বনমালী সরকার লেন-এর বড়বাড়ির সামনে আসতেই ব্রিজ সিং দেখতে পেয়ে ডাকলে—এ শালাবাবু, এ শালাবাবু—এ–
ভূতনাথ প্রথমটায় অবাক হয়ে গেল। তাকে হঠাৎ ডাকে কেন? তারপর বললে—কী দারোয়ান?
–আরে আপনাকে ছুটুকবাবু ডাকিয়েছেন–
ভূতনাথ আরো অবাক হয়ে গেল। ছুটুকবাবু তাকে ডাকবেন কেন! ব্ৰজরাখাল কিছু জানে নাকি। ছুটুকবাবু তাকে চিনলেই বা কী করে! বড়বাড়িতে কে-ই বা তাকে চেনে। সবার অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে রোজ বাড়িতে এসে ঢোকে সে——আবার সকালবেলা নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় চাকরি করতে। কারুর সঙ্গে পরিচয় বা আলাপ করবার সাহসও হয় না তার। বংশী অবশ্য আসে মাঝে মাঝে। নিজের সমস্যা নিয়ে সে বিব্রত। তার কাছেই এ-বাড়ির সকলের নাম শুনেছে সে। স্নান করতে গিয়ে ভিস্তিখানার মধ্যে অন্য চাকর-বাকরদের সঙ্গে কথাবার্তা কয়েছে একটু কিন্তু সে সামান্যই।
ওই ভিস্তিখানার পাশ দিয়ে যেতেই একদিন লোচন ধরেছিল। খোঁচা খোঁচা কদমফুলের মতো দাড়ি। গলায় দু’ সারি কণ্ঠী। একটা চোখ বোধ হয় ট্যারা। বুড়ো মানুষ বটে।
তখন আপিস যাবার তাড়া ছিল। কোনোরকমে একটুখানি জল নিয়ে স্নান সেরে হাঁটা দিতে হবে। কিন্তু ভিস্তিখানায় তখন জল নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। জল তুলছে শ্যামসুন্দর। সকাল বেলায় এ-বাড়িতে বিশেষ তাড়াহুড়ো থাকে না। কর্তারা বেলা করে ওঠেন। তাই বেলাতেই কাজের চাপ।
লোচন ডেকে বসিয়েছিল বেঞ্চিতে। বললে—অধীনের নাম লোচন দাস–
চারিদিকে হুঁকো গড়গড়া ফরসি আর তামাকের বোয়েম। দেয়ালের গায়ে সার সার নল ঝুলছে। লাল নীল রেশমের সিস্কের জরির কাজ করা সব। হুঁকোর নলের মধ্যে শিক পুরে দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে।
শিক চালাতে চালাতে লোচন বললে—তামাক ইচ্ছে করবেন নাকি শালাবাবু
এ-বাড়িতে শালাবাবু নামেই ভূতনাথকে সবাই চেনে। আর সুবিনয়বাবুর বাড়িতে সে কেরানীবাবু।
ভূতনাথ বললে—তামাক খাইনে তো আমি–
কথাটা শুনে লোচন মনোযোগ সহকারে ভূতনাথের দিকে চেয়ে দেখলে খানিকক্ষণ, তারপর বললে-কিন্তুক এই তো তামাক ধরবার বয়েস আপনার—এবার ধরে ফেলুন আজ্ঞে—আর দেরি করবেন না
ভূতনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। ভূষণ কাকা তামাক খেতে খুব। রাধার বাবা নন্দজ্যাঠাও তামাক খেতেন। তাছাড়া বারোয়ারি ক্লাবের যাত্রার দলে ছোট বড় সবাই কম বেশি তামাক খেতে। কেউ সামনে—কেউ বা লুকিয়ে। মল্লিকদের তারাপদ খেতে ‘বার্ডস-আই’। একবার যাত্রাঘরের প্রায়-নিভন্ত হুঁকোতে টানও দিয়েছিল ভূতনাথ। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিল তখনি। বাইরে রসিক মাস্টার আসছিল। ঘরে ঢুকতেই বললে—কাশে কে—
তারপর ভূতনাথকে দেখে বললেও, নতুন খাচ্ছো বুঝি ছোকরা—তা প্রথম প্রথম অমন হবেই তো-একটু জল খাওহেঁচকি উঠবে না–
সেই হেঁচকির চোটে আর খাওয়া হলো না তামাক। তারপর কলকাতায় এসে ব্ৰজরাখালের সঙ্গেই কাটলো দিনরাত। শহরের আশে পাশে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে ব্ৰজরাখাল। তার ওসব নেশা-টেশার বালাই নেই। আর সুবিনয়বাবু ঘোর ব্রাহ্ম। তার বাড়িতে ও-পাটই নেই। ফলাহারী পাঠকরা বিড়ি খায়—তাও কারখানার ভেতরে বসে নয়। রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে খেয়ে আসে।
লোচন বললে-তেল মাখার পরেই তামাকটা জমে কি না— দিই সেজে—বলে সত্যি সত্যিই সাজতে লাগলো লোচন। বললে –মেজকত্তা যেটা ভাত খাবার আগে খান—সেই তামাকটা দিই আপনাকে—দেখবেন খিদে হবে—রাত্তিরে ঘুম হবে ভালো।
ভূতনাথ বললে—না লোচন, তামাক আমাকে ধরিও না— গরীব লোক, শেষকালে—
লোচন বললে–পয়সা খরচ আপনার কিসে হচ্ছে—এই তো ভৈরববাবু খান–বাড়িতে তামাকের পাট রাখেননি—আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছি—দিনে একটি করে পয়সা দেন, যতবার খুশি খেয়ে যান—ওঁর ডাবা হুঁকো আমি কাউকে ছুঁতে দিইনে—
লোচন বেশ চুরিয়ে চুরিয়ে তামাক সাজতে সাজতে বললে— এ-বাড়িতে কোনো জিনিষের তো আর হিসেব নেই—ছত্রিশ রকমের নেশা বাবুদের-তারি মধ্যে যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন ওই তামাকটাই যা খান—ওই যে ছুটুকবাবুকে দেখেছেন তো–
ভূতনাথ বললে—দেখেছি বৈ কি-ওই যে গানের আসর বসান–
—আজ্ঞে, ওই ছুটুকবাবুকে তো আমিই ধরিয়েছি—হালের ছোকরা মানুষ—তামাকের চেয়ে সিগারেটের দিকেই ঝোক বেশি, দশ পয়সায় এক কৌটো সিগারেট হয়—আর বাহারও খোলে চেহারার—আমি একদিন বড়মাকে গিয়ে বললাম—খোকাবাবুর বয়েস হচ্ছে, এবার তামাক ধরিয়ে দেই—
তা বড়মা বললেন—তামাক ধরাবি খোকাবাবুকে তা আমার অনুমতি কেন–
বড়মা আমার ভারি রাশভারি মানুষ, বিধবা হয়েছেন ওই খোকাবাবু হবার পরকারো সাতে পাঁচে থাকেন না, চেহারা নয় তো, যেন সাক্ষাৎ ভগবতী।
আমি হেসে বললাম—তা কি হয় বড়মা, যদ্দিন আপনি বেঁচে আছেন তদ্দিন আপনার হুকুম না মেনে কি কিছু করতে পারিশেষকালে অধমকে অপরাধী করবেন আপনারা সবাই
লোচন বলতে লাগলো তারপর থেকে খোলাখুলি হুঁকোর ব্যবস্থা করে ফেললাম, খাজাঞ্চীখানায় গিয়ে সরকারবাবুকে ধরলুম, বড়মা’র হুকুম পেয়েছি—আর কার তোয়াক্কা–চিৎপুরের নতুন বাজার থেকে রূপোর গড়গড়া, ফরসি সব এল—ভসচায্যি মশাইকে দিয়ে দিনক্ষণ দেখিয়ে হাতে নল ধরিয়ে দিলুম-কলকেয় ফুঁ দিতে দিতে লোচন বললে—গোলাপ জল দিয়ে কাশীর কলকেয় বেশ করে তাওয়া দিয়ে বালাখানা তামাক সেজেছিলুম, ছুটুকবাবু খেয়ে এক গাল হাসি, ভারি খুশি হয়েছিলেন, একটু কাশি নয়, হেঁচকি নয়—বললে বিশ্বেস করবেন না, নগদ এক টাকা আমায় বকশিস করে ফেললেন, আর সরকারবাবুকে বলে দিলেন আমার নামে একটা গামছার খরচা খাতায় লিখতে
তারপর একটা কড়ি বাঁধা ডাবা হুঁকোয় কলকে বসিয়ে ভূতনাথের দিকে এগিয়ে দিলে। বললে—এটা বামুনের হুঁকোতারকবাবু মতিবাবু সব এতেই খান–
ভূতনাথ বললে—কেন মিছিমিছি পেড়াপীড়ি করছে লোচন, আমি ও খাইনে—
—এ কেমনধারা কথা হলো আজ্ঞে?
লোচন যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে এল। তারপর যেন একটা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করতে পেরেছে এমনি ভাবে বললে মরুকগে তা না হয় আপনি একটা করে আধলাই দেবেন রোজ, আমি তো রইলাম, রোজ এসে খেয়ে যাবেন যখন ইচ্ছে হয়–এই যে আজ দেখছেন এ-বাড়িতে সকলের মুখে মুখে হুঁকো, এ কেবল এই অধমের জন্যেই, নইলে কবে উঠে যেতে এ-বাড়ি থেকে তামাক খাওয়ার পাট-আর তামাক খাওয়াই যদি উঠে যায় তো এ অধমের চাকরি কিসে থাকে বলুন তোএতদিন ধরে তামাক সেজে সেজে, এখন বুড়ো বয়সে তো আর ঘর ঝাঁট দেওয়া কাপড় কুঁচোনো কি মোসায়েবি করা পোষাবে না—
ভূতনাথ বললে—তা এতদিন ধরে তুমি এই কাজ করছে, এখন কি আর তা বলে তোমার জবাব হয়ে যাবে রাতারাতি
—তা হুজুর সবই সম্ভব, এই দেখুন না বাবুরা শুনছি মটর গাড়ি কিনবে, তা কিনলে ইব্রাহিম মিয়ার চাকরি কি আর থাকবে, আগে এই বাড়িতেই ছোটবেলায় দেখেছি পাঁচখানা পাল্কি, এখন যেখানে দাসু জমাদারের ঘর দেখছেন ওইখানে থাকতে পাল্কি-বেহারারা, কোথায় সব চলে গেল—এখন চুরুট সিগারেট যদি বাবুরা ধরে তা হলে গড়গড়া হুঁকো কে আর খাবে বলুন-–
লোচন আরো বলতে লাগলোবাবু এই বয়েসে কত দেখলুম —ঘোড়ার টেরাম ছিল—এখন কলের টেরাম হলো—তারপর কলের গাড়িও হবে—তা আর ভেবেই বা কী হবে, একদিন হয় তো হুঁকো কেউ খেতেই চাইবে না, তখন…কিন্তু তার আগেই যেন যেতে পারি বাবু—নিন—ধরুন, গুলের আগুন কি না—গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে—তাহলে ওই কথাই রইলো, আপনি একটা করে আধলা-ই দেবেন—
কিন্তু ভূতনাথকে নিতে হলো না। বাধা পড়লো।
—এই যে ভৈরববাবু এসে গিয়েছেন।
লোচন তাড়াতাড়ি ভৈরবাবুর হুঁকো তৈরি করতে ভেতরে গেল। ভূতনাথ চেয়ে দেখলে—বাবু বটে ভৈরববাবু! ঢেউখেলানো বাড়ি চুল, বাঁকা সিঁথি, পরনে ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি, গায়ে চকচকে বেনিয়ান, গলায় মিহি চুনোট করা উড়নি, পায়ে বগলস আঁটা চিনে-বাড়ির জুতো
লোচন হুঁকো বাড়িয়ে দিয়ে বললে—আজ যে এত সকালসকাল ভৈরববাবু?
—আজ যে ছেনি দত্তর সঙ্গে পায়রার লড়াই আছে রে— শুনিসনি তুই—মেজবাবু সেবার হেরে গিয়েছিল না, এবার পশ্চিম থেকে নতুন পায়রা এসেছে-ছেনি দত্তর গুমোর ভাঙবো এবার, ভালো গমের দানা খাওয়ানো হচ্ছে তো ওই জন্যে—এবার দেখৰি ছেনি দত্তর পায়রা তিনবার চক্কর খেয়েই বোম্-এ বসে পড়বে— মেজবাবুর সঙ্গে টেক্কা দিতে এসেছে ঠঠনের দত্তরা—
খানিক ভুড়ক ভুড়ক করে হুঁকো টানতে লাগলো ভৈরববাবু—
লোচন বললে-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো হুজুর–
—বল না–
—শুনেছি ছেনিবাবু নাকি হাটখোলায় তেনার মেয়েমানুষকে পাকাবাড়ি করে দিয়েছে—
–শুনছিস ঠিকই লোচন, কিন্তু সে-বাড়ি তিন-তিনবার মর্টগেজ হয়ে এখন সে-বাড়ি মায় মেয়েমানুষ মল্লিকদের হাতে গিয়ে পড়েছে—সে খবর রাখিস–মাগগি গণ্ডার বাজারে মেয়েমানুষ পোষা ছেনি দত্তর কম্ম নয়—আর এদিকে আমাদের চুঁচড়োর বাগানে গিয়েছিলি নাকি এদানি?
—আজ্ঞে না।
—গিয়ে একদিন দেখে আসিস লোচন, খড়দা’র রামলীলার মেলায় সেদিন তিনটে মেয়েমানুষকেই নিয়ে গিয়েছিল মেজবাবু, দূর থেকে ছেনি দত্ত আড় চোখে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছিল— মেজবাবু বারণ করলো, নইলে শালাকে…
হঠাৎ এতক্ষণে ভূতনাথের দিকে নজর পড়তেই জিজ্ঞেস করলো —এ কে রে লোচন?
—আজ্ঞে উনি আমাদের মাস্টারবাবুর শালা, এখানেই থাকেন।
ভৈরববাবু তামাক খাওয়া বন্ধ করে বললে-তাই নাকি? কী নাম তোমার ছোকরা?
ভূতনাথ বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে—আমার নাম শ্ৰীভূতনাথ চক্রবর্তী।
—দেশ কোথায়?
–নদেয়—ফতেপুর গাঁ।
–কী করা হয় এখানে?
–‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরি করি।
–কত বেতন পাও?
–সাত টাকা আর একবেলা খাওয়া।
—আর উপরি, উপরি কত…উপরি নেই? চলা শক্ত, নেশাটাআশটা করতে গেলে একটু টেনে-বুনে চলতে হবে ভাই—আগে সস্তা-গণ্ডার দিন ছিল, আগের কালে তুই বললে বিশ্বাস করবিনি লোচন, ওই এক পাটের দাম ছিল চার আনা,—ওই গাঁজাই বল আর চরস-ই বল সব জিনিষের দাম কেবল বেড়েই চলেছে—এমন করে দিন দিন জিনিষের দাম বাড়লে কী খেয়ে মানুষ বাঁচে বল—
লোচন বললে–উনি তামাকই খান না—তায় আবার বোতলের কথা বলছেন—
ভৈরববাবু বললে—তা তামাক খাও আর না-খাও ভাইপাড়াগাঁ থেকে নতুন এসেছো, বড় ভাই-এর মতো ভালো কথা বলছি ওটি খাবেনইলে এ লোনা হাওয়ার দেশ এমন পেট ছাড়বে— তখন…বলে ভৈরববাবু আবার টান দিলে হুঁকোয়। তারপর থেমে বললে-বিশ্বেস হচ্ছে না বুঝি ভাই। মেজবাবু তো লেখা-পড়াজানা লোক, মেজবাবু তো আর মিথ্যে বলবে না। তা ওই মেজবাবুর কাছেই শুনেছি, সেকালের মস্ত বড় একজন বাবু রামমোহন রায় খেতো আর সকলকে ডেকে ডেকে খাওয়াতো। রাজনারায়ণ বোস খেতো, মাইকেল মধুসূদন খেতে। তাছাড়া রামমোহন রায় তো ছিল মাল খাওয়া শেখাবার গুরু রে। তারপর এক টান টেনে ভৈরববাবু বললে—এই এখন তো আমার এই চেহারা দেখছিস, আগে ছিল প্যাকাটির মতন, মেজবাবু বললেন—নোনা লেগেছে—মাল খেতে হবে। মেজবাবুর কথায় খেতে শুরু করলুম—শেষে নীলু কবিরাজের সালসায় যা হয়নি, মাল খেয়ে তাই হলো, এখন যা খাই দিব্যি হজম হয়ে যায়। জিনিষটা যদি খারাপই হতো তো সাহেব বেটারা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এখানে এসে আর রাজত্ব করতে পারে?
কথাটা ভাববার মতন। না বিশ্বাস করে উপায় নেই।
তারপর ভৈরববাবু বললে—একবার চুপি চুপি খবরটা নাও তো লোচন মেজবাবুর ঘুম ভাঙলো কিনা। তারপর পকেট থেকে বার করলে একটা তামার পয়সা। বললে—নাও তোমার মামুলি নাও।
লোচন পয়সাটা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজলো।
সেদিন ওই পর্যন্ত। এ-বাড়ির হাল চাল দেখে ভূতনাথ এখন আর অবাক হয় না। রবিবার দিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসের ছুটি। ব্রজরাখাল সেদিন সকাল-সকাল বেরিয়ে যায়—বরানগরের বাগানে। ঠাকুরের চেলারা ওখানে থাকে। সারাদিন কী করে সেখানে, তারপর আসে সেই অনেক রাত্রে।
মেজবাবুকে এক-এক রবিবার দেখা যায়। গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়ায় ইব্রাহিম মিয়া গাড়ি নিয়ে। আরো দুখানা গাড়িতে থাকে মেজবাবুর মোসাহেবের দল। সকলেরই চুনোট করা উড়নি। বাঁকা সিঁথি, বাবড়ি চুল। ইব্রাহিমের গাড়ির ভেতর মেজবাবুর মেয়েমানুষ। ভালো করে দেখা যায় না। ফরসা টুকটুকে চেহারা। ঘোমটা খোলা। নাকে নাকছাবি। পানের ডিবে হাতে নিয়ে নামে এক-একদিন।
মেজবাবুর চাকর বেণী বলে—শালাবাবু সরে যান এখেন থেকে—বাবু দেখতে পেলে রাগ করবে।
সদলবলে চলে যায় সবাই। কখনও বাগানবাড়িতে। কখনও গঙ্গায় নৌকো-ভ্রমণে। কখনও খড়দা’র মেলায়। সঙ্গে থাকে ড়ুগি তবলা, ঘুঙুর। মেঝের ওপর শোয়ানো থাকে নাকি সার সার বোতল। খাবারের চাঙারি গাড়ির মাথায়।
বেণী বলে—ওই যে কমবয়সী মেয়েমানুষটা দেখলেন, ও যা নাচে–
কমবয়সী মেয়েমানুষটার নাম হাসিনী। হাসিনী নাকি যেমন নাচে তেমনি গায়। ওর মা এসেছিল কাশী থেকে একবার দোলের সময় এ-বাড়িতে গান গাইতে। সঙ্গে এসেছিল হাসিনী। তখন হাসিনীর বয়স আট কি দশ। মেজবাবুর ভারি ভালো লাগলো দেখে। মা আর মেয়েকে আর ফিরে যেতে হলো না কাশীতে। এখানে বাড়ি ভাড়া করে দিলেন। আসবাবপত্র চাকর দারোয়ান বহাল হলো। তারপর হাসিনী বড় হলে, বুড়ী মা গেল মরে। এখন হাসিনী মেজবাবুর সম্পত্তি।
প্রথমে ছিল একজন। তারপর একজন বেড়ে হলো দুই। এখন তিনজন। মেজবাবুর বাবুয়ানি দেখে কলকাতার বাবু-সমাজের তাক লেগে গিয়েছে।
ভূতনাথ বললে-মেজগিন্নী এসব জানেন তো?
বেণী বলে–মেজমা বড় ঘরের মেয়ে-ওসব গা-সওয়া। মেজবাবুর শ্বশুর এখন বুড়ো থুত্থুড়ো, তবু এখনও রবিবার রাতটা বাড়িতে কাটান না, বাঁধা মেয়েমানুষ আছে তার। মেজমা তাকে রাঙামা বলে ডাকে। এ-বাড়ি থেকে পূজোর নেমন্তন্ন গেলে রাঙামা’র বাড়িতেও খবর দিতে হবে—তত্ত্ব এলে দু’বাড়ি থেকেই আসে। সেবার মেজমা’র অসুখ হলো—রাঙামা নিজে এসে সাতদিন সাত রাত্তির সেবা করলে। কারো নিজের মা-ও অমন সেবা করতে পারে না। আহা, সাক্ষাৎ সতীলক্ষ্মী, যেমন রূপ…তেমনি…এদানি তত মেজবাবু তবু যা হোক রাত্তিরে বাড়ি ফেরেন—আর আগে?
আগেকার ব্যাপার ভূতনাথের জানবার কথা নয়।
-আগে সেখানেই পড়ে থাকতেন যে। খাজাঞ্চীবাবু আমার হাতে দপ্তরের কাগজপত্তর দিতেন, আমি সেই মেজবাবুর মেয়েমানুষের বাড়ি থেকে সই সাবুদ করে নিয়ে আসতুম। মদ খেলে মেজবাবুর আর জ্ঞান থাকতো না কিনা, কাপড় সামলাতে পারতেন না। আমি গেলেই জুতো পেটা করতেন। ও ছাই ভস্ম খেলে কি আর জ্ঞান গম্যি থাকে মানষের? আমি হাসতুম—কিন্তু মাঠাকরুণ খুব বকুনি দিতেন। বলতেন—নেশা করেছে বলে কি একেবারে বেহেড হয়ে গিয়েছে। তুই কিছু মনে করিসনে বাবা, এই চার আনা পয়সা নেমেঠাঁই কিনে খাস।
বেণী বলে—ওই যে পানের ডিবে হাতে বুড়োপানা মেয়েমানুষকে দেখলেন—ওই হলো বড়মাঠাকরুণ। মেজবাবু ওঁকে ভারি ভয় করেন। বড়মাঠাকরুণ যদি বলেন মদ খাওয়া বন্ধ—তো বন্ধ। মেজমাঠাকরুণ বলুন আর ছোটমাঠাকরুণই বলুন—বড়মাঠাকরুণ একবার ‘না’ বললে কারু সাদ্যি নেই মেজবাবুকে দিয়ে হাঁ বলায়।
রবিবার মোসাহেব আর মেয়েমানুষের দল নিয়ে মেজবাবু চলে গেলেন। হয় তো গঙ্গার ওপর পানসিতে বসে খানা-পিনা হবে। বড়মাঠাকরুণ নিজে মেপে মেপে মদ ঢেলে দেবেন। তার নিজের পূজো-আর্চা ব্রত-পার্বণ আছে। সব সময় তিনি দলে যোগ দেন না। বড়মাঠাকরুণ পূর্ণিমে-অমাবস্যা তিথি-নক্ষত্র দেখে চলেন। ভারি বিচার সব বিষয়ে। বাসি কাপড়ে মদ খান না। কাচা কাপড় পরে ঠাকুরঘরে ঢোকেন। কালীবাড়িতে বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজো পাঠিয়ে দেন পাণ্ডার হাতে।
আর মেজমা?
বেণী বলে—আর মেজমাকে দেখে আসুন গিয়ে। তেতলায় পালঙে বসে সিন্ধুর সঙ্গে বাঘ-বন্দী খেলছেন—নতুন নতুন গয়না গড়াচ্ছেন, একবার গোটছড়া ভেঙে বিছে হার হচ্ছে, বিছে হার পুরোনো হলে অনন্ত হচ্ছে, অনন্তও পুরোনো হয়ে গেলে চূড় হচ্ছে। হয় তো এবার পূজোয় হলো কমল হীরের নাকছাবি, আবার কালীপূজোয় হবে চুণী বসানো কান-ফুল, মুক্তোর চিক নয় তো পান্না বসানো লকেটওয়ালা চন্দ্রহার।
মেজবাবুর গাড়ি চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ভূতনাথ চুপ চাপ সেইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে। পিসীমা’র কথা মনে পড়ে যায়। পিসীমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঁচ টাকা মনি-অর্ডার আসতে। ওই টাকাতেই মাস চলবে। ওই পাঁচটা টাকার জন্যেই পিসীমা’র কত ভাবনা। গাজনার পোস্টাপিসে ভূতনাথ হয় তো গিয়ে দেখলে মাস্টারবাবু নেই। শোনা গেল, পোস্টমাস্টারবাবুর অসুখ। বলে পাঠিয়েছে—আজ আর উঠতে পারছিনে—কাল এসো।
পোস্টমাস্টারবাবু বুড়ো মানুষ। এক-একদিন হয় তো গরুর জাব দিচ্ছে। বলে পাঠিয়েছে-এবেলা আর হবে না, বড় কাজে ব্যস্ত আছি, ওবেলা সকাল-সকাল এসো হে।
ওবেলা যেতে মাস্টারবাবু হয় তো বললে—গায়ে তো যাচ্ছে, তা গায়ের চিঠিগুলো নিয়ে যাও না সঙ্গে। পিওন আর আজকে ওদিকে যেতে পারবে না, গঞ্জের হাটে পাঠিয়েছি তাকে।
ছোটো একটা বাক্সর মধ্যে সেই পাঁচটি টাকা রেখে একটি করে গুণে গুণে পয়সা খরচ করতে পিসীমা। ভূতনাথ মাঝে মাঝে চাইতে–একটা আধলা দাও না পিসীমা।
আধলা পিসীমা দিতো না। বলতে—রইল তত তোরই জন্যে—আমি মরে গেলে তুই-ই নিস।
কিন্তু সে পয়সা-কড়ি পিসীমা’র অসুখেই সব খরচ হয়ে গেল। তা তার জন্য আর কি থাকবে?
আর এ-বাড়িতে কোথায় কেমন করে কে পয়সা উপায় করে কে জানে। বাবুরা ঘুম থেকেই ওঠে দুপুর একটার সময়। আপিসেও কেউ যায় না। ব্যবসাও কেউ করে না। অথচ এতগুলো লোক—সব বসে বসে খাচ্ছে।