১.৩ কোট স্যুট

অধ্যায় ২১

লোকটাকে এখন চেনাই যাচ্ছে না। কোট স্যুট পড়ে কেতাদুরস্ত হয়ে এসেছে। পরিচিত কেউ দেখলে ভিমড়ি খাবে। নামীদামি একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। কোনার একটা টেবিল আগে থেকেই রিজার্ভ করে রাখা ছিল। সেখানেই আধঘণ্টা ধরে বসে আছে লোকটা। শিষ্যদের কাছে তিনি মুর্তিমান আতংক, লুসিফারের চেলা, বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত আকবর আলী মৃধা নামে।

অনেকক্ষন ধরেই অপেক্ষা করছেন আকবর আলী মৃধা। ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে বসেছেন যেন। সময় কাটতেই চায় না। প্রফেসর মানুষেরা ক্লাসে যায় দেরি করে, তাই সেটাই তাদের অভ্যাস হয়ে যায়, এই ভাবনাটা মাথায় ঘুরঘুর করছে। এরা কখনো সময়ের মূল্য বোঝে না।

যার সাথে দেখা করার কথা তিনি বিশিষ্ট একজন ভদ্রলোক, সমাজের মাথা। ধনসম্পদের পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতিও আছে লোকটার। সরকারী দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন। একসময় ইউনিভার্সিটিতে ছেলেমেয়েদের নৃবিজ্ঞান পড়াতেন।

রাশেদের সাথে দুই-দুইবার যে লোকটাকে দেখা গেছে তার পরিচয় বের করতে পেরেছেন আকবর আলী মৃধা। সেও একজন প্রফেসর। নাম ড. আরেফিন। এই লোকটাও একসময় পড়াতো, এখন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে কাজ করেন। যার সাথে দেখা করার জন্য এসেছেন তার সহকর্মী লোকটা।

ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয়টা বাজতে চলল। আর দশমিনিটের বেশি অপেক্ষা করা যাবে না, শিষ্যদের নিয়ে সান্ধ্যকালীন সভায় বসেন তিনি। এই অনুষ্ঠান কোনভাবেই বাদ দেয়া সম্ভব নয়। সেখানে শিষ্যদের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, ভূগোল সবই আলোচনা করা হয়। তিনি চান শিষ্যরাও জ্ঞানী হোক, তাতে ভবিষ্যতে যে দলটা তিনি করেছেন তাদের কেউ হারাতে পারবে না। তবে শিষ্যদের মধ্যে গাধা-গবেটই বেশি।

পরিচিত লোকটাকে আসতে দেখা গেল, এই গরমেও স্যুট-টাই পরনে। বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়, তা না হলে দেখতে আগের মতোই আছে, ভাবলেন আকবর আলী মৃধা। এই বয়স্ক লোকটা তার একসময়ের বন্ধু। শাখাওয়াত হোসেন, এখন নামের আগে ড বিসর্গ যোগ হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়গুলোর কথা মনে পড়লো, কতোদিন আগের কথা!

‘আসাদ, কেমন আছিস?’ পাশে বসতে বসতে বললেন ড. শাখাওয়াত।

একটু অবাক হলেন আকবর আলী মৃধা, আসাদ? সে আবার কে? পরমুহূর্তে নিজের আসল নামটা মনে পড়ে গেল তার। আসাদ শিকদার, এটাই ছিল তার পিতৃপ্রদত্ত নাম। অনেক দিন পর কেউ এই নামে ডাকলো।

‘আমি ভালো, তোর খবর কি?’ আকবর আলী মৃধা বললেন।

‘এই তো, চলছে আর কি,’ বললেন ড. শাখাওয়াত, আশপাশে তাকাচ্ছেন, খুঁজছেন কাউকে, সম্ভবত ওয়েটারকে। আচ্ছা, তুই আমাকে খবর দিলি কি মনে করে? তাও এতো দিন পর?

‘আছে, কারন আছে।‘ আস্তে আস্তে বললেন আকবর আলী মৃধা।

ওয়েটারকে কিছু খাবারের অর্ডার দিলেন ড. শাখাওয়াত। কাবাব জাতীয় খাবার, সাথে নান, কোক। অনেকদিন এইসব খাওয়া হয় না তার। আজ অনেক পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা, এই উপলক্ষে খাওয়া যেতেই পারে।

‘তোর কারন আগে শুনি? নিশ্চয়ই ছোটখাট কিছু হবে না?’ ড. শাখাওয়াত বললেন, ‘তোকে যতটুকু চিনি আমি, একেবারে বদলাসনি তুই, আগের মতোই উদ্ভট চিন্তাগুলো তোর মাথায় ঘোরাঘুরি করে।’

‘ভুল বলিসনি একেবারে, এবারও হয়তো অন্ধের মতো কিছু একটার পিছে ঘুরছি, পরে দেখা যাবে কিছুই না।‘

ড. শাখাওয়াতের ফোন নাম্বার জোগাড় করা খুব কঠিন কিছু ছিল না। শুধু ভাবছিলেন, এতোদিন পর ডাকলে আসতে রাজি হবে কি না। কিন্তু খুব জোরাজুরি করতে হয়নি। এমনিতেই রাজি হয়ে গেছে পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য, ভাবছেন আকবর আলী মৃধা। প্রস্তাবটা আজই দিতে হবে। রাজি হবে কি না কে জানে। রাজি হলে ভালো তবে রাজি না হলে উপায় একটাই। মৃত্যু। কারন তার গোপনীয়তা যে কোন ভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে।

‘শাখাওয়াত, একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি তোকে,’ ইতস্তত করে শুরু করলেন আকবর আলী মৃধা।

‘বল না, সমস্যা কি?’

ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে গেল, ফলে দুজনেই চুপ রইলো কিছুক্ষন।

‘ঘটনা হচ্ছে, তোর এক সহকর্মীকে আমার খুব দরকার, তার কাছে এমন একটা জিনিস আছে, যা যেকোন মূল্যে পেতে হবে আমাকে, এই কাজে সাহায্য করতে পারিস তুই,’ বললেন আকবর আলী মৃধা।

অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন ড. শাখাওয়াত।

‘আমার সহকর্মী? কি নাম?’

‘ভালো করেই চিনিস তুই লোকটাকে, সেও ইউনিভার্সিটিতে পড়াতো। নাম ড. আরেফিন।

চোয়াল স্কুলে পড়ল ড. শাখাওয়াতের। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। রাশেদ এবং ড. আরেফিনের উপর হামলাকারী তার সামনে বসা বন্ধুটির লোকজন হতে পারে। কিন্তু আসাদ নামে তার সেই বোকাসোকা বন্ধুটা এতো খবর জোগাড় করলো কি করে? তার হামলা করার কারনই বা কি? সেই প্রাচীন বই না অন্যকিছু? সিদ্ধান্ত নিলেন চুপ করে শুনবেন আগে।

‘হ্যাঁ, ড. আরেফিন বলে একজন সহকর্মী আছে আমার,’ বললেন ড. শাখাওয়াত।

‘ড. আরেফিনের সাথে রাশেদ নামে একটা ছেলেও আছে। ওদের কাছেই আছে এখন জিনিসটা। আমার এখান থেকে চুরি করা হয়েছে।‘

‘চুরির কেস? তাহলে থানায় খবর দে। ড. শাখাওয়াত এমনভাবে বললেন যেন ভাঁজা মাছটিও উল্টে খেতে জানেন না।’

‘তুই বোধহয় খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছিস না, সেরকম চুরি হলে অবশ্যই খবর দিতাম। কিন্তু চুরি হয়েছে আমার একটা বই।‘

‘কি বই?’ এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যেন কিছুই জানেন না ড. শাখাওয়াত।

‘সে অনেক ঘটনা, পরে বলবো তোকে, আমার শুধু ওদের ঠিকানাটা দরকার,’ আকবর আলী মৃধা।

‘বইটা এমন কি মূল্যবান? খুলে বল আমাকে,’ ড. শাখাওয়াত বললেন।

‘তুই শুধু আমাকে ঠিকানাটা দে, ব্যস, আর কিছু কি তোর জানার দরকার আছে, হ্যাঁ?’ একটু রাগত স্বরেই বললেন আকবর আলী মৃধা।

‘দরকার আছে, কারন বইটা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল ওরা, বইটার গুরুত্বও আমি জানি, কাজেই লুকানোর প্রয়োজন নেই তোর।’ কাবাব মুখে দিতে বললেন ড. শাখাওয়াত।

এবার সত্যিই অবাক হলেন আকবর আলী মৃধা। মাথায় জট পাকিয়ে গেল যেন। বইটা নিয়ে ওরা শাখাওয়াতের কাছে এসেছিল, তার মানে কি? শাখাওয়াত কি করতে পারবে?

‘তুই কি ভাবছিস বুঝতে পারছি আমি, প্রাচীন ভাষার উপর কমবেশি পড়াশোনা আমিও করেছি, তাই নিয়ে এসেছিল আমার কাছে, বইটা আমি রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাশেদ ছেলেটা রাখতে দিলো না।’ ড. শাখাওয়াত বলে চলেছেন, বইটা আমারও চাই।’

‘আচ্ছা, তাহলে তুই আমাকে বইটা উদ্ধার করতে সাহায্য কর, তারপর দুজনে মিলেই পাঠোদ্ধার করবো। আকবর আলী মৃধা বললেন।

‘ঠিক আছে, কিন্তু তোর কথার উপর ভরসা কি? কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে আমাকে ভুলে যেতে তোর সময়ও লাগবে না। তোর গুন্ডাবাহিনী আমি দেখেছি স্বচক্ষে। ড. শাখাওয়াত বললেন।

‘লুসিফারের কসম,’মাথায় হাত দিয়ে বললেন আকবর আলী মৃধা।

‘লুসিফার তোর ঈশ্বর হতে পারে, আমার নয়। যাই হোক, তাহলে এই কথাই রইলো। খাবারে আবার মনোযোগ দিলেন ড. শাখাওয়াত।

‘ঠিকানা কোথায়?’ চিবিয়ে বললেন আকবর আলী মৃধা।

‘ধীরে বন্ধু, ধীরে। এতোদিন পর দেখা হলো, গল্প করি, খাই, ঠিকানা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তবে একটা কথা, ড. কারসন থাকলে কাজটা আরো সহজ হতো।‘

‘কি রকম সহজ হতো?’

‘এই লোকটা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে, সে থাকলে পাঠোদ্ধার করা মোটেই ককর কিছু হতো না।’ ড. শাখাওয়াত বললেন।

‘মনে কর, সে আছে আমাদের সাথে।‘

‘কিভাবে?’ অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন ড. শাখাওয়াত। তারপর বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন হো হো করে। আকবর আলী মৃধার কাছে চেয়ার এগিয়ে নিয়ে বসলেন, ‘তোরাই তাহলে কিডন্যাপার! তাই তো বলি, মুক্তিপন চায় না কেন?

‘মুক্তিপন চাই না আমার। কাজ হয়ে যাক, তারপর একেবারে মুক্তি দিয়ে দেবো ওকে।’ বললেন আকবর আলী মৃধা।

কথাটায় হাসির কিছু ছিল না, কিন্তু কি কারনে দুজনেই হেসে উঠলেন হো হো করে।

*

ধ্যায় ২২

অনেক অনেক পথ হেঁটেছেন তিনি। মাইলের পর মাইল। দিন নেই রাত নেই। কিন্তু তাতেও ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি। একবার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। তিব্বত নেপাল সীমান্তের একটা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে কিছু একটা খাচ্ছিল বেঈমানটা। তিনি চলেও গিয়েছিলেন কাছাকাছি। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়েছে রামপ্রসাদের। কিভাবে যেন টের পেয়ে হাওয়া হয়ে গেছে লোকটা। তারপর আবার হাঁটা। সেই হাঁটাও যেন অনন্ত, শেষ হয় না। হেঁটে হেঁটে এরপর নেপাল ছাড়িয়ে আবার ভারতবর্ষ। যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই বোম্বের দিকে যাচ্ছেন তিনি। খুব বেশি দূরে নয় এখান থেকে।

মানুষজন সবাই তাকায় তার দিকে। চেহারায়সাহেব অথচ সাদামাটা পোষাক পরনে, যা দেখে তারা মোটেও অভ্যস্ত নয়। তাদের চোখে একধরনের ভয়, ঘনাও দেখতে পান তিনি। সাম্রাজ্যবাদীদের পছন্দ করে না কেউ, বিশেষ করে ব্যবসা করতে এসে যারা জাঁকিয়ে বসে তাদের তো নয়ই। রবার্ট ক্লাইভ যার সাথে তিনি একদিন এই ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিয়েছিলেন, সেই প্রথম প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সুযোগে বাংলার মসনদ দখল করে ছিল। তারপর একে একে পুরো ভারত। সেই ক্লাইভও বাঁচতে পারেনি শান্তিতে। শেষে আত্মহত্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করেছিল। বোম্বের এই বন্দরেই এসে নেমেছিলেন তিনি কিছুদিন আগে, ইউরোপের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে। সেখানেই কুড়িয়ে নিয়েছিলেন রামপ্রসাদকে।

যে এলাকাটায় আছেন সেখানে চলছে এক মহাযজ্ঞ। ট্রেন লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিজেদের স্বার্থেই ট্রেন ব্যবস্থা শুরু করেছে। ভারতে। সহজ এই যানবাহনটি ইউরোপে চলছে আরো অনেক দিন ধরে। ভারতবর্ষে শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধার জন্য ট্রেন লাইন বসানোর কাজ হাতে নিয়েছে ইংরেজরা। মাত্র কাজ শুরু হয়েছে, শেষ হতে কতোদিন লাগবে কে জানে। এখানে যারা কাজ করছে তারা জীবনে ট্রেন দেখেনি,হাজার চাকার আজব এক যন্ত্র খুব শিগগিরি তার যাদুকরি ক্ষমতা দেখানো শুরু করবে, কিন্তু এর সুফল ভারতবাসী পাবে আরো পরে। বর্তমান গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির আমলেই অনেক ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ট্রেন লাইন এবং টেলিগ্রাফের তার বসানো উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনা।

দুপুর গড়িয়ে গেছে, কোথাও থাকবার ব্যবস্থা নেই। তিনিসাহেবদের মধ্যে পড়েন, চাইলেই যে কোন জায়গায় বসে বিশ্রাম নিতে পারেন না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে কোথাও সুখে নেই ভারতবাসী। ক্ষোভ, ঘৃনা, বিদ্বেষ বাড়ছেই সাধারন মানুষের মনে। হিন্দুরা তবুসাহেবদের ভাষা শেখায় মনোযোগ দিয়েছে, কিন্তু মুসলমানরা যারা এই কিছুদিন আগেও এই সাম্রাজ্যের প্রথম শ্রেনির বাসিন্দা ছিল, তারা মোটেও উৎসাহী নয় ইংরেজদের সাথে তাল মিলিয়ে, হুজুর হুজুর বলে চলতে।

বোম্বে বেশি দূরে নয়। রামপ্রসাদকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটাও ভালো করে জানা তার। রাস্তার একপাশে এখানে গাছ কেটে ট্রেন লাইনের কাজ চলছে, অন্যপাশে জনমানুষহীন। শ্রমিকরা কেউ দেখেনি এখনো তাকে। কাজেই তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে চলে গেলেন তিনি। রোদের তেজ এখন অনেক কম। চারপাশ ছায়াঘেরা। নরম ঘাসের উপর আলতো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা জায়গায় আগেও গিয়েছিলেন তিনি। বহু আগে।

ক্ষুধা লেগেছে খুব, কিন্তু এখন দরকার বিশ্রাম, পাগুলোকে একটু শান্তি দেয়া উচিত বলে মনে হলো তার।

ছোট একটা ঝোঁপ বেছে নিলেন তিনি। এখানে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে থাকা যায়। তারপর ঘুম থেকে উঠে সারারাত হাঁটলে বোম্বে বন্দরে পৌঁছানো যাবে। সাথে কিছুই নেই, ঝাড়া হাত-পা। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন, কিংবা দ্রাচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। স্বপ্নে ভেসে গেলেন অনেক দূর দেশে। ব্যাপারটা হয়তো শুধুই স্বপ্ন ছিল না, ছিল স্মৃতি, যা এখনো মাথায় রয়ে গেছে স্বপ্নের মতো করে।

কয়েকশ মানুষের বিশাল একটা দল। বেশিরভাগ কৃষ্ণবর্ণের মানুষ, উচ্চতা স্বাভাবিক। এরমধ্যে কিছু মানুষ আছেন যারা অভিজাত, তাদের গায়ের রঙ ঈষৎ তামাটে। মানুষের দলের সাথে আরো আছে, হাতি এবং ঘোড়ার বিশাল এক দল।

অভিজাত মানুষদের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এদের। দলের মাঝামাঝি আছে। সবচেয়ে দামি হাওদা, সেখানে যাত্রী একজনই, রাণী মাকিদা, যাকে আরো অনেক নামেই ডাকা হয়। শেবা শহরে রাজধানী করেছেন বলে তাকে অনেকে ডাকে শেবার রাণী বলে। অনেক দূরের এক শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন তারা। শহরের নাম জেরুজালেম, বর্তমান শাসকের নাম সলোমন। যিনি দাউদের পুত্র, সোলায়মান নামেও পরিচিত তিনি। পিতার মৃত্যুর পর শাসনে বসেছেন সলোমন।

সোমনের বিশেষ এক আমন্ত্রনে যাত্রা শুরু করছেনে শেবার রাণী। একটা চিঠি পাঠিয়েছেন সলোমন। বাহক কে ছিল কেউই জানে না। যাত্রায় রাণী সাথে নিয়েছেন বিস্তর ধন-দৌলত। ম্রাটকে উপঢৌকন দেয়ার জন্য। সাড়ে চার টন সোনা নিয়েছেন সাথে, অন্যান্য সামগ্রী তো আছেই।

রাণীর হাওদার পাশাপাশি যাচ্ছে একটি ঘোড়া। সওয়ারীর নাম মুগওয়া। বয়স পয়তাল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মতো। স্বাস্থ্যবান মানুষ তিনি। রাণীর যেকোন প্রয়োজনে হাজির সবসময়। রাণী যেকোন বিষয়ে পরামর্শ করেন তার সাথে।

জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার পূর্বে মুগওয়ার সাথে কথা বলেছেন রাণী। অন্যান্য পরামর্শকরা ছিল, কিন্তু মুগওয়া সম্মতি না দেয়া পর্যন্ত কোন কাজে হাত দেন না তিনি। মুগওয়ার পরামর্শেই বিপুল পরিমান সোনা নিয়েছেন ম্রাটকে উপহার দেয়ার জন্য।

মাথার উপর গনগনে সূর্য তার সমস্ত তাপ ঢেলে দিচ্ছে। এই সূর্যকেই আরাধ্য মানা হয় শেবায়। আফ্রিকার পূর্ব কোণে ছোট একটা জায়গায় অবস্থিত এই শেবা। শান্তশিষ্ট একটি রাজ্য, কোন যুদ্ধে নেই, ষড়যন্ত্রে নেই। রাণী শান্তিপুর্নভাবে দেশ চালাচ্ছেন। অশেষ জ্ঞানের অধিকারিণী রাণী এখন পূন্যাত্মাদের লীলাভূমি জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। তিনি এখনো অবিবাহিত। সৌন্দর্য্যে তিনি অপরুপা। চাইলে যে কাউকে মনের সিংহাসনে বসাতে পারেন, কিন্তু মনের মতো কাউকে খুঁজে পাননি তিনি।

সম্রাট সলোমন এরমধ্যেই একজন জ্ঞানী শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মীয় নানা সংস্কারে অবদান আছে তার। একশ্বেরবাদের প্রচারক তিনি। দিকে দিকে ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সূর্যপূজারী রাণীকে আমন্ত্রন পাঠিয়েছেন তিনি।

মুগওয়া আকাশের দিকে তাকালেন। আরো কিছুদিন বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না। চারপাশে শুষ্ক ধুসর মরু, পথ হারিয়ে অন্যদিকে চলে গেলে মহা সমস্যা। জেরুজালেমে যাওয়ার পথ একমাত্র তিনিই জানেন। তার দিকনির্দেশনায় চলছে পুরো দল। রাণী বিশেষ পছন্দ করেন তাকে, সেই পছন্দের সূত্র ধরে ইচ্ছে করলে এখন পুরো দলটাকে বেপথে নিয়ে লুটে নিতে পারেন। কিন্তু সেরকম কোন ইচ্ছে তার নেই। এখানে এসেছেন বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যএখন সফল হওয়ার পথে। কিন্তু কিছুটা সমস্যা আছে। দলে এমন কিছু লোক আছে, যারা তাকে মোটেও সহ্য করতে পারছে না। যে কোন সময় পেছন থেকে ছুরি মারতেও দ্বিধাবোধ করবে না।

চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। দূরে একটা হৈচৈ এর শব্দে বাস্তবে ফিরে এলেন। এগিয়ে গেলেন তিনি। তেমন কিছু না। দুই সৈন্য লড়ছে। বাকিরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠলো মুগওয়ার। এটা একধরনের বিনোদন। এই শুষ্ক যাত্রায় এর প্রয়োজন আছে।

আগামী কাল দুপুরের মধ্যেই জেরুজালেমে পৌঁছে যাবেন বলে আশা করছেন মুগওয়া।

রাতটা কাটিয়ে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রওনা দিল দলটা। জেরুজালেম খুব বেশি দূরের পথ নয় এখন। দুপুরের মধ্যেই তাই তারা পৌঁছে গেল জেরুজালেমের প্রবেশপথে।

দারুন এক অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছিল অভিযাত্রীদের জন্য। প্রবেশদ্বারের দুপাশে সারি বেঁধে দাঁড়ানো কয়েকশ মানুষ অপেক্ষা করছিল তাদের বরন করে নেয়ার জন্য। তাদের হাতে ফুল। ছিটিয়ে দিচ্ছিল অতিথিদের উদ্দেশ্যে। একপাশে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে গান গাইছে। দলটার সম্মুখভাগে মুগওয়া আছেন, পাশে রাণীর পরামর্শকদের মধ্য থেকে দুজন। সবার মুখে স্মিত হাসি। এতো চমৎকার পরিবেশ আশা করেনি কেউ। চারপাশে সবাই আনন্দ করছে, যেন তাদের আগমন বিশেষ কিছু এখানকার জনগনের কাছে।

দলটার ঠিক মাঝখানে আছেন রাণী। হাতির পিঠে সওয়ার। ঠিক রাজকীয় ভঙ্গিতেই বসে আছেন হাওদার উপর। হাত নাড়ছেন জনগনের উদ্দেশ্যে। অবাক হয়েছেন তিনিও। সম্রাট সলোমনের শাসনে যে এরা খুশি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শহরটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ঘরবাড়ি সাজানো গোছানো, যেন একটা বাগানের মতো। সামনে তাকালেন তিনি। মুগওয়ার দিকে। এই লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। এতো দূর দেশে আসার পেছনে মূল উৎসাহদাতা এই মুগওয়া। জন্ম কোথায়, হঠাৎ কোথা থেকে আবির্ভাব কিছুই জানেন না। কিন্তু তারপরও একেবারে আপন করে নিয়েছেন তাকে। লোকটার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সবই আকৃষ্ট করে। কোনকিছুই চাপিয়ে দেয়নি সে কখনো, শুধু দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছে। বিনিময়ে আশাও করেনি কিছু তার কাছ থেকে। না টাকা-পয়সা, না কোন উচ্চতর পদ।

বেশি কিছুক্ষন যাওয়ার পর সম্রাটের প্রাসাদ চোখে পড়ল। এধরনের কিছু জীবনে চোখে পড়েনি মুগওয়ার, কিংবা আশাও করেননি জীবনে দেখবেন কোনদিন। বিশালকায় এক নির্মান, ইট-পাথরে গড়া, মাঝে ঝকঝকে কাঁচের উপস্থিতি। প্রাসাদে ঢোকার পথে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে স্বাগতম জানানোর জন্য। মুগওয়া দাঁড়ালেন। পেছনে পুরো দলটা দাঁড়িয়ে গেল। পুরো দল নিয়ে প্রাসাদে ঢোকা সমুচিত মনে করলেন না তিনি। শুধু রাণী ঢুকবেন, সাথে তার পরামর্শকল এবং উপঢৌকন বহনকারীরা।

হাতির উপর থেকে নেমে এলেন রাণী। এবার সামনে থাকলেন তিনি। বাকিরা সারিবদ্ধভাবে পেছনে, অনুসরন করলো রাণীকে। প্রাসাদে ঢোকামাত্র অদ্ভুত এক শব্দ করে উঠলেন রাণী। বাকিরাও প্রায় স্তম্ভিত। পায়ের নিচে বিশাল এক হ্রদ খেলা করছে। পরিস্কার পানিতে দেখা যাচ্ছে মাছ আর সামুদ্রিক সব প্রানীদের। মেঝেটা কাঁচ দিয়ে তৈরি, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। বিরাট দরবারের শেষপ্রান্তে বসে আছেন ম্রাট সলোমন। রাণী নিজের পরনের কাপড় উঁচু করে ধরলেন, তার কাছে মনে হচ্ছে একটা হ্রদের পানির উপর হাঁটছেন।

রাণীকে সম্ভাষন জানাতে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন সম্রাট সলোমন। কিন্তু রাণী এখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার বাকি সঙ্গিরাও না।

আরো আশ্চর্যজনক জিনিস অপেক্ষা করছিল অতিথিদের জন্য, রাণীর প্রিয় সিংহাসন দেখা যাচ্ছে, ম্রাটের সিংহাসনের পাশেই। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না মুগওয়া। সলোমনের অনেক আলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনেছেন, কিন্তু এর তুলনা কি? কোন যাদুবলে সুদূর শেবা থেকে সিংহাসন তুলে নিয়ে এসেছেন তিনি?

মুগাওয়ার কাজ শেষ। রাণীকে এতোদূর পৌঁছে দেয়াই ছিল তার মূল দায়িত্ব। দরবার থেকে বের হয়ে এলো সে। প্রাচীন নগরীটির সৌন্দর্য তাকে মোহিত করছে। কিন্তু এখানে থাকা যাবে না। আরো বড় কাজ অপেক্ষা করছে সামনে। এই শহর একসময় হয়ে উঠবে ধর্মীয় অনুভূতির প্রানকেন্দ্র। এর দখলের জন্য লড়বে লক্ষ কোটি মানুষ। বড় এক মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে, তখন সবই বদলে যাবে, কিন্তু তার এখনো অনেক দেরি। আরো ৯৫০ বছর পর কুমারী মেয়ে মরিয়মের গর্ভে আসবে সে। তখন থেকে সভ্যতার ইতিহাস রচিত হবে নতুন করে।

চোখ কচলে উঠে বসলেন। ইদানিং তন্দ্রা বা ঘুমে স্মৃতির দেশে হারিয়ে যান তিনি। কুইন অব শেবা এখন শুধুই একটা মিথ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বোম্বে আর বেশি দূরে নেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পাখির দল নীড়ে ফিরেছে, কিন্তু তিনি মহাকালের পথে হাঁটছেন, সবাই যখন ঘরে ফেরে, তখন তার সময় হয় বাইরে যাবার। হাঁটা শুরু করলেন। দূর আকাশের চাঁদটাই বোধহয় তার দীর্ঘ সফরের একমাত্র সাক্ষি।

*

অধ্যায় ২৩

আকবর আলী মৃধা নিজের রুমে পায়চারী করছেন। বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। একটা ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে যথেষ্টই। ইচ্ছে করলে রেস্টুরেন্টেই ঠিকানা দিয়ে দিতে পারতো শাখাওয়াত। কিন্তু দুদিন সময় নিয়েছে কোন কারনে কে জানে। অবশ্য আজ রাতের মধ্যে ফোন করার কথা। কিন্তু এখনো ফোনকলটা আসেনি বলে চিন্তিত আকবর আলী মৃধা।

শাখাওয়াত এখন অনেক কিছু জানে। বিশেষ করে ড. কারসনের ব্যাপারটা। ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যেতে পারতেন বিষয়টা। কেন যে বলতে গেলেন ড. কারসনকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। শাখাওয়াত বুঝতে পেরেছে ড. কারসনের অপহরনকারী আর কেউ নয়, আকবর আলী মৃধা। এখন লোকটা যদি পুলিশে খবর দেয়, তাহলেই সমস্যা। চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। অবশ্য পুলিশে খবর দিয়ে দিলে এততক্ষনে কিছু একটা হয়ে যেত, শাখাওয়াতের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা কার পর দুদিন পার হয়ে গেছে। সমস্যা কিছু হয়নি এখনো। আরেকটা ভালো জিনিস হচ্ছে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিটা একটু কমে এসেছে ড. কারসনকে নিয়ে। কারন দেশে দেবার মতো আরো খবর আছে। এক কারসনকে নিয়ে পুলিশ কিংবা অন্যান্য বাহিনী সারা সময় কাটিয়ে দিতে পারে না। যদিও এতে ঘটনার গুরুত্ব কমে গেছে বলে ভাবেন না তিনি। পুলিশের প্রায়োরিটি লিস্টে এক নাম্বারেই আছে ড. কারসনের কেসটা। ড. কারসনকে এখন ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে।

ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়। শাখাওয়াতের নাম্বার। মৃদু হাসি দেখা গেল আকবর আলী মৃধার ঠোঁটের কোনে।

একমিনিটের মধ্যে ড. আরেফিনের ঠিকানা নিয়ে নিলেন তিনি। এবার অপারেশনে যাওয়ার পালা। আজ রাতের মধ্যেই উদ্ধার করতে হবে বইটা। আটজনের একটা দল তৈরি করেছেন তিনি। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সবাই। একটা কমান্ডো দলের মতো। পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রও আছে ওদের কাছে। ঠিক এক ঘণ্টার ভেতর বের হয়ে যাবে সবাই।

দলের নেতা হিসেবে রেখেছেন সালমান নামে একটি ছেলেকে। মানুষ না বলে ভয়ানক একটি প্রানী বলা যায় একে। রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলেন ছেলেটাকে তিনি। আরো বছর পাঁচেক আগে। রাতে ড্রাইভ করে আসছিলেন ময়মনসিংহ থেকে। গাজীপুরের কাছে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন ছেলেটাকে। খালি গায়, শুধু একটা জিন্সের প্যান্ট পরনে। ছেলেটার চেহারা দেখেই পিলে চমকে গিয়েছিল তার। এতো সুন্দর, এতো সুদর্শন, এতো সুঠাম দেহের গড়ন অন্তত বাঙ্গালীদের মাঝে চোখে পড়ে না। গ্রিক দেবতা মনে হবে হঠাৎ। নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। কথা বলানোর চেষ্টা করেছেন অনেক, ছেলেটা হয় জন্ম থেকেই বোবা নয়তো ভান ধরে আছে। যাই হোক না কেন, একে দিয়ে সব কাজ করানো যায়। বিশেষ করে যেসব কাজে পেশীশক্তির প্রয়োজন হতে পারে। এমনিতে দিনরাত ব্যায়াম নিয়ে থাকে, রান্নাবান্না করে, বাইরে যেতে না বললে বাইরে বের হয় না। ব্যায়াম করার কারনে একটা লাভ হয়েছে। শরীরটা হয়েছে দেখার মতো। সিনেমায় ঢুকতে পারলে ভালো নাম কামাতে পারত। তাই হিন্দি সিনেমার নায়কের নামে নাম রেখেছেন তিনি। কথা বলতে পারে না ঠিকমতো, কিন্তু স্বভাবটা খুনে। রক্ত খুব পছন্দ করে। লুসিফারের উদ্দেশ্যে এখন পর্যন্ত যে কয়টা বলি চড়িয়েছেন, তাতে মূল জল্লাদের ভূমিকা ছিল এই সালমানের। এখন বয়স প্রায় পঁচিশের মতো। যখন উদ্ধার করেছিলেন তখন নিজের নাম পরিচয় কিছুই বলতে পারেনি ছেলেটা। মাথাটা একেবারে খালি। ছিল না কোন সাধারন জ্ঞান, তবে অক্ষরজ্ঞান আছে, বই পড়তে পারে, এমনকি ইংরেজিও। রিফ্লেক্স খুব ভালো ছিল। কথা বললে মন দিয়ে শোনে এবং বোঝে। আজ রাতের মিশন পুরোপুরি বোঝান হয়েছে ওকে। দলের বাকি সদস্যরা সাধারন। তবে এদেরকেও প্রশিক্ষন দিয়েছেন তিনি। অন্তত অস্ত্র চালানোয় পারদর্শী সবাই।

আটজনের দলটা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির উঠোনে। আজ বাকি সবাইকে চলে যেতে বলেছেন আগে আগে। শুধু সোহেল আছে তার সাথে। দোতলা থেকে নেমে এলেন তিনি। পরনে কালো আলখেল্লা। মুখে একধরনের কালো রঙ মেখেছেন। অপারেশনে নামার আগে এদের কিছুটা উদ্বুদ্ধ করা দরকার। এবারের কাজে কোনভাবেই ব্যর্থ হওয়া চলবে না।

*

আজিজ ব্যাপারির মন মেজাজ খারাপ। চেয়ারম্যান হওয়ার পর মনে হচ্ছে সবাই শত্রু হয়ে গেছে তার। পদে পদে ঝামেলা, শান্তিতে একটা দিন কাটাতে পারেননি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে। তারমধ্যে শুরু হয়েছে বুড়ো বাপকে নিয়ে ঝামেলা। লোকটার আচার আচরন বেশ সন্দেহজনক। সালেহার ধারনা, তার শ্বশুড় জ্বীন। রাত-বিরাতে তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেখেছে সে কয়েকবার। সুস্থ সবল মানুষের মতো চলাফেরা। কথাবার্তায়ও অনেক রহস্য পাওয়া গেছে বুড়োর। কিন্তু নিজের বাপকে নিয়ে কোন কথা শুনতে রাজি নন আজিজ ব্যাপারি।

নিজের মনেও যে কিছু সন্দেহ আসেনি তা নয়। কিন্তু কাউকে তা বলা যাবে না। প্রথম সন্দেহ হচ্ছে নুরুদ্দিনকে নিয়ে। ছেলেটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, বুঝদার ছেলে ছিল। এভাবে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। ছেলের বাপ গত সপ্তাহেও এসেছিল। কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিয়েছেন। এভাবে কতোদিন? একদিন না একদিন টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা যাবে না, তখন পুলিশ আসবে, মামলা মোকাদ্দমা হবে। এই ঝামেলার মূলেও তার বাবা আছেন এটা নিশ্চিত আজিজ ব্যাপারি। জয়নালের মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। কেউ খুন করেছে তাকে। সালেহার কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বুড়োর পক্ষে খুন করা অস্বাভাবিক কিছু হবে না। বুড়োর শরীর বাইরে থেকে যেরকম দেখা যায় আসলে হয়তো সেরকম নয়। এছাড়া সালেহাকে বাচ্চা-কাচ্চার ব্যাপারেও টেনশন করতে না করেছে তার বাবা, এটাও অস্বাভাবিক, তিনি কি মৌলানা না পীর, যে পানি পড়া দেবেন।

নিজের বুড়ো বাপকে সন্দেহ করছেন বলে একটু লজ্জাও লাগলো আজিজ ব্যাপারির। এইতো ঠিক উঠোনের মাঝখানে বসে আছেন তিনি, প্রতিদিনকার মতো। হাতে মুড়ির পাত্রটা নিয়ে। এগুলো কি সবই অভিনয়? তার বাবা কি কোন মানুষ নয়, জ্বীন, ভূত বা অন্যকিছু?

গ্রামের কিছু লোক চলে আসাতে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আজিজ ব্যাপারি। বাবার কথা তার মনেই রইলো না।

***

সন্ধ্যা মেলানোর একটু আগে নিজের ঘরে ফিরে এলেন মজিদ ব্যাপারি। বুড়ো মানুষের মতো কুঁজো হয়ে হেঁটে আসতে খুব খারাপ লাগছিল। অভিনয় করতে আর ভালো লাগছে না। আজ রাতেই যা করার করে ফেলতে হবে বলে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন তিনি। ঘরটার দিকে তাকালেন। এককোনায় মৃত স্ত্রীর ছবিটা চোখে পড়ল, কি সুন্দর সজীব চেহারা। সাদাকালোয় তোলা। কিন্তু এখনো চেহারাটা চোখে ভাসছে। মিশরের ক্লিওপেট্রা কিংবা নেফারতিতির তুলনায় কম সুন্দরি ছিল না তার মৃত স্ত্রী। তিনি নিজে অন্তত তাই মনে করেন। এখানকার পাট শেষ হয়েছে ভাবলেই বুকটা হু হু করে উঠছে। কিন্তু এখানে থাকাটা আর ঠিক হবে না। ছেলে, ছেলের বৌ দুজনের চোখে সন্দেহের বিষ দেখেছেন তিনি, যদিও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সন্দেহ একসময় অবিশ্বাসে রুপ নেবে, তারপর ঘৃনা কিংবা লোভে পরিণত হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি হওয়ার আগেই চলে যেতে হবে এখান থেকে।

সন্ধ্যার পর কিছু খান না তিনি। ছেলের বৌ এসে এক গ্লাস দুধ রেখে যায়, সেটাই তার একমাত্র আহার। আজও আসবে, অপেক্ষা করছেন মজিদ ব্যাপারি।

সালেহা এলো না। দুধ হাতে আজিজ ব্যাপারিকে দেখা গেল। বাপের জন্য নিজেই দুধ নিয়ে এসেছে হাতে করে। এ ধরনের দৃশ্য আগে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না মজিদ ব্যাপারি। খাটের উপর পা তুলে বসেছেন তিনি। এবার একটু নড়চড়ে বসলেন। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্যে এসেছে তার ছেলে।

‘বাজান, তোমার দুধ?’ বাবার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন আজিজ ব্যাপারি।

দুধের গ্লাসটা হাতে নিলেন মজিদ ব্যাপারি। এক ঢোঁকে খেয়ে নিলেন সবটুকু। খেয়েই বুঝলেন ভুল হয়ে গেছে একটু। একজন বৃদ্ধ মানুষ এভাবে দুধ খাবে না, সে দুধ খাবে ধীরেসুস্থে। যাই হোক, যা হবার হয়ে গেছে।

‘বাজান, তোমার লগে কিছু কথা ছিল?’

‘আইজ আমার মন মেজাজ ভালো না, গত রাইতে তর মারে স্বপ্নে দেখছি, সে আমারে ডাকে।‘ মিথ্যে করে বললেন মজিদ ব্যাপারি, গলার স্বরে কিছুটা কান্নাভাব আনলেন ইচ্ছে করে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি, আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইলেন।

একটু থতমত খেয়ে গেছেন আজিজ ব্যাপারি। রীতিমতো আবেগপ্রবন কথা, মৃত্যুর দিকে ধাবিত একজন বুড়ো মানুষ যে ধরনের কথা বলে অনেকটা সেরকম।

‘কি কইতে আইছিলি ক’? আবার বললেন মজিদ ব্যাপারি। নিজেকে একটু সামলে নেয়ার অভিনয় করলেন তিনি।

‘তোমার তো অনেক বয়স হইছে, চাইছিলাম তোমারে ঢাকায় নিয়া বড় ডাক্তাররে দেখাইয়া আসবো।’ আজিজ ব্যাপারি বললেন, যদিও ঠিক এই কথাটা বলার উদ্দেশ্যে আসেনি,তার উদ্দেশ্য ছিল নুরুদ্দিন কিংবা জয়নালকে নিয়ে কিছু কথা বলার। কিন্তু যা বলেছেন চিন্তা করে দেখলেন তাও খুব খারাপ বলেননি। ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করলেই সব বোঝা যাবে। বুড়ো কি আসলেই বুড়ো একজন মানুষ, নাকি অন্য কিছু, যার ভয়ে সালেহা আজ দুধ দিতে আসতে চায়নি।

‘ঢাকা, সে তো মেলা দূর, মজিদ ব্যাপারি বললেন, মনে মনে ভাবলেন এটাই উত্তম সুযোগ।

‘দূর হোক, তোমার ভালো চিকিৎসা কামু আমি, এছাড়া রাশেদের কুন খবর নাই, ওর হলে যামু, ওর খবর নিতে হবে আমার, জানে অশান্তি লাগতাছে খুব,’ আজিজ ব্যাপারি বললেন।

‘ভালো কথা, কবে যাইতে চাও?’

‘আপনি বললে কালই।’

‘ঠিক আছে, চলো যাই, রাশেদরে যেমনেই হোক খুইজ্যা বাইর করতে হবে।‘

‘আমি যাই, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে, একটা গাড়ি পাইছি, সেটাতেই রওনা দিমু সকাল সকাল।‘

‘ঠিক আছে,’ বললেন মজিদ ব্যাপারি।

আজিজ ব্যাপারি বের হয়ে গেলে নিজের মনে একটু হেসে নিলেন মজিদ ব্যাপারি। নাদান ছেলে। ডাক্তারের কাছে পরীক্ষার নামে দেখতে চায় তার বাপ আসলে কি। তার বাপ আসলে কি তা সে নিজেই জানে না, মনে মনে বললেন মজিদ ব্যাপারি। ঘুম আসছে না, তবু কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন মজিদ ব্যাপারি।

আজ রাতের প্ল্যান বাতিল। নতুন প্ল্যান হচ্ছে ঢাকা। বাংলার রাজধানী।

*

অধ্যায় ২৪

রাত জাগা একটা নেশার মতো, একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সহজে ছুটতে চায় না। ছোটকাল থেকেই রাত জাগার অভ্যাস তার। একেবারে জন্মগতও বলা যায়। পরিবারের সবাই রাত জাগতেন। বাবা, বড় ভাই, চাচা এবং তার পরিবারের সবাই। রাত জাগার কারন একেকজনের ছিল একেকরকমের। একান্নবর্তী পরিবার ছিল তখন। এখন কে কোথায় কেউ খবরও রাখে না। রাত জাগার ছোটবেলার অভ্যাসটা এখনো আছে ড. আরেফিনের। স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে চলে আসেন নিজের ঘরটায়। এখানেই একান্তে কেটে যায় অনেক সময়। বেশিরভাগ সময়ই কাটে বই পড়ে। মাঝে মাঝে গান শোনেন, গুন গুন করেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় ক্লাসে পড়ানোর বিষয়গুলোর উপর চোখ বুলাতে হতো। এখন সেই ঝামেলা থেকে মুক্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সময়গুলো ভালো ছিল। তরুন সব প্রানের মাঝে সময় ভালোই কেটে যেত। এখন সরকারী অফিস, গত্বাঁধা জীবন।

একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ড. আরেফিনের। সন্তান-সন্ততি নেই বলে টেনশনও কম। স্ত্রীকে সন্ধ্যায় কিছুটা সময় দেন। একসাথে টিভি দেখে, ডিভিডি প্লেয়ারে সিনেমা দেখেন, তারপর একা সময় কাটান এই রুমটায়, স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে। বন্ধুবান্ধব খুব একটা নেই এখন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বিদেশ চলে যেতে, ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তারপরই বাদ দেন এসব পরিকল্পনা, কি দরকার, দেশই তো অনেক ভালো। শুধু যানজট, খুনখারাপি, দুর্নীতি যদি দূর করা যেতো তাহলে সবকিছুই সুন্দর হতো এখানে।

সুন্দর একটা চেয়ার বানিয়ে নিয়েছেন ড. আরেফিন, আরাম করে বসার জন্য। বই পড়া যায়, মাঝে ইচ্ছা করলে একটু ঘুমিয়েও নেয়া যায়। টেবিলের উপর বসানো কম্পিউটারটা অন করা। মেসেঞ্জারে বেশ কিছু বিদেশি বন্ধুদের দেখলেন তিনি। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কারো সাথে। এদের বেশিরভাগই তার সহপাঠী, ব্রিটেনে যখন পড়তে গিয়েছিলেন, সেই সময়কার। ইচ্ছে করলে সেখানেই থিতু হতে পারতেন। কিন্তু কেন যেন ভালো লাগলো না। চলে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে।

একটা বই বেছে নিলেন তিনি। শেলফে থরে থরে সাজানো বইগুলো থেকে। ইতিহাস তার প্রিয় বিষয়। অটোমান সাম্রাজ্যের উপর একটা বই নিলেন। আগেই পড়েছিলেন বইটা। কিন্তু ইতিহাস তার কাছে এমন একটা বিষয় বারবার পড়লেও যার আবেদন কমে না। ছয় সাতশ’ বছরের রাজত্বও কিভাবে শেষ হয়ে এলো তার সুন্দর বর্ননা আছে বইটাতে। আছে বর্তমান সম্রাট বা রাজাদের উত্তরাধিকারীদের নামের তালিকা। যারা এখন থাকেন আমেরিকায় কিংবা ইংল্যান্ডে। তুরস্কের পাসপোর্ট তাদের কাছে বিষতুল্য। নিজেদের তারা এখনো রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেন। দারুন ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় পড়ার জন্য।

অনেক রাত হয়েছে, ঘুম আসছে না ড. আরেফিনের। বাসায় প্রানী বলতে এখন মাত্র চারজন, সেটাও রাশেদকে নিয়ে। ড্রাইভার থাকে এখান থেকে একটু দূরে। যেকোন প্রয়োজনে ডাকা যায়, রাত হলেও কোন সমস্যা নেই।

রাত বারোটা বেজেছে অনেকক্ষন হলো।

দরজায় বারবার নক করা শব্দ হলো এইসময়। চেয়ারে উঠে বসলেন ড. আরেফিন। এতো রাতে কে আসতে পারে?

*

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ এখন। জানালাটা খোলা। বাইরে থেকে সুন্দর ঠান্ডা বাতাস আসছে। সিগারেট ধরিয়েছে সে। চাঁদ উঠেছে। পরিস্কার আকাশে তারাগুলো সব দেখা যাচ্ছে। মনটা উদাস হয়ে গেল রাশেদের। গাঁয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে রাতে ঘুরতে বের হতো। অনেক আগের কথা। গাঁয়ের বন্ধুরা কে কোথায় হারিয়েছে কে জানে। এখন ইচ্ছে করলেই সেইসব দিনে ফিরে যাওয়া যাবে না। মন খারাপের সময় সব পুরানো কথাগুলো মনে পড়তে থাকে। শামীমের কথা মনে পড়ছে। কতো ভালো বন্ধু ছিল তার। ঢাকায় আসার পর একমাত্র বন্ধু। যার সাথে সবকিছু ভাগ করে নেয়া যেত। তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল লিলি যদিও সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা ছিল না রাশেদের।

হাতে মোবাইল ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল রাশেদ। এখন বন্ধ সেটটা। গত কয়েকদিন ধরেই। ইচ্ছেই হচ্ছে না চালু করার। কার সাথে কথা বলবে। লিলির সাথে কথা বলা যায়, কি করছে, কেমন আছে, ক্লাসে যাচ্ছে কিনা, কিংবা বাবার সাথেও, উনার কাজকর্ম কেমন চলছে, চেয়ারম্যান হয়ে কি কি কাজ করছেন, কিন্তু আসলে মানসিক শান্তি না থাকলে কিছুই ভালো লাগে না। কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। থাক বন্ধ আরো কয়েকদিন। সমস্যাটা কাটুক। তারপর কথা বলা যাবে। ইচ্ছে আছে গ্রামে গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার। বুড়ো দাদার সাথে কতোদিন খুনসুটি করা হয় না।

সিগারেটটা ফেলতে যাবে জানালা দিয়ে এই সময় মনে হলো কোন একটা নড়াচড়া ধরা পড়েছে তার চোখে। জানালার একটু পেছনে চলে এলো রাশেদ। যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পায়। এই এলাকাটা নির্জন। ড. আরেফিনের ঠিক পাশের প্লটটা ফাঁকা। অন্যপাশেও একই ব্যাপার। ফলে বাড়ির চারপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই লুকানো থাকে না। বাড়ির চারপাশটা উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। পাঁচিলের মাথায় আবার কাঁচের টুকরো বসানো। টপকে এপাশে আসাটা তাই কঠিন একটা কাজ হবে যে কারো জন্য। সত্যিই কি কোন নড়াচড়া চোখে পড়েছে? দ্বিধায় পড়ে গেল রাশেদ। আরো কিছুক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে।

বারোটা বেজেছে অনেকক্ষন হলো। এতো রাতে চোর ছাড়া কে হতে পারে। ঘরের বাতিটা বন্ধ করে দিলো রাশেদ একটু এগিয়ে। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আবার। এবার স্পষ্ট একটা অবয়ব চোখে পড়ল তার চোখে। পাঁচিলটা পার হচ্ছে। কালো পোষাক পরনে, মুখে একধরনের মুখোশ। সাহসী বলে সুনাম আছে তার। অন্য যে কেউ হলে ভূত বলে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু ভূত-প্রেতে বিশ্বাস নেই রাশেদের। এবার আরো একজনকে দেখা গেল। একই পোষাক পরনে, আগেরজনের পেছন পেছন উঠছে। সাধারন চুরি করতে আসেনি এরা। হয় এরা ডাকাতি করতে এসেছে নয়তো শামীমকে যারা খুন করছে সেই দলের সদস্য।

দেরি করা ঠিক হবে না। ড. আরেফিনের রুমটা কাছেই। তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলো সে। এখান থেকে পালাতে হবে এক্ষুনি। ওরা কতোজন এসেছে কে জানে? বইটা নেয়াই ওদের মতলব নয়, পারলে ওদের দুজনকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে কালো পোষাক পড়া এই লোকগুলো।

ড. আরেফিনের দরজায় ক্রমাগত ধাক্কাতে লাগল।

রাশেদের মুখ দেখেই ড. আরেফিন বুঝলেন ঝামেলা হয়েছে। নিজের রুমে একটা রিভলবার রাখেন তিনি। লাইসেন্স করা। টেবিলের ড্রয়ারে তালাবদ্ধ থাকে সবসময়। তালা খুলে রিভলবারটা কোমরে খুঁজে নিলেন। স্যুটিং প্রাকটিস করেছেন কিছুদিন। নিশানা খুব একটা ব্যর্থ হয় না তার। আজ প্রয়োজনে অস্ত্রটি ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করলেন। গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নিলেন। নেই। ড্রয়ার খুলে গুলির ম্যাগাজিন থেকে ছয়টা গুলি ভরে নিলেন। কতোজন আছে ওরা কে জানে!

পাশের বেডরুমে স্ত্রী ঘুমাচ্ছে। বেচারী জানেও না কি বিপদ ঘটতে চলেছে এই বাড়িতে।

‘তোমার ব্যাগটা আগে নিয়ে এসো, কাঁধে ঝোলাও,’ ফিসফিস করে বললেন ড. আরেফিন।

রুম থেকে বের হয়ে এলো দুজন। ফাঁকা একটা স্পেসের পরই রাশেদের থাকার রুমটা। মাথা নিচু করে দুজনে ঢুকে পড়েছে রুমটায়। রাশেদ চলে গেছে আলমারির দিকে, যেখানে তার ট্রাভেল ব্যাগটা রাখা আছে। ড. আরেফিন চলে গেছেন জানালার পাশে। মাথা নিচু করে। রিভলবার ধরে আছেন যেকোন সময় গুলি করতে প্রস্তুত অবস্থায়। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে চুপচাপ ড. আরেফিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রাশেদ। শিক্ষক এখন শুটারের ভূমিকায়। দেখতে ভালোই লাগছে। সাহস আছে লোকটার, স্বীকার করতে বাধ্য হলো রাশেদ। জানালার ফাঁক দিয়ে রিভলবারের নলটা গলিয়ে দিয়ে গুলি করলেন ড. আরেফিন। বাইরে ধুপ করে একটা শব্দ হলো। আর্ত চিৎকার ভেসে এলো পাঁচিলের দিক থেকে। একজনকে ঘায়েল করা গেছে তাহলে, ভাবল রাশেদ।

হঠাৎ ভয়ানক একটা শব্দে কানা তালা লাগার জোগাড় হলো রাশেদের। মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে গরম কিছু একটা চলে গেছে। দেয়ালে গিয়ে লেগেছে জিনিসটা। বুলেট! ওরাও আক্রমন করেছে।

ড. আরেফিন উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছেন বারবার। কাউকে দেখতে পেলে গুলি করতে দ্বিধা করবেন না। একটু সরে এসে দাঁড়িয়েছে রাশেদ। মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে পালাতে হবে যে করেই হোক। কিন্তু তার আগে সবার নিরাপত্তা

নিশ্চিত করতে হবে। ড. আরেফিনের স্ত্রী আছেন বাসায়, কাজ করে যে বুয়া সেও আছে। এদের রেখে পালানো হবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। যা কোন অবস্থাতেই করা যাবে না।

‘আমি ম্যাডামকে সাবধান করে আসি,’ ড. আরেফিনের কানে ফিসফিস করে বলল রাশেদ।

কোন উত্তর এলো না। ভদ্রলোকের সমস্ত মনোযোগ এখন বাইরে।

রুম থেকে বেরিয়ে এলো রাশেদ। ড. আরেফিনের কামরার পাশেরটাই বেডরুম। মাথা নিচু করে দৌড়ে খোলা জায়গাটা পার হলো রাশেদ। কোথা থেকে বুলেট এসে পড়বে তার ঠিক নেই। আবার শব্দ হলো। গুলির। শব্দটা খুব বেশি নয়। কিন্তু রাতের এই নিঃশব্দতায় অনেক জোরালো হয়ে উঠেছে এই আওয়াজ।

সখিনা বুয়া এর মধ্যে উপরে চলে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে বেডরুমটার সামনে।

‘আপনি ভেতরে যান,’ রাশেদ বলল বুয়াকে। মহিলা বয়স্ক, মাথার চুলে পাক ধরেছে। গুলির শব্দেও খুব বেশি ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না।

বেডরুমের দরজা খুলে গেছে। ড. আরেফিনের স্ত্রীকে প্রথমবার দেখল রাশেদ। বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো যথেষ্ট সুন্দরি।

‘তোমার নাম রাশেদ?’ জিজ্ঞেস করলেন মহিলা। গলার স্বর একেবারে স্বাভাবিক। অবাক হলো রাশেদ। এতোটা নির্বিকার থাকে কি করে এরা।

‘জি, আপনাদের নিয়ে বাইরে যাবো আমরা,’ রাশেদ বলল, কিন্তু তার কথার কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না মহিলা দুজনের মধ্যে।

‘আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না, আমরা ঠিক থাকবো। তোমরা যাও।’ মহিলা বললেন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে।

তাকিয়ে রইল রাশেদ বেশ কিছুক্ষন। মহিলা কি দেখতে পাচ্ছেন না আজ যেকোন সময় মারা পড়তে পারেন দুর্বত্তদের হাতে?

‘চিন্তার কিছু নেই রাশেদ। নিচের তলার মেঝেতে ছোট একটা জায়গা আছে, যেখানে আমরা দুজন লুকিয়ে থাকতে পারবো। জায়গাটা এমন, উপর থেকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না মেঝের নিচে কিছু আছে। আমার বুদ্ধি ছিল সেটা। জিনিসপত্র রাখার জন্য কাজে দিতো। কিন্তু গতকালই জায়গাটা পরিস্কার করা হয়েছে।’

আরো অবাক হলো রাশেদ। এমন কখনো শুনেনি সে। ইংরেজি বইয়ে পড়েছে। বাড়ির নিচে সেলার থাকে, সেখানে সবকিছু জমা রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কারো বাড়িতে এমন কিছু থাকতে পারে তা না জানলে বিশ্বাস করা কঠিন।

‘সত্যিই কোন সমস্যা হবে না?’ ইতস্তত স্বরে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

‘আমরা দুজন এখনই নিচে যাচ্ছি।’ ড. আরেফিনের স্ত্রী বললেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নীচে।

উপর থেকে দেখছে রাশেদ। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার কাছেই জায়গাটা বড় একটা কার্পেট দিয়ে ঢাকা। সখিনা বুয়া কার্পেট উঠানো মাত্র সেখানে চারকোনা আকৃতির একটা ঢাকনা দেখা গেল। সখিনা বুয়া টান দিয়ে তুলে ফেলল ঢাকনাটা। উপর থেকে সব পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে রাশেদ। ঢাকনার নীচে বেশ খানিকটা জায়গা দুজন লুকিয়ে থাকার জন্য পযাপ্ত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বেশিক্ষন থাকতে হলে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। কিছু বলল না সে। এই দুজনকে নিয়ে সমস্যার আপাতত সমাধান হয়েছে।

মাথা নীচু করে দৌড়ে আবার নিজের রুমে চলে এলো রাশেদ। ড. আরেফিন এখনও রিভলবার তাক করে আছেন বাইরের দিকে। মাঝে মাঝে গুলি ছুড়ছেন।

‘কয়জন ওরা? বুঝতে পারলেন কিছু?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

‘সাত-আটজনের কম হবে না, একই সুরে উত্তর দিলেন ড. আরেফিন।’

‘এখন আমাদের কি করা উচিত? রাশেদ বলল।

জানালা থেকে এবার মুখ ফেরালেন ড. আরেফিন। চিন্তিত দেখাল তাকে। আসলেই কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চলেছে। এতোক্ষনে পুলিশের খবর হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশে এক বন্ধু ছিল কিন্তু তার নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।

‘তুমি গাড়ি চালাতে পারো?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘অল্পস্বল্প, রাশেদ বলল। শামীমের কাছে কিছুদিন তালিম নেয়া ছিল। কিন্তু তাতে কতোটা কাজ হবে নিশ্চিত নয় সে।’

‘অল্পস্বল্প হলেই হবে, আমি তোমাকে কাভার দেবো, তুমি শুধু গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দেবে, পারবে না?

‘পারবো মনে হয়, রাশেদ বলল মৃদু সুরে। গলায় আত্মবিশ্বাসের অভাব।

‘ঠিক আছে, চলো তাহলে,’ বললেন ড. আরেফিন। নিচু হয়ে সরে এলেন জানালার কাছ থেকে। আক্রমনকারীরা সবাই পেছন দিয়ে নাও ঢুকতে পারে, সামনে কেউ থাকতে পারে। রাশেদের গায়ে গায়ে লেগে হাঁটছেন তিনি। কিছু বুলেট খরচ হওয়াতে আবার লোড করে নিয়েছেন রিভলবারটা। প্রস্তুত, যে কোন আক্রমনের জন্য।

দোতলা থেকে নেমে এলো দুজন। রাশেদ তাকাল কার্পেটটার দিকে, ড. আরেফিনও তাকালেন। অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসলেন।

সামনের দরজার পাশে দাঁড়াল দুজন। এবার দরজা খুলে বাইরে যেতে হবে। বাইরে যে কেউ অপেক্ষা করে নেই তা বলা যাবে না, থাকতেও পারে। দরজা খোলার সাথে সাথে গুলির শব্দ হলো। দরজা লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছে। তারমানে বাইরে আছে ওরা।

চিন্তার ভাঁজ পড়ল ড. আরেফিনের কপালে। এখান থেকে সশরীরে বের হওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। ওরা মারতে এসেছে, বইটা ওদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বাসার ঠিকানা পেল কি করে? ওরা রাশেদকে চেনে, তাকে তো চেনে না। চিনলে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিছু হবে না হয়তো। কিন্তু তারপরও চিন্তাটা খচখচ করতে লাগল ড. আরেফিনের মনের মধ্যে।

দরজার নবে আবার হাত রেখেছে রাশেদ। ইশারায় দরজা খুলতে নিষেধ করলেন ড. আরেফিন। ওরা এখন ওৎ পেতে আছে। বেরুনো মাত্র গুলি করবে। নিজের জানের মায়া নেই ড. আরেফিনের। কিন্তু স্ত্রী আর রাশেদের কথা ভেবে খারাপ লাগছে। তার স্ত্রী কোনভাবেই জড়িত নয় এই কাজের সাথে, আর রাশেদ, অল্পবয়সী একটা ছেলে, দুনিয়াই দেখেনি এখনো।

গোলাগুলির শব্দ বেড়ে গেছে হঠাৎ। মনে হচ্ছে চারপাশ থেকে গুলি হচ্ছে। দরজার পাশে দাঁড়াল রাশেদ। বলা যায় না বুলেট কাঠের দরজা ভেদ করে চলে আসতে পারে। কিন্তু এতো বুলেট খরচ করার কি দরকার ওদের, ভেবে পেলো না সে। ড. আরেফিন দাঁড়িয়ে আছেন রিভলবারটা ধরে। কেউ আসলে ছাড় দেবেন না। মৃত্যুর আগে দু’একটা সাথে নিয়ে মরবেন বলে যেন পণ করেছেন।

এই সময় হঠাৎ একটা শব্দ শুনে দারুন ভালো লাগল রাশেদের। মাইকিং করছে পুলিশ। পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে তারা। আত্মসমর্পন করতে বলছে আক্রমনকারীদের। আরো কিছু বুলেটের শব্দ শোনা গেল। আর্তচিৎকার শোনা গেল কাছেই কোথাও। তারপর আবার সব চুপ।

বেশ কিছুক্ষন এভাবেই কেটে গেল। দুজন স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে দরজার দু’পাশে। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আরো কিছুক্ষন পর দরজায় নক করার শব্দ পাওয়া গেল। কি-হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখল রাশেদ। পুলিশ।

‘কে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘পুলিশ, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রনে, আপনারা দরজা খুলতে পারেন,’ কেউ একজন বলল দরজার ওপাশ থেকে।

‘রাশেদ, তুমি নিশ্চিত পুলিশ ওরা?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

‘তাই তো মনে হলো,’ রাশেদও বলল একই সুরে।

‘দরজা খুলুন, বললাম তো ভয়ের কিছু নেই,’ দরজার ওপাশ থেকে আবারো একই কণ্ঠ শোনা গেল, এবার কিছুটা বিরক্তি মেশানো ছিল কথাটায়।

দরজা খুলল রাশেদ।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা। বয়স্ক এবং ভারিক্কি চেহারা। গম্ভীর চালে ভেতরে ঢুকলেন তিনি।

‘পরিস্থিতি এখন আমাদের নিয়ন্ত্রনে,’ বললেন পুলিশ কর্মকর্তাটি। ব্যাজটা দেখল রাশেদ। বজলুল করিম নাম ভদ্রলোকের।

কাঁধের ট্রাভেল ব্যাগটা সরিয়ে ফেলা দরকার। পুলিশ হয়তো জানতে চাইতে পারে কি আছে এর ভেতর। এক পাশে সোফা, তারপর পুলিশ কর্মকর্তার চোখের আড়ালেই ব্যাগটা রেখে দিল রাশেদ। ভদ্রলোক এখন ড. আরেফিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো হাতে ধরা রিভলবারটা দেখে অবাক হয়েছেন।

‘লাইসেন্স আছে অস্ত্রটার?’ জিজ্ঞেস করলেন বজলুল করিম ড. আরেফিনকে।

রিভলবারটা নামিয়ে রাখলেন ড. আরেফিন।

‘জি, লাইসেন্স আছে,’ মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন তিনি।

‘থানায় যেতে হবে আমাদের সাথে, মামলা করতে হবে, বিরাট বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখানে,’ একটু থামলেন বজলুল করিম, রাশেদের দিকে তাকিয়েছেন, ‘এই ছেলেটি কে?’ ড. আরেফিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘আমার দুঃসম্পর্কের ভাতিজা,’ ড. আরেফিন বললেন।

‘যাই হোক, যা বলছিলাম, আটজনের একটা দল ছিল, এরকম আমি জীবনে দেখেনি, মনে হচ্ছিল কমান্ডো স্টাইলে অপারেশনে এসেছিল ওরা। হাতে আধুনিক অস্ত্র। সাতজন নিহত হয়েছে ওদের, একজন আহত।’ বললেন বজলুল করিম। একটু বিশ্রাম নিলেন, তাকালেন চারদিকে। ‘সাধারন ডাকাতি বলে মনে হচ্ছে না, দুলাভাই।’

‘দুলাভাই! অবাক হলেন ড. আরেফিন।

‘হ্যাঁ, আপা কল করেছিল বলেই তো এতো তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছি, এবার হো হো করে হাসলেন বজলুল করিম। উনি কোথায়, দেখছি না তো?’

অবাকভাব কাটেনি ড. আরেফিনের। রাশেদও বোকা বনে গেছে। ড. আরেফিনের স্ত্রী তাহলে থানায় জানিয়েছিল ঘটনা শুরু হওয়ার সাথে সাথে।

‘রাশেদ, যাও তো ওদের বের করে নিয়ে এসো,’ ড. আরেফিন বললেন রাশেদের উদ্দেশ্যে।

কার্পেটের নিচের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে এলো দুজন একটু পর। বজলুল করিম সরাসরি ড. আরেফিনের স্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। দেখার মতো একটা দৃশ্য, মনে মনে বলল রাশেদ। জানা গেল ভদ্রলোক ড. আরেফিনের স্ত্রীর দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই। এখানে বদলি হয়ে এসেছেন কিছুদিন আগে।

তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছি আমি, আহত ছেলেটাকে নিয়ে, না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, পুরো নায়কের মতো চেহারা। কমান্ডো পোশাকে মানিয়েছেও ভালো। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটা কথা বলতে পারে না, সোফা বসে বলছেন বজলুল করিম।

‘ওরা কারা, উদ্দেশ্য কি ছিল, কিছু বুঝতে পারলেন?’ রাশেদ জিজ্ঞেস করল এবার।

‘এখনই বলা যাবে না। তদন্ত করতে হবে। তবে দুলাভাইকে একটা মামলা করতে হবে, ডাকাতি মামলা। আগে ওদের নাম-পরিচয় বের করি, তারপর বুঝতে পারবো ওরা কারা এবং কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিল।‘ বজলুল করিম বললেন।

রাশেদের সাথে চোখাচোখি হলো ড. আরেফিনের। দুজনের চোখ তারপর চলে গেল ট্রাভেল ব্যাগটার দিকে। বজলুল করিমের উল্টোদিকের সোফায় অতি নিরীহ ভঙ্গিতে পড়ে আছে যেটা।

পুলিশেরা চলে গেল একটু পরই। ড. আরেফিনও গেলেন তাদের সাথে। রাশেদ ফিরে এলো নিজের রুমে। সারারাত ঘুম হলো না তার। ভোরে দিকে চোখ ভারি হয়ে এলো। ট্রাভেল ব্যাগটা বিছানায় নিয়ে শুয়েছে। ওটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

*

অধ্যায় ২৫

সেদিন ছিল ঝকঝকে একটা দিন। দিনটি একজনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন। অনেকদিনের পরিশ্রম আর স্বপ্ন বোধহয় সত্যি হতে চলল। যে ইচ্ছে পূরণ হবার কথা আরো অনেক অনেক আগে, সেই স্বপ্ন আজই বোধহয় পূর্ন হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন তিনি। কিছুদিন ধরেই নিজেকে খুব হীন, অসহায় প্রানী বলে বিবেচনা করছিলেন, এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন তৈরি হচ্ছে, শৈশব থেকে যে স্বপ্ন লালন করছিলেন তাই পূরন হবে আজ।

পোশাক পরিচ্ছদে কোন ত্রুটি রাখেননি। রাজদরবারে যেতে হবে সেখানকার উপযোগী পোশাক পড়তে হবে, এর ব্যতিক্রম হলে চলবে না।

কি না করেছেন এই যাত্রায় যাওয়ার জন্য, কার কাছে হাত পাতেননি তিনি! কিন্তু নাবিক হিসেবে কেউ তাকে তেমন মূল্য দেয়নি। সাত বছর আগের কথা, পর্তুগালে গিয়েছিলেন জন দ্য সেকেন্ডের কাছে তার পরিকল্পনায় অর্থ সংস্থান করার জন্য। শর্ত ছিল, ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেই ফিরবেন এবং পুরো উপমহাদেশটাকে পুর্তগীজ উপনিবেশ বানাবেন। বিনিময়ে চাইলেন নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ আর নতুন ভূখন্ড থেকে আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু রাজার বিজ্ঞ পরামর্শদাতারা তার এই সুন্দর প্রকল্পটি বাতিল করে দিল তখন খোঁড়া একটা যুক্তি দিয়ে। এর তিন বছর পর আবারো গিয়েছিলেন তিনি লিসবনে, রাজার কাছে। কিন্তু এবারও একই ফল।

অবশ্য এর মধ্যে স্পেনের রাণীর কাছেও একই আবেদন রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রস্তাবটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি দ্য সেভেন্থ এর কাছে। অপেক্ষা করেছেন অনেক দিন, বলা যায় প্রায় এক বছর ভালো একটা খবর শোনার জন্য। কিন্তু তাও হয়নি।

তবে একটা লাভ হয়েছিল। একই প্রস্তাব নিয়ে অন্য কোথাও যাতে না যান এজন্য ১৪৮৯ সালে সরকারী একটা বিধিও চালু করা হয়েছিল, ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের যেকোন স্থানে বিনামূল্যে খাবার এবং মাথার উপর ছাদ পাবেন। এছাড়া বছরে বারো হাজার স্থানীয় মুদ্রাও বরাদ্দ করা হয়েছিল তার নামে। কিন্তু এসব কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। সমুদ্র তাকে ডাকছিল বেরিয়ে পড়ার জন্য। মনে মনে নিশ্চিত ছিলেন। ভারতবর্ষ আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন।

শেষে ১৪৯২ সালে আবার স্পেনের রাজদরবারে দেখা যায় তাকে। এবার ঘটনা ভিন্ন। এমন একটা ইতিহাস রচনা করবেন তিনি যাতে পৃথিবী জুড়ে মানুষ মনে রাখবে তার নাম, ক্রিস্টফার কলোম্বাস।

একজন মাত্র লোকের কাছে ঋনী তিনি। রাজা ফার্নিনান্দের একান্ত সহকারী লোকটা। এই লোকটার কথা রাজা শোনেন। গ্রানাডা থেকে মুসলিমদের পরাজিত করেছেন রাজা কিছুদিন আগেই। মুসলমানদের তাড়িয়ে গ্রানাডাকে স্পেনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। কাজেই তার মন এখন খুবই প্রসন্ন। অবশ্য মন প্রসন্ন কি না তা জানতে পারে একজনই। লোকটার নাম জারমোনি। বয়স পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। ভেনিস কিংবা রোম থেকে এসেছে লোকটা এবং রাজদরবারে জুড়ে বসেছে। রাজা অনেকসময় রাণীর কথাও অগ্রাহ্য করেন, কিন্তু জারমোনির কথার বাইরে যান না। সেই জারমোনির সাথে পরিচয়টা হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। বেশ কিছুদিন আগে তার সাথে দেখা করতে আসে লোকটা। মনোবল হারিয়ে নিজের বাড়িতেই ছিলেন তিনি। গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে সবকিছু থেকে। তারমধ্যে দেবদূত হিসেবে এই লোকটার আবির্ভাব তার বাড়িতে। অনেক রাতে।

পরিচয় দেয়াতে বসার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন লোকটাকে তিনি। ছোট একটা বাড়ি, খুব দামি কোন আসবাব নেই, যা আছে সব একেবারে সাধারন।

‘সময় হয়েছে মি. কলম্বাস,’ মৃদু স্বরে বলেছিলেন জারমোনি। চেয়ারে বসতে বসতে বলেছিল লোকটা।

চোখ চকচক করে উঠেছিল কলম্বাসের। ‘সময়? কিসের সময়?’

‘অজানা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার,’ জারমোনি বললেন আবার।

উঠে দাঁড়িয়েছিলেন কলম্বাস, হাতে থাকা সুরার পাত্রটা ছলকে উঠল, কোনমতে সামলে নিলেন।

‘যা আপনি সারাজীবন চেয়েছিলেন তাই হবে, আপনি নতুন করে কাজ শুরু করুন,’ জারমোনি বললেন।

চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন কলম্বাস। ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে হ্যারিকেনটা। তার মধ্যেও যে কেউ তার মুখের দিকে তাকালে উত্তেজনাটা লক্ষ্য করতে পারতো।

‘আপনি কি আমার হয়ে সুপারিশ করেছেন জনাব জারমোনি?’

‘এতো কিছু বলা যাবে না, শুধু এইটুকু জানুন, সময় হয়েছে, আপনি প্রস্ততি নিন।’

সুরার একটি পাত্র জারমোনির দিকে বাড়িয়ে দিলেন কলম্বাস, কিন্তু সেদিকে মোটেও আগ্রহ দেখা গেল না অতিথির।

‘এই মাসের মধ্যেই নতুন করে প্রস্তাবনা পাঠান, আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে,’ জারমোনি বললেন, হাত দিয়ে সরিয়ে একটু দূরে রেখেছেন সুরার পাত্রটা।

‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, এতো দারুন একটা খবর শোনানোর জন্য,’ গদগদ কণ্ঠে বলেছিলেন তিনি।

‘এবার আসি আমি,’ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন জারমোনি। তারপর বের হয়ে গিয়েছিলেন, আর কিছু বলার সুযোগ দেননি।

জারমোনির কথামতো নতুন করে আবারো প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন কলম্বাস, তারই সূত্র ধরে আজ দেখা করতে যাওয়া। রাজা এখন কর্ডোভায় আছেন, সাথে রাণীও।

দুএকদিন আগেই এখানে এসেছেন তিনি। চমৎকার একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় নিয়েছেন, হাজারহোক রাজদরবারে যাচ্ছেন তিনি। আলক্যাজার প্রাসাদে এর আগে কখনো যাননি কলম্বাস।

রাজদরবারে প্রবেশের পরই কলম্বাস একটা ধাঁধায় পড়ে গেলেন। রাজা অনুপস্থিত। জারমোনিও নেই। রাণী আছেন, সাথে আছে তার পরামর্শক এবং মন্ত্রীসভার কিছু লোক। তিনি ভেবেছিলেন গেলেই সাদর সম্ভাষন পাবেন এবং তার প্রস্তাবনাটা গ্রহন করা হবে। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন এখানে। সিংহাসনে বসে আছেন রাণী। রাজা ফানিনান্দ বিশেষ কাজে বাইরে গেছেন। বিকেলের মধ্যেই ফিরবেন প্রাসাদে। কিন্তু চলে যখন এসেছেন এখন আর পিছু ফেরার উপায় নেই কলম্বাসের। মহামান্য রাণী ইসাবেলাকে কুর্নিশ করে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন কলম্বাস।

‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস, আপনি পেশ করুন আপনার আর্জি, সবাই আছেন এখানে, তারা মতামত দেবেন,’ রাণী ইসাবেলা বললেন।

হতাশ হয়ে চারপাশে তাকালেন। সবাই যারা, গতবার যারা তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। আবারো ওরা একই কাজ করবে নিশ্চিত তিনি।

‘মহামান্য রাণী, আপনার সদয় অনুমতির জন্য ধন্যবাদ,’ বললেন কলম্বাস, তারপর শুরু করলেন, কিভাবে ভারতবর্ষে যাওয়া যাবে, কতো সময় লাগবে, দূরত্ব কতোদূর, কতোজন লোক লাগবে, সেখানে গেলে কি কি লাভ হতে পারে স্প্যানিশ রাজ্যের, তিনি নিজে কি আশা করেন, ইত্যাদি। আধ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগলো পুরো বক্তব্য দিতে। পুরো রাজদরবারে পিনপতন নীরবতা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে আগ্রহি এক নাবিকের বক্তব্য।

বক্তব্য শেষ হলে রাণীর দিকে তাকালেন কলম্বাস। ভালো কিছু আশা করছেন রাণীর মুখ থেকে। কিন্তু প্রশ্নটা আসলে এক মন্ত্রীর মুখ থেকে, যিনি নিজে একসময় নাবিক ছিলেন বলে দাবী করেন।

‘আপনি ভারতবর্ষের যে দূরত্ব হিসেব করেছেন তা কি সঠিক?’ প্রশ্ন করলেন মন্ত্রী।

‘আমার হিসেবে দূরত্ব হবে দুইহাজার চারশো মাইল, হয়তো কিছুটা কম বেশি হতে পারে, কিন্তু তা খুবই গৌন,’ বললেন কলম্বাস বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে।

‘কতোদিন সময় লাগতে পারে আপনার? একবছর অনেক বেশি হয়ে যায় জনাব কলম্বাস,’ এবার বললেন অন্য একজন মন্ত্রী।

‘আমরা যাত্রা করছি অজানার উদ্দেশ্যে, তাই কিছুটা সময় হাতে রেখেছি আমি, আশা করছি একবছরের মধ্যেই ফিরে আসবো,’ কলম্বাস বললেন।

‘আপনি খরচের হিসেব দিয়েছেন, এবার রাণী বললেন, এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তা অনেক বেশি মনে হচ্ছে, এছাড়া রাজ্যে আরো অনেক কাজ আছে, এতো অর্থের সংস্থান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এখন,’ একটু থামলেন রাণী ইসাবেলা, তাকালেন কলম্বাসের দিকে, অসম্ভব মন খারাপ হয়েছে লোকটার দেখেই বুঝতে পারছেন তিনি, ‘কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আপনার প্রস্তাবটা খালি হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছি আমি, অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে আমরা অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবো।’

আবার পিনপতন নীরবতা নেমে এলো পুরো রাজদরবারে। সবাই তাকিয়ে আছে কলম্বাসের দিকে। নিজেকে কোনভাবে শান্ত রেখেছেন তিনি। চোখ বেয়ে যে কোন সময় অশ্রু বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু রাজদরবার কান্নার জায়গা নয়, এখানে কেঁদে কেউ কোনদিন সুবিধা করতে পারেনি।’

‘মহামান্য রাণীর ইচ্ছাই শিরোধার্য,’ বললেন কলম্বাস, তারপর কুর্নিশ করে বেরিয়ে আসলেন রাজদরবার থেকে।

দিনটা এখনো সুন্দর। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। কর্ডোভা অনেক সুন্দর একটা নগরী। কিন্তু হতাশ, বিষণ্ণ, হতোদ্যম কলম্বাসের কাছে সবকিছু বিষময় মনে হচ্ছে। জারমোনিকে কাছে পেলে শিক্ষা দিয়ে দিতেন এখন। যে ঘোড়াগাড়িটা ভাড়ায় নিয়ে এসেছিলেন, ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। এই শহরে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। জেনোয়াতে নিজের আপন ঠিকানায় ফিরে যাবেন কি না বুঝতে পারছিলেন না। হার হয়েছে তার। চরম হার। মেরুদন্ডই ভেঙে গেছে যেন।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে চলে এলেন। দুপুরের রোদ কমে এসেছে। কম দামে একটা খচ্চর ভাড়া নিলেন। জুড়িগাড়িতে চড়া মানায় না তার। গম্ভীর মুখে খচ্চরটায় চড়ে বসলেন। তারপর রওনা দিলেন কর্ডোভা থেকে দূরে।

কিন্তু ঘটনার বাকি ছিল তখনো। রাজা ফার্নিনান্দ প্রাসাদে ফিরে শুনলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে খালি হাতে। রাণীর এই সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ হলেন তিনি। জারমোনি তখনো তার পাশে ছিল। বারবার বলছিল দারুন একটা সুযোগের অপচয় করা হয়েছে। স্পেনের নাম, ক্যাথলিক ক্রুশ পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ চলে গেছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মাধ্যমেই পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার কথা রাজা ফার্নিনান্দের নাম, স্প্যানিশ রাজ্যের সুনাম।

রাজা ফার্নিনান্দ সাথে সাথে রাজকীয় বাহিনী থেকে লোক পাঠালেন কলম্বাসের খোঁজে। রাণীকে ভৎর্সনা করলেন। রাণী ইসাবেলাকে বিয়ের মাধ্যমে ক্যাস্টিল রাজ্য এবং আরো কিছু রাজ্যকে একীভূত করে বড় একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় চিন্তায় ছিলেন রাজা। সম্প্রতি গ্রানাডা দখলের পর আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তার সাম্রাজ্য। এখন তাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে, সম্প্রসারন করতে হবে। অর্থ খরচের অজুহাতে নতুন সুযোগ ছাড়া যাবে না।

রাজদরবারে দ্বিতীয়বারের মতো এসে দাঁড়ালেন কলম্বাস। এবার সবকিছু হলো নতুনভাবে। নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। তিনটি জাহাজ নিয়ে অভিযাত্রার পরিকল্পনা হলো, সান্তা মারিয়া, পিন্টা এবং নিনা। নাবিকের দল হলো সব মিলিয়ে সাতাশি জন।

তারপর আগস্টের তিন তারিখ বিকেলে যাত্রা করলেন কলম্বাস। তার আগে জারমোনিকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না। কলম্বাস এই যাত্রায় ভারতবর্ষে হয়তো পৌঁছতে পারেননি,কিন্তু তিনি আবিষ্কার করে বসেছিলেন ওয়েষ্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ এবং সেখানকার অধিবাসীদের তিনি ভারতীয় বলেই মনে করেছিলেন। ভারত আবিষ্কার করেছেন এই ধারনা নিয়েই মৃত্যু হয় তার। জারমোনি কলম্বাসের যাত্রার পরপরই হারিয়ে গিয়েছিল কর্ডোভা থেকে। রাজা ফার্নিনান্দ অনেক খুঁজেও বের করতে পারেননি তাকে। একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল সে।

*

ধ্যায় ২৬

গভীর রাত। জায়গাটা চেনা। তা না হলে এই অন্ধকারে হেঁটে এখানে আসা খুব ঝামেলার একটা কাজ। চারপাশে ঘন জঙ্গল। তার মাঝে ছোট একটা ঘর। এতো রাতে পথ খুঁজে ঘরটার আশপাশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এসবের পরোয়া করলে চলবে না এখন। প্রচুর সাপ আছে জঙ্গলটায়। যথাসম্ভব দেখে হাঁটতে থাকলেন তিনি। আর দেরি করা যাবে না। দেরি করলে রামপ্রসাদকে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

হাতে ছোট একটা ছড়ি নিয়েছেন। পথ চলতে সাহায্য করছে জিনিসটা। ঘরটার প্রায় কাছে চলে এসেছেন। টিমটিম করে হ্যারিকেন জ্বলছে। এতো রাতেও জেগে আছে রামপ্রসাদ। ভেবেছিলেন বেকায়দা অবস্থায় ধরে ফেলবেন। এমনিতে রামপ্রসাদ লোকটা যথেষ্ট শক্তি ধরে গায়ে। তাকে উপরে তুলে ছুঁড়ে ফেলা অসম্ভব হবে না লোকটার পক্ষে।

আরো কাছে চলে এসেছেন ঘরটার। এবার আক্রমন করতে হবে। হাতে অস্ত্র বলতে কিছু নেই। ছড়ি আছে, কিন্তু তাকে অস্ত্র বলা ঠিক হবে না।

যতোটা জানেন এখানে একাই থাকছে রামপ্রসাদ। গত কিছুদিন ধরে। হয়তো এখান থেকে অন্যকোথাও যাবে লোকটা। কিংবা এখানে থেকে যাবে। যাই হোক না কেন, রক্ত ঝরাতে চান না তিনি, কিন্তু শান্তিতে না দিলে রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করবেন না।

দরজাটা পুরোপুরি লাগানো না, চুরি করতে কেউ আসবে না এখানে অন্তত। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। সময় হয়েছে।

দরজা খুলে মুহূর্তে ঘরটায় ঢুকে পড়লেন এবং অবাক হয়ে গেলেন। রামপ্রসাদ একা নয়, আরো চারজন আছে তার সাথে। একটা সুটকেস হা করে খোলা। সবাই দেখছে কি আছে ভেতরে। অন্য সুটকেসটা এক পাশে সরানো, এখনো খোলা হয়নি মনে হচ্ছে। রাগ সামলাতে পারলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকগুলোর উপর।

রামপ্রসাদ সরে দাঁড়িয়েছে একপাশে, লড়াই করছেন চারজনের সাথে। সবাই পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনজন মিলে ধরে রেখেছে তাকে, একজন একের পর এক ঘুষি মারছে পেটে। সহ্য করছেন দাঁতে দাঁত চেপে। মুক্ত হবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বলশালী তিনজনের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া সোজা কথা নয়। তিব্বতে থাকাকালীন আত্মরক্ষার কিছু কৌশল শিখেছিলেন, সেগুলো কাজে লাগানোর চিন্তা করলেন, বাঁ-পাশের একজনের তলপেটে কনুই দিয়ে একটা গুতো দিলেন। হাতটা মুক্ত হওয়ামাত্র বাকি দুজনের উপর হামলে পড়লেন তিনি। ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো ওরা।

রামপ্রসাদ আক্রমনে যায়নি,মালিককে নিজের চোখে কচুকাটা করতে দেখেছে সে তিববতে যাওয়ার আগে। তার চিন্তা কিভাবে এখান থেকে পালানো যায়।

নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন তিনি। এখন মাঝখানে, চারজন বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে তাকে। একজনের হাতে ছোট একটা ছুরি দেখা গেল। হাত বদল করছে ছুরিটা একহাত থেকে অন্যহাতে। বোঝা যাচ্ছে ছুরিবাজিতে ভালো দক্ষতা আছে লোকটার। বৃত্তাকারে ঘুরছেন তিনি, চোখে চোখ রেখে। ছুরিসহ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লোকটা, তার পেট লক্ষ্য করে। একপাশে সরে গেলেন তড়িৎ গতিতে, হাতটা ধরে ছুরিটা নিয়ে নিলেন নিজের হাতে।

একজোড়া জুতো শুরু থেকেই দৃষ্টি কেড়েছিল রামপ্রসাদের। হীরে লাগানো অনেকগুলো, নিঃসন্দেহে দামি হবে, কতো দামি সে সম্পর্কে ধারনা নেই। সুটকেস খুলে এর চেয়ে দামি কিছু চোখে পড়েনি তার। বাকি সবকিছুই ছিল বই বা এধরনের জিনিস। একটা বইও সে আলাদা করে রেখেছে নিজের জন্য। দ্বিতীয় সুটকেসটা ভোলা যায়নি এখনো। ভাঙ্গার চেষ্টাও করেছে সে। কিন্তু ব্যর্থ। এতো শক্ত কিছু দিয়ে বানানো জিনিস দুটো যে হাজার চেষ্টাতেও কিছু করতে পারেনি সে একা। তাই এসব সঙ্গিসাথি জোগাড় করেছিল সে, শর্ত ছিল ভেতরে যাই থাকবে সমানভাগে ভাগ করে নেবে সবাই। রামপ্রসাদ একটু বেশি নেবে, কারন এতোদূর থেকে এগুলো টেনে এনেছে সে ই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভেস্তে যেতে বসেছে সব। মালিকের হাতে ছুরি চলে এসেছে। বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগল রামপ্রসাদ।

ছুরি হাতে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন তিনি। এখনো চারজন ঘিরে আছে তাকে। কেউ আগে বাড়ছে না। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না অনন্তকাল। এদেরকে একটা শিক্ষা দিয়ে দিতে হবে পুরো জীবনের জন্য। হাঁটু গেড়ে বসে বৃত্তাকারে ঘুরে চারজনের পা লক্ষ্য করে ছুরি চালালেন তিনি। তিনজনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যভেদ করেছেন, গোড়ালীর উপর পায়ের রগ কেটে গেছে তিনজনের। পা ধরে বসে পড়েছে ওরা। রক্ত বেরুচ্ছে গলগল করে। এই রক্ত পড়া থামবে না। একজন এখনো দাঁড়িয়ে আছে, চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। বিশ্বাস করতে পারছে না এই বয়স্ক লোকটা এতো দ্রুত কিভাবে আক্রমন করছে। এবার এগিয়ে এলো লোকটা, ছুরি দিয়ে লোকটার ঘাড়ের নীচে ছুঁইয়ে দিলেন তিনি। ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে লোকটা। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর ধরাম করে মেঝেতে পড়ে গেল।

চারজনকে পরাস্ত করেছেন তিনি। এবার রামপ্রসাদের উদ্দেশ্যে তাকালেন। নেই। পালিয়েছে। সুটকেস দুটোর দিকে তাকালেন। একটা আধখোলা অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যটা এখনো খুলতে পারেনি মনে হচ্ছে। বাইরে পড়ে থাকা নিজের সাধনার জিনিসগুলো আস্তে আস্তে খোলা সুটকেসটায় ভরলেন। তেমন কিছু নিতে পেরেছে বলে মনে হলো না। সাম্ভালার চামড়ার খোপটা পড়ে ছিল। ঢোকালেন। লক্ষ্য করলেন জুতো জোড়া নেই আর বইটা নেই। প্রাচীন এই বইটা অন্য কারো হাতে পড়লে মহাবিপদ। যদিও এর অর্থ কেউ উদ্ধার করতে পারবে বলে মনে করেন না তিনি। এছাড়া রামপ্রসাদ এদুটো জিনিস নিয়ে পালিয়ে কোথায় যাবে। যেখানেই যাক, উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ওর পিছু ছাড়বেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি।

চারজনই পড়ে আছে, ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সহজে মরবে না। কষ্ট পেয়ে মরবে। সুটকেস দু’টো ঠিক ঠাক করে নিয়েছেন। লোকগুলোর দিকে তাকালেন আরেকবার। বেরিয়ে আসলেন ছোট ঘরটা থেকে। নাক খাড়া করলেন বাতাসে। রামপ্রসাদের গন্ধ নেয়ার চেী করলেন। পুবে গেছে বলে মনে হলো। হাঁটা ধরলেন তিনি। কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন, এতোদিন পর সুটকেস দুটো ফিরে পেয়ে।

এরপর দীর্ঘদিন তিনি ঘুরে বেড়ালেন ভারতবর্ষের পথে পথে। বোম্বে থেকে দিল্লি, মাদ্রাজ, জলন্ধর, অমৃতসর, কাশ্মীর, কলকাতা, পুনা, হায়দ্রাবাদ, কোচি সবগুলো শহরে গেলেন, পশ্চিমে করাচী, লাহোর বাদ দিলেন না কিছুই। কিন্তু রামপ্রসাদের কোন চিহ্নই পেলেন না কোথাও। সবগুলো শহরেই থাকলেন তিনি, কোথাও একবছর, কোথাও দুই, কোথাও এর চেয়ে বেশি। দেখলেন সিপাহী বিপ্লবসহ ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর আন্দোলন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখলেন, কিন্তু কিছুই প্রভাবিত করতে পারলো না তাকে। প্রায় এক শতক কাটিয়ে দিলেন এই অভিযাত্রায়। কিন্তু যার পেছনে এই যাত্রা সে-ই যেন নেই হয়ে গেছে একেবারে। এবার পুবের দিকে যাবেন বলে ঠিক করলেন। টানা অনেকদিন হার্টার পর মনে হলো নতুন একটা জায়গায় এসেছেন তিনি। সবুজ, শ্যামল একটা এলাকা। এখানকার ভাষাও অন্যরকম। কলকাতায় আগে কিছুদিন থাকার ফলে বাংলা ভাষা কিছুটা জানা ছিল। সেই জ্ঞান এখানে কিছুটা কাজে দিচ্ছে। কিন্তু এখানকার উচ্চারন একেবারে অন্যরকম এবং স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার উচ্চারন ভঙ্গিও যেন আরো বদলে যাচ্ছে। রামপ্রসাদকে খুঁজে পাননি এখনো। শুধুমাত্র ধারনার উপর ভিত্তি করে চলে এসেছেন এই অঞ্চলে। ইংরেজ শাসনের বাইরে নয় এই অঞ্চল। কিন্তু খুব বেশি ব্রিটিশের পা পড়েনি এখানে। ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার এই এলাকাটা বেশ ভালো লেগে গেল তার। খুব সাধারন জীবনযাত্রা মানুষের। বড় কোন শহর নেই, দিল্লী বা বোম্বের মতো। এক অমাবশ্যা রাতে সুটকেস খুলে পান করলেন অমৃত সুধা। পঁচিশ বছরের যুবাতে পরিণত হলেন যেন। গায়ের রঙ বদলে গেছে, ইউরোপীয় ছাপ নেই এখন চেহারায়। মনে হচ্ছিল সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত বংশের সন্তান তিনি। তারপর পরিচয় হলো রহিম ব্যাপারির সাথে। ব্যাপারি নিজের ছেলের মতো টেনে নিলো তাকে। প্রথমে দোকানে কাজ করালেও পরে নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে একেবারে পাকাঁপোক্ত করে নিলো। নামও দিল একটা। মুসলিম নাম। আব্দুল মজিদ ব্যাপারি।

এখানেই রয়ে গেছেন তিনি এখনো। নিজের পূর্ব পরিচয় ভুলে, অনেককাল হলো। রামপ্রসাদের পিছু ধাওয়া করেননি এরপর। সুটকেস দুটোকে তালাবদ্ধ করলেন একটি ঘরে, যেখানে প্রবেশ নিষেধ, সকলের জন্যই।

কিন্তু সাম্ভালা এখনো ডাকে তাকে। সুটকেসটায় শেবারনের দেয়া সেই চামড়ার খোপটা এতোদিনে একবারও খোলেননি তিনি। এবার হয়তো সময় হয়েছে খোলার।

*

ধ্যায় ২৭

রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে আকবর আলী মৃধার। আরো একটা অপারেশন ব্যর্থ। এবার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা আটজন লোককে হারাতে হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে সালমানকে হারানোয়। একটা রত্ন ছিল ছেলেটা। বিস্তারিত কিছু জানেন না এখনো। পুলিশে নিজের দলের কিছু লোক আছে। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, শুধুমাত্র সালমানকে জীবিত পাওয়া গেছে, বাকিরা পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত। সালমানকে নিয়ে অবশ্য চিন্তার কিছু নেই, পুলিশকে সে কোন তথ্যই দিতে পারবে না যতো নির্যাতনই করা হোক না কেন, বোবা একজন মানুষ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য দিক নিয়ে, রাশেদরা এখন আরো সতর্ক হয়ে উঠবে, কাউকে বিশ্বাস করবে না। এছাড়া পুলিশের বড় একজন কর্মকর্তা বের হয়েছে যে ড. আরেফিনের আত্মীয়। কাজেই পুলিশও ড. আরেফিনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল এই সময়। ড. শাখাওয়াতের ফোন। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমায়নি লোকটা এখনো, ভাবলেন আকবর আলী মৃধা। ব্যর্থতার খবরটা হয়তো সেও পেয়ে গেছে।

‘হ্যালো, বলো বন্ধু, এতো রাতে কি মনে করে?’ বললেন আকবর আলী মৃধা, যেন কিছুই হয়নি এমন সুরে।

‘খবর পেলাম মাত্র, ড. আরেফিনের বাসায় হামলা করেছে দুষ্কৃতিকারীরা, কিন্তু তাদের কোন ক্ষতি হয়নি,উল্টো আক্রমনকারীদের সাতজন মারা গেছে, পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে,’ এক নিঃশ্বাসে ওপাশ থেকে বললেন ড. শাখাওয়াত।

‘বাহ, খবর দেখি বাতাসের আগে ছড়ায়, তুমি জানলে কি করে?’

‘তোমার সোর্স আছে যেমন, আমারো আছে,’ বললেন ড. শাখাওয়াত, একটু থামলেন, এখন কি করবে তুমি?

‘শেষ একটা বুদ্ধি আছে আমার কাছে, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, তোমাকে অবশ্যই জানাবো, বইটা হাতে পাওয়া মাত্র,’ বললেন আকবর আলী মৃধা।

‘তুমি নিশ্চিত?’

‘একশতভাগ।

‘ঠিক আছে, রাখলাম, পরে কথা হবে,’ বলে ফোন রেখে দিয়েছেন ড. শাখাওয়াত।

আকবর আলী মৃধা ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন। রাশেদকে আটকানোর শেষ চালেই যেতে হচ্ছে তাহলে। ফোনটা তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন।

‘ওস্তাদ, থুক্ক, বস, বলেন কি সেবা করতে পারি, ওপাশ থেকে বলল একজন।’

‘রিপোর্টটা কালকের মধ্যে লাগবে আমার।’

‘সকালেই পেয়ে যাবেন বস।’

‘মনে থাকে যেন,’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন আকবর আলী মৃধা।

বারান্দায় চলে এসেছেন। বাইরে আজ তুমুল জোছনা। কিন্তু মন এখন খুবই অশান্ত। বইটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাবেন না তিনি, এটা এখন নিশ্চিত।

শেষ চাল দিতে হবে এখন। রাশেদ নিজ থেকে আসবে তার কাছে। সুড়সুড় করে।

*

অধ্যায় ২৮

একটা মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়েছেন আজিজ ব্যাপারি। পরিচিত একজনের কাছ থেকে। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন সকালে। দুপুরের মধ্যে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। কখন পৌঁছানো যাবে বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ।

গাড়িতে যাত্রী দুজনই। আজিজ ব্যাপারি এবং তার বুড়ো বাপ। ড্রাইভার আছে। সামনের সিটে একাই বসে আছেন আজিজ ব্যাপারি। বারবার তাকাচ্ছেন পেছনের দিকে। বুড়ো কি করছে দেখার জন্য। বুড়ো কিছুই করছে না। ঘুমাচ্ছে। এতে ঘুম কি করে পায় কে জানে, ভেবে অবাক হন আজিজ ব্যাপারি। নাকি ভান ধরে আছে। নিজেকেই আবার ছি ছি করলেন, এ ধরনের বাজে চিন্তা করার জন্য। বুড়ো একজন মানুষ, কিছুটা বেশি ঘুমাতেই পারে।

তার নিজেরও ঝিম ঝিম ভাব আসছে, কিন্তু কেটে যাচ্ছে রাস্তার ঝাঁকিতে। গ্রামের রাস্তাও মনে হয় এর চেয়ে ভালো।

সন্ধ্যা গড়ানোর সময় ঢাকায় ঢুকল গাড়ি। কোন আত্মীয়-স্বজন নেই ঢাকায়। প্রথম স্ত্রীর দিকের কিছু লোকজন ছিল। স্ত্রীর মৃত্যুর পরও সেই যোগাযোগ কিছুটা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের পর আর থাকেনি। ওরাও যোগাযোগ করেনি,তিনিও না। কাজেই ঢাকায় থাকার একমাত্র জায়গা হচ্ছে হোটেল। এখন মেডিক্যাল সেন্টার কিংবা ডায়াগনোস্টিকে যাওয়ার শারীরিক সামর্থ্য বা মনমানসিকতাও নেই। গাড়ি নিয়ে সোজা মগবাজার চলে এলেন তিনি। অনেক কাল আগে এখানকার কোন একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করেছিলেন। প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন সেবার। অনেককাল আগের কথা।

ড্রাইভার মগবাজার চেনে, সোজা চলে এলেন মগবাজার মোড়ে। কিছু খাওয়া দরকার। বুড়ো বাপের দিকে তাকালেন, ভাগ্য ভালো, ঘুম ভেঙেছে বুড়োর। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। সেখানে শিশুর মতো রাজ্যের বিস্ময়।

বড় একটা রেস্টুরেন্ট দেখে তার সামনে গাড়ি থামাতে বললেন ড্রাইভারকে আজিজ ব্যাপারি। মাইক্রোবাস থেকে নামলেন। বুড়োকে নামালেন হাতে ধরে। ড্রাইভারকেও আসতে বললেন গাড়িটা পার্ক করে।

রেস্টুরেন্টে বেশি কিছু খেলেন না আজিজ ব্যাপারি, যদিও ক্ষুধা পেয়েছিল খুব। বুড়ো তো মুখে কিছুই দিল না। চিন্তিত মুখে বের হয়ে আসলেন আজিজ ব্যাপারি। বুড়ো বাপকে দেখছেন আড় চোখে। কেমন একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে বুড়োর চেহারায়। পুরো পথে একটা কথাও বলেনি। নিজে তেমন কোন কাপড় চোপড় আনেননি আজিজ ব্যাপারি। কিন্তু বুড়ো বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছে সাথে। এতো বড় ব্যাগ আনার মানে কি বুঝতে পারলেন না আজিজ ব্যাপারি। কি আছে ওর ভেতরে? ব্যাগটা কাউকে ধরতেও দেয়নি বুড়ো। ভারি জিনিসটা নিজেই ধরে রেখেছে। হাতে। যে লোকটার হাঁটতে কষ্ট হয় বলে ধরতে হয় মাঝে মাঝে সে কেন নিজের ব্যাগ নিজেই বহন করবে।

‘বাজান, ব্যাগটা আমার কাছে দেন, আপনের কষ্ট করার কি দরকার?’ আগে এই কথা একবার বলেছিলেন, আবার বললেন আজিজ ব্যাপারি।

উত্তর এলো না কেন, শুধু একবার আজিজ ব্যাপারির দিকে তাকালেন বুড়ো। তারপর এমনভাব করে হাঁটতে থাকলেন যেন শুনতেই পাননি ছেলের কথা।

আর কিছু বললেন না আজিজ ব্যাপারি। যা খুশি করুক বুড়ো, তিনি আর বাঁধা দেবেন না বলে ঠিক করলেন।

রাশেদের মোবাইলে ডায়াল করলেন রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে। সুইচড অফ। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। গত কিছুদিন ধরেই নাম্বারটায় ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি, উত্তর একই, সুইচড অফ। এবার রাশেদের সাথে দেখা না করে বাড়ি ফিরবেন না বলে ঠিক করলেন। কি সমস্যায় পড়েছে ছেলেটা, বাপ হিসেবে তার দায়িত্ব আছে সেই সমস্যা থেকে ছেলেকে বের করে আনার। টাকা-পয়সার অভাব নেই তার। আর টাকা-পয়সা ছড়ালে যে কোন সমস্যার সমাধান করা যায় বলে বিশ্বাস করেন। তিনি।

ড্রাইভার সিটে বসেছে। গাড়ি স্টার্ট দেবে। বুড়োর উদ্দেশ্যে তাকালেন আজিজ ব্যাপারি। একটু আগেই তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন নেই। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলেন আজিজ ব্যাপারি। হয়তো টয়লেটে গেছে, ভাবলেন তিনি। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেন, কিন্তু খবর নেই। টয়লেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, দরজা খোলা। কেউ নেই। রেস্টুরেন্টটার ভেতরে তাকালেন, হয়তো কোন টেবিলে বসে আছে। কিন্তু না, কোথাও নেই। পুরো রেস্টুরেন্টটায় একটা চক্কর দিলেন তিনি।

নেই।

বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন। মাথায় আসছে না কিছুই। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বুড়ো গেল কোথায়? এই শহরের কিছুই চেনে না বুড়ো। হারিয়ে গেছে? কিন্তু তা কি করে হয়, মাত্রই তো পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, মাইক্রোবাসটাও দাঁড়ানো সামনে। ইচ্ছে করেই কি চলে গেল লোকটা?

আরো কিছুক্ষন আশপাশে খোঁজাখুঁজি করলেন, লোকজনদের জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু ব্যস্ত এই শহরে কেউ কারো দিকে তাকানোর সময়ই করতে পারে না। কাজেই কেউ কিছু বলতে পারলো না। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মানুষটা।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাত কাটানোর মতো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আশপাশেই অনেকগুলো হোটেল আছে, ড্রাইভারকে স্টার্ট দিতে বললেন। রাস্তার উল্টোদিকে বড় একটা হোটেলের সামনে থামলেন আজিজ ব্যাপারি। এখানেই রাত কাটাবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। মাইক্রোসহ ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিলেন, ড্রাইভারের পরিচিত একটা গ্যারেজে গাড়ি থাকবে, ড্রাইভারও থাকবে সেখানে। সকাল হলেই চলে আসবে এই হোটেলে।

চিন্তিত মুখে হোটেল রুমে ঢুকলেন আজিজ ব্যাপারি। আগে রাশেদকে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন, এখন বুড়ো বাপও হারিয়ে গেছে। এতো বড় এই শহরে দুই দুইজন মানুষকে কিভাবে খুঁজে পাবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। সারারাত ঘুম হলো না তার, এপাশ ওপাশ করলেন, বাজে সব দুঃস্বপ্ন দেখলেন, ছেলে এবং বাবাকে নিয়ে।

*

অধ্যায় ২৯

সারারাত ঘুম হয়নি রাশেদের। সকালে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দরজায় নক হলো এই সময়। বিরক্ত হলেও উঠে পড়ল রাশেদ। দরজা খোলার আগে পোশাক ঠিক করে নিলো।

ড. আরেফিন দাঁড়িয়ে। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনিও ঘুমাননি।

‘তুমি বোধহয় সারারাত ঘুমাওনি রাশেদ?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।

কিছু বলল না রাশেদ।

‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, থানায়, তোমাকে নেয়া ঠিক হবে না,’ বললেন ড. আরেফিন, একটু সময় নিলেন, তুমি কোথাও যেও না, বাসায় থেকো, বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

‘জি,আচ্ছা,’ বলল রাশেদ।

‘আমার মোবাইল নাম্বার তো আছেই তোমার কাছে, তেমন জরুরী কোন দরকার হলে ফোন দিও আমাকে,’ বললেন ড. আরেফিন।

‘ঠিক আছে, বলল রাশেদ।’

‘যাও, ঘুমিয়ে নাও, আমি আসি,’ বলে চলে গেলেন ড. আরেফিন।

এই কয়দিনে যতটুকু দেখেছে ড. আরেফিন লোকটাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে রাশেদ। চুপচাপ মানুষ। জানার আগ্রহ অনেক। কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলেন না। মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন বিপদে। এগুলো অনেক বড় গুন। সহজে আসে না এসব গুন, সাধনার ব্যাপার।

দরজা লাগিয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল রাশেদ। চোখ বন্ধ হয়ে আসার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। শরীর এবং মন দুটোর উপরই খুব চাপ যাচ্ছে। কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে সে। কিছুই বলা যাচ্ছে না। শামীমের মৃত্যুর পর থেকে পুরো জীবনটা যেন এলোমেলো হয়ে গেল। শামীম নিজে এমন বিপদ ডেকে এনেছিল যা সে নিজেও জানতো না। সাথে জড়িয়ে গেছে আরো কয়েকটা জীবন। সে মারা গেছে, এখন বাকিদের পালা হয়তো। মৃত্যুর হাত থেকে, ধরা পড়ার হাত থেকে কয়েকবার বেঁচে গেছে রাশেদ, কিন্তু ভাগ্য বারবার সহায় নাও হতে পারে।

মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো রাশেদ। অনেক দিন ধরেই ফোনটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। লিলি, বাবা, এই দুজনের সাথে কথা বলাটা খুব জরুরী। এই দুজনই সবচেয়ে বেশি চিন্তা করছে হয়তো তাকে নিয়ে। বুড়ো দাদু, বাড়িতে থাকা সৎ মা, এদের জন্যও খারাপ লাগছে রাশেদের । সৎ মা হলেও কোনদিন আচরনে, স্নেহে বুঝতে দেননি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। বুড়ো দাদুর কথা তো আরো আলাদা, একেবারে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন রাশেদকে তিনি। কতো মজার মজার গল্পে সময় কেটে যেত দুজনের। একটু বড় হওয়ার পর রাশেদকে আর গল্প শোনাতেন না তিনি। বলতেন গল্প হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য।

এই রুমেও একটা টিভি আছে, একটু পুরানো, এর মধ্যে একদিনও টিভিটা চালিয়ে দেখেনি রাশেদ। এখন ছাড়ল।

খবরের চ্যানেল দেখে সে সবসময়। এবারও দেশি খবরের চ্যানেল ছেড়ে বিছানায় আরাম করে শুয়ে পড়ল রাশেদ। দেশের খবর, রাজনীতির খবর, খেলার খবর কিছুই নেয়া হয় না অনেকদিন।

কিছুক্ষনের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে উঠল সে। একই জিনিস বারবার দেখানো হচ্ছে, বিরক্তিকর। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাশেদ। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। কপাল ভালো তাই গতরাতে সিগারেট খাওয়ার উদ্দেশ্যে এখানেই এসে দাঁড়িয়েছিল। আগে থেকে চোখে না পড়লে কাল রাতে এই বাড়ীর সবার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারতো না। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসেছিল আততায়ীরা। এই ধরনের অপারেশনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, তারমানে এর পেছনে যে বা যারা আছে, তারা আর্থিকভাবে বেশ শক্তিশালী। বইটা তাদের দরকার।

একটা সিগারেট ধরালো রাশেদ। বইটা ওদের দরকার, খুব দরকার। কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বইটার পাঠোদ্ধার করাবে তারা কাকে দিয়ে। সে রকম কেউ কি আছে বাংলাদেশে? একজন ছিলেন, বেড়াতে এসেছিলেন, এখন নিখোঁজ, ড. কারসন। এমন কি হতে পারে ড. কারসনকে এরাই অপহরন করেছে? হতে পারে, খুবই সম্ভব। এ ব্যাপারটা মাথায় আসেনি কেন আগে ভেবে অবাক হলো রাশেদ। পুরো বিষয়টা নিয়ে সময় নিয়ে ভাবা দরকার আসলে।

ড. আরেফিনকে জানানো দরকার বিষয়টা। পুলিশ হয়তো এসব ব্যাপার চিন্তাও করেনি,আর চিন্তা করবেই বা কিভাবে, ওরা তো জানে না এখানে প্রাচীন বইয়ের কোন ব্যাপার আছে। ওদের ধারনা বিশাল অংকের মুক্তিপনের জন্যই অপহরন করা হয়েছে ড. কারসনকে। কতো টাকা চাইছে ওরা? অনেকদিন পত্রিকাও পড়া হয় না রাশেদের। এই কেসটার বর্তমান খবর কি কে জানে? এমনও হতে পারে ওরা কোন টাকাও চায়নি,কারন টাকা আদায় ওদের আসল উদ্দেশ্য না।

আসল উদ্দেশ্য প্রাচীন বইটার পাঠোদ্ধার।

মাত্র এগারোটা বাজে। সারাদিন কি করে কাটবে ভেবে অস্থির লাগল রাশেদের। নিজেকে কেমন বন্দি মনে হচ্ছে। অপরাধ কিছু না করেই জেল খাটছে যেন। বের হতে হবে বাইরে। এখন নিশ্চয়ই ঝুঁকির কিছু নেই। কাল রাতের হামলায় ওরা ভীষন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি আরো একটি হামলার সম্ভাবনা তাই অনেক কম।

টি-শার্টটা পরে সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল রাশেদ। একটু দূরেই পুলিশের একটা ভ্যান দাঁড়ান, রাস্তার উপরে, ড. আরেফিনের বাসার উপর নজর রাখছে। রাশেদকে দেখে একজন পুলিশ এগিয়ে এলো।

‘কোথাও যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করলো পুলিশের লোকটা।’

‘তেমন কোথাও না, একটু হাঁটতে বের হয়েছি,’ রাশেদ বলল।

‘আমাদের একজনকে দিচ্ছি আপনার সাথে।’

‘লাগবে না?’

‘লাগবে, আর নইলে বাড়ীর বাইরে যেতে পারবেন না আপনি, বেশ কঠিন গলায় বলল পুলিশের লোকটা এবার। ব্যাজে নামটা দেখে নিল রাশেদ, নাজমুল।

‘ঠিক আছে, কিন্তু পাশে পাশে হাঁটতে পারবে না। একটু দূরত্ব রেখে হাঁটতে বলবেন,’ রাশেদ বলল।

নাজমুল লোকটা চলে গেল। কিছু বলল না। বেশ বিরক্ত হয়েছে মনে হলো।

হাঁটতে থাকল রাশেদ। কিছুটা দূরত্বে হাঁটছে পুলিশের একজন কন্সটেবল। ভালোই লাগছে রাশেদের।

ড. আরেফিনের বাড়িটা থেকে একটু দূরেই ছোটখাট একটা পার্ক। পার্কটার ভেতরে চলে এলো রাশেদ। এখানে সময় কেটে যাবে বেশ। সিমেন্টে বানানো একটা বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসল রাশেদ। চোখ লেগে আসছে তার এখন। অথচ কিছুক্ষন আগেই ঘুম আসছিল না। কোনমতে তাকিয়ে আছে রাশেদ। সরাসরি উল্টোদিকে অন্য একটা বেঞ্চে বসেছে পুলিশের লোকটা। কিন্তু সবকিছু কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে। এক কাপ চা খেলে ভালো হতো, কিংবা মুখে একটু পানি ছিটালে ঘুম ঘুম ভাব হয়তো চলে যেতো, ভাবল রাশেদ।

পার্কের সীমানার মধ্যেই একজন তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। তাকে এখন কেউ চিনতেও পারবে না। আটাশ ত্রিশ বছরের এক যুবকের মতো দেখাচ্ছে। হাল ফ্যাশানের শার্ট এবং জিন্স পরনে। চোখে রোদচশমা। হাতে একটা সিগারেট, কিন্তু তাতে কোন আগ্রহ নেই তার। আগামী কিছুদিন রাশেদের ছায়া হয়েই থাকবে সে।

*

অধ্যায় ৩০

অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না লিলি। মুখেও কিছু একটা আটকানো। সম্ভবত টেপ। হাত-পা নাড়ানো যাচ্ছে না। শুধু চোখ দুটো খোলা। কিন্তু চোখ খোলা হলেও লাভ নেই। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা সে, বুঝতে পারলো লিলি। দড়ি দিয়ে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এতো গুমোট একটা পরিবেশে আর কিছুক্ষন থাকলে এমনিতেই মারা পড়বে। অক্সিজেনের অভাবে। চোখ ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো। লাভ হলো না। দেখা যাচ্ছে না কিছুই।

এখানে কিভাবে এলো মনে করতে পারছে না। বিকেলে বাসায় ফিরছিল, সবসময়ের মতো একাই, রিক্সা নিয়ে। গাড়ি আসেনি নিতে, কি একটা পার্টস নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে। বাবাকে বললে অন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু বাবা’কে বিরক্ত করতে ভয় পায় সে। কাজেই গাড়ির কোন সমস্যা হলে সচরাচর রিক্সা নিয়েই বাড়ি ফেরে। আজও ফিরছিল। ফুলার রোড দিয়ে। ইউনিভার্সিটির কাছেই এই রোডটা। সবসময় মানুষ থাকে, ছাত্ররা আসা-যাওয়া করে, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার, ব্রিটিশ কাউন্সিল, একটা স্কুল, সবই আছে এই রোডটায়। ভয়ের কিছু থাকার কথা না। কিন্তু এর মধ্যেই একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়িয়েছিল তার রিক্সার পাশে। রিভলবার দেখিয়ে তাকে উঠতে বলে মাইক্রোবাসটায়। চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ঠিক দুপুরবেলার এই সময়টায় পুরো রোডটাই খাঁ খাঁ করছিল। কাজেই বাধ্যগত মেয়ের মতো মাইক্রোবাসটায় উঠে বসে। তারপর কিছু মনে নেই। সম্ভবত ক্লোরোফর্ম ধরা হয়েছিল নাকে। এইজন্য বাকি কিছুই আর টের পায়নি।

দিনেদুপুরে কিডন্যাপ। অনেক সাহস এদের। নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরে তার উপর নজর রাখছিল কিডন্যাপাররা।

কিডন্যাপারদের উদ্দেশ্য ভালোই বুঝতে পারছে লিলি। নিশ্চয়ই অনেক টাকার মুক্তিপন দাবি করা হবে। লিলির বাবা মোঃ আখতার হোসেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, অনেকগুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর মালিক, বাড়ি-গাড়িও কম নয়। ইচ্ছে করলেই যেকোন অংকের টাকা দিয়ে দিতে পারেন তিনি।

দরজা খুলল এই সময়। আলোয় চোখ কুঁচকে গেল লিলির। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সামনে দীর্ঘকায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে, আলোর বিপরীতে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আলখেল্লার মতো পোষাক পরনে। দরজাটা লাগিয়ে ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিল লোকটা।

এবার অন্য একটা জিনিস চোখে পড়ল লিলির। কামরার অন্যপ্রান্তে ঠিক একইরকমভাবে আরো একজনকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটা বিদেশি। বয়স্ক, মুখে চাপ দাঁড়ি। মাথার চুল কিছুটা কম। লোকটাকে চেনা চেনা লাগলো লিলির। কোথাও দেখেছে সে এই বিদেশিকে। হ্যাঁ, পত্রিকায়। বিদেশি যে বিজ্ঞানী অপহৃত হয়েছেন ইনিই তিনি। ড. কারসন। ব্রিটিশ নাগরিক। যাকে উদ্ধারের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে পুরো বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী।

দুজনের মাঝখানে একটা চেয়ার টেনে বসেছে দীর্ঘকায় লোকটা। এবার চেহারাটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এবং লোকটাকে মোটেও কিডন্যাপকারী বা সাধারন অপরাধির মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কিংবা লেখক, সাংবাদিক। গায়ের রঙ ফর্সা, গালে একটা কাটা দাগ আছে যা চেহারাটায় অন্য এক মাত্রা নিয়ে এসেছে।

‘লিলি,’ লোকটা বলল গম্ভীর স্বরে, আপনাকে ধরে আনার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

লিলি তাকাল সরাসরি লোকটার চোখের দিকে। প্রানহীন, ঠিক তার কথাগুলোর মতো।

‘বিশেষ উদ্দেশ্যে আমরা আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। টাকার কথা ভাবলে ভুল করবেন আপনি। মুক্তিপন আদায় করা আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়।’

ঢোঁক গিলল লিলি। টাকা যদি আসল উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে বুঝতে হবে এই লোকটার উদ্দেশ্য আরো খারাপ কিছু হবে।

‘ঘাবড়াবার কিছু নেই,’ বলল লোকটা।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে লিলি। যাদের অপহরন করা হয় বেশিরভাগ সময়ই তাদের ভাগ্যে জোটে মৃত্যু। তার ভাগ্যেও হয়তো তাই আছে। কান্না পাচ্ছে লিলির। কিন্তু কাঁদলে লোকটা আরো পেয়ে বসবে ভেবে কোনমতে নিজেকে সামলালো লিলি।

খুব সহজ সরল চাওয়া আমার মিস লিলি, ‘আপনার ছেলেবন্ধু, রাশেদকে চাই আমার, রাশেদকে পেলেই মুক্তি দেয়া হবে আপনাকে,’ বলল লোকটা।

মাথা নাড়ল লিলি। কিছু বলতে চাইছে।

মুখ থেকে টেপ সরিয়ে দিলেন আকবর আলী মৃধা।

‘এখানে চেঁচিয়ে কোন লাভ হবে না মিস লিলি, যা বলার শান্ত সুরে বলুন।’

‘রাশেদ আপনার কি ক্ষতি করেছে?’ মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল লিলি।

‘রাশেদ জানে না সে আমার কি ক্ষতি করেছে, অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ক্ষতি আসলে করেছিল আমার নিজের লোক, শামীম।

‘শামীম!’

‘ও, হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, শামীম তো আপনারও বন্ধু ছিল, যাই হোক, খুব গুরুত্বপুর্ন একটা জিনিস শামীম আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যায়, যা এখন আছে আপনার প্রিয় রাশেদের কাছে।‘

‘কি সেই জিনিস?’

‘এতো বিস্তারিত জানার দরকার নেই আপনার,’ বেশ রাগত স্বরে বললেন আকবর আলী মৃধা।

‘কি করতে হবে আমাকে?’

‘তেমন কিছুই না, একটা ফোন কল। তাকে ধরা দিতে হবে আমার কাছে, জিনিসটাসহ, তাহলেই আপনাকে মুক্তি দেয়ার চিন্তা করবো আমি।’

‘ওর মোবাইল নাম্বার নেই আমার কাছে,’ লিলি বলল।

‘হাসালেন আমাকে,’ বলল আকবর আলী মৃধা, ‘নাম্বার অবশ্যই আছে, শুধু মনে করতে হবে আর মনে করাতে হয় কিভাবে ভালো জানা আছে আমার, হাসলেন তিনি ক্রুর ভঙ্গিতে।

এর সাথে চালাকী করে লাভ হবে না, নিষ্ঠুর একজন মানুষ, একই সাথে বুদ্ধিমান, ভাবল লিলি।

‘আমাকে কিছুটা সময় দিন,’ বলল লিলি, জানে সময় নিয়ে লাভ হবে না, রাশেদকে ফোন করতেই হবে।

‘ঠিক আছে, দিলাম সময়, ঠিক একঘণ্টা পর আসছি আমি,’ বললেন আকবর আলী মৃধা। তারপর বেড়িয়ে গেলেন ঘরটা থেকে।

যাওয়ার আগে বাতি নিভিয়ে গেছেন তিনি। ফলে ঘরটা আগের মতোই অন্ধকার হয়ে গেছে। এখানে চোখ খুলে রাখা আর বন্ধ রাখা একই কথা। কামরার অন্যপ্রান্তে চেয়ারে যে বিদেশি ভদ্রলোক বাঁধা আছে তার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।

যাই হোক, রাশেদের সাথে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। বাসায় কি হচ্ছে কে জানে? এতোক্ষনে সবাই জেনে গেছে নিশ্চয়ই সে ফেরেনি। তারা হয়তো এখনো চিন্তাও করছেন না লিলিকে অপহরন করা হয়েছে। হয়তো ভাবছেন কোথাও গেছে, মোবাইল বন্ধ। সময় হলে ফিরে আসবে। রাতের মধ্যে যখন ফিরবে না তখন টনক নড়বে সবার। বাবাও নিশ্চয়ই উঠে পড়ে লাগবেন লিলিকে খুঁজে বের করার জন্য। চোখের কোনে একটু ভিজে উঠল লিলির। রাশেদ আসলেও এরা হয়তো তাকে মেরে ফেলবে। রাশেদকেও ছাড় দেবে না। বিদেশি একজনকেও অপহরন করেছে এরা। কাজ হাসিল হলে তিনজনের কাউকে ছাড় দেবে না ওরা। কেউ হয়তো কোনদিন জানতেও পারবে না কি হয়েছিল রাশেদ, লিলি এবং বিদেশি বিজ্ঞানীর।

একঘণ্টা হতে এখনো অনেক দেরি। চোখ বন্ধ করে মনে মনে সুন্দর কিছু ভাবার চোঁ করছে লিলি। কিন্তু ভালো কিছু মাথায় আসছে না। আজে বাজে সব চিন্তা হচ্ছে।

রাশেদের সাথে ঘুরে বেড়াবার দিনগুলো ছিল আনন্দের। সেই দিনগুলো কি আবার ফিরে আসবে? সম্ভাবনা খুবই কম। এই খারাপ লোকেদের হাতে সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটবে।

যাই হোক না কেন, সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে সে, মনে মনে ভাবল লিলি। মরার আগে মরে গিয়ে লাভ নেই। চেষ্টা করতে হবে এখান থেকে বের হওয়ার, যে করেই হোক।

* * *

যে কাজে ঢাকা এসেছিলেন তার কিছুই হলো না। উলটো বুড়ো বাপকে হারিয়ে একেবারে দিশেহারা বোধ করছেন আজিজ ব্যাপারি। সারারাত ঘুম হয়নি তেমন। সকালে উঠেই মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে ফোন করে নিয়ে এসেছেন। নাস্তা করা হয়নি এখনো। কাপড়-চোপড় বদলে হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। নিজেকে খুব শক্ত এবং সাহসী বলে মনে করতেন। এখন মনে হচ্ছে ধারনা ভুল।

ড্রাইভার চলে এসেছে। ইউনিভার্সিটির যে হলে রাশেদ থাকে সেখানে যেতে বললেন ড্রাইভারকে। খুব বেশি দূর নয় মগবাজার এলাকা থেকে। অল্প সময়েই পৌঁছাতে পারবেন বলে মনে হলো। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। রাস্তাঘাট প্রায় খালিই।

বিশ মিনিটেই হলের সামনে চলে এলেন তিনি। পুরানো একটা হল, প্রথমবার রাশেদকে তুলে দিতে এসেছিলেন এখানে, কয়েকবছর আগের কথা। এততদিনে একটুও পরিবর্তন হয়নি কোথাও। শ্যাওলা ধরা, রঙ চটা, হলটা আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। রুম নাম্বার মনে ছিল আজিজ ব্যাপারির। গটগট করে ঢুকে গেলেন ভেতরে। কেউ আটকালো না গেটে, তার চেহারায় হয়তো অভিভাবক ছাপ পড়ে গেছে, ভাবলেন তিনি।

রাশেদকে রুমে পাওয়া যাবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু আশপাশের রুমের বাসিন্দাদের সাথে কথা বললে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। এটাই মূল উদ্দেশ্য আজিজ ব্যাপারির। সিঁড়ি বেয়ে বেশ কয়েকতলা উঠলেন তিনি। রাশেদের রুমটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

যা ভেবেছিলেন তাই। তালা লাগানো।

ডানপাশের রুমে নক করলেন তিনি।

বেরিয়ে এলো একজন। বোঝাই যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। মুখ হাত ধোয়ারও সময় পায়নি।

‘জি, বলুন?’

‘আমি রাশেদের বাবা, এই রুমে যে থাকে,’ রাশেদের রুমটা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন আজিজ ব্যাপার।

‘আচ্ছা, বলুন, গতকালও একজন এসেছিল, রাতে, রাশেদের খবর নেয়ার জন্য, কিন্তু রাশেদ তো বেশ কিছুদিন ধরেই নেই।’

‘কে এসেছিল?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আজিজ ব্যাপারি। রাশেদ যে তেমন মিশুক নয় এটা তিনিও ভালো জানেন।

‘আমি চিনি না, আগে দেখিনি,আমাদের একটু সিনিয়র হবে, ফর্সা, আটাশ-উনত্রিশ বয়স হবে লোকটার,’ ছেলেটা বলল।

এ বয়সের লোক রাশেদের বন্ধু হবার কথা না। কিন্তু লোকটা কে জানতে পারলে ভালো হতো।

‘কোন পরিচয় বলেছিল?’

‘শুধু বলল পরিচিত, আর কিছু না।’

‘আচ্ছা, রাশেদ কতোদিন ধরে নেই রুমে?’

‘অনেকদিন হলো, মাসখানেকের মতো হবে মনে হয়।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাচ্ছি, কোন খবর পেলে আমাকে জানাবে, ঠিক আছে?

‘ভেতরে আসুন আপনি, বসুন।’ বলল ছেলেটা।

চমৎকৃত হলেন আজিজ ব্যাপারি। এ ধরনের আতিথিয়তা আশা করেননি তিনি।

‘না বাবা, আমার আরো কিছু কাজ আছে,’ বললেন আজিজ ব্যাপারি। নিজের একটা কার্ড দিলেন ছেলেটার হাতে, চেয়ারম্যান হওয়ার পর নিজের খরচে কার্ডটা ছাপিয়েছিলেন তিনি। বেশ কাজে দিলো এখন।

ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে চলে এলেন তিনি। থানায় যেতে হবে এখন। বুড়ো বাবার নিখোঁজ। একটা জি.ডি. করাতে হবে।

হলের বাইরে এসে কিছুক্ষন দাঁড়ালেন আজিজ ব্যাপারি। মনের ভেতর একটা খচখচানি থেকে গেল। রাশেদের সাথে দেখা করতে এসেছিল লোকটা কে? মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি, বুড়ো বাবা এবং ছেলেকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না তিনি। চেয়ারম্যানগিরি চুলোয় যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *