অধ্যায় ৪১
আবার একঘেয়ে ভ্রমণ, প্রফেসরের সাথে যাচ্ছেন ড. আরেফিন, সাথে রামহরিও আছে, আছে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা, সন্দীপ যাচ্ছে ড. কারসনের সাথে অন্য মাইক্রোবাসটায়। সুরেশের ইচ্ছে ছিল ড. কারসনের গাড়িতে যাওয়ার, কিন্তু ড. কারসন সাড়া দেননি। সাতসকালে উঠেই রওনা দিয়েছেন ড. কারসন, দলবল নিয়ে। দুপুর হয়ে গেছে এখন। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ঘন্টায় আশি কিলোমিটারের চেয়ে বেশি বেগে গাড়ি চলছে। এখন। এই গতিতে গেলেও কমপক্ষে চব্বিশ ঘন্টা একটানা গাড়ি চালাতে হবে। ডঃ কারসন অবশ্য বলে দিয়েছেন যে করেই হোক দুই দিনের মধ্যে তাকে কাঠমুন্ডু পৌঁছাতে হবে। ড্রাইভাররা তিন ঘন্টার বিশ্রাম পাবে শুধু। প্রয়োজনে পালা করে গাড়ি চালাবে দলের অন্যান্য সদস্যরা। সন্দীপের কোন আপত্তি নেই গাড়ি চালাতে, বরং বেশ উৎসাহই দেখিয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনে সুরেশও ভালো চালাতে পারে।
ঘুম আসছে না, তাই ল্যাপটপ খুলে বসেছেন ড. আরেফিন। কেন জানি কিছু ভালো লাগছে না তার। কোথাও একটা গন্ডগোল আছে, সেটা ঠিক কি বোঝা যাচ্ছে না।
পেছনের সীটে বসে নাক ডাকাচ্ছে সুরেশ। বিচ্ছিরি অভ্যাস। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছেন না ড. আরেফিন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। খুব রোদেলা দিন নয়, বলা যায় চমৎকার এক উষ্ণ আবহাওয়া। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সোজা নেপালে যেতে হবে, তারপর নেপাল থেকে তিব্বত। নেপালে যাওয়াটা কোন সমস্যা না, তবে সেখানে পৌঁছেই যে তিব্বতের ফ্লাইট ধরা যাবে তা নিশ্চিত না। সাধারনত সপ্তাহে দুই দিন ফ্লাইট থাকে, এ ব্যাপারে সুরেশ এখনো কিছু বলেনি। সেখানে গিয়েই হয়তো ব্যবস্থা নেবে। সেক্ষেত্রে ফ্লাইট না পেলে কাঠমুন্ডুতে দু’একদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।
প্রফেসর গম্ভীর মুখে বসে আছেন পাশে, মাইক্রোবাস ছাড়ার পর একটা কথাও বলেননি। আগবাড়িয়ে কথা না বলে সময় কাটানোর জন্য ল্যাপটপ বেছে নিয়েছেন ড. আরেফিন। ঢাকার সাথে গত কয়েকদিন যোগাযোগ হয়নি। কোন মেইল আছে কি না দেখার জন্য ব্যক্তিগত মেইলে ঢুকলেন তিনি।
***
খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে বিনোদ চোপড়ার। বেশ আরামের একটা ঘুম হচ্ছিল, কিন্তু লখানিয়া সিং সব ভেস্তে দিয়েছে। কান টুপি আর জ্যাকেট পরে আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল লোকটা। কাজেই তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে নিয়েছে বিনোদ চোপড়া। তার অবশ্য তৈরি হওয়ার কিছু নেই, কাপড়-চোপড় সব নিজের হোটেল রুমে। চমৎকার একটা ওভারকোট দিয়েছে লখানিয়া সিং। সেটা পরে যেকোন ধরনের ঠান্ডা সামাল দেয়া যাবে।
লখানিয়া সিংয়ের কাছে এতোটা সদয় ব্যবহার আশা করেনি বিনোদ। মনে হয়েছিল লোটার নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। এখন তা মনে হচ্ছে না। তবে তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে, সেই উদ্দেশ্য এখন না জানলেও চলবে। তাই লখানিয়া সিংয়ের পিছুপিছু হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। বিনোদ। যাদের পেছন পেছন এতোদূর আসা তারা অবশ্য এতোক্ষনে ধর্মশালা পেরিয়ে অনেকদূর চলে গেছে, কিন্তু তথ্যটা জানা নেই বিনোদ চোপড়ার। এছাড়া এই মুহূর্তে ড. কারসনের পেছনে যেতে চাচ্ছে না সে। লখানিয়া সিংয়ের উদ্দেশ্য জানাটাই এখন তার আসল আগ্রহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাইরে এখনো নীরব, রাস্তায় লোকজন খুবই কম। লখানিয়া সিংয়ের পেছন পেছন হাঁটছে বিনোদ চোপড়া, লোকটার দ্রুতগতির হাঁটার সাথে তাল মেলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ঠান্ডা বাতাস বইছে, ওভারকোটের সাথে হুড থাকায় রক্ষা। হাঁটতে হাঁটতে ছোট শহরটার বাইরে চলে এসেছে দুজন। অনেক দূরে খোলা প্রান্তরে বরফের মাঝে ছোট মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। ড. কারসনকে অনুসরন করে এখানে এসেছিল বিনোদ আগে একবার। তবে কাছে যাওয়া হয়নি লখানিয়া সিংয়ের হুমকির কারনে। বোঝা যাচ্ছে। মন্দিরটা সম্ভবত লখানিয়ার বর্তমান গন্তব্য।
লখানিয়ার সাথে দূরত্ব কমাতে হাঁটার জোর বাড়াল বিনোদ। তার আরো পেছনে হাঁটছে যজ্ঞেশ্বর, সারা শরীর চাদরে পেঁচিয়ে নিয়েছে। তার চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে কেবল।
মন্দিরের সিঁড়িতে এসে চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। পেছনে তাকালেন না। বিনোদ চোপড়া এখনো এসে পৌঁছেনি,আরো পেছনে যজ্ঞেশ্বর আছে এটাও তার জানা। এর আগের বার একা এসেছিলেন মন্দিরে, আজ এতোগুলো মানুষকে দেখলে হয়তো কথাই বলতে চাইবে না পুরোহিত। এই শীতের মধ্যেও পা থেকে জুতো খুলে মন্দিরে ঢুকলেন তিনি। বিনোদ চোপড়া সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র, তাকে হাত দেখিয়ে উপরে উঠতে নিষেধ করলেন।
এতো সকালে এখানে দর্শনার্থী থাকে না, তাই মন্দিরটা খুবই নীরব। সেদিন যেখানে বসেছিলেন সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসলেন তিনি। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুরোহিতের দেখা পেলেন। বৃদ্ধকে আজ বেশ সতেজ দেখাচ্ছে।
‘আজ আসার কথা ছিল,’ বললেন তিনি।
‘হুম, জানি আপনি আসবেন,’ বললেন পুরোহিত।
‘তাহলে বলুন কি করতে হবে।‘
উঠে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধ পুরোহিত। চারপাশে তাকাচ্ছেন, যেন কেউ আছে কি না দেখে নিচ্ছেন। বিনোদ চোপড়া কিংবা যজ্ঞেশ্বরকে এখান থেকে দেখা যাবে না এটা নিশ্চিত তিনি। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো বৃদ্ধের চিন্তাভাবনা অন্যরকম। সে আসলে কাউকে ইশারা দিচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বৃদ্ধের ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না। দাঁড়িয়েই অবাক হয়ে গেলেন, ছোট মন্দিরটার ভেতরের ছোট ছোট থামগুলোর আড়াল থেকে সাত থেকে আটজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বের হয়ে এসেছে, রীতিমতো ভোজবাজির মতো। মাথার চুল কামানো, পরনের পোশাক হলদে রঙের, সারা শরীর পেঁচিয়ে আছে কাপড়টা। দু’হাত জোড় করে প্রনামের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সবাই, তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ পুরোহিতের দিকে। অপেক্ষা করছে ইশারার। তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
‘জনাব লখানিয়া সিং, যদিও জানি এই নামটা বানানো, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না আমাদের, গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ পুরোহিত, আপনার কাছে আমাদের ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ আছে। আশা করি যার জিনিস তার কাছে ফেরতে দিতে আপনার কোন আপত্তি থাকবে না।’
‘এটা আপনার জিনিস না, পুরোহিত,’ ঠান্ডা গলায় বললেন তিনি, মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য।
‘এখানে ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ জড়িত নেই, স্থির গলায় বললেন পুরোহিত, এটা আমাদের তিব্বতি সংস্কৃতির অংশ। সাম্ভালার অস্তিত্ব থাকলে সেটা বের করার দায়িত্বও আমাদের।‘
‘আপনি যাই বলুন, বললেন তিনি, এভাবে জোর করে ছিনিয়ে নেয়াটা ঠিক হবে না। আপনি চাইলে আমি এমনিই দিতাম।‘
হাসলেন বৃদ্ধ পুরোহিত, শব্দহীন হাসি, যেন এমন অদ্ভুত কৌতুক আগে কখনো শোনেননি।
‘ঠিক আছে, তাহলে দিয়ে দিন,’ বললেন বৃদ্ধ পুরোহিত।
এক পা পিছু সরলেন তিনি। হাত দুটো মুবিদ্ধ হয়ে গেল। এক পা সামনে এক পা পেছনে ফাঁক করে দাঁড়ালেন। সহজে এদের হাতে হার মানা চলবে না। এতোদিনের পরিশ্রম সব মাটি হয়ে যাবে তাহলে।
বৃদ্ধ এবার সরে গেলেন সামনে থেকে। মাথা নাড়িয়ে ইশারা দিলেন তার শিষ্যদের।
চারপাশে তাকালেন তিনি। সবাই বের হয়ে এসেছে থামের আড়াল থেকে। ছোটখাট আকার, কিন্তু এদের প্রত্যেকেই দারুন শক্তি ধরে। দীর্ঘদিন ধরে নানা নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে বড় হয়, সাথে সাথে শারীরিক কৌশলও শেখে, যেটা আগেরবার তিব্বতের মন্দিরে দেখেছিলেন। এদের সাথে পাল্লা দেয়া সহজ হবে না, এছাড়া এরা আটজন, তিনি একা। বিনোদ চোপড়া কিংবা যজ্ঞেশ্বরের সাহায্য চাওয়ার কথা চিন্তাই করা যাবে না।
বামপায়ের উপর ভর করে ডানপাটা সামনে ছড়িয়ে দিলেন তিনি, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে তৈরি।
পেছন থেকে দুজন এগিয়ে এসে কাঁধের উপর হাত দিয়ে কোপ মারতে চাইল, তিনি সামান্য সরে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল দুজন, সাথে সাথে ডান পায়ে একজনের পেটে লাথি দিলেন, অন্যজনের পিঠে দুহাত দিয়ে সর্বশক্তিতে আঘাত করলেন। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ছেলেটা, অন্যজন পেটে হাত দিয়ে বসে পড়েছে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, বারবার তাকাচ্ছেন চারপাশ ঘিরে থাকা অল্পবয়েসি ভিক্ষুদের দিকে। পা সামনের দিকে বাড়ানো। এবার একজন এগুলো সামনে থেকে, অন্যজন পেছন দিয়ে। ডানপাশেও একজন এগুচ্ছে। চোখের কোন দিয়ে ডানপাশের রুনের অবস্থান দেখে নিয়ে সামনের তরুনের কোমর বরাবর লাথি দিলেন, পরপর দুবার, সাথে সাথেই পেছনে চলে এসেছেন, এই সুযোগে পেছনের তরুণ এগিয়ে এসে তাকে জাপটে ধরে ফেলেছে। মাথা দিয়ে পেছন দিকে আঘাত করলেন, একেবারে নাকে গিয়ে লাগল মাথার পেছন অংশটা, বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠেছে তরুণ, সম্ভবত নাক ভেঙে গেছে। নাক দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছে, রক্ত থামাতে গিয়ে বাঁধন ছেড়ে দিল তরুণ। ডানপাশ থেকে অপরজন আক্রমন করার আগেই হাতটা ধরে ফেললেন তিনি, মুচড়ে দিলেন সাথে সাথে। কড়াত করে শব্দ হলো হাড় ভাঙার। পা দিয়ে লাথি দিলেন, মেঝেতে পড়ে গেল আক্রমনকারি।
জ্যাকেটের ভেতরে হাত দিয়ে দেখলেন সব ঠিক আছে কি না, তারপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পাঁচজন পড়ে আছে আশপাশে, ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বাকি তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছেন এক সঙ্গে আক্রমন করার পরিকল্পনা করছে তিনজন। প্রস্তুত তিনি।
কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলেন দুজন পড়ে গেছে। ওদের একজনের পেছনে বিনোদ চোপড়া, অন্যজনের পেছনে যজ্ঞেশ্বর, দুজনের হাতেই বড় কাঠের চেলা। একেবারে মাথায় আঘাত করেছে। কাঠের চেলাগুলো মন্দিরের বাইরে দেখে এসেছিলেন, হয়তো মন্দিরের কোন কাজের জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছিল।
বাকি একজন দাঁড়িয়ে আছে এখনো। দুহাত সামনে বাড়িয়ে রীতিমতো মুষ্টিযুদ্ধ করার মতো ভঙ্গিতে। এই শীতেও ছেলেটার কপালে ঘাম লক্ষ্য করলেন তিনি। সঙ্গিদের অবস্থা দেখে খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না সামনে এগুনোর। ইশারায় তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে চলে যেতে বললেন তিনি। এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে গেল তরুণ।
পা নামিয়ে নিলেন তিনি। বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বৃদ্ধ পুরোহিতের খোঁজে ভেতরে গেলেন, যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়াকে ইশারা করলেন পুরো মন্দির তন্নতন্ন করে খুঁজতে। কিন্তু পুরোহিতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তরুণ অনুচরদের আঘাত করতে বলে সাথে সাথে সরে পড়েছে বৃদ্ধ। হয়তো বুঝতে পেরেছিল এই লোককে কাবু করা সহজ হবে না।
মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সাধারনত আক্রমনাত্মক হয় না, যদিও আত্মরক্ষার কৌশল তারা ছোট থেকেই রপ্ত করে থাকে। কিন্তু ওরা জানে না কার সাথে মারামারি করতে এসেছে, জানলে কখনোই এই ভুল করতো না। বেচারাদের জন্য মায়া লাগছে। অল্প কয়েকটা আঘাতেই এদের কাত করে দিয়ে এসেছেন তিনি, যা এরা জীবনেও ভুলতে পারবে না।
মন্দিরের সিঁড়িতে রাখা জুতো পরে নিলেন। পেছনে পেছনে বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরও আছে। যজ্ঞেশ্বরের মুখটা হাসিতে ঝলমল করছে, তিনিও হাসলেন ওর দিকে তাকিয়ে। বেচারা সন্ন্যাসী এমন আনন্দ সচরাচর পায় না। বিনোদ চোপড়াও হাসছে। মনে হচ্ছে না তাকে গতরাতেই জোর করে আটকে রেখেছিলেন তিনি।
হাঁটছেন তিনি, এখানে থেকে কাজ হবে না বোঝা যাচ্ছে। তিব্বতে যাওয়া ছাড়া কোন পথ নেই। তিব্বতে যাওয়ার সেই পথটা আবছা মনে আছে, সেই আবছা স্মৃতির উপর ভিত্তি করে এগুতে হবে। সীমানা পার করে যেতে হবে তিব্বতে। পাসপোর্ট-ভিসা এসব ঝামেলায় যাওয়ার মতো কোন সময় নেই। এই দুজনকে এখানে রেখে যেতে হবে।
আজ আচমকা এই আক্রমনে যথেষ্টই অবাক হয়েছেন তিনি। বুড়ো পুরোহিত মনে মনে কি প্ল্যান করছিল তা মোটেও টের পাওয়া যায়নি।
পেছনে গল্প করতে করতে হাঁটছে যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া, এতো অল্পসময়ের মধ্যে দুজনের এতো বন্ধুত্ব কি করে হলো ভেবে অবাক হয়ে গেলেন তিনি।
হোটেলে ফিরেই বের হয়ে পড়তে হবে। দেরি করার মতো সময় নেই হাতে। দ্রুত পা চালালেন তিনি।
*
অধ্যায় ৪২
সাড়ে দশটায় ঘর থেকে বের হয়ে এলো রাশেদ। সাথে দুই পাহারাদার। চারপাশে পাখি ডাকছে। চমৎকার এই সকালটা উপভোগ করার কোন সুযোগ নেই। এবার বের হতে হবে। সঞ্জয় নিশ্চয়ই তৈরি রওনা দেয়ার জন্য।
দশ হাত দূরেই সঞ্জয়ের কামরা, কিন্তু এটুকু যেতেই মনে হচ্ছিল অনন্তকাল লাগছে। খুবই ধীর গতিতে হাঁটছে রাশেদ, চারপাশে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। লোকগুলোর অবস্থান দেখে নিচ্ছে, এখনো ওরা প্রস্তুত নয়। কয়েকজন হাত-পা ছড়িয়ে বসে যে যার অস্ত্র চকচকে করে নিচ্ছে। দুএকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নেই, তার বদলে লম্বা ফলাওলা বড় ছুরি। সেগুলো পাথরে ঘষে ধারাল করে নিতে ব্যস্ত ওরা।
দু’পাশে সারি করে বানানো ঘরগুলোর কোন একটায় রাজু আছে। এতোদিনে ওর কি অবস্থা কে জানে? বাঁচিয়ে রেখেছে না মেরে ফেলেছে সেটাও এখনো নিশ্চিত না। ভাবতে ভাবতে সঞ্জয়ের কামরার সামনে চলে এসেছে রাশেদ। পাহারাদারদের একজন টোকা দিল দরজায়। দরজা খুলে দিল সঞ্জয়ের দেহরক্ষীদের একজন। গতকাল রাতে এই লোকটাকে সঞ্জয়ের সাথে দেখেছিল।
কামরায় ঢুকে কিছুক্ষন অন্ধকার দেখল রাশেদ। বোঝার চেষ্টা করছিল সঞ্জয়ের অবস্থান কোন দিকে। এককোনায় দুজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে প্রায় আঁতকে উঠেছিল রাশেদ। এদের একজনের পায়ে গুলি করেছিল রাশেদ, বান্দরবনের হোটেলে, লরেন্সের সাথে পরিচিত হওয়ার পরের দিন। অন্যজনকে আচমকা আঘাতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল রাজু। বেশিদিন আগের কথা নয়। পায়ে গুলি খাওয়া লোকটা একটা স্ট্রেচারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে।
গতকাল যেখানে বসেছিল সেখানেই বসে আছে সঞ্জয়। মুখে হাসি।
‘কি রাশেদ, তোর যমকে চিনতে পারিস?’ হেড়ে গলায় বলল সঞ্জয়, বোঝা যাচ্ছে এই সকাল বেলায় যথেষ্ট পান করে ফেলেছে।
উত্তর দিলো না রাশেদ। সঞ্জয়ের উল্টোদিকে রাখা চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে তাকে বসিয়ে দিল পাহারাদারেরা, তারপর বাইরে চলে গেল।
লরেন্স নেই, সরিয়ে ফেলা হয়েছে এই কামরা থেকে। অন্য কোন কামরায় রেখেছে অথবা মেরে ফেলেছে। গতরাতে অবশ্য কোন গুলির আওয়াজ কানে আসেনি,কিন্তু তাতে কি? ছুরি ব্যবহার করতেও জুরি নেই এইসব বদমাসদের।
‘ঐ শালা তো তোকে পেলে টুকরো টুকরো করবে বলে কসম কেটেছে,’ স্ট্রেচারে ভর করে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখিয়ে বলল সঞ্জয়। আমি বললাম, ধীরে। আমার কাজ শেষ হোক, তারপর যা খুশি করিস।
‘কিন্তু আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কাজ শেষ করে দিলে আমাকে আর রাজুকে ছেড়ে দেবেন।’ ঠান্ডা গলায় বলল রাশেদ।
‘বলেছি যখন ছেড়ে দেবো,’ বলে সবার দিকে তাকাল সঞ্জয়, অ্যাই, তোরা দেখেছিস সঞ্জয় কখনো কথার বরখেলাপ করে?
কামরায় উপস্থিত সঞ্জয়ের দেহরক্ষীসহ ঐ দুজনও মাথা নাড়াল, তারমানে সঞ্জয় কখনোই কথার বরখেলাপ করে না। যদিও ওদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায় দিয়েছে।
‘ঠিক আছে। লরেন্স কোথায়?’
‘ঐ হারামীর কথা চিন্তা করাও তোর জন্য পাপ, গম্ভীর গলায় বলল সঞ্জয়। ওর সাথে আমার ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়া আছে।‘
‘কিন্তু রাজুকে দেখতে চাই, একবারের জন্য হলেও, রাশেদ বলল। তা না হলে…’
কথা শেষ করতে পারলো না রাশেদ, রুমে রাজু ঢুকল। হাতে হ্যান্ডকাফ, পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন। এলোমেলো চুল আর লম্বা দাঁড়িতে রাজুকে প্রায় চিনতেই পারছিল না রাশেদ।
‘এই নে তোর রাজু, তোর পেয়ারের রাজু’হা হা করে হাসল সঞ্জয়।
রাজুকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল রাশেদ, কিন্তু সঞ্জয়ের দেহরক্ষীর ইশারায় বসে পড়ল সাথে সাথে। এখন কোন ভুল করা চলবে না।
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাজু বন্ধুর দিকে বিশ্বাস করতে পারছে না রাশেদ তার সামনে বসে আছে।
‘এই বদটাকে নিয়ে যা,’ রাজুকে দেখিয়ে পাহারাদারদের উদ্দেশ্যে বলল সঞ্জয়। রাজুকে নিয়ে বের হয়ে যেতেই রাশেদের দিকে তাকাল সঞ্জয়।
‘কাল রাতে যা চেয়েছিলি পাঠিয়েছিলাম, এবার বল তোর কাজের অগ্রগতি, আমরা কখন রওনা দেবো?’
‘আমি তো ভেবেছিলাম এখানে আপনার কথামতোই সব চলে, আমি আর কি বলবো?’
‘চালাকি করিস আমার সাথে। তোকে আর তোর বন্ধুকে প্রানে বাঁচিয়ে রেখেছি একটা কারনে, কারনটা তুই ভালো করে জানিস।’
‘আমি এখনি তৈরি যাওয়ার জন্য।’
হাসি ফুটল সঞ্জয়ের মুখে। এই না হলে স্মার্ট ছেলে। রুমে যা, তৈরি হয়ে নে। ঠিক এক ঘন্টা পর রওনা হচ্ছি আমরা।’
পাহারাদারদের সাথে সঞ্জয়ের কামরা থেকে বের হয়ে এলো রাশেদ। ডান পাশের সারির সবচেয়ে শেষের কামরাটার পাশের কামরায় ঢোকানো হচ্ছে রাজুকে, চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল রাশেদ। ঘুরে তাকাল না।
.
১৯৮৫ সাল, আসামের পাহাড়ি এলাকা
চমৎকার দিন কাটছে মিচনারের। সেই রাজস্থান, পাঞ্জাব হয়ে পুরো ভারত ঘুরে আসামের এই পাহাড়ি এলাকায় আবাস করে নিয়েছে মিচনার। পাহাড়ের মাথায় ছোট একটা কুঁড়েঘরে একাই থাকে সে। আশপাশে স্থানীয় আদিবাসিদের ঘরবাড়ি আছে। ওরা সরল সোজা মানুষ। কখনোই বিরক্ত করতে আসে না। শহর থেকে আসা কিছু লোকজনই বিরক্ত করে, কথা বলতে চায়। জানতে চায় কেন সে একা থাকে, তার নাম কি, পরিবারের লোকজন কোথায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তর দেয় না মিচনার। নিজেকে স্থায়ী বোবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। ইদানিং কেউ তাকে ঘাটায় না বরং নরম চোখে দেখে। হয়তো বোবা বলেই।
দিনগুলো খুব সহজভাবে কেটে যাচ্ছে, নিজেকে ইদানিং খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে মিনারের কাছে, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হচ্ছে সে। কোন ধরনের হিংসাত্মক কাজে নিজেকে জড়ায়নি এরমধ্যে, কারো রক্ত ঝরেনি তার হাতে। বনে জঙ্গলে ঘুরে সারাদিন, সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফেরে নিজের ছোট কুঁড়েতে। এরচেয়ে সুন্দর নিরুপদ্রব জীবন আর কি হতে পারে? যে কয়জন মানুষ তাকে চেনে সবাই ভালোভাবে গ্রহন করেছে তাকে। কিন্তু তারপরও সব কিছু নীরস লাগতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা করা হচ্ছে না, কিছু একটা করা দরকার।
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বাতি জ্বালালো না মিচনার। ঘরের সামনের ছোট উঠোনটায় চুপচাপ বসে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। এতো দীর্ঘ জীবন এভাবে বয়ে বেড়াতে আর ভালো লাগছে না। কোন রোমাঞ্চ নেই, বন্ধু নেই, প্রেম-ভালোবাসা কিছুই নেই। অদ্ভুত এক অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে যেন সে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতাব্দির পর শতাব্দি।
উঠোন থেকে পুরো এলাকা দেখা যায়। সন্ধ্যার পর মিটিমিটি জোনাকির আলো আর দূর পাহাড়ের প্রতিবেশিদের হ্যারিকেনের আলোকে একই মনে হয়। আকাশে বড়সড় চাঁদ উঠেছে। সেখানে তাকিয়ে বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উঠোনের শেষ প্রান্তে পাহাড় খাড়া হয়ে নেমে গেছে নীচে। হেঁটে ঠিক শেষ সীমানায় এসে দাঁড়াল মিচনার। কালো মিশমিশে অন্ধকার অপেক্ষা করছে তার জন্য। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে চলে এলো মিচনার। ঘুম পাচ্ছে। ছোট একটা খাঁটিয়া বানিয়ে নিয়েছিল নিজ হাতে। খাঁটিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মিচনার।
হঠাৎ মনে হলো কুঁড়ে ঘরটায় কেউ আছে, অন্ধকার ঘরের চারপাশে তাকাল মিচনার। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ মনে হচ্ছে পাশ দিয়ে কেউ একজন হেঁটে গেল, আলতো বাতাসের মতো লাগলো গায়ে। এতোদিন নির্ভীক বলে আত্মগর্ব থাকলেও এখন নিজের অজান্তেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে মিচনারের। অশরীরী কিছুর মুখোমুখি আজ পর্যন্ত হতে হয়নি তাকে। যদিও নিজেকেই সে এক ভয়ংকর প্রানী বলে মনে করে, কিন্তু এমন ভয়ের মুখোমুখি আজ পর্যন্ত হতে হয়নি তাকে।
বারবার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে মিচনার, চোর হতে পারে, যদিও তার এখানে চুরি করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না। সবাই জানে বোবা-কালা অসহায় এক মানুষ এখানে একা একা থাকে, যার সহায়-সম্বল বলতে কিছুই নেই।
দরজা খোলা, বাইরে থেকে হঠাৎ শীতল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল মিচনারকে। হাওয়াটা এখন ঘরে খেলা করছে। বাতি জ্বালায়নি বলে মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। এই অন্ধকারে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। সামনেই আছে অথচ দেখা দিচ্ছে না। দৌড়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত মিচনার, কিন্তু পা যেন আটকে আছে মেঝের সাথে। অবশ হয়ে আসছে সারা শরীর। এটাই কি মৃত্যু? নিজেকে প্রশ্ন করলো মিচনার। এতোদিন পর মৃত্যুর সময় হলো তার সামনে আসার? সে কি তৈরি, আবার নিজেকে প্রশ্ন করলো মিচনার।
না, আমি তৈরি নই, আমি আরো বাঁচতে চাই, কথাগুলো মনে মনে বললেও শেষ অংশটা বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। শীতল হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল আবার, মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
‘ঠিক তোর মতোই একজন আছে, তুই ছাড়া আর কেউ তাকে সরাতে পারবে না,’ ফিসফিস করে কেউ একজন বলল তার কানে কানে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মিচনার, কেউ নেই আশপাশে। ভয় পেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।
‘আমার লাভ?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো মিচনার।
‘তোরা দুজন একসাথে পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াতে পারবি না, যে কোন একজনকে মরতে হবে। ওর হাতে তোর মৃত্যু হবে অথবা তোর হাতে ওর। আর কেউ তোদের মারতে পারবে না।’
‘তার আগে বলো তুমি কে?’
‘আমি কেউ না, কিছু না।’
‘আমি এখানেই থাকবো। কারো পেছনে ছোটার ইচ্ছে আমার নেই।’
‘তুই খুঁজে বের না করলে সেই তোকে খুঁজে বের করবে,’ চাপা গলায় কণ্ঠটা আবার বলে গেল।
‘আমি… আমি…’কথাটা শেষ করতে পারলো না মিচনার। ঘুম থেকে জেগে উঠার পর যে ধরনের অনুভূতি হয় তেমন লাগছিল। চারপাশে তাকাল, সব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। বিছানায় নিজেকে আধশোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? তা কিভাবে সম্ভব? সবকিছু এতো স্বাভাবিক এতো প্রানবন্ত ছিল, স্বপ্ন হয় কি করে?
উঠে দাঁড়াল মিচনার। ঘরের দরজা লাগানো, ভেতর থেকে। হ্যারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। চারপাশ ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আজ সম্ভবত অমাবশ্যা। আকাশে চাঁদের চিহ্নমাত্র নেই।
কানে কানে তাহলে কে কথা বলে গেল? সত্যিই কি কেউ ছিল নাকি এই কথাগুলো তার নিজের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেকদিন ধরে। আজ হঠাৎ অবচেতন মনে কথাগুলো জেগে উঠেছে। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কেউ নেই। কিন্তু যে কথাগুলো বলে গেল তা কি সত্যি?
‘তুই খুঁজে বের না করলে সেই তোকে খুঁজে বের করবে!’
ঘরে এসে হ্যারিকেন নিভিয়ে দিল মিচনার। ঠিক তার মতোই অভিশাপ বয়ে বেড়ানো আর কেউ কি সত্যিই আছে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে, একসময় সে আসবে, অবশ্যই আসবে। কিন্তু এভাবে বসে বসে অপেক্ষা করার চেয়ে সেই মানুষটার খোঁজে বেরিয়ে পড়া ভালো।
ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু ঘুম পুরোপুরি হয়নি। তাই আবার শুয়ে পড়ল মিচনার। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তে হবে। কোথাও না কোথাও অবশ্য পাওয়া যাবে সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে, সত্যিই যদি তেমন কেউ থাকে।
*
অধ্যায় ৪৩
আধঘন্টা হলো বের হয়েছে রাশেদ। সাথে সঞ্জয়ের বিশাল দলটাও আছে। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না, আকাশ মেঘলা। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিছুক্ষন হলো। রাশেদের পাশে হাঁটছে সঞ্জয়। কাঁধে একটা আটোমেটিক রাইফেল ঝুলিয়ে হাঁটছে। বুক ফুলিয়ে হাঁটছে, এই অঞ্চলের সবচেয়ে হিংস্র প্রানীটিও নাকি এই লোকটিকে দেখে ভয় পায়।
লরেন্সের দেখানো পথেই চলেছে রাশেদ। পার্চমেন্ট কাগজে লেখা ভাষার যতোটুকু তর্জমা করা গেছে তাতে মনে হচ্ছে জায়গাটার অবস্থান বান্দরবান আর আরাকান সীমান্তের কাছাকাছি। সেখানে তিনটি পাহাড় আছে পরপর, যেগুলোর উচ্চতা প্রায় কাছাকাছি। এই পাহাড়গুলোর কোন একটার গুহায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তিবাওয়ের ধনসম্পদ। এই ধরনের পাহাড় এই অঞ্চলে অজস্র, তার মধ্য থেকে লরেন্সের পূর্বপুরুষের পাহাড় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই পাহাড়গুলো চেনার ছোট একটা উপায় বলা আছে। যদিও আজকের এই মেঘলা দিনে সেই সূত্র কতোটা কাজে লাগবে তাতে যথেষ্ট সন্দিহান রাশেদ।
বেশ ফুর্তিতে আছে সঞ্জয়। পাহাড়ি একটা গান শিস দিয়ে বাজাচ্ছে। বেশ বড়সড় একটা দল নিয়ে এগুচ্ছে সঞ্জয়। কোন ঝামেলার আশংকা করছে না। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে কিভাবে দিনের পর দিন চালিয়ে নিচ্ছে সঞ্জয় ভেবে অবাক হলো রাশেদ।
‘রাশেদ, আর কতো দূর?’ হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো সঞ্জয়।
উত্তর দিলো না রাশেদ। বিরক্তির চোখে তাকালো। হাতে ভোলা পার্চমেন্ট কাগজটার দিকে তার দৃষ্টি। ছোট খাট একটা ম্যাপও আঁকা আছে কাগজটায়। সেখানে পাহাড়গুলোকে দেখানো হয়েছে, ছোট একটা ত্রিভুজের তিন কোনায় তিনটা পাহাড়। মাঝখানের ছোট উপত্যকায় থাকার কথা তিবাওয়ের ধনসম্পদ। ঠিক এই ধরনের
অবস্থানে পাহাড় খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ হবে না।
হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাশেদ। একসাথে সবগুলো রাইফেলের নল ঘুরে গেল তার দিকে। নিজে নিজেই উঠে দাঁড়াল। ইশারায় সবাইকে রাইফেল নামাতে বলল সঞ্জয়।
‘বুঝলি তো, একটু এদিক-সেদিক হলেই মৃত্যু,’ বলল সঞ্জয়।
চুপচাপ হাঁটতে থাকল রাশেদ। কোটি কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ নিতে হচ্ছে অথচ ভাগ্যে জুটবে একটা বুলেট! সঞ্জয়ের মতো লোক তাকে আর রাজুকে কখনোই ছেড়ে দেবে না। শ
***
সন্ধ্যার পরপর কাঠমুন্ডুতে ঢুকে হোটেলে যে যার রুমে চলে গিয়েছিল। একটানা এতো দীর্ঘসময় অনেক দিন ভ্রমন করা হয় না, তাই শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছিল না ড. আরেফিনের। বিছানায় শুয়ে টিভি চ্যানেল ঘোরাচ্ছিলেন, সব ভারতীয় চ্যানেল। নেপালীরা ভারত পছন্দ না করলেও এখানে সবকিছুই প্রায় ভারতীয়। আগে থেকে ভিসার প্রয়োজন হয়নি নেপালে ঢুকতে, এছাড়া সুরেশ আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল, কাজেই নেপালে ঢুকতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি তাদের। এমনকি সাধারন কাস্টমস চেকিং পর্যন্ত হয়নি দলের কারো। ব্যাপারটাতে অবাক হলেও প্রকাশ করেননি তিনি। হয়তো এটাই স্বাভাবিক নিয়ম কে জানে।
ঘন্টাখানেক পর ড. কারসনের রুমে যেতে হবে। আবার মিটিং। আগামীদিনের প্ল্যান সম্পর্কে বলবেন ড. কারসন। সম্ভবত কালকেই যাওয়া যাবে তিব্বতে, কিন্তু সেখানে গিয়ে কিভাবে কাজ শুরু করবেন ড. কারসন সেটাই আসল প্রশ্ন।
টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন ড. আরেফিন। হঠাৎ দরজায় ক্রমাগত ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙল তার।
***
অধ্যায় ৪৪
ইচ্ছে ছিল না কিন্তু যজ্ঞেশ্বর এবং বিনোদ চোপড়া দুজনকে সঙ্গি করেছেন তিনি। এখানে থেকে কাজ হবে না, তারচেয়ে তিব্বতে যাওয়া ভালো। সেখানে হয়তো কোন খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তবে বৃদ্ধ কিংবা তরুণ সব ধরনের পুরোহিতদের কাছ থেকে সাবধান থাকতে হবে। নিজেদের সংস্কৃতির কোন কিছুই তারা বেদখল করতে চায় না। যদিও এখন পুরোপুরি চীনের শাসনে চলছে তিব্বত তবু সাধারন তিব্বতিরা মনে প্রানে বিশ্বাস করে এই পরাধীনতা সাময়িক, যে কোন দিন আবার তারা স্বাধীন হবে।
সাধারন পর্যটকদের সাথে মিশে যেতে হবে। আগেরবার পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে গিয়েছিলেন তিব্বতে, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে। এবার সেভাবে যাওয়ার সুযোগ নেই। সীমান্ত এলাকায় দেশগুলো তাদের প্রহরী বসিয়েছে, যারা একটি মাছিকেও স্বজ্ঞানে সীমান্ত পার হতে দেবে না।
আরেকটা উপায় হচ্ছে তীর্থযাত্রীদের সাথে যাওয়া, যজ্ঞেশ্বর নিজে সন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রীরা যারা কৈলাস কিংবা মানস সরোবর প্রদক্ষিনের উদ্দেশ্যে যায় তাদের সাথে মিশে যাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে যেতে হবে নেপালে। নেপাল সীমান্ত দিয়েই তিব্বতে প্রবেশ করা এখন সবচেয়ে সহজ হতে পারে। যদিও প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক তীর্থযাত্রীকে কৈলাস এবং মানস সরোবরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। গত বছর এই সংখ্যা ছিল মাত্র নয়শ জন। এই বছর সেই সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। যদিও এই তীর্থযাত্রার প্রধান সময় হচ্ছে জুন থেকে ডিসেম্বর।
ছোট একটা জীপ ভাড়া করেছেন তিনি, ম্যাকলডগঞ্জ থেকে নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবে তাদের। প্রায় দুই দিন সময় লাগবে। এতোটা সময় মাইক্রোবাসে কাটানো অনেক কঠিন হলেও আপাতত এছাড়া কোন উপায় নেই। হোটেলে ঢুকে ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছেন, যজ্ঞেশ্বরের সাথে তেমন কিছু নেই। এরপর বিনোদ চোপড়ার হোটেলে যেতে হলো। বিনোদ চোপড়ার দুটো সুটকেস। বাধ্য হয়ে নিতে হলো সাথে, যদিও যাত্রায় মালপত্র যতো কম নেয়া যায় ততো ভালো। নেপালে ঢোকার আগে জীপ ছেড়ে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তিব্বত সীমান্তে যথেষ্ট কড়াকড়ি এখন। তবে যতো কড়াকড়িই থাক তিব্বতে ঢোকা কেউ আটকাতে পারবে না।
* * *
হাতে পার্চমেন্ট কাগজটা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। আর কিছুদূর গেলেই বার্মা সীমান্ত। চারপাশে ঘন জঙ্গল। সারাদিন হেঁটে কাদা আর ধুলোয় চেহারা হয়েছে কিম্ভুতকিমাকার। দুপুর হয়ে গেলেও রোদ না উঠার কারনে কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। এই ঘন জঙ্গলটা পেরুলেই সামনে পাহাড়ের সারি। এই পর্বতমালা আসাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে বার্মায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সামনে পাহাড়গুলোর যেকোন একটার চূড়ায় উঠতে হবে। তাহলেই হয়তো পার্চমেন্টে আঁকা ম্যাপের কোন কূলকিনারা করা যেতে পারে।
একটানা হেঁটে দলের বেশিরভাগ সদস্যই ক্লান্ত। সঞ্জয়কে অবশ্য ক্লান্ত দেখাচ্ছে না, অসম্ভব প্রানশক্তির অধিকারি লোকটা, ভাবল রাশেদ। বারবার আড়চোখে সঞ্জয়কে দেখে নিচ্ছে রাশেদ। লোকটার মতিগতি বোঝা খুব কঠিন, কখন কি করে বসে বোঝা যায় না।
‘আমার মনে হয় এবার একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার,’ বেশ ক্লান্ত গলায় বলল রাশেদ।
‘কোন বিশ্রাম নেই, আমি যখন ক্লান্ত হবো তখন দেখা যাবে,’ বাজখাই গলায় বলল সঞ্জয়। আগে তোর কাজ শেষ কর।
বিরক্ত হলেও কথা বাড়াল রাশেদ। বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, পার্চমেন্টটা খুলে। কি ভেবে সঞ্জয়ও এসে দাঁড়াল পাশে।
‘এবার আমাকে বুঝিয়ে দে কি করতে হবে, তোর উপর ভরসা পাচ্ছি না,’ সঞ্জয় বলল।
‘নিন, আপনি নিজেই খুঁজে নিন,’ পার্চমেন্ট কাগজটা সঞ্জয়ের দিকে বাড়িয়ে বলল রাশেদ।
‘তুই দেখা, পারলে তো নিজেই খুঁজে নিতাম।‘
সঞ্জয়কে পার্চমেন্টের দিকে তাকানোর ইশারা করলো রাশেদ, ছোট একটা ম্যাপ আঁকা, অনেক ঝাপসা হয়ে গেছে। আর প্রায় চারশো বছর আগে আঁকা জায়গাটা ঠিক আগের মতো আছে কি না তাতেও সন্দেহ আছে।
‘এখানে দেখুন,’ রাশেদ বলল, পার্চমেন্টে আঁকা ম্যাপটায় আঙুল রাখল, ‘ঠিক তিনটি পাহাড়ের মাঝখানের ছোট উপত্যকায় গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন তিবাও, এখন লক্ষ্য করে দেখুন পাহাড়গুলোর অবস্থান। জ্যামিতিক ত্রিভূজের ঠিক তিনকোনায় পাহাড় তিনটি অবস্থান করছে। দাগ কেটে দেখালে অনেকটা সমবাহু ত্রিভুজের মতো দেখাবে।‘
‘এতো ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ বুঝি না, পাহাড় তিনটা কোথায়?’
‘ঐ সময় বার্মা-বান্দরবান আলাদা কোন সীমানা ছিল না, এই অঞ্চল ছিল আরাকান রাজ্যের মধ্যেই। তাই পাহাড় তিনটার সত্যিকার অবস্থান বের করা কঠিন।‘
‘এতোদূর হাঁটিয়ে এনে ফাজলামি করিস?’
‘এমনি এমনি এতোদূর হাঁটিনি, এখানে দেখুন, ম্যাপের আরেকটা জায়গায় আঙ্গুল রাখল রাশেদ, এখানে ছোট একটা বিন্দুর মতো সুৰ্য্যের অবস্থান দেখানো হয়েছে। সূর্য এখানে ঠিক মধ্যগগনে অবস্থান করছে। এর সাথে পাহাড়ের অবস্থানগুলো বিচার করলে সম্ভাব্য জায়গার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। কিন্তু সমস্যা হলো…’
‘আবার কি সমস্যা?’
‘আজ সুর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই ধরনের হিসেবনিকেশে আমার চেয়ে রাজু অনেক অভিজ্ঞ। রাজু এখানে থাকলে অনেক সহজ হতো কাজটা।’
‘তুই আগে বলতি তাহলে রাজুকে সাথে করে নিয়ে আসতাম।’
‘আগে তো বুঝতে পারিনি এমন অবস্থা হবে,’ আমতা আমতা করে বলল রাশেদ।
‘ঠিক আছে দাঁড়া, আমি রাজুকে আনাচ্ছি, শুধু রাজু না লরেন্সও আসবে, তারপর দেখি আর কোন অজুহাত বের করতে পারিস কি না তুই!’ রাগত স্বরে বলল সঞ্জয়।
হাত দিয়ে সঙ্গিদের মধ্য থেকে দুজনকে ডাকল সঞ্জয়।
‘এখনি ক্যাম্পে যাবি, রাজু আর লরেন্সকে সাথে নিয়ে আসবি, আরো তিনজনকে নিয়ে যা,’ সঞ্জয় বলল, ‘যাবি আর আসবি। দেরি হলে তোদের খবর আছে।‘
পাঁচজন চলে গেল। একটু আগে বিশ্রাম দিতে না চাইলেও এখন বাধ্য হয়ে সবাইকে বিশ্রাম নিতে বলল সঞ্জয়।
ধূলোময় মাটিতে বসে পড়ল রাশেদ। আরো একটু সময় পাওয়া গেল, লরেন্স আর রাজু আসতে দুই ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা। ক্ষুধা পেয়েছে রাশেদের, যদিও এখন কিছুই দেয়া হবে না একটু আগে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সঞ্জয়। তাই খাবার-দাবার চাইলো না রাশেদ। গাছের গোড়ার দিকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল, এই সময়টা ঘুমিয়ে নেয়া ভালো। তারপর অনেক দৌড়-ঝাঁপ বাকি আছে, শক্তি জমিয়ে রাখতে হবে সময়মতো ব্যবহার করার জন্য।
*
অধ্যায় ৪৫
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকেছে রামহরি। পেছনে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামও ঢুকেছেন। দুজনকেই বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন ড. আরেফিন, রুমের চারদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে ওরা।
‘কি ব্যাপার প্রফেসর, কোন সমস্যা?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
সোফায় হেলান দিয়ে বসেছেন প্রফেসর, এখনো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।’
‘আমাদের সামনে খুব বিপদ ড. আরেফিন, প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বললেন।’
‘কি বিপদ?’
‘একটু আগে এক চাইনীজ এসেছিল, আমার রুমে,’ বললেন প্রফেসর, ‘বলা যায় একধরনের হুমকি দিয়ে গেছে।’
‘কি হুমকি?’ বিছানা ছেড়ে উঠেলেন ড. আরেফিন।
‘আমরা যেন তিব্বতে ঢোকার চেষ্টা না করি, তাহলে নাকি সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।‘
‘লোকটা কে? কি মনে হলো আপনার?’
‘বুঝতে পারিনি। তবে মনে হয় আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানে।’
‘ড. কারসনকে জানিয়েছেন?’
‘না, বলিনি কিছু। তিনি হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন।‘
‘তারপরও জানানো দরকার। চলুন,’ কথা বলতে বলতে কাপড়চোপড় পাল্টে নিলেন ড. আরেফিন।
‘আমার মনে হয় এখনই আমাদের সরে যাওয়া উচিত, কি দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে।‘
‘ঝামেলার কিছু নেই। তিব্বতে যাওয়ার ভিসা নেয়া আছে আমাদের। আর আমরা সন্ত্রাসী নই।’
‘এমনিতেই ভারতের সাথে নানা দিক দিয়ে সমস্যা আছে চীনের। ভিসা হয়তো আছে, কিন্তু তারপরও ওরা চাইছে না আমরা তিব্বতে যাই।‘
‘আমি যাবো। ড. কারসনও নিশ্চয়ই পিছপা হবেন না।’
‘যাবেন?’
‘হ্যাঁ, সন্দীপ জানে?’
‘না।‘
‘ঠিক আছে, একটু পর ড. কারসনের রুমে কথাগুলো বলবেন, তখন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে,’ বোঝা গেল একটু হতাশ হয়েছেন প্রফেসর, ভেবেছিলেন ড. আরেফিন হয়তো ভয়ে রাজি হবেন না তিব্বতে যেতে।
‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন তো?’ বললেন প্রফেসর।
‘বিশ্বাস করবো না কেন?’
দরজায় নক হলো এই সময়। রামহরিকে ইশারা করলেন ড. আরেফিন, দরজা খুলে দিতে। সুরেশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
‘কাল সকালে আপনাদের ফ্লাইট, সুরেশ বলল, নাস্তা করেই বেরিয়ে যাবো আমরা।’
‘ঠিক আছে,’ বললেন ড. আরেফিন।
সুরেশ চলে গেলে প্রফেসরের দিকে তাকালেন তিনি, ভদ্রলোকের চেহারায় এখনো ভয়ের ছাপ স্প। অভিনয় কি না বোঝা যাচ্ছে না, নাকি সত্যি কেউ এসে ভয় দেখিয়ে গেছে।
দরজা লক করে বেরিয়ে এলেন তিনজন। রাতের খাবারের পর ড. কারসনের রুমে যেতে হবে।
***
নীচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল সন্দীপ। এমনিতে সিগারেটের অভ্যাস নেই তার, কিন্তু টেনশনের সময়গুলোতে ভালো লাগে। রাতের খাবার হয়নি এখনো, তারপর ড. কারসনের রুমে যেতে হবে।
বিরক্তির একশেষ এই ড. কারসন, এর আগে অবশ্য এমন কখনো মনে হয়নি। নেপালে ভালোই শীত, মনে করে কিছু ভারি কাপড়-চোপড় সাথে নিয়ে আসা হয়েছিল। সোমা মনে করে দিয়েছিল। সোমা-শান্তনুর সাথে কথা হয়নি আজ সারাদিন, একবার ফোন না করলে হয়তো চিন্তা করবে। মোবাইল ফোন বের করে স্ত্রীর নাম্বারে ডায়াল করলো সন্দীপ। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন, লক্ষ্য করেনি।
অল্প কিছুক্ষন কথা বলে ঘুরে হোটেলের দিকে ফিরল সন্দীপ, কিন্তু নাক বোঁচা এক লোক পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ছিনতাইকারি? এতো লোকজনের মাঝে? বিশ্বাস হচ্ছি না সন্দীপের। লোকটার হাতে ছোট আকারের একটা পিস্তল দেখা যাচ্ছে।
লোকটাকে পাশ কাটাতে ব্যর্থ হলো সন্দীপ, ঠিক কোমরের কাছে পিস্তলটা ঠেকিয়ে রেখেছে। নড়াচড়া করতে গেলেই গুলি করে বসতে পারে। প্যান্টের পকেটে হাত নিয়ে গিয়ে ম্যানিব্যাগে হাত দিলো সন্দীপ। ভালোয় ভালোয় জান নিয়ে ফিরে আসতে পারলে হয়। ম্যানিব্যাগটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে, কিন্তু সেদিকে কোন নজরই নেই লোকটার। চোখ দিয়ে ইশারায় দূরে দাঁড়ানো একটা প্রাইভেট কারের দিতে যেতে বলছে। বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করলো সন্দীপ।
সাধারন ছিনতাইকারি নয় এই লোক, তাকে অপহরন করতে এসেছে। খুব ধনী কোন মানুষ নয় সে, সম্ভবত তার অভিযানের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে, মনে মনে ভাবল সন্দীপ।
আবারো ইশারা করলো লোকটা, চেহারায় শীতল একটা ভাব। এই লোক নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করতে পারে, মনে মনে ভাবল সন্দীপ। হার মেনে নেয়ার একটা ভান করে লোকটা ইশারা করা গাড়িটার দিকে হাঁটছে সন্দীপ, এর হাতে এভাবে ধরা দেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু এলোপাথারি দৌড় দিতে যাওয়াও দারুন ঝুঁকিপূর্ন হতে পারে। পেছনে না তাকিয়ে হাঁটছে সে এখন। লোকটার সাথে তার দূরত্ব প্রায় তিন-চার ফুট। হঠাৎ ভোঁতা একটা আওয়াজ শুনে চমকে পেছনে তাকাল সন্দীপ। নাকবোচা লোকটা রাস্তায় পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে, নাক থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। লোকটাকে পরীক্ষা করে দেখছে একজন, উবু হয়ে, মানুষটা সন্দীপের খুব পরিচিত।
.
কিছুদিন আগে, ঢাকা
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, বিপন্ন হয়ে যখন রাস্তার পাশে পড়েছিল সে, তখন একজন মানুষ ঠাই দিয়েছিল তাকে। অনেকদিন পর মনে হয়েছিল ঠিক মানুষের সঙ্গ পেয়েছে। লোকালয়, মানুষ এড়িয়ে চলতে চলতে মানুষ সম্পর্কে একধরনের বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল। এই মানুষটার সংস্পর্শে এসে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল যেন মিচনার। নিজের ভেতর আগের সেই হিংস্রতা জাগিয়ে তুলেছিল লোকটা, যেন বুঝতে পেরেছিল সে আসলে কি চায়। রক্ত দেখতে ভালো লাগতো তার, তাই শয়তান উপাসক মানুষটা সবসময়ই চেষ্টা করতো তার সেই ভালোলাগাগুলো পূরন করতে। কিন্তু সেই সুন্দর সময়টাও বেশিদিন টিকলো না।
আশ্রয়দাতা মানুষটা এখন জেলে, কোন জেলে আছে জানলে এতোক্ষনে বের করে নিয়ে আসতো মিচনার। সে নিজে যেভাবে বের হয়ে এসেছে। সামনে একটা উদ্দেশ্যই বাকি আছে, তা হচ্ছে প্রতিদ্বন্ধীকে খুঁজে বের করে তাকে শেষ করে দেয়া।
এছাড়া আর কোন কিছুই মাথায় নেই তার। মাথার ভেতর অদ্ভুত কথাগুলো এখনো শুনতে পায় মিচনার। তাকে বলে আরো দূরে কোথাও যেতে। ধারনার উপর ভিত্তি করে চলেছে মিচনার। যে বাড়িটায় ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল সেখানেও গিয়েছিল একবার। সেই ভদ্রলোকের উপর এমনিতেই রাগ ছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে মিচনার। এখন অন্য কাজে মন না দিয়ে আসল কাজে মন দিতে হবে।
সীমানা কিংবা দূরত্ব তার কাছে বড় কোন ব্যাপার না, মন বলছিল তার শিকার এখন এই অঞ্চলে নেই। সম্ভবত বরফ ঢাকা কোন পাহাড়ি এলাকার দিকে গেছে, এরকম মনে করার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোন কারন অবশ্য নেই। কিন্তু আন্দাজের উপর ভর করে চলতে কোন দ্বিধা নেই তার।
চমৎকার পোশাক জোগাড় করে নিতে সমস্যা হয়নি,রাতে একজন পথচারিকে মেরে পথের পাশে ফেলে রেখে এসেছে। টাকা-পয়সার কোন দরকার কখনো অনুভব করেনি মিচনার, দেশ-বিদেশের সীমারেখা তাকে আটকাতে পারবে না। সে জানে বাংলাদেশে কোথাও বরফে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চল নেই, তাকে যেতে হবে ভারতে যেখানে গত শতাব্দির অনেকটা সময় কেটেছে তার। সীমান্ত পার করতেও কোন কষ্ট হবে না। তাকে আটকে রাখার মত সীমান্তরক্ষী এখনো জন্মেনি।
ইদানিং রাতে ঘুম আসে না তার। ঢাকা থেকে রংপুরগামী একটা ট্রেনের যাত্রী হয়ে বসেছে সে। জানালার পাশের চেয়ারে বসে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে পুরানো দিনের কথা ভাবছিল মিচনার। সব যেন ঝাপসা, সেই সব দিনগুলো যেন অন্য কোন মানুষের জীবনে ঘটা কাহিনি।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষন হলো। অল্প কিছু টাকা পেয়েছিল প্যান্টের পকেটে থাকা ম্যানিব্যাগটায়, সেই টাকায় টিকিট করেছে। অল্প কিছু টাকা এখনো আছে বুক পকেটে, সেই সাথে ছোট একটা ম্যাপও। ভাঁজ করে রাখা ম্যাপের উপর হাত বুলাল মিচনার। এই ম্যাপ দেখে দেখে এগুতে হবে। সেই সাথে সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর তো আছেই তাকে পথ দেখানোর জন্য।
*
অধ্যায় ৪৬
চোখ বুজে এসেছিল রাশেদের সারাদিন হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে। হঠাৎ হৈ চৈ-এ চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। রাজু আর লরেন্স চলে এসেছে। ঘন্টাখানেক পার হয়নি ওদের আনতে লোক পাঠিয়েছিল সঞ্জয়। এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে এলো মাথায় আসছিল না রাশেদের।
দুজনকেই ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে, সম্ভবত ধরে আনতে বলা হলেও বেঁধে আনা হয়েছে ওদের। রাশেদকে দেখে রাজুর ক্লান্ত চেহারায় একটা হাসি খেলে গেল। লরেন্স চুপচাপ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের হাতই পেছন থেকে বাঁধা।
উঠে দাঁড়াল রাশেদ। এবার আসল ঝামেলার পালা। সঞ্জয়ের মতো লোককে খুব বেশি সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ইতিহাসের ছাত্র রাজু কিভাবে ম্যাপ দেখে আসল জায়গা খুঁজে বের করবে! একেবারেই অসম্ভব একটা কাজ। জ্যামিতিক সূত্র কিংবা বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাপারে কোনদিনই কোন আগ্রহ ছিল না রাজুর। কিন্তু রাজুর নাম যেহেতু বলা হয়ে গিয়েছে তাই কোন না কোনভাবে ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে।
রাজুর দিকে এগিয়ে গেছে সঞ্জয়, ভাবখানা এমন যে শিকারকে হাতের নাগালে পেয়ে খেলছে বাঘ। রাশেদও এগিয়ে গেল রাজুর দিকে, সবার অলক্ষ্যে চোখ মারল। রাজু তাকিয়ে আছে তার দিকে, কিন্তু ইশারা বুঝতে পেরেছে কি না সন্দেহ হচ্ছিল রাশেদের।
‘অ্যাই, তুই নাকি সব বুঝিস?’ রাজুর কাছে গিয়ে হুংকার ছাড়ল সঞ্জয়।
কিছুক্ষন চুপচাপ তাকিয়ে থাকল রাজু। বুঝতে পারছে না কি বলবে। রাশেদের দিকে তাকাল, কিন্তু ইশারা দিতে পারছে না রাশেদ, সঞ্জয়ের সব লোক এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ বুঝে ফেলতে পারে।
‘সব বুঝি না, কিছু কিছু বুঝি,’ ধীর গলায় উত্তর দিল রাজু।
‘অ্যাই, কে আছিস, ওকে খুলে দে, দেখি কি করতে পারে,’ দলের একজনকে বলল সঞ্জয়।
দৌড়ে গিয়ে একজন বাঁধন খুলে দিল রাজুর। মুক্ত হয়েই শরীর একটু ঝাঁকিয়ে নিলো রাজু। হাসতে গিয়ে নিজেকে থামাল রাশেদ। যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অস্বাভাবিক একটা গুন আছে রাজুর।
‘আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান সব কিছু নিয়ে পড়াশোনা করেছি,’ সঞ্জয়ের সামনে গিয়ে বলল রাজু, ‘আপনার কি সমস্যা বলুন, আমি সমাধান করে দেবো।
‘শালা আমার সাথে ফাইজলামি করিস!’ ক্ষেপে যাচ্ছিল সঞ্জয়, নিজেকে শেষমুহূর্তে নিয়ন্ত্রনে নিলো। বেশি কিছু করতে হবে না তোর, ঐ ম্যাপ দেখে গুপ্তধনের জায়গাটা দেখিয়ে দিবি শুধু।
রাশেদের দিকে এগিয়ে এলো রাজু। চারপাশে তাকাচ্ছে বারবার, সঞ্জয়ের দলের লোকদের অবস্থান দেখে নিচ্ছে, হয়তো দৌড়ে পালাবার একটা মতলব ছিল, কিন্তু অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে এতোগুলো লোককে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে প্ল্যান বাদ দিলো।
‘দোস্ত, কি ঝামেলায় পড়লাম,’ রাশেদের সামনে এসে ফিসফিস করে বলল রাজু, ‘আমি কি এইসব কিছু বুঝবো নাকি?’
‘বোঝার ভান কর, একটা না একটা পথ বেরিয়ে আসবে,’ গলা নামিয়ে বলল রাশেদ।
‘অ্যাই, তোরা কী ফিসফিস করছিস?’ বাজখাই গলায় বলল সঞ্জয়।
‘কিছু না,’ কাঁচুমাচু গলায় বলল রাজু।
জঙ্গলের এই অংশটা পার হলেই পাহাড় শুরু হয়েছে একের পর এক। এই দুপুর বেলাও কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক।
‘একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, রাশেদ বলল, সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে।
‘কি বলবি তাড়াতাড়ি বল।’
‘আজ আবহাওয়ার যে অবস্থা তাতে আজ বরং আমরা ফিরে যাই,’ রাশেদ বলল, ‘কাল আকাশ পরিস্কার থাকলে আবার আসবো।‘
হা হা করে হেসে উঠলো সঞ্জয়। তার দেখাদেখি দলের বাকিদের মুখেও হাসি দেখা যাচ্ছে।
‘তোরা কি আমাকে বোকা পেয়েছিস?’ সঞ্জয় বলল, ‘এই ম্যাপের সাথে চাঁদ সূর্যের কোন সংযোগ আছে কি না জানি না, তবে এতোটুকু জানি তোদেরকে দিয়ে কিছু হবে না, আমি শুধু দেখছিলাম আমাকে কতোটা বোকা মনে করিস।‘
রাশেদের হাত থেকে ম্যাপটা কেড়ে নিলো সঞ্জয়। ‘আমি জানতাম তোরা পারবি না, পারবে একমাত্র লরেন্স,’ বলল সঞ্জয়, ‘কিন্তু জান গেলেও তার বাপদাদার সম্পদ সে আমাকে পেতে দেবে না। কি, ঠিক বলিনি লরেন্স?’
প্রশ্নটা লরেন্সের উদ্দেশ্যে করা হলেও উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজনবোধ করলো না লরেন্স। আগের মতোই নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে রইল।’
‘জানি তুই সহজে কথা বলবি না, তাই তোর মুখ থেকে কথা বের করার ব্যবস্থা করেছি,’ সঞ্জয় বলল, দলের একজনকে ইশারা করতেই গাছের আড়াল থেকে বয়স্ক একজন মানুষকে বের করে আনা হলো।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না রাশেদ। লরেন্সও তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। রাজুর কাছেই মানুষটা অপরিচিত।
‘কি, চিনতে পারছিস তো লরেন্স?’ হাসিহাসি মুখে বলল লরেন্স, ‘তোর চাচা এঞ্জেল ডি ক্রুজ। এবার মুখ খুলবি তো?’
৪৪৪
***
রাত দশটায় ড. কারসনের রুমে জমায়েত হয়েছে সবাই। আগামীকাল সকালে তিব্বতের উদ্দেশ্য যাত্রা করবে দলটা। সেই অনুযায়ী ফ্লাইটও কনফার্ম করা হয়েছে।
ড. কারসন সবার দিকে তাকাচ্ছেন এক এক করে। বোঝার চেষ্টা করছেন কে কি ভাবছে।
‘আপনাদের মনে কোন দ্বিধা থাকলে এখনই বলে ফেলুন,’ বললেন ড. কারসন, ‘আমি চাই না পরবর্তীতে কোন ভুল বোঝাবুঝি হোক।’
মাথা নীচু করে রয়েছে সন্দীপ, বাকিরাও চুপচাপ।
‘এখনো সময় আছে ফেরত যাওয়ার, কেউ কিছু বলবে না, কিছু মনে করবে না, বলে চলেছেন ড. কারসন, কিন্তু একবার তিব্বতে ঢুকে পড়লে আর সহজে ফিরে আসবো না আমরা, সাম্ভালা বের না করা পর্যন্ত।
‘আমি আছি, ড. আরেফিন বললেন।’
‘সন্দীপ, আপনি?’
‘আমিও আছি,’ ছোট করে বলল সন্দীপ।’
‘প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, আপনি?’
প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছেন ড. কারসন, উত্তরের আশায়, কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন না প্রফেসর, রামহরির দিকে তাকালেন একবার।
‘আমিও আছি।’
রামহরি কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল মনিবের দিকে। এই উত্তর সে আশা করেনি।’
‘ঠিক আছে, আমরা সবাই তাহলে আছি,’ প্রসন্ন গলায় বললেন ড. কারসন।
‘আমাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন হবে, প্লেনে করে যাচ্ছি না আমরা, স্থলপথে সীমান্ত পার হবো, লাসায় আমাদের কোন কাজ নেই, আমাদের কাজ হচ্ছে মানস সরোবর আর কৈলাস সংলগ্ন এলাকায়।‘
‘কিন্তু আমরা যে টিকিট বুকিং দিয়ে ফেললাম?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন, বেশ অবাক হয়েছেন তিনি ড. কারসনের আকস্মিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে।
‘বুঝে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি, ড. কারসন বললেন।
‘কোন পথে যাবো আমরা?’ সন্দীপ জিজ্ঞেস করলো।
‘আমাদের পথ দেখাবে সুরেশ,’ ড. কারসন বললেন, ‘এই অঞ্চল ওর চেনা। যদিও রাজি হতে চাইবে না, কারন তিব্বতের এয়ারপোটে আমাদের জন্য একজন গাইডের ব্যবস্থা থাকার কথা, কিন্তু টাকার লোভ দেখাব, রাজি না হয়ে পারবে না।‘
‘কাল সকাল থেকে আপনাদের সব যোগাযোগ বন্ধ থাকবে, মোবাইল ফোনগুলো আমার কাছে জমা দেবেন,’ ড. কারসন বললেন।
‘অসম্ভব, প্রতিদিন বৌ-বাচ্চার সাথে কথা বলি আমি?’ সন্দীপ বলল, তাকে বেশ অসন্তুষ্ট মনে হলো।
‘মোবাইল ফোন আমার কাছে থাকবে, যখন প্রয়োজন হবে নিয়ে ফোন করবেন, এই মুহূর্তে অভিযানের গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।‘
‘আপনার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারন জানতে পারি,’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
‘একটু আগেই বলেছি সময় হলেই বলব, আশা করি কিছু সমস্যা এভাবে এড়াতে পারব আমরা।’
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন ড. আরেফিন। এই অঞ্চলে এখন প্রচুর শীত পড়েছে। কাল সকালে উঠে মার্কেট থেকে আরো কিছু ভারি কাপড়-চোপড় কিনতে হবে।
‘ড. কারসন, কাল কখন রওনা দেবো আমরা?’ সন্দীপ জিজ্ঞেস করলো।
‘সকাল সকাল রওনা দেবো। ঠিক সাতটায় নীচে লবীতে উপস্থিত থাকবেন সবাই,’ বললেন ড. কারসন, উঠে দাঁড়ালেন।
সবাই বের হয়ে এলো ড. কারসনের রুম থেকে। দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে ড. কারসনের চেহারায়। পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে। হঠাৎ করে এভাবে প্ল্যান বদলানোর ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু মনে হচ্ছে তিব্বতে তাদের খুব সাদরে বরন করে নেয়া হবে না। যে উদ্দেশ্যে এতোদূর আসা তার পুরোটাই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তারচেয়ে নিজের মতো করে যাওয়া অনেক ভালো।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. কারসন। পরিচিত কিছু মানুষকে দেখলেন মনে হলো, এদের আগে কোথাও দেখেছেন, ঠিক কোথায় মনে করতে পারলেন না।
টেবিলের উপর ল্যাপটপ খোলা ছিল, সেখানে সাম্ভালা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আছে। আরো অনেক তথ্য জোগাড় করা বাকি এখনো। তিব্বতে যাওয়ার ম্যাপটাও দেখে নিতে হবে, সুরেশের উপর পুরো ভরসা করে থাকা ঠিক হবে না।
***
হোটেল ওরিয়েন্টালে উঠেছেন তিনি। পাঁচতলায় পাশাপাশি তিন রুম ভাড়া নিয়েছেন। হোটেলের ভেতরের রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বিনোদ চোপড়াকে সাথে নিয়ে বের হয়েছেন তিনি। কাঠমুন্ডু ছোট সুন্দর একটা শহর। বছরের এই সময়টা পর্যটকে গিজগিজ করে। রাস্তায় হাঁটাচলা করাও মুশকিল হয়ে যায়, এখন অবশ্য বেশ রাত হয়ে গেছে, তবু রাস্তায় লোকজনের অভাব নেই। নেপালে আগে এশবার আসা হয়েছিল, ঘুরে দেখা হয়নি। তবে বুঝতে পারছেন দেশটা অনেক সুন্দর। পাহাড়ের কোলে এতো চমৎকার একটি দেশে পরে কেন আর আসা হয়নি ভেবে আফসোস হচ্ছে তার।
শীতকালের এই সময়টায় প্রচন্ড ঠান্ডা এখন কাঠমুন্ডুতে। রাত হয়ে গেছে তাই দূরের বরফে ঢাকা পর্বতচূড়া দেখা যাচ্ছে না। বিনোদ চোপড়াকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। নেপালে প্রথমবারের মতো এসেছে সে। সবকিছু ভালো লাগছে। গা গরম করার জন্য পাশের একটা বারে যেতে চাইল বিনোদ চোপড়া। বাঁধা দিলেন না তিনি, এই শীতে উষ্ণপানীয় দরকার হতেই পারে।
যজ্ঞেশ্বরকে রুমেই রেখে এসেছেন। এইসব এলাকায় সন্ন্যাসী অনেকবার এসেছেন, তাই সাথে নিয়ে বের হননি। দীর্ঘ একটা ভ্রমনের পর একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। বিনোদ চোপড়াকে ব্যতিক্রম মনে হলো, শারীরিকভাবে যথেষ্ট কষ্টসহিষ্ণু লোকটা।
বারে প্রচুর লোক, কোনায় একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়লেন তিনি। বিনোদ চোপড়ার জন্য বীয়ারের অর্ডার দিলেন। নিজের জন্য এককাপ কফির কথা বললেন।
কাঠমুন্ডু থেকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। দীর্ঘ একটা ভ্রমন পড়ে আছে সামনে। বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরকে সঙ্গি করবেন কি না বুঝতে পারছেন না। দুজনকেই ভালো লেগেছে, কিন্তু এতো দলবল নিয়ে রওনা দিতে ইচ্ছে করছে না। এখন পর্যন্ত বিনোদ চোপড়াকেই সাথে নেবেন বলে ঠিক করেছেন, কিন্তু যজ্ঞেশ্বর মনে হয়ে মন খারাপ করবে এতে। গত কয়েকদিন একসাথে থেকে লোকটার ছেলেমানুষীকে ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি।
কফি খেতে খেতে বারে আগত পর্যটকদের দেখে নিচ্ছেন তিনি। নেপালি, ভারতীয়, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, মঙ্গোলীয় সব ধরনের মানুষ দেখা যাচ্ছে এখানে।
স্থানীয় কোন লোক পেলে ভালো হতো, গাইড হিসেবে কাজে লাগানো যেতো। এখানকার শেরপা জনগোষ্ঠি হিমালয়ের চূড়াগুলোয় উঠার ক্ষেত্রে পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়া সাধারন নেপালিদের মাঝ থেকে গাইড পাওয়া কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু লোকজনের সংখ্যা তাতে বেড়ে যাবে, আপাতত এই ঝুঁকি নেয়া যাবে না।
কফি শেষ করে বেরিয়ে এলেন বার থেকে। ঠান্ডা কনকনে হাওয়া আসছে উত্তর থেকে। বিনোদ চোপড়াকে পাশে নিয়ে হাঁটছেন, কোন কথা বলছেন না বিনোদ, যে কোন কারনেই হোক, বোঝা যাচ্ছে বেশ চিন্তিত।
‘কি ভাবছেন?’
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিনোদ চোপড়া, তাকাল।
‘কিছু ভাবছি না, মানে… আসলে মনে হচ্ছে এভাবে আমি আপনার সাথে থেকে গেলাম, কি কারনে?’
‘কি কারনে?’
‘আমি নিজেও জানি না, হাসল বিনোদ, মনে হচ্ছে সামনে দারুন কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।‘
‘আমারও তাই ধারনা।‘
হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের সামনে চলে এলো দুজন।
‘আমাদের একটু সাবধান থাকা উচিত,’ যজ্ঞেশ্বর বলছিল, ‘হঠাৎ বলল বিনোদ চোপড়া।‘
‘সাবধান? আমরা তো সাবধানে আছিই?’
‘তা আছি, কিন্তু যজ্ঞেশ্বরের ধারনা আপনার উপর কোন হামলা হতে পারে,’ বলল বিনোদ চোপড়া, ‘উনার কথা আমি ঠিক বুঝিনি।‘
‘আমিও না,’ বললেন তিনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ইদানিং কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, মনে হয় দূর থেকে কেউ যেন তাকে দেখছে। কেউ যেন তাকে বলছে সাবধানে থাকার জন্য, কেউ একজন আসছে তার সাথে মোকাবেলা করার জন্য। আদৌ কি সেটা সম্ভব? প্রকৃতি এক ভুল বারবার করে না। তেমন কেউ কি আছে যে তার কোন ক্ষতি করতে পারবে? অনেকগুলো প্রশ্ন কিন্তু উত্তর নেই কোন।
‘আপনি ভাববেন না, বিনোদ চোপড়াকে বললেন তিনি। আমি জানি কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না।’
হোটেলে ঢুকে যে যার রুমে চলে গেল।
সারারাত জানালার পাশে জেগে রইল বিনোদ চোপড়া, ঘুম আসছে না, মাথায় রাজ্যের চিন্তা। সারাজীবন অর্থের পেছনে ছুটেছে সে, পরিবার পরিজনকে সময় দেয়া হয়নি,নিরাপদ কোন জীবনও পায়নি। সাম্ভালা যদি সত্যি থেকে থাকে তাহলে সেই বিশেষ জায়গাটা দেখার এবং সেখানে থেকে যাওয়ার গোপন একটা ইচ্ছা মনে মনে ধারন করছে বিনোদ। ইউরোপে তার পরিচয় বিশিষ্ট অ্যান্টিক চোর, কোন কিছুর পেছনে লাগলে তা আদায় না করে ছাড়ে না। এবার অবশ্য তার ব্যতিক্রম হচ্ছে।
যে উদ্দেশ্যে ভারতে আসা তা বাদ দিয়ে সে এখন লখানিয়া সিংয়ের পেছন পেছন ঘুরছে। লোকটার আত্মবিশ্বাস দেখেও বেশ অবাক হয়েছে। এতোটা আত্মবিশ্বাস খুব কম মানুষের ভেতরই দেখা যায়। এতো রহস্যময় মানুষ জীবনে খুব কম চোখে পড়েছে। হয়তো আর চোখে পড়বেও না।
*
অধ্যায় ৪৭
কিছুই ভালো লাগছিল না রাশেদের। মনে হচ্ছে কিছু অসুস্থ মানুষের পালণ্ডায় পড়েছে। যাদের হাত থেকে সহজে মুক্তি নেই। বিনা পরিশ্রমে কিংবা শটকার্টে অর্থ উপার্জনের জন্য প্রয়োজনে অন্য একজনের জীবন নিতেও দ্বিধা নেই এই লোকগুলোর।
পার্চমেন্ট কাগজটা গতরাতে বেশ ভালো করে দেখেছে রাশেদ। তিবাওয়ের সম্পদের যে পরিমান সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা টাকার অংকে অবিশ্বাস্য, কাজেই লরেন্স আর সঞ্জয়ের মতো তোক যে পাগল হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পার্চমেন্টে আঁকা নক্সাটাই সব গুলিয়ে দিয়েছে। এই পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ তিনটা পাহাড় খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল, নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্নে পাহাড়গুলোর অবস্থান।
হয়তো লরেন্স জানে পাহাড়গুলোর অবস্থান, হয়তো খুব আশপাশেই এর অবস্থা, হাতের তালুর মতো এই এলাকা তার পরিচিত, সঞ্জয়ের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ন লরেন্স।
এঞ্জেলকে বন্দী অবস্থায় দেখেও লরেন্সের চেহারায় তেমন কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। যা খুশি করতে পারো এমন একটা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে দূরের কোন এক পাহাড়ের দিকে। ব্যাপারটা সঞ্জয়ও লক্ষ্য করেছে, কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে। লরেন্সের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য হয়তো এঞ্জেলের গালে পরপর তিনটি ঘুষি মারল। এঞ্জেলের বয়স হয়েছে, সঞ্জয়ের শক্ত হাতের ঘুষিতে তার দাঁত ভেঙে যাওয়ার কথা, ভাবল রাশেদ। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি,অল্প কিছু রক্ত ঝরেছে শুধু।
‘তুই যদি কথা বলতে শুরু না করিস,’ হুমকি দিয়ে বলল সঞ্জয়, ‘তোর চাচার একটা একটা করে হাত-পা ভাঙবো, আশা করি খুব একটা খারাপ লাগবে না তোর।‘
‘কাপুরুষের মতো বুড়ো মানুষটার পেছনে লেগেছিস কেন?’ অনেকক্ষন পর উত্তর দিলো লরেন্স, চারপাশে তাকাল, ‘যা করার আমাকে কর।’
উত্তরে হাসল সঞ্জয়, যেন এমন মজার কথা অনেক দিন শোনেনি। ‘তোকে কিছু কার থাকলে তো করেই ফেলতাম, শুধু শুধু বাঁচিয়ে রেখেছি নাকি।‘
আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, অনেকক্ষন ধরেই সূর্যের দেখা নেই। এখন ঠান্ডা বাতাসও বইছে।
‘ঠিক আছে, তোর কথামতোই কাজ হবে, লরেন্স বলল, এঞ্জেল আর ছেলে দুটোকে ছেড়ে দিবি এই শর্তে যাবো আমি।’
‘শর্ত দেয়ার মতো কোন পরিস্থিতি নেই তোর, তাই না?’ সঞ্জয় বলল, ‘তারপরও তোর এই শর্ত আমি মেনে নিলাম।‘
দলের সবাইকে তৈরি হতে বলল সঞ্জয়। লরেন্স, এঞ্জেল, রাশেদ আর রাজুকে মাঝখানে রেখে এগিয়ে চলছে দলটা। পেছনে আছে সঞ্জয়ে, হাতে পার্চমেন্ট নিয়ে।
লরেন্সের কথামতো এগিয়ে চলছে দলটা, পাহাড় শুরু হয়ে গেছে, সামনে একের পর এক পাহাড় দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল রাশেদের, একটু থামলেই অটোমেটিকের বাট দিয়ে গুতো দিচ্ছে সঞ্জয়ের পাহারাদাররা। তাই থেমে যাওয়ার উপায় নেই। মাঝে মাঝে রাজুর দিকে তাকাচ্ছে রাশেদ, একেবারে নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে ছেলেটাকে। গত কিছুদিন দাড়িগোঁফ না কামিয়ে একেবারে সন্ন্যাসীর মতো চেহারা হয়ে গেছে।
লরেন্স হাঁটছে নিজের মতো করে, বারবার মনে মনে হিসেব করে নিচ্ছে কোন দিক দিয়ে এগুবে। এখানকার পাহাড়গুলোর উচ্চতা খুব বেশি নয়, কিন্তু প্রতিটাই খুব ঘন জঙ্গলে আবৃত। এখন একটা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উপরে উঠছে দলটা। আর অল্প কিছু দূর উঠলেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে যাবে।
চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে এই দুপুরবেলায়, তাই কাছের পাহাড়টাকেও মনে হচ্ছে কুয়াশায় ঢাকা কোন রহস্যময় দেশের মতো।
লরেন্সের দিকে তাকাল রাশেদ, কোন সংকেত দেয় কি না দেখার জন্য। কিন্তু লরেন্সকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিবাওয়ের সম্পদের খোঁজ বের করতে যাচ্ছে সে। সেই সম্পদ যার হাতেই পড়ুক না কেন তা বের না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
যতো সময় যাচ্ছে ততো বিপদ বাড়ছে, তিবাওয়ের গুপ্তধন যদি সত্যি সত্যি পাওয়া যায় তাহলে তাদের চারজনের মৃত্যু অনিবার্য। সঞ্জয় কখনোই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে না, ব্যাপারটা বুঝেও লরেন্স কেন এমন আচরন করছে বুঝতে পারছে না রাশেদ।
বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে, শীতের শুরুতে আবহাওয়ার এই ধরনের আচরন একেবারেই বেখাপ্পা, মনে হচ্ছে বৃষ্টি শুরু হবে যে কোন সময়। এমনিতেই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত রাশেদ, তার উপর এই বৃষ্টি শুরু হলে দূর্ভোগের মাত্রাটা আরো বাড়বে।
আশপাশে অন্য কোন মানুষজন দেখা যায়নি,হয়তো এই গহীন অঞ্চলে কেউ আসে। তারপরও রাশেদের মনে হলো কেউ যেন দেখছে তাদের। তাদের হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ ছাড়া অন্য কোন শব্দ শোনা যায়নি,কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে নজর রাখা হচ্ছে তাদের উপর।
একটা ঢালে গিয়ে থামল দলটা, লরেন্সের ইশারায়। সঞ্জয় এগিয়ে গেল সামনে।
‘কি? এখানে থামলি কেন?’ জিজ্ঞেস করলো সঞ্জয়।
‘আমাদের সবার একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না, লরেন্স বলল, আমার সাথে কিছু লোক দে, উপরে উঠে চারপাশটা দেখে আসি।’
‘তোর মতলবটা কি?’
‘পালাবো না, এটা বলতে পারি, অন্তত এঞ্জেল যতোক্ষন তোর হাতে আছে,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল লরেন্স।
‘উপরে উঠে কি করবি?’
‘উপর থেকেই পাহাড়গুলোর অবস্থান বের করার চেষ্টা করতে হবে, আজ সুৰ্য্য উঠলে ভালো হতো, তাহলে অনেক পরিস্কার ধারনা পাওয়া যেতো, কিন্তু সে কথা তোকে কে বোঝাবে।‘
‘এতো বোঝার দরকারও নেই, পাঁচজনকে দিচ্ছি সাথে, একটু উলটাপালটা করবি তোর চাচা আর এই দুই ছোঁড়ার পেট গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেবো।‘
উত্তর দিলো না লরেন্স। পাঁচজনের একটা দল লরেন্সের সাথে দিলো সঞ্জয়। লরেন্সের চারপাশ ঘিরে আছে ওরা, নির্দেশ দেয়া আছে একটু এদিক-সেদিক দেখলেই গুলি করতে যেন দেরি না করে।
নীচে দাঁড়িয়ে রইল বাকিরা, পাঁচজনের দলটা নিয়ে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে লরেন্স। ঠান্ডা বাতাসের জোর বাড়ছে ক্রমে। আকাশ আরো অন্ধকার হয়ে এসেছে।
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা নেমে এলো এই সময়।
.
দুই দিন আগে, ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকা
ঢাকা থেকে রংপুর, তারপর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসেছে মিচনার। রাতের অন্ধকারে একদল চোরাকারবারির সাথে সীমানা পাড়ি দিয়ে এপারে চলে এসেছে। কাজটা ঝুঁকিপূর্ন, সীমান্তরক্ষীদের হাতে অল্পের জন্য ধরা পড়েনি। আগেরবারের মতোই টাকা জোগাড় করে নিয়েছে। বাসে, টেম্পোতে করে চলাচল করছে, হেঁটে সারাদেশ ভ্রমন করার ইচ্ছে নেই, তাতে সময় নষ্ট। এছাড়া যতো দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে শিকারের ততো বেশি কাছে এসে পড়ছে সে। এই মনে হওয়াটাই আসল, পুরোপুরি এর উপর ভিত্তি করেই এতোদূর এসেছে।
নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে মিচনার। স্থানীয় একটা হোটেলে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। ছোট শহর, প্রতিদিন হাজার হাজার ভারতীয় আর নেপালি এখানে আসছে আর যাচ্ছে। সাধারনত সুনাউলি শহরের চেক পোস্ট দিয়েই লোকজন আসা-যাওয়া করে, কিন্তু মিনারের জন্য ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে। তার কাছে কোন পাসপোর্ট নেই, সে কোন দেশের নাগরিক নয়।
বাংলাদেশ থেকে যেভাবে রাতের অন্ধকারে ভারতে চলে এসেছিল ঠিক সেভাবেই নেপালে ঢুকতে হবে। এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আগের দিনগুলোর কথা ভাবছিল মিচনার। কোন ধরনের পাসপোর্ট বা কাগজপত্রের প্রয়োজন পড়েনি তার কোনদিন। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে, কাগজপত্র করে রাখা দরকার। টাকা দিলে সবই সম্ভব, সকালে সেই চেষ্টাই করতে হবে, যদি পাসপোর্টের কোন ব্যবস্থা করা যায় তো ভালো, নইলে আগামী রাতে সীমান্ত পার হবে সে।
বাতি নিভিয়ে দিলো মিচনার। গত কয়েকদিন টানা ভ্রমনের উপর আছে, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে কিছুক্ষন পর।
***
ড. আরেফিন ঘুমাননি এখনো, মিটিং শেষ করে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। বেশ কিছুদিন আগে রাশেদের একটা মেইল পেয়েছিলেন, খুলে দেখা হয়নি। ক্লিক করে খুললেন মেইলটা। ছেলেটা এখনো তাকে মনে রেখেছে দেখে ভালো লাগল। ওকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হয়।
মেইলে শুধু লেখা ‘আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন, ঢাকা কবে আসবেন জানাবেন, দয়া করে।‘
চিন্তিত মুখে ল্যাপটপ বন্ধ করে জানালার সামনে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। বিশেষ প্রয়োজন? বুঝতে পারছেন না, হঠাৎ এমন কি প্রয়োজন পড়তে পারে রাশেদের!
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, দরজায় টোকা পড়ল এই সময়।
‘কে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘আমি সন্দীপ।’
‘এতো রাতে?’
‘আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।’
‘আসছি।’
দরজা খুলে দিলেন ড. আরেফিন। সন্দীপ দাঁড়িয়ে আছে, পাশে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা।
দুজনকে ঢুকতে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন ড. আরেফিন।
বুঝতে পারছেন না সন্দীপের সাথে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালার কি কাজ থাকতে পারে। লোকটাকে কখনোই বিশ্বাসী মনে হয়নি,মনে হয়েছে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে
এসেছে, কাজ শেষ হলে সরে পড়বে।
‘বসুন,’ সন্দীপকে চেয়ার দেখিয়ে বললেন ড. আরেফিন, সুরেশও বসল পাশের চেয়ারটায়।
‘কি ব্যাপার, এতো রাতে?’
‘আমরা আসলে খুব বিপদের মধ্যে আছি ড. আরেফিন,’ সন্দীপ বলল।
‘হমম, প্রফেসরও আমাকে একই কথা বলেছিলেন, ঘটনা খুলে বলুন সন্দীপসাহেব।’
‘চীন সরকার আমাদের উদ্দেশ্য জানে, তারা কোনভাবেই চায় না আমরা সাম্ভালা খুঁজে বের করি,’ সন্দীপ বলল। এমনিতে আমাদের ভিসা দিতে আপত্তি করেনি,কারন সরকারি পর্যায়ে তারা কোনরকম তিক্ততা চায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাদের বাঁধা দেয়ার সবরকম প্রস্তুতি সেরে রেখেছে।‘
‘দেখুন, ড. কারসন হচ্ছেন আমাদের দলনেতা, এসব কথা আপনারা তাকেই বলতে পারেন,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু ড. কারসনের সাথে আমার খুব একটা ভালো জমছে, আমি বললে তিনি হয়তো উড়িয়ে দেবেন। আপনি উনাকে বলবেন, কিন্তু একটা ব্যাপার গোপন রাখতে হবে তার কাছ থেকেও।‘
‘কোন কথাটা?’
‘সুরেশের ব্যাপারটা।‘
‘সুরেশের আবার কোন ব্যাপার গোপন রাখতে হবে,’ বললেন ড. আরেফিন, ‘আমি কিন্তু বেশ কনফিউজড।’
‘ব্যাপারটা শুধু আমি জানতাম, এখন আপনাকে জানানোও ঠিক মনে করছি, সন্দীপ বলল, ‘সুরেশ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোক, মূলত আমাদের নিরাপত্তা আর এই অভিযানে ভারতের স্বার্থরক্ষার কাজে তাকে দেয়া হয়েছে।’
‘ড. কারসন এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না?’
‘না। সুরেশকে খুব নিপুনভাবে ঢোকানো হয়েছে এই অভিযানে। তিনি কিছু বুঝতে পারেননি।‘
বেশ অবাক হয়ে সুরেশের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। এতোদিন যেভাবে দেখেছেন লোকটাকে তাতে মনে হয়েছে একেবারে অভদ্র একটা মানুষ এই সুরেশ। ভালো পরিবার কিংবা সমাজে মেশার সুযোগ পায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে ধারনা একেবারে ভুল। এর কৃতিত্ব পুরোটাই সুরেশের, তার অভিনয়ও চমৎকার ছিল। ‘তাহলে ওর নাম নিশ্চয়ই সুরেশ না, তাই না?’ বললেন ড. আরেফিন।
‘আমার আসল নাম জানার প্রয়োজন নেই ড. আরেফিন,’ মুখ খুলল এবার সুরেশ। আপনাদের কাছে আমি সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা।
‘ওর কারনেই কিছুক্ষন আগে অপহৃত হতে হতে বেঁচে গেছি আমি, নইলে এক চায়নীজ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।‘
‘প্রফেসর সুব্রামানিয়ামও একজন চায়নীজের কথা বলছিল।’
‘হয়তো একই লোক,’ সন্দীপ বলল, ‘প্রফেসরকেও সুরেশের আসল পরিচয়ের কথা বলার দরকার নেই। শুধু নিশ্চয়তা দেবেন ভয়ের কিছু নেই। কি বলেন আপনি?’
সুরেশের দিকে তাকিয়ে বলল সন্দীপ। হাসল সুরেশ, তার হাতে কালো একটা ব্যাগ ছিল যা এতোক্ষন চোখে পড়েনি। ব্যাগ খুলে ছোট টেবিলের উপর রাখল। ভেতরটা কালো কুচকুচে, তাই জিনিসগুলো প্রথমে চোখে পড়েনি ড. আরেফিনের, দুটো পিস্তল পাশাপাশি সাজানো।
‘এগুলো দিয়ে কি হবে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘আপনাদের নিরাপত্তার জন্য, ড. কারসন আর প্রফেসরের জন্য আমি আছি,’ সুরেশ বলল।
পিস্তল বের করে হাতে নিলেন ড. আরেফিন, এই ধরনের জিনিস আগে কখনো ব্যবহার করেননি,তার বাসায় যেটা আছে তার চেয়ে অনেক আধুনিক মনে হচ্ছে। জিনিসটাকে। রেখে দিলেন আবার জায়গামতো। ছোট এক বাক্স বুলেটও আছে ব্যাগে। সুরেশ নিজের হাতে পিস্তল দুটো লোড করে দিলো।
‘চালাতে পারেন তো?’ জিজ্ঞেস করল সুরেশ।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল সন্দীপ, দেখাদেখি তাই করলেন ড. আরেফিন।
‘কাল ভোরে রওনা দেবো আমরা,’ সুরেশ বলল, ‘সব সময় বিপদের আশংকা থাকবে, তাই সাবধান।‘
সন্দীপ আর সুরেশকে বিদায় দিলেন কিছুক্ষন পরেই। সুরেশের নতুন পরিচয় যথেষ্ট অবাক করেছে তাকে, সামনে অবাক করার মতো আরো অনেক কিছুই হয়তো ঘটবে। তার জন্য প্রস্তুত তিনি। পিস্তলটা সাইড টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লেন তিনি। ভোরে উঠতে হবে।
*
অধ্যায় ৪৮
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিটতে কাঁপ ধরে যাচ্ছিল। কিন্তু তারমধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে সবাই, রাশেদ আর রাজু আছে পাশাপাশি। লরেন্স উপরে গেছে অনেকক্ষন হলো। এখনো নামেনি। দাঁড়িয়ে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। আশপাশে অনেক গাছ আছে, সেগুলোর নীচে দাঁড়ালে হয়, কিন্তু সঞ্জয়ের নির্দেশ ছাড়া এক পা নড়ার সাহস নেই কারো।
রাজুর অবস্থা আরো ভয়াবহ। চোখ লাল হয়ে আছে, লম্বা চুল আর দাঁড়িতে চেহারাটা বিদঘুঁটে দেখাচ্ছে। এতোক্ষন একসাথে থাকলেও আর কোন কথা বলেনি রাজু। ওর আচরন স্বাভাবিক নয়, ভাবছে রাশেদ। ঢাকায় যেতে পারলে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে।
সঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। তার মাথায় ছাতা ধরে আছে একজন। পার্চমেন্টটা হাতে ধরে রেখেছে সঞ্জয়। বৃষ্টির ছোঁয়া থেকে বাঁচানোর জন্য শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে চেয়েও রাখল না। অস্থির হয়ে আছে, অনেকক্ষন হয়ে গেছে। লরেন্সের কোন খবর নেই। নিজের দলের লোকদেরও কোন খবর নেই। এখানে ওয়ারলেস সেট ব্যবহার করা বিপজ্জনক, বাংলাদেশ বা মায়ানমার আর্মি এখানকার যেকোন ফ্রিকোয়েন্সি ধরে ফেলতে পারে। তাই ওয়ারলেস সেট ব্যবহার করে না সঞ্জয়। আর দলের লোকগুলোও সব বেছে বেছে নেয়া, যে কোন পরিস্থিতিতে হার মানার লোক নয় ওরা। তাই দেরি হলেও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঞ্জয়। যে কোন সময় ওরা নীচে নেমে আসবে।
***
সকাল সকাল রওনা দিয়েছে দলটা। এবার বড় একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে সুরেশ। নেপালি ড্রাইভার তার পূর্ব পরিচিত। বয়স হলেও হাত একেবারে পাকা। পাহাড়ি রাস্তায় এই ধরনের অভিজ্ঞ ড্রাইভারই প্রয়োজন। আগে কোন এক ট্যুর কোম্পানীতে চাকরি করতো, কাঠমুন্ডু থেকে কৈলাসে যাবার পথ খুব ভালো করে চেনা।
গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু টিপস দিয়েছে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা। সামনে যতো যাওয়া হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ততো বাড়বে, এর সাথে খাপ খাওয়াতে হলে প্রচুর পানি খেতে হবে, সেই সাথে সময় সুযোগ মতো হাল্কা ব্যায়ামও করতে হবে। বাকি সবার জন্য কথাগুলো সাধারন হলে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়তে দেখলেন ড. আরেফিন। বেচারা কায়িক শ্রমকে খুব ভয় পায়।
যে রুটে গাড়ি চলছে তা অতি পরিচিত একটা রুট। স্থলপথে যারা তিব্বত কিংবা কৈলাস আর মানস সরোবর দেখতে যায় তারা এই পথটাই ব্যবহার করে। কাঠমুন্ডু শহর ছেড়ে বেরিয়ে হাইওয়েতে চলে এসেছে গাড়ি। ড. কারসন ঘুমিয়ে নিচ্ছেন, সন্দীপ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। ড. আরেফিনও তাকিয়ে আছেন, এতো চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। চারপাশে সবুজ আর সাদার এক অদ্ভুত সংমিশ্রন। দক্ষিনে হিমালয়ের পর্বতগুলো দেখা যাচ্ছে, আট হাজার মিটার উঁচু।
প্রফেসর ঘুমানোর চেষ্টা করছেন, ঘুম আসছে না তার। সামনের প্রতিকূল দিনগুলোর কথাই হয়তো ভাবছেন। পেছনের সীটে রামহরি তাকিয়ে আছে তার মনিবের দিকে। বুঝতে পারছে বেশ টেনশনে আছে তার মনিব।
সুরেশ সামনের সীটে বসে গুনগুন করে গান গাইছে। দেখে মনে হবে খুব আনন্দে আছে, পিকনিকে যাচ্ছে বন্ধুবান্ধবদের সাথে। কিন্তু একই সাথে এক জোড়া সতর্ক চোখও আছে তার। ছোটখাট কোন ব্যাপারই তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। গতরাতে যে লোকটা সন্দীপকে তুলে নিতে চেয়েছিল ওরা নিশ্চয়ই সহজে ছেড়ে দেবে না, এমনকি প্রফেসর সুব্রামানিয়ামকেও হুমকি দিয়ে গেছে। কোমরে গোঁজা অটোমেটিক রিভলবারের অবস্থা মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে। যে কোন সময় এর প্রয়োজন হতে পারে।
কাঠমুন্ডু থেকে প্রথমে যেতে হবে ঝাংমুতে, তিব্বতের ছোট সীমান্তবর্তি শহর, এখানে কাস্টমস পার হতে হবে তাদের। পাঁচ ঘন্টার মতো লাগবে ঝাংমুতে যেতে। সেখান থেকে যেতে হবে সাগা, সাগা থেকে পাইরাং তারপর মানস সরোবর এবং কৈলাস পর্বত। চারদিন সময় লাগবে কৈলাস পর্যন্ত যেতে। লাসায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে সুরেশের, কিন্তু মানস সরোবর দেখা হয়নি। জায়গাটা তার জন্য তীর্থভূমি, এমনকি সফরের বাকি ভারতীয়দের জন্যও।
সাধারন গতিতে চালাচ্ছে ড্রাইভার, তাকে এভাবেই চালাতে বলে রেখেছেন ড. কারসন। রেডিওতে খবর হচ্ছিল, আবহাওয়া বার্তা শুরু হওয়ার সময় কান পাতলেন ড. আরেফিন। সামনে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হতে পারে। নেপালের এই অংশে হাল্কা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে, সেই সাথে তুষারপাতেরও সম্ভাবনা আছে।
ব্যাপারটা চিন্তার হলেও করার কিছু নেই, প্রয়োজনে অপেক্ষা করতে হবে আবহাওয়া ঠিক না হওয়া পর্যন্ত। সুরেশের দিকে তাকালেন, অতি পরিচিত একটা গানের সুর তুলছে শিস দিয়ে। অদ্ভুত চরিত্র, সত্যিকারের পেশা আড়াল রাখতে সফল একজন মানুষ বলা যায়। কে বলবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস একজন অফিসার সে।
ঘুম আসছিল, এড়ানোর চেষ্টা করছিলেন এতোক্ষন, কিন্তু এই অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সময় কাটানোর জন্য জানালার বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীতে মনোযোগ দিলেন ড. আরেফিন। টানা চার ঘন্টা ধরে চলছে গাড়ি, ঝাংমু আর বেশি দূরে নেই।
হঠাৎ মনে হলো গাড়ির গতি কমে আসছে। প্রশ্নবোধক চোখে সুরেশের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন, সন্দীপও টের পেয়েছে।
‘চিন্তার কিছু নেই, সামনের রাস্তাটা অনেক আঁকাবাঁকা,’ সুরেশ বলল ইংরেজিতে, ‘তাই গতি কমাচ্ছে ড্রাইভার।‘
দুজনই অশ্বস্ত হলো সুরেশের ব্যাখ্যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন ড. আরেফিন, সন্দীপও তাই করল। সুরেশ আবার গানে ফিরে যাচ্ছিল, হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে পেছনে একটার গাড়ির উপর চোখ আটকে গেল তার। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে গত রাতের নাকবোচা চায়নীজটা, মুখে ব্যান্ডেজ। এবার সে একা নয়, সাথে আরো কয়েকজন আছে মনে হলো।
ড্রাইভারকে ইশারা করলো সুরেশ গতি বাড়ানোর জন্য। আচমকা গতি বাড়ানোতে আবার সুরেশের দিকে তাকাল জেগে থাকা দুই যাত্রী।
‘লেজ খসাতে হবে স্যার, গম্ভীর গলায় বলল সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা, আপনারা তৈরি থাকুন।‘
*
অধ্যায় ৪৯
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে এসেছেন তিনি। এই ট্যাক্সি করে যেতে হবে তিব্বতে সীমান্তের কাছাকাছি ঝাংমু নামক জায়গায়। সেখানে সীমান্ত পার হয়ে সিগটসে অথবা সরাসরি মানস সরোবরের দিকে যাওয়া যাবে। যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি,তাই নিজের রুমে বসে কিভাবে কি করবেন তার একটা হিসেব করে নিচ্ছেন।
রোদ উঠেনি এখনো, আজকের দিনটা হয়তো মেঘলাই থাকবে। যজ্ঞেশ্বরের জন্য চামড়ার জ্যাকেট কিনেছেন গতরাতে, পড়বে কি না কে জানে। বিনোদ চোপড়াকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, ব্যাগভর্তি কাপড়-চোপড় আছে তার।
দরজায় টোকা শুনে কিছুটা অবাক হলেন, দরজা খুলে অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরো বাড়লো। যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ দুজনেই তৈরি বাইরে যাওয়ার জন্য। বিনোদের কাছ থেকে সুয়েটার আর মাফলার নিয়ে পড়েছে যজ্ঞেশ্বর, নিচে এখনো ধুতি। কিম্ভুতকিমাকার দেখা যাচ্ছে লোকটাকে।
হেসে দুজনকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন।
‘আমরা দুজনই তৈরি, আপনি?’
‘আমিও তৈরি।’
‘তাহলে বেরিয়ে পড়া যাক, প্রস্তাব দিলো যজ্ঞেশ্বর।’
‘আপনি সন্ন্যাসী মানুষ, আপনি কি এগুলো পারবেন?’
‘সন্ন্যাসী হয়েছি তো কি হয়েছে, পারবো।‘
‘লোকে বলে আপনার বয়স পাঁচশো বছর, এই বয়সে এতো ধকল নেয়া ঠিক হবে আপনার?’
হো হো করে হেসে উঠলো যজ্ঞেশ্বর।
‘এইসব কথা নিজেই ছড়াই, অশিক্ষিত লোকজনকে কাবু করতে হলে এসব ছাড়া উপায় নেই, বয়স কিন্তু আমার পঞ্চাশও হয়নি।‘
‘তাহলে চলুন, কিন্তু একটা কথা…’
‘কি কথা?’ দুজনেই বলে উঠল।
‘আমার কথার বাইরে কিছু করতে পারবেন না।’
‘ঠিক আছে, যথা আজ্ঞা।‘
বেরিয়ে পড়লেন তিনি রুম থেকে। পেছনে যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ। নীচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল।
রোদ উঠেছে তখন। আবার এক যাত্রা শুরু হলো।
***
মোটামুটি প্রায় আঠারোজনের একটা দল, রাশেদ, রাজু আর এঞ্জেলকে বাদ দিলে। সবার অবস্থা জুবুথুবু। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বিরক্তিতে বারবার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। সঞ্জয়। প্রায় ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেছে, এততক্ষনে লরেন্সদের চলে আসার কথা। অপেক্ষা করতে তার কোন কালেই ভালো লাগে না। এই মুহূর্তে তার বিরক্তি সীমা ছাড়িয়ে গেছে, যে কয়টাকে লরেন্সের সাথে পাঠানো হয়েছে নেমে আসা মাত্র ওদের গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেবে বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে সে।
রাশেদও কাঁপছিল, অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে। বৃষ্টির পানি এতো ঠান্ডা মনে হচ্ছে যেন বরফের টুকরো ভেঙে পড়ছে আকাশ থেকে। লরেন্স এতোক্ষনে নেমে আসছে না দেখে কিছুটা বিরক্ত লাগছে। কি এতো কাজ উপরে? আজ কোনভাবেই কাজ এগুবে না সেটা সঞ্জয়কে বুঝিয়ে বললেও হতো। তাহলে অন্তত এই বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় এলো কথাটা। রাজুর দিকে তাকাল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও রাজু তাকিয়ে আছে অন্যদিকে, কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। এঞ্জেল দাঁড়িয়ে আছে ডান দিকে, চারপাশে ঘেরাও হয়ে। হয়তো বিপদের আশংকা করছে সঞ্জয়। তাই যে লোকগুলো দূরে দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরও দেখা যাচ্ছে কাছাকাছি। এসে দাঁড়াতে।
লরেন্স কি করছে এতোক্ষন? মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে, জলদস্যুর গুপ্তধনে তার কোন আগ্রহ নেই, রাজুকে সাথে নিয়ে ফিরে যেতে পারলেই তার কাজ শেষ।
তার পাশের একজনকে হঠাৎ পড়ে যেতে দেখল রাজু, বুকে হাত দিয়ে, সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। যা ভেবেছিল একটু আগে সেটাই বোধহয় ঘটতে যাচ্ছে। রাজুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাশেদ। মাটিতে শুয়ে পড়ল দুজনেই পরমুহূর্তে। গুলি শুরু হয়ে গেছে।
উপর থেকে ঝাঁক ঝাঁক গুলি আসছে, বশির মতো। সঞ্জয়ের লোকেরাও গুলি করছে, এলোপাথারি, গুলি ঠিক কোনদিক দিয়ে আসছে বুঝতে পারছে না তারা। একের পর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে সঞ্জয়ের দলের লোকগুলো। আচমকা আক্রমনে আসলে সবাই ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
হামাগুড়ি দিয়ে একটা গাছের আড়ালে চলে গেল রাশেদ, রাজুকে সাথে নিয়ে। চোখের কোনা দিয়ে দেখল এঞ্জেলও হামাগুড়ি দিয়ে তাদের দিকেই আসছে।
একপাশে ঢাল, অন্য দিকে সঞ্জয়ের দল। গাছের আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ। রাজুকে সামলাতে সমস্যা হচ্ছে, বারবার বাঁধন কেটে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। একবার ঐ গোলাগুলির মধ্যে পড়লে সব শেষ, তাই শরীরের সব শক্তি দিয়ে হলেও রাজুকে ধরে রেখেছে রাশেদ।
উপরের দিকে তাকাল রাশেদ। কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গুলি একদিক থেকে আসছে না এটা নিশ্চিত। হয়তো সঙ্গি পেয়েছে লরেন্স, সঞ্জয়ের লোকগুলোকে মেরে ওদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে।
নীচে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল। তার সঙ্গিদের কেউ পাশে নেই, সম্ভবত এর মধ্যেই গুলি খেয়েছে। একটা গাছের আড়াল নিয়েছে সঞ্জয়, হাতে অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে। মাঝে মাঝে অদৃশ্য শক্রর উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ছে। চারপাশে তাকাল রাশেদ, সঞ্জয়ের দলের অনেককেই দেখা যাচ্ছে আহত কিংবা নিহত হয়েছে। দু’একজন এখনো আড়াল থেকে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির তেজ আরো বেড়েছে, সেই সাথে শীতল হাওয়া। অন্ধকার হয়ে এসেছে। চারদিক। বাতাসের গতি বাড়ছে, মনে হচ্ছে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। কোনমতে গাছটা ধরে রেখেছে রাশেদ, ছেড়ে দিলেই এই বাতাস হয়তো উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে, সেই সাথে রাজুকেও। নীচের ঢালের দিকে তাকাল। কতোদূরে শেষ হয়েছে এই ঢাল বোঝা যাচ্ছে না। একবার পড়া শুরু করলে থামবে না।
এরমধ্যেই হামাগুড়ি দিয়ে এঞ্জেল চলে এসেছে পাশে। বুড়োর মুখ হাসি হাসি, যেন জানতো এরকম কিছু একটা হবে।
গাছের আড়াল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে সঞ্জয়। সঙ্গিদের লাশ দেখছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে সঞ্জয়ের হুংকার কানে এলো রাশেদের, ‘তুই আমাদের সঙ্গিদের মেরেছিস, তোকে আমি ছাড়বো না।‘
একটা গুলি ঠিক সঞ্জয়ের পায়ের কাছে মাটি তুলে নিয়ে গেল। কিন্তু এক পা নড়লো না সঞ্জয়।
‘এই নে হারামী, তোর ম্যাপ,’ বলল সঞ্জয়, হাতের ম্যাপটা দুহাতে উপরে তুলে ধরল সে, বৃষ্টির পানিতে এরমধ্যেই ভিজে গেছে জিনিসটা, সঞ্জয় পার্চমেন্ট কাগজটা টেনে দু’ভাগ করে ফেললো, আরো কয়েকবার টুকরো করে বাতাসে ভাসিয়ে দিল, ‘নে তোর পরদাদার ধনসম্পদ, আমি না পেলে তুইও পাবি না।’ বলল সঞ্জয়।
ঠিক তখনি গুলির আওয়াজ পেল রাশেদ, দূরে দাঁড়ানো সঞ্জয়কে দেখল অসহায়ের মতো দুই হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, তারপর দড়াম করে পড়ে গেল কাদামাটিতে।
এঞ্জেলের দিকে তাকাল রাশেদ, বুড়োর চেহারায় কোন ছাপ নেই, যেন বুঝতে পারছে না খুশি হওয়া উচিত না দুঃখ পাওয়া উচিত, কারন সঞ্জয় মরলেও গুপ্তধনের নক্সাটাও নষ্ট করে গেছে।
বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়ছে। পায়ের তলায় হঠাৎ মনে হলো মাটি নেই রাশেদের। রাজুকে সাথে নিয়ে হুড়মুড় করে নীচে পড়তে লাগল সে। এই অঞ্চলের অতি সাধারন ভূমিধ্বস। এছাড়া ক্রমাগত বৃষ্টির পানিতে মাটি আলগা হয়ে গেছে। নামতে নামতে নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করছিল রাশেদ। হঠাৎ মনে হলো থেমে গেছে সবকিছু। চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল, রাজুর শরীরটাও তার শরীরের উপর পড়েছে এটুকু বুঝতে পারছে রাশেদ। আর কিছু বোঝার আগে জ্ঞান হারাল সে।
***
ড. কারসনকে আস্তে করে ধাক্কা দিলেন প্রফেসর স্ট্রামানিয়াম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াতে কিছু বুঝতে পারছিলেন না ড. কারসন। প্রফেসর নিজের মাথা নীচু করে রেখেছেন, রামহরিও। ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন ড. কারসন। বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঠিক নেই।
সুরেশের হাতে পিস্তল দেখে চোখ কপালে উঠার অবস্থা ড. কারসনের। কি হচ্ছে এসব?
সন্দীপের হাতেও পিস্তল দেখতে পেলেন তিনি। সামনে ফাঁকা রাস্তা, ড্রাইভার ঘন্টায় একশো মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না ড. কারসন। এরা কি কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠি? সন্দীপ, সুরেশ? এবার ড. আরেফিনের হাতে পিস্তল দেখে নিজেকে থামাতে পারলেন না ড. কারসন।
‘হচ্ছে কি এসব?’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি।
‘মাথা উঠাবেন না দয়া করে,’ শান্ত গলায় বললেন ড. আরেফিন, যে কোন মুহূর্তে আক্রমন হতে পারে।
‘আক্রমন? কে করবে?’
প্রফেসরের দিকে তাকালেন, কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর, তার কোন ধারনা নেই।
‘আমাদের পেছনে লেগেছে, সম্ভবত চায়নীজ গোয়েন্দা সংস্থার লোক হবে,’ ফিসফিস করে বলল সন্দীপ।
‘কি বলছো এসব!’
‘চুপচাপ থাকুন, দেখা যাক কি হয়, ড. আরেফিন বললেন।
পেছনের গাড়িটার দিকে নজর সবার। গতি বাড়িয়ে কাছাকাছি আসার চেী করছে। আর কিছুদূর গেলেই হয়তো তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে, কিন্তু ততটুকু সময় পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে ছিল সুরেশ, হঠাৎ দেখল কাঁচটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ভয় পেয়েছে বুড়ো ড্রাইভার, সর্বশক্তিতে স্টিয়ারিং ঘোরাল। ভেতরের সবাই একজন আরেকজনের উপর উলটে পড়া থেকে সামলাল কোনমতে। সুরেশ পিস্তল হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে অর্ধেক শরীর বের করে দিয়ে গুলি করা শুরু করেছে। ডান দিকের জানালা বন্ধ ছিল, ড. আরেফিন খুলে ফেললেন জানালাটা, হপিস্তলের নল বের করে ফায়ার করলেন পরপর তিনবার। পেছনের গাড়ীটা থেকেও একের পর এক গুলি হচ্ছে, কিছু কিছু মাইক্রোবাসের চকচকে বডিটা ছেদ করে চলে যাচ্ছে, কিছু লক্ষ্য ভ্রষ্ট হচ্ছে। ড্রাইভারের দিকে চোখ ইশারা করল সুরেশ, বারবার ডানে বামে স্টীয়ারিং ঘোরাচ্ছে ড্রাইভার, যাতে ঠিকমতো টার্গেট ঠিক করতে না পারে হামলাকারিরা।
প্রফেসর ঘামছেন, ড. কারসন মাথা নীচু করে বসে আছেন, আশংকা করছেন যে কোন সময় গুলি লাগতে পারে শরীরে। সন্দীপ পিস্তল হাতে তৈরি, কোন দিক থেকে গুলি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না, তার দু’পাশে ড. কারসন আর প্রফেসর বসা।
সুরেশ একের পর এক গুলি করে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শরীর বের করে দিচ্ছে জানালার বাইরে, পরমুহূর্তেই আবার ভেতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। পেছনের গাড়িও ডান বাম করে সুরেশ গুলি এড়ানোর চেষ্টা করছে।
ড. আরেফিনও মাঝে মাঝে গুলি ছুঁড়ছেন, তেমন লক্ষ্য না করেই।
দুপুর হয়ে গেছে, হাইওয়ে ফাঁকা, দূর দিগন্তে মিশে গেছে, গোলাগুলির শব্দ দূর পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে।
ওরা এবার মেশিনগান বের করেছে, মাইক্রোবাসের পেছনের চাকা ছিদ্র করে ফেলেছে মেশিনগানের গুলিতে। সুরেশের শরীর জানালার বাইরে ছিল, ড্রাইভার হঠাৎ স্টিয়ারিং ঘোরানোতে ভারসাম্য রাখতে পারল না সুরেশ, ছিটকে পড়ে গেল বাইরে। ড. আরেফিন অবাক হয়ে দেখলেন সুরেশের রিফ্লেক্স। মাটিতে পড়েই গড়ান দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে একের পর এক ফায়ার করছে সুরেশ। মেশিনগানধারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে, এরপর টায়ার লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি করে গেল সুরেশ। ওদের গাড়ির সামনের চাকা দুটো ফুটো হয়ে গেছে, তাল সামলাতে না পেরে নাক বোঁচা ড্রাইভার ব্রেক কষেছে। প্রচন্ড গতিতে হঠাৎ ব্রেক কষায় উল্টে গেল গাড়িটা, দুই তিনবার ডিগবাজি খেয়ে হাইওয়ের পাশে পড়ল।
ড. আরেফিনের ইশারায় গতি কমিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার, দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠে বসল সুরেশ। ড. আরেফিনের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল।
‘কোথাও লাগেনি তো?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘না, সমস্যা নেই, দাঁত বের করে বলল সুরেশ। ড্রাইভার জী, স্পেয়ার চাকা আছে না?’
‘আছে,’ ভয়ে ভয়ে বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে জোরে চালান, এক মাইল যেতে পারবেন তো?’
‘পারবো।’
ড. কারসন এবার মাথা তুলেছেন।
‘কি হলো এইসব? তুমি কে?
‘যে অভিযানে বের হয়েছেন, তাতে এরকম বিপদ আরো আসবে, আপনারা প্রস্তুত তো,’ সুরেশ বলল, তাকাল সবার দিকে।
কেউ কিছু বলল না, একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। প্রফেসরের চেহারায় ঘাম দেখা দিয়েছে।
‘প্রস্তুত না হলেও অসুবিধে নেই, বের যখন হয়েছেন সাম্ভালা খুঁজে বের না করে ফিরে যেতে পারবেন না।’
হাসল সুরেশ, প্রানখখালা হাসি।
***
ট্যাক্সির হুড খোলা, তাই বাতাসে যজ্ঞেশ্বরের লম্বা চুল উড়ছিল। পেছনের সীটে বসে আছেন তিনি, অনেকদিন এরকম দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ চোখে পড়েনি যেখানে আকাশ ছোঁয়ার আশায় বড় বড় পর্বত উঠে গেছে। চারপাশে সাদা, মাঝে মাঝে কিছু জায়গা সবুজ, সেখানে যাযাবরেরা তাদের গৃহপালিত পশু চড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে ভেড়া আর ইয়াকের সংখ্যাই বেশি। মাঝে মাঝে যাযাবরদের তাঁবু চোখে পড়ছে, নানা রঙের। বেশ ভালো লাগছে, বিনোদ চোপড়ার দিকে তাকালেন, বুঝতে পারছেন সেও খুব উপভোগ করছে।
দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেছে, সাধারন কাস্টমস পার হয়ে তিব্বতে ঢোকা সম্ভব হবে, ঝাংমুতে পৌঁছানোর আগেই ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে ঢুকতে হবে তিব্বতে। রাতের অন্ধকারে পাড়ি দিতে হবে পাহাড়। নিজেকে নিয়ে কোন সংশয় না থাকলেও যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
সরু রাস্তাটা একেবেকে চলে গেছে অনেক দূরে। এই সময়ে মানস সরোবর কিংবা কৈলাসে যাওয়ার লোকের সংখ্যা একেবারে কম। চারপাশে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখে পড়ল জিনিসটা। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটা মাইক্রোবাস। ট্যাক্সি থামাতে বললেন। বিনোদ আর যজ্ঞেশ্বরকে বসে থাকতে বলে এগিয়ে গেলেন তিনি। জনমানবহীন হাইওয়ের পাশে এভাবে একটা গাড়ি পরে থাকার কথা না এততক্ষন। স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অথবা হাসপাতালে এখনো নিশ্চয়ই খবর পৌঁছেনি। আহত কিংবা নিহত কেউ থাকতে পারে।
গাড়িটা দামি, তবে এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেছে একে আর সহজে ঠিক করা যাবে না, ভাবলেন তিনি। আহত কেউ থাকতে পারে, অথবা বিপদ হয়তো ফাঁদ পেতে আছে সামনে। তাই বেশ দেখেশুনে এগুচ্ছেন তিনি। গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কেউ নেই। সামনের কাঁচটা ভাঙা। ড্রাইভিং সিট আর তার পাশের সিট রক্তে ভেজা। পেছনের সিটগুলোরও একই অবস্থা। এমনভাবে দুমড়ে গেছে এখানে মানুষ থাকলে তাদের বাঁচার কথা না। গাড়িটার আরো সামনে দাঁড়ালেন। এবার পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। এখানে সেখানে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে, বুলেটের চিহ্ন। সামনের টায়ার পরীক্ষা করে দেখলেন। বুলেটের চিহ্ন এখানেও পরিস্কার। সাধারন কোন দূর্ঘটনা নয় এটা, এখানে রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। আশপাশে অনেক খোসা পড়ে আছে বুলেটের। হেঁটে আবার সামনে চলে এলেন।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কিভাবে গাড়িটা এভাবে উল্টে যেতে পারে। রাস্তার পীচ পরীক্ষা করে দেখলেন। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে টায়ারের ছাপ, কিছু কিছু জায়গায় রাবার লেগে আছে। তারমানে আক্রমনকারি গাড়িটা চলে গেছে, কিন্তু সেটার টায়ারে গুলি লেগেছে। খুব বেশি দূর যাওয়ার কথা না।
ট্যাক্সির সামনে চলে এলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ।
‘কি দেখলেন এতে মনোযোগ দিয়ে?’ জিজ্ঞেস করল যজ্ঞেশ্বর।
‘তেমন কিছু না, তবে সাবধানে থাকতে হবে।’
‘আপনি তো আছেন, আমাদের চিন্তা কি,’ হেসে বলল বিনোদ চোপড়া। উত্তর দিলেন না তিনি।
ব্যাপারটা বোঝার চো করছেন। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটার যাত্রীরা কোথায়? কিভাবে গেল? নিশ্চয়ই তাদের উদ্ধার করেছে কেউ না কেউ। এমনও হতে পারে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটাই আক্রমন করেছিল অন্য গাড়িটাকে।
যাই হোক, এ নিয়ে বেশি চিন্তা করে লাভ নেই। এই দুর্ঘটনার সাথে তার কোন যোগসূত্র নেই, কোনভাবেই নেই।
ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। উত্তরের হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ঝাংমুর কাছে পৌঁছে যাবেন। শুরু হবে নতুন এক যাত্রা। জ্যাকেটের ভেতর পকেটে থাকা সাম্ভালার নক্সাটার উপর হাত রাখলেন। তার এই দীর্ঘজীবন অর্থহীন হয়ে যাবে সাম্ভালার খোঁজ না পেলে, যদি সত্যিই এর অস্তিত্ব থেকে থাকে।
যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া হাসছে তার দিকে তাকিয়ে, মজার কিছু হয়তো বলেছে, অন্যমনস্ক থাকায় শুনতে পাননি। তিনিও হাসলেন, বিকেলের শেষ আলোয় অপূর্ব দেখাল সেই হাসি।
*
অধ্যায় ৫০
পাহাড়ের ঢালের মাঝে এমন অদ্ভুত গুহা থাকতে পারে ধারনা ছিল না রাশেদের। উপর থেকে পড়তে পড়তে হঠাৎ এই গুহার ভেতর ঢুকে পড়েছে কিভাবে মনে করতে পারছে না। নড়তে কষ্ট হচ্ছে, তবু ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বৃষ্টির পানি উপর থেকে পড়ছে ঝর্নার মতো। রাজু এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে পাশে। হাত বাড়িয়ে পানি নিয়ে রাজুর মুখে ছিটিয়ে দিল রাশেদ। চোখ পিটপিট করছে রাজু।
উপরে তাদের দুজনের নাম ধরে ডাকছে কেউ। সম্ভবত লরেন্স হবে। কিন্তু সেই ডাকে সাড়া দেয়ার মতো অবস্থা নেই কারো। সারা শরীর কেটে ছড়ে গেছে, হাঁটু আর কনুই থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। পুরোপুরি সন্ধ্যা না হলেও বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। আরো কিছুক্ষন ডাকাডাকি করে ফিরে যাবে ওরা। কিছু করতে হলে এখনই করতে হবে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল রাশেদ, নীচে ঢালু হয়ে গেছে পাহাড়টা, সেখান দিয়ে নামা প্রায় অসম্ভব। রাজু চোখ খুলে তাকিয়েছে মাত্র, বুঝতে পারছে না কোথায় আছে।
মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না, তবু শরীরের সব শান্তিতে চিৎকার করে উঠলো রাশেদ।
‘বাঁচাও, আমরা এখানে।‘
সেই শব্দ উপরে গেছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আবারও চেঁচাল রাশেদ, অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাজু, কি করবে বুঝতে পারছে না।
‘ভয় পেলে চলবে না,’ রাশেদ বলল, ‘এখান থেকে বের হতে হবে যে করেই হোক।’
‘কিভাবে বের হবো?’
‘সেটা আমার উপর ছেড়ে দে,’ রাশেদ বলল।
লরেন্সের ডাক আবার শুনতে পেল রাশেদ। কোন একটা সিগন্যাল দিতে পারলেও হতো, গুহার ভেতর তাকাল, কাদাময় একটা জায়গা।
‘দেখতে তো, পাথর পাস কি না’, রাজুকে বলল রাশেদ।
রাজু নড়তে পারছে না, তারপরও কষ্ট করে কাদাময় জায়গাটায় হাত বুলিয়ে ছোট একটা মাটির ঢেলা বের করে আনল।
‘এটা দিয়ে কি করবি?’
‘দেখি কি করা যায়, হাত বাড়িয়ে মাটির ঢেলাটা নিলো রাশেদ, একটু দূরে লম্বা গাছটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। থপ করে আওয়াজ হলো শুধু, এই বৃষ্টির মধ্যে কান পেতে না থাকলে এই শব্দ শোনা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।
‘একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম,’ রাজু বলল।
‘বলে ফেল।’
‘ওরা চলে যাক, আমরা বের হবো পরে,’ রাজু বলল।
‘কিভাবে বের হবো?’ অবাক হয়ে বলল রাশেদ।
‘সেটা দেখা যাবে। ঐ লোকগুলোর সাথে কোন সম্পর্ক রাখা ঠিক হবে না আমাদের। ওরা সন্ত্রাসী ক্রিমিনাল, কতোগুলো লোককে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলল।‘
‘তা না হলে ওরাই মারা পড়তো, আর গতবার কিন্তু লরেন্সই আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল।’
‘যাই হোক, আমার যা ভালো মনে হলো তাই বললাম,’ রাজু বলল, মুখ কোঁচকাল ব্যথায়।
‘ঠিক আছে,’ বলল রাশেদ, শরীরের যেটুকু অংশ বাইরে ছিল ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল।
ছোট গুহাটার চারপাশে তাকাল। কেন জানি মনে হলো গুহাটা এখানেই শেষ নয়, আরো বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে ঢুকে গেছে ভেতরের দিকে। হামগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল রাশেদ। জায়গাটা অপ্রসস্ত, একজন মানুষও ঠিক মতো যেতে পারবে না সামনের দিকে। দু’পাশের আঠাল কাদাময় দেয়ালের সাথে বারবার আটকে যাচ্ছে শরীর, তবু এগিয়ে গেল রাশেদ। হঠাৎ মনে হলো কোন কিছুতে আটকে গেছে সে, সামনে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, হাত বাড়িয়ে অবলম্বন খুঁজল, কিন্তু… অদ্ভুত একটা কিছু স্পর্শ করেছে তার হাত। ভয় হচ্ছে, কি আছে সামনে বোঝা যাচ্ছে না।
‘রাজু, এদিকে আসবি?’ অনুরোধের সুরে বলল রাশেদ।
‘কি হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না, রাশেদ বলল, নড়াচড়া করতেই অস্বস্তি লাগছে কেন জানি। ‘তুই আমাকে পেছন থেকে টান দে।‘
‘আটকে পড়েছিস নাকি?’
‘কথা বলিস না, যা বলছি তা কর,’ রপশেদ বলল।
পেছনে পা ধরে টানছে রাজু, টের পেল রাশেদ। অনেকটা বেরিয়ে এসেছে, জিন্সের প্যান্টের নীচে কিছু একটা আটকে গেছে যার কারনে বেরুতে পারছেনা।
‘আরো জোরে টান দে,’ রাশেদ বলল, দুই পাশের দেয়াল যেন শক্ত করে আটকে রেখেছে তাকে।
এবার হ্যাঁচকা টান দিয়েছে রাজু, টাল সামলাতে না পেরে রাজুর উপর পড়ে গেল রাশেদ।
‘কী সে আটকে গিয়েছিলি?’ প্রশ্ন করলো রাজু।
‘কি জানি,’ বলল রাশেদ, হাতের মুঠোয় আটকে আছে জিনিসটা, মানুষের হাড়। সম্ভবত পায়ের হাড় হবে। যে জিনিসটার স্পর্শ পেয়েছে তা হয়তো পায়ের মালিকের বাকি অংশ, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোন প্রয়োজনবোধ করছে না সে।
‘এটা কি কবরখানা নাকি?’ ঠাট্টা করে বলল রাজু।
‘বুঝতে পারলাম না,’ রাশেদ বলল, কৌতূহল হলেও গুরুত্ব দিলো না।
মাথায় অনেক কিছু ঘুরছিল, কথায় কথায় লরেন্স বলেছিল গুপ্তধন লুকানোর পর তিবাও নাকি তার সংগীদের সবাইকে মেরে ফেলেছিল, কাজেই এই এলাকার কোথাও বহু পুরানো কোন কংকাল বা এই জাতীয় কিছু পাওয়া গেলে তার আশপাশে গুপ্তধনও পাওয়া যাবে। এই কথার সত্যতা কতোটুকু কে জানে।
‘বাদ দে, এখান থেকে কিভাবে বের হবো সেটা চিন্তা করা ভালো, কোনমতে পেছন ফিরল রাজু, রাশেদকেও পেছনে আসার জায়গা করে দিলো।
একটু কষ্ট করে সামনে এগুতে পারলেই দারুন এক বিস্ময়ের দেখা পেতে পারতো রাশেদ। কিন্তু পেছনে ফিরে এলো সে।
দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলো রাশেদ, এখানে কতোক্ষন আটকে থাকতে হবে জানা নেই। বাইরে বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। একটু পর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল রাশেদ। চোখ খুলে রাখতে পারছে না, রাজু তাকিয়ে আছে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না রাজু। হয়তো বুঝতে পারছে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে রাশেদ।
ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসল রাশেদ। বাইরে রোদ ঝকঝক করছে। রাজুর কোন চিহ্ন নেই কোথাও। কি করবে বুঝতে পারছে না। কতোক্ষন ঘুমিয়েছে সে?
‘কি? ঘুম ভাঙল?’ রাজুকে দেখা যাচ্ছে, খুশি খুশি চেহারা। গুহায় ঢোকেনি,শুধু চেহারাটা দেখা যাচ্ছে।
‘কতোক্ষন ঘুমিয়েছি?’
‘এখন মনে হয় বারোটা বাজে, রাজু বলল, চল, তৈরি হয়ে নে।’
‘তৈরি হওয়ার কি আছে?’ অবাক হয়ে বলল রাশেদ, উঠতে গিয়ে বুঝতে পারল পুরো শরীরে ব্যথা করছে।
‘হমম, তা ঠিক। খুব সাবধানে নামলে এই ঢাল বেয়ে নামা সম্ভব,’ রাজু বলল, ‘আমি কিছুদূর নেমেছিলাম, পরে উঠে এলাম।‘
‘আমি তো দেখলাম খাড়া ঢাল?’
‘ভুল দেখেছিস,’ রাজু বলল, ‘হাত বাড়া।‘
এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল রাশেদ, বাইরে তাকাল। সত্যিই গতকাল যতোটা খাড়া মনে হচ্ছিল ঢালটা ততোটা খাড়া নয়। বরং সাবধানে নামতে থাকলে নীচে পৌঁছানো যাবে।
ঢালের গায়ে হেলান দিয়ে আস্তে আস্তে নামছে দুজন। মাঝে মাঝে থামছে, বিশ্রাম নেয়ার জন্য।
‘লরেন্স উপরে গিয়েছিল একা, সঞ্জয়ের এতোগুলো লোককে কাবু করে কিভাবে ওদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিলো, কিছুই বুঝলাম না, রাজু বলল।
‘পাহাড়ে লরেন্সের অনেক বন্ধু। ওর চার-পাঁচজন পাহাড়ি সঙ্গি আশপাশেই ছিল। ওরাই হয়তো সাহায্য করেছে ওকে।
‘হুম, আর ওর ধনসম্পদ?’
‘হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে সঞ্জয়।’
‘ওহ। কি অপচয়? নিজে পেলো না, বেচারা লরেন্সকেও পেতে দিলো না।’
‘ঐ লুকানো সম্পদে অনেক রক্ত মাখা, খুঁজে না পাওয়াই ভালো।’
‘আমরা এখন কি করবো?’
‘যে কোনভাবে ঢাকায় যাবো, রাশেদ বলল, তারপর দেখা যাক।‘
‘আমি কিন্তু তোর সাথেই আছি,’ হেসে বলল রাজু, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কোনমতে আটকাল রাশেদ, ‘তুই আমার সাথেই থাকবি, কোন সমস্যা নেই,’ বলল রাশেদ।
গতকালের ঝড়ে চারপাশ কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কিন্তু আজ চমৎকার রোদ উঠেছে। নোংরা, ছেঁড়া কাপড় পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় নামছে দুই বন্ধু, দুজনের মুখেই হাসি।
*
অধ্যায় ৫১
রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে একটানা হেঁটে কাঠমুন্ডুতে পৌঁছেছে সে। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। নিজেকে বড় অস্থির, রিক্ত আর ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। দিশাহীন পথিকের মতো অচেনা এক প্রতিদ্বন্দ্বীর খোঁজে এভাবে আর কতোদিন পথ চলতে হবে। নিজেকে শান্ত রাখতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। চারপাশের সবকিছু ভেঙেচুড়ে ফেলতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো, মনের ভেতর কেমন অদ্ভুত একটা ক্রোধ বড় হচ্ছিল, সেটা আরো বড় হয়ে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখন রক্ত দেখতে ইচ্ছে করছে, একমাত্র রক্তই পারে তাকে শান্ত করতে।
নিজেকে অনেক দিন আগেই মানুষরুপি পশু হিসেবে নিজেকে ভাবে মিচনার। এই মৃত্যুহীন জীবন তার কাছে এক অভিশাপ, এক বোঝা। আবার সেই অভিশাপকে চিরস্থায়ী করার জন্য সে নেমেছে এক অচেনা প্রতিদ্বন্দ্বীর খোঁজে। কি অদ্ভুত! একই সাথে দুই রকম চিন্তা মাথায় খেলা করে, একবার মনে হয় কি লাভ পশুর মতো এই জীবন, আবার মনে হয় জীবন অনেক সুন্দর, কষ্টকর মৃত্যুর কোন মানে হয় না।
মাথার ভেতর অচেনা কণ্ঠস্বরের তাগিদেই এখানে এসেছে সে। বরফে ঢাকা এই এলাকার কোথাও আছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই প্রতিদ্বন্দ্বীই নিশ্চয়ই প্রস্তুত, তাকে মোকাবেলা করার জন্য, কিংবা সেই হয়তো তার পিছু নিয়েছে, কে জানে।
পরনে জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট, দ্রুত গতিতে হাঁটছে সে কাঠমুন্ডুর পথে। এই সকালে মোটা জ্যাকেট, পুলওভার পরে স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে যারা বের হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে বিস্ময় দেখতে পাচ্ছে মিচনার।
সেই অচেনা প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে চেনার কোন পথ নেই, সে দেখতে কেমন, কি নাম কিছুই জানা নেই মিচনারের। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, ঠিক জায়গাতেই এসেছে সে, তার মনের ভেতরে সেই কণ্ঠস্বর তাকে ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছে।
হিমালয়ের পাহাড়চূড়ায় ভোরের প্রথম আলো পড়ে ঝিকমিক করে উঠেছে। একটু পর পুরো শহর, জনপদ আলোকিত হয়ে উঠবে, কর্মব্যস্ততায় মেতে উঠবে লক্ষ মানুষ। হঠাৎ মনে হলো এই শহরে তার কোন কাজ নেই। এখান থেকে যেতে হবে আরো অনেক দূর। ঠিক কোথায় নিশ্চিত নয় সে, তবু হাঁটতে থাকল মিচনার।