারতে ছোটবাবু পড়ে গেলেন আজ্ঞে মাটিতে।

-তারপর?

—তারপর বংশী আবার ধরে তুললে ছোটবাবুকে। ছোটবাবু উঠেই আবার মার, দৌড়ে এল সব লোক, যে-যেখানে ছিল, আমার তো তখন শরীর থর থর করে কাপছে শালাবাবু। বংশী মার খাচ্ছে আর জোরে জাপটে ধরে আছে ছোটবাবুকে—যাতে ছোটবাবু আবার না পড়ে যায়–শেষে–

বংশীও হাউ হাউ করে কাঁদছিল আর বলছিল–ছোটবাবুর যদি চেহারা দেখতেন শালাবাবু-রক্তে একেবারে ভেসে গিয়েছে গা

-কী যে হবে শালাবাবু!

মধুসূদন এক ধমক দিলে।-থাম তুই বংশীকাঁদিসনে পাগলের মতন।

ধমক খেয়ে চুপ করে গেল বংশী।

বেণী বলে—কিন্তু সেই অবস্থায়ও বংশী ছোটবাবুকে ধরে তুলে নিয়ে গেল ঘরে। তারপর তো এই অবস্থা এখন জলপটি দিচ্ছি। আমাকে যেবার মেজবাবু মেরেছিল—মনে আছে কাকা? সেবার তো জলপটি দিয়ে দিয়েই সারলো—রাগলে তো মাতাল মানুষদের জ্ঞান থাকে না।

ভূতনাথ বললে কিন্তু ছোটবুর রক্তারক্তি কেন হলো— কিছু জানো?

উত্তর দিলে বংশী। বললে—উঃ, ছোটবাবুর কী কষ্টটাই যে হচ্ছে শালাবাবু—আপনি দেখলে আপনার চোখ দিয়ে নিঘ্যাৎ জল গড়াতে আজ্ঞে।

মধুসূদন ধমক দিলো।—থাম দিকি তুই, লজ্জা করে না তোর কথা বলতে।

—আমার লজ্জা হবে কেন কাকা, আমি দোষ করেছি তাই মার খেয়েছি—কী বলেন শালাবাবু। কিন্তু ছোটবাবুর কষ্টটার কথা তোমরা একবার ভাবে দিকিনি।

ভূতনাথ কিন্তু তখনও ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারেনি। বললে কিন্তু ছোটবাবুর রক্তারক্তি হলো কিসে বেণী?

বেণী বললে—আজ্ঞে, গাড়ি বোধহয় উল্টে গিয়েছিল—নেশা করা তো ছিলই—ঠিক ঠাহর হয়নি হয় তো রাস্তা।

বংশী কাঁদতে কাদতে বলে—এখন কেমন আছে ছোটবাবু? শশী ডাক্তার এসেছে?

মধুসূদন ধমকে উঠলো—তুই থাম তো বংশী, তোর নিজের ঘা সামলা আগে—বলে, মরে যাসনি এই ঢের, যে-মার খেয়েছিলিস।

লোচন দৌড়াতে দৌড়োত হঠাৎ ঘরে ঢুকলো। হাঁফাচ্ছে। বললে—সব্বনাশ হয়েছে কাকা, পুলিশ এসেছে!

—পুলিশ! একসঙ্গে যেন সবাই বলে উঠলো। পুলিশ কেন?

লোচন বললে—দেখো গে গিয়ে, বারবাড়ির উঠোন একেবারে ছেয়ে গিয়েছে লোকে। দারোগা সাহেব কথা বলছে সরকার মশাই-এর সঙ্গে।

বেণী, শ্যামসুন্দর, মধুসুদন—সবাই দৌড়লো। শুধু দাঁড়িয়ে রইল লোচন।

বংশী ভূতনাথের দিকে চেয়ে হঠাৎ কেঁদে উঠলো আবার। ভুতনাথ বললে-কাদিস কেন রে? খুব কষ্ট হচ্ছে?

—শালাবাবু, কী হবে?

—কীসের কী হবে?

–পুলিশ যদি ছোটবাবুকে ধরে?

–ছোটবাবুকে ধরবে কেন? ছোটবাবু কী করেছে যে, ধরতে যাবে তাকে?

–তবে পুলিশ এল কেন?

—আরে, পুলিশ তো দু’বেল। আসছে বাড়িতে, দারোগা তো মেজবাবুর বন্ধু।

বংশী তাতেও যেন সান্ত্বনা পেলে না। বললে—আজ যে ছোটবাবু রক্তারক্তি করেছে।

ভূতনাথ বললে—দূর, গাড়ি উল্টে পড়ে গিয়েছে তা রক্ত পড়বে না—ছড়ে গিয়েছে হয় তত হাত-পা।

-না শালাবাবু, লোচন কাছে সরে এল। গলা নিচু করে বললে—না শালাবাবু, তা না।

লোচনের ভাব-ভঙ্গি দেখে কেমন যেন সন্দেহ হলে ভূতনাথের। বললে—কী হয়েছে তবে?

—আজ্ঞে, কাউকে বলবেন না—বলে লোচন এবার চারদিকে দেখে নিলে।

—না, কাউকে বলবো না, বলো।

—ছোটবাবু খুন করেছে।

–কাকে?

কিন্তু কাকে খুন করেছে সে-উত্তর আর দেওয়া হলো না। ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। যেন অনেক লোক জমায়েৎ হয়েছে বড়বাড়ির উঠোনে। লোচন সেই দিকেই ছুটলো।

ভুতনাথ বললে—দেখে আসি বংশী, কী হচ্ছে বাইরে।

বংশী বললে—যাবেন না শালাবাবু, পুলিশের হাঙ্গামা ওখানে। তারপর বললে—ছোটমা ফিরে এসেছে শালাবাবু?

—ফিরে এসেছে।

—ছোটমা শুনেছে সব?

—কি জানি, তা যাবো একবার বৌঠানের সঙ্গে দেখা করতে?

-আপনি বরং ছোটবাবুকে একবার দেখে আসুন শালাবাবু, ছোটবাবুর জন্যে মনটা কেমন করছে আমার। আচ্ছা শালাবাবু, ছোটবাবু বাঁচবে তো!

বাইরে যেন আবার গোলমাল শোনা গেল। ভূতনাথ উঠলো এবার। বললে—আসছি আমি বংশী। কী হচ্ছে ওদিকে, দেখে আসি একবার।

তোষাখানার বাইরে এসে দাঁড়ালো ভূতনাথ। চারদিকে একবার চেয়ে দেখলে। শশী ডাক্তারের গাড়িটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি-বারান্দার তলায়। ইব্রাহিম দোতলার উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াসিনও দাঁড়িয়ে দেখছে। মিয়াজান, আব্বাস, ইলিয়াস তারাও উঠোনে ভিড় করেছে। লাল পাগড়ি পরা দু’চারটে পুলিশ গেট-এর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লাঠি। খাজাঞ্চীখানার ভেতর আলো জ্বলছে। দরজার সামনে-সেখানেও ভিড় জমেছে। দারোগা সাহেব বোধহয় ওখানে ঢুকেছে। সারা বাড়িতে যেন একটা চাপা চাঞ্চল্য। ভূতনাথ আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে এল।

কে যেন সামনে আসছিল। সামনে আসতেই চেনা গেল। মধুসূদন।

-কী খবর মধুসূদন?

—সব্বনাশ হয়ে গিয়েছে শালাবাবু।

—কী হলো?

–চুনীদাসী খুন হয়ে গিয়েছে শুনছি। আমি যাচ্ছি একবার সেখানে।

—চুনীদাসী!

—শুনছি তো! কী জানি, কী ব্যাপার!

–কে খুন করলে?

মধুসূদন বললে—শুনছি ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্তর সঙ্গে নাকি মারামারি হয়েছে ছোটবাবুর।

-নটে দত্ত?

—আজ্ঞে, ছোটবাবু আজ জানবাজারে গিয়ে দেখে নটে দত্ত নাকি চুনীদাসীর ঘরে বসে আছে—দেখে বোধহয় আর রাগ সামলাতে পারেনি। তারপর মারামারি হয়েছে দুজনে। ও-পাড়ার গুণ্ডারা তো সব নটে দত্তর হাতের মুঠোয়, এদিকে ছোটবাবু তো একলা-তা ছেনি দত্তদের সঙ্গে এ-বাড়ির ঝগড়া তো আজকের নয়। সেই দেখলেন না ছুটুকবাবুর বিয়ের সময় কী কাণ্ডটা হলো!

–কিন্তু খুনটা করলো কে?

—কে করলো, কে জানে, হয় নটে দত্ত, নয় ছোটবাবু।

ভূতনাথ বললে-চুনীদাসী কি মারা গিয়েছে?

মধুসূদন বললে-শুনছি তো এখনও জ্ঞান আছে—যাই, তাড়াতাড়ি একবার দেখে আসি গিয়ে। বড় ভালোমানুষ ছিল আজ্ঞে—বলে মধুসূদন চলে গেল।

ভূতনাথ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। একবার মনে পড়লো চুনীদাসীর কথা। সেদিনকার সেই দেখা, তারপরেই এ কী কাণ্ড। চুনীদাসীকে সেদিন সত্যি-সত্যি বিশেষ খারাপ লাগেনি তার। কী চমৎকার ব্যবহার। খাতির করেছে খুব। কীসে ভূতনাথের সুবিধে হয় সেই কথাই বলেছে বারবার। তামাক খাবার কথা বলেছে। জল চেয়েছিল, দিয়েছে সরবৎ। তা সরবতে কী দোষ থাকতে পারে। হয় তো সিদ্ধি মেশানো ছিল সামান্য। যারা সিদ্ধি খায় তাদের তাতে নেশা হয় না। কিন্তু ভূতনাথের তো অভ্যেস নেই। হয় তো মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছিল। কিন্তু তারপরে চুনীদাসী নিজে তার মাথাটা কোলে করে নিয়ে কত যত্ন করেছে। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিয়েছে। কে অমন করে! ভূতনাথকে আদর যত্ন করে তাদের কী লাভ! আর তারপর যদি নটে দত্ত আসার জন্যে তাকে ঘর থেকে বাইরে চলে যেতে বলে থাকে তো এমন কিছু অন্যায় করেনি। ছোটবাবু যাওয়া বন্ধ করলে ওদের চলে কী করে! সংসার তো চলা চাই! অত চাকর, ঝি, নিজে, আবার একটা পাখী! খরচ কি কম। গাড়িটা পর্যন্ত বেচে দিতে হলো।

আস্তে আস্তে ভূতনাথ একেবারে উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো।

ছুটুকবাবু তখন বাড়িতেই ছিল। খবর পেয়ে নিচে এসে গিয়েছে। হাবুল দত্ত রোজকার মতো বড়বাড়িতে এসেছিল। পেছন পেছন সে-ও এসে দাঁড়ালো!

দারোগা সাহেবের সঙ্গে ছুটুকবাবুর কী সব কথা হচ্ছে।

এমন সময় হৈ চৈ শুরু হলো—হটো সব, ভিড় ছাড়ো–

একটা সোরগোল উঠলো। ভিড়ের মধ্যে এতক্ষণে যেন একটা আশার সঞ্চার হলো হঠাৎ! মেজবাবু এসে গিয়েছে!—ওই মেজবাবু এসে গিয়োছ, মেজবাবু এসে গিয়েছে।

এতক্ষণে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো সকলের। মেজবাবু থাকলে কি এতক্ষণ পুলিশের সঙ্গে এত কথা কাটাকাটি হয়। কতবার কত কাণ্ড হয়ে গিয়েছে আগে। সুখচরে খুন হয়েছে প্রজাপাঠক, প্রজারা কাছারি বাড়িতে এসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই বাড়িতেই যেবার দুর্গাপুজোর সময়ে নবমীর রাত্রে মেজমা’র পুরোনো ঝি বিলাসীবালা গলায় দড়ি দিয়েছে, অন্দরমহলের কড়িকাঠের থেকে ঝুলছে শরীরটা—সেদিনও অনেক পুলিশ-থানার হেফাজত থেকে বাঁচিয়েছে মেজবাবুই। মেজবাবু এসে পড়াতে ভূতনাথও অনেকখানি স্বস্তি পেলো যেন। যাক, মেজবাবু এসেছে, বাঁচা গিয়েছে।

মেজবাবুর গাড়ি গড়গড় করে একেবারে গাড়ি-বারান্দার তলায় শশী ডাক্তারের গাড়ির পেছনে এসে থামলো।

দারোগা সাহেব খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছে।

মেজবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। পেছনে ভৈরববাবু।

দারোগা সাহেব সামনে এসে সেলাম করলে একবার।

মেজবাবু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা ওপরে উঠে গেলেন। ভৈরববাবুকে বললেন—ছোটবাবু কেমন আছে আগে দেখে আসি।

ভৈরববাব বললে-কী হয়েছে দারোগা সাহেব?

দারোগা সাহেব বললে—জানবাজারে খুন হয়েছে সন্ধ্যেবেলা।

ভৈরববাবু বললে খুন হয়েছে জানবাজারে, তা এখানে কেন?

—কৌস্তুভমণি চৌধুরীর স্টেটমেন্ট নেবো।

—খুন করেছে কে?

—সেই ইনভেস্টিগেশন করতেই তো এসেছি।

খানিক পরেই ডাক এল। বেণী এল। দারোগা সাহেবকে বললে—আপনাকে মেজবাবু ওপরে ডাকছেন।

দারোগা চলে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে যেন সমস্ত ঘটনার ওপর একটা যবনিকা পড়ে যায়। যে-যার জায়গায় চলে যায় একে-একে। এবার আর কোনো ভয় নেই। মেজবাবু দারোগা সাহেবকে ওপরে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। দারোগা সাহেবই আসুক আর লাটসাহেবই আসুক, একবার নাচঘরে গিয়ে বসলে জলের মতো সোজা হয়ে যাবে সব। কতবার সব সমস্যার সমাধান ওইখানে হয়ে গিয়েছে নিঃশব্দে। কতদিন সব সন্দেহের নিরসন হয়ে গিয়েছে ওই ঘরের নির্জনে।

আবার আস্তে-আস্তে উঠোনটা নিরিবিলি হয়ে এল। আবার নির্জন হয়ে এল বড়বাড়ি। টিমটিম করে ইব্রাহিমের ঘরের সামনের বাতিটা তেমনি জ্বলতে লাগলো। রাত নেমে এল ঘন হয়ে। শশী ডাক্তার কিন্তু তখনও যায়নি। ঘোড়াটা মাথা নিচু করে ঘাস খেতে-খেতে এক-একবার পা ঠোকে। ইটের দাগরাজি করা মেঝের ওপর তার পা-ঠোকার শব্দ যেন অনেক দূর থেকে শোনা যায়। আর পুলিশ ক’টা তখনও দাঁড়িয়ে আছে গেট-এর কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খৈনি খাচ্ছে।

একা-একা নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় ভূতনাথের। এত দুর্ঘটনা, এত উত্তেজনার মধ্যেও কেন নিজেকে এত দুর্বল মনে হয় কে জানে। যেন কোথাও কেউ নেই। এত বড় বাড়ি-তবু যেন মনে হয় এখানে অরণ্যের স্তব্ধতা। সেই আদিম কলকাতার প্রাগৈতিহাসিক চেহারা যেন ফিরে এসেছে। ভূমিপতি চৌধুরী এ-বাড়ি তৈরি করবার আগেকার চেহারা। যেন ডোবা-পুকুর, চারপাশে ব্যাঙ ডাকছে নির্ভয়ে। দু একটা হিজল আর হোগল গাছের ঝোপ-ঝাড়। তাঁতিদের কুঁড়েঘর কয়েকটা। সন্ধ্যে হতে না হতে বাঘের ভয়ে ঘরের ভেতর সেধিয়েছে সবাই। অথচ ভূতনাথের চোখের ওপরেই তো এই শহর বেড়ে চলেছে। হ্যারিসন রোডটা চোখের সামনে গড়ে উঠলো। কলের জল, বড় বড় রাস্তা, ইলেকটিক আলল, কলের ট্রাম—ধনে-জনে কলকাতার কত ভিড় বাড়লো, বস্তি ভেঙে নতুন-নতুন বাড়ি হলো, পুকুর-ডোবা, খানাখন্দ বুজিয়ে খেলার মাঠ হলো। বেড়াবার পার্ক হলো। তবু এই রাত্রিবেলা বড়বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সে যেন কলকাতা শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে অনেক পেছনে চলে গিয়েছে। শহর, সভ্যতা, সমাজ, পরিচিত অপরিচিত সকলের চোখের আড়ালে অন্য এক দেশে! অথচ প্রথম যেদিন এখানে এসেছিল ভূতনাথ, কত আশা ছিল মনে। এই বড়বাড়িকে কত ঈর্ষা করতো। কত উদগ্র কৌতূহল ছিল এই বড়বাড়িকে ঘিরে। কত রাতে জেগে জেগে শুনেছে এ-বাড়ির প্রত্যেকটি খুটিনাটি শব্দ। ভেতর বাড়িতে ঝনঝন করে হয় তত কারো হাত থেকে কঁসার থালা-বাসন পড়ে গেল, ছাদের কোণ থেকে পায়রার ববকম্ শব্দ, দাসু জমাদারের উঠোন ঝাঁট দেওয়ার শব্দটা পর্যন্ত ভালো লাগতো তার। যদুর মা শিল নোড় নিয়ে বাটনা বেটে চলেছে, সৌদামিনী কুটনো কুটতে কুটতে বকবক করে গালাগালি দিয়ে চলেছে—পেছনের বাগানে দাসু জমাদারের ছেলের বাঁশীতে ‘ওঠা নামা প্রেমের তুফানের সুর, এমনকি পুকুরের ধারে আমলকি গাছে একটা অচেনা পাখীর ডাক—সমস্ত, সমস্ত ভালো লেগেছে। আরো ভালো লেগেছে যখন অনেক রাত্রে ঘড়ঘড় শব্দে গেট খুলে যেতো, আর তারপর মেজবাবুর গাড়ি ঢুকতে উঠোনে। যেন অলৌকিক সব ব্যাপার। আর ভোরবেলা নাথু সিং-এর সেই ডন-বৈঠকের আওয়াজ আর নিচে একতলায় আস্তাবল বাড়িতে ঘোড়ার ডলাইমলাই-এর ক্লপ-ফ্লপ, হিস-হিস থাপ্পড় মারার শব্দ। কিন্তু এ সমস্ত শব্দ-তরঙ্গ ছাপিয়ে আর এক শব্দ উঠতো এক-একদিন। সে কোথাকার শব্দ কে জানে। সেই সুর, সেই শিষের মতো মৃদু আওয়াজ ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে সারা বাড়িময়। উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে। সে সুর কেউ শুনতে পায় নি। খিড়কির দিকের একতলার সিঁড়ির নিচে থেকে হয় তো উঠতো। আর শুনতো বুঝি মাত্র দুজন। একজন ভূতনাথ। আর একজন এ-বাড়িরই লোক–সে পটেশ্বরী বৌঠান!

কিন্তু ওখানে অন্যরকম। ওই জবাদের বাড়িতে। ওখানে গেলেই মনে হয়, জীবনের পথ যেন এখনও অনেকখানি বাকি। যৌবনের যেন শুরু হলো এইমাত্র। ঐশ্বর্য যখন ছিল সুবিনয়বাবুর, তখনও যেন আড়ম্বর ছিল না কোথাও। প্রাচুর্য ছিল, কিন্তু এমন অপচয় ছিল না। তা ছাড়া আজকাল রাস্তায়, ঘাটে, বাজারেও যেন নতুন জীবন ফিরে এসেছে। কোথায় যেন ভেতরে-ভেতরে কোন্ আন্দোলনের শিখা অনির্বাণ হয়ে জ্বলছে। মাঝে-মাঝে তার প্রকাশ চোখে পড়ে। সিস্টার নিবেদিতা বাগবাজারে স্কুল খুলেছেন। কোন্ এক বিদেশি মেয়ের এ কি বিচিত্র খেয়াল! কিন্তু শুধুই কি খেয়াল! সেদিন বড়বাজারে যারা গান গেয়ে-গেয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলো, তাদেরও কি শুধু খেয়াল! আর কিছু নয়! নিবারণরা শুধু কি অকারণেই ভেতরে-ভেতরে অমন জ্বলবার জন্যে তৈরি হচ্ছে!

শশী ডাক্তার বুঝি এবার নামলো। বিধু সরকার ওষুধের বাক্সটা গাড়িতে তুলে দিলো।

একবার মনে হলো বিধু সরকারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে— সরকার মশাই, কেমন আছেন ছোটবাবু—কিন্তু ভয় হলো। দরকার কী! লোকটা বিশেষ সুবিধের নয়। সেদিন বদরিকাবাবু খুব জব্দ করেছে বিধু সরকারকে! নিচেই বৈঠকখানা। এদিকে তো এত কাণ্ড, কিন্তু বদরিকাবাবু কী করছে এখন কে জানে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলে ভূতনাথ।

হঠাৎ সারা কলকাতা কাঁপিয়ে একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। রাত ন’টা বাজলো বুঝি। তোপ পড়লে কেল্লায়। চিৎপাত হয়ে শুয়েছিল বদরিকাবাবু। শব্দটা কানে যেতেই চিৎকার করে উঠলো —ব্যোম কালী কোলকাত্তাওয়ালী-বলে উঠে বসলো। তারপর টাক থেকে ঘড়িটা বার করে মিলিয়ে নিলো সেটা। তারপর দেয়ালের বড় ঘড়িটার দিকেও একবার তাকালে। সেটাতেও ঢং-ঢং করে ন’টা বাজছে তখন। ভূতনাথকে দেখতে পেয়েই ডাকলে— শোন–আয় এদিকে।

ভূতনাথ গিয়ে বসলো তক্তপোশের ওপর। খানিক পরে বললে-শুনেছেন, কী হয়েছে?

বদরিকাবাবু নিলিপ্তের ভঙ্গিতে বললে—আমি জানতাম।

–আর শুনেছেন, বংশীও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মার খেয়ে।

–আমি জানতাম এ-হবে।

–আর চুনীদাসী খুন হয়েছে।

–তাও হবে জানতাম।

বদরিকাবাবু কেমন করে সব জানতে কে জানে!

বদরিকাবাবু আবার বললে—আরে কী কী হবে তাও বলে দিতে পারি, শুনবি?

ভূতনাথের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে বদরিকাবাবু বলতে লাগলো—দেখবি, একদিন এই কড়িকাঠ ভেঙে পড়বে, এই বাড়ি গুড়ো হয়ে যাবে, বড়বাড়ির ভিটেতে ঘুঘু চরবে, পায়রাগুলো না খেতে পেয়ে মরবে, চাকর-বাকর সবাই পালাবে, যদি না পালায় তো সবাই ইট চাপা পড়ে মরবে দেখে নিস—তারপর এই বাড়ি ভেঙে মাটি সমান হবে একদিন, সেই মাটি খুড়তে খুড়তে মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে কুলি-মজুরদের, শেষে মাটি খুড়ে…বদরিকাবাবু থামলো।

ভূতনাথ বললে–তারপর? মাটি খুড়ে…?

—মাটি খুড়ে স্ফটিক-পাথর পাওয়া যাবে একটা।

—স্ফটিক-পাথর?

—হ্যাঁ রে, স্ফটিক পাথর, বিশ্বাস হচ্ছে না?

—স্ফটিক-পাথর? কেন?

–সব বলবো না এখন, তুই ভয় পেয়ে যাবি, কিন্তু তুইও রেহাই পাবি না তা বলে, তোকেও ভুগতে হবে, মাথা ফেটে তোর রক্ত ঝরবে, তোরও সময় হয়ে এসেছে যে, তখন এক গেলাশ জলের জন্যে ছটফট করবি, কেউ জল দেবে না, এ-বংশের রক্তের সঙ্গে তোর রক্তের ছোঁয়া লেগেছে কিনা। দর্পনারায়ণের অভিশাপ কি বৃথা যাবে ভেবেছিস, এক ফোটা জল পর্যন্ত পায়নি শেষকালে, মুর্শিদকুলি খা’র ‘বৈকুণ্ঠে’ বসে তিলেতিলে শুকিয়ে মরেছে, আর মরবার শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত কেবল শাপ দিয়ে গিয়েছে যে কথা বলতে বলতে বদরিকাবাবুর মুখ চোখের ভাব-ভঙ্গি কেমন যেন ভয়াবহ হয়ে উঠলো। ফুলে উঠলে চোখ দুটো! ভূতনাথ নিঃশব্দে উঠে এল ঘর থেকে। যেন মারমুখী হর্ষে উঠেছে আজ বদরিকাবাবু! সর্বক্ষণ ঘড়ি ধরে-ধরে যেন শাপ দিয়ে চলেছে নিজের অন্নদাতাকে! অথচ কিসের এ ক্ষোভ! কেন এ অভিযোগ! কিন্তু কে জানতো

বদরিকাবাবুর কথাগুলো এমন বর্ণে-বর্ণে ফলে যাবে শেষ পর্যন্ত।

বংশীর ঘরে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে একবার দেখলে ভূতনাথ। জ্বরে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে তার।

হঠাৎ মধুসূদন ঘরে ঢুকলো।

ভূতনাথ বললে—কী দেখে এলে মধুসূদন?

মধুসূদন বললে-হাসপাতালে গিয়েছিলাম শালাবাবু, চুনীদাসীকে চাঁদনীর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।

-কেমন আছে এখন?

মধুসূদন বললে—জ্ঞান হয়েছে একটু।

—কথা বলছে।

–কথা বলছে না, তবে আমায় দেখে চিনতে পারলে আজ্ঞে, চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, কিন্তু ডাক্তার বললে, ভয় নেই, বেঁচে যাবে, তবে সময় লাগবে অনেক।

—কী হয়েছিল?

–কে জানে শালাবাবু, কেউ বলতে পারছে না, নটে দত্ত আর ছোটবাবুতে মারামারি হয়েছিল, ছোটবাবুর হাতে তো ছিল চাবুক, আর নটে দত্তর গুণ্ডার দল তৈরিই ছিল ও-পাড়ায়, ঠিক যে আসলে কী হয়েছিল কেউ বলতে পারছে না।

আস্তে-আস্তে ভূতনাথ নিজের চোরকুঠুরিতে এসে উঠলো। আজ বংশী নেই, কে আর খেতে ডাকতে আসবে। নিজের বিছানাটা পেতে নিয়ে চিত হয়ে অন্ধকারের মধ্যেই শুয়ে পড়লো ভূতনাথ। অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়া-মৃতি যেন নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করছে বলে মনে হলো। কোথায় যেন কত যুগের পরপার থেকে সেই ইটালিয়ান শিল্পী ফিরে এসেছে আবার তার স্ত্রীর শয্যার পাশে। ভূমিপতি চৌধুরীকে যেন আজ হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছে সে। আবার যেন আজ নতুন করে প্রতিশোধ নেবে। আজ আর পিস্তলের গুলী ফস্কে যাবে না তার। অনেক সমুদ্র অনেক নদী পার হয়ে আবার ভারতবর্ষে এসেছে হারানো স্ত্রীর খোঁজে। দেয়ালের গায়ের অস্পষ্ট ছবিগুলো যেন আবার সজীব হয়ে উঠেছে। উড়ন্ত পরীদের আবার নতুন করে পাখা গজিয়েছে। নতুন করে যেন অভিসার হবে এই ঘরে।

হঠাৎ যেন দরজার পাশ থেকে কার গলার আওয়াজ এল। ডাকছে-বাবু, বাবু–

অতি মৃদু ডাক। আওয়াজ শুনে বোঝা যায় না কার গলা। তবু বোঝা গেল যেন মেয়েমানুষের গলার শব্দ।

দরজা খুলে ভূতনাথ বাইরে আসতেই দেখলে পাশে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিন্তা। হাতে একটা হ্যারিকেনের আলো। থান কাপড় পরা। অন্যদিকে মুখ ফেরানো। বললে—আমায় ডাকছিলে? ভূতনাথ আর যে কী বলবে ভেকে পেলে না।

চিন্তা তেমনি ঘোমটা ঢেকেই বললে—আপনার খাবার দেওয়া হয়েছে বাবু।

ভূতনাথ বললে—চলো, আমি যাচ্ছি।

আগে-আগে চললো চিন্তা। পেছনে ভূতনাথও চলতে লাগলো। গলি ঘুজির মতো রাস্তা। বড়বাড়ির এ-দিকটা রান্নাবাড়ির গায়ে। রান্নাবাড়ির পাশেই ভাড়ার ঘর। তারপর একটা শুধু দেয়ালের ব্যবধান। আর দেয়ালের গা দিয়ে রান্নাবাড়ির রাস্তা। সারা দেয়ালে ধোয়ার দাগ। বহুদিনের ব্যবহারে মেঝেটার জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট উঠে গিয়েছে। থালা সোজা হয়ে বসে না। ঘরের কোণে একটা আরশোলা চুপচাপ বসে শুঁড় নাড়াচ্ছে।

ভূতনাথ ভাত খেতে-খেতে একবার আরশোলাটার দিকে চেয়ে, দেখলে। মনে হলো যেন আরশোলাটাও তার দিকে চেয়ে দেখছে। অদ্ভুত বাদামি রং। চোখের চারপাশে গোল পাঁশুটে দাগ। কী মতলব করছে বসে-বসে কে জানে। হয় তো আলো দেখে বিব্রত হয়েছে। কিম্বা হয় তো ভাত খাওয়া শেষ হবার পর এটো বাসন চাটবার লোভে অপেক্ষা করছে। কী খেয়ে ওরা বাঁচে কে জানে। কতটুকু প্রাণ ওদের! কোথায় থাকে! এই ঘরের মধ্যেই হয় তো কোনো গর্ত আছে। সেখানে ডিম পাড়ে আর এটো খেয়ে জীবন ধারণ করে। আরশোলাটার দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় এল ভূতনাথের। ও-ও তো এ-বাড়ির আশ্রিত। তার সঙ্গে ওই আরশোলাটার তফাৎ কী!

হঠাৎ মনে হলো যেন আরশোলাটা নড়তে শুরু করেছে। ঠিক তার ভাতের থালাটা লক্ষ্য করে যে আসছে তা নয়, কিন্তু সেইটেই যেন লক্ষ্য। প্রথমে উত্তর দিকে চলতে লাগলো, তারপর অকারণেই হঠাৎ পুব দিকে মুখ ফেরালো। তারপর এদিক-ওদিক দেখে একবার শুঁড় নাড়াতে লাগলো। তারপর আর নড়ে না। মনে হলো যেন এদিকে আর আসবে না।

ভূতনাথ নিজের মনেই ভাত খেতে লাগলো এবার। না, আর সে ওদিকে দেখবে না। সমস্ত শরীর যেন তার শিরশির করে উঠছে। কত অদ্ভুত সব সৃষ্টি। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, ওই আরশোলাটাও তো সেই তঁরই সৃষ্টি। কিন্তু এমন বিপরীত সৃষ্টি একই হাতে কী করে সম্ভব! একবার অন্যমনস্কভাবে হঠাৎ আবার ভূতনাথের চোখ গিয়ে পড়লো আরশোলাটার ওপর। এবার মনে হলো, আস্তে-আস্তে আরশোলাটা যেন তার দিকেই আসছে!

আরও কাছে এল। আরো কাছে। এবার খুব সন্তর্পণে কাছে এসে ঠিক তার থালায় মুখ দিতেই…

—দাদা কেমন আছে, জানেন?

ভূতনাথের যেন চমক ভাঙলো এবার। ঘরে কেউ নেই। প্রশ্নটা এল দরজার আড়াল থেকে।–কে, বংশী? বংশীর কথা বলছে?

-হ্যাঁ।

–দেখে এলাম তো, জ্বর হয়েছে খুব।

—আজ কিছু খাবে দাদা?

—আজ আর কিছু খাবার দরকার নেই, আজ রাতটা উপোসই থাক।

হঠাৎ মনে হলো আরশোলাটা যেন থালার ধারে মুখ লাগিয়ে কী খাচ্ছে। মুখ নড়ছে না। শরীর নড়ছে না। শুধু শুডটা যেন অল্প-অল্প হেলছে দুলছে। ভূতনাথ থালাটা একবার নাড়িয়ে দিলে। যদি ভয় পেয়ে চলে যায় তো যাক। কিন্তু অদ্ভুত নির্ভীক এই আরশোলাটা! নড়ে না চড়ে না। কাঠ হয়ে লেগে রইল থালার গায়ে! ভূতনাথের শরীর আবার শিরশির করতে লাগলো।

–ছোটমা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, জানেন?

ভূতনাথ খেতে-খেতে মুখ তুললো। বললে—অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন?

দরজার আড়াল থেকে আবার সেই গলা। বাড়িতে এসেই ছোটবাবুর খবর পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে অজ্ঞান।

—তারপর?

—মাথায় বরফ দিয়ে-দিয়ে এখন জ্ঞান হয়েছে একটু—আপনার কথা বলছিলেন।

—আমায় ডাকছিলেন নাকি?

–-হ্যাঁ, আমি ডাকতে গিয়েছিলাম, আপনাকে পেলাম না ঘরে। আমার বড় ভয় করছিল। চোখ দেখে মনে হচ্ছিলো ঘোট বুঝি বাঁচবে না, একলা তখন কী যে করি, মেজমাকে খবর দিলাম, বড়মাকে খবর দিলাম, শেষে বরফ আনিয়ে মাথায় দিতেই–

—এখন কেমন আছেন?

-এখন একটু ভালো, সারাদিন তো উপোস দিয়েছেন, পেটে কিছুই পড়েনি, আমি ছোটবাবুর পা ছোঁয়া জল আনতে পাঠিয়েছিলাম, দাদা তো নেই, বেণী বললে-ছোটবাবু পা ছুঁড়ে জলের বাটি ফেলে দিলেন, পাথরের বাটি তো, বাটিটাও ভেঙে গিয়েছে। ছোটমার কিছু খাওয়া হয়নি, এখন একটু ওষুধ খেতে চাইছিলেন।

—ওষুধ? কী ওষুধ?

–যে-ওষুধ খান রোজ।

প্রথমটা বুঝতে পারেনি ভূতনাথ। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলো। তাই তো! ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—ওটা কি এখনও খান রোজ?

—হ্যাঁ, রোজই তো খান।

রোজই খায় বৌঠান! কেমন যেন লাগলো ভূতনাথের। খাওয়ার পর উঠে আসতে গিয়ে হঠাৎ পেছন ফিরে একবার দেখলে ভূতনাথ। আরশোলাটা এবার তার থালার ওপর একেবারে উঠে বসেছে। কেমন ঘিনঘিন করতে লাগলো সারা শরীরটা।

তারপর বিছানায় শুয়েও অন্ধকারের মধ্যে মনে হলো যেন অতিকায় একটা আরশোলা তার দিকে মিটমিট করে চাইছে। তারপরেই মনে হলো, ওটা আরশোলা নয়, তারই বিকৃত মন কুৎসিত একটা জীবের রূপ নিয়ে তাকে গ্রাস করতে আসছে বুঝি। চোখের চারদিকে তেমনি পাঁশুটে দাগ, লম্বা-লম্বা শুড়, অনিশ্চিত গতি। তেমনি বিবর্ণ, কুৎসিত। তেমনি বীভৎস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *