৩.৬ শারীরিক পরিশ্রমে

অধ্যায় ৫১

শারীরিক পরিশ্রমে খুব একটা অভ্যস্ত নয় রাশেদ, গত কয়দিন টানা উপরে উঠতে গিয়ে বুঝেছে এভাবে আরো কয়েকদিন চললে সে নির্ঘাত মারা যাবে। অন্যদিকে রাজুকে দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না, বরং উপভোগ করছে সে। এর আগে পর্বতে উঠার কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও অনায়াসে রাশেদকে পথ দেখাচ্ছে রাজু। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে কৈলাস পর্বতের উচচতা ছয় হাজার মিটারের মতো, ছয় হাজার মিটার না হলেও অন্তত চার হাজার মিটার উচ্চতার কাছাকাছি অবস্থান এখন তাদের। পথ কেবল বন্ধুর হচ্ছে।

ড. কারসন আর দলবলের বেশ কিছু চিহ্ন চোখে পড়েছে, বিশেষ করে কিছুক্ষন আগে যে জায়গাটা পার হয়ে এসেছে তারা, সেখানে রীতিমতো ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্নও চোখে পড়েছে রাশেদের। বরফে রক্তের ফোঁটা দেখেছে একজায়গায়। যাই হয়ে থাকুক, খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই ড. কারসন আর দল এটা নিশ্চিত, একই কথা ড. আরেফিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিশ্চয়ই এই অভিযানের বিরুদ্ধে এমন কোন দল লেগেছে যারা সংখ্যায় এবং অস্ত্রশস্ত্রে ভারি। ড. কারসনের সাথে দেখা না হলে ড. আরেফিনকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আফরোজা আরেফিনকে কিভাবে মুখ দেখাবে সেটা নিয়েও চিন্তিত রাশেদ। ভদ্রমহিলা অনেক আশা করে পাঠিয়েছে তাদের।

সাম্ভালা বা এই ধরনের মিথে মোটেও বিশ্বাস করে না রাশেদ, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কিভাবে এই ধরনের মিথের পেছনে ছোটে তাই মাথায় আসে না তার। ড. আরেফিনের মতো মানুষ কেন এতো দূর দেশে এলেন, বুঝতে পারে না রাশেদ। এর আগেও প্রাচীন এক বই নিয়ে ড. আরেফিনের আগ্রহ ছিল সীমাহীন, অবশ্য তিনি আগ্রহি না হলে রাশেদের সমস্যা হতো সবচেয়ে বেশি, তাকে সাহায্য করার মতো আর কেউ ছিল না। সেই ঋন শোধ করার জন্য রাশেদ আসেনি,ড. আরেফিন কোন প্রতিদানের জন্য রাশেদকে সাহায্য করেননি,তিনি মানুষটাই অন্যরকম। কিন্তু আফরোজা আরেফিনের সেই মেইলটা তার চোখে ভাসে, ভদ্রমহিলার জীবন আবর্তিত হয় ড. আরেফিনকে ঘিরে, এমন একজন মানুষকে সাহায্য করতে না পারলে জীবনটাই অর্থহীন হয়ে যাবে।

কৈলাস পর্বতের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা, একজন দক্ষ শেরপা সাথে থাকলে পাহাড়ে উঠা আরো অনেক সহজ হতো হয়তো। অক্সিজেন সল্পতার সাথে কিভাবে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তা জানা যেতো। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে রাশেদের, মাঝে মাঝে তাই বিশ্রাম নিচ্ছে। ড. কারসন আর তার দল কোনদিক দিয়ে গিয়েছেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শুধু আরো নতুন কিছু পায়ের ছাপ যোগ হয়েছে তার সাথে। অন্তত পনেরোজন মানুষের ট্র্যাক অনুসরন করে যাচ্ছে ওরা এবং ক্রমশ নীচের দিকে নামছে। এমন হতে পারে যারা ড. কারসনকে বন্দী করেছেন তাদের ঘাঁটি আরো নীচুতে, কিংবা ড. কারসন স্বেচ্ছায় ওদের সাথে গিয়েছেন।

হঠাৎ রাজু হাত উঠিয়ে থামতে বলল রাশেদকে। ইশারায় দূরের কিছু একটা দেখাল। রাশেদ তাকাল, অনেক দূরে বিন্দুর মতো কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে, তাঁবুগুলোকে দেখাচ্ছে খেলনার মতো, সাদা পোশাকপড়া লোকগুলোর হাতে অস্ত্র।

তোর কি মনে হয় এগুনো ঠিক হবে? জিজ্ঞেস করল রাজু, পিছু হটে রাশেদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

হুমম, ওখানেই ড. কারসন আছেন, রাজু বলল, আমার মনে হয় ড. আরেফিনকে আমরা ওখানেই পাবো।

তাহলে তো আর কথা নেই, রাজু বলল, চল এগুই।

এখন খুব সাবধানে এগুতে হবে, দলটা সম্ভবত পেশাদার, দূরে তাকিয়ে দ্যাখ, এবার রাশেদ ডানদিকে ইশারা করল আঙুল দিয়ে, তারপর বামদিকে। বরফ দিয়ে ছোট ছোট ঢিবির মতো বানানো হয়েছে তাঁবুগুলোর চারপাশে। সেখানে পাহারাদার দেখা যাচ্ছে, অস্ত্র তাক করে আছে, কোন নড়াচড়া দেখলেই গুলি করবে।

ক্যামোফ্লাজ নিতে হবে আমাদের, রাজু বলল।

সেরকম কিছু কি আছে আমাদের কাছে?

ভারি কিছু জ্যাকেট কিনেছিলাম, সাদা রঙের, সাথে সাদা প্যান্ট তো আছেই।

সাদা প্যান্ট? আমার কোন সাদা প্যান্ট নেই।

কাঠমুন্ডুতে কিনেছিলাম, তোকে বলিনি,তুই রাগ করবি বলে, হাসল রাজু। এখন চল, জামা-কাপড় পাল্টাই।

এই অবস্থায়!

হ্যাঁ, বন্ধু, রাজু বলল, এখানে ড্রেসিং রুম পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

ভেরি গুড, রাশেদ বলল, প্রচন্ড অনীহা থাকলেও আপাতত এছাড়া কোন উপায় নেই, তাও ভালো রাজু বুদ্ধি করে প্যান্ট আর জ্যাকেট কিনেছিল।

রাজু তার ব্যাকপ্যাক থেকে একজোড়া জ্যাকেট আর প্যান্ট বের করে আনলো। বাড়িয়ে দিল রাশেদের দিকে।

আফসোস হচ্ছিল পিস্তলগুলোর জন্য, ওগুলো থাকলে কিছুটা ভরসা পাওয়া যেতো, খালি হাতে পেশাদার অস্ত্রধারীদের সাথে লাগতে যাওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

বেশিক্ষন লাগল না কাপড় বদলে নিতে, এবার ধীরে ধীরে ঐ তাঁবুগুলোর দিকে অগ্রসর হবার পালা।

***

বুঝতে পারছেন না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করবে, নাকি অন্য কোন শারীরিক নির্যাতন অপেক্ষা করছে তার জন্য? দুই পাশ থেকে সাদা পোশাকধারি দুইজন সৈন্য চেয়ার থেকে টেনে হিঁচড়ে তাঁবুর বাইরে নিয়ে এসেছে তাকে।

দিনের আলোয় অনেকদিন পর বাইরে বেরিয়েছেন তিনি, চারদিকে সাদা আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল শুরুতে। পাশাপাশি বেশ কিছু তাঁবু খাটানো দেখতে পেলেন। এটাই সম্ভবত ওদের সাময়িক ঘাঁটি, তাঁবুগুলোর চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকারে কিছুদূর পরপর ছোট ছোট বাংকার বানিয়ে পাহারা দিচ্ছে লোকজন। চ্যাঙ কিংবা বৃদ্ধ লামাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও, নিদিষ্ট একটা তাঁবুর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।

পায়ে জোর পাচ্ছেন না ড. আরেফিন, পিঠে রাইফেলের বাটের গুতো খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। মাথা ঘুরছিল, পরনে ভারি জ্যাকেট থাকলেও বেশ শীত করছিল তার। সৈনিক দুজনের ধাক্কায় তাঁবুতে ঢুকলেন তিনি।

যা আশা করেননি,তাই চোখের সামনে দেখতে পেলেন। ড. কারসন, সন্দীপ, লতিকা আর সুরেশ, চারজনকেই খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে চেয়ারে বসে আছে চ্যাঙ আর বৃদ্ধ লামা।

নিন, সঙ্গিদের সাথে যোগ দিন এবার, ড. আরেফিন, বৃদ্ধ লামা বললেন, হাসি মুখে।

ড. কারসন অবাক হয়েছেন, তবে তার চেয়ে খুশি হয়েছেন বেশি তা চেহারা দেখেই বুঝতে পারছেন ড. আরেফিন। মেয়েটার সাথে দেখাই হয়নি,তবে এ যে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের মেয়ে তা বুঝতে সমস্যা হলো না তার। সন্দীপ এবং সুরেশকে দেখেও খুশি মনে হলো, যদিও সুরেশের চেহারা দেখে বুঝতে পারছেন ভাব প্রকাশের সুযোগ অনেক কম সেখানে।

ড. কারসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, সৈনিক দুজন এসে তাকে বেঁধে দিলো খুঁটির সাথে।

আপনারা সবাই এখানে, আমরা তাহলে নতুন করে শুরু করি, কি বলেন? বৃদ্ধ লামা বললেন। উত্তর আসবে না জানেন, তাই নিজেই বলে চললেন, আমাদের ছোট একটা সংগঠন আছে, যাকে ইংরেজিতে বলা যায় প্রটেক্টরস অফ সাম্ভালা, যুবা বয়সে সেই সংগঠনের সাধারন একজন সদস্য ছিলাম আমি, এখন…, একটু থামলেন বৃদ্ধ, এখন আমিই প্রধান। যাই হোক, হাজার বছর পুরানো এই সংগঠনের কাজ একটাই, সাম্ভালাকে রক্ষা করা, বাইরের শত্রুর হাত থেকে, কেউ যেন এর খোঁজ জানতে না পারে। স্বাভাবিকভাবেই, ড. কারসন ম্যাকলডগঞ্জে যখন আমার কাছে এলেন, তিনি ভুল করলেন, মহাভুল। আমার উচিত ছিল তখনই একটা কিছু করে ফেলা, যাই হোক, আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জিজ্ঞেস করুন, কেন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, ড. কারসনের উদ্দেশ্যে বললেন বৃদ্ধ লামা।

শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ড. কারসন, বৃদ্ধ লামা আসলে কি বলতে চাইছে বুঝতে পারছেন না, মাথা নাড়ালেন তিনি।

জিজ্ঞেস না করলেও আমি বলবো, একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন বদ্ধ, এতো জীবন ধরে প্রটেক্টরস অভ সাম্ভালায় কাজ করে একটা জিনিস ইদানিং খুব পীড়া দিচ্ছিল আমাকে। যে জিনিস রক্ষা করার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি আমি এবং আমার লোকেরা, সেই জায়গাটা অন্তত একবার নিজের চোখে দেখা দরকার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন?

আবারও ড. কারসনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ লামা, বুঝতে পারলেন এবারও কোন উত্তর পাবেন না ড. কারসনের কাছ থেকে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সাম্ভালার অবস্থান আমরা নিজেরাই জানি না, বলে হাসলেন বৃদ্ধ, চ্যাঙের দিকে তাকালেন। আমি ঠিক করেছি, সাম্ভলার অবস্থান জানা জরুরি আমাদের জন্য। আপনি কি বলেন?

নো কমেন্টস,ড. কারসন বললেন কোনমতে।

ড. কারসন, আপনার মতো দায়িত্বশীল মানুষের মুখ থেকে নো কমেন্টস আশা করি না, যেহেতু এখানে বেশ কয়েকজনের জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার জড়িত।

আমরা কিছু খুঁজে পাইনি এখনো, পাবো বলেও মনে হয় না, ড. কারসন বললেন।

এভাবে এড়িয়ে গেলে হবে না, ড. কারসন, বৃদ্ধ লামা বললেন, চ্যাঙের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন, উঠে দাঁড়াল চ্যাঙ, কিছু একটা রু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে হলো, আপনার একটু সহযোগিতা আমরা আশা করতেই পারি।

আমি কিছু জানি না, কিভাবে সহযোগিতা করবো।

আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না, ড. কারসন, বৃদ্ধ লামা বললেন, এরপর চ্যাঙ কী করবে সেটা চ্যাঙের ব্যাপার! বলে উঠে গেলেন বৃদ্ধ।

চ্যাঙ এগিয়ে যাচ্ছে লতিকার দিকে, তার হাতে একটা কাঁচি, বেশ ধারাল মনে হচ্ছে জিনিসটা। বাতাসে কাঁচি চালাচ্ছে চ্যাঙ, দেখাচ্ছে এরপর সে কি করতে যাচ্ছে। পাগলের মতো হেসে উঠছে, উল্লাস করে দেখাচ্ছে কতোটা আনন্দ পাবে লতিকার হাতে কাঁচিটা চালাতে। লতিকা চুপচাপ তাকিয়ে আছে চ্যাঙের দিকে, হয়তো লোকটা তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, হয়তো আশা করছে ড. কারসন সাম্ভালার ঠিকানা বলে দেবেন লতিকাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু চ্যাঙের চোখের দিকে তাকিয়ে লতিকার মনে হলো চ্যাঙ সাধারন মানুষ নয়, লোকটা ঠান্ডা মাথার একজন খুনি। যে খুন করার আগে নির্যাতন করে মজা পায়, আর গোয়েন্দা সংস্থার এই পদ তাকে বিপজ্জনক শত্রুদের খুন করার স্বাধীনতা দিয়েছে।

লতিকার কাছাকাছি চলে এসেছে চ্যাঙ, বারবার তাকাচ্ছে ড. কারসনের দিকে, বোঝার চেষ্টা করছে ড. কারসন কিছু বলবেন কি না। লতিকার চেহারা লাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। তার নাকের ঠিক দুই ইঞ্চি আগে ক্রমাগত চলছে কাঁচিটা, নাপিতের হাতে কাঁচি যেমন চলতেই থাকে, চ্যাঙের হাতে তেমন ক্রমাগত চলছে সেটা। শব্দটাকে বীভৎস মনে হচ্ছে, মাথায় ক্রমাগত ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা আঘাত করে যাচ্ছে। লতিকা প্রস্তুত, নিযাতন করে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাকে মেরেই ফেলবে চ্যাঙ, তবু ড. কারসনের কাছ থেকে কিছু পাবে না।

নাকের ঠিক এক ইঞ্চি আগে কাঁচি থেমে গেল, চ্যাঙ উঠে দাঁড়িয়েছে, গম্ভীর চেহারায় এগিয়ে গেল ড. কারসনের দিকে।

একজন সুন্দরি মহিলার অঙ্গহানি করতে ভালো লাগবে না আমার, হেসে বলল চ্যাঙ, তার চেয়ে বরং ঐ গোমড়ামুখো বদমাশটাকে শায়েস্তা করি, ও আমাদের কোন কাজেই আসবে না।

ড. কারসন বুঝতে পারছিলেন না কার কথা বলছে চ্যাঙ, সন্দীপের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াল তখন বুঝতে পারলেন। চোখের নিমিষে ঘটনা ঘটে গেল, সন্দীপের চিৎকারে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল ড. কারসনের। সন্দীপের বাম হাতের দুটো আঙুল একসাথে কেটে ফেলেছে চ্যাঙ, ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে ক্ষতস্থান থেকে। চিৎকার করেই যাচ্ছে সন্দীপ, চ্যাঙের ইশারায় দুজন সৈনিক তোয়ালে নিয়ে এসে সন্দীপের হাতের উপর ধরল।

চ্যাঙের চেহারায় পুরো পাগলামির ছাপ স্পষ্ট। কখন কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। ড. আরেফিন মুখ ঢেকে রেখেছেন, সন্দীপের চিৎকার তিনি সহ্য করতে পারছেন না। লতিকা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে চ্যাঙের দিকে, সুরেশ বোধশক্তিহীনের মতো পড়ে আছে। তার আধখোলা চোখে সে দেখেছে সবই, কিন্তু চেহারা প্রতিক্রিয়া শুন্য।

ড. কারসন, আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি করতে পারি, ড. কারসনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে চ্যাঙ, কাঁচিটা ছুঁড়ে ফেলেছে দূরে, এবার অন্য একটা জিনিস ব্যবহার করবো, সেটা কার উপর করবো, কিভাবে করবো, আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না।

তুমি কি মানুষ! গুঙিয়ে বললেন ড. কারসন।

হ্যাঁ, মানুষ, তবে ভিন্ন প্রজাতির, উঠে দাঁড়াল চ্যাঙ, সৈনিকদের ইশারা করতেই ওরা লম্বা একটা হাতুড়ি এনে দিল চ্যাঙের হাতে। ঠিক মাথার মাঝখানে বসাবো, খুলি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, তাই না ড. কারসন?

কাল সকালে আমরা রওনা দেবো, সাম্ভালার উদ্দেশ্যে, ড. কারসন বললেন, একমাত্র আমিই তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো।

আজ নয় কেন, ড. কারসন? মোলায়েম গলায় বললেন বৃদ্ধ লামা, তাঁবুর প্রবেশপথের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, ড. কারসনের কণ্ঠ শুনে ভেতরে ঢুকেছেন।

বিশেষ সময়ে বিশেষ জায়গায় উপস্থিত থাকতে হবে, ড. কারসন বললেন, কাল সকালেই রওনা দেবো আমরা।

আপনি কি ভেবেছেন এভাবে সময় নিতে পারবেন, যাতে পালানোর বুদ্ধি আঁটা যায়?

আমি পালাবো না এটুকু নিশ্চিত থাকুন, ড. কারসন বললেন, কিন্তু কারো উপর নির্যাতন করা যাবে না।

ঠিক আছে, বৃদ্ধ লামা বললেন, চ্যাঙ-কে বাইরে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। হতাশ চেহারায় তাঁবুর বাইরে চলে গেল চ্যাঙ, হাতের হাতুড়ীটা ছুঁড়ে ফেলেছে দূরে।

তাহলে কথা রইলো, আগামীকাল সকালে রওনা দিচ্ছি আমরা।

জি, ড. কারসনের কথার হেরফের হয় না, মিঃ…

নিজের নাম বলার প্রয়োজনবোধ করলেন না বৃদ্ধ লামা। বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে। একটানা চিৎকার করে নেতিয়ে পড়েছে সন্দীপ, ড. কারসনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, একটু আগে বললেই পারতেন মি. কারসন!

উত্তর দিলেন না ড. কারসন। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, এখন উত্তেজিত হলে সবারই ক্ষতি হবে।

অন্তত আজকের দিনটা সময় পাওয়া গেছে, এই সময়টায় কিছু না কিছু বের করতে হবে। সাম্ভালা ওদের হাতে পড়তে দেয়া ঠিক হবে না।

*

অধ্যায় ৫২

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাতে থাকার জন্য নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজে নেয়া দরকার। যজ্ঞেশ্বর একটানা হেঁটে ক্লান্ত, দূর থেকে দেখা ছোট তাঁবুগুলো এখনো অনেক দূরে মনে হচ্ছে। বোঝা অনেক কমিয়ে ফেলেছেন তিনি, সাথে শুধু আছে ছোট একটা তাঁবু। আর শেবারনের দেয়া সেই প্রাচীন ম্যাপ, যদিও সেটার কথা যজ্ঞেশ্বর জানে না। কাল সকালের মধ্যে তাঁবুগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে। ততক্ষনে বাংলাদেশি ঐ লোকটার কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু যজ্ঞেশ্বরের এখন যা অবস্থা তাতে বিশ্রাম না নিলে সন্ন্যাসীকে নিয়ে পথ চলা কঠিন হয়ে যাবে।

এখানে সন্ধ্যা নেমে আসে হঠাৎ করে, একটু আগেও বিকেলের আলো ছিল, এখন কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। তিনি জানেন, সাম্ভালার খুব কাছে চলে এসেছেন, এখন শুধু সঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করার অপেক্ষা।

যজ্ঞেশ্বরের জন্য তাঁবু খাঁটিয়ে দিলেন তিনি। শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল সন্ন্যাসী।

কৈলাস শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। রহস্যময় এই চূড়া, হিন্দু ধর্মের অবতার শিবের আবাস। আরো অনেক ধর্মেই বিশেষ সম্মানের সাথে দেখা হয়। তার নিজেরও চোখ বুজে আসছিল। শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি মানসিক উত্তেজনাই হয়তো এর কারন।

অনেক দূরে গোলাকার একটা বৃত্ত চোখে পড়ল তার এই সময়, পাইন গাছের সারি ভেদ করে উপরে ঠিক ভাসমান অবস্থায় আছে বৃত্তটা। ঠিকমতো বুঝে উঠার আগেই বৃত্তটা মিলিয়ে গেল যেন, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, বৃত্তটা সোনালী রঙের, মনে হয় যেন খাঁটি সোনা দিয়ে বানানো। তন্দ্রার ঘোরে তিনি কি ভুল দেখেছেন? সন্ধ্যার ডুবন্ত সুৰ্য্যকেই সোনালী গোলক বলে ভুল হচ্ছে?

চোখ কচলে আবার তাকালেন, সূৰ্য্য ডুবে গেছে। সোনালী গোলকের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।

হ্যাঁ, ভুলই দেখেছেন তিনি!

সন্দেহ দূর করার জন্য জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে শেবারনের দেয়া চামড়ার খোপটা বের করলেন তিনি। এবার মনে হচ্ছে ভুল দেখেননি তিনি, চ্যাপের ঠিক মাঝখানেই একটা গোলক আঁকা, ঠিক যেমনটা একটু আগেই তিনি দেখেছেন। গোলকটা একটা তোরনের উপর বসানো, সাম্ভালার প্রবেশপথ!

সাম্ভালা তাহলে শুধুই একটা মিথ নয়, সত্যিই এর অস্তিত্ব আছে! আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল তার। অনেক অনেক বছর আগে ইতালির এক বিজ্ঞানীকে দেখেছিলেন নগ্ন গায়ে ইউরেকা ইউরেকা বলতে বলতে ছুটে বেড়াতে। তার নিজের অনুভূতিও এখন অনেকটা সেরকম। সব ক্লান্তি মুছে গেছে যেন হঠাৎ করেই, চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাব উধাও। যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন। গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। সন্ন্যাসীকে আজ আর জাগানো ঠিক হবে না।

আজ সারা রাত তার ঘুম হবে না, ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে রওনা দেবেন বলে ঠিক করলেন।

***

সন্ধ্যার পরপর মনে হলো এবার থামা দরকার। ভারি পোশাক পড়ে একটানা হেঁটে এসেছে ওরা অনেকদূর, সাথে কোন কিছু আনেনি,দুটো স্লিপিং ব্যাগ ছাড়া। বাকি সব জিনিসপত্র ছোট একটা গর্তে লুকিয়ে এসেছে, উপরটা পাথর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না ভেতরে কিছু আছে কি না।

মনে হচ্ছে ড. আরেফিন, ড. কারসন আর তার দলবলকে ঐ তাঁবুগুলোতে পাওয়া যাবে। তবে অস্ত্র নিয়ে যেভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে তাতে খুব সহজে কাছে ঘেষা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

সন্ধ্যা হয়ে গেলেও তাঁবুগুলোকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বড়সড় একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে রাশেদ আর রাজু। আজ রাতটা এখানেই কাটাবে বলে ঠিক করেছে ওরা। পালাক্রমে একজন জেগে থাকবে, অপরজন ঘুমাবে। রাজু মনে করে কিছু বিস্কিট নিয়ে এসেছিল, নেপালে থাকতে কেনা, ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে আছে, কামড় দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে দাঁত দিয়ে বিস্কিট ভাঙার শব্দ সুদূর কাঠমুন্ডু থেকেও শোনা যাবে।

রাজু এরমধ্যেই ক্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়েছে, ওর নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছে রাশেদ। পুরো এলাকায় এই নাক ডাকার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই এখন। শব্দটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আকাশের তারা গোনার দিকে মন দিলো রাশেদ, মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে তাঁবুগুলোকে দেখে নিচ্ছে। ব্যাটারী চালিত আলোতে আলোকিত হয়ে আছে জায়গাটা। একটা তাঁবুর সামনে চারজন প্রহরী অস্ত্রহাতে পাহারায় দাঁড়ানো। ঐ তাঁবুতেই হয়তো ড. আরেফিন আছেন, কিংবা ড. কারসন।

তাঁবুকে ঘিরে যে বলয় তৈরি করা হয়েছে তা এড়িয়ে ভেতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। চোখ রাখতে হবে সবসময়, আর একটু সাবধান হতে হবে। এখানে ভুল করার সুযোগ নেই, ড. আরেফিন কিংবা ড. কারসন এখানে আছেন এতোটুকু নিশ্চিত না হয়ে তাঁবুগুলোর দিকে যাওয়া যাবে না।

খুব একা একা লাগছিল রাশেদের, নিজ দেশ থেকে এতো দূরে এসে এতো বড় ঝুঁকি নেয়া হয়তো ঠিক হয়নি। স্বাভাবিক একটা জীবন চেয়েছিল সে, কিন্তু অস্বাভাবিকতা যেন তার পিছু ছাড়ছে না। ড. আরেফিনকে উদ্ধার করতে পারলে তার দায়িত্ব শেষ। এরপর এই ধরনের কোন কাজে নিজেকে জড়াবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ। তবে শান্তির জীবন হয়তো তার জন্য নয়। আকবর আলী মৃধার মতো একজন শয়তান উপাসকও তার পেছনে লেগেছে। সম্ভবত এতোক্ষন তিব্বতে চলে এসেছে তাকে খুঁজতে। এই লোক যতোদিন বেঁচে আছে তততদিন নিজেকে নিরাপদ ভাবার কোন সুযোগ নেই। হয় রাশেদকে মরতে হবে, নয় আকবর আলী মৃধাকে। নিজের মৃত্যু কখনোই কাম্য নয় রাশেদের, সেক্ষেত্রে অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও আকবর আলী মৃধাকে মৃত্যু উপহার দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

* * *

তার নিজেরও বেশ বয়স হয়েছে বুঝতে পারছেন আকবর আলী মৃধা। টানা কয়েক ঘন্টা উপরে উঠার পর শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। আগে বুঝতে পারলে অতিরিক্ত অক্সিজেন সাথে করে নিয়ে আসতেন।

সোহেলকে বললেই হতো, কোন না কোনভাবে ম্যানেজ করে ফেলতো। কিন্তু কে জানতো এতো উঁচু এই পাহাড়ে মরতে আসবে রাশেদ!

সেই তুলনায় আহমদ কবির এখনও অনেক শক্ত, চেহারায় কোন ক্লান্তির ছাপ পড়েনি,আগেও হয়তো পাহাড়ে উঠেছে, ভাবলেন আকবর আলী মৃধা। সোহেলও ক্লান্ত, মোটাসোটা শরীর নিয়ে এতোটা উঁচুতে উঠে কাহিল অবস্থা বেচারার, মুখ ফুটে বলছে তিনি কিছু মনে করেন কি না ভেবে।

হেলান দিয়ে বসার মতো কোন জায়গা নেই, তাই যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই বসে পড়লেন আকবর আলী মৃধা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষন হলো। এই ধরনের জায়গায় রাত কাটানোর মতো কোন প্রস্তুতি ছিল না। তাহলে সিপিং ব্যাগ কিংবা ছোট তাঁবু সাথে আনা যেতো। এখন কি করবেন বুঝতে পারছেন না আকবর আলী মৃধা। আজ রাতটা জেগেই কাটাতে হবে।

আহমদ কবিরকে পাশে বসতে বললেন, বয়স্ক লোকটা কোনমতে পাশে বসল, সোহেল দাঁড়িয়ে আছে, তাকিয়ে আছে দূরে, যেন কিছু চোখে পড়েছে তার।

বস, দূরে কিছু তাঁবু দেখা যায়, সোহেল বলল, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। দূরে একটা জায়গা নির্দেশ করলো আঙুল দিয়ে।

এখানে এসে বসো, আকবর আলী মৃধা, এখানে তাঁবু আসবে কোত্থেকে?

কিন্তু…আমি তো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, সোহেল বলল।

তাঁবু থাকুক, এতোদূর যাওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নেই আমার, কাল সকালে যাওয়া যাবে, এবার এখানে এসে বসো, আকবর আলী মৃধা বললেন।

তার নির্দেশ অমান্য করার শক্তি সোহেলের নেই, বাধ্যগত ছাত্রের মতো একপাশে এসে বসল।

ঘুম আসছিল আকবর আলী মৃধার। চোখ খুলে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিন দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। দুইপাশে দুজনকে রেখে মাঝখানে কোনমতে বসে আছেন তিনি।

চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। নীচে যে জিনিসটা দেখলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।

মনে হলো একজন মানুষ উঠে আসছে উপরে। এটা এমন এক জায়গা যেখানে অন্য কোন মানুষের দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, তাও সন্ধ্যার পরপর এমন সময়ে। সাহসী মানুষ তিনি, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন সত্যিই কিছু চোখে পড়েছে কি না, নাকি ভুল দেখেছেন।

চাঁদ উঠে গেছে এতোক্ষনে। পুরো এলাকাটা চাঁদের আলোয় কেমন ঝকঝক করছে, এই আলোয় চকচকে সাদা দেহটা আরেকবার চোখে পড়ল তখন, দ্রুত উঠে আসছে উপরে। দারুন একটা ধাক্কা যেন বুকে এসে লাগল, এও কী সম্ভব। এই মানুষটা এখানে কিভাবে!

নিজের হাতে চিমটি কাটলেন, স্বপ্ন দেখছেন কি না বোঝার জন্য, না, স্বপ্ন নয়, একদম বাস্তব, এবার বাঁ দিকে তাকিয়ে বুঝলেন অবাক দৃষ্টিতে সোহেলও তাকিয়ে আছে, মানুষটার দিকে।

হ্যাঁ, চলে এসেছে। একেবারে সামনে দাঁড়ানো। জলজ্যান্ত! তার আরেক অনুগত শিষ্য যাকে রাস্তার উপর থেকে তুলে এনেছিলেন একসময়। রক্ত যার খুব পছন্দ!

কিছু করতে হলো না, শিষ্য এসে টেনে তুলল তাকে, বুকে জড়িয়ে ধরল। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল সবকিছু। এই যুবককেই পাঠিয়েছিলেন রাশেদ আর ড. আরেফিনকে মেরে সেই বইটা ছিনিয়ে আনতে, দূর্ভাগ্যক্রমে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দলটা। বাকিরা বন্দুকযুদ্ধে মরে গেলেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সুদর্শন এই যুবক। কিন্তু সেখান থেকে এই এতোদূর তিব্বতে কিভাবে এলো তা কখনোই জানা যাবে না, কারন কথা বলতে পারে না যুবক।

দুই পাশে আহমদ কবির আর সোহেল এখনো তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে, তাদের ঘোর এখনো কাটেনি।

*

অধ্যায় ৫৩

প্রহরীদের একজন মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে কে কী অবস্থায় আছে, প্রতিবারই।

একই দৃশ্য দেখছে সে। কেউ তার জায়গা থেকে এক চুল নড়েনি,এমনকি মুখের ভাবেও কোন পরিবর্তন নেই। হঠাৎ দেখলে যে কেউ ভাববে তাঁবুর ভেতরের মানুষগুলো মূর্তিতে পরিণত হয়েছে অদৃশ্য কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায়। ড. কারসনের পাশেই বসে আছে লতিকা, চুপচাপ কেটে যাচ্ছে সময়, কেউ কোন কথা বলছে না। ড. আরেফিন এক কোনায় বসে আছেন, তিনিও চুপচাপ। সন্দীপ কিছুক্ষন আগেও ফিসফিস করে পানি চাইছিল, সেই ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। আর সুরেশ ঘোরের জগতে আছে, মাঝে মাঝে ভুল বকছে, আবার নীরব হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়ের জন্য।

ড. আরেফিনের খুশি হওয়ার কথা দলের বাকি সদস্যদের দেখতে পাওয়ার জন্য, কিন্তু খুব একটা খুশি লাগছে না তার। বিশেষ করে যখন জেনেছেন ড. কারসন সাম্ভালার সম্ভাব্য অবস্থান জানেন। অথচ তিনি সেটা কাউকে জানাননি। এতো ভনিতা করে সরাসরি তিব্বতে চলে এলেই হতো। মাঝখান দিয়ে ঝামেলা বাড়িয়েছেন।

ক্ষুধা পেয়েছে খুব, ওরা রাতে কিছু খেতে দেবে কি না সন্দেহ। চ্যাঙ খুব ভয়ানক ধরনের মানুষ, সাধারন মানুষের বিবেকবোধ বলে ওর কিছু নেই। কিন্তু বৃদ্ধ লামা তো অহিংস একজন মানুষ, তিনি কিভাবে নিরাপরাধ কয়েকজনকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন, ভাবছিলেন ড. আরেফিন।

তাঁবুর প্রবেশপথ দিয়ে বৃদ্ধ লামাকে ঢুকতে দেখলেন তিনি। পেছনে চ্যাঙ। সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। বৃদ্ধ লামা কিছু একটা বলতে এসেছেন মনে হলো। ড. কারসনের দিকে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ।

কাল সকালে আমরা রওনা দিচ্ছি, ড. কারসনকে বললেন তিনি, আমরা তিব্বতিরা জাতি হিসেবে খুব অতিথিপরায়ন। কাউকে না খাইয়ে ছাড়ি না। আপনাদের জন্য রাতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করেছি আমি।

ধন্যবাদ, কোনমতে বললেন ড. কারসন।

তবে এটুকু মনে রাখবেন, ড. কারসনকে বলতে গিয়েও থেমে গেলেন বৃদ্ধ লামা, চ্যাঙ-কে ইশারা করলেন তাঁবু থেকে বের হয়ে যেতে, ইতস্তত করলেও বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে চলে গেল চ্যাঙ। আমরা যেমন আতিথেয়তা করতে জানি, সেভাবে শত্রুকেও মোকাবেলা করতে জানি।

এই জন্যই তো আপনাদের দেশের লোক অন্যদেশে আশ্রিতের মতো থাকে, কথাগুলো বলল সুরেশ, তার গলায় তীব্র ঝাঁজ, বোঝা গেল তার কান এখনো ভালো কাজ করছে।

দেখুন মি. স্পাই, উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ লামা, তিব্বতের ইতিহাস আপনাদের পড়ানো হয়েছে কি না জানি না। গৌতম বুদ্ধের বানী পৃথিবীর এই ছাদে এসে পৌঁছেছে অনেক পরে, কিন্তু তাকে উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়েছে এখানেই, এই তিব্বতেই। যুদ্ধবাজ তিব্বতি জাতি একসময় রুশদের আক্রমন করেছে, ভারতবর্ষ আক্রমন করেছে, এমনকি চীনাদেরও রেহাই দেয়নি। কিন্তু সেই যোদ্ধারাই একসময় যুদ্ধের বদলে বেছে নেয় ধর্ম, দূর্গের বদলে তৈরি করে মন্দির। শত শত যোদ্ধার বদলে তৈরি হয় হাজার হাজার লামা। আমরা আধ্যাত্মিকতার চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পুরো চীন, ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত সবাই আমাদের জানতে আধ্যাত্মিক জাতি হিসেবে। নিজেদের অরক্ষিত করে তুলেছিলাম আমরা, ভেবেছিলাম আমাদের অহিংস নীতিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু তা কী হয়েছে? হয়নি। গণচীন নিজের দেশের অংশ মনে করে এক দিনেই দখল করে নিলো আমাদের দেশটাকে, হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ মারা গেল, স্বয়ং দালাইলামা দেশ ছাড়লেন বাধ্য হয়ে। নিজ দেশে আমরা পরাধীন হয়ে রইলাম। কেন জানেন? উত্তরের অপেক্ষায় সবার দিকে তাকালেন লামা, বুঝতে পারলেন এই প্রশ্নের উত্তর তাকেই দিতে হবে, কারন হচ্ছে আমরা ছিলাম। শান্তিপ্রিয়, অহিংস জাতি। কিন্তু আমরা সেটাকে বদলে দিতে চাই। আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। দেশকে আমরা স্বাধীন করে তুলবোই।

আপনি একজন ধর্মীয় গুরু, আপনার মুখে এসব শোভা পায় না, আবারও বলল সুরেশ, সে একটু উঠে বসেছে।

আমাকে ধর্ম শেখাতে আসবেন না, সুরেশ বাবু। সারাজীবন আমি ধর্ম-কর্ম করেছি, একজন বৌদ্ধ লামাকে কি ধরনের শিক্ষাদীক্ষা আর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারনাই নেই মি. সুরেশ, বৃদ্ধ লামা বললেন, ধর্ম আমাকে স্বাধীনতা দেয়নি,ব্যাপারটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে।

আপনি তো জঙ্গিবাদের কথা বলছেন, ড. আরেফিন বললেন এবার।

জঙ্গি বললেও সমস্যা নেই, আমার দেশের ষাট ভাগ জনগন যেখানে যাযাবর, আমরা তো একটু জঙ্গি হতেই পারি, নাকি? নিজের কৌতুক করার প্রয়াশে নিজেই হাসলেন বৃদ্ধ লামা। যাই হোক, আর কথা বাড়াবো না। একটু পরই খাবার চলে আসবে। খেয়ে ঘুম দিন। খুব সকাল সকাল উঠতে হবে।

বলে বেরিয়ে গেলেন বৃদ্ধ লামা।

এই লোকটার সম্ভবত মাথা খারাপ হয়েছে, বিড়বিড় করে বলল সুরেশ।

যথেষ্ট কারনও আছে তার পেছনে, সন্দীপ বলল, এতোক্ষন সে চুপ করে ছিল। তার কাটা আঙুলে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে চ্যাঙের লোক। ব্যথায় তার চেহারা কুচকে যাচ্ছিল।

তারপরও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি না, মনে হচ্ছে যুদ্ধবাজ কোন ফ্যানাটিকের পাল্লায় পড়েছি আমরা।

তিনি যুদ্ধবাজ হননি এখনো, পরিকল্পনা করছেন, সাম্ভালা খুঁজে পেলে হয়তো তিনি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন, সন্দীপ বলল।

সেটা কিভাবে? এবার জিজ্ঞেস করল লতিকা। সেও এতোক্ষন চুপচাপ ছিল, সন্দীপের কথাগুলো তার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।

ধরো, লতিকার দিকে তাকিয়ে বলল সন্দীপ, সাম্ভালায় গিয়ে তিনি এবং তার অনুসারিরা যদি অমরত্ব পেয়ে যান, তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তি তাদের মারতে পারবে না। তারা তিব্বতকে মুক্ত করবে, হয়তো একসময় পুরো পৃথিবীই দখল করে বসবে।

কি বলছেন এসব? এতো আজগুবি চিন্তা মানুষের মাথায় আসে না কি? পাশ থেকে অবাক কণ্ঠে বলল সুরেশ। অতি উৎসাহের বশে সে এবার উঠে বসেছে।

মানুষের মাথায়ই উদ্ভট চিন্তা আসে, ড. আরেফিন বললেন, সত্যিই যদি সাম্ভালা থেকে থাকে এবং সেখানে গেলে অমরত্ব পাওয়া যায়, তাহলে সেটা কে কিভাবে ব্যবহার করবে তা আমরা কেউ বলতে পারবো না আগে থেকে। এইজন্যই হয়তো সাম্ভালা কেউ খুঁজে পায়নি। খুঁজে পাবেও না।

ড. কারসন সাম্ভালার অবস্থান জানেন, লতিকা বলল।

উনি ধারনা করছেন, সত্যি কি মিথ্যা সেটা কালই প্রমান হবে, ড. আরেফিন বললেন।

তার কণ্ঠে রীতিমতো বিক্তি ঝরে পড়ল।

ড. কারসন তাকালেন ড. আরেফিনের দিকে, কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। বুঝতে পারছেন ড. আরেফিন রেগে আছেন তার উপর আগে থেকে কিছু না বলার কারনে, যা একদম যুক্তিযুক্ত। ড. আরেফিনের জায়গায় থাকলেও তিনিও হয়তো মেনে নিতে পারতেন না।

দুইজন প্রহরী ঢুকল এইসময়। তাদের হাতে প্লেট, সেখানে নানা ধরনের খাবার দেখা যাচ্ছে। খাবার দেখে তাঁবুর বাসিন্দারা ক্ষনিকের জন্য হলেও সাম্ভালা নিয়ে তর্ক করা ভুলে গেল। সারাদিন কারো পেটে তেমন কিছু পড়েনি।

*

অধ্যায় ৫৪

এরকম ভোর অনেকদিন পর দেখছেন তিনি। বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়ার মাথায় সূৰ্য্য যেন উঁকি দিলো ভয়ে ভয়ে, তারপর ধীরে ধীরে তার লজ্জা ভাঙল যেন, নিজের আলো ছড়িয়ে দিল সবখানে। সারারাত ঘুম হয়নি,আসলে ঘুমানোর মতো ইচ্ছেই হয়নি। মনে হচ্ছিল লক্ষ্যের এতো কাছাকাছি এসে ঘুমিয়ে থাকাটা অনুচিত হবে। যজ্ঞেশ্বর ঘুম থেকে উঠেছে এই মাত্র। নিয়মমতো ধ্যানে বসেছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিলেন তিনি। এবার নীচের দিকে নামতে হবে, আগে তাঁবুগুলোর দিকে যেতে হবে। বাঙালি লোকটাকে ছাড়াতে হবে। তারপর আসল কাজ।

যজ্ঞেশ্বরের ধ্যান ভাঙল তাড়াতাড়ি। সাথের জিনিসপত্র মোটামুটি গোছানোই ছিল, রওনা দিয়ে দিলেন তিনি। তাঁবুগুলোকে তার জায়গা থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ভোরের প্রথম ঘন্টায় নিশ্চয়ই কোন বিপদের আশংকা করবে না ওরা। এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে।

যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকালেন, সন্ন্যাসীকে বেশ উৎসাহী দেখাচ্ছে। বিনোদ চোপড়া চলে যাওয়ার পর যজ্ঞেশ্বরের চেহারায় হাসি দেখেননি তিনি।

দক্ষিন দিক থেকে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তার প্রতিপক্ষ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারছেন। যতোটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি মানুষটাকে। কিন্তু আর বেশিক্ষন এড়ানো যাবে না। মানসিকভাবে প্রস্তুত তিনি, গতবার আচমকা

আঘাতে অপ্রস্তুত হয়ে চলে গেলেও, এবার প্রতিপক্ষ আসছে তৈরি হয়ে।

তাঁবুগুলোর কাছাকাছি চলে এসেছেন। বড় একটা তাঁবু থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ বের হয়ে এসেছে। এরমধ্যে বাঙালি ভদ্রলোককে পরিস্কার চিনতে পারলেন তিনি। লোকটাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দলটাকে, এই দলটাকে তিনি ম্যাকলডগঞ্জে দেখেছিলেন। তার যতোদূর ধারনা, এই দলটাও রওনা দিয়েছে সাম্ভালার উদ্দেশ্যে। ওদের ঘিরে রাখা অস্ত্রধারি চাইনীজ সৈন্যরাও নিশ্চয়ই সেখানেই চলেছে এখন। আপাতত এই দলটাকে অনুসরন করবেন বলে ঠিক করলেন, আঘাত হানার সময় এখনো আসেনি।

***

এভাবে আকবর আলী মৃধার সাথে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাই করতে পারেনি মিচনার। ভাগ্য বোধহয় ভালোই তার। ভোর হওয়ার পরপর রওনা দিয়েছে চারজনের দলটা। আগে আগে যাচ্ছে সে, পথ দেখিয়ে। আকবর আলী মৃধাকে এখন একটু সতেজ দেখাচ্ছে, যদিও রাতে খুব একটা ঘুম হয়নি কারো। পরস্পরকে জড়াজড়ি করে বসেছিল তিনজন। দেখে মজাই লাগছিল মিচনারের। সাধারন মানুষদের মতো এতো ঠান্ডা-গরমের অনুভূতি নেই তার। তাকে খালি গায়ে দেখে দলের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। এই লোকটার সাথে তার আগে দেখা হয়নি,দেখা হয়েছিল সোহেলের সাথে, বিশেষ করে ঢাকায় থাকতে সোহেলের সাথে সম্পর্কটা বেশ আন্তরিকও ছিল।

তাকে অনুসরন করতে কষ্ট হচ্ছে বাকি তিনজনের। তাই কিছুটা পথ এগিয়ে থামতে হচ্ছে। এরমধ্যে পুরো এলাকাটা একবার দেখে নিয়েছে মিচনার। অনেক দূরে কিছু তাঁবু চোখে পড়েছে। ওখানে তার প্রতিপক্ষের থাকার কথা নয়। কিন্তু সেখানে তার বাকি সঙ্গিদের জন্য প্রয়োজনীয় গরম কাপড় আর খাবার পাওয়া যাওয়ার কথা। গরম কিছু পোশাক আর খাবার ছাড়া আকবর আলী মৃধা আর তার দল আর বেশিক্ষন টিকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আকবর আলী মৃধাকে পুরোপুরি চাঙা করা দরকার। তারপর প্রতিপক্ষের খোঁজে যাওয়া যাবে, কেন জানি মনে হচ্ছে খুব কাছাকাছিই আছে তার প্রতিপক্ষ। যেকোন সময় দেখা হয়ে যেতে পারে। আকবর আলী মৃধার মতো একজন শয়তান উপাসকের উপস্থিতি তাকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।

***

কাছাকাছি চলে এসেছে রাশেদ আর রাজু। তাঁবুগুলো এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। পালাক্রমে রাত জেগেছে দুজন। তারপর ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েছে। বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে তাঁবুগুলোকে দেখে নিচ্ছিল রাশেদ। অন্তত দশজন আছে তাঁবুগুলোর চারপাশে, সবার হাতেই অত্যাধুনিক অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। এখানেই ড. আরেফিন এবং বাকিরা আছে বলে সন্দেহ করছে সে।

চারদিকে কুয়াশার রেশ এখনো কাটেনি,এর মধ্যেই তাঁবুগুলো থেকে বেরিয়ে আসা লোকজন দেখে আরো সজাগ হলো রাশেদ। হ্যাঁ, ড. আরেফিনকে দেখা যাচ্ছে, সাথে আরো কয়েকজন আছে, এদের মধ্যে ড. কারসনকে চিনতে অসুবিধা হলো না। এগারো হজনকে গুনতে পারল রাশেদ। তাঁবুগুলোর পাহারায় কয়েকজনকে রেখে রওনা দিয়েছে এগারোজনের দলটা। একজন মেয়েকেও দেখতে পেল। হোটেল রেজিস্টারে ড. লতিকা প্রভাকরের নাম দেখেছে, মনে পড়ল রাশেদের। সাথে কোন অস্ত্র নেই, এখন একমাত্র বুদ্ধি দিয়ে কাজ সারতে হবে। তাঁবুগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে। দলটা। ওদের পিছু নেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই এখন। রাজুকে ইশারা করল রাশেদ, তাকে অনুসরন করার জন্য। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে শক্ত পাথুরের মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটা আশ্রয় খুঁজছে, তাঁবুগুলোর চারপাশ ঘিরে যে পাহারা আছে তা ফাঁকি দিয়ে অনুসরন করতে হবে দলটাকে। কাজটা খুব সহজ হবে না।

পেছনে তাকিয়ে রাজুকে ইশারা করতে গিয়ে লক্ষ্য করল রাজু নেই পেছনে, আতংকে দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো রাশেদের। রাজু কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। বাম দিক থেকে শিস দেয়ার মতো শব্দ আসছে, তাকাল রাশেদ। রাজু বাম দিক দিয়ে কখন এগিয়ে গেছে সে টের পায়নি।

আরেকটু এগিয়ে গেলেই তাঁবুগুলোকে আড়াল করার মতো বড় কিছু পাথরের স্তূপ আছে। সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে রাজু। ড. আরেফিনের দলটা এখনো দৃষ্টিসীমার মধ্যে আছে। একবার আড়াল হলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। নিজের অবস্থান বদলে দ্রুত রাজুর পিছু নিলো রাশেদ।

*

অধ্যায় ৫৫

মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হ্রদের দূরত্ব খুব বেশি নয়, প্রতিবছর অনেক তীর্থযাত্রী মানস সরোবর ভ্রমন করে যায়, সেটাও নিদিষ্ট একটা সময়ে। তীর্থযাত্রীরা যে পথে যায় মানস সরোবরের উদ্দেশ্যে সে পথেই চলছেন ড. কারসন। এখন তীর্থ যাত্রার সময় নয়, তাই কারো সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন। ড. কারসনের সাথে আছেন ড. আরেফিন, লতিকা, সন্দীপ আর সুরেশ। বৃদ্ধ লামা আর চ্যাঙও আছে সাথে। এছাড়া পাহারায় আছে চ্যাঙের দলের সৈন্যরা। মাত্র চারজনকে সাথে নিয়ে এসেছে চ্যাঙ। বুড়ো কয়েকজন মানুষকে সামলানোর জন্য খুব বেশি লোকের প্রয়োজন নেই। বাকি সবাইকে তাঁবুতে রেখে এসেছে, পাহারা দেয়ার জন্য, এছাড়া সাম্ভালার অবস্থান খুব বেশি মানুষের জানার দরকার প্রয়োজন মনে করেনি চ্যাও।

ভোরেই রওনা দিয়েছেন ড. কারসন, ঘুম থেকে উঠেই দেখেন একেবারে তৈরি হয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চ্যাঙ। বৃদ্ধ লামাও ছিলেন সাথে। ঘুম থেকে উঠে হাল্কা কিছু খেয়েই রওনা দিতে হয়েছে। সবচেয়ে সমস্যা হয়েছে সুরেশের, সম্ভবত বুকের পাঁজরে আঘাত পেয়েছে, হাঁটতে গেলেই চেহারা কুচকে যাচ্ছে ব্যথায়। বৃদ্ধ লামাকে বলেছিলেন যেন সুরেশকে রেখে যাওয়া হয়, কিন্তু চ্যাঙ রাজি হয়নি। সুরেশের মতো লোককে সবসময় চোখে চোখে রাখতে চায় সে।

মোটামুটি একটা অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ হিসেব করে এসেছেন ড. কারসন, সেখানেই থাকার কথা সাম্ভালার। সেই হিসেবে তিল পরিমান ভুল করার অবকাশ নেই। হাঁটতে হাঁটতে কখনো উপরে উঠতে হচ্ছে, কখনো নামতে হচ্ছে নীচের দিকে। যথেষ্ট পরিমান অক্সিজেন নিয়ে এসেছে চ্যাঙ, যাতে অক্সিজেনের অভাবে কাজের ব্যাঘাত না ঘটে, এছাড়া ক্লাইমবিং গিয়ারও আছে। এগুলো কি কাজে লাগবে জানেন না ড. কারসন, তিনি কিংবা তার দলের কেউ পেশাদার ক্লাইম্বার নন। কিন্তু চ্যাঙ-কে কোন উপদেশ দেয়ার মতো অবস্থা নেই, একদম গোঁয়ার মানুষ একটা।

ভোরের এই সময়টা কুয়াশায় ঢেকে আছে চারদিক। অল্প কিছুদূরে কী আছে তা দেখা যায় না। এরমধ্যে অসমতল পাহাড়ি এলাকায় উঠানামা প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ন। ড. কারসনের পেছনেই আছে লতিকা, তারপর ড. আরেফিন। সুরেশ আর সন্দীপ আসছে দশ ফুট দূরত্ব রেখে, তাদের পেছনেই আছে চ্যাঙ।

একটু দাঁড়ালেন ড. কারসন, হাঁপ ধরে গেছে তার। এর আগেও একটানা উঠেছেন উপরে, কিন্তু এখানে যেন পাহাড় ক্রমশ খাড়া হয়ে উঠে গেছে। কুয়াশা থাকলেও কৈলাসের চূড়া দেখা যাচ্ছে পরিস্কার, সোজা উঠে গেছে, অজেয় এখনো। মনে মনে সংখ্যাগুলো ভেবে নিলেন আবার। সাথে করে সেক্সট্যান্ট, চমৎকার একটা ঘড়ি নিয়ে এসেছিলেন অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ হিসেব করার জন্য, কিন্তু ভোরের এই সময়টায় সূর্যের অবস্থান পুরোপুরি পরিস্কার না হওয়াতে চ্যাঙের দেয়া পোর্টেবল জিপিএস রিসিভার ব্যবহার করতে হবে। লতিকার এই ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় আপাতত জিনিসটা ওর হাতেই দিয়েছেন ড. কারসন।

ড. কারসনের সাথে আছেন বৃদ্ধ লামাও। প্রচন্ড ঠান্ডা তাকে কাবু করতে পারেনি,এমনকি এতোটা উঁচুতে উঠার পরও লোকটার মাঝে কোন বিকার দেখতে পেলেন না ড. কারসন। ড. আরেফিন আর সন্দীপ নিজেদের মধ্যে কিছু নিয়ে কথা বলছিল, চ্যাঙ পেছন থেকে ধমক দেয়ায় থেমে গেল ওরা।

জায়গাটা অসমতল। এখানে সেখানে পাইন বন দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করেই। একপাশ দিয়ে পাহাড় উপর দিকে উঠে গেছে। সোজা হয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে হাত রাখলেন ড. কারসন, হাত দেখিয়ে সবাইকে থামার জন্য ইশারা করলেন। বরফ জমা পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছুক্ষন হাত বুলালেন তিনি।

চ্যাঙের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন, একটা ছোট হাতুড়ি নিয়ে এলো সৈন্যদের একজন। ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে বরফের গায়ে টোকা দিচ্ছেন ড. কারসন। বরফ ঝরে পড়ছে একটু একটু করে, মনে হয় লক্ষ-কোটি বছর ধরে এভাবেই পাহাড়ের গায়ে জমে আছে, তাই ছুটতে চাচ্ছে না। অল্প অল্প করে বেশ কিছুক্ষন হাতুড়ি চালিয়ে গেলেন ড. কারসন। তারপর হতাশ হয়ে তাকালেন পেছনে অপেক্ষমান পুরো দলটার দিকে, উদগ্রীব হয়ে আছে সবাই, বিশেষ করে বৃদ্ধ লামা।

বুঝতেই পারছেন, এখানে কিছু নেই, আরো একটু সামনে যেতে হবে, ড. কারসন বললেন।

সামনে মানে কোনদিকে, উপরে না নীচে? জিজ্ঞেস করল চ্যাঙ।

লতিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. কারসন। জিপিএস রিসিভারটা নিজের হাতে তুলে নিলেন, আমরা আছি ল্যাটিচিউড ৩১.১৪ নর্থ আর লঙ্গিচিউড ৮১.১৩ ইস্টে, আমাদের গন্তব্য হচ্ছে ল্যাটিচিউড ৩১.১৫ নর্থ আর লঙ্গিচিউড ৮১.১৬ ইস্ট। সোজা পশ্চিম দিকে, সেখানে ক্রমশ নীচের দিকে গেলে আমরা একটা হ্রদ পাবো, সেটা কিন্তু মানস সরোবর নয়, মানস সরোবর কিংবা রাক্ষসতাল থেকে এখনো বেশ কিছুটা দূরে আমরা।

লতিকা তাকাল ড. কারসনের দিকে, ৩১১৫ আর ৮১১৬ সংখ্যা দুটো স্রেফ উলটো করলেই ৫১১৩ আর ৬১১৮ পাওয়া যায়। এই সংখ্যা দুটো নিয়ে অবেক ভেবেছে সে, কিন্তু এগুলো যে ল্যাটিচিউড আর লঙ্গিচিউড হতে পারে এই সাধারন বিষয়টা তার মাথায় আসেনি বলে নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল।

আবার পথ চলা শুরু হলো। কৈলাস শৃঙ্গের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন ড. কারসন, এবার পশ্চিমের দিকে যাচ্ছে দলটা। হাতে জিপিএস রিসিভার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

***

তাঁবুগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, পুরো চেহারা রক্তে রঞ্জিত। দুই হাত উঁচু করে সঙ্গিদের দেখালো, সেখানেও রক্ত, প্রচন্ড ঠান্ডায় অল্প সময়েই জমাট বেঁধে গেছে।

রাগে-ক্ষোভে হুংকার দিয়ে উঠেছে মানুষটা। সামনে একজন চায়নীজ সৈন্য দাঁড়ানো, মাথা নীচু করে। কাঁপছে অল্প অল্প, একটু আগে চোখের সামনে যে বীভৎসতা দেখেছে তা মনে করে। একটা মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। এর আগে চ্যাঙ-কেই মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষ। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো খালি গায়ের এই মানুষটা সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে যেন।

লোকটা এলো ঝড়ের বেগে, ভোর হয়েছে একটু আগে, চ্যাঙ আর বৃদ্ধ লামা বন্দীদের নিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষন হলো। তাঁবুগুলোর পাহারায় থাকা ছয়জন সৈন্য ছিল নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত। এই সময় কোন ধরনের ঝামেলা হতে পারে তাদের ধারনার মধ্যেই ছিল না। এই সময় এলো লোকটা, সৈন্যরা নিজেদের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার সুযোগই পেল না। তার আগে সবাইকে নির্মমভাবে খুন করেছে এই অদ্ভুত মানুষ। মানুষ না বলে মানুষের দেহে রাক্ষস বললেই লোকটাকে বেশি মানায়।

শুধুমাত্র তাকে জীবিত রেখেছে, কেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দক্ষিন দিক থেকে হাওয়া আসছিল সকাল থেকেই, তার তীব্রতা বেড়েছে হঠাৎ করেই। ভয় আর ঠান্ডায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল সৈনিকের।

অদ্ভুত মানুষটার কয়েকজন সঙ্গিও আছে, তারা এসেছে মাত্র। দেখতে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে, অন্তত পোশাক-আশাকে। দুজন তাঁবুগুলোর মধ্যে ঢুকেছে, বের হয়ে এসেছে একগাদা গরম কাপড়-চোপড় আর খাবারের ক্যান নিয়ে। বাকি একজন এগিয়ে এলো তার দিকে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে নেতাগোছের, তাকে দেখে সরে দাঁড়াল নগ্নগাত্র মানুষটা।

তোমাদের দলনেতা কে? পরিস্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

চ্যাঙ, ভাঙ্গা গলায় বলল সৈনিক।

সে এখন কোথায়?

কৈলাসের দিকে।

কখন আসবে?

জানি না, সাথে আরো কয়েকজন ছিল।

কারা ছিল?

জানি না।

ওকে নিয়ে যা করার করো, এবার নগ্নগাত্র লোকটার উদ্দেশ্যে বলল দলনেতা।

আমি জানি কারা কারা ছিল, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সৈনিক, একটু আগে নিজের চোখে দেখেছে কী ভয়াবহভাবে একেকজনকে খুন করেছে ঐ হিংস্র মানুষটা। সে নিজে এর শিকার হতে চায় না।

বলল তাহলে।

ড. কারসন, ড. লতিকা, ড. আরেফিন…

কী বললে? বেশ অবাক হলো তার কথা শুনে, ড. কারসন, ড. আরেফিন?

জি, এছাড়া…

তুমি শিউর, ড. কারসন আর ড. আরেফিন ছিলেন?

হ্যাঁ, নিশ্চিত, সৈনিক বলল, কারন চ্যাঙের মুখে ওদের নাম আমি অনেকবার শুনেছি। এছাড়া ড. আরেফিন অনেকদিন ধরেই আমাদের হাতে বন্দি ছিলেন।

চায়নীজ সৈনিকের দিকে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করল লোকটা। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়। তাই দৌড় দিল সৈনিক। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না, অবাক হয়ে দেখল তার সামনে নগ্নগাত্র হিংস্র মানুষটা দাঁড়ানো। আর বেশিক্ষন বাঁচতে পারবে না জেনেও চিৎকার করলো গলা ফাটিয়ে, সেটাই ছিল তার শেষ চিৎকার।

সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছেন আকবর আলী মৃধা। এরমধ্যে খাবারের ক্যান খুলে বিস্কিট খেয়েছে সোহেল, আহমদ কবিরের হাতেও দিয়েছে। মিচনার পাশে দাঁড়ানো, সারা দেহ রক্তে মাখামাখি, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

বুঝলে সোহেল, আমি ভাবছিলাম, রাশেদ কেন তিব্বতে এসেছে? এখানে ওর কী কাজ? এখন বুঝলাম, একটু থামলেন আকবর আলী মৃধা, ড. আরেফিনকে উদ্ধার করতে এসেছে রাশেদ। ড. আরেফিনের সাথে আবার আছেন ড. কারসন। তিনি এখানে কেন এসেছেন সেটা জানা কিন্তু খুব দরকার, কি বলল?

জি, আপনি ঠিক বলেছেন, কোনমতে বলল সোহেল।

ড. কারসন বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন এই এলাকায়। এই লোকটাকে গতবার অপহরন করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি,ঐ রাশেদ আর ড. আরেফিনের কারনে। এবার তিনজনকে একই জায়গায় পেয়েছি। দারুন ব্যাপার!

জি।

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা, এই বোবা পিশাচ আছে আমাদের সাথে, রক্তারক্তির যতো কাজ ও করবে।

জি।

অস্ত্র যা পারো সাথে নিয়ে নাও, আমরা রওনা দেবো এক্ষুনি।

জি, বলে সামনে থেকে চলে গেল সোহেল। তিনজনের জন্য তিনটা অটোমেটিক রাইফেল বেছে নিলো, সাথে একটা রিভলবার।

তাঁবু থেকে বের হয়ে কোনদিকে গেছে সবাই তা বের করতে খুব কষ্ট হলো না, মিচনারকে কেবল একটু বেশি উত্তেজিত মনে হলো। সে ধীরে ধীরে যেতে চাচ্ছে না, কোনমতে তাকে আটকে রাখলেন আকবর আলী মৃধা। মিনারের এতো অধীরতার কারন বুঝতে পারছেন না, সম্ভবত রক্তের নেশায় পেয়ে বসেছে, ভাবলেন তিনি।

তার ভাবনাচিন্তায় ভুল ছিল না, সত্যিই রক্তের নেশায় পেয়েছে মিচনারকে। এখানে প্রতিপক্ষ এসেছিল, সম্ভবত তারা আসার আগেই চলে গেছে। বরফের বুকে পায়ের ছাপ স্পষ্ট, সেগুলো ধরে ধরেই এগুচ্ছে তার দল। কিন্তু তর সইছে না মিচনারের, বহুদিন পর নিজের মধ্যে পশুত্বকে জেগে উঠতে দেখেছে সে, এই সময়টার সদ্ব্যবহার করা দরকার।

*

ধ্যায় ৫৬

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ড. কারসন, পাশে ড. আরেফিনও চুপচাপ দেখছেন, জিপিএস রিসিভারে দেখাচ্ছে ল্যাটিচিউড ৩১.১৫ নর্থ, লঙ্গিচিউড ৮১.১৬। হঠাৎ করেই এখানে বেশ ঘন পাইন গাছের সারি, বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে, জায়গাটা একটা পাহাড়ের শেষ সীমা, এরপর রয়েছে বিশাল এক খাদ। অন্তত ত্রিশ ফুট প্রশস্ত এই খাদটার তলায় ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। খাদের ওপারে ন্যাড়া পাথর, শুষ্ক ধূসর পাহাড়। এবার আরো একটু সরে এলেন ড. কারসন, আরো অল্প কিছুটা এলাকা এই রিডিংয়ের মধ্যে থাকবে, কিন্তু পারফেক্ট রিডিং ধরলে এই জায়গাটাই সেই জায়গা।

ইশারায় বৃদ্ধ লামাকে ডাকলেন ড. কারসন, হাতের জিপিএস রিসিভারে যে ল্যাটিচিউড এবং লঙ্গিচিউড দেখাচ্ছে তা দেখালেন। বৃদ্ধের চেহারায় মুহূর্তে লাল আভা দেখতে পেলেন ড. আরেফিন। পরক্ষনেই সেখানে হতাশার ছায়া দেখলেন, এমন একটা জায়গায় কিভাবে সাম্ভালার অবস্থান হতে পারে তা বিশ্বাস হচ্ছে না বৃদ্ধের।

আমরা আসল জায়গায় এসেছি, ধীরে সুস্থে বললেন ড. কারসন।

তুই কি বলতে চাস এটাই সাম্ভালা! তেড়ে এলো চ্যাঙ, যে কোন মুহূর্তে হাত তুলবে যেন ড. কারসনের উপর।

আমার হিসেব বলছে, শীতল কণ্ঠে বললেন ড. কারসন।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে লতিকা, সন্দীপ এবং সুরেশ, বুঝতে পারছে আসলে কি হচ্ছে, ওদের পেছনে দুজন সৈনিক দাঁড়ানো, অস্ত্র তাক করে, একটু নড়লেই গুলি করতে দ্বিধা করবে না।

থামো, চ্যাঙ, বৃদ্ধ লামা বললেন এবার, ড. কারসন হয়তো ঠিক বলেছেন, সাম্ভালা যে দিনের আলোর মতো পরিস্কার দেখা যাবে তা কিন্তু নয়, একটু থামলেন ভদ্রলোক, বিশেষ একটা কিছু দরকার, এমন কিছু যা সাম্ভালার প্রবেশপথ খুলে দেবে আমাদের জন্য। কিন্তু কী সেটা? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ লামা, তারপর ড. কারসনের দিকে ফিরলেন, আপনার কোন ধারনা আছে?

সম্ভবত কালচক্র মন্ত্র, মৃদুস্বরে বললেন ড. কারসন, মন্ত্রটা আমার জানা আছে, কিন্তু আপনি পড়লেই বোধহয় ভালো হবে।

কালচক্র মন্ত্র আমি জানি, কিন্তু সে তো অনেক দীর্ঘ মন্ত্র, অনেক সময় লাগবে, বৃদ্ধ লামা বললেন।

সময় লাগলেও কিছু করার নেই, ড. কারসন বললেন। আমরা এখানে অপেক্ষা করবো।

ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন ড. কারসন, ইশারায় কিছু একটা বলতে চাইলেন, কিন্তু ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন ড. আরেফিন। ড. কারসনকে মোটেই পছন্দ হচ্ছে না তার। লোকটা শুরু থেকেই সব কিছু জানে, জেনে শুনেও দলের বাকি সদস্যদের কিছু জানায়নি। দিল্লি থেকে ম্যাকলডগঞ্জে যাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না, সন্দীপকে সেই হলদে হয়ে যাওয়া পার্চমেন্টে লেখা বাইনারি কোড ভাঙতে গিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার ছিল না। ড. কারসন আসলে তাদের ব্যবহার করেছেন, হয়তো সময়মতো তাদের সবাইকে সরিয়ে দিয়ে নিজে একা সাম্ভালা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ লামার দল তাতে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। এই সময় প্রফেসর সুব্রামানিয়াম থাকলে হয়তো আরো ক্ষেপে যেতেন।

বৃদ্ধ লামা বসলেন একটা পাথরের উপর, পদ্মাসনে, তার হাতে প্রেয়ার-হুঁইল বা যপযন্ত্র। যন্ত্রটা ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি কালচক্র মন্ত্র পড়তে শুরু করবেন। এমনিতে প্রতিবছর কালচক্র অনুষ্ঠান হয় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে, জায়গা হিসেবে বেছে নেয়া হয় ভারত-তিব্বত সীমান্ত। ধর্মীয় গুরু দালাই লামা সেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, কালচক্র মন্ত্রের পাশাপাশি সেখানে আরো অনেক ধরনের নিয়মকানুন পালন করতে হয়, টানা সাতদিন চলে সেই অনুষ্ঠান, প্রতিবছর সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন বৃদ্ধ লামা। এই কালচক্র মন্ত্র শিখতে গিয়ে জীবনের বড় একটা সময় ব্যয় হয়েছে, কখনো তা প্রয়োগ করতে হবে ভাবেননি তিনি।

বন্দীদেরকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে, তাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে অস্ত্রধারী চার সৈনিক। বৃদ্ধ লামার দিকে তাকিয়ে আছে চ্যাঙ এক দৃষ্টিতে, কিছু বলতে গিয়ে বলল না।

মন্ত্র উচ্চারন শুরু করেছেন বৃদ্ধ লামা।

বেশ কিছুক্ষন পার হয়েছে ইতিমধ্যে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। চারপাশের বাতাস যেন কেমন জমে গেছে, কোথাও কোন শব্দ নেই, পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। হঠাৎ চ্যাঙের মধ্যে খানিক চাঞ্চল্য দেখা গেল, সে কোন শব্দ শুনতে পেয়েছে। বাকি সৈনিকদের ঠিকমতো চোখ রাখার জন্য ইশারা করে চলে গেল যেদিক থেকে পাইন বনে ঢুকেছিল সেদিকে।

সন্দীপ তাকিয়ে আছে ড. আরেফিনের দিকে, সুরেশ দাঁড়িয়ে আছে কোনমতে, লতিকার চেহারা এখন পর্যন্ত অভিব্যক্তিহীন। মন্ত্রের গতি বাড়ছে, ড. আরেফিন তাকালেন চারপাশে, মনে হলো হঠাৎ করেই পৃথিবী জেগে উঠতে শুরু করেছে। সাম্ভালা তাহলে এখানেই!

***

৭২৪

বাঙ্গালি ভদ্রলোকের পেছন পেছন দলটাকে অনুসরন করে এসেছেন অনেকক্ষন হলো, বড় একটা পাথরখন্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন এখন। সামনে ছোটখাট একটা পাইন বন, দলটা বনের ভেতর ঢুকেছে বেশ কিছুক্ষন হলো, পিছু নিতে গিয়েও যাননি,খুব চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হবে এখন, অন্তত চারজন সৈনিকের হাতে অস্ত্র চোখে পড়েছে, এদেরকে সামলানো খুব কঠিন হবে না, কিন্তু যজ্ঞেশ্বরের কথাটা ভাবতে হচ্ছে, সন্ন্যাসীর জীবন নিয়ে ঝুঁকি নেয়া যাবে না। জ্যাকেটের ভেতর থেকে শেবারনের দেয়া চামড়ার খোপটা বের করলেন। ভেতর থেকে চামড়ায় তৈরি ম্যাপটা ভাজ করে রাখলেন পাথরের গায়ে। যজ্ঞেশ্বর আগে কখনো দেখেনি,এগিয়ে এলো সামনে। তার দৃষ্টিতে বিস্ময়।

কি এটা? জিজ্ঞেস করল যজ্ঞেশ্বর।

আমাদের উদ্দেশ্য পূরনের হাতিয়ার।

আর কিছু বলল না যজ্ঞেশ্বর, ম্যাপটা দেখছে। যদিও কিছু বুঝতে পারছে বলে মনে হলো না।

ম্যাপটা দেখে চাঞ্চল্যবোধ করছেন তিনি। আশপাশেই হবে জায়গাটা, গোলকটার যে অবস্থান ম্যাপে নির্দেশ করা আছে এবং গতরাতে দেখা গোলকের অবস্থানের সাথে মিলিয়ে নিলেন মনে মনে। হ্যাঁ, খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি। গুটি গুটি কিছু হরফ চোখে পড়ল নীচে, এর আগে অন্তত কয়েকশ বার এই ম্যাপ খুলেছেন তিনি, কখনো এই লেখাগুলো চোখে পড়েনি। প্রাচীন তিব্বতি হরফ, পড়ার চেষ্টা করলেন, বহুবছর আগে শেবারনের মন্দিরে শেখা তিব্বতি ভাষার জ্ঞান কাজে লাগল এবার। কালচক্র মন্ত্রের গোপন কিছু শ্লোক, যার উল্লেখ সাধারন কালচক্র মন্ত্রে নেই। বিড়বিড় করে আত্মস্থ করে নিলেন লাইনগুলো।

যজ্ঞেশ্বরের ডাকে পেছন ফিরলেন, ইশারায় কিছু একটা দেখাচ্ছে। তাকালেন, স্থির হয়ে গেলেন সাথে সাথে। এরা এখানে কি করছে? চারজনের আরো একটা দল পিছু নিয়েছে প্রথম দলটার। এদের একজন তার প্রতিপক্ষ, পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি, বাকি তিনজনের মধ্যে একজনকে পরিচিত মনে হলো। হ্যাঁ, এঁকে তিনি দেখেছিলেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বিশেষ সেই বইটা এঁর হাতেই তুলে দিতে যাচ্ছিল রাশেদ, সময়মতো তিনি কেড়ে নিতে পেরেছিলেন। বাকি দুজন সম্ভবত ওদের সাগরেদ, প্রতিপক্ষ ছাড়া বাকি তিনজনের হাতে অস্ত্র দেখা যাচ্ছে।

ভয়ংকর কিছু ঘটবে আজ। মানসিকভাবে প্রস্তুত তিনি। আজ প্রতিপক্ষের সাথে মোকাবেলার দিন।

***

নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল রাশেদের, মনে হচ্ছিল একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার, কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। ড. আরেফিনের যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজের কাছেই দায়ি থাকতে হবে সারাজীবন। সামনের জায়গাটা কিছুটা সমতল, প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এখানে ছোটখাট একটা পাইন বন দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু জুতোর ছাপ চোখে পড়েছে, ছাপগুলো সোজা পাইনবনের সারি ভেদ করে ভেতরে চলে গেছে। ঢুকবে কি না সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই দেখল রাজু ঢুকে পড়েছে। পিছু নিলো রাশেদ। পাইন গাছগুলোর মধ্যে খুব বেশি দূরত্ব নেই, মনে হয় যেন প্ল্যান করে লাগানো হয়েছে। বাইরে দিনের আলোর তেজ থাকলেও এখানে কেমন আলোআঁধারি খেলা করছে। কোথাও কোন শব্দ নেই, সব থেমে আছে যেন। গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে দূরের এক জায়গা থেকে। আশপাশের বাতাস যেন ভারি হয়ে আছে, অদ্ভুত করুন এক সুর খেলা করছে পুরো পাইন বনে। রাজুর কাঁধ খামচে ধরল রাশেদ, গোঁয়ারের মতো একটানা হেঁটেই চলেছে।

চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল দুজন। গমগম শব্দ আসছে সামনে থেকে, মনে হচ্ছে ভারি গলায় কেউ কিছু আবৃত্তি করছে। রাজু চোখ ইশারা করল সামনে এগুনোর জন্য, রাশেদ বুঝতে পারছে না কী করবে, এগুবে না এখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝবে।

সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বেশি সময় পাওয়া গেল না। সামরিক পোশাক পরনে একজন চায়নীজকে দেখা গেল, রাজু খেয়াল করেনি,সে রাশেদের দিকে ফিরে ছিল। ঠিক রাজুর মাথায় তাক করেছে রিভলবার। কোত্থেকে মানুষটা উদয় হলো বুঝতে পারছে না রাশেদ, সম্ভবত অনেকক্ষন ধরেই তাদের অনুসরন করছিল। গাছের আড়ালে আড়ালে অনুসরন করেছে বলে টের পাওয়া যায়নি।

রিভলবার দিয়ে সামনে এগুনোর জন্য ইশারা করলো চায়নীজ অফিসার। কিছু করার নেই, এভাবে বন্দি হতে হবে মেনে নিতে পারছে না রাশেদ। তবে আশার কথা এই লোকটাই হয়তো ড. কারসন এবং ড. আরেফিনকে অপহরন করেছে। ওরা বেঁচে আছে কি না তা হয়তো অল্প পরেই জানা যাবে।

সামনে রাজু আর রাশেদকে রেখে পেছন পেছন আসছে চায়নীজ অফিসার। গমগমে শব্দে যে আবৃত্তি শুনতে পাচ্ছিল রাশেদ, তার গতি বেড়েছে মনে হচ্ছে। ভারি বাতাস ক্রমশ আরো ভারি হয়ে উঠেছে। চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে, এরমধ্যে সামনে এগুনো কঠিন হয়ে গেলেও অনেকটা অন্ধের মতো পা বাড়াচ্ছে দুজন। পেছনে রিভলবার তাক করে থাকা চায়নীজ অফিসারকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হলো, সে ঠিক জায়গায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে দুজনকে।

অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি ভোলা একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল রাশেদ, সামনে বেশ কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পরিচিত মুখটাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করল রাশেদের। কিন্তু আপাতত নিজেকে সামলাল রাশেদ। ড. আরেফিনও তাকে দেখেছেন, অবাক হয়েছেন, কিন্তু তিনিও নিজেকে সামলে নিয়েছেন মুহূর্তের মধ্যে, চোখ দিয়ে ইশারা করেছেন যেন রাশেদ কিছু বুঝতে না দেয় সবাইকে।

রাশেদ আর রাজুকে ঠেলে বাকিদের সাথে দাঁড় করিয়ে দিলো চায়নীজ অফিসার। ড. আরেফিনের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশেদ, চোখের ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বললেন ড. আরেফিন।

বৃদ্ধ লামা একটানা কালচক্র মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে উপরে উঠছে, মাঝে মাঝে নীচের দিকে নামছে। তার হাতে ছোট একটা যন্ত্র, কাঠের তৈরি, সেটাকে একটানা ঘোরাচ্ছেন মন্ত্র পড়ার পাশাপাশি।

ড. কারসনের সাথে আগে দেখা হয়েছিল ঢাকায়, একটি আন্তর্জাতিক হোটেলে, একবার দেখলেও তাকে চিনতে সমস্যা হলো না রাশেদের, দলের বাকি সদস্যদের নামও জানা ছিল হোটেল রেজিস্টার থেকে। দুজন পুরুষের মধ্যে একজন সন্দীপ, সম্ভবত গোলগাল চেহারার ফর্সা লোটাই হবেন, তবে অপরজনের নাম জানা নেই রাশেদের, এই লোকটা সম্ভবত দলের গাইড বা এই ধরনের কিছু ছিল। ড. লতিকাকে দেখে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। রাজু এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ইশারা করল রাশেদ, সাথে সাথে অন্য দিকে মুখ ঘোরাল রাজু। মাথা থেকে বাকি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলল রাশেদ। ড. আরেফিনকে পাওয়া গেছে সেটাই আসল কথা। এখন এই বিপদ থেকে কিভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে সেটা ভাবতে হবে।

হঠাৎ মনে হলো দুদ্দার শব্দে কিছু একটা ছুটে আসছে। ঘুরে তাকানোর সময়ও পেল না রাশেদ, তার আগেই জ্ঞান হারাল।

*

অধ্যায় ৫৭

অনেকক্ষন ধরেই সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলেন আকবর আলী মৃধা। বৃদ্ধ লামা আর তার বন্দিদের অনুসরন করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি,পাইন বনে ঢুকেছেন বেশ কিছুক্ষন হলো, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন গাছের আড়ালে, সবাইকে ইশারা দিয়ে রেখেছেন যেন কেউ কোন শব্দ না করে। তিনজনের হাতেই এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র, সাথে আছে হিংস্র ছেলেটা। ছয় জন অস্ত্রধারী সৈনিকের যে অবস্থা করেছে তাতে একটু দূরে দাঁড়ানো চারজন সৈনিক তো দাঁড়াতেই পারবে না।

বন্দীদের মধ্যে ড. কারসন আর ড. আরেফিনকে চিনতে পেরেছেন। বাকি একটা মেয়ে আর দুজন পুরুষ বন্দী, বোঝা যাচ্ছে বিশেষ কোন কাজে দলবলসহ এতোদূর এসেছেন ড. কারসন। কিন্তু কাজটা কী? অবাক হলেন যখন দেখলেন বয়স্ক লামা মাটিতে বসে এক নিঃশ্বাসে কী এক মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। এই ধরনের কোন কিছু আগে শুনেছেন বলে মনে হলো না। কিন্তু সুরটায় অদ্ভুত একটা টান আছে, মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, স্থান-কাল-পাত্র ভুলিয়ে দেয়। এই সময় নতুন দুই বন্দীর আগমনে আরো আনন্দিত হলেন আকবর আলী মৃধা।

রাশেদ আর তার বন্ধু। অস্ত্রের মুখে ওদের নিয়ে এসেছে তরুন চায়নীজ অফিসার, বোঝাই যাচ্ছে বাকি চারজন সৈনিকের নেতা সে, ড. কারসন আর বাকিদের এই অফিসারই বন্দী করে রেখেছে।

সময় এসে গেছে, সোহেলের পেছনেই দাঁড়ানো মিচনার, অদ্ভুত দেখাচ্ছে এখন তাকে, চেহারায় এখন আগেকার সুদর্শনভাবটা নেই বরং হিংস্র আকার ধারন করেছে। হঠাৎ দেখলে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য। শারিরীকভাবেও যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হচ্ছে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায়। আকবর আলী মৃধা ইশারা করলেন, সাথে সাথে ছুটে গেল মিচনার, রিভলবার থেকে ছোঁড়া গুলির মতো। চারটা আঙুল দেখিয়েছিলেন তিনি, ছেলেটা ইশারা বুঝতে পারবে এই ভরসা আছে। আহমদ কবির আর সোহেলকে নিয়ে ধীরে সুস্থে এগিয়ে চললেন তিনি।

মন্ত্র পড়া থামায়নি বৃদ্ধ। তিনি বৃদ্ধের চারপাশে একটা চক্কর কাটলেন, তারপর পাশে বসে কিছুক্ষন বোঝার চেষ্টা করলেন। হাল ছেড়ে দিয়ে এবার ঘটনাস্থলের দিকে তাকালেন। সব লন্ডভন্ড করে ফেলেছে ছেলেটা। চারজন সৈনিকের ছিন্নভিন্ন লাশ, রক্ত, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তরুন চায়নীজ অফিসার এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, চোখে নিন দৃষ্টি, যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না, বুঝতে পারছে না। বোধশক্তিহীন হয়ে গেছে। বন্দীরা সবাই এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। চার আঙুল দেখিয়ে যে চার সৈনিকের কথা বুঝাতে চেয়েছেন এটুকু ছেলেটা বুঝতে পেরেছে। দেখেই অবাক হয়েছেন আকবর আলী মৃধা। ঐ চারজন ছাড়া বাকিদের কারো উপর হাতও তোলা হয়নি।

কিন্তু এতো প্রচন্ড গতিতে আঘাত হানা হয়েছে যে তা বৈদ্যুতিক শকের মতো বাকি সবাইকেও এলোমেলো করে দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে থাকা সবার চেহারা দেখে নিলেন, সোহেলকে ইশারা করলেন রাশেদ, ড. আরেফিন এবং ড. কারসনকে বাকি সবার কাছ থেকে আলাদা করতে। এই তিনজনের সাথে তার বিশেষ হিসেব বাকি আছে।

সামনেই বেশ বড়সড় একটা খাদ, খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছেন আকবর আলী মৃধা। অল্প কিছুদূর সূর্যের আলো যায়, বাকি অংশ নিকষ অন্ধকার। ছোট একটা পাথরের টুকরো ছেড়ে দিলেন, দীর্ঘক্ষন চলে গেল, কান পেতে থেকে পেছনে ফিরলেন তিনি। এই খাদ অনেক গভীর, মনে হয় যেন পৃথিবীর তলদেশে চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ পর্যবেক্ষন করছেন। জায়গাটা অস্বাভাবিক, বৃদ্ধ লামার একটানা একঘেয়ে সুরে মন্ত্র পড়া ছাড়া আর কোন শব্দই কানে আসছে না। বাতাসে কোন গন্ধ নেই, পাখি নেই, বন্য কোন জম্ভর ডাক নেই। সবাইকে এই জায়গায় নিয়ে আসার কারন জানতে হবে, বৃদ্ধ লামাই বা পরিস্থিতি ভুলে একটানা মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন? কিসের মন্ত্র এটা?

ড. আরেফিন চোখ মেলে তাকিয়েছেন, নড়তে চড়তে পারছেন না। বেশ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে তাকে, সাথে ড. কারসন আর রাশেদও আছে, জ্ঞানহীন। বাকিদের একটু দূরে আলাদা করে বাঁধা হয়েছে। ওরাও কেউ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে বলে মনে হয় না।

সামনে তাকিয়ে দেখলেন চ্যাঙের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন আকবর আলী মৃধা, হাতে ছোট একটা ছুরি দেখা যাচ্ছে, ছুরিটা হাতে নিয়ে খেলছে লোকটা। কিছু একটা জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানাল চ্যাঙ। সাথে সাথে ছুরিটা গলায় বসিয়ে দিয়েছেন আকবর আলী মৃধা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল চ্যাঙের গলা দিয়ে, ছটফট করছে। যন্ত্রনায়, নিস্তেজ হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যে। নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করলেন ড. আরেফিন। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত চোখে পড়ছে। চ্যাঙ-কে তিনি রীতিমতো ঘৃনা করেন। তারপরও বেচারার এমন মৃত্যু আশা করেননি। চোখ খুলে তাকালেন আবার। চ্যাঙের নিথর দেহটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আকবর আলী মৃধা, খাদের দিকে। একেবারে খাদের কিনারে নিয়ে গিয়ে ডান পায়ের মৃদু টোকায় ফেলে দিলেন লাশটা। তারপর কান পেতে রইলেন কিছুক্ষন, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে চলে এলেন বৃদ্ধ লামার সামনে।

চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন ড. আরেফিন। মানুষ মারতে এদের হাত কাঁপে না, এরা মানুষ নয়, স্রেফ পশু। পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন, আকবর আলী মৃধা এগিয়ে আসছে সম্ভবত। মানসিকভাবে প্রস্তুত তিনি, আঘাত হানার চেষ্টা করবেন যে করেই হোক, মরার আগে এই পশুদের একটাকে সাথে নিয়ে মরতে পারলেও শান্তি।

ড. কারসন, ভারি কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলেন খুব কাছ থেকেই। ড. কারসন তার পাশে উঠে বসেছেন তা চোখ বন্ধ অবস্থায়ও বুঝতে পারছেন ড. আরেফিন, শামীমের হত্যাকারী, আকবর আলী মৃধা ড. কারসনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি, বলে চলেছেন আকবর আলী মৃধা।

আমিও না, কাটা কাটা গলায় উত্তর দিলেন ড. কারসন।

তারপরও দেখা যখন হয়েই গেল, আপনার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চাইছি, আশা করি নিরাশ করবেন না গতবারের মতো।

আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই, একই রকম গলায় বললেন ড. কারসন।

একটু আগে একজন একই কথা বলেছিল, তাকে খাদে ফেলে দিয়েছি, ফেলে দেয়ার আগে ওর গলাটা কাটতে ভুল করিনি অবশ্য, আকবর আলী মৃধা বললেন।

আর ড. আরেফিন, আমি জানি, আপনি সব শুনতে পাচ্ছেন। উঠে বসুন। ঘাড়ে বেশ বলিষ্ঠ এক জোড়া হাত টের পেলেন ড. আরেফিন, চোখ খুলে তাকালেন। আকবর আলী মৃধার শিষ্য, বেশ স্বাস্থ্যবান, গুরুর ইশারায় তাকে টেনে তুলেছে।

একটা সুযোগ দিচ্ছি, আপনাদের দুজনের মধ্যে যে কোন একজন বলার সুযোগ পাবেন, হাসি হাসি মুখ করে বললেন আকবর আলী মৃধা, যদি দুজনের কেউ মুখ না খোলেন তাহলে মাঝখান থেকে বেচারা রাশেদের জানটা যাবে। বেহুশ অবস্থায় ও বুঝতেও পারবে না কোথায় চলে গেছে।

আমি বলছি,ড. আরেফিন বললেন।

ওকে, ফাইন, আকবর আলী মৃধা বললেন, এখানে আপনারা কেন এসেছেন?

সাম্ভালার খোঁজে।

সাম্ভালা? সেটা আবার কি জিনিস? হাসতে হাসতে বললেন আকবর আলী মৃধা।

চিরশান্তির দেশ, যেখানে সবাই অমর…

দারুন তো! একেই কি সাংথিলা বলে?

হ্যাঁ।

আর ঐ বুড়ো কী করছে?

মন্ত্র পড়ছে, কালচক্র মন্ত্র।

তাতে কি হবে?

আমাদের ধারনা সাম্ভালার খুব কাছে চলে এসেছি আমরা, এই মন্ত্র সাম্ভালার প্রবেশপথ খুলে দেবে আমাদের জন্য।

তারপর কি করবেন? সুড়সুড় করে সাম্ভালায় চলে যাবেন, অমর হয়ে যাবেন, পৃথিবীময় শান্তি বিরাজ করবে?

সেটা আমি জানি না।

গুড, যথেষ্ট সৎ উত্তর দিয়েছেন, আকবর আলী মৃধা বললেন, কিন্তু জানেন কী, আপনাদের তিনজনের জন্য আমার জীবন থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ন বছর হারিয়ে গেছে, দেশ ছাড়া হয়েছি, জানেন?

অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে, ড. আরেফিন বললেন।

আপনার সাহস আছে স্বীকার করতে হবে জনাব, আকবর আলী মৃধা বললেন, আপনাদের সবাইকেই আমি মারবো। কিন্তু তার আগে সাম্ভালা দেখার শখ আমার মধ্যেও তৈরি করে দিয়েছেন আপনি। আমি লুসিফারের সেবক, সাম্ভালা বলে যদি কোন জায়গা থেকে থাকে, তাহলে তা ধ্বংস করাই মনে হয় লুসিফার পছন্দ করবেন।

চুপচাপ থাকলেন ড. আরেফিন, ড. কারসনও চুপ করে আছেন। বিকৃত মস্তিষ্ক এই মানুষটার সাথে কথা বলার রুচি পাচ্ছেন না।

কতোক্ষন লাগবে ঐ বুড়োর মন্ত্র পড়া শেষ হতে? জিজ্ঞেস করলেন আকবর আলী মৃধা।

জানি না।

আপনি না জানলেও এই বুড়ো ভামটা অবশ্যই জানে, এবার ড. কারসনের সামনে দাঁড়ালেন আকবর আলী মৃধা, একহাতে ড. কারসনের গাল টেনে ধরলেন, রক্তবর্ন ধারন করেছে ড. কারসনের চেহারা, তারপর ছেড়ে দিলেন।

হ্যাল্লো মি. কারসন, বলতে সমস্যা আছে না আরো জোরে টান দেবো, আকবর আলী মৃধা বললেন।

খুব দ্রুত পড়লেও অন্তত ঘন্টাচারেক সময় লাগার কথা, ড. কারসন বললেন।

চার ঘন্টা? সে তো অনেক সময়, এতোক্ষন আমরা বসে বসে কি করবো? আকবর আলী মৃধা বললেন, পায়চারি করছেন ড. কারসনের সামনে।

উনাকে বিরক্ত করা যাবে না, ড. কারসন বললেন, মন্ত্র পড়ায় বাঁধা পড়লে কাজ নাও হতে পারে।

ওহ! আমাকে ভয়ও দেখানো হচ্ছে, ঠিক আছে… বলে কী একটা ভাবলেন আকবর আলী মৃধা, এই সময়টা কাজে লাগাবো আমরা। যে কয়জন মানুষ বাড়তি আছে তাদের এক এক করে খাদে ফেলবো। তবে তার আগে আমার ঐ পাগল ছোকরা ওদের নিয়ে একটু মজা করবে, রক্ত না দেখলে ওর আবার ভালো লাগে না, একপাশে দাঁড়ানো মিচনারকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি।

মিচনার দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, তার চোখ খোলা, দুই ঠোঁট চেপে আছে পরস্পরের সাথে, নাকের পাটা ফুলে উঠছে নিঃশ্বাস নেয়ার সাথে সাথে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। বাড়তি লোকগুলোকে মেরে ফেলার প্রতি তার মনোযোগ নেই। তার মন বলছে। প্রতিপক্ষের মানুষটা আশপাশেই আছে, খুব কাছাকাছি কোথাও। এই সময় অন্য কাজে ব্যস্ত না হওয়াই ভালো।

***

অল্প সময় পর জেগে উঠলো রাশেদ, চারপাশে রক্ত, ভয়ংকর দর্শন একজন মানুষ, আকবর আলী মৃধা, সোহেল আর আহমদ কবিরকে দেখতে পেল। ড. কারসন আর ড. আরেফিন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে আগেই, এই মুহূর্তে হাঁটু গেড়ে বসা আকবর আলী মৃধার সামনে। অন্যদিকে একটানা মন্ত্র পড়েই চলেছে বৃদ্ধ লামা, কোন কিছুই তার মনঃসংযোগে চির ধরাতে পারেনি। একটু দূরে বাকি চারজন পড়ে আছে, লতিকা, সন্দীপ, রাজু আর আরেকজন, যার নাম জানে না রাশেদ। ওদের মধ্যে সন্দীপ, রাজু আর লতিকা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে, পরস্পরের সাথে গা ঘেষাঘেষি করে বসে আছে। অন্য লোকটার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।

কি হে মি. রাশেদ, তুমিও জেগে উঠেছো দেখছি, এবার রাশেদের সামনে এসে দাঁড়ালেন আকবর আলী মৃধা। সোহেলের দিকে ফিরলেন তিনি, এই ছেলেটার পেছনে এসে ক্ষতি হয়নি,কি বলো সোহেল?

জি, মাথা নেড়ে সায় দিলো সোহেল।

কিন্তু অনেক ভুগতে হয়েছে, নিজের মনে বলে চলেছেন আকবর আলী মৃধা, ঢাকায় কি আরামে ছিলাম আমি, কতো চমৎকার একটা দল বানিয়েছিলাম, এই ছেলেটার কারনে জেলে যেতে হলো আমাকে, পচে মরছিলাম। কিন্তু আমাকে আটকে রাখবে এমন কোন কারাগার কি আছে?

নেই।

গুড। এবার কাজের কথায় আসি। এই ছেলেটাকে আমি শাস্তি দেবো, যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি, সেটা কেমন হতে পারে বলে তোমার ধারনা?

আপনি যা শাস্তি দেবেন সেটা ভালোই হবে।

ভালো বলেছে, হাসলেন আকবর আলী মৃধা, আনুগত্য খুব ভালো গুন। শামীম সেটা বুঝতে পারেনি। ভুল করে জান দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে। এবার রাশেদের পালা।

মিচনারকে ইশারা করলেন তিনি, ইতস্তত করছিল মিচনার, তার মনোযোগ এখনো অন্যদিকে।

ওকে একবারে মেরে ফেলিস না, ধীরে ধীরে কাজ করবি, ওর যন্ত্রনা দেখতে আমার ভালো লাগবে, আকবর আলী মৃধা বললেন।

রাশেদ তাকাল ভয়ংকর দর্শন লোকটার দিকে, সারা শরীরে পেশি যেন কিলবিল করছে। এগিয়ে আসছে তার দিকে, ধীর পায়ে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন শিকার করার আগে শিকারকে সম্মোহন করে নিচ্ছে। কিছুক্ষন আগে লোকটা তান্ডব চালিয়েছে এখানে, কি ধরনের নৃশংস হতে পারে মানুষটা তার একটা ধারনা পেয়ে গেছে রাশেদ। এখন নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে মৃত্যু।

রাজুকে চোখে পড়ল হঠাৎ, রাশেদকে বাঁচানোর জন্য উঠে দৌড়ে আসছে লোকটার দিকে, হতাশায় মাথা নাড়ল রাশেদ। কিছুই করতে পারবে না, মাঝখান থেকে নিজের প্রানটা খোয়াবে। সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার কাঁধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজু, দুই হাত দিয়ে একনাগারে ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে লোকটার মুখে, মাথায়। কিন্তু এক বিন্দু টলাতে পারেনি লোকটাকে। বরং একটানে রাজুকে দূরে ছুঁড়ে মারল ভয়ংকর দর্শন মানুষটা, যেমন শরীরের উপর হঠাৎ এসে পড়া কীটপতঙ্গ ফেলে দেয় সাধারন মানুষ। উড়ে গিয়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেল রাজু, অচেতন হয়ে পড়ল নীচে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে অনবরত।

জীবনের মায়া নেই রাশেদের, বন্ধু রাজুর এই পরিণতি দেখে নিজেকে সামলাতে পারলো না। উঠে দাঁড়াল সে। শত্রুকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না। কাছে চলে এসেছে মানুষটা, মুখে ভয়ংকর এক চিলতে হাসি ঝুলছে। আত্মরক্ষার যতোগুলো কৌশল ছিল মনে করার চেষ্টা করছে রাশেদ, কিন্তু এই মানুষটার শক্তির সাথে ঐসব কৌশল কোন কাজে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। আরো কাছে চলে এসেছে মানুষটা। নিজেকে কেমন ছোট আর অসহায় মনে হচ্ছিল রাশেদের। এভাবে ভিন দেশে অসহায়ভাবে প্রান দেয়ার কোন মানেই হয় না। এখন আর কিছু করার নেই। গলায় শক্ত হাতের স্পর্শ টের পেল রাশেদ, হাত ছোঁড়াছুড়ি করে লোকটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে। এক হাতে ধীরে ধীরে তাকে শুন্যে তুলে ধরেছে লোটা, পায়ের নীচে এখন মাটি নেই। শুকনো ডাঙায় মাছ যেমন খাবি খায় সেভাবে খাবি খাচ্ছে রাশেদ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, গলার উপর চাপ বাড়ছে ক্রমাগত। যে কোন সময় কষ্ঠার হাড় ভেঙে যাবে। নিজের অজান্তেই চিৎকার বেরিয়ে আসছিল রাশেদের গলা দিয়ে, কিন্তু সেই চিৎকার এখন বেরুনোর পথ পাচ্ছে না, গোঙাচ্ছে রাশেদ। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

ড. আরেফিন মাথা নীচু করে রেখেছেন, দুই হাত মুঠো হয়ে গেছে কিছু না করতে পারার আক্ষেপে। তার জন্যই এতো দূর দেশে এসে জীবন দিচ্ছে দুই বন্ধু। অথচ তিনি কিছু করতে পারছেন না। মাথার উপর রাইফেল ধরে রেখেছে সোহেল। ড. কারসনের দিকে তাকালেন, চোখ বন্ধ করে রেখেছে বৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ।

রাশেদের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন, তার কষ্ট হচ্ছে তাকাতে, ছেলেটা কষ্ট পেয়ে মরে যাচ্ছে তার চোখের সামনে! উঠে দাঁড়ালেন তিনি, কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই মাথার পেছন দিকে আঘাত পেলেন। জ্ঞান হারালেন তিনি।

***

বৃদ্ধ লামার গলার স্বর ক্রমে উপর দিকে উঠছে আবার, রাশেদকে উপরে তুলে ধরে চারপাশে তাকাল মিচনার। ঝড় আসছে, এই ঝড় প্রাকৃতিক কোন ঝড় নয়, বিশেষ একজন আসছে, তার আগে এই ছেলেটাকে খতম করে ফেলা দরকার। হাতের চাপ বাড়াল, আরেকটু চাপ দিলেই ঘাড় ভেঙে যাবে শিকারের, কিন্তু তার আগেই থামতে বাধ্য হলো সে। প্রতিপক্ষ চলে এসেছে। হুংকার দিয়ে উঠল মিচনার। এই মুহূর্তটির জন্য গত কয়েক শতাব্দি ধরে অপেক্ষা করে আছে সে, এই মুহূর্তটার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে হাজার হাজার মাইল। অন্য কোন দিকেই মনোযোগ দেয়ার সময় এখন নেই।

*

অধ্যায় ৫৮

আর কোন উপায় নেই, অন্তত নিজের চোখে রাশেদের কোন ক্ষতি হয়ে যাবে এটা তিনি কল্পনাই করতে পারেন না। তাই রাশেদকে যখন জীবনের জন্য ছটফট করতে দেখলেন নিজেকে থামাতে পারলেন না তিনি। যজ্ঞেশ্বরকে পেছনে রেখে এগিয়ে এসেছেন। পরনের জ্যাকেটটা যজ্ঞেশ্বরের কাছে রেখে এসেছেন, সেখানে চামড়ার খোপে থাকা ম্যাপের মধ্যে কালচক্র তন্ত্রের বিশেষ কিছু অংশ লেখা, বৃদ্ধ একজন লামা একপাশে বসে একনাগাড়ে মন্ত্রোচ্চারন করেই যাচ্ছে, মৃদু হাসি খেলে গেল তার মুখে। বৃদ্ধ জানে না অনেক কিছুই। আগে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে হবে, এড়ানোর কোন পথ খোলা নেই। তারপর অন্য কিছু নিয়ে ভাবা যাবে।

প্রতিপক্ষকে আগে একবার দেখেছিলেন, তখন এতোটা ভয়ংকর মনে হয়নি। এখন লোকটাকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পৃথিবীর আদিমতম অন্ধকার থেকে উঠে আসা এক দানব। তিনি যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন সেখানে এই ধরনের দানবের কোন স্থান নেই। সাম্ভালা খুঁজে বের করার আগে এই দানবকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেয়া জরুরি। রাশেদকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে দানবটা, রনহুংকার দিয়ে উঠেছে, পুরো পৃথিবী যেন কেপে উঠলো সে হুংকারে। এগিয়ে গেলেন তিনি।

***

আকবর আলী মৃধা একপাশে সরে এলেন, সামনে এখন যা হতে চলেছে তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। নতুন এই লোকটা কে, কোত্থেকে আগমন তার কিছুই তিনি জানেন না, বহুদিন আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই লোকটাই যে সেই বই কেড়ে নিয়েছিল তা এখন আর তার মনে নেই। সোহেল আর আহমদ কবিরকেও ইশারা করলেন একপাশে সরে আসতে। জায়গাটা বাকি সবার কাছ থেকে একটু দূরে, এখান থেকে সবার উপর রাইফেল তাক করে রাখতে কোন অসুবিধা নেই। নিজের নিরাপত্তা সবার আগে, ঐ দুজন মানব-দানবের মাঝে পড়ে অযথা নিজের জীবন খোয়াতে চান না তিনি। বোবা ছেলেটার এই ধরনের রূপান্তর তাকে অবাক করেছে, ছেলেটা যে বিশেষ একটা কিছু সেটা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু এতো ভয়ংকর রুপে দেখতে হবে কোনদিন তা কল্পনাও করেননি। নতুন যে লোকটা এসেছে তাকেও বিশেষ কিছু মনে হচ্ছে, তবে মানুষটার ভেতর হিংস্রভাব কম।

ড. আরেফিন আর ড. কারসনের দায়িত্ব দিলেন আহমদ কবিরকে, বাকিদের দায়িত্ব সোহেলের উপর। এখানে একটা লড়াই হতে যাচ্ছে, সেই লড়াইয়ে মনোযোগ দিতে চান তিনি আপাতত।

*

অধ্যায় ৫৯

মুখোমুখি হয়েছে দুজন। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিপক্ষকে হিসেব করে নিচ্ছে। উপস্থিত কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেন দর্শক, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে সামনে।

সমশক্তিতে দুজন দুপাশ থেকে পরস্পরের উপর আছড়ে পড়েছে। পুরো পাইন বন কেঁপে উঠলো যেন। কারো হাতে কোন অস্ত্র নেই। কিন্তু শারীরিক শক্তিতে মনে হচ্ছে দুজনই সমান। একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরেছে। মিচনার দুই হাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছে, হা করা মুখে দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ধারাল দাঁত, কাটা কাটা, কাঁচা মাংস খেয়ে অভ্যস্ত এই দাঁত দিয়ে প্রতিপক্ষের কাঁধে কামড় বসাতে চাইছে মিচনার। বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন লখানিয়া সিং, একবার দাঁত বসাতে পারলে নিজেকে কোনভাবেই অক্ষত রাখতে পারবেন না এটুকু বুঝতে পারছেন। একটানা আঘাত করে চলেছেন মিনারের তলপেট বরাবর। কিন্তু কাজ হচ্ছে না, যেন টেরই পাচ্ছে না মিচনার। আরো শক্ত করে চেপে ধরেছে লখানিয়া সিংয়ের গলা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে লখানিয়া সিংয়ের। এবার তলপেটের বদলে মিচনারের সোলার প্লেক্সাস বরাবর আঘাত করতে শুরু করেছেন লখানিয়া সিং। সাধারন কেউ হলে এক আঘাতেই সোলার প্লেক্সাস ভেঙে যেতো। কিন্তু মিনারের ব্যাপারটা ভিন্ন। অন্য কৌশল নিতে হবে, খুব তাড়াতাড়িই। গলায় চেপে ধরা মিচনারের দুই হাত ধরে সরানোর চেষ্টা করছেন লখানিয়া সিং, চাপ তাতে কমছে না বরং বাড়ছে। হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেছে মিচনার, এবার শুয়ে পড়লেন তিনি। তাতে ভারসাম্য হারিয়ে মিচনারের বিশাল দেহটা তার উপর পড়তে যাচ্ছিল। দুই পা জোড়া করে মিনারের পেটে বসিয়ে দিলেন তিনি। অন্তত দশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল মিচনারের দেহটা।

সেকেন্ডের মধ্যে নিজের ভারসাম্য ফিরে পেল মিচনার, কিন্তু সামনে শত্রু নেই। আশপাশে তাকাল, নেই, যেন নিমিষেই হারিয়ে গেছে। পেছন ফিরে তাকাতে গিয়ে বুঝল, শত্রু এখন পেছনে। তার পিঠ বরাবর দারুন এক লাথি বসিয়ে দিয়েছেন লখানিয়া সিং। এবার সামনের দিকে উড়ে গিয়ে পড়ল মিচনার। উঠে দাঁড়াল সাথে সাথেই, চোয়াল বরাবর আঘাত আসছে বুঝতে পেরে মাথা নীচু করল। এবার ভারসাম্য হারালেন লখানিয়া সিং। দুই হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলেছে মিচনার। আস্তে আস্তে উপরে তুলছে, হাঁটু ভাঁজ করে রেখেছে ঠিক সেখানেই আছড়ে ফেলবে লখানিয়া সিং কে, কোমর বরাবর। উপর থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রানপন চেষ্টা করছেন লখানিয়া সিং, কিন্তু হাতের বাঁধন খোলার আগেই মিচনার সজোরে তাকে নামিয়ে আনলো নীচে। হাঁটুর ঠিক উপরের অংশ আঘাত হানলো তার পাঁজরের নীচে, দুইহাতে কিছুক্ষন ধরে রেখে ছেড়ে দিল মিচনার দেহটা। মাটিতে পড়ে গিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষন শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলেন লখানিয়া সিং। পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে নিশ্চিত, মুখে হাত দিয়ে দেখলেন, রক্ত চলে এসেছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলেন দেরি হয়ে গেছে, তাকে আবারও উপর তুলে ধরছে মিচনার, এবারও যদি একইভাবে আঘাত করে তাহলে বুকের সব হাড় ভেঙে যাবে নিশ্চিত।

কোনমতে মিনারের ডান হাতে কামড় বসালেন লখানিয়া সিং। এতে আরো ক্ষেপে উঠলো মিচনার, একটানে তাকে মাথার উপর তুলে ফেলল দুহাত দিয়ে। ঘুরাচ্ছে, অসহায়ের মতো হাত-পা ছুঁড়ছেন লখানিয়া সিং। এবার দূরে ছুঁড়ে মারল মিচনার দেহটা। প্রায় বিশ হাত দূরে একটা পাইন গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়লেন লখানিয়া সিং। এবার দেরি না করে উঠে দাঁড়ালেন তাড়াতাড়ি। কিছুটা দূরত্বে যজ্ঞেশ্বরকে আসতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। আকবর আলী মৃধার পেছন দিক দিয়ে আসছে যজ্ঞেশ্বর, হাতে ছোট একটা ছুরি, এই ছুরি দিয়ে কী করবে সন্ন্যাসী ভেবে পেলেন না লখানিয়া সিং। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে মিচনার। মাথা সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে, বুক বরাবর আঘাত করতে চায়। কোনমতে মিচনারকে পাশ কাটালেন লখানিয়া সিং। কিন্তু বেশিক্ষনের জন্য না। মিচনার আবার আসছে।

***

ছোট্ট একটা ছুরিকে হাতিয়ার বানিয়েছে যজ্ঞেশ্বর, এটা দিয়ে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু ঝুঁকি নিতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। নিজের উদ্দেশ্য পূরনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সে। সামনের তিনজনকে নিরস্ত্র করা না গেলে হবে না, লখানিয়া সিং ব্যস্ত দানবের মতো একজনের সাথে লড়াই করতে। এই মুহূর্তে তার চুপচাপ বসে থাকার কোন মানে নেই। লখানিয়া সিংয়ের উপর ভরসা আছে। তিনি হারতে পারেন না। কিন্তু এই লোকগুলোর হাতে অস্ত্র থাকা মানে লখানিয়া সিং জিতে গেলেও হয়তো এদের অস্ত্রের কাছে পরাজিত হবেন।

ওদের মধ্যে দলনেতা একজন, সবার ডানে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা অটোমেটিক, তাক করে আছে সামনের দিকে। বাকি দুজনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে চলমান এক যুদ্ধ। ধীর পায়ে ডানের লোকটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল যজ্ঞেশ্বর, গলার উপর ছুরি ধরে ফিসফিস করে বলল, তোমার অস্ত্রটা আমার হাতে দাও, আর ওদেরকে বলো অস্ত্র ফেলে দিতে।

আকবর আলী মৃধা অবাক হলেও হুকুম তামিল করতে দেরি করলেন না, গলার উপর ধারাল ছুরিটা এঁটে আছে। সবকিছু নিয়ে ঝুঁকি নিতে রাজি হলেও নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নেয়ার কোন ইচ্ছেই তার নেই। আহমদ কবির আর সোহেলকেও ইশারা করলেন অস্ত্র ফেলে দিতে। নির্দ্বিধায় অস্ত্র ফেলে দিলো দুজন। সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে ছিল দুজন বন্দী, এদের মধ্য থেকে মাঝবয়স্ক একজন উঠে দাঁড়াল, যজ্ঞেশ্বর ইশারা করল তাকে বসে পড়তে। এই লোকগুলো খারাপ হবে বলে মনে হয় না, কিন্তু আপাতত কোন ঝুঁকি নেবে না যজ্ঞেশ্বর। অস্ত্র তিনটি একসাথে করে, নিজের হাতে একটা তুলে নিল। বাকি দুটো একটা একটা করে ছুঁড়ে মারল দূরে। এবার সদ্য নিরস্ত্র হওয়া তিনজনকে বয়স্ক দুজনের সাথে হাঁটু গেড়ে বসার জন্য ইশারা করল যজ্ঞেশ্বর। অল্প একটু দূরত্বের ব্যবধানে বৃদ্ধ একজন লামা একটানা মন্ত্রোচ্চারন করে যাচ্ছে। যজ্ঞেশ্বরের চোখ চলে গেল সামনের দিকে। সেখানে এখনো যুঝছে লখানিয়া সিং ঐ দানবটার সাথে।

***

রাশেদ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে মাত্র। এভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে সে কল্পনাই করতে পারেনি। একটু দূরে রাজুর দেহটা পড়ে আছে, কিন্তু ততোটুকু যাওয়ার মতো শক্তি এখন রাশেদের শরীরে নেই। কোনমতে একটা গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসল সে। কিছুটা দূরে নতুন এক চরিত্রকে দেখল, পরনে গেড়ুয়া, লম্বা চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, একজন সন্ন্যাসী। হাতে একটা রাইফেল যা সম্ভবত আকবর আলী মৃধার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারন ড. কারসন এবং ড. আরেফিনের সাথে আকবর আলী মৃধাকেও হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে দলসহ। ড. কারসনের দলের বাকি সদস্যরা এখনো বসে আছে আগের জায়গায়, সবার চোখেই বিস্ময়। কি ঘটছে, কেন ঘটছে, এতোগুলো লোক কারা কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। মেয়েটাকে সবচেয়ে বেশি হতবাক মনে হচ্ছে। চোখের সামনে অদ্ভুত এক লড়াই চলছে যার মানে তারা কেউই বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না রাশেদও। হামাগুড়ি দিয়ে রাজুর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে রাশেদ, ছেলেটার দেহে প্রান আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে।

***

এখন লড়াই হচ্ছে সমানে সমানে। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না, ক্রমেই পাইন বনের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে দুই প্রতিদ্বন্ধী। আর দশ হাত দূরেই খাদ। এই মুহূর্তে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে দানবের মতো লোকটা, তার চেয়ে কিছুটা ছোটখাট প্রতিপক্ষকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে খাদের দিকে, উদ্দেশ্য পরিস্কার। ফেলে দেবে খাদে। এই খাদে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। কতোটা গম্ভীর হতে পারে এই খাদ সে সম্পর্কে কোন ধারনাও নেই কারো।

লখানিয়া সিং বুঝতে পারছেন তার প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য কি, একটানা লড়াই করে তিনি কিছুটা ক্লান্ত, সারা শরীরে অসংখ্য জায়গায় কেটে ছিঁড়ে গেছে, রক্ত পড়ছে, বিশেষ করে দুই চোখ ফুলে গেছে এর মধ্যে এবং ডান চোখে আপাতত কিছু দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু নিজেকে সরিয়ে নেননি এখনো লড়াই থেকে, প্রতিপক্ষের একটানা আক্রমন না ঠেকিয়ে নিজেও পালটা আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছেন। যতো সময় পার হচ্ছে ততো ভয়ংকর হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষ। চেহারা হয়ে উঠেছে হিংস্র, লাল দুই চোখ যেন কোটর ছেড়ে ঠিকরে বের হয়ে আসবে যে কোন সময়। ক্লান্তি বলে কিছু নেই প্রতিপক্ষের, তাকে শেষ না করা পর্যন্ত থামবে না।

পেছনে তাকালেন লখানিয়া সিং, আর মাত্র পাঁচ হাত দূরে খাদ, দুই হাত দিয়ে তার কাঁধ ধরে রেখেছে প্রতিপক্ষ, একটানা ঘুষি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি প্রতিপক্ষের মুখ বরাবর, বেশ কয়েকটা চোয়ালে আঘাত হানলেও তা উপেক্ষা করল প্রতিপক্ষ, এই ধরনের আঘাতে তার কিছুই আসে যায় না, দুই পা পেছনে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন লখানিয়া সিং, এবার তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে বেগ পেতে হবে প্রতিপক্ষকে। এবার একহাত সরিয়ে নিয়ে একটানা তার মুখ বরাবর আঘাত করতে থাকল প্রতিপক্ষ আর অন্য হাত দিয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে নিচ্ছে পেছনের দিকে। ঘুষিগুলো এড়াতে পারলেও নিজেকে এক জায়গায় স্থির রাখতে পারছেন লখানিয়া সিং। খাদ থেকে তার দূরত্ব এখন সর্বোচ্চ দুই হাত।

***

লতিকা কাঁপছিল, শীতে না ভয়ে তা সে নিজেই বুঝতে পারছিল না। সব ধরনের অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুতি ছিল তার, কিন্তু এই ধরনের কোন কিছু যে হবে তা তার কল্পনারও বাইরে। তার পাশে সন্দীপ, ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দেখছে সবকিছু। হয়তো বুঝে গেছে এখান থেকে প্রান নিয়ে ফিরে যাওয়া যাবে না। সন্দীপের পাশে সুরেশ কিছুক্ষন আগেও জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে ছিল। জ্ঞান ফিরে পেয়েছে মাত্র, কিন্তু তার মুখেও কোন শব্দ নেই। দুই মানবরুপি দানবের লড়াই তাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে। সন্দীপ তাকাল সুরেশের দিকে, ইশারায় কিছু বলতে গিয়েও বলল না। তার মনে হচ্ছে এদের মধ্যে একজনের পক্ষ নেয়া দরকার এবং সেটা এক্ষুনি। দ্বিতীয় যে লোকটা এখানে এসেছে, রাশেদ যার কারনে মরতে মরতে বেঁচে গেছে, তাকে যে কোনভাবেই হোক সাহায্য করা দরকার। নইলে ঐ দানব তাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। কিন্তু সন্দীপ কিছু করার আগে উঠে দাঁড়াল সুরেশ। আরেক নতুন চরিত্র যজ্ঞেশ্বরের দিকে ইশারা করল তার দিকে রাইফেলটা ছুঁড়ে দেয়ার জন্য। প্রথমে ইতস্তত করলেও সুরেশের দিকে রাইফেলটা ছুঁড়ে দিল যজ্ঞেশ্বর।

জিনিসটা দেখে নিলো সুরেশ, চায়নীজ আর্মির জিনিস। চমৎকার ম্যাকানিজম। তাক করল সে বিশালদেহি দানবের বুক বরাবর। আর মাত্র এক হাত দূরে খাদ, ঐ লোকটাকে খাদে ফেলার আগেই গুলি ছুঁড়তে হবে।

ট্রিগারে চাপ দিল সুরেশ।

*

অধ্যায় ৬০

নিজের সামর্থ্যের শেষটুকু দিয়ে লড়ছিলেন তিনি, কিন্তু দানবের সাথে লড়াইয়ে টিকে থাকার মতো শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে পেছন দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাকে প্রতিপক্ষ। আর অল্প একটু পেছালেই খাদ। দানবটা তাকে নিজ হাতে না মেরে ঠেলে দিচ্ছে খাদের দিকে, হয়তো নিজ হাতে মেরে ফেলার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না, কেননা তাতে নিজেরও ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, কোনমতে যদি খাদে ফেলে দেয়া যায় তাহলে সেই ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। খাদে পড়ে যদি সে জীবিতও থাকে, তখন তাকে খুন করা একেবারে পানির মতো হয়ে যাবে প্রতিপক্ষের এই দানবটার জন্য। এই খাদ যতোই গভীর হোক না কেন, সেখানে পৃথিবীর কেউ যদি যেতে পারে তাহলে এই দানবটাই সেখানে যেতে পারবে।

রাগে-ক্ষোভে হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি। এভাবে মরতে আসেননি তিনি এইখানে। সারাজীবন ধরে ধারন করা জ্ঞান এই দানবের কারনে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু শারীরিক শক্তিতে দানবটার তুলনায় তিনি বেশ দুর্বল এখন। পাঁজরের হাড় যে কটা ভেঙেছে সব জানান দিচ্ছে এখন। সেই নীল তরলও রেখে এসেছেন অনেক দূরের এক গ্রামে, যেখানে সবাই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল লখানিয়া সিং বলে। সেই তরল কিছুটা থাকলে হয়তো কাজে দিতো, কিন্তু এখন সাহায্য করার মতো কিছু নেই, কেউ নেই। রাশেদকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে এখানে যারা আছে তারা কেউ রক্ষা পাবে না।

ডানে তাকালেন তিনি। এবার ড. আরেফিনের দলের মধ্যে থেকে একজনকে উঠে দাঁড়াতে দেখলেন। হাতে চায়নীজ আর্মির অটোমেটির রাইফেল, তাদের দিকেই তাক করে আছে, সম্ভবত নিশানা করছে দুজনের একজনকে। বুঝতে পারছেন, সম্ভবত প্রতিপক্ষের বুক বরাবর নিশানা করছে যুবক।

মাথা নীচু করে ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেন তিনি, বৃদ্ধের একটানা মন্ত্রপড়া ছাপিয়ে গেল আরেকটা শব্দ। গুলির শব্দ। প্রতিপক্ষের হাতের চাপ কমেনি এখনো ঘাড়ের উপর থেকে, কিন্তু বুকে এসে লেগেছে বুলেট স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি। একটা ধাক্কা খেয়ে কিছুটা নড়ে উঠলো প্রতিপক্ষ, আধ সেকেন্ডের এই সুযোগটা কাজে লাগালেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে জায়গা অদলবদল করে ফেললেন প্রতিপক্ষের সাথে, খাদের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এখন প্রতিপক্ষ, বুকের যেখানটায় গুলি লেগেছে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে অনবরত, তিনি জানেন এই গুলিতে মরবে না প্রতিপক্ষ, আহত হয়েছে মাত্র। কিন্তু ক্ষনিকের এই সুবিধাটুকু পুরোপুরি নিলেন তিনি, দুই হাত এলোমেলোভাবে ছুঁড়লেন যে তার কাঁধের উপর থেকে প্রতিপক্ষের হাত দুটো ছুটে গেল। খাদের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল প্রতিপক্ষ, কিন্তু প্রস্তুত তিনি। ডান হাত দিয়ে বুক বরাবর চাপ দিলেন তিনি, আলতো করে। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে পড়ে গেল তার প্রতিপক্ষ। বাতাসে খাবি খাচ্ছে কোন কিছু আঁকড়ে ধরার জন্য, কিন্তু অন্ধকার খাদ তাকে আপন করে নিচ্ছে। দীর্ঘ একটা চিৎকার কাঁপিয়ে দিলো পুরো পাহাড়টা। খাদের প্রান্ত থেকে সরে এলেন তিনি। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। অনেকদিন পর নিজেকে পুরোপুরি স্বাধীন বলে মনে হলো, এখন আর কেউ তার পিছু ধাওয়া করবে না।

***

ড. আরেফিন উঠে দাঁড়িয়েছেন, মন বলছে এখন আর কোন বিপদ নেই। তাঁর দেখাদেখি ড. কারসনও উঠে দাঁড়ালেন। আকবর আলী মৃধা আর দুই সঙ্গি এখনো হাঁটু গেড়ে বসে, সন্ন্যাসী ধরনের একজন মানুষ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, অস্ত্র তাক করে। এর আগে একবার উঠে দাঁড়াতে বাঁধা দিলেও এবার কিছু বলল না। ড. কারসন তাঁর দলের সদস্যদের দিকে এগিয়ে গেলেন। ড. আরেফিন এগিয়ে গেলেন রাশেদের খোঁজে। একটু দূরেই রাশেদকে দেখা যাচ্ছে, রাজুর সামনে উবু হয়ে বসে আছে, দূর থেকেই বুঝতে পারছেন কাঁদছে ছেলেটা। এর আগেও একবার প্রিয় বন্ধু হারিয়েছিল রাশেদ, এবার হয়তো আরেকজন হারাতে চলেছে।

ড. আরেফিন হাত রাখলেন রাশেদের কাঁধে। ঘুরে তাকাল রাশেদ, তার চোখে পানি, লুকালোর চোঁ করলো না রাশেদ। রাজুর দিকে ইশারা করে বলল, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মরেছে ছেলেটা!

মরেনি ও, বেঁচে আছে বোকা ছেলে! মৃদু ধমক দিলেন ড. আরেফিন, রাশেদের চোখে পড়েনি,কিন্তু ছেলেটার চোখের পাপড়ি নিমিষের জন্য কেঁপে উঠতে দেখেছেন তিনি। তোমার কাছে পানি আছে?

নেই, রাশেদ বলল, এবার রাজুর মুখের দিকে তাকাল। এখনো অনেক সতেজ দেখাচ্ছে, যদিও রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে মুখটা।

তুমি সরো, আমি দেখছি, ড. আরেফিন বললেন, রাশেদকে একপাশে সরিয়ে ছেলেটার হাতের পালস বোঝার চেষ্টা করলেন। পালস আছে। ওদের কারো কাছে দেখো, পানি আছে কি না?

উঠে দাঁড়াল রাশেদ, মনে হচ্ছে সব সমস্যা কেটে গেছে, এবার ড. আরেফিন আর রাজুকে নিয়ে দেশে ফেরা যাবে।

কিন্তু আরো কিছু ঘটার বাকি আছে মনে হচ্ছে, সামনের দিকে তাকাল সে। ড. কারসন অন্য রুপে আবির্ভূত হয়েছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *