৩.২ নেপাল

অধ্যায় ১১

নেপাল। দেশটা সম্পর্কে যতোটুকু জানা ছিল বই পড়ে। হিন্দুপ্রধান দেশ। হিমালয়ের কোলে এর অবস্থান। ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে নেমে কাঠমুন্ডু দরবার স্কয়ারের কাছে একটা হোটেল খুঁজে নিলো রাশেদ। নামী-দামী হোটেলে থাকার কোন ইচ্ছেই তার নেই, দেখার মতো অনেককিছু থাকলেও সে সময় বা সুযোগ কোনটাই নেই। কাজে নামতে হবে। রাজুকে বোঝানো অবশ্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত একটাদিন পুরো কাঠমুন্ডু ঘুরে দেখতে চায় সে, কিন্তু রাশেদ জানে, সময় হাতে খুবই কম। এতোদূর এসে অযথা সময় ন করার কোন মানে নেই।

কাঠমুন্ডু জনাকীর্ন শহর, পর্যটকে গিজগিজ করছে। পুরো শহরে সাধারন নেপালীদের সাথে প্রচুর ভারতীয়দেরও দেখা যাচ্ছে। একটু পরপর মন্দির, পানির ফোয়ারা। গাছের ডালে বানরের লাফালাফি অতি পরিচিত একটা দৃশ্য।

হোটেলের রুমে ঢুকে শাওয়ার সেরে নিলো রাশেদ। দুপুর একটার কাছাকাছি বাজে, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু। রাজু জানালা দিয়ে দূরের ঝাপসা হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বিছানায় বসে নিজের কার্যক্রম ঠিক করে নিচ্ছে রাশেদ। নেপাল-তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক জায়গায় ড. আরেফিন আছেন, সেখান থেকেই শেষ কথা বলেছিলেন তার স্ত্রীর সাথে। তিনি এখন নেপালে থাকতে পারেন, আবার তিব্বতেও চলে যেতে পারেন। সেটা জানার একমাত্র উপায় সীমান্তবর্তী সেই এলাকায় যাওয়া, জায়গাটার নাম কোদারি, সীমান্তের কাছাকাছি একটা গ্রাম। সেখানে না পাওয়া গেলে ঝাংমু দিয়ে তিব্বতেও ঢুকতে হতে পারে। সমস্যা সেখানেই।

তিব্বতে ঢোকার জন্য স্পেশাল পাস নিতে হয় বলে শুনেছে রাশেদ। সবাইকে সে পাস দেয়া হবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। চীন সরকার যাদের নিরাপদ মনে করে কেবল তাদেরকে তিব্বতে ঢোকার পাস দেয়, সেই পাস আবার যোগাড় করতে হয় চীন আম্বেসী থেকে। অনেক কাজ বাকি আছে, ঝামেলার মাত্র শুরু।

দোস্ত, আমি এভারেস্টে যেতে চাই, জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল রাজু।

তুই বান্দরবনের পাহাড়ে গতবার যেমন ভড়কে গেছিলি, এভারেস্টে গেলে তো হারিয়েই যাবি, বিছানায় হেলান দিয়ে বলল রাশেদ। অল্প সময়ের ফ্লাইট, কিন্তু বেশ ক্লান্ত লাগছিল, গতরাতে তেমন ঘুম হয়নি।

বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি এরমধ্যেই হিমালয় জয় করছে, আমি পারবো না কেন?

তুইও পারবি, কিন্তু একেবারে ট্রেনিং ছাড়া গেলে মারা পড়বি।

হমম, মারা পড়লে পড়বো। কিন্তু ঐ হিমালয়ে আমাকে যেতেই হবে, রাজু বলল অনেকটা গোঁয়ারের মতো।

আচ্ছা, যাবি। কিন্তু এখন না, অন্য একটা কাজে এসেছি আমরা, তুই জানিস ভদ্রমহিলা আমাদের উপর কেমন আস্থা রাখেন।

তা জানি। আগে তাহলে কাজটা শেষ করে নেই, তারপর হিমালয়।

আমি আর তুই বিকেলে ঘুরতে বেরুবো, তার আগে আমাকে একটা কাজ করতে হবে।

কি কাজ?

অস্ত্র লাগবে আমার।

অস্ত্র! অস্ত্র দিয়ে কি করবি?

সামনে কি ঘটবে কোন ধারনাই নেই, একটু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।

এখানে অস্ত্র তুই পাবি কোথায়? আমরা কি কাউকে চিনি নাকি?

চিনি না, চিনে নেবো।

টাকা? বেশ ভালো পরিমান টাকা লাগার কথা।

লাগবে। আমি নিয়ে এসেছি, ভদ্রমহিলাকে অবশ্য বলিনি।

তাহলে তুই একাই বাইরে যাবি?

হ্যাঁ, তুই রেস্ট নে, আমি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে চলে আসবো।

ঠিক আছে, আরেকটা জিনিস আনতে ভুলিস না?

কি জিনিস?

সিমকার্ড, ভুলে গেছিস?

ও হ্যাঁ, দুজনের দুটো সিমকার্ডও লাগবে।

তুই যা তাহলে, আমি একটু ঘুমিয়ে নেই, জানালা থেকে সরে দাঁড়াল রাজু। ডাবল বেডের রুমে তার বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

আমি ঠিক দুই ঘন্টা ঘুমাবো, এরমধ্যে তুই না এলে আমি কিন্তু খুঁজতে বেরুবো।

চিন্তা করিস না, দুই ঘন্টার আগেই চলে আসবো আমি।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রাশেদ।

বাইরে ঝকঝকে রোদ।

বিমানবন্দরের বাইরে এসেই ডলার ভাঙ্গিয়ে রূপি করে নিয়েছিল রাশেদ, একটি টুপি আর সানগ্লাস কিনেছিল সাথে সাথেই। সেগুলো এখন কাজে দিচ্ছে। হোটেলের বাইরে এসে চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল সে। রাস্তায় প্রচুর ভীড়, যেন সারা পৃথিবীর লোক একসাথে জড়ো হয়েছে কাঠমুন্ডুতে। সাইনবোর্ড আর দেয়াল লিখনগুলো পড়া অসম্ভব, বেশিরভাগই হিন্দিতে লেখা।

কারো সাথে পরিচয় নেই এই দেশে, থাকার কথাও না। অনেকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বাঙ্গালি। কিন্তু রাশেদ জানে ওরা ভারতীয়ও হতে পারে। দুটো জিনিস দরকার তার, অস্ত্র আর তিব্বতের পাস। তিব্বতের পাস নিয়ে যে কারো সাথে কথাবার্তা বলা যেতে পারে, কিন্তু অস্ত্র কিভাবে জোগাড় করা সম্ভব তাই মাথায় ঢুকছে না।

রাস্তায় নেমে হাঁটছে রাশেদ। আবহাওয়া চমৎকার। চারদিকে হাসিখুশি সব মানুষ। রাস্তার পাশের দোকানীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। দরবার স্কয়ারের একপাশে রাজকীয় সব ভবন, অনেক পুরানো, এর উল্টো দিকেই খোলামেলা জায়গাগুলো, এরকম স্কয়ার আরো বেশ কয়েকটা আছে কাঠমুন্ডুতে। এখানকার ফ্রিক স্ট্রীটের নামও শুনেছে রাশেদ, সত্তরের দশকে হিপ্পিদের আড্ডাখানা ছিল, সরকারিভাবে এখানে গাঁজা বিক্রি হতো। পরবর্তীতে আমেরিকার চাপে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে নেপাল সরকার। পথে বেশ কয়েকটা বারও চোখে পড়লো। একটু দূরে মন্দির, সেখানেও অনেক ভীড়। এতে ভীড়ের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কেন জানি ঘুরে দাঁড়াল রাশেদ, মনে হচ্ছে কেউ যেন তার প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দেয়ার চেষ্টা করলো মাত্র। ঘুরে দাঁড়ানোর ফল হলো অন্যরকম, সরাসরি এক লোকের সাথে ধাক্কা লেগে গেল। লোকটা বয়স্ক, ধাক্কা সামলাতে পারেনি,সাথে সাথে পড়ে গেছে।

ব্যস্ত হয়ে লোকটাকে উঠাল রাশেদ।

দুঃখিত, আমি খুবই দুঃখিত, ইংরেজিতে বলল রাশেদ।

ঠিক আছে, উত্তরটা এলো বাংলায়। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন।

অবাক হলো রাশেদ, কিভাবে বুঝতে পারলো ভদ্রলোক সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে!

অবাক হওয়ার কিছু নেই, আপনি যে টি-শার্টটা পড়েছেন সেখানে কিন্তু বাংলাই লেখা, বলল লোকটা, উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঝেরে নিচ্ছে।

ঠিকই বলেছে লোকটা, ভাবল রাশেদ। তার টি-শার্টে পরিস্কার বাংলায় লেখা বাংলাদেশ

ভদ্রলোকের দিকে তাকাল রাশেদ। বয়স পঞ্চাশের কম হবে না, মাথায় চুল কম, তবে স্বাস্থ্য দেখে মনে হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম করেন। হাসলে সুন্দর দেখায়, একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো।

আমি আসলে এখানে প্রথমবার এসেছি, রাশেদ বলল, একা একা ঘুরতে বেড়িয়েছি।

গুড। নেপাল খুবই চমৎকার জায়গা। আমি প্রায়ই আসি।

আপনার কাছে অনেক কিছু জানা যাবে তাহলে।

তা জানা যাবে। আপনার যা দরকার সব আপনি নেপালে পাবেন, বাঁকা একটা হাসি দিলো লোকটা।

আপনার নামই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি,আমি রাশেদ। উত্তরায় থাকি।

আমি আহমদ কবির, বাসা ধানমন্ডিতে।

পরিচিত হয়ে ভালো লাগল কবিরসাহেব, রাশেদ বলল, তারপর এগিয়ে গেল সামনে।

আমার এই নাম্বার রাখুন, যে কোন প্রয়োজনে ফোন করবেন, আহমদ কবির বলল, ছোট একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিয়ে।

হমম, আমারও সিমকার্ড কেনা দরকার, কোথায় পাবো বলতে পারেন? জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

পাসপোর্ট আছে সাথে?

আছে, দুটো সিমকার্ড নেবো।

বউকে নিয়ে এসেছেন?

না, বিয়ে করিনি এখনো, বন্ধুর জন্য লাগবে।

সমস্যা নেই, চলুন আপনাকে সিমের ব্যবস্থা করে দেই, আহমদ কবির বলল। হাঁটতে থাকল রাশেদ, পাশে আহমদ কবির।

আমার আরো কিছু জিনিস দরকার, চাপা গলায় বলল রাশেদ।

টাকা হলে যে কোন জিনিস পাওয়া যাবে, শুধু চাইতে হবে, আহমদ কবিরও বলল নীচু গলায়।

বিশ্বাস করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না রাশেদ। মাত্রই পরিচয়, এরমধ্যেই অনেক কথা হয়ে গেছে লোকটার সাথে। কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক না, অন্তত সে এখন যে ধরনের কাজে এসেছে। কিন্তু একেবারে নতুন এক জায়গায় কারো না কারো উপর ভরসা রাখা উচিত। তবে একটু সময় নেয়া দরকার, লোকটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করার আগে আরো একটু বাজিয়ে দেখা দরকার।

আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন কবিরসাহেব?

হোটেল সানসাইন, আপনি?

একই হোটেলে! অবাক কণ্ঠে বলল রাশেদ।

চমৎকার।

আরো অনেকবার দেখা হবে আমাদের, কি বলেন?

চুপচাপ মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অন্যমনস্ক হয়ে গেল যেন হঠাৎ।

হ্যাঁ, আরো অনেকবার দেখা হবে, ভাবল আহমদ কবির। দোকানির ডাকে ফিরে তাকাল।

*

অধ্যায় ১২

চেকপোস্ট। দুপুর হয়ে গেছে প্রায়। লম্বা একটা সেতু পার হতে হবে, তাহলেই তিব্বত। চেকপোস্টে লাইন মোটামুটি লম্বাই বলা চলে, কিন্তু একেকটা গাড়ি ছাড়তে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। এই লোকগুলো এই পোস্ট দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই যাতায়াত করে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা, তবু ছাড় মেলে না, দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশির পরই সেতু পার হওয়ার সুযোগ পায় তারা।

বেশ টেনশন হচ্ছিল ড. কারসনের। গত কিছুদিনে ড. আরেফিন এবং সুরেশ থাকায় কোন ঝামেলাকেই ঝামেলা মনে হয়নি। কিন্তু এখন দুজনের একজনও পাশে নেই। সুরেশ থাকলে এই ঝামেলা থেকে অনায়াসে পার হওয়া যেতো, কিন্তু ভারতীয় একজন এজেন্ট খোলামেলাভাবে তাদের সাথে থাকতে পারে না। নিজের আসল পরিচয় কোনভাবেই ঝুঁকিতে পড়তে দেবে না সুরেশ। তবে আশার কথা সুরেশের লোকজন হয়তো আছে এখানে। যারা হয়তো তাদের সাহায্য করবে। দুজনের নামও বলে দিয়েছিল সুরেশ, চলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে।

ঘাম হওয়ার কথা নয়, তবু ঘেমে যাচ্ছেন ড. কারসন। সন্দীপ এবং তার কাছে স্পেশাল পাস আছে, সমস্যা হবে ড. লতিকাকে নিয়ে। তবে মেয়েটাকে মনে হচ্ছে একদম স্বাভাবিক। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। দূরে চেকপোস্টে কী হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছে।

সুরেশ যে নামগুলো বলেছিল মনে করার চেষ্টা করছেন ড. কারসন। রাজেন থাপা আর গনেশ ওঝা। এই চেকপোস্টে ডিউটিতে থাকার কথা ওদের। তবে রোস্টার ডিউটি, আট ঘন্টা পর পর দায়িত্ব বদল হয়, একদল আরেকদলের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যায়। রাজেন আর গনেশ যদি না থাকে এই সময় তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ওদেরকে বলে রাখার কথা সুরেশের। তবে এই মুহূর্তে ওরা চেকপোস্টে আছে কি না তা জানাও বেশ ঝামেলার ব্যাপার।

ড্রাইভারের দিকে তাকালেন, লোকটা নেপালি, কম কথা বলে। কোদারি থেকে রওনা হওয়ার পর এতোক্ষন একটা কথা বলেছে কি না সন্দেহ। অবশ্য গাড়িতে যাত্রীদের অন্যকেউও কথা বলেনি। সন্দীপ আর লতিকা সন্দেহজনক নীরবতা পালন করছে। দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন হয় তাহলে বিপদ, ভাবলেন ড. কারসন। ড. আরেফিন থাকলে অনেক সুবিধা হতো। ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্বটাই এমন যে কেউ সহজে মিশে যেতে পারে তার সাথে। একটু গম্ভীর হলেও খুব বেশি দূরত্ব বজায় রেখে চলেন না কারো সাথে।

লাইনটা বেশ লম্বা ছিল, কিন্তু প্রপর কয়েকটা গাড়ি ছেড়ে দেয়াতে চেকপোস্টের কাছাকাছি চলে এসেছে জীপটা। ড. কারসন উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন চেকপোস্টের অফিসারদের দিকে। এদের মধ্যেই রাজেন্দ্র আর গনেশের থাকার কথা। না থাকলে চরম বিপদ। আগে বিপদটাকে তেমন ঝামেলার কিছু মনে হয়নি,কিন্তু এখন মনে হচ্ছে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামকে যেতে দিয়ে ভুল হয়েছে, চরম ভুল।

আর মাত্র একটা গাড়ি সামনে।

ড. কারসন, চিন্তা করবেন না, আমি নামছি ওদের সাথে কথা বলার জন্য, সন্দীপ বলল।

না, আমিই যাবো। কাগজপত্র সব আমার কাছে দিন, ড. কারসন বললেন।

সন্দীপ আর কথা বাড়াল না, তার স্পেশাল পাসের কাগজটা বাড়িয়ে দিল ড. কারসনের দিকে, ড. লতিকার দিকে তাকাল, চোখ ফিরিয়ে নিলো সাথে সাথেই।

ড. লতিকা, যদি দেখি তুমি যেতে পারছে না, তাহলে কাঠমুন্ডুতে ফিরে যেও, ড. কারসন বললেন।

আমি ফিরে যেতে আসিনি,ড. কারসন, লতিকা বলল, তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস থাকলেও এর কোন ভিত্তি খুঁজে পেলেন না ড. কারসন।

সামনের গাড়িটা পার পেয়ে গেছে, সামনে এগুলো জীপটা।

নেপালি সীমান্ত রক্ষীর পোশাক পড়া দুজন অফিসার এগিয়ে এলো। দরজা খুলে নামলেন ড. কারসন।

আমি ড. কারসন, ইংল্যান্ড থেকে একটা রিসার্চের কাজে এসেছি, হেসে একজনের সাথে হাত মেলালেন ড. কারসন।

লোকটা লম্বায় তার চেয়ে ছোট, ছিপছিপে স্বাস্থ্য, চিকন গোঁফ আছে, চোখে সানগ্লাস। ব্যাজটা দেখে নিলেন ড. কারসন। শুধু অভিজিত লেখা, মনটা খারাপ হয়ে গেল, এই লোককে দেখে কঠিন লোক মনে হচ্ছে। সহজে ছাড় পাওয়া যাবে না। পাশের অফিসার তুলনামূলকভাবে একটু লম্বা, ওর ব্যাজটা দেখে আরো হতাশ হলেন ড. কারসন। এর নাম রাজশেখর।

ওকে, গাড়িতে কে কে আছেন, তাদের নামতে বলুন, শান্ত গলায় বলল অভিজিত। হাতের ওয়াকিটকিটা বেজে উঠলো এই সময়। কারো সাথে নেপালি ভাষায় কথা বলল অফিসার।

আপনারা এখানেই থাকুন, বলল অভিজিত, সঙ্গি রাজশেখরকে ইশারা করল। দুজন একসাথে চেকপোস্টে ফিরে গেল।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন ড. কারসন। উত্তেজনা সহ্য করতে পারেন না তিনি, স্পেশাল পাস ছাড়া কিভাবে একজনকে এই চেকপোস্ট পার কাবেন? এমনিতে কোন ধরনের অবৈধ কাজে প্রশ্রয় দেন না তিনি, কিন্তু এখন কোন না কোন ভাবে অবৈধ পথেই এগুতে হবে। প্রয়োজনে এই দুজনকে ঘুষ দিতে হবে।

বেশ কিছুক্ষন পার হওয়ার পরও কেউ এলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেছে ড. কারসনের, কিন্তু এমনভাবে তাকাচ্ছেন তিনি যেন চারপাশের প্রকৃতি দেখে তিনি মুগ্ধ। পেছনে লাইন লেগে গেছে গাড়ির। দুএকজন হর্নও দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি পার হওয়ার জন্য।

এবার আসতে দেখলেন দুজনকে। তবে এরা অন্য অফিসার। কাছাকাছি এসে দাঁড়াল যখন, একজনের বুকে রাজেন আর অন্য জনের বুকে গনেশ ব্যাজ দেখে স্বাভাবিক হলেন ড. কারসন।

সুরেশের উপর কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল মন, এই ছেলেটা না থাকলে কি যে হতো!

রাজেন আর গনেশের কল্যানে নেপাল কাস্টমস পার হলেও আসল চিন্তা সেতু পার হওয়ার পর। সেতুর পর চীন কাস্টমস। ওখানে কে পার করে দেবে তাদের? ওখানে নিশ্চয়ই সুরেশের কোন হাত নেই।

জীপে বসে সব ভুলে গেলেন নীচে বটেকোশি নদীর প্রবল স্রোত দেখে, দুপাশের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি এই জলকন্যা।

নেপালের তুলনায় চীনা কাস্টমস অনেক সুরক্ষিত, প্রচুর আয়োজন সেখানে, অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে মিলিটারীর লোকজন, প্রতিটি ব্যাগ, প্রতিটি জিনিস ওরা তন্নতন্ন করে খুঁজবে, সেখানে তিব্বতি স্বাধীনতা সম্পর্কিত কিছু পাওয়া গেলে, সেখান থেকেই ফেরত দিতে পারে ওরা, এমনকি দালাই লামা সম্পর্কিত কিছু থাকলে একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু সে তুলনায় তেমন কিছু হলো না।

রাজেন তার হাতে স্পেশাল পাসগুলো দিয়েছিলো, সীল মেরে, এতোক্ষন খেয়াল করেননি,এবার দেখে অবাক হলেন ড. কারসন। ড. লতিকা প্রভাকরের জন্যও একটা পাস আছে সেখানে। কিভাবে সম্ভব?

চেহারায় এতোক্ষন গম্ভীর একটা ছায়া ছিল ড. কারসনের, সেই ছায়াটা সরে গেল মুহূর্তেই। তাকে দেখলে যে কেউ এখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ বলতে দ্বিধা করবে না।

মনে মনে সুরেশকে আবার ধন্যবাদ জানালেন তিনি।

***

সময় কিভাবে যাচ্ছে টের পাচ্ছেন না তিনি। ঘোরের মধ্যে আছেন, একটানা অন্ধকারে থেকে কেমন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে তার অনুভূতি। পুরো ঘরে কেমন অদ্ভুত বাজে একটা গন্ধ, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে যেমন হয়। আগে টের পাননি,আজ যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। গতরাতে খাবার খেয়েছিলেন মনে পড়ে, দুটো রুটি আর কলা। তারপর দীর্ঘ সময় পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা তেমন অনুভব করছেন না, সব অনুভূতি যেন। মরে গেছে।

কটা বাজে নিশ্চিত না হলেও এখন অনেক রাত এটুকু বুঝতে পারছেন। সামনের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসে। দিনের আলো নিভে গেছে অনেকক্ষন হলো। আজ সারাদিনে কেউ একবার উঁকি দিতেও আসেনি। ওরা কি তাহলে তাকে ফেলে চলে গেল? এমন তো হবার কথা নয়।

ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলার শব্দ পেলেন। চোখ খুললেন না, এর আগে যে বৃদ্ধ এসেছিল সেই হয়তো এসেছে। দরজা খুলে কেউ একজন ঢুকেছে। বুটের মচমচ শব্দ পাচ্ছেন, এগিয়ে আসছে তার দিকে। এবার চোখ খুললেন তিনি। একশ ওয়াটের বাতিটা জ্বলে উঠেছে।

তরুন একজন এসেছে এবার। সোজা, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ফর্সা, ভোঁতা চেহারায় বেশ কিছু কাটা দাগ, একদম তাজা।

গলা চেপে ধরল তরুন সরাসরি। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের আগুনেই ভস্ম করে দেবে। দম বন্ধ হয়ে আসলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন তিনি। ভয় পেয়েছেন বুঝতে পারলে এরা আরো ভয়ংকর রুপে হাজির হবে।

তুই কি আমাকে চিনিস? ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল তরু। গলা থেকে হাত এখনো সরায়নি।

না-সূচক মাথা নাড়লেন তিনি।

কিন্তু আমি তোকে চিনি, তুই আমাদের উপর গুলি চালিয়েছিলি, তোর নাম ড. কামাল আরেফিন, বলল তরুন, গলা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখের উপর থেকে টেপ খুলে নিলো।

এবার বল, তোর উদ্দেশ্য কি?

আমি একজন ডক্টর, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম, কোনমতে বললেন ড. আরেফিন, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার।

শিক্ষকের হাতে অস্ত্র শোভা পায় না, ঘুরে দাঁড়াল তরুন, রুমে পায়চারি করতে থাকল।

আবার বলছি, উদ্দেশ্য কি বল? জোরে চিৎকার করে উঠল তরুন এবার।

তরুনের হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন ড. আরেফিন। পুরো মিলিটারি ভঙ্গি, চেহারা মঙ্গোলীয়, তবে নেপালীদের মতো নয়। সম্ভবত চীনা এবং সামরিক বাহিনীতে কাজ করে।

আমরা এসেছি সাম্ভালার খোঁজে, বললেন ড. আরেফিন, বৃদ্ধ যেহেতু জানে, তাহলে সাম্ভালার কথা এই তরুনের না জানার কথা নয়।

সাম্ভালা? সাম্ভালা কি? আমার সাথে চালাকি?

সাম্ভালা হচ্ছে…

চোপ…

ধমকে উঠল তরুন, ঐ সব তিব্বতি গালগল্প আমাকে শোনাতে এসো না। আসল কথা বলো।

আসল কোন কথা নেই।

চোখ বন্ধ করলেন তিনি। তরুন যেরকম উত্তেজিত অবস্থায় আছে, তাতে গায়ে হাত তোলা অস্বাভাবিক না।

আচ্ছা, তাহলে আসল কথা নেইনরম সুরে বলল রুন।

এগিয়ে এসে ড. আরেফিনের হাত চেপে ধরল। ব্যথায় কাতরে উঠলেন তিনি। এই হাল্কা পাতলা শরীরে এতশক্তি ধরে দেখে বোঝা যায় না।

তোদের সাথে ইন্ডিয়ান র-এর এজেন্ট কি জন্য? সেও কি সাম্ভালার খোঁজে বের হয়েছে, আমাদের বোকা মনেকরিস?

উত্তর দিলেন না তিনি।

এবার আশংকা সত্যি হলো। এগিয়ে এসে গালে বেশ কয়েকবার ঘুষি বসাল তরুন। জীবনে কখনো এমন অসহায় অবস্থায় পড়েননি। তার মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত বেরুচ্ছে। এই তরুনকে এখন যাই বলবেন তার কোনটাই বিশ্বাস করবে না, তাতে মারের মাত্রাটা আরো বেড়ে যাবে। এরচেয়ে চুপচাপ সহ্য করা ভালো। এই চায়নীজ তরুনের কথাই বলেছিলেন প্রফেসর সুবামানিয়াম, সন্দীপ যার কথা বলেছিল, সেও মনে হয় এই তরুন। এছাড়া কাঠমুন্ডু থেকে কোদারি আসার পথে যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছিল তাতেও ছিল এই তরুন। এরা সম্ভবত চায়নীজ সরকারের লোক, চায় না সাম্ভালার খোঁজে তিব্বতে কেউ যাক।

আমি কাল আবার আসবো, তৈরি থাকিস, বলল তরুন, পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত দুটো পরিস্কার করে নিলো, সেখানে রক্ত লেগে আছে।

যাওয়ার সময় মুখে টেপ লাগিয়ে গেল না তরুন, দরজা খোলা রেখেছে, এর আগে যে ছেলেটা রুটি আর কলা দিয়েছিল তাকে ঢুকতে দেখা গেল।

মুখে হাসি খেলল ড. আরেফিনের। এখানে এই অবস্থায় কতোদিন থাকতে হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, এমনকি এখান থেকে জীবিত বের হতে পারবেন কি না তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাই যতোটা পারা যায়, খেয়ে নেয়া ভালো। সুযোগ এলে শারীরিক সব শক্তিই তার কাজে লাগবে। কিন্তু সুযোগ কি আসবে? ড. কারসন কিংবা দলের অন্য কারো পক্ষে এখানে আসা অসম্ভব। তাদের আসার সম্ভাবনা কম, কারন অনির্দিকালের জন্য নেপালে অপেক্ষা করা ড. কারসনের পক্ষে সম্ভব না। সেক্ষেত্রে এখান থেকে বের হওয়ার পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।

ছেলেটার বয়স কম, নেপালি হবে সম্ভবত। চেহারায় ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। তাকে কোনরকম রুটি-কলা খাইয়ে দিয়ে চলে যাবে। শক্ত রুটি আর কলা দেখে কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠলো ড. আরেফিনের। ছেলেটা রুটি বাড়িয়ে দিয়েছে তার মুখের দিকে, ইচ্ছে না হলেও এই খাবার খেতে হবে তাকে। কার্বোহাইড্রেট শরীরে শক্তি জোগাবে। খাওয়া শেষ হলে ছেলেটার দিকে তাকালেন তিনি, ইশারা করলেন তার হাতের দিকে তাকাতে। বাথরুমে যাওয়া দরকার, সেই ইশারা করছেন তিনি। ছেলেটা বুঝতে পারলো না কি না বোঝা গেল না। দরজা বন্ধ করে চলে গেল। যাওয়ার সময় বাতিটা নিভিয়ে যেতে ভুলল না।

*

অধ্যায় ১৩

বুড়োকে এতোদিনে কাছের লোক বলে মনে করতে শুরু করেছে কিশোর। তিনি ছাড়া আর কেউ নেই তার। বছর দুয়েক পার হয়েছে এরমধ্যে। পাহাড়ের সেই গুহা আর ভেড়া চড়ানোর মধ্যেই যার জীবন ছিল সীমাবদ্ধ, এই বুড়োর সাথে থেকে গত দুবছরে সে দেখেছে অনেক কিছু। মরুভূমি থেকে সমুদ্র, শুষ্ক পাহাড় থেকে গহীন অরন্য, বুড়োর সাথে সাথে অনেক জায়গায় ঘুরেছে সে।

বুড়ো লোকটা আজব মানুষ। একটানা পথ চলে, মাঝে মাঝে একটানা হাঁটছে তো হাঁটছেই, পথের ধারে লোকালয় পড়লে সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে কিছুদিন, তারপর আবার ছুটে চলা। বুড়ো মানুষটার কাছে ক্লান্তি বলে কোন শব্দ নেই। যেখানেই গেছে মানুষের চোখে শ্রদ্ধা দেখেছে সে বুড়ো মানুষটার জন্য, সকলেরই তিনি আপন। অদ্ভুত, অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে বুড়োর, যা সে কাউকে বলে না। কিন্তু বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধারে এগিয়ে গেছে সবসময়। কোথাও হয়তো অনাবৃষ্টি, কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও পাহাড় থেকে নেমে আসা বন্যজন্তুর আক্রমনে জীবন অতিষ্ঠ, সবধরনের কাজের সমাধান ছিল বুড়োর কাছে। সেই সব সমাধান সবার সামনে করেননি তিনি, তবে সমাধান হয়ে যেতো।

বেশিরভাগ সময়ই খোলা জায়গায় ঘুমাতে পছন্দ করেন বুড়ো। সবচেয়ে পছন্দ করেন বন-জঙ্গল। রাতে বুড়োর কাছাকাছি ঘুমায় কিশোর। ঘুমায় না বলে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে বলা যায়। ঠিক মাঝরাতের পর বুড়ো জেগে উঠেন। হেঁটে বেড়ান, বিড়বিড় করে কিছু বলেন। একটানা অদ্ভুত সুরের সেই বিড়বিড়ানি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায় কিশোর। ভোরের প্রথম আলোতে যখন তার ঘুম ভাঙে বেশিরভাগই সময়ই দেখা যায় বুড়ো ঘুমাচ্ছে। তখন প্রায়ই কিশোরের ইচ্ছে হয় বুড়োর ঝোলা আর লম্বা লাঠিটা নিয়ে পালিয়ে যেতে। এই ঝোলার ভেতরেই আছে বুড়োর সব বাহাদুরি। কিন্তু সাহস হয় না, এই মানুষটা তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, এছাড়া নিজের জন্য এখনো কোন ঠিকানা খুঁজে পায়নি কিশোর, এই বুড়োই তার শেষ ঠিকানা যে বিপদ আপদে তাকে রক্ষা করবে।

আজকের দিনটা সম্ভবত অন্যান্য দিনের মতো নয়, কারন ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে কিশোরের। এই অঞ্চল মরুময়, যতোদূর দেখা যায় লোকালয়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। গত দুদিন বুড়োর কোমরে ঝোলানো চামড়ার থলে থেকে শুধু পানি খেয়েছে কিশোর, মিষ্টি সে পানি, এই পানি খেলে সহজে ক্ষুধা-তৃষ্ণা পায় না। আগের রাতেই পাথুরে এক পাহাড়ের ঢালে আস্তানা গেড়েছিল তারা, এই অংশটা আরো বেশি অন্ধকার। বুড়ো যেখানে শুয়েছিল সেদিকে তাকাল কিশোর। বুড়ো নেই!

ছায়াময় অংশটার দিকে এগিয়ে গেল কিশোর। বুড়ো যেখানে শুয়েছিল তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাকে একা ফেলে কোথাও যাওয়ার কথা নয় বুড়োর। সেই গ্রাম থেকে চলে আসার পর এখন পর্যন্ত তাকে ফেলে কোথাও যায়নি লোকটা। আরো একটু এগিয়ে গেল কিশোর, ধীর পায়ে। কোথাও কোন শব্দ নেই, এমনকি বাতাসও যেন থেমে আছে। জীবনের কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না কোথাও, অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হয়ে গেছে সামনের দিকে।

আরো একটা এগুতেই একটা বাঁক পেরুলো কিশোর, বুড়োকে দেখল তখন। উবু হয়ে বসে আছেন, নড়াচড়া করছেন না একদম। সামনে ছোট একটা আগুনের কুন্ড, সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন গভীর মনোযোগে। কিশোরের আগমন তার মনোযোগে বিন্দুমাত্র ছেদ ঘটাতে পারেনি।

নিজেকে আড়াল করে নিলো কিশোর মুহূর্তেই। বুড়ো আসলে কী করছে তা দেখা দরকার। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে, কিন্তু বুড়োর কোন চঞ্চলতা নেই, স্থির তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে।

ঘুম ভাঙল কখন, বাছা? কানের কাছে বুড়োর কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠলো কিশোর। মাত্র কিছুক্ষন আগেই আগুনের সামনে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছে সে বুড়োকে।

এখন জলজ্যান্ত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে হাসি, হাতে চিরচেনা লম্বা লাঠিটা।

এই মাত্র…

এখনো ভোর হয়নি,ঘুমাতে যাও, বললেন বৃদ্ধ। আমার সব জ্ঞান তুমি পাবে, বাছা। অস্থির হওয়ার কিছু নেই।

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল কিশোর, ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল, পেছনে তাকাতেও ভয় হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল তাকালেই বাজে কোন দৃশ্য দেখতে পাবে। এই বুড়োর কাছ থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত অনেক গল্প শুনেছে সে। তার যে কোনটা বাস্তব হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়!

অনেক কিছুই শিখেছে সে বুড়োর কাছ থেকে। সে অতি প্রাচীনকালেও এমনসব জিনিস নিয়ে মেতে উঠেছিলেন বুড়ো যাকে বর্তমানকালের রসায়ন অথবা ফার্মেসীর সাথে তুলনা করা যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত উৎস থেকে এমন সব উপাদান যোগাড় করতেন। যা এখনকার বিজ্ঞানীদের ধারনারও বাইরে। সেই উপাদান নিয়ে চলতে নানা ধরনের গবেষনা, গবেষনায় প্রাপ্ত জিনিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া স্বর্ন, রুপার মতো পদার্থ কৃত্রিমভাবে তৈরির কাজও করছিলেন। বুড়ো। যার স্বাক্ষী তিনি নিজে। ইউরোপে একসময় ফিলোসফার্স স্টোনের মিথ খুব জনপ্রিয় ছিল। যদিও সেই আদিকালে কোন রকম শিক্ষা-দীক্ষা আর যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সেই বস্তু তৈরি করেছিলেন বুড়ো, যার প্রক্রিয়া একমাত্র তাকেই শিখিয়ে গেছেন।

সবকিছুই মনে আছে তার, হাতে-কলমে শেখা কাজ, উপাদানগুলো সব তার মুখস্ত। তখন ভাবেননি,সোনালী রঙের সেই বস্তুর ক্ষমতা কতোদূর হতে পারে।

বর্তমানে ফিরে এলেন তিনি, লখানিয়া সিং। পাহাড়ের ঢালে অন্ধকার একটা কোনা বেছে নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি, সঠিক সময়ের জন্য। রাত বারোটার মতো বাজে। তেমন কোন শব্দ নেই চারপাশে। শুধু পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বটেকোশি নদীটার কুলুকুলু শব্দ ছাড়া। তার দুই দিকে বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর। এসব ব্যাপারে দুজনের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও দেখা যাচ্ছে তাকে ঠিকমতো অনুসরন করে যাচ্ছে ওরা।

নেপাল-তিব্বতের সীমান্তের মাঝামাঝি অবস্থান এখন তাদের। নো ম্যানস ল্যান্ডে। বিকেলের দিকে নেপাল সীমান্ত পার হওয়ার কথা থাকলেও পরে বাতিল করে দিয়েছেন তিনি। এতো কড়া নিরাপত্তা থাকবে, ভাবেননি। কাঁধে ঝোলানো রাইফেল নিয়ে সীমান্তরক্ষীরা ঘোরাফেরা করছে, একটু এদিক-সেদিক দেখলে গুলি করতে দ্বিধা করবে না। সন্ধ্যার পরপর অন্ধকারে এতোদূর আসতে পেরেছেন তিনি। পরনের কাপড় জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। হাত-পা কেটে গেছে কয়েক জায়গায়। কিন্তু সেদিকে তাকানোর উপায় নেই। নেপাল সীমান্ত পার হয়েছেন, এবার বাকি তিব্বত সীমানা দিয়ে ঢুকে পড়া। ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। চীন তার সীমান্তে দারুন তৎপর। অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম দিয়ে সীমান্তরক্ষী দল গড়ে তুলেছে। এছাড়া তিব্বত সবসময়ই একটা স্পর্শকাতর এলাকা চীনের জন্য। তাই এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জটিল। প্রায় দুই তিন গজ পরপরই একজন সীমান্ত রক্ষীকে দেখা যাচ্ছে, যারা তাদের দেশের জন্য বিনা বাক্যব্যয়ে প্রান দিতে প্রস্তুত।

আগেই বলে রেখেছেন বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরকে, তার ইশারা ছাড়া এক ইঞ্চি যেন না নড়ে কেউ। ওরা এতোক্ষন তাই করেছে, ডানে-বায়ে তাকায়নি। তার ইশারামতো কাজ করে গেছে। এবার আসল বাঁধা সামনে।

উপরে বড় বড় সার্চ লাইট বসানো, একটু পরপর পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। কোন মানুষ বা এই ধরনের আকৃতি দেখা মাত্র গুলি করবে সীমান্তরক্ষীরা, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই তার।

উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি, ছোট-বড় পাথরে পুরো এলাকা, মাটি অমসৃন। তারপর এগুতে থাকলেন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সরীসৃপ ধরনের কিছু হেঁটে যাচ্ছে। নিজেকে মাটির সাথে প্রায় মিশিয়ে রেখেছেন। মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বরের অবস্থান দেখে নিচ্ছেন। বিনোদ চোপড়া এভাবে বুকে হেঁটে চলতে পারলেও, যজ্ঞেশ্বর কিভাবে কি করবে ভাবছেন তিনি।

সার্চলাইট পাশ দিয়ে চলে গেল আবার, তিনি গড়িয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে চলে এলেন। জ্যাকেটের ভেতর চামড়ার সেই খোপটা রাখা, চেইনখুলে বের করে এনে একটু দেখলেন, কোন ক্ষতি হয়েছে কি না দেখে রেখে দিলেন। এই ঝোঁপটা দারুন একটা আড়াল। ইশারায় বিনোদ চোপড়াকে এগিয়ে আসতে বললেন তিনি।

বিনোদ চোপড়ার স্বাস্থ্য ভালো, নিয়মিত ব্যায়াম করে। খুব বেশি একটা বেগ পেতে হলো না ঝোঁপ পর্যন্ত আসতে। এবার যজ্ঞেশ্বরের পালা। সার্চলাইটের আলো চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে ইশারা করলেন তিনি।

পাথুরে জমিতে বুকে হেঁটে চলে এলো যজ্ঞেশ্বর। হাপাচ্ছে। হাসি পেলেও চুপচাপ থাকলেন তিনি। সন্ন্যাসী পুরুষের এই রুপ দেখলে তার ভক্তরা খুবই হতাশ হবে নিশ্চিত। সারা শরীর ধুলোবালিতে মাখা অবস্থায় একদম ভূতের মতো দেখাচ্ছে। সন্ন্যাসীকে।

জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট বাইনোকুলারটা বের করলেন। কাঠমুন্ডুতে থাকা অবস্থায় কিনেছিলেন। চারপাশ দেখে নিলেন, নেপাল সীমান্ত থেকে কিছুটা দূরে থাকায় ছোট নদীর ঐ পাশে কিছু দেখতে পেলেন না। এপাশে বেশ কয়েকজনকে চোখে পড়ল তার। এতোগুলো লোককে একসাথে শায়েস্তা করা অসম্ভব। অন্য কোন উপায়ে এগুতে হবে।

বিনোদ চোপড়াকে ইশারা করলেন তিনি, যতোটা সম্ভব মাথা নীচু করে রাখার জন্য। যজ্ঞেশ্বর পারলে যেন মাটির সাথে মিশে যায়। মাথা একটু তুলে তাকালেন, ঢালটা প্রায় পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোনে উপরে উঠে গেছে। ধীরে ধীরে বেয়ে উপরে উঠতে হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে সেখানে সীমান্তরক্ষীদের কেউ আছে কি না তা জানা যাচ্ছে না। এখান থেকে। না থাকার কোন কারন নেই যদিও।

ঢাল বেয়ে উপরে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সাবধানে এগুতে হবে, সার্চলাইট আছে, সীমান্তরক্ষীদের সাথে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত কুকুর আছে, একটু এদিক-সেদিক হলে জীবন নিয়ে আর ফেরা যাবে না।

***

জায়গাটায় এসে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল মিচনার। বাতাসে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করল। এখানে আজ মানুষ ছিল, তারা থেকেছে, রান্নাও করেছে। সেই গন্ধ এখনো বাতাসে পাক খাচ্ছে। তবে আলাদা করে একটা গন্ধ পাচ্ছে মিচনার। গন্ধটা একেবারেই অপরিচিত। দীর্ঘদিন বনে-জঙ্গলে থেকে প্রতিটা গন্ধ আলাদা করে চেনার বিশেষ একটা ক্ষমতা হয়েছে তার। গন্ধের মধ্যেই বিপদ চিনতে পারে সে। আলাদা যে গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা বিপদের। লোকটা ছিল এখানে, তার প্রতিদ্বন্ধী।

কিন্তু লোকটা একা ছিল না। পুরো জায়গাটা পর্যবেক্ষন করল মিচনার, অনেকক্ষন ধরে। আরো অন্তত দুজন মানুষ ছিল লোকটার সাথে। পায়ের ছাপগুলো আলাদা আলাদা করে বিবেচনা করলে তাই পাওয়া যায়। ঠিক তার মতোই একা থাকার কথা লোকটার, কিন্তু সে একা না, তার সঙ্গি আছে। কেন আছে তা জানা দরকার। এই পাহাড়ি এলাকায়ই বা কী কাজ লোকটার সেটাও জানা দরকার।

বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মিচনার। মনে হচ্ছে লোকালয় এখান থেকে বেশি দূরে নয়। লোকটা হয়তো লোকালয়ে গেছে। বাতাসে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করল মিচনার, পায়ের ছাপগুলো আরো মনোযোগ দিয়ে দেখল। একটা নির্দিষ্ট দিকে গেছে ওরা। সম্ভবত পূবে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখানেই আজ রাতটা কাটাবে বলে ঠিক করলো সে। এখানে একসময় হয়তো মন্দির ছিল, এখন ভাঙ্গাচোরা একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রাতে ঘুমানোর মতো একটা জায়গা পরিস্কার করে নিয়ে হেলান দিয়ে বসল মিচনার।

অনেক কাছে চলে এসেছে সে, আর একটু বাকি। শত্রুকে হাতে পেতে আর বেশি সময় লাগবে না। একটানা এতোদূর হেঁটে এসেছে বলে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে মিনারের। সন্ধ্যার আকাশে এর মধ্যেই তারা দেখা যাচ্ছে। চমৎকার বাতাস বইছে। চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছে, তাই চোখ বন্ধ করে ভালো কিছু চিন্তা করতে চাইল মিচনার।

অনেক খুঁজেও চিন্তা করার মতো ভালো কিছু পেল না। তার সব স্মৃতি মুছে গেছে যেন, পুরো মস্তিষ্কে শুধু একটাই গন্তব্য, একটাই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যও খুব কাছাকাছি। আগামীকাল সূৰ্য্য উঠার আগেই রওনা দেবে বলে ঠিক করলো সে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

.

অধ্যায় ১৪

দুপুরের আগেই রুমে ফিরে এসেছে রাশেদ। সাথে খাবারের দুটো প্যাকেট। দুটো সিমকার্ড! রাজু এখনো ঘুমাচ্ছে। ছোট টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার বের করে রাখল রাশেদ। ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু খাওয়ার আগে একটা কল করা দরকার।

নাম্বার ডায়াল করলো রাশেদ।

হ্যালো, ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ শোনা গেল।

কি খবর তোমার?

কে বলছেন?

একটু চেনার চেষ্টা করো, রাশেদ বলল, প্রায় ফিসফিসিয়ে। রাশেদ, বলতে গিয়ে ওপাশের নারীকণ্ঠ কেঁপে গেল যেন।

হ্যাঁ, লিলি, রাশেদ বলছি।

তুমি কি ঢাকায়?

না, আমি এখন কাঠমুন্ডুতে।

ওখানে কি করছো?

লাইন কেটে গেল, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডায়াল করলো রাশেদ। কিন্তু কল যাচ্ছে না। প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিল। হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা। কিংবা লিলি কেটে দিয়েছে।

রাজু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে লক্ষ্য করেনি রাশেদ।

কি রে, এতোকাল পর প্রেমিকার কথা মনে পড়লো?

খাবার এনেছি, খেয়ে চুপ থাক, এড়িয়ে গেল রাশেদ।

কী আনলি?

পরোটা আর ডিম।

এই খেয়ে চলবে আমার, আমি ভাত ছাড়া বাঁচবো? প্রশ্নটা কাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাজু বোঝা গেল না।

আগে খুলে দ্যাখ।

বিছানা ছেড়ে খাবার প্যাকেট খুলল রাজু। হাসিতে তার সব দাঁত বের হয়ে গেছে। সাদা ভাত আর মুরগীর মাংস।

এখানে পাওয়া যায়?

এক বয়স্ক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সাথে দেখা, তিনি দোকানটা চিনিয়ে দিয়েছেন, রাশেদ বলল, খাওয়ার পর বাইরে যাবো আমি, কাজের কাজ একটাও হয়নি।

আমিও যাবো তোর সাথে। দরজায় টোকা শুনে চমকে তাকাল রাশেদ। রুম সার্ভিসের এই সময়ে আসার কথা নয়। তাহলে কে এসেছে?

দরজার কী হোলে তাকাল রাশেদ। আহমদ কবির দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটাকে পছন্দ হয়েছে রাশেদের। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই ধরনের লোক পাশে থাকলে অনেক কাজে সুবিধা হয়।

আসুন, ভেতরে আসুন, রাশেদ বলল।

তোমরা খেয়েছো, আহমদ কবির বললেন ঢুকতে ঢুকতে। কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন ভদ্রলোক খেয়াল করেনি রাশেদ, অবশ্য এই বয়েসি একজন লোক তাকে তুমি করে বলতে পারে, তাতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই।

এই তো খাবো, দরজা বন্ধ করতে করতে রাশেদ বলল।

তোমরা খাও তাহলে, আমি টিভি দেখি, বলে রিমোটে চাপ দিয়ে টিভি ছেড়ে দিলেন আহমদ কবির।

রাজু একটু অবাক হলেও খাওয়া বন্ধ করেনি। রাশেদ গিয়ে বসল ওর পাশে।

আড়চোখে আহমদ কবিরকে লক্ষ্য করছিল রাশেদ। অদ্ভুত টাইপের লোক, অচেনা মানুষের সাথে ভাব জমাতে বেশি দেরি করে না। এরা হয় বোকা ধরনের, অথবা খুবই ধূর্ত। আহমদ কবির কেমন কে জানে?

খাওয়া দাওয়া শেষ হতে বেশিক্ষন লাগলো না। রাজুকে দেখে মনে হলো খুব তৃপ্তি করে খেয়েছে। তার ধারনাও ছিল না এখানে এই ধরনের খাবার পাওয়া যাবে।

আহমদ কবির চুপচাপ টিভি দেখছিলেন, ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে দেখে ঘুরে বসলেন।

তোমরা তো এবারই প্রথম এলে, তাই না?

জি, উত্তর দিলো রাশেদ।

নেপালে কিন্তু দেখার মতো অনেক জায়গা আছে, পোখরা যেতে পারো, লুম্বিনী যেতে পারো, আরো অনেক জায়গা আছে দেখার মতো। তোমরা থাকছে কয় দিন?

সপ্তাহ দুয়েক থাকার ইচ্ছে আমাদের, রাশেদ বলল, রাজু, উনি হচ্ছেন আহমদ কবিরসাহেব।

রাজু উঠে গিয়ে হাত মেলাল আহমদ কবিরের সাথে।

তোমরা চাইলে আমি তোমাদের সাথে যেতে পারি, আমার এখানে তেমন কোন কাজ নেই।

চিন্তা করছিল রাশেদ, কি বলবে। কাউকে সঙ্গি করার প্রশ্নই আসে না। এই লোকটা মনে হচ্ছে গায়ে পড়া টাইপের।

শুধু শুধু আপনার সময় নষ্ট হবে, আমরা দেখে নেবো, সব, আমতা আমতা করে। বলল রাশেদ।

উনি আমাদের সাথে গেলে তো ভালোই হয়, রাজু বলল, রাশেদ তাকে ইশারা করছিল, কিন্তু তার চোখে পড়েনি।

অবশ্যই, হেসে বললেন আহমদ কবির, আমি অনেক জায়গা চিনি। তোমাদের ভালোই হবে, আমারও খারাপ কাটবে না সময়।

ঠিক আছে, আপনার সমস্যা হবে ভেবেই বলছিলাম আর কি, রাশেদ বলল। রাজুকে কান ধরে উঠ বস করাতে ইচ্ছে করছিল, কখন কি বলতে হবে বুঝতে পারে না।

আমার কি সমস্যা? তোমাদের মতো ইয়াংম্যানদের সাথে ঘুরতে আমার ভালোই লাগবে।

রাশেদ হাসল, অনিচ্ছাকৃত হাসি। এমন কাজে এসেছে যা অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে গেলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কথা যখন দিয়ে দিয়েছে, তখন আর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। একসময় পেছন থেকে ঝেড়ে ফেললেই হবে।

রাশেদ, উনাকে বল না, রাজু বলল, রাশেদের দিকে ঝুঁকে, ফিসফিস করে।

কি বলব? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাশেদ। তিব্বতের কথা? উনি হয়তো স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

আহমদ কবিরের চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করলো রাশেদ, তিব্বত শব্দটা হয়তো কানে গিয়ে থাকবে।

না বুঝে কথা বলিস না, চাপা গলায় বলল রাশেদ।

তোমরা কি তিব্বতে যেতে চাও? আহমদ কবির বললেন, একটু লজ্জিত স্বরে।

হ্যাঁ, রাশেদ বলল, রাজুর দিকে তাকাল এমনভাবে যেন চোখ দিয়েই পুড়িয়ে ফেলতে চায়।

আমি তোমাদের স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি, যদিও একটু খরচ করতে হবে।

খরচ করতে পারবো আমরা, রাজু বলল রাশেদকে দেখিয়ে, ওর অনেক দিনের শখ।

এইসব শখ অপূর্ন রাখতে হয় না। তা কবে যেতে চাও তোমরা?

পাস পেলেই যাবো।

ঠিক আছে, কালই দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি না, বললেন আহমদ কবির।

কালকেই?

হুম, এখানে আমার অনেক পরিচিত।

তাহলে তো ভালোই হয়,রাজু বলল।

তোমরা থাকো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, বললেন আহমদ কবির, দরজা খুলে এগিয়ে দিল রাশেদ।

একটা সমস্যার তো সমাধান হলো, রাজু বলল।

আরেকটার সমাধান কিভাবে করবো, অস্ত্র?

এগুলো আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাজ, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তাহলে চল, বাইরে ঘুরে আসি।

একটু পরই হোটেলের বাইরে চলে এলো দুজন। অনেক দূর থেকে ওদের লক্ষ্য করছিলেন আহমদ কবির। মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দিলেন।

***

ঝাংমু জায়গাটা চমৎকার, যেন মেঘের কোলে ছোট্ট একটা শহর। সুন্দর রাস্তাঘাট, রাস্তার দুপাশে একতলা, দোতলা হোটেল, বিপনীবিতান। সীমান্তবর্তী শহর, তাই প্রচুর পর্যটক চোখে পড়ে। পাহাড়ের গায়ে হেলান দেয়া সুন্দর, ছিমছাম একটা হোটেল বেছে নিলেন ড. কারসন। তিন রুম ভাড়া নিলেন, সঙ্গি বলতে এখন কেবল সন্দীপ আর লতিকাই অবশিষ্ট আছে। নেপাল সীমান্তেই ড্রাইভার আর জিপ ছেড়ে দিয়েছেন ভাড়া মিটিয়ে, এপাশে তাই নতুন করে গাড়ি ভাড়া করতে হবে।

তবে সমস্যা হচ্ছে এসব কাজ তাকে নিজেই করতে হবে। সন্দীপ চুপচাপ থাকে, না বললে কোন কথার উত্তর দেয় না। লতিকা মেয়ে হিসেবে অনেক গম্ভীর। যদিও এর আগে যখন দেখা হয়েছিল তখন তাকে এতোটা গম্ভীর মনে হয়নি।

হোটেলের লবীটা ছোেট। রুম তৈরি হয়নি এখনো, তাই এখানে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছে তিনজন। মাথার উপর আদিকালের একটা ফ্যান ঘুরছে, তাতে শব্দ উৎপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন কাজ হচ্ছে না। সন্দীপ একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছে, চায়নীজ ভাষায় পত্রিকা দেখে সে কি করবে বুঝতে পারলেন না ড. কারসন। লতিকাও চুপচাপ, কোন কিছু নিয়ে ভাবছে গভীরভাবে।

সন্দীপ, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে, ড. কারসন বললেন।

কি কাজ?

আমাদের একটা জিপ লাগবে, সাথে দুজন লোক।

দুজন লোক কেন?

কিছু মালপত্রও লাগবে, যেমন বেলচা, ছুরি, বালতি, এইসব জিনিস।

তিব্বতে ঢুকতে পেরেছি এটাই অনেক কিছু, ওরা যদি ভাবে আমরা কোন খোঁড়াখুড়ি করতে যাচ্ছি, তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। চায়নীজরা এমনি সন্দেহের চোখে দেখে তিব্বতে আগত সব পর্যটককে। এছাড়া পাস থাকলেও সব জায়গায় যেতে পারবো না আমরা।

পারবো না কেন?

পাসে যে যে জায়গার কথা লেখা, তার বাইরে কোথাও যেতে পারবো না।

তুমি আমাদের পাস খুলে দেখেছো?

না, আমতা আমতা করে বলল সন্দীপ, তারপর ব্যাগ খুলে পাস বের করে এগিয়ে দিলো ড. কারসনের দিকে।

এখানে লেখা, ড. কারসন বললেন, দিজ পারসনস এন্ট্রি এজ নট রেস্ট্রিকটেড ইন তিবেত ফর নেক্সট ফিফটেন ডেইজ।

চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো সন্দীপের।

যাক, কিন্তু পনেরো দিনে আমাদের কাজ হবে?

সম্ভাবনা কম, প্রয়োজনে মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করতে হবে।

রিসেপশন থেকে এগিয়ে এলো একজন, চেহারায় হাসি ঝুলিয়ে।

অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ, স্যার, আপনাদের রুম তৈরি, রিসেপশনের লোকটা বলল।

আচ্ছা, এখানে জিপ পাওয়া যাবে, ভাড়া?

হ্যাঁ, পাওয়া যাবে, আপনার কখন লাগবে।

উত্তর দেয়ার আগেই একজনকে হোটেলে ঢুকতে দেখলেন ড. কারসন। হাঁটাচলার ভঙ্গিটা পরিচিত মনে হলো। কাউন্টারে এসে রিসেপশনের লোকটার দিকে তাকাল।

হ্যালো, তোমাকেই খুঁজছিলাম, রিসেপশনিষ্ট বলল, গেস্টদের জিপ দরকার, বেশ কয়েকদিনের জন্য। তুমি ফ্রি আছো?

ঘুরে তাকাল লোকটা, মাথায় ছোট একটা টুপি, পরনে টাইট প্যান্ট, সবুজ রঙের, পরনের শার্টটাও বাহারি। অনেকটা সত্তরের দশকের হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো লাগছে, ভাবল সন্দীপ। লোকটার গায়ের রঙ সাধারন তিব্বতীদের চেয়ে একটু চাপা, চোখ দুটো ছোট ছোট।

টাকা দিলে আমি ফ্রি, হেসে বলল লোকটা, বোঝা গেল সে জিপ চালায়।

হাসিটা পরিচিত ড. কারসনের, তিনি কিছু বলতে যাবেন, লোকটার ইশারায় থেমে গেলেন। এই মানুষটা তার খুবই পরিচিত। এই মুহূর্তে খুব আপনও মনে হচ্ছে।

আমরা বিকেলে একটু ঘুরতে বের হবো, ড. কারসন বললেন, আপনি জিপ তৈরি রাখবেন।

জি, আচ্ছা, বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল লোকটা, তারপর চলে গেল বাইরে।

কিছু মনে করবেন না, লোকটা এমনই, রিসেপশনিষ্ট বলল, তবে ড্রাইভার ভালো, ওর হাতে কোনদিন অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। এছাড়া গাইড হিসেবেও চমৎকার।

কতোদিন ধরে চেনেন ওকে? সন্দীপ জিজ্ঞেস করল।

প্রায় ছয় সাত বছর হলো আমাদের এখানে কাজ করছে, রিসেপশনিষ্ট বলল।

হোটেল বয় ব্যাগপত্র নিয়ে গেল সবার। নিজেদের নাম পরিচয় রেজিস্টারে লিখে রুমের দিকে হাঁটতে থাকলেন ড. কারসন, পেছনে ড. লতিকা আর সন্দীপ।

ড্রাইভারটাকে চিনতে পেরেছো? ড. কারসন জিজ্ঞেস করলেন সন্দীপের উদ্দেশ্যে।

কিভাবে চিনবো, এই প্রথম তিব্বতে এলাম, সন্দীপ বলল।

ভেবে বলো।

কিছুক্ষন ভাবল সন্দীপ। তার মাথায় কিছু খেলছে না।

ড্রাইভার আর কেউ না। সুরেশ, আমাদের সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা!

*

অধ্যায় ১৫

বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে কিশোর। তার দুরন্তপনা বেড়েছে। কৌতূহল তার চরিত্রের প্রধান গুন। সব কিছুই সে জানতে চায়, বুঝতে চায়। বাবা-মা হারানোর দুঃখ অনেক আগেই ভুলে গেছে। জানে, পৃথিবীতে অতীত আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে হবে না, এগিয়ে যেতে হবে। তবে এই পৃথিবীতে এগিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি অনেক ধীর। বলা যায়, পৃথিবী একই নিয়মে চলছে, চলবে আরো বহুদিন।

নিজের মাতৃভূমি ছেড়েছে অনেকদিন হলো, সেই বৃদ্ধের সাথে। বছর গড়ানোর সাথে সাথে বৃদ্ধের বয়স বেড়েছে, এখন আর ঘর ছেড়ে বের হয় না কোথাও। সেও এখন আর কিশোর নেই। তাকে তরুন বলা চলে। কুড়ি বছর হতে আর বেশি দিন বাকি নেই। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল, ঝকঝকে চেহারা, সুন্দর এক জোড়া চোখ, এক দেখায় যে কেউ তাকে সুদর্শন বলতে বাধ্য। বৃদ্ধের সাথে থেকে আরেকটা ব্যাপার রপ্ত করেছে, তা হচ্ছে ভাষা শিক্ষা। অনেক ধরনের ভাষা সে জানে এখন। এক সময় বৃদ্ধের সাথে সাথে অনেক দেশ ঘুরেছে। অনেক মানুষের সাথে মিশেছে। গত কয়েকবছর ছিল তার জন্য শেখার বয়স। তার কৌতূহলি মন এক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্য আরেক দিকেও তার মনোযোগ বেড়েছে। সেটা হচ্ছে নারী। যদিও ঘনিষ্টভাবে কারো সাথে মেশার সুযোগ হয়নি,তবু তার প্রতি নারীজাতি যে আকর্ষন বোধ করে এটা মাঝে মাঝেই টের পায় সে। কিন্তু বৃদ্ধ তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে রেখেছে। সামান্য নারীর পেছনে দেয়ার মতো সময় তার নেই। তাকে তৈরি করা হচ্ছে আরো বড় কোন কাজের জন্য। মানবজাতির বৃহত্তর উপকারের জন্য। কথাগুলো বৃদ্ধের মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কী কোন ধারনাই নেই তার। তার মতো সাধারন একজন মানুষ মানবজাতির কী উপকারে লাগতে পারে, এটা মাথায়ই আসে না। কিন্তু বৃদ্ধের কথা ফেলে দেয়ার অবকাশ নেই।

এই লোকটা না থাকলে বহু আগেই তার এই দেহ পৃথিবীর মাটিতে মিশে যেত।

মজার ব্যাপার হলো, বৃদ্ধ তাকে একটা নামও দিয়েছে, মিনোস। এই নামে নাকি কোন এক রাজা এক দ্বীপ রাজ্য শাসন করতো, দ্বীপটার নাম ক্রীট। যাই হোক, নাম নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার। নাম একটা হলেই হলো। বৃদ্ধের অবশ্য একটা নাম ছিল, এখন সেই নামে আর কেউ ডাকে না, সবাই বলে পাগল বুড়ো।

নীল নদের ধারে তার বসবাস। মাটির একটা ঘর আছে বৃদ্ধের, সেই ঘরের পাশে তার জন্য আলাদা একটা ঘর তৈরি করে নিয়েছে সে কিছুদিন হলো। এই দেশটায় আলাদা একটা সম্মান আছে বৃদ্ধের। একসময় রাজকীয় পুরোহিত ছিল। পরবর্তীতে ফারাওয়ের মৃত্যুর পর রাজকীয় পুরোহিতের কাজ থেকে অবসর নেন বৃদ্ধ। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান এবং এক সময় বিপদ থেকে উদ্ধার করেন মিনোসকে।

সন্ধ্যার কিছু পরপর বাসায় ফিরলো মিনোস। বৃদ্ধ বসে ছিল উঠোনে। ইদানিং চোখে তেমন দেখে না। তবে মিনোস এসেছে বুঝতে পারল।

কোথা থেকে এলে?

এই তো, এখানেই ছিলাম, হাসি খুশি মিনোস উত্তর দিলো।

আজ তোমাকে গুরুত্বপূর্ন কিছু কথা বলব।

কণ্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনালো বৃদ্ধের। এগিয়ে গেল মিনোস।

তোমাকে আমি অনেক কিছুই শিখিয়েছি, তোমার কি সেসব মনে আছে?

জি, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি ব্যাখ্যা মনে আছে।

কাল সকালেই তুমি এখান থেকে চলে যাবে, খুকখুক করে কাশলেন বৃদ্ধ, যাওয়ার আগে কিছু জিনিস তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি, সেগুলো নিয়ে যাবে।

আমি কেন যাবো? এখানে তো ভালোই আছি।

এখানে থাকা আর নিরাপদ না তোমার জন্য, রাজকীয় বাহিনীর চোখে পড়ে গেছে তুমি, ওরা যে কোন সময় ধরে নিয়ে যাবে তোমায়।

কিন্তু আমি তো অন্যায় কিছু করিনি।

আমি জানি তুমি কিছু করোনি। তুমি অনেক বড় কাজের জন্য তৈরি হয়েছে, এখানে এই গ্রামে পড়ে থাকা তোমার জন্য বেমানান।

কিন্তু…

তোমাকে কিছু জিনিস শিখিয়েছি, সাধারনের চোখে তা যাদু, কিন্তু নেহাত যাদু নয় তা, তুমিও জানো। আমি চাই এই শিক্ষাগুলো তুমি কাজে লাগাবে।

কিন্তু আমি তো এভাবেই থাকতে চাই।

বৃদ্ধ তাকালেন চারপাশে। যেন আশংকা করছেন আশপাশে কেউ আছে, কানপেতে তাদের কথা শুনছে।

আমি নিজেই হয়তো পারতাম, কিন্তু মন উঠে গেছে, আমার আর কিছু ভালো লাগছে না।

বুঝলাম না।

তুমি কি এমন জীবন যাও, যেখানে কোন মৃত্যু নেই, জ্বরা নেই। শুধু সীমাহীন জীবন?

আমি চাই না,দৃঢ়কণ্ঠে বলল মিনোস।

কিন্তু আমি চাই, তাই সারা পৃথিবী ঘুরেছি, তার ফলও পেয়েছি, বহু ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, মরুভূমি, সাগর, বরফে ঢাকা পাহাড়, বৃষ্টি, সব দেখেছি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল একটাই।

কি উদ্দেশ্য?

অমরত্ব। সেই খোঁজ আমি পেয়েছি।

চুপ হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। মিনোস তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। লোকে পাগল বুড়ো এমনি এমনি বলে না তাহলে!

আপনি অমরত্ব খুঁজে পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

ভালো কথা, তাহলে অমর হয়ে যান, মানা করছে কে? হাল্কা চালে বলল মিনোস।

কেউ মানা করেনি,কিন্তু এখন আমার ইচ্ছে করে না।

বুঝলাম না। আপনি অমরত্বের পেছনে দেশে দেশে ঘুরেছেন, সেটা খুঁজেও পেয়েছেন, কিন্তু এখন আর চাচ্ছেন না?

না।

তাহলে আর কি, বাদ দিন এই প্রসঙ্গ।

আমি চাই, তুমি অমর হও।

এই জীবনটা এভাবেই যাক না, কী হবে অমর হয়ে?

সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু তোমাকে আমি পথ বলে দেবো, বাকিটা তোমার কাজ।

আমার মোটেও ইচ্ছে নেই।

যাই হোক, কাল সকালেই এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তোমার জন্য একটা নৌকা তৈরি থাকবে। এখান থেকে অনেক দূরে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

আমি যাবো না।

যেতে তোমাকে হবেই।

আপনার যা ইচ্ছে হয় বলুন। আমি যাচ্ছি না এদেশ ছেড়ে।

ঘুমাতে যাও।

উঠে পড়ল মিনোস, আসলেই তার ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সে। বৃদ্ধকে রেখে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। লোকটার মাথা আসলেই খারাপ হয়েছে, ভাবছিল সে। তার বিছানার উপর ছোট একটা পোটলা রাখা, সাধারনত কোথাও যাওয়ার সময় ব্যবহার করা হয়। পোটলা খুলল মিনোস।

বেশ কিছু জামা-কাপড়, আর একটা মাটির তৈরি পাত্র চোখে পড়ল। বেশ ভারি জিনিসটা। মুখটা শক্ত করে লাগানো। ঝাঁকি দিল, ভেতরে ভারি কোন কিছু আছে, জোরে চাপ দিয়ে মুখটা খুলে ফেলল মিনোস। পুরো পাত্রটা স্বর্ন দিয়ে ভরা, ছোট ছোট গোলাকার স্বর্ন। এই জিনিসের আলাদা কোন মূল্য নেই মিনোসের কাছে, তবু বৃদ্ধ যখন দিয়েছেন নিশ্চয়ই বিশেষ কোন কারন আছে। আরো একটা জিনিস আছে, পোড়া মাটির একটা ফলক, চ্যাপ্টা ধরনের, লাল রঙা ফলকটা বেশ শক্ত, বিছানায় সাবধানে রাখল সে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা জিনিস আঁকা, তার এখানে সেখানে বেশ কিছু তীর চিহ্ন, বড় একটা চিহ্ন আছে, বোঝা যাচ্ছে সেটাই লক্ষ্যবস্তু। চিহ্নটা একটা গোলকের, সেখান থেকে আলোর বিচ্ছুরন হচ্ছে বোঝানোর জন্য বেশ কিছু দাগ দেয়া গোলকের চারপাশে, গোলকের নীচের দিকে ছোট একটা পাত্র আঁকা। গোলকটা একটা ত্রিকোন আকৃতির মধ্যে বসানো। এই ধরনের আকৃতি আগে কখনো দেখেনি সে। এটা সম্ভবত কোন পাহাড় হবে, ভাবল মিনোস।

বিছানা তৈরিই ছিল। পোটলাটা একপাশে সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল সে। সকালে তার তেমন কোন কাজ নেই। শুয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল মিনোস।

হ্যাঁ, তার নাম ছিল মিনোস। অদ্ভুত, অনেক দিন পর নামটা মনে পড়লো। এখন এই নামে কেউ ডাকলে কি সাড়া দেবেন তিনি। সম্ভাবনা কম। গত কয়েক মাসে লখানিয়া সিং নামটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। এই নামটাও অদ্ভুত, এর মানে কী কে জানে।

সেদিন ভোর রাতেই পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। পালানোর সময় সাথে পোটলাটা সঙ্গে নিতে ভোলেননি। গ্রামটা নদীর পাশেই ছিল, বৃদ্ধের কথামতো একটা নৌকাও ছিল ঘাটে। হয়তো অন্য কারো আসার কথা ছিল, কিন্তু কারো জন্য অপেক্ষা করার সময় ছিল না। অন্ধকারে নিজেই দাঁড় বেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।

ঘুম ভেঙে গিয়েছিল উঠানে কারো পদশব্দ শুনে, একজন ছিল না, অনেকে এসেছিল একসাথে। এক হাতে ছিল মশাল, অন্য হাতে খোলা তরবারি, পরনে রাজকীয় সৈন্যের পোশাক। এই সময় আক্রমন করার মানে আর কিছুই না, খুন করতে এসেছে। ওরা। কি কারনে সেটা কখনো জানা হয়ে উঠেনি। বৃদ্ধকে বাঁচানোর উপায় ছিল না, অন্ধকারে কোনমতে নিজের প্রান বাঁচিয়ে চলে আসতে হয়েছিল। হয়তো এই বিপদের আশংকাই করছিলেন বৃদ্ধ। তাই তাকে চলে যেতে বলেছিলেন।

দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। এতোদিন পর আজ বৃদ্ধের চেহারাটা তার চোখে ভাসছে। কেমন শান্ত, সৌম্য চেহারা ছিল। রাজকার্য থেকে শুরু করে, ধর্ম, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা সব কিছুতেই দখল ছিল লোকটার। এমনকি সাধারন কোন বস্তুকে কিভাবে সোনায় পরিণত করা হয় সেটাও জানা ছিল। সেই সময় ব্যাপারটাকে স্রেফ যাদু মনে হলেও পরবর্তীতে তিনি দেখেছেন কিভাবে লোকজন এই গুপ্তজ্ঞান আবিষ্কার করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। সে আরো অনেক পরের কথা।

সেই ভোরে তিনি পালিয়েছিলেন গ্রাম থেকে। আর ফিরে যাননি। নীল নদের দেশে পরে যাওয়া হয়েছিল, অন্য নামে, অন্য বেশে।

কি ভাবছেন এতো? যজ্ঞেশ্বর বলল, পাশে বসে ছিল।

অন্যমনস্ক ছিলেন, তাকালেন যজ্ঞেশ্বরের দিকে। বিনোদ চোপড়াও আছে পাশে। চোখ বন্ধ, সম্ভবত ঘুমিয়ে নিচ্ছে।

তেমন কিছু না, বললেন তিনি, এখানে আরো ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করবো আমরা।

তারপর?

দূরের একটা পাহাড় দেখালেন তিনি। ভোরের আলো পড়ে কেমন ঝিকমিক করছে চূড়াটা।

ঐখানে যাবো আমরা, আরো অনেক পথ বাকি। যজ্ঞেশ্বর কি বুঝলো বোঝা গেল না, তাকিয়ে আছে পাহাড়টার দিকে।

এখন তারা তিব্বতে। অনেক কষ্টে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছে নিষিদ্ধ দেশে। সারারাত নির্ঘম কেটেছে, সারা শরীর এখানে-সেখানে কেটে গেছে।

এখন একটু বিশ্রাম দরকার। কিন্তু এমন খোলা জায়গায় সে ঝুঁকি নেয়া যাবে না।

বিনোদ চোপড়াকে আস্তে করে ধাক্কা দিলেন তিনি। প্রায় সাথে সাথে চোখ খুলল লোকটা, বিপদের আশংকায় প্রস্তুত।

উঠে পড়ুন, আর কিছুদূর গিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করবো, বললেন তিনি। কিছুক্ষনের ভেতরেই প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই।

আসল যাত্রা শুরু হলো এবার।

*

অধ্যায় ১৬

কাঠমুন্ডু শহরটা ভালো লাগছে রাশেদের, ব্যস্ত একটা জায়গা। এই সময় পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। এই শহরে তাদের পরিচিত কেউ নেই, এটাই সমস্যা। তিব্বতে যাওয়ার স্পেশাল পাস হয়তো যোগাড় করা সম্ভব, কিন্তু অস্ত্র পাবে কোথা থেকে এটাই মাথায় আসছে না। এই ভিনদেশে কে তাদের সাহায্য করবে। আহমদ কবির লোকটাকে ভালো এবং উপকারি মনে হয়েছে, কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তাকে বিশ্বাস করার কোন মানে নেই।

দরবার স্কয়ারে দাঁড়িয়ে চারপাশের লোকজন দেখছিল দুজন। রাজুকে খুব উফুল্ল দেখাচ্ছে। প্রথমবার বিদেশে আসার আনন্দ এখন কমে যায়নি।

কিন্তু একটা ফোন করা দরকার, তারা নিরাপদে কাঠমুন্ডুতে পৌঁছেছে এটা জানানো দরকার বিশেষ একজনকে।

নাম্বারটায় ডায়াল করলো রাশেদ। ফোন তুললেন ভদ্রমহিলা।

কি খবর তোমাদের? সব ঠিক তো?

জি, ম্যাডাম। সব ঠিক।

সীমান্তের দিকে রওনা হচ্ছো কবে?

কাল পাসের ব্যবস্থা হবে, পরদিন যাবো।

আর কিছু লাগবে তোমাদের?

ভাবছিলাম, আত্মরক্ষার্থে কিছু একটা প্রয়োজন ছিল আমাদের, মানে, সামনে কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা তো আগাম বলা যাচ্ছে না।

বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তোমাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারবো না।

ঠিক আছে, আমরাই ম্যানেজ করে নেবো।

কিভাবে?

দেখি, ম্যানেজ হয়ে যাবে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

ঠিক আছে, ভালো থেকো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখল রাশেদ।

চারপাশের লোকজন মন দিয়ে দেখছিল রাশেদ। সবাই কাজে ব্যস্ত, পর্যটকরা ছবি তুলছে একের পর এক।

একটা ক্যামেরা আনার দরকার ছিল, পাশ থেকে বলল রাজু। বিদেশে এলাম, অথচ কোন প্রমান নাই।

কেন, মোবাইলে তোল!

ওহ, ভুলেই গেছি। মোবাইলেও তো ছবি তোলা যায়, রাজু বলল, তুই আমার একটা ছবি তুলে দে, বলে রীতিমতো পোছ দিয়ে দাঁড়ায় রাজু।

পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে পটাপট কিছু ছবি তোলে রাশেদ। রাজুকে দেখায়। ছবি তোলার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রাশেদের। কিন্তু রাজুর চাপাচাপিতে তুলতে হয় কয়েকটা।

ছবি তুলতে গিয়েই ধাক্কা লাগল এক ছেলের সাথে। মনে হলো ছেলেটাই ধাক্কা দিয়েছে ইচ্ছে করে, রাজু পড়তে গিয়েও নিজেকে কোনমতে সামলাল। ছেলেটাকে দেখে নেপালি মনে হলো, গায়ের রঙ বেশ ফর্সা, টানা চোখ।

দেখে চলো না, চোখ নাই তোমার, পরিস্কার বাংলায় চেঁচাল রাজু।

তোমার চোখ নাই, ছেলেটাও বলল বাংলায়। তবে বলার ভঙ্গিটা অন্যরকম।

অ্যাই, আবার বাংলায় ঝারি দেয় দেখি, রাজু এগিয়ে যায় হাত তুলে, যেন বসিয়ে দেবে ছেলেটার গালে।

রাশেদ এগিয়ে আসে এবার, সরিয়ে নেয় রাজুকে।

এটা কি ঢাকা পেয়েছিস? চাপা গলায় রাজুকে বলে রাশেদ।

ঢাকা হোক আর কাঠমুন্ডু, ধাক্কা দিলো কেন, আবার সরি না বলে চোখ গরম করে পোলা।

ভাই, আপনি এতো চমৎকার বাংলা পারেন কি করে? ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে রাশেদ।

আমি ঢাকায় ছিলাম অনেকদিন, পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু পড়াশোনা শেষ না করেই চলে আসি, ছেলেটা বলল, বেশ স্বাভাবিক সুরে।

আচ্ছা, অবাক হলো রাশেদ, এভাবে কাকতালীয়ভাবে এমন একজনের সাথে পরিচয় হয়ে যাবে যে বাংলায় কথা বলে এবং স্থানীয়, এতোটা সে আশা কওেনি। বয়সও তাদের কাছাকাছি। এমন একজনকেই খুঁজছিল সে মনে মনে।

কিছু মনে করবেন না, আমার এই বন্ধুটির মাথা একটু গরম, রাজুকে দেখিয়ে বলল রাশেদ, হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটির দিকে, আমি রাশেদ, আজই এলাম ঢাকা থেকে।

আমি প্রশান্ত থাপা, ছেলেটিও হাত বাড়াল।

ও আমার বন্ধু রাজু।

মুখ গোমড়া করে হলেও হাত বাড়াল রাজু। হাত মেলাল প্রশান্ত থাপা।

এই প্রথম এলেন? প্রশান্ত থাপা বলল।

হ্যাঁ, প্রথমবার, রাশেদ বলল।

দোস্ত, ক্ষুধা পাইছে, রাজু বলল পাশ থেকে।

এখানে ভালো কোন হোটেলে যাওয়া যায়, যাষ্ট নাস্তা করবো, রাশেদ বলল।

আমার সাথে এসো, তোমাদের পছন্দমতো কিছু কিছু খাবার পাওয়া যাবে, প্রশান্ত থাপা বলল।

ছেলেটাকে ভালো লেগে গেছে রাশেদের, চুপচাপ ধরনের ছেলে। রাস্তার আশপাশে অনেক ছোট ছোট হোটেল, রেস্তোরাঁ, কিন্তু ছেলেটা এসব এড়িয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে। পেছন পেছন রাশেদ আর রাজু। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষন হলো। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করেছে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

আমার বাসায়, নিজের হাতে তোমাদের রান্না করে খাওয়াবো আমি, প্রশান্ত থাপা বলল।

মোরগ পোলাও করতে পারো?

এটুকু বলতে পারি আমার হাতে মোরগ পোলাও খাওয়ার পর আর কিছু খেতে চাইবে না তোমরা, হেসে বলল প্রশান্ত থাপা।

ওদের থেকে অন্তত পঞ্চাশ গজ দূরে অনুসরনকারি আছে একজন। প্রশান্তকে সেই পাঠিয়েছে, নিজেদের বয়েসি কারো সাথে ওদের বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগবে না মনে করে। ধারনা মনে হয় ঠিক। তার মুখে লম্বা চুরুট, মাথায় হ্যাঁ, চোখে মোটা চশমা। গায়ে ভারি পুলওভার, কাঠমুন্ডুতে যদিও এখনো তেমন শীত পড়েনি। নিজেকে আড়াল করার জন্যই হয়তো এই সতর্কতা। কিন্তু কাছে গেলেই তাকে চিনতে অসুবিধা হবে না পরিচিত কারো। তিনি আহমদ কবির। এই মুহূর্তের জন্য হলেও রাশেদকে চোখের আড়াল করা চলবে না। বস যে কোন সময় চলে আসবেন কাঠমুন্ডুতে। তখন তৈরি থাকতে হবে। নইলে মহাবিপদ।

***

ড. কারসন, আমি আসবো? দরজায় টোকা শুনতে পেলেন ড. কারসন, সন্দীপের গলা।

এসো।

ছোট একটা টেবিলে ল্যাপটপটা চালু করে কিছু কাজ করছিলেন ড. কারসন, বন্ধ করে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।

হোটেল রুমে ঢুকেছেন বেশিক্ষন হয়নি। গোসল শেষে স্থির হয়ে বসেছেন মাত্র। এরমধ্যে সন্দীপ এলো, একটু বিশ্রাম নেওয়াও কঠিন হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। সন্দীপকে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছিলেন না তিনি, বিশেষ করে ভিনগ্রহের প্রানী সম্পর্কিত ধারনা বলার পর থেকে। কিন্তু এখন লোকজন কম, সন্দীপকে এখন হাতে রাখতে হবে, ওর ধারনা যাই হোক না কেন।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো সন্দীপ। তার হাতে হলদে হয়ে যাওয়া খামটা।

এ ব্যাপারে আমাদের কথা হয়েছে, মি. সন্দীপ, ড. কারসন বললেন।

আমি আসলে আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলাম, সন্দীপ বলল।

ঠিক আছে, বলুন।

হলদে হয়ে যাওয়া পার্চমেন্ট কাগজটাকে সাবধানে বিছাল সন্দীপ। তার পাশে সাদা একটা কাগজ রাখল। তার হাতে চমৎকার একটা বলপয়েন্ট কলম দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বেশ তৈরি হয়ে এসেছে।

কিছু লেখা শুরু করবে এমন সময় দরজায় টোকা শোনা গেল। উঠে দরজা খুলে দিল সন্দীপ। ড. লতিকা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে জিন্সের প্যান্ট, উপরে ভারি সোয়েটার। সন্দীপকে দেখে একটু ইতস্তত করে রুমে ঢুকল।

আমি কি বিরক্ত করলাম? ড. কারসনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল লতিকা, তাকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছে।

আরে না, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম, ড. কারসন বললেন, একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন উঠে।

সন্দীপ এসে বসল তার আগের জায়গায়। দেখে মনে হচ্ছে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।

আপনারা কোন বিষয়ে কথা বলছিলেন, আমি তাহলে পরে আসি, লতিকা বলল।

তুমি আসাতে ভালোই হয়েছে, মি. সন্দীপ আমাদের একটা ধারনার কথা বলেছিলেন আগে, সে ব্যাপারেই আরো আলোচনার জন্য এসেছেন, ড. কারসন বললেন, এবার তাকালেন সন্দীপের দিকে, শুরু করুন মি. সন্দীপ।

এর আগে যখন কথা হয়েছিল, আপনি এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রানী সম্পর্কিত ধারনা একেবারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, সাম্ভালার সাথে ভিনগ্রহের প্রানী ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ডট চিহ্ন আর অন্যান্য কিছু চিহ্নকে আপনি ধরে নিয়েছেন তিব্বতিদের কাজ। কিন্তু আমি নেট ঘেটে দেখলাম, পৃথিবীর অন্যান্য অনেক জায়গায় যেখানে ভিনগ্রহের প্রানী এসেছিল বলে ধারনা করা হয়, সেখানে এসব চিহ্ন কিছু পাওয়া গেছে।

সেটা কিরকম?

হলদে পার্চমেন্ট থেকে দেখে দেখে কিছু চিহ্ন সাদা কাগজটায় আকঁল সন্দীপ। বেশ দ্রুততার সাথে, তারপর এগিয়ে দিল ড. কারসনের দিকে। বেশ মনোযোগ দিয়ে চিহ্নগুলো দেখলেন ড. কারসন, তারপর কাগজটা এগিয়ে দিলেন ড. লতিকার দিকে।

কিছু বুঝলে লতিকা? জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

আসলে বোঝার তেমন কিছু নেই, ড. কারসন, লতিকা বলল, বেশ কয়েকবার খুটিয়ে দেখল চিহ্নগুলো, এই রকম মিলে যাওয়াকে কাকতালীয় বলা যাবে না, কিন্তু যেসব স্থানের চিহ্নের সাথে এই চিহ্নগুলোর মিল আছে সেখানে সত্যি সত্যি ভিনগ্রহের প্রানী এসেছিল কি না তা এখনো প্রমান হয়নি,আর প্রমান ছাড়া যে কোন কিছুই অচল, টেবিলে রাখা পার্চমেন্টটা তুলে নিলো সে, আর এই কোড, এটা একটা বাইনারি কোড, মাঝে মাঝে অচেনা কিছু চিহ্ন থাকার কারনে পুরো মানেটাই বদলে গেছে। বাইনারি কোডে যেখানে শুন্য আর একের ব্যবহার থাকে, এখানে অন্য কোন সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে।

 আচ্ছা, বুঝলাম, এখন এই কোড আমাদের ভাঙতে হবে, কিভাবে সম্ভব? ড. কারসনের দিকে তাকিয়ে বলল সন্দীপ।

আমাদের দরকার এমন একজন যিনি প্রাচীন তিব্বতি জ্ঞান ধারন করেন, এখানে কোন মন্দিরে গিয়ে লাভ হবে না, পাহাড়ে অনেক গুফা আছে, যেখানে লামারা থাকেন, তাদের কেউ হয়তো আমাদের সাহায্য করতে পারেন, ড. কারসনের উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলল লতিকা।

দুজনের আচরন চোখ এড়াল না ড. কারসনের, কিন্তু তিনি আপাতত এসব ব্যাপারে নাক গলাতে রাজি নন। সন্দীপের সাথে প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের তেমন মিল ছিল না, এসবের পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।

আপনার কাছে দ্বিতীয় কোন প্ল্যান আছে? সন্দীপ জিজ্ঞেস করলো।

এই পার্চমেন্টের উপর ধারনা করা ছেড়ে দিয়েছি ধর্মশালা ছাড়ার আগেই। আমার ছোট খাট একটা প্ল্যান আগে থেকেই ছিল, নির্দিষ্ট একটা জায়গা আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি, সেখানে আমি যাবোই, ড. কারসন বললেন।

জায়গাটা নির্বাচন করলেন কিভাবে?

এখানে আসার আগে তিব্বতের উপর প্রচুর পড়াশোনা করেছি আমি, তিব্বতের নতুন-পুরাতন সব ম্যাপ ঘেঁটেছি, শেষে স্যাটেলাইট থেকে তথ্য যোগাড় করেছি। এমন জায়গার খোঁজ করেছি, যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি,যার তেমন কোন রেকর্ড নেই। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ সব হিসেব করে একটা জায়গা আমি ঠিক করে নিয়েছি, আসলে একটা না, দুটো জায়গা আমার মাথায় আছে। সম্ভবত এই দুই জায়গার একটি অথবা এর মাঝামাঝি কোথাও সাম্ভালার অবস্থান।

আপনি নিশ্চিত আপনার সব তথ্য সঠিক? মানে যে কেউ এসব তথ্য বদলাতে পারে, খুব কঠিন কিছু নয়।

তা নয়, কিন্তু আমার তথ্যগুলো একটা স্যাটেলাইটের তথ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। বলা যায় বেশ কয়েকটা হিসেবের পর আমি আমার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।

তাহলে তো আর কথাই নেই, সন্দীপ বলল, বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ মর্মাহত হয়েছে ড. কারসন তার ধারনার উপর গুরুত্ব না দেয়াতে।

কথা আছে মি. সন্দীপ, আপনার কাছে যে পার্চমেন্ট দিয়েছি, তার তথ্যেরও মূল্য আছে। যেকোন সময় আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হতে পারে, আমার হিসেবে ভুল থাকতে পারে, তা যদি হয়, তাহলে আপনার হিসেবমতো এগুতে হবে আমাদের।

ঠিক আছে, ড. কারসন, আমি উঠি, সন্দীপ দাঁড়াল, একটু পর আমাদের ড্রাইভার আসবে। আপনি বাইরে যাবেন?

না, যাবো না। তুমি যাবে, লতিকা? লতিকার উদ্দেশ্যে বললেন ড. কারসন।

না, আমি যাবো না।

এরকম উত্তরই আশা করছিল সন্দীপ। আর দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

আপনি কি ঐ কো-অর্ডিনেটসগুলো আমায় বলবেন, ড. কারসন?

সময় হলে সব বলবো, লতিকা, ড. কারসন বললেন, একটু ধৈর্য্য ধরো!

ধৈৰ্য্য একটি মহৎ গুন, হেসে বলল লতিকা।

তুমি এখন কি নিয়ে পড়াও? জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

আমার স্পেশালিটি হচ্ছে ওরিয়েন্টাল আর্কিওলজি, এখন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের উপরও কাজ করছি।

ভালো লাগলো শুনে, তোমার বাবার দখল তো মারাত্মক এই ক্ষেত্রে।

হুম, তার একটা বই আমাদের এখানে পাঠ্য। আর আপনাকে নিয়ে তো কথাই নেই, ওখানে আপনার কতো ফ্যান আপনি নিজেই জানেন না।

আমার মতো বুড়ো প্রফেসরের ফ্যান! অদ্ভুত!

আমি নিজেও কিন্তু আপনার বড় ভক্ত, লতিকা বলল, সাম্ভালার উপর আপনার বিশেষ একটা টান আছে সেটা আমি জানি।

বিশেষ কোন টান নেই লতিকা, শীতল গলায় বললেন ড. কারসন।

আমরা রওনা দিচ্ছি কখন? অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল লতিকা।

কাল সকালে। আজ এখানে বসে প্ল্যান গুছিয়ে নেবো। ডিনারের পর একসাথে বসবো আমরা।

ঠিক আছে, আমি তাহলে আসি, লতিকা বলল, রাতে দেখা হচ্ছে।

হ্যাঁ, হেসে হাত নাড়লেন ড. কারসন, রাতে দেখা হচ্ছে।

লতিকা চলে যাওয়ার পর চুপচাপ বসে রইলেন ড. কারসন, সাম্ভালার প্রতি তার বিশেষ টানের কথা আর কারো জানার কথা নয়। লতিকা কিভাবে জানে, নাকি কিছুই জানে না, কথার কথা বলেছে মাত্র।

পায়চারি করতে করতে ড. আরেফিনের কথা মনে হলো তার। উচিত ছিল এই লোকটার কাছে জায়গাটার কো-অর্ডিনেটসগুলো দিয়ে রাখা। বিশ্বাস করার মতো একমাত্র সে-ই ছিল।

জানালা দিয়ে তাকালেন বাইরে। দূরে পরিচিত মানুষটার কাঠামো দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার হিসেবে ভালোই অভিনয় করছে ছেলেটা। বেশ কিছু বছর আগেই হয়তো এখানে তাকে ঢোকানো হয়েছে, কাভার হিসেবে চেহারায় দেয়া হয়েছে অসাধারন মেক আপ। তিব্বতের মতো গুরুত্বপূর্ন স্থানে সাধারন কাউকে দেয়নি গোয়েন্দা সংস্থা র। লোকটাকে এখন দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না, এই মানুষটাই একজন ভারতীয়, র এর এজেন্ট, যে কোন সময় মানুষ মারতে যার হাত একবিন্দু কাঁপবে না, যে কোন উপায়ে নিজের মিশন পূরন করতে বদ্ধপরিকর।

সাম্ভালা খুঁজে পেলে, কী হবে? বৈজ্ঞানিক বড় একটা আবিষ্কার হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব? হাজার বছর ধরে যা লুকানো তিনি নিজেই কি তা খুঁজে করতে পারবেন? সেখানে এই র এজেন্টের কাজ কি হবে? কাজ শেষ হলে লোকটা যে তাদের মেরে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কি?

আসলে এই মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এখন দরকার ছিল ড. আরেফিনকে। এই লোকটা এখন কোথায়? কি অবস্থায় আছে?

***

আগের দিনগুলোই ভালো ছিল, কোথাও যেতে কোন ঝামেলা ছিল না, ছিল না কোন সীমান্ত। সেই জাহাজ ডুবির পর কতো দেশে দেশে ঘুরেছে, ধুলিধুসর মরুভূমি, বরফে ঢাকা পাহাড়, জঙ্গলের সেই আদিম ডাক, সব কিছুই এখন দারুনভাবে অনুভব করে মিচনার। সেই সময়গুলো হয়তো আর পাওয়া যাবে না, হয়তো যাবে, হয়তো নতুন করে ফিরে আসবে সব। একটাই লক্ষ্য সামনে, সেটা পূরন না হওয়া পর্যন্ত থামা যাবে না।

সারাদিন দূর থেকে সীমান্তরক্ষীদের কাজকর্ম লক্ষ্য করেছে মিচনার। দিনে-দুপুরে ছোট খরস্রোতা নদীটা পার হওয়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। এতোগুলো লোকের চোখ ফাঁকি দেয়া প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। সীমান্ত পারি দিতে হবে রাতে, যেমন তার প্রতিদ্বন্ধী দিয়েছে। জায়গাটা সনাক্ত করতে পেরেছে মিচনার। গায়ের গন্ধ, পায়ের ছাপ প্রতিটি জিনিস খুটে দেখেছে, চোখের সামনে চিত্রায়ন করে নিয়েছে কিভাবে পার হয়েছে ওরা সীমান্ত। এখন শুধু রাতের জন্য অপেক্ষা।

হাতে রাইফেল নিয়ে থ্যাবড়ামুখো চাইনীজদের যথেষ্ট বিপজ্জনক মনে হয়েছে মিচনারের কাছে। বোঝাই যাচ্ছিল এরা খুন করতে দ্বিধা করবে না অবৈধ অনুপ্রবেশকারিকে। কাজেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিচনার।

ছোট একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে আছে সে এখন। একটানা হেঁটে আসাতে ক্লান্ত লাগছিল কিছুটা। চোখ বন্ধ করে পুরানো কিছু জিনিস ভাবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল মিচনার। সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ভারি পোশাক, হাতে অস্ত্র, তাক করা তার দিকে।

***

সোহেল?

জি, বস।

যাওয়ার ব্যবস্থা করেছো?

জি, বস।

কবে?

আপনি বললে কালই।

কিভাবে যাচ্ছি আমরা?

বাই রোডে, জিপ ভাড়া নিয়েছি।

ঠিক আছে, যাও তুমি।

সোহেল চলে যাওয়ার পর আসনে বসলেন তিনি। কালো আলখেল্লা পরনে, মুখোশ পড়েছেন, মোমবাতির আলোয় পুরো রুমে অপার্থিব একটা পরিবেশের সূচনা হয়েছে। আগামী ঘন্টাখানেক সময় কেউ আর তাকে বিরক্ত করবে না। মহান লুসিফারের কাছে প্রার্থনায় বসেছেন তিনি। সামনে ছোট পেয়ালায় রাখা থকথকে কালচে তরলটা এক ঢোকে পান করে নিলেন। অদ্ভুত ভালো লাগছে। অনেক দিন পর শরীরে আলাদা এক ধরনের শক্তি অনুভব করছেন তিনি। সাধনা করার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। চারদিকে পাহাড়, মাঝখানের ঘন এই জঙ্গলে কেউ আসে না। কিন্তু এই সাধনায় ছোট একটা ছেদ টানতে হচ্ছে আপাতত। কালই রওনা দেবেন নেপালের উদ্দেশ্যে। ছেলেটা এখন প্রায় হাতের মুঠোয়, তিনি নিজের হাতে ওকে কজা করবেন, তার সাথে লাগতে যাওয়ার শাস্তি এবার হাতে হাতে টের পাবে ছোঁড়া। এই পেয়ালায় এবার ওর রক্ত দেখতে চান তিনি। মুখে ক্রুর একটা হাসি ফুটে উঠল তার।

জয়, মহান লুসিফারের জয়! তার গমগমে ভরাট কণ্ঠে পুরো ঘর কেঁপে উঠলো যেন।

*

অধ্যায় ১৭

প্রশান্ত, নামটাই সুন্দর, ভাবছিল রাশেদ। ছেলেটা মিশুক প্রকৃতির, চঞ্চল, প্রানবন্ত, অনেকটা রাজুর মতোই, যদিও রাজুর সাথে খুব একটা বনিবনা হবে বলে মনে হচ্ছে। না। সে নিজে সাধারণত কারো সাথে খুব তাড়াতাড়ি সহজ হতে পারে না। কিন্তু প্রশান্তকে অল্প সময়েই কাছের মানুষ মনে হতে লাগল রাশেদের কাছে। এটা হয়তো ভিনদেশে সমবয়েসি একজনকে পাওয়ার কারনে হতে পারে, সেই সাথে ছেলেটা বাংলায় কথা বলে। সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে, ছেলেটা তাদের জন্য নিজের সময় নষ্ট করছে।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে ওরা। ভীড় এড়িয়ে এখন যে এলাকায় হাঁটছে সেখানে রাস্তায় লোজন কম। এটা কোন বানিজ্যিক এলাকা নয়, কাঠমুন্ডু শহরের অভিজাত লোকেদের বাস এখানে। রাস্তার পাশে সুন্দর সুন্দর সব বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়ানো, ঢাকায় গুলশান, বারিধারায় এধরনের বাড়ি চোখে পড়ে। প্রতিটি বাড়ীর সামনে ছোট লন, সেখানে বাগানে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে।

পাশাপাশি হাঁটছিল তিনজন, প্রশান্ত মাঝখানে। শিস দিয়ে অতি পরিচিত একটা বাংলা গানের সুর তুলছে প্রশান্ত, ভালোই লাগছিল হাঁটতে রাশেদের। মনে হচ্ছে ঢাকার কোন রাস্তায় হাঁটছে সে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে।

কোথায় যাচ্ছি আমরা, প্রশান্ত? জিজ্ঞেস করল রাশেদ, তোমার বাসা কি আশপাশে কোথাও?।

এই তো একটু সামনেই, বাংলা খাবারের সব রেসিপি আমার জানা, হেসে বলল প্রশান্ত।

তোমাদের এখানে চিংড়ি পাওয়া যায়?

যাবে না কেন? তবে বাসায় চিংড়ি নেই, মোরগ পোলাও খেতে চেয়েছে, সেটাই রান্না করে খাওয়াব।

মোরগ পোলাও! জিভে জল এসে যাচ্ছে, রাজু বলল, চোখ চকচক করছে ভালো কিছু খাওয়ার আশায়।

রাস্তার শেষ মাথায় ছোট একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল প্রশান্ত, ছোট একটা উঠোন পেরিয়ে বাড়িটা, টাইলসের ছাদ, ইটের পাশাপাশি কাঠও ব্যবহার করা হয়েছে। উঠোনটা অন্ধকার, গেট খুলে এগিয়ে গেল প্রশান্ত, প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করলো।

আমি একাই থাকি, বলল প্রশান্ত, চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।

দরজার পাশেই সুইচে চাপ দিয়ে বাতি জ্বালাল প্রশান্ত।

বাড়িটায় ঢুকে অবাক হলো রাশেদ। বেশ বড় একটা বাসা। ঢুকতেই ড্রইং রুম, একপাশে ডাইনিং। শোবার রুমগুলো সম্ভবত ভেতরের দিকে। ড্রইং রুমটা চমৎকার, দেয়ালে ঝুলছে একটা এলসিডি টিভি যেটা মাত্র অন করেছে প্রশান্ত। সুন্দর লাইটিং রুমটায়, চোখে লাগে না। সুন্দর সোফাসেটে বসল রাশেদ, রাজু এখনো দেখছে ভেতরটা, সে ঠিক এমন বাড়ি আশা করেনি। প্রশান্ত বাড়াবাড়ি রকমের ধনী, এই ধারনা হলো তার।

বিয়ার চলবে? প্রশান্ত জিজ্ঞেস করল।

না-সূচক মাথা নাড়ল রাশেদ, রাজুর মুখ হাসি হাসি। প্রশান্ত ভেতরে ঢুকে গেল, সম্ভবত রান্নাঘরের দিকে, বিয়ার আনতে।

রাজুকে ইশারা করলো রাশেদ, পাশে বসার জন্য।

আমার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে, রাশেদ বলল।

অস্বস্তি কেন?

বুঝতে পারছি না, বলল রাশেদ, হাতে ছোট দুটো কাঁচের বোতল নিয়ে ঢুকল প্রশান্ত।

তোমরা টিভি দেখো, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি, রাজুর হাতে একটা বোতল ধরিয়ে ভেতরে চলে গেল প্রশান্ত।

রাজুকে কখনো বিয়ার খেতে দেখেছে বা শুনেছে বলে মনে পড়লো না রাশেদের, এক ঢোক খেয়েই চেহারা রীতিমতো কুঁচকে গেছে, আরেক ঢোক খাবে বলে মনে হলো

তার কাছে। টিভিতে একটা হিন্দি সিনেমা হচ্ছিল, মন বসছিল না রাশেদের, উঠে গিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা সরাতেই স্থির হয়ে গেল সে। গেইটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, ছোট মাইক্রোবাসের মতো, দুজনকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল গাড়িটা থেকে। কালো পোশাক পড়া, হাতে পিস্তল। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা নিরাপদ হবে না, ভাবল রাশেদ।

ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে আরো অবাক হলো। প্রশান্তের হাতে চকচকে একটা অস্ত্র, রাজুর পিঠের উপর ধরে আছে, দুহাত উঁচু করলো রাশেদ।

আমাদের কাছে তেমন কিছু নেই, রাশেদ বলল, আমাদের যেতে দাও।

তোমাদের কাছে কিছু চেয়েছি? ব্যঙ্গ করে বলল প্রশান্ত।

তাহলে, এধরনের আচরনের মানে কি? রাশেদ বলল, তার মাথায় কিছু আসছিল, যা করার এখনই করতে হবে, অস্ত্রধারি ঐ লোক দুজন প্রশান্তের সঙ্গি। সম্ভবত তাদের দুজনকে তুলে নিতে অথবা মেরে ফেলতে এসেছে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল রাশেদ, দুই হাত উঁচু করে রেখেছে, প্রশান্তের চোখে চোখ। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, রাজুর পিঠ থেকে পিস্তল তুলে রাশেদের দিকে তাক করতে গেল প্রশান্ত। তাতেই সুযোগ পেয়ে গেল রাজু। সোফা থেকে লাফ দিয়ে প্রশান্তের কব্জি ধরে ফেলল একহাতে, অন্য হাতে ভারসাম্য রেখে পড়ে গেল মেঝেতে। তাল সামলাতে না পেরে প্রশান্তও পড়ে গেল। দরজা খুলল প্রায় সাথে সাথে। কালো পোশাকধারী একজনের হাত দেখা গেল, দরজার পাল্লা দিয়ে জোরে আঘাত করলো রাশেদ। লোকটার হাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল মেঝেতে। হাত সরিয়ে নিয়েছে লোকটা, সাথে সাথে দরজা আটকে ফেলল রাশেদ। লক করে দিলো, ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে বাইরে দাঁড়ানো কালো পোশাকধারী দুজন।

পিস্তলটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল রাশেদ। মেঝেতে রাজু প্রশান্তের সাথে লড়ছে, প্রশান্ত ছোটখাট হলেও বেশ শক্তি ধরে, দুই হাত দিয়ে রাজুর গলা টিপে ধরেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রাজুর। আরেকটু এগিয়ে পিস্তলের বাট দিয়ে প্রশান্তের মাথায় আঘাত করলো রাশেদ। একপাশে ঢলে পড়ল প্রশান্ত। গলা ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়াল রাজু। দরজার তখনো ক্রমাগত ধাক্কিয়ে যাচ্ছে দুজন।

কি করবো এখন? রাশেদ বলল।

আমাদের দুজনের কাছে দুটো পিস্তল আছে এখন, রাজু বলল, প্রশান্তের পিস্তলটা হাতে নিতে নিতে।

যাই হোক, এখান থেকে পালাতে হবে, চারপাশে তাকাচ্ছে সে।

আমার পেছন পেছন আয়,বলল রাজু, রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

রান্নাঘরটা ছোট, গোছানো। এখান থেকে কিভাবে বাইরে যাওয়া যাবে মাথায় ঢুকছে না রাশেদের। রাজু কি যেন খুঁজছে তন্নতন্ন করে, বড় একটা রেকের পেছনে পাওয়া গেল জিনিসটা, ছোট একটা দরজা। তালা লাগানো। দরজাটা খুলবে বাড়ির পেছন দিকে। পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করলো কয়েকবার, খুলে গেল। দরজা খুলতেই দূর্গন্ধে দম আটকে এলো রাশেদের। আশপাশের সব ময়লা এখানে ফেলা হয়। একটু সামনেই ডোবা মতো, সেখানে ময়লার স্তূপ।

কিন্তু এখন এতোকিছু দেখার সময় নেই রাশেদের। রাজুর হাত ধরে টেনে বেরিয়ে পড়ল সে, পেছনে শুনতে পেল কালো পোশাকধারী দুজন ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েছে। নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত সময় হাতে নেই।

অন্ধকারে পাগলের মতো এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে দুজন, ডোবার পাশ দিয়ে। ময়লার স্তূপে মাঝে মাঝে পা হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাচ্ছে। পেছনে একবার তাকাল রাশেদ। রান্নাঘরের দরজায় একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। স্থির করতে পারছে না এই ময়লার স্তূপে ওদের খুঁজতে বের হবে কি না। ছোট একটা ঝোঁপমতো দেখে বসে পড়ল রাশেদ, রাজুও বসেছে পাশে।

বুঝলি তো, কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না, ফিসফিস করে বলল রাশেদ। কিন্তু একটা কাজ কিন্তু হয়ে গেছে, হেসে বলল রাজু।

কী?

একটার বদলে দুটো অস্ত্র এখন আমাদের হাতে, রাজু বলল।

এ কথাটা এতোক্ষন মাথায় আসেনি ভেবে অবাক হলো রাশেদ।

এখানে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না, হয়তো অন্য কোন পথে চলে আসতে পারে ওরা, রাশেদ বলল।

তাহলে কি করবো?

যেভাবেই হোক মেইন রোডে উঠতে হবে, তারপর হোটেলে ফিরতে হবে, এখানে বসে থাকলে ওরা সুযোগ পেয়ে যাবে।

তাহলে বসে আছি কেন?

প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাশেদ। হাত-পা কাদা, ময়লায় মাখামাখি। খেতে এসে এমন ঝামেলায় পড়তে হবে কল্পনাও করেনি সে। কিন্তু এভাবে তাদের পেছনে লাগার কারন কি? এই লোকগুলো কে? সাধারন ছিনতাই করার জন্য এতো ঝামেলা করার দরকার ছিল না। এর পেছনে বড় কোন কারন আছে। ড. আরেফিন সম্ভবত বড় কোন ঝামেলায় জড়িয়েছেন, ভাবল রাশেদ। শত্রুপক্ষ জেনে গেছে ড. আরেফিনকে উদ্ধার করতে তারা দুজন এসেছে নেপালে, তাই এই আক্রমন। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। তাদের দুজনকে হাঁটিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গেছে প্রশান্ত, অপহরন করার ইচ্ছে থাকলে তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো, কিন্তু তা করা হয়নি। আসলে ওদের ইচ্ছে ছিল রাশেদ আর রাজুকে মেরে ফেলা। প্রশান্ত প্রফেশনাল কিলার না, তার কাজ ছিল জায়গামতো দুজনকে নিয়ে যাওয়া, কিছুক্ষন আটকে রাখা। এই নেপালে কে তাদের মারতে চাইবে?

রাজুকে ইশারা করলো রাশেদ। থামতে হবে এখন। প্রায় মেইন রোডের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। সারা শরীর কাদায় মাখামাখি, এই অবস্থায় হোটেলে ফিরলে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কিন্তু কিছু করার নেই, এই সময় কারো বাসায় নক করে বলা যাবে না গোসলের পানি দিতে।

পরিচিত লোকটাকে দেখে আনন্দে চিৎকার দিতে ইচ্ছে হলো রাশেদের। আহমদ কবির এই সময় এখানে কি করছেন, সে কথা একবারও ভাবলো না সে। দৌড়ে এগিয়ে যাবে, পেছন থেকে আকঁড়ে ধরল রাজু।

দোস্ত, মনে নেই কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না? কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রাজু।

কিন্তু এই লোককে অবিশ্বাস করার মতো কোন কারন তো দেখি না, রাশেদও বলল ফিসফিস করে।

যাই হোক, এখান থেকে বের হবো না আমরা, রাজু বলল।

আহমদ কবির রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কারো সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। দূর থেকে দেখে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, একটু এগিয়ে গেল রাশেদ, একটা ঝোঁপের পেছনে লুকাল। আহমদ কবির এখন তার কাছ থেকে হাত দশেক দূরে।

একটা ট্যাক্সি ক্যাব আসছিল রাস্তা দিয়ে, হাত দেখিয়ে থামালেন আহমদ কবির, উঠে পড়লেন। ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়ার পর ঝোঁপের আড়াল ছেড়ে বের হলো রাশেদ, ইশারায় রাজুকে ডাকল।

কি হতো ঐ লোকটার সাথে গেলে? রাশেদ বলল, খুব সহজে হোটেল পর্যন্ত একটা লিফট পেয়ে যেতাম।

আমার তো মনে হলো লোকটা ওদের সাথে জড়িত, কাঁচুমাচু হয়ে বলল রাজু, ধারনা মনে হয় ভুল।

কিছু করার নেই, এখানেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে ওরা হয়তো সামনে আছে, অপেক্ষা করছে আমরা কখন এই রাস্তা দিয়ে যাব।

সারারাত এখানেই থাকবো আমরা, এই ভিজে কাপড়ে!

ঠিক আছে, চল, হাঁটি, কিন্তু সামনের রাস্তা দিয়ে না, উলটো দিকে যাবো আমরা, কোন ট্যাক্সি পেলে উঠে পড়বো, রাশেদ বলল।

রাজুর চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকলো ওরা, কিন্তু উল্টোদিকে।

*

অধ্যায় ১৮

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে লতিকার, ছোটবেলার অভ্যাস। তারপর একটু ব্যায়াম, হাল্কা নাস্তা শেষে কাজের জন্য তৈরি হয়ে নেয়া। এখানে অবশ্য সেসব নেই। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষন বসে রইল লতিকা। বাবার কথা ভাবছে। এতোক্ষনে হয়তো নিজের বাড়িতে পৌঁছে গেছেন, সাথে যেহেতু রামহরি আছে তাই কোন চিন্তা নেই। সেই ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর এই দুজনই তার সবচেয়ে আপন লোক। এখন চাকরির প্রয়োজনে অনেক দূরে থাকলেও মন পড়ে থাকে বাবার কাছে।

এই রকম একটা অভিযানে আসার মতো শারীরিক সামর্থ্য না থাকার পরও স্রেফ ইচ্ছে শক্তিতে এতোদূর এসেছিলেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। লতিকা বাঁধা না দিলে তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত থাকতেন। তাতে হয়তো ভদ্রলোকের স্বাস্থ্য আরো ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতো। তাই বাবাকে সরানোর জন্য ছুটি নিয়ে এতোদূর আসা লতিকার। জানতো এখানে পরিচিত আরো একজন থাকবে, যাকে একসময় সে প্রানের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো।

হ্যাঁ, সন্দীপ চক্রবর্তী। এই লোকটাকে সে ভালোবাসতো। একই সাথে পড়তে তারা চেন্নাই ইউনিভার্সিটিতে। বিয়ের কথাও ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সন্দীপ বেঁকে বসে। তার মৃত্যুপথযাত্রী মাকে দেয়া কথা রক্ষা করার জন্য অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। ব্যাপারটা আদৌ সত্যি কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে লতিকার। হয়তো তাকে কোনদিনই ভালোবাসেনি সন্দীপ। তার বাবা প্রফেসর সুব্রামানিয়ামও তাদের প্রেমের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন সন্দীপ তার মেয়ের সাথে প্রতারনা করছে, তিনি সহ্য করতে পারেননি। লতিকা তারপর স্কলারশীপ নিয়ে চলে যায় লন্ডনে, সেখানে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতায় যোগ দেয় হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে।

এতোদিন পর সন্দীপকে দেখে কেমন অস্বস্তি লেগেছে লতিকার। সন্দীপের ব্যক্তিত্বের সেই ছিটেফোঁটাও নেই, যেন অন্য এক মানুষ এই সন্দীপ চক্রবর্তী। অল্প বয়সেই বুড়িয়ে গিয়েছে যেন, তার সামনে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। হয়তো অপরাধবোধে ভুগছে, ভাবল লতিকা।

অতীত নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ সে নয়, যোগ্য কোন সঙ্গি এখন পর্যন্ত পায়নি,তাই অবিবাহিতই থেকেছে এখন পর্যন্ত।

সকাল আটটা বাজে। রুমে নাস্তা দিয়ে গেছে রুম সার্ভিস, সাথে একটা চিরকুট। নীচে লবিতে অপেক্ষা করছেন ড. কারসন। নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে নিল লতিকা। আজ ড. কারসনের প্ল্যান কি জানা নেই, এই হোটেলেই থাকবেন না রওনা দেবেন, বোঝা যাচ্ছে না। রুম থেকে বের হবার সময় ল্যাপটপের ব্যাগটা সাথে নিতে ভুলল না লতিকা, লাগেজের বড় ব্যাগটাও তৈরি, যেকোন সময় রওনা দেয়ার জন্য।

নীচে লবিতে সন্দীপের সাথে দেখা হয়ে গেল, তাকে দেখেই কেমন সংকুচিত হয়ে গেল লোকটা, চোখ এড়াল না লতিকার। ড. কারসনও ছিলেন, এগিয়ে এলেন লতিকাকে দেখে।

গুড মর্নিং, ড. কারসন বললেন, ঘুম হয়েছে ঠিকমতো?

হ্যাঁ, হেসে উত্তর দিলো লতিকা।

একটু পরই রওনা দেবো আমরা, তোমার লাগেজ রেডি?

জি।

হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়াল লতিকা। হুডখোলা দুটো জিপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একটায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ব্যাগ দেখতে পেল, সম্ভবত সন্দীপ আর ড. কারসনের। তার লাগেজ ব্যাগটা এনে রাখল একজন।

আমি আর তুমি সামনের জীপে বসছি, সন্দীপ বসবে পেছনেরটায়, ড. কারসন বললেন, পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কখন লক্ষ্য করেনি লতিকা।

ঠিক আছে।

প্রথম জীপটার পেছনের সীটে বসল লতিকা। ড্রাইভার এসে বসেছে মাত্র। লোকটাকে গতকাল হোটেলে একঝলক দেখেছে বলে মনে পড়ল। ড. কারসন পাশে বসলেন।

ড্রাইভার, গাড়ি ছাড়ো, ড. কারসন বললেন।

দুটো জিপ ছেড়ে দিলো।

বেশ ভালো লাগছিল তার। তিব্বতে আসার ইচ্ছে অনেকদিন আগে থেকেই ছিল।

ড. কারসন? ড্রাইভার বলল তার সীট থেকে, পেছন না ফিরে।

বলো, হেসে বললেন ড. কারসন।

ভাড়া কিন্তু ডাবল দিতে হবে, হেসে বলল ড্রাইভার। একটা সিগারেট ধরালো।

সিগারেট ধরালে কিন্তু একশ ডলার করে ফাইন হবে, রসিকতা করলেন ড. কারসন।

লতিকা কিছু বুঝতে পারছিল না। একজন ড্রাইভারের সাথে এতো খোশগল্প বা রসিকতার কি আছে।

তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার নতুন করে, ড. কারসন বললেন। ড্রাইভারসাহেব আমাদের পূর্বপরিচিত সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা, আর ইনি হচ্ছেন ড. লতিকা, প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের মেয়ে।

আমি উনাকে চিনি,ড্রাইভার ওরফে সুরেশ বলল, এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল।

লোকটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল লতিকা, এতো চমৎকার মেক-আপ হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তিব্বত সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল পরে দেখা হবে, কিন্তু সেটা যে এমন রুপে তা কল্পনাও করেনি সে। এই লোকটা যে ভারতীয় তা বোঝার কোন অবকাশই নেই।

আপনাকে দেখে ভালো লাগলো, হেসে বলল লতিকা।

আমি আছি, কোন চিন্তা নেই আপনাদের, সুরেশ বলল।

পেছনের জিপের ড্রাইভার বিশ্বস্ত তো? জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

একশ পারসেন্ট, কোনদিকে যাচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করল সুরেশ।

তুমি ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে চলতে থাকো, তারপর বলবো, ড. কারসন বললেন, পেছনের জিপের দিকে তাকালেন। সন্দীপ বেচারা কেমন একা পড়ে গেছে। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ বন্ধ করলেন ড. কারসন। অদ্ভুত ভালো লাগছিল তার। লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছেন মনে হচ্ছে। যদিও কাজ এখনো অনেক বাকি। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে এবার।

***

নিজের উপর আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই তার, অদ্ভুত ঘরের ভেতর কাটছে সময়। এখানে দিন রাত কিছু নেই, শুধু নিকষ অন্ধকার। মাঝে মাঝে আলোর চেহারা দেখেন, তবে সেটা সূর্যের আলো নয়, কিন্তু সে আলোতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। এই অন্ধকার রুমের সাথে আরো অন্ধকার একটা টয়লেটও আছে, গত কয়েকদিনে মাত্র দুতিনবার গিয়েছেন, সেটাও অস্ত্রের মুখে। কী অপরাধে এই ধরনের যন্ত্রনা ভোগ করতে হচ্ছে বুঝতে পারছেন না তিনি। অপরাধ একটাই, সাম্ভালার খোঁজ। একটা জায়গার যদি অস্তিত্ব নাই থেকে থাকে, তাহলে এতো ঝামেলা করার দরকার কী। তবে আগে কিছুটা সংশয় থাকলেও এখন তিনি একদম নিশ্চিত, সম্ভিালা আছে। প্রবলভাবেই আছে। কেউ কেউ সেই জায়গা চেনেও। এই লোকগুলো সেই দলে পড়ে না। এরা শুধু রক্ষাকারীর ভূমিকায় আছে।

ড. কারসন এখন কতোদূর কে জানে? সন্দীপ, সুরেশ, লতিকাকে নিয়ে তিনি হয়তো সত্যি সত্যি খুঁজে বের করতে পারবেন সাম্ভালা। তখন হয়তো তিনি থাকবেন না। ব্যাপারটা বেশ কদায়ক, এতোদূর এসেও শেষ পর্যন্ত থাকতে না পারাটা আসলেই দুঃখজনক। এরা হয়তো তাকে মেরে ফেলবে, অপেক্ষা করছে কোন নির্দেশের জন্য, কিংবা সময় নিচ্ছে। তবে তার ভাগ্যে যে মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ড. আরেফিন। একমাত্র মিরাকল কিছু ঘটলেই হয়তো মুক্তি পেতে পারেন এই লোকগুলোর হাত থেকে। মিরাকল ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীন। প্রিয় মুখ আর হয়তো দেখা হবে না, আফরোজা দিনের পর দিন তার অপেক্ষায় থাকবে। সে অপেক্ষা আর ফুরাবে না। কেউ নেই তাকে সাহায্য করার।

দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ড. আরেফিনের বুক চিরে।

এভাবে হার মানলে চলবে না, চোখ খুলে তাকালেন তিনি। একটা না একটা পথ বের হবেই।

দরজা খুলে গেল এই সময়। তরুন সেই চায়নীজকে ঢুকতে দেখলেন ভেতরে, পাশে সেই বৃদ্ধ পুরোহিত।

দুটো চেয়ার নিয়ে এসে তার সামনে বসল দুজন। তাকালেন ড. আরেফিন, আজ এদের চেহারা বেশ শান্ত দেখাচ্ছে, বিশেষ করে তরুন চায়নীজ আজ তার ধ্বংসাত্মক রুপে নেই আজ।

ড. আরেফিন, এই অঞ্চলের উপর জার্মান আগ্রহের কথা জানা আছে আপনার? বেশ শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ।

না।

ভ্রিল বলে কোন শব্দ শুনেছেন কখনো?

না।

থুল সোসাইটি?

না।

মুখ বেঁকিয়ে হাসলেন বৃদ্ধ। না ছাড়া আর কিছু বলা শেখেননি ড. আরেফিন, পাশে বসা তরুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন বৃদ্ধ।

যাই হোক, আপনি না জানতে পারেন কিন্তু আমরা জানি, বলে চলেছেন বৃদ্ধ, আপনি বাংলাদেশের সাধারন একজন প্রফেসর, কেন এসবের পেছনে এলেন সেটাই মাথায় ঢুকছে না।

উত্তর দিলেন না ড. আরেফিন।

একটা প্রস্তাব আমি আপনাকে দিতে পারি, একটু ঝুঁকে এলেন বৃদ্ধ, প্রায় ফিসফিস করে বললেন ড. আরেফিনের কানে কানে।

আপনি রাজি? জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ। মাথা নাড়ালেন ড. আরেফিন, না-সূচক।

ঠিক আছে, আরো দুটো দিন সময় দিলাম, বৃদ্ধ বললেন, এরপর তোমার যা ইচ্ছে হয় করো, তরুন চায়নীজের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি।

চোখ বন্ধ করেছিলেন ড. আরেফিন। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চোখ খুললেন। আবার অন্ধকার গ্রাস করেছে তাকে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই লোকগুলোও সাম্ভালার অবস্থান জানে না।

*

অধ্যায় ১৯

অনেক বছর পার হয়ে গেছে, মিনোসের বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। সেই পালানোর পর থেকে বদলে গেছে অনেক কিছু, পৃথিবী যেন অল্প সময়েই বদলে গেছে অনেকটা। গত কয়েকবছর ধরেই লোকালয় থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে মিনোস। এমন এক জায়গায় যেখানে বহু বছর আগে থেকেই তার আনাগোনা। সেই পুরানো পাহাড়ের গুহা। কৈশোরের অনেকটা সময় এখানে কাটিয়েছে সে। এখনো এই জায়গাটা তার অনেক ভালো লাগে।

তার নিজের গ্রামটা আর নেই। তার বদলে সেখানে ঘরবাড়ির ভাঙা কিছু কাঠামো চোখে পড়ে। পুরো এলাকা এখন পরিত্যক্ত, জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই কোথাও। যারা এই গ্রামটা আক্রমন করেছিল কোন এক সময় তারাই হয়তো এখানে থাকার কোন কারন খুঁজে পায়নি। পুরো এলাকা এখন বিষণ্ণ, নীরব। পাহাড় আর জঙ্গলের আধিপত্য এখানে, এই পরিবেশটাই ভালো লাগে মিনোসের। এখানে সে একাই থাকে, একাই শিকার করে, রান্না করে খায়। বেশিরভাগ সময়ই কাটে চিন্তা করে, তার এই জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী, এভাবেই একদিন সে মরে যাবে, পৃথিবীর বুকে সামান্য একটি আচঁড়ও না ফেলে। কি ভয়াবহ অপচয়, ভাবতেই শিউরে উঠে সে। অস্থিরভাবে পায়চারি করে গুহার মধ্যে। এই পৃথিবীর কেউ তাকে চেনে না, জানে না। কোন ধরনের জ্ঞানও সে হাসিল করেনি এতোদিনে, সেই বৃদ্ধ যা শিখিয়েছিল তার সামান্যই মনে আছে এখন।

খুব সামান্যই মনে আছে তার, বৃদ্ধের শেখানো জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষা, এগুলো চর্চা করা হয় না অনেকদিন। এছাড়া ছোটখাট কিছু যাদু, এই ধরনের যাদু একমাত্র সেই জানে এখন। সাধারন যে কোন পদার্থকে চকচকে সোনালী ধাতুতে পরিণত করা এখনো তার কাছে অনেক সহজ কাজ। পুরো পৃথিবীকেই হয়তো সেই সোনালী ধাতুর বিনিময়ে হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব। কিন্তু সে ধরনের কোন অভিপ্রায় নেই মিনোসের। ক্ষমতা মানুষকে পশু করে তোলে, অন্তত গত কয়েকবছর মানববসতিতে বাস করে তার এই ধারনাই হয়েছে। নিজেকে কোনভাবে লুকিয়ে রেখেছে সে, তার ভেতরের জ্ঞানকে বিকশিত হতে না দিয়ে, তাতে শুধু ঝামেলাই বাড়বে, আর কিছু হবে না।

কিন্তু আর ভালো লাগছিল না মিনোসের। এবার বের হতে হবে পাহাড়ের এই গুহা থেকে, অনেক বড় বড় কাজ বাকি আছে তার। বৃদ্ধ তাকে বলেছিল, অনেক বড় কাজের জন্য তার জন্ম। তিনি নিশ্চয়ই এমনি এমনি কথাগুলো বলেননি। পাহাড়ের গুহায় হেলান দিয়ে বসে তার যাবতীয় সম্পদের দিকে তাকাল মিনোস। বৃদ্ধের দেয়া জিনিসগুলো সব পড়ে আছে এক কোনায়, অনাদরে, অবহেলায়। সেই পোড়া মাটির ফলক, তা এখনো তেমনি আছে।

উঠে দাঁড়াল মিনোস। ঐ ফলকে দিনের পর দিন তাকিয়ে থেকেছে সে, বোঝার চেষ্টা করেছে সাপের মতো আঁকাবাঁকা সেই দাগটাকে, আলোর মতো চিহ্নটাকে, তিনকোনা আকৃতিগুলোকে। এতোদিন কেন মাথায় আসেনি ব্যাপারটা ভেবে অবাক হলো মিনোস।

সাপের মতো আঁকাবাঁকা দাগটা আর কিছু না, নীল নদ। সেই নদ ধরে যেতে হবে ঐ আলোর কাছে। তিনকোনা আকৃতিগুলো হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়গুলোর অবস্থান থেকে বের করতে হবে ঐ আলোর উৎস।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগে। অস্থির লাগছিল, আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছিল না গুহার এই আরাম আয়েশে। ঐ আলোক চিহ্ন তাকে ডাকছে। হয়তো আরো অনেক আগেই যাওয়া দরকার ছিল, হয়তো দেরি হয়ে গেছে অনেক। কিন্তু চোঁ করতে হবে, অন্তত বৃদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে।

রাতের অন্ধকারেই তৈরি হয়ে নিলো মিনোস। নীল নদ এখান থেকে অনেক দূর। পায়ে হেঁটে গেলেও অন্তত আট পূর্নিমা পর পৌঁছানোর কথা, পথে নানা কারনে দেরি হয়ে গেলে সময় আরো বেশি লাগবে। তেমন কিছু সম্বল নেই, বৃদ্ধের দেয়া জিনিসপত্রগুলোই তার একমাত্র সম্পদ। সেগুলো একটু গুছিয়ে নিয়ে গুহার বাইরে চলে এলো মিনোস। বাইরে আকাশে তখন পূর্ন চন্দ্র, পুরো পাহাড়, দূরের বন পূর্নিমায় আলোয় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।

আপনি কি এতো ভাবেন বলুন তো? যজ্ঞেশ্বরের খোঁচায় বর্তমানে ফিরে এলেন তিনি। পুরানো সব স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালো লাগে। এমন সব স্মৃতি যা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় না। ম্লান হাসি দেখা গেল তার মুখে।

এখানে রাত অনেক হয়েছে। সীমান্ত থেকে অনেক ভেতরে চলে এসেছেন তিনি। দিনের আলোয় পথ না চলে রাতের অন্ধকারকে বেছে নিয়েছেন। সঙ্গি দুজনের তাতে বেশ সমস্যা হলেও রাতের অন্ধকারে পথ চলতে তার কোন সমস্যা হয় না। দূর আকাশের তারারা তাকে পথ চেনায়।

সকাল পর্যন্ত এখানেই বিশ্রাম নেবো আমরা, বললেন তিনি।

সন্ধ্যার পরপর হাঁটতে শুরু করেছিলেন, এখন মধ্য রাত পার হয়ে গেছে। তার নিজের বিশ্রাম না লাগলেও সঙ্গি দুজনের বিশ্রাম দরকার। বড় একটা ঝোঁপের আড়াল বেছে নিলেন তিনি, বিশ্রামের জন্য। চারপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষন করে দেখলেন। এখানে লোকজন খুব একটা আসে বলে মনে হলো না। হয়তো রাখালের দল তাদের ইয়াক বা ছাগলের পাল নিয়ে চলে আসে, সেটাও খুব কম।

ঝোঁপের আড়ালে নিজেদের ঘুমানোর মতো ব্যবস্থা করে নিলেন তিনি। একপাশে বিনোদ চোপড়া আর যজ্ঞেশ্বর, অন্যপাশে নিজের জন্য বিছানা করলেন। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো দুজন, অন্তত যজ্ঞেশ্বরের ব্যাপারে নিশ্চিত, যেভাবে নাক ডাকছে তাতে নিশ্চিত না হয়ে উপায় নেই। বিনোদ চোপড়াও ঘুমিয়ে পড়েছে, এক টানা হেঁটে ক্লান্ত।

যজ্ঞেশর আর বিনোদ চোপড়াকে নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবেন তিনি। বেশ কিছু দিন ধরেই চুপচাপ বিনোদ চোপড়া, সারাক্ষন একমনে কি একটা ভাবে। তবে চোখ সজাগ, তার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে সেই ম্যাকলডগঞ্জ থেকে রওনা দেয়ার সময় থেকে। আর যজ্ঞেশ্বর আগের মতোই আছে, সবসময়ই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে।

এই দুজন তার সাথে আছে, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছাড়া সেটা মোটামুটি অসম্ভব। উদ্দেশ্যগুলো কি সে সম্পর্কেও খানিকটা ধারনা আছে তার। আরো চিন্তা করলে ধারনা পরিস্কার হয়ে যাবে, কিন্তু এই বিষয়ে ভাবতে চাচ্ছেন না তিনি এখন। এরা দুজন এখনো তার সহযোগী, সময়মতো হয়তো ভালোভাবেই কাজে লাগানো যাবে। যদি উলটাপালটা করার চেষ্টা করে তাহলে কি করতে হবে সেটা তার ভালোই জানা আছে।

ঘন্টাখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর উঠে বসলেন তিনি। এবার একটা প্ল্যানে চলা দরকার। তিব্বত পর্যন্ত চলে এসেছেন, কিন্তু এলোপাথারি ঘুরে কোন লাভ হবে না। সবচেয়ে বড় কথা সেই শেবারনের দেয়া চামড়ার খোপটা তার সাথে আছে। এবার সেই খোপ খোলার সময় হয়েছে।

আজও পূর্নিমা, সেদিন গুহা ছাড়ার সময় যেমন পূর্নিমা ছিল, ঠিক তেমনি। পূর্নিমার আলোয় সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে সাবধানে উঠলেন, যাতে কোন শব্দ না হয়। চামড়ার খোপটা যে ব্যাগে আছে সেটা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। গোলাকার একটা পাথরের উপর রাখলেন খোপটা, তারপর ভেতর থেকে বের করে আনলেন শেবারনের দেয়া সেই ম্যাপ, দুপাশে কাঠের টুকরোর মাঝে ভাঁজ করা পার্চমেন্ট।

এর আগে একে পার্চমেন্ট মনে হলেও হাত দিয়ে দেখলেন তিনি, জিনিসটা আসলে কাপড়ের তৈরি, বেশ পুরু আর মসৃন, এতো বছর ধরে পড়ে আছে, অথচ মনে হচ্ছে। একেবারে নতুন। তিব্বতি ভাষা শিখেছিলেন একসময়, এখনো সব মনে আছে। কিন্তু এখানে যে হরফগুলো দেখতে পেলেন তা অনেকটাই অন্যরকম, বেশ প্যাঁচানো। সম্ভবত প্রাচীন তিব্বতী হরফ বা চিহ্ন যা হয়তো অনেক আগে থেকেই বদলে গেছে। কালো কালিতে লেখা হরফ আছে বেশ কিছু, সেই সাথে একটা ম্যাপ। ম্যাপের মাঝখানে লম্বা একটা আকৃতি আঁকা যার উপরে গোলাকার একটা বস্তু বসানো। অনেকটা ফুটবল আকৃতির। চারপাশের উঁচু নিচু দাগগুলোকে নিঃসন্দেহে পাহাড় হিসেবে নিশ্চিত করা যায়।

এই ধরনের গোলক কোথাও দেখেছেন কি না মনে করতে পারলেন না তিনি, এমনকি কেউ কখনো এই গোলকের কথা উল্লেখও করেনি। চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশে তাকালেন। ম্যাপটার দিকে আবার তাকালেন, এবার অবাক হওয়ার পালা।

ম্যাপের হরফগুলো স্থান পরিবর্তন করছে, রেখাগুলো উঁচু নীচু হচ্ছে, গোলাকার বস্তুটাও স্থান বদলাচ্ছে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, কিন্তু চোখের সামনে এখন যা হচ্ছে তা একেবারে বাস্তব।

হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলেন তিনি একটা হরফে, মুহূর্তেই থেমে গেল সব। যেন ঠিকমতো নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে লেখাগুলো, সাথে ম্যাপটাও।

আমি কী পাগল হয়ে যাচ্ছি, ভাবলেন তিনি। হাসি আসছিল, সবসময় এক জিনিস নিয়ে ভাবেন বলেই বোধহয় এমন হচ্ছে। কাঠের টুকরোর মাঝে ভাঁজ করে রেখে দিলেন কাপড়টা।

আসলে ঘুমানো দরকার, ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাবলেন তিনি। ধীর পায়ে হেঁটে চলে এলেন যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়ার পাশে শুয়ে পড়ার আগে চারপাশে আবার তাকালেন। বিপদের কোন সম্ভাবনা তার চোখে পড়ল না, নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

* * *

রাতে খুব ভালো ঘুম হয়েছে রাশেদের, এতো চমৎকার ঘুম বহুদিন হয়নি। সকালে রাজু যখন ধাক্কা দিলো, তখনও মনে হচ্ছিল গ্রামের বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে সে, বাবা বাজারের দিকে যাচ্ছে, মা রান্নাঘর থেকে ডেকেই যাচ্ছে, ভাপা পিঠে গরম গরম খেয়ে নেয়ার জন্য। শীতকালের ঐ সময়টা স্কুল ছুটি থাকাতে ঘুম থেকে দেরিতে উঠতো রাশেদ, ফলে গরম পিঠের ভাগ্য তার ছিল না। মাকে অনেকদিন পর স্বপ্নে দেখল রাশেদ, কিন্তু স্বপ্নে দেখা মুখ এখন আর মনে পড়ছে না। সেই কতো কতো বছর আগের কথা! মা নেই, কিন্তু মায়ের ছায়া আছে। সেই ছায়া মাঝে মাঝে স্বপ্নে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে যায়, আদর করে যায়, কিন্তু মায়ের মুখটা মনে করতে গেলেই সালেহার চেহারাটা ভেসে উঠে। সেই ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সালেহা হয়ে উঠে তার মা, সৎ মার কোন গুনই ছিল না সালেহার, বরং যে আদরে তাকে মানুষ করেছে তাতে মায়ের কথা মনে হলেই সালেহার চেহারাটা ভেসে উঠে। আজ একবার এখান থেকে গ্রামে ফোন দেবে বলে ঠিক করলো রাশেদ।

কি রে, কয়টা বাজে জানিস? রাশেদকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল রাজু।

জানি না, কোনমতে বলল রাশেদ।

বারোটা বাজে, আহমদ কবিরসাহেব এসেছিলেন, উনি আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন, স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা করতে।

আমাকে ডাকবি না তুই? ধড়মড় করে উঠে বসল রাশেদ, স্পেশাল পাসের ব্যাপারটা তার মাথায়ই ছিল না।

বহুবার ডাকা হয়েছে, কিন্তু তুই তো কুম্ভকর্নের বাপ, রাজু বলল, যাই হোক, উনি বললেন, চিন্তার কিছু নেই, দুপুরের দিকে রুমে ফিরবেন, তখন স্পেশাল পাসগুলো আমাদের দিয়ে যাবেন।

আমি তো ভেবেছিলাম অনেক সময় লাগবে ভদ্রলোকের, রাশেদ বলল।

হয়তো এখানে উনার কোন কানেকশন আছে, রাজু বলল, এবার উঠ, বাইরে যাবো।

বাইরে কোথায়?

লাঞ্চ করতে।

আমি বাইরে যাবো না, রাশেদ বলল, শরীর ভালো লাগছে না। উঠে বসল সে।

গতকাল অনেক রাতে ময়লা শরীরে হোটেলে ফিরেছিল ওরা, তারপর কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘটনাগুলো সব মনে পড়ছে এখন। অনেকদূর হেঁটে ট্যাক্সি পেয়েছিল একটা, সেটায় করে রাত দুটোর দিকে হোটেলে ফিরেছিল দুজন। হোটেলের লোকজন অবাক হয়ে তাকালেও প্রশ্ন করেনি,চুপচাপ নিজেদের রুমে ফিরে এসেছিল ওরা।

লোকটাকে আমার সন্দেহ হয়, রাশেদ বলল।

কাকে?

কাকে আবার? আহমদ কবিরকে। উনাকে দেখে যা মনে হচ্ছে উনি আসলে তা নন।

একই কথা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তাই না? হেসে বলল রাজু, সন্দেহের ভিত্তিটা কী?

জানি না, মন বলছে, রাশেদ বলল, লোকটা যেচে আমাদের উপকার করছে, এছাড়া গতরাতে ঐ রাস্তায় তাকে দেখেছিলাম।

হয়তো কোন কাজে গিয়েছিলেন, আন্দাজে কাউকে সন্দেহ করার কোন মানে নেই, রাজু বলল।

কিছুক্ষনের মধ্যে তৈরি হয়ে নিলো রাশেদ, এরমধ্যে গোসল সেরে নিয়েছে, ক্ষুধা পেয়েছে খুব।

এখুনি বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না, ভদ্রলোকের কাছে আমাদের পাসপোর্ট, রাজু বলল।

চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে রাশেদের, অপরিচিত একটা লোকের কাছে পাসপোর্ট দিয়ে দেয়াটা মোটই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। রাজুর উচিত ছিল ওনার সাথে যাওয়া, তাহলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো। এখন পুরোটাই নির্ভর করছে ভাগ্যের উপর। এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে এই কাঠমুন্ডুতেই তাদের শত্রুর অভাব নেই। সেখানে আহমদ কবির যে ওদের কেউ নন, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।

ক্ষুধা পেলেও আপাতত চেপে রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই, অপেক্ষা করতে হবে ভদ্রলোকের জন্য। ঠিক এক ঘন্টা অপেক্ষা করবে বলে ঠিক করলো রাশেদ, তারপর বেরিয়ে পড়তে হবে। নীচে রিসেপশনে খবর নেয়া যায় অবশ্য, ভদ্রলোক কি চেক আউট করেছেন কি না।

*

অধ্যায় ২

হাতের অস্ত্র তাক করে আছে সৈনিক দুজন। সামনে দাঁড়ানো নগ্ন গাত্র লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে, বুঝতে পারছে না কি করবে। আদেশ আছে উল্টোপাল্টা কিছু দেখলেই যেন গুলি চালায় তারা। সীমান্ত কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, সেই ট্রেনিংয়ের বিশেষ অংশ ছিল কাউকে ছাড় না দেয়ার একটা অধ্যায়। পাগল, অসুস্থ এসব ভান করতে পারে অনেকে, সেক্ষেত্রেও সুযোগ দেয়ার কোন উপায় নেই, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারীর একটাই নিয়তি, মৃত্যু। যদিও এই নিয়ম অনেকক্ষেত্রে শিথিল, বিশেষ করে যারা তিব্বত-নেপাল সীমান্ত দিয়ে রীতিমতো চোরাচালানী করে। বেশ টাকা পয়সার ব্যাপার, যার ভাগ খুব অল্প কয়েকজন ভাগ্যবানই পায়।

সৈনিক দুজন দুজনের দিকে তাকাল, উদোম গায়ে এমন বলিষ্ঠদেহি যুবক খুব কমই চোখে পড়েছে। কিন্তু এমন আবহাওয়ায় খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা একমাত্র পাগল ছাড়া আর কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। বেশ দ্বিধাগ্রস্ত দুজনেই, একটা বুলেট খরচ করা কখনোই কোন সমস্যা না তাদের কাছে, কিন্তু যখন বুলেটটা মানুষের উপর খরচ করতে হবে, তখন বিনাকারনে খুন করাটা তাদের কাছে মাঝে মাঝে অযৌক্তিক মনে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এই লোকটা পাগল, কেমন একটানা তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে, যেন বোঝার চেষ্টা করছে, জানার চেষ্টা করছে তাদের মনোভাব।

ডানপাশের সৈনিক কিছুটা লম্বা দ্বিতীয়জনের চেয়ে। কোমর থেকে ওয়াকিটকি বের করে কারো সাথে কথা বলল, মনে হলো অনুমতি চেয়েছে কোন কাজ করার জন্য। ওয়াকিটকি কোমরে খুঁজে সঙ্গিকে ইশারা করলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

লোকটা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, দেখছে দুজনকে। খাটো সৈনিক তার অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসছে, পেছন থেকে তাকে কাভার দিচ্ছে দ্বিতীয়জন। সম্ভবত তাকে জীবিত বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। তবে পুরোপুরি সাহস পাচ্ছে না সৈনিক দুজন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে খুব একটা পড়তে হয় না তাদের। খালি গায়ে দাঁড়ানো লোকটা বলশালী হবে বলেই ধারনা।

আরো কিছুদূর এগুলো সৈনিক, দূর থেকেই লোকটার কপালের ঘাম চোখে পড়লো মিচনারের। এতে নার্ভাস হলে চলে! মনে মনে হাসল সে। তৈরি। সারাজীবন স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল, এখন অস্ত্রের জোরে নাকবোচা দুজন সৈনিক তাকে ধরে নিয়ে যাবে সেটা কখনোই হতে দেবে না। কিন্তু কিভাবে?

সামনে এগিয়ে আসা লোকটাকে কোনভাবে কাবু করা গেলেও পেছনের যে লোকটা অস্ত্র তাক করে আছে, তার ধারেকাছে যাওয়ার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলবে তাকে। হাসল মিচনার, তার এই হাসি দেখে হয়তো আরো একটু দূর্বল হয়ে গেল আগুয়ান সৈনিক।

দারুন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিচনার, সৈনিক আর পাঁচ কদম এগুনোর সাথে সাথে তা কার্যকর করতে হবে।

এক, দুই, তিন, চার… পাঁচ…

ডিগবাজি দিয়ে দুজনের মাঝখানের দূরত্ব অতিক্রম করলো মিচনার, চোখের নিমিষেই বলা যায়, সৈনিকের হাঁটুর ঠিক নীচে পা দিয়ে লাথি দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সৈনিক দেখল এক হাতে তার কোমরে গোঁজা কমান্ডো ছুরি বের করে নিয়ে এসেছে খালি গায়ের লোকটা। ছুঁড়ে মেরেছে অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা সৈনিকের বুক বরাবর, যে দ্বিধায় ছিল গুলি করবে কি করবে না। কারন লাইন অফ ফায়ারে ছিল তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। এই দ্বিধাই তার কাল হলো, ধেয়ে আসা ছুরিটা ধারাল, তার বুকে গেঁথে গেল অনেকটা বর্শার মতো। কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল।

এক হাতে ছুরি টেনে নেয়ার সময় অন্যহাতে সৈনিকের হাতে থাকা রাইফেলটা ধরে রেখেছিল মিচনার, সেটা ছোটানোর জন্য সর্বশক্তি দিয়েও কাজ হলো না। রাইফেলটা কেড়ে নিলো মিচনার, হাঁটুর উপর পাটকাঠির মতো ভেঙে ফেলল তা।

সৈনিক কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছে, মিচনার এবার উঠে দাঁড়াল। নিজের ভেতর পৈশাচিকতা অনেকদিন ধরেই টের পাচ্ছিল, একজনকে খুন করার পর সেই নেশা এবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেকটা মুষ্ঠিযোদ্ধাদের মতো দুই হাত মুঠো করে চক্রাকারে ঘোরা শুরু করেছে সৈনিক, মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে তার সহকর্মীর দিকে। হয়তো সাহায্য আশা করছিল, কিন্তু তার সহকর্মী এখন নিথর, পাথুরে জমিতে মুখ দিয়ে পড়ে আছে, বুক থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে লাল করে দিচ্ছে তার চারপাশটা।

শান্ত হয়ে কিছুক্ষন তাকাল মিচনার, সৈনিকের কার্যকলাপ দেখে হাসি পেলেও নিজেকে সামলাল। এগিয়ে গেল, দুই হাত পাশে ঝোলানো, যেন আঘাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই।

রীতিমতো একজন পেশাদার মুষ্ঠিযোদ্ধার মতো একটানা পাঞ্চ করে যাচ্ছে সৈনিক, মিনারের মুখ বরাবর। আঘাতে আঘাতে ক্রমেই রক্তাক্ত হয়ে উঠলো মিচনারের মুখ। দুই হাত পাশে এখনো ঝোলানো অবস্থায় আছে, বাঁধা দেয়ার কোন চেষ্টাই করছে না সে। বাঁধা না পেয়ে আরো উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সৈনিক, এবার মিনারের পেটে একটানা পাঞ্চ করলো সে। অন্য কেউ হলে এই ধরনের পাঞ্চ একটাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু ক্রমাগত আঘাত করার পরেও কোন ভাবান্তর নেই দেখে অবাক হলো সৈনিক। তার শক্তি ফুরিয়ে আসছে, শেষের কয়েকটা পাঞ্চ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। হাঁপিয়ে গেছে সৈনিক, সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে দম নেয়ার জন্য।

মিচনারের চোখে চোখ পড়লো।

বুঝতে পারলো তার আর কিছুই করার নেই।

এবার দুই হাত উঠালো মিচনার, সৈনিকের গলা চেপে ধরলো। দম বন্ধ হয়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা সৈনিকের, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, চেহারায় রক্ত জমেছে।

মট করে শব্দ হলো একটা। নিস্তান দেহটাকে একপাশে রেখে এগিয়ে গেল মিচনার, সৈনিকের কোমরে থাকা ওয়াকিটকিটা পা দিয়ে মুচড়ে দিলো, দ্বিতীয় সৈনিকের কাছে থাকা ওয়াকিটকিটা তুলে নিলো। কিছু একটা বলা হচ্ছে ওয়াকিটকিতে, সম্ভবত পরিস্থিতি জানতে চাইছে।

এখানে থাকা আর নিরাপদ না, এই ওয়াকিটকিটাও হাত দিয়ে চেপে ভেঙে ফেলল মিচনার। এই দুজনের খোঁজে কিছুক্ষনের মধ্যে অন্যরা চলে আসবে। একসাথে বেশি লোক সামাল দেয়া তখন কঠিন হয়ে যাবে।

সৈনিকের বুকে গেঁথে থাকা ছুরিটা টেনে বের করে নিজের কোমরে খুঁজে নিলো মিচনার, হাঁটতে থাকল। মুখ এক চিলতে হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *