কাহিনী
ফতেপুর গ্রাম থেকে তিন ক্রোশ পথ হেঁটে তবে মাজদিয়া ইস্টিশান। সেই ইস্টিশানে ট্রেন ধরে একদিন এসেছিল ভূতনাথ এই কলকাতায়।
শেয়ালদা ইস্টিশানের চেহারা, লোকজন, চিৎকার আর বাইরের দৃশ্য দেখে হা হয়ে গেল ভূতনাথ। কোথায় এসে পড়েছে সে। কুলিদের টানাটানি বাঁচিয়ে কোনওরকমে বাইরে এসে দাঁড়ালো। দুটো টাকা ছিল পকেটে–সে দুটো পুরে নিলো ট্যাঁকে। ব্ৰজরাখাল বলেছিল—খুব সাবধান, পকেটে টাকাকড়ি থাকলে সে আর দেখতে হবে না-কলকাতা শহর তোমার ফতেপুর নয় যে…
কলকাতা শহর যে ফতেপুর নয় তা ভূতনাথ জানতো। মল্লিকদের তারাপদ সেবার বারোয়ারি পার্টির যাত্রার নাটকের বই কিনতে এসেছিল কলকাতায়। ‘হরিশ্চন্দ্র’ পালার বই। তার কাছেই শোনা। বললে—ওই যে দেখছে মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছ—ওই টিপ-চালতে গাছের হাজার-ডবল উঁচু সব বাড়ি, বুঝলে কাকা—সেই উঁচু বাড়ির মাথায় দেখি না মেয়েমানুষরা দিব্যি আরামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে—
ভূষণ কাকার বয়স হয়েছে। প্রচুর টাকার মালিক। তবু কলকাতায় যায়নি কখনও। যাবার প্রয়োজনও হয়নি। কাকা বললে—মাথায় ঘোমটা-টোমটা কিছু নেই।
তারাপদ বললে–ঘোমটা দেবে কেন শুনি—কোন্ দুঃখে ভালো করে কি ছাই দেখতে পাচ্ছে কেউ তাদের—আমি রাস্তা থেকে দেখছি ঠিক যেন এই একটা য়্যাট্টুক কড়ে আঙুলের মতো–
ভূষণ কাকা বললো রে শুনেছি নাকি কলকাতায় আজকাল বিয়ে-অলা মেয়েরা সিঁদুর পরে না—ঘোমটা খুলে সোয়ামীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে হাওয়া খেতে যায়, শ্বশুর-ভাসুরের সামনে সোয়ামীর সঙ্গে কথা বলে—
মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা কাকা-তারাপদ মাথা নাড়তে লাগলো।—তা হতে পারে না—আমি যে নিজের চোখে সমস্ত দেখে এলাম কাকা—ধরে না কেন সকালবেলা নামলাম তো ট্রেন থেকে—আর সন্ধ্যেবেলা আবার ট্রেন ধরলামকলকাতার কিছু দেখতে তো আর বাকি রাখিনি কাকা-রানাঘাট থেকে পাউরুটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম—আর মাজদের রসগোল্লা-পেটটি পুরে তাই খেয়ে নিয়ে সব খুটে খুটে দেখলাম ঘোড়ার ট্রাম গাড়ি দেখলাম—কী জোরে যায় যে কাকা–সামনে আসতে দেখলে বুকটা দুর দুর করে ওঠে।
—কেন, বুক দুর দুর করে কেন?—জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ। জবাব দিয়েছিল ভূষণ কাকা। বলেছিল—তুই থাম তত ভূতে—বোকার মতো কথা বলিস নে–লোকে হাসবে।
ভূতনাথ সত্যি সত্যি আর কথা বলেনি। চুপ-চাপ শুনে গিয়েছিল।
তারাপদ বলেছিল-আমার একবার ইচ্ছে করে কাকা ভূতোকে দিই ছেড়ে গিয়ে কলকাতার রাস্তায়ও ঠিক হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলবে—দেখো–
ভূষণ কাকাও যেন বিজ্ঞের মতো জবাব দিয়েছিল—তা তো বটেই—এ কি আর ছিন্নাথপুরের গাজনের মেলা যে, রাত হয়ে গেলে ভাবনা নেই—কেষ্ট ময়রার দোকানের মাচায় দুটো চিড়ে মুড়কি চিবিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মল্লিকদের বাড়ির তারাপদর কথায় সেই ছোটবেলা থেকেই কলকাতার নাম শুনলে যেন রোমাঞ্চ হতো ভূতনাথের। একদিন মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছটার মগডালে গিয়েও উঠেছিল ভূতনাথ। এর হাজার-ডবল উঁচু। সে যে কতখানি—তা অনুমান করা শক্ত। তবু অনেক অনেক দূরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সে। সোজা পশ্চিমদিকে চাইলে শুধু দেখা যায় কেবল গাছ আর গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ। তারপর আকাশ। শুধু আকাশ আর আকাশ। আকাশময় চারিদিক। সন্ধ্যেবেলা বাদুড়গুলো ওদিক থেকে ফল-পাকড় খেতে একটার পর একটা উড়ে আসে। ওই শইরের দিক থেকে। মাজদে’ স্টেশনের চেয়েও অনেক দূরে—কত শহর—ফতেপুরের মতো কত গ্রাম পেরিয়ে তবে কলকাতা। সেখানে ঘোড়ার ট্রামগাড়ি চলে খুব জোরে-সামনে আসতে দেখলে বুক দুর দুর করে। (কেন করে তা বলা যায় না) মিত্তিরদের টিপু-চালতে গাছের হাজার-ডবল উচু সব বাড়ি। তার মাথায় লোক গুলো দেখায় এতটুকু কড়ে আঙুলের মতো।
এমতি ভাবতে ভাবতে গাছ থেকে একসময় নেমে পড়ে ভূতনাথ।
এর পর আর একদিনের ঘটনা। তখন অনেক বড় হয়েছে ভূতনাথ। ইস্কুলে এসে ভর্তি হলো গঞ্জের হাসপাতালের বড় ডাক্তারের ছেলে ননী। ভারি ফুটফুটে ছেলেটা। যেমন ফরসা, তেমনি কালো কালো চোখ, বড় বড় চুল। পরে অনেকবার ভূতনাথ ভেবেছে ননী যেন ছেলে নয়। অনেক ভাব হবার পরেও ননীর হাতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে কেমন যেন শিউরে উঠতে ভূতনাথ। ইস্কুল থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসার পথে ননীর কথাই সারা রাস্তাটা ভাবতো। এক-এক সময় মনে হতো, ননী তার বোন হলে বেশ হতো। তাহলে দুজনে এক বাড়িতে থাকতো, শুতে এক বিছানায়। অনেক ছুটির দিন ভূতনাথ হেঁটে হেঁটে একা চলে গিয়েছে ইস্কুলের কাছে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালের আশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। ননীকে যদি একবার এক ফাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। আবার লজ্জাও হতে। যদি ননী তাকে সত্যি সত্যিই দেখে ফেলে। যদি ননী জিজ্ঞেস করে-কী রে ভূতনাথ, তুই এখানে কেন—তখন কী জবাব দেবে সে।
ননীকে তো বলা যায় না যে তাকে দেখতেই তার আসা। ভুল করে নিজের একটা বই কতদিন নীর বই-এর মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে। তবু যদি সেই অছিলায় স্কুলের পরেও তারে সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ হয়। সেই ননী কতোদিনই বা ছিল তাদের স্কুলে। তবু কত গল্প হতো। কত জায়গায় তার বাবা বদলি হয়েছে। কত স্কুলের গল্প—কত ছেলের গল্প।
সেই ননী একদিন চলে গেল। চলে গেল চিরকালের স্বপ্নের দেশ–কলকাতায়। যাবার আগের দিন কেমন যেন মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথর। ননীর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় যাবে–
ননীর তাই আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু ভূতনাথ অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করেছিল-তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না ননী।
—কেন? কষ্ট হবে কেন?
কলকাতায় যাওয়াতে কষ্ট হওয়ার যে কী আছে তা ননীর মাথায় আসেনি। কিন্তু ভূতনাথের মনে হয়েছিল তার নিজের যেমন কষ্ট হচ্ছে—ননীর তেমন হলেই যেন ভালো হতো। কেন যে ননীর মনে কষ্ট হওয়া উচিত—তা ভূতনাথ লজ্জায় ব্যাখ্যা করে আর বলতে পারেনি। ভূতনাথের সে-দুঃখ সেদিন বুঝতে পারেনি ননী। না পারবারই কথা। কত দেশ সে দেখেছে। কত বড় লোক তারা। কতো ভূতনাথ তার জীবনে আসবে যাবে। মনে আছে ননীরা কলকাতায় চলে যাবার দিন খাটরোর বিলের ধারে শাড়া গাছটার তলায় বসে হাউহাউ করে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল সে।
কিন্তু একদিন ননীর চিঠি এল। খাস কলকাতা থেকে। জীবনে সেই তার প্রথম চিঠি পাওয়া। সেদিন সে-চিঠি পড়ে যে-আনন্দ ভূতনাথ পেয়েছিল—তা আর কোনদিন কোনও চিঠি পড়ে পায়নি। চিঠিখানা সে কতবার পড়েছে। বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়েছে দিনের পর দিন। চিঠিখানা জামার তলায় বুকের ওপর রেখেছে। যেন ননীর হাতটার স্পর্শ আছে ওই একটুকরো কাগজে। অথচ কী-ই বা লিখেছে ননী। বলতে গেলে কিছুই নয়। ননী লিখেছিল—
‘প্রিয় ভূতনাথ,
আমরা গত শনিবার দিন এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। কলিকাতা বেশ বড় দেশ—কী যে চমৎকার দেশ বলিতে পারিব না। এখানে আসিয়া অবধি বাবার সঙ্গে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। বড় বড় বাড়ি আর বড় বড় রাস্তা। খুব আনন্দ করিতেছি, তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি কেমন আছো জানাইও। উপরের ঠিকানায় চিঠি দিও–
সেই চিঠির উত্তর দিতেই ভূতনাথের দশখানা খাতার কাগজ নষ্ট হয়ে গেল। তবু সেদিন ননীর চিঠির উত্তর আর কিছুতেই পছন্দ হয়নি তার। কত কথা ভূতনাথ লেখে—আবার কেটে দেয়। বড় লজ্জা করে। কলকাতা থেকে ননীর চিঠি আসাটাই সেদিন মনে হয়েছিল জীবনের চরম স্মরণীয় ঘটনা। সেই ননীর চিঠির উত্তর পাঠাতে হবে কলকাতায়! এ যেমন বিস্ময়কর তেমনই অবিশ্বাস্য যে। শেষ পর্যন্ত চিঠি ভূতনাথ কোনওরকমে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার উত্তর আসেনি আর এ-জীবনে। সেদিনকার মতো ননী হারিয়েই গিয়েছিল ভূতনাথের জীবন থেকে একেবারে। কিন্তু কলকাতার স্বপ্ন ভূতনাথের মন থেকে কোনোদিন মুছতে পারেনি কেউ!
এর পর আর এক ঘটনা ঘটলো। ভূতনাথের বয়েস তখন বারো কি তেরো আর রাধার এগারো। রাধার বিয়ে হবে। রাধাকে দেখতে এল কলকাতা থেকে। সে যে কী রোমাঞ্চ! রাধার রোমাঞ্চ হলো কিনা ভূতনাথ জানতে পারেনি সেদিন। কিন্তু যদি হয়েই থাকে তত তার হাজারগুণ হয়েছিল ভূতনাথের। রাধা! সেই রাধা! তার শ্বশুরবাড়ি হবে কলাকতায়। কী যে হিংসে হয়েছিল ভূতনাথের মনে। রাগও হয়েছিল খুব। রাগে রাধার সঙ্গে ভূতনাথ ক’দিন দেখাও করেনি, কথাও বলেনি।
কোঁচানো চাদর আর বার্নিশ করা পম্পসু পায়ে কয়েকজন ভদ্রলোক একদিন এল ফতেপুরে। একটা রাত থাকলোও। খেলও খুব। নন্দ জ্যাঠা গাছের ডাব, পুকুরের মাছ, গাওয়া ঘি, ছিন্নাথপুরের কেষ্ট ময়রার কাঁচাগোল্লা আর কাটারিভোগ চালের ভাত খাওয়ালেন।
রাধাকে পছন্দও করে গেল তারা। মাজদিয়া ইস্টিশন থেকে পাল্কি চড়ে একদিন ব্ৰজরাখাল এল বর হয়ে। ব্ৰজরাখাল কলকাতা থেকে বিয়ে করতে এসেছে। বর দেখে রাধার পছন্দ হলো কিনা কে জানে কিন্তু ভূতনাথের হলো না। বরের গোঁফ নেই এ কী রকম বর! ফতেপুরে যত বর এসেছেসব বরের গোঁফ ছিল। রাধার সই হরিদাসীর বরেরও গোঁফ ছিল আর ভূষণ কাকার মেয়ে জ্ঞানদার বর এখনও আসে— তারও গোঁফ। কিন্তু সেদিন সেই অল্প বয়সে ভূতনাথের মনে হয়েছিল রাধার বরের গোঁফ থাকলেই যেন মানাতো। এখন অবশ্য ভাবলেই হাসি পায়। যা হোক, সেদিন ব্ৰজরাখালের গোঁফ না থাকায় যে ক্ষোভ হয়েছিল ভূতনাথের, অপুষিয়ে গিয়েছিল রাধার কলকাতার শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সৌভাগ্যে।
বাসরে অনেক রাত পর্যন্ত ভূতনাথ বসেছিল বরের পাশে। কত লোক কতরকম প্রশ্ন করছে—একে একে সব উত্তর দিচ্ছে ব্ৰজরাখাল। রাঙাকাকী ভূতনাথকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল
—একে দেখছো তো—এ তোমার বড় সম্বন্ধী–সম্পর্কে গুরুজন
মল্লিকদের আন্না বলেছিল—ত গুরুজন যদি, এখেনে আমাদের সঙ্গে বসে কেন বাপু-বাইরে যাও না তুমি ভূতেদাদা।
সবাই হেসে উঠেছিল।
লজ্জায় ভূতনাথও আর বেশিক্ষণ বসতে পারেনি সেখানে। আস্তে আস্তে এক ফাঁকে উঠে চলে আসতে হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল— ব্ৰজরাখালের সঙ্গে আলাপ করে, কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করে কলকাতার বড় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীকে চেনে কিনা জেনে নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি কত কথা মনের ভেতরে গুঞ্জন করছিল, কিন্তু কিছুই হলো না। পরের দিন যতক্ষণ ব্ৰজরাখাল ছিল বাড়িতে, তার সামনে যেতেও লজ্জা হলো তার।
সকালবেলা, মনে আছে, কুয়োতলার পাশে আতাগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভূতনাথ শুনতে পেলে রাধা জ্যাঠাইমাকে বলছে
—মা, ভূতেদাদা বলছিল ও আমার সঙ্গে যাবে।
–কোথায়?—অবাক হয়ে গিয়েছে জ্যাঠাইমা।
-আমার সঙ্গে।
—তোর শ্বশুরবাড়িতে? কেন?
—তা জানিনে-ভূতোদাদা বলছিল।
—পাগল—বলে হেসে উঠেছিল জ্যাঠাইমা। ছি ছি—কী ভাবলো জ্যাঠাইমা। রাধা যে সে-কথা জ্যাঠাইমাকে বলবে কে জানতো। কী বোকা মেয়ে।
কিন্তু পরে শুনতে পেলে ভূতনাথ। রাধার শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় নয়। কলকাতা থেকে অনেক দূরে গ্রামের মধ্যে। কামারপুকুরে। কোথায় কামারপুকুর কে জানে। রাধা সেইখানে থাকে। আর ব্রজরাখাল কলকাতার আপিসে চাকরি করে। শনিবার-শনিবার শুধু বাড়ি যায়।
রাধা যখন প্রথম বাপের বাড়ি এল—সে-রাধাকে আর যেন চেনাই যায় না।
রাধা হেসে উঠলো হো হো করে-ওমা, ভূতোদাদা আমার দিকে কেমন হাঁ করে চাইছে দেখো–
ভূতনাথ কিন্তু অন্য জিনিস দেখছিল। রাধা এই ক’দিনে এতো মোটা-সোটা হলে কী করে! আরো ফরসা হয়েছে যেন। ভালো ভালো জামা-কাপড় পরেছে। আরো গয়না হয়েছে।
রাধা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল-না বাপু, তুমি আমার পানে অমন করে চেয়ে না ভূতোদাদা-ভয় করে আমার
ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিল—কেন, ভয় কিসের–
—বারে নজর লাগে না বুঝি, আমার নতুন বিয়ে হয়েছে— নজর লাগা বুঝি ভালো
-আহা। তাই নাকি আবার লাগে।
—আর আমি যদি নজর দেই—তোমার কেমন লাগে শুনি
—দে না, যতো পারিস নজর দে—কিসে নজর দিবি দে—বলে ভূতনাথ রাধার দিকে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রাধা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলে। ভূতনাথের নজর দেবার মতো কিছু আছে কিনা হয় তো তাই দেখলে। তারপর বললে—এখন তো দেবে না, তোমার বউ আসুক তখন দেবো
সে অবকাশ রাধা পায়নি। পরের বার রাধা এল।
ভূতনাথ চেহারা দেখে অবাক—এ তোর কী চেহারা হয়েছে। রে রাধা
রাধা বললে—তোমারও তো চেহারা খারাপ দেখছি ভূতোদাদা
—আমার হোক—কিন্তু তোর কেন হবে—
রাধা এবার যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর। কিছু কথা বললে না। মাথা নিচু করে রইলো।
ভূতনাথ বললে—সেবার আমি নজর দিয়েছিলাম বলে, নারে–
—দূর, তা কেন—বলে রাধা চুপ করলো। আর কিছু বললে। শেষে মল্লিকদের আন্নার কাছে শুনতে পেলে ভূতনাথ। আন্না বললে-জানো ভূতেদা—রাধাদি’র ছেলে হবে–
সেদিন খবরটা শুনে ভূতনাথ যে কেন অমন চমকে উঠেছিল কে জানে। কিন্তু চমকানো শেষ হলো ভূতনাথের, যেদিন পেটে ছেলে নিয়ে রাধা মারা গেল। কেমন করে যে কী হলো সব আজ মনে নেই। তবু মনে আছে, খবর পেয়ে ব্রজরাখাল এসেছিল শেষ দেখা দেখতে। গম্ভীর মানুষ ব্ৰজরাখাল। বেশি কঁদেনি। রাধার গায়ের গয়না-টয়নাও কিছু নিলে না। নন্দজ্যাঠার একমাত্র মেয়ে। তার শোকটাও সমান গভীর। তবু বারবার পীড়াপীড়ি করলে।
ব্ৰজরাখাল বললে—মানুষটাই যখন চলে গেল—তখন আর মিছিমিছি ওসব…।
নন্দজ্যাঠা কিন্তু এদিকে শক্ত মানুষ। বললে—তুমি আবার বিয়ে করো বাবা—আমি বলছি
সেইবারই ব্রজরাখালের সঙ্গে প্রথম যা হোক দু একটা কথা বললে ভূতনাথ।
ব্ৰজরাখাল বললে-কলকাতা? তা আমি তো কলকাতাতেই থাকি আমার বাসায়—দেখাবো তোমায় কলকাতা। সে আর বেশি কথা কি—কলকাতা দেখতে তোমার এতো সাধ?
ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে ভূতনাথ। ঠিক হলো—ভূতনাথ চিঠি লিখলেই সব ব্যবস্থা করবে ব্রজরাখাল। তারপর যতোদিন ইচ্ছে তার বাসায় থাকো আর দেখে বেড়াও কলকাতা শহর!
ব্ৰজরাখাল পরদিনই চলে গিয়েছিল কলকাতায়। আর আসেনি।
তারপরেই এল ভূতনাথের পরীক্ষা। মহকুমা থেকে একদিন এন্টান্স পরীক্ষাও দিয়ে এল। কোথা দিয়ে দিন আর রাত কাটতে লাগলো কে জানে। আর তারপরেই বিধবা পিসী পড়লে অসুখে। পিসী ছিল মা’র মতন। ভারি কঠিন অসুখ। কয়েক মাস চললো পিসীকে নিয়ে।
পিসী প্রায়ই বলতো—ভূতত মানুষ হবার পর যেন মরি—এই কামনা করে মা তোমরা
লোকে বলত—তুমি নিজের পরকাল তিথি-ধম্মো নিয়ে থাকো কেন—ছেলে হয়ে জন্মেছে, যেমন করে হোক ওর উপায় ও করে নেবেই—
পিসী বলতো—পেটেই ধরিনি-নইলে বাপ-মা কী জিনিস ও জানে না তো—আমি চোখ বুজলে ওকে দেখবার কেউ নেই যে
পাড়ার বউদের সঙ্গে গল্প করতে পিসী আর ভূতনাথ শুনতে পাশে বসে-বউ-এর ছেলে হয় আর মরে যায়—শেষে বামুনগাছির পঞ্চানন্দের থানে মানত করলাম আমি—সেই পঞ্চানন্দের দোর ধরেই তো হলো এই ছেলে। ওর বাপ সতীশ বললে—নাম রাখো ‘অতুল’-আমি বললাম-শিবের দোর ধরে যখন বেঁচেছেনাম থাক ভূতনাথ। তা ভূতনাথ তো ভূতনাথই আমার-আমার ভোলানাথ-বই পড়ছে তো পড়ছেই—ঘুমুচ্ছে তত ঘুমুচ্ছেই— খেতে ভুলে যায় এমন ছেলে কখনো দেখেছো মা তোমরা-ওকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো মা।
সেই পিসীমাও একদিন মারা গেল।
পিসীমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে বিধবার নামে পাঁচ টাকা করে মাসোহারা আসতো—তা গেল বন্ধ হয়ে। তখন আর করবার কিছু নেই। ভূতনাথ বারোয়ারিতলায় গিয়ে আড্ডা জমালো। আডও বলতে পারে, আবার যাত্রার মহড়াও বলতে পারো।
‘নল-দময়ন্তী’ পালায় একবার ভূতনাথ প্রতিহারীর পার্ট করলে যাত্রার আসরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু বড় ভয় করতে লাগলো তার। কাঁপতে লাগলো পা দুটো। কেমন গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগলো। গ্লাশ-গ্লাশ জল খেলে খুব।
ভূষণ কাকা বললেও তারাপদ, ভূতোকে কেন পার্ট দিলে শুধু-শুধু—কোনও কম্মের নয়—লেখাপড়া শিখলে কী হবে–মাথায় যে গোবর পোরা।
কিন্তু ভূতোর তবলা শুনে সবাই অবাক। রসিক মাস্টার বললে—ড়ুগিতবলায় খাসা হাত তত ছোকরার—
দিনকতক তবলা নিয়েই পড়লো ভূতনাথ। বহুদূর থেকে শোনা যায় ভূতনাথের তবলার চাটি। অন্ধকার রাত্রে ঘরে বসে বসে সাধনা করে ভূতনাথ। বোল মুখস্ত করে—তা গে না ধিন, না গে ধিন-আবার কখনো–
তা ধিন
তা তা ধিন
ধিন ত্রে কেটে ত্রে কেটে তাক্—
ধিন…
কিন্তু তবলাও ঠিক শান্তি দিতে পারলে না ভূতনাথকে। পিসীমা’র মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন হঠাৎ তার জীবনের একটা পরিচ্ছেদের একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। মনে হলো একান্ত নিরাশ্রয় সে। আজ এর বাড়ি, কাল ওর বাড়ি—এমনি করে পরের অন্নদাস হওয়ার অগৌরব যেন তার ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসলো সেদিন প্রথম আর প্রখর হয়ে। ভূতনাথ একদিন বাঁয়া তবলা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে এল বারোয়ারিতলায়। আর ও-মুখো হলো না।
খুব ছোটবেলায় ভূতনাথ একটা বেজি পুষেছিল। বুনো বেজি। বেশ পোষ মেনেছিল। কিন্তু সংসারে যারা পোষ মানে তারাই বুঝি কষ্ট পায় বেশি। ভূতনাথেরই অত্যাচারে মারা গেল একদিন বেজিটা। সেই বেজির মৃত্যু প্রথম আর শেষ পিসীমা। দুই প্রান্তের দুই চরম শোকের মধ্যে ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীর বিচ্ছেদ আর রাধার মৃত্যু—সমস্ত মিলিয়ে ভালোমানুষ ভূতনাথ কেমন যেন মনে মনে স্তিমিত হয়ে এল।
এমন সময় এল ব্রজরাখালের চিঠি। রাধার স্বামী ব্রজরাখাল। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথের চিঠি পেয়েছে অনেক পরে। এজরাখাল যে-ঠিকানা দিয়েছিল ভূতনাথকে, সে-ঠিকানা বদলে গিয়েছে। তাই চিঠি পেতে অত দেরি।
পরীক্ষায় পাশ করেছে জেনে ব্রজরাখাল খুশি হয়েছে। লিখেছে —চাকরি চেষ্টা করলে হতে পারে। কিন্তু এখনি কিছু বলা যায় না। তবে কলকাতায় কিছুদিন থাকতে হবে—ঘোরাঘুরি করতে হবে। শেষে লিখেছে—চলিয়া আইস—যেমন যেমন নির্দেশ দিলাম ওইভাবে আসিবে। বাসস্থান ও আহারের বন্দোবস্ত আমি করিব। এ কলিকাতা শহর—ট্রেনে ও রাস্তায় খুব সাবধানে আসিবে। জুয়াচোরেরা নতুন মানুষ জানিলে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
পিসীমা’র পেতলের ঘটিটা আর রূপোর গোট ছড়াটা হর গয়লানীর কাছে বন্ধক রেখে বাড়ির দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে ভূতনাথ রাত থাকতে বেরিয়ে পড়েছে পায়ে হেঁটে। তারপর সকালবেলা এই কলকাতা। রেলের টিকিট কিনে, বাকি দুটো টাকা রয়েছে। টাকা দুটো সাবধানে টাকে পুরে নিয়ে ভূতনাথ শেয়ালদা’ স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো।