২০. সেদিন ছোটবৌঠান ডেকে পাঠালেন

সেদিন ছোটবৌঠান ডেকে পাঠালেন।

বংশী বললে—অত ঘুরে যাবার দরকার কী শালাবাবু—এই তো সামনেই দরজা।

কী জানি কেমন যেন সঙ্কোচ হলো ভূতনাথের। সেদিন দরজার ফাঁক দিয়ে অন্দরমহলের যে নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখেছে তারপর ওটা খুলতে আর সাহস হয়নি তার। এ ক’দিন একটু একটু বাগানে গিয়ে বেড়িয়েছে। পুকুরের পাড়ে গিয়ে হাওয়া খেয়েছে।

ছুটুকবাবু দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল—কী খবর ভূতনাথবাবু, দেখাই পাওয়া যায় না যে আপনার। সেদিন ওস্তাদ ছোট্ট, খ এসেছিল, আহা, পুরিয়ার খেয়াল যা শোনালে ভাই-কানা বাদল খাঁ’র পরে অমন পুরিয়া আর শুনিনি মাইরি।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আজকে আসর বসবে নাকি?

—আর আসর—আসরই বোধহয় ভেঙে দিতে হবে। এখন যাত্রা-থিয়েটারের গানেরই আদর বেশি দেখছি—ওস্তাদী গানের আর কদর কই—তেমন ওস্তাদও আর জন্মাচ্ছে না—তা আসুন আজকে আপনি।

-কখন?

–সন্ধ্যেবেলা।

 

বাড়ির চারদিকে রাজমিস্ত্রী খাটছে। ছুটুকবাবুর বিয়ের জন্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।

সেই লোচন আবার দেখতে পেয়ে ডাকলে একদিন।—আসুন শালাবাবু।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—এ-সব কী হচ্ছে লোচন?

এ-ঘরেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ঘর বোয়া মোছ। চলছে। হুঁকো নল ফরসি সব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছে লোচন। বললে—ছুটুকবাবুর বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে হুজুর। নতুন ফরসি এসেছে সব, নতুন তামাক এসেছে গয়া থেকে, খেয়ে দেখবেন নাকি?

ভূতনাথ বললে—না, এখনও খাইনে।

—বড় ভালো জিনিষ ছিল আজ্ঞে, ন’ সিকে ভরির জিনিষ, এখানে বসে খেলে এ-বৌবাজার অঞ্চলটা একেবারে খোশবায় হয়ে যাবে, মেজবাবু ফরমাশ দিয়ে আনিয়েছে হুজুর, ছোটবাবুর বিয়ের সময় একবার এসেছিল। খাস নবাবী মাল কিনা তা আধলা না-হয় নাই দিলেন, কে আর জানতে পারছে।

আতরের শিশি নিয়ে ঢেলে তামাক মাখতে বসলে লোচন।

তাড়াতাড়ি লোচনকে এড়িয়ে ভিস্তিখানায় জল নিয়ে স্নান সেরে নিলে ভূতনাথ। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে ভাবলে, একবার ব্রজরাখালের ঘরটায় গিয়ে দেখলে হয়। কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। কেমন ধারা লোক ব্ৰজরাখাল! একটা খবর পর্যন্ত দিলে না। কোথায় গেল! কেমন আছে সেখানে। কিন্তু ব্ৰজরাখালের ঘর তেমনি তালাবন্ধই পড়ে আছে।

পাশের ঘরে ব্রিজ সিং আটা মাখছিল। বললে-মাস্টার সাব তো নেহি হ্যায় শালাবাবু।

—কোথায় গিয়েছেন জানো ব্রিজ সিৎ?

—কেয়া মালুম বাবু, রোজ রোজ হামেশা দশ বিশঠো আদমি এসে পুছে—লেকিন মাস্টার সাব তো পাত্তা ভেজলো না।

দুপুরবেলাটাও কাটতে চায় না তার। সেই কর্কশ এক-একটা চিলের ডাক বাতাসে ভেসে আসে। এখানে বসে ফতেপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ‘কুয়োর ঘটি তোলা— আ—আ’ শব্দ করতে করতে যায়। কখনও যায় মুশকিল আসান। তখন অন্দরে বেশ গুলজার চলে। দরজাটার কাছে গিয়ে কান পাতলে বিচিত্র কথা শোনা যায়।

মেজবৌ প্রশ্ন করো বড়দি,, সিন্ধু যে তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে বড়!

সত্যি সত্যি বড়বৌ-এর ঝি সিন্ধুই ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আজ।

—ওমা একি! গিরিও এসে পাশে দাঁড়িয়ে গালে হাত দেয়।

শুচিবায়ুগ্রস্ত বড়বৌ-এর বিচিত্র কাণ্ড দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে।

সিন্ধু বলে—বড়মা’র দুটো হাতই অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে আজ।

মেজবৌ হাসতে হাসতে বলে—এরকম অশুদ্ধ হলে কী করে বড়দি?

বড়বৌ হাসেন না। বলেন—কাপড় শুকোবার দড়িতে হাত দিয়েছিলুম মরতে আর ওমনি পোড়ারমুখো একটা কাক কোত্থেকে এসে বসলো দড়িতে।

হাসি চাপতে পারে না গিরি।

মেজবৌ আবার জিজ্ঞেস করে-তা এমন অশুদ্ধ, ক’দ্দিন চলবে তোমার?

বড়বৌ বুঝি রাগ করেন। বলেন—হাসিস নে মেজবৌ, হাসতে নেই-হাসলে তোরও হবে।

মেজবৌ বলে—রক্ষে করো মা, আমার হয়ে কাজ নেই, সাত জন্মে অমন রোগ আমার যেন না হয়। আমার ভাতার আছে, আমার কেন হতে যাবে।

বড়বৌ মেজবৌকে কিছু বলেন না। বলেন সিন্ধুকে—শুনলি লো সিন্ধু, তবু যদি ওর ভাতার ঘরে শুতে।

মেজবৌ কিন্তু রাগে না কথা শুনে। খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসির দমকে হাতের চুড়ি গায়ের গয়না টুংটাং করে বেজে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে—আর ভাসুর ঠাকুর কা’র ঘরে শুতে বলবো বড়দি—বলে দেবো?

কথা শুনতে শুনতে ভূতনাথের একবার কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে। এত বড় বাড়ির বউ সব—এরা কী ভাষায় কথা বলে!

বড়বৌ একবার চিৎকার করে ডাকেন—ছোটও ছোট–ও ছোটবউ—ছুটি—

চিন্তা খর খর করে এগিয়ে আসে—ছোটমাকে ডাকছো নাকি বড়মা?

—ডাকতো একবার ছোটমাকে তোর—এসে কাণ্ড দেখে যাক।

—কী হলো বড়দি?

ছোটবৌঠান বুঝি এতক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বলে–আবার বুঝি তুমি বড়দিকে কিছু বলেছে মেজদি।

—দেখো না ভাই—সারা দিনমান উনি ন্যাংটো হয়ে ঘোরাঘুরি করবেন, কিছু বললেই দোষ, আমরাও গা খুলে বেড়াই, কিন্তু পরনের কাপড়টা পর্যন্ত…

—ওর না হয় রোগ হয়েছে মেজদি, কিন্তু তোমাকেও তো দেখেছি, তুমিই বা কম যাও কিসে?

তুই আর বলিসনি ছোট, তোর আবার বড় বাড়াবাড়ি, কে আছে শুনি দশটা চোখ মেলে? অত জামা কাপড়ের বাহার কেন শুনি, ঘরের মানুষেরা তো ফিরেও চায় না!

ছোটবৌঠান কী জবাব দেবে বুঝি ভেবে পেলে না। তারপর বললে—তুমি কি সত্যিই চাও মেজদি যে, ঘরের মানুষ ঘরে থাকুক।

—তুই আর কথা বাড়াসনে ছোট, বড়ঘরের পুরুষমানুষেরা কবে আর ঘরে কাটিয়েছে শুনি, আমার বাপের বাড়িতেও দেখেছি, এ-বাড়িতেও দেখছি। তোর বাপের বাড়ির কথা অবিশ্যি আলাদা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। নাপতিনী আসে আলতা পরাতে। মেজবৌ আলতা পরে, নখ চাঁছে, পায়ে ঝামা ঘষে। গল্প করে ইনিয়ে বিনিয়ে। সাদা-সাদা পা বাড়িয়ে দিয়ে মেজবৌ গল্প করে— হ্যাঁ রে রঙ্গ, কাল রাত্তিরে তোদের পাড়ায় শাঁখ বাজছিল কেন রে?

নাপিতবৌ বলে—ধোপাবৌ-এর ছেলে হয়েছে যে মেজমা শোননি?

—ওমা, এই সেদিন যে মেয়ে হলো রে একটা–বছর বিয়ুনি নাকি? খুব ভাগ্যি ভালো তো ধোপাবৌ-এর।

হঠাৎ তেতলার সিঁড়ি দিয়ে বংশী উঠে আসে। বলে— ছোটবাবু আসছে মা।

নাপতিনী সন্ত্রস্ত হয়ে এক মাথা ঘোমটা টেনে দেয়। মেজবৌ গায়ের কাপড়টা টেনে দেয়। গিরি লম্বা করে ঘোমটা টেনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো।

মেজবৌ বলে—ওমা, ছোট দেওর যে…কী ভাগ্যি?

ছোটবাবু তর তর করে উঠে আসে তেতলায়। বাতাসে একটা মৃদু গন্ধ। চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায় এক মুহূর্তে।

প্রতিদিন এই দৃশ্যেরই রকম-ফের অন্দরের বউ-মহলে। ভূতনাথের মনে হলো এত বড় বাড়ির বৌ সব—এরাও তত আর পাঁচ বাড়ির বৌদের মতনই সাধারণ। অতি সাধারণ। শুধু দূর থেকেই বুঝি একটা রহস্যের আবরণ থাকে। অন্দরমহলের ভেতরে যখন এই দৃশ্য, বাইরের মহলেও ওমনি সাধারণ ঘটনাই ঘটে সব।

বংশী সেদিন শশব্যস্ত হয়ে ডাকতে এসেছিল।—আসুন শালাবাবু, মজা দেখবেন আসুন, গন্ধবাবা এসেছে।

—গন্ধবাবা?

-আজ্ঞে হ্যাঁ, বারবাড়িতে লোক আর ধরছে না, গন্ধবাবা এসেছে, যে-যা গন্ধ চাইছে তাই-ই দিচ্ছে।

ভূতনাথও ছুটলো। গাড়িবারান্দার নিচে পৈঁঠের ওপর বসে আছে এক সাধু। মাথায় জটা। কপালে সিঁদুরের প্রলেপ। বিকটাকার মূর্তি। চার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে চাকর-বাকর লোকলস্কর সবাই। দাসু জমাদারের ছেলেমেয়েরাও এসে দূরে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ইব্রাহিমের ছাদের ওপরেও লোক।

অনেক কষ্টে বংশী ভূতনাথকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকলো ঠেলে ফুলে।

লম্বা চওড়া চেহারা লোকটার। বলছে—বেহেস্ত কা হুরী আউর জাহান্নম্ কা কুত্তি ইয়ে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়–হামারা ইয়ে পাথ দেওতা মহাদেওতানে আপনা হাতসে দিয়া হুয়া হ্যায়— ই পাঙ্খ দেখো-গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মোকমামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা-মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ দেনেওয়ালাই পাথ দেখো—দেওতাকে জরিমানা পাঁচ পাঁচ আনা।

মধুসূদন ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে গন্ধবাবা, আমাকে পদ্মফুলের গন্ধ করে দাও দিকি হাতে-দেখি একবার।

গন্ধবাবা পাথরটা দিয়ে মধুসূদনের হাতের তেলোয় ঘষে দিলে।

মধুসূদন হাতের তেলোটা শুঁকে দেখে। সত্যিই তো! খাঁটি পদ্ম ফুলের গন্ধ।

—দেখি মধুসূদন কাকা, দেখি শুঁকে।

—দেখি, আমি শুঁকে দেখি।

সবাই শুঁকে পরীক্ষা করে দেখে ভুল নেই। কোনো ভুল নেই। পদ্মফুলই বা কোত্থেকে এল।

—গন্ধবাবা, আমার হাতে কোরোসিন তেলের গন্ধ করে দাও তো দেখি?

গন্ধবাবা পাথরটা তার হাতে ঘষে দিলে আবার। যে-হাতে পদ্মফুলের গন্ধ ছিল সেই হাতেই এখন কেরোসিন তেলের কড়া গন্ধ।

দেখি, শুঁকে দেখি—ওমা, কেরোসিনের গন্ধই তো বটেক— সবাই ঝুঁকে পড়ে। গন্ধবাবা আবার বক্তৃতা দেয়—বেহেস্ত কা হুরী আউর জাহান্নম্ কা কুত্তি ইসসে সব কুছ ঘায়েল হোতি হ্যায়— হামারা, ইয়ে পাথ দেওতা মহাদেওতানে আপনা হাতসে দিয়া হুয়া হ্যায়ই পাঙ্খল দেখো—গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মকমামে সিদ্দি দেনেওয়ালা, মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ দেনেওয়াল—দেওতাকো জরিমানা পাঁচ পাঁচ আনা…

পাঁচ আনার পূজো দিতে হবে। মাত্র পাঁচ আনাতেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে। এমন সুযোগ বোধহয় কেউ ছাড়তে চাইলে না। বংশী চুপি চুপি বললে—শালাবাবু, ভাইটার চাকরির জন্যে পাঁচ আনা জরিমানা দেবো নাকি?

মধুসূদনেরও বুঝি কিছু মনস্কামনা ছিল। দেশের একটা ধানজমির ওপর বহুদিনের লোভ ওর। নিজের জমির লাগোয়া। দরে পোষাচ্ছিলো না। সে-ও পাঁচ আনা দিলে জরিমানা। হুড় হুড় করে আরো পয়সা পড়তে লাগলো।

গন্ধবাবা তখনও বক্তৃতা দিয়ে চলেছে—সব ইয়ে পাথকা খেল, মহাদেও মহদেওকী খে, ইয়ে পাথ…দুনিয়ামে যো কুছ মানা হ্যায় তো মাঙ লেও, ইয়ে পাথকে দৌলতমে সব কুছ মিলনেওয়াল হ্যায়, বেহেস্তকা হুরী আউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়, হামারা ইয়ে পাথ—গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মকদমামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ মিলনেওয়ালা দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট টাকার খুচরো পয়সা জমে উঠলো গন্ধবাবার সামনে।

হঠাৎ ভূতনাথেরও মনে হলো যেন তারও কিছু মনস্কামনা আছে। নিজের চাকরি নয়। সংসারে কারোর কিছু নয়। কিন্তু অন্তত ছোটবৌঠানের জন্যে যেন পাঁচ আনা জরিমানা দিলে হয়। যেন সুখী হয় ছোটবৌঠান। যেন স্বামীসেবা করতে পারে ছোটবৌঠান। যেন মনস্কামনা সিদ্ধি হয় ছোটবৌঠানের। যেন ‘মোহিনী-সি দুরে’ যে-কাজ হয়নি তা সফল হয়।

গন্ধবাবা জিজ্ঞেস করলে তুলসীপাতা হ্যায় ইধার?

—আছে বাবা, আছে, তুলসীপাতা আছে।

গন্ধবাবা সবার হাতে গাঁজার কল্কে থেকে নিয়ে একটু করে পোড় তামাক দিলে। সেই পোড়া তামাক হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে তুলসীগাছকে প্রণাম করে এসে আবার হাতের মুঠো খুলতে হবে।

বংশী, মধুসূদন, লোচন, বেণী, দাসু জমাদার, ইব্রাহিম কোচোয়ান, ইয়াসিন সহিস, ব্রিজ সিং সবাই মনস্কামনা নিয়ে মহাদেবকে পাঁচ আনা জরিমানা দিয়েছে। সবাই হুকুম মতো কাজ করলো।

গন্ধবাবা এবার সকলের মুঠোর ওপর তার স্ফটিক পাথরটা ছুঁইয়ে দিলে। মনে মনে কোনো মন্ত্র পড়লে কিনা কে জানে। তারপর বললে—আভি মুঠি খোলল।

বংশী ভূতনাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বংশীও মুঠো খুললো।

ভূতনাথ দেখলে তার মুঠোর মধ্যে পোড় তামাকের বদলে একটা নীল কাগজ। নীল কাগজের ওপর একটা ত্রিভুজ আঁকা। সেই ত্রিভুজের ভেতর আরেকটা ত্রিভুজ।

সকলের হাতের মুঠোর মধ্যে ওই একই ব্যাপার।

গন্ধবাবা বললে—মাদুলী করে ওটা গলায় পরতে হবে। একমাস পরে গন্ধবাবা আবার আসবে এ-বাড়িতে, তখন যদি না মনস্কামনা পূর্ণ হয় তত সকলের পয়সা ফেরৎ দিয়ে যাবে।

বংশী বললে—শালাবাবু, আপনিও একটা জরিমানা দিন না আজ্ঞে।

ভূতনাথও সেই কথা ভাবছিল।

গন্ধবাবা তখন টাকাপয়সাগুলো কুড়োচ্ছে আর মুখে বক্তৃতা বেহেস্ত, কা হুরী, আউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়–ই পাখ-মহাদেওনে দিয়া হুয়া হ্যায়—গরীবোকো রূপে দেনেওয়ালা, মকদ্মামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা মাঙনে

ওয়ালোকো সব কুছ…

হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটে গেল।

বদরিকাবাবু বুঝি গোলমাল শুনে বেরিয়ে এসেছেন। বললেনকী হচ্ছে রে? এত গোলমাল কীসের?

মস্ত বড় ভুঁড়ি। গায়ে তুলোর জামা। বরাবর বৈঠকখানা ঘরে শুয়েই থাকেন। বড় একটা লোকচক্ষুর সামনে বেরোন না। এই আজকের অস্বাভাবিক গোলমালে আকৃষ্ট হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন প্রথম।

—কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া? গন্ধবাবার সামনে এসে বললেন–কেয়া হুয়া? কোন্ হ্যায় তুম্?

বংশী বললে—উনি গন্ধবাবা।

আরো অনেকে বললে—যা গন্ধ চান, উনি করে দেবেন আজ্ঞে।

সব শুনলেন বদরিকাবাবু। বললেন—দাও দিকি আমার হাতে গন্ধ করে—ফুলের গন্ধ করে দাও–নিমফুলের গন্ধ।

নিমফুল! তাই সই।

গন্ধবাবা স্ফটিক পাথরটি একবার হাতে ঘষে দিলে বদরিকাবাবুর। তারপর আওড়াতে লাগলো-বেহেস্তকা হুরী ওউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হেতি হ্যায়…কেয়া বাবুজি মিলা?

বদরিকাবাবু বার-বার নিজের হাতটা শুকতে লাগলেন। যেন অবাক হয়েছেন একটু। বললেন—কী করে করলে বলো দেখি বাপধন?

—ইয়ে পাথষ্কা খেল হ্যায় বাবুজি, মহাদেওতানে দিয়া হুয়া হ্যায়।

—দেখি বাবা তোমার পাথরখানা—ছোট স্ফটিকখানা নিয়ে বার বার দেখতে লাগলেন বদবিকাবাবু। সামান্য এক টুকরো পাথরের কারসাজি! অবিশ্বাসের বিদ্রূপ ফুটে উঠলে ভাব-ভঙ্গীতে। ছোট ছেলে যেমন রসগোল্লা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে! মুর্শিদকুলী খা’র কানুনগো দর্পনারায়ণের শেষ বংশধরও সহজে বিচলিত হবার লোক নন। কত রাজা মহরাজাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তুড়ি দিয়ে। ইতিহাসের বিলুপ্তপ্রায় অধ্যায়ের এক টুকরো ফসিল যেন হাতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বসেছেন। বললেন—কী হয় এতে বাপধন?

গন্ধবাবা বললে—সব কুছ হো স্যাক্তা হ্যায় বাবুজি—মহাদেওকা কিরপা মে…

–অমর হওয়া যাবে?

—জী হাঁ, অমর ভি হোস্যাক্তা হ্যায়।

—তবে অমরই হয়ে যাই—বলে বলা-নেই, কওয়া-নেই বদরিকাবাবু পাথরটা নিয়ে টপ করে মুখে পুরে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে গন্ধবাবা চিৎকার করে উঠলো—সত্যনাশ হো গয়া, সত্যনাশ হো গয়া…

—আরে রাখ তোর সর্বনাশ, সর্বনাশের মাথায় বলে বদরিকাবাবু যেন কেমন নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু যেন কিছু অস্বস্তি বোধ করছেন। বললেন—লোচন এক গ্লাশ জল দে তো।

গন্ধবাবা বলেন—বাবুজী ম যাইয়ে গা।

কিছুক্ষণ পরেই মনে হলো যেন বদরিকাবাবুর দম আটকে আসছে। আইঢাই করতে লাগলো সারা শরীর। চোখ দুটো উল্টে এলো। গেলাশ গেলাশ জল খেলেন। মস্ত বড় ভুঁড়ি আরো ফুলে উঠলে দেখতে দেখতে। সাক্ষাৎ মহাদেবের দেওয়া স্ফটিক যে!

গন্ধবাবা চলে গেল এক ফাঁকে। যাবার সময় বলে গেল বাবুজী মহাবীর হ্যায়—লেকিন্ হরগীজ মর যায়গা।

মধুসূদন ভয় পেয়ে গেল—কী সর্বনেশে কাণ্ড!

লোচনও ভয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কী জানি কী কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। বদরিকাবাবু যদি মারাই যায়, সাক্ষীসাবুদ, পুলিশআদালত নানান হ্যাঙ্গাম পোয়াও। মেজবাবু যদি টের পায়, কানে যদি যায় কোনোরকমে। মেজবাবুর যা মেজাজ, জরিমানা হবে সকলের।

বদরিকাবাবু গাড়িবারান্দার তলায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে হাঁসাস করছেন।

বংশী বললে—চলে আসুন শালাবাবু ওখান থেকে—কাজ কী এসব হ্যাঙ্গামে।

হ্যাঙ্গাম দেখে সত্যিই তখন সবাই সরে পড়েছে একে একে। ভূতনাথ চেয়ে দেখলে জায়গটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

বংশী আবার কামিজটা ধরে টানলে চলে আসুন শালাবাবু, কাজ কি ছেড়া ঝঞ্চাটে—আমার আবার ওদিকে কাজ পড়ে রয়েছে।

ভূতনাথবাবু বললে—তুই বরং যা বংশী, ছোটবাবু জানতে পারলে আবার।

—তাই যাই—বলে বংশীও চলে গেল।

ভূতনাথ নিচু হয়ে বদরিকাবাবুর মাথায় হাত দিলে। মুর্শিদকুলী খাঁ’র কানুনগোর শেষ বংশধর। এখানে এই বেঘরেই বুঝি গেলএবার।

হঠাৎ যেন অস্পষ্ট শব্দ বেরোলো। বদরিকাবাবু কথা বলছেন— বেটা গিয়েছে নাকি হে ছোকরা?

ভূতনাথও কম অবাক হয়নি। বললে—কেমন আছেন?

চোখ মিট মিট করতে করতে বদরিকাবাবু বললেন—বেটা গিয়েছে নাকি হে ছোকরা?

—চলে গিয়েছে—কিন্তু আপনি কেমন আছেন?

বদরিকাবাবু এবার উঠে বসলেন। নিজের জামা-কাপড় সামলাতে সামলাতে বললেন—আমার হয়েছে কি যে কেমন থাকবে—বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নিজের বৈঠকখানার দিকে চলতে লাগলেন।

ভূতনাথও সঙ্গে সঙ্গে গেল। বদরিকাবাবু ঘরে ঢুকে শেতলপাটি বিছানো তক্তপোশের ওপর আবার চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে একবার টক ঘড়িটা বার করে সময় দেখে নিলেন।

ভূতনাথের যেন ভারি অবাক লাগছিল সমস্ত ঘটনাটা ভেবে। বললে—আপনি শুধু শুধু কেন খেতে গেলেন পাথরটা—সাধুসন্ন্যাসীদের পাথর।

—খেতে যাবো কেন,-“খাইনি তো-বদরিকাবাবু বিস্মিতের মতো চাইলেন। আমার আর কাজ-কম্ম নেই, আমি ওই পাথর গিলতে যাবো। বলে কি ছোকরা, ‘এই দেখো-বলে আর এক টাক থেকে স্ফটিক পাথরটা বার করলেন—এই দেখো।

—তাজ্জব ব্যাপারই বটে।

–নবাবের আমলের পুরোনো বংশ আমাদের হে, আমি সেই বংশের শেষ বংশধর বটে, তা আমি গলায় পাথর আটকে মরতে যাবো কেন শুনি? এতদিন ধরে ঘড়ি ধরে বসে আছি অপঘাতে মরবো বলে? সব দেখতে হবে না! ইতিহাস কি মিথ্যে হবে নাকি? সব লাল হয়ে যাবে না। রণজিৎ সিং তো মিথ্যে বলবার লোক নয়, নাজির আহমদ রইল না, রইল না রেজা খাঁ, বলে মধুমতীর তীরের সীতারাম আর ফৌজদার আবুতোরাব—তারাই রইল না! কোথায় গেল পীর খাঁ, কোথায় গেল তোর বক্স আলী-এক পুরুষের পর আর এক পুরুষ উঠেছে আবার নামছে—চৌধুরীরাও নামবে—এই বড়বাড়িও ভাঙবে একদিন, রাজসাপ যখন কামড়েছে, একেবারে ভিটেমাটি উচ্ছন্ন করবে না! এখনও যে দর্পনারায়ণের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি রে।

কী কথায় কী কথা উঠে গেল।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু গন্ধবাবা কি দোষ করলো?

-আরে, এটা যে গন্ধবাবার যুগ রে, গন্ধবাবারাই তো আজ রাজা হয়ে বসেছে—ওদের তাড়াতে হবে না? এই আমাদের মেজবাবু, ছোটবাবু, তোর এই ‘মোহিনী-সিঁদুর’ সব যে গন্ধবাবার দল।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না ভূতনাথ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল হঠাৎ। ও-কথার তো আর শেষ নেই। সব কথার মানেও বোঝা যায় না বদরিকাবাবুর। সেদিন সুবিনয়বাবুও বললেন, ‘মোহিনী-সিঁদুর’ বুজরুকি। এই এত ঐশ্বর্য, গাড়ি, বাড়ি, লোকজন, চাকর-বাকর সব উচ্ছন্নে যাবে! কী অদ্ভুত যুক্তি, কী অদ্ভুত হেঁয়ালী!

সন্ধ্যেবেলা ছুটুকবাবুর ঘরে গিয়ে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে আজ এখনও কেউ আসেনি?

ছুটুকবাবু আসর সাজিয়ে বসেছিলো। বললে—এই আপনার কথাই ভাবছিলাম, কোথায় ছিলেন এ্যাদ্দিন, ননীলাল খুঁজছিল?

-ননীলাল? গঞ্জের ডাক্তারবাবুর ছেলে সেই ননীলাল? নামটার সঙ্গে যেন অনেক রোমাঞ্চ, অনেক স্মৃতি জড়ানো আছে। অনেক সমারোহ, অনেক সৌরভ। ননীলালের নামটা মনে পড়লেই যেন সমস্ত ছেলে-বেলাটা আবার সজীব হয়ে ওঠে। তার সেই চিঠি। সেই চিঠিটা আজো সযত্নে টিনের বাক্সের মধ্যে যে রেখে দিয়েছে সে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমার খোঁজ করছিল কেন?

—ওর বিয়ে হলো কি না? আপনাকে নেমন্তন্ন করতে চেয়েছিল।

—বিয়ে? হয়ে গিয়েছে?

ছুটুকবাবু বললে–হ্যাঁ, হয়ে গেল বিয়েটা। ননীটা যা হোক খুব দাও মেরেছে বিয়েতে। তিনখানা বাড়ি-সাত লক্ষ টাকা।

সেকি? ভূতনাথও কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। এই সেদিন যে সে টাকা ধার করতে এসেছিল ছুটুকবাবুর কাছে। এরই মধ্যে এত টাকার মালিক হয়ে গেল সে!

ছুটুকবাবু আবার বললে—এ যাত্রায় খুব বেঁচে গেল ননীটা, বরাবর জানতুম ও একটা সোজা ছেলে নয়। আমাদের টাকায় বরাবর বাবুয়ানি করে আমাদের ওপরই টেক্কা মেরেছে—তা বাহাদুরি আছে ননীর, কোত্থেকে কার সঙ্গে ভাব জমিয়ে শেষ পর্যন্ত কী যে করে বসলো—

—কী করে কী হলো ছুটুকবাবু?

ননীলাল অবশ্য তার কল্পনায় চিরকালই উচু ছিল। ছোটবেলা থেকে ননীই ছিল ভূতনাথের আদর্শ। অমন চমৎকার সুন্দর চেহারা। রূপবানই বলা যায়। কিন্তু মাঝখানে যেদিন দেখা হয় ওর সঙ্গে, সেইদিনই কেমন আঘাত পেয়েছিল ভূতনাথ মনে মনে। তার সেই আগেকার চেহারা যেন আর নেই। সেই লাবণ্য মুছে গিয়েছে মুখ থেকে। তার সেই ঘন ঘন সিগারেট খাওয়া। সেই কোঠরগত চোখ। আর সেই অশ্লীল প্রসঙ্গ আলোচনা। যে-মানুষ এত নিচে নামতে পারে, চরিত্রহীনতার একেবারে শেষ ধাপে, সে কেমন করে জীবনে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে! কেমন করে সে সাত লক্ষ টাকার মালিক হবে—তিনখানা বাড়ির স্বত্ত্বাধিকারী হবে।

ছুটুকবাবু বলতে লাগলো–হেন রোগ নেই, যা ওর হয়নি ভূতনাথবাবু, আমরা কত বারণ করেছি এ-পথে আর যাসনি—কিন্তু ননী বলতো’ও-সব তোদের কুসংস্কার,—এটা আর কুলমর্যাদার যুগ নয় রে—এটা টাকার যুগ’ বলতো’টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম, টাকা বংশ, টাকা গোত্র—টাকাই জপ-তপ-ধ্যান—সবার চাইতে বড় কুলীন টাকা, শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ টাকা’ বলতাম—তোর স্বাস্থ্য গেলে টাকা কে খাবে?

ননী বলতো—টাকা না থাকলে এ স্বাস্থ্য নিয়ে কী হবে? কখনও বলতো—এ যুগের খৃস্ট, বুদ্ধ আর চৈতন্যদেব কে জানিস? আমরা প্রশ্ন শুনে হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম–খৃস্ট, বুদ্ধ আর চৈতন্যদেব—ওরা আবার যুগে যুগে বদলায় নাকি?

ননীলাল বলতে-বলতে পারলিনে? এ যুগের অবতার হলেন শেঠ-শীল আর মল্লিক।

ছুটুকবাবু কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়লো। হাসির চোটে ভুঁড়ির মাংস থল থল করে নেচে ওঠে। যেন একটা কৌতুক করবার দারুণ বিষয় পাওয়া গিয়েছে।

আমাদের কলেজের ভেতর ঢুকতে মস্ত বড় সদর-দরজার ওপর লেখা ছিল—“God is Good”। একদিন কলেজে মহা সোর গোল বেধে গেল। হৈ-চৈ কাণ্ড। কী সর্বনাশ ব্যাপার! দেখা গেল কে যেন বড় বড় হরফে সেখানে লিখে রেখেছে—“God is Money”। আমরা তো অবাক সবাই। সেকালে রসিকলাল মল্লিক আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যখন বলেছিল-“I do not believe in the holiness of the Ganges’ তখনও হিন্দুসমাজ এত চমকায়নি—ত সেই ননীলাল শেষ পর্যন্ত…

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে–বউ কেমন হয়েছে?

-বউটাও রূপসী ভূতনাথবাবু, তাই তো বলছি— ওর কপালটা ভালো, কাল নেমন্তন্ন খেয়ে এসে পর্যন্ত ওই কথাই তো ভাবছি। শালাটা করলে কী? আজ এসেছিল সবাই গান-বাজনা করতে মন বসলো না। পাঁচ শ’ টাকা ধার নিয়ে গিয়েছে ননী এই সেদিন–এখনো শোধ করেনি। তার কাছে পাঁচ শ’ টাকা চাইতেই এখন লজ্জা করবে আমার। পাঁচ শ টাকার জন্যে নয়, পাঁচ হাজার টাকা গেলেও কিছু ভাবতম না। ননী আমার কাছ থেকে অমন অনেক টাকা নিয়েছে—হিসেব রাখিনি কখনও-কিন্তু এমনভাবে ননী আমাকে টেক্কা দিয়ে যাবে ভাবিনি তা কখনও।

ছুটুকবাবু যেন কেমন মুষড়ে পড়েছে। বলতে লাগলো— এই যে সব নেশা-টেশা দেখছেন এ-সব ও-ই আমাকে প্রথম শেখায়, এই যে গান-বাজনার সখ—এ-ও ওরই কাছ থেকে প্রথম শিখি—তখন কলেজে সবে ঢুকেছি। চাকরের সঙ্গে গাড়িতে যাই আর গাড়ি করে ফিরে আসি। একদিন হঠাৎ দুপুরবেলা কলেজ ছুটি হয়ে গেল—দুজনে একসঙ্গে বেরোলাম রাস্তায়। কোন রাস্তা দিয়ে ঢুকে কোন রাস্তায় বেরিয়ে শেষে এক গলির মধ্যে নিয়ে গেল ননী, সেখানে একটা বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছিলো। আমাকে বললে—পেছন পেছন চলে আয় চূড়োবলে নিজেই আগে ঢুকে পড়লো।

আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি দোতলার ওপর গানের আসর বসেছে গান গাইছে একটা মেয়ে, নাকে একটা প্রকাণ্ড নথ।

ননী একপাশে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে পড়লো। আমাকেও টেনে পাশে বসালো।

গান থামলো। সারেঙ্গী বাজাচ্ছিলো যে সে-ও থামলো। তবলচিও থামলো।

ননী গিয়ে মেয়েটার কানে কানে চুপি চুপি কী বললো কে জানে! মেয়েটা আমার দিকে দু হাত তুলে সেলাম করে বললে— আপনার বহুত, মেহেরবানি—কী গান গাইবো ফরমাশ করুন?

তা বুঝলেন, তখন আমার বুক কাপছে, বয়েসও কম, গোঁফও ওঠেনি বলতে গেলে, তা ছাড়া ওসব জায়গায় কখনও যাই নি আগে, আমি কিছু কথাই বলতে পারলুম না। গান-বাজনা শোনা অবশ্য অভ্যেস ছিল আমার, বাড়িতে এসে কত বাঈজী গান গেয়ে গিয়েছে, নজরানা নিয়ে গিয়েছে, নাচ দেখেছি, সে-সব অন্য রকম। নাচঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি আমরা, বাড়ির চাকর-বাকর সবার কাছে কত কিছু শুনেছি, কাকামশাইরা বাঈজীদের সঙ্গে সারারাত ধরে ফুর্তি করেছে। খাওয়া দাওয়া হয়েছে, নেশা-টেশাও চলেছে, তোষাখানায় যখন গিয়েছি চাকরদের মুখে বাবুদের কীর্তিকলাপ শুনেছি। বড় ছোট মাঝারি নানান মাপের রঙ বেরঙের বোতলের চেহারা দেখেছি, কিন্তু আমরা মানুষ হয়েছি ও-সব আওতার বাইরে। ওসব চলতো আমাদের চোখের আড়ালে। কিছু আমাদের জানতে পারবার কথা নয়! মা’র কাছে গিয়ে বাবামশাই-এর অন্য চেহারা দেখতুম! বড় ভয় করতাম কিনা কর্তাদের—কিন্তু এমন করে বাঈজীর মুখখামুখি হই নি কখনো। ননী মেয়েটাকে বললে—কিছু খাওয়াও ভাই আমাদের—আমার বন্ধু আজ এই প্রথম এল এ-সব জায়গায়।

আমার দিকে চেয়ে বললে—কী রে চূড়ো—খিদে পেয়েছে— কী খাবি বল? তোর তো আজ বিকেলের বরাদ্দ দুধ খাওয়া হয়নি।

আমার তখন ভাই ঘাম ঝরছে—খাবো কি মাইরি, খেতেই ইচ্ছে করছে না। ননী জানতে বিকেলবেলা এক গেলাশ দুধ আর ফল খাওয়া অভ্যেস আমার। কতদিন কলেজের পরে আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে ও ফলটল খেয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন কে আমার কথা শোনে ভাই! মেয়েটা কাকে যেন কী বললে। আর খানিক পরেই এল সব খাবার। ফলও এল, মিষ্টিও এল। আর আমার জন্যে দুধও এল। মেয়েটা আমাকে বললে—আপনার বড় লজ্জা বুঝি।

কিন্তু ননীটা কী বদমাইশ জানেন! মেয়েটাকে বললে—তুমি তো লজ্জাহারিণী ভাই—ওর লজ্জা আজ ভাঙতে পারবে না?

মেয়েটা জিব কেটে বললে—তেমন অহঙ্কার আমার নেই ননীবাবু, আপনাদের মতন ভদ্রলোকের পায়ের ধুলো পড়ে আমার কুঁড়ে ঘরে, তাইতেই আমি ধন্য।

ননী বললে—বাজে কথা থাক, খাবার দিলে, আর মুখশুদ্ধি দিলে না, এ কী রকম! তেষ্টা পাচ্ছে যে।

মেয়েটা ঝলমল করে উঠে পড়লো। বললে—ছি ছি আগে বলতে হয়।

বেনারসী ওড়নার ঘোমটা সরিয়ে খস্ খস্ শব্দ করতে করতে গিয়ে এবার দাঁড়িয়ে দেরাজ খুলে পেছন ফিরে তাকালে আমার দিকে। বললে—কড়া জিনিষ চলবে আপনার?

তখন কড়া মিঠে কিছুই জানিনে। কখনও খাইনি ওসব। কিন্তু খেলাম। কড়া খেলাম কি মিঠে খেলাম জানি না ভাই কিন্তু খেলাম! সেদিন কী আদর আমার! আমাকে তোয়াজ করাই একমাত্র কাজ হলো বাড়িসুদ্ধ লোকের।

তারপর গান চলতে লাগলো। মতিয়ার মুখেই ওই গানটা প্রথম শুনি। এখনও মনে আছে সেটা—’জখমী দিলকো না মেরে দুখায়া করো’–

একে গজল তায় মতিয়ার গলা, সঙ্গে সারেঙ্গী আর পেশাদারী হাতের সঙ্গত্। তার ওপর আবার একটু অমৃত পেটে গিয়েছে। কখন যে কোথা দিয়ে সময় চলেছে টের পাবার কথা নয়। তখন বাড়ির কথাও আর মনে নেই, কারোর কথাই মনে নেই। তখন মতিয়াকে নাকি আমি কেবল বলেছি নেশার ঘোরে-তোমায় বিয়ে করবো আমি—তোমায় ছাড়বো না আমি।

ভোর বেলা যখন ঘুম ভেঙেছে নেশা কেটেছে তখন ননী এল।

এসেই গালাগালি। বললে—ছি ছি চূড়া তোর একটা জ্ঞানগম্যি নেই, সারা রাত বাঈজীর বাড়ি কাটালি এত বড় বংশের ছেলে হয়ে।

আমি তো অবাক। বলে কী। আমাকে ওই-ই নিয়ে এল আর এখন কিনা আমাকেই গালাগালি!

আড়ালে নিয়ে এসে চুপি চুপি বললে—আমরা ভদ্দরলোকের ছেলে—একটু ফুর্তিটুতি করে চলে যাবো নিজের বাড়ি, তা না রাত কাটাবো এখানে? কত বললুম—চল চূড়ো চল, চল—তুই কিছুতেই শুনলি না। ছি ছি—এখানে কি রাত কাটাতে আছে?

তখন আমরে। তাই মনে হচ্ছিলো মাইরি। এ কী করলুম! আমি তো ভদ্রলোক! আমি বড়বাড়ির ছেলে—আমি নিমক মহলের বেনিয়ান ভূমিপতি চৌধুরীর প্রপৌত্র। সূর্যমণি চৌধুরীর নাতি, বৈদূর্যমণি চৌধুরীর ছেলে—আমার এ কী পরিণাম। বললাম

—চল বাড়ি চল।

ননীলাল বললে—সে কি? বাড়ি যাবি কী রে?

আবার কী দোষ হলে বুঝতে পারলাম না! বললাম—কেন?

—ওকে কিছু দে-মতিয়ার তত এটা ব্যবসা–ও এত কষ্ট করলো-সারা রাত জাগলো।

তাও তো বটে! কিন্তু সঙ্গে তো কিছু আনিনি।

ননী বললে—বাড়ি থেকে আনিয়ে দে—কিছু না দিলে খারাপ দেখাবে যে—তোদের বংশের মুখে চুনকালি পড়বে যে।

বললাম—কত দিতে হবে??

–তোর যা খুশি, মতিয়া কিছু চাইবে না, ও তেমন মেয়ে নয়, তা হলে আর তোকে এখানে আনতুম না, অন্য মেয়ে হলে অবশ্যি হাজার টাকা চেয়ে বসতো, তা ছাড়া তুই তো কিছু বলিসনি, আমিই এনেছি তোকে দায়িত্বটা তো আমারই। তবে ওর তো এটা ব্যবসা, ওরই বা চলে কিসে—আর তোদর বংশের নামডাক আছে—দেখিস যেন বদনাম না হয়।

—কত দেবো তুই বল।

ননী গলা নিচু করে বললে—নবাবী করে যেন আবার বেশি দিতে যাসনি তুই। আসলে তো ওরা বাঈজী—পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে নমো নমো করে সেরে দে এ-যাত্রা।

তা এই হলো ননীলাল! আপনি ভেবেছেন ননী সেই পাঁচ শ’ টাকার সবটা দিয়েছে মতিয়াকে? নিশ্চয়ই অর্ধেক নিজে মেরে দিয়েছে। তারপর যখন আবার পরে একদিন মতিয়ার কাছে গেলুম-জিজ্ঞেস করলুম।

মতিয়া বললে সে কি, আমাকে একটা পয়সাও তো দেয়নি সেদিন?

তা ননীলালকে চিনতে আমার আর বাকি নেই ভূতনাথবাবু। আর শুধু কি আমাকে! আমার মতন আরো কত বড়লোক আছে কলকাতায়। সারা কলকাতার লোকের কাছ থেকে ধার করেছে। ঠনঠনের ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্তর কাছ থেকেও নিয়েছে। একটু বড়লোক দেখলেই তার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। শোধ কাউকেই দেয়নি। শুধু কি একবার। বারবার আমার কাছে একটা-না-একটা ছুঁতে করে ধার চেয়েছে। ওর ওই একটা গুণ। ও চাইলে কেউ না বলতে পারে না। খানিক থেমে ছুটুকবাবু বললে—একটু চলবে নাকি আজ? একটুখানি?

ভূতনাথ ছুটুকবাবুর হাত দুটো চেপে ধরে বললে–মাপ করবেন ছুটুকবাবু। সেদিন তো খেয়েছিলাম—আজকে আর নয়…

ছুটুকবাবু বললে—তবে বলছেন যখন থাক, কিন্তু আমি একটু খেয়ে আসি-বলে পর্দার ভেতরে গিয়ে আবার মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। এসে বললে— সেই কথাই কাল থেকে ভাবছি, ননীটা বাহাদুর ছেলে বটে—কত ঘাটের যে জল খেয়েছে আর কত ঘাট যে পার হয়েছে তার শেষ নেই। অথচ একজামিনেও পাশ করলে, আর নেশা ধরে গেল আমাদেরই…

হঠাৎ সুযোগ বুঝে ভূতনাথ বললে—আপনার সেই শশী কোথায় গেল—শশীকে দেখছিনে।

–না ভাই, ও-সব চাকর আর রাখবো না ঠিক করেছি, পারা ঘা হয়েছিল সারা গায়ে।

–বংশীর একটা ভাই আছে, বংশী বলছিল ওর ভাইটাকে যদি…

কথাটা শুনে ছুটুকবাবু যেন চটে গেল। বললে—না ভাই ও-সব এক ঝাড়ের বাঁশ, ওদের কাউকেই আর বিশ্বাস নেই, বেটারা সবাই পাজিও সবাই যেন মালকোষের ধৈবত—যেখানেই থাকুক ঘুরে ফিরে ঠিক সেই ধৈবতে এসে দাঁড়াবে…তা এবার ভাবছি পরীক্ষাটা আবার দেবো—একটা মাস্টার ঠিক করেছি। হপ্তায় চারদিন লেখাপড়া আর তিনদিন গান-বাজনা আর এই নেশাভাঙটাও ছাড়তে হবে—বলে আবার উঠলে ছুটুকবাবু। উঠে পর্দার আড়াল থেকে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। বলে— আপনি বেশ ভালো আছেন স্যার—কোনো নেশাটেশার মধ্যে নেই–এ একবার ধরলে ছাড়ায় কোন শালা।

হঠাৎ বাইরে যেন কার ছায়া পড়লো।

ছুটুকবাবু চিৎকার করে উঠলো—কে রে, কে ওখানে? কে?

-আমি বংশী আজ্ঞে।

—তা বাইরে কেন? ভেতরে আয়-কী দরকার?

বংশী বললে—আমি শালাবাবুকে একবার ডাকছিলাম।

–ও–বলে ভূতনাথ উঠে বাইরে এল।

ভূতনাথ বাইরে আসতেই বংশী গলা নিচু করে বললে—কই, ছোটমা’র কাছে যাবেন বলেছিলেন—যাবেন না?

ভূতনাথ বললে–ছোটবাবু আছেন, না চলে গিয়েছেন?

বংশী বললে–ছোটবাবুর তো অসুখ খুব—পেটে যন্তরণা হচ্ছে কতদিন থেকে বাড়িতেই থাকেন।

-তাহলে?

–আমি ছোটমা’কে বাইরে ডেকে আনবো’খন, আপনি কথা বলবেন—তাতে কি—ছোটমাও যে আপনার কথা বলছিলেন আজ্ঞে।

—তবে চল। ছুটুকবাবুর ঘরে ঢুকে ভূতনাথ বললে—তাহলে আজ আসি ছুটুকবাবু, আর একদিন আসবো। বাইরে বেরিয়ে ভূতনাথ বললে—কোন্ দিক দিয়ে যাবি বংশী?

বংশী বললে—কেন আপনার সেই চোরকুইরির সরু বারান্দা দিয়ে?

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ইটবাঁধানো উঠোনের ওপর তখন ইব্রাহিমের ছাদের আলোটা থেকে একফালি আলো এসে পড়েছে। ওদিকে খাজাঞ্চীখানার দরজায় তালা পড়ে গিয়েছে। দক্ষিণের বাগানের কোণ থেকে দাসু মেথরের ছেলেটা বাঁশীতে বিমঙ্গলের সুর ভাঁজছে—“ওঠা নাবা প্রেমের তুফানে’— আস্তাবলের ভেতর ছোটবাবুর শাদা ওয়েলার জোড়া অন্ধকারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঠকাঠক পা ঠুকে চলেছে। আস্তাবলের ওপর দোতলায় ব্ৰজরাখালের ঘরটা তেমনি অন্ধকার। তার পাশে ব্রিজ সিং-এর ঘরে টিম টিম আলো জ্বলছে। বোধ হয়, আটা মাখছে এখন। থপ থপ শব্দ আসছে সে-ঘর থেকে। তার পেছনে তোষাখানায় চাকরদের ঘরে এখন তাস-পাশা চলছে। সন্ধ্যেবেলা কাজ কম। বাবুরা বেরিয়ে গিয়েছেন বেড়াতে।

ভূতনাথ আস্তাবল বাড়ির পাশ দিয়ে একেবারে বাগানের কাছে এল। বংশী আগে আগে চলেছে। মনে হলো—প্রথমে গিয়ে কী কথা বলবে। বহুদিন থেকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ছোটবৌঠানকে। গিয়ে বলতে হবে–“মোহিনী-সিঁদুর আগাগোড়া সব মিথ্যে কথা! সব বুজরুকী! ছোটবৌঠান যেন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ না পরে। আগে যদি জানতো ভূতনাথ ‘মোহিনী-সিঁদুর’ দিতে কখনও।

বংশী এবার ডাকলে—চলে আসুন শালাবাবু।

-এ আবার কোন্ রাস্তা বংশী?

চোরকুঠুরির ঠিক সামনাসামনি একটা দরজা। এতদিন নজরে পড়েনি তো! সেই ইটালিয়ান সাহেবের মেমসাহেব! এখান দিয়ে এই গুপ্ত পথে বুঝি অভিসারের আয়োজন হতো। ভূমিপতি চৌধুরী বুঝি এই দরজা খুলে দিতেন মধ্যরাত্রে। নিমক মহলের বেনিয়ানের হৃদয় নিয়ে লেনদেন চলতে বুঝি এইখানে। এই লোকচক্ষুর অন্তরালে!!

বংশী বললে—এই রাস্তা দিয়েই ছোটমা আনতে বলছেন আপনাকে আজ্ঞে।

অতি নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। ভূতনাথের মনে হলোভূমিপতি চৌধুরীর পর এ-দরজা এই প্রথমবার বুঝি আবার খোলা হলে এতদিন পরে। নিঃশব্দে সে বুঝি পেরিয়ে চলে এসেছে সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যায়ে। সেদিনটা এই বারান্দার মতোই বুঝি অন্ধকারাচ্ছন্ন। কলিকাতা শহর তখন সবে গড়ে উঠছে।’ সূতানুটীতে তখন কেবল হোগর জঙ্গল। সেই হোগর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আর্মেনিয়ানরা মেয়েমানুষের ব্যবসা করে আর ডাকাতরা টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে পথিকদের খুন করে ফেলে দেয় গঙ্গার জলে। মানুষ বলি দেয় কালীঘাটের কালীর সামনে। তারপর জব চার্নকের আমল থেকে শুরু হয়ে শহর যখন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলে এসে প্রথম এক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো, তখন এল স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস আর এক মাদাম গ্র্যাণ্ড! পৃথিবীর সেরা প্রেমের কাহিনী। সেদিন সেই রাত্রে যখন মাদাম গ্র্যাণ্ডের শোবার ঘরে প্রথম ধরা পড়লে ফ্রান্সিস সাহেব তখন ভূমিপতি চৌধুরীরও জন্ম হয়নি। কিন্তু মাদাম গ্র্যাণ্ড বুঝি বার-বার বিভিন্ন রূপ নিয়ে জন্মেছে সংসারে। কখনও ফ্রান্সিস সাহেবকে, কখনও ভূমিপতি চৌধুরীকে, আবার কখনও জবার রূপ নিয়ে ছলনা করেছে পুরুষ জাতকে। এই অসময়ে ছোটবৌঠানের আকর্ষণের পেছনেও যেন সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে এক মহা-অপরাধের পূর্বাভাষ। নইলে এত আকর্যণ কেন? ব্রজরাখাল তো বারবার বলেছিল–কাজটা ভালো করোনি বডোকুটুম—ওরা হলো সাহেব-বিবির জাত—আর আমরা হলাম গিয়ে গোলাম—ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম ভালো নয়।

সেই অন্ধকারাবৃত আবহাওয়ায় বংশীর পেছনে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল ভূতনাথ। কেন সে পাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে। কার কাছে যাচ্ছে। এ কি তার কলকাতা দেখতে আসা। জীবনে সে প্রতিষ্ঠা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে—তবে আজ কেন এই অভিসার! রোজ রোজ ঘরের অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে কেন এই তিমিরাভিসার! যে-পথ দিয়ে স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস, ভূমিপতি চৌধুরী সবাই একদিন গিয়েছে, আজ ভূতনাথও আবার সেই পথ দিয়ে বুঝি যাত্রা করছে-তার এই অবৈধ নৈশ যাত্রা!

বংশী পেছন ফিরে আর একবার ডাকলে কই, আসুন শালাবাবু।

হঠাৎ কী যেন হলো। মনে পড়লো ছোটবৌঠানের যশোদাদুলালকে! মনে পড়লো ফতেপুরের বারোয়ারিতলার মা মঙ্গলচণ্ডীকে। আর মনে পড়লো—নরহরি মহাপাত্রের সর্বসিদ্ধিদাতা বিনায়ককে। ভূতনাথ বললে-চল—যাই।

দরজাটা খুলেই সামনে ছোটবৌঠানের ঘর। একেবারে মুখোমুখি।

আগে থেকেই বুঝি বন্দোবস্ত ঠিক ছিল সব। বংশী দরজার সামনে যেতেই ছোটবৌঠান বেরিয়ে এল। ঘরের আলো পড়ে ছোটবৌঠানের কানের হীরেটা চক চক করে উঠলো। ভূতনাথকে তখনও বুঝি ভালো করে দেখতে পায়নি ছোটবৌঠান। বললে— কই রে বংশীভূতনাথ কই?

ভূতনাথ সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। বললে—বৌঠান এই যে আমি!

—ও, এসেছে—এসো-মাথা থেকে নিঃশব্দে ঘোমটাটা খসে গেল বৌঠানের। এতক্ষণে ভালো করে যেন দেখতে পেল মুখটা। সেই ছোটবৌঠান। ভূতনাথের যেন চোখ নামতে চায় না। ছোটবৌঠানের নজরে পড়লো। একটু হেসে বললে–এসো, ঘরের ভেতরে এসো।

তবু ভূতনাথের যেন দ্বিধা হলো। বললে–ছোটবাবু কোথায়?

—আছেন, কিন্তু সেজন্যে তোমার কিছু ভয় নেই—তুমি এসো। ঘরে যেতেই ছোটবৌঠান বললে—কেমন আছো ভূতনাথ?

ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে দেখলে একবার। সব ঠিক তেমনি আছে। আলমারির পুতুলগুলো ঠিক তেমনি করে তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সোনার বাঁশি হাতে করে ছোটবৌঠানের যশোদাদুলাল তেমনি অচল অটল দাঁড়িয়ে। ছোটবৌঠানের দিকে চাইতেই ভূতনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। মনে হলো, একটু আগেই যেন ছোটবৌঠান খুব কেঁদে ভাসিয়েছে। কিন্তু ভূতনাথের চোখে চোখ পড়তেই ছোটবৌঠানের ঠোটে হাসি ফুটে উঠলো। বললে—কী দেখছো ভাই অমন করে?

ভূতনাথ বললেন, আমি আপনাকে বলতে এসেছিলাম একটা কথা।

—কী কথা-বলল না শুনি?

—ও সিঁদুর আর আপনি পরবেন না—ওই ‘মোহিনী-সিঁদুর।

-কেন, সিঁদুরে আবার কী দোষ করলো ভাই—জবার সঙ্গে বুঝি ঝগড়া হয়েছে?

—না, ঠাট্টা নয়, সুবিনয়বাবু নিজে বলছেন, ওসব বুজরুকী।

—তা হোক, কিন্তু আমার কাজ হয়েছে ভাই!

—সে কি!

-হ্যাঁ, ‘মোহিনী-সি’ দুরে’র ফল ফলেছে আমার, অনেক ওষুধবিষুধ আগে খেয়েছি, মাদুলি-তাগা, কিছুই বাদ রাখিনি, পূজোমানত সব করে দেখেছি, কিছুতে কিছু হয়নি আগে—কিন্তু ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কাজ হয়েছে।

—সে কি বৌঠান, সুবিনয়বাবু নিজেই বললেন যে ও বুজরুকীর ব্যবসা তুলে দেবেন।

—তা হোক।

—কী করে হলো?

—সব কথা তো তোমাকে বলা যায় না, তুমি শুনতেও চেও না কিছু—কিন্তু..

—কিন্তু কী বৌঠান?

ছোটবৌঠান যেন একটু দ্বিধা করলো। তারপর বললেছোটকর্তা কথা দিয়েছেন আমাকে, জানবাজারের বাড়িতে আর যাবেন না। বরাবর রাত্রে বাড়িতেই থাকবেন, যদি আমি…

–যদি আপনি…?

–এখন এর বেশি আর শুনতে চেও না—এর বেশি আমি বলবোও না।

ছোটবৌঠান যেন নিজেকে সামলে নিলে।

তারপর বংশীকে ডেকে ছোটবৌঠান বললে—বংশী তুই এখন যা—পরে ডেকে পাঠাবে।

বংশী চলে যাবার পর ছোটবৌঠান গলা নিচু করে বললে— কিন্তু ভূতনাথ, তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবেআজকেই।

ভূতনাথের উৎসুক দৃষ্টির সামনে চোখ রেখে পটেশ্বরী বৌঠান বললে-করবে? পারবে?

–পারবো। কী?

–কেউ যেন জানতে না পারে-বংশীও নয়।

–কেউ জানবে না বৌঠান।

—আমাকে মদ কিনে এনে দিতে হবে।

—মদ?

—হ্যাঁ, মদের অভাব নেই এ-বাড়িতে তা সবাই জানে। এ-বাড়িতে ছেলে বুড়ো সবাই খায়, কিন্তু তবু দরকার, খুব ভালো মদই নিয়ে এসে, বেশি নয়, সামান্য হলেই চলবে’খন, কিন্তু আজ রাত্রেই—আমি টাকা দিচ্ছি। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে টাকা বার করে দিলে—বললে—এই জন্যেই তোমায় ডেকেছিলাম।

ভূতনাথ উঠলো। পটেশ্বরী বৌঠান বললে—হ্যাঁ ভাই যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। রাস্তা তো চিনে নিলে—ওইখান দিয়ে আসবে, কেউ জানবে না।

হতবুদ্ধির মতো ভূতনাথ বেরিয়ে এল বাইরে। কোথাও কিছু নেই, কিন্তু এমন যে হবে ভাবতে পারেনি ভূতনাথ। বড়বাড়ির রহস্যই বুঝি আলাদা। অন্য কোনো নিয়মে বুঝি একে বাঁধা যায় না। ইতিহাসের পাতায় এর মানুষগুলো বড় বেশি নড়ে চড়ে, কথাও বুঝি বেশি বলে—কিন্তু কিছুতেই বুঝতে দেয় না নিজেদের। ভূতনাথের মনে হলো পটেশ্বরী বৌঠান যেন সত্যিই ইস্কাপনের বিবির মতন—হাতে যদিই বা আসে সে শুধু হাতের বাইরে চলে যাবার জন্যে!

ভূতনাথ সন্ধ্যের অন্ধকারেই গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *