তখন বিংশ শতাব্দীর শুরু। লর্ড কার্জনেব রাজত্ব। আজও সাইকেল-এ যেতে যেতে স্পষ্ট মনে পড়ে সব। সেদিনকার আঘাতে সে যে মরেনি এই-ই তো আশ্চর্য! গোলদীঘির ধারেই বুঝি কোন্ একটা বাড়িতে কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাকে।
প্রথম যখন চোখ মেললে, দেখলে—একটা পাকা ঘর। পুরোনো ময়লা দেয়াল। চারিদিকে লাল কালিতে লেখা-“বন্দেমাতরম্। কয়েকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। জানালা খোলা ছিল। দেখা যায়—সামনে কুস্তির আখড়া। বাইরে বিকেল হয়ে এসেছে। সমস্ত শরীরে ব্যথা! একটু ওঠবার চেষ্টা করতেই কে একজন এসে ধরলে। কামিজ পরা, অল্প অল্প দাড়ি গোঁফ উঠেছে। চেহারাটা যেন চেনা চেনা মনে হলো।
মাথাটা ধরে বললে—এখন উঠতে চেষ্টা কোরো না ভাই। তারপর কাকে যেন ডেকে বললে—শিবনাথ আর একটু দুধ আনো তো।
শিবনাথ দুধ এনে দিতে লোকটি বললে—এটুকু খেয়ে নাও দিকি।
দুধ খেয়ে আবার যেন একটু তন্দ্রা এসেছিল খানিকক্ষণ। আবার যখন তন্দ্রা ভাঙলে কানে এল কাদের কথাবার্তা। বেশ অন্ধকার হয়েছে চারিদিকে। একটা হারিকেন জ্বলছে টিম টিম করে। ভূতনাথ মনে মনে ভাবছিল এ কোথায় এল সে। যারা একটু আগে এসে তাকে দুধ খাইয়ে গিয়েছে, তারা বোধ হয় বাইরেই রয়েছে।
কে একজন বলছে—কদমদা’, এবার ওদের একটা শিক্ষা দিতেই হবে। কালকে গড়ের মাঠেও একজন গোরা বুটের লাথি মেরে
একজনকে একেবারে অজ্ঞান করে দিয়েছে।
—গোরাতে একে মেরেছে জানলি কী করে?
–গোরাতে না মারলে কি ভূতে মারতে এল?
-গুণ্ডাও তো হতে পারে? নিজের চোখে তো দেখিসনি তুই? কলকাতার রাস্তায় গুণ্ডাও তো কম নেই আর তা ছাড়া একটা গোরাকে মেরেও তো লাভ হবে না কিছুক’টা গোরাকে সামলাবি? শেষকালে কেল্লা থেকে যখন হাজার হাজার গোরা বেরিয়ে মারতে শুরু করবে তখন বাঙালীরা পালাবে কোথায়? সাহস তো খুব বোঝা গিয়েছে। একটা কুস্তির আখড়াতেই মেম্বর যোগাড় করা যায় না।
—কিন্তু কদমদা’ ভারতবর্ষ জয় করতে ক’টা ইংরেজ এসেছিল?
খানিকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না। তারপর কে যেন বলতে লাগলো—তোরা ভুল করছিস শিবনাথ, আমাদের যুবক সঙ্ঘের’ উদ্দেশ্যই যে তা নয়—স্বামিজী বলেছেন—“The world is in need of those whose life is one burning love-selfless. That love will make every word tell like a thunder-bolt. Awake, awake great souls! The world is burning in misery, can you sleep?” রাজনীতি দিয়েও দেশের উপকার হবে না, ধর্মের জয়ঢাক পিটিয়েও কিছু হবে না, অর্থনীতি দিয়েও অভাব মিটবে না আমাদের, আমরা যুবক সজের সভ্যরা একটা জিনিষ চাই, সে এই যে, দেশের ওপর মাতৃভূমির ওপর প্রেম—জ্বলন্ত প্রেম। সে প্রেম তোর আত্মা, তোর বিত্ত, তোর সন্তানের চেয়েও বড়। যে সেই জ্বলন্ত প্রেম নিয়ে গরীব বড়লোক, হিন্দু মুসলমান, জৈন খৃস্টান সকলকে সমান চোখে দেখতে পারবে, সেই শুধু পারবে। তবেই সমস্ত ভারতবর্ষ এক হবে। তোরা ভুল বুঝিসনে আমাকে, সিস্টার নিবেদিতাও সেদিন সেই কথাই বললেন—বড়দা’রও সেই মত।
হঠাৎ অনেকগুলো গলার আওয়াজ এক সঙ্গে উঠলো—ওই যে বড়দা এসে গিয়েছেন।
বড়দা এসেই জিজ্ঞেস করলে—কীসের কথা হচ্ছে?
শিবনাথ বললে-সেদিন আর একজনকে এক গোরা মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে।
–কই? কোথায়?
–ওই যে ঘরের ভেতর রয়েছে।
ঘরে আসতেই চেহারা দেখে চমকে উঠলো ভূতনাথ।
ব্ৰজরাখালও কম বিস্মিত হয়নি। বললে—এ কী, বড়কুটুম?
ভূতনাথের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। কিন্তু মুখে কিছু বলবার ক্ষমতা নেই।
ব্ৰজরাখাল মাথায় হাত বুলোতে বুলোত বললে কাঁদছো কেন বড়কুটুম, কোনো ভয় নেই তোমার, আমাদেরই ‘যুবক সঙ্ঘে’ রয়েছে, এখানে কোনো অসুবিধে হবে না তোমার, কদম রয়েছে শিবনাথ রয়েছে, বরং বড়বাড়িতে থাকলে দেখাশোনা করতে কে? তারপর শিবনাথের দিকে চেয়ে বললে—আরে এ যে আমার বড়কুটুম হয়—কোথায় পেলি একে!
যাবার সময় ব্ৰজরাখাল বলে গেল—আসবো আবার আমি, এখন কিছুদিন বড় ব্যস্ত আছি।
সে কতকাল আগের কথা! গোলদীঘির ধারের সেই যুবক সঙ্ঘের’ ঘরটাতে ভূতনাথ তারপরেও কতদিন গিয়েছে। জীবনের এক সন্ধিক্ষণে নিতান্ত অসহায়ের মতন যে কয়েকদিন সে শুয়ে পড়েছিল ওখানে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তার স্মৃতি যেন জড়িয়ে আছে। শুয়ে শুয়েই সব দেখতে সব শুনতে সে। ছেলেরা কুস্তি করতে, মুগুর ভাজতে লাঠি খেলতে আর গান করতে। কয়েকটা গান এখনও মনে আছে—
“মা গো যায় যেন জীবন চলে
বন্দে মাতরম বলে–
বেত মেরে কি মা ভোলাবে
আমি কি মা’র সেই ছেলে!
দেখে রক্তারক্তি বাড়বে শক্তি
কে পালাবে মা ফেলে–”
আর একটা গান–
“শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত মোরা
অভয়া চরণে নম্র শির।
ডরি না রক্ত ঝরিতে ঝরাতে
দৃপ্ত আমরা ভক্তবীর–”
নিবারণের কথাও মনে পড়লো। ছেলেটা মাথার কাছে বসে ছিল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সামনের আখড় ফাকা। কারো গলার শব্দ আসছে না। হঠাৎ মাথার কাছে একটা শব্দ হতেই ভূতনাথ চোখ তুলে দেখলে কে যেন বসে আছে তার দিকে চেয়ে।
নিবারণ বলেছিল নিচু হয়ে কিছু কষ্ট হচ্ছে আপনার?
ভূতনাথ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখেছিল নিবারণের মুখের দিকে। কিছু কথা বলেনি।
নিবারণ শেষে নিজেই বলেছিল—একটু জল খাবেন?
জল খেয়েও ভূতনাথ তেমনি তাকিয়ে আছে দেখে নিবারণ বলেছিল—কিছু বলবেন আমাকে?
ভূতনাথ বলেছিল—তুমি কে?
নিবারণ বলেছিল—আমি নিবারণ, আমায় চিনতে পারবেন না—আমি ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ থেকে নতুন এসেছি—আপনার কাছে রাত্রে থাকবে।
ভূতনাথ বললে–’আত্মোন্নতি সমিতি’ কোথায়?
–আগে খেলা ইনস্টিটিউশনে বসতে—এখন যুবক সঙ্ঘের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, যেদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ফিরিঙ্গীদের সঙ্গে মারামারি হয়, সেদিন থেকেই ঠিক হয়েছে দুটো সমিতি এক হয়ে যাবে। ফিরিঙ্গীগুলো বড় অত্যাচার আরম্ভ করেছে কিনা, যাকে তাকে রাস্তায় মারধোর করছে। আমরাও ঠিক করেছি ফিরিঙ্গী ছোকরা দেখলেই মারব, কিন্তু কদমদা’ বলে, ওতে কাজ হবে না, তাই নিয়েই তো আজকে মিটিং ছিল আমাদের।
–মিটিং-এ কী ঠিক হলো।
—ঠিক হলো না কিছুই, বড়দা’ হাজির ছিলেন না।
—বড়দা’ কে?
–ব্ৰজরাখালবাবু, উনিই আমাদের প্রেসিডেন্ট কিনা।
ব্ৰজরাখাল! নামটা শুনেই ভূতনাথ যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। একথা তো ব্রজরাখাল কখনও বলেনি।
নিবারণ কিন্তু তখন নিজের মনেই বলে চলেছে—কিন্তু কদমদা’ যাই বলুন, আমরা ঠিক করেছি আমরাও আমাদের নিজেদের পথে চলবে। বৃটিশ রাজত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন মনুষ্যত্ব বজায় রেখে বেঁচে থাকা কঠিন।
আজো মনে পড়ে সেদিনকার নিবারণের সেই কথাগুলো। কী জ্বলন্ত আগুনের ফুল্কির মতো সব ছেলে। কথাগুলো যেন আজো কানে বাজছে। সেই ২২শে জুন তারিখের ঘটনা যেন তার কণ্ঠস্থ। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ডায়মণ্ড জুবিলী উৎসবের পর পুণার গণেশখণ্ডের লাটসাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল প্লেগ কমিশনার র্যা সাহেব। দুর্দান্ত বদমাইশ সাহেব। সামনে গিয়ে মুখখামুখি দাঁড়িয়ে খুন করলে দুই ভাই দামোদর চাপেকার আর বালকৃষ্ণ চাপেকার। শিবাজী মহারাজার বংশধর। বাঙলার বিপ্লব আন্দোলনের সেই তো আরম্ভ। আর সেই চাপেকার সঙ্ঘের সদস্যরাই তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরু। সে বুঝি ১৮৯৯ সাল। একদিন শেষ রাত্রে দুই ভাই-এর ফাসি হয়ে গেল নিঃশব্দে। কিন্তু যে-বিশ্বাসঘাতকরা চাপেকার ভাইদের ধরিয়ে দিলে, তারাও তো প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত।
নিবারণ হঠাৎ থেমে বললে—কিন্তু বাঙালীরাই বা পেছিয়ে থাকবে কেন। তাই চাপেকার সঙ্ঘ থেকে লোক কলকাতাতেও আসছে—আমি চিঠি দেখেছি। একটা ব্যাণ্ডকে খুন করলে তোল কিছু কাজ হবে না, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ র্যাণ্ড ছড়িয়ে রয়েছে যে ভারতবর্ষে, নীলকর সাহেবরা গিয়েছে কিন্তু চা-বাগানের সাহেবরা?
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কারা আসছে কলকাতায় বললে?
—তিনজন বাঙালী, যতীন বাঁড়ুজ্জে, বারীন ঘোষ আর তার দাদা অরবিন্দ ঘোষ। আর এখানে আমাদের ব্যারিস্টার সাহেব পি. মিত্তির রয়েছেন। একটা সমিতি করার কথা হয়েছে, নাম হবে ‘অনুশীলন সমিতি’। মানিকতলা স্ত্রীটের মানিক দত্তের বাড়িতে ওদের আড্ডা বসছে। তারপর একটু থেমে নিবারণ আবার বললে
-আপনি ওখানে যাবেন একদিন?
—আমাকে যেতে দেবে কেন?
-খুব যেতে দেবে। নিবারণ বললে–আপনি ব্ৰজরাখালবাবুর শালা, কেউ আটকাবে না, আর সবাই মিলে না লাগলে কিছু হবেও না, এই সেদিন বুয়র যুদ্ধ হয়ে গেল, আবার রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ বাধছে। দেখবেন শাদা চামড়ারা এবার হারবেই হারবে। আপনি ম্যাটসিনি গ্যারিবল্ডির লাইফ পড়েছেন? আপনাকে আমি বই দিতে পারি। এইরকম করেই তারাও তো স্বাধীন হয়েছিল। সেদিন সিস্টার নিবেদিতা এসেছিলেন এখানে, তিনিও আশীর্বাদ করে গিয়েছেন আমাদের, বলেছেন—তোমরা স্বামিজীর মতন হও।
নিবারণের কথা শুনতে শুনতে ভূতনাথের চোখ দুটো বুজে এল। মনে হলো—এ এক আশ্চর্য জগতে এসে পৌচেছে সে। কলকাতার কেন্দ্রে বসে ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। জব চার্নক আর লর্ড ক্লাইভের কলকাতার এ যেন এক বিস্ময়কর রূপান্তর। যে-কলকাতায় ননীলাল থাকে, থাকে ছুটুকবাবু, ছোটবাবু, ছোটবৌঠান আর থাকে সুবিনয়বাবু আর জবা—এ যেন সে-কলকাতা নয়। কলকাতায় এসে ভূতনাথও তো নিজের চোখে কত কি দেখেছে।
সেদিনের সেই ঘটনাটা মনে পড়লো। বৌবাজার থেকে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকতে সেই যে বটগাছটার তলায় সান বাঁধানো বেদীটার ওপর নরহরি মহাপাত্রের বিগ্রহগুলোলক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, দুর্গা, মনসা, শিব, কালী, ছোট পুতুলের মাপের অসংখ্য ঠাকুর সব! প্রথম যেদিন কলকাতায় এসে পৌঁছোয় ভূতনাথ, নরহরি তাকে ওইখানে প্রণাম করিয়ে পয়সা নিয়েছিল। মন্তর পড়িয়েছিল। তারপর ‘মোহিনী-সিঁদুর আপিসে যাতায়াতের পথে কতবার কত পয়সা আদায় করেছে। মিথ্যে হোক, বুজরুকি হোক, তবু ঠাকুর দেবতা তো! যে অদৃশ্য শক্তি এই বিশ্ব চরাচরের নিয়ামক, তাকে অগ্রাহ্য করবার শক্তি তো ভূতনাথের নেই। ভূতনাথের নিজেরই জন্ম তত পঞ্চাননতলায় মানতের ফলে। হোক ওটা নরহরি মহাপাত্রের ব্যবসা বা দোকান, তবু ঈশ্বরের নাম করে যখন চাইছে, তাতে কী-ই বা এমন ক্ষতি। তাই আসা-যাওয়ার পথে প্রণাম করতে কখনও ভোলেনি ভূতনাথ।
কিন্তু সেদিন দুপুরে কী অভাবনীয় কাণ্ড!
গোটা কতক গোরা সৈন্যই বুঝি! বনমালী সরকার লেন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো শিষ দিতে দিতে। সামনে যথারীতি নরহরি মহাপাত্র সবে গঙ্গাস্নান সেরে মাথার শিখাতে একটা গাঁদাফুল ঝুলিয়ে পথচারীদের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে! এমন রোজই থাকে সে। নতুন কিছু নয়। কিন্তু ওই দৃশ্য দেখে গোরা সৈন্য দুটোর কী মতলব হলো মনে কে জানে? একজন হাতের ছড়িটা দিয়ে মারলে নরহরির মাথার গাঁদা ফুলটাকে। উদ্দেশ্য হয় তো রসিকতাই, কিন্তু ভয় পেয়ে নরহরি চিৎকার করে উঠলো। সে-চিৎকারে ফল ফললে উল্টো। পাশ থেকে একজন গোরা সৈন্য বট দিয়ে মারলে নরহরির মুখে। কিন্তু মুখ তা বলে বন্ধ হলো না নরহরির। রাস্তার ধারে এক নিমেষে ছিটকে পড়লো নরহরি আর কাটফাটা চিৎকার করতে লাগলো। শব্দ শুনে এদিক-ওদিক থেকে জনতা কতক বেরিয়েও এল ব্যাপার দেখতে।
ভূতনাথও শব্দ শুনে বড়বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখতে এসেছে।
কিন্তু সে কি লোমহর্ষণ ব্যাপার! বুক দুর দুর করে কাঁপছে সকলের। কারো কিছু বলবার সাহস নেই।
ভারি ভারি বুট দিয়ে দুটো গোরা তখন লাথি মারতে শুরু করছে। এক একটা লাথি মারে আর লক্ষ্মী গণেশ ঠাকুরগুলো দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। শিব, দুর্গা মনসা, সব মার্বেল গুলির মতো যেদিকে খুশি ছিটকে ফেলছে। শান বাঁধানো বেদীটাও বুঝি ভেঙে-চুরে গেল বুটের ঠোকর লেগে। আর একপাশে পড়ে নরহরি মহাপাত্র চিৎকার করে পাড়া মাত করছে।
শেষকালে যেন ক্ষেপে উঠলো গোরা দুটো। যাকে সামনে পায়, তাকেই মারতে যায়। বড়বাড়ির গেটে ব্রিজ সিং দাঁড়িয়েছিল। বুকে গুলীর বেল্ট। হাতে সঙ্গীন লাগানো বন্দুক। লোহার গেট বন্ধ করে দিলে। যে-যেখানে পারলে লুকোলে গিয়ে। সব বাড়ির দরজা জানালা খড়খড়ি খটাখট বন্ধ হয়ে গেল।
এমন সময় বড়বাড়ির মেজকা হিরণ্যমণি চৌধুরী বেরুচ্ছিলেন।
কোচোয়ানের বসবার জায়গায় আমিরী ভঙ্গিতে ইব্রাহিম লাগাম ধরে জুড়ি চালাচ্ছে। শঙ্কর মাছের চাবুকটা খাপের ওপর খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। মোম লাগানো মস্ত গোঁফ জোড়া দু’পাশে কাকড়া বিছের মতো চিতোনো। মাথায় বাবরি চুল কাঁধের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। মাথার পেছনে কাঠের চিরুনি আঁটা। জরির কাজ করা শাদা প্লেটের ওপর সোনার তক্তি ঝুলছে গলায়। আর ইয়াসিন সহিস পেছনে পাদানির ওপর দাঁড়িয়ে সাবধান করছে সবাইকে। হুঁশিয়ার হো-হুঁশিয়ার হো–-
ব্রিজ সিং লোহার গেট খুলে দিয়ে ম্যাটেনসনের ভঙ্গীতে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ি বেরুবার আগে চিৎকার করে উঠলো— হুঁশিয়ার—হুঁশিয়ার হো—
সে-চিৎকারে হঠাৎ যেন কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চমকে উঠেছে। গোরা দুটো লড়াই থামিয়ে যেন একটু ইতস্তত করতে লাগলো।
ততক্ষণে গাড়ি সামনে এসে গিয়েছে। ভেতরে ভৈরববাবু বসেছিলেন। চেঁচিয়ে বললে—ইব্রাহিম গাড়ি থামাও-মেজবাবু গাড়ি থামাতে বলছেন—থামাও গাড়ি।
আগে মেজকর্তা নামলেন। পেছনে ভৈরববাবু। মেজবাবু হাঁকলেন—ইব্রাহিম চাবুকটা দে তো।
কিন্তু গোরা দুটো তখন রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে পোঁ পোঁ ছুটতে শুরু করেছে।
মেজবাবু নরহরির কাছে গিয়ে এক ধমক দিলেন—উল্লুক, শুয়ার-কা-বাচ্চা, কাঁদছিস কেন? মারতে পারলি না দু’ঘা—আবার পড়ে পড়ে কাঁদছিস। বেল্লিক কাঁহিকা—বলে সপাং সপাং করে চাবুকটা দিয়ে বেদম মারতে লাগলেন নরহরি মহাপাত্রের পিঠে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! নরহরি কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগলো রাস্তার ওপর। যারা এতক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ করে মজা দেখছিল, তারা এবার দরজা খুলে নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ নরহরিকে মারা বন্ধ করে তাদের দিকে চাবুকটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন মেজকর্তা। বললেন—কি দেখছিস সব
বেরো এখান থেকে বেরো
আবার ঝটাপট সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শান্ত সৌম্য মেজকর্তা হিরণ্যমণি চৌধুরীকে কেউ রাগতে দেখেনি। সেই তিনিও রেগে লাল হয়ে উঠলেন। তারপর ভৈরববাবু আর মেজকর্তা গাড়িতে উঠে বসতেই জুড়ি আবার বনমালী সরকার লেন পার হয়ে গেল।
পরদিন খাজাঞ্চী বিধু সরকারের ডাক পড়লো। বেলা তিনটে তখন। বিধু সরকার আসতেই বললেন—নরহরি মহাপাত্রকে এক শ’ টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও তো বিধু—আর সুখচরের গোমস্তাকে চিঠি লিখে দাও, রাজীবপুরের বিলের ধারের দশ বিদ্বে জমি ওর নামে প্রজাবিলি করে দেয় যেন।
যে হুকুম সেই কাজ। তারপরে নাথু সিংকে ডেকে বললেন
নরহরি যেন এ গলির মধ্যে কখনও না ঢোকে আর তাকে যদি কখনও দেখতে পাই তো গুলী করবো, ওকে বলে দিস।
তারপর থেকে নরহরিকে আর কখনও ভূতনাথ দেখেনি কলকাতায়।
গল্প করতে করতে নিবারণ যেন একবার থামলো। বোধ হয় ঘুম আসছিল ওর। ঘরের আলোটা একটু একটু কাঁপছে। ভূতনাথেরও চোখে যেন কেমন তার ভাব। আর শুধু কি নিবারণ আর ভূতনাথ? সমস্ত ভারতবর্ষই বুঝি ছিল তন্দ্রাচ্ছন্ন। বাদশাহী আফিঙের নেশা। জাগতে চেষ্টা করলেও ভালো করে চোখ মেলা যায় না। এক শ’ বছরে রাজ্য ভাঙা-গড়ার ইতিহাস নেই, রাজবংশের উত্থান-পতনের গুরুগর্জন নেই। বেশ নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় সবাই ঘুমিয়েছে। সেই সর্বনাশা ঘুমের অন্তরালে কখন ধানকল এসেছে চুপিচুপি, এসেছে পাটকল আর গম-পেষা কল, কাপড়ের কল, আরে এসেছে স্টীম ইঞ্জিন, স্টীমার, ছাপাখানা আর টাকাছাপানো কল—কেউ টের পায়নি। তৈমুর লঙ-এর আরবী ঘোড় আর নাদির শা’র তলোয়ার যা পারেনি তাই করেছে এক শ’ বছরের ইংরেজ রাজত্ব। ওপর-নিচে সমস্ত ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভেতরে ভেতরে সমাজের ভিত গিয়েছে সে। বুদ্ধ-যিশু-মহম্মদ আর চৈতন্য যা পারেননি তাই পেরেছে বাষ্প আর বাষ্পীয় যান।
ঘুম ভেঙে গিয়েছে নিবারণের।
ঘুম ভেঙে গিয়েছে ভূতনাথেরও।
বাইরে কে যেন জোরে কড়া নাড়ছে। ডাকছে—নিবারণ–নিবারণ-ও নিবারণ–
নিবারণ ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলে দিলে। বললে-কে, কদমদা’ নাকি?
-হ্যাঁ, শিগগির চলবেলুড়ে যেতে হবে।
–কেন? এত রাত্রে?
—হ্যাঁ, স্বামিজী মারা গিয়েছেন।
—স্বামিজী? —হ্যাঁ, স্বামী বিবেকানন্দ!