২৬. পায়রা ওড়ানো শেষ হতে

পায়রা ওড়ানো শেষ হতে প্রায় দশটা বেজে গেল।

মেজবাবু যখন নিচে নেমে এলেন তখন রাস্তায় আরো ভিড় জমেছে। দারোগা সাহেব বিধু সরকারের ঘরে বসে বসে তখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে দেয়ালের চারদিকে চেয়ে দেখছে। গোটাকতক ঠাকুর দেবতার ছবি টাঙানো এ-ঘরে। হনুমান গন্ধমাদন পাহাড় বয়ে নিয়ে উড়ে চলেছে সমুদ্রের ওপর দিয়ে। রাবণ রাজা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে এসে সীতার কাছে ভিক্ষে চাইছে। এমনি আরো সব। সায়েব কিছু বুঝলে কিনা কে জানে।

অধৈর্য হয়ে একবার সাহেব বললে-মেজবাবুকো বোলাও।

বিধু সরকার চশমা তুলে বললে—আর একটু বসুন হুজুর এইবার আসবার সময় হলো, এই দশটা বাজলে এবার।

–কী করছে বাবুসাহেব এতক্ষণ?

—পায়রা ওড়াচ্ছেন হুজুর পিজিয়ন্। সাহেব কী বুঝলো কে জানে। লাঠিটা আর একবার ঠুকে বসে পড়লো তক্তপোশে। বললে—ড্যাম ইট–

কিছু বলাও যায় না। পূজোর সময়ে বড়বাড়ি থেকে প্রতি বছর মোটা রকমের প্রসাদ বিতরণ হয় থানার লোকদের। বিয়ের ব্যাপারেও কাপড়, চোপড়, পোষাক-আশাক দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া পুলিশের লোকদের ওপর বড়বাড়ির বিশেষ কৃপা আছে। সেকালের কর্তাদের আমল থেকে এ-রেওয়াজ। পূজোর পুরোনো খেরো খাতায় লিস্টির মধ্যে থানার দারোগার নাম আছে শ্রীযুক্ত মিস্টার উইলসন কালাইল ব্লেক। নাম লেখা আছে ব্লেক সাহেবের। কিন্তু ব্লেক সাহেব কবে চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছে। নিয়ে স্কটল্যাণ্ডের এক কবরের তলায় মাটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজো তার নামে খরচ লেখা হয়। ভূমিপতি চৌধুরীকে এই ব্লেক সাহেবই খুনের দায় থেকে বাঁচিয়েছিলেন। যে-রাত্রে ইটালিয়ান শিল্পী তার মেমসাহেবকে গুলী করে পালায়, সেই রাত্রেই থানার দারোগার কাছে পৌঁছে যায় পাঁচ শ’ এক গিনি। তারপর ব্লেক সাহেবের পর থানার ভার নিয়ে এসেছে টাউনসেণ্ড সাহেব। তারও খাতির ছিল এ-বাড়িতে। তারপর যেবার বৈদূর্যমণি চৌধুরী রাজাবাহাদুর হলেন, বড়লাটকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে চীনে-অর্কিড উপহার দেওয়া হলো, সেবার থানার চার্জে ছিল রবিনসন সাহেব। খানা-পিনার অর্ধেক যা বাঁচলো সেদিন, সব গিয়েছিল রবিনসন সাহেবের বাড়িতে। খাটি সব বিলাতী মাল। তারপর হিরণ্যমণি চৌধুরীর বিয়ে গিয়েছে, কৌস্তুভমণির বিয়ে হয়েছে, শেষ বিয়ে হয়েছে চূড়ামণি চৌধুরীর। পুলিশের সঙ্গে দোস্তি না রাখলে সেদিন ঠনঠনের ছেনি দত্তর শবদেহ নিয়ে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বেধে যেতে। ব্রিজ সিং বন্দুকটা সোজা করে ছুঁড়লে দাঙ্গাটা জোর বেধে উঠতো। কিন্তু বাঁচালে দারোগা সাহেব।

যতবার সিধে গিয়েছে পুলিশ সাহেবের বাড়িতে, বিধু সরকার পুরোনো খেরো খাতাটা পেড়ে নিয়ে ততবার লিখেছে—শ্ৰীযুক্ত মিস্টার উইলসন কার্লাইল ব্লেক সাহেবকে মিষ্টান্ন বিতরণ বাবদ…।

 

খাওয়া-দাওয়ার পর ভিস্তিখানায় আঁচাতে গিয়ে বংশীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মনে হলো বড় যেন ব্যস্ত আজ বংশী। বংশীর তখনও স্নান হয়নি। তাড়াতাড়ি মাথায় দু’ ঘটি জল ঢেলে সরে পড়বার মতলব।

ভূতনাথকে দেখেই বংশী বললে—আজ আর কথা বলবার সময় নেই শালাবাবু—চললুম আজ্ঞে।

ভূতনাথ বললে—কাজ তোমার খুব বেড়েছে বংশী এদানিসত্যি কথা।

কথাটা মিথ্যে নয়। যতদিন ছোটবাবু বাড়িতে থাকতো না, ততদিন বংশীরও বেশি কাজ ছিল না। গল্প করে কাটাতে এ-ঘর ও-ঘর। তোষাখানায় বসে তাস নিয়ে বিন্তি খেলেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাঝে মাঝে ফাইফরমাশ খেটেছে ছোটমা’র। আজকাল দেখাই হয় না শালাবাবুর সঙ্গে। ভূতনাথ ও চাকরির চেষ্টায় ঘুরেছে কেবল। অনেক লোকের বাড়ি-বাড়ি গিয়েছে। ব্রজরাখালের পরিচয় সুবাদে যেখানে যেখানে একটু সামান্য পরিচয় ছিল সব জায়গায় গিয়ে ধন্না দিয়েছে। সুবিনয়বাবুর নাম করে সমাজের কয়েকজনের সঙ্গেও দেখা করেছে। সামান্য একটা চাকরি, যে-কোনো রকমের। যে-কোনো মাইনের। পাঁচ টাকা, ছ’ টাকা, যা হয়। তারপর ডালহৌসি স্কোয়ারের বড় বড় হোঁসগুলোতে দুপুরবেলা গিয়ে খোঁজ করেছে। নতুন আপিস হয়েছে সব এদিকে। র্যালি ব্রাদার্স, মালকম এণ্ড কোং, মার্টিন পিলার্স এণ্ড কোং, টার্নার ক্যাডোগান এণ্ড কোং। তারপর দেশী কোম্পানীও আছে। প্রেমাদ কিলস এণ্ড কোং, দত্ত লিনজি এণ্ড কোং…

কেউ কেউ শুধু বক্তৃতা দিয়েই বিদায় দিয়েছে—মতি শীলের নাম শুনেছো হে ছোকরা, তোমার মতো গরীব অবস্থা থেকেই বড়লোক হয়েছিলেন—শুধু বসে বসে তাস খেললে তো চলবে না!

ভূতনাথ হয় তো মৃদু প্রতিবাদ করেছে—তাস খেলতেই জানি স্যার তা–

—ওই দেখো সামান্য তাস, ওই তাসের ব্যবসা করেই কত লোক লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে, আর তোমরা তাসটা খেলতে শিখলে না। মতি শীল বোতল আর কর্কের ব্যবসা করে কত পয়সা কামিয়েছেন, জানো সেকালে বিস্কুট চালান দিতেন অস্ট্রেলিয়ায় ওই মতি শীল। শুধু মতি শীল কেন, বিশ্বম্ভর সেন আট দশ টাকা নিয়ে ব্যবসায়ে নেমে শেষে দু’ লক্ষ পাউণ্ড গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে—আর রাজা নবকেষ্ট–

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। তবু উদাহরণ দেয় সবাই। উপদেশ দেয় সবাই। হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, ফেয়ারলি সাহেবের দেওয়ান রামদুলাল দে, নুনের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস, কলকাতার জমিদারী কাছারির দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র, রসদের ঠিকেদার গোকুলচঁদি মিত্র, পামার কোম্পানীর খাজাঞ্চী গঙ্গানারায়ণ সরকার, মুনের কারবারি কৃষ্ণচন্দ্র পাল চৌধুরী, শ্রফের ব্যবসায় মথুর সেন, হেস্টিংস-এর সরকার রামমোহন.. ইত্যাদি ইত্যাদি অজস্র উদাহরণ!

ভূতনাথ বলে–শেষ পর্যন্ত দারোগা সাহেব কী বলে গেল বংশী?

—বলবে আবার কী মাথামুণ্ডু শালাবাবু, কাল সিধে যাবে সাহেবের কুঠিতে—চুকে যাবে ল্যাঠা। আমার ভাবনা শুধু ওই চিন্তাকে নিয়ে—সোয়ামীকে খেয়েছে, এদিকে আবার খেটে খাবার যুগ্যিতা নেই—তার ওপর এই তো দেখছেন বড়বাড়ির হালচাল।

কৌতূহলটা আর চাপতে পারলে না ভূতনাথ। বললে—এসব কার কাজ বংশী?

-এ-কাণ্ড এই কি প্রথম দেখলেন শালাবাবু, মাঝখান থেকে শশীর চাকরি গেল শুধু মধু পারা হয়েছে বলে—তা এদানি গিরির চেহারা কী হয়েছে দেখেছেন?

-গিরি?

-আজ্ঞে মেজবাবু তো এই মারে আর সেই মারে, বলে-বার বার পারবো না ঠেকাতে। মেজমাও চেঁচিয়ে উঠলো। বললে—যত দোষ মেয়েমানুষের, আগে বাড়ির ছেলেকে সামলাও তোমার, আজ বাদে কাল যার বিয়ে হবে তার প্রবৃত্তির বলিহারি, তোমাদেরই তো শিক্ষা, তোমাদেরই তো রক্ত—কত আর ভালো হবে। মেজবাবু ধীর স্থির মানুষ, বেশি কিছু বললে না—কিন্তু তারপর চুলোচুলি বাধলো বড়মা’তে আর মেজমা’তে।

ভূতনাথ বললে—কী রকম?

—বড়মা সাজাঘরে গিয়েছিল, কানে গিয়েছে কথাটা—সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে এল। বললে—আমার ছেলের নামে তুই এই অপবাদ দিস মেজবৌ? আমার ছেলে রূপে গুণে কার্তিক, সে আর মেয়েলোক পেলে না! শহরে কি মেয়েলোক নেই, না খাজাঞ্চীখানার পয়সা কম পড়েছে, কত্তা বেঁচে থাকতে বাড়িতে নাচউলী আসেনি? খেমটাউলী আসেনি? না কর্তার নজরের কথা কেউ জানে না? কত্তা একরাতে ল্যাখ টাকা ওড়ায়নি? তোর বাপ পেরেছে তেমন ওড়াতে? তোর চোদ্দপুরুষ পেরেছে? আমার ছেলের নামে অপবাদ! সে আর মেয়েলোক পেলে না, নজর দিতে গেল তোর ঝি-এর ওপর!

–তারপর, নতুনবউ সব শুনলে তো?

বংশী বলে—সে এক কুরুক্ষেত্তোর কাণ্ড শালাবাবু, আপনি দেখতেন যদি, সিন্ধু তাড়াতাড়ি এসে ভিজে গামছাখানা বড়মা’র গায়ে ঢাকা দিলে—তাই একটু আবরু হলো।

–আর নতুনবউ?

—ছুটুকবাবু ঘরের মধ্যেই ছিল, বাইরে বেরিয়ে এসে মাকে বললে—তুমি থামো মা, থামো তুমি…সে অনেক কাণ্ড, পরে বলবো অখন, আমার এখন মরবার ফুরসত নেই—চললুম আজ্ঞে।

এত কাজ তোমার কিসের বংশী?

—না শালাবাবু, ছোটবাবু আজ আবার বেরোবেন আজ্ঞে। ছোটমা’র সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে।

বলেই চলে যাচ্ছিলো বংশী। কিন্তু ভূতনাথ চেপে ধরলো। বললে—কোথায় যাবে ছোটবাবু আবার?

–আবার কোথায়, জানবাজারে?

–সে কি!

জানবাজারে! আবার সেই চুনীদাসীর কাছে! এতদিনের সব আয়োজন, সব সাধনা ব্যর্থ হলো বুঝি! কোথাও কোনো ত্রুটি হয়েছে নাকি! সাধনায় কোনো বাধা! ব্যাঘাত! এতদিন ছোটবাবু ঘর থেকে একদিনের জন্যেও বেরোয়নি। ছোটবাবুর ল্যাণ্ডে। এক’দিন আস্তাবলে আলসে হয়ে পড়েছিল। ঘোড়া দুটো কেবল খামকা দানা খেয়েছে আর জিরিয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুটিয়েছে। এত বড় বিয়ে গেল বাড়িতে, দু’একবার ছাড়া ছায়াও দেখা যায়নি ছোটকর্তার। অন্দরমহলে কোথায় নিজের ঘরে বসে কী করেছে কেউ জানে না। বরযাত্রীর দলের মধ্যেও যায়নি সেদিন পাথুরেঘাটাতে।

অবাক শুধু ভূতনাথই হয়নি। অবাক হয়েছে বাড়িশুদ্ধ লোক। লোচন, মধুসূদন, শ্যামসুন্দর, বেণী, ঝি, ঝিয়ারী, বিধু সরকার। কেউ বাদ যায়নি। অবাক হয়েছে ইব্রাহিম কোচোয়ান, দাসু জমাদার, সবাই। সবাই!

মেজবৌ মুখ টিপে হেসেছে।—তুই কিছু তুকতাক করলি নাকি ছোটবৌ?

বিধবা বড়বৌও কথাটা শুনেছে সিন্ধুর কাছে।-বলিস কি সিন্ধু, এ-বংশে রাত্তিরে মাগের কাছে শোয়া এই প্রথম দেখলুম মা, বড়বাড়ির কর্তাদের নাম ডোবাবে ছোটবাবু এবার!

গিরির আজকাল আর সে-তেজ নেই। দুপ-দাপ সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে তেতলায় উঠতে পারে না। গলা চড়িয়ে ঝগড়া করতে পারে না আর সৌদামিনীর সঙ্গে। কিন্তু সৌদামিনী তারকেশ্বরের প্রকাণ্ড বঁটিটা নিয়ে এচোড় কুটতে কুটতে নিজের মনেই ফোড়ন কাটে তেমনি—অমন ভাতারের নিকুচি করেচে মা, দিনরাত মাগের আঁচল ধরে পড়ে থাকে, এ কেমন ধারা ভাতার মা, ভোলার বাপ তাই বলতো-ফুলবৌ, চোখ থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও। তা ভোলার বাপ নিজেও মলল, আমাকেও মেরে রেখে গেল মা।

ভাড়ার ঘরের পাশের কুঠুরিতে বসে যদুর মা একমনে হলুদ, লঙ্কা ধনে বেটে চলে পাথরের শীল-নোড়া নিয়ে। হলুদের সোনালি জল নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে উঠোনে পড়ে একাকার হয়ে যায়। সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে বাটনা বাটতে বাটতে সব শোনে বুড়ী। বলে—কার কথা বলছিস লা সদু?

সৌদামিনী উত্তর না দিয়ে চুপ করে যায় হঠাৎ।

সেদিন গিরির একেবারে সামনাসামনি পড়ে গেল ভূতনাথ। সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল গিরি। গজ গজ করছে আপন মনে—শতেক খোয়ারিরা চোখের মাথা খা, আমার দিকে নজর দিতে আসে, আমার গতর ভেঙেছে তো তোদের কি লা, তোদের কী সব্বনাশ করেছে গিরি, গতরখাগীদের গতরে পোকা পড়ক—বলছি আমি গিয়ে মেজমার কাছে।

তারপর সামনে মাথা তুলে ভূতনাথকে দেখেই হঠাৎ একগলা ঘোমটা টেনে পাশে সরে দাঁড়ালো। এক পলকের দেখে নেওয়া। ঘোমটার ভেতর থেকেই গিরি তেমনি গজ গজ করতে লাগলো কোন্ অদৃশ্য শত্রুকে লক্ষ্য করে—মর হারামজাদিরা— আবাগীরা মরলে আমার হাড় জুড়োয়, পিণ্ডি দিয়ে আসি গয়ায় গিয়ে, কাঁধে করে তুলে নিয়ে পুড়িয়ে আসি নিমতলায়, কলসী করে জল ঢালি তার চিতের ওপর।

এরই মধ্যে কিন্তু যেটুকু দেখা গেল, ভূতনাথের মনে হলো যেন পোড়া কাঠের মতো চেহারা হয়েছে গিরির। অথচ এই ক’দিনের মধ্যেই। এমন তো ছিল না। কিছুদিন আগেও গোলগাল ভারী মানুষ ছিল।

বংশী বলেছিল—এই নিয়ে তো ওর চারবার হলে শালাবাবু। এই হালচালের মধ্যে চিন্তাকে রেখেছি শুধু পেটের দায়ে—মাইরি বলছি আজ্ঞে শুধু পেটের দায়ে।

হাবুল দত্তর মেয়ের দশ বছর বয়েস। এ-বাড়িতে নতুনবো হয়ে এসেছে। সে-ও অবাক। অবাক হয়ে গিয়েছে সে-ও।

এ-বাড়িতে বউ হয়ে আসার আগে শুনেছিল অনেক কথা। পুরুষরা কেউ রাত্রে বাড়ি থাকে না। না-থাকাটাই নাকি আইন। আরো অনেক কথা। বনেদী বাড়ির হালচাল সম্বন্ধে!

মেজখুড়শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করেছে—ছোটঠাকুর বুঝি রাতের বেলায় বাড়ি থাকেন?

মেজমা হেসেছে। হেসে ঠেলা মেরেছে গিরিকে—শোন লা গিরি, কথা শোন বৌ-এর।

বাঘ বন্দি খেলতে খেলতে গিরি বলে—যাই বলে মা, আমার তো মন বলে, ছোটমা ছোটকর্তাকে তুক করেছে পূজো আচ্চা সব বাজে কথা, ওযুদ-বিষুদ খাইয়েছে কিছু।

সত্যিই সবাইর অবাক লেগে গিয়েছিল ছোটবাবুর কাণ্ড দেখে। বনেদী বাড়ির ছেলের এ কী অ-বনেদীয়ানা!

ছোটবৌঠানও এতদিনের মধ্যে আর তেমন ডেকে পাঠায়নি ভূতনাথকে। ভূতনাথও মনে মনে ভেবেছে মদ খাওয়াটা হলো উপলক্ষ্য। আসলে ফল ফলেছে ‘মোহিনী-সিঁদুরের গুণে! মন্ত্রপূত সিঁদুরের অলৌকিক ক্রিয়া। গাদাগাদা যে-সব চিঠি আসতো আপিসে, তখন এতটা বিশ্বাস হয়নি তার। কিন্তু আজ বিশ্বাস হয়েছে যেন। মনে হলো—হবেও বা। সব জিনিষের কি প্রমাণ পাওয়া যায়।

মাঝখানে একবার ছোটবৌঠানের কাছে গিয়েছিল ভূতনাথ। গিয়েছিল নিজের গরজেই।

চোরকুইরির বারান্দাটা পেরিয়ে চুপিসাড়ে গিয়ে পৌচেছে একেবারে ছোটবৌঠানের ঘরের সামনে। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বারান্দায় কেউ নেই কোথাও। মেজবোঠানের ঘরের ভেতর তখন একমনে বাঘ বন্দি খেলা চলেছে। আর বড়মাও তখন নিজের ঘরে সিন্ধুর সঙ্গে গল্প জুড়েছে আবোল তাবোল। যেমন সচরাচর হয়। বারান্দার কোণে সাজাঘরের সামনে ঘোট বাতিটা টিম টিম করে জ্বলছে। এই সুযোগ! আর ছুটুকবাবুর বিয়েও তখন হয়নি। নতুনবৌও আসেনি বড়বাড়িতে!

ঘরের সামনে গিয়েই ভূতনাথ চাপা গলায় ডাকলে—ছোটবৌঠান—

ঘরের ভেতর বৌঠান কী করছিল কে জানে। মিষ্টিগলার আওয়াজ এল—কে রে, ভূতনাথ না?

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে ভাবছে। এমন সময় ঘোমটা টেনে চিন্তা বেরিয়ে এসে মুখ নিচু করে বললে—ভেতরে যান—বলে চিন্তা ঘরের বাইরে অন্ধকারের আড়ালে মিলিয়ে গেল।

পা কাঁপছিল ভূতনাথের। ছোটবৌঠানের কাছে এলেই ভূতনাথের কেমন যেন পা দুটো কাঁপে। শুধু পা কেন—সর্বাঙ্গ। কেন কাপে তা বলা শক্ত! বোঝানো শক্ত! অথচ জবাও তত তার যে খুব ঘনিষ্ঠ তা নয়। জবাও তার কাছে আকাশের চাঁদের মতো দূরের মানুষ। তাকে এত ভয় করে না। বোধহয় এতখানি ভালোও বাসে না তাকে। তবু কেন যে এমন হয় কে বলবে!

ছোটবৌঠান বোধহয় পালঙ-এর ওপর শুয়েছিল, আর গা হাত পা টিপে দিচ্ছিলো চিন্তা!

ঘরের ভেতর মাথা গলিয়ে ওই অবস্থা দেখে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল ভূতনাথ।

ছোটবৌঠানও ওঠবার বা শশব্যস্ত হবার চেষ্টা করলো না।

–আয়, দাঁড়িয়ে রইলি কেন রে? আয়, বোস এখেনে।

ভূতনাথ পায়ে-পায়ে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু কেমন অহেতুক লজ্জা করতে লাগলো যেন। বললে—শরীর খারাপ বুঝি বৌঠান?

ছোটবৌঠান শুয়ে শুয়ে হাসলো—শরীর খারাপ কেন হতে যাবে? আমি খুব ভালো আছি রে আজকাল। তারপর একটু থেমে হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলে—আমাকে তোর মনে পড়ে

এখনও?

-রোজই আসতে ইচ্ছে করে তোমার কাছে।

–তা বলে যেন রোজ আসিস নে তুই!

-কেন? প্রশ্নটা করে ভূতনাথ কেমন চমকে উঠলো। যেন অধিকার আছে তার রোজ এ-ঘরে আসবার।

-না, রোজ আসতে নেই, আজকাল ছোটকর্তা আসে যে এ-ঘরে।

—সে তো রাত্রে।

–তুই জানিসনে ভূতনাথ, রাত্রে ছোটকর্তা আসে বটে কিন্তু দিনের বেলাও সেই রাত্রের কথাই ভাবি যে। আমার দিনরাত যে একাকার হয়ে গিয়েছে আজকাল। জানিস, সময় মতো যশোদা-দুলালের পূজো করতেও ভুলে যাই আজকাল।

—সে কী!

—কেন, তাতে দোষ কী! যশোদাদুলাল আর স্বামী কি আলাদা নাকি! যে-যশোদাদুলাল সেই তো…

ভূতনাথ চুপ করে রইল। কথা বলতে বলতে ছোটবৌঠানের মুখটা কেমন যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠলো। এ ক’দিনে যেন ছোটবৌঠান শুধু আরো সুন্দরই হয়নি, আরো শুচি শুভ্র হয়েছে, পবিত্র হয়েছে। আরো সম্পূর্ণ হয়েছে। আরো নতুন, আরো নরম।

ভূতনাথ বললে-একটা কাজে এসেছিলাম তোমার কাছে বৌঠান।

—কী কাজ, বল?

হাতের একটা ন্যাকড়ায় বাধা পুটলি দেখিয়ে বললে—এই কিছু টাকা এনেছিলাম—রেখে দেবো তোমার কাছে। আমার তো বাক্স-পেটরা কিছু নেই।

—টাকা কিসের?

—এই পাঁচ শ’ টাকা পেলাম সুবিনয়বাবুর কাছে। জবার বাবা দিলেন, চাকরি চলে গেল কিনা—আপিসই উঠে গেল তা চাকরি থাকবে কী করে?

—চাকরি চলে গেল, ভালোই হয়েছে।

—বারে, চাকরি চলে গেল থাকবো কোথায়, খাবো কী— চিরকাল তো তুমি খাওয়াবে না।

–খাওয়াবো রে, চিরকাল খাওয়াবো, আমি যদি বেঁচে থাকি, তোর খাবার অভাব হবে না। তুই থাকবি বড়বাড়িতে, কে তোকে কী করবে শুনি, ছোটকর্তাকে এখন যা বলবে শুনবে। তুই আমার এত বড় উপকার করলি ভূতনাথ—আমি যে আবার স্বামীসেবা করতে পেলাম, বাঘের মুখ থেকে ছোটকর্তাকে ফিরে পেয়েছি—এ কার জন্যে শুনি—ছোটবৌঠান এবার পাশ ফিরলো। বার দুই আড়ামোড় ভাঙলো। একবার হাই তুললে।

ভূতনাথ বললে–তোমার ঘুম পাচ্ছে—আমি এখন তাহলে

—না রে পাগল, ঘুম পায় নি, সারারাত ছোটকর্তা ঘুমোতে দেয় না বটে—কিন্তু তা বলে এত সকাল-সকালও ঘুম আসে না। এই নে, চাবিটা নে, ওই যে সিন্দুকটা দেখছিস, ওখানে গিয়ে চাবি দিয়ে ওটা খুলে ভেতরে রেখে দে।

ভূতনাথের কেমন ভয় হলো কথাটা শুনে।

—নে, চাবি নে।

বৌঠানের গলায় ধমকের সুর নয়, আদেশের সুর নয়। সুরটা কিসের তাই বিচার করতে গিয়ে ভূতনাথ ছোটবৌঠানের মুখের দিকে একবার চাইলে। চোখে কি সুর্মা পরেছে বৌঠান! না কালি পড়েছে! রাত জাগার কালিমা! আশ্চর্য লাগে, এই চোখের এত আকর্ষণ কী করে ছোটকর্তা এতদিন এড়াতে পেরেছিল। এত মোহ, এত মায়া, এত নেশা আছে মেয়েমানুষের সহজ চাউনিতে, ভাবা যায় না। সেই ফতেপুরের রাধা! সেও যখন অভিমান করতো এত নেশা ছিল না সে-চোখে। আর সেই যে টিটকিরি দিতে কথায় কথায় আন্না! আন্নাকালী! এত টানতো না। সে মেয়েও। হরিদাসী ছিল গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু পেটে পেটে দুষ্টমি ছিল তার-ও। সে-ও যখন ঠাট্টা করতে ভূতনাথকে নিয়ে, তখন খুব রাগ হতো বটে, কিন্তু ভালোও লাগতো! জবা যখন কথার মারপ্যাচ দিয়ে পাড়াগেঁয়ে বলে তাকে উপহাস করে বিদ্রূপ করে, হাজার রাগ হলেও তা ভালো লাগে। কিন্তু ভালো লাগারও তো একটা তারতম্য আছে। এ-ভালো লাগার যেন শেষ নেই।

ভূতনাথ বললে—আমি কি চাবি খুলতে পারবো?

–খুব পারবি, আমি এখন উঠতে পারছিনে তা বলে।

—যদি না পারি?

–খুব পারবি, না পারবি তো পুরুষমানুষ হয়েছিলি কী জন্যে?

সিন্দুকের ভেতর চোখ মেলে সেদিন ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওটা বুঝি মুক্তোর হার, তার পাশে একগাদা গিনি। হীরের কয়েকটা গয়না অন্ধকারের ভেতর জ্বল জ্বল করছে। একটা রূপোর রেকাবি ছিল, তারই ওপর টাকার তোড়াটা রেখে দিলে ভূতনাথ। রাখতেই একটা ঝন ঝন শব্দ করে উঠলো। চমকে উঠলো ভূতনাথ। কেমন যেন শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরাতে তার ঝঙ্কার চলতে লাগলো কিছুক্ষণ ধরে। মনে হলো যেন বৌঠানের গায়ে হাত ঠেকে গিয়েছে তার। পাতলা নরম গা। হাত ঠেকতেই বৌঠান চমকে উঠেছে, আর হাতের চুড়িগুলো বেজে উঠলো ঠুন ঠুন করে।

—সিন্দুকটা বন্ধ করে, দেরাজ থেকে ওই বোতলটা আন তো ভূতনাথ।

ভূতনাথের নজরে পড়লো কালো একটা বোতল। তার ওপর কাগজের লেবেল আঁটা।—কী আছে ওতে? মদ?

—হ্যাঁ, নিয়ে আয় না।

নিতে গিয়েও ভূতনাথের হাতটা সরে এল। একবার দ্বিধা হলো। মনে হলো যেন একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে ওখানে মিট মিট করে মাথাটা তুলে তাকাচ্ছে। হাত ছোঁয়ালেই ছোবল মারবে। ভূতনাথ এবার পেছন ফিরলো। বললে—এখন কি আবার ওইটে খাবে নাকি!

বৌঠান উঠে বসলো। বললে—শরীরটা কেমন যেন লাগছে।

—তা বলে ওইটে খেলে কি সারবে?

বৌঠান হাসলো এবার। বললে–-সারবে রে সারবে, সেদিন নীলের উপোস ছিল, সারাদিন তো জল মুখে দিইনি, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা ওই একটু খেয়ে বেশ তাজা হয়ে উঠলুম।

—এখন আর বমি আসে না বৌঠান? সেই প্রথম যেমন হয়েছিল?

-বমি আসবে কেন?

—মনে নেই, প্রথম প্রথম কী রকম ঝঝ লেগেছিল—সেই আমি যেদিন প্রথম কিনে এনে দিলাম, মনে নেই-ছিপি খুলতে গিয়েই কেমন বমি-বমি ভাব এসেছিল তোমার?

বৌঠান হো হো করে হেসে উঠলো।

-হাসছো যে?

—হাসবো না, এখন যে উল্টো হয়েছে, সারাটা দিন না খেলেও চলে—কিন্তু সন্ধ্যে হলেই কেমন হাই ওঠে, ফাঁকা ফাকা মনে হয়, কিন্তু একটু জিভে ছোঁয়ালেই সব ঠাণ্ডা।

ভূতনাথ গম্ভীর হয়ে গেল—তোমার তাহলে নেশা হয়েছে বৌঠান। ঠিক নেশা হয়েছে—আমি বলছি।

–দূর, ছোটকর্তা যতদিন চায় ততদিন খাবো, তারপরই দেবো ছেড়ে।

–তা হলে এখন কেন আবার খাচ্ছো?

—শরীরটা কেমন করছে তাই—দে তুই, একটুখানি খাবো। সত্যি বলছি—বিছানায় শুয়ে শুয়েই হাত বাড়ালো বৌঠান।

–দেবো না আমি—আমাকে তুমি কথা দিয়েছিলে যে বেশি খাবে না।

–সত্যি বেশি খাই না রে ভূতনাথ, সত্যি বলছি বেশি খাই না। যেদিন ছোটকর্তার পাল্লায় পড়ে খাই—সেদিন খুব শরীর খারাপ হয়, মাথা তুলতে পারি না সকালবেলা, একদিন সারাদিন জ্ঞান হয়নি, আবোল-তাবোল কী সব বকেছি, চিন্তা দিনভোর আমার পাশে বসে বরফ দিয়েছে মাথায়। ছোটকর্তাকে বললাম, উনিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, বললেন—প্রথম প্রথম অমন একটু হয়—অভ্যেস হয়ে গেলে আর হবে না। দেখছিস না ওটা খাবার পর থেকে কেমন মোটা হয়ে গিয়েছি।

বৌঠান সত্যিই মোটা হয়েছে কিনা ভূতনাথ তাকিয়ে দেখলে। বললে—মোটা কোথায়-তবে তোমায় দেখতে আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছে।

—ছোটকর্তা বলেছে মদ খেলে কখনও শরীর খারাপ হয় না। মদ তো আঙুরের রস-ফলের রস।

ভূতনাথ বললে-কখখনো না, মদ যদি আঙুরের রস হবে তো ওটা খেলে অমন নেশা হবে কেন? মদের নেশায় লোকে সর্বস্বান্ত হয় কেন? কেন মদ খেলে মাথা ঘোরে, পা টলে, আবোলতাবোল কথা বলে?

বৌঠান এবার শুয়ে পড়লো আবার বালিশে মাথা দিয়ে। বললে—তা তুই কি বলতে চাস ভূতনাথ যে, ছোটকর্তার কথা না শুনে তোর কথাই শুনি?

ভূতনাথ হঠাৎ আবার কাছে সরে এল। বললে–আমি কি তাই বলেছি? আমার নামে মিছিমিছি দোষ দিচ্ছো কেন বৌঠান?

—তবে তুই যে বড় বারণ করতে আসিস?

–আমি বারণ করি, সেকি বৌঠান আমার জন্যে? তুমি বসে বসে চোখের সামনে আত্মঘাতী হবে তাতে তোমারই ক্ষতি আমার কী?

বৌঠান বললে—আত্মঘাতী যদি হই-ই, তবু তো ছোটকর্তার পায়ে মাথা রেখে আত্মঘাতী হতে পারবো। স্বামীসেবা করতে করতে মরবো-সধবা মেয়েমানুষের এর চেয়ে আর বড় সাধ কী থাকতে পারে বল তো?

ভূতনাথের তখন সত্যিই বেশ রাগ হয়েছে। খপ করে কালো বোতলটা দেরাজ থেকে নিয়ে এসে হাতে দিয়ে বললে—তবে তুমি মরে বৌঠান, গেলো, প্রাণের সাধ মিটিয়ে খাও।

বৌঠান হাসতে হাসতে এবার উঠে বসলো। বললে—তা হলে যখন এটা দিলি সোডার বোতলটাও দে—বলে বোতলের ছিপিটা নিজেই খুলে ফেললে।

ভূতনাথ এক দৃষ্টে চেয়ে দেখতে লাগলো। একদিন মদের বোতল হাতে তুলে নিতে এই পটেশ্বরী বৌঠানেরই হাত কেঁপে উঠেছিল। বোধহয় কিছুটা আতঙ্কও হয়েছিল। বোধহয় বুকচাপা কান্না ঠেলে উঠেছিল গলায়। সেদিনের সে-দৃশ্যটা ভাবতে গেলে এখন যেন আর বিশ্বাস হয় না। অথচ আজ কত সহজ হয়ে গিয়েছে। কত সংক্ষিপ্ত। অভ্যস্ত হাতের কৌশলে বৌঠান গেলাশে ঢেলেছে বিষ! টল টল করতে লাগলো পাত্রটা ইলেকটি ক আলোর তলায়।

তারপর?

তারপর বিস্মিত ভূতনাথের নির্নিমেষ দৃষ্টির সামনে…পটেশ্বরী বৌঠান একবার শুধু একটু ঘোমটা তুলে দিলো মাথায়। তারপর নিঃশেষ হয়ে গেল গেলাশটা। একটু মুখ-বিকৃতি নেই। একটু সঙ্কোচ নেই। সমস্তটা খেয়ে নিয়ে হাসতে লাগলো বৌঠান। বললে—তোকে ঠিক কালপেঁচার মতো দেখাচ্ছে ভূতনাথ—তারপর আর একটু ঢেলে বললে—তুই একটু খাবি ভূতনাথ?

ভূতনাথ কথা বললে না।

—খেয়েই দেখ না একবার—আয় না এক সঙ্গে দুজনে মরি।

ভূতনাথ এবারও কথা বললে না।

পটেশ্বরী বৌঠান মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে গেলাশটা এক চুমুকে আবার নিঃশেষ করে দিলে। তারপর যেন কেমন স্থির হয়ে এল। থিতিয়ে এল। সমস্ত শরীরে সেই আগেকার মতন প্রশান্তি। যেন নিজের মনেই বৌঠান বলতে লাগলো—আমি যদি খাই, কার কি বলবার আছে শুনি, পরের পয়সায় খাচ্ছি না আমি। বেশ করবে খাবো…আলবৎ খাবো…এই তো আবার খাচ্ছিকে কী বলে দেখি—বলে সত্যি সত্যিই বৌঠান আবার ঢাললে গেলাশে। তারপর আবার এক চুমুকে নিঃশেষ হয়ে গেল গেলাশটা। এবার ঘোমটা খসে গেল মাথা থেকে। বললে—বেশ করছি খাচ্ছিআমার খুশি আমি খাবো–যার ভালো লাগে না। সে সরে যাক এখান থেকে—বেরিয়ে যাক ঘর থেকে—আমি কারো খাই না পরি।

এবারও ভূতনাথের মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরোলে না।

বৌঠানের চোখ দুটো দেখতে দেখতে লাল হয়ে এল। গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। পাতলা ঠোট দুটো যেন হঠাৎ রসালো হয়ে উঠলো। পালঙ-এর ওপর তাকিয়াটা হেলান দিয়ে উঠে বসলো একবার। বললে–কি দেখছিস ভূতনাথ?

ভূতনাথ বললে–তোমার লজ্জা করছে না—-ছিঃ!

বৌঠান–হেসে উঠলো খিল খিল করে। হাসির দমকে সমস্ত শরীর যেন উথলে উঠতে লাগলো। তারপর থেমে বললে—লজ্জা! লজ্জা করবো কোন দুঃখে শুনি–আমার মতন কে এত সুখী বলতে পারিস, আমার মতো রূপসী কেউ আছে, আমার মতো এত বড় লোকের বাড়ির বউ-ছোটকর্তার মতো স্বামী—যা এ বংশে কেউ কখনও করেনি, ছোটকর্তা আমার জন্যে তাই করেছে জানিস। ছোটকর্তা রাত্তিরে বাড়িতে শোয়-আমার মতো সুখী কে লজ্জা করবো কোন্ দুঃখে রে? হিংসেয় তোদের বুক ফেটে যাচ্ছেবুঝতে পারছি।

ভূতনাথ চুপ করে রইল। মনে হলো—বৌঠান যেন তার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

একটু থেমে বৌঠান আবার বলতে লাগলো—ছোটকর্তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম—তুমি সুখী হয়েছে তো? ছোটকর্তা কি বললে জানিস—বললে…

-কী বললে?

—বললে—আমার কথা থাক, তুমি সুখী হয়েছে? তুমি যা চেয়েছিলে পেয়েছে তো?

আমি বললুম—তোমার সুখেই আমার সুখ, আমার আলাদা সুখ বলে কিছু নেই, স্বামীর সুখেই স্ত্রী সুখী—কিন্তু তুমি? তুমি কি সুখী হওনি? আমি কি পারি নি তোমায় সুখী করতে? তুমি যে বলেছিলে—আনন্দ দিতে পারে বাগানবাড়ির মেয়েরা, ওরা কায়দা-কানুন জানে। আমি যে বড় গলায় বলেছিলুম—আমি পারবে, তোমার জন্যে সব করতে পারবে—তুমিই বলো তো আমি কি পেরেছি? ছোটকর্তা হাসতে লাগলো। রাত তখন শেষ হয়ে আসছে। আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তখন ছোটকর্তা। মাথার চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আবার বললুম—উত্তর দিচ্ছে না যে—কথা বলে?

ছোটকর্তা অনেকক্ষণ কি ভাবলে। বললে—মন্ত্রে বিশ্বাস করে। তুমি ছোটবউ?

বললুম—তুমি কী যে বলো-মন্ত্রে যদি পৃথিবীতে কেউ একজন বিশ্বাস করে তো সে আমি। আজ যে তোমাকে বুকে পেয়েছি সে তো মন্ত্রের জোরে। আমার এই মুখের দিকে চেয়ে দেখো তো—দেখো চেয়ে।

ছোটকর্তার চিবুকটা ধরে আমার দিকে ফেরালুম। বললুমকী দেখছো বলো তো?

-কই কিছু না।

—কপালে কী দেখছো আমার?

—কপালে? কিছুই দেখছি না তো?

—সিঁদুর দেখতে পাচ্ছে না?

—হ্যাঁ, সিঁদুরের টিপ দেখছি।

-ওই তো মন্ত্র, মন্ত্রপড়া সিঁদুর, ‘মোহিনী-সিঁদুর’, ওই সিঁদুরের জোরেই তোমায় ফিরিয়ে পেয়েছি—এই যে তুমি আমার কাছে রয়েছে—এ ওরই জন্যে।

কথাটা শুনে ছোটকর্তা হাসতে লাগলো। হাসলে ছোটকর্তাকে খুব ভালো দেখায়। কখনও তো আগে হাসি দেখিনি। বললাম-হাসছো যে।

ছোটকর্তা বললে—আমি ও মন্ত্রের কথা বলছি না। ও তো বুজরুকি–পয়সা নেবার ফিকির—আমি বলছি অন্য মন্ত্রের কথা, মনে আছে বিয়ের সময় রূপলাল ঠাকুর মন্ত্র পড়িয়েছিল—তোমার হয় তো মনে নেই ছোটবউ, তোমার তখন বোধ হয় দশ বছর বয়েস। সে মন্ত্রের মানেও তখন বুঝিনি—তবু যেটুকু মানে বুঝেছি তাতে তোমার ওপর আমি অন্যায় করেছি ছোটবউ।

মুখটা চাপা দিয়ে দিলাম হাত দিয়ে। বললাম—তুমি কিছু অন্যায় করোনি গো, সে আমার কপালের দুর্ভোগ—তুমি কী করবে।

ছোটকর্তা বললেন ছোটবউ-আমি অন্যায়ই করেছি তোমায় আমি যে মদ ধরিয়েছি।

সারারাত দুজনে তখন অনেক মদ খেয়েছি, তবু দেখলাম ছোটকর্তার জ্ঞান রয়েছে খুব। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম-ও আমি যেদিন তুমি বলবে সেইদিনই ছেড়ে দেবোতোমার ভালো লাগে বলেই তত খাই।

ছোটকর্তা বললে—না ছোটবউ, আমি দেখছি তোমার নেশা পরে গিয়েছে।

কথাটা বলেই ছোটকর্তা চোখ বুজলো। চেয়ে দেখি, দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। জানিস ভূতনাথ, মানুষটাকে এতদিন আমরা কেবল ভুল বুঝেছি। আসলে বড়বাড়িতে কেউ ওকে বুঝলে না, তাই কাউকেই ও বুঝতে চায় না। ওই তো মেজভাসুর রয়েছেন, তার তো একটা নেশা নয়, দশ রকমের নেশা নিয়ে কাটাচ্ছেন, কিন্তু ছোটকর্তার শুধু জানবাজার, আসলে জানবাজারের চুনীদাসীর ওপর ওর নেশা নয়, ওর নেশাটা বাইরের জিনিষ, ও ভারী অভিমানী, তাই অভিমান করে নেশায় ড়ুবিয়ে রাখে নিজেকে। দেখেছি তো-বাড়িতেও খুব যে মদ খায় তা নয়, বরং আমাকেই খাওয়ায় বেশি—আদর করলে গলে যায়, ভালোবাসা পেলে কৃতার্থ হয়।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু বৌঠান সত্যি সত্যিই যদি তোমার নেশা ধরে যায়?

বৌঠান বললে—ওটা নেশা নয় ভূতনাথ, তুই খেয়ে দেখ, তুইও বুঝবি, কেমন যেন একটা আমেজ আসে, সে-সময়ে মনে হয় সকলকে বুঝি ক্ষমা করতে পারি, সকলকে ভালোবাসতে পারি, কাবোর খারাপটা আর চোখে পড়ে না। আমার যোদাদুলাল আমার ছোটকর্তা সব তখন একাকার হয়ে যায়—তোকেও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে তখন।

ভূতনাথ বললে কিন্তু এমন করলে—আমার আর এ-বাড়িতে বেশিদিন থাকা চলবে না।

বৌঠানের মুখের ভাব হঠাৎ বদলে গেল।–কেন?

–সবাই বলাবলি করে তোমার সঙ্গে আমার নাকি খুব মাখামাখি, তুমি আমাকে জামা-জুতো-কাপড় কিনে দিয়েছে, বিধু সরকার তত খোরাকির খাতা থেকে আমার নাম কেটেই দিয়েছিল—তুমিই জোর করে…

–বলে নাকি? বৌঠান বসে বসেই যেন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগলো। তারপর সেইভাবে ঝুঁকে পড়ে ভূতনাথের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল, খানিকক্ষণ। তারপর আর একটু হলেই যেন পালঙ থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতো।

হঠাৎ ঠিক সময়ে ভূতনাথ খপ করে ধরে ফেলেছে বৌঠানকে। বললে—এখনি কি সর্বনাশ হতো বলে দিকিনি বৌঠান।

—হাত ছাড়, গায়ে হাত দিসনে বলে বৌঠান নিজের কাপড় সামলে নেবার চেষ্টা করলে একবার।—যা, বেয়রা এখন তুই—বলে বৌঠান আবার বোতল উপুড় করে গেলাশে ঢালতে গেল।

ভূতনাথ বললে—আবার খাবে নাকি তুমি ওই—

—যদি খাই, তোর কি?

ভূতনাথ সামনে সরে এগিয়ে দাঁড়ালো। বললে—আর খেতে পাবে না তুমি!

—জোর নাকি?

-হ্যাঁ জোর, ছোটকর্তার সামনে যা করো। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিনে, কিন্তু আমার সামনে আর খেতে পাবে না-বলে ভূতনাথ জোর করে বোতলটা বৌঠানের হাত থেকে কেড়ে নিতে গিয়েই পিছলে পড়ে গেল মেঝের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝন ঝন শব্দে চুরমার হয়ে গিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে গেল কাচের টুকরো। সমস্ত ঘরময় মদের স্রোতে সব ভিজে গেল। কাচের টুকরো লেগে ভূতনাথের হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে তখন। অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ সেই মুহূর্তে।

কিন্তু আর এক কাণ্ড করে বসলো পটেশ্বরী বৌঠান।

হঠাৎ-কী যে হলো কে জানে—খিল খিল করে সশব্দে হেসে উঠলো বৌঠান। সে-হাসি আর থামতে চায় না। ঘর ফাটানো সে-হাসি। হাসতে হাসতে বৌঠানের যেন দম আটকে আসবে। বোতল ভাঙার শব্দের সঙ্গে বৌঠানের হাসির শব্দ যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল সে-রাত্রে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *