৩.৭ লোকটার মাথা খারাপ

অধ্যায় ৬১

এই লোকটার মাথা খারাপ, আর কোন কিছু মাথায় এলো না লতিকার। একটু আগেও মানুষটা মরতে বসেছিল, অথচ এখন মনে হচ্ছে জীবন ফিরে পেয়ে সে তার আসল রূপ ফিরে পেয়েছে। একজন নাৎসি অফিসারের রক্ত বইছে যার শরীরে, থুল-ভ্রিল এই ধরনের অদ্ভুত ধারনার যিনি বার্তাবাহক তার কাছে এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করা ঠিক হয়নি। সারাজীবন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় বড় হয়েও, সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও নিজেকে একজন গোঁয়ার জার্মানের পরিচয় থেকে আলাদা করতে পারেননি ভদ্রলোক, হয়তো মানসিকভাবে হিটলারের অনুরক্ত আছেন এখনো।

হ্যাঁ, ড. কারসন এবার অন্য পথ ধরেছেন। লতিকার গলা জড়িয়ে ধরেছেন পেছন থেকে। বোঝাই যাচ্ছে খালি হাতে একজন মেয়ে মানুষকে গলা টিপে মেরে ফেলা তার জন্য খুব কঠিন কাজ হবে না। সন্ন্যাসী কি করবে বুঝতে পারছে না, একবার আকবর আলী মৃধার দিকে রাইফেল তাক করছে, আরেকবার ড. কারসনের দিকে। ড. কারসন বুঝে গেছেন সন্ন্যাসীর পক্ষে সত্যি সত্যি কাউকে গুলি করা অসম্ভব।

লতিকাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি, বৃদ্ধ লামার কাছে। বৃদ্ধ লামা এখনো মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন, আশপাশে কতো কী ঘটে গেছে সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

আমার কাছে কেউ আসবে না, তাহলে এই মেয়েটা মরবে, ড. কারসন বললেন জোর গলায়।

বৃদ্ধ লামার কাছে গিয়ে বসলেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করছেন আর কতোক্ষন লাগবে মন্ত্র পড়া শেষ হতে।

আপনি ভুল করছেন, মি. কারসন, ঘুরে তাকালেন তিনি। এই লোকটাই একটু আগে ঐ দানবটার সাথে লড়ছিল। সারা শরীরের অনেক জায়গায় কেটে গেছে, চোখে কালসিটে পড়ে গেছে, হাঁটছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

আপনি কে?

আমার নাম লখানিয়া সিং, সাম্ভালার খোঁজে আছি আমিও।

আপনি কিভাবে জানেন আমি ভুল করছি।

আমি জানি, হেসে বলল লখানিয়া সিং, কারন, এই মন্ত্রটা দিয়ে কাজ হবে না, এই মন্ত্রেরই কিছু বিশেষ অংশ আছে, যা সাধারন লামাদের কাছে অচেনা, সেই অংশটা পাঠ করতে হবে আগে।

আপনি আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না, দূরে গিয়ে দাঁড়ান, ড. কারসন বললেন।

আপনার চোখের সামনে ঐ পিশাচের মতো মানুষটাকে হারিয়েছি, হেসে বলল লখানিয়া সিং, আপনার মতো বৃদ্ধকে ভয় পেলে চলবে?

ভয় পাওয়া না পাওয়া আপনার ব্যাপার, এই মেয়েটাকে জীবিত দেখতে চাইলে সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।

আপনি কি সাম্ভালার খোঁজ চান?

অবশ্যই চাই।

তাহলে মেয়েটাকে ছেড়ে দিন, বলে সন্ন্যাসীর দিকে এগিয়ে গেল লখানিয়া সিং।

আর এক পা এগুবেন না, বললেন ড. কারসন, লতিকার গলাটা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলেন। থেমে গেলেন লখানিয়া সিং। এই লোকটাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে হবে, তিনি যজ্ঞেশ্বরের কাছে চলে গেলেন। যজ্ঞেশ্বর তার জ্যাকেটটা পড়ে ছিল, ভেতরে লুকিয়ে রাখা চামড়ার খোপটা বের করে নিয়ে এলেন। ম্যাপটা খুললেন। এখানেই সেই তোরন দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে আছে অসীম এক খাদ।

এটা হচ্ছে আসল ম্যাপ, ড. কারসনের সামনে গিয়ে বললেন তিনি। বাঁধন ঢিলে করে দিলেন ড. কারসন, বুঝতে পারছেন লতিকাকে এভাবে জিম্মি করে রাখা বোকামি হয়ে গেছে, কারন বৃদ্ধ লামা সারা দিন-রাত কালচক্র মন্ত্র জপলেও কোন লাভ হবে না। এই রকম একটা ধারনা তার মধ্যেও ছিল, কেননা প্রতিবছরই চৌদ্দতম দালাই লামা এই কালচক্র পাঠের আয়োজন করেন, কালচক্র তন্ত্রে যদি সাম্ভালায় প্রবেশ করা যেতো, তাহলে সেটা দালাই লামার জানা থাকার কথা, অথচ সাম্ভালা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সাম্ভালা একটি মানসিক শান্তির স্থান, সত্যিকার সেরকম স্থান পৃথিবীতে নেই, মানসিক শান্তি লাভ করলেই পৃথিবীটাই হয়ে যায় সাম্ভালা।

যাই হোক, লতিকাকে মুক্ত করে দিয়ে লখানিয়া সিংয়ের দিকে এগিয়ে এলেন ড. কারসন।

কালচক্র তন্ত্রের কোন অংশ এখানে লেখা আছে, আমাকে দেখান, ড. কারসন বললেন এগিয়ে এসে।

দেখুন, বলে ম্যাপের সেই বিশেষ স্থানটা দেখালেন লখানিয়া সিং। অক্ষরগুলো যেন আরো পরিস্কার হয়ে উঠেছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছু পংক্তি সেখানে লেখা। একপাশে লম্বা একটা তোরনের চিহ্নও আঁকা।

এবার আশ্বস্ত হলেন ড. কারসন। ড. আরেফিনসহ বাকিরাও এগিয়ে এলো ম্যাপটা দেখার জন্য। সন্দীপকে দারুন উত্তেজিত দেখা গেল। সুরেশ চুপচাপ দেখে গেলেও কোন মন্তব্য করলো না।

রাশেদ এখানে আসেনি,সে তার বন্ধুকে পানি খাওয়াতে ব্যস্ত। লতিকা ছোট একটা ফ্লাস্কে করে গরম পানি নিয়ে এসেছিল।

এবার তাহলে কি করা উচিত, মি. লখানিয়া? ড. আরেফিন জিজ্ঞেস করলেন।

এই অংশটুকু আমি পাঠ করবো।

আপনি প্রাচীন তিব্বতি লেখা পড়তে পারবেন? জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন, আমি কিছুটা পারি।

আমি পারি। কিভাবে শিখেছি সেটা না জানলেও হবে আপনাদের, লখানিয়া সিং বললেন।

উনাকে কি বলবেন? বৃদ্ধ লামাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধ লামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় আরো প্রাচীন কিছু শ্লোক আবৃত্তি করলেন। এর আগে এতো সব ঝড় ঝাঁপটাতেও মন্ত্র পড়া থামাননি বৃদ্ধ লামা, কিন্তু এবার চোখ খুলে তাকাতে বাধ্য হলেন। হারিয়ে যাওয়া এই শ্লোকগুলো খুব কম মানুষই জানে, প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় রচিত এই শ্লোকগুলোর উল্লেখ কিছু কিছু লেখায় পাওয়া গেলেও শ্লোকগুলো কোনটাই লিখিত আকারে পাননি,এতে প্রাচীন তিব্বতি ভাষা যিনি জানেন, তিনি অসাধারন কেউ হবেন ভেবেই চোখ খুলে তাকালেন বৃদ্ধ লামা এবং অবাক হলেন বয়সে অনেক তরুন একজনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। যদি তরুনের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলেন তিনি, মনে হয় যুগ যুগান্তর দেখেছে এই তরুন, কিন্তু কিভাবে? এই প্রশ্ন কার আগে চারপাশে তাকালেন, চ্যাঙসহ দলের বাকি সদস্যদের দেখতে পাচ্ছেন না, ওদের কি হাল হয়েছে তা চারপাশে ছড়িয়ে থাকা রক্তের দাগ থেকে সহজেই অনুমান করতে পারছেন। এবার কি তাহলে তাঁকেই খুন করবে এই লোকগুলো?

দুই হাত জোড় করে বৃদ্ধ লামাকে প্রনাম করলেন লখানিয়া সিং। এতে আরো অবাক হলেন বৃদ্ধ। ড. আরেফিনের অবশ্য রাগ হচ্ছিল খুব, কিন্তু বৃদ্ধ একজন মানুষের উপর শোধ তোলা তার পক্ষে সম্ভব না।

আপনিও সাম্ভালায় যেতে চান? বৃদ্ধ লামাকে জিজ্ঞেস করলেন লখানিয়া সিং।

হ্যাঁ, যেতে চাই, মৃদু স্বরে বললেন বৃদ্ধ লামা, বুঝতে পারছেন এখানে তার দলের কেউ নেই, সাবধানে কথাবার্তা বলা উচিত, সারাজীবন কেবল কল্পনাই করে গেছি সত্যি সেই জায়গাটা কেমন হবে!

তাহলে আমার পেছনে দাঁড়ান।

কিন্তু আমি তো কালচক্র মন্ত্র পাঠ করছিলাম…

চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সাম্ভালা দেখাবো, বললেন লখানিয়া সিং।

মৃদু অথচ গম্ভীর স্বরে ম্যাপে লেখা প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় লেখা পাঠ করতে শুরু করেছেন লখানিয়া সিং। তার পেছনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, কেবল যজ্ঞেশ্বর দাঁড়িয়ে আছে দূরে, আকবর আলী মৃধা আর তার সঙ্গি দুজনের দিকে রাইফেল তাক করে। রাশেদও যোগ দিয়েছে মাত্র। রাজুও এসেছে তার সাথে, কাঁধে ভর দিয়ে এসেছে রাশেদের। সারা মুখে রক্ত লেগে থাকলেও দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে কোন কষ্টে আছে, বরং আজ রাশেদের কাছে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তার খুবই ভালো লাগছে।

দ্রুত পড়ে চলেছেন লখানিয়া সিং। তার কণ্ঠস্বর ক্রমশ উপরে উঠছে, নীচে নামছে।

চারপাশ বদলে যেতে শুরু করল।

*

অধ্যায় ৬২

চারপাশের দৃশ্যপট এতো দ্রুত বদলে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি রাশেদ। সবার পেছনে রাজুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, সামনের দিকে তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। যেন পর্দা উঠে গেছে, সামনে শুরু হয়েছে থ্রিডি টেকনোলজিতে নির্মিত অসাধারন কোন সিনেমার দৃশ্য। প্রথমে পরিবর্তন এলো চারপাশের আবহাওয়ায়, সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের বদলে দেখা গেল সুউচ্চ সবুজ পাহাড় শ্রেনি, এখানে সেখানে মেঘ ঝুলে আছে ছোট ছোট ভেলার মতো। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে লাল-নীল হরেক রঙের টিয়ে পাখি, সবুজের মাঝে চোখে পড়ছে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার নীল জলরাশি, সেই জলরাশি ছোট্ট নদীর মতো চলে যাচ্ছে দিগন্তের শেষ সীমানার দিকে, কোথায় তা বুঝতে পারছে না রাশেদ। আরো অনেক দূরে চমৎকার সব প্রাসাদ চোখে পড়ল, রূপকথার গল্পে যেমন দেখা যায়, মেঘ ভেদ করে উঠে গেছে সেইসব প্রাসাদের চূড়া। সুর্যের আলোয় সেই চূড়ায় পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কোথাও কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না, বরং কল্পনার জগতের অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু প্রানী চোখে পড়ল, ইউনিকর্ন ছাড়া বাকিগুলোকে চিনতে পারল না রাশেদ। দ্বিতীয় পরিবর্তন হচ্ছে শব্দ, অদ্ভুত এক সুর খেলা করছে পুরো জায়গাটায়, সেই সুরে আসছে রঙিন এই দেশটা থেকে। তৃতীয় পরিবর্তন হচ্ছে, চমৎকার একটা তোরন, লম্বা উঠে উঠে গেছে আকাশের দিকে, তার উপরে সোনালী একটা গোলক শোভা পাচ্ছে।

অপূর্ব এই দেশটির শুরু খাদের শেষ প্রান্ত থেকে, এতোক্ষন যে জায়গাটা মনে হচ্ছিল অসীম অন্ধকার কালো সেখানেই ফুটে উঠেছে এই অপূর্ব দৃশ্যাবলী। এপাশে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে বারোজন মানুষ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই, চোখে মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে। যজ্ঞেশ্বর তার অস্ত্র ফেলে দিল হাত থেকে, এখন আর এই অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। সামনেই সেই চিরসবুজের দেশ, অজানা নয়জন রহস্যমানবের দেশ, এর খোঁজেই রয়েছে সে বছরের পর বছর।

আকবর আলী মৃধা আর তার সঙ্গিদের ফেলে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলো যজ্ঞেশ্বর, দাঁড়ালো লখানিয়া সিং এর সাথে। আকবর আলী মৃধাও তাকিয়ে আছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতে, এই মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছেন না তিনি। এমনিতে সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে দেরি করেন না তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুটা দ্বিধা কাজ করছে তার মনে। লুসিফারের সেবায় সারাজীবন রক্তারক্তি করার চেয়ে সামনের চির যৌবনের দেশে চলে যাওয়া অনেক ভাল বলে মনে হলো তার কাছে। সোহেল আর আহমদ কবিরকে ইশারা করলো তার পেছন পেছন আসার জন্য। লখানিয়া সিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন আকবর আলী মৃধা। তার চেহারায় এখন কুটিলতার কোন ছাপ নেই।

সামনে এখন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মাঠ। অনেক দূরে কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে, তারা আসছে সামনের দিকে।

ড. কারসন চুপচাপ দেখছিলেন সবকিছু। দেখো, আমি সাম্ভালা খুঁজে পেয়েছি, ড. আরেফিনকে বললেন তিনি ফিসফিস করে।

আমার মনে হয় খুঁজে পাওয়ার জন্য কাউকে ধন্যবাদ দিতে হলে লখানিয়া সিং-কে ধন্যবাদ দেয়া উচিত আমাদের, ড. আরেফিন বললেন।

আপনার ধারনা ভুল, মি. আরেফিন, যাই হোক, এ বিষয়ে আর কথা বাড়াবো না, ড. কারসন বললেন। আমি এখন সাম্ভালায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি, আপনারা কে কে আসবেন আমার সাথে, হাত তুলুন, শেষ কথাগুলো একটু জোরে বললেন ড. কারসন। সবার দিকে তাকাচ্ছেন। সবাই উৎসুক, কিন্তু কিছুটা দ্বিধা, ভয় কাজ করছে সবার মধ্যেই।

কেউ না গেলে আমি একাই যাবো, বলে সামনের দিকে পা বাড়ালেন তিনি, তাঁর দেখাদেখি আকবর আলী মৃধা তাঁর দুই সহযোগীসহ সঙ্গি হলো। যজ্ঞেশ্বরও যোগ দিতে চাইছিল, হাত ধরে ওকে থামালেন লখানিয়া সিং।

সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন লখানিয়া সিং। তাঁর সারাজীবনের স্বপ্নকে এভাবে সত্যি হতে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছেন তিনি। পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ানোর অভিশাপ থেকে হয়তো সত্যিই তিনি মুক্তি পেতে যাচ্ছেন অবশেষে। সাম্ভালাই হবে তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল।

সুরের পরিবর্তন হচ্ছে, রঙের পরিবর্তন হচ্ছে, চমঙ্কার সাদা পায়রার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে আকাশে, একশৃঙ্গ ঘোড়া থেকে শুরু করে কাল্পনিক রাজ্যের সব ধরনের প্রানীকূলকে দেখা যাচ্ছে একসাথে ঘুরে বেড়াতে। দূর থেকে আগত মানুষদের এখন কিছুটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। গুনলেন লখানিয়া সিং, নয়জন আছে একসাথে। চমৎকার সাদা পোশাক পরনে, মুখে স্মিত হাসি। যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন তিনি, শেষপর্যন্ত যজ্ঞেশ্বরের উদ্দেশ্যও পূরন হচ্ছে তাহলে। এরাই সম্ভবত অজানা নয়জন রহস্যমানব, যারা মানবসমাজের উপকারে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কাজ করে যাচ্ছেন, এঁদের কাছেই হয়তো জাগতিক সব দুঃখ-কষ্টের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার প্রতিকার আছে।

ড. কারসন এগিয়ে যাচ্ছনে দৃঢ় পায়ে, তাঁর পেছন পেছন যাচ্ছেন আকবর আলী মৃধা, সাথে সোহেল আর আহমদ কবির। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লখানিয়া সিং। সাম্ভালা খুব সহজেই বহিরাগতদের বরন করে নেবে না, এই সাধারন সত্যিটা ড. কারসন মেনে না নিয়ে ভুল করতে যাচ্ছেন।

বৃদ্ধ লামার দিকে তাকালেন, বুড়ো মানুষটা চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছে যেন, যদিও নিজের অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়েনি লোকটা।

সন্দীপ তাকিয়ে আছে, তার ইচ্ছে করছিল ড. কারসনের সাথে যোগ দেয়ার জন্য, কিন্তু একটু আগে ড. কারসন লতিকার সাথে যে ব্যবহার করেছে তার জন্য কখনোই ক্ষমা করবে সে ড. কারসনকে।

কাজেই আপাতত দর্শক হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা সন্দীপের। তার বা পাশে লতিকা আর সুরেশ দাঁড়ান। সে লক্ষ্য করেনি লতিকা নিজের অজান্তেই সুরেশের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দিকে তাকিয়ে এতোটাই আবিষ্ট হয়ে আছে লতিকা, কখন সুরেশের হাত ধরেছে তা নিজেও জানে না। সুরেশ এতে মোটেও বিরক্ত নয়, কারন বিরক্ত হওয়ার কোন সুযোগ তার নেই। লতিকা এখনো হয়তো সন্দীপকে পছন্দ করে, এই ধারনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সুরেশ। যদিও লতিকা সন্দীপকে পছন্দ করে এমন কোন নজির নেই, কিন্তু মেয়ে মানুষের মন বোঝা খুব মুশকিল।

লখানিয়া সিং স্থান পরিবর্তন করে পেছনে এসে দাঁড়ালেন, রাশেদের পাশে। ফিসফিস করে কিছু বললেন রাশেদের কানে কানে। অবাক বিস্ময়ে মাথা নাড়াল রাশেদ, কিন্তু কিছু বলল না। আসলে বিস্ময়ে কথা খুঁজে পাচ্ছে না রাশেদ। এই লোকটাই কি আব্দুল মজিদ ব্যাপারি? সেটা কিভাবে সম্ভব? চোখ দুটো অনেক কাছ থেকে দেখেছে। সে। এই চোখ তার পরিচিত। যে কথাগুলো বলে গেল লখানিয়া সিং সেগুলো আব্দুল মজিদ ব্যাপারি ছাড়া আর কেউই জানে না। তার শৈশব কৈশোরের কথা, বাবার কথা, মায়ের কথা, সত্মার কথা, এ কথাগুলো পরিবারের মানুষ ছাড়া আর কারো জানার কথাও নয়। সত্যিই কি এই মানুষটাই তার দাদা? চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিল রাশেদ, অনেক রহস্য লুকিয়েছিল তার দাদাকে ঘিরে, শেষে কিভাবে হারিয়ে গেল ঢাকা থেকে সেটাও অনেক অদ্ভুত, কিন্তু তারপরও রীতিমতো বৃদ্ধ একজন মানুষ কিভাবে এরকম তরুন হতে পারে তার মাথায় খেলছিল না। তার কাঁধে হাত দিয়ে চোখ চোখ রেখেছে লখানিয়া সিং। তুমি আমার যোগ্য উত্তরাধিকার, যেভাবে বললাম সেভাবে করো, অসীম জীবন অপেক্ষা করছে তোমার জন্য, ফিসফিস করে কথাগুলো বললেন লখানিয়া সিং, রাশেদের কানে কানে।

পাশে দাঁড়ানো রাজুর এসবে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, সে কোনমতে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে, এতোসব কি ঘটছে তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বারবার মনে হচ্ছে সে মৃত, মৃত্যুর পরের পৃথিবীর কোন ছবি দেখছে। একটু পর রাশেদকে মোটামুটি স্তম্ভিত অবস্থায় রেখে নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন লখানিয়া সিং। সব কাজ শেষ হয়েছে, এবার সাম্ভালায় যাওয়ার পালা।

সামনের দিকে তাকালেন লখানিয়া সিং। ড. কারসন প্রায় পৌঁছে গেছেন, খাদের শেষপ্রান্ত পার করে সাম্ভালার দিকে পা বাড়াবেন, তার পাশাপাশি আছেন আকবর আলী মৃধা আর তার দুই শিষ্য। প্রায় একই সময় পা বাড়াল চারজন। এরপরের দৃশ্যটা অস্বাভাবিক। যেখানে সাম্ভালার দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের শুরু সেখানেই পা দিয়েছিল সবাই। কিন্তু পা দেয়ার পরপরই বুঝতে পারল আসলে শুন্যে পা বাড়িয়েছে। ততক্ষনে যা হবার তাই হলো, ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে শুরু করল চারজন, একটু আগে যেখানে নানা রঙের অপূর্ব সাম্ভালা দেখেছিল, সেখানে তারা দেখল সেই পুরানো অন্ধকার খাদ। চিৎকার করে উঠলো চারজনই, কিন্তু সেই চিৎকার কারো কানে পৌঁছাল না। পৃথিবীর শেষ অন্ধকার সীমায় আছড়ে পড়ার আশংকা নিয়ে তারা পড়তেই থাকল।

ঠিক এরকমটাই আশা করেছিলেন লখানিয়া সিং, মুহূর্তের জন্য সাম্ভালাকে মনে হয়েছিল প্রজেক্টর মেশিনে দেয়ালে দেখানো ছবির মতো, যে মুহূর্তে ড. কারসন বাকিদের নিয়ে সাম্ভালায় পা রাখেন, সাম্ভালার পরিবর্তে তা হয়ে গেল পুরানো সেই খাদ। হয়তো এটাই ওদের প্রাপ্য ছিল, ভাবলেন লখানিয়া সিং। যজ্ঞেশ্বরের মুখে স্মিত হাসি দেখতে পেলেন। বৃদ্ধ লামার চেহারায়ও স্বস্তির ছাপ।

সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছে রাশেদ, একজন চিরশত্রু পৃথিবী থেকে কমে গেল তার। আর কেউ কখনো তার পিছু তাড়া করবে না।

সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, একদম প্রানবন্ত মনে হচ্ছে সবাইকে, সবার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, উজ্জ্বল শ্যামবর্ন মানুষগুলোর দেহ থেকে যেন অদ্ভুত এক আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

কিছুটা এগিয়ে গেলেন লখানিয়া সিং। অনেক প্রশ্ন তার মনে, আজ সময় এসেছে সব কিছু জেনে নেয়ার।

আপনি মহাঋষি মিলারপার বংশধর, আপনার কাছে এই আচরন আশা করিনি আমরা, মাঝখানের একজন বলে উঠলেন, দিব্যকান্তি চেহারা, গলার স্বর কোমল কিন্তু কথায় শ্লেষ ছিল বুঝতে সমস্যা হলো না কারো। ঠিক কার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেছেন তা বুঝতে একটু সময় লাগল সবার।

মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ লামা, বোঝা যাচ্ছে অনুতপ্ত তিনি।

আপনি সাম্ভালার রক্ষক, অথচ আপনি নিজে এসেছেন সাম্ভালা সত্যি কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে, আপনার বিশ্বাস যথেষ্টই নাজুক, এবার বললেন আরেকজন, গলার স্বরে কোন পার্থক্য নেই, যেন একই মানুষ কথাগুলো বলছে।

আর ভুল হবে না, আমি সারাজীবন সাম্ভালার রক্ষক হয়েই থাকতে চাই, মৃদু স্বরে বললেন বৃদ্ধ লামা, হাঁটু মুড়ে বসেছেন, দুই হাত জোর করে।

একটু আগে চার অবিশ্বাসীর পরিণতি আপনারা সবাই দেখেছেন, মনকে লোভ মুক্ত করুন, ঘৃনা, হিংসা, দ্বেষ মুক্ত করুন, পাপাচার-ব্যভিচার মুক্ত থাকুন, সাম্ভালার দরজা আপনাদের সবার জন্য খোলা, এবার আরেকজন বলল, সম্ভবত সবার ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি।

আমি আসতে পারবো সাম্ভালায়? আমি শান্তি চাই, আমার স্মৃতি থেকে মুক্তি চাই, আপনাদের আমি খুঁজেছি, পথে-প্রান্তরে, পাহাড়ে-সাগরে, কিন্তু পাইনি, হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে যজ্ঞেশ্বর, তার চোখে অশ্রু দেখা গেল, অঝোর ধারায় ঝরছে।

আমরা জানি। আপনি চলে আসুন যজ্ঞেশ্বর জী, সাম্ভালায় আপনাকে স্বাগতম।

নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না যজ্ঞেশ্বর। সবার দিকে ঘুরে তাকাল একনজর।

আমি কী করবো? এবার মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলেন লখানিয়া সিং।

আপনি তো আমাদেরই লোক, হেসে বলল মাঝখানের মানুষটি, সেই কয়েক হাজার বছর আগে আপনিই প্রথম সাম্ভালার সন্ধান পান, আপনি কী তা ভুলে গেছেন?

কিন্তু সে তো অন্য জায়গায়, অন্য পরিবেশে! বিস্মিত হয়ে বললেন লখানিয়া সিং।

সাম্ভালা কি একটাই? উলটো প্রশ্ন এলো।

সাম্ভালা কি তাহলে অনেক জায়গায় আছে? জিজ্ঞেস করলেন লখানিয়া সিং। তাঁর মাথায় ঢুকছিল না কিছু।

জি, পবিত্ৰজ্ঞানে জ্ঞানীরাই তা খুঁজে বের করতে পারেন। আপনি হাজার বছর আগে খুঁজে পেয়েছিলেন সাম্ভালা, অমরত্ব অর্জন করেছেন, তারপর আর ফিরে আসেননি।

আমি সেখানে ফিরে গিয়েছিলাম!

ফিরে গিয়েছিলেন কিন্তু ঠিক জায়গায় যাননি, এবার বলল আরেকজন।

আর ঐ দানবটা, যাকে একটু আগে আমি খাদে ফেলেছি?

সাম্ভালার বিপরীত জায়গাও আছে পৃথিবীতে, যেখানে পাপ, ঘৃনা আর ঈর্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়, মিচনার যখন অসহায়ের মতো মরতে বসেছিল তখন পাপের দেবী তাকে নিজের করে নেয় অমরত্বের বিষ পান করিয়ে, সে জন্য ছেলেটা বেঁচে ছিল, কিন্তু মানুষ ছিল না সে কোনভাবেই।

আর কোন প্রশ্ন নেই লখানিয়া সিংয়ের মনে। নিজেকে অনেক ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল। এতো দীর্ঘ একটা জীবন এই পৃথিবীর বুকে পার করেছেন তিনি, কোন কিছুতেই কোন অপূর্নতা নেই তার। রাশেদের মতো চমৎকার একজন উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন যে তার রক্তকে বয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে।

বাংলাদেশের সেই অজ পাড়া গাঁয়ে আর হয়তো ফেরা হবে না, কিন্তু আফসোস নেই কোন। যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন, খাদের শেষ প্রান্ত পার হয়ে এখন সাম্ভালার জমিতে পা রাখছে সন্ন্যাসী। ড. কারসনের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল এক্ষেত্রে তেমন কিছু হলো না। বরং সাম্ভালায় পা রাখার সাথে সাথে যজ্ঞেশ্বরের গা থেকেও অদ্ভুত সুন্দর আভা বিচ্ছুরিত হতে শুরু করল।

সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন লখানিয়া সিং। তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদ।

ছেলেটার মনে ঝড় চলছে এটা বাইরের কেউ বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু এখানে থাকার সময় ফুরিয়েছে।

আপনারা কেউ যাবেন আমাদের সাথে? প্রশ্ন করলেন লখানিয়া সিং।

আপনি কি যেতে চান? সন্দীপকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল নয়জনের মধ্য থেকে একজন।

না, আমি যেতে চাই না, ছেলে আর স্ত্রীকে অনেকদিন দেখি না, সন্দীপ বলল, এখানেই থাকছি আমি।

আমিও যাব না, সুরেশ বলল।

আমিও না, বলল লতিকা, আমার বাবা এখনো জীবিত, তাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি।

আমি যাবো না, ড. আরেফিন বললেন, স্ত্রীর চেহারাটা মনে পড়েছে, এই মানুষটাকে একা রেখে আর কোথাও যাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। পৃথিবীতে তিনি ছাড়া আফরোজার আর তো কেউ নেই।

আমরাও যাবো না, রাশেদ বলল।

ধন্যবাদ।

ধীর পায়ে সাম্ভালায় পা রাখলেন লখানিয়া সিং, যজ্ঞেশ্বরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুজনের শরীর থেকেই এখন কেমন অদ্ভুত জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

কোনদিন যদি মনে হয় জাগতিক সব লোভ, কাম, হিংসা, ঘৃনা মন থেকে দূর করতে পেরেছেন, তাহলে আসবেন, সাম্ভালা আপনাদের বরন করে নেবে, মাঝখানের দিব্যকান্তি মানুষটি বলল।

হাত নাড়াচ্ছিলেন লখানিয়া সিং, যজ্ঞেশ্বর। তোরন ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছে, সোনালী গোলকটা মিলিয়ে গেল আকাশেই। চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে সাম্ভালার সব চিহ্ন, দৃশ্য। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাম্ভালা হারিয়ে গেল। যেন সেখানে কিছু ছিলই না। অন্ধকার খাদটা প্রকট হয়ে দেখা দিল আগের মতোই। কিছুক্ষন স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এলো সবাই।

বৃদ্ধ লামা সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে চলে গেলেন। কেউ তাঁকে বাঁধা দিল না। পাইন বনের গাছের সারিতে হারিয়ে গেলেন তিনি।

***

কতো দীর্ঘ একটা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এতোকাল, পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছিল তার কাছে। এমন কোন দেশ নেই যেখানে পা রাখেননি তিনি, মিশেছেন মানব সভ্যতায় অবদান রাখা মহান সব ব্যক্তিদের সাথে, এমন সব চরিত্র বেছে নিয়েছেন যা এককথায় অদ্ভুত, সেইসব চরিত্রের কার্যকলাপে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনতে পেরেছেন যা হয়তো ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিয়েছে, সেখানে তার নাম হয়তো লেখা নেই, কিন্তু বিন্দুমাত্র হতাশা নেই তাতে, বরং অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে আছে। একটা মিথ সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে শেষপর্যন্ত। সাম্ভালায় পা রাখার পর মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তার থাকার জন্য এখন কেবল এই জায়গাটাই উপযুক্ত। এখানে কোন যুদ্ধ নেই, মানুষে মানুষে ঘৃনা বা দ্বেষ নেই। পৃথিবীময় সাম্ভালা ছড়িয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হতো, যদিও জানেন সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন, মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভাসছে লোকটা। ইশারায় তাকে কাছে ডাকল, তারপর ছেলেমানুষের মতো দৌড়ে চলে গেল দূরে। হাসলেন তিনি। সন্ন্যাসীও তার কাঙ্খিত গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে অবশেষে। একদিন হয়তো আরো অনেকে আসবে এই অসীম সুখের দেশে। পুরো পৃথিবীটাই হয়ে উঠবে সাম্ভালা।

হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে যাচ্ছেন তিনি। তাদের দুজনকে অভ্যর্থনা জানাতে অনেক লোক এসেছে, রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, হাত নাড়ছে, কেউ কেউ ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে। নারী-পুরুষ সবার পরনে শুভ্র পোশাক, চমৎকার চাকচিক্যময় সব ঘরবাড়ি আর প্রাসাদ চারপাশে, বাতাসে সুন্দর গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ একটা জীবনের শেষ লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছেন এবার।

***

এবার ঘরে ফেরার পালা। দীর্ঘ অভিযাত্রায় সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত ড. লতিকা। সন্দীপ, সুরেশ আর রাজু আহত, বাকিরা ঠিক থাকলেও কারো শরীর বা মন খুব একটা ভালো নেই। দীর্ঘ পথ হেঁটে, পাহাড় বেয়ে ঠিক সেখানে এসে দাঁড়াল যেখানে জিপ লুকিয়ে গিয়েছিল রাশেদ। সেখানে এসে মর্মান্তিক দৃশ্যটা দেখে মন আরো খারাপ হয়ে গেল সবার। ড্রাইভার দুজনকে জিপের সাথে বেঁধে রেখে গিয়েছিল কেউ, সম্ভবত আকবর আলী মৃধা। সেখান থেকে ছুটতে পারেনি ওরা, অনাহার আর প্রচন্ড শীতে মরে কাঠ হয়ে গেছে দুজন।

কোনমতে ওদের সক্কার করে জিপ বের করে আনলো সুরেশ ঝোঁপের আড়াল থেকে। ঝাংমু যেতে হবে, তবে ঝাংমুতে ঢোকার আগেই জীপটা ছেড়ে যেতে হবে রাস্তায়। নয়তো ড্রাইভারদের খোঁজ জানতে চাইবে সবাই, যার গ্রহনযোগ্য উত্তর দেয়া সম্ভব না কারো পক্ষে।

জীপ চলতে শুরু করেছে। সবার পেছনে বসেছে রাশেদ, রাজুকে নিয়ে। এখন অনেকটা সুস্থ রাজু। সন্দীপ আর ড. আরেফিন বসেছেন মাঝখানের সীটে। কষ্ট হলেও ড্রাইভিং করছে সুরেশ, তার পাশে বসেছে লতিকা। গত কিছুদিন একসাথে থেকে সাহসী এই যুবককে পছন্দ করে ফেলেছে সে। তবে এই যুবকের সাথে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে কোন আকাংখা নেই লতিকার, তারা দুজন সম্পূর্ন আলাদা দুই ভুবনের মানুষ। সাম্ভালা সত্যি সত্যি আছে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া এই অভিযানে, প্রফেসর সুব্রামানিয়াম যদি থাকতেন তবে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো কোন ধারনাই নেই লতিকার, তবে বাবার কাছে সাম্ভালা খুঁজে পাওয়া বিষয়ে কিছু বলবে না স্থির করল। কেননা, সাম্ভালা আছে জানতে পারলে এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি রওনা দিয়ে দিতে পারেন রামহরিকে সাথে নিয়ে।

সন্দীপ চুপচাপ বসে আছে ড. আরেফিনের পাশে। এতোদূর এসে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে সে, অতীতকে ভুলে যাওয়া ভালো। দুটো আঙুল হারানো গেলেও তাতে খুব একটা চিন্তিত নয় সে, জীবন নিয়ে যে দেশে ফিরতে পারছে সেটাও অনেক বড় পাওয়া। অনেক দূর পেরিয়ে গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসেও মনে হয়েছে ধুলিকালিময় এই পৃথিবী অনেক ভালো, এখানে তার ভালোবাসা আছে, নিজের সন্তান আছে, যাকে সে একজন পবিত্র মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। লতিকাকে নিয়ে নিজের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করতো একসময়, সেই অপরাধবোধ থেকেও এখন নিজেকে অনেকটা মুক্ত মনে হচ্ছে। লতিকা এখন সম্পুর্ন স্বাধীন একজন নারী, যে তার ভবিষ্যত নিজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারে, পুরানো কিছু সে এখন অনেক পেছনে ফেলে এসেছে।

ড. আরেফিনের দিকে তাকাল সন্দীপ। মানুষটাকে খুব ভালো লেগে গেছে তার, সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারেন, ভালো-মন্দ বেছে নিতে পারেন। তার সাথে সব সময়ই যে একমত হয়েছে তা নয়। মাঝে মাঝেই তার কথায় অনাস্থা প্রকাশ করেছেন ভদ্রলোক, এখন মনে হচ্ছে লোকটার ধারনাই ঠিক। ভিনগ্রহ বা এই ধরনের কোন কিছুই সাম্ভালার সাথে যায় না।

ড. আরেফিন ভাবছিলেন, সাম্ভালা যে সত্যিই আছে তা নিজের চোখে দেখে ফিরছেন এটাই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, সাম্ভালার সেই অপূর্ব দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভাসছে। তিব্বতের সৌন্দর্য ঠিকমতো উপভোগ করতে পারেননি,এই কটা হয়তো পরে কোন একসময় পূরন করে নেবেন। স্ত্রীর ভালোবাসা আরেকবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, তাকে খোঁজার জন্য রাশেদকে পাঠিয়েছে এতোদূর। রাশেদের প্রতিও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার। সাহসী এই যুবক জীবনে অনেক দূর যাবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি।

ড. আরেফিনকে সুস্থ দেহে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে এতেই আনন্দিত রাশেদ, ব্যক্তিগতভাবে তার চাওয়ার তেমন কিছু ছিল না। আফরোজা আরেফিনের কাছে দেয়া কথা রাখতে পেরেছে, এটাই তার প্রাপ্তি। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সাম্ভালার দেখা পাওয়া। বিজ্ঞানের বাইরে এই ধরনের কিছু যে সত্যিই থাকতে পারে তা ধারনা করা সত্যিই অসম্ভব। লখানিয়া সিং নামক সেই যুবকের কথাগুলোও তার মাথায় ঘুরছে। সত্যিই লোকটা আব্দুল মজিদ ব্যাপারি কি না সেটা প্রমান করার কোন উপায় নেই। একটা উপায় অবশ্যই আছে, কিন্তু তার আগে বিশ্রাম দরকার রাশেদের, বিশ্রাম।

তিব্বতি সুরে শিস দিতে দিতে গাড়ি চালাচ্ছে সুরেশ ওরফে রোহিত গোয়েঙ্কা, শারিরীক অসুস্থতা নেই এখন, তার মিশন সফল, বাম হাতে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ছোট রেকর্ডারটার উপস্থিতিটা বুঝে নিল। লখানিয়া সিংয়ের সেই অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারন পুরোটাই রেকর্ড আছে এখানে। যদিও কতোটা পরিস্কার বোঝা যাবে তাতে যথে সন্দেহ আছে তার।

জিপ চলছে। দীর্ঘ এক অভিযাত্রায় সমাপ্তি খুব কাছেই, তারপর যে যার ঠিকানায় ফিরে যাবে।

*

উপসংহা

কিছুদিন হলো ঢাকায় ফিরেছে রাশেদ, চুপচাপ কেটে যাচ্ছে দিন কোন ঝামেলা ছাড়া। কয়েকদিন আগে দেখা হয়েছে লিলির সাথে। অনেকদিন পর দেশে ফিরেছে লিলি, মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে রাশেদ, এখানে সেখানে। মাঝে একদিন ড. আরেফিনের বাসায়ও গিয়েছিল। রাজু আর লিলিকে নিয়ে। দারুন আড্ডা জমেছিল সেদিন। আফরোজা আরেফিন সবাইকে খাইয়েছেন ইচ্ছেমতো। গত কয়েকমাসে বেশ শুকিয়ে গিয়েছিলেন ড. আরেফিন, তাকেও বেশ হৃষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছিল দেখে। রাজু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হিমালয় ভ্রমনের জন্য, এভারেস্টেও চূড়ায় উঠবে বলে মনস্থির করেছে, টাকা পয়সা যা লাগে খরচ করবেন আফরোজা আরেফিন, নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন তিনি রাশেদ আর রাজুকে।

গতকাল পত্রিকায় এক অদ্ভুত খবর ছাপা হয়েছে, নেপাল-তিব্বত সীমান্তের কোন এক স্থানে সুদর্শন এক তরুনকে বাঁচিয়ে তুলেছে স্থানীয় বৈদ্যরা। সেই তরুন দেখতে গ্রীক দেবতাদের মতো, কথা বলতে পারে না, কিন্তু তরুনের শরীরে অপরিমেয় শক্তি। একটানা ছুটতে পারে মাইলের পর মাইল। খবরটা পড়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাশেদের, পৃথিবীতে কত কিছু ঘটতে পারে তার কোন হিসেব নেই। এই তরুন কি সেই, যে লখানিয়া সিংয়ের সাথে লড়েছিল, যাকে লখানিয়া সিং খাদে ফেলে দিয়েছিল?

কে জানে? আপাতত এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার কোন ইচ্ছেই তার নেই।

গত কিছুদিন যাবত অস্থিরতা আবার পেয়ে বসেছে রাশেদকে। তার উপর এক; গুরুদায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে আসামের দিকে ছোট একটা গ্রামে যেতে হবে তা সেখানে লখানিয়া সিংয়ের বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে। লখানিয়া সিংয়ের বুড়ি মাকে কিছু টাকা দিয়ে আসতে হবে। আর নিয়ে আসতে হবে বিশেষ দুটো সুটকেস যা নাকি বাড়ির পেছনে মাটি চাপা দেয়া আছে।

কী আছে সেই সুটকেসে? জানে না রাশেদ।

তবে জানতে তাকে হবেই। একজনকে সে কথা দিয়েছে, যে কোনভাবেই হোক, জিনিসগুলো নিজের কাছে এনে রাখবে। অন্য কারো হাতে পড়তে দেয়া যাবে না।

কি আছে সেই সুটকেসে? উত্তর না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না রাশেদ।

লিলি আর রাজুকে কিছু না বলে একরাতে বেরিয়ে পড়ল রাশেদ। উত্তরাধিকার বড় কঠিন জিনিস। এই দায়িত্ব বর্তালে তা কোনভাবেই এড়ানো যায় না। তার গন্তব্য এবার আসামের ছোট এক গ্রাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *