২.২ সুন্দর মুখ

অধ্যায় ১১

১৭৬০ খৃস্টাব্দ।

এতো সুন্দর মুখ কখনো দেখেনি তাই কিছুক্ষন স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল মিচনার। চারপাশ কেমন অদ্ভুত সুন্দর, মায়াময়। আলো আধারীতে কেমন মায়াবী লাগছে সবকিছু। যেন চারদিকে সবকিছু ভাসছে, সে নিজেও কিছুটা ভাসমান অবস্থায় আছে বলে মনে হলো। দুলছে ধীরে ধীরে। মনে হয় পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে সে। সেই জগতে এই অদ্ভুত সুন্দর মুখশ্রীর মানুষ বাস করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কালো চোখগুলোর তুলনা কি, ঢেউ খেলানো চুলগুলো দুলছে সেই সুন্দর মুখশ্রীর চারদিকে। চোখে ইশারা, যেন কিছু বলতে চায়, কিছু দেখাতে চায়।

আশপাশে তাকাল মিচনার। সুন্দরি মেয়েটার হাতে একটা কিছু আছে, একটা পানপাত্র। ইশারায় সেটা নিতে বলল মেয়েটা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আদেশ পালন করছে। মিচনার, যেন এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। পানপাত্রটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল সে। টলটলে স্বচ্ছ এক ধরনের পানীয় দেখা যাচ্ছে। ইশারায় পান করতে বলছে মেয়েটা। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো তা পান করে নিয়েছে মিচনার, চোখ বন্ধ করে। জানে না কি হবে সামনে, মৃত্যু! এই পানীয় কি বিষ না অন্যকিছু। বুদ্ধিবিবেচনা করার অধিকার যেন নেই তার। পানীয়টা গলা দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন অদ্ভুত একটা স্বাদ লেগে রইল মুখে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই আশপাশে। চারপাশ কেমন দুলছে। চারদিক আলোয় ভরে গেছে। হাঁসফাঁস করছে সে, এ নিশ্চয়ই স্বপ্ন, জেগে উঠতে হবে যে করেই হোক।

জেগে উঠলো মিচনার।

সাগরে কতোক্ষন ভেসেছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে প্রচন্ড ঝড়ের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল সে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ডুবে যায়নি কেন সেটাই আশ্চর্য্য। চোখ মেলে তাকিয়ে অবাক হলো মিচনার। চারপাশ আলোয় আলোকিত। ঝকঝকে বালিতে সুৰ্য্যের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে সে। মাথার উপর সুর্য আলো দিচ্ছে, সামনে সমুদ্রের টলটলে নীল পানি। চারপাশে তাকাল, ছোট সুন্দর একটা সৈকতে শুয়ে আছে সে। বালি যেখানে শেষ সেখানে শুরু হয়েছে নারকেল গাছের সারি। লম্বা লম্বা গাছগুলো বাতাসে অল্প অল্প দুলছে।

নিজেকে চিমটি কেটে নিলো মিচনার, সে কি স্বর্গে চলে এসেছে? কাল রাতে ঝড়ে মারা পড়েছে? কিন্তু চিমটিটা জোরে দিয়েছিল তাই ব্যথায় ককিয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। চাইলে এখানে অনন্তকাল শুয়ে থাকা যায়, কিন্তু ক্ষুধা বলেও একটা ব্যাপার আছে।

কিভাবে কখন এখানে এসেছে মনে পড়ছে না, হয়তো প্রচন্ড ঝড়ে সাগরের ঢেউয়ে এতোদূর চলে এসেছে। হতে পারে, সবই সম্ভব, হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল মিচনার। সহজে মারা যাওয়ার লোক নয় সে, পুরো পৃথিবী দেখার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে ছিল একদিন। সেই উদ্দেশ্য পূরন না করে মৃত্যু তার কাছে ভিড়তে পারবে না।

একটা স্বপ্ন দেখছিল সে, স্বপ্ন না বাস্তব তা পরিস্কার নয়, কেননা মুখে এখনো সেই অদ্ভুত স্বাদটা লেগে আছে। কিন্তু এমন একটা স্বপ্ন বাস্তব হয় কি করে? অদ্ভুত সুন্দর সেই মুখ, সেই হাসি আর চারপাশের অপার্থিব পরিবেশ বাস্তবে অসম্ভব। সেই পানপাত্র! এমন জিনিস চোখে দেখেনি কোনদিন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে পানীয় সে পান করেছে তার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে কি করে!

সুৰ্য যদিও মধ্যগগনে তবু খুব একটা তাপ অনুভব করছে না মিচনার, সমুদ্রের হাওয়ায় গা জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। পরনের কাপড়-চোপড় শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এর মধ্যে। তাই শুধু প্যান্টটা রেখে শার্ট ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। হাঁটছে, তপ্ত বালির উপর। যদিও তাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তার।

গতকাল বিকেলে সামান্য খাওয়া জুটেছিল কপালে, তারপর শত্রুর জাহাজের হঠাৎ আক্রমন, সমুদ্রে পড়ে যাওয়া, ঝড়ের কবলে পড়ে সুন্দর এই সমুদ্রসৈকতে চলে আসা, অনেক সময় পার হয়ে গেলেও এখনো ক্ষুধা অনুভব করছে না মিচনার। সেই সাথে তৃষ্ণাও। মুখে লেগে থাকা স্বাদটা চেনার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু চেনাজানা কোন পানীয় কিংবা খাবারের সাথে এর কোন মিল নেই।

জায়গাটা ঘুরে দেখা দরকার, চারপাশে সবকিছু চমৎকার, ছবির মতো। কিন্তু কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না, কোনকালে কেউ এসেছিল তার কোন লক্ষনও চোখে পড়ছে না। জায়গাটাকে দ্বীপ বলেই মনে হচ্ছে। পুরোটা ঘুরে না দেখা পর্যন্ত নিশ্চিত বোঝা যাবে না।

হাঁটছে মিচনার, বয়স কম হলেও তার শারীরিক গড়ন অদ্ভুত সুন্দর, যেন গ্রীক দেবতাদের আদলে তৈরি করা হয়েছে। আকাশের দিকে তাকাল, এখন মধ্য দুপুর। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। ছায়াময় একটা জায়গা বেছে নিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম থেকে উঠে যা করার করতে হবে।

***

ড. কারসনের রুমে বসে আছে তিনজন, সন্দীপ, ড. আরেফিন এবং প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, তিনজনকেই কিছুটা গম্ভীর দেখাচ্ছে। ড. কারসন দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। ছোট একটা টেবিলে ল্যাপটপ এবং একটা প্রজেক্টর মেশিন দেখা যাচ্ছে, উলটো পাশের দেয়ালটাকে প্রজেক্টরের পর্দা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ড. কারসনের মাত্রই তার বক্তব্য শেষ করলেন। এখন তাকিয়ে আছেন তার সহকর্মীদের দিকে। তিনজনই মোটামুটি নির্বাক, যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ড. আরেফিনকে কিছুটা উশখুশ করতে দেখা গেল, যেন কিছু বলতে চান, কিন্তু ইশারায় নিষেধ করেছেন ড. কারসন। তিনি প্রফেসর সুব্রামানিয়াম কিংবা সন্দীপের মুখ থেকে কিছু শুনতে চান। আগে।

‘মি, সুব্রামানিয়াম, আপনি কিছু বলুন? এই বিষয়ে আপনার ধারনা কি?’

জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

উত্তর দেয়ার আগে বাকি দুজনের দিকে তাকালেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, তাকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে।

‘আমি আসলে কনফিউজড, এই বিষয়ে একসময় কিছুটা আগ্রহ থাকলেও মিথ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছিলাম।’

‘ড. সন্দীপ, আপনার কি মত?’ এবার সন্দীপের দিকে ফিরলেন ড. কারসন।

‘এই ভারতে লক্ষ লক্ষ মিথ আছে, একজন বিজ্ঞানী হয়ে প্রমান ছাড়া কোন কিছুতেই বিশ্বাস করবো না। আপনার দেখানো বিষয়গুলো যদিও অকাট্য প্রমান নয়, তবু মনে হচ্ছে আমাদের একবার চেষ্টা করা উচিত।‘

‘ড. আরেফিন,’ আপনি কিছু বলবেন?

কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছেন ড. আরেফিন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনায় মিথকে গুরুত্বের সাথে দেখা হলেও বাংলাদেশে সেভাবে কাজ করার সুযোগ কখনো আসেনি। ড. কারসন যা বলেছেন কিছুক্ষন আগে তাতে সত্যতা থাকলে তা মানবজাতির ইতিহাসে বড় একটা আবিষ্কার বলে বিবেচিত হবে সন্দেহ নেই, সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে এই বিষয়ে তার ব্যক্তিগত কোন পড়াশোনা বা অভিজ্ঞতা কোনটাই নেই।

‘আমি আসলে এই বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ, তবে আমি আপনার সাথে আছি,’ বললেন ড. আরেফিন, সঙ্গি দুজনের দিকে তাকালেন।

‘ওকে, ফাইন, কাল ভোরে রওনা দেবো আমরা, ঠিক সাড়ে ছটায়, প্রজেক্টর থেকে ল্যাপটপের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন ড. কারসন।

উঠে দাঁড়িয়ে একে একে বেরিয়ে এলো তিনজন ড. কারসনের রুম থেকে। এক অসম্ভবের পেছনে দৌড়ানোর অভিযানে বের হতে যাচ্ছে তারা। একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যে যার রুমের দিকে হাঁটতে থাকল।

ড. আরেফিনের মনে হলো পরিচিত কাউকে পাশ কাটালেন তিনি। অল্প বয়স্ক সুন্দর এক তরুণ। যদিও মুখটা দাড়িতে ঢাকা, তবু চোখ দুটো চেনা মনে হলো। এই দৃষ্টি আগে কোথাও দেখেছেন। কোথায়? মনে করতে পারলেন না। ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটতে থাকলেন।

.

অধ্যায় ১২

‘লরেন্স ডি ক্রুজ! এটা আবার কেমন নাম?’ অবাক কণ্ঠে বলল রাজু।

‘ভদ্রলোক খৃস্টান, তাই নাম এরকম, অবাক হওয়ার কি আছে,’ বিছানায় হেলান দিয়ে বসল রাশেদ।

‘তোর কাছে অবাক লাগলো না, আমাদের কাছে নাম বলল তানভীর রহমান, অথচ হোটেলে নাম লেখানো লরেন্স ডি ক্রুজ!’

‘উনি হয়তো ইচ্ছে করেই হোটেলে ভুল নাম এন্ট্রি করিয়েছেন, রাশেদ বলল।’

‘নাকি আমাদের কাছে ভুল নাম বলেছেন?’

‘বাদ দে, ঐ লোকের সাথে আমাদের আর কাজ নেই,’ ঘুম পাচ্ছিল রাশেদের, তাই কথা বাড়াতে চাচ্ছে না।

‘আমি কিছু বললেই বাদ দে, ঠিক আছে দিলাম,’ রাশেদের বিছানার পাশের ছোট চেয়ারটায় আরাম করে বসল রাজু।

‘আমরা এসেছি বেড়াতে, বিপদে পড়েছিলাম উদ্ধার পেয়ে গেছি,’ রাশেদ বলল, ‘এখন শান্তিমতো ঢাকা পৌঁছাতে পারলেই খুশি।’

‘কবে যাবি?’

‘আজ রাতেই যাবো, যা দেখার দেখেছি, এখন ঘুমা, বিকেলে বের হবো।’

‘তুই ঘুমা, আমি বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।’

‘তোর কি ক্লান্তি বলে কিছু নেই?’

‘না, এতোদূর এসে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না, তুই ঘুমো। আমি বিকেলের আগ চলে আসবো।

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে রাজু। একা একা বাইরে যেতে ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। হোটেল রুমে বসে বসে বিরক্ত হওয়ার চেয়ে বাইরে হেঁটে আসা ভালো।

জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে রাশেদের দিকে তাকাল। ঘুমিয়ে পড়েছে এর মধ্যেই ছেলেটা। দরজাটা লাগিয়ে বাইরে চলে এলো রাজু।

সন্ধ্যা পর্যন্ত বান্দরবান শহরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেল রাজু। এর মধ্যে দুপুরে রেস্টুরেন্টে কালি ভুনা দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিয়েছে। এখন হোটেলে ফেরা দরকার।

শহরটা ছোট, হোটেলটা শহরের শেষ দিকে, ছোট এক টিলার উপর বানানো। ধীর পায়ে ফিরছে রাজু। বারবার লরেন্স লোকটার কথা মনে পড়ছে তার। অদ্ভুত মানুষ। কি চমৎকারভাবে দুজন দুষ্কৃতিকারীকে সামাল দিয়ে বাঁচিয়েছে ওদেরকে। নিজের নাম নিয়ে ভুল তথ্য দেয়ার কি কারন থাকতে পারে তা মাথায় ঢুকছে না। যাই হোক, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই, হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে বলছিল রাজু। দৃষ্টিসীমার মধ্যে হোটেল চলে এসেছে। ক্লান্ত লাগছে খুব, বিশ্রাম নেয়া দরকার ছিল। রাশেদ হয়তো এতোক্ষনে ঘুম থেকে উঠেছে। যদিও মোবাইলে কল করেনি এখনো।

হোটেলের লবীতে এসে কিছুক্ষন দাঁড়াল রাজু। তানভীর রহমান ওরফে লরেন্স ডি ক্রুজ বাইরে গিয়েছিল সকালে, সেও হয়তো এতোক্ষনে ফিরে এসেছে। রুম নাম্বার মনে আছে। সেখানে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় কেন ওদের দুজনকে ভুল নাম বলছে লোকটা। অবশ্য এর কোন প্রয়োজন আছে কি না বুঝতে পারছে না রাজু। ঐ লোকের সাথে তাদের আর কোন কাজ নেই, যোগাযোগ করারও কোন প্রয়োজন নেই। উনার নাম ছল্ট হলেই বা কি আর বন্টু হলেই বা কি।

কিন্তু তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না রাজু। ভদ্রলোক ভয়ংকর কিছু নন, উপকারী মানুষ বলা যায়। একবার গিয়ে অন্তত দেখা করা যায়। রাশেদকে ছাড়া একা একা যাওয়া ঠিক হবে না, রুমের দিকে হাঁটতে থাকল রাজু।

*

অধ্যায় ১৩

নিজের রুমে বসে আছেন ড. আরেফিন। ল্যাপটপটা সামনে খোলা রেখে সিগারেট ধরিয়েছেন। অনেকক্ষন হলো ড. কারসনের রুম থেকে এসেছেন। ঘুমিয়ে পড়া উচিত এখন। কিন্তু ঘুম আসছে না। অদ্ভুত এক প্রোজেক্ট নিয়ে এসেছেন ড. কারসন। ‘সাম্ভালা’ শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলেন না, আজই প্রথম ড. কারসনের মুখে নামটা শুনে চমকে গেলেন। আগে কখনো শব্দটা শোনেননি এটা নিশ্চিত। তবু এমন একটা অনুভূতি হওয়ার কারন কি?

ড. কারসন একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করে রেখেছিলেন তার তিন সহকর্মীর জন্য, পেন ড্রাইভে করে জিনিসটা নিয়ে এসেছেন ড. আরেফিন।

সিগারেটটা আসট্রেতে গুঁজে দিয়ে পেড্রাইভ থেকে ফাইলটা বের করে ওপেন করলেন, ড. কারসন কিছু লেখা এবং কিছু ছবির সাথে নিজের ভারি কণ্ঠের ধারাবর্ননা যোগ করে ভালো একটা প্রেজেন্টেশনটা তৈরি করেছেন।

প্রেজেন্টেশনটা চালু করলেন।

‘আমি ড. নিকোলাস কারসন, চমৎকার একটা বিষয় আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি। শব্দটা আপনাদের মধ্যে অনেকেই শুনেছেন, অনেকেই শোনেননি। শব্দটা হচ্ছে ‘সাম্ভালা’। এর মানে কি? ‘সাম্ভালা কি একটা স্থান? একটা জাতি? বিশেষ কোন জ্ঞানের নাম? সত্যিকারভাবে বলা যায় সাম্ভালা আসলে এটা একটা স্থানের নাম। আরো অনেক নামে ডাকা হয় একে, যেমন সাংঘিলা, জ্ঞানগঞ্জ, সিদ্ধাশ্রম ইত্যাদি। বলা হয়ে এখানে অমররা বাস করেন। আমাদের পৃথিবীর মধ্যেই এমন একটি শহর যেখানে মৃত্যু, শোক, জরা-ব্যাধি মানুষকে স্পর্শ করে না। এখানকার জনসংখ্যা সীমিত।

এবার কিছু ছবি দেখা যাবে, মরুভূমির ছবি, বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়ার ছবি, গহীন জঙ্গলের ছবি এবং এই ধরনের আরো কিছু ছবি।

‘আপনারা কিছু ছবি দেখলেন, এই ছবিগুলো দেখানোর উদ্দেশ্য হলো ধারনা করা হয় এই ধরনের কোন স্থানে সাম্ভালার অবস্থান, যদিও সঠিকভাবে ঠিক কোথায় তা কেউ বলতে পারে না, কারো ধারনা এর অবস্থান হিমালয়ের পর তিব্বতের কোন এক পাহাড়ী এলাকায়, কারো ধারনা মঙ্গোলিয়ার মরুভূমির নীচে এবং কারো ধারনা ভারতের কোন এক জঙ্গলে। তিব্বতে এর অবস্থান, এখন পর্যন্ত এই ধারনাটাই বেশি শক্তিশালী, তবে বাকি সম্ভাবনাগুলোকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না।’

ছবিটার দিকে চোখ আটকে গেল ড. আরেফিনের। ‘কালচক্র’এর ছবি এটি। আগে কোন একটা যাদুঘরে দেখেছেন। হিন্দু এবং বৌদ্ধ দুই ধর্মেই মানা হয় একে।

ড. কারসনের ধারাবর্ননা চলছে, ছবিটা কালচক্রের। কালচক্র হিন্দু এবং বৌদ্ধ দুটো ধর্মেই বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। কালচক্র হচ্ছে সময়ের চক্র বা সময় চক্র। যেহেতু সময়ই সব কিছুর নিয়ামক তাই এই চক্রে পৃথিবীর যাবতীয় শক্তি আধারিত আছে বলে বিশ্বাস করে বৌদ্ধরা।

‘কালচক্রের প্রসঙ্গ আসার কারন বলতে গেলে এর সাথে সাম্ভালার সম্পর্কও বলতে হয়। সাম্ভালার প্রথম রাজা যাকে সাংস্কৃত ভাষায় সুচন্দ্র বলা হয়ে থাকে তিনি একবার মহাজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধের কাছে মহাজ্ঞান বা নির্বান চাইলেন। বুদ্ধ তখন অবস্থান করছিলেন অনেক দূরে, কিন্তু সেখান থেকেই কালচক্রের সূত্র শিখিয়েছিলেন সুচন্দ্রকে, সেই সাথে সুচন্দ্রের পুরো দেশবাসীকেও। এই সূত্র শেখার কারনেই সাম্ভালার মানুষজন নির্বান লাভ করে এবং অমরত্ব পায়।‘

‘এখন কথা হলো, এগুলো হচ্ছে মিথ, যা মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়েছে। হাজার বছর ধরে। এর উপর ভিত্তি করে কোন অভিযানে যাওয়া নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু ইদানিং কলকি রাজার উত্থানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।’

‘এখন আপনারা জিজ্ঞেস করবেন কলকি রাজা আবার কি জিনিস? হিন্দুদের প্রধান দেবতা বিষ্ণুর দশম অবতার হচ্ছে এই কলকি রাজা যিনি পৃথিবী থেকে কলিযুগের অবসান ঘটিয়ে আবার সত্য যুগ ফিরিয়ে আনবেন। তার সাথে থাকবে একটি সাদা ঘোড়া। যদিও হিন্দু ধর্ম মতে কলি যুগ শেষ হতে ঢের বাকি, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মমতে সাম্ভালায় পঁচিশজন কলকিরাজা রয়েছেন, যাদের কেউ যে কোন মুহূর্তে আবির্ভূত হতে পারেন।‘

এবার কিছু ছবি দেখা যাবে, দেবতা বিষ্ণু সাদা ঘোড়া আর হাতে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

‘এছাড়া ভারতে বসবাসকারী আগা খানের অনুসারী শিয়া মুসলিমদের একটি দল ধারনা করে, তাদের নবীর নাতিদের কেউ একজন কলকি রাজা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারগুলো কিভাবে যেন জট লেগে যাচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য হবে এই জটগুলো ভোলা আর সেজন্য সাম্ভালার খোঁজ পাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।‘

‘এখানে আরো একটি ভবিষ্যতবানীর কথা না বললেই নয়, শ্রী বীরব্রামে স্বামী প্রায় এক হাজার বছর আগে তার দিব্য মহাকাল জ্ঞান গ্রন্থে বলে গেছেন, দুই হাজার বারো বা তার কিছু পর কলকি রাজা আসবেন যখন চাঁদ, সুৰ্য্য, মঙ্গল এবং বৃহস্পতি একই চিহ্নে প্রবেশ করবে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে সেই সময় সমাগত।’

‘শেষ করার আগে, বিশেষ একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের এই পৃথিবীর অনেকেই সাম্ভালার খোঁজ জানেন। ইংল্যান্ডে এক বিশেষ সাধুপুরুষের সাথে কিছুদিন আগে আমার দেখা হয়েছিল, তিনি এমন একটা জিনিস দেখিয়েছেন যা কেবল সাম্ভালায় থাকতে পারে। অদ্ভুত একটি প্রানীর ছবি, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ইউনিকর্ন, শিংওলা ঘোড়া, সাদা রঙের। ছবিটা একনজর দেখিয়ে চলে গেলেন তিনি, আর খুঁজে পেলাম না। আপনারা ভাবছেন ছবিটা হয়তো ডিজিটাল কারিগরির মাধ্যমে করা, কিন্তু বিশ্বাস করুন নকল ছবি এবং সত্যিকার ছবির পার্থক্য বুঝতে পারি আমি। কাজেই এটা নিশ্চিত ছবিটা নকল ছিল না। সেই ছবিতে ঘোড়া ছাড়াও ছিলেন সাধুপুরুষ নিজে এবং আরো দুজন ভদ্রলোক, যারা প্রাচীন তিব্বতি পোশাক পড়ে ছিলেন। চারপাশ ছিল বরফে আচ্ছাদিত। এ থেকে আরো একটা ধারনা পেলাম, জায়গাটা বরফ আচ্ছাদিত এলাকায় অবস্থিত এবং সম্ভবত জায়গাটা তিব্বতে।’

‘বক্তব্য আর দীর্ঘায়িত করবো না, কলকি রাজা সত্যি না মিথ্যা তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, পৃথিবী টিকে থাকবে বা ধ্বংশ হবে তা নিয়েও ভাবি না। কিন্তু ঐ ইউনিকর্ন আর সাম্ভালার অস্তিত্ব যদি সত্যি থেকে থাকে তাহলে তা আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে, যে করেই হোক। আশা করি আপনারা আমার পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ।’

ল্যাপটপটা বন্ধ করলেন ড. আরেফিন। ড. কারসনের উপস্থাপনা চমৎকার ছিল। কিন্তু তারপরও কোথাও যেন কোন একটা ফাঁক রয়েছে যা আপাতত ধরতে পারছেন না। সাম্ভালার সাথে অমরত্বের সংযোগ আছে, সেখানে যারা থাকে তারা চিরসুখী, তারা কেন পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের দুঃখদুর্দশা দূর করার চেষ্টা করছেন না? এর আগে অমরত্বের পেছনে তিনিও ছুটেছিলেন কিছুদিন, আলেয়ার পিছে ছোটার মতো ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল অনেকটা, খুব কাছে গিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। তবু আফসোস নেই। চেষ্টা যা করার করেছিলেন।

আবার একটা সিগারেট ধরালেন। বুঝতে পারছেন ঘুম আসবে না। মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছে। সাম্ভালা বিষয়ে আরো খবর নিতে হবে। সহকর্মী এবং দলনেতার উপর ভরসা করে থাকা ঠিক হবে না।

জানালার বাইরে পুরো দিল্লী এখনো সজীব, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে বলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিছানার কাছে গেলেন ড. আরেফিন। তখনি মনে হলো কেউ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার একপাশে সরে দাঁড়ালেন যাতে কেউ আচমকা ঢুকে পড়লে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যায়।

দরজার নবটা ঘুরছে।

দরদর করে ঘামছেন তিনি। তৈরি, আঘাত করার জন্য।

***

অন্যান্য গ্রামের মতো এই গ্রামটিও অতি সাধারন। ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি এখনো। ফলে গ্রামবাসী খুব রাত করে না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।

এখন রাত দশটার মতো বাজে। ছোট খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে লখানিয়া। নিঘুম। ঘরের অপর প্রান্তে ছোট খাঁটিয়াটার দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়ি শুয়ে আছে সেখানে। এতোক্ষনে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত উঠা ঠিক হবে না।

আজ রাতেই সরে যেতে হবে এখান থেকে। লখানিয়া হিসেবে সময়টা খারাপ কাটেনি। আরো কিছুদিন থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বুড়ির ভাবসাব ভালো ঠেকছে না ইদানিং। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা করার জন্য মরীয়া হয়ে আছে। প্রতিদিনই কোন না কোন পাত্রীর খবর নিয়ে লোক আসছে। এই অবস্থায় এখানে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সুটকেস দু’টোর একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুড়ে ঘরটার পেছনে একটা ঝোঁপের পাশে গর্ত করে রাখা হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে। আজ সেখানে সুটকেস দু’টো রেখে চলে যেতে হবে। বৃদ্ধ শেবারনের দেয়া চামড়ার খোপটা শুধু নেয়া হবে সাথে।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লখানিয়া। বুড়ির দিকে তাকাল। চিন্তার কিছু নেই, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বালিশের নীচ থেকে প্লাস্টিকের ছোট একটা প্যাকেট বের করে বুড়ির মাথার কাছে রাখল। বেশ কিছু টাকা আছে এখানে, যা দিয়ে বুড়ির বাকি জীবন সুন্দরভাবে কেটে যাবে।

বাইরে ঝকঝকে জোছনা। কাঁধে শুধু একটা ঝোলা নিয়ে পথে নামবে আজ লখানিয়া। সুটকেস দু’টোর গতি করা হয়েছে একটু আগে। এমনভাবে গর্তে রেখে আসা হয়েছে যাতে আবার জায়গাটা চিনতে সমস্যা না হয়। আবার কবে এই গ্রামে আসা হয় তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আসতে একদিন হবেই, সেদিন পর্যন্ত বুড়ি বেঁচে থাকবে কি না কে জানে।

এই গ্রামটা পার হওয়ার সাথে সাথে লখানিয়া নামটাও হারিয়ে যাবে। আবার নতুন কোন পরিচয়ে পরিচিত হবে সে।

*

অধ্যায় ১৪

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ আর রাজু। কিছুটা ইতস্তত করছে। নক করবে কি করবে না। ভেতরে বাতি জ্বলছে, তারমানে ভদ্রলোক রুমে আছেন। ইশারায় রাজুকে নক করতে বলল রাশেদ। রাজু তাকাল চারদিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। লোকজনের চলাচল কিছুটা কম এখন। কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে নেই, তাকিয়ে থাকলেও অবশ্য ক্ষতির কিছু ছিল না।

দরজায় নক করতে গিয়ে দেখা গেল দরজাটা খোলা। রাশেদের দিকে তাকাল রাজু, অনুমতি চাচ্ছে ভেতরে ঢোকার। নবে হাত দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিতে খুলে গেল দরজাটা।

বাতি জ্বলছে, কোন সাড়াশব্দ নেই অবশ্য।

‘তানভীরসাহেব, আপনি কি আছেন?’ কম্পিত কণ্ঠে বলল রাজু।

কোন উত্তর এলো না।

ছোট প্যাসেজের মতো জায়গাটা পেরিয়ে রূম। রাজু সামনে, পেছনে রাশেদ। এরমধ্যে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে রাশেদ যাতে বাইরের কেউ তাদের দেখতে না পায়।

ছোট রুমটায় ঢুকে বেশ একটা ধাক্কা খেল দুজন। একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে তানভীর আহমেদ ওরফে লরেন্স ডি ক্রুজ। বুকে বিশাল একটা ছোরা গেঁথে আছে। রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল রাজু, হাত ধরে ওকে থামাল রাশেদ।

‘এখান থেকে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে,’ ফিসফিস করে বলল রাজু।

‘একটু দাঁড়া, রাশেদ বলল, এগিয়ে গেল নিথর হয়ে পড়ে থাকা তানভীরের দেহটার দিকে। হেলে পড়া একটা হাত তুলে নিয়ে পালস দেখার চেষ্টা করল।

রাজুর দিকে ঘুরে তাকাল, ইশারা করল সামনে আসতে।

‘ভদ্রলোক এখনো বেঁচে আছেন,’ ফিসফিস করে বলল রাশেদ।

‘আমাদের এখন কি করা উচিত?’

‘নীচে রিসেপশনে জানানো দরকার, ওরা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করবে।’

‘কিন্তু আমরা কেন এখানে, নিজেদের পক্ষে কি বলবো আমরা?’

চিন্তায় পড়ে গেল রাশেদ, আসলেই নিজেদের পক্ষে বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। অবশ্য ছুরিতে খুনীর আঙুলের ছাপ থাকবে, সে ছাপ তার আর রাজুর সাথে মিলবে না এটা নিশ্চিত। তবু পুলিশি একটা ঝামেলার শঙ্কা থেকে যায়।

‘তোমরা…’

নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল দুজন, তাই তানভীরের দিকে লক্ষ্য করতে পারেনি। চোখ খুলে তাকিয়েছে লোকটা, দূর্বল স্বরে কথা বলার চেষ্টা করছে।

‘কে আপনাকে মারলো? উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রাজু।

‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও, ওদের ধারনা তোমরা আমার সাথে জড়িত, কোনমতে কথাগুলো বলল তানভীর।

‘কাদের ধারনা আমরা আপনার সাথে জড়িত? কিসের সাথে জড়িত?’

‘আমাকে একটু পানি দাও।

রাজুকে ইশারায় পানির বোতল আনতে বলল রাশেদ। ঘামছে সে, কোন সমস্যায় জড়াতে যাচ্ছে কে জানে।

কোনমতে পানি খাওয়ালো রাজু মধ্যবয়স্ক লোকটাকে। বোঝাই যাচ্ছে কোনমতে বেঁচে আছে, বেশিক্ষন টিকবে না।

‘আমি আর আমার বন্ধু সঞ্জয়, বিশেষ একটা দলের সাথে জড়িত, যারা এই পাহাড়ি অঞ্চলে অস্ত্র-মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করে,’ বলল তানভীর, হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে আমার চোখের রঙ নীল। এর কারন আমার পর্তুগীজ পূর্বসুরি। আমি এমন এক পরিবারের সদস্য যার শুরু হয়েছিল একজন পর্তুগীজ জলদস্যু থেকে। হঠাৎ করেই সেই প্রপিতামহের একটা গোপন সম্পদ আমার হাতে চলে আসে। কোটি কোটি টাকার গুপ্তধনের নক্সা। বুঝতে পারি গুপ্তধন এই পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও লুকানো আছে। তারপর সেটা আমি সঞ্জয়কে জানাই, কারন সঞ্জয় আমার অনেকদিনের বন্ধু, যা কার একসাথে করেছি আর এই এলাকায় কোন কাজ করতে হলে তা একা করতে পারব না আমি। কারো না কারো সাহায্য লাগবে, তাই সঞ্জয়কে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু ও আমার সাথে বেঈমানি করল। আমাকে মেরে নক্সাটা ছিনিয়ে নিতে এসেছিল।

‘তারপর?’ উত্তেজনায় রাজুর চোখ চকচক করছে।

একটানা অনেকগুলো কথা বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে তানভীর। রাশেদ তাকিয়ে আছে, লোকটার কথার গুরুত্ব বোঝার চো করছে। মৃত্যুপথযাত্রী একজন নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবে না।

‘কিন্তু পারেনি,নক্সাটা এখনো আমার কাছেই আছে,’ মৃদু হাসি ফুটেছে তানভীরের চেহারায়।

‘কোথায়?’

‘তোমাদের দুজনকে আমার ভালো লেগেছে, তাই বলছি,’ ফিসফিস করে বলল তানভীর।

উত্তেজনায় কাঁপছে রাজু, রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে, লোকটার হাত এখনো তার হাতে। কেমন শীতল অনুভব করছে সে।

‘তোমাদের ঘরে আছে জিনিসটা, লাল যে ট্রাভেল ব্যাগটা আছে ওতে ঢুকিয়ে রেখেছি, তানভীর বলল।

‘কখন করলেন এই কাজ? বিস্ময়ে কপালে চোখ উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা রাজুর।

‘তুমি তখন বাইরে ছিলে, রাশেদ ঘুমাচ্ছিল, দরজার লক খুলে ভেতরে ঢোকা আমার জন্য কোন সমস্যাই না, সবসময় ভয় ছিল কখন ওরা এসে কেড়ে নেবে নক্সাটা আমার কাছ থেকে, তাই তোমাদের ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম পরে একসময় নিয়ে নেবো তোমাদের অজান্তেই।‘

অবাক হলো রাশেদ, সে ঘুমিয়ে ছিল আর একটা লোক তার রুমে ঢুকে তার ব্যাগ নাড়াচাড়া করেছে! সে কিছু টেরই পায় নি!

 ‘আমি বোধহয় মরবো না, তোমরা তাড়াতাড়ি রুমে যাও, তারপর বেরিয়ে পড়ো, দূর্বল স্বরে বলল তানভীর। আমি এখন রিসেপশনে খবর দেবো অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য।’

‘আপনি পারবেন?’ জিজ্ঞেস করল রাজু।

‘তুমি শুধু টেলিফোন সেটটা এখানে এনে দাও।‘

দৌড়ে বিছানার পাশে রাখা টেলিফোন সেট তানভীরের সামনে রাখল রাজু।

‘তোমরা যাও। আমি যদি বেঁচে ফিরতে পারি তাহলে যোগাযোগ হবে, নইলে ঐ গুপ্তধনের পুরো মালিকানা তোমাদের দুজনের!’ মৃদু হেসে বলল তানভীর।

‘আপনার আসল নাম কি? তানভীর না লরেন্স?’

‘জেনে গেছো দেখা যায়। আমি লরেন্স, লরেন্স ডি ক্রুজ। যাও এবার। ওরা হয়তো এবার তোমাদের দুজনের পেছনে লাগবে।’

আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না ভেবে রাজুকে ইশারা করল রাশেদ। তারপর দুজনই বেরিয়ে এলো রুমটা থেকে। এখন নিজেদের রুমে যেতে হবে, লাল ট্রাভেল ব্যাগটা খুলে দেখতে হবে সত্যিই লোকটা কিছু রেখেছে কি না সেখানে!

লোকটার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তাদের হাতে বেশি সময় নেই। সঞ্জয়ের দল নিশ্চয়ই এখন খুঁজছে ওদেরকে। দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি পা চালাল রাশেদ। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় মনে হলো লোক লেগে গেছে এরমধ্যে। দৌড় দিল রাশেদ, কিছু না বুঝে রাজুও দৌড়াচ্ছে তার পেছন পেছন। গন্তব্য নিজেদের রুম।

১৭৬০ খৃস্টাব্দ

টানা পাঁচ সপ্তাহ দ্বীপটায় ঘুরে বেড়াল মিচনার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দ্বীপ, বন্যপ্রানী বলতে কিছু বন্য শুয়োর, কাঠবেড়ালী, নানা জাতের পাখি আছে, ফলমূলের মধ্যে নারকেল আর কলাগাছে ভরা দ্বীপটা। যদিও ক্ষুধাতৃষ্ণা অনেকটাই জয় করতে পেরেছে সে ইতিমধ্যে। মুখের মধ্যে সেই অদ্ভুত স্বাদটা এখনো আছে। এরমধ্যে কোন মানুষের দেখা পায়নি। কোনদিন মানুষের পায়ের ছাপ এই দ্বীপে পড়েছে কি না সন্দেহ আছে। নিজের মতো স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করছে সে। ইদানিং নিজের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে মিচনার। পরিবর্তনটা ভয়াবহ। রক্ত দেখতে ভালো লাগে তার।

বন্য কিছু শুয়োর আছে দ্বীপটায়। কারন ছাড়াই এদের কয়েকটাকে মেরেছে সে। ধারাল পাথর দিয়ে ছুরির মতো একটা জিনিস বানিয়ে নিয়েছে। এতো ধারাল হয়েছে জিনিসটা যে হাত ছোঁয়ালেই কেটে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। প্রানীগুলোকে মেরে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে সেগুলোকে ফেলে দিয়েছে সমুদ্রে। নিজের এমন হিংস্রতা দেখে নিজেই অবাক মিচনার। একটা পিঁপড়ে মারতেও যার হাত কাপতো সে এখন নির্দ্বিধায় খুন করছে অবোধ প্রানীগুলোকে। রক্ত দেখতে ভালো লাগছে তার। খুবই ভালো।

*

অধ্যায় ১৫

দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে তৈরি ড. আরেফিন। নবটা পুরো ঘুরে গেছে। কেউ একজন ঢুকবে ভেতরে।

‘আপনি?’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন। এভাবে চোরের মতো আসার প্রয়োজন পড়লো কেন লোকটার ভেবে অবাক হলেন। আরেকটু হলেই আঘাত করতে যাচ্ছিলেন তিনি।’

‘আমার খুব টেনশন হচ্ছে?’

ফিসফিস করে বললেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ‘পানি খাবো।‘

‘ভেতরে আসুন।’ বলে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। প্রফেসরের ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না তার কাছে। দরজায় নক করলেই হতো, তা না করে চুপিচুপি রুমে ঢোকার চোঁ করাটা ভালো লাগেনি।

সরাসরি বিছানায় গিয়ে বসেছেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। হাঁপাচ্ছেন অল্প অল্প। নীচের তলার একটা রুমে উঠেছেন, সেখান থেকে হয়তো হেঁটে এসে হাঁপিয়ে গেছেন, এমনিতেই মোটা শরীর তার। অল্প পরিশ্রমে কাতর হয়ে পড়েন। এই ধরনের লোক নিয়ে কোন কাজে নামা কতোটা যুক্তিযুক্ত বুঝতে পারছেন না ড. আরেফিন। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল আর একটা গ্লাস এগিয়ে দিলেন প্রফেসর সুব্রামানিয়ামের দিকে।

পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন প্রফেসর।

‘আমার মনে হয় বড় কোন সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি আমরা, প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বললেন।

‘কেন এরকম মনে হচ্ছে আপনার?’

‘জানি না, কিন্তু মনে হলো আমাদের পেছনে কেউ লেগে আছে,’ ফিসফিস করে বললেন প্রফেসর, চারপাশে তাকাচ্ছেন যেন কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।

দরজা লাগিয়ে এসেছেন ড. আরেফিন। নক করছে কেউ। ভীত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছে প্রফেসর। ইশারায় দরজা খুলতে নিষেধ করছেন।

উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগুলেন ড. আরেফিন।

সন্দীপ চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে আছে। ড. আরেফিন দরজা খোলা মাত্রই ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে পড়ল। প্রফেসরকে দেখে একটু থমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে উল্টো দিকে রাখা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

‘আপনি এতো রাতে?’

‘এলাম, গল্প করতে।’

‘আচ্ছা।‘

‘কিন্তু মনে হচ্ছে ভুল সময়ে এসে পড়েছি, বিড়বিড় করে বলল সন্দীপ, কথাটা কানে গেছে প্রফেসরের, কিন্তু না শোনার ভান করলেন তিনি।

দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন। গলা পরিস্কার করে নিলেন।

‘বুঝতে পারছি, আপনারা দুজনেই এসেছেন বিশেষ কোন সমস্যা নিয়ে আলাপ করার জন্য। সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বলে ফেলুন,’ প্রফেসরের দিকে তাকালেন ড. আরেফিন। ‘আপনিই বলুন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম।‘

একটু সময় নিচ্ছেন প্রফেসর, সন্দীপের সামনে হয়তো কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছেন। এখন কিছুটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে।

‘আমার মোবাইলে একটা ফোন কল এসেছিল বিদেশি একটা নাম্বার থেকে, আমাকে সাবধান করা হয়েছে আমি যেন এই অভিযানে না যাই,’ বললেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, ‘এছাড়া এখানে আসার পর থেকেই কেউ আমার উপর নজর রাখছে বলে মনে হচ্ছে।‘

‘কি দেখে এমন মনে হচ্ছে আপনার?’

‘বুঝিয়ে বলতে পারবো না, কেউ পেছন দিক থেকে কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সেটা টের পায়।‘

‘মি. চক্রবর্তী, এবার আপনি বলুন?’ ড. আরেফিন বললেন।

‘আমি কোন ফোন কল পাইনি,কিন্তু কেউ একজন আমাকে অনুসরন করছে এটুকু টের পাচ্ছি,’ সন্দীপ বলল। প্রফেসরের দিকে না তাকিয়ে কথা বলছে সে।

চুপ করে কিছুক্ষন চিন্তা করলেন ড. আরেফিন। কিছু একটা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে, দুই দুজন বয়স্ক লোকের পক্ষে একই ধরনের মিথ্যে বলার কোন মানে নেই। সে অবশ্য কিছু টের পায়নি। হয়তো তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব ভালোভাবে কাজ করে না!

এই দুজনকে এখন বিদায় করা দরকার।

‘কাল ভোরে আমরা যাত্রা শুরু করবো, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে,’ ড. আরেফিন বললেন। ‘কাজেই এখনই ঘুমাতে যাওয়া প্রয়োজন আমাদের সবার। ড. কারসনকে এখনই কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। আমরা তিনজন লক্ষ্য রাখবো সবদিকে, চোখ কান খোলা রাখবো। কেউ যদি আমাদের অনুসরন করে তাহলে কোন না কোন উপায়ে বুঝতে পারবো আমরা। তারপর যে কোন একটা ব্যবস্থা নেয়া যাবে।‘

‘আমি উঠি তাহলে,’ সন্দীপ বলল, উঠে দাঁড়িয়েছে সে।

‘আচ্ছা,’ ড. আরেফিন বললেন।

সন্দীপ বেরিয়ে গেলে প্রফেসরের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোক এখনো চুপচাপ বসে আছেন। মনে হয় আরো কিছু বলতে চাচ্ছেন।

‘প্রফেসর, আপনার না একজন ব্যক্তিগত সহকারী আছে, কি যেন নাম?’

‘রামহরি, রুমে আছে এখনো।‘

‘আপনি তো তাহলে একা নন। ঘুমাতে যান। দেখা যাক না কি হয়? ভয়ের কিছু নেই।‘

উঠে দাঁড়িয়েছেন প্রফেসর। দরজার দিকে যেতে যেতে পিছু ফিরে তাকালেন।

‘কেন জানি মনে হচ্ছে সামনে খুব ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে,’ বলে দরজাটা লাগিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।

দরজা লক করে বিছানায় এসে বসলেন ড. আরেফিন। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে তার। সকাল সকাল বেরুতে হবে ভাবতেই অস্থির লাগছে। ঠিক মতো ঘুম না হলে কোন কাজ করেই আরাম নেই। এছাড়া দুজন যা বলে গেল তাতে বোঝা যাচ্ছে সামনে সত্যিই হয়তো বড় কোন ঝামেলা অপেক্ষা করছে।

চোখ লেগে এসেছিল প্রায়। দরজায় ক্রমাগত ধাক্কাচ্ছে কে যেন। লাগিয়ে উঠে পড়লেন ড. আরেফিন। ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘ড. আরেফিন, আমি প্রফেসর সুব্রামানিয়াম।‘

বিরক্ত হলেও দরজা খুললেন ড. আরেফিন। এই লোকটা জ্বালাবে দেখছি!

‘আপনি? ঘটনা কি?’

‘কেউ একজন রুমে ঢুকে আমার ল্যাপটপ নিয়ে গেছে, রামহরিকে বেঁধে রেখে গেছে চেয়ারের সাথে,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন প্রফেসর।

অবাক হলেন ড. আরেফিন। সন্দেহ তাহলে পুরো মিথ্যে নয়।

‘ড. কারসনের রুমে চলুন, এ নিয়ে হৈচৈ করার প্রয়োজন নেই।’

‘চলুন।‘

 রুম থেকে বেরুনোর আগে ল্যাপটপটা সাথে নিতে ভুললেন না ড. আরেফিন।

*

অধ্যায় ১৬

রুমে ঢুকে প্রথমেই লাল ব্যাগটা যেখানে রাখা ছিল সেদিকে তাকাল রাশেদ। ব্যাগটা আছে। রাজু আছে পেছনে। সিঁড়ি বেয়ে তাড়াহুরো করে উঠতে গিয়ে দুজনই এখন হাঁপাচ্ছে।

‘এখন কি করবো আমরা?’ রাজু জিজ্ঞেস করল।’

‘আগে ব্যাগটা খুলে দেখি।’

চেইনটা একটানে খুলে ফেলল রাশেদ। কাপড়চোপড় সরিয়ে দেখছে, কিছুটা হতাশ মনে হলো তাকে। ব্যাগ থেকে একটা একটা করে যাবতীয় জিনিসপত্র এক এক করে বিছানায় ছুঁড়ে মারছে, কোথাও নেই নক্সাটা। লরেন্স কি তাহলে মিথ্যে বলল?

‘নেই তো!’ রাশেদ বলল। বিছানায় বসে পড়েছে।

‘সাইড পকেটে দ্যাখ।’

‘তুই দ্যাখ।’

ট্রাভেল ব্যাগটার সাইড পকেটের চেইন খুলে হাত ঢুকিয়েছে রাজু। বিস্মিত মনে হচ্ছে তাকে, ছোট চারকোনা একটা বাক্স বের করে আনলো সে। বাক্সটা কাঠের, কালো রঙের।

‘খুলে দ্যাখ, মিথ্যে বলেনি মনে হচ্ছে,’ উত্তেজনায় কেঁপে গেল রাশেদের কণ্ঠস্বর।

আস্তে আস্তে বাক্সটার উপরের অংশটা খুলল রাজু। কাগজের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, মোড়ানো, সাবধানে বের করে বিছানায় রাখল কাগজটা।

‘নক্সা!’ ফিসফিস করে বলল রাজু।

‘যেখানে ছিল সেখানে রেখে দে, এখন থেকে সরে যেতে হবে এক্ষুনি,’ উঠে দাঁড়িয়েছে রাশেদ, যা যা জিনিসপত্র বিছানায় ফেলেছিল একটা একটা করে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে।

‘কোথায় যাবো?’

‘দেখি, ঢাকায় গেলে ভালো হয়।’

‘ঠিক আছে।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ দরজায় দুজন অতিথিকে লক্ষ্য করলো রাজু। তারা দুজন যখন কথা বলছিল লোকগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। শক্তসমর্থ দুজন মানুষ। এখানকার স্থানীয়, চাকমা অথবা অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর লোক হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ানক কথা দুজনের হাতেই পিস্তল!

ব্যাগ গোছানো থামিয়ে দাঁড়াল রাশেদ, রুমের চারপাশে তাকাল। দরজা ছাড়া এই রুম থেকে বের হওয়ার আর কোন পথ নেই। অনাহুত দুই আগুন্তক মনে হয় তৈরি হয়ে এসেছে, এরাই হয়তো নীচে লরেন্সের উপর আক্রমন করেছে, কে জানে?

এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি করা উচিত মাথায় আসছিল না রাশেদের। রাজুর দিকে তাকাল একবার। বেচারার মুখ শুকিয়ে গেছে, লোক দুজনকে দেখেই মনে হচ্ছে মানুষ মারা ওদের কাছে ডালভাত। চোখ-মুখে হিগ্রতা ফুটে বেরুচ্ছে।

‘হাত উপরে, কড়াগলায় হুকুম দিল পিস্তলধারীদের একজন।

হাত উপরে তুললো রাশেদ। মাথা খাঁটিয়ে কোন একটা বুদ্ধি বার করার চেষ্টা করছে। রাজুও দুই হাত উপরে তুলেছে। একহাতে কাঠের বাক্সটা দেখা যাচ্ছে।

‘ঐ বাক্সটা বিছানায় রাখ,’ এবার বলল দ্বিতীয়জন।

সুবোধ বালকের মতো বিছানায় কাঠের বাক্সটা রেখে সরে দাঁড়াল রাজু।

পিস্তল হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে দ্বিতীয়জন, বিছানা থেকে বাক্সটা নেয়ার জন্য, পেছন থেকে তাকে কাভার দিচ্ছে তার সঙ্গি।

হঠাৎ রাজুকে পড়ে যেতে দেখল রাশেদ, মনে হলো অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু না, পুরোপুরি পড়ে যায়নি,অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে এমন ভান করে বিছানার দিকে এগিয়ে আসা লোকটার পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাজু। হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নেয়ার চো করছে। দুজনের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি চলছে। দরজার সামনে দাঁড়ানো পিস্তলধারী লক্ষ্য ঠিক করার চোঁ করছে, কিন্তু ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যে গুলি করলে নিজের লোকও আহত হতে পারে দেখে গুলি করতে পারছে না। রাশেদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, দু’হাত তুলে। কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। রাজু হঠাৎ এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে কল্পনাও করতে পারেনি।

লোকটাকে পেঁচিয়ে ধরে বিছানা থেকে একটু দূরে সরে গেছে রাজু, পিস্তলটা ফেলে দিতে পেরেছে লোকটার হাত থেকে, ইশারায় কাঠের বাক্সটা বিছানা থেকে তুলে নিতে বলছে রাশেদকে। লোকটাকে সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলেও হাল ছাড়েনি রাজু। দরজার কাছে দাঁড়ান লোকটা পিস্তল তাক করেছে রাজুর দিকে। বুঝতে পারছে তার সঙ্গির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রাজু দেখতে তেমন স্বাস্থ্যবান না হলেও প্রচন্ড শক্তি ধরে, যা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না।

এবার বিছানার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাশেদ, এক হাতে কাঠের বাক্স অন্য হাতে মেঝেতে পড়ে থাকা পিস্তলটা নিয়ে নিয়েছে। তাক করার সময় নেই, দরজার সামনে দাঁড়ান লোকটার হাঁটু বরাবর গুলি ছুঁড়ল রাশেদ।

পুরো হোটেল যেন কেঁপে উঠেছে গুলির আওয়াজে। দরজার সামনে দাঁড়ান লোকটার চোখে বিস্ময়, হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছে, তার বাম পা ছুঁয়ে বুলেট চলে গেছে। কাঁপা হাতে পিস্তল ঘুরাচ্ছে সে রাশেদের দিকে। কিন্তু সে সময় পেলো না, দ্বিতীয় বুলেট খরচ করল রাশেদ। সরাসরি ডান পায়ে লেগেছে বুলেট। দরদর করে রক্ত বের হয়ে আসছে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠেছে লোকটা। হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিয়েছে।

রাজুর দিকে তাকাল রাশেদ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাজু তার দিকে, বিশ্বাস করতে পারছে না এ ধরনের ক্ষিপ্রতা রাশেদের মধ্যে আছে। রাশেদ যখন গুলি ছুঁড়ছিল নিজের বেনীতে থাকা শত্রুকে অজ্ঞান করে ফেলেছে সে। এবার উঠে দাঁড়াল।

‘রাশেদ, পুলিশ আসবে এক্ষুনি, চল পালাই,’ রাজু বলল।

ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে রাশেদ, জিন্সের প্যান্টের পকেটে পুরে রেখেছে পিস্তলটা। দরজার সামনে আহত লোকটা এখনো গোঙ্গাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলল রাজু। নীচে শোরগোল শোনা যাচ্ছে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন। হোটেলের লোকজন কিংবা পুলিশ আসার আগেই পালাতে হবে। দৌড়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়াল দুজন। ছোট একটা জানালা আছে এখানে, কাঁচ নেই। ইশারায় রাজুকে জানালা দিয়ে লাফ দিতে বলল রাশেদ।

এতো উঁচু থেকে লাফ দেয়ার অভিজ্ঞতা দুজনের কারো নেই। কিন্তু এখন চিন্তা করার সময় নেই। ছোট জানালাটা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিল রাজু, তারপর লাফ দিল।

রাজু লাফিয়ে পড়ার পর নীচের দিকে তাকালো না রাশেদ। লোকজনের কথাবার্তা হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। এক্ষুনি হয়তো হোটেলের লোকজন এসে পড়বে। কাঁধে ব্যাগটা শক্ত করে ঝুলিয়ে নিয়ে জানালা এসে দাঁড়াল রাশেদ, তারপর ঝাঁপ দিল।

১৭৬০ খৃস্টাব্দ

দ্বীপ জীবন ভালোই কাটছিল মিচনারের। এতো চমৎকার পরিবেশ হয়তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু মানুষের দেখা মিলছে না। ফলে আস্তে আস্তে বিরক্তি এসে গেছে তার। আর কতো শুয়ে বসে আরামে সময় কাটানো যায়। সৈকত থেকে একটু ভেতরে নিজের ছোট একটা আবাস তৈরি করে নিয়েছে, ডালপালা দিয়ে। সেখানেই রাত কাটায়, মাঝে মাঝে ঘুম না এলে সৈকতে এসে বসে থাকে। আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে পেছনে ফেলে আসা নিজের শহর আর লোকজন নিয়ে ভাবে। সবাই হয়তো জানে সে মারা গেছে।

তারপর এলো সেই দিন। সকালে ঘুম ভেঙে গেলেও আলসেমী করে উঠেনি মিচনার। দুপুর পর্যন্ত মাঝে মাঝে শুয়ে থাকে, তারপর উঠে গাছ থেকে নারকেল পেড়ে খেয়ে নেয়। আজও সেরকম করার ইচ্ছে। কিন্তু সৈকতে কোন কিছু নড়তে দেখে ঝটপট উঠে দাঁড়াল সে। একটা গাছের আড়ালে লুকাল। মানুষ মনে হচ্ছে, সাদা চামড়ার। দুজন লোক, নাবিকের পোশাক পরনে। সৈকতে একটা ডিঙ্গি নৌকা দেখা যাচ্ছে। এরাও হয়তো তার মতো জাহাজ ডুবির শিকার, ভাবল মিচনার।

দুজন লোকের একজন বেশ বয়স্ক, অন্যজন তার মতোই তরুণ। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। দূরে থাকায় কিছুই বুঝতে পারছে না মিচনার। ওদের কথাবার্তা শোনার জন্য আরেকটু কাছে যাওয়া দরকার। বড় পাইন গাছের আড়াল থেকে সৈকতের কাছাকাছি একটা নারকেল গাছের পেছনে দৌড়ে গেল সে।

লোকগুলো স্প্যানিশ, চেহারা এবং কথাবার্তা শুনে কিছুটা ধারনা হয়েছে মিচনারের। এই লোকগুলোকে মেরে ঐ ডিঙ্গি নৌকাটা দিয়ে এই দ্বীপ থেকে বের হওয়া যায়। কিন্তু এই অঞ্চল সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই তার। হয়তো অনিশ্চিতের উদ্দেশ্য যাত্রা হবে সেটা। এখানে দিনের পর দিন একেঘেয়ে জীবন কাটানোর কোন মানে নেই।

লোক দুজন সৈকত ছেড়ে এদিকেই আসছে, হয়তো পানি খুঁজছে। গাছের আড়ালে নিজেকে আরো বেশি লুকালো মিচনার। লোকগুলো ভালো না খারাপ না বুঝে ওদের সামনে পড়া ঠিক হবে না। এই কদিনে রোদে পুড়ে তার গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে, আইরিশম্যান বলে কেউ ভাববে না সহজে। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো মিচনার।

*

অধ্যায় ১৭

জুলাই ৪, ১৭৭৬ এর বিকেল। ফিলাডেলফিয়ার স্টেট হাউজে শ’খানেকের উপর লোক জমায়েত হয়েছে। স্টেট হাউজের বাইরেও কিছু লোক ঘোরাঘুরি করছে উদ্বিগ্ন মুখে। আজ বিশেষ একটা দিন। বিশেষ একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। স্বাধীনতার স্বাদ সবাই পেতে চায়। আজই হয়তো সেই স্বাধীনতার দলিল তৈরি হবে এই স্টেট হাউজে। তেরোটি স্টেটের কংগ্রেসম্যান এর মধ্যেই উপস্থিত।

বারবার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছিল এডওয়ার্ড রুতলেজ। এই ধরনের উত্তেজনাকর মুহূর্ত তার জীবনে আর আসেনি। গত এক সপ্তাহ হলো ফিলাডেলফিয়ায় এসেছে সে। তারপর থেকে একের পর এক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। যা করতে যাচ্ছে তা কি আদৌ ভালো ফল নিয়ে আসবে? ইংরেজ রাজ তাদের এই কর্মকান্ডকে দেখবে দেশদ্রোহিতা হিসেবে, এর ফল মৃত্যুদন্ড, সোজা ফাঁসিকাঠ। কিন্তু তারপরও আমেরিকা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জেগে উঠতে পারে এই সম্ভাবনার কথা মনে হলো জীবনের ঝুঁকি নিতেও তেমন দ্বিধা হয় না।

জেফারসন, আড্যামস এবং ফ্রাঙ্কলীন মিলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কাজ করছে অনেকদিন হলো। এই তিনজনের সাথে আরো দুজনকে যোগ করে একটা কমিটিও গঠিত হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো যার চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন থমাস জেফারসন। স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র তৈরি করতে গিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতে হয়েছে জেফারসনকে, সেই সাথে কমিটির সবার সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর গতকালই ঘোষনাপত্র জমা দেয়া হয়েছে কংগ্রেসে। আজ এখানে জমায়েত হয়েছে তেরোটি স্টেটের ছাপান্নজন প্রতিনিধি যাদের প্রত্যেকের স্বাক্ষর জরুরি আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষনা করার জন্য।

বেশ কিছুক্ষন পায়চারি করার পর বিশাল হল রুমটার এক কোনায় স্থির হলো রুতলেজ। এখান থেকে পুরো হলরুমের পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। সবার মুখে অজানা এক শংকা কিংবা দ্বিধা লক্ষ্য করলো রুতলেজ। সে নিজেও কিছুটা একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জন হ্যাঁনকক কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি, সবার আগে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে তারই স্বাক্ষর করার কথা। কিন্তু ভদ্রলোককে দূর থেকে দেখে কিছুটা আত্মবিশ্বাসহীন বলে মনে হচ্ছে রুতলেজের কাছে। একমাত্র বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলীনকে কিছুটা উফুল্ল দেখাচ্ছে, বয়স হয়ে গেছে লোকটার, সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু এখনো প্রানচঞ্চল, যে কোন কাজের মাঝে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ভালোবাসেন। তার স্নেহমাখা বুদ্ধিদীপ্ত কথা তার মতো তরুণকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

পুরো হলরুমে গুমোট একটা পরিবেশ। সবাই কথা বলছে, কেউ কারো কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষর করার আগ মুহূর্তে সবাই কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, নতুন পৃথিবীর সূচনা করার আগে পুরানো পৃথিবীর সাথে সম্পর্কের সূতো কাটতে সবাই যেন কিছুটা ভীত। ফাঁসিকাঠে কেউ ঝুলতে চায় না তা খুবই স্বাভাবিক। রুতলেজ নিজেও সেই দলের। ছাব্বিশ বছরের এই জীবন, মাত্র শুরু, আরো অনেক কিছু দেখার আছে, শোনার আছে। স্ত্রীর মিষ্টি হাসি, ছোট ছোট বাচ্চাদের কলকাকলি, ওদের সাথে খেলা, আইনব্যবসা, বাবার সম্পত্তি, দাসের উপর রাজত্ব করা কোনকিছুর ঝুঁকি নিতেও ইচ্ছে করছে না এখন। সবার মধ্যে উশখুসভাব।

রুতলেজের ঠিক বিপরীতে আরো একজন দাঁড়িয়ে আছে। বড় একটা থামের পাশে। চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষন করছে গভীর মনোযোগে। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স। কালো লম্বা আলখেল্লা পরনে, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখ দুটি যেন জ্বলছে, যে কেউ ঐ চোখ দুটোর দিকে তাকালে বুঝবে অনেক কিছু দেখেছে চোখজোড়া। চেহারা অভিব্যক্তিহীন। দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত সম্পকের কারনেই এখানে তার আগমন। বিশিষ্ট ব্যক্তি দুজনের একজন জর্জ ওয়াশিংটন এবং অপরজন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলীন। আমেরিকার পতাকা ডিজাইন করার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের বানানো কমিটিতে এই দুজনের সাথে তিনিও ছিলেন। যে ডিজাইন তৈরি করে দিয়েছেন তা কিছুটা সংস্কারের মাধ্যমে এখনকার পতাকাটা তৈরি করেছে মাডাম রোজ। নিজেকে প্রফেসর পরিচয় দিতেই ভালো লাগে তার। ফ্রাঙ্কলীন তাকে এই নামেই ডাকেন।

আজ সেই সূত্রেই এখানে আগমন, স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষর হওয়ার কথা, এই বিশেষ মুহূর্তের জন্য অনেক অনেক বছরের অপেক্ষা ছিল তার। ঘোষনাপত্রে ‘সকল মানুষের সমঅধিকার’ এই কথাগুলো মনে প্রানে বিশ্বাস করেন তিনি, যদিও এই ব্রিটিশ শাসিত আমেরিকায় দাসত্ব প্রথা এখনো ব্যপকহারে প্রচলিত। রুলেজের মতো বাচ্চাছেলের কাছেও পঞ্চাশ জন দাস আছে কাজ করার জন্য। তবে তেমন একদিনের স্বপ্ন দেখেন যখন এই আমেরিকায় সব মানুষ একসাথে কাজ করবে, উপার্জন করবে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় পূর্ন জীবন-যাপন করবে। সেই দিনের সূচনার জন্য আজকের এই স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষরের চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।

কেউ একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল, দুঃখিত বলার প্রয়োজনও বোধ করলো না। লোকটাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। নিউ জার্সির আব্রাহাম ক্লার্ক। বেচারা বোধহয় দারুন টেনশনে আছে, তাই চারদিকে কি ঘটছে লক্ষ্য করছে না। অবশ্য সবার অবস্থাই এক। তিনি নিজেও দারুন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছেন, আজ যদি স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে সাক্ষর না হয় তাহলে তা আর কোনদিনই হবে না। পুরো আমেরিকার সবাই হবে দাস, বৃটিশ রাজের, রাজা তৃতীয় জর্জের। কিন্তু তা কখনোই হতে দেয়া যাবে না।

থমাস জেফারসন আর অন্যান্য কগ্রসম্যানরা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র চূড়ান্ত হলেও সবাই অপেক্ষা করছে বিশেষ একটা মুহূর্তের জন্য। কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট জন হ্যাঁনকককে বিশেষভাবে চিন্তিত দেখাচ্ছে, বারবার তাকাচ্ছে ফ্রাঙ্কলীনের দিকে, উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে তার বয়স বেশি, অভিজ্ঞতাও বেশি। কিন্তু তিনিও নিশ্চুপ।

কয়েকজন এর মধ্যেই তর্ক জুড়ে দিয়েছে নিজেদের মধ্যে, তর্কের বিষয়বস্তু এখনই স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র স্বাক্ষর করা অথবা অপেক্ষা করা সঠিক মুহূর্তটার জন্য।

ফ্রাঙ্কলীনের সাথে চোখাচোখি হলো তার। তিনি ইশারায় কিছু বলতে চাইলেন, যদিও ফ্রাঙ্কলীনের মনোযোগ অন্যদিকে। পুরো হলরুমের আবহাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই কয়েকজনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দেশদ্রোহিতার অপরাধে বৃটিশ রাজের ফাঁসিকাঠে মাথা পেতে দেয়ার ঝুঁকি নিতে অনেকেই রাজি নয়। তেরোটা স্টেটের প্রায় পঞ্চাশ জন উপস্থিত থাকলেও দ্বিধাবিভক্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। দ্বিধান্বিত হবার সুযোগ দিলে তা একসময় সবার মাঝে ছড়িয়ে যাবে। এখনই সময়, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে এখনই একটা কিছু করা দরকার। আমেরিকা হবে স্বাধীন মানুষদের বসতি, এক নতুন আটলান্টিস।

মোটা থামের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। কেউ এখনো তার দিকে নজর দেয়নি।

‘ঈশ্বর আমেরিকা তৈরি করেছেন স্বাধীন থাকার জন্য,’ হঠাৎ বজ্রকণ্ঠে ঘোষনা করলেন তিনি।

পুরো হলরুমের কোলাহল এক মুহূর্তেই থেমে গেল। সবাই ঘুরে তাকিয়েছে বক্তাকে দেখার জন্য। অচেনা একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তারা, ঈষৎ ঋজু ভঙ্গিতে। চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে।

‘ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষর করুন সবাই, আমরা আর বৃটিশ রাজের নীচে থাকবো না, আমরা স্বাধীন একটা জাতি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলে চলেছেন তিনি, সবাই তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো, হলরুমে পিনপতন নীরবতা।

‘স্বাক্ষর করুন এই পার্চমেন্টে যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনা লেখা, আপনার পূর্বপুরুষদের জন্য, আপনার অনাগত ভবিষ্যতের জন্য, সুন্দর নিরাপদ এক আমেরিকার জন্য যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না,’ বলে চলেছেন তিনি।

লোকজনের চোখে অবাক বিস্ময়, কে এই অচেনা ভদ্রলোক, কোথা থেকে আগমন, উত্তরের জন্য একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু কারো কাছে কোন উত্তর নেই।

‘আজ সাহসীকতার দিন, আজ শেকল ভাঙার দিন, আজ আমরা নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে যাচ্ছি, নতুন এক সভ্যতা যা একসময় বিশ্ব শাসন করবে, আমরা ভীরু নই, কাপুরুষ নই, দেখিয়ে দিন আমরাও পারি,’ বলেছিলেন তিনি।

উপস্থিত কংগ্রেসম্যান এবং সাধারনের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনা দেখা গেল, মনে হলো জাদুর চমকে হঠাৎ কেউ তাদের জাগিয়ে দিয়েছে।

‘ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষর করুন, এক নতুন বিশ্ব তৈরি করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না,’ কথাগুলো বলে আস্তে আস্তে পিছু সরে গেলেন তিনি।

কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জন হ্যাঁনককের সামনে পার্চমেন্টে লেখা স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র ছিল। সবার প্রথম তিনিই স্বাক্ষর করলেন, তারপর একে একে তেরোটি স্টেটের কংগ্রেসম্যানরা এগিয়ে এলো, তাদের মধ্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, কে কার আগে স্বাক্ষর করবে।

ঠিক চৌত্রিশ জন স্বাক্ষর করলেন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে যার মধ্যে থমাস জেফারসন, জন এডামস পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ স্বাক্ষরদাতা ছিল রুতলেজ।

স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে তার কপি পাঠিয়ে দেয়া হলো নিকটবর্তী প্রেসে। খবরের কাগজ এবং জনসাধারনের মাঝে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। উৎফুল্ল হয়ে সব কংগ্রেসম্যান বেরিয়ে এলো বাইরে। আজ তারা স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে, আজ থেকে তারা স্বাধীন।

কিন্তু অচেনা সেই লোকটার কথা বেমালুম ভুলে গেল সবাই যার কথায় সব দ্বিধা ভুলে আজকের এই ঐতিহাসিক ঘটনা সম্ভব হয়েছে। দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন তিনি। মুখে মৃদু হাসির রেখা। পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। ফ্রাঙ্কলীনের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি,ওয়াশিংটনের সাথে আবার কখনো দেখা হবে কি না ঠিক নেই, কিন্তু এখানে তার কাজ ফুরিয়েছে। নতুন পৃথিবীর গোড়াপত্তন করা হয়েছে। একসময় এই আমেরিকা হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াবে, সব মানুষকে সমমর্যাদা দেবে, সেই দিনের স্বপ্ন দেখেন তিনি।

তারিখটা ৪ জুলাই, স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়, তার নাম হয়তো থাকবে না সেখানে। অনাগত ভবিষ্যত জানবে না এর পেছনের ইতিহাসের কথা। নিজেকে ইতিহাসের অংশ মানতেই ভালো লাগে তার, সেখানে বইয়ের পাতায় নাম লেখা না থাকলেই বা কি যায় আসে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সবার চোখের অলক্ষ্যে কালো আলখেল্লা পড়া মানুষটা হারিয়ে যায় অন্ধকারে। এবার তার গন্তব্য অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

দুপুরে ঘুমানোর চেষ্টাটা বাদ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। বহুদিন আগের কিছু স্মৃতি ভিড় করেছিল মাথায়। সব স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমেরিকা এখন স্বাধীন একটা দেশ, সেই ৪ঠা জুলাই ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। পুরো পৃথিবীতে মোড়লের দায়িত্ব নিয়েছে এখন আমেরিকা, অথচ সেদিন এ ধরনের কোন উচ্চাভিলাষ আমেরিকার গোড়াপত্তনকারীদের মধ্যে দেখা যায়নি। আমেরিকা এখন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কিংবা অর্থে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ভাবতে ভালো লাগলেও ঠিক যেধরনের স্বপ্ন ছিল তার আমেরিকাকে নিয়ে তার অনেকটাই ভেঙে গেছে। যাক, ওসব নিয়ে এখন ভাবলেও চলবে।

উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, দূরে আকাশের গায়ে ঝাপসা দাগের মতো পাহাড়ের চিহ্ন দেখা যায়। ঐ খানেই তার গন্তব্য, হিমালয়ের কোলে। গতবার বাগসু দিয়ে ঢুকেছিলেন তিব্বতে, দিল্লি থেকে বাগসু যাওয়া অনেকটাই সহজ ছিল, কিন্তু এবার বাগসু বলে কোন জায়গার নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নামের জায়গাটা যেন পৃথিবী থেকেই উঠে গেছে। প্রায় দেড়শ বছর আগে বাগসু গিয়েছিলেন তিনি, সেখান থেকে তিব্বত। তার স্মৃতিতে এখনো মরচে ধরেনি। এবার বাংলাদেশ থেকে রওনা দিয়েছেন তিনি। মেঘালয় দিয়ে ভূটান হয়ে তিব্বতে যাওয়ার ইচ্ছে তার।

লখানিয়া পরিচয়ে জাল আইডি তৈরি করেছেন, টাকা খরচ করলে পাওয়া যায় না। এমন কিছু নেই এদেশে। তবে দেড়শ বছরে এই অঞ্চল দারুনভাবে বদলে গেছে। পথঘাট, বাড়িঘর, মানুষজন সবকিছু বদলে গেছে।

মেঘালয়ের এই শহরটা ছোট, চারপাশে প্রচুর গাছপালা। এখনো বড় বড় অট্টালিকায় ঢাকা পড়েনি শহরের আকাশ। মানুষজনও প্রানবন্ত, সজীব। এখানে আরো কয়েকটা দিন থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হাতে সময় নেই বেশি, তিব্বতে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছে মন। সেই বৃদ্ধ শেবারন আর প্রাচীন সেই মন্দির হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। হয়তো এখন সেখানে কিছুই নেই, হয়তো আছে।

*

অধ্যায় ১৮

‘এখন কি করবো আমরা?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রাজু। বড় একটা ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে আছে দুজন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ, কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগটা ঝোলানো।

‘ঢাকায় ফিরবো।’

‘কিভাবে? এতোক্ষনে হয়তো পুলিশে খবর চলে গেছে, চারদিকে আমাদের নিশ্চয়ই খোঁজা হচ্ছে।’

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। হোটেলের তিনতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে দৌড়ে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন, বড় একটা ঝোঁপের আড়ালে। এখানে থেকে হোটেল দেখা যাচ্ছে। পুলিশের একটা গাড়ি কিছুক্ষন আগে হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। খোঁজাখুঁজি শুরু করেনি এখনো মনে হচ্ছে। তবে শিগগির করবে।

‘জানি না কিভাবে, তবে ঢাকা যেতেই হবে।’

‘বাস স্ট্যান্ডে যাই চল, একটা না একটা বাস পেয়েই যাবো।‘

‘ওরা আগে বাস স্ট্যান্ডে খোঁজ লাগাবে, এর চেয়ে কোন মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাওয়া ভালো, তবে তার আগে এখান থেকে বেরুতে হবে।‘

রাস্তার পাশের ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো রাশেদ। এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। রাজুকে ইশারায় আসতে বলল। খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে দুজন, যেন কোন তাড়া নেই। সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হয়েছে।

পাশ দিয়ে একটা স্কুটার যাচ্ছে, হাত দিয়ে থামাল রাশেদ। দুজন উঠে পড়ল দুপাশ দিয়ে।

‘কোথায় যাবো?’ জিজ্ঞেস করল রাজু।

‘কথা বলিস না বেশি, চুপ করে থাক শুধু,’ রাশেদ বলল।

স্কুটারচালককে ইশারায় চালাতে বলল সামনের দিকে। শহরের মাঝখানে রেন্ট এ কারের একটা দোকান চোখে পড়েছিল, সেখানে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।

সন্ধ্যার পরপরই রওনা দিল দুজন। একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেছে। ভাড়া বেশি চাইলেও আপত্তি করেনি রাশেদ। আগে এই শহর থেকে বের হতে হবে। এর মধ্যেই হয়তো দুজনের খোঁজে নেমে পড়েছে পুলিশ। ঐ লোক দুজন নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। আর লরেন্সের কি অবস্থা কে জানে। মারা না গিয়ে থাকলে হয়তো আবার দেখা হবে। নিজের গরজেই ওদের খুঁজে বের করবে লোকটা।

১৭৬০ খৃস্টাব্দ

ঘন্টা তিনেক দ্বীপটায় ঘোরাঘুরি করলো লোকগুলো। এখন ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে সৈকতে। হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই রওনা দেবে। এই সময়টা পুরোপুরি আড়ালে থেকে ওদের লক্ষ্য করেছে মিচনার। দু’একবার ইচ্ছে হয়েছে ওদের উপর আক্রমন করতে, কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে দমিয়েছে সে। এদের মাধ্যমেই হয়তো আবার সভ্যভূমিতে ফেরা যাবে।

আড়াল থেকে বের হয়ে ওদের সামনে যাবে কি না তা নিয়ে দ্বিধা কাজ করছিল মনে। কিন্তু যখন মনে হলো ওরা এখন চলে যাবার জন্য প্রস্তুত তখন আর নিজেকে থামাতে পারলো না মিচনার। এই দ্বীপে একা থেকে বিরক্তি চলে এসেছে।

দৌড়ে নৌকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মিচনার। চমকে গেছে লোক দুজন। মোটামুটি পুরো দ্বীপ হেঁটে এসেছে ওরা। কোথাও মানুষের অস্তিত্ব তাদের চোখে পড়েনি। এখন সামনে সাদা চামড়ার সুদর্শন এক পুরুষকে দেখে চমকে গেছে দুজন। হাত নেড়ে সামনে এসে দাঁড়াল মিচনার। তার পরনের প্যান্ট শতচ্ছিন্ন, উপরের অংশ খালি। চেহারা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে, চোখ গাঢ় সবুজ।

সাহেবী ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিল মিচনার একজনের দিকে।

হাত মেলাল লোকটা।

‘আমার নাম গঞ্জালেজ, রাফায়েল গঞ্জালেজ, তুমি?’

প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য মুখ খুলল মিচনার। কিন্তু গলা থেকে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। বারবার বলতে চাইল আমার নাম আন্ডু মিচনার, আয়ারল্যান্ডে বাড়ি। জাহাজ ডুবির পর এই দ্বীপে আটকা পড়েছি। কোন শব্দই বের হচ্ছে না মুখ থেকে।

অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল মিচনার। সে কি চিরকালের জন্য বোবা হয়ে গেল? দ্বীপে পা রাখার পর কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি,তাই এতোদিন মনে হয়েছিল সব ঠিক আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আর কোন দিন কথা বলতে পারবে না সে। মুখের ভেতর সেই পানীয়ের স্বাদটা এখনো আছে। সেই জন্যই কি এমন হচ্ছে?

‘আমার মনে হয় ছেলেটা বোবা, রাফায়েল গঞ্জালেজের সঙ্গি বলল।

‘লুই, হতে পারে, ছেলেটা মনে হয় আমাদের সাথে যেতে চাচ্ছে?’ রাফায়েল গঞ্জালেজ বলল।

‘তোমার কি মনে হয় নেয়া ঠিক হবে?’

‘বুঝতে পারছি না, তবে এরকম একটা জনশুন্য দ্বীপে একা একা থাকাটা খুব কঠিন হবে ওর জন্য।

‘তাহলে নিয়ে নাও।‘

‘কিন্তু ক্যাপ্টেনকে কি বলবো?’

‘সে আমি বুঝিয়ে বলবো। আর দেখছো না ছেলেটা কেমন শক্ত সমর্থ, ওকে জাহাজে কোন কাজে লাগিয়ে দেবো।’

নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল রাফায়েল গঞ্জালেজ আর সঙ্গি লুই। পরিস্কার সব বুঝতে পারছিল মিচনার। তাকে এখানে ফেলে যাবে না এতেই সে খুশি কিছুটা। একই সাথে কথা বলতে পারছে না ভেবে খারাপ লাগছে।

ইশারায় নৌকায় উঠতে বলল রাফায়েল। ছোট নৌকা তারপরও তিনজনের জন্য যথে। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা। অনেক দূরে ঝাপসা

একটা কাঠামো চোখে পড়ল মিচনারের কাঠামোটা একটা জাহাজের। পরিচিত মনে হলো তার কাছে। আরো একটু কাছে যাওয়ার পর একেবারে পরিস্কার চিনতে পারলো। সে জাহাজটা। এটাই সে জাহাজ যা তাদের ব্ল্যাক ডাহলিয়াকে আক্রমন করেছিল। যার জন্য ক্যাপ্টেন জেমস হার্ডওয়েল মারা গেছেন, যার জন্য আজ তার এই অবস্থা। জাহাজটাকে তার কৃতকর্মের শাস্তি পেতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল মিচনার।

*

অধ্যায় ১৯

হোটেল রুমে বসে আছে তিনজন। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম, সন্দীপ এবং ড. আরেফিন। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। প্রফেসরের রুমে এখন গভীর নিরবতা। রামহরিকে ছাড়ানো হয়েছে। সে যে বলেছে তার সারমর্ম হলো, দরজার নক করা শুনে সে ধারনা করে প্রফেসর ফিরে এসেছে, দরজা খোলা মাত্র দাড়িওয়ালা এক লোক তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে, কোন একটা ভারি জিনিস দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। এরপরের কোন কিছু তার মনে নেই। জ্ঞান ফিরে নিজেকে চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পায়। মুখে টেপ লাগানো ছিল, তাই চেঁচানোর সুযোগ ছিল না।

একটু আগে সন্দীপকে তার রুম থেকে ডেকে এনেছেন ড. আরেফিন। পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করা দরকার ড. কারসনকে সব জানানোর আগে। আসলে কিসের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে তা আগে বিচার বিবেচনা করা দরকার। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। প্রফেসর কিছুটা মুষড়ে পড়েছেন তার ব্যক্তিগত ল্যাপটপ চুরি হয়ে গেছে বলে। সেখানে রাখা গুরুত্বপূর্ন ফাইলের চেয়ে আদ্যিকালের যন্ত্রটার শোকই ভুলতে পারছেন না ভদ্রলোক।

সন্দীপ বসে আছে গম্ভীর ভঙ্গিতে। রামহরি দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায় চুপচাপ।

‘আমাদের এখন কি করা উচিত?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন। প্রশ্নটা তার দুই সহকর্মীর প্রতি।

উত্তর এলো না। প্রফেসর এবং সন্দীপ দুজনেই তাকিয়েছে ড. আরেফিনের দিকে।

‘আমার মনে হয়, ড. কারসনকে জানানো দরকার ব্যাপারটা, আমাদের পেছনে কে বা কারা লেগেছে তা জানা জরুরি। মনে হচ্ছে এই অভিযান যতোটা সহজ মনে হচ্ছে ততোটা সহজ হবে না,’ সন্দীপ বলল, উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার ছেড়ে। ড. আরেফিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

‘এর চেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে আমার, মৃত্যুর মুখ থেকে অনেকবারই বেঁচে ফিরেছি, তাই এসব নিয়ে ভয় করি না।’

মৃদু হাসির রেখা দেখা গেল প্রফেসরের মুখে।

‘তোমার সাহস কতো তা ভালোই জানা আছে আমার,’ কিছুটা টিটকিরি দিয়ে বললেন প্রফেসর।

‘দেখুন সুব্রামানিয়াম জি, খোঁচা দিয়ে কথা বলবেন না, আপনার সাহসও আমি ভালোই জানি,’ সন্দীপ বলল।

‘আমি জানি না আপনাদের দুজনের মধ্যে সমস্যা কি, তবে এটুকু বুঝি একসাথে কাজ করতে এসেছি আমরা, আগে যদি কোন ঘটনা ঘটেও থাকে তা এখন ভুলে থাকা দরকার, ড. আরেফিন বললেন।

‘আমরা যে কাজে বের হতে যাচ্ছি, মনে হয় সামনে অনেক ঝামেলা হবে এবং সেই সময়গুলোতে আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করে লাভ হবে না।’

‘আমি তাকে খোঁচা দিইনি,তিনিই আক্রমন করেছেন আমাকে,’ সন্দীপ বলল।

‘আচ্ছা, বাদ দিন। এবার কাজের কথা বলি, যে বা যারা প্রফেসরের ল্যাপটপ চুরি করেছে তারা এখন আমাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানে। আমরা কি করবো, কোথায় যাবো, কি খুঁজবো সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পেয়ে গেছে তারা, কাজেই মনে হয় এ ব্যাপারে ড. কারসনের মতামত খুব জরুরি।

‘হ্যাঁ, জরুরি। তিনিই এই অভিযানের নেতা,’ প্রফসর সুব্রামানিয়াম বললেন।

‘যে বা যারাই আমাদের পেছনে লেগে থাকুক, ড. কারসন নিশ্চয়ই সে সম্পর্কে কিছু না কিছু জানেন। তিনি এখানে আসার সময় নিয়ে আমাদের সাথে কিন্তু রহস্য করেছিলেন,’ ড. আরেফিন বললেন।

দরজার বাইরে নক শোনা গেল। কথা বন্ধ করলেন ড. আরেফিন। রামহরি তার জায়গা থেকে সরল না, গতবার দরজা খোলার অভিজ্ঞতা তার ভালো হয়নি। ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সন্দীপ।

ড. কারসনকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। একসঙ্গে সবাইকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন ড. কারসন।

‘কি ব্যাপার আপনারা সবাই একসাথে?’ রুমে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।

‘একটা ঝামেলা হয়েছে ড. কারসন, প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বললেন।

‘ঝামেলা?’

‘আমার ল্যাপটপ চুরি হয়েছে, যেখানে আমার যাবতীয় তথ্য ছিল।’

‘আচ্ছা, তাহলে পুলিশে কমপ্লেইন করুন,’ স্বাভাবিকভাবেই বললেন ড. কারসন।

‘সেখানে যাবতীয় তথ্য ছিল, এমনকি আপনি যে ব্রিফ করলেন সেগুলোও,’ প্রফেসর সুব্রামানিয়াম বলল।

‘ওহ, গড!’

‘এছাড়া আমার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমার উপর নজর রাখছে, সেই কাজটা করেছে মনে হচ্ছে,’ সন্দীপ বলল।

‘লোকটা দেখতে কেমন?’

‘দাঁড়ি আছি, নকল না সত্যি কে জানে।’

‘রামহরিও তো দাঁড়িওয়ালা একটা লোকের কথাই বলল,’ ড. আরেফিন বললেন।

একটা চেয়ার টেনে বসলেন ড. কারসন। বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে। চারদিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চোঁ করলেন।

‘বিষয়টা এতোদূর গড়াতে পারে বুঝতে পারিনি,’ বিড়বিড় করে বললেন ড. কারসন।

‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না ড. কারসন,’ সন্দীপ বলল।

‘আসলে, সেই লন্ডন থেকেই কেউ একজন পিছু নিয়েছে আমার, ড. কারসন বললেন, ‘বিশেষ একটা অভিযানে বের হয়েছি আমি, অনেকেই জানতো, কিন্তু সেটা কি নিয়ে একমাত্র ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আর ভারত সরকারের উঁচু মহল ছাড়া আর কেউ জানে না।

‘আপনার কি ধারনা আমাদের এই অভিযান বাধাগ্রস্ত করার জন্যই কেউ পিছু নিয়েছে?

হয়তো আমাদের আগেই ওরা আমরা যা খুঁজতে বের হয়েছি তা বের করতে চায়, কিন্তু সেটা এতো সহজ হবে না, ড. কারসন বললেন।

‘ওরা হয়তো এখন আমাদের উদ্দেশ্য জেনে গেছে, কি কারনে আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি, কিন্তু কিভাবে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সফল করবো তা ওরা জানতে পারবে না,’ ড. কারসন বললেন।

‘আপনি কি নিশ্চিত এটা কোন সংঘবদ্ধ দলের কাজ?

‘যে লোকটা এখানে এসেছে আমাদের পেছনে সে নিশ্চয়ই একা নয়, কারো মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে সে।’

‘কে হতে পারে? আপনার সাথে কারো রেষারেষি আছে এমন কেউ?’

‘ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে কারো কোন রেষারেষি নেই, তবে কেউ একজন আমার পিছু নিয়েছে সেই প্যারিস থেকে,’ ড. কারসন বললেন।

‘প্যারিস থেকে?’

‘হ্যাঁ, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ফিরে লুভ্যর মিউজিয়ামে এক জোড়া জুতো উপহার পাঠাই আমি, সাধারন জুতো ছিল না, দামী সব হীরে লাগানো ছিল সেই জুতোর গায়ে,’ ড. কারসন বললেন।

‘আপনি বাংলাদেশ থেকে হীরে লাগানো জুতো নিয়ে এসেছিলেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন। ‘কই, আমি তো কিছু জানি না!’

‘কাউকে বলিনি,এই জুতো জোড়ার ইতিহাস দারুন চমকপ্রদ, তোমাদের ওখানে মিউজিয়ামে এতো দামী জিনিস সংরক্ষন করার ব্যবস্থা নেই।‘

‘কিন্তু আপনি আমাদের বলে দেখতে পারতেন। ড. শাখাওয়াত ঐ সময় সন্দেহ করেছিলেন, আমারও মনে হয়েছিল আপনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন, রেগে গেছেন ড. আরেফিন। এভাবে আমাদের বোকা না বানালেও পারতেন।‘

‘স্বীকার করছি তোমাদের না বলাটা ভুল হয়েছে,’ ড. কারসন বললেন, কিন্তু ঐ জুতো জুড়ো গবেষনার দাবীদার, যা তোমাদের দেশে বসে করা সম্ভব না।

‘ঠিক আছে, মানলাম, ড. আরেফিন বললেন, কিন্তু এর সাথে প্রফেসরের ল্যাপটপ চুরি হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে বলতে চান?’

‘নিশ্চিত নই, থাকতেও পারে। তবে এসবে ভয়ের কিছু নেই, যে কাজে বের হয়েছি তা সফল করতেই হবে যে করেই হোক। সত্যিই যদি সাম্ভালা বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে তা মানবচক্ষুর আড়ালে থাকবে না। সত্য উদঘাটন আমরা করবোই। বিপদ যাই আসুক না কেন।

চুপচাপ শুনছিলেন প্রফেসর সুব্রামানিয়াম। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা দরকার তাহলে? এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?

‘নিরাপত্তার জন্য সবসময় দুজন থাকবে আমাদের সাথে, কাল সকালেই যোগ দেয়ার কথা আমাদের সাথে, ব্যবস্থা করে রেখেছি, বাংলাদেশে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না আমার জন্য,’ ড. কারসন বললেন।

উত্তর দিলেন না ড. আরেফিন। ড. কারসনের অপহরনের ঘটনা অনেকেই জানে।

‘আমি তাহলে উঠি, ড. কারসন বললেন, আপনারাও যার যার রুমে যান, ভোরে দেখা হচ্ছে লবিতে।‘

বেরিয়ে গেলেন ড. কারসন। একে একে বিদায় নিয়ে বাকিরাও চলে গেল। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম রামহরিকে ইশারা করলেন দরজা বন্ধ করে দিতে। ল্যাপটপ হারানোর শোক ভুলতে পারছেন না তিনি। ছয় বছর আগে কেনা, তাঁর লাখ লাখ ফাইল ছিল ল্যাপটপটায়। যেগুলো তাঁর সারাজীবনের পরিশ্রমের ফল। ড. কারসনের কাছে এর ক্ষতিপূরন চাইতে হবে।

*

অধ্যায় ২০

রাতের অন্ধকারে একরকম পালিয়ে ঢাকা চলে এসেছে রাশেদ। রাজুও সাথে আছে। ভোরে ফার্মগেটের কাছে মাইক্রোবাস নামিয়ে দিয়েছে দুজনকে। ইচ্ছে করলে মাইক্রোবাসটা নিয়ে বাসার সামনে যেতে পারতো রাশেদ, কিন্তু সেই ঝুঁকি নেয়নি। অচেনা কাউকে বাসা চেনানোর প্রয়োজন নেই।

তিনতলার এই ফ্ল্যাটটায় রাশেদ থাকে, সেই সাথে রাজুও। আরো একটা ছেলে থাকে, বয়সে ছোট। দিনরাত পড়াশোনা নিয়ে থাকে। নাম সবুজ। রাশেদ আর রাজুকে এতো ভোরে বাসায় আসতে দেখে অবাক হয়েছে সবুজ। দুজনকেই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে।

এসেই ঘুমিয়ে নিয়েছে রাশেদ। বান্দরবানে যাওয়ার পর টেনশনবিহীন ঘুম এখনো হয়নি। বিকেলে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো রাশেদ। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে।

‘কি রে? তুই কখন উঠলি?’ পেছনে রাজু এসে দাঁড়িয়েছে।

‘এই তো, কিছুক্ষন আগে, তুই কোথায় ছিলি?’

‘নীচে।‘

চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল দুজন কিছুক্ষন।

‘নীচে গিয়েছিলাম কেন জিজ্ঞেস করলি না?’ বলল রাজু। হাতে একটা খবরের কাগজ ছিল, সেটা বাড়িয়ে দিল রাশেদের দিকে।

‘পত্রিকা দিয়ে কি করবো?’

‘পড় না, শেষ পাতায় খবরটা আছে।’

পত্রিকাটা হাতে নিলো রাশেদ, শেষ পাতায় চলে গেল সরাসরি।

বান্দরবানে মাদকচক্রের দুজন গুলিবিদ্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক:- বান্দরবান শহরের অভিজাত হোটেল ‘নিউ মুন ইন্টারন্যাশনাল’-এ গতকাল বিকেলে আহত অবস্থায় সঞ্জয় বাহিনীর দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে, প্রতিপক্ষ গ্রুপের সাথে মাদক ব্যবসায় আধিপত্য নিয়ে সংঘাতের ফলে হোটেল রুমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আহত দুজনের নাম এখনো অজ্ঞাত। হোটেল রুম থেকে প্রতিপক্ষ গ্রুপের দুই ক্যাডার পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে তাদের ধরার জন্য প্রয়োজনে চিরুনী অভিযানে নামবে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশের একাধিক সূত্র। উল্লেখ্য, সঞ্জয় গ্রুপ পুরো পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে মাদক ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রনকারী হিসেবে চিহ্নিত। সঞ্জয় সিং এই গ্রুপের প্রধান।

‘ইন্টারেস্টিং,’ বিড়বিড় করে বলল রাশেদ।

‘তোর কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হলো, আমাদের দুজনকে এখন খুঁজছে পুলিশ, তাও মাদক ব্যবসার দায়ে, বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা তুই?’

‘আমি শুধু চিন্তিত লরেন্সকে নিয়ে, লোকটা মারা গেছে না বেঁচে আছে বোঝা যাচ্ছে না। পত্রিকায় কিন্তু কিছুই লেখেনি।’

‘বাদ দে, চল বাইরে যাই, অনেক দিন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয় না,’ রাজু বলল।

‘তুই যা, আড্ডা দিয়ে আয়, ঐ বাক্সটা কোথায়?’

‘আছে, তোর ব্যাগেই আছে। কি করবি ওটা দিয়ে?’

‘দেখা দরকার। লরেন্স সত্যি কথা বলল কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’

‘হমম, আমি শুধু একটা জিনিস বুঝেছি এটা সাধারন কাগজ না, পার্চমেন্ট বলে একে, ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু ছবির সাথে মিলিয়ে দেখছিলাম।‘

‘হতে পারে। আর কিছু বুঝেছিস?’

‘ধৈৰ্য্য কম। তুই দ্যাখ। সত্যিই যদি কোন গুপ্তধনের নক্সা হয় তাহলে বেরিয়ে পড়বো দুজনে।‘

‘আরে না। গুপ্তধনের গল্পে আমার বিশ্বাস নেই। তবু জিনিসটা ঘেঁটে দেখা দরকার।‘

‘তুই ঘাটাঘাটি কর। আমি আসছি।‘

বলে বেরিয়ে গেল রাজু। বাসায় এখন একা রাশেদ। সবুজও বাইরে, কোথায় জানি টিউশনি করে। রাত আটটার আগে বাসায় ফিরবে না।

রুমে ঢুকে আরো কিছুক্ষন শুয়ে থাকল। সময় কাটছিল না, বারবার লিলির কথা মনে হচ্ছিল। গত কয়েকদিন কোন মেইল আসেনি। মেয়েটা বোধহয় আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছে তাকে। এমনটাই স্বাভাবিক, এমনই হয়। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো রাশেদের বুক চিরে। শামীমের কথা মনে পড়ছে, রাজু এখন তার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু শামীমের জন্য অন্য এক ধরনের মায়া কাজ করতে যা ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব নয়। পিশাচ শ্রেনির কিছু মানুষের নির্মমতার বলি হয়েছে ছেলেটা।

ট্রাভেল ব্যাগটা চোখে পড়ল। বাক্সটা আছে ব্যাগে। খুলে দেখলে হয়। কৌতূহল জয় করার কোন কৌশল রাশেদের জানা নেই, কাজেই উঠে গিয়ে ব্যাগ খুলে ছোট বাক্সটা বের করে নিয়ে এসে বিছানায় বসল সে।

এসৃন, নক্সাকাটা বাক্সটা, কাঠের রঙ মিশমিশে কালো। ভেতরে ভাঁজ করা পার্চমেন্ট কাগজটা বের করে আনল। অনেক পুরানো, একটু এদিক-সেদিক হলেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই খুব সাবধানে কাগজটা বিছানার উপর বিছাল রাশেদ।

লম্বায় বারো ইঞ্চি, প্রস্থে ষোল ইঞ্চির মতো মাপ হবে কাগজটার অনুমান করল রাশেদ। ছোট ছোট করে কি যেন লেখা, প্রায় মুছে গেছে, একপাশে একটা ম্যাপও আছে মনে হচ্ছে। কালের স্পর্শে অনেক কিছুই মুছে গেছে। সবার নীচে সাক্ষর দেখা যাচ্ছে। অক্ষরগুলো চেলেও ভাষাটা সম্ভবত স্প্যানিশ অথবা পর্তুগীজ, ধারনা করল রাশেদ। ‘meu nome e tibao’ এই টুকু পরিস্কার বুঝতে পারছে। nome নিশ্চয়ই নাম আর tibao নিশ্চয়ই তিবাও বিড়বিড় করে বলল রাশেদ। এছাড়া ‘Arabhumi’, ‘colina’, এই শব্দগুলোও মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে।

বাকি লেখাগুলো ঝাপসা, অস্পষ্ট। একমাত্র বিশেষজ্ঞ ছাড়া এর অর্থ বের করা মোটামুটি অসম্ভব। একপাশে ছোট করে একটা ম্যাপও আঁকা। ত্রিভুজ আকৃতির। অনেকটা পাহাড়ের মতো দেখতে। কমপক্ষে তিন-চারশ বছর পুরানো লেখা হবে, পার্চমেন্টের যুগ শেষ হয়েছে কবে।

লাইব্রেরীতে যাওয়া দরকার, ইন্টারনেটেও বসা যায় অবশ্য। কোন কিছু নিয়ে কাজ করার জন্য লাইব্রেরীই পছন্দ রাশেদের। বাংলায় পর্তুগীজ সম্পর্কে নিশ্চয়ই অনেক লেখা পাওয়া যাবে ইউনিভার্সিটি অথবা পাবলিক লাইব্রেরীতে।

সুন্দর করে ভাঁজ করে কাগজটা আবার বাক্সে ভরে রাখল রাশেদ। বাসায় বসে বসে বিরক্ত হওয়ার চেয়ে বাইরে যাওয়া ভালো। টি-শার্ট আর জিন্স পড়ে বেরিয়ে এলো রাশেদ। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষন। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। হঠাৎ আব্দুল মজিদ ব্যাপারির কথা মনে পড়ল। বুড়ো এখন কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না কে জানে।

১৭৬০ খৃস্টাব্দ

জাহাজটা মাঝারি আকারের, দুই মাস্তুল, মাঝিমাল্লা আর নাবিক মিলিয়ে ষাট জন যাত্রী। নাম এল মাতানকা। নামটার অর্থ কি জানে না মিচনার। ঘন্টাখানেক আগে দুই অফিসারের সাথে জাহাজে এসে উঠেছে। এরমধ্যে কাজেও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। জাহাজের ডেক পরিস্কারের কাজ। এক বালতি পানি, একটা কাঠের মগ আর মেঝে পরিস্কারের ঝাড়ু, এই হচ্ছে তার সম্বল। আগেও এই ধরনের কাজ করতে হয়েছে ব্ল্যাক ডাহলিয়াতে শাস্তি হিসেবে, কাজেই খারাপ লাগছে না। তবে চারপাশের লোকজনের চেহারা দেখে বেশি একটা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।

লোকগুলো সব অদ্ভুত ধরনের, কিছু একটা করার জন্য মুখিয়ে আছে। কোমরে তলোয়ার ঝুলছে। পারলে বের করে এখনি কারো কল্লা কেটে নেয় এমন অবস্থা। কয়েকজন দুস্যু এর মধ্যে মিনারের সাথে খোঁচাখুঁচি করে গেছে। সাড়া না পেয়ে ফিরে গেছে হতাশ হয়ে।

জাহাজের দু’পাশে সারি সারি কামান বসানো। তৈরি যে কোন সময় আক্রমন করার জন্য, শুধু হুকুমের অপেক্ষা। জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দেখা হয়নি এখনো, লোকটা সম্ভবত নিজের কামরা ছেড়ে বেরুয় না। জলদস্যুদের কথা অনেক শুনেছে, এখন ঠিক ওদের মাঝখানে এসে অদ্ভুত লাগছে সবকিছু।

রাফায়েল গঞ্জালেজকে আসতে দেখল মিচনার। লোকটা দেখতে নরম, মিশুকে, মুখে সবসময় একটা হাসি ঝুলে থাকে।

‘কাজ শুরু করে দিয়েছো তাহলে?’ রাফায়েল গঞ্জালেজ বলল ঠিক সামনে এসে।

উত্তরে কোন কথা বের হলো না মিনারের মুখ থেকে। মাথা দুলিয়ে একটু হাসল।

‘তুমি কি বোবা নাকি?’ মাথা নাড়াল মিচনার।

‘হা করো তো দেখি,’ রাফায়েল গঞ্জালেজ বলল।

মুখ হা করল মিচনার। গভীর মনোযোগে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল রাফায়েল। চেহারা থেকে হাসিভাবটা উধাও হয়ে গেছে।

‘তোমার সাথে পরে কথা বলবো, যাই,’ বলল রাফায়েল, তারপর চলে গেল।

মন দিয়ে আবার কাজে লেগে পড়ল মিচনার। তার এই দুরাবস্থার জন্য এই লোকগুলো দায়ী। শাস্তি এদের পেতেই হবে, কিন্তু কিভাবে?

নাবিকদের মধ্য থেকে মধ্য বয়স্ক একজন এগিয়ে এসেছে তার দিকে। আড় চোখে তাকাল মিচনার, লোকটার ভাবসাব ভালো মনে হচ্ছে না। মারবে নাকি?

‘অ্যাই, তুই কি ইংলিশ?’

মাথা নাড়ল মিচনার।

‘কথা বলতে পারিস না, উত্তর দে?’

‘আবারো মাথা নাড়াল মিচনার।’

‘তোকে দেখে কেমন সন্দেহ হচ্ছে? তুই ইংলিশ? আমাদের জাহাজে কোন ইংলিশের বাচ্চার ঠাই নেই,’ এবার চেঁচিয়ে বলল লোকটা, চারদিকে তাকাচ্ছে সমর্থনের আশায়। কয়েকজন হৈ হৈ করে উঠল।

‘চোপ! এই জাহাজে কে থাকবে আর কে থাকবে না তা ঠিক করবো আমি, তুই বলার কে?’

বাজখাই গলায় বলল কেউ, আপার ডেক থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে সবাই, এই কণ্ঠস্বর তাদের পরিচিত, একমাত্র মিনারের কাছেই তা অপরিচিত।

লোকটাকে দেখে অবাক হলো মিচনার। সাড়ে ছ’ফিটের কম লম্বা হবে না, পেটা শরীর। পরনের পোশাকটা অনেক পুরানো, কোমরে স্বাভাবিকভাবেই তলোয়ার আর পিস্তল ঝুলছে। মুখে দাঁড়ি। চেহারায় খুনে একটা ভাব, দেখলেই বোঝা যায় এই লোক সাধারন কেউ না।

সবার পেছনে সরে দাঁড়িয়েছে, মিচনার দাঁড়িয়ে আছে একা। লোকটা উপর থেকে নীচে নেমে এলো। মিনারের ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ থেকে মদের কড়া গন্ধ পাচ্ছে মিচনার, সাথে তামাকের গন্ধও মিশে আছে।

‘তোর নাম কি রে?’

গলার স্বর নিচু করে বলল ক্যাপ্টেন।

‘উত্তর দিলো না মিচনার। চারপাশে তাকাল।’

‘বোবা, কথা বলতে পারে না,’ নাবিকদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলল।

‘চোপ! ও বোবা কি না আমি বুঝবো,’ আবারও গর্জে উঠল ক্যাপ্টেন, ‘অ্যাই, তোর বাড়ি কি ইংল্যান্ডে?’

না-সূচক মাথা নাড়াল মিচনার।

‘এই তো, বুঝতে পারিস সবকিছু। কাজ কর,’ বলল ক্যাপ্টেন, তারপর ধীরে ধীরে আপার ডেকে গিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে দূরবীন বের করে দূরে কিছু দেখার চো করল।

নীচে সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, ক্যাপ্টেন কিছু একটা বলবে মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কেবিনে চলে গেল সে। নাবিকরাও যার যার কাজে ফিরে গেল।

মিচনারও দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষন চুপচাপ। তারপর কাজে লেগে পড়ল। ক্যাপ্টেন লোকটা বুদ্ধিমান। লোকটার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছে সে। একে বোকা বানানো সহজ হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *