অধ্যায় ১১
ঢাকার নামিদামি একটা হোটেলে উঠেছেন ড. কারসন। রুমে বসে আছেন তিনি। বগুড়া থেকে এসেছেন বেশিক্ষণ হয়নি। গোসল সেরে চুপচাপ বসে আছেন। ভাবছেন। বাক্সটা এখনো সাথে আছে। বিছানার উপর রাখা। তাকালেন তিনি। অনেক দামি জিনিস, কতো দাম হতে পারে ধারনাও হচ্ছে না, দামি এবং ঐতিহাসিক একটা জিনিস। এর প্রকৃত মালিক কে ছিল সেটা এখন গবেষনার দাবী রাখে। তবে বোঝা যাচ্ছে যিনি এটা এই অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন তিনি এর মালিকের সংস্পর্শে ছিলেন এবং মনে হচ্ছে চুরি করে আনা হয়েছে এই জুতোজোড়া। জুতোর ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা ইউরোপীয়, যোড়শ শতকে এই ধরনের জুতো পরা হতো। প্যারিসের স্যুভর মিউজিয়ামে এ ধরনের কিছু দেখেছিলেন তিনি, লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামেও কিছু আছে। কিন্তু হীরক খচিত এই জুতো জোড়ার মালিক কে ছিল, জানতে ইচ্ছে করছে ড. কারসনের।
গাড়িতে দুই ডক্টর অনেক ঝামেলা করেছে। নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল তাকে। বিশেষত ড. শাখাওয়াত। বাক্সটায় কি আছে জানতে চাইছিল বারবার। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন ড. কারসন। শেষে বলছেন, বাক্সে যদি অবৈধ কোন জিনিস থাকে তাহলে এয়ারপোর্ট কাস্টমসে যেন বলে রাখেন ওরা, তারা ড. কারসনের জিনিসপত্র চেক করে তারপর যেতে দেবে। রাজি হয়েছে ওরা। কিন্তু এ কথাগুলো বলে নিজের ঝামেলাই বাড়িয়েছেন ড. কারসন। এখন চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। সত্যিই যদি এয়ারপোর্টে চেক করে, করবেই এতে কোন সন্দেহ নেই, তাহলে তাকে সবাই বলবে চোর। যদিও জিনিসটার বর্তমান মালিকই তাকে জুতোজোড়া ইউরোপের কোন মিউজিয়ামে দিয়ে দিতে বলেছে।
যাই হোক, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। যা হবার হবে। এ দেশের আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্পটে যাবার কথা আছে ড. কারসনের। কিন্তু কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। এখানে যে উদ্দ্যেশে এসেছিলেন তার অনেকটাই পূরণ হয়েছে। যদিও কাউন্ট দ্য সেইন্ট জারমেইন সম্পর্কে কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি। কতোগুলো আজব ধারনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এই লোকটা সম্পর্কে। এখন দেখা যাচ্ছে, ধারনাগুলো কতোটা ভিত্তিহীন। যদিও এখনও অনেক কিছু দেখা এবং খোঁজা বাকি রয়ে গেছে তার।
চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল টেলিফোন বেজে উঠার শব্দে।
‘হ্যাল্লো।’
‘স্যার, ড. আরেফিন নামে একজন দেখা করতে এসেছেন, পাঠিয়ে দেবো?’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ড. কারসনের। নাছোড়বান্দার মতো পেছনে লেগে থাকার মতো স্বভাব এই ড. আরেফিন লোকটার।
‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন,’ বললেন ড. কারসন।
বিছানার উপর থেকে বাক্সটা হাতে নিলেন। লুকিয়ে রাখতে হবে। ড. আরেফিনের চোখে যেন না পড়ে, তাহলেই আবার হাজারটা প্রশ্ন শুরু হয়ে যাবে।
দরজায় নক করার শব্দ পেলেন কিছুক্ষন পরেই ড. কারসন।
‘চলে আসুন, ড. কারসন বললেন।
ভেতরে এলেন ড. আরেফিন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উত্তেজিত অবস্থায় আছেন তিনি।
‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, ড. আরেফিন কাচুমাচ হয়ে বললেন।’
‘সমস্যা নেই, ড. কারসন বললেন।’
‘এলিক্সির অফ লাইফ, মনে আছে তো আপনার?’
‘মনে আছে, এ বিষয়ে কথা হয়েছিল আমাদের।’
‘আমি জানি কিভাবে এর খোঁজ পাওয়া যাবে।
‘আচ্ছা, উত্তেজনা প্রকাশ করলেন না ড. কারসন, তাতে হয়তো মাথায় উঠে যাবে। এছাড়া এ ধরনের ভিত্তিহীন কথা আগেও অনেকবার শুনেছেন তিনি।
‘আপনাকে সঙ্গি হিসেবে চাই আমার।‘
‘আমি কিভাবে সঙ্গি হবো, খুব বেশি দিনের জন্য বাংলাদেশে আসি নি?’ বিরক্ত স্বরে বললেন ড. কারসন।
‘আপনাকে লাগবে আমার, প্লিজ, মানা করবেন না।‘
‘আচ্ছা, দেখা যাক, এখন আসল কথা বলুন, এলিক্সির অফ লাইফের সন্ধান আমরা কিভাবে পাবো?’
‘একটা বই, প্রাচীন, কি ভাষায় লেখা হয়েছে জানি না, আমাদের এখান থেকে কেউ এর পাঠোদ্ধার করতে পারবে বলে মনে হয় না।‘
‘আচ্ছা।’
‘আপনি হয়তো পারবেন।‘
‘পারবো কি না জানি না, তবে চেষ্টা করবো, বইটা কি আপনার সাথে আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।
‘না, সাথে নেই, তবে কোথায় আছি জানি, ড. আরেফিন বললেন।’
‘ওহ, আপনি কি বইটা দেখেছেন স্বচক্ষে?’
‘দেখেছি একবার, খুব কম সময়ের জন্য।’
‘কিছু মনে করবেন না, মনে হচ্ছে কেউ আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছে, বইটার কথা বলে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেবে আপনার কাছ থেকে, কাজেই এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো।’
‘যার কাছে বইটা আছে, তার অর্থ-সম্পত্তি যথেষ্টই আছে, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো…’থামলেন ড. আরেফিন। তাকালেন চারদিকে, যেন দেখে নিতে চাচ্ছেন কথাটা বলা নিরাপদ হবে কিনা।
কথাটা কি?
‘মারা গেছে সে। খুন করা হয়েছে ছেলেটাকে। নৃশংসভাবে। মাথা আলাদা করে ফেলা হয়েছিল।’
‘ওহ, বইটার জন্য খুন করা হয়েছিল বলে ভাবছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, ছেলেটা সম্ভবত কোন কালোযাদুর দলের সদস্য ছিল, ওর সারা দেহে যেসব উল্কি আঁকা ছিল, আমার তাই মনে হচ্ছে। থানায় পরিচিত লোক আছে আমার, খবর নিয়েছি, ওদের ধারনা, যে ছেলেটার সাথে সে হলে থেকেছিল, সেই ওর হত্যাকারী।
‘আপনি ধারনা করছেন সেই ছেলের কাছেই বইটা পাওয়া যাবে?
‘হ্যাঁ, ওর কাছেই আছে বইটা। কিন্তু এই ছেলেটাও উধাও। পুলিশ খুঁজছে তাকে। আমি নিশ্চিত। খুন না করলে ও পালাতে না এবং ওর কাছেই বইটা আছে।’
‘হুম, এখন যদি ছেলেটা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাহলে তো ঐ বইটা আমরা নাও পেতে পারি।‘
‘ঠিক বলেছেন ড. কারসন, আমি চাইছি পুলিশের আগেই ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে।’
‘কিভাবে সম্ভব সেটা?’
‘ছেলের সব বন্ধুদের উপর নজর রাখছি আমি, ভাগ্য ভালো ছেলেটা মেশে খুব কম, কাজেই অনেকজনের উপর নজর রাখার হাত থেকে বেঁচে গেছি। ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হলো লিলি নামের একটা মেয়ে। এর উপরই কড়া নজর রাখছি, ওর সাথে ছেলেটা যোগাযোগ করবেই কিংবা এখনো করে, মেয়েটাই জানে ছেলেটার আসল অবস্থান।‘
‘নজর রাখার জন্য লোক আছে আপনার?’
‘ছিল না, যোগাড় করেছি, আসলে আপনি হয়তো এলিক্সির অফ লাইফের মাহাত্ম বুঝতে পারছেন না। এর জন্য অনেকগুলো জীবনই বিসর্জন দেয়া যায়, অনেক টাকা খরচ করা যায়, কারন কোন বিনিয়োগই এর জন্য যথেষ্ঠ নয়।’
‘আপনি বইটা জোগার করুন, আমি চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করতে।’
‘অনেক ধন্যবাদ ড. কারসন, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করছিলাম আমি,’ ড. আরেফিন বললেন, উনাকে দেখে মনে হলো সত্যি সত্যি খুশি হয়েছেন তিনি।
উত্তরে কিছু বললেন না ড. কারসন, মাথা ঝাঁকালেন শুধু। এবার লোকটা গেলে হয়।
‘আমি যাই, কাজ আছে অনেক।‘
ড. আরেফিনকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন ড. কারসন। মুখে মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি, ভদ্রতার হাসি। দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। অনেকদিন পর আরামদায়ক একটা ঘুমের আশা করছেন।
***
সময়টা ১৮৫০। তিব্বতের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। একটার পর একটা পাহাড় পাড়ি দিয়েছেন, ধীরে ধীরে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন তিনি। সমস্যা হচ্ছে রামপ্রসাদকে নিয়ে। বেচারা হাঁটার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। হাড় কাঁপানো শীত এ জায়গাটায়। এ ধরনের শীতে অভ্যস্ত তিনি। কিন্তু রামপ্রসাদের জন্য অভিজ্ঞতাটা একেবারে নতুন, চিন্তাটা ওকে নিয়েই। বরফের জায়গার কথা বেচারী এতোদিন শুধু শুনেছে, এখন চোখে পড়াতে জীবন ধন্য হয়ে গেছে তার। এই হিমালয় পবর্তমালা থেকেই বের হয়েছে বড় বড় নদী। হিন্দুদের পুন্যতীর্থ মানস সরোবর, কৈলাস সরোবর এই অঞ্চলেই অবস্থিত। সময় পেলে রামপ্রসাদকে নিয়ে এ সরোবরগুলো ঘুরে আসবেন বলে ঠিক করলেন তিনি।
‘হাঁটতে পারবে তুমি, রামপ্রসাদ?’ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘হুজুর, একটু জিরিয়ে নেই,’ বলে বসে পড়ল রামপ্রসাদ একটা বড় পাথরের টুকরোয়।
ছোট-খাট একটা পাথরের টুকরো নিয়ে তিনিও বসলেন। গন্তব্য সন্নিকটে। মনে হচ্ছে, অনেক দূর চলে এসেছেন। এই ঠিকানায় হয়তো স্থায়ী হবেন। কিংবা কে জানে, আরো কোন কিছু তাকে ডাকছে আরো দূর কোন দেশে যাবার জন্য।
তিব্বতী ভাষা কিছুটা জানেন, কিন্তু ব্যবহার করার তেমন সুযোগ পাওয়া যায়নি,অনেক অনেক আগে শিখেছিলেন, এখানে আসার ইচ্ছে ছিল আরো আগেই, কিন্তু ইউরোপকে দেখছিলেন তরতর করে বেড়ে উঠতে, তাই সে বাড়ন্ত অবস্থায় ফেলে আসতে মন সায় দেয়নি,এখন ইউরোপ শাসন করছে পুরো দুনিয়া, সেখানে এখন তার দরকার নেই। বিজ্ঞানের সাধারন কিছু ধারনা এখন ওদের হাতের মুঠোয়, বিদ্যুৎ, বারুদ, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কাজ শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এই জিনিসগুলোই বাকি সব আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে দেবে ওদের।
অন্যদিকে, এই দূর্গম পাহাড়ী বরফাচ্ছাদিত এলাকা। পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, পৃথিবীর ছাদ। রহস্যময় লামারা অশেষ শক্তির অধিকারী বলে শুনেছেন তিনি। তারা উড়তে জানে, বছরের পর বছর ধরে না খেয়ে থাকতে পারে, এমনি আরো নানা কাহিনী শুনেছেন এসব কথার অনেকাংশই হয়তো মিথ্যা, কিন্তু তারপরও বৌদ্ধ ধর্মকে এরা নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। নিজেদের জীবন যাপনে এখনো সরলতা ধরে রেখেছে সাধারন তিব্বতীরা।
বসে বসে ভাবছিলেন তিনি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতে পারেননি। জেগে উঠে যা দেখলেন তাতে অবাক হয়ে গেলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। চারপাশে যেন কালো কিছু ছায়া ঘিরে আছে তাকে। মানুষের মতো অবয়ব। ভয় বলে কখনো কিছু অনুভব করেননি। এখনো ভয় পেলেন না। চোখ কচলে আবার তাকালেন। আস্তে আস্তে অবয়বগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে তাকে। স্বস্তির কথা তাদের হাতে কোন অস্ত্র বা ধারালো কিছু নেই। চোখ মুখে কেমন অবাক বিস্ময়। পরনে হাল্কা হলুদ বর্ণের পোশাক। মাথায় চুল কামানো। উঁচু হনু, একটু বোঁচা নাক এবং ছোট চোখ। বুঝতে পারলেন তিনি এরা এখনকার স্থানীয় লোক। সামনের গ্রামেই হয়তো এদের বসবাস। রামপ্রসাদের দিকে তাকালেন। বেচারা এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দু’হাত উঁচু করে দেখালেন লোকগুলোকে। বোঝালেন কোন অস্ত্র বহন করছেন না। গুনে দেখলেন সাতজনের একটা দল এরা। হেঁটে সামনে গেলেন। লোকগুলো সরে জায়গা করে দিলো, সসম্মানে। রামপ্রসাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলেন।
ধড়মড় করে উঠে পড়ল রামপ্রসাদ। তাকাল চারদিকে। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সে।
‘হুজুর, কোন বিপদ?’
‘বিপদ না, ভালোই হয়েছে বলা চলে, রাতে আরো ভালো জায়গায় ঘুমাতে পারবে তুমি, এখন জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নাও, রওনা দেবো আমরা।’ বললেন তিনি।
লোকগুলো তাকিয়ে আছে, মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথা, বোঝার চেষ্টা করছে। তিনি তাকালেন ওদের দিকে। তারপর তিব্বতী ভাষায় বললেন, ‘আমি সুদূর পশ্চিম থেকে এসেছি, তোমাদের দেশে, আশা করি অতিথিকে অসম্মান করো না তোমরা?
মুখ হা হয়ে গেছে লোকগুলোর। শ্বেতবর্ণের একজন লোক তাদের ভাষায় কথা বলছে, তাও এতো নিখুঁতভাবে, বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের। দু’একজন মুখ তাকাতাকি করলো। বাকিরা যেন মূর্তি হয়ে গেছে।
‘তোমাদের গ্রামে নিয়ে চলো আমাদের,’ বললেন তিনি। লোকগুলোর মধ্যে নেতাগোছের একজন এগিয়ে এলো।’
‘মাননীয় অতিথি, চলুন আমাদের সাথে, আপনাদের যত্নে কোন অবহেলা হবে না,
রামপ্রসাদ দেখছিল তাকিয়ে তাকিয়ে। মনিবের মুখে অদ্ভুত এক ভাষা শুনে তাক লেগে গেছে তার। সুটকেস দুটো নিয়ে রওনা দিলো সে। সামনে তিনজন লোক, পেছনে তিনজন, নেতাগোছের লোকটা তার মনিবের সাথে, সেও ওদের সাথে, দলটার ঠিক মাঝখানে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে তারা বুঝতে পারল রামপ্রসাদ। এরা তিব্বতী। পরনের পোষাক দেখে মনে হচ্ছে এরা সবাই আশ্রমের লোক।
উঁচু-নিচু পথে হেঁটে যেতে প্রায় ঘণ্টাতিনেক সময় লেগে গেল দলটার। রাত হয়ে গেছে, গ্রামটা নিরব-নিথর। কোথাও কোন শব্দ নেই। একটা প্রাচীন মন্দিরের আঙ্গিনায় থামল দলটা। অবাক চোখে চারপাশ দেখছেন তিনি। মনে হচ্ছে এসব স্বপ্নদৃশ্য। পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে মন্দিরটা। ভেতর থেকে বয়স্ক একজন লোক বের হয়ে এলো। লোকটার বয়স আশি-নব্বই-এর কম হবে না।
বৃদ্ধ সরাসরি তার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতদুটো ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে চেপে আছে। এই মন্দিরটার প্রধান হবেন বৃদ্ধ। তিনি তাকালেন বৃদ্ধের দিকে। একে কিছু সংকেত দিতে চাচ্ছেন তিনি। কিন্তু সংকেত দিতে হলো না, তার আগেই বৃদ্ধ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তার সামনে। বাকি সবাইও অনুসরন করলো বৃদ্ধকে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু দু’জন। রামপ্রসাদ এবং তিনি।
ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না রামপ্রসাদ। অতি ভক্তি চোরের লক্ষন- এজাতীয় একটা প্রবাদবাক্যই তার মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল।
মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো দুজনকে। বৃদ্ধ পথ দেখিয়ে হাঁটতে থাকলেন সামনে, অতিথি দুজন পেছনে। এরকম কোন জায়গায় আগে কখনো আসেননি তিনি। কাজেই দেখে নিচ্ছেন সব। মোমবাতির আলোয় যতোটুকু দেখা যায়। কেমন অন্ধকার সবকিছু। আলো-ছায়ার খেলায় রহস্যময় রুপ ধারন করেছে মন্দিরের ভেতরটা। রামপ্রসাদের দিকে তাকালে সে হাত ইশারা করে পেট দেখাল। ক্ষুধা পেয়েছে।
বৃদ্ধ যেন হেঁটেই চলেছে অনাদিকাল ধরে, অনন্তের পথে। লম্বা একটা করিডোর ধরে হাঁটছে সবাই। অনেকক্ষন হাঁটার পর বড় একটা হলরুমের মতো জায়গায় এসে পড়লো তারা। মাঝখানে বিশালকায় এক বৌদ্ধমূর্তি। মূর্তিটার নিচে এক লোক বসা। সে মনে হচ্ছে আরো বৃদ্ধ। চোখ বন্ধ, ধ্যানে মগ্ন সে। হাত ইশারা করে দুজনকে বসতে বলল বৃদ্ধ। এখানে বসার জন্য কোন চেয়ার নেই। মেঝেতেই বসতে হবে।
পাশাপাশি বসে পড়ল দুজন। এর মধ্যে দেখা গেল খাবারের পাত্র নিয়ে এসেছে মন্দিরের দুজন ভৃত্য। এরা নিরামিশাষী। কাজেই খাবার হিসেবে নিরামিশই পরিবেশন করার কথা এবং তাই করা হয়েছে। রামপ্রসাদ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের পাত্রের উপর। তিনি হাসলেন। এই ক্ষুধাকেই বশ করেছেন তিনি।
খাবারের পাট চুকতে বেশি সময় লাগল না। অল্প একটু খেয়ে রেখে দিয়েছেন তিনি, যদিও জানেন খাবারের অপচয় করা ঠিক না। রামপ্রসাদ পেটপুরে খেয়েছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেমন সুখি সুখি ভাব। মনে হচ্ছে তাকে এখন মেরে ফেললেও সে হাসতে হাসতে মরতে পারবে।
ধ্যানরত বৃদ্ধ চোখ খুলে তাকিয়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুজ একজন মানুষ, কিন্তু চোখ কেমন ধারালো মশালের মতো, যেন জ্বলজ্বল করছে। এগিয়ে এলেন অতিথিদের কাছে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বৃদ্ধ এসে জড়িয়ে ধরল তাকে, যেন অনেকদিন পর কাছের কাউকে ফিরে পেয়েছে সে। আপন ভাইয়ের মতো কেউ।
‘আপনাকেই আমরা আশা করছিলাম অনেকদিন ধরে,’ বললেন বদ্ধ। কণ্ঠস্বরে শ্রদ্ধা ফুটে উঠলো।
‘আমারও এখানে আরো আগেই আসার কথা, কিন্তু—’ বললেন তিনি।
‘এই কোদারী গ্রামে আপনাকে স্বাগতম, এখানে কিছুদিন বিশ্রাম নিন আপনি, অনেক ধকল হয়েছে এখানে আসতে।’
‘আপনার ধারনা ঠিক, অনেক ক্লান্ত আমি, তবে এখান থেকে অনেক কিছু শিখতে চাই, মহামান্য শেবারন।
‘সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে, আপনাদের দুজনের জন্য,’ বললেন বদ্ধ। কাউকে ডাকলেন ইশারায়।
‘আপনারা বিশ্রাম করুন, কাল সকালে দেখা হবে,’ আবার বৃদ্ধ বললেন।
একজন শিষ্য এগিয়ে এলো সামনে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বিশাম নেয়ার জায়গায়।
‘হুজুর ‘শেবারন’ মানে কি?’ জানতে চাইল রামপ্রসাদ।
প্রশ্নটা শুনে অবাক হলেন তিনি। রামপ্রসাদেরও তাহলে কৌতূহল আছে দেখা যাচ্ছে। বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান এবং জ্ঞানী ব্যক্তিকে শেবারন বলা হয় তিব্বতে।
যেন সব বুঝে গেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রামপ্রসাদ। এখন ওর জন্যই বিশ্রাম নিতে চাইলেন তিনি। নয়তো অনেক অনেক কথা আলোচনা করার ইচ্ছে ছিল এই বৌদ্ধ শেবারনের সাথে। দুটি লক্ষ্য নিয়ে এতো পথ পাড়ি দিয়ে তিব্বতে এসেছেন। একটি হচ্ছে, এখানকার গুপ্ত সম্প্রদায়ে যোগ দেয়া এবং লামাদের জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, থাক, সে কথা আরো পরেও চিন্তা করা যাবে, ভাবলেন তিনি।
***
হোটেলের রুমগুলো এতো ছোট হতে পারে তা ধারনাও ছিল না রাশেদের। অবশ্য ছোট রুমে থেকে অভ্যস্ত সে। কিন্তু এই রুমগুলোয় বাতাস আসা যাওয়ারও কোন জায়গা নেই। মাথার উপর একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে, ঢিমে তালে। ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করার নেই। কেন যে না বুঝে এই সস্তা হোটেলটাই বেছে নিলো!
এখন রাত একটা বাজে। জানালা নেই, থাকলে বাইরে তাকিয়ে কিছুটা সময় কাটানো যেত। রুম থেকে বের হবে কি না ভাবল রাশেদ। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল। এখন বের হওয়া ঠিক হবে না।
হাইওয়েতে উঠেই একটা বাস পেয়ে গিয়েছিল রাশেদ। বাসটা প্রায় খালি ছিল। সোজা ঢাকায় চলে এসেছে। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে থেমেছিল বাসটা। তখন প্রায় দশটা বাজে। কাজেই সামনের একটা রেস্টুরেন্টে, খাওয়া-দাওয়া সেরে এই হোটেলটা বেছে নিয়েছিল থাকার জন্য। তখন বোঝা যায়নি এর ভেতরের অবস্থা এতো খারাপ।
ট্রাভেল ব্যাগটা খুলে প্রাচীন সেই বইটা বের করল রাশেদ। এসব বিষয়ে তার আগ্রহ অনেক কম। কিন্তু এই বইটার জন্যই প্রান দিতে হয়েছে শামীমকে। শামীমের বাকি কাজ এখন তাকেই শেষ করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে ড. আরেফিনকে। বের করা খুব কঠিন হবে না। ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। সেখানে অবশ্যই তার ঠিকানা বা যোগাযোগ করার নাম্বার পাওয়া যাবে।
বইটার পাতায় পাতায় ছবি, হাতে আঁকা। পাশে ছোট ছোট অক্ষরে অনেক কিছু লেখা। এই ছবিগুলো বা লেখার অর্থ বোঝা সম্ভব না, অন্তত রাশেদের পক্ষে। চিঠিটা বের করলো আবার। পড়লো পুরোটা। কি থেকে কি ঘটে গেল একটা বইয়ের জন্য। শামীম ছেলেটা এতো চাপা স্বভাবের ছিল নিজের মনের কষ্টটাও বুঝতে দেয়নি কাউকে। লিলিকে পছন্দ করতো ব্যাপারটা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি রাশেদ। লিলিও বুঝতে পারেনি,বুঝতে পারলে অবশ্যই বলতো রাশেদকে। যাই হোক, লিলির কথা মনে পড়ছে খুব, ঝামেলায় আছে হয়তো মেয়েটা। কিন্তু কিছুই জানার উপায় নেই, মোবাইলটা বন্ধ সেদিনের ঘটনার পর থেকে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রাশেদ। ঘুমানো সম্ভব না এতো গরমে। একটা সিগারেট ধরালো। প্ল্যান করে এগুতে হবে সামনে। কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
*
অধ্যায় ১২
নিজের রুমে বসে আছেন ড. আরেফিন। এটা তার পড়ার ঘর। বেডরুম লাগোয়া এই রুমটা তিনি নিজের মতো করে নিয়েছেন। কেউ আসে না এই রুমে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। থাকতে পছন্দ করেন তিনি। তবু কাজের লোককে ঢুকতে দেন না ড. আরেফিন। নিজের হাতেই পরিস্কার করেন সব কিছু।
তার সংগ্রহের নামী-দামি বইগুলো আছে এই রুমে। থরে থরে সাজানো। বিভিন্ন বিষয়ের উপর এই বইগুলো। বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অপবিজ্ঞান, কল্পসাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র কিছুই বাদ নেই। বইগুলো অনেকটা নিজের সন্তানের মতো। তিনি সেলফ থেকে বের করে পড়েন, ঝেড়ে পুছে আবার রেখে দেন জায়গামতো। কাজের লোক এর মর্ম বুঝবে না। এমন কি নিজের স্ত্রীকেও এই রুমে ঢুকতে দেন না তিনি। অনেক রাগারাগি হয়েছে এ নিয়ে, কিন্তু তার জেদের কাছে হার মেনেছে তার সহধর্মিনী, যা সচরাচর ঘটেনা। বই ছাড়াও এই রুমে আছে কম্পিউটার, মিউজিক সিস্টেম, একটা ফটোকপি মেশিন, একটা বেহালা এবং টুকটাক আরো কিছু জিনিস।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। জানালা দিয়ে তাকালে নিচের বাগানটা দেখা যায়। অনেক যত্নে গড়া এই বাগান। তিনি যেমন বই নিয়ে থাকতে পছন্দ করেন, তার স্ত্রীও তেমনি পছন্দ করে বাগান করতে, গাছপালা, ফুল হচ্ছে তার জীবন। সন্তান নেই এতোটা বয়স পরেও, তাই হাতের অনেকটা সময় কাটানোর জন্য কিছু একটা বেছে নিতে হয়েছে দু’জনকেই।
শামীম ছেলেটার কথা ভাবছেন তিনি। কী অদ্ভুত রকম চুপচাপ একটা ছেলে ছিল, অথচ পরিণতিটা হলো কতো ভয়াবহ! তিনি নিজেও বইটার ব্যাপারে খুব আগ্রহি। এতে হয়তো তার জীবনও বিপন্ন হতে পারে। হোক, সমস্যা নেই। শামীম যা বলেছে তার কিছুটাও যদি সত্যি হয়, তাহলে এই বইটার জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয়া যায়।
শামীমের বন্ধুটার নাম পেয়েছেন তিনি। রাশেদ। গ্রামের ছেলে, শামীমের সাথেই পড়তো। যেখানে থাকে সেখানেও খবর নিয়েছেন তিনি। ছেলেটা হল ছাড়া বেশ কিছুদিন হলো, রুম তালাবদ্ধ। গ্রামের বাড়িতে খোঁজ লাগিয়েছিলেন তিনি, সেখানেও যায়নি ছেলেটা। হাওয়া হয়ে গেছে যেন। কিন্তু একেই এখন দরকার ড. আরেফিনের। মহামূল্যবান জিনিসটা হয়তো ওর কাছেই রেখে গেছে শামীম। শামীমের মাও বলেছিল রাশেদ নামে একটা ছেলে শামীমের একটা ব্যাগ নিয়ে গেছে বাসা থেকে বেশ কিছুদিন আগে।
এখন রাশেদকে খুঁজে বের করে বের করতে হবে। ছেলেটার পেছনে পুলিশ লেগেছে, শামীমের শত্রুরাও হয়তো খুঁজছে ওকে। কে জানে এতোক্ষনে হয়তো লাশ হয়ে কোথাও পড়ে আছে রাশেদ।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। সেলফ থেকে বই টেনে নিলেন একটা। নেড়েচেড়ে রেখে দিলেন আবার। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যে বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে তা সবাইকে ডেকে ডেকে বলার মতো নয়। কম্পিউটার খোলা আছে, চাইলে ইন্টারনেটে কিছু সময় কাটানো যায়। কিন্তু এখন কিছুই ভালো লাগছে না।
হাতের কাছে মোবাইলটা ছিল। শেষ যে নাম্বারটায় কল করেছিলেন সেটার দিকে তাকালেন। রাশেদের নাম্বার। অনবরত চেষ্টা করছেন তিনি কয়দিন ধরে। কিন্তু সবসময়ই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এখন আরেকবার চেষ্টা করবেন কি না ভাবলেন। জানা কথা লাভ হবে না, তারপর নাম্বারটায় চাপ দিলেন তিনি।
নাম্বারটা ভোলা পাওয়া গেল। রাত একটা বাজে। অধৈর্য হয়ে পড়ছেন ড. আরেফিন। তিনবার রিঙ হয়েছে। এই সময় ওপাশ থেকে রিসিভ করলো কেউ।
‘হ্যালো, ড. আরেফিন বললেন।’
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আমি ড. আরেফিন, এটা কি রাশেদের নাম্বার?’
‘আমি রাশেদ বলছি।’
বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন ড. আরেফিন। অবশেষে পাওয়া গেছে। ছেলেটাকে!
‘তুমি করে বলি, কিছু মনে করো না, তুমি তো শামীমের বন্ধু ছিলে, তাই না?’
‘জি।’
‘শামীম কি আমার কথা তোমাকে কিছু বলে গেছে, মানে, যে কোন কিছু?
‘শামীমের একটা চিঠি আছে আমার কাছে, সেখানে সে বলেছে আমি যেন আপনার সাথে দেখা করি।’
‘কোন বিশেষ কিছু কি শামীম রেখে গিয়েছিল তোমার কাছে?’
হ্যাঁ।’
‘তাহলে কাল আমরা দেখা করছি।’
‘জি না।’
‘কেন?
‘আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, আপনিই যে ড. আরেফিন তার প্রমান কি? এছাড়া আপনি যে আমার কোন ক্ষতি করবেন না তারই বা গ্যারান্টি কি?
এর উত্তর কখনো চিন্তা করেননি ড. আরেফিন। কাজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি কিছুক্ষনের জন্য।
‘তুমি তাহলে বলল কি করলে বিশ্বাস করবে আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না?
‘কিছুই করতে হবে না, আমি আপনাকে খুঁজে নেবো সময় হলে, এখন রাখি, অনেক রাত হয়েছে স্যার।
‘শোনো, আমি…’
কথা শেষ করতে পারলেন না ড. আরেফিন। ফোন রেখে দিয়েছে ছেলেটা। দারুন অবিশ্বাস ছেলেটার মনে। ভয় থেকেই অবিশ্বাসের জন্ম। দারুন ভয়ের মধ্যে সময় কাটাচ্ছে ছেলেটা। ইচ্ছে করলে ওকে বের করা যায়। পুলিশে ঘনিষ্ঠ মানুষ আছে ড. আরেফিনের, মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে লোকেট করতে বললে সাথে সাথেই ছেলেটার অবস্থান বের করে দেবে ওরা। কিন্তু এতে অসুবিধাও আছে। রাশেদের অবস্থান তাহলে ওদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাবে। যতদূর জানেন তিনি, শামীম হত্যা মামলায় রাশেদকে অন্যতম খুনি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ঘড়ির কাটা দুইটা ছুঁইছুঁই করছে। ঘুমানো দরকার। রাশেদ যখন বলেছে সে নিজেই যোগাযোগ করবে। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা।
***
একই কক্ষে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল দুজনের জন্য। ছিল আরামদায়ক বিছানা। উ কম্বল। রামপ্রসাদ মরার মতো ঘুমিয়েছে। কিন্তু সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি তিনি। সকালের প্রথম আলো ফোঁটার সময় বের হয়ে এলেন তিনি তার কক্ষ থেকে। মন্দিরের কর্মীদের দু’একজন জেগে উঠেছে এর মধ্যে। এদের কাউকে আশপাশে দেখলেন। হয়তো তার কর্মকান্ডের উপর নজর রাখছে এরা। রাখুক, অসুবিধা নেই।
দূরে পর্বত চূড়ায় সোনালী আলো পড়ে এক অপার্থিব দৃশ্যের সূচনা হয়েছে। অনেক অরুনোদয় দেখেছেন তিনি জীবনে। কিন্তু এর মতো দৃশ্য কখনো চোখে পড়েনি তার। সূর্য যদিও উঠেনি,চারপাশ এখনো ঘন কুয়াশায় ঢাকা, কিন্তু তার মধ্যে দূরের ঐ পবর্তশৃঙ্গে ঐ সোনালী আলোর ঝলকানি বুঝিয়ে দিচ্ছে আলোকতপ্ত একটা দিনের সূচনা হতে যাচ্ছে। ঘন কুয়াশারা বিদায় নেবে এখনই। সাদা বরফে উজ্জ্বল আলো পড়ে বরফ। টুকরোগুলোকে করে তুলবে একেকটা হীরের মতো। তিব্বতে আসার বড় একটা সাধ ছিল জীবনের। হাজার বসন্ত এবং শীত পেরিয়ে আজকে তিনি এসেছেন তার বিশ্রামতীর্থে। যদিও শুধুই বিশ্রামেই নিজের কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ রাখবেন না তিনি। দুটি উদ্দেশ্য আছে তার। একটা সবাইকে বলা যাবে, বাকিটা আপাতত নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি।
মন্দিরের কর্মীদের একজন এলো তার কাছে। একটা পেয়ালা দেখা যাচ্ছে হাতে, ধোঁয়া উঠছে। চা হবে হয়তো।
চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আস্তে আস্তে, অনেকদিন পর দারুন একটা পানীয় পাওয়া গেল, শরীরটাকে অনেকটা হাল্কা করে দিয়েছে চাটা।
বৃদ্ধ শেবারন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন মাত্র। কতো বয়স দেখে বোঝা সম্ভব না, তবে ধারনা করলেন তিনি একশত বছর পার করেছে এই সাধু অনেকদিন আগেই। যদিও মৃত্যুকে পুরোপুরি জয় করতে পারেনি এই লোকটি, কিন্তু জীবনকে দীর্ঘায়িত করেছে সাধনার মাধ্যমে। সেই সাধনা শুধু শারীরিক সংযম নয়, শুভ চিন্তা, চেতনা, ধারনা, বিশ্বাসকে লালনের মাধ্যমে নিজের আত্মাকেও পরিশুদ্ধ করার একটা সংগ্রাম।
জীবনে এই কথা তিনি অনেক অনেকবারই শুনেছেন, এতো বেঁচে কি হবে! কিন্তু কতো কিছুই যে দেখার বাকি রয়ে যায়, জানার মধ্যে আসে না, কতো রহস্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করে, এ সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নেই। তিনি নিজের কথা ভাবলেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তার এখনো আসেনি। আসবে বলে মনেও হচ্ছে না। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি, বোঝার বাকি, শোনার বাকি এবং করার বাকি। এই তিব্বতে এসেছেন হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে। উদ্দ্যেশ্যটা সফল করতেই হবে।
‘মহান পরিব্রাজক, আপনি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন তিব্বতে, আপনার যেকোন সেবা দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো,’ বললেন বদ্ধ।
তিনি ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধের দিকে। হাসলেন। কিছু বললেন না।
‘আমরা আপনার সেবা যত্নে কোন ত্রুটি করবো না, বৃদ্ধ আবার বললেন। যেন এর উত্তরের উপরই তার জীবন মরন নির্ভর করছে।
‘এভাবে বলবেন না,’ এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধের হাত ধরলেন তিনি। আপনাদের দেশটায় ঘুরবো আমি। গৌতম বুদ্ধের জ্ঞানে আলোকিত হবো।
‘আমরা বিশেষ একটা সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে আমি এবং আমার অনুগত শিষ্যরা। আপনি চাইলে আমি উপর মহলে কথা বলে দেখতে পারি। আপনাকে আমরা লামা হিসেবে নিতে পারবো কি না।’
‘আপনাদের ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের নাম হচ্ছে খে-লান। আমি জানি।’
‘আপনি আসলেই সবজান্তা,’ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বৃদ্ধ। তার এই ভ্রাতৃসম্প্রদায়টি গুপ্ত এবং এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনাও আছে। কেউ জানে না এই সম্প্রদায়ের কথা শুধুমাত্র সদস্যরা ছাড়া। অবশ্যই লোকটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে, এই ধারনাটি দৃঢ় হলো তার মনে।
‘সিগটেসে যাবো আমি, ব্যবস্থা করুন আপনি, বললেন তিনি।
‘আসলে আমরা খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি মহানুভব। তিব্বতে বহিরাগতদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপনি চলে এসেছেন, কিন্তু এখন কেউ জেনে ফেললে আপনাকে সাথে সাথে বের করে দেয়া হবে।’
‘আচ্ছা।’
‘চীন আমাদের দখল করে রেখেছে, দালাইলামা আছেন, কিন্তু কোন ক্ষমতাই নেই তার হাতে,’ বৃদ্ধ বললেন।
‘তাহলে এখন আমি কি করবো?‘
‘এখানে থাকুন কিছুদিন, দেখুন সবকিছু, পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে আপনাকে শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। আপনাকে কোন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারি না।‘
‘যা ভালো বোঝেন আপনি।‘
একটু নিচু হয়ে সম্মান জানিয়ে চলে গেলেন বৃদ্ধ। তিনি তাকিয়ে আছেন দূরের পর্বতচূড়োর দিকে, সূর্য উঠেছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার।
***
আকবর আলী মৃধা, বসে আছেন তার রুমটায়। কোন বাতি জ্বালানো নেই, শুধু কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে। এছাড়া একধরনের ধুপ জ্বালিয়েছেন তিনি। পুরো ঘরটা তাই হাল্কা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বড় একটা মাদুর পেতে বসে আছে সে, চোখ দুটো বোজা, গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। তার উল্টোদিকে বসেছে আরো দশ-বারোজন লোক। কারো চেহারাই ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না। তবে যারা আছে সবাই পুরুষ এবং বয়স ত্রিশের মধ্যে।
বিশেষ একধরনের মন্ত্র পাঠ করছেন আকবর আলী মৃধা, মৃদু একটা ধ্বনি ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো রুমটায়। সম্মোহন করে ফেলেছেন তিনি সবাইকে। যারা এসেছে তারা সবাই নতুন। একবার যখন এসেছে এদের কেউ আর ফিরতে পারবে না স্বাভাবিক জীবনে। সবাই হয়ে থাকবে তার গোলাম। এদেরকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারবেন তিনি, বিনা প্রশ্নে আদেশ মানবে এই লোকগুলো। ক্ষমতাধর হয়ে উঠবেন। অনেক ক্ষমতাধর। যদিও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কিছু ক্ষতি হয়েছে। প্রথমে শামীম এবং পরে কায়েসের মতো দুটি দুর্দান্ত ছেলেকে হারাতে হয়েছে। কিন্তু সোহেল আছে এবং এই লোকগুলো সোহেলেরই সংগ্রহ করা। বোঝা যাচ্ছে, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কিছুটা হলেও আছে সোহেলের, ওকে দিয়ে আরো লোক যোগাড় করতে হবে, দলকে করতে হবে আরো শক্তিশালী।
এরা সবাই সামাজিক জীবনে হতাশাগ্রস্ত, মানসিক শক্তি নেই বললেই চলে। এদের প্রভাবিত করা সোজা এবং একবার প্রভাবিত করতে পারলে এদের দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেয়া যায়। দল এখন আরো ভারি করতে হবে। চক্রাকারে।
রাত আটটার মতো বাজে। ধ্যান ভাঙ্গার সময় হয়েছে এখন। আকবর আলী মৃধা আধ-চোখে তাকালেন। সবাই নিমগ্ন হয়ে আছে। চোখ পুরো খুলে তাকালেন। দেখলেন সবাইকে। সোহেল নেই, বাইরে গেছে।
‘জেগে উঠো, সবাই, লুসিফারের সন্তানেরা,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আকবর আলী মৃধা।
আস্তে আস্তে সবাই চোখ খুলল। মনে হলো অনেক দূরের যাত্রা করে এসেছে তারা। কোন জায়গায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। তারপর বুঝতে পারল, স্বাভাবিক হয়ে এলো সবার চোখের দৃষ্টি।
ঘরের কোনায় একটা প্রজেক্টর বসানো ছিল। একটা রিমোটে চাপ দিয়ে প্রজেক্টরটা চালু করলেন আকবর আলী মৃধা।
‘এখন আমি একজনের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো,’ বলে চলছেন তিনি। প্রজেক্টরে একজনের ছবি ভেসে উঠল। অতি সাধারন একটা ছবি। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিভার্সিটির কোন একটা জায়গায়।
গুনগুন শোনা গেল দর্শকদের মাঝে। এই ছেলেকে দেখানোর মানে কি তা তারা জানতে চায়।
‘এই ছেলেটার নাম, রাশেদুল হাসান, পিতার নামঃ আজিজ ব্যাপারি, এই মহূর্তে আমাদের দলের সবচেয়ে বড় শত্রু। তার কাছে খুব গুরুত্বপুর্ন একটা জিনিস আছে। জিনিসটা আমাদের সম্পত্তি ছিল। কেড়ে নেয়া হয়েছে আমাদের কাছ থেকে। এখন এই সম্পত্তি উদ্ধার করতে হবে। তোমাদের সবাইকে। ছেলেটাকে যদি খুনও করতে হয় কোন সমস্যা নেই। তার জন্য আমি তাকে পুরুস্কৃত করবো।’
‘আমরা ওকে খুন করবো, ওর রক্ত উপহার দেবো মহান লুসিফারকে, সমবতে কণ্ঠে বলল সবাই।
‘হ্যাঁ, ওর রক্ত চাই আমার, উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন আকবর আলী মৃধা।’
‘মহান লুসিফারের জয়,’ আবার বলল সবাই।
বেশ পুলকিত হলেন আকবর আলী মৃধা। এরা এতোটা পোষ মেনে গেছে বুঝতে পারেননি তিনি। এবার বইটা উদ্ধার হবে। এখানে মোট এগারোজন শিষ্য আছে, এতো জনের হাত থেকে নিশ্চয়ই বাঁচতে পারবে না রাশেদ। রাশেদের রক্ত তিনি লুসিফারকে উপহার দেবেন বলে ঠিক করেছেন।
‘তোমরা সবাই যাও, কাল থেকে কাজে লেগে পড়ো,’ বললেন তিনি। যেকোন ধরনের তথ্য লাগলে সাথে সাথে জানাবে আমাকে, কোথাও যদি মনে হয় অন্য কারো সাহায্য দরকার, তাহলেও জানাবে। আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন ব্যাপারটা। বুঝতে পেরেছো তোমরা?
‘জি, সবাই বলল আবার একসাথে।’
‘এবার যাও,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন আকবর আলী মৃধা।
একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে সবাই। সকলের পরনে কালো আলখেল্লা, সেটা খুলে পাশের রুমে রেখে যাবে ওরা। নিজেদের পোষাক সেখানেই বদলে নেবে।
প্রজেক্টরটা খোলাই ছিল। তিনি তাকালেন রাশেদের ছবিটার দিকে। একেও অনেকটা শামীমের মতো মনে হচ্ছে, প্রানবন্ত, সজীব এবং জ্ঞানী। ছেলেটা কি বইয়ের রহস্যটা জানে? শামীম কি ওকে সব জানিয়েছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তখনই যখন ছেলেটাকে হাতে-নাতে ধরা যাবে।
শেষবার ওকে দেখা গিয়েছিল গাজীপুরে। সেখানেই প্রান হারাল দলের অন্যতম সদস্য কায়েস। যে বাগান বাড়িটায় ছিল ছেলেটা, খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সে বাড়ির মালিকের মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। নাম লিলি। এই লিলির মাধ্যমেই ছেলেটা ঐ বাগান বাড়ীতে উঠতে পেরেছে। এই তথ্যটাও খুব গুরুত্বপুর্ন। সময়মতো কাজে লাগানো যাবে।
সোহেল এসে ঢুকলো রুমটায়। বাইরে থেকে ঘেমে নেয়ে এসেছে।
‘সোহেল, ডাকলেন তিনি।’
‘জি, স্যার।’
‘তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।’
‘বলুন স্যার।’
‘গাজীপুরের ঐ বাগানবাড়ীটার মালিকের একটা মেয়ে আছে, লিলি, ওর সব খবর আমার চাই, কালকের মধ্যে।
‘জি, স্যার, দেয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে, এখন যাও,’ বললেন তিনি। শার্টের পকেট থেকে একটা নোট বের করে দিলেন সোহেলের হাতে। একহাজার টাকার। এতো টাকা খরচ হবে না এই তথ্য সংগ্রহ করতে, তবু সবসময় তিনি বেশি দিতে পছন্দ করেন।
সোহেল চলে যাবার পর আবার ধ্যানে বসলেন তিনি। প্রাচীন কিছু মন্ত্র পড়ছেন, লুসিফারের সান্নিধ্য চাচ্ছেন। লুসিফারের সাহায্যে আগে জয় করবেন মৃত্যুকে, তারপর বাকি সব কিছুকে। এখন দরকার ঐ বইটা।
***
হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলা ছিল একটা গাড়ি দেয়ার জন্য। ঢাকায় ঘুরে বেড়াবেন তিনি। কিন্তু বেরিয়েই বুঝলেন ভুল হয়ে গেছে। হোটেলের সামনেই বিশাল এক জ্যাম। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছেন। তিন-চাকার মানুষচালিত গাড়ি, পুরোপুরি ম্যানুয়াল, শারীরিক শক্তির উপর চলে। অবাক হলেন দেখে, হাল্কা পাতলা একেকজন লোক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চালিয়ে বেড়াচ্ছে বাহনগুলোকে। যাত্রীরাও বসে আছে নির্বিকার। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছে গাড়ি আর মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে ড. কারসনের।
পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এমন সময়।
‘হ্যালো, বিরক্তি চেপে বললেন ড. কারসন। দুই ডক্টরের কেউ হবে।’
‘ড. কারসন, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, আমি ড. আরেফিন বলছি।‘
‘বুঝতে পেরেছি, ক্যারি অন।’
‘আপনার কিছুটা সময় দরকার আমার।’
‘কখন?’
‘আজ হলে ভালো হয়।
‘দেখুন ড. আরেফিন, আজ আমি কিছুটা ব্যস্ত থাকবো, আপনি কাল সকালে আসুন।
‘যে বইটার কথা বলেছিলাম, তা হাতে পাবো আজ, তাই দেরি করতে চাচ্ছিলাম না।‘
‘আপনার কৌতূহলের মাত্রা বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু আজ আমি সত্যিই ব্যস্ত থাকবো।‘
‘ঠিক আছে, তাহলে কাল সকালেই আসছি আমি।’
‘ওকে, সকাল দশটায়, আমি রুমেই থাকবো,’ ফোন রেখেদিলেন ড. কারসন।
সত্যি কথা বলতে তার নিজেরও অনেক কৌতূহল হচ্ছে বইটা দেখার জন্য। কিন্তু জীবনে অনেকবারই ঠক খেয়েছেন তিনি, প্রতিবারই দেখা গেছে অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু তারপর দেখা গেছে প্রাপ্ত বস্তুখানা একেবারেই রদ্দি জিনিস, নকল। এগুলোর পেছনে একসময় অনেক টাকাও খরচ করেছেন, কিন্তু এখন অনেক সাবধান তিনি। অযথা কোন সময় নষ্ট করতে চান না, হয়তো এতোটা বয়স হবার পর বুঝে গিয়েছেন নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেইও।
বাংলাদেশে একমাস থাকবেন বলে ঠিক করে এসেছিলেন ড. কারসন। ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটিও নিয়েছেন সেভাবে। কিন্তু মহাস্থানগড় থেকে ঘুরে এসে কেমন যেন অলস বোধ করছেন তিনি। অথচ আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় যাবার কথা তার। ড. শাখাওয়াত আজ সকালেও ফোন করেছিলেন। অসুস্থতার কথা বলে পরবর্তী যাত্রা আরো দুদিন পিছিয়েছেন তিনি। এই দু’দিন এখন কি করে কাটাবেন সেই চিন্তা করছেন ড. কারসন। আগামীকালের প্ল্যান করা হয়ে গেছে। ড. আরেফিন আসবেন সকালে। তারপর দিন শুধু বিশ্রাম। আজ বেরিয়েছেন ঢাকা ঘোরার জন্য। এখানে দুটি জাদুঘর আছে, ন্যাশনাল মিউজিয়াম এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, এই দুটিতে যেতে হবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য স্থানের একটা তালিকা করলেন তিনি, সেখানে আছে আহসান মঞ্জিল, লালবাগের কেল্লা, ছোট কাটরা, বড় কাটরা। যোগ করার মতো আর কিছু পেলেন না তিনি, মজার ব্যাপার সবগুলো জায়গাই পুরানো ঢাকায় অবস্থিত এবং সেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া নাকি খুব ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়াতে অস্থির হয়ে পড়লেন ড. কারসন। জুতোর বাক্সটা রেখে এসেছেন রুমে, কিন্তু কোথায় রেখেছেন মনে পড়ছে না এখন। এই ধরনের হোটেলে বাক্সটা কেউ ছুঁয়েও দেখবে না, রুম সার্ভিস শুধু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে চলে যাবে। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এই জিনিস কারো চোখে পড়া চলবে না। কোটি টাকা দামের সম্পদ।
বেশিদূর আসেননি হোটেল থেকে। গাড়ি ঘোরাতে বললেন তিনি। এই জ্যামের মাঝে ঢাকা শহর ঘোরার কোন মানেই হয় না। অন্য আরেক দিন যাওয়া যাবে।
*
অধ্যায় ১৩
বিকেলের আলো পড়ে এসেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা জায়গায় বসে আছে রাশেদ। ছোট একটা ব্যাগ ধরে আছে সে, বুকের উপর। চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে ছেলেটা খুব টেনশনে আছে। ঠিক ছয়টায় সময় দেয়া আছে ড. আরেফিনকে। ছয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি এখনো। পার্কে আগত মানুষদের ছায়া দেয়ার জন্য কিছু ছাতার মতো জিনিস বানানো হয়েছে পার্কটায়। গেট থেকে ডানে এসে গুনে গুনে দশ নাম্বার ছাতার নিচে দাঁড়ানোর কথা রাশেদের। কিন্তু সাবধানতার জন্য রাশেদ দাঁড়িয়েছে আট নাম্বার ছাতাটার নিচে। দশ নাম্বার ছাতাটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কেউ দাঁড়ায়নি এখনো এর নিচে। লোকজন আসছে যাচ্ছে। তাদের কেউ এসেছে জগিং করতে, কেউ আড্ডা দিতে, কেউ স্রেফ নেশা করার জন্য। জগিং করতে এসেছে যারা, তাদের সংখ্যা কমে আসছে ধীরে ধীরে। হয়তো এটাই এখানকার স্বাভাবিক নিয়ম।
বেশি আগে চলে এসেছে সে, ভাবল রাশেদ। এতো তাড়াহুরো করার দরকার ছিল না। মোবাইলটা দেখছে বারবার। যেকোন সময় ড. আরেফিনের নাম্বার থেকে কল আসতে পারে।
গত কয়েকদিনের টেনশনে শুকিয়ে গেছে রাশেদ। চোখের নিচে কালো ছাপ পড়েছে। গায়ের শার্টটাও অনেক ময়লা হয়ে গেছে। ফর্সা রঙটা তামাটে হয়ে গেছে। নিজেকে অনেকদিন আয়নায় দেখেনি আর এখন এসব নিয়ে চিন্তা করার সময়ও নেই। ড. আরেফিন কখন আসবেন এটাই একমাত্র চিন্তার বিষয়।
নিজের চারদিকে সবাইকে সন্দেহ হচ্ছে রাশেদের। মনে হচ্ছে যে কোন সময় শামীমের ঘাতকেরা আবার হামলা করবে যে কোন দিক দিয়ে। এই মাত্র দুজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে ছাতার তলায়। মধ্যবয়সী লোক, কি উদ্দেশ্যে এসেছে কে জানে। তবে জগিং করতে এসেছে বলে মনে হচ্ছে না। এদের কি সন্দেহ করা যায়, যদিও দুজনের কেউ তাকাচ্ছে না তার দিকে নিজেদের গল্পেই মশগুল তারা।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো রাশেদের। ড. আরেফিনের কল।
‘আমি ছাতার নিচে, তুমি কোথায়?’ ড. আরেফিন বললেন।
‘আমি আসছি, একটু দাঁড়ান,’ বলল রাশেদ। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে হাঁটা শুরু করল।
দশ নাম্বার ছাতাটার নিচে একজন দাঁড়িয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। হ্যাংলা-পাতলা একজন লোক।
রাশেদ পৌঁছে সালাম দিল লোকটাকে। লোকটা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। এক অর্থে তারও শিক্ষক।
‘তুমি রাশেদ?’ ড. আরেফিন বললেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন মেলানোর জন্য।’
‘জি, রাশেদ বলল।
‘আমি ড. আরেফিন, শামীম আমার পরিচিত ছিল, দূরসম্পর্কের আত্মীয়,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘জি, আমি জানি।‘
‘এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা নিরাপদ হবে না, চলো আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, বাইরে পার্ক করা।‘
‘ঠিক আছে, কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আমি একটু সাবধান হতে চাচ্ছি,’ রাশেদ বলল।
‘কি রকম সাবধান হতে চাচ্ছো, বলো?’
‘আপনার যে কোন পরিচয়পত্র দেখতে চাই আমি, ভোটার আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, যে কোন কিছু।’
‘ভোটার আইডি তো সাথে নেই, তবে, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলাম তার একটা কার্ড আছে, দেখাই?
‘জি,’ বলতে একটু সংকোচই হলো রাশেদের, কিন্তু কোন রকম ঝুঁকি নেয়া যাবে না।
ম্যানিব্যাগ বের করে একটা কার্ড বের করে দিলেন ড. আরেফিন। অনেক পুরানো কার্ডটা। তবে এটার মালিক এবং ড. আরেফিন যে তিনিই তার স্বাক্ষ্য দিচ্ছে এই কার্ডটা।
‘আমি সন্তুষ্ট, রাশেদ বলল।’
‘চলো তাহলে এগুনো যাক,’ ড. আরেফিন বললেন।
পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। রাশেদের মনের সন্দেহ দূর হয়েছে। এখন বইটা হস্তান্তর করলেই কাজ শেষ। কিন্তু হস্তান্তর করলেই কি ঝামেলা মিটে যাবে। শামীমের ঘাতকেরা কি তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে। এছাড়া শামীম বইটার যে রহস্যের কথা বলেছে, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে বইটা ছেড়ে দেয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এলিক্সির অফ লাইফের রহস্য যদি সত্যিই এখানে লেখা থাকে, তাহলে ড. আরেফিন অবশ্যই এই রহস্য বের করার জন্য প্রানপন চেষ্টা চালাবেন। তিনি যদি সফল হয়ে যান, তাহলে তিনি অমরত্বের পথে এগিয়ে যাবেন। তখন রাশেদকে থাকতে হবে সাথে, যাতে এই সফলতার ভাগ সেও পেতে পারে। এই আবিষ্কার হবে অমূল্য, পৃথিবীর সব টাকা দিয়েও এর মুল্য শোধ করা যাবে না।
আগডুম বাগডুম অনেক কিছুই ভাবছিল রাশেদ। পাশে হাঁটতে থাকা ড. আরেফিনও পুঁদ হয়ে আছেন দিবাস্বপ্নে। এই বইটা আগে একবার হাতে এসেছিল। শামীমকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন তিনি বইটা রেখে যাওয়ার জন্য, ছেলেটা রেখে যায়নি। রেখে গেলে হয়তো তার পরিণতিও হয়তো শামীমের মতো হতো। কিংবা নাও হতে পারতো। যাই হোক, বইটা আবার চলে এসেছে তার কাছে। এবার আর হাত ছাড়া করা যাবে না। রাশেদ ছেলেটাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। তারপর বইটা নিয়ে বসতে হবে ড. কারসনের সাথে।
দু’জন হাঁটছিল, যে যার চিন্তায় বিভোর। রাশেদ ব্যাগটা এখনো চেপে আছে বুকের সাথে। এই এলাকায় ছিনতাই হয় বলে শুনেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, গেটের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। এর মধ্যে এ অদ্ভুত অনুভূতি হলো রাশেদের। মনে হলো পেছন পেছন কেউ আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। সেই দুজন লোককে দেখা যাচ্ছে, যারা তার সাথে একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষন। এখনো নিজেদের মাঝে গল্প মশগুল তারা।
রাশেদ তাকাল ড. আরেফিনের দিকে। ইশারা বুঝতে পারলেন ড. আরেফিন। তিনিও তাকালেন পেছনে, এমনভাবে যেন এমনিই তাকিয়েছেন। লোকদুটিকে দেখলেন তিনিও। কিন্তু ভয়ের কিছু আছে বলে মনে হলো না। কিন্তু এর মধ্যে অন্যদিক থেকে আক্রান্ত হলেন তিনি। ঠিক নাকের উপর একটা ঘুষি খেয়ে পড়ে গেলেন। পড়ে যেতে যেতে দেখলেন দু’জন লোক আক্রমন করেছে রাশেদকে। এলোপাথারি মেরে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে ব্যাগটা। কিন্তু রাশেদ বাঁধা দিচ্ছে প্রাণপণ। পেছনের লোকদুটোকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে দেখলেন ড. আরেফিন। এরা তাহলে এতোক্ষন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল? কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমান করে দিয়ে আক্রমনকারীদের উপর চড়াও হলো লোকদুটো। দুজনই মনে হলো মার্শাল আর্টে বেশ দক্ষ। তাদের সামনে দাঁড়াতে পারলো না আক্রমনকারী দু’জন। পালালো। রাশেদের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। মাটিতে পড়ে আছে। মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। কিন্তু বুকের সাথে শক্ত করে ধরে রেখেছে ব্যাগটা।
উঠে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। রাশেদকে উঠে দাঁড়াতে সহযোগিতা করল দুজনের একজন। একটু আগেই এদের সন্দেহ করছিলেন বলে খারাপ লাগল ড. আরেফিনের।
‘আপনাদের যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো, ড. আরেফিন বললেন, গলায় কৃতজ্ঞতার সুর।’
‘ভাই, পারলে মার্শাল আর্ট শেখেন, ব্যায়াম করেন, আইজ তো তক্তা হইয়া যাইতেন,’ দুজনের একজন বলে উঠল।
সত্যি কথাই বলেছে লোকটা, কিন্তু নিজেকে তক্তার সাথে তুলনা করতে ভালো লাগল না ড. আরেফিনের।
‘জি, ঠিকই বলেছেন আপনি,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘আগে লোকটারে লইয়া হাসপাতালে যান, মাথা ফাটছে, আমাদের ধন্যবাদ না দিলেও চলবে, দ্বিতীয় লোকটা বলে উঠলো এবার।
রাশেদের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। আসলেই বেশ রক্ত বের হচ্ছে।
রাশেদের একটা হাত নিজের কাঁধে টেনে নিলেন তিনি। তোক দুটো এখনো সাথেই আসছে। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে।
গেটের ঠিক বাইরেই পার্ক করা ছিল ড. আরেফিনের মাইক্রোবাসটা। ড্রাইভারকে ডেকে দুজনে পেছনের সিটে তুলে নিলেন রাশেদকে। ছেলেটা এখনো বুকের সাথে শক্ত করে আটকে রেখেছে ব্যাগটাকে।
গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। যে লোক দুটো আক্রমন করেছিল তাদের একজনকে দেখলেন বলে মনে হলো ড. আরেফিনের কাছে। একটা রিক্সার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে তাদের চলে যাওয়াটা। হয়তো পিছু নেবে।
ব্যাপারটা পরিস্কার হলো ড. আরেফিনের কাছে। এরা সাধারন ছিনতাইকারী নয়। রাশেদের কাছ থেকে বইটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যই আক্রমন করেছিল ওরা। ঐ লোক দুজন না থাকলে কিছুতেই হয়তো রক্ষা করা যেতো না ব্যাগটা। অবশ্য রাশেদ ছেলেটাও ছাড় দেয়নি।
বুঝতে পারছেন এখন কি দারুন ঝামেলার মধ্যে জড়াতে চলেছেন তিনি। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সামনে এগুতে হবে। রাশেদকে টাকা-পয়সা দিয়ে বিদায় করে দেয়ার চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললেন মাথা থেকে। এখন এ ধরনের সাহসী একটা ছেলেকে পাশে চাই তার।
ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল কাছেই। কিন্তু সেদিকে গেলেন না তিনি, ইউনিভার্সিটির টিএসসির সামনে এসে গাড়িটা ছেড়ে দিলেন। ছেলেটাকে নিয়ে উঠলেন একটা সিএনজিতে। ওরা যদি গাড়িটাকে ধাওয়া করে ধরতেও পারে, তাহলে তাকে পাবে না। ড্রাইভারকে বলে দিলেন গাড়ি নিয়ে যেন বাসায় না যায় এখন, যদি নিরাপদ মনে করে তাহলে রাতটা ভাড়ায় কোন গ্যারেজে রাখতে বললেন তিনি।
সিএনজি ছুটছে দ্রুতগতিতে। পরিচিত একটা ক্লিনিক আছে সামনেই, সেখানেই যাচ্ছেন আপাতত ড. আরেফিন। রক্ত পড়া থামেনি এখনো রাশেদের মাথা থেকে। গায়ের শার্টটা অনেকটাই ভিজে গেছে রক্তে। রাশেদের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। ছেলেটা তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। শুন্য দৃষ্টিতে।
***
বেশ কয়েকমাস পার করে দিয়েছেন তিনি কোদারি গ্রামটায়। কিন্তু এখান থেকে বের হওয়ার মতো সুযোগ হয়ে উঠছে না। তিব্বতীরা তাদের সুবর্ন দিন হারিয়ে ফেলেছে। যদিও একাদশ দালাই লামা আছেন, কিন্তু তার অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো। রাজধানী লাসার আগের শহরটা হচ্ছে সিগটেসে। আপাতত ওখানে যাওয়ার ইচ্ছেই ছিল তার। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এখনো। একদিকে চীনের আগ্রাসন অন্যদিকে বৃটিশ সাম্রাজ্য তার বিস্তৃতি ঘটাতে চাচ্ছে নেপাল ছাড়িয়ে হিমালয় পেরিয়ে এই তিব্বতেও। পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে। তিব্বতীরা শান্তিপ্রিয় মানুষ অনেককাল হলো। হাতের অস্ত্র তারা রেখে দিয়েছে, কণ্ঠে তাদের এখন গৌতম বুদ্ধের শান্তির বানী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা তা শুনবে কেন। যুগে যুগে শান্তিকামীদের হটিয়ে একেকটি সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছে, যারা সমরে ভালো করতে পারেনি তারা হয় অন্যের পদানত হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে পৃথিবী নামক এই গ্রহটার আরো লক্ষ লক্ষ প্রজাতির মতো।
সভ্যতা এসেছে, জয় করেছে সবকিছু, তারপর হারিয়েও গেছে, সেই প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে এই বৃটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত। বলা হয়, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যাবে না। যাবে কি না তা হয়তো ভবিষ্যতই বলে দেবে।
এই মুহূর্তে রামপ্রসাদকে নিয়ে চিন্তায় আছেন তিনি। সাধারন লোক, এখানকার বৌদ্ধমন্দিরের কঠিন নিয়মে থাকতে হয়তো ভালো লাগছে না বেচারার। কিন্তু এখন তো কিছুই করার নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া।
এই কয়মাস একটা দিকে এগিয়ে গেছেন তিনি। তা হচ্ছে ভাষা। যতটুকু জানা ছিল, তা ছিল সামান্য। এখন এই বিশাল অবসরে ভাষা শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন তিনি এবং বলা যায়, স্থানীয় তিব্বতীদের মতো একই সুরে কথা বলতে পারেন এখন। বিষয়টা দারুন আলোড়নের সৃষ্টি করেছে মন্দিরে থাকা শেবারন এবং তার শিষ্যদের মধ্যে। দিন যতো যাচ্ছে, ততো যেন ভক্ত হয়ে পড়ছে ওরা।
কিন্তু এখানে এভাবে বেশিদিন থাকা যাবে না। তার দুটো উদ্দ্যেশ্যের মধ্যে একটি প্রায় পূরন হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টি এখনো বাকি।
এখানকার শেবারন অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু ঘুনাক্ষরেও সেই শব্দটা উচ্চারন করেননি তার সামনে। হয়তো লোকটা সে সম্পর্কে কিছুই জানে না, নয়তো এড়িয়ে গেছে।
শব্দটা হচ্ছে ‘সাম্ভালা।‘
এই সাম্ভালার খোঁজ করতে হবে। সাম্ভালা একটা জায়গার নাম। কাল্পনিক? হতে পারে। আবার সত্যিও হতে পারে। অনেককাল আগে শোনা এই জায়গাটা মনের ভেতরে একটা দাগ কেটে গেছে যেন। ইচ্ছে ছিল, যদি কোনদিন অবসর সময় মেলে, তাহলে নিজেই বের করে নেবেন আসলে জায়গাটা সত্যি আছে, নাকি লক্ষ মিথের মতো একটা মিথ।
পৃথিবীতে কত শত মিথের জন্ম হয়েছে, পাখা মেলে সেসব মিথ ঘুরে বেড়িয়েছে। দেশ থেকে দেশান্তরে। সাম্ভালাও হয়তো এরকম একটা মিথ। প্রাচীন একটা নগরী। হিমালয়ের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারনের সীমার বাইরের একটি রাজ্য। যেখানে আছে নিরবিচ্ছিন্ন সুখ, নেই কোন হানাহানি, নেই মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ। তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের এক চিরায়ত বিশ্বাস সাম্ভালা আছে। শুধুমাত্র সাধনার বলেই কেউ দেখতে পারবে জায়গাটা, বসবাস করতে পারবে সেই শান্তির ভুবনে। মৃত্যু বলে কোন জিনিস নেই সেই শহরে।
মৃত্যুকে জয় করেছেন তিনি। কাজেই সেসব নিয়ে ভাবছেন না এখন। কিন্তু একটা চিন্তা মাঝে মাঝে তাকে নাড়া দিয়ে যায়, এই পৃথিবীতে তিনি কি একাই এই দুর্লভ শক্তির অধিকারী, না আরো কেউ আছে। থাকলে তাকে বা তাদের খুঁজে বের করতেই হবে। এতো বড় একটা গোপনীয়তা একা একা বহন করে চলেছেন তিনি। মাঝে মাঝে বড়ই অসহায় লাগে যখন দেখেন বেঁচে থাকার জন্য সাধারন মানুষের কি দুর্নিবার আকুতি।
সাম্ভালার রহস্য জানে এমন কাউকে দরকার এখন। কিন্তু কেউ কি নিজ থেকে বলবে এই গোপন রহস্যের কথা? সাম্ভালা কি আসলেই এই তিব্বতের কোথাও লুকিয়ে আছে লোকচক্ষুর আড়ালে। মোঙ্গলদের বিশ্বাস সাম্ভালার অবস্থান সাহারা মরুভুমির নিচে কোথাও। কিন্তু কেন জানি তত্ত্বটা পছন্দ নয় তার। সাম্ভালা মাটির তলদেশে অবস্থিত কোন শহর নয়, এর অবস্থান পৃথিবীর উপরিভাগেই।
অনেকক্ষন বাইরে রয়েছেন তিনি। মন্দিরের ছাদ বলা যায় জায়গাটাকে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রায়ই দূরের হিমালয় দেখেন। একেকটা চূড়া যেন আকাশ ছুঁয়েছে। পুরো এলাকাটা দেখা হয়নি এখনো। হিন্দুদের তীর্থ বেশ কিছু সরোবর রয়েছে এই অঞ্চলেই। যেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত নদীর। রামপ্রসাদের খুব আগ্রহ এই জায়গাগুলো দেখার। যখন দেশে ফিরবে তখন হয়তো সবার সাথে গল্প করে বেড়াবে সে কি কি দেখেছে, লোকজন চোখ গোল গোল করে তার কথা শুনবে।
পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ, টের পেলেন তিনি। কাউকে বিশ্বাস হয় না তার। কোমরে গোঁজা ছুরিটা হাতে নিয়ে তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন।
লোকটা অন্য কেউ না, রামপ্রসাদ। মনিবের হাতে ছুরি দেখে ভড়কে গেছে। কিছুদিন আগে ঐ লোকগুলোকে শায়েস্তা করার কথা মনে পড়ে যেতে শিউরে উঠলো
সে। তলোয়ার এবং ছুরি চালানোয় তার মনিব যে সিদ্ধহস্ত এটা তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।
‘হুজুর, আমি রামপ্রসাদ, কোনমতে বলল সে, ঢোক গিলতে গিলতে।’
‘কিছু বলবে?’ ছুরিটা কোমরে গুজতে গুজতে বললেন তিনি।’
‘এখানে তো অনেকদিন হয়ে গেল, দেশে যেতে মন চায়।’
‘কোন দেশে? দিল্লিতে?’
‘জি, হুজুর।’
‘আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো, আমি যদি না ফিরি তোমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।’
‘জি, হুজুর।’
‘এখন যাও,’ বলে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। সূর্য ডোবার সময় হয়ে গেছে। এসময়টা মন খারাপ থাকে তার। রামপ্রসাদকে ছাড়া যাবে না, ওকে ধরে রাখতে হবে। অনেক অনেক রহস্য জেনে ফেলেছে লোকটা, এছাড়া দুটো সুটকেস বহন করার মতো লোকও তো পেতে হবে। তারপরও একবার লোকটার মন যেহেতু বাড়ির দিকে টেনেছে, তাহলে ওকে আটকানো খুব কঠিন হবে।
সূর্য ডুবে যাবার একটু পর মন্দিরে ঢুকলেন তিনি। একটা ভালো সংবাদ পেলেন। আগামী পরশু সিগটেসে যাবার ব্যবস্থা করেছেন এই মন্দিরের প্রধান। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছেন খে-লান ভাতৃসম্প্রদায়ের বড় স্তরের নেতারা।
***
আজিজ ব্যাপারি ইলেকশনে জিতেছেন। চারদিকে খুব হৈচৈ পড়ে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। যা তা কথা নয়। ইলেকশনের আগে বাড়িতে পুলিশ আসার ঘটনায় আরেকটু হলেই হেরে যেতেন। কিন্তু এবার কপাল সত্যিই ভালো। পরপর তিনবার দাঁড়ানোর পর এবার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল তার।
বাড়িতে নতুন একটা ঘর তুলেছেন তিনি। বৈঠকখানা। সেখানে সবাই আসে, তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। গ্রাম্য সালিশিতে তার কথাই এখন প্রায় আইন। এইসব জিনিস ভালোই উপভোগ করছেন তিনি।
কিন্তু মন খারাপ অন্য দিক থেকে। রাশেদের কোন খবর নেই। উধাও হয়ে গেছে। যেন ছেলেটা। মোবাইল ফোন বন্ধ। হলেও লোক পাঠিয়েছেন কয়েকবার কিন্তু প্রতিবারই নিরাশ হয়ে ফিরেছে তারা। একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন ছেলেটা। সবসময়ই মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকেন, এই বুঝি ছেলের কল আসে।
থানায় জিডি করাবেন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু কিছুটা সময় নিচ্ছেন তিনি। আরো কিছুদিন দেখা যাক।
দোকানেও তেমন একটা বসেন না ইদানিং। খারাপ দেখা যায়, তাই একজন ম্যানেজার রেখে দিয়েছেন তিনি, গ্রামের ছেলে, অল্পসল্প লেখাপড়া জানা, আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটার বাপ হচ্ছে জয়নাল। এক রাতে মহাবিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল যে লোকটা। জয়নাল এখন সবসময় তার সাথেই থাকে। তার ডান হাত। সবাই ওকে। ভয় পায়।
বৈঠকখানায় বসে আছেন তিনি। বড় দেখে একটা টেবিল বানিয়েছেন, সেগুন কাঠ দিয়ে, চেয়ারও বানিয়েছেন, বিশালকায়। চেয়ারম্যানের চেয়ার বলে কথা। আরাম করে বসে আছেন এখন, পান চিবুচ্ছেন। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন সামনে বসে থাকা লোকজনের দিকে। একেকজন একেক সমস্যা নিয়ে এসেছে। তিনি সমাধান দিচ্ছেন। সমাধান দিতে ভালো লাগে তার।
বাইরে উঠোনে বসে থাকা বুড়ো বাপের দিকে তাকালেন একবার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে বুড়ো। হাতে টিনের পাত্রে রাখা মুড়ির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। কি এতো ভাবে লোকটা, অবাক হয়ে ভাবেন তিনি।’
‘আইজক্যা তোমরা যাও, আমার কিছু কাজ আছে,’ সামনে বসে থাকা সবার উদ্দ্যেশ্যে বললেন তিনি।
জয়নালকে ইশারা করলেন সবাইকে যেন বের করে দেয় বৈঠকখানা থেকে। ছেলের কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। কারো সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করতে চান না তিনি।
লোকজন বের হয়ে যাওয়ার পর উঠে দাঁড়ালেন। জয়নালকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন।
‘জয়নাল, তুমিও যাও, কাল সকালে আইসো আবার,’ বললেন তিনি।
‘ঠিক আছে,’ বলল জয়নাল। তারপর বেরিয়ে গেল।
উঠোনে এসে দাঁড়ালেন আজিজ ব্যাপারি। বুড়ো বাপকে দেখছেন একদৃষ্টিতে। লোকটা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে যেন। বাপের ইতিহাস মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। এই লোকটা অনেক বছর আগে এই এলাকায় এসেছিল, একা, সাথে দুটো সুটকেস নিয়ে। নামহীন, পরিচয়হীন। কাজেই তার বংশ কি ছিল, দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল কি না কেউ জানে না। কোন চাচা-ফুফুর কথা শোনেননি কখনো তিনি। ছোটবেলা মাই ছিল সহায়। বাপ কথা বলতো, তাও খুব মেপে মেপে।
আর এখন তো কথাই বলে না প্রায়।
একটা পিড়ি নিয়ে বুড়োর পাশে বসলেন তিনি। বুড়ো টিনের পাত্র থেকে মুখ উঠিয়ে তাকাল তার দিকে, তারপর যা কখনো করেনি জীবনে তাই করলেন আজিজ ব্যাপারি। বুড়োর বুকে মাথা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
বুড়ো কিছু না বলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেলেন আজিজ ব্যাপারির মাথায়। ‘কান্দিস না বাপ, সব ঠিক হইয়া যাইবো,’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন বুড়ো।
‘আমার রাশেদের তো কোন খবর পাই না, বাজান,’ আজিজ ব্যাপারি বললেন চোখ মুছতে মুছতে।
‘রাশেদ আছে, সমস্যায় আছে, চিন্তার কিছু নাই, আমার নাতি সে, বিপদ পার করতে পারবে।‘
‘বাজান, তোমার কথায় অনেক ভরসা পাই।’
‘আমি বানাইয়া বানাইয়া কথা কই না।’
কেঁদে একটু হাল্কা হয়েছেন আজিজ ব্যাপারি। বুড়ো বাপের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। কি নিশ্চিন্ত, নির্লোভ চেহারা। নুরাণী একটা ছাপ আছে সেখানে।
‘বাজান, কিছু মনে না করলে একটা কথা কই?’
বুড়ো তাকালেন ছেলের দিকে, বোঝার চোঁ করছেন কি বলতে চাইছে আজিজ ব্যাপারি।
‘আমি এতো নিশ্চিত কইরা কিভাবে সব বলতে পারি, এই তো? উত্তর দিলেন না আজিজ ব্যাপারি। আসলে এই প্রশ্নটা করতে চাচ্ছিলেন তিনি।
‘শোন বাবা, সবকিছুর উত্তর হয় না, আর সব কিছু না জানাই ভালো, বুড়ো বললেন।
এরপর আর কথা চলে না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন আজিজ ব্যাপারি। দোকানের দিকে যাওয়া দরকার। হিসাব-কিতাব নিতে হবে। হাতের মোবাইল ফোনটা শক্ত করে ধরে আছেন তিনি। কখন রাশেদের কাছ থেকে ফোন আসে কে জানে।
*
অধ্যায় ১৪
হোটেল কক্ষে শুয়ে আছেন ড. কারসন। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। বাক্সটা নিজের ট্রাভেল ব্যাগে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে রেখেছেন এবং এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত তিনি। কিন্তু বাংলাদেশে যে কাজে এসেছেন সেই কাজই করা হয়নি ঠিকমতো। কাজেই ঠিক করলেন একটা মেইল করবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, যাতে তার ছুটি আরো কিছুদিন বাড়ানো হয়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসা তা শতভাগ পূরন হয়নি। তবে জুতোজোড়া পাওয়া গেছে এটাও বিশাল এক প্রাপ্তি। বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় জুতো উদ্ধার হওয়া বিশাল এক ঘটনা। এখন দেশে ফিরে গিয়ে উপযুক্ত প্রযুক্তির মাধ্যমে এর সত্যিকারের বয়স নির্ধারন করতে হবে। তাহলেই প্রমান করা সহজ হবে, সবার জানার বাইরেও বিশেষ একজন গিয়েছিলেন ঐ অঞ্চলে।
সেইন্ট জারমেইন নামটা তাকে আকর্ষন করে চুম্বকের মতো। অনেক দেশ ঘুরেছেন তিনি এবং প্রতিটি দেশেই এমন কিছু পেয়েছেন যাতে মনে হচ্ছে লোকটার পা পড়েছিল সেই দেশে। যেন পৃথিবীর প্রতিটি এলাকায় নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চেয়েছিল লোকটা। এমনও হতে পারে, জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল ছিল লোকটার এবং সেজন্যেই ঘুরে বেড়িয়েছে সে পুরো পৃথিবীময়।
এখন সে কোথায়? এই বাংলাদেশে? কে জানে? সর্বশেষ যে লোক নিজেকে সেইন্ট জারমেইন দাবি করছিল সে ছিল ফ্রান্সের অধিবাসী। টেলিভিশনের পর্দায় লোকটা এও দাবি করেছিল রাজা ষোড়শ লুই জীবিত আছেন। রিচার্ড চ্যানফ্রে নামক সেই ভদ্রলোক শেষে অবশ্য আত্মহত্যা করেছিলেন। সেটাও অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু তারপর সেইন্ট জারমেইনকে নিয়ে বিশেষ কোন লেখালেখি বা অনুসন্ধান চলেনি। লোকজন ভুলেই গেছে। কিন্তু ভোলেননি ড. কারসন।
মোবাইল ফোনটা বালিশের নিচে রেখেই শুয়েছিলেন তিনি। ফোন বেজে উঠাতে বিরক্ত হয়েই কল রিসিভ করলেন তিনি।
‘ড. কারন বলছি।’
‘গুড আফটারনুন,’ আমি ড. আরেফিন।
‘বলুন, বেশ বিরক্ত হলেন ড. কারসন, দুপুরের এতো সুন্দর ঘুমটা ন’ হচ্ছে বলে।
‘আমি সন্ধ্যায় আপনার সাথে দেখা করতে চাই, সময় হবে?’
‘সন্ধ্যা কয়টায়?’
‘সাতটায় আসি?’
‘আসুন।‘
‘বাই।‘
ফোনটা বালিশের নিচে আবার খুঁজে রাখলেন তিনি। ড. আরেফিনকে যথেষ্ট বিরক্তিকর মনে হয় কারসনের কাছে। যদিও লোকটা কখনো অভদ্র আচরন করেনি।
ঘুম আসবে না এখন, ল্যাপটপটা খুলে বসলেন তিনি। ছোট ছোট নোট করে রেখেছেন, যাতে ভুলে না যান। পড়া শুরু করলেনঃ সেইন্ট জারমেইনের গুনাবলী বা তার সম্পর্কে লোকজনের ধারনাঃ
চমৎকার ভায়োলিন বাজাতে পারেন এই ভদ্রলোক।
চমৎকার একজন আঁকিয়েও।
যেখানেই গেছেন, সেখানে একটা পরীক্ষাগার স্থাপন করেছেন, সম্ভবত আলকেমি নিয়ে গবেষনা করার জন্য।
লোকটা যথেষ্টই ধনী, যদিও কোন ব্যাঙ্কে তার কোন একাউন্ট আছে বলে জানা যায়নি (এর কারন হতে পারে, তিনি লোহাকে সোনায় পরিণত করতে পারতেন, যা জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি কখনো।)
বন্ধুবান্ধবদের সাথে নিয়ে খাবার আয়োজন করতে পছন্দ করতেন, কিন্তু নিজে কখনো খেতেন না, তার খাবার ছিল সাধারন ওটমিল।
ত্বকের যত্ন নেবার জন্য কিংবা চুলে রঙ করার জন্য বিশেষ ধরনের দ্রব্য ব্যবহার করার পরামর্শ দিতেন, যা অন্যকেউ তৈরি করতে পারতো না।
রত্ন পছন্দ করতেন, জামাকাপড় এমনকি জুতোয় রত্ন ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে তাকে।
ধারনা করা হয় ছোট কয়েকটি হীরের সাহায্যে বড় আকারের হীরে তৈরি করতে পারতেন। এমনকি মুক্তোকেও বিশেষ উপায়ে অনেক বড় করে তৈরি করতে পারতেন।
বেশ কিছু গুপ্তসংগঠনের সদস্য ছিলেন তিনিঃ রসিকুসিয়ানস, ফ্রি ম্যাসনস, সোসাইটি অফ এশিয়াটিক ব্রাদারস, দ্য নাইটস অফ লাইট, দ্য ইলুমিনাটি, খে-লান এবং অর্ডারস অফ দ্য টেমপ্লারস।
জুতোজোড়া, যা এখন তার ট্রাভেল ব্যাগে বন্দী তা অবশ্যই সেইন্ট জারমেইনের। তালিকাটা পড়ে ধারনাটা বদ্ধমূল হলো ড. কারসনের। জুতোজোড়া যখন এসেছিল এখানে, তারমানে সেইন্ট জারমেইনও এসেছিলেন বাংলাদেশে। যদিও তখন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। এখনো হয়তো এখানেই আছে সে, ছদ্মবেশে। হয়তো এই ঢাকা শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো আবার। বালিশের নিচে চাপা পড়ে আছে। বিরক্ত চোখে তাকালেন জিনিসটার দিকে। চিন্তাভাবনায় যথে’ ছেদ ঘটায় এই ফোন।
ড. শাখাওয়াতের ফোন। এই আরেক সমস্যা।
‘কারসন বলছি।’
‘ড. কারসন, আমি ড. শাখাওয়াত, আপনি ভালো আছেন?’
‘জি, ভালো আছি।’
‘মনে আছে তো আপনার, মনে করিয়ে দিতে আবারো ফোন করলাম।’
‘মনে নেই,’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন ড. কারসন। সত্যিই কিছু বলেছিলেন কি না মনে নেই তার।
‘আজ রাতে আপনার অনারে আমি ডিনার পার্টি দিয়েছি, আমার বাসায়, অনেক গন্যমান্য ব্যক্তি আসবেন, ঠিক সাতটায় আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।’
‘আটটায় গাড়ি পাঠান, আমি তৈরি থাকবো।’
‘সবধরনের আদর-আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে আপনার জন্য।’
‘শুনে ভালো লাগল, এখন রাখি, একটা কাজ করছি।’
‘আচ্ছা, বাই।
এবার ফোনটা সাইলেন্ট করে বালিশের তলায় চাপা দিলেন ড. কারসন। সন্ধ্যা সাতটায় আসবে এক ডক্টর, আটটায় আরেকজন, পুরো রাতটাই পাগল করে দেবে এই দুই ডক্টর মিলে।
***
মিরপুরের একটা ক্লিনিকে আছে রাশেদ এখন। মাথায় ব্যান্ডেজ, বেডে শুয়ে আছে সে। গাজীপুরে সেই পাঁচিল থেকে পড়ে যাওয়া আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হামলায় শরীরের উপর দিয়ে যথে’ ঝড় গেছে তার। এছাড়া টেনশন তো আছেই। সব মিলিয়ে কিছুদিন আগের রাশেদ এবং এখনকার রাশেদের মধ্যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। কেমন একটা গোঁয়ারভাব এসে গেছে চেহারাটায়, আগের সেই নরমসরম ভাবটা একেবারে উধাও।
ড. আরেফিন একটা কেবিন ভাড়া নিয়েছেন রাশেদের জন্য। রাতে যখন রাশেদকে নিয়ে এসেছিলেন এই ক্লিনিকটায়, তখন চোখে সব ঝাপসা দেখছিল সে। কোনমতে দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে ছিল, মনের জোরে। কাঁধে ঠিকই ঝোলানো ছিল ব্যাগটা। সেদিকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে পাহারায় বসিয়েছিল রাশেদ। কেউ ব্যাগটা ধরতে গেলেই আচমকা হাতটা ধরে ফেলতো, মনের অজান্তেই। ড. আরেফিন দু’একবার চেষ্টা করেছিলেন ব্যাগটা সরিয়ে নিতে, যদিও উদ্দেশ্য ছিল রাশেদকে একটু ভারমুক্ত করার। কিন্তু এই ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করে না সে। কাজেই ড. আরেফিনকে ব্যর্থ হতে হয়েছে। অবশ্য তিনি চাইলে পরে নিয়ে নিতে পারতেন। রাশেদকে যখন ঘুমিয়ে পড়তে হলো, তখন তিনি অবশ্যই ব্যাগটা নিয়ে নিতে পারতেন। ট্রাভেল ব্যাগটা রাখা আছে বেডের পাশে, ছোট একটা টেবিলে।
ক্লিনিকটা হয়তো ড. আরেফিনের পরিচিত কারো, যত্ন-আত্তির অভাব হচ্ছে না। একটু পর পর নার্স এসে দেখে যাচ্ছে। কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে। মৃদু হেসে ফিরিয়ে দিচ্ছে রাশেদ।
লিলির কথা মনে পড়ছে বারবার। কেমন আছে কে জানে? মারাত্মক একটা ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে সে মেয়েটাকে। জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল। বন্ধ হয়ে আছে। বোম টিপে চালু করল ফোনটা। মনে মনে ঠিক করছে, কাকে কাকে ফোন করা দরকার। লিলিকে, বাবাকে। এছাড়া আর কেউ নেই অবশ্য।
লিলির নাম্বারে চেষ্টা করল রাশেদ। নেটওয়ার্ক সমস্যা। তিনবারের চেষ্টায় ওপাশে রিঙ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।
‘হ্যালো, লিলির কণ্ঠ শোনা গেল ওপাশ থেকে।’
‘আমি, রাশেদ, কেমন আছো তুমি লিলি?’
‘ভালো নেই রাশেদ, তুমি কোথায়?’
‘আছি, পরে বলবো তোমাকে, এখন রাখি,’ রাশেদ বলল। আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না সে।’
‘রেখো না, প্লিজ, দারুন ঝামেলা হয়েছিল, বাবা ডাকাতি কেস করেছেন থানায়, কপাল ভালো তুমি যে ওখানে ছিলে কেউ বুঝতে পারেনি,সবাই ভেবেছে সাধারন ডাকাতির কেস, কিন্তু, যাই হোক, নিজেকে খুবই অপরাধি লাগে, ঐ দুজনের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।
‘তুমি নও, আমি দায়ী, শামীম এবং ওদের মৃত্যুর বদলা নেবো আমি।’
‘শোন, বদলা নেবার প্রয়োজন নেই, যে ঝামেলায় আছে সেটা থেকে বের হয়ে আসো, তোমার কাছে আর কিছু চাই না আমি।’
‘চেষ্টা করছি, তোমাকে জানাবো, এখন রাখি।’
‘আচ্ছা।‘
ফোন রেখে দিল রাশেদ। তবু স্বস্তি পেয়েছে সে যে বড় কোন ঝামেলায় পড়েনি লিলি। সময় সুযোগ মতো ওর সাথে দেখা করতে হবে একবার। বাবাকে ফোন করা দরকার এখন। নাম্বার ডায়াল করল রাশেদ।
‘হ্যালো,কে? ওপাশ থেকে একটা বাজখাই কণ্ঠ শোনা গেল। একেবারে অপরিচিত কণ্ঠ, জীবনে কখনো শোনেনি রাশেদ।
‘আমি রাশেদ, আপনি কে?’
‘আমি জয়নাল, চেয়ারম্যানসাহেবের খাস লোক।‘
রহস্য যেন আরো ঘনীভূত হলো রাশেদের কাছে। চেয়ারম্যান কে? আজিজ ব্যাপারি চেয়ারম্যান হয়েছেন? দারুন ব্যাপার।
‘আমি চেয়ারম্যানের ছেলে রাশেদ বলছি, বাবাকে দিন।‘
‘ভুল হইয়া গেছে বাজান, দিতাছি, একটু ধরেন,’ ওপাশে বাজখাই কণ্ঠ মিইয়ে গেছে।
‘রাশেদ, বাবা, তুমি কই?’ বাবার কণ্ঠ শুনতে পেল রাশেদ।’
‘আমি ঢাকায়।
‘মিছা কথা কইয়ো না বাজান, অনেক খুঁজছি তোমারে, কোন হদিস নাই, ঢাকার কোথায় আছো, লোক পাঠাইতাছি, এক্ষুনি তুমি গ্রামে আসবা।’
‘আর কয়টা দিন, খুব জরুরী একটা কাজে আছি, কাজ শেষ হলেই আসবো।
‘বাজান, তোমারে দেখার জন্য বেজায় পেরেশান হইয়া আছি, তাড়াতাড়ি আসো।’
‘একটু ধৈর্য ধরো, এখন রাখি বাবা, পরে কথা হবে।‘
‘শোনো, আর যাই করো, মোবাইল বন্ধ রাখবা না, আমি ব্যাপক টেনশনে থাকি তোমারে লইয়া।
‘ঠিক আছে, বাবা, মোবাইল খোলা থাকবে, এখন রাখি।‘
ওপাশ থেকে আরো কিছু কথা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কেটে দিল রাশেদ। এখন বেশি কথা বলা যাবে না। তাতে বাবার টেনশন আরো বাড়বে। এই ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারলে গ্রামে গিয়ে বছরখানেক থেকে আসবে বলে ঠিক করল রাশেদ। একটা চিন্তামুক্ত স্বাভাবিক জীবন চাই তার। লুকিয়ে-পালিয়ে এভাবে থাকাকে জীবন বলে না।
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল রাশেদ। এসময় ঢুকলেন ড. আরেফিন। গতকাল বিকেল থেকে অনেক রাত লোকটা তার সাথেই থেকেছে। তাই কিছুটা হলেও এর কাছে কৃতজ্ঞ রাশেদ।
‘কেমন লাগছে এখন?’ ড. আরেফিন জিজ্ঞেস করলেন বিছানার পাশে বসে।’
‘ভালো।’
‘তুমি কি হাঁটতে চলতে পারবে, মানে…’ একটু ইতস্তত করলেন ড. আরেফিন, বলবেন কি বলবেন না ভাবছেন, তোমাকে নিয়ে একজনের সাথে দেখা করার প্ল্যান করেছিলাম।
‘কার সাথে?’
‘ড. কারসন, প্রাচীন ভাষার উপর একজন বিশেষজ্ঞ, প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক এবং গবেষক, এখন ঢাকায় আছেন তিনি, এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগ, উনার কাছে বইটার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।’
‘তাহলে হাঁটতে পারবো আমি,’ উৎসাহী হয়ে উঠেছে রাশেদ।
‘ঠিক আছে, সন্ধ্যার আগেই বেরুব আমরা, তুমি তৈরি থেকো, তোমার উপর আসলে বেশি চাপ হয়ে যাচ্ছে,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘অসুবিধা নেই, যেতে পারবো আমি,’ রাশেদ বলল।
উঠে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন, ট্রাভেল ব্যাগটার দিকে তাকালেন। কিছু বলবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু না বলে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
ড. আরেফিনকে পছন্দ হয়েছে রাশেদের। প্রচন্ড কৌতূহলি লোক, কিন্তু তা স্বত্তেও ব্যাগে হাত দেননি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রাশেদ। আটাচড বাথরুমে চলে এলো আস্তে আস্তে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে সারামুখ ভরে গেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। কেন, নিজেই জানে না।
***
ঈশ্বর কি? মহাবিশ্বের জন্ম কিভাবে? ঈশ্বর কি এক না অনেক মানুষ কি ঈশ্বরের সৃষ্টি না কি বিবর্তনের ধারা ধরে কালক্রমে এই পর্যায়ে এসেছে?
এই ধরনের নানা প্রশ্ন সব সময়ই ঘুরপাক খায় মাথায়। সঠিক উত্তর আজও পাননি তিনি। উত্তরের খোঁজে এই পৃথিবীর বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাজার বছর ধরে। দেখেছেন শত সহস্র সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, আরো কতো দেখতে হবে কে জানে? এতো বছরেও উপরের একটা প্রশ্নেরও সঠিক জবাব পাননি তিনি। কে জানে আদৌ পাবেন কি না।
মানুষকে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে দেখেছেন, আবার দেখেছেন মাটি দিয়ে মূর্তি বানিয়ে তাকে মাথায় তুলে রাখতে। প্রতিটি জিনিসের জন্য আলাদা আলাদা দেবতার জন্ম দেখেছেন তিনি, আলোর দেবতা, পানির দেবতা, ঝড়ের দেবতা, ফসলের দেবতা, যুদ্ধের দেবতা এরকম আরো কত কি। একঈশ্বরে বিশ্বাসীরাও পৃথিবীতে ভাগ হয়ে আছে। যে যার শ্রদ্ধা প্রকাশে আরেকজনকে মাড়িয়ে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না। ধর্ম নিয়েই পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হানাহানি হয়েছে, যে যার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমান করতে সচেষ্ট। কিন্তু তিনি আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারেননি কি বিশ্বাস করবেন, কি করবেন না। তাই মানবতা ধর্মকেই নিজের ধর্ম করে নিয়েছেন। মানুষের কল্যানই আসল ধর্ম। এই হচ্ছে তার মূলনীতি।
ইদানিং অবশ্য কিছুতেই মন টানে না তার। অনেকেই তার পরিচয় জেনে ফেলেছে। কেউ কেউ তার আসল রহস্য উদ্মাটনে বেশি আগ্রহি। এতে তার নিজেরও যে তেমন দোষ ছিল না তা নয়। অনেকক্ষেত্রে তিনি নিজেই কৌতূহলের আগুনে ঘি ঢেলেছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। অনেকেই সন্দেহ করে তার পরিচয় নিয়ে, তার বয়স নিয়ে। একবার যদি প্রমান পেয়ে যায় কেউ, তাহলে আর নিস্তার নেই। তার গোপন রহস্যের খোঁজে পালে পালে এগিয়ে আসবে মানুষ। ক’জনকে ঠেকাতে পারবেন তখন? তাছাড়া সবাই যদি হাজার বছরের আয়ু চায়, তাহলে প্রকৃতিও তা সহ্য করবে না। নিজস্ব উপায়ে ধ্বংস করে ছাড়বে সবকিছু। প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য বজায় রাখবে যে কোন মূল্যে। তার মানে রহস্যে জেনে ফেললে মানুষ নিজের ধ্বংসই টেনে আনবে। কিন্তু প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচার উপায় মানুষের জানা নেই।
সিগটেসে রওনা দেবেন কাল। খে-লান ভ্রাতৃসম্প্রদায় তাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রন জানিয়েছে, সেখানে যাবার জন্য। সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন। এখানে কাটানো সময়গুলো খুব ভালো কেটেছে। এই মন্দিরের সবাই এখন তাকে ডাকে পেহ-লিং বলে, যার অর্থ হচ্ছে শ্বেত লামা। লামা পদবিটা যে কেউ তার নামের সাথে লাগানোটা সম্মানজনক মনে করে এবং এই পদবিটা জ্ঞান এবং সাধনার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। এরা তাকে প্রচুর সম্মান করে। কিন্তু অনেকদিন কাটানো হয়েছে এই এলাকায়। ভাষা শিক্ষাও শেষ পুরোপুরি।
এখন সকাল, হাঁটতে বের হয়েছেন তিনি। মন্দিরটা একটা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে এসেছেন অনেকটা। কোদারী গ্রামটা ছোট একটা গ্রাম। লোকবসতিও খুব একটা নেই। পশুপালনই এখানকার অধিবাসীদের জীবনধারনের একমাত্র অবলম্বন। চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। সারাবছর বরফে ডুবে থাকে এলাকাটা, চাষাবাদ তাই প্রায় অসম্ভব।
গ্রামটা সাজানো গোছানো একটা ছবির মতো। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পুরুষরা বেশিরভাগই বাইরে গেছে, মেয়েরা গৃহস্থালি কাজ করছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরের টুকরোর উপর বসে ছিলেন তিনি আর ভাবছিলেন ঈশ্বর নিয়ে, সৃষ্টি রহস্য নিয়ে।
অনেক অনেক আগের কথা মনে পড়লো তার।
রমুলাস অগাস্টাস। শেষ রোমান সম্রাট। প্রাসাদে একা একা বসে আছেন। সাথে আছে প্রিয় সহকারী নেবুলাস। রাভেন্না শহর এখন রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী। অপূর্ব সুন্দর একটা শহর। কিন্তু এখন পুরো রোমান সাম্রাজ্যের চারপাশে যেন আগুন জ্বলছে। বর্বর জার্মানরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। রোমান সেনাবাহিনী হতোদ্যম, শক্তিহীন, কাপুরুষতার পরিচয় দিচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। জান বাঁচিয়ে পালাচ্ছে যে যেদিকে পারে, কিংবা মুহূর্তে ভোল পালটে যোগ দিচ্ছে আক্রমনকারীদের শিবিরে। এছাড়া খোদ রোমান বাহিনীতে কর্মরত আছে অসভ্য জার্মানদের অনেক বংশধর। যারা যুগে যুগে রোমানদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে। লুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই জার্মানরা হাল ছাড়েনি। এখন তারা যোগ দিয়েছে বিদ্রোহী দলে। যুগের পর যুগ তাদের আক্রমন আছড়ে পড়েছে রোমের প্রাচীরে। রোমান সাম্রাজ্যও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এদের ঠেকাতে ঠেকাতে।
এই বর্বর জার্মানদের না আছে কোন শিল্পবোধ, না আছে জীবনযাত্রা সম্পর্কে উঁচু কোন ধারনা। এরা শুধু ধ্বংশ করতে জানে, বেঁচে থাকার তাগিদে এরা কাউকে খুন করতে দ্বিধা করে না। নীল চোখ আর ধুসর লাল চুল হচ্ছে এদের চেনার মূল উপায়। শারীরিক কাঠামোও অনেক শক্তিশালী। দলে দলে আদি জার্মান এলাকা ছেড়ে এই বর্বর দলগুলো চলে এসেছে রোমান সাম্রাজ্যের সীমানায়, বসতি গড়ে তুলেছে। ছোট ছোট গোত্র করে থাকে সবাই, পশুশিকারই হচ্ছে মূল পেশা। এখন কৃষিকাজেও কেউ কেউ মনোযোগ দিচ্ছে।
কিন্তু এদের আসল লক্ষ্য দলগতভাবে রোম দখল করে নেয়া। যে ঐশ্বর্যের ঝলকানি এরা দেখেছে, তা নিজের হাতে নিতে চায় ওরা। মাঝে মাঝে তাই আক্রমনও করে বসে রোমানদের এবং তাতে প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির শিকারও হয়। কিন্তু দমে যাওয়ার অভ্যাস নেই এই বর্বরদের। রোমানরা এখন অনেক নরম, অনেক কম হিংস্র, তারা এখন জিশু খৃস্টের শান্তির বানীতে মোহাবিষ্ট, বাকিরা আরাম-আয়েস, বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। অনেক বর্বর জার্মানকে যুদ্ধবন্দী করে আনা হয়েছিল, এরাই এখন গৃহভৃত্য হিসেবে সেবা করছে তাদের। অনেক বর্বর জার্মানকে রোমার সৈন্যবাহিনীতেও অন্তভুক্ত করা হয়েছে। এরাই পরবর্তীতে প্রতিশোধ নিচ্ছে, চরম প্রতিশোধ।
৪৭৬ খৃস্টাব্দ, সেপ্টেম্বর মাস। নেবুলাস বার বার তাকাচ্ছে রমুলাস অগাস্টাসের দিকে। কিছু একটা নির্দেশ দেবেন তিনি। শত্রু দ্বারপ্রান্তে। চারদিকে আগুন জ্বলছে। প্রাসাদের চারদিকে যদিও যথেষ্ট পরিমানে সৈন্য মোতায়েন করা আছে, কিন্তু এই সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। বর্বররা হানা দিলে এরা মোটেও বাঁধা দিতে পারবে না।
‘নেবুলাস, ডাকলেন সম্রাট রমুলাস। যুবক তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে দেখাচ্ছিল একজন বৃদ্ধের মতো।
বলুন হুজুর, নেবুলাস বলল।
‘তুমি আমাকে অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছিলে, আমি শুনিনি, ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন সম্রাট রমুলাস।
‘জি, হুজুর, সাবধান করেছিলাম।’
‘এখন আমার কি করা উচিত?’
‘শুনলে হয়তো আমার উপর রাগ করবেন?’
‘নির্দ্বিধায় বলো।’
‘আপনার বয়েস অনেক কম, পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সূর্য এখন অস্ত যাওয়ার পথে, এখন আপনার উচিত হবে আত্মসমর্পন করা।‘
‘আত্মসমর্পন করা আর মৃত্যু কি একই কথা নয়?’ রেগে গেলেন সম্রাট রমুলাস।
‘যুদ্ধে যে কেউ হারতে পারে মহামান্য সম্রাট, এতে আপনার মযার্দাহানি হবে না, কিন্তু এরপর আমরা আবার শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে পারবো।’
‘আত্মসমর্পন করবো আমি?’
‘এতে আপনার ভালোই হবে, পূর্বের রোমানরা যদি সাহায্য করে তাহলে পরে আবার এই রাজত্ব আমরা দখল করে নিতে পারবো।
‘কিন্তু মন যে সায় দেয় না নেবুলাস, এই রোমান সাম্রাজ্যের সম্মান আমি ধূলোয় মিশিয়ে দিতে পারি না।’
‘আপনি আমার অভিমত চেয়েছেন, আমি জানালাম, এখন আপনার ইচ্ছে।’ নেবুলাস বলল মাথা নিচু করে। চোখে পানি চলে এসেছে তার। বয়স পয়তাল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মতো। এখনো শক্ত গড়ন। রমুলাসকে যথে’ স্নেহ করে সে। এই সম্রাটকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে ইচ্ছে করছে না।
মাত্র একবছর হলো সিংহাসনে বসেছেন রমুলাস। পিতা ওরেস্তেস যেখানে চাইলেই সিংহাসনে বসতে পারতেন, সেখানে কেন সন্তানকে বসালেন তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। কিন্তু রমুলাসকে সবাই মেনে নিয়েছিল। কেন না রমুলাস কোমল মনের অধিকারী, বিলাস-বসনে সময় নষ্ট না করে প্রজাকল্যানে নানা ধরনের কাজ করেছেন। কিন্তু কোন ভালো কাজের মূল্যায়ন খুব তাড়াতাড়ি হয় না। এখন বর্বর জার্মানরা কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছে, কিন্তু এদের হাত থেকে শহর রক্ষা করার মতো প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই সম্রাট মুলাসের।
কি করা উচিত ভাবছেন রমুলাস। নেবুলাস যা বলছে হয়তো ঠিকই বলছে, আজ পর্যন্ত খারাপ কোন পরামর্শ নেবুলাসের কাছ থেকে পাননি তিনি। কিন্তু আত্মসমর্পন! হয়তো এতেই শান্তি নিহিত আছে। অযথা রক্তপাত করে কি লাভ। তিনি আরো লড়তে চাইলে মানা করবে না কেউ, কিন্তু তাতে অহেতুক জানমালের ক্ষতি হবে। বর্বর জার্মানরা কোন কিছুরই পরোয়া করে না। মায়ের সামনে ছেলের বুকে ছোঁড়া বসাতে হাত বিন্দুমাত্র কাঁপে না ওদের।
নেতা হিসেবে হিংস্র একজনকে পেয়েছে ওরা। ওডোএকার। রোমান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিল। এখন বিদ্রোহী জার্মানদের বিভিন্ন গোত্রকে এক করে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেছে। উদ্দেশ্য পুরো রোম দখল করা। যে কোন সময় প্রাসাদে ঢুকে পড়বে শয়তানটা। একসময় মুলাসের পিতা ওরেস্তেসের কাছের লোক ছিল এই ওড়োএকার। কিন্তু এখন পুরো ভোল পালটে নেতা হয়েছে জার্মান বর্বর বাহিনীর।
নেবুলাসের দিকে তাকালেন রমুলাস। এই লোকটা তার মন্ত্রীপরিষদের কেউ নয়। কিন্তু বিপদে আপদে এর উপরই ভরসা করেন তিনি। লোকটা একাধারে তার পার্শ্বসহচর, দার্শনিক, ভ্রমনকারী এবং আবিষ্কারক। এমন সব ঘটনা লোকটার কাছে শুনেছেন তিনি যা অবিশ্বাস্য, শত শত বছর আগের ইতিহাস অনায়াসে বলে দেয়ার মতো জ্ঞান আছে লোকটার, এবং সবসময়ই তাকে বলে যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে কেউ না ভোলে। আজ হয়তো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার দিন, একজন পরাজিত রাজার অবশ্য কর্তব্য কি তা বুঝতে হবে। রমুলাস সিদ্ধান্ত নিলেন নেবুলাসের কথা মতো আত্মসমর্পন করবেন তিনি, অযথা রক্তপাত চান না আর। একজন দূতকে ইশারায় ডাকলেন তিনি।
‘ওডোকারের কাছে যাও, গিয়ে বলল আমি শান্তি চাই,’ রমুলাস বললেন বিষণ্ণ সুরে।
দূত বের হয়ে গেল সাথে সাথে। নেবুলাসের দিকে তাকালেন তিনি, লোকটার চেহারা ম্লান হয়ে আছে, সিদ্ধান্তটা কারো জন্যেই খুব সুখের কিছু নয়। কয়েকশ’ বছরের রোমান সাম্রাজ্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতায় আজ নেকড়ের আঁচড় পড়েছে। সাম্রাজ্যের পিতৃপুরুষ যেমন ছিলেন মুলাস, ধ্বংসের সূচনাও হচ্ছে আরেক রমুলাসের হাতে। প্রকৃতির কি অদ্ভুত পরিহাস।
বাস্তবে ফিরে এলেন তিনি। তিব্বতের অজ এক পাড়া গাঁয়ে। রমুলাসের কথা মনে করছিলেন এতোক্ষন। রমুলাস আত্মসমর্পন করেছিল। তারপর রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছিল কোথায় কেউ তা জানে না। নেবুলাসকেও এরপর কেউ দেখেনি আর। সেদিন কতোদিন আগের কথা। রমুলাস ঝাঁপ দিয়েছিল পাহাড়ের উপর থেকে, সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে তার। আত্মসমর্পন করে বেঁচে থাকাটা তার কাছে ছিল মৃত্যুর সামিল। নেবুলাস হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিল পুরো উত্তর ইউরোপ, বাইজেন্টাইনের দিকে আসার ইচ্ছে ছিল তার, যেহেতু সেটাই ছিল রোমান সভ্যতার পূর্ব অংশ। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলে পশ্চিম ইউরোপের দিকে যাত্রা করেন তিনি। নেবুলাস, এই নামটা ইতিহাসের কোন পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারন সবক্ষেত্রেই পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি।
আর এখন?
আড়াল এবং বিশ্রামই তার চাই। রাজাদের প্রিয়পাত্র হয়েছেন অনেকবার, জনকল্যানমূলক পরামর্শ দিয়ে মানব সভ্যতার উপকার করতে চেয়েছেন সবসময়, যুদ্ধের বদলে শান্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এখন দিন বদলে যাচ্ছে। শেষ ফরাসি বিপ্লবের পর, এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না তার। এখন চাই বিশ্রাম। যদি আবারও কখনো মনে হয়, হস্তক্ষেপ করা দরকার, তাহলেই কাজে নামবেন তিনি। দেখা যাক, সেই সময় আদৌ আসে কি না, কিংবা আসলেই তিনি সক্রিয়ভাবে কাজে নামবেন কি না কে জানে।
আপাতত তিব্বত নিয়ে ভাবছেন তিনি। শান্তিপ্রিয় একটা জাতি এই তিব্বতীরা। একসময় হয়তো যুদ্ধের অস্তিত্ব কিছুটা ছিল এদের জীবনে, কিন্তু সে অনেক আগের কথা। মাঞ্চুরিয়ানরা এখানে শক্ত হাতে হাল ধরেছে। প্রশাসন, জনগন, সামরিক শক্তি সমস্তটাই এদের দখলে। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের তুলনায় আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে। লেগেছে সবচেয়ে কম। তাই এখানেই কিছু দিন থাকার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
‘হুজুর আপনি এখানে?’ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রামপ্রসাদ, অন্যমনস্ক বিধায় লক্ষ্য করেননি তিনি।
‘কেন, কি হয়েছে?’
‘পেহ-লিং, পেহ-লিং বলে পুরো এলাকা খুঁজছে ওরা আপনাকে, কপাল ভালো ওদের আগে আমিই পেয়ে গেলাম।‘
‘কি ব্যাপার, বলো তো?‘
‘হুজুর, খবর পেলাম, আজ রাতে রাজধানী লাসা থেকে কিছু অতিথি আসবেন, তারা যদি এখানে আপনাকে অবিষ্কার করে তাহলে মন্দিরের ওরা খুব সমস্যায় পড়ে যাবে।’
‘অতিথি হিসেবে আমাদের উচিত নয় ওদের এভাবে সমস্যায় ফেলা।’
‘জি, হুজুর, আমতা আমতা করে বলল রামপ্রসাদ। কিন্তু যাবো কোথায় আমরা?’
‘সেটা নিয়ে ভেবো না তুমি, বিকেলেই রওনা দেবো আমরা, এখন যাও, ওদের খবর দাও, আমাকে পাওয়া গেছে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
‘জি, হুজুর,’ বলে চলে গেল রামপ্রসাদ।
চারদিকে তাকালেন তিনি। সকালের রোদে ঝিলমিল করছে চারদিক। আজ খুব নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন তিনি। বারবার অতীতের কথা মনে পড়ছে, সেই অতীতও আবার অনেক ভাগে বিভক্ত। কিন্তু এখন চিন্তা করার সময় না, কাজ করার সময়।
কাজেই পাথরের টুকরোটার উপর থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দূরে দেখা যাচ্ছে রামপ্রসাদকে। ছোট একটা কাঠামো, ছোট একটা টিলার ওপাশে হারিয়ে যাচ্ছে, বেশ কিছুটা দূরে বৌদ্ধ মন্দিরটা দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। সেখানে শেবারনের সাথে দেখা করে তার পরামর্শমতো এগুতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই খারাপ বুদ্ধি দেবেন না।
*
অধ্যায় ১৫
রাতের অন্ধকারে অনেক কিছুই রহস্যময় বলে মনে হয়। ছায়া ছায়া কিছু দেখলেই ভয় জাগে মনে। অন্ধকার মানুষের জীনে ঢুকিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। সূর্যের আলোয় যেমন নিরাপদবোধ করে মানুষ, অমাবশ্যা রাত্তিরে তেমনই ভয়ের একটা বোধ আসে মনে। বিশেষ করে গ্রামের এই পরিবেশ, যাকে গা ছম ছম করা পরিবেশ বললেও ভুল হবে না।
আজ অমাবশ্যা। বিশেষ একটা অমাবশ্যা। হাজার রাতের পর আসে এমন এক রাত। আব্দুল মজিদ ব্যাপারি রক্তে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। আজ রাতে বের হতে হবে বাইরে। এমনটাই করে এসেছেন সারাজীবন। হাজার রাত পর আসা এই অমাবশ্যায় নিজেকে নতুন করে তৈরি করে নেবেন তিনি। রাতের আকাশ অন্ধকার থাকলেও নিজের জন্য প্রকৃতি থেকে শক্তি আহরন করেন। এই নিয়মের ব্যতয় ঘটার কোন উপায় নেই।
অনেক রাত হয়েছে। ছেলে ঘুমিয়েছে। পাহারাদার লোকটাও ঘুমিয়েছে নতুন বৈঠকখানায়। পা টিপে ঘর থেকে বের হলেন মজিদ ব্যাপারি। সারাদিন বাঁকা হয়ে কাত হয়ে থাকেন। এভাবে থাকতে কষ্ট হয় তার। বুড়ো মানুষ হিসেবে সেভাবেই থাকা উচিত। কিন্তু এখন যখন তাকে দেখার কেউ নেই, সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। সেই ঋজু ভঙ্গিতে। সেই রোমান সম্রাট যেভাবে দেখেছে তাকে, রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সাথে যেভাবে চলাফেরা করতেন তিনি। এমনকি এখানে আসার আগে, সেই তিব্বতে, যেভাবে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, সেভাবে দাঁড়ালেন মজিদ ব্যাপারি।
উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন। আজই সেই অমাবশ্যা। সন্দেহ নেই কোন। এককোনায় থাকা চালা ঘরটার দিকে তাকালেন। তালাবদ্ধ করে রেখেছেন সেই ঘরটা। শুধুমাত্র খোলা হয় এই বিশেষ অমাবশ্যার দিনেই। আজও খোলা হবে। লুঙ্গীর গিঁটে আটকানো চাবিটা বের করে হাতে নিলেন। কতত দিন পর খুলতে যাচ্ছেন ঘরটা। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় মনে! নিজের জীবনের অমূল্য কিছু সম্পদ, যুগ যুগ ধরে যা বয়ে বেড়াচ্ছেন, রাখা আছে এই ঘরটায়। স্ত্রীকেও কখনো চাবি দেননি,কত রাগ অভিমান, তবু, এর রহস্য নিজের কাছেই রেখেছেন। এছাড়া কোন উপায়ই নেই অবশ্য তার। ছেলে কিংবা নাতিও চেষ্টা করেনি কখনো ঘরটায় ঢুকতে।
আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি ঘরটার দিকে। বড় একটা তালা লাগানো দরজাটায়। খুলে ফেললেন। তাকালেন পেছনে। কেউ নেই। তার শ্রবণশক্তি অনেক ভালো, ঘ্রান শক্তিও অসাধারন। কিছুটা সময় নিয়ে দাঁড়ালেন ঘরটার দিকে, চারপাশের গন্ধ নিলেন, কান পেতে শোনার চেী করলেন, অসামঞ্জস্যপূর্ন কিছু শুনতে পেলেন না।
ঘরটায় ঢুকলেন। ছোট একটা জায়গা। মাঝখানে বড় একটা চৌকি পাতা। চৌকির উপর দুটো সুটকেস। অনেক পুরানো। নিজের হাতে বানিয়েছিলেন তিনি। তামার সাথে এমন এক যৌগ মিশিয়েছিলেন তাতে জীবনে রঙ নষ্ট হবে না সুটকেসগুলোর, মরিচা পরবে না। এখনো ঠিক নতুনের মতো আছে জিনিসগুলো। মনে মনে একবার প্রসংশা করে নিলেন নিজের হাতের কাজের। স্যুটকেসগুলোও তালা লাগানো। জোর করে খোলা যাবে না, এমনকি ভাঙাও যাবে না সহজে। দুতিনজন মানুষ অন্তত পারবে না ভাংতে নিশ্চিত আছেন তিনি।
সুটকেসগুলোর চাবি লুকিয়ে রেখেছেন মাটির তলায়। চৌকির নিচে। বেশ কিছুটা জায়গা খুদে মাটির নিচে রেখে দিয়েছিলেন দুটো চাবি। শেষবার কবে স্যুটকেসগুলো খুলেছিলেন মনেও পড়ছে না তার। তখন স্ত্রী বেঁচে ছিল এটুকু শুধু মনে পড়ল।
চৌকির তলা থেকে চাবিদুটো বের করলেন। বেশ পরিশ্রম হলো তাতে। ঠিক জায়গাটা খুঁজে পেতে বেশ কয়েক জায়গায় খুঁড়তে হলো। এখন হাঁপাচ্ছেন। একটু বিশ্রাম নেয়া যায় এখন। রাত এখনো ঢের বাকি। চাবিগুলোর দিকে তাকালেন। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে। রুপা আর সোনা দিয়ে তৈরি, নরম যাতে না হয় সেজন্য কিছুটা ব্রোঞ্জ মেশানো হয়েছে চাবিগুলোতে। এগুলোও নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন একসময়। তখন মেশিনপত্রের কোন বালাই ছিল না, কিছু বানাতে হলে তা হাতেই বানাতে হতো।
দরজাটা ঠিক মতো লাগিয়েছেন, বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না ঘরটায় কেউ আছে। যদিও এই রাতে কারো উঠার তেমন সম্ভাবনা নেই। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ঘরের ভেতরেও তাই। একটা কুপি বা হারিকেন সাথে আনতে পারতেন। কিন্তু অযথা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন না মজিদ ব্যাপারি। চাবিদুটো হাতে নিয়ে দেখলেন অনেকক্ষন। কবে বানিয়েছিলেন দিন-ক্ষন সব মনে আছে তার। স্মৃতি কখনো প্রতারনা করেনি তার সাথে। মানুষ করেছে। শাস্তিও পেয়েছে অনেকে। কিন্তু একজনকে শাস্তি দিতে পারেননি তিনি। একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিল লোকটা। তার খোঁজেই এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসেছিলেন অনেক অনেক বছর আগে। সেসব নিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না এখন, কিন্তু চিন্তার উপর তো হাত নেই। সময় অসময় অনেক হাবিজাবি চিন্তা মাথায় খেলতে থাকে।
আজ সময় এসেছে নিজেকে নতুন করে নেবার। এ যেন অনেকটা ব্যাটারির মতো ব্যাপার, চার্জ করে নিতে হয় মাঝে মাঝে।
সুটকেসগুলোতে আছে তার অমুল্য সম্পদ। হাজার বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি এই সম্পদ। আজ পর্যন্ত কেউ হতে দিতে পারেনি। একজন দিয়েছিল। যাক সে কথা, বার বার সেই বেঈমানটার কথা মনে পড়ে কেন ভেবে অবাক হলেন।
বা দিকের ছোট চাবিটা দিয়ে একটা সুটকেস খুললেন তিনি। অনেক দিন পর খোলা হলো। সুটকেসটা খুলতেই দারুন এক সৌরভে ভরে গেল চারদিক। এই সৌরভটাও নিজের হাতে বানানো তার। প্যারিসে অনেক বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এই সৌরভ। নিজে বানিয়ে ছিলেন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের জন্য, খুবই পছন্দ করতেন রাজা এই সুগন্ধটা। নির্দেশ দিয়েছিলেন আর কাউকে যেন এই সুগন্ধী বানানোর কৌশল শেখানো না হয়। কাউকেই শেখাননি তিনি। আজ অনেকদিন পর এই সৌরভ তাকে অনেকটাই তাজা করে তুললো।
সুটকেসটার একপাশে চামড়ার একটা বাক্স। বাক্সটা ছোট, চারকোনা, নানা ধরনের অলংকরন বাক্সটার গায়ে। বাক্সটা খোলার আগে একটু সময় নিলেন তিনি। আজকেই তো সেই অমাবশ্যা, তাই না? হিসেবে কোন ভুল হয়নি তো? মনে মনে আরেকবার হিসেব করে নিলেন, না, সব ঠিক আছে। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, ভুল রাতে ভুল সময়ে কাজটা করলে তার ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে।
বাক্সটা খুললেন তিনি। হাল্কা নীল এক আলোর ছটায় ভেসে গেল যেন পুরো ঘরটা। কাঁচের ছোট একটা বোতল রাখা আছে বাক্সটায়, সেই কাঁচের বোতলে হাল্কা নীল রঙের একটা তরল যা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অপার্থিব এই আলো। গায়ে একটা চাদর পড়া আছে মজিদ ব্যাপারির। তাড়াতাড়ি বোতলটা চাদরের তলায় লুকিয়ে ফেললেন তিনি। সাবধান থাকা ভালো। এই নীল আলো কেউ দেখলে কতো কিছু যে। কল্পনা করবে গ্রামের মানুষ তা ভালোই জানেন।
অন্য সুটকেসটার দিকে তাকালেন। এর ভেতরে আছে এক রহস্যের চাবি। চামড়ার একটা খোপের ভেতর। সেই রহস্য উঘাটনে এক না একদিন বেরুতেই হবে তাকে, অনেক বছর আগেই বের হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে এসে কেমন বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন। সময় হয়তো চলে এসেছে সেই রহস্য উদঘাটনে বের হবার, কিংবা কে জানে আরো কততদিন এখানে থাকবেন।
সুটকেসটা বন্ধ করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বাইরে চলে এলেন মজিদ ব্যাপারি। সময় হয়েছে এখন। যদিও হাতে ঘড়ি নেই, কিন্তু সময় সম্পর্কে তার ধারনা খুব টনটনে। অন্ধকার। অন্যকেউ হলে এই উঠোনে তিনবার হোঁচট খেতো, কিন্তু এই উঠোন মজিদ ব্যাপারির কাছে হাতের তালুর মতো পরিচিত। উঠোনটা সাবধানে পেরিয়ে বাড়ির সীমানার বাইরে চলে এলেন। সময় বেশি নেই হাতে। বড় একটা বটগাছ আছে এখানে। এখানে দাঁড়িয়েই কাজ সারবেন বলে ঠিক করলেন।
চাদরের নিচ থেকে কাঁচের বোতলটা বের করলেন। নীলাভ আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। এই তরলটা একফোঁটা দরকার মাত্র। একফোঁটা। এতেই কাজ হয়। এরচেয়ে বেশি হলে তাকে বলতে হবে অপচয়। এই তরল শেষ হয়ে গেলে নতুন করে পাওয়া সম্ভব নয়, কেউ বানাতেও পারবে না এই পৃথিবীর। কাজেই একফোঁটা তরলের বেশি নষ্ট করা যাবে না। বোতলের মুখটা বিশেষভাবে বানিয়ে নিয়েছিলেন মজিদ ব্যাপারি, তাতে একবারে একফোঁটার বেশি তরল চাইলেও বের হবে না। শেষবার যদিও তিনফোঁটা তরল নিয়েছিলেন তিনি, বয়সটাকে আরো কমানোর জন্য। মাত্র পঁচিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছিল তিনফোঁটা তরল নেয়ার কারনে। নতুন করে জীবন শুরু করেছিলেন এই অঞ্চলে, দেখা হয়ে গিয়েছিল রহিম ব্যাপারির সাথে। সেসব কথা থাক।
সময় হয়েছে এখন। এছাড়া চারদিকে যে নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছে তা রাতজাগা কারো চোখে পড়া অসম্ভব কিছু নয়।
বোতলটা উঠিয়েছেন, নীল তরলটা আস্তে আস্তে বেয়ে নিচে নেমে আসছে, এমন সময় অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো মজিদ ব্যাপারির। মনে হলো কেউ দেখছে তাকে। বোতলটা সোজা করে ধরে চারদিকে তাকালেন। না, কেউ নেই। মনের ভুল।
বোতলটা আবার উপরে উঠিয়ে আস্তে করে একটা ঝাঁকি দিলেন, নীল তরল নীচে নামছে। বোতলের মুখটা ধরে রেখেছেন ঠোঁটের কাছে, বাইরে যেন পড়ে না যায় তাই এই সাবধানতা। পড়ল একফোঁটা নীল তরল, ঠিক জিভের মাঝখানটায়। তাড়াতাড়ি বোতলটা সোজা করে মুখ আটকিয়ে দিলেন তিনি, তারপর সাবধানে চাদরের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। যাক, কোন বিপদ হয়নি।
জিভের মাঝখানটায় যেখানে ফোঁটাটা পড়েছিল তা আস্তে আস্তে যেন নিচের দিকে নামছে, টের পেলেন মজিদ ব্যাপারি। গলা ছাড়িয়ে পেটের দিকে যাচ্ছে তরলটা। দারুন একটা চাঞ্চল্য অনুভব করছেন তিনি। অনুভব করছেন সারা শরীর যেন তরুন হয়ে উঠেছে, হাতের ভাঁজগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে, হাত-পায়ের পেশিগুলো শক্ত হচ্ছে। চোখ, মুখ, নাক যেন আরো সতেজ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সামনের পুরো মাঠটা দৌড়ে পার করতে। অনেক শক্তি ভর করেছে শরীরে। কিন্তু ব্যবহার করা যাবে না অযথা।
এবার হাঁটা দিলেন ব্যাপারি। বাড়ির উদ্দেশ্যে। চাইলে ঝড়ের গতিতে চলতে পারেন, গায়ে এতোটাই শক্তি এখন। কিন্তু আস্তে আস্তে হেঁটেই বাড়ির উঠোনে এলেন তিনি। নাক এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো এখন অনেক সতেজ। বিশেষ একজনের গন্ধ পেলেন তিনি। সবারই আলাদা আলাদা গন্ধ আছে, এবং এই গন্ধ দিয়েই সবাইকে চিনে নিতে পারেন তিনি। এই গন্ধটা নতুন একজনের। নতুন বানানো বৈঠকখানাটার দিকে তাকালেন। কোন নড়াচড়া বা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না তার।
নিজের ঘরটায় ঢুকে কাঁচের বোতলটা জায়গামতো রাখলেন। সুটকেস দুটো তালাবদ্ধ করলেন। চাবিদুটো এবার আর মাটির তলায় পুতলেন না। নিজের কোমরে খুঁজে নিলেন। বাইরে এসে ঘরে তালা লাগিয়ে দিলেন তিনি।
কাজ শেষ। নিজের ঘরে এসে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকলেন মজিদ ব্যাপারি। এখনো আরো অনেকটা তরল আছে, যা দিয়ে আরো কয়েক হাজার বছর হয়তো চালিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু তারপর? যাক, সে চিন্তা পরে করা যাবে। এখন ভাবছেন অন্যকথা। তার শরীরের চামড়া এখন অনেক সতেজ, পেশী এখন অনেক শক্ত, স্বাভাবিক, যে কেউ দেখলে এখন আর তাকে থুথুরে বুড়ো বলে মেনে নিতে চাইবে না। একটা উপায়ই আছে, ভালো করে মেকাপ করতে হবে, যাতে কারো চোখে কিছু ধরা না। পড়ে, অভিনয় করতে হবে সাবধানে, যাতে অতি-অভিনয় না হয়ে যায়।
***
লিলির কিছুই ভালো লাগে না ইদানিং। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয় না বেশ কিছুদিন হলো। এমনিতে ভালো ছাত্রি সে, রেজাল্টও খুব ভালো। কিন্তু গতকিছুদিনের ঘটনায় মনটা ভীষন খারাপ। গাজীপুরের বাংলো বাড়িতে দু’জন মারা গেল। সম্পূর্ন দোষ তার। রাশেদকে খুঁজতে গিয়েই ওদের মেরেছে খুনিটা। বাবা প্রভাবশালী মানুষ। সাধারন ডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। লিলি অবশ্য কাউকে বলেইনি ওখানে কাউকে থাকতে পাঠিয়েছিল সে। বাবা সব জানতেন। হয়তো কেয়ারটেকার চাচা জানিয়েছিলেন, কিন্তু না জানার ভান করেছিলেন তিনি। কেমন অদ্ভুত একটা মানুষ! মেয়েকে পরে জিজ্ঞেসও করেননি কে গিয়ে থাকছে ঐ বাড়িটায়, কেন থাকছে, কতোদিন থাকবে। প্রশ্ন করাটাই ধাতে নেই লোকটার। সেটা একটা ভালো দিক, কোন কৈফিয়ত চাননি তিনি কোনদিন। মা হচ্ছে ঠিক তার উলটো। তিনি যদি রাশেদের কথা কিছু শুনতেন তাহলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতেন। যাই হোক, সমস্যাটা এড়াননা গেছে। কিন্তু অপরাধবোধ যায়নি লিলির মন থেকে। রাশেদ হয়তো বড় কোন বিপদেই পড়েছে, যা সে বলতে পারছে না। ছেলেটা এমনিতেই কম কথা বলে, লাজুক টাইপের, নিজের সমস্যার কথা বলতে পছন্দ করে না। কাজেই ওকে জিজ্ঞেস করে তেমন লাভও নেই।
তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে লিলি যে শামীমের হত্যার সঙ্গে রাশেদের এই সমস্যাটার কোন যোগসুত্র আছে। পুলিশে যে আত্মীয় আছেন তিনি প্রায়ই বলেন শামীমের খুনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, খুনি না কি খুব চালাক। শুনে অদ্ভুত লাগে লিলির। রাশেদ খুন করতেই পারে না। এই বিশ্বাস রাশেদের উপর আছে তার। কেন আছে এর পক্ষে কোন যুক্তি নেই।
বিকেল চারটা বাজে। বারান্দায় এসে দাঁড়াল লিলি। তাদের এই বাড়িটা একটা লেকের পাশে। বারান্দায় এলে লেকটা দেখা যায়। কিছুদিন আগেও খুব অপরিস্কার ছিল। এখন এলাকার সচেতন কিছু মানুষ মিলে পরিস্কার করেছে লেকটা। রেলিং-এ হেলান দিয়ে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে রইল লিলি। হাতে মোবাইল ফোনটা ধরা আছে, ইচ্ছে করছে রাশেদকে ফোন করে খবর নিতে। নাম্বার ডায়াল করল সে, কিন্তু বন্ধ।
লেকের পাড়ে বেশ বড় বড় কিছু গাছ, নাম জানে না লিলি। কৃষ্ণচূড়া হতে পারে, লাল রঙের ফুল ফুটেছে। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল লিলি। লক্ষ্য করলো না সেই গাছের আড়াল থেকেই দুজন যুবক লক্ষ্য করছে তাকে। তাদের চেহারা সাধারন না, পাশুটে একটা ছাপ দেখা যাচ্ছে, চোখ দুটোর দিকে তাকালে মনে হবে আগুন বের হচ্ছে সেখান থেকে।
এরা হিংস্র, নেকড়ের মতো। শিকারের ঘ্রান শুঁকে শুঁকে চলে এসেছে এখানে।
***
তিব্বতী ভাষা শিখেছেন, পড়তেও পারেন ইদানিং তিনি। আজ সন্ধ্যায় রাজধানী লাসা থেকে কিছু অতিথি এসেছেন বৌদ্ধ মন্দিরটায়। এতোদিন যে কক্ষটায় আশ্রয় মিলেছিল দুজনের, সেই কক্ষটা হাতছাড়া হয়ে গেছে আজকে। মন্দিরটায় সবচেয়ে সুন্দর কক্ষ ছিল ওটাই। অতিথিরা আজ রাতটা ওখানেই থাকবে। কাল দুপুরে চলে যাবে ওরা। পার্শ্ববর্তী অন্য একটা গ্রামে। আজ রাত তাই আড়ালেই থাকতে হবে। মন্দিরের ভৃত্যরা যেখানে থাকে তেমন একটা জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন মন্দিরের প্রধান, শেবারন। তিনি কিছু বলেননি। আজ বিকেলে এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেবারনের অনুরোধে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। রামপ্রসাদ ঘুমুচ্ছে বেঘোরে। একধরনের সবজি আর রুটি ছিল খাবারের মেনুতে। পেট পুরে খেয়ে ঘুমাতে গেছে রামপ্রসাদ। কিন্তু ঘুম আসছে না তার।
সাম্ভালা সম্পর্কে অনেক কিছু জানার ছিল। শেবারনকে এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করেছেন তিনি, কিন্তু প্রতিবার বিভিন্ন ছুতোয় এড়িয়ে গেছে লোকটা। হয়তো সত্যিই এই বিষয়ে জানেন না শেবারন, কিংবা বাইরের কারো কাছে বলা নিষেধ আছে তাই বলেন না। পড়ার জন্য বেশ কিছু পুরানো পুঁথি নিয়ে এসেছেন তিনি। প্রাচীন তিব্বতী লিপিতে লেখা। সেখানে যদি সাম্ভালা সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায়!
কিন্তু হতাশ হতে হলো তাকে। কোন পুঁথিতেই এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি,জায়গাটা সত্যিই আছে নতুবা তিব্বতী লামাদের উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি। মৃত্যুর পরের জীবনকে স্বীকার করে না সাম্ভালায় বিশ্বাসকারীগন। বাকিদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর স্বর্গ এবং নরক বলে একটা জায়গা আছে, যে যার কর্মফল অনুসারে স্বর্গ বা নরকে যাবে। কিন্তু সাম্ভালায় বিশ্বাসকারীগনের ধারনা সাম্ভালা বা শান্তির দেশের অবস্থান এই পৃথিবীতেই।
আরো অনেক কিছু পড়াশোনা করা দরকার, অনুভব করলেন তিনি। হিন্দুদের কালাচক্র তন্ত্র থেকে সাম্ভালা ধারনাটার সৃষ্টি। যদিও আজও সাম্ভালার কোন চিহ্ন বা প্রমান পাওয়া যায়নি,হারানো একটা সভ্যতা যা সবার চোখের সামনে থেকে বিলীন হয়ে গেছে, রয়ে গেছে তার কিছু মিথ, যা যুগ যুগান্ত ধরে মানুষ তার জীনে বয়ে বেড়াবে।
যাই হোক, শেষ পুঁথিটা পড়া শেষ হলে কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। অন্ধকারে দূরের পাহাড়গুলো কেমন ছায়া ছায়া হয়ে ভেসে আছে আকাশের বুকে। আজ অমাবশ্যা। এই রাতগুলোতে কেমন এক অস্থিরতা বোধ করেন তিনি। শিকারের নেশা জাগে মনে।
রাত অনেক হয়েছে তাই চারদিক কেমন শব্দহীন। নিজের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দই কেবল কানে আসে। পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে টের পেলেন তিনি। নিঃশব্দে আসার চেষ্টা করেছে আগুন্তক। অসাধারন শ্রবণশক্তির অধিকারী তিনি, কাজেই কেউ তাকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি এবং পেছনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে অবাক হলেন। শেবারন। বৃদ্ধ নিজেও যথেষ্ট অবাক হয়েছেন অতিথির এত দ্রুত টের পাওয়া দেখে।
‘আপনি ঘুমিয়েছেন কি না দেখতে এসেছিলাম, শেবারন বললেন নিজেকে কিছুটা আত্মস্থ করে।
‘ঘুম আসছে না,’ ছোট করে উত্তর দিলেন তিনি।
‘পেহ-লিং, আপনি তো জানেন আমাদের এখানে বহিরাগতদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
‘জানি।’
‘তারপরও বিশেষ উদ্দেশ্যে আপনাকে আমরা রেখেছি, কারন খে-লান ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের একজন সদস্য আপনি, এছাড়া এই অল্পদিনে আপনি যেভাবে আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন, তা আমাদের কাছে দুঃসাধ্য মনে হয়েছে।‘
‘ধন্যবাদ।‘
‘আপনি বহুবার আমার কাছে সাম্ভালা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, আমি এড়িয়ে গেছি, কারন বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই, কিন্তু গোপন একটা জিনিস যত্ন করে রেখেছি আমি বহুদিন ধরে। এর হদিস কারো জানা নেই। আমার গুরু আমার হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বাস করে, বলেছিলেন, নিজেকে যদি যোগ্য মনে করো, তাহলে রহস্য উদ্মাটনে বেরিয়ে পড়ো। আর নিজের উপর যদি বিশ্বাসের অভাব থাকে, তাহলে যোগ্য ব্যক্তির হাতে হস্তান্তর করো।‘
তাকালেন তিনি বৃদ্ধের দিকে, গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছে লোকটার, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।
‘নিজেকে আমি এই রহস্য উঘাটনে কখনোই যোগ্য ভাবিনি, বৃদ্ধ দম নিয়ে বলা শুরু করলেন আবার, কিন্তু কার কাছে এই রহস্যের চাবি রেখে যাবো তা ঠিক করতে পারছিলাম না, আপনি যেদিন এসেছিলেন, আপনাকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, আপনিই সেই লোক, যার উপর আমি ভরসা করতে পারি।’
এবার উৎসাহী হয়ে উঠলেন তিনি। রহস্য উঘাটনের চাবি। সত্যিই চাবি, না অন্যকিছু? চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বৃদ্ধের কথা এখনো শেষ হয়নি।
‘তারপরও সিদ্ধান্ত নিতে কিছুদিন সময় নিয়েছি,’ বৃদ্ধ বললেন। এতোক্ষন হাত দুটো তার পেছনে ছিল, এবার সামনে নিয়ে এলেন। দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছেন জিনিসটা। যেন পড়লেই ভেঙে যাবে। লম্বাকৃতির একটা খোপের মতো। এক দিক থেকে খোলা যায়, মনে হচ্ছে চামড়ার তৈরি।
খোপের এক প্রান্ত খুললেন বৃদ্ধ। ভেতর থেকে লম্বা কাগজের মতো একটা বস্তু বেরিয়ে এলো। খেয়াল করে দেখলেন তিনি। না, চাবি না এটা। চামড়ায় তৈরি কাগজের মতো একটা জিনিস। গোল করে ভাঁজ করা।
‘এটাই সেই রহস্যের চাবিকাঠি, সাম্ভালার যাওয়ার পথ লেখা আছে এখানে, আমি অনেক চেষ্টা করেও পাঠোদ্ধার করতে পারিনি,পুরোটাই সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এটা এখন আপনার সম্পত্তি, আপনি যদি না পারেন তাহলে আপনিও জিনিসটা হস্তান্তর করে যাবেন যোগ্য ব্যক্তির কাছে, যে এর অসদ্ব্যবহার করবে না, নিন, হাতে নিন,’ বলে খোপটা বাড়িয়ে দিলেন বৃদ্ধ তার অতিথির দিকে।
হাত বাড়িয়ে নিলেন তিনি। মুখটা লাগিয়ে দিলেন। হৃদপিন্ডের গতি অনেক বেড়ে গেছে। সত্যিই সাম্ভালা নামক জায়গা তাহলে আছে পৃথিবীর বুকে! কাল্পনিক কোন গাঁথা নয় এই সাম্ভালা! সাংকেতিক চিহ্নগুলোর মানে বের করতে হবে, পারবেন তিনি? আরো অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল তার। কিন্তু চেহারায় নিরুত্তাপ ভাবটা ধরে রাখলেন, এই বৃদ্ধের কাছে নিজের মনের অবস্থা প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না।
‘ঘুমাতে যাই এখন, আমি জানি এই সাম্ভালার খোঁজেই এতোদূর আসা আপনার, মহামতি বুদ্ধ আপনাকে সফল করুন,’ বললেন বৃদ্ধ। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেলেন।
স্থানুর মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বুঝে উঠতে পারছেন না হাতে সত্যিই সাম্ভালার রহস্য ধরে রেখেছেন। হেঁটে নিজের কক্ষে চলে এলেন। সুটকেসে ভরে রাখলেন তিনি খোপটা। তাকালেন চারদিকে। রামপ্রসাদ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কেউ দেখেনি। নিশ্চিন্ত মনে শুতে গেলেন তিনি।
কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বুঝলেন কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। কিছু একটা ঠিক নেই। রামপ্রসাদ যেখানে ঘুমিয়েছিল সে জায়গাটা ফাঁকা। এবার অন্যদিকে তাকালেন তিনি। হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন সাথে সাথে। সুটকেস দুটোও নেই।
***
সন্ধ্যা সাতটার সময় দেখা করার কথা ড. কারসনের সাথে। ঠিক সময়মতোই হোটেলের লবীতে পৌঁছেছেন ড. আরেফিন। রাশেদও আছে সাথে। কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগটা ঝুলানো। রিসিপসনে মাত্র খবর দেয়া হয়েছে যে ড. কারসনের সাথে দেখা করার জন্য দু’জন অতিথি আছে। ড. কারসন অপেক্ষা করতে বলেছেন দুজনকে। এতে একটু বিরক্তই বোধ করছেন ড. আরেফিন। সরাসরি রুমে ডাকলেই পারতো লোকটা। আগেই জানানো হয়েছে, সাথে অনেক গুরুত্বপুর্ন একটা জিনিস থাকবে। সেটা এই উন্মুক্ত লিবেত দেখানো মোটেই ঠিক হবে না।
তাই মোবাইলে কল করলেন ড. আরেফিন।
‘শুভ সন্ধ্যা, ড. কারসন, আমরা লবীতে আছি, আপনার রুমে আসলে বেশি ভালো হতো,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘আসুন, রুম নং, আমি রিসিপসনে বলে দিচ্ছি,’ গলাটা কেমন ঘ্যাসঘ্যাসে শোনাল ড. কারসনের।
‘আপনি কি অসুস্থ?’
‘শরীরটা ভালো লাগছে না, আপনারা আসুন,’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন ড. কারসন।
শরীর খারাপ হলেও এখন ফিরে যাওয়া চলবে না ভাবলেন ড. আরেফিন। অনেক ঝামেলার পর পাওয়া গেছে রাশেদকে, এখন দেরি করা ঠিক হবে না। শত্রুপক্ষ এর মধ্যেই পিছু লেগে গেছে।
বর চারপাশটা দেখে নিলেন ড. আরেফিন। কোথাও অসংলগ্ন কিছু চোখে পড়ল না। একটা আন্তর্জাতিক হোটেল যেরকম হবার কথা চারপাশের পরিবেশ সেরকমই। কিন্তু মনে একটা খচখচানি ঢুকে গেছে তার। পার্কের গেটে যেমন হঠাৎ আক্রমন হলো সেরকম কিছু যেকোন জায়গায় ঘটতে পারে।
ইশারায় রাশেদকে উঠতে বললেন ড. আরেফিন। বেচারার মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ লাগানো। শারীরিক অবস্থাও সুবিধার নয়। তারপরও স্রেফ মনের জোরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। জানার কৌতূহল হোক কিংবা বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব থেকে হোক, ছেলেটার মনের জোর দেখে অবাক না হয়ে পারেননি ড. আরেফিন। যদিও তাকে একশত ভাগ বিশ্বাস করে না ছেলেটা, কিন্তু এতে দোষ দেয়ার কিছু দেখেন না তিনি, ওর অবস্থায় থাকলে কাউকে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। ওর কাছে আছে অমরত্ব জয়ের কৌশল। কিংবা কে জানে পুরো ব্যাপারটা স্রেফ ধাপ্পাবাজি।
ভিজিটর কার্ড নিয়ে সরাসরি লিফটে করে ছয়তলায় চলে এলো দুজন। লম্বা করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় ৬১২ নাম্বার রুমটা।
নক করতেই খুলে গেল দরজাটা। যেন আগে থেকেই ভোলা ছিল। সোজা ভেতরে ঢুকে গেল ড. আরেফিন, পেছনে রাশেদ।
বিছানার উপর বসে আছেন ড. কারসন। দুজনকে দেখে স্বাগত জানালেন। উল্টোদিকে দুটো চেয়ার দেখিয়ে দিলেন ইশারায়, বসতে বললেন।
‘রাশেদ, ইনি হচ্ছেন ড. কারসন, বাংলাদেশে এসেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো দেখার জন্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।‘ ড. আরেফিন বললেন।
রাশেদ উঠে গিয়ে হাত মেলালো ড. কারসনের সাথে। ড. কারসন মাথা নাড়লেন। দেখে মনে হচ্ছে খুবই অসুস্থ তিনি।
‘ড. আরেফিন, বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে খুবই অসুস্থ আমি, জ্বর আসছে,’ ড. কারসন বললেন, গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।
মন খারাপ হয়ে গেল ড. আরেফিনের। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন। আজই একটা কিছু যদি বের করা যায় ড. কারসনকে দিয়ে। কিন্তু লোকটার এ অবস্থা দেখে এখন কিছু বলতেও সংকোচ হচ্ছে।
‘আমরা কি তাহলে কালকে আসবো?’ ড. আরেফিন বললেন।
‘না, কষ্ট করে এসেছেন আপনারা, বসুন,’ ড. কারসন বললেন, বিছানা থেকে নামলেন নিচে, দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে।
‘কষ্টের কিছু নেই, আমরা কাল আসবো আবার।’
‘বইটা কি এনেছেন আপনারা? চাইলে রেখে যেতে পারেন,’ ড. কারসন বললেন।
দারুন দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে গেলেন ড. আরেফিন। প্রাচীন গ্রন্থটা রেখে যেতে মন চাইছে, কিন্তু ভদ্রলোককে মানা করলেও ভাববেন যে তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে। ঝামেলাটা থেকে মুক্তি দিল রাশেদ। এতো ঠোঁটকাটা ছেলে কখনো দেখেননি তিনি, তবে ভারমুক্ত মনে হলো অনেকটা।
‘বইটা এখানে রেখে যাওয়া মানে আপনাকে বিপদে ফেলে যাওয়া,’ রাশেদ বলল আচমকাই, ‘খারাপ লোকেরা এই বইটার পেছনে লেগেছে, আপনি অসুস্থ মানুষ, ঝামেলায় ফেলতে চাই না আমরা, কাল আবার আসবো আমরা।‘
ড. কারসন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এক মুহূর্তের জন্য রাশেদের কাছে মনে হলো অসুস্থতা ব্যাপারটা পুরোটাই লোকটার অভিনয়।
‘আপনারা যা ভালো বোঝেন, ড. কারসন বললেন, ‘তবে কাল আসার আগে একটা কল দিয়ে আসবেন।
উঠে দাঁড়াল দুজন। ড. কারসন ওদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। ওরা চলে যাওয়ার পর সোজা বিছানায় এসে বসে পড়লেন তিনি। দারুন বুদ্ধিমান ছোকরা ঐ রাশেদ। ড. আরেফিন হয়তো বইটা রেখেই যেত, কিন্তু ঐ ছোঁড়ার জন্য পারলো না। মোটেই অসুস্থ নন তিনি। অভিনয়টা ভালোই করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল ওদের কাছ থেকে বইটা আজকে রাতের জন্য রেখে দেয়ার। নিজে নিজে বের করতে চেয়েছিলেন বইটাতে আসলেই বিশেষ কিছু আছে কি না। কিন্তু চালাকিতে এক কাঠি উপরে রাশেদ ছেলেটা। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল ড. কারসনের।
কিছুক্ষন পর ড. শাখাওয়াতের পার্টিতে যেতে হবে। তৈরি হয়ে নেয়া দরকার। ওরা গাড়ি পাঠাবে নিচে। আটটা প্রায় বাজে।
তৈরি হতে বেশি সময় লাগলো না ড. কারসনের। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেজেগুজে নিচে লবীতে এসে দাঁড়ালেন তিনি। গাড়ি এখনো আসেনি। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন একবার। আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। বেশ কিছুক্ষন পায়চারি করলেন লবিতে। তারপর হোটেলটা থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
কালো রঙের একটা মাইক্রো এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা হাসছে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি। ড. শাখাওয়াতের পাঠানো গাড়ি নয়তো এটা! ভাবলেন ড. কারসন।
‘ড, শাখাওয়াত, আপনি কি গাড়ি পাঠিয়েছেন?’ মোবাইলে কল করলেন ড. শাখাওয়াতের নাম্বারে।
‘হ্যাঁ, কালো রঙের একটা মাইক্রো,’ ওপাশ থেকে বললেন ড. শাখাওয়াত।
‘ঠিক আছে, গাড়িটা এসেছে, আমি আসছি,’ বললেন ড. কারসন, তারপর এগিয়ে গেলেন কালো মাইক্রোটার দিকে।
‘আমি ড. কারসন,’ বললেন তিনি।
ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা কিছু বলল না, তবে হাসল, দাঁত বের করে। এখানকার অধিকাংশ লোকই ইংরেজি বলতে পারে না, কাজেই কিছু মনে করলেন না ড. কারসন। তিনিও হাসলেন একটু, ভদ্রতা করে।
লোকটা বের হয়ে এসে মাইক্রোর বড় স্লাইডিং দরজাটা খুলে দিল। চড়ে বসলেন ড. কারসন। সাথে সাথে স্টার্ট দিল গাড়িটা। চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন ড. কারসন। এখন শরীর সত্যি সতি কিছুটা খারাপ লাগছে।
তাকিয়ে থাকলে দেখতে পেতেন হোটেলটার গেটে কালো রঙের একটা মাইক্রো এসে দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভারের সামনে উইন্ডস্ক্রীনের নিচে ছোট একটা প্ল্যাকার্ড, সেখানে লেখা ‘ড. কারসন।
*
অধ্যায় ১৬
কোন কিছুই জীবনে পরিকল্পনা করে করেননি আকবর আলী মৃধা। ব্যর্থ একজন মানুষের সব বৈশিষ্ট্য নিজের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি এবং একই সাথে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন জীবনের সকল ক্ষেত্রে। কপাল ভালো বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। বাবা আলাউদ্দিন শিকদার ছিলেন সফল একজন ব্যবসায়ী। ঢাকায় তিনটি বাড়ি রেখে গেছেন, ব্যাংকে অজস্র টাকা। কাজেই আকবর আলী মৃধার কোন সমস্যা হয়নি। মজার ব্যাপার, এই নামটা একেবারে ভূয়া। তার সত্যিকারের নাম হচ্ছে আসাদ শিকদার। নামের এই পরিবর্তন করার কোন কারন নেই, একদিন হঠাৎ করেই নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করলেন আকবর আলী মৃধা বলে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়া শেষ করে প্রথমে বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু কিছুদিনেই বুঝে যান, এই ব্যবসা চালান তার পক্ষে সম্ভব না। তখন সারাদিন সময় কাটতো তার বই পড়ে, টুকটাক নেশাও যে করতেন না, তাও না। শেষে বিরক্ত হয়ে বাবা-মা বিয়ে দিলো তার। কিন্তু বৌ টিকলো না, বিয়ের কিছুদিন পরই পালিয়ে গেল বৌটা। সম্ভবত প্রেম ছিল কারো সাথে। কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, জীবনে আর বিয়ে নয়। এরপর বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন। পুরো ব্যবসা, সম্পত্তি চলে এলো তার হাতে। ব্যবসা বলতে গোটা পঁচিশেক ট্রাক ছিল তার বাবার, যেগুলো সারাদেশে চলতো, পন্য পরিবহন করতো। বিক্রি করে দিলেন সব, কারন এই ব্যবসা তার পছন্দ ছিল না মোটেও। বিক্রি করা সব টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিলেন ফিক্সড ডিপোজিট করে। শান্তিনগরের বাসাটা নিজে নিয়ে নিলেন, সব ভাড়াটেদের সরিয়ে দিয়ে। বাকি দুটো বাড়ি মিরপুর আর রামপুরায়। সেখান থেকে বাড়িভাড়ার টাকা সব ব্যাঙ্কের একাউন্টে জমা হয়।
কাজেই বলা যায়, বেশ সুখেই কাটছিল সময় তার। বই পড়ে, সিনেমা দেখে, অল্পসল্প নেশা করে কেটে যাচ্ছিল দিন। তারপর একদিন মনে হলো, বিদেশ ভ্রমন করতে হবে। ব্যাঙ্কে বেশ ভালো অংকের টাকা জমা আছে, শুধু পাসপোর্ট করা বাকি।
পাসপোর্ট করে বেড়িয়ে পড়লেন তিনি বিদেশ ভ্রমনে। প্রথমে গেলেন সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, হংকং, এরপর চীন, জাপান, নেপাল এবং শেষ ভারত। ভারতেই দেখা পেলেন তার গুরুর। যে তার চোখ খুলে দিয়েছিল। অন্য এক জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেও অনেকদিন আগের কথা। বোম্বের শহরতলীতে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি, গুরুর কাছে, শয়তানের মন্ত্র যপ করে হয়েছিলেন এক গুপ্ত কালো দলের সদস্য। লুসিফার সেই দলের আরাধ্য দেবতা। সেখানে থেকে দেখেছেন, কিভাবে কালো যাদু কাজ করে, কিভাবে লুসিফারকে সন্তুষ্ট করা হয়, কিভাবে নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তিনবছর সেখানে কাটান তিনি। তারপর একসময় চলে আসেন নিজের দেশে। এই বাড়িটাতেই কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুতে তিনি ছিলেন একা। প্রায় পাঁচ বছর পুরো একা কাটিয়েছেন। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সেই সময়টায়, বই পড়েছেন, লুসিফারের সেবা করেছেন। পাঁচ বছরে পাঁচটা বলি দিয়েছেন এই বাড়িটায়। নিজের হাতে। পাঁচটা মেয়েকে খুন করে তার রক্ত উৎসর্গ করেছেন লুসিফারকে। লুসিফার খুশি হয়েছেন। লুসিফার খুশি হয়েছেন এই ধারনা হলো তখন, যখন নিজের একজন যোগ্য সঙ্গি তিনি খুঁজে পেলেন। কায়েস ছিল সেই সঙ্গি। যদিও কিছুদিন হলো মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়েছে তার।
এখন তার দল অনেক বড়। কিছুদিন আগেও যেখানে চার-পাঁচ জনের ছোট একটা দল ছিল, এখন সদস্যের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। এদের বেশিরভাগই পথভ্রষ্ট যুবক, নেশা করে করে জীবনের সঠিক পথটাও যারা হারিয়ে ফেলেছে। এদেরকে নিয়েছেন নিজের দলে। সংখ্যা আরো ভারি হওয়া দরকার তার। শিষ্য যতো বাড়বে ততোই ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন তিনি।
আজ দারুন একটা কাজ হয়েছে। ড. কারসন নামক এক পন্ডিত কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে এসেছেন। এই লোকটাকে খুব দরকার ছিল আকবর আলী মৃধার। খোঁজ খবর নিয়ে আসার জন্য যে হোটেলটায় লোকটা উঠেছে সেখানে দুজনকে পাঠিয়েছিলেন। একটু আগে খবর এসেছে ড. কারসন নিজ থেকে তার পাঠানো কালো মাইক্রো বাসে চড়ে বসেছেন। শুনে মজাই লেগেছে আকবর আলী মৃধার। লোকটাকে কিভাবে বাগে আনবেন চিন্তা করছিলেন, কিন্তু লোকটা স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। আজব। লুসিফারকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন তিনি। সবই লুসিফারের ইচ্ছা।
নিচতলার একটা রুমকে অতিথিশালা বানিয়েছেন তিনি। সেখানেই ঢোকানো হয়েছে ড. কারসনকে। ভদ্রলোক প্রথমে খুব গাইগুই করেছেন, কিন্তু যখন খোলা অস্ত্র দেখানো হলো তখন বুঝতে পেরেছেন কাদের পাল্লায় পড়েছেন। অযথা জীবন খোয়াতে রাজি নন ড. কারসন। সাধারন কিডন্যাপার এরা। হয়তো মুক্তিপন চাইবে, তারপর ছেড়ে দেবে। কাজেই সুবোধ বালকের মতো এরপর আর উচ্চবাচ্য করেননি ভদ্রলোক। মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়েছে ওরা। এটাই চিন্তার বিষয়। একটু বুঝতে পারলে কাউকে জানানো যেত, এসএমএস করে। কিন্তু নিজে নিজেই মরনফাঁদে পা দিয়েছেন ড. কারসন। ড. শাখাওয়াত নিশ্চয়ই এদের পাঠাননি তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে।
ড. কারসনের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে আকবর আলী মৃধার। কিন্তু নিজেকে সংযত করলেন তিনি। একটু টেনশনে থাকুক। চিন্তা করুক, কি কারনে তাকে আনা হয়েছে এখানে। যখন উত্তর খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দেবে তখনই দেখা দেবেন তিনি। এখন একা থাকুক।
শিষ্যদের একজন এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
‘কিছু বলবে?’ রাশভারি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আকবর আলী মৃধা।
‘মোবাইল ফোনটা নিয়ে কি করবো?’
গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন, ভাবলেন তিনি। ইদানিং মোবাইল ফোন ট্রাকিং করার পদ্ধতি বের হয়েছে, বন্ধ থাকা মোবাইলও খুঁজে বের করা যায় টেকনোলজির মাধ্যমে।
‘বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসতে বলো কাউকে।’
‘ঠিক আছে, ওস্তাদ,’ বলে চলে গেল ছেলেটা।
একজন বিদেশিকে অপহরন করা হয়েছে। কালকেই পত্রিকার শিরোনাম হবে খবরটা। সারাদেশে খোঁজা শুরু হয়ে যাবে। কাজেই, বোঝা যাচ্ছে, বড় একটা ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে। এখন আর পিছু হটা চলবে না।
কালো, লম্বা একটা আলখেল্লা পড়েছেন তিনি, কপালে তিলক কেটেছেন লাল রঙের। তার গায়ের রঙ ফর্সা, গালে কাটা একটা দাগ আছে। গোঁফজোড়া বেশ যত্নে পালিত। উঠে দাঁড়ালেন তিনি, পায়চারী করলেন কিছুক্ষন। বড় বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। এই লোকটা কি খুব বেশি কাজে লাগবে তার?
ঝুঁকির কিছু নেই, মেরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেই হলো। এর জন্য মুক্তিপন তো চাইতে যাচ্ছে না কেউ। কাজেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যথেষ্ট বেগ পেতে হবে একে খুঁজে বের করতে হলে। আপন মনে হাসলেন আকবর আলী মৃধা। পুলিশ বাহিনীকেও একটা শিক্ষা দেয়া যাবে এর মাধ্যমে। চব্বিশ ঘণ্টা দৌড়ের উপর থাকবে ওরা। যেনতেন কথা নয়, একজন বৃটিশ নাগরিক, আবার বিখ্যাত একটা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। দেশে একটা আলোড়ন পড়ে যাবে মনে হচ্ছে।
পায়চারি করতে করতে ড্রইং রুমে চলে এলেন তিনি। সোফাটার দিকে চোখ পড়ল। কোন দুঃখে যে এই সোফার নিচে বইটা রাখতে গিয়েছিলেন ভাবলেই মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে তার। মনে হয়েছিল সোফার নিচে কে লক্ষ্য করবে, কিন্তু ভাগ্যটাই খারাপ। শামীমেরও ভাগ্য খারাপ। তাই এতো অল্প বয়সে প্রান দিতে হলো। লুসিফারকে উপহার দিয়েছেন তিনি শামীমের রক্ত। লুসিফারও নিশ্চয়ই তাকে হতাশ করবে না। এখন বইটা উদ্ধার করতে হবে। শামীমের বন্ধুর কাছেই আছে জিনিসটা। আরেকটু হলেই বইটা হাতে পাওয়া যেত। কিন্তু কপাল খারাপ। কোত্থেকে দুই পালোয়ান এসে উদ্ধার করল ছেলেটাকে, চিন্তাও করা যায়নি।
বইটার কথা মনে হতেই পুরানো দিনে ফিরে গেলেন তিনি। বোম্বে। প্রিয় একটা শহর। তারকাদের শহর। তিনি অবশ্য তারকাদের খোঁজে যাননি সেখানে। বোম্বেতেই জীবনের মোড় ঘোরান দিনগুলো কেটেছে তার। সেই গুরু। সেই শিক্ষা। লুসিফারের ছায়ায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া। বেঈমানি অবশ্য তিনিও করেছিলেন। গুরুর কাছে থাকা বইটা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। গুরু প্রায়ই বলতেন, এই বইটার পাঠোদ্ধার করতে হবে, দারুন এক রহস্যের উঘাটন হবে তাহলে। গুরুত্ব দেননি তিনি গুরুর কথায়, কিন্তু আসার সময় বইটা চুরি করে আনার কথা ভোলেননি। সেই বইটা এখন ঢাকায়, হাতে হাতে ঘুরছে। ওরা কি পারবে পাঠোদ্ধার করতে? কে জানে?
ড. কারসন সম্পর্কে পত্রিকায় পড়েছিলেন কিছুদিন আগে। এই লোক প্রাচীন কিছু ভাষা জানেন, যেসব ভাষার ব্যবহার হতো তিন-চার হাজার বছর আগে। তখনই ঠিক করেছিলেন এই লোককে দিয়েই বইটার পাঠোদ্ধার করাবেন তিনি। যদিও এর আগেই বইটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল শামীম। কিন্তু তিনি জানেন বইটা তার হাতে আসবেই এবং এবার আসা মাত্র এর রহস্য উদঘাটনে পিছ পা হবেন না তিনি।
চারদিকে লোক লাগানো আছে। সেদিন রাশেদ ছেলেটার সাথে একজন লোক ছিলেন, যিনি আহত রাশেদকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এই লোকটাকেও খুঁজে বের করতে হবে, তাহলে হয়তো রাশেদকে বের করা যাবে। রাশেদকে একবার খুঁজে পাওয়া গেলে, তিনি নিজে অপারেশনে নামবেন। যে করেই হোক, বইটা কজা করতে হবে। একটা চুরুট ধরালেন তিনি। জানালা দিয়ে তাকালেন আকাশের দিকে। দু’একাত আগেই ছিল পূর্ণ অমাবশ্যা। সেদিন লুসিফারকে তুষ্ট করতে ভোলেননি তিনি।
***
গতকাল রাতের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে জয়নালের। এধরনের দৃশ্য জীবনে দেখবে বলে কল্পনাও করেনি সে। সারা রাত আর ঘুম আসেনি তার। সকালের দিকে চোখ লেগে এসেছিল, কিন্তু ঘুমায়নি সে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। সাহসী মানুষ হিসেবে লোকে চেনে তাকে। সত্যিই সাহস আছে তার, আসলে ভয় জিনিসটার অভাব সেই ছোটবেলা থেকেই। কাজেই ভয়ের অভাবই বোধহয় সাহস, ভাবে জয়নাল।
নিজের হাতে গুনে গুনে ছয়টা খুন করেছে জয়নাল। একবারও হাত কাঁপেনি,করুনা হয়নি মৃত্যুপথযাত্রীর করুন চোখ দেখেও। সাধারন মানবিক এসব ব্যাপার পছন্দ হয় না তার। ছেলেমানুষ থাকবে পাথরের মতো, শক্ত। সে নিজেকে এতোকাল তাই মনে করে এসেছে, শক্ত পাথর। কিন্তু গতকাল রাতেই নিজেকে চিনতে শিখেছে সে, আসলে সারাজীবন কখনো সত্যিকারের ভয়ের মুখোমুখি হয়নি জয়নাল, কাজেই ভয় বলে কিছু ভেড়েনি তার কাছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পেরেছে, ভয়ের আছে অনেক কিছু।
উঠোনে এসেই মাঝখানে রাখা চেয়ারটার দিকে নজর চলে গেল জয়নালের। এই চেয়ারটায় মজিদ ব্যাপারি বসে। আসলেই কি মজিদ ব্যাপারি! না কি কোন জ্বিন-ভূত। আসল মজিদ ব্যাপারিকে মেরে তার রুপ ধরে এখানে আছে? এ ধরনের অনেক কাহিনী ছোটবেলায় নানী-দাদীর মুখে শুনেছে সে। কিন্তু কান দেয়নি। আর দশটা ছোট ছেলেমেয়ে যখন ভয়ে কাটা হয়ে থাকতো এসব গল্প শুনে, তখন মিটিমিটি হাসতো জয়নাল।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে সালেহা, রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে জয়নাল যে বৈঠকখানায় থাকে সেখান থেকে। কি নিশ্চিন্ত এরা। জানেও না কার পাল্লায় পড়েছে। বুকে কুলহু আল্লাহু তিনবার পড়ে ফুঁ দিল সে। এখন বাইরে বেরুতে হবে। ব্যাপারিসাহেব থুক্কু চেয়ারম্যানসাহেবের চলে আসার সময় এসেছে। সে হচ্ছে চেয়ারম্যানের খাস লোক। খাস লোককে প্রস্তুত থাকতে হবে আগে।
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল জয়নাল। চেয়ারটা খালি নেই। উঠোনের মাঝখানের চেয়ারটা। মজিদ ব্যাপারি বসে আছে। আরাম করে। চোখ বন্ধ।
‘স্লামালেকুম, ভালো আছেন হুজুর,’ জয়নাল বলল মজিদ ব্যাপারি সামনে এসে।
‘রাইতে ঘুম হইছে ভালো মতো?’ চোখ না খুলেই জিজ্ঞেস করলেন মজিদ ব্যাপারি।
‘একটু কেঁপে উঠলো জয়নাল। বুড়া কি টের পেয়ে গেছে নাকি?’
‘আল্লার রহমতে, শুইলেই ঘুম, এক ঘুমে রাইত কাবার,বলল জয়নাল।’
‘ঘুমে আবার উলটাপালটা স্বপ্ন দেহ নাতো? গরম অনুভব করল জয়নাল। লোকটা কি ইশারায় কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে না।’
‘স্বপ্ন কি জিনিস জানিই না হুজুর, গরীবের আবার স্বপ্ন।’
‘স্বপ্ন দেখলেই কাউরে কইবা না স্বপ্নের কতা, তাইলে কিন্তু সমস্যা হয়,’ এবার চোখ খুলে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালন মজিদ ব্যাপারি জয়নালের দিকে।
ঢোক গিলল জয়নাল।
‘জি, হুজুর, আপনের কথা মনে থাকবো।’
‘যাও, এখন কাজে যাও, অন্যদিকে মন দিবা না, মন দিয়া শুধু কাজ করবা।’
‘জি, হুজুর, সালাম,’ বলে কোনমতে চলে আসল জয়নাল।
কাউকে কিছু বলা যাবে না, বোঝা যাচ্ছে না বললে কোন সমস্যা হবে না, কিন্তু বললে মহাসমস্যা। কিন্তু যাই হোক না কেন, এই চাকরী ছাড়া দেবে সে, এর চেয়ে খুন-খারাপি করা অনেক ভালো।
***
গেস্ট রুমটা পছন্দ হয়েছে রাশেদের। ড. কারসনের ওখান থেকে সরাসরি ড. আরেফিনের বাসায় এসে উঠেছে। বেশ বড়সড় একটা বাড়ী। সামনে উন্মুক্ত জায়গায় অনেকখানি বাগান। তারপর দোতলা বাসাটা বেশ খোলামেলা। মানুষজন খুবই কম। ড. আরেফিন এবং তার স্ত্রী থাকেন। এছাড়া আছে কাজের লোক, দাড়োয়ান এবং ড্রাইভার, কিন্তু ওরা এখানে থাকে না। আরেফিন দম্পতি নিঃসন্তান। কাজেই বিশাল বড় বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাত্রই রুমে ঢুকেছে রাশেদ। খাওয়া-দাওয়া হয়নি এখনো। লোকজন কম, তাই কেমন শব্দহীন সবকিছু। গেস্টরুমটা এক তলায়। ড. আরেফিন থাকেন দোতলায়। ডাইনিং রুমটাও সম্ভবত সেখানে। কারন আসার পথে নিচে কোথাও ডাইনিং রুম নজরে পড়েনি রাশেদের। আসলে অনেক ক্ষিদে পেয়েছে তার। তাই বারবার ডাইনিং রুমের কথাই মনে পড়ছে।
ড. কারসনের সাথে দেখা হওয়াটা মোটেও কাজে লাগেনি। ভদ্রলোক অসুস্থ ছিলেন না এটা নিশ্চিত রাশেদ। কিন্তু এই ধরনের অভিনয় কর মানে কি মাথায় এলো না তার। লোকটা চেয়েছিল বইটা ওরা রেখে যাক ড. কারসনের কাছে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে ড. আরেফিন হয়তো রেখেও আসতেন, কিন্তু সময়মতো আটকাতে পেরে খুশি রাশেদ। এই বইটার জন্যই তার প্রিয় বন্ধু প্রান হারিয়েছে। এছাড়া প্রান দিয়েছে নিরাপরাধ আরো দুজন। কাজেই বইটার রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কারো হাতে একেবারে দিয়ে দেয়ার চিন্তাও করছে না সে।
কাপড়-চোপড় পালটে বিছানায় বসে আছে রাশেদ। সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একজন শিক্ষকের ঘরে বসে সিগারেট ধরানোটা কেমন বেয়াদবী করা হবে বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। ইতস্তত করে একটা ধরালো রাশেদ।
কোন কিছুই গভীরভাবে চিন্তা করছে না সে, ভাবল রাশেদ। চিন্তা এবং প্ল্যান, দুটোরই খুব দরকার এখন। এখন এই নিঃশব্দ পরিবেশটাই হচ্ছে চিন্তা করার উপযুক্ত সময়। এছাড়া খিদেও পেয়েছে যথেষ্ট, খিদে পেটে নাকি গভীর চিন্তা করা যায়। যে করেই হোক বইটার রহস্য বের করতে হবে, পাশাপাশি নিজেকেও নির্দোষ প্রমান করতে হবে। বন্ধুর খুন সে করেনি। ট্রাভেল ব্যাগটায় অনেকগুলো টাকা রেখে গিয়েছিল শামীম। ঐ টাকার উপর ভর দিয়েই চলছে এখন রাশেদ। বাবাকে ফোন করলেই হয়তো টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কিন্তু ফোন করলেই বাড়ি যেতে বলবেন তিনি, এই মুহূর্তে যা সম্ভব না।
লিলির কথাও ভাবছে রাশেদ। যদিও সময়টা রোমান্টিকতার জন্য উপযুক্ত না। বেশিদিন আর ইউনিভার্সিটির ছাত্র থাকবে না তারা, তারপর কি হবে?
চুলোয় যাক সব, এখন খিদে পেয়েছে, সেটার সমাধান দরকার।
দরজায় টোকা পড়ল তখনই। খুলতেইড্রাইভার লোকটাকে দেখল রাশেদ।
‘স্যারে দোতলায় যাইতে কইছে আপনেরে?’ ড্রাইভার লোকটা বলল।
‘ঠিক আছে, আমি আসছি,’ দরজা বন্ধ করে দিল রাশেদ।
সহজাত প্রবৃত্তিতেই আরামের উদ্দেশ্যে লুঙ্গি পড়ে ফেলেছিল সে, সেটা পালটে একটা প্যান্ট পড়ে নিলো, উপর একটা টি-শার্ট।
ডুপ্লেক্স বাড়ী। ঠিক মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। বাঁকানো সিঁড়ি। উপরে উঠেই ড. আরেফিনকে দেখতে পেল।
বড় একটা ডাইনিং টেবিলের একপাশে বসেছেন ড. আরেফিন, একা। একজন মহিলা খাবার বেড়ে দিচ্ছে।
‘এসো, রাশেদ, এইখানে বসো,’ নিজের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন ড. আরেফিন।
বসল রাশেদ। টেবিলটার দিকে তাকাল। খুব বেশি কিছু সাজানো নেই, রুই মাছের তরকারি, ডাল, একটা সবজি।
রাশেদের প্লেটেও খাবার বেড়ে দিলো মহিলাটি। পারলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশেদ, কিন্তু ভদ্রতা তো বজায় রাখতে হবে। কাজেই ধীরে ধীরে খাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ড. আরেফিনের দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবারে মন নেই তার। কিছু একটা নিয়ে ভাবছেন।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়, ড. আরেফিনের। ডাইনিং টেবিলেই রাখা ছিল ফোনটা, তুলে নিলেন তিনি।
‘হ্যাল্লো,’ ড. আরেফিন বললেন।
ওপাশ থেকে কে কথা বলছে বোঝার চেষ্টা করল রাশেদ।
‘জি, ড. শাখাওয়াত, বলুন, খেতে বসেছিলাম, সমস্যা নেই।‘
ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো যা শুনে চিন্তার ছাপ পড়ল ড. আরেফিনের মুখে। খেতে খেতে সব লক্ষ্য করছে রাশেদ। খারাপ কোন খবর পেয়েছেন ড. আরেফিন, মনে হলো রাশেদের।
‘মোবাইল বন্ধ, হোটেলেও নেই, হয়তো বাইরে বের হয়েছেন,’ বলে চলছেন ড. আরেফিন।
‘তাহলে তো চিন্তার কথা, এতো বড় মানী একটা লোক,’ আবার বললেন ড. আরেফিন, ওপাশের কোন একটা কথা উত্তরে।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি দেখছি, কোন খবর পাই কি না, আপনিও কিছু জানলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না,’ বললেন ড. আরেফিন।
মোবাইল ফোনটা রেখে রাশেদের দিকে তাকালেন তিনি।
‘কিছু বুঝলে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘জি, না,’ বলল রাশেদ। সমস্যা কিছু একটা হয়েছে বুঝেছে, কিন্তু কি ধরতে পারেনি সে।
‘ড. কারসনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘পাওয়া যাচ্ছে না!’
‘হ্যাঁ, আজ আটটার সময় ড. শাখাওয়াতের ওখানে তার দাওয়াত ছিল, একটা মাইক্রোও পাঠিয়েছিলনে ড. শাখাওয়াত। কিন্তু ড. কারসনকে হোটেলে পাওয়া যায়নি,এমনকি তার ফোনটাও বন্ধ।‘
‘আজব ঘটনা, তিনি তো আমাদের সামনে এমনভাব করছিলেন যেন চরম অসুস্থ,’ রাশেদ বলল।
কথাটা বলেই ভুল হয়ে গেছে বুঝল রাশেদ। এতো রূঢ়ভাবে কথাটা বলা ঠিক হয়নি যখন ভদ্রলোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ড. আরেফিন কিছু বললেন না।
‘এখন আমাদের কি করা উচিত?’
‘দেখা যাক, অপেক্ষা করা ছাড়া তো গতি নেই, আশা করি ভদ্রলোক কোন ঝামেলায় পড়েননি,তাহলে বইটার রহস্য উঘাটনের জন্য অন্য উপায় বের করতে হবে আমাদের। তবে, একটা জিনিস কি বুঝতে পারছো?’
‘কি?’
‘অনেক বিপদের মধ্যে আছি আমরা। ড. কারসন যদি অপহৃত হয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে ঝামেলা আরো বাড়বে।
রাশেদ তাকিয়ে রইল ড. আরেফিনের দিকে। ইতিমধ্যে খাওয়া শেষ করেছেন তিনি।
‘যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকো তুমি, নিজের মনে করে থাকবে, কিছু দরকার থাকলে সখিনা বুয়াকে বলবে, সংকোচ করবে না, ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে,’ মাথা নাড়ল রাশেদ। মহিলাটির দিকে তাকাল, এই তাহলে সখিনা বুয়া। রান্না ভালো মহিলার। থাকতে সমস্যা হবে না।
খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজের রুমে ফিরে এলো রাশেদ। পেট পুরে খাওয়া হয়েছে, এখন ঘুম দরকার। বহুদিন এরকম আরামের বিছানা-বালিশে ঘুমানো হয়নি তার।
***
শেবারনের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন অল্প কিছুক্ষন হলো। বৃদ্ধ ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না তাকে। কিন্তু প্রয়োজনটা এমন চাইলেও থাকতে পারছিলেন না তিনি। তার অমূল্য সম্পদ দিয়ে উধাও হয়ে গেছে রামপ্রসাদ। কখন বেড়িয়েছে কেউ বলতে পারছে না। মন্দিরের পূজারী এবং শেবারনের শিষ্যরা অনেকে সূর্য উঠার সময়ই উঠে পড়ে, স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য নানাধরনের কসরত করে, কিন্তু ওরাও দেখেনি রামপ্রসাদকে। তারমানে রাত থাকতে থাকতে বের হয়ে গেছে লোকটা, সাথে বড় বড় দুটো সুটকেস। এতো বড় দুটো জিনিস নিয়ে কততদূর যেতে পারবে লোকটা, ভাবলেন তিনি। ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো তার। এখন পিছু নিতে যাচ্ছেন তিনি।
মনে হচ্ছে যে পথে ঢুকেছিলেন এই অঞ্চলে সে পথটাই ব্যবহার করবে রামপ্রসাদ। সেটাই স্বাভাবিক, কারন এই অঞ্চল একেবারেই অচেনা লোকটার।
তুষারপাত হচ্ছে বাইরে, বেশ কিছুক্ষন ধরে হাঁটছেন তিনি। তুষারপাতে পথের উপর নতুন করে বরফ পড়বে, এটাই চিন্তার কথা। তাতে আগের পায়ের ছাপগুলো একেবারে মুছে যাবে। কাজেই রামপ্রসাদকে খুঁজে বের করা খুব সোজা কাজ হবে না। লোকটার উপর বিশ্বাস জন্মেছিল তার। কিন্তু বিশ্বাস বোধহয় কাউকেই করা যায় না। মানবজাতির ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার। যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকতা দেখেছেন তিনি, নিজেও যে দু’একবার এর শিকার হননি তা নয়। কিন্তু আচমকা এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে হতেই অনেক অনেক পুরানো স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন।
সাল খৃস্ট পূর্ব ৪৪। জিশু জন্ম নেননি তখনো। রোম সাম্রাজ্যের সূর্য মধ্যগগনে। শাসন করছেন জুলিয়াস সিজার। রোম শুধু একটা সাম্রাজ্য নয় এখন, রোম এখন রোমান রিপাবলিক। পশ্চিমে এই নামে চলছে রোমের সম্প্রসারন, পূর্বে সে বিস্তার লাভ করেছে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে।
বিকেলের আলোতে প্রাসাদের ব্যালকনিতে বসে আছেন সিজার। সাথে আছে সহধর্মিনী কালপুর্নিয়া পিসোনিস। নাস্তা হিসেবে প্লেটে সাজানো আছে নানা ধরনের ফল, যা এসেছে রোমান সম্রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে। সূর্য অস্ত যায়নি এখনো, তবে রোদের তেজ কমে এসেছে। প্রহরী এসে জানাল জনাব মার্কাস ডাসিডিয়াস এসেছেন দেখা করার জন্য, অনুমতি চাচ্ছেন।
মার্কাস ডাসিডিয়াস, লোকটার কথা ভাবলেন সিজার। মধ্যবয়সী লোক। অন্য অঞ্চল থেকে এসেছে, সম্ভবত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের কোন অঞ্চল থেকে। চেহারায় এক ধরনের স্থিরতা আছে ভদ্রলোকের, বেশ জ্ঞানী, কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। কারন অনেক বিষয়েই জ্ঞান রাখে লোকটা এবং কথাবার্তায়ও বেশ পারদর্শী। বয়স পয়তাল্লিশ হবে এবং অবিবাহিত। আয়ের উৎস ঠিক জানেন না, তবে মনে হয় খাদ্যশস্যের ব্যবসা করে। যাই হোক, হাত ইশারায় ব্যালকনীতে পাঠিয়ে দিতে বললেন সিজার। এখানে আসলেও সমস্যা নেই, তার স্ত্রীও উপভোগ করে মার্কাসের সঙ্গ। কেননা কথা বলায় ওস্তাদ লোকটা।
গতবছর দেখা হয়েছিল, তারপর আজ, কিন্তু লোকটাকে দেখে একটু অবাক হলেন সিজার, বয়েস মনে হয় আরেকটু কমেছে মার্কাসের।
‘মহামান্য সিজার, আমার অভিবাদন গ্রহন করুন,’ মার্কাস এসে দাঁড়িয়েছেন ব্যালকনীর দরজায়।
‘ভেতরে আসুন আপনি,’ সিজার বললেন।
ভেতরে এসে দাঁড়ালেন মার্কাস। মাথা নীচু করে আছেন। যদিও এতোটা আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করেন না সিজার। কিন্তু রোমের সম্রাট বলে কথা।’
‘কি ব্যাপার, মার্কাস, দিন দিন আপনি তো দেখি আরো তরুন হয়ে উঠছেন? জিজ্ঞেস করলেন সিজারের সহধর্মিনী।
‘প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ, লতা-পাতার নিযার্স দিয়ে একটা জিনিস বানিয়েছি, আপনাকে দেবো, চেহারায় লাবন্য নিয়ে আসে।‘
‘দেবেন মানে, আজকেই আপনার সাথে লোক পাঠাবো, তার হাতে দিয়ে দেবেন।‘
সিজার অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। এসব কথায় মনোযোগ নেই তার। বয়স ষাট পেড়িয়েছে অনেক আগেই। জীবনের শেষ ভাগে চলে এসেছেন। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ছে তার। দেখতে কি সুদর্শন ছিলেন! পেশীবহুল শরীর ছিল, কত যুদ্ধ, কত হত্যা, কত নারী! এখন সব বিস্বাদ লাগে।
কিছুদিন আগেই স্পেন জয় করে এসেছেন। রোমের ভেতরের আভ্যন্তরীন কোন্দল, গৃহযুদ্ধ মিটিয়েছেন। এমনকি তার মৃত্যুর পর শাসন করতে কে আসবে তাও উইল করে গিয়েছেন, এরপর শাসনে আসবে অক্টোভিয়ান, তার নাতি, কিন্তু অক্টোভিয়ান যদি কোন কারনে তার আগে মারা যায়, তাহলে সাম্রাজ্যের শাসনভার যাবে মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাসের কাছে। অনেকেই এই ব্রুটাসের ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করেছে, অনেক আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু কারো কথায় কান দেবার লোক সিজার নন। ব্রটাসকে তিনি পছন্দ করেন, কি কারনে করেন তা গোপন।
রোম সাম্রাজ্যকে এক সূতোয় গাঁথতে চান তিনি এখন। এতোগুলো আলাদা আলাদা রাজ্যকে একসাথে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনা কঠিন। কিন্তু সেদিকেই পা বাড়িয়েছেন। অনেককাল ধরেই ছোট ছোট রাজ্যগুলো তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখত, যারা সেই ছোট রাজ্যের শাসনকর্তার আদেশে কাজ করতো। সেই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছেন সিজার। কেউ কেউ তা মানতে চায়নি,ফলে নিজ সাম্রাজ্যের ভেতর যুদ্ধও করতে হয়েছে তাকে। পম্পেই, যে নিজেকে দ্য গ্রেট বলে প্রচার করতো তাকে হারিয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে, তারপর সব শান্ত ছিল অনেকদিন। এখন মাঝে মাঝে খবর আসে, কেউ কেউ বিদ্রোহ করতে চায়। কিন্তু তার আগেই দমন করার ব্যবস্থা নেন। এছাড়া রাষ্ট্রকাঠামোকে একটা ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চান তিনি। তাই সমাজের গন্যমান্য এবং অভিজাত বংশীয় লোকদের নিয়ে তৈরি করছেন সিনেট। সিনেটের সদস্যরা সাম্রাজ্যের সব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরতে পারে, যদিও তা মানা না মানার ব্যাপারটা নিজের হাতেই রেখেছেন সিজার। গল জয় করেছেন কিছুদিন আগে, বুটাসকে বানিয়েছেন গলের গভর্নর। ব্রুটাস তার প্রিয় পাত্র, সিনেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য, যদিও বয়স বেশি নয় ছেলেটার। অনেকেরই ধারনা, ব্রটাস তার সন্তান। তিনি জানেন আসল সত্যটা কি, কিন্তু কাউকে বলেননি কোনদিন।
মার্কাস লোকটার দিকে তাকালেন। কথা বলেই যাচ্ছে তার স্ত্রীর সঙ্গে। মেয়েমানুষের সাথে কথা বলতে তিনি নিজেও কম পারদর্শী নন। বিয়ে করেছেন তিনবার, প্রেমিকারও অভাব ছিল না তার। কিন্তু এই লোকটাও কোন অংশে কম যায় না।
লোকটা বিনা কারনে আসেনি তার সাথে দেখা করতে। বিশেষ কোন প্রয়োজনে এসেছে।
‘মার্কাস, আপনি কি কোন কাজে এসেছেন?’
‘জি, মহামান্য সিজার, আপনি অনুমতি দিলে নির্ভয়ে বলতে পারি।’
‘বলুন, কোন সমস্যা নেই।‘
‘হয়তো এসব বিষয়ে কথা বলার কোন অধিকার নেই আমার, কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা ধারনা চলে এসেছে আমার মনে।‘
‘কি ধারনা, খুলে বলুন?’
‘মহামান্য, পুরো রোম জুড়ে এখন শান্তি বিরাজ করছে, কোথাও কোন অশান্তি নেই, আপনার বিচক্ষন শাসনে পুরো রোমেই এখন আইনের শাসন বর্তমান, কিছুদিন আগে আপনাকে দশ বছরের জন্য ডিক্টেটরশীপও প্রদান করেছে সিনেট।‘
‘এসব আমি জানি।‘
‘কিন্তু আমার ধারনা, আপনার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কোথাও, এবং এই ষড়যন্ত্রের মূল প্রোথিত আছে সিনেটে।‘
‘আপনি কি জানেন, কাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন আপনি?’
‘এখন সিনেটই ডিক্টেটরের সময়কাল নির্ধারন করে, এবং তাদের মধ্যে ক্রমশ একটা ধারনা বেড়ে উঠছে যে আপনি নিজেকে সম্রাট ঘোষনা করবেন এবং সিনেট লুপ্ত ঘোষনা করবেন।’
‘এ ধরনের চিন্তা আমার মাথায় যে একেবারে আসেনি তা নয়, কিন্তু সিনেটে আমার বিশ্বাসী লোক আছে, সেরকম কোন ষড়যন্ত্র হলে আমি আগেই জানতে পারতাম।‘
‘জি, মহামান্য সিজার। কিন্তু আমার এই ধারনাও ভুল হবার কথা নয়।‘
‘আপনার বিরুদ্ধে আমি দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনবো এবং বিচারের সম্মুক্ষীন হবেন আপনি। আপনি আমার সিনেটের প্রতি অনাস্থা এনেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়েছি, আপনার শাস্তি কি জানেন?’
‘দেশদ্রোহিতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড।’ মৃদু কণ্ঠে বললেন মার্কাস ডাসিডিয়াস।
‘কিন্তু আপনাকে আমি পছন্দ করি, যাই হোক, এসব কথা ঘুনাক্ষরেও আর কাউকে বলবেন না, তাহলে কাঁধের উপর মাথাটা আস্ত থাকবে না।‘
‘জি, মহামান্য সিজার, অধমকে ক্ষমা করে দিন।’
‘আপনি এখন আসুন।‘
হাত তুলে ইশারা করলেন সিজার। তাড়াতাড়ি ব্যালকনি থেকে বের হয়ে এলেন মার্কাস। কপাল ভালো, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। সিজারের কাছ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করেননি। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। সিনেট সিজারকে শক্তিশালী হতে দেবে না। নিজেদের অসহায় মনে করছে তারা। যে ব্রটাসকে সিজার এতো বিশ্বাস করেন, সেও এই ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যুক্ত এবং অন্যতম প্রধান। এই ব্রুটাসকে তুলে নিয়ে এসেছেন সিজার, সেই লোকটাই বিশ্বাসঘাতকদের দলনেতা। এই তথ্য মার্কাস জানেন, কিন্তু ততটুকু বলতে হয়নি,বললে হয়তো তার কল্লাটাই যেত আজ। সিজার লোকটাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন মার্কাস, তাই সাবধান করতে এসেছিলেন। কিন্তু কথা শুনলো না লোকটা।
এর কিছুদিন পরই সিনেট সদস্যদের এক সভায় মারা যান জুলিয়াস সিজার। স্ত্রী বার বার নিষেধ করেছিল যেতে। কিন্তু শোনেননি তিনি। সিনেটের সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এক সদস্য তার আসামী ভাইকে ক্ষমা করার জন্য আবেদন করেন সিজারের কাছে, যাকে কিছুদিন আগেই দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন সিজার। তিনি আবেদন না মঞ্জুর করে দেয়া মাত্রই আক্রমন করে আবেদনকারী সিনেটর। তিনি বাঁধা দিতে গেলে পুরো সিনেটই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। আক্রমনকারীদের সংখ্যা ষাট জনের কম হবে না। কমপক্ষে তেইশ বার ছুরিকাঘাত করা হয় সিজারকে। তিনি যথাসম্ভব প্রতিরোধ করছিলেন। কিন্তু তার সব প্রতিরোধ ভেঙে যায় যখন আক্রমনকারীদের মধ্যে দেখেন প্রিয়পাত্র ব্রুটাসকে। ব্রুটাসের হাতেও বড় একটা ছুরি এবং সেটা রক্তস্নাত। ব্রুটাসকে শুধু বললেন, ‘তুমিও ব্রুটাস?’, তারপর আক্রমনকারীদের ঠেকাননি তিনি। একদল বিশ্বাসঘাতকদের হাতে করুন মৃত্যু হয় তার। পতন হয় এক শক্তিশালী পুরুষের যিনি জয় করেছিলেন নারীর হৃদয়, সেই সাথে রোমান সাম্রাজ্যে যোগ করেছিলেন নতুন নতুন প্রদেশ।
আবার বর্তমানে ফিরলেন তিনি। সেই বিশ্বাসঘাতকতার তুলনায় আরো বড় বিশ্বাসঘাতকতা প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবী, যদিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন না তিনি। জুডাসের প্রতারনায় প্রান গিয়েছিল নাজারেনের জিশুর। সেইসব বিশ্বাসঘাতকতার তুলনায় রামপ্রসাদের বিশ্বাসঘাতকতা তো সামান্য, ভাবলেন তিনি। কোন একসময় লোকটাকে প্রানে বাঁচিয়েছিলেন, তার প্রতিদানে এই বিশ্বাসঘাতকতা। আশ্চর্য!
তুষারপাত আরো বেড়েছে। পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে, কারণ সামনের দিকে কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এগিয়ে চলেছেন তিনি। তার সারা জীবনের সঞ্চয় এভাবে এক বিশ্বাসঘাতকের হাতে পড়তে দেয়া ঠিক হবে না।
***
পরদিন সকালে উঠেই পত্রিকার পাতায় খবরটা পড়ল রাশেদ। একেবারে প্রথম পাতায়। ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক ড. কারসন নিখোঁজ। সম্ভবত অপহৃত হয়েছেন তিনি। কিন্তু কোন দল বা গোষ্ঠী এর দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেনি। মনে করা হচ্ছে বিশাল অংকের মুক্তিপনের জন্য অপহৃত হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে অবস্থানরত বৃটেনের পররাষ্ট্রদূত বিশেষ শংকা প্রকাশ করেছেন এই পরিস্থিতিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। কাজেই মনে হচ্ছে, দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী এখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে প্রথিতযশা এই নৃতাত্তিক বিজ্ঞানীকে উদ্ধার করার জন্য। এছাড়া এর উপর বাংলাদেশ ও বৃটেনের সম্পর্কও নির্ভর করছে।
যে বা যারা ড. কারসনকে অপহরন করেছে, তারা সহজে নিস্তার পাবে না, এই বিষয়ে নিশ্চিত রাশেদ। এখন পর্যন্ত কোন মুক্তিপন দাবি করা হয়নি এটাই সরকারের জন্য মহা চিন্তার কথা। পত্রিকায় এটুকু পড়েই থামল রাশেদ। মুক্তিপন দাবি করেনি অপহরনকারীরা। এর মানে কি? ঐ বুড়ো লোকটাকে নিয়ে কি করবে ওরা? শুধু শুধু এমন বিখ্যাত একজন ব্যক্তিকে অপহরন করার ঝুঁকি কেন নিতে যাবে অপহরনকারীরা? নিশ্চয়ই এমন কোন কাজে ভদ্রলোককে তুলে নিয়েছে ওরা, যা একমাত্র তিনিই করতে পারবেন। কি হতে পারে সেই কাজ?
একটু আগেই নাস্তা করেছে রাশেদ। গতকিছুদিনের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ের পর একটু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সে ড. আরেফিনের বাসায় এসে। এখানে সব কিছু শান্ত, গোছানো, খাবার-দাবার, ঘুমের কোন সমস্যা নেই। আপাতত কিছুদিন এটাই খুব দরকার ছিল রাশেদের।
নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কাজে নেমেছে রাশেদ। তার আগে ধরা পড়া চলবে । একই সাথে শামীমের শেষ ইচ্ছেটাও পূরন করতে হবে। প্রতিবন্ধক হচ্ছে শামীমের খুন করেছিল যারা সেই দলটা। একই সাথে এই মুহূর্তে পুলিশও, কারন পুলিশের চোখে সেই একমাত্র অপরাধি। শামীম মারা যাওয়ার পরই গা ঢাকা দিয়েছিল সে, এটা হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর এসব চিন্তা করে লাভ নেই।
ড. কারসনের কথা মনে হলো আবার। ভদ্রলোকের আচরন খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি তার কাছে। কিন্তু এখন অপহৃত হয়েছেন শুনে খারাপ লাগছে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করছে রাশেদ। বেশ কয়েকদিন হলো ফোনটা প্রায় সারাদিনই বন্ধ থাকে। লিলি, ড. আরেফিন এবং বাসার লোক ছাড়া আর কেউ জানে না নাম্বারটা। ফোনটা চালু করল।
সখিনা বুয়ার কাছে শুনেছে ড. আরেফিন সকালেই বের হয়ে গেছেন। এখন বাজে সকাল দশটা মাত্র। সারাদিন কোন কাজ নেই হাতে। পত্রিকা পড়ে পড়ে সারাদিন কাটানো প্রায় অসম্ভব। মোবাইল ফোনটার দিকে তাকাল রাশেদ। কাউকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাকে ফোন করা যায়?
ফোন করার আগেই ফোন এসে গেল রাশেদের মোবাইলে। ড. আরেফিনের নাম্বার থেকে এসেছে কলটা।
‘রাশেদ, নাস্তা করেছো?’ রাশেদ ফোন রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে বললেন ড. আরেফিন।
‘জি, নাস্তা করেছি।’
‘চলে এসো তুমি, শাহবাগ, জাদুঘরের ঠিক সামনে।’
‘এখনই?’
‘হ্যাঁ, এখনই।’
‘ঠিক আছে, আসছি আমি, রাশেদ বলল।’
‘আসার সময় মনে করে ব্যাগটা নিয়ে এসো, কাজে লাগতে পারে।’
‘ঠিক আছে, ব্যাগ নিয়েই আসছি,’ বলল রাশেদ।
তৈরি হয়ে নিলো রাশেদ তাড়াতাড়ি। ট্রাভেল ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিলো কাঁধে। সাথে অল্প কিছু টাকাও নিলো। কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। কি কাজে ডেকেছেন ড. আরেফিন বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছে রাশেদ এই মুহূর্তে এই লোকটার উপরই হয়তো বিশ্বাস রাখা যাবে। আর কারো উপর নয়।
***
মজিদ ব্যাপারি বসে আছেন তার চিরপরিচিত জায়গায়, মানে উঠোনের ঠিক মাঝখানে। একটু আগে কথা হয়েছে জয়নালের সাথে। প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি দিয়ে দিয়েছেন লোকটাকে। জয়নাল যেভাবে ঢোঁক গিলল তাতে মনে হচ্ছে গতকাল রাতের ঘটনা সে দেখেছে, তা না হলে এতো ভয় পেতো না। ঢিলটা মেরেছিলেন আন্দাজে, কিন্তু মনে হয় ঠিক জায়গায় লেগেছে। এর আগে নুরুদ্দিনকে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি, যদিও বেচারার এতে কোন দোষ ছিল না। কিন্তু নিজের গোপনীয়তা তিনি যেকোন মূল্যে প্রকাশ হতে দিতে পারেন না। এখন এই জয়নালের একটা বিহিত করতে হবে। গ্রামের মানুষকে বিশ্বাস নেই। এরা কোন কথা পেটে রাখতে পারে না।
নতুন বৈঠকখানায় অনেক লোকের জমায়েত। একটা হাট বসেছে মনে হচ্ছে। সালেহা সারাদিন চূলোর পারে। চা-নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। ব্যাপারি বাড়ির ঐতিহ্যের একটা ব্যাপার আছে, এখানে কেউ এলে না খেয়ে যেতে পারে না। এখন চায়ের লোভের গ্রাম্য বদমাসগুলো ভীড় করছে এখানে। সবই লক্ষ্য করছেন মজিদ ব্যাপারি। ছেলেকে ডেকে একটু সাবধান করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু আজিজও দারুন মজা পাচ্ছে তার নতুন পরিচয়ে। সবাই সম্মান করছে, চেয়ারম্যান সাব, চেয়ারম্যান সাব, করছে, বিষয়টা উপভোগ করছে। তাই সাবধান করে বেচারার মন খারাপ করে দিতেও ইচ্ছে করছে না মজিদ ব্যাপারির। তিনি জানেন, মানা করার সাথে সাথে এখান থেকে বৈঠকখানা উঠিয়ে দেবে তার ছেলে। বাপকে সে যমের মতোই ভয় পায়। যদিও জীবনে। কোনদিন ছেলের গায়ে হাত তোলেননি তিনি।
সন্তান, এই ধারনাটাই নতুন ছিল তার কাছে। নিজের একটা অস্তিত্ব। কিন্তু এসব দিকে মনোযোগ দেয়ার সময়ই পাননি তিনি। জ্ঞানের অন্বেষনে পুরো পৃথিবীময় ঘুরেছেন। সমস্ত শক্তিশালী রাজ্যের প্রধান দরবারে আনাগোনা করেছেন। দেখেছেন সুন্দর সব রমনী, কিন্তু কখনো আক্রান্ত হননি প্রেম-ভালোবাসা নামের আজব রোগটাতে, কিন্তু এই এলাকাটাতে এসে নিজেকে সামলাতে পারেননি। রহিম ব্যাপারির বড়ো মেয়েকে তার মনে হয়েছিল রুপকথার রাজকন্যার মতো। গায়ের রঙটা ছিল কালো। কিন্তু কি সুন্দর চোখ, যেন চোখ দিয়েই ঘায়েল করে দিয়েছিল তাকে। তারপর বিয়ে, তারপর আজিজ। তার নিসংগ জীবনের একমাত্র উত্তরাধিকারী। যদিও যে সম্পদ বহন করে চলেছেন তিনি, তা কাউকে দেয়া হবে না তার। কেননা মানুষ মারা গেলেই তার সম্পদ উত্তরাধিকারীরা পায়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে তো সেরকম ঘটার কোন সুযোগ নেই। অনন্তকাল ধরে বেঁচে আছেন তিনি, হয়তো বাঁচবেন আরো অনন্তকাল। কিন্তু এটাই শেষ। স্নেহের বাঁধনে নিজেকে আর কখনো জড়াবেন না তিনি। একমাত্র নাতি রাশেদও তার অনেক প্রিয়, অনেক আদরের। যদিও দেখা হয় না ছেলেটার সাথে অনেকদিন। তিনি বেঁচে থাকবেন, কিন্তু নিজের বংশধরেরা কেউ থাকবে না। এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে।
সবসময়ের মতো একটা মুড়ির পাত্র তার হাতে। রোজ সকালে সালেহা কিছু গুড় আর মুড়ি দিয়ে যায়। তিনি টুকটুক করে কিছু মুড়ি খান। আর ভাবেন।
গতরাতের ঘটনার পর, শরীরে আলাদা শক্তি পাচ্ছেন তিনি। গায়ের চামড়াও অনেক সুন্দর, চকচকে হয়েছে। স্কুলে পড়া ভাবটা নেই এখন। কিন্তু হঠাৎ এই পরিবর্তন সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে, তাই খানিকটা মেকাপের সাহায্য নিয়েছেন তিনি। সুটকেসেই কিছু ক্যামিকেল রেখে দিয়েছিলেন। সেগুলো কাজে লেগেছে এখন। গতকাল এবং আজকে দেখলে কেউ তার চেহারায় কোন পরিবর্তন ধরতে পারবে না। কিন্তু পরিবর্তন ঘটে গেছে। চাইলে এখন দৌড়ে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারবেন তিনি। কিন্তু দেখানোর কোন উপায় নেই। বুড়ো হয়েই থাকতে হবে তাকে এখানে, যতদিন সম্ভব।
জয়নালের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখছেন তিনি। জয়নাল মাঝে মাঝেই চোরা চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। তিনিও এমনভাব করছেন যেন ঝিমাচ্ছেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। এই লোকটা সুবিধার হবে না। খানিকটা ভয় হয়তো পেয়েছে, কিন্তু সেটা সাময়িক। যে কোন সময় হাঁটে হাড়ি ভেঙে দিতে পারে লোকটা। তার আগেই ঠেকাতে হবে তাকে। কিন্তু দিনের আলোয় সবার সামনে কিছু করার উপায় নেই। যা করার করতে হবে রাতে। আজিজ ঘুমালে।
মৃদু একটা হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটের কোনে। মানুষ খুন করতে তার ভালো লাগে না, কিন্তু রাত-বিরেতে যারা অন্য লোকের পিছু নেয়, তাদের শায়েস্তা করা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
*
অধ্যায় ১৭
ড. কারসন বসে আছেন, চুপচাপ। একটা চেয়ারে। মুখটা একধরনের টেপ দিয়ে আটকানো। হাত-পা বাঁধা, শক্ত করে, চেয়ারের সাথে। চোখ খোলা তার। বুঝতে চেষ্টা করছেন কাদের পাল্লায় পড়েছেন তিনি। এরা কি ইন্টারন্যাশনাল কোন সন্ত্রাসী সংগঠন, মুক্তিপনের জন্য অপহরন করেছে তাকে, নাকি অন্য কিছু। বোঝা যাচ্ছে না কিছু। লোকগুলোর বয়স কম, কিন্তু চেহারায় একধরনের হিংস্রতা লক্ষ্য করেছেন। মনে হচ্ছে একধরনের আচ্ছন্নতায় আক্রান্ত এরা। তাকাচ্ছে, কিন্তু দৃষ্টিতে কোন প্রান নেই। কথা বলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিক মানুষ নয় এরা, মৃত এবং ফাঁপা কিছু রক্তমাংসের দেহ।
তিনি নিজে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, ইশারা করেছেন, কিন্তু সেই যে বেঁধে রেখে চলে গেছে, এখনো কেউ আসছে না তার সামনে। হয়তো এদের প্রধান যে, সেই হয়তো আসবে তার সাথে কথা বলতে। এরা কি জানে কী দারুন বিপদজ্জনক একটা কাজ করে ফেলেছে। ব্রিটিশ নাগরিক তিনি। ব্রিটেন তার নাগরিককে রক্ষা করার জন্য এককদম পিছু হটবে না। ইতিমধ্যে হয়তো অপারেশন ব্রু হয়ে গেছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে। কিংবা নাও হতে পারে। কেউ হয়তো বুঝতেই পারছে না। কোথায় গেছেন তিনি। যদিও ড. শাখাওয়াতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। যেহেতু পৌঁছাননি সেখানে, ড. শাখাওয়াত নিশ্চয়ই খবর নিয়েছেন হোটেলে। ধুর, এসব সাত পাঁচ চিন্তা করে লাভ নেই, ভাবলেন ড. কারসন। যা হবার হবে। পড়াশোনা, গবেষনা, দেশ-ভ্রমন এসবের পেছনের কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনটা। এখনও কতো কিছু জানার বাকি রয়ে গেল!
ইতিহাস ছিল তার প্রিয়, সেই সাথে ইতিহাসের সব চরিত্ররা। কিভাবে সময় বদলের সাথে সাথে সভ্যতা বদলেছে, ক্ষমতার কেন্দ্র বদলেছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কতো কিছুই না সহ্য করেছে এই পৃথিবী এবং কোনকিছুই ঠিক হারিয়ে যায়নি পৃথিবী থেকে। সবকিছুরই একটা না একটা চিহ্ন পৃথিবী যত্ন করে রেখে দিয়েছে নিজের বুকে। সেই চিহ্নের পেছনেই ছিলেন সারা জীবন, চষে বেড়িয়েছেন নেপাল থেকে গ্রীস পর্যন্ত, পেরু থেকে কানাডা পর্যন্ত। অনেক কিছু জেনেছেন, বুঝেছেন। কিন্তু যা বুঝেছেন, দেখেছেন, তাই কি সত্য? নিজের চোখে দেখা, জানা কি আরো গুরুত্বপুর্ন নয়!
যে লোকটা অনেক কিছুই দেখেছে নিজের চোখে, অনেক গুরুত্বপুর্ন ঘটনার স্বাক্ষী, তাকে খুঁজে পেলেই অনেক অনেক রহস্যের কিনারা করা যেতো। সেই লোকটা অষ্টাদশ শতকে সেইন্ট জারমেইন নামে পুরো ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর হিমালয়ের কোলে বিশ্রামে চলে গিয়েছিল। সে কি এখনো বেঁচে আছে? থাকলে প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্যতার সব রহস্যের কিনারা করা যেতো, উত্তর পাওয়া যেতো অনেক অনাকাংখিত ঘটনার।
জুতোজোড়া, যা এখনো হোটেল রুমে আছে, প্রমান করছে, সেইন্ট জারমেইন এসেছিলেন এই বাংলায়। এখনো হয়তো এখানেই কোথাও আছেন। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তবে তার আগে এই বিপদ থেকে বাঁচতে হবে।
সামনের দরজাটা খুলে গেল। বিশালদেহী আলখাল্লা পড়া একজনের আবির্ভাব ঘটলো দরজায়। বুঝতে পারছেন ড. কারসন, আসল লোক চলে এসেছে। এখন জানা যাবে কি কারনে এখানে আনা হয়েছে তাকে। টাকা, না কি অন্যকিছু।
আলখেল্লাধারী একটা চেয়ার নিয়ে বসেছে তার সামনে। কিন্তু আবছায়ায় লোকটার চেহারা দেখতে পেলেন না ড. কারসন। বেশ লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্য লোকটার, মাথায় ঝাকড়া চুল, শুধু এটুকুই বুঝতে পারলেন কোনমতে।
‘মহামান্য ড. কারসন,’ গলা খাকারি দিয়ে বলল লোকটা, ‘লুসিফারের দরবারে আপনাকে স্বাগতম।‘
উত্তর দেয়ার কোন অবকাশ নেই, মুখে টেপ লাগানো ড. কারসনের। তার চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে অবিশ্বাস আর ভয়ের ছটা। ব্ল্যাক ম্যাজিক এবং শয়তানের উপাসনাকারীদের পাল্লায় পড়েছেন তিনি! সাধারন কোন অপহরনকারী নয় এরা, টাকার লোভে কাজটা করেনি,অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে।
‘আপনাকে কষ্ট দিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে বলে আমি দুঃখিত, আবার বলল লোকটা, কিন্তু কিইবা করার ছিল, দাওয়াত দিলে তো আসতেন না নিশ্চয়ই।’ বলে নিজের কথায় নিজে হা হা করে হাসল কিছুক্ষন লোকটা।
অবাক হলেন ড. কারসন। এতো মাথা খারাপ মানুষ! সামনে কি আছে কে জানে।
‘আমি আপনার কাছে একটা ব্যাপারে সহযোগীতা চাইব, বেশি কিছু না, কিছু প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার করে দেবেন আপনি,’ বলে চলল লোকটা, একটু ঝুঁকে এলো ড. কারসনের দিকে, ‘বিনিময়ে পাবেন মুক্তি।’
আবারো হো হো করে হাসি। লোকটা নিজের কথাবার্তায় নিজেই হাসছে, উপভোগ করছে পুরো ব্যাপারটা।
মন দিয়ে পরিস্থিতিটা ভাবছেন ড. কারসন। প্রাচীন ভাষার উপর তার দখলের ব্যাপারটা এতোদূর ছড়িয়েছে ধারনা ছিল না। এই সুদূর বাংলাদেশের এক শয়তানের উপাসকও তার জ্ঞানের সীমানা জানে। অবাক লাগলো ড. কারসনের কাছে। গর্ববোধ করতেন, কিন্তু পরিস্থিতিটা আসলে খুব একটা অনুকূলে নয় এখন।
‘সব কথা আমিই বলছি, কারন, আপনার কথা বলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এখনো। যে বইটা থেকে পাঠোদ্ধার করতে হবে আপনাকে সেই বইটাই নেই আমার কাছে,’ আবারো হো হো করে হাসি, ‘আপনাকে এতো তাড়াতাড়ি ধরার ইচ্ছে ছিল না আমার। শিষ্যদের পাঠিয়েছিলাম একটু রেকি করে আসতে, কিন্তু গুটি গুটি পায়ে আপনি নিজে এসেই ধরা দিলেন, কি আর করার ছিল আমাদের, বলুন?’
একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই ড. কারসন। তিনি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন। ড. আরেফিনের কাছে একটা প্রাচীন গ্রন্থ আছে যেটার পাঠোদ্ধার করতে হবে, আর এই শয়তানের পূজারীদেরও উদ্দেশ্য এক, একটা প্রাচীন গ্রন্থের পাঠোদ্ধার, যদিও বইটা তাদের হাতে নেই। বই কি তাহলে একটাই? ড. আরেফিন যে বইটা নিয়ে এসেছিলেন, ওরাও কি একই বইয়ের কথা বলছে? এই বইটার প্রকৃত মালিক কে?
নানাধরনের প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু লোকটা বিড়বিড় করে কি যেন বলল। কোন মন্ত্র বা এধরনের কিছু একটা হবে। এধরনের লোক অনেক দেখেছেন জীবনে ড. কারসন, ভন্ড ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি এদের। কিন্তু এবারের মতো করে দেখেননি,কারন এবার তিনি এদের হাতে জিম্মি।
‘মহামান্য ড. কারসন, আপনাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে, পুরো ঢাকার পুলিশ, গোয়েন্দা সব লেগে পড়েছে আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য, হাজার হোক, আপনারা প্রভুর জাতি। কিন্তু, যতো যাই হোক, আপনাকে ওরা পাবে না, যদি না আমি আপনাকে ফেরত দেই,’ একটু থামল লোকটা, ‘পালাবার চেষ্টা বা কোন ধরনের অসহযোগীতা করবেন না। তাহলে লুসিফারের দরবারে এরপরের শিকার হবেন আপনি, সাবধান।’
উঠে দাঁড়াল লোকটা, তারপর চলে গেল দরজা বন্ধ করে। আবারো নিকষ অন্ধকারে পতিত হলেন তিনি। চুপচাপ পড়ে রইলেন কিছুক্ষন, তারপর ঘুমিয়ে গেলেন।
* * *
শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। বেশি সময় হয়নি এখানে এসেছে। ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে ঝোলান। মাথায় একটা ক্যাপ পড়ে নিয়েছে। যাতে সহজে কেউ চিনতে না পারে। পাশেই ইউনিভার্সিটি এলাকা। ক্লাসমেট, হলমেট কারো না কারো সাথে দেখা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়। একটা সিগারেট ধরাল সে। টেনশন কিংবা অপেক্ষার সময় এরচেয়ে ভালো সঙ্গি আর হয় না।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো রাশেদ। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ড. আরেফিনের নাম্বারটা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না, নাকি সত্যি সত্যি মোবাইল বন্ধ, বিষয়টা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তাকে। ফোন বন্ধ থাকার কোন কারন নেই, বিশেষত তিনি নিজেই যখন ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে তাকে। দায়িত্ববান লোক তিনি, নিশ্চয়ই কোন সমস্যার কারনে ফোন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন, ভাবল রাশেদ।
তেমন কোন তাড়াও নেই তার, চাইলে সারাদিন এখানে কাটিয়ে দিতে পারবে রাশেদ। পকেট ভর্তি টাকা আছে, পাশেই ভালো ভালো খাবার রেস্টুরেন্ট আছে। এছাড়া চায়ের স্টল তো আছেই। বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেলেছে এর মধ্যেই রাশেদ।
ছোট একটা বেঞ্চ দখল করে বসে আছে রাশেদ, একা। চাইলে পাশে আরো দু’একজন এসে বসতে পারে। কিন্তু আপাতত একাই বসে আছে সে। দুএকজন রিক্সাওয়ালা আরাম করে খাচ্ছে। রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে। একপিস পাউরুটি, একটা কলা, সাথে নেভী সিগারেট।
একটা সিগারেট ধরাল রাশেদ। বিরক্ত লাগছে। অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর কাজ আর নেই। কিন্তু চলে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। অবশ্য চলে যাবেও বা কোথায়? এখন ঠিকানা তো ড. আরেফিনের বাসা।
একটা লোক এসে পাশে বসলো রাশেদের। একটু সরে জায়গা করে দিলো রাশেদ। কালো কুচকুচে গায়ের রঙ লোকটার। গা থেকে কেমন বোটকা গন্ধ আসছে। কেমন অস্বস্তিবোধ করছে রাশেদ। এই লোকটাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হলো। এককাপ চা আর একটা বেনসন চেয়েছে লোকটা দোকানদারের কাছে। মুখে নিরাসক্তভাব। যেন জগতসংসারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। চুপচাপ বসে আছে। লোকটা। আড়চোখে তাকাল রাশেদ। চোখে পড়ার মতো আর কিছু লক্ষ্য করল না সে।
সিগারেট ফেলতে যাবে, লক্ষ্য করল দোকানের সামনে আরো একজন এসে দাঁড়িয়েছে। একটা কলা ছিঁড়ে নিচ্ছে সামনে থাকা কলার কাদি থেকে। অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল রাশেদের। মনে হলো পাশে বসে থাকা লোকটার সাথে নতুন আসা লোকটার মধ্যে ইশারায় কোন ভাববিনিময় হয়েছে। আবার চোখের ভুলও হতে পারে।
উঠে দাঁড়াল রাশেদ। কাউকে বিশ্বাস করার মতো অবস্থায় নেই সে এখন, তাই সবকিছুকেই সন্দেহ হচ্ছে, ভাবল রাশেদ। মোবাইল ফোনটা বের করে ড. আরেফিনকে আরেকবার চেষ্টা করল। ফলাফল একই। দুঃখিত, সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিরক্তিতে থু থু ফেলল সে। কলা খাচ্ছে যে লোকটা সে দোকানের সামনে থেকে সরে এসে দাঁড়াল রাশেদের সামনে।
‘থুথু ফেললেন যে?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা রাশেদকে, চোখে কড়া দৃষ্টি।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাশেদ। কি বলছে এই লোকটা? সে যেখানে থু থু ফেলেছে লোকটা সেখান থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়েছিল। তার তো সমস্যা হবার কথা নয়।
‘আমি থুথু ফেলেছি, কিন্তু আপনার ধারেকাছেও তো ফেলিনি, কি সমস্যা আপনার?’ একই রকম জেদী উত্তর দিল রাশেদ।
‘এই মিয়া, এরকম বেয়াদবের মতো কথা বলছেন কেন? এক চড়ে দাঁত ফেলে দেবো,’ লোকটা বলল এবার। হাত গুটিয়ে নিয়েছে শার্টের। মারমুখী ভঙ্গি। বেঞ্চের পাশে বসা লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে, এই লোক কার পক্ষে কথা বলবে বুঝতে পারছে না রাশেদ।
উত্তর দিতে একটু সময় নিলো রাশেদ। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। লোকটা গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাইছে। বেঞ্চে বসা লোকটা হয়তো একই সাথের। এমনকি হতে পারে, এরা গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়ে তার হাত থেকে ট্রাভেল ব্যাগটা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। অসম্ভব কিছু নয়। প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রাশেদ। মানিব্যাগ থেকে দোকানদারের বিল মিটিয়ে দিল। লোকটা এখনো মারমুখি ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।
এবার এখান থেকে চলে যেতে হবে, এর সাথে ঝামেলা না করেই, ভাবল রাশেদ।
‘কি, কথা কন না ক্যান?’ আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা।
উত্তর দিলো না রাশেদ। পাশ দিয়ে বের হতে চাইছে সে এখন।
রাশেদের কাঁধে হাত দিলো লোকটা।
‘বেয়াদব, কই যাস উত্তর না দিয়া?’
হাসল রাশেদ, ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ বাঁকা করল বলা ঠিক হবে। কাঁধের উপর থেকে নামিয়ে দিল হাতটা আস্তে করে।
এবার পেছন থেকে অন্য কাঁধে হাত দিলো বেঞ্চে পাশে বসা লোকটা। ঘুরে দাঁড়াল রাশেদ। সরাসরি একটা ঘুষি বসিয়ে দিল লোকটার নাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় এমনিতেই বোকা হয়ে গেছে কালো লোকটা, নাকের উপর এধরনের একটা আঘাত আশা করেনি। নাকটা ভেঙে গেছে মনে হলো রাশেদের। বসে পড়েছে লোকটা। মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আবার ঘুরলো রাশেদ। এবার একে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু সাথে সাথেই বুঝল চালে ভুল হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। এখন পালাতে হবে। কারন আরো তিনজন কোত্থেকে চলে এসেছে এর পাশে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সোজা দৌড় দিল রাশেদ। দ্বিগবিদিক ভুলে।
প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটছে এসব। দোকানী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এতে ছোট কারনে এ ধরনের ঝগড়া হতে পারে ধারনাতেও ছিল না তার। আশপাশে পুলিশ নেই। তবে, জাতীয় জাদুঘরের গেটে এবং এর উল্টোদিকে সবসময়ই কিছু পুলিশ সদস্য থাকে।
প্রানপনে দৌড়াচ্ছে রাশেদ। সামনেই জাতীয় জাদুঘর, সেখানে পুলিশ আছে। কিন্তু সেখানে যাওয়া যাবে না। তাহলে এমনিতেই গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। চারজন লোক ধাওয়া করছে তাকে। তবে মনে হচ্ছে এদের কারো হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। রাস্তার লোকজন কৌতূহলি দৃষ্টিতে দেখছে এই ধাওয়া। এবার উল্টোদিকে ঘুরে কাটাবনের দিকে দৌড় দিল রাশেদ। ধাওয়াকারীরাও পিছু ছাড়ল না। রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করছে, বাস, প্রাইভেট কার কিংবা মাইক্রোবাসের অভাব নেই। এর মধ্যেই ছুটে চলেছে রাশেদ। পুলিশের চোখে এখনো পড়েনি। পড়লে চারজনকেই ধরা পড়তে হবে তাতে সন্দেহ নেই কারো। কিন্তু ধাওয়াকারীদের ভুক্ষেপ নেই সেদিকে। রাশেদকে তারা ধরবেই যে কোন মূল্যে।
কাঁটাবনের মোড় একটু সামনে। সেখানে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, যদিও এদিকে নজর পড়েনি ওদের এখনো। হাঁপাচ্ছে রাশেদ। পিঠের উপর ব্যাগটাকে মনে হচ্ছে কয়েক মন ওজনের একটা বস্তা। কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। যেকোন সময় ধরে ফেলবে। এই সময় পাশেই মাইক্রোবাস দাঁড়াল একটা। দরজাটা খুলে গেল। একটা হাত বের হয়ে এলো ভেতর থেকে। রাশেদের দিকে বাড়ানো। কোনদিকে তাকানোর সময় নেই রাশেদের। আগে এই ধাওয়াকারীদের হাত থেকে বাঁচা দরকার। ঢুকে গেল সে মাইক্রোবাসটায়। দরজা বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে।
চোখে প্রথমে অন্ধকার দেখছিল রাশেদ, বাইরে সূর্যের আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকারে চলে আসার কারনে। হাত বাড়িয়েছে যে লোকটা তাকে চিনতে পারেনি সে। বয়স্ক একজন মানুষ। তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে। পাশে বসা লোকটাকে অবশ্যই চিনতে পেরেছে রাশেদ। ড. আরেফিন।
‘দুঃখিত রাশেদ, দেরি করার জন্য,’ ড. আরেফিন বললেন।
কিছু বলল না রাশেদ। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি এখনো।
‘পরিচিত হও, ইনি ড. শাখাওয়াত। আমার সিনিয়র কলিগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন,’ পাশের লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ড. আরেফিন।
হাত বাড়িয়েছে ড. শাখাওয়াত নামের লোকটা। রাশেদও হাত মেলালো তার সাথে।
‘আমি রাশেদ, ইউনিভার্সিটিতে—’
‘শুনেছি সবকিছু ড. আরেফিনের কাছ থেকে, রাশেদ কথা শেষ করার আগেই বললেন ড. শাখাওয়াত।
‘পরিচিত হয়ে ভালো লাগল,’ বলল রাশেদ। মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে দিলো। মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে ড. আরেফিনের উপর। এই শাখাওয়াত লোকটা সব জানে! কেন জানে! কি প্রয়োজন ছিল জানানোর!
***
বহুদিন পর নতুন কাজের আসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে তাকে। বসের কৃপা। কাজ তো সে খারাপ করেনি। তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই তো শামীমকে ধরা হয়েছিল। এমনকি শামীম যে তার বন্ধুর কাছে ব্যাগটা রেখেছে সে খবরও তো সেই দিয়েছিল বসকে।
এবারের কাজটা জটিল কিছু না। একটা মেয়ের উপর নজর রাখতে হবে। কি করে, কোথায় যায়, কার সাথে মেশে এইসব আর কি। এগুলো তার বা’হাতের খেলা। বস তার কিছু শিষ্যদের নিয়োগ দিয়েছিল আগে। কিন্তু নজর রাখার ব্যাপারে ওরা মোটেও পেশাদার না। বিশাল কোন ব্যক্তির বাড়ির সামনে কিভাবে ঘোরাফেরা করতে হয় তাও জানা ছিল না ওদের দু’একজনের। ফলে সন্দেহজনক আচরনের জন্য একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মেয়েটাই হয়তো জানিয়েছিল পুলিশকে। তা না হলে সামান্য ঘোরাফেরা করার জন্য কাউকে সহজে গ্রেফতার করে না পুলিশ।
যাই হোক, এখন মেয়েটাকে আবার অনুসরন করতে হবে। তারপর একটা রিপোর্ট দিতে হবে বসের কাছে। এর পরিণতিও কি শামীমের মতো হবে কি না কে জানে।
মেয়েটা যে একেবারে অপরিচিত তাও না। এর আগেও এই মেয়ের পিছু নিতে হয়েছিল। তখন মেয়েটার সাথে ছিল শামীমের বন্ধুটা, রাশেদ নাম বোধহয় ছেলেটার।
ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে এসেছে মেয়েটা। ডাক নাম লিলি। আসল নাম এখনো জানা হয়নি। সারাদিন সাদা গাড়িটা নিয়ে ভার্সিটিতে টহল মারাই কাজ হয়ে গেছে লোকটার। কারন মেয়েটা ক্লাস করার জন্য বের হয় শুধু। বিকেলে ফেরে বাসায়। তারপর আর কোথাও বের হয় না। টানা সাতদিন হয়ে গেছে নজর রাখছে সে।
দুপুরে একটু যখন ঝিমঝিম লাগছিল, তখন কলাভবন থেকে মেয়েটাকে বের হয়ে আসতে দেখল লোকটা। কেমন বিমর্ষ, মনমরা ভাব। আজ কি ক্লাস শেষ? এখান থেকে কোথায় যাবে মেয়েটা? পিক করার জন্য গাড়ি আসার কথা আরো পরে। সবকিছু একই রকম চলছে গত সাতদিন। আজ অন্যরকম হওয়ার কারন কি?
যাই হোক, গাড়িটায় স্টার্ট দিলো লোকটা। মেয়েটার পিছু ছাড়া যাবে না। আজই হয়তো সুযোগ। বসকে জানাতে হবে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো সে।
*
অধ্যায় ১৮
নেপাল সীমান্ত বেশি দূরে নয়। অনেকটা পথ হেঁটেছেন তিনি। টানা চারদিন। কিন্তু এর মধ্যে রামপ্রসাদের টিকিটিও চোখে পড়েনি তার। ঠিক পথে চলেছেন না ভূল পথে তাও বোঝা যাচ্ছে না।
সীমান্তবর্তী একটা গ্রামে এসে থামলেন তিনি। ভেতরে ঢোকেননি এখনো। একটা উপত্যকায় ছোট একটা গ্রাম। ছোট একটা টিলা মতোন জায়গা থেকে গ্রামটাকে দেখছেন তিনি। পুরো বরফে ঢাকা। মানুষজন তেমন একটা চোখে পড়ছে না। নেপাল দিয়ে যেতে হলে এই গ্রাম অবশ্যই পার হতে হবে রামপ্রসাদকে। সেই ক্ষেত্রে গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক সুবিধা হতো। কিন্তু গায়ের রঙ এবং ভাষাটাই সমস্যা। তিব্বতী কিছু কিছু জানেন তিনি, কিন্তু নেপালের ভাষা একদমই অজানা। এরা ভারতবর্ষের কাছাকাছি থাকার কারনে হিন্দীটা ভালো বোঝে। হিন্দীতে চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারন ভারতবাসীর মতো চেহারা নয় তার।
কিছু খাবার নিয়ে এসেছিলেন তিনি, ছোট একটা ব্যাগে করে। দুই টুকরো রুটি এখনো অবশি আছে। পানি আছে অল্পই। যদিও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হন না, তারপরও একেবারে কিছু না খেয়ে থাকলে শারীরিক শক্তি কিছুটা হলেও হাস পায়।
বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসলেন তিনি। সূর্য এখন মধ্যগগনে থাকার কথা। ঠিক দুপুর এখন। কিন্তু আকাশ মেঘলা। অল্প অল্প তুষারপাত হচ্ছে। আলো অনেক কম। একটুকরো রুটিতে কামড় বসালেন তিনি। জমে শক্ত হয়ে গেছে প্রায়। দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা।
একঢোক পানি খেয়ে খাওয়া শেষ করলেন তিনি। মাথাটা এলিয়ে দিলেন। ঘুম আসছে। টানা চারদিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত। ঘুম হয়নি ঠিকমতো। এখন একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। কিন্তু ঘুম এলো না, তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু চোখে হারিয়ে গেলেন তিনি, অনেক অনেক আগের কোন এক সময়ে, কোন এক দিনে।
* * *
সময়টা খৃস্টপূর্ব ১৩৪৫। স্থান আখেতাতেন (বর্তমান নাম আমারনা), মিশর, নতুন একটা শহর। দেবী আতেনের সম্মানে শহরটা নির্মান করেছেন বর্তমান ফারাও আখেনাতেন। তার পূর্ব নাম চতুর্থ আমেনহোটেপ । তার শাসনকাল চলছে মিশরে। ফারাও হিসেবে খুব বেশি জনপ্রিয়তা এখনো অর্জন করতে পারেননি তিনি। এর কারন হিসেবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংস্কারকে দায়ি করা যায়। সনাতন পদ্ধতিতে অনেক দেব দেবীকে পূজা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সাধারন মিশরীয়দের জীবন। তিনি সেখানে একজন মাত্র দেবী পূজার আবির্ভাব ঘটান। দেবীর নাম আতেন। সূর্যের দেবী তিনি।
প্রাসাদে গা এলিয়ে বসে আছেন আখেনাতেন। শয়নকক্ষে যাওয়ার পথে এটা হচ্ছে তার বিশ্রাম কক্ষ। একটু পর প্রিয় একজন মানুষ আসবে সেই অপেক্ষায় আছেন। স্ত্রী হিসেবে নেফারতিতির যোগ্য আর কেউ নেই তার কাছে। কিয়া যদিও সুন্দরি। কিন্তু নেফারতিতি একই সাথে বুদ্ধিমান, একজন ফারাওয়ের যোগ্য সহধর্মিনী।
নেফারতিতি বয়স মাত্র পঁচিশ। কিন্তু এই বয়সেই একটা রাজ্য চালানোর মতো প্রজ্ঞা ধারন করে সে। রাস্ট্রের যেকোন বিষয় নিয়ে নির্দ্বিধায় তার সাথে আলোচনা করেন ফারাও। সিদ্ধান্ত নেন স্ত্রীর কথার উপর ভিত্তি করে।
তন্দ্রা মতো আসছিল তার। দুপাশে দুজন প্রহরী পাখায় বাতাস করে যাচ্ছে। হঠাৎ নাকে একটা সুবাস পেলেন তিনি। বুঝতে পারলেন আসছে তার প্রিয়তমা, নেফারতিতি। চোখ খুলে উঠে বসলেন তিনি।
‘এসো, প্রিয়ে, তোমার অপেক্ষায় ছিলাম,’ বললেন ফারাও, গলায় যতটা সম্ভব মধু ঢেলে দিয়ে।
কক্ষে প্রবেশ করেছে নেফারতিতি। যেন আলো হয়ে গেছে চারদিক। দীর্ঘ কোমল দেহ, পরনে রাজকীয় পোষাক, টানা কাজল চোখ, আবারো অভিভূত হয়ে গেলেন ফারাও। নেফারতিতি নামের অর্থ সুন্দরি নারী, নামটা আসলে সার্থক, ভাবলেন ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ।
‘মহামান্য,’ স্বামীর পাশে এসে বসেছেন নেফারতিতি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আস্তে করে।
‘বলো,’ ফারাও বললেন।
‘আজ যে সুগন্ধিটা ব্যবহার করেছি তা কি চিনতে পেরেছেন?’
আমতা আমতা করলেন ফারাও। ‘গন্ধটা সুন্দর। কিন্তু পৃথক কিছু আছে কি না বুঝতে পারলেন না।‘
‘জানি আপনি পারবেন না বলতে, এই শহরেই দুর্দান্ত এক লোক আশ্চর্য এই সুগন্ধি বানিয়েছে, নেফারতিতি বললেন।
‘কে? আমি চিনি?’
‘থুতমসকে তো চেনেনই, তার এক সহকারী, নতুন এসেছে কাজে।’
‘চলো থুতমসের কাছে, বেশি দূরে তো নয়।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ, তোমার একটা প্রতিকৃতি বানাতে বলেছি তাকে, কাজটার কি অবস্থা দেখে আসাও হবে তাহলে।‘
‘আপনি এখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, এরমধ্যেই বাইরে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, তোমার প্রতিকৃতিটা কেমন বানিয়েছে দেখতে খুবই ইচ্ছে করছে আমার,’ ফারাও বললেন।
কথা বাড়ালেন না নেফারতিতি। উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীকে চেনেন তিনি। একবার কোন কথা বলে ফেললে তার নড়চড় হবার কোন উপায় নেই।
দুজনে বেড়িয়ে এলেন বাইরে। ঘোড়ার গাড়ি তৈরিই থাকে। সাথে কিছু সৈন্য। রওনা হয়ে গেলেন তারা। বেশিদূর নয়, কাছেই প্রিয় থুতমসের বাসা।
ভাস্কর থুতমস অবিবাহিত। কৃশকায় কিন্তু অনেক লম্বা। হাতগুলোও অনেক লম্বা সাধারন মানুষের তুলনায় এবং আঙুলগুলো চিকন। শিল্পীর আঙুল। অনেক শিল্পকর্মের পেছনে রয়েছে এই আঙুলের নিপুন ছোঁয়া। কিন্তু এখন কিছুটা বয়স হয়েছে। শরীর আগের মতো চলতে চায় না। তাই একজন সহকারী নিয়েছেন। সহকারী লোকটাও খুব কম বয়সী কেউ নয়। পয়তাল্লিশের কম হবে না বয়স। কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখ, আর খাড়া নাক, দেখেই বোঝা গিয়েছিল একে দিয়ে কাজ হবে। এখন কাজের অনেকটাই করে এই সহকারী লোকটা, হোরাস নাম লোকটার। বাবা-মার পরিচয় জানেন না। আগে কোথায় ছিল, কি করতো কিছুই জানেন না থুতমস। প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করলে কোন না কোন ভাবে এড়িয়ে যায়। তাই প্রশ্ন করা বাদ দিয়েছেন।
ফারাওয়ের পরিবারের কিছু ভাস্কৰ্য্য করছেন থুতমস। বিশাল বড় বাড়ী তার। মাঝখানের বড় রুমটা হচ্ছে তার প্রদর্শনী কক্ষ। পাশাপাশি যে কক্ষগুলো আছে সেগুলোতে কাজ করেন তিনি। একেককক্ষে একেকটা ভাস্কর্য নিয়ে কাজ করেন, যাতে একটার প্রভাব আরেকটাতে না পড়ে যায়। ফারাও নিজের কোন ভাস্কৰ্য্য বানাতে দেননি। ভাস্কৰ্য্য করতে হচ্ছে তার দুই স্ত্রী এবং সন্তানদের। নেফারতিতি আলাদাভাবে হুমকি দিয়ে গিয়েছে এর মধ্যে, যেন তার ভাস্কৰ্য্যটা ভালো হয়, ফারাওয়ের অপর স্ত্রী কিয়ার ভাস্কর্য্যের চেয়ে। অনেক মাথা খাটাতে হচ্ছে এজন্য থুতমসকে। কিন্তু কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে তার সহকারী, হোরাস। বিশেষ একধরনের রঙ তৈরি করা হয়েছে নেফারতিতির ভাস্কৰ্য্য টার জন্য। এই রং কিয়ার ভাস্কর্যে ব্যবহার করা হবে না। তাতেই নেফারতিতির মন রক্ষা করা যাবে। কে না জানে, মিশরে ফারাওয়ের পর এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হচ্ছে তার স্ত্রী নেফারতিতি। যদিও আরো চারজন স্ত্রী আছে। তার, কিন্তু নেফারতিতিই সবার সেরা, সবার প্রিয় এবং সবচেয়ে সুন্দরি।
বাড়ির সামনে ছোট প্রবেশপথটা দিকে তাকিয়ে আছেন থুতমস। বিকেল হবো হবো করছে। কিন্তু সূর্যের তাপ কমেনি এখনো। প্রবেশপথটায় ছোট একটা নামফলক লাগানো হয়েছে গতকাল। নিজের হাতেই তৈরি করেছেন থুতমস নামফলকটা।
হোরাস এখনো কাজ করছে, ভেতরে তাকিয়ে দেখলেন গুতমস। শেখার দারুন আগ্রহ লোকটার। ভাস্কৰ্য্য ছাড়াও সুগন্ধী তৈরিতেও হোরাসের নিপুন দক্ষতা আছে, যার প্রমান এর মধ্যেই পেয়েছেন তিনি। আলাদা একটা কক্ষ তাই ছেড়ে দিয়েছেন তাকে, সুগন্ধী নিয়ে কাজ করবার জন্য। নেফারতিতিকে একটা সুগন্ধী বানিয়ে দিয়েছে লোকটা। এমনই সুগন্ধী সেটা, যে কেউ প্রশংসা করতে বাধ্য হবে।
থুতমস একটু অবাক হলেন প্রবেশ পথে অতিথিদের দেখে। যেন তেন কেউ না, একেবারে রাজকীয় অতিথি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন থুতমস। মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলেন ফারাওকে। পাশে বসে থাকা তার সুন্দরি স্ত্রীকেও সম্মান জানাতে ভুললেন না।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসেছেন ফারাও, পাশে নেফারতিতি।
থুতমস এগিয়ে গেল সামনে।
থুতমস, তোমার কাজ কতদূর?
মহামান্য ফারাও, আগামী চাঁদের আগেই শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি, থুতমস বললেন, খুবই অনুগত সুরে।
‘আগামী চাঁদ? সে তো বেশ দেরি। যাই হোক, তোমার এখানে সুগন্ধী বানায় কে?’
ভয় পেয়ে গেলেন থুতমস। হোরাসের কথা ফারাও জানলো কি করে? কোন অপরাধ করেছে তার সহকারী? ফারাও যখন কাউকে খোঁজেন তার ভাগ্যে থাকে অঢেল সম্পদ অথবা তার গর্দান যায়। সারাজীবন তাই দেখে এসেছেন তিনি।
‘মহামান্য ফারাও, হোরাস নাম লোকটার।’
‘ডাকো তাকে,’ ফারাও বললেন।
তড়িঘড়ি করে ভেতরে চলে আসলেন থুতমস। কি জানে কি আছে কপালে।
হোরাস একটা ভাস্কর্যের উপর কাজ করছিল, থুতমস পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি সে। কাজটা প্রায় শেষের পথে। গভীর মনোযোগ দরকার এখন। ফারাও পরিবারের সদস্যের ভাস্কর্য। একটু এদিক-সেদিক হওয়ার উপায় নেই।
‘হোরাস,’ চাপা গলায় ডাকলেন থুতমস।
পেছন ফিরল হোরাস। ‘কিছু বলবেন?’
‘তাড়াতাড়ি এসো।’
‘কেন? ফারাও এসেছে?’ জিজ্ঞেস করল হোরাস।
অবাক হলেন থুতমস। ফারাও এসেছে কিভাবে জানলো হোরাস? আন্দজে ঢিল ছুঁড়েছে! এই লোকটাকে আরেকবার রহস্যময় বলে মনে হলো তার কাছে।
ফারাওয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে হোরাস। পাশে থুতমস। রাণী হাসছেন মিটিমিটি। যেন মজার কিছু ঘটতে চলেছে।
‘হোরাস নাম তোমার?’ জানতে চাইলেন ফারাও।
‘মহামান্য ফারাও, অধমের নাম হোরাস, আপনার সেবায় হাজির।’
‘হোরাস, তুমি নাকি ভালো সুগন্ধি বানাতে পারো?’ ফারাও জিজ্ঞেস করলেন।
‘মহামান্য ফারাও, খুব ভালো পারি না, চেষ্টা করি,’ হোরাস বলল, যতোটা ভাবে বলা যায়।
‘আমার স্ত্রী তোমার সুগন্ধীতে মুগ্ধ, তাই তোমাকে পুরষ্কার দেবো ঠিক করেছি।’ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল হোরাস। বলার কিছু নেই এই ক্ষেত্রে।
‘পুরস্কার হচ্ছে, রাজপ্রাসাদেই থাকার ব্যবস্থা হবে তোমার, সেখানে নিত্যনতুন সুগন্ধী তৈরি করে দেবে আমার স্ত্রীকে, এছাড়া অর্থ দেয়া হবে তোমাকে যা তোমার ধারনার বাইরে।
‘মহামান্য ফারাও, আমি এখানে এসেছি আমার গুরুর কাছ থেকে ভাস্কর্যের উপর শিক্ষা নিতে, এখান থেকে যেতে হলে তার অনুমতি প্রয়োজন হবে আমার,’ হোরাস বলল, তাকাল থুতমসের দিকে।
‘আমার কোন আপত্তি নেই হোরাস, তুমি যেতে পারো, তবে মহামান্য ফারাওয়ের নিকট আবেদন, কিছু ভাস্কর্যের উপর কাজ চলছে, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার এখানে থাকার অনুমতি দিন তাকে, থুতমস বললেন।’
‘ঠিক আছে, ভাস্কর্য গুলো শেষ করো তাড়াতাড়ি,’ ফারাও বললেন। নেফারতিতির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
নেফারতিতির চোখ তখন অন্যদিকে। হোরাসের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এই দৃষ্টিটা হোরাসের পরিচিত। আহবান আছে যেন এই দৃষ্টিতে, যেন ডাকছে কাছে যাওয়ার জন্য। চোখ নামিয়ে নিলো হোরাস। নেফারতিতির মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে। জীবনে অনেক নারীর সান্নিধ্যে আসা হোরাসের কাছে নারীর এই মনোভাবটা অজানা নয়। ফারাও হয়তো তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য তাকে আমন্ত্রন করেছে, কিন্তু এই আমন্ত্রনটা গ্রহন করা হবে চরম বোকামি। এখান থেকে চলে যেতে হবে তাকে এবং সেটা খুব শিগগিরই।
ফারাও এবং নেফারতিতি চলে যাওয়ার পর থুতমসের দিকে ফিরল হোরাস। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন থুতমস রাজকীয় অতিথিদের গমন পথের দিকে।
‘মহামান্য থুতমস, আপনার কাছে আমি ঋনী, অনেক কিছু শিখেছি আপনার কাছ থেকে,’ হোরাস বলল।
‘এভাবে বলছো কোন প্রিয় হোরাস, তোমাকেও আমার বিশেষ দরকার।’
‘রাণীর ভাস্কর্যের জন্য বিশেষ ধরনের রঙ তৈরি করেছি, যা তার ভাস্কর্যে ব্যবহার করার উপযুক্ত হয়েছে এখন,’ একটু থামল হোরাস, আজ সূর্য ডোবার সাথে সাথেই চলে যাবো, আপনি বলবেন আমি পালিয়েছি, দূর কোন দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি, কিন্তু একজন রাজার বাধ্যগত চাকর হিসেবে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
একটু অবাক হলেন থুতমস। এধরনের লোভনীয় প্রস্তাব কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে কল্পনাই করতে পারেননি তিনি। এই লোকটা অন্যরকম, শুরুতেই বুঝেছিলেন। কিন্তু এতোটা ব্যতিক্রম ধারনা করতে পারেননি।
এর কিছুক্ষন পরই হারিয়ে গেল হোরাস, চিরতরে, আমারনা কিংবা মিশরে আর কখনো দেখা গেছে বলে শোনা যায়নি। থুতমসের বানানো সেই ভাস্কর্যগুলো পরবর্তীতে ১৯১২ সালে জার্মানীর এক প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে বের করেছিলেন, আমারনা শহরেরই ধ্বংসস্তূপে, তারমধ্যে নেফারতিতির ভাস্কৰ্য্যটা খুবই উল্লেখযোগ্য।
* * *
তন্দ্রা কেটে গেল হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে। তার কান খুবই সজাগ, চারপাশে তাকালেন, কিছুই চোখে পড়লো না। তিনহাজার বছর আগের একটা সময়ে চলে গেছিলেন, তার রেশ এখনো রয়ে গেছে মনে। চোখে ভাসছে সুন্দরি নেফারতিতির সেই অদ্ভুত দৃষ্টি, ফারাও আখেনাতেনের রাজকীয় ভঙ্গি। হারিয়ে গেছে সব কালের গর্ভে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিছুটা চাঙ্গা লাগছে। রওনা দেয়া দরকার। যতোই দেরি করবেন রামপ্রসাদ তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। সেটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না। পৃথিবীর যেখানেই যাক না কেন, রামপ্রসাদ ধোঁকা দিতে পারবে না।
*
অধ্যায় ১৯
তিনদিন ধরে জয়নালের কোন খবর নেই। একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে যেন লোকটা। আজিজ ব্যাপারি আছেন মহা ঝামেলায়। সবসময়ের জন্য বিশ্বস্ত একজন লোক দরকার। জয়নাল বেশ ভালো সামলে নিয়েছিল। এছাড়া যথেষ্ট বিশ্বস্তও ছিল লোকটা। ওর ছেলেটাকে দোকানে বসিয়েছেন আজিজ ব্যাপারি। বাপ কোথায় গেছে বিন্দুমাত্র ধারনাও নেই ছেলেটার। হাজারহোক একজন চেয়ারম্যান এখন তিনি। খাসলোক যদি না থাকে তাহলে মানইজ্জত বলে কিছু থাকে না। নিজের ছাতা যদি নিজেকেই বহন করতে হয়, তাহলে আর কিসের চেয়ারম্যান। এরচেয়ে ডুবে মরা অনেক ভালো।
বৈঠকখানার সামনে বসে আছেন আজিজ ব্যাপারি। লোকজন কম। দোকান থেকে একজন কর্মচারি নিয়ে এসেছেন। সবাইকে চা-নাস্তা দিচ্ছে সেই ছেলেটা। কিন্তু একেবারে অকাজের। এরমধ্যে তিনটা চায়ের কাপ ভেঙেছে। ইদানিং চেয়ারম্যানের কাজটাও ভালো লাগছে না তার। সম্মান আছে, কিন্তু শক্ররও অভাব নেই। সারাজীবন রাজনীতিও করেননি,কাজেই মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে তার। এক শ্রেনির লোক সারাক্ষন মোসাহেবি করে কাজ বাগিয়ে নিতে চাচ্ছে, আরেক শ্রেনি আছে যারা সুযোগ খুঁজছে কিভাবে তাকে ফাসানো যায়। এরচেয়ে গঞ্জে দোকানদারি ছিল সেটাই ভালো ছিল।
অন্যসব দিনের মতো উঠোনের ঠিক মাঝখানটায় বুড়ো বাপকে বসে থাকতে দেখল সে। বসে আছে, স্থির, অনড়, তাকিয়ে আছে, কিন্তু দৃষ্টিতে কোন প্রান নেই। এতোটা বয়স হয়েছে, শুধুমাত্র শারীরিক শক্তি কমেছে, এছাড়া হার্ট, কিডনি কোথাও কোন সমস্যা নেই।
উঠে দাঁড়ালেন আজিজ ব্যাপারি। মন বসছে না কিছুতেই। ছেলেটার কোন খবর নেই। নিজেই একবার ঢাকা ঘুরে আসবেন কি না ভাবছেন তিনি। তাতে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
দূরে কোথাও হৈ চৈ হচ্ছে শুনতে পেলেন আজিজ ব্যাপারি। বৈঠকখানায় যারা বসে আছে তারাও শুনতে পেয়েছে। বের হয়ে এসেছে সবাই বৈঠকখানা থেকে। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে বুঝতে পারলেন ব্যাপারি। দল বেঁধে লোকজন তার এখানেই আসছে। সবার চেহারায় উত্তেজনা এবং ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। এমন কিছু করেননি চেয়ারম্যান হবার পর থেকে, যাতে কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কাজেই মনে মনে তৈরি করে নিলেন নিজেকে। যাই হোক না কেন, নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। এই সময় জয়নালের প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। একাই দাঁড়িয়ে যেতে পারতো সবার বিরুদ্ধে। গলা পরিস্কার করে নিলেন আজিজ ব্যাপারি। যে কোন ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত। কিন্তু যে খবরটা এলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
এই দলটার নেতৃত্বে আছে নছু মোড়ল। হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে, দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন আজিজ ব্যাপারি। নতুন করে কোন সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করছে লোকটা। তিনি চেয়ারম্যান হওয়াতে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি নছু মোড়ল, কথাগুলো কানে এসেছে তার। লোকটা সুযোগসন্ধানী, ছিদ্রান্বেষী। কোন খুঁত পেলেই তার পিছু লাগবে এটা খুব ভালোই জানেন আজিজ ব্যাপারি।
বাড়ির সামনে চলে এসেছে দলটা। হাত ইশারায় ওদের থামতে বললেন আজিজ ব্যাপারি। একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ওদের সামনে।
‘ঘটনা কি, তোমরা দলবল নিয়া কই যাও?’ জিজ্ঞেস করলেন আজিজ ব্যাপারি। সবার দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করেছেন তিনি, কিন্তু উত্তরটা দেবে নছু এটা নিশ্চিত তিনি।
‘ঘটনা তো মারাত্মক, এই রকম কান্ড বাপের জন্মে দেহি নাই,’ ব্যাপারির ধারনা ঠিক করে উত্তরটা নছু মোড়লই দিল।
‘কি এমন কান্ড হইছে যা জীবনে দেহ নাই,’ আজিজ ব্যাপারি বললেন, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেী করলেন।
‘উত্তরের বন্ধে গিয়া দেইখ্যা আসেন, তারপর ব্যবস্থা নেন,’ এবার পাশ থেকে বলল আরেকজন।
উত্তরের বন্ধে কি আছে, কৌতূহলি হয়ে উঠলেন আজিজ ব্যাপারি। ভালো কিছু নয় নিশ্চয়ই?
‘পারলে সাথে পুলিশ নিয়া যান,’ এবার অন্যএকটা কণ্ঠ শোনা গেল।
পুলিশ নিয়ে যেতে হবে? তাহলে কেস মারাত্মক। থানা এখান থেকে অনেকদূর, সেই উপজেলা সদরে। সেখান থেকে পুলিশ আসতেও সময় লাগবে। কিন্তু ততক্ষন অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
‘পুলিশরে জানাইছি, তারা রওনা দিছে, আমি আগে যাই, কিন্তু তার আগে জানা দরকার কি ঘটছে যে তোমরা এতো ব্যস্ত হয়ে গেছো?’ ছোটখাট দলটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন আজিজ ব্যাপারি। ইতিমধ্যে থানার ওসিকে মোবাইল করে আসতে বলে দিয়েছেন তিনি।
সবাই চুপ। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
‘খুনের ঘটনা ঘটছে,’ নছু মোড়ল বলল অবশেষে, তোমার ডাইন হাত, জয়নালরে ঘাড় মটকাইয়া মাইরা রাখছে উত্তরের বন্ধে, দেইখ্যা আসো, মাথা একদিকে আর শরীর আরেকদিকে।
বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে গেল আজিজ ব্যাপারির। জয়নালের মৃত্যু সংবাদ আশা করেননি তিনি। যে লোকটা এতো সাহসী তার ঘাড় মটকে মেরে ফেলেছে কেউ। ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। জয়নালের শরীরেও ছিল অসুরের মতো শক্তি। যে তাকে এভাবে ঘায়েল করেছে, সে তাহলে কী পরিমান শক্তি ধরে, ভাবলেন তিনি। বুকের কাছটায় ব্যথা করে উঠলো তার। গত কিছুদিনে জয়নালকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। মনে হলো সত্যি সত্যি নিজের ডান হাত খসে গেছে তার শরীর থেকে।
উত্তরের বন্ধের দিকে রওনা দিচ্ছেন তিনি। নিজের কিছু লোক এবং নছু মোড়লের সাথের লোকগুলোও পিছু নিয়েছে তার। দোকানের কর্মচারি ছেলেটা ছাতা ধরেছে। মাথায়। নিজের অজান্তেই পেছনে তাকালেন আজিজ ব্যাপারি। বৃদ্ধ বাপকে দেখলেন উঠোনের মাঝখানের চেয়ারটায় বসে বসে ঝিমুচ্ছে। কেন জানি তার মনে হলো, এসবের পেছনে এই বৃদ্ধের কোন হাত আছে।
লাশটা জয়নালের। কোন সন্দেহ নেই। ৩৬০ ডিগ্রি কোনে মাথাটা ঘুরিয়ে ফেলা হয়েছে। চোখ দুটো খোলা, রক্ত জমাট বেধে আছে সেখানে। মুখ দিয়েও অনেক রক্ত বের হয়ে পুরো পিঠ ভাসিয়ে দিয়েছে। বীভৎস দৃশ্য। আজিজ ব্যাপারি একবার তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিলেন। জয়নালের মতো সাহসী মানুষকে এভাবে কে মারতে পারে? ভূত, জ্বীন? আশপাশের সবাই জ্বীন, ভূতকেই খুনি হিসেবে মেনে নিয়েছে, কোন মানুষের পক্ষে এভাবে খুন করা সম্ভব না। এছাড়া উত্তরের এই বন্ধে অনেক অশরীরীর উপস্থিতি অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছে। কাজেই জ্বীন-ভুতের হাতেই জয়নালের প্রান গেছে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই আগত বেশিরভাগ মানুষের মনে। কিন্তু আইন-আদালত, পুলিশ তারা তো আর জ্বীন-ভূতের কথা মানবে না।
জয়নালের শক্ররও অভাব ছিল না অবশ্য। পেশাদার খুনি হিসেবে অনেকের জান নিয়ে ছিল, কাজেই কেউ প্রতিশোধ নিতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। পুলিশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন ব্যাপারি, জয়নাল তার এখানেই কাজ করতো, এছাড়া এই অঞ্চলের চেয়ারম্যানও তিনি, কাজেই চলে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
* * *
আরো একটা অপারেশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। আকবর আলী মৃধা নিজের কক্ষে বসে গজগজ করছেন। হাতে পেয়েও শিকার ছুটে গেছে। দৈবক্রমে রাশেদকে পাওয়া গিয়েছিল শাহবাগ মোড়ে। অপেক্ষা করছিল কারো জন্য। কাঁধে ঝোলান ছিল শামীমের সেই ট্রাভেল ব্যাগটা। চারজন লোক পাঠিয়েছিলেন তিনি, তৎক্ষণাৎ। তারপরও কাজ হয়নি,ব্যর্থ হয়েছে তার শিষ্যরা। রাশেদের ছবি পকেটে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমেছে। তার তিনশ শিষ্য। কাজেই খুব শিগগিরিই রাশেদের খবর আবার পাওয়া যাবে এই ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি। কিন্তু একটা জিনিস পোড়াচ্ছে তাকে, ঘটনাস্থলে আরো একজন ব্যক্তির উপস্থিতি। এই লোকটা এর আগেও রাশেদকে নিয়ে পালিয়েছিল, পরেরবার সময়মতো উপস্থিত হয়েছে একটা মাইক্রো নিয়ে। এই লোকটার পরিচয়ও জানতে হবে, তাহলে রাশেদকে বের করা খুব কঠিন হবে না।
ড. কারসনকে আপাতত ড্রাগ দিয়ে রাখা হচ্ছে। সারাক্ষন ঘুমের মধ্যে আছে লোকটা। পত্রিকায় খবর বের হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উঠে পড়ে লেগেছে ড. কারসনকে উদ্ধার করার জন্য। কাজেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে আকবর আলী মৃধাকে। শিষ্যদের মধ্যে অল্প কয়েকজন জানে, বেশি লোক জানলেই সমস্যা।
আরো অনেক কিছু নিয়ে কাজ করছেন আকবর আলী মৃধা। নিজের অস্তিত্ব এবং লুসিফারের চেতনা আরো বড় আকারে ছড়িয়ে দেয়ার প্ল্যান করছেন তিনি এখন। সেজন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন। সফটওয়্যার তৈরির কাজ চলছে। সেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করবে, দলের কর্মসূচী সম্পর্কে জানবে, অংশগ্রহন করবে। পুরো সংগঠনটা সাজানো হবে একটা মাকড়শার জালের মতো করে। মাঝখানে থাকবেন তিনি। সেই সংগঠনের মাধ্যমে একসময় পুরো বাংলাদেশের উপর কজা করতে হবে। আস্তে আস্তে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হবে পুরো পৃথিবীময়। কিন্তু এতে সময় লাগবে অনেক। এক জীবনে এতো বড় একটা কাজ শেষ করে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখন দরকার অস্বাভাবিক কিছু। যা স্বাভাবিক জীবনকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। সেই প্রাচীন বই, যার মর্ম তিনি বুঝতে পারেননি,তাই হেলাফেলা করে লুকিয়ে রেখেছিলেন সোফার নীচে। রাগে-দুঃখে এখন মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়।
‘হ্যাল্লো, কি খবর বলো?’ আকবর আলী মৃধা বললেন।
‘ওস্তাদ, আর কতোদিন পিছে পিছে ঘুরমু, এবার নতুন কিছু দ্যান,’ ওপাশ থেকে বলল লোকটা।
‘আমি যতক্ষন না বলবো, অনুসরন চালিয়ে যাও, ঠিক দুইদিন পর ফাইনাল রিপোর্ট দেবে আমাকে।’
‘ঠিক আছে, ওস্তাদ।’
‘ওস্তাদ বলা বন্ধ করো, এরপর আর যেন না শুনি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন আকবর আলী মৃধা।
‘ঠিক আছে, বস।’
‘আগামীকাল তোমার একাউন্টে টাকা ঢুকে যাবে, যে কাজটা করতে দিয়েছি সেটা ছাড়া অন্য কোন দিকে মনোযোগ দেবে না।’
‘ঠিক আছে।‘
রেখে দিলেন ফোনটা। এই লোকটা তার খুবই বিশ্বস্ত। আজ পর্যন্ত দুজনের দেখা হয়নি। প্রায় তিনবছর হয়ে গেল। বয়স্ক একটা লোক। একা থাকে। পরিবার-পরিজন কেউ নেই। একটা গাড়ি আছে। লোকটার কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র অনুসরন করা, তথ্য জোগাড় করা, এর বেশি কিছু না।
পায়চারী করছেন এখন আকবর আলী মৃধা। সন্ধ্যায় শিষ্যদের সাথে বসতে হবে। নতুন নতুন মুখ আসছে প্রতিদিন। লুসিফারের সেবায়। ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ফুটে উঠল তার। শুধু লুসিফারের সেবাই তার মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। আরো বড় ইচ্ছে আছে। তার। অনেক বড়।
* * *
লোকালয় এড়িয়ে চলছে সে। বরফে ঢাকা পথ, তুষারপাত, হাঁড়কাঁপানো শীত,ক্ষুধা গতকিছুদিন ধরে এগুলোই তার পথের সাথি। দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি, সাথে রাজ্যের ক্ষুধা, বড় একটা গাছের ছায়া বেছে নিয়ে বসল সে। এই অঞ্চল তার একেবারেই অচেনা। ভাষাও অপরিচিত। কিন্তু বাঁধা যাই থাকুক না কেন, এখন আর থামার উপায় নেই, পিছু ফেরার কোন পথ নেই। খাবার-দাবার সাথে নেই। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। গতকিছুদিন ভালোই ছিল সে। খাবার-দাবার, থাকার জায়গা কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু লোভের কাছে সব জলাঞ্জলী দিয়েছে সে।
আজ নিয়ে প্রায় ছয় দিন হাটছে।
সাথে দুটো বড় সুটকেস।
রামপ্রসাদ জানে মালিক পিছু নিয়েছেন। গত কিছুদিন একসাথে থাকার পর একটা দৃঢ় বিশ্বাস মনে বাসা বেঁধেছে তার। এই লোক খুব সাধারন কেউ না। অলৌকিক কোন ক্ষমতা এর অবশ্যই আছে। পালাতে গিয়ে তাই বারবার হিসেব করেছে সে। পালানোটা কি ঠিক হবে না হবে না। পালালে কখন পালাতে হবে, ইত্যাদি। কিন্তু ধৈর্যে আর কুলায়নি। তিব্বতে এসে ধারনা হয়েছিল এটাই আপাতত তাদের শেষ গন্তব্যস্থল। এখানেই হয়তো মালিক থিতু হয়ে বসবেন। ইচ্ছে ছিল আরো কিছুটা দিন অপেক্ষা কার। কিন্তু লোভ? একে জয় করা আসলেই কঠিন।
মালিক হিসেবে লোকটার তুলনা চলে না। অসাধারন একজন মানুষ। যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে রামপ্রসাদ। সেই বোম্বেতে দেখা হয়েছিল লোকটার সাথে। আগের দিন রাতে কিছু গুন্ডার সাথে হাতাহাতির কারনে সেদিন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিল রামপ্রসাদ, মুখের উপর রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল, ভেঙে গিয়েছিল পাঁজরের দুটো হাড়। নড়াচড়ারও শক্তি ছিল না। সেই সময় মালিক এসেছিল এক দেবদূতের মতো। পথে পড়া থাকা এক অচেনা মানুষকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিল। তারপর তার পিছু ছাড়েনি রামপ্রসাদ। বোঝাগুলো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সে। কিন্তু কতোদিন আর পেছন পেছন চলা যায় কাঁধে দুটো বড় বোঝা নিয়ে? অনেক অনেক বার চিন্তা করেছে সে, এই সুটকেসগুলোতে কি আছে, কি থাকতে পারে। জবাব মেলেনি। মালিককে জিজ্ঞেস করলে লোকটা শুধু হাসতো, উত্তর দিতো না। এখন বোঝ?
বেঈমানি করলে ফল ভালো হয় না, ছোট কালেই শিক্ষাটা পেয়েছিল রামপ্রসাদ। কিন্তু শিক্ষাটা ধরে রাখা হয়নি তার। এজন্য নিজের মনের কাছেই অনেক ছোট হয়ে আছে। যে লোকটা তার জীবন বাঁচিয়েছে তার সবকিছু নিয়ে পালাচ্ছে। কাজটা ঠিক হয়নি,কিন্তু এখন ছুঁড়ে মারা বর্শা আর ফেরাতে চায় না সে।
দূরে একটা হরিন চোখে পড়ল রামপ্রসাদের। বেশ তাগড়া সাইজের। পেট মুচড়ে উঠলো তার। গত কয়দিন দানাপানি পেটে কিছুই পড়েনি। সেদিন রাতে তাড়াহুরোয় বের হয়ে আসার কারনে, খাবার-দাবার জোগাড় করা যায়নি। একটু মাংস পেলে শরীরে বল পাওয়া যেতো। এই হরিনটা থেকে একটু দূরে ছোটখাট একটা হরিনের পাল চোখে পড়ল তার। বিভিন্ন আকারের হরিন আছে পালটায়। কোমর থেকে ছুরিটা বের করল সে। এই ছুরি দিয়ে শিকার করাটা হবে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সে হরিনের পালটার দিকে। সুবিধা হচ্ছে বড় বড় কিছু ঝোঁপ রয়েছে আশপাশে, তার আড়ালে অনায়াসে একজন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। ছোটখাট একটা বাচ্চা হরিন নিশানা করে এগুল সে। ছুরি দিয়ে নিশানা ভেদ করতে সে দারুন পারদর্শী। তাই বেশিক্ষন লাগল না হরিনটা শিকার করতে।
হরিণটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে বড় গাছটার নিচে চলে এলো রামপ্রসাদ। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। শুকনো কিছু পাতা জোগাড় করে রাখল। আগুন জ্বালাতে কাজে লাগবে। ছাল ছাড়িয়ে মাংস কেটে ছোট ছোট টুকরো করলো। কোমরে বাঁধা একটা ঝোলায় নিয়ে নিলো বেশিরভাগ টুকরো। পড়ে আগুনে জ্বালিয়ে খাওয়া যাবে। আপাতত দু-তিন টুকরো হলেই হবে তার। পাথর ঘষে আগুন পুড়িয়ে সে। তারপর হরিনের মাংসের টুকরোগুলো ধরল আগুনের উপর। একেবারে কাঁচা গেলে পেটে সইবে না। সময় নিয়ে মাংসগুলো পুড়িয়ে খেল সে।
পেট ভরেছে রামপ্রসাদের। কিন্তু জানে না, এই আগুন জ্বালিয়ে নিজের বিপদকেই কাছে টেনে এনেছে। দূরে তার মালিক এই ধোঁয়ার চিহ্ন দেখতে পেয়ে পথ পরিবর্তন করে এখন এদিকেই আসছে। যদিও সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই রামপ্রসাদের। খাওয়ার পর তার এখন ঘুমানো দরকার। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
* * *
অনেক দিন পর নিজের ভেতর একধরনের সজীবতা অনুভব করছেন তিনি। এতোদিন মনে হচ্ছিল সত্যি বয়স হয়ে গেছে, আর কিছুই করার নেই। কিন্তু পৃথিবীটা আবার নতুন মনে হচ্ছে। চারপাশের বাতাস, ফুল-পাখী, মাটির সোঁদা গন্ধ সবই নতুন করে অনুভব করছেন। বেঁচে থাকাটা শুধুই একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠা, উঠোনে নির্বাক, স্থানুর মতো বসে থাকা, তারপর আবার ঘুমানো। এভাবে দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন, নিজেকে আবার সজীব, ঝরঝরে মনে হচ্ছে। এখানে, সাধারন এই গ্রামে আর কতোদিন।
গ্রামে নতুন একটা ঝামেলা হয়েছে। জয়নালের লাশ পাওয়া গেছে উত্তরের বন্ধে। তা নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। যে যার মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তবে সবচে জনপ্রিয় ধারনা হচ্ছে, জয়নালের মৃত্যু হয়েছে কোন জ্বীনের হাতে। কারন, কোন মানুষই এতো সহজে একটা লোকের মাথা ঘুরিয়ে মেরে ফেলতে পারে না। উত্তরের বন্ধে সন্ধ্যার পর লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। উঠোনে বসে বসে হাসেন মজিদ ব্যাপারি। শক্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে। পরীক্ষার ফলাফলে তিনি খুব খুশি।
এই অঞ্চলের প্রতি কেমন একটা টান এসে গেছে তার। এখানেই জীবনে প্রথমবারের মতো এক নারীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন তিনি, প্রথমবারের মতো সন্তানের মুখ দেখেছিলেন, নিজের প্রথম বংশধর। এখন কিভাবে চলে যাবেন, ভাবতেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে।
জয়নাল লোকটা ছিল শক্তিশালী। কিন্তু তাকে কাবু করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি তাকে। অসুরের মতো শক্তি এখন তার শরীরে। এই অবস্থায় সারাদিন অক্ষমের মতো বসে থাকার চেয়ে কষ্টকর কাজ আর কিছু নেই।
পুলিশের কিছু লোক এসেছে। বৈঠকখানায় বসানো হয়েছে তাদের। এরকম খুন খারাপি গ্রামে-গঞ্জে হয়ই। চেয়ারম্যানের খাস লোক ছিল, তাই ধারনা করা হচ্ছে শত্রুতা করে খুনটা করেছে কেউ। আশপাশে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ। কিন্তু কেউ কিছু দেখেনি, কেউ কিছু শোনেনি।
লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মজিদ ব্যাপারি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটার অভ্যাসটা ভালোই করেছেন। কেউ বুঝতেও পারবে না সব কিছুই অভিনয়।
পুলিশের একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। প্রায় থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন মজিদ ব্যাপারি। একেবারে সেই লোকটার মতো দেখতে, দাঁড়ানো, তাকানোর ভঙ্গি। সেই তিব্বত থেকে যাকে অনুসরন করে এই শ্যামল দেশে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি বহুদিন আগে, সেই একই চেহারা। কিন্তু এ সেই লোক নয়, হতে পারে না।
‘কিছু বলবা?’ পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘না, চাচা মিয়া,’ পুলিশটা উত্তর দিল।
আস্তে আস্তে হেঁটে চলে এলেন উঠোনের বাইরে। অসম্ভব রোদ উঠেছে। চলে যাবার সময় এসে গেছে মনে হচ্ছে। এখানে কিছুই আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে। এখানে থাকলে আরো অনেক ক্ষতি হবে। নিজেকে গোপন রাখার জন্য মুখ বন্ধ করার একমাত্র কৌশলটা আর ভালো লাগছে না মজিদ ব্যাপারির। হত্যা কোন সমাধান হতে পারে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সীমানা পেরিয়ে চলে গেলেন অনেক দূরে। ইচ্ছে করছে এসব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু এখনকার দিন আর আগের মতো নেই। ইচ্ছে করলেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া যায় না। পাসপোর্ট, ভিসা, নাগরিকত্ব ইত্যাদি অনেক কিছুই চালু হয়েছে। সবাই সবার সীমানা সংরক্ষনে ব্যস্ত। কাজেই এখন অন্য কোথাও যেতে হলে অনেক চিন্তাভাবনা করে এগুতে হবে। আগে সীমানা ছিল উন্মুক্ত, যে কেউ চাইলে যে কোন দেশে যেতে পারতো, এখন তা সম্ভব না। সেজন্য লাগবে নতুন পরিচয়। লাগবে পাসপোর্ট। টাকা খরচ করলে সবকিছুই সম্ভব। এই অজ পাড়াগাঁয়ে থেকে তা জোগাড় করা সম্ভব হবে না। রাজধানীতে যেতে হবে। সেখানে নাকি সবই সম্ভব। ঢাকার বাতাসে টাকা ওড়ালে যে কোন কিছু পাওয়া যায়।
কিন্তু এখনো পুরোপুরি মনস্থির করতে পারেননি মজিদ ব্যাপারি। আগে যা হয়নি এখানে থেকে তাই হয়েছে, মায়া পড়ে গেছে জায়গাটার উপর। এখানকার শান্তশিষ্ট জীবন আর কোথাও কি পাওয়া যাবে, হয়তো না। কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার সময় চলে এসেছে। রাজধানীতেই হয়তো যেতে হবে। ঢাকা, সে কি খুব দূর? দূর বলে কি কোন কিছু তার অভিধানে আছে? হাসলেন মজিদ ব্যাপারি। নেই। এতোদূর এসেছেন তিনি, এখন দূরকে ভয় পেলে চলবে?
*
অধ্যায় ২০
বাড়িটা একটা প্রাসাদের মতো। সামনে বিশাল বাগান। মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার শেষ মাথায় সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠে বাসায় ঢোকার দরজা। দরজাটা কাঠের তৈরি, অনেক পুরানো এবং নানা নকশাকাটা। ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল এলাহী কান্ড। নিচে বসার জায়গা। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি চলে গেছে দোতলায়। দুপাশে সারি সারি রুম। বসার জায়গাটা সাজানো দারুনভাবে। মনে হয় পুরানো কোন জমিদার বাড়ি এটা। নতুন করে আবার সাজানো হয়েছে। বসার জায়গাটা শৌখিন এবং দামি সব আসবাবপত্রে সাজানো। দেয়ালে ঝুলে আছে স্টাফ করা বিভিন্ন প্রানীর মাথা। ভালুক, হরিন, বাঘ সবই সাজানো আছে সারি করে। উপরে ঝুলছে ঝাড়বাতি।
মাইক্রোবাসে করে কিছুক্ষন আগে এখানে এসে পৌঁছেছে রাশেদ। বেশিক্ষন হয়নি। সোফায় বসে আছে। একপাশে ড. আরেফিন, উল্টোদিকে ড. শাখাওয়াত।
ড. শাখাওয়াতকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে নিয়েছে রাশেদ। ভদ্রলোক বশানুক্রমিক বড়লোক, খানদানী। এদের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিল। জমিদারী নেই এখন, কিন্তু সেই হাব-ভাব রয়ে গেছে। একটা পাইপ ধরিয়েছেন ড. শাখাওয়াত। বেশ মানিয়েছে লোকটাকে। অভিজাত একটা ভাব আছে চেহারায়, কিংবা পাইপ টানার কারনেই হয়তো এরকম লাগছে। গন্ধটা এতো সুন্দর, নামটা জেনে নিতে হবে ভাবল রাশেদ।
‘তোমার নাম রাশেদ?’ পাইপ সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ড. শাখাওয়াত।
‘জি,’ একটু অবাক হলো রাশেদ। এই প্রশ্নের উত্তর ভদ্রলোকের জানা আছে বলেই তার ধারনা।
‘তুমি শামীমের বন্ধু?’
‘জি।’
‘শামীম তোমাকে ব্যাগটা দিয়ে কি বলেছিল? তোমার মনে আছে?’
উত্তর দিলো না রাশেদ। তাকাল ড. আরেফিনের দিকে। তিনি নিশ্চুপ। তবে ইশারা করলেন যেন প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয় রাশেদ।
‘দেখুন স্যার, সবকিছু আমি খুলে বলেছি ড. আরেফিন স্যারকে, এখন খুব ক্লান্ত আমি, এক গ্লাস পানি দিতে বলুন আমাকে।’ রাশেদ বলল।
ড. শাখাওয়াত নিজেই উঠে গেলেন। পাশের একটা টেবিলে পানির জগ ছিল, একটা গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে এসে দিলেন রাশেদকে।
পানি খেল রাশেদ।
তাকাল ড. আরেফিনের দিকে। ভদ্রলোক একেবারে চুপচাপ এখানে। কথা বলছেন বললেই চলে।
‘শামীম আমাকে কিছু বলেনি,একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল,’ বলল রাশেদ।’
‘চিঠিটা এখন কোথায়?’
‘সাথে নেই, সম্ভবত হলের রুমেই রেখে এসেছি,’ মিথ্যে বলল রাশেদ। সাথে আছে বললে ভদ্রলোক হয়তো চাইতে পারেন। জিনিসটা হাতছাড়া করার কোন ইচ্ছেই তার নেই। এই চিঠিই হয়তো তাকে বাঁচাতে পারে। ম্যানিব্যাগের এক কোনায় সযতনে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে রাশেদ চিঠিটা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে,’ বললেন ড. শাখাওয়াত, তাকালেন ড. আরেফিনের দিকে, ‘প্রাচীন সেই বইটা কি দেখানো যাবে?’
বইটা ব্যাগেই আছে। মানা করে লাভ হবে না। চেইন খুলে সাবধানে বইটা বের করল রাশেদ। সামনে রাখা টি-টেবিলের উপর রাখল বইটা।
ড. শাখাওয়াত ঝুঁকে হাতে নিলেন বইটা। পর্যবেক্ষন করছেন গভীর মনোযোগে। উল্টেপাল্টে দেখছেন জিনিসটা। অবিশ্বাসের ছোঁয়া তার চোখে। যেন বিশ্বাসই করতে চাইছেন না। ড. আরেফিনের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর রাশেদের দিকে।
‘এই বইটা, আমার ধারনা মতে, এর বয়েস, একহাজার বছরের কম হবে না, ড. শাখাওয়াত বললেন ধীর স্বরে। আপনাদের দুজনের জন্যই একটা কুইজ, বলুনতো ছাপানো বই হিসেবে স্বীকৃতি কোন বইটির?’।
‘বাইবেল, গুটেনবার্গের প্রেসের প্রথম বই ছিল সেটি,’ উত্তর দিল রাশেদ। কিছুদিন আগেই গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কার নিয়ে একটা আর্টিক্যাল পড়েছিল সে একটা ম্যাগাজিনে।
‘রাইট, গুটেনবার্গের বাইবেল প্রথম ছাপা হয়েছিল কতো সালে, তা বলতে পারবেন কেউ?
‘সঠিক সাল জানা যায়নি,ধারনা করা হয় ১৪৫৫-এর মধ্যে বাইবেল ছাপানো হয়।
‘এবারো সঠিক উত্তর। এবার আসা যাক, আমার হাতের এই বইটার ক্ষেত্রে। এর বয়স কমপক্ষে একহাজার বয়স হবে। এটা আমার একটা অনুমান। কার্বন টেষ্ট করতে দিলে আসল বয়স বের করতে পারবো আমরা,’ বললেন ড. শাখাওয়াত।
রাশেদ তাকাল ড. আরেফিনের দিকে। ভদ্রলোক এখনো নিশ্চুপ। গভীর মনোযোগে শুনছেন সিনিয়র সহকর্মীর কথা।
‘আমি কালকেই এর কার্বন টেস্টের ব্যবস্থা করছি, আসল বয়স বের করা গেলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে আমাদের জন্য।
উঠে দাঁড়ালেন ড. শাখাওয়াত। পায়চারী করছেন। বইটা এখনো হাতে তার। চিন্তিত।
‘আমাদের এখন কি করা উচিত?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘আপনারা চলে যান, কাল দুপুরে চলে আসবেন আমার অফিসে, সেখানেই কার্বন টেস্টের রেজাল্ট পেয়ে যাবো আমরা।’ বললেন ড. শাখাওয়াত।
‘তাহলে কাল সকালেই বইটা নিয়ে আসবো আপনার অফিসে, রাশেদ বলে উঠল, বইটা সে একরাতের জন্যও হাতছাড়া করতে চাইছে না।
ড. শাখাওয়াত তাকালেন রাশেদের দিকে, অবাক দৃষ্টিতে। যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না রাশেদ এই মাত্র যা বলল। ড. আরেফিনের দিকেও তাকালেন। যদিও সেখানে কোন উত্তর পেলেন না।
‘তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো?’ শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলেন ড. শাখাওয়াত।
‘এখানে অবিশ্বাস করার কিছু নেই,স্যার। এই বইটাই আমার রক্ষাকবচ। যেকোন। মূল্যে বইটা হাতছাড়া করতে রাজি নই আমি। আপনি কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত।’ উত্তর দিল রাশেদ। উঠে দাঁড়াল।
কিছু বললেন না ড. শাখাওয়াত। চুপচাপ হাটছেন। পাইপ নিভে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই। উশখুশ করছে রাশেদ। এখানে বসে থেকে কোন কাজ নেই। শুধু শুধু এই লোকটাকে জানাতে গেছে ড. আরেফিন, ভাবল সে। এমন কোন কাজে লাগবে না লোকটা।
‘আমরা তাহলে উঠি, কাল সকালে আসছি আপনার অফিসে?’ ড. আরেফিন বললেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনিও।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, সকালেই আমাকে একটা ফোন দেবেন,’ আসার আগে, ড. শাখাওয়াত বললেন।
প্রাসাদোপম বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো দুজন কিছুক্ষনের মধ্যেই। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দুজনকেই। ড. আরেফিনকে মনে হচ্ছে বেশি পরিশ্রান্ত, বিমর্ষ এবং হতাশ। রাশেদ চুপচাপ হাঁটছে। বিদেশি এবং দেশি, দুজন বিশেষজ্ঞই বইটা নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল, ব্যাপারটা ভেবে অবাক হলো রাশেদ। হয়তো কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না তাদের, কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার মতো অবস্থায় নেই সে। এই বইটাই একমাত্র সম্বল, যা শামীম তার জন্য রেখে গেছে। সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে চিঠিটা যা এখন তার ম্যানিব্যাগে আছে, যদিও নিরাপরাধ প্রমানের জন্য তা যথেষ্ট কি না বেশ সন্দেহ আছে তার।
দুপুর হয়ে গেছে, বেশ খিদে পেয়েছে রাশেদের। সূর্য এখন মধ্যগগনে। গগনে আগুন ছড়াচ্ছে। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। পাশে একজন শিক্ষক হাঁটছেন, একেবারে অলস, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।
‘রাশেদ, বইটা কি সম্পর্কিত ধারনা আছে তোমার? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘না, ধারনা নেই।’
‘আমার ধারনা, অনন্ত জীবন লাভের উপায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইটায়। দারুন আগ্রহ জন্মেছিল আমার, ঘুম না আসার যোগাড়। মনে হয়েছিল, যদি পেতাম তাহলে যেকোনভাবেই হোক না কেন, অমরত্ব জিনিসটা হাসিল করে ছাড়তাম আমি। কিন্তু এখন ভাবছি…’ বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন ড. আরেফিন, ‘ভাবছি, কি হবে এতো দীর্ঘ জীবন নিয়ে, একটা জীবন এমনিতেই কেটে যাবে, শুধু শুধু তা দীর্ঘায়িত করে কি লাভ।
ব্যক্তিগত জীবনে ভদ্রলোক সুখি নন, ভাবল রাশেদ। এমন একটা জিনিস কাছে থাকা মানে রাজ্য জয় করার মতো অবস্থা। কিন্তু ভদ্রলোক অন্যভাবে চিন্তা করছেন পুরো জিনিসটা। সে নিজেও অবশ্য অনন্তকাল বাঁচার আশা করে না। কি হবে এতো বেঁচে থেকে?
একটা সিএনজি নিয়ে নিলো দুজন। গন্তব্য ড. আরেফিনের বাসা।
* * *
ক্লাস করতে ইদানিং ভালো লাগেনা লিলির। একঘেয়ে হয়ে গেছে জীবনটা। রাশেদ নেই। শামীম নেই। এরা দুজনই ছিল তার বন্ধু, বাকিদের সাথে এতোদিন পরেও ঠিকমতো মেশা হয়নি তার। ফলে ক্লাস করেই চলে আসে বাসায়। আজ তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়াতে দুপুরের মধ্যেই বাসায় ফিরেছে সে। এখন টিভিতে খবর দেখছে। নতুন এক ঘটনা নিয়ে খুব আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বৃটিশ এক প্রত্নতাত্ত্বিক অপহৃত হয়েছেন। টিভি চ্যানেলগুলো সেই খবর নিয়েই মেতেছে। পুলিশ, গোয়েন্দা কিংবা অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনী কিছুই করতে পারছে না। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে লোক আসবে। কারন বৃটিশ সরকার ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
রাশেদ ফোনও করে না কিছুদিন হলো। কেমন আছে, কি করছে, কে জানে। সবসময়ই একধরনের টেনশন কাজ করছে। খবর পাওয়ার একমাত্র উপায় পুলিশের এক আত্মীয়। কিন্তু তার ধরন-ধারন সুবিধার নয়। প্রেম প্রেম ভাব আছে, যা একেবারেই সহ্য করতে পারে না লিলি।
কলিংবেল বেজে উঠলো এই সময়।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল লিলি। অতিথিকে দেখেই ভাবল, এই লোকের হায়াত অনেক বেশি। মাত্রই পুলিশের এই আত্মীয়টার কথাই ভাবছিল সে। কামরুল নাম লোকটার। দূরসম্পর্কের এক মামার ছেলে।
‘আসতে পারি?’ কামরুল বলল। বেশ বিনীত ভঙ্গিতে, পুলিশের পোষাকে যা খুব একটা মানায় না।
‘আসুন, হাসিমুখেই বলল লিলি। যদিও এখন মেজাজ তুমুল খারাপ হয়ে গেছে তার।
উল্টোদিকের সোফায় বসল লোকটা।
‘আপনি তো কখনো এই সময় আসেন না?’ জিজ্ঞেস করল লিলি।
‘ঠিক বলেছো, আসলে বিশেষ একটা কাজে এসেছি তোমার কাছে, কামরুল বলল।
‘আমার কাছে কাজ?’ বেশ অবাক হলো লিলি।
‘হ্যাঁ, শামীম হত্যার কেসটা এখন আমার হাতে। বিশিষ্ট একজন ব্যবসায়ীর ছেলে সে। সেই লোক এখন পাগলপ্রায়। ছেলের হত্যাকারীকে ধরার জন্য তিনি পুরো পুলিশ ফোর্সের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। এটা আমার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ, হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে হবে।
‘বুঝতে পেরেছি, কিন্তু এখানে আমার কি করার আছে?
‘আমার ধারনা রাশেদ এই কাজটা করেনি,কিন্তু সে জানে কে বা কারা করেছে। রাশেদ তোমার বন্ধু। সে কি কখনো তোমার সাথে যোগাযোগ করেছে?
‘না তো,’ মিথ্যে বলল লিলি।
‘আচ্ছা, অপেক্ষা করো, করতেও পারে। কারন ছেলেটার সাথে তোমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমি জানি, খবর নিয়েছি। সত্যি কথা বলতে, খবরটা জেনে আমার খারাপই লেগেছে। যাই হোক, সে তোমার সাথে যোগাযোগ করবেই। কাজেই তার ভালোর জন্য তুমি তাকে বলবে আমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমার নাম্বার আছে তোমার কাছে। তাহলে সে নিজেও খুনের দায় থেকে বাঁচতে পারবে, আমিও আসল খুনিকে ধরতে পারবো।’
চুপ করে থাকল লিলি। লোকটা তাহলে সব জেনে গেছে, রাশেদের সাথে তার সম্পর্ক শুধুই যে বন্ধুর মতো নয়, তা ইউনিভার্সিটির প্রায় সবাই জানে। এতে হয়তো লোকটার খারাপ লেগেছে। কিন্তু একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, নিজের মুখে কিছু বলতে হয়নি।
‘আমি তাহলে উঠি, কামরুল উঠে দাঁড়াল।’
‘চা-কফি কিছু দিতে বলি, লিলি বলল।’
‘ধন্যবাদ, যেতে হবে আমাকে,’ কামরুল বলল, তারপর চলে গেল।
দরজা লাগিয়ে আবার টিভি সেটের সামনে বসল লিলি। কামরুল যা বলে গেল তা কি আসলেই সত্যি। রাশেদের উপর পুলিশের কোন সন্দেহ নেই। এমনও তো হতে পারে এটা একটা ফাঁদ। টিভি বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে রইল লিলি। কান্না পাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি বড় কোন বিপদে পড়েছে রাশেদ।